গবাদি প্রাণীর সদ্যজাত বাছুরের যত্ন ও পরিচর্যা
মোঃ শাহজাহান মিয়া
স্তন্যপায়ী প্রায় সকল প্রাণীর জন্ম প্রক্রিয়া একই হলেও কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে জন্মপরবর্তী নিবিড় যত্ন দরকার হয়। আমাদের দেশে ঘাস আর খড়ের উপর নির্ভর করে পালন করা দেশি গরুর বাছুরের জন্ম পরবর্তী জটিলতা হতো না বললেই চলে কারণ একদিকে গর্ভাবস্থায় গরু যেমন পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টিকর ঘাস পেতো আবার অন্যদিকে গরু ছিল সব জাতের। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় বিদেশি ক্রস জাতের গাভী এবং বাছুরের জন্য জন্মপরবর্তী নিবিড় পরিচর্যা জরুরি। যে কোন প্রাণী ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে খুব অসহায় অবস্থায় থাকে এবং পরিচর্যার মাধ্যমে তাকে সুস্থ সবল করে তুলতে হয়। জন্মপরবর্তী পরিচর্যার উপরেই একটা বাছুরের ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভরশীল। একটা বাছুরের যত্ন প্রধান করণীয় পর্যায়ক্রমিক কিছু কাজ রয়েছে। সেগুলো নিম্নরূপে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
প্রাথমিক পরিচর্যা ও যত্ন
বাছুরের জন্মের পরপরই পরিষ্কার বেøড দিয়ে নাভি কেটে শক্ত করে বেঁধে দিতে হবে। কাটার পর স্থানটিতে টিংচার আয়োডিন বা টিংচার বেনজিন জাতীয় জীবাণুনাশক ওষুধ লাগাতে হবে। এর ফলে রোগজীবাণু প্রবেশ করতে পারবে না। বাচ্চা প্রসবের পরপরই বাচ্চার নাক ও মুখের লালা ও ঝিল্লিই পরিষ্কার করে দিতে হবে নতুবা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যেতে পারে। যদি বাছুর প্রসব হওয়ার পর শ্বাস-প্রশ্বাস না নেয় তাহলে কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করতে হবে। বাছুরের বুকের পাঁজরের হাড়ে আস্তে আস্তে কয়েকবার চাপ দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করা যায় এছাড়া বাছুরের নাকে-মুখে ফুঁ দিয়েও শ্বাস-প্রশ্বাস চালু করা যায়। বাছুরের নাক মুখ পরিষ্কারের পর গাভীর সামনে শুকনো খড় বিছিয়ে রাখলে গাভী চেটে বাচ্চার গা পরিষ্কার করে দেয়। এরপর শুকনো নরম খড়, কাপড় অথবা চট দিয়ে বাছুরের গা ভালো করে পরিষ্কার করে দিতে হবে। শীত বা অতিরিক্ত ঠাÐায় শুকনো কাপড় বা চট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। অথবা আগুন জ্বালিয়ে বাছুরের শরীর গরম রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সুস্থ-সবল বাছুর জন্মের ১৫ মিনিট পর থেকেই উঠার চেষ্টা করে এবং দুধ খেতে সক্ষম হয়। অনেক সময় নিজের চেষ্টায় দাঁড়াতে ও দুধ খেতে পারে না। এ অবস্থায় বাছুরকে দাঁড়াতে ও দুধ খাওয়াতে সাহায্য করতে হবে। প্রসবের ১-২ ঘণ্টার মধ্যে তার মায়ের শালদুধ খাওয়াতে হবে। যদি বাছুর দুর্বলতার কারণে দাঁড়াতে বা দুধ খেতে না পারে তবে বোতলে নিপল লাগিয়ে দুধ খাওয়াতে হবে।
সদ্যজাত বাছুরের বাসস্থান ব্যবস্থাপনা
বাছুরের জন্য উপযুক্ত বাসস্থান প্রয়োজন। স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান বাছুরকে রোগমুক্ত রাখার প্রধান সহায়ক। রোগমুক্ত রাখার জন্য তাদেরকে পৃথক করে রাখতে হবে এবং এর ফলে প্রতিটি বাছুরের রক্ষণাবেক্ষণ সহজতর হয়। অনেক বাছুর একসাথে থাকলে দুর্বল বাছুরগুলো সবল বাছুরদের সাথে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে প্রয়োজনমাফিক খাবার খেতে পারে না এবং আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। বাছুরের ঘর ঢালু এবং শুকনো ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়া ভালো। বাসস্থানে আলো-বাতাস সরাসরি প্রবেশের ব্যবস্থা থাকা উচিত। গ্রীষ্মকালে প্রচÐ গরম এবং শীতকালে প্রচÐ ঠাÐা দ্বারা বাছুরগুলো যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ঘরের মেঝেতে শুকনো খড় বা ছালার চট বিছিয়ে রাখা যেতে পারে। প্রতিটি বাছুরের জন্য ৪ ফুট দ্ধ ২ ফুট মাপের ঘরের প্রয়োজন। গ্রামীণ পর্যায়ে বাঁশ ও কাঠের সাহায্যে অতি সহজে ঘর নির্মাণ করা সম্ভব। ঘরে খাদ্য ও পরিষ্কার পানি সরবরাহ করার জন্য পাত্র রাখতে হবে।
খাদ্য ব্যবস্থাপনা
জন্মের পরপরই মায়ের শালদুধ খাওয়াতে হবে। অনেক বাছুরকেই জন্মের পরে পর্যাপ্ত শালদুধ খাওয়ানো হয় না ফলে বছরের মধ্যে সঠিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মায় না। দুধ খাওয়ানোর নিয়ম হলো দৈনিক প্রতি ১০০ কেজি ওজনের জন্য ১০ কেজি অর্থাৎ ২০ থেকে ২৫ কেজি ওজনের জন্য দৈনিক ১.২ থেকে ১.৫ কেজি দুধ খাওয়াতে হবে। অবশ্যই আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে খাওয়ানো শুরু করা উচিত। এই দুধ খাওয়ালে বাছুরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বাছুরকে নিয়মিত গাভীর দুধ খাওয়াতে হবে অন্যথায় মিল্ক রিপ্লেসার এর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পুষ্টিরমান নিশ্চিত করতে হবে।
অন্যান্য সতর্কতা
সদ্যজাত বাছুরকে পানি দিয়ে ধৌত করা সমীচীন হবে না কারণ পানির সংস্পর্শে আসলে ঠাÐা লেগে যেতে পারে এবং নানা ধরনের রোগের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে সংকর জাতের বাছুরের প্রায় ৪০ ভাগই যথাযথ যতেœর অভাবে মারা যায় ফলে খামারি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। এজন্যই খামারিকে সদ্যজাত বাছুরের যতœ ও পরিচর্যার প্রতি বিশেষভাবে নজর দেওয়া উচিত।
গবাদি প্রাণীর রোগবালাই যথাযথ হয়ে থাকে। চিকিৎসার ব্যবস্থা করাও জরুরি। বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে সচরাচর যে চিকিৎসা করা হয় তা সাতটি সূত্রে উল্লেখ করা হলো। সারণি-১ দ্রষ্টব্য।
উপসহকারী, প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, সিলেট সদর, সিলেট, মোবাঃ ০১৭৬২৪১১১৩০, ইমেইল : shajahanmia318@gmail.com
বিলুপ্ত প্রায় মাছ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন
ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ
মাছ বাঙ্গালির কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ। দেশে মিঠাপানির ২৬০টি প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৪৩ প্রজাতির ছোট মাছ রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে দেশীয় প্রজাতির মাছ আমাদের সহজলভ্য পুষ্টির অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এর মধ্যে মলা, ঢেলা, পুঁটি, বাইম, টেংরা, খলিশা, পাবদা, শিং, মাগুর, কেচকি, চান্দা ইত্যাদি অন্যতম। এসব মাছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ রয়েছে। এসব উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলে এবং রক্তশূন্যতা, গলগÐ, অন্ধত্ব প্রভৃতি রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলাশয় সংকোচন, অতি আহরণ ইত্যাদি নানাবিধ কারণে মাছের প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র বিনষ্ট হওয়ার ফলে প্রাকৃতিক জলাশয়ে ছোট মাছের প্রাপ্যতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়।
ওটঈঘ (২০১৫) এর তথ্য মতে, দেশে বিলুপ্ত প্রায় মাছের সংখ্যা ৬৪টি। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) হতে বিলুপ্ত প্রায় ও দেশীয় মাছের ওপর গবেষণা পরিচালনা করে ইতোমধ্যে ২৩ প্রজাতির মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর মধ্যে পাবদা, গুলশা, টেংরা, গুজিআইর, চিতল, ফলি, মহাশোল, বৈরালী, বালাচাটা, গুতুম, কুচিয়া, ভাগনা, খলিশা, গজার ইত্যাদি অন্যতম। এসব প্রযুক্তি মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারিত হওয়ায় বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির মাছের প্রাপ্যতা সাম্প্রতিকালে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মাছের মূল্য সাধারণ ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এসেছে। তা ছাড়া নদ-নদী, হাওড় ও বিলে দেশীয় মাছের পোনা অবমুক্তকরণ ও মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিলুপ্ত প্রায় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ মাছের জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এটি বর্তমান সরকারে একটি অন্যতম সাফল্য।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে পুকুরে দেশীয় ছোট মাছের মোট উৎপাদন ছিল ৬৭,৩৪০ মেট্রিক টন - যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২.৪১ লক্ষ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ গত ১১ বছরে দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন বেড়েছে ২৫৮%।
বর্তমান সরকারের আমলে দেশীয় মাছ সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। ইতোপূর্বে শুধুমাত্র ইনস্টিটিউটের ময়মনসিংহস্থ স্বাদুপানি গবেষণা কেন্দ্র থেকে বিলুপ্ত প্রায় মাছ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে গবেষণা পরিচালনা করা হতো। বর্তমানে ময়মনসিংহ স্বাদুপানি কেন্দ্র ছাড়াও বগুড়ার সান্তাহার, নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর ও যশোর উপকেন্দ্রে বিলুপ্ত প্রায় মাছ সংরক্ষণে গবেষণা পরিচালনা করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইনস্টিটিউট হতে উদ্ভাবিত কয়েকটি দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজনন ও চাষ কৌশল নি¤েœ সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো:
১. বিপন্ন প্রজাতির টেংরা মাছের কৃত্রিম প্রজনন : আইইউসিএন (২০১৫) এর তথ্যানুযায়ী টেংরা (গুংঃধংারঃঃধঃঁং) বর্তমানে একটি বিপন্ন প্রজাতির মাছ। প্রজাতিটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার্থে এবং চাষের জন্য পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইনস্টিটিউটের স্বাদু পানি উপকেন্দ্র, সৈয়দপুরে এর কৃত্রিম প্রজনন, পোনা প্রতিপালন এবং চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। উদ্ভাবিত প্রযুক্তি মৎস্য অধিদপ্তরে ইতোমধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। ফলে মাঠপর্যায়ে এর চাষাবাদ শুরু হয়েছে। টেংরা মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষ সম্প্রসারণের ফলে দেশে টেংরা মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ বিপদাপন্ন অবস্থা থেকে এ প্রজাতিটিকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
২. বৈরালি মাছের জীনপুল সংরক্ষণ : বৈরালি মাছ উত্তর জনপদের একটি সুস্বাদু মাছ। বৈরালি মাছ বরালি ও খোকসা নামেও পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম ইধৎরষরঁংনধৎরষধ। এ ছাড়াও ইধৎরষরঁংনধৎহধ, ইধৎরষরঁংনবহফবষরংংরং, ইধৎরষরঁংঃরষবড় ও ইধৎরষরঁংাধমৎধ নামেএ মাছের আরো ৪টি প্রজাতি রয়েছে। খাল, বিল, পাহাড়ি ঝর্ণা ও অগভীর স্বচ্ছ নদীতে মূলত এ মাছটি পাওয়া যায়। ওটঈঘ (২০১৫) কর্তৃক এ মাছটিকে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বিপন্নের হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সৈয়দপুর স্বাদুপানি উপকেন্দ্র কর্তৃক রংপুরের চিকলি নদী ও দিনাজপুরের আত্রাই নদী হতে বরালিমাছ সংগ্রহ করে উপকেন্দ্রের পুকুরে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে প্রতিপালন করা হয়। অতঃপর ২০২০ সালে দেশে প্রথমবারের মতো বরালি মাছের কৃত্রিম প্রজননে সফলতা অর্জিত হয়। ফলে এর পোনা প্রাপ্তিসহ জাত হয়েছে এবং ইতোমধ্যে উত্তরবঙ্গে এর চাষাবাদ শুরু হয়েছে।
৩. বালাচাটা মাছের কৃত্রিম প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন : বালাচাটা মাছ এর বৈজ্ঞানিক নাম ঝড়সরষবঢ়ঃবংমড়হমড়ঃধ। দেশের উত্তরাঞ্চলে এ মাছটি এক সময় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। বর্তমানে এ মাছটি সীমিত পরিমাণে পাওয়া যায়। পাহাড়ি ঝর্ণা ও অগভীর স্বচ্ছ জলাশয় এদের বেশি প্রিয়। প্রজাতিটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে এবং চাষের জন্য পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ইনস্টিটিউট হতে ২০১৯ সালে দেশে প্রথমবারেরমতো এর কৃত্রিম প্রজনন, নার্সারি ব্যবস্থাপনা ও চাষ কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে।
একটি পরিপক্ব (৯-১৪ গ্রাম) বালাচাটা স্ত্রী মাছের ডিম ধারণক্ষমতা ৪ থেকে ৮ হাজার এবং প্রজননকাল এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত। গবেষণায় দেখা গেছে যে, একই বয়সের পুরুষের চেয়ে স্ত্রী মাছ তুলনামূলকভাবে আকারে বড় এবং দেহ প্রশস্ত হয়ে থাকে। হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগের ৭-৮ ঘণ্টা পর প্রাকৃতিকভাবে স্ত্রী মাছ ডিম ছাড়ে। সাধারণত ডিম ছাড়ার ২৩-২৪ ঘণ্টা পর ডিম ফুটে রেণু বের হয়ে আসে। রেণুপোনা ট্রেতে ০৪-০৫ দিন রাখার পর নার্সারি পুকুরের হাপাতে লালন-পালন করে অঙ্গুলি পোনায় পরিণত করা হয়। ছোট ছোট শুঁককীট জাতীয় খাবার খেয়ে এ মাছটি জীবনধারণ করে। মাছটি খেতে খুবই সুস্বাদু, মানব দেহের জন্য উপকারী অণু পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ এবং কাটা কম।
৪. গুতুম মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে সফলতা : আমাদের দেশে উত্তরবঙ্গের চলন বিল, ছোট যমুনা নদী ও হালতি বিলে এ মাছ পাওয়া যায়। এ ছাড়াও ময়মনসিংহ, সিলেট, দিনাজপুর এবং রংপুরের ছোট ছোট নদীতে এ মাছ মাঝে মধ্যে পাওয়া যায়। এ মাছটি সাধারণত গুতুম, গুটিয়া, গোরকুন, পোয়া, পুইয়া নামে পরিচিত হলেও উত্তর জনপদে গোতরা বা পুয়া মাছ নামে বেশি পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম খবঢ়রফড়পবঢ়যধষঁং মঁহঃবধ। বাংলাদেশে এই মাছটিকে মূলত খাবারের মাছ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাহারি মাছ হিসেবে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা বিলুপ্ত প্রায় গুতুম মাছের পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জন করেছে। ফলে চাষাবাদের মাধ্যমে এর উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবে।
৫. খলিশা মাছের পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জন : খলিশা বাংলাদেশের অতি পরিচিত দেশীয় প্রজাতির একটি ছোট মাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম ঈড়ষরংধভধংপরধঃঁং, যা আমাদের দেশে খৈলশা, খলিশা, খৈলা নামে পরিচিত। প্রাকৃতিকভাবে এ প্রজাতিটি বাংলাদেশসহ, ভারত, নেপাল ও মিয়ানমারে মূলত পাওয়া যায়। মিঠাপানির জলাশয়ে বিশেষ করে পুকুর, নদী, ঝর্ণা, খাল, বিলে এক সময় এ মাছটি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। শস্যক্ষেতে কীটনাশকের যথেচ্ছ প্রয়োগ, অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণ, জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরা, কলকারখানার বর্জ্য নিঃসরণ ইত্যাদি নানাবিধ কারণে বাসস্থান ও প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস হওয়ায় এ মাছের প্রাচুর্যতা সাম্প্রতিককালে ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রজাতিটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে এবং চাষের জন্য পোনা প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ২০১৬ সাল হতে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, স্বাদুপানি উপকেন্দ্র, সৈয়দপুর হতে গবেষণা পরিচালনা করে ২০১৮ সালে মাছটির কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন কলাকৌশল উদ্ভাবনে সাফল্য লাভ করে। উক্ত প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে খলিশা মাছ চাষের ক্ষেত্রে পোনা প্রাপ্তি এবং চাষাবাদ সহজতর হবে। উল্লেখ্য, বয়স, আকার ও ওজন অনুপাতে এর ডিম ধারণক্ষমতা ৫,০০০ থেকে ১৩,০০০ এবং প্রজননকাল মে থেকে সেপ্টেম্বর।
