Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

১৬ অক্টোবর ২০২৩ বিশ^ খাদ্য দিবস। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ঋঅঙ) ১৯৪৫ সাল থেকে ১৬ অক্টোবরকে বিশ^ খাদ্য দিবস হিসেবে উদ্যাপন করে আসছে। পৃথিবীর সব মানুষের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের জোগান নিশ্চিতকরণ, পুষ্টিহীনতা দূরীকরণ এবং দরিদ্রতার মূলোৎপাটন করে ক্ষুধামুক্ত নির্মল পৃথিবী গড়ার কাজে ঋঅঙ নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৮১ সাল থেকে বিশ^ খাদ্য দিবস প্রতিপাদ্যভিত্তিক পালিত হয়ে আসছে। এ বছর প্রতিপাদ্য ‘ডধঃবৎ রং ষরভব, ধিঃবৎ রং ভড়ড়ফ. খবধাব হড় ড়হব নবযরহফ.’ এর ভাবার্থ ‘পানি জীবন, পানিই খাদ্য। কেউ থাকবে না পিছিয়ে।’ যা পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক জলবায়ুতে সময়োপযোগী ও অর্থবহ।
পানি, জীব, অর্থনীতি, প্রকৃতির চালিকাশক্তি এবং মানুষের খাদ্যের ভিত্তি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরবর্তী দেশ গঠনে কৃষি ক্ষেত্রে পানির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন। ১৯৬০ এর দশকে প্রায় ৯৫ শতাংশ ভূউপরিস্থ এবং ৫ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার হতো। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কৃষি উন্নয়নের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিএডিসি কর্তৃক  ক্ষুদ্রসেচ উইং বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচি গ্রহণ করেন। ভূগর্ভস্থ ও ভূউপরিস্থ পানির ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহারে আধুনিক সেচ ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ব্যবহার প্রচলন করেন। তাঁরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদ্য নিরাপত্তায় যুগোপযোগী পদক্ষেপ চলমান রয়েছে। ফলে বিশ^ মানচিত্রে বাংলাদেশ আজ দানাদার খাদ্যের উদ্বৃত্ত দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। মাছ, মাংস, ডিম উৎপাদনেও দেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ।
বর্তমানে বৈশি^ক মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং নানাবিধ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক আগ্রাসনের কারণে প্রাকৃতিক সম্পদ পানি প্রভাবিত হচ্ছে। গত কয়েক দশকে জনপ্রতি স্বাদুপানি ২০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বর্তমান সরকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যায়ক্রমে নিরাপদ-সাশ্রয়ী খাবার পানি সর্বজনীন ও সমান অধিকার অর্জনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। পানির সমন্বিত ও পরিকল্পিত কার্যক্রম গ্রহণ, পরিবেশবান্ধব নীতি অবলম্বন, পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, অপচয় রোধ এবং সেচ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের মাধ্যমে উচ্চফলনশীল জাতের ফসল উৎপাদনসহ বাস্তবমুখী কার্যক্রম নিজ নিজ অবস্থান হতে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। এভাবে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ২০৩০ সালের মধ্যে কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে নিরাপদ পানি সহজলভ্যতা ও স্যানিটেশন অর্জন সম্ভব হবে।
প্রিয় পাঠক, কৃষি মন্ত্রণালয় ও এফএও বাংলাদেশের উদ্যোগে বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৩ উদ্যাপিত হচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে মাসিক কৃষিকথার বিশেষ সংখ্যা মুদ্রণ করা হচ্ছে। কৃষিকথা বিশেষ সংখ্যায় দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরে দিকনির্দেশনামূলক বাণী এবং মানসম্পন্ন ও তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ লেখা যারা দিয়েছেন তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। আশা করি তথ্য সংবলিত লেখাগুলো বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্যের সফল বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিশ্ব খাদ্য দিবস সফল ও সার্থক হবে এই কামনা।

বিস্তারিত
সূচিপত্র

৮৩তম বর্ষ ড় ৭ম সংখ্যা ড় কার্তিক-১৪৩০ (অক্টোবর-নভেম্বর ২০২৩)

সূচিপত্র

নিবন্ধ/প্রবন্ধ
    পানি জীবনের সূত্র, খাদ্যের অভিন্ন অংশ    ১১    
    ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার, ড. সুষ্মিতা দাষ
    নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তায় আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনা    ১৩
    বাদল চন্দ্র বিশ্বাস
    পানি জীবন, পানিই খাদ্য। কেউ থাকবে না পিছিয়ে।    ১৫
    ড. সুরজিত সাহা রায়
    পানি শোধনকল্পে স্যানিটাইজারের ব্যবহার এবং ফলমূল ও শাকসবজি হতে অণুজীব দূরীকরণ    ১৭    
    ড. মো: গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী, মো: হাফিজুল হক খান
    জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ    ১৯
    আব্দুন নাসের খান
    পানির সাশ্রয়ী ব্যবহার ও টেকসই ভবিষ্যৎ      ২১    
    স্বপ্নীল বড়–য়া, মো. এনায়েত উল্ল্যাহ রাফি
    এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন বাস্তবায়নে বিএডিসির অভীষ্ট    ২৩
    মোঃ জামাল উদ্দীন    
    কৃষিকাজে পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি    ২৫
    কৃষিবিদ খোন্দকার মোঃ মেসবাহুল ইসলাম
    বসতবাড়িতে পাটশাক উৎপাদন ও পারিবারিক পুষ্টির চাহিদাপূরণ    ২৮
    ড. এ. টি. এম. মোরশেদ আলম
    পুষ্টিগত অবস্থার উন্নয়নে প্রতিদিন নিরাপদ পানি পানের গুরুত্ব    ৩০
    কৃষিবিদ প্রিন্স বিশ^াস

আগামীর কৃষি ভাবনা

    চতুর্থ শিল্পবিল্পবের আলোকে সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনার অত্যাধুনিক প্রযুক্তি    ৩২
    ড. দেবজিৎ রায়, ড. প্রিয় লাল চন্দ্র পাল, ড. মীর নুরুল হাসান মাহমুদ
    মাটির নিচের পানি ব্যবহারে মিতব্যয়ী হতে হবে    ৩৪    
    মৃত্যুঞ্জয় রায়
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ
    নিরাপদ খাদ্য নিরাপত্তায় ধানক্ষেত সমন্বিত মাছ উৎপাদন কৌশল    ৩৬
    মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন
    নতুন জাতের ঘাস ‘জারা’    ৩৮    
    ডা: মনোজিৎ কুমার সরকার
উচ্চমূল্যের ফসল চাষাবাদ
    উচ্চমূল্যের ফসল চাষাবাদ : হাইব্রিড ভুট্টা    ৩৯
    ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন
সফল কৃষকের গল্প
    একজন কৃষক ছানোয়ারের ভাগ্য বদলের গল্প    ৪১    
    কৃষিবিদ সাবরিনা আফরোজ    
নিয়মিত বিভাগ
    প্রশ্নোত্তর    ৪৩
    কৃষিবিদ আকলিমা খাতুন
    অগ্রহায়ণ মাসের কৃষি (১৬ নভেম্বর-১৫ ডিসেম্বর)    ৪৪
    কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম

বিস্তারিত
পানি জীবনের সূত্র, খাদ্যের অভিন্ন অংশ

পানি জীবনের সূত্র, খাদ্যের অভিন্ন অংশ
ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার১ ড. সুস্মিতা দাস২
বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাঁর দেখানো পথেই হাঁটছেন। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে তাঁর সাহসী এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্বে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশও প্রতিবছর বিশ্ব খাদ্য দিবস অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে আসছে। মানবজাতির অস্তিত্বের সঙ্গে খাদ্যের অপরিহার্যতার গুরুত্ব বিষয়ে বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যেই ১৬ অক্টোবর প্রতিবছর বিশ্ব খাদ্য দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কেননা এই দিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জাতিসংঘের অন্যতম একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বিশ্বখাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)। বিশ্বখাদ্য দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘Water is life, water is food. Leave no one behind’ এর ভাবার্থ ‘পানি জীবন, পানিই খাদ্য। কেউ থাকবে না পিছিয়ে’। বর্তমান সময়ের জন্য এবারের প্রতিপাদ্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রতিনিয়ত সুপেয় পানির আধার কমে যাচ্ছে। পানির অপর নাম জীবন। জীবনের অধিকার মানে পানির অধিকার। পানি থাকলেই জীবন থাকবে। পানি ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। সুপেয় পানির প্রাপ্তির সুযোগ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘ পানি অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হলেও এখনো এ অধিকার থেকে বঞ্চিত ৭৬ কোটিরও বেশি মানুষ। তাই সুপেয় পানির অধিকার রক্ষা করা আজ জরুরি। না হলে সংকটাপন্ন এলাকাগুলো আরো বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ পর্যাপ্ত পানি পায় না। বলা হচ্ছে, আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ ৯৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ৭০০ কোটিই পানির সমস্যায় পড়বেন। কাজেই এ সমস্যা মোকাবিলা করতে হলে পানির অপচয় রোধ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতি বছর ভূগর্ভের পানির স্তর দুই থেকে পাঁচ মিটার করে নিচে নামছে। এতে পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ যেমন বাড়ছে, আশঙ্কা দেখা দিয়েছে ভূমিধস ও মাটি দেবে যাওয়াসহ নানা দুর্ঘটনার।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে সেচের খরচে শীর্ষে এখন বাংলাদেশ। এক কেজি বোরো ধান উৎপাদনে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার লিটার পানি ব্যয় হয়। এই পানি মাটির গভীর থেকে ওঠাতে প্রতি বিঘার জন্য প্রায় দেড় হাজার টাকা ব্যয় হয়।
সম্প্রতি ওয়াটার রিসোর্স প্ল্যানিং অর্গানাইজেশনের (ওয়ারপো) পক্ষ থেকে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানি পরিস্থিতি নিয়ে হাইড্রোলজিক্যাল অনুসন্ধান ও মডেলিং শীর্ষক গবেষণা করেছে। গবেষণাটি ২০১৮ সালে শুরু হয় এবং চলতি বছরের জুন মাসে ওয়ারপোর অনুমোদন পায়। গবেষণায় উঠে এসেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে পরিস্থিতি আগের চেয়ে দিন দিন পানি সংকটাপন্ন এলাকা বাড়ছে। গবেষণার তথ্য মতে, ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলে গড় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ২৬ ফুট নিচে। সে সময় সর্বোচ্চ তানোরে পানির স্তর নেমেছিল ৬৮ ফুট।
খাবার পানি, সেচ, মাছ চাষের মতো বিভিন্ন কাজে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তোলায় ২০১০ সালে পানির গড় ছিল ৫০ ফুট। ২০২১ সালে  ভূগর্ভস্থ পানির গড় আরও নিচে নেমে দাঁড়ায় ৬০ ফুটে। একই বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের একটি স্থানে ভূপৃষ্ঠ থেকে মাটির নিচে পানি নামে ১৫৩ ফুট।
আন্তর্জাতিক পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ভূউপরিভাগ ও ভূগর্ভস্থ পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত না করলে, পানি সম্পর্কিত  সমস্যাগুলো বৃদ্ধি হতে পারে, যা পুরো সমাজের উন্নতির উপর অসামান্য প্রভাব ফেলতে পারে।
পানির গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবসের  প্রতিপাদ্য যথার্থ হয়েছে।
খাদ্য  ও পুষ্টি  নিরাপত্তার সাথে  পানির গুরুত্বের কথা  বিবেচনা করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল ও  নার্স প্রতিষ্ঠান  বিভিন্ন যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফসল উৎপাদনের উপযোগী এলাকা নির্বাচনপূর্বক শস্য আবাদের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল ফসল জোনিং কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। ইতোমধ্যে অনলাইন জিআইএসভিত্তিক ক্রপ জোনিং ইনফরমেশন সিস্টেম এবং ‘খামারি’ মোবাইল অ্যাপ চালু করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৩৫৫টি উপজেলায় মোট ৭৬টি ফসলের ক্রপ জোনিং কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। অবশিষ্ট ১৪০টি উপজেলার ক্রপ জোনিং কার্যক্রম চলমান। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষকের সর্বাধিক আয় নিশ্চিতকরণে কৃষকসহ অন্যান্য উপকারভোগীর নিকট জমির উপযোগী ফসল, লাভজনক ফসল, উপজেলাভিত্তিক উপযোগী ফসল এলাকার পরিমাণ, ভূমির উর্বরতামান অনুযায়ী ফসলভিত্তিক সুষম সার সুপারিশ, মাটির গুণাগুণ, সেচ এবং ফসল বিন্যাস ইত্যাদি তথ্য সরবরাহ করার লক্ষ্যে ‘খামারি’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। গুগল প্লে-স্টোর হতে ডাউনলোড করে অ্যাপটি ব্যবহার করা যাচ্ছে। মাঠপর্যায়ে ‘খামারি’ মোবাইল অ্যাপ সম্পর্কে অবহিতকরণ ও প্রচলনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ঋঅঙ এর আর্থিক সহায়তায় ৫০টি উপজেলায় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, কৃষকদের ‘খামারি’ মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন (কএঋ) এর আর্থিক সহায়তায় আরও ৪০টি উপজেলায় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। ‘খামারি’ অ্যাপের পাশাপাশি নীতিনির্ধারক ও পরিকল্পনাকারী পর্যায়ে সহজে এবং স্বল্পতম সময়ে উপরোক্ত তথ্য প্রাপ্তির সুবিধার্থে ক্রপ জোনিং ড্যাশবোর্ড তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও কৃষির সাথে সম্পৃক্ত উপকারভোগী প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে ক্রপ জোনিং ও খামারি অ্যাপ বিষয়ক মতবিনিময়/পরামর্শক কর্মশালা আয়োজন কার্যক্রম চলমান।
বিএআরসি কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা, ফসল সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, এনএআরএসভুক্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের বিজ্ঞানীদের দিকনির্দেশনা, পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করছে। এ ছাড়া কৃষি উৎপাদনে শ্রমিকের ঘাটতি এবং সংগ্রহোত্তর ক্ষতি হ্রাসের লক্ষ্যে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ রোডম্যাপ ২০২১, ২০৩১ ও ২০৪১ প্রণয়ন করা হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, পানি: জীবনের উৎস, পানিই খাদ্যের শাসক। জলবায়ুর প্রেক্ষাপটে পানি সমস্যা বাড়বে। এ জন্য এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। পানির অধিকারে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ও কৃষি উৎপাদনকে প্রাধান্য দিতে হবে। ভূগর্ভের পানি মজুদ রাখতে উপরিভাগের পানির ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সবাইকে সমন্বয়ে কাজ করতে হবে। তবেই ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে পরিণত হবে।

লেখক : ১নির্বাহী চেয়ারম্যান, ২প্রধান ডকুমন্টেশস কর্মকর্তা, বাাংলাদেশে কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, মোবাইল : ০১৭১১১০২১৯৮, ই-মেইল :susmitabare@gmail.com

বিস্তারিত
নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তায় আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনা

নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তায়
আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনা
বাদল চন্দ্র বিশ্বাস
জাতির পিতার পথ ধরেই গ্রামীণ ও কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে উন্নত, সুখী ও সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সদ্যস্বাধীন দেশ পুনর্গঠনে জাতির পিতা  কৃষি বিপ¬বের ডাক দিয়েছিলেন। তিনি  কৃষির উন্নয়নে কৃষকদের মাঝে খাস জমি বিতরণ, ভর্তুকি মূল্যে সার, কীটনাশক, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করেন। সরকারের যুগোপযোগী নীতি ও পদক্ষেপে দেশ দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ফল, সবজির উৎপাদন অনেক গুণ বেড়েছে। কিন্তু সুস্থ সবল জাতি গঠনে ফলন বৃদ্ধির পাশাপাশি পুষ্টিসম্মত নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নাই। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূণর্তা অর্জন করেছে। কিন্তু পুষ্টি নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে আমাদের কার্যক্রম চলমান আছে। পুষ্টিকর খাদ্যশস্য আর প্রাণিজ আমিষ উৎপাদনের  মাধ্যমে আমরা পুষ্টির নিশ্চয়তা অর্জন করতে পারি। সুস্বাস্থ্য নির্ভর করে পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য গ্রহণের উপর। দেহের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে হলে একজন ব্যক্তির জন্য সুষম খাদ্য নির্বাচন, খাদ্যের সহজলভ্যতা ও পুষ্টিমূল্য বজায় রেখে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক অবস্থা, খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির ওপরও পুষ্টি অনেকটাই নির্ভর করে।
মানুষের শরীরের যেসব রোগ হয়, তার মধ্যে ২০০ রোগ কোনো না কোনোভাবে খাদ্যের মাধ্যমে হয়ে থাকে। তাই নিরাপদ পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ নিয়ে ভাবনার বিষয়টি খুবই প্রাসঙ্গিক।  কৃষি ও নিরাপদ খাদ্য-বিষয় দুটি সম্পূরক। তাই খাদ্য নিরাপদ চাইলে নিরাপদ কৃষি উৎপাদনের কথাও ভাবতে হবে। কৃষি উৎপাদনে অপ্রয়োজনীয়ভাবে সার বিষ প্রয়োগের মাত্রাকে মানব শরীরের জন্য সহনীয় ও নিরাপদ পর্যায়ে কমিয়ে আনতে হবে।
নিরাপদ এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য উৎপাদন
বাংলাদেশের উন্নয়নের নতুন এজেন্ডা হবে নিরাপদ পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করা। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করতে হলে কৃষকদের উত্তম কৃষি চর্চা (এড়ড়ফ অমৎরপঁষঃঁৎধষ চৎধপঃরপবং-এঅচ) সম্পর্কে উদ্ধুদ্ধ করতে হবে। কৃষিজ উৎপাদন এবং ভোক্তার মধ্যে তথ্য বিভ্রান্তিকর যে দেয়াল তৈরি হয়েছে, সেটাকে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে ভেঙে দিতে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার সকলের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের নিশ্চয়তা দিতে নিরলসভাবে কাজ করছে। চলছে ফসলের নিরাপদ উৎপাদনের জন্য প্রচেষ্টা। ইতোমধ্যে উত্তম কৃষি চর্চা নীতিমালা ২০২০ মেনে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এই নীতিমালার আওতায় উত্তম কৃষি চর্চার ক্যাটাগরি, সার্টিফিকেশন, টেস্টিং, মনিটরিং, রিপোর্টিং ইত্যাদি ব্যবস্থাপনা থাকবে। এর মাধ্যমে ট্রেসেবিলিটি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির লক্ষ্যে খাদ্য শৃঙ্খলের প্রাথমিক অর্থাৎ কৃষক পর্যায় থেকে প্রতিটি স্তরে প্রত্যেক কর্মীকে তার নিয়ন্ত্রণাধীন বিষয়ে দায়িত্বশীল থেকে সকল কার্যক্রমের বিবরণ যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ করা আবশ্যক। উৎপাদনকারীকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে উৎপাদিত পণ্য খাদ্য হিসেবে ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ। এক্ষেত্রে উৎপাদকের পাশাপাশি প্যাকেজিং, সরবরাহ, পরিবহন, গুদামজাতকরণ ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় সকলেরই দায়িত্ব খাদ্যকে নিরাপদ এবং মানসম্পন্ন রাখা। এঅচ বাস্তবায়নে ফলমূল ও শাকসবজির বিদেশে রফতানি বাড়াতে সার্টিফিকেশন সিস্টেম উন্নত করা, পূর্বাচলে অ্যাক্রিডিটেড ল্যাব প্রতিষ্ঠা, শ্যামপুরে প্যাকেজিং ও প্রসেসিং কেন্দ্রের আধুনিকায়ন, বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় ওয়াসিং ফেসিলিটিসহ ভ্যাকুয়াম হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ হাতে নেয়া হচ্ছে।
নিরাপদ ফসল উৎপাদনে অনুসরণীয়
অনিরাপদ সবজি পুষ্টির পরিবর্তে মানুষের শরীরে বিভিন্ন রোগ ছড়াচ্ছে এবং দেশের বাইরে রপ্তানি করার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করছে। নিরাপদ সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রে রাসায়নিক ব্যবহার পরিহার করতে হবে যেন মাটি, পানি ও বায়ু দূষণ না হয় এবং কৃষক ভাইদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষা হয়। তাই আইপিএম, আইসিএম, উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির সম্প্রসারণে জোর  দেয়া হচ্ছে। মাটির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য জমিতে জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া কম্পোস্ট সার, কেঁচো সার ইত্যাদি প্রয়োগ করলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। বালাইনাশকের ক্ষেত্রে নিম, নিশিন্দা, বিষকাটালী ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে কৃষকের স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে না।
নিরাপদ সবজি উৎপাদনে রাসায়নিক ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে কতিপয় বিষয়ে খেয়াল রাখা জরুরি। যেমন: ১) রাসায়নিক দ্রব্যের সঠিক ব্যবহার অনুসরণ। ২) সবজি আবাদি জমির পরিবেশকে রাসায়নিক সংক্রমণ হতে সুরক্ষা করা। ৩) সঠিক রাসায়নিক সার/কীটনাশক গ্রহণযোগ্য মাত্রায় ব্যবহার। ৪) সেচ ব্যবস্থাপনায় পানির ঝুঁকি মূল্যায়ন ও নিয়ন্ত্রণ।
নিরাপদ এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিতকরণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পদক্ষেপসমূহ
খাদ্য উৎপাদনে ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপাদান যেমন আগাছানাশক, কীটনাশক, এন্টিবায়োটিক, গ্রোথ হরমোন, ভারী ধাতু ইত্যাদি ব্যবহারে কৃষক পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্প চলমান রয়েছে। মাঠপর্যায়ে আইপিএম কার্যক্রমের মাধ্যমে কৃষকদের কীটনাশক ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার ক্রমাগত হ্রাসের ফলশ্রুতিতে ২০১৮ সালে কীটনাশকের ব্যবহার ছিল ৩৯২৩৭.০০ মে. টন/কিলোলিটার। ২০১৯ সালে ব্যবহার হয়েছে ৩৮৩৬৯.০০ মে.টন/কিলোলিটার। যা পূর্বের বছরের তুলনায় ৯১৪.২২ মে. টন/কিলোলিটার কম। তাছাড়া সম্প্রতি ১০৮টি জৈব বালাইনাশকের লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। আইপিএম পদ্ধতি ব্যবহারকারী উপকারভোগী কৃষকদের ধান চাষে হেক্টরপ্রতি ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ, সবজি চাষে হেক্টরপ্রতি ২৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং ফল চাষে ১৪ শতাংশ খরচ কমেছে। ফলন বেড়েছে গড়ে ৫ থেকে ৭ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৬৪৯ টি এফএফএস ও ১১১৬৬টি জৈব কৃষি ও জৈবিক বালাই ব্যবস্থাপনা প্রদর্শনী স্থাপনার মাধ্যমে প্রায় ৩০৪০ হেক্টর জমিতে বিষমুক্ত ও নিরাপদ ফসল উৎপাদিত হয়েছে এবং ৫১৩৫০ জন কৃষক প্রত্যক্ষভাবে বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে প্রশিক্ষিত হয়েছেন।
নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদনে লাগসই প্রযুক্তি সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরদার করতে অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন করা হচ্ছে। পিছিয়ে পড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠির খাদ্য ও পারিবারিক পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের জন্য বসতবাড়ির আঙ্গিনায় সারা বছর সবজি উৎপাদনসহ পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে ইউনিয়ন পর্যায়ে ২,৫২,০৯৬টি (২০২০-২১ অর্থবছরে ৮৩৬৪টি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯৩০২৫টি এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৫০৭০৭টি)  পুষ্টিবাগান স্থাপিত হয়েছে। এর ফলে প্রায় ৩৭৮১৪৪ শতক (৩৭৮১.৪৪ একর/ ১৫৩০.৯৪ হেক্টর) অনাবাদি পতিত জমি চাষের আওতায় এসেছে।
দেশের নিম্ন অঞ্চলের জলাবদ্ধ এলাকায় ভাসমান বেড পদ্ধতিতে সবজি ও মসলা উৎপাদন করে কৃষক। বালাইনাশক ব্যবহার না করেই নিরাপদ সবজি ও মসলা উৎপাদনের পাশাপাশি বর্ষাকালীন আমন ধানের চারা উৎপাদন করছে। সেই সাথে পচা কচুরিপানা জমিতে জৈবসার হিসেবে ব্যবহার করে জমির উর্বরতা ও উৎপাদন শক্তি বাড়ছে এবং জৈবকৃষি বা পরিবেশবান্ধব কৃষি বাস্তবায়নে মাত্রিক অবদান রাখছে।
বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পসহ অন্যান্য প্রকল্পের মাধ্যমে ১১০০০টি মিশ্রফল বাগান, ৪৫০০টি বাণিজ্যিক ফলবাগান, ১৭০০০টি বসতবাড়ি বাগান স্থাপন এবং কৃষক প্রশিক্ষণ, উদ্যোক্তা উন্নয়ন করা হয়েছে।
ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার এ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট এর মাধ্যমে কমপক্ষে ১০টি পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকায় সেচের পানি ব্যবহার দক্ষতা শতকরা ৫০ ভাগ সাশ্রয়ী করা এবং সেই সাথে প্রকল্প এলাকার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা রয়েছে।
আধুনিক পানি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির মাধ্যমে সেচ দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে সৌর শক্তি ও পানি সাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাইলট প্রকল্প গৃহিত হয়েছে। ভূউপরিস্থ পানির নূন্যতম ব্যবহারের মাধ্যমে সেচ পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধি করাসহ ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূউপরিস্থ পানি ব্যবহারে উৎসাহিত করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা এবং সেচ খরচ কমানো সম্ভব।
সৌরশক্তিকে সেচ কাজে ব্যবহার করে সেচ খরচ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশে এবং খামার পর্যায়ে আধুনিক পানি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির সম্প্রসারণের মাধ্যমে সেচ দক্ষতা ২০ থেকে ২৫ শতাংশ উন্নয়ন করার লক্ষ্যে সৌর শক্তি ও পানি সাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি (পাইলট) প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। যা বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৩ এর প্রতিপাদ্য ‘পানিই জীবন, পানি খাদ্য, কেউ থাকবে না পিছিয়ে’ সফলভাবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
নিরাপদ ফসল উৎপাদন সহায়তায় কৃষকদের জন্য বীজ, সারসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ সহনশীল মূল্যে ক্রয়ের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এছারাও শতকরা ৫০ থেকে ৭০ ভাগ পর্যন্ত ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষিযান্ত্রিকীকরণ বিস্তৃত করার পাশাপাশি কৃষকদের ঋণ সুবিধা প্রদান, নগদ আর্থিক ও উপকরণ সহযোগিতা প্রদান, ফসলের সময়োপযোগী উপযুক্ত জাত ও টেকসই প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করা হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কৃষি উন্নয়নের রোলমডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশের প্রত্যেক মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। যিনি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তার যেমন সচেতনতা প্রয়োজন, তেমনই যিনি ভোগ করবেন, তার ক্ষেত্রেও নিরাপত্তার বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বস্তুত নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। এ অধিকার সফলভাবে প্রতিটি মানুষের প্রাপ্যতা অর্জনে সরকারি-বেসরকারি সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন।  নিরাপদ উৎপাদন ব্যবস্থা এবং ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’-এর সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনসাধারণের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত। পরিশেষে আমি বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৩ এর সাফল্য কামনা করছি।

লেখক: মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর,  ফোন: +৮৮০২৫৫০২৮৩৭০

