ড. মো. শাহজাহান কবীর
আমন শব্দটির উৎপত্তি আরবি শব্দ ‘আমান’ থেকে যার অর্থ আমানত। অর্থাৎ আমন কৃষকের কাছে একটি নিশ্চিত ফসল (ঝঁৎব ঈৎড়ঢ়) বা আমানত হিসেবে পরিচিত ছিল। আবহমান কাল থেকে এ ধানেই কৃষকের গোলা ভরে, যা দিয়ে কৃষক তার পরিবারের ভরণ-পোষণ, পিঠাপুলি, আতিথেয়তাসহ সংসারের অন্যান্য খরচ মিটিয়ে থাকে। ২০১৮-১৯ আমন মৌসুমে দেশে ৫৬.২২ লাখ হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ হয়, এর মধ্যে ৩.৩৯ লাখ হেক্টর বোনা, ৮.৭২ লাখ হেক্টর স্থানীয় জাতের এবং ৪৪.১১ লাখ হেক্টর জমিতে উফশী রোপা আমন চাষ হয় যা থেকে উৎপাদন হয় ১ কোটি ৫৩ লাখ টন। ২০১৯-২০ মৌসুমে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের ফলে আমন আবাদ এরিয়া ৫% বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে ৩.১৩ লাখ হেক্টর বোনা, ৮.৫১ লাখ হেক্টর স্থানীয় জাতের এবং ৪৭.১৯ লাখ হেক্টর জমিতে উফশী রোপা আমন চাষ হয়। নানা সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও প্রতিবছর আমনের উৎপাদন বাড়ছে এবং গত বছর আমনের উৎপাদন ১ কোটি ৫৫ লাখ টনে পৌঁছায়। এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছে নতুন নতুন উদ্ভাবিত জাত, আধুনিক ব্যবস্থাপনা ও সরকারের সঠিক নীতি কৌশল। এ বছর বোরো উৎপাদনের পর আউশ এবং আমনের উপর সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। করোনার কারণে যেন খাদ্য সংকট না হয়, দেশে যেন দুর্ভিক্ষের মতো কোনো অবস্থা সৃষ্টি না হয়, মানুষ যেন খাদ্য কষ্টে না ভোগে, সেজন্যই এসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
আমন ধান মূলত দুই প্রকার; রোপা আমন ও বোনা আমন। রোপা আমন আষাঢ় মাসে বীজ তলায় বীজ বোনা হয়, শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে মূল জমিতে রোপণ করা হয় এবং কার্তিক- অগ্রহায়ণ-পৌষ (এলাকাভেদে) মাসে ধান কাটা হয়।
বোনা আমন ছিটিয়ে বোনা হয়। চৈত্র-বৈশাখ মাসে মাঠে বোনা আমনের বীজ বপন করা হয় এবং অগ্রহায়ণ মাসে পাকা ধান কাটা হয়। একে আছড়া আমন, বাওয়া আমন বা গভীর পানির আমনও বলা হয়। আমন মৌসুমে যেহেতু আবাদ আমনে আবাদ এলাকা বৃদ্ধির তেমন সুযোগ নেই তবে কিছু কিছু এলাকা যেমন;
১. সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে অনেক জমি পতিত থাকে তার মূল কারণ জমির মালিক বিদেশ থাকে (অনংবহঃবব ভধৎসবৎ);
২. নোয়াখালী ও বরিশালের চর অঞ্চল;
৩. যেসব এলাকায় আগাম সবজি চাষ করা হয় সেসব জমি পতিত না রেখে স্বল্প জীবনকালীন জাত যেমন ব্রি ধান৫৭, ৬২, ৭১, ৭৫ চাষ করা
৪. বোরো-পতিত-পতিত শস্য বিন্যাসে আমন মওসুমে জমি পতিত না রেখে ব্রি উদ্ভাবিত ব্রি ধান৯১, অন্যান্য স্থানীয় জাত চাষ করে উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে। আমন ধানের উৎপাদন বৃদ্ধিতে করণীয় বিষয়গুলো-
জাত নির্বাচন : বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমন মৌসুম ও এর পরিবেশ উপযোগী ৪১টি (৩৯টি ইনব্রিড ও ২টি হাইব্রিড) উফশী ধানের জাত ও ধান উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নানা রকম কৃষিতাত্তি¡ক ব্যবস্থাপনা উদ্ভাবন করেছে। অনুক‚ল ও প্রতিক‚ল পরিবেশে চাষযোগ্য আমন জাতগুলো নি¤েœ উল্লেখ করা হলো।
অনুক‚ল পরিবেশ উপযোগী জাতসমূহÑ
বিআর৪, বিআর৫, বিআর১০, বিআর১১, ব্রি ধান৩০, ব্রি ধান৩২, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৯, ব্রি ধান৪৯, ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭২, ব্রি ধান৭৫, ব্রি ধান৭৯, ব্রি ধান৮০, ব্রি ধান৮৭, ব্রি ধান৯০, ব্রি ধান৯৩, ব্রি ধান৯৪, ব্রি ধান৯৫।
প্রতিক‚ল পরিবেশে চাষযোগ্য জাত
* খরা প্রবণ এলাকায় ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭ ও ব্রি ধান৬৬, ব্রি ধান৭১।
* বন্যা প্রবণ এলাকার জন্য উপযোগী জাতগুলো হলো- ব্রি ধান৫১, ব্রি ধান৫২, ব্রি ধান৭৯। এছাড়া বিআর২২, বিআর২৩, ব্রি ধান৪৬ জাতগুলোর নাবি গুণ থাকার জন্য এদের বীজ ২০-৩০ শ্রাবণে বপন করে ৩০-৪০ দিনের চারা সর্বশেষ ৩১ ভাদ্র পর্যন্ত বন্যা প্রবণ এলাকায় রোপণ করা যায়।
* লবণাক্ত এলাকায় বিআর২৩, ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৪, ব্রি ধান৭৩, ব্রি ধান৭৮।
* জোয়ার-ভাটা প্রবণ অলবণাক্ত এলাকার উপযোগী জাতগুলো হলো- ব্রি ধান৪৪, ব্রি ধান৫২, ব্রি ধান৭৬,ব্রি ধান৭৭।
* জলাবদ্ধ এলাকার জন্য উপযোগী জাত- বিআর১০, বিআর২৩, ব্রি ধান৩০, ব্রি ধান৭৯, ব্রি ধান৭৬, ব্রি ধান৭৮।
* বোরো-পতিত-পতিত শস্য বিন্যাসে ব্রি ধান৯১ সহ গভীর পানিতে চাষাবাদ উপযোগী স্থানীয় জলি আমন ধান যেমন গোপালগঞ্জ ও বরিশাল অঞ্চলের ল²ী ও বাঁশিরাজ, সিলেট অঞ্চলে লালমোহন, হবিগঞ্জে দুধলাকি ও ফুলকুড়ি, ফরিদপুরে খইয়া মটর এবং সিরাজগঞ্জে সড়সড়িয়া।
* বরেন্দ্র এলাকার জন্য জাতগুলো হলো-ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬৬, ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭৫ ও ব্রি ধান৮০। এছাড়া সুগন্ধি ব্রি ধান৩৪ সহ সমতল বরেন্দ্র অঞ্চলে অনুক‚ল পরিবেশের জন্য সুপারিশকৃত সব জাতই চাষ করা সম্ভব।
* পাহাড়ি এলাকার জন্য উপযোগী জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে- ব্রি ধান৪৯, ব্রি ধান৭০, ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭৫, এবং ব্রি ধান৮০।
প্রিমিয়াম কোয়ালিটি জাত : দিনাজপুর, নওগাঁসহ যেসব এলাকায় সরু বা সুগন্ধি ধানের চাষ হয় সেখানে বিআর৫, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৭, ব্রি ধান৩৮, ব্রি ধান৭০, ব্রি ধান৭৫ ও ব্রি ধান৮০ চাষ করা যায়।
ব্রি উদ্ভাবিত হাইব্রিড জাত : আমন মওসুমের জন্য ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলো হলো ব্রি হাইব্রিড ধান৪ ও ৬। এ জাতগুলো বন্যামুক্ত এলাকায় রোপা আমনে অনুক‚ল পরিবেশে চাষযোগ্য। এ জাতগুলোর চাল মাঝারি চিকন, স্বচ্ছ ও সাদা এবং লম্বা, ভাত ঝরঝরে হওয়ায় কৃষকের কাছে পছন্দনীয়।
নতুন উদ্ভাবিত আমনের জাত ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭২, ব্রি ধান৭৫, ব্রি ধান৭৯, ব্রি ধান৮০ এবং ব্রি ধান৮৭ জাতগুলো চাষ করে প্রতিনিয়ত উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
বীজতলা তৈরি ও বীজ বপনের সময় : উঁচু এবং উর্বর জমিতে বীজতলা তৈরি করতে হবে যেখানে বন্যার পানি উঠার সম্ভাবনা নেই। যেসব এলাকায় উঁচু জমি নেই সেসব এলাকায় ভাসমান বীজতলা তৈরি করার জন্য পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। দীর্ঘ, মধ্যম ও স্বল্প জীবনকালের জাতের জন্য আলাদা আলাদা স্থান ও সময়ে বীজতলায় বপন করতে হবে। পরিমিত ও মধ্যম মাত্রার উর্বর মাটিতে বীজতলার জন্য কোনো সার প্রয়োগ করতে হয় না। তবে নিম্ন, অতি নিম্ন অথবা অনুর্বর মাটির ক্ষেত্রে গোবর অথবা খামারজাত সার প্রতি শতকে ২ মণ হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে। ভালো চারা পাওয়ার জন্য ভালো বীজের বিকল্প নেই। তাই বিএডিসি, স্থানীয় কৃষি বিভাগ বা ব্রি কার্যালয়ের সাথে যোগাযোগ করে ভালো বীজ সংগ্রহ করে বীজতলায় বপন করতে হবে।
আমন বীজতলায় রোগ ব্যবস্থাপনা : আমন বীজতলায় বাকানি রোগ দেখা দিতে পারে। বাকানি রোগাক্রান্ত ধানের চারা স্বাভাবিক চারার চেয়ে হালকা সবুজ, লিকলিকে ও স্বাভাবিক চারার চেয়ে অনেকটা লম্বা হয়ে অন্য চারার ওপরে ঢলে পড়ে। আক্রান্ত চারাগুলো ক্রমান্বয়ে মারা যায়। আক্রান্ত চারার নিচের গিট থেকে অস্থানিক শিকড়ও দেখা যেতে পারে।
দমন ব্যবস্থাপনা : বাকানি রোগ দমনের জন্য অটিস্টিন ৫০ ডবিøউপি বা নোইন ৫০ ডবিøউপি দ্বারা বীজ অথবা চারা শোধন করা (১ লিটার পানিতে ৩ গ্রাম অটিস্টিন ৫০ ডবিøউপি বা নোইন ৫০ ডবিøউপি মিশিয়ে তাতে ধানের বীজ অথবা চারা ১০-১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখা)। আক্রান্ত গাছ সংগ্রহ করে পুঁড়িয়ে ফেলতে হবে। বীজতলা হিসেবে একই জমি ব্যবহার না করা।
আমন বীজতলায় পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা : আমন বীজতলায় সাধারনত থ্রিপস এবং সবুজ পাতা ফড়িং পোকার আক্রমণ দেখা যায়।
দমন ব্যবস্থাপনা : বীজতলায় পানি কিংবা ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগের মাধ্যমে থ্রিপস পোকার আক্রমণের তীব্রতা কমানো যেতে পারে। সবুজ পাতা ফড়িং পোকা দমনের জন্য হাতজাল কিংবা আলোক ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে। আক্রমণের তীব্রতা খুব বেশি হলে উভয় পোকার ক্ষেত্রে ক্লোরপাইরিফস গ্রæপের কীটনাশক যেমন ডার্সবান২০ ইসি প্রতি বিঘায় ১৩৪ মিলি লিটার হারে ব্যবহার করা যেতে পারে।
চারা রোপণ : লাইন বা সারিবদ্ধভাবে চারা রোপণ করতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো ও বাতাস চলাচলের জন্য উত্তর-দক্ষিণ বরাবর সারি করে লাগালে ভালো। সাধারণত সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০ সেমি. (৮ ইঞ্চি) ও গুছি থেকে গুছির দূরত্ব ১৫ সেমি. (৬ ইঞ্চি) রাখলে ভাল ফলন পাওয়া যাবে। তবে জমি উর্বর হলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫ সেমি. (১০ ইঞ্চি) ও গুছি থেকে গুছির দূরত্ব ১৫ সেমি. (৬ ইঞ্চি) রাখা যেতে পারে।
চারার বয়স
* আলোক-অসংবেদনশীল দীর্ঘ ও মধ্যম মেয়াদি জাতগুলোর চারার বয়স হবে ২০-২৫ দিন।
* আলোক-অসংবেদনশীল স্বল্পমেয়াদি জাতগুলোর চারার বয়স হবে ১৫-২০ দিন।
* লবণাক্ততা সহিষ্ণু জাতগুলোর (যেমনঃ ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৪, ব্রি ধান৭৩) চারার বয়স হবে ৩০-৩৫দিন।
* আলোক-সংবেদনশীল জাতগুলোর (যেমন- বিআর২২, বিআর২৩, ব্রি ধান৪৬, ব্রি ধান৭৬, ব্রি ধান৭৭) নাবীতে রোপণের ক্ষেত্রে চারার বয়স হবে ৩৫-৪০দিন।
রোপণ সময়
* রোপা আমনের আলোক-অসংবেদনশীল দীর্ঘ ও মধ্যম মেয়াদি জাতগুলোর উপযুক্ত রোপণ সময় হচ্ছে ১৫ জুলাই-১৫ আগস্ট। তাছাড়া প্রতিদিন বিলম্বের জন্য ফলন কমে যাবে।
* আলোক-অসংবেদনশীল স্বল্প মেয়াদি জাতগুলোর উপযুক্ত রোপণ সময় হচ্ছে ২৫ জুলাই-২৫ আগস্ট। এই সময়ের আগে লাগালে ইঁদুর ও পাখি আক্রমণ করে।
* আলোক-সংবেদনশীল জাতগুলোর (বিআর২২, বিআর২৩, ব্রি ধান৪৬, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৫৪, নাইজারশাইল) বপন সময় হলো ৩০ আগস্ট পর্যন্ত এবং রোপণ সময় হচ্ছে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
* সকল সুগন্ধি এবং স্থানীয় জাত ১-২০ ভাদ্র সময়ের মধ্যে রোপণ করতে হবে।
সম্পূরক সেচ : আমন চাষাবাদ পুরোটাই বৃষ্টিনির্ভর। তবে প্রতি বছর সকল স্থানে বৃষ্টিপাত এক রকম হয় না। এমনকি একই বৎসরের একই স্থানে সবসময় সমানভাবে বৃষ্টিপাত হয় না। বৃষ্টি-নির্ভর ধানের জমিতে যে কোনো পর্যায়ে সাময়িকভাবে বৃষ্টির অভাবে খরা হলে অবশ্যই সম্প‚রক সেচ দিতে হবে। প্রয়োজনে সম্প‚রক সেচের সংখ্যা একাধিক হতে পারে। তা না হলে ফলনে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। তাই সম্পূরক সেচ নিশ্চিত করার জন্য জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে ১. পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি যাতে বোরো মৌসুমের পর পাম্পে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করে তার ব্যবস্থা করা, ২. কৃষকের সেচ খরচে প্রণোদনা দেয়া।
সার ব্যবস্থাপনা : আবহাওয়া ও মাটির উর্বরতার মান যাচাই এবং ধানের জাত, জীবনকাল ও ফলন মাত্রার উপর ভিত্তি করে সারের মাত্রা ঠিক করা হয়। আলোক-অসংবেদনশীল দীর্ঘ ও মধ্যম মেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে বিঘা প্রতি ইউরিয়া-ডিএপি/টিএসপি-এমওপি-জিপসাম যথাক্রমে ২৬-৮-১৪-৯ কেজি হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির শেষ চাষে সমস্ত ডিএপি/টিএসপি-এমওপি- জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সমান ভাগে তিন কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। ১ম কিস্তি চারা রোপণের ৭-১০ দিন পর, ২য় কিস্তি চারা রোপণের ২৫-৩০ দিন পর এবং ৩য় কিস্তি কাইচ থোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে।
আলোক-অসংবেদনশীল স্বল্পমেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে বিঘা প্রতি ইউরিয়া-ডিএপি/টিএসপি-এমওপি-জিপসাম যথাক্রমে ২০-৭-১১-৮ কেজি হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির শেষ চাষে ১/৩ অংশ ইউরিয়া এবং সমস্ত ডিএপি/টিএসপি(লাল অংশ বা টিএসপি বাদ)-এমওপি-জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। বাকি ইউরিয়া সমানভাগে দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। ১ম কিস্তি চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর এবং ২য় বা শেষ কিস্তি কাইচ থোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে।
নাবীতে রোপণকৃত আলোক-সংবেদনশীল জাতের ক্ষেত্রে বিঘা প্রতি ইউরিয়া-ডিএপি/টিএসপি-এমওপি-জিপসাম যথাক্রমে ২৩-৯-১৩-৮ কেজি হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির শেষ চাষে ২/৩ অংশ ইউরিয়া এবং সমস্ত ডিএপি/টিএসপি-এমওপি-জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। বাকি ইউরিয়া কাইচ থোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। ব্রি ধান৩২ এবং স্বল্প আলোক-সংবেদনশীল সুগন্ধিজাত ধানের ক্ষেত্রে বিঘা প্রতি ইউরিয়া-ডিএপি/টিএসপি-এমওপি-জিপসাম যথাক্রমে ১২-৭-৮-৬ কেজি হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে।
* ডিএপি সার ব্যবহার করলে সবক্ষেত্রেই প্রতি কেজিতে ৪০০গ্রাম ইউরিয়া কম ব্যবহার করলেই হবে। ঘওচ উপাদানের মধ্যে ঝুহবৎমরংঃরপ বা অতিপ্রভাব বিদ্যমানের ফলে ধান গাছ মাটি থেকে অধিক পরিমাণ ঘ আহরণের পাশাপাশি চ আহরণের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। ফলে ধান গাছের কুশি উৎপাদন, দানার গঠন ও পরিপুষ্টতা ত্বরান্বিত হয়। এতে গাছ শক্ত হয় এবং রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়। ফলশ্রæতিতে আমনের ফলন বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে।
সাশ্রয়ী সার ব্যবহারে কয়েকটি প্রযুক্তি
আমরা জানি, উদ্ভিদের নাইট্রোজেন এর অভাব পূরণে জমিতে ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ধরনের জৈব সার (যেমন-সবুজ সার, আবর্জনা পচা সার, পচা গোবর), নাইট্রোজেন ফিক্সিং ব্যাকটেরিয়াল ইনোকুলাম প্রয়োগ এবং অ্যাজোলার চাষ বাড়ানো যেতে পারে। ব্রি’র তথ্যমতে, দুই সেমি. পর্যন্ত পানিযুক্ত কাদা মাটিতে গুটি ইউরিয়া ও প্রিল্ড ইউরিয়া প্রয়োগের মাধ্যমে শতকরা ২৫-৩০ ভাগ ইউরিয়া সাশ্রয় হয়। তবে জোয়ারভাটা অঞ্চলে গুটি ইউরিয়ার ব্যবহার করে ভালো ফলন পাওয়া যায়। অন্যদিকে ডাই এমোনিয়াম ফসফেট বা ডিএপি ব্যবহার করলে একই সঙ্গে ইউরিয়া ও ফসফরাসের অভাব পূরণ করা সম্ভব। জিংক সালফেট (মনো বা হেপ্টা) সার ফসফরাস জাতীয় সারের সঙ্গে একত্রে ব্যবহার করা যায় না। এ সমস্যা সমাধানে জিংক সারের সর্বশেষ প্রযুক্তি চিলেটেড জিংক প্রয়োগ করা যেতে পারে। মূল জমিতে ধানের চারা রোপণের ২০-২২ দিন পর প্রথমবার এবং ৪০-৪৫ দিন পর দ্বিতীয়বার ১ লিটার পানিতে ১ গ্রাম লিবরেল জিংক স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যাবে। রোপা আমন ধানের জমি তৈরির সময় বিঘাপ্রতি (৩৩ শতক) ৩০০ কেজি জৈব সার ব্যবহার করলে রাসায়নিক সারের ব্যবহার শতকরা ৩০ ভাগ কমানো সম্ভব।
আগাছা ব্যবস্থাপনা : ধানক্ষেত ৩৫-৪০ দিন পর্যন্ত আগাছামুক্ত রাখতে পারলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। হাত দিয়ে, নিড়ানি যন্ত্র দিয়ে এবং আগাছানাশক ব্যবহার করে আগছা দমন করা যায়। রোপা আমন ধানে সর্বোচ্চ দুইবার হাত দিয়ে আগাছা দমন করতে হয়। প্রথম বার ধান রোপণের ১৫ দিন পর এবং পরের বার ৩০-৩৫ দিন পর। নিড়ানি যন্ত্র দিয়ে ধানের দু’সারির মাঝের আগাছা দমন হয় কিন্তু দু’গুছির ফাঁকে যে আগাছা থাকে তা হাত দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়। যান্ত্রিক দমনে অবশ্যই সারিতে ধান রোপণ করতে হবে। আগাছানাশক ব্যবহারে কম পরিশ্রমে ও কম খরচে বেশি পরিমাণ জমির আগাছা দমন করা যায়। প্রি-ইমারজেন্স আগাছানাশক ধান রোপণের ৩-৬ দিনের মধ্যে (আগাছা জন্মানোর আগে) এবং পোস্ট ইমারজেন্স আগাছানাশক ধান রোপণের ৭-২০ দিনের মধ্যে (আগাছা জন্মানোর পর) ব্যবহার করতে হবে। আগাছানাশক প্রয়োগের সময় জমিতে ১-৩ সেন্টিমিটার পানি থাকলে ভালো। আমন মৌসুমে আগাছানাশক প্রয়োগের পর সাধারণত হাত নিড়ানির প্রয়োজন হয় না। তবে আগাছার ঘনত্ব যদি বেশি থাকে তবে আগাছানাশক প্রয়োগের ৩০-৪৫ দিন পর হাত নিড়ানি প্রয়োজন হয়।
পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা : নিবিড় চাষাবাদ ও আবহাওয়াজনিত কারণে আমনে পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব ও আক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। ফলে ক্ষতিকর পোকা দমন এবং ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বাড়বে। এলাকাভেদে আমনের মুখ্য পোকাগুলো হলো- মাজরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, চুংগি পোকা, সবুজ পাতাফড়িং, বাদামি গাছফড়িং, সাদা পিঠ গাছফড়িং, গান্ধি পোকা, শীষকাটা লেদা পোকা ইত্যাদি। পোকার ক্ষতির মাত্রা পোকার প্রজাতি, পোকার সংখ্যা, এলাকার সামগ্রিক পরিবেশ, জমি বা তার আশেপাশের অবস্থা, ধানের জাত, ধানগাছের বয়স, উপকারী পরভোজী ও পরজীবী পোকামাকড়ের সংখ্যা ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। ধান ক্ষেতে ক্ষতিকারক পোকা দেখা গেলে এর সাথে বন্ধু পোকা, যেমন- মাকড়সা, লেডি-বার্ড বিটল, ক্যারাবিড বিটল সহ অনেক পরজীবী ও পরভোজী পোকামাকড় কি পরিমাণে আছে তা দেখতে হবে এবং শুধুমাত্র প্রয়োজনে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষষণায় দেখা যায় যে, রোপা আমন মৌসুমে ধানের চারা রোপনের পর ৩০ দিন কীটনাশক ব্যবহারে বিরত থাকলে যে সমস্ত উপকারী পোকা-মাকড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় সেগুলো ক্ষতিকর পোকার সংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিহত করে এবং এর ফলে ক্ষতিকর পোকার অর্থনৈতিক ক্ষতির মাত্রার দ্বারপ্রান্তের নিচে থাকে। ফলে সমস্ত মৌসুমে পোকা দমনে কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না কিংবা একবার মাত্র প্রয়োগ করলেই চলে। প্রধান প্রধান ক্ষতিকর পোকা দমন করলে রোপা আমন মৌসুমে শতকরা ১৮ ভাগ ফলন বেশি হতে পারে।
ধানক্ষেতে ডালপালা পুতে দিয়ে মাজরা পোকা ও পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কমানো যায়। আলোক ফাঁদ/সোলার লাইট ট্রাপের সাহায্যে মাজরা পোকা ও পাতা মোড়ানো পোকা, সবুজ পাতাফড়িং ্ও গান্ধি পোকার আক্রমণ কমানো যায়। জমি থেকে পানি বের করে দিয়ে চুংগি পোকা, বাদামি গাছ ফড়িং এবং সাদা পিঠ গাছ ফড়িং পোকার আক্রমণ কমানো যায়। উল্লিখিত ব্যবস্থা গ্রহণের পরও পোকার আক্রমণ বেশি পরিলক্ষিত হলে মাজরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা ও চুংগি পোকা দমনের জন্য কার্টাপ গ্রæপের যেমন- সানটাপ ৫০পাউডার প্রতি বিঘায় ১৮০-১৯০ গ্রাম হারে অথবা যে কোনো অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। মাজরা পোকা ও পাতা মোড়ানো পোকা দমনের জন্য ভিরতাকো ৪০ ডবিøউজি প্রতি বিঘায় ১০ গ্রাম হারে ব্যবহার করতে হবে। বাদামি গাছফড়িং ও সাদা পিঠ গাছফড়িং দমনের জন্য মিপসিন ৭৫পাউডার প্রতি বিঘায় ১৭৫ গ্রাম, পাইমেট্রোজিন ৪০ডবিøউজি ৬৭গ্রাম, ডার্সবান ২০ইসি ১৩৪ মিলি হারে ব্যবহার করতে হবে। পাতা মোড়ানো পোকা, চুংগি পোকা ও শীষকাটা লেদা পোকা দমনের জন্য কার্বারিল ৮৫পাউডার অথবা সেভিন পাউডার প্রতি বিঘায় ২২৮ গ্রাম হারে ব্যবহার করতে হবে।