৬. কুচিয়ার পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনা : কুচিয়া অন্যতম পুষ্টিসমৃদ্ধ ও ঔষধি গুণসম্পন্ন একটি মাছ। আন্তর্জাতিক বাজারে এর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। বিগত কয়েক বছর যাবৎ কুচিয়া রপ্তানি করে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। মূলত প্রকৃতি থেকে কুচিয়া সংগ্রহ করে বিদেশে রপ্তানি করা হয়। কুচিয়াও বর্তমানে ১টি বিপন্ন প্রায় প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত। আন্তর্জাতিক বাজারে কুচিয়ার যথেষ্ট চাহিদা থাকায় কুচিয়ার উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রজনন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য ইনস্টিটিউট থেকে গবেষণা পরিচালনা করা হয়। গবেষণা মাধ্যমে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে কুচিয়ার পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জিত হয়েছে এবং দেশীয় প্রচলিত খাবারে ক্রমশ কুচিয়াকে বর্তমানে অভ্যস্থ করা হচ্ছে। কুচিয়ার পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জিত হওয়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে কুচিয়ার নির্বিচারে আহরণ হ্রাস পাচ্ছে এবং এর চাষাবাদ সহজতর হয়েছে।
দেশীয় ছোট মাছ সুরক্ষাসহ গবেষণায় গৌরবজনক ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০২০ সালে একুশে পদক অর্জন করে। ফলে ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা গবেষণা কাজে আরো অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং ইনস্টিটিউটে গবেষণার পরিধি বিস্তৃত করা হয়েছে। দেশের মৎস্য উৎপাদনে দেশীয় ছোট মাছের অবদান ৩০-৩৫%। দেশীয় মাছের চাষাবাদ বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে হ্যাচারিতে দেশীয় মাছের পোনা ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। পোনা প্রাপ্তি সহজতর হওয়ায় বর্তমানে মাঠপর্যায়ে পাবদা, গুলশা, শিং, টেংরা, মাগুর ও কৈ মাছ ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। ইদানীং বাটা মাছের চাষ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশীয় মাছের চাষাবাদ বৃদ্ধি পাওয়ায় এদের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, ইনস্টিটিউট থেকে বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায় মাছ ঢেলা, শালবাইম, রাণী, কাজলি, পিয়ালি, বাতাসি, কাকিলা ও ভোল মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রযুক্তি উদ্ভাবনও সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিলুপ্ত প্রায় সকল দেশীয় মাছকে পর্যায়ক্রমে খাবার টেবিলে ফিরিয়ে আনাই এসব গবেষণার মূল উদ্দেশ্য।য়
মহাপরিচালক, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট; ফোন : ০৯১৬৫৮৭৪, ইমেইল: dgbfri@gmail.com
টমেটো ও বেগুনের রোগ দমনে জোড়কলম প্রযুক্তি
ড. বাহাউদ্দিন আহমেদ
বেগুন ও টমেটো বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রধান দুটি সবজি। বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বেগুন ও টমেটো চাষের জন্য প্রধান সমস্যা হলো মাটিবাহিত বিভিন্ন রোগ। প্রধানত ঢলেপড়া রোগ ও শিকড়ের গিট রোগ টমেটো ও বেগুন চাষে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। উচ্চ তাপমাত্রা ও মাটিতে বেশি আর্দ্রতা থাকলে এই দুটি রোগ দ্রæত বিস্তার লাভ করে। ঢলে পড়া রোগের জীবাণু হলো Ralstonia Solanacearum নামক একটি ব্যাকটেরিয়া এবং শিকড়ের গিট রোগের জীবাণু হলো Meloidigyne incognita নামক একটি কৃমি বা নেমাটোড। এ দুটি রোগের কারণে বেগুন ও টমেটোর ফলন ৩০-৫০ ভাগ বা তার বেশি কমে যায়। বাংলাদেশ বা অন্য কোন দেশে রাসায়নিক বিষ বা অন্য কোন দমন পদ্ধতির মাধ্যমে এ রোগ দুটি সন্তোষজনকভাবে দমন করা এখনো সম্ভব হয়নি। ব্যাপক হারে মাটি শোধন বা মাটি জীবাণুমুক্ত করা প্রায় অসম্ভব। এ ছাড়া এ পদ্ধতি মাটির বিভিন্ন উপকারী জীবাণু ধ্বংস করে।
গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে তিত বেগুন (Solanum torvum) ও কাটা বেগুন (S. sisymbriifolium) নামক দুটি জংলি বেগুনের প্রজাতির মধ্যে এই দুটি রোগ প্রতিরোধের খুব উচ্চমানের ক্ষমতা রয়েছে। এই দুটি জংলি বেগুনের প্রজাতি বাংলাদেশের সব জায়গায় জন্মায়। এসব জংলি বেগুন গাছের উপর কলমের মাধ্যমে বেগুন ও টমেটো গাছ তৈরি করে মাটি বাহিত বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করে উচ্চফলন নিশ্চিত করা যায়। এই পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে বেগুন ও আগাম টমেটো চাষে ব্যাপক সাফল্য বয়ে আনবে, আমাদের সবজি চাহিদা মিটানো যাবে এবং কৃষকেরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।
মাটিবাহিত রোগসমূহ শনাক্ত
টমেটো ও বেগুন গাছ যে কোন বয়সেই ঢলেপড়া ও শিকড়ের গিট রোগা আক্রান্ত হতে পারে। বিশেষ করে উচ্চ তাপমাত্রায় (৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট) বেগুন ও টমেটোর ঢলেপড়া ও শিকড় গিট রোগের মারাত্মক প্রাদুর্ভাব পরিলক্ষিত হয়। উঁচু জমি যেখানে বেগুন ও টমেটো পর্যায়ক্রমে বছরের পর বছর আবাদ করা হয় সেখানে এসব রোগ বেশি দেখা যায়। ঢলেপড়া রোগাক্রান্ত জমিতে সেচ দিলে রোগ প্রকট হয় এবং সমস্ত জমিতে ছড়িয়ে পড়ে। ঢলেপড়া রোগে আক্রান্ত গাছের পাতা প্রথমে আংশিক ও পরে সম্পূর্ণ নেতিয়ে পড়ে এবং ৩-৪ দিনের মধ্যে গাছটি মারা যায়। যদি ফসলের প্রাথমিক অবস্থায় এ রোগের আক্রমণ দেখা দেয় তাহলে টমেটো ও বেগুনে ফল ধরার আগেই অধিকাংশ বা সব গাছ মারা যেতে পারে। কৃমি বা নেমাটোডের আক্রমণে শিকড়ের স্থানে ফুলে গিয়ে গিট রোগের সৃষ্টি করে এবং আক্রান্ত গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। গিট রোগের আক্রমণের ফলে গাছ মাটি হতে যে খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে তা উপরে যেতে পারে না ফলে গাছ দুর্বল হয়ে মারা যায়। কৃমির ব্যাপক আক্রমণে গাছ প্রায়ই মারা যায়। উপরন্তু, কৃমির আক্রমণে শিকড়ে সৃষ্ট ক্ষত ঢলেপড়া রোগের ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক জীবাণু অনুপ্রবেশে সাহায্য করে।
জোড়কলমের উদ্দেশ্য
জোড়কলমের মাধ্যমে বেগুন ও টমেটো চাষ করলে ৯০%-৯৫% গাছ ঢলেপড়া রোগ এবং শিকড় গিট রোগ থেকে রক্ষা পায়। বেগুন ও আগাম টমেটো চাষে এই রোগ ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। তাই আগাম টমেটো ও বেগুন চাষের জন্য জোড়কলম পদ্ধতি অত্যন্ত উপযোগী ও লাভজনক। জংলী বেগুনের শিকড় সুস্থ ও সবল হওয়ায় মাটি থেকে সঠিক পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করতে পারে, ফলশ্রæতিতে ফলন অনেক বেশি হয় এবং এক থেকে দেড় মাস বেশি ফলন দিয়ে থাকে। পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, জোড়কলম পদ্ধতিতে বেগুন ও টমেটোর চাষ করলে ১.৫-২ গুণ বেশি ফলন পাওয়া যায়।
জোড়কলম প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও বিস্তার
জোড়কলম প্রযুক্তি সর্ব প্রথম জাপানি বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেন এবং জংলী বেগুনের সাথে আবাদি বেগুন বা টমেটোর জোড়কলমের মাধ্যমে মাটিবাহিত রোগ দমনে সফলতা পান। ১৯৩০ সালে জাপানে শতকরা ৯৫ ভাগ বেগুন চাষি কলমকৃত বেগুন গাছ রোপণ করেন। জাপানি প্রকল্প ঈঠঝজঈ এর আওতায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) বিজ্ঞানীগণ ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে বেগুনের জোড়কলম প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (ইঝগজঅট)-এ জোড়কলম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ১৯৯৮ সালে ওচগ-ঈজঝচ প্রকল্পের আওতায় বারিতে জোড়কলম পদ্ধতির মাধ্যমে বেগুন ও টমেটোর চাষাবাদ পরীক্ষা আকারে শুরু হয়। পরীক্ষাটি সাফল্যজনকভাবে সমাপ্তির পর, গাজীপুরের কাশিমপুরে কৃষকের মাঠে পরীক্ষাটি প্রদর্শন করা হয়। পরবর্তীতে গাজীপুরের শ্রীপুর ও যশোর জেলার নওদাগাঁও ও বাঘারপাড়ার গাইঘাট গ্রামে পরপর ৩ বছর কৃষকের মাঠে প্রদর্শনী প্লট করা হয়। সমস্যার ব্যাপকতা ও কৃষকের আগ্রহের কথা বিবেচনা কর পরবর্তীতে কুমিল্লা, বগুড়া, নরসিংদী ও গাজীপুর জেলায় এ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করার জন্য প্রদর্শনী প্লট এবং মাঠ দিবস হয়। এর ফলে কৃষকের মধ্যে প্রযুক্তিটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করে।
আদি জোড় ও উপজোড়ের চারা উৎপাদন
যে গাছের ওপর কলম করা হয় তাকে ‘আদি জোড়’ বলে। আর যে গাছকে কলমের জন্য ব্যবহার করা হয় তাকে উপজোড় বলে। জোড়কলম করার জন্য প্রথমে আদি জোড় হিসাবে কাঁটা বেগুনের বীজ বীজতলায় ফেলতে হবে। কাঁটা বেগুনের ২-৩টি পাতা বের হলে এ চারা ১৮ সেমি.ী১৩ সেমি. আকারের মাটি ভর্তি পলিথিন ব্যাগে স্থানান্তর করতে হবে। বেশি বয়সের চারা পলিথিন ব্যাগে স্থানান্তর করলে কলম তৈরির জন্য উপযোগী হবে না। পলিথিন ব্যাগে অর্ধেক পচা গোবর ও অর্ধেক ভিটে বালুর মিশ্রণ থাকবে। টমেটো ও বেগুনের চারায় নিয়মিত পানি দিতে হবে যাতে চারা সুস্থ ও সবল থাকে। কাঁটা বেগুনের বীজ ফেলার ৭-১০ দিন পর উপ-জোড়ের জন্য আবাদি বেগুন বা টমেটোর বীজ ফেলতে হবে। কাটা বেগুনের চারা ৪০-৫০ দিন এবং বেগুনের চারা ও টমেটোর চারা ৩০-৩৫ দিন হলে জোড়কলম করার উপযুক্ত হয়।
জোড়কলম তৈরি পদ্ধতি
কলম করা উপযোগী টমেটো বা বেগুনের চারা বীজতলা থেকে উঠিয়ে শিকড়ের মাটি ধুয়ে কিছুটা পানিসহ একটি পাত্রে শিকড় ডুবিয়ে রাখতে হবে যাতে চারাগুলো শুকিয়ে না যায়। জংলী বেগুনের চারার ব্যাগগুলো এনে একটি ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে এরপর, পলিথিন ব্যাগের জংলী বেগুনের চারার গোড়া থেকে ৫-৬.৫ সেমি. (২ ইঞ্চি-২.৫ ইঞ্চি) কাÐ রেখে উপরের অংশ কেটে ফেলে দিতে হবে। কাÐের কাটা মাথাকে বেøডের অর্ধেক পরিমাণ ঢুকিয়ে প্রায় ১ সেমি. গভীর করে ২ ভাগে লম্বালম্বি কাটতে হবে। এরপর টমেটো বা বেগুনের চারার মাথার উপরের অংশের প্রায় ৫ সেমি. কেটে বড় পাতা ফেলে দিতে হবে কাটা অংশের নিচে দুই পাশ থেকে প্রায় ১ সেমি. লম্বা “ঠ” অক্ষরের মতো কাটতে হয়। এবার টমেটো বা বেগুনের “ঠ” এর ন্যায় মাথাটি (উপজোড়) জংলী বেগুন চারার কাটা স্থানে (আদি জোড়) ঢুকিয়ে দিতে। পরবর্তীতে প্লাস্টিক ক্লিপ দিয়ে জোড়াটি ভালোভাবে আটকে দিতে হবে এবং গাছের উপরের অংশে ছোট হাত স্প্রে মেশিন দিয়ে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। জোড়ার স্থানে যেন পানি না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কলম করার কাজ বিকাল বেলা করাই ভালো। জোড়কলম করার পর কী কী পরিচর্যা করা দরকার। কলম করা বেগুন বা টমেটো গাছ বাঁশের তৈরি ছই-এর মতো একটি গ্রাফটিং হাউজে বা ঘরে রেখে পলিথিন ও চট বা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এতে ঘরের ভেতরে প্রচুর আর্দ্রতা বজায় থাকবে এবং সূর্যের আলো সরাসরি লাগবে না, যা কলমের জোড়া লাগাতে সাহায্য করবে। কলম করার পর ৭ দিন পর্যন্ত প্রতি দিন ৪-৫ বার স্প্রে মেশিন দিয়ে কুয়াশার ন্যায় পানি ছিটাতে হবে। বৃষ্টি না হলে রাতে ঘরের আচ্ছাদন খুলে দিতে হবে, তাতে রাতের কুয়াশায় গাছ সতেজ থাকবে। দিনের বেলায় ঘর ঢেকে রাখতে হবে নতুবা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে উপজোড় শুকিয়ে যাবে। এক সপ্তাহ পর পলিথিন সরিয়ে শুধু চট বা কালো কাপড় দিয়ে ১ সপ্তাহ ঢেকে রাখতে হবে। এ সময়ে প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে আচ্ছাদন খুলে দিতে হবে এবং প্রখর রোদের সময় তা ঢেকে রাখতে হবে। কলম করার ১৫-২০ দিন পর গাছ মাঠে লাগানোর উপযুক্ত হয়। মাঠে কলমের চারা লাগানোর ৭-১০ দিন পর জংলী বেগুনের গাছের গজানো ডালপালা কেটে ফেলতে হবে। চারা মাঠে লাগানোর কয়েক দিন পরে ক্লিপ খুলে নিতে হবে। একজন লোক দৈনিক ৪০০-৫০০টি জোড়কলম তৈরি করতে পারেন। উপযুক্ত পরিচর্যা করলে শতকরা ৯৫ ভাগ জোড়কলম টিকে থাকে।
ঢলেপড়া রোগ আগাম টমেটো ও বেগুন চাষে একটি বিরাট অন্তরায়। তাই জোড় কলম পদ্ধতি আগাম টমেটো এবং বেগুন চাষে একটি লাভজনক প্রযুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এছাড়া বেগুনের অন্যান্য মাটিবাহিত রোগও এ প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং আগাম ও দীর্ঘদিন ধরে ফলনের জন্য কৃষকেরা ব্যাপকভাবে লাভবান হবেন। এই পদ্ধতি নার্সারি ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসার উপকরণ হতে পারে এবং বাণিজ্যিকভাবে এই কলাকৌশলের বিস্তার ঘটানো সম্ভব এবং সফলভাবে মাটিবাহিত রোগজীবাণু দমন করা সম্ভব।য়
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সবজি বিভাগ, উদ্যানতত্ত¡ গবেষণা কেন্দ্র, বারি, জয়দেবপুর, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৫৫৬৩৬৩৯০১, ই-মেইল : bahauddinahmed57@yahoo.com,
কৃষিবিদ ড. মো. আখতারুজ্জামান
বাংলার প্রকৃতি তার আপন মহিমার সবটুকু যেন উজাড় করে ছড়িয়ে দিয়েছে প্রতিটি বাঙালি নরনারীর মনে-প্রাণে। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে নানান ধরনের রূপ রস আর সুবাসিত সৌরভ আমাদের হৃদয় মনকে শিহরিত করে। প্রতিটি ঋতুর মাঝেই বাঙালি খুঁজে নেন বৈচিত্র্যময়তায় পরিপূর্ণ নানান উৎসব। তাই তো উৎসব প্রিয় বাঙালি প্রকৃতির আপন মহিমার সবটুকুর সর্বোচ্চ ব্যবহারে আনন্দ বিনোদনে মাতোয়ারা হয়ে সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় করে উৎসব আমেজে নিজেদের মতো করে চাঁদের হাট বসিয়ে স্ব স্ব হৃদমাঝারে চিত্ত বিনোদনের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের চেষ্টা করে থাকেন।
বিত্ত বৈভবের প্রাচুর্য না থাকলেও বাঙালির আমোদ আহলাদ ও আত্মিক আতিথেয়তার এতটুকু কমতি নেই। এজন্য বুঝি, তাবৎ বাঙালি কবি সাহিত্যিক তাঁদের মনের মাধুরী মিশিয়ে বাংলার প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রকৃতি নির্ভর উৎসব নিয়ে নানান কাব্য কথন রচনা করে চলেছেন। এ দেশের মাটি, আবহাওয়া ও জলবায়ু কৃষি উৎপাদনের জন্যে অনেক বেশি উপযোগী, যেমনটি বিশ্বের খুব কম দেশেই আছে। কবির ভাষায় বলতে হয়, ধন ধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা/তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা/ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।/এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,/সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি,/সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি।
বাংলার এ মাটিতে শীত গ্রীষ্ম বর্ষাসহ বছরের সকল অর্তবে সত্যিই সোনার ফসল ফলে । ষড়ঋতুর পথ বেয়ে বঙ্গ ঋতুনাট্যে শীতের হিমেল পরশ আর রাশি রাশি, ভারা ভারা কনক আভাময় পাকা ধান খেতের শোভা নিয়ে বাঙালির দোরে কড়া নাড়ে হেমন্ত ঋতু। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমন ধান ফলানো কৃষক তাঁর সোনালী ধান খেতের এমন দৃশ্যে মনে পায় অনাবিল শান্তির বারতা। দিগঙ্গনার অঙ্গন হেমন্তের দানে পূর্ণতা প্রাপ্তির আনন্দে নব আনন্দে মেতে ওঠেন বাংলার কৃষক-কৃষানিরা। “নবান্ন” বা নতুন ধানের অন্ন কেন্দ্রিক মূলতঃ একটি লোকজ উৎসব। কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় প্রধান খাদ্যশস্য ধান সংগ্রহকে কেন্দ্র এ উৎসব পালিত হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতে অধিক শস্য প্রাপ্তি, বৃষ্টি, সুসন্তান লাভ ও পশুসম্পদ কামনা এ উৎসব প্রচলনের প্রধান কারণ। ভারত ও বাংলাদেশের নানাবিধ অঞ্চলে বিভিন্ন স¤প্রদায় ও গোত্রের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে নবান্ন উৎসব পালন করবার চল রয়েছে। হেমন্তে আমন ধান কাটার পর অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিনে কিংবা পৌষ মাসে গৃহস্থরা এ উৎসব পালনে মেতে উঠতেন।
