রাব্বী সরকার, গ্রাম : হরকাডাঙ্গা, উপজেলা : গোমস্তাপুর, জেলা : চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রশ্ন : লটকন গাছের পাতা হলুদ হয়ে যায় এবং পরে শুকিয়ে যায় এবং গাছ ধীরে ধীরে ৮-১০ দিনের মধ্যে নেতিয়ে পড়ে মারা যায়। কী করব?
উত্তর : ফিউজেরিয়াম নামক ছত্রাকের কারণে এ সমস্যাটি হয়ে থাকে। এ রোগের কোনো প্রতিকার নেই। তবে এ রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয়া যায়। সেগুলো হলো- দ্রুত পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। রোগের প্রথম দিকে কপার অক্সিক্লোরাইড গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন-সানভিট, সুলকক্স ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া বাগানের মাটির অম্লত্ব কমাতে জমিতে চুন প্রয়োগ করতে হয়। পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধী আদিজোড়ের ওপর কলম করলে এ সমস্যার সমাধান করা যায়।
শাহাদাত কবীর, গ্রাম : খাটুরিয়া, উপজেলা : গোবিন্দগঞ্জ, জেলা : গাইবান্ধা
প্রশ্ন : আমার জিনিয়া ফুলগাছের পাতার ওপর ছোট ছোট দাগ পড়ে পাতা ঝলসে গাছ মারা যায়। এ সমস্যা রোধে কী করণীয়?
উত্তর : জিনিয়া ফুল গাছের এ সমস্যাটিকে পাতার দাগ বা ঝলসানো রোগ বলে। এ সমস্যা রোধে গাছ অনুমোদিত রোপণ দূরত্ব বজায় রেখে সুষম সার ব্যবহার করতে হবে যেন গাছের ডালপালা বেশি না হয়। আর এ রোগ প্রতিকারে কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন- নোইন, এমকোজেম প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে অথবা প্রোপিকোনাজল যেমন-টিল্ট, এভোনাজল ১ লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। তাহলেই এ সমস্যার সমাধান হবে।
রায়হান শেখ, গ্রাম : ধল্লাপারা, উপজেলা : ঘাটাইল, জেলা : টাঙ্গাইল
প্রশ্ন : বারি বাতাবি লেবু-৩ এর চারা লাগানোর গর্তে কী কী সার প্রয়োগ করতে হবে। জানাবেন।
উত্তর : বারি বাতাবি লেবু-৩ এর চারা রোপণের জন্য ৫-৬ মিটার দূরত্বে ৬০x৬০x৬০ সেমি. আকারের গর্ত তৈরি করতে হবে। রোপণের ১৫-২০ দিন আগে গর্ত প্রতি ১৫-২০ কেজি পচা গোবর, ৩০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০-৩০০ গ্রাম এমওপি ও ২০০ গ্রাম জিপসাম সার গর্তের মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে গর্ত বন্ধ করে দিতে হবে এবং গর্তে পানি দিতে হবে। গর্তে সার প্রয়োগের ১৫-২০ দিন পর গোড়ার মাটিসহ চারা গর্তের মাঝখানে সোজাভাবে রোপণ করা হয়। চারা রোপণের পর হালকা পানি সেচ, খুঁটি ও বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
সফিউল্লাহ, গ্রাম : এলাইগা, উপজেলা : পীরগঞ্জ, জেলা : ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন : চিচিঙ্গা ক্ষেতের চিচিঙ্গা পচে যায়। কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে উপকার পাবে, জানাবেন।
উত্তর : রোগ যাতে না হয় সেজন্য ভালো জাতের রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে কার্বেনডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন- নোইন, ইকোজিম ১ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালোভাবে ৭-১০ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে। তবেই আপনি সুফল পাবেন। তাছাড়া চিচিঙ্গা বীজ উৎপাদনের জন্য অবশ্যই অনুমোদিত ছত্রাকনাশক নিয়মমাফিক ব্যবহার করলে চিচিঙ্গা বীজের মাধ্যমে এ রোগ ছড়াতে পারবে না।
রাবেয়া বেগম, গ্রাম : দৌলতপুর, উপজেলা : নড়াইল সদর, জেলা : নড়াইল
প্রশ্ন : সাতকরা গাছের ডাল ছাঁটাই সম্পর্কে জানতে চাই?
উত্তর : নতুন সাতকরা গাছের চারা লাগানো হলে আদিজোড় থেকে উৎপাদিত কুশি অবশ্যই ভেঙে দিতে হবে। নাহলে গাছের বাড়বাড়তি কমে যাবে। গাছটির অবকাঠামো মজবুত করার জন্য গোড়া থেকে ১ মিটার পর্যন্ত কোনো ডালপালা রাখা যাবে না। এক থেকে দেড় মিটার উপরে বিভিন্ন দিকে ছড়ানো ৪-৫টি শাখা রাখতে হবে যাতে করে গাছটির সুন্দর কাঠামো তৈরি হয়। এছাড়া প্রতি বছর ফল সংগ্রহের পর মরা, পোকামাকড় ও রোগাক্রান্ত ডাল ছাঁটাই করে ডালপালার কর্তিত স্থানে বর্দোপেস্টের প্রলেপ দিতে হবে। এভাবে সাতকরা গাছে ডাল ছাঁটাই করলে ফলন অনেক বেশি পাওয়া যাবে।
শেফালি ইয়াছমীন, গ্রাম : সনগাঁও, উপজেলা : বালিয়াডাঙ্গি, জেলা : ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন : কলা গাছের পাতা সরু, খাটো ও উপরের দিকে বাঁকানো এবং গাছ বড় হচ্ছে না কী করব?
উত্তর : কলা গাছের এ ধরনের সমস্যাকে বানচি টপ রোগ বলে। এ জন্য বানচি টপ রোগ প্রতিরোধী জাতের চাষ এবং রোগমুক্ত বাগান বা এলাকা থেকে চারা সংগ্রহ করতে হবে। তাছাড়া রোগাক্রান্ত গাছ দেখামাত্র উঠিয়ে ধ্বংস করতে হবে। যথেষ্ট পরিমাণে সার প্রয়োগ করলে ফসলের রোগ সহনশীলতা বাড়ে। রোগটি যেহেতু ভাইরাসজনিত। সেজন্য ভাইরাসের বাহক জাবপোকা দমনের জন্য ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক যেমন-টিভো, এডমায়ার প্রতিলিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
শেফালি ইয়াছমীন, গ্রাম : সনগাঁও, উপজেলা : বালিয়াডাঙ্গি, জেলা : ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন : মেহগনি গাছের ডগা ছিদ্রকারী পোকার দমন সম্পর্কে জানাবেন।
উত্তর : মেহগনি গাছের ডগা ছিদ্রকারী পোকা দমনের জন্য সুস্থ সবল মাতৃবৃক্ষ হতে বীজ সংগ্রহ করে চারা উত্তোলন করে বাগান করতে হবে। এছাড়া বাগান নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেও আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। চারা রোপণের আগে পরিমাণমতো গর্ত করে সুষম জৈব ও রাসায়নিক সার মিশিয়ে চারা রোপণ করলে উপকার পাওয়া যায়। আর পোকার আক্রমণ দেখামাত্র আক্রান্ত ডগা পোকাসহ কেটে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে অথবা আক্রান্ত ডগা ধারালো ছুরি বা ব্লেড দিয়ে কেটে পোকা মেরে ফেলতে হবে। পোকা আক্রান্ত বাগানে প্রতি গাছে ৬-১০ গ্রাম কার্বোফুরান-৫জি দানাদার অন্তর্বাহী কীটনাশক গাছের গোড়ায় ২০ সেমি. ব্যাসের মধ্যে মাটিতে ছিটিয়ে মেশাতে হবে এবং পর্যাপ্ত পানি দিতে হবে, যাতে ওষুধ গাছের শিকড়ে পৌঁছায়। তাহলেই মেহগনি গাছের এ ক্ষতিকর পোকা দমন করা সম্ভব হবে।
মো. রুবেল বৈরাগী, গ্রাম : বেদেরপুকুর, উপজেলা : কাহারোল, জেলা : দিনাজপুর
প্রশ্ন : কাতলা মাছের মাথা মোটা এবং লেজ চিকন হয়ে আসছে। এ অবস্থায় কী করণীয়?
উত্তর : পুকুরে পর্যাপ্ত খাবারের অভাবের কারণে এমনটি হয়ে থাকে। সে কারণে প্রাকৃতিক খাবারের পাশাপাশি প্রতি শতকে গোবর ২০০ গ্রাম, ইউরিয়া ৫ গ্রাম, টিএসপি ৩ গ্রাম হারে ৭ দিনের একসাথে দিলে সুফল পাওয়া যাবে। এছাড়া প্রতিদিন সম্পূরক খাবার হিসেবে চালের কুঁড়া, খৈল, ভুসি, ভিটামিন একসাথে মিশিয়ে মাছের ওজনের শতকরা ৫ ভাগ হারে সকালে ও বিকেলে নির্দিষ্ট হারে দিলে মাছের এ সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
আরশেদ খান, গ্রাম : লখাইডাঙ্গা, উপজেলা : মণিরামপুর, জেলা : যশোর
প্রশ্ন : পুকুরের পানি ঘোলা হয়ে গেছে। এ সমস্যা দূর করতে কী করতে হবে?
উত্তর : পুকুরের এ সমস্যা দূর করার জন্য প্রতি শতকে পোড়া চুন ১-২ কেজি বা জিপসাম ১.৫-২ কেজি হারে প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া প্রতি শতকে ফিটকিরি ২৪৫ গ্রাম ৩০ সেমি. পানির গভীরতায় প্রয়োগ করে পানি পরিবর্তন করতে হবে। পাশাপাশি পুকুরে খাবার প্রয়োগ কমিয়ে দিতে হয়। আর পুকুর তৈরির সময় জৈব সার বেশি দিতে হবে। এভাবে এ সমস্যার সামাধান করা যাবে।
সাব্বির আহমেদ, গ্রাম : চারনারিয়া, উপজেলা : গফরগাঁও, জেলা : ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : আমার গরুর গায়ে ঘা হয়েছে। এতে পুঁজ দেখা যাচ্ছে। গরু হাঁটতে পারছে না। গরুর তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি। এমতাবস্থায় করণীয় কী?
উত্তর : গরুকে শুকনো পরিষ্কার স্থানে রাখতে হবে। ক্ষতস্থান জীবাণুনাশক দ্বারা পরিষ্কার করতে হবে। প্রোকেইন পেনিসিলিন জি প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ২২০০০ ইউনিট হিসাবে দিনে দুইবার মাংসপেশীতে প্রয়োগ করতে হবে। তাহলেই আপনার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
মো. আলআমিন, গ্রাম : তাম্বুলখানা, উপজেলা : ফরিদপুর সদর, জেলা : ফরিদপুর
প্রশ্ন : গরুর কাঁধে ঘা হয়েছে। যা পায় তার সাথে কাঁধ ঘষে। ঘর্ষণের ফলে রক্ত বের হয়ে যাচ্ছে। ঘায়ের উপরের অংশ শক্ত হয়ে যাচ্ছে। কী করব?
উত্তর : ক্ষতস্থানে যাতে মাছি বসতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। ক্ষতের চারপাশে তারপিন তেল লাগিয়ে রাখতে হবে। আভারমেকটিন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। এন্টহিস্টামিনিক ইনজেকশন দিতে হবে। নেগুভন পাউডার ভ্যাসলিন বা নারিকেল তেলের সাথে মিশিয়ে ক্ষতস্থানে লাগাতে হবে। তবেই আপনার উল্লিখিত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
কৃষির যে কোনো প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান পেতে বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো মোবাইল থেকে কল করতে পারেন আমাদের কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ এ নাম্বারে। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত যে কোনো দিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এ সময়ের মধ্যে। তাছাড়া কৃষিকথার গ্রাহক হতে বার্ষিক ডাক মাশুলসহ ৫০ টাকা মানি অর্ডারের মাধ্যমে পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ এ ঠিকানায় পাঠিয়ে ১ বছরের জন্য গ্রাহক হতে পারেন। প্রতি বাংলা মাসের প্রথম দিকে কৃষিকথা পৌঁছে যাবে আপনার ঠিকানায়।
কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন
উপপ্রধান তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, মোবা : ০১৭১১১১৬০৩২, taufiquedae25@gmail.com
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২ এর মূল লক্ষ্য বাস্তবায়নে ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়ার প্রত্যয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট
জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০৩০ সালের মধ্যে একটি সুন্দর বিশ্ব গড়ার প্রত্যয় নিয়ে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিত করে ক্ষুধা থেকে মুক্তির পরিকল্পনা করা হয়েছে। জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতি প্রাপ্ত এমডিজির রোল মডেল বাংলাদেশের বর্তমান সরকার টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টসমূহ অর্জনের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব প্রদান করেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান হিসেবে এদেশের মানুষের জন্য সারা বছর নিরাপদ, পুষ্টিকর এবং পর্যাপ্ত খাদ্য নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন ফসলের উচ্চফলনশীল উন্নত জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি সর্বোচ্চ ফলনের জন্য লাগসই উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যার দেশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.২৬ শতাংশ অব্যাহত থাকলে এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ভিশন-২০৩০, বিএআরসি ২০১২ এর প্রক্ষেপণ অনুসারে ২০৩০ সালে আমাদের প্রয়োজন হবে ধান ৩৯.৮০ মিলিয়ন টন, গম ৩.৮৫ মিলিয়ন টন, ভুট্টা ৪.০০ মিলিয়ন টন, ডাল জাতীয় শস্য ৩.৫০ মিলিয়ন টন, তৈল জাতীয় শস্য ১.৭০ মিলিয়ন টন, আলু ৫.২৫ মিলিয়ন টন, শাকসবজি ১৩.৯৮ মিলিয়ন টন এবং ফল ৬.২৪ মিলিয়ন টন। সুতরাং এসডিজি- এর লক্ষ্য মাত্রা অর্জন করতে হলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা জরুরি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশের সর্ববৃহৎ বহুবিদ ফসল গবেষণা প্রতিষ্ঠান। দেশের সার্বিক কৃষি উন্নয়ন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা অর্জন, কৃষকের আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে এ প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন প্রকার দানা জাতীয় ফসল, কন্দাল ফসল, ডাল ফসল, তেল ফসল, মসলা ফসল, সবজি, ফল, ফুল এবং সামুদ্রিক শৈবালসহ ২০৮টি ফসলের উপর গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এ প্রতিষ্ঠান এসব ফসলের খরা, লবণাক্ততা প্রতিরোধী, স¦ল্প দৈর্ঘ্যরে বায়োফর্টিফাইড উচ্চফলনশীল উন্নত জাত এবং উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবন, ফসল ব্যবস্থাপনা, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা, পোকামাকড় ও রোগ-বালাই প্রতিরোধী জাত ও ব্যবস্থাপনা, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, ফসলের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, এলাকা ভিত্তিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন, হাইড্রোপনিক পদ্ধতি, সমনি¦ত খামার পদ্ধতি উন্নয়ন, পাহাড়ি অঞ্চলে ফসল উৎপাদন এবং সামুদ্রিক শৈবাল চাষ ইত্যাদি বিষয়ের উপর লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে তার সম্প্রসারণকর্মী, কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট এনজিও কর্মী এবং কৃষকের নিকট হস্তান্তরের জন্য নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত গম, ভুট্টা, আলু, ডাল ও তেলবীজ, শাক-সবজি, ফল, ফুল ও মসলাসহ বিভিন্ন ফসলের ৫৩১টি উচ্চফলনশীল উন্নত জাত এবং ৫০৫টি উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে।
উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল উন্নত জাত : উচ্চফলনশীল গমের জাত এবং অন্যান্য উৎপাদন প্রযুক্তিসমূহ উদ্ভাবন ও কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশে গম উৎপাদন ও বিশেষভাবে ফলন উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিএআরআই কর্তৃক এ পর্যন্ত ৩৩টি উন্নত গমের জাত এবং ২টি ট্রিটিকেলি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। গত ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৪.২৮৮ লক্ষ হেক্টর থেকে উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ১৪.২৩৬ লক্ষ টন গম এবং গড়ে হেক্টরপ্রতি ফলন রেকর্ড হয়েছে ৩.৩২ টন। গত ১৯৭২ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে গমের হেক্টরপ্রতি গড় ফলন প্রায় ২৩৮% বৃদ্ধি পেয়েছে যা একটি মাইলফলক। এ অর্জনের মূল কারণ হলো গমের উচ্চফলনশীল রোগ প্রতিরোধী ও প্রতিকূলতা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন ও কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণ। বর্তমানে দেশে যে গম আবাদ হয় তার প্রায় ১০০% বিএআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত জাত। এ পর্যন্ত ১৫টি হাইব্রিড ভুট্টা এবং ৯টি মুক্ত পরাগায়িত ভুট্টার জাত অবমুক্ত করা হয়েছে যার মধ্যে একটি খৈ ভুট্টা, একটি মিষ্টি ভুট্টা ও একটি বেবিকর্নের জাতও রয়েছে। এ ছাড়াও বার্লির ৭টি, কাউনের ৩টি অবমুক্ত করা হয়েছে। বিএআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল আলুর জাত কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদের ফলে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ আলু চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। বর্তমানে দেশের চাহিদা পূরণ করেও প্রচুর পরিমাণে আলু বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৫.২৮৩ লক্ষ হেক্টর জমিতে ১১৩.৩২৭ লক্ষ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয় চাষাবাদের দিক থেকে বাংলাদেশে ধান ও গমের পরেই আলুর অবস্থান।
দেশকে তেল ফসলে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য বিএআরআই ৮টি গুরুত্বপূর্ণ তেল ফসলের উপর গবেষণা করে উচ্চফলনশীল সরিষার ১৮টি, চীনাবাদামের ১১টি, তিলের ৪টি, সয়াবিনের ৬টি, সূর্যমুখীর ২টি, তিসি, গর্জন তিল এবং কুসুম ফুলের ১টিসহ তৈলবীজ জাতের সর্বমোট ৪৪টি জাত উদ্ভাবন করেছেন। বর্তমানে স¦ল্পমেয়াদি বারি সরিষা-১৪,বারি সরিষা-১৫ বোরো ধান-রোপা আমন ধান শস্য বিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করে সরিষার উৎপাদন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টি স্বল্পতা দূর করতে, মাটির হারানো উর্বরা শক্তি ফিরে পেতে, মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে, সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে ডালের আবাদ বৃদ্ধি বর্তমান সময়ের অপরিহার্য দাবি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী সুষম খাদ্য তালিকায় একজন মানুষের জন্য প্রতিদিন ন্যূনতম ৪৫ গ্রাম ডালের প্রয়োজন। কিন্তু দেশে উৎপাদিত ডাল থেকে জন প্রতি প্রতিদিন মাত্র ১৭ গ্রাম ডালের সংস্থান হয়। সুতরাং ডালের এই ঘাটতি পূরণে উচ্চফলনশীল জাত ও আধুনিক উৎপাদন কৌশলের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিএআরআই উদ্ভাবিত জাতসমূহ উচ্চফলনশীল যার ফলন স্থানীয় জাতের প্রায় দ্বিগুণ। অতএব স্থানীয় জাতের পরিবর্তে উন্নত জাতের চাষাবাদের মাধ্যমেই ডালের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ করা সম্ভব। স¦ল্পমেয়াদি উচ্চফলনশীল বারি মুগ-৬ ইতিমধ্যে কৃষক পর্যায়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এবং মাঠ পর্যায়ে ডাল ফসলের ফলন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