রোগ ব্যবস্থাপনা : আমন মৌসুমে ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া, খোলপোড়া, বøাস্ট, বাদামি দাগ, খোল পচা, টুংরো, বাকানি, এবং ল²ীরগু (ঋধষংব ঝসঁঃ) সচরাচর দেখা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপ‚র্ণ রোগগুলো হল খোলপোড়া, ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া, বøাস্ট, টুংরো, বাকানি এবং ল²ীরগু রোগ। খোলপোড়া রোগ দমনের জন্য পটাশ সার সমান দু'কিস্তিতে ভাগ করে এক ভাগ জমি তৈরির শেষ চাষে এবং অন্য ভাগ শেষ কিস্তি ইউরিয়া সারের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। পর্যায়ক্রমে ভেজা ও শুকনা পদ্ধতিতে সেচ ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এছাড়া ফলিকুর, নেটিভো, এবং স্কোর ইত্যাদি ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করে সফলভাবে দমন করা যায়। ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতাপোড়া রোগের প্রাথমিক অবস্থায় ৬০ গ্রাম এমওপি, ৬০ গ্রাম থিওভিট ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। থোড় বের হওয়ার আগে রোগ দেখা দিলে বিঘা প্রতি ৫ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
এ মৌসুমে সকল সুগন্ধি ধানে নেক বøাস্ট রোগের আক্রমণ দেখা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ধানে থোড় আসার শেষ পর্যায় অথবা শীষের মাথা অল্প একটু বের হওয়ার সাথে সাথে প্রতিরোধমূলক ছত্রাকনাশক যেমন ট্রুপার অথবা নেটিভো ইত্যাদি অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। বিক্ষিপ্তভাবে দুই একটি গাছে টুংরো রোগের লক্ষণ দেখা দিলে, আক্রান্ত গাছ তুলে পুঁতে ফেলতে হবে। রোগের বাহক পোকা সবুজ পাতা ফড়িং উপস্থিতি থাকলে, হাতজালের সাহায্যে অথবা আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে সবুজ পাতা ফড়িং মেরে ফেলতে হবে। হাত জালের প্রতি টানে যদি একটি সবুজ পাতা ফড়িং পাওয়া যায় তাহলে বীজতলায় বা জমিতে কীটনাশক, যেমন মিপসিন, সপসিন এবং সেভিন অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। ল²ীরগু দমনের জন্য (বিশেষ করে ব্রি ধান৪৯ জাতে) ফুল আসা পর্যায়ে বিকাল বেলা প্রোপিকোনাজল গ্রæপের ছত্রাকনাশক যেমন- টিল্ট (১৩২ গ্রাম/বিঘা) সাত দিন ব্যবধানে দুই বার প্রয়োগ করা।
ফসল কাটা, মাড়াই ও সংরক্ষণ : শীষে ধান পেকে গেলেই ফসল কাটতে হবে। অধিক পাকা অবস্থায় ফসল কাটলে অনেক ধান ঝড়ে পড়ে, শীষ ভেঙ্গে যায়, শীষকাটা লেদাপোকা এবং পাখির আক্রমণ হতে পারে। তাই মাঠে গিয়ে ফসল পাকা পরীক্ষা করতে হবে। শীষের অগ্রভাগের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। এ সময়ে ফসল কেটে মাঠেই বা উঠানে এনে মাড়াই করতে হবে। তাড়াতাড়ি মাড়াইয়ের জন্য ব্রি উদ্ভাবিত মাড়াই যন্ত্র যেমন- রিপার, হেড ফিড কম্বাইন হার্ভেস্টার ও মিনি কম্বাইন হার্ভেস্টার ব্যবহার করতে হবে। ধান মাড়াই করার জন্য পরিচ্ছন্ন জায়গা বেছে নিতে হবে। কাঁচা খলায় সরাসরি ধান মাড়াই করার সময় চাটাই, চট বা পলিথিন বিছিয়ে নেয়া উচিত। এভাবে ধান মাড়াই করলে ধানের রঙ উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকে। মাড়াই করার পর অন্তত ৪-৫ বার রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। ভালোভাবে শুকানোর পর ঝেড়ে নিয়ে গোলাজাত বা সংরক্ষণ করতে হবে।
ধানের বীজ সংরক্ষণ : ভালো ফলন পেতে হলে ভালো বীজের প্রয়োজন। আমন মৌসুমে নিজের বীজ নিজে রেখে ব্যবহার করাই উত্তম। এ কথা মনে রেখেই কৃষক ভাইদের ঠিক করতে হবে কোন জমির ধান বীজ হিসেবে রাখবেন। যে জমির ধান ভালোভাব পেকেছে, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়নি এবং আগাছামুক্ত সে জমির ধান বীজ হিসেবে রাখতে হবে। ধান কাটার আগেই বিজাতীয় গাছ সরিয়ে ফেলতে হবে। মনে রাখতে হবে গাছের আকার-আকৃতি ও রঙ, ফুল ফোটার সময় ও শীষের ধরন, ধানের আকার আকৃতি, রঙ ও শুঙ এবং সর্বশেষ ধান পাকার সময় আগে-পিছে হলেই তা বিজাতীয় গাছ। সকল রোগাক্রান্ত গাছ অপসারণ করতে হবে। এরপর বীজ হিসেবে ফসল কেটে এবং আলাদা মাড়াই, ঝাড়াই, বাছাই করে ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে মজুদ করতে হবে। য়
মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর, ফোন : ৪৯২৭২০৪০, ইমেল : dg@brri.gov.bd
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম
কাজু বাদাম একটি নাট (ঘঁঃ) বা বাদাম জাতীয় ফল। বৃক্ষ জাতীয় ফসলের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কাজু বাদামের স্থান তৃতীয়। এর বীজ থেকে পাওয়া বাদাম সুস্বাদু ও পুষ্টিকর এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়েও মূল্যবান। বাদামের উপরের অংশের ফল থেকে জুস, ভিনিগার এবং অ্যালকোহল তৈরি করা যায়। তাছাড়া বাদামের খোলসের তৈল শিল্প কাজে ব্যবহৃত মূল্যবান দ্রব্য। আমাদের দেশের জলবায়ু কাজু বাদাম চাষের জন্য বেশ সহায়ক। বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলে ব্যাপকভাবে কাজু বাদাম চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা এখানে অল্প মূল্যে প্রচুর জমি পাওয়া যায়, যেখানে কাজু বাদাম চাষের উপযুক্ত আবহাওয়াও রয়েছে। আরও একটু যতœবান হলে অর্গানিক কাজুু বাদাম উৎপাদন করা খুবই সম্ভব যা রফতানিযোগ্য এবং এর বাজারমূল্যও অনেক।
কাজু বাদামের ইতিহাস
আজ থেকে প্রায় ৩০-৩৫ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এবং উদ্যান উন্নয়ন বিভাগ (কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ) সমন্বয়ে পার্বত্য এলাকায় কৃষকের উন্নয়নের জন্য প্রচুর পরিমাণে অন্যান্য ফলের চারা/কলমের সাথে কাজু বাদামের চারা সরবরাহ করে থাকে। কালের চক্রে কাজু বাদাম গাছ বড় হয়ে ফল দিতে থাকে। কিন্তু কাজু বাদামের বিক্রি, বাজারজাত করা বা প্রক্রিয়াজাত করার কোন প্রকার ব্যবস্থা তেমন ছিল না। শুধু রাঙ্গামাটিতে দেশীয় পদ্ধতিতে স্বল্প কিছু কাজু বাদাম প্রক্রিয়াজাত করা হতো। তবে বিপুল পরিমাণ কাজু বাদাম অবিক্রীত থেকেই যেত। লোকসান বিধায় কাজু বাদামের প্রতি কৃষকগণ অনীহা প্রকাশ করে এবং অনেকে প্রতিষ্ঠিত বাগানের গাছ কেটে ফেলে। পরবর্তীতে কিছু রপ্তানিকারক ভারত, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে স্বল্প পরিমাণে কাজু বাদাম রপ্তানি করতে থাকে। লেখক রুমা এবং থানচি উপজেলার দায়িত্ব পাওয়ার পর কাজু বাদামের বিক্রি, বাজারজাত করা বা প্রক্রিয়াজাত করার ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে মনোযোগ দেন। এ ব্যাপারে বিগত ২৫/৯/২০১৬ সালে থানচিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ উচ্চপর্যায়ের কর্মশালার ব্যবস্থা করেন। এতে লেখক প্রধান আলোচক হিসাবে পেপার উপস্থ্াপন করেন। এর ফলে পরবর্তী মৌসুমে কৃষকগণ আগ্রহ সহকারে কাজু বাদাম সংগ্রহ ও সংরক্ষণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এতে কাজু বাদামে বাজারমূল্য অনেক বেশি হয় এবং উৎপাদনকারীগণ বিপুল পরিমাণে আর্থিকভাবে লাভবান হন। বর্তমানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বাংলাদেশ কাজু বাদাম সমিতি লিমিটেড আধুনিক ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। আশা করা যায়, অচিরেই এদেশের প্রক্রিয়াজাতকৃত কাজু বাদাম জনগণ খাওয়ার সুযোগ পাবেন।
কাজু বাদামের পুষ্টি গুণ : খাদ্য মানের দিক দিয়ে কাজু বাদাম অতি পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যকর। এ বাদামে শতকরা ২১ ভাগ আমিষ, ৪৭ ভাগ ¯েœহ, ২২ ভাগ শর্করা, ২.৪ ভাগ খনিজ পদার্থ, ০.৪৫ ভাগ ফসফরাস, ০.৫৫ ভাগ ক্যালসিয়াম এবং প্রতি ১০০ গ্রাম বাদামে ৫ মিলিগ্রাম লৌহ ৭৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-১, ১১০ মিলিগ্রাম রাইবোফ্লোবিন রয়েছে। প্রচুর শর্করা, আমিষ, ¯েœহ, খনিজ পদার্থ, ভিটামিনসহ অন্যান্য উপকারী অনেক ফাইটো ক্যামিক্যালস রয়েছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। বিশেষজ্ঞদের মতে স্বাস্থ্যের জন্য কাজুবাদাম নিম্নের কাজগুলি করে থাকে।
১। হৃৎপিন্ডের শক্তিদায়ক; ২। হাড় ও দাঁতের গঠনে সাহায্যে করে; ৩। ক্যান্সার প্রতিরোধ করে; ৪। হজমে সাহায্যে করে; ৫। চুলের উপকার করে; ৬। পিওথলি/কিডনি পাথর তৈরিতে বাধা দেয়; ৭। ভালো ঘুম আনয়ন করে; ৮। ¯œায়ুতন্ত্রকে সুস্থ সবল করে; ৯। বøাড প্রেসার কমায়; ১০। ডায়বেটিস রোগীর জন্য উপকারী; ১১। রক্ত শূন্যতা কাজ করে; ১২। অবসাদ দূর করে ইত্যাদি।
কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা
কাজু বাদামের চাষে, ফল সংগ্রহে ও প্রক্রিয়াজাতকরণে অনেক লোকের প্রয়োজন হয়। পাহাড়ি এলাকায় জনগণের সরকারি/বেসরকারি পর্যায়ে তেমন কোন চাকুরীর সুযোগ নেই। কিন্তু কাজু বাদাম চাষে, ফল সংগ্রহে এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণে প্রচুর লোকের প্রয়োজন হয়। সাথে সাথে বেকার জনগণের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব
বর্তমান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্যের তালিকায় বৃক্ষ জাতীয় ফলের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কাজু বাদামের স্থান তৃতীয়। আর বাদামজাতীয় ফসলে কাজু বাদাম প্রথম স্থানে রয়েছে। আমাদের দেশের কথা চিন্তা করলে দেখতে পাই, সাধারণ কৃষকগণ কাজু বাদাম প্রক্রিয়াজাত করতে না পারলেও শুধু বাদাম বিক্রি করে টন প্রতি যার মূল্য প্রায় ১,০০,০০০/- থেকে ১,২০,০০০/- টাকা পেয়ে থাকেন। তবে এর বাজার বেশ পরিবর্তনশীল।
পাহাড়ি অঞ্চলে কাজু বাদামের উন্নয়ন সম্ভাবনা
কাজু বাদাম চাষের জন্য উপযুক্ত আবহাওয়া হলো, গড়ে ২৫ সেন্টিগ্রেড থেকে ২৭ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা, ১০০০ মিমি. থেকে ২০০০ মিমি. বার্ষিক বৃষ্টিপাত, ৫০০-১০০০ মিটার সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা এবং বন্যামুক্ত অ¤øীয় বালু বা বালু দোঁআশ মাটি। এসব বিষয়গুলো বিবেচনা করলে কাজু বাদাম চাষের উপযুক্ত জমি এ পাহাড়ি অঞ্চলে প্রচুর রয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় নভেম্বর থেকে প্রায় এপ্রিল/মে মাস পর্যন্ত সাধারণত কোন বৃষ্টিপাত হয় না। অর্থাৎ ৫/৬ মাস পাহাড়ি ভ‚মি বৃষ্টিবিহীন অবস্থায় থাকে। আবার সেখানে সেচ দেয়ার তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই। মার্চ এপ্রিল মাসে প্রচÐ খরা এবং গরম হাওয়া বিদ্যমান থাকে। সে অবস্থায়ও কাজু বাদাম বেশ ভালো ফলন দিয়ে থাকে। আবার স্বল্প মূল্যের জমি এবং কর্মঠ শ্রমিক প্রাপ্যতা এখানে রয়েছে। তাছাড়া এখানে বসবাসকারীগণ খুবই কর্মঠ ও পরিশ্রমী। এ জনবলকে কাজে লাগাতে পারলে কাজু বাদাম চাষে আরো সুবিধা হবে। তাছাড়া এখানকার মানুষ আগে থেকে কাজু বাদাম চাষের অভিজ্ঞতা রয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় কাজু বাদাম স্বল্প পরিচর্যায় পাহাড়ি পতিত জমিতে ফলন দিয়ে থাকে। সামান্য পরিচর্যা করা হলে এক হেক্টর থেকে ১.৫ থেকে ১.৮ টন কাজু বাদাম পাওয়া সম্ভব।
অর্গানিক কাজু বাদাম চাষের গুরুত্ব
ইদানীং দেখা যায়, আগের তুলনায় মারাত্মক রোগ যেমন- ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ, বøাডপ্রেসার, কিডনি, লিভারসহ শারীরিক সমস্যা অনেক বেশি দেখা যায়। বিশেষজ্ঞের মতে এগুলোর অনেক কারণ থাকলেও বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যসহ বালাইনাশকের অপব্যবহার একটি প্রধান কারণ। আমরা কৃষি পণ্য উৎপাদন করতে কৃত্রিম রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার যত কমাতে পারব ততই মানব স্বাস্থ্য রক্ষায় উপকার হবে। বিগত কয়েক দিন আগে মন্ত্রী পরিষদ সভায় বাংলাদেশে জৈব কৃষিনীতি অনুমোদন করেছে। আমরা অন্যান্য ফল ফসলের মতো কাজু বাদাম উৎপাদনে জৈব কৃষি নীতি পালন করে, এদেশে এবং আন্তর্জাতিক বাজারেও ভালো দামে বিক্রির সুযোগ পাবো। আর আন্তর্জাতিক বাজারেও অর্গানিক ফসলের চাহিদা তো দিন দিন বাড়ছেই।
রপ্তানি
কাজু বাদাম আমাদের দেশে উৎপন্ন হলেও প্রক্রিয়াজাত করার অভাবে খোসাসহ বাদাম বিদেশে রপ্তানি করতে হয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ভারত আমাদের দেশের কাজু বাদাম আমদানি করে থাকে। তবে আধুনিক মেশিনের সাহায্যে প্রক্রিয়াজাত করা হলে বাদামের বাণিজ্যিক মূল্য বেড়ে যায়। যদি আধুনিক পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত করা হয়, তবে আমরাই আবার আকর্ষণীয় মূল্যে কাজু বাদাম বিদেশে রপ্তানি করতে পারব। এতে দেশের যেমন অতিরিক্ত বৈদিশিক মুদ্রা উপার্জন হবে সাথে সাথে এখানে কর্মসংস্থানের উন্নতি হবে।
মানসম্পন্ন কাজু বাদাম উৎপাদন ও সংরক্ষণ ঠিক মতো করতে না পারলে কাজু বাদামের ভালো মূল্য পাওয়া যায় না। মানসম্পন্ন কাজু বাদাম চাষের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নি¤œরূপঃ
উন্নত জাতের বাদামে চারা লাগানো : কাজু বাদামের আকার ছোট বড় ও মাঝারি আকারে হয়ে থাকে। কাজু বাদামের বাগান করা সময় অবশ্যই মানসম্পন্ন, উন্নত জাতের চারা ব্যবহার করতে হবে। যে জাতে বড় আকারে বাদাম হয় এবং ফলন ভালো হয় এমন গুণসম্পন্ন বাদামের গ্রাফটিং চারা লাগাতে পারলে সব চেয়ে ভালো। তা না হলে বড় আকারে বাদাম হয় এবং ফলন বেশি হয় এমন মার্তৃগাছ নির্বাচন করে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। সে বীজ দ্বারা চারা করে গাছ লাগাতে হবে। এখানে মনে রাখতে হবে ১ কেজি কাজু বাদামে ১৮০টি বীজ হলে গ্রেড-অ এবং ১৮১ থেকে ২১০টি বাদামে ১ কেজি হলে গ্রেড- ই এবং ১ কেজিতে ২১০ এর বেশি হলে গ্রেড- ঈ, যার মূল্য অনেক কম। তাই অবশ্যই বড় আকারে বাদাম হয় এমন চারা লাগানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
আগাছা পরিষ্কার করা : সঠিকভাবে বাগান পরি”র্যা করার জন্য বাগান অবশ্যই আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। এতে পোকামাকড়সহ রোগবালাই অনেক কম হয়। আবার মানসম্পন্ন ফসল সংগ্রহে সুবিধা হয়।
সার ব্যবস্থাপনা : সার হলে গাছের খাবার। কাজু বাদাম যদিও মাঝারি মানের উর্বর জমিতে হয়। কিন্তু ভালো ফলন পেতে হলে জৈবসার, ইউরিয়া, টিএসপি/ডিএপি, এমওপি, জিংক ও বোরন সার পরিমিত মাত্রাই প্রয়োগ করতে হবে।
বালাই ব্যবস্থাপনা ও সেচ ব্যবস্থাপনা : এখানে কাজু বাদামে মারাত্মক তেমন কোন রোগবালাই দেখা যায় না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিলে সমস্যার সমাধান সম্ভব। কাজু বাদাম শুকনা আবহাওয়াতেও ফল দিতে পারে তবে শুকনা মৌসুমের সেচ দিতে পারলে ফলন প্রায় দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সঠিক সময়ের কাজু বাদাম সংগ্রহ করা : সাধারণত আমাদের দেশে মে-জুন মাসে কাজু বাদাম পরিপক্ব হয়। পরিপক্বের পরপরই এ বাদাম সংগ্রহ করতে হয়। পরিপক্ব হলে বাদাম গাছ থেকে পড়ে যায়। কাঁচা অবস্থায় এ বাদামের ফল থেকে বাদামটি বেশ বড় এবং নরম থাকে। পাকার সময় বাদামটি ছোট এবং পরিপুষ্ট হয়। তখনই বাদাম সংগ্রহ করতে হবে। অপরিপক্ব বাদাম থেকে কখনও ভােলা মানসম্পন্ন কাজু বাদাম পাওয়া সম্ভব নয়।
সঠিকভাবে শুকানো ও সংরক্ষণ : এদেশে কাজু বাদাম সংগ্রহের সময় সাধারণত মে থেকে জুলাই মাস। এ সময় আমাদের দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বাতাসে আর্দ্রতা থাকেও প্রচুর। কাজু বাদাম তৈলাক্ত জাতীয় ফসল। বাদামটিকে প্রচুর আর্দ্রতাসহ গুদামজাত করা হলে ভিতরে বাদাম বা কার্নেল অতি দ্রæত নষ্ট হয়ে যায়। বাদামে উপরের রং ও নষ্ট হয়। আন্তর্জাতিক বাজারেও এর মূল্য অনেক কমে যায়। অনেক ক্ষেত্রে রপ্তানি করা যায় না। তাই ফসল সংগ্রহের পর পরই বাদামগুলো ভালভাবে গুকানো প্রয়োজন।
শুকনা বাদামগুলো বায়ুরোধক বস্তায় সংরক্ষণ করা উচিত। সঠিকভাবে গুদামজাত করা হলে বাদামের গুণাগুণ ৬ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে।
কাজু বাদামের ফেক্টরি স্থাপন
আন্তর্জাতিক বাজারে কাজু বাদামের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। আমাদের দেশে প্রায় ৭০০ মেট্রিক টন কাজু বাদাম উৎপন্ন হলেও প্রক্রিয়াজাত করার অভাবে খোসাসহ বাদাম বিদেশে রপ্তানি হয়ে যায়। অন্য দিকে আমাদের প্রয়োজনে আবার বেশি দামে কাজু বাদাম আমদানি করে থাকি। এক কেজি প্রক্রিয়াজাত করা কাজু বাদামের মূল্য প্রায় ১২০০/- থেকে ১৮০০/- টাকা। এক কেজি প্রক্রিয়াজাত করা বাদাম পেতে প্রায় ৩.৫ -৪ কেজি খোসাসহ কাজু বাদামের প্রয়োজন হয়। এর দাম প্রায় ৩০০-৪০০/- টাকা। তবে আমাদের দেশে বিছিন্ন ভাবে দেশীয় এবং প্রাচীন পদ্ধতিতে কিছু কিছু বাদাম প্রক্রিয়াজাত করা হলেও এ গুলোর গুণগত মান তেমন ভালো নয়। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা একেবারে নেই। তবে আধুনিক মেশিনের সাহায্যে প্রক্রিয়াজাত করা হলে বাদামের বাণিজ্যিক মূল্য অনেক বেড়ে যায়। তখন আমাদের প্রয়োজন মিটায়ে আমরাই আবার আকর্ষণীয় মূল্যে কাজু বাদাম বিদেশে রপ্তানি করতে পারব। এতে দেশের যেমন বৈদিশিক মুদ্রা উপার্জন হবে সাথে সাথে এখানে কর্মসংস্থানেরও উন্নতি হবে।
বর্তমানে কাজু বাদামের সমস্যাবলী এবং সম্ভাব্য সমাধান
ি আমাদের দেশে যে কাজুবাদামের চাষাবাদ হচ্ছে তা তেমন উন্নত জাতের নয়।
ি ভারত, ভিয়েতনামে গবেষণা করে বেশ উন্নত জাতের কাজু বাদামের জাত উদ্ভাবন করেছে যেগুলোর ছোট ছোট গাছে তাড়াতাড়ি ফলন দেয়। আর ফলনও হয় প্রচুর এবং আকারেও বড়। সেগুলোর আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য অনেক বেশি।
ি উন্নত জাত উদ্ভাবনে বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) কার্যকরি ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।
ি স্থানীয় জাতগুলোর উন্নয়নে গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেয়া যেতে পারে।
ি ভারত, ভিয়েতনামের যে স্থানে কাজু বাদাম চাষ হয় সেখানকার আবহাওয়া বাংলাদেশের অনুরূপ। বর্তমানে জরুরিভিত্তিতে সেসব উন্নত জাতের জার্মপ্লাজম আমদানি করে স্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানে উপযোগিতা যাচাই করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে পাহাড়ি এলাকার কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকরি ভ‚মিকা রাখতে পারে।
ি বর্তমান জাতগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষকদেরকে বাগান ব্যবস্থাপনার উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা যেতে পারে।
ি উন্নত বাজার ব্যবস্থাপনার লিংকেজ (উৎপাদক, পাইকার, প্রসেসর/এক্সপোর্টার) জোরদার করতে হবে।