বাঙালির নবান্ন উৎসবের একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে আমাদের দেশে উৎপাদিত নানা ধরনের সুগন্ধি চাল। নবান্ন উৎসবে এসব সুগন্ধি চালের ফিরনি পায়েশ, জর্দ্দা, ভুনা খিচুড়ির বেশ প্রচলন রয়েছে। আবার একটু মানসম্পন্ন কলেবরের নবান্ন উৎসবে পোলাও, বিরিয়ানি, কাচ্চি, রান্নাতেও সুগন্ধি চালের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। সুগন্ধি চাল আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য। উত্তরবঙ্গের জেলা দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, রংপুর, নওগাঁ, রাজশাহী প্রভৃতি জেলা সুগন্ধি চাল উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে। দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী সুগন্ধি কাটারিভোগ চালের খ্যাতি ছড়িয়েছে দেশে বিদেশে। একটা সময় স্থানীয় জাতের কাটারিভোগ, কালিজিরা, চিনিগুঁড়া, চিনি আতপ, বাদশাভোগ, খাসকানি, বেগুনবিচি, তুলসীমালা প্রভৃতি সুগন্ধি চালের কদর থাকলেও হালে আমাদের দেশের ধান বিজ্ঞানীরা এক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতা দেখিয়েছেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উচ্চফলনশীল সুগন্ধি ধান হিসেবে উদ্ভাবন করেছেন, ব্রি ধান৩৭, ব্রি ধান৩৮, ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৬৩, ব্রি ধান৮০, ব্রি ধান৯০। আবার বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতোমধ্যে উদ্ভাবন করেছেন বিনা ধান৯ ও বিনা ধান১৩ আরো দু’টি সুগন্ধি চাল। এসব সুগন্ধি ধানের মধ্যে একমাত্র ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৬৩ ব্যতিরেকে সবগুলো ধানই আমন মৌসুমে জন্মে থাকে, যা আমাদের নবান্ন উৎসবের এক নবতর সংযোজন। সুগন্ধি চালের সুগন্ধ এখন জাতীয় অঙ্গন ছেড়ে আন্তর্জাতিক পরিমÐলে স্থান করে নিয়েছে। এ বছর জুলাই মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এফসি ট্রেডিং কর্পোরেশন নামক প্রতিষ্ঠানকে এক হাজার মেট্রিক টন সুগন্ধি চাল রপ্তানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। এবারের নবান্ন উৎসবে এটিও আমাদের জন্যে একটা আনন্দ বার্তা বটে।
২০১৯ সালের শেষ লগনে চীনের উহান থেকে শুরু হওয়া বৈশ্বিক মহামারি মানুষের স্বাভাবিক গতিপথ ও আনন্দ উৎসবে অনাহ‚ত বাঁধা সৃষ্টি করে চলেছে। বৈশ্বিক এই অতিমারির মধ্যেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে কৃষি উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ, কৃষিতে ব্যাপক প্রণোদনা প্রদান, ৪% সরল সুদে কৃষকের ঋণ সহায়তা প্রদান, ৫০-৭০% ভর্তুকি মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতির সরবরাহের কারণে করোনাকালে আমাদের কৃষি মুখ থুবড়ে পড়েনি বরং ধান উৎপাদনের আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং চতুর্থ থেকে তৃতীয় স্থানে উন্নীত হয়েছে; কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের হার বৃদ্ধিতে এশিয়া মহাদেশের শীর্ষস্থান লাভ করেছে। এ ছাড়া ছোট্ট বাংলাদেশের সার্বিক কৃষিতে রয়েছে আরো অনান্য আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং অর্জন।
সর্বোপরি কারোনাকালে লক্ষ্যমাত্রা অপেক্ষা বোরো ও আউশ ধানে বাম্পার ফলন হয়েছে। এ কৃতিত্বের বড় অংশীদার কৃষক ভায়েরা, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষকের পাশে রয়েছেন কৃষি মন্ত্রণালয় ও তাদের সকল সহযোগী প্রতিষ্ঠান। তৃণমূলে কৃষকের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করে চলেছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের বিশাল কর্মীবাহিনী।
আশা করা যাচ্ছে বোরো ও আউশের মতো আমন ধান উৎপাদনেও লক্ষ্যমাত্রা অপেক্ষা বাম্পার ফলন হবে; কৃষকের মুখে হাসি ফুটবে, সোনালী ধানে ভরবে তাঁদের গোলাঘর; সুগন্ধি চালের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। কৃষি খাতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভপর হবে। য়
পরিচালক (প্রশাসন), জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমি, মোবাইল : ০১৭১১৮৮৪১৯১, ই-মেইল : akhtar62bd@gmail.com
ড. নির্মল চন্দ্র শীল১ ড. মোঃ আশরাফ হোসেন২
জিংক বা দস্তা এমন একটি অণুপুষ্টি যা উদ্ভিদ ও প্রাণী দেহের জৈবিক ও বিপাকীয় কার্যাবলীর জন্য একান্ত অত্যাবশ্যক। পরিমাণে কম লাগে এ বিবেচনায় জিংককে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বললেও এর কার্যাবলী অনেক গুরুত্বপূর্ণ যা জীবসত্তার বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। আমাদের দেশের কৃষিতে জিংকের প্রয়োজনীয়তার কথা আশির দশক থেকে কৃষি বিজ্ঞানীগণ উপলব্ধি করে আসছেন। ধানভিত্তিক শস্য চাষে জিংক ব্যবহারের বিষয়টি উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই। জিংক ঘাটতিতে যেমন উদ্ভিদের বৃদ্ধি, বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়ে ফলন কমে যায় তেমনি মানবদেহে জিংক অপুষ্টির কারণে নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ হয়। বিশেষ করে জিংকের অভাবজনিত কারণে ক্ষুধামন্দা, শিশুদের বৃদ্ধি কমে যাওয়া, চুল ও নখের অস্বাভাবিকতা, হাড় গঠনে অসামাঞ্জস্যতা, ক্ষতস্থান স্বাভাবিক হতে বিলম্ব হওয়া, বন্ধ্যত্ব, ডায়েরিয়া, রক্তশূন্যতা, স্নায়বিক দুর্বলতা, রাতকানা, মানসিক অস্থিরতা ও ডায়াবেটিসসহ নানা ধরনের অসুস্থতা দেখা দেয়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ জিংক ঘাটতিজনিত অপুষ্টিতে ভুগছে। ইউনিসেফ এর তথ্য মতে জিংক ঘাটতিজনিত কারণে সারা বিশ্বে চার লক্ষেরও অধিক শিশু মারা যায়। সারা পৃথিবীর অন্ততঃ ৫০ শতাংশ কৃষি জমিতে জিংক ঘাটতি বিদ্যমান, ফলে একদিকে যেমন ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে অন্যদিকে মানুষের দেহে জিংকের অপুষ্টি বেড়ে চলেছে। উন্নয়নশীল দেশের মানুষ যেহেতু দানাজাতীয় শস্য বেশি খায় তাই তাদের শরীরে জিংকের ঘাটতি খুবই প্রকট।
উদ্ভিদদেহে জিংকের ভূমিকা
উদ্ভিদদেহে জিংক বৃদ্ধি সহায়ক হরমোন অক্সিন গঠনে সাহায্য করে। আমিষ সংশ্লেষণ করে, ক্লোরোফিল তৈরিতে অংশগ্রহণ করে। কোষ ঝিল্লি (Membrane)) কে দৃঢ়তা বা অখÐতা দান করে। উৎসেচক এর কার্যাবলী গতিশীল করে। পরাগরেণু গঠন নিয়ন্ত্রণ করে।
জিংকের ঘাটতিজনিত লক্ষণ
উদ্ভিদদেহে জিংকের অভাব হলে কচিপাতা মধ্যশিরার গোড়ার দিক থেকে বিবর্ণতা (Chlorosis) দেখা দেয় ও সবুজ রং হারিয়ে সাদাটে হতে থাকে। বৃদ্ধি কমে যায় এবং গাছ খর্বাকৃতি হয়। ফসল পরিপক্ব হতে বেশি সময় লাগে। পত্রের আকৃতি ছোট হতে থাকে ক্রমান্বয়ে ছোট আকারের গুচ্ছ পাতা তৈরি হয় যা রোসেটিংনামে পরিচিত। নিচের পাতায় বাদামি দাগ পড়ে। পরবর্তীতে পাতা খয়েরি আকার ধারণ করে এবং ক্রমান্বয়ে পুড়ে যাওয়া বর্ণ ধারণ করে। লেবুজাতীয় উদ্ভিদের মধ্য শিরা সবুজ থাকে কিন্তু শিরার মধ্যবর্তী অংশ সাদাটে হয়ে যায়। লিগিউম জাতীয় উদ্ভিদের বিশেষত মুগডালের পাতা প্রাথমিক অবস্থায় হলুদাভ হয়ে যায়। পরবর্তীতে শিরার মধ্যবর্তী অংশে পচন (নেক্রোসিস) দেখা দেয় কিন্তু শিরা তখনও সবুজ থাকে।
মৃত্তিকা ও উদ্ভিদে জিংক ঘাটতির কারণ
মৃত্তিকা ও উদ্ভিদে জিংক ঘাটতির কারণ হচ্ছে : ১। অধিক ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম বাই কার্বনেট সমৃদ্ধ ক্ষারীয় (pH>7.5) চুনযুক্ত মাটিতে জিংকের প্রাপ্যতা কম। ২।মাটিতে অধিক মাত্রায় ফসফরাস থাকলে জিংক ফসফেট হিসাবে অদ্রবীভূত রাসায়নিক যৌগ তৈরি হয়ে যায় ফলে উদ্ভিদ কর্তৃক জিংক পরিশোষণ ব্যাহত হয়। তাছাড়া, মৃত্তিকার দ্রবণে অধিক মাত্রায় কপার, আয়রন ও ম্যাঙ্গানিজ আয়ন থাকলে উদ্ভিদ কর্তৃক জিংক পরিশোষণ বাঁধাগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশের মাটিতে জিংক ঘাটতি
উচ্চফলনশীল ধান চাষ আবাদের ফলে বাংলাদেশের বেশির ভাগ জমি যেহেতেু বছরের অধিকাংশ সময় জলমগ্ন থাকে তাই এদেশের মাটিতে জিংকের ঘাটতি ক্রমান্বয়ে প্রকট আকার ধারণ করছে। মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউট এর তথ্য মতে, বাংলাদেশের ২.৭৬ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে জিংকের ঘাটতি বিদ্যমান যা মোট আবাদি জমির এক তৃতীয়াংশেরও অধিক। কৃষির নিবিড়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে এ ঘাটতি উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। তাছাড়া চুনযুক্ত মাটি, বেলে মাটি, অতি বেশি জৈব পদার্থপূর্ণ পিটমাটি, উচ্চমাত্রার পিএইচ সমৃদ্ধ লবণাক্ত মাটি, পাহাড়ের পাদদেশের পিডমন্ট মাটিতে জিংকের সহজাত ঘাটতি বিদ্যমান।
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল (অঊত) ভিত্তিক জিংকের ঘাটতিপূর্ণ অঞ্চলের মধ্যে সক্রিয় গঙ্গা প্লাবনভূমি (অঞ্চল-১০) উঁচু গঙ্গা বিধৌত প্লাবনভুমি (১১)। নিম্ন গঙ্গা বিধৌত প্লাবনভুমি (১২), গোপালগঞ্জ-খুলনা বিল (১৪), সেন্টমার্টিন কোরাল দ্বীপ (২৪), আখাউড়া সোপান (৩০), পুরাতন হিমালয়ের পাদভূমি (১), সক্রিয় তিস্তা প্লাবনভুমি (২), তিস্তা সর্পিল (গবধহফবৎ) প্লাবনভূমিতে (৩) জিংকের ঘাটতি খুবই প্রকট। বৃহত্তর সিলেট এলাকার বিস্তীর্ণ তিনটি কৃষি পরিবেশ অঞ্চল (২০,২১,২২) ব্যতীত দেশের বাদবাকি অঞ্চলে জিংকের কমবেশি ঘাটতি বিদ্যমান রয়েছে। বিশেষ করে রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর, বরিশাল ও কুমিল্লা জেলার অধিকাংশ এলাকায় জিংকের তীব্র ঘাটতি রয়েছে ।
জিংক সংবেদনশীল ফসল
এদেশের মাটিতে জিংকের ঘাটতি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রায় সব ধরনের ফসলেই জিংক সার ব্যবহারের ফলে তাৎপর্যপূর্ণ সাড়া তাদের ফলন বৃদ্ধি ও বিকাশের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়েছে। ভুট্টা, ধান, গম, আলু পিয়াজ, মরিচ, টমেটো, পালংশাক, মটরশুঁটি, মুগডাল, সয়াবিন, সূর্যমুখী, সরিষা জাতীয় ফসল জিংক ঘাটতিরপ্রতি অতি সংবেদনশীল। তাছাড়া লেবুজাতীয় উদ্ভিদও জিংকের প্রতি ষ্পর্শ কাতর।
জিংক সার ব্যবহারের সুফল
বাংলাদেশের জিংক ঘাটতিপূর্ণ অঞ্চলে বিভিন্ন ফসলে জিংক সার ব্যবহারের ফলে ফসলের ফলন বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। জিংক ব্যবহারের ফলে হলুদের ফলন ৪৪%, ভুট্টার ফলন ৪৩%, মরিচ এর ফলন ৩৮%, আদার ফলন ২৮% বৃদ্ধি পেয়েছে । তাছাড়া জিংক সার ব্যবহারের ফলে রোপা আমন ধানের ২৪% অধিক ফলন রেকর্ড করা হয়েছে। আবার জিংক সার পাতায় স্প্রে করে গমের দানায় জিংকের ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। তদ্রƒপ ধানের দানায় জিংক এর পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার গবেষণালব্ধ ফলাফল পাওয়া গেছে। সম্প্রতি হেক্টরপ্রতি ৩ কেজি জিংক সার ব্যবহার করে গমের ও ধানের দানায় যথাক্রমে ৫২ পিপিএম ও ২৫ পিপিএম জিংকসমৃদ্ধ হয়েছে। এক্ষেত্রে জিংক ব্যবহারে ফলে দানায় ১০-২০% জিংক বৃদ্ধি পেয়েছে।
জিংক সার ব্যবহারের সুপারিশ
মৃত্তিকার উর্বরতা উন্নয়নে জিংক সার ব্যবহারের নিয়মাবলি যেমন : ০১) মৃত্তিকার উর্বরতার মাত্রা, ফসলের ধরন, ঋতুভেদে এদেশের মাটিতে সাধারণত ২-৫ কেজি/হেক্টর জিংক সার সুপারিশ করা হয়। ০২) কৃষি পরিবেশ অঞ্চল-১০, ১১, ১২ ও ক্ষেত্র বিশেষে ১৩ যেখানে মাটি চুন যুক্ত ঐ সব এলাকায় রবিও খরিপ উভয় মৌসুমের ফসলের জন্য জিংক সার প্রয়োগ করতে হবে। ০৩) যে সমস্ত এলাকার মাটিতে বছরে ২-৩ টি ধান চাষ করা হয় সেখানে প্রথমে জন্মানো ধান যেমন- বোরো আবাদের জন্য সুপারিশের পূর্ণমাত্রার পরিমাণ জিংক সার প্রয়োগ করতে হবে। পরবর্তী ২য় ও তৃতীয় ধান ফসলে প্রত্যেকটির জন্য সুপারিশের অর্ধেক পরিমাণ জিংক সার প্রয়োগ বিধেয়। ০৪) ধানভিত্তিক শস্যবিন্যাসে শুধুমাত্র ধান ফসলে জিংক সার প্রয়োগ করতে হবে। পরবর্তী রবিশস্যে জিংক সার প্রয়োগ না করলেও চলবে। তবে শস্যবিন্যাসে ভুট্টা, আলু, সবজি ও মসলা জাতীয় (মরিচ, পেঁয়াজ) ফসল থাকলে ধান ফসলে পূর্ণ মাত্রায় জিংকসার ব্যবহার করার পরেও পরবর্তী ওই সমস্ত ফসলে সুপারিশ মোতাবেক পূর্ণমাত্রায় জিংক সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। ০৫) সুপারিশ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় জিংকসার কিছু ঝুর ঝুরে মাটির সাথে মিশিয়ে ছিটিয়ে প্রয়োগ করা যায়। কর্দম প্রধান মাটিতে ব্যান্ড পদ্ধতিতেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। ০৬) পাতা ও সবজিজাতীয় ফসল, ফলদ বৃক্ষে জিংকসার পাতায় প্রয়োগ (ঋড়ষরধৎ ংঢ়ৎধু) করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রতিলিটার পানিতে ৩-৪ গ্রাম জিংক সালফেট হেপ্টাহাইড্রেট দ্রবীভূত করে পাতায় সিঞ্চণ করা যেতে পারে। ধান ও ভুট্টা ফসলে যদি জিংক-এর তীব্র ঘাটতি পরিলক্ষিত হয় তবে উক্ত মাত্রার জিংক সার ১৫ দিন অন্তর ২ বার সিঞ্চণ করা যেতে পরে। এ ক্ষেত্রে, হেক্টর প্রতি ১০০-১৫০ লিটার স্প্রে দ্রবণ প্রয়োজন হতে পারে। ০৭) ফসলের বীজ ০.১ % জিংক সালফেট হেপ্টাহাইড্রেট দ্রবণে কয়েক ঘণ্টা ভিজিয়ে নিয়ে প্রাইমিং করে বপন করলে উত্তম ফল পাওয়া যেতে পারে।
জিংকসার প্রয়োগের সাবধানতা
মৃত্তিকা নমুনা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সুপারিশকৃত মাত্রা অনুযায়ী জিংক সার প্রয়োগ করতে হবে। জিংক সার ফসফেট (টিএসপি, এসএসপি ও ডিএপি) ও কম্পোস্ট সারের সাথে মিশ্রিত করা যাবে না। তাই জমিতে শেষ চাষের বেশ পূর্বে কম্পোস্ট ও ফসফেট সার এবং শেষ চাষের সময় জিংক সার প্রয়োগ করা বিধেয়। প্রখর সূর্যালোকের মধ্যে পাতায় স্প্রে না করে পড়ন্ত বিকেলে সূর্যাস্তের পূর্বে স্প্রে করা উত্তম। জিংকসার জিংক সালফেট মনোহাইড্রেট (৩৬% জিংক ) ও জিংক সালফেট হেপ্টাহাইড্রেট (২৩% জিংক) সরকার কর্তৃক সুপারিশকৃত। অনুমোদিত ডিলারের কাছ থেকে জিংক সালফেট সার ক্রয় করতে হবে । কোন অবস্থাতেই ভেজাল সার ব্যবহার করা যাবে না। এক্ষেত্রে সন্দেহ দেখা দিলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে।
খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা, মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও মৃত্তিকার উর্বরতা উন্নয়নে এদেশের মাটিতে জিংকসার প্রয়োগ অনস্বীকার্য। সুপারিশকৃত মাত্রা ও প্রথা অনুযায়ী জিংকসার ব্যবহারের কার্যক্রম জোরদারকরণের মাধ্যমে এদেশের কৃষি যুগোপযোগীকরণ এখন সময়ের দাবি।
১মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন উইং, মোবাইল ঃ ০১৭১৮২০১৪৯৯, ই-মেইল ঃ nirmal_shil@yahoo.com, ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, খামার বিভাগ, বিএআরআই, জয়দেবপুর, গাজীপুর
(১৬ ডিসেম্বর-১৪ জানুয়ারি)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
হেমন্ত শেষ। ঘন কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে শীতের আগমন। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আপনাদের সবার জন্য রইল শীতের শুভেচ্ছা। শীতের মাঝেও মানুষের খাদ্য চাহিদা নিশ্চিতে কৃষক-কিষানি ব্যস্ত হয়ে পড়েন মাঠের কাজে। মাঠের কাজে সহায়তার জন্য আসুন সংক্ষেপে আমরা জেনে নেই পৌষ মাসে সমন্বিত কৃষির সীমানায় কোন কাজগুলো আমাদের করতে হবে।
বোরো ধান
অতিরিক্ত ঠাÐার সময় বীজতলা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢেকে রাখা যায় এবং বীজতলার পানি সকালে বের করে দিয়ে আবার নতুন পানি দেয়া যায়। সে সাথে প্রতিদিন সকালে চারার ওপর জমাকৃত শিশির ঝরিয়ে দিতে হবে। এতে চারা ভালোভাবে বেড়ে ওঠে। বীজতলায় সব সময় নালা ভর্তি পানি রাখতে হয়। চারাগাছ হলদে হয়ে গেলে প্রতি বর্গমিটারে ৭ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। এরপরও যদি চারা সবুজ না হয় তবে প্রতি বর্গমিটারে ১০ গ্রাম করে জিপসাম দিলে সুফল পাওয়া যায়। চারা রোপণের জন্য মূল জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে পানিসহ কাদা করতে হবে। জমিতে জৈবসার এবং শেষ চাষের আগে ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার দিতে হবে। চারার বয়স ৩৫-৪৫ দিন হলে মূল জমিতে চারা রোপণ করতে হয়। ধানের চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর প্রথম কিস্তি, সাধারণত গুছিতে কুশি দেখা দিলে দ্বিতীয় কিস্তি এবং কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন আগে শেষ কিস্তি হিসেবে ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করা ভাল।
গম