সবজির ঘাটতি পূরণের জন্য বিএআরআই এ পর্যন্ত ৩৪টি সবজির ১০৭টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে যার অনেকগুলোর মধ্যে রোগ, পোকামাকড়, লবণাক্ততা, উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। যে কারণে বিভিন্ন সবজি ফসলের আবাদযোগ্য জমি ও সার্বিক উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া তাপসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনের ফলে অনেক সবজি সারা বছরই চাষ করা সম্ভবপর হচ্ছে। গ্রীষ্মকালীন টমেটোর বেশ কয়েকটি হাইব্রিড জাত টমেটো চাষে এক নীরব বিপ্লব সংঘটিত করেছে। বিএআরআই এ যাবৎ ২৮টি টমেটোর উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে যার মধ্যে ১১টি হাইব্রিড জাত রয়েছে। সাম্প্রতিক উদ্ভাবিত জাতের মধ্যে বারি টমেটো-১৬, ১৭ এবং বারি টমেটো-৮ ও ৯ অন্যতম। বারি হাইব্রিড টমেটো-৪ ও ৮ গ্রীষ্মকালীন জাত হিসেবে সারা দেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। বারি টমেটো-১৫ হলুদ পাতা কোঁকড়ানো ভাইরাস রোগ প্রতিরোধী এবং বারি টমেটো-১৬ ও ১৭ উচ্চ সংরক্ষণশীল জাত হিসেবে পরিচিত। বিএআরআই এ পর্যন্ত ১২টি বেগুনের জাত উদ্ভাবন করেছে, যার মধ্যে ৪টি হাইব্রিড জাত রয়েছে। এদের মধ্যে বারি বেগুন-৮ ও ১০ উচ্চফলনশীল জাত ও ব্যাকটেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ প্রতিরোধী। জীব প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বিএআরআই উদ্ভাবিত বিটি বেগুনের ৪টি জাত ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী। আগাম জাত বারি ব্রোকলি-১ রোপণের ৭৫ দিনের মধ্যে সংগ্রহ উপযোগী। বারি লাউ-৪ সারা বছরব্যাপী চাষ করা যায় ও লাভজনক হিসাবে কৃষকদের নিকট ব্যাপকভাবে সমাদৃত। বারি শিম-৭একটি গ্রীষ্মকালীন জাত যা উচ্চ তাপমাত্রায় ফল ধারণে সক্ষম। বারি কামরাঙ্গা শিম-১ জাতটি পুষ্টিকর ও উন্নতমানের খনিজ সমৃদ্ধ। বারি ঝিঙ্গা-২ সারা দেশে গ্রীষ্মকালে চাষোপযোগী রোগ ও পোকামাকড় সহনশীল জাত। বারি ঢেঁড়শ-২ হলুদ পাতা কোঁকড়ানো ভাইরাস প্রতিরোধী।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ৩২টি ফল ফসলের ৭৯টি জাত উদ্ভাবন করেছে। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন ফল ফসল উৎপাদনের হার দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে, বিশেষত পাহাড়ি অঞ্চলসহ অনেক অনাবাদি জমিতে বিএআরআই উদ্ভাবিত জাতসমূহ দিয়ে ফল বাগান প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে বছরব্যাপী দেশীয় ফলের সহজলভ্যতা বাড়ছে। বিশেষ করে সারা দেশে বারি মাল্টা-১ ও বারি পেয়ারা-২ এর চাষ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। সম্প্রতি বারি আম-১১ (বারমাসী) এর উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের ফলে বছরের অধিকাংশ সময়ে আমের প্রাপ্যতা বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়েছে। বারি আম-৪ (হাইব্রিড) একটি নাবী ও সুস্বাদু জাত হিসেবে ইতিমধ্যে সারা দেশে কৃষক পর্যায়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
বিএআরআই এর মসলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে ১৫টি ফসলের ৩৫টি জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের জাত কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয় হয়েছে। বারি রসুন-২ জাতটি চলনবিল এলাকায় ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। বারি রসুন-৩ ও ৪ বড় আকারের ও বড় কোয়াযুক্ত যা ভোক্তা ও কৃষকদের কাছে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে। বারি আদা-২ ও ৩ উচ্চফলনশীল ও উন্নত মানের। বারি আলুবোখারা-১ মসলা, আচার ও চাটনিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি আকর্ষণীয় লাল রঙের, টক মিষ্টি স্বাদের, রসালো এবং এন্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। বারি দারুচিনি-১ জাতটি গুণেমানে ভালো এবং আমদানি করা সেরা দারুচিনির মতোই ঝাঁঝ, মিষ্টতা ও সুগন্ধিযুক্ত। বারি পাতা পেঁয়াজ-১ চাষে সারা বছর পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
উৎপাদন প্রযুক্তি : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উন্নত ফসল বিন্যাস, সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা, উন্নত সংরক্ষণ পদ্ধতি, সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনাসহ ৫০৫টি লাগসই উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। চার ফসল ভিত্তিক ৩টি কার্যকরী ফসল ধারা যেমন রোপা আমন - সরিষা - বোরো - রোপা আউশ, রোপা আমন - আলু - বোরো - রোপা আউশ এবং রোপা আমন - সরিষা - মুগ - রোপা আউশ উদ্ভাবনের মাধ্যমে ফসলের নিবিড়তা ১৯১% থেকে ৪০০% পর্যন্ত উন্নীতকরণের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বারি উদ্ভাবিত আইপিএম পদ্ধতিতে সেক্স ফেরোমন ও বিষটোপ ফাঁদ যৌথভাবে ব্যবহার করে বিভিন্ন সবজি যেমন- টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, কচু, ঢেঁড়শ, শিম ইত্যাদি এবং আম, পেঁয়ারা, কমলা, ডালিম ইত্যাদি ফলের উৎপাদন যেমন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে তেমনি প্রযুক্তিসমূহ স্বল্প ব্যয়সম্পন্ন হওয়ায় আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব। কোন ধরনের কীটনাশক (বিষ) প্রয়োগ করার প্রয়োজন হয় না বলে উদ্ভাবিত আইপিএম পদ্ধতিসূমহ পরিবেশবান্ধব, স্বাস্থ্যগত সমস্যামুক্ত।
শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন টমেটো এবং বেগুন, ক্যাপসিকাম, স্ট্রবেরি, তরমুজ, পেঁপে, পিঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি ফসলের জন্য উদ্ভাবিত ফার্টিগেশন ও স্প্রিংলার সেচ প্রযুক্তি বাণিজ্যিক কৃষকগণের নিকট সমাদৃত হয়েছে।
বিএআরআই উদ্ভাবিত মাটি ব্যবস্থাপনা ও মাটির উর্বরতা সংরক্ষণ প্রযুক্তিসমূহ কৃষকের মাঠে ফলন বৃদ্ধিতে সফল ভূমিকা রাখছে। জৈব আর্বজনা থেকে ভার্মিকম্পোস্ট বা কেঁচোসার উৎপাদন কলাকৌশল, ফসল উৎপাদনে বায়োস্লারির ব্যবহার, ভুট্টার দানা গঠনে চুন ও বোরন সারের প্রভাব, সরিষা ফসলে বোরনের প্রভাব, ঝাড়শিম উৎপাদনে রাইজোবিয়াম অণুজীব সার, চীনাবাদাম উৎপাদনে রাইজোবিয়াম অণুজীব সারের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তি।
কৃষি শ্রমিকের স্বল্পতা, সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের কথা বিবেচনা করে ৩৮ ধরনের উন্নত এবং লাগসই কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। পাওয়ার টিলারের বহুমুখী ব্যবহারের জন্য বেশ কয়েক ধরনের কৃষি যন্ত্রপাতি, যেমন বীজ বপন যন্ত্র, আলু উত্তোলন যন্ত্র, ধান ও গম কর্তন যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে। এছাড়াও বারি উদ্ভাবিত ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র, শুকনা জমি নিড়ানি যন্ত্র, শস্য ঝাড়াই যন্ত্র, আলু রোপণ যন্ত্র, আলু উত্তোলন যন্ত্র, আলু গ্রেডিং যন্ত্র, আম পাড়া যন্ত্র, আম শোধন যন্ত্র, গাজর বা মূল জাতীয় ফসল ধৌতকরণ যন্ত্র ইত্যাদি কৃষক পর্যায়ে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে। শস্য সংগ্রহোত্তর বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্যের মূল্য ও পুষ্টিমান সংযোজন করে উদ্যোক্তা তৈরি ও বেকারত্ব সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখা হচ্ছে।
সামুদ্রিক শৈবাল : বিশ্বের বহুদেশে সামুদ্রিক শৈবাল মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের রয়েছে বিশাল উপকূলীয় এলাকা। বাংলাদেশের উপকূলীয় তটরেখার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭১০ কিলোমিটার যেখানে ২৫০০০ বর্গ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা বিস্তৃত। বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন যেখানে প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর শৈবাল জন্ম নিয়ে থাকে। বিএআরআই অগভীর সামুদ্রিক উপকূলীয় এলাকায় শৈবাল গবেষণা কার্যক্রম হাতে নিয়ে ইতোমধ্যে চাষ উপযোগী কয়েকটি শৈবাল চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা নিরূপণে অগাদ সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিকূল আবহাওয়ায় খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিতকরণ : বিএআরআই প্রতিকূল আবহাওয়া যেমনÑ লবণাক্ততা, খরা, উষ্ণতা, জলমগ্নতা প্রভৃতি পরিস্থিতিতে খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করণে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করেছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ফসলের বেশ কয়েকটি জাত উদ্ভাবন করেছে। প্রতিকূল পরিবেশ প্রতিরোধী জাতের মধ্যে বারি গম-২৫ তাপ ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু, বারি গম-২৬ তাপ সহিষ্ণু, বারি গম-২৮ এবং বারি গম-৩০ স্বল্প মেয়াদি ও তাপ সহিষ্ণু, বারি গম-৩৩ ব্লাস্টরোগ প্রতিরোধী, বারি আলু-২৮ লবণাক্ততা সহিষ্ণু, বারি সরিষা-১১ খরা সহিষ্ণু, বারি সরিষা-১৬ খরা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু, বারি তিল-৪ খরা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু, বারিছোলা-৯ খরা সহিষ্ণু, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১২ ও বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৩ খরা সহনশীল, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৪ ও বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৫ তাপ সহনশীল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
অত্র প্রতিষ্ঠানের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, বিভিন্ন ফসলের জাতসমূহের মধ্যে গমের ক্ষেত্রে ১০০%, আলুর ক্ষেত্রে ৮৬%, সরিষায় ৯০.৪%, চীনাবাদামে ৫২.০%, তিলের ক্ষেত্রে ৬৫.০৯%, সয়াবিনে ১০০%, মসুরে ৮৭.৫৫%, মুগবিনে ৯৭.৮২%, মাসকালাইয়ে ৪৭.৫৭% এবং ছোলার ক্ষেত্রে ৭১.৯৫% কৃষক বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত জাতসমূহ ব্যবহার করছে এবং দেশের মাঠ ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। বর্তমান কৃষি বান্ধব সরকারের গবেষণা ক্ষেত্রে আন্তরিক সহযোগিতায় ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত বিএআরআই বিভিন্ন ফসলের ২২২টি হাইব্রিডসহ উচ্চফলনশীল উন্নত জাত এবং ২৫০টি উন্নত ফসল ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। বিভিন্ন ফসলের মধ্যে গমের ৯টি, ভুট্টার ৬টি, আলুর ৫০টি, ডালের ১৪টি, তৈলবীজ ফসলের ৬টি, শাকসবজির ৪৫টি ও ফলের ৪০টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের ফলে ফলন ও মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বিভিন্ন ফসলের মোট উৎপাদন বৃদ্ধির উন্নত জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের মাধ্যমে অনাহার বা ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়ার পথকে নিশ্চিত করে চলেছে।
ড. আবুল কালাম আযাদ
মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, জয়দেবপুর, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৭১৪১৭৯০৪৮
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। উৎপাদনশীলতা ও আয় বৃদ্ধি ও গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বিশাল জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধির জন্য কৃষির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৪.১০% এবং দেশের জনশক্তির ৪১ ভাগ কৃষিকাজে নিয়োজিত। তাই এদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষির উন্নয়ন অপরিহার্য। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, চাষযোগ্য জমি ও মৃত্তিকার উর্বরতা হ্রাস এবং পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রেক্ষাপটে আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। কৃষির এই বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমাদের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল কৃষিতে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমের ১২টি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। গবেষণা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কাউন্সিল নার্সভুক্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের গবেষণা পরিকল্পনা প্রণয়ন, পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন এবং কৃষি গবেষণার মান উন্নয়নসহ বিজ্ঞানীদের গবেষণা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করছে।
কৃষিতে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাউন্সিলের গৃহীত কার্যক্রম
গবেষণা অগ্রাধিকার ও নীতি-নির্ধারণী ডকুমেন্ট প্রণয়ন : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল মাঠ পর্যায়ের ও অঞ্চলভিত্তিক চাহিদা নিরূপণ করে দেশের চাহিদার ও বৈশি^ক জলবায়ু পরিবর্তন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে গবেষণা অগ্রাধিকার ও ভিশন ডকুমেন্ট ২০৩০ প্রণয়ন করেছে। কৃষির ১২টি সাব-সেক্টরের জন্য প্রণীত এ ভিশন ডকুমেন্ট দেশের ভবিষ্যৎ কৃষি গবেষণার দিক নির্দেশক হিসেবে কাজ করছে। এ ছাড়া জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮ প্রণয়নসহ বিভিন্ন নীতি-নির্ধারণী ডকুমেন্ট প্রণয়নের কাজ করছে।
গবেষণা সমন্বয়, মনিটরিং ও মূল্যায়ন : কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে দ্বৈততা পরিহার এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম প্রণয়নে গবেষণা প্রতিষ্ঠানমূহকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান কাউন্সিলের প্রধান কাজ। বিএআরসি সহযোগী সংস্থার বিজ্ঞানী/কর্মকর্তা সমন্বয়ে সারা দেশের মাঠ পর্যায়ের নার্সভুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের গবেষণা কার্যক্রম পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করছে। এ ছাড়া নার্সভুক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তি হস্তান্তর ও সম্প্রসারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কার্যক্রম : বিএআরসি জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমে কর্মরত বিজ্ঞানীদের গবেষণা সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘ মেয়াদি প্রশিক্ষণ ও উচ্চ শিক্ষার জন্য মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনা ২০২৫ প্রণয়ন করেছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য মানব সম্পদ উন্নয়নে রাজস্ব ও বৈদেশিক অর্থায়নে পরিচালিত এনএটিপি প্রকল্পের আওতায় কৃষি বিজ্ঞানীদের পিএইচডি/পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জনের সুযোগসহ বিভিন্ন মেয়াদে প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। প্রশাসনিক এবং দাপ্তরিক শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সম্যক ধারণা দেয়ার লক্ষ্যে জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমের বিজ্ঞানীদেরকে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। এছাড়া দক্ষ জনশক্তি গড়ার লক্ষ্যে দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ/সেমিনার/কর্মশালা অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা প্রদান করছে।
ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রজেক্ট (এনএটিপি) ফেজ-১ ও ২: ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রজেক্ট (এনএটিপি) ফেজ-১ এর মাধ্যমে ১০৮টি গবেষণা উপ-প্রকল্প নার্সভুক্ত ১২টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং ৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং ৪২টি হস্তান্তরযোগ্য প্রযুক্তি (শস্য-২২টি, প্রাণিসম্পদ-৫টি, মৎস্য-৩টি, তথ্য প্রযিুক্তি ও অন্যান্য-১২টি) উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রজেক্ট (এনএটিপি) ফেজ-২ এর মাধ্যমে মোট ১৯০টি সিআরজি ও ৩৯টি পিবিআরজি গবেষণা উপ-প্রকল্প বিভিন্ন নার্স প্রতিষ্ঠান, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
কৌলিসম্পদ সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং ব্যবহার : ক্রমবর্ধিষ্ণু জনসংখ্যা ও বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যৎ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে উচ্চ ফলনশীল, পুষ্টি সমৃদ্ধ বায়োটিক ও এবায়োটিক ঘাত সহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবন, সংরক্ষণ এবং এর যথাযথ ব্যবহার বর্তমান সময়ের অন্যতম চাহিদা। খাদ্য নিরাপত্তা বিধানে ফসলের কৌলিসম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ইতোমধ্যে দেশের ভেতরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্মানো ফসলের উত্তম স্থানীয় জাত সংগ্রহ ও মূল্যায়ন করে অনেক ফল ও সবজির জাত অবমুক্ত করা হয়েছে। তাছাড়া দেশের বাইরে থেকে প্রবর্তিত উদ্ভিদ কৌলিসম্পদ মূল্যায়ন করেও এদেশে চাষ উপযোগী অনেক ফসলের জাত অবমুক্ত করা হয়েছে। সংরক্ষিত কৌলিসম্পদকে উদ্ভিদ প্রজনন কর্মসূচিতে ব্যবহার করে ফসলের বিভিন্ন রকম গুণগত মানসমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি এসব জাতের ব্যবহার পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ইতোমধ্যে উদ্ভাবিত জিংক সমৃদ্ধ ধান, লবণাক্ততা সহনশীল ধানের জাত, ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ মিষ্টি আলু ইত্যাদি এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