বিস্তারিত
পানি জীবন, পানিই খাদ্য কেউ থাকবে না পিছিয়ে

পানি জীবন, পানিই খাদ্য
কেউ থাকবে না পিছিয়ে
ড. সুরজিত সাহা রায়
‘পানি জীবন, পানিই খাদ্য। কেউ থাকবে না পিছিয়ে’। এই প্রতিপাদ্য নিয়ে এ বছর পালিত হচ্ছে বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৩। দেশের খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত দেশের অন্যতম সংবিধিবদ্ধ সরকারি সংস্থা কৃষি মন্ত্রণালয় প্রতিবারের মতো এবারও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে দিবসটি পালনে সেমিনার আয়োজন করেছে।
বিশ্ব খাদ্য দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো ক্ষুধা, অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা, কৃষিভিত্তিক উৎপাদনে উৎসাহ দান করা, কৃষির উন্নতিতে মনোযোগ দেওয়া, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলো সহায়তা গ্রহণে উৎসাহ প্রদান করা, গ্রামীণ জনগণ, মূলত নারী ও পিছিয়ে পড়া মানুষের অবদানে উৎসাহ দান ও প্রযুক্তির সমৃদ্ধিকে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া।
মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্যই প্রথম। বৈজ্ঞানিক বিবেচনায় পানি খাদ্য বিবেচিত না হলেও খাদ্য উৎপাদন এবং এ সংশ্লিষ্ট কর্মকা-ে পানির যে অপরিহার্যতা রয়েছে তাতে পানিকে খাদ্য বললেও অত্যুক্তি হবে না। পৃথিবীতে জীবনধারণের জন্য পানি অপরিহার্য। আমাদের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া সরাসরি পানির ওপর নির্ভরশীল। আমাদের দেহের প্রায় ৫০ এবং পৃথিবী পৃষ্ঠের ৭০ শতাংশই হলো এই পানি। কিন্তু বিপুল পরিমাণ পানির মাত্র ২.৫ শতাংশ কৃষিকাজ, শিল্প উৎপাদন এবং মানুষের পান উপযোগী। পানি শুধু জীবন, অর্থনীতি ও প্রকৃতির চালিকা শক্তিই নয়, এটি আমাদের খাদ্য উৎপাদনের মূল ভিত্তি। পৃথিবীর স্বাদুপানির ৭২ শতাংশই কৃষি তথা খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু এই পানি অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের মতো অসীম নয়। বিশ্বব্যাপী দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শহরায়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দ্রুত এই পানি শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমরা ক্রমেই এই মহামূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদটি হারাতে হারাতে এমন অবস্থানে পৌঁছে যাচ্ছি যেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনো সুযোগ নেই। জলজ বাস্তুতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল বিশ্বের প্রায় ৬০০ মিলিয়ন মানুষ এই পানি দূষণ, বাস্তুতন্ত্রের বিলোপ, জলবায়ু পরিবর্তন ও অটেকসই চর্চার দরুন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আমাদের বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য যেমন আরো অধিক খাদ্য উৎপাদন করতে হবে, তেমনি পানির ব্যবহার আরো যৌক্তিক ও সীমিত করতে হবে যাতে করে পানির সমান প্রাপ্যতা নিশ্চিত হয়, আমাদের জলজ বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষিত থাকে এবং কেউই পিছিয়ে না থাকে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সতেজ মৌসুমি খাদ্য বেছে নিয়ে, এমনকি খাদ্য অপচয় রোধ করে এবং নিরাপদ উপায়ে তা পুনর্ব্যবহারের পথ অনুসন্ধান করে আমরা পরিবর্তন সাধন করতে পারি যাতে করে পানি দূষণ ও অপচয় হ্রাস পায়।
বলা বাহুল্য, এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের বিস্তৃত ভূখ-ের ওপর দিয়ে বহমান নদ-নদী, হাওর-বাঁওড়, বিল-ঝিল, পুকুর-দিঘি, বৈচিত্র্যপূর্ণ বিপুলসংখ্যক ছোট-বড় জলধারার পানি ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নে বর্তমান সরকার অসংখ্য  গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ অর্জনের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ পানি ব্যবস্থাপনা, স্যানিটেশন, কৃষিকাজ, শিল্প খাত ও বাস্তুচ্যুতি ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পানি চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকার পানি অবকাঠামো সংস্কার, নদীর তীর সংরক্ষণ, নদীর নাব্য রক্ষার্থে ড্রেজিং, খাল পুনঃখনন, প্রাকৃতিক জলধার রক্ষণাবেক্ষণ এবং নতুন জলাধার ও ব্যারাজ নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।
সাম্প্রতিক মহামারি করোনা মারাত্মক সংকট ডেকে এনেছিল কৃষক ও খাদ্য ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার জীবনে। করোনাভাইরাস সংকটের কারণে খাদ্য সমস্যাটি কঠিন হয়ে ওঠার আশঙ্কা ছিল উন্নত দেশগুলোতেও। দুই বছরের করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কা না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বকে চরম খাদ্য সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু তীব্র সংকটময় এ পরিস্থিতেও বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ইতিবাচক। বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘র‌্যাপিড অ্যাসেসমেন্ট অব ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন সিকিউরিটি ইন দ্য কনটেক্সট অব কোভিড-১৯ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিগত ৪০ বছরে কৃষিক্ষেত্রে ও খাদ্য নিরাপত্তায় বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। বিশেষত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আবাদযোগ্য জমি হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তন এবং দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ার চ্যালেঞ্জের মধ্যেও বাংলাদেশ দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, পেয়েছে শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, মাংস উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা।
কৃষির উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সম্প্রতি আমরা নিরবচ্ছিন্ন, সাশ্রয়ী ও দ্রুত যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছি। এ সেতুর মাধ্যমে নদীবিধৌত উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি ও মৎস্যসম্পদ আহরণ এবং সারা দেশে দ্রুত বাজারজাতকরণের ফলে কৃষি ও কৃষকের জীবনমান আরো উন্নত হবে এবং দেশের সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী পদক্ষেপে আমরা খাদ্য উৎপাদনের অন্যতম রসদ পানির যুক্তিযুক্ত ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা যুক্ত হয়েছি ডেল্টা প্ল্যানের মতো বৃহৎ কর্মকা-ে। কৃষির উন্নয়নকে টেকসই করতে তথা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদার কথা মাথায় রেখেই এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
২০২১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ ফুড সিস্টেম সামিটে করোনা-পরবর্তী পুনরুদ্ধার ও স্থিতিশীল খাদ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের ওপর জোর দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য অধিক খাদ্য উৎপাদন, খাদ্যের অপচয় হ্রাস, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য কৃষিতে গবেষণা, বিনিয়োগ, উন্নত প্রযুক্তি বিনিময়, প্রয়োজনীয় তহবিল ইত্যাদিসহ পাঁচ দফা সুপারিশ পেশ করেন। জাতিসংঘ ফুড সিস্টেম সামিটে বিশ্ব খাদ্য ব্যবস্থার সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ দফা বাস্তবায়ন ও ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এই সুপারিশগুলো মাথায় রেখে এবং পানিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আমরা একত্রে খাদ্য, মানুষ তথা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সামনে এগিয়ে যেতে পারি।

লেখক : পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন : ০১৭১১৯৬৯৩১৮ ই-মেইল :dirais@ais.gov.bd

বিস্তারিত
পানি শোধনকল্পে স্যানিটাইজারের ব্যবহার এবং ফলমূল ও শাকসবজি হতে অণুজীব দূরীকরণ

পানি শোধনকল্পে স্যানিটাইজারের ব্যবহার এবং ফলমূল ও শাকসবজি হতে অণুজীব দূরীকরণ
ড. মো: গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী১ মো: হাফিজুল হক খান২
নিরাপদ পানি জীবনের জন্য অপরিহার্য জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষের সুস্থভাবে জীবনধারণের জন্য দৈনিক ১.৫-৩.৫ লিটার পানি পান করা দরকার। শহর এলাকায় ৪০ ধরনের উপরে বোতলজাত পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। জারের পানি ও ব্র্যান্ড বোতলজাত পানিতে প্রাপ্ত টিডিএস (মিলিগ্রাম/লিটার) এর পরিমাণ বিডিএস স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী নিচে রয়েছে। একইভাবে ক্লোরাইড, নাইট্রেটের পরিমাণও নিচে রয়েছে। পানিতে কলিফর্ম ও ফোক্যাল কলিফর্মের উপস্থিতি রয়েছে সেখানে বিডিএস স্ট্যান্ডার্ড শূন্য ধরা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে খাবার পানির টিডিএস মাত্রা প্রতি লিটার পানিতে ৩০ মিলিগ্রাম হওয়া বাঞ্ছনীয়। বর্তমানে বেশির ভাগ বোতল জাত পানি ‘রিভার অসমোসিস’ পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় যেখানে জীবাণুমুক্ত হয় তবে খনিজ উপাদানের পরিমাণ কিছুটা হ্রাস পায়। তবে জারে ব্যবহারকৃত পানি মান নিয়ন্ত্রণভাবে উৎপাদন করা হয় বিধায় জারের পানির টিডিএস এর মাত্রা বোতলজাত পানির মাত্রার চেয়ে বেশি থাকে। ডব্লিউএইচও এর মাত্রা অনুযায়ী পানির টিডিএস ৩০০ এর নিচে থাকা উত্তম পানি হিসেবে বিবেচ্য আবার ১২০০ এর উপরে টিডিএস অগ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
অনুরূপভাবে, আমাদের দেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই ভূগর্ভস্থ পানিতে অজৈব আর্সেনিকের মাত্রা অনেক বেশি যা জৈব আর্সেনিকের চেয়ে মারাত্মক ক্ষতিকর। বিভিন্ন গবেষণালব্দ ফলাফল হতে দেখা যায়, দেশের চাঁদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, সাতক্ষীরা, ফরিদপুর, মেহেরপুর, বাগেরহাট জেলায় আর্সেনিকের মাত্রা অন্যান্য জেলার চেয়ে অধিক পরিলক্ষিত হয়। অজৈব আর্সেনিকযুক্ত খাবার বা পানি দীর্ঘদিন গ্রহণ করার ফলে চর্ম ক্যান্সার, ক্ষত হওয়াসহ অন্যান্য জটিল রোগের কারণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদনে যথেচ্ছা রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও অন্যান্য  রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের ফলে অনেক ক্ষুদ্র প্রাণিকুলের আবাস যেমন ধবংস হচ্ছে এবং অনেক সময় পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। তেমনি অতিরিক্ত ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের ফলে রাসানিক দ্রব্যের অবশিষ্টাংশের উপস্থিতির কারণে তা মানবদেহে ক্যান্সারের ন্যায় বিভিন্ন রোগের সৃষ্টিরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক সময় ফসলের জমিতে পানির সাথে মিশিয়ে যাচ্ছে এবং পরবর্তীতে উক্ত পানিতে পণ্য ধৌতকরণের ফলে লেড, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, নিকেল এর মতো ভারি ধাতব পদার্থ এর উপস্থিতির প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ- ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনাসহ বিভিন্ন জায়গা হতে বিভিন্ন ফল, সবজি ও ব্যবহারকৃত পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয় এবং সেখানে দেখা যায়, কুমিল্লা হতে সংগ্রহীত ফুলকপি ও শিম এর নমুনার প্রায় ২৭ ভাগ ঊ. পড়ষর এবং বাঁধাকপি, ফুলকপি ও টমেটো নমুনার প্রায় ২৭ ভাগ ঝযরমবষষধ দ্বারা আক্রান্ত ছিল। যশোর থেকে সংগ্রহীত টমেটো, লালশাক ও ঢ়েঁড়স নমুনার প্রায় ৬৩ ভাগ ঊ. পড়ষর দ্বারা আক্রান্ত পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, যা স্বাস্থ্যসম্মত নির্দেশকের সীমানার মধ্যে রয়েছে। এনএটিপি-২ প্রকল্প এর গবেষণা কাজের জন্য ৩০টি নমুনা গাজীপুর অঞ্চল হতে সংগ্রহ করা হয় এবং তাতে দেখা যায়, ফল ও সবজি ধৌতকরণের জন্য বিপণনকৃত পণ্যে যে পানি ব্যবহার করা হচ্ছে সেখানে ক্রোমিয়াম এর উপস্থিতি ১৩৬ পিপিএম লক্ষণীয়। একইভাবে গাজীপুর এর কাপাসিয়া হতে সংগ্রহীত নলকূপের পানিতে নিকেল (০.০৪ পিপিএম) এবং কোবাল্ট (০.০২ পিপিএম) এর উপস্থিতি রয়েছে।
সাম্প্রতিক জাতিসংঘের একদল গবেষকের তথ্য মোতাবেক ৩৭ হাজার ক্ষতিকর ও বিষাক্ত অণুজীব শনাক্ত হয়েছে যা পানি, মাটি ও বাতাসে বিচরণ করছে এবং তাদের প্রভাবে বছরে সারা বিশে^ ৪২ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হচ্ছে এবং এই ক্ষতির পরিমাণ ৪ গুণ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে যা নিঃসন্দেহে দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কাজেই ফলমূল ও শাকসবজি মানসম্মত পানি দ্বারা ধৌত করা যেমন দরকার তেমনি প্রয়োজনে স্যানিটাইজার বা শোধন করে নিতে হবে যাতে অণুজীবের সংক্রমণ না ঘটে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) এর পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ কৃষিপণ্যে অণুজীবের সংক্রমণ হ্রাস করতে স্যানিটাইজার এর ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করছে যা সতেজ ফলমূল ও শাকসবজি বা ফ্রেশকাট পণ্যের গুণগতমান অক্ষুণœ রেখে জীবণকাল বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
স্যানিটাইজার হলো এমন একটি রাসায়নিক যৌগ যা অণুজীবের সংক্রমণ কমাতে সহায়তা করে। সাধারণত খাদ্যের সংস্পর্শে থাকা অণুজীবকে নির্মূল বা কমাতে ক্লোরিন ব্লিচ বা অ্যামোনিয়াম যৌগ স্যানিটাইজার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ক্লোরিন ও হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের যথাযথ পরিমাণ খাদ্যদ্রব্যের অণুজীবের সংক্রমণ কমাতে সহায়তা করে। সতেজ ফলমূল ও শাকসবজি মাঠ হতে বাজার পর্যন্ত স্থানান্তরকালে সরবরাহ চেইনে (ঝঁঢ়ঢ়ষু পযধরহ) বিভিন্ন পর্যায়ে হাত বদলের ফলে জীবাণু সংক্রমণের (ঈৎড়ংং পড়হঃধসরহধঃরড়হ) সম্ভাবনা থাকে। দূষিত পানি, মাটি ও অন্যান্য উৎস হতে বিভিন্ন ক্ষতিকর অণুজীব যেমন: ঊ. পড়ষর, ঝধষসড়হবষষধব ইত্যাদি সতেজ কৃষিপণ্যে প্রবেশ করতে পারে। এছাড়াও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকালে স্বাস্থ্যসম্মত ও উপযুক্ত তাপমাত্রায় সংরক্ষণ না করার ফলেও অণুজীবের উপস্থিতির সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে ফ্রেশকাট পণ্য স্বাস্থ্যসম্মত ও উপযুক্ত প্যাকেটে সংরক্ষণ না করার ফলে খাদ্য দ্রব্যে বিভিন্ন ক্ষতিকর অণুজীবের উপস্থিতি বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে লক্ষ করা যায়। আমাদের দেশে শহরের রাস্তা ও মার্কেটের পাশে অনেক ক্ষুদ্র বিক্রেতাকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সতেজ ফলমূল কেটে বিক্রয় করতে দেখা যায় যেখানে একই পাত্রের পানি বার বার ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলমূল কেটে টুকরো করতে স্টেইনলেস স্টিলের চাকু বা ছুরি ব্যবহার না করা ও জীবাণুমুক্ত পানিতে না ধৌতকরণের ফলে বিভিন্ন ক্ষতিকর অণুজীব অতি সহজেই খাবারে প্রবেশের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত অনেকেই বিভিন্ন অসুস্থতায় ভুগছে। উপযুক্ত স্যানিটাইজার ব্যবহারের মাধ্যমে সতেজ কৃষিপণ্যের গুণাগুণ অক্ষুণœ রেখে সংরক্ষণ করা যায় যা ক্ষতিকর অণুজীবের পরিমাণ কমাতে সহায়তা করে যা ফলমূল ও শাকসবজির সংগ্রহোত্তর জীবনকাল বৃদ্ধি পায়।
ফলমূল ও শাকসবজি হতে অণুজীব দূরীকরণ পদ্ধতিসমূহ                                                                                                     
ফলমূল ও শাকসবজি প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ধৌতকরণ : ফলমূল/শাকসবজি ধৌতকরণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম হাত ভালোভাবে (১৫-২০ সেকেন্ড) ধুয়ে নিতে হবে। এরপর ব্যবহৃত পাত্র/গামলা ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সামগ্রী (ছুরি, কাঁচি, চপিং বোর্ড) ১ লিটার পানিতে ০.১ গ্রাম ক্যালসিনেটেড ক্যালসিয়াম (০.০১%) অথবা ১ লিটার পানিতে ৫ মিলিলিটার এসিটিক এসিড (০.৫%) দ্বারা ধৌত করতে হবে।
সাধারণ পানিতে ফলমূল ও শাকসবজি ধৌতকরণ : ফলমূল ও শাকসবজির ক্ষেত্রে বেশির ভাগ রোগ জীবাণুর উৎস মাটি। সংগ্রহকৃত ফলমূল ও শাকসবজি বা যেকোন কৃষিপণ্য প্রথমেই চলমান অথবা স্থায়ী পানি দ্বারা ধৌত করার মাধ্যমে অণুজীব অনেকাংশে দূর করা যায়। ধৌত করার সময় ফলমূল বা শাকসবজির উপরিভাগ ১ মিনিট হাত দিয়ে ঘষে ভাল করে পরিষ্কার করে নিতে হবে। কিন্তু শাকসবজির ক্ষেত্রে ৪-৫ বার ধুয়ে নিতে হবে যাতে কোন মাটি/ধূলিকণা অথবা অন্যকোন পদার্থ লেগে না থাকে।
ফুটানো/সিদ্ধ পানিতে ফলমূল ও শাকসবজি ধৌতকরণ : গবেষণা ফলাফলে পর্যবেক্ষণ করা গেছে যে, ফলমূল ও শাকসবজি চলমান অথবা স্থায়ী পানি দ্বারা ধৌত করার মাধ্যমে যে পরিমাণ রোগ জীবাণু দূর করা যায় তার চেয়ে ফুটানো/সিদ্ধ পানি দ্বারা শাকসবজি ধৌত করা হলে অণুজীবের পরিমাণ অনেকাংশে হ্রাস পায়।
শাকসবজি পর্যাপ্ত তাপমাত্রায় রান্না করা : সাধারণত পর্যাপ্ত তাপমাত্রায় (৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের উপরে) রান্না করা অর্থাৎ ভাল করে সিদ্ধ করা হলে খাদ্যে অণুজীবের উপস্থিতি থাকে না বা অণুজীব মারা যায়। এ পদ্ধতির কার্যকারিতা নির্ভর করে রান্নার সময় তাপমাত্রার পরিমাণ, খাদ্যদ্রব্যে পানি সংযোজনের পরিমাণ এবং রান্নার ধরন (খোলা/বন্ধ) ইত্যাদির উপর। অবশ্যই রান্নার পূর্বে হাত এবং পাত্র ভালভাবে সাবান/ডিটারজেন্ট/ডিশ ওয়াশার দিয়ে পর্যাপ্তভাবে ধৌত করতে হবে।
ফলমূল ও শাকসবজি বিভিন্ন স্যানিটাইজার দ্রবণে ধৌতকরণ ক্যালসিনেটেড ক্যালসিয়াম এক প্রকার প্রাকৃতিকভাবে তৈরিকৃত স্যানিটাইজার। প্রথমে নির্দিষ্ট পরিমাণে ক্যালসিনেটেড ক্যালসিয়াম দ্রবণ তৈরি করতে হবে। একটি পরিষ্কার গামলা/পাত্র নিয়ে তাতে ১ লিটার পানিতে ০.১ গ্রাম (০.০১% ক্যালসিনেটেড ক্যালসিয়াম, ঢ়ঐ প্রায় ১১) পাউডার যোগ করে ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। এখন শাকসবজি/ফলমূল ১-৩ মিনিট উক্ত মিশ্রণে ডুবিয়ে রাখতে হবে এবং হাত দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে। অতঃপর পরিষ্কার পানিতে একবার ধৌত করে নিতে হবে এবং পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। এতে করে ক্ষতিকর অণুজীবের সংখ্যা হ্রাস পায় ফলে শাকসবজি/ফলমূলের সংগ্রহোত্তর জীবনকাল বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও গবেষণায় প্রতীয়মান হয় যে, প্রতি লিটার পানিতে ৫ মিলিলিটার অ্যাসিটিক এসিড (৫% এসিটিক এসিড) মিশিয়ে ২-৩ মিনিট ফলমূল/শাকসবজি ডুবিয়ে রাখলে অণুজীবের সংখ্যা হ্রাস পায়। অ্যাসিটিক এসিড মিশ্রিত দ্রবণ থেকে ফলমূল/শাকসবজি উঠিয়ে নিয়ে বাতাসে ৫-৬ মিনিট শুকিয়ে নিতে হবে। এতে করে ফলমূল বা শাকসবজির গুণগত ও পুষ্টিমানের তেমন কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের কৃষি আবহমানকাল থেকে অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে। কৃষি বর্তমানে রোলমডেল হিসেবে বিশে^ স্বীকৃত। কৃষির এই অগ্রগতিতে কৃষিবান্ধব সরকারের রয়েছে বহুমুখী ও ব্যাপক কর্মকা-, বিনিয়োগ এবং সার্বক্ষণিক নিবিড় পর্যবেক্ষণ। কৃষক, গবেষক, সম্প্রসারণ, উন্নয়নকর্মী, কৃষি সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে সর্বমহলের মনোযোগ, অক্লান্ত পরিশ্রম ও পারস্পারিক সহযোগিতা। ফলে কৃষির উৎপাদন বেড়েছে ব্যাপক এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে রপ্তানি হচ্ছে অনেক কৃষিজাত পণ্য। কৃষিতে বিনিয়োগে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি ব্যক্তিবর্গ তথা উদ্যোক্তা। এতদ্সত্ত্বেও কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে রয়েছে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ। বর্তমান সরকার এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ৪ওজ কে সর্বক্ষেত্রে যুক্ত করাতে কৃষিকে করবে আরও প্রাণসঞ্চার ফলে আগামীর কৃষি হবে আধুনিক ও উন্নত কৃষি।

লেখক : ১ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও খাদ্য প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষক,   ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১। মোবাইল : ০১৭১২২৭১১৬৩, ই-মেইল: ferdous613@gmail.com

 