গমের জমিতে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ এবং প্রয়োজনীয় সেচ দিতে হবে। চারার বয়স ১৭-২১ দিন হলে গমক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করে একরপ্রতি ১২-১৪ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয় এবং সেচ দিতে হয়। সেচ দেয়ার পর জমিতে জো এলে মাটির ওপর চটা ভেঙে দিতে হবে। গমের জমিতে যেখানে ঘনচারা রয়েছে সেখানে কিছু চারা তুলে পাতলা করে দেয়া ভাল।
ভুট্টা
ভুট্টাক্ষেতের গাছের গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে। গোড়ার মাটির সাথে ইউরিয়া সার ভালো করে মিশিয়ে দিয়ে সেচ দিতে হয়। গাছের নিচের দিকের মরা পাতা ভেঙে দেয়া ভাল। ভুট্টার সাথে সাথী বা মিশ্র ফসলের চাষ করে থাকলে সেগুলোর প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে।
আলু
চারা রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর অর্থাৎ দ্বিতীয়বার মাটি তোলার সময় ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হয়। দুই সারির মাঝে সার দিয়ে কোদালের সাহায্যে মাটি কুপিয়ে সারির মাঝের মাটি গাছের গোড়ায় তুলে দিতে হবে। ১০-১২ দিন পরপর এভাবে গাছের
গোড়ায় মাটি তুলে না দিলে গাছ হেলে পড়বে এবং ফলন কমে যাবে। এ সময় আলু ফসলে নাবি ধসা রোগ দেখা যায়। নি¤œ তাপমাত্রা, কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া ও বৃষ্টির পূর্বাভাস পাওয়ার সাথে সাথে ডাইথেন এম-৪৫ অথবা ইন্ডোফিল এম-৪৫ অথবা ম্যানেকোজেব গ্রæপের যেকোন ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হয়। গাছে রোগ দেখা দেয়া মাত্রই ৭ দিন পর পর সিকিউর অথবা অ্যাক্রোভেট এম জেড ২ গ্রাম/লিটার হারে মিশিয়ে স্প্রে করা প্রয়োজন। মড়ক লাগা জমিতে সেচ দেয়া বন্ধ রাখতে হবে। তাছাড়া আলু ফসলে মালচিং, সেচ প্রয়োগ, আগাছা দমনের কাজগুলোও করতে হয়। আলু গাছের বয়স ৯০ দিন হলে মাটিরসমান করে গাছ কেটে রেখে দিতে হবে ১০ দিন পর আলু তুলে ফেলতে হবে। আলু তোলার পর ভালো করে শুকিয়ে বাছাই করতে হবে এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
তুলা
এ সময় তুলা সংগ্রহের কাজ শুরু করতে হয়। তুলা সাধারণত ৩ পর্যায়ে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। শুরুতে ৫০% বোল ফাটলে প্রথম বার, বাকি ফলের ৩০% পরিপক্ব হলে দ্বিতীয় বার এবং অবশিষ্ট ফসল পরিপক্ব হলে শেষ অংশের তুলা সংগ্রহ করতে হবে। রৌদ্রময় শুকনা দিনে বীজ তুলা সংগ্রহ করা ভাল। ভালো তুলা আলাদাভাবে তুলে ৩-৪ বার রোদে শুকিয়ে চট অথবা ব্যাগে সংরক্ষণ করতে হবে।
ডাল ও তেল ফসল
মসুর, ছোলা, মটর, মাষকলাই, মুগ, তিসি পাকার সময় এখন। সরিষা, তিসি বেশি পাকলে রোদের তাপে ফেটে গিয়ে বীজ পড়ে যেতে পারে, তাই এগুলো ৮০ ভাগ পাকলেই সংগ্রহের ব্যবস্থা নিতে হবে। আর ডাল ফসলের ক্ষেত্রে গাছ গোড়াসহ না উঠিয়ে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি রেখে ফসল সংগ্রহ করতে হয়। এতে জমিতে উর্বরতা এবং নাইট্রোজেন সরবরাহ বাড়বে।
শাকসবজি
ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, ওলকপি, শালগম, গাজর, শিম, লাউ, কুমড়া, মটরশুঁটি এসবের নিয়মিত যতœ নিতে হয়। বিভিন্ন শাক যেমন- লালশাক, মুলাশাক, পালংশাক একবার শেষ হয়ে গেলে আবার বীজ বুনে দিতে পারেন। টমেটো ফসলের মারাত্মক পোকা হলো ফলছিদ্রকারী পোকা। ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে এ পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রতি বিঘা জমির জন্য ১৫টি ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। আক্রমণ তীব্র হলে কুইনালফস গ্রæপের কীটনাশক (দেবীকুইন ২৫ ইসি/ কিনালাক্স ২৫ ইসি/করোলাক্স ২৫ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার পরিমাণ মিশিয়ে স্প্রে করে এ পোকা দমন করা যায়। টমেটো সংগ্রহ করে বাসায় ৪-৫ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করার জন্য আধা পাকা টমেটোসহ টমেটো গাছ তুলে ঘরের ঠাÐা জায়গায় উপুর করে ঝুলিয়ে টমেটোগুলোকে পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। শীতকালে মাটিতে রস কমে যায় বলে সবজি ক্ষেতে চাহিদামাফিক নিয়মিত সেচ দিতে হবে। এ ছাড়া আগাছা পরিষ্কার, গোড়ায় মাটি তুলে দেয়া, সারের উপরিপ্রয়োগ ও রোগবালাই প্রতিরোধ করা জরুরি।
গাছপালা
বর্ষায় রোপণ করা ফল, ঔষধি বা কাঠ গাছের যতœ নিতে হয়। গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। প্রয়োজনে গাছকে খুঁটির সাথে বেঁধে দেয়া যায়। রোগাক্রান্ত গাছের আক্রান্ত ডালপালা ছাঁটাই করে দিতে হবে। গাছের গোড়ায় নিয়মিত সেচ দেয়া জরুরি।
প্রাণিসম্পদ
শীতকালে পোলট্রিতে অপুষ্টি, রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা এসব সমস্যা দেখা যায়। তাই প্রয়োজনীয় যতœ নিতে হবে। মোরগ-মুরগীর অপুষ্টিজনিত সমস্যা সমাধানে ভিটামিন এ, সি, ডি, ই, কে ও ফলিক এসিড খাওয়াতে হবে। শীতের তীব্রতা বেশি হলে পোলট্রি শেডে অবশ্যই মোটা চটের পর্দা লাগাতে হবে এবং বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ সময় হাঁসের যেসব রোগ হয় সেগুলো হলোÑ হাঁসের প্লেগ রোগ, কলেরা রোগ এবং বটুলিজম। প্লেগ রোগ প্রতিরোধে ১৮-২১ দিন বয়সে প্রথম মাত্রা এবং প্রথম টিকা দেয়ার পর ৩৬-৪৩ দিন বয়সে দ্বিতীয় মাত্রা পরবর্তী ৪-৫ মাস পরপর একবার ডাক প্লেগ টিকা দিতে হবে। গাভীর জন্য শীতকালে মোটা চটের ব্যবস্থা করা খুব জরুরি। শীতকালে ছাগলের নিউমোনিয়া রোগটি খুব বেশি হয়। যদি ৫ দিনের বেশি কাশি ও দুর্গন্ধযুক্ত পায়খানা হয় তবে বুঝতে হবে প্যারাসাইটের জন্য নিউমোনিয়া হয়েছে। নিউমোনিয়াতে সেফট্রাইএক্সোন ও টাইলোসিন ব্যবহারে খুব ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
মৎস্যসম্পদ
এ সময়ে পুকুরে পানি কমে যাওয়ায় মাছের বিশেষ যতœ নেয়া দরকার। পানি দূষিত হয়। মাছের রোগবালাইও বেড়ে যায়। শীতের সময় কার্প ও শিং জাতীয় মাছে ড্রপসি বা উদর ফোলা রোগ বেশি হয়। এ রোগ প্রতিরোধে মাছের ক্ষত রোগ যাতে না হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। আর এ রোগের প্রতিকারে প্রতি কেজি খাদ্যের সাথে ১০০ মিলিগ্রাম টেরামাইসিন বা স্ট্রেপটোমাইসিন পর পর ৭ দিন খাওয়াতে হবে। এ সময় আগামী বর্ষায় রুইজাতীয় মাছকে কৃত্রিম উপায়ে ডিম ফুটাতে ইচ্ছুক চাষিগণ প্রজননক্ষম বয়ঃপ্রাপ্ত মাছ সংগ্রহ করে মজুদ পুকুরে রেখে দিন।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, শীতকাল শুকনো মৌসুম বলে মাটিতে রস কম থাকে। তাই প্রতি ফসলে চাহিদামাফিক সেচ প্রদান নিশ্চিত করতে পারলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে। কৃষির মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করতে পারি। কৃষির যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য আপনার নিকটস্থ উপজেলা কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন অথবা ১৬১২৩ এ নম্বরে যে কোনো মোবাইল অপারেটর থেকে কল করে নিতে পারেন বিশেষজ্ঞে পরামর্শ। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা।য়
সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪, মেইল : editor@ais.gov.bd
কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন
কৃষি বিষয়ক
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
মোছাঃ আনজুআরা বেগম, গ্রাম: দক্ষিণ পাতাকাটা, উপজেলা: বরগুনা সদর, জেলা: বরগুনা
প্রশ্ন: ডালিয়া ফুলের পাতায় সাদা সাদা গুঁড়ার মতো আবরণ পড়ে। এ সমস্যা দূরীকরণে কী করব। জানালে উপকৃত হবো।
উত্তর : ডালিয়া ফুলের পাতার এ সমস্যাকে সাদা গুঁড়া রোগ বা পাউডারি মিলডিউ রোগ বলে। এটি এরিসাইফি পলিগনি নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে। আর্দ্র ও ছায়াযুক্ত স্থান এবং অল্প জায়গাতে বেশি গাছ থাকলে এ রোগের প্রকোপ বাড়ে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও রাতে ঠাÐা আবহাওয়া বিরাজ করলে এ রোগ বেশি হয়। সেজন্য রোগ দেখা দিলে সালফার জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন-থিয়োভিট ৮০ ডবিøউজি বা কুমুলাস ডিএফ ১ লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে অথবা প্রোপিকোনাজোল যেমন-টিল্ট ২৫০ ইসি ১ লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করবেন। আশা করি আপনার ফুলের সমস্যার সমাধান হবে এবং আপনি উপকৃত হবেন।
মো: হাবিব, গ্রাম: দক্ষিণ মহেশপুর, উপজেলা: ফুলবাড়ি, জেলা: দিনাজপুর
প্রশ্ন : গত বছর মিষ্টি আলুতে কালো দাগ পড়ে সংরক্ষিত মিষ্টি আলু নষ্ট হয়েছিল। এ বছর কী ব্যবস্থা নিলে এ সমস্যা দূর হবে। জানাবেন।
উত্তর : মিষ্টি আলুর এ রোগটিকে কালচে রোগ বা চারকোল রট বলে। আর এটি ম্যাক্রোফোমিনা ফ্যাজিওলিনা/ডিপ্লোডিয়া নাটালেনসিস নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। এ রোগের সমাধানে আপনাকে রোগমুক্ত মিষ্টি আলুর লতা লাগাতে হবে। এ ছাড়া শস্যপর্যায় অবলম্বন করা দরকার। জমিতে মিষ্টি আলুর লতা লাগানোর আগে কার্বেন্ডাজিম গ্রæপের ছত্রাকনাশক যেমন-অটোস্টিন অথবা কার্বোক্সিল ও থিরাম গ্রæপের ছত্রাকনাশক যেমনÑপ্রোভ্যাক্স ২০০ ডবিøউপি প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে তার মধ্যে লতা ডুবিয়ে শোধন করে জমিতে লাগাতে হবে। এ ছাড়া সংরক্ষিত মিষ্টি আলুকে এ রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য মিষ্টি আলুকে সংরক্ষণের আগে ভালোভাবে কিউরিং বা শুকিয়ে নিতে হবে। এ রোগ যাতে না হয় সেজন্য কাটা, ছেড়া ও থেঁতলানো মিষ্টি আলু না নিয়ে শুধু নিখুঁত মিষ্টি আলু সংরক্ষণ করবেন। আর ফসল সংগ্রহের পর মেনকোজেব গ্রæপের ছত্রাকনাশক যেমন-ডাইথেন এম ৪৫ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে মিষ্টি আলুতে স্প্রে করে সংরক্ষণ করবেন। বালাইনাশক স্প্রে করা ফসল কমপক্ষে ৭ থেকে ১০ দিন খাওয়া যাবে না। এসব ব্যবস্থা নিলে আপনি উপকার পাবেন।
মোকসেদুর রহমান, গ্রাম: উমরগ্রাম, উপজেলা: গঙ্গাচরা, জেলা: রংপুর
প্রশ্ন: আলু গাছের গোড়ার দিকে কালো দাগ পড়ে। আলু গাছ শক্ত ও মট করে ভেঙে যায়। এমনকি আলু গাছের কাÐের সাথে ছোট সবুজ আলু দেখা যায়। এ অবস্থায় কী করণীয়। জানাবেন।
উত্তর : আপনার আলু গাছের এ সমস্যাটিকে আলুর স্টেম ক্যাংকার বা স্কার্ফ রোগ বলে। এমনকি কৃষক পর্যায়ে একে রাইজোকটনিয়া রোগও বলে। উচ্চ তাপমাত্রা ও উচ্চ আর্দ্রতা এ রোগের সহায়ক। এ রোগটি বীজ ও মাটিবাহিত। সেজন্য এ রোগ দমনে প্রত্যায়িত বা রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া ভালোভাবে অঙ্কুরিত বীজ আলু রোপণ করার পাশাপাশি শস্যবিন্যাস অবলম্বন করা জরুরি। আর কোনোভাবেই বীজআলু মাটির গভীরে লাগানো যাবে না। বীজআলু শোধনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম প্রোভেক্স ২০০ অথবা কার্বেনডাজিম গ্রæপের ব্যাভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ৩ গ্রাম মিশিয়ে বীজআলু শোধন করলে উপকার পাওয়া যায়। যদি কোনো কারণে ক্ষেতে রোগের প্রকোপ বেড়ে যায় তবে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে কম্প্যানিয়ন অথবা সানভিট মিশিয়ে গাছের গোড়া ভিজিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে আপনি উপকার পাবেন।
মো: ফারুক, গ্রাম: রনসিয়া, উপজেলা: পীরগঞ্জ, জেলা: ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন : অনুন্নত আমগাছকে কিভাবে উন্নত জাতের আমগাছে পরিণত করা যাবে ?
উত্তর : টপ ওয়ার্কিং এর মাধ্যমে অনুন্নত আমগাছকে সহজেই উন্নত জাতের আম গাছে পরিণত করা যায়। এজন্য ফেব্রæয়ারি-মার্চ মাসে অনুন্নত আম গাছের সব শাখা প্রশাখা কেটে ফেলতে হবে। জুন-জুলাই মাসে আম গাছের কর্তিত শাখা প্রশাখা থেকে উৎপন্ন ডালসমূহে ভিনিয়ার বা ক্লেফট পদ্ধতিতে উন্নত জাতের কলম করতে হয়। কলমের নিচে থেকে কুশি বের হলে তা নিয়মিতভাবে কেটে দিতে হবে। এভাবে ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে অনুন্নত আমগাছটি উন্নত জাতের আমগাছে পরিণত হবে।
মো. জয়নাল উদ্দীন, গ্রাম: ল²ীরপাড়, উপজেলা: বিশ্বম্বপুর, জেলা: সুনামগঞ্জ
প্রশ্ন : মাল্টা গাছের ডাল ছাঁটাই সর্ম্পকে জানতে চাই।
উত্তর : মাল্টা গাছের জন্য ডাল ছাটাই খুব জরুরি। গাছ লাগানোর পর ফল ধরার আগ পর্যন্ত গাছকে একটা ভালো আকার দিতে হয়। এতে করে গাছ চারদিকে ছড়াতে পারে। কারণ পাশের ডালগুলোতে বেশি মাল্টা ধরে। মাল্টা গাছের কাÐের ১ মিটার বা ৩ ফুট পর্যন্ত সব ধরনের ডাল ছাঁটাই করে দিতে হয়। ডাল ছাঁটাই করার পর কাটা অংশে বর্দোপেস্ট এর প্রলেপ দিতে হয়। নাহলে রোগের আক্রমণ হতে পারে। অনেক সময় মাল্টা গাছে পানি তেউর বা ওয়াটার সাকার দেখা যায়। এসব অংশ দেখামাত্রই কেটে দিতে হবে। মরা, শুকনো এবং রোগ, পোকামাকড় আক্রান্ত ডালপালা সবসময়ই পরিষ্কার রাখতে হবে। এভাবে মাল্টা গাছের যতœ নিলে রতœ মিলে।
মো. গোলাম মোস্তফা, গ্রাম: পিরোজপুর, উপজেলা: মেহেরপুর সদর, জেলা: মেহেরপুর
প্রশ্ন : বেগুন গাছের পাতা কেমন জানি ছোট হয়ে গেছে এবং পাতাগুলো গুচ্ছাকারে দেখা যাচ্ছে। এ সমস্যার সমাধান জানাবেন।
উত্তর : বেগুন গাছের এ সমস্যাকে বেগুনের ছোট পাতা রোগ বলে। এ ধরনের সমস্যা মাইকোপ্লাজমা জনিত কারণে হয়ে থাকে। জ্যাসিড পোকা এ রোগ ছড়ায়। এ ধরনের রোগাক্রান্ত গাছ ক্ষেতে দেখামাত্রই সেটি তুলে ফেলা দরকার। আর সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি জরুরি সেটি হলো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। সেজন্য আক্রান্ত জমিতে বেগুন ফসলের চাষ না করা। আর বেগুন গাছের বয়স ১ মাস হলেই বাহক পোকা অর্থাৎ জ্যাসিড দমনের জন্য ইমিডাক্লোরপ্রিড গ্রæপের কীটনাশক যেমন এডমায়ার ১ মিলি বা এমিটাফ ১ মিলি বা এসাটাফ ০.২৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে। আশা করি উপকৃত হবেন।
মৎস্য বিষয়ক
মোঃ ইয়াজুল ইসলাম, গ্রাম: বাগজান, উপজেলা: পাঁচবিবি, জেলা: জয়পুরহাট
প্রশ্ন : পানির রঙ গাঢ় সবুজ, মাছ মরে যাচ্ছে কী করব ?
উত্তর : অতিরিক্ত প্ল্যাকটন তৈরি হওয়ার কারণে এবং অক্সিজেনের অভাব হলে এমনটি হয়। এ সমস্যার প্রতিকারে শতকপ্রতি ৫০০ গ্রাম পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে। খাবার ও রাসায়নিক সার সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রাখতে হবে। কপার সালফেট বা তুঁতে ১২ থেকে ১৪ গ্রাম শতকপ্রতি ছোট ছোট কাপড়ের পোঁটলায় বেঁধে বাঁশের খুঁটিতে বেঁধে দিতে হবে যেন ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার পানির নিচে থাকে। সিলভার কার্প মাছ ছাড়া যেতে পারে। এছাড়া জিপসাম প্রয়োগ করা যাবে শতকপ্রতি ১ কেজি হারে।
শিউলি বেগম, গ্রাম: আসমাড়াই, উপজেলা: রাজবাড়ী সদর, জেলা: রাজবাড়ী
প্রশ্ন : মাছের বৃদ্ধি হচ্ছে না। কি করব ?
উত্তর : পুকুরের পানির পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হবে। এক সপ্তাহ পরপর জাল টানতে হবে। খাদ্য চাহিদা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। এ ছাড়া দ্রæত দৈহিক ওজন বৃদ্ধি, প্রজনন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এসিমিক্স সুপার ফিস ব্যবহার করতে হবে ১ থেকে ২.৫ কেজি প্রতি টন খাদ্যে। এসব ব্যবস্থা নিলে আপনি উপকার পাবেন।
প্রাণিসম্পদ বিষয়ক
শুভচন্দ্র, গ্রাম: মূলগ্রাম, উপজেলা: কালাই, জেলা: জয়পুরহাট
প্রশ্ন: আমার ছাগলের বয়স ৬ মাস। খাবার খেতে চায় না। রক্তশূন্যতা দেখা দিচ্ছে। এমতাবস্থায় কি করণীয়। পরামর্শ চাই।
উত্তর: আক্রান্ত ছাগলকে এনডেক্স বা রেনাডেক্স ১৫০০ মিলগ্রাম (৭০ কেজির জন্য ১টি ট্যাবলেট) খাওয়াতে হবে। ছাগলকে বছরে অন্তত ২ বার বর্ষার শুরুতে এবং বর্ষার শেষে কৃমির ওষুধ খাওয়াতে হবে। তাহলে আপনি উপকার পাবেন।
মোঃ আক্কাছ আলী, গ্রাম: খাটুরিয়া, উপজেলা: ডোমার, জেলা: নীলফামারী
প্রশ্ন : আমার টার্কির বয়স ১ মাস। টার্কিও গায়ে অতিরিক্ত জ¦র। সব টার্কি একসাথে জমা হয়ে থাকছে। সাদাটে চুনের মতো ডায়রিয়া হচ্ছে। এমতাবস্থায় কি করব?
