Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

আমার বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির পিতা। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান রূপকার, বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের সার্থক অগ্রনায়ক। তিনি বিশ^ময় বাঙালি সমাজে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে সতত স্মরণীয়।


পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক ও সামরিকতান্ত্রিক শাসন-শোষণের বলয় ভাঙার সংগ্রামে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারির সফল গণঅভ্যুত্থানে অনবদ্য নেতৃত্ব দেয়ার স্বীকৃতি হিসেবে এদেশের ছাত্র জনতা তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তৎকালিন ছাত্রনেতা, ডাকসুর ভিপি এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ম-লির সদস্য বর্ষীয়ান জননেতা জনাব তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধু শব্দটি প্রথম ঐ  সমাবেশে উচ্চারণ করেন। সেই থেকেই এ তার ভুবন জোড়া পরিচয়, নামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি যেমন সরল ও সহজবোধ্য তেমনি আকর্ষণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের আদি নাম বঙ্গ। বঙ্গ ও বঙ্গে যারা বাস করে তিনি তাদের অকৃত্রিম বন্ধু। তাই ‘বঙ্গবন্ধু’। এই উপাধি তার বিশ^াস, কর্ম ও আচরণের সাথে এতটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ যে, তা সার্থকতার এভারেস্টশৃঙ্গসম উচ্চতায় অধিষ্ঠিত। তাই তো তিনি আমাদের মনের মণিকোঠায় সর্বদা বীরত্বের ব্যঞ্জনায় সমাসীন বাঙালির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম মহানায়ক।


আমার আজকের এই লেখায় আমি স্মরণ করার চেষ্টা করছি ইতিহাসের এই মহানায়ক কখন থেকে কিভাবে আমার মনোজগতে স্মরণীয়দের তালিকার শীর্ষে স্থাপিত হলেন। আর সে কারণেই এই লেখার শিরোনাম ‘আমার বঙ্গবন্ধু।’


বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তবর্তী অধুনা চুয়াডাঙ্গা জেলার চিনিকল সমৃদ্ধ দর্শনা বাজারের কাছাকাছি ‘হৈবৎপুর’ নামের এক সত্যিকারের অজপাড়াগাঁয়ের এক কৃষক পরিবারে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এই গ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হলো ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় এ গ্রামের শতভাগ হিন্দু পরিবার পাশর্^বর্তী পশ্চিমবঙ্গে চলে যায় এবং আমাদের পরিবারসহ নিকটবর্তী পশ্চিম বঙ্গের জয়ঘাটা গ্রাম থেকে বিতাড়িত ২৫-৩০টি পরিবার এই গ্রামে বসতি স্থাপন করে। সেই বিবেচেনায় আমার বাবার বয়সী প্রজন্মই এক অর্থে নতুন করে স্থাপিত এই গ্রামের আদি বাসিন্দা যারা দ্বিজাতি তত্ত্বের নিষ্ঠুরতার শিকার, হিন্দু মুসলিম বিভাজনে ক্ষত-বিক্ষত এক মানবগোষ্ঠী। আমাদের জন্মের পর ১৯৬৫ সালে এই জনগোষ্ঠীকে আবার এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। আমি তখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। আমাদের পরিবারের কিছুটা সচ্ছলতা থাকার সুবাদে একটি প্রশস্ত বৈঠকখানা ও বিস্তৃত উঠোন ছিল। এই বৈঠকখানা ও উঠোনে গ্রামবাসীদের বৈঠক, সলা পরামর্শ, এমনকি খেলাধুলাও হতো। এই যুদ্ধের সময় বৈঠকখানার আলোচনা থেকে আমরা প্রথম হিন্দু-মুসলমান বিভেদতন্ত্রের পাঠ গ্রহণ করি। রাজনীতির বিভিন্ন সংলাপ আমাদের মনোজগতে মানুষের জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে নানান ধারণার  বীজ বপন করতে থাকে।


প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে পাশর্^বর্তী মেমনগর বিপ্রদাস উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই ১৯৬৮ সালে। এই স্কুলটি চিনিকলের শ্রমিক অধ্যুষিত দর্শনার সন্নিকটে অবস্থিত হওয়ায় এ স্কুলে রাজনীতির প্রভাব ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায়। হাইস্কুলে ভর্তি হয়েই এ বিষয়টি টের পেলাম। মাঝে মধ্যেই স্কুলের বড় ভাইয়েরা মিছিল বের করতেন। সেই মিছিলে যোগ দিতে হতো আমাদের। বড় ভাইয়েরা দুই দলে বিভক্ত- একদলের নাম ‘ছাত্রলীগ’ অন্য দলের নাম ছাত্র ইউনিয়ন। সেই ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র হিসেবে এই দুই দলের কোনো এক দলে না গিয়ে কোন উপায় ছিল না। আমরা ক’জন বন্ধু চিন্তায় পড়ে গেলাম কোন দলে যাব।


স্কুলের দশম শ্রেণির বিজ্ঞানের ছাত্র এবং ৮ম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়া ক্লাসে প্রথমস্থান অধিকারী কেরামত আলী ভাই ছাত্রলীগ করেন। তারই সহপাঠী অত্যন্ত সুদর্শন ও সুবক্তা এবং স্কুল ফুটবল দলের গোলকিপার আজাদ ভাইও ছাত্রলীগ করেন। তাদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করলাম এবং তাদের সাথে মিছিলে যোগ দেয়া শুরু করলাম। এই মিছিলে একটি সতত উচ্চারিত অনিবার্য স্লোগান ছিল- ‘জেলের তালা ভাঙ্গবো শেখ মুজিবকে আনবো’। তাদের বক্তৃতায় শুনতে থাকি কিভাবে শেখ মুজিব পাকিস্তানি সামরিকজান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে কারাবরণ করেছেন। আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে শেখ মুজিবকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করতে চায়। এ অন্যায়, মস্ত বড় জুলুম, একজন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা  যিনি দেশকে, মানুষকে ভালোবেসে তাদের পক্ষ নিয়ে লড়াই সংগ্রাম করছেন তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হবে এ কেমন কথা। আমার কিশোর মনে সেই থেকে বীরত্ব ও বেদনার আখরে লেখা এক নামÑ শেখ মুজিব। এই নামের জপমালা কণ্ঠে ধারণ করে সেই থেকে আজ অবধি আমার পথ চলা।


এল ঐতিহাসিক ১৯৬৯ সাল। জানুয়ারিতেই তুমুল আন্দোলন। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন এক হয়ে আন্দোলন করছে। প্রতিদিনই আমাদের মিছিলে যেতে হয়। প্রবল উদ্দীপনা এবং উত্তেজনা। সামরিক স্বৈরতন্ত্রকে পরাজিত করে রাজবন্দিদের মুক্ত করতে হবে। এ সময়েই আমার ‘রাজবন্দি’ শব্দের সাথে পরিচয়। কেমন যেন সম্ভ্রম উদ্যোগকারী শব্দ। শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায়-ভক্তিতে মাথা নত হয়ে আসে। তখন শেখ মুজিব, মওলানা ভাসানী এবং মনি সিং এই তিন নেতার নামে স্লোগান হতো বেশি। ঢাকায় ডাকসু নেতাদের তৎপরতার কথা আমরা আমাদের নেতাদের বক্তৃতায় শুনতাম। ঊনসত্তরের উন্মাতাল জানুয়ারির ২৪ তারিখ আইয়ুব খানের পতন হলো। আমাদের প্রতিদিনের স্লোগান- ‘আইয়ুব শাহীর গদিতে আগুন জ¦ালো একসাথে’ স্বার্থক হলো। সূচিত হলো ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান। জানুয়ারির ২০ তারিখ পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানের শহীদ হওয়ার অভিঘাতে এই গণঅভ্যুত্থান ত্বরান্বিত হয়। শেখ মুজিবসহ অন্যদের বিরুদ্ধ দায়ের করা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অবসান হলো। মাস খানেকের মধ্যেই শেখ মুজিব মুক্তি পেলেন কারাগার থেকে। সংগ্রামের বিজয়ে আনন্দে উদ্বেলিত ছাত্র জনতা ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত বিজয় উৎসব ও সংবর্ধনা সভায় শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধায় ভূষিত করলেন। সেই থেকে তিনি বাঙালির অনন্তকালের বঙ্গবন্ধু আমারও বঙ্গবন্ধু। আমার কাছে এই নামের অর্থ হলো বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি ও বিশ^মানবের জন্য ভালোবাসা, তাদের কল্যাণের জন্য উৎসর্গকৃত এক চিরসংগ্রামী অমর মহামানবের প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধুর অগ্রজ প্রাতঃস্মরণীয় দুই মহান বাঙাালি কবির একজন ‘রবীন্দ্রনাথ’ তাঁর গানে ‘ঐ মহামানব আসে’ এবং অন্যজন ‘নজরুল’ তাঁর ‘আমি সৈনিক’ প্রবন্ধে মানবের দুঃখ বিনাশী এক মহামানবের আগমনের আগাম বার্তা ঘোষণা করেছিলেন। আমার কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির মুক্তিদূতরূপী সেই মহামানব। ইতিহাসের পাতায় পাতায় কীর্তিময় আপন অবদানের স্বর্ণ খচিত স্বাক্ষর রেখে তিনি হয়ে আছেন মহীয়ান, গরিয়ান, অবিস্মরণীয়, চিরঞ্জীব।


জীবনের ছাপান্ন বছরের দৈর্ঘ্য এমন বড় কিছু নয় অথচ এই জীবন পরিধির ভেতরেই তিনি আধুনিক বাঙালি জাতিসত্তা সংগঠিত করেছেন। বাংলাদেশ নামের জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। ধর্ম, বর্ণ, কর্মের বিভাজনে নিপীড়িত, নির্যাতিত  মানবগোষ্ঠীর সহমর্মী ও সংগ্রামী নেতা হিসেবে তিনি ভুবনজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর একজন নগন্য ভক্ত ও একনিষ্ঠ অনুসারী এবং বাঙালি হিসেবে আমার প্রাণের গভীরে দেশপ্রেম ও মানব প্রেমের যে অনুপ্রেরণা সঞ্চারিত হয়েছে তা ধারণ করতে এবং লালন করতে পেরে আমি ধন্য। তাই ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি আমার কাছে অসম সাহসিকতা এবং সুগভীর দেশপ্রেম ও মানব প্রেমের সমার্থক এক প্রবল অনুপ্রেরণাসঞ্চারী মানব অভিধা।


ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের পতনের পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হলেন আর এক সামরিক স্বৈরাচার ইয়াহিয়া খান। বঙ্গবন্ধু সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে মনোযোগী  হলেন। নিজ দল আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করতে নিরন্তর সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন। চলতে থাকল ব্যাপক জনসংযোগ। লক্ষ্য, নির্বাচনে জয়ী হওয়া। নির্বাচনের দিন ধার্য হলো ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর। এই নির্বাচনে আমাদের নির্বাচনী এলাকায় এমএনএ (মেম্বার অব ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলি) পদে ব্যারিস্টার আবু মোহাম্মদ আফজালুর রশীদ (বাদল ব্যারিস্টার নামে খ্যাত) এবং এমপিএ (মেম্বার অব প্রভেনশিয়াল অ্যাসেম্বলি) পদে অ্যাডভোকেট ইউনুস আলী নৌকা মার্কা নিয়ে আওয়ামী লীগের হলেন। আমার জীবনে সেই প্রথম ভোটের মিছিলে শরিক হওয়া এবং ঘোড়ার গাড়িতে মাইক লাগিয়ে অ্যাড. ইউনুস আলীর পক্ষে ভোট চাওয়ার এক অনন্য অভিজ্ঞতা অর্জন। এই নির্বাচন উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু চুয়াডাঙ্গা কলেজের বিশাল মাঠে জনসভা করতে আসবেন জেনে আমাদের মাঝে সে কী বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা! বঙ্গবন্ধুকে দেখার প্রবল উত্তেজনা নিয়ে আমরা স্কুল থেকে দর্শনা এবং দর্শনা থেকে রায়টার লোকাল নামের ট্রেনে চেপে যখন চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের মাঠে এসে পৌঁছলাম-তখন সভাস্থলে লোকে লোকারণ্য। মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে দোতালা ঘর সমান উঁচু করা বিশাল মঞ্চ। হেমন্তের অবিস্মরণীয় সেই বিকেলে আকাশ জোড়া মেঘ রৌদ্রের খেলা। অনর্গল বক্তৃতা চলছে স্থানীয় নেতাদের। মঞ্চের আশপাশজুড়ে দড়িতে ঝুলছে “সোনার বাংলা শ্মশান কেন?” শিরোনামের সেই অসাধারণ পোস্টার। যে পোস্টার খুব যৌক্তিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে-পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের এক দ্রোহ উদ্যোগকারী চিত্র। আমার আজও মনে হয় ঐ পোস্টার সাধারণ বাঙালির মনে পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি যে তীব্র ঘৃণার রেখাপাত ঘটিয়েছিল-তার তুলনা মানব সভ্যতার ইতিহাসে অত্যন্ত বিরল। আমি আজ অবধি ঐ পোস্টারের তুল্য কোন রাজনৈতিক পোস্টার দেখিনি।


বিপুল স্লোগান আর করতালির মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাস্থলে এলেন। বর্ণনাতীত সেই দৃশ্য। তিনি হাত নেড়ে জনতার প্রতি অভিনন্দন জানাচ্ছেন। আবার উচ্ছ্বসিত উদ্বেলিত জনতার অভিবাদন গ্রহণ করছেন। সেই প্রথম দেখলাম বঙ্গবন্ধুকে। আমার মনের মণিকোঠায় অম্লান হয়ে রইল সেই স্মৃতি। তার সফেদ পাঞ্জাবি শোভিত সুদর্শন চেহারা ও বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। তিনি বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরলেন। ছয় দফা ও ১১ দফা দাবিভিত্তিক নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে, বাঙালির অধিকার নিয়ে কথা বললেন। জনগণকে নৌকা মার্কায় ভোট দেয়ার আহ্বান জানালেন। উপস্থিত জনতাকে তার আহ্বানে সাড়া দেয়ার সমর্থক সূচক হাত তোলার আমন্ত্রণ জানালে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সূচনা হলো। লক্ষ জনতার উত্তোলিত হাত, তারপর মহুর্মুহু হাততালি। হাততালি যেন থামতেই চায় না। সভাশেষে আমরা ঘরে ফিরলাম-যেন দেশাত্মবোধে প্রবলভাবে উদ্বুদ্ধ এক নতুন মানুষ। এই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের বিস্ময়কর বিজয় ঘটল। জাতীয় পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়ী হলেন।


সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরের ঘটনা আমাদের সবার জানা। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান ও তার দোসর জুলফিকার আলী ভুট্টো গং নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সরকার গঠন করার আহ্বান জানানোর পরিবর্তে নানান ছলচাতুরি ও ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকলেন। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত চলল এই খেলা। পরিস্থিতি ও পরিণতি আঁচ করতে পেরে বঙ্গবন্ধু তার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূর্ণ করতে প্রস্তুত হলেন। মার্চ মাসের ৭ তারিখে রেসকোর্সের মাঠে লক্ষ লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে উচ্চারণ করলেন প্রতিটি বাঙালির মনের কথা। “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। ভাষণের শেষের এই কাব্য পঙ্ক্তিতে বাঙালির শোষণমুক্তির চিরকালীন আকাক্সক্ষা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হলো। তাঁর সেই ১৭ মিনিটের কাব্যময় ভাষণ বিশে^র ইতিহাসে মুক্তিকামী মানুষের বজ্রকঠিন ঐক্যে সংযুক্ত করার এক অনন্য ঐতিহ্যের দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। আমরা রেডিও মারফত সেই ভাষণ শুনে প্রবল উদ্দীপনায় শিহরিত ও আবিষ্ট হলাম। তার তুল্য উদ্দীপনার কোনো ঘটনা বুঝি এ জীবনে আর ঘটেনি। ঘরে ঘরে সাজ সাজ রব, যুদ্ধের প্রস্তুতি। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা বিস্ময়করভাবে আন্দোলিত। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ শুরু হলো। ২৫ মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরপরাধ বাঙালির ওপর। সবার আগে আক্রান্ত হলো ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, পিলখানার ইপিআর ক্যাম্প ও রাজারবাগের পুলিশ হেডকোয়ার্টার এবং বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করা হলো। বিচক্ষণ বঙ্গবন্ধু বন্দি হবার আগেই তাঁর সহযোগিদের সহায়তায় ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) এর ওয়ারলেস সিস্টেমে প্রচার করার জন্য প্রস্তুত করে রাখেন স্বাধীনতার ঘোষণা। সেই ঘোষণা প্রচারিত হলো চট্টগ্রাম বেতারের কালুর ঘাট কেন্দ্র থেকে। বঙ্গবন্ধুর নামে প্রথমে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হান্নান এবং তারপর মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করলেন। স্ফুলিঙ্গের মতো তা ছড়িয়ে পড়ল দিকবিদিকে। আমাদের গ্রামে তখন একটি মাত্র রেডিও। সিরাজুল ভাই এরই শ^শুর বাড়ি থেকে পাওয়া। আমরা সেই রেডিওর চারপাশে জড় হই, শুনি স্বাধীনতার অমিয়বাণী, দেশাত্মবোধক গান। সে এক অনন্য সময় আমাদের কৈশরকে উন্মাদনায় উদ্বেলিত করে তুলল। আমাদের বড়রা, যারা স্কুলের গ-ি পেরিয়ে কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ে পড়েন তারা চলে গেলেন যুদ্ধে। গ্রামগুলো যুবকশূন্য হয়ে গেল। আমরা যারা বয়সের কারণে যুদ্ধে যাবার যোগ্য হয়ে উঠিনি, তারা রয়ে গেলাম গ্রামে। গভীরতর দুশ্চিন্তার বিষয় হলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি কোথায় আছেন? কেমন আছেন? আদৌ বেঁচে আছেন কি না? এসব বিষয়ে মুখে মুখে নানা কথা রটতে থাকল। পাকিস্তান রেডিও নিশ্চিত করে বলছে বঙ্গবন্ধু বন্দি অবস্থায় তাদের কারাগারে আটক রয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী সন্তানেরা কে কোথায় আছেন? কেমন আছেন? সাধারণ মানুষের চোখে-মুখে সেই জিজ্ঞাসাও নিরন্তর স্পষ্ট। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বলছে বঙ্গবন্ধু মুক্ত আছেন। পরে ধীরে ধীরে খোলসা হলো বঙ্গবন্ধু সত্যি সত্যিই পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। মুরব্বিরা, মা-বোনেরা নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন বঙ্গবন্ধুর জীবন ভিক্ষার। এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখে এক আশাজাগানিয়া ঘটনা ঘটলো। চুয়াডাঙ্গার খুব কাছে মেহেরপুরে সদর থানার দৈন্যনাথ তলার (পরবর্তীতে মুজিব নগর) আম বাগানে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠিত হল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে। উপ-রাষ্ট্রপতি ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সকল সঙ্কটকালের অনুগত সঙ্গী তাজউদ্দীন আহমেদ এই সরকার মুজিবনগর সরকার নামে খ্যাত হল। যুদ্ধ চলল ৯ মাস ১১টি সেক্টর জুড়ে। সেই সাথে বর্ষাকাল জুড়ে প্রবল বন্যা। মানুষের দুঃখ দুর্দশার সীমা রইল না। আমাদের গ্রামের দক্ষিণে ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন বারাদী গ্রামে প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প হলো জুন মাসের দিকে। এ ক্যাম্পে প্রায় সকল মুক্তিযোদ্ধাই আমাদের মেমনগর স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। লিয়াকত, বিল্লাল, নূরহাকিম, রঞ্জু, মোবারক, নওশের, গোলাম হোসেন প্রমুখ। একগুচ্ছ টগবগে তরুণ। তারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ভারতের দেরাদুন থেকে। লিয়াকত আলী এদলের কমান্ডার। ওপারের বানপুরের ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজের পরবর্তীতে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ও সংসদ সদস্য নেতৃত্বে আর একদল মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নিলেন। এর কিছুদিন পরে আমাদের গ্রামে চার সদস্যের মুজিব বাহিনী ক্যাম্প করল সিরাজুল ভাইয়ের পরিত্যক্ত বাড়িতে। এ দলের নেতা রহমতুল্লাহ তিনি বিশ^বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেছেন। তার সাথে আছেন আজাদুল ইসলাম (বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক), মির্জা শাহারিয়ার লন্টু, মির্জা সুলতান রাজার ছোট ভাই ও বর্তমানে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও আরাফাত মাস্টার মদন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক বিএসসি শিক্ষক। সবাই সুশিক্ষিত। তারা গ্রাম গ্রামান্তরে ঘুরে যুদ্ধের পক্ষে মানুষের মনোবল অটুট রাখা এবং নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন করতে লাগলেন। এরপর আমাদের গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশের ছোটবলদিয়া গ্রামে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের আর একটি ক্যাম্প হল। এ ক্যাম্পের অনেক যোদ্ধাই আমাদের উত্তর পাশের মদনা গ্রামের যুবক। রেজাউল করিম এদের কমান্ডার। মোফাজ্জল, আশরাফ, লুৎফর আছেন এই দলে। আমাদের গ্রামের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী ৮নং সেক্টরের অন্যত্র যুদ্ধরত। বারাদী, বানপুর ও ছোট বলদিয়া থেকে মুক্তিযোদ্ধারা নিয়মিত পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে গেরিলা লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে লাগলেন। আমাদের জীবন হয়ে উঠল হুমকির সম্মুখীন। তাছাড়া আমাদের বাড়িতে মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর সদস্যদের নিয়মিত আসা যাওয়া, বিশ্রাম নেয়া ও খাওয়া দাওয়া করার বিষয়টি নিয়ে এক শ্রেণির লোক আমার বাবা-মায়ের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালাতে থাকলেন। বাবা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেন। কিন্তু মা পরম মমতায় মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান স্নেহে খাবার যোগাতে লাগলেন। আমাদের কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য খাবার পৌঁছে দেয়া-তাদের হুমুক শোনা। এতেই আমরা ছোটরা হাফ মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেলাম। সেসময় আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে চুয়াডাঙ্গা ও দর্শনা থেকে আসা আমাদের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি পরিবার। তাদের মধ্যে বিক্রমপুর সানোয়ার দর্জির স্ত্রী-কন্যা সন্তান প্রসব করলেন। আমরা এই সদ্যজাত শিশুর নাম রাখলাম মুক্তি। আমাদের গ্রাম চারবার আক্রান্ত হলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা। গ্রামের অদূরে ভারত সীমান্ত হওয়ায় এবং পাকিস্তানি মিলিটারি আগমণের আগাম সংবাদপ্রাপ্তির সুবাদে আমরা চারবারই পালিয়ে বাঁচলাম। কিন্তু পাশের গ্রামের ৪ জন কৃষক এবং একজন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রাণ দিতে হলো আমাদের মাঠে সম্মুখ সমরে। মুজিব বাহিনীর সদস্যরা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান সৌভাগ্যক্রমে। যুদ্ধ শেষে সেসব ক্ষত-বিক্ষত লাশ দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে আমার। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম আব্দুল মান্নান আর কৃষকেরা হলেন- আবু ইছাহাক, আবুদাউদ, জুড়ন ম-ল ও বাহার আলী। বাহার আলী ছিল পলিও আক্রান্ত কিশোর। এদের স্মরণে আমাদের গ্রামে সম্প্রতি একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে আমাদের ইউপি চেয়ারম্যান জাকারিয়া আলমের প্রচেষ্টায়। যুদ্ধে গুলি খাওয়ার ক্ষত চিহ্ন নিয়ে এই স্মৃতিসৌধের পরিচর্যা করছে টুকু মিয়া। যার ভাই মোহাম্মদ আলী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এবং বাবা মোতাহার হোসেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক।


মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার মধ্যে বেড়ে উঠতে উঠতে আমরা আসল বয়সের তুলনায় অধিক বয়সী হয়ে উঠলাম। আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া আমার ফুফাতো বোনের স্বামী ইলিয়াস হোসেন মাস্টারের একটি করাচি নির্মিত ফিলিপস তিন ব্যান্ডের রেডিও ছিল। এই রেডিওতে আমরা নিয়মিত বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ “বজ্রকণ্ঠ” শুনতাম। বজ্রকণ্ঠ প্রচারের সাথে প্রায় অবধারিতভাবে যুক্ত হতো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত দুটি অবিস্মরণীয় গান- ‘শোন একটি মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি’/‘আকাশে বাতাসে ওঠে রণি/’ এবং মুজিব বাইয়া যাওরে-/ নির্যাতিত দেশের মাঝে, জনগণের নাও  রে/ মুজিব বাইয়া যাওরে।’ এমআর আকতার মুকুলের জল্লাদের দরবার ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। এসব ছাড়াও নিয়মিত গান ও কবিতা প্রচারিত হতো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।’ ‘ওভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি’/‘সোনা সোনা সোনা... লোকে বলে সোনা’/ ‘কারার ঐ লৌহকপাটÑএই শিকলপরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল’/ রবীন্দ্রাথের অমোঘ বাণী ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই/নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’ নজরুলের কাব্য পঙ্তি ‘হিন্দু না ওরা মুসিলম ্ঐ  জিজ্ঞাসে কোন জনকা-ারী বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার বা ‘ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হয় ভারতের দিবাকর/আমাদের খুনে রাঙিয়া সে রবি উদিবে পুনর্বার’ আকাশবাণীর দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়ের বৈশিষ্টম-িত কণ্ঠের সংবাদ পাঠ শুনতে আমরা উৎসুক হয়ে থাকতাম। এ সঙ্কটকালে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিশেষত বিবিসির মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত হলাম বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে আটক আছেন এবং তার বিচার চলছে। মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রাণন্ত চেষ্টা করছেন বিশ^জনমত গঠন করে বঙ্গবন্ধুর বিচার বন্ধ করতে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করতে। ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীও মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছেন বঙ্গবন্ধুর কারামুক্তির। একদিকে রণাঙ্গনের লড়াই অন্যদিকে বিশ^জনমতকে পক্ষে নেয়ার প্রবল প্রচেষ্টা। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল বাঙালি বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে নেয়া এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ত্বরান্বিত করার প্রক্রিয়া নিয়ে বিপুল তৎপরতায় লিপ্ত। এসব খবর আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছাড়াও আকাশবাণী ও বিবিসির মাধ্যমে নিয়মিত জানতে পারছি। শেষবার সেপ্টেম্বর মাসের ১৫ তারিখে যখন পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের গ্রাম আক্রমণ করে সেবার তারা এই রেডিওটি আছাড় মেরে ভেঙে পদপৃষ্ঠ করে রেখে যায়। আমরা গভীরভাবে বেদনাহত হই। এই ঘটনা থেকে আমরা উপলব্ধি করি চুরমার করে পাক     বাহিনীর সদস্যদের রেডিওর ওপর কী প্রবল আক্রোশই না ছিল।


১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্সে পাকিস্তানের সেনাপতি এনকে নিয়াজি আত্মসমর্পণ করলে আমরা স্বাধীন হলাম। পরমারাধ্য স্বাধীনতা এখন আমাদের হাতের মুঠোয়- সে এক অনির্বচনীয় উপলব্ধি। যারা এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হননি তাদেরকে এই আনন্দের উচ্ছ্বাস বোঝানোর কোন যুতসই ভাষা বুঝি এখনো আবিষ্কার হয়নি।


আমরা স্বাধীনতা অর্জন করলাম লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে। আনন্দের জোয়ার বইল। কিন্তু তবু বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন স্বদেশে ফিরে না পাওয়ার বেদনা আমাদের প্রতি মুহূর্তে উদ্বিগ্ন করে রাখল। তারপর এলো সেই সোনালি দিন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে এলেন আমাদের মাঝে। আমরা রেডিওতে ধারা বর্ণনা শুনি আর আনন্দাশ্রুতে ভাসি। বঙ্গবন্ধুর ক্রন্দনসিক্ত কণ্ঠস্বর আজও কানে বাজে “কবিগুরু দেখে যাও আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে”।


শুরু হলো নতুন দেশের নবযাত্রা। হাল ধরলেন বঙ্গবন্ধু। আমরা ফিরে এলাম স্কুলে। লুটপাটে বিধ্বস্ত বিবর্ণ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অর্ধশতাব্দি বয়সী ঐতিহ্যবাহী স্কুল। দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া পরিবারগুলো ফিরে আসছে, চলছে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের কাজ। অক্লান্ত বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মীরা নিরন্তর সচেষ্ট থেকে কাজ করছেন পুনর্গঠনের। এর মধ্যে খবর পেলাম বঙ্গবন্ধু যশোরে আসবেন। জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন স্টেডিয়ামে।


আমাদের দর্শনা থেকে যশোর ৫২ মাইল দূরে। তাতে কি? অনেক চেষ্টায় কেরু কোম্পানির একটি ট্রাক যোগাড় করা গেল। এই খোলা ট্রাকে দাঁড়িয়ে আমরা ছাত্রলীগের কর্মীরা গেলাম- স্বাধীনতার মহানায়ককে সালাম জানাতে, তাঁকে একনজর দেখতে। স্টেডিয়ামের কাছে ট্রাক নিয়ে যাওয়া গেল না, মানুষের ঢল নেমেছে। আমরা জনস্রোতে মিশে স্টেডিয়ামের দিকে প্রবাহিত হচ্ছি। পাছে হারিয়ে না যাই- সেজন্য একজন আর একজনের কোমর ধরে বা হাত ধরে এগোচ্ছি। অনেক কষ্ট করে পদদলিত হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে শেষ পর্যন্ত স্টেডিয়ামের এক কোনায় ঠাঁই নিতে পারলাম। দুচোখ সার্থক হলো ইতিহাসের মহানায়ককে দেখে, শ্রবণ ধন্য হলো-তার দেশ গড়ার মন্ত্রে উজ্জীবিত ভাষণ শুনে। এরপর বঙ্গবন্ধুকে শেষবার দেখি ১৯৭৩ সালের ২২ জুলাই ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে। ছাত্রলীগের মহাসম্মেলনে। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এ দিনটিও তাৎপর্যপূর্ণ। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র দেড় বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ দুই ভাগ হয়ে গেল এই দিনে। মহান মুক্তিযুদ্ধে যে সংগঠন অনন্য ভূমিকা পালন করেছে সেই সংগঠনের এই পরিণতি ছিল অতীব দুঃখজনক। রাষ্ট্রবিপ্লবের ইতিহাসে প্রতিবিপ্লবের দৃষ্টান্ত নেহাত কম নয়। বাংলাদেশের ললাটেও সেই দৃষ্টান্তের কালিমা লেপনের অপপ্রয়াস শুরু হলো যুদ্ধ ফেরত এক শ্রেণির অতিবিপ্লবীদের দ্বারা। আ স ম আব্দুর রব ও শাহজাহান সিরাজের প্রকাশ্য নেতৃত্বে এবং সিরাজুল আলম খানের নেপথ্য প্ররোচনায় রাতারাতি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচারণায় লিপ্ত হলো এক অপশক্তি। তাদের সাথে দ্রুত যুক্ত হলো মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাক বাহিনীর এদেশীয় দালালরা। ছাত্রলীগের একাংশ রব-সিরাজপন্থী অন্য অংশ নূরে আলম সিদ্দিকী ও আব্দুল কুদ্দুস মাখনপন্থী। আমরা হতচকিত হলাম কিন্তু দিকভ্রষ্ট হলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম সম্মেলনে যাব এবং বঙ্গবন্ধু যাদের সাথে থাকবেন আমরাও তাদের সাথে যোগ দেব। ভরা শ্রাবণ, হার্ডিঞ্জ সেতু ভাঙা। দর্শনা থেকে ভেড়ামারা ট্রেনে এসে তারপর নৌকায় চড়ে উন্মত্ত পদ্মা নদী পাড়ি দেয়া, সে এক ভীষণ ঝুঁকি। নৌকায় উঠে আমাদের বন্ধু মোসাহেব কান্নাকাটি শুরু করল এবং ঢাকায় না যাওয়ার জন্য বায়না ধরল। আমরা তাকে ‘মরণ ভিতুর ডিম’ আখ্যায়িত করে ফেরত পাঠালাম। তারপর পাকশী থেকে ঈশ^রদী, ঈশ^রদী থেকে ট্রেনে সিরাজগঞ্জ ঘাট। এই ঘাটে এসে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলাম। ছাত্রলীগের সম্মেলন উপলক্ষ্যে যে লঞ্চের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তাতে এত পরিমাণ ছাত্র উঠেছে যে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। আমাদের দলের সিনিয়র ভাই আনোয়ারুল ইসলাম বাবুর বাড়ি সিরাজগঞ্জে। তিনি অনেক কষ্ট করে আবারো একটি নৌকা  ভাড়া করলেন, আমরা সেই নৌকায় চড়ে রওনা দিলাম। হাকলবেরী ফিনের সমুদ্রযাত্রা যেন। বাইরে যতই সাহস দেখাই না কেন বুক দুরু দুরু কাঁপছে। বড় বড় ঢেউয়ের দুলনীর সময় বার বার মনে হচ্ছে মোসাহেবই বুঝি ঠিক করেছে। কিন্তু তবু ঢাকায় যেতে হবে। আমরা স্কুলে ছাত্রলীগের নেতা। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর ভক্ত। আমাদের ভিতু হলে চলবে কেন। একবার প্রবল বাতাসে আর স্রোতের টানে আমাদের নৌকা ডুব চরে আটকে গেল। লুঙ্গি-গামছা পরে সাহসী কয়েকজন নদীতে নেমে নৌকা ঠেলে আবার চালানোর মতো জায়গায় নিলে আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে এসে ট্রেনে উঠব কিন্তু কোনো যাত্রীবাহী বগিতে ঠাঁই পেলাম না। ঠাঁই মিলল মালবাহী বগিতে। যেখানে বমন উদ্রেগকারী শুঁটকি মাছের গন্ধ। তবু ঢাকায় যাওয়া চাই। শুনতে হবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। যে ভাষণে থাকবে ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা। দেড় দিনের যাত্রা শেষে আমরা যখন কমলাপুর স্টেশনে নামলাম তখন আর আমাদের হাঁটার ক্ষমতা নেই। তাতে কি? আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম, আমাদের পৌঁছাতেই হবে গন্তব্যে। গন্তব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা টিএসসি বরাবর আসার পর নানা উল্টাপাল্টা খবর শুনতে লাগলাম, রব-সিরাজের নেতৃত্বে পল্টনের মাঠে আয়োজিত সম্মেলনে যাবেন বঙ্গবন্ধু। অপর পক্ষ বলছে না তিনি রেসকোর্সে সিদ্দিকী-মাখন গ্রুপের সভায় আসবেন। কেউ কেউ বলছেন তিনি কোনোটাই যাবেন না। আমরা মহসীন হলে অবস্থান নিলাম। রাতে থাকতে হবে। পর দিন সম্মেলন। পরিস্থিতির কারণে আমরা মুখ খুলছি না কোন দিকে যাব। পরদিন সকালে গুজবের অবসান ঘটল। জানা গেল বঙ্গবন্ধু আসবেন রেসকোর্সে, আমরা প্রসন্ন হলাম। আমরা রেসকোর্সের সম্মেলনে গেলাম। এই সেই রেসকোর্স যেখানে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে ভাষণ দিয়ে বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এখানে আত্মসমর্পণ করেছে পরাজিত পাকিস্তানের সেনাপতি নিয়াজি। আমরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনলাম। মনোকষ্ট আর আবেগের সংমিশ্রণ ছিল সেই ভাষণে। নিজ হাতে গড়া সংগঠনের এই পরিণতি তার জন্য সহজভাবে মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না।


আমরা বিভক্তির বেদনা বুকে চেপে রেখে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আবারো যাত্রাপথের দূরত্বতা অতিক্রম করে ঘরে ফিরলাম। সামনে সেপ্টেম্বর মাসে আমাদের এসএসসি পরীক্ষা, সে দিকেই মনোযোগ দিতে হবে এখন।


এসএসসি পরীক্ষা হলো গোলেমালে। ভালো পরীক্ষা হওয়ার কোন কারণ ছিল না। এত বড় যুদ্ধের ধাক্কা-স্কুল ও ছাত্র শিক্ষকদের পরিবারের বেহাল অবস্থা এবং সর্বোপরি ক্লাস নাইনে পড়ার সুযোগ না পাওয়া  এসবই পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচ্চ্য। সকল ক্লাসের শিক্ষার্থীদের জন্য ১৯৭১ সালের না পড়া ক্লাসটি অটো প্রমোশনের আওতায় নেয়া হয়। এসএসসির সিলেবাস কমিয়ে ৯০০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়া হয়। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলে দেখা গেল যারা অনেক ভালো ফলাফল করার কথা তারা তা করতে পারেনি। আমরা মাত্র তিনজন ফাস্ট ডিভিশনে পাস করলাম। এরপর কলেজে পড়ার পালা।


১৯৭৪ সালের শুরুতে ভর্তি হলাম যশোর এমএম কলেজে। বড়ই বিশৃঙ্খল অবস্থা। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবণতি ঘটতে লাগলে, আ স ম আব্দুর রবের ও মেজর জলিলের জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল গোপন শাখা গণবাহিনী গঠন করলো। চীনপন্থী বিপ্লবীরা তখনও অর্জিত স্বাধীনতা গ্রহণ করতে পারিনি তারা পূর্ববাংলা বিপ্লবী কমিউিনিস্ট পার্টির নামে অরাজকতা শুরু করল। ভারতের নক্সাল আন্দোলনের নেতা চারুমজুমদারের অনুসারী কেউ কেউ রাতারাতি সমাজবিল্পব সমাধা করার জন্য শ্রেণি শক্র খতমের নামে অরাজকতা শুরু করল। সিরাজ সিকদার এই ধারার বিপ্লবী নেতা। আওয়ামী লীগের সাথে ন্যাপ (মোজাফফর) ও কমিউনিস্ট পার্টি (মনিসিং) আওয়ামী লীগের সহযোগিতায় এগিয়ে এলো। কিন্তু অরাজকতা বেড়েই চলল। আমাদের নিজ থানা দামুড়হুদা-আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আবুল কালামকে হত্যা করা হলো, কুষ্টিয়া-কুমারখালীর এমপি গোলাম কিবরিয়াকেও। মুক্তিযোদ্ধের পরাজিত শক্তি এদেশীয় দালাল রাজাকার আলবদরদের পরিবার এই শক্তির সাথে মিশে ইন্ধন যোগাতে লাগল। যুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নেয়া প্রায় ১ কোটি মানুষের পুনর্বাসন, বিধ্বস্ত অবকাঠামো কার্যাপেযোগী করা, শূন্যের অবস্থান থেকে অর্থব্যবস্থাকে একটি চলনসই কাঠামোর দাঁড় করানো ইত্যাদি বড় বড় চ্যালেঞ্জও মোকাবিলায় যখন সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার কথা তখন এই বিভক্তি ও বৈরিতা ছিল নিতান্তই অনভিপ্রেত ও অপ্রত্যাশিত। ইতোমধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা ঘোষণা করা হয়েছে। কাজেই তার দায়দায়িত্বের শেষ নেই। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সাহায্যের জন্য দুনিয়ার দেশে দেশে হাত পেতে তিনি যে সহযোগিতা পাচ্ছেন

বিস্তারিত
কৃষিতে বঙ্গবন্ধুর অবদান

যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান...। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার গর্বিত নাগরিক আমরা। ত্রিশ লাখ জীবনের বিনিময়ে প্রাপ্ত এ বাংলাদেশকে সোনালি ফসলে ভরপুর দেখতে চেয়েছিলেন। সে কারণেই স্বাধীনতার পর তিনি ডাক দিয়েছেন সবুজ বিপ্লবের। তার প্রণীত এ পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে সবুজায়িত হবে সারা বাংলা, সুখে থাকবে বাংলার মানুষ। স্বাধীনতা উত্তর বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়িত হলে আমরা অনেকটুকু এগিয়ে যেতে পারব কৃষি উন্নয়নে সমৃদ্ধিতে সফলতায়। আর কৃষি উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারলে আমাদের দেশও উন্নত হবে, হবে স্বনির্ভর।