ফসলের সারের মাত্রা সুপারিশমালা : নার্সভুক্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহে দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে বিভিন্ন ফসলের উপর পরিচালিত গবেষণা ফলাফল সংকলিত করে বিএআরসি কর্তৃক ঐ অঞ্চলে বিভিন্ন ফসলের সারের মাত্রা সুপারিশ করা হয়। প্রতি ৫ বছর অন্তর উক্ত সার সুপারিশমাল হালনাগাদ করে Fertilizer Recommendation Guide (FRG) প্রকাশ করা হয়। সর্বশেষ সার সুপারিশমালা FRG-2018 প্রকাশ করা হয়েছে এবং তা দেশের সকল কৃষি সম্প্রসারণ ও গবেষণায় নিয়োজিত কর্মকর্তা/বিজ্ঞানীদের মাঝে বিতরণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
শস্য বিন্যাস উদ্ভাবনের মাধ্যমে জমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি : বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণার মাধ্যমে অঞ্চল উপযোগী ফসলের স্বল্প-মেয়াদি জাত উদ্ভাবন এবং তা শস্য বিন্যাসে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে নতুন নতুন শস্য-বিন্যাসের প্রচলন করা হচ্ছে। নতুন শস্য বিন্যাস প্রযুক্তি কৃষক পর্যায়ে প্রচলনের ফলে একদিকে যেমন শস্য-নিবিড়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে জমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের মোট ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
জমির উপযোগিতা ভিত্তিক ক্রপ জোনিং ম্যাপ প্রণয়ন : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল মাটি, জলবায়ু ও এলাকা উপযোগী ফসল নির্বাচন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ক্রপ জোনিং ম্যাপ প্রণয়ন করছে। নার্স প্রতিষ্ঠান এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় বিএআরসি কর্তৃক ১৭টি ফসলের ম্যাপ তৈরির কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় অন্যান্য ফসলের ক্রপ জোনিং ম্যাপ তৈরির লক্ষ্যে ৩০০টি উপজেলায় ক্রপ জোনিং প্রকল্পের কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে।
পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার : পানিসম্পদের পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ফসল উৎপাদনের জন্য সেচ কাজে বিভিন্ন পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি নার্সভুক্ত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবন করা হয়েছে। ভূ-গর্ভস্থ পানি সেচের পরিবর্তে ভূ-উপরিস্থ পানি দ্বারা সেচ প্রদানে অধিক গুরুত্ব প্রদান, দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, ঘাটতি সেচের মাধ্যমে প্রযোজ্য এলাকায় ফসল উৎপাদন এবং পানি সাশ্রয়ী শস্য বিন্যাস অনুসরণ এবং আর্থিকভাবে লাভজনক শস্য-বিন্যাসকে সেচ ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা প্রোগ্রাম উন্নয়ন ও প্রসার : সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিষমুক্ত উচ্চমূল্য সবজি যেমন টমেটো, বেগুন, শসা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, মিষ্টিকুমড়া, ঢেঁড়স, শিম ইত্যাদি উৎপাদনের লক্ষ্যে এ ফসলগুলোর বালাই প্রতিরোধক জাত নির্বাচন এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনায় টেকসই প্যাকেজ উদ্ভাবনের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাকরণে বিএআরসি সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেছে। ফেরোমন ট্র্যাপ পদ্ধতি সবজি ফসলের পোকা ও রোগবালাই দমনে মাঠ পর্যায়ে কার্যকর প্রযুক্তি হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে এবং কৃষক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
উত্তম কৃষি পদ্ধতি ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন : নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও পুষ্টি নিরাপত্তা আমাদের নিশ্চিত করতে এসডিজির সঙ্গে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পুষ্টিসহ বহুমাত্রিক বিষয় জড়িত। তাই এসডিজি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিষমুক্ত খাদ্য উৎপাদনে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল উচ্চমূল্য ফসলের জন্য উত্তম কৃষি পদ্ধতির নীতি নির্ধারণ, বাস্তবায়ন এবং সংশ্লষ্টি অংশীজনকে প্রশিক্ষিত করার মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে কাজ করছে। এ ছাড়া মাঠ পর্যায়ে কৃষিপণ্য ও খাদ্য সংরক্ষণে ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার রোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ছে। ফসল উৎপাদনে পরিবেশ ও মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কৃষকদেরকে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব এবং জীবাণু সার প্রয়োগ করার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে।
পতিত ও লবণাক্ততা অঞ্চলে শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধি : খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে সামগ্রিক কৃষি উন্নয়ন পরিকল্পনার সাথে সরকার দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৪টি উপকূলীয় জেলাকে অন্তর্ভুক্ত করে মাস্টার প্লান প্রণয়ন করেছে। উক্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী কাউন্সিল নার্সভুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ কর্তৃক উদ্ভাবিত জাত ও প্রযুক্তিসমূহ দক্ষিণাঞ্চলসহ উপকূলীয় অঞ্চলে সম্প্রসারণের কাজ করছে। এ ছাড়া যে সমস্ত অঞ্চলে শস্য নিবিড়তা কম সেখানে শস্যের নিবিড়তা বাড়াতে গবেষণা ও সম্প্রসারণ প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি প্রকল্পের আওতায় স্বল্প সেচে বা বিনা সেচে রবি ফসল যেমন সরিষা, ছোলা, মশুর, খেসারি, মুগডাল, তিল চাষের মাধ্যমে এক বা দুফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তরের জন্য বৃহত্তর সিলেট ও বরিশাল অঞ্চলে গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
কৃষি যান্ত্রিকীকরণ : বিএআরসি কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা, ফসল সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, নার্সভুক্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমুহের বিজ্ঞানীদের দিক নির্দেশনা, পরামর্শ ও কারিগরি সহয়তা প্রদান করছে। এ ছাড়া কৃষি যন্ত্রিকীকরণ রোডম্যাপ ২০২১, ২০৩১ ও ২০৪১ প্রণয়ন করা হয়েছে। National Agricultural Technology Project (NATP)-ও এর অর্থায়নে পাহাড়ে সেচের পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অভাবনীয় উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণে ফলে কৃষি উৎপাদনে কৃষি শ্রমিকের ঘাটতি ও সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমানো সম্ভব হচ্ছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন : দেশের প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৩০ শতাংশ যোগান দেয় মাছ। ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে সকল জীবিত জলজ সম্পদের সার্বিক উন্নয়ন ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনার পাশাপাশি স্বল্প ব্যয়ে পরিবেশবান্ধব উন্নত মৎস্যচাষ এবং ব্যবস্থাপনা; প্রক্রিয়াজাতকরণ, মান নিয়ন্ত্রণ ও বিপণন ব্যবস্থার মাধ্যমে বহুবিধ মৎস্যজাত দ্রব্যাদির উন্নয়ন এবং জনপ্রিয়করণের উদ্দেশ্যে গবেষণা পরিচালনাসহ ইলিশ, চিংড়ি, কুচে মাছ, ঝিনুক, মুক্তাসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ জলজ সম্পদের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রযুক্তি উদ্ভাবন করার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
দেশের জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ গবাদি-প্রাণী ও হাঁস-মুরগি পালন ও প্রজনন কর্মসূচির আওতায় জীবিকা নির্বাহ করে। বিএআরসি দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণকল্পে দুধ, মাংস ও ডিম উৎপাদন বৃদ্ধিতে নার্স ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানে সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।
সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদন : দেশের সামুদ্রিক সম্পদ যথাযথভাবে ব্যবহারের লক্ষ্যে বিএআরসি সামুদ্রিক শৈবাল গবেষণা ও উন্নয়নের কাজ করছে। এ গবেষণার অংশ হিসেবে সামুদ্রিক শৈবালের ৭টি প্রজাতি নার্সারিতে সাফল্যজনকভাবে চাষ করা হয়েছে এবং এদের মধ্যে হিপনিয়া প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবালটি উন্মুক্ত সমুদ্রে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
কৃষিজাত পণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনা ও বাজারজাতকরণ : দেশের কৃষিজাত পণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনা ও বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি প্রকল্প এর আওতায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের আয় বৃদ্ধির জন্য বাজার ব্যবস্থা ও নির্বাচিত শস্য বাজারজাতকরণের উন্নয়নের জন্য কৃষক-বিপণন সমন্বয় ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়াস নেয়া হয়েছে। সাপ্লাই চেইন উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন সরকারি, এনজিও ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিসমূহের উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
তথ্য প্রযুক্তি ভিত্তিক কৃষি উন্নয়ন : বিএআরসি জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমভুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের কৃষি গবেষণা সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরণের তথ্য/উপাত্তের ডাটাবেইজ স্থাপন করে তথ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ জন্য ICT কে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য ইতোমধ্যে কাউন্সিলসহ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহে ICT Cell গঠন করা হয়েছে এবং এর বাস্তবায়নের জন্য কাউন্সিলে ডাটা সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কাউন্সিলে জিওগ্রাফিকাল ইনফরমেশন সিস্টেম (GIS) এর কাজ অব্যাহত আছে। এর পাশাপাশি কাউন্সিলে জলবায়ু বিষয়ক তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে যা দেশে কৃষি ক্ষেত্রে ঝুঁকি হ্রাস ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। এ ছাড়া কৃষকদেরকে মোবাইল অ্যাপস-ভিত্তিক মাঠ-পর্যায়ের কৃষি সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান প্রদান করে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানে কাজ করছে।
খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয় পদক্ষেপসমূহ
পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রেক্ষাপটে টেকসই খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিতকরণে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। বর্ধিত জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিকরণে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পরিবর্তিত কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন ও টেকসই খাদ্য উৎপাদনে নিমোক্ত বিষয়সমূহে গুরুত্বারোপ করতে হবে;
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট খরা, বন্যা, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, তাপমাত্রা এবং রোগ ও পোকা প্রতিরোধী ফসলের উচ্চফলনশীল ও পুষ্টিমান সম্পন্ন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম গ্রহণ;
দেশের বিলুপ্ত প্রায় ফসলের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রজনন কাজে ব্যবহার;
কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সুষম সার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা;
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল-ভিত্তিক লাগসই ফসল নির্বাচন, ফসল বিন্যাস নির্ধারণের মাধ্যমে শস্যর নিবিড়তা বৃদ্ধি, উন্নত ও আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের নিমিত্ত বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদন;
নার্স প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত বিভিন্ন ফসলের নতুন জাতের পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রজনন বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উন্নতমানের প্রত্যয়িত বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিতকরণ;
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সার্বিক উন্নয়নকল্পে গবেষণা ও সম্প্রসারণে বিনিয়োগ বাড়ানো;
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে উত্তম কৃষি পদ্ধতি (Good Agricultural Practices) বাস্তবায়ন;
বর্ধিত জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণে উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি গবেষণা ও মাঠ পর্যায়ে ফলনের পার্থক্য কমানো;
ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার সাশ্রয়ী পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে টেকসই খাদ্য উৎপাদন স্থিতিশীল রাখা;
সমন্বিত খামার ও বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি উন্নয়ন করা;
খাদ্যচক্রে ব্যবহৃত রাসায়নিকের ক্ষতিকর প্রভাব বিষয়ে গবেষণা এবং শিল্প উদ্যোক্তা ও ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ;
কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে উৎসাহিতকরণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার ও শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি উদ্ভাবন;
কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, সবররাহ ও মূল্য সংযোজন এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের উপর গবেষণা পরিচালনা করা এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাজার ব্যবস্থাপনার প্রসার ঘটানো;
কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বিজ্ঞানী, কর্মকর্তা, সম্প্রসারণ কর্মী ও কৃষককে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ওপর দেশে/বিদেশে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন;
কৃষিতে আইসিটি প্রয়োগ এবং গণমাধ্যম ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারের মাধ্যমে জনগণের পুষ্টি ও স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ;
উদ্ভাবিত জাত ও উৎপাদন প্রযুক্তি দ্রুত হস্তান্তর এবং গবেষণা, শিক্ষা, সম্প্রসারণ ও কৃষক সংযোগ জোরদার করন;
কৃষিপণ্যের মান নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন Accredated গবেষণা ল্যাব স্থাপন এবং কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে উদ্যোক্তা পর্যায়ে প্রণোদনা প্রদান/স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা।
দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দেশকে উন্নত করার অগ্রযাত্রা সফল করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল জাতীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সহযোগী সংস্থাসমূহকে জাতীয় কৃষি নীতিমালার ভিত্তিতে গবেষণার মান উন্নয়নে দিক-নির্দেশনা ও সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করে আসছে। কৃষি সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলা সক্ষম হবে।
ড. মো: কবির ইকরামুল হক
নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল : ০১৭১১৪৬৬৪২৪
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, সবাইকে নবান্নের শুভেচ্ছা। নবান্নের উৎসবের সাথে সমান্তরালে উৎসবমুখর থাকে বৃহত্তর কৃষি ভুবন। কেননা এ মৌসুমই কৃষির জন্য তুলনামূলক নিশ্চিত একটি মৌসুম।। তাহলে আসুন আমরা জেনে নেই অগ্রহায়ণ মাসের কৃষিতে আমাদের করণীয় কাজগুলো।
আমন ধান : এ মাসে অনেকের আমন ধান পেকে যাবে তাই রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে। ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকায় আমন ধান শতকরা ৮০ ভাগ পাকলে কেটে ফেলতে হবে। আমন ধান কাটার পরপরই জমি চাষ দিয়ে রাখতে হবে, এতে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে মাটির রস কম শুকাবে। উপকূলীয় এলাকায় রোপা আমন কাটার আগে রিলে ফসল হিসেবে খেসারি আবাদ করতে পারেন। আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে প্রথমেই সুস্থ সবল ভালো ফলন দেখে ফসল নির্বাচন করতে হবে। এরপর কেটে, মাড়াই-ঝাড়াই করার পর রোদে ভালোমতো শুকাতে হবে। শুকানো গরম ধান আবার ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হবে এবং ছায়ায় রেখে ঠা-া করতে হবে। পরিষ্কার ঠাণ্ডা ধান বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ রাখার পাত্র টিকে মাটি বা মেঝের ওপর না রেখে পাটাতনের ওপর রাখতে হবে। পোকার উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে হলে ধানের সাথে নিম, নিসিন্দা, ল্যান্টানার পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে মিশিয়ে দিতে হবে।