উত্তর: এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ যার নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই। তবে এই রোগে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং অন্যান্য রোগের সংক্রমণ খুব সহজেই হয়। সেজন্য নি¤েœ্াক্ত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। সিপ্রোফ্লক্সাসিন ১ মিলি ১ লিটার পানিতে এবং ভিটামিন সি ১ গ্রাম ৩ লিটার পানিতে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে ৩ থেকে ৫ দিন।
(মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক প্রশ্ন কৃষি কল সেন্টার হতে প্রাপ্ত)
উপপ্রধান তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, ফোন নং: ০২-৫৫০২৮৪০০, ই-মেইল : taufiquedae25@gmail.com
ভাসমান কৃষি কৌশল
ড. মোঃ আলতাফ হোসেন১
পানির উপরে ভাসমান কৃষি দেখতেই লাগে বেশ
আর সেই কৌশলটিই এখন জানিয়ে দিব সমগ্র দেশ।
দেশের অনেক এলাকাই দীর্ঘ সময় থাকে পানিতে নিমজ্জিত
তাই জন্য সেখানে মাটিতে কৃষি উৎপাদন করা যায় না ঠিকমতো।
ভাসমান কৃষি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় হাওড় ও উপক‚লবর্তী এলাকায়
বরিশাল, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলায়।
দৃষ্টিনন্দন এই কৃষি কাজ কিভাবে সেখানে করে
এই লেখায় সেই কৌশলটিই- ধরছি আমি তুলে।
সাধারণত কচুরীপানা দিয়ে তৈরি করা হয়- “ভাসমান প্লাটফর্ম”
এর উপরে ছড়িয়ে দেয়া হয়, টোপাপানাসহ বিভিন্ন ঘাসের আবরণ।
বাঁশের ব্যবহারে প্লাটফর্ম হয় শক্ত, বৃদ্ধি পায় এর স্থায়িত্ব
অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার সুবিধাসহ টেকসইও হয় এর অস্তিত্ব।
ভাসমান এই প্লাটফর্মকে বলা হয়- বাইরা গেটো, ধাপ ও বেড
কখনো এটি ব্যবহার হয় সীডবেড অথবা কৃষির ভাসমান ক্ষেত।
জলজ আগাছা ও খুদিপানা দিয়ে তৈরি করা হয়, ছোট বলাকৃতির মাদা
মাদার মধ্যে দেয়া হয় পচা টোপাপানা ও কাঠের গুঁড়া- যেন ভেজা কাদা।
অঙ্কুরিত সবজি বীজ মাদায় বপন করে বেডে তৈরি করা হয় চারা
আর চারা তৈরি করেই বেডের কাজটি হয়ে যায় না কখনোই সারা।
চারার মধ্যে অন্যতম কুমড়া জাতীয় সবজি, টমেটো, মরিচ, শিম, কপি ও বেগুন
আগাম চারা বিক্রয় করে কৃষক পেয়ে থাকেন স্বাভাবিকের চেয়ে দাম “কয়েক গুণ”।
চারা উৎপাদন ছাড়ার ও ভাসমান বেড ব্যবহৃত হয়, সবজি ও মসলা ফসল চাষে
হাওড় ও উপক‚লীয় এলাকায় বিভিন্ন সবজি ও মসলা ফসল এখান থেকেই আসে।
ভাসমান সবজি উৎপাদনে রাসায়নিক সারের প্রয়োজন নাহি লাগে
তবুও সবজিগুলো বেড়ে উঠে মাটিতে জন্মানো সবজির তুলনায় আগে।
প্রায় ১০ গুণ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় ভাসমান বেডে সবজির চাষে
মাটিতে চাষের তুলনায় শতকরা ৩৫-৫০ ভাগ উৎপাদন খরচও কমে আসে।
দীর্ঘ সময় যেখানে জলাবদ্ধ থাকে, করা যায় না কোন চাষাবাদ
ভাসমান কৃষি কৌশলের ব্যবহার সেখানে কৃষির জন্য হয় আশির্বাদ।
কচুরীপানা ভর্তি জলাবদ্ধ এলাকায় ভাসমান কৃষি কৌশল বাস্তবায়নে
বাড়তি লাভ হবে মাছ চাষে ও মশা নিধনে যা অবদান রাখবে দারিদ্র্য দূরীকরণে।
পরিবেশবান্ধব কৃষির অন্যতম প্রধান নাম “ভাসমান কৃষি”
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যা ভূমিকা রাখছে দিবানিশি।
হেমন্তের নবান্ন পর্ব
মো: জুন্নুন আলী প্রামাণিক২
ঘাসের শেষে মাসের দেখা অগ্রহায়ণ যেমন,
ঋতুর পরে ঋতুর চক্র হেমন্তঋতু তেমন।
যুগের সেরা ধানের চাষে ফলনভারে ওজন,
চাষীর ঘরে, আনন্দ করে নিকটতম স্বজন।
নবান্ন পর্বে সুবাস উড়ে আয়োজনের সাজন,
আপন পর বিভেদ ভুলে আত্মীয়তার বাঁধন।
শুধুই দুধে খেজুর গুড় আতপচাল চিকন,
মিষ্টান্ন তৈরী মধুর স্বাদে খুশিমতন রাধন।
পিয়াজ কাটে মরিচ বাটে চঞ্চলতায় নয়ন,
ক্ষেতের শ্রেষ্ঠ সবজি শাক আশানুরূপ চয়ন।
গোশত মাছ বিশুদ্ধ পানি তালিকাভুক্ত রাখেন,
বিচিত্র পাকে গৃহিনী নিজে ব্যস্তমুখর থাকেন।
দিনের সূর্য বিদায় নিলে তাঁরকাভরা গগন,
নতুন খাদ্যে ভরিয়ে যায় তরুলতার ভুবন।
হরেক পিঠা বানায় যতেœ মন ভোলানো গঠন,
ঐতিহ্যে শ্রদ্ধা স্বাগত জানে নতুনত্বের বরণ।
আনন্দ ফোটে নির্মল মনে শুভেচ্ছাবাণী জ্ঞাপন,
বিভেদ ভুলে সবাই মিলে পাড়াপড়শি আপন।
গর্বের প্রথা ফিরিয়ে হাসে শুকতাঁরার মতন,
সবার মুখে খাবার তালে প্রশংসার বচন।
নিয়মে আসে বছর ঘুরে বাংলামাস অঘ্রান,
চাষীর বাড়ী ঐশ্বর্যে ভরে রান্নাবান্নার সুঘ্রাণ।
শ্রমের কষ্ট ভুলিয়ে দেয় সার্থকতায় জীবন,
ঘুমের ঘোরে কৃষক দেখে কৃষিকাজের স্বপন।
বনের পাখি সকালে ডাকে নিত্যনতুন কুজন,
তাদের কণ্ঠে ফুটিয়ে উঠে কৃষকবৃন্দ সুজন।
১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কীটতত্ত¡ বিভাগ, ডাল গবেষণা কেন্দ্র, বারি, ঈশ্বরদী, পাবনা, মোবাইল : ০১৭২৫-০৩৪৫৯৫ ই-মেইল : hossain.draltaf @gmail.com, ২গ্রাম: বিদ্যাবাগীশ, ডাকঘর ও উপজেলা : ফুলবাড়ী, জেলা : কুড়িগ্রাম, মোবাইল : ০১৭৩৫২০২৭৯৮
মো. কাওছারুল ইসলাম সিকদার
কৃষিই ছিল বাংলার আদি পেশা। এ অঞ্চলের মাটি, পানি তথা জলবায়ু ছিল কৃষির জন্য আদর্শ হিমালয়ের অববাহিকায় ভাটি অঞ্চলে বাংলার অবস্থান বিধায় অধিকাংশ নদী বাংলার উপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। চীন, তিব্বত, নেপাল, ভুটান এবং ভারতের সীমানায় অবস্থিত হিমালয় পর্বতমালার অসংখ্য হিমবাহের গলিত রূপ নদ ও নদীরূপে বাংলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এ অঞ্চলকে করেছে সুজলা, শ্যামলা ও নদীমাতৃক। জীবন ও জীবিকাকে করেছে সহজ-সরল। মানুষকে করেছে কোমল। সংস্কৃতিকে করেছে বহুমাত্রিক। খাদ্যাভ্যাসও ছিল স্বতন্ত্র।
ফসল উৎপাদনের ধরন ছিল বহুমুখী। প্রতিটি কৃষি পরিবার তার প্রয়োজনের প্রায় সব শস্য ও মসলা উৎপাদন করত। সে সময়ে গম, কাউন, মটরশুঁটি, ডাল (মুগ, মসুর, মাসকালাই), ধনিয়া, পেঁয়াজ, রসুন, গোলআলু, মিষ্টি আলু প্রভৃতি ফসল উৎপাদন হতো। পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় সবজি চাষ মূলত বাড়ির আশপাশে, ঘরের আঙ্গিনায়, ঘরের চালে মহিলারাই উৎপাদন করত। মাচা দিয়ে লাউ, বাঁশের কঞ্চিতে শিম আর ঘরের চালের উপর পাটখড়ির মাচায় চালকুমড়া ও মিষ্টি কুমড়ার চাষ হতো। বাড়ির উঠানের এক পাশে ডাঁটা, ঢেঁড়স ও অন্যান্য শাক উৎপাদিত হতো। টমেটো, মুলা, ধনিয়া পাতা বাড়ির আশেপাশে বিদ্যমান ছোট জমিতে চাষ হতো। আর বড় বড় জমিতে ধান, পাট, গমসহ প্রয়োজনীয় ফসল উৎপাদন করা হতো। সে সময়কার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে মহিলাদের কাজকর্ম বাড়ির ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। অপরদিকে পুরুষেরা নিয়োজিত ছিল মাঠের কাজে, ফসল উৎপাদনে এবং অযান্ত্রিক পানি সেচে, খাদ্যশস্য পরিবহণ ও বাজারজাতকরণে। সত্তরের দশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়া কৃষিতে লাগেনি। তাই কৃষির সাথে সম্পর্কিত সকল কাজ, মূলত কায়িক শ্রম এবং গবাদিপশুর উপরই নির্ভর করতে হতো। জমি তৈরির একমাত্র অবলম্বন যাদের গরু কমছিল তারা অন্যান্য পরিবারের সাথে একত্র হয়ে সকলের গরু ও জোয়াল একত্র করে পালাক্রমে একে অপরের জমি তৈরি করত। সে সময়ে জমি চাষ ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনার জন্য লাঙ্গল, জোয়াল, মই, আঁচড়া, কাঁচি, নিড়ানি পাতলা (রোদ ও বৃষ্টি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মাথায় দেওয়ার উপকরণ) প্রভৃতি ব্যবহার করা হতো এবং খাল-বিল, পুকুর ও ডোবা হতে সেচের পানি জমিতে দেয়ার জন্য কাঠের তৈরি দোরণ এবং বাঁশের তৈরি ওড়া ব্যবহৃত হতো।
গ্রামীণ সমাজে কৃষিসহ প্রায় সকল কাজই শুরু হতো সেই ভোর হতে এবং চলতো সকাল ৮-৯ ঘটিকা পর্যন্ত । এর পর সকালের খাবার এবং কিছুটা সময় বিশ্রাম নিত। সকালের খাবারে রাতের রান্না করা শুকনো/ পানি দেওয়া পান্তা ভাত এবং তার সাথে শুঁটকি ও অন্যান্য সবজি, ভর্তা, ভাজি ইত্যাদি থাকত।
ভোরে কাজ শুরু মূল লক্ষ্যই ছিল রোদ্রের প্রখরতা গায়ে লাগার আগেই যেন জমি তৈরির মতো পরিশ্রমের কাজ অনেকটা সম্পন্ন করা যায়। নাশতা ও বিশ্রামের পরে আবার কৃষকেরা মাঠে নেমে পড়তেন এবং চলতো দুপুর অবধি। একান্ত প্রয়োজন না হলে কৃষকদেরকে (বদলি) দুপুরের খাবারের জন্য বাড়িতে আনা হতো না। তাদের দুপুরের খাবার মাঠেই পৌঁছে দেওয়া হতো। যাতে করে সময়ের অপচয় না ঘটে এবং অধিক কাজ করা সম্ভব হয়। জমি তৈরি, ফসল উৎপাদন, কাটা, বাড়িতে আনা, শস্যের স্তূপ (গাদা), মাড়াই, সিদ্ধ, শুকানো, ঢেঁকিতে ছাঁটাই করে মটকা (মাটির বড় পাত্র), ডোল এবং গোলায় (পাটখড়ি বা বাঁশ দ্বারা নির্মিত) শস্য রাখা হতো। এ কাজগুলো মূলত পুরুষেরা করলেও ধান সিদ্ধ, শুকানো ও ঢেঁকিতে ভাঙ্গার কাজে মহিলারাই অংশগ্রহণ করত। গ্রামের কৃষকেরা সাধারণত একত্র হয়ে পর্যায়ক্রমে অবস্থাপন্ন পরিবারের জমির ফসল মাঠ থেকে কেটে এনে দিত। একাজ সম্পন্ন হওয়ার পরে সচ্ছল পরিবারসমূহ পৃথক পৃথকভাবে পর্যায়ক্রমে কৃষকদের জন্য একবেলা ভালো খাবারের ব্যবস্থা করত। যা কৃষকদের মাঝে আনন্দ ঘন ও উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করত। ধান কাটা শেষ হলে খেয়াঘাটের মাঝি, নাপিত ও অন্যান্য গরিব ও নিম্নবর্ণের মানুষেরা তাদের সেবার বিনিময়স্বরূপ বার্ষিক মজুরি হিসেবে সচ্ছল পরিবার হতে ধান সংগ্রহ করত।
বাজার ছিল সপ্তাহে দুই দিন। মানুষের প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য সাপ্তাহিক বাজার ব্যতীত নিকটবর্তী তেমন কোন দোকান-পাট ছিল না। তবে প্রতিদিন সকালে উক্ত বাজারসমূহে সকালে তাজা মাছ, সবজি, দুধ ও অন্যান্য উপকরণ স্বল্প সময়ের জন্য স্বল্প পরিসরে ক্রয়-বিক্রয় হতো। সকালের এই সংক্ষিপ্ত বাজার ব্যবস্থাপনা ‘আড়ং’ হিসেবে প্রচলিত ছিল। সে সময় শিল্পের প্রসার ছিল না বললেই চলে। সরকারি চাকরিজীবীও গুটি কয়েক সরকারি ব্যাংকের মধ্যেই মূল অর্থনৈতিক কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল। সরকারি চাকরিজীবী ও ব্যাংকার ভিন্ন অন্যদের হাতে নগদ টাকা ছিল না বললেই চলে। তাই অধিকাংশ মানুষ তার উদ্বৃত্তপণ্য বাজারে বিক্রয় করে প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতো। সেসময়ে প্রাত্যহিক বাজারে প্রতিটি পরিবারের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ছিল লবণ ও কেরোসিন তেল। কারণ, এ দুটি পণ্য পারিবারিকভাবে উৎপাদনের সুযোগ ছিল না। তাই, রান্নার জন্য লবণ এবং প্রতিদিনের সাঁঝের আলোর জন্য কুপি ও হারিকেনে ব্যবহৃত হতো কেরোসিন তেল। কুপি ও হারিকেনের এ জ্বালানী সাশ্রয়ীর জন্য গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই সান্ধ্যকালীন কাজকর্ম, খাওয়া-দাওয়া, শিশুদের পড়াশোনা এবং এশার নামায আদায় করে দ্রæত ঘুমিয়ে পড়ত। চিনি ছিল না বললেই চলে, তবে আখের গুড়ের প্রাপ্যতা ছিল পর্যাপ্ত। খাবার তেল বলতে সরিষার তেল ছিল প্রথম স্থানে। তবে ক্ষেত্র বিশেষে তিলের তেল ও ব্যবহৃত হতো। এসবই ছিল বিশুদ্ধ। তেল ভাঙ্গানোর (তৈরি) জন্য কাঠের ঘানি ছিল; যা গরু দ্বারা চালানো হতো। ঘানি হতে উৎপাদিত তেল তেলবীজের মালিক পেতেন। অপর দিকে খৈল (তেল বের হওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকত) ঘানিওয়ালা পেত। এ বার্টার ব্যবস্থা মূলত নগদ টাকার স্বল্পতার কারণেই প্রচলিত ছিল।
বাজার ব্যবস্থাপনা ছিল পণ্য বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম। অনেকগুলো গ্রামের জন্য ছিল এক একটি বাজার। তাই প্রতিটি পরিবারকে হাট দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হতো এবং প্রয়োজনের তাগিদে পরিবারের কোন না কোন পুরুষ সদস্যকে হাটে যেতে হতো। পুরুষ সদস্য না থাকলে প্রতিবেশীর নিকট পণ্য আনার জন্য অনুরোধ করতে হতো। সে সময়ে বর্ষায় মাঠঘাট পানিতে টইট¤ু^র থাকত। রাস্তাঘাট ছিল না। নৌকাই ছিল একমাত্র বাহন। তাই বাড়ির সকল পরিবার মিলে এক বা একাধিক নৌকায় বাজারে যেত।
টাকার তারল্যতা কম থাকায় প্রায় সকলেই উদ্বৃত্ত শস্য বাজারে নিত আবার ক্রয়কৃত পণ্য নিয়ে বাড়ি ফিরত। এমনকি শ্রমিকের মজুরি দেওয়া হতো হাটে পণ্য বিক্রি করে। অনেক ক্ষেত্রে সবজি জাতীয় পণ্যের দাম খুব কম বা চাহিদা না থাকলে তা বাজারেই ফেলে আসতে হতো। এসব সবজির মধ্যে ছিল টমেটো, খিরা, মুলা ইত্যাদি। সবজির ওজন বেশি হওয়ায় বিক্রি না হলে বাজারে ফেলে আসা ছাড়া উপায় ছিল না।
বর্ষা মৌসুমে গ্রামের মাঠঘাট ছিল ধান ও পাটের সমারোহ। সেসময় পাটের চাহিদাও উৎপাদন ছিল ব্যাপক। অনুক‚ল পরিবেশ, বিশেষ করে স্বচ্ছ ও অথৈই পানি এবং সস্তা শ্রমিকের প্রাচুর্যের কারণে পাট উৎপাদন, কর্তন, জাগ দেওয়া, পাটখড়ি থেকে পাটকে পৃথককরণ, পাট ধোয়া এবং বাঁশের উপর পাট শুকানো ছিল গ্রামীণ বর্ষার অন্যতম চিত্র। সে সময়ে ধান ও পাট পৃথক জমিতে উৎপাদন করা হলেও কোন কোন কৃষক আউশ ধানের সাথে পাট একত্রে ফলাতেন। তৎকালীন সময়ে রাসায়নিক সারের প্রচলন ছিল না; তাই পাটের গোড়া জমিতে মিশে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পেত।
খরিপ মৌসুমে আউশ ও আমন ধান ছিল কৃষকের প্রধান ফসল। প্রচলিত এসব ধানের কাÐ বর্ষার পানি বাড়ার সাথে সাথে বৃদ্ধি পেত। তবে হঠাৎ অতিরিক্ত পানি বৃদ্ধি পেলে অনেক সময় ধান গাছ পানিতে তলিয়ে যেতে দেখা যেত। যার কারণে ধানের উৎপাদন কম হতো। অগ্রহায়ণ মাস ছিল ধান কাটার মৌসুম। ধান কাটার সময় ধানের খড় ও নাড়ার নিচে যে ধান ঝরে যেত তা গ্রামের হত দরিদ্র মানুষ ঝাড়ু দিয়ে সে ধান সংগ্রহ করত। এ ছাড়া ধানী জমিতে প্রচুর ইঁদুরের গর্ত থাকত। ইঁদুর সাধারণত ধান কেটে গর্তে নিয়ে রাখত। গ্রামের গরিব মানুষ বিশেষ করে শিশু ও মহিলারা গর্ত থেকে সেই ধান সংগ্রহ করে বছরের খাদ্য চাহিদার কিছুটা পূরণ করত। সেসময়ে প্রচলিত ধানের জাতসমূহ সুস্বাদু হলেও বিঘাপ্রতি ফলন ছিল খুবই কম। তাই প্রতি বছর নতুন ধান আগমনের পূর্বে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ খাদ্যাভাবের শিকার হতো। সে কারণে চালের স্বল্পতায় পরিবারের চাহিদা অনুযায়ী ভাতের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য চালের সাথে আলু কুঁচি করে একত্রে রান্না করতে দেখা যেত।
শীতকালে গ্রামের পরিবেশ ছিল উৎসব মুখরও কর্মচঞ্চলে ভরপুর। একদিকে নতুন ধানের আগমন অপরদিকে বিভিন্ন শস্যের জন্য জমি তৈরির প্রস্তুতি। নবান্নের বিশেষত্ব এই জন্য যে নতুন ধানের আগমনে কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে পরিবারের সদস্যের জন্য পর্যাপ্ত আহারের ব্যবস্থা সেই সাথে নতুন চালের গুঁড়া দিয়ে হরেক রকম পিঠা ও মিষ্টান্ন তৈরির ধুম। নবান্ন হলে হরেক রকম পিঠাপুলি, মিষ্টান্ন, জালার জাউ (নতুন ধান হতে গাজন প্রক্রিয়ায় তৈরি একরকম খাবার) তৈরি হতো।
প্রচলিত এসব জাতের ধানের উৎপাদনকাল দীর্ঘছিল বিধায় তাহা ছিল অধিক পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ এবং সুস্বাধু ও মিষ্টি। এক বা দুই সিদ্ধ ঢেঁকিছাটা পুষ্টিসমৃদ্ধ লাল চালই ছিল মানুষের প্রাত্যহিক খাবার। ধান কর্তনের পরপর নতুন ফসলের উৎপাদনের জন্য জমি চাষের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। সে সময়ে রাসায়নিক সারের প্রচলন ছিল না বিধায় জৈব ও সবুজ সারই ছিল জমির উৎপাদিকাশক্তি। বর্ষায় দুটি ফসল ধান ও পাটের আধিক্য থাকলেও রবিমৌসুমে কৃষকের চাহিদার প্রয়োজনে বহুমুখী ফসল যেমন- গম, কাউন, মুগ, মসুর, মটরশুঁটি, কালাই, মাসকালাই, তিল, সরিষা, ধনিয়া, গোলআলু, মিষ্টিআলুসহ পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ উৎপন্ন হতো। এছাড়া এসময়ে শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, মুরগি, ডিম ও দুধের পর্যাপ্ত জোগান থাকত বিধায় গ্রামীণ জনপদের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ হতো।
বর্ষা, বন্যা এবং অথৈই নদীমাতৃক বাংলা ছিল মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ এবং অসংখ্য মিঠা পানির মৎস্যের অভয়াশ্রম। মাছের বিস্তৃত বিচরণ ক্ষেত্র, প্রাকৃতিক খাদ্যে ভরপুর বিশাল জলরাশি এবং দীর্ঘ সময় পানির স্থায়িত্বের কারণে প্রাকৃতিকভাবে মৎস্য সম্পদ বেড়ে উঠতো। তাই মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ছিল সর্বত্র। সেসময়ে মাছের প্রাপ্যতা ছিল সর্বত্র এবং মাছ ও ছিল সুস্বাদু। তাই সেøাগান ছিল “মাছে ভাতে বাঙালি”।
স্বাধীনতা-উত্তর গ্রামবাংলার প্রাণিসম্পদের চিত্র সমৃদ্ধতর ছিল না। এর দ্বারা সে সময়কার গ্রামীণ অর্থনীতিকে সহজেই অনুমান করা যায়। অনুন্নত জাত, রোগাক্রান্ত ও দুর্বল-স্বাস্থ্যহীন পশুই ছিল চাষাবাদের একমাত্র অবলম্বন। কারণ একটি দেশের অর্থনীতি তার গবাদিপশুর স্বাস্থ্যের অবস্থা থেকে সম্যক উপলব্ধি করা যায়। এছাড়া শস্য পরিবহণ ও মাড়াইয়েও গরু ও মহিষ ব্যবহার করা হতো। একাজে গরুর ব্যবহার প্রধান হলেও উত্তরবঙ্গে মহিষ চাষাবাদসহ পরিবহণ কাজে অপেক্ষাকৃত বেশি ব্যবহার করা হতো। সেসময়ে গ্রামীণ সমাজে মানুষের জন্য চিকিৎসক পাওয়া ছিল দুষ্কর। তাই পশুর চিকিৎসক পাওয়া কথাছিল অবান্তর। সে সময়টা পশুর চিকিৎসা ব্যবস্থা মোটেও বিজ্ঞান সম্মত ছিল না। তাই বিভিন্ন রোগে তথা মড়কে অনেক গবাদিপশু মারা যেত। পুষ্টিকর পশু খাদ্যের অভাব এবং অনুন্নত স্থানীয় জাতের সাথে প্রজনন ব্যবস্থার কারণে গবাদিপশুর হাল ছিল খুবই দুর্বল।
সে সময়ে রাস্তাঘাট, পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিল না বলে স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন মৌসুমি ফল মূল স্থানীয় বাজার ভিন্ন অন্য কোথাও বিক্রির তেমন সুযোগ ছিল না। মূলত বাড়ির আঙ্গিনায় ও ঘরের আশপাশে উৎপন্ন ফলজ গাছ থেকে প্রাপ্ত ফলই ছিল মৌসুমি ফলের প্রধান উৎস।
প্রাকৃতিক বনায়নের পরিধি ছিল ব্যাপক। সারাদেশই মূলত ছিল ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছে ভরপুর। কারণ কৃষি ভিন্ন অন্যকোনো খাতের বিকাশ তখনও শুরু হয়নি। সামাজিক বনায়ন, কৃষি বনায়ন ছিল মানুষের চিন্তার অতীত। মহাসড়কসমূহ ছিল অপ্রসস্থ এবং দেশে মহাসড়ক ব্যতীত তেমন কোন সড়ক ছিল না বললেই চলে। তাই সে সময়ে সামাজিক বনায়নের ভাবনা ছিল না। তবে মহাসড়কের দু’পাশে বৃটিশ ও পাকিস্তানি আমলে লাগানো বড় বড় গাছ দেখা যেত।