ি অনাবাদি ও সাময়িক পতিত জমিগুলো কাজু বাদাম চাষের আওতায় নিয়ে আসা।
ি কাজুবাদাম পচনশীল নয় বিধায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে পচনশীল ফলের চাষের পরিবর্তে কাজুবাদাম চাষের আওতায় নিয়ে আসা।
সমাধানের উপায়
কাজু বাদাম প্রক্রিয়াজাত ফ্যাক্টরি স্থাপন হলে বাদাম ছাড়াও আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য পাওয়া যায়।
১। কাজু জুস : কাজু বাদামের উপরে কাজু ফল বা আপেল থাকে। এ আপেলে প্রায় ৮০ শতাংশ জুস থাকে, যা অনেক ঔষধিগুণ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ এবং কমলা লেবুর চেয়ে ৬ গুণ বেশি ভিটামিন সি থাকে। কাজু থেকে উৎপাদিত কাজু জুস দিয়ে দেশের মানুষের পুষ্টিহীনতা দূর করা যায়।।
২। ঈঘঝখ : কাজু বাদাম শেল বা খোসা থেকে উৎপাদিত তেল দিয়ে উৎকৃষ্টমানের জৈব বালাইনাশক উৎপাদন করা যাবে, যা নিরাপদ ফসল এবং খাদ্য উৎপাদনে অত্যন্ত জরুরি। অপরদিকে মানবদেহ এবং পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক কীটনাশক আমদানি করতে হবে না বরং আমদানি প্রতিহত করে শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করবে। বাদামের খোসার তৈল শিল্প কাজে ব্যবহৃত মূল্যবান দ্রব্য। পেইন্টিং ফ্যাক্টরির মূল্যবান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৩। জৈবসার : কাজু আপেল থেকে জুস বের করে নেয়ার পর যে মন্ড বা ছোবরা হবে তা দিয়ে হাজার হাজার টন মাটির প্রাণ উত্তম জৈবসার উৎপন্ন হবে। ঠিক একইভাবে শেল বা খোসা থেকেও তেল বের করে নেয়ার পর যে খৈল হবে তা দিয়েও হাজার হাজার টন জৈবসার হবে। য়
অতিরিক্ত পরিচালক (অব.), ডিএই ও সাবেক পরিচালক এআইএস, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৫১১১৪৮৬, ই-মেইল :subornoml@yahoo.com
ড. মো. দুররুল হুদা১, বিধান চন্দ্র নাথ২, ড. মো. গোলাম কিবরিয়া ভূঞা৩, সুব্রত পাল৪ এবং শারমিন ইসলাম৫
বাংলাদেশের কৃষি এখনও মানুষ ও পশুশক্তি, সনাতন খামার যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জামের ওপর নির্ভরশীল। গত তিন দশকে জমি কর্ষণ ও সেচব্যবস্থা যান্ত্রিকীকরণের কারণে শস্যের নিবিড়তা শতকরা ১৯৩ ভাগে উন্নীত হয়েছে। শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধির কারণে দুই ফসলের মধ্যবর্তী সময় অর্থাৎ এক ফসল কাটা ও অন্য ফসলের জন্য জমি তৈরি করে ফসল লাগানোর সময় কমে আসছে। যুগ যুগ ধরে আমাদের দেশের কৃষকগণ কাস্তে দিয়ে হাতের সাহায্যে মাঠের ধান কেটে থাকেন। কিন্তু কাস্তে দিয়ে ধান কাটার কার্যক্ষমতা অত্যন্ত কম হওয়ায় ধান কাটতে অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। নির্দিষ্ট সময়ে ধান কাটতে না পারলে অনেক সময় পরিপক্ব ধান মাঠে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে, কিংবা অতিরিক্ত পেকে মাঠে ঝরে পড়ার কারণে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়। এ ছাড়াও দেশে ধান কাটার ভরা মওসুমে শ্রমিকের অভাব প্রকট হয়ে দেখা দেয়ায় সময়মতো ধান কাটা সম্ভব হচ্ছে না। শ্রমিকের অভাব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কোন কোন সময় পুরো ফসলই নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে ফসল কর্তন বাংলাদেশের কৃষির প্রধান সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এতে ধান কাটতে কৃষককে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে কৃষক তার কাঙ্খিত মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কম্বাইন হারভেস্টার, রিপার, রিপার বাইন্ডার ইত্যাদি যন্ত্রের সফল প্রায়োগিক ব্যবহারের মাধ্যমে কর্তনকাজ সম্পাদন করা সম্ভব। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অন্যান্য উন্নত দেশে যে ধরনের কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহৃত হয় সেগুলো আকারে বড় হওয়ায় আমাদের খÐ খÐ ছোট জমিতে চালানো কঠিন। এছাড়া যন্ত্র চলাচলের জন্য মাঠে রাস্তা না থাকার কারণে এক প্লট থেকে অন্য প্লটে যন্ত্র নেয়া খুবই কঠিন এবং আমাদের দেশ মূলত মাটি পলিমাটি দ্বারা গঠিত (অ্যালুভিয়াল টাইপ) হওয়ায় বড় ভারী যন্ত্র মাটিতে দেবে যাওয়ার কারণে অনেক সময় চালানো যায় না।
এসব সমস্যা দূর করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে ধান-গম কাটার জন্য হেড ফিড মিনি কম্বাইন হারভেস্টার উদ্ভাবন করেছে, যা দিয়ে একই সঙ্গে ধান-গম কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও বস্তাবন্দী করা যায় এবং খড় আস্ত থাকে। যন্ত্রটি ১৫-২০ সেমি মাটির গভীরে শক্ত স্তর (প্লাউ-প্যান) যুক্ত কাদামাটিতে চলতে পারে। যন্ত্রটি দিয়ে কম সময়ে অধিক জমির ধান-গম কাটা যায় বিধায় কর্তনোত্তর অপচয় হ্রাস পায় এবং সার্বিক উৎপাদন খরচ কম হয়। তাছাড়া সঠিক সময়ে দ্রæত ফসল কেটে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি থেকে শস্য রক্ষা করা যায়। ফলে কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হয় এবং কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়।
এটি ডিজেল ইঞ্জিনচালিত এমন একটি যন্ত্র, যা দিয়ে ধান ও গম একই সাথে কর্তন, মাড়াই, ঝাড়াই ও বস্তাবন্দী করা যায়। শস্য সংগ্রহের প্রধান চারটি কাজ (কর্তন, মাড়াই, ঝাড়াই ও বস্তাবন্দী) একই সঙ্গে করা যায় বিধায় যন্ত্রটির নাম কম্বাইন হারভেস্টার বলা হয়ে থাকে। সনাতন পদ্ধতিতে কাঁচি দিয়ে শস্য কাটার তুলনায় অল্প সময় ও কম খরচে ধান ও গম কাটা যায়। ফলে সময় ও কায়িক শ্রম লাঘব হয়। যন্ত্রটি ওই সব ফসল কাটার কাজে ব্যবহার করা যাবে যেগুলোর উচ্চতা মোটামুটি একই রকম ও শীষ/ছড়া গাছের উপরের দিকে থাকে এবং নিচের দিকে অবশিষ্ট অংশ থাকে। সেগুলো হলো- ধান, গম, জব, বার্লি ইত্যাদি।
কম্বাইন হারভেস্টার সাধারণত হেড ফিড ও হোল ফিড দু’ধরনের হয়ে থাকে।
হেড ফিড কম্বাইন হারভেস্টারে শুধু ধানের শীষ মাড়াই হয়ে থাকে এবং খড় নষ্ট হয় না। আমন মওসুমে শুকনো ক্ষেতে খড় আস্ত রাখতে এ যন্ত্রের উপযোগিতা রয়েছে।
অন্যদিকে হোল ফিড কম্বাইন হারভেস্টারে পুরো ধানগাছ মাড়াই হয় এবং মাড়াইকৃত খড় জমিতে এলোমেলোভাবে পড়ে থাকে যা ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা যায় না। বোরো ও আউশ মওসুমে ধানক্ষেতে পানি থাকলে এবং হাওর অঞ্চলে এ যন্ত্রের উপযোগিতা রয়েছে।
কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ফসল সংগ্রহের প্রধান চারটি কাজ একই সঙ্গে হয়ে থাকে। এ কারণে এক কাজের সঙ্গে অন্য কাজের সমন্বয় না হলে যন্ত্রের কার্যকারিতা ভালো হয় না। পরিবহনের সময় ঝাঁকুনিতে যন্ত্রের যে কোনো অংশের সমস্যা হতে পারে। যন্ত্র মাঠে প্রবেশ করানোর আগে ইঞ্জিন চালু করে গিয়ার নিরপেক্ষ-অবস্থা (নিউট্রাল) অবস্থায় রেখে শস্য সংগ্রাহক অংশে বালুর বস্তা অথবা অন্য ভারী বস্তু স্থাপন করে হেডার উপরে-নিচে ওঠানামা করতে হবে, ইঞ্জিনের গতি বাড়িয়ে দিয়ে কাটারবারসহ ঘূর্ণায়মান অংশে গতি সঞ্চালন করে কোন অংশ থেকে কোনো প্রকার অস্বাভাবিক শব্দ আসছে কি না পরীক্ষা করতে হবে। তারপর যন্ত্র মাঠে প্রবেশ করিয়ে শস্যের উচ্চতার সঙ্গে হেডার ওঠানামা করে হেডার নিয়ন্ত্রক লিভার সমন্বয় করে নিতে হবে। অল্প শস্য কেটে যন্ত্রের মাড়াই ও ঝাড়াই কার্যক্রম দেখে শস্য কাটার প্রস্ততা ঠিক করে নিতে হবে। কাটার প্রস্ততা প্লটের আকার, শস্যের ঘনত্ব ও মাটির অবস্থার ওপর নির্ভর করে ঠিক করতে হয়। মাড়াই ও ঝাড়াই কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে ফসল কাটার মূল কাজ শুরু করতে হবে। চালকের দক্ষতা ও সঠিক নিয়মে যন্ত্র চালানোর ওপর যন্ত্রের কার্যকারিতা ও কর্তন অপচয় নির্ভর করে।
চালানোর সময় করণীয়
কম্বাইন হারভেস্টার জ্ঞাননির্ভর একটি প্রযুক্তি। ফসল সংগ্রহের প্রধান চারটি কাজ একই সঙ্গে সম্পন্ন হয় বিধায় যন্ত্র চালকের যন্ত্রের প্রধান অংশগুলোর কাজ এবং অন্যান্য অংশের সঙ্গে সমন্বয়ের বিষয়ে অবশ্যই প্রাথমিক ধারণা থাকতে হবে। যন্ত্র সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নাই এমন চালক দিয়ে যন্ত্র চালনা যাবে না। শস্যের ক্ষতির পরিমাণ এবং গুণগতমান নির্ভর করে যন্ত্রটির সর্বোত্তম ব্যবহারের ওপর।
ক) জমি ও ফসলের অবস্থা
মাঠে ফসলের অবস্থা ও জমির প্রস্ততার ওপর শস্য কাটা অনেকটা নির্ভর করে। জমিতে যদি অতিরিক্ত আগাছা থাকে তবে কম্বাইন হারভেস্টার দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারে না বিধায় জমি নির্বাচনের সময় বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।
া ৬৫ থেকে ১৩০ সেমি. দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট শস্য কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে কাটার উপযোগী।
া ১৩০ সেমি. দৈর্ঘ্যরে বেশি শস্যের জন্য হেডার যতটা সম্ভব ওপরে উত্থাপন করে এবং ৬৫ সেমি এর কম দৈর্ঘ্যরে ফসল কাটাতে যতটা সম্ভব হেডার নিচু করে চালাতে হবে;
া শস্য ৬০০ এর বেশি কোণে হেলে পড়লে বিপরীত দিক থেকে যন্ত্র আস্তে আস্তে চালাতে হবে।
া আদ্র ও শিশির ভেজা ফসল কম্বাইন দিয়ে কাটার উপযুক্ত নয়।
া স¦াভাবিক অবস্থায় ২০ সেমি. এর বেশি পা দেবে যায় এমন জমি কম্বাইন চালানোর উপযুক্ত নয়।
ফসল কর্তনের সময়
া যখন শীষের ৮০% ভাগের বেশি ধান হলুদ বর্ণের হয়ে যায়, তখন জমির ফসল কাটার উপযুক্ত সময়;
া ফসল বেশি পাকার পর কর্তন করলে শস্যে ঝরে পড়ে, খড় ভেঙে গিয়ে পরিষ্কারে সমস্যা হয়, ক্ষেত্র বিশেষে অংকুরোদগম হয়ে গুণগতমান নষ্ট হয়, সর্বোপরি ফসলের ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়।
া মাঠের বাম পাশ থেকে এমনভাবে ফসল কাটা শুরু করতে হবে যাতে খড়ও বাম পাশে পড়তে পারে। আইলের উচ্চতা যদি এমন উঁচু হয় যে খড় পড়তে অসুবিধা হবে তাহলে আইলে পাশের ০.৫ মিটার চওড়া করে আগেই ধান হাত দিয়ে কেটে নিতে হবে।
া ফসল কর্তনের সময় যতটা সম্ভব যন্ত্র সোজা করে চালাতে হবে। বৃত্তাকার বা আঁকাবাঁকাভাবে ফসল কর্তন করলে শস্য ডিভাইডার ঠিকমতো কাজ নাও করতে পারে। শস্য বাঁকা হয়ে কনভেয়ার বেল্টে প্রবেশ করলে খড় ভেঙে গিয়ে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়।
া ফসল কাটার শুরুর আগে নিশ্চিত হতে হবে যে ফসল যথেষ্ট শুকনা কি না? মাড়াইকালীন শস্যের আর্দ্রতা ২৫% এর বেশি হলে শস্যেদান ভেঙে যাওয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়।
মাড়াই ও ঝাড়াই এর সাথে কাটার প্রস্থতা সমন্বয়
া ধারকের ভেতর থেকে বের হওয়া খড় পরীক্ষা করে কাটার প্রস্থতা ঠিক করতে হবে।
া মাড়াইয়ের সময় ভালো ফলাফল পাওয়ার জন্য ফসলের অবস্থা বুঝে সামনের চলার গতি, কর্তনের উচ্চতা, রীল ইত্যাদি সমন্বয় করতে হবে। ফসল একদম নিচ থেকে কাটা উচিত না। এতে মাটির সাথে কাটারবার আটকিয়ে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। ভেজা পাতাযুক্ত খড় মাড়াইয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে;
া প্রতিদিন কাজ শেষে ভেতরকার ময়লা, খড়কুটা, অন্যান্য বস্তু ইত্যাদি পরিষ্কার করতে হবে। পরিষ্কার করার সময় ইঞ্জিন আগে থেকেই বন্ধ রাখতে হবে, পার্কিং ব্রেক লক করতে হবে।
নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর যন্ত্র পরীক্ষা করা
মেশিনের ঘূর্ণায়মান অংশের কম্পনের কারণে পরিবহনের সময় লোড পরিবর্তন, বিভিন্ন পরিবেশে মেশিন চালানো ইত্যাদির জন্য মেশিনের কারিগরি অবস্থাগুলো খারাপ থাকলে মেশিনের দক্ষতা কমে যায়, বিভিন্ন অংশ নষ্ট হয় বা গুরুতর দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য মেশিনটি সঠিকভাবে চালাতে হবে, সকল অংশগুলো পরীক্ষা করতে হবে এবং পরিষ্কার রাখতে হবে। বেল্টগুলো টাইট করতে হবে এবং যখন প্রয়োজন তখন যন্ত্রাংশগুলো পরিবর্তন করতে হবে।
দৈনিক করণীয়
া এয়ার ফিল্টার, ওয়েল কোলার স্ক্রিন, রেডিয়েটর এবং ইঞ্জিনের সুরক্ষা স্ক্রিন চেক এবং পরিষ্কার করা;
া ইঞ্জিন ওয়েল, হাইড্রোলিক ওয়েল, রেডিয়েটর এবং পানির ট্যাংক চেক করতে হবে যাতে লিক না হয়;
া মেশিনের ভেতরে আটকিয়ে থাকা সকল খড়কুটা দূর করা;
া সকল চেইন এ লুব্রিকেন্ট দিতে হবে, কাটারবার থেকে কাঁদা এবং খড়কুটা দূর করতে হবে, চেইন এবং কাটার এর কোনো ক্ষতি হলে তা চেক করে প্রয়োজনে প্রতিস্থাপন করতে হবে, উপরের এবং নিচের কাঁচির মধ্যে লুব্রিকেন্ট যোগ করতে হবে (প্রতি ২ ঘণ্টা চালানোর পরপর চেইন এবং কাটারের লুব্রিকেন্ট যোগ করতে হবে);
া চেইনের টান কমে গিয়েছে কি না তা পরীক্ষা করা;
া থ্রেসার অংশের মাড়াই দাঁত চেক করা, বিপরীত ভাবে মাউন্ট করা বা প্রয়োজন হলে তাদের প্রতিস্থাপন করা;
া ক্রলারের টান চেক করা এবং প্রয়োজন হলে টাইট দেয়া;
া রোলার, ক্রলার গাইড, ফ্রেম এবং ট্রান্সমিশনের মধ্যকার কাঁদা, ঘাস অথবা খড়কে সরিয়ে ফেলতে হবে। অন্যথায় ক্রলার সামনে চলতে বাঁধাগ্রস্ত হবে, তার শক্তি হ্রাস পাবে;
া জ্বালানি ট্যাংক পূর্ণ করা;
া ইঞ্জিন এবং অন্যান্য অংশ স্বাভাবিক অবস্থায় আছে কি না তা পরীক্ষা করা;
া নাট-বোল্ট আলগা হয়ে গেলে তা টাইট দিতে হবে।
পরীক্ষণ সতর্কতা
া ঠাÐা না হওয়ার আগে রেডিয়েটরের ক্যাপ না খোলা। সঠিক নিয়মে ব্যাটারি লোড ও আনলোড করতে হবে। প্রথমে ধনাত্মক চার্জযুক্ত দÐটি (অ্যানোড) সংযোগ করতে হবে এবং যখন ব্যাটারি স্থাপন করা হয় তখন ঋণাত্মক চার্জযুক্ত দÐটি (ক্যাথড) সংযোগ করতে হবে। বিচ্ছিন্ন করার সময় প্রথমে ঋণাত্মক চার্জযুক্ত দÐটি (ক্যাথড) বিচ্ছিন্ন করতে হবে। পরে আনলোড করার সময় ধনাত্মক চার্জযুক্ত দÐটি (অ্যানোড) বিচ্ছন্ন করতে হবে;
া পরীক্ষা করার সময় এবং রক্ষণাবেক্ষণের সময় ইঞ্জিন বন্ধ রাখা এবং ব্রেক প্যাডেল লক করে রাখতে হবে;
া ব্রেক চেক করা এবং স্ক্রু এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা;
া নিয়ন্ত্রণ লিভারগুলো চেক করতে হবে;
া ব্রেক সঠিকভাবে সমন্বয় করে রাখতে হবে;
া ঘুর্ণায়মান দÐ (শ্যাফ্ট) এবং অন্যান্য অংশগুলো স্পর্শ করা যাবে না;
া উচ্চচাপের লিকিং ওয়েল স্পর্শ না করা;
া খুলে রাখা যন্ত্রাংশ সঠিকভাবে রাখেতে হবে যেন শিশুরা এ গুলো নাড়াচাড়া করতে না পারে।
া চালু অবস্থায় যন্ত্রের কোন অংশে মবিল/গ্রিজ দেয়া কিম্বা নাটবেøাট টাইট দেয়া যাবে না। এবং কোন যন্ত্রাংশ মেরামত করা যাবে না।
া দুর্ঘটনা এড়াতে শুধুমাত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালক দিয়ে যন্ত্রটি চালাতে হবে এবং চালক উপযুক্ত পোশাক (ঢিলা পোশাক পরা যাবে না) পরিধান করে যন্ত্র চালনা করবে।
রক্ষণাবেক্ষণ সতর্কতা
া অপারেশনের পরে পরিদর্শন ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্য পরিচালনা করা। কাজের শেষে মেশিনটি পরিষ্কার করা, পরিদর্শন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কাজ করা এবং সকল সরঞ্জামাদি পরীক্ষা করতে হবে;
া সমতল মাটিতে মেশিনটি সংরক্ষণ করতে হবে। কাটিং অংশটি নিচু করে রাখতে হবে এবং ব্রেক প্যাডেল লক করে রাখতে হবে;
া মেশিনটি ঠাÐা না করে এর উপর কভার দেয়া ঠিক না। আগে মেশিনটি ঠাÐা করে পরে প্রয়োজনীয় কভার দিয়ে মেশিনটি ঢেকে রাখতে হবে।
ব্রি উদ্ভাবিত যন্ত্রটি স্থানীয়ভাবে দেশীয় মালামাল দিয়ে তৈরি বিধায় এর দাম দেশের কৃষকের আর্থসামাজিক অবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। নতুন উদ্ভাবিত যন্ত্রটি কৃষি যান্ত্রিকীকরণে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে এবং এর মাধ্যমে খোরপোশের কৃষি হতে বাণিজ্যিক কৃষিতে উত্তরণ এবং প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতিকে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে উন্নীতকরণে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে। এ কারণে মাঠ পর্যায়ে যন্ত্রটির ব্যাপক সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। য়
১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ,বিআরআরআই,গাজীপুর, (mdurrulh@hotmail.com; ০১৭১৯৭৮৩৫৫৮)। ২উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ৩কৃষি প্রকৌশলী, ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বিআরআরআই, গাজীপুর
ড. এম. এ. গোফফার
টমেটো ‘সোলানেসি’ পরিবারের অন্তর্গত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সবজি। অধিক পুষ্টিগুণসম্পন্ন এ সবজিটি প্রায় সারা পৃথিবীতেই জন্মানো হয়। অধিক ফলন, আগাম ফসল প্রাপ্তি, অমৌসুমে উৎপাদন ইত্যাদি নানান কারনে হাইব্রিড টমেটোর রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। বিশ্বের নামীদামি সব বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত অধিকাংশ বীজই তাই হাইব্রিড বীজ। সামগ্রীকভাবেই যে কোন ফসলের ভাল বীজ উৎপাদন করা ঐ একই ফসলের উৎপাদনের তুলনায় অধিক দক্ষতা ও শ্রমসাধ্য ব্যাপার। আর হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের বেলায় সমগ্র কর্মকাÐ পরিচালনায় অধিক মনোযোগ, বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োগ করতে হয়। যাহোক, নি¤েœ টমেটোর হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের কলাকৌশল আলোকপাত করা হলো।
হাইব্রিড জাত
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যতায় আলাদা ভিন্ন দুইটি লাইনের মাতৃ ও পিতৃ গাছের মধ্যে সংকরায়নের মাধ্যমে উৎপন্ন জাত যার উৎপাদনশীলতা মাতৃ বা পিতৃ গাছ উভয়ের চেয়েই বেশি হয় সেই জাতটিকে সাধারণ ভাবে হাইব্রিড জাত বলা হয়ে থাকে।
হ্ইাব্রিড টমেটো বীজ উৎপাদনের বিভিন্ন ধাপ
হাইব্রিড টমেটো বীজ উৎপাদন সাধারণ ফসলের বীজ উৎপাদনের মতো নয়। নিম্নলিখিত ধাপে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে এটা করা হয়ে থাকে।
১. প্যারেন্টাল লাইনের উন্নয়ন/ইনব্রিড তৈরি/জাত নির্বাচন(উবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ ঢ়ধৎবহঃধষ ষরহবং/ রহনৎবফ/ াধৎরবঃু ংবষবপঃরড়হ);
২. চারা উৎপাদন, রোপণ ও পরিচর্যা (ঝববফষরহম ৎধরংরহম, ঢ়ষধহঃরহম ্ সধহধমবসবহঃ);
৩. স্ত্রীফুল নির্বাচন ও পুংহীনকরণ (ঋবসধষব ভষড়বিৎ ংবষবপঃরড়হ ্ বসধংপঁষধঃরড়হ);
৪. পরাগরেণু সংগ্রহ (চড়ষষবহ পড়ষষবপঃরড়হ);;
৫. পরাগায়ন ও পরবর্তী পরিচর্যা (চড়ষষরহধঃরড়হ্ ধভঃবৎ পধৎব);
৬. মাতৃ ও পিতৃ সারির ব্যবস্থাপনা (গধহধমবসবহঃ ড়ভ সধষব ্ ভবসধষব ষরহবং);
৭. আন্তঃ পরিচর্যা (ওহঃবৎপঁষঃঁৎধষ ড়ঢ়বৎধঃরড়হং)
৮. বীজ ফল সংগ্রহ (ঋৎঁরঃ পড়ষষবপঃরড়হ ভড়ৎ ংববফ); এবং
৯. বীজ সংগ্রহ (ঝববফ পড়ষষবপঃরড়হ)।
১. প্যারেন্টাল লাইনের উন্নয়ন/ ইনব্রিড তৈরি/জাত নির্বাচন
কাঙ্খিত মাতা-পিতা/জাত নির্বাচনপূর্বক এর মানসম্পন্ন বীজ সংগ্রহ করতে হবে। উল্লেখ্য যে, কোন হাইব্রিড বীজ উৎপাদনে প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি হলো-বিভিন্ন কর্ম পরিক্রমার মাধ্যমে বিশুদ্ধ মাতৃ ও পিতৃ সারির উন্নয়ন করা হয়। অতঃপর মাতৃ ফুলে পিতৃ গাছের পরাগরেণু স্থানান্তর পূর্বক হাইব্রিড বীজ উৎপন্ন হয়। তাই কাক্সিক্ষত সংকর জাতের বিশুদ্ধ মাতৃ-পিতৃ গাছের বীজ সংগ্রহ করতে হয়। উল্লেখ্য যে, মাতৃ গাছকে “বীজ মাতা” আর পিতৃ গাছকে “পরাগ মাতাও” বলা হয়ে থাকে ।
