ড. মো. আবদুল মুঈদ
১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাণ হারিয়েছেন। জাতীয় শোক দিবসে বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারের সকল শহীদের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। বঙ্গবন্ধু যদি প্রাণ না হারাতেন তবে এবার আমরা তাঁকে নিয়েই বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সহিত পালন করতাম বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। কাকতালীয়ভাবে একই সাথে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে বাংলাদেশ তাঁর স্বাধীনতার অর্ধশত বার্ষিকীতে পদার্পণ করবে। এই দুয়ে মিলেই রূপ নিয়েছিল এবারের মুজিব শতবর্ষ। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিকে যেমন সেদিন বিলীন করে দিয়েছিল ঘাতকের বুলেটের আঘাত, একইভাবে এবারের মুজিব শতবর্ষ পালনের সময় প্রস্তুতি যখন সম্পন্ন, ঠিক তখনই গেল ৮ই মার্চ, ২০২০ কোভিড-১৯ নামক ভাইরাসের আক্রমণে করোনা নামক রোগের প্রকোপে সমস্ত প্রস্তুতিতে ভাটা ফেলে দিলো। আর তাই শত বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করেই সীমিত আকারে হলেও পালিত হচ্ছে মুজিব শতবর্ষ উদযাপন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরও সে থেকে ব্যতিক্রম নয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বলেছিলেন ‘বাংলার মাটি সোনার চেয়ে খাঁটি তাইতো বারবার বিদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে ও শোষণকে টেনে এনেছে।’ এই বাংলার মাটি বাংলাদেশের মাটি, যদি সোনার চেয়ে খাটি না হতো তাহলে এতদিন আমাদের পরাধীন থাকতে হতো না। তিনি আরো বলেন, বাংলার মাটি দুনিয়ার কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই মাটিতে সোনালি ফসল ফলিয়ে সোনার বাংলা তৈরি করা সম্ভব। কৃষি বিপ্লবের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামের দিকে নজর দিতে হবে, কৃষকদের রক্ষা করতে হবে। অধিক শস্য উৎপাদন করার জন্য মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। সেদিনই তিনি সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একটি নারিকেলের চারা রোপণ করে। কৃষিবিদদের ‘ক্লাস ওয়ান’ কর্মকর্তা হিসেবে ঘোষণাও সেদিন তিনি দিয়ে আসেন। এইভাবে কৃষি-কৃষক- কৃষিবিদদের সাথে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কৃষি ও কৃষকবান্ধব মানুষ। সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর উন্নত বাংলাদেশ এবং সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য কৃষির উন্নতির কোন বিকল্প ছিল না। সেই লক্ষ্যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিল তাঁর অন্যতম কাজ। তিনি জানতেন মানুষের প্রথম চাহিদা খাদ্য আর খাদ্য নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে তিনি কৃষি এবং কৃষকের উন্নয়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের জন্য গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশকে কৃষি অর্থনীতিতে স্বনির্ভর করে তোলার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ ও কর্মসূচি গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন কৃষি ও কৃষকের উন্নতি বিধান নিশ্চিত করা না গেলে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তিনি স্বপ্ন দেখতেন কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করতে। এ জন্য তিনি উচ্চতর শিক্ষা গবেষণা প্রশিক্ষণ এবং শহরের দিকে দৃষ্টি দিয়েছিলেন। জাতীয় বৈদেশিক নীতির জন্য তিনি বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু প্রথম বাজেটে কৃষিখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। ২১ দফার প্রতিটা দফাই ছিল কোনো না কোনোভাবে কৃষি ও কৃষকের মঙ্গলকামি। কৃষির উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। বন্যা ও খরার হাত থেকে কৃষককে রক্ষার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সরকারি ইজারাদারি প্রথা বিলুপ্ত করেন।
সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ঢাকা সফরে এসে বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করেছেন ‘বিশ্ব নেতা’ হিসেবে, যা অনুসরণীয় হতে পারে অন্যান্য দেশের কাছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও কিন্তু অনুসরণ করছেন তার বাবার প্রদর্শিত পথকেই। করোনার প্রভাবে বাংলাদেশে দিনে দিনে মৃত্যুর মিছিল যখন বাড়ছে, ঠিক তখন এই রোগ হতে মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে ঢালরূপে আবির্ভূত হয়েছে বাংলার কৃষি। সেই ঢাল হাতে নিপুণ সৈনিক বাংলার কৃষক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সর্বস্তরের কর্মচারীবৃন্দ। আর এই পুরো কর্মযজ্ঞের সফল পরিচালক বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম ব্যস্ত মন্ত্রণালয় কৃষি মন্ত্রণালয়, যার মূল চালিকা আসনে বসে আছেন এই কৃষি পরিবারেরই একজন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী কৃষিবিদ ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক, এমপি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষি বান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদী না থাকে’ এই সেøাগান পালনের জন্য দেশের এই মহামারীতে সম্ভাব্য খাদ্য সংকট মোকাবেলায় মাননীয় কৃষি মন্ত্রীর পদক্ষেপগুলো রীতিমত বিশ্ব নজির হিসেবে ইতোমধ্যেই সমাদৃত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন দানাদার শস্য ধান উৎপাদনে বিশ্বে ৩য় স্থান অর্জনকারী দেশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যেখানে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন চাহিদা ছিলো ৩.৫০ কোটি টন, সেখানে আমরা উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছি ৩.৬৪ কোটি টন। এই উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যের কারণেই এখন আমাদের ১৯.৩ লক্ষ টন ধারণ ক্ষমতার মধ্যে ইতোমধ্যেই ১২.৬৫ লক্ষ টন মজুদ করা সম্ভব হয়েছে।
কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি করোনার প্রাদুর্ভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন খেটে খাওয়া, হতদরিদ্র ও ভাসমান মানুষেরা কথা মাথায় রেখে সরকার বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে। সারাদেশে নিম্ন আয়ের মানুষদের ১০ টাকা কেজি দরে ৯০ হাজার টন চাল দেওয়া হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা মোকাবেলায় গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য বিনামূল্যে ঘর, ছয় মাসের খাদ্য এবং নগদ অর্থ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ পর্যন্ত ৬৪ জেলায় ১২ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা এবং প্রায় ৪৬ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য সহায়তা দিয়েছে। সরকার এই সমস্ত কার্যক্রমে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের সকল পর্যায়ের কর্মচারীরা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে করোনার বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষনা করেছে। এই যুদ্ধ করতে গিয়ে ১২ জুলাই, ২০২০ হিসাব মতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ১৩৯ জন কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। করোনার আগ্রাসনে মৃত্যুবরণ করে আমাদের মাঝ থেকে চলে গেছেন বগুড়ার উপপরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ আবুল কাশেম আযাদ (৫৮) ও একজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা। এতো ভয়াবহতার পরও থেমে নেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম। গত ৭ই জুলাই, ২০২০ তারিখে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে মাননীয় কৃষি মন্ত্রী কর্তৃক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুজিববর্ষ উদযাপনের অংশ হিসেবে গণভবন প্রাঙ্গণে একটি ফলদ, একটি বনজ এবং একটি ঔষধি গাছের চারা রোপণের মাধ্যমে সারাদেশে ১ কোটি চারা বিতরণ ও বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশে ২০১৮-১৯ সালের হিসাব মতে মোট ৭ লাখ ২৭ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ফলের আবাদ হয়েছিল, যার মধ্যে প্রধান ফল হিসেবে আম আবাদের জমি ছিলো প্রায় ১ লাখ ৮৮ হাজার হেক্টর আর উৎপাদন ছিলো ২২ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন, কাঁঠাল আবাদ হয়েছিল ৭১ হাজার ছয়শত হেক্টর জমিতে যার ফলন ছিল ১৮ লাখ ৮৭ হাজার মেট্রিক টন, আর লিচু ছিল ৩১ হাজার চারশত এর মতো, যার ফলন ছিল ২ লাখ ২৬ হাজার মেট্রিক টন। এ বছর ২০১৯-২০ সালে সেই লক্ষমাত্রা বেড়ে প্রায় ১ লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছে এবং প্রত্যাশিত উৎপাদন ২২ লক্ষ ৩২ হাজার মে.টন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কৃষিবিদদের যত আশা-আকাক্সক্ষা, চাওয়া-পাওয়া ছিল বা আছে, তার সবগুলোই পূরণ হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত নিজেস্ব চাওয়া থেকে এবং পরবর্তীতে বর্তমান কৃষি বান্ধব সরকারের প্রধান তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃষিবিদের দীর্ঘদিনের একটি দাবি ছিল কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে একজন কৃষিবিদের জন্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবার সরকার গঠনের পর কৃষিবিদদের সেই আশাকে বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্ব তুলে দেন তাঁরই অত্যন্ত আস্থাভাজন ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক, এমপির হাতে। সেই থেকে অক্লান্ত পথ চলা তাঁর। এবারের মুজিববর্ষ পালনে তাই তিনিসহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর গ্রহণ করেছে বিভিন্ন কর্মসূচি। কৃষি নির্ভর এই বাংলাদেশ যেন করোনাকালীন সময়ে কোনোরূপ খাদ্য সংকটে না পড়ে তার পূর্ণ প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই গ্রহণ করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে আউশ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩.২৯৬ লক্ষ হেক্টর জমিতে ৩৬.৪৫ লক্ষ মে. টন, আমন ৫৮.৯৫ ২৯৬ লক্ষ হেক্টর জমিতে ১৫৩.৮ লক্ষ মে.টন। কৃষিবান্ধব এই সরকার বরাবরই মনে করেন, যে কোন দুর্যোগ মোকাবেলায় কৃষি হবে প্রধান রক্ষাকবচ হাতিয়ার। ‘কৃষিতেই হবে সমৃদ্ধ আগামীর বাংলাদেশ’ মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার। য়
মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। ফোন : ৯১৪০৮৫০, ই-মেইল : dg@dae.gov.bd
১ড. মো. আমজাদ হোসেন, ২ড. সমজিৎ কুমার পাল
কৃষি প্রধান বাংলাদেশের কৃষিই আমাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। তাছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে কৃষির অবদানই সবচেয়ে বেশী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন এদের উন্নতি না হলে দেশের উন্নতি হবেনা, স্বাধীনতার সুফল আসবেনা। তাই তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল কৃষিকে প্রাধান্য দেয়া। বিশেষ করে শিল্পভিত্তিক কৃষি। পাকিস্তানী শাসন আমলে এদেশে বিশেষত দেশের উত্তরাঞ্চলে শিল্পের কোন প্রসার ছিল না। একমাত্র চিনি শিল্পই এখানকার সম্পদ, যার বেশির ভাগই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বৃটিশ আমলে। তাই দেশ গড়ার দিকে নজর দিয়ে তিনি চিনি শিল্পকে নতুন করে সাজানোর জন্য জোর দিয়েছিলেন। তিনি সুসমন্বিত কৃষি শিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণ সিস্টেম প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে উপলব্ধি করেন এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান সমূহের আধুনিকায়ন ও সার্বিক উন্নয়নের প্রয়োজন অনুভব করেন। বঙ্গবন্ধু এই লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। এই আদেশ বলে কৃষি গবেষণা এবং কৃষি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়।
স্বাধীনতার পূর্বকালে আন্দোলনের উত্তাল সময়ে ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৫ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত হয় অসহযোগ আন্দোলনের নির্দেশাবলী। সর্বমোট ৩৫টি নির্দেশের মধ্যে ১৭ নং নির্দেশনাটি ছিল কৃষিপণ্য চলাচল এবং ক্রয়-বিক্রয়ে কোন নিষেধাজ্ঞা না থাকার বিষয়ে।
ঐ নির্দেশের ২৫ নং নির্দেশের (৩) অনুচ্ছেদে আন্দোলনের উত্তাল দিনেও ব্যাংকগুলোকে যে সব বিষয়ে অর্থ দান অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তার মধ্যে ছিল “চিনি কলের জন্য আখ এবং পাটকলের জন্য পাটসহ শিল্পের কাঁচামাল কেনার জন্য অর্থ দান।”
অর্থাৎ সেই উত্তাল দিনেও তিনি আবেগে হারিয়ে না গিয়ে কৃষি এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছিলেন। যার মধ্যে আখ ছিল অন্যতম। এভাবেই আখের প্রতি তাঁর ভালবাসার প্রস্ফুটন ঘটে, যা চ‚ড়ান্ত রূপ পায় স্বাধীনতার পর।
এসব বিবেচনা করেই স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই জাতির পিতা ১৯৭২ সালে মহামান্য রাষ্ট্রপতির ২৭ নম্বর আদেশ বলে বাংলাদেশ সুগার মিলস্ করপোরেশন গঠন করেন। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন নামে প্রতিষ্ঠিত হয়।
যে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি ইক্ষু চারা পরীক্ষাগার নামে এদেশে ১৯৩১ সালে ঢাকার মনিপুরি পাড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে ঈশ্বরদীতে ১৯৫১ সালে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা ইনস্টিটিউটে (ইক্ষু গবেষণা স্টেশন) রূপলাভ করে তা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটিকে ‘বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট’ নামে পুনর্গঠিত করে ১৯৭৩ সালে তিনি ‘বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট’ স্থাপন করেন। কারণ তিনি জানতেন গবেষণা ছাড়া কোন ফসলের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। বিদেশ থেকে জাত কিংবা প্রযুক্তি এনে দেশের কৃষি উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই গবেষণার পাশাপাশি ইক্ষু চাষ বাড়ানোর এবং চিনি শিল্পের উন্নয়নের জন্য তিনি ‘নিবিড় ইক্ষু উন্নয়ন প্রকল্প’ ও ‘খামার আধুনিকীকরণ প্রকল্প’ গ্রহণ করেন। তিনি নতুন চিনিকল স্থাপন ও বিদ্যমান কয়েকটি চিনিকলের যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপন ও আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেন। চিনির পাশাপাশি গুড় শিল্পের উন্নয়নেও তার ছিল যথেষ্ট সদিচ্ছা। তাই আখ-চিনি-গুড় এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ঐকান্তিক ভালবাসা। সেকারণেই তাঁরই আদর্শের উত্তরসূরী হিসেবে তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে ‘বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট’ আইন এবং ২০২০ সালে ‘বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট’ আইন মহান সংসদে অনুমোদিত হয়।
জাতির পিতা নিজে গুড় খেতে পছন্দ করতেন। তাঁর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্মৃতিচারণমূলক এক লেখায় পাওয়া যায় তার চিত্র। ‘খাবার বেলায় খুব সাধারণ ভাত, মাছের ঝোল, সবজিই তিনি পছন্দ করতেন। খাবার শেষে দুধ ভাত-গুড় ও কলা খুবই পছন্দ করতেন।’ (আমার পিতা শেখ মুজিব। -শেখ হাসিনা। ১৩ আগস্ট ১৯৯১। সাপ্তাহিক প্রতিচিত্র, আগস্ট ২০০৮)।
পল্লীর সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর ছিল মনের মিল। সাধারণ মানুষও তখন চিনির চেয়ে গুড়ই বেশি পছন্দ করতেন। গুড় গ্রামীণ শিল্প আজো আছে। তবে বর্তমানে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী গুড়ে ভেজাল মেশানোর অপচেষ্টায় আছে। এ অপচেষ্টা রোধ করলে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত হবে।
১মহাপরিচালক, ২পরিচালক (গবেষণা), বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী, পাবনা। ফোন : ০৭৩২৫৬৫৩৬২৮, ই-মেইল : dg-bsri.gov.bd
কৃষিবিদ মো. আবু সায়েম
করোনাকে সহঅবস্থানে রেখে কিভাবে আমাদের জীবন-জীবিকা অব্যাহত রাখা যায় সে ব্যাপারে ভাবতে হবে। বাঁচতে হলে খেতে হবে এর যেমন বিকল্প নেই, ঠিক তেমনি চালই হচ্ছে ভেতো বাঙালির খাদ্য নিরাপত্তার অন্যতম নিয়ামক। আদিকাল থেকে গোলায় ধান থাকলে বাঙালি নিজেকে নিরাপদ অনুভব করে, এটাই আমাদের স্বভাব জাত বৈশিষ্ট্য। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৩২ লাখ ১১ হাজার মেট্রিক টন। চলতি বোরো মৌসুমে ২ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত ফলন বেশ আশানুরূপ ও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) পূর্বাভাস বলছে বিশ্বে চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়াকে টপকে একধাপ এগিয়ে চীন ও ভারতের পর পরই তৃতীয় অবস্থানে উঠে আসবে। করোনা পরিস্থিতি কত দিন দীর্ঘায়িত হবে তা অনেক সমীকরণে ফেলেও অনুমান করা যাচ্ছে না। ফলে চালের অধিক উৎপাদন দেখে উচ্ছ¡সিত না হয়ে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে চালের ব্যবহারে আমাদের আরও কৌশলী ও মিতব্যয়ী হতে হবে। তাই ভাতের ওপর চাপ কমিয়ে পুষ্টিসমৃদ্ধ বিকল্প খাদ্যাভ্যাসে নজর দিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর এক ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘খাদ্য শুধু চাল, আটা নয়; মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, তরিতরকারিও আছে।’ বঙ্গবন্ধুর এ কথা থেকে উপলব্ধি করা যায় তিনি পুষ্টিনির্ভর জাতি বিনির্মাণে মনোযোগ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুসরণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উৎসারিত কৃষিবান্ধব নীতি কৌশল এবং কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক, এমপি’র জ্ঞান-সাধনায় শুধু খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা নয় বরং পুষ্টি নির্ভর মেধাবী জাতি গঠনে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ভিটামিন ও মিনারেলের প্রধান উৎস মৌসুমি ফল একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার, যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। বিশেষ করে আম, কাঁঠাল, আনারস ও লিচু এর মধ্যে অন্যতম।
ফলের রাজা (ঞযব করহম ড়ভ ঋৎঁরঃং) আমই হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল। এ ফল শিশু, বালক-বালিকা, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া সকলের কাছে অতি প্রিয় একটি ফল। এ বছর প্রায় ১ লক্ষ ৮৯ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে এবং সাম্প্রতিক আমফানের প্রভাবে উৎপাদন কিছুটা কমে গেলেও সম্ভাব্য উৎপাদন প্রায় ২২ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ মূল্যায়নে আম উৎপাদনে সপ্তম বাংলাদেশ। বর্তমানে প্রায় ২০টি অধিক জেলায় বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ হচ্ছে। ভরা মৌসুমে সারা দেশে দৈনিক গড়ে ১৫ হাজার মেট্রিক টন আম বেচাকেনা হয়ে থাকে।
আমের পরেই উৎপাদনের দিক থেকে যে ফলটি অধিক উৎপাদিত হয় সেটি হলো বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল। ভারতের কাঁঠাল বিশ্বে ঝঁঢ়বৎ ভড়ড়ফ নামে আর শ্রীলঙ্কায় কাঁঠাল ধান বৃক্ষ (জরপব ঃৎবব) হিসেবে সুপরিচিত। এ বছর বাংলাদেশে ৭১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে কাঁঠাল চাষ হয়েছে এবং সম্ভাব্য উৎপাদন ১৮ লক্ষ ৮৯ হাজার মেট্রিক টন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। কাঁচা কাঁঠাল বিশ^ বাজারে সবজি মাংস বা ঠবমবঃধনষব সবধঃ হিসেবে পরিচিত। কোষ ও আঁটি পরিপূর্ণ হলে অর্থাৎ পরিপক্ব ফল চিপ্স করার উপযোগী বা অন্যান্য তরকারির সাথে রান্না করা যায়। পাকা ফলের কোষ সরাসরি খাওয়া হয়। আবার পাকা ফলের কোষ বা পাল্প থেকে ক্যান্ডি, ফ্লেক্স, হালুয়াসহ রকমারি খাবার তৈরি করা যায়।
অ¤øমধুর স্বাদ ও সাধারণ সর্দি বা কাশিতে পথ্য হিসেবে যে ফলটি ধনী-গরিব সকলের কাছে বেশ সমাদৃত তা হলো আনারস। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সফল প্রয়োগের ফলে অসময়ে আনারস পাওয়া গেলেও সিংহভাগ বাজারে আসে মে-জুলাই মাসে। এ বছর আনারস চাষ হয়েছে ২০ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে এবং সম্ভাব্য উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৪ লক্ষ ৯৭ হাজার মেট্রিক টন। আনারস একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল।
বিশাল জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র এদেশে ফল-ফসল উৎপাদনে ধারাবাহিক ঈর্ষণীয় সাফল্য বা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখে আগামী দিনগুলোতে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না বরং যৌক্তিক খাদ্য গ্রহণ করোনা সংকটকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় আলোর পথ দেখাবে।
শুধু তো খাবার খেলেই চলবে না করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) রোধে রোগ প্রতিরোধী খাবার খেতে হবে। প্রতি ১০০ গ্রাম সিদ্ধ চাল, আম, কাঁঠাল, আনারস ও লিচুর তুলনামূলক খাদ্যমান তুলনা করলে দেখা যায় চালে খাদ্যশক্তি ৩৪৯ কিলোক্যালরি এবং ভিটামিন বা মিনারেল নেই বললেই চলে। সেখানে পাকা আমে খাদ্যশক্তি ৮০ কিলোক্যালরি, ভিটামিন এ ৬০০ আইইউ (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ টহরঃ) ও ভিটামিন সি ১৬ মিলিগ্রাম (কাঁচা আমে ৩ গুণ বেশি) পাওয়া যায়। পাকা কাঁঠালে খাদ্যশক্তি ৯৮ কিলোক্যালরি (কাঁঠালের বীজ বা আঁটিতে খাদ্যশক্তির পরিমাণ ১৩৯ কিলোক্যালরি), ভিটামিন এ ৫৪০ আইইউ ও ভিটামিন সি ১০ মিলিগ্রাম পাওয়া যায়। পাকা আনারসে খাদ্যশক্তি ৮৭ কিলোক্যালরি, ভিটামিন এ ৫ আইইউ ও ভিটামিন সি ৩৪ মিলিগ্রাম পাওয়া যায় এবং লিচুতে খাদ্যশক্তি ৬০ কিলোক্যালরি ও ভিটামিন সি ১১ মিলিগ্রাম পাওয়া যায়। স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় মোটাদাগে বলা হয়ে থাকে একক উৎস থেকে অধিক খাদ্যশক্তিসম্পন্ন খাবার কম খাওয়াই উত্তম। পরামর্শ দেয়া হচ্ছে করোনা প্রতিরোধে ঘন ঘন পানি পানসহ ভিটামিন সি যুক্ত ফল খেতে হবে। বেশির ভাগ ফলেই শতকরা ৮০ ভাগ পানি থাকে। ভিটামিন-মিনারেলসমৃদ্ধ এসব ফল মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। পুষ্টিবিদের মতে রাতে ঘুমানোর আগে নিয়মিত পাকা আম-লিচু খেলে ঘুম ভালো হয়, মানসিক প্রশান্তি বা স্বস্তিবোধও বাড়িয়ে দেয়। যাহোক, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের হিসাব মিলাতে অঙ্ক কষে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন খাবারটি কেন এবং কী পরিমাণে খেতে হবে।
ঐড়ঁংবযড়ষফ ওহপড়সব ্ ঊীঢ়বহফরঃঁৎব ঝঁৎাবু (ঐওঊঝ), ২০১৬ মতে বাংলাদেশে দৈনিক একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ মাথাপিছু ২২০০ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি গ্রহণ করে থাকে এবং দৈনিক মাথাপিছু চাল বা দানাদার খাদ্য গ্রহণের মাত্রা প্রায় ৪০৬ গ্রাম। সে হিসেবে শুধু চাল থেকে ১৪১৫ কিলোক্যলরি খাদ্যশক্তি এবং অন্যান্য খাদ্য উৎস হতে বাকিটা পূরণ হচ্ছে। যদিও শরীর সুস্থ-সবল রাখতে ৩৫০ গ্রাম চাল খেলেই যথেষ্ট। একই সাথে বর্তমান সংযত ও নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতিতে শারীরিক পরিশ্রমের হার অনেক কমে যাওয়ায় স্বাভাবিকের তুলনায় তিন-চতুর্থাংশ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি গ্রহণ যথেষ্ট বলে ধরে নেয়া যায়। পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের প্রতিদিন ২০০ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার থাকলেও আমরা খাচ্ছি মাত্র ৮০ গ্রামেরও কম। তিন মাস যদি জনপ্রতি দৈনিক ২০০ গ্রাম বা তার অধিক ফলাহার করি এবং সমপরিমাণ ভাত কম গ্রহণ করি তাহলে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩৩ হাজার মেট্রিক টন চাল বাঁচান সম্ভব। তিন মাস হিসেব করলে চালের মজুদের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৯ লক্ষ ৭০ হাজার মেট্রিক টন, যা দিয়ে সাড়ে ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীকে অতিরিক্ত দেড় মাসের অধিককাল অনায়াসে খাওয়ানো যাবে। দরকার শুধু সচেতনতা, কার্যকর পরিকল্পনা ও সঠিক উদ্যোগ।
