সম্পাদকীয়
চৈত্র বঙ্গাব্দের শেষ মাস। ষড়ঋতুর দেশে ঋতুর সাথে প্রকৃতি বদলায়। ফাল্গুনে আসা আমের মুকুলে আমের গুটি আসে। বাজারজুড়ে মৌসুমি ফুল, ফলের সমারোহ হতে শুরু করে। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বৈশাখ মাস গ্রীষ্মের শুরু হলেও চৈত্রেই রুক্ষতা ও খরতাপের প্রভাব পড়ে। পাশাপাশি বিজ্ঞানের কল্যাণে ছোঁয়া পড়েছে কৃষিতে। কৃষি বিজ্ঞানীগণ কর্তৃক উদ্ভাবিত নতুন নতুন জাত ও প্রযুক্তি কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীরা কৃষকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। ফলে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কৃষিজীবী ভাইবোনেরা নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসল উৎপাদন অব্যাহত রাখছেন।
বাংলাদেশের জনগণের একটা বিশাল অংশ জীবনধারণের জন্য কৃষির উপর নির্ভর করে। উর্বর জমি ও পানির প্রাচুর্যতার কারণে দানাদার, ফল ও সবজিসহ নানাবিধ ফসল উৎপাদন করে বিশে^ কৃষি উন্নয়নের দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশ বিশে^ পাট রপ্তানিতে প্রথম ও উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। পাট বাংলাদেশের একটি অন্যতম আঁশ ফসল। বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক পণ্য বর্জন ও প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে দেশী পাট, তোষা পাট, কেনাফ ও মেস্তা পাটসহ মোট ৯৫.৮১৫ লক্ষ বেল পাট উৎপাদন হয়েছে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের মিশন- পাটচাষি, ব্যবসায়ী ও পাটকলগুলোর সহায়তায় পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে পাট খাতের উন্নয়ন করা। সে লক্ষ্যে ‘খরাপ্রবণ এলাকায় পাট চাষাবাদ প্রযুক্তি’ তথ্যসমৃদ্ধ নিবন্ধটিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এবারের কৃষিকথায়।
এ ছাড়াও কৃষি বিশেষজ্ঞগণের সময়োপযোগী প্রবন্ধ, আগামীর কৃষি ভাবনা, সফল কৃষকের গল্প ও নিয়মিত বিভাগ দিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের সংখ্যা। কৃষিকথায় এসব মানসম্পন্ন ও তথ্যপ্রযুক্তি লেখা দিয়ে যারা সমৃদ্ধ করেছেন তাদের প্রতি রইল আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। আশা করি প্রকাশিত লেখাগুলো কৃষিকে টেকসই ও আধুনিকীকরণের মাধ্যমে উন্নয়নের ধারা গতিশীল রাখতে সহায়ক হবে।
গ্রীষ্মকালীন
টমেটোর
উৎপাদন
কলাকৌশল
ড. মোঃ হাফিজুর রহমান
বিশ্বব্যাপী সকল স্তরের মানুষের কাছে টমেটো একটি অন্যতম প্রধান সবজি। বাংলাদেশে টমেটো প্রধানত শীতকালীন বা রবি মৌসুমের ফসল। এর আকর্ষণীয়তা, স্বাদ, উচ্চ পুষ্টিমান এবং বহুবিধ ব্যবহারযোগ্যতার কারণে পৃথিবীর সর্বত্রই এটি জনপ্রিয় সবজি হিসেবে স্বীকৃত। টমেটোতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ‘, ভিটামিন ‘সি‘, ক্যালসিয়াম ও লৌহ বিদ্যমান। টমেটো খেলে ভিটামিন ও খনিজ লবণের ঘাটতি পূরণ, রোগ প্রতিরোধ, ক্ষুধা বৃদ্ধি, পাকস্থলী সুস্থ রাখা এবং কোষ্টকাঠিন্য দূর করা সম্ভব হয়। টমেটোর ফল সালাদ, তরকারি ও টক হিসেবে খাওয়া যায়। এ ছাড়া জ্যাম, সস, সুপ, কেচআপ ইত্যাদি তৈরিতেও ব্যাপকভাবে টমেটো ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশে গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে অর্থাৎ মার্চ থেকে অক্টোবর মাসে উচ্চতাপমাত্রা ও অতিবৃষ্টি টমেটো চাষের প্রধান অন্তরায়। আবহাওয়াগত এ সমস্যা উত্তরণ তথা গ্রীষ্ম মৌসুমে উৎপাদন উপযোগী জাত উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সবজি বিজ্ঞানীগণ গবেষণার মাধ্যমে কয়েকটি উচ্চতাপমাত্রা সহিষ্ণু টমেটোর জাত এবং এগুলোর উৎপাদন কলাকৌশল উদ্ভাবন করেছেন এবং এইজাতগুলো গ্রীষ্মকালীন টমেটোর জাত হিসেবে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে চাষাবাদ করা হয়।
জাত : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত জাতগুলোর মধ্যে বারি টমেটো-৪ ও বারি টমেটো-৫ গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে পলিথিন ছাউনির ভেতরে ও ফুটন্ত ফুলে হরমোন প্রয়োগের সাহায্যে এবং বারি হাইব্রিড টমেটো-৩, বারি হাইব্রিড টমেটো-৪, বারি হাইব্রিড টমেটো-৮, বারি হাইব্রিড টমেটো-১০ ও বারি হাইব্রিড টমেটো-১১ জাতগুলো হরমোন প্রয়োগ ছাড়া পলিথিন ছাউনির ভেতরে চাষাবাদের জন্য অনুমোদন করা হয়েছে। এ ছাড়াও আরও দুটি জাত অর্থাৎ বারি টমেটো-৬ (চৈতি) ও বারি টমেটো-৯ (লালিমা) সারা বছরব্যাপী চাষাবাদের জন্য অনুমোদিত হয়েছে। এ দুটো জাত বছরের যে কোন সময় চাষাবাদ করা যায়। তবে গ্রীষ্ম মৌসুমে চাষাবাদের জন্য পলিথিন ছাউনি এবং হরমোন প্রয়োগের ব্যবস্থাদি অবলম্বন করতে হয় ।
মাটি জলবায়ু : আলো বাতাসযুক্ত উর্বর দো-আঁশ মাটি টমেটো চাষের জন্য ভালো। পানি নিকাশের সুবিধাযুক্ত এবং পানি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এঁটেল দো-আঁশ মাটি টমেটো চাষের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী। মাটির অম্লতা ৬.০-৭.০ হলে এর আবাদ ভালো হয়। মাটির অম্লতা বেশি হলে জমিতে চুন প্রয়োগ করা উচিত। সাধারণত টমেটো ২০-২৫ সে. তাপমাত্রায় সবচেয়ে ভালো হয়। অপেক্ষাকৃত অধিক তাপমাত্রায় বারি কর্তৃক উদ্ভাবিত জাতগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় না। তবে ভরা গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে গাছের বৃদ্ধি স্বাভাবিক হলেও আশানুরূপ ফলনের জন্য বিশেষ চাষ পদ্ধতি প্রয়োজন হয়।
বীজতলা : পানি নিষ্কাশনের সুবিধা রয়েছে এমন উন্মুক্ত উঁচু জমি বীজতলা তৈরির জন্য উপযুক্ত জায়গা। বীজতলায় সেচের জন্য পানির উৎসের কাছাকাছি বীজতলা তৈরি করতে হবে। চারা তৈরির উদ্দেশ্যে বীজতলা সাধারণত বালু, পঁচা গোবরসার/কম্পোস্ট ও উর্বর মাটি সমপরিমাণে মিশিয়ে মিহি করে তৈরি করতে হয়। প্রতিটি বীজতলা ৩ মি. দৈর্ঘ্য ও ১ মি. প্রস্থ এবং ১৫ সেমি. উঁচু হলে ভালো। পাশাপাশি দুটি বীজতলার মধ্যে ৩০ সেমি. নালা থাকবে। প্রতিটি প্রাথমিক বীজতলায় ১০ কেজি গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপনের পর থেকে রোপণের উপযুক্ত হওয়া পর্যন্ত চারাগুলোকে ঝড়বৃষ্টি এবং রোদ থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় চালার ব্যবস্থা করতে হবে।
বীজ শোধন : কেজি প্রতি ২ গ্রাম ভিটাভেক্স/অটোস্টিন দিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।
বীজ বপন ও চারা উৎপাদন : এপ্রিল-জুন মাস বীজ বপনের সময়। প্রথমে যে সব বীজতলায় বীজ ফেলা হয় সেগুলোকে প্রাথমিক বীজতলা বলে। প্রাথমিক বীজতলায় ঘন করে বীজ বপন করা হয়। গজানোর পর উপযুক্ত সময়ে (৭-১০ দিন পর) চারাগুলোকে নার্সারি বীজতলায় বা ২য় বীজতলায় স্থানান্তর করা হয়। ৩/১ মি. সাইজের প্রাথমিক বীজতলায় ৪০ গ্রাম বীজ বপন করা যেতে পারে। এ হিসেবে প্রতি হেক্টরের জন্য ২০০ গ্রাম ভালো বীজ বুনতে ৫টি বীজতলার প্রয়োজন হবে। বীজ গজানোর ৭-১০ দিন পর (দুপাতা বিশিষ্ট) চারা দ্বিতীয় বীজ তলা অর্থাৎ নার্সারি বীজতলায় ৪/৪ সেমি. দূরত্বে (সারি/গাছ) স্থানান্তর করতে হবে। এক হেক্টর জমিতে টমেটো চাষের জন্য এরূপ ২০টি বীজতলার প্রয়োজন হবে। দ্বিতীয় বীজতলার চারা লেগে উঠতে ৫-৬ দিন লাগবে। এ সময়ে ১ দিন অন্তর পানি সেচ দিতে হয়। পরবর্তীতে ৪-৫ দিন পরপর সেচ দেয়া বাঞ্ছনীয় এতে চারা শক্তিশালী হবে। কারণ অতিরিক্ত সেচ দিলে চারা লম্বা, লিকলিকে এবং দুর্বল হয় এবং পরবর্তীতে এরূপ গাছ থেকে ফলন কম পাওয়া যায় ।
জমি তৈরি : টমেটো চাষের জন্য সারাদিন রোদ পায় এমন জমিই উপযুক্ত। টমেটোর শিকড় প্রায় ১ মিটার গভীরে প্রবেশ করে। সুতরাং গভীর চাষ দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। মাটির প্রকৃতি ও স্থান এবং রোপণকাল ভেদে ২৫-৩০ সেমি. উঁচু এবং ২৩০ সেমি. চওড়া বেড তৈরি করতে হবে। বেডের দৈর্ঘ্য ২০ মিটার অথবা জমির দৈর্ঘ্যরে উপর ভিত্তি করে তৈরি করা যেতে পারে। সেচ অথবা পানি নিকাশের সুবিধার্থে ২টি বেডের মাঝখানে ৩০ সেমি. চওড়া নালা রাখতে হবে।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি : মাটির প্রকারভেদে সারের পরিমাণ কম বেশি হতে পারে। প্রতি হেক্টর জমিতে সার ব্যবহারের সুপারিশ সারণি দ্রষ্টব্য।
সারণি : সারের পরিমাণ (প্রতি হেক্টর)
ইউরিয়া এবং পটাশ সার বেডে ছিটিয়ে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে দিলেই চলবে। গাছের গোড়ায় দিতে হবে না। উল্লেখ্য, সারের উপরিপ্রয়োগের পর অবশ্যই পানি সেচ দিতে হবে।
চারা রোপণ : বীজ বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে চারা রোপণের উপযুক্ত হয়। এ সময় চারাগুলো ৭.৫-১০ সেমি. উঁচু হয় এবং প্রতিটি চারায় ৫-৬টি প্রকৃত পাতা হয়ে থাকে। চারা রোপণের দূরত্ব সারি থেকে ৬০ সেমি. এবং গাছ থেকে গাছ ৪০ সেমি. হিসেবে লাগাতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতি হেক্টরে ৪২,৫০০টি চারার প্রয়োজন হবে।
পরিচর্যা : ক্ষেতের আগাছা দমন খুবই জরুরি। প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তি সারের উপরিপ্রয়োগের সময় পার্শ্বকুশি ছাঁটাই করে দিলে গাছ কম ঝোপালো হয়। ফলে গাছের ভেতর আলো বাতাস প্রবেশ করতে পারে। এতে পোকা-মাকড়ের উপদ্রব এবং রোগবালাইও কম হয়। চারা রোপণের ২-৩ সপ্তাহ পরই গাছে খুঁটি দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। বাঁশের চটা, কানচি, ধৈঞ্চা ইত্যাদি একাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। যথাযথ সময়ে পানি সেচ এবং নিড়ানি দিয়ে আগাছা দমন ও গাছের গোড়ায় মাটি ঝুরঝুরা করে দিতে হবে। ফলে গাছের বৃদ্ধি ও অধিক ফল ধারণে সহায়ক হবে।
হরমোন প্রয়োগ : গ্রীষ্মকালীন টমেটো গাছে প্রচুর ফুল ধরে তবে উচ্চতাপমাত্রা ও বৃষ্টির জন্য গাছপ্রতি ফল কম হয়। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য টমেটোটন নামক কৃত্রিম হরমোন প্রয়োগ করে প্রতি গাছে আশানুরূপ ফল ধারণ করানো সম্ভব হয়। হাত সিনচন যন্ত্রের সাহায্যে টমেটোটন (৫ চা চামচ/লিটার পানিতে) শুধুমাত্র ফুটন্ত ফুলে ৮-১০ দিন অন্তর ২ বার ছিটাতে হয়। গাছ প্রতি ২০-২৫টি ফল ধরলে স্বাভাবিক ফলন হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