সার্বিক কৃষিকে কীভাবে বঙ্গবন্ধু দেখতেন এবং এর সমৃদ্ধির জন্য তার মনোভাব কেমন ছিল এ কথার জবাবে বলা যায়Ñ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় তিনি দেখতে চেয়েছিলেন দেশের কৃষি ও কৃষকের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন এবং স্বনির্ভরতা। বঙ্গবন্ধুর সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের পুরো দায়িত্ব এখন আমাদের সবার। কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষুধা, অপুষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি সুদৃঢ় করাই হোক আমাদের চলমান অঙ্গীকার। সুতরাং আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি কৃষিই হচ্ছে আমাদের এ অঙ্গীকার পূরণের প্রধান বাহন।
১৯৭৩ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহে বঙ্গবন্ধু বিশেষ ভাষণ দিয়েছিলেন। সে ভাষণে তিনি কৃষি বিপ্লবের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন গ্রামের দিকে নজর দিতে হবে। কেননা গ্রামই সব উন্নয়নের মূল কেন্দ্র। গ্রামের উন্নয়ন আর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যখন বেগবান হবে তখন গোটা বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে সম্মুখপানে। মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের           কৃষি শিক্ষায় আকৃষ্ট করে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার মানসে জাতির পিতা এসময় কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদা প্রদান করেন। তাঁর অদম্য ইচ্ছা ছিল যে কোনো উপায়ে              কৃষকের স্বার্থরক্ষা করা। কেননা কৃষকই এ দেশের আসল নায়ক যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের সবার অন্ন জোগায়।               কৃষকের চলমান, চাহিদা যথোপযুক্তভাবে নিশ্চিত করতে পারলে কৃষক অনেক আগ্রহে স্বতঃস্ফূর্ততায় কৃষিতে নিজেকে বিনিয়োগ করতে পারবে, উন্নয়নের জোয়ার বইবে। কৃষকের উন্নয়ন হলে দেশের উন্নয়ন সময়ের ব্যাপার। বঙ্গবন্ধু ভাবতেন এত দিন আমরা শোষণে নিষ্পেষণে আমাদের মেধা প্রতিভাকে কাজে লাগাতে পারিনি, এখন সময় এসেছে নিজেদের দেশে নিজেদের জ্ঞান মেধা দক্ষতাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো। আমরা তখন গর্বের সঙ্গে বলতে পারব এই তো আমার স্বনির্ভর সোনার বাংলাদেশ।
সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর বৃহৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছেন সবার আগে দরকার আমাদের টোটাল জরিপ। জরিপ ছাড়া কোনো পরিকল্পনাই সফল হবে না। সেজন্য সব কাজ করার আগে আমাদের সুষ্ঠু জরিপ করতে হবে। জরিপের ওপর ভিত্তি করে আমাদের সার্বিক পরিকল্পনা করতে হবে। আমাদের আর্থসামাজিক কারণে দেশে দিন দিন জমির বিভাজন বেড়ে চলছে। যদি সমন্বিত             কৃষি খামার গড়ে তোলা না যায় তাহলে আমাদের কৃষি উন্নয়ন ব্যাহত হবে, আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব না। আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ব। কোঅপারেটিভ সোসাইটির মাধ্যমে আগাতে পারলে আমাদের কৃষির উৎপাদন এবং সার্বিক উন্নয়ন দুটিই মাত্রা পাবে। অধিক শস্য উৎপাদনের জন্য আমাদের সবার সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। মাঠের ফসল, গবাদিপশু, মাছ পরিবেশ সব কিছুর মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় করেত হবে। তা না হলে আমরা কাক্সিক্ষতভাবে এগোতে পারব না। মানুষকে অধিক মাত্রায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। বিশেষ করে কৃষিশিক্ষা কৃষি অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানে সংশ্লিষ্ট সবাইকে শিক্ষিত করতে হবে। তখন এমনিতেই আমাদের উন্নয়ন বেগবান হবে। আরেকটি কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধুÑ গ্রামের কৃষক অনেক অভিজ্ঞ অনেক দক্ষ। তাদের সাথে শেয়ার করে সমন্বয় করে আধুনিক কৃষিতে এগোতে হবে। তবেই আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত সফলতা পাবো অনায়াসে।
মানুুষের ওপর জোর করে কিছুই চাপিয়ে দেয়া যাবে না এটি খুব ভালো করে জানতেন বঙ্গবন্ধু। তাই তো তিনি বলেছেন করে দেখাতে হবে, এতে কৃষক নিজে নিজে শিখে নিজের আঙিনায় বাস্তবায়ন করবে। এক গ্রামের ২০ জনকে একসাথে ক্ষেতখামারে হাতে কলমে কাজ দেখালে পাশের অন্য কৃষক দেখে দেখে নিজের জমিতে বাস্তবায়ন করলে উৎপাদন বেড়ে যাবে। তখন সারা বাংলার অন্যরা এগিয়ে আসবে সম্পৃক্ত হবে উন্নয়নের মূলধারায়। কেননা আমাদের কৃষক দেখে বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত। তিনি কৃষিবিদদের উদ্দেশে বলেছেন, আপনারা যারা কৃষি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন আপনাদের গ্রামে গিয়ে              কৃষকের সাথে মিশে যেতে হবে, মনোযোগ দিতে হবে তাদের চাহিদা আর কর্মের ওপর, তবেই তারা সাহসী হবে, আগ্রহী হবে, উন্নতি করবে। ফলবে সোনার ফসল ক্ষেত ভরে। আপনারা এখন শহরমুখো হওয়ার কথা ভুলে যান। গ্রাম উন্নত হলে দেশ উন্নত হবে, তখন আপনারা আপনা-আপনি উন্নত হয়ে যাবেন। গ্রামভিত্তিক বাংলার উন্নতি মানে দেশের উন্নতি, আর আপনাদের উন্নতি তখন সময়ের ব্যাপার। শহরের ভদ্রলোকদের দিকে তাকিয়ে আপনাদের চিন্তা বা আফসোস করার কোনো কারণ নেই। কেননা গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের দিকে আমাদের সবার ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। কৃষক বাঁচাতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে, তা নাহলে বাংলাদেশ বাঁচতে পারবে না।
অনেকের আগ্রহ থাকতে পারে কৃষি উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অর্থ বরাদ্দ কেমন ছিল। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন উৎসবে ১৩ ফেব্রুয়ারি ৭৩ তারিখে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন...খাদ্য বলতে শুধু ধান, চাল, আটা, ময়দা আর ভুট্টাকে বুঝায় না বরং মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি এসবকে বুঝায়। সুতরাং কৃষির উন্নতি করতে হলে এসব খাদ্যশস্যের উৎপাদন উন্নতি করতে হবে। ১৯৭২-৭৩ সালে ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ ছিল এর মধ্যে ১০১ কোটি টাকা শুধু কৃষি উন্নয়নের জন্য রাখা হয়েছিল। এতে তখন থেকেই কৃষির প্রতি, কৃষি সম্প্রসারণের প্রতি, কৃষি উন্নয়নের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা প্রকাশ পায়। বঙ্গবন্ধু ভাবতেন সবার আগে দরকার খাদ্যের। খাদ্যের নিশ্চয়তা না দিতে পারলে সব উন্নয়ন কার্যক্রম বিফলে যাবে। সুতরাং নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজেরা উৎপাদন করতে হবে। সবুজ বিপ্লবের কথা বঙ্গবন্ধু বলতেন। কিন্তু তিনি এও বলতেন, সবুজ বিপ্লবের কথা শুধু মুখে বললেই চলবে না। এর সাথে যেসব সমস্যা আছে সেগুলোকে যাচাই-বাছাই করে সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। তবেই সবুজ বিপ্লব সফল হবে।
প্রাতিষ্ঠানিক কৃষি উন্নয়ন তথা কৃষি এবং কৃষকের কথা ভেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জনগণের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্তির লক্ষ্যে কৃষি উন্নয়নের বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কৃষির দূরদর্শিতাকে অসামান্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। এ কারণেই তিনি কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন, পুনঃসংস্করণ, উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন। কৃষি বিষয়ক বিদ্যমান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো ও কার্যক্রমের আমূল পরিবর্তন ও সংস্কারের মাধ্যমে এবং প্রযুক্তি চর্চায় মেধা আকর্ষণের যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। জাতির জনক বলেছেন খাদ্যের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য আমাদেরই উৎপাদন করতে হবে। আমরা কেন অন্যের কাছে খাদ্য ভিক্ষা চাইব। আমাদের উর্বর জমি, আমাদের অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ, আমাদের পরিশ্রমী মানুষ, আমাদের গবেষণা সম্প্রসারণ কাজে সমন্বয় করে আমরা খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করব। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। আরেকটি কথা বঙ্গবন্ধু সব সময় বলতেন আমাদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আমাদের উৎপাদন আমাদের সুখশান্তি সব বিপন্ন হবে। সুতরাং যে করেই হোক আমাদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।
কৃষি উপকরণে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাচেতনা যা ছিল আজ এত বছর পরেও আশ্চর্য হতে হয়। কৃষিশিক্ষা, মানসস্মত বীজ উৎপাদন এবং বিতরণ, সুষ্ঠু সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা, কৃষিতে ভর্তুকি, বালাই ব্যবস্থাপনা, সমন্বিত ফসল ব্যবস্থাপনা, খামারভিত্তিক ফসল ব্যবস্থাপনা, সমবায়ভিত্তিক চাষাবাদ, ভেঙে যাওয়া অর্থনীতি পুনর্গঠন, মিল্কভিটা পুনর্গঠন, সার, সেচ, বীজ বিষয়ক কার্যক্রম এসবের ওপর সর্বাত্মক জোর দিয়েছেন। কেননা তিনি জানতেন এগুলো যথাযথভাবে না করতে পারলে আমরা অনেক পিছিয়ে যাবো। বিশেষ করে রাসায়নিক সারের বিষয়ে তিনি বলেছেন, আমাদের যে সার কারখানাগুলো আছে এগুলোকে নিশ্চিত উৎপাদনমুখী করতে হবে বেশি করে। প্রয়োজনে আরও নতুন নতুন সারের কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে হবে কৃষি বিপ্লব বাস্তবায়নের জন্য। সুতরাং আমরাও একান্তভাবে বিশ্বাস করি আমাদের উন্নয়নের কর্মসূচি পরিকল্পনা গ্রহণ করার আগে সুষ্ঠু সমন্বিত বাস্তব অবস্থাভিত্তিক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। সর্বোচ্চ শ্রম, মেধা, বিনিয়োগ করে এগিয়ে গেলে আমরা নিশ্চিত সফল হবোই।
গবাদিপশুর কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। গরু দিয়ে হাল চাষ, গরুর গোবর জমিতে প্রয়োগ করে জমির উর্বরতা বাড়ানোর তাগিদ তিনি তখনই দিয়েছেন। বালাই ও বালাইনাশকের কথাও তিনি বলেছেন। নিজেদের বালাইনাশক কারখানা তৈরি ও এর সুষ্ঠু ব্যবহারের প্রতি তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নিজেরা বীজ উৎপাদন করতে হবে। প্রয়োজনে শুরুতে বিদেশ থেকে মানসম্মত বীজ আমদানি করে দেশের বীজের চাহিদা মেটাতে হবে। পরে আমরা নিজেরাই মানসম্মত উন্নত বীজ উদ্ভাবন করব। শীতকালীন ফসল উৎপাদনে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন শীতকাল আমাদের ফসল উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি নির্ভেজাল এবং নিশ্চিত মৌসুম। তাছাড়া অন্য দুই মৌসুমের চেয়ে এ মৌসুমে বেশি সংখ্যক বেশি পরিমাণ ফসল উৎপাদিত হয়। সেজন্য শীতকালে ফসল উৎপাদন বাড়িয়ে আমাদের শস্যভা-ার টইটুম্বুর করতে হবে।
কৃষিবিদদের তিনি শহরে অবস্থান না করে গ্রামেগঞ্জে চলে গিয়ে কৃষকের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করতে বলেছেন। কেননা বঙ্গবন্ধু জানতেন গ্রাম এবং কৃষকই কৃষি উন্নয়নই আমাদের সব উন্নয়নের মূলভিত্তি। গ্রাম এবং কৃষককে উন্নত করতে পারলে কৃষি তথা দেশ এমনিতেই উন্নত হয়ে যাবে। জমির খ-ায়ন বঙ্গবন্ধু পছন্দ করতেন না। তিনি চাইতেন সবাই মিলে একসাথে সমবায়ের ভিত্তিতে জমিকে বিভক্ত না করে বড় জমিতে কৃষি কাজ করা। এতে খরচ কমে যাবে লাভ বেশি হবে।
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে কৃষির গুরুত্ব সীমাহীন। আমাদের রয়েছে উর্বর মাটি, প্রকৃতি প্রদত্ত অফুরন্ত সম্পদ, আর পরিশ্রমী জনগণ। এগুলোর সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে আমরা অসাধ্য সাধন করে ফেলতে পারি। গড়তে পারব বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা, সুখে থাকবে বাংলার মানুষ, সুখে থাকবে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর আজীবনের লালিত স্বপ্ন ছিল এদেশের শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত কৃষকের মুখে হাসি ফোটানো, তাই তিনি সার্বিক কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার প্রদানের পাশাপাশি কৃষি উন্নয়নের সৈনিক কৃষিবিদদের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। এজন্য বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে আমরা সবাই বদ্ধপরিকর। দরকার আমাদের সমন্বিত, আন্তরিক এবং কার্যকর পদক্ষেপ। বঙ্গবন্ধু একটি নতুন মানচিত্র চেয়েছিলেন, নতুন ভূখ- চেয়েছিলেন, নতুন জাতিসত্তা চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন একটি স্বনির্ভর সুখী মানুষের সোনার  দেশ।
আমাদের সবার সম্মিলিত আন্তরিক এবং কার্যকরী প্রচেষ্টায় আমাদের নিয়ে যাবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সর্বোচ্চ সীমায়। অদূর ভবিষ্যতে আমরা বিনির্মাণ করতে পারব স্বনির্ভর সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ। একটি কথা শুধু বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে বা শ্রদ্ধা করেই স্বনির্ভর সোনার বাংলা গড়া যাবে না। বঙ্গবন্ধুর কথাগুলোকে তিল তিল করে কাজে লাগাতে হবে, কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত করতে হবে বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন। তবেই আমরা তার কথা রেখেছি সে কথা বলতে পারব গর্বের সাথে। কথার চেয়ে কাজ বেশি, পরিকল্পনার চেয়ে বাস্তবায়ন বেশিই হোক আমাদের আন্তরিক অঙ্গীকার। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হোক আমাদের হৃদয়ের মন মানসিকতার ঐকান্তিক ইচ্ছা ও কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে। আমরা যেন তখন মাথা উঁচু করে বলতে পারি সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এ দেশে। য়

মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা, ফোন : ৯১৪০৮৫০, ই-মেইল : ফম@ফধব.মড়া.নফ

বিস্তারিত
বঙ্গবন্ধু ও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে কৃষি গবেষণা

বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন মহান স্বাধীনতা লাভের অব্যাবহতি পরেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের দিকে আমাদের সবার ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।’ তিনি বলেছিলেন ‘কৃষক বাঁচাতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে তা না হলে বাংলাদেশ বাঁচতে পারবে না।’ তাঁর সেই ভবিষ্যৎ বাণীর বহিঃপ্রকাশ আজকের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সময় বিবেচনায় খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো সহজ ছিল না, কেননা, পূর্ব বাংলার খাদ্য ঘাটতি বহু আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। যদিও ষাটের দশকে এ দেশের কৃষি ব্যবস্থাপনায় আধুনিকতার ছোঁয়া লেগে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতির দিকে যেতে থাকে কিন্তু ১৯৭০ সালের শতাব্দীর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় এবং ধ্বংসলীলার কোন শেষ ছিল না। উপকূলে কৃষি ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে যায় ফলে দেশে খাদ্য ঘাটতি আরো বেড়ে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় কৃষি ব্যবস্থা আরো বেশি নাজুক হয়ে পড়ে কেননা নগন্য সংখ্যক কৃষক জমি চাষ করার সুযোগ পায়। ফলে বিপুল পরিমাণ খাদ্য ঘাটতির বোঝা নিয়েই দেশের স্বাধীনতার প্রাপ্তি ঘটে। বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো দেখা দেয় ১৯৭৪ সালের মারাত্মক বন্যা যার ফলে ফসলহানি ঘটে ও খাদ্য উৎপাদনের সুযোগও কমে যায়। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে হয়ে পড়ে। বিদেশ থেকে আমদানি করে সংকট মেটানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ সময়ে আন্তর্জাতিক সা¤্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশের ওপর খাদ্য কূটনীতি প্রয়োগ করে যার ফলে আমদানিকৃত খাদ্য সমুদ্রপথে প্রত্যাহার করে অন্যত্র চলে যায়। এরপর থেকে বঙ্গবন্ধু খাদ্য উৎপাদনের গুরুত্ব বিশেষভাবে অনুভব করে তাঁর মন্ত্রিসভা ও সদস্যদের কে যথাসাধ্য ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। ফলে সে বছরই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়ায়। কৃষি উৎপাদন উল্ল্যেখযোগ্য পরিমাণ বাড়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল সম্পূর্ণ কৃষি ভিত্তিক। বঙ্গবন্ধুর গতিশীল ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন পরিকল্পনার জন্য সে বছর কৃষিতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার পৌঁছেছিল ৭ শতাংশে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর পরবর্তী সামরিক সরকার সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ব্যবস্থা করেনি।


ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায় তিনি দেখতে চেয়েছিলেন দেশের কৃষি ও কৃষকের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন এবং স্বনিভর্রতা। তাই তো বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত কৃষি ক্ষেত্রে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহে বঙ্গবন্ধু বিশেষ ভাষণ দিয়েছিলেন। সে ভাষণে তিনি কৃষি বিপ্লবের কথা বলেছিলেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন উৎসবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘খাদ্য বলতে শুধু ধান, চাল, আটা, ময়দা আর ভুট্টাকে বোঝায় না বরং মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি এসবকে বোঝায়।’ সুতরাং কৃষি উন্নতি করতে হলে এসব খাদ্যশস্যের সমন্বিত উৎপাদন বাড়াতে হবে। ১৯৭২-৭৩ সালে ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ ছিল। এর মধ্যে ১০১ কোটি টাকা শুধু কৃষি উন্নয়নের জন্য রাখা হয়েছিল। এতে তখন থেকেই কৃষির প্রতি, কৃষি উন্নয়নের প্রতি তাঁর গভীর আন্তরিকতা প্রকাশ পায়। বঙ্গবন্ধু ভাবতেন সবার আগে দরকার খাদ্যের। আর খাদ্যের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য আমাদেরই উৎপাদন করতে হবে। খাদ্যের নিশ্চয়তা না দিতে পারলে সব উন্নয়ন কার্যক্রম বিফলে যাবে। সেই ভাবনা থেকেই বঙ্গবন্ধু এ দেশে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিষ্ঠা ও কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলেন।


প্রাতিষ্ঠানিক কৃষি উন্নয়ন তথা কৃষি এবং কৃষকের কথা ভেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জনগণের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্তির লক্ষ্যে কৃষি উন্নয়নের বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন, সংস্কার, উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন। কৃষি বিষয়ক বিদ্যমান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো ও কার্যক্রমের আমূল পরিবর্তন ও সংস্কারের মাধ্যমে এবং প্রযুক্তিচর্চায় মেধা আকর্ষণের যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। জাতির পিতা বলেছেন, স্বাধীনতা উত্তরকালে কৃষি সেক্টরে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা। বাংলাদেশ  কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল নামক একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত কৃষি গবেষণা কাউন্সিল পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেম প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল বর্তমানে নার্স এর শীর্ষ সংস্থা হিসেবে ১২টি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।


দেশে ধান গবেষণার গুরুত¦ অনুধাবন করেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে আইন পাসের মাধ্যমে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এর প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেন এবং ধানের ওপর নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক বি আর ৪ (ব্রিশাইল) এবং বিনা কর্তৃক ধানের উন্নত জাত ওজঅঞঙগ ২৪ এবং ওজঅঞঙগ ৩৮ উদ্ভাবিত হয় এবং ধান উৎপাদন ব্যবস্থা শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এসব কার্যক্রমের ফলে সে সময় দেশের খাদ্য আমদানি প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার কারনে ধানের উচ্চফলনশীল আধুনিক জাত উদ্ভাবন স¤ভব হয়েছে এবং অদ্যাবধি বিএআরআই কর্তৃক বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবনসহ ধানের ৯৭টি উচ্চফলনশীল জাত অবমুক্ত করা হয়েছে। ফলে বর্তমানে দেশে চাহিদার অতিরিক্ত ধান উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।


একইভাবে বঙ্গবন্ধু শাসন আমলে কৃষি গবেষণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার লক্ষ্যে ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর সিংহভাগ ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ কার্যক্রম পরিচালিত হয় যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭৬ সালে এটি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বর্তমানে বিভিন্ন ফসলের উন্নত জাতসহ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে যা দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বঙ্গবন্ধু শাসন আমলে ১৯৭৩ সালে সর্ব প্রথম গমের উচ্চফলনশীল (ঐণঠ) জাত এদেশে গবেষণার জন্য আনা হয় এবং গমের ওপর গবেষণা কাজের সূচনা করা হয়। ১৯৭৪ সালে গমের উচ্চফলনশীল জাত (ঝড়হড়ৎধ৬৪, গধীর চধশ৬৫, ঊহরধ৬৬, ঘড়ৎঃড়হড় ৬৭ ্ ঝড়হধষরশধ) মুক্ত করা হয় যার মধ্যে সোনালিকা জাতটি এদেশে গম উৎপাদনে যুগান্তকারী ভূমিকার শুভ সূচনা করেছিল। অদ্যাবধি বিএআরআই বিভিন্ন ফসলের ৫৩৯টি উচ্চফলনশীল জাতসহ ১০৪৪টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। শাকসবজি, ফলমূল, গম, তৈল বীজ ফসল এবং ডাল জাতীয় ফসলের বিভিন্ন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশে আজ বহুলাংশে খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা মিটানো সম্ভব হয়েছে।


বঙ্গবন্ধুর শাসন আমলেই ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, হর্টিকালচার উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তুলার ৩টি জাত (উ-৫২, উ-১০, ও উ-১২৪) ১৯৭৫ সালে উদ্ভাবন করা হয়।


কৃষকদের মাঝে কৃষি খাতে প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭৪ সাল থেকে কৃষি উন্নয়নে জাতীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় পুরস্কার প্রদান চালু করেন। বঙ্গবন্ধুর সময় দেশের প্রথম কৃষি ঋণ ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়। কৃষকরা যাতে সহজভাবে ঋণ পেতে পারে এ লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করা হয়। তিনি কয়েক লক্ষ কৃষকের কৃষি ঋণের সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার করেছিলেন এবং ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে খাস জমি বিতরণ এবং সহজশর্তে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করেছিলেন। তখনকার প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতির ক্ষেত্রে কৃষির আধুনিকায়নে জাতির পিতা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সে সময়ে কৃষকদের খাদ্যশস্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধু কিছু দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যাতে কৃষক সমৃদ্ধভাবে জীবনযাপন করতে পারে। বঙ্গবন্ধু কৃষিখাতের মাঠকর্মী ও সরকারি কর্মকর্তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বঙ্গবন্ধু উন্নত এবং স্বল্পমেয়াদি চাষাবাদ পদ্ধতি, মানসম্মত বীজ সরবরাহ, সেচ এবং অন্য কৃষি উপকরণ সহযোগিতার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রান্তিক চাষিদের কৃষিঋণ মওকুফ, তাদের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার এবং ভূমিহীনদের মাঝে খাস জামি বণ্টনের ব্যবস্থা করেন।


সর্বোপরি তাঁরই নীতি অনুসরণ করে তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে পথে এগোচ্ছেন এবং কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আসছেন। স্বাধীনতার পরে ৪৫ বছরে প্রায় ৩০ শতাংশ আবাদি ভূমি কমে যাওয়া সত্ত্বেও ধানসহ খাদ্যশস্য উৎপাদন ১৯৭২ সালের ১ দশমিক ১০ কোটি মেট্রিক টন থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সে দানাদার ফসলের উৎপাদন বেড়ে প্রায় ৪১৩.২৫ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। কৃষিতে অভাবনীয় সফলতা এনে তিনি বিশ্ব দরবারে রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমরা সবাই বদ্ধপরিকর। দরকার আমাদের সমন্বিত, আন্তরিক এবং কার্যকর পদক্ষেপ। বঙ্গবন্ধু একটি নতুন মানচিত্র চেয়েছিলেন, নতুন ভূ-খ- চেয়েছিলেন, নতুন জাতিসত্তা চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন একটি স্বনির্ভর-সুখী মানুষের সোনার দেশ। সুতরাং আমরাও একান্তভাবে বিশ্বাস করি আমাদের উন্নয়নের কর্মসূচি পরিকল্পনা গ্রহণ করার আগে সুষ্ঠু সমন্বিত বাস্তব অবস্থাভিত্তিক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। সর্বোচ্চ শ্রম, মেধা, শ্রম বিনিয়োগ করে এগিয়ে গেলে আমরা নিশ্চিত সফল হবই। সবার সম্মিলিত আন্তরিক এবং কার্যকরী প্রচেষ্টা আমাদের নিয়ে যাবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সর্বোচ্চ সীমায়। বঙ্গবন্ধুর প্রণীত পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে সবুজায়িত হবে সারা বাংলা, সুখে থাকবে বাংলার মানুষ। অদূর ভবিষ্যতে আমরা বিনির্মাণ করতে পারব স্বনির্ভর সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ।

 

ড. মো. কবির ইকরামুল হক

নির্বাহী চেয়ারম্যান, বিএআরসি, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন : ৯১৩৫৫৮৭, ই-মেইল : ec-barc@barc.gov.bd

বিস্তারিত
বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় আজকের কৃষি

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ সালে এ দেশের মুক্তিপাগল মানুষ পরাধীনতার শিকল ভাঙ্গতে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র-বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পূর্বে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ আর বঞ্চনার শিকার ছিল এই বাংলা । এ বাংলার অর্থনীতির অবস্থান ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল  শোষণমুক্ত, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে সোনালি ফসলে ভরপুর দেখতে চেয়েছিলেন। সে কারণে স্বাধীনতার পর তিনি ডাক দিয়েছেন সবুজ বিপ্লবের, কৃষিকে দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ গুরুত্ব। কৃষকের সব বকেয়া খাজনা ও সুদ তিনি মাফ করে দেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরতরে মওকুফ করেন। ১৯৭২-৭৩ সালে ৫০০ কোটি টাকার উন্নয়ন বরাদ্দে ১০১ কোটি টাকা তিনি রাখেন শুধু কৃষির উন্নয়নে। কৃষকদের বিনামূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক ও আনুষঙ্গিক উপকরণ, কৃষি যন্ত্রপাতি, সেচ সুবিধা সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে  ১৯৭২ সালে ১৬ হাজার ১২৫ টন উচ্চফলনশীল ধানবীজ, ৪৪ টন পাটের বীজ, এক হাজার ৩৭ টন গমের বীজ বিতরণের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে কৃষির উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের অগ্রযাত্রা সূচিত করেন। টেকসই কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে গবেষণাসহ কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং পুনর্গঠন করেন। তিনি আধুনিক ও উন্নত কৃষির প্রয়াসে কৃষি শিক্ষায় মেধাবীদের চাকরিতে আকৃষ্ট করে উন্নত কৃষি ব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে, কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদা প্রদান করেন। তাঁর এই যুগান্তকারী পদক্ষেপে দেশের মেধাবী সন্তানগণ আগ্রহী হয় কৃষি পেশায়।    