স্বাধীনতা উত্তর গ্রামেই ছিল অধিকাংশ মানুষের বসবাস। নগরায়নের পরিধি ছিল খুবই কম। এ ছাড়া, পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল অনেক। তাই সে সময়ে গ্রামে মানুষ ছিল অনেক কিন্তু থাকার জন্য পর্যাপ্ত ঘর ছিল না। পরিবারের ৫ থেকে ৭ জন সদস্যকে এক একটি চৌকিতে ঘুমাতে হত। ঘরবাড়ির দেয়াল ছিল অধিকাংশই টিন, বাঁশ, মাটি দ্বারা তৈরি এবং চাল ছিল টিন অথবা শন দ্বারা নির্মিত। তবে হতদরিদ্র মানুষ তাদের ঘরবাড়ি চতুর্পাশ পাটখড়ি এবং উপরে শনের ছাউনি দ্বারা তৈরি করত। তবে সবারই মেঝে/ভিটি ছিল মাটির তৈরি। সে সুযোগে সিঁধেল চোরেরা রাতে ঘরের এক পাশের ভিটি কেটে চুরি করত। অভাব অনটনে জর্জরিত গ্রামীণ সমাজে সিঁধেল চুরি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। সে সময়ে চৌকিদার ভিন্ন পুলিশের উপস্থিতি দেখা যেত না। স্থানীয়ভাবে সালিসির মাধ্যমেই চুরিসহ সমাজের প্রায় অধিকাংশ অনাচারের বিচার হতো। তবে অপেক্ষাকৃত বড় চুরি, অনাচার বা ডাকাতির ক্ষেত্রে পুলিশের হস্তক্ষেপ লক্ষ্য করা গেছে। অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থার কারণেই প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ভিন্ন স্থানীয় সালিসির মাধ্যমেই গ্রামীণ সমাজের বিচারকার্য সম্পন্ন হতো। সে সময়ে গ্রামীণ জনপদে ব্রিটিশ আমলে তৈরি জমিদার বাড়ি ভিন্ন কোন দালানকোঠা চোখে পড়ত না। প্রায় সকল অবস্থাসম্পন্ন কৃষকদের চৌচালা এক বা একাধিক টিনের ঘর বা বসতবাড়ি ছিল। অনেকের বাড়ির প্রবেশ পথে পথিক ও দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়স্বজনের রাত্রি বাসের জন্য পৃথক ঘর ছিল। যা কাচারি ঘর নামেই পরিচিত। নিম্ন অবস্থা সম্পন্ন কৃষকদের ঘর সাধারণত একচালা টিন বা শনদ্বারা নির্মিত ছিল। রান্নাঘর বসতঘর হতে একটু দূরে পৃথকভাবে নির্মিত হতো এবং এগুলো সাধারণত শন বা পাটখড়ি দ্বারা তৈরি করা হতো। বাড়ির পুকুরই ছিল মানুষের গোসল, কাপড় ধোয়া এবং তৈজসপত্র পরিষ্কারসহ খাবার পানির উৎস। সাধারণত পুকুরের পানি সিদ্ধ করেই মানুষ পান করত। এ ছাড়া, গরু রাখার জন্য পৃথক গোয়ালঘর ছিল। অনেকে চোরের উপদ্রবের কারণে বসতঘরের প্রাচীর/দেয়াল ঘেসে এ গোয়ালঘর নির্মাণ করতেন। সে সময়ে কাঠামোগত কোন সৌচাগার ব্যবস্থা না থাকায় উন্মুক্ত ব্যবস্থাপনায় তা সম্পন্ন হতো। মানুষ বাড়ি হতে একটু দূরে ঝোপঝাড়ে অথবা খেতে প্রাকৃতিক কার্য সম্পন্ন করত। তবে বর্ষাকালে পয়ঃকার্য সম্পাদনের জন্য পানির উপর বাঁশের তৈরি ছোট্ট সাঁকোসদৃশ কাঠামো তৈরি করা হতো। অনেক কৃষক তাদের ছাগল ঘরের ভেতর রাতে রাখতেন। তবে মুরগি ও হাঁস প্রতিটি ধনী বা গরিব সবাই পালন করতেন। মহিলারা সাধারণত হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি করে নগদ টাকার প্রয়োজন মেটাতেন। প্রতিটি গ্রামে সাধারণত একটি মসজিদ ছিল। পৃথক ঈদগাহ ময়দান তেমন ছিল না।
সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেমন- বিদ্যালয়, উপাসনালয়সহ বাজারের দোকানপাটসমূহ ছিল অনুন্নত ও জরাজীর্ণ। প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মসজিদসমূহের চুতর্পাশ ছিল বাঁশের তৈরি বেড়া এবং চালা ছিল টিনদ্বারা নির্মিত। খুঁটিসমূহ ছিল বাঁশ ও গাছের তৈরি। বিদ্যালয়ে বসার জন্য বেঞ্চ থাকলেও বই খাতা রাখা ও লেখার জন্য কোন উঁচু বেঞ্চ ছিল না। প্লেঅথবা নার্সারি নামে কোন ক্লাস না থাকলেও প্রাথমিকভাবে অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন হওয়ার জন্য ছোট ওয়ান নামক ক্লাসের ব্যবস্থা ছিল। সে সময়ে ছোট ওয়ান থেকে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত প্রায় সকল ছাত্রছাত্রীর স্কুল ছুটির পূর্বে একত্রে উচ্চস্বরে নামতা এবং বাংলা ও ইংরেজি বর্ণমালাসমূহ শিখত। এ ছাড়া ছোট ওয়ানের শিশুরা কাঠের তৈরি/পাথরের তৈরি সিলেট ও চক পেন্সিল দ্বারা বর্ণমালা ও সংখ্যা লেখার চর্চা করত। অনেকে মাটিতে দাগ কেটে বর্ণমালা লেখার চর্চা করত। সে সময়ে বিদ্যালয়ের সংখ্যা কম থাকায় দূর-দূরান্ত হতে ছাত্রছাত্রীরা হেঁটে আসতে হতো বিধায় ক্লাস শুরু হতো একটু দেরিতে। তাই বিদ্যালয়সমূহে ক্লাস শুরু হতো সকাল ১০-১১ ঘটিকার মধ্যে। বিশেষ করে শিশুরা ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে হালকা নাশতা হিসেবে মুড়ি, গুড় খেয়ে মক্তবে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য যেত। মক্তবে পড়াশোনা শেষ করে বাড়ি ফিরে সকালের খাবার খেয়ে বিদ্যালয়ে গমন করত।
নদীমাতৃক বাংলার যোগাযোগ ও পরিবহণের জন্য সে সময়ে প্রধান মাধ্যম ছিল জলপথ। সাধারণত বর্ষায় নদীপথে বড় বড় পালতোলা ডিঙ্গি নৌকায় পণ্য পরিবাহিত হতো। তবে খালের ভেতর দিয়ে পণ্য পরিবাহী ডিঙ্গি নৌকাসমূহকে শক্ত ও মোটা রশি দ্বারা বেঁধে এক বা একাধিক ব্যক্তি কর্তৃক খালের পাড়সমূহ অবলম্বন করে টেনে অগ্রসর হতে দেখা যেত। এসব নৌকা গুনটানা নৌকা বলা হতো। এটি যে কি কঠিন ও দুঃসাধ্য কাজ ছিল তা না দেখলে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। নৌকাতেই মাঝি মাল্লাদের রান্না বান্নার কাজ হতো। নৌকার পেছনে দিকনির্দেশক একটি বড় বৈঠা বা হাল থাকে। এ ছাড়া এক বা একাধিক ব্যক্তি লম্বা সরু বাঁশ অথবা বৈঠা চালিয়ে নৌকাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিত। খালের উপরে কংক্রিটের স্থায়ী সেতু ছিল না বললেই চলে। মূলত ছিল বাঁশের তৈরি নিচু সাঁকো। নৌকা চলাচলের সময় সাঁকোর বাঁশ উঁচু করে তার নিচদিয়ে নৌকা চলাচল করত। পণ্য পরিবহণ ছাড়াও দূরের আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার জন্য বর্ষাই ছিল উপযুক্ত সময়। কাঠের তৈরি এবং নৌকার মাঝে বাঁশের ছাউনি দ্বারা নির্মিত ছোট কোশা ও কেরায়া নৌকায় পরিবারের সদস্যরা সকলে মিলে মৌসুমি ফল আম, কাঁঠাল এবং মিষ্টি ও পিঠা জাতীয় খাবার তৈরি করে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন। মহিলা, শিশু এবং বয়স্কদের জন্য বর্ষাই ছিল আরামদায়ক ভ্রমণকাল। বর্ষার পানি নেমে গেলে মাঠঘাট কাদায় পরিপূর্ণ হয়ে থাকত। এ সময়টি পণ্য পরিবহণ ও চলাচল জন্য ছিল খুবই কষ্টকর। তবে শীতের প্রারম্ভে মাটি শুকিয়ে গেলে গ্রামীণ জনপদের চলাচল স্বাভাবিক হয়ে আসত। তাই এ সময়টি যেমন ছিল কর্মচঞ্চল তেমনি ছিল বিনোদন ও খেলাধুলায় ভরপুর। এছাড়া দিনে গ্রামীণ মেলা ও রাতে যাত্রা/ড্রামা উদযাপন করা হতো। এসব যাত্রায় আশপাশের ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার দূরের গ্রামের লোকজন অংশগ্রহণ করত। আলোর জন্য হ্যাজাক লাইট ব্যবহার করত। হ্যাজাক লাইটের চতুর্পাশে কাঁচ এবং ভেতরে অধিক আলোর জন্য নেটদ্বারা নির্মিত মেন্টেল ব্যবহার করা হতো। এ সকল লাইটের জ্বালানি ছিল কেরোসিন; যা পাম্পের মাধ্যমে মেন্টেলে কেরোসিন প্রেরণ করা হতো এবং সেখান থেকে উজ্জ্বল আলো বিচ্ছুরিত হতো। এ ছাড়া অঞ্চলভেদে পালাগানের আসর বসত। ধর্মীয় ও গ্রামীণ রক্ষণশীলতার কারণে পৌরাণিক ও অতীত কাহিনী নির্ভর এসব যাত্রা/ড্রামায় ছেলেরাই মেয়েদের অভিনয় করত। গ্রামীণ জনগণের কণ্ঠেছিল আব্দুল আলিমের মরমী ও আধ্যাত্মিক গান, আব্বাস উদ্দীনের পল্লীগীতি এবং কবি নজরুলের গজল। এ ছাড়া জারি, সারি, মুর্শিদি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি এবং বাউল সঙ্গীত ছিল লোকের মুখে মুখে। শীতকাল ছিল খেলাধুলার জন্য উৎকৃষ্ট সময়। বড়রা ফুটবল ও ভলিবল, ছোটরা দাড়িয়া বান্দা, গোল্লাছুট, সাতচারা, মোরগ লড়াই এবং মেয়ে দেয় মাঝে দড়ি লাফ, কুতকুত, বৌচি, লুডু, ষোল গুঁটি প্রভৃতি খেলা জনপ্রিয় ছিল। সাধারণত ধানের জমির খড় ও নাড়াপুড়িয়ে/সরিয়ে ফেলে ফুটবল ও ভলিবল খেলার মাঠ তৈরি করা হতো। ভলিবল খেলা নিজেদের মধ্যে হলেও ফুল বল খেলা হতো আন্তঃ গ্রামের মধ্যে। শীতের শেষে বসন্তে ঘুড়ি ওড়ানো ছিল গ্রামীণ জনপদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।
গ্রামীণ উৎসবের মধ্যে ইদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা এই দুই ঈদ, বিয়ে ও খৎনাজনিত উৎসবই ছিল প্রধান। দুই ঈদে গ্রামের সকলে এবং শহরে চাকরি ও ব্যবসায়ে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ একত্র হওয়ার সুযোগ পেত। দীর্ঘদিন পরে অনেকের সাথে সাক্ষাতের কারণে পারস্পরিক কুশল বিনিময়, কোলাকুলি এবং আপ্যায়নের মাধ্যমে গ্রামীণ জনপদে আন্তরিকতা ও আনন্দ ঘনচিত্র ফুটে উঠত। আর্থিক দৈন্যতা এবং বস্ত্রশিল্পের অনগ্রসরতার কারণে অধিকাংশ মানুষই ঈদের নতুন কাপড় পরিধান করতে পারত না। তৈরি পোশাকের প্রাপ্যতা কম থাকায় দর্জি ছিল পোশাক তৈরির প্রধান মাধ্যম। বিয়ের অনুষ্ঠানে বর পক্ষকে আপ্যায়নের শুরুতে মিষ্টি পানীয় (শরবত) এবং হাতে তৈরি পিঠা-পুলি ও মিষ্টি দ্বারা আপ্যায়ন করা হতো। অতঃপর প্রধান খাবার হিসেবে পোলাও, ভাত, মুরগির মাংস, খাশি/গরুর মাংস, মাসকালাইয়ের ডাল এবং সব শেষে চাল, গুড় ও দুধ দ্বারা নির্মিত মিষ্টান্ন (সিন্নি) পরিবেশন করা হতো। মোড়কীকরণ ব্যবস্থা উন্নত ছিল না বিধায় বর ও কনে পক্ষ সাধারণত মাটির হাঁড়িতে করে একে অপরের বাড়িতে হাতে তৈরি পিঠা ও নিয়ে যেত দোকান থেকে মিষ্টান্ন (রসগোল্লা, জিলাপি) তবে শীতকাল গ্রামের মানুষের জন্য কষ্টেরও কারণ ছিল। গ্রামের বসতবাড়ি ছিল খোলামেলা এবং শীতল বাতাস প্রবেশে বাধা দেওয়ার তেমন কার্যকর কোন ব্যবস্থা ছিল না। তাই রাতে ঠাÐায় শীতে মানুষ কষ্ট পেত এবং রোদ পোহানোর জন্য সুর্য উঠার অপেক্ষায় থাকত। এছাড়া, চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো না থাকার কারণে সর্দি, কাশিসহ শীতজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগত। মূলত দুর্বল অর্থনৈতিকভিত্তি ও অবকাঠামোর কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ নির্ভর ছিল গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রা, বিনোদন ও সার্বিক সমাজব্যবস্থা।
কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার নদী বিধৌত নিচু এলাকা যেখানে বর্ষায় ৫ থেকে ৬ মাস পানি থাকে, সে এলাকার গ্রামীণ অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা এখানে বর্ণিত হয়েছে। য়
কৃষি অর্থনীতিবিদ ও পলিসি স্পেশালিস্ট, উপসচিব, বিএফএসএ, খাদ্য মন্ত্রণালয়, মোবাইল : ০১৫৫২৩৫৫৮৫৩, ই-মেইল : Kawserul1173@gmail.com
ড. মো: মুজাহিদ-ই-রহমান১ ড. মোঃ এছরাইল হোসেন২
আদিকাল হতে বর্তমান সময়ের পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে খাদ্যাভাসের পরিবর্তনের প্রচেষ্টা যেন নিরন্তর। প্রায় দশ হাজার বছর আগে মেক্সিকোতে ভুট্টার চাষাবাদ শুরু হয় এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানুষের প্রধান খাদ্য হিসেবে ভুট্টা ব্যবহৃত হতে থাকে। বাংলাদেশে দানাশস্যের মধ্যে ধান ও গমের পরেই রয়েছে ভুট্টার অবস্থান। ভুট্টার পুষ্টিমান ধান ও গমের চেয়েও অধিক। ভুট্টার চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে ভুট্টা চাষের জমির পরিমাণ ও উৎপাদন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে ভুট্টার মোট আবাদি জমি ও উৎপাদনের পরিমাণ যথাক্রমে ১.৭৪ লক্ষ হেক্টর এবং ১১.৩৭ লক্ষ মেট্রিক টন ছিল যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে যথাক্রমে ৫.৫৪৪ লক্ষ হেক্টর এবং ৫৪.০২৫ লক্ষ মেট্রিক টন এ দাঁড়িয়েছে। প্রাণি খাদ্যে শতকরা ৮৫ ভাগ এবং মাছের খাদ্যে কমপক্ষে শতকরা ১০ ভাগ ভুট্টা ব্যবহৃত হয়। ভুট্টায় পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকায় দেশে পশু-পাখি ও মাছের খাদ্য হিসেবেও ভুট্টার গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় ভুট্টা সংযোজন করা গেলে তা নিঃসন্দেহে আমাদের খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তায় বিশেষ অবদান রাখতে পারে।
ভুট্টার পুষ্টিমান
ভুট্টার দানাই প্রধানত খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ভুট্টায় বিভিন্ন খাদ্য উপাদানের প্রায় সবকিছুই রয়েছে। ভুট্টার পুষ্টিমান সারণি-১ দ্রষ্টব্য। ভুট্টায় রয়েছে বিভিন্ন উদ্ভিদ রাসায়নিক যৌগ যা মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভুট্টা থেকে তৈরি একশত এরও বেশি খাদ্য রয়েছে যার মধ্যে প্রায় ৮২টি প্রধান খাদ্য, ১৫ ধরনের পানীয় এবং ১২ টিরও বেশি নাশতা জাতীয় খাবার হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরির উপাদান হিসেবেও এর কোন জুড়ি নেই।
স্বাস্থ্য রক্ষায় ভুট্টার উপকারিতা
১। ভিটামিন এ এর ভালো উৎস হওয়ায় ভুট্টা দৃষ্টিশক্তির উন্নতিতে সাহায্য করে। লুটিন ও জিজান্থিন আমাদের চোখকে বার্ধক্যজনিত চোখের ক্ষয় রোগ থেকে রক্ষা করে। তাই প্রতিদিন ৫-৬ গ্রাম ভুট্টা খেলে চোখে ছানি পড়াও প্রতিরোধ করতে পারে। ভুট্টায় উপস্থিত ভিটামিন বি কমপ্লেক্স সুন্দর ত্বক, চুল এবং হজমের জন্য অপরিহার্য যা বাত রোগের নিরাময়েও ব্যবহৃত হয়। ভিটামিন এ, সি, ও কে একত্রে বিটা ক্যারোটিন ও সেলেনিয়ামের সাথে থাইরোয়েড গ্রন্থির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে ও রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
২। ফাইটোস্টেরল, বায়োফ্লাভোনয়েডস ও লিনোলেনিক এসিডে সমৃদ্ধ থাকায় রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি করে এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে হৃৎপিÐকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। ভুট্টার এন্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ফ্রি রেডিকেল এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
৩। ভুট্টায় উপস্থিত ল্যাক্টিন এ রয়েছে এইচআইভি ভাইরাসের প্রতিষেধক। ভুট্টায় উপস্থিত ক্যারটিন কোলন ক্যান্সার, লিউকোমিয়া ও গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার কোষ সৃষ্টিতে বাধা দেয়। ভুট্টায় উপস্থিত অ্যান্থোসায়ানিনে এন্টি-কার্সিনোজেনিক, এন্টি-ডায়াবেটিক ও এন্টি-মাইক্রোবিয়েল জাতীয় বিশেষ গুণাগুণ বিদ্যমান রয়েছে।
৪। ফলিক এসিডের চমৎকার উৎস বেবিকর্ন যা শিশুর ওজন বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে। তাই গর্ভবতী মহিলাদের খাদ্যতালিকায় বেবিকর্ন যুক্ত খাদ্য থাকা বেশ জরুরি। এতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে যা রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ করে।
৫। কচি হলুদ ভুট্টার শাঁসে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন ও কপার থাকে এবং বিশেষ করে ফসফরাস থাকে যা মজবুত হাড়ের জন্য অপরিহার্য।
৬। ভুট্টাজাতীয় খাবার মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ ও সঠিক কার্যক্রমের সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে।
৭। উচ্চমাত্রার ফাইবার থাকে বলে ভুট্টা খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। সে কারণে কোলন ক্যান্সারের রোগীদের ভুট্টা খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে ভুট্টার ব্যবহার
ভুট্টার বহুমুখী ব্যবহার থাকলেও দেশে প্রধানত পোলট্রি ও মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মুরগি ও মাছের খাদ্য তৈরিতে শতকরা ২৮ ভাগ হতে ৮০ ভাগ পর্যন্ত ভুট্টা ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে পোলট্রি ফিড হিসেবে ভুট্টার চাহিদা ব্যপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গোখাদ্য হিসেবে ভুট্টার প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বিভিন্ন উপায়ে ভুট্টা গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভুট্টার সাইলেজ গবাদি পশুর অন্যতম খাদ্য। যদিও দেশে স্টার্চ উৎপাদনে অনেক আগে থেকেই ভুট্টার কিছু ব্যবহার রয়েছে। তবে মানুষের খাবার হিসেবে ভুট্টার ব্যবহার এখনও সীমিত আকারেই রয়েছে। ভুট্টার খই, সিদ্ধ ভুট্টা, পোড়ানো ভুট্টা, চাপাতি, সবজি (বেবিকর্ন), সুপ, আটা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভুট্টার ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই গমের আটার সাথে ভুট্টার আটা মিশ্রিত করে বিভিন্ন খাদ্য তৈরির কথা শোনা যায়। বাংলাদেশে মানুষের খাবার হিসেবে ভুট্টার ব্যবহার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশে মানুষের খাদ্য হিসেবে ভুট্টা গবেষণার অগ্রগতি
দেশে মানুষের খাদ্য হিসেবে ভুট্টাকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে ১৯৮৬, ২০০২, ও ২০১৩ সালে যথাক্রমে পপকর্ন (খই ভুট্টা), বারি মিষ্টি ভুট্টা-১ ও বারি বেবিকর্ন-১ অবমুক্ত করা হয়। এসবের মধ্যে খই ভুট্টা দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট ডাবিøউএমআরআই হাইব্রিড বেবিকর্ন- ১ (২০২০ সালে) অবমুক্ত করে। ভোজ্যতেল হিসেবে ভুট্টা তেলের পুষ্টিগুণ উপলব্ধি করে সয়াবিনসহ অন্যান্য তেলের উপর চাপ কমাতে অত্র প্রতিষ্ঠান ভুট্টা থেকে তেল উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে পরীক্ষামূলক গবেষণায় সাফল্য লাভ করে ও ভবিষ্যতে যাতে দেশে ব্যাপক হারে ভুট্টা তেল ব্যবহার হয় তার সুযোগ তৈরি হয়েছে। দেশেই বাণিজ্যিকভাবে ভুট্টা দিয়ে কর্নফ্লেক্স ও কর্ন অয়েল তৈরিতে উদ্যেক্তাদের সংশ্লিষ্ট করতে জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
বর্তমান কোভিড-১৯ জনিত মহামারির এ সংকটকালে সুস্থ ও সবল জাতি গঠনের বিকল্প নেই। বিশেষ করে খাদ্য পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা বিশেষ প্রয়োজন। এই প্রেক্ষিতে আমাদের চাল নির্ভর খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে খাদ্য তালিকায় অধিকতর পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার সংযোজন করা দরকার। ভুট্টা একটি স্বাস্থ্যকর খাবার যার শিল্প উপযোগিতাও রয়েছে। বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান এবং জৈব রাসায়নিক উপাদান ভুট্টার পুষ্টিমান আরও বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু ভুট্টা চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় ভুট্টার চাষও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, এদেশেও ভুট্টার বহুমুখী ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে। অধিক ও মানসম্পন্ন আমিষ, স্বাস্থ্যকর তেল এবং ভিটামিন ও মিনারেলসমৃদ্ধ হওয়ায় মানুষের খাদ্য হিসেবে সর্বস্তরে ভুট্টার ব্যবহার এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।য়
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ২মহাপরিচালক, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, নশিপুর, দিনাজপুর, মোবাইল : ০১৭১৭৪৩৪৯০৬৬, ই-মেইল :mmer_bari@yhoo.com
কৃষিবিদ মো. মুকসুদ আলম খান (মুকুট)