জাতভেদে টমেটোর জীবনকাল ১২০-১৫০ দিন। বীজ বপনের সময় সেপ্টে¤¦র- অক্টোবর। বীজ প্রতি হেক্টরে ২০০ গ্রাম (১ গ্রা/শতাংশ)। তবে হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ১৭০ গ্রাম বীজ স্ত্রীফুল ও ৩০ গ্রাম বীজ পুরুষ ফুল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন হয়।
২. চারা উৎপাদন রোপণ ও পরিচর্যা
ি সবল চারা উৎপাদনের জন্য প্রথমে ৫০ গ্রাম সুস্থ বীজ ঘন করে প্রতিটি বীজতলায় (১মিদ্ধ৩ মি) বুনতে হয়।
ি এই হিসেবে প্রতি হেক্টরে ২০০ গ্রাম (১ গ্রাম/শতাংশ) বীজ বুনতে (গজানোর হার ৮০%) ৪ টি বীজতলার প্রয়োজন। কিন্তু হাইব্রিড বীজ উৎপাদনে ৩০ গ্রাম বীজ পুরুষ ফুল উৎপাদনের জন্য স্ত্রী গাছের বীজ বপনের ৭-১০ দিন আগে বপন করতে হয়।
ি গজানোর ৭-১০ দিন পর চারা দ্বিতীয় বীজতলায় ৪দ্ধ৪ সেমি. দূরত্বে স্থানান্তর করতে হবে।
ি এক হেক্টর জমিতে টমেটো চাষের জন্য এরূপ ২২টি বীজতলার প্রয়োজন হয়।
ি বীজতলায় ৪০-৬০ মেস (প্রতি ইঞ্চিতে ৪০-৬০ টি ছিদ্র যুক্ত) নাইলন নেট দিয়ে ঢেকে চারা উপোদন করলে চারা অবস্থায়ই সাদা মাছি পোকার দ¦ারা পাতা কোঁকড়ানো ভাইরাস রোগ ছড়ানোর হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যায়। এরুপ সুস্থ সবল ও ভাইরাসমুক্ত চারা রোপণ করে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
ি অতিরিক্ত বৃষ্টি ও রোদের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রয়োজনে পলিথিন ও চাটাই এর আচ্ছাদন ব্যবহার করতে হবে।
জমি তৈরি
টমেটো বীজের ভাল ফলন অনেকাংশেই জমি তৈরির উপর নির্ভর করে। তাই ৪-৫ বার চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। মাটির প্রকৃতি ও স্থানভেদে ১মি. চওড়া ও ১৫-২০ সেমি. উঁচু বেড তৈরি করতে হবে। দুটি বেডের মাঝে ৩০ সেমি. চওরা নালা করতে হবে যাতে পানি সেচ ও নিষ্কাশনের সুবিধা হয়।
সার প্রয়োগ : নিম্ন বর্ণিত মাত্রায় সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
উপরের মাত্রায় গোবর ও রাসায়নিক সার শেষ চাষের আগে জমিতে ভাল করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। উপরি প্রয়োগের ইউরিয়া এবং এমওপি সার গাছের গোড়ার ১০-১৫ সেমি. দূরে দিয়ে মাটির সঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে।
চারা রোপণ ও পরিচর্যা
সাধারণত পুরুষ/পিতৃ লাইন (গধষব ঢ়ধৎবহঃ) স্ত্রী লাইনের (ঋবসধষব ঢ়ধৎবহঃ) ৭-১০ দিন পূর্বে লাগানোর হয় যাতে করে পরবর্তীতে স্ত্রী ফুলে পরাগায়নের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ভাল উর্বর শক্তিসম্পন্ন (ভবৎঃরষব ধহফারমড়ৎড়ঁং) পরাগরেণু পাওয়া যায়। সাধারণভাবে পুরুষ ও স্ত্রী লাইনের অনুপাত ১ঃ৫ রাখা হয়। বিকেলের পড়ন্ত রোদে চারা রোপণ করাই উত্তম এবং লাগানোর পর গোড়ায় হালকা সেচ প্রদান করতে হবে। এক মিটার চওড়া বেডে দুই সারি করে চারা লাগাতে হবে। এক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দুরত্ব ৬০ সেমি. এবং সারিতে চারা থেকে চারা ৪০ সেমি. দূরত্বে লাগাতে হবে। তবে ৭০ সেমি চওড়া বেডে ৫০ সেমি. দূরত্বেও চারা রোপণ করা যেতে পারে। বিভিন্ন অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা যেমন সার প্রয়োগ, মালচিং, আগাছা দমন, সেচ ও নিষ্কাশন, শাখা ছাঁটাই, রোগ ও পোকা দমন এগুলো এমন ভাবে করতে হবে যেন পরাগায়ন ও ফল ধারণের সময় গাছ সজীব ও সতেজ থাকে। তবে পরাগায়ন ও পুংহীনকরণের পূর্বেই বিভিন্ন সময় রোগিং এর মাধ্যমে অনাকাক্সিক্ষত গাছ সরিয়ে ফেলতে হবে এবং প্যারেন্ট লাইনের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। এ সময়ে ইতোমধ্যেই ফুটে যাওয়া ফুল ও ফলও ছেঁটে ফেলতে হবে।
৩. স্ত্রীফুল নির্বাচন ও পুংকেশর অপসারণ
ি প্রথম ফুলগুচ্ছ (ঋষড়বিৎ পঁষংঃবৎ) অপসারণ পূর্বক ২য় ভষড়বিৎ পঁষংঃবৎ এর ফুল থেকে শুরু করতে হয়।
ি ফুলের থোকায় যদি ফল বা ফুটন্ত ফুল থাকে তা কেটে ফেলা দরকার।
ি মোটামুটি ১/২ দিন পর ফুটবে এমন অফুটন্ত হালকা হলুদ রং এর কুঁড়ি বিবেচনায় নিতে হয়। কারণ এ অবস্থার আগে নিলে কুঁড়ি খুব ছোট থাকায় গর্ভদÐ বা গর্ভাশয় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আর এর পরে নিলে ফুলের ভেতর স¦তস্ফ‚র্ত ভাবে পরাগায়ন পরাগধানী অপসারণের সময় ঘটে যেতে পারে, বিধায় হাইব্রিড বীজ হবে না।
ি পরাগায়নের আগের দিন বিকালে চিমটা (ঋড়ৎপবঢ়) দ্বারা অতি সাবধানে কুঁড়ি উন্মুক্ত করে পুংকেশর (পুদন্ডসহ পরাগধানী) অপসারণ করতে হবে। উল্লেখ্য যে, ক্রসিং কাজের মোট সময়ের ২/৩ অংশ সময়ই পুংরহিত করণ কাজে ব্যয় হয়। বাণিজ্যিক বীজ উৎপাদনে পুংরহিত করণের পর কাগজের ব্যাগ দিয়ে ঢাকতে হয় না কারণ ফুটন্ত কোন ফুল স্ত্রী বøকে রাখা হয় না।
৪. পরাগরেণু সংগ্রহ
পূর্ব নির্ধারিত রোপিত পুরুষ গাছের ফুল যা সকালে ফুটেছে বা ফুটন্ত অবস্থায় আছে এমন ফুল সংগ্রহ করে একটি কাঁচের বাটি বা পেট্রিডিসে রাখতে হয়। অতঃপর কাল কাচ খÐের উপর বাম হাতে ধরে সুচ দ্বারা হালকা টোকা দিলে পুংস্তবক থেকে পরাগরেণু বের হবে। যা কাঁচের ছোট টিডবেও সংরক্ষণ করা যায়। যদি আলোক উজ্জ্বল আবহাওয়া না হয় তাহলে শিশির সিক্ত ফুল সংগ্রহ করার পর সাবধানতার সাথে ফুল থেকে কলি বের করে পাতলা সেলোফেন ব্যাগে ভরে ১০০ ওয়াট বৈদ্যুতিক বাতির নিচে ২৯-৩০০ ডিগ্রি সে. তাপে ২৪ ঘন্টা শুকিয়ে নিয়ে পরাগরেণু সংগ্রহ করা যায়।
৫. পরাগায়ন ও পরবর্তী করণীয়
পরাগরেণু সংগ্রহের পরপরই সকাল ৮.৩০-১১.০০ টার মধ্যে আগের দিন পুংরহিত স্ত্রীফুলের গর্ভমুÐে লাগিয়ে দিতে হয়। যা নিমোক্তভাবে করা যায়ঃ
ি সকালের মেঘ বা কুয়াশামুক্ত সময়ে গাছের সারিকে বামে রেখে বাম হাতে পুংরহিত স্ত্রীফুল ধরতে হয়।
ি ডান হাতে রক্ষিত ভেসেলটির পরাগরেণু গর্ভমুÐে ২-৩ বার স্পর্শ করতে হয় যাতে পর্যাপ্ত পরাগরেণু গর্ভমুÐে স্থানান্তরিত হয়।
ি পরাগায়িত স্ত্রীফুলটির ২-৩ টি বৃত্তাংশ কেটে দিতে হয় যাতে পরাগায়িত ও অপরাগায়িত ফুল সহজে চিহ্নিত করা যায়।
ি মাঝে মধ্যে অবশ্যই পরিদর্শনপূর্বক অপরাগায়িত ফুল, ফল ও অবাঞ্চিত ডালসহ কুড়ি ছাটাই করে দিতে হবে।
উপরোক্ত পরাগায়ন কার্যক্রমটি প্রতি গাছের ৪০-৫০টি ফুলে করতে হয় যাতে প্রতিটি গাছে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ফল ধারণ ছোট ছোট ফল বিশিষ্ট প্রতি টমেটো গাছে ৬০-৭০টি ফুল এবং মাঝারি থেকে বড় ফল বিশিষ্ট টমেটো গাছের ৪৫-৫০টি ফুল করতে হয়। যাতে মোটামুটি যথাক্রমে ৪০-৫০টি ও ৩০-৪০টি ফল ধারন করে যদিও গাছে ফলের সংখ্যা রাখা নির্ভর করে বীজ মাতার ফলের গড় ওজন বা আকার ও ফল প্রতি বীজের সংখ্যার উপর। সাধারণভাবে বড় আকারের ফল হলে ২০ ফল/গাছ, মাধ্যম আকারের হলে ৩০ফল/গাছ আর যদি ছোট ছোট ফল হয় তাহলে প্রতি গাছে ৩০ টির অধিক ফল রাখা হয় যাতে পর্যাপ্ত বীজ পাওয়া যায়।
৬. মাতৃ-পিতৃ সারির ব্যবস্থাপনা
উল্লেখ্য যে, মাতা-পিতার কৌলিতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্য রক্ষার্থে একই জমির স্ত্রীগাছের বøক হতে অপরাগায়িত বাছাই করা ফল এবং পুরুষ গাছের বøক হতে নির্বাচিত ফল থেকে পুনশ্চ ব্যবহারের জন্য বীজ রাখা যেতে পারে। কি¤¦া মাতা-পিতার বীজ বর্ধনের জন্য আলাদা আলাদা জমিতে টমেটো ফসল চাষ করে বীজ সংরক্ষণ করা যায়।
৭. পরবর্তী পরিচর্যা
সেচ ও নিষ্কাশন : চারা রোপণের ৩-৪ দিন পর পর্যন্ত হালকা সেচ ও পরবর্তীতে প্রতি কিস্তি সার প্রয়োগের পর জমিতে সেচ দিতে হয়। টমেটো গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। সেচ অথবা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি দ্রæত নিষ্কাশনের জন্য নালা পরিমিত চওড়া (৩০-৪০ সেমি.) এবং এক দিকে সমান ঢালু হওয়া বাঞ্চণীয়।
মালচিং : প্রতিটি সেচের পরে মাটির উপরিভাগের চটা ভেঙ্গে দিতে হবে যাতে মাটিতে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করতে পারে।
আগাছা দমন : টমেটোর জমিকে প্রয়োজনীয় নিড়ানি দিয়ে আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
সার উপরি প্রয়োগ : সময়মত বর্ণিত মাত্রায় প্রয়োজনীয় সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
বিশেষ পরিচর্যা : ১ম ফুলের গোছার ঠিক নিচের কুশিটি ছাড়া নিচের সব পার্শ্ব কুশি ছাঁটাই করতে হবে। মুটামুটি ৪-৫ বার ছাঁটাই বা প্রুনিং করতে হয়। আর ঙঢ় উন্মুক্ত পরাগায়িত বীজ উৎপাদনে ফলের থোকায় ছোট ফলগুলো অপসারণ করে পাতলা করতে হয়। গাছে বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঠেকনা দিতে হবে।
বালাই ব্যবস্থাপনা
সাদা মাছি পোকা
ি এরা পাতার রস চুষে খায় বলে পাতা কুঁকড়ে যায়।
ি এদের আক্রমণে পাতার মধ্যে অসংখ্য ছোট ছোট সাদা বা হলদে দাগ দেখা যায়। পরে অনেক দাগ একত্রে মিশে সবুজ শিরাসহ পাতা হলুদ হয়ে যায়।
ি সাদা মাছি পোকার নিম্ফ রস খাওয়ার সময় এক ধরনের আঠালো মধুর মতো রস নিঃসরণ করে। এ রস পাতায় আটকে গেলে তাতে শুটিমোল্ড নামক এক প্রকার কালো রঙের ছত্রাক জন্মায় ফলে গাছের সালোকসংশ্লেষণ ক্রিয়া বিঘিœত হয়।
ি হলুদ পাতা কোঁকড়ানো ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে।
দমন ব্যবস্থাপনা
ি সহনশীল জাত যেমন বারি উদ্ভাবিত টিএলবি ১৩০, টিএলবি ১৮২ চাষ করা।
ি এক কেজি আধা ভাঙ্গা নিম বীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে উক্ত পানি পাতার নীচের দিকে স্প্রে করা।
ি বীজতলা মশারীর নেট দিয়ে ঢেকে রাখা।
ি হলুদ রঙের ফাঁদ ব্যবহার করা।
ি আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি জাতীয় কীটনাশক (প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি পরিমাণ) অথবা এডমায়ার ২০০ এস এল (প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি পরিমাণ) মিশিয়ে স্প্রে করা। তবে ঘন ঘন কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ এর ফলে এ পোকা কীটনাশকের প্রতি দ্রæত সহনশীলতা গড়ে তোলে।
ড্যা¤িপং অফ
ি ছত্রাকজনিত কারণে চারার গোড়ায় পানিভেজা দাগ হয়ে পচে যায়। অনেক সময় শিকড় পচে ও চারা মারা যায়।
দমন ব্যবস্থাপনা
ি মুরগীর বিষ্ঠা/সরিষার খৈল বীজ বপনের তিন সপ্তাহ আগে জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
ি আক্তান্ত জায়গায় রিডোমিল গোল্ড (০.২%) দিয়ে মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে।
ঢলেপড়া রোগ
ি গাছের যে কোন বয়সে এ রোগ দেখা যায়।
ি আক্রান্ত গাছ যে কোন সময় ঢলে পড়ে যায়।
ি পুরো গাছটি দ্রæত মারা যায় ও ফলন কম হয়।
দমন ব্যবস্থাপনা
ি আক্রান্ত গাছ দেখলেই তা তুলে ধ্বংস করা।
ি রোগ প্রতিরোধী জাতের চাষ করা।
ি বন বেগুন যথা টরভাম ও সিসি¤িব্রফলিয়ামের সাথে জোড় কলম করা।
নাবী ধসা/মড়ক
ি টমেটো গাছের পাতাতে কালো কালো দাগ দেখা যায় যা পানিতে ভিজা ভিজা মনে হবে।
ি আক্রান্ত পাতার নিচে সাদা রঙের ছাতা (ছত্রাকজালি) পড়ে থাকতে দেখা যায়। আক্রান্ত পাতা বা কাÐে তুলার মতো ছত্রাকজালির আবরণ দেখা যায়।
ি আক্রান্ত জমি থেকে পোড়া পোড়া গন্ধ পাওয়া যায়।
ি শেষ অবস্থায় এসে পাতা, কাÐ, শাখা সবই আক্রান্ত হয়ে গাছগুলো দেখতে সম্পূর্ণ পুড়ে যাবার মতো মনে হবে।
দমন ব্যবস্থাপনা
ি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন অথবা ঘন কুয়াশা ও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ৩-৪ দিনের বেশি চলতে থাকলে দেরি না করে ছত্রাকনাশক যেমন-রিডোমিল গোল্ড বা ম্যানকোজেব ব্যবহার করা। ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১ম বার স্প্রে করার ৩ দিন পর ২য় বার স্প্রে করতে হবে।
ি আক্রান্ত বছরের ফসল স¤পূর্ণ পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।
হলুদ পাতা কুঁকড়ানো
ি পাতার কিনারা থেকে মধ্যশিরার দিকে গুটিয়ে যায়।
ি পাতা খসখসে হয়ে শিরাগুলো স¦চ্ছ হলুদ হয়ে কুঁকড়িয়ে যায়। পাতা পীতবর্ণ হয়ে কুঁকড়িয়ে যায়।
ি আক্রান্ত গাছের ডগায় ছোট ছোট পাতা গুচ্ছ আকার ধারণ করে।
দমন ব্যবস্থাপনা
ি চারা লাগানোর এক সপ্তাহ পর থেকে ৭-১০ দিন পরপর এডমায়ার নামক বিষ প্রয়োগ করে সাদা মাছি পোকা দমন করতে হবে।
ি টমেটোর জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে। আক্রান্ত গাছ উঠিয়ে মাটিতে পুঁতে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
ি রোগমুক্ত চারা লাগাতে হবে।
ি ক্ষুদ্র ছিদ্রযুক্ত (প্রতি বর্গইঞ্চিতে ৪০-৬০ টি ছিদ্র) নাইলনের নেট দিয়ে বীজতলা ঢেকে চারা উৎপাদন করতে হবে।
ি ফল সংগ্রহের দুই সপ্তাহ আগেই স্প্রে বন্ধ করতে হবে।
বীজ উৎপাদনের জন্য বিশেষ কাজগুলো করণীয়
রোগিং : পাতার রং, আকার, আকৃতি, গাছের উচ্চতা, ফলের রং, আকার, আকৃতি ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে কোন গাছ ভিন্নতর মনে হলে তা উঠিয়ে ফেলতে হবে। রোগাক্রান্ত গাছ দেখা মাত্রই সম্পূর্ণ সরিয়ে ফেলতে হবে। টমেটো বীজ ফসলের মাঠ কমপক্ষে ৩ বার পরিদর্শন করতে হবে। ফুল আসার আগে প্রথম পরিদর্শন, ফুল আসা ও ফল ধরার সময় দ্বিতীয় পরিদর্শন এবং ফল পরিপক্ব হওয়ার সময় তৃতীয় পরিদর্শন করতে হয়।
পৃথকীকরণ দূরত্ব : টমেটো একটি স্বপরাগায়িত ফসল হলেও ২-৫% পরপরাগায়ন ঘটে থাকে। বীজ ফসলের জমি অন্য জাতের জমি থেকে ৫০ মিটার দূরত্ব রাখলে বিশুদ্ধ বীজ উৎপাদন হবে।
বীজ ফল চিহ্নিতকরণ ও সংগ্রহ : রোগাক্রান্ত, ক্ষতিগ্রস্ত বা পচা ফল বাদ দিয়ে শুধুমাত্র সুস্থ স্বাভাবিক ফল বীজের জন্য বাছাই করে আলাদাভাবে সংগ্রহ করতে হবে। ফলের রং গাঢ় লাল হলেই ফল সংগ্রহ করা উচিত। শুধুমাত্র পরিপূর্ণভাবে পরিপক্ব হলেই ফল বীজের জন্য সংগ্রহ করা যায়। ফল সংগ্রহ করার পূর্বে নিশ্চিত হবার জন্য বৃতি কাঁটা আছে কিনা লক্ষ্য রাখতে হবে। অতঃপর সংগ্রহকৃত ফলগুলো ২-৩ দিন রেখে দিতে হয়।
বীজ ফল সংগ্রহ
ি সংগ্রহকৃত ফল প্রথমে একটি জায়গায় ২-৩ দিনের জন্য পালা করে রাখতে হয় যতক্ষণ না পর্যন্ত তা নরম হয়ে যায়।
ি এরপর ফলগুলোকে একটি কাঠের বা প্লাস্টিকের বা সিমেন্টের পাত্রে গাজন প্রক্রিয়ার জন্য রাখা হয়। তবে ধাতব কোন পাত্র কোন ক্রমেই ব্যবহার করা উচিত নয়। এসময় সম্পূর্ণ ফলগুলিকে পা দিয়ে মাড়িয়ে ভেঙে দেয়া হয়। ফল শক্ত হলে চাকু দিয়ে কেটে শুধু ভিতরের পাল্পসহ বীজগুলোকে আলাদা করে রাখা যেতে পারে। সাধারণত ২০০-২১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ২৪-৩৬ ঘণ্টা ফারমেনটেশনে রাখলেই যথেষ্ট। গাজন প্রক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন হওয়ার জন্য এসময় কোনক্রমেই পানি দেয়া যাবে না।
ি গাজন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে পাত্রে পানি ঢেলে দিয়ে ভালোভাবে নাড়িয়ে দিতে হবে।
ি এভাবে কিছুক্ষণ নাড়ালে বীজ নরম জেলির মতো অংশ হতে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে নিচে পড়ে থাকবে। তখন নেটের সাহায্যে উপরের উচ্ছিষ্ট অংশগুলো ফেলে দিয়ে বীজগুলো সংগ্রহ করতে হবে।
ি বীজস্থ মিউসিলেজ দূর করার জন্য প্রতি কেজি ফলের পাল্পে ২০ মিলি. বাণিজ্যিক হাইড্রোকেøারিক এসিড (এসিড পাল্পে ঢালতে হবে) মিশিয়ে ৩০ মিনিট রেখে তারপর ধুতে হবে। এতে বীজের অংকুরোদগম হারও বৃদ্ধি পায়।
ি সংগ্রহকৃত বীজ সাথে সাথেই কয়েক দিন রৌদ্রে শুকাতে হবে। ভালোভাবে শুকানো বীজে জলীয় অংশের পরিমাণ ৮% থাকে।
বীজের ফলন
বীজের ফলন অনেক গুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করলেও এক টন ফল থেকে মোটামুটিভাবে ১০ কেজি বীজ পাওয়া যায় অর্থাৎ ফ্রেশ টমেটোর ১% বীজ হয়ে থাকে। য়
প্রধান বৈজ্ঞাানিক কর্মকর্তা সবজি বিভাগ, উদ্যানতত্ত¡ গবেষণা কেন্দ্র বারি, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৫৫২৪৪২৫১২, ই-মেইল : mgoffar@yahoo.com
সৈয়দ মোহাম্মদ সালেহ উদ্দিন
একালের ঢাকা শহরের লোকেরা আনই ফলটি দেখেছে বলে মনে হয় না। হয়ত এখনই সময় তা পুনরুদ্ধারের নয়তো এটি আর কেউ কোনদিন দেখবে না।
আমাদের বালক বেলায় ঢাকার মনিপুরি ফার্মের নিকটের বুনো ঝোপে বা বিমান বন্দরের টিলা ও বনে এফল প্রাকৃতিকভাবে জন্মাত। পাখি আর বানরের এ প্রিয় খাবারটিতে আমরাও সময়ে সময়ে ভাগ বসাতাম।
বর্তমানে এ ফলটি হতে পারে এ দেশের মানুষের প্রিয় একটি পুষ্টিদায়ক খাবার। একটি অর্থকরী কৃষি পণ্য হিসেবে এদেশে এর চাষ নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ আগ্রহী হবে সে আশায় এ উপস্থাপনা।
ঢাকা ফার্মের যেসব ভূমি সেকালে ফসল গবেষণার জন্য ব্যবহার করা হত এবং ফার্মের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি যেখানে ছিল এর বেশিরভাগের উপর এখন দৃষ্টিনন্দন সংসদ ভবন এর বাগান, মাঠ এবং বহুবিধ সরকারি ইমারত এবং চন্দ্রিমা উদ্যান।
তবে সেকালে খেত-খামারের চড়াই-উতরাইয়ের ঢালে স্থানে স্থানে ছিল বুনো ঝোপ-ঝাড়। যেখানে ছিল খাটাস, শিয়াল, সাপ, গুই, বেজি, পাখ-পাখালি আর পোকা-মাকড়ের আবাস। সেসব জায়গায়ই আনই, খুূদি জাম, বঙ্কুই, বৈচি, ফটুক্কা, মটকিলা ও অন্য ধরণের বুনো ফলের দেখা মিলত।
বিমানবাহিনীর টিলাগুলি এখন আর নাই। ২য় মহাসমরকালে বানানো সেসব টিলা বিশেষ আকৃতিতে বানানো হয়েছিল যাতে সেকালের ফাইটার আর বোম্বারগুলিকে শত্রæ বিমান আক্রমণ থেকে আড়াল করা যায়। জেট বিমান যুগে সে সবের প্রয়োজনীয়তা না থাকায় টিলার মাটি কেটে অন্য কাজে লাগানো হয়েছে।
তবে বিমান বাহিনীর দেওয়ালের ভিতর কিছু বনজ গাছ ও ফলবাগান দৃশ্যমান। এখন বিমান আড়াল করে রাখার জন্য বন সৃষ্টি করা হয়। আমার বিমানবাহিনী জীবনে রানওয়ে ও ৩ নং স্কোয়াড্রনের মাঝের জঙ্গলে প্রবেশ করে বানর ও পাখির দলের মজা করে আনই আর কিছু টক জাতীয় ছোট ফল খেতে দেখতাম।
এখন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান কার্যক্রম গাজীপুরে। দেশের অন্যান্য জায়গায় রয়েছে এদের শাখা প্রশাখা। ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আর গাজীপুরস্থ সালনার নিকটে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ও কৃষি বিষয়ক বিবিধ গবেষণায় অবদান রাখছে। এখান থেকেই বহু কৃষি গবেষক ডক্টর হয়েছেন। এখান থেকেই পিএইচডি সমাপন করেছেন এমন একজনের নিকট থেকে আমি জেনেছি ভাওয়ালের গজারি বনে আনই ফলের অস্তিত্ব এখনো নাকি আছে। আমিও গাজীপুরের ভুরুলিয়ার এক বসত বাড়ির নিকটে বড়-সড় একটি আনই গাছ দেখেছিলাম। এখানেও এককালে ভাওয়াল রাজের গজারি বন ছিল।
ফলটি সম্পর্কে আপনাদের ধারণা দেওয়ার জন্য এখন আমার স্মৃতিই ভরসা।
আগে ঢাকা ফার্মে স্থানীয় শ্রমিকদের পাশাপাশি মনিপুরি উপজাতির লোকজন শ্রম দিতেন। কৃষি কর্মকর্তাদের সরকারি আবাসিক এলাকার পাশের বনে তাদেরও আবাসের জন্য কুটির বানানো হয়েছিল। আর মনিপুরি পাড়া নামটিই হয়েছে উপজাতিটির নামানুসারে। আমি আমার বালক বেলায় ও এমনকি কৈশোরে সরকারি ল্যাবরেটরির পিছনে ওদের বসবাস করতে দেখেছি।
ফার্মের যে বনের মাঝে মনিপুরি বা অন্যদের আবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল সে বনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সাথী সাহাবের সাথে প্রবেশ করেছিলাম। ছাত্ররা ছুটির ঘন্টা বাজলে কামরাঙ্গা, বকুল আর পিয়ারার টানে সে বনে প্রবেশ করত। ফলবান গাছের ডালে ডালে কেউ কেউ পাকা ফল খোজত। ভয় ডর হীন ছাত্রদের কেউ কেউ সাপের ভয় উপেক্ষা করে আনই, গোজিগোটা, বঙ্কুই এসব বুনো ফল পেড়ে এনে ভাগ করে খেতো।