পুষ্টিগুণ না জানা, নানাবিধ ব্যবহারের অজ্ঞতা এবং সর্বোপরি সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার অভাবে আমাদের দেশে উৎপাদিত ফলের সিংহভাগ নষ্ট হয়। ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও আমেরিকার বাজারে ক্যানজাত আনারস সিরাপের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমাদের উদ্বৃত্ত আনারস ক্যানজাত করে বা ¯øাইস করে রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে কিছু কিছু কোম্পানি এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাগণ ফলের জুস, চকোলেট, পানীয়, আচার, চাটনি, ম্যাঙ্গোবার, আমচুর ইত্যাদি উৎপাদন ও বাজারজাত করে মূল্য সংযোজন করছে। আবার দেশে এমন কোন বিশেষায়িত হিমাগার গড়ে উঠেনি যে অধিক সময় সংরক্ষণ করে মৌসুমি ফল বেশি দিন খাওয়ানো যাবে। বিকল্প একটিই আমাদের খাদ্যাভাস পরিবর্তন করতে হবে, ভাত কম খেতে হবে এবং বেশি বেশি করে ফলের নানাবিধ ব্যবহার বাড়াতে হবে।
আসন্ন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আর্থিক সামর্থ্য থাকলেই যে তা খাবার কেনার সামর্থ্যে রূপ নেবে এমন নিশ্চয়তা কিন্তু কেউ দিতে পারবে না। তাই ব্যক্তিগত সচেতনতার পাশাপাশি সরকারের উচ্চ মহল এ বিষয়ে জরুরি সিদ্ধান্তসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে আমের জন্য একটি বিশেষ ট্রেনের মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী থেকে ঢাকা স্বল্পমূল্যে আম পরিবহনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। প্রান্তিক কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ এবং ভোক্তারা যাতে তাদের চাহিদা মতো কৃষিপণ্য পেতে পারে সেজন্য বাংলাদেশের সর্বপ্রথম উন্মুক্ত কৃষি মার্কেটপ্লেস ‘ফুড ফর ন্যাশন’ চালু করেছে। আমাদের দেশে ডাক বিভাগ ‘কৃষকবন্ধু ডাক সেবা’ চালু করেছে যার মাধ্যমে কৃষকদের উৎপাদিত শাকসবজি-ফলমূল বিনামাশুলে পরিবহন করে ঢাকার বিভিন্ন বাজার ও সুপারশপে পৌঁছে দিচ্ছে। উদ্যোগ গ্রহণই শেষকথা নয় বরং উদ্যোগের আওতাভুক্ত সকল অংশীজনের কার্যকর অংশগ্রহণই কেবলমাত্র এ সমস্ত উদ্যোগের কাক্সিক্ষত সফলতা বয়ে আনতে পারে। য়
অতিরিক্ত উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রেষণে পিএইচডি গবেষক, হাবিপ্রবি, দিনাজপুর। মোবাইল-০১৭১৯৫৪৭১৭৯, ই-মেইল : sayemdae@yahoo.com
ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান শাহ
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরের প্রচেষ্টায় কৃষিকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে মূল্যায়ন করেছেন। কৃষিতে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা অপরিসীম। কৃষির উন্নতি ও মেধাবীদের কৃষিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য তিনিই কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদা দেন। পরবর্তীতে তাঁর সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন “সোনার বাংলা” গড়ার প্রত্যয়ে বদ্ধপরিকর। জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ধান-গমের পাশাপাশি খাদ্য তালিকায় ভুট্টার ব্যবহার যেমন মিষ্টি ভুট্টা, খই ভুট্টা, বেবি কর্ণ ইত্যাদি নতুন সংযোজন।
বর্তমান করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকট যাতে না হয় সরকার সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন। কিন্তু ভুট্টা উৎপাদনে নতুন একটি অন্তরায়, বিধ্বংসী পোকা ফল আর্মিওয়ার্ম (ঋধষষ অৎসুড়িৎস)। যার আক্রমণে ভুট্টার পুরো ফসল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এই পোকা ভুট্টা ছাড়াও ধান, সরগাম, আখ, তুলা ও সব্জি জাতীয় ফসলসহ ৮০টিরও বেশী ফসলে আক্রমণ করে। তাই বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকোট মোকাবেলায় ফল আর্মিওয়ার্ম দমন ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত তাৎপর্য বহন করে।
ফল আর্মিওয়ার্ম (ঋধষষ অৎসুড়িৎস) খবঢ়রফড়ঢ়ঃবৎধ বর্গের একটি পোকা যার বৈজ্ঞানিক নাম ঝঢ়ড়ফড়ঢ়ঃবৎধ ভৎঁমরঢ়বৎফধ ঔ.ঊ ঝসরঃয। এটি প্রধানত উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার পোকা হলেও বর্তমানে এর বিস্তৃতি বিশ্বব্যাপী লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০১৬ সালে আফ্রিকা মহাদেশে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশ এবং চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এটি ছড়িয়ে পড়ে।
ফল আর্মিওয়ার্ম চেনার উপায়
ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার লার্ভার শরীরের অষ্টম খÐাংশের উপরের দিকে চারটি সুস্পষ্ট কালো ফোটা বিদ্যমান, যা বর্গাকৃতি আকারে সজ্জিত থাকে। লার্ভার সম্মুখভাগে সাদা উল্টা ‘ণ’ এর মত চিহ্ন থাকে। ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার পুরুষ এবং স্ত্রী মথের বাহ্যিক অবয়বে সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। পুরুষ এবং স্ত্রী উভয় মথের পেছনের পাখা সিলভারি সাদা রঙের। তবে পুরুষ মথের সামনের পাখায় সাদা দাগ থাকে কিন্তু স্ত্রী মথের পাখায় কোন সাদা দাগ থাকে না।
ক্ষতির প্রকৃতি
ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার পূর্ণাঙ্গ মথ অনেক দূর পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে বিধায় এদের প্রাদুর্ভাব দ্রুত এক অঞ্চল হতে অন্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি, এক রাতে এরা ১০০ কিমি. পর্যন্ত উড়তে সক্ষম এবং পুত্তলি থেকে পূর্ণাঙ্গ মথ হওয়ার পর ডিম পাড়ার পূর্বেই ৪৮০ কিমি. পর্যন্ত স্থানান্তরিত হয়।
এরা সাধারণত দলবদ্ধভাবে এক ফসল থেকে অন্য ফসলে আক্রমণ করে। এই পোকার কীড়া ভুট্টা গাছের কচি পাতা ও কচি মোচার ভেতরের ভুট্টার দানা খেয়ে থাকে। ডিম থেকে কীড়া বের হওয়ার পরপরই দলবদ্ধভাবে কচি পাতার সবুজ অংশ কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে ছোট ছোট গোলাকার জালিকার ছিদ্র করে, যাকে ডরহফড়ঢ়িধহ বলে।
পরবর্তীতে কীড়া বড় হওয়ার সাথে সাথে ভুট্টা গাছের ডগার ভেতর ঢুকে পড়ে ও ডগার ভেতরের কচি পাতা খেয়ে (ওহভবংঃবফ যিড়ৎষ) গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত করে।
মোচা ধরা পর্যায়ে আক্রমণ করলে ভুট্টার কচি মোচা ছিদ্র করে ভেতরে প্রবেশ করে এবং ভ্ট্টুার দানা খেয়ে ফেলে, ফলে ফলন কমে যায়।
আক্রান্ত গাছে ভেজা লাল-বাদামি রঙের পোকার মল দেখা যায়। কীড়ার ৪র্থ থেকে ৬ষ্ঠ ধাপ (ওহংঃধৎ) অবস্থায় খাদ্য চাহিদা অত্যন্ত বেড়ে যায় এবং এক রাত্রের মধ্যে পুরো ফসল বিনষ্ট করতে পারে।
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনাই ফল আর্মিওয়ার্ম দমনের জন্য কার্যকর পদ্ধতি। এজন্য নি¤েœাক্ত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে।
ভুট্টা বীজ কীটনাশক দিয়ে শোধন করে জমিতে বপন করতে হবে। প্রতি কেজি ভুট্টা বীজের সাথে ২.৫ মিলি ফরটেনজা এবং ৪ মিলি পানি পলিব্যাগে একসাথে প্রায় ১মিনিট ভালোভাবে ঝাঁকাতে হবে যাতে বীজের গায়ে প্রলেপ পড়ে। এর পর আধঘণ্টা ছায়াযুক্ত স্থানে শুকিয়ে ঐদিনই জমিতে বীজ বপন করতে হবে।
ভুট্টার সাথে আন্তঃফসল হিসেবে যথাসম্ভব শিম (খবমঁসব) জাতীয় ফসল চাষাবাদ করতে হবে। একই জমিতে বার বার ভুট্টা চাষ পরিহার করতে হবে। ভুট্টার চারা গজানোর সাথে সাথে খাওয়ার লক্ষণ বা মল দেখে পোকার আক্রমণ চিহ্নিত করতে হবে এবং আক্রমণের মাত্রা নির্ণয় করতে হবে।
ফেরোমন ফাঁদ (প্রতি একর জমিতে ৩-৪টি) ব্যবহার করেও ফল আর্মিওর্য়াম পোকার উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। সম্ভব হলে আক্রান্ত গাছ হতে ডিম বা সদ্য প্রস্ফুটিত দলবদ্ধ কীড়া চিহ্নিত করে মেরে ফেলতে হবে কিংবা মাটির এক ফুট গভীরে পুঁতে ফেলতে হবে। আক্রান্ত ফসলে জৈব বালাইনাশক যেমন এসএফএনপিভি (স্পোডোপটেরা ফ্রুজিপারডা নিউক্লিয়ার পলিহেড্রোসিস ভাইরাস) বা এসএনপিভি (স্পোডোপটেরা নিউক্লিয়ার পলিহেড্রোসিস ভাইরাস) প্রতি লিটার পানিতে ০.২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এভাবে ৭ দিন পর পর ২-৩ বার গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ট্রাইকোগ্রামা এবং ব্রাকন নামক উপকারী পোকা ভুট্টা ফসলে অবমুক্ত করা যেতে পারে। আক্রান্ত ফসলে সেচ দেয়ার সময় যথাসম্ভব প্লাবন সেচ দিতে হবে। আক্রমণের মাত্রা শতকরা ২০ ভাগ বা তার অধিক হলে রাসায়নিক কীটনাশক যেমন স্পিনোসাড্ (ট্রেসার ৪৫ এসসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৪ মিলি বা সাক্সেস ২.৫% এসসি প্রতি লিটার পানিতে ১.৩ মিলি হারে) বা এমামেকটিন বেনজোয়েট (প্রোক্লেম ৫ এসজি প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে) বা ক্লোরেনট্রানিলিপ্রোল (কোরাজেন ১৮.৫% এসসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে) বা ফ্লুবেনডায়ামাইড (বেল্ট ২৪ ডবিøউজি প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে) আক্রান্ত ভুট্টা ফসলে সুরক্ষা সরঞ্জাম পরিহিত অবস্থায় স্প্রে করতে হবে।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভুট্টার ফল আর্মিওয়ার্ম দমন করি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। য়
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কীটতত্ত¡ বিভাগ, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, নশিপুর, দিনাজপুর-৫২০০। মোবাইল-০১৭১২৫৬১৫৯২। ওয়েবসাইট: www.bwmri.gov.bd
কৃষিবিদ ড. মো. আখতারুজ্জামান
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কৃষি ও কৃষকবান্ধব। সোনার বাংলাদেশ গড়তে ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমৃদ্ধ কৃষির যে কোন বিকল্প নেই এটা বঙ্গবন্ধু বেশ করে বুঝেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ভাল করেই জানতেন, ‘যারা জোগায় ক্ষুধার অন্ন কৃষি হলো তাঁদের জন্যে’। তাই বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বল্পকালীন সময়ের শাসনামলে কৃষি উন্নয়নে যেসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তার অন্যতমÑ ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ; গ্রাম্য সমাজ ভিত্তিক কৃষকের জন্যে সুদমুক্ত ঋণের প্রবর্তন; স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ২২ লাখ কৃষককে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ; বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে ১৯৭২ সালে ১৬,১২৫ মে.টন উফশী ধান বীজ, ৪৪,০০০ মে.টন পাট বীজ এবং ১,০৩৭ মে.টন গম বীজ কৃষকদের মাঝে বিতরণ; প্রাকৃতিক পরিবশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রথম বৃক্ষরোপণ অভিযান চালুকরণ; বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের প্রথম বাজেটেই কৃষিতে ভর্তুকির ব্যবস্থা গ্রহণসহ সার, কীটনাশক ও সেচ যন্ত্রাংশ সরবরাহ; প্রাইম সাপোর্ট হিসেবে ধান, পাট, আখ প্রভৃতি ফসলের ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ; গ্রামভিত্তিক সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ; ১৯৭২-৭৩ সালের ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়ন বাজেটের মধ্যে ১০১ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছিল কৃষি; উন্নয়নের জন্যে। যেটি বঙ্গবন্ধুর কৃষিবান্ধব নীতির কারণেই সম্ভব হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর কৃষিবান্ধব চিন্তা শুধু গাছপালা আর ফুল ফসলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নই ছিল বঙ্গবন্ধুর কৃষি ভাবনার মূলসুর।
কৃষিতে স্নাতক শেষ করে চাকরিতে যোগদানের সময় কৃষিবিদদের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে পদায়ন করা হতো। ফলে চিকিৎসক এবং প্রকৌশলীদের মতো কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার মর্যাদা দেয়ার দাবি উঠতে থাকে স্বাধীনতার আগে থেকেই। স্বাধীনতার পরও তাদের এ দাবি অব্যাহত থাকে। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রæয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সভায় গুরুত্ব সহকারে কৃষিবিদদের এ দাবি মেনে নেন। শুধু তাই না, ঘরোয়া আলোচনায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিবিদদের মর্যাদা হবে সবচে বেশি...।’ বঙ্গবন্ধু সেই দিনই (১৩ ফেব্রæয়ারি, ১৯৭৩) কৃষিবিদদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার পদমর্যাদায় উন্নীত করেন।
কালের পরিক্রমায় কৃষি গ্রাজুয়েটরা তাদের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মোতাবেক দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। কৃষি শিক্ষায় মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের প্রবেশ বাড়তে থাকে; যদিও ১৯৭৭ সালের বেতন কাঠামোয় কৃষিবিদদের সেই মর্যাদা আবারও একধাপ নামিয়ে দেয়া হয়। কৃষিবিদদের তীব্র আন্দোলনের মুখে তদানীন্তন সরকার কৃষিবিদদের সেই হারানো সম্মান আবার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন। ফলে বঙ্গবন্ধুর কারণে আজকে আমরা কৃষিবিদরা গর্ব করে বলতে পারি, ‘বঙ্গবন্ধুর অবদান, কৃষিবিদ ক্লাস ওয়ান’।
বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর যারা ক্ষমতায় আসেন, তারা নানাভাবে কৃষিবিদদের অবমূল্যায়ন করার চেষ্টা করে। এরপর ভিন্ন ধারার রাজনীতির ডামাডোলে পরে ১৩ ফেব্রæয়ারি বিশেষ দিনটিকে মনে করার কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি। অবশেষে ‘কৃষিবিদদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৩ ফেব্রæয়ারি দিনটিকে কৃষিবিদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ফলে ২০১১ সাল থেকে যথাযোগ্য মর্যাদায় নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ১৩ ফেব্রæয়ারি দিনটিকে কৃষিবিদ দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এদিন কৃষিতে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য অবদান ও কৃষিবিদদের মর্যাদা বৃদ্ধির বিষয়টি স্মরিত হয় অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধাভরে।
কৃষিবিদরা তাঁদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলেও ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি। কারণ সে সময় দেশের জনসংখ্যা সাড়ে ৭ কোটি থেকে ১৩ কোটিতে উন্নীত হয়েছিল। এ সমস্যা সমাধানে কৃষিবিদ ও কৃষকদের প্রয়োজনীয় সার, বীজ, তেল ও অন্যান্য সুবিধা না দেয়ায় কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেননি। ন্যায্যমূল্যে সার প্রাপ্তির আশায় আন্দোলন করতে যেয়ে ১৯৯৫ সালের ১৫ মার্চ, ১৮ জন নিরীহ কৃষককে প্রাণ হারাতে হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর কৃষি উন্নয়নে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়। সার, বীজ, সেচ ব্যবস্থা উন্নয়ন, খাদ্য মজুদ বৃদ্ধি, কৃষি পণ্যের সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাসহ কৃষি উন্নয়নে বিভিন্ন বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়। ফলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে।
কৃষিই আমাদের কৃষ্টির মূল। বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে আমরা যতই উন্নতি করি না কেন, খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা মেটানোর জন্য আমাদেরকে বারবার ফিরে যেতে হয় কৃষি ও কৃষকের কাছে। একবিংশ শতাব্দীর এই ক্ষণে আমরা বিজ্ঞানের সকল শাখার অভ‚তপূর্ব উন্নয়নের কথা জোর দিয়ে বলতে পারি। পুষ্টিকর মানব খাদ্যের জন্যে পৃথিবীর তাবদ মানুষকে আজও সেই সমৃদ্ধ ও গৌরবমÐিত পেশা কৃষির উপরেই নির্ভর করতে হয়। কৃষিতে বাংলাদেশের মত অল্প সময়ে এত উন্নয়ন বিশ্বের খুব কম দেশেই হয়েছে। এখন প্রয়োজন নিরাপদ ও পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার নিশ্চিতকরণ। দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের জন্যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলেও নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ এখনও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এ ব্যাপারে বর্তমান সরকার এবং কৃষি মন্ত্রণালয় ভীষণভাবে তৎপর। আশা করছি এ সমস্যার সমাধানও এখন সময়ের দাবি মাত্র।
দেশ স্বাধীনের অব্যবহিত পরে এ দেশে আবাদযোগ্য জমি ছিল ১ কোটি ৮৫ লক্ষ হেক্টর এবং মোট খাদ্য উৎপাদন ছিল ৯৫ লক্ষ মে.টন। বর্তমানে সেই আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৮৫ লক্ষ হেক্টর অথচ দেশে ২০১৭-১৮ বছরে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে ৪০৭.১৪ লাখ মেট্রিক টন। ১৯৭১ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ৭ কোটি আর বর্তমানে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ কোটিতে। আবার প্রতি বছর দেশে যোগ হচ্ছে ২৪ লক্ষ নতুন মুখ। অন্যদিকে প্রতিনিয়তই আমাদের দেশের আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এক হিসেবে মতে শিল্পকারখানা স্থাপন, নগরায়ন, আবাসন, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও নদী ভাঙনের ফলে প্রতি বছর দেশ থেকে ৬৮,৭০০ হেক্টর করে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার কারণেও প্রতিদিন ২০ শতাংশ করে ফসলি জমি কমছে। মোদ্দাকথা বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো প্রাকৃতিক প্রতিক‚লতা সত্তে¡ও আমাদের কৃষি কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েনি; মাথা উঁচু করে সগৌরবে চলমান রয়েছে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের চাহিদা মেটাতে কৃষকদের সাথে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন তাদের সহযোগী সকল প্রতিষ্ঠান দিন-রাত পরিশ্রম করে নতুন নতুন জাত আবিষ্কার, কৃষিপ্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করে যাচ্ছেন কৃষিবিদরা ও তাঁদের সহযোগীরা আর কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাঁদেরকে সার্বিক সহায়তা করে যাচ্ছে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার।
বঙ্গবন্ধুর সেই কৃষি উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর সফল সরকারের শাসনামলে আজ সার্বিক কৃষিতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কৃষিতে এখন বহুমুখীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে। বর্তমান সরকার খ্যাতি পেয়েছে ‘কৃষি বান্ধব’ সরকার হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর কৃষি উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকার কারণে আজকের খাদ্যে স্বয়ম্ভর বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে স্বীকৃতি পেয়েছে।
বলতে দ্বিধা নেই, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সব সেক্টরে বর্তমান সরকার যেভাবে পৃষ্ঠপোষকতাসহ সরকারি অনুদান প্রদান করে যাচ্ছে সেটি এশিয়া মহাদেশের কোথাও নেই। এমনকি পৃথিবীর খুব কম দেশেই এমনটি আছে। বিগত ২০১৯ সালে থাইল্যান্ড ও ভারতে অনুষ্ঠিত দু’টি আন্তর্জাতিক কৃষি সভায় (৬ঃয ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈড়হভবৎবহপব ড়হ অমৎরপঁষঃঁৎব, ২০১৯, ইধহমশড়শ ,ঞযধরষধহফ ্ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঝবসরহধৎ ড়হ অমৎরপঁষঃঁৎব, জবংবধৎপয ওহফঁংঃৎু ্ খরাবষরযড়ড়ফ, ২০১৯, ইঈকঠ, কধষষুধহর, ডবংঃ ইবহমধষ, ওহফরধ) যোগদান শেষে আমার মধ্যে এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে। কৃষি উন্নয়নসহ আমাদের সাম্প্রতিক সর্বিক উন্নয়ন সূচককে বিশ্ব মহল রীতিমতো বিস্ময়ের চোখে দেখছেন। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়িখ্যাত বাংলাদেশ এখন, তলাযুক্ত সম্পদশালী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ। কৃষি সেক্টরে সরকারের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা, অসামান্য অর্থায়ন, নির্বিঘœ সার সরবরাহের ব্যবস্থা, বারবার সারের মূল্য হ্রাস, অধিক কৃষিভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ, কৃষিতে ভর্তুকি প্রদান, ৫০-৭০% সাশ্রয়ী মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতির সরবরাহ এবং কৃষি প্রণোদনাসহ অনান্য কৃষিবান্ধব নীতির যথাপোযুক্ত রূপায়ন এবং কৃষক, কৃষিবিদ ও এঁদের সহযোগীদের সম্মিলিত প্রয়াসেই আজকে আমরা মাথা উঁচু করে বলতে পারছি।
ি চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় স্থানে;
ি সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় স্থানে;
ি পেয়ারা উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ স্থানে;
ি মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ স্থানে;
ি ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ স্থানে;
ি আম উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে সপ্তম স্থানে;
ি আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে সপ্তম স্থানে;
ি কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বাংলাদেশ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষস্থানে;
ি ফল ফসলের জাত উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বসেরা স্থানে।
বৈশ্বিক ও জাতীয় করোনা সংকট মোকাবেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষি উৎপাদনের ধারা সচল রাখার জন্য ৪% সরল সুদে কৃষি ঋণ বিতরণসহ প্রতি ইউনিয়নে কালিকাপুর মডেল অনুসরণ করে ৩২টি সবজি বাগান করাসহ নানাবিধ কৃষি উন্নয়নমূলক কার্যক্রম ও প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনা সংকটের ধারাবাহিকতায় খাদ্য সংকট যেন কোনভাবেই জাতীয় সমস্যার সৃষ্টি না করে সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রেখে কৃষি মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করে চলেছেন।
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থায়নে আমাদের কৃষি যেভাবে দুর্দান্ত ও দুর্বার গতিতে সম্মুখপানে এগিয়ে চলেছে, তাতে করে আগামী দিনে বাংলাদেশের কৃষি বিশ্ব সেরা স্থান দখল করবেই করবে।
আমরা সেই সুদিনের অপেক্ষায়।
জয়তু বঙ্গবন্ধু! মুজিববর্ষ সফল হোক। য়
পরিচালক (প্রশাসন), জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমী, গাজীপুর, মোবাইল: ০১৭১১৮৮৪১৯১, ইমেইল: akhtar62bd@gmail.com
ড. খান মোঃ মনিরুজ্জামান
বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর সমুন্নত আসন,
জাতিসংঘে জাতির পিতার বাংলায় ভাষণ।
বিশ্ব দরবারে মোদের সম্মান,
বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ সবার হৃদয়ে সুমহান।
হায়েনার গুলিতে পিতার হৃদয়,
ইতিহাস এ নিষ্ঠুর বর্রতার ঘৃণ্য কথা কয়।
বত্রিশ কাঁদে, কাঁদে বাংলাদেশ,
বাঙালি হৃদয়ে চিরভাস্বর বঙ্গবন্ধুর বেশ।
বাঙালির অস্তিত্বে বঙ্গবন্ধু ভাব,
সন্তানের অস্থি-মজ্জায় তার পিতৃ স্বভাব।
বাঙালি তাঁর পরানের পরান,
গাহি মোরা সবে এমন দরদীর জয়গান।
মরিয়া অমর যাঁরা বিশ্ব চরাচরে,
ধুলি ধরায় হীরাজ্ঞানে বাঙালি হৃদয়ে ধরে।
মোদের বঙ্গবন্ধু এমনি একজন,
তুলনা হয় না তাঁর খুঁজে ফিরে জনম জনম।
নিষ্ঠুরতা তাঁরে ভুলাতে পারে নাই,
বাঙালি হৃদয়ে তাঁর নিগূঢ় ভালবাসার ঠাঁই।
বঙ্গবন্ধুকে ভুলানোর বৃথা চেষ্টা,
তাঁর প্রতি বেড়েছে বাঙালির আরও তেষ্টা।
ইতিহাস বিকৃতির দোসর যাঁরা,
ইতিহাসের পচা ভাগাড়ে নিক্ষেপিত তারা।
সত্যি কি আর লুকানো যায়?