বিস্তারিত
জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ

জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ
আব্দুন নাসের খান
প্রত্যাশিত ব্যবহার ও উপযোগিতা অনুযায়ী মানুষের জন্য বিশুদ্ধ ও স্বাস্থ্যসম্মত আহার্যই নিরাপদ খাদ্য। অনিরাপদ খাদ্য শুধু স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণই নয় বরং দেহে বিভিন্ন রোগের বাসা বাধারও কারণ। নিরাপদ খাদ্য মানুষের অন্যতম প্রধান মৌলিক অধিকার। তাই আমাদের খাদ্য নিরাপদ, পুষ্টিকর ও সুষম হওয়া প্রয়োজন। নিরাপদ খাদ্য একদিকে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ সুগম করে। দীর্ঘজীবন ও সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার অত্যাবশ্যক।
সকলের জন্য পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (ঝউএ) এর লক্ষ্যমাত্রা ২, ৩, ৬, ৮, ১২ এবং ১৭ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চয়তার সাথে সম্পর্কিত। সরকার এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তিতে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। খাদ্য শৃঙ্খলের শুরু হতে ভোক্তা পর্যন্ত দূষণ ও ভেজালমুক্ত নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ প্রণীত হয়। এই আইন বাস্তবায়নে খাদ্যের পুষ্টিমান ও নিরাপদতা নিশ্চিতকল্পে সরকারের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী সংস্থা বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানামুখী কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্য। ব্যবস্থাপনা করাই হচ্ছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের রূপকল্প।
কৌশলগত লক্ষ্য
নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দ্বিতীয় মেয়াদে ৫ (পাঁচ) বছর (২০২২-২০২৬) মেয়াদী কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে :
া    কৌশলগত লক্ষ্য ১ : সামগ্রিক নিরাপদ খাদ্য ইকোসিস্টেম সমন্বয়ের জন্য বিএফএসএ কে একটি একক নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
া    কৌশলগত লক্ষ্য ২ : নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা আমলে নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক মান প্রতিষ্ঠা করা।
া    কৌশলগত লক্ষ্য ৩ : বাংলাদেশে একটি কার্যকর ও স্বচ্ছ কাঠামো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণমূলক প্রতিপালন পদ্ধতি   শক্তিশালী করা।
া    কৌশলগত লক্ষ্য ৪ : বৈশ্বিক পর্যায়ে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি এবং বাণিজ্য সহজীকরণে বিএফএসএ এর ভূমিকা বৃদ্ধি করা।
া    কৌশলগত লক্ষ্য ৫ : (নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক বৈজ্ঞানিক/কারিগরি কর্মকান্ডের কার্যকারিতা দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে বাড়ানো।
া    কৌশলগত লক্ষ্য ৬ : খাদ্য নিরাপদতা এবং পুষ্টির ক্ষেত্রে সমস্ত অংশীজনদের সক্ষমতা তৈরি করা।
া    কৌশলগত লক্ষ্য ৭: নিরাপদ এবং পুষ্টিকর খাবারের চাহিদা বাড়াতে ভোক্তা সচেতনতা তৈরি করা
নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে কর্তৃপক্ষ সংশি¬ষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞজন এবং অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে আইনের ৮৬ ও ৮৭ ধারা অনুযায়ী অদ্যাবদি ৩টি বিধিমালা ও ১১টি প্রবিধানমালা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করে চলছে।
অভিযোগ ও মতামত  গ্রহণের জন্য হটলাইন নাম্বার ১৬১৫৫ চালু করা হয়। খাদ্য নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা কার্যক্রম বেগবান এবং খাদ্যপণ্য পরীক্ষা ও রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশে বিদ্যমান খাদ্য পরীক্ষাগারসমূহের জন্য অনলাইন খধনড়ৎধঃড়ৎু ওহভড়ৎসধঃরড়হ জবঢ়ড়ংরঃড়ৎু সফটওয়্যার প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া খাদ্যপণ্যের স্ট্যান্ডার্ড হারমোনাইজেশন তৈরি ও রপ্তানিকারকদের জন্য খাদ্যপণ্যের অনলাইন স্বাস্থ্য সনদ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে বিএফএসএ এর নিজস্ব টিম কর্তৃক ১১৪৯৮টি খাদ্যস্থাপনা (পাইকারি বাজার, খুচরা বাজার, কাঁচা বাজার, রেস্টুরেন্ট, খাদ্য কারখানা ইত্যাদি) পরিদর্শন করা হয়।
পানির নমুনা পরীক্ষা
২০২২-২৩ অর্থবছরে চট্টগ্রাম, গোপালগঞ্জ, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলা হতে মনিটরিং ও অভিযোগের ভিত্তিতে প্রেরিত ১৮টি পানির নমুনায় আর্সেনিক (অং), মারকারী (ঐম), সীসা (চন), ক্যাডমিয়াম (ঈফ), ঝধষসড়হবষষধ, ঊ. পড়ষর, ঋবপধষ পড়ষরভড়ৎস ব্যাকটেরিয়া পরীক্ষা করা হয়। ফলাফল বিশে¬ষণ করে  গোপালগঞ্জ হতে প্রেরিত ৪টি পানির নমুনায় ঋবপধষ পড়ষরভড়ৎস,ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায় যার উপস্থিতি মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ঋবপধষ পড়ষরভড়ৎস ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেলে পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
কোমল পানীয় ক্যাফেইনের পরিমাণ নির্ণয় বিষয়ক গবেষণা
২০২২-২৩ অর্থবছরে কোমল পানীয়ের ২৬টি নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার ফলাফল বিশে¬ষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশ স্টান্ডার্ড ইউঝ ১১২৩:২০১৩ (ঞযরৎফ জবারংরড়হ) অনুযায়ী ২৬টি কোমল পানীয়ের নমুনার মধ্যে ০৯টি নমুনায় ক্যাফেইন এর মাত্রা অনুমোদিত মাত্রা ১৪৫ মি.গ্রা:/লি. এর সামান্য উপরে পাওয়া যায়। এছাড়াও ফ্রুট সিরাপে ক্যাফেইন এর উপস্থিতি রয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে মোবাইল ল্যাবরেটরির মাধ্যমে পরীক্ষিত নমুনার ফলাফল
কর্তৃপক্ষের মোবাইল ল্যাবরেটরি দ্বারা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঢাকার বিভিন্ন স্থান হতে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, সবজি, ভোজ্যতেল, পাউরুটি ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্যের মোট ৩০০টি নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যে আলফাটক্সিন গ১, অ্যাবামেক্টিন, অ্যান্টিবায়োটিকের অবশিষ্টাংশ, ডিটারজেন্ট ও হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড এর উপস্থিতি পরীক্ষার সকল নমুনার ফলাফল গ্রহণযোগ্য হিসেবে পরিলক্ষিত হয়।
এছাড়া সবজির ১০টি নমুনায় সাইপারমেথ্রিন ও ১০টি নমুনায় কার্বোফুরান কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ পরীক্ষা করে ফলাফল সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার নিচে পাওয়া যায়। ৫৮টি পাউরুটির নমুনায় পটাশিয়াম ব্রোমেটের উপস্থিতি শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা হয় এবং সকল নমুনায় পটাশিয়াম ব্রোমেটের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় নাই।
মোবাইল ল্যাবের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন স্থাপনার ভাজা-পোড়া খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত তেলের টোটাল পোলার কমপাউন্ড এর পরিমাণ পরীক্ষা করা হয় এবং ৭৯টি পরীক্ষিত নমুনার মধ্যে ১৪টিতে অগ্রহণযোগ্য মাত্রায় পোড়া তেল লক্ষ করা যায়। তাছাড়া ১৬টি ফর্টিফাইড ভোজ্যতেলের নমুনায় ‘ভিটামিন এ’ এর পরিমাণ পরীক্ষায় ৫টি নমুনায় মাত্রা বহির্ভূত ফলাফল পাওয়া যায় (চিত্র-১ দৃষ্টব্য)। ভিটামিন এ পরীক্ষার নমুনা পুনঃপরীক্ষণের জন্য ল্যাবে প্রেরণ করা হয়।
নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে জনসচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা কার্যক্রম
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বছরব্যাপী উপজেলা/জেলা/বিভাগীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে সচেতনতামূলক ৩১৬টি কর্মসূচি  সুশীলসমাজ ও খাদ্যকর্মীদের নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে অবহিতকরণ শীর্ষক ০৫টি সেমিনার এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিরাপদ খাদ্যের ভূমিকা শীর্ষক ৬৫টি কর্মশালাসহ সর্বমোট ৩৮৬টি সেমিনার/কর্মশালা/কর্মসূচি সম্পন্ন করা হয়। উক্ত কর্মসূচিতে মোট ১১,১৪৮ জন অংশীজন অংশগ্রহণ করেন।
২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশব্যাপী খাদ্যকর্মীদের অংশগ্রহণে ২২০টি প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয়েছে যেখানে ৬,৯৮০ জন খাদ্যকর্মীকে নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
পারিবারিক পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১২ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ‘নিরাপদ খাদ্যবিষয়ক পারিবারিক নির্দেশিকা’ এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। পারিবারিক পর্যায়ে ১,১৫,০০০ নির্দেশিকা বিতরণ হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের মাঝে নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সূচনালগ্ন হতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেমিনার/কর্মসূচি আয়োজনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ৪৯৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেমিনার/কর্মসূচি আয়োজন করে এবং এতে প্রায় ৪৯,৫০০জন শিক্ষার্থীকে নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে অবহিত করা হয়।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ২০২২-২৩ অর্থবছরে গবেষণা অনুদান প্রদানের লক্ষ্যে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয় হতে গবেষণা প্রস্তাব আহ্বান করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হতে মোট ১১৪টি গবেষণা প্রস্তাব পাওয়া যায়। উক্ত গবেষণা প্রস্তাবসমূহ কারিগরি ও প্রেজেন্টেশন মূল্যায়নের ভিত্তিতে মোট সাতটি গবেষণা প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫০% অর্থাৎ ৩৭ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে এবং বাকি অর্থ আগামী বছরে নীতিমালা অনুযায়ী প্রদান করা হবে।
বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য শুধু খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয় বরং নিরাপদ ও পুষ্টিসম্মত খাদ্যের মাধ্যমে অপুষ্টির অভাব দূর করে সুস্থ সবল মেধাবী জাতি গঠন নিশ্চিত করতে হবে। দেশের খাদ্য শৃঙ্খলের বিভিন্ন ধাপে বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদন হতে খাবার টেবিল পর্যন্ত খাদ্যকে জনগণের জন্য নিরাপদ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দেশে মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য সংস্থানের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ, এসডিজির অভীষ্টসমূহ অর্জনে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ, কর্তৃপক্ষের কার্যপরিধি সম্প্রসারণ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্যশৃঙ্খলের নিরাপদতার মান উন্নয়নে যথাযথ ভূমিকা পালন করছে।

লেখক : সচিব, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, খাদ্য মন্ত্রণালয়, বিএসএম অফিস কমপ্লেক্স (ভবন ২), ১১৯ কাজী নজরুল ইসলাম সড়ক ঢাকা। ফোন : ২২২২২৩৪৩৬, ই-মেইল :secretary@bssa.gov.bd

বিস্তারিত
পানির সাশ্রয়ী ব্যবহার ও টেকসই ভবিষ্যৎ

পানির সাশ্রয়ী ব্যবহার ও টেকসই ভবিষ্যৎ
স্বপ্নীল বড়–য়া১  মো. এনায়েত উল্ল্যাহ রাফি২
নীলনদকে ঘিরে প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা গড়ে উঠার পেছনে অন্যতম নিয়ামক ছিল পানি, সুপেয় পানি। পৃথিবীর মানবসভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে স্বাদু পানির উৎসকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আধুনিক মানবসভ্যতা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও কৃষি।
পৃথিবী পৃষ্ঠের শতকরা ৭১ ভাগ পানি দ্বারা আচ্ছাদিত। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এইটাও সত্য যে, পৃথিবীর মাত্র ২.৫ শতাংশ পানি মানুষের জন্য ব্যবহারযোগ্য, যা দিয়েই কৃষি, শিল্পসহ যাবতীয় প্রয়োজন মিটানো হয়। মানবদেহের শতকরা ৫০ ভাগ পানি দ্বারা পূর্ণ। শারীরতাত্ত্বিক যাবতীয় কার‌্যাবলী পানির উপস্থিতি ছাড়া অসম্পূর্ণ। তাই খাদ্যের ছয়টি মৌলিক উপাদানের মধ্যে পানি অন্যতম। পানি ছাড়া যেমন খাদ্য অসম্পূর্ণ ঠিক তেমনি পানির প্রয়োজন রয়েছে শিল্পসহ সকল সেক্টরে।
কিন্তু সুপেয় পানির উৎস ক্রমহ্রাসমান। ফলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা সুপেয় পানির অভাব বোধ করছে। পৃথিবী জুড়ে প্রায় ২.৪ বিলিয়ন ব্যক্তি খড়াপ্রবণ অঞ্চলে বাস করে। তাদের মধ্যে অগণিত কৃষক পানির উৎসের অপ্রতুলতার কারণে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগীদের মধ্যে আদিবাসী, অভিবাসী ও উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী অন্যতম। রূঢ় বাস্তবতা হলো যে এই মহামূল্যবান সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা প্রতিনিয়ত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, ফলে  দুর্বল সম্প্রদায়গুলো নিরাপদ পানির অভাবে ভুগছে। পরিসংখ্যান বলে বিগত দশকে জনপ্রতি বিশুদ্ধ পানির উৎস শতকরা ২০ ভাগ কমেছে। যার বিরূপ প্রভাব প্রতীয়মাণ হয়েছে বাংলাদেশেও। ইউনিসেফের তথ্য মতে, বাংলাদেশে ৩৮.৩ শতাংশ মানুষ অনিরাপদ উৎস থেকে পানি পান করে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত কমতে থাকা, ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতির কারণে নিরাপদ পানির সন্ধানে উপকূলবাসীদের কলসি, বোতল, ড্রাম নিয়ে নৌকা বা ভ্যানে করে দূরপাল্লার পথ পাড়ি দিতে হয়। নদীমাতৃক দেশ হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর থেকে দেশের জলাভূমি ৭০ শতাংশ কমেছে। অনেক নদীও শুকিয়ে গিয়েছে। ইতোমধ্যে সারাদেশে অন্তত আট হাজার কিলোমিটার নৌপথ হারিয়ে গেছে। এই ক্রমহ্রাসমান পানির উৎসের পরিস্থিতির বিরূপ প্রভাব পড়েছে মানবসভ্যতা, কৃষি, খাদ্য ও শিল্প উৎপাদনে। ফলে, খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ অর্জন ব্যাহত হচ্ছে। মানুষের অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা, ভুগর্ভস্ত পানির যথেচ্ছ ব্যবহার, পানি দূষণমূলক কর্মকা-, অপরিকল্পিত নগরায়ন, জনসংখ্যার ক্রমবৃদ্ধি, পরিপূর্ণ পুনঃব্যবহারের অভাব এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিদ্যমান পানির উৎসসমূহকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
জাতিসংঘ ঘোষিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাতেও (এসডিজি)’  প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পানির অপরিসীম এই গুরুত্বকে, যার ষষ্ঠ লক্ষ্য হলো ‘নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন’ সকলের জন্য পানি ও স্যানিটেশন টেকসই ব্যবস্থাপনা ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্য অর্জনের লক্ষ্যে এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘পানি জীবন, পানিই খাদ্য। কেউ থাকবে না পিছিয়ে।’ এই মূল প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আগামী  ১৬ই অক্টোবর বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৩’ উদযাপিত হবে। ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-র ২০তম সাধারণ সভায় হাঙ্গেরির তৎকালীণ খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী  ড. প্যাল রোমানি বিশ্বব্যাপী এই দিনটি উদ্্যাপনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৮১ সাল থেকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিষ্ঠার দিনটিতে (১৬ অক্টোবর, ১৯৪৫) দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিবারণের  লক্ষ্যে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোতে এই দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় এ বছরেও বিশ্বব্যাপী নানা  আয়োজনের  মধ্যে দিয়ে  বিশ্ব খাদ্য দিবস উদ্যাপিত হতে চলেছে। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নগরায়ণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানির প্রাপ্যতাকে বুদ্ধিমত্তার সাথে পানি ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বাড়ানোই হবে এ দিবস উদ্যাপনের মূল লক্ষ্য।
নিরাপদ পানির সহজলভ্যতা পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তার উল্লেখযোগ্য পরিমাপক, যা নিশ্চিতকরণে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং এফএও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের অর্থায়নে Program on Agricultural and Rural Transformation for Nutrition, Entrepreneurship, and Resilience in Bangladesh (PARTNER) প্রণয়নে এফএও, বাংলাদেশ সরকারকে প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা প্রদান করেছে, যার ১০টি  Disbursement Linked Indicator (DLI) এর মধ্যে একটি হলো ঊভভরপরবহঃ ওৎৎরমধঃরড়হ গধহধমবসবহঃ, অর্থাৎ দক্ষ সেচব্যবস্থা। তাছাড়াও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা, পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্ট প্রযুক্তির প্রবর্তন ও প্রশিক্ষণসহ জাতীয়পর্যায়ে পানির সদ্ব্যবহার এর মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে বাংলাদেশ সরকারকে এফএও প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা প্রদান করে চলেছে।
ই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর কৃষি মন্ত্রণালয়  এবং এফএওর  যৌথ উদ্যোগে বিভিন্ন  কর্মশালা ও কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্ব খাদ্য দিবস উদযাপন করা হয়ে থাকে। এই বছরও ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৩’ উদযাপন উপলক্ষ্যে সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে পানির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করার উদ্দেশ্যে মুঠোফোনে খুধেবার্তা পাঠানো, বিটিভি ও অন্যান্য বেসরকারি টেলিভিশনে টকশো আয়োজন, বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৩ এর  প্রতিপাদ্য বিষয় সম্বলিত পোস্টার, বিলবোর্ড এবং তথ্যচিত্র প্রচার, ৫-১৯ বছর বয়সী শিশু এবং কিশোরদের মাঝে পোস্টার অঙ্কন প্রতিযোগিতা, কৃষিকথা পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশসহ নানাবিধ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে জেলা এবং উপজেলা পর্যায়েও ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৩’ বর্ণাঢ্যভাবে আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বিশ্ব খাদ্য দিবসের জন্য দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল ক্ষুধা ও দারিদ্র্য হ্রাস করে এবং সমস্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের মাধ্যমে জীবন ও জীবিকার কেন্দ্রস্থল হিসেবে তুলে ধরেছেন পানির ভূমিকা। এই বিশ্ব খাদ্য দিবসে, সবার জন্য বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। পানি যাতে দূষিত না হয় সে ব্যবস্থা নেওয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন কমাতে এবং গৃহস্থালি ও অন্যান্য উদ্দেশ্যে ভূপৃষ্ঠের পানির সর্বোচ্চ ব্যবহারে মনোযোগ দিতে হবে। পানি আমাদের খাদ্য ব্যবস্থাপনার সুতিকাগার। এই পৃথিবীতে জীবের অস্তিত্ব নির্ভর করবে সাশ্রয়ী পানি ব্যবস্থাপনার উপর। আমাদের আজকের পানি সাশ্রয়ী কর্মকা-ই নির্ধারণ করবে আগামীর টেকসই ভবিষ্যৎ।

লেখক : ১টিম অ্যাসিস্টেন, ২প্রোগ্রাম সাপোর্ট অ্যাসিস্টেন, এফএও, বাংলাদেশ। মোবাইল : ০১৭৬৬৮৩১০৩০, ই-মেইল :swapnil.barua@fao.org

বিস্তারিত
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা : নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন বাস্তবায়নে বিএডিসির অভীষ্ট

এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা : নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন
বাস্তবায়নে বিএডিসির অভীষ্ট
মোঃ জামাল উদ্দীন
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (ঝউএং) বিশ্বব্যাপী উচ্চাভিলাষী এবং চ্যালেঞ্জিং প্রকৃতির হিসাবে স্বীকৃত। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়; তবে, বাংলাদেশ সরকার নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই বিভিন্ন পর্যায় থেকে বহুমুখী উদ্যোগ ও কর্ম পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এটা ধরে নেওয়া হয় যে কার্যকর এবং নিয়মিত অগ্রগতি ট্র্যাকিং আমাদের পথে সাফল্যের চাবিকাঠি হবে।
বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার আকাঙ্খা করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নির্ধারিত এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যগুলো ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার এজেন্ডার সাথে মিলে গেছে যা এর সকল সদস্য রাষ্ট্রের দ্বারা গৃহীত হয়েছিল। এটি ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বত্র মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য সমস্ত সদস্য দেশগুলির দ্বারা পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানোর একটি এজেন্ডা ছিল। এটি সর্বজনীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অবিভাজ্য যেখানে নেতারা বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এবং ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিটি দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য শান্তিও সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে।
এসডিজি অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) সংজ্ঞায়িত মিশন হচ্ছে ‘বিভিন্ন ফসলের উচ্চ ফলনশীল বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও সরবরাহ বৃদ্ধি; সেচ প্রযুক্তির উন্নয়ন; ভূপৃষ্ঠের পানির সর্বোত্তম ব্যবহার; সেচের দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং সেচযোগ্য এলাকা বৃদ্ধি এবং মানসম্পন্ন সার সরবরাহ করতে। সংজ্ঞায়িত ভিশন হল মানসম্পন্ন কৃষি উপকরণ সরবরাহ এবং দক্ষ সেচ ব্যবস্থাপনা। যা কৃষি মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত বিশ্ব খাদ্য দিবস-২০২৩ এর প্রতিপাদ্য ‘পানি জীবন, পানিই খাদ্য। কেউ থাকবে না পিছিয়ে’। সফল বাস্তবায়নে বিএডিসি কাজ করে যাচ্ছে।  
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ৬. নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন (সকলের জন্য পানি ও স্যানিটেশনের টেকসই ব্যবস্থাপনা ও প্রাপ্যতা  নিশ্চিত করা) নিয়ে বিএডিসির অভীষ্ট ও লক্ষ্যমাত্রা হলো - ৬.৪.২: জলের চাপের স্তর ও স্বাদুপানির সম্পদের অনুপাত হিসাবে স্বাদুপানি উত্তোলন করা।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বিএডিসির ক্ষুদ্রসেচ উইং এর ভূমিকা অপরিহার্য। ১৯৬০ এর দশকে মাত্র ১,৫৫৫টি শক্তিচালিত পাম্পের মাধ্যমে ভূউপরিস্থ পানি ব্যবহারের লক্ষ্যে বিএডিসি কর্তৃক দেশে আধুনিক সেচ ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার ছিল নগণ্য। ১৯৬৭-৬৮ সালে ১০২টি গভীর নলকূপ এবং ১৯৭৩-৭৪ সালে ৯৯৮টি অগভীর নলকূপ স্থাপন করে ভূগর্ভস্থ ও ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার শুরু হয়। তখন প্রায় ৯৫% ভূউপরিস্থ এবং % ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার হতো। পরবর্তীকালে ক্ষুদ্রসেচ উইং বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ ও ভূউপরিস্থ পানির ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহারে সেচ ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সুবিধা সম্প্রসারণ করে খাদ্য উৎপাদনে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সারাদেশে আবাদযোগ্য জমি ৮৫ লক্ষ হেক্টর সেচযোগ্য জমি ৭৬ লক্ষ হেক্টর এবং সেচকৃত জমির পরিমাণ ৫৬.২৭ লক্ষ হেক্টর। ক্ষুদ্র সেচের মাধ্যমে গত বোরো মৌসুমে ৭২.৫% সেচযোগ্য জমিতে সেচ প্রদান করা হয়েছে। খাদ্য উৎপাদনে দেশে দুই ধরনের সেচ কার্যক্রম প্রচলিত আছে- বৃহৎ সেচ ও ক্ষুদ্র সেচ। রবি মৌসুমে ক্ষুদ্র সেচের মাধ্যমে ৯৫% এবং বৃহৎ সেচের মাধ্যমে ৫% জমিতে সেচ প্রদান করা হচ্ছে। তন্মধ্যে সারাদেশে ভূউপরিস্থ পানির সাহায্যে ২৭.১০% এবং ভূগর্ভস্থ পানির সাহায্যে ৭২.৯% জমিতে সেচ প্রদান করা হচ্ছে।
বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার-২০১৮ অনুযায়ী পুষ্টিসম্মত ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা ও কৃষি ব্যবস্থায় যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে সুখী-সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে রূপকল্প -২০২১ সফলভাবে সম্পন্নকরণের মাধ্যমে মধ্যম আয়ের দেশ, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি (ঝউএ) বাস্তবায়ন, ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদা অর্জন এবং শতবর্ষী বদ্বীপ পরিকল্পনা (উবষঃধ চষধহ-২১০০) এর আলোকে বিএডিসি ক্ষুদ্রসেচ উইং খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বহুমুখী সেচ সেবা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এই উইং এর উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম নিচে দেয়া হলো:
    খাল/নালা/পুকুর খনন/পুনঃখনন/সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে ভূউপরিস্থ পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণপূর্বক সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ এবং জলাবদ্ধতা দূর করে জলাবদ্ধ ও অধঃপতিত জমি আবাদি জমিতে রূপান্তরকরণ।
    অনাবাদী জমি সেচের আওতায় আনয়নপূর্বক সেচ এলাকা বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখা।
    পানি সাশ্রয়ী অর্থাৎ যে সকল ফসলের সেচ কম লাগে সে সকল ফসলের আবাদ বৃদ্ধির মাধ্যমে সেচ খরচ হ্রাসকরণ।
    অচল/অকেজো গভীর/ফোর্সমোড নলকূপ সচলকরণের মাধ্যমে লাগসই ও টেকসই সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ।
    বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্রসমূহের বিদ্যুতায়ন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সেচ খরচ হ্রাসকরণ।
    সেচযন্ত্রে স্মার্টকার্ড বেইজ্ড প্রিপেইড মিটার স্থাপনের মাধ্যমে সেচ দক্ষতা ও সেচের পানির অপচয় রোধকরণ।
    নবায়নযোগ্য শক্তি যেমন- সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, বায়োগ্যাস ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ।
    সেচ কাজে ভূূউপরিস্থ পানিসম্পদের প্রাপ্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তির ব্যবহার, সম্প্রসারণ ও সুসংহত করার কার্যক্রম গ্রহণ (যেমন: রাবার/হাইড্রোলিক এলিভেটর ড্যাম নির্মাণ)।
    সৌরশক্তিচালিত পাতকুয়া  স্থাপনের মাধ্যমে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ।
    পাহাড়ি এলাকায় আর্টেশিয়ান নলকূপ  স্থাপনের মাধ্যমে কম খরচে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ।
    বারিড পাইপ ও পাকা সেচনালা, আধুনিক ড্রিপ ও স্প্রিংকলার সেচ ব্যবস্থা স্থাপনের মাধ্যমে সেচ এলাকা  সম্প্রসারণ, সেচের পানির অপচয়রোধ, সেচ খরচ হ্রাস, সেচের নিবিড়তা এবং সেচ দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ।
    ভূূউপরিস্থ পানির প্রাপ্যতাবিহীন এলাকায় ফোর্সমোড নলকূপ স্থাপন।
    ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার হ্রাসকরণের মাধ্যমে ভূূউপরিস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধিকরণ।
    পাহাড়ি এলাকায় স্থায়ী জলাধার তৈরি এবং সেচ কার্যক্রম পরিচালনা।
    ফসলের ফলন পার্থক্য  কমানো।
   AWD (Alternate Wetting and Drying), ফিতা পাইপ ও পোর্টেবল/মোভেবল সেচ পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে সেচের পানির অপচয় রোধ করে সেচ খরচ কমানো এবং সেচদক্ষতা বৃদ্ধিকরণ।
  সেচ, পানি ব্যবস্থাপনা ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ওপর একটি কেন্দ্রীয় তথ্য ভান্ডার গড়ে তোলা এবং মাঠ পর্যায়ে কৃষক পর্যন্ত ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে পৌঁছানো।
    পানি সাশ্রয়ী সেচ প্রযুক্তি এবং পরিবেশবান্ধব পলিশেড নির্মাণের মাধ্যমে নিরাপদ ও রপ্তানিযোগ্য সবজি, ফুল ও ফল উৎপাদন বৃদ্ধিকরণ।
    বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে সেচ সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ।
    ভূগর্ভস্থ লবণ পানির অনুপ্রবেশ মনিটরিং এর মাধ্যমে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির লবণাক্ততা পর্যবেক্ষণ এবং লবণাক্ততা নিরূপণের মাধ্যমেMap Salinity Intrusion Map  তৈরিকরণ।
 ক্ষুদ্রসেচ উন্নয়নের লক্ষ্যে সেচযন্ত্র, সেচ এলাকা, সেচের পানি ইত্যাদির নিয়মিত জরিপ, অনুসন্ধান, পানির গুণাগুণ পরীক্ষাকরণ, ভূগর্ভস্থ পানি মনিটরিং এ অটো ওয়াটার লেভেল রেকর্ডার ও ডাটা লগার স্থাপন এবং পর্যবেক্ষণ নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ স্থিতিশীল পানির স্তর পরিমাপ করে Ground Water Zoning Map  তৈরিকরণ;
  Smart Agricultural Practice, Space Technology (ST), Remote Sensing (RS), Geophysical Survey  এর মাধ্যমে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, তথ্য সংগ্রহ, আধুনিক প্রযুক্তি যেমন:Geographic Information System (GIS) Modelling এর মাধ্যমে বিশ্লেষণ, পরিবীক্ষণপূর্বক সুপারিশ প্রণয়ন, প্রচার এবং ডাটাবেজ উন্নয়ন ও সরকারকে তা অবহিতকরণ।
  সেচ বিভাগসহ অন্যান্য উইং সংস্থা/অধিদপ্তরের অফিস ভবন/স্থাপনা নির্মাণ, মেরামত রক্ষণাবেক্ষণকরণ;
    মাঠ পর্যায়ে কৃষি কাজে ভূগর্ভস্থ পানি আইন-২০১৮ ও তদীয় বিধিমালা-২০১৯ অনুযায়ী সেচযন্ত্রের লাইসেন্স প্রদান;
    সংস্থার নির্মাণকাজ বাস্তবায়নের জন্য পিপিআর/সংশ্লিষ্ট বিধি অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্তি ও নবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ।
    নির্মাণ কাজের ড্রইং, ডিজাইন ও প্রাক্কলন প্রণয়ন এবং মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে কারিগরি দিকনির্দেশনা প্রদান;
    কৃষি মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য সংস্থার চাহিদার প্রেক্ষিতে নির্মাণ কাজের প্রয়োজনীয় ড্রইং, ডিজাইন, প্রাক্কলন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
    সর্বোপরি কৃষি ব্যবস্থা যান্ত্রিকীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণে সহায়তা প্রদান।
লক্ষ্যমাত্রা
    বিএডিসির মাধ্যমে ৭.৬০ লক্ষ হেক্টর সেচ এলাকা টেকসইকরণ;
    সেচ দক্ষতা ৩৮% থেকে ৫০% এ উন্নীতকরণ;
    সেচ কাজে ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার ৩০% এ উন্নীতকরণ;  
    সেচ কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার ৭০% এ হ্রাসকরণ।
    সময়মত ও পরিমাণমত ফসলে সেচের ব্যবস্থা করা;
    কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে পরিবেশের সাথে তালমিলিয়ে স্বল্প সময়ে কৃষি জমি তৈরি, ফসল সংগ্রহ, কর্তন এবং পরবর্তী ফসল নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা;
    “অন ফার্ম ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট” বিষয়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতন করে তোলা।
বিএডিসির বার্ষিক কর্ম পরিকল্পনায় অত্যন্ত নিবিড়ভাবে এবং সতর্কতার সাথে ঝউএ এং বাস্তবায়ন ও অর্জনের যত্ন নেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও যে সকল পক্ষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে (কৃষক, প্রকল্প অফিস ইত্যাদিসহ) বিএডিসির ঝউএ লক্ষ্যমাত্রা ৬.৪.২ সেই অনুযায়ী অর্জন করা সম্ভব হবে মর্মে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

লেখক : উপপ্রধান (পরিকল্পনা) ও এসডিজি বিষয়ক ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা বিএডিসি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৯১৪০১২৪৮৮, ই-মেইল : mdjamal1984@gmail.com