একদিন এমদাদ আলোচ্য বনটির উল্টা দিকে বড় সাহেবের বাংলোর কাছাকাছি একটি ঝোপের ভেতর আমাকে নিয়ে গেলো। দেখলাম বড় একটি এলাকা জুরে ডালে ডালে থোকা থোকা আনই ফল। সেগুলো আঙুরের থোকার মতো ঝুলছে। চেহারা ছুরত ছোট আঙুরের মতই তবে রসালো নয়। আমরা বেছে বেছে পাকা ফল খেলাম আর পকেটে ভরে নিলাম। সেসব ছিল চমৎকার স্বাদের। ঘি স্বাদের মিষ্টি ফল। একটু কম পাকাগুলো বেলে, কষ্টি তবে মিষ্টি। ফলটির বিচি আমাদের দেশি বুটের আদলের তবে রং ফলটির মতোই সফেদ।
আনই গাছের পাতা আমাদের বড়ই পাতার মতো তবে বেশ বড়। কাÐ ডাল-পালা অবশ্য বড়ই গাছের মতো নয়। কাষ্টল-লতানো তবে অপর গাছের সহায়তায় নয় বরং নিজের কান্ডেই ডাল-পালা ছড়িয়ে ফলভারে নত হয়ে মাখলুকাতের সেবারত। আনই ও অন্য বুনো ফলের প্রধান ভাগিদার বনের ফলখেকো পশু, পাখি আর বনে বসবাসকারী মানব সন্তান। ফার্মের বনের ফলগুলির কথা আমাদের সময়ের সে বনে বাস করা উপজাতীয় সন্তানদের অজানা থাকার কথা নয়।
জানা যায় বৃটিশ সরকার সরকারি ফার্মে কাজের জন্য এসব পরিশ্রমী উপজাতীয় শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছিল। পরে পূর্ব পাকিস্তান আমলে তারা সরকারের সেবা করেছে। এ দেশের কৃষির উন্নয়নে তাদের রয়েছে যথেষ্ট অবদান।
আমি নারী-পুরুষদের ফার্মের নিচু এলাকায় ধানের খেত, উঁচু এলাকায় বাদাম খেত ও অন্যত্র কর্মরত দেখেছি। এখন যেখানে বাংলদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) সেখানে দেখেছি কমলা বাগান। একসময় সেখানে কফি বাগানও করা হয়েছিল। সেখানে কমলা এবং থোকা থোকা কফি ফল ফলতে দেখেছি। সম্ভবত সেসব কৃষি গবেষণার অংশ ছিল। এর উল্টা দিকে ছিল হর্টিকালচারের বিশাল ঘেরাও দেওয়া এলাকা। মানুষ ও গবাদিপশু থেকে ফলজ গাছগুলি বাঁচানোর জন্য খুঁটিতে কাঁটা তার ঝুলিয়ে সে ঘের দেওয়া হয়েছিল। এর ভেতরে ছিল উঁচু দুচালা ঘরের মতো একটি কাঠামো তবে চালটি ছিল মোটা তারের জাল দিয়ে ছাওয়া। এতে লতাজাতীয় গাছ ঝুলত।
এলাকাটির ভেতর বিবিধ ফলের গাছ বাহির থেকেও দেখা যেত। কৃষি বিভাগের এসব কর্মকান্ডেও সেসব উপজাতীয় শ্রমিকদের অবদান ছিল। ফার্মগেট থেকে কলেজগেট পর্যন্ত কৃষি বিষয়ক যেসব কর্মকাÐ ছিল তা এখন গাজীপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে বিজ্ঞানীগণ ধান ও কৃষি পণ্যের উন্নয়নে কঠোর পরিশ্রম করছেন। প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে জার্মপ্লাজম বিভাগের। কঠোর পরিশ্রমী বিজ্ঞানীগণ কৌশলে উদ্ভাবন করে চলেছেন উন্নত জাতের ধান, সব্জি ও ফল ফলারি।
যতদূর জানা যায় উল্লিখিত গবেষণা বিভাগটি দেশজ প্রচলিত ফল ফলারি ছাড়া এদেশে আগে জন্মানো যেত না এবং দেশজ অপ্রচলিত ফল নিয়ে গবেষণা করছে। মাল্টা, কমলা, শরবতি লেবু, বিলিম্বি ইত্যাদির উন্নত জাত যা এদেশে জন্মানো সম্ভব তা নিয়ে গবেষণা করে মাঠ পর্যায়ে অবমুক্ত করা হচ্ছে।
সাতকরা, ডেফল, ডেউয়া, তৈকর, ডুমুর, খুদিজাম, আনজির (মিষ্টি ডুমুর), গাব, কাউফল, ফলসা, লুকলুকি, বেতফল এবং এমন আরো অনেক অপ্রচলিত দেশজ ফল নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে।
কিছু বিদেশী ফল যা পূর্বে আমাদের দেশে ফলানো যেত না যেমন রুটিফল, ড্রাগনফল, স্ট্রবেরি, রাম্বুটান ইত্যাদি তারা এদেশে ফলাতে পেরেছে। এদেশে অপরিচিত ফল যেমন শানতোল, ডুরিয়ান, জাবটিকাবা, প্যাসন ফল, অ্যাভোকেডো, পার্সিমন, মিষ্টি তেতুল, মিষ্টি আমলকী, গোলপাতা ফল এসব নিয়ে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
ঢাকা ফার্ম এখন খোজে পাওয়া সম্ভব নয়। ফার্মগেটের হর্টিকালচারের গাছগাছালি কেটে বানানো হয়েছে পার্ক। একসময় রচনা করা হয়েছিল ফুলের বাগান। এখন অবশ্য সেখানে সকাল বিকাল ছেলেদের বল পায়ে ছুটতে দেখা যায়। এর পশ্চিমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল। এরই উল্টা দিকে বাংলাদেশের কৃষি নিয়ন্ত্রণকারী কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ভবন খামারবাড়ি। সেকালে এখানেই ছিল সরকারি এপি কালচারের মৌমাছি পালন প্রকল্প।
এখন যেখানে ক্রিকেট খেলার মাঠ সেখানে আমার বালক বেলায় চিনাবাদাম লাগাতে দেখেছি। এর ইন্দিরা রোড লাগোয়া জমিনে ছিল বড় বড় কাটা জাতীয় গাছ। এর ফল দেখতে ছিল জিলাপির মত। এর ভিতরে ছিল পপ কর্ণের মতো দেখতে খাবার উপযোগী শাস যার প্রতিটির ভেতর ছিল তরমুজের বিচির মতো বর্ণের কিন্তু শক্ত আঁটি। আমরা এর নাম দিয়েছিলাম জিলাপি ফল।
ঢাকাতে এমন ফলের প্রায় বিলুপ্তি ঘটেছে। তবে যমুনার কিনারায় সেনানিবাসে এমন ফলের অনেক গাছ দেখেছি। এর স্বাদ চেখে দেখেছি। জানতে পারলাম এ ফল গাছটির নাম ছাতিয়ান (ছাতিম নয়)। একসময় আমি যশোর সেনানিবাসে কর্মরত ছিলাম। চুরামন কাঠির লেকের পাশে বিমান বাহিনীর সেনাদের ব্যারাকের কাছের বাজারে এমন গাছ সেকালে দেখা যেত। সেনানিবাসের কাছেই ছিল ছাতিয়ান তলা। সম্ভবত নামকরণকালে সেখানে এ গাছ ছিল। ঢাকার ফার্মগেটের দরবার শরিফের উল্টাদিকে পার্কের পশ্চিম পাশে ইস্পাহানী চক্ষু হাসপাতালের নিকট দুইটি ছাতিয়ান গাছ এখনো রয়েছে। এর কাছে ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত মনিপুরি পাড়ায় স্থাপিত কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের লাল ভবন। বর্তমানের প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও মৃত্তিকা ভবনের মাঝের এ স্থাপনাটিকে আমরা ছোট বেলায় ল্যাবরেটরি বলতাম।
হামজাম, আলুবোখারা, কাজুবাদাম, স্টার আপেল, টমটমি, বনআম, বহরি, গাব, বিলাতি গাব, লটকন, করমচা, অরবরই, মুড়মুড়ি, আঁশফল, চিনার, পানিজাম, কাকজাম, বুটিজাম, চাপালিশ কাঠাল, আমরুল, মহুয়া, খিরনি, আকুরা, স্ট্রবেরি, কুমকই, তুতফল, জামান ফল ইত্যাদি বাংলাদেশের ফলে থাকে। এসব এদেশে স্বল্প পরিচিত ফল। এ সবের কোনটি অনেকের কাছে মোটেই পরিচিত নয়। তবে পুষ্টি বিবেচনায় এদের কোনটিই ফেলনা নয়। এদেশে যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান ফল-ফলারি নিয়ে কাজ করছে তারা এসব ফলের মানোন্নয়নের মাধ্যমে উন্নত জাত কৃষক পর্যায়ে অবমুক্ত করতে পারে। তারা সেসব উতপাদন ও বাজারে বিক্রয়ের মাধ্যমে দেশের জনগণের পুষ্টির জোগান দিয়ে নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাতে পারে। য়
অধ্যাপক (খÐকালীন) ক্যাম্ব্রিয়ান ইন্টারন্যাশনাল কলেজ অব এভিয়েশন, ঢাকা। ১৭,তল্লাবাগ, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল : ০১৮১৯১৫৪৬৬৪ salehuddinsyed@gmail.com
ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান
প্রতিটি প্রাণির বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশকীয় উপকরণ হল পানি। সারাবিশ্বে শুধু মানুষের কথা চিন্তা করলেও অনেক মানুষ বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাবার পানি থেকে বঞ্চিত। তাহলে যেখানে সব মানুষই শতভাগ বিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত সেখানে প্রাণির জন্য নিরাপদ পানির ব্যাপারটি অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে।
মুরগীর স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য উপাদান হল পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন পানি। কিন্তু সবসময় শতভাগ নিরাপদ পানি পাওয়া বেশ কঠিন। পানির পরিচ্ছন্নতা এবং হাইজিনের বেশ কয়েকটি স্তর আছে। অনেকে শুধু মনে করেন পানি দেখতে স্বচ্ছ এবং দুর্গন্ধ না থাকলে তা বিশুদ্ধ পানি। পরিষ্কার ঝকঝকে পানিতেও অনেক সময় গোপন শক্রু বা জীবাণু থাকে। যা আমরা স্বাভাবিক ভাবে দেখতে বা বুঝতে পারিনা। এটিও অনেক সময় বিপদের কারণ হয়ে উঠে।
পোলট্রি স্বাস্থ্যের অন্যতম মৌলিক বিষয় হল পানির গুনগতমান। এপ্লাইড ব্যাকটেরিয়াল কন্ট্রোল (এবিসি) এর মতে পানির গুণাগুণ বাচ্চার ভাল পুষ্টি এবং স্বাস্থ্য নিশ্চিত করে। স্বাভাবিক তাপমাত্রা ও পরিবেশে মুরগী সাধারণত ফিডের চেয়ে দ্বিগুণ পানি গ্রহণ করে থাকে। পানি পরিপাকে, পুষ্টি সরবরাহ, দৈহিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং বর্জ্য পদার্থ বের করতে বিশেষ ভ‚মিকা পালন করে। এটি ফার্মের কর্মদক্ষতা এবং পোলট্রি স্বাস্থ্যে ব্যাপক প্রভাব রাখে।
ফার্মের পরিচ্ছন্ন ও সুস্থ পানি সরবরাহের জন্য দুই ভাবে ভাগ করা যায়-
১. বিশেষ পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা।
২. অনবরত পানির পরিচ্ছন্নতা ধরে রাখা যেমন অর্গানিক এসিডস।
অনেক ফামার্স তাদের ফার্মের কর্মদক্ষতা বা লাভজনক অবস্থা পর্যবেক্ষণের সাথে সাথে পানির গুণাগুণ নিয়মিত পরীক্ষা করে থাকে ।
প্রতিটি খামারী সাধারণত একটি ফ্লক শেষ হওয়ার পর পানি ব্যবস্থাপনা সিস্টেমকে ভালভাবে পরিষ্কার করে থাকেন। এই নিয়মের মধ্যে একটু বিশেষ যতœ গ্রহণ করা হলে তা নিরাপদ পানির পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যেতে পারে। প্রতিটি পদ্ধতির নির্দিষ্ট নিয়মনীতি ভালভাবে অন‚সরণ করা হলে কাজের ফলাফল ভাল হয়। যে উপকরণ ব্যবহার করে বায়োফ্লিম পরিস্কার করা হয় তা দীর্ঘ সময় অপ্রয়োজনে রাখলে আবার তলানী পড়ে যার ফলে পরবর্তীতে তা ধুয়ে ফেলা বেশ কষ্টকর হয় এবং পরিচ্ছন্নতার কার্যকারীতা হ্রাস পায়।
পানি পরীক্ষা করা
পানির গুণাগুণের উপর বার্ডের পানি গ্রহণ এবং পানির পিএইচ পানির স্বাদ এবং উপকারী ব্যাকটেরিয়ার জন্য ক্ষতিকরও হতে পারে। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ক্ষারীয় পানি পছন্দ করে অন্যদিকে উপকারী ব্যাকটেরিয়া অ¤øীয় পানিতে বেশী বাড়ে। পানিতে অতিরিক্ত ক্ষারীয় পিএইচ থাকলে তা ওষুধ এবং ভ্যাকসিনের কার্যকরীতা অনেকটা কমিয়ে দেয়। অপরদিকে খুব বেশী অ¤øীয় হলে পানির স্বাদ কমে পানির গ্রহণ অনেকাংশে কমে যায়। পানি পরীক্ষা করে পোলট্রিতে পানি সরবরাহ করা উচিত।
পোলট্রির পানির পাত্র এবং পানির পুরো সিস্টেম পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখতে হয় এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু অনেকে হয়ত মনে করেন এটা শুধু ব্যাচ শুরু হওয়ার সময় করবে আবার শেষ হলে একবার। এই ধারণা ভুল। কারণ নিয়মিত পানিতে বায়োফ্লিম জমা হয় পানির পাইপ লাইন, পানির পাত্র প্রভৃতিতে। পানিতে বায়োফ্লিম জমা হলে ওষুধের কার্যকরিতা কমে এমনকি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিতে কাজ করে। পানিতে ওষুধ দেয়ার প‚র্বে বায়োফ্লিম পরিস্কারের ব্যবস্থা করতে পারলে সবচেয়ে ভাল। ভিটামিন ও অনান্য মেডিসিন পরিচ্ছন্ন পানিতে ভাল কাজ করে। প্রয়োজনে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড দিয়েও পানি বিশুদ্ধ করা যায়।
অর্গানিক এসিডস
অনান্য সকল উপকরণের ছাড়াও ফিড প্রস্তুত কারীদের জন্য অর্গানিক এসিড ব্যবহারের উপর মনোযোগ দিতে হবে কারণ ফিডে এমাইনো এসিড গাট মাইক্রোফ্লরাকে সুস্থ্য রাখতে সহায়তা করে। মুরগী পানির সাহায্যে কোন ব্যাকটেরিয়া গ্রহণ করলে তা পোলট্রির স্বাস্থ্য ঝুকি নেয়া উচিত হয়না।
অর্গানিক এসিড ব্যবহারের তিনটি বিশেষ উপকারিতা
১। তারা পানিকে বিশুদ্ধ করে থাকে।
২। চুনকে ভাঙ্গতে সহায়তা করে।
৩। পোলট্রি গাট হেলথকে ভাল রাখে।
পানির পিএইচ কমাতে অর্গানিক এসিড বেশ উপকারী
পানি পরিস্কার করণ উপকরণ যেমন ক্লোরিনের সাথে অর্গানিক এসিড ব্যবহারে পানির পিএইচ কমাতে সহায়তা করে। এভাবে মুরগীর জন্য আদর্শ পিএইচ ৫.৫ রাখা যায়। তাছাড়া যদি পানিতে এসিড ব্যবহার করা হয় তখন পানির পিএইচ ৩.৮ হতে ৪.২ পর্যন্ত রাখতে হয় যেন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া গুলো পানি হতে দ‚রীভ‚ত হয়ে যায়। পোলট্রি এসিডিক পানি সম্প‚র্ণ সহ্য করে এবং পছন্দ করে। কিন্তু যদি তা ৩.৫ পিএইচ এর নীচে আসে তাহলে তা গাট এর লাইনিং নষ্ট করে দেয়ার ঝুঁকি থাকে।
বাফেরেড বা প্রটেকটেড এসিডের ব্যবহার
পানিতে যে এসিড ব্যবহৃত হচ্ছে তা বাফারেড বা প্রটেকটেড কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ গাটে গিয়ে এসিড ব্যাকটেরিয়ার সেল ওয়াল দিয়ে পাস হয় এবং তা বহিচ্ছেদ ঘটায় এবং ব্যাকটেরিয়ার মধ্যের পিএইচ কমিয়ে দেয়। বিস্তৃত সীমানার অর্গানিক এসিড এর সহজলভ্য হচ্ছে ফর্মিক এসিড এবং প্রোপায়োনিক এসিড যা সালমোনেলা এবং ই-কোলাই নিয়ন্ত্রণে বেশ কার্যকর। অন্যদিকে ল্যাকটিক এসিড এবং বিউটাইরিক এসিড গাট মাইক্রোফ্লোরার উপকারী ব্যাকটেরিয়া বাড়াতে সহায়তা করে।
নিরাপত্তার জন্য ডোজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা
এসিড, ক্লোরিন এবং অন্যান্য স্যানিটেশন উপকরণ সঠিকভাবে ব্যবহার না করা হলে তা আরো ভয়ানক হতে পারে। ফ্লকের জন্য কি পরিমাণ উপকরণ লাগছে তা ভালভাবে হিসাব করে রাখতে হবে। যেন কোনভাবে এর বেশি হলে পানির প্রকৃতি গুণাবলিতে মারাত্বক নীতিবাচক প্রভাব না পড়ে।
মুরগীর সর্বাধিক উৎপাদনের জন্য পানিতে প্রোবায়োটিক ও ইমিউনিটি বৃদ্ধি করে এমন উপকরণ দেয়া হয়। এতে করে গাট এর স্বাস্থ্য ভাল থাকে এবং উপকারী অনুজীবের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তবে বিশোধন উপকরণ অতিমাত্রায় দেয়া থাকলে প্রোবায়োটিক এর কার্যকরিতা কমে যায়। এক্ষেত্রে পরামর্শ প্রোবায়োটিক দেয়ার সময় পানিতে স্যানিটাইজার বেশি করে দেয়া ভাল।
পানির লাইন পরিস্কার ও পরিছন্ন করার পরেই ওষুধ ও অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করতে হয়। পানি জমা করে রাখার পরে তাতে ক্লোরিন ও অর্গানিক এসিড ব্যবহার করে পানির গ্রহনযোগ্যতা বাড়ানো হয়।
পানির পরিচ্ছন্নতা ও বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করে ই-কোলাই এর প্রাদুর্ভাব অনেকটাই কমানো সম্বব। প্রয়োজন ছাড়া ব্রুডিং এ এন্টিবায়োটিক ব্যবহার ও দীর্ঘ সময় এন্টিবায়োটিক ব্যবহার না করে পরিচ্ছন্নতা ও বায়োসিকিউরিটি বাড়িয়ে ই. কোলাই সহ অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া থেকে রক্ষা করা যাবে। এতে করে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলো সহজে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করতে পারবেনা।
পোলট্রির পানি সরবরাহ : ব্রিডারের জন্য পর্যাপ্ত, পরিষ্কার ও ফ্রেস পানির সর্বাক্ষনিক সরবরাহ রাখতে হবে। সাধারণত পোলট্রি খাবারের চেয়ে বেশি পানি পান করে। ২১ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি এবং ফিডের অনুপাত ১.৬-১.৮ঃ ১ (পানিঃ ফিড, কম অনুপাত হয় নিপুল ড্রিংকারের ক্ষেত্রে এবং সর্বোচ্চ অনুপাত বেল টাইপ ড্রিংকারের ক্ষেত্রে)। ডিম পাড়ার সময় এ পরিমাণ কিছুটা বেড়ে যায়। ফিড গ্রহণ পরিবেশের তাপমাত্রার কারণে পানি গ্রহণের পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। পরিবেশের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে পানির পরিমাণ বেড়ে যায়।
পানির ব্যবস্থাপনা সিস্টেম পরিস্কার করার নিয়ম
ি ট্যাংকের পাইপ এবং মুখ খুলে দিতে হবে।
ি লাইনকে পরিস্কার পানি দিয়ে ধুতে হবে।
ি উপরের ট্রাংকে কোন ময়লা থাকলে তা ঘসে ঘসে পরিষ্কার করে, আবরণ উঠিয়ে বাইরের লাইন দিয়ে পানি বের করে দিতে হবে।
ি ট্রাংকের পানি খালি করার পর পুনরায় বিশুদ্ধ পানি ভর্তি করে। উপযুক্ত পানি পরিশুদ্ধকারী উপকরণ মিশিয়ে দিতে হবে।
ি সঠিক মাত্রায় জীবাণুনাশক মিশিয়ে সকল লাইনে পানি প্রবাহিত করতে দিতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোন বাতাস না থাকে। স্যানিটাইজার উপকরণ ড্রিংকারের মধ্যে গেলে কোন ক্ষতি হবে কিনা জেনে নিতে হবে।
ি উপরের ট্রাংকে স্বাভাবিক ভাবে লাগিয়ে উপযুক্ত জীবাণুনাশক প্রয়োগ করে অন্তত ৪ ঘন্টা রাখতে হবে। প্রয়োজনে পানির ঢাকনা পরিবর্তন করতে হবে
ি জীবাণুনাশক যুক্ত পানি ফেলে দিয়ে পরিষ্কার ফ্রেস পানি দিয়ে ধুয়ে দিয়ে হবে।
ি বাচ্চা উঠানোর পুর্বে ফ্রেস পরিষ্কার পানি পূর্ণ রাখতে হবে।
পানির পাইপের মধ্যে বায়োফ্লিম এর স্তর জমে যায়। এতে করে পানির প্রবাহ কমে। ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমন হতে পারে। নিয়মিত এই ফ্লিম পরিস্কার করার প্রয়োজন হয়। সাধারণত প্লাস্টিক এবং এলকাথেন পাইপে তুলনামূলকভাবে দ্রæত এই স্তর জমা হয়। পানিতে ভিটামিন এবং মিনারেলের ব্যবহার করলে এই স্তর জমার প্রবনতা বাড়ে। শারীরিক চেষ্টার মাধ্যমে সব সময় এই স্তর পরিস্কার করা সম্বব হয়না। ফ্লকের মধ্যে এই বায়োফ্লিমের স্তর দূর করতে বেশি মাত্রায় ক্লোরিন (১৪০ পিপিএম) বা পার অক্সিজেন যৌগ ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে বাচ্চা পানি পান করার পূর্বে বারবার পানি প্রবাহ বাড়িয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
ভিটামিন মিনারেলের পরিমাণ বেশি হলে (ক্যালসিয়াম) অনেক সময় এসিড ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। ধাতব পাইপ ঠিক একইভাবে পরিষ্কার করা হয় কিন্তু রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ছিদ্র হতে পারে।
পানির মান নিয়ন্ত্রণ
পানি কোন অর্গানিক উপাদান বা সন্দেহজন বস্তু মুক্ত হওয়া উচিত। নিয়মিত পর্যাবেক্ষণ করে এই মান এবং জীবাণু মুক্ত কিনা দেখতে হবে। বিশেষত পানি অবশ্যই সিউডোমোনাস এবং ইসচেরিচিয়া কোলাই মুক্ত হতে হবে। পানিতে প্রতি মিলিতে ১টা কলিফর্ম জীবাণুর বেশি হওয়া উচিত নয় এবং যদি প্রতি মিলি পানিতে ৫টার বেশি কলিফর্ম জীবাণু থাকে তবে তা ব্যবহার করা যাবেনা।
পোলট্রির ক্ষেত্রে পানির গুণাগুনের তালিকা টেবিল ২৭ এ দেয়া আছে। যেখানে পানি প্রধান উৎস থেকে সরবারহ হয় সেখানে পানির কোয়ালেটি বা গুণ মোটামুটিভাবে ভাল থাকে। কুপ বা গর্তের পানিতে নাইট্রোটের পরিমাণ এবং ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেশি থাকে। কারণ আবাদী জমি থেকে সার সংক্রমিত হওয়ায় এসবের পরিমাণ বেশি। যে পানিতে ব্যাকটেরিয়ার লোড বেশি সেখানে যতটা সম্ভব পানি পরিশোধিত করতে হবে। ব্যাকটেরিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্লোরিনেশন পদ্ধতিতে ৩-৫ পিপিএম মুক্ত ক্লোরিনের ব্যবহার খুবই কার্যকর। তবে এক্ষেত্রে কোন ক্লোরিন ব্যবহার করা হয় তা লক্ষ্যনীয়।
অতিবেগুনী রশ্মিও পানি জীবাণুমুক্ত করার কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কো¤পানীর নিয়মিত মেনে চলা আবশ্যক।
পানিতে বেশি আয়রণ বা লোহা যাকে (হার্ড ওয়াটারও বলা হয়) থাকলে ড্রিংকারের লাইনে এবং ভালপে বকেজ সৃষ্টি করে। এর তলানী পাইপের মধ্যে ছিদ্র কমিয়ে দেয়। এসব পানিতে ৪০-৫০ মাইক্রোনের ফিলটার বা ছাকুনি ব্যবহার করতে হয়। আয়রণ বেশি পানি ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিতে সহায়তা করে তাই এইসব পানিতে ডিম পরিস্কার করা উচিত নয়।
প্রতিবছরে অন্তত এক বার করে সব পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করা উচিত। আর যেখানে উৎপাদনে ত্রæটি বা পানির সমস্যা সেখানে আরো বেশি ও নিয়মিত পানি পরীক্ষা করা উচিত। শেড পরিস্কার করার পর এবং বাচ্চা উঠানোর পুর্বেই পানির উৎস, ট্রাংক এবং ড্রিংকার পয়েন্টের পানির নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করতে হবে। য়
প্রাণিস¤পদ স¤প্রসারণ কর্মকর্তা (এলডিডিপি), উপজেলা প্রাণিস¤পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল, ভোলাহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ। মোবাইল : ০১৭০২৩৭৮৬৮৭৭, ইমেল : mmrdvm10@gmail.com