বোরো ধান : আগ্রহায়ণ মাস বোরো ধানের বীজতলা তৈরির উপযুক্ত সময়। রোদ পড়ে এমন উর্বর ও সেচ সুবিধাযুক্ত জমি বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হবে। চাষের আগে প্রতি বর্গমিটার জায়গার জন্য ২-৩ কেজি জৈব সার দিয়ে ভালোভাবে জমি তৈরি করতে হবে। পানি দিয়ে জমি থকথকে কাদা করে এক মিটার চওড়া এবং জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বা করে ভেজা বীজতলা তৈরি করতে হবে। যেসব এলাকায় ঠাণ্ডার প্রকোপ বেশি সেখানে শুকনো বীজতলা তৈরি করতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রতি দুই প্লটের মাঝে ২৫-৩০ সেমি. নালা রাখতে হবে। যেসব এলাকায় সেচের পানির ঘাটতি থাকে সেখানে আগাম জাত হিসেবে ব্রি ধান৪৫ এবং ব্রি ধান৫৫, ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৮১, ব্রি ধান ৮৪ ও ব্রি ধান৮৬, উর্বর জমি ও পানি ঘাটতি নাই এমন এলাকায় ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৫৮, ব্রি ধান৫৯, ব্রি ধান৬০, ব্রি ধান৬৩, ব্রি ধান ৬৪, ব্রি ধান৬৮, ব্রি ধান৭৪, ব্রি হাইব্রিড ধান২, ব্রি হাইব্রিড ধান৩ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৫, ঠাণ্ডা প্রকোপ এলাকায় ব্রি ধান৩৬, হাওর এলাকায় বিআর১৭, বিআর১৮, বিআর১৯, লবণাক্ত এলাকায় ব্রি ধান৪৭, ব্রি ধান৫৫, ব্রি ধান৬১ চাষ করতে পারেন। বীজ বপন করার আগে ৬০-৭০ ঘণ্টা জাগ দিয়ে রাখতে হবে। এ সময় ধানের অঙ্কুর গজাবে। অঙ্কুরিত বীজ বীজতলায় ছিটিয়ে বপন করতে হবে। প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ৮০-১০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
গম : অগ্রহায়ণের শুরু থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ পর্যন্ত গম বোনার উপযুক্ত সময়। এরপর গম যত দেরিতে বপন করা হবে ফলনও সে হারে কমে যাবে। দো-আঁশ মাটিতে গম ভালো হয়। অধিক ফলনের জন্য গমের আধুনিত জাত যেমন- বারি গম-২৫, বারি গম-২৬, বারি গম-২৭, বারি গম-২৮, বারি গম-২৯, বারি গম-৩০, বারি গম-৩১, বারি গম-৩২ এসব বপন করতে হবে। বীজ বপনের আগে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক দ্বারা বীজ শোধন করে নিতে হবে। গজানোর ক্ষমতা শতকরা ৮০ ভাগ বা তার বেশি হলে বিঘাপ্রতি ১৬ কেজি বীজ বপন করতে হবে। সেচসহ চাষের ক্ষেত্রে জমি তৈরির সময় প্রতি শতক জমিতে ৩০-৪০ কেজি জৈবসার, ৬০০-৭০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫৫০-৬০০ গ্রাম টিএসপি, ৪০০-৪৫০ গ্রাম এমওপি, ৪৫০-৫০০ গ্রাম জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। তিন পাতা বয়সে প্রথম সেচের পর দুপুর বেলা মাটি ভেজা থাকা অবস্থায় প্রতি শতাংশে ৩০০-৪০০ গ্রাম ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করতে হবে। উল্লেখ্য যে, সেচ ছাড়া চাষের ক্ষেত্রে সমস্ত ইউরিয়া শেষ চাষের সময় অন্যান্য সারের সাথে প্রয়োগ করতে হবে। গমে তিনবার সেচ দিলে ফলন বেশি পাওয়া যায়। বীজ বপনের ১৭-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ, ৫০-৫৫ দিনে দ্বিতীয় সেচ এবং ৭৫-৮০ দিনে ৩য় সেচ দিতে হবে।
ভুট্টা : ভুট্টা গত মাসে আবাদ না করে থাকলে এ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হবে। ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৯, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১০, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১১, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১২, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৩ এসব। এক শতাংশ জমিতে হাইব্রিড বীজ বপনের জন্য ৮০-৯০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। ভালো ফলনের জন্য সারিতে বীজ বপন করতে হবে। এক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০ সেমি. এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ২৫ সেমি. রাখতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সার প্রয়োগ করলে কম খরচে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে সাধারণভাবে হাইব্রিড ভুট্টা চাষের জন্য প্রতি শতাংশ জমিতে ইউরিয়া ২-২.২৫ কেজি, টিএসপি ৯৫০-১০০০ গ্রাম, এমওপি ৭০০-৯০০ গ্রাম, জিপসাম ৯৫০-১০০০ গ্রাম, দস্তা ৪০-৬০ গ্রাম, বরিক এসিড ২০-৩০ গ্রাম এবং ১৬-২০ কেজি জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে।
সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল : তেল ফসলের মধ্যে সরিষা অন্যতম। তাছাড়া বাদাম, সূর্যমুখী এসব আবাদ করতে পারেন। সরিষা গাছে ফুল আসলে শতাংশপ্রতি ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। উপরি সার প্রয়োগের পর হালকা একটি সেচ দিতে হবে। মাটিতে রস কমে গেলে ২০-২৫ দিন পর আবারো একটি সেচ দিতে হবে।
আলু : উপকূলীয় অঞ্চলে এ মাসেও আলু আবাদ শুরু করা যায়। অন্যান্য স্থানে রোপণকৃত আলু ফসলের যত্ন নিতে হবে। মাটির কেইল বেঁধে দিতে হবে এবং কেইলে মাটি তুলে দিতে হবে। সারের উপরিপ্রয়োগসহ প্রয়োজনীয় সেচ দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
ডাল ফসল : ডাল আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। মাঠে এখন মসুর, মুগ, মাষ, মটর, খেসারি, ছোলা, ফেলন, সয়াবিন প্রভৃতি ডাল ফসল আছে। সারের উপরিপ্রয়োগ, প্রয়োজনে সেচ, আগাছা পরিষ্কার, বালাই ব্যবস্থাপনাসহ সব ক’টি পরিচর্যা সময়মতো যথাযথভাবে করতে পারলে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যাবে।
শাকসবজি : মাঠে এখন অনেক সবজি বাড়ন্ত পর্যায়ে আছে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, মুলা এসব বড় হওয়ার সাথে সাথে চারার গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। চারার বয়স ২-৩ সপ্তাহ হলে সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সবজি ক্ষেতের আগাছা, রোগ ও পোকা-মাকড় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ ব্যবহার করতে পারেন। এতে পোকা দমনের সাথে সাথে পরিবেশও ভালো থাকবে। জমিতে প্রয়োজনে সেচ প্রদান করতে হবে। টমেটো গাছের অতিরিক্ত ডাল ভেঙে দিয়ে খুটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। ঘেরের বেড়িবাঁধে টমেটো, মিষ্টিকুমড়া চাষ করতে পারেন।
অন্যান্য রবি ফসল : মাঠে এখন মিষ্টি আলু, চীনা, কাউন, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচসহ অনেক অত্যাবশ্যকীয় ফসলের প্রাথমিক বৃদ্ধি পর্যায়। এসময় ভালোভাবে যতœ পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে আশাতীত ফলাফল বয়ে আনবে। এসব ফসলের কোনটি এখনো না লাগিয়ে থাকলে দেরি না করে চারা লাগাতে হবে। তবে এক্ষেত্রে অতিরিক্ত যত্ন নিতে হবে। এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত খরা সহনশীল ছোলা, মুগ, তিল, তিসি, যব এসব বপন করা যায়।
গাছপালা : এবারের বর্ষায় রোপণ করা ফল, ঔষধি বা বনজ গাছের যতœ নিতে হবে। গাছের গোড়ায় মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। প্রয়োজনে গাছকে খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। গাছের গোড়ায় জাবরা প্রয়োগ করলে তা পানি ধরে রাখবে। মাটিতে রসের পরিমাণ কমে গেলে গাছের গোড়ায় সেচ প্রদান করতে হবে। এ সময় গাছের বাড়বাড়তি কম হয় তাই পারত পক্ষে এখন গাছের ডালপালা কাটা ঠিক হবে না।
প্রাণিসম্পদ : হাঁস-মুরগির ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর ভালো সময় এখন। তাছাড়া সামনে শীতকাল আসছে। শীতকালে পোল্ট্রিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যায় এবং রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, বসন্ত রোগ, কলেরা এসব রোগ মহামারী আকারে দেখা দিতে পারে। এসব রোগ থেকে হাঁস-মুরগিকে বাঁচাতে হলে এ মাসেই টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ মাসে পশুখাদ্যের কোনো অভাব থাকে না। বিশেষ করে কাঁচা ঘাসের। তাই আমন ধানের খরসহ অন্যান্য খাদ্য যেমন ভুট্টা, ডাল, ঘাস দিয়ে সাইলেজ তৈরি করে ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিতে পারেন। এ সময় গবাদি পশুর ক্ষুরা রোগ, তড়কা, গলাফুলা দেখা দিতে পারে। গবাদি প্রাণীতে রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে প্রাণী চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
মৎস্যসম্পদ : মাছের খাবার হিসেবে উদ্ভিজ খাদ্য এবং প্রাণিজ খাদ্য তৈরিতে গোবড়/আবর্জনা পচা সার, রাসায়নিক সার বেশি উপযোগী। এসব পরিমাণমতো প্রয়োগ করতে হবে। জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে মৎস্যবিদদের সাথে পরামর্শ করে চুন বা তুঁতে প্রয়োগ করতে পারেন। পুকুরে রৌদ পড়া নিশ্চিত করতে পুকুর পাড়ের গাছের ডালপালা কেটে পরিষ্কার করতে হবে। পুকুরের ঢালে প্যারা, নেপিয়ার বা অন্যান্য ঘাসের চাষ করলে অতিরিক্ত ফসল পাওয়া যায় এবং কার্প জাতীয় মাছের খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া মাছ সংক্রান্ত যে কোনো পরামর্শের জন্য উপজেলা মৎস অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, সংক্ষেপে আগামী তথা অগ্রহায়ণ মাসের কৃষিকথা উপস্থাপন করা হলো। বিস্তারিত কৌশল জানার জন্য স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বা উপজেলা কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করতে হবে। এ ছাড়া কৃষি সম্পর্কিত যে কোন সমস্যার সমাধানের জন্য যে কোনো মোবাইল থেকে ১৬১২৩ নম্বরে কল করতে পারেন। মনে রাখবেন আমাদের সম্মিলিত অংশগ্রহণই নিয়ে আসবে কৃষির কাক্সিক্ষত সাফল্য।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন
তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫,মোবা : ০১৯১১০১৯৬১০, ইমেইল : ioag@ais.gov.bd
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) ফসল উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ৩টি উপকরণ যেমন-বীজ, সার ও সেচ সরবরাহ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। উপকরণ ৩টির মধ্যে বীজ অন্যতম। বিভিন্ন ফসলের গুণগত মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বিতরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে কৃষকের দোরগোড়ায় বীজ, চারা ও কলম পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে সংস্থাটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে ফলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে।
মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ কার্যক্রম : ফসল উৎপাদনে বীজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। অন্যান্য কৃষি উপকরণের কার্যকারিতা গুণগত মানসম্পন্ন বীজের উপর নির্ভরশীল। তাছাড়া কোনো ফসলের সম্ভাব্য ফলন বীজের মানের সাথে সরাসরি জড়িত। বীজ উৎপাদন ও মানসম্পন্ন বীজ কৃষকের হাতে তুলে দিতে বিএডিসি ৩৪টি ভিত্তিবীজ বর্ধন ও উৎপাদন খামারের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন করছে। এর মধ্যে দানাজাতীয় বীজ উৎপাদন খামার ২৪টি, পাটবীজ খামার ২টি, ডাল ও তৈলবীজ খামার ৪টি, সবজি বীজ খামার ২টি ও আলুবীজ খামার ২টি। ১ লাখ ৯ হাজার ৫৩১ একর কমান্ড এরিয়া নিয়ে ৭৫টি কন্ট্রাক্ট গ্রোয়ার্স জোন ও ৩৭ হাজার ৬১১ জন চুক্তিবদ্ধ কৃষক যুক্ত আছেন। ১ লাখ ৬৮ হাজার ৭০০ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ৫২টি আধুনিক বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ কেন্দ্র, ৩টি অটো সিড প্রসেসিং প্লান্ট ও ডিহিউমিডিফায়েড গুদাম এবং ঢাকায় একটি কেন্দ্রীয় বীজ পরীক্ষাগার রয়েছে। দেশব্যাপী ট্রানজিট বীজ গুদামসহ ১০০টি বীজ বিক্রয় কেন্দ্র, ৮ হাজার ৫৬ জন বীজ ডিলার নিয়ে একটি সুসংগঠিত মার্কেটিং চ্যানেল রয়েছে। বীজের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য রয়েছে অভ্যন্তরীণ মান নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১৪টি এগ্রো সার্ভিস সেন্টার ও নয়টি উদ্যান উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে। বীজ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিএডিসি কর্তৃক বাস্তবায়িত প্রকল্প, বীজ কার্যক্রম ও চুক্তিবদ্ধ চাষিদের মাধ্যমে বিগত ৯ বছরে বিভিন্ন ফসলের সর্বমোট ১২.৯০ লক্ষ মেট্রিক টন বীজ উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়েছে।
বোরো ধানবীজ সরবরাহ বৃদ্ধিকরণ : দেশের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য দানা জাতীয় ফসলের মধ্যে বোরো ধানবীজ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বিএডিসি ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে সর্বমোট ৬৬৪৯৫ মেট্রিক টন বোরো ধানবীজ কৃর্ষক পর্যায়ে সরবরাহ করেছে যা বোরো ধানবীজের চাহিদার প্রায় ৬৪%। ভিশন ২০২১ অনুযায়ী আগামী ২০২১ সাল নাগাদ বিএডিসি কৃষক পর্যয়ে ৬৯,০০০ মেট্রিক টন বোরো ধানবীজ উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
আমন ধানবীজ সরবরাহ : দেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য দানা জাতীয় ফসলের মধ্যে আমন ধানবীজ অন্যতম। বিএডিসি ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে সর্বমোট ১৭৭৯০ মেট্রিক টন আমন ধানবীজ কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করেছে। এসব বীজই উফশী জাতের। আমনে কৃষকরা মূলত নিজেদের সংরক্ষণকৃত স্থানীয় জাতের ধানবীজ ব্যবহার করে। ফলে আমনে কৃষকের কাছে বিএডিসি বীজের চাহিদা কম। তবে আশার কথা BRRI এবং BINA কর্তৃক উদ্ভাবিত উফশী জাতের ধানবীজ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। যদি BRRI এবং BINA কর্তৃক উদ্ভাবিত উফশী জাতের আমন বীজ বিএডিসি’র মাধ্যমে কৃষকদের কাছে পৌঁছানো যায় তাহলে ধান উৎপাদনে কৃষিতে একটি উল্লম্ফন ঘটবে। ভিশন ২০২১ অনুযায়ী আগামী ২০২১ সাল নাগাদ ২৮,০০০ মেট্রিক টন আমন ধানবীজ উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
আউশ ধানবীজ সরবরাহ : বিএডিসি ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে সর্বমোট ১৩২০ মেট্রিক টন আউশ ধানবীজ কৃর্ষক পর্যায়ে সরবরাহ করেছে। ভিশন ২০২১ অনুযায়ী আগামী ২০২১ সাল নাগাদ ২,৭০০ মেট্রিক টন আউশ ধানবীজ উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে সরবারাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আউশ ধান কৃষকের মাঠ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছিল। এর মূল কারণ আউশের কম উৎপাদনশীলতা। কিন্তু মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর নির্দেশে গবেষণা সংস্থা BRRI এবং BINA কর্তৃক উদ্ভাবিত আউশের উফশী জাত ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয় হয়েছে। আশা করা যায় আউশের হৃতগৌরব পুনরায় ফিরে আসবে। গত তিন বছরে উফশী আউশ ধান বীজের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
SL-8H জাতের সুপার হাইব্রিড বোরো ধানবীজ সরবরাহ বৃদ্ধিকরণ : বিএডিসি কর্তৃক ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে SL-8H জাতের ৬৫৪ মেট্রিক টন সুপার হাইব্রিড বীজ উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়েছে। কৃষক পর্যায়ে বিএডিসি’র ঝখ-৮ঐ জাতের সুপার হাইব্রিড বোরো ধানবীজ সরবরাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। SL-8H জাতের হাইব্রিড ধানবীজের হেক্টর প্রতি ফলন ১০-১২ মেট্রিক টন। এ জাতের ধান চাষে দেশে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভিশন ২০২১ অনুযায়ী আগামী ২০২১ সাল নাগাদ ১,৮০০ মেট্রিক টন SL-8H জাতের সুপার হাইব্রিড বোরো ধানবীজ উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
গমবীজ উৎপাদন ও সরবরাহ : দেশে গমের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে সর্বমোট ১৮১১১ মেট্রিক টন গম বীজ উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়েছে। ভিশন ২০২১ অনুযায়ী আগামী ২০২১ সাল নাগাদ ২৬,০০০ মেট্রিক টন গমবীজ উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ভুট্টাবীজ উৎপাদন ও সরবরাহ : বিএডিসি দেশে ভুট্টার উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে সর্বমোট ১৬ মেট্রিক টন ভুট্টাবীজ উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করেছে। ভিশন ২০২১ অনুযায়ী আগামী ২০২১ সাল নাগাদ ৩০০ মেট্রিক টন ভুট্টাবীজ উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ডাল ও তৈলবীজ উৎপাদন ও সরবরাহ : দেশের জনগণের আমিষের চাহিদা পূরণকল্পে বিএডিসি কর্তৃক ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ডাল জাতীয় ৮৩৪ মেট্রিক টন ও তৈল জাতীয় ২৩১৫ মেট্রিক টন বীজ উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে বিতরণ করা হয়েছে। ফলে দেশে ডাল ও তৈল ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া নোয়াখালী জেলার সুবর্ণচর উপজেলায় বিএডিসি কর্তৃক ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে একটি ডাল ও তৈলবীজ বর্ধন খামার স্থাপনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। উক্ত খামারের বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার চর এলাকায় একর প্রতি ডাল ও তৈল ফসলের ফলন বৃদ্ধি পাবে। ভিশন ২০২১ অনুযায়ী আগামী ২০২১ সাল নাগাদ ৩,০০০ মেট্রিক টন ডাল জাতীয় বীজ ও ২,২০০ মেট্রিক টন তৈলবীজ উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বীজআলু উৎপাদন ও সরবরাহ : বিএডিসি কর্তৃক ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৩২৬২৭ মেট্রিক টন বীজআলু উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়েছে। এতে দেশব্যাপী আলু উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ভিশন ২০২১ অনুযায়ী আগামী ২০২১ সাল নাগাদ ৪৫,০০০ মেট্রিক টন আলুবীজ উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