বিস্তারিত
কৃষিকাজে পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি

কৃষিকাজে পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি
কৃষিবিদ খোন্দকার মোঃ মেসবাহুল ইসলাম
কৃষি উৎপাদনে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ হলো সেচের পানির প্রাপ্যতা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল হিসেবে ফসল উৎপাদন এলাকায় অনিয়তিভাবে খরা ও বন্যা দেখা দিচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে   কৃষিকাজে পানির ব্যবহারেও দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন। বর্তমানে ২.৮ বিলিয়ন মানুষ পানি স্বল্পতায় ভুগছে, কিন্তু ২০৩০ সালে এই সংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকে উন্নীত হওয়ার আশংকা করছেন বিজ্ঞানীরা। অতীতের জীবাশ্ম-পানির ব্যবহার পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, আগামীতে কৃষিতে সেচের পানি ব্যবহারে ও বৃষ্টিনির্ভর সেচ পদ্ধতিতে দক্ষতা আনতে না পারলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা মেটাতে উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হবে না।
অসেচকৃত জমির চেয়ে সেচকৃত জমি থেকে তিনগুণ বেশি ফলন পাওয়া যায়। মুদ্রানীতি অনুযায়ী সেচকৃত জমির ফসলের ফলনের মূল্যমান অসেচকৃত জমির ফসলের চেয়ে প্রায় ছয়গুণ বেশি। কৃষিকাজে পানি ব্যবহারের অনেক পদ্ধতি হাজার বছরেরও পুরনো যা অনেক শুষ্ক অঞ্চলে বা কম বৃষ্টিপাত হয় এমন অঞ্চলে এখনো সাফল্যের সাথে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফসল আবাদে যে উৎস থেকেই পানি ব্যবহার করা হোক না কেন; যদি সঠিক পরিমাণ পানি ফসলের জন্য সঠিক উপায়ে ব্যবহার করা হয়, তাহলে একদিকে যেমন পানির সাশ্রয় করা সম্ভব হবে তেমনি অর্থের অপচয়ও কম হবে। ফসলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বা বৃদ্ধির পর্যায়ে পানির সঠিক ব্যবহার করতে পারলে ফসলের কাক্সিক্ষত ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়। তবে ফসলের ক্ষেত্রে পানি সাশ্রয়ের বিভিন্ন পদ্ধতির বা কৌশলের যথাযথ প্রয়োগই অধিক বা কাক্সিক্ষত ফলন প্রাপ্তিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
সেচ পদ্ধতি  
সেচের পানি সাশ্রয়ে বেশ কিছু সেচ পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ড্রিপ পদ্ধতি, ভূনিম্নস্থ সেচনালা পদ্ধতি, ফিতাপাইপ ব্যবহার ও পাকা সেচ নালা ব্যবহার অন্যতম।
ড্রিপ সেচ : ড্রিপ সেচ পদ্ধতিতে গাছের মূলের কাছাকাছি সরাসরি পানি পৌঁছে দেয়া হয়। এতে পানির বাষ্পায়ন কমে পানির অপচয় কম হয়। ড্রিপ পদ্ধতিতে দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে যদি ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরা নির্দিষ্ট সময় পরপর সেট করে দেয় যায়, তাহলে পানির অপচয় কম হয়। যেমন, সকালে যখন ঠা-া পরিবেশ থাকে তখন ফোঁটার সংখ্যা কম এবং দুপুরে রোদ থাকলে ফোঁটার সংখ্যা বাড়ানো অথবা রাতে বন্ধ করে রাখা। যদি সঠিকভাবে ড্রিপ সেচ পদ্ধতিটি স্থাপন ও পানি সেচ নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তাহলে প্রথাগত সেচ পদ্ধতির চেয়ে ৫০-৭০% পর্যন্ত পানির সাশ্রয় করা সম্ভব হতে পারে এবং            ২০-৯০% পর্যন্ত উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে পারে।  এতে সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে পানি পাওয়ায় মাটিতে প্রয়োগ করা সার থেকে গাছ প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান নিতে পারে এবং ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ও উৎপাদন খরচ কমে।
ফিতাপাইপ : ফিতাপাইপ দিয়ে সাধারণত অগভীর নলকূপের পানি সেচকাজে ব্যবহার করা হয়। ফিতাপাইপের সুবিধা হলো, সেচনালা না থাকলেও এটি ব্যবহার করে জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব হয়। খরা প্রবণ এলাকায় ফিতাপাইপ ব্যবহার করে সেচ প্রদান করলে উৎস থেকে দূরবর্তী নির্দিষ্ট স্থানে অপচয় ছাড়াই সেচের পানি পৌঁছানো যায়।
পাকা সেচনালা : পাকা সেচনালা দিয়ে পানির অপচয় হয় না বললেই চলে। তবে পাকা সেচনালা স্থায়ী হলেও নির্মাণ ব্যয় বেশি এবং জমিও নষ্ট হয়। ইঁদুরের কারণে পুরনো পাকা সেচনালা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ভূনিম্নস্থ সেচ নালা : ভূনিম্নস্থ সেচ নালা পদ্ধতিতে পানি সেচ দিলে  ভূউপরিস্থ পানির বাষ্পায়ন কম হয় ও ফসলের শিকড়ের কাছাকাছি সেচের পানি পৌঁছানো সম্ভব হওয়ায় সেচের পানির সাশ্রয় হয়। এছাড়া মাটি ও পুষ্টি উপাদানের অপচয় হয়না, মূলের কাছাকাছি পুষ্টি উপাদান প্রয়োগ করা যায়, আগাছা কম জন্মায়, ফসলে রোগ কম হয়, ফসলের ফলন বৃদ্ধি পায় এবং শ্রমিক ও সেচ খরচ কম লাগে। এ পদ্ধতির অসুবিধা হলো প্রাথমিকভাবে স্থাপন খরচ বেশি লাগে, কাদায় পাইপের ছিদ্র বন্ধ হয়ে যেতে পারে বা পাইপ ছিদ্র হতে পারে। এ ছাড়া ইঁদুর গর্ত করে পাইপের পাশের বা উপর-নিচের মাটি সরিয়ে ক্ষতি করতে পারে। এসব সমস্যা মাটির নিচে হয় বিধায় সাথে সাথেই দেখা যায় না বা বুঝা যায় না। এজন্য কিছুদিন পরপর পাইপের মধ্যে পানি প্রবাহ দিয়ে পরীক্ষা করতে হয়।  
ক্ষুদ্র সেচে প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার : বর্তমানে বিভিন্ন পানীয় ও পানির ফেলে দেয়া বোতলগুলো ছোট আকারের সেচ কাজে ব্যবহার করা যায়। বোতলের ছিপিটিতে কয়েকটি ছিদ্র করে বোতলটি পানি ভর্তি করে সবজি বা ছোট আকারের ফল গাছের গোড়া থেকে কিছুটা দূরে উপুড় করে মাটির ভেতরে পুঁতে দিয়ে সেচ প্রদান করা যায়। এতে শিকড় এলাকায় মাটির রস গাছের পুষ্টি উপাদান সংগ্রহের উপযোগী অবস্থায় আসে। ছাদ বাগানের পট/টব/হাফ ড্রাম বা ছোট আবারের সবজি ক্ষেতে বা ছোট আকারের ফল গাছে এভাবে সেচ দেয়ায় পানির সাশ্রয় করা যেতে পারে।
কলসি সেচ : মাটির কলসি দিয়ে সবজি ক্ষেতে সেচ প্রদান একটি প্রাচীন পদ্ধতি। সবজি ক্ষেতের দুই সারির মাঝে বা চারটি গাছের মধ্যবর্তী স্থানে একটি কলসির গলা পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে দেয়া হয়। এর পর কলসিতে পানি ভর্তি করা হয়। এ পদ্ধতিতে প্রায় ৭০% পর্যন্ত পানি সাশ্রয় করা যেতে পারে। কলসির সূক্ষ্ম ছিদ্র পথে ভেতরের পানি কলসির ব্যাসের প্রায় অর্ধেক বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। যতক্ষণ পর্যন্ত না মাটি পূর্ণ সিক্ত হয় ততক্ষণ তা গাছের শিকড়ের জন্য মাটি থেকে পুষ্টি উপাদান সংগ্রহে খুবই সহায়ক থাকে। ফসল ও বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর করে কলসিতে সপ্তাহে ২-৩ বার পানি ভরতে হতে পারে। শুষ্ক ও লবণাক্ত এলাকায় কলসি পদ্ধতিতে সেচ প্রদান খুবই কার্যকর হতে পারে।
বালুচরে মিনিপুকুর পদ্ধতি : দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর চরাঞ্চলে বিভিন্ন ফসলের চাষ হলেও অনেক চরই অনাবাদি পড়ে থাকে। এসব চরে মূলত বালুর কারণে  প্রচুর জমি অনাবাদি পড়ে থাকে। শুধু বালুচরে দানাজাতীয়, তেলজাতীয়, ডালজাতীয় ও মসলাজাতীয় ফসল উৎপাদন সম্ভব না হলেও পিট তৈরি করে কিছু কিছু সবজি চাষ সম্ভব। যেমন, মিষ্টিকুমড়া, লাউ ও স্কোয়াশ। চরের বালুতে একমিটার চওড়া ও গভীর করে গর্ত খুঁড়ে গর্তের ভেতরে ১০-১২ কেজি পরিমাণ শুকনো গোবর বা জৈব সার দিতে হয়। অন্যত্র তৈরি মিষ্টি কুমড়া বা লাউ চারা ঐ গর্তে লাগাতে হয়। তবে স্কোয়াশের বেলায় ৩০ সে.মি. চওড়া ও গভীর করে গর্ত তৈরি করতে হয় এবং ৫-৬ কেজি শুকনো গোবর বা জৈবসার প্রয়োগ করতে হয়। পানি সেচের সুবিধার্থে চরে সারি করে ১০-১৫ মিটার পর পর ৩ বর্গমিটার আয়তনের ও এক মিটার গভীর বালু খুঁড়ে মোটা পলিথিন বিছিয়ে প্রথমে মিনিপুকুর তৈরি করতে হয়। এরপর শ্যালো বসিয়ে বা নিকটস্থ নদীর পানিপ্রবাহ থেকে ফিতাপাইপের সাহায্যে মিনি পুকুরে পানি ভরতে হয়। বালতি দিয়ে মিনিপুকুর থেকে পানি তুলে গর্তের চারায় বা গাছে সেচ দেয়া যায়।
সেচের জন্য পানি সংরক্ষণ
পুকুরও খাল-বিল সংস্কার করে দীর্ঘ সময় বৃষ্টির পানি ধরে রাখার বা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করার উপযোগী করে তোলা যায়, তাহলে শুকনো মৌসুমে এই পানি সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে সেচ বাবদ খরচ কমবে।
মৌসুমে বোরো ধান, ভুট্টা, গম, শাকসবজি এবং ফল বাগানে প্রয়োজনীয় পানি সেচ প্রদান করা যেতে পারে।
শুষ্ক অঞ্চলে পাতকুয়া খনন করে সেটিতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা এবং প্রয়োজনের সময় সেখান থেকে পাশের সবজি খেতে পানি সেচ দেয়া যায়।
পরিকল্পিত সেচ সময়সূচি নির্ধারণ  
সেচের কাজেও “স্মার্ট সেচ ব্যবস্থাপনা” প্রয়োগ করা যায়। ফসলে প্রয়োজনের চেয়ে কম বা বেশি পানি সেচ দিতে কৃষক আবহাওয়ার পূর্বাভাসকে সঠিকভাবে অনুসরণ করবে, সে সাথে মাটির রসের অবস্থা বা জো অবস্থা বিবেচনা করে এবং গাছের বয়স ও বৃদ্ধির ধরণ অনুযায়ী বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ পানির চাহিদা বুঝে সেচের পানির পরিমাণ নির্ধারণ করবে। ফল বাগানে রাতের বেলায় যদি সেচ দেয়া যায় তাহলে পানির বাষ্পায়ন কম হবে এবং এবং পানি মাটির নিচে চুইয়ে যাওয়ার প্রবণতাও বেশি হবে। অর্থাৎ মাটির জো অবস্থা তৈরি সহজ হবে। এতে মাটিতে প্রয়োগ করা সার সহজে গাছের গ্রহণ উপযোগী অবস্থায় আসবে। মাটির নিচে চুইয়ে যাওয়া পানি ভূনিম্নস্থ পানির আধারকে সমৃদ্ধ করবে।
ফসল চাষাবাদের সময় সেচ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি
ফসল চাষে বিভিন্ন উপকরণ ব্যয়ের পাশাপাশি সেচের জন্য ব্যয় কত তা বের করা প্রয়োজন। পাশাপাশি ফসল চাষাবাদের সময় সেচ সাশ্রয়ী প্রযুক্তিগুলো অনুসরণ করা প্রয়োজন। যেমন : খরা সহিষ্ণু ফসল হিসেবে বাংলাদেশে আউশ ধান, ভুট্টা, গম, তিল ফসলের চাষ করা হয়ে থাকে।
শুকনো চাষ : বর্তমানে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে জো অবস্থায় থাকা জমি কর্ষণের সময় একই সাথে বীজও বুনে দেয়া হয়। এতে শ্রমিক ব্যয় কমানোর পাশাপাশি জমি তৈরিতে পানি সেচের ব্যবহার এড়িয়ে পানির সাশ্রয় করা হচ্ছে। যেসব ফসলে পানি কম লাগে (যেমন- গম, তিল) সেসব ফসল চাষে এ পদ্ধতি কার্যকর।
বিনাচাষে ফসল উৎপাদন : বর্ষার পর যেসব এলাকায় জমির জো অবস্থা আসতে দেরি হয় অর্থাৎ জমিতে চাষ দেয়া সম্ভব হয় না, সেসব জমিতে বিনা চাষেই রসুন, আলু, ছিটিয়ে বোনা ধান সহজেই চাষ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে, ফসলের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য প্রাথমিকভাবে সেচের পানির খুব একটা প্রয়োজন হয় না। ফসল বেড়ে উঠলে যখন মাটির আর্দ্রতা বা মাটির রসের পরিমাণ কমতে থাকে তখন প্রয়োজন মতো সেচ দিতে হয়।
নিবিড় ধান উৎপাদন পদ্ধতি বা এসআরআই এবং নিবিড় ফসল উৎপাদন পদ্ধতি বা এসসিআই : সবচেয়ে কম উপকরণ ব্যবহার করে ফসলের বৃদ্ধির কাম্য পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া যেতে পারে নিবিড় ধান উৎপাদন পদ্ধতি (এসআরআই) ও নিবিড় ফসল উৎপাদন (এসসিআই) পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে। এর ফলে ফসলের গাছ দৈর্ঘ্যে লম্বা, সতেজ ও দীর্ঘস্থায়ী মূল-প্রণালী বিশিষ্ট হয় এবং মাটিস্থ অণুজীবের বহুমুখী কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। এসবের মধ্যে উপকারী অণুজীবগুলো গাছের দৈহিক বৃদ্ধি ও সতেজতায় কার্যকরী ভূমিকা রাখে। এসআরআই ও এসসিআই পদ্ধতিতে ২৫-৪০% কম সেচ প্রদান করতে হয়। এতে মাটির পানিধারণ ও পানি শোষণ ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে ফসল তাপমাত্রা ও খরা সহিষ্ণু হয়ে বেড়ে ওঠে। এসআরআই ও এসসিআই পদ্ধতিতে বজরা বা জোয়ার, লিগুমজাতীয় ফসল, ভুট্টা, সরিষা, আখ, তিল, হলুদ, গম, ধান ও সবজি চাষ করা যেতে পারে।  একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, এ দুই পদ্ধতি উল্লিখিত বিভিন্ন ফসলে ব্যবহার করে গমে সর্বনিম্ন ১০% এবং তিলে সর্বোচ্চ ৪০০% পর্যন্ত ফলন পাওয়া যেতে পারে।
মালচিং-এ কালো পলিথিন ব্যবহার : শুষ্ক ও ঠা-া মৌসুমে জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত সবজি ক্ষেতে মালচিং দ্রব্য হিসেবে কালো পলিথিন প্লাস্টিক ফিল্ম সবজি বেডের সারিতে একাধিক মৌসুম পর্যন্ত ব্যবহার করা যেতে পারে। মালচিং এ কালো পলিথিনের ব্যবহার ২৫% পর্যন্ত পানি সাশ্রয় করে থাকে। এক্ষেত্রে, বেড তৈরির পর সবজি চারা রোপণ বা বীজ বপন দূরত্ব অনুযায়ী ড্রিপ সেচের পাইপ স্থাপন করতে হয় বেডের ওপর। এরপর কালো পলিথিন প্লাস্টিক ফিল্ম বিছিয়ে বেডের দু’পাশে মাটি চাপা দিতে হয়। যে সব স্থানে চারা রোপণ বা বীজ বপন করা হয়, সে সব স্থানে ধারালো চাকু দিয়ে কালো প্লাস্টিক গোল করে কাটতে হয়। ড্রিপ সেটের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সার পানির সাথে মিশিয়ে সেচ দিলে বাষ্পায়নের মাধ্যমে পানি এবং ইউরিয়া কোনটারই অপচয় হয় না। এতে মাটির রস কাম্য মাত্রায় থাকার পাশাপাশি মাটির তাপমাত্রাও ঠিক থাকে এবং আগাছাও জন্মায় না। অন্যদিকে, গরমের মৌসুমে কালো পলিথিনের ওপর শুকনো খড় বা শুকনো ঘাস-খড়কুটা বা ফসলের শুকনো অবশিষ্টাংশ বিছিয়ে দিলে অতিরিক্ত তাপ থেকে ফসল রক্ষা পায়। এতে ড্রিপ সেটের মাধ্যমে পানি সেচও কম লাগে।
আচ্ছাদিত ফসল  : মাটিকে ক্ষয় হওয়া থেকে রক্ষার জন্য যে কোন ধরনের গাছ বা ফসল লাগাতে হয়, তা’না হলে উন্মুক্ত মাটি বিভিন্নভাবে ক্ষয় প্রাপ্ত হয়। এজন্য আচ্ছাদন ফসল চাষ করলে আগাছা কম জন্মানোর পাশাপাশি মাটির উর্বরতা শক্তিও বৃদ্ধি পায়। আচ্ছাদন ফসলের শিকড় মাটির ক্ষয়রোধ করে ও মাটিকে দৃঢ়তা প্রদান করে। এ অবস্থায় মাটিতে সেচ দিলে পানি সহজেই মাটিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। একটি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, খরা প্রবণ অঞ্চলে জমিতে সেচ দিলে যে পানি লাগে আচ্ছাদিতভাবে ফসল চাষ করার পর সেচের পরিমাণ তার চেয়ে ১১-১৪ ভাগ পর্যন্ত কম লাগে। ফল বাগানে আচ্ছাদন ফসল চাষ করলে সহজেই সেচের পানির সাশ্রয় করা যায়।
সংরক্ষিত চাষ : ১৯৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রচ- খরা ও বায়ূ দূষণের পর মাঠের বহুবর্ষজীবী ঘাস কমানোর জন্য গভীর চাষের একটি নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন হয়। সংরক্ষিত চাষ একটি বিশেষ চাষ পদ্ধতি, যাতে পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং কম পক্ষে ৩০% শস্যের অবশিষ্টাংশ রেখে জমি চাষ করা হয়। আচ্ছাদন শস্যের চাষ করা হয়, যাতে মাটির পানি বাষ্পীকরণ, মাটি ক্ষয় ও মাটির দৃঢ়তা কমে এবং মাটির রস ধারণক্ষমতা বাড়ে। মাটিতে প্রচুর জৈবসার ও প্রয়োজনে মালচিং দ্রব্যও ব্যবহার করা হয়।
জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ : প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ হয়ে আসছে। কৃষি বিজ্ঞানের ক্রম উন্নতির সাথে এদেশের কৃষিতেও যুক্ত হয়েছে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি বা কৃষি কলাকৌশল। এসবের মধ্যে যেমন আছে উৎপাদনের বিভিন্ন উপকরণ তেমনি আছে কৃষি যন্ত্রপাতিও। আরো আছে কৃষি বাজার ব্যবস্থাপনা। তবে ফসল আবাদের সাথে প্রাথমিকভাবে জড়িত যে সব কৃষি উপকরণ বাংলাদেশের কৃষিকে প্রাচীন কৃষি থেকে আলাদা করেছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বীজ, সার ও বালাইনাশক। মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে যেসব সার ব্যবহার করা হয়ে থাকে সেগুলোর কিছু কিছু মাটির গুণাগুণের কিছুটা পরিবর্তনও ঘটায় যা মাটির পানি ধারণক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলে। রাসায়নিক সারের পরিবর্তে শুধুমাত্র জৈবসার ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করলে মাটির পানি ধারণক্ষমতা বাড়ে, সে সাথে বাড়ে মাটির অনুজৈবিক কার‌্যাবলী। যুক্তরাষ্টে এক মাঠ পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, মাঠ ফসল চাষে রাসায়নিক সার প্রয়োগে আধুনিক পদ্ধতিতে সেচের পানির ব্যবহারের চেয়ে জৈব পদ্ধতিতে  ২০ ভাগ কম পানি লাগে।
মাইকোরাইজা ব্যবহার : আধুনিক কৃষিতে মাইকোরাইজার ব্যবহার কৃষিতে পানি সাশ্রয়ের পাশাপাশি গাছের প্রয়োজনীয় ফসফরাসসহ অন্যান্য আরো কিছু পুষ্টি উপাদান মাটি থেকে গ্রহণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মাইকোরাইজাকে ইদানিং “শিকড় ছত্রাক” বলা হয়। মাইকোরাইজা মাটির নিচে গাছের শিকড়গুলোকে একটার সাথে আরেকটাকে যুক্ত করে, ফলে গাছের খাদ্য গ্রহণ এলাকা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া এক ধরনের এনজাইম নিঃসরণ করার ফলে শিকড়ের স্থায়ীত্ব বৃদ্ধি পায় ও মাটিস্থ পুষ্টি উপাদান গাছের গ্রহণীয় অবস্থায় আসে। মাইকোরাইজা মাটিতে থাকার কারণে ২৫% পর্যন্ত সেচের পানির সাশ্রয় হয় এবং গাছকে খরা সহিষ্ণু হয়ে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। কখনো কখনো কম পানি ও সার থাকলেও ফুল ও ফল ধরতে সাহায্য করে থাকে। লিচু বাগানে মাইকোরাইজা ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি সুফল পাওয়া যায়। এজন্য লিচু বাগানের পুরোটা জুড়ে চাষ ও রাসায়নিক সার দেয়ার প্রয়োজন হয় না।
এডব্লিউডি পদ্ধতি : ধান চাষের বেলায় প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। বলা হয়ে তাকে যে, এক কেজি ধান উৎপাদনে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। আসলে ধান গাছের সব পর্যায়েই পানির প্রয়োজন হয় না বা একই পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয় না। কখনো কখনো ছিপছিপে পানি থাকলেও চলে। এসব দিক বিবেচনা করে কৃষি বিজ্ঞানীগণ অলটারনেট ওয়েটিং এন্ড ড্রাইং পদ্ধতির প্রচলন করেছেন। এতে  বোরো ধানে ৪-৫টি সেচ কম লাগে। এডব্লিউডি পদ্ধতিতে        ৭-১০ সেমি. ব্যাস ও ২৫ সেমি. লম্বা ছিদ্রযুক্ত পিভিসি পাইপ বা বাঁশের চোঙ বোরো ক্ষেতে চারটি গুছির মাঝে খাড়াভাবে স্থাপন করতে হয় যেন এর ছিদ্রহীন ১০ সেমি. মাটির উপরে এবং ছিদ্রযুক্ত ১৫ সেমি. মাটির নিচে থাকে এবং পাইপের ভেতরে কোন মাটি না থাকে। পাইপের ভেতরের পানির পরিমাণ দেখে সেচ প্রদান করা হয়ে থাকে ৪০-৪৫ দিন পর্যন্ত। গাছের থোড় অবস্থা আসার পর এটির ব্যবহার আর করা হয় না।    
নালায় সেচ প্রদান : উঁচু বেড পদ্ধতিতে চাষাবাদে দুই বেডের মধ্যবর্তী নালায় সেচ প্রদান করে সেচের পানির সাশ্রয় করা সম্ভব। বেডগুলো যদি ১৫ সেমি. উঁচু হয়, তাহলে মধ্যবর্তী নালায় পানি ধরে রাখলে দু’পাশে পানি শুষে নিয়ে গাছের মূল-প্রণালী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। ভাসানো সেচের প্রয়োজন পড়ে না। আবার ভাসানো সেচ দিলে আগাছা বেশি জন্মায় ও সে জন্য নিড়ানি খরচের পাশাপাশি অতিরিক্ত পানিও খরচ হয়ে যায়।
জৈব জ্বালানি হিসেবে ফসল উৎপাদন বন্ধ করা
বর্তমানে জ্বালানির বিকল্প উৎস হিসেবে জৈব জ্বালানি ব্যবহারের চেষ্টা করছে অনেক দেশ। এজন্য তারা বিশেষ ধরনের ফসল আবাদের উপর জোর দিচ্ছে। এসব ফসল উৎপাদনে প্রচুর সেচের পানির প্রয়োজন, যা অন্যান্য খাদ্যশস্য উৎপাদনের উপর প্রভাব ফেলতে বাধ্য। তাই শুধু জৈব জ্বালানি হিসেবে উৎপাদিত ফসল উৎপাদন বন্ধ করেও সেচের পানি সাশ্রয় করা সম্ভব।  
পরিবেশে কৃষি ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে যে বিপুল পরিমাণ পানির ব্যবহার হয়, তা যদি পুনঃব্যবহারযোগ্য করে কৃষিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশেষ করে শিল্প ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়, তাহলে বিপুল পরিমাণ পানির সাশ্রয় করা সম্ভব।

লেখক : উদ্যান বিশেষজ্ঞ, সংযুক্ত : সরেজমিন উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা, মোবাইল : ০১৮১৮৭১৯৪৫৩ ই-মেইল  : mesbahul65@gmail.com