পলিথিন ছাউনি : পলিথিন ছাউনি প্রযুক্তি ব্যবহার করে অতিবৃষ্টির হাত থেকে গাছকে রক্ষা করা সম্ভব। এতে ছাউনির মধ্যে লাগানো চারার বৃদ্ধি স্বাভাবিক থাকে। মূলকথা বর্ষা মৌসুমে সবজি উৎপাদনের প্রায় ৭০ ভাগেরও বেশি সাফল্য নির্ভর করে গাছে পলিথিন ছাউনি দেয়া উপর। মাঠে পলিথিন ছাউনি দেওয়া খুবই সহজ। তবে এ কাজের জন্য কিছুটা কারিগরি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। মাঠে চারা লাগানোর পূর্বেই নৌকার ছইয়ের আকৃতি করে স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ছাউনি দিতে হয়। চারা লাগানো এবং অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যার সুবিধার্থে একটি ছাউনির উচ্চতা সবজির প্রকারভেদে উভয় পাশে ১.২০-১.৩৫ মিটার এবং মাঝখানে ১.৮০-২.১০ মিটার হওয়া বাঞ্ছনীয়। ছাউনির জন্য স্বচ্ছ পলিথিন; বাঁশ, ধনুক, বাতা, আঁড়া, খুঁটি; দড়ি-পাটের সুতলি প্রয়োজন হয়। পলিথিন যাতে বাতাসে উড়ে না যায় সেজন্য ছাউনির উপর দিয়ে উভয় পার্শ্ব থেকে আড়াআড়িভাবে দড়ি পেচানো হয়ে থাকে। পাশাপাশি ২টি ছাউনির মাঝে ৫০-৭৫ সেমি. চওড়া নালা রাখতে হবে যাতে ছাউনি থেকে নির্গত বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনসহ বিভিন্ন পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়।
পলিথিন ছাউনির জন্য পলিথিন নানা রঙের হয়ে থাকে। ছাউনি তৈরির ক্ষেত্রে স্বচ্ছ পলিথিন ব্যবহার করতে হয়। এই পলিথিন ব্যবহার করলে গাছ অতি সহজে প্রচুর সূর্যের আলো পেতে পারে। পলিথিন চওড়ায় ভাঁজসহ ৭২ ইঞ্চি অর্থাৎ খোলা অবস্থায় ১৪৪ ইঞ্চি প্রশস্ত হবে। বাজারে সাধারণত ৮/১০/১২ পুরু পলিথিন পাওয়া যায়। এর মধ্যে থেকে ১০ পুরু ছাউনির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। পলিথিন ছাউনির প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে হেক্টরপ্রতি ১৬২-১৭০টি (২০/২.৩ মিটার) ছাউনি তৈরি করা যায়। একটি ছাউনি থেকে সবজির জাতভেদে অনায়াসে ২০০-৩০০ কেজি টমেটো ফলানো যায়। বাঁশের তৈরি কাঠামোর খুঁটি, ধনুক এবং কাঠি যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করলে ২-৩ মৌসুম ব্যবহার করা যায়। অতএব, বাঁশের খরচ প্রাথমিকভাবে বেশি মনে হলেও একাধিক মৌসুম ব্যবহার করা যায় বলে খরচ আনুপাতিক হারে কম হয়। স্বল্পমেয়াদের একটি ছাউনির খরচ অঞ্চল ও সবজির প্রকারভেদে তারতম্য হতে পারে।
অনিষ্টকারী পোকামাকড় এবং রোগবালাই : টমেটো ফসলের প্রতিস্তরে কীটপতংগ ও রোগবালাই দমনে সচেষ্ট থাকতে হবে। বীজতলায় সাধারণত “ড্যাম্পিং অফ” ও “আশুধসা” রোগের আক্রমণ হয়। ভ্যাম্পিং অফ রোগের জন্য ডায়াথেন এম-৪৫ অথবা রিডোমিল এম জেড এবং আশুধসা রোগের জন্য রোভারাল (২ গ্রাম/লিটার) পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর বীজতলায় চারায় প্রয়োগ করতে হবে। পাতার দাগপড়া রোগ টমেটোর বাড়ন্ত গাছে দেখা যায়। ব্যাভিষ্টিন ছত্রাকনাশক (১ গ্রাম/লিটার) পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করলে এ রোগ দমন হয়। টমেটো গাছে সাদা মাছি পোকার আক্রমণ হতে দেখা যায়। এ পোকা খুব ছোট এবং পাতার নিচের দিকে থাকে বলে চোখে পড়ে না। পাতা কোকড়ানো ভাইরাস রোগের বাহক হিসেবে এ পোকা কাজ করে। এ পোকা দমনের জন্য ডাইমেক্রণ নামক কীটনাশক (১মিলি./লিটার) পানিতে মিশিয়ে পাতার নিচের দিকে স্প্রে করতে হবে। ১৫ দিন অন্তর আরো একটি স্প্রে করা যেতে পারে। জাবপোকার আক্রমণ হলেও এই ওষুধ ব্যবহার করা যাবে। কোন কোন অঞ্চলে পাতায় সুড়ঙ্গ পোকার আক্রমণ হতে দেখা যায়। এ পোকা কচি পাতার রস চুসে খায়। ফলে পাতায় সাদা আঁকাবাঁকা দাগ দেখা যায়। ডাইমেক্রন, ডায়াজিনন অথবা রিপকর্ড (১ মিলি./লিটার) পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর স্প্রে করলে দমন করা সম্ভব। উল্লেখ্য, কীটনাশক প্রয়োগের অন্তত ১৫ দিন পর টমেটো সংগ্রহ করতে হবে।
ফসল সংগ্রহ ও ফলন : চারা লাগানোর ৬০ দিনের মধ্যে পাকা টমেটো সংগ্রহ শুরু হয়। প্রতি গাছ থেকে ৪-৫ বার ফল সংগ্রহ করা যায়। কৃত্রিম হরমোন প্রয়োগের মাধ্যমে ফলানো টমেটো বীজবিহীন হয়। তাই শীতকালে এর বীজ উৎপাদন করতে হবে। জাতভেদে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর হেক্টরপ্রতি ফলন ২২-৫২ টন।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, শিবপুর, নরসিংদী; মোবাইল নম্বর : ০১৭২০৬৪৫৬২৯;
বাণিজ্যিক আম
বাগানে এ সময়ের
যত্ন ও পরিচর্যা
ড. মোঃ শরফ উদ্দিন
আম এ দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ফসল এবং জনপ্রিয় মৌসুমি ফল। ছোট-বড় সকলের কাছে এ ফলটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এ দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে আম বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সারাদেশে আমের উৎপাদন হলেও দেশের ২৩টি জেলায় বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদন হচ্ছে। গুণগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদনের জন্য এ সময়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত আমচাষি বা উদ্যোক্তাগণ আম গাছে পুষ্পমঞ্জরি বের হওয়ার পর যত্ন-পরিচর্যা শুরু করে থাকেন। আবার অনেকে আম গাছে গুটি বাঁধার পর আম বাগান পরিচর্যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রকৃতপক্ষে আমের বাণিজ্যিক চাষাবাদের ক্ষেত্রে আমবাগানে সারা বছরই কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। কোন সময় বাগানের কাজকর্ম তুলনামূলক বেশি আবার কোন কোন সময় কম থাকে। সময়ের কাজ সময়ে সম্পাদন করলে গাছের সুষম বৃদ্ধি ও গুণগত মানসম্পন্ন ফলন নিশ্চিত হয়। যেমন-আম বাগানে সার প্রয়োগ। এটি অবশ্যই আম সংগ্রহের পরপরই করতে হবে। কেহ যদি অক্টোবর-নভেম্বর মাসে সার প্রয়োগ করেন তবে কোনোভাবেই ভালো ফলাফল পাবেন না। সুতরাং সার প্রয়োগের কাজটি অবশ্যই সময়মতো ও নির্দেশিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। আমগাছে ভালো ফলন পাওয়ার জন্য এ সময়ের যত্ন-পরিচর্যাসমূহ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যা ধারাবাহিকভাবে নি¤েœ আলোচনা করা হলো।
পুষ্পমঞ্জরি বের হওয়ার পূর্বে যত্ন-পরিচর্যা
সাধারণত বর্ষাকালে আম বাগানে প্রচুর আগাছা জন্মাতে দেখা যায়। অনেক আগাছা বর্ষাকালেই তাদের জীবন চক্র সম্পন্ন করে। ফলে পরবর্তী মৌসুমেও এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এজন্য বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার সাথে সাথে জমির আগাছা সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার করতে হবে। সম্ভব হলে আগাছার ডালপালা, শাখা-প্রশাখা, শেকড় আচড়া দ্বারা সংগ্রহ করে মাটির নিচে পুঁতে দিতে হবে অথবা পুড়ে ফেলতে হবে। তবে কিছু কিছু আগাছা আছে যেগুলো শাখা-প্রশাখা দ্বারা বংশবিস্তার করতে পারে না, সেগুলো মালচ বা জাবড়া হিসেবে আম গাছের গোড়ায় ব্যবহার করা যেতে পারে। আম বাগানে আগাছা দমন করা সম্ভব না হলে সেই বাগান হতে রোগ ও পোকার আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। আগাছা অনেক রোগ ও পোকার আবাসস্থল/আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। আমগাছে পুষ্পমঞ্জরি বের হওয়ার পূর্বে আমগাছকে জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। এ জন্য আমগাছে পুষ্পমঞ্জরি বের হওয়ার আনুমানিক ১৫-২০ দিন পূর্বে একটি ভালোমানের কীটনাশক (ইমিডাক্লোপ্রিড/কার্বারিল/ ল্যামডা সাইহ্যালোথ্রিন গ্রুপের) এবং একটি ছত্রাকনাশক (মেনকোজেব/ কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের) নির্দেশিত মাত্রায় মিশিয়ে সমস্ত গাছ ভালোভাবে ধুয়ে দিতে হবে। এর ফলে আম গাছে বসবাসকারী রোগ-জীবাণু, পোকার ডিম, লার্ভা, পিউপা ও পূর্ণাঙ্গ পোকা ধ্বংস করা সম্ভব হবে। আমগাছে বসবাসকারী এসকল রোগ ও পোকা পরবর্তীতে পুষ্পমঞ্জরিতে আক্রমণ করে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে পুষ্পমঞ্জরি নষ্ট করে, ফলে সেই পুষ্পমঞ্জরিতে আর ফল ধারণ সম্পন্ন হয় না। ফলশ্রুতিতে আমের ফলন মারাত্নকভাবে কমে যায়।
পুষ্পমঞ্জরি বের হওয়ার পর যত্ন-পরিচর্যা
আমবাগানে ফুল আসার পূর্বে যত্ন-পরিচর্যাসমূহ সঠিকভাবে সম্পাদন করলে সতেজ ও রোগমুক্ত পুষ্পমঞ্জরি বের হয়। এ পুষ্পমঞ্জরি বের হওয়া থেকে আমের গুটি বাধা পর্যন্ত ২৫-২৮ দিন সময় লাগে। এ সময়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং রোগ ও পোকার আক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয়। বিশেষ করে হপার বা ফুদকি পোকা এবং এ্যানথ্রাকনোজ রোগ পুষ্পমঞ্জরির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। এগুলো দমন করার জন্য পুষ্পমঞ্জরির দৈর্ঘ্য ১০-১২ সেমি. হলে একটি কীটনাশক (ইমিডাক্লোপ্রিড/ কার্বারিল/ল্যামডা সাইহ্যালোথ্রিন/সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের) এবং একটি ছত্রাকনাশক ম্যানকোজেব গ্রুপের) নির্দেশিত মাত্রায় একত্রে মিশিয়ে রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ায় স্প্রে করতে হবে। এই স্প্রেটি গাছের পুষ্পমঞ্জরি, পাতা ও কা-ে করতে হবে। গাছের পাতা ভেজা অবস্থায় স্প্রে করা ঠিক হবে না। কারণ পাতা ভেজা অবস্থায় স্প্রে করলে ব্যবহৃত বালাইনাশক খুবই দ্রুত পাতা হতে গড়িয়ে পড়ে এবং ব্যবহৃত বালাইনাশকের কার্যকারিতা কমে যায়। বিগত কয়েক বছর কোন কোন আমবাগানে ইনফ্লোরোসেন্স মিজ পোকার আক্রমণ লক্ষ করা যাচ্ছে। এ পোকার আক্রমণ পরিলক্ষিত হলে ফিপ্রোনিল/(সাইপারমেথ্রিন +ক্লোরপাইরিফস) গ্রুপের কীটনাশক নির্দেশিত মাত্রায় স্প্রে করতে হবে। এ সময় শুধুমাত্র পুষ্পমঞ্জরি ও পাতায় স্প্রে করতে হবে। আমরা সবাই জানি, ফুল ফোটা অবস্থায় স্প্রে করা উচিত নয়, তবে রোগ ও পোকার আক্রমণ বেশি হলে এবং ফলন বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থাকলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী ফুলেও স্প্রে করা যেতে পারে। এ ছাড়া ফুল ফোটা শুরু হলে প্রথম ৭ দিন পুষ্পমঞ্জরিতে কোন উভয়লিঙ্গ ফুল না ফোটার কারণে স্প্রে করতে কোন বাধা নেই।
আমের গুটির যত্ন-পরিচর্যা