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়, শৈশবে বাবা-মার আদরের খোকা এই বাঙ্গালির রাজনীতি করতে করতেই একদিন হয়ে ওঠে শেখ মজিব, শেখ সাহেব এবং মজিব ভাই। সময়ের পরিক্রমায় ১৯৬৯ এ হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। এই জাতির রাষ্ট্রীয় পরিচয় প্রাপ্তির জটিল ও কঠিন পরিক্রমায় অনুঘটক ছিলেন বঙ্গবন্ধু, তাই তিনি আমাদের জাতির পিতা। শৈশব থেকে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন, স্কুল জীবন থেকে অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পথ আগলিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে ছাত্র হলের ছাদের পানি পড়ার দীর্ঘদিনের সমস্যার তাৎক্ষণিকভাবে অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার দাবি আদায়ে কি সাহসিকতারই পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৩৮ সালে ১৮ বছর বয়সে কারাবন্দী জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেছেন ‘আমায় যেদিন প্রথম জেল হয় সেদিন থেকেই আমার নাবালকত্ব ঘুচেছে বোধ হয়’। দারিদ্র্য মানুষের প্রতি বা মানুষের প্রতি সম্মান বোধই জনতালগ্ন নেতার বড় গুণ। আর এই গুণই তাকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালিতে পরিণত করেছে। একবার গোপালগঞ্জ এলাকায় বেশ খরা হয়েছিল। তিনি স্কুল ফেরার পথে কজন হতভাগ্য কৃষককে নিয়ে বাড়ি ফেরেন এবং প্রত্যেককে দিয়ে দেন কিছু ধান ও চাল, কাউকে কিছু না বলেই। বাবা বাড়ি এসে খোকাকে গালমন্দ করলেন। কিন্তু খোকার বেশ দৃঢ় উত্তর ছিল ‘আমাদের তো ধান ও চাল ভালোই আছে, তা থেকে ওদের সামান্য দিলাম, কারণ ওদেরও পেট আছে, ওদেরও খিধে আছে’। এভাবে জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে তিনি সাধারণ মানুষের সাথে সম্পৃক্ত থেকে সাধারণ মানুষের কাছের মানুষ হয়েছেন।
১৯৪৭ এর পাকিস্তানের স্বাধীনতার স্বাদ বিস্বাদে পরিণত হয় ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ শাসকের কারণে। তারা পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিভেদ ও বৈষম্য গড়ে তোলে, পূর্ব বাংলার মানুষকে তারা শোষণ করে। দুই বছর যেতে না যেতেই মুসলিম লীগের প্রগতিশীল একটি অংশ আওয়ামী (মুসলিম) লীগ নামে ২৩ জুন ১৯৪৯ সালে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তার নেতৃত্ব দেন সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম, শেখ মুজিব ও শামসুল হক প্রমুখ। তার পূর্বে শেখ মুজিব ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ নামে একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
শেখ মুজিব সব সময় মানুষের কল্যাণের রাজনীতি করতেন। ১৯৫৪ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। যুক্তফ্রন্ট ৩০৯টি আসনের মধ্যে পায় ২২৩টি আসন, আওয়ামী লীগ এককভাবে ১৪৩টি আসন পেয়ে সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে। যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করলেও বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি, ওরা এ সরকারকে অচিরেই বরখাস্ত করে ভুয়া কারণ দেখিয়ে এখানেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়। একবার নির্বাচনী প্রচারণায় এক বৃদ্ধা মহিলা তার বাসায় ডেকে নিয়ে গরুর দুধ খাইয়ে বঙ্গবন্ধুকে কিছু টাকা উপহার দিয়ে ছিলেন, তখন তার উপলব্ধি হয়ে ছিল গরিব দুঃখী সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করা যাবে না দেশের জন্য মানুষের জন্য কিছু করতেই হবে। রাজনৈতিক সকল সঠিক সিদ্ধান্ত তিনি গ্রহণ করতেন। কারণ তিনি সাধারণ মানুষের মনের কথা জানতেন, বুঝতেন এবং পড়তে পারতেন। তিনি জীবনে কোন ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন নাই। তাই তো তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তাধারা বুঝতে হলে একটি বিষয়ে ভালোভাবে মনে রাখতে হবে। সেটি হলো তিনি তার জীবনের বেশির ভাগ সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থেকে বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বহুদিন সংগ্রাম করেছেন। দেশ স্বাধীনের পর মাত্র সাড়ে তিন বছর তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন। স্বাধীনতার ৫০ বছরের তুলনায় এটি খুবই নগণ্য। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ১২ বছর ৮ মাস অর্থাৎ ৪৬৮২ দিন কারাগারে থেকেছেন। একজন সাধারণ বন্দী হিসেবে রাজনৈতিক জীবন শুরু হলেও বঙ্গবন্ধু খুব অল্প সময়ের মধ্যে সাংগঠনিক ক্ষমতা ও অতুলনীয় ভাষণ দিয়ে কোটি কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন। ভারতীয় ক‚টনৈতিক শশাংক এস ব্যানার্জির ভাষায় ‘শেখ মুজিবুর রহমান একজন দুধর্ষ সাহসী রাজনীতিবিদই ছিলেন না; বরং বিচক্ষণ নেতাও ছিলেন। অনন্য অসাধারণ সংগঠক ছিলেন’। শেখ মুজিবকে দেখেছি ‘তিনি আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পেতেন না এবং তিনি তার বিশ্বাস ও লক্ষ্য অর্জনে অসীম সাহসী, বেপরোয়া ও অবিচল ছিলেন’। বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি, একজন বাঙ্গালি হিসেবে যা কিছু বাঙ্গালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়, নিরন্তর সম্প্রীতির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে’। তিনি তার দলকে শক্তিশালী করেছেন জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং ইয়াহিয়া খানের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে একচ্ছত্র বিজয় অর্জন করে বিশ্ববাসীর সামনে বাঙ্গালির একমাত্র নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭১ মাত্র সাত বছরের একটু বেশি সময় নিয়ে স্বাধীনতার মূল আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন এবং জনগণের সামনে এই অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি জনগণের জন্য দেশের জন্য জীবন দিতে পারেন এই বিশ্বস্ততা অর্জন করেছেন। শেখ মুজিব ৬৬ সালে ৬ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি তাঁর দল ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। ৬ দফা আসলে পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার কর্মসূচি। এ দাবিকে বন্ধ করতে না পেরে আগরতলা মামলায় ফাঁসি দিতে চেয়েছিলেন। মুজিব তখন বাঙ্গালি জাতির বিশ্বস্ত নেতা হয়ে উঠেছেন তারই ধারাবাহিকতায় ছাত্র জনতার গণ-আন্দোলনে আইয়ুবের পতন হয়। শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। আর সেই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভ‚ষিত হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালির নয়নের মনিতে পরিণত হন। ষাটের দশকে বাঙ্গালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কারাগারে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও অবিচল থেকেছেন তিনি, সংগ্রামী এই জীবন শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতার মর্যাদায় অসীন করেছে।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ সবকিছু ধ্বংস করা হয়েছে। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে তিনি দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দেন। মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ শাসন করেছেন, চমকপ্রদ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন যুগান্তকারী বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে শোষণ মুক্ত সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। তিনি গণমানুষের কল্যাণে রাজনীতি করতেন, ১৯৭২ সালে শাসনতন্ত্র তথা সংবিধান প্রণয়ন ছিল খুব স্বল্প সময়ের উপহার, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নে ‘দারিদ্র্যবিমোচন ও সামাজিক নিরাপত্তা’ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছেন। ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্তকরণ ব্যাংক চালু করে বৈচিত্র্যময় সোনালী, জনতা, কৃষি, অগ্রণী, রূপালী ও পূবালী নামকরণ করে ছিলেন। খাদ্য সংকট নিরসনে টিসিবির মাধ্যমে রেশনিং সিস্টেম চালু করেন। পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাষ্ট্রায়াত্ত¡/ জাতীয়করণ (ব্যাংক, বীমা, শিল্প, কল-কারখানা, স্কুল-কলেজ ইত্যাদি) করেছিলেন। বিসিক শিল্পনগরী চালুসহ বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠান চালু করেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে পরীক্ষামূলক ১২টি পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র চালু করেন। সংস্কৃতি, খেলাধুলাসহ সকল ক্ষেত্রে গোড়াপত্তন করে ছিলেন, শিল্পকলা একাডেমি চালু, চলচিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (এফডিসি) পুনর্গঠন করেন। ইসলামী ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠাসহ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন করেন। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে ৬৪টি জেলা/সাব বিভাগে জেলা গভর্নর নিয়োগ করেন। স্বল্প সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী ভারতে পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাষ্ট্রের স্থল সীমানা ও সমুদ্র সীমানা নির্ধারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ভ‚উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করেন, যা আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে অগ্রণী ভ‚মিকা রাখছে। তাঁর পররাষ্ট্রনীতি ছিল কারো সাথে শত্রæতা নয় সবার সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক বজায় রাখা, এই নীতি আজও বজায় রয়েছে। তিনি চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, রাশিয়া তথা বিশ্ব রাজনীতি ভালো করে জানতেন এবং বুঝতেন, অতি অল্প সময়ে প্রায় ২০টি উন্নত রাষ্ট্র সফর করে রাষ্ট্র প্রধানদের সাথে বৈঠক করেছেন এবং জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন, ওআইসি সম্মেলন, কমন ওয়েল্থ সম্মেলন, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশের সদস্য পদ অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন, তিনিই প্রথম জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ প্রদান করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ছিলেন। বিশ্বশান্তিতে অনন্য ভ‚মিকার জন্য তিনি জুলি ও কুরি শান্তি পুরস্কারে ভ‚ষিত হয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন কৃষির উন্নতি ছাড়া এ দেশের মানুষের মুক্তি আসতে পারে না। এ লক্ষ্যে কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন। কৃষিভিত্তিক নতুন প্রতিষ্ঠান গড়া ও পুরাতন প্রতিষ্ঠানসমূহকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তুলা উন্নয়ন বোর্ড ও সিড সার্টিফিকেশন এজেন্সি গঠন করেন, পুনর্গঠন করেন হর্টিকালচার বোর্ড এবং রাবার উন্নয়নের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। সোনালী আঁশের সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করতে গঠন করেন পাট মন্ত্রণালয়, পাট গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে পুনর্গঠন করেন। কৃষি উপকরণ তথা বীজ, সার ও সেচ সহজলভ্য করার লক্ষ্যে বিএডিসিকে পুণর্গঠন করেন এবং সারাদেশে বীজ বিক্রয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। কৃষকের অর্থের যোগানদানের জন্য কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। কৃষি গবেষণা কাজের সমন্বয়ের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, পুনর্গঠন করেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং পারমাণবিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
অধিকতর মেধাবী শিক্ষার্থীদের কৃষি শিক্ষায় আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রæয়ারি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের মতো কৃষিবিদদের চাকরি ক্ষেত্রে ১ম শ্রেণীর পদমর্যাদা ঘোষণা করেন, জাতির পিতার এই ঘোষণাকে স্মরণীয় করে রাখতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ প্রতি বছর ১৩ ফেব্রæয়ারি ‘কৃষিবিদ দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। কৃষিকে গুরুত্ব দিয়ে ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলে ছিলেন ‘আমার দেশের এক একর জমিতে যে ফসল হয় জাপানের এক একর জমিতে তার তিনগুণ ফসল হয়, কিন্তু আমার জমি দুনিয়ার সেরা জমি। আমি কেন সেই জমিতে দ্বিগুণ ফসল ফলাতে পারব না, তিনগুণ করতে পারব না? আমি যদি দ্বিগুণও করতে পারি তাহলে আমাকে খাদ্য কিনতে হবে না। আমি চাই বাংলাদেশের প্রত্যেক কৃষক ভাইয়ের কাছে, যারা সত্যিকারের কাজ করে, যারা প্যান্টপরা কাপড়পরা ভদ্রলোক তাদের কাছেও চাই জমিতে যেতে হবে, ডাবল ফসল করুন, প্রতিজ্ঞা করুন, আজ থেকে ওই শহীদদের কথা স্মরণ করে ডাবল ফসল করতে হবে। যদি ডাবল ফসল করতে পারি আমাদের অভাব ইনশাআল্লাহ হবে না”। জাতির পিতা চেয়েছিলেন সমবায়ভিত্তিক আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতিতে কৃষিতে ২য় বিপ্লবের কর্মসূচি প্রবর্তন করা। ১৯৭৪ সাল দেশে যে কৃত্রিম খাদ্য সংকট তৈরি করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু তাঁর দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতায় সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন, ফলোশ্রæতিতে ১৯৭৫ সালে দেশে খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার দারপ্রান্তে পৌঁছেছিল, যা ডিসেম্বর ১৯৭৫ ঘোষণা দেওয়ার কথা ছিল। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সেই সময় এতটা সন্তোষজনক ছিল বিধায় ১৯৭৪-৭৫ সালে জিডিপি ৭ শতাংশের উপরে উঠা সম্ভব হয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংগঠিত হয় ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাÐ, এই হত্যাকাÐে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের ১৭ জন সদস্য নিহত হন। ১৮টি বুলেট ব্যবহার করা হয়েছে, জানা যায় বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য তাঁর দুই পায়ের রগ কাটা হয়েছিল কি রকম নৃশংস ও নারকীয় এই হত্যাকাÐ ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। বিদেশে অবস্থান করায় সৌভাগ্যবশত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান। এই হত্যাকাÐের মাধ্যমে দেশ বিপরীত দিকে চলতে শুরু করে। স্বাধীনতা বিরোধী জামাত/বিএনপি চক্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভ‚লণ্ঠিত করে। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পান। ১৯৯৬-২০০১, ২০০৯-২০১৩, ২০১৪-২০১৮ এবং ২০১৯ থেকে চলতি ৪র্থ মেয়াদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার পদাংক ও নীতি অনুসরণ করেই দেশ পরিচালনা করছেন। দেশ এগিয়ে চলছে অদম্য অগ্রযাত্রায়, তাই যতদিন এ ভ‚খÐ থাকবে এ দেশ থাকবে ততদিনই বঙ্গবন্ধু প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে।
২০২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মদিন এবং ২০২১ সালে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ৫০ বছরসুবর্ণ জয়ন্তী। সরকার এ বছরকে মুজিব শতবর্ষ হিসেবে সগৌরবে পালনের ঘোষণা দিয়েছিল কিন্তু বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের কারণে সামাজিক নিরাপত্তা বিবেচনা করে স্বল্প পরিসরে উদ্যাপন করা সম্ভব হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের চলমান অদম্য অগ্রযাত্রা আমরা অব্যাহত রেখেই জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলব এটাই হবে মুজিব শতবর্ষের অঙ্গীকার “জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু”। য়
উপপরিচালক, বিএডিসি ও যুগ্ম মহাসচিব, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ ও সহ পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদ পরিষদ, মোবাইল : ০১৭৪৭৩৪৭২৪৬
বাংলাদেশে কফি চাষের সম্ভাবনা ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব
কৃষিবিদ কবির হোসেন১ কৃষিবিদ সাবিনা ইয়াসমিন২
পৃথিবীব্যাপী কফি একটি জনপ্রিয় পানীয়। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, সেমিনার, কনফারেন্স চলাকালে টি ব্রেক বা কফি ব্রেক বলে খ্যাত ছোট্ট বিরতির এই রেওয়াজ চালু হয়েছিল আমেরিকায় আঠারো শতকের প্রথম দিকে। চা বাংলাদেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করলেও আমরা এখনো পর্যন্ত কফি চাষে পিছিয়ে রয়েছি। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার বাণিজ্যিক কৃষির জন্য উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশকে খোরপোশ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর করতে কফি ও কাজুবাদামের সম্প্রসারণে জোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কফি একটি অর্থকরী ফসল বিধায় এটি চাষ করে এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন হবে তেমনি এটি বহুমাত্রিক পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ বলে জনগণের পুষ্টি চাহিদা ও পূরণ করবে। এক কাপ বø্যাক কফি (১২৫ মিলিলিটার) কার্যত কোনও ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট বা প্রোটিন থাকে না সুতরাং এর শক্তির পরিমাণ কেবল ১-২ কিলোক্যালরি। কফিতে অনেকগুলো খনিজ এবং ভিটামিন রয়েছে।
বাংলাদেশে কফি চাষের বর্তমান অবস্থা ও বাজার পরিস্থিতি
কফি গ্রহণের ও বিপণনের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে দেশের পার্বত্য অঞ্চলের তিনটি জেলায় এটি উৎপাদিত হলেও এর মধ্যে প্রায় ৯০% উৎপাদিত হয় বান্দরবানে । পাহাড়ি এলাকা বাদে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায় ইতোমধ্যে চাষ শুরু হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী ও রংপুর জেলায় এবং টাঙ্গাইলে কফির চাষ শুরু হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) হর্টিকালচার উইং এর তথ্য মতে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে কফির উৎপাদন এলাকা ছিল প্রায় ১১৮.৩ হেক্টর এবং মোট উৎপাদন প্রায় ৫৫.৭৫ টন। বর্তমানে কৃষকগণ যতটুকু চাষ ও প্রক্রিয়াজাত করছে তার সবটুকুই সনাতন পদ্ধতিতে করছে যার ফলন অনেক কম এবং লাভও কম হয়। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে আমদানিকৃত গ্রিন কফির পরিমাণ হলো ৩২.৫১৭ টন (সূত্র: উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং, ডিএই)। চাহিদার বেশির ভাগ অংশই প্রায় ৯৫% পূরণ হচ্ছে আমদানি করা কফি দিয়ে। তাই আমাদের কফির উৎপাদন বৃদ্ধিতে ও প্রক্রিয়াজাতকরণে এক্ষণই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