বিস্তারিত
বসতবাড়িতে পাটশাক উৎপাদন ও পারিবারিক পুষ্টির চাহিদাপূরণ

বসতবাড়িতে পাটশাক উৎপাদন
ও পারিবারিক পুষ্টির চাহিদাপূরণ
ড. এ. টি. এম. মোরশেদ আলম
বাংলাদেশের বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কৃষিকে টেকসই করার জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। সে প্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে পতিত জমির যথাযথ ব্যবহারের লক্ষ্যে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। উক্ত নির্দেশনায় তিনি বলেছেন-‘এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না’। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য বসতবাড়ির আশপাশের চাষযোগ্য পতিত জমিতে বছরব্যাপী বিভিন্ন প্রকার শাকসবজির চাষাবাদ করা একান্ত প্রয়োজন বলে  কৃষি সংশ্লিষ্ট সকলেই মনে করেন। এক্ষেত্রে বসতবাড়ির সবজি বাগানের একটি অংশে অথবা আশপাশের চাষযোগ্য পতিত জমিতে সারা বছর ধরে পাটশাক উৎপাদন করে সহজেই পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি প্রয়োজনের অতিরিক্ত পাটশাক বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়।
বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত পুষ্টিসমৃদ্ধ পাটশাক : পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক কমপক্ষে ৩০০ গ্রাম শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। কারণ, শাকসবজিতে মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ভিটামিন, খনিজ লবণ ও আঁশ রয়েছে। এসব শাকসবজি কেবল শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় না, বরং ভক্ষণকৃত খাদ্যকে হজম, পরিপাক ও বিপাকে সহায়তা করে এবং খাবারে রুচি বৃদ্ধি ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শাকসবজির এসব গুণাগুণ বিবেচনা করে দেশের প্রাচীনতম গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট শাক হিসেবে ব্যবহারের জন্য পাটের তিনটি জাত উদ্ভাবন করেছে।  উক্ত জাতগুলোর মধ্যে বিজেআরআই দেশি পাটশাক ১ বিজেআরআই দেশি পাটশাক ২ ও বিজেআরআই দেশি পাট শাক ৩। ১০০  গ্রাম পাটশাকে ক্যালসিয়াম ১.৯৭ গ্রাম, পটাশিয়াম ১.৬৮ গ্রাম, সোডিয়াম ০.১১৮  গ্রাম, ফসফরাস ০.৬২১ গ্রাম, আয়রন ৮৫৮ গ্রাম, আর্দ্রতা ৮৪.৭২ গ্রাম, প্রোটিন ৩.৬০ গ্রাম, শর্করা ১৭.৩৪ গ্রাম, বিটা ক্যারোটিন (মাইক্রো গ্রাম/১ গ্রাম) ১২২.২০ গ্রাম, ভিটামিন-সি (মিলিগ্রাম/ ১০০ গ্রাম) ৬৭.৭৩%।
বসতবাড়ির আশপাশে পাটশাক উৎপাদনের সুবিধা : পাট একটি পরিবেশবান্ধব ফসল। বসতবাড়ির আশপাশে বছরব্যাপী বিভিন্ন জাতের পাটশাক চাষাবাদের ফলে বসতবাড়ির পরিবেশ ভাল থাকে। কারণ, পাট ফসল বায়ুম-ল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং
বায়ুম-লে
অক্সিজেন ত্যাগ করে। এ ছাড়া সারাবছর পাটশাক চাষাবাদের উপকারিতা নিম্নরূপ-
নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী সারাবছর বিভিন্ন জাতের পাটশাক চাষ করা যায়; পাটশাক বিভিন্ন প্রকার পুষ্টিগুণ ও ঔষধিগুণ সমৃদ্ধ;  স্বাস্থ্যসম্মত ও বিভিন্ন বয়সের টাটকা পাটশাক সারা বছর পাওয়া যায়; পুষ্টির দিক থেকে অন্যান্য শাকসবজি অপেক্ষা পাটশাক উন্নতমানের হয়ে থাকে; বাড়ির আশপাশের পতিত জমির সর্বোত্তম ব্যবহার হয়ে থাকে; উৎপাদন কৌশল সহজ ও উৎপাদন ব্যয় তুলনামূলকভাবে কম; বাড়ির সদস্যরা সহজেই চাষ করতে পারে বিধায় শ্রমিক ব্যয় হয় না এবং সহজেই পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়।
বসতবাড়িতে পাটশাক চাষাবাদ কলাকৌশল
চাষ উপযোগী জমি : পলি দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ ও এটেল দো-আঁশ মাটি বিজেআরআই দেশি পাটশাক ১ চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত। বিজেআরআই দেশি পাটশাক ২ এবং বিজেআরআই দেশি পাটশাক ৩ এর ফলন ভাল হয় বেলে দো-আঁশ ও  দো-আঁশ মাটিতে।
বপনকাল : শাকের ভাল ফলন পাওয়ার জন্য বিজেআরআই দেশি পাটশাক ১ ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি থেকে ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বপন করা যায়। বিজেআরআই দেশি পাটশাক ২ বপনের উপযুক্ত সময় ফাল্গুন মাসের ১ম থেকে মধ্য কার্তিক পর্যন্ত। বিজেআরআই দেশি পাটশাক ৩ মধ্য ফাল্গুন থেকে মধ্য আশি^ন পর্যন্ত বপন করা হয়। এছাড়াও পাটশাকের জাতগুলো সারা বছরই চাষ করা যায়।
জমি তৈরি : পাটশাকের প্রতিটি জাতের ক্ষেত্রে জমি তৈরির জন্য কোদাল দিয়ে কুপিয়ে জমি ভালভাবে চাষ করতে হয়। বাঁশ/কাঠের লাঠি দিয়ে মাটির ঢেলা গুঁড়া করে জমির মাটি মিহি করে প্রস্তুত করতে হয়।
বীজ বপন : ছিটিয়ে বা সারিতে উভয় পদ্ধতিতে পাটশাকের বীজ বপন করা যায়। বিজেআরআই দেশি পাটশাক ১ সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সে.মি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৫-৬ সেমি. বজায় রাখতে হয়। বিজেআরআই দেশি পাটশাক ২ এবং বিজেআরআই দেশি পাটশাক ৩ সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ১৫-২০ সেমি. এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২-৪ সেমি. রাখতে হয়। তবে সারিতে বীজ বপন করলে গাছের পরিচর্যা করা সহজ হয় এবং এতে পাটশাকের ফলনও বৃদ্ধি পায়।
বীজের পরিমাণ : বিজেআরআই দেশি পাটশাক ১ ছিটিয়ে বপন করলে প্রতি শতাংশ জমিতে ৩০-৪০ গ্রাম বীজ  এবং সারিতে বপন করলে  ২৪-২৫ গ্রাম বীজ লাগে। বিজেআরআই দেশি পাটশাক ২ ছিটিয়ে  বপন করলে প্রতি শতাংশে ৪০-৪৫ গ্রাম বীজ এবং সারিতে বপন করলে প্রতি শতাংশে ৩০-৩৫ গ্রাম বীজ লাগে। আবার, বিজেআরআই দেশি পাটশাক ৩ ছিটিয়ে  বপন করলে প্রতি শতাংশে ৪০-৫০ গ্রাম বীজ  এবং সারিতে বপন করলে প্রতি শতাংশ জমিতে ৩০-৩৫ গ্রাম বীজ লাগে।
সার প্রয়োগের পরিমাণ : বিজেআরআই দেশি পাটশাক ১ চাষাবাদের ক্ষেত্রে গোবর সার প্রয়োগ না করলে প্রতি শতাংশ জমিতে ২৬৭ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি ও ১৬২ গ্রাম এমওপি সার জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে। পক্ষান্তরে বিজেআরআই দেশি পাটশাক ২  এবং বিজেআরআই দেশি পাটশাক ৩ আবাদ করলে যদি জমিতে গোবর সার প্রয়োগ করা না হয় তাহলে  উভয়ের ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশ জমিতে ৩০৩ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ টিএসপি ও ৫০ গ্রাম এমওপি সার জমি তৈরির সময় মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। জমিতে যদি গোবর সার ব্যবহার করা হয় সে ক্ষেত্রে রাসায়নিক সার অপেক্ষাকৃত কম লাগবে।
আন্তঃপরিচর্যা : বীজ বপনের ১-২ সপ্তাহ পর জমির জোঁ বুঝে আঁচড়া দিতে হবে। এ সময় চারার সংখ্যা ঘন হলে প্রাথমিকভাবে চারা পাতলা করে দিতে হয়। বিজেআরআই দেশি পাটশাক ১ এর ক্ষেত্রে গাছের বয়স ৩০-৩৫ দিন হলে এবং বিজেআরআই দেশি পাটশাক ২ (ম্যাড়াশাক, লাল) ও বিজেআরআই দেশি পাটশাক ৩ (ম্যাড়াশাক, সবুজ)-এর ক্ষেত্রে গাছের বয়স ২০-২৫ দিন হলে  একবার নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করা প্রয়োজন। এ সময় সুস্থ ও সবল গাছ রেখে দুর্বল ও চিকন গাছ তুলে ফেলতে হবে। সাধারণত  তিনটি জাতের পাটশাকে তেমন কোন রোগ ও পোকার আক্রমণ দেখা যায় না বিধায় কোনো প্রকার কীটনাশক/ছত্রাক নাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। বিজেআরআই দেশি পাটশাক ২ (ম্যাড়াশাক, লাল) ও বিজেআরআই দেশি পাটশাক ৩ (ম্যাড়াশাক, সবুজ)-এর গাছের ‘ক্যানোপি’ কম হওয়ায় অল্প জায়গায় অধিক সংখ্যক গাছের সংকুলান হয়।
পাটশাক সংগ্রহ : বিজেআরআই দেশি পাটশাক ১ এর ক্ষেত্রে গাছের বয়স ৩৫-৪৫ দিন হলে এবং বিজেআরআই দেশি পাটশাক ২ (ম্যাড়াশাক, লাল) ও বিজেআরআই দেশি পাটশাক ৩ (ম্যাড়াশাক, সবুজ)-এর ক্ষেত্রে গাছের বয়স ৩০-৩৫ দিন হলে তখন থেকেই শাক খাওয়া যায়। প্রথমে গাছ তুলে এবং পরবর্তীতে গাছের সংখ্যা কমে গেলে গাছের ডগা ছিঁড়ে শাক খাওয়া যেতে পারে। বিজেআরআই দেশি পাটশাক ১ জাতের শাক একবার চাষ করে দীর্ঘ কয়েক মাস পর্যন্ত শাক সংগ্রহ করা যায়। বাড়ির ছাদে কয়েকটি টবে পাটশাক চাষ করে ছোট পরিবারের শাকের চাহিদা সহজেই পূরণ করা যায়। পক্ষান্তরে বিজেআরআই দেশি পাটশাক ২ (ম্যাড়াশাক, লাল) ও বিজেআরআই দেশি পাটশাক ৩ (ম্যাড়াশাক, সবুজ) জাতের শাক গাছে দ্রুতই ফুল এসে যায় বলে এক-দুই ধাপেই শাক সংগ্রহ করা যায়।
পাটশাকের ফলন : বিজেআরআই দেশি পাটশাক ১ এবং বিজেআরআই দেশি পাট শাক ২ (ম্যাড়াশাক, লাল)-এর ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশ জমি থেকে প্রায় ১২-১৫ কেজি পাটশাক পাওয়া যায়। অপর দিকে বিজেআরআই দেশি পাটশাক ৩ (ম্যাড়াশাক, সবুজ)-এর ক্ষেত্রে শাক পাতার ফলন প্রতি শতাংশ জমিতে প্রায় ১৫-২০ কেজি হয়ে থাকে।
বিজেআরআই-এর বিজ্ঞানীগণ মনে করেন পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ ও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় পাটের শাক অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন সুতরাং, নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সুখী, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে সহজলভ্য ও পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য হিসেবে দৈনিক খাবারের তালিকায় পাটশাক অন্তর্ভূক্ত করা অত্যন্ত যুক্তিসংগত। এমতাবস্থায় পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা মিটাতে বসতবাড়ির সবজি বাগানে/ আশপাশের পতিত জমিতে পাটশাকের আবাদ করা আমাদের প্রত্যেকেরই কর্তব্য।

লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল : ০১৭৪০-৫৫৯১৫৫, ই-মেইল : atmmorshed65@gmail.com

বিস্তারিত
পুষ্টিগত অবস্থার উন্নয়নে প্রতিদিন নিরাপদ পানি পানের গুরুত্ব

পুষ্টিগত অবস্থার উন্নয়নে প্রতিদিন নিরাপদ
পানি পানের গুরুত্ব
কৃষিবিদ প্রিন্স বিশ্বাস
কোন জাতির পুষ্টিগত অবস্থার উন্নয়নের সাথে সেই জাতির মেধার ও কর্মদক্ষতার উন্নয়ন জড়িত। পুষ্টিগত অবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করে তাই মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দারিদ্র্য পীড়িত বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদে ‘জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন’ মর্মে উল্লেখ করা হয়।  
পুষ্টিগত অবস্থার উন্নয়নের প্রথম শর্তই হলো খাদ্যের সহজলভ্যতা তথা খাদ্য সকল পেশার মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকা। সে ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি করা খুবই জরুরি। এক সময়কার আমদানি নির্ভর খাদ্য ব্যবস্থা বর্তমানে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে কোন কোন ক্ষেত্রে আজ রপ্তানিমুখী। বর্তমান উৎপাদিত পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্যের সকল পেশার মানুষের মধ্যে সহজলভ্যতা, ক্রয়ক্ষমতা ও সমবন্টনের অভাবে সুষম খাদ্যাভাস গড়ে ওঠেনি। সমাজের একটি বড় অংশের মানুষের মধ্যে পুষ্টি জ্ঞানের অভাব, অজ্ঞতা বা অবহেলার কারণে গ্রহণকৃত খাদ্য দ্রব্য থেকেও যে পরিমাণ পুষ্টি উপাদান পাওয়ার কথা তা থেকেও মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ ডিমোগ্রাফিক এ্যান্ড হেল্থ সার্ভে (ইউঐঝ)-২০২২ ও ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন অনুযায়ী, এখনো পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মধ্যে ২৪ শতাংশ খর্বকার, ১১ শতাংশ কৃশকায় এবং ২২ শতাংশ বয়সের তুলনায় কম ওজন। ৫৬ শতাংশ নারী অপর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণ করছে এবং প্রজনন বয়সী প্রায় ৫০ শতাংশ নারী বিভিন্ন রকমের পুষ্টি উপাদানের অভাবজনিত অপুষ্টিতে ভুগছে।  
বাংলাদেশের খানার আয় ও ব্যয় জরিপ (ঐওঊঝ)-২০২২ অনুযায়ী একজন মানুষ গড়ে প্রতিদিন দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য ৩৪.১ গ্রাম, মাংস ৪০ গ্রাম, মাছ ৬৭.৮ গ্রাম, সবজি ২০১.৯ গ্রাম এবং ফলমূল ৯৫.৪ গ্রাম গ্রহণ করে থাকেন। অপরদিকে বছরে ডিম গ্রহণ করে থাকেন গড়ে ১০৪.২৩টি। যা কোন কোন ক্ষেত্রে খাদ্য শ্রেণিগুলোর ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা অর্জিত হয়নি। আবার দেশব্যাপী সকল বয়সী ও শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে মোট প্রাপ্যতা অনুযায়ী সমভাবে বন্টনও হয়নি।  
যেখানে একজন মানুষের মোট ক্যালরির ৫৫-৬০ শতাংশ দানাদার খাদ্য থেকে গ্রহণ করা উচিত সেখানে বেশির ভাগ মানুষ এখনো ৭০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি ক্যালরি ভাত ও রুটি থেকে গ্রহণ করেন। অপরদিকে অপর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাণিজ আমিষ, ফল, শাকসবজি গ্রহণ করার ফলে জনসংখ্যার বড় একটি অংশ লুক্কায়িত ক্ষুধা বা ভিটামিন এ, ফলিক এসিড,  আয়োডিন, আয়রন, জিংক, ক্যালসিয়াম প্রভৃতি মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের অভাবে ভুগছেন। ফলে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর খর্বতা, কৃশকায়, কম ওজন প্রভৃতির মতো গুরুতর ও পুষ্টি সংক্রান্ত সমস্যা বিদ্যমান। এর ফলে শিশুর সুস্বাস্থ্য, শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে চাহিদার ভিত্তিতে পূর্ণ বয়স্ক মানুষের কার্যক্ষমতা বাড়ছে না। পাশাপাশি পুষ্টি সংশ্লিষ্ট অসংক্রামক ব্যাধি ও শারীরিক সমস্যা যেমন অতিরিক্ত ওজন, স্থূলতা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও লিভারের মতো রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দৈনিক একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা (জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা অনুযায়ী)
পরিশ্রমভেদে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ২৭০-৪২০ গ্রাম (সর্বোচ্চ) এর সমপরিমাণ চাল বা গম মাঝারি আকারের ১-৪ টুকরো (এক টুকরো = ৫০ গ্রাম) মাছ/মাংস এবং ১ থেকে ২ কাপ ডাল (৩০-৬০ গ্রাম) জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক উভয়েই নিশ্চিন্তে দৈনিক একটি ডিম খেতে পারবেন। অল্প পরিমাণে কাঁচা অথবা শুকনো ভাজা বিভিন্ন ধরণের বাদাম এবং বীজ জাতীয় খাবার লবণ ছাড়া সপ্তাহে চার বা পাঁচবার খাওয়া যেতে পারে।
মজবুত হাড় এবং দাঁতের জন্য ক্যালসিয়ামের ভালো উৎস হিসেবে প্রতিদিন কমপক্ষে ২৫০ মি. লি. দুধ বা দুধজাতীয় পণ্য গ্রহণ করা উচিত। দুধ সহ্য না হলে দুধের পরিবর্তে দই বা সয়াদুধ গ্রহণ করা যেতে পারে। দইয়ে ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া থাকে যা দেহের জন্য উপকারী এবং যা দুধের ল্যাকটোজ পরিপাক করতে সাহায্য করে।
প্রতিদিন কমপক্ষে ২টি মৌসুমি ফল গ্রহণ করা উচিত। একটি লেবু জাতীয়, অন্যটি ভিটামিন এ এর উল্লেখযোগ্য উৎসগুলোর থেকে একটি। খাদ্য গ্রহণের পর আয়রনের পরিশোষণ বৃদ্ধির জন্য ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল গ্রহণ প্রয়োজন। প্রতিদিন অন্তত ১০০ গ্রাম বা ১ আঁটি শাক এবং ২০০ গ্রাম বা ২ কাপ সবজি গ্রহণ করা উচিত।
দৈনিক ৩০ গ্রামের (সর্বোচ্চ ২ টেবিল চামচ) বেশী তেল গ্রহণ না করাই ভালো। হাইড্রোজেনেটেড তেল কিংবা মাখন, ঘি এর মতো সম্পৃক্ত চর্বির তুলনায় সরিষার তেল, সয়াবিন, রাইসব্রান প্রভৃতি উদ্ভিজ্জ তেল বেশি ভালো এবং স্বল্প পরিমাণে ব্যবহার করার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়। প্রাকৃতিক সম্পৃক্ত চর্বি, যেমন মাখন, ঘি নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় ব্যবহার অথবা প্রয়োজন হলে ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। খাবারের সাথে বাড়তি লবণ গ্রহণের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে এবং দৈনিক গহণের পরিমান এক চা চামচের (৫ গ্রাম) মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। দৈনিক ২৫ গ্রাম বা ৫ চা চামচ-এর কম চিনি গ্রহণ করতে হবে। দৈনিক তরলের চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে নিরাপদ ও সুপেয় পানি পান করতে হবে।
প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ পানি পানের নিয়মাবলী ও গুরুত্ব
পানি একটি অজৈব যৌগ রাসায়নিক পদার্থ। যা পৃথিবীর হাইড্রোস্ফিয়ারের প্রধান উপাদান এবং সমগ্র পরিচিত জীবনের অস্তিত্বের জন্য অত্যাবর্শকীয়।
এটি মানবদেহের একটি মুখ্য উপাদান এবং একটি অত্যাবশ্যক পুষ্টি উপাদান। বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি খাদ্য পরিপাক, পরিশোষণ, পরিবহন, বর্জ্য পদার্থ দূরীকরণ এবং শরীরের তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রয়োজন। নবজাতক যারা সঠিক নিয়মে মায়ের দুধ পান করে তাদের জন্য বাড়তি পানির প্রয়োজন হয় না। বাড়ন্ত ভ্রƒণ এবং অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইডের চাহিদা পূরণ এবং এক্সট্রা সেলুলার ফ্লুইড বৃদ্ধির কারণে গর্ভবতী নারীর অতিরিক্ত পানি পানের প্রয়োজন হয়। মায়ের দুধের সাথে বেরিয়ে যাওয়া তরলের ঘাটতি পূরণের জন্য মাতৃদুগ্ধদানকারী নারীকে পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ পানি পান করতে হবে।
আমাদের শরীরের মোট ওজনের ৭০% পরিমাণ পানি এবং রক্ত ও অন্যান্য অত্যাবশ্যক শারীরিক তরলের উপাদানও পানি। শরীর থেকে প্রতিদিন প্রায় দুই লিটার পানি বের হয়ে যায়। প্রতিদিন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের ১.৫-৩.৫ লিটার অর্থাৎ ৬-১৪ গ্লাস নিরাপদ পানি পান করা প্রয়োজন। নিরাপদ পানি বিষয়ে সন্দেহ থাকলে ফুটানো পানি পান করা যেতে পারে। কোমল পানীয় এবং কৃত্রিম জুসের পরিবর্তে ডাবের পানি অথবা টাটকা ফলের রস পান করা পুষ্টিসম্মত। তাজা ফলমূলের জুস পরিমিত পরিমাণে পান করতে হবে।
শরীরে পানির ঘাটতি দেখা দিলে শরীর নিজে থেকে কিছু সংকেত দিয়ে জানিয়ে দেয়। জেনে নেয়া যাক যেসব লক্ষণ জানিয়ে দেয় শরীরে পানির ঘাটতি রয়েছে।
১) শরীরে পানির অভাবে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায় এবং ঠোঁট ফাটতে শুরু করে। হঠাৎ করে ত্বক রুক্ষ বোধ করতে শুরু করলে এবং ত্বকে ব্রণ ও চুলকানির সমস্যা দেখা দেয়।
২) পানির অভাবে প্রস্রাবের রং হলুদ হয়ে যায় ও প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায় এবং প্রস্রাব করার সময় জ্বালা বোধ হয়।
৩) পানির অভাবে শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি মুখে দুর্গন্ধও হয়। পানি মুখে পর্যাপ্ত পরিমাণে লালা উৎপন্ন করতে সাহায্য করে। যা নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়াগুলি নিয়ন্ত্রণে কাজ করে।
৪) ডিহাইড্রেশন অবস্থায় বারবার তৃষ্ণা অনুভব হয়। বার বার পানি খেলেও শরীরে পানি জমা থাকতে পারে না। সাধারণ পানির পরিবর্তে লেবু-পানি বা ইলেকট্রল দ্রবণযুক্ত পানি পান করলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। ডিহাইড্রেশনের সমস্যায় খুব বেশি খিদেও পায়।
৫) পানির অভাবে শরীরে অনেক সময় নিম্ন রক্তচাপের সমস্যা দেখা যায়। এর ফলে কোনও কারণ ছাড়াই হঠাৎ মনে আতঙ্ক জাগে বা মাথাব্যথা। সারাক্ষণ আলস্য ও ক্লান্তি অনুভূত হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যাও হতে পারে শরীরে পানির ঘাটতির কারণে।
৬) পানির অভাবে রক্ত স্বল্পতাও দেখা দেয়। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে পর্যাপ্ত রক্ত পৌঁছে দিতে হৃদযন্ত্রকে আরও বেশি পরিশ্রম করতে হয়। ফলে হৃদ্যন্ত্র উপর চাপ পড়ে। হঠাৎ করে হৃদ্স্পন্দন এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বেড়ে যায়।
কেবল পান করার পানিই নিরাপদ হলেই হবে না। খাদ্য রন্ধন বা গ্রহণের পূর্বে খাদ্যদ্রব্য ভালভাবে নিরাপদ পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে। রন্ধন ও খাবার পরিবেশন কাজে ব্যবহৃত বাসন পরিষ্কার করার কাজে ও রন্ধন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত পানিও অবশ্যই নিরাপদ হওয়া প্রয়োজন। কারণ এসব কাজে ব্যবহৃত পানির মাধ্যমে আমাদের দেহে বিভিন্ন রোগের জীবাণু প্রবেশ করতে পারে এবং পানি বাহিত বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করতে পারে।   
সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং দেশি ও আন্তর্জাতিক এনজিও/সংস্থার মিলিত কার্যক্রমের ফলেই বর্তমানে মানুষের মধ্যে পুষ্টি বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বিগত কয়েক বছরে জাতীয় পর্যায়ে অপুষ্টিজনিত সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে পুষ্টিগত অবস্থার উন্নতি এবং নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন টেকসই ব্যবস্থাপনা ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে খাদ্যভিত্তিক পুষ্টি ও নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টির বাস্তবসম্মত ও কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। আর এর মধ্যদিয়েই দেশের পুষ্টিগত অবস্থার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে।

লেখক : বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (বারটান), মোবাইল: ০১৭২৮ ৩৩৫৯৩৩, ই-মেইল: princebiswas211@gmail.com

বিস্তারিত
চতুর্থ শিল্পবিল্পবের আলোকে সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনার অত্যাধুনিক প্রযুক্তি