আমের পুষ্পমঞ্জরির অর্ধেকের নিচের অংশে সাধারণত গুটি আসে না বা খুবই কম আসে। গুটি মূলত পুষ্পমঞ্জরির অর্ধেকের উপরের অংশে বেশি আসে। একটি পুষ্পমঞ্জরির ৭০-৮০ ভাগ ফুল ফোটার পর আমের গুটি বাঁধতে দেখা যায় এবং ৯৫ ভাগ ফুল ফোটার পর কাক্সিক্ষত গুটি বাঁধা সম্পন্ন হয়। আমের গুটি নাকফুল বা সরিষা দানাকৃতি হলে গুটি রক্ষার জন্য কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় গুটিতে এ্যানথ্রাকনোজ এবং হপার পোকার আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। আমের গুটিকে রোগ ও পোকামুক্ত করতে হলে একটি ভালো কীটনাশক (ইমিডাক্লোপ্রিড/সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের) এবং একটি ছত্রাকনাশক কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের নির্দেশিক মাত্রায় স্প্রে করতে হবে। এরপরও গুটিতে কোন অনাক্সিক্ষত দাগ দেখা দিলে নিকটস্থ কৃষি অফিস বা আম গবেষকবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমের গুটির বয়স ২২ দিন অতিবাহিত হলে ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ দেখা যায় এবং ৪৫ দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এ পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করতে হলে (সাইপারমেথ্রিন+ক্লোরপাইরিফস)/ল্যামডা সাইহ্যালোথ্রিন/ সুমিথিয়ন গ্রুপের কীটনাশক নির্দেশিত মাত্রায় স্প্রে করতে হবে। আমের গুটি ঝরা বন্ধ হলে ফ্রুট ব্যাগিং করেও এ পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা যায়। এর পরবর্তী সময়ে শুধুমাত্র রুটিনমাফিক (সেচ, ব্যাগিং, রোগবালাই দমন, আম সংগ্রহ) ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করলেই ভালোমানের আম উৎপাদন সম্ভব হবে।
আমের বাণিজ্যিক চাষাবাদ বিজ্ঞানভিত্তিক এবং প্রত্যেকটি কাজকর্ম গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে করা হয়। সুতরাং গুণগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি কাজকর্ম সময়মতো ও যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে হবে। ফলশ্রুতিতে বাণিজ্যিক আম বাগান হতে গুণগত মানসম্পন্ন ভালোমানের আম উৎপাদন নিশ্চিত হবে।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বারি, গাজীপুর, মোবাইল নং-০১৭১২১৫৭৯৮৯
পরিবেশ সুরক্ষা ও পানি সাশ্রয়ে
এডব্লিউডি সেচ পদ্ধতি
ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। আউশ, আমন, বোরো মৌসুমে আমাদের দেশে ধান চাষ হলেও বোরো মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ধান চাষ হয়ে থাকে। ফলনও অন্যান্য মৌসুমের চেয়ে বোরো মৌসুমে বেশি। ধান চাষে সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বোরো মৌসুম বৃষ্টিহীন বিধায় সেচের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। আমাদের দেশে বোরো মৌসুমে ধান উৎপাদনে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তাছাড়া ধান উৎপাদনে যে পরিমাণ পানি প্রয়োজন তার সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি পরিমাণ পানি অপচয় হচ্ছে। ফলে একদিকে ফসল উৎপাদনে খরচ বাড়ছে ও অন্যদিকে দিন দিন ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গিয়ে ভবিষ্যৎ চরম পানি সংকট ও সেচ ব্যবস্থাপনা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। এর থেকে বাঁচতে সেচের পানির সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পানি সাশ্রয়ী পদ্ধতির ব্যবহার অতীব জরুরি। ভূগর্ভস্থ পানির অপচয় রোধে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় সেচ সাশ্রয়ী এডব্লিউডি (অডউ) বা একান্তর সেচ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
কথিত আছে, এক কেজি ধান ফলাতে প্রায় ২৫০০-৩৫০০ লিটার পানি দরকার হয়! যদিও সম্প্রতি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায় এই পরিমাণ কোনভাবেই ৮০০-১২০০ লিটারের বেশি নয়। ধানের জমিতে যে পানি সেচ হিসেবে সরবরাহ করা হয় তার ৫০% কেবল ধান গাছ গ্রহণ করে বাকি পানি বিভিন্ন উপায়ে ভূগর্ভস্থ পানিতে যুক্ত হয়। সেচে পানির অপচয় রোধে এডব্লিউডি একটি পরীক্ষিত ও কার্যকরী কৃষি প্রযুক্তি। এডব্লিউডি (অডউ) পদ্ধতির মূল বিষয় হলো ধান চাষের ক্ষেত্রে জমিতে সার্বক্ষণিকভাবে পানি না রেখে পর্যায়ক্রমে জমি ভেজা ও শুষ্ক পদ্ধতি অনুসরণ করা। জমির পর্যায়ক্রমে ভেজা ও শুষ্ক অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশেষ কৌশল অবলম্বন করতে হয়। ধান চাষে একবার সেচ দিয়ে পরবর্তী সেচের সঠিক সময় নির্ধারণের জন্য জমিতে ছিদ্রযুক্ত পিভিসি পাইপ (পর্যবেক্ষণ নল) বসাতে হয়। এ পাইপে পরবর্তী নির্দিষ্ট লেভেলে পানি নেমে গেলে সেচ দিতে হয়। এভাবে পর্যায়ক্রমে জমিতে সেচ প্রদান করতে হয়।
সঠিক সেচ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি
ধানের চারা রোপণের পর জমিতে কম পরিমাণে পানি রাখা উচিত যাতে চারা তলিয়ে না যায়। ধানের জমিতে সবসময় দাঁড়ানো পানি রাখার প্রয়োজন নেই তবে একটি পূর্ণমাত্রায় সেচ প্রদান করে পরবর্তী সেচ প্রদানের পূর্বে জমি দুই-তিন দিন শুকনো রাখলে ধানের ফলন কমে না। উপরন্তু ২৫-৩০ ভাগ পানি সাশ্রয় হয়। এ পদ্ধতিতে আগাছার পরিমাণ বেশি হলে আগাছা নাশক ব্যবহার করে আগাছা দমন লাভজনক হবে। ধানের জমির কাইচ থোড় আসার পূর্ব পর্যন্ত এভাবে সেচ দেওয়া যায়। তবে কাইচ থোড় আসা শুরু হলে ৫-৭ সেমি. দাঁড়ানো পানি রাখা দরকার হয়। আমন ধান কাটার পর জমি পতিত না রেখে একটি বা দুটি চাষ করে রেখে দিলে বোরো মৌসুমে জমিতে ২০ ভাগ পানি কম লাগবে। কারণ পতিত জমিতে ফাটল ধরে জমি তৈরির সময় ফাটল দিয়ে প্রচুর পানির অপচয় ঘটে। সারের উপরিপ্রয়োগের পূর্বে জমিতে পানি কম রেখে সার প্রয়োগ করলে সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। ধান পাকার সময় দানা শক্ত হওয়া শুরু করলে সেচ বন্ধ করতে হবে। এতে ধান পাকার সময় কম নেবে ও সেচের পানির অপচয় কমবে।
এডব্লিউডি বা একান্তর সেচ পদ্ধতি
বোরো মৌসুমে ধান আবাদে পানি সাশ্রয়ী একটি পদ্ধতির নাম অলটারনেট ওয়েটিং অ্যান্ড ড্রায়িং বা এডব্লিউডি। অনেকে এটিকে একান্তর সেচ পদ্ধতি হিসেবে চিনেন। এ পদ্ধতির জন্য প্রয়োজন হয় একটি ৭-১০সেন্টিমিটার ব্যাস ও ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা ছিদ্রযুক্ত পিভিসি পাইপ বা চোঙ্গ। এটি চারা রোপণের ১০-১৫ দিনের মধ্যে জমিতে চারটি ধানের গোছার মাঝে খাঁড়াভাবে স্থাপন করতে হবে যেন এর ছিদ্রবিহীন ১০ সেন্টিমিটার মাটির উপরে এবং ছিদ্রযুক্ত ১৫ সেন্টিমিটার মাটির নিচে থাকে। এবার পাইপের তলা পর্যন্ত ভেতর থেকে মাটি উঠিয়ে নিতে হবে। মাটি শক্ত হলে গর্ত করে পাইপটি মাটিতে বসানো যেতে পারে। যখন পানির স্তর পাইপের তলায় নেমে যাবে তখন জমিতে এমনভাবে সেচ দিতে হবে যেন দাঁড়ানো পানির পরিমাণ ৫-৭ সেন্টিমিটার হয়। আবার ক্ষেতের দাঁড়ানো পানি শুকিয়ে পাইপের তলায় নেমে গেলে পুনরায় সেচ দিতে হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে ভিজানো ও শুকানো পদ্ধতিতে সেচ চলবে জাতভেদে ৪০-৫০ দিন পর্যন্ত। যখনই গাছে থোড় দেখা দেবে তখন থেকে দানা শক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত ক্ষেতে স্বাভাবিক ২-৫ সেন্টিমিটার পানি রাখতে হবে।
দেখা গেছে, এডব্লিউডি পদ্ধতিতে বোরো ধানে সেচ দিলে দাঁড়ানো পানি রাখার চেয়ে ৪-৫টি সেচ কম লাগে এবং ফলনও কমে না। ফলে সেচের পানি, জ্বালানি ও সময় সাশ্রয় হয় এবং উৎপাদন খরচও হ্রাস পায়। এ পদ্ধতিতে ধানের জমিতে প্রয়োজনমাফিক সেচ দেওয়া হয়। ফলে পানির অপচয় রোধ হয়। এর জন্য জমিতে একটি পর্যবেক্ষণ নল স্থাপন করে সেই নলের ভিতর পানির অবস্থা দেখে প্রয়োজন মাফিক সেচ দেওয়া হয়।
পর্যবেক্ষণ নল তৈরি
পর্যবেক্ষণ নল হিসেবে পিভিসি পাইপ, বাঁশের চোঙ্গা অথবা প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার করা যায়। নলটি লম্বায় ৩০ সেমি. ও ব্যাস ৭-১০ সেমি. হতে হবে। নলের নিচের দিকে ২০ সেমি. বা ৮ ইঞ্চি ছিদ্রযুক্ত এবং উপরে ১০ সেমি. বা ৪ ইঞ্চি ছিদ্রহীন থাকবে। নলের নিচের ২০ সেমি. এর মধ্যে ১০ মিলিমিটার দূরে দূরে ৫ মিলিমিটির ব্যাসের ছিদ্র থাকবে। ছিদ্রগুলো সারিতে থাকবে এবং এক সারি থেকে অন্য সারির দূরত্ব থাকবে ১০ মিলিমিটার।
নল জমিতে স্থাপন কৌশল
ধানের চারা রোপণের পূর্বে জমি ভালোভাবে সমতল করতে হবে। জমিতে নলটি স্থাপনের সময় নলের ছিদ্রযুক্ত অংশের চারপাশে পাতলা কাপড় বা মিহি নেট ব্যবহার করতে হবে যাতে কাদা বা ময়লা আবর্জনায় ছিদ্র বন্ধ না হয়ে যায় এবং মাটির ভেতরের পানি নলের ভেতর সহজে প্রবেশ করতে পারে এবং বেরিয়ে যেতে পারে। জমিতে নলটি স্থাপনের সময় ছিদ্রযুক্ত ৮ ইঞ্চি মাটির নিচে ও ছিদ্রহীন ৪ ইঞ্চি মাটির উপরে থাকবে। ফলে সেচের পানির সাথে সংযুক্ত খড়কুটা ময়লা আবর্জনা নলে প্রবেশ করতে পারবে না। নলটি আইলের পাশে সুবিধাযুক্ত স্থানে স্থাপন করতে হবে, যাতে উক্ত স্থানটি সমস্ত প্লটের প্রতিনিধিত্ব করে ও পর্যবেক্ষণ কাজ সহজ হয়। একটি প্লটে কমপক্ষে একটি নল স্থাপন বা দুই থেকে তিনটিও স্থাপন করা যাবে। সাধারনত ১৫ শতক জমির জন্য একটি নল স্থাপন করাই উত্তম ।
সেচ প্রদান পদ্ধতি
জমিতে ধানের চারা রোপণের ১৫ দিন পর্যন্ত ২-৪ সেমি দাঁড়ানো পানি রাখতে হবে যাতে আগাছা কম জন্মে। চারা রোপণের ১৫ দিন পর থেকে উক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করে সেচ দিতে হবে। জমিতে সেচ আরম্ভ করার পর যখন জমির উপর ৫ সেমি. দাঁড়ানো পানি জমবে তখন সেচ প্রদান বন্ধ করতে হবে। জমির পানি শুকানোর পর নলের ভেতরে পানির মাত্রা পরিমাপ করতে হবে। পর্যবেক্ষণ নলের ভেতর পানির স্তর জমির লেভেল থেকে ১৫ সেমি. পর্যন্ত নিচে নেমে গেলে সেচ দিতে হবে। এভাবে উক্ত পদ্ধতিতে ধান গাছের থোড় পর্যায় সময় পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে সেচ চলবে। পরবর্তীতে ধান গাছে ফুল আসা থেকে দুধ স্তর পর্যন্ত পর্যন্ত জমিতে অবশ্যই ৫ সেমি. দাঁড়ানো পানি রাখতে হবে। অতঃপর ধান কাটার দুই সপ্তাহ পূর্বে সেচ দেয়া বন্ধ করতে হবে।
এডব্লিউডি পদ্ধতিতে সেচ প্রদান সুবিধা
এ পদ্ধতিতে সেচের পানি জ্বালানি ও শ্রমিক খরচ সাশ্রয় হয়। শতকরা ৩০-৩৫ ভাগ সেচের পানি সাশ্রয় হয়। ডিজেল এর ব্যবহার ৩০ ভাগ কম হয়, ধানের ফলন ১২ ভাগ বেশি হয়, পরিবেশবান্ধব ও সর্বোপরি কম খরচে বেশি লাভ করা যায়। ক্রমাগত জলমগ্ন জমি থেকে গ্রীনহাউজ গ্যাস নিংসরণ হতে হয়। কিন্তু এডব্লিউডি সেচ পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে জমি পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও শুকানো হয় বিধায় গ্রীনহাউজ গ্যাস নিংসরণ হ্রাস পায়। ফলে পবিবেশ দূষণ রোধ করা যায়।
লেখক : ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। ফোন-০১৭১৬-৫৪০৩৮০, ইমেল-smmomin80@gmail.com.