বঙ্গবন্ধুর প্রাণাধিক চেয়েও প্রিয় ছিল বাংলার কৃষক। বঙ্গবন্ধু যখন দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন তখন এ দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ লোক ছিল কৃষির উপর নির্ভরশীল। তিনি বলেছিলেন, ‘গ্রামের দিকে নজর দিতে হবে। কেননা গ্রামই সব উন্নয়নের মূল কেন্দ্র। গ্রামের উন্নয়ন আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন যখন বেগবান হবে, তখন গোটা বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।’ তাঁর অদম্য ইচ্ছা ছিল যে কোনো উপায়ে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করা। কেননা কৃষকরাই এ দেশের উন্নয়নের আসল নায়ক যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের সবার অন্ন জোগায়। কৃষকদের চলমান চাহিদা যথোপযুক্তভাবে নিশ্চিত করতে পারলে কৃষক অনেক আগ্রহে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেকে বিনিয়োগ করতে পারবে। উন্নয়নের জোয়ার বইবে তখন।


বঙ্গবন্ধু কৃষিপণ্য রপ্তানির মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের স্বপ্নবীজ বুনেছিলেন। তিনি পাট, চা, পশুর চামরা, মৎস্য, বনজসম্পদ ইত্যাদি রপ্তানি করে অর্থনৈতিক মুক্তির প্রয়াস নিয়ে ছিলেন। স্বাধীনতার পর স্বাধীনতাবিরোধীদের কুৎসিত ষড়যন্ত্রে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ জাতির পিতা সপরিবারে নির্মমভাবে শাহাদতবরণ করেন। থমকে যায় উন্নয়নের চাকা। এই বাংলার দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্রের হাত থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পাইনি বহুকাল। ১৯৯৬-২০০১ সনে বাংলার আপামর মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর কৃষিভিত্তিক মিশন আর ভিশনকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সফল প্রধানমন্ত্রী কৃষকরত্ন শেখ হাসিনা জাতির পিতার অসমাপ্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে সর্বপ্রথম খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। এর ফলশ্রুতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ভূষিত হন জাতিসংঘের গৌরবময় সেরেস পদকে। পরবর্তীতে সরকার বদলের প্রেক্ষিতে সে উন্নয়নের ধারা চরমভাবে ব্যাহত হয়।


২০০৯ সালে এ আওয়ামী লীগ সরকার আবার রাষ্ট্র পরিচালনায় এলে দেশের উন্নয়নের চাকা আবার সচল হতে থাকে। জাতিসংঘের হিসেব খাতায় আমাদের দেশ ছিল স্বল্পউন্নত দেশের কাতারে। সেখান থেকে উন্নয়নশীল দেশের সম্মানে উন্নীত হতে আর্থসামাজিক সকল সূচক অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ। আর এ সম্মান অর্জন সম্ভব হয়েছে বর্তমান সরকারের সৎ, দক্ষ ও সাহসী, নেতৃত্বের কারণে। কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে-এই মূলমন্ত্রের প্রতি অবিচল থেকে বর্তমান সরকার কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষুধা, অপুষ্টি, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গঠনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ১৯৭১-৭২ সালে খাদ্যশস্যের উৎপাদন হয়েছিল ৯৭ লাখ মেট্রিক টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে খাদ্যশস্যের উৎপাদন হয়েছে ৪১৩.২৫ লাখ মেট্রিক টন  বাংলার শস্যভা-ার আজ কানায় কানায় পূর্ণ, খাদ্য স্বল্পতার দেশ থেকে বাংলাদেশ আজ উদ্বৃত্ত খাদ্যের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।


সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টা, বিনিয়োগ, সময়োপযোগী নীতি-পদক্ষেপ এর ফলে কৃষি উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত হয়েছে ধানের ১০৮টি জাত খরা, লবণাক্ত ও জলাবদ্ধতা, জিংকসমৃদ্ধ এবং স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত উদ্ভাবন কৃষি ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গম, আলু, ভুট্টা, ডাল, তেল, শাকসবজি, ফলমূল, মসলা ফসলের এ পর্যন্ত ৫৪৫টি উচ্চফলনশীল উন্নত জাত এবং আখের ৮টি, সুগারবিটের ৪টি ও তুলার ৭টি  উন্নত জাত এখন কৃষকের কাছে। উদ্ভাবিত হয়েছে ৫০৫টি উন্নত ফসল ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি যা কৃষিকে আরও নিবিড়ভাবে নিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন নীতি ও পদক্ষেপ বিশ্ব কৃষিকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে দারুণভাবে। বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বের কৃষি উন্নয়নের রোল মডেল। কৃষি উৎপাদনের নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ^ আসরে মর্যাদার আসন লাভ করেছে। বাংলাদেশ এখন পাট রপ্তানিতে বিশ্বে প্রথম, পাট  ও কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়, মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়, ধান উৎপাদনে বিশ্বে  চতুর্থ, বদ্ধ জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম, আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম, পেয়ারা ও আলু উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম, মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বে দশম। ইতোমধ্যে পাট, ধৈঞ্চা ও ইলিশের জন্ম রহস্য আবিষ্কার হয়েছে। ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে ইলিশ ও খিরসাপাত আমের স্বীকৃতি পেয়েছে। শস্য নিবিড়তা বেড়েছে কাক্সিক্ষত মাত্রায়। বর্তমান সরকার কৃষি প্রণোদনা ও কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি চালু করেছে। কৃষক ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ পেয়েছে। সরকারের দেয়া প্রণোদনার টাকা কৃষকের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। উৎপাদন খরচ সহনীয় মাত্রায় আনতে সারের মূল্য কমিয়ে এনেছে। বর্তমান সরকার সর্বপ্রথম কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড চালু করেছে। বাংলাদেশ কৃষি যান্ত্রিকীকরণেও উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ফসলের ক্ষতি বিবেচনা করে আধুনিক কৃষিযন্ত্র ক্রয়ে ভর্তুকি প্রদানে অব্যাহত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ৫০% থেকে ৭০% উন্নয়ন সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বকে তাক লাগিয়ে পাটের জিনোম রহস্য উন্মোচনে বাংলাদেশ পায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ভূ-উপরিস্থ পানি সরবরাহের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন অঞ্চলসহ সেচের পানি স্বল্পতা অঞ্চলে কৃষিতে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। পরিবর্তিত জলবায়ুর সাথে খাপখাইয়ে নেয়ার প্রত্যয়ে সরকার সম্প্রসারণ করছে জলমগ্ন হাওর এলাকায় ভাসমান সবজি চাষ। এ পদ্ধতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা কর্তৃক সমাধৃত হয়েছে। আর আমরা পেয়েছি বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি। খাটো জাতের নারিকেলের চাষাবাদ দুর্যোগ প্রতিরোধে উপকূলীয় বেষ্টনী এলাকা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে  কৃষিতে গতি সঞ্চারিত হয়েছে। কিষান-কিষানি এখন ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্য সেবা পেয়ে থাকে নানাভাবে। কৃষিক্ষেত্রে অসামান্য অবদানে স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার প্রবর্তন করেছে বর্তমান সরকার।


বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এবং কাঠামোগত উৎকর্ষতা দৃশ্যমান। বর্তমান সরকারের উন্নয়ন অভিপ্রায় ইতোমধ্যে আমরা দানাদার খাদ্যশস্যে পুনরায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। সবজি, ফল, সুগন্ধি চালসহ কৃষিপণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছি। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিল্প-বাণিজ্য এবং কাঠামোগত উন্নয়নে সব দিক থেকে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এখন আমাদের লক্ষ্য হলো সবার জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অর্থাৎ নিরাপদ ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ  এবং ২০৪১ সালের মধ্যে স্বপ্নের উন্নত দেশের সম্মান। সে লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে নানামুখী উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মসূচি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের দীপ্ত পদক্ষেপের ফলে সে লক্ষ্যে নিশ্চিতভাবে পৌঁছে যাবো বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

 

কৃষিবিদ ড. মো. নুরুল ইসলাম১ কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম২

১পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। ফোন : ৯১১২২৬০, ই-মেইল :  dirais@ais.gov.bd ২সম্পাদক, কৃতসা, খামারবাড়ি, ফোন : ৫৫০২৮৪০৪, ই-মেইল : editor@ais.gov.bd

 

বিস্তারিত
ইক্ষু ফসলের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান

মানুষটির সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হচ্ছে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, তিনি বাঙালির জাতির পিতা, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিতে সমসাময়িককালের একজন রাষ্ট্র নায়কের উদ্ধৃতিই যথেষ্ট। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিডেল ক্যাস্ট্রো আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বলেছিলেন ‘I have not seen the Himalayas. But I have seen Sheikh Mujib. In personality and in courage this man is the Himalayas. I have thus had the experience of witnessing the Himalayas. অতএব হিমালয় সদৃশ এ মানুষটির অবদান এত ছোট একটি নিবন্ধে  প্রকাশ করা সম্ভব নয়, সে অপারগতা প্রথমেই স্বীকার করে নেই। টুঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চে যে শিশুটির জন্ম হয়েছিল কালের বিবর্তনে সেই হলো বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি আমাদের জাতির পিতা।


১৯৪৩ এর মন্বন্তর প্রত্যক্ষ করেই তিনি হয়ে ওঠেন স্পষ্টভাষী। এরপর ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ এর নির্বাচন, যুক্তফ্রন্ট সরকারের কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ, ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রদেশিক সরকারে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ, ১৯৬৬ এর ৬ দফা অন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১ এর ৭ মার্চের ভাষণ এবং পরবর্তীতে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা; এসবই তাঁর জীবনের মাইলফলক। এর মধ্যেই তিনি বিশাল উচ্চতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন; সে কথা সবার জানা। আমরা এখানে শুধু ইক্ষু বিষয়ে তাঁর দর্শন এবং সে প্রেক্ষিতে তাঁর অবদান নিয়ে কিছু কথা বলব।


কৃষি প্রধান বাংলাদেশের কৃষিই আমাদের অর্থনীতির মূলভিত্তি। কৃষিকে ঘিরেই এ দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালিত হয়। তাছাড়া দারিদ্র্যবিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে কৃষির অবদানই সবচেয়ে বেশি। এ দেশের বেশির ভাগ মানুষও কৃষির উপর নির্ভরশীল। বঙ্গবন্ধু মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন এদের উন্নতি না হলে দেশের উন্নতি হবে না, স্বাধীনতার সুফল আসবে না। তাই তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল কৃষিকে প্রাধান্য দেয়া। বিশেষ করে শিল্প ভিত্তিক কৃষি। পাকিস্তানি শাসন আমলে এ দেশে বিশেষত দেশের উত্তরাঞ্চলে শিল্পের কোন প্রসার ছিল না। একমাত্র চিনি শিল্পই এখানকার সম্পদ, যার বেশির ভাগই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। তাই দেশ গড়ার দিকে নজর দিয়ে তিনি চিনি শিল্পকে নতুন করে সাজানোর জন্য জোর দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সাল থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত (১৯৭৫) তাঁর কর্মকা- পর্যালোচনা করলেই এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। যে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি ইক্ষু চারা পরীক্ষাগার নামে এদেশে ১৯৩১ সালে ঢাকার মনিপুরিপাড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে ঈশ্বরদীতে ১৯৫১ সালে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা ইনস্টিটিউটে (ইক্ষু গবেষণা স্টেশন) রূপলাভ করে তা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটিকে ‘বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট’ নামে পুনর্গঠিত করে ১৯৭৩ সালে তিনি ‘বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট’ স্থাপন করেন।  কারণ তিনি জানতেন গবেষণা ছাড়া কোন ফসলের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। বিদেশ থেকে জাত কিংবা প্রযুক্তি এনে দেশের কৃষি উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই গবেষণার পাশাপাশি ইক্ষু চাষ বাড়ানোর এবং চিনি শিল্পের উন্নয়নের জন্য তিনি ‘নিবিড় ইক্ষু উন্নয়ন প্রকল্প’ ও ‘খামার আধুনিকীকরণ প্রকল্প’ গ্রহণ করেন। তিনি নতুন চিনিকল স্থাপন ও বিদ্যমান কয়েকটি চিনিকলের যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপন ও আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেন। চিনির পাশাপাশি গুড় শিল্পের উন্নয়নেও তার ছিল যথেষ্ট সদিচ্ছা। তাই আখ-চিনি-গুড় এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর ঐকান্তিক ভালোবাসা। তারই ধারাবাহিকতায় আজ যখন তারই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ দেশে তালগাছ রোপণের আহ্বান জানান তখন আমাদেরও বুঝতে বাকি থাকে না যে তিনি শুধু বজ্রপাত প্রতিরোধের জন্যই এ কর্মসূচি দেননি বরং বজ্রপাত প্রতিরোধের পাশাপাশি তালগাছ থেকে রস আহরণ করে, তার গুড় তৈরি করে দেশের মানুষ যেন আরো বেশি করে মিষ্টি খাবার গ্রহণ করতে পারে সে উদ্যোগও তিনি পরোক্ষভাবে দেশের মানুষকে নিতে বলেছেন। কারণ উপযুক্ত পরিমাণে মিষ্টিজাতীয় খাবার গ্রহণ ছাড়া দেশের মানুষের মেধা পরিপূর্ণ বিকশিত হবে না আর তা না হলে তিনি যে উন্নত এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার কর্মসূচি নিয়েছেন তার সাথে তালমিলিয়ে এ দেশের সাধারণ মানুষ এগিয়ে যেতে পারবে না। তাই বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের আখ চিনি গুড় শিল্পের উন্নয়ন করতে হবে। এতে একদিকে যেমন বাড়বে আখচাষির আয় অন্যদিকে মিটবে মানুষের পুষ্টি চাহিদা, হবে মেধাশক্তির বিকাশ।

 

ড. মো. আমজাদ হোসেন১ ড. সমজিৎ কুমার পাল২

১মহাপরিচালক, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী, পাবনা। ২পরিচালক (গবেষণা), বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী, পাবনা, ফোন : ০৭৩২৬৬৩৬২৮, ই-মেইল : bsridg123@gmail.com

বিস্তারিত
সাহিত্য ভুবনে চিরজাগ্রত বঙ্গবন্ধু

মসুর রাহমান তাঁর এক কবিতায় লিখেছেন ‘আমাদের দিনগুলি ঢেকে যাচ্ছিল শোকের পোশাকে/ তোমার বিচ্ছেদের সঙ্কটের দিনে/ আমরা নিজেদের ধ্বংসস্তূপে বসে বিলাপে ক্রন্দনে আকাশকে ব্যথিত/ করে তুলেছিলাম ক্রমাগত; তুমি সেই বিলাপকে-/ রূপান্তরিত করেছো জীবনের স্তুতিগানে কেননা জেনেছি/জীবিতের চেয়েও অধিক জীবিত তুমি।’ আর কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় এভাইে বিধৃত হয়েছে বঙ্গবন্ধু, ‘সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল/খুব ভালোবাসি/ রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেই সব গোলাপের/একটি গোলাপ গতকাল আমাকে বলেছে/ আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি/ আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি...।’ আর অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন, ‘যতোকাল রবে পদ্মা যমুনা/গৌরী  মেঘনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান...।’ কাজেই যুগ যুগ ধরে তাঁর কীর্তি নিয়ে চলবে গবেষণা, চলবে সাহিত্য সাধনা।  বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এ নিবন্ধের সাথে কবিদ্বয়ের কবিতার প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।


হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালি, স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তি ও রাজনৈতিক জীবন ও কর্ম এখন দেশে-বিদেশে গবেষণা, সাহিত্যে, রাজনৈতিক দলসমূহের জন্য অনুকরণীয়, অনুসরণীয় এবং অপরিহার্য হয়ে ওঠছে। তাঁর উপর রচিত হয়েছে বিশ্বের সর্বাধিক সংখ্যক বই। বিশ্বের এ যাবৎকালের কোনো নেতা, রাষ্ট্রনায়কের ওপর এত বেশি সংখ্যক বই রচিত হয়নি। তাছাড়া ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারের হত্যার প্রতিবাদে, দ্রোহে, ক্ষোভে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মতো জ্বলে ওঠে ছিলেন দেশ বিদেশের বহু কবি, ছড়াকার, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক, কথা সাহিত্যিকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যে এসব বিষয়ে লেখা এই পর্যন্ত দেশ-বিদেশে প্রায় ১৩ শতাধিক মৌলিক গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে। বাংলা একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, শিশু একাডেমি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দেশের অধিকাংশ প্রকাশনা সংস্থা থেকে এসব বই প্রকাশিত হয়েছে। এর বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিসহ বিশ্বের খ্যাতিমান লেখকরা প্রচুর বই লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে।


‘বঙ্গবন্ধু নিজেই ছিলেন রাজনীতির কবি’। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে লাখো মানুষের জনস্রোতে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত হওয়া ‘ভাষণ’ বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ এবং সর্বশ্রেষ্ট সাহিত্য বললে ভুল হবে না। জনমানুষের কবি, বাংলাদেশসহ তামাম দুনিয়ার মজদুর, শোষিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায় ও মুক্তির দিশারী। তাঁর সমপর্যায়ের বিশ্বমানের রাজনৈতিক হিসেবে মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা, ইয়াসির আরাফাত প্রমুখ। অবশ্য বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যতটা শিল্প সাহিত্য, সংস্কৃতির ক্রম বিকাশ ঘটেছে ততটা ঘটেনি বিশ্বের অপরাপর বড় মাপের নেতাদের নিয়ে। বাঙালির শোকের মাস এই আগস্টকে সামনে রেখে পাবলিক লাইব্রেরির, জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র, বাংলা বাজার কেন্দ্রিক প্রকাশনা সংস্থাসমূহের অনুসন্ধান চালিয়ে এ তথ্য পেয়েছি।‘ একজন নেতার ওপর পৃথিবীর আর কোন দেশে এত বিপুল সংখ্যক বই প্রকাশ পায়নি। এই বইগুলো বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত। এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ওপর বেশ সংখ্যক বই চীনা, জাপানি, ইতালি, জার্মানি, সুইডিশসহ কয়েকটি বিদেশি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।


বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনের লেখা ‘বঙ্গবন্ধু বিষয়ক গ্রন্থপঞ্জি’ ১৯৯৮ সালে ‘বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু চর্চা’ শিরোনামে যে বইটি প্রকাশ পেয়েছিল তাতে বঙ্গবন্ধুর ওপর বইয়ের সংখ্যা ছিল ৩৫০। আর বর্তমান ‘বঙ্গবন্ধু বিয়ষক গ্রন্থ’ বইটিতে এ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। তার এই বইটি প্রকাশের পর তিন বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুর ওপর আরও তিন শতাধিক বই প্রকাশ পেয়েছে। এ নিয়ে শুধুমাত্র ১৪০০ মৌলিক গ্রন্থ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রকাশ পেয়েছে।


কিন্তু বঙ্গবন্ধু একটি বহতা নদীর মতো, প্রতিদিন নিত্যনতুন রূপে বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেশে দেশে তাঁকে নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, প্রবন্ধ, নিবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে। প্রকাশিত হচ্ছে নতুন নতুন বই। বিভিন্ন ভাষায় বঙ্গবন্ধুর উপর প্রকাশিত সর্বশেষ বইয়ের সংখ্যা কত এ হিসেব করা কষ্টসাধ্য। কারণ প্রতি দিনই বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাঁর ওপর বই বের হচ্ছে। এক কথায় বঙ্গবন্ধু বিশ্ব পরিম-লে এক অমূল্য সম্পদ। তাঁকে নিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে গবেষণা হচ্ছে, তাঁর দেয়া বিভিন্ন বক্তব্য, বিবৃতি, ভাষণ প্রভৃতি থেকে বিশ্ব নেতারা গবেষণা করে তথ্য উপাত্ত নিজেদের জীবনে, রাজনীতিতে, রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রয়োগ করছেন। এখানেই জাতির পিতার সার্থকতা। তিনি বিশ্ব রাজনীতিতে একজন দার্শনিক, শিক্ষাগুরু, পথপ্রদর্শক।


‘বঙ্গবন্ধু বিষয়ক গ্রন্থপঞ্জি’ বইতে যে পরিসংখ্যান দেয়া হয়, তা ১৬টি শিরোনামে বিভক্ত করা হয়। এর মধ্যে ‘ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু’ বিষয়ক বই প্রকাশ পেয়েছে ৯টি। ‘আগরতলা মামলা ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান’ বিষয়ে সাতটি, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু’ বিষয়ে ১১৭টি, রাজনীতি, প্রশাসন ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক ১৭৩টি, ‘স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ’ বিষয়ে ৩২টি, আলোকচিত্র ও দলিলপত্র বিষয়ে ১২৬টি, প্রবন্ধ ও নিবন্ধ বিষয়ে ১০৪টি, গল্প ও উপন্যাস বিষয়ে ১২২টি, কবিতা ও ছড়া বিষয়ে ৯৮টি, জীবনী গ্রন্থ-১৫১টি, শিশুতোষ গ্রন্থ- ৭৮টি, ‘বঙ্গবন্ধু বিরোধীদের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু’ বিষয়ে-১৪টি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা যাত্রা, নাটক, সঙ্গীত, গীতি আলেখ্য গ্রন্থ ১১টি, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- বিষয়ক গ্রন্থ ৮১টি, মূল্যায়নধর্মী গ্রন্থ ৫৫টি এবং দেশি-বিদেশি লেখকদের লেখা ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত গ্রন্থ ৬৭টি প্রকাশ পেয়েছে। দেলোয়ার হোসেন বইটির ভূমিকায় বলেন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালের লাইব্রেরিসহ, বাংলা একাডেমি লাইব্রেরি, কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি ও বিভিন্ন জেলার লাইব্রেরি এবং কলকাতাসহ কয়েকটি দেশ থেকেও বঙ্গবন্ধুর ওপর বইয়ের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এরপরও দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রকাশিত অনেক বই প্রকাশিত হচ্ছে নিরন্তর। প্রায় তিন শতাধিক প্রকাশনী বইগুলো প্রকাশ করেছে।