চতুর্থ শিল্পবিল্পবের আলোকে সেচ ও পানি
ব্যবস্থাপনার অত্যাধুনিক প্রযুক্তি
ড. দেবজিৎ রায়১ ড. প্রিয় লাল চন্দ্র পাল২ ড. মীর নূরুল হাসান মাহমুদ৩
বাংলাদেশের জনসংখ্যার উলে¬খযোগ্য অংশ তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষিকাজের উপর নির্ভর করে, আর সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের কৃষি খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (৪ওজ)-এর প্রযুক্তিগুলো সেচ এবং পানি ব্যবস্থাপনার সাথে যুক্ত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য উদ্ভাবনী সমাধান প্রদান করে, যা ফসলের পানির সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারে, সেচ দক্ষতা উন্নত করে এবং কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের ধরণ, নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে পানির ঘাটতি এবং পানি বণ্টন ও ব্যবস্থাপনায় চ্যালেঞ্জসহ বাংলাদেশ কৃষিতে পানি সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি। এই সমস্যাগুলো ফসলের ফলন, কৃষকের আয় এবং সামগ্রিক কৃষি স্থায়িত্বের উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। ৪ওজ প্রযুক্তি গ্রহণ করে, বাংলাদেশ সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে বিপ্লব ঘটাতে পারে, পানি সম্পদের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত এবং কৃষি খাতের স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করতে পারে।
সেচ ব্যবস্থায় ইন্টারনেট অফ থিংস (ওড়ঞ) প্রয়োগ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (অও)-যুক্ত সেন্সরভিত্তিক পানি নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা কৃষি ক্ষেত্রে সেচের পানির অপচয় রোধ করে সেচ দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারে। এআই এবং মেশিন লার্নিং, আবহাওয়া ও জলবায়ুর দীর্ঘমেয়াদী তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে, ফসলের প্রয়োজনীয় পানির চাহিদার ভবিষ্যদ্বাণীমূলক মডেলিং সক্ষমতা বাড়াবে। স্যাটেলাইট ইমেজ এবং ড্রোনসহ রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তির ব্যবহার পানি সম্পদের অনুসন্ধান এবং সেচ ব্যবস্থার দক্ষতা মূল্যায়নে সহায়তা করতে পারে। বাংলাদেশে সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনায় ৪ওজ প্রযুক্তি গ্রহণের জন্য সরকার, বেসরকারি খাত, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং কৃষকদের সম্পৃক্ত করে একটি সহযোগিতামূলক কাঠামোর প্রয়োজন। ৪ওজ প্রযুক্তি বাংলাদেশের কৃষি খাতে সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি পরিবর্তনের জন্য অপার সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের কৃষিতে ওড়ঞ, অও, বিগ ডেটা অ্যানালিটিক্স এবং রিমোট সেন্সিংস প্রযুক্তি প্রয়োগ করে পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও পানি সংরক্ষণ, অতিরিক্ত পানির অপচয় রোধ, ফসলের ফলন বৃদ্ধি নিশ্চিত করা যায় যা চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করবে।
সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনার প্রাধিকারপ্রাপ্ত গবেষণা ক্ষেত্র
১. ৪র্থ শিল্প বিপ¬বের জন্য প্রিসিশন ইরিগেশন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহার
২. পানি ব্যবস্থাপনায় জিআইএস ও রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি প্রয়োগ
৩. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুক্ত করে সেচের পানি ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি
৪. কৃষিতে ব্যবহৃত পানির উৎপাদনশীলতার উন্নয়ন
৫. টেকসই ও স্বয়ংক্রিয় ভুগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা
৬. সেচের জন্য নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণ
৭. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে পানি ব্যবস্থাপনা
৮. পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় ক্রপ মডেলিং ব্যবহার
ধানের জমিতে সেচ প্রদানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত স্বয়ংক্রিয় এডবি¬উডি প্রযুক্তি
ধানের জমিতে সেচ প্রদানের জন্য অটোমেটেড এডবি¬উডি পদ্ধতির উন্নয়ন করা হচ্ছে। এই গবেষণা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এডবি¬উডি সেচ পদ্ধতিতে ব্যবহৃত পিভিসি পাইপের উপর একটি পানির স্তর সনাক্তকারী সেন্সর বসানো থাকবে। পিভিসি পাইপে পানির স্তরের উঠানামার উপাত্ত, সেন্সরটি তারবিহীন ব্যবস্থায় দূরবর্তী পাম্পে স্থাপিত বেজ স্টেশনে প্রেরণ করবে। বেজ স্টেশনের সাথে সংযুক্ত পাম্পটি পানির স্তরের উঠানামার উপর ভিত্তি করে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে চালু বা বন্ধ হবে এবং ধানের জমিতে প্রয়োজন অনুপাতে পানি সরবরাহ করবে। গবেষণাধীন এই পদ্ধতিতে সেচ প্রদান করা গেলে সেচকাজে শ্রমঘন্টা সাশ্রয় হবে এবং সেচের পানির অপচয় রোধ হবে। গবেষণাধীন ‘ধানের জমিতে সেচ প্রদানের জন্য অটোমেটেড এডবি¬উডি পদ্ধতির’ উন্নততর ব্যবস্থায় একটি কন্ট্রোলপ্যানেলের মাধ্যমে একইসাথে অনেক জমিতে প্রয়োজন অনুসারে সেচ প্রদান নিয়ন্ত্রন করা যাবে, জ্বালানী তেল বা বিদ্যূতের পরিবর্তে সৌরবিদ্যুতের সংযোগের মাধ্যমে জ্বালানী খরচ সাশ্রয় করা যাবে যা সেচ খরচ কমাতে সাহায্য করবে। সেচ ব্যবস্থায় ইন্টারনেট অফ থিংস (ওড়ঞ) ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে এবং মাটির আর্দ্রতার মাত্রা, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং আবহাওয়ার অবস্থার তথ্য ব্যবহার করে সেচ প্রদান বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব।
নদীর পানির লবণাক্ততার স্বয়ংক্রিয় পর্যবেক্ষণ
বাংলাদেশের দক্ষিনে উপকূলীয় অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর লবণাক্ততা নিয়মিতভাবে নদীগুলোর বিভিন্ন স্থানে পর্যবেক্ষণ ও লবণাক্ততার তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু লবণাক্ততার তথ্য সংগ্রহের পুরো প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ ও শ্রমসাধ্য। একাজে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল প্রয়োজন হয় এবং যাতায়াত সুবিধা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নদীর পানির লবণাক্ততা নির্ণয়ে সেন্সর নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি ব্যবহার করা সম্ভব। পানির লবণাক্ততা নির্ণয়, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংরক্ষণের জন্য সেন্সরসংযুক্ত বিশেষ যন্ত্র নদীর সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন অংশে স্থাপন করা হয়। লবণাক্ততা সংক্রান্ত উপাত্ত সংগ্রহের পর তা রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি কেন্দ্রীয় সার্ভারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় সার্ভার থেকে নদীর লবণাক্ততার তথ্য ও উপাত্ত যে কোন সময় পর্যবেক্ষণ করা যায়। লবণাক্ততার তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে, নদীর বিভিন্ন অংশের পানির সেচ উপযোগীতা নির্ণয় করা যায় এবং পরবর্তীতে নদীর উক্ত অংশের পানি সেচ কাজে ব্যবহার করা যায়। স্বল্প খরচে, কম শ্রমে এবং অল্প প্রশিক্ষিত জনবল ব্যবহার করে ব্যপকভাবে সকল নদীর পানির লবণাক্ততার মাত্রা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা যায় এবং কোন কারণে নদীর কোন অংশের লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে গেলে সাথে সাথেই সেই পানি সেচ কাজে ব্যবহারে সর্তকতা জারী করা সম্ভব হবে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সেন্সর দ্বারা সংগৃহীত লবণাক্ততার তাৎক্ষনিক উপাত্ত কম্পিউটার মডেলিং-এ জন্য খুবই দরকারী তথ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
লবণাক্ত সেচের পানি নির্লবণীকরণ
লবণাক্ত সেচের পানি নির্লবণীকরণ বা ডিসেলিনেশন হলো লবণমিশ্রিত বা লবণাক্ত পানিকে লবণ থেকে মুক্ত করার প্রযুক্তি। এই পদ্ধতিতে লবণাক্ত পানি থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় লবণ বা অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থগুলো সরিয়ে দেওয়া হয়। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বেশী লবণাক্ত পানিকে কম লবণাক্ত পানিতে রূপান্তরিত করে ধানের সেচের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। নির্লবণীকরণ বা ডিসেলিনেশন প্রযুক্তিতে লবণাক্ত পানি থেকে লবণ সরিয়ে দিতে বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেমন: থার্মাল ডিসটিলেশন, রিভার্স ওসমোসিস এবং ইলেক্ট্রোডায়ালাইসিসি। থার্মাল ডিসটিলেশন পদ্ধতিতে লবণাক্ত পানিকে তাপ দিয়ে বাষ্পে পরিণত করা হয়, ফলে পানি লবণ থেকে আলাদা হয়ে যায়। পরবর্তীতে, বাষ্পকে ঠা-া করে অলবণাক্ত পানি পাওয়া যায়। রির্ভাস ওসমোসিস পদ্ধতিতে লবণাক্ত পানিকে একটি মেমব্রেনের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত করা হয়, ফলে লবণ ও লবণ জাতীয় পদার্থ মেমব্রেনে আটকে যায় এবং লবণমুক্ত পানি আলাদা করে সংরক্ষণ করা হয়। ইলেক্ট্রোডায়ালাইসিসি পদ্ধতিতে ইলেকট্রিক চার্জ ব্যবহার করে লবণাক্ত পানি থেকে লবণ বা অন্যান্য পদার্থগুলো আলাদা করা হয়। উল্লেখিত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে বিশ্বব্যাপী রিভার্স ওসমোসিস পদ্ধতিটি বেশ জনপ্রিয়, কারণ এতে তুলনামূলক খরচ কম হয় এবং বেশী পরিমান লবণাক্ত পানি একসাথে ও কমসময়ে স্বাদু পানিতে পরিণত করা যায়। তবে, লবণাক্ত পানি নির্লবণীকরণ একটি ব্যয়বহুল প্রযুক্তি বিধায় এই প্রযুক্তি ব্যবহারের আগে সম্ভাব্যতা যাচাই জরুরী। বাংলাদেশে ধান চাষে ডিসেলিনেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে লবণাক্ততা দূর করে নদী বা খালের লবণাক্ত পানিকে সেচ উপযোগী করা সম্ভব হলে, তা ফসলের নিবিড়তা ও উৎপাদনশীলতা বহুগুনে বাড়াতে সাহায্য করবে।
সেচের পানির উৎস সন্ধানে স্যাটেলাইট ইমেজ বিশে¬ষণ
স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ সেচের পানির উৎস হিসেবে ব্যবহারের জন্য পানিসম্পদ অনুসন্ধানের অত্যন্ত উপযুক্ত ও কার্যকরী একটি প্রযুক্তি। স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ ব্যবহার করে স্থলভাগের অভ্যন্তরে নদী, জলাভূমি, জলধারাসমূহ, জলাশয় ও অন্যান্য পানিসম্পদের উৎস, পরিমাণ, গতিবিধি ও অবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা পাওয়া যায় । স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে পানির উপস্থিতির পরিমান বিভিন্ন রঙ দিয়ে নির্ণয় করা হয়, যা পানিসম্পদের স্তর, পরিমাণ ও গতিবিধি সনাক্ত করতে সাহায্য করে। স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণের ফলে সেচ কাজে পানিসম্পদের সঠিক পরিচালনা, সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা এবং পরিকল্পনা সহজে করা যায়। স্যাটেলাইট ইমেজ বিশে¬ষণ পানিসম্পদ অনুসন্ধানে অত্যন্ত উপযুক্ত এবং কার্যকরী প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে।
ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধানের জমিতে সেচের প্রয়োজনীয়তা নির্ণয়
ইউএভি (টহসধহহবফ অবৎরধষ ঠবযরপষব) প্রযুক্তি, যা ড্রোন নামে পরিচিত, ব্যবহারের মাধ্যমে ধানগাছের পানির চাহিদার তথ্য নির্ধারণের মাধ্যমে খরা মোকাবিলা এবং সেচ ব্যবস্থাপনা করা একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। সামগ্রিকভাবে ড্রোন থেকে প্রাপ্তি ইমেজ বিশ্লেষণ করে ধানের জমিতে সেচের প্রয়োজনীয়তা নির্ণয় করা যায়। এটি সঠিক সেচ পরিকল্পনা এবং জমির উপযুক্ত পানি ব্যবস্থাপনা করতে সাহায্য করে, যা ধান গাছের বৃদ্ধি ও ফলনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ড্রোনের সাথে সংয্ক্তু সেন্সরসমূহ জমির আকার, গাছের উচ্চতা, গাছের বৃদ্ধির পর্যায়, মাটির অবস্থা ও অনান্য পরিমাপকের উপাত্ত সংগ্রহে সহায়তা করে যা সেচের প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ড্রোন হতে প্রাপ্ত ইমেজ থেকে ফসলের জমিতে কোন অংশে পানির অভাব আছে এবং কোন অংশে অতিরিক্ত পানি রয়েছে তা সনাক্ত করা সম্ভব। ড্রোন দিয়ে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জমির বিভিন্ন অংশে সেচের প্রয়োজনীয় পরিমান এবং সেচ প্রদানের সঠিক সময় নির্ধারণ করা যায়। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সম্পূর্ণ জমিতে ঢালাও সেচ না দিয়ে শুধু মাত্র সেচের প্রয়োজন আছে এমন অংশে চাহিদা মোতাবেক সেচ সরবরাহ করা যায় এবং জমির অনান্য অংশের জন্য অপ্রয়োজনীয় সেচ প্রদান এড়ানো যায়, যা সেচের পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে, সেচের পানির অপচয় রোধ করে এবং সেচ দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭৬৩৪৩৬৬০৩।

বিস্তারিত
মাটির নিচের পানি ব্যবহারে মিতব্যয়ী হতে হবে

মাটির নিচের পানি ব্যবহারে মিতব্যয়ী হতে হবে
মৃত্যুঞ্জয় রায়
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী বায়ুম-লের উষ্ণতা বাড়ছে, বনে দাবানল লাগছে, বৃষ্টিপাত কমছে, মাটির আর্দ্রতা কমছে। আর এসব কারণে এ শতকেই বিশ্বে চরম খরা ও মরুকরণের আশংকা করছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ খরার ঝুঁকিতে রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগ পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় ২০২০ সাল থেকে ২১০০ সালের মধ্যে বায়ুম-লের তাপমাত্রা বর্তমানের চেয়ে ১.৫-২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে তার প্রভাবে শুধু উত্তরবঙ্গ না, আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশের দক্ষিণ ও মধ্য পূর্বাঞ্চলেও খরা ছড়িয়ে পড়বে। খরার পেছনে মূল কারণ জলের স্বল্পতা বা জলশূন্যতা। বিবিএস-এর হিসেবে খরায় এ দেশে বছরে প্রায় ৭ লাখ টন ফসল নষ্ট হয়।
সতের কোটির বেশি লোকের এ দেশে দৈনন্দিন কাজ ও পানের জন্য রোজ বিপুল পরিমাণ জলের দরকার হচ্ছে। পানি লাগছে শিল্প-কলকারখানায়। এর সাথে আছে চাষাবাদের জন্য সেচের পানি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শুধু বৃষ্টিপাতের ওপর ভরসা করে চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। তাই কোনো কৃষক ফসল চাষে ঝুঁকি না নিয়ে সেচের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়ে দিয়েছেন। সেচের পানি আসে দু জায়গা থেকে- মাটির উপরের পানি ও মাটির নিচের পানি। মাটির উপরের পানি হলো নদী-নালা, খাল-বিল। দিন দিন পানির এসব উৎস কমে আসছে। ফলে চাপ বাড়ছে মাটির নিচের পানির ওপর। কৃষিকাজে এখন বিপুল পরিমাণ মাটির নিচের পানি ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যাপক নগরায়নের ফলে সুপেয় জলের ব্যবস্থা করতে নগরকর্তারাও মাটির নিচ থেকে পানি তুলছেন। বিদেশে নগরে ব্যবহৃত পানি শোধন বা রিসাইক্লিং করে পুনরায় ব্যবহারের যোগ্য করে তোলেন, মাটির নিচে সঞ্চিত পানিভা-ারকে যতটা সম্ভব মজুদ রাখেন। সংকটকালীন সময় ছাড়া সেই মজুদকৃত পানিতে কেউ হাত বাড়াতে চান না। কিন্তু আমাদের দেশে বিষয়টা একবারে উল্টো। আমরা মাটির উপরের চেয়ে মাটির নিচের পানি তুলতেই বেশি আগ্রহী। দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ আবাদি জমি এখন সেচের আওতায়। ছোট্ট একটা দেশে সেচযন্ত্র আছে প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ।
আমাদের মনে থাকে না যে, মাটির নিচের কোনো সাগর বা পদ্মা-মেঘনার মতো নদী নেই। মাটির নিচে পানি থাকে মাটিকণার ফাঁকে  ফাঁকে। মাটির গঠনটা বেশ অদ্ভুত। আমরা যাকে মাটি বলি, তা বহু শিলা বা নুড়ির ক্ষয়ে যাওয়া কণা। এসব কণার ফাঁকে থাকে পানি অথবা বায়ু। সাধারণত কোনো মাটির ভেতরে এসব কণার মধ্যে ফাঁকা থাকে অর্ধেক অংশ। এ অর্ধেকের আবার অর্ধেক অর্থাৎ সিকি ভাগ থাকে পানি ও সিকি ভাগ থাকে বায়ু একটা কমলে অন্যটা বাড়ে। নদ-নদী বা অন্যান্য জলাশয়ে যে পানি থাকে এবং বৃষ্টিপাতের ফলে যে পানি হয় তা চুইয়ে মাটি কণার ফাঁক দিয়ে নিচে গিয়ে জমা হয়, মাটির গভীরে খালি হয়ে যাওয়া জায়গায় পানির পুনর্ভরণ হয়। সেসব পানিই আমরা যন্ত্র দিয়ে মাটির নিচ থেকে তুলে আনি। এক্ষেত্রে নানা ধরনের নলকূপ ব্যবহার করে মাটির বিভিন্ন স্তর থেকে বা বিভিন্ন গভীরতা থেকে পানি তুলে আনা হয় উপরে।
বর্তমানে পানির ব্যবহার বহুগুণ বেড়ে গেছে। মাটির নিচ থেকে অতিরিক্ত পানি তোলার কারণে সেখানে সঞ্চিত পানি কমে যাচ্ছে, পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে চাষের মৌসুমে সেচের সংকট দেখা দিচ্ছে। সাময়িক খরা পরিস্থিতিতে পড়ে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া অতিরিক্ত পানি তোলার কারণে তার সাথে মাটির নিচ থেকে উঠে আসছে সীসা ও আর্সেনিকের মতো ভারী ধাতব কণা যা আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই, জলবায়ু বদলে যাওয়ার কারণে এ দেশের পানি পরিস্থিতির ওপরও সংকট নেমে এসেছে। বিশ্বব্যাপী এখন আগের চেয়ে বেশি খরা পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে খরা বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি ও নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে জাতীয় খরা সম্মেলন ২০২৩ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্মেলনে বাংলাদেশের খরা পরিস্থিতি, প্রভাব, করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে সেখানে অনেক আলোচনা করা হয়েছে। সম্মেলন শেষে আলোচকরা সুপারিশ করেছেন, ‘এ দেশের কৃষিকে রক্ষা করতে হলে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কৃষিকাজে ভূউপরিস্থ পানি ব্যবহার করতে হবে। তৃণমূল মানুষদের সমস্যার কথা শুনতে হবে। কৃষককে বাঁচাতে নীতি গ্রহণ করতে হবে। খরা মোকাবিলায় বন্যাকবলিত এলাকার পানিকে খরাপ্রবণ এলাকায় স্থানান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’ এই সম্মেলন নিঃসন্দেহে এ সময়ের জন্য খুবই দরকার। সুপারিশগুলো পর্যালোচনা ও বিবেচনার দাবি রাখে।
দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ইতোমধ্যে উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলোকেও আমলে নিতে হবে। খরা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সেচ সাশ্রয়ী পদ্ধতিতে কিভাবে ফসল উৎপাদন অব্যাহত রাখা যায় তা দেখতে হবে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ধানের কিছু খরা সহনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট তাপসহনশীল জাতের গম উদ্ভাবন করেছে। আমাদের দেশে খরা সইতে পারে অতীতে এমন বেশ কিছু দেশী ধানের জাত ছিল। উচ্চফলনশীল আধুনিক ও হাইব্রিড জাত আসায় সেগুলো হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে। সেসব জাতের বৈশিষ্ট্য নিয়ে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা বায়োটেকনোলজি কৌশল গ্রহণ করে ফসলের খরা সহনশীলতা বাড়ানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। খরা পরিস্থিতি যেভাবে বাড়ছে সেজন্য আরও অনেক ফসলের খরা ও তাপ সহনশীল জাত উদ্ভাবন করা দরকার। পাশাপাশি খরা পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানোর ও সেচ সাশ্রয়ী আরও চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা দরকার। ভূগর্ভস্থ পানির চেয়ে কৃষি ও দৈনন্দিন কাজে ভূপৃষ্ঠস্থ পানি ব্যবহারে জোর দিতে হবে। এ দেশে বোরো ধানে সবচেয়ে বেশি মাটির নিচের পানি সেচ দেওয়ার জন্য তোলা হয়। ধানের চেয়ে শাকসবজি ও ফল চাষে সেচ কম লাগে। তাই রবি মৌসুমে যেসব জমিতে ধানের বদলে শাকসবজি চাষ করা যায় সেসব জমিতে তা করতে হবে। ধানের ঘাটতি হলে আউশ মৌসুমে আরও উচ্চফলনশীল জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে এবং চাষ এলাকা সম্প্রসারণ করে সে ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও পদক্ষেপ নিতে হবে।  
যেসব এলাকায় নিয়মিতভাবে একটি বিশেষ সময়ে খরা দেখা দেয় ও ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেসব এলাকায় কম পানি লাগে বা স্বল্প পানিতে চাষ করা যায় এরূপ ফসলের চাষ করতে হবে। মাটি থেকে পানি যাতে দ্রুত না শুকিয়ে যায় সেজন্য ফসলের খেতে বেড তৈরি করে তা মালচিং ফ্লিম দিয়ে ঢেকে চাষ করতে হবে। মাদায় হয় এমন ফসল যেমন মিষ্টি কুমড়া, তরমুজ, খিরা, বাঙ্গি এমনকি ফলগাছ লাগিয়ে তার মাদা বা গোড়া কচুরিপানা বা খড় দিয়ে ঢেকে রাখলে সেখানকার মাটি থেকে পানি কম শুকাবে, এতে সেচও কম লাগবে। খরাপ্রবণ এলাকায় সমাজভিত্তিকভাবে পাশাপাশি জমি রয়েছে এমন কয়েকজন কৃষক মিলে তাদের মোট জমির ৫ থেকে ১০ শতাংশ পরিমাণ জমিতে মিনিপুকুর খুঁড়ে সেখানে বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি বা বন্যার পানি আটকে রেখে খরার মৌসুমে সেসব মজুদ পানি পরিমিত পরিমাণে ব্যবহার করে ফসল ফলানো, তাতে খরার ঝুঁকি কমে। এমনকি আউশ ধান চাষে সম্পূরক সেচের দরকার হলে তাও এ পানি দিয়ে মেটানো যায়। আধুনিক ড্রিপ বা ফোঁটা সেচ পদ্ধতিতেও ফসলে সেচ দিয়ে অনেক কম পানি ব্যবহার করে ভালোভাবে ফসল উৎপাদন করা যায়।  
মাচায় হয় এমন লতানো সবজি জমিতে লাগিয়ে যদি মাচায় তুলে জমিকে তার লতাপাতা দিয়ে ঢেকে রাখা যায় তাহলে সেসব জমির মাটি সূর্যের তাপে কম শুকাবে। এতে সেচ কম দিলেও চলবে। শুধু গাছের গোড়ায় পানি ঢাললেই তাতে ফসল ভালো হবে, সমস্ত জমি ভাসিয়ে সেচ দেয়ার দরকার হবে না। এতে বিপুল পরিমাণ পানি সাশ্রয় হবে। তাছাড়া আমরা সেচের জন্য ধান ও সবজি খেতে যেসব  প্রচলিত পদ্ধতি ব্যবহার করে সেচ দিচ্ছি, তাতে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ সেচের পানি অপচয় হচ্ছে। এত দামের পানির এভাবে নষ্ট হওয়া কোনভাবেই কাম্য না। ভূগর্ভস্থ নালা, পাকা সেচনালা, ফিতাপাইপ ইত্যাদি ব্যবহার করে সেচ দিলে সেচের পানির অপচয় অনেক কমে। সেচের পানির সাশ্রয় মানে মাটির তলার পানির মজুদ ভালো থাকা ও সেচযন্ত্র চালাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমে যাওয়া।
মোদ্দা কথা হলো মাটির নিচের পানি ব্যবহারে এখন অনেক বেশি মিতব্যয়ী হতে হবে, জোর দিতে হবে মাটির উপরে থাকা পানি বেশি ব্যবহারের ওপর এবং মাটির উপরে জলাশয় খনন, নদী বা খালে রাবার ড্যাম তৈরি, নদী ও খাল সংস্কার, রাস্তার দুধারে নালা থাকলে তার গভীরতা বাড়িয়ে পানি মজুদ করে রাখা ও খরার সময় তা ব্যবহার করা। এসব কাজ করলে তা জলবায়ু পরিবর্তনকেও কমাবে। এজন্য দরকার ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারকারীদের সচেতনতা এবং বাস্তবসম্মত সঠিক কৌশলপত্র প্রণয়ন ও পরিকল্পনা।   

লেখক : অতিরিক্ত পরিচালক (অব:), ডিএই; কৃষি বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশন ও সিন্ডিকেট সদস্য, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মোবাইল : ০১৭১৮২০৯১০৭ ই-মেইল : kbdmrityum@yahoo.com