ইতিহাস কালের সাক্ষী বিশ্ব পাঠশালায়।
অপশক্তির সব মিথ্যার প্রলাপ,
ইতিহাসে সময়ের প্রেক্ষিতে তাদের অভিশাপ।
সত্য রুধিতে পারে না কোনকিছু,
মিথ্যা চলে কেবল ধূর্ত মিথ্যুকের পিছু পিছু।
সাগরের মত উদার হৃদয় যাঁর,
মানুষ বধে না তাঁরে, বধে বিচ্ছু কুলাঙ্গার।
হত্যা করা যায় কি বঙ্গবন্ধুরে?
সেতো আছে বাঙালির পুরাহৃদয় মন ভরে।
পঁচাত্তর পর বঙ্গবন্ধুর নির্বাসন,
ফুল ফসলে খালে বিলে তাঁর রচনা বিরচন।
নবজাতকেরে আলো-জলে কয়,
মুজিবের এদেশে বঙ্গবন্ধু তোমার পরিচয়।
নির্বাসনে দিয়ে কি লাভ তব বল?
তাঁর দেশে তাঁরে নকল করেই তো তুমি চল।
এ দেশে তোমার কোন ইতিহাস নাই,
বঙ্গবন্ধুর মাঝে তো আমি তোমারে খুঁজে পাই।
কাজেই চাতুরী বন্ধ কর বেঈমান,
চ‚ড়ান্ত বিজয়ে হেরে যায় পাপিষ্ঠ শয়তান।
দেশে বঙ্গবন্ধুর সৃষ্ট সংবিধান,
বঙ্গবন্ধুর দেশে বঙ্গবন্ধু তো শিখা অনির্বাণ।
বিশ্বনেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা,
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের জ্যেষ্ঠ কন্যা।
পিতার আদর্শের ধারক ও বাহক,
পিতা যে তাঁর মহাকালের নায়কের নায়ক।
আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার,
জাতির অহংকার তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ,
এমন দিনের স্বপ্নে মোর বঙ্গবন্ধু মহীয়ান।
একচল্লিশে উন্নত বিশ্বের মিশন,
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার ভিশন।
বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ অনুকরণ,
তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়া কার্যকরণ। য়
জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার, ডিএই, ঝিনাইদহ। মোবাইলনং- ০১৭১২-৮২২৭৪৯, ই- মেইল : dr.md.monir7@gmail.com
মো. সজীব আল মারুফ
ভারত উপমহাদেশের অসহযোগ আন্দোলনের পথিকৃৎ মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘একজন ক্ষুধার্ত ব্যক্তি এক টুকরো রুটির মধ্যে ¯্রষ্টাকে দেখেন’। বঙ্গবন্ধু এই ঐতিহাসিক বাণী উপলব্ধি করে বলেছিলেন, “খাবার অভাব হলে মানুষের মাথা ঠিক থাকে না। সে জন্য খাওয়ার দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে অন্নহীন মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিতে”। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু প্রত্যাগমন করেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রথম আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে যে বিষয়টি দৃঢ়ভাবে তুলে ধরেন তাহলো: ‘অর্থনীতিকে অবশ্যই পুনর্গঠন করতে হবে। খাদ্য, আশ্রয় ও বস্ত্র অবশ্যই দিতে হবে মানুষকে’ (বাঙালির মহামানব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মো. ফজলুল হক, ২০১৮)। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই স্বাধীনতা আমার কাছে সেদিনই প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেদিন বাংলাদেশের কৃষক, মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে। আমাদের এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে হবে, যে সমাজে এই কৃষকরা, এই শ্রমিকরা, এই ক্ষুধার্ত জনগণ আবার হাসতে পারবে। জনগণের প্রাণ ধারণের অন্যতম চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা বিধান করা না গেলে স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়বে। কাজেই সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি, মূলত সংগ্রাম মাত্র শুরু হয়েছে। এবারের সংগ্রাম সোনার বাংলা গড়ে তোলার সংগ্রাম। বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা হবে না’ (বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অর্থনীতি, মো. শাহাদাৎ হোসেন, ২০১০)।
স্বাধীনতার পর জনগণের মুখে অন্ন তুলে দেওয়া ছিল কঠিন কাজ। সে সময় হালের বলদই ছিল চাষাবাদের প্রধান হাতিয়ার। কিন্তু যুদ্ধের সময় অধিকাংশ কৃষক ঘর ছাড়া। যুদ্ধ শেষে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হালের বলদ আর পাওয়া যায়নি। ফলে কৃষক জমি চাষ করতে পারছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে এক লাখ হালের বলদ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ৫০ হাজার গাভীও বিতরণ করা হয়। একই সঙ্গে সে সময়েই উদ্যোগ নেওয়া হয় বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন মান্ধাতার আমলের কৃষি দিয়ে বাংলার মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। কৃষিকে হতে হবে আধুনিক। কৃষি হতে হবে তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর। বাংলার কৃষক ও কৃষিবিদ সমাজ ক্ষুধামুক্ত সোনার বাংলা গড়ার সঠিক দিকনির্দেশনা পায় কিন্তু ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট থেমে যায় একটি দীর্ঘ স্বপ্নের যাত্রাপথ। বঙ্গবন্ধু কতিপয় স্বার্থান্ধ, উচ্চাভিলাষী বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে সপরিবারে নিহত হন। সেই সাথে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায় তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর কৃষির স্বপ্ন।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্বপ্ন দেখেছিলেন, ‘বিশ্ব জগত দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে’। ইন্টারনেট প্রযুক্তির মাধ্যমে সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। মোবাইল ও কম্পিউটারে ইন্টারনেট সংযুক্তি সারা পৃথিবীকে হাতের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে । দেশে ৯৭% লোক মোবাইল ব্যবহার করে। কৃষি তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎপাদন বাড়ে এটি নিশ্চিত একটি বিষয়। বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনার হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর আধুনিক তথা প্রযুক্তিনির্ভর কৃষির দিকে এগিয়ে চলছে আমাদের কৃষি।
আগের দিনে কৃষকেরা অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করতেন। কৃষি সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হতো। কৃষকেরা তাঁদের ফসল, হাঁস-মুরগির খামার ও মৎস্যসম্পদের বিভিন্ন রোগবিষয়ক তথ্য সময়মতো না পাওয়ায় ক্ষতির সম্মুখীন হতেন। এসব রোগের দ্রæত সমাধান সব সময় পাওয়া যেত না। কিন্তু এখন কৃষিক্ষেত্রে দেশ অনেক এগিয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে। মুঠোফোন, কম্পিউটার ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভ‚মিকা রাখছে। কৃষিতে তথ্য প্রযুক্তি নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। বিশ্বের সঙ্গে তালমিলিয়ে দিনদিন দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে অর্থনীতির চাকা। আর এই এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে দেশের অন্যান্য খাতের মতো কৃষির অবদানও অনেক। বঙ্গবন্ধু কৃষিতে যে বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন সেই কৃষির নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন হয়েছে। আর এই বিপ্লবের পেছনে কৃষি-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সাধারণ কৃষক যেমন জড়িত, তেমনি প্রযুক্তির অবদান রয়েছে ব্যাপক। এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৮৪ শতাংশ কৃষক মুঠোফোন ব্যবহার করেন। তাদের অধিকাংশই এখন কৃষি তথ্য পেতে সহায়তা নিচ্ছেন তথ্য প্রযুক্তির। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সরকারের সুপ্রসারিত কৃষিনীতিতে রয়েছে আর্থসামাজিক উন্নয়ন, বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাণিজ্যিক কৃষি উন্নয়ন, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং উন্নয়নসহ কৃষির আধুনিকীকরণ, নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও স¤প্রসারণে গবেষণা সুবিধা বৃদ্ধিসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ। অন্যদিকে প্রতি বছর কৃষি জমি কমতে থাকা, জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টাবিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ।
বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টায় ডিজিটালাইজেশন ঘটছে আমাদের কৃষিতে। ডিজিটাল কৃষিতথা ই-কৃষি প্রবর্তনের ধারা জোরদার করা হয়েছে। কৃষিকল সেন্টারে ১৬১২৩ নম্বর এ যে কোন অপারেটরের মোবাইল ফোন থেকে প্রতি মিনিটে ২৫ পয়সা হারে কল করে কৃষকরা কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ে যে কোন সমস্যার তাৎক্ষণিক বিশেষজ্ঞ পরামর্শ পাচ্ছেন । গ্রাম পর্যায়ে স্থাপিত কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি) এর মাধ্যমে কৃষকেরা নিজেরাই নিজেদের মাঝে তথ্য সেবা গ্রহণ ও বিতরণের কাজটি করছেন। এসব কেন্দ্রে প্রশিক্ষণসহ যাবতীয় আইসিটি উপকরণ (কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, মডেম, ক্যামেরা ইত্যাদি) সরবরাহ করা হয়েছে। কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে কৃষি পরামর্শ গ্রহীতাদের অনলাইনে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। এর ফলে প্রান্তিক জনগণের মাঝে তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ বৃদ্ধি হয়েছে। বর্তমানে দেশব্যাপী ৪৯৯টি কেন্দ্রতাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রতিটি এআইসিসি থেকে দৈনিক ২২-২৫ জন মানুষ তথ্য সেবা পেয়ে উপকৃত হচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলায় স্থাপন করা হয়েছে টাচ স্ক্রিন কিওস্ক। কৃষিবিষয়ক বিভিন্ন তথ্য, অডিও ভিডিও কনটেন্ট ইত্যাদি খুব সহজেই ব্যবহারের একটি অনন্য মাধ্যম হলো টাচ স্ক্রিন কিয়স্ক। হাতের স্পর্শে প্রতিযোগিতা ছাড়াই একজন ব্যবহারকারী খুব সহজেই তার কাক্সিক্ষত তথ্যটি এই কিয়স্ক থেকে পেতে পারেন। কিয়স্কের ভেতর কৃষি তথ্য সার্ভিস কর্তৃক নির্মিত বিভিন্ন ই-বুক, ভিডিওসামগ্রী, অডিওসামগ্রী, এআইসিসি ডাটাবেইজ ইত্যাদি সন্নিবেশিত করা হয়েছে। তাছাড়া এসব কিয়স্কে উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগও প্রদান করা হয়েছে। আগ্রহী কৃষক বা যেকোন ব্যবহারকারী তাঁর প্রয়োজনীয় কৃষি তথ্য এখান থেকে নিতে পারছেন।
কৃষক, স¤প্রসারণকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সবার বছরব্যাপী আইসিটিভিত্তিক প্রশিক্ষণের জন্য কৃষি তথ্য সার্ভিস দশটি আধুনিক আইসিটিল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি ল্যাবে ২৫টি ডেস্কটপ কম্পিউটার, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ইন্টারনেট সংযোগসহ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ প্রশিক্ষণার্থীদের আইসিটি বিষয়ক প্রশিক্ষণের জন্য আদর্শ ভেন্যু হিসেবে বিবেচিত। এসব ল্যাবে শুধু কৃষি তথ্য সার্ভিসের বিভিন্ন প্রশিক্ষণই নয়, কৃষি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও যথাযথ অনুমোদন সাপেক্ষে প্রশিক্ষণ কাজে ব্যবহার করতে পারেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে আইসিটিভিত্তিক নিরবচ্ছিন্ন প্রশিক্ষণ, কর্মশালার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনে এসব ল্যাব কার্যকর ভ‚মিকা রেখে চলেছে।
কৃষকের দোরগোড়ায় ডিজিটাল সেবা পৌঁছে দেওয়া এবং দেশব্যাপী ই-কৃষি সেবা স¤প্রসারণের লক্ষ্যে সম্প্রতি ডিজিটাল প্লাটফর্ম ‘কৃষিবাতায়ন’ এবং ‘কৃষকবন্ধু’ ফোন সেবা চালু হয়েছে। ‘কৃষি বাতায়ন’ ব্যবহারের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে কৃষি স¤প্রসারণ কর্মীর সঙ্গে কৃষকের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ, কৃষি গবেষণার সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের সংযোগ সাধন, কৃষি তথ্যভিত্তিক জ্ঞানভাÐার গড়ে তোলা এবং মাঠপর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিবিধ রিপোর্ট আদান-প্রদান সহজ হচ্ছে। এ বাতায়নের সহায়ক মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ‘কৃষকবন্ধু ফোন সেবা’র মাধ্যমে ৩৩৩১ নম্বরে ফোন করে কৃষক নিকটস্থ উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংযোগ স্থাপন এবং অতি সহজে প্রয়োজনীয় কৃষি সেবা পাচ্ছেন।
সম্প্রতি বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতিতে কৃষি মন্ত্রণালয় দেশের খাদ্যশস্য ও কৃষিপণ্যের সঠিক বিপণন, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, চাহিদা মোতাবেক সহজলভ্যতা তৈরি এবং জরুরি অবস্থায় ফুড সাপ্লাইচেইন অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশের প্রথম উন্মুক্ত কৃষি মার্কেটপ্লেস ফুড ফর ন্যাশন (িি.িভড়ড়ফ ভড়ৎহধঃরড়হ. মড়া.নফ) চালু করা হয়েছে। এই মার্কেটপ্লেসটি সম্পূর্ণ ফ্রি প্ল্যাটফর্ম, এর ব্যবহার করে ক্রয়-বিক্রয় বা বিজ্ঞাপন দেয়া যাবে বিনামূল্যে।
জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় কৃষিমন্ত্রীর যুগোপোযোগী পরিকল্পনা, পরিশ্রমী কৃষক এবং মেধাবী কৃষিবিদের যৌথ প্রয়াসেই এ সাফল্য। য়
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার, দৌলতপুর, কুষ্টিয়া, মোবাইল : ০১৭২৩২৬৯৮৭৩, ই-মেইল : sagibmaruf@gmail.com
কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন
বাংলাদেশে ক্ষুধা নিয়ে আপাতত কোন দুশ্চিন্তা নেই কিন্তু চিন্তা এখন অদৃশ্য ক্ষুধা (ঐরফফবহ ঐঁহমবৎ) বা অপুষ্টিকে ঘিরে। ক্ষুধা নিবারণে আমাদের দেশের কৃষকরা প্রতি বছর প্রায় চার কোটি মেট্রিক টন দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদন করছেন, অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকা সত্তে¡ও ও এটা আমাদের বিশাল সাফল্য; কিন্তু খাদ্য হিসেবে আমাদের শুধু কার্বহাইড্রেট বা শর্করা খেলে তো হবে না, আমাদের প্রয়োজন সুষম খাদ্য। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ আর্থিক অসচ্ছলতা বা সচেতনতার অভাবে বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবার যেমন-মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, কলা, আঙুর, আপেল ইত্যাদি পরিমাণে কম গ্রহণ করছেন। এ অবস্থায় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা মেটানো সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নলালিত সোনার বাংলা বিশ্ব দরবারে উন্নত দেশের কাতারে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে। বর্তমানে বাংলাদেশ নিম্নমধ্য আয়ের দেশ। আগামী ২০৪১ সালে বিশ্বে উন্নত দেশে উপনীত হওয়ার লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যসমূহ অর্জনের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এসডিজির উল্লেখযোগ্য লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়া এবং প্রতিটি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রচিত ১৯৭২ সালের সংবিধানে নাগরিকের পুষ্টি উন্নয়ন কে রাষ্ট্রের প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। ১৯৭২ এর সংবিধানে উল্লেখ করা হয় ‘জনগণের পুষ্টিস্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্রের প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবে’।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা এবং এসডিজির ২নং অভীষ্ট অর্জনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট(ব্রি) বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান যেমন- জিংক, আয়রন, প্রোটিন, মিনারেলস্সহ শরীরের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদানগুলো দেহের প্রয়োজন অনুসারে চালে সংযোজন, সরবরাহ বা পরিমাণে বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কাজ করছে। পুষ্টিসমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবনে বিশ্বের সর্বাধুনিক বায়োফর্টিফিকেশন ও জিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।
বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাত ও প্রযুক্তি এবং সরকারের নানামুখী ইতিবাচক পদক্ষেপের ফলে দেশে বিগত বারো বছরে (২০০৯-২০) চালের উৎপাদন ৬.০০ লক্ষ টন হারে বেড়েছে এবং উৎপাদন বৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত আছে। সরকারের ভিশন ২০২১ এবং ২০৪১ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে ব্রি ইতোমধ্যে ‘রাইস ভিশন ২০৫০’ প্রণয়ন করেছে। রাইস ভিশনে যে প্রক্ষেপন করা হয়েছে তাতে দেখানো হয়েছে উৎপাদনের বর্তমান গতিশীলতা অব্যাহত থাকলে ২০৩০, ২০৪১ এবং ২০৫০ সালে চালের উৎপাদন হবে যথাক্রমে ৪০, ৪৪ এবং ৪৭ মিলিয়ন টন। বিপরীতে ২০৩০, ২০৪১ এবং ২০৫০ সালে যথাক্রমে ১৮৬, ২০৩ এবং ২১৫ মিলিয়ন লোকের খাদ্য চাহিদা পূরণে চাল প্রয়োজন হবে যথাক্রমে ৩৮.৫০, ৪২ এবং ৪৪.৬ মিলিয়ন টন। অর্থাৎ বর্তমানের ন্যায় সামনের দিনগুলোতেও চাহিদা মিটিয়ে কিছু উদ্বৃত্ত উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়েই ব্রির গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। অন্য পুষ্টিকর খাবার জোগাড় করতে না পারলেও দু বা তিন বেলা ভাতের সংস্থান প্রায় সকলেরই সামর্থ্যরে মধ্যে। সুনিদিষ্ট করে বলতে গেলে, প্রতি ১০০ গ্রাম চাল থেকে আমরা মোটামুটি ১২৯ কিলোক্যালরি শক্তি, ৭৮.০৯ গ্রাম শর্করা, ৭.১২ গ্রাম প্রোটিন, ০.২৮ গ্রাম চর্বি, ১.৩০ গ্রাম আঁশ ০.০৭ মি. গ্রাম থায়ামিন, ০.০১৫ মি. গ্রাম রিভোফ্লাবিন, ১.০৯ মি. গ্রাম জিংক, ২৮ মি. গ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৮০ মি. গ্রাম আয়রন, ২৫ মি. গ্রাম ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপোদান থাকে (ইউএসএইড পুষ্টি ডেটাবেজ)। বাংলাদেশে মাথাপিছু চালের গ্রহণ হার হিসেবে মোটামুটি দৈনিক যে পরিমাণে পুষ্টি আমরা চাল বা ভাত থেকে পাই যা কোনভাবেই আমাদের চাহিদার সমান নয়। এ কারণে খাদ্যের চাহিদা মিটলেও পুষ্টির চাহিদায় পূরণে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর প্রায় দু-তৃতীয়াংশই কোনো না কোনো মাত্রার অপুষ্টিতে ভুগছে, এর মধ্যে শতকরা ১৪ ভাগ শিশু ভুগছে মারাত্মক অপুষ্টিতে। এর কারণ পুষ্টি সচেতনতার অভাব অথবা পুষ্টিকর খাবার ক্রয় করার অসামর্থতা।
এটি বিবেচনায় নিয়ে বিজ্ঞানীরা ভাবছেন ভাতে কিভাবে শরীরের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপোদানগুলো দেহের প্রয়োজন অনুসারে সংযোজন, সরবরাহ বা পরিমাণে বৃদ্ধি করা যায়। কেননা দেশের সাধারণ মানুষ দুধ-ডিম ও মাংসসহ অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার কিনতে না পারলেও তারা ভাত নিয়মিত খেতে পারছে। এজন্য জিংক, আয়রন, প্রোটিন, এন্টি-অক্সিডেন্ট, গামা এমাইনো বিউটারিক এসিড (এআইএ) ও প্রো-ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ গোল্ডেন রাইস এবং স্বল্প জিআই সম্পন্ন ডায়বেটিক ধানসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর ধান উদ্ভাবন করেছে ব্রি। দেশের সাধারণ মানুষ ৭০ থেকে ৭৫% কার্বোহাইড্রেট এবং ৬০ থেকে ৬৫ প্রাত্যহিক প্রোটিন ভাতের মাধ্যমে পাচ্ছেন। সুতরাং ভাত বহির্ভূত উৎস থেকে আমাদের বাকী ২৫% থেকে ৩০% কার্বোহাইড্রেট এবং ৩৫ থেকে ৪০% প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ করার কৌশল ঠিক করতে হবে।