পাটবীজ উৎপাদন ও সরবরাহ : বিএডিসি কর্তৃক ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৭৭৫ মেট্রিক টন পাটবীজ উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়েছে। এতে দেশব্যাপী পাটবীজের আমদানি নির্ভরতা কমেছে। ভিশন ২০২১ অনুযায়ী আগামী ২০২১ সাল নাগাদ ২,৫০০ মেট্রিক টন পাটবীজ উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সবজি ও মসলাবীজ উৎপাদন ও সরবরাহ : দেশের জনগণের পুষ্টি চাহিদা পূরণকল্পে বিএডিসি কর্তৃক ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৭৭ মেট্রিক টন সবজিবীজ ও ১১০ মেট্রিক টন মসলাবীজ উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে বিতরণ করা হয়েছে। ভিশন ২০২১ অনুযায়ী আগামী ২০২১ সাল নাগাদ ২০০ মেট্রিক টন সবজিবীজ ও ২০০ মেট্রিক টন মসলাবীজ উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
উদ্যান সংক্রান্ত কার্যক্রম : বিএডিসি বিগত ২০১০-১১ হতে ২০১৬-১৭ সময়ে সমন্বিত মানসম্পন্ন উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্প, এগ্রো সার্ভিস সেন্টার কার্যক্রমের মাধ্যমে ২৫.১৩৩ লক্ষ মেট্রিক টন সবজি; ০.৩৭ লক্ষ মেট্রিক টন মসলা; ৪.৪৮ লক্ষ মেট্রিক টন ফল; ৩৯৮.৩২ লক্ষ সবজি চারা; ২০১৪.২৫৫ লক্ষ চারা/কলম ও ২৮.৬৮৫ লক্ষ নারিকেল চারা উৎপাদন ও বিতরণ করেছে। ফলে সময়ের সাথে সাথে সবজি, ফল, মসলা ইত্যাদির জাতীয় উৎপাদন বেড়েছে। কৃষক পর্যায়ে মানসম্পন্ন উদ্যান ফসলের চারা বিতরণের ফলে দেশব্যাপী উদ্যান ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে দেশের জনগণের পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে।
বিএডিসি ২০২১ সাল নাগাদ বিভিন্ন ফসলের ১,৮০,৯০০ মেট্রিক টন মানস¤পন্ন বীজ কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
মো: মাহমুদ হোসেন
বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো প্রতিবছর ১৬ অক্টোবর তারিখে “বিশ^ খাদ্য দিবস” আন্তরিকতা ও গুরুত্বের সাথে পালন করে। এবারের প্রতিপাদ্য “কর্ম গড়ে ভবিষ্যৎ, কর্মই গড়বে ২০৩০-এ ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব ”(Our actions are our future. A#zero hunger world by 2030 is possible) । অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়তে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের অন্যান্য সেক্টরের তুলনায় কৃষি সেক্টর এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এসডিজি ((SDG)’সহ ভিশন ২০২১ ও ২০৪১ অর্জনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র নেতৃত্বে এবং মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী’র, নিরলস প্রচেষ্টায় দেশ ইতোমধ্যেই দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এর পাশাপাশি, বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনের চতুর্থ, সবজি উৎপাদনে তৃতীয় ও ফল উৎপাদনে হার বিবেচনায় সপ্তম অবস্থানে রয়েছে। এক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয়াধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভূমিকা অগ্রগণ্য।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) কৃষি মন্ত্রণালয়াধীন দেশের সর্ববৃহৎ কৃষি সম্প্রসারণ সেবা প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে দেশের কৃষির উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সংস্থাটি ২০০টিরও বেশি ফসলের উৎপাদন, দলভিত্তিক সম্প্রসারণ সেবা প্রদান, সেচ ব্যবস্থাপনা, বীজ ব্যবস্থাপনা, ফসল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, মানসম্পন্ন কৃষি উপকরণ সহজলভ্যকরণ ও বিপণন প্রযুক্তির সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন দুর্যোগে কৃষকের পাশে থেকে সেবা প্রদানের মাধ্যমে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং গ্রামীণ আর্থসামাজিক উন্নয়নে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। প্রতিবছর কৃষি আবাদী জমি কমে গেলেও আধুনিক ও লাগসই কৃষি প্রযুক্তিসমূহের কার্যকরী সম্প্রসারণের কারণে আমাদের দানাদার খাদ্যশস্যের উৎপাদন এখন ৪ কোটি মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে এবং যা ক্রমান্বয়ে আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। উল্লেখ্য, স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭১ সালে দেশের মোট দানাদার ফসল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। অথচ, বিগত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে সর্বমোট ৪১৩.২৫ লক্ষ মেট্রিক টন দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয় এবং যা ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল ৩২৮.৯৫ লক্ষ মেট্রিক টন। শুধু খাদ্যশস্যই নয়, অন্যান্য শস্য উৎপাদনের পরিমাণও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিগত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উৎপাদিত আলুর পরিমাণ ছিল ১০৩.১৭ লক্ষ মেট্রিক টন, যা ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল মাত্র ৫২.৬৮ লক্ষ মেট্রিক টন। এছাড়া বর্তমানে দেশের ফসল আবাদের নিবিড়তা বৃদ্ধি পেয়ে ২১৫% হয়েছে, যা ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল ১৭৯%।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মাঠ ফসলের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় বিভিন্ন ফসলের এলাকাভিত্তিক অভিযোজন কলাকৌশল মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ করছে। এছাড়াও ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি ও মসলা চাষ সম্প্রসারণ করে সবজি ও মসলা উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রচলিত কৃষির পাশাপাশি উচ্চ মূল্যের সবজি চাষ এবং অপ্রচলিত ও ট্রপিক্যাল অঞ্চলের বিদেশি ফল-মূল জনপ্রিয় করাসহ এর উৎপাদন বৃদ্ধিতেও ডিএই’র অনন্য অবদান রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে সেচ কাজে ভূ-উপরিস্থ ও ভূ-গর্ভস্থ পানির সুসমন্বিত ও সুপরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিতকরণে ডিএই’র প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৬৬.১০ লক্ষ হেক্টর হয়েছে, যা বিগত ২০১১-১২ অর্থবছরে ছিল ৫৩.২২ লক্ষ হেক্টর। সংস্থাটির বিভিন্ন উদ্যোগ ও কার্যক্রমের ফলে বর্তমানে দেশের কৃষি জমি চাষাবাদের ক্ষেত্রে প্রায় ৯৫% যান্ত্রিকীকরণ সম্ভব হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিশেষ কর্মসূচির আওতায় কৃষিযন্ত্র ক্রয়ে ৫০-৭০ শতাংশ উন্নয়ন সহায়তা (ভর্তুকি) প্রদান করা হচ্ছে।
সংস্থাটি ইতোমধ্যেই ২,০৫,৯৯,৮৬৯ জন কৃষকের মধ্যে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড বিতরণ করেছে এবং দেশের কৃষকগণের মাঝে নতুন নতুন প্রযুক্তি সম্প্রসারণ ও আপদকালীন কৃষি সহায়তা প্রদানে ডিএই নিয়মিত প্রণোদনা ও পুনর্বাসন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। রাজস্ব অর্থায়নে নতুন জাত ও প্রযুক্তি দ্রুত কৃষক পর্যায়ে হস্তান্তরের লক্ষ্যে রাজস্ব অর্থের আওতায় ফসলের উন্নত জাত ও প্রযুক্তি প্রদর্শনী স্থাপনের জন্য ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রায় ৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়। দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে কৃষি পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। বন্যার ক্ষয়ক্ষতির কারণে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সহায়তার লক্ষ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬১ জেলায় ৫,৪১,২০১ জন কৃষকের মাঝে প্রায় ৫৮.৭৬ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রণীত রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ বাস্তবায়নে কৃষি উন্নয়নে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন ও গ্রামীণ উন্নয়নের পাশাপাশি দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য প্রতিটি মানুষকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে। দেশের কৃষি সেক্টরের উন্নয়নের মাধ্যমেই গ্রামীণ আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের কর্মসংস্থানও পূর্বের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্লেখ্য, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় একটি ঝুঁকি অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন এবং আধুনিকায়ন। এতে প্রতিবছর বেশকিছু কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে। কর্মসংস্থানের অভাবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বিরাট একটি অংশ বিদেশে পাড়ি জমানোর পাশাপাশি গ্রামাঞ্চল ছেড়ে শহরমুখী হয়ে পড়ছে। অথচ গ্রামীণ উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও গ্রামীণ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে এ ধরনের অভিবাসন রোধ করাসহ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর শহরমুখী প্রবণতাকেও রোধ করা সম্ভব। সে লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষি উন্নয়নে কর্মদক্ষতা বাড়ানোর বিভিন্ন সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।
যেহেতু কৃষি প্রধান বংলাদেশের শ্রমশক্তির প্রায় ৪৭ শতাংশ এখনও কৃষির ওপর নির্ভরশীল এবং এই শ্রমশক্তির সিংহভাগই প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চলে বিস্তৃত, তাই দেশের অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়নে গ্রামীণ শ্রমশক্তির আর্থসামাজিক উন্নয়ন অত্যাবশ্যক। সে লক্ষ্যে গ্রামীণ উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে এবং দেশের অভ্যন্তরে বহুমুখী কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে ডিএই নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিগত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি কৃষকের মাঝে পৌঁছে দেয়া ও কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়াসে ডিএই এডিপির আওতায় ২৩টি এবং এডিপিবহির্ভূত একটিসহ মোট ২৪টি প্রকল্প সফলতার সাথে বাস্তবায়ন করেছে। এ প্রকল্পগুলোর মধ্যে বেশ কিছু প্রকল্প প্রত্যক্ষভাবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে যার ফলে গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর একটি অংশের শহরমুখী প্রবণতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।
আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির (SDG) ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা ২ (ক্ষুধামুক্তিঃ ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন এবং টেকসই কৃষির প্রসার) অর্জনে বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর লিড এজেন্সি হিসেবে কাজ করছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের এসডিজি বাস্তবায়ন বিষয়ক Action Plan-এ ১৭৪টি উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে ডিএই’র ৫৮টি প্রকল্প সন্নিবেশিত হয়েছে। এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে আমরা অচিরেই ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হবো । এজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ইতোমধ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ও লক্ষ্যমাত্রা প্রণয়নসহ তা বাস্তবায়ন করছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কর্মপরিকল্পনাসমূহ হলো-
কৃষি সম্প্রসারণে আইসিটি ও নতুন নতুন উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া ব্যবহারেও সংস্থাটি অগ্রনী ভূমিকা পালন করছে। উল্লেখ্য, ইতোমধ্যেই ডিএই’র সহায়তায় “কৃষি বাতায়নে” প্রায় ৮০ লক্ষ কৃষকের তথ্যাদি সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এছাড়া, ফসলের সমস্যার সমাধানকল্পে সংস্থা কর্তৃক উদ্ভাবিত “কৃষকের জানালা”, “কৃষকের ডিজিটাল ঠিকানা”, “ডিজিটাল বালাইনাশক নির্দেশিকা” প্রভৃতি উদ্যোগ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমাদৃত ও পুরস্কৃত হয়েছে। কৃষিতে অর্জিত সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে এবং লাগসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ কৃষকের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নিরলস প্রচেষ্টা অব্যহত থাকবে।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মহসীন
মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭০০৭১৫০০০, dg@dae.gov.bd
পাট পাতা সবজি ও ঔষধি হিসেবে ২০৩০-এ দেশের মানুষের পুষ্টি ও স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে
(কর্ম গড়ে ভবিষ্যৎ, কর্মই গড়বে ২০৩০-এ ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব)
পাটের ব্যবহারিক উপযোগিতা, অর্থনৈতিক গুরুত্ব ইত্যাদি বিবেচনা করে পাটকে “সোনালী আঁশ” বলে অভিহিত করা হয়। পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। আট থেকে দশ মিলিয়ন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাট ও এ জাতীয় আঁশ ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বাংলাদেশে ৯০ দশকে পাট হতো ১২ লক্ষ হেক্টর জমিতে। মাঝে প্রায় ৩০-৪০ বৎসর পাটের এলাকা কমতে কমতে ৪.০-৪.৫ লক্ষ হেক্টরে নেমে যায়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে প্রাকৃতিক আঁশের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধির সাথে সাথে গত ২০১০-২০১৫ সাল পর্যন্ত এর বৃদ্ধি প্রায় ৭-৮ লক্ষ হেক্টরে পৌঁছে গেছে। শুধু তাই নয় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে পূর্বের ১২ লক্ষ হেক্টর এলাকা থেকে যে পরিমাণ পাট পাওয়া যেতো এখন ৭.০-৮.০ লক্ষ হেক্টর জমি থেকেই তার চেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে তখন ১২ লক্ষ হেক্টর থেকে প্রায় ৬০-৬৫ লক্ষ বেল পাট পাওয়া যেতো আর সম্প্রতিকালে মাত্র ৭.০-৮.০ লক্ষ হেক্টর জমিতেই প্রায় ৮৪ লক্ষ বেল পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে পাটের গড় ফলন হেক্টর প্রতি প্রায় ২.০৪ টন। বাংলাদেশে বছরে উৎপাদিত পাট আঁশের শতকরা প্রায় ৫১ ভাগ ভারী পাট কলগুলোতে ব্যবহৃত হয়, প্রায় ৪৪ ভাগ কাঁচা পাট বিদেশে রপ্তানি হয় এবং মাত্র ৫ ভাগ দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবহারে কাজে লাগে। এ ফসল নিজেই মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্ধিত জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটাতে অধিক পরিমাণ উর্বর জমি খাদ্য-শস্য চাষের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়, পাটের উর্বর আবাদি জমির পরিমাণ কম এবং ক্রমাগত প্রান্তিক ও অনুর্বর জমিতে পাট আবাদ স্থানান্তরিত হলেও জাতীয় গড় উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এর প্রধান কারণ পাট চাষে বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত আধুনিক প্রযুক্তি যেমন উচ্চফলনশীল জাত এবং উৎপাদন কলাকৌশলের ব্যবহার। বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় শতকরা ১০-১২ ভাগ পাট চাষ এবং পাটশিল্প যেমন প্রক্রিয়াকরণ, আঁশ বাঁধাই, গুদামজাতকরণ, স্থানান্তর ও বিপণন ইত্যাদি কাজের সাথে জড়িত।
এ ছাড়াও কাঁচা পাট ও পাট জাত দ্রব্য বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষেত্রে রাজস্ব আয়ের একটি বড় উৎস। পাট ফসল দেশের কর্মসংস্থানে, গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বিস্তৃত ভাবে বিরাট সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। মোট কর্মসংস্থানের শতকরা প্রায় ১০ ভাগ পাট চাষ এবং চাষ পরবর্তী বিভিন্ন প্রক্রিয়া যেমন- পাট চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, আঁশ বাঁধাই, গুদামজাতকরণ, স্থানান্তর ও বিপণন ইত্যাদি কাজের সাথে জড়িত। বিশেষ করে পাটের আঁশ পচার পর আঁশ ছাড়ানো, ধোয়া ও শুকানো ইত্যাদি কাজে কৃষক পরিবারের মহিলা সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি দেশের মহিলা কর্মসংস্থানের এক বিরল উদাহরণ। পাটের আঁশ বিক্রির টাকা গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখে, গ্রামীণ জনপদে সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও পরবর্তী রবি শস্য চাষের আর্থিক মোকাবেলা করার সাহায্য করে থাকে এই পাট চাষ।
দরি, ছালা, ব্যাগ, বস্তা, কার্পেট, কাপড় ইত্যাদি বিভিন্ন ব্যবহার্য্য দ্রবাদি তৈরিতে ব্যবহৃত একটি উদ্ভিদ জাত আঁশ হিসেবেই পাটের বহুল পরিচিতি। কিন্তু একথা স্পষ্টই প্রমাণ পাওয়া যায়, প্রাচীন কালে সবজি ও ওষুধ হিসেবেই প্রথম পাটের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ভেষজ হিসেবে পাটের পাতার ব্যবহার প্রাচীন কাল থেকে হয়ে আসছে। পাট পাতার রস রক্ত পিত্তনাশক, বাত নিরোধক, ক্ষুধাবৃদ্ধি কারক, আমাশয়, উদারাময় ও অম্লরোগের মহৌষধ। শুকনোপাতা গুঁড়া করে পানির সাথে মিশিয়ে রোগ মুক্তির জন্য এবং কাঁচা পাতা শাক হিসেবে বহু কাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আমাদের দেশের একটা বিরাট অংশে পাটের দেশি ও তোষা পাটের চাষ হয়। তাছাড়াও দেশের চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলে এবং মিসর, আরব ও প্যালেস্টাইনে বাগানের সবজি হিসেবে পাট চাষের প্রচলন আছে। “সেই রমনী ভাগ্যবতী, যিনি প্রত্যহ স্বামীকে গরম ভাতের সাথে ঘি, মাছের ঝোল ও পাট শাক সহযোগে আহার্য্য পরিবেশন করেন”। এ যুগের রমনীদের বেলায় এ কথা কতটুকু পালনীয় সেদিকে দৃষ্টি না দিলেও, এ কথা বিশ্বাস অবশ্যই করতে হবে যে, প্রাচীন বাংলায় পাটশাকের জনপ্রিয়তা ও আভিজাত্যের উপস্থিতি ছিল। পাট শাক ব্যাপক পুষ্টিগুণ ও বিভিন্ন ঔষুধিগুণে গুণান্নিত। নিম্নে পাট ফসল চাষের গুরুত্ব বোঝাতে দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার একটি চিত্র দেখানো হলো যাহা খন্দকার ও অন্যান্য, (১৯৯৫) -দের গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত।