বিস্তারিত
নিরাপদ খাদ্য নিরাপত্তায় ধানক্ষেতে সমন্বিত মাছ উৎপাদন কৌশল

নিরাপদ খাদ্য নিরাপত্তায় ধানক্ষেতে
সমন্বিত মাছ উৎপাদন কৌশল
মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন
বাংলাদেশ ১,৪৪,০০০ বর্গ কিমি. আয়তনের ১৬৫.৫৮ মিলিয়ন (বিবিএস-২০২২) লোকের বসবাস, ফলে এটি বিশ্বের জনবহুল দেশসমূহের একটি। আমাদের একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। অর্থাৎ আবহমান কাল থেকেই মাছ এবং ভাত বাঙালির খাদ্য তালিকার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের দেশে প্রতি বছর ৩ মিলিয়ন লোক মোট জনসংখ্যার সাথে যুক্ত হচ্ছে, ফলে খাদ্যের চাহিদা বেড়েই চলছে। উদ্ভুত সমস্যা সমাধানে খাদ্যের জোগান, আয় এবং পুষ্টির চাহিদা পূরণে সমন্বিত ধানক্ষেতে মাছ চাষ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়/কৌশল। জমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, অব্যাহত জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাহিদা পূরণ, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং পুষ্টির চাহিদা পূরণে সমন্বিত ধানক্ষেতে মাছ চাষের বিকল্প নেই।
ধানক্ষেতে মাছ চাষের সুবিধা : ধানক্ষেতে মাছ চাষ করলে অতিরিক্ত ফসল হিসেবে মাছ পাওয়া যায়। মাছের দেহের বর্জ্য ধানক্ষেতে সার হিসেবে কাজ করে ফলে মাটির উর্বরতা বাড়ায়। মাছ ধানক্ষেতের ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ফেলে ফলে জমিতে কীটনাশক ছিটানের প্রয়োজন হয় না এবং  খরচ কম হয়। ইঁদুরের আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষা পায়। যেহেতু কোন ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ করা হয় না, তাই এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত ধান বিষমুক্ত এবং এর বাজারমূল্য বেশি। ধানক্ষেতে মাছ চাষ পরিবেশগতভাবে উপকারী কারণ এর ফলে ফসফরাস এবং নাইট্রোজেনের আধিক্য মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে, পানিতে অক্সিজেনের প্রবাহ বাড়ায় এবৎ জলজ আগাছা নিয়ন্ত্রণ করে। ধানক্ষেতে মাছ চাষ করলে চাষির মুনাফা ৩ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় এবং ধানের উৎপাদন ১০-১২% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
ধানক্ষেতে মাছ চাষের বর্তমান প্রেক্ষাপট : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০২২ এর তথ্য মতে আমাদের দেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৮.২৯ লাখ হেক্টর, সেচকৃত জমির পরিমাণ ৭৮.৭৯ লাখ হেক্টর এবং ২৬.৪৬ লাখ হেক্টর প্লাবনভূমি (উড়ঋ-২০২২) রয়েছে। ধানক্ষেতে মাছ চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও মোট কি পরিমাণ ধানের জমিতে মাছ চাষ হচ্ছে বা কি পরিমাণ ধানি জমি মাছ চাষের উপযোগী এবং কি পরিমাণ মাছ ধান ক্ষেত হতে উৎপাদিত হয় তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন মৎস্য সংকলনে ধানক্ষেতে মাছের উৎপাদনকে মৌসুমি জলাশয়ের সাথে একীভূত করে দেখানো হয়।
ধানক্ষেতে চাষযোগ্য মাছের প্রজাতি এবং ধানের জাত : ধানক্ষেতে চাষযোগ্য উল্লেখ্য মাছের প্রজাতি হলো গলদা, বাগদা, তেলাপিয়া, পার্সি, কমনকার্প, সিলভার কার্প, রুই, রাজপুটি, শিং, মাগুর ইত্যাদি। উচ্চফলনশীল ধানের জাত যা নুয়ে পড়ে না, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এমন উচ্চফলনশীল ধান যেমন : বোরো মৌসুমের জন্য বিআর-১, বিআর-২, বিআর-৩, বিআর-৭, বিআর-৮, বিআর-৯ বিআর-১২, বিআর-১৪, বিআর-১৮,  ব্রি ধান-৩৫, ব্রি ধান৪৭ ও ব্রি ধান৫৫। আমন মৌসুমের জন্য বিআর-৪, বিআর-১০, বিআর-১১, বিআর-২২, বিআর-২৩, ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৪৪ ও ব্রি ধান৫৬। এছাড়া ব্রি ধান৪৭, ব্রি ধান৬১, বিনা-৮ এবং বিনা-১০ লবণাক্ত সহনশীল জাতের ধানের সাথে চিংড়ি চাষ করা যায়।
চাষ পদ্ধতি : ধানক্ষেতে মাছ চাষকে সাধারণত দুইভাগে ভাগ করা হয় : ধানের সাথে মাছ চাষ এবং ধানের পরে মাছ চাষ
ধানের সাথে মাছ চাষ : আমন মৌসুমে বর্ষাকালে জমিতে যখন ৪-৫ মাস পানি থাকে  অথবা বোরো মৌসুমে সেচের পানির সুবিধা আছে  এমন জমিতে একইসাথে ধান ও মাছ চাষ করা হয়।
ধানের পরে মাছ চাষ : আমন মৌসুমে বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানির কারনে ধান চাষ ব্যহত হয় তখন মাছ চাষ করা হয় অথবা  বোরো মৌসুমে পানির অভাব থাকে সেক্ষেত্রে ধানের পরে মাছ চাষ করা হয়। আমাদের দেশে কুমিল্লা জেলায় এই পদ্ধতিতে মাছ করা হয় যা দাউদকান্দি মডেল নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
আমাদের দেশে দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে ধানের জমিতে লবণাক্ততার উপর ভিত্তি করে বাগদা এবং গলদা চিংড়ি চাষ করা হয়।
চাষ পদ্ধতি : বর্ষাকালে লবণাক্ততার পরিমাণ ‘০’ পিপিটি (পার্টস পার থাউজেন্ড, সালাইনোমিটার) হলে ধানের সাথে গলদা চিংড়ি চাষ করা হয়।
অপরদিকে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে লবণাক্ততা বাড়তে থাকে, তখন বাগদা চাষ করা হয়। দেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে ফেব্রুয়ারি-মার্চে ধানের জমিতে তেলাপিয়া এবং কমন কার্পের পোনা উৎপাদন করা হয়। প্রতি হেক্টর ধানের  জমিতে ৩-৪ লাখ পোনা উৎপাদন করা হয়। কোন কোন জায়গায় ধানের সাথে শিং এবং মাগুর চাষ করা হয়। এক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি ১০,০০০-১২০০০টি শিং মাগুরের পোনা অবমুক্ত করে হেক্টরপ্রতি ১৩০০-১৫০০ কেজি মাছ উৎপাদিত হয়।
এশিয়ার কয়েকটি দেশে ধানক্ষেতে মাছ চাষ কৌশল
চীন : এশিয়ার মধ্যে চীন ধানক্ষেতে মাছ চাষে অগ্রগামী। ধান রোপণের জন্য জোড়া সারি পদ্ধতি অনুসরণ করে, ধানের জমিতে পানির গভীরতা ৫-১০ সেমি., সারি থেকে সারির দূরত্ব সর্বনিম্ন ১৮ সেমি. থেকে সর্বোচ্চ ৩৬ সেমি., মজুদ ঘনত্ব ১৩১২৫টি/হে. এবং গড় উৎপাদন ২.৫ টন/হে.। চীনের কোন কোন প্রদেশে সমন্বিত ধান মাছের সাথে হাসও প্রতিপালন করা হয়।
ভিয়েতনাম : ধানের পরে ও ধানের সাথে দুই পদ্ধতিতে ভিয়েতনামে মাছ চাষ হয়। কমনকার্প, রুই, সিলভার কার্প, গলদা, বাগদা, তেলাপিয়া ইত্যাদি মাছ ধানক্ষেতে চাষ করা হয়। প্রতি বর্গমিটারে ২টি করে মাছ মজুদ করা হয়, দেহ ওজনের ২-৩ ভাগ খাদ্য প্রয়োগ করে হেক্টরপ্রতি ২.২ টন মাছ উৎপাদন রেকর্ড করা হয়েছে। অপর দিকে প্রতি বর্গমিটারে  ১০-১৫টি পি এল মজুদ করে হেক্টরপ্রতি ৭০০ কেজি থেকে শুরু করে ৩.৫ টন পর্যন্ত চিংড়ি মাছ উৎপাদন রেকর্ড করা হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়া : ধানক্ষেতে মাছ চাষে ইন্দোনেশিয়া উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রথম পর্যায়ে পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করে পরে ক্লাস্টার এপ্রোচ পদ্ধতি অনুসরণ করে মাছ চাষে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। বর্তমানে ইয়োগিকার্তা প্রদেশে সরকারের সহায়তায় ১ মিলিয়ন হে: জমিতে সমন্বিত ধানক্ষেতে মাছ চাষ করছে এবং এফ এ ও তাদের কারিগরি সহযোগিতা করছে। ধানী জমির চারপাশে ৪-৫ শতাংশ জায়গায় নালা তৈরি করে পলিথিনের শিট বিছিয়ে দেওয়া হয় ফলে পানি চুয়ে যায় না। ধান রোপণের জন্য জোড়া সারি পদ্ধতি অনুসরণ করে, ধানের জমিতে পানির গভীরতা ৫-১৫ সেমি. এবং নালায় পানির গভীরতা ৬৫-৬৯ সেমি. থাকে। প্রতি বর্গমিটারে ১.২টি করে লাল তেলাপিয়া মজুদ করা হয়। মোট দেহের ওজনের ২-৩ শতাংশ হারে ২৫% আমিষ সমৃদ্ধ পিলেট খাবার প্রতিদিন দুইবার করে দেওয়া হয়। হেক্টরপ্রতি সর্বোচ্চ ৪.৪ টন মাছ উৎপাদন রেকর্ড করা হয়েছে।    
ধানক্ষেতে মাছ চাষে সমস্যা : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কারিগরি জ্ঞানের অভাব, বন্যা ও খরা, জলাবদ্ধতা, রোগবালাই, মাছ চুরি, সময়মতো মানসম্মত পোনা না পাওয়া, উচ্চশ্রমিক মূল্য, প্লট প্রস্তুতিতে অধিক খরচ, মাছের অপ্রত্যাশিত মৃত্যু ইত্যাদি ধানক্ষেতে মাছ চাষে প্রধান বাধা। ধানক্ষেতে মাছ চাষে সমস্যাসমূহকে প্রধান তিনভাগে ভাগ করা যায় : মূলধনের অভাব; কারিগরি সমস্যা এবং সামাজিক সমস্যা।
এ ছাড়া গুণগত মানের পোনার অভাব, পোনার উচ্চমূল্য, মাছের খাদ্যের অধিক দাম, উৎপাদিত মাছের বাজারজাতকরণের সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় চাষিরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে চাষিদের আগ্রহ কম লক্ষ্য করা যায়। এককথায় সমন্বিত ধানক্ষেতে মাছ চাষ মূল কৃষির অংশ হিসেবে এখনও বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা পায়নি।                                                                        
বাংলাদেশে ধানক্ষেতে মাছ চাষের সম্ভাবনা : আবাদযোগ্য জমি সেচকৃত আবাদি জমি এবং প্লাবনভূমি জমিসমূহ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রায় উৎপাদনশীল করার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত, আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আমিষের চাহিদা পূরণ তথা ২০৪১ এর প্রজেকশান নির্ধারণ করা হয়েছে তা বাস্তবায়নে ধানক্ষেতে মাছ চাষ হতে পারে একটি সহজ কৌশল। আমাদের দেশে যে পরিমাণ ধানী জমি রয়েছে তার ২.৮৩ মিলিয়ন জমি ধানক্ষেতে মাছ চাষের আওতায় আনা যায় তাহলে প্রতি বছরে ০.৭৩ মিলিয়ন টন অতিরিক্ত মাছ উৎপাদিত হবে (অযসবফ ধহফ এধৎহবঃঃ ২০১১). আর্থিক বিশ্লেষণে দেখা যায় সমন্বিত ধানক্ষেতে মাছ চাষ করলে চাষির মুনাফা ৬৫.৮% বৃদ্ধি পায় (ঝধরশরধ ধহফ উধং ২০০৮). ধানের একক চাষ অপেক্ষা সমন্বিত ধানক্ষেতে মাছ চাষ করলে চাষির লাভ ৩ গুণ বৃদ্ধি পায় (জধযসধহ বঃ ধষ. ২০১২). অধিক উৎপাদনশীলতা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, অব্যাহত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সহজ প্রযুক্তি, কম কার্বন নি:সরণ তথা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে সমন্বিত ধানক্ষেতে মাছ চাষ একটি একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনার নতুন কৌশল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
ধানক্ষেতে মাছ চাষ এর সুফল পেতে কার্যকর কৌশল গ্রহণ
সরকারি বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা; ডিজেল ভতুর্কির মতো ধানক্ষেতে মাছচাষিদের ভর্তুকি প্রদান করা; প্রশিক্ষণ, শিক্ষা এবং প্রদর্শনী খামার স্থাপন করে চাষিদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি; মাঠপর্যায়ে জনবল বৃদ্ধি করে সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরদার করা এবং চাষিদের প্রযুক্তি গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণ; প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন : মাছের খাদ্য ও গুণগত মানের পোনা নিশ্চিত করা এবং উৎপাদিত ধান ও মাছের বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করা যেন চাষি ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত না হয়; ইন্দোনেশিয়ার মতো ক্লাস্টার এপ্রোচ পদ্ধতি অনুসরণ করা; সেচ বা অন্য বিকল্প উপায়ে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ নিশ্চিতকরণ; সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করা এবং চাষিদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা।
দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জমি খ--বিখ-করণের ফলে জমির আনুভূমিক সম্প্রসারণ দ্রুত গতিতে হ্রাস পাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সরকারের ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নের জন্য ধান ক্ষেতে মাছ হলো একটি সহজ প্রযুক্তি। সেচকৃত আবাদি জমির পরিমাণ ৭৮.৭৯ লাখ হেক্টর (বিবিএস-২০২২) এর মধ্যে ২০% জমি সমন্বিত ধান ক্ষেতে মাছ চাষের আওতায় আনা যায় এবং প্রতি হেক্টরে ১ মে. টন মাছ উৎপাদন করা যায় তাহলে বছরে প্রায় ১৬ লাখ মে. টন অতিরিক্ত মাছ উৎপাদিত হবে যা দেশের মোট ইলিশ উৎপাদনের প্রায় ৩ গুণ। তাই ধান ক্ষেতে মাছ চাষ প্রযুক্তি বিস্তারে অধিক কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
লেখক : সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার, মনোহরদী, নরসিংদী। মোবাইল : ০১৮৪৯-৫০৬৪৬৮, মেইল :ufozia25th@gmail.com

বিস্তারিত
নতুন জাতের ঘাস ‘জারা’

নতুন জাতের ঘাস ‘জারা’
ডা: মনোজিৎ কুমার সরকার
গরুর খামার স্থাপন করতে হলে প্রথমেই যে কাজটি করতে হবে তাহলো চাহিদা নির্ধারণ করে পরিমাণ মতো জমিতে উন্নত জাতের ঘাসের চাষ করা। গবাদিপশুর দৈনিক খাদ্য তালিকার প্রধান উপাদান হলো কাঁচা ঘাস। পশুর স্বাস্থ্য রক্ষা, দুধ উৎপাদন ও বৃদ্ধির জন্য ঘাস প্রয়োজন। জনবহুল বাংলাদেশে পশুর জন্য চারণভূমি নেই। দিন দিন আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এ কারণে অধিক উৎপাদনশীল ও অধিক পুষ্টিগুণ সম্পূর্ণ ঘাস চাষ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ঠিক তেমনি একটি উৎকৃষ্ট মানের ঘাস হলো ‘জারা’।
‘জারা’ ঘাস চীন দেশ থেকে আনা হয়েছে। জারা-১ হাইব্রিড সবচেয়ে বেশি ফলনশীল ঘাস। এই ঘাস দ্রুত বাড়ে, অনেকটা আখের মতো। অনেক মোটা, নরম ও রসালো। জারা-১ এর পুষ্টি গুণাগুণ অনেক বেশি। রোপণের ৫৫ দিন পর প্রথম কাটিং করা যায়। এরপর থেকে ২০-২৫ দিন পর পর ঘাস সংগ্রহ করা যায়। এ ঘাস যতবার কাটা যায় শাখা-প্রশাখা ততোই বাড়বে।
ঘাসের বৈশিষ্ট্য : প্রোটিন ১৮-২০%; খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়; ঘাস নরম, রসালো, সুস্বাদু; গরুকে দৈনিক ১৫-২০ কেজি করে খাওয়ানো যায়; সুগার ২৮-৩০%; দুধ উৎপাদন ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধি পায়; উচ্চতা ১৪-১৬ ফুট; প্রতি কাটিং-এ প্রতি বিঘায় উৎপাদন ২০-২৫ মে.টন; বছরে যে কোন সময় রোপণ করা যায়; সারা বছর সমান ফলন পাওয়া যায়। (সূত্র : ইন্টারনেট)
চাষ পদ্ধতি : জমি ৩-৪ বার চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে গোবর সার দিতে হবে। একর প্রতি ৫০ কেজি টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে। ৫-৭ দিন জমি রোদে শুকিয়ে নিলে রোগজীবাণু নষ্ট হয়ে যাবে। ঘাস লাগানোর জন্য প্রথমে সুতা দিয়ে লাইন সোজা করে নিতে হবে। কাটিং প্রস্তুতকরণের জন্য ৭০-৮০ দিন বয়সের ঘাস সংগ্রহ করে ধাড়ালো দা দিয়ে এক গিটের বা দুই গিটের চারা তৈরি করতে হবে। সেই কাটিং/চারা ৩-৪ দিন ছায়াযুক্ত স্থানে রেখে দিতে হবে এবং সকালে বিকালে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। প্রতি গিট থেকে কুশি বা অংকুর বেড় হবে। সাধারণত বিকাল বেলা রোপণ করার উপযুক্ত সময়।
গিটের চোখ মাটির উপর দিক রেখে ১ ইঞ্চি নিচে পুঁতে দিতে হবে। এক গিটের ২টা কাটিং একসঙ্গে দিলে ভালো হয়। ২ গিটের কাটিং লাগানোর জন্য মাটির সমান্তরালে লাগাতে হবে, যাতে ২টি গিট মাটির সংস্পর্শে থাকে। কাটিং ১-১.৫ ফুট দূরে লাগাতে হবে এবং লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব রাখতে ২ ফুট। ঘাস গজানোর পর সেচ ও ইউরিয়া সারের ডোজ দিলে ভালো হয়।
অন্যান্য পরিচর্যা : প্রতি বার ঘাস সংগ্রহের পর সেচ দিয়ে এর প্রতি ৪৫ কেজি ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। বৃষ্টির সময় ঘাস কাটা যাবে না, প্রয়োজনে ঘাস কাটার পর পলিথিন দিয়ে মোথা ঢেকে রাখতে হবে। মাটি ঘেসে ঘাস কাটতে হবে। ইউরিয়া সার প্রয়োগের পর কমপক্ষে ১৪ দিন পর ঘাস সংগ্রহ করতে হবে। ২-৩ বছর পর আগের ঘাস তুলে ফেলে নতুন করে আবারও লাগাতে হবে। অন্যথায় উৎপাদন কমে যেতে থাকবে।
সংরক্ষণ পদ্ধতি : ২০-২৫ দিন বয়সে ঘাস কেটে সাইলেজ তৈরি করে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করা যায়। চারা সংগ্রহের জন্য যোগাযোগ করা যেতে পারে। সওদাগর এগ্রো, রাজশাহী ০১৭১১১০৪২৯০; সেলিম, চিরির বন্দর, দিনাজপুর ০১৩০০১৫৫৯২২; গাজীপুর ০১৭৫৯৫৫২৭৫৯

লেখক : ভেটেরিনারি অফিসার, জেলা ভেটেরিনারি হাসপাতাল, ঝিনাইদহ। মোবাইল : ০১৭১৫২৭১০২৬; ই-মেইল : drmonojit66@gmail.com

বিস্তারিত
উচ্চমূল্যের ফসল চাষাবাদ : হাইব্রিড ভুট্টা

উচ্চমূল্যের ফসল চাষাবাদ : হাইব্রিড ভুট্টা
ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন
ভুট্টা আমাদের দেশ দিন দিন জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে বর্তমানে (২০২২-২৩) বাংলাদেশে আবাদকৃত ৫.১৯ লক্ষ হেক্টর জমিতে প্রায় ৫৭.৫৩ লক্ষ টন ভুট্টা উৎপাদিত হয়েছে। যার হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ১১.০৮ টন।  ভুট্টা যদিও আমাদের দেশে প্রধান খাদ্যশস্য নয় কিন্তু বর্তমানে ইহার নানাবিধ ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশের তৃতীয় প্রধান দানাদার শস্য হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। হাইব্রিড ভুট্টার ফলন অন্য যে কোন দানাদার ফসলের চেয়ে অনেক বেশি । অধিকন্তু অন্য দানা ফসলের তুলনায় উৎপাদন খরচ কম এবং পরিবেশবান্ধব। এ ছাড়া সম্ভাবনাময় ফসল হিসাবে দেশের বর্তমান উৎপাদিত ভুট্টা থেকে প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার টন তেল উৎপাদন করা সম্ভব, যার বাজারমূল্য ৪,০০০ কোটি টাকারও বেশি।
জাত নির্বাচন
বর্তমানে অধিকাংশ হাইব্রিড ভুট্টার জাতের বীজ  বিদেশ হতে আমদানিকৃত। আবাদকৃত বাণিজ্যিক জাতগুলের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য : রবি মৌসুমের জন্য এন এইচ- ৭৭২০, পি- ৩৩৫৫, বালাজী এবং খরিপ মৌসুমের জন্য প্যাসিফিক-১৩৯, প্যাসিফিক-১৬৪, প্যাসিফিক-৩৩৯ প্রভৃতি। তবে আশার কথা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিডাব্লিউএমআরআই) বেশ কিছু রবি মেীসুমের  উচ্চফলনশীল হাইব্রিড ভুট্টার জাত অবমুক্ত করেছে  যেগুলোর মধ্যে  হাইব্রিড ভুট্টা ১৬, বারি হাইব্রিড ভুট্টা ১৭, বিডাব্লিউএমআরআই হাইব্রিড ভুট্টা ১ ও বিডাব্লিউএমআরআই হাইব্রিড ভুট্টা ২ (অবমুক্তির বছর ২০২২)  অন্যতম  যাহা  কৃষকের মাঠে রবি মৌসুমে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ভবিষতে এজাতগুলোর বীজ ব্যবহার করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করা সম্ভব। এজাতগুলোর মধ্য থেকে বিডাব্লিউএমআরআই হাইব্রিড ভুট্টা ২ এর উপর দিনাজপুরে  গত  ১ মে ২০২৩ একটি মাঠ দিবস অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে মাননীয় কৃষি সচিব মহোদয় উপস্থিত ছিলেন যার ফলন প্রায় ১৪ টন/হেক্টর যা অন্য যে কোন বাণিজ্যিক জাতের চেয়ে ভাল ফলন দিতে সক্ষম ।
উচ্চমূল্যের ভুট্টা ফসল চাষাবাদের মাধ্যমে চাষিরা বর্তমানে অন্যান্য দানাদার ফসলের তুলনায় অনেক বেশি লাভবান হচ্ছে। তাই আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করা একান্ত জরুরি। নি¤েœ এ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
বীজের প্রপ্তিস্থান : বিডাব্লিউএমআরআই হাইব্রিড ভুট্টার জন্য স্থানীয় বিএডিসি অথবা বিডাব্লিউএমআরআই, নশিপুর, দিনাজপুর এছাড়া বাণিজ্যিক জাতসমূহের  বীজ স্থানীয় বীজ ডিলারের কাছে পাওয়া যাবে ।
বীজ শোধন : বপনের পূর্বে ছত্রাকনাশক প্রোভ্যাক্স-২০০ ডব্লিউপি @ ৩ গ্রাম/কেজি বীজ  এবং পরবর্তীতে বীজ বপনের ঠিক ১২-২৪ ঘণ্টা পূর্বে কীটনাশক ফরটেনজা @ ২.৫ মিলি লিটার/কেজি বীজ হারে শোধন করে বীজ বপন করলে বীজবাহিত রোগজীবাণুসহ চারা অবস্থায় প্রায় ২৫-৩০ দিন পর্যন্ত  সবচেয়ে ক্ষতিকারক পোকা  যেমন ফলআর্মিওয়ার্ম দমন করা সম্ভব। বিশেষত : খরিপ ভুট্টার জন্য ফরটেনজা দিয়ে  শোধন করা অপরিহার্য ।
বীজ বপনের উপযুক্ত সময় : বীজ  বপনের জন্য উপযুক্ত সময় মধ্য অক্টোবর-নভেম্বর /৩০ অশ্বিন-মধ্য অগ্রহায়ণ (রবি মৌসুম) এবং মধ্য মার্চ হতে এপ্রিল/১ ফাল্গুন-মধ্য চৈত্র পর্যন্ত (খরিপ মৌসুম) পর্যন্ত। এছাড়া ভুট্টা সারা বছরই চাষাবাদ করা য়ায। তবে রবি মৌসুমের ফলন সবচেয়ে ভাল এবং রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ অনেক কম থাকে।
জমি তৈরি ও বীজ বপন : পাওয়ার টিলার বা ট্রাক্টর দ্বারা চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে ও আগাছামুক্ত করে জমি তৈরি করতে হবে। শেষ চাষের পূর্বে নির্ধারিত পরিমাণ সার প্রয়োগ করে একটি হালকা চাষ ও মই দিয়ে ৬০ সেমি. (২৪ ইঞ্চি) পর পর সারি করে ২৫ সেমি. (১০ ইঞ্চি) পর পর ১/২টি করে  বীজ বপন করতে হবে। দুটি করে বীজ বপনের ক্ষেত্রে বীজ বপনের ২০-২৫ দিন পর সবলটি রেখে দুর্বলটি তুলে ফেলা ।
সার প্রয়োগ : মাটি পরীক্ষা করে সারের মাত্রা নিরূপণ করে তা প্রয়োগ করা উত্তম তবে তা সম্ভব না হলে একর প্রতি ইউরিয়া-টিএসপি-এমওপি-জিপসাম-রোবন-জৈবসার-ফুরাডান যথাক্রমে ২৪০-১৪০-১০০-৮৫-৪-৩০০০-৮ কেজি (রবি মৌসুম) অথবা ১৮০-১০০-৮০-৬৫-৩-১৫০০-৮ কেজি (খরিফ মৌসুম) হারে শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে  ইউরিয়া সমান তিন কিস্তিতে (শেষ চাষের সময়, ৮-১০ পাতা অবস্থায় এবং ফুল ফোটার সময়)  এবং এমওপি দুই কিস্তিতে (দুই       তৃতীয়াংশ শেষ চাষের সময় এবং এক তৃতীয়াংশ ফুল ফোটার সময়) প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া প্রয়োজনমতো ম্যাগনেসিয়াম সালফেট. জিংক সালফেট এবং ডলোচুন ব্যবহার করা যেতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে অম্ল মাটিতে ডলোচুন একবার প্রয়োগ করলে ৩ বছর আর প্রয়োগ করতে হবে না।
সেচ প্রয়োগ ও আগাছা দমন : মাটির প্রকারভেদে ভুট্টা চাষে সাধারণত ৩-৫টি সেচের প্রয়োজন হয়। যেমন ৩-৫ পাতা, ৮-১০ পাতা, ফুলফোটা এবং দানাবাধার সময়। সেচের পানি কোন অবস্থাতে জমিতে আটকিয়ে রাখা যাবে না । প্রথম সেচের পর ক্ষেত্র বিশেষে আগাছা দমন অপরিহার্য হয়ে উঠে । সেক্ষেত্রে সঠিক মাত্রায় অনুমোদিত আগাছানাশক অথবা নিড়ানী ব্যবহার করতে হবে।  
রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন : ছত্রাকবাহিত রোগ যেমন পাতা ঝলসানো, পাতার দাগ প্রভৃতির জন্য অনুমোদিত মাত্রার ছত্রাকনাশক যেমন টিল্ট-২৫০ ইসি, অটোস্টিন ৫০ ডব্লিউডিজি অথবা এমিস্টার টপ স্প্রে করা যেতে পারে। পাকামাকড়ের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ফলআর্মিওয়ার্ম যা দমনের জন্য সমন্বিত দমনব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ পোকার  আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত মাত্রার কীটনাশক প্রোকলেইম, বেল্ট, ট্রেসার, কোরাজেন প্রভৃতি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে কোন কীটনাশকই দুই বারের বেশি ব্যবহার না করা  ভালো কারণ সেক্ষেত্রে পোকা কীটনাশকের প্রতিসহনশীল ক্ষমতা  তৈরি হতে থাকে ।  
জীবনকাল : ভুট্টার জীবনকাল জাত ও অবস্থাভেদে তারতম্য হয়ে থাকে সাধারণত ১৪৫-১৫৫ দিন (রবি মৌসুম) এবং  ১১০-১১৫ দিন (খরিপ মৌসুম)।
ফসল সংগ্রহ : মোচার খোসা শুকনো খরের রং  ধারণ করলে ও দানার গোড়ায়  কালো দাগ হলে ফসল সংগ্রহের উপয়ুক্ত সময়  হয়েছে বলে বুঝতে হবে । অতঃপর দেরি না করে  মোচা থেকে খোসা সরাতে হবে ও মাড়াই মেশিন দিয়ে মারাই করে দানা শুকাতে হবে অথরা খোসা ছড়ানো মোচা রোদ্রে শুকানোর পর মাড়াই করতে হবে।  এর পর স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা অথবা সংরক্ষণ করতে হলে ভালভাবে রোদে শুকিয়ে ছায়ায় ঠান্ডা করে যখন দাঁতে কামড় দিলে কট কট শব্দ হয় অথবা ১৪% আর্দ্রতা  রয়েছে এমন অবস্থায় বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে রাখতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে হাইব্রিড ভুট্টার দানা  কোন অবস্থাই পরবর্তী বছরের জন্য বীজ হিসাবে ব্যবহারের জন্য রাখা যাবে না।
ফলন
উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভুট্টার ফলন ১৩-১৪টন/হেক্টর( রবি মৌসুম) এবং ৯-১০ টন/হেক্টর (খরিপ মৌসুম) পাওয়া সম্ভব।

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, নশিপুর, দিনাজপুর, মোবাইল : ০০৮৮-০১৭১৫৫৭২৫৬৭, ই-মেইল : mamunrwre@yahoo.com