কৃষিবিদ মোঃ আলতাফ হোসেন চৌধুরী
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস রোগ প্রথম হানা দেয় চীনের উহান প্রদেশে। বর্তমানে এই রোগটি বৈশ্বিক মহামারী রোগ হিসাবে দেখা দিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই এই রোগটি হানা দিয়েছে। রোগটির প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির চাকা আজ নড়বড়। এই অবস্থা চলতে থাকলে বিশ্ব অর্থনীতির চাকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। বিশ্ব তথা বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরেই কোভিড-১৯ এর থাবা হানা দিয়েছে যা থেকে মৎস্য সেকটরের বাঁচার উপায় নেই।
মাছ চাষ মুলতঃ তিনটি বিষয়ের উপর ওৎপ্রোতভাবে জড়িত, বিষয়গুলো হলোঃ (১) ফিড(খাবার), (২) সিড (পোনা), (৩) ম্যানেজমেন্ট (ব্যবস্থাপনা)। উক্ত বিষয়গুলোর একটির ঘাটতি হলেও মাছচাষ ব্যাহত হয়। তাছাড়াও মাটি ও পানির ভৌত রাসায়নিক গুণাবলী মাছচাষের জন্য বড় নিয়ামক হিসাবে কাজ করে। তাপমাত্রা কম ও ভৌত রাসায়নিক গুণাবলীর সঠিক সমন্বয় মাটি ও পানিতে বিদ্যমান না থাকার কারণে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর সুস্থ্ভাবে বেঁচে থাকা এবং বৃদ্ধি জটিল হয়ে পড়ে। অতীতে প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে ব্যাপক মৎস্য আহরণ সম্ভব ছিল কিন্তু বর্তমানে মনুষ্য সৃষ্টি কারণে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ব্যাপকমাত্রায় হ্রাস পেয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে মাছের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার কারণে চাষের মাছের উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকগুণ। আর অধিক ঘনত্বে মাছচাষ করতে এবং অধিক উৎপাদন লাভের জন্য একদিকে যেমন অধিক পুজির প্রয়োজন তেমনি মাছের রোগ বালাইসহ বিভিন্ন সমস্যাও দেখা যায়। তাই এই মৎস্য সম্পদের ক্ষতি মোকাবেলায় করোনা (কোভিড-১৯) কালীন সময়ে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো ঃ
করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নয়নে প্রাণীজ (মৎস্য) আমিষের ভুমিকা
করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে জয়ী হতে চাইলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নয়ন ঘটাতে চাইলে মাছ ও মৎস্য জাত দ্রব্য শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজন। মৎস্য শিল্পের মাধ্যমে আমরা সহজে মৎস্য প্রোটিনের জোগান দিতে পারি। মাছ এবং মৎস্যজাত এমন একটি খাদ্যদ্রব্য যেখানে অত্যাবশ্যকীয় ্অ্যামাইনো এসিড, ভিটামিন, মিনারেল, ফ্যাট এবং অ্যান্টি অক্রিড্যান্ট বিদ্যমান। শরীরের ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্য প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় মাছ রাখতে হবে। মাছ এমন একটি খাবার যাতে কোনো অরুচি আসে না। সামুদ্রিক মাছে আছে যথেষ্ট মিনারেল এবং খনিজ লবণ যা শরীর গঠনে অতীব জরুরি। তাছাড়াও ভিটামিন বি-৬ রয়েছে যা আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয়তার অর্ধেক পুরন করে এবং সরাসরি লোহিত এবং শ্বেত রক্ত কনিকা তৈরি করে। প্রাণীজ আমিষ না খাওয়ার ফলে শরীর জিংক, কপার ও ভিটামিন বি-৬ কম পাবে এবং শরীর কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারবে না। এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর কোনো টিকা বা ঔষধ আবিষ্কার হয়নি তাই ছোট, বড় বা যে কোনো বয়সের মানুষকে মাছ বা মৎস্য জাত দ্রব্য সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ভক্ষণের মাধ্যমে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে।
কর্মসংস্থানে মৎস্য ও মৎস্যজাত শিল্পের গুরুত্ব
বাংলাদেশে মৎস্য শিল্প একটি ক্রমবিকাশমান শিল্প। মৎস্য অধিদপ্তরের পরিকল্পিত কর্মপরিকল্পনায় বিগত ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৭৩.১৭১ মে.টন মৎস্য ও মৎস্যজাত দ্রব্য পণ্য রপ্তানি করে ৪২৫০ কোটি টাকা আয় হয়েছে। আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনের ৩.৭৫ শতাংশ এবং জাতীয় কৃষিজ উৎপাদনের ২৫.৩০ শতাংশ মৎস্য সেক্টরের অবদান। আমাদের দৈন্দদিন মাথাপিছু ৬০ গ্রাম চাহিদার বিপরীতে মাছ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৬২.৫৮ গ্রামে। মৎস্যখাতে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৬ লক্ষ লোকের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। সে হিসাবে এখাতে বিগত ১০ বছরে প্রায় ৬০ লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
মৎস্য সম্পদে করোনার প্রভাব
করোনা ভাইরাসের কারণে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে লকডাউনের শুরুতে প্রথমেই ধাক্কা খায় মাছের রেণু উৎপাদনকারী খাত। যদিও লকডাউনের প্রভাব মুক্ত রাখা হয়েছে মৎস্য উৎপাদন ও সরবরাহকে তবুও দূরদূরান্তের মৎস্য খামারিদের মাঝে মৎস্য জাত দ্রব্য ও পোনা সরবরাহে জটিলতা দেখা যায়। উৎপাদনের চেয়ে সঠিক মূল্যে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য বিক্রয় জটিল হয়ে পড়ছে। ফড়িয়াদের দৌরাত্বে সঠিক মূল্য পাবে কিনা খামারিরা আতংকে আছেন। বিভিন্ন মিডিয়ায় মনোসেক্স তেলাপিয়া করোনা ছড়ানোর অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। অথচ সারা দুনিয়ায় মনোসেক্স তেলাপিয়া বা মৎস্যজাত দ্রব্য থেকে করোনা ছড়িয়েছে এমন কোনো রেকর্ড নেই। মৎস্য অধিদপ্তর এরই মধ্যে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে খামারিদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে মৎস্য ও মৎস্যজাত দ্রব্য বিক্রয়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। এতে খামারিরা কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে।
করোনা পরিস্থিতিতে করণীয়
* পুকুরের পাড় উঁচুকরণ, পাড়ের সকল রকম গর্ত ও অন্তরমুখী নালা বন্ধ করা যাতে বন্যাসহ অন্যান্য বাইরের পানি পুকুরে প্রবেশ করতে না পারে।
* পুকুরে নলক‚পের অথবা শোধিত পানি সরবরাহ করা, পুকুরের সাথে নদী-নালা, খাল-বিল বা অন্য কোন নর্দমা বা ড্রেন কেটে সংযোগ দেওয়া যাবে না। কারন পানি রোগজীবাণুর একটি অন্যতম প্রধান বাহক।
* রোগমুক্ত এলাকা থেকে সুস্থ ও সবল পোনা লবণ জলে শোধন করার পর মজুদ করা (২.৫% লবণ জলে ২/৩ মিনিট বা সহ্য ক্ষমতা অনুযায়ী ততোধিক সময়ে গোসল করানো)।
* পুকুরে সকল প্রকার বন্য মাছ, পোকামাকড়, কাঁকড়া, সাপ ব্যাঙ ইত্যাদির প্রবেশ রোধ করতে হবে। কারণ এরা বাইরের রোগজীবাণু পুকুরের ভেতরে নিয়ে আসে।
* প্রাকৃতিক জলাশয়, ধানক্ষেত, হাওর, বাঁওড়, বিলের পানিতে কাজ করার পর পুকুরে নেমে হাত-পা বা অন্য কোন সামগ্রী ধৌত করা যাবে না।
* জালসহ অন্যান্য খামার সরঞ্জাম পুকুরে ব্যবহারের পূর্বে জীবাণুমুক্ত করতে হবে( বিøচিং পাউডার, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ইত্যাদি ব্যবহার করে)।
* খামারে/হ্যাচারিতে প্রবেশের পূর্বে খামারকর্মী ও দর্শনার্থীদের পা, জুতা ইত্যাদি জীবাণুমুক্ত করা উচিত
* (বিøচিং পাউডার দ্রবণে)।
* রোগের যাবতীয় বাহক (ঈধৎৎরবৎ) যেমন- পানি, বন্যামাছ, মানুষ, গরু, ছাগল, পাখি, পোকা-মাকড় ইত্যাদি দ্বারা রোগ ছড়ানোর ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।
* খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রীর মূল্য কৃষকদের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখার জন্য ভর্তুকি প্রদান করা যেতে পারে।
* করোনা কালীন সময়ে মৎস্য অধিদপ্তরের যেসব কর্মকর্তা এবং কর্মচারী মাঠ পর্যায়ে সক্রিয় থেকে সরকারি দায়িত্ব পালন করছেন তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
* আমিষ খাওয়ার বিষয়ে স্যোসাল মিডিয়ায় প্রচারিত বিভিন্ন নেতিবাচক প্রচারণার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
* কোভিড -১৯ এর পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষতিগ্রস্থ প্রান্তিক খামারিদের স্বল্পসুদে ব্যাংকঋণ এর ব্যবস্থা করতে হবে এবং খামারিদের প্রণোদনার টাকা ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে দিতে হবে।
বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার কৃষি সেক্টরের মতো মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতেও প্রণোদনার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। আশা করা যায় খুব দ্রæত বাস্তবায়ন হবে। য়
খামার ব্যবস্থাপক, মৎস্যবীজ উৎপাদন খামার, গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা, Email: Chowdhari_33@yahoo.co, মোবাইল : ০১৭১২৪০৮৩৫৩
জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃষিতে করণীয়
ড. মোঃ আলতাফ হোসেন১
পরিবর্তিত এই পৃথিবীতে পরিবর্তনের অন্ত নাই
‘জলবায়ু পরিবর্তন’ তাদের মধ্যে অন্যতম ভাই।
দীর্ঘমেয়াদি (৩০-৭০ বৎসর) আবহাওয়ার গড়কে জলবায়ু বলা হয়
যার মধ্যে তাপমাত্রা, বায়ু প্রবাহ ও বৃষ্টিপাত প্রধানত অন্তর্ভুক্ত রয়।
জলবায়ু পরিবর্তন একটি নিয়মিত প্রাকৃতিক ঘটনা
মানবসৃষ্ট কর্মকাÐে ত্বরান্বিত হচ্ছে এর পরিবর্তনের রচনা।
আধুনিকতায় বাড়ছে নগরায়ন, যান্ত্রিক সভ্যতা ও শিল্প-কারখানার চাপ
সেই চাপ সামলাতে পুড়ছে- অধিক জ্বালানি, হচ্ছে বৃক্ষ নিধন- বাপরে বাপ!
বায়ু মন্ডলে ঈঙ২সহ গ্রীন হাউজ গ্যাসের ঘনত্ব বাড়ছে আধুনিক সভ্যতার কর্মকাÐে
এসব গ্যাসের ঘনত্বের প্রভাবে পৃথিবী হচ্ছে উত্তপ্ত ক্রমবর্ধমান তাপে।
গ্রীন হাউজ গ্যাস পৃথিবীর তাপকে উপরে যেতে দেয় না
আর সেই তাপ উপরে যেতে না পেরে ধরে অনেক বায়না।
সেই বায়নায় বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে জলবায়ু হচ্ছে পরিবর্তিত
আর সেজন্য বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরা হচ্ছি সর্বদাই আবর্তিত।
অসময়ে বৃষ্টি, আকস্মিক বন্যা, জলাবদ্ধতা ও খরা-জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠাÐা-গরম, সাইক্লোন এবং ঝড় ও জলোচ্ছাসের প্রাদুর্ভাব।
মোকাবেলা করে এসব দুর্যোগ ফলাতে হবে প্রয়োজনীয় সব ফসল
উদ্ভাবন করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনেও ফসল উৎপাদনের নতুন কৌশল।
আগাম বন্যাপ্রবণ এলাকায় চাষ করুন স্বল্পমেয়াদি বোরো ধান
বন্যাপ্রবণ নিচু এলাকায় জলমগ্নতা সহনশীল ধান চাষ করে যান।
অতি নিচু ও নিচু জলাবদ্ধ জমিতে ভাসমান বেডে সবজি ও মসলার চাষ করা যায়
বন্যা কবলিত এলাকায় ধানের চারাও করতে পারবেন ভাসমান বীজ তলায়।
হাওর এলাকায় চাষ করুন স্বল্পমেয়াদির বিফসলসহ ভুট্টা ও গম
বন্যাপ্রবণ চর এলাকায় ডালফসল, মিষ্টিকুমড়া ও বাদাম- অভিযোজন সক্ষম।
খরাপ্রবণ এলাকায় করতে হবে স্বল্পমেয়াদী আমন ও আউশ ধানের চাষ
বসত ভিটায় করুন সবজি আর জ্বালানী সাশ্রয়ী চুলার ব্যবহার বার মাস।
সাশ্রয় করে জ্বালানী- কৃষি উচ্ছিষ্ট দিয়ে করতে হবে কম্পোস্ট ও মাল্চিং
মিতব্যয়ী পানি সেচ আর উৎপাদন করতে হবে ফসল- কম চাষ বা চাষ বিহীন।
মিনিপুকুর খনন করে আমন ধানের কাক্ষি ফলন পেতে দিতে হবে সেচ
সেই সাথে পুকুর পাড়ে সবজি আর পুকুরে মাছ চাষ করা যাবে বেশ!
আমন ধান কাটার পর জমিতে রস থাকতেই করতে হবে ডাল বা তেল ফসলের চাষ
এসব এলাকায় করা যাবে মসলা ও সবজির চাষ, ছাঁটায় করে-খরাসহিষ্ণু কুল গাছ।
উপক‚লীয় লবণাক্ততাপ্রবণ এলাকায় করতে হবে লবণাক্ততা সহনশীল ধানের চাষ
সর্জান পদ্ধতিতে উঁচু বেডে চাষ করে পাওয়া যাবে সবজি ও ফল- বারমাস।
মাল্চিং পদ্ধতি ব্যবহার ও জমিতে গভীরভাবে চাষ করে উপরে লবণ আসা করা যাবে নিয়ন্ত্রণ
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে জমিতে মিনিপুকুর খনন করে শুষ্ক মৌসুমেও ফসলে দেয়া যাবে সেচন।
অবলম্বন করে বর্ণিত কলাকৌশল মোকাবেলা করা যাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
আশা করি কৃষির অগ্রগতি অদম্যই থাকবে, হবেনা কখনো কৃষিপণ্যসহ খাদ্যের অভাব। য়
১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কীটতত্ত¡ বিভাগ, ডালগবেষণা কেন্দ্র, ঈশ্বরদী, পাবনা। মোবাইলনং- ০১৭২৫-০৩৪৫৯৫, ই- মেইল : hossain.draltaf@gmail.com.
ফল
ড. খান মো. মনিরুজ্জামান২
ফল খেলে বল বাড়ে,
জ্ঞান বুদ্ধির জট ছাড়ে।
চেহারা যে দৃষ্টি কাড়ে,
গুরুত্ব বুঝি হাড়ে হাড়ে।
ফল খেয়ে পাব ফল,
ফল খেয়ে খাবনা জল।
খাবারে নীতি কৌশল,
ফলাহারেই বুদ্ধি বল।
ফল খেয়ে পোয়াবারো,
সন্দেহ নেই তাতে কারো।
পরিমিত খেতে পারো,
ফল কিনে ধারে ধারো।
তাল, বেল, আতা, আম,
কলা, চেরি, লিচু, জাম।
এসব ফল নয়নাভিরাম।
উপাদেয় খেয়ে কি আরাম!
সফেদা, কাঁঠাল, ড্রাগন,
পেয়ারা, পেঁপে, পার্সিমন।
খেলে সতেজ হয় জীবন।
স্বাদে, গুণে মানিক রতন।
আমলকী, আমড়া, ডেফল,
আনারস, আতা, আঁশফল।
কামরাঙা, কুল, পানিফল।
ম্যাঙ্গোস্টিন গাব অবিকল।
ডুংকর, বিলিম্বি, চালতা,
শরিফা, ডেউয়া, আতা।
স্ট্রবেরি, লটকনের কথা,
ফল টক, মিষ্টি, তিতা।
ফলে বৃক্ষের পরিচয়,
জয় পরাজয় নির্ণয়।
প্রচেষ্টায় ফল সমন্বয়।
ফল খেয়ে ভালো ফল হয়। য়
২জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার, ডিএই, ঝিনাইদহ। মোবাইলনং- ০১৭১২-৮২২৭৪৯, ই- মেইল : dr.md.monir7@gmail.com
কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন
কৃষি বিষয়ক
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
মোঃ করিম মÐল, গ্রাম: বুন্দুলিতলা, উপজেলা: চৌগাছা, জেলা: যশোর
প্রশ্ন: কচি ডাবের বোঁটার কাছে আঁচড় কেটেছে দেখা যাচ্ছে এবং কাটা কাটা ভাবও মনে হচ্ছে। এখন এ সমস্যায় কী করব। জানালে উপকৃত হবো।
উত্তর: এ ধরনের সমস্যা নারকেল গাছে মাকড়ের আক্রমণ হলে হয়ে থাকে। এজন্য ফুট পাম্পের সাহায্যে অনুমোদিত মাকড়নাশক যেমন-ভার্টিমেক ওমাইট প্রতিলিটার পানিতে ১.৫ মিলি. মিশিয়ে ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করলে আপনি উপকার পাবেন। এছাড়া বর্ষার আগে ও পরে নারকেল গাছের বয়স অনুযায়ী সুষম সার প্রয়োগ করলে আপনি কাক্সিক্ষত ফলন পাবেন।
মোছাঃ সুলতানা ইয়াছমীন, গ্রাম: দক্ষিণ পাতাকাটা, উপজেলা: বরগুনা সদর, জেলা: বরগুনা
প্রশ্ন: পানের বরে পাতায় প্রথমে ছোট ছোট পানিভেজা দাগ পড়ে। আস্তে আস্তে দাগগুলো বড় হয় এবং পানের বাজার দর কমে যায়। কী করব?
উত্তর: পানের পাতায় এ ধরনের সমস্যা হলে এ রোগকে পানের পাতায় দাগ পড়া রোগ বলে। কলেটোট্রিকাম নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। এ রোগে আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলতে হয়। যদি আক্রমণ বেশি পরিমাণে হয়ে থাকে তবে কপার জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন-অক্সিভিট ৪ গ্রাম প্রতিলিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ২ থেকে ৩বার স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যাবে।
মো. ময়েজ উদ্দীন, গ্রাম: লক্ষীরপাড়, উপজেলা: বিশ্বম্ভপুর, জেলা: সুনামগঞ্জ
প্রশ্ন: শিমের গায়ে বাদামি-কালো রঙের কালো দাগ পড়ে এবং শিমগুলো পচে যাচ্ছে। কি করলে উপকার পাবো?
উত্তর: শিমের গায়ে বাদামি-কালো রঙের দাগ পড়ে শিম পচে যায় এ্যানথ্রাকনোজ রোগের জীবাণু আক্রমণ করলে। এ সমস্যার সমাধানে প্রপিকোনাজল গ্রæপের যেমন টিল্ট ১ মিলিলিটার ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করলে সুফল পাবেন। কিংবা কার্বেনডাজিম গ্রæপের যেমন টপসিন ২ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে শিম গাছে বিকেল বেলা স্প্রে করলে ভালো ফলাফল পাবেন। এছাড়া এ রোগ প্রতিরোধে রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা প্রয়োজন। আর শিম গাছ ও বাগানকে সবসময় পরিচ্ছন্ন রাখলে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ অনেক কমে যাবে। আর অনেক বেশি ফলনও পাওয়া যাবে।
মোছাঃ কবিতা বেগম, গ্রাম: মৌতলা, উপজেলা: কালিগঞ্জ, জেলা: সাতক্ষীরা
প্রশ্ন: নারিকেলের ছোট ফলগুলো ঝরে পড়ছে। ঝরা ফলগুলোর মুখ কালো। কী করবো?
উত্তর: নারিকেল গাছের ফল ঝরে পড়ে যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমওপি বা পটাশ সারের অভাবে। সে কারণে নারিকেল গাছের বয়স জেনে সুষম মাত্রার সার প্রয়োগ করতে হয়। সেক্ষেত্রে ১-৪ বছর বয়সী গাছের জন্য গোবর ১০ কেজি, ইউরিয়া ২০০ গ্রাম, টিএসপি ১০০ গ্রাম, এমওপি ৪০০ গ্রাম, জিপসাম ১০০ গ্রাম, জিংক সালফেট ৪০ গ্রাম, বরিক এসিড ১০ গ্রাম গাছের গোড়া থেকে চারদিকে ৩ ফুট বাদ দিয়ে মাটি কুপিয়ে ৮-১২ ইঞ্চি মাটির গভীরে সারগুলো প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগ করতে হয় দুইকিস্তিতে। প্রথম কিস্তিতে অর্ধেক সার মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য জ্যৈষ্ঠ (মে) এবং দ্বিতীয় কিস্তিতে বাকি অর্ধেক সার মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য আশ্বিন (সেপ্টেম্বর) মাসে। নারিকেল গাছের বয়স ৫-৭ বছর ও ৮-১০ বছর বয়স হলে ১-৪ বছর বয়সী নারিকেল গাছের সারের মাত্রাকে ২ ও ৩ গুণ করে নিয়মমাফিক প্রয়োগ করলেই কাক্সিক্ষত ফলন পাবেন। নারিকেল গাছের ঝরা ফলগুলো কালো হয় মাকড় বা মাইটের কারণে। সেজন্য ভালো হয় এবামেকটিন গ্রæপের যেকোন ভালোমানের মাকড়নাশক আক্রান্ত নারিকেল গাছে সঠিক নিয়মে প্রয়োগ করা।
মোঃ কমল পাটোয়ারী গ্রাম: খাটুরিয়া, উপজেলা: গোবিন্দগঞ্জ, জেলা: গাইবান্ধা
প্রশ্ন: কামরাঙা ফল পচে যায় এবং গাছের পাতাও ঝরে পড়ে। কি করণীয়?
উত্তর: কামরাঙা গাছের পাতা ও ফলে এ্যানথ্রাকনোজ রোগের আক্রমণে এ ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। এ রোগটি ছত্রাকের আক্রমণে হয়ে থাকে। এ রোগ হলে পাতা, ফুল ও ফলে ছোট ছোট বাদামি দাগ পড়ে এবং দাগগুলো আস্তে আস্থে বড় হয়ে কালো রঙ ধারণ করে এবং আক্রান্ত স্থান পচে যায়। এ রোগ দমনে আক্রান্ত পাতা, ফুল ও ফল সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আর রোগ দেখা দিলে কার্বেনডাজিম গ্রæপের ব্যাভিস্টিন বা নোইন ৫ ডবিøউপি প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০ থেকে ১৫ দিন অন্তর ২ বা ৩ বার সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যাবে।
মোঃ রহিম বেপারী, গ্রাম: সুরগ্রাম, উপজেলা: গোপালগঞ্জ সদর, জেলা: গোপালগঞ্জ
প্রশ্ন: জলপাই ফলে দাদের মতো খসখসে দাগ পড়ে। বাজারে কম দাম পাই। সমস্যার সমাধান জানাবেন।
উত্তর: জলপাই গাছের গোড়ার মাটিতে বোরন নামক পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি হলে জলপাই ফলের গায়ে দাদের মতো খসখসে দাগ পড়ে। আর এতে করে ফলের উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে যায় এবং বাজারে দামও কম পাওয়া যায়। এ সমস্যা প্রতিকারে বর্ষার শেষ দিকে গাছপ্রতি ৫০ গ্রাম হারে বরিক এসিড বা ১০০ গ্রাম হারে বোরাক্স প্রয়োগ করতে হবে। এসব ব্যবস্থা নিলে আপনি উপকার পাবেন।
মৎস্য বিষয়ক
লোকমান মজুমদার, গ্রাম: লখাইডাঙ্গা, উপজেলা: মণিরামপুর, জেলা: যশোর
প্রশ্ন: রুই মাছে সাদা দাগ রোগ হয়েছে। কি করলে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাবো?