ব্রির পুষ্টিকর ধান গবেষণায় প্রথম সাফল্য আসে ২০১৩ সালে। ব্রির বিজ্ঞানীরা বিশ্বের সর্বপ্রথম জিংকসমৃদ্ধ ধানের জাত ব্রিধান ৬২ উদ্ভাবন করেন। মানব শরীরের জন্য জিংক খুব প্রয়োজনীয় একটি খনিজ উপাদান। মানবদেহে ২০০ এর ও বেশি এনজাইমের নিঃসরণে অংশগ্রহণ করে যেগুলো দেহের অনেক বিপাকীয় কাজে এটি অংশ নেয়। এছাড়া দেহে এন্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, শর্করার ভাঙনে, দেহ কোষের বৃদ্ধিতে এবং পলিপেটাইড, গ্যাসটিন নিঃসরণের এর মাধ্যমেই স্বাদের অনুভূতি বা রুচি বাড়াতে ভূমিকা রাখে। জিংক ডিএনএ ও আরএনএ পলিমারেজ এনজাইমের একটি আবশ্যক উপাদান। হাড়ের বৃদ্ধির জন্য কেরাটিন তৈরি ও তার পরিপক্কতা, ত্বকের ক্ষত সারানো, আবরনি কোষের রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি কাজে মানব শরীরে জিংকের প্রয়োজন হয়। উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরীদের বেড়ে উঠার ব্যপারে জিংকের অভাব হলে শিশু-কিশোররা বেটে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু জিংক সমৃদ্ধ জাতের ভাত খেলে শরীরে জিংকের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটে যাবে এবং বেটে হবার সম্ভানা থাকবে না।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের শরীরে জিংকের দৈনিক চাহিদা ১৫ মিলিগ্রাম এবং প্রাপ্তবয়স্ক নারীর দৈনিক চাহিদা ১২ মিলিগ্রাম। ব্রিধান ৬২তে জিংক এর পরিমাণ ১৯ মিলিগ্রাম। অর্থাৎ মানুষের শরীরে জিংকের যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে তার পুরোটাই মিটাতে পারে ব্রিধান ৬২ জাতের চাল। সাধারণত লাল মাংস, কাঠ বাদাম, চিনা বাদাম, সয়া, দুগ্ধজাত খাবার, মাশরুম, যকৃত এবং সূর্যমুখীর বীজ জিংকের চমৎকার উৎস কিন্তু ভাতের ন্যায় এগুলো সহজলভ্য নয়। পরবর্তীতে ব্রি জিংক সমৃদ্ধ আরো চারটি জাত যেমন- ব্রি ধান৬৪, ব্রি ধান৭২, ব্রি ধান৭৪ এবং ব্রি ধান৮৪ অবমুক্ত করে। এই জাতগুলোর চাল জিংকের চাহিদা মেটাতে আদর্শ অপশন হতে পারে।
অনুরূপভাবে, প্রোটিন বা আমিষের অভাবে দেহে সুনির্দিষ্ট অভাবজনিত লক্ষণ দেখা দেয়। শরীরের প্রতি কেজি ওজনের জন্য পূর্ণ বয়স্কদের ক্ষেত্রে ১ গ্রাম, শিশুদের জন্য ২-৩ গ্রাম আমিষের প্রয়োজন। মাছ, মাংস ও ডাল প্রোটিনের অন্যতম উৎস হলেও এসব খাবার ভাতের মতো সহজলভ্য নয়। ব্রি উদ্ভাবিত প্রোটিনসমৃদ্ধ জাতগুলোতে যে পরিমাণ প্রোটিন রয়েছে তা আমাদের প্রোটিনের চাহিদার ৬০ ভাগ পূরণ করতে সক্ষম। যেমন-ব্রিধান ৬২তে প্রোটিনের পরিমাণ প্রায় শতকরা ৯ ভাগ। ফলে এই ধানটির ভাত মানবদেহে জিংকের পাশাপাশি প্রোটিনের চাহিদাপূরণে ও অনন্য ভূমিকা রাখতে পারবে।
গবেষণায় দেখা গেছে যদি ১% প্রোটিনের পরিমাণ চালে বৃদ্ধি করা যায়, তবে মানব শরীরে ৬.৫% বেশি চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে। আমাদের পুরানো ধানের জাতগুলোর প্রোটিনের মাত্রা ছিল মাত্র ৮ থেকে ৯% তবে আমাদের নতুন জাতগুলোর প্রোটিনের পরিমাণ ৯ থেকে ১০%। উদাহরণ স্বরূপ- ব্রি ধান৮১ এ প্রোটিনের পরিমাণ ১০.৩%, ব্রি ধান ৮৬ এ প্রোটিনের পরিমাণ ১০.১%, এবং ব্রি ধান৯৬ এ প্রোটিনের পরিমাণ ১০.৮%। এই জাতগুলো জনপ্রিয় ও সহজলভ্য করা গেলে পুষ্টি নিরাপত্তা নিয়ে যে আশঙ্কা তা অনেকাংশেই মোকাবেলা করা সম্ভব। ভবিষ্যতে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ১২ থেকে ১৩% প্রোটিন সমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবন করা যাতে আমরা চাল থেকে প্রতিদিনের প্রোটিন চাহিদার কমপক্ষে ৮০% প্রয়োজন পূরণ করতে পারি।
আমাদের নতুন জাত ব্রি ধান৮৪ তে আয়রনের পরিমাণ ১০পিপিএম; আগে ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলোতে আয়রনের পরিমাণ ছিল ৩ থেকে ৫ পিপিএম। ব্রির ‘হেলদিয়ার রাইস’ গবেষণা কর্মসূচির অধীনে এখন ৪৫ পিপিএম জিংক এবং ১৫ পিপিএম আয়রন সমৃদ্ধ দ্বৈত সুবিধার নতুন জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা যাতে মানব শরীরের মোট চাহিদার কমপক্ষে ৮০% জিংক এবং ৫০% আয়রনের চাহিদা চালের মাধ্যমে পূরণ করা যায়।
এছাড়া আমরা জানি ভিটামিন-এ এর ঘাটতি এখনো বাংলাদেশের একটি প্রধান জন স্বাস্থ্য সমস্যা। দেশের প্রি-স্কুল এবং স্কুল-বয়সী শিশুদের ২০% এর বেশি এবং গ্রামাঞ্চলে ২৫% গর্ভবতী মহিলা ও স্তন্যদানকারী মা এই সমস্যায় ভোগেন। অবমুক্তির অপেক্ষায় থাকা ভিটামিন এ সমৃদ্ধ ধান গোল্ডেন রাইস আমাদের এই সমস্যা সমাধানে ভুমিকা রাখবে। আশা করা যাচ্ছে, গোল্ডেন রাইস অনুমোদিত ও অবমুক্ত হলে ভিটামিন এ এর চাহিদার ৩০-৫০% পর্যন্ত পূরণ করতে পারবে। কেননা গ্রামাঞ্চলের মানুষ দৈনিক ২-৩ বার ভাত খেয়ে থাকেন।
আগেই বলেছি চালকে প্রধান খাদ্যশস্য বিবেচনায় রাখতে হলে আমাদের কমপক্ষে ৭০ থেকে ৭৫% কার্বোহাইড্রেট বা ক্যালরি চাল থেকে নিতে হবে। তা না হলে ডায়াবেটিক, স্থুলতাসহ বিভিন্ন জীবনাচরিত (লাইফ স্টাইল) রোগ বেড়ে যাবে। সে হিসেবে মাথাপিছু চালের গ্রহণ জনপ্রতি ১৩৪ কেজি নিচে আসা উচিত হবে না। অথচ ইদানীং দেখা যাচ্ছে, অনেকে ওজন কমানোর জন্য খাদ্য তালিকা থেকে ভাত বাদ দিচ্ছেন। ভাতের পরিবর্তে তারা ফাস্ট ফুডের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছেন, যা ভাতের তুলনায় আরও বেশি ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবার।
অনেকে আবার বলে থাকেন নিয়মিত ভাত খেলে লাইফস্টাইল রোগ বাড়ে। এটা আসলে সত্যি নয় বরং আমরা প্রতিনিয়ত বাইরে যেসব স্ট্রিট ফুড বা মুখরোচক খাবার খাই, সেসব খাবারের সঙ্গে ট্রান্সফ্যাট খাচ্ছি এগুলোই লাইফস্টাইল রোগের জন্য অনেক খানি দায়ী।
পরিশেষে বলতে চাই, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য খাদ্য গ্রহণে আমাদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। এজন্য আমাদের দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা থাকতে হবে এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি আমাদের শিক্ষিত ও সুশীল সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশের প্রচার মাধ্যমগুলোকে এ বিষয়ে জনমত তৈরিতে সচেষ্ট থাকতে হবে। তাহলেই কেবল বঙ্গবন্ধুর কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পুষ্টিস্তর উন্নয়নের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। য়
ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১। ই-মেইল:smmomin80@gmail.com,, ফোন- ০১৭১৬৫৪০৩৮০।
মোতাহার হোসেন
গোপালগঞ্জে জন্ম নেয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন মুক্তিকামী,স্বাধীনতাকামী মানুষের এবং সকল প্রকার অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে চির প্রতিবাদ কণ্ঠস্বর। শুধু তাই নয় তিনি ছিলেন,বিশ্বের নিপীড়িত মানুষেরও মুক্তির পথপ্রদর্শক। তিনি মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে বাংলার আনাচে কানাছে ঘুরেছেন, কৃষক, শ্রমিক, চাষাভুসা, কামার কুমার, জেলে, তাঁতিসহ সর্বস্তরের মানুষের সাথে মিশেছেন, তাদের অভাব, অভিযোগ, সমস্যার কথা শুনেছেন, সমাধানে তাদের নিয়েই রাজপথে আন্দোলন করেছেন। ফলে বাংলার কৃষক শ্রমিক, ছাত্র, মজুর সকলের সমস্যা, অভাব তিনি জানতেন। তাই তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার পর পরই কৃষক, শ্রমিক, মজুর, ছাত্রসহ সকল স্তরের মানুষের কল্যাণে নিয়েছিলেন পৃথক পৃথক কর্মসূচি। তিনি একাদ্বারে কৃষক, শ্রমিক মুজুর, ছাত্র, শিক্ষকের, খেটে খাওয়া মানুষের নেতা। এমন এক মহীরুহ ছিলেন জাতির পিতা ১৯৭৫ সালে আগস্টের ১৫ তারিখ একদল ক্ষমতা লিপ্সু রাতের অন্ধকারে সপরিবারে হত্যা করেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে।
তিনি শোষণহীন সমাজ গঠনের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি বাংলার প্রত্যেক মানুষের জীবনের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজন আহার, কাপড়, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির জন্য নিজেকে বিসর্জন দিয়েছেন। বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে তিনি ছিলেন আপসহীন। বিপন্ন জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি জনগণের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। এ জন্য সারা জীবন জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন, এমনকি ফাঁসির দড়িও তাঁকে লক্ষ্য থেকে একচুল নড়াতে পারেনি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও বঙ্গবন্ধু বিজয়ীর বেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ফিরে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশে। ফিরে আসেন তাঁর প্রিয় জনগণের মাঝে। নিজেকে সঁপে দেন দেশ গড়ার কাজে। শুরু হয় জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তিলাভের সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন এ দেশের শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত কৃষকদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। তাই তিনি সব সময় কৃষির প্রতি শ্রদ্ধা ও অগ্রাধিকার প্রদান করেছিলেন। দার্শনিক রুশোর একটি উক্তি এখানে প্রাসঙ্গিক, তিনি বলেছিলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও গৌরবমÐিত শিল্প হচ্ছে কৃষি। শতাব্দীর মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী ও বিজ্ঞানমনস্ক। চির আধুনিক রাজনৈতিক নেতা। তিনি দার্শনিক রুশোর বাণীকে লালন করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, অর্থনৈতিকভাবে উন্নত ও সমৃদ্ধ একটি সোনার বাংলা গড়তে কৃষিশিল্পের উন্নয়ন অপরিহার্য। তিনি উপলব্ধি করতেন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন হতে না পারলে, মানুষের অন্ন সংস্থান করতে না পারলে সকল অর্জন ব্যর্থ হবে। তিনি বুঝেছিলেন কৃষি একটি জ্ঞাননির্ভর শিল্প। তাই শিক্ষিত জনগৌষ্ঠীকে দেশ গঠনে কৃষি কাজে মনোনিবেশ করার উপর গুরত্ব দিয়েছেলন। কারণ তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, গতানুগতিক কৃষিব্যবস্থা দ্বারা দ্রæত ক্রমবর্ধমান বাঙালি জাতির খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য চাই কৃষির ব্যাপক আধুনিকীকরণ, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। আর কৃষিশিল্পের আধুনিকীকরণ ও লাগসই উন্নয়নের একমাত্র কারিগর হচ্ছেন কৃষি শিক্ষায় শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটরা। এ জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের ১১ দফায় কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন। সব প্রতিক‚লতা সত্তে¡ও আত্মমর্যাদাশীল কৃষিবিদরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে দেশের বর্ধিষ্ণু জনগোষ্ঠীর খাদ্য জোগানে নিয়োজিত রয়েছেন। কৃষিবিদদের চিন্তাচেতনা, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, আধুনিক প্রযুক্তিগত ধারণা ও প্রগতিশীল কর্মকাÐের মাধ্যমে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ উপহার দিতে সক্ষম।
কৃষির সার্বিক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু যে মমত্ববোধ ও আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রæয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রদত্ত ভাষণটি একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে আজও সাক্ষ্য দেয়। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রæয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি গৌরবময় দিন। বঙ্গবন্ধু শত ব্যস্ততার মধ্যেও কৃষি ও কৃষকের টানে ছুটে এসেছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ শ্যামল আঙিনায়। এ দেশের কৃষি, কৃষক ও কৃষিবিদদের সঙ্গে যে তাঁর আত্মার সম্পর্ক ছিল তা প্রদত্ত ভাষণে তিনি স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি। সবুজ বিপ্লবের কথা আমরা বলছি। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের যে অবস্থা, সত্য কথা বলতে কী বাংলার মাটি, এ উর্বর জমি বারবার দেশ-বিদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে ও শোষকদের টেনে এনেছে এই বাংলার মাটিতে। এই উর্বর এত সোনার দেশ যদি বাংলাদেশ না হতো, তবে এতকাল আমাদের থাকতে হতো না। যেখানে মধু থাকে, সেখানে মক্ষিকা উড়ে আসে। সোনার বাংলা নাম আজকের সোনার বাংলা নয়। বহু দিনের সোনার বাংলা। বাংলার মাটির মতো মাটি দুনিয়ায় দেখা যায় না। বাংলার মানুষের মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলার সম্পদের মতো সম্পদ দুনিয়ায় পাওয়া যায় না। তিনি কৃষির গুরুত্ব উপলব্ধি করে বলেন, যেভাবে মানুষ বাড়ছে যদি সেভাবে আমাদের বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে, তবে ২০ বছরের মধ্যে বাংলার মানুষ বাংলার মানুষের মাংস খাবে। সে কারণেই আমাদের কৃষির দিকে নজর দিতে হবে এবং কৃষিবিদদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের কোট-প্যান্ট খুলে একটু গ্রামে নামতে হবে। কেমন করে হালে চাষ করতে হয়, এ জমিতে কত ফসল হয়, এ জমিতে কেমন করে লাঙল চষে, কেমন করে বীজ ফলন করতে হয়। আগাছা কখন পরিষ্কার করতে হবে। ধানের কোন সময় নিড়ানি দিতে হয়। কোন সময় আগাছা ফেলতে হয়। পরে ফেললে আমার ধান নষ্ট হয়ে যায়। এগুলো বই পড়লে হবে না। গ্রামে যেয়ে আমার চাষি ভাইদের সঙ্গে প্রাকটিক্যাল কাজ করে শিখতে হবে। তাহলে আপনারা অনেক শিখতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু কৃষি ও কৃষক তথা আপামর জনগণের মুক্তির জন্য আজীবন প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাঁর প্রদত্ত ভাষণ থেকে তা সহজেই অনুমেয়। তিনি ছিলেন আবহমান বাংলার একজন পথচারী। বংলার মাটির সাধারণ মানুষ। বঙ্গবন্ধুকে নির্মম ভাবে হত্যার মধ্যদিয়ে দেশের স্বাধীনতা,মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির সব পথ রুদ্ধ করে দেয় ঘাতক চক্র। সেই সঙ্গে কৃষের স্বপ্নও ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। বরং সার, বীজসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অলিখিত ভাবে দেশের কৃষকের উপর চালানেরা হয় এক প্রকারের স্টিম রোলার।
এই বৈশ্বিক দুর্যোগে বঙ্গবন্ধুর এবারের শাহাদতবার্ষিকী নতুন রূপে, নতুন আঙ্গিকে বিশেষ করে তাঁর জš§শতবার্র্ষিকীর এই শুভ লগ্নে তাঁকে নতুন করে , নব রূপে আবিষ্কার, তাঁর চেতনায়, তাঁর আদর্শের মশাল ভবিষ্যত প্রজšে§র কাছে পৌঁছে দেয়ার একটি বিরাট সুযোগ। বঙ্গবন্ধুকে, তাঁর প্রতিষ্ঠিত দলকে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, দুলক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম হানি আর বিপুল বিশাল সম্পদ ক্ষতির স্বীকার করে অর্জিত মহান স্বাধীনতাকে হৃদয়ে ধারণ করে সামনের দিকে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন শোষণ মুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়েই মূলত তাঁকে স্মরণ এবং সম্মান দেয়া সম্ভব হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই তাঁকে স্বরণ, অনুকরণ, অনুপ্রেরণাই হবে আজকের প্রজšে§র সামনে শিক্ষণীয়।
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি বাংলাদেশের এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় কবির ভাষায় বলা প্রাসঙ্গিক যে, ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত/বঙ্গবন্ধু মরে নাই/যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো/ বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই/তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা/আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা/যে মানুষ ভীরু কাপুরুষের মতো/ করেনি কো কখনো মাথা নত/এনেছিল হায়েনার ছোবল থেকে/ আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা/কে আছে বাঙালি তার সমতুল্য/ ইতিহাস একদিন দেবে তার মুল্য...।’
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মাশাল এখন বহন করছেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে কৃষি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পুষ্টি উন্নয়ন, মহিলাদের কৃষিতে অংশগ্রহণ ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে কয়েকটি বছর আবার কৃষি খাতের উন্নয়ন থমকে ছিল। ২০০৮ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত শক্তি আবার ক্ষমতায় এলে কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে সম্ভাবনার আরো এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। কৃষি খাতে আবার ভর্তুকি, সার বিতরণ ব্যবস্থা, সেচব্যবস্থার উন্নয়ন, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, শস্য বহুমুখীকরণসহ অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ১৯৭২ সালে অর্থাৎ স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে যেখানে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল প্রায় এক কোটি টন সেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে খাদ্যশস্যের উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৪ কোটি ৩২ লাখ টন। একই সময়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদেরও উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়েছে। কৃষি ক্ষেত্রে এ যুগান্তকারী সাফল্য, বঙ্গবন্ধুর অবদান বাঙালি জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ রাখবে।
বর্তমানে জনসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব, শিল্পায়ন নগরায়ণ, কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার, রাসায়নিক সার ও কল-কারখানার দূষিত বর্জ্যে কৃষিসম্পদ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য এ দেশের কৃষি, কৃষক, কৃষিবিদ ও কৃষিবান্ধব সরকারের যৌথ উদ্যোগে কাজ করে চলছে। এই দিনে তাঁর বিদেহী আতœার মাগফেরাত কামনা করছি। একই সঙ্গে এ দিনে তাঁর পরিবারের অপরাপর শহীদ সদস্যদের রূহের মাগফেরাত কামনা করছি। য়
সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জা জার্নালিস্ট ফোরাম। মোবাইল ০১৮৪১৮১২৭৫ motaherbd123@gmail.com
ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জনক বঙ্গবন্ধু শুধু স্বাধীনতার কথাই বলেননি একই সাথে কোটি কোটি মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন। অর্থনৈতিক মুক্তি এবং খাদ্য ও পুষ্টির অভাব থেকে মুক্তির জন্য চিন্তা করেছেন। তাঁর চিন্তা চেতনার হাত ধরেই তাঁরই কন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সকল মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ সেক্টর। শুধু দুই বেলা দুমুঠো ভাত খেলেই হবে না। মেধাবী জাতি গঠনে পুষ্টিকর খাবার এবং আমিষ ও স্নেহ জাতীয় খাবারের জোগান এবং অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য প্রাণিসম্পদ বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম কৃষিবিদদের ক্লাস ওয়ান মর্যাদা দিয়েছিলেন। বর্তমানে তারই চিন্তার ফসল হিসাবে আজ আমরা আমিষের ঘাটতি থেকে বাড়তি অবস্থানে এসেছি। আমরা বঙ্গবন্ধু কন্যার নির্দেশনায় ভেটেরিনারিয়ান এবং কৃষিবিদদের ঐকান্তিক চেষ্টায় আমদানি থেকে রপ্তানির পর্যায়ে আসতে পেরেছি। যখন দেশের জনসংখ্যা মাত্র ৭-৮ কোটি ছিল তখনই দেশে আমিষের প্রচÐ ঘাটতি ছিল। এখন প্রতিটি মানুষ প্রতিদিনই মাংস দুধ ডিম খেয়ে থাকেন। পুষ্টিহীনতার কারণে রোগগুলোর হাত থেকে এখন দেশের মানুষ নিরাপদ।