এর মধ্যে বেশি সংখ্যক বই প্রকাশ করেছে, বাংলা একাডেমি, আগামী প্রকাশনী, ইউপিএল, মওলা ব্রাদার্স, সময় প্রকাশনী, পারিজাত প্রকাশনী, পার্ল, অন্বেষা, অন্য প্রকাশ, হাক্কানী, পাঠক সমাবেশ, বর্ণায়ন, অনুপম, প্রতীক, মীরা প্রকাশনী, জাগৃতি। এ ছাড়া এক থেকে পাঁচটি পর্যন্ত বই প্রকাশ করেছে শতাধিক প্রকাশনী। অন্যদিকে ইংরেজি ভাষায় দেশে সবচেয়ে বেশি বই প্রকাশ করেছে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি একযোগে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ করে। বাংলা একাডেমি ও আগামী প্রকাশনীও ইংরেজি ভাষায় এ সংক্রান্ত বই প্রকাশ করেছে। বাংলা একাডেমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা’সহ ৯টি বই প্রকাশ করেছে। এই বইটি বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বিক তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়। মীরা প্রকাশনী থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা তদন্ত, ডেথ রেফারেন্স, সওয়াল জবাব, সাক্ষীদের জেরা ও রায় নিয়েই শুধু আবুল হোসেনের লেখা ৯টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। মীরা থেকে বঙ্গবন্ধু বিষয়ে প্রকাশিত হয়েছে ২২টি বই। বাংলা এডাডেমি বঙ্গবন্ধুর ওপর গ্রন্থপঞ্জি বইটি প্রকাশের পর গত তিন বছরে বঙ্গবন্ধুর ওপর আরও প্রায় তিন শতাধিক বই প্রকাশ পেয়েছে। ফলে এ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ওপর শুধুমাত্র মৌলিক গ্রন্থ ১৩ শতাধিক দাঁড়িয়েছে। গত তিন বছরে একুশের গ্রন্থমেলায় বঙ্গবন্ধুর ওপর অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়েছে, হবে ভবিষ্যতেও।


বাংলাদেশ নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে থেকেও বঙ্গবন্ধুর ওপর এত বই বের হয়েছে, তা তাঁর প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। তাঁর জীবন ও কর্মের ওপর অপ্রকাশিত অনেক তথ্য বের হয়ে আসছে প্রতিনিয়ত। ফলে বঙ্গবন্ধুর ওপর বই প্রকাশনা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। আগামী প্রকাশনী থেকে বঙ্গবন্ধুর ওপর ৮০টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইটি বিপুলসংখ্যক বিক্রি হয়েছে। প্রতি মাসেই অসংখ্য বই বের হচ্ছে জাতির পিতাকে নিয়ে। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত একটি বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, বঙ্গবন্ধু বিষয়ক বইয়ের সংখ্যা ১ হাজারের বেশি। সেই সময়েই ১১০০ প্রকাশ পেয়েছিল। আর গত তিন বছরে বের হয়েছে ২৫০-এর মতো বই। সংখ্যাটা বর্তমানে ১৩০০-এর বেশি হবে। বাঙালি জাতির জন্য এটা সৌভাগ্য যে-বঙ্গবন্ধুর ওপর এত বই প্রকাশ পেয়েছে।


আমাদের সমাজ ব্যবস্থায়, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, সংস্কৃতিতে যতটা দিন বদলের হাওয়া লেগেছে, ঠিক তার চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছেন জাতির পিতার আদর্শ, অর্থাৎ তাঁর  জীবন, সংগ্রাম কর্ম অনুসরণ, অনুকরণ করা। একই সাথে ঘাতকের বুলেটে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়া জনকের করুণ বিদায় দেশের সর্বশ্রেণির মানুষকে যেমনি শোকে মুহ্যমান করেছে তেমনি দেশে বিদেশের কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে দ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। আর  এই ক্ষোভ, দ্রোহের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সাহিত্যে। এর ফলে ‘জীবিত মুজিব’ অপেক্ষা ‘মৃত মুজিব’ রাজনীতিবিদের জন্য বিশেষ করে তাঁর আদর্শের অনুসারীদের জন্য যতটা উজ্জীবিত করে আন্দোলনে, সংগ্রামে, দেশ গঠনে, উন্নয়নে, জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে, ঠিক সমান চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে সাহিত্যিকদের মধ্যেও। ‘আদর্শের যে মৃত্যু নেই’ এটা তাকে দিয়ে প্রমাণিত। আজকের এই দিনে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাঁর পরিবারের অপরাপর শহীদের বিদেহী আত্মার শান্তি, বেহেশত কামনা করছি।

 

মোতাহার হোসেন


সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম। মোবাইল : ০১৮৪১৮১২৬৭৫, ই-মেইল : motaherbd123@gmail.com

 

বিস্তারিত
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ জাতীয়তাবাদের উন্মেষ বিকাশের আত্মকথন

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে বড় নিয়ামক হিসেবে আমাদের পথ প্রদর্শন করবে এবং শক্তি সাহস যোগাবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন কর্ম, তাঁর দর্শন, তাঁর ধ্যান ধারণা আমাদের জন্য পাথেয়। জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এক অনন্য স্বপ্নের রূপ রেখা এবং আত্মকথনও বটে। একইভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশের অনন্য দলিল। এ আত্মকথন নতুন রাজনীতির গতিপথ, জনমানুষের চাওয়া-পাওয়া, মানুষের অধিকার সম্পর্কে সচেনতনা সৃষ্টি ও নতুন জাতির জন্ম, উন্মেষ, বিকাশ - এসব ভাবনা নিয়েই বঙ্গবন্ধু মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনী আমাদের জন্য এক অনন্য দলিল এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথ নির্দেশিকা।


বঙ্গবন্ধুর এই অসমাপ্ত আত্মজীবনী ধ্রুপদী ভঙ্গীতেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এবং জীবন কথক। হাজার বছর ধরেই বাঙালির জাতীয়তাবাদের সত্ত্বার পরিপূর্ণ বিকাশ এবং উন্মেষ ঘটে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের আহ্বানে এবং তাঁর সুদীর্ঘ ২৪ বছরের রাজনীতি, আন্দোলন, সংগ্রাম, দেশের মানুষকে আন্দোলনে অংশীজনে পরিণত করার অর্থাৎ মুক্তির দীক্ষার বহিঃপ্রকাশ তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী মূলক এই অমূল্য দলিল। এই গ্রন্থের গোড়ার দিকে স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার আখ্যান পাওয়া যাবে অজ্ঞাত পূর্ব, অধুনা আবিষ্কৃত ও গদ্য প্রকাশিত এই স্মৃতিকথনে। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট লেখক আলাপন বন্দোপাধ্যায় ‘শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের আলোচনাকালে ‘বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এই মন্তব্য করেন। পাক্ষিক ‘দেশ’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি (আলাপন) এসব কথা বলেন। নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১২ সালের ২ ডিসেম্বর।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী নিয়ে আলাপন বন্দোপাধ্যায়ের এই নিবন্ধটি খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন অনেক লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদ। ‘জাতির জীবন : দেশ ও নায়ক’ শীর্ষক এই নিবন্ধে আলাপন বন্দোপাধ্যায় বলেন, একদিকে সুভাষ চন্দ্রের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি অনুরাগ, অন্যদিকে বর্তমান মুসলমানের জন্য শান্তির, সহমর্মিতার, সহনশীলতার এবং ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখান মানুষকে। এই দৃঢ়বিশ্বাস- এসব নিয়েই ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম যৌবন।


বঙ্গবন্ধুর এই আত্মজীবনীকে ভারতের সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, বিপিন চন্দ্র পাল, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, সুভাষ চন্দ্র বসু, রাজেন্দ্র প্রসাদ, মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মতো অনেক অগ্রগণ্য নেতা এবং সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রনায়ক লি কুয়ান ইউয়ে, স্বাধীন ঘানার পরিক্রমা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলার আত্মচরিতের সাথে তুলনা করে বলেছেন, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের পুরোধা পুরুষ কেসলি হেফোর্ড, দক্ষিণ আফ্রিকায় সাদাদের দ্বারা কালো মানুষের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ, বঞ্চনার, বর্ণবৈষম্য নিরসনে সে দেশের কোটি কোটি মানুষের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, প্যালেস্টাইন নামক স্বতন্ত্র দেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইতে আজীবন সংগ্রামী সাহসী পুরুষ ইয়াসির আরাফাত, জাম্বিয়ার মার্কাস গার্ডে, জামাইকার কেনেথ কাউন্ডা কিংবা কেনিয়ার জোলো কেনিয়াটা প্রমুখের স্মৃতিচর্চাও একই গোত্রভুক্ত। ঐতিহাসিকদের এই দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করলে শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটিকে বাংলাদেশের ক্লাসিক্যাল জাতীয় আত্মকথা বলে গ্রহণ করা যেতে পারে।


একদিকে পশ্চিম পাকিস্তান ও উর্দুর ঘনায়মান ও ক্রমবর্ধমান প্রভাব পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানকে অধীর করে তোলে। কৃষক প্রজার জন্য এক ন্যায়ের স্বপ্ন, নবগঠিত পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার তীব্র আর্তি এবং অনাদৃত মাতৃভাষার জন্য অনির্বচনীয় মমত্ব নিয়ে ক্রমেই জন্ম নিতে থাকে এক অন্যতর ও নতুনতর স্বাধীনতার সংকল্প- শেখ মুজিবুর রহমান এর বর্ণনায় উঠে এসেছে। আলাপন বন্দোপাধ্যায় লিখেন, পশ্চিম পাকিস্তান ও মুসলিম লীগ ক্রমেই আগ্রাসী, ক্ষমতাতান্ত্রিক ও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, বৃহত্তর জনতার বিপুলতর আর্তিতে এক নতুন রাজনীতি ও নতুন জাতির জন্ম দরকার- এই কেন্দ্রীয় ভাবনা নিয়েই আত্মজীবনীর অসমাপ্ত উপহার। প্রায় সোয়া পৃষ্ঠার নিবন্ধে উপসংহারে বলা হয়, এই গ্রন্থ স্বহস্তে এক নতুন জাতির নির্মাণে এক নিঃসঙ্গ নায়কের কাহিনী সর্ব অর্থেই তাঁর জাতির আত্মজীবনীর অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি হয়ে উঠেছে।


অবশ্য বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে প্রয়াত প্রথিতযশা ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব ত্যাগের আদর্শে পরিণত’ হয়েছিলেন। শওকত ওসমান ১৯৭১ সালে তার ‘জাহান্নাম হতে বিদায়’ উপন্যাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির জন্য নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে মানুষের প্রেম ও বিশ্বাসের পরিণত হওয়ার চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘মানুষটি ত্যাগের আদর্শে পরিণত হলেন, কেউ তাঁর এই আদর্শ কেড়ে নিতে পারবে না।’ এক ভদ্রলোক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কবলিত একটি শহর থেকে নৌপথে পালিয়ে যাচ্ছিল। একপর্যায়ে নৌকার মাঝি তাকে জিজ্ঞেস করল ‘শেখ মুজিব কি গ্রেফতার হয়েছেন? যাত্রী বললেন ‘হ্যাঁ’ একটু নীরবতার পর নৌকার মাঝি আবার জিজ্ঞেস করল ‘শেখ মুজিব কি গ্রেফতার হয়েছেন? যাত্রী আবার বললেন ‘হ্যাঁ’ একদা নীরবতা ভেঙে তিনি (নৌকার মাঝি) বলেন ‘আপনি কিছুই জানেন না, কে তাঁকে গ্রেফতার করবে?’ তাঁর (শওকত ওসমান) সারকথাটা ‘সাধনায় মানুষ ভাবমূতির্তে পরিণত হয়, ভাবমূর্তি, আদর্শকে, চেতনা কেউ গ্রেফতার করতে পারে না।’ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত শওকত ওসমানের ‘জাহান্নাম হতে বিদায়’ উপন্যাসে মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ও ভালোবাসার বর্ণনা করা হয়েছে।


শওকত ওসমানের একটি লাইন উদ্ধৃত করে বঙ্গবন্ধু বিষয়ে ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইতিহাসের দরজা উন্মুক্ত হয়েছে শেখ মুজিবের নামে’। তাঁকে শুধুমাত্র বিশাল পর্বতের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এটা মনে হতে পারে যে পর্বতটি আমাদের পাশেই, কিন্তু এটি আমাদের কাছ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার দলীল’ শীর্ষক একটি বইতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে শওকত ওসমানের ‘কাছ থেকে দূরে, দূর থেকে কাছে শেখ মুজিব’ লেখাটিতে বর্ণনা এভাবেই তুলে ধরেন। নিবন্ধে তিনি মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলনের পাশাপাশি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়েও লিখেছেন। একুশে পদক, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কার বিজয়ী এই লেখক জাতির জনক হত্যাকা- সম্পর্কে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘সেই ভয়ঙ্কর রাতের পরে আমি স্বেচ্ছায় নির্বাসনে গিয়েছিলাম।’ বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী প্রসঙ্গে এ উক্তিগুলো প্রাসঙ্গিক বলেই এখানে বিধৃত হয়েছে। একই সঙ্গে শিশু রাসেল এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ সেদিন যারা ঘাতকের বুলেটে শহীদ হয়েছেন তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

ফারিহা হোসেন
ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলাম লেখক, মোবাইল : ০১৮৫৯৮১২৭১৩, ই-মেইল : fariha12345prova@gmail.com

বিস্তারিত
বাংলাদেশে তুলা চাষে সাফল্য ও সম্ভাবনা

তুলা এবং বস্ত্র উৎপাদনে বাংলাদেশের গৌরবময় ঐতিহ্য আছে। মধ্যযুগে বাংলা সূক্ষ্ম সুতার মসলিনের জন্য বিখ্যাত ছিল। মসলিন শাড়ি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় তুলা চাষ করা হতো ঢাকার আশপাশের উঁচু জমিতে যেখানে বেশির ভাগ তাঁত শিল্প গড়ে উঠেছিল। বস্তুত ব্রিটিশ শাসনামলে মসলিনের উৎপাদন এবং ব্যবসা ক্রমান্বয়ে কমে যায়। ফলস্বরূপ উনিশশতকের শুরুর দিকে কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। পাকিস্তান শাসনামলে এদেশে তুলা উৎপাদনের প্রচেষ্টা খুব সীমিত ছিল। স্বাধীনতার আগে স্থানীয় বস্ত্রকলের জন্য কাঁচামালের জোগান দেওয়া হতো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধ করে করে দিলে স্থানীয়ভাবে তুলার উৎপাদনের গুরুত্ব অনুভূত হয়। সে সময় আমাদের বস্ত্র শিল্পগুলো কাঁচামালের অভাবে মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হয়। এই অবস্থায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর দূরদর্শী চিন্তার ফসল হিসেবে তাঁর একান্ত ইচ্ছায় বাংলাদেশে তুলা চাষের গুরুত্ব বিবেচনা করে স্বাধীনতার পর Resolution No. III Cotton-8/72-393 dt. 14th December ১৯৭২ মোতাবেক কৃষি মন্ত্রণালয়ের নতুন প্রতিষ্ঠান হিসেবে তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হয়। এ প্রতিষ্ঠানটি দেশে তুলার গবেষণা এবং তুলা চাষ সম্প্রসারণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে এবং বতর্মানে তৈরি পোশাকশিল্প ও জাতীয় অথর্নীতির অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তুলা একটি আঁশজাতীয় ফসল এবং এর বীজ হতে উপজাত হিসেবে ভোজ্যতেল ও খৈল পাওয়া যায়। তুলা বীজ হতে ১৫-১৭% ভোজ্যতেল ও ৮০% উন্নতমানের খৈল পাওয়া যায়। দেশে বেসরকারি উদ্যোগে ১৮টি জিনিং শিল্পে প্রায় ১০০টি জিনিং মেশিন ও তুলার বীজ হতে তৈল আহরণের জন্য ১৫-২০টি ঊীঢ়বষষবৎ মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। অপরিশোধিত তেলকে পরিশোধনের মাধ্যমে ভোজ্যতেলে পরিণত করার জন্য ইতোমধ্যেই কুষ্টিয়ায় একটি রিফাইনারি কারখানা স্থাপিত হয়েছে। বর্তমান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তুলা উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক গৃহীত সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে বিগত কয়েক বছর যাবৎ দেশে তুলার উৎপাদন ক্রমবর্ধনশীল। তুলা চাষকে চাষিদের নিকট অধিকতর লাভজনক করার লক্ষ্যে তুলা উন্নয়ন বোর্ড গবেষণা, সম্প্রসারণ, বীজ উৎপাদন ও বিতরণ, ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ ও তুলার বাজারজাতকরণে চাষিদের সহায়তা প্রদানের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে ২০১৮-১৯ মৌসুমে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ৪টি অঞ্চল, ১৩টি জোন ও ১৯৫টি ইউনিটের মাধ্যমে ৪০ জেলায় ৪৪১৮৫ হেক্টর জমিতে তুলা আবাদ করে ১,৭১,৪৭০ বেল আঁশ তুলার উৎপাদন করা হয়েছে। অর্থকরী ফসল হিসেবে তুলার আবাদ বস্ত্র শিল্পের প্রধান কাঁচামাল জোগানোর পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের খাদ্য নিরাপত্তায় কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। তুলার বীজবপন থেকে শুরু করে বীজ তুলা প্রক্রিয়াজাতকরণ ও জিনিং পর্যন্ত মহিলা শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তুলা আমদানিকারক দেশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমাদের দেশে প্রায় ৮১ লাখ বেল তুলা আমদানি করা হয়েছে যার আনুমানিক বাজারমূল্য ৪০,০০০ কোটি টাকা। তুলা চাষ বৃদ্ধির ফলে একদিকে যেমন নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে অপরদিকে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে বাংলাদেশ তৈরি পোশক রপ্তানিতে ২য় অবস্থানে রয়েছে। এই সেক্টরে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫৫ লক্ষ। দেশের প্রধান রপ্তানিশিল্পের সংকট মোকাবেলায় অভ্যন্তরীণ তুলা উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে তুলা উন্নয়ন বোর্ড কাজ করে যাচ্ছে।
 

তুলা উন্নয়ন বোর্ডের উল্লেখযোগ্য সাফল্য
তুলা উন্নয়ন বোর্ড গবেষণার মাধ্যমে সিবি-১ হতে সিবি-১৭ ও পাহাড়ি তুলা-১ থেকে ৩ নামে মোট ২০ (বিশ)টি উচ্চফলনশীল জাত অবমুক্ত করেছে। এছাড়াও সিবি হাইব্রিড-১ নামে একটি উচ্চফলনশীল হাইব্রিড অবমুক্ত করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে চীনা হাইব্রিড জাতের তুলার বীজ ২০০৯-১০ মৌসুম হতে মাঠ পর্যায়ে চাষাবাদ করা হচ্ছে, যার ফলন বিঘা প্রতি ১২-১৫ মণ। তুলা চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ‘সম্প্রসারিত তুলা চাষ প্রকল্প (ফেজ-১)’ শীর্ষক একটি বড় প্রকল্প ২০১৪ খ্রি: অনুমোদিত হয়েছে, যার কার্যক্রম মাঠ পর্যায়ে চলমান রয়েছে। তুলা গবেষণা কেন্দ্রে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি চাষি পর্যায়ে হস্তান্তরের লক্ষ্যে কৃষক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়েছে। খরা প্রবণ, লবণাক্ত, চর ও পাহাড়ি এলাকার উপত্যকার সমতলভূমিতে আপল্যান্ড তুলা চাষ সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ভিত্তিবীজ ও মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন করে তা চাষিপর্যায়ে স্বল্পমূল্যে/বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। দেশীয় শিমুল তুলার সম্প্রসারণের জন্য তুলা উন্নয়ন বোর্ড চাষিদের মাঝে ২,৭৮,০৫৮টি শিমুল তুলার চারা উৎপাদন করে তা বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। দেশে তুলা চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে লিফলেট, পোস্টার, তুলার তথ্য সংবলিত নোটবুক ও বুকলেট বিতরণ করা হয়েছে।


তুলার গুণগত মাননির্ণয় করার জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি ঐঠও মেশিন তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সদর দপ্তরে স্থাপন করা হয়েছে। তুলা উন্নয়ন বোর্ডের পরামর্শে কুষ্টিয়ায় বেসরকারি উদ্যোগে ১টি তুলার তেল রিফাইনারি কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। বিগত ৩ বছরে উক্ত কারখানা হতে মোট ১৯৫০ মেট্রিক টন ভোজ্যতেল উৎপাদন করা হয়েছে। তুলা উন্নয়ন বোর্ডের প্রচেষ্টায় তুলার গুণগত মান বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং স্টেকহোল্ডারদের সাথে নিয়মিত সভার প্রেক্ষিতে স্কয়ার, ইস্পাহানীসহ অন্যান্য স্পিনিং/টেক্সটাইলমিল আমদানিকৃত তুলার পাশাপাশি দেশীয় তুলা ব্যবহার করছে। তুলা চাষিদের সহজশর্তে স্বল্প পরিসরে ঋণ বিতরনের লক্ষ্যে তুলা উন্নয়ন বোর্ড বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এর সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে।


দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আমন ধানকাটার পর পতিত জমিতে রবি মৌসুমে তুলা চাষ সম্প্রসারণের কাজ শুরু করা হয়েছে। সে লক্ষ্যে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল ও খুলনা বিভাগের পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, বরগুনা, গোপালগঞ্জ, ভোলা, পিরোজপুর, বাগেরহাট, যশোর ও সাতক্ষীরাসহ কয়েকটি জেলায় নতুন ১২টি ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। এসব ইউনিট অফিসের মাধ্যমে গত ৩ বছরে পরীক্ষামূলকভাবে ২৫০টি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হয়েছে। এ সময়ে তুলা উন্নয়ন বোর্ড বেশ কয়েকটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এ সকল প্রযুক্তির মধ্যে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলা ও ফলন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন সার এর ফলিয়ার স্প্রে এবং প্লান্ট গ্রোথ রেগুলেটর (পিজিআর) প্রয়োগ, ফেরোমেন ট্র্যাপ, কালার ট্র্যাপ ও ঝোলা গুড়ের ফাঁদ এর মাধ্যামে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে তুলা ফসলের বিভিন্ন পোকা ব্যবস্থাপনা, পার্বত্য তিন জেলায় জুমচাষ এর পরিবর্তে ‘ধান-তুলা আন্তঃচাষ’ পদ্ধতিতে ‘দুই সারি ধান ও এক সারি তুলা চাষ’ প্রযুক্তির প্রবর্তন, তুলার অঙ্গজ শাখা কর্তন পদ্ধতি এবং বৈরী আবহাওয়ায় আম পাতায় তুলার চারা উৎপাদন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বিভিন্ন ফলজ বাগানে আন্তঃফসল হিসেবে তুলা আবাদ করে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে। আর তামাক চাষ এলাকার চাষিদের তুলা চাষে উদ্বুদ্ধকরণ করা হচ্ছে।


বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BINA) এবং IAEA (International Atomic Energy Agency) এর কারিগরি সহায়তায় মিউটেশন ব্রিডিং এর মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদি ও রোগ প্রতিরোধিজাত উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে। প্রতিকূল পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর লক্ষ্যে তানজানিয়া হতে ৩টি, পাকিস্তান হতে ৪টি, ব্রাজিল হতে ১টি, তাজিকিস্তান হতে ৩টি, চীন হতে ২টি ও ভারত থেকে ৩টি স্বল্পমেয়াদি জাতের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করা হয়েছে এবং গবেষণার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। IAEA (International Atomic Energy Agency) হতে ২টি উচ্চ তাপসহিষ্ণু মিউট্যান্ট তুলার জাতের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। বাংলাদেশে বিটিকটনের প্রবর্তনের লক্ষ্যে ভারতের JK Agro Genetics Limited Company হতে Bt cotton seed এর Contained Trial -এর অনুমোদন পাওয়া গিয়েছে এবং গঞঅ স্বাক্ষর সম্পন্ন হয়েছে। ২০১৮-১৯ মৌসুমে ট্রায়াল স্থাপন করা হয়েছে। দেশের ঐতিহ্যবাহী ‘মসলিন’ তৈরির প্রযুক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সাথে ‘ফুটিকার্পাস’ এর অনুসন্ধান ও গবেষণা কাজে তুলা উন্নয়ন বোর্ড কাজ করে যাচ্ছে। তুলা উৎপাদনকারী উন্নত দেশসমূহের আধুনিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশল সম্পর্কে মতবিনিময়ের লক্ষ্যে International Cotton Advisory Committee (ICAC) ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বাংলাদেশে Asian Cotton Research and Development Network (ACRDN) এর ৬ষ্ঠ সভা কৃষি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় তুলা উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক বাস্তবায়িত হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ International Cotton Advisory Committee (ICAC) এর সদস্য পদ লাভ করেছে। তুলা উন্নয়ন বোর্ড ২০১২ সালে National Agricultural Research System (NARS) এর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।
 

তুলা উন্নয়ন বোর্ডের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

তুলা একটি খরা ও লবণাক্ততা সহনশীল ফসল, বন্যা মুক্ত ও উঁচু জমি তুলা চাষের উপযোগী। খাদ্য উৎপাদনে কোনো বিঘ্ন না ঘটিয়ে স্থানীয়ভাবে মোট চাহিদার ৮-১০% মেটানোর জন্য তুলা উন্নয়ন বোর্ড অপ্রচলিত অঞ্চলসমূহের পাশাপাশি স্বল্প উৎপাদনশীল এলাকা যেমন- খরা, লবণাক্ত, চরাঞ্চল, পাহাড়ি এলাকা, বাগানে আন্তঃফসল হিসেবে এবং তামাক চাষকৃত উঁচু জমিতে তুলা আবাদের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
 

ক. খরা প্রবণ অঞ্চলে তুলা চাষ
বাংলাদেশে তুলা চাষ সম্প্রসারণের অন্যতম সম্ভবনাময় এলাকা হলো রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের অন্তর্ভুক্ত উঁচু বরেন্দ্র ভূমি। বরেন্দ্র ভূমিতে মোট ৫.৮২ লাখ হেক্টর আবাদযোগ্য জমির রয়েছে। যার ৮৪% এক ফসলি, উক্ত অঞ্চলে ফসলের নিবিড়তা মাত্র ১১৭%। মৌসুমি বৃষ্টিপাত ও সম্পূরক সেচে উক্ত অঞ্চলে তুলা চাষ আবাদের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং চাষিরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে।     

 

খ. পাহাড়ি অঞ্চলে তুলাচাষ
ঐতিহ্যগতভাবে পাহাড়ের ঢালে চাষিরা ঝুম পদ্ধতিতে বিভিন্ন ফসলের সাথে তুলা চাষ করে আসছে। ঝুম পদ্ধতিতে চাষকৃত পাহাড়ি জাতের তুলার হেক্টর প্রতি এর গড় ফলন যেমন অত্যন্ত কম তেমনিভাবে এর আঁশের দৈর্ঘ্য খাটো হওয়ায় এটিকে স্পিনিং মিলে ব্যবহার করা যায় না। ফলে ঝুম পদ্ধতিতে তুলাচাষ লাভজনক না হওয়ায় তুলা উন্নয়ন বোর্ড বিগত কয়েক বছর গবেষণার মাধ্যমে পাহাড়ের ঢালে আন্তঃফসল পদ্ধতিতে দুই সারি ধান ও এক সারি আপল্যান্ডজাতের তুলা চাষের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। ফসল ব্যবস্থাপনার সুবিধার কারণে আন্তঃফসল চাষে ধান ও তুলা উভয়েরই ফলন বৃদ্ধি পাওয়ায় এ পদ্ধতি উক্ত অঞ্চলের চাষিদের নিকট জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

 

গ. লবণাক্ত এলাকায় তুলা চাষ
বাংলাদেশের সমগ্র অঞ্চলের ২০% হলো উপকূলীয় এলাকার আয়তন ২৮.৫ লাখ হেক্টর। উক্ত উপকূলীয় এলাকায় আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ হলো ৮.৩ লাখ হেক্টর। তুলা মধ্যম মাত্রার লবণাক্ততা সহিষ্ণু ফসল হওয়ায় আমন ধান কাটার পর পতিত জমিতে রবি মৌসুমে তুলা চাষের গবেষণাও সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

 

ঘ. চরাঞ্চলে তুলা চাষ
নদী মাতৃক বাংলাদেশে ব্যাপক চর অঞ্চল রয়েছে। চরাঞ্চলে মাটির গঠন বেলে প্রকৃতির, মাটির উর্বরতা ও পানি ধারণক্ষমতা কম হওয়ার কারণে উক্ত অঞ্চলে ফসলের নিবিড়তা অনেক কম। তুলা গভীর মূলি ফসল হওয়ায় দেশের বিভিন্ন চরাঞ্চলে তুলাচাষ করা হচ্ছে। তাছাড়া চরাঞ্চলে তুলাচাষের ফলে জমিতে তুলার পাতা যোগ হয়ে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মাটির ঊর্ব্বরতা শক্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

ঙ. তামাকের জমিতে তুলা চাষ
আমাদের দেশে বিশেষ করে কুষ্টিয়া, লালমনিরহাট, রংপুর, মেহেরপুর, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়িতে প্রায় ৫০-৭০ হাজার হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ করা হচ্ছে। তুলা উন্নয়ন বোর্ড তামাকের অধীন উঁচু জমিকে ক্রমান্বয়ে তুলা চাষের আওতায় নিয়ে আসার জন্য কার্যক্রম অগ্রাধিকারভিত্তিতে বাস্তবায়ন করছে।

 

চ. কৃষি বনায়ন জমিতে তুলা চাষ
বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকায় আম, পেঁপে এবং লিচুবাগানের পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৭০০০০ হেক্টর জমি ফলজ ও বনজবাগানের আওতাভুক্ত। উক্ত ফলজ বা বনজ জমিতে গাছের বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ে ২-৩ বছর সাফল্যজনকভাবে তুলা চাষ করার লক্ষ্যে তুলা উন্নয়ন বোর্ড বিগত কয়েক বছর যাবৎ নবসৃজনকৃত বাগানে তুলা চাষ সম্প্রসারণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।

 

পরিশেষে, তুলা উন্নয়ন বোর্ড বাংলাদেশের অদম্য অগ্রযাত্রায় বর্তমান সরকারের সঠিক দিকনির্দেশনায় গবেষণার মাধ্যমে জলবায়ু উপযোগী ও কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী প্রযুক্তি উদ্ভাবন, মানসম্পন্ন উচ্চফলনশীল জাতের বীজ সরবরাহ, বিদ্যমান চাষ এলাকার পাশাপাশি দেশের স্বল্প উৎপাদনশীল জমিতে তুলা চাষ সম্প্রসারণ ও বাজারজাতকরণ সহায়তার মাধ্যমে বস্ত্র শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে তুলার উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছে।

 

ড. মো: ফরিদ উদ্দিন

নির্বাহী পরিচালক, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, ফোন ৫৫০২৮৩৫৫, ই-মেইল :  mfaridcbd@gmail.com

বিস্তারিত
ইতিহাসের রাখাল রাজা : বঙ্গবন্ধু ও কৃষি

...এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান? যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁরই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি, চোখে নীলাকাশ বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি। যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান...।


বঙ্গোপসাগরের কোল জুড়ে উত্তাল ঐশ্বর্য আর স্নিগ্ধ শান্ত স্বভাবের একটি সমৃদ্ধ দেশ বাংলাদেশ। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া অতনু সিক্ত নীলাম্বরীতে দেহঘেরা উর্বশী পত্র পল্লবে বিকশিত তেপান্তরের               সোনালি মাঠ আামদের মায়াবি হাতছানি দেয়া। অনাদিকালের রোদ বৃষ্টি নদী-পলিভূমি আর মানুষের সৃষ্টিশীল বিবর্তন ধারার কোন এক মাহেন্দ্রক্ষণে জন্ম নিয়েছিল বাঙালি জাতিসত্তার ভ্রুণ। কৃষি কৃষ্টি সমাজ সংস্কৃতি আর মুক্তিকামী রাজনীতির যৌক্তিক ধারাবাহিকতায় নিরন্তর ত্যাগ দানে মানে পুষ্ট হয়ে সে ভ্রুণ পূর্ণাঙ্গরূপ পায় তখনই যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে জনগণ ও জনসমুদ্র সমার্থক হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠা পায় স্বাধীন সার্বভৌম কৃষি প্রধান বাংলাদেশ।


বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার অন্যতম ভিত্তি ছিল কৃষি। তাইতো স্বাধীনতার ঊষালগ্নে কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে তিনি দেশে সবুজ বিপ্লবের/কৃষি বিপ্লবের ডাক দেন। শুরু হয় কৃষিতে গ্রামীণ উন্নয়ন আর আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার। মওকুফ করেন ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনার দায়। প্রত্যাহার করেন লাখ লাখ কৃষি ঋণের সার্টিফিকেট মামলা; ভূমিহীন কৃষকের নামে বিতরণ করা হয় খাসজমি; দেশে প্রথম প্রবর্তন করা হয় কৃষি ঋণ ব্যবস্থার এবং ’৭৩ এর ৭নং অ্যাক্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয় কৃষি ব্যাংক; গঠন করা হয় কৃষিতে জাতীয় পুরস্কার তহবিল। মানসম্মত বীজ, সারের কারখানা প্রতিষ্ঠা, সেচ ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুকরণ, বালাইনাশক কারখানা তৈরি, জমির খ-ায়ন রোধ, বন্যা থেকে রোধে বাঁধ নির্মাণ, কৃষির আধুনিক যান্ত্রিকীকরণ, সমন্বিত কৃষি বাস্তবায়ন, জমির প্রকৃতি বুঝে ফসল ফলানো, সময় মতো ফসল উৎপাদন, জরিপ করেই কেবল পরিকল্পনা গ্রহণ, রবি মৌসুমে বেশি করে ফসল ফলানোর তাগিদ, শহর ছেড়ে গ্রামমুখী হওয়া, কৃষিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলাসহ কৃষি উন্নয়ন আর সমৃদ্ধির অগণিত কার্যক্রম।


যে বজ্র কণ্ঠে স্বাধীনতা সংগ্রাম সে কণ্ঠেই ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘোষিত হয়-কৃষিবিদদের আর্থসামাজিক মর্যাদার স্বীকৃতি- প্রথম শ্রেণির পদ মর্যাদা। আকাশে বাতাসে ভেসে উঠে বঙ্গবন্ধুর অবদান, কৃষিবিদরা ক্লাস ওয়ান। গৌরবময় এ দিনটি কৃষিবিদরা দেশব্যাপী ‘কৃষিবিদ দিবস’ হিসেবে পালন করে চলেছে যথাযোগ্য মর্যাদায়।  

 কৃষিবিদদের মর্যাদার স্বীকৃতির ঘোষণাই শুধু নয়, কৃষি গবেষণা ও শিক্ষায় মেধাবীদের আকর্ষণ করার লক্ষ্যে বৃত্তি বরাদ্দ বাড়ানো হয় এবং প্রতিষ্ঠিত হয় একক ও বহুমুখী কৃষিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ’৭৩-এর ১০নং অ্যাক্টের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। ধান ব্যতিরেকে বহুমুখী ফসল গবেষণার সুযোগ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে। পুনর্গঠন করা হয় হর্টিকালচার বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, সিড সার্টিফিকেশন এজেন্সি, রাবার উন্নয়ন কার্যক্রম, কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ গবেষণা সমন্বয়ের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। সোনালি আঁশের সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করতে প্রতিষ্ঠা করা হয় পাট মন্ত্রণালয়।


১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ তারিখে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন...খাদ্য বলতে শুধু ধান, চাল, আটা, ময়দা আর ভুট্টাকে বুঝায় না বরং মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি এসবকে বুঝায়। সুতরাং কৃষির উন্নতি করতে হলে এসব খাদ্য শস্যের উৎপাদন উন্নতি করতে হবে। ১৯৭২-৭৩ সালে ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ ছিল এর মধ্যে ১০১ কোটি টাকা শুধু কৃষি উন্নয়নের জন্য রাখা হয়েছিল। এতে তখন থেকেই কৃষির প্রতি, কৃষি উন্নয়নের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা প্রকাশ পায়। বঙ্গবন্ধু ভাবতেন সবার আগে দরকার খাদ্যের। খাদ্যের নিশ্চয়তা না দিতে পারলে সব উন্নয়ন কার্যক্রম বিফলে যাবে। আর জরিপ করে ভবিষ্যৎ সকল কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।


বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে উদ্বুদ্ধ কৃষিবিদ এবং ফসলযোদ্ধা কৃষকের মেলবন্ধনে তাইতো প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কৃষি খাতে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি উন্নীত হয় শতকরা প্রায় ৫ ভাগে। ১৯৭৫-১৯৭৬ সালে খাদ্য উৎপাদন ৮৭ লাখ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ১৩ লাখ টনে। আগস্ট ’৭৫ জায়নামাজের মতো বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে দাঁড়িয়ে বাংলার কৃষক ডুকরে কেঁদে উঠছে- সোনার বাংলা এতিম হয়ে গেছে।


পরপারের স্বর্গোদ্যান থেকে জাতির পিতা যেন গেয়ে উঠলেন-কৃষক বাঁচাও, দেশ বাঁচাও। এর সে ধারাবাহিকতায় কৃষি সমৃদ্ধির আন্দোলনের ডাক দিলেন জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা কৃষক রত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা। কৃষক সমাজের অনিবার্য শক্তি এবং গণমানুষের ইচ্ছার প্রতিফলনে তিনি হাল ধরলেন খাদ্য ঘাটতির দিশাহারা দেশের। আত্মনিয়োগ করলেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে। হাতে নিলেন কৃষি উন্নয়নের অনেক কাঠামোগত সংস্কার কর্মযজ্ঞ। ফল হলো ’৯৮ এর শতাব্দীর দীর্ঘস্থায়ী ও ভয়াবহ বন্যা মোকাবিলা করেও ’৯৯ সালে রেকর্ড পরিমাণ ২ কোটি ৫০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদন। বিশ্ব স্বীকৃতির মর্যাদাপূর্ণ সেরেস পদক তিনি উৎসর্গ করলেন কৃষি প্রধান দেশের জনগণকে। সে সময় কৃষিতে ভর্তুকি দেয়া হয় প্রায় ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। গ্রহণ করা হয় ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি। বিতরণ করা হয় ১০০০ কোটির টাকার খাদ্যশস্য ঋণ। ন্যায্যমূল্যে সরবরাহ করা হয় কৃষি উপকরণ। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বোরো মৌসুমে সরবরাহ করা হয় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। ঐতিহাসিক পানি চুক্তির মাধ্যমে পানি প্রাপ্যতায় চালু হয় জিকে সেচ প্রকল্প। ২০ হাজার হেক্টর জমি আসে আবাদের আওতায়। গড়ে তোলা হয় আঞ্চলিক মৃত্তিকা গবেষণার ও ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষার সুযোগ। সমন্বিত বালাই ব্যস্থাপনা নীতি হিসেবে পাশ হয়। পুনঃপ্রবর্তন করা হয় বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার। কৃষি ক্ষেত্রে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার দিগন্ত প্রসারের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয় বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৬টি কৃষি ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। কৃষক নিবেদিত জননেত্রীর কারিশমা, প্রযুক্তির প্রসার, কৃষকের ঘামঝরানো পরিশ্রম আর প্রকৃতির শুভেচ্ছায় সৃষ্টি হয় ফসল উৎপাদনে নতুন রেকর্ড। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে দেশ সেবায় দ্বিতীয়বারের মতো অভিষিক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা দেখলেন চক্রান্তে আবার পিছিয়ে গেছে দেশের জীবন মানের চাকা। দেশ আবারো খাদ্য ঘাটতির অনিশ্চয়তার কবলে পড়ে। অর্থ দিয়েও বিশ্বের কোথাও মিলছে না খাদ্য।


মানুষকে ভালোবাসার অগাধ বিশ্বাসে কৃষকের দিন বদলের সনদ বাস্তবায়নে বীজ, সার, জ্বালানি, সেচসহ সব কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করলেন তিনি। ননইউরিয়া সারের দাম কমিয়ে কৃষকের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে এনে নিশ্চিত করা হলো জমিতে সুষমসার ব্যবহারের সুবর্ণ সুযোগ। ভর্তুকিসহ সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ ও কৃষকদের মাঝে কৃষি উপকরণ কার্ড বিতরণ করে উপকরণ প্রাপ্তিতে কৃষক হয়রানি স্থায়ীভাবে বন্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া হয়।


মাত্র ১০ টাকায় কৃষকদের সুযোগ দেওয়া হয় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার এবং উপকরণ সহায়তার অর্থ সরাসরি কৃষকের অ্যাকাউন্টে প্রদান করা হয়। কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য যন্ত্রপাতির মূল্যের শতকরা ২৫ ভাগ অর্থ ভর্তুকি হিসেবে দেয়া হয়। বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্রের বিদ্যুৎ বিলের ওপর দেয়া হয় শতকরা ২০ ভাগ হারে রিবেট সুবিধা। শেখ হাসিনার দেয়া প্রণোদনায় দেশের বরেণ্য বিজ্ঞানীদের দ্বারাই উন্মোচিত হয় পাট ও ক্ষতিকর ছত্রাকের জিনোম রহস্য। প্রধানমন্ত্রীর মহতী উদ্যোগ হতদরিদ্রের জন্য চালু হয়েছে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি। তা বাস্তবায়নে ১০ টাকা কেজিতে চাল দেয়া হচ্ছে। বছরের ৫ মাস দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হতদরিদ্র ৫০ লাখ পরিবারকে প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল দেয়ার কার্যক্রম চালু করেছে সরকার। দেশের জনসাধারণের দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষি গবেষণা ও শিক্ষা কার্যক্রম, কৃষি সম্প্রসারণ ও প্রশিক্ষণ, কৃষি পণ্যের বিপণন, কৃষি সহায়তা ও পুনর্বাসন, পরিবর্তিত জলবায়ুতে অভিযোজন কৌশল, কৃষি উপকরণ ও আধুনিক যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন, সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা, বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ, সেচ অবকাঠামো উন্নয়ন ও সেচ কার্যক্রম, দুর্যোগ মোকাবিলা, শস্য সংরক্ষণসহ সামগ্রিক কৃষি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বহুমুখী উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালনা করছে দক্ষতার সাথে। খাদ্য শস্যের পাশাপাশি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপখাতকে বিকশিত করার লক্ষ্যে বাস্তবমুখী ও যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন চলছে।


কৃষিবিদদের মর্যাদা নতুন মাত্রায় উন্নীত করতে শেখ হাসিনা ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে জমি বরাদ্দসহ দিকনির্দেশনা দেন কৃষিবিদ ও কৃষকের মর্যাদার প্রতীক পেশাজীবী সংগঠনের প্রাণকেন্দ্র কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটশন বাংলাদেশ-এর নান্দনিক ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠায়। গুরুত্বারোপ করেন দক্ষ কৃষিবিদ তৈরির। গ্রামীণ অর্থনীতির বুনিয়াদ গড়ে তুলে কৃষকদের স্বাবলম্বী করার দূরদর্শী লক্ষ্যে একটি বাড়ি একটি খামার ধারণার গোড়াপত্তন করা হয়। কৃষকের হাতে সহজে অর্থ সরবরাহের জন্য সৃষ্টি করা হয় দেশব্যাপী ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও পল্লীকর্ম সহায়ক ব্যাংক। বঙ্গবন্ধু কন্যার সৃষ্ট আলোকিত পথে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে উন্নয়নের এক রোল মডেল। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সক্ষমতা দিয়ে মাথাউঁচু করে দাঁড়াবার অনুসরণীয় উদহারণ। আর এসব কারণেই তিনি নিজে পরিণত হয়েছেন বিশ্ব নেতায়। দেশে এখন খাদ্য উৎপাদন প্রায় ৪ কোটি মেট্রিক টন। কৃষক-কৃষিবিদ-সহায়ক নীতি ও প্রণোদনায় ধান উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন ৪র্থ, চাল রফতানি হয়েছে শ্রীলংকায়, বাজার খোঁজা হচ্ছে আফ্রিকার দেশে দেশে; বিভিন্ন দেশ চাল ক্রয়ের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সবজি উৎপাদনে ৩য়; আলু উৎপাদনে ৮ম; মৎস্য উৎপাদনে ৪র্থ। নতুন সমুদ্রসীমা চুক্তির ফলে মৎস্যসহ সম্ভাবনাময় সম্পদ আহরণের অপরিসীম সম্ভাবনা ও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলার মাটিতে ফলানো ফল ও সবজি রফতানি হচ্ছে বিদেশে। দেশের বীজ সেক্টর পেয়েছে গর্বিত শিল্পের মর্যাদা।


বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য কৃষিতে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও জাত উদ্ভাবিত হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে প্রযুক্তি সম্প্রসারণে সরকারের সহায়ক নীতি আলোক বর্তিকার মতো কাজ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টায় বাংলাদেশ অভিষিক্ত হচ্ছে চ্যাম্পিয়নশিপে। বিশ্ব স্বীকৃতি মিলছে- ওয়ার্ল্ড হেরিটেজে ভাসমান সবজি উৎপাদন প্রযুক্তির গর্বিত স্বত্বাধিকারী বাংলাদেশ।
 