আধুনিক পদ্ধতিতে মাষকলাই ডাল
চাষে ফলন ও লাভ বেশি আসে
ড. মোঃ কামরুজ্জামান১ সৌরভ অধিকারী২
মাষকলাই বাংলাদেশের একটি সুপরিচিত ডাল ফসল। ভারতীয় উপমহাদেশে এই ডাল শস্যটি সবথেকে বেশি প্রচলিত এবং বহুল ব্যবহৃত। বাংলাদেশে যেসব ডাল জাতীয় ফসল চাষ হয় তার মধ্যে মাসকলাই চতুর্থ স্থানে। দেশে মোট উৎপাদিত ডালের মধ্যে মাষকলাই এর উৎপাদন ৯-১১%। এজন্য ডাল ফসল হিসেবে মাষকলাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাষকলাই খরা সহিষ্ণু এবং উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল ফসল হিসেবে পরিচিত। মাষকালাই খেতে সুস্বাদু এবং রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণ। এতে রয়েছে প্রোটিন ও লৌহ যা দেহের বল ও পুরুষের শুক্রাণু বৃদ্ধি করে এবং পেশি গঠনে ভূমিকা রাখে। ফাইবার, যা খাবার হজমে সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। ম্যাগনেশিয়াম যা রক্তপ্রবাহ বাড়ায় এবং হৃদযন্ত্র ভালো রাখতে সাহায্য করে। শরীরে কোলস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করতে এ ডাল উপকারী। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণাতেও মাষকলাই ডালের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি দেখা গেছে। ত্বকের চর্চা ও মাথার খুশকি দূর করতেও এর ব্যবহার রয়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর সুপারিশ মতে আমাদের সুষম খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন জনপ্রতি ৪৫ গ্রাম ডালের চাহিদা থাকলেও আমরা পেয়ে থাকি মাত্র ১২-১৫ গ্রাম। ডালের গুরুত্বকে তুলে ধরার জন্য সংস্থাটি প্রতি বছর ১০ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক ডাল দিবস হিসেবে উদযাপন করে আসছে। প্রতি বছর আমাদের প্রায় ২৬ লাখ টন ডালের চাহিদা রয়েছে যার বিপরীতে উৎপাদন হয় মাত্র ১০ লাখ মেট্রিক টন এবং আমদানি করা হয় ১০-১২ লাখ টন (কৃষি ডাইরি, ২০২২) আর বাকি ৫-৬ লাখ টন ঘাটতিই রয়ে যায়। বিদেশ থেকে ডাল আমদানি করতে প্রতি বছর আমাদের প্রায় ৮-৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। তবে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ডাল ফসল চাষের সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে ডালের আমদানি নির্ভরতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করা সম্ভব।
দেশের পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে আউশ ধান/পাট-পতিত-রবি ফসল এই শস্যবিন্যাসে প্রায় ৮০-৯০ দিন জমি পতিত পড়ে থাকে। পতিত সময়ের এই জমিগুলোকে মাষকলাইয়ের চাষের আওতায় আনা সম্ভব। এছাড়া খরিফ-১ মৌসুমের মাষকলাই সংগ্রহের পর সকল উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে খরিফ-২ মৌসুমে আবারও মাষকলাই চাষ করা যায়। অভিযোজনক্ষমতা বেশি থাকায় বিভিন্ন রাস্তা ও বাঁধের ধারে, পুকুর পাড়ে এবং বিভিন্ন ধরনের ফল বাগানেও মাষকলাই চাষ করা যায়। বিগত ১০ বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী উচ্চফলনশীল জাত ও আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডালের ফলন ২.০ বা তার বেশি গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। কৃষি ডাইরি ২০২৪ অনুযায়ী, ডালের এলাকা, উৎপাদন ও ফলন অনেক বেড়েছে। যেখানে ২০১২ সালে প্রতি হেক্টরে ডালের গড় ফলন ছিল ৮০০ কেজি, সেখানে ২০২৪ সালে হয়েছে ১২৭১ কেজি। সঠিক নিয়ম মেনে মাষকলাই চাষ করলে আরও অধিক লাভবান হওয়া যাবে।
মাষকালাই উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি
জাত নির্বাচন : বাংলাদেশে চাষকৃত মাষকলাই এর বেশ কিছু উন্নত ও স্থানীয় জাত রয়েছে। এর ভিতর বেশ কিছু ঊফশী জাত যেমন : বারি মাষ-১(পান্থ), বারি মাষ-২(শরৎ), বারি মাষ-৩(হেমন্ত), বারি মাস-৪, বিনা মাষ-১ এবং
বিনা মাষ-২ এবং বেশ কিছু স্থানীয় জাত যেমনঃ রাজশাহী, সাধুহাটি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উচ্চফলনশীল জাতগুলোর জীবনকাল ৬০-৮০ দিন, গাছগুলো খাটো হতে মধ্যম আকৃতির হয়। মাষকলাইয়ে আমিষের পরিমাণ ২১-২৪%, এবং ফলন ১৫০০-২০০০ কেজি পর্যন্ত হয়।
জমি নির্বাচন ও চাষ : মাষকলাই চাষের জন্য সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি উপযোগী। পানি জমাট বাধার আশঙ্কা থাকে না এমন উঁচু থেকে নিচু সব ধরনের জমিতে মাষকলাই চাষ করা যায়। উষ্ণ ও শুকনো জলবায়ু মাষকলাই চাষের জন্য উপযোগী। মাষকলাই চাষের জন্য খুব মিহিভাবে জমি তৈরির প্রয়োজন হয় না। জমি ও মাটির প্রকারভেদে ২-৩টি আড়াআড়ি চাষ ও ৪-৫টি মই দিয়ে জমি সমান করে তৈরি করতে হয়। এতে বীজের অংকুরোদগমের হার বেড়ে যায় এবং ফসলের বৃদ্ধিও ভালো হয়।
বীজ বপনের সময় ও বপন পদ্ধতি : মাষকলাই বীজ ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে মধ্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বপন করা যায় অর্থাৎ খরিফ-১ ও খরিফ-২ মৌসুম। খরিফ-১ মৌসুমে ফেব্রুয়ারির শেষ হতে মধ্য মার্চ এবং খরিফ-২ মৌসুমে আগস্টের ২য় সপ্তাহ হতে সেপ্টেম্বরের ১ম সপ্তাহ পর্যন্ত বীজ বপন করতে হবে। মাষকলাইয়ের বীজ ছিটিয়ে বা সারি করে বপন করা যায়। তবে বীজের জন্য সারিতে বপন করা ভালো। সারিতে বপন করার ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেমি. রাখতে হয়। সারিতে বীজগুলো ৩-৪ সেমি. গভীরে বপন করা হয় যাতে অংকুরোদগম ভালো হয় এবং পাখি বীজ নষ্ট করতে না পারে। ছিটানো পদ্ধতিতে শেষ চাষের সময় মই দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হয়।
উল্লেখ্য বীজ বাহিত রোগ দমনের জন্য বীজ শোধন করে বপন করা দরকার।
সার ব্যবস্থাপনা : গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে মাষকলাই চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে উর্বরতার উপর ভিত্তি করে সারের মাত্রা ঠিক করা হয়। তবে জৈবসার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকে। তবে কম উর্বর জমিতে মাষকলাই চাষাবাদে হেক্টর প্রতি ইউরিয়া ৪০-৫০ কেজি, টিএসপি ৮০-৯০ কেজি, এমওপি ৪০-৪৫ কেজি প্রয়োজন হয়। জমি তৈরির শেষ চাষের সময় সবসার একসাথে প্রয়োগ করতে হবে। জীবাণু সার প্রয়োগ করা হলে ইউরিয়া সার প্রয়োগের দরকার হয় না। প্রতি কেজি বীজের জন্য ৮০ গ্রাম হারে অণুজীব সার প্রয়োগ করতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা : মাষকলাইয়ের জমিতে পোকা ও রোগের আক্রমণ দেখা দিলে তা দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। বপনের পর জমিতে রসের পরিমাণ কম বা অভাব হলে হালকা সেচ দিতে হবে। সেচের পর ‘জো’ অবস্থায় আসলে মাটির উপরের স্তর ভেঙে দিতে হবে। চারা গজানোর পর আগাছা দেখা দিলে ১৫-২০ দিন পর নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হবে। মাষকলাইয়ের জমিতে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা থাকলে পানি বের করার ব্যবস্থা করতে হবে।
রোগ দমন ব্যবস্থাপনা
পাতার দাগ রোগ : এ রোগটি হয় সারকোস্পোরা নামক ছত্রাক দ্বারা। আক্রান্ত পাতার উপর ছোট ছোট লালচে বাদামি গোলাকৃতি হতে ডিম্বাকৃতির দাগ পড়ে। আক্রান্ত অংশের কোষসমূহ শুকিয়ে যায় এবং পাতা ছিদ্র হয়ে যায়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পাতা ঝলসে যায়। পরিত্যক্ত ফসলের অংশ, বায়ু ও বৃষ্টির মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। শতকরা ৮০ ভাগের বেশি আর্দ্রতা ও ২৮ ডিগ্রি সে. এর বেশি তাপমাত্রায় এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। রোগ প্রতিরোধী জাতের (পান্থ, শরৎ ও হেমন্ত) মাষকলাই চাষ করতে হবে। আক্রমণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে ছত্রাকনাশক অটোস্টিন-৫০ ডব্লিউপি প্রতি লিটার পানিতে ২.০ গ্রাম মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
পাউডারি মিলডিউ রোগ : ওইডিয়াম প্রজাতির ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে। সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে (খরিফ-২) বীজ দেরিতে বপন করলে এ রোগের প্রকোপ দেখা যায়। এ রোগে পাতার উপর পৃষ্ঠে পাউডারের মতো আবরণ পড়ে। হাতে স্পর্শ করলে ছত্রাককে পাউডারের গুঁড়ার মতো লাগে। পাতা হতে লক্ষণ পরবর্তীতে কা-, ফুল ও ফলে ছড়াতে পারে। বীজ, পরিত্যক্ত গাছের অংশ ও বায়ুর মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। এ রোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইলে রোগমুক্ত উৎস হতে প্রাপ্ত বীজ সময়মত বপন করতে হবে। বীজ ছত্রাকনাশক দ্বারা শোধন করে বপন করা উচিত। বিকল্প পোষক ও গাছের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। টিল্ট-২৫০ ইসি/০.৫ মিলি বা থিওভিট ৮০ ডব্লিউপি ২.০ গ্রাম হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে রোগের আক্রমণের শুরু হতে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার প্রয়োগ করতে হবে।
হলদে মোজাইক ভাইরাস : মোজাইক ভাইরাস দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে। আক্রান্ত পাতার উপর হলুদ ও গাঢ় সবুজ মিশ্র মোজাইকের মতো দাগ পড়ে। কচি পাতা প্রথমে আক্রান্ত হয়। দূর থেকে আক্রান্ত জমি হলদে মনে হয়। আক্রান্ত বীজ ও বায়ুর মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। সাদা মাছি এ রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। বিকল্প পোষক ও সাদা মাছি বেশি হলে এ রোগ দ্রুত ছড়ায়। এ রোগ দমনে রোগমুক্ত বীজ বপন করতে হবে। সাদা মাছি দমনের জন্য ম্যালাথিয়ন স্প্রে করতে হবে। রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে বা মাটি চাপা দিতে হবে। শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে। রোগ প্রতিরোধী জাতের মাষকলাইয়ের চাষ করতে হবে। বারি ও বিনার উচ্চফলনশীল মাষকলাই এর জাতগুলো এ রোগের সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন।
পোকা দমন ব্যবস্থাপনা