গরু ছাগল পালনের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা চলমান আছে। গ্রামের মেয়েরাই কয়েকটি করে গরু ছাগল অনায়াসেই পালন করে তাদের সংসার চালিয়ে আসছেন। বর্তমানে মুসলমানদের ইদুল আজহার গবাদিপশু এখন আমাদের দেশের পশু দিয়েই চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মিল্ক ভিটা প্রতিষ্ঠা করে ডেইরি সেক্টরকের অগ্রযাত্রাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছেন। তিনি ডেইরি জোনকে লাভজনক করার জন্য সকল পদক্ষেপও গ্রহণ করেছিলেন। সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় ভালো ভালো ব্রিড আমদানি করে এসব অঞ্চলকে দুগ্ধ অঞ্চল হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর তৈরি করা এবং স্বপ্নের মিল্ক ভিটার মাধ্যমে খামারিরা দুধের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন। ঠিক তেমনি ভোক্তারা পাচ্ছেন ভালো মানের দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যসম্ভার। বর্তমানে বাংলাদেশের ডেইরি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে খামারিদের থেকে সবচেয়ে বেশি দামে এবং বেশি পরিমাণে দুধ সংগ্রহ করে থাকেন।
বর্তমানে আগের চেয়ে গুঁড়োদুধ কম আমদানি করা হয়। বাংলাদেশ এখন মাংস উৎপাদনে স্বনির্ভর। মানুষের জনপ্রতি গ্রহণের হার বেড়েছে অনেকাংশে।
বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলাদেশ যেন সব কিছুতেই বিদেশের ওপর নির্ভর না করে। তিনি স্বাধীনতার কথা বলার সাথে সাথে মুক্তির সংগ্রাম কথাটি বলেছেন। আমরা ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র বাংলাদেশ পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়েই তার স্বপ্নকে স্তব্ধ করে দেননি। তিনি মুক্তির জন্য প্রতিনিয়ত শ্রম ও মেধা এবং দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। ১৯৭১ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণ পর্যন্ত সর্বদা মানুষের মুক্তির ও পুষ্টির নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য সকল বিষয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
প্রাণিসম্পদের উন্নতির জন্য দেশে প্রতিষ্টিত হয়েছে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট। এখান থেকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বাস্তবিক বিষয়ে গবেষণা হয়ে প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। পূর্বে গবাদি প্রাণির অসংখ্য রোগবালাই অনেক প্রাণী মারা যেত, কিন্তু বর্তমানে ভ্যাকসিনের প্রয়োগ এবং বিজ্ঞানসম্মত খামার ও পরিচর্যায় রোগের প্রকোপ ও মৃত্যু অনেকাংশে কমানো সম্ভব হয়েছে।
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মুক্তির উপায় প্রাণিসম্পদ : গ্রামের মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা এবং পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিতে অন্যতম হাতিয়ার প্রাণিসম্পদ। ছোট থেকে বড় যে কোন পরিসরে খামার করে লাভবান হচ্ছেন সবাই। গ্রামে একটি ডেইরি খামার একদিকে যেমন উদ্যোক্তার আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উপায় ঠিক তেমনি এলাকার মানুষের তরল দুধের চাহিদা পূরণ করে পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মহিলাদের আর্থিক লাভবানের একমাত্র উপায় এই প্রাণিসম্পদ। গ্রামের মহিলারা তাদের হাতে সর্বদা টাকা থাকে যারা মুরগী, হাঁস, ছাগল ও গরু লালন পালন করেন। যাদের ডিম ও দুধ কিনে খাওয়ার সামর্র্থ্য নাই তারাও নিজেরা মুরগী ও গরু লালন পালন করে পুষ্টি ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু এই সোনার বাংলা গড়তে পুষ্টি খাদ্যে সমৃদ্ধ মেধাবী জাতি গঠনের কোনো বিকল্প নেই। বর্তমানে আমিষ ও স্নেহজাতীয় খাবার গ্রহণের প্রবণতা বেশি হওয়ার মেধাবি ও সুস্থ স্বাভাবিক সন্তান জন্মদানের সংখ্যা আগের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা মেধাবী জাতি গঠনের জন্য একটি সুসংবাদ। গ্রামের মানুষের পুষ্টির জন্য কারো প্রতি নির্ভর করতে হয় না। মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার জন্য গ্রামের পরিবেশ এখন অনেকাংশে শহরে সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে।
করোনাকালীন সময়ে পুষ্টি নিরাপত্তা দেবে প্রাণিসম্পদ : মহামারী করোনাভাইরাসের আক্রমণে সারা বিশ্ব কুপোকাত। প্রতিনিয়ত বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা এবং বাড়ছে লাশের মিছিল। করোনা ভাইরাসের ভয়াল থাবা থেকে বাদ পড়েনি বাংলাদেশও। এ দেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে। প্রাণিজ প্রোটিন এর গঠন বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষের ইমিউনিটি বৃদ্ধিতে সবচেয়ে ভ‚মিকা রাখে প্রাণিজ আমিষ। মাংস, ডিম ও দুধের মধ্যে উপকারী এমাইনো এসিড এবং অন্যান্য মূল্যবান উপাদান আমাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উন্নত করে।
বর্তমানে চিকিৎসকরা যাদের করোনা পজিটিভ পেয়েছেন এবং যে কোন সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চিকিৎসার পাশাপাশি প্রাণিজ আমিষ গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন।
উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার উপরে থাকায় সকল প্রাণিজ আমিষ বিশেষ করে ডিম, দুধ ও ব্রয়লার মাংস নায্যমূল্যে এবং মানুষের নাগালে ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিদিন একটি করে ডিম এবং এক গøাস দুধ যে কোন বয়সের মানুষের শারীরিক সমস্যায় ভাল ফল প্রদান করতে পারে।
করোনাকালে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির উপায় প্রাণিসম্পদ : এই মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রভাবে দেশের শিল্পের এক বিরাট ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। বিদেশী ক্রেতা কম, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় খাদ্য ছাড়া অন্যান্য সকল শিল্পে একটি ধস নেমেছে। এমন অবস্থায় মানুষের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখার জন্য প্রাণিসম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ছোট, মাঝারি এবং বড় যে কোন পর্যায়ে প্রাণিসম্পদ খামারি এবং উদ্যোক্তারা এখন ব্যবসায় লাভ করতে পারবেন। এই মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের জন্য মাননীয় প্রাধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রণোদনা দিয়েছেন। বর্তমানে খামারিরা ডিম, দুধ ও মাংশের উৎপাদনমুখী শিল্প চালু করলে ভাল মুনাফা অর্জন করতে পারবেন। করোনাভাইরাসের কারণে পূর্বের তুলনায় প্রাণিজ আমিষ ও স্নেহ জাতীয় খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে প্রাণিসম্পদের পুষ্টি উপাদানের চাহিদা বেড়েছে। এক্ষেত্রে নতুন করে উদ্যোক্তা হওয়ার একটি ভাল সুযোগ রয়েছে।
বর্তমান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী প্রাণিসম্পদের উন্নতির জন্য নিবেদিত হয়ে সর্বদা সকল দিকনির্দেশনা প্রদান করছেন। তার এই নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মচারীগণ প্রাণিসম্পদের উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক শক্তিতে আরো বেগবান করতে এখন সবচেয়ে ভ‚মিকা রাখতে পারে প্রাণিসম্পদ। ইউরোপের দেশগুলো তাদের প্রাণিসম্পদকে অগ্রাধিকার দিয়ে সর্বোচ্চ স্থান অর্জন করতে পেরেছেন। বাংলাদেশ সরকার ডেইরি ও প্রাণিসম্পদকে আরো শক্তিশালী করতে বেশ কিছু বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছেন, যেমন এনএটিপি, এলডিডিপি প্রভৃতি। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের দুধ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে প্রকল্পের পরিচালনা পরিষদ থেকে শুধু করে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এলডিডিপি প্রকল্পের মাধ্যমে খামারিরা সরাসরি লাভবান হতে পারবেন। ডেইরি হাব এবং ডেইরি শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হবে। গুরুর সংখ্যা না বাড়িয়ে দুধ উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করে দেশের দুধের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলাদেশ গড়তে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া কাজ করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধাণমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ সেক্টর তার কাক্সিক্ষত সাফল্যে পৌঁছাতে পারবে। মাঠপর্যায়ের কর্মচারী বৃদ্ধি করে জনগণকে উপযুক্ত সেবা প্রদাণের মাধ্যমে দেশ উন্নয়নশীল থেকে উন্নত বিশ্বে পরিণত হবে। য়
ডিভিএম, প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা (এলডিডিপি), উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল, পভালাহাট, চাপাইনবাবগঞ্জ মোবাইল : ০১৭০২৩৭৮৬৮৭৭, ই-মেইল : mmrdvm10@gmail.com
কৃষিবিদ মো. আলতাফ হোসেন চৌধুরী
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর মুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণের লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রহণ করেছিলেন বিভিন্ন বৈপ্লবিক কর্মসূচি। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে কুমিল্লার এক জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন মাছ হবে ২য় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ। এই উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা গণভবনের লেকে পোনা মাছ অবমুক্ত করে মৎস্য উৎপাদনে সামাজিক আন্দোলনের শুভ সূচনা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য বাঙালি জাতির জন্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রীয়াশীল চক্র জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে আর এখানেই শুরু হয় মাছের আঁতুড়ঘরের অপমৃত্যু। কিন্তু বীরের জাতি বাঙালি রক্তের দাগ শুকানোর পূর্বেই মাছ চাষে মনোযোগী হয়ে উঠে।
মাছচাষ মূলত তিনটি বিষয়ের উপর ওতপ্রোতভাবে জড়িত, বিষয়গুলো হলো : (১) ফিড (খাবার), (২) সিড (পোনা), (৩) ম্যানেজমেন্ট (ব্যবস্থাপনা)। উক্ত বিষয়গুলোর একটির ঘাটতি হলেও মাছচাষ ব্যাহত হয়। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাছ চাষে অনেক সমস্যা দেখা যায়। তাছাড়াও মাটি ও পানির ভৌত রাসায়নিক গুণাবলি মাছ চাষের জন্য বড় নিয়ামক হিসাবে কাজ করে। তাপমাত্রা কম ও ভৌত রাসায়নিক গুণাবলির সঠিক সমন্বয় মাটি ও পানিতে বিদ্যমান না থাকার কারণে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর সুস্থ্ভাবে বেঁচে থাকা এবং বৃদ্ধি জটিল হয়ে পড়ে। অতীতে প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে ব্যাপক মৎস্য আহরণ সম্ভব ছিল কিন্তু বর্তমানে মনুষ্য সৃষ্ট কারণে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে মাছের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার কারণে চাষের মাছের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকগুণ। আর অধিক ঘনত্বে মাছচাষ করতে এবং অধিক উৎপাদন লাভের জন্য একদিকে যেমন অধিক পুঁজির প্রয়োজন তেমনি মাছের রোগবালাইসহ বিভিন্ন সমস্যাও দেখা যায়। তাই এই মৎস্যসম্পদের ক্ষতি মোকাবেলায় বাঙালি জাতিকে প্রাণিজ (মৎস্য) প্রোটিন থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষার জন্য মৎস্য অধিদপ্তর মৎস্য খাতে অর্জিত সাফল্য ও উন্নয়ন সম্ভাবনাসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি : স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যেখানে চাষকৃত মাছের উৎপাদন ছিল নগণ্য তা ২০১৭-১৮ আর্থিক সালে ৪২.৭৭ লক্ষ মে. টনে দাঁড়িয়েছে।
বদ্ধ জলাশয়ে মৎস্য চাষ নিবিড়করণ : ব্রæড ব্যাংক স্থাপন প্রকল্পের মাধ্যমে চীন থেকে আমদানিকৃত সর্বোচ্চ জেনেটিক গুণ সম্পন্ন প্রায় ৩৯ হাজার সিলভার কার্প, বিগহেড কার্প ও গ্রাস কার্প এর পোনা দেশের ৯টি সরকারি হ্যাচারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তীতে এসব মাছ অন্যান্য সরকারি হ্যাচারিতে সরবরাহ করা হয় (মৎস্য বীজ উৎপাদন খামার গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা)
পোনা অবমুক্তি কার্যক্রম ও বিল নার্সারি স্থাপন : ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ কার্যক্রমের ফলে ২০৫০ মেট্রিক টন মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
সমাজভিত্তিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা ও মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন : এ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের বিলুপ্ত প্রায় মৎস্য প্রজাতির উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
মাছের আবাসস্থল উন্নয়ন : এর মাধ্যমে ২০১৮-১৯ আর্থিক সালে ৮১২ হে. জলাশয় পুনঃখননের মাধ্যমে গড়ে প্রায় ৬৫০০ মে.টন অতিরিক্ত মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র সংরক্ষণ : গৃহীত উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত হালদা নদী থেকে মোট ৩৭৫৭ কেজি কৌলিতাত্তি¡ক বিশুদ্ধ মানের রেণু উৎপাদিত হচ্ছে।
পরিবেশবান্ধব চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণ : এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে ২০১৭-১৮ সালে ২৫৪৩৬৭ মে.টন চিংড়ি উৎপাদিত হয়েছে।
শীলা কাঁকড়ার হ্যাচারি স্থাপন ক্র্যাবলেট উৎপাদন : দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদার ভিত্তিতে সমুদ্র উপক‚লবর্তী এলাকায় শীলা কাঁকড়ার চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
জাটকা সংরক্ষণ ও ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন : প্রতি বছর আশ্বিন মাসের প্রথম উদিত চাঁদের পূর্ণিমার দিনসহ আগের চারদিন এবং পরের সতেরো দিনসহ মোট ২২ দিন উপক‚লীয় এলাকাসহ দেশব্যাপী ‘দি প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিস রুলস ১৯৮৫ (সংশোধিত) বাস্তবায়নের ফলে ২০১৭-১৮ সালে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ৫.১৭ লক্ষ. মে. টনে দাঁড়িয়েছে।
মৎস্য আইন বাস্তবায়ন : মৎস্য খাতের উন্নয়ন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার নিমিত্ত সরকার ইতোমধ্যেই বেশ কিছু নীতি, আইন বিধিমালা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
জেলেদের পরিচয়পত্র প্রদান : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সানুগ্রহ দিকনির্দেশনায় সরকার মৎস্যসম্পদ ও মৎস্যজীবীদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে যুগান্তকারী কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করেছে : যা উন্নয়নের রোল মডেল হিসাবে বিশ্বে স্বীকৃত। এ প্রকল্পের মাধ্যমে এ যাবৎ ১৬.২০ লক্ষ জেলের নিবন্ধন সম্পন্ন এবং ১৪.২০ লক্ষ জেলের পরিচয়পত্র প্রদান এবং বিতরণ করা হয়েছে।
সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা : বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের দুরদর্শিতার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারিত হওয়ায় ১,১৮,৮১৩ বর্গ কিমি. এলাকায় মৎস্য আহরণে আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতনি এবং স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ মাছ সরবরাহ : মৎস্য পরিদর্শন এবং মান নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত সকল তথ্যাদি সংরক্ষণের জন্য অ্যাকোয়া ফুড সেইফটি আর্কাইভ মৎস্য ভবনে স্থাপন করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং মৎস্যসম্পদ : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণসহ ধরন ও পরিবর্তন হচ্ছে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে মৎস্য প্রজনন ও উৎপাদনে, বিশেষ করে দেশীয় প্রজাতির ক্ষেত্রে।
মানবসম্পদ উন্নয়ন : কোনো সংস্থাকে জনমুখী, সময়ের চাহিদার প্রতি সংবেদনশীল, অধিকতর সক্ষম ও কার্যকর করার জন্য মানবসম্পদ উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই ২০১৮-১৯ আর্থিক সালে উন্নয়ন প্রকল্প এবং রাজস্ব খাতের আওতায় ৪ (চার লক্ষাধিক) মৎস্যচাষি, মৎস্যজীবী, সরকারী কর্মচারী এবং এনজিও কর্মীকে অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তি সেবা প্রদান : আগামী ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের ডায়নামিক ওয়েবসাইড কার্যকর রয়েছে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি : বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মৎস্য অধিদপ্তরের আওতায় ১৪টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। যার প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৩৫৫২.৮৭ কোটি টাকা মাত্র।
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি : বার্ষিক সম্পাদন চুক্তির আওতায় ২০১৯-২০অর্থবছরের চুক্তিতে ৪টি কৌশলগত উদ্দেশ্যের বিপরীতে মৎস্যচাষ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক ১৭টি, সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক ৬টি এবং সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ বিষয়ক ৫টিসহ মোট ২৮টি কার্যক্রমের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় এবং যা অর্জিত হয়েছে।
পরিশেষে বলা যায় যে ১৫ আগস্ট বনাম বাঙালি জাতিকে প্রাণিজ (মৎস্য) প্রোটিন থেকে বঞ্ছিত করার ষড়যন্ত্র যা সফল হয়নি, কারণ মাছ ও অন্যান্য জলজ সম্পদের স্থায়িত্বশীল উৎপাদন নিম্ন হওয়ার পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্যের নিরাপত্তা বিধান, জনগোষ্ঠীর পুষ্ঠি চাহিদাপূরণ, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। মৎস্য উৎপাদনের অর্জিত সাফল্যকে স্থায়িত্বশীল করে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। য়
খামার ব্যবস্থাপক, মৎস্যবীজ উৎপাদন খামার, গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা, E-mail: Chowdhari_33@yahoo.co, মোবাইল : ০১৭১২৪০৮৩৫৩
কৃষিবিদ ড. মো. আখতারুজ্জামান