উত্তর: এ রোগে মাছের পাখনা, কানকো ও দেহের উপর সাদা দাগ দেখা যায়। মাছের ক্ষুধামন্দা এবং দেহের স্বাভাবিক পিচ্ছিলতা লোপ পেয়ে খসখসে হয়ে যায়। ইকথায়োপথেরিয়াস প্রজাতি এ রোগের কারণ। এ রোগ প্রতিকারে ১ পিপিএম তুঁতে পানিতে গোসল দেয়া কিংবা শতকরা ২.৫ ভাগ লবণ পানিতে কয়েক মিনিটের জন্য রাখা যতক্ষণ পর্যন্ত মাছ লাফিয়ে না পড়ে। এছাড়া এ ধরনের রোগ যাতে না হয় সেজন্য শামুকজাতীয় প্রাণী পুকুর থেকে সরিয়ে ফেলা। শতকরা ২.৫ ভাগ লবণ পানিতে ৫-৭ মিনিট গোসল দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে পোনা মজুদ করতে হয়। তাছাড়া রোদে শুকনা জাল পুকুরে ব্যবহার করাও দরকার। আরেকটি বিষয় অনুসরণীয় সেটি হলো মাছের স্বাভাবিক সংখ্যা বজায় রেখে অতিরিক্ত মাছ সরিয়ে নেয়া।
মোঃ মহব্বত আলী, গ্রাম: সাটুরিয়া, উপজেলা: ডোমার, জেলা: নীলফামারী
প্রশ্ন: চিংড়ি মাছের নরম ও স্পেঞ্জের মতো দেহের কারণ ও এ সমস্যার প্রতিকার বিষয়ে জানতে চাই।
উত্তর: পানিতে ক্যালসিয়াম কমে গেলে, এ্যামোনিয়া ও তাপমাত্রা বেড়ে গেলে, পুষ্টিকর খাদ্য কমে গেলে এবং পানির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে গেলে এ সমস্যা দেখা দেয়। আর এ রোগে চিংড়ির খোলস নরম হয়ে যায়। উপর থেকে চাপ দিলে নিচে ডেবে যায়। খোলস ও মাংসের মধ্যে ফাঁক সৃষ্টি হয়। এ সমস্যার সমাধানে মজুদ ঘনত্ব কমিয়ে পুকুরে অন্তত ৫০% পানি বদল করা। পুকুরে ২ থেকে ৩ মাস অন্তর চুন প্রয়োগ এবং পুকুরে সার ও খাদ্য প্রয়োগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এসব ব্যবস্থা নিলে আপনি উপকার পাবেন।
প্রাণিসম্পদ বিষয়ক
মোঃ রহিম মিয়া, গ্রাম: জলিশা, উপজেলা: দুমকি, জেলা: পটুয়াখালী
প্রশ্ন: আমার বাছুরের বয়স ১৫ দিন। নাভী ফুলে গেছে। জ্বর আছে, নাভীতে পুঁজ হয়েছে। এমতাবস্থায় কী করণীয় ?
উত্তর: নাভীর ক্ষতস্থান টিংচার-আয়োডিন দ্বারা পরিষ্কার করতে হবে। নাভী পেকে গেলে একটু কেটে সম্পূর্ণ পুঁজ বের করে ফেলতে হবে। পরে জীবাণুনাশকযুক্ত পানি দ্বারা পরিষ্কার করে কাটা জায়গার মধ্যে টিংচার আয়োডিনযুক্ত গজ ঢুকাতে হবে। একদিন পরপর এইভাবে পরিষ্কার করে গজ ঢুকাতে হবে। এছাড়া পেনিসিলিন অথবা স্ট্রেপটোমাইসিন ইনজেকশন দিতে হবে।
মোছাঃ শবনম বেগম, গ্রাম: সারানপুর, উপজেলা: গোদাগাড়ী, জেলা: রাজশাহী
প্রশ্ন: গরুর গা খসখসে এবং ঘা হচ্ছে। এ অবস্থায় কী করণীয়?
উত্তর: ইনজেকশন ভারমিক প্রতি ২৫ কেজি গুরুর দেহের ওজনের জন্য ১ সিসি ১ বার চামড়ার নিচে পুশ করতে হবে। যদি সমস্যাটি বেশি হয় তবে ৭ দিন পর বুস্টার ডোজ আবারও ১ বার দিতে হবে। এছাড়া ইনজেকশন অ্যাসটাভেট ১০০ কেজি গরুর দেহের ওজনের জন্য ৫ সিসি. করে দৈনিক ১ বার ৩ থেকে ৫ দিন মাংসে পুশ করতে হবে এবং ইনজেকশন অ্যামক্সিভেট ১ ভায়েল করে রোজ ১ বার ৩ দিন মাংসে পুশ করতে হবে। এসব ব্যবস্থা নিলে আপনার গরুর সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
(মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক প্রশ্ন কৃষি কল সেন্টার হতে প্রাপ্ত) য়
উপপ্রথান তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ মোবাইল: ০১৭১১১১৬০৩২, ইমেল :taufiquedae25@gmail.com
(১৬ আগস্ট-১৫ সেপ্টেম্বর)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, নীল আকাশে সাদা মেঘ ও কাশফুলের ঋতু শরতের শুভেচ্ছা। এ সময় বর্ষার পানিতে সারাদেশ টইটুম্বুর থাকে, সাথে ঝরে অঝোর বৃষ্টি। সেজন্য কৃষিতে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি। করোনা পরিস্থিতিতে ও খাদ্য সংকট মোকাবেলায় কৃষির এ ক্ষতি মোকাবেলায় আমাদের নিতে হবে বিশেষ ব্যবস্থাপনা। কৃষির ক্ষতিটাকে পুষিয়ে নেয়া এবং প্রয়োজনীয় কাজগুলো যথাযথভাবে শেষ করার জন্য ভাদ্র মাসে কৃষিতে করণীয় বিষয়গুলো জেনে নেবো সংক্ষিপ্তভাবে ।
আমন ধান
আমন ধান ক্ষেতের অন্তর্বর্তীকালীন যতœ নিতে হবে। ক্ষেতে আগাছা জন্মালে তা পরিষ্কার করে ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। আমন ধানের জন্য প্রতি একর জমিতে ৮০ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োজন হয়। এ সার তিনভাগ করে প্রথম ভাগ চারা লাগানোর ১৫-২০ দিন পর, দ্বিতীয় ভাগ ৩০-৪০ দিন পর এবং তৃতীয় ভাগ ৫০-৬০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে। নিচু জমি থেকে পানি নেমে গেলে এসব জমিতে এখনো আমন ধান রোপণ করা যাবে। দেরিতে রোপণের জন্য বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রি ধান৪৬, বিনাশাইল, নাইজারশাইল বা স্থানীয় উন্নত ধান বেশ উপযোগী। দেরিতে চারা রোপণের ক্ষেত্রে প্রতি গুছিতে ৫-৭টি চারা দিয়ে ঘন করে রোপণ করতে হবে। আমন মৌসুমে মাজরা, পামরি, চুঙ্গী, গলমাছি পোকার আক্রমণ হতে পারে। এছাড়া খোলপড়া, পাতায় দাগ পরা রোগ দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে নিয়মিত জমি পরিদর্শন করে, জমিতে খুঁটি দিয়ে, আলোর ফাঁদ পেতে, হাতজাল দিয়ে পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাছাড়া সঠিক বালাইনাশক সঠিক মাত্রায়, সঠিক নিয়মে, সঠিক সময় শেষ কৌশল হিসাবে ব্যবহার করতে হবে।
পাট
বন্যায় তোষা পাটের বেশ ক্ষতি হয়। এতে ফলনের সাথে সাথে বীজ উৎপাদনেও সমস্যা সৃষ্টি হয়। বীজ উৎপাদনের জন্য ভাদ্রের শেষ পর্যন্ত দেশি পাট এবং আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত তোষা পাটের বীজ বোনা যায়। বন্যার পানি উঠে না এমন সুনিষ্কাশিত উঁচু জমিতে জো বুঝে লাইনে বুনলে প্রতি শতাংশে ১০ গ্রাম আর ছিটিয়ে বুনলে ১৬ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। জমি তৈরির সময় শেষ চাষে শতকপ্রতি ২৭০ গ্রাম ইউরিয়া, ৪০০ গ্রাম টিএসপি, ১৬০ গ্রাম এমওপি সার দিতে হবে। পরবর্তীতে শতাংশপ্রতি ইউরিয়া ২৭০ গ্রাম করে দুই কিস্তিতে বীজ বপনের ২০-২৫ দিন এবং ৪০-৪৫ দিন পর জমিতে দিতে হবে।
আখ
এসময় আখ ফসলে লালপচা রোগ দেখা দিতে পারে। লালপচা রোগের আক্রমণ হলে আখের কাÐ পচে যায় এবং হলদে হয়ে শুকিয়ে যেতে থাকে। এজন্য আক্রান্ত আখ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং জমিতে যাতে পানি না জমে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া রোগমুক্ত বীজ বা শোধন করা বীজ ব্যবহার করলে অথবা রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করলে লালপচা রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। লালপচা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন কয়েকটি আখের জাত হচ্ছে ঈশ্বরদী ১৬, ঈশ্বরদী ২০, ঈশ্বরদী ৩০।
তুলা
ভাদ্র মাসের প্রথম দিকেই তুলার বীজ বপন কাজ শেষ করতে হবে। বৃষ্টির ফাঁকে জমির জো অবস্থা বুঝে ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করে বিঘা প্রতি প্রায় ২ কেজি তুলা বীজ বপন করতে হয়। লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ৬০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ৩০ থেকে ৪৫ সেন্টিমিটার বজায় রাখতে হয়। তুলার বীজ বপনের সময় খুব সীমিত। হাতে সময় না থাকলে জমি চাষ না দিয়ে নিড়ানি বা আগাছা নাশক প্রয়োগ করে ডিবলিং পদ্ধতিতে বীজ বপন করা যায়। বীজ গজানোর পর কোদাল দিয়ে সারির মাঝখানের মাটি আলগা করে দিতে হবে। সমতল এলাকার জন্য সিবি-৯, সিবি-১২, হীরা হাইব্রিড রূপালী-১, ডিএম-২, ডিএম-৩ অথবা শুভ্র জাতের চাষ করতে পারেন। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড়ি তুলা-১ এবং পাহাড়ি তুলা-২ নামে উচ্চফলনশীল জাতের তুলা চাষ করতে পারেন।
শাকসবজি
ভাদ্র মাসে লাউ ও শিমের বীজ বপন করা যায়। এজন্য ৪-৫ মিটার দূরে দূরে ৭৫ সেমি. চওড়া এবং ৬০ সে.মি গভীর করে মাদা বা গর্ত তৈরি করতে হবে। এরপর প্রতি মাদায় ২০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম টিএসপি এবং ৭৫ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। মাদা তৈরি হলে প্রতি মাদায় ৪-৫টি বীজ বুনে দিতে হবে এবং চারা গজানোর ২-৩ সপ্তাহ পর দুই-তিন কিস্তিতে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৭৫ গ্রাম এমওপি সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এ সময় আগাম শীতকালীন সবজি চারা উৎপাদনের কাজ শুরু করা যেতে পারে। সবজি চারা উৎপাদনের জন্য উঁচু এবং আলো বাতাস লাগে এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে। এক মিটার চওড়া এবং জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বাকরে বীজতলা করে সেখানে উন্নতমানের ও উন্নতজাতের উচ্চফলনশীল ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, টমেটো এসবের বীজ বুনতে পারেন। বীজতলার মাটি অবশ্যই শুকনো হতে হবে। অন্যথায় গোড়া ও মূল পচা রোগে সব চারা পচে যেতে পারে।
গাছপালা
ভাদ্র মাসেও ফলদবৃক্ষ এবং ঔষধি গাছের চারা রোপণ করা যায়। বন্যায় বা বৃষ্টিতে মৌসুমের রোপিত চারা নষ্ট হয়ে থাকলে সেখানে নতুন চারা লাগিয়ে শূন্যস্থানগুলো পূরণ করতে হবে। এছাড়া এবছর রোপণ করা চারার গোড়ায় মাটি দেয়া, চারার অতিরিক্ত এবং রোগাক্রান্ত ডাল ছেঁটে দেয়া, বেড়া ও খুঁটি দেয়া, মরা চারা তুলে নতুন চারা রোপণসহ অন্যান্য পরিচর্যা করতে হবে। ভাদ্র মাসে আম, কাঠাল, লিচু গাছ ছেঁটে দিতে হয়। ফলের বোঁটা, গাছের ছোট ডালপালা, রোগাক্রান্ত অংশ ছেঁটে দিলে পরের বছর বেশি করে ফল ধরে এবং ফলগাছে রোগও কম হয়।
প্রাণিসম্পদ
ভাদ্র মাসের গরমে পোলট্রি শেডে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করতে হবে। টিনশেডে চটের ছালা রেখে মাঝে মাঝে পানি দ্বারা ভিজিয়ে দিতে হবে। যাতে করে অধিক গরমে মুরগিগুলো মারা না যায় এবং নানা রোগের বিস্তার না ঘটে। ভেজা আবহাওয়া ও মাঝে মাঝে গরম পোলট্রির ক্ষেত্রে গামবোরো রোগের সংক্রমণ বৃদ্ধি করে। এ রোগে মুরগির পালক নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। গা গরম ও কাঁপুনি দেখা দেয়। সাদা পানির মতো পাতলা পায়খানা দেখা যায়। মুরগি সহজে নড়ে না। এমনিতে ভাইরাসজনিত এ রোগের কোন চিকিৎসা নেই। এজন্য আগে থেকেই সতর্ক থাকতে হবে ও রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ মাসে হাঁস-মুরগির বাচ্চা ফুটানো যেতে পারে। এ মাসে ফুটানো মোরগ-মুরগির বাচ্চার ককসিডিয়া রোগ হতে পারে এদের চিকিৎসা করাতে হবে।
বাংলাদেশে গোখাদ্যের সমস্যা এখনও বিরাজমান। সে কারণে পতিত জমিতে নেপিয়ার, বাজরা, খেসারি, মটর, ইপিল ইপিল, গিনি ঘাস লাগানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা দুধবতী গাভী পালন এবং যারা গরু মোটাতাজাকরণ করবেন, তাদের অবশ্যই গবাদিপশুকে সুষম খাবার সরবরাহ করতে হবে। কোন জায়গায় যদি পানি জমে থাকে সে এলাকায় জন্মানো ঘাস গবাদিপশুকে খাওয়ানো যাবে না। কারণ এতে গাভী বা গরুর রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। গরু ও ছাগলকে নিয়মিত গোসল করার ব্যবস্থা করতে হবে। গোয়াল ঘরের গোবর নিয়মিত পরিষ্কার করা দরকার। আর গরুর গায়ের আঠালি, মাছি, জোঁক পোকামাকড় বেছে দিতে হবে। তড়কা, বাদলা, গলাফুলা রোগ যাতে না হয় সেজন্য উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বা ভেটেরিনারি সার্জনের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
পুকুরে সার ব্যবহারের মাত্রা আস্তে আস্তে কমিয়ে ফেলতে হবে। জৈবসার ব্যবহার না করাই ভালো। খাদ্য ঘাটতির জন্য পরিমাণ মতো অজৈব সার ব্যবহার করা দরকার। পুকুরে পর্যাপ্ত আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
পুকুরে নতুন মাছ ছাড়ার সময় এখন। মাছ ছাড়ার আগে পুকুরের জলজ আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। পুকুর জীবাণুমুক্ত করে সঠিক সংখ্যক সুস্থ সবল পোনা মজুদ করতে হবে। যেসব পুকুরে মাছ আছে সেসব পুকুরে জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা দরকার। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি-পুকুরে পাঙ্গাশ মাছের চাষ, ধান ক্ষেতে মাছ চাষ, প্লাবিত এলাকায় ঘেরের মাধ্যমে রাজপুঁটি ও চিংড়ির চাষ, পুকুরে রুই জাতীয় ও চিংড়ির মিশ্র চাষ এবং প্লাবিত এলাকায় খাঁচায় মাছ চাষ করা যেতে পারে। বন্যার কারণে ভেসে যাওয়া পুকুরের মাছ পুকুরে রাখতে ভেসে যাওয়া পুকুরগুলোর ১৫ থেকে ২০ মিটার দূরত্বে একটি চটের ব্যাগে ৫ থেকে ৭ কেজি ধানের কুড়া বা গমের ভুসি ৫০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার পানির নিচে একটি খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। তবে ব্যাগটিতে অবশ্যই ছোট ছোট ছিদ্র করে দিতে হবে। খাবার পেয়ে মাছ পুকুরেই অবস্থান করবে। কোন কারণে পুকুরের পানি যদি দূষিত হয় তবে ভাইরাস, ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে মাছের ক্ষত রোগ দেখা দিতে পারে। প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে দেহের ভারসাম্যহীনতা, শরীরে লাল দাগ দেখা যায়। পরে মাছ ক্ষতরোগে মারা যায়। এ রোগ প্রতিকারে অধিক আক্রান্ত মাছ উঠিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। প্রতি শতক পুকরে ১ কেজি চুন ও ১ কেজি লবণ প্রয়োগ করতে হবে। ছোট ও ব্রæড মাছের জন্য প্রতি কেজি খাদ্যের সাথে ৬০ থেকে ১০০ মিলি গ্রাম টেরামাইসিন মিশিয়ে মাছকে খাওয়ানো যেতে পারে।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, বৃষ্টিভেজা প্রকৃতি এখন সবুজ শ্যামলিমায় ভরপুর। সে সাথে পরিবর্তিত জলবায়ু ফলে বন্যা, প্লাবন, বৈশ্বিক করোনাও আমাদের নিত্য সহচর। তাই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে সবসময়। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা আমাদের কৃষিকে নিয়ে যাবে সাফল্যের দারপ্রান্তে। সবার জন্য নিশ্চিত সফল কৃষি উৎপাদন কামনা করে এ মাসের কৃষি এখানেই শেষ করলাম। য়
সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, টেলিফোন:০২৫৫০২৮৪০৪, ই-মেইল : editor@ais.gov.bd
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। তিনি প্রতিটি বাড়ির আনাচে কানাচে বিভিন্ন ধরনের ফল ও সবজি দিয়ে ভরিয়ে ফেলার নির্দেশনা দিয়েছেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় মাননীয় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, ‘যদিও আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে, তথাপি সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং কৃষক ভাইদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ১০ বছরে কৃষি খাতে ৩.৭ শতাংশ গড় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।’ আর করোনা পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে বিশ্ব এখন মন্দার যুগে প্রবেশ করেছে তাই আমাদের পরিকল্পিত কৃষির ওপর বেশি নজর দিতে হবে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবজাতি সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পড়েছে। তাই সারা বিশ্বের মতো অর্থনৈতিক সংকটে পড়ার প্রবল ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশেরও। যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ তিনটি ধরা যায় যা কৃষি, পোষাক রপ্তানি এবং প্রবাসি শ্রমিক খাত। আইএমএফ এরই মধ্যে জানিয়েছে দেশের অর্থনীতির বড় দুই খাত পোশাক রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে ক্ষতিটা হচ্ছে বেশি। তাই কৃষিই এখন প্রধান হাতিয়ার এদেশকে সামনে নিয়ে যেতে।
এই পরিস্থিতিতে আমাদের বসতবাড়িতে শাকসবজি, ঔষধি ও ফলমূল তৈরিতে নজর দিতে হবে। কারণ খাদ্য বিজ্ঞানীরা একজন প্রাপ্ত বয়স্কের জন্য প্রতিদিন ৪০০ গ্রাম ফল-সবজি খাবার পরামর্শ দেন। এর মধ্যে শাকপাতা ১১০ গ্রাম, ফুল-ফল-ডাঁটা জাতীয় সবজি ৮৫ গ্রাম, মূল জাতীয় ৮৫ গ্রাম ও ফল ১১০ গ্রাম ধরা হয়েছে। দেশে ১ কোটি ৯৪ লাখ বসতবাড়ির আওতাধীন প্রায় ৪৫ লাখ হেক্টর জমি রয়েছে। এখনও মোট উৎপাদিত ফলের প্রায় ৫৩ শতাংশ ফল বাণিজ্যিক বাগান থেকে উৎপাদিত হয়, বাকি ৪৭ শতাংশ ফলের জোগান আসে বসতবাড়ি ও তৎসংলগ্ন জমি থেকে। কাজেই ফলসমৃদ্ধ দেশ গড়তে দুই জায়গাতেই ফল চাষে জোর দিতে হবে। বিগত ৫ বছরে আমের বাণিজ্যিক বাগান ও উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। নিরাপদ ফল উৎপাদনে এখনও বসতবাড়িতে ফল চাষ পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
বসত বাড়িতে চাষাবাদের সুবিধা হচ্ছে-বসতবাড়িতে পরিকল্পিত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফলদ, মসলা, সবজি ও ঔষধি বাগান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পারিবারিক খাদ্য, পুষ্টি ও আয় বৃদ্ধি করা যাতে পরিবারের সব সদস্যের শ্রম বিমেষ করে মহিলাদের শ্রম উৎপাদন কাজে লগিয়ে স্ব-কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করা। এছাড়া সম্পদের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার করে পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা যায়। অল্প পরিমাণ জমিতে অনেক ধরনের সবজি ও ফল আবাদ করা যায়। সবজি আবাদে অপেক্ষাকৃত কম সময় লাগে। একই জমিতে বছরে কয়েকবার সবজি চাষ করা সম্ভব। পুষ্টির দিক থেকে প্রায় সব শাকসবজি উন্নত মানসম্পন্ন হয়ে থাকে। ফলে বছরব্যাপী উপযুক্ত পরিমাণ সবজি খেয়ে পুষ্টিহীনতা দূর করা এবং রোগমুক্ত থাকা সম্ভব হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বসতবাড়িতে কৃষির জন্য অবস্থা, পরিসর, সম্পদ, পুঁজি, ক্ষমতা, সুযোগ ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে ৪টি গ্রæপের কৃষকদের জন্য ভাগ করে বাস্তবায়ন করলে সুফল বেশি পাওয়া যাবে। প্রথমটি ভ‚মিহীন এবং প্রান্তিক কৃষকদের জন্যে, দ্বিতীয়টি ক্ষুদ্র বা ছোট কৃষকদের জন্যে, তৃতীয়টি মাঝারি কৃষকদের জন্যে এবং চতুর্থটি বড় কৃষকদের জন্যে। এভাবে ক্যাটাগারি করে পরিকল্পনা মডেল তৈরি করলে সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করলে সুবিধা এবং সফলতা বেশি আসবে।
বসতবাড়িতে বছরব্যাপী ফসল ও ফলদ বৃক্ষ রোপণ কৌশল
আমাদের বাড়ি বা বাড়ির আশপাশে অনেক জায়গা রয়েছে। এসব জায়গায় সারা বছরই ফসল ও ফলদ বৃক্ষ চাষ করা যায়। তবে জানতে হবে কোথায় কি ধরনের চাষ করা যায়। আসুন জেনে নেই সেই সম্পর্কে।
বাড়ির উত্তর-পশ্চিম পাশে : আম, কাঁঠাল, কামরাঙা, আমড়া, বেল, আমলকী, নারকেল, সুপারিসহ বড় গাছ
উত্তর- পূর্ব ও দক্ষিণ- পশ্চিমে : কলা, পেঁপে, আনারস, লেবু, পেয়ারা, কুল এসব
বাড়ির সীমানায় : কাঁচকলা, পেয়ারা, কুল, সজিনা, পেঁপে ইত্যাদি চাষ করুন।
খোলা জায়গা: খোলা জায়গায় সব ধরনের সবজি চাষ করা যায়। তার মধ্যে বাঁধাকপি, লালশাক, গিমাকলমি, পুঁইশাক, পালংশাক, বাটিশাক ও ডাঁটাশাক।
স্থায়ী মাচায় এক বর্ষজীবী : কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, শিম, চালকুমড়া, পুঁইশাক, ধুন্দল, ঝিঙা, শসা লাউ, চিচিংগা, করলা ও লতা জাতীয় শাক-সবজি। মাচার নীচে বা আংশিক ছায়াযুক্ত জায়গা আদা, হলুদ, কচু, মানকচু, ওলকচ, আর স্যাঁতস্যেতে জায়গায় পানিকচু।
ডালের বাউনি বা সাধারণ গাছে : লতাজাতীয় সবজি হিসেবে লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, ঝিঙা, ধুন্দল, সিম, গোল মরিচ, পান, গাছআলু, চিচিংগা এবং অন্যান্য ফসল হিসেবে পান চাষ করা যায়।
সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য : তেজপাতা, দারুচিনি, সফেদা, ফলসা, ডালিম গোলাপজাম, এসব লাগানো যেতে পারে। ছায়াদানের জন্য বড় গাছ যেমন- শরিফা, আতা, সুপারি, তেজপাতা, দারুচিনি খাটো জাতের কলম।
ঘরের চালে ও ছাদে: লাউ, মিষ্টিকুমড়া, শিম, চালকুমড়া, পুঁইশাক জাতীয় লতা সবজি। আর পাকা ঘরের ছাদে টবে পেয়ারা, কুল, মরিচ, আদা, হলুদ, পেঁপে, লেবু, ডালিম ইত্যাদি।
জ্বালানির জন্য : বাড়ির বেড়ায় খেজুর, বকফুল, সজিনা, মান্দার, জিকা, বাবলা, ইপিল ইপিল, ইউক্যালিপ্টাস
পুকুরের পাড়ের জন্য করণীয় : হেজে মজে যাওয়া পুকুর ডোবা সংস্কার করে মাছ চাষের উপযোগী করতে হবে। এর পাশে হাঁস-মুরগি পালন করতে হবে। পুকুর পাড়ে নিমগাছ লাগাতে হবে যাতে পানি শোধন হয়। এর সাথে নারিকেল সুপারির গাছ থাকবে। পুকুরের মধ্যে পানিফল লাগানো যেতে পারে। এতে মাছ ছায়া পাবে। এছাড়া মৌমাছি, কোয়েল, কবুতর এর পাশে চাষ করা যেতে পারে। পুকুর পাড়ে পেয়ারা, কলা, লেবু, ডালিম, লাউ, করলা, ঝিঙ্গা, সাথে মিষ্টি কুমড়া বা অন্যান্য লতাজাতীয় সবজি, নেপিয়ার ঘাস ইত্যাদি চাষ করা যায়।