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সাড়ে ৭ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান দেয়া ছিল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। যেখানে বর্তমানে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের সংস্থান করেও বাংলাদেশ এখন খাদ্য উদ্বৃত্তের গর্বিত দেশ। কৃষিতে তাক লাগানো এ সাফল্যের নেপথ্যের প্রেরণা আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা আর স্বাধীনতা অর্জনের মহানায়ক, ইতিহাসের রাখাল রাজা, শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার প্রদর্শিত স্বপ্নের সোনার বাংলার বাস্তবায়নে বাংলার মানুষ এখন স্বপ্ন দেখে তাঁরই কন্যা কৃষকরতœ শেখ হাসিনার চোখে। কৃষক ও যুগবান্ধব নীতি, উদার সহায়তা আর কৃষিবিদদের পেশাগত মর্যাদার পৃষ্ঠপোষকতায় তাইতো আসে কৃষিতে ধারাবাহিক সাফল্য। যুক্তিপ্রযুক্তি, কৃষি ও কৃষ্টির সদাচারী হয়ে আমরা কৃষিবিদ এবং বাংলার শস্যযোদ্ধা উন্নয়নের মহানায়ক কৃষক সোনার বাংলা বিনির্মাণে নিয়োজিত আছি নিরন্তর, সানন্দ ভালোবাসায়।

কৃষিবিদ চণ্ডী দাস কুণ্ডু
পরিচালক, হর্টিকালচার উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। ফোন : ৯১১৭০৩০, ই-মেইল : dhw@dae.gov.bd

বিস্তারিত
বঙ্গবন্ধুর অবদানে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির কার্যাবলি ও অর্জন

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ১ম জাতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (১৯৭৩-৭৮) আওতায় বীজের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে ১৯৭৪ সালে ২২ জানুয়ারি বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উৎপাদিত ও বাজারজাতকৃত নিয়ন্ত্রিত ফসলের (ধান, গম, পাট, আলু, আখ, মেস্তা ও কেনাফ) বীজের প্রত্যয়ন ও মান নিয়ন্ত্রণে সংস্থাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।


সরকারি পর্যায়ে উদ্ভাবিত জাতের গুণগত মান যাচাই এবং উৎপাদিত বীজের উৎকর্ষতা নিরূপণ করত বীজ প্রত্যয়ন টাগ বা সার্টিফিকেট প্রদানের দায়িত্ব প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির ওপর অর্পিত হয়। দেশে কৃষি ফসলের জাত পরীক্ষাপূর্বক ছাড়করণ/ নিবন্ধন থেকে শুরু করে মাঠ পরিদর্শন ও প্রত্যয়ন, পীক্ষাগারে ও কন্ট্রোল ফার্মে বীজের মান পরীক্ষণ, প্রত্যয়ন ট্যাগ ইস্যুকরণ, মার্কেট মনিটরিং এবং বীজ আইন ও বিধিমালা লঙ্ঘনকারীদের বিরদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ পর্যন্ত সংস্থাটির কার্যক্রম সম্প্রসারিত।
কার্যাবলি :
-   নিয়ন্ত্রিত ফসলের জাত মূল্যায়ন ও ছাড়করণ কার্যাদির সমন্বয় সাধন;
-  নিয়ন্ত্রিত ফসলের ব্রিডার, ভিত্তি ও প্রত্যায়িত শ্রেণির বীজ প্রত্যয়ন করা;
-   পরিদর্শন ও বীজ পরীক্ষার মাধ্যমে উৎপাদিত ও বাজারজাতকৃত বীজের মাননিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন;
-  দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং  করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিঃ হতে ট্যাগ মুদ্রণপূর্বক সন্তোষজনক ফলাফলের ভিত্তিতে আঞ্চলিক বীজ প্রত্যয়ন অফিসার কার্যালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিসার কর্তৃক ট্যাগ সরবরাহ নিশ্চিত ও তদারকি করা;
-  অনুমোদিত বীজ ডিলার কর্তৃক বিক্রীত বীজের মান সঠিক আছে কি না যাচাই করার লক্ষ্যে মার্কেট মনিটরিংয়ের মাধ্যমে বীজ আইন, ২০১৮ এর বিধানসমূহ প্রয়োগ করা/ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা।

 

অর্জন :
- বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি প্রতিষ্ঠালগ্নে ১২,০০০ মে.টন বীজ প্রত্যয়ন করা হয়েছিল। বর্তমানে ৩৯,৫০০ হেক্টর জমির মাঠ প্রত্যয়নের মাধ্যমে ১,৬০,৬২৯ মে.টন বীজ প্রত্যয়ন করা হচ্ছে;
- ডিইউএস ভিসিইউ পরীক্ষার মাধ্যমে এ পর্যন্ত মোট ইনব্রিড ধানের ১১৮টি, গমের ৩৫টি, আলুর ৮১টি, আখের ৪৬টি, আশ জাতীয় ফসলের ৫০টি জাত ছাড়করণ এবং হাইব্রিড ধানের ১৭৩টি জাত নিবন্ধন করা হয়;
- প্রি-পোস্ট কন্ট্রোল গ্রো-আউট টেস্ট এর মাধ্যমে জাতের কৌলিক বিশুদ্ধতা যাচাই করে উৎপাদনকারী ও প্রত্যয়নকারীদের পরামর্শ প্রদান করা হয়;
- পূর্বে শুধুমাত্র বিএডিসি কর্তৃক উৎপাদিত বীজ প্রত্যয়ন করা হতো। বর্তমানে প্রায় ৫০০ নিবন্ধিত বীজ উৎপাদনকরীদের প্রত্যয়ন সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
-  বর্তমানে মার্কেট মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ২,৭০৬টি বীজ নমুনা সংগ্রহপূর্বক পরীক্ষা করা এবং বীজ আইন লঙ্গনকারীদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ৬৭,০০০ টাকা জরিমানা করা হয়।
প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অচিরেই দেশে একটি শক্তিশালী বীজ শিল্প গড়ে উঠবে, বীজের মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে, দেশে টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা অর্জিত হবে এবং দেশ কাক্সিক্ষত সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে- এ আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস।

 

কিংকর চন্দ্র দাস
পরিচালক, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, গাজীপুর, ফোন : ৪৯২৭২২০০, ই-মেইল : dir.sca.gov.bd@gmail.com

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর (ভাদ্র ১৪২৬)

কৃষি বিষয়ক
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
 

মোসা. নীলুফার, গ্রাম : মৌতলা, উপজেলা : কালীগঞ্জ, জেলা : সাতক্ষীরা
প্রশ্ন : সূর্যমুখী গাছে এক ধরনের পোকার আক্রমণে পাতা, ফুল ও কাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সময়মতো দমন করতে পারি নাই। এ বছর আগেভাগেই আপনার পরামর্শ পেতে চাই।

উত্তর :  সূর্যমুখী গাছে সাধারণত বিছা পোকার আক্রমণে এ অবস্থা হয়ে থাকে। আর এ পোকার আক্রমণে সূর্যমুখী গাছের বাড়বাড়তি ব্যাহত হয়। এমনকি ফুল ও ফল ধারণও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্য এ পোকা আক্রমণ করলে ২/১টি পাতায় বিছাপোকার দলবদ্ধ অবস্থান দেখা গেলে সাথে সাথেই পাতাসহ কীড়া সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে। আর যদি কোনো কারণে পোকার আক্রমণ বেশি হয় তবে সাইপারমেথ্রিন ও ক্লোরোপাইরিফস গ্রুপের কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করতে হবে। আর এ কাজটি করতে ১০ দিন অন্তর কমপক্ষে ২বার। আশাকরি এ সমস্ত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করলে আপনি উপকার পাবেন।  
 

মো. রকিবুল ইসলাম, গ্রাম : পাটগা মুন্সিপাড়া, উপজেলা : রানীশংকৈল, জেলা : ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন : পানিকচু গাছের করম পচে যায়। এ সমস্যায় করণীয় কী?  

উত্তর :  পানিকচু গাছের করম পচে গেলে গাছের পাতা হলুদ এবং গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। এছাড়া একরকম কোনো ধরনের ফলন পাওয়া যায় না বললেই চলে। এ রোগ দমনে রোগমুক্ত এলাকা হতে চারা বা কলম সংগ্রহ করতে হবে। পরিষ্কার চাষাবাদ ও শস্যাবর্তন করার পাশাপাশি ফসল কাটার পর ফসলের অবশিষ্টাংশ ধ্বংস করে ফেলতে হবে। আক্রমণের মাত্রা বেশি মনে হলে মেনকোজেব ও মেটালেক্সিল গ্রুপের যেকোনো ছত্রাকনাশক যেমন রিডোমিল গোল্ড ২ গ্রাম লিটারপ্রতি ভালোভাবে মিশিয়ে স্প্রে করা হলে সুফল পাওয়া যায়। খেয়াল রাখতে হবে উল্লিখিত ছত্রাকনাশকটি যেন ফসলের গোড়ার মাটি ভালোভাবে ভিজিয়ে দেয়।  তবে মাটি ভিজানোর ১ দিন পর আবার পানি দেয়া যাবে। আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে সেটি হলো ছত্রাকনাশক ছিটানোর সময় ডিটারজেন্ট যেমন সার্ফ বা হুইল পাউডার ২০ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। অন্যথায় ছিটানো ছত্রাকনাশক পাতা থেকে গড়িয়ে পড়ে যাবে। এতে করে ছত্রাকনাশক ছিটানোর কাক্সিক্ষত সফলতা পাওয়া যাবে না। এসব ব্যবস্থা নিলে আপনার উপকার হবে।
 

মোসা. সুইটি বেগম, গ্রাম : মামুদপুর, উপজেলা : ক্ষেতলাল সদর, জেলা : জয়পুরহাট
প্রশ্ন : পেয়ারার গায়ে ছোট ছোট রঙের দাগ দেখা যায়। পরে দাগগুলো বড় হয়ে পেয়ারার গায়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়। এ সমস্যার সমাধান জানাবেন।  

উত্তর : এটি পেয়ারা অ্যানথ্রাকনোজ রোগ। কলেট্রোট্রিকাম সিডি নামক ছত্রাকের আক্রমণ হলে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। এ রোগ হলে পেয়ারাগুলো ফেটে যায়। এমনকি ফলের শাঁস শক্ত হয়ে যায়। এ সমস্যার প্রতিকারে গাছের নিচে ঝরে পড়া পাতা ও ফল সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আর গাছে ফুল আসার পর টপসিন-এম প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম অথবা টিল্ট-২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ৩ থেকে ৪ বার ভালোভাবে স্প্রে করলে এ সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে।  
 

মো. রমজান আলী, গ্রাম : দক্ষিণ বারপোতা, উপজেলা : শার্শা, জেলা : যশোর
প্রশ্ন : সাতকরা চারা লাগানোর ভালো সময়, গর্ত  তৈরি  এবং সার প্রয়োগ স¤পর্কে জানতে চাই।

উত্তর :  ভাদ্র-আশ্বিন মাস সাতকরার চারা বা কলম লাগানোর উপযুক্ত সময়। চারা বা কলম লাগানোর ১৫ থেকে ২০ দিন আগে ৫-৬ মিটার দূরত্বে ৭৫ ঢ ৭৫ ঢ ৭৫ সেন্টিমিটার মাপের গর্ত তৈরি করতে হবে। তারপর প্রতি গর্তে ১৫ কেজি কম্পোস্ট বা পচা গোবর, ৩-৫ কেজি ছাই, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি এবং ২৫০ গ্রাম চুন গর্তের উপরের মাটির সাথে ভালাভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর পানি দিয়ে গর্ত ভিজিয়ে দিতে হয়। গর্ত তৈরি করার ১০-১৫ দিন পর গর্তের মাঝে ১ বছর বয়সের নির্বাচিত চারা/কলমটি সোজাভাবে লাগাতে হয়।  আর চারা লাগানোর পরপরই খুঁটি ও পানি দেয়া জরুরি। এভাবে আপনি সাতকরা চারা লাগাতে পারেন। আশা করি উপকার পাবেন।
 

মো. হামিদ হোসেন, গ্রাম : পাটগাঁ মুন্সিপাড়া, উপজেলা : রানীশংকৈল, জেলা : ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন :  মরিচ গাছের ডগা, ফুলের কুঁড়ি ও ফল পঁচে যাচ্ছে এবং গাছ ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করে। এতে ফলনও অনেক কমে যায়। এ অবস্থায় কী করণীয়?

উত্তর : এ সমস্যা প্রতিকারের জন্য সুস্থ ও সবল ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। প্রোভেক্স-২০০ বা ব্যাভিস্টিন প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে বীজ শোধন করে বীজ তলায় বপন করতে হবে। এছাড়া জমির পানি নিকাশের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি গাছের পরিত্যক্ত অংশ, আগাছা ও ধুতুরা জাতীয় গাছ একসাথে করে সব ধ্বংস করে ফেলতে হবে। এছাড়া গাছে রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে প্রপিকোনাজল গ্রুপের যেমন টিল্ট ২৫০ ইসি ০.৫ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। এসব ব্যবস্থা নিলে গ্রহণ করলে উপকার পাবেন।
 

মো. জিয়াউর রহমান, গ্রাম : টেপিবাড়ি, উপজেলা : ভুয়াপুর, জেলা : টাঙ্গাইল
প্রশ্ন : মুগ গাছের পাতায় পাউডারের মতো আবরণ পড়ে। পরবর্তীতে পাতার উপরের সাদা পাউডার ছাই রঙ ধারণ করে এবং তা কালো বা বাদামি রঙের পাউডারে পরিণত হয়। এ রোগ দমন সম্পর্কে জানাবেন।  

উত্তর :  মুগ গাছের এ সমস্যাটিকে পাউডারি মিলডিউ রোগ বলে। এটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগ দেখা দিলে প্রপিকোনাজল গ্রুপের যেমন টিল্ট প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলিলিটার ভালোভাবে মিশিয়ে ৭ হতে ১০ দিন পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করলে সুফল পাবেন। এছাড়া পাউডারি মিলডিউ প্রতিরোধী জাত এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে নেই। সে কারণে আগাম বোনা অর্থাৎ ভাদ্র মাসের শুরু থেকে আশ্বিন মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বোনা ফসলে এ রোগের আক্রমণে ক্ষতির পরিমাণ কম হয়। এ বিষয়টি খেয়াল রাখলে এ রোগের ক্ষতি কমানো সম্ভব।   
 

মৎস্য বিষয়ক
মো: আক্কাস আলী, গ্রাম : বনগ্রাম, উপজেলা : কাউনিয়া, জেলা : রংপুর
প্রশ্ন : পুকুরে আগাছার পরিমাণ বেড়ে গেছে কী করব?

উত্তর:  জলজ উদ্ভিদকে আগাছা ও ক্ষতিকারক হিসাবে চিহ্নিত করলেও সব জলজ উদ্ভিদ ক্ষতিকারক নয়। কখনও কখনও এগুলো মাছ চাষের জন্য উপকারে আসে। আবার কুটিপানা, ক্ষুদিপানা এসব গ্রাসকার্প ও সরপুটির খাদ্য হিসেবে বব্যহৃত হয়। কচুরিপানা ও অন্যান্য জলজ আগাছা তুলে কম্পোস্ট তৈরির কাজে ব্যবহার করা যায়। জলজ আগাছ নিয়ন্ত্রণের বেশ কয়েকটি পদ্ধতি আছে। সেগুলো হলো-কায়িক শ্রম পদ্ধতি অর্থাৎ পুকুরের যাবতীয় আগাছাকে দা, কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলে হাত দিয়ে তুলে ফেলা যায়। কখনও কখনও পুকুরে দড়ি টেনে আগাছার শিকড় আলাদা করে পরে টেনে তোলা যায়। এছাড়া জৈবিক পদ্ধতিতে নানা ধরনের মাছ আছে যেমন গ্রাস কার্প, মিরর কার্প যারা ডুবন্ত উদ্ভিদ খেয়ে সহায়তা করে। আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে সার প্রয়োগ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে পুকুরে ডুবন্ত উদ্ভিদ থাকলে বেশি পরিমাণে অজৈব সার প্রয়োগ করে তা দমন করা যায়। যদি পুকুরে ডুবন্ত উদ্ভিদ থাকে তাহলে প্রতি শতাংশে ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে ২ থেকে ৩ দিনের মাঝে পুকুরে সবুজ স্তরের সৃষ্ট করে। ফলে সূর্যালোক না পাওয়ার ফলে অল্প কয়েক দিনের মধ্যে মারা যাবে। সর্বশেষ পদ্ধতি হচ্ছে রাসায়নিক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে জলজ আগাছা দমনের জন্য যে সমস্ত রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহৃত হয় সেগুলো হলো- সিমাজিন ও এনডোথল। সিমাজিন ৩ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার পানিতে চারাজাতীয় উদ্ভিদ ধ্বংসের জন্য এবং এনডোথল ১ থেকে ৩ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার পানিতে কেশরীয়

উদ্ভিদ ধ্বংসের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে।  
মো: গাফফার আলী, গ্রাম : পইলসা উপজেলা : ভ্ঞুাপুর, জেলা : টাঙ্গাইল

প্রশ্ন : অ্যালকোহলের সাথে হরমোন মিশ্রণের কৌশল ও মাত্রা জানতে চাই।  
উত্তর : তেলাপিয়ার পুরুষ মাছ উৎপাদনের জন্য ১৭ আলফা মিথাইল টেস্টোস্টেরন নামক হরমোন প্রয়োজন। এক দিন বয়সী বাচ্চাকে পুকুর থেকে ধরে হাপায় স্থানান্তরের পর ঐ হাপায় হরমোন মিশ্রিত খাবার দিতে হবে। সাধারণত হ্যাচারিতে তেলাপিয়ার বাচ্চা ফুটানোর পর ৫ থেকে ৬ দিন হরমোন মিশ্রিত খাবার খাওয়ানোর পরে পুকুরে স্থাপিত হাপায় খাবার প্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে হ্যাচারির কোন হাউস বা সিস্টার্ন ব্যবহার না করে সরাসরি পুকুরে স্থাপিত হাপায় খাবার দিতে হবে। প্রথমে একটি ছোট  স্প্রে মেশিনের ছোট বোতলে পরিমিত মাত্রায় হরমোন ভরে তারপর ওই হরমোনের সাথে অ্যালকোহল মিশাতে হবে। অ্যালকোহলে হরমোন দ্রবীভূত হয়ে মিশে যাবে। পরে ওই হরমোন মিশ্রিত অ্যালকোহল খাবারের উপর কমপক্ষে চারবার স্প্রে করতে হবে। অ্যালকোহলের সাথে হরমোন মিশানোর অর্থ হলো হরমোন মিশ্রিত অ্যালকোহল খাবারের উপর স্প্রে করার পর অ্যালকোহল উড়ে গিয়ে খাবারের মধ্যে হরমোন মিশে যাবে। এখানে অ্যালকোহল শুধুমাত্র খাবারে হরমোন মিশানোর মিডিয়া হিসেবে কাজ করে। এক কেজি খাবারের জন্য প্রথমে দরকার ১ কেজি ভাসমান নার্সারি খাবার। এক কেজি খাবার প্রস্তুতের জন্য ৭৫ মিলিগ্রাম ১৭ আলফা মিথাইল টেস্টোস্টেরন নামক হরমোন প্রয়োজন। বিশুদ্ধ ইথাইল অ্যালকোহল লাগবে ১০০ মিলিলিটার।    
 

(মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক প্রশ্ন কৃষি কল সেন্টার হতে প্রাপ্ত)
প্রাণিসম্পদ বিষয়ক

 

মো. আল আমিন, গ্রাম : চামেশ্বরী, উপজেলা : ঠাকুরগাঁও সদর, জেলা: ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন : গরুর বয়স সাড়ে দুই বছর। জোরে শ্বাস প্রশ্বাস হচ্ছে। কিছু খাচ্ছে না। জ্বর আছে, পা খুঁড়িয়ে হাঁটছে। এমতাবস্থায় কী করণীয় ?