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কৃষি ও কৃষকবান্ধব। সোনার বাংলাদেশ গড়তে ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমৃদ্ধ কৃষির যে কোন বিকল্প নেই এটা বঙ্গবন্ধু বেশ করে বুঝেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ভাল করেই জানতেন, ‘যারা জোগায় ক্ষুধার অন্ন কৃষি হলো তাঁদের জন্যে’। তাই বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বল্পকালীন সময়ের শাসনামলে কৃষি উন্নয়নে যেসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তার অন্যতমÑ ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ; গ্রাম্য সমাজ ভিত্তিক কৃষকের জন্যে সুদমুক্ত ঋণের প্রবর্তন; স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ২২ লাখ কৃষককে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ; বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে ১৯৭২ সালে ১৬,১২৫ মে.টন উফশী ধান বীজ, ৪৪,০০০ মে.টন পাট বীজ এবং ১,০৩৭ মে.টন গম বীজ কৃষকদের মাঝে বিতরণ; প্রাকৃতিক পরিবশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রথম বৃক্ষরোপণ অভিযান চালুকরণ; বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের প্রথম বাজেটেই কৃষিতে ভর্তুকির ব্যবস্থা গ্রহণসহ সার, কীটনাশক ও সেচ যন্ত্রাংশ সরবরাহ; প্রাইম সাপোর্ট হিসেবে ধান, পাট, আখ প্রভৃতি ফসলের ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ; গ্রামভিত্তিক সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ; ১৯৭২-৭৩ সালের ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়ন বাজেটের মধ্যে ১০১ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছিল কৃষি; উন্নয়নের জন্যে। যেটি বঙ্গবন্ধুর কৃষিবান্ধব নীতির কারণেই সম্ভব হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর কৃষিবান্ধব চিন্তা শুধু গাছপালা আর ফুল ফসলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নই ছিল বঙ্গবন্ধুর কৃষি ভাবনার মূলসুর।
কৃষিতে স্নাতক শেষ করে চাকরিতে যোগদানের সময় কৃষিবিদদের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে পদায়ন করা হতো। ফলে চিকিৎসক এবং প্রকৌশলীদের মতো কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার মর্যাদা দেয়ার দাবি উঠতে থাকে স্বাধীনতার আগে থেকেই। স্বাধীনতার পরও তাদের এ দাবি অব্যাহত থাকে। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রæয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সভায় গুরুত্ব সহকারে কৃষিবিদদের এ দাবি মেনে নেন। শুধু তাই না, ঘরোয়া আলোচনায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিবিদদের মর্যাদা হবে সবচে বেশি...।’ বঙ্গবন্ধু সেই দিনই (১৩ ফেব্রæয়ারি, ১৯৭৩) কৃষিবিদদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার পদমর্যাদায় উন্নীত করেন।
কালের পরিক্রমায় কৃষি গ্রাজুয়েটরা তাদের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মোতাবেক দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। কৃষি শিক্ষায় মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের প্রবেশ বাড়তে থাকে; যদিও ১৯৭৭ সালের বেতন কাঠামোয় কৃষিবিদদের সেই মর্যাদা আবারও একধাপ নামিয়ে দেয়া হয়। কৃষিবিদদের তীব্র আন্দোলনের মুখে তদানীন্তন সরকার কৃষিবিদদের সেই হারানো সম্মান আবার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন। ফলে বঙ্গবন্ধুর কারণে আজকে আমরা কৃষিবিদরা গর্ব করে বলতে পারি, ‘বঙ্গবন্ধুর অবদান, কৃষিবিদ ক্লাস ওয়ান’।
বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর যারা ক্ষমতায় আসেন, তারা নানাভাবে কৃষিবিদদের অবমূল্যায়ন করার চেষ্টা করে। এরপর ভিন্ন ধারার রাজনীতির ডামাডোলে পরে ১৩ ফেব্রæয়ারি বিশেষ দিনটিকে মনে করার কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি। অবশেষে ‘কৃষিবিদদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৩ ফেব্রæয়ারি দিনটিকে কৃষিবিদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ফলে ২০১১ সাল থেকে যথাযোগ্য মর্যাদায় নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ১৩ ফেব্রæয়ারি দিনটিকে কৃষিবিদ দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এদিন কৃষিতে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য অবদান ও কৃষিবিদদের মর্যাদা বৃদ্ধির বিষয়টি স্মরিত হয় অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধাভরে।
কৃষিবিদরা তাঁদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলেও ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি। কারণ সে সময় দেশের জনসংখ্যা সাড়ে ৭ কোটি থেকে ১৩ কোটিতে উন্নীত হয়েছিল। এ সমস্যা সমাধানে কৃষিবিদ ও কৃষকদের প্রয়োজনীয় সার, বীজ, তেল ও অন্যান্য সুবিধা না দেয়ায় কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেননি। ন্যায্যমূল্যে সার প্রাপ্তির আশায় আন্দোলন করতে যেয়ে ১৯৯৫ সালের ১৫ মার্চ, ১৮ জন নিরীহ কৃষককে প্রাণ হারাতে হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর কৃষি উন্নয়নে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়। সার, বীজ, সেচ ব্যবস্থা উন্নয়ন, খাদ্য মজুদ বৃদ্ধি, কৃষি পণ্যের সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাসহ কৃষি উন্নয়নে বিভিন্ন বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়। ফলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে।
কৃষিই আমাদের কৃষ্টির মূল। বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে আমরা যতই উন্নতি করি না কেন, খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা মেটানোর জন্য আমাদেরকে বারবার ফিরে যেতে হয় কৃষি ও কৃষকের কাছে। একবিংশ শতাব্দীর এই ক্ষণে আমরা বিজ্ঞানের সকল শাখার অভ‚তপূর্ব উন্নয়নের কথা জোর দিয়ে বলতে পারি। পুষ্টিকর মানব খাদ্যের জন্যে পৃথিবীর তাবদ মানুষকে আজও সেই সমৃদ্ধ ও গৌরবমÐিত পেশা কৃষির উপরেই নির্ভর করতে হয়। কৃষিতে বাংলাদেশের মত অল্প সময়ে এত উন্নয়ন বিশ্বের খুব কম দেশেই হয়েছে। এখন প্রয়োজন নিরাপদ ও পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার নিশ্চিতকরণ। দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের জন্যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলেও নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ এখনও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এ ব্যাপারে বর্তমান সরকার এবং কৃষি মন্ত্রণালয় ভীষণভাবে তৎপর। আশা করছি এ সমস্যার সমাধানও এখন সময়ের দাবি মাত্র।
দেশ স্বাধীনের অব্যবহিত পরে এ দেশে আবাদযোগ্য জমি ছিল ১ কোটি ৮৫ লক্ষ হেক্টর এবং মোট খাদ্য উৎপাদন ছিল ৯৫ লক্ষ মে.টন। বর্তমানে সেই আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৮৫ লক্ষ হেক্টর অথচ দেশে ২০১৭-১৮ বছরে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে ৪০৭.১৪ লাখ মেট্রিক টন। ১৯৭১ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ৭ কোটি আর বর্তমানে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ কোটিতে। আবার প্রতি বছর দেশে যোগ হচ্ছে ২৪ লক্ষ নতুন মুখ। অন্যদিকে প্রতিনিয়তই আমাদের দেশের আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এক হিসেবে মতে শিল্পকারখানা স্থাপন, নগরায়ন, আবাসন, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও নদী ভাঙনের ফলে প্রতি বছর দেশ থেকে ৬৮,৭০০ হেক্টর করে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার কারণেও প্রতিদিন ২০ শতাংশ করে ফসলি জমি কমছে। মোদ্দাকথা বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো প্রাকৃতিক প্রতিক‚লতা সত্তে¡ও আমাদের কৃষি কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েনি; মাথা উঁচু করে সগৌরবে চলমান রয়েছে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের চাহিদা মেটাতে কৃষকদের সাথে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন তাদের সহযোগী সকল প্রতিষ্ঠান দিন-রাত পরিশ্রম করে নতুন নতুন জাত আবিষ্কার, কৃষিপ্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করে যাচ্ছেন কৃষিবিদরা ও তাঁদের সহযোগীরা আর কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাঁদেরকে সার্বিক সহায়তা করে যাচ্ছে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার।
বঙ্গবন্ধুর সেই কৃষি উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর সফল সরকারের শাসনামলে আজ সার্বিক কৃষিতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কৃষিতে এখন বহুমুখীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে। বর্তমান সরকার খ্যাতি পেয়েছে ‘কৃষি বান্ধব’ সরকার হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর কৃষি উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকার কারণে আজকের খাদ্যে স্বয়ম্ভর বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে স্বীকৃতি পেয়েছে।
বলতে দ্বিধা নেই, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সব সেক্টরে বর্তমান সরকার যেভাবে পৃষ্ঠপোষকতাসহ সরকারি অনুদান প্রদান করে যাচ্ছে সেটি এশিয়া মহাদেশের কোথাও নেই। এমনকি পৃথিবীর খুব কম দেশেই এমনটি আছে। বিগত ২০১৯ সালে থাইল্যান্ড ও ভারতে অনুষ্ঠিত দু’টি আন্তর্জাতিক কৃষি সভায় (৬ঃয ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈড়হভবৎবহপব ড়হ অমৎরপঁষঃঁৎব, ২০১৯, ইধহমশড়শ ,ঞযধরষধহফ ্ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঝবসরহধৎ ড়হ অমৎরপঁষঃঁৎব, জবংবধৎপয ওহফঁংঃৎু ্ খরাবষরযড়ড়ফ, ২০১৯, ইঈকঠ, কধষষুধহর, ডবংঃ ইবহমধষ, ওহফরধ) যোগদান শেষে আমার মধ্যে এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে। কৃষি উন্নয়নসহ আমাদের সাম্প্রতিক সর্বিক উন্নয়ন সূচককে বিশ্ব মহল রীতিমতো বিস্ময়ের চোখে দেখছেন। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়িখ্যাত বাংলাদেশ এখন, তলাযুক্ত সম্পদশালী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ। কৃষি সেক্টরে সরকারের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা, অসামান্য অর্থায়ন, নির্বিঘœ সার সরবরাহের ব্যবস্থা, বারবার সারের মূল্য হ্রাস, অধিক কৃষিভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ, কৃষিতে ভর্তুকি প্রদান, ৫০-৭০% সাশ্রয়ী মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতির সরবরাহ এবং কৃষি প্রণোদনাসহ অনান্য কৃষিবান্ধব নীতির যথাপোযুক্ত রূপায়ন এবং কৃষক, কৃষিবিদ ও এঁদের সহযোগীদের সম্মিলিত প্রয়াসেই আজকে আমরা মাথা উঁচু করে বলতে পারছি।
*চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় স্থানে;
*সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় স্থানে;
* পেয়ারা উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ স্থানে;
*মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ স্থানে;
* ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ স্থানে;
*আম উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে সপ্তম স্থানে;
*আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে সপ্তম স্থানে;
*কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বাংলাদেশ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষস্থানে;
*ফল ফসলের জাত উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বসেরা স্থানে।
বৈশ্বিক ও জাতীয় করোনা সংকট মোকাবেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষি উৎপাদনের ধারা সচল রাখার জন্য ৪% সরল সুদে কৃষি ঋণ বিতরণসহ প্রতি ইউনিয়নে কালিকাপুর মডেল অনুসরণ করে ৩২টি সবজি বাগান করাসহ নানাবিধ কৃষি উন্নয়নমূলক কার্যক্রম ও প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনা সংকটের ধারাবাহিকতায় খাদ্য সংকট যেন কোনভাবেই জাতীয় সমস্যার সৃষ্টি না করে সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রেখে কৃষি মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করে চলেছেন।
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থায়নে আমাদের কৃষি যেভাবে দুর্দান্ত ও দুর্বার গতিতে সম্মুখপানে এগিয়ে চলেছে, তাতে করে আগামী দিনে বাংলাদেশের কৃষি বিশ্ব সেরা স্থান দখল করবেই করবে।
আমরা সেই সুদিনের অপেক্ষায়।
জয়তু বঙ্গবন্ধু! মুজিববর্ষ সফল হোক।
পরিচালক (প্রশাসন), জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমী, গাজীপুর, মোবাইল: ০১৭১১৮৮৪১৯১, ইমেইল: akhtar62bd@gmail.com
অক্ষয় শোণিতের গান
কৃষিবিদ হামিদুর রহমান১
শুনেছি সে কথা লেখা আছে ইতিহাসে
আমার সোনার দেশ করেছে লুণ্ঠন
ইংরেজ, পাঞ্জাবী, বর্গী যত দুশমন
বণিক, শাসক, দস্যু নানা ছদ্মবেশে।
এদেশের মাটি ও মানুষ ভালবেসে
বিসর্জিত হলো কত প্রাণ অগমন
নিজেকে উজাড় করে স্বাধীনতা ধন
বাঙালি জাতিকে তুমি দিয়ে গেলে হেসে।
আজও শুনি আমার দুখিনী স্বদেশে
তোমারই সে অক্ষয় শোণিতের গান,
মুক্তির আলোয় দীপ্ত মুজিব মহান
পুজ্য রবে দেশে দেশে প্রীতির সুবাসে
নিপীড়িত মানুষের সংকল্প নিবাসে
তোমারই সে মূর্তিখানি রবে অম্লান।
বঙ্গবন্ধুর অবদান
ড. সমজিৎ পাল২
বঙ্গবন্ধু মুজিব ছিলেন জনগণের নেতা
স্বল্পকালেই প্রমাণটা তার করেছিলেন সে তা।
প্রশাসনিক পুনর্গঠন, সংবিধানটি সৃষ্টি
যোগাযোগের উন্নয়ন আর পুনর্বাসন দৃষ্টি।
প্রাথমিকে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক দান
মাধ্যমিকে নামমাত্র মূল্যে বাড়ায় মান।
মদ, জুয়া, ঘোড় দৌড় যত অনৈসলামিক কর্ম
বন্ধ করে মাদ্রাসা বোর্ড আনেন শিক্ষা-ধর্ম।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন সেটাও তাঁরই গড়া
চল্লিশ হাজার প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ করা,
এগার হাজার প্রাইমারি স্কুল নতুন করে গড়েন
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ‘কল্যাণ ট্রাস্ট’ করেন।
নারী পুনর্বাসন সংস্থা তাঁরই অবদান
কৃষি উপকরণ করেন বিনামূল্যে দান।
পঁচিশ বিঘা কৃষি জমির খাজনা করেন মাফ
পরিত্যক্ত ব্যাংক-বীমাতে বাড়ান কাজের চাপ।
পাঁচশ আশি শিল্প ইউনিট জাতীয়করণ করেন
লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীর কাজের সুযোগ গড়েন।
ঘোড়াশাল ও আশুগঞ্জের শিল্প গড়ে তাতে
অর্থনৈতিক উন্নয়নে দেশটা তখন মাতে।
স্বল্পকালেই অধিক দেশের স্বীকৃতি যায় পাওয়া
সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে অনেক দূরে যাওয়া।
এই সবই হয় স্বাধীনতার পরের বছর জুড়ে
ঐ গতিতে চললে এদেশ যেত অনেক দূরে।
তাঁর সে গতি থামিয়ে দেয় দালাল ছিল যারা
মুজিবসহ খুন করেছে বাংলাদেশকে তারা।
কালের বিবর্তনে আবার তারাই হলো শেষ
শেখ মুজিবের আদর্শে ফের উঠলো জেগে দেশ।
পিতার নীতি মানব-প্রীতি মেয়ের হাতে ফেরা
উন্নয়নে দেশটা হলো সকল দেশের সেরা।
তাইতো তাঁকে সালাম জানাই দেশ এনেছেন যিনি
বাঙালিরা চিরকালেই থাকবে তাতে ঋণী।
১সম্মানিত সদস্য, এপিএ পুল, কৃষি মন্ত্রণালয়, সাবেক মহাপরিচালক, ডিএই, মোবাইল : ০১৭১১৮০৩৬৯৫, ই-মেইল : hamidur2152@gmail.com
২পরিচালক (গবেষণা), বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী, পাবনা, মোবাইল : ০১৭১২০২১১৪০, ই-মেইল :samajitpal@gmail.com
মোঃ মাজেদুল ইসলাম (মিন্টু)
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। বঙ্গবন্ধু বুঝতেন মেধাবী জাতি গঠনে দরকার সুষম খাদ্য ও পুষ্টি। তাই বঙ্গবন্ধু সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থার উপর জোর দেন। বঙ্গবন্ধুর সমন্বিত ভাবনায় অদ্যকার যৌথ বাজার নিয়ে নাটিকা।
১ম দৃশ্য
(মাজেদ মোল্লার চা স্টলে সকাল বেলা কেটলী পরিস্কার করে পানি গরম করছে, কাপ- পিরিচ ধুয়ে সাজাচ্ছে)।
সোলেমান : (মাথা চুলকাতে চুলকাতে চা স্টলে প্রবেশ) পেয়ারার বীজ গ্রামের হাট থেকে কিনে আনলাম, গাছের অবস্থা তো ভালো না। এবার মনে হয় ফলন ভালো পাবো না। সার, বিষ, পানি, পরিশ্রম সব-ই বৃথা যাবে।
(মোবাইলে গান বাজাতে বাজাতে ৩ জন কৃষক চা স্টলে প্রবেশ)
রফিক : মাজেদ ৩ টা লাল চা দে, এবার পেয়ারার ফলন ভালোই হবে, আল্লাই দিলে কিছু পয়সা পাবো। (মোবাইলে পেয়ারা গাছের ছবি দেখাবে)।
সোলেমান : রফিক ভাই, পেয়ারার বীজ কিনেছিলে কোন্থেকে?
রফিক : কেন! আমাদের বøকের এসএএও সাহেব আছে না! তার কাছ থেকে ভালো বীজের নাম লিখে নিয়ে পাবনা বীজ ভান্ডার থেকে ১ কৌটা বীজ এনেছিলাম।
সোলেমান : ও তাই নাকি! তাহলে আমার বীজের মধ্যেই সমস্যা। কিন্তু আমার তো এক কৌটা বীজ দরকার নাই।
মানিক : আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে!
সোহান : কি বুদ্ধি? বলো বলো শুনি।
মানিক : আমরা তো সবাই পেয়ারা চাষ করি, তাহলে ১টা বড় কৌটা বীজ কিনে সকলে ভাগ করে নিলে কারই ক্ষতি হবেনা। বীজ ভালো হবে, দাম ও কম পড়বে । তাহলে এ কথাই থাকলো কিন্তু! আগামী বছর একসাথে বীজ কিনবো (প্রস্থান)।
২য় দৃশ্য
(সোলেমান মন খারাপ করে চা স্টলে প্রবেশ)
সোলেমান : পেয়ারা বিক্রি করে লাভতো হলোই না, বরং আজকের দিনটাই মাটি। আবার হাটের খাজনা দেও, গাড়ী ভাড়া দেও, এভাবে কি সংসার চলে? দুত্তুরী মাজেদ, এককাপ চা দে (মাজেদ চা বানিয়ে দিবে)।
(রফিক হাসতে হাসতে গাইতে গ্ইাতে ফুরফুরে মনে প্র্রবেশ)
রফিক : পেয়ারা নিয়ে আজ পাবনা বড় বাজারে গেছিলাম, ভালোই দাম পায়ছি, ফলগুলো কি সুন্দর! ওজনও বেশি ভালোই লাভ হয়েছে, মাজেদ সবাইকে চা দে (মাজেদ সবাইকে চা দিবে)।
সোলেমান : আমার এই অল্প পেয়ারা নিয়ে কি শহরে যাওয়া যায়? তাতে তো খরচ আরও বেড়ে যায়।
সোহান : আচ্ছা মানিক ভাই, ক্ষুদ্র কৃষকরা অল্প পেয়ারা নিয়ে তো বড় বাজারে যেতে পারেনা, তাহলে আমরা সবাই একদিনে পেয়ারা তুলে বড় বাজারে নিয়ে গেলে কেমন হয়?
মানিক : ঠিকই বলেছ ভাই, সবাই একসাথে পেয়ারা বড় বাজারে বিক্রি করলে লাভ বেশি হয়। আবার বেশি পেয়ারা উৎপাদন হলে পাইকারী ব্যবসায়ীরা ট্রাক নিয়ে মাঠে চলে আসে।
সোলেমান : ঠিক আছে, আগামী দিনে আমরা একদিনে পেয়ারা তুলে বড় বাজারে বিক্রি করব। লাভ বেশি হবে, খরচ ও কম পড়বে (প্রস্থান)
৩য় দৃশ্য
মনিরা : বাড়িতে মোরগ-মুরগী বড় হয়েছে, হাটেও নিতে পারছে না,খালি কাজ আর কাজ, আমারও হাত খাটো, মুরগি বিক্রি করতে পারলে নতুন শাড়ী কিনতে পারতাম।
সাঈদ : (ফড়িয়া ঝুড়ি নিয়ে প্রবেশ) মুরগি বিক্রি করবে গো মু-র-গি (৩ বার)।
মনিরা : মুরগি আছে গো চাচা, তোমার এত দেরী হলো কেনো গো?
সাঈদ : কয়টা মুরগি আছে রে মা!
মনিরা : ৩টি মোরগ আর ৯ টি মুরগি, সেই সকাল থেকে ধরে রেখেছি গো চাচা।
সাঈদ : এখন বাজারে মুরগির দাম কম ১২ টা নেও ৬০০ টাকা, তোমাকে ঠকাবো না, বাজার মন্দা, তাছাড়া আমার পেট আছে না!
মনিরা : ৬০০ টাকা হাতে নিয়ে ভাবছে (শাড়ির দাম তো হলো না)।
হুমায়ন : (জমি চাষ করে এসে শুনতেই) তোকে মুরগি বেচতে কে বলেছে? ঐ বেটা ফড়ি ব্যাপারী কম দামে মুরগি কেনে, মহিলারে ঠকায়। আমি বড় বাজারে নিতে চেয়েছিলাম বেশি দাম পেতাম,তুই এত কম দামে মুুরগি বেচলি কেন? (ধস্তাধস্তি করবে, প্রতিবেশিরা ঠেকাবে)।
ফাতেমা : মুরগির ডিম গুলো গুছায়ে রাখছি বিক্রি করবো । ছেলের জন্য একটা ঘড়ি কিনবো।
সাঈদ : ডিম বিক্রি করবে গো ডি- ই- ম....(৩ বার)।
ফাতেমা : আছে গো আছে, ১০ হালি ডিম আছে। তো কত করে হালি দিবে?