বিস্তারিত
একজন কৃষক ছানোয়ারের ভাগ্য বদলের গল্প

একজন কৃষক ছানোয়ারের ভাগ্য বদলের গল্প
কৃষিবিদ সাবরিনা আফরোজ
অজপাড়াগায়ের প্রান্তিক কৃষক ছানোয়ার হোসেন। কৃষক বাবা চেয়েছিলেন যে কষ্টের জীবন তিনি পাড়ি দিচ্ছেন সেই কষ্ট তার সন্তানকে স্পর্শ না করুক। কবি ইশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মত তিনিও চেয়েছিলেন “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”। বাবার কথা রাখতে পড়াশোনা করেছিলেন। বিএ পাশ করে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু শিরায় যার কৃষির রক্ত  সে আর অন্য পেশায় কিভাবে থাকতে চায়! ছোটবেলায় পাড়াশোনার পাশাপাশি বাবার সাথে মাঠে যেতেন কৃষি কাজ করতে। সেই থেকে মাঠের সাথে সখ্যতা। তবে  কৃষিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার পর তিনি  গতানুগতিক কৃষিকে পাশ কাটিয়ে গ্রহণ করেছেন আধুনিক কৃষি। শুরু করেন আধুনিক ও বানিজ্যক কৃষির জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদ। তিনি নানা ধরনের দেশি বিদেশি ফলের চাষ বিশেষ করে পেঁপে ,পেয়ারা , কুল, মাল্টা ড্রাগন, কলা ,আনারস সহ মৌসুম ভিত্তিক নানা ফসল উৎপাদন করে এলাকার কৃষিতে এক বিপ্লবের সুচনা করেন।
কফি চাষ : ছানোয়ার হোসেন ২০১৭ সালে শখের বসে কফি চাষ শুরু করেন। প্রথমে রাঙ্গামাটি জেলার রায়খালি থেকে ২০০টি চারা সংগ্রহ করেন।  মধুপুরের লাল মাটি ও জলবায়ু কফি চাষের উপযুক্ত হওয়ায় এটি চাষ করে তার সফলতা এসেছে অনেক। তিনি এখন দুই বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন বিশাল কফির বাগান। তার বাগানে বর্তমানে ছয়শোর অধিক পরিপক্ক কফির গাছ আছে। ছানোয়ার হোসেন তার বাগানে এরাবিকা ও রোবাস্টা এই দুই ধরনের কফি চাষ করছেন। তবে রোবাস্টা গাছের কফি চাষ করে তিনি ভাল ফলন পেয়েছেন। দেবদারুর চারার মত দেখতে কফির চারাগুলোয় থোকায় থোকায় যখন ফল ধরে তখন এক অভাবনীয় নৈসর্গিক দৃশ্যের অবতারনা হয়। কফির লালটুকটুকে পাকা ফল অথবা কাঁচা হলুদ ফল দুটোই বাগানের সৌন্দর্য্য বর্ধন করছে বহুলাংশে। ছানোয়ার হোসেন জানান মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় পরিকপক্ক কফি গাছে ফুল আসা শুরু করে। মে থেকে জুন মাসের মধ্যে ফুল থেকে গুটি গুটি ফল আসে। আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ফল পরিপক্কতা লাভ করে। লালচে হয়ে যাওয়া কফির ফল গাছ থেকে  সংগ্রহ করে পরিস্কার পানিতে ধুয়ে নিতে হয়। তারপর লম্বা সময় পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। একটু নরম হওয়ার পর কফির উপরের চামড়া ছাড়িয়ে নিতে হয়। পরে এগুলো রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। রোদে শুকিয়ে নেওয়ার পর খোসা সহ প্রতি কেজি কফি বিক্রি হয় এক হাজার টাকায়। একটি গাছ থেকে বছরে পাচ কেজি কফি ফল পাওয়া যায়। ফলন দেওয়া শুরু করলে একটানা ২০ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত কফি পাওয়া যায় একটি গাছ থেকে। ছানোয়ার হোসেন বলেন কফি প্রক্রিয়াজাত করাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। বাজারজাত ও কফি পান করার উপযুক্ত করতে মেশিনের মাধ্যমে কফি বীজ গুড়া করতে হয়। তিনি গ্রিন কফি দেড় হাজার টাকা ও প্রসেসিং করা কফি আড়াই হাজার টাকা করে বিক্রি করেছেন। তিনি আরও বলেন পাচ বছরে আমার প্রায় দুই লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমি পাঁচ লক্ষ টাকার কফি বিক্রি করেছি। আমি মুলত এই কফি প্রসাধনী কোম্পানি ও অনলাইনের মাধ্যমে বিক্রি করি। আমি কফি প্রক্রিয়াজাত করা মেশিন কিনেছি। কফিকে বড় একটি শিল্পে নিয়ে যাবার ইচ্ছে আছে আমার।
বাউকুল : বাউকুল চাষের মাধ্যমে এক বিঘা জমি থেকে ছয় বছরে সম্ভাব্য নুন্যতম ১৮-২০ লক্ষ টাকা আয় করা সম্ভব। চারা লগানোর প্রথম বছর ছাড়াও প্রতি বছর গাছ ছাটার পর জমি ফাঁকা হয়ে যায়। তখন মৌসুমী সবজি চাষ করে কুল বাগানের বাৎসরিক খরচ উঠিয়ে নেওয়া সম্ভব। অন্তবর্তীকালীন ফসল হিসেবে বেগুন, গ্রীষ্মকালীন টমেটো, ঢেঁড়শ অথবা হাইব্রিড ধনেপাতার  চাষ করা যায়। এক বিঘা জমিতে কুল চাষ করতে প্রথম বছর চারার দরকার হয় ১৫০ টি। তিন বছর পর দুটি গাছের মাঝখান থেকে একটি গাছ উঠিয়ে ফেললে বিঘা প্রতি গাছের সংখ্যা দাড়ায়  ৭৫ টি। সেই হিসেবে ছয় বছরে এক বিঘা জমি থেকে নীট লাভ হয় ১৭-১৮ লক্ষ টাকা। বাউকুল থেকে সফলতা পাওয়ার পর এলাকার অনেক যুবক বাউকুল চাষ করে স্ববলম্বী হয়েছে।
নিরাপদ আনারস চাষ : মধুপুরের আউশনারা ইউনিয়নের ইদিলপুর গ্রামের গারো ভেরেনা সাংমা ষাটের দশকে ভারতের মেঘালয় থেকে জায়ন্টকিউ জাতের কিছু চারা এনে প্রথমবারের মত মধুপুর গড়ে আনারস চাষ শুরু করেন। এখন আশেপাশের কয়েকটি উপজেলা সহ প্রায় ১০ হাজার হেক্টরে এখন আনারস চাষ হচ্ছে। বছরে প্রায় ২ লাখ টন আনারস উৎপাদিত হয় এ অঞ্চলে। জুলাই আগস্ট এই দুই মাস আনারসের মৌসুম ধরা হলেও এখন প্রায় সারা বছরই মধুপুরের আনারস পাওয়া যায়। জায়ান্টকিউ, হানিকুইন, আশি^না ইত্যাদি জাতের আনারস চাষ হয় এখানে। সম্প্রতি ফিলিপাইনের এমভি-২ জাতের আনারসেরও চাষ হচ্ছে মধুপুরে। কিন্তু বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিকর ক্যামিকেলের অপব্যবহারের কারণে মধুপুরের আনারস তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। কৃষক ছানোয়ার হোসেন অসাধুচক্রের মাধ্যমে আনারসের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে শুরু করেন নিরাপদ আনারস চাষের সংগ্রাম। প্রথমদিকে এককভাবে নিরাপদ আনারস বিপননে তিনি বিভিন্নভাবে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। এরপরও তিনি হাল ছেড়ে দেননি। নিরাপদ আনারস নিয়ে প্রচারণার কারনে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এককভাবে তিনি আনারসের যোগান দিতে পারছিলেন না। পরবর্তীতে তিনি এলাকার ৫০ জন প্রগতিশীল চাষী নিয়ে গঠন করেন নিরাপদ ফল ও ফসল উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি লিমিটেড যার মাধ্যমে নিরাপদ আনারস উৎপাদন করে তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। ২০২১ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদোগে ফিলিপাইন থেকে আমদানিকৃত এমভি-২ জাতের আনারস চাষ শুরু হয়। সুপার সুইট হিসেবে পরিচিত বিখ্যাত  এমভি-২ জাতের আনারস খুবই সুস্বাদু ও পুষ্টিগুনসম্পন্ন। বিশ^বাজারে এর অনেক চাহিদা রয়েছে। রপ্তানিযোগ্য এ আনারস আমাদের দেশের প্রচলিত আনারসের তুলনায় অনেক বেশি মিষ্টি ও ভিটামিন সি এর পরিমাণ ৩-৪ গুণ বেশি। এমভি-২ আনারস একইরকম সাইজের হয়। এ আনারস দ্রুত পঁচে না। এছাড়া দেশীয় আনারসের চোখগুলো থাকে ভিতরের দিকে। আর এ জাতের আনারসের চোখগুলো থাকে বাহিরের দিকে। ফলে পুষ্টিসম্পন্ন অংশের অপচয় কম হয়। ছানোয়ার হোসেন আশা করেন এই আনারস চাষের মাধ্যমে ভাগ্য বদলাবে মধুপুরের হাজারো আনারসচাষীর।
অন্যান্য ফসলের চাষ
কৃষক ছানোয়ার হোসেন ২০১৫ সালে মধুপুরে প্রথম বনিজ্যিকভাবে ড্রাগন চাষ শুরু করেন। নানারকম গুণসম্পন্ন ড্রাগনফল বানিজ্যিকভাবে চাষ করে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন তিনি। রোগবালাই কম হওয়ার পাশাপাশি চাষ পদ্ধতি সহজ হওয়ায়  তিনি ড্রাগন চাষের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। তার বাগানে তিনি লাল, হলুদ ও সাদা তিনপ্রকার ড্রাগন চারা রোপণ করেছেন। বর্তমানে প্রতিটি গাছে  ফল ধরে। প্রতি কেজি ড্রাগন  তিনি ২০০-২৫০ টাকায় বিক্রি করছেন। এছাড়া তিনি তার বাগানে থাই পেয়ারার চাষ করেছেন। কৃষক ছানোয়ার জানান প্রতি একর জমিতে থাই পেয়ারা চাষে খরচ হয় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। উৎপাদিত পেয়ারা বিক্রি হয় ৮৫ থেকে ৯৫ হাজার টাকায়। এছাড়া তিনি রপ্তানিযোগ্য কলা জি-নাইন চাষ করেছেন। এ জাতের কলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি উচ্চ ফলনশীল। এ জাতের কলার একটি ছড়ি আড়াই মণ পর্যন্ত হতে পারে। প্রতিটি ছড়িতে প্রায় ২০০ টি কলা পাওয়া যায়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের দপ্তর সংস্থার সহযোগিতা/পরামর্শে কৃষক ছানোয়ার কলাগুলোকে নিরাপদ রাখতে ছড়িগুলোতে ফ্রুটব্যাগ পরিয়েছেন। এতে করে কলাগুলো সতেজ থাকবে ও কলাগুলোতে পোকার আক্রমণ হবে না। এছাড়া কলা চাষের জমিতে তিনি অন্তবর্তীকালীন ফসল হিসেবে বেগুন, পেঁপে চাষ করেন। এক বছরে তার কলা চাষে দেড় লক্ষ টাকা লাভ করেছেন। প্রতিদিন প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার কৃষি খামার অনেক লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। তার এ কৃষি খামার থেকে বাৎসরিক আয় প্রায় ৮-১০ লক্ষ টাকা। তিনি ও তার পরিবারের সকলেই এ কৃষি খামারের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করছেন।
সামাজিক কার্যক্রম ও সম্মাননা : ছানোয়ার হোসেন ছিলেন একজন শিক্ষক। সেখান থেকে এসেছেন কৃষি পেশায়। কিন্তু গ্রামে এসে উপলব্ধি করেন অধিকাংশ কৃষক শিক্ষার অভাবে তাদের জীবনমানের পরিবর্তন করতে পারেন না। অর্থাভাবে তাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারেন না। কৃষকেরা যেন তাদের সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারেন সে জন্য ২০১৪ সালে পাঁচ বিঘা জমি দান করে এলাকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করেন মহিষমারা কলেজ। এছাড়া কৃষির প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধির জন্য কৃষি ও কৃষিকাজে তরুনদের মাঝে জনপ্রিয়করে তোলার জন্য ২০১৭ সালে শুরু করেন উৎপাদনমুখী শিক্ষা কার্যক্রম, শিশু, কিশোর, তরুনদের বিনোদন ও খেলার ছলে বাড়ির আশেপাশে পরিত্যক্ত ও অব্যবহৃত জমিতে ছাদে বারান্দায় ও টবে নিরাপদ ফল, ফসল ও শাকসবজি উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত করায় এ উৎপাদনমুখী শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছেন। কৃষি কাজে সফলতার জন্য তিনি বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মাননা ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয়কৃষি পুরুষ্কার-১৪২৬-এ ব্রোঞ্জ পদক’ পেয়েছেন।
আমাদের দেশে এখন বাড়ছে স্বাস্থ্য সচেতনতা। একজন সচেতন কৃষকই হতে পারে একটি সুস্থ জাতির অন্যতম নিয়ামক। কৃষিতে মাত্রারিক্ত সার ও কীটনাশকের ব্যবহার মানবদেহের জন্য যেমন ক্ষতিকর তেমনি এটি ফসলের ক্ষেতে মাটির বুনটে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে। দেশে এখন অনেক চাষী জৈব কৃষির দিকে ঝুঁকছেন। উত্তম কৃষি চর্চা যেখানে ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ সবক্ষেত্রেই খাদ্য নিরাপদ রাখার প্রচেষ্টায় আছে সমগ্র বিশ^, বাংলাদেশেও তার ছোঁয়া লেগেছে। কৃষক ছানোয়ারের মত প্রগতিশীল কৃষককেরাই আমাদের দেশের অর্থনৈতিক চাকার গতি বাড়াবে। বাংলাদেশকে বিশ^বাজারে নিয়ে যাবে এক অনন্য উচ্চতায়।

লেখক : আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৭৫২৬৮৪০, ই-মেইল :sab.ar777@gmail.com

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর

প্রশ্নোত্তর

কৃষিবিদ আকলিমা খাতুন

নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
হাসানুল করিম, উপজেলা : নলছিটি, জেলা : ঝালকাঠী
প্রশ্ন : ‘হপার বার্ন’ কিভাবে বুঝতে পারবো? প্রতিকার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : বাদামি গাছফড়িং/কারেন্ট পোকা ধানের একটি মারাত্মক ক্ষতিকর পোকা। এ পোকা ধান গাছের গোড়ায় বসে রস শুষে খায়। ফলে গাছ পুড়ে যাওয়ায় বর্ণ ধারণ করে। আক্রান্ত ক্ষেতে বাজ পোড়ার মতো হপার বার্নের সৃষ্টি হয়।
   আমন মৌসুমে আগস্ট মাসের শুরু থেকে নিয়মিত ধান গাছের গোড়া পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। পোকা থাকলে আক্রান্ত জমির পানি সরিয়ে দিয়ে ৭-৮ দিন জমি শুকনো রাখতে হবে।
    আক্রান্ত জমিতে ২-৩ হাত দূরে দূরে বিলিকেটে সূর্যের আলো ও বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়।
    সঠিক দূরত্বে (সারি থেকে সারি ২০-২৫ সেমি. ও গুছি থেকে গুছি ১৫-২০ সেমি. লাইনে চারা রোপণ ও পদ্ধতি (১০ লাইন পরপর ১ লাইন ফাঁকা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
    আলোক ফাঁদ ব্যবহার করা ও পরবর্তীতে নাড়া পুড়ে ফেলতে হবে।
    জমির অধিকাংশ গাছে ৪টি ডিমওয়ালা পুর্ণবয়স্ক স্ত্রী পোকা বা ১০টি ছোট বাদামি গাছফড়িং দেখা গেলে অনুমোদিত কীটনাশক গাছের গোড়ায় দ্রুত স্প্রে করতে হবে।
    বাদামি গাছফড়িং দমনে কার্যকরী কীটনাশক পাইমেট্রোজিন গ্রুপের ওষুধ পাইরাজিন ৭০ ডব্লিউ জি ৪ গ্রাম ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতক জমিতে স্প্রে করা অথবা আইসোপোকার্ব ৭৫ ডব্লিউপি (সপসিন/মিপসিন) = ০.২ গ্রাম/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
মো: বজলুল হক, উপজেলা : কসবা, জেলা : ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
প্রশ্ন : সরিষা চাষের উপযুক্ত সময় ও উন্নত জাত সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : সরিষা বাংলাদেশের প্রধান ভোজ্যতেল ফসল। বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ হেক্টর জমিতে এর চাষাবাদ হয়। এটি একটি স্বল্পকালীন ফসল। বিভিন্ন জাতের সরিষা বীজে ৪০-৪৪% তেল থাকে। বিভিন্ন অঞ্চলের তারতম্য ও জমির জো অনুযায়ী যেসব জমিতে উফশী বোরো ধানের চাষ হয় সেসব জমিতে স্বল্পমেয়াদি সরিষা চাষ হয়। অধিকাংশ বীজ মধ্য আশ্বিন মধ্য কার্তিক মাস পর্যন্ত বপন করা যায়। সরিষার উন্নত জাতগুলো হলো বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৭, বারি সরিষা-১৮ বিনা সরিষা-৪ ও বিনা সরিষা-৯, বিনা সরিষা -১০। বারি সরিষা ১৮ পরিমিত সার ও সেচ প্রয়োগে হেক্টরপ্রতি ১৮ মে.টন ফলন পাওয়া যায়। বিনা-৪ জাতের সরিষা উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় হেক্টরপ্রতি ১.৮৮-২.৫৫ মে. টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। বিনা সরিষা ৯ এর ফলন ১.৮ টন হেক্টর।
মো: নাজমুল, উপজেলা : শিবালয়, জেলা : মানিকগঞ্জ
প্রশ্ন : আনারসের জনপ্রিয় জাত এমডি-২ সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : ‘সুপার সুইট’ খ্যাত এমডি-২ আনারস ফিলিপাইনের একটি জাত। এটি অত্যাধিক চাহিদাসম্পন্ন অম্ল মধুর মিষ্টতায় (১৪% বিক্স)। দেশে প্রচলিত জাতের তুলনায় ৪ গুণ ভিটামিন ‘সি’ ছাড়াও ভিটামিন ‘এ’, ভিটামিন ‘ কে’, ফসফরাস ও জিংক রয়েছে। বর্ষার পর অক্টোবর-নভেম্বর মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। এ জাতের মুকুট ভাসা থাকায় ভক্ষণশীল অংশের পরিমাণ বেশি। সাকারের আকার অনুযায়ী ১২-১৬ মাসে উৎপাদিত হয়। প্রতিটি আনারস ১.৫-২ কেজি ওজনের হয়। ফলন গড়ে ৪০০০-৪৫০০ কেজি প্রতি বিঘায় তবে উপযুক্ত সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ফলন প্রতি বিঘা ৮০০০-৯৫০০ কেজি হতে পারে।
মো: ইমরান হোসেন, উপজেলা : হরিরামপুর, জেলা : মানিকগঞ্জ।
প্রশ্ন : পুঁইশাকের পাতায় গোল গোল বাদামি দাগ পড়ে ও সমস্ত পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। দমন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে চাই।   
উত্তর : এটি একটি বীজবাহিত রোগ। বাতাস, বৃষ্টি ও সেচের পানি দ্বারা রোগটির জীবাণুর বিস্তার ঘটে। এটি পুঁইশাক পাতার দাদ রোগ নামে পরিচিত ও পবৎপড়ংঢ়ড়ৎধ নবঃরপড়ষধ নামক ছত্রাক দ্বারা সংঘটিত হয়।
    আক্রান্ত পাতাগুলো তুলে নষ্ট করে ফেলতে হবে।
    বপনের আগে কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক (নোইন) দ্বারা শোধন করা প্রয়োজন। প্রতি কেজি বীজের জন্য ২.৫ গ্রাম ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে।
    সুষম সার ব্যবহার ও পরিমিত সেচ প্রদান করতে হবে।
    ছত্রাকনাশক ব্যবহারের আগে অব্যশই খাওয়ার উপযোগী পাতা তুলে নিতে হয়। স্প্রে করার ১ সপ্তাহ পর খাওয়ার জন্য পাতা সংগ্রহ করতে হবে।
সাওফা ফাতেমা, উপজেলা : রূপপুর, জেলা : নারায়ণগঞ্জ।
প্রশ্ন : লাউ ফসলের কৃত্রিম পরাগায়ন ব্যবস্থাপনা কিভাবে করতে পারি?
উত্তর : লাউয়ের পরাগায়ন প্রধানত মৌমাছি দ্বারা সম্পন্ন হয়। প্রাকৃতিক পরাগায়নের জন্য হেক্টরপ্রতি দু’টি মৌমাছির কলোনি স্থাপন করা প্রয়োজন। নানা কারণে লাউয়ের সব ফুলে প্রাকৃতিক পরাগায়ন ঘটে না এবং ফলন কমে যায়। হাত দিয়ে কৃত্রিম পরাগায়ন করেও লাউয়ের ফলন ৩০-৩৫% বৃদ্ধি করা সম্ভব। লাউয়ের ফুল ঠিক মতো রোদ পেলে দুপুরের পর ফোটা শুরু হয়ে রাত ৭-৮টা পর্যন্ত ফোটে। কৃত্রিম পরাগায়ন ফুল ফোটার দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত এবং পরদিন সকাল পর্যন্ত করা যায়। তবে পর দিন সকালে পরাগায়ন করলে ফল কম ধরে। কিন্তু ফুল ফোটার দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত যে কয়টা ফুলে পরাগায়ন হয় তার সবকটিতে ফল ধরে। কৃত্রিম পরাগায়নের নিয়ম হলো ফুল ফোটার পর পুরুষ ফুল ছিড়ে ফুলের পাঁপড়ি অপসারণ করা এবং ফুলের পরাগধানী (যার মধ্যে পরাগরেণু থাকে) আস্তে করে স্ত্রী ফুলের গর্ভমু-ে ঘষে দেয়া। একটি পুরুষ ফুল দিয়ে ২-৪টি স্ত্রী ফুলে পরাগায়ন করা যায়।
মো: আমজাদ মিয়া, উপজেলা : নবাবগঞ্জ, জেলা : ঢাকা।
প্রশ্ন : ফুলকপির চারার গোড়া কেটে দিচ্ছে। কী করণীয়?
উত্তর : কাটুইন পোকা পোকা রাতের বেলা চারা মাটি বরাবর কেটে দেয়। কাটুই পোকার আক্রমণে সকাল বেলা চারা মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
ব্যবস্থাপনা  
   সকাল বেলা কেটে ফেলা চারার আশেপাশে মাটি খুঁড়ে পোকা বের করে মেরে ফেলতে হবে।
    কেরোসিন (২-৩ লি:/হে:) মিশ্রিত পানি সেচ দেয়া প্রয়োজন।
    জমি চাষ দিয়ে মাটি উলট-পালট করে পোকা নষ্ট করা যায়।
    পাখি বসার জন্য জমিতে ডাল পুঁতে দেয়া প্রয়োজন।
    জমিতে সন্ধ্যার সময় বিষটোপ ব্যবহার (১ কেজি চাউলের কুঁড়া/গমের ভুসির সাথে ২০ গ্রাম সেভিন কীটনাশক পানি/চিটাগুড়ের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা প্রয়োজন।
    প্রতি লিটার পানিতে ক্লোরোপাইরিফস (ডার্সবান) ১.৫ মিলি হারে গাছের গোড়ায় ১০ দিন পরপর ৩ বার ব্যবহার করতে হবে।

লেখক : তথ্য অফিসার (পিপি), কৃষি তথ্য সার্ভিস,
খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৯১৬৫৬৬২৬২;
ই- মেইল : aklimadae@gmail.com

বিস্তারিত
অগ্রহায়ণ মাসের কৃষি ১৬ নভেম্বর-১৫ ডিসেম্বর

অগ্রহায়ণ মাসের কৃষি
১৬ নভেম্বর-১৫ ডিসেম্বর
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
প্রকৃতির ঋতুচক্রে আমাদের মাঝে অষ্টম মাস হিসেবে হাজির হয় অগ্রহায়ণ। এ মাসের বড় আয়োজন নবান্ন। ঘরে ঘরে সোনালী ফসল তোলার মহা আয়োজন। কৃষকদের মুখে দেখা দেয় অনাবিল সুখের হাসি। উৎসবমুখর পরিবেশের সমান্তরালে বীর কৃষিজীবী ভাইবোনেরা ব্যস্ত থাকেন নিরাপদ ও পুষ্টি খাদ্য সরবরাহে। তাহলে আসুন আমরা জেনে নেই অগ্রহায়ণ মাসের কৃষিতে আমাদের করণীয় কাজগুলো।
আমন ধান
এ মাসে প্রায় আমন ধান পেকে যাবে। তাই রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে। ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় আমন ধান শতকরা ৮০ ভাগ পাকলে কেটে ফেলা ভালো। শ্রম, সময় ও খরচ সাশ্রয়ে প্রয়োজনে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে সুস্থ সবল ভালো ফসল কেটে, মাড়াইঝাড়াই করার পর রোদে ভালোমতো শুকাতে হবে। শুকানো গরম ধান আবার ঝেড়ে পরিষ্কার করে এবং ছায়ায় রেখে ঠা-া করতে হয়। পরিষ্কার ঠা-া ধান বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে।
বোরো ধান
বোরো ধানের বীজতলা তৈরির উপযুক্ত সময়। রোদ পড়ে এমন উর্বর ও সেচ সুবিধাযুক্ত জমি বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হয়। যেসব এলাকায় ঠা-ার প্রকোপ বেশি সেখানে শুকনো বীজতলা তৈরি করতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রতি দুই প্লটের মাঝে ২৫-৩০ সেমি. নালা রাখতে হবে। বোরো মওসুমের পানি সাশ্রয়ী জিংকসমৃদ্ধ জাত ছাড়াও এলাকাভিত্তিক আধুনিক উচ্চফলনশীল ও ব্রি হাইব্রিড ধানের জাত নির্বাচন করতে পারেন। বীজ বপন করার আগে ৬০-৭০ ঘণ্টা জাগ দিয়ে রাখতে হবে। এ সময় ধানের অঙ্কুর গজাবে। অঙ্কুরিত বীজ বীজতলায় ছিটিয়ে বপন করতে হবে। প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য      ৮০-১০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
গম
অগ্রহায়ণের শুরু থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ পর্যন্ত গম বোনার উপযুক্ত সময়। এরপর গম যত দেরিতে বপন করা হবে ফলনও সে হারে কমে যাবে। দো-আঁশ মাটিতে গম ভালো হয়। অধিক ফলনের জন্য এলাকাভিত্তিক ও ঘাতসহিষ্ণু আধুনিক উচ্চফলনশীল গমের জাত বপন করতে হবে।
ভুট্টা
ভুট্টা গত মাসে আবাদ না করে থাকলে এ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে জমি তৈরি করে এলাকাভিত্তিক ও ঘাতসহিষ্ণু আধুনিক উচ্চফলনশীল জাতের বীজ বপন করতে হবে।
সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল
তেল ফসলের মধ্যে সরিষা অন্যতম। তাছাড়া বাদাম, সূর্যমুখী এসব আবাদ করতে পারেন। সরিষা গাছে ফুল আসার সময় শতাংশপ্রতি ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সার উপরি প্রয়োগের পর হালকা একটি সেচ দিতে হবে। মাটিতে রস কমে গেলে ২০-২৫ দিন পর আবারো একটি সেচ দিতে হবে।
আলু
উপকূলীয় অঞ্চলে এ মাসেও আলু আবাদ শুরু করা যায়। অন্যান্য স্থানে রোপণকৃত আলু ফসলের যতœ নিতে হবে। মাটির কেইল বেঁধে দিতে হবে এবং কেইলে মাটি তুলে দিতে হবে। সারের উপরিপ্রয়োগসহ প্রয়োজনীয় সেচ দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
শাকসবজি : মাঠে এখন অনেক সবজি বাড়ন্ত পর্যায়ে আছে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, মুলা এসব বড় হওয়ার সাথে সাথে চারার গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। চারার বয়স ২-৩ সপ্তাহ হলে সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হয়। সবজি ক্ষেতের আগাছা, রোগ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ ব্যবহার করতে পারেন। এতে পোকা দমনের সাথে সাথে পরিবেশও ভালো থাকবে। জমিতে প্রয়োজনে সেচ প্রদান করতে হবে। টমেটো গাছের অতিরিক্ত ডাল ভেঙ্গে দিয়ে খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে ঘেরের বেড়িবাঁধে টমেটো, মিষ্টিকুমড়া চাষ করতে পারেন। মিষ্টি আলু, চীনা, কাউন, পেঁয়াজ, রসুন, মরিসচসহ অনেক অত্যাবশ্যকীয় ফসলের প্রাথমিক বৃদ্ধি পর্যায়। এসব ফসলের কোনটি এখনো না লাগিয়ে থাকলে দেরি না করে চারা লাগাতে হবে। এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত খরা সহনশীল ছোলা, মুগ, তিসি, এসব বপন করা যায়।
গাছপালা
এবারের বর্ষায় রোপণ করা ফল, ঔষধি বা বনজ গাছের যতœ নেয়া প্রয়োজন। গাছের গোড়ায় মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। প্রয়োজনে গাছকে খুঁটির সাথে বেঁধে দেয়া যেতে পারে।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, সংক্ষেপে আগামী তথা অগ্রহায়ণ মাসের কৃষি উপস্থাপন করা হলো। এ মাসে ৫ অক্টোবর বিশ^ মৃত্তিকা দিবস ২০২৩ উদ্যাপিত হবে। ফসল উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের পাশাপাশি সুষম সার প্রয়োগসহ টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়াও বিস্তারিত কৌশল জানার জন্য স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা উপজেলা কৃষি অফিসার, তাছাড়া কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি কল সেন্টার ১৬১২৩ নম্বরে কল করে তাৎক্ষণিক পরামর্শ পেতে পারেন। মনে রাখতে হবে আমাদের সম্মিলিত অংশগ্রহণই নিয়ে আসবে কৃষির কাক্সিক্ষত সাফল্য।

লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪, ই-মেইল : editor@ais.gov.bd

বিস্তারিত