উত্তর : আক্রান্ত পশুকে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে এবং প্রচুর পানি খাওয়াতে হবে। এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন যেমন জেন্টামাইসিন অথবা অক্সিটেট্রাসাইক্লিন কিংবা পেনিসিলিন গ্রুপের ইনজেকশন দিতে হবে। প্যারাসিটামল গ্রুপের ওষুধ খাওয়াতে হবে এবং এন্টিহিস্টামিনিক গ্রুপের ইনশেকশন দিতে হবে।     
 

কমল সরকার, গ্রাম : সুরগ্রাম, উপজেলা : গোপালগঞ্জ সদর, জেলা : গোপালগঞ্জ

প্রশ্ন : বাছুরের বয়স ২ মাস। মুখ ফুলে গেছে। কিছু খেতে চাচ্ছে না। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কিছু চাবাতে পারছে না। কী করণীয়?
উত্তর: আক্রান্ত বাছুরকে দ্রুত আলাদা ঘরে সরিয়ে ফেলতে হবে। বাছুরের খাবারপাত্র, পানির পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। বাছুরের মুখে  কোন ঘাও আছে কিনা দেখতে হবে। কোট্টিম ভেট বোলাস খাওয়াতে হবে অথবা জেন্টামাইসিন অথবা অক্সিটেট্রাসাইক্লিন গ্রুপের ইনজেকশন দিতে হবে পাশাপাশি এন্টিহিস্টামিনিক ইনজেকশন দিতে হবে। আশা করি আপনি উপকৃত হবেন।

 

কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন


উপপ্রধান তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল ০১৭১১১১৬০৩২, ই-মেইল : ঃtaufiquedae25@gmail.com

বিস্তারিত
আশ্বিন মাসের কৃষি

দিগন্ত জুড়ে সবুজ, শুভ্র কাশফুল আর সুনীল আকাশে ভেসে বেড়ায় চিলতে সাদা মেঘ জানান দেয় শরৎকাল ঋতুর। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আপনাদের সবার জন্য সাদা কাশফুলের শুভেচ্ছা। বর্ষা মৌসুমের সবটুকু ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া আর চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে কার্যকরি প্রস্তুতি নেবার সময় এখন। এ প্রেক্ষিতে আসুন সংক্ষেপে জেনে নেই আশ্বিন মাসের বৃহত্তর কৃষি ভুবনের করণীয় বিষয়গুলো।


আমন ধান
আমন ধানের বয়স ৪০-৫০ দিন হলে ইউরিয়ার শেষ কিস্তি প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হবে এবং জমিতে ছিপছিপে পানি রাখতে হবে। এ সময় বৃষ্টির অভাবে খরা দেখা দিতে পারে। সে জন্য সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। ফিতা পাইপের মাধ্যমে সম্পূরক সেচ দিলে পানির অপচয় অনেক কম হয়। শিষ কাটা লেদা পোকা ধানের জমি আক্রমণ করতে পারে। প্রতি বর্গমিটার আমন জমিতে ২-৫টি লেদা পোকার উপস্থিতি মারাত্মক ক্ষতির পূর্বাভাস। তাই সতর্ক থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সময় মাজরা, পামরি, চুঙ্গী, গলমাছি পোকার আক্রমণ হতে পারে। এক্ষেত্রে নিয়মিত জমি পরিদর্শন করে, জমিতে খুঁটি দিয়ে, আলোর ফাঁদ পেতে, হাতজাল দিয়ে পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। খোলপড়া, পাতায় দাগ পড়া রোগ দেখা দিতে পারে। সঠিক রোগ শনাক্তকরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।


নাবি আমন রোপণ
কোন কারণে আমন সময় মতো চাষ করতে না পারলে অথবা নিচু এলাকায় আশ্বিনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রি ধান৪৬, বিনাশাইল বা স্থানীয় জাতের চারা রোপণ করা যায়। গুছিতে ৫-৭টি চারা রোপণ করতে হবে। অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি ইউরিয়া প্রয়োগ ও অতিরিক্ত পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায় এবং দেরির ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায়।

 

তুলা
এ সময় তুলাক্ষেতে গাছের বয়স ৬০ দিন পর্যন্ত আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। গোড়ার সবচেয়ে নিচের ১-২টি অঙ্গজ শাখা কেটে দেয়া ভালো। লাগাতার বৃষ্টি এবং ঝড়ো বাতাসের কারণে গাছ হেলে পড়লে পানি নিষ্কাশনসহ হেলে যাওয়া গাছ সোজা করে গোড়ায় মাটি চেপে দিতে হবে। ইউরিয়া, এমওপি ও বোরনসহ অন্যান্য অনুখাদ্য নিয়মিতভাবে পাতায় প্রয়োগের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এ সময় রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা গেলে সঠিক বালাই শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

পাট
নাবী পাট বীজ ফসল উৎপাদনে এ সময় গাছ থেকে গাছের দূরত্ব সমান রেখে অতিরিক্ত গাছ তুলে পাতলা করে দিতে হবে। দ্বিতীয় কিস্তির ইউরিয়া সার ১৫-২০ দিনে এবং তৃতীয় কিস্তির ইউরিয়া সার ৪০-৪৫ দিনে প্রয়োগের সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকে। এ সময় সবজি ও ফল বাগানে সাথী ফসল হিসেবে বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারেন।

 

আখ
আখের চারা উৎপাদন করার উপযুক্ত সময় এখন। সাধারণত বীজতলা পদ্ধতি এবং পলিব্যাগ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করা যায়। পলিব্যাগে চারা উৎপাদন করা হলে বীজ আখ কম লাগে এবং চারার মৃত্যুহার কম হয়। চারা তৈরি করে বাড়ির আঙ্গিনায় সুবিধাজনক স্থানে সারি করে রেখে খড় বা শুকনো আখের পাতা দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়।  চারার বয়স ১-২ মাস হলে মূল জমিতে রোপণ করা উচিত। কাটুই বা অন্য পোকা যেন চারার ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।

 

বিনা চাষে ফসল আবাদ
মাঠ থেকে বন্যার পানি নেমে গেলে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় বিনা চাষে অনেক ফসল আবাদ করা যায়। ভুট্টা, গম, আলু, সরিষা, মাসকালাই বা অন্যান্য ডাল ফসল, লালশাক, পালংশাক, ডাঁটাশাক বিনা চাষে লাভজনকভাবে আবাদ করা যায়। সঠিক পরিমাণ বীজ, সামান্য পরিমাণ সার এবং প্রয়োজনীয় পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে লাভ হবে অনেক। যেসব জমিতে উফশী বোরো ধানের চাষ করা হয় সেসব জমিতে স্বল্পমেয়াদি সরিষা  জাত (বারি সরিষা-৯, বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বিনা সরিষা-৪, বিনা সরিষা-৯ ইত্যাদি)চাষ করতে পারেন।

 

শাকসবজি
আগাম শীতের সবজি উৎপাদনের জন্য উঁচু জয়গা কুপিয়ে পরিমাণ মতো জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে শাক উৎপাদন করা যায় যেমন মুলা, লালশাক, পালংশাক, চিনা শাক, সরিষা শাক অনায়াসে করা যায়। সবজির মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, টমেটো, বেগুন, ব্রোকলি বা সবুজ ফুলকপিসহ অন্যান্য শীতকালীন সবজির চারা তৈরি করে মূল জমিতে বিশেষ যত্নে আবাদ করা যায়।

 

কলা
অন্যান্য সময়ের থেকে আশ্বিন মাসে কলার চারা রোপণ করা সবচেয়ে বেশি লাভজনক। এতে ১০-১১ মাসে কলার ছড়া কাটা যায়। ভালো উৎস বা বিশ্বস্ত চাষি ভাইয়ের কাছ থেকে কলার অসি চারা সংগ্রহ করে রোপণ করতে হবে। কলার চারা রোপণের জন্য ২-২.৫ মিটার দূরত্বে ৬০ সেমি. চওড়া এবং ৬০ সেমি গভীর গর্ত করে রোপণ করতে হবে। গর্তপ্রতি ৫-৭ কেজি গোবর, ১২৫ গ্রাম করে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সার এবং ৫ গ্রাম বরিক এসিড মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে ৫-৭ দিন পর অসি চারা রোপণ করতে হবে। কলা বাগানে সাথী ফসল হিসেবে ধান, গম, ভুট্টা ছাড়া যে কোন রবি ফসল চাষ করা যায়।


গাছপালা
বর্ষায় রোপণ করা চারা কোনো কারণে নষ্ট হলে সেখানে নতুন চারা রোপণ করতে হবে। বড় হয়ে যাওয়া চারার সঙ্গে বাঁধা খুঁটি সরিয়ে দিতে হবে এবং চারার চারদিকের বেড়া প্রয়োজনে সরিয়ে বড় করে দিতে হবে। মরা বা রোগাক্রান্ত ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। চারা গাছসহ অন্যান্য গাছে সার প্রয়োগের উপযুক্ত সময় এখনই। গাছের গোড়ার মাটি ভালো করে কুপিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে। দুপুর বেলা গাছের ছায়া যতটুকু স্থানে পড়ে ঠিক ততটুকু স্থান কোপাতে হবে। পরে কোপানো স্থানে জৈব ও রাসায়নিক সার ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে।

 

প্রাণিসম্পদ
হাঁস-মুরগির কলেরা, ককসিডিয়া, রানীক্ষেত রোগের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। প্রাথমিকভাবে টিকা প্রদান, প্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়ানোসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক। এ মাসে হাঁস-মুরগির বাচ্চা ফুটানোর ব্যবস্থা নিতে পারেন। বাচ্চা ফুটানোর জন্য অতিরিক্ত ডিম দেয়া যাবে না। তাছাড়া ডিম ফুটানো মুরগির জন্য অতিরিক্ত বিশেষ খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

 

আশ্বিন মাসে গবাদিপশুকে কৃমির ওষুধ খাওয়ানো দরকার। গবাদি পশুকে খোলা জায়গায় না রেখে রাতে ঘরের ভিতরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। পানিতে জন্মানো গোখাদ্য এককভাবে না খাইয়ে শুকিয়ে খরের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। এ সময় ভুট্টা, মাসকলাই, খেসারি বুনো ঘাস উৎপাদন করে গবাদিপশুকে খাওয়াতে পারেন। গর্ভবতী গাভী, সদ্য ভূূমিষ্ঠ বাছুর ও দুধালো গাভীর বিশেষ যত্ন নিতে হবে। এ সময় গবাদি প্রাণীর মড়ক দেখা দিকে পারে। তাই গবাদিপশুকে তড়কা, গলাফুলা, ওলান ফুলা রোগের জন্য প্রতিষেধক, প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চত করতে হবে।
 

মৎস্যসম্পদ
বর্ষায় পুকুরে জন্মানো আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং পুকুরের পাড় ভালো করে বেঁধে দেয়া প্রয়োজন। পুকুরের মাছকে নিয়মিত পুষ্টিকর সম্পূরক খাবার সরবরাহ করা দরকার। এ সময় পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া পুকুরে জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং রোগ সারাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি মাছের খামার থেকে জিওল মাছের পোনা সংগ্রহ করে পুকুরে ছাড়ার ব্যবস্থা নিতে পারেন।


আশ্বিন মাসে নিয়মিত কৃষি কাজের পাশাপাশি সারা দেশজুড়ে ইঁদুর নিধন অভিযান শুরু হয়। ইঁদুরের হাত থেকে ফসল রক্ষা করার জন্য এ অভিযান। এককভাবে বা কোন নির্দিষ্ট এলাকায় ইঁদুর দমন করলে কোন লাভ হবে না। ইঁদুর দমন কাজটি করতে হবে দেশের সকল মানুষকে একসাথে মিলে এবং ইঁদুর দমনের সকল পদ্ধতি ব্যবহার করে। ইঁদুর নিধনের ক্ষেত্রে যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায় সেগুলো হলো- পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক চাষাবাদ, গর্তে ধোঁয়া দেয়া, ফাঁদ পাতা, উপকারী প্রাণী যেমন- পেচা, গুঁইসাপ, বিড়াল দ্বারা ইঁদুর দমন, বিষটোপ এবং গ্যাসবড়ি ব্যবহার করা। আসুন সবাই একসাথে ইঁদুর দমন করি। সবাই ভালো থাকি।

 

কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, টেলিফোন:০২৫৫০২৮৪০৪, ই-মেইল :editor@ais.gov.bd

বিস্তারিত
হে বঙ্গবন্ধু! অসীম দূরদৃষ্টি তোমার (কবিতা ভাদ্র ১৪২৬)

কৃষিবিদ শেখ মোঃ মুজাহিদ নোমানী
১৯২০ সাল, হে বঙ্গবন্ধু! তুমি জন্মেছিলে
টুঙ্গিপাড়ার এক অজপাড়াগাঁয়ে
চোখ মেলেই তুমি দেখেছো,
তোমার সোনার বাংলা আছে পরাধীন হয়ে।
ক্লাস ফোরের ছাত্র তখন তুমি,
দেখলে শীতে কাঁপছে বৃদ্ধফকির খালি গায়ে,
তা দেখে তোমার দয়ার মন উঠলো কেঁদে,
আর তাই নিজের গায়ের কাপড় দিলে তাকে পরিয়ে।
ক্লাস সেভেনের ছাত্র তুমি, কতটুকুই বা আর বয়স তোমার,
অথচ পথ আটকে দিলে প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলার,
বজ্রদীপ্ত দাবি ছিল একটাই, ছাত্র হোস্টেলের ছাদ,
মেরামত করে দিতে হবে চমৎকার।
কিশোরেই তোমার সাহস দেখে
মুগ্ধ হলেন নেতা শেরেবাংলা,
সেই কিশোর তুমি, আজ মোদের
জাতির পিতা ৭১ এ জন্ম দিলে সোনার বাংলা।
১৯৭২ সাল, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত,
ক্ষত-বিক্ষত তোমার সোনার বাংলা,
সাত কোটি মানুষের দিতে হবে,
অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা।
বুঝেছিলে তুমি তখনই
উৎপন্ন করতে হবে অনেক খাবার,
আর তাই প্রয়োজন ভালো বীজের
নইলে সোনার বাংলা হয়ে যাবে ছাড়খার।
তাই প্রতিষ্ঠা করলে তুমি বিএডিসি, এসসিএ,
১৯৭৩ সাল, তোমার পদভারে ধন্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ।
 বজ্র কণ্ঠে ঘোষণা করলে তোমার অবদান,
‘আজ থেকে কৃষিবিদ তোরা ক্লাশ ওয়ান’।
তুমি বলেছিলে, ‘মান রাখিস তোরা আমার’
হে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু!
তোমার চির উন্নত শির, উঁচু রেখেছি বারবার।
আজ তাই তোমার সোনার বাংলায়
মাছ মাংস ভাতের নেই কোন হাহাকার।য়

বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার প্রাপ্ত কৃষি সাংবাদিক, জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিসার (পিআরএল), এসসিএ, জামালপুর, মোবাইল : ০১৭১৮৭৩৯৮৫৫,
ই-মেইল ঃ
nomani1961@gmail.com 

বিস্তারিত
বঙ্গবন্ধু (কবিতা ভাদ্র ১৪২৬)

কৃষিবিদ আহমেদ হাছিব মোল্লা১

হে বঙ্গবন্ধু
তুমি বীজ পুরুষ ধানের কবিতা তুমি
তুমি ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি
কৃষি কাব্যে স্বর্ণালী অক্ষর তুমি
তোমার সারা গায়ে ফসলের সমারোহ

হে বঙ্গবন্ধু
তুমি স্বাধীনতার মহাকবি
তুমি বিশে^র এক মহান নেতা
তুমি বাঙালির জাতির পিতা
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি তুমি

হে বঙ্গবন্ধু
তুমি প্রশস্য কৃষির প্রবাদ পুরুষ তুমি
তোমার সুষম ঘামে সিক্ত ফসলের মাঠ
উর্বর মাঠ জুড়ে সোনালি ফসল তুমি
তোমার সুঘ্রাণে উদ্ভাসিত চাষি সকল

হে বঙ্গবন্ধু
তুমি রাজনীতির মাঠে ত্রিকালদর্শী এক নেতা
তুমি বঙ্গশার্দূল লোকপ্রিয়তায় শীর্ষ তুমি
খাঁটি দো-আঁশ মাটির খাঁটি বাঙালি তুমি
তুমি লড়াকু মুক্তির দিশারী তুমি

হে বঙ্গবন্ধু
তুমি কৃষি ও কৃষকের অহংকার
প্রগাঢ় এক সবুজ ভূ-খ- তুমি
তেরশত নদী তোমার শরীরে প্রবাহিত
দ্বৈমাতৃক ধানের মাঠে তুমি স্বর্ণ শীষ

হে বঙ্গবন্ধু
তুমি বপ্তা পুরুষ ফসলের রংধনু তুমি
শস্যের শুভ্র ন¤্র প্রণতা ফুল তুমি
ধন ধান্যে ধন্য পুরুষ তুমি
কৃষি ও কৃষকের সহজাত এক বন্ধু তুমি

হে বঙ্গবন্ধু
তুমি মহীরুহ তুমি মহানায়ক
তুমি মানুষের বন্ধু তুমি বঙ্গবন্ধু
তুমি কোটি মানুষের উচ্চারিত শব্দ নাম
তুমিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
হে বঙ্গবন্ধু
তুমি হিমালয় তুমি বঙ্গোপসাগর
তুমি অমৃতায়মান তুমি মহান
তোমাকে ভালোবাসি গভীরভাবে
তোমাকে ভালোবাসি নিবিড়ভাবে

হে বঙ্গবন্ধু
তুমি অমর তুমি জাগ্রত অনন্ত
তুমি শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকো
কৃষকের শস্য প্রাসাদে

 

স্বপ্ন পুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান
ড. সমজিৎ পাল২


এই বাঙালির স্বপ্নপুরুষ স্বাধীনতার নেতা
যার কারণে বাঙালি হয় পূর্ণ স্বাধীন-চেতা
যার কারণে বাঙালি পায় স্বাধীন দেশের মাটি
যিনি ছিলেন উন্নয়নেও সোনার জিয়নকাঠি
যার কারণে সবুজ হলো পোড়া মাটির দেশ
কৃষক আবার আনলো মাঠে সফল কাজের রেশ
কামার-কুমার, তাঁতি-জেলে উঠলো আবার জেগে
যাত্রা সবার শুরু হলো হৃদয়-মনের বেগে।
যার ডাকে ফের গড়তে এ দেশ সবাই দিলো সাড়া
নিজের হাতে যে লাগালো সোনার দেশে চারা।
শিক্ষা হলো সরকারি আর জমির খাজনা মাফ
কলের শ্রমিক মালিক হলো বাঁচলো ছেড়ে হাঁফ।
বিশ্বসভায় ঠাঁই পেল দেশ বাঙালির গৌরব
যার কারণে আসলো সেদিন উন্নয়নের রব
উন্নয়নের নয়ন যখন উৎপাদনের লক্ষ্য
ঠিক তখনই ছিদ্র হলো বাঙালিদের বক্ষ।
ষড়যন্ত্রের কূটচালেতে খুন হলো সেই নেতা
হত্যা করে চিরতরে যায় না কিছু জেতা।
ইতিহাসের আস্তাকুঁড়েই হত্যাকারীর দল
তাদের যারা সঙ্গী ছিল দেখায় নানান ছল।  
আগস্ট মাসের পনেরো হয় সেই সে শোকের দিন
তার কাছে যে সবার আছে চিরকালের ঋণ।
সেই ঋণেতেই গাছের পাতায় আজও বাতাস বহমান
শ্রদ্ধা জানাই; জাতির পিতা, শেখ মুজিবুর রহমান।

১সাবেক অতিরিক্ত পরিচালক, ডিএই, বরিশাল, মোবাইল ০১৭১১-৪৮৬৫৮৩। ২ পরিচালক (গবেষণা), বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী, পাবনা। মোবাইল : ০১৭১২০২১১৪০, ই-মেইল : samajitpal@gmail.com

বিস্তারিত
বঙ্গবন্ধুর প্রতি নিবেদিত পঙ্ক্তিমালা (কবিতা ভাদ্র ১৪২৬)


আবু হেনা ইকবাল আহমেদ

টুঙ্গিপাড়া গ্রাম
সাবেক ফরিদপুর, বর্তমানে গোপালগঞ্জ নাম
ব্রিটিশ শাসন কাল
১৭ মার্চ,  ১৯২০ সাল
এই দিনে জন্ম নিলো এক খোকা
যেন একরাশ রজনীগন্ধার থোকা।
মাতা সায়েরা খাতুন,  বাবা শেখ লুৎফর রহমান
চার মেয়ে দুই পুত্রের মাঝে শেখ মুজিবুর তৃতীয় সন্তান ॥
 
যতো শিশু দেশময়  যে যেখানে মেতে রয়  আঠারোর নিচে বয়স
শিশু দিবসের দিনে তারে নিতে হবে চিনে কেন মার্চে এ দিবস।
জেল জুলুম মাড়িয়ে  বজ্রকণ্ঠে হাঁক দিয়ে  জনতাকে বলে যান
‘এবারের  সংগ্রাম- স্বাধীনতার  সংগ্রাম’- শেখ মুজিবুর রহমান ॥

ব্রিটিশের থেকে ধর্মের নামে হলো যে পাকিস্তান
সেদেশ বাংলারে বানালো আরেক নারকীয় গোরস্থান
জনতার অধিকার ছিনিয়ে আনার  খেটে জেল ও জুলুম
শিকের আড়াল অহোরাত্র বেল  তার কেটেছে নির্ঘুম।

হাজার বছর পরে এ বাংলায় শুনি  আজ পেতে কান
ছিল এতদিন যার প্রতীক্ষায় সে তো শেখ মুজিবুর রহমান ॥

তোমারই জন্য সব, ওই ওঠে কলরব প্রিয় জাতির পিতা
আমাদের এ উৎসব আনন্দ আর বৈভব তোমার জন্য তা ॥

স্মরণসভায় মেলা আজকের এই দিনের
তোমারি শ্রমের আর তোমারি রক্ত ঋণের
অভাব ঘুচালে  দুঃখ যে মুছালে  নাশ করে সকল দৈন্যতা॥

বাংলার মাঠের সোনালি ফসল ফুকারে ওই বারতা
উন্নয়নের সোপনে ওড়ে আজ বিজয়ের সফলতা।

বাঙ্গালিরে তুমি  দেখালে জগতে   নবরূপে পথচলা
তোমার কণ্ঠের জাতিসংঘে প্রথম  বাংলায় কথা বলা
তোমারই আশা মাতৃভাষা একুশে পেল তার পূর্ণতা॥

ত্রিশ লাখ মানুষের প্রাণ ক্ষয়ে
মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে
আনলো বিজয়কে যে মহানায়ক  তার নাম
শেখ মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশ অভ্যুদয়ে যার অবদান  
এসো গাই তার জয়গান ॥
জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু আমাদের প্রিয় নাম-
শেখ মুজিবুর রহমান
তোমারই শততম জন্মদিনে নাও
 সোনালি সালাম॥

শিশু থেকে বুড়ো হয়ে যেতো জড়ো  বজ্রকণ্ঠে যার
 এ বাংলার স্থল   নদী বিল জল  যেই নামে একাকার।
বাংলাদেশজুড়ে লাল সবুজের পতাকা ওড়ার
অবদানে তার নাম
পিতৃদত্ত খোকা শেখ মুজিবুর রহমান সবে
বঙ্গবন্ধু বলে ডাকলাম॥

আমাদেরে দিলে সাহসবীর্য শোনায়ে অমর বজ্রকণ্ঠ
জনগণে দিলে সামনে চলার বিজয়ের মূলমন্ত্র
সাতই মার্চের স্মরণীয় ভাষণে
বিশ্বে বাড়ালে সম্মান॥

হাজার বছর পতিত ছিল পদ্মা মেঘনা যমুনার লোক
তাদেরে দেখালে আঁধার বিনাশী স্বাধীন সোনালি সূর্যালোক।

বিশ্বে আজিকে সোনার বাংলা স্বনির্ভরতার দেশ
পসরা আর খেলায় পতাকা ওড়ায় বিশ্বে অনিমেষ
আমাদেরে দিলে একটি স্বদেশ
বাংলাদেশ যার নাম॥

বর্গি ও ঠগেরা মিলে     লুটে নিতো আশা
কেউ কেড়ে নিতে ছিল  মুখ থেকে ভাষা
কৃষক মজুর ঠকে ঠকে  হয়ে যেতো বোকা
সে অধিকার ফিরাতে    জন্মে এক খোকা।

চোঙ্গা ফুঁকে এ বাংলার  ধুলামাখা পথে
বুলাতেন হাত তিনি     কৃষকের ক্ষতে
বৃষ্টি ভিজে রোদে পুড়ে  গ্রাম গ্রামান্তরে
গেঁথে নেন নিজ নাম    সবার অন্তরে।

দুঃখীদের প্রাণে তিনি    ভরসা জাগিয়ে
অধিকার এনে দেন      স্বাধীনতা দিয়ে
শিশুকালে যার নাম      রাখাছিল খোকা
বড় হয়ে বুঝেছিল       কারা দেয় ধোঁকা।
কৃষি এবং কৃষকের      দরদি আবাল্য
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিমূলে       দেই পুষ্প মাল্য ॥

কৃষিবিদ ও  পরিচালক (অব.), বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী, কৃষি মন্ত্রণালয়। মোবাইল : ০১৬১৪৪৪৬১১১ ই-মেইল : ahiqbal.ahmed@yahoo.com

বিস্তারিত