সাঈদ : গরমের দিন তো লোকে ডিম খায় না, ১০ হালি ডিম ১৬০ টাকা হয়, খুচরা নাই তো ১৫০ টাকা নেও ।
ফাতেমা : ১৫০ টাকা নিয়ে ভাবছে (ঘড়ির দাম তো হলো না)।
রওশন : কেরে ডিম বিচলো কে? ডিম গুলো গুনে রেখেছি সমিতির বাজারে নিয়ে যাবো, সেখানে সবার ডিম এক সাথে করে বড় বাজারে বিক্রি করবো তাহলে ন্যায্য দাম পাওয়া যায়। আর তুই কম দামে বিক্রি করলি আজ তোর একদিন কি আমার একদিন (ধস্তাধস্তি,অন্যরা ঠেকাবে)।
(সকলে মঞ্চে উঠে) আমরা যৌথ বাজারে কৃষিপণ্য বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমাদের ও বলি যৌথ বাজারে পণ্য বিক্রি করলে ঠকতে হবেনা। য়
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, পাবনা সদর, পাবনা। মোবাইল : ০১৭১৭৪৬৬৯৯৮, ই-মেইল : mazegul321@gmail.com
ড. মো. আব্দুল মালেক
চলতি ২০২০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। মুজিববর্ষে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণের পূর্বশর্ত হলো খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিপরীতে ক্রমহ্রাসমান আবাদি জমি, বৈরী আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বহুবিধ সমস্যা মোকাবিলা করে বর্তমানে কৃষিতে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। ১৯৭১ সালে শোষণ ও বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর লাল-সবুজের স্বাধীন বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নেয়ার পর বাংলাদেশকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বলেছেন, বাংলাদেশ হচ্ছে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে উন্নয়নের রোল মডেল। উন্নয়নের বিভিন্ন নির্দেশকের মধ্যে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায়ও বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছর ধরে সমানতালে এগিয়ে চলেছে। আর দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ বিশ্বের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় এবং গত দুই দশকে বাংলাদেশ দুই কোটি মানুষকে দরিদ্র্যবস্থা থেকে মুক্ত করেছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে দেশ চাল ও রপ্তানি শুরু করেছে।
খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও বাংলাদেশের শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধি ও ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম এবং এর মূল কারণ হলো প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় পরিমিত মাত্রার আমিষ, চর্বি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ পুষ্টিকর খাবারের ঘাটতি।
সয়াবিন ডালজাতীয় ফসল হলেও সারাবিশ্বে তেল ফসল হিসেবে ব্যাপকভাবে সমাদৃত, কারণ সয়াবিন তেল ফসলের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ। পুষ্টিমানে ভরপুর সয়াবিনে অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিড সমৃদ্ধ উচ্চমানের ৪০-৪৪% আমিষ, ২৪-২৬% কার্বোহাইড্রেট ও অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ ১৮-২২% তেল বিদ্যমান। সয়াবিনে আমিষ, কার্বোহাইড্রেট এবং তেল ছাড়াও বিভিন্ন খনিজ পদার্থ যথা ক্যালসিয়াম, লৌহ ও ফসফরাস এবং ভিটামিন-এ, বি, সি, ডি ও ই এর একটি ভালো উৎস। তাছাড়া সয়াবিনে মানবদেহের মস্তিষ্ক বৃদ্ধিতে সহায়ক লেসিথিন এবং হৃদরোগ প্রতিরোধসহ রক্তনালীতে প্লাক তৈরিতে বাধাদানকারী ও ক্যান্সার প্রতিরোধী আইসোফ্লভেনস্ বিদ্যমান। এতদ্ব্যতীত সয়াবিনে বিদ্যমান দ্রবণীয় এবং অদ্রবণীয় ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
দৈনিক খাদ্য চাহিদার বিবেচনায় বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি অংশ পুষ্টিহীনতার শিকার। শিশু এবং মহিলাদের মাঝে এই অপুষ্টি আরো ব্যাপক। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে এই অপুষ্টি বিভিন্ন মাত্রার আমিষ, ক্যালরি, ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থের অভাবজনিত কারণে হয়ে থাকে। এসব বিবেচনায় বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর আমিষ ও ক্যালরির ঘাটতি পূরণ এবং অপুষ্টি দূরীকরণে সয়াবিন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাংলাদেশে সয়াবিনের উৎপাদন ও ব্যবহার
দেশের সয়াবিন সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে পরিচিত বৃহত্তর নোয়াখালী এবং চাঁদপুর জেলায়। বিগত ছয় বছরে গড়ে ৭৬.৯৩ হাজার হেক্টর জমি হতে উৎপাদিত সয়াবিনের পরিমাণ গড়ে ১.৩১ লক্ষ টন (টেবিল-১ দ্রষ্টব্য)। দেশে উৎপাদিত এ স্বল্প পরিমাণ সয়াবিন তেল নিষ্কাশনে ব্যবহৃত না হয়ে পোলট্রি এবং মাছের খাদ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও পোলট্রি এবং মাছের খাদ্য শিল্পে ব্যবহারের জন্য বিদেশ থেকেও বিপুল পরিমাণ দানা সয়াবিন ও সয়ামিল আমদানি করা হয়ে থাকে। মূলত সিটি, মেঘনা ও যমুনা গ্রæপসহ এবং আরও কিছু ছোট ছোট কোম্পানি তেল নিষ্কাশনের উদ্দেশ্যে বিদেশ হতে প্রতি বছর প্রায় ২০ লক্ষ টন সয়াবিন আমদানি করে যার কিছু অংশ সরাসরি তেল নিষ্কাশনে এবং বাকি অংশ দেশের পোলট্রি এবং মাছের খাদ্য তৈরির শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশের সয়াবিন চাষাধীন এলাকা
সয়াবিন সাধারণত বেলে দো-আঁশ এবং দো-আঁশ মাটিতে ভালো জন্মায়। মাটির বুনটের বিবেচনায় বাংলাদেশের বৃহত্তর নোয়াখালী এবং চাঁদপুর ছাড়াও ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, যশোর, মেহেরপুর, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও জামালপুর জেলায় সয়াবিন আবাদ বৃদ্ধির যথেষ্ঠ সুযোগ রয়েছে। এছাড়া সয়াবিন মধ্যম মাত্রার লবণ সহিষ্ণু বিধায় উপক‚লীয় জেলাসমূহে সয়াবিন চাষের সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশে সয়াবিন চাষের গুরুত্ব
১. বাংলাদেশের আবহাওয়ায় রবি ও খরিফ-২ মৌসুমে চাষোপযোগী একটি ফসল হলো সয়াবিন;
২. বর্তমান নিবিড় চাষাবাদের ফলে বাংলাদেশের মাটির স্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন। তাই প্রচলিত শস্যবিন্যাসে সয়াবিন অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে মাটির স্বাস্থ্যের উন্নতি করা যেতে পারে এবং সয়াবিন চাষ পরবর্তী ফসলে রাসায়নিক সার কম প্রয়োজন হয়। তাই বোরো ধানের আবাদ সীমিত করে সয়াবিন-রোপা আউশ-রোপা আমন শস্যবিন্যাসের প্রচলন করার যথেষ্ঠ সুযোগ আছে। ফলে শস্যবিন্যাসটি কৃষকের নিকট একটি লাভজনক শস্যবিন্যাস হিসেবে বিবেচিত হবে।
৩. সয়াবিন একটি পরিবেশবান্ধব ফসল, সয়াবিন গাছ শিকড়ে সৃষ্ট গুটি/নডিউলের মাধ্যমে বাতাস হতে নাইট্রোজেন গ্রহণের মাধ্যমে মাটিতে নাইট্রোজেন যোগ করে বিধায় সয়াবিন চাষে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয় না;
৪. উদ্ভিজ্জ আমিষ উৎপাদনকারী অন্যান্য ডাল ফসলের তুলনায় সয়াবিনের ফলন এবং আমিষের পরিমাণ উভয়ই বেশি;
৫. বাংলাদেশের মানুষের পুষ্টিহীনতা দূর করতে সয়াবিন বিশেষ ভ‚মিকা রাখতে পারে, কারণ সয়াবিনে সবগুলো অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিড সমৃদ্ধ উৎকৃষ্টমানের আমিষ বিদ্যমান যার পুষ্টিমান মাছ-মাংসের ন্যায়। এ ছাড়া সয়াবিনে তেল, কার্বোহাইড্রেট, খনিজ লবণ এবং ভিটামিনের একটি ভালো উৎস।
৬. কোলস্টেরলমুক্ত এবং অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডযুক্ত ভোজ্যতেলের অভাব মিটাতে সয়াবিনের আবাদ বৃদ্ধি বিশেষ গুরুত্ব রাখে;
৭. সয়াবিন মাছ, হাস-মুরগী এবং গৃহপালিত অন্যান্য পশু-পাখির একটি উৎকৃষ্ট খাদ্য;
৮. অন্যান্য মাঠ ফসলের তুলনায় সয়াবিন চাষাবাদ তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ;
৯. সয়াবিন লবণাক্ততা সহিষ্ণু ফসল, তাই দেশের উপক‚লীয় লবণাক্ত এলাকায় সয়াবিন চাষ সম্প্রসারণের সুযোগ আছে;
১০. অন্যান্য ফসলের তুলনায় সয়াবিন চাষে সার, সেচ, কীটনাশক ও পরিচর্যা তুলনামূলকভাবে কম লাগে; এবং
১১. বিভিন্ন মাঠ ফসল (যেমন আম, ভুট্টা) সাথে সয়াবিন আন্তঃফসল/সাথী ফসল হিসেবে চাষ করা যায়।
বাংলাদেশে সয়াবিন আবাদ বৃদ্ধির উপায়সমূহ
১. মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার
মানুষের খাদ্য হিসেবে সয়াবিন সরাসরি বা প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবহার করার প্রচলন বাংলাদেশে এখনো শুরু হয়নি। যদিও কয়েকটি কোম্পানি যেমন-অলিম্পিক, ড্যানিশ এবং অলটাইম ইদানীংকালে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সয়াবিন দিয়ে স্বল্প পরিসরে কিছু খাবার যেমন- সয়াবিস্কুট, সয়াকেকসহ বিভিন্ন খাবার তৈরি করছে।
সয়াবিন হতে মানুষের জন্য বিভিন্ন ধরনের খাদ্য যেমন- সয়াআটা দিয়ে সয়াপরাটা বা রুটি, কেক ও নিমকি, সয়াডাল ভর্তা, সয়াডাল, সয়া ঘুগনী, সয়াবিনের চটপটি, ছোলা বা মটরের মতো সয়াবিন ভাজা, মাছে বা সবজির সাথে সবজি হিসেবে সয়াবিন, সয়াদুধ, সয়াদুধের দধি ও পুডিং, সয়াপিয়াজু, সয়াহালুয়া, সয়াছানা, সয়ামাংস, সয়াসিঙ্গারা, সয়াবিস্কুট, সয়াকেক ইত্যাদি খুব সহজেই তৈরি করা যায়। তাই উচ্চ পুষ্টিগুণসম্পন্ন সয়াবিনকে সরাসরি মানুষের খাদ্য হিসেবে বা প্রক্রিয়াজাতকরণ করে ব্যবহারে উদ্বুদ্ধকরণের জন্য গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার ও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
২. তেল নিষ্কাশন যন্ত্রের ব্যবহার
স্থানীয় ঘানি বা দেশে প্রচলিত এক্সপেলার মেশিনে সয়াবিন থেকে তেল নিষ্কাশন করা যায় না। অত্যাধুনিক নিষ্কাশন মেশিনে বীজ হতে তেল নিষ্কাশন করা যায়, যা আমেরিকা, জাপান, চীন, ব্রাজিলসহ সয়াবিন উৎপাদনকারী দেশে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে সিটি, মেঘনা ও যমুনা গ্রæপ সয়াবিন হতে তেল নিষ্কাশনের জন্য সীমিতভাবে আধুনিক মেশিন ব্যবহার করছে এবং প্রয়োজনীয় সয়াবিন বিদেশ হতে আমদানি করছে।
পর্যাপ্ত সয়াবিনের জোগানের নিশ্চয়তা পেলে বেসরকারি শিল্প উদ্যোক্তারা অধিকতর উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তেল নিষ্কাশন মেশিন আমদানি করতে উদ্বুদ্ধ হবে। তাছাড়া সরকার শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অত্যাধুনিক এবং উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সয়াবিন তেল নিষ্কাশন মেশিন আমদানি করে কোন বেসরকারি শিল্প উদ্যোক্তাকে দায়িত্ব দিয়ে তেল নিষ্কাশন করাতে পারে। বর্তমান লাভজনক এবং বাণিজ্যিক কৃষিকে বিবেচনায় এনে সরকারি উদ্যোগে বিএডিসির মাধ্যমে গুণগতমানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনসহ ডিএই-কে দিয়ে সয়াবিন উৎপাদনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে সয়াবিন উৎপাদন করাতে হবে। সয়াবিন আবাদ লাভজনক বিবেচিত হলে কৃষক সয়াবিন চাষে উদ্যোগী হবেন এবং কৃষকগণ অন্য রবি ফসল যেমন- বোরো ধান আবাদ কমিয়ে সয়াবিন চাষে ঝুঁকবে এবং এতে স্বল্প সময়েই দেশে সয়াবিনের চাহিদার অনেকটাই মেটানো সম্ভব হবে। এজন্য কৃষি বিশেষজ্ঞবৃন্দকে দেশের অর্থকরী ও লাভজনক এবং সম্ভাবনাময় ফসল হিসেবে সয়াবিনকে বিবেচনায় আনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা পালন করতে পারেন। কাজেই সরকার উদ্যোগী হলে দেশের উৎপাদিত সয়াবিন দিয়ে ভোজ্যতেলের চাহিদার অধিকাংশই মেটানো সম্ভব হবে।
উল্লেখ্য, সয়াবিন থেকে তেল নিষ্কাশনের পর সয়ামিল থেকে মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের জন্য পুষ্টি সমৃদ্ধ সয়াময়দাসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার এবং পোলট্রি, গবাদিপশু ও মাছের খাবারও তৈরি করা যাবে।
৩. বীজ সমস্যা
সয়াবিন বীজ আর্দ্রতার প্রতি খুবই সংবেদনশীল অর্থাৎ কোন কারণে বীজে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি হলে বীজের গুণগতমান অর্থাৎ অংকুরোদগম ক্ষমতা দ্রæত কমে যায় এবং বীজ গজায় না।
বীজের গুণগতমান নির্ভর করে সঠিকভাবে বীজ সংরক্ষণের উপর। বীজের আর্দ্রতা কমিয়ে বায়ুরোধী পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করতে পারলে বীজ গজানোর হার ৯০% পর্যন্ত বজায় রাখা যায়। তাই সঠিক আর্দ্রতায় ও বায়ুরোধী পাত্রে বীজ সংরক্ষণের উপর কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অপরদিকে বিএডিসি কর্তৃক চাহিদার বিপরীতে বীজ সরবরাহের পরিমাণ খুবই কম এবং বিএডিসি কর্তৃক রবি মৌসুমে উৎপাদিত বীজ পরবর্তী রবি মৌসুমে ভালো গজায় না। তাই বিএডিসি কর্তৃক খরিফ-২ মৌসুমে পর্যাপ্ত বীজ উৎপাদন করে রবি মৌসুমে ব্যবহারের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
খরিফ-২ মৌসুমে সয়াবিন বীজ উৎপাদন : এ মৌসুমে সয়াবিন বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমন ধানের সহিত প্রতিযোগিতা করতে হয়। তাছাড়া খরিফ-২ মৌসুমে এমন এলাকা নির্বাচন করতে হবে যেসব এলাকা উঁচু অর্থাৎ বন্যার আশংকামুক্ত। এ বিবেচনায় বন্যার আশংকামুক্ত জেলাসমূহ নির্বাচন করে আমন ধাননির্ভর শস্যবিন্যাসসমূহে আমন ধানের পরিবর্তে মানসম্পন্ন সয়াবিন বীজের জন্য সয়াবিনকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সে হিসেবে বর্তমানে চাষকৃত প্রায় ৮০.০০ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষের জন্য মানসম্পন্ন সয়াবিন বীজের প্রয়োজন হবে প্রায় ৪,৮০০ টন (হেক্টর প্রতি ৬০ কেজি বীজ হিসেবে) এবং এজন্য প্রায় ২,৪০০ হেক্টর জমির (হেক্টর প্রতি ২.০ টন বীজ উৎপাদন হিসেবে) প্রয়োজন হবে। লাভজনক ফসল আমন ধানকে বাদ দিয়ে কৃষকদের সয়াবিন চাষ করাতে হলে বিএডিসি-কে চুক্তিবদ্ধ কৃষকদের নিকট থেকে রবি মৌসুমের চেয়ে বেশি মূল্যে অর্থাৎ প্রতি কেজি সয়াবিন বীজ ৮০ হতে ৯০ টাকা দরে ক্রয় করতে হবে। তাছাড়া বীজের গুণগতমানের নিশ্চয়তা দিতে পারলে সয়াবিন চাষের কৃষকগন অধিক মূল্যেও বীজ ক্রয় করতে আগ্রহী হবেন।
৪. বোরো ধানের সহিত প্রতিযোগিতা
বাংলাদেশের মাটি, আবহাওয়া ও পরিবেশ সয়াবিন চাষের জন্য সম্পূর্ণ উপযোগী ও অনুক‚ল এবং ভাল ফলন দিলেও রবি মৌসুমের ফসল হওয়ায় বোরো ধানের সহিত প্রতিযোগিতা করতে হয়।
অপেক্ষাকৃত কম লাভজনক বোরো ধান চাষের পরিবর্তে অধিকতর লাভজনক সয়াবিন আবাদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে রোপা আমন-পতিত -বোরো শস্যবিন্যাস (এ শস্যবিন্যাসে জমির পরিমাণ ২৩.১০ লক্ষ হেক্টর) এর পরিবর্তে রোপা আমন - সয়াবিন - আউশ শস্যবিন্যাস প্রবর্তন করার বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। উল্লেখ্য, প্রবর্তিত শস্যবিন্যাসে সয়াবিন অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে মাটির স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটবে, ফলে পরবর্তী আউশ ও আমন ধান চাষে রাসায়নিক সার কম প্রয়োগ করতে হবে। তাই সয়াবিন অন্তর্ভুক্ত করে ব্যাপকভাবে প্রদর্র্শনী স্থাপন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. অস্থিতিশীল বাজার দর
বর্তমানে দেশের সয়াবিন চাষাধীন এলাকায় সয়াবিনের বাজার দর স্থিতিশীল নয়। বাজার দর উচ্চ এবং স্বাভাবিক/স্থিতিশীল থাকলে কৃষকগণ নিজেরাই সয়াবিন চাষে আগ্রহী হবেন এবং একটি অর্থকরী ফসল হিসেবে সয়াবিন আবাদ বৃদ্ধির সম্ভাবনা বেশ বৃদ্ধি পাবে। এজন্য মধ্যস্বত্বভোগী বিশেষ করে পাইকার বা আড়তদারগণের পরিবর্তে সরকারিভাবে সয়াবিন ক্রয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
৬. সয়াবিনের উৎপাদন খরচ ও ফলন
সনাতন পদ্ধতিতে সয়াবিন চাষ হওয়ায় উৎপাদন খরচ বাড়ে এবং ফলনও কম হয় অর্থাৎ ১.৬৯ টন/হে. মাত্র জমি তৈরি, বীজ বপন, আগাছা বাছাই, সেচ প্রয়োগ, বালাইনাশক প্রয়োগসহ অন্যান্য পরিচর্যা, ফসল সংগ্রহ ও মাড়াই এবং শুকানো পর্যন্ত কাজগুলো যান্ত্রিকভাবে না করার কারণে উৎপাদন খরচ বেশি হয়। বীজ বপন যন্ত্রের মাধ্যমে বীজ বপন ও পরবর্তীতে নিড়ানি যন্ত্রের সাহায্যে নিড়ানি দিতে পারলে উৎপাদন খরচ কমানোর পাশাপাশি ফলনও বেশি পাওয়া যায়। মাঠ হতে সংগ্রহের পর যান্ত্রিকভাবে সয়াবিন মাড়াই করতে পারলে পোস্ট হারভেস্ট ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। তাছাড়া দেশে সয়াবিন চাষে কোন প্রণোদনার ব্যবস্থা নাই, তাই সয়াবিন চাষে সরকারকে সেচসহ অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন বীজ বপন, নিড়ানি, সংগ্রহ ও মাড়াইযন্ত্রের উপর প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. সয়াবিন চাষে জীবাণুসারের ব্যবহার ও সঠিক মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ
দেশে সয়াবিন চাষে জীবাণুসারসহ রাসায়নিক সারের ব্যবহার খুবই কম, ফলে ফলনও অনেক কম। অথচ জীবাণুসার এবং সঠিক মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারে সয়াবিনের ফলন অনেকাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব।
গবেষণায় দেখা গেছে জীবাণুসার ব্যবহারে সয়াবিনের ফলন ৭৫-২০০% এবং সঠিক মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারে ২৫-২৭% বৃদ্ধি করা সম্ভব। তাই সয়াবিন চাষে সুষম মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার নিশ্চিত করা ও জীবাণুসারের প্রাপ্যতাসহ এর ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এজন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেমন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং ডিএইর সমন্বয়ে সঠিক মাত্রায় রাসায়নিক ও জীবাণুসার ব্যবহারে কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যাপকভাবে ফলাফল প্রদর্শন, মাঠ দিবস আয়োজন এবং কৃষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. উপক‚লীয় অঞ্চলের লবণাক্ত এবং পতিত জমিতে সয়াবিন চাষ
উপক‚লীয় খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ল²ীপুর, ফেনী এবং চাঁদপুর জেলার ২.৮৫ মিলিয়ন হে. জমিতে স্বল্প থেকে মধ্যম মাত্রা পর্যন্ত লবণাক্ততা (৪-৯ ডিএস/মি.) বিধায় এ অঞ্চলের চাষযোগ্য জমির অধিকাংশই পতিত থাকে।
সয়াবিন জেনেটিক্যালি মধ্যম মাত্রার লবণাক্ততা (৮-৯ ডিএস/মি. পর্যন্ত) সহনশীল, তাই নিম্ন হতে মধ্যম মাত্রার লবণাক্ত উপক‚লীয় এলাকায় সয়াবিন চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে আশানুরূপ ফলন পাওয়াও সম্ভব। চারা অবস্থা থেকে ফল পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত সয়াবিন মধ্যম মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে বিধায় উপক‚লীয় অঞ্চলে সহজেই সয়াবিন চাষে কোনো সমস্যা হবে না।
দেশে ভোজ্যতেলের উৎপাদনে যে বিপুল পরিমাণ সয়াবিন প্রয়োজন তা দেশে উৎপাদিত সয়াবিন দিয়ে চাহিদার ৫০% মেটানো যেতে পারে। দেশে বর্তমানে ১৫.০ লক্ষ টন ভোজ্যতেলের আমদানির বিপরীতে সয়াবিনের দেশীয় উৎপাদন প্রয়োজন প্রায় ৯০.০ লক্ষ টন (বীজ হতে নিষ্কাশিত তেল ১৬.৬৭%)। তাই ১৮.০ লক্ষ হেক্টর জমিতে আধুনিক পদ্ধতিতে উচ্চফলনশীল সয়াবিনের জাত (টেবিল-২ দ্রষ্টব্য) বিনাসয়াবিন-২, বিনাসয়াবিন-৩, বিনাসয়াবিন-৫, বিনাসয়াবিন-৬, বারি সয়াবিন-৬ ও বিএইউ সয়াবিন-১ চাষ করে উৎপাদিত ৪৫.০ লক্ষ টন সয়াবিন হতে ৭.৫ লক্ষ টন ভোজ্য সয়াবিন তেল দিয়ে ভোজ্যতেলের চাহিদার ৫০% পূরণ করা যেতে পারে। তেল নিষ্কাশনের পর সয়াবিনের অবশিষ্টাংশ বা সয়ামিল (যার পরিমাণ প্রায় ৩৭.৫ লক্ষ টন) থেকে মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের জন্য সয়াময়দাসহ বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার এবং পোলট্রি গবাদিপশু ও মাছের খাবার তৈরি করা যেতে পারে। এ লক্ষ্যে ৪টি মন্ত্রণালয় যথা-কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর তথ্যে দেখা যায় গত ২০১৮ সালে দেশে ৪৬.২১ লক্ষ টন ভোজ্যতেল আমদানিতে ২৭.৭৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়, যদিও আমদানিকৃত তেলের বড় একটি অংশ শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত হয়। উল্লেখ্য, দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ফলে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় বিগত তিন বছরে এই আমদানি হার পূর্ববর্তী বছরগুলো তুলনায় আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাথাপিছু দৈনিক ৪০ গ্রাম হারে ২০২১ সালে দেশে শুধুমাত্র ভোজ্যতেলেরই চাহিদা দাঁড়াবে প্রায় ২৫.০ লক্ষ টন। উপরোল্লিখিত উপায়ে দেশে সয়াবিন আবাদ বৃদ্ধি করা গেলে উৎপাদিত সয়াবিন হতে তেল আহরণ করে দেশে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় সম্ভব হবে এবং পুষ্টি নিরাপত্তায়ও অগ্রগতি আসবে। য়
মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ-২২০২, মোবাইল : ০১৭১২-১০৬৬২০; ই-মেইল: lekbina@gmail.com
আশ্বিন মাসের কৃষি
১৬ সেপ্টেম্বর - ১৫ অক্টোবর
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
দিগন্ত জোড়া সবুজ, শুভ্র কাশফুল আর সুনীল আকাশে ভেসে বেড়ায় চিলতে সাদা মেঘ জানান দেয় শরৎকাল ঋতুর। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আপনাদের সবার জন্য সাদা কাশফুলের শুভেচ্ছা। বৈশ্বিক কোরনা পরিস্থিতিতে এবং চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে কার্যকরি প্রস্তুতি নেবার সময় এখন। এ প্রেক্ষিতে আসুন সংক্ষেপে জেনে নেই আশ্বিন মাসের বৃহত্তর কৃষি ভুবনের করণীয় বিষয়গুলো।
আমন ধান
আমন ধানের বয়স ৪০-৫০ দিন হলে ইউরিয়ার শেষ কিস্তি প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হবে এবং জমিতে ছিপছিপে পানি রাখতে হবে। এ সময় বৃষ্টির অভাবে খরা দেখা দিতে পারে। সে জন্য সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। ফিতাপাইপের মাধ্যমে সম্পূরক সেচ দিলে পানির অপচয় অনেক কম হয়। শিষ কাটা লেদা পোকা ধানের জমি আক্রমণ করতে পারে। প্রতি বর্গমিটার আমন জমিতে ২-৫টি লেদা পোকার উপস্থিতি মারাত্মক ক্ষতির পূর্বাভাস। তাই সতর্ক থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সময় মাজরা, পামরি, চুঙ্গী, গলমাছি পোকার আক্রমণ হতে পারে। এক্ষেত্রে নিয়মিত জমি পরিদর্শন করে, জমিতে খুঁটি দিয়ে, আলোর ফাঁদ পেতে, হাতজাল দিয়ে পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। খোলপোড়া, পাতায় দাগ পড়া রোগ দেখা দিতে পারে। সঠিক রোগ শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
নাবি আমন রোপণ
কোন কারণে আমন সময়মতো চাষ করতে না পারলে অথবা নিচু এলাকায় আশ্বিনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রি ধান৪৬, বিনাশাইল বা স্থানীয় জাতের চারা রোপণ করা যায়। গুছিতে ৫-৭টি চারা রোপণ করতে হবে। অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি ইউরিয়া প্রয়োগ ও অতিরিক্ত পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায় এবং দেরির ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায়।
তুলা
এ সময় তুলাক্ষেতে গাছের বয়স ৬০ দিন পর্যন্ত আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। গোড়ার সবচেয়ে নিচের ১-২টি অঙ্গজ শাখা কেটে দেয়া ভালো। লাগাতার বৃষ্টি এবং ঝড়ো বাতাসের কারণে গাছ হেলে পড়লে পানি নিষ্কাশনসহ হেলে যাওয়া গাছ সোজা করে গোড়ায় মাটি চেপে দিতে হবে। ইউরিয়া, এমওপি ও বোরনসহ অন্যান্য অনুখাদ্য নিয়মিতভাবে পাতায় প্রয়োগের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এ সময় রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা গেলে সঠিক বালাই শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
পাট
নাবি পাট ফসল উৎপাদনে এ সময় গাছ থেকে গাছের দূরত্ব সমান রেখে অতিরিক্ত গাছ তুলে পাতলা করে দিতে হবে। দ্বিতীয় কিস্তির ইউরিয়া সার ১৫-২০ দিনে এবং তৃতীয় কিস্তির ইউরিয়া সার ৪০-৪৫ দিনে প্রয়োগের সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকে। এ সময় সবজি ও ফল বাগানে সাথী ফসল হিসেবে বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারেন।
আখ
আখের চারা উৎপাদন করার উপযুক্ত সময় এখন। সাধারণত বীজতলা পদ্ধতি এবং পলিব্যাগ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করা যায়। পলিব্যাগে চারা উৎপাদন করা হলে বীজ আখ কম লাগে এবং চারার মৃত্যুহার কম হয়। চারা তৈরি করে বাড়ির আঙ্গিনায় সুবিধাজনক স্থানে সারি করে রেখে খড় বা শুকনো আখের পাতা দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। চারার বয়স ১-২ মাস হলে মূল জমিতে রোপণ করা উচিত। কাটুই বা অন্য পোকা যেন চারার ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
বিনা চাষে ফসল আবাদ
মাঠ থেকে বন্যার পানি নেমে গেলে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় বিনা চাষে অনেক ফসল আবাদ করা যায়। ভুট্টা, গম, আলু, সরিষা, মাসকালাই বা অন্যান্য ডাল ফসল, লালশাক, পালংশাক, ডাঁটাশাক বিনা চাষে লাভজনকভাবে আবাদ করা যায়। সঠিক পরিমাণ বীজ, সামান্য পরিমাণ সার এবং প্রয়োজনীয় পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে লাভ হবে অনেক। যেসব জমিতে উফশী বোরো ধানের চাষ করা হয় সেসব জমিতে স্বল্পমেয়াদি সরিষা জাত (বারি সরিষা-৯, বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বিনা সরিষা-৪, বিনা সরিষা-৯ ইত্যাদি) চাষ করতে পারেন।
শাকসবজি
আগাম শীতের সবজি উৎপাদনের জন্য উঁচু জায়গা কুপিয়ে পরিমাণ মতো জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে শাক উৎপাদন করা যায় যেমনÑ মুলা, লালশাক, পালংশাক, চীনা শাক, সরিষা শাক অনায়াসে করা যায়। সবজির মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, টমেটো, বেগুন, ব্রোকলি বা সবুজ ফুলকপিসহ অন্যান্য শীতকালীন সবজির চারা তৈরি করে মূল জমিতে বিশেষ যতেœ আবাদ করা যায়।
কলা
অন্যান্য সময়ের থেকে আশ্বিন মাসে কলার চারা রোপণ করা সবচেয়ে বেশি লাভজনক। এতে ১০-১১ মাসে কলার ছড়া কাটা যায়। ভালো উৎস বা বিশ্বস্ত চাষি ভাইয়ের কাছ থেকে কলার অসি চারা সংগ্রহ করে রোপণ করতে হবে। কলার চারা রোপণের জন্য ২-২.৫ মিটার দূরত্বে ৬০ সেমি. চওড়া এবং ৬০ সেমি গভীর গর্ত করে রোপণ করতে হবে। গর্ত প্রতি ৫-৭ কেজি গোবর, ১২৫ গ্রাম করে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সার এবং ৫ গ্রাম বরিক এসিড মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে ৫-৭ দিন পর অসি চারা রোপণ করতে হবে। কলাবাগানে সাথী ফসল হিসেবে ধান, গম, ভুট্টা ছাড়া যে কোন রবি ফসল চাষ করা যায়।
গাছপালা
বর্ষায় রোপণ করা চারা কোনো কারণে নষ্ট হলে সেখানে নতুন চারা রোপণ করতে হবে। বড় হয়ে যাওয়া চারার সঙ্গে বাঁধা খুঁটি সরিয়ে দিতে হবে এবং চারার চারদিকের বেড়া প্রয়োজনে সরিয়ে বড় করে দিতে হবে। মরা বা রোগাক্রান্ত ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। চারা গাছসহ অন্যান্য গাছে সার প্রয়োগের উপযুক্ত সময় এখনই। গাছের গোড়ার মাটি ভালো করে কুপিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে। দুপুর বেলা গাছের ছায়া যতটুকু স্থানে পড়ে ঠিক ততটুকু স্থান কোপাতে হবে। পরে কোপানো স্থানে জৈব ও রাসায়নিক সার ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে।
প্রাণিসম্পদ
হাঁস-মুরগির কলেরা, ককসিডিয়া, রানীক্ষেত রোগের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। প্রাথমিকভাবে টিকা প্রদান, প্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়ানোসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক। এ মাসে হাঁস-মুরগির বাচ্চা ফুটানোর ব্যবস্থা নিতে পারেন। বাচ্চা ফুটানোর জন্য অতিরিক্ত ডিম দেয়া যাবে না। তাছাড়া ডিম ফুটানো মুরগির জন্য অতিরিক্ত বিশেষ খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
আশ্বিন মাসে গবাদিপশুকে কৃমির ওষুধ খাওয়ানো দরকার। গবাদি পশুকে খোলা জায়গায় না রেখে রাতে ঘরের ভেতরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। পানিতে জন্মানো গোখাদ্য এককভাবে না খাইয়ে শুকিয়ে খরের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। এ সময় ভুট্টা, মাসকলাই, খেসারি বুনো ঘাস উৎপাদন করে গবাদিপশুকে খাওয়াতে পারেন। গর্ভবতী গাভী, সদ্য ভূূমিষ্ঠ বাছুর ও দুধালো গাভীর বিশেষ যতœ নিতে হবে। এ সময় গবাদি প্রাণীর মড়ক দেখা দিকে পারে। তাই গবাদিপশুকে তড়কা, গলাফুলা, ওলান ফুলা রোগের জন্য প্রতিষেধক, প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চত করতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
বর্ষায় পুকুরে জন্মানো আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং পুকুরের পাড় ভালো করে বেঁধে দেয়া প্রয়োজন। পুকুরের মাছকে নিয়মিত পুষ্টিকর সম্পূরক খাবার সরবরাহ করা দরকার। এ সময় পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া পুকুরে জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং রোগ সারাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি মাছের খামার থেকে জিওল মাছের পোনা সংগ্রহ করে পুকুরে ছাড়ার ব্যবস্থা নিতে পারেন।
আশ্বিন মাসে নিয়মিত কৃষি কাজের পাশাপাশি সারা দেশজুড়ে ইঁদুর নিধন অভিযান শুরু হয়। করোনা পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তায় ইঁদুরের হাত থেকে ফসল রক্ষা করার জন্য এ অভিযান খুবই জরুরি। এককভাবে বা কোন নির্দিষ্ট এলাকায় ইঁদুর দমন করলে কোন লাভ হবে না। ইঁদুর দমন কাজটি করতে হবে দেশের সকল মানুষকে একসাথে মিলে এবং ইঁদুর দমনের সকল পদ্ধতি ব্যবহার করে। ইঁদুর নিধনের ক্ষেত্রে যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায় সেগুলো হলো- পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক চাষাবাদ, গর্তে ধোঁয়া দেয়া, ফাঁদ পাতা, উপকারী প্রাণী যেমন- পেচা, গুঁইসাপ, বিড়াল দ্বারা ইঁদুর দমন, বিষটোপ এবং গ্যাসবড়ি ব্যবহার করা। আসুন সবাই একসাথে ইঁদুর দমন করি। সবাই ভালো থাকি। য়
সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪; ই-মেইল : fardousi30@gmail.com
কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন
কৃষি বিষয়ক
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
মোঃ কবির হোসেন, গ্রাম: তিনিশপুর, উপজেলা: নরসিংদী সদর, জেলা: নরসিংদী
প্রশ্ন: ভুট্টার কাÐ পঁচারোধে কী করতে হবে ?
উত্তর: খরিফ মৌসুমে এ রোগ বেশী হয়। এছাড়া জমিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশি ও পটাশের পরিমাণ কম হলে এ রোগের সম্ভাবনা বাড়ে। এ রোগে কাÐের নীচের দিকে নরম ও পানি ভেজা দাগ পড়ে পাশাপাশি রোগের আক্রমণে গাছের কাÐ পচে যায় এবং গাছ মাটিতে ভেঙ্গে পড়ে। সুস্থ ও সবল বীজ বপন এবং সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করতে হবে। বীজ বপনের পূর্বে কার্বেন্ডাজিম গ্রæপের ছত্রাকনাশক যেমন অটোস্টিন অথবা কার্বোক্সিন + থিরাম গ্রæপের প্রোভ্যাক্স ২০০ ডবিøউপি প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে শোধন করলে এ রোগ দমন করা যায়। এছাড়া আক্রমনের মাত্রা বাড়লে ডাইফেনোকোনাজল গ্রæপের স্কোর ২৫০ ইসি এক লিটার পানিতে ০.১ মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করলে আপনি সুফল পাবেন।
সুবিল কুমার, গ্রাম: তালুকগোলনা, উপজেলা: জলঢাকা, জেলা: নীলফামারী
প্রশ্ন: বেগুন গাছের জাব পোকা দমন সর্ম্পকে জানাবেন।
উত্তর: বেগুন গাছের জাব পোকা দমনের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয় সেগুলো হলো- বেগুন সংগ্রহের পর ফসলের অবশিষ্টাংশ নষ্ট করে ফেলা। আঠালো হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করা। এছাড়া বায়োনিম প্লাস ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত পাতায় স্প্রে করা। এছাড়াও ইমিডাক্লোরপ্রিড গ্রæপের যেমন এডমায়ার প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি ভালোভাবে মিশিয়ে স্প্রে করলে উপকার পাবেন।
মোঃ ইনাম আহমেদ, গ্রাম: চরকেশবপুর, উপজেলা: শিবচর, জেলা: মাদারীপুর
প্রশ্ন: মুখী কচুর পাতায় এক ধরনের দাগ পড়ছে। সবগুলো দাগ মিলে পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে। কি করলে এ ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি পাবো?
উত্তর: মুখী কচুর পাতায় এ ধরনের সমস্যা কে পাতার দাগ রোগ বলে। এ রোগ দমনের জন্য কার্বেন্ডাজিম গ্রæপের ১ গ্রাম ছত্রাকনাশক ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে এ সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আর যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে সেটি হলো রোগমুক্ত গাছ থেকে চারা সংগ্রহ করা। আশা করি এসব নিয়ম মেনে চললে ভবিষ্যতে আর এ ধরনের সমস্যা থাকবে না।
মোছা: তৌহিদা নাজনীন গ্রাম: লাউযুথি, উপজেলা: ঠাকুরগাঁও সদর, জেলা: ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন: পেয়ারা ফল কাটলে পেয়ারার মাঝে কীড়া দেখা যায়। আক্রান্ত ফলও পচে যায়। কি করণীয়?
উত্তর: পেয়ারা ফলে ফলের মাছি পোকা আক্রমণ করলে এ ধরনের সমস্যা দেখা যায়। সেক্ষেত্রে পোকাযুক্ত ফলগুলোকে মাটিতে গভীর গর্ত করে পুতে ফেলতে হয়। এ ছাড়া বিষফাঁদ ব্যবহার করলেও উপকার পাওয়া যায়। এমনকি জৈব কীটনাশকও ব্যবহার করা যায়। গাছের গোড়া পরিষ্কার করে মাটি কুপিয়ে দিলেও সুফল পাওয়া যায়। আর যদি আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে তবে ১ মিলি ইমিডাক্লোরপ্রিড গ্রæপের কীটনাশক ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে ২/৩ বার স্প্রে করলে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
মোঃ লতিফুল হায়দার, গ্রাম: কেরাদারি, উপজেলা: রাজারহাট, জেলা: কুড়িগ্রাম
প্রশ্ন: ঢেঁড়স গাছের শিকড়ে প্রচুর গিট দেখা যাচ্ছে এবং গাছের পাতা ছোট আকারের হয়ে যাচ্ছে। এ সমস্যা কিভাবে সমাধান করবো?
উত্তর: ঢেঁড়স গাছের এ সমস্যাটি কৃমিজনিত রোগ। এ রোগ হলে গাছের পাতা ছোট ও শিকড়ে প্রচুর গিট দেখা যায়। এজন্য এ রোগ দেখা দিলে আক্রান্ত গাছ দেখলেই তা তুলে ধ্বংস করতে হবে। একই জমিতে বারবার চাষ না করা। জমি গভীরভাবে চাষ করা। শেষ চাষের সময় কার্বোফুরান জাতীয় দানাদার কীটনাশক জমিতে প্রয়োগ করা। এসব নিয়ম অনুসরণ করলে আপনার সমস্যার কাক্সিক্ষত সমাধান পাবেন।
মোঃ গোলাম মোস্তফা, ইব্রাহিম, গ্রাম: দৌলতপুর, উপজেলা: নড়াইল সদর, জেলা: নড়াইল
প্রশ্ন: লটকন গাছের পাতা হলুদ হয়ে শাখা-প্রশাখা ও পুরো গাছ মারা যাচ্ছে। এ সমস্যার সমাধান কী?
উত্তর: এ রোগের কোন প্রতিকার নেই। তবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কিছু করণীয় আছে। সেগুলো হলো দ্রæত পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া রোগের প্রাথমিক অবস্থায় বর্দোমিক্সার বা কপার অক্সিক্লোরাইড গ্রæপের ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে। আর বাগানের মাটির অ¤øত্ব কমানোর জন্য জমিতে চুন প্রয়োগ করতে হবে। সেক্ষেত্রে গাছ প্রতি ২৫০ গ্রাম চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে। এছাড়া রোগ প্রতিরোধী আদি জোড়ের উপর কলম করতে হবে। এসব ব্যস্থা গ্রহণ করলে লটকনের উল্লিখিত সমস্যার সমাধান হবে।
মৎস্য বিষয়ক
মোঃ তারেক হোসেন, গ্রাম: দরিদাঘি, উপজেলা: নেত্রকোনা সদর, জেলা: নেত্রকোনা
প্রশ্ন: ডিম স্টিপিং পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর: হরমোন ইনজেকশন দেওয়ার পর স্ত্রী মাছকে ব্রিডিং পুলে ¯্রােত ও ফোয়ারা সহকারে রাখতে হবে। পুরুষ মাছকে হরমোন ইনজেকশন দেওয়ার পর পৃথক ব্রিডিং পুলে ¯্রােত ও ফোয়ারা সহকারে স্ত্রী মাছ হতে বিচ্ছিন্নভাবে রাখতে হবে। ডিম পারার সঠিক সময়ে স্ত্রী মাছ ধরে শুকনো কাপড় দ্বারা মুছে পেটে সামান্য চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে একটি পাত্রে ডিম সংগ্রহ করতে হবে। এরপর পুরুষ মাছের পেটে চাপ দিয়ে বীর্য পূর্বে সংগৃহীত ডিমের উপর ফেলতে হবে এবং মুরগির নরম পালক দিয়ে বীর্যকে ডিমের সাথে মিশিয়ে ডিমকে নিষিক্ত করতে হবে। নিষিক্ত ডিম ক্রমান্বয়ে পানি দিয়ে ডিমের পানির শোষণ সম্পূর্ণভাবে শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। পানি শোষিত নিষিক্ত ডিমকে পরিমাপ সহকারে হ্যাচিং পুলে পানির ¯্রােত ও ফোয়ারার মধ্যে স্ফুটনের জন্য রাখতে হবে।
মোঃ রুবেল হোসেন, গ্রাম: লখাইডাঙ্গা, উপজেলা: মণিরামপুর, জেলা: যশোর
প্রশ্ন: মাছের ছত্রাকজনিত রোগের ক্ষেত্রে কি করণীয়?
উত্তর: রুইজাতীয় ও অন্যান্য চাষযোগ্য মাছে এবং মাছের ডিম আক্রান্ত হয়। ছত্রাকজনিত রোগের লক্ষণগুলো হলো-পুচ্ছ পাখনা, ময়লাবর্ণ তুলার ন্যায় ছত্রাক দেখা যায়। চামড়ায়, মাছের ডিম আক্রান্ত হয়ে সাদাটে হয়ে যায়। পানির ¯্রােত যখন স্থির হয় কিংবা বদ্ধ জলায় অথবা হ্যাচারি ট্যাংকে যেখানে অনিষিক্ত ডিমের বাপক সমাগম ঘটে সেখানে ছত্রাক রোগ দ্রæত ছড়ায়। এছাড়া প্রাকৃতিক জলাশয়ের প্রায় শতকরা ৯৮ ভাগ ডিম এ রোগ দ্বারা আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সমস্যা রোধে-হ্যাচারির প্রতিটি যন্ত্রপাতি ও ট্যাংক সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার করার পর শতকরা ১০ ভাগ ফরমালিন পানি দিয়ে ধৈৗত করতে হবে। অনিষিক্ত ও মৃত ডিমগুলোকে দ্রæত হ্যাচারি থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। হ্যাচারিতে অধিক খাদ্য প্রয়োগ না করা। এসবের পাশাপাশি হ্যাচারিতে পালনকৃত ডিমগুলো ২৫০ পিপিএম ফরমালিন দিয়ে ধৌত করা। খাঁচা ও পেনে চাষকৃত আক্রন্ত মাছগুলোকে শতকরা ৩-৫ ভাগ ফরমালিন দিয়ে ২-৩ মিনিটের মতো গোসল করানো। আর বিকল্প হিসেবে শতকরা ৫ ভাগ লবণ পানিতে আক্রান্ত মাছগুলোকে গোসল করানো।
প্রাণিসম্পদ বিষয়ক
মোঃ রহিম প্রামানিক, গ্রাম: কেওয়াপূর্বখন্ড, উপজেলা: উল্লাপাড়া, জেলা: সিরাজগঞ্জ
প্রশ্ন: আমার ছাগলের বয়স আড়াই বছর। বিভিন্ন জায়গার মাংস শক্ত হয়ে গেছে। দাঁতে কপাট রাগে এবং খিঁচুনি দেখা দেয়। কোন শব্দ শুনলে চমকে উঠে। এমতাবস্থায় কী করণীয়?
উত্তর: সাধারণত এ রোগের চিকিৎসায় তেমন ফল হয় না। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ সনাক্ত করতে পারলে ক্ষতস্থান অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে এবং মাংসে এটিএম ইনজেকশন দিতে হবে। এছাড়া উচ্চমাত্রায় পেনিসিলিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হবে। মাংসপেশি শিথিল করার জন্য ক্লোরাল হাইড্রেট ও ম্যাগনেসিযাম সালফেট ইনজেকশন দিতে হবে। খাসি করানো বা অন্য কোন অস্ত্রোপচারের আগে ধনুষ্টংকার রোগের টিকা দিতে হবে। তাছাড়া স্বাস্থ্যসম্মতভাবে যে কোন অস্ত্রোপচার করতে হবে।
মোছাঃ রহিমা বেগম, গ্রাম: খাটুরিয়া, উপজেলা: গোবিন্দগঞ্জ, জেলা: গাইবান্ধা
প্রশ্ন: আমার বাড়ির মুরগিগুলোর পায়ুস্থানে ময়লা লেগে থাকছে। পালকগুলো কুঁচকে আছে,ডায়রিয়া হচ্ছে। এমতাবস্থায় কী করণীয়। পরামর্শ চাই।
উত্তর: আপনার মুরগিগুলোর গামবোরো রোগ হয়েছে। এই রোগ যাতে না হয় সেজন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ১০ থেকে ২১ দিনে বয়সে গামবোরোর টিকা প্রদান করতে হয়। আর রোগে আক্রান্ত হয়ে গেলে দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য এনফ্লক্স ভেট সলিউশন অথবা কট্টা ভেট পাউডার এবং সাথে ইলেকট্রোমিন পাউডার খাওয়াতে হবে।
(মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক প্রশ্ন কৃষি কল সেন্টার হতে প্রাপ্ত)
উপপ্রধান তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ মোবাইল: ০১৭১১১১৬০৩২, ইমেল : taufiquedae25@gmail.com