বাংলাদেশে পাট ফসল চাষের গুরুত্ব
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে পাট আঁশ ফসল হিসাবে চাষ হয়ে আসছে। পৃথিবীতে খুবই কম দেশে পাট আবাদ করা সম্ভব। সেই দিক বিবেচনায় পাট বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ। বর্তমান বিশ্বে প্রাকৃতিক আঁশের কদর বাড়ছে। মানুষ বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে কৃত্রিম আঁশের বিষাক্ত থাবা কতটা ভয়ংকর। পাট আঁশ বিক্রির টাকা দিয়ে খাদ্য শস্য ক্রয় করা অস্বাভাবিক হবে না। তাছাড়া খাদ্য শস্য উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উৎস হলো মাটি এবং মাটিতে ফসলের খাদ্য উৎপাদনে পরিমাণ বা মাটির উর্বরতা। সার ব্যবহারের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। কিন্তু বৎসরের পর বৎসর অজৈব রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে দেশের মাটির স্বাস্থ্য এখন খুবই নাজুক। বিশ্ব এখন পুনরায় জৈব সারের কথা ভাবছে দুই কারণে। এক হলো জনস্বাস্থ্য ও অপরটি পরিবেশ তথা মাটির স্বাস্থ্য। বাংলাদেশের কৃষক মাঠ ফসল হিসাবে পাট চাষ করে। ফসল কর্তনের পর পাটের মূল জমিতে থেকে যায়। তাছাড়া পাট ফসলের জীবনকালে ব্যাপকভাবে জমিতে পাতা পড়ে। জমিতে থাকা মূলে ও পাতা পচে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি হয়। তাছাড়া পাট চাষে ব্যবহৃত সারের কিছু অংশ জমিতে অব্যবহৃত থেকে যায়। ইত্যাদি বহুবিধভাবে পাটের জমি জৈব পদার্থে ভরপুর থাকে। যা পরবর্তী ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে খুবই কাজে লাগে। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে শস্যক্রমে পাট আছে। তাই বাংলাদেশের গরিব কৃষক এ পর্যন্ত জমির ফসলহানির হাতে বাঁধা পড়েনি। পাটের শস্যক্রমগুলো বিবেচনা করলে দেখা যায়, পাট-রোপা আমন-গম, পাট-রোপা আমন-আলু, পাট-রোপা আমন-রবিশস্য, পাট-পতিত-মরিচ/সরিষা/গোলআলু, পাট-মুগ-গম+মসুর, পাট-রোপা আমন-খেসারি ইত্যাদি বহু অঞ্চল ভিত্তিক ফসলের প্রয়োজন ভিত্তিক শস্যক্রম বাংলাদেশের কৃষক পরিচালনা করে আসছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, যে জমির শস্যক্রমে পূর্বে ফসল পাট থাকে, সে জমির যে কোনো পরবর্তী খাদ্য শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
পাটের পাতার পুষ্টিগুণ
পাটের পাতার পুষ্টিগুণ খুবই অবাক হওয়ার মতো। তবে সহজলভ্য ও সস্তা হওয়ার ফলে এর পুষ্টিগুণ সম্পর্কে আমরা সচেতন নই। বাজারে বহু শাক পাওয়া যায়। যেমন- পুঁইশাক, পালংশাক, ডাঁটাশাক, কচুশাক, মুলাশাক ইত্যাদি। এ সকল শাকের মধ্যে পালংশাক আমাদের কাছে বহুল পরিচিত, পুষ্টিকর, মূল্যবান ও প্রিয় শাক। এই পালংশাকের সাথে পাট শাকের পুষ্টিমানের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে পাট শাকের পুষ্টিমানের গুরুত্বের বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
পালংশাক ও পাটশাকের মধ্যে কিছু পুষ্টিমানের তুলনা (প্রতিটির ১০০ গ্রাম ওজনের ভিত্তিতে)
নিচে ছকের মাধ্যমে তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে পাট শাকের পুষ্টিমান খুবই উন্নত। অন্যান্য শাকের তুলনায় পাট পাতায় প্রচুর পরিমাণে শক্তি, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ক্যারোটিন ও ভিটানিম-সি বিদ্যমান। অতএব সবজি হিসাবে পুষ্টিহীনতায় পাট পাতার ব্যবহারের গুরুত্ব অপরিসীম।
পাটপাতার সবজি ও ঔষধি ব্যবহার পুষ্টি ও স্বাস্থ্য রক্ষায় ভবিষ্যৎ (২০৩০-এ) সম্ভাবনা
আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের বড় চাষিরা পাটের মৌসুমে জমিতে আন্তঃপরিচর্যার জন্য যে শত শত শ্রমিক নিয়োগ করে, চাষিদের পক্ষ থেকে তাদের নগদ টাকা ও এক বেলা বা দু বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এই বিপুল পরিমাণ শ্রমিকের সকাল বা দুপুরের খাবার দেওয়া হয় ভাতের সাথে পাটশাক, ডাল, মরিচ এবং কখনো কখনো অন্য কোনো একটি তরকারী। এ ক্ষেত্রেও প্রচুর পরিমাণে পাটশাক সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তা ছাড়া বর্তমানে একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে শহর অঞ্চলের বড় বড় কাঁচাবাজারগুলোতে পাটের শাক প্রায় বছরের সব সময়ই পাওয়া যায় এবং বহুলভাবে কেনা বেচা হয়।
পাট মৌসুমে বাংলাদেশে দেশি ও তোষা উভয় জাতের পাটের পাতাই সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পাট ফসলের আন্তঃপরিচর্যার সময় বীজ বপনের পর ২০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে ২ অথবা ৩ বার গাছ পাতলা করণের মাধ্যমে সাধারণত এই কচি পাট পাতা সংগ্রহ করা হয়। বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কারণেই পাটের গাছের সংখ্যার চাইতে জমিতে অতিরিক্ত বীজ বপন করা হয়। প্রায় ৫ থেকে ১০ লক্ষ কচি পাট গাছ এইভাবে পাট ফসলের জমিতে থেকে পাতলাকরণের মধ্যমে সরিয়ে ফেলা হয়। এই ভাবে ১ হাজার থেকে ২ হাজার কেজি সবুজ পাতা যাহা ২০০ থেকে ৪০০ কেজি শুকনা পাতার সমপরিমাণ হয়। এইভাবে সংগৃহীত পাট পাতা সারা দেশে সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একটি গবেষণার তথ্যে উল্লেখ পাওয়া যায়, এক হেক্টর পাটের জমি থেকে ১২০ দিনে ৩.৫ থেকে ৫.০ টন কাচা পাতা উৎপাদিত হয়। সে হিসেবে সারা দেশে বছরের ১২০ দিনের ৮ লক্ষ হেক্টর পাট ফসলের জমি থেকে মোট প্রায় ২৮-৪০ লক্ষ টন পাতা উৎপাদন সম্ভব। যেখানে বাংলাদেশে ভাত হলো আমাদের প্রধান খাদ্য, সেখানে পাট পাতা শাক হিসেবে, স্যুপ হিসেবে, ভেজিটেবল চপ এবং ভাজা পাতা হিসেবে খাওয়ার প্রচলন তৈরি করা খুবই সহজ এবং গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ জমি সবজি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এই সবজি উপাদনের বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। যেমন- জমির প্রাপ্যতা, প্রযুক্তির অভাব, খারাপ মানের বীজ, খারাপ আবহাওয়া, পোকা মাকড়ের আক্রমণ, কর্তন পরবর্তীতে উৎপাদিত ফসল নষ্ট হওয়া এবং বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে সঠিক মূল্য না পাওয়া ইত্যাদি। তবে এত কিছু সমস্যার মাঝেও পাট পাতার উৎপাদনে তেমন কোনো সমস্যা নেই। যদিও পাট গ্রীষ্মের ফসল তবে বছরের যে কোনো সময় সবজি হিসেবে পাট পাতার উৎপাদন করা সম্ভব। তা ছাড়া যে কোনো সময়ে উৎপাদিত পাতা শুকিয়ে সংরক্ষণ করলে বছরের যে কোনো সময় চাহিদা মতো সবজি বা ঔষধি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তাছাড়া জাপানি ব্যবহারকারীদের কাছে গাড় সবুজ রং-এর শুকনা পাট পাতা খুবই পছন্দনীয়। অতএব, আগামীতে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে পাট পাতার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।
দেশের কৃষকের নগদ অর্থ উপার্জনে, কর্মসংস্থানে, দারিদ্র্য বিমোচনে, বৈদেশিক অর্থ আহরণে ও সর্বোপরি জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তভাবে বিনির্মাণে পাটের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির নানা পরিবর্তনের ফলে, বাংলাদেশের পাটখাত নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সকল চিন্তা, চেতনা এবং উদ্যোগ হয়তো এখনি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না, তবে একথা অনস¦ীকার্য যে, পাটখাত নিয়ে বঙ্গবন্ধুর গঠনমূলক কল্যাণচিন্তা সর্বদাই আমাদের পথপ্রদর্শক বা নীতিনির্ধারক হয়ে থাকবে। উপরোক্ত বিষয়গুলো অনুধাবন করে পরিকল্পিতভাবে উদ্দোগ গ্রহণ করা গেলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে জাপান এবং অন্যান্য দেশে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় পাট পাতাকে সহজেই অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে এবং সাথে সাথে বাংলাদেশকে ২০৩০ সালে ক্ষুধা মুক্ত তথা স্বাস্থ্য রক্ষা ও পুষ্টিহীনতার সমস্যা থেকে মুক্ত করার প্রয়াশ পাওয়া অবশ্যই সম্ভব।
কৃষিবিদ ড. মো. মাহবুবুল ইসলাম
মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রধান কৃষিতত্ত্ব¡ বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল-০১৫৫২৪১৬৫৩৭
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ। এটি কৃষিনির্ভর দেশ হিসেবেও বিশ্বখ্যাত। গ্রাম প্রধান এ দেশ অন্তত ৬৮ হাজার গ্রাম নিয়ে গঠিত। এ দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ এবং শ্রমশক্তি ৬০ ভাগ কৃষি কাজে নিয়োজিত। ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশের কথা বলতে গেলে গ্রামের উন্নয়নের কথা প্রথমে আসে। আর এ জন্য প্রয়োজন কৃষি উন্নয়ন, কৃষিভিত্তিক শিল্প, বাণিজ্য ও সেবা খাতের উন্নয়ন। এ দেশের অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ খাত কৃষি। এখনো দেশের বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রধান পেশা কৃষি এবং অধিকাংশ জনগণই জীবন-জীবিকা ও কর্মসংস্থানের জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল। কাজেই কৃষিভিক্তিক শিল্পে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও প্রণোদনা আমাদের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে যেমন কাক্সিক্ষত সাড়া জাগাতে পারে তেমনি জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-২০৩০ এর অন্যতম অভীষ্ট ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে।
বিশ্ব ক্ষুধা সূচক বা গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (জিএইচআই)-২০১৭ রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা এবং অপুষ্টির মাত্রা ২০০০ সালে যা ছিল, তার চেয়ে ২৭ শতাংশ কমেছে। বিগত ২০১৭ সালে গড় বিশ্ব ক্ষুধা সূচক বা জিএইচআই স্কোর ২১.৮-এ নেমে এসেছে, যা ২০০০ সালে ছিল ২৯.৯%। একই জরিপ অনুযায়ী, ১১৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ২৬ দশমিক ৫০ স্কোর নিয়ে ৮৮তম অবস্থানে আছে। গত ২০০০ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৩৭ দশমিক ৬ এবং ২০০৫ সালে তা ছিল ৩২ দশমিক ২। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, ক্ষুধা বলতে সাধারণত খাদ্যের অভাব, অপুষ্টি এবং একজন লোকের স্বাভাবিক দৈহিক কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য যে পরিমাণ ক্যালরির দরকার, তার চেয়ে কম শক্তির জোগান দেয় এমন খাদ্যগ্রহণকে বোঝানো হয়। ভৌগোলিক এলাকাভেদে ক্যালরি গ্রহণের চাহিদার পার্থক্য হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় প্রধান উপাদান ভাত। অর্থাৎ মানুষের ক্যালরি চাহিদার সিংহভাগ আসে ভাত থেকে। দেশে জনপ্রতি চালের চাহিদা ১৪৫ কেজি/বছর। এছাড়া চালজাত বিবিধ রকমের খাদ্য উপাদানতো রয়েছেই। সুতরাং এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গঠনে ধানের ভূমিকা অপরিসীম।
ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে ধানভিত্তিক খামার ব্যবস্থা দেশব্যাপী ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করতে ধানভিত্তিক কৃষির বিকল্প নেই। বহির্বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে ধান চাষে আধুনিক জাত এবং প্রযুক্তির বিস্তার ও ব্যবহার বাড়াতে পারলে আমাদের পক্ষেও বিদেশের তুলনায় দেশেই বেশি আয় করা সম্ভব। বীজ সরবরাহ, সার-সেচে ভর্তুকিসহ বহুমুখী সরকারি প্রণোদনার কারণে এখন ধান চাষ আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় লাভজনক। দেশের বাজারে এখন এক মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায়। বর্তমানে এক কেজি মোটা চালের দাম ৪০-৫০ টাকা। সরু চাল বিক্রি হচ্ছে প্রকারভেদে কেজিপ্রতি ৬০ থেকে ১০০ টাকায়। ফলে ধান উৎপাদন এখন আর অলাভজনক নয়। আগে যেখানে হেক্টরপ্রতি ধানের গড় উৎপাদন ছিল ২ থেকে ২.৫ টন এখন নতুন নতুন জাত ও প্রযুক্তির কারণে তা ৩.৫ থেকে ৭.০ টনে দাঁড়িয়েছে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে উদ্ভাবন করা হয়েছে উচ্চফলনশীল ধানের একাধিক জাত ও লাভজনক শস্যক্রম। যেমন- স্বল্প জীবনকালের খরা সহনশীল ব্রি ধান৫৬/খরা পরিহারকারী ব্রি ধান৫৭ এবং জিংক সমৃদ্ধ ব্রি ধান৬২ চাষ করে বৃষ্টিনির্ভর বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে বিনা সেচে ছোলা এবং মসুর চাষ করা যায় এমন একটি অধিক লাভজনক শস্যবিন্যাস উদ্ভাবন করেছেন ব্রি’র বিজ্ঞানীরা। এ শস্য বিন্যাস অবলম্বন করে জমির উৎপাদনশীলতা ১৮-৩২ শতাংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব (আরএফএস বিভাগ, ব্রি)। একইভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্রি উদ্ভাবিত বিভিন্ন সময়োপযোগী উন্নত ধানের জাত চাষাবাদ করে কৃষক যেমন নিজে স্বাবলম্বী হতে পারে তেমনি ধানভিত্তিক কৃষি খামার ব্যবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে বহু মানুষের কর্মসংস্থানও নিশ্চিত করতে পারে।
অধিকন্তু বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এমন কিছু ধান জাত উদ্ভাবন করেছে যেগুলো সুগন্ধি, প্রিমিয়াম কোয়ালিটি, উন্নত পুষ্টি ও ঔষধি গুণসম্পন্ন। এসব ধান জাতের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে বিনিয়োগ করেও লাভজনক খামার ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। যেমন- ব্রি উদ্ভাবিত বিআর৫, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬৩ ও ব্রি ধান৭০, ব্রি ধান৭৫, ব্রি ধান৮০ প্রিমিয়াম কোয়ালিটি সম্পন্ন জাত। বিআর১৬, ব্রি ধান৪৬ ও ব্রি ধান৬৯ লো-গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (লো-জিআই) গুণসম্পন্ন জাত, এসব জাতের চালের ভাত ডায়াবেটিক রোগীরা নিরাপদে খেতে পারেন। ব্রি উদ্ভাবিত জিংক সমৃদ্ধ চারটি ধানের জাত ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৬৪, ব্রি ধান৭২ এবং ব্রি ধান৭৪। এসব বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জাতগুলোর ভোক্তা চাহিদা যেমন বেশি, বাজারমূল্যও অধিক। তাই ধানভিত্তিক খামার বিন্যাসে এ জাতগুলো উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ কর্মসংস্থানের অন্যতম উপায় হতে পারে। এ খাতে বর্ধিত হারে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগকৃত পুঁজি লাভসহ তুলে আনা সম্ভব।
মঙ্গা তাড়ানো ধান ও শস্যক্রম : উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় আশ্বিন-কার্তিক মাসে গ্রামাঞ্চলে কৃষকের ঘরে খাবার ও কৃষি শ্রমিকদের হাতে কাজ থাকে না। কাজ না থাকায় হাজার হাজার শ্রমিক ও কর্মজীবী মানুষ খেয়ে না খেয়ে দিন যাপন করে। এ সময় অভাবী মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য দেশের বিভিন্ন জেলায় কাজের সন্ধানে ছুটে যায়। কেউ কেউ নিছক জীবন ধারণের জন্য আগাম শ্রম বিক্রিসহ বাড়ির হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, গাছপালা বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এসব কথা চিন্তা করেই বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট রংপুরে আশ্বিন-কার্তিক মাসে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কৃষকদের মাঝে স্বল্পমেয়াদি ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৬২-আগাম আলু-মুগ-ব্রি ধান৪৮ অধিক লাভজনক ধানভিত্তিক চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে তা কৃষক পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। আর এ ধান রোপণের মাত্র ১০০-১১০ দিনের মধ্যে পেকে যায়। যেখানে অন্যান্য জাতের ধান পাকতে সময় লাগে ১৪০-১৫০ দিন। অল্প সময়ে পাকে বলেই গ্রামাঞ্চলের চাষিরা এর নাম দিয়েছেন মঙ্গা তাড়ানো ধান। স্বল্পমেয়াদি এসব আগাম ধান কাটার পর ওই জমিতে আগাম আলু, ভুট্টা চাষাবাদ করা যায়। এতে মঙ্গা থেকে বাঁচা যায়। তেমনি আগাম আলু করে লাভবান হওয়া যায়। তাই বর্তমানে কৃষকরা এসব ধান চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। এ ছাড়া আশ্বিন-কার্তিক মাসে ফসল ঘরে উঠলে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। কৃষকরা ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় এবং গো-খাদ্যের চাহিদা পূরণ হয়।
কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহারে বাড়বে কর্মসংস্থান : বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত দেশের কৃষকদের ব্যবহার উপযোগী ৩২টি কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করেছেন এবং শ্রমিক সংকট মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত ৬০ শতাংশ ভর্তুকিতে কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষক পর্যায়ে বিতরণ করছেন। চারা রোপণ, আগাছা নিধন থেকে ধান কাটা ও মাড়াই সব কিছুতেই লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। সরকার ঘোষিত ৬০ শতাংশ ভর্তুকিতে কেনা একটি রাইস টান্সপ্লান্টার বা কম্বাইন হার্ভেস্টার স্ব-কর্মসংস্থানের অন্যতম উপায় হতে পারে। এছাড়া যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বর্তমানে কৃষকরা লাভবান হতে পারেন সেগুলোর মধ্যে আছে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, চারা রোপণ যন্ত্র বা ট্রান্সপ্লান্টার, রোটারি টিলার, ধান-গম কাটার যন্ত্র, ধান-গম মাড়াই যন্ত্র, কম্বাইন হারভেস্টার ও আগাছা দমন যন্ত্র বা উইডার ইত্যাদি। কৃষকরা এসব যন্ত্র নিজেরা ব্যবহারের পাশাপাশি ভাড়া দিয়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতেও অন্যদের এসব সেবা প্রদান করে লাভবান হতে পারেন। সর্বোপরি, প্রতিটি কৃষক দেশের বীজ ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের ফসল ও বীজ উৎপাদনের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদন খরচ কমাতে সক্ষম হবেন। কৃষকের হাতে নিজেদের উৎপাদিত উন্নত জাতের দেশি বীজ থাকবে ফলে বীজ বা প্রযুক্তির জন্য অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না। বাংলাদেশের কৃষিতে একক বা ক্ষুদ্র কৃষকের স্থলে যৌথ বা সমবায়ভিত্তিক কৃষি খামার সৃষ্টি হবে। ফলে তারা যৌথভাবে একটি এলাকার কৃষির নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে এবং যার মালিকানার অংশীদার হবে তারা নিজেরা। তারা নিজেরাই নিজেদের ফসলের বীজ, উন্নত জাতের মাছের বীজ ও মাছ উৎপাদন করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাকিটা বিক্রি করতে পারবে। তাদের নিজেদের আয় হতে প্রাপ্ত অর্থ আবার পোল্ট্রি, গবাদি বা দুগ্ধ সরবরাহকারী পশু খামারে বিনিয়োগের মাধ্যমে আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ফলে একদিকে যেমন পুষ্টি চাহিদা মেটাবে তেমনি অন্যদিকে বাড়তি উৎপাদন বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হবে। কৃষকরা দেশে তৈরি পাওয়ার ট্রিলার, ধান মাড়াই যন্ত্র বা দানা ফসল মাড়াই যন্ত্র, আগাছা নাশক যন্ত্র, বীজবপন যন্ত্র, ফসলকাটা ও শ্রেণি বিন্যাসকরণ যন্ত্র, মূলজাতীয় ফসল মাটি থেকে উত্তোলন যন্ত্র, উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন সেচ যন্ত্র, ফসল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি শ্রমিকের চাহিদা ও খরচ দুটোই কমাতে সক্ষম হবে। একই সাথে দেশে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠবে যাতে অনেক লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে এবং ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গঠনের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জিত হবে।
বীজ ব্যবসায় বিনিয়োগে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ : ফসল উৎপাদনের প্রধান উপকরণ হলো ভালো বীজ। কথায় বলে, ভালো বীজে ভালো ফলন। ভালো বীজের অভাবে আমাদের কৃষকরা প্রায়শই প্রতারিত হন। এ পর্যন্ত মাত্র ৪৬ ভাগ চাষি মান সম্পন্ন বীজ ব্যবহার করতে পারেন। বাকি ৫৪ ভাগ কৃষক অপেক্ষাকৃত নি¤œ মান সম্পন্ন বীজের ওপর নির্ভরশীল। মৌসুমভিত্তিক চিত্র হচ্ছে, আমনে শতকরা ২০-২৩ ভাগ, আউশে শতকরা ১৬ ভাগ, এবং বোরোতে ৮০ শতাংশ কৃষক মান সম্পন্ন বীজ ব্যবহার করে থাকেন। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ব্রি প্রতি বছর ১৫০ টনের অধিক ব্রিডার (প্রজনন) বীজ উৎপাদন এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে। ব্রি থেকে ব্রিডার বীজ, ভিত্তি বীজ ও টিএলএস সংগ্রহে সামান্য পুঁজি বীজ ব্যবসায় বিনিয়োগ করে বীজ উৎপাদন ও সরবরাহের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা যায় যা অভিবাসনের বিকল্প হতে পারে। এছাড়াও ধানভিত্তিক বিভিন্ন খাবার প্রস্তুত ও প্রক্রিয়াজাতকরণ (যেমন- চিড়া, মুড়ি, খই, রাইস কেক, চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি পিঠা-পুলি), কম ছাঁটা বা ঢেঁকি ছাঁটা চাল (অধিক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন), বিভিন্ন মৎস্য ও পশু খাদ্য প্রস্তুতি ও প্রক্রিয়াজাতকরণের উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সামান্য পুঁজি বীজ ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা যায়। অভিবাসন ব্যয়ের সিকিভাগও যদি কৃষক পর্যায়ে উন্নত মান সম্পন্ন বীজ সরবরাহ, সার, সেচ সরবরাহ ও বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, কৃষি যন্ত্রপাতি এবং উন্নত পুষ্টি ও ঔষধি গুণ সম্পন্ন ধান উৎপাদন, ধানের চাল থেকে খাবার প্রস্তুত ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা যায় তাহলে কৃষক পর্যায়ে যেমন ঝুঁকিমুক্ত ও টেকসই কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, তেমনি ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
ড. মো. শাহজাহান কবীর
মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), গাজীপুর, মোবাইল : ০১৭১২২৮০০৮৩ ই-মেইল : dg@brri.gov.bd
টেকসই প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গঠন
খাদ্য নিরাপত্তা ও পর্যাপ্ত পুষ্টি প্রত্যেক নাগরিকের মৈালিক অধিকার। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টে ঘোষিত “ক্ষুধা মুক্তি” অর্জনে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণে টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনার কোন বিকল্প নেই। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়ার কার্যকর উদ্যোগ ও অঙ্গীকার প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব খাদ্য দিবস। বিশ্ব খাদ্য দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য- “Our Actions are our Future. A#Zero hunger world by 2030 is possible” অর্থাৎ “কর্মই গড়ে ভবিষ্যৎ, কর্মই গড়বে ২০৩০-এ ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব।” World Food Program (WFP) এর প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এরই মধ্যে যথেষ্ট উন্নতি করলেও, অনিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টিহীনতায় ভুগছে এখনও অধিক সংখ্যক মানুষ, যাতে নারী ও শিশুর সংখ্যা অত্যাধিক। শিশুদের এক তৃতীয়াংশ ক্ষীণস্বাস্থ্য ও পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। তাছাড়া আর্থ-সামাজিক এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রণীত রূপকল্প ২০২১ এবং ২০৪১ বাস্তবায়ন করতে সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। উল্লেখ্য যে, কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি, পুষ্টি নিরাপত্তা এবং দারিদ্র্য নিরসনে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। জনসংখ্যার প্রায় ২০% প্রত্যক্ষ এবং ৪৫% পরোক্ষভাবে প্রাণিসম্পদ খাতের উপর নির্ভরশীল। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দেশের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি ও দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধিসহ সংরক্ষণ, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও জাত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিগত এক দশকে দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন যথাক্রমে ৩.১১ গুণ, ৫.৭০ গুণ এবং ২.৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ যদিও অনেক দূর এগিয়েছে কিন্তু ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে কিছু প্রতিবন্ধকতা আমাদের এখনও অতিক্রম করতে হবে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনগোষ্ঠী এখনও খাদ্য অনিশ্চয়তা এবং ক্ষুধার্ত জীবনযাপন করে, তাদের যথাযথ পুষ্টিকর খাদ্য ও বহুমাত্রিক খাদ্য তালিকায় প্রবেশের সুযোগ এখনও হয়নি। খাদ্য নিরাপত্তা এবং সকলের জন্য কর্ম নিশ্চিত করতে নারীর ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে সামনে অগ্রসর করা এবং সামগ্রিক কৃষি ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক (যেমন শস্য বহুমুখীকরণ, মূল্য সংযোজিত প্রাণিজাত খাদ্য উৎপাদন ইত্যাদি) উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করা এখন সময়ের দাবি। ক্ষুধা দূরীকরণ, খাদ্য নিরাপত্তাসহ উন্নত সহজলভ্য পুষ্টির জোগান এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্য-২ বাস্তবায়ন কৃষিখাতের উপর অর্পিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে কাক্সিক্ষত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও প্রাণিজ আমিষের পর্যাপ্ত জোগান আমাদের আশাবাদী করছে। আগামীতে ক্ষুধামুক্ত বিশ^ গঠনে খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের উন্নয়নের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ খাত নির্ভরযোগ্য ভূমিকা ও অবদান রাখতে সক্ষম।
প্রাণিসম্পদ খাত খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। মানব সভ্যতা বিকাশের প্রতিটি স্তরে প্রাণিসম্পদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কৃষি কাজ শুরুর পূর্বে পশু শিকারই মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন হলেও, সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে পশুকে কর্ষণ, পরিবহন ও খাদ্য উৎপাদনসহ বিভিন্ন কাজে লাগানো হয়েছে। গৃহপালিত পশু-পাখি এখন মানুষের প্রাণিজ আমিষের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ৭০ এর দশকে পারিবারিক আমিষের চাহিদা পূরণ, জমি কর্ষণ ও পরিবহন শক্তিই ছিল পশু-পাখির পালনের প্রধান উদ্দেশ্য। ৮০ এর দশক থেকে এই খাতে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে সূচিত হয়েছে উৎপাদনশীল পশু-পাখির বাণিজ্যিক পালন পদ্ধতি। ফলে, সামগ্রিক প্রাণিসম্পদ খাত শিল্পখাতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গার্মেন্টের পর পোল্ট্রি শিল্প এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থান খাত, যেখানে প্রায় ৬০ লক্ষের অধিক মানুষ সরাসরি কর্মরত।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ একটি সম্ভাবনাময় ও লাভজনক শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে প্রতিবছর গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি জাত উৎপাদন বেড়ে চলছে। স্বাধীনতা উত্তর ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে দেশে দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১০ লক্ষ মেট্রিক টন, ৫ লক্ষ মেট্রিক টন এবং ১৫০ কোটি, যা বর্তমানে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে ৯৪.০৬ লক্ষ মেট্রিক টন, ৭২.৬০ লক্ষ মেট্রিক টন এবং ১৫৫২ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। উক্ত পরিসংখ্যানই বলে দেয়, পুষ্টিসমৃদ্ধ এসকল খাদ্য উপাদানসমূহ অর্থাৎ দুধ, মাংস ও ডিমের প্রতি মানুষের আগ্রহ ক্রমশই বাড়ছে। বর্তমানে দুধ, মাংস ও ডিমের প্রাপ্যতা যথাক্রমে ১৫৮.১৯ মিলি/জন/দিন, ১২২.১০ গ্রাম/জন/দিন এবং ৯৫.২৭টি/জন/বছর।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের রূপকল্প হচ্ছে প্রাণিসম্পদের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে সকলের জন্য নিরাপদ, পর্যাপ্ত ও মানসম্মত প্রাণিজ আমিষ সরবরাহ করা। সম্প্রীতি বিশ^ ব্যাংকের প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে যে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে। তাই পর্যায়ক্রমে উন্নত দেশের তালিকায় উন্নীত হতে গেলে দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় প্রাণিজ আমিষের আধিক্য বাড়াতে হবে। কারণ উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন পূরণে সবার আগে প্রয়োজন পর্যাপ্ত পুষ্টি এবং নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ। তাই দুধ, মাংস ও ডিমের প্রাপ্যতা বৃদ্ধির জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। দুগ্ধ জাতীয় পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা এবং স্কুল ফিডিং এর মাধ্যমে দুধ পানের অভ্যাস জনপ্রিয়তা লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর প্রতিবছর প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ পালন করে থাকে। প্রতিবছর ০১ জুন “দুধ পানের অভ্যাস গড়ি, পুষ্টি চাহিদা পূরণ করি” প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে বিশ^ দুগ্ধ দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশকে দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের মাধ্যমে গাভী ক্রয় করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ডিমকে বিশ্বে একটি উন্নতমানের ও সহজলভ্য আমিষ জাতীয় খাদ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ইন্টার ন্যাশনাল Egg Commission প্রতিবছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার বিশ^ ডিম দিবস পালন করে আসছে। ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে ও দিনটি পালন করা হয়ে থাকে। মাননীয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ তারিখে বাংলাদেশ মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে মর্মে ঘোষণা করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ ঈদুল আজহায় প্রথম বারের মতো দেশীয় গবাদিপশু দ্বারা কোরবানির চাহিদা পূরণ হয়েছে।
দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক, যুব মহিলা, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষককে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালনে সম্পৃক্ত করে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূরীকরণে ও ভাগ্য পরিবর্তনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিগত দশকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রায় ৮৮ লক্ষ বেকার যুবক, যুব-মহিলা, দুস্থ মহিলা, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষককে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালন বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে যা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। মাঠ পর্যায়ে ক্ষুদ্র খামারি ও কৃষকদেরকে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি লালন পালনের উপর প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা ও পরামর্শ সেবা প্রদান সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে উপজেলা প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে প্রাণিচিকিৎসক কর্তৃক সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে। দারিদ্র্য বিমোচন ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক নিম্নবর্ণিত প্রযুক্তির সম্প্রসারণ হয়েছে। এগুলো হলো-
স্বাস্থ্যসম্মত ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গরু হৃষ্টপুষ্টকরণ, ক্ষুদ্র খামারিদের জন্য বাণিজ্যিক লেয়ার ও বয়লার পালন মডেল, স্ল্যাট/স্লট পদ্ধতিতে ছাগল পালন বাংলাদেশের সাধারণত উন্মুক্ত অবস্থায় ছাগল পালন করা, গ্রামীণ পরিবেশে হাঁস পালন পদ্ধতি, পারিবারিক পর্যায়ে কোয়েল/টার্কি/খরগোশ পালন প্রযুক্তি বর্তমান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন প্রকল্প কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দারিদ্র্য বিমোচন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে, যার প্রতিফলন বাংলাদেশ এলডিসি থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তোলন করেছে।
প্রাণিসম্পদ সম্পর্কিত সেবার মান উন্নত এবং যুগোপযোগী করা, সেবা গ্রহীতাদের সাথে আরো নিবিড় সমন্বয় সাধন করা, প্রাণিসম্পদ খাতের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধির অগ্রযাত্রাকে সমুন্নত রাখা, পুষ্টি নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এ খাত দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে প্রাণিসম্পদ হতে উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে গবাদিপশুর উৎপাদনশীলতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া, প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে দেশের আবহাওয়া উপযোগী সংকর জাতের বিফ ব্রিড উন্নয়নের লক্ষ্যে আমেরিকা থেকে ১০০% ব্রাহমা জাতের সিমেন আমদানি করে দেশি জাতের গাভীর সাথে প্রজনন করে মাংসল জাতের গরুর উৎপাদন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের জন্য মোট ১৭ প্রকারের টিকা উৎপাদন, বিতরণ ও প্রয়োগ করে আসছে। রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা, ডিজিজ সার্ভিলেন্স, ট্রান্সবাউন্ডারি প্রাণী রোগ দমন কার্যক্রম জোরদার করার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে। ই-প্রাণিসম্পদ সেবা, আইসিটি উন্নয়ন, উদ্ভাবনী কার্যক্রম, প্রাণিসম্পদ সহায়ক মোবাইল অ্যাপ এবং সফ্টওয়্যার ভিত্তিক রিপোটিং চালুর মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ায় অগ্রসরমান। প্রাণী বর্জ্য, পশু জবাইজাত উপকরণ, ওষুধ উৎপাদন ও ব্যবহার, পরস্পর সংক্রমণযোগ্য (জুনোটিক) রোগ দমন, আবির্ভূত ও পুনঃআবির্ভূত রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রাণিসম্পদ খাতের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রাণিসম্পদ খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ, সক্ষমতা বৃদ্ধি, ভ্যালু চেইন ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিদ্যমান আইন ও নীতিমালার প্রয়োগ, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং লজিস্টিক সহায়তার মাধ্যমে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটানো পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচন সাথে ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। ফলশ্রুতিতে সরকারের রূপকল্প অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তরের লক্ষ্যে নিরাপদ প্রাণিজ আমিষের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে প্রাণিসম্পদ সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ডাঃ হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক১ ফয়সাল মেহেদী হাসান২
১মহাপরিচালক, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ, ঢাকা, মোবাইল : ০১৭১১৫৭৩৮৪৭; ২বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রাণিসম্পদ অর্থনীতি শাখা, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, ঢাকা, মোবাইল : ০১৭১৩৪০৩২১৩
জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রথম এবং প্রধান উপজীব্য হচ্ছে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়া। ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়তে আগে দরকার ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়া। ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়ার প্রথম অঙ্গীকার ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তারই ফলশ্রুতিতে তিনি কৃষিকে ঢেলে সাজাবার প্রয়াস নিয়েছিলেন। কৃষি ভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি গড়ে তুলেছিলেন এদেশের মিষ্টিফসলের ভিত্তি। কারণ মিষ্টিফসলের সবগুলি উদ্ভিদ উৎসই প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহ্য করে টিকে থাকতে পারে। অন্যদিকে মিষ্টিফসল সবই অধিক পুষ্টিমানসম্পন্ন। ফলে ভবিষ্যতের সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অল্প জমিতে অধিক পুষ্টিকর খাবার উৎপাদন করতে মিষ্টিফসলই হবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মিষ্টিফসল হচ্ছে আখ। আখ থেকে হয় রস, গুড়, চিনি। আখের পাশাপাশি রয়েছে তাল, খেজুর, গোলপাতা, স্টেভিয়া, সুগারবিট, মধু, যষ্টিমধু প্রভৃতি। তাল থেকে হয় রস, গুড়, তালমিছরি প্রভৃতি। খেজুর ও গোলপাতা থেকেও হয় রস, গুড়। সুগারবিট থেকে হয় গুড়, চিনি, মাছের খাবার, গবাদি পশুর খাবার প্রভৃতি। স্টেভিয়া, যষ্টিমধু এবং মধুর পুষ্টিগুণ ও ঔষধিগুণ সর্বজনবিদিত। আর বড় কথা হলো এসব খাবারের পাশাপাশি ঐ সমস্ত ফসলভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের খাদ্য শিল্প গড়ে তোলা যেতে পারে। তাতে রয়েছে দারিদ্র্য মোচনেরও অপার সম্ভাবনা। এসব ছাড়াও তাল এর বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি তাল গাছ বজ্রপাতের বিপদ থেকে রক্ষা করে। এখানে আলোচিত ফসলগুলির মধ্যে আখ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে বেশি প্রতিকূল পরিবেশ সহিষ্ণু। তবে তাল ও খেজুর গাছও প্রতিকূল পরিবেশ সহ্য করতে পারে। গোলপাতা গাছ সেখানেই হয় যেখানে অন্যকোন ফসল হয় না। অর্থাৎ জোয়ার-ভাটা যুক্ত লবণাক্ত এলাকায়। তাই এখানে আখ কেন্দ্রিক আলোচনাতেই বেশি জোড় দেয়া হলো।
এখন দেখা যাক, কে, কোথায় এবং কিভাবে মিষ্টিফসল চাষের মাধ্যমে অধিক পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার উৎপাদন করতে এবং অধিক লাভ করতে পারেন।
১। অতি দরিদ্র পরিবারের আয় এবং পুষ্টির চাহিদা মেটাতে আখচাষ এর ভূমিকা আমাদের দেশের গ্রাম-শহর সর্বত্রই চিবিয়ে খাওয়ার উপযোগী আখ জাতের (চিউইং কেন) ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। যে সমস্ত পরিবার দৈনিক মজুরির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে যাদের বসতভিটা ছাড়া আবাদি কোন জমি নেই। পরিবারের কর্তা-ব্যক্তিটি সকালে কাজের সন্ধানে বের হয়ে যায়, কাজের বিনিময়ে পাওয়া মজুরি দিয়ে পরিবারের সবার চাল-ডালের সংস্থান করেন। তার পক্ষে সন্তানদের জন্য ১টি আখ ৩০/- টাকা দিয়ে কেনা খুবই কষ্টকর। ঐ ব্যক্তিটি যদি তার বসতভিটার আশেপাশে ১০০টি চিবিয়ে খাওয়ার আখের চারা সঠিক সময়ে এবং সঠিক পদ্ধতিতে লাগিয়ে রাখে এবং পরিবারের সদস্যরা সঠিক পরিচর্যা করে তবে রোপণকৃত ১০০টি চারা থেকে কমপক্ষে ৬০০টি সুস্থ সবল আখ পাওয়া সম্ভব, যা সর্বনিম্ন বাজারদরে বিক্রি করে ১৫,০০০/- টাকা আয় করা সম্ভব। আর এজন্য যে পরিচর্যা দরকার তা বাড়ির মহিলারাই করতে পারে। অর্থাৎ মাসে ১০০০ টাকা আয় করতে বাড়ির কর্তা ব্যক্তিকে কোন চিন্তা করতে হয় না। অথবা ৬০০টি আখের মধ্যে কিছু আখ বিক্রি করে টাকা আয় করতে পারে এবং অবশিষ্টগুলি শিশুদের খেতে দিলে তাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয়।
২। অল্প জমিতে আখ চাষ করে অনেক বেশি উপার্জন করা আজকাল সারাদেশে সারাবছর উপজেলা শহর থেকে গ্রাম-গঞ্জ পর্যন্ত প্রতিটি বাজারের কোণায় কোণায় চিবিয়ে খাওয়া আখ বিক্রি ব্যাপকহারে শুরু হয়। যার বাজার দর এলাকাভেদে ২০ টাকা থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রতিটি আখের দাম অপেক্ষাকৃত কম হলেও মধ্য, দক্ষিণ ও পাহাড়ি অঞ্চলে দাম ও চাহিদা খুবই বেশি। এক বিঘা জমিতে ৩০০০টি চিবিয়ে খাওয়া ইক্ষুর চারা রোপণ করা যায়। (এক্ষেত্রে লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ১ মিটার এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব হবে ৪৫ সে.মি.।) এক বিঘা অর্থাৎ ১৩৪৯ বর্গমিটার জমিতে এ মাপে লাগানো হলে ২৯৯৮ বা ৩০০০টি চারা লাগানো যাবে। সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে এটা রোপণ করে, সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে গাছ প্রতি কমপক্ষে ৫টি কুশি পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে ঝাড় প্রতি ১টি মাতৃগাছ এবং ৫টি কুশি অর্থাৎ ৬টি আখ পাওয়া যাবে। সুতরাং ৩০০০টি ঝাড়ে ৩০০০x৬=১৮০০০টি আখ পাওয়া যাবে) তাথেকে ১৮০০০টি সুস্থ ও সবল আখ উৎপাদন করা সম্ভব। সর্বনিম্ন বাজারদরে (১৮০০০x১০টাকা=১,৮০,০০০ টাকা) তা বিক্রি করেও এ থেকে ১,৮০,০০০/-টাকা আসবে যার চাষাবাদ থেকে বিক্রি পর্যন্ত মোট খরচ হয় প্রায় ২৫০০০ থেকে ৩০০০০ টাকা। অর্থাৎ নিট লাভ হয় ১,৫০,০০০ টাকা। এটা গেল আখের হিসাব। আখ ছাড়াও ঐ জমিতে সাথী ফসল চাষ করে প্রায় ১০,০০০-১৫,০০০ টাকা নিট লাভ হবে। এ টাকা দিয়ে চাষি তার আখ চাষের ঐ খরচ মিটাতে পারবে। যদিও বলা হয় আখ ১২-১৪ মাস মাঠে থাকে কিন্তু এর পরিপক্বতার জন্য ১০-১২ মাসই যথেষ্ঠ। তদুপরি যদি চিবিয়ে খাওয়ার আখ হয় তাহলে তা ৭-৮ মাসেই বিক্রির উপযোগী হয়। এক বিঘার মতো এত অল্প জমি ব্যবহার করে শুধুমাত্র সঠিক জাত ও প্রযুক্তির মাধ্যমে আখ ও সাথী ফসল চাষ করে এত বেশি আয় শুধু আখ চাষের মাধ্যমেই তুলে আনা সম্ভব। সেকারণেই সঠিক জাত ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আখ চাষ করে জমির সুষ্ঠু ব্যবহার করা যেমন সম্ভব তেমনি সম্ভব অধিক উপার্জন এর মাধ্যমে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান করা এবং এভাবেই সম্ভব দেশের দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকার পুষ্টি চাহিদা মিটিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা।
৩। আখের রস বিক্রেতাদের জীবিকানির্বাহ সারা বছরই দেশের সকল উপজেলা শহরের অলিগলিতে দেখা যায় আখের রস বিক্রেতাদের। এরা ছোট ছোট হস্তচালিত মাড়াই মেশিনে তাৎক্ষণিকভাবে আখ মাড়াই করে রস বিক্রি করে। জাতের এবং সময়ের তারতম্য অনুসারে একটি আখ থেকে প্রায় ৬-৮ গ্লাস রস হয়। প্রতি গ্লাস আখের রস স্থানভেদে ৫-১০ টাকা বিক্রি হয়। অর্থাৎ ঐ ব্যক্তি ১০ টাকার আখ থেকে সর্বনিম্ন ৩০ টাকার রস বিক্রি করে আখ প্রতি কমপক্ষে ২০ টাকা লাভ করে। প্রতিদিন এরা মৌসুমভেদে গড়ে প্রায় ২৫- ৫০টি আখ বিক্রি করে ৫০০-১০০০ টাকা নিট লাভ করে। এসব রস বিপণন কাজে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর জন্য অধিক রস উৎপাদন উপযোগী আখ চাষ বৃদ্ধি করতে হবে, সারাবছর আখের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং রস উৎপাদনের মেশিনটিকে একটু সংস্কার করে স্বাস্থ্যসম্মত করতে হবে। তাহলেই সাধারণ জনগণের জন্য আখের রসের চাহিদা পূরণ করা যাবে। পাশাপশি রস বিপণন কাজে আরো বেশি সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। এতে একদিকে দারিদ্র্য বিমোচনে যেমন অপরিসীম ভূমিকা পালন করবে, তেমনি পুষ্টি উপাদানের যোগানও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
৪। আখ চাষের মাধ্যমে বড় চাষিদের বিশেষ ভূমিকা বড় চাষিদের দায়িত্বও বড়। তারা যদি বাণিজ্যিকভাবে আখ ও সাথী ফসল চাষ করে তা চিনিকলে দেয়ার জন্য, গুড় তৈরির জন্য কিংবা চিবিয়ে খাওয়ার জন্য যে কারণেই করুক না কেন, আখ যেহেতু সারা বছর ব্যাপী মাঠে থাকে তাই শ্রমিকের কর্মসংস্থানও সারা বছরব্যাপী করতে পারে। তাছাড়া আখ পরিবহনে, গুড় তৈরিতে এবং গুড় বাজারজাতকরণে যে পরিমাণ মানুষের কর্মসংস্থান হয়, অন্য কোন একক ফসলে এত কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ নেই। কেউ হয়তো ভাবতে পারেন এত মানুষের কর্মসংস্থান করার পর গুড় তৈরি করে তা কি লাভ হবে? অবশ্যই হবে। কারণ বাজারে চিনির চেয়ে গুড়ের দাম বেশি। আর যদি ভেজালমুক্ত গুড় তৈরির প্রমাণ করতে পারেন এবং সেই গুড়ের একটা ব্র্যান্ড/ট্রেড মার্ক তৈরি করতে পারেন তবে তার সে ব্যবসাটি হবে দীর্ঘস্থায়ী এবং অধিক লাভজনক।
৫। আখ চাষের মাধ্যমে বড় উদ্যোক্তা তৈরি করা অনেক দেশের মতোই বাংলাদেশেও এখন আখের রস বোতলজাত করে বাজারজাত করার প্রযুক্তি রয়েছে। আখের রসের ভেষজ গুণ, পুষ্টিমান এবং স্বাদের কারণে এর চাহিদা এবং জনপ্রিয়তা যেকোন কোমল পানীয়ের চেয়ে অনেক বেশি। অতএব অল্পকিছু বিনিয়োগের করে আখের রস বোতলজাত করার মাধ্যমেও একটি উন্নতমানের ব্যবসা শুরু করা যেতে পারে। এক্ষেত্রেও অনেক কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে। এমনকি তা রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও সুযোগ রয়েছে। এসব ছাড়াও আখ থেকে বায়োফুয়েলসহ আরো অনেক শিল্প স্থাপনেরও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
এসব কারণেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ভিত্তিক আখ চাষ করা জরুরি প্রয়োজন। আখ চাষে জমির মালিকের লাভের পাশাপাশি অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়। যদিও চিনিকল এলাকার আখচাষিরা আখ সরবরাহ করে সময়মতো আখের দাম না পাওয়াতে হতাশায় ভোগেন, তবে দেরিতে হলেও সেখানে আখের মূল্যটি কিন্তু নির্দিষ্ট থাকে। অন্য ফসলের মতো ওঠানামা করে না। আর চিনিকল বহির্ভূত গুড় উৎপাদন এলাকায় আখ চাষিরা অপেক্ষাকৃত বেশি দামে আখ বিক্রি করে থাকেন। অন্যদিকে চিবিয়ে খাওয়া আখ উৎপাদনকারীগণ লাভ করেন সবচেয়ে বেশি। ফলে শেষোক্ত দুই এলাকার আখ চাষিদের আখ চাষে কোন হতাশা নেই। তাই সারা দেশের সকল ধরনের জমিতেই আখের আবাদ বিস্তৃত করা যেতে পারে। বিশেষ করে চাষের জন্য প্রতিকূল জমি এবং দুযোগপূর্ণ আবহাওয়ায় একমাত্র আখই নিশ্চিতভাবে চাষিকে ফসলহানির আশংকা থেকে মুক্ত রাখে। এখানে তারই কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হলো।
ক) খরা পীড়িত এলাকা দেশের আখ ফসল সবচেয়ে বেশি খরায় টিকে থাকতে পারে। শুধু তাই নয় যেখানে অন্যসব ফসল পানির অভাবে মারা যায় সেখানেও আখ ফসল বেঁচে থাকতে পারে এবং পানি পেলে তা আবার পত্র-পল্লবে সুশোভিত হয়ে ওঠে। সেজন্যই উত্তরাঞ্চলের খরা পীড়িত এলাকায় আখ চাষের ব্যাপকতা বেশি। শুধু আখই নয়, খরা পীড়িত এলাকার জন্যও আখের সাথে সাথী ফসল চাষের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
খ) চরাঞ্চলের বালিময় পতিত জমি চরের বালিময় পতিত জমিতে যেখানে অন্য কোন ফসল চাষ করে লাভ করা যায় না, সেখানেও আখ চাষ করে, আখের সাথে সাথী ফসল করে এবং গুড় তৈরি করে যথেষ্ট লাভ করার সুযোগ রয়েছে। এর কারণ আখের শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত গভীরে চলে যেতে পারে। তাছাড়া চরে অন্যান্য ফসল চাষ করে চাষিরা ঝুঁকিতে থাকেন। কারণ বন্যায় তা ডুবিয়ে নিয়ে যেতে পারে। অথচ আখ এমন একটি ফসল যা ১২-১৫ ফুট লম্বা হয় এবং বন্যায় এর নিম্নাংশ ডুবে থাকলেও কোন ক্ষতি হয় না। আবার চরে যেসব স্বল্পমেয়াদি ফসল হয় সেগুলোকে সাথী ফসল হিসেবে আখের সাথে চাষ করা যায়। ফলে আখ থেকে গুড় তৈরি করে মূল লাভের পাশাপাশি আরো বেশি লাভ করা সম্ভব হয়।
গ) দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকা যেখানে লবণাক্ততার কারণে অন্য কোন ফসল উৎপাদন করা যায় না সেখানেও আখ ফসল তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। আরো নির্দিষ্ট করে বলা যায় উচ্চ মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করার মতো প্রচলিত ফসলধারায় অন্য কোন ফসল নেই। সম্প্রতি অবমুক্ত কেবলমাত্র কয়েকটি ধানের জাত (বিনা ধান ১০ প্রতি মিটারে ১২ ডিএস এবং ব্রি ধান ৬৭ প্রতি মিটারে ৮ ডিএস) ঐ মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। কিন্তু আখ ফসল তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়েই প্রতি মিটারে ১৫ ডিএস মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। তাই লবণাক্ত এলাকারও লাভজনক ফসল আখ।
ঘ) পাহাড়ি এলাকা পাহাড়ি এলাকায়ও এক বিঘা জমিতে ৩০০০টি চিবিয়ে খাওয়া আখের চারা সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে রোপণ করে তাহলে সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে তা থেকে ১৮০০০টি সুস্থ ও সবল আখ উৎপাদন করা সম্ভব। পাহাড়ি এলাকায় আখের বাজার দর অপেক্ষাকৃত বেশি। ফলে সর্বনিম্ন বাজারদরে তা বিক্রি করেও ৩,০০,০০০/- টাকা উপার্জন করা সম্ভব। অল্প জমি ব্যবহার করে সঠিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আখ ও সাথী ফসল চাষ করে এত বেশি আয় করা শুধু আখ চাষের মাধ্যমেই সম্ভব। একইভাবে পাহাড়ি এলাকায় গুড়ের দামও বেশি। তাই ওখানকার মানুষ গুড় করেও বেশি লাভ করতে পারেন।
ঙ) পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকা হাওর এলাকার অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে অল্প কিছুদিন পরেই পানি নেমে যায়। এসব জায়গাগুলি নির্বাচন করে সেখানে জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু আখের জাত রোপণ করা যেতে পারে। যেমন ঈশ্বরদী ৩৭, ঈশ্বরদী ৩৪, ঈশ্বরদী ২০, ঈশ্বরদী ২১ প্রভৃতি। তাছাড়া হাওরে প্রতি বছর বজ্রপাতের কারণে অনেক সংখ্যক মানুষ মারা যায়। তাই এই এলাকায় অধিক তালগাছ রোপণের মাধ্যমে তালের রস, গুড়, তালমিছরি প্রভৃতি বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবার পাওয়ার পাশাপাশি বজ্রপাত প্রতিরোধেরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
চ) দুযোর্গ এর ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় এলাকা সমুদ্র তীরবর্তী উপকূলীয় এলাকা যেখানে প্রায় প্রতিবছরই সিডর-আইলা’র মতো মারাত্মক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হানা দিয়ে ক্ষেতের সব ফসল লণ্ড-ভণ্ড করে দেয়, সেখানে আখফসল থাকলে তা ঐ এলাকার জীবন রক্ষাকারী ফসলে পরিণত হয়। কারণ ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ড-ভণ্ড সবকিছুতে রান্না করার উপকরণও চলে যায়, ঘরের শুকনা খাবারও (যদি থাকে) শেষ হয়ে যায়, আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় পানীয় জলের। অন্যদিকে ঢাকা তথা দেশের দূর-দূরান্ত থেকে পানীয় জল কিংবা খাদ্য সাহায্য পৌঁছাতেও সময় লাগে। আর এ সময়েই পানির অভাবে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় ঐ এলাকার শিশুরা, এমনকি তাদের জীবনহানিরও আশংকা দেখা দেয়। অথচ ঐ এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে চিবিয়ে খাওয়া আখ থাকলে, ঝড়ে তা যত ক্ষতিগ্রস্তই হোক না কেন, তা থেকে পানি ও পুষ্টি উভয়ই পাওয়া যেতে পারে। সংকটকালীন ঐ সময়ে বাড়ির শিশুদের জন্য তা হয় জীবন রক্ষাকারী খাদ্য। সেকারণেই সমুদ্র তীরবর্তী উপকূলীয় এলাকার প্রতিটি বাড়িতেই চিবিয়ে খাওয়া আখের আবাদ করতে হবে।
অর্থাৎ সারাদেশেই আখ চাষ করা এখন জরুরি প্রয়োজন। বরং উল্টা করে বলা যায়, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে যখন বিজ্ঞানীরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন পরিবর্তন সহিষ্ণু ফসল, সেখানে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন সহিষ্ণু ফসল হচ্ছে আখ। আখের রস যেমন পুষ্টিকর, আখের চাষও তেমনি লাভজনক। এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হচ্ছে এলাকাভিত্তিক আখের জাত নির্বাচন করে তার ভাল বীজের সরবরাহ বৃদ্ধি করা। এটা করতে পারলেই আখ চাষ সম্প্রসারণ করা অনেক সহজ হবে, কারণ আখ সম্প্রসারণের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে ভাল বীজের অভাব। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে আখ চাষের উপকরণ, প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি-জ্ঞান এবং উৎপাদিত কাঁচামালের বাজার সবই আমাদের দেশেই যথেষ্ট ভালো রয়েছে। তাই দেশের যেকোন এলাকায় আখচাষে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা তেমন কোন কঠিন কাজ নয়। আর এটা করতে পারলেই দেশের চিনি ও গুড় এর যোগান নিশ্চিত করার পাশাপাশি অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্য বিমোচনেও যথেষ্ঠ ভূমিকা রাখা সম্ভব।
ড. মো. আমজাদ হোসেন১ ড. সমজিৎ কুমার পাল২
১মহাপরিচালক, মোবাইল : ০১৭১৮৪২৬২০০ ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালক, মোবাইল : ০১৭১২০২১১৪০ বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী, পাবনা