বিছা পোকা : এ পোকা মাষকলাই ফসলের অন্যতম শত্রু। এ পোকা পাতা, অপরিপক্ব সবুজ ফলের রস খেয়ে ফেলে। আক্রান্ত পাতাসহ সমস্ত গাছ সাদা জালিকার মতো হয়ে যায়, ফলে ফলন কমে যায়। এ পোকার আক্রমণ দেখা দিলে হাত দ্বারা সেগুলোকে সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে পরিমাণ মতো সাইপারমেথ্রিন ইসি ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া পূর্ণ বয়স্ক পোকা ও কীড়া উভয়ই গুদামজাত মাষকলাই ডালের ক্ষতি করে থাকে। এ পোকা ডালের খোসা ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে শাঁস খেতে থাকে। ফলে দানা হালকা হয়ে যায়। এর ফলে বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় এবং খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায়। বীজের জন্য টন প্রতি ৩০০ গ্রাম ম্যালাথিয়ন বা সেভিন শতকরা ১০ ভাগ গুঁড়া মিশিয়ে প্রয়োগ করলে পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়।
জাব পোকা : এ পোকা দলবদ্ধভাবে গাছের পাতা, কা-, ও ফুল-ফলের রস চুষে খায় ফলে বীজ পুষ্ট হতে পারে না। জাব পোকা দেখা গেলে ডাইমেথয়েট গ্রুপের যেকোনো কীটনাশক মোড়কের গায়ে উল্লেখিত মাত্রায় স্প্রে করে সহজেই দমন করা যায়।
ফসল কাটা, মাড়াই ও গুদামজাতকরণ : মাষকলাইয়ের গড় ফলন হেক্টর প্রতি ১.৫-২.০ টন হয়ে থাকে। খরিফ-১ মৌসুমে মে মাসের শেষ এবং খরিফ-২ মৌসুমে অক্টোবর মাসের শেষে ফসল সংগ্রহ করা হয়। পরিপক্ব হলে সকালের দিকে ফসল সংগ্রহ করতে হবে। প্রথম দিকে পরিপক্ব ফল হাত দিয়ে এবং শেষবারের বেলায় কাঁচি দিয়ে গাছগুলো গোড়া থেকে কেটে নিতে হবে। গাছগুলো রোদে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বা গরু দিয়ে মাড়াই করে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। সংগৃহীত বীজ ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে পরিষ্কার ও ঠা-া করে মাটি বা টিনের পাত্রে মুখ বন্ধ করে গুদামজাত করতে হবে।
লেখক : ১ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), উপকেন্দ্র, গোপালগঞ্জ, মোবাইল : ০১৭৭৬৯৬০৭৬৯, ই-মেইল : kamruzzaman_bina2013@yahoo.com
মহাঔষধি সুপার ফুড কাঁচা কাঁঠালের
বহুমুখী ব্যবহার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি
ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী১ জনাব মো. হাফিজুল হক খান২
বাংলাদেশে কাঁঠাল জাতীয় ফল হিসেবে পরিচিত হলেও বিগত বছরগুলোতে অবহেলিত ফল হিসেবেই পরিগণিত হয়েছে। দেশে পাকা কাঁঠাল খাওয়ার প্রবণতা খুব বেশি। শুধুমাত্র প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ প্রযুক্তি প্রয়োগের অভাব ও জনসাধারণের অসচেতনতার কারণে প্রতি বছর অধিক পরিমাণে এ ফলের অপচয় হয়ে থাকে। গবেষণা চলাকালীন গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলাস্থ জৈনা বাজার ও মাওনা এলাকার কৃষক, ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কাঁঠালকে শুধুমাত্র পাকা ফল হিসেবে খাওয়ার কারণে এটি যখন পাঁকতে শুরু করে তখন একসাথে বেশি ভাগ কাঁঠালই পেকে যায়। ভরা মৌসুমে গাছ হতে শতকরা ৩০-৪০ ভাগ কাঁঠাল প্রাকৃতিকভাবে পড়ে যায়, যা খাওয়ার উপযোগী থাকে না অর্থাৎ ব্যাপক কাঁঠাল এক্ষেত্রে নষ্ট হয়। অবস্থা এমন যে, গবাদিপশু বা পাখিও পাকা কাঁঠাল খায় না। কিন্তু কাঁঠালকে কাঁচা হতে ব্যবহার শুরু করা গেলে এবং বাণিজ্যিকীকরণের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এটি হতে পারে পুষ্টি নিরাপত্তার এক বড় নিয়ামক যেখানে পারিবারিক আয় বৃদ্ধিসহ একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও সঠিক পরিচর্যা ও প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য সামগ্রী তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করা হলে এ ফলটিকে সারা বছর খাওয়ার টেবিলেও পেতে সক্ষম। এক সময় কাঁঠালকে গরিবের ফল বলা হতো। এখন জনসাধারণের কিছুটা সচেতনতা ও সাম্প্রতীক বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধির উপক্রম বাড়ার কারণে পুষ্টির চাহিদা পূরণে পুষ্টি সমৃদ্ধ ফলমূলের প্রাধান্য বেড়েছে। সেক্ষেত্রে কাঁঠাল একটি সর্বগুণে গুণান্বিত, মহাঔষধি সুপার ফুড হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।
কাঁচা কাঁঠাল রোগ ব্যাধি উপশমে যেমন কার্যকর তেমনি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বহুগুণ বাড়ায়। এটি ক্যান্সারের মোকাবেলায়ও সাহায্য করে। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে খনিজ উপাদান যা আমাদের হাড়ের গঠন ও হাড় শক্তিশালীকরণে এবং রক্তে শর্করা বা চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। আরও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান শক্তিশালী এন্টি-অক্সিডেন্ট, যা দেহকে ক্ষতিকর ফ্রি-রেডিকেলস থেকে রক্ষা করে। কাঁঠাল সর্দি-কাশি রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে ও ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস-আলসার, উচ্চরক্তচাপ এবং বার্ধক্য প্রতিরোধে সক্ষম। এতে রয়েছে আয়রন যা দেহের রক্তাল্পতা ও এটি আঁশযুক্ত হওয়ায় কোষ্ঠকাঠিন্যও দূর করে। কাঁচা কাঁঠাল থেকে ৫৩ কিলোক্যালরি এবং কাঁঠালের বীজ থেকে ১৩০ কিলোক্যালরি পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায়। কাঁঠালের অন্যতম উপযোগিতা হল ভিটামিন ‘সি’। প্রাকৃতিকভাবে মানবদেহে ভিটামিন ‘সি’ তৈরি হয় না। ভিটামিন ‘সি’ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দাঁতের মাড়িকে শক্তিশালী করে। এতে আরও আছে ভিটামিন ‘বি৬’ যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান কাঁঠাল থেকে পাওয়া সম্ভব। অনেক খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞানী চেহারায় লাবন্য দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য কাঁঠাল খাওয়ার পরামর্শ দেন।
কাঁঠালের সুনির্দিষ্ট জাত না থাকায় এই ফলের বিচিত্রতা অধিক যা বিদেশে রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাতের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা। উপমহাদেশের কাঁঠালের জাতের মধ্যে পরিচিত জাতগুলো হচ্ছে গালা, খাজা ও দোরোসা বা রস খাজা। কাঁঠালকে জনপ্রিয় ও যথাযথ ব্যবহার বৃদ্ধি করার প্রয়াসে বিএআরআই-এর উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র এ পর্যন্ত ৬টি জাত (বারি কাঁঠাল-১, বারি কাঁঠাল-২, বারি কাঁঠাল-৩, বারি কাঁঠাল-৪, বারি কাঁঠাল-৫ ও বারি কাঁঠাল-৬ উদ্ভাবন করেছে, যা বছরব্যাপী ভোক্তাদের নিকট সরবরাহ করতে সহায়তা করবে।
কাঁচা কাঁঠাল প্রোটিন সমৃদ্ধ হওয়ায় এটি ভেজিটেবল মিট হিসেবে স্বীকৃত ও মাংসের বিকল্প হিসেবে এশিয়া মহাদেশের অনেক দেশেই সারা বছর খাওয়া হয়ে থাকে। ভারতের কেরালা, শ্রীলংকা, নেপাল, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশে কাঁঠালের তৈরিকৃত খাদ্যসামগ্রী বছরব্যাপী পাওয়া যায়। কাঁচা কাঁঠালের বহুবিধ খাবারের মধ্যে ভর্তা, সবজি, ফ্রাইড প্রডাক্টচিপ্স বা ঝুড়ি ভাজা, সিংগারা, সমুচা, ভেজিটেবল রোল, কাটলেট, স্যান্ডউইচ, বার্গার উল্লেখযোগ্য। ভারতের কেরালায় কাঁচা কাঁঠাল খুবই জনপ্রিয়। সেখানে ‘ভেজিটাবল মিট’সহ বিভিন্ন উপকরণে ১০০ প্রকার কাঁচা কাঁঠাল দিয়ে তৈরিকৃত খাবার বিভিন্ন হোটেল, রেস্টুরেন্ট, রাস্তার পাশে দোকানসহ বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যায়। এ ছাড়াও কাঁচা কাঁঠাল সংরক্ষণের মাধ্যমে রকমারি খাদ্যসামগ্রী সহজেই তৈরি করা যায় ও বাজারজাত করা সম্ভব। কাঁচা কাঁঠালের ফ্রোজেন খাদ্যসামগ্রী হিসেবে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। প্রবাসীদের নিকট কাঁচা কাঁঠাল ও কাঁঠালের বীচির কদর খুব বেশি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই দক্ষিণ এশিয়ার সুপার-সপগুলোতে ফ্রোজেন অবস্থায় প্রক্রিয়াজাতকৃত কাঁচা কাঁঠালের কোষ, ক্যান প্রডাক্ট ও কাঁঠালের বীচি বিক্রয় করতে দেখা যায়।
পৃথিবীর ৬০টিরও অধিক দেশে প্রায় ৩.৭ মিলিয়ন টন কাঁঠাল উৎপাদিত হচ্ছে। তন্মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২য়। এফএও এর মোতাবেক দেশে উৎপাদিত প্রায় ১.২৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন কাঁঠালের খুব অল্প পরিমাণে বিদেশে রপ্তানি হয় এবং এর ক্রেতা অধিকাংশই প্রবাসী বাংলাদেশী। বাংলাদেশ বর্তমানে ১৫টিরও অধিক দেশে ৩৫ ধরনের বেশি ফল বিদেশে রপ্তানি করছে। অন্যান্য ফলের রপ্তানির তুলনায় কাঁঠাল রপ্তানি খুবই নগণ্য। ডিএই ও হটেক্স ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে ২০২১-২০২২ সালে রপ্তানি ছিল ২০৫০ টন। আমাদের দেশের কাঁঠালের মধ্যে হবিগঞ্জের বড় ও ভালোমানের কাঁঠাল ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে কাতার, ওমান, বাহরাইন, সৌদি আরব, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। উত্তম কৃষি চর্চা, উন্নত প্যাকেজিং প্রযুক্তি, সঠিক পরিপক্বতা নির্ধারণ, সুনির্দিষ্ট জাত নির্বাচন, প্যাকিং হাউজ সুবিধাসহ যথাযথ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি প্রয়োগ করার মাধ্যমে জাতীয় ফল কাঁঠালকে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানি বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে যা কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি যেমন নিশ্চিত করবে তেমনি অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল কাঁঠালের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
দেশের তরুণ, যুবক ও বেকার জনগোষ্ঠীর আত্মকর্মসংস্থানের জন্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও সহজ ঋণ সুবিধাসহ আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা নেয়া হলে প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প দ্রুত এগিয়ে যাবে, কাঁঠালের ন্যায় অন্যান্য কৃষি পণ্যের অপচয় রোধ হবে, কাঁঠাল পণ্যের রপ্তানি বাড়াবে এবং পারিবারিক আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। সর্বোপরি খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানসহ দেশের অর্থনীতিকে বেগমান করবে। কাঁচা কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির চাহিদা পূরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে যা এসডিজি এর লক্ষ্য পূরণেও সহায়ক হবে।
লেখক : ১খাদ্য প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষক ও ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, , মোবাইল : ০১৭১২২৭১১৬৩; ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, ই-মেইল : cso.pht@bari.gov.bd, ফোন : ০২-৪৯২৭০১৭৬, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১।