কফি চাষ সম্প্রসারণে সম্ভাবনাময় দিকসমূহ
কফি হতে পারে বাংলাদেশের পাহাড়ি মানুষের বিকল্প আয়ের উৎস। কফি চাষের সাথে আন্তঃফসল হিসেবে পেঁপে, আনারস, গোলমরিচ অনায়াসে চাষ করা যায়। কফি হালকা ছায়ায় ভালো হয় এবং অতিরিক্ত সার ও সেচের তেমন প্রয়োজন হয় না যা পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে রৌদ্রোজ্জ্বল স্থানে চাষ করলে সার ও সেচের প্রয়োজন আছে। স্থানীয় চাহিদা অনেক বেশি ও রপ্তানির সুযোগ রয়েছে বলে এটির উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকার বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে কফি এবং কাজুবাদাম চাষ সম্প্রসারণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষয়ক একটি প্রকল্প প্রণয়নের কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও কফির চাষ বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে নর্থ এন্ড কফি রোস্টার্স, ঢাকা। যারা সরাসরি পার্বত্য অঞ্চলের কফি উৎপাদকদের কাছ থেকে কফি ক্রয় করছেন। তাছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) মোনঘর, রাঙ্গামাটি, অরণ্যক ফাউন্ডেশন প্রশিক্ষণ ও কফির চারা বিতরণ করেছেন। কফির চাষ বৃদ্ধিতে উৎপাদক, গবেষক, সম্প্রসারণ অফিসার, মিডিয়া, বেসরকারি সংস্থা ও বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থাকে এগিয়ে আসা উচিত যাতে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ সফল হয়।
বাংলাদেশে চাষ উপযোগী আবহাওয়া ও জলবায়ু এবং জাতসমূহ
বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু কফি চাষের অনুক‚ল তবে ভালো ও উন্নত স্বাদের ও ঘ্রাণের কফি পেতে এর চাষ সম্প্রসারণের জন্য পাহাড়ি এলাকায় বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। কফি চাষের উপযোগী মাটি হলো গভীর, ঝুরঝুরে, জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ ও হিউমাস সমৃদ্ধ, হালকা অ¤øমাটি (পিএইচ ৪.৫-৬.৫)। পৃথিবীতে ৬০ প্রজাতির কফি থাকলেও বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদযোগ্য কফির ২টি জাত রয়েছে যেমন- ঈড়ভভবধ ধৎধনরপধ ধহফ ঈড়ভভবধ পধহবঢ়যড়ৎধ–ৎড়নঁংঃধ। রোবাস্টা জাতের কফি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় খুব উপযোগী। এটি সাধারণত সমুদ্র থেকে ৫০০-১০০০ মিটার উচ্চতায় এবং ১০০০-২০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিতে ভালো ফলে সেজন্য বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকা যেমন -পার্বত্য অঞ্চল ও টাংগাইলের মধুপুর গড়ের আবহাওয়ায় এটির সম্প্রসারণ সম্ভব। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ১২ শতাংশ জমির এলিভেশন প্রায় ১০০০ মিটার। এ ছাড়া পাহাড়ি এলাকাবাদে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায়ও চাষ করা যাবে। রোবাস্টা জাতের কফি গাছে রাস্ট রোগ কম হয়। এরাবিকা জাত আমাদের দেশে চাষ উপযোগী তবে ফলন কম হয়।
কফি চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি সম্প্রসারণে সরকারের উদ্যোগসমূহ
কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প কফির উৎপাদনে, সম্প্রসারণে ও প্রক্রিয়াজাতকরণে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন- কফি চাষ বৃদ্ধির জন্য সরকারিভাবে হাইব্রিড কফির কলম সংগ্রহ করে বিতরণ করা হবে। ভিয়েতনাম থেকে ঈড়ভভবধ ৎড়নঁংঃধ জাতের কফির কলম আনা প্রক্রিায়াধীন আছে। প্রাথমিকভাবে ঐড়সবংঃবধফ ঈড়ঃঃধমব ওহফঁংঃৎু স্থাপনের জন্য ১০টি কৃষক গ্রæপকে সরকারিভাবে প্রকল্পের মাধ্যমে তাদেরকে প্রশিক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের যন্ত্রপাতি প্রদান করা হবে । গুণগতমান সম্পন্ন কফির চারা/ কলম সরবরাহ করা হবে। আগামীতে কফি সম্প্রসারণের জন্য প্রকল্প বা কর্মসূচি গ্রহণ করার কাজ চলছে। কৃষি মন্ত্রণালয় ও ডিএই এর কর্মকর্তা দেশব্যাপী কফির বর্তমান অবস্থা নিয়মিতভাবে পরিবীক্ষণ করছেন। চাষিদের প্রযুক্তিগত পরামর্শ দিচ্ছেন এবং নতুন বাগান সৃজনে উদ্বুদ্ধ করছেন।
সংক্ষেপে কফির প্রক্রিয়াজাতকরণ
আমেরিকার জাতীয় কফি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে কফির চারা রোপণ থেকে কাপে পানযোগ্য কফি পেতে কমপক্ষে ১০টি ধাপ পেরোতে হয়। ফল সংগ্রহ থেকে শুরু করে শেষ ধাপ পর্যন্ত সম্পন্ন করতে যা যা করতে হবে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ ধারাবাহিকভাবে নিচে দেয়া হলো:
কফির বেরি যখন পেকে গাঢ় লাল বা হলুদ রং হয় তখন এগুলো গাছ থেকে সংগ্রহ করতে হয় । বছরে ১ বার ফলন সংগ্রহ করতে হয়। বিশ্বের কোথাও কোথাও হাত দিয়ে আবার কোথাও যেমন সমতল ভূমিতে যন্ত্রের মাধ্যমে ফল সংগ্রহ করা হয়। সংগ্রহকৃত পাকা কফি পরবর্তীতে প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্রে পাঠানো হয়। প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্রে পৌঁছানোর সাথে সাথেই এর কার্যক্রম শুরু করে দিতে হয় অন্যথায় পচন শুরু হতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি দুই ধরনের হয়ে থাকে যেমন : শুকনো ও ভেজা পদ্ধতিতে। শুকনো পদ্ধতি পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাবে এটি করা হয়। কফিগুলোকে রেকে বা মাটিতে বিছিয়ে তাতে পাতলা করে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং সূর্যের আলোতে এটি শুকানো হয় যতক্ষণ না পর্যন্ত কফি বীজের আর্দ্রতা ১১ শতাংশ হয়। এটি অনেক সময়সাপেক্ষ পদ্ধতি। ভেজা পদ্ধতিতে পাল্পিং মেশিনের মাধ্যমে উপরের নরম ও পাল্প আবরণ সরানো হয়। এরপর পানির চ্যানেলের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় রোটেটিং মেশিনের মাধ্যমে বীজের আকার অনুসারে গ্রেডিং করা হয়। ফার্মেন্টেশনের জন্য এই বীজগুলোকে রাখা হয় পানি ভর্তি বিশাল ট্যাংকে ১২-২৪ ঘণ্টা। তারপর বীজের উপরের পাতলা পর্দা সরে যায় ও ভালো পানি দিয়ে ধুয়ে শুকানো হয়। ভেজা পদ্ধতিতে সংগৃহীত কফি বীজগুলোকে রোদে বা ড্রায়ারে আর্দ্রতা ১১ শতাংশে না পৌঁছানো পর্যন্ত শুকাতে হবে, এই অবস্থার কফিকে পার্চমেন্ট কফি বলে। তারপর ব্যাগে ভরে সংরক্ষণ করতে হবে।
হালিং মেশিনের মাধ্যমে পার্চমেন্ট লেয়ার সরাতে হবে বা সম্পূর্ণ শুকনা আবরণ সরাতে হবে । যদি পলিশিং করলে এর গুণগতমান বাড়ে তবে এটি করা বাধ্যতামূলক বা জরুরি নয়। আকার ও ওজন দেখে কফিকে গ্রেডিং ও বাছাই করতে হবে। নিশ্চিতভাবে ভালো গ্রিন কফিগুলো রাখতে হবে রপ্তানির জন্য। পাটের ব্যাগ বা অন্যান্য বায়ুরোধী ব্যাগে ভরে জাহাজে চড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলে যায় বিখ্যাত পানীয় এর মূল উপকরণ।
কফির স্বাদ ও গুণগতমান পরীক্ষা করা হয় বিভিন্নভাবে। বাছাইকৃত গ্রিন কফিকে রোস্টিং করে তৈরি করা হয় সুঘ্রাণযুক্ত বাদামি কফি বীজ। যেটা আমরা সুপার সপ বা ক্যাফে থেকে ক্রয় করে থাকি। বেশির ভাগ রোস্টিং মেশিনের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয় প্রায় ৫৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এই সময়ে সঠিকভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি কারণ এই ধাপেই সৃষ্টি হয় অসাধারণ স্বাদ ও ঘ্রাণ। এই প্রক্রিয়াকে বলে পাইরোলাইসিস। রোস্টিং এর পর অতি দ্রæত ঠাÐা করতে হবে। তাহলেই এর স্বাদ ও গন্ধ অটুট থাকবে যার জন্য ক্রেতাগণ অনেক বেশি আকৃষ্ট হবে কেনার জন্য। কফির স্বাদ ও ঘ্রাণ গ্রাহকের কাপ পর্যন্ত রাখতে হলে সঠিকভাবে কফি গ্রাইন্ডিং করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কফি বীজ গুঁড়া করা যত মিহি হবে তত দ্রæত সুন্দর কফি তৈরি হবে। আধুনিক বিভিন্ন মেশিনের সাহায্যে বেøক কফি বা মিল্ক কফি তৈরি করে কফি প্রেমিদের সন্তুষ্টি করা যায়। বাংলাদেশে কফি চাষের জন্য উপযোগী। কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন উদ্যোগ এবং মাঠ পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাগণের কফি বিষয়ক প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকায় এদেশে কফি চাষ বৃদ্ধি ও এর সম্প্রসারণ করা সম্ভব। আধুনিক প্রক্রিয়াজাত মেশিন ও প্রযুক্তি সহজলভ্যতা হলে এর চাষ বৃদ্ধি পাবে। দেশের কৃষি উদ্যোক্তাগণকে কফি চাষে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই কফির স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও বৃদ্ধি করা যাবে, এভাবেই কৃষি ও অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ হবে সোনার বাংলাদেশ। য়
১পরিচালক, হর্টিকালচার উইং, ডিএই অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল: ০১৭১৬৩৮৪৫৩৮,২উপজেলা কৃষি অফিসার (সংযুক্ত : হর্টিকালচার উইং), ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল: ০১৬৮৮০৫৪৭৮৬, ই-মেইল :
dhw@dae.gov.bd
প্রতি ইঞ্চি জায়গা ব্যবহার করে বসতবাড়িতে সমন্বিত খামার
মৃত্যুঞ্জয় রায়
করোনাভাইরাস আমাদের নতুন করে অনেক কিছুই শিখিয়ে দিচ্ছে। অনেকেই বলছেন, করোনা যদি থেকেই যায় তো তার সাথে তো আমাদেরও থাকতে হবে। সারাক্ষণ এ রকম আতংক নিয়ে কি বাঁচা যায়? কিন্তু এটাও সত্যি, এ রকম ভয় যার মনে বাসা বাঁধবে করোনা তাকে মারার আগে সেই ভয়ই তাকে আগে মারবে। ভয় না করে করোনাকে জয় করতে হবে। এজন্য প্রত্যেকেরই এখন
দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাটা যে কোনভাবেই হোক ঠিক রাখতে হবে, সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। রোজ একটা লেবু, একটা ডিম, একটু শাকসবজি, দুধ, মাংস বা মাছ-এগুলো খেতে হবে। কোনভাবেই দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এখন কমতে দেয়া যাবে না। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে শুধু করোনা না, অন্য রোগও দ্রæত আমাদের কাবু করে এমনকি মেরে ফেলতে পারে। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হলে দরকার রোজ পুষ্টিসম্মত নিরাপদ খাবার। বসতবাড়ির আঙ্গিনাটাই হতে পারে সেসব নিরাপদ পুষ্টিকর খাবারের প্রধান উৎস। বসতবাড়ির প্রতি ইঞ্চি জায়গা সদ্ব্যবহার করে আমরা উৎপাদন করতে পারি টাটকা শাকসবজি, ফলমূল, ডিম, মাংস, দুধ, মাছ, মসলা ইত্যাদি। এতে শুধু পরিবারের পুষ্টি বা স্বাস্থ্য সুরক্ষাই নয়-পরিকল্পিতভাবে প্রতি ইঞ্চি জায়গা ব্যবহার করলে বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে বাড়তি আয় করাও সম্ভব।
সমন্বিত খামারের ধারণা
যেখানে বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য উৎপাদন হয় সেটাই হলো খামার। বসতবাড়িতে বহু রকমের পণ্য উৎপাদিত হয় বলে তা বহুমুখি খামার। এরূপ খামারে বিভিন্ন উৎপাদনের মধ্যে সম্পর্ককে বিবেচনা করে অর্থাৎ একটির উপজাত আর একটির উৎপাদনে ব্যবহার করে যখন পরিকল্পিতভাবে উৎপাদন করা হয় তখন তা সমন্বিত খামারে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য সকল প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটে। এরূপ খামারে উৎপাদন ব্যয় সাশ্রয় করা যেমন সম্ভব হয় তেমনি বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদনের সুযোগ ঘটে। এতে ব্যবসায়িক ঝুঁকিও কমে।
প্রতি ইঞ্চি জায়গা ব্যবহারের পরিকল্পনা
বসতবাড়িকে একটি স্বপ্নের সুন্দর বাড়ি বানাতে হলে তার জন্য প্রথমেই দরকার একটি সঠিক পরিকল্পনা। আপনার বাড়ি যেমনই হোক, যতটুকু জায়গাই থাকুক- তাকে একটি সুন্দর রূপ দেয়া কিন্তু সম্ভব। এজন্য প্রথমে আপনাকে কাগজে একটা নকশা এঁকে নিতে হবে। বাড়ির জমি যতটুকু আছে সে অনুযায়ী কাগজে দিকনির্দেশ করে প্রথমে বাড়ির সীমানা বা চৌহদ্দি আঁকতে হবে। এরপর বাড়িতে প্রবেশ পথ চিহ্নিত করতে হবে। সীমানার ভেতরে যেখানে যে স্থাপনা মানে ঘরবাড়ি, পুকুর, শৌচাগার, গোয়াল, হাঁস-মুরগির ঘর, টিউবওয়েল ইত্যাদি রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এরপর নকশায় দেখাতে হবে কোথায় কি গাছপালা আছে। বর্তমানে যেখানে যা আছে তা আঁকার পর এবার দেখতে হবে কোথায় কোন জায়গা কতটুকু কি উৎপাদনে ব্যবহারের সুযোগ আছে। একটি বাড়িতে নানা ধরনের জায়গা থাকে। সব জায়গাকেই উৎপাদনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে, প্রতি ইঞ্চি জায়গার সদ্ব্যবহার করতে হবে, রাখতে হবে উঠোন। উৎপাদন পরিকল্পনায় ভারসাম্য রাখতে হবে যাতে সারা বছর বসতবাড়ি থেকে প্রতিদিনের জন্য প্রয়োজনীয় অধিকাংশ খাবারের যোগান নিশ্চিত করা যায়।
শুরুর কাজ
পরিকল্পনা সঠিকভাবে করলে তা বাস্তবায়ন করা সহজ হয়। বসতবাড়িকে স্বপ্নের বাড়ি বানাতে হলে পরিবারের সকলকেই প্রথমে একটু সময় দিতে হবে। পরিবারের সদস্যরা মিলে একসাথে কাজ করলে কাজটা করা সহজ হবে, নিজেরা কিছু দৈহিক পরিশ্রম করে শরীরটাকে ঠিক রাখা যাবে আর পারিবারিক সম্পর্কেরও উন্নতি হবে। নিজেদের পরিশ্রমে গড়া পারিবারিক খামার থেকে উৎপাদিত খাদ্য আপনাদের দেবে পুষ্টি, সুস্বাদ ও অনাবিল আনন্দ। তাই বসতবাড়িতে আপনি কি করতে চাইছেন তা পরিবারের সদস্যদের
সাথে আলোচনা করুন। সদস্যদের পছন্দকে গুরুত্ব দিন। এরপর কোথায় কি উৎপাদন করবেন তার একটা তালিকা তৈরি করুন। উৎপাদনে যাওয়ার আগে দুটো কাজ আপনাকে করতে হবে- প্রথমে বাড়ির সীমানায় প্রাচীর থাকলে ভালো, না হলে বেড়া দিয়ে বাড়িটাকে ঘিরে ফেলুন। সুরক্ষা ও সৌন্দর্যের জন্য এটা দরকার। যে কেউ দেখে যেন বুঝতে পারেন যে ওই ঘেরা জায়গাটুকুই আপনার বাড়ি। দ্বিতীয় কাজটা হলো, আপনার ঘরবাড়ি, গোয়াল বা হাঁস-মুরগির ঘর এসব যতটা সংস্কার করে আধুনিক করা সম্ভব তা করে ফেলুন। একবারে না পারলে ধাপে ধাপে করা যায়। পুকুর থাকলে তা সংস্কার করুন। এসব স্থাপনা আধুনিকায়ন করতে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।
বসতবাড়ির যে জায়গায় যা করা যায়
বসতবাড়িতে নানা ধরনের জায়গা থাকে। কোনো জায়গায় রোদ পড়ে- কোনো জায়গায় থাকে ছায়া। কোনো জায়গা উঁচু, কোন জায়গায় ডোবা। যে কোনো জায়গায় যে কোন কিছু উৎপাদন করা যায়না। এজন্য স্থান উপযোগী পণ্য উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত স্থান ঠিক করতে হবে। আপনার বসতবাড়িতে যে ধরনের জায়গা রয়েছে সে অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন বা ফসল চাষের জন্য বেছে নিতে পারেন। সারণি-১ দ্রষ্টব্য।
যেভাবে করবেন
শাকসবজি চাষ : খোলা স্থানে কালিকাপুর মডেলে ৬ মিটার লম্বা ও ৬ মিটার চওড়া জায়গা ঘিরে পাঁচটি বেডের একটি সবজি বাগান করবেন। শীতকালে সেখানে চাষ করবেন পালংশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ওলকপি, পিয়াজ, বাটিশাক, লালশাক, মুলা, ঝাড়শিম, টমেটো ইত্যাদি। গরমকালে ও বর্ষাকালে চাষ করবেন গিমাকলমি, পুঁইশাক, ঢেঁড়স, লালশাক, ডাঁটা, মুখিকচু, ওলকচুু ইত্যাদি। সবজি ক্ষেতের চারপাশের বেড়ার কোলে লাগাতে পারেন মরিচ, বেড়ার উপরে বরবটি ও করলা। শাকসবজির উন্নত জাতের বীজ বা চারা ব্যবহার করবেন, কেঁচোসার দেবেন, ঠিকমতো সেচ দেবেন, বালাই আক্রান্ত গাছের অংশ তুলে ফেলবেন ও আগাছা পরিষ্কার করবেন, সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ দেবেন, কোন বালাইনাশক ব্যবহার করবেন না।
ফল চাষ : প্রতি মাসেই যেন বাড়ির আঙ্গিনায় ফল পেতে পারেন এজন্য কমপক্ষে বারো রকমের ফলগাছ লাগাবেন। বারোমাস পাওয়া যায় পেঁপে ও কলা। শীতে পাবেন মালটা, কুল ও কমলা, গ্রীষ্মে পাবেন আম, লিচু, শরিফা, কাঁঠাল, জামরুল, গ্রীষ্ম-বর্ষায় পেয়ারা। শরতে ডালিম, মালটা, বাতাবি লেবু, আমড়া, কদবেল। হেমন্তে কামরাঙ্গা, বসন্তকালে বেল। উন্নত জাতের চারা-কলম লাগিয়ে যতœ নেবেন। আম, পেয়ারা, কলা, ডালিম ইত্যাদি ফলে ব্যাগিং করতে হবে। ফলগাছে পরিমাণ মতো কেঁচোসার ব্যবহার করবেন, পারতপক্ষে কোনো বালাইনাশক স্প্রে করবেন না।
ঔষধি গাছ : বসতবাড়ির আঙ্গিনায় কিছু ঔষধি গাছ যেমন থানকুনি, বাসক, তুলসী, পুদিনা, কালমেঘ, পাথরকুচি, ঘৃতকুমারী ইত্যাদি গাছ লাগাতে পারেন। হাতের কাছে থাকা এসব গাছ আপনাকে প্রাকৃতিক চিকিৎসায় সাহায্য করতে পারবে।
ফুল চাষ : বাড়ির শোভা বাড়ানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে কিছু ফুল ও বাহারি গাছ লাগানো যায়। জায়গা বেশি থাকলে ব্যবসায়িকভাবে গø্যাডিওলাস, গোলাপ, রজনীগন্ধা, জিপসোফিলা, চন্দ্রমল্লিকা, জারবেরা, গাঁদা ইত্যাদি ফুলের চাষ করে আয় করা যায়। আধুনিক প্রযুক্তিতে এসব ফুলের চাষ করতে হবে। ছাউনিঘর করে তার ভেতরে গø্যাডিওলাস, লিলিয়াম ও জারবেরা ফুলের চাষ করা যায়।
ছাগল ও ভেড়া পালন : ছাগলের জন্য মাচাযুক্ত ঘরের ব্যবস্থা করতে হবে, লতাপাতা ও ঘাসের পাশাপাশি রোজ দানাদার খাবার খাওয়াতে হবে, নিয়মিত ছাগলকে টিকা দেবেন ও কৃমিনাশক খাওয়াবেন।
গরুপালন : দুধ ও মাংসের জন্য গরু পালন করতে পারেন। গোয়ালঘরকে আধুনিক স্বাস্থ্যসম্মত ঘরে রূপান্তরিত করবেন। গরুকে কৃমিনাশক খাওয়াবেন ও টিকা দেবেন। ঘাসপাতার ও খড়ের পাশাপাশি গরুকে রোজ পরিমাণ মতো দানাদার খাবার খওয়াবেন। গরু মোটাতাজা করতে হলে সেসব গরুকে ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র বা ইউএমএস খাওয়াবেন। এটা সহজে খড়, চিটাগুড় ও ইউরিয়া সার মিশিয়ে বাড়িতে বানিয়ে নেয়া যায়। ইউএমএস খাওয়ালে গরুর ওজন ও মাংস দ্রæত বাড়ে।
হাঁস-মুরগি পালন : যদি পুরনো ঘর থাকে তবে তাকে আধুনিক ঘরে রূপান্তরিত করুন। মুরগির ঘরকে তিনতলা করবেন, হাঁস-মুরগিকে উন্নত খাবার রোজ পরিমাণ মতো খেতে দেবেন ও নিয়মিত টিকা দেবেন। মুরগির ডিম ফোটানোর জন্য উন্নত হাজল ব্যবহার করবেন।
পুকুরে মাছ চাষ : পুকুর পাড়ের ঝোপ-জঙ্গল পরিষ্কার ও পাড় মেরামত করবেন। চৈত্র মাসে পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলে পুকুর সংস্কার করে চুন প্রয়োগ করা যায়। পুকুরের পানির গভীরতা বুঝে মাছের প্রজাতি নির্বাচন করে সঠিক পরিমাণে পোনা ছাড়বেন। পুকুরে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ, পাঙ্গাস, নাইলোটিকা ইত্যাদি মাছ চাষ করা যায়। গড়ে প্রতি শতক জলায়তনের পুকুরে মিশ্র মাছ চাষের জন্য প্রায় ২৫-৩০ টি পোনা ছাড়া ভাল। চৈত্র-বৈশাখ মাস পোনা ছাড়ার উপযুক্ত সময়। মাছকে নিয়মিত খাবার খেতে দিতে হবে।
“প্রতি ইঞ্চি জায়গার সদ্ব্যবহার
বসতবাড়ি হবে সমন্বিত খামার।” য়
প্রকল্প পরিচালক, সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনা কম্পোনেন্ট- ২য় পর্যায় (আইএফএমসি- ২) প্রকল্প, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা, মোবাইল : ০১৭১৮২০৯১০৭, ই-মেইল : kbdmrityur@yahoo.com