বসতবাড়ির আঙ্গিনায় জৈব পদ্ধতিতে সারা বছর শাকসবজি চাষ করা যায়। কিছু মডেল অনুসরণ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। যেমন কালিকাপুর সবজি উৎপাদন। এই মডেলের সবজি বিন্যাস অনুসরণ করে চাষাবাদের মাধ্যমে চার সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিবারের সারাবছরের সবজি উৎপাদন করা সম্ভব। এজন্য বসতবাড়ির রোদযুক্ত উঁচু স্থানে ৬ মিটার লম্বা ও ৬ মিটার চওড়া জমি নির্বাচন করে পাঁচটি বেড তৈরি করতে হবে। যেখানে প্রতিটি বেডের প্রস্থ হবে ৮০ সে.মিটার এবং দুই বেডের মাঝখানে নালা থাকবে ২৫ সে. মিটার।
সবজি বিন্যাস :
১) প্রথম খÐের বিন্যাস: মুলা/ টমেটো-লালশাক-পুঁইশাক।
২) দ্বিতীয় খÐের বিন্যাস : লালশাক+বেগুন-লালশাক-ঢেঁড়শ।
৩) তৃতীয় খÐের বিন্যাস: পালংশাক-রসুন/ লালশাক-ডাঁটা-লালশাক।
৪) চতুর্থ খÐের বিন্যাস: বাটিশাক-পেঁয়াজ/ গাজর-কলমীশাক-লালশাক।
৫) পঞ্চম খÐের বিন্যাস: বাঁধাকপি-লালশাক-করলা-লালশাক।
সবজি ও ফল সমৃদ্ধ দেশ গড়তে করণীয়
* সবজি ও ফল রপ্তানির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। আমাদেও দেশে প্রায় ২৫%-৪০% পর্যন্ত নানা রকম ফল ও সবজি নষ্ট হয় তা কমাতে হবে।
* প্রতিটি জেলায় মানসম্মত হর্টিকালচার সেন্টার স্থাপন করে এর মাধ্যমে সে এলাকার উপযোগী সবজি ও ফলের চারা কলম চাষিদের মাঝে সুলভ মূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
* বেসরকারি নার্সারিগুলো ফলের মানসম্মত চারা উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে।
* সবজি ও ফলের ক্রপ জোনিং করতে হবে।
* সবজি ও ফল রপ্তানির জন্য উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
* সবজি ও ফলের সংগ্রহোত্তর অপচয় কমানোর জন্য বাস্তবমুখী পদক্ষেপ ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
* সবজি ও ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পকে আরও উৎসাহিতকরণ করতে হবে সবজি ও ফল সংরক্ষণের জন্য এলাকাভিত্তিক হিমাগার স্থাপনসহ পরিবহনের জন্য কুলিং ভ্যান ও প্যাকেজিং ব্যবস্থা উন্নতকরণ করতে হবে প্রতি গ্রামে বা ওয়ার্ডে যদি একটি করে সমবায় গড়ে তোলা যায় তাহলে, ঐ পণ্যগুলো সমবাযের নিকট বিক্রি করবে এবং বাজারজাত করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে, দুর্ভিক্ষে, সংকটে সরকার প্রধানের আস্থার জায়গা কৃষি। ইতিমধ্যে এদেশের মানুষ পৃথিবীর বুকে নানা ঈশর্^ণীয় পরিসংক্যান স্থাপন করতে সামর্থ্য হয়েছে যেমন: ফসলের নতুন জাত উদ্ভাবনে বিশ্বের মধ্যে প্রথম বাংলাদেশ, বিশ্ব পাট উদ্ভাবনে দ্বিতীয়, আলুতে বিশ্বে সপ্তম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, ধান উৎপাদনে চতুর্থ তবে তৃতীয় হওয়ার দ্বার প্রান্তে, আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম। এসব কিছুই সম্ভব বর্তমান কৃিষবন্ধব সরকারের দূরদর্শিতা, সময়মতো বিনিয়োগ এবং কৃষক এবং কৃষি বিভাগের আন্তরিকতার কারণে। এখন কৃষকদের মাঝে সচেতনতা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে জন্য সরাসরি কৃষি পরামর্শ সেবা ও লিফলেট বিতরণ করতে হবে এবং কৃষি কলসেন্টার, ফেসবুক, ইউটিউব, মোবাইল অ্যাপস এর মতো ই-কৃষি বা ডিজিটাল কৃষি সেবার মান ও সক্ষমতা আরোও বৃদ্ধি করে কৃষকদের সেবা প্রদান। এভাবে বসতবাড়িতে চাষ করে দেশের মোট ফলন বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান শিক্ষিত বেকার তরুণ জনগোষ্ঠীর আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি, পুষ্টি নিরাপত্তা বিধান, বৈদেশিক অর্থ উপার্জন ও ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষ) অর্জনে লক্ষণীয় ভ‚মিকা রাখা সম্ভব। অধিক উৎপাদিত দেশী ফল ও সবজি পুষ্টিহীনতা দূরীকরণের পাশাপাশি দানাদার খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস সংকোচিত করে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের সোনার বাংলাকে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় ভ‚মিকা রাখবে।
কৃষিবিদ মোঃ আব্দুল্লাহ-হিল-কাফি
আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী অঞ্চল, রাজশাহী। ফোন : ০৭২১৭৭৩২৭৭, ই-মেইল : rajshahi@ais.gov.bd
ড. মোঃ মনিরুল ইসলাম
(পূর্বের আষাঢ় ১৪২৭ সংখ্যার পর)
আমরা যা খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করি যেন সর্বোচ্চ পুষ্টির ব্যবহার হয়, সেজন্য সচেষ্ট হতে হবে। অনেকেরই জানা নেই অনেক ফল-সবজির খোসাতে বেশি পরিমাণ পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। সেজন্য যেসব ফল-সবজি খোসাসহ খাওয়া যায় তা খোসা না ফেলে খেতে হবে। বিভিন্ন ফল-সবজি যেমন আপেল, কলা, শসা, বেগুন, লাউ, কুমড়া, আলু পুষ্টিতে ভরপুর; তেমনি এসব স্বাস্থ্যকর ফল বা সবজির খোসাও অনেক উপকারী। এখন দেখে নেওয়া যাক উল্লেখযোগ্য ফল-সবজির খোসার পুষ্টি গুণাগুণ।
আপেলের খোসার গুণাগুণ
আপেলের অভ্যান্তরাংশের চেয়ে আপেলের খোসায় বা ছালে ফাইবারের পরিমাণ বেশি। ফাইবার বা আঁশ দীর্ঘ সময়ের জন্য পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে, এতে বারবার খাওয়ার প্রবণতা কমে ও ক্যালরিও কম খাওয়া হয়। তাছাড়া ফাইবার হাড়, যকৃত সুস্থ রাখতে সাহায্য করে (কৃষি বিভাগ, ইউএসএ)। এছাড়া ও আপেলের খোসায় কুয়েরসেটিন নামের একটি এন্টি অক্সিডেন্ট আছে, যা হৃদপিন্ড, ফুসফুস ও মস্তিষ্কের জন্য খুবই উপকারী।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে আপেলের খোসায় থাকে প্রচুর পরিমাণে পলিফেনল যেমন- পেকটিন। এই পেকটিন হল এক ধরনের ফাইবার যা কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। একই সঙ্গে পেকটিন রক্তে সুগার আর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতেও সাহায্য করে। আপেলের খোসায় ভিটামিন এ, সি এবং কে রয়েছে। তাছাড়া পটাশিয়াম, ফসফরাস ও ক্যালসিয়ামের মতো অপরিহার্য খনিজও রয়েছে, যা শরীরের জন্য খুবই উপকারী।
শসার খোসার গুণাগুণ
শসার খোসায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান, পটাশিয়াম আর ভিটামিন-কে। তাই শসার খোসা ফেলে না দিয়ে খোসাসহ খাওয়া বেশি উপকারী।
লাউ বা কুমড়ার খোসার গুণাগুণ
লাউয়ের খোসায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক, যা ত্বককে সতেজ রাখে। বাড়ায় ত্বকের উজ্জ্বলতাও। লাউয়ের খোসা আলাদা করে ভাজি হিসাবেও খাওয়া যায়।
বেগুনের খোসার গুণাগুণ
বেগুনের খোসায় রয়েছে ‘নাসুনিন’ নামের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যা অ্যান্টি-এজিং-এ সহায়ক। এ ছাড়াও বেগুনের খোসা ত্বককে সতেজ রেখে উজ্জ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করে।
কলার খোসার গুণাগুণ
কলার খোসায় রয়েছে লুটেন নামক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যা দৃষ্টিশক্তি ভাল রাখতে সাহায্য করে। কলার খোসায় থাকা ট্রিপটোফ্যান শরীরে সেরোটনিনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। আর এই সেরোটনিন মন মেজাজ ভাল রাখতে সাহায্য করে।
তরমুজের খোসার গুণাগুণ
রসাল তরমুজের পুরু ও শক্ত খোসায় ’এল সাইট্রলিন’ নামের অ্যামাইনো এসিড আছে। এই অ্যামাইনো এসিড শরীর চর্চা ও খেলাধুলায় দক্ষতা বাড়াতে এবং বিশেষতঃ মাংসপেশীর ব্যাথা কমাতে বা এর নমনীয়তা বাড়াতে সহায়তা করে। রক্ত থেকে নাইট্রোজেন দূর করতেও সহায়তা করে এই ‘সাইট্রলিন’ (যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসডিএ’ কৃষি গবেষণা সংস্থা ২০০৩)।
আলুর খোসার গুণাগুণ
আলু এমন একটি সবজি যে কোন তরকারিতেই ব্যবহার করা যায়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা আলুর খোসা ফেলে দেই। আলুর খোসায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন আর পটাশিয়াম। এছাড়াও এতে রয়েছে ভিটামিন বি, সি এবং প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান। তাই সর্বোচ্চ পুষ্টি পেতে আলু খেতে হবে খোসাসহ।
প্রথম উপকারিতা : আলুর খোসায় প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম এবং মিনারেল রয়েছে। যা শরীরের রাসায়ানিক প্রক্রিয়াকে উন্নত করে। পটাশিয়াম আমাদের স্নায়ুতন্ত্রকে সচল রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত উপকারী। এক একটি আলুর খোসা থেকে আমরা ৬০০ গ্রাম পটাশিয়াম পেতে পারি। যা আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
দ্বিতীয় উপকারিতা : মানুষের প্রতিদিন অত্যন্ত পক্ষে ১৬ মিলিগ্রাম করে নিয়াসিন শরীরের জন্য প্রয়োজন। শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় এই নিয়াসিন সহজেই পাওয়া যেতে পারে আলুর খোসা থেকে। নিয়াসিন শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
তৃতীয় উপকারিতা : আলু থেকে আমরা প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল এবং কার্বোহাইড্রেট পাই। তেমনি আলুর খোসাতেও এসব উপাদান থাকে। তাই আলুর খোসা না ছাড়িয়ে খাওয়া হয়, তাহলে প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল এবং কার্বোহাইড্রেট বেশি পরিমাণে পাওয়া যাবে। এতে শরীর আরও শক্তিশালী ও রোগ প্রতিরোধী হয়ে উঠবে।
চতুর্থ উপকারিতা : আয়রন হল শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। আয়রণ দেহের রক্ত কণিকার স্বাভাবিক কার্যপ্রণালীকে সক্রিয় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক দিন ৩-৫টি খোসা সহ আলু খেলে শরীরে ৪ মিলিগ্রাম লোহা বা আয়রন জোগান দেবে।
পঞ্চম উপকারিতা : যাদের হজমশক্তি দুর্বল তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে আলুর খোসা খাওয়া অত্যন্ত উপকারী। কারণ, আলুর খোসায় প্রচুর পরিমাণে ফাইবার আছে। ফাইবার শরীরের হজমশক্তি বৃদ্ধি করে। আলুর খোসা গুরুপাক খাবারও সহজে হজম করতে সাহায্য করে।
ষষ্ঠ উপকারিতা : আলুর খোসায় প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকার ফলে হজমশক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি শরীরের অতিরিক্ত গøুকোজ শুষে নেয়। এতে আলুর খোসা শরীরের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রিত করতে সাহায্য করে। যদিও ডায়াবেটিস রোগীদের আলু খেতে নিষেধ; তবে আলু যদি খোসা সমেত সিদ্ধ করে পানি ফেলে দিয়ে রান্না করা হয় বা খাওয়া হয় তাতে খুব একটা ক্ষতি হয় না।
নির্ভয়ে ফল গ্রহণ
অন্যদিকে কোন গবেষণালব্ধ ফলাফল বা বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত ব্যতিরকে কিছু গণমাধ্যম ও এক শ্রেণীর সংগঠন বা ব্যক্তি কর্তৃক দুধ, মৌসুমি ফল, শাকসবজিসহ মাছে ফরমালিন ব্যবহারের নেতিবাচক প্রচারণার ফলে কিছু মানুষ শুধু ফল খাওয়াই ছেড়ে দেয়নি, চাষি পর্যায়ে আর্থিক ক্ষতিসহ রপ্তানি বাণিজ্যে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে এবং হচ্ছে। সেজন্য জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে জানোনো যাচ্ছে আপনারা নির্ভয়ে ফল খান, দেশী-বিদেশী ফল (যেমন : আম, কলা, আনারস, লিচু, আপেল, কমলা, মাল্টা ইত্যাদি) সংরক্ষণে ফরমালিন ব্যবহার করা হয় না। তাছাড়া কীটনাশক নিয়েও ভ্রান্ত ধারণা আছে, আধুনিক কৃষিতে কীটনাশক ব্যবহার ব্যতিরেকে চাষাবাদ কল্পনাতীত। কীটনাশক এর শুধু ক্ষতিকর দিক নিয়েই বেশি আলোচনা করি, মনে রাখা দরকার কীটনাশক কিন্তু ফসলের অনেক ধরনের ক্ষতিকর ফাংগাসসহ অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান বিনষ্ট করে খাদ্য নিরাপদ করার মাধ্যমে আমাদেরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। তাই নীরোগ ও সুস্থ থাকতে রোগ-প্রতিরোধ খাবার হিসাবে ফলমুল, শাকসবজির কোন বিকল্প নেই।
আমে রাসায়নিকের ব্যবহার
প্রতিটি আমের পরিপক্বতার একটি নির্দিষ্ট সময় আছে। তবে, এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বিশ্ব জলবায়ু দ্রæত পরিবর্তনশীল; তাই বছরভিত্তিক জলবায়ুর এরূপ আচরণগত বৈশিষ্ট্যের কারণে/প্রভাবে পরিপক্বতার সময় ২-৫ দিন আগে বা পরে হতে পারে। তাই বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, সব আম গাছে পাকে এগুলোর চেয়ে পূর্ণ পরিপক্বতা লাভকারী আমসমূহ যদি ৫-৭ দিন পূর্বে গাছ থেকে আহরণ করা হয় অপেক্ষাকৃত সেসব আম গাছে পাকা আমের চেয়ে অধিক মিষ্ট হয়, সাথে কোন প্রকার স্বাস্থ্য ঝুঁকিও নেই।
আমে ক্যালসিয়াম কার্বাইডের ব্যবহার
ইথোফেন যেমন ইথিলিন গ্যাস নির্গমন করে , কার্বাইড তেমনি এসিটিলিন গ্যাস নির্গমন করে এবং একইভাবে ফল পাকায়। তবে কার্বাইড মূলতঃ নিষিদ্ধ একটি রাসায়নিক। শিল্প-কারখানায় ব্যবহারের জন্য সীমিত আকারে কার্বাইড আমদানি করা হয়। রাসায়নিক মুক্ত (কার্বাইড) মুক্ত পাকা আম খেতে ২৫ মে এর পূর্বে ক্রয় পরিহার করতে হবে এবং সরকার কর্র্তৃক মার্চ- এপ্রিল মাসে কোন প্রকার আম যেন আমদানি না হয় সেজন্য উক্ত ২ মাস এলসি বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে। কার্বাইড দিয়ে পাকানো আম খেলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মুখে ঘা ও ঠোট ফুলে যাওয়া, শরীরে চুলকানি, পেটব্যথা, ডায়রিয়া, পেপটিক আলসার, শ্বাসকষ্ট, মস্তিকে পানি জমাজনিত প্রদাহ, মাথা ঘোরা, ঘুম ঘুম ভাব, মহিলাদের বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ফলে ফরমালিনের ব্যবহার
ফরমালিন হচ্ছে অতি উদ্বায়ী ও অতি দ্রবণীয় একটি বর্ণহীন ও ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত রাসায়নিক। ফলমূল শাকসবজি হচ্ছে ফাইবার অর্থাৎ আঁশ (ঋরনৎব) জাতীয় খাবার, তাই ফরমালিন ফল সংরক্ষণ বা পাকাতে কোন ভূমিকা রাখে না। ফল-সবজিতে খুবই সামান্য প্রোটিন থাকায় ফরমালিন প্রয়োগ করা হলে কোন বন্ডিং সৃষ্টি করে না, তা উড়ে চলে যায়। তাছাড়া ফল-মূলে প্রাকৃতিকভাবেই নির্দিষ্ট মাত্রায় ফরমালিন (৩-৬০ মিলিগ্রাম/কেজি) বিদ্যমান থাকে। ইউরোপিয়ান ফুড সেইফটি অথোরিটি (ঊঋঝঅ) এর মতে একজন মানুষ দৈনিক ১০০ পিপিএম পর্যন্ত ফরমালিন কোন প্রকার স্বাস্থ্য ঝুঁকি ছাড়াই গ্রহণ করতে পারে।
ফল পাকানো এবং সংরক্ষণে ইথোফেনের ব্যবহার
ইথোফেন একটি বিশ্ব সমাদৃত ও বহুল ব্যবহৃত অত্যন্ত নিরাপদ রাসায়নিক. যা ফলে প্রাকৃতিক ভাবেই বিদ্যমান থাকে। সেজন্য, ফল পরিপক্বতা লাভের সময়ে বিভিন্ন ফলে সামান্য পরিমাণ ইথোফেন গ্যাস তৈরি হয়; ফলশ্রæতিতে ফলের অভ্যন্তরে বিদ্যমান অনেকগুলো জিন তড়িৎ সচল হয়। তখন ফলের রং পরিবর্তন, মিষ্টতা ও গঠনবিন্যাস (ঞবীঃঁৎব) এ পরিবর্তন আসে এবং ফল পাকতে শুরু করে। কৃষকের মাঠ হতে সংগ্রহকৃত নমুনা বাজারজাত পর্যায়ের নমুনা ও গবেষণাগারে বিভিন্ন মাত্রায় ইথোফেন (২৫০-১০০০০ পিপিএম) সরাসরি স্প্রে করার পর সকল পরীক্ষায় দেখা গেছে যে ইথোফেন প্রয়োগের অব্যাহতি পর হতেই প্রয়োগকৃত ফলের দেহ থেকে তা দ্রæত বের হয়ে যায় এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তা ঈড়ফবী অষষরসবহঃধৎু ঈড়সসরংংরড়হ (ঋঅঙ/ডঐঙ) কর্তৃক মানব দেহের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ গ্রহণীয় মাত্রার (গজখ ২ পিপিএম ) বেশ নিচে চলে আসে। আরও উল্লেখ্য যে , শুধুমাত্র মানবদেহের জন্য নির্ধারিত গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা (গজখ) ছাড়াও অউও(অপপবঢ়ঃধনষব উধরষু ওহঃধশব) এর মাত্রার ওপরেও ইথোফেনের ক্ষতিকর প্রভাব নির্ভর করে। ঈঙউঊঢ/ঋঝঝঅও এর সুপারিশ মোতাবেক একজন মানুষ কোন প্রকার স্বাস্থ্য ঝুঁকি ছাড়া তার প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের বিপরীতে প্রতিদিন ০.০৫ পিপিএম গ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ যদি একজন মানুষের ওজন ৬০ কেজি হয় তাহলে সে সর্বোচ্চ (৬০ী০.০৫) ৩ পিপিএম ইথোফেন প্রতিদিন গ্রহণ করতে পারবে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, যদি কোন ফলে প্রতি কেজিতে ০.৫০ পিপিএম ইথোফেন অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়, তাহলে কোন ব্যাক্তিকে নুন্যতম দৈনিক ৬ কেজি ফল খেতে হবে।
আমদানিকৃত আপেল
অন্যান্য ফলের ন্যায় আপেলেও ফরমালিন ব্যবহার করা হয়না। তবে আমদানিকৃত আপেল দীর্ঘদিন সতেজ রাখার জন্য সাধারণত ফুড গ্রেড বা ইডিব্ল (তরল ও কঠিন) প্যারাফিন প্রয়োগ করা হয়। কঠিন বা তরল প্যারাফিন যে কোন মাত্রায় খাদ্যের সাথে মানবদেহে প্রবেশ করলেও তা কোন ক্ষতিকর বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না বা হজম প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হয় না, ফলে এটি সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত অবস্থায় পুনরায় শরীর হতে বেরিয়ে যায়। সুতরাং এসব মোমযুক্ত/প্যারাফিনযুক্ত আমদানিকৃত আপেল ভক্ষণ নিরাপদ। আরও উল্লেখ্য যে বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত নব নব উদ্ভাবনের মাধ্যমে শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পণ্যের মান বৃদ্ধি ও পঁচনকে দীর্ঘায়িত করার জন্য নব নব বিভিন্ন প্রযুক্তিও উদ্ভাবন করে চলেছে। বর্তমানে প্যারাফিন ওয়াক্সের পাশাপাশি কৃষিজ উপজাত যেমন ঃ ফলমূলের খোসা, কাÐ, পাতা, গাছের প্রাকৃতিক নির্যাস ব্যবহার করে অত্যন্ত পাতলা অবরণ সমৃদ্ধ ফিল্ম তৈরি করে আপেলসহ অন্যন্য ফলের গায়ে ওয়াক্স হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এধরনের ওয়াক্স একদিকে যেমন ফল-কে সতেজ রাখতে সাহায্য করছে তেমনি পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করছে।
হর্টিকালচার ক্রপস তথা ফল-সবজিতে ক্ষেত্রভেদে ৪০-৯৮ ভাগ পানি বিদ্যমান থাকে। তাই ব্যাপকভাবে যাতে ওজন হ্রাস না হয়, সেজন্য ওয়াক্স ব্যবহার করা হয়। উল্লেখ্য যে প্রকার/জাত ভেদে হর্টিকালচার ক্রপ এর ক্ষেত্রে প্রতিদিন ৫-১০ গ্রাম ওজন কমে। তাছাড়া চকচকে-তকতকে ভাব বজায়, ফাংগাস/ছত্রাক এর আক্রমণ থেকে রক্ষা, দীর্ঘদিন সংরক্ষণ, কোল্ড স্টোরেজ এ সংরক্ষণকালীন সংবেদনশীলতা রোধ, আর্দ্রতার অপচয় রোধ ও অন্যান্য বাহ্যিক আঘাত রোধসহ রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু রোধ করার জন্য ইডিব্ল প্যারাফিন ওয়াক্স বা ইডিপিল ব্যবহার করা হয়। আপেলে ব্যবহৃত ওয়াক্স একটি খাওয়ার যোগ্য মোম, এতে কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই।
বাজারে প্রাপ্ত আঙ্গুর
বাজারে প্রাপ্ত আমদানিকৃত আঙ্গুর নিয়েও মানুষের মাঝে অস্থিরতা বিরাজমান। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, আধুনিক কৃষি ও কৃষি পণ্য কীটনাশক ও প্রিজারবেটিভস ব্যবহার ছাড়া উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও সংরক্ষণ করা প্রায় অসম্ভব। মানুষ জ্বর-সর্দি-কাশি বা জীবাণূ দ্বারা আক্রান্ত হলে যেমনি ঔষধ খাওয়ার প্রয়োজন হয়; তেমনি ফসলের পোঁকামাকড় দমন, ছত্রাকের আক্রমন রোধ ও নির্দিষ্ট সময়ান্তে সতেজ রাখার জন্য প্রিজারবেটিভস প্রয়োজন। আঙ্গুরে মূলতঃ ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা হয়; এর কার্যক্ষমতা বেশি সময় থাকেনা, খাওয়ার পূর্বে ভালভাবে ধুয়ে নিলে কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকিও থাকেনা। তাছাড়া শিপমেন্টের পূর্বে সালফার ডাই অক্সাইড ব্যবহারে বাষ্পশোধন করা হয় ও পরিবহনের সময় কার্টুনে সালফার ডাই অক্সাইড প্যাড ব্যবহার করা হয়।
অনেকেই আঙ্গুরের গায়ে বা ত্বকের বাইরের অংশে সাদা পাউডার জাতীয় পদার্থ দেখে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে বলে মনে করে অজানা অস্বস্তিতে ভোগেন। প্রকৃতপক্ষে আঙ্গুরের গায়ে সাদা পাউডার জাতীয় যে পদার্থ দেখা যায়, তা একেবারেই প্রাকৃতিক এবং তা ‘ওল্ড ডাস্ট’, ‘বøুম বা বøাস’, এসিডোফাইলাস (ব্যাকট্রেরিয়াম) নামে পরিচিত, যা একটি প্রাকৃতিক প্রলেপ। এটা আর্দ্রতা রোধসহ আঙ্গুরকে পচন ও পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করে। তাছাড়া মদ তৈরির প্রাথমিক পর্যায়ে ফারমেন্টশেন এ সহায়তা করে। এধরনের বøুম পামজাতীয় ফলেও দেখা যায়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের রয়েছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। অতীতে যেমনি প্রতিটি দূর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ সক্ষমতা দেখিয়েছে। বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতিতে নিঃসন্দেহে বলা যায়, কৃষি প্রিয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় ও সময়ের সাহসী যোদ্ধা সুযোগ্য কৃষি মন্ত্রীর সার্বিক তত্ত¡াবধানে কৃষি আবার প্রাণ ফিরে পাবে। আশা করা যায়, কৃষকদের সময়মতো সার, বীজ ও প্রনোদনা যথাসময়ে যথাযথভাবে কৃষকদের কাছে পৌঁছানো গেলে দেশের কৃষি ও কৃষক আবার ঘুরে দাঁড়াবে। দেশের অর্থনীতিসহ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। এ ব্যাপারে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
পরিচালক (পুষ্টি), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, ফার্মগেট, ঢাকা, মোবাইল : ০১৭৭৭৬৮৬৮৬৬, ই-মেইল : dmmislam@yahoo.com