মাছের পিটুইটারী গ্ল্যান্ড বা পিজি সংগ্রহ সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের কৌশল
মোঃ মাসুদ রানা
বাংলাদেশ মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ, দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য পুকুর, নদ-নদী, খাল-বিল ও হাওর-বাঁওড় রয়েছে, বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিশাল হাওড় এলাকা মৎস্য সম্পদের সূতিকাগার। মাছ সাধারণত প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রজনন করে থাকে, আমাদেরে দেশের খাল, বিল, নদী, হাওর-বাঁওড়ে এক সময় প্রচুর মাছ প্রজনন করত। মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন করার জন্য যে সকল নিয়ামকের প্রয়োজন দিন দিন নষ্ট হয়ে পড়ার কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশে মাছের প্রজনন দিন দিন কমতে থাকে। ফলে দিন দিন মাছের প্রাপ্যতা দেশের প্রাকৃতিক জলাশয়ে কমতে থাকে, এমনকি কিছু কিছু মাছ প্রজনন করতে না পারায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে মাছের কৃত্রিম প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন করেন, যেখানে মৎস্য হ্যাচারিতে মাছকে হরমোন প্রয়োগ করে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন করা হয়।
বাংলাদেশের চাষের মাছের প্রায় ৯০-৯৫ শতাংশ পোনা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উৎপাদন করে মৎস্য খামারিদের পোনার চাহিদা পূরণ করা হয়ে থাকে। মৎস্য হ্যাচারিতে কৃত্রিম প্রজননের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় যে হরমোন তার নাম পিজি বা পিটুইটারি গ্ল্যান্ড। দেশে দিন দিন মৎস্য হ্যাচারি শিল্প সম্প্রসারণ ঘটায় পিজির চাহিদা বাড়তে থাকে, প্রতি বছর এ চাহিদা পূরণে আমাদের প্রায় ৮০-৯০ কেজি পিজি আমদানি করতে হয়। প্রতি কেজি পিজির বাজারমূল্য প্রায় ৬০-৭০ লক্ষ টাকা।
মাছের প্রজনন মৌসুমে যে গ্রন্থি গোনাডোট্রপিন নামক হরমোন নিঃসরণ করে তাকে পিটুইটারি গ্ল্যান্ড বা পিজি বলে। মাছের পিজির রং ঈষৎ গোলাপী যার অবস্থান মাছের মস্তিষ্কের ঠিক নিচেই। মাছের পিজির গুণগত মান নির্ভর করে মাছের গুণগত মান ও পরিপক্বতার উপর, সাধারণত পরিপক্ব মাছ (কার্প জাতীয় মাছের ক্ষেত্রে যে সকল মাছ প্রজননক্ষম) হতে পিজি সংগ্রহ করলে তার গুণগত মান ভাল হয়। স্ত্রী বা পুরুষ উভয় প্রকার মাছ থেকেই পিজি সংগ্রহ করা যেতে পারে, পিজি বছরের যে কোন সময় পরিপক্ব মাছ থেকে সংগ্রহ করা যেতে পারে, তবে মাছের প্রজনন মৌসুমে সংগ্রহ করলে উত্তম পিজি পাওয়া যায়।
বাণিজ্যিকভাবে মাছের পিজি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কৌশল
সদ্য মৃত মাছ, বরফ দিয়ে সংরক্ষিত বা কোল্ডস্টোর থেকে বের করে বাজারজাত করার যোগ্য মাছ থেকে পিজি সংগ্রহ করা যায়। আমাদের দেশের সকল বাজারেই এখন মাছ কেটে বিক্রি করা হয়, বাজারে যারা মাছ কাটের তাদের বটিওয়ালা বলা হয়ে থাকে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও অনান্য জেলা উপজেলা শহরে প্রতিদিন মাছ কেটে জীবিকা নির্বাহ করছে কযেক লাখ বটিওয়ালা। যেহেতু পিজি সংগ্রহ করার জন্য মাছের মাথার মগজ অপসারণ করতে হয় সেহেতু বাণিজ্যিকভাবে পিজি সংগ্রহ করার জন্য যারা প্রতিনিয়ত মাছ কাটেন তাদের মাধ্যমে করা যায়। বটিওয়ালারা সাধারণত মাছের মাথা শরীর থেকে আলাদা করার পর দ্বিখ-িত করে। পিজি সংগ্রহ করার জন্য মাছের মাথা এমনভাবে দ্বিখ-িত করতে হবে যেন একপাশে ৫২% ও অন্য পাশে ৪৮% অংশ থাকে। যে পাশে বড় অংশ সে পাশে মগজ থাকবে আর সেই মগজের নিচ থেকে পিজি সংগ্রহ করার জন্য একটি নিডিল বা চামুচাকৃতির সুচ লাগবে যা দিয়ে খুব সাবধানে মগজটিকে আলাদা করে বা একপাশে সরিয়ে নিতে হবে, তারপর নিচের পর্দাটি অতি সতর্কতার সাথে সরিয়ে পিজি সংগ্রহ করতে হবে। পিজি সংগ্রহ করার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন পিজির দানাটির উপর কোন চাপ বা আঘাত না লাগে, সেক্ষেত্রে সুচটির মাথা দিয়ে সাবধানতার সাথে পিজি বের করে সংরক্ষণ করতে হবে। আমাদের দেশের মাছ বাজারগুলোতে প্রাপ্ত মাছের মধ্যে রুই, কাতলা, কালিবাউস, মিরর কার্প, গ্রাস কার্প, মৃগেল, বিগহেড কার্প মাছ হতে পিজি সংগ্রহ করা যেতে পারে। তাৎক্ষণিকভাবে সংগৃহীত পিজি হ্যাচারিতে ব্যবহার করা যেতে পারে বা পরবর্তীতে ব্যবহার বা বাজারজাতকরণের জন্য সংরক্ষণ করা যেতে পারে। পিজি সংগ্রহ করার সময় কোনো ভাবেই পিজির গায়ে পানি লাগানো যাবে না, পানির সংস্পর্শে আসলে পিজির পচন ও গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়।
পিজি সংগ্রহ করার পর অতি সাবধানতার সাথে তা অ্যালকোহল বা অ্যাসিটোন দ্রবণে সংরক্ষণ করতে হয়। ২০-৩০ সিসি মাপের কাঁচের শিশিতে অ্যালকোহল বা অ্যাসিটোনসহ পিজি দানা সংরক্ষণ করতে হয়, প্রথমবার পিজি দানা রাখার ১২-১৬ ঘণ্টা পর একবার এবং পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা পর আরেকবার দ্রবণ পরিবর্তন করে পিজি সংরক্ষণ করতে হয়। অ্যালকোহল বা অ্যাসিটোন দ্রবণ পিজিতে থাকা পানি ও চর্বি শোষণ করে পচন রোধ করে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এভাবে দ্রবণে সংরক্ষণ করে পিজি প্রায় ১ বছর থেকে ২ বছর ব্যবহার করা যায় তবে ফ্রিজিং করলে ২-৩ বছর ব্যবহার করা যায়। অন্যদিকে পিজিকে ২-৩ মাস পর দ্রবণ থেকে বের করে ৩০-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার ড্রায়ার ব্যবহার করে শুষ্ককরণ করে কাচের কর্কযুক্ত (এয়ারটাইট) শিশিতে সংরক্ষণ করলে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ করা যায়।
মাছের পিজির বাজার ব্যবস্থা ও সম্ভাবনা
আমাদের দেশে ছোট-বড় সব মিলিয়ে ৯৮৪ টি মৎস্য হ্যাচারি রয়েছে (মৎস্য অধিদপ্তর, ২০২৩)। এসব হ্যাচারিতে প্রতিনিয়ত বাণিজ্যিকভাবে কৃত্রিম পদ্ধতি ব্যবহার করা পোনা উৎপাদন করে দেশের মাছ চাষিদের পোনার জোগান দেওয়া হচ্ছে। দেশের প্রায় সকল মৎস্য হ্যাচারি আমদানিকৃত পিজির উপর নির্ভর করে টিকে আছে, তাই দেশে উৎপাদিত মৎস্য পিজির ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। বাণিজ্যিকভাবে পিজি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের জন্য সংগৃহীত পিজিকে দানার আকার অনুযায়ী আলাদা গ্রেডিং করে নির্দিষ্ট ভায়ালে লেভেলিং করে বাজারজাত করা সম্ভব, তবে অবশ্যই বাজারজাতকরণের পূর্বে মৎস্য অধিদপ্তরের গুণগুত মান নিয়ন্ত্রণ সনদ ও অনুমতিপত্র লাগবে। প্রতি কেজি পিজির বাজারমূল্য প্রায় ৬০-৭০ লক্ষ টাকা (আকারভেদে)। দেশের বড় বড় বাজারগুলোতে যে পরিমাণ মাছ বিক্রয় ও কর্তন হয় তা থেকে যদি সঠিকভাবে পিজি সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয় তাহলে আমাদের দেশের সকল হ্যাচারির চাহিদা মিটিয়ে পিজি রপ্তানি করা সম্ভব বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশের মাছ বাজারে কর্মরত বটিওয়ালাদের যদি সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে মাছের পিজি সংগ্রহ, সংরক্ষণের কলাকৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় তাহলে প্রতিদিন দেশের মাছ বাজারগুলো থেকে বিপুল সংখ্যক পিজি সংগ্রহ করা যাবে। পিজি সংগ্রহ করলে একদিকে যেমন আমাদের পিজি আমদানির উপর নির্ভরতা কমবে অন্যদিকে যারা মাছ কাটে (বটিওয়ালা) তাদের অতিরিক্ত উপার্জনের রাস্তা বের হবে এবং তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হবে। পরিশেষে, বলা যায় দেশের মাছ বাজারগুলো থেকে পিজি উৎপাদনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে যা মৎস্য হ্যাচারি শিল্পে এক নব বিপ্লব আনার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ফিশারিজ, একোয়াকালচার অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-১২০৭। মোবাইল নংঃ ০১৭৪৫৬২৬১৫৩
পরিবেশ সুরক্ষায় প্রাণিসম্পদ
খামারের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
ডা: মোঃ সুলাইমান হোসাইন১ ড. মোঃ আব্দুল মালেক২
খামার পরিচালনায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গবাদি প্রাণীর বাণিজ্যিক খামারের বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনায় খামারের আয়ের উৎসের পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ রোধ করতে পারে। খামারের কঠিন বর্জ্যরে মধ্যে রয়েছে বিষ্ঠা, উচ্ছিষ্ট খাদ্য, শুকনো ঘাস/খড়, বেডিং ম্যাটেরিয়ালস ব্যবহৃত খড় এছাড়া তরল বর্জ্য পদার্থের মধ্যে রয়েছে মূত্র ও খামারের কাজে ব্যবহৃত পানি। দেখা গেছে ত্রিশ কেজি ওজনের একটি প্রাপ্ত বয়স্ক ছাগল/ভেড়া দৈনিক প্রায় ৫০০-৮০০ গ্রাম তাজা বিষ্ঠা এবং প্রায় ৬০০ মিলি মূত্র ত্যাগ করে। ৩০০ কেজি ওজনের একটি প্রাপ্ত বয়স্ক গরু/মহিষ দৈনিক প্রায় ১০-১৫ কেজি তাজা বিষ্ঠা এবং প্রায় ১৫-২০ লিটার মূত্র ত্যাগ করে।
প্রাণিসম্পদ খামারের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উপকারিতা
গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি ইত্যাদির সরবরাহকৃত খাদ্যের ৫০-৬০% মল ও মূত্র হিসাবে বেরিয়ে আসে, যা আংশিক বা পরিপূর্ণভাবে নষ্ট বা অপচয় হওয়ার কারণে পরিবেশ ও সামাজিক নিরাপত্তায় বিঘœ ঘটে। খামার ব্যবস্থাপনায় গবাদিপশুকে পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য সরবরাহ করায় রুমেন থেকে মিথেন উৎপাদন প্রায় ৩০% হ্রাস পায় ও পরিবেশ সুরক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। প্রাণীর রোগ মুক্তি ও পরিবেশ সুরক্ষায় মৃত প্রাণীর চামড়া ছাড়ানো যাবে না। মৃত পশু-পাখি যত্রতত্র মাঠে ময়দানে বা ঝোপঝাড়ে না ফেলে মাটিতে পুঁতে রাখতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষায় গোবর/বিষ্ঠা, মূত্র, খাদ্যের উচ্ছিষ্ট ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ যথাযথভাবে ও সময়মতো অপসারণ করলে পরিবেশ সুরক্ষিত হবে। এ কাজে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট করা যেতে পারে। গোবর/বিষ্ঠা থেকে কম্পোস্ট সার প্রস্তুত করা হলে একদিকে পরিবেশে দুর্গন্ধ দূর হয় ও অন্যদিকে উৎপাদিত কম্পোস্ট সার কৃষিতে ব্যবহার করায় কৃষির উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট থেকে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি উৎপাদন হওয়ায় দূষণমক্ত বায়ু ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি ও উন্নত মানের জৈবসার উৎপাদন হয়। তাই বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট সামাজিক নিরাপত্তায় অবদান রাখছে। বর্জ্য সঠিকভাবে কম্পোস্ট করা হলে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস মারা যায় ও প্রাণীর রোগ নিয়ন্ত্রিত হয়। খড় এর সাথে মোলাসেস মিশিয়ে গরু/মহিষকে খাওয়ালে ৩০-৩৫% মিথেন গ্যাস উৎপাদন কমে আসবে এবং পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
প্রাণিসম্পদ খামারের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কিছু কার্যকর পদ্ধতি
পরিবেশ সুরক্ষার জন্য প্রাণিসম্পদ খামারের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নলিখিত কিছু কার্যকর পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে :
প্রাণিসম্পদ খামার থেকে উৎপন্ন জৈব বর্জ্য কম্পোস্টে রূপান্তর করে কৃষিকাজে ব্যবহার করা যেতে পারে, যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক।
প্রাণিসম্পদ খামার থেকে বর্জ্য ব্যবহার করে বায়োগ্যাস উৎপাদন করা যায়, যা রান্না ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়।
বর্জ্য জমা করার জন্য ল্যাগুন সিস্টেম ব্যবহার করা যেতে পারে, যেখানে বর্জ্য প্রাকৃতিকভাবে পচে যায়।
খামারের বর্জ্য থেকে পানি আলাদা করে তা ফিল্টার করা ও শোধন করা যেতে পারে, যা পুনরায় ব্যবহারের জন্য উপযোগী।
গবাদিপশুর মল ও অন্যান্য বর্জ্য মালচিং উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়, যা মাটির ক্ষয় রোধে সহায়ক।
খামারের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি করা উচিত, যা বর্জ্য উৎপাদনের স্থান থেকে শুরু করে তার পুনর্ব্যবহার পর্যন্ত সকল ধাপকে অন্তর্ভুক্ত করবে।
আমাদের দেশের প্রাণিসম্পদ খামারিরা খুব কম খরচে স্বল্প সময়ে নিচের যেকোন পদ্বতিতে অবলম্বন করে তাদের খামারের উৎপাদিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে পারবেন।
কম্পোস্টিং এর মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : নিয়ন্ত্রিত জৈবিক প্রক্রিয়ায় খামারের কঠিন বর্জকে গাঁজানোর মাধ্যমে জৈবসারে পরিণত করা যায়। এক্ষেত্রে বর্জ্যে বিদ্যমান জীবাণু তাপ সৃষ্টির মাধ্যমে জৈব পদার্থের রূপান্তর ঘটায়। এর ফলে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয় এবং বর্জ্যসমূহের জলীয় অংশ উদ্বায়ী হয়ে সহজে বহনযোগ্য হালকা বস্তুতে পরিণত হয়। আবার কেঁচো সার উৎপাদনের মাধ্যমেও বর্জ্য থেকে জৈবসার তৈরি করা যায়।
কম্পোস্ট ও কম্পোস্টিং প্রক্রিয়া : কম্পোস্ট হচ্ছে পচা জৈব উপকরণের এমন একটি মিশ্রণ যা উষ্ণ আর্দ্র পরিবেশে অণুজীব কর্তৃক প্রক্রিয়াজাত হয়ে উদ্ভিদের সরাসরি গ্রহণ উপযোগী পুষ্টি উপকরণ সরবরাহ করে। কম্পোস্টিং বা পচানো হচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত একটি জৈবপচন প্রক্রিয়া, যা জৈব পদার্থকে স্থিতিশীল দ্রব্যে রূপান্তর করে। যেসকল অণুজীব পচনশীল পদার্থকে তাদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার কবে, সেসব অণুজীবের উপর এ প্রক্রিয়া নির্ভরশীল। কম্পোস্টিং প্রক্রিয়ায় বর্জ্যরে গন্ধ ও অন্যান্য বিরক্তিকর সমস্যা সম্বলিত পদার্থকে স্থিতিশীল গন্ধ ও রোগ জীবাণু, মাছি ও অন্যান্য কীটপতঙ্গের প্রজননের অনুপযোগী পদার্থে রূপান্তরিত করে। এ প্রক্রিয়াটি চলার সময় নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পরিত্যক্ত বর্জ্য প্রক্রিয়ার ফলে যে তাপ উৎপন্ন হয় তাতে রোগ জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়। মুরগির বিষ্ঠা ও আবর্জনার প্রকারভেদে কম্পোস্ট সার প্রস্তুত হওয়ার সময় ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তবে কম্পোস্ট সার হিসাবে তখনই উপযুক্ত হবে যখন তার রং গাঢ় বাদামি হবে, তাপ কমে আসবে এবং একটা পচা গন্ধ বের হবে। কম্পোস্ট তৈরির জন্য খামারের একপাশে একটি উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে স্থানটি চারদিকে নির্দিষ্ট মাপের (দৈর্ঘ্য ৮ ফুট, প্রস্থ ৫ ফুট ও গভীরতা ৫ ফুট) ইট দিয়ে ঘিরে একটি পিট তৈরি করতে হবে। জৈব বর্জ্যরে মিশ্রণ খড়, মুরগির দেহাবশেষ, বিষ্ঠা ও পানির অনুপাত হবে যথাক্রমে ১ ঃ ১ ঃ ১.৫ ঃ ০.৫ । প্রতি স্তরে তিন ভাগ পানি যোগ করতে হবে। উক্ত অনুপাত ঠিক রেখে মিশ্রণটি তৈরি হলে দ্রুত এবং গন্ধহীনভাবে বর্জ্য কম্পোস্টিং হবে। কম্পোস্টিং প্রক্রিয়া ১৪ দিনের মধ্যে সঠিকভাবে সম্পন্ন হবে।
কুইক কম্পোস্ট এর মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : প্রথমে ১ ভাগ খৈল ভালভাবে গুঁড়া করে ২ ভাগ চালের কুঁড়া/কাঠের গুঁড়া এবং ৪ ভাগ গোবর/হাঁস-মুরগির বিষ্ঠার সাথে ভাল করে মিশাতে হবে। প্রয়োজনীয় পরিমাণে পানি মিশিয়ে স্তূপ করে রেখে দিতে হবে, উপরে কোন কিছু দিয়ে ঢাকা যাবে না। তিন-চার দিন পর স্তূপ ভেঙ্গে ওলট-পালট করে পুনরায় স্তূপ করে রাখতে হবে। স্তূপ বেশি গরম অনুভূত হলে খৈলের সমপরিমাণ গোবর/হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা পুনরায় মিশিয়ে দিতে হবে। প্রতি দুইদিন পর পর স্তুূপ ভেঙ্গে ওলট-পালট করে পুণরায় স্তূপ করে রাখতে হবে। এভাবে দুইদিন পরপর ওলট-পালট করতে থাকলে ১৪-১৬ দিনের মধ্যে উক্ত সার জমিতে প্রয়োগ উপযোগী হয়ে যাবে।
ভার্মি-কম্পোস্টিং এর মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : কেঁচো সার উৎপাদনের জন্য প্রথমে কাঁচা গোবর সংগ্রহ করে স্তূপ করে রাখতে হবে। স্তূপকৃত গোবর পলিব্যাগ/চটের বস্তা বা চট দিয়ে ৬-৮ দিন ঢেকে রাখলে তা আধা গাঁজানো গোবরে পরিণত হবে। আধা গাঁজানো গোবর নেড়েচেড়ে আলাদা করে কাঁচা গোবরের গন্ধ বের করে দিতে হবে ও কেঁচো পালনের উপযোগী করতে হবে। এরপর ছায়াযুক্ত, বসতবাড়ি হতে কিছুটা দূরে নিরিবিলি পরিবেশে, পানি জমে না এরূপ স্থানে কেঁচো সার উৎপাদনের জন্য চাড়ি বা রিং স্থাপন করে তাতে আধা গাঁজানো গোবর দিতে হবে। নির্ভরযোগ্য উৎস্য হতে বিশেষ জাতের গোবরখাদক কেঁচো সংগ্রহ করে সাধারণত ১৫০ কেজি গোবরে ন্যূনতম ২০০০টি কেঁচো যোগ করতে হবে। রিং বা চাড়ির ভেতর পিঁপড়া, উইপোকা, ছুঁচো প্রভৃতির আক্রমণ হতে রক্ষার জন্য রিং বা চাড়ির চারপাশে ২ ইঞ্চি প্রশস্ত ও ২ ইঞ্চি গভীর গর্ত করে সর্বদা পানি ভরে রাখতে হবে এবং রিং বা চাড়ির মুখ নেট দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। কেঁচোযুক্ত আধা গাঁজানো গোবর মিশ্রণে হালকাভাবে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট মিশ্রণের উপর আধা ভেজা চটের ব্যাগ দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। কয়েকদিন পর চটের ব্যাগটি পরীক্ষা করতে হবে। মিশ্রণের উপরের চটটি শুকিয়ে গেলে আবার হালকা ভিজিয়ে রাখতে হবে। কেঁচো ৮-১০ সপ্তাহে প্রজননক্ষম হবে। প্রজননক্ষম কেঁচো ডিম পাড়া শুরু করে এবং এক বছর পর্যন্ত অনবরত প্রতি সপ্তাহে ২-৩টি ডিম পাড়ে । কেঁচোর ডিম কোকনে পরিণত হবে। কোকন বা ডিম থেকে বাচ্চা হতে প্রায় ৩২-৭৩ দিন সময় লাগবে। সাধারণত ১৫০ কেজি আধা-গাঁজানো গোবরে ন্যূনতম ২০০০টি কেঁচো ছাড়লে ৪০-৪৫ দিনে প্রায় ৫০ কেজি কেঁচো সার পাওয়া যেতে পারে। কেঁচো সাধারণত উপর থেকে নিচের দিকে গোবর খেয়ে থাকে, এজন্য কেঁচো ছাড়ার ১৫-২০ দিন পর রিং বা চাড়ির উপরের স্তর থেকে চা পাতার মত ঝুরঝুরে কেঁচোর মল সংগ্রহ করে সার হিসেবে তা আলাদা করতে হবে। রিং বা চাড়ি থেকে কেঁচো ও কেঁচো সার মিশ্রণ চালুনিতে ছেঁকে আলাদা করতে হবে। কেঁচো সার থেকে সব কেঁচো আলাদা না হওয়া পর্যন্ত এ পদ্ধতি চালিয়ে যেতে হবে। চালুনি দিয়ে সংগ্রহ করা কেঁচো সারে প্রায় ৩০-৪০% পানি থাকে। এরূপ ভেজা কেঁচো সার ৫-৬ ঘণ্টা উজ্জ্বল রোদে শুকাতে হবে। ভেজা কেঁচো সার ঝুরঝুরে না হওয়া পর্যন্ত রোদে শুকাতে হবে।
ট্রাইকো-কম্পোস্টিংয়ের মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : ট্রাইকো-কম্পোস্টিংয়ের প্রয়োজনীয় উপকরণ হলো গোবর, পচা লতা পাতা, গৃহস্থালি আবর্জনা, ধানের তুষ, কাঠের গুঁড়া, কচুরীপানা, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা ইত্যাদি। প্রথমে ১ মিটার দৈর্ঘ্য, ১ মিটার প্রস্থ ও অর্ধহাত গভীরতা বিশিষ্ট একটি গর্ত তৈরি করতে হবে। সর্বপ্রথম সংগৃহীত আবর্জনা হতে অপচনশীল দ্রব্য সরিয়ে ফেলতে হবে। তারপর গর্তে ১ম স্তরে পচনশীল বর্জ্য ঢালতে হবে। এরপর ১ম স্তরে ট্রাইকোডার্মা সাসপেনশন স্প্রে করতে হবে। আবার গর্তে ২য় স্তরে পচনশীল বর্জ্য ঢালতে হবে। এরপর ২য় স্তরে আবার ট্রাইকোডার্মা সাসপেনশন স্প্রে করতে হবে। গর্তের ৩য় স্তরে আবার পচনশীল বর্জ্য ঢালতে হবে। এরপর ৩য় স্তরে আবার ট্রাইকোডার্মা সাসপেনশন স্প্রে করতে হবে। বৃষ্টি/প্রচ- রোদ থেকে রক্ষার জন্য পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে অথবা ছাউনি দিতে হবে। সাত দিন পরপর গর্তের বর্জ্য ভালভাবে মেশাতে হবে। এভাবে মোটামুটি ৪-৫ সপ্তাহের মধ্যে সার তৈরি হয়ে যাবে।
পানি মিশ্রিত বিষ্ঠা ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : খামারের পানি মিশ্রিত বিষ্ঠা ও তরল বর্জ্যকে ড্রেনের মাধ্যমে সিমেন্টের তৈরি আধারে সংরক্ষণ করা যায়। আধার ছোট বা বড় হওয়া নির্ভর করে খামারের আকারের উপর। এ ছাড়াও পাম্প সুবিধা থাকলে তরল বর্জ্যকে সরাসরি জমিতে বা কম্পোস্ট তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এভাবে গবাদিপ্রাণির খামারে উৎপাদিত পানি মিশ্রিত বিষ্ঠা ও তরল বর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়।
পরিশেষে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় য়ে, উল্লিখিত উপায়ে সঠিকভাবে প্রাণিসম্পদ খামারের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা গেলে পরিবেশ সুরক্ষা হবে এবং অর্থনৈতিক উপকার পাওয়া যাবে।
লেখক : ১উপব্যবস্থাপক, মোবাইল : ০১৭১৩৭৭৫০৩৬, সমন্বিত কৃষি ইউনিট, পিকেএসএফ, ইমেইল : ংঁষধরসধহাবঃ@মসধরষ.পড়স ২মহাব্যবস্থাপক, সমন্বিত কৃষি ইউনিট, পিকেএসএফ,
আর্থিক সচ্ছলতা নয় বরং কৃষি ও কৃষকের সেবাই আমিনুলের সফলতা
কৃষিবিদ মোছা: ফরিদা ইয়াছমিন১ ডা: কারি মো: রমজান আলী২
‘ভোর না হতেই লাঙ্গল কাঁধে, মাঠ পানে কে যায়?
সে আমাদের গাঁয়ের কৃষক বাস আমাদের গায়।’
কৃষির নিয়ন্ত্রক হচ্ছে কৃষক। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে এমনই কৃষকের বাস। ১৯৭৯ সাল। দিনাজপুর সদর উপজেলার সুন্দরবন গ্রামের কৃষক আজিজুল ইসলাম ও নুর নেহার বেগমের ঘর আলো করে আসে আমিনুল ইসলাম। একাধারে কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য সম্পদ এর সার্বিক উন্নয়নে পরিবেশবান্ধব জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার, রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনে ভেষজ উপাদানে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান এবং প্রসারে অসামান্য ভূমিকা রেখে আসছেন এই কৃষি প্রেমী। আর্থিক সচ্ছলতার চেয়ে কৃষির সার্বিক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে কৃষি ও কৃষকের সেবাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, অদম্য সাধনায় হয়ে উঠেন ‘দক্ষ কৃষি ডাক্তার’। কৃষি অনুরাগী সেই আমিনুলের নাম আজ সবার মুখে মুখে। কৃষি সেবক আমিনুলের কৃষি ডাক্তার হয়ে ওঠার এই গল্প অনেককেই কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জোগাবে।
আমিনুলের জরাজীর্ণ সেই পৈতৃক ভিটা আজ পাকা বাড়িতে উন্নত। গোয়ালের শোভা বাড়াচ্ছে গোটা ছয়েক গরু। বাড়ির উঠানে ছাগল ও হাঁস-মুরগির বিচরণ। বাড়ির পাশেই রয়েছে মাছে ভরা পুকুর। এরই মাঝে নিজ লাইব্রেরিতে শিম, বরবটির ভাইরাস রোগের চিকিৎসা প্রদানকালে দেখা মিলে আমিনুলের, কথা হয় তার সাথে।
কৃষির প্রতি আগ্রহ শুরু হওয়ার পেছনের গল্প বলতে গিয়ে আমিনুল জানান, শৈশবে বাবার হাত ধরেই কৃষিতে আমার হাতেখড়ি। পড়াশোনা করার ইচ্ছে থাকলেও ছিল না সামর্থ্য। এটা ১৯৯৫ সালের কথা, নবম শ্রেণিতে পড়ালেখার পাট চুকিয়ে সংসারের প্রয়োজনে কাজ নেই রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক এর দোকানে, সম্মুখীন হই নতুন নতুন অভিজ্ঞতার। এ সময় আমার কাছে কৃষকরা ফসলের রোগবালাই, পোকামাকড় সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের সমস্যা নিয়ে আসত। কিন্তু এসব সমস্যা সমাধানের জ্ঞান না থাকায় আমি তখন বিভিন্ন বালাইনাশক কোম্পানির অফিসারদের সাথে কথা বলে কৃষকদরকে পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করি তবে তা যথার্থ ছিল না। আর সেই ব্যর্থতা থেকেই কৃষির প্রতি আমার ভালোলাগা আর কৃষি সমস্যা সমাধানের আগ্রহ তৈরি হয় ।
কৃষিতে দক্ষতা অর্জনের কথা উল্লেখ করে আমিনুল বলেন, ১৯৯৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সমন্বিত কৃষির উপর বিভিন্ন মেয়াদি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে প্রায় শতাধিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন তিনি। তিনি প্রথমে ‘মেসার্স কৃষি রকমারি বিতান এন্ড সীড ফার্ম’ এবং পরে ‘লাইভস্টক অ্যান্ড ফিসারিজ মেডিসিন শপ’ নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে নিজ আগ্রহে গড়ে তুলেছেন কৃষি বিষয়ক লাইব্র্রেরি, তার সংগ্রহে রয়েছে প্রায় হাজারেরও বেশি দেশী-বিদেশী কৃষি, প্রাণী ও মৎস্য বিষয়ক বই, আর্টিকেল, ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রভৃৃতি। জ্ঞানের নেশায় তিনি পারি জমান দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলাসহ বিদেশেও। বিভিন্ন সময়ে ভারত, নেপাল ভ্রমণকালে তিনি বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় কৃষি বিষয়ক প্রযুক্তি, তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে আসতেন এবং সেগুলো বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করে নিজ খামারে প্রয়োগ করতেন, এতে তিনি ভালো ফলাফল পেতেন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি ২০১৪ সালে তার বসতবাড়ি সংলগ্ন স্থানে একটি “সমন্বিত কৃষি ক্লিনিক” স্থাপন করেন। এখানে নানা রোগবালাই ও পোকামাকড় সনাক্ত করে ব্যবস্থাপত্রের মাধ্যমে রোগ দমনের রাসায়নিক ও ভেষজ চিকিৎসা এবং উপযুক্ত টেকনোলজি (গরম পানিতে বীজ শোধন যন্ত্র, রসুনের ট্যাবলেট, এলামান্ডা ট্যাবলেট, ট্রাইকো-সাসপেনশন, আইপিএম বায়োপেস্টিসাইড) কৃষকদের মাঝে প্রেসক্রিপসন করে আসছেন তিনি। এ ছাড়াও তিনি কৃষকদের ফসল, প্রাণী, মৎস্য চাষের আধুনিক প্রযুক্তি, মাটি ও পানি পরীক্ষা, জৈবিক প্রযুক্তি (ঘনজীব আমরুত, ঘনবীজ আমরুত, ভার্মি কম্পোস্ট, ট্রাইকো কম্পোস্ট) প্রভৃতি বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করেন। অবশেষে আমিনুল ২০১৭ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন প্রফেসর এবং ৩০ জন মাস্টার্স এ অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে বিভিন্ন ফসলের বালাই নির্ণয়, মাঠ পর্যায়ে সরেজমিন আগাছা, পোকামাকড়, রোগবালাই ও পুষ্টিগত সমস্যা শনাক্তকরণ এবং আইপিএম ও রাসায়নিক ব্যবস্থাপনার উপর তিন দিনব্যাপী সাক্ষাৎকার ও নিবিড় পর্যবেক্ষণের পর “দক্ষ কৃষি ডাক্তার” হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেন। এরপর থেকে তিনি প্রাণী, মৎস্য ও কৃষি বিষয়ক সমস্যার সম্ভাব্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে মোবাইলে ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিয়মিত পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং জটিল ও কঠিন সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনে সরেজমিনে তাদের নিয়ে এসে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। এছাড়া তিনি কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন “এ্যাপস” অনুসরণ করে কৃষকদের সমন্বিত কৃষিতে সেবা প্রদান করছেন। তার নিকট ফসলের উৎপাদন প্রযুক্তি বিষয়ে আধুনিক পরামর্শ ও চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে হাজার হাজার কৃষক এবং খামারি উপকৃত হচ্ছেন।
আমিনুল তার অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, রাসায়নিক ব্যবস্থাপনায় উৎপাদনের তুলনায় প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনায় উৎপাদনের ক্ষেত্রে সমস্যা অনেক কম। তিনি ২০২৩ সালে নিরাপদ ও পুষ্টিযুক্ত খাদ্য চর্চার জন্য বাংলাদেশ উত্তম কৃষিচর্চা খামার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নামে একটি খামার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিজিএএসএফ) স্থাপন করেন। সেখানে তিনি গুড এগ্রিকালচার প্রাক্টিস্টশনার হিসাবে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য চর্চা শুরু করেন ও আশেপাশের কৃষকদেরকে উৎসাহিত করেন এবং স্বেচ্ছায় আগ্রহীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে তিনি অত্র এলাকার ও তার প্রতিষ্ঠানে পরিবেশ বান্ধব ফসল চাষাবাদ ও প্রাণী, মৎস্য খামার সম্প্রসারণের জন্য ‘দক্ষ প্রশিক্ষক ও উত্তম কৃষিচর্চার সমন্বয়ক এর দায়িত্ব পালন করছেন। আগে রাসায়নিক সার ব্যবহার করে চাষাবাদ করলেও তাকে দেখে অনুপ্রাাণিত হয়ে এবং তার পরামর্শে ইতোমধ্যে উপজেলার অনেক কৃষক এখন চাষাবাদ করছেন জৈব পদ্ধতিতে। তাই স¦প্রণোদিতভাবে এই জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে জৈব কৃষির প্রসারে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন আমিনুল।
বছরে আয়ের পরিমাণ জানতে চাইলে আমিনুল বলেন, আমি ব্যবসাকে কেবলমাত্র আমার জীবিকা হিসাবে বেছে নিয়েছি। কৃষি আর কৃষকের সেবা করাই আমার মূল লক্ষ্য। আমার সময়ে কালের ব্যবসায়ী এমনকি আমার সহকারীরাও আজ ব্যবসা করে আর্থিক সফলতার দিক দিয়ে আমাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে কিন্তু আমি সবসময় সেবাকে প্রাধান্য দিয়েছি। এতে আমি সুধীজনদের কাছে, আমার এলাকাবাসীর কাছে যে সম্মান আর ভালোবাসা পেয়েছি তাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া। তিনি আরও বলেন, এক সময় আমার কিছুই ছিলনা, এখন আমি চারটা প্রতিষ্ঠান দিয়েছি। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৮-১০ জন কর্মচারী সার্বক্ষনিক শ্রম দেয়। আমার প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত ‘মাটির জীবন (ভার্মি ও ট্রাইকোডার্ম সমৃদ্ধ কম্পোষ্ট)’ নামক জৈবসার এলাকায় এবং এলাকার বাহিরে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। আমার খামারে উৎপাদিত বিষমুক্ত সবজি বা ফসলাদি এলাকার চাহিদা মিটিয়ে এলাকার বাহিরেও সরবরাহ করছি। আমার ছেলে গবাদিপশুর উপর ডিপ্লোমা করে কলকাতার একটি দুই বছর মেয়াদি কোর্স সম্পূর্ণ করে এখন আমার সাথেই কৃষকদের পাশে থাকার চেষ্টা করছে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। মেয়ে জামাইও কৃষি কর্মকা-ের সাথে জড়িত। এখন আমার মনে হয় আমার মতো সুখী আর সফল মানুষ খুবই কম আছে।
সেই অতীতের মতো আজও বাংলাদেশ মানে কৃষকের দেশ। আপন সুখ-শান্তি ও নির্মোহভাবে বিসর্জন দিয়ে কৃষকের স্বার্থে প্রতিদানহীন, নীরব নিঃস্বার্থ ভূমিকায় অবতীর্ণ আমিনুল ইসলাম। প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদেরকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব চিন্তাকে জাগ্রত করার জন্য টেকসই সমন্বিত কৃষির উন্নয়নে তার এই মহতি উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। তার সৃজনশীলতা অব্যাহত রাখতে এবং উৎসাহ জোগাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত ও সম্মানিত করা সময়ের দাবি বলে আমি মনে করি।
লেখক : ১আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা; ২সহকারী কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার (অব:), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, দিনাজপুর সদর, দিনাজপুর। মোবাইল: ০১৭৬২৩৪৮৫২৭
বৈশাখ মাসের কৃষি
(১৪ এপ্রিল- ১৪ মে)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
বৈশাখ মাস কৃষি, প্রকৃতি এবং অর্থনীতির অংশ। প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখেই কৃষক তার ফসলকে খাদ্যে রূপান্তরিত করে। বৈশাখে নববর্ষের উৎসবের পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তার কারিগর কৃষক, পুরনো বছরের ব্যর্থতাগুলো ঝেড়ে নতুন প্রত্যাশায় পুনরুজ্জীবিত হয়ে ফসল উৎপাদনে কাজে ব্যস্ত থাকে। আসুন জেনে নেই বৈশাখে কৃষির করণীয় দিকগুলো।
বোরো ধান
ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। নাবি বোরো ধানের থোড় আসার সময় পানির অভাব না হয় তাই আগে থেকেই সম্পূরক সেচের জন্য মাঠের এক কোণে মিনি পুকুর তৈরি করতে হবে। ধানের দানা শক্ত হলে জমি থেকে পানি বের করে দিতে হবে। এ মাসে আক্রান্ত বালাই দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ মাসে শিলাবৃষ্টি হতে পারে, বোরো ধানের ৮০% পাকলে তাড়াতাড়ি কেটে ফেলতে হবে।
আউশ ধান
আউশ ধানের জমি তৈরি ও বীজ বপনের সময় এখন। বোনা আউশ উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি এবং রোপা আউশ বন্যামুক্ত আংশিক সেচনির্ভর মাঝারি উঁচু ও মাঝারি নিম্ন জমি আবাদের জন্য নির্বাচন করতে হবে। জমি তৈরির শেষ চাষের সময় শতাংশপ্রতি ৬০০ গ্রাম ইউরিয়া, ২০০ গ্রাম টিএসপি ও ৩০০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। বৃষ্টিনির্ভর বোনা আউশ এলাকায় ইউরিয়া দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করত হবে। প্রথম কিস্তি শেষ চাষের সময় এবং দ্বিতীয় কিস্তি ধান বপনের ৩০-৪০ দিন পর। জমিতে গন্ধক এবং দস্তার অভাব থাকলে শতাংশ প্রতি ১৩৫ গ্রাম জিপসাম ও ২০ গ্রাম জিঙ্ক সালফেট প্রয়োগ করতে হবে। আউশের উন্নত জাত হিসাবে বিআর২০, বিআর২১, বিআর২৪, ব্রি ধান৪২, ব্রি ধান৪৩ ও ব্রি ধান৮৩, ব্রি ধান ১০৬ এবং রোপা হিসেবে বিআর২৬, ব্রি ধান২৭, ব্রি ধান৪৮, ব্রি ধান৮২, ব্রি ধান৮৫, ব্রি ধান৯৮ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৭ । এ ছাড়াও খরাপ্রবণ বরেন্দ্র এলাকাসহ, পাহাড়ি এলাকার জমিতে বিনা ধান-১৯, বিনা ধান-২১ চাষ করতে পারেন।
পাট
বৈশাখ মাস তোষা পাটের বীজ বোনার উপযুক্ত সময়। ফাল্গুনী তোষা ও-৯৮৯৭, বিজেআরআই তোষা পাট-৫, বিজেআরআই তোষা পাট-৬, বিজেআরআই তোষা পাট-৭, বিজেআরআই তোষা পাট-৮ (রবি-১), বিজেআরআই তোষা পাট-৯ (খরিফ-১) ভালো জাত।
ভুট্টা (খরিফ)
খরিফ ভুট্টার বয়স ২০-২৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। মাটিতে রসের ঘাটতি থাকলে হালকা সেচ দিতে হবে। জমিতে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং একই সাথে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে।
শাকসবজি
বসতবাড়ির বাগানে জমি তৈরি করে ডাঁটা, কলমিশাক, পুঁইশাক, করলা, ঢেঁড়স, বেগুন, পটোল চাষের উদ্যোগ নিতে হবে। মাদা তৈরি করে চিচিঙ্গা, ঝিঙা, ধুন্দুল, শসা, মিষ্টিকুমড়া, চাল কুমড়ার বীজ বুনে দিতে পারেন। আগের তৈরি করা চারা থাকলে ৩০/৩৫ দিনের সুস্থ সবল চারাও রোপণ করতে পারেন। লতানো সবজির জন্য মাচা তৈরি করে নিতে হবে।
গাছপালা
এ মাসে আমের মাছি পোকাসহ অন্যান্য পোকার জন্য সতর্ক থাকতে হবে। মাছি পোকা দমনের জন্য সবজি খেতে যে রকম বিষটোপ ব্যবহার করা হয় সে ধরনের বিষটোপ বেশ কার্যকর। ডিপটরেক্স, ডারসবান, ডেনকাভেপন সামান্য পরিমাণ দিলে উপকার পাওয়া যায়। এ সময় কাঁঠালের নরম পচা রোগ দেখা দেয়। এলাকায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব থাকলে ফলে রোগ দেখা দেয়ার আগেই ফলিকুর ০.০৫% হারে বা ইন্ডোফিল এম-৪৫ বা রিডোমিল এম জেড-৭৫ প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৩ বার স্প্রে করতে হবে। বাড়ির আঙিনায় সুস্থ সবল, উন্নত নারিকেল চারা এবং গ্রামের রাস্তার পাশে পরিকল্পিতভাবে খেজুর ও তালের চারা এখন লাগাতে পারেন। যত্ন, পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে ৩-৪ বছরেই গাছগুলো অনেক বড় হয়ে যাবে।
প্রিয় পাঠক, বৈশাখ নতুন আবাহনের সৌরভের পাশাপাশি নিয়ে আসে কালবৈশাখীকে। কালবৈশাখীর থাবা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কৃষিতে আগাম বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সুবিবেচিত লাগসই কৌশল আর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সব বাধা ডিঙিয়ে আমরা কৃষিকে নিয়ে যেতে পারব সমৃদ্ধির ভুবনে। আপনাদের সবার জন্য নতুন বছরের শুভ কামনা। কৃষি সংশ্লিষ্ট তথ্য জানতে কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি কল সেন্টার ১৬১২৩ নম্বরে কল করুন।
লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪,