বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিও কৃষি। বর্তমান সরকার কৃষক ও কৃষিবান্ধব সরকার। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জমি হ্রাসের প্রেক্ষাপটে মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানের জন্য এবং পাশাপাশি কৃষি ও কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার গ্রহণ করেছেন বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এরই ফলে দানাজাতীয় শস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি খাদ্যশস্য রপ্তানিও করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ভৌগলিকভাবেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা, রোগবালাই ও পোকামাকড়ের উপদ্রব বেশি। তবে এত প্রতিকূলতার মাঝেও কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, সরকারের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে খাদ্য ঘাটতির দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু দেখা যায় প্রতি বছর কৃষকের উৎপাদিত ফসলের একটি বড় অংশ ইঁদুর দ্বারা নষ্ট হয়। ইঁদুর মাঠ থেকে শুরু করে ফসল কর্তনের পরেও গুদামজাত অবস্থায় বা গোলায় তোলার পরও ক্ষতি করে। সুতরাং ইঁদুর আমাদের ফসলের এমন একটি অনিষ্টকারী বালাই যা সর্বাবস্থায় আমাদের ক্ষতি করতে সক্ষম। ইঁদুর শুধু যে ফসলের ক্ষতি করে তা নয় মানুষেরও ব্যাপক ক্ষতি করে এবং রোগজীবাণুর বাহক হিসাবে কাজ করে। তাই কৃষকদের ফসলের মাঠে সময়মতো ইঁদুর দমনে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রতি বছরই ইঁদুর নিধন কার্যক্রম পরিচালনার প্রয়োজন রয়েছে।
কৃষকের উৎপাদিত ফসলের একটি বড় অংশ ইঁদুর দ্বারা নষ্ট হয়। ইঁদুর যে পরিমাণ খাবার খায় তার চেয়ে বেশি কেটেকুটে নষ্ট করে। ক্রমবর্ধমান হলেও বর্ধনশীল জনসংখ্যার খাদ্যের প্রয়োজন মেটাতে মাঠে একাধিক ফসলের চাষ হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি বছর ইঁদুরের কারণে ১০-১২ লাখ টন খাদ্যশস্য নষ্ট হয়ে থাকে। একটা ইঁদুর প্রতিদিন তার দেহের ওজনের ১০ ভাগ খাদ্য গ্রহণ করে এবং সমপরিমাণ কেটেকুটে নষ্ট করে। ইঁদুর ছোট প্রাণী হলেও এর ক্ষতির ব্যাপকতা অনেক বেশি। ইঁদুর শুধু ফসলের ক্ষতিই করে না এটা মানব স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এর মলমূত্র ও লোম আমাদের খাদ্য দ্রব্যের মিশে টাইফয়েড, জন্ডিস, চর্মরোগ, কৃমিসহ ৩৩ প্রকারের রোগ ছড়ায়। মারাত্মক প্লেগ রোগের বাহকও এই ইঁদুর। ইঁদুর মাঠের ও ঘরের ফসল নষ্ট করা ছাড়াও বৈদ্যুতিক তার কেটে আগুনের সূত্রপাত ঘটায়, টেলিফোনের তার কেটে টেলিফোন অচল করে দেয়, কম্পিউটারসহ ঘরের কাপড়চোপর, কাগজপত্র কেটে নষ্ট করে। এছাড়া রাস্তা, বাঁধ ও রেললাইনে গর্ত করার ফলে বৃষ্টি বা বন্যার সময় পানি ঢুকে রাস্তা, বাঁধ ও রেললাইন ভেঙে যায়।
ইঁদুর দ্রুত বংশবিস্তারকারী প্রাণী। একজোড়া ইঁদুর এক বছরে ৩০০০টি বংশধরের সৃষ্টি করতে পারে। ফলে ইঁদুর নিধন করা অত্যাবশ্যক। এক জরিপ অনুযায়ী ধানের শতকরা ৫-৭ ভাগ, গমের শতকরা ৪-১২ ভাগ, গোল আলুর শতকরা ৫-৭ ভাগ, আনারসেশতকরা ৬-৯ ভাগ এবং সেচ নালার পানি ৭-১০ ভাগ ইঁদুরের কারণে নষ্ট হয়। বাংলাদেশে ইঁদুর নিধনঅভিযান ১৯৮৩ সন থেকে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিটি অভিযানের কার্যক্রম বাস্তবায়ন বিশেষজ্ঞ দ্বারা মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে এবং ফলাফলের ভিত্তিতে পরবর্তী অভিযানের কার্যক্রম কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। ইঁদুর নিধন অভিযানের ফলে প্রতি বছর ইঁদুরের আক্রমণের হাত থেকে ফসল রক্ষার পরিমাণ বেড়েছে। ইঁদুর নিধনের উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল। কেননা শুষ্ক মৌসুমে ইঁদুর মাটির গর্তে বা উপয্ক্তু পরিবেশে দ্রুত বিচরণ করতে পারে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে খোলা পানিতে আবদ্ধ থাকে বিধায় দ্রুত বিচরণ করতে পারে না। তাই বর্ষায় ইঁদুর নিধন সহজ হয়। এক সময় প্রাকৃতিকভাবে ইঁদুর নিধন হতো। কেননা সাপ, পেঁচা, ঈগল, চিল, বিড়াল, কুকুর ইঁদুর নিধনকারী প্রাণী। এসব পরভোজী প্রাণীর সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় উপযুক্ত পরিবেশে ইঁদুর দ্রুততার সাথে বংশবিস্তার করে চলছে। ইঁদুর নিধন কার্যক্রমকে জোরদার করার ফলে ইঁদুরের আক্রমণের হাত থেকে ফসলের একটা বড় অংশ রক্ষা পাবে বলে আশা করা যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক গত ছয় বছরে ইঁদুর নিধন অভিযান কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে কি পরিমাণ আমন/বোরো ফসল রক্ষা পেয়েছে তার হিসেব এখানে দেয়া হলো। (উপরের ছক দেখুন)
বছর |
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষক, ছাত্রছাত্রী ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা/ কর্মচারীর সংখ্যা |
নিধনকৃত ইঁদুরের সংখ্যা |
ইঁদুরের আক্রমণ থেকে রক্ষাকৃত ফসলের পরিমাণ (মে. টন) |
২০০৯ |
৪৯৪৫১৭৫ |
৮৭৮৬৫০২ |
৭১৩৬৪ |
২০১০ |
৬০৭৩৭৪৩ |
১০৭৩৯৩৫৭ |
৮০৫৪৫ |
২০১১ |
৬০৮৪৯৫৪ |
১১৩৭২৫৫৭ |
৮৫২৯৮ |
২০১২ |
৫৫০৩৪৬১ |
১৩৬২২০৯৫ |
১০২১৬৯ |
২০১৩ |
৮৩,৮৭,৮৭২ |
১,৩৯,৩৯,৯৮৬ |
১,০৪,৫৪৯.৮৯৫ |
২০১৪ |
৬৪,৩৯,৫৮৯ |
১,২৮,৯২,৯৩৩ |
৯৬,৬৯৬.৯৯ |
ইঁদুর নিধন অভিযান ২০১৫-এর উদ্দেশ্য
* কৃষক, কৃষাণী, ছাত্রছাত্রী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আইপিএম/আইসিএম ক্লাবের সদস্য, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহসহ সর্বস্তারের জনগণকে ইঁদুর দমনে উদ্বুদ্ধ করা।
* ইঁদুর দমনের লাগসই প্রযুক্তি কৃষিকর্মীরা মাধ্যমে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছানো।
* ঘরবাড়ি, দোকানপাট, শিল্পকারখানা ও হাঁস-মুরগির খামার ইঁদুরমুক্ত রাখার জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।
* আমনফসল ও অন্যান্য মাঠ ফসলে ইঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ কম রাখা।
* গভীর ও অগভীর নলকূপের সেচের নালার ইঁদুর মেরে পানির অপচয় রোধকরা।
* রাস্তাঘাট ও বাধের ইঁদুর নিধনের জন্য সর্বস্তরের জনগনকে উদ্বুদ্ধ করা।
* ইঁদুরবাহিত রোগের বিস্তার রোধ করা এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা।
ইঁদুর নিধনে পুরস্কার প্রদান : ইঁদুর নিধনের জন্য নগদ অর্থ প্রদান করা হয়। যারা পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন তাদের ক্রমানুসারে ১টি ক্রেস্ট, ১টি সনদপত্র ও নগদ অর্থ প্রদান করা হবে। বিগত অভিযান বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাপ্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা পর্যায়ে পুরস্কার দেয়া হয়ে থাকে। পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য প্রাথমিকভাবে অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক যাচাই করার পর জাতীয় পর্যায়ের কমিটির মাধ্যমে যাচাই করে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়।
উপসংহার : ইঁদুর দমনপদ্ধতি পোকা ও রোগবালাই দমন পদ্ধতির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে বিষটোপ ও ফাঁদ লাজুকতার সমস্যা রয়েছে। সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতি ও সঠিক স্থানে দমন পদ্ধতি গ্রহণ না করা হলে দমন ব্যবস্থা ততটা কার্যকর হয় না। একা ইঁদুর মারলে দমনব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কারণ ইঁদুর সর্বদা খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য স্থান পরিবর্তন করে থাকে। এজন্য পাড়া প্রতিবেশীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একই দিনে ও একই সময়ে ইঁদুর নিধন করা প্রয়োজন (মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও গনচীনে নির্দিষ্ট দিনে ও নির্দিষ্ট সময়ে এভাবে ইঁদুর নিধন করা হয়)। ইঁদুর দমনের কলাকৌশল অধিকসংখ্যক কৃষকের নিকট পৌঁছানোর জন্য প্রত্যেক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাতার ব্লকের ৬০০ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ প্রদান করবেন। এ বছর ১৫,০০০ কর্মসূচি পুস্তিকা ও ১০০০০ পোস্টার মুদ্রণ করে অঞ্চল, জেলা ও উপজেলায় পাঠানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কর্মসূচি পুস্তিকায় ইঁদুর দমন প্রযুক্তি সংক্ষিপ্ত আকারে সংযোজিত করা হয়েছে। এছাড়া সরকার অনুমোদিত ইঁদুরনাশক (ল্যানিরাট, ব্রমাপয়েন্ট ও ২% গম মিশ্রিত জিংক ফসফাইড) বিষটোপ যথেষ্ট পরিমাণে বালাইনাশক ডিলারের দোকানে মজুদ রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
ইঁদুর সমস্যা দীর্ঘদিনের এ সমস্যা পূর্বে যেমন ছিল, বর্তমানেও রয়েছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং অংশীদারিত্ব। একা ইঁদুর নিধন করার সাথে সাথে অন্যদের ইঁদুর নিধনের জন্য উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। একা ইঁদুর নিধন করলে সাময়িকভাবে এ সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে, তবে অল্পকিছু দিনপরই আবার অন্য স্থানের ইঁদুর এসে সমস্যার সৃষ্টি করবে। ঘরবাড়ি, গুদাম, হাঁস-মুরগির খামার, অফিস ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিনিয়ত ইঁদুরের উপস্থিতি যাচাই করে ইঁদুর নিধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ইঁদুর নিধন অভিযানের সফলতানির্ভর করে সর্বস্থরের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ওপর।
মো. আবুল কালাম আজাদ*
* পরিচালক, উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা
ইঁদুরের গুরুত্ব বলতে গেলে গত বছরে ইঁদুর দ্বারা ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করাই যথেষ্ট। সংসদের তথ্যানুযায়ী গত অর্থবছর (২০১৪-১৫) ৭২৩ কোটি ৭২ লাখ ৭ হাজার ৩৫৫ টাকার শুধুমাত্র ধান, চাল ও গম ফসলের ক্ষতি হয়েছে। আর তার পরিমাণ হলো ধান প্রায় ২ লাখ ৩৭ হাজার ৭৪৪ মে. টন চাল, প্রায় ৬২ হাজার ৭৬৪ মে. টন, এবং গম ফসলের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৯ হাজার ৬৬০ মে. টন। ইঁদুর যে শুধুমাত্র দানাদার ফসলের ক্ষতি করে তা নয়, এরা অন্যান্য ফসল ও ফলমূল, আসবাবপত্র ইত্যাদিতে ক্ষতি সাধন করে যেমন- নারিকেল, আলু, ডাল, অন্যান্য সবজি ইত্যাদি। বৈদ্যুতিক তার ও যন্ত্রপাতি এর হাত থেকে রেহাই পায় না। তাছাড়া ইঁদুর বিভিন্ন ধরনের স্থাপনাও কেটে নষ্ট করে, যার অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক তবে তা মুদ্রা মানে এর আগে খুব একটা হিসাব করা হয়নি। সরকারি-বেসরকারি খাদ্য গুদাম, পাউরুটি ও বিস্কুট তৈরির কারখানা, হোটেল-রেস্তোরাঁ, পাইকারি ও খুচরা পণ্য বিক্রেতার দোকানে বিপুল পরিমাণে খাদ্য ইঁদুর নষ্ট করছে এরও কোনো হিসাব এখন পর্যন্ত করা হয়নি।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের কাটাকাটির স্বভাব তার প্রকৃতিগত। যেমন- কাঠবিড়ালি, সজারু, ইঁদুর ইত্যাদি। দাঁত ছোট রাখার জন্য এরা প্রতিনিয়তই কাটাকাটি করে। যদি ইঁদুরের এ অভ্যাস বন্ধ রাখা হয় তবে তার দাঁত অনেক বড় হয়ে যাবে। সুতরাং ছোট রাখার জন্য তাকে প্রতিনিয়তই কাটাকাটি করতে হয়। এক হিসাবে দেখা গেছে যে, ইঁদুর যে পরিমাণ ভক্ষণ করে তার দশগুণ সে কেটে নষ্ট করে।
বিশ্বের অন্যতম ইঁদুর উপদ্রব এবং বংশবিস্তারকারী এলাকা হচ্ছে গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র অববাহিকা। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখানকার উপকূলীয় লোনা ও মিঠাপানির মিশ্রণের এলাকাগুলো ইঁদুরের বংশবিস্তারের জন্য বেশ অনুকূল। ফসলের মাঠ ছাড়াও এ অববাহিকায় অবস্থিত হাঠ-বাজার ও শিল্পাঞ্চলগুলোতেও ইঁদুরের দাপট বেশি পরিলক্ষিত হয় (ইউএসডিএ, ২০১০)।
ইঁদুরের উৎপাতের কারণে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয় হিসাবে ১১টি দেশকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্ধেক জমির ফসল ইঁদুরের আক্রমণের শিকার হয়। বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ ধান, গম ইঁদুর খেয়ে ফেলে ও নষ্ট করে। ফসলের মোট ক্ষতির বিবেচনায় ইঁদুরের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ফিলিপাইন। দেশটির উৎপাদিত ধানের ২০ শতাংশ ইঁদুর খেয়ে ফেলে ও নষ্ট করে। এর পরই আছে লাওস । দেশটির প্রায় ১৫ শতাংশ ধান ইঁদুরের পেটে যায় (ইরি)। ডিএই এর মতে, ২০১৩ সালে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৩৯ হাজার ৯৮৬টি ইঁদুর মারা হয়। এর ফলে এক লাখ ৪ হাজার ৫৫০ মে. টন ফসল ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়।
বাংলাদেশে ইঁদুরের আক্রমণে বছরে আমন ধানের শতকরা ৫-৭ ভাগ, গম ৪-১২ ভাগ, গোলআলু ৫-৭ ভাগ, আনারস ৬-৯ ভাগ নষ্ট করে। গড়ে মাঠ ফসলের ৫-৭% এবং গুদামজাত শস্য ৩-৫% ক্ষতি করে। ইঁদুর শতকরা ৭ থেকে ১০ ভাগ সেচ নালাও নষ্ট করে থাকে। সেটা ফসলের উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলে। ইরির ২০১৩ সালের এক গবেষণা মতে, এশিয়ায় ইঁদুর বছরে যা ধান-চাল ক্ষেয়ে নষ্ট করে তা ১৮ কোটি মানুষের এক বছরের খাবারের সমান। আর শুধু বাংলাদেশে ইঁদুর ৫০-৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট করে। তাছাড়া ইঁদুরের মাধ্যমে মোট ৬০ ধরনের রোগ ছড়ায়। ইঁদুর মুরগির খামারে গর্ত করে মুরগির ডিম ও ছোট বাচ্চা খেয়ে ফেলে। বারি এর অমেরুদণ্ডী প্রাণী বিভাগের হিসাবে ইঁদুর দেশের প্রতিটি মুরগির খামারে বছরে ১৮ হাজার টাকার ক্ষতি করে।
বেড়িবাঁধ, গ্রামীণ সড়ক, বিভিন্ন বাজারে ইঁদুর দ্বারা ক্ষতি
ক. গ্রীষ্ম মৌসুমে ইঁদুর সাধারণত ফসলের ক্ষেতে ও গ্রাম এলাকার বিভিন্ন স্থানে গর্ত করে সেখানে অবস্থান করে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে নিম্নভূমি প্লাবিত হলে এবং ফসলের জমিতে বৃষ্টির পানি জমলেই ইঁদুর গিয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উঁচু গ্রামীণ সড়ক, বেড়িবাঁধ ও পুরনো স্থাপনায় ইঁদুরের দল গিয়ে আশ্রয় নেয়। এ অবকাঠামোগুলো কাটাকাটি করে ইঁদুর বাসা তৈরি করে। বর্ষা এলে জোয়ার-ভাটার পানির মতো ইঁদুরও বেড়িবাঁধগুলোর জন্য অভিশাপ হয়ে আসে। জোয়ার ও পানি ফসলের মাঠ ডুবিয়ে দিলে ইঁদুর এসে বেড়িবাঁধ ও গ্রামীণ সড়ক ফুটো করে সেখানে আশ্রয় নেয়। আর ওই ফুটো দিয়ে পানি প্রবেশ করে বেড়িবাঁধ ও সড়কগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু সরকারি নিয়মানুযায়ী বছর শেষে ওই মেরামত কাজ করতে করতে বাঁধ ও সড়কের ক্ষতি আরও বড় হয়।
খ. প্রথম আলোর এক বাজার জরিপে ৫০টি ডাল, ২০টি চাল, ২০টি পশুখাদ্য, ৫টি ওষুধ, ৫টি কাপড়ের, ২৩টি মুদি, ৫টি হোটেল এবং ২টি পাখি খাদ্যের পাইকারি দোকান ও গুদামের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রতি কেজি ডালের গড় মূল্য ৪০ টাকা হিসাবে বছরে একটি ডালের দোকান বা গুদামে ৬৮ হাজার টাকার ডাল ইঁদুরের পেটে যায় অথবা বিনষ্ট হয়। এ হিসাব অনুযায়ী, ৫০টি দোকান বা গুদামে বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৪ লাখ টাকায়। এছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানে বছরে অন্তত সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার খালি বস্তা কেটে নষ্ট করে ইঁদুর।
সাভার বাজারে চালের দোকান ব্যবসায়ীদের দেয়া হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর এসব দোকানের প্রায় ১৫ হাজার কেজি চাল ইঁদুরের পেটে যায় অথবা নষ্ট হয়। ৫০ কেজি প্রতি বস্তা চালের মূল্য দুই হাজার টাকা হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ছয় লাখ টাকা। আর বস্তা কাটার কারণে ক্ষতি ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বাজারটিতে এসব মুদি দোকানে বছরে অন্তত ২ লাখ ৩০ হাজার টাকার পণ্য ইঁদুরের পেটে যায় অথবা বিনষ্ট হয় বলে হিসাব দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বাজারটিতে পশুখাদ্যের দোকানের ইঁদুরের কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ীরা বছরে অন্তত ৪ লাখ টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হন। একইভাবে পাঁচটি দোকানের ক্ষতি অন্তত ৫০ হাজার টাকা। কাপড় কেটে ফেলায় বছরে একটি দোকানের ক্ষতি হয় অন্তত ১০ হাজার টাকার। সে অনুযায়ী পাঁচটি কাপড়ের দোকানের ক্ষতি ৫০ হাজার টাকা। পাঁচটি হোটেলে বছরে ক্ষতির হিসাব পাওয়া যায় ৭৫ হাজার টাকা। আর দুটি পাখি খাদ্যের দোকানে ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ৫০ হাজার টাকা। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে ব্যবসায়ীরা চান সরকারিভাবে বাজারেও যেন ইঁদুর নিধন অভিযান চালানো হয়।
বংশবিস্তার ও জীবন চক্র : ইঁদুর দ্রুত বংশবিস্তারকারী প্রাণী। এরা যে কোনো পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে দ্রুত বংশবিস্তার করতে পারে। উপযুক্ত এবং অনুকূল পরিবেশে একজোড়া প্রাপ্ত বয়স্ক ইঁদুর বছরে প্রায় ২০০০টি বাচ্চা সৃষ্টি করতে পারে। এ পর্যন্ত দেশে ১৮ প্রজাতির ইঁদুর শনাক্ত করা হয়েছে। মাঠ ফসলের ক্ষতিকারক একটি কালো ইঁদুরের ওজন ১৫০-২৫০ গ্রাম হয়ে থাকে। আর বড় কালো ইঁদুরের ওজন আধা কেজি থেকে এক কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ইঁদুর সন্তান জন্ম দেয়ার দুই দিনের মাথায় এরা আবারও গর্ভধারণ করতে পারে। এদের গর্ভধারণ কাল ১৮-২২ দিন। ইঁদুর বছরে ৬ থেকে ৮ বার বাচ্চা দেয়। প্রতিবারে ৪-১২টি বাচ্চা দিতে পারে। তিন মাসের মধ্যে বাচ্চা বড় হয়ে আবার প্রজননে সক্ষম হয়ে উঠে। প্রতি ধান মৌসুমে একটি স্ত্রী ইঁদুর অনুকূল পরিবেশে প্রায় ২৪টি বাচ্চা দিতে পারে।
ইঁদুরের উপস্থিতির লক্ষণগুলো : মাঠ ফসলে, গুদামে, ঘরবাড়ি, মুরগির খামার ও অন্যান্য স্থানে ইঁদুরের উপস্থিতির লক্ষণগলো হলো-শব্দ, মল-বিষ্টা, মূত্র, কর্তন, চলাচলের রাস্তা, পায়ের ছাপ, নোংরা দাগ, গর্ত, বাসা এবং কর্তনকৃত খাদ্য অবশিষ্টাংশ, পোষা প্রাণীর উত্তেজনা, ইঁদুরের গন্ধ এবং অভিজ্ঞতা।
ইঁদুর ব্যবস্থাপনা : ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতির ধরন, ব্যাপকতা ও দমন প্রক্রিয়া অন্যান্য বালাই থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও কৌশলগত। তাই স্থান কাল পাত্র ভেদে কৌশলের সঠিক ও সমন্বিত দমন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ইঁদুর নিধন করা যায়। এতে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি, ইঁদুরবাহিত রোগ ও পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমানো সম্ভব হয়। তবে ইঁদুরকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন। ইঁদুর যেহেতু নোংরা স্থান পছন্দ করে, সেহেতু ফসলের মাঠ, বাঁধ, বাড়িঘরসহ ইঁদুরের বংশবিস্তারের সব স্থান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখলে বংশবৃদ্ধি কমে আসে। এছাড়া ফাঁদ পেতেও ইঁদুর নিধন করা যায়।
ইঁদুর দমন পদ্ধতিকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়-
ক. অরাসায়নিক দমন : ভৌতিক ও যান্ত্রিক কলাকৌশলের মাধ্যমে ইঁদুর দমন করা যেতে পারে। এ পদ্ধতির আওতায় রয়েছে-
▪ গর্ত খুঁড়ে দমন
▪ ইঁদুরের গর্তে পানি ঢেলে দমন
▪ ইঁদুরের গর্তে মরিচের ধোঁয়া দিয়ে দমন
▪ ফাঁদ ব্যবহার করে দমন- যেমন বাঁশের ফাঁদ, কাঠের, লোহার ও মাটির তৈরি বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করা। ওই ফাঁদগুলো আবার দুই ধরনের-জীবিত ও মৃত (স্ন্যাপ) ফাঁদ। জীবন্ত ফাঁদে আবার একক ইঁদুর বা বহু ইঁদুর জীবন্ত ধরার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে জীবন্ত ফাঁদে খাবার দিতে হয়। খাবার হিসাবে ধান বা চালের সাথে নারিকেল তৈলের মিশ্রণ তৈরি করে নাইলন বা মশারির কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে টোপ হিসাবে দিতে হয়। এছাড়াও শুঁটকি মাছ, সামুকের মাংসল অংশ, পাকা কলা ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। বন্যাপ্রবণ এলাকায় কলা গাছের ভেলার ওপর ফাঁদ স্থাপন করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
▪ বোর্ডে বা মেঝেতে ইঁদুরের খাবার রেখে গ্লু বা আঠা লাগিয়ে রাখা - এক্ষেত্রে ইঁদুর খাওয়ার জন্য গ্লু-এর ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় আটকে যায়, আটকে পড়া বাত্তি ইঁদুরকে সহজেই মেরে মেলা যায়।
নিম্নলিখিতভাবে ইঁদুরের প্রকোপ কমানো যায়-
▪ ক্ষেতের আইল ছোট (৬"-৮") রেখে
▪ ফসল একই সময়ে লাগানো ও কর্তন করা হলে
▪ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে : বাড়িঘর ও ক্ষেতের আশপাশের ঝোপঝাড়, জলাশয়ের কচুরিপানা পরিষ্কার করে
▪ গাছের কাণ্ডে পিচ্ছিল ধাতব পাত পেঁচিয়ে রাখলে ইঁদুর গাছে উঠতে পারে না বিধায় ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়া যায়
▪ প্রতিরোধক জাল ব্যবহার করে
▪ বিভিন্ন যান্ত্রিক উৎপীড়ক (রিপেলেন্ট) যেমন-ভিডিও ফ্লিম টানিয়ে, মানুষের প্রতিকৃতি অথবা আলট্রা শব্দ সৃষ্টি করে জমি থেকে ইঁদুরকে সাময়িক সরিয়ে রাখা যায়। এর কার্যকারিতা তেমন নয় কারণ এতে ইঁদুরের সংখ্যা কমে না বরং এসব ডিভাইসের প্রতি অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
খ. রাসায়নিক দমন : এ পদ্ধতিতে নিম্নলিখিত তিন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়-
একমাত্রা বিষটোপ : এ ধরনের বিষটোপ ইঁদুর একবার খেলেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়। যেমন-গমে মিশ্রিত জিংক ফসফাইড (<২%) বিষটোপ। জিংক ফসফাইড অমিশ্রিত গম কয়েক দিন দিয়ে অভ্যাস করে হঠাৎ একদিন <২% জিংক ফসফাইড মিশ্রিত গম প্রদান করা। এতে বিষটোপ লাজুকতা দেখা দিতে পারে যদি মৃত ইঁদুরগুলো সরিয়ে ফেলা না হয়।
দীর্ঘমেয়াদি বিষটোপ : এ ধরনের বিষটোপ ইঁদুর খেলে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় না। ইঁদুরের শরীরে বিশেষ প্রতিক্রিয়া হয় এবং কিছু দিন (২-১৪ দিন) পর মারা যায়। যেমন-ল্যানির্যাট, ব্রমাপয়েন্ট, ক্লের্যাট ইত্যাদি। এ বিষটোপগুলোকে আবার একমাত্রা এবং বহুমাত্রা এই দুই ভাগে ভাগ করা হয় অর্থাৎ বিষটোপ ইঁদুরের দেহে কার্যকরী হওয়ার জন্য একমাত্রা বিষের ক্ষেত্রে একবার এবং বিহুমাত্রা বিষের ক্ষেত্রে কয়েক বার খেতে হয়। একমাত্রা দীর্ঘমেয়াদি বিষের মধ্যে, তীব্র বিষক্রিয়া গুণাগুণ বিদ্যামন। তবে এ বিষ একবার খেলে ২-৩ দিন পরে ইঁদুরের মৃত্যু ঘটে। এক্ষেত্রে বিষটি কার্যকর হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময় পর পর বার বার প্রয়োগ করতে হয়। যেমন-ডাইফেনাকাম, ব্রোডিফেকাম, ব্রোমাডিওলন ইত্যাদি। বহুমাত্রা দীর্ঘমেয়াদি বিষের বেলায় বিষটোপ বার বার একটি নির্দিষ্ট জায়গায় প্রদান করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত খাওয়া বন্ধ হয়। এ ধরনের বিষটোপ হলো ওয়ারফেরিন, ফিউমারিন, ক্যালসিফেরন এর ০.০২৫-০.০৩৭৫% ঘনমাত্রার কার্যকরী উপদান।
গ্যাস-বড়ি : বিষ গ্যাস-বড়ি মরণ গ্যাস উৎপন্ন করে। প্রতিটি নতুন সচল গর্তে একটি করে গ্যাস বড়ি প্রয়োগ করে ইঁদুর নিধন করা যায়। মাঠে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট বারো সিস্টেমের নতুন সচল গর্তের মধ্যে দিয়ে ওই গর্তে সহ অন্যান্য সব গর্তের মুখ কাঁদা মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিলে গর্তে আটকা পড়া ইঁদুর মারা যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট ছাড়াও ফসটক্সিন ট্যাবলেট, হাইড্রোজেন/রাসায়নিক ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।
অনুমোদিত ইঁদুরনাশক ও তার বাণিজ্যিক নাম দেয়া হলো-
ইঁদুরনাশকের ধরন |
ইঁদুরনাশকের জেনেরিক নাম |
বাণিজ্যিক নাম |
ক. তীব্র বিষ |
<২% জিংক ফসফাইড বেইট |
ফিনিক্স, র্যাট কিলার, র্যাট বুলেট, র্যাটকিল, বিষটোপ, ইরিচ, র্যাট-ফাইটার |
খ.একমাত্রা দীর্ঘমেয়াদি বিষ |
ব্রোডিফেকাম ০.০০৫% |
ক্লের্যাট ল্যানির্যাট, ব্রোমাপয়েন্ট |
ব্রোমাডিওলন ০.০০৫% |
||
গ. দীর্ঘমেয়াদি বিষ |
ফ্লোকোমাফেন ০.০০৫% |
স্ট্রম |
ঘ. ফিউমিগ্যান্টস |
অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট |
অ্যালুফন, কুইকফিউম, এগ্রিফস, গ্যাস টক্সিন, লেফফস |
রাসায়নিক রিপলেন্ট : গুদামজাত বীজে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করলে তা রিপলেন্ট হিসাবে কাজ করে। যেমন-গেছু ইঁদুর-ঘরের ইঁদুর ম্যালাথিয়ন ব্যবহৃত স্থান এড়িয়ে চলে। এছাড়া দেখা গিয়েছে যে, সাইক্লোহেক্সামাইড ব্যবহৃত এলাকায় ইঁদুরের উপস্থিতি একেবারেই নগণ্য।
ইঁদুর দমনের উপযুক্ত সময় : ১. যে কোনো ফসলের থোড় আসার পূর্বে। এ সময় মাঠে ইঁদুরের খাবার কম থাকে বিধায় ইঁদুর বিষটোপ সহজে খেয়ে থাকে। ২. ঘর বাড়িয়ে সারা বছরব্যাপী ও বর্ষার সময়। ৩. বর্ষার সময় রাস্তাঘাট ও বাঁধে (যখন মাঠে পানি থাকে)। ৪. গভীর ও অগভীর সেচের নালায় প্রথম পানি ছাড়ার দিন।
গ. জৈবিক দমন পদ্ধতি : জীব দিয়ে ইঁদুর দমনের কৌশল এ পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক শত্রু যেমন- শিয়াল, বেজি, বনবিড়াল, সাপ, গুঁইসাপ, পেচা এসব দিয়ে ইঁদুর মারা যায়। কাজেই ইঁদুরভোজী প্রাণীদের বংশবিস্তারের যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে।
সম্ভাব্য গবেষণা কার্যক্রম :
ইঁদুর দমনে বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক (যেমন-লাইট ট্র্যাপ, স্ন্যাপ ট্র্যাপ), রাসায়নিক (যেমন-ফসটক্সিন, মিথাইল ব্রোমাইড) ব্যবহার হচ্ছে। তবে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের গাছের, যাদের জন্মনিরোধ (Antifertility) গুণাগুণ আছে (যেমন-Tripterygium wilfordii) এবং যাদের বিতারক (Repellent) গুণাবলী আছে যেমন Lemongrass, Eucalyptus ইত্যাদি), তাদের মাধ্যমে গবেষণা কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। এছাড়া জৈব পদ্ধতি যেমন পেঁচা লালন-পালন বা প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে ইঁদুর দমন করা যেতে পারে। আশার কথা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এ বিষয়ে একটি ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। তবে এখনও তা প্রাথমিক পর্যায়ে। আশা করা যায় আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এর সুফল পাওয়া যাবে।
ড. নূর আহাম্মদ*
মো. মোফাজ্জল হোসেন**
* বিভাগীয় প্রধান ** প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর
গম দানাদার খাদ্যশস্য হিসেবে বাংলাদেশে দ্বিতীয় স্থান দখল করে আছে। উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি, উচ্চ ফলনশীল বীজ, সেচ ও সার ব্যবহারের মাধ্যমে এদেশে দিন দিন গমের আবাদ ও ফলন উভয়ই বাড়ছে। গত ২০১৩-১৪ গম আবাদ মৌসুমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী ৩.৫৮ লাখ হেক্টর জমিতে ৯.৯৫ লাখ মেট্রিক টন গম উৎপাদিত হয়েছে যা হেক্টরপ্রতি গড় ফলন প্রায় ৩.০০ মেট্রিক টন।
ইঁদুর স্তন্যপায়ী, সর্বভুক ও নিশাচর প্রাণী। ফসলের জন্য ক্ষতিকর স্তন্যপায়ী প্রাণিদের মধ্যে ইঁদুর মানুষের প্রধান শত্রু। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে ইঁদুর আমাদের প্রধান সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (১৯৬৭) হিসাব মতে, ইঁদুর প্রতি বছর বিশ্বের ৩ কোটি ৩৩ লাখ টন খাবার নষ্ট করে। বিশ্বে প্রতি বছর ইঁদুর যে পরিমাণ খাবার নষ্ট করে, সে খাবার খেয়ে অনায়াসেই ২৫/৩০টি দরিদ্র দেশের মানুষ এক বছর বাঁচতে পারে। প্রতিবছর দেশে ইঁদুরের কারণে গড়ে ৫০০ কোটি টাকারও বেশি ফসলের ক্ষতি করে থাকে। ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে ইঁদুর প্রায় ৭২৪ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি করেছে (দৈনিক প্রথম আলো ২২ জুন ২০১৫)। কৃষি সংস্থা ইউ এসডি এর ২০১০ সালের বিশ্বব্যাপী ইঁদুরের ক্ষতি করা নিয়ে গবেষণায় বলা হয়েছে ইঁদুর এশিয়ায় বছরে ১৮ কোটি মানুষের ১২ মাসের খাবার নষ্ট করে। বাংলাদেশে প্রায় ৮-১০ শতাংশ ধান ও গম ইঁদুর নষ্ট করে যা ৫০-৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবারের সমান। ইঁদুর বছরে আমন ধানের শতকরা ৫-৭ ভাগ, গমের শতকরা ৪-১২ ভাগ, গোলআলুর শতকরা ৫-৭ ভাগ, আনারসের শতকরা ৬-৯ ভাগ নষ্ট করে । ইঁদুর শুধুমাত্র গম ফসলে বছরে প্রায় ৭৭,০০০ মেট্রিক টন ক্ষতি করে যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। ইঁদুর দ্বারা বছরে ফসলের প্রায় ১.৫-২.০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। তাছাড়াও ইঁদুর প্রায় ৪০ প্রকার রোগ ছড়ায়। বেশির ভাগ ইঁদুর গর্তে বাস করে বলে সম্পূর্ণভাবে দমন বা নির্মূল করা সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ১৮ প্রজাতির ইঁদুর দেখা যায়। তবে এদের মধ্যে মাঠের কালো ইঁদুর (Lesser bandicoot rat, Bandicota benglensis (Gray) মাঠ ফসলে সব চেয়ে বেশিক্ষতি করে থাকে। এরা মাঝারি আকৃতির ওজন প্রায় ১৫০-২৫০ গ্রাম, পশম কালো ধূসর রঙের। ইঁদুর মাঠ ও গুদামে উভয় স্থানেই গর্ত করে ফসল কেটে, খেয়ে, গর্তে নিয়ে, গুদামে খেয়ে, পায়খানা, প্রস্রাব ও পশম মাটি ও শস্যের সাথে মিশিয়ে ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। গম উৎপাদনে পোকামাকড়, রোগবালাই এর উপদ্রব থাকলেও প্রধান অন্তরায় হচ্ছে ইঁদুর। গ্রামাঞ্চলে ‘কথায় বলে ইঁদুর গমের যম’। বীজ গজানো থেকে শুরু করে গম কাটা পর্যন্ত মাঠে ইঁদুরের উপদ্রব দেখা যায়। গম ফসলে এরা কুশি বের হওয়া অবস্থা থেকে পরিপক্ব অবস্থা পর্যন্ত বেশি ক্ষতি করে থাকে। তবে ইঁদুর শিষ বের হওয়া অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। শিষ বের হওয়ার শুরু থেকে কুশি কেটে গাছের নরম অংশের রস খায় ও পরে গাছ কেটে ও গম খেয়ে ফসলের ক্ষতি করে। গম যতই পরিপক্ব হতে থাকে ক্ষতির পরিমান ততই বাড়তে থাকে। ইঁদুর গাছ কেটে গমসহ শীষ গর্তে নিয়েও প্রচুর ক্ষতি করে থাকে। একটি ইঁদুর এক রাতে ১০০-২০০ টি পর্যন্ত কুশি কাটতে সক্ষম।
সমন্বিত পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন
ইঁদুর দমনের জন্য বেশ কয়েকটি পদ্ধতি আছে। যেমন - অরাসায়নিক, রাসায়নিক, জৈবিক নিয়ন্ত্রণ, গ্যাস বড়ি, আঠা, পরভোজী প্রাণী ইত্যাদি। এ সব পদ্ধতি প্রয়োগ করে ইঁদুর দমনকে সমন্বিত দমন পদ্ধতি বলে।
অরাসায়নিক দমন পদ্ধতি
মাঠে ইঁদুরের উপস্থিতি লক্ষ রাখতে হবে এবং দেখা মাত্রই মারার ব্যবস্থা করতে হবে। জমির আইল ও আশেপাশের ঝোপ জঙ্গল পরিষ্কার রাখতে হবে। জমির আইল ছেঁটে চিকন রাখতে হবে যাতে ইঁদুর গর্ত করে বংশ বিস্তার ও ফসলের ক্ষতি করতে না পারে। সতেজ গর্তে শুকনা মরিচের ধোঁয়া দিয়ে ও পানি ঢেলে ইঁদুর দমন করা যায়। গর্তে গোবরের মিশ্রণ (২০-৩০%) দিয়েও গর্তের ইঁদুর দমন করা যায়। ইঁদুর দমন কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষক বা জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে ও একযোগে ইঁদুর মারার ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিভিন্ন রকমের জীবন্ত ও মরণফাঁদ মাঠে ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করা যায়। জীবন্ত ফাঁদের ভিতর বাঁশের ফাঁদ, লোহার তারের তৈরি ফাঁদ, কাঠের তৈরি ফাঁদ ইত্যাদি। মরণ ফাঁদের মধ্যে বাঁশের ও লোহার তৈরি ফাঁদ এলাকা ভিত্তিক পাওয়া যায়। তবে আকর্ষণীয় ও সুস্বাদু খাবার যেমন শুঁটকিমাছ ও নারিকেল দিলে ইঁদুর ফাঁদে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে যে, খাবারের সাথে কার্বনডাই ফসফাইড (০.১-৫ পিপিএম) টোপ হিসেবে দিলে ফাঁদে আটকানোর সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় (প্রায় ৭০% সফলতা) ।
বপন পদ্ধতি পরিবর্তনের মাধ্যমে
বপন পদ্ধতির ওপর ইঁদুরের আক্রমণ কমবেশি হয়ে থকে। যেমন গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, সারিতে বপন ছিটিয়ে বপনের চেয়ে ইঁদুরের আক্রমণ কিছুটা কম হয় আবার বেড পদ্ধতিতে গম আবাদ করলে ইঁদুরের আক্রমণ কম হয়।
পরভোজী প্রাণী দ্বারা
শিয়াল, বনবিড়াল, বিড়াল, পেঁচা, সাপ, গুইসাপ, বেজী, বাজপাখি ইত্যাদি প্রাণী ইঁদুর খায়। এসব পরভোজী প্রাণির সংখ্যা বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে প্রাকৃতিক উপায়ে ইঁদুর দমন করা সম্ভব।
রাসায়নিক দমন বা ইঁদুরনাশক দিয়ে দমন
বাজারে দুই ধরনের ইঁদুরনাশক পাওয়া যায়। প্রথমটি হল তীব্র বা তাৎক্ষণিক বিষ, এটি খাওয়ার সাথে সাথে বা ২/১ ঘণ্টার মধ্যে ইঁদুর মারা যায়, যেমন জিংকফসফাইড (২%) বিষটোপ।
অনিষ্টকারী মেরুদণ্ডী প্রাণী বিভাগ থেকে ফরমুলেশনকৃত জিংক ফসফাইড (২%) বিষটোপ সাফল্যজনকভাবে গর্তের ইঁদুর দমন করা যায়। বিষটোপ তৈরির পদ্ধতি হলো একটি এ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে ১০০ মিলিলিটার পানির মধ্যে ১০ গ্রাম সাগু বা বার্লি মিশিয়ে জ্বাল দেয়ার পর যখন পানি ঘন আঠাল হয়ে আসবে তখন পাত্রটি নামিয়ে ঠাণ্ডা করে ২৫ গ্রাম জিংক ফসফাইড ২% তার সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে ৯৬৫ গ্রাম গম ঢেলে দিতে হবে। পাত্রের ভিতরে গম নেড়ে চেড়ে এমন ভাবে মিশাতে হবে যেন সমস্ত গমের গায়ে কাল আবরণ পড়ে এবং পাত্রের মধ্যে জিংক ফসফাইড মিশানো সাগু বা বার্লি অবশিষ্ট না থাকে। এরপর মিশ্রিত গম ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা রোদে শুকিয়ে ঠাণ্ডা করে বায়ুরোধক পাত্রে রেখে দিতে হবে। পরে সেখান থেকে নিয়ে প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে হবে। এ বিষটোপ পর পর দুই থেকে তিন দিনের বেশি ব্যবহার না করাই ভালো কারণ পরবর্তীতে বিষটোপ লাজুকতা দেখা দিতে পারে।
দ্বিতীয় ইঁদুরনাশক হলো বহুমাত্রা বা দীর্ঘমেয়াদি বিষ। যেমন- লানির্যাট, স্টর্ম, ব্রোমাপয়েন্ট, ক্লেরাট। এসব ইঁদুরনাশক খাওয়ার ৬/৭ দিনের মধ্যেই ইঁদুর মারা যায়। জীবিত ইঁদুরেরা বুঝতেই পারেনা যে এ বিষটোপই তাদের সঙ্গীদের মৃত্যুর কারণ। সেজন্য এরা বিষটোপ খেতে ভয় পায়না। ফলে ইঁদুর দমনে সফলতার হার অনেক বেশি। যে সব ক্ষেতে গর্তের মুখে নতুন মাটি তোলা দেখা যায়, সে সব গর্তের ভিতর বা আশপাশে কোনো পাত্রে বিষটোপ প্রয়োগ করতে হবে।
ব্যবহার বিধি
মাঠে যেখানে ইঁদুরের উপস্থিতি বুঝা যায় সেখানে বা ইঁদুর চলাচলের রাস্তায় বা সতেজ গর্তের আশপাশে জিংক ফসফাইড বিষটোপ কোনো পাত্রে রেখে দিতে হবে। জমির ওপর এইভাবে বিষটোপ দিয়ে ইঁদুর দমন করা একটি বড় সমস্যা হল প্রায়ই ইঁদুর এই বিষটোপ খেতে চায় না এবং বৃষ্টি বাদলের দিনে ভিজে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি যার ফলে ইঁদুর দমনে কাক্সিক্ষত সফলতা আসে না। বিশেষ করে গম বা ধান ক্ষেতে যখন ইঁদুরের আক্রমণ হয় তখন পাকা গম বা ধান না খেয়ে বিষটোপ খাবার সম্ভাবনা খুব কম। তাই জমির উপরে বিষটোপ না দিয়ে ৩-৪ গ্রাম বা ৮-১০ টি বিষমাখা (জিংক ফসফাইড) গম ৮ ও ৬ (সেমি.) আকারের একটি কাগজ দিয়ে পুঁটলি বেঁধে সতেজ গর্তের মুখ পরিষ্কার করে গর্তের ভিতর ঢুকিয়ে দিতে হবে। গর্তের ভিতর কাগজের পুঁটলিটি এমনভাবে নিক্ষেপ করতে হবে যেন গর্তের মুখ থেকে আনুমানিক ৮-১০ ইঞ্চি ভিতরে যায়। প্রয়োজনে একটি ছোট কাঠি দিয়ে গর্তের ভেতরে ঠেলে দেয়া যেতে পারে। তবে সব সময় লক্ষ রাখতে হবে কাগজটি যেন কখনো মাটির নিচে চাপা না পড়ে। এরপর গর্তের মুখ হালকাভাবে মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। এভাবে বিষটোপ প্রয়োগের সুবিধা হলো (১) এই বিষটোপ ইঁদুর বেশি খায় (২) অন্য কোন প্রাণী যেমন পাখি, বিড়াল, কুকুর বা অন্যান্য পোষা প্রাণী এই বিষটোপ খেতে পারেনা। এতে অপ্রত্যাশিত প্রাণির মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকেনা। তাছাড়া পরিবেশ দূষণের সম্ভাবনাও খুব কম। মৃত ইঁদুর গর্তের ভিতর থাকে বলে মৃত ইঁদুর খেয়ে কাক, চিল ও বিড়াল মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা। এই পদ্ধতির সফলতা প্রায় ২৫% বেশি। তাছাড়া কৃষক ভাইদের তেমন কোনো বাড়তি খরচ নেই। তাই গর্তের ভিতরের ইঁদুর সফলভাবে দমনের জন্য এই পদ্ধতি বেশ লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা সহজেই এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন।
গ্যাসবড়ি দিয়ে ইঁদুর দমন
বিষটোপ ছাড়া এক প্রকার গ্যাস বড়ি দিয়েও ইঁদুর দমন করা যায়। যেমন-এ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট। এই ট্যাবলেট বাজারে ফসটক্সিন, কুইকফিউম, কুইকফস, সেলফস, ডিসিয়া গ্যাস এক্সটি, এলুমফস, এগ্রিফস, গ্যাসটক্সিন নামে পরিচিত। ইঁদুর আছে এমন গর্তের মুখের মাটি সরিয়ে প্রতিটি সতেজ গর্তের ভিতর একটি করে বড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে গর্তের মুখ ভালোভাবে বন্ধ করে দিতে হবে। বড়ি গর্তের ভিতর ভেজা মাটির সংস্পর্শে এলে এক প্রকার বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয়। এই গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে ইঁদুর মারা যায়। গর্তের মুখসহ আশপাশের অন্যন্য গর্তগুলো ভালোভাবে বন্ধ করে দিতে হবে যাতে গ্যাস বের হতে না পারে। বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে ইঁদুর গর্তের ভিতর মারা যায়।
সতর্কতা
জিংক ফসফাইড বিষটোপ তৈরির সময় কাপড় দিয়ে নাক ঢেকে দিতে হবে। বিষটোপ তৈরির পরও ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে ভালভাবে হাত ধুতে হবে। ছোট শিশু ও বাড়ির গৃহপালিত পশু পাখি যেন এই বিষটোপের সংস্পর্শে না আসে তা লক্ষ রাখতে হবে। মৃত ইঁদুরগুলি একত্রিত করে গর্তে পুঁতে ফেলতে হবে। বিষটোপ প্রস্তুত ও প্রয়োগে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে এবং কোন রকম অসুস্থতা অনুভব করলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। গ্যাস বড়ি ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
কোন নির্দিষ্ট একক পদ্ধতি ইঁদুর দমনের জন্য যথেষ্ট নয়। ইঁদুর দমনের সফলতা নির্ভর করে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং বিভিন্ন সময়োপযোগী পদ্ধতি ব্যবহারের ওপর। অতএব সম্মিলিত এবং সময়োপযোগী দমন পদ্ধতি প্রয়োগ করলেই জমিতে ইঁদুরের উপদ্রব কমানো সম্ভব।
ড. মো. শাহ আলম**
ড. গোবিন্দ চন্দ্র বিশ্বাস*
* প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ** ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, অনিষ্টকারী মেরুদ-ী প্রাণী বিভাগ, বিএআরআই, গাজীপুর
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কমবেশি ইঁদুরের সমস্যা আছে। সমতল ভূমি, উঁচুভূমি, পাহাড়, পর্বত, জলাভূমি, গ্রাম, শহরবন্দর এবং উঁচু দালানকোঠা, ৩০০ মিটার নিচু খনি ও উড়োজাহাজসহ সর্বত্র এদের উপস্থিতি বিদ্যমান। ইঁদুরজাতীয় প্রাণীর উপকারী ও অপকারী ভূমিকা রয়েছে। অসংখ্য বন্যপ্রাণী ও বহু মানুষের প্রোটিনের জোগান দিয়ে থাকে। কোনো কোনো সমাজে ইঁদুরের মাংস বিশেষ ধরনের সংস্কৃতির ধারক হিসেবে বিবেচিত হয়। উদাহরণস্বরূপ দক্ষিণ ভিয়েতনামে কিছু বিবাহ অনুষ্ঠানে এক প্লেট ইঁদুরের মাংস প্রতি টেবিলে সরবরাহ ছাড়া বিবাহোৎসব অভ্যর্থনা সম্পূর্ণ হয় না। নবদম্পতির জন্য ইঁদুরের মাংস গুরুত্বপূর্ণ উর্বরতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইঁদুরের মাংস রোস্ট হিসেবে পরিবেশন করে থাকে। Khiem et al (2003) দক্ষিণ-ভিয়েতনামের কয়েকটি প্রদেশের ইঁদুরের মাংস বাজারজাতকরণ ও হোটেলগুলোতে প্রাপ্যতা বিষয়ে জরিপ করেছিলেন। জরিপ ফলাফলে দেখা যায় যে, দক্ষিণ ভিয়েতনামের ৬টি প্রদেশে ৫টি পথে ইঁদুরের মাংস বাজারজাত হয়ে থাকে। সব মেকংগের (Mekong) সব হোটেলে ইঁদুরের মাংস প্রধান জনপ্রিয় মেনু হিসাবে বিক্রি হয়। গণনা করে দেখেছেন যে, প্রতি বছর ইঁদুরের মাংসের জন্য ৩৩০০-৩৬০০ টন জীবন্ত ইঁদুর বাজারজাত করা হয়। তাদের মতে, প্রতি বছর ২৫ লাখের বেশি সংখ্যক ইঁদুর মাংসের জন্য বাজারজাত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, দিনাজপুরসহ অনেক জেলায় বহু মানুষ ইঁদুরের মাংস খেয়ে থাকেন। দেশে কত মানুষ ইঁদুরের মাংস খেয়ে থাকে এর কোনো তথ্য নেই। যেসব এলাকায় ইঁদুরের মাংস খেয়ে থাকে সেসব এলাকায় অন্যান্য পণ্যের মতো কোনো মার্কেট বা বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। জীবন্ত মাঠের বড় কালো ইঁদুর ও মাঠের কালো ইঁদুর যদি সমতল ভূমি এলাকা থেকে ওইসব উঁচু ভূমির ভুক্তাদের নিকট বাণিজ্যিকভাবে নেয়া হলে বাজার গড়ে উঠার সম্ভাবনা আছে। এছাড়া এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশে ইঁদুরের মাংস মানুষের প্রোটিনের উৎস। এসব দেশে অন্যান্য প্রাণীর মাংসের ন্যায় ইঁদুরের মাংস রফতানি করার জন্য মার্কেট অনুসন্ধান করার যেতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞান, কৃষি বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞানের নানা রকম পরীক্ষার জন্য ইঁদুর ব্যবহার হয়। বিভিন্ন প্রকার বন্যপ্রাণীর যেমন- বনবিড়াল, শিয়াল, সাপ, গুঁইসাপ, কুকুর, পেঁচা ইত্যাদি প্রাণী প্রধান খাদ্য হচ্ছে ইঁদুর। ইঁদুর যখন বনে থাকে তখন কিন্তু ইঁদুর ক্ষতিকারক বালাই নেই। ইঁদুরের প্রজনন ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি হওয়ায় এদের নিধন করা হলেও প্রকৃতিতে কোনো প্রভাব বা ভারসাম্যহীনতা হবে না বরং নিধন না করা হলে ফসল ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেড়ে যাবে।
স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে ইঁদুর জাতীয় প্রাণী দ্বারা মানুষের সম্পদ ও ফসলের, সেচের পানি, নালা, যন্ত্রপাতি, দালানকোঠা, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ইত্যাদির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বেশি ক্ষতি হয়ে থাকে। এরা খাওয়ার জন্য সবকিছু ক্ষতি করে না। এদের ছেদন দাঁত ঠিক রাখার জন্য যেখানে যে অবস্থায় থাকে সেই অবস্থাই কাটাকাটি করে। কারণ ইঁদুরের ছেদন দাঁত জন্মের পর হতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত বাড়ে ও পড়ে না। এ জন্য আজও গ্রাম অঞ্চলে শিশুদের দুধ দাঁত পড়লে ইঁদুরের গর্তে দিয়ে বলে ইঁদুরের দাঁতের মতো যেন দাঁত হয়। তবে ইঁদুরের স্বভাব যেন না পায়। ছেদন দাঁতের বৃদ্ধি রোধের জন্য কাটাকাটি করে থাকে। ইঁদুর জাতীয় প্রাণী মানুষ ও প্রাণীর ৬০ প্রকারের বেশি রোগের বাহক ও বিস্তারকারী। ইফতেখার মাহমুদ (প্রথম আলো, ১৬ জুন ২০১৫) এর জরিপ তথ্য থেকে জানা যায় যে, সাভারের নামা পাইকারি বাজারে ইঁদুরের আক্রমণে বছরে ১৬ কোটি টাকার পণ্য নষ্ট করে। বাংলাদেশের অন্যান্য মার্কেটে ইঁদুরের দ্বারা পণ্যের ক্ষয়ক্ষতির একই চিত্র পাওয়া যাবে। এ বিষয়ে ক্ষয়ক্ষতির কোনো জরিপ তথ্য নেই। বিভিন্ন খাদ্য মার্কেটে ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতির জরিপ হওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশে ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব
গ্রামের চেয়ে শহরে ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব বা উপদ্রব দিন দিন বেড়ে চলছে। শহরে ইঁদুরের উপদ্রব বেশি হওয়ার প্রধান প্রধান কারণগুলো হচ্ছেÑ ক. ইঁদুরভোজী প্রাণী অস্বাভাবিকহারে কমে যাওয়ার জন্য ইঁদুর বংশবিস্তার করতে পারছে। গাছপালা না থাকার কারণে বন বিড়াল, গুঁইসাপ, সাপ, শিয়াল, পেঁচা ও অন্যান্য পাখির সংখ্যা কমে গেছে। বহুতল দালানে বিড়াল পালন করে না। খ. সারা বছর শহরের খাদ্য, পানি ও বাসস্থান বিদ্যমান। কারণ ডাস্টবিন ইঁদুরকে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য দিয়ে থাকে। পানি সরবরাহ লাইনের পাইপ ছিদ্র বা লিকেজের কারণে পানি পেতে তাদের অসুবিধা হয় না। ড্রেনে, ডাস্টবিনের নিকট গর্ত খুঁড়ে, দালানকোঠার ভেতরে ও বাহিরের নিরাপদে বাস করতে পারে। গ. সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভাগুলোতে মশা নিধনের কার্যক্রম রয়েছে, কিন্তু ইঁদুর নিধনের কোনো কর্মসূচি নেই। ইঁদুর নিধন করা হয় ব্যক্তিগতভাবে। সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভাগুলোতে ইঁদুর নিধন কর্মসূচি নেয়া প্রয়োজন। এতে ইঁদুরবাহিত রোগের বিস্তাররোধ হবে এবং পানি, খাদ্যদ্রব্যের এবং রাস্তাঘাটের ক্ষয়ক্ষতি কম হবে। পরিবেশের দূষণ কমবে।
ফসলের মাঠে ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব
বাংলাদেশে কমবেশি সব ফসলেই ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব হয়। সবচেয়ে বেশি প্রাদুর্ভাব ও ক্ষতি বেশি হয় গম, আমন ধান এবং ঝুম ফসলে। যে বছর বাঁশে ফুল ও ফল ধরে সে বছর ইঁদুর বন্যা হয় এবং ৮০-৯০% ঝুম ফসলের ক্ষতি হয়। গম ফসলে (২০%) ও আমন ফসলে (১০-১৫%) প্রতি বছর ইঁদুরের প্রাদুর্ভাবে ক্ষতি হয়ে থাকে। যে কোনো ফসলের থোড় হতে পাকা স্তরে ইঁদুরের আক্রমণ বেশি হয়। সারা দেশে মাঠ ফসলে ও শহরে মাঠের কালো ইঁদুরের উপস্থিতি রয়েছে। কিন্তু দক্ষিণ অঞ্চলের জেলাগুলোতে এবং দেশের হাওড় এলাকাতে মাঠের বড় কালো ইঁদুরের উপস্থিতি বেশি রয়েছে। উভয় জাতের ইঁদুর সাতারে বেশ পটু এবং গর্তে বাস করতে পারে।
অন্যান্য স্থানে ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব
সলই ইঁদুর ও গেছু ইঁদুর ঘরবাড়ি ও দালানকোঠায় বেশি থাকে, কারণ এ প্রজাতির ইঁদুর সাধারণত গর্তে বাস করে না। হাঁস-মুরগির খামারে সাধারণত মাঠের কালো ইঁদুরের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে। কারণ এরা হাঁস-মুরগির উচ্ছিষ্ট ছড়ানো ছিটানো প্রচুর খাবার পায়, সুযোগ পেলে ডিম ও ছোট বাচ্চা খেয়ে থাকে। বর্ষার পানির জন্য মাঠের ইঁদুর বেড়িবাঁধ, সড়ক মহাসড়ক, রেলরোড, রাস্তাঘাটে মাঠের কালো ইঁদুর ও মাঠের বড় কালো ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব ও ক্ষতি বেশি হয়ে থাকে। প্রতি কিলোমিটারে ১৫০-৩০০টির বেশি ইঁদুরের উপস্থিতি ঘটে। গর্ত খোঁড়ার জন্য সহজেই বেড়িবাঁধ, সড়ক-মহাসড়ক, রাস্তাঘাট, রেলপথ সহজেই ভেঙে যায়। এসব স্থাপনাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে সরকারি বিভাগে ইঁদুর দমনের ব্যবস্থার কোনো সুযোগ বা ব্যবস্থা নেই। ক্ষতিগ্রস্ত স্থানগুলো মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়। বর্ষার আরম্ভে এসব স্থাপনার ইঁদুর নিধন করা হলে ক্ষতিরোধ হবে এবং বর্ষা শেষে ইঁদুরগুলো আমন ধান ও অন্যান্য ফসলের ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমে যাবে। গুদামজাত শস্যে বর্ষার সময় ইঁদুরের উপদ্রব বেশি হয়। কারণ মাঠের ইঁদুরের আগমন ঘরবাড়িতে হয়। গুদাম জাত শস্যের ক্ষয়ক্ষতি ১৫-২০% বেশি হতে পারে। মলমূত্র ও লোম ফেলে খাদ্যশস্যেও ক্ষতি করে থাকে। এক্ষত্রে গেছু ইঁদুর, সলই ইঁদুর এবং মাঠের কালো ইঁদুর দ্বারা গুদামজাত শস্যের ক্ষতি হয়।
ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশে ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা ব্যক্তি নির্ভর। ইঁদুরকে সবাই চিনে। যে কোনো মানুষকে জিজ্ঞাসা করলে বলবে আপনার কি ইঁদুরের সমস্যা আছে? তখন অকাতরে বলবেন আমার ঘরের সব জিনিসপত্র কেটে শেষ করে দিয়েছে। ইঁদুরের যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারি না। মাঠের ফসল কেটে সাবাড় করে ফেলেছে। কিন্তু ইঁদুর দ্বারা সম্পদ ও ফসলের ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত কেউ ইঁদুর দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। বাংলাদেশের কৃষকরা ফসলের পোকা দমনের জন্য ৫০০-৩০০০ টাকার বেশি খরচ করে থাকেন। কিন্তু ফসলের মাঠে ইঁদুর দমনের জন্য ১০ টাকাও খরচ করতে চায় না। সাধারণত ঘরবাড়ি ও বাসাবাড়ির ইঁদুর ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিধন করে থাকে। কৃষি বৈজ্ঞানিকরা ইঁদুরের চেয়ে পোকামাকড় ও রোগবালাই নিয়ে গবেষণা ও কাজ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ও সম্মানজনক মনে করে থাকেন। ইঁদুর দমন প্রযুক্তির উন্নয়নের গবেষণা ও সম্প্রসারণের জন্য সরকারিভাবে তেমন অর্থের ব্যবস্থা নেই। ভারতে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে তখন কয়েক দিন ইঁদুরের গুরুত্ব পেয়ে থাকে। যদিও ইঁদুর দ্বারা পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে যে কোনো বালাইয়ের চেয়ে ফসল, সম্পদ ও রোগবালাইয়ের ক্ষয়ক্ষতি অনেকগুণ বেশি। ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপারের অন্যান্য বালাইয়ের চেয়ে গুরুত্ব সরকারিভাবে ও ব্যক্তি পর্যায়ে অনেক কম দেয়া হয়। যদিও সবাই জানে ইঁদুর একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রাণী। ইঁদুর দমন ব্যবস্থা ও প্রযুক্তি অন্যান্য বালাই হতে সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ একটি পদ্ধতি দ্বারা ইঁদুর দমন করা বাস্তবে সম্ভব নয়। ইঁদুর দমন পদ্ধতি সঠিক স্থানে, সঠিক সময়ে ও সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। একজন কৃষক বলেছিলেন ইঁদুর মারতে হলে ইঁদুরের চেয়ে স্মার্ট হতে হবে।
কৃষক পর্যায়ে ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশের কৃষকরা বিভিন্ন রকমের (১০-১৫ প্রকারের অধিক) ফাঁদ ব্যবহার করে থাকে। অনেক ফাঁদ কৃষকদের নিজেদের উদ্ভাবনকৃত, যেমন- বাঁশের তৈরি ফাঁদ। এ ফাঁদগুলো গর্তে অবস্থানকারী ইঁদুরের জন্য খুবই কার্যকর। এ ফাঁদগুলো বাজারে পাওয়া যায় না। কৃষকরা নিজেরাই তৈরি করে থাকে। কাঠের তৈরি ফাঁদ বাজারের পাওয়া যায়।
লোহার তৈরি নানা রকম জীবন্ত ও মৃত ইঁদুর ধরার ফাঁদ বাজারে পাওয়া যায়। ব্যক্তি পর্যায়ে একটি বা দুইটি ফাঁদ ব্যবহার করে থাকে। এতে কয়েকটি ইঁদুর মারা সম্ভব হয়। কম পক্ষে ৫টি ফাঁদ ব্যবহার করা হলে এর কার্যকারিতা বেশি পাওয়া যাবে।
ইঁদুর দমনের জন্য গ্লুবোর্ড হার্ডওয়ারের দোকানে পাওয়া যায়। একটি গ্লুবোর্ড দ্বারা ৫-১০টি ছোট বড় ইঁদুর নিধন করা যায়। বাসাবাড়িতে এবং অফিসে গ্লুবোর্ডের ফাঁদ ব্যবহার করা হলে ইঁদুর মরে গন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ঝুম ফসল রক্ষা করার জন্য কৃষকরা বাঁশের বেড়া দিয়ে মাঝে মাঝে বাঁশের ফাঁদ ব্যবহার করে থাকেন। এ পদ্ধতি বেশ কার্যকর। ফসলের মাঠের চারদিকে পলিথিন দিয়ে ঘেরা দিয়ে মাঝে মাঝে বাহিরে ও ভেতরে জীবন্ত ইঁদুর ধরার ফাঁদ পেতে রাখতে হবে। ইন্দোনেশিয়ায় এ পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন করা হয়।
দক্ষিণ অঞ্চলে জোয়ারের সময় টেঁটা দিয়ে মাঠের বড় কালো ইঁদুর সহজেই নিধন করা যায়। জোয়ারের সময় ধান ফসল ডোবে গেলে ইঁদুর কচুরিপানার দলে, হুগলা গাছে এবং মাঠের গাছে আশ্রয় নিয়ে থাকে। এ সময় দল বেঁধে ইঁদুর নিধন করা হলে আমন ফসলের ইঁদুর দ্বারা ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হবে।
ইঁদুরনাশক দ্বারা ইঁদুর দমন
সবাই মরা ইঁদুর দেখতে চায়। অধিকাংশ মানুষ ইঁদুর নিধনে জিংক ফসফাইড ব্যবহার করে থাকে। যুগযুগ ধরে জিংকফসফাইড এ দেশে প্রয়োগ হচ্ছে। বাজার থেকে নিয়ে এ বিষ ব্যবহার করে থাকে। এ বিষ ব্যবহারকারীদের জিজ্ঞাসা করলে বলবে বিষে কাজ হয় না, ইঁদুর মরে না, খায় না ইত্যাদি। কৃষকরা ইঁদুরকে খাওয়ানোর জন্য টোপ হিসেবে নানা রকম খাদ্য ব্যবহার করে থাকেন। এ বিষের প্রধান সমস্যা হচ্ছে- সঠিক মাত্রার তৈরি না হলে ইঁদুর বিষটোপ খাবে না বা খেলেও মারা যাবে না। জিংক ফসফাইডের সঠিকমাত্রা হচ্ছে ২%। গমের সাথে মিশ্রিত ২% বিষটোপ বাজারে পাওয়া যায়। ফ্রেস চিংড়ি মাছ অথবা শামুকে ২% জিংক ফসফাইড বিষ মিশিয়ে ইঁদুরের গর্তে একটি চিংড়ি বা শামুক প্রয়োগ করে ইঁদুর নিধন করা যায়। মুন্সীগঞ্জে গোল আলো খেতে তাজা কাকড়ার গায়ে জিংক ফসফাইড লাগিয়ে ইঁদুরের গর্তে ছেড়ে দিয়ে কৃষকরা সফলভাবে ইঁদুর দমন করতে পেরেছেন বলে জানিয়েছেন। বাজারে বহুমাত্রার তৈরি বিষটোপ যেমন-ল্যানির্যাট, ব্রমাপয়েন্ট পাওয়া যায়। এ বিষটোপ ইঁদুরকে ৩/৪ বার খাওয়াতে হবে এবং খেলে ৭-১০ দিন পর মারা যাবে। এ বিষটোপে না খাওয়ার সমস্যা নেই। ১০০% ইঁদুরের পপুলেশন নষ্ট করা সম্ভব হবে। বিষটোপ ব্যবহারে সাবধানতার নিয়মগুলো অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।
গ্যাস বড়ি দিয়ে ইঁদুর নিধন
গ্যাসবড়ি (অ্যালুমেনিয়াম ফসফাইড ৩ গ্রাম) সাধারণত গুদামজাত খাদ্য শস্যের পোকা দমনের জন্য ব্যবহার হয়। বর্তমানে ইঁদুর নিধনে গ্যাস বড়ির ব্যবহার কৃষকদের নিকট বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। গর্তে বসবাসকারী ইঁদুর নিধনের জন্য খুবই কার্যকর। একটি গর্তে ৩ গ্রামের একটি বড়ি প্রয়োগ করে সব গর্তের মুখ মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। যে কোনো ফসল থোর থেকে পাকা স্তরে ফসলে প্রয়োগকৃত বিষটোপ ইঁদুর খায় না। এ ক্ষেত্রে গ্যাস বড়ি প্রয়োগ করা উত্তম। গ্যাসবড়ি প্রয়োগে সাবধানতার নিয়ম মেনে প্রয়োগ করতে হবে।
ইঁদুর নিধন অভিযান
প্রতি বছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দেশে ইঁদুর নিধন অভিযান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে থাকে। অভিযানে জাতীয়, আঞ্চলিক, জেলা পর্যায়ে জনগণকে ইঁদুর নিধনে উৎসাহ প্রদানের জন্য বেশ কিছু পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এক গবেষণা তথ্য থেকে জানা গেছে যে, ৮৬% কৃষক পুরস্কারের পরিবর্তে বাজারে ভলোমান সম্পন্ন ইঁদুরনাশক বিষটোপ সরবরাহ চেয়েছেন। তাদের যুক্তি হলো পুরস্কার দ্বারা অল্প সংখ্যক ব্যক্তি উপকৃত হয়ে থাকে। আকর্ষণীয় পুরস্কারের পরিবর্তে বিষটোপ এবং ফাঁদ সরবরাহ করা হলে অভিযানের দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল ভালো হবে। এ ক্ষেত্রে অভিযানের সময় প্রতি গ্রাম হতে ২ জন কৃষকে একদিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিষটোপ ও ফাঁদ দেয়া যেতে পারে। এতে সারা দেশে ৬৮,০০০০ কৃষক ইঁদুর দমনের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ পাবে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষকরা গ্রামবাসীদের ইঁদুর নিধনে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করবেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ইঁদুর দমনের প্রযুক্তিগত জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য একটি প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েল তৈরি করে সরবরাহ করা প্রয়োজন।
দলগতভাবে ইঁদুর নিধন ব্যবস্থাপনা
নিজের ইঁদুর নিজেকেই মারতে হবে ইহা যেমন সত্য, তেমনি একা ইঁদুর নিধন করে ভালো ফল হবে না ইহা বাস্তব সত্য। ইঁদুরের সমস্যা একটি সামাজিক সমস্যা। কমিউনিটির সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া ইঁদুর দমন কার্যকর হবে না। সিঙ্গাপুরের দেশকে প্লেগমুক্ত রাখার জন্য আইন করা হয়েছে কোনো বাড়ির আঙিনায় ইঁদুরের উপস্থিতি পাওয়া গেলে মোটা অংকের জরিমানা দিতে হবে। এতে ওই দেশে ইঁদুর দমনের ক্ষেত্রে শহরে সফলতা পেয়েছে। ফিলিপাইনে কমিউনিটি পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন করে সফল হয়েছে। এক্ষেত্রে তারা একটি গ্রাম বা পাড়া নির্বাচন করে ৫-১০ সদস্যের কমিটি করে সারা বছর ইঁদুর দমন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে । কমিটির সদস্যদের ইঁদুর দমন প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও উপকরণ দিয়ে সহায়তা করতে হবে। দলগতভাবে ইঁদুর দমন করে বিএডিসি দশমিনা বীজ বর্ধন ১০০০ একর খামারে সফলতা পেয়েছে। এ খামারে ৭০-৮০% ধান ফসল ইঁদুর দ্বারা প্রতি বছর ক্ষতি হতো। বর্তমানে দলগতভাবে ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনার ফলে খামারের ফসলের ৫% ভাগের নিচে রাখা সম্ভব হয়েছে। ইঁদুর দমন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলা প্রয়োজন। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইঁদুর দমন ব্যবস্থা উন্নয়নের প্রল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। দেশে সারা বছর ধরে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে ইঁদুরের পপুলেশন সমস্যা ও ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সঠিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগ ছাড়া এ সমস্যা সমাধান করা বাস্তবে সম্ভব হবে না।
ড. সন্তোষ কুমার সরকার*
* রূপায়ণ লোটাস, ৬ বি, ১৩ তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০, মোবাইল : ০১৭১৪২২২১৫৭
অন্ন ও বাসস্থানের পাশাপাশি বস্ত্র মানুষের একটি মৌলিক চাহিদা। সকল ফসলের মধ্যে শুধুমাত্র তুলা হতেই আঁশ ও খাদ্যসামগ্রী পাওয়া যায়। তুলা হলো একটি আঁশজাতীয় ফসল যা থেকে ভোজ্যতেল ও পশুখাদ্য খৈল পাওয়া যায়। তুলার আঁশ বস্ত্রশিল্পের প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা বিশ্ব অর্থনীতি এবং সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলের ৭০টির বেশি দেশে ২.৫% চাষাবাদযোগ্য জমিতে তুলার আবাদ হচ্ছে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর দেশীয় বস্ত্রশিল্পে তুলার মারাত্মক সংকট দেখা দেয়ার প্রেক্ষিতে দেশে তুলাচাষ সম্প্রসারণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর একান্ত ইচ্ছায় ১৯৭২ সনের ১৪ ডিসেম্বর তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হয়। যা ১৯৭৩ সনের ৪ জানুয়ারি তারিখের বাংলাদেশ গেজেট, পার্ট-১ এ প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৯১ সনে তুলা গবেষণার দায়িত্ব বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট হতে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের ওপর ন্যস্তকরণের পর তুলা উন্নয়ন বোর্ডের রেজুলিউশনটি সংশোধন করা হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন তুলা উন্নয়ন বোর্ড দেশে তুলার গবেষণা এবং তুলা চাষ সম্প্রসারণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে এবং বতর্মান তৈরি পোশাক শিল্প ও জাতীয় অর্থর্নীতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তুলা টেক্সটাইল মিলের প্রধান কাঁচামাল এবং চাষিদের নিকট একটি অর্থকরী ফসল। তুলা চাষকে চাষিদের নিকট অধিকতর লাভজনক করার জন্য তুলা উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রধান কার্যক্রমসমূহ হলো- গবেষণা, সম্প্রসারণ, বীজ উৎপাদন ও বিতরণ, ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ ও তুলার বাজারজাতকরণে চাষিদের সহায়তা প্রদান। বর্তমান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তুলা উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক গৃহীত সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে বিগত কয়েক বছর যাবৎ আমাদের দেশে তুলার উৎপাদন ক্রমবর্ধনশীল। ২০১৪-১৫ সনে দেশে ৪২,৭০০ হেক্টর জমিতে তুলা আবাদ করে ১,৬১,০০০ বেল আঁশ তুলার উৎপাদন করা হয়েছে, যা তুলা উন্নযন বোর্ড প্রতিষ্ঠাকাল পর থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ। আমাদের দেশের ৩৯২টি স্পিনিং মিলের বার্ষিক আঁশতুলার চাহিদা প্রায় ৪৫ লাখ বেল (১ বেল = ১৮২ কেজি)। বর্তমান উৎপাদন দেশীয় চাহিদার ৩.৬% মাত্র। স্থানীয়ভাবে মোট চাহিদার ১৫-১৬% মেটানের জন্য তুলা উন্নয়ন বোর্ড আগামী ২০২০-২০২১ সালের মধ্যে ১,০০,০০০ হেক্টর জমিতে তুলা আবাদের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশ পৃথিবীর ৫ম বৃহত্তম তুলা ব্যবহারকারী এবং ২য় বৃহত্তম আমদানিকারী দেশ। বাংলাদেশ সাধারণত ভারত, সিআইএস (উজবেকিস্তান, কাজাখাস্তান ইত্যাদি) এবং আফ্রিকার দেশসমূহ থেকে তুলার আমদানি করে থাকে। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে, আমাদের দেশে উৎপাদিত তুলার গুণগতমান আমদানিকৃত তুলার গুণগতমানের চেয়ে উৎকৃষ্ট।
আঁশের বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশী তুলা ভারতীয় তুলা সিআইএস তুলা
আঁশের দৈর্ঘ্য (মিমি) ২৮.৭৯-৩০.৪০ ২৭.৫-২৯.৫০ ২৭.৬৪-২৮.৬৮
মাইক্রোনেয়ার ৩.৮৭-৪.২০ ৩.২০-৪.৯০ ৪.৮১-৫.১৫
আঁশের শক্তি ২৯.০০-৩০.৫৩ ২৮.০০-৩০.০০ ২৭.১০-৩০.৬০
তুলার আবাদ বস্ত্র শিল্পের প্রধান কাঁচামাল তুলার আঁশ জোগানোর পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের খাদ্য নিরাপত্তায় কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। তুলার বীজ বপন থেকে শুরু করে বীজ তুলা প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যন্ত মহিলা শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। উৎপাদিত বীজতুলা থেকে ৪০% আঁশ ও ৬০% বীজ পাওয়া যায়। বীজ থেকে পুনরায় ১৫% ভোজ্যতেল ও ৮৫% খৈল পাওয়া যায়। তুলার খৈল মাছ ও পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অপরদিকে শুকনো তুলা গাছ জ্বালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রাক্কলন করে দেখা যায় যে, ১ লাখ হেক্টর জমিতে তুলার আবাদ করা হলে তা থেকে ১,৮৪১ কোটি টাকা মূল্যমানের ৭ লাখ বেল আঁশতুলা, ৫৪০ কোটি টাকা মূল্যমানের ৪৫,০০০ টন ভোজ্যতৈল, ৩৩৮ কোটি টাকা মূল্যমানের ১,৩৫,০০০ টন খৈল এবং ২৪০ কোটি টাকা মূল্যমানের ৪,৮০,০০০ টন জ্বালানি কাঠ পাওয়া যাবে অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে দেশীয় অর্থনীতিতে প্রায় ৩,০০০ কোটি টাকার মূল্য সংযোজন করা সম্ভব হবে।
ইতোমধ্যে দেশে ১৫-১৮টি প্রাইভেট জিনিং মিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ওই মিলসমূহে তুলাচাষি কর্তৃক উৎপাদিত বীজতুলা হতে প্রথম ধাপে বীজ ও আঁশতুলা আলাদা করা হয়। পরবর্তীতে, বীজ থেকে অপরিশোধিত তুলার তৈল নিষ্কাশন করা হয় ও তুলা বীজের খৈল তৈরি করা হয়। অপরিশোধিত তৈলকে পরিশোধনের মাধ্যমে ভোজ্যতেলে পরিণত করার জন্য ইতোমধ্যেই আমাদের দেশে একটি রিফাইনারি কারখানা স্থাপিত হয়েছে। ওই রিফাইনারি কারখানায় প্রাইভেট জিনিং মিল কর্তৃক নিষ্কাশিত অপরিশোধিত তৈল পরিশোধন করে ভোজ্যতেল হিসেবে বাজারজাত করা হচ্ছে।
তুলা একটি খরা ও লবণাক্ততা সহনশীল ফসল। তবে এটি মধ্যমমেয়াদি জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে বিধায় বন্যামুক্ত ও উঁচু জমি তুলা চাষের উপযোগী। আমাদের দেশে চাষাপযোগী উঁচু ও উর্বর জমিকে চাষিরা সাধারণত স্বল্পমেয়াদি শাকসবজির চাষ ও দীর্ঘমেয়াদি ফল বাগান তৈরিতে ব্যবহার করে থাকেন। তাই খাদ্য উৎপাদনে কোনো বিঘ্ন না ঘটিয়ে তুলা চাষ সম্প্রসারণের জন্য তুলা উন্নয়ন বোর্ড অপ্রচলিত অঞ্চলসমূহে যেমন- তামাক ও কৃষি বনায়ন জমিতে, খরা, লবণাক্ত, চর ও পাহাড়ি এলাকার তুলা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে।
তামাকের জমিতে তুলা চাষ
আমাদের দেশে বিশেষ করে দৌলতপুর, কুষ্টিয়া; লালমনিরহাট, রংপুর; মেহেরপুর, বান্দরবানের লামা ও আলিকদম এবং দিঘীনালা, খাগড়াছড়িতে প্রায় ২০টি মাঠ ফসলকে প্রতিস্থাপন করে ৫০,০০০ হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ করা হচ্ছে। তামাকের জমিতে সারা বছর শুধুমাত্র একটি ফসল করা গেলেও তামাক কোম্পানিসমূহ কর্তৃক বীজ বপনের পূর্বেই নগদ টাকা প্রদান, উপকরণ সরবরাহ এবং পূর্বনির্ধারিত মূল্যে তামাক পাতা বিক্রির নিশ্চয়তাই তামাক চাষ সম্প্রসারণের অন্যতম কারণ। বর্তমানে তুলা উন্নযন বোর্ড তামাকাধীন জমিকে তুলা চাষের আওতায় নিয়ে আসার জন্য কার্যক্রম অগ্রাধিকারভিত্তিতে বাস্তবায়ন করছে।
খরাপ্রবণ অঞ্চলে তুলা চাষ
বাংলাদেশে তুলা চাষ সম্প্রসারণের অন্যতম সম্ভাবনাময় এলাকা হলো রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের অন্তর্ভুক্ত উঁচু বরেন্দ্র ভূমি। বরেন্দ্র ভূমিতে মোট ৫.৮২ লাখ হেক্টর আবাদ যোগ্য জমি রয়েছে। যার ৮৪% এক ফসলি। ওই অঞ্চলে ফসলের নিবিড়তা মাত্র ১১৭%। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হওয়া এবং সঠিক সময়ে বৃষ্টিপাত না হওয়াই বরেন্দ্র অঞ্চল খরাপ্রবণতার প্রধান কারণ। তুলার চাষাপযোগী সময় অর্থাৎ খরিফ-২ (জুলাই-অক্টোবর) মাসে বৃষ্টিনির্ভর আমনের চাষ করা হয়ে থাকে। ওই ধান রোপণ ফুল আসা এবং দানা বৃদ্ধির পর্যায়ে খরার কারণে আমনের ফলন অত্যন্ত কম হয়ে থাকে। মাঠ প্রদর্শনী থেকে দেখ যায় যে, ওই সময়ে তুলার চাষের ফলে চাষিদের আয় অনেক বৃদ্ধি পায়।
বরেন্দ্র অঞ্চলে ধান ও তুলার তুলনামূলক আয়-ব্যয় (প্রতি বিঘায়)
বিবরণ |
ধান |
তুলা |
উৎপাদন খরচ |
৬,০০০.০০ |
৮,০০০.০০ |
ফলন |
১০ মণ |
১০ মণ |
ফলন থেকে আয় |
৭০০০/- |
২০,০০০/- |
বিঘাপ্রতি লাভ |
১০০০/- |
১২,০০০/- |
পাহাড়ি অঞ্চলে তুলা চাষ
বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল বাংলাদেশের এক-দশমাংশ হলেও বিদ্যমান পাহাড়ের কারণে এ অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠের আয়তন অনেক বেশি । উক্ত অঞ্চলে ১১টি বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠী বসবাস করে থাকে। কৃষি হলো উপজাতি গোষ্ঠীসমূহের অন্যতম পেশা। ঐতিহ্যগতভাবে পাহাড়ের ঢালে চাষিরা জুম পদ্ধতিতে ফসল চাষ করে আসছে। জুম চাষের সনাতন পদ্ধতিতে ৭-৮টি ফসল মিশ্র পদ্ধতিতে চাষ করে থাকে। জুম ফসলের মধ্য অন্যতম হলো ধান ও তুলা। সনাতন পদ্ধতিতে ধান ও তুলা উভয়েরই ফলন কম হয়। তুলা উন্নয়ন বোর্ড বিগত কয়েক বছর গবেষণার মাধ্যমে পাহাড়ের ঢালে আন্তঃফসল পদ্ধতিতে সারিতে ধান ও তুলা চাষের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। আন্তঃফসল চাষে ধান ও তুলা উভয়েরই ফলন বৃদ্ধি হয়।
পাহাড়ের ঢালে জুম পদ্ধতিতে চাষিরা সাধারণত পাহাড়ি তুলার চাষ করে থাকে। ওই তুলা সমভূমির অঞ্চলে চাষকৃত তুলার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। হেক্টরপ্রতি এর গড় ফলন যেমন অত্যন্ত কম তেমনিভাবে এর আঁশের দৈর্ঘ্য খাটো হওয়ায় এটিকে স্পিনিং মিলে ব্যবহার করা যায় না। বর্তমান সরকারের সময়কালে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের অন্যতম সাফল্যের মধ্যে ১টি হলো পাহাড়ের ঢালে সমভূমির তুলার চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা। গবেষণার দেখা গিয়েছে যে, আন্তঃফসল পদ্ধতিতে পাহাড়ের ঢালে আমেরিকান তুলা লাভজনকভাবে চাষ করা সম্ভব।
সনাতন জুম চাষ পদ্ধতি ও উন্নত ধান তুলা আন্তঃচাষ পদ্ধতি তুলনামূলক আয়-ব্যয়
|
সনাতন জুম চাষ পদ্ধতি |
উন্নত ধান তুলা আন্তঃচাষ পদ্ধতি |
বপন পদ্ধতি |
মিশ্র |
সারি |
ফসল |
ধান, তুলাসহ অন্যান্য ৫-৭টি |
ধান ও তুলা |
ধানের ফলন (কেজি/হে.) |
১৯৮৮ |
২৭১৩ |
তুলার ফলন (কেজি/হে.) |
৪৬৮ |
১০৬০ |
উৎপাদন খরচ (কেজি/হে.) |
৬৬,৪৯২.০০ |
৭৩,৯০২.০০ |
সকল ফসল থেকে মোট আয় (টাকা/হে.) |
৭৭,৭২০.০০ |
১,১৭,৮৬০.০০ |
নিট লাভ (টাকা/হে.) |
১১,২২৮.০০ |
৪৩,৯৫৮.০০ |
লবণাক্ত এলাকায় তুলা চাষ
বাংলাদেশের সমগ্র অঞ্চলের ২০% হলো উপকূলীয় এলাকা যার আয়তন ২৮.৫ লাখ হেক্টর। ওই উপকূলীয় এলাকায় আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ হলো ৮.৩ লাখ হেক্টর। জমিতে লবণাক্ততার কারণে কৃষিকাজে ওই ভূমির ব্যবহার খুবই কম। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান ফসলসমূহ লবণাক্ততা সংবেদনশীল হওয়ার কারণে অধিকাংশ জমিই সারা বছর পতিত হিসেবে পড়ে থাকে। তুলা লবণাক্ত অঞ্চলে জন্মানোর একটি উপযোগী ফসল। তবে খরিফ মৌসুমে তুলা বপনকালীন সময়ে জলাবদ্ধতার কারণে ওই অঞ্চলে সমতল ভূমির অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় খরিফ-২ মৌসুমে তুলা আবাদের উপযোগিতা কম। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে সুন্দরবন অঞ্চলে হাইডেনসিটি প্লান্টিং সিস্টেমের মাধ্যমে গ্রীষ্মকালীন সময়ে তুলার চাষ করা হয়ে থাকে, যা আমাদের দেশের জন্যও প্রযোজ্য হবে।
চরাঞ্চলে তুলা চাষ
নদীমাতৃক বাংলাদেশে ব্যাপক চর অঞ্চল রয়েছে। চরাঞ্চলে মাটির গঠন বেলে প্রকৃতির, মাটির উর্বরতা ও পানি ধারণক্ষমতা কম হওয়ার কারণে ওই অঞ্চলে ফসলের নিবিড়তা অনেক কম। বাংলাদেশের চরাঞ্চলসমূহ তুলাচাষ সম্প্রসারণের সম্ভাবনাময় এলাকা। কারণ তুলার মূল মাটির অনেক গভীর থেকে রস ও খাদ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম। তাছাড়া ও চরাঞ্চলে তুলা চাষের ফলে জমিতে তুলার পাতা যোগ হয়ে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মাটির উর্বরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে এমন অনেক চরাঞ্চল যেখানে প্রথম পর্যায়ে শুধুমাত্র তুলার আবাদ হতো সেখানে বর্তমানে বহুবিধ ফসলের আবাদ হচ্ছে।
কৃষি বনায়ন জমিতে তুলা চাষ
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আম, পেঁপে এবং লিচু বাগানের পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৭০০০০ হেক্টর জমি ফলজ ও বনজ বাগানের আওতাভুক্ত। ওই ফলজ বা বনজ জমিতে গাছের বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ে সাফল্যজনকভাবে তুলা চাষ করার লক্ষ্যে তুলা উন্নয়ন বোর্ড বিগত কয়েকবছর যাবৎ গবেষণা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
তুলাভিত্তিক শস্যবিন্যাস
তুলা গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। আমাদের দেশে সমভূমির অঞ্চলসমূহের মধ্যে ৩৪টি জেলার উঁচু জমিতে তুলার আবাদ করা হয়। এসব জমির উপযোগী শস্যবিন্যাসসমূহ হলো- তুলা-পাট, তুলা-তিল, তুলা-মিষ্টিকুমড়া, তুলা-তরমুজ, তুলা-মুগ, তুলা-ভুট্টা, তুলা-গম, তুলা-আলু ইত্যাদি। এরূপ ৭০০০০ হেক্টর জমি রয়েছে যা তুলার আবাদ উপযোগী যার মধ্যে ১৫০০০ হেক্টর জমিকে তুলা চাষের আওতায় নিয়ে আসার কর্মপরিকল্পনা তুলা উন্নয়ন বোর্ড গ্রহণ করেছে।
উপসংহার
তুলা একটি খরা ও লবণাক্ততা সহনশীল ফসল। তবে বন্যামুক্ত ও উঁচু জমি তুলা চাষের উপযোগী। খাদ্য উৎপাদনে কোনো বিঘ্ন না ঘটিয়ে তুলা চাষ সম্প্রসারণের জন্য অপ্রচলিত অঞ্চলসমূহে যেমন- তামাক ও কৃষি বনায়ন জমিতে, খরা, লবণাক্ত, চর ও পাহাড়ি এলাকার তুলা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে। ইতোমধ্যে সমতল ভূমিতে তুলা চাষের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও সাফল্যজনকভাবে চাষির কাছে হস্তান্তর করেছে। তবে অপ্রচলিত অঞ্চলসমূহের জন্য লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য তুলা উন্নয়ন বোর্ড গবেষণা কার্যক্রমকে জোরদারকরণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
ড. মো. ফরিদ উদ্দিন*
* নির্বাহী পরিচালক, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, খামারবাড়ি, ঢাকা
অ্যাসপারাগাস (Asparagus officinalis) লিলি গোত্রের বহু বর্ষজীবী গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। আমাদের দেশে এর ব্যবহার নতুন হলেও ইউরোপ আমেরিকাসহ জাপান, চীন ও কোরিয়ায় বহুল ব্যবহৃত একটি জনপ্রিয় সবজি। উন্নত বিশ্বে প্রতি বেলার খাবার মেনুতে অ্যাসপারাগাস খুবই কমন, তবে স্থান কাল পাত্রভেদে এর পরিবেশন পদ্ধতিতে ভিন্নতা রয়েছে। কখনো বা খাবারের আগে অ্যাপিটাইজার হিসেবে, কখনো বা স্যুপে, কখনো সবজির সাথে ব্যবহৃত হয় অ্যাসপ্যারাগাস। পশ্চিমা বিশ্বের হোটেল রেস্তোরাঁগুলোতে হালকা চিকেন বা টোনাফিস স্লাইস সহযোগে অ্যাসপারাগাস সালাদ খুবই প্রচলিত। জাপানে ম্যায়নিজ মিশ্রিত আলু ভর্তায় অ্যাসপারাগাস ব্যবহার খুবই জনপ্রিয়। তবে ফ্রাইপ্যানে হালকা তেলে ভেঁজে বা ভাঁপে সিদ্ধ করে অ্যাসপারাগাস সহজেই খাওয়া যায়। এছাড়া মুরগি বা গরুর মাংস অথবা চিংড়ি বিভিন্ন সস দিয়ে রান্নায় অ্যাসপারাগাস দিলে বেশ সুস্বাদু হয়, পাশাপাশি পরিবেশনের সময় ডিসটাও দেখতে সুন্দর দেখাবে। বিশ্বব্যাপী অ্যাপারাগাসের রকমারি ব্যবহার এটি আরও জনপ্রিয় এবং আবশ্যকীয় হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে দিন দিন। অ্যাসপারাগাস-এর বাংলা নাম শতমূলী।
ঔষধি গুণের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোতে অ্যাসপারাগাস বহুল সমাদৃত। এর আছে বহুমাত্রিক পুষ্টিগুণ। অ্যাসপারাগাস মূলত প্রোটিনসহ ভিটামিন B6, A, C, E ও K, থায়ামিন, রিভোফ্লাভিন, রুটিন, নায়াসিন, ফলিক এসিড, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, পটাসিয়াম, কপার ও ম্যাঙ্গানিজসমৃদ্ধ। অ্যাসপারাগাসে প্রচুর পরিমাণে প্লান্টপ্রোটিন হিস্টোন এবং গ্লটাথিয়ন থাকে, যা এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে দেহের ক্ষতিকারক ফ্রিরেডিক্যালের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত কাজ করে। যা ক্যান্সার প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখে এবং দেহের টনিক হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া ফলিক এসিড থাকার কারণে অ্যাসপারাগাস হার্টে ব্লক সৃষ্টিতে সরাসরি বাধা দেয়। এজন্য হৃদরোগীদের জন্য আ্যাসপ্যারাগাস বেশ উপকারী। উচ্চতর গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে যে, মানব দেহের ত্বক ও ফুসফুসের ক্যান্সারসহ কিডনি ইনফেকশান ও পিত্ত থলিতে পাথর প্রতিরোধেও অ্যাসপারাগাস উল্লেখযোগ্য কাজ করে। প্রতিদিন ২ বার সকাল সন্ধ্যায় ২-৩টি অ্যাসপারাগাস স্টিক খেলে ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যেই এসব রোগের উপশম হয়।
উপকারিতা
* উচ্চ রক্তচাপ কমায়;
* এসিডিটি, দুর্বলতা, যে কোনো ধরনের ব্যথা, ডায়রিয়া, আমাশয় দূর করে;
* শরীরের নানা ধরনের প্রদাহ, পাইল্স সারিয়ে তোলে;
* চোখ ও রক্তের যে কোনো সমস্যা দূর করে;
* নার্ভে কার্যক্ষমতা ঠিক রাখে;
* শতমূলির শিকড় লিভার, কিডনি ও গনোরিয়ার জন্য উপকারী;
* যাদের বদহজমের সমস্যা রয়েছে, তারা শতমূলির শিকড় রস করে তাতে মধু মিশিয়ে খান, উপকার পাবেন।
অ্যাসপারাগাস পর্যাপ্ত জৈব পদার্থসমৃদ্ধ সুুনিষ্কাশিত মাটিতেই ভালো হয়। মাটিতে যেন পানি না জমে সেদিকে লক্ষ রাখতে হয়। মাটি ঝুরঝুরা হলে স্পেয়ার্স এর সংখ্যা বেশি হয়। মাটির পিএইচ মাত্রা ৬-৭তে অ্যাসপারাগাস ভালো হয়। জমি তৈরি করার সময় বেডে পরিমাণ মতো চুন প্রয়োগ করে নিতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে গোবর সার ও খৈলগুঁড়া প্রয়োগ করতে হবে। মার্চ মাসের দিকে স্পেয়ার্স বের হতে শুরু করলে এবং জুলাই মাসের শেষের দিকে বছরে ২ বার ১:১:২ : ইউরিয়া : টিএসপি : এমপি অনুপাতে প্রতিবার হেক্টর প্রতি ১০০ কেজি সার মাটির উপরিভাগে ছিটিয়ে হালকা করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
বীজ থেকে সহজেই চারা উৎপাদন করা যায়, তবে বীজ থেকে উৎপাদিত অ্যাসপারাগাস থেকে প্রথম বছর কোনো ফলন পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় বছর থেকে ফলন দিতে থাকে এবং পর্যায়ক্রমে ফলন বাড়তে থাকে। সারা বছর স্পেয়ার্স উৎপাদিত হলেও শীতে উৎপাদন কমে যায়। বর্ষায় জমিতে কোনোভাবেই পানি জমতে দেয়া যাবে না, শুকনো মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি সেচ দিতে হবে। অ্যাসপারাগাসে সাধারণত স্ত্রী ও পুরুষ দুই ধরনের গাছ দেখা যায়। পুরুষ গাছে উন্নতমানের স্পেয়ার্স উৎপাদিত হলেও, বীজ কিন্তু স্ত্রী গাছেই হয়। স্ত্রী গাছে স্পেয়ার্স খুব কম হয় ও উৎপাদিত স্পেয়ার্স নিম্নমানের হয়। স্পেয়ার্স ১৫-২০ সেন্টিমিটার লম্বা হলেই ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে নিতে হবে। দ্বিতীয় বছর থেকে গড়ে ৮-১০টি স্পেয়ার্স প্রতি গাছ থেকে সংগ্রহ করা যাবে, তবে বয়সের সাথে সাথে তা বাড়তে থাকবে।
ফিউজারিয়াম রট ও ক্রাউন রট অ্যাসপারাগাসের মারাত্মক ক্ষতি করে। তাই বছরে অন্তত ২-৩ বার রিডোমিল বা ডাইথেন স্প্রে করতে হবে যেন মাটিসহ ভিজে যায়। মাটিতে সেভিন ডাস্ট দিলে স্পেয়ার্সে পিঁপড়া বা বিটলের আক্রমণ হবে না। তা ছাড়া গবেষণায় দেখা যায় যে, সরিসার খৈলের পরিবর্তে নিমের খৈল ব্যবহার অথবা জমিতে নিমপাতা গুঁড়া ব্যবহার করলে ফিউজারিয়াম রট কমে হয়।
অ্যাসপারাগাস যেমন খাবারের পুষ্টিমান বাড়ায় তেমনি ডিস সাজানোতে আনে শৈল্পিক সৌন্দর্য কারুময়তা। নিত্যদিনের খাবার মেনুতে অ্যাসপারাগাস রেখে আমরা কিন্তু আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি অনায়াসে। সংসারের প্রতিদিনের অ্যাসপারাগাস নিজেই বাড়ির আঙিনায়, ব্যালকনিতে বা ছাদে বড় বড় টবেই উৎপাদন করে নেয়া যায়। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে অ্যাসপারাগাসের বাংলাদেশে উৎপাদন উপযোগিতা, উৎপাদন পদ্ধতি ও পুষ্টিমান নিয়ে গবেষণা চলছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে চাষযোগ্য ৩টি লাইন সাউ অ্যাসপারাগাস-১ (মেরী ওয়াশিংটন), সাউ অ্যাসপারাগাস-২ (গ্রীন বাংলা) ও সাউ অ্যাসপারাগাস-৩ (ওয়েলকাম ঢাকা) উৎপাদন শুরু হয়েছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্যানতত্ত্ব খামারে। এ লেখাটির তথ্য সরবরাহকারী ড. এ ফয়েজ এম জামাল উদ্দিন, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
* উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫
কৃষি ব্যবস্থা একটি বহুমুখী কর্মধারার সমন্বয়। বাংলাদেশের জিডিপি প্রায় এক-চতুর্থাংশই বর্তমানে কৃষি সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। কৃষি সেক্টরের মধ্যে শুধুমাত্র শস্য ক্ষেত্রে এর অবদান কৃষি জিডিপির প্রায় ৬০ শতাংশ। কৃষি প্রযুক্তি কৃষি সেক্টরের উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বীজ, সার ও কীটনাশক, পানি ব্যবস্থাপনা এবং কৃষি যন্ত্রপাতিই মূলত দেশে ব্যবহৃত কৃষি প্রযুক্তি। এর মধ্যে কৃষি যন্ত্রপাতি তথা কৃষি যান্ত্রিকীকরণ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি। বাংলাদেশে প্রায় ৬২ শতাংশ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন সেক্টরে, যার মধ্যে শস্য সেক্টরেই প্রায় ৫৫ শতাংশ। দেশের জনসংখ্যার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি সেক্টরের যেমন চাপ বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খাদ্য শস্য উৎপাদন, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এই সেক্টরের গুরুত্ব। নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ফলে দেশের শস্য উৎপাদন বিগত ২৫ বছরে প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি অর্জন সম্ভব হয়েছে। গত অর্থবছরে খাদ্য শস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৬৯৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। তবে শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কৃষি যন্ত্রপাতির সঠিক ব্যবস্থাপানার অভাবে প্রতি বছর মোট খাদ্য শস্য উৎপাদনের ৭-১০ ভাগ অপচয় হয়। কৃষি কাজের প্রতিটি স্তরে স্তরে কৃষি যন্ত্র ব্যবহার নিশ্চিতকরণ করা হলে বছরে আরো ৭০ মিলিয়ন খাদ্যশস্য উৎপাদন বেশি হতো। কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন ব্যাপক কৃষি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দানা শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে, উন্নত কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রযুক্তি প্রয়োগে শস্য উৎপাদনের কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রাপ্ত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও ফসল কর্তনোত্তর ক্ষতি কমানোর মাধ্যমে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ হলেও কৃষি সেক্টরে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর দেশে কৃষি প্রযুক্তি যান্ত্রিকীকরণে স্বর্ণযুগের আরম্ভ হয়। ঐ বছর বিদেশ থেকে আমদানিকৃত কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর থেকে ‘কৃষি যন্ত্রপাতির মান নিয়ন্ত্রণ কমিটি’ এর শর্তগুলো শিথিল করলে দেশে পাওয়ার টিলার আমদানি বেড়ে যায়। আর এভাবে কৃষি কাজে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের স্বর্ণ যুগ শুরু হতে থাকে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে চাষের পর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় বীজ বপন, গুটি ইউরিয়া সার প্রয়োগ, শস্য কর্তন, শস্য মাড়াই, শস্য ঝাড়াই সহ অন্যান্য কার্যাবলিতে কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার। একটা ফসল কাটার পর আর একটা ফসল লাগানোর মধ্যবর্তী সময় না কমালে কৃষিযন্ত্র ব্যবহার করে ফসলের নিবিড়তা বাড়ানো সম্ভব নয়। যান্ত্রিকীকরণের বহুবিধ সুবিধাদির ফলে কৃষক দিন দিন কৃষিযন্ত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে কৃষকদের ফসল উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে একটা ফসল থেকে আর একটা ফসল লাগানোর মধ্যবর্তী সময় কমে যাওয়ায় কৃষকরা বছরে এখন ২টা ফসলের স্থানে ৩টা ফসল অনায়াসেই করতে পারছে। এমনকি সুনির্দিষ্ট শস্য বিন্যাস ও স্বল্প জীবনকালের ফসল নির্বাচন করে যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে বছরে ৪টি ফসল পর্যন্ত করা সম্ভব হচ্ছে। বর্তমানে দেশে জমি তৈরির ৯০% কাজ পাওয়ার টিলার বা ট্রাক্টর দিয়ে করা হচ্ছে। সার প্রয়োগ ও আগাছা দমনের কাজে যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছে এবং দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি পর্যায়ে ভাড়ার ভিত্তিতে ফসল কাটার যন্ত্র রিপার/কম্বাইন এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। মাড়াই যন্ত্র বিশেষ করে ধান, গম ও ভুট্টাসহ সকল দানাদর ফসল মাড়াই কাজে মাড়াই যন্ত্র প্রায় ৯৫% ভাগ ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের প্রফেসর ড. প্রকৌশলী এটিএম জিয়াউদ্দিন মনে করেন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ফলে ফসলের উৎপাদন খরচ যেমন অনেকাংশে কমে যায়, একই সাথে ফসলের নিবিড়তা ৫-২২ ভাগ বেড়ে যায়। এছাড়াও বীজ বপন যন্ত্র দ্বারা ফসল মাঠে বুনলে বীজ ২০ ভাগ সাশ্রয়ের পাশাপাশি সার ১৫-২০ সাশ্রয় হয়। অন্যদিকে ফসলের উৎপাদনও ১২-৩৪ ভাগ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে কৃষকের মোট আয় বেড়ে যায় ২৯-৪৯ ভাগ।
ফসল উৎপাদনের ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কর্তনপূর্ব, কর্তনকালীন ও কর্তনোত্তর সময়ে ফসলের ক্ষতি হয়। বাংলাদেশে দানাশস্যে ফসল কর্তনোত্তর ক্ষতির পরিমাণ মোট উৎপাদনের ১২-১৫ ভাগ, যা ফল ও শাকসবজির ক্ষেত্রে প্রায় ২৫-৪০ ভাগ। এ ছাড়া অন্য আর একটি গবেষণায় জানা যায় যে, বাংলাদেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৭ ভাগ গম, ১২.০৫ ভাগ তেল বীজ, ২৫ ভাগ শাকসবজি এবং আলু, ১২.০৫ ভাগ ডাল ফসল এবং ১০.০৫ ভাগ মরিচ ফসলে কর্তনোত্তর ক্ষতি হয় শুধু দক্ষ যন্ত্রপাতি ব্যবহারের না করার ফলে। বিগত ২০০৯-১০ অর্থবছরে সরকারের সঠিক পদক্ষেপের কারণে যেখানে ৩২.৫ মিলিয়ন মে. টন ধান উৎপাদিত হয়েছিল, সেখানে ফসল কর্তনোত্তর ক্ষতির পরিমাণ ছিল আনুমানিক ৪-৫ মিলিয়ন মে. টন, যা ২০০৮-০৯ অর্থবছরের খাদ্য সরবরাহ ও জোগানের ২.২ মিলিয়ন মে. টন ঘাটতির চেয়ে বেশি। কৃষি প্রকৌশলীগণ মনে করেন যে, খাদ্য সরবরাহ ও জোগানের মধ্যে যে ঘাটতির রয়েছে তা সঠিক ফসল কর্তনোত্তর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই কমানো সম্ভব। বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কৃষি প্রকৌশলীদের মতে, ধান ফসল যদি যান্ত্রিক উপায়ে কর্তন বা রিপার দ্বারা কর্তন করা সম্ভব হয়, তবে কৃষকদের প্রায় ৮৪৫০০০ মে. টন ধান সাশ্রয় হবে। এক গবেষণায় জানা যায়, দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকার খাদ্য শস্য নষ্ট হয় শুধুমাত্র পরিকল্পিতভাবে ফসল কর্তন, ফসল কর্তনোত্তর ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে। কৃষি প্রকৌশলীদের গবেষণায় আরো জানা যায় যে, বিগত দশকে দেশে ফসল কর্তনোত্তর ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২,৫০,০০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে প্রতিনিয়তই কৃষি কাজে শ্রমিকের অভাব দেখা দেয়ায় কৃষকরা সঠিক সময়ে ফসল জমিতে লাগাতে পারছে না ফলে কৃষকদের মাঝে কৃষি কাজে যন্ত্র ব্যবহারের ব্যাপক চাহিদা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কৃষি কাজের এ অবস্থার কারণে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতির চাহিদা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। স্থানীয়ভাবে তৈরি এসব কৃষি যন্ত্রপাতির চাহিদার বৃদ্ধির ফলে গড়ে ওঠেছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি কারখানা। বারির ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক জরিপে দেখা গেছে, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের শুধুমাত্র বারি গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্র ও মাড়াই যন্ত্র ব্যবহারের ফলে ইউরিয়া সাশ্রয় ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি সাশ্রয় বাবদ ৭৩৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।
বর্তমানে দেশে কৃষি যন্ত্র প্রস্তুতকারী অনেক শিল্প কারখানা গড়ে উঠলেও এসব শিল্প কারখানায় দক্ষ জনগোষ্ঠীর অভাবে এদের উৎপাদিত যন্ত্রপাতির মানও তেমন ভালো নয়, যার ফলে মাঠে কৃষিযন্ত্রের প্রয়োজনীয় কার্যদক্ষতা পাচ্ছে না কৃষকরা। দেশে ছোট বড় প্রায় ৮০০টি কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি কারখানা বারি এবং ব্রি মডেলে কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করছে। এছাড়াও ৭০টি ফাউন্ডারি সপ, ১৫০০টি ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ তৈরি কারখানা এবং ২০০০০টি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কারখানা এই সেক্টরের সাথে জড়িত (প্রফেসর ড. মো. মঞ্জুরুল আলম, ২০১২)। এর ফলে দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারখানা গড়ে ওঠার পাশাপাশি আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও প্রয়োজনীয় সরকারি উদ্যোগ ও কার্যকরী যথাযথ অবকাঠামো না থাকায় এ সেক্টরের ক্রমবিকাশ যতটুকু গড়ে ওঠা দরকার তা গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আশার কথা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতি মাঠ পর্যায়ে প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বারির এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ১০ বছরের উদ্ভাবিত হাইস্পিড রোটারি টিলার ৪,০০০টি, বারি বীজ বপন যন্ত্র ১,০০০টি, গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্র ১৬,০০০টি, ধান, গম কর্তন যন্ত্র ১০০টি, শস্য মাড়াই যন্ত্র ৪,০০,০০০টি, ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র ৪,০০০টি, শস্য কর্তন যন্ত্র ২০০টি কৃষকের মাঠে সঠিক কর্মদক্ষতার সাথে কাজ করছে।
যেহেতু দেশে এখন পর্যন্ত কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সেক্টরটি গড়ে উঠেছে বিচ্ছিন্নভাবে, তাই বর্তমানে এর সঠিক অবস্থা নিরূপণ করা সম্ভব নয়। তবে বিছিন্নভাবে এসব তথ্য থেকেই এর প্রয়োজনীয়তা, চাহিদা, প্রসার ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সহজেই অনুধাবন করা যায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের প্রফেসর ড. মো. মঞ্জুরুল আলমের ২০১২ সালের এক তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৭১.১৬ টাকার কৃষি যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য কৃষি যন্ত্রাংশ লেনদেন হয় তার মধ্যে শুধুমাত্র কৃষি যন্ত্রপাতি খাতে ৮০ বিলিয়ন টাকার লেনদেন হয়। এর মধ্যে দেশে তৈরি কৃষি যন্ত্রপাতি খাতে লেনদেন হয় ৩৩.৮৫ বিলিয়ন টাকা। পাওয়ার টিলার খাতে ১৩০০০ মিলিয়ন টাকা, ট্রাক্টর খাতে ৫৫২৫ মিলিয়ন টাকা, সেন্টিফিউগাল পাম্প খাতে ১৪০০ মিলিয়ন টাকা, কয়েক প্রকার ইঞ্জিনের খাতে ২০০০০ মিলিয়ন টাকা, মাড়াই যন্ত্র খাতে ৬৭০ মিলিয়ন টাকা, ম্প্রেয়ার যন্ত্রাংশ খাতে ৪২ মিলিয়ন টাকা, ইঞ্জিন, পাওয়ার টিলার ও পাম্প স্প্রেয়ার যন্ত্রাংশ খাতে ৩২০০ মিলিয়ন টাকার লেনদেন হচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৬৫০০০০ পাওয়ার টিলার ব্যবহৃত হচ্ছে এবং প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৬০ হাজার পাওয়ার টিলার আমদানি হচ্ছে। অন্য দিকে অগভীর নলকূপের জন্য ব্যবহৃত সেন্ট্রিফিউগাল পাম্পের সরবরাহ প্রধানত নির্ভর করছে দেশের স্থানীয় প্রস্তুতকারকদের ওপর। বর্তমানে প্রায় ৮ লাখ ৫০ হাজার অগভীর নলকূপ রয়েছে এবং প্রতি বছর এর পাম্পের চাহিদা প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার। দেশে ব্যবহৃত স্পেয়ার সমূহের মধ্যে শুধুমাত্র পাওয়ার স্প্রেয়ার ব্যতীত প্রায় সকল প্রকার হস্ত ও পা চালিত স্প্রেয়ার বর্তমানে দেশেই প্রস্তুত করা হচ্ছে। প্রতি বছর এর চাহিদা প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার। দেশে প্রস্তুতকৃত স্প্রেয়ারগুলোর মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ লেনদেন হচ্ছে ঢাকায় এবং বাকি শতকরা ৭০ ভাগ লেনদেন হচ্ছে দেশের অন্যান্য জেলায়। দেশে ব্যবহৃত মাড়াই যন্ত্রগুলোও এখন দেশের স্থানীয় কারখানাগুলোতে তৈরি করা হচ্ছে। দেশে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের মাড়াই যন্ত্রের সংখ্যা এখন ৪ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।এবং প্রতি বছর এর চাহিদা প্রায় ৬০ হাজার। এছাড়াও দেশে অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতির চাহিদা দিন দিন উচ্চহারে বেড়েই চলেছে। দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর আজ এর ওপর নির্ভর করে জীবিকা অর্জন করছে। তবে আরো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ সেক্টরে আরো দ্রুত প্রসার ঘটানো সম্ভব।
দেশের কৃষি যন্ত্রাংশের ওপর মাঠপর্যায়ে গবেষণারত কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের প্রফেসর ড. প্রকৌশলী এটিএম জিয়াউদ্দিন এর তথ্যানুসারে আশির দশকের গোড়ার দিকে দেশীয় কারখানার যন্ত্রাংশ উৎপাদন শুরু হয়। পুরনো ঢাকার জিনজিরা, ধোলাইখাল টিপু সুলতান রোড, নারায়ণগঞ্জের ডেমরায় বিপুল পরিমাণে কৃষি যন্ত্র উৎপাদন শুরু হয়। বর্তমানে বগুড়া, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ওয়ার্কশপে এখন প্রচুর পরিমাণে মানসম্মত যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে। দেশীয় এরকম ছোট ছ্ােট শিল্প কারখানা ৮৬ সালে ঘোষিত প্রথম শিল্পনীতিতে শিল্পায়নে জাতীয় মডেল হিসাবে স্থান পায়। এ কারখানায় বিদেশ হতে আমদানি বিকল্প অসংখ্য ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে। এসব কৃষি যন্ত্রাংশের মধ্যে পাওয়ার পাম্প, পাওয়ার টিলারের টাইন, ব্লেড, লাইনার পিস্টন, পিস্টন রিং, গজপিন ও অন্যান্য স্প্রেয়ার পাম্প বেশি পরিমাণে উৎপাদিত হচ্ছে। এগুলো যন্ত্রাংশ তৈরির মধ্যে শুধুমাত্র বর্তমানে বগুড়ায় ৮০-৮৫ শতাংশ যন্ত্রাংশ তৈরি হয়। বগুড়ার এক স্থানীয় যন্ত্রাংশ ব্যবসায়ীর সাথে আলাপকালে জানা যায়, বিদেশি যন্ত্রাংশ আমদানি করতে দেশ প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে। এতে দেশীয় কারখানাগুলোর উৎপাদিত পণ্যের বাজার চরমভাবে মার খাচ্ছে। দেশীয় যন্ত্রাংশের সঠিক মূল্যয়ান না করে ঢালাওভাবে বৈধ ও অবৈধ পন্থায় আমদানি করা হচ্ছে এ সব যন্ত্রাংশ। অথচ দেশের বগুড়ায় তৈরি ক্ষুদ্র কৃষি যন্ত্রাংশ দেশের চাহিদা মিটিয়ে নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও ভারতসহ অন্যান্য দেশে রফতানি হচ্ছে। কৃষি যন্ত্রাংশ কারখানাগুলো বর্তমানে দেশের সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। দেশে অবাধ আমদানি রোধ করে এ শিল্পকে আরো গতিশীল করতে প্রয়োজন সরকারি পদক্ষেপ। যে সকল ক্ষুদ্রযন্ত্রাংশ দেশে প্রস্তুত হচ্ছে সেসব আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে দেশে উৎপাদিত যন্ত্রাংশের মান নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সঙ্গে দেশীয় কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের ওপর মূল্য সংযোজন কর হ্রাস বা প্রত্যাহার করা প্রয়োজন। স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশীয় ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ তৈরি শিল্পকারখানাগুলোকে উন্নত করার লক্ষ্যে এ শিল্পে প্রয়োজনীয় মূলধনের জোগান দিয়ে বিনিয়োগ উৎসাহিত করা জরুরি। এতে দেশের বেকার জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ এ শিল্পে যোগদানের সুযোগ পাবে। দেশ বিপুল পরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে পারবে।
কৃষি সেক্টরের প্রতি স্তরে রোপণ থেকে শুরু করে শস্য ঘরে উঠানো পর্যন্ত কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বিপুল সম্ভাবনা আজ দেখা দিয়েছে। কিন্তু এ সব কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রযুক্তি মাঠপর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এখন প্রয়োজন সরকারি অবকাঠামো, কারিগরি জনবল ও সরকারি বেসরকারি সম্মিলিত উদ্যোগ। তবে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার কৃষক পর্যায়ে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বিভিন্ন বাধা দূর করতে এবং কৃষকদের এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিতে ও উৎসাহিত করতে বিগত জুলাই ২০১০ সন হতে বারি, ব্রি ও ডিএইর সম্মিলিত ‘কৃষি যন্ত্রপাতি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প’ চালু করে। ফলে দেশের কৃষি সেক্টরের কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষি যন্ত্র শিল্প ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। এ প্রকল্প হতে বাজারমূল্যের ৬০ ভাগ ছাড়ে কৃষকের কাছে কৃষি যন্ত্র দেয়া হচ্ছে বারি ও ব্রি উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতি হাইস্প্রিড রোটারি টিলার, বীজ বপন যন্ত্র, বেড প্লান্টার, জমি নিড়ানি যন্ত্র, গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্র, ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র, শস্য মাড়াই যন্ত্র, ধান-গম কর্তন যন্ত্র ও শস্য ঝাড়াই যন্ত্র যা কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কৃষককে যন্ত্র ব্যবহারে আগ্রহী করছে। যন্ত্রের কার্যকরী ব্যবহার নিশ্চিতকরণের জন্য এ প্রকল্পে হতে ২৪টি উপজেলার প্রায় ২০০০ কৃষককে এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক মেকানিককে কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে সেই সাথে কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারকদেরও মানসম্পন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খামার যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প হতেও ২৫ ভাগ ভর্তুকি মূল্যে কৃষকদের মাঝে কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ করা হচ্ছে। এসব প্রকল্প হতে খামার যান্ত্রিকীকরণ ফসল ফলনোত্তর কর্তনোত্তর ক্ষতি কমানোর বিষয়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান, মাঠ প্রদর্শনী আয়োজনের মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ, কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ, কৃষি শিক্ষার প্রসার ইত্যাদি কর্মকাণের জন্য ব্যাপকভিত্তিক পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করলে দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা হবে আশা করা যায়।
প্রকৌশলী মো. শোয়েব হাসান*
*পরিচালক, ডাল গবেষণা কেন্দ্র, ঈশ্বরদী, পাবনা
দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগৎ নিয়েই মানুষ ও মানুষের জীবন। হাদিস শরিফে আছে, ‘দুনিয়া হচ্ছে আখিরাতের কৃষিক্ষেত্র’। জীবনধারণের জন্য পার্থিব সম্পদ ও উপকরণ আহরণ তা প্রতিপালন এবং সংরক্ষণের সাধারণ নাম কৃষি। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। কৃষি সম্পর্কেও ইসলাম পর্যাপ্ত দিক নির্দেশনা প্রদান করেছে। কোরআন মজিদ ও হাদিস শরিফে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় মৌলিক নীতি ঘোষিত হয়েছে এবং কৃষির উন্নয়নের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইসলামের মৌলিক নীতির আলোকে কৃষি ও মানবকর্ম বিষয়ক ধারণা সবার জানা দরকার।
রিজিক
আল্লাহই সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও রিজিকদাতা। একজন মুমিন হিসেবে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হয়। মানুষ ও অন্য সব প্রাণীর আহার্যের উপকরণসমূহ তারই সৃষ্টি। মহান আল্লাহ তায়ালা খাবার বা আহার্যের উপকরণসমূহকে অনুগ্রহ করে মানুষের অধীনস্ত করে দিয়েছেন। এসব বিষয়ের বর্ণনায় কোরআন মজিদে বহু আয়াত নাজিল হয়েছে যেমন- ‘তোমরা কি দেখ না আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে আল্লাহ তায়ালা তার সমস্তই তোমাদের জন্য নিয়োজিত রেখেছেন। তোমাদের ওপর তার (আল্লাহর) প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করেছেন’ (সূরা লুকমান : আয়াত-২০)। পশুপাখি লালন পালন প্রসঙ্গে, ‘তিনি পশুকুল সৃষ্টি করেছেন। এগুলোতে রয়েছে তোমাদের জন্য শীত নিবারক উপকরণ ও উপকার। আর তা থেকে তোমরা আহার্য পেয়ে থাক’ (সূরা আন নাহল : আয়াত-৫)। মাছচাষ সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি জলরাশিতে অধীন করে দিয়েছেন, যাতে তা থেকে তোমরা তাজা মাছ আহার করতে পার’ (সূরা নাহল : আয়াত-১৪)।
অন্যদিকে মহান আল্লাহ তায়ালার ঐশী কুদরতের দ্বারা আমরা মাটি থেকে ফসল ফলাই। কোরআন মজিদে বলা আছে, ‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ করুক। আমি তো অঝর ধারায় বৃষ্টি বর্ষণ করেছি। অতঃপর মাটিকে বিদীর্ণ করেছি। আর তাতে উৎপন্ন করেছি শস্যাদি, আঙুর, শাকসবজি, জলপাই, খেজুর, বহু বৃক্ষ বিশিষ্ট বাগান, ফল-ফলাদি ও ঘাস। এসব তোমাদের ও তোমাদের পালিত পশুকুলের জীবনধারণের জন্য’ (সূরা আবাছা : আয়াত ২৪-৩২)। কোরআন মজিদে আরও বলা আছে- ‘বলতো কে সৃষ্টি করেছেন নভোম-ল ও ভূম-ল এবং আকাশ থেকে তোমাদের জন্য বর্ষণ করেছেন পানি, অত:পর তা দ্বারা আমি মনোরম বাগান সৃষ্টি করেছি’ (সূরা-নহল : আয়াত-৬০)। ফসল উৎপাদনে মানবীয় পরিশ্রমের ফলে খাদ্য উৎপাদন হয় না বরং বীজ হতে চারা, ভূগর্ভস্থ হতে সেচ, শিকড় মাটির গভীরে প্রবেশ, প্রত্যেকটি কাজই হয় আল্লাহ তায়ালার কুদরতি ব্যবস্থাপনায়। এ প্রসঙ্গে বলা আছে, তোমরা যে বীজ বপন কর সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা তা থেকে উৎপন্ন কর, না আমি উৎপন্নকারী? ইচ্ছা করলে, আমি উহা খরকুটা করে দিতে পারি। অতঃপর তোমরা হয়ে যাবে হতভম্ব’ (সূরা ওয়াক্বিয়া: আয়াত-৬৩-৬৫)। তাছাড়া ‘তোমরা যে পানি পান কর সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা তা মেঘ হতে নামিয়ে আন, না আমি বর্ষণ করি। আমি ইচ্ছা করলে উহা লোনা করে দিতে পারি। এসত্ত্বেও তোমরা কেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর না’। মহাবিশ্বের সৃষ্টি ব্যবস্থায় মানুষকে আল্লাহর খলিফার মর্যাদা দান করেছে।
রিজিক অন্বেষণ
মানুষকে খাদ্যবস্তু ও জীবন নির্বাহের উপকরণ ও উপাদান সংগ্রহ ও সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোরআন মজিদে এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা রয়েছে। যেমন- ‘তিনিই তোমাদের জন্য মাটিকে ব্যবহারের উপযোগী করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা এর দিক দিগন্তে বিচরণ কর এবং তার দেয়া রিজিক আহার কর। পুনরুজ্জীবন তারই কাছে হবে’ (সূরা মূলক : আয়াত-১৫)। কোরআন মজিদের অন্যত্রে বলা হয়েছে, ‘নামাজ শেষ হলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) অন্বেষণ কর এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর- যাতে তোমরা সফলকাম হও’। (সূরা জুমায়াহ : আয়াত-১০)। কোরআন মজিদের নির্দেশনার পাশাপাশি হাদিস শরিফের জীবন নির্বাহে কৃষিকর্মের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা জমিনের প্রচ্ছন্ন লুকায়িত ভা-ারে খাদ্য অন্বেষণ কর’ (তিরমিযী)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত ‘এটা দুর্ভিক্ষ নয় যে, তোমরা বৃষ্টি পাও না বরং ইহা দুর্ভিক্ষ যে, তোমরা বৃষ্টির উপর বৃষ্টি পাও অথচ ভূমিতে কিছু জন্মায় না’ (মুসলিম)। হুজুর (সা.) বলেছেন, ‘ফজরের নামাজের পর তোমরা জীবিকা অর্জনের কাজে অমনোযোগী হয়ে আবার ঘুমিয়ে যেও না’ (কানযুল উম্মাল)। কোরআন ও হাদিসের আলোকে কৃষি কাজ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা হলো, ‘আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য পৃথিবীর মধ্যে যেসব খাদ্যবস্তু ও জীবনধারণের উপকরণ তৈরি করে রেখেছেন তা আহরণ, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা করার দায়িত্ব মানুষেরই’। ‘মানুষের নেতিবাচক আমল, আলস্য ও কর্মবিমুখতাই অভাবের জন্য দায়ী’। ‘যে ব্যক্তি রিজিকের ব্যবস্থায় নিজের শ্রম ও জ্ঞানকে সঠিকভাবে কাজে লাগায় না সে নাফরমান ও গুনাহগার’।
জীবন নির্বাহ
শরিয়ত সম্মত ও হালাল রিজিক খাওয়ার উচিত। কোরআন মজিদে বলা হয়েছে, ‘ভালো যা তোমাদের দিয়েছি তা থেকে খাও’ (সূরা আরাফ : আয়াত-১৬০)। হাদিসে বলা আছে, ‘হালাল উপার্জনের অন্বেষণ ফরজ ইবাদাতের পরই আরেকটি ফরজ’ (বায়হাক্বী)। হাদিসে আরও বলা আছে, ‘সৎ পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্জিত খাদ্যই যে কোনো লোকের পবিত্রতম বা সর্বোত্তম হালাল খাদ্য’ (বোখারী)। এ সব উদ্ধৃতি থেকে বিচার করলে কৃষি অর্থাৎ ফসল উৎপাদন, বনায়ন, পশুপালন, মৎস্য চাষ ইত্যাদি কাজকে আমরা মানুষের শ্রেষ্ঠ ও পবিত্রতম জীবিকার উপায়।
কৃষি কাজের গুরুত্ব
ইসলামে কৃষি কাজের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। হাদিসে বর্ণিত আছে, হজরত আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন রাসূল (স.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলিম যদি বৃক্ষরোপণ করে কিংবা খাদ্যশস্যের বীজ বপন করে অতঃপর তা থেকে কোনো মানুষ, পাখি অথবা পশু কিছু অংশ খায় তবে তার জন্য এই কাজ (বীজ বপন) সাদাকাহ হিসেবে বিবেচিত হবে’ (বোখারী, মুসলিম)। ওই হাদিস হতে আমরা বিভিন্ন ধারণা পাই- প্রথমত, কৃষিকাজ করা কিংবা গাছ লাগানো জীবিকার একটি স্বাভাবিক মাধ্যম। যার উপকারিতা ও কল্যাণ মানুষ এবং পশুপাখি তথা সব জীবের ওপর সমভাবে পৌঁছে থাকে। দ্বিতীয়ত, কৃষিক্ষেত্র থেকে মানুষ বা পশু পাখি যারই উপকার ও কল্যাণ সাধিত হোক তার বিনিময়ে অবশ্যই সে (কৃষিক্ষেত্র তৈরিকারী) নেকি পেতে থাকে। তৃতীয়ত, কৃষির উন্নতি বিধান করা অবশ্যই জরুরি। কেননা কৃষি ব্যতিরেকে মানুষ কিংবা পশুপাখি সবার জীবন ও জীবিকাই সংকীর্ণ ও রুদ্ধ হয়ে থাকে। মহানবী (সা.) কোনো আবাদযোগ্য ভূমি কৃষিকাজ ব্যতিরেকে পতিত কিংবা অনাবাদি না রাখার জন্য দৃঢ় ঘোষণা দিয়েছিলেন- ‘যে ব্যক্তি কোনো পতিত ভূমি আবাদ করবে, সে সেই জমির মালিক হবে। এ ঘোষণার প্রতিধ্বনি আরেকটি হাদিস আছে, ‘যে ব্যক্তি এমন অনাবাদি জমি আবাদ করে যা অন্যের নয়, সে ওই জমির মালিকানার ব্যাপারে অর্ধেক দাবিদার’ (বোখারী শরীফ)। হজরত জাবির (রা) থেকে বর্ণিত রাসূল পাক (সা.) বলেন, ‘যার জমি আছে সে যেন নিজেই তা চাষ করে। যদি নিজে চাষ না করতে পারে তবে (পতিত না রেখে) কোনো প্রতিদান ছাড়াই যেন অপর ভাইকে তা দান করে’ (মুসলিম শরিফ)। কৃষি উন্নয়নমূলক সংস্কারে হজরত ওমর (রা.) বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তিনি সমগ্র বিজিত এলাকায় নদীনালায় সংস্কার, বাঁধ নির্মাণ, পুকুর খনন, জলাধার তৈরি ইত্যাদি কাজ করেছেন। স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠাসহ শুধু মিসরেই প্রায় এক লাখ বিশ হাজার শ্রমিক বার্ষিক ভিত্তিতে এই কৃষি সংস্কার উন্নয়নমূলক কাজে নিযুক্ত ছিল। কোরআন মজিদের বহু স্থানে বৃক্ষ, তরুলতা, বাগান ও উদ্যানের কথা উল্লেখ করে এর নানাবিধ উপকারের কথা ইঙ্গিত করা হয়েছে। ‘যিনি নানা প্রকারের লতা বিশিষ্ট ও কা-ের উপর দ-ায়মান বিশিষ্ট বাগান খেজুর গাছ ও নানা প্রকার খাদ্যের উদ্ভিদ, ভেষজ, ফল-ফলাদি, যাইতুন ও আনারের গাছ সৃষ্টি করেছেন, যা বাহ্যিক রূপে সাদৃশ্যপূর্ণ কিন্তু স্বাদে সাদৃশ্যহীন’ (সূরা আনআম: আয়াত-১৪১)। কোরআন মজিদে বলা আছে, ‘আমি জলধর মেঘমালা থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত করি। যাতে তা দ্বারা উৎপন্ন করি শস্য, উদ্ভিদ ও পাতাঘন উদ্যানরাজি’ (সূরা আন নাবা : আয়াত ১৪-১৬)।
মহানবী (সা.) বলেছেন, মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য প্রাণিজ আমিষের প্রয়োজন এবং পশুপাখিই এই উৎস। নবীজী আরও বলেছেন, তোমরা ভেড়া পালন কর। কারণ এরা সকাল সন্ধ্যায় তোমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। তিনি আরও বলেন, দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত সব নবীই মেষ চরিয়েছেন। নবীজী নিজেও মেষ পালন করেছেন। সূরা বাকারা ও সূরা আনয়াম-এই দুটি সূরার নামকরণ করা হয়েছে পশুর নামানুসারে। বাকারা শব্দের অর্থ গাভী এবং আনয়াম শব্দের অর্থ পশুসম্পদ। জলরাশিকে মাছচাষের উপযোগী করে অসংখ্য প্রজাতির বিচিত্র মাছ আল্লাহ তৈরি করেছেন যাতে মানুষ সাগর-মহাসাগর, নদনদী, পুকুর, হাওর-বাঁওড়, হ্রদ ইত্যাদি থেকে মাছ আহরণ করতে পারে এবং প্রয়োজনমতো পুকুর, ডোবা ও খাল বিলে মাছ চাষ করে প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে পারে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে বর্ণিত আছে, ‘দুইটি দরিয়া এক রকম নয়, একটির পানি সুমিষ্ট ও সুপেয় এবং অপরটির পানি লবণাক্ত ও বিস্বাদ। তোমরা প্রত্যেকটি থেকে মাছ ধরে এর তাজা গোশত খাও’ (সূরা ফাতির : আয়াত ১২)। সুস্বাদু ফল ফলাদি-জ্বালানি ও গৃহ সামগ্রী তৈরিতে গাছের তথা বনায়নের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবেশের ভারসাম্য বজায়, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার অন্যতম হাতিয়ার বনায়ন। মহানবী (সা.) বৃক্ষরোপণের জন্য সাহাবিগণকে উৎসাহিত করেছেন। তিনি নিজেও বাগানে কাজ করেছেন। তিনি বৃক্ষ রোপণ ও ফসল বপনকে সদকায়ে জারিয়ার কাজ বলেছেন। ‘কোনো মুসলমান বৃক্ষ রোপণ অথবা শস্য বপন করলে যদি তা থেকে কোনো মানুষ, পাখি অথবা পশু কিছু আহার করে তবে তা তার জন্য সাদাকাস্বরূপ হবে’ (বোখারী, মুসলিম)। বৃক্ষরাজি, তরু লতা ও উদ্ভিদসমূহ আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত। আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে এবং জমিনকে বিদীর্ণ করে আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য এগুলো সৃষ্টি করেছেন। খাবার, ফলমূল, পশুর খাদ্য ইত্যাদি আমরা বিভিন্ন গাছ-গাছালি থেকে পেয়ে থাকি। এ সম্পর্কে কোরআন মজিদে উল্লেখিত আছে ‘তিনি আমাদের জন্য বৃষ্টির দ্বারা জন্মান শস্য, জয়তুন খেজুর বৃক্ষ এবং সর্ব প্রকার ফল। অবশ্যই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে’ (সূরা নাহল : আয়াত-১১)।
প্রতিপালন ও সংরক্ষণ
কৃষি কাজের ওপর গুরুত্বের পাশাপাশি উপকরণসমূহের সদ্ব্যবহার ও উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণ করার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে কোরআন মজিদে বর্ণিত আছে- ‘তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবনধারণের উপকরণ) স্মরণ কর। আর জগতে বিনষ্টকারী ও বিপর্যয়কারী হয়ো না’ (সূরা আল আরাফ : আয়াত-৭৪)। এ প্রসঙ্গে হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘নবী করিম (স.) সম্পদ নষ্ট করতে নিষেধ করেছেন’ বোখারী ও মুসলিম)। নবীজী বৃক্ষ নিধন এমনকি অকারণে বৃক্ষের পাতা ছিঁড়তেও নিষেধ করেছেন। শস্য ব্যবহারের উপযোগী না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রহ করা বা বিক্রয় করা উচিত নয়। এ প্রসঙ্গে হজরত আবদুল্লাহ (রা) হতে বর্ণিত ‘রাসূলুল্লাহ (স.) ফলে পরিপক্বতা দেখা না দেওয়া পর্যন্ত বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন’ (বোখারি, মুসলিম)। জগতে সব প্রাণীই আল্লাহর পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।
হাদিস শরিফে আছে- ‘সব সৃষ্টি আল্লাহর পরিবারে অন্তর্ভুক্ত। অতএব, যে ব্যক্তি তার সৃষ্টি (প্রাণী ও উদ্ভিদ সব জীব)- এর প্রতি উত্তম আচরণ করবে সে তার নিকট অধিক প্রিয়’ (বায়হাক্বী)। উৎপাদিত ফসলের সংরক্ষণের ধারণা কোরআন মজিদের সূরা ইউসুফে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বহু বছর আগে নবী হজরত ইউসুফ (আ.) মিসরের দায়িত্বকালে শস্য সংরক্ষণ রীতি অনুযায়ী খাদ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণের সুব্যবস্থা করেছিলেন। ফলে পর পর সাত বছরের দুর্ভিক্ষের করালগ্রাস থেকে তার দেশবাসী মুক্তি পেয়েছিল। আল্লাহ পাক কোরআন মজিদে এ ব্যবস্থাপনার বর্ণনা করেছেন ‘তিনি (ইউসুফ আ.) বললেন, তোমরা সাত বছর উত্তমরূপে চাষাবাদ করবে। অতঃপর যে ফসল পাওয়া যাবে তার মধ্য থেকে সামান্য পরিমাণ খাবে অবশিষ্ট শস্য শিষসমেত রেখে দেবে। আর এরপর আসবে দুর্ভিক্ষের সাত বছর। তোমরা এ দিনের জন্য যা সঞ্চিত রেখেছিলে তা খেয়ে যাবে কিন্তু অল্প পরিমাণ ব্যতীত যা তোমরা তুলে রাখবে‘ (সূরা ইউসুফ : ৪৭-৪৮)। ইসলামের দৃষ্টিতে সংরক্ষণের আরেকটি দিক হলো অপচয় না করা। অপচয় উৎপাদনের সুফল নস্যাৎ করে এবং আর্থিক সচ্ছলতা ধ্বংস করে। কোরআন মজিদে বলা হয়েছে- ‘তোমরা অপচয় করো না, নিশ্চয়ই অপচয়কারী শয়তানের ভাই’ (সূরা বণী ইসরাইল : আয়াত-২৬-২৭)।
অতঃপর শুকরিয়া আদায় করা উচিত। কোরআন মাজিদে বলেছেন, ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর তাহলে অবশ্যই আমি তোমাদের সম্পদ বাড়িয়ে দেব’ (সূরা ইবরাহীম : আয়াত-৭)। অতঃপর শুকরিয়া জানানোও একটি নৈতিক দায়িত্ব। ভাবতেও ভালোলাগে কৃষিকাজ করা সুন্নত। শুকরিয়া জানাই করি নজরুলের অমর বাণীকে স্মরণ করে-
‘এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল
মিঠা নদীর পানি, খোদা তোমার মেহেরবানী’।
মোহাইমিনুর রশিদ*
* আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, সিলেট
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে হাওর। সুনামগঞ্জের শাল্লা, হাওরবেষ্টিত একটি উপজেলা। এখানে অধিকাংশ জমিতে বছরে একবার শুধু বোরো মৌসুমে প্রচুর পরিমাণ ধান জন্মানো হয়। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় সব জমি জলাবদ্ধ থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হাওরের জীববৈচিত্র্য, কৃষি ও জীবনযাত্রা নানাভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। দিনে দিনে হাওরে পলি ভরাটের ফলে একদিকে যেমন এর পানি ধারণক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে অন্যদিকে বৃষ্টিপাতের ধরনের পরিবর্তন যেমন- হঠাৎ হঠাৎ প্রচুর বৃষ্টির ফলে পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি করছে, যা এ এলাকার একমাত্র ফসল বোরো ধান চাষকে প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত করে। আবার খালগুলোতে পর্যাপ্ত পানি ধারণক্ষমতা না থাকায় ধান চাষের জন্য পর্যাপ্ত সেচের পানির অভাব দেখা দেয়। অগভীর হাওরের কিছু জমি আছে যা সাধারণত বন্যার পানিতে অপেক্ষাকৃত দেরিতে ডুবে আবার আগে জাগে। এমন মধ্যম নিচু জমিতে বিনা চাষে কিংবা চাষ দিয়ে সরিষার চাষ করা যায়, ফলে বোরো ধানের আগে আর একটি বাড়তি ফসল ঘরে তোলা সম্ভব।
কৃষক রিংকু বরন, গ্রাম-নিয়ামতপুর, ইউনিয়ন-হবিবপুর, উপজেলা-শাল্লা, জেলা- সুনামগঞ্জ। ইসলামিক রিলিফ, বাংলাদেশের সহায়তায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের পরামর্শে তিনি গত বছর তার ১০ শতক জমিতে বারি সরিষা-১৫ জাতের চাষ করেন। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে তিনি সরিষা বপন করেন এবং ডিসেম্বর মাসের শেষভাগে কর্তন করেন। তার ফসলের ক্ষেতের আশপাশে আর কোনো ফসল ছিল না বিধায় সরিষা ক্ষেতে গবাদিপশুর আক্রমণসহ নানা রকম আপদ মোকবেলা করেও প্রায় ১ টন/হেক্টর হারে ফলন পান। সরিষা চাষের জন্য তিনি স্থানীয় উপজেলা কৃষি অফিসারের পরামর্শ নিয়ে সার প্রয়োগসহ অন্যান্য পরিচর্যা নিশ্চিত করেন। সরিষার গাছগুলোকে তিনি পরবর্তীকালে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেন। অন্যদিকে এর খৈল গরুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেন।
স্থানীয় অন্যান্য কৃষকের মাঝে সরিষা চাষ ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। ভালো বীজ, পরামর্শ আর আর্থিক সহায়তা পেলে এ অঞ্চলে সরিষা চাষের মাধ্যমে কৃষকদের ঝুঁকি কমানোর সাথে সাথে ফসলের বৈচিত্র্য আনা সম্ভব। অধিক পরিমাণে সরিষার চাষ করা গেলে ভবিষ্যতে মৌমাছি চাষের মাধ্যমে বহু কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হবে অন্যদিকে তেল আমদানি বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
সরিষা চাষ পদ্ধতি
বীজ বপন সময় : অক্টোবর মাসের প্রথম থেকে মধ্য অক্টোবর।
বীজহার : বিঘাপ্রতি ৭০০-৮০০ গ্রাম।
বপন পদ্ধতি : জমিতে জো থাকা অবস্থায় বীজ ছিটিয়ে বুনতে হয়।
পরিচর্যা : প্রয়োজনে বীজ বপনের ১৫-২০ দিন পর একবার এবং ফুল আসার আগে দ্বিতীয়বার নিড়ানি দিতে হয়।
সেচ প্রয়োগ : বীজ বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ এবং ৫০-৫৫ দিনের মধ্যে দ্বিতীয় সেচ দিতে হবে। বপনের সময় মাটিতে রস কম থাকলে চারা গজানোর ১০-১৫ দিনের মধ্যে একটি হালকা সেচ দিতে হবে।
রোগ ও পোকামাকড় : প্রতি গাছে ৫০টির বেশি জাবপোকা থাকলে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি বা ডায়াজিনন ৬০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি. হারে মিশিয়ে দুপুরের পর স্প্রে করতে হবে কারণ এসময় মৌমাছি ক্ষেতে থাকে না।
সার প্রয়োগ : মাটিতে রসের তারতম্য অনুসারে সার প্রয়োগ করতে হয়।
সারের নাম বিঘাপ্রতি*
ইউরিয়া ২৬-৩৫ কেজি
টিএসপি ২০-২৪ কেজি
এমপি ১০-১২কেজি
জিপসাম ১৭-২০ কেজি
বরিক পাউডার ১.২৫ কেজি
*মাটির উর্বরতাভেদে এ সারের পরিমাণ কম বেশি হতে পারে।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি : ইউরিয়া সারের অর্ধেক এবং বাকি অন্যান্য সার বপনের আগে এবং বাকি অর্ধেক ইউরিয়া সার গাছে ফুল আসার সময় উপরি প্রয়োগ করতে হয়। সার উপরি প্রয়োগের পর হালকা সেচের ব্যবস্থা করতে হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃষি অভিযোজনবিষয়ক এ পাতাটি ইসলামিক রিলিফ, বাংলাদেশের সৌজন্যে প্রকাশিত। এ পাতাটিতে জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিযোজন সম্পর্কিত প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি বিষয়ে যে কেউ লেখা দিতে পারেন। ইসলামিক রিলিফ, বাংলাদেশ, হাউজ ১০, রোড ১০, ব্লক কে, বারিধারা, ঢাকা।
হ্যামিলনের বংশীবাদক
মুনশী আবদুল মোমেন*
হ্যামিলনের বংশীবাদক
কোথায় আছো ঘুমি?
একবার এসে দেখা কর
বাংলাদেশে তুমি।
আর কত সইব বন্ধু
সব হইল শেষ,
এবার ইঁদুর কুরে খাবে
আমাদের এই বাংলাদেশ।
কাটে কত কাগজপত্র
মহামূল্য অতি,
শাল কম্বল লেপ তোষক
কেটে করে ক্ষতি।
নষ্ট করে চারা গাছ
ক্ষেতের ফসল যত
কাঁচা পাকা ফল ফুল
কাটে অবিরত।
যত মারি তত বাড়ে
কমতি নাই তার
কাটে যত জিনিসপত্র
সব করে উজাড়।
তড়িতের তার কেটে
করে অনাসৃষ্টি
এত কিছুর প্রতি আজ
রাখব কত দৃষ্টি।
ঝুট জালিয়াতি নয় বন্ধু
টাকা দেবে সরকার
হ্যামিলনের বংশীবাদক
এসো তুমি একবার॥
ইঁদুর
মো. দুলা মিঞা**
রোডেনসিয়া বর্গ তাদের মিউরিডি পরিবার,
ছেদনদন্ত আছে ওদের, এই পরিচয় ইঁদুরের।
স্বভাব তাদের কাটাকাটি, মলত্যাগ বারবার,
রাত্রিবেলা আড়াল পথে নিরাপদে চলবার।
আসবাবপত্র, কাপড়চোপড়, নালায়, চালায়
টাকা, বই, দলিলেও দন্ত চালায়।
কাটে বাঁধ, ভিত আর ক্যাবল শুধু নয়
নালা কেটে করে তারা সেচের অপচয়।
ঘরে কাটে, মাঠে কাটে, গাছে কাটে ভাই
ফল আর ফসল শুধু নয়, সবই কাটা চাই।
কেটে করে সর্বনাশ অর্থ, সম্পদ, ফসলের
মল তাদের কারণ হয় পরিবেশ দূষণের।
রোগ বিস্তার করে এন্তার, কপাল ভাঙ্গে কৃষকের
আরামের ঘুম হারাম করে সর্বস্তরের মানুষের।
ঘরের ইঁদুর, গাছের ইঁদুর, মাঠের ইঁদুর ভাই
সবাই মোদের জ্ঞাত শত্রু, কাউকে খাতির নাই।
ইঁদুরকুলের চিরশত্রু মোদের বন্ধু ভাই
সাপ, গুঁইসাপ,শেয়াল, বেজি, পেঁচককে বাঁচাই।
বিড়াল পুষে, ফাঁদ পেতে ইঁদুর মারায় নেই লাজ,
ইঁদুরনাশক ব্যবহারে ইঁদুর মারা সহজ কাজ।
হ্যামিলনের বংশীবাদক ইঁদুরের এখন নয় জম,
দামালদের লাঠির আঘাতেই ইঁদুর বেটারা হয় খতম।
ইঁদুর করে অপচয়, হয় রোগের কারণ
সবে মিলে চল ভাই, করি ইঁদুর নিধন॥
* গ্রাম-লক্ষ্মীপদুয়া, ডাকঘর-মাহিনী বাজার, মাধ্যম-নাঙ্গলকোট, জেলা-কুমিল্লা,
** উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিস, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা
রাজু আহমেদ
ধামুরহাট, নওগাঁ
প্রশ্ন : ধান গাছের পাতা পেঁয়াজ পাতার মতো নলাকার হয়ে যায়। মাঝে মাঝে কচি কা-ের ভেতরে পোকায় খেয়ে ফেলছে। এ পোকা কীভাবে দমন করা যাবে।
উত্তর : নলি মাছি বা গলমাছির কীড়া ধান গাছের বাড়ন্ত কুশিতে আক্রমণ করে এবং আক্রান্ত কুশি পেঁয়াজ পাতার মতো হয়ে যায়। ফলে কুশিতে আর শিষ হয় না। প্রতিকার হিসাবে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
১. রোপণের পর নিয়মিত জমি পর্যবেক্ষণ করা।
২. আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে পূর্ণবয়স্ক পোকা দমন করা।
৩. জমিতে শতকরা ৫ ভাগ পেঁয়াজ পাতার মতো লক্ষণ দেখা গেলে কার্বোফুরান অথবা ফেনিট্রোথিয়ন জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
মঈনউদ্দিন আহম্মেদ
লালপুর, নাটোর
প্রশ্ন : শিমের পাতার নিচের দিকে শিরা বরাবর লাল বা কালো দাগ পড়ে। এছাড়া ফলের ওপর ছোট ছোট দাগ পড়ে। করণীয় কী?
উত্তর : এটি শিমের ছত্রাকজনিত রোগ। আক্রান্ত বীজ, পরে চারা ও গাছ এবং তার অবশিষ্টাংশের মাধ্যমে এ রোগ বিস্তৃত হয়। প্রতিকার হিসাবে-
১. রোগমুক্ত ভালো বীজ ব্যবহার করতে হবে।
২. শিমের পরিত্যক্ত অংশ একত্র করে পুড়িয়ে ফেলা।
৩. বীজ শোধন করা (প্রোভেক্স ২.৫ গ্রাম বা ব্যাভিস্টিন ২ গ্রাম/ ১ কেজি বীজ)।
৪. গাছে রোগের লক্ষণ দেখা দিলে ছত্রাকনাশক টিল্ট-২৫০ ইসি ০.৫ মিলি. বা ডাইথেন এম-৪৫ ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা।
বাদল রায়
খানসামা, দিনাজপুর
প্রশ্ন : করলার পাতা ছোট হয়ে গুচ্ছ আকারে হয়ে গেছে। কী করলে উপকার পাব।
উত্তর : এটি করলার মাইকোপ্লাজমাজনিত রোগ। এ রোগে আক্রান্ত গাছের পাতাগুলো গুচ্ছ আকারে দেখা যায়। গাছ বাড়ে না। ফুল ও ফল কমে যায়। বাহক পোকা হিসেবে জ্যাসিড পোকা দ্বারা এ রোগ ছড়ায়।
১. আক্রান্ত গাছ দেখামাত্র তুলে নষ্ট বা পুড়িয়ে ফেলা।
২. রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা।
৩. ক্ষেতের আশপাশের আগাছা পরিষ্কার করা।
৪. বাহক পোকা ধ্বংস করার জন্য বালাইনাশক প্রয়োগ করা যেমন- এসাটাফ, টিডো, এডমায়ার এর যে কোনো একটি।
মো. মনিরুজ্জামান
নীলফামারী
প্রশ্ন : নারিকেলের চারায় উঁইপোকা আক্রমণ কীভাবে প্রতিহত করব।
উত্তর : উঁইপোকা চারা গাছের শিকড় নষ্ট করে গাছের ক্ষতি করে। এ পোকা দমনে যা করতে হবে তাহলো-
- উঁইপোকার ঢিবি খনন ও ধ্বংস করতে হবে।
- গাছের গোড়ার মাটি কুপিয়ে পরিষ্কার করা।
- উঁইপোকার আক্রমণ বেশি হলে কীটনাশক ক্লোরপাইরিফস (ডার্সবান) প্রতি লিটার পানিতে ৫ মিলি. হারে মিশিয়ে মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
মো. আমিনুল ইসলাম
নওগাঁ
প্রশ্ন : ঢেঁড়সের পাতা বিবর্ণ হয়ে কুঁকুড়ে যাচ্ছে। কী করলে উপকার পাবো।
উত্তর : ঢেঁড়সের জ্যাসিড/সাদামাছি পোকা চারা গাছ থেকে শেষ পর্যন্ত পাতার রস চুষে খায় এবং আক্রান্ত পাতা বিবর্ণ হয় ও কুঁকড়ে যায়। এ পোকা দমনে করণীয় হলো-
- ক্ষেতের আশপাশে বেগুন, তুলা, মেস্তা চাষ না করা।
- আক্রান্ত গাছ তুলে নষ্ট করা।
- পোকার আক্রমণ বেশি হলে ডাইমেথয়েড অথবা ইমিডাক্লোরপিড জাতীয় কীটনাশক গাছে স্প্রে করতে হবে।
সুমন
চট্টগ্রাম
প্রশ্ন : ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র বা ইউএমএস তৈরি করা যায় কীভাবে?
উত্তর : ইউএমএস তৈরির প্রথম শর্ত হলো সর্বদা এর গঠন সঠিক রাখতে হবে। ১০০ কেজি ইউএমএস তৈরি করতে হলে ৮২ কেজি শুকনা খড়, ১৫ কেজি চিটাগুড় ও ২-৩ কেজি ইউরিয়া মিশাতে হবে। খড়গুলো পলিথিন বিছিয়ে তার ওপর মাঝারিভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। বালতিতে ৫ লিটার পানির সাথে ৩ কেজি ইউরিয়া মিশিয়ে নিতে হবে। এবারে মিশ্রণটি খড়ের ওপর অর্ধেক ছিটিয়ে দিতে হবে। খড়গুলোর গায়ে ভালোভাবে মিশ্রণ লাগিয়ে উক্ত খড় গরুকে খেতে দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে মিশ্রণ যেন কোনোভাবেই পলিথিনে আটকে না থাকে। এভাবে তৈরি ইউএমএস ৩ দিনের বেশি সংরক্ষণ না করাই ভালো।
মমিনুল
নীলফামারী
প্রশ্ন : তড়কা বা অ্যানথ্রাক্স রোগের লক্ষণ ও প্রতিরোধ সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর :
রোগের লক্ষণ
১. তড়কা রোগে মৃত্যুহার অত্যধিক, অনেক ক্ষেত্রে লক্ষণ প্রকাশের অল্পক্ষণের মধ্যেই হঠাৎ করে মৃত্যু হতে পারে।
২. প্রচ- জ্বর হয়। জ্বরের ফলে কাঁপুনি দেখা যায় ও লোম খাঁড়া হয়ে যায়। তাপমাত্রা ১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে।
৩. ক্ষুধামন্দা, পেটফাঁপা, পেটে ব্যথার কারণে লাথি মারে, রক্ত মিশ্রিত প্রস্রাব ও তরল পায়খানা হতে পারে। রোগের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে মল আলকাতরার মতো কালো ও শক্ত হয়ে যায়।
৪. ঘাড়ের পেছনে চামড়ার নিচে তরল পদার্থ জমে ফুলে উঠে।
৫. গর্ভবতী গাভীতে গর্ভপাত ও দুগ্ধবর্তী গাভীর দুধ উৎপাদন কমে যায়।
৬. রোগের চূড়ান্ত পর্যায়ে পশু নিস্তেজ হয়ে পড়ে। শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, মাংসপেশিতে কাঁপুনি ও খিঁচুনি দেখা দেয়। লক্ষণ প্রকাশের ১-৩ দিনের মধ্যে আক্রান্ত পশু হঠাৎ পড়ে মারা যায় এবং নাক, মুখ ও মলমূত্রের ছিদ্রপথ দিয়ে রক্ত বের হতে পারে।
প্রতিরোধ :
১. তড়কা রোগের জীবাণু পরিবেশে অনেক দিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। স্যাঁতসে্যঁতে পরিবেশে এ জীবাণু বেশি বিস্তার লাভ করে। তাই এ রোগে মৃত পশু আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে বা ২ মিটার গভীর গর্তে পর্যাপ্ত কলিচুন সহযোগে পুঁতে ফেলতে হবে।
২. আক্রান্ত পশুর প্রাকৃতিক ছিদ্রপথগুলো দিয়ে মৃত্যুর আগে বা পড়ে যাতে রক্ত বের হতে না পারে সেজন্য তুলা দিয়ে ছিদ্রপথগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। মাটিতে আক্রান্ত পশুর রক্ত পড়ে থাকলে রক্তসহ মাটি পুড়িয়ে ফেলতে হবে অথবা গভীর গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে।
৩. এ রোগে আক্রান্ত মৃত পশু কাটা ছেঁড়া করা উচিত নয়। ময়নাতদন্ত করার প্রয়োজন হলে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মনে রাখতে হবে অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণু দ্বারা মানুষও আক্রান্ত হয়।
৪. পশুজাত দ্রব্য অর্থাৎ মিট বা বোনমিল থেকেও জীবাণু ছড়াতে পারে বলে আক্রান্ত পশুর উপজাত থেকে মিট বা বোনমিল তৈরি করা উচিত নয়।
৫. এ রোগে আক্রান্ত হলে আশপাশের সমস্ত পশুকে সঙ্গে সঙ্গে পৃথক করা উচিত এবং সুস্থ পশুকে অ্যানথ্রাক্স রোগের টিকা প্রদান করা উচিত।
জাহিদুর রহমান
বরগুনা
প্রশ্ন : মাছের সুষম খাবার তৈরি ও প্রয়োগ পদ্ধতি কী?
উত্তর : পুকুরের মাছের ওজনের ৩%-৫% হারে ভালো কোম্পানির ফিড প্রতিদিন প্রয়োগ অথবা খৈল, চালের কুঁড়া, গমের ভুসি ১০০ কেজি মাছের জন্য ৩ কেজি খাবার (১.৫ কেজি একদিন পূর্বে ভিজিয়ে রাখা খৈল ও ১.৫ কেজি গমের ভুসি বা চালের কুঁড়া) মিশিয়ে ছোট ছোট ম- তৈরি করে পুকুরে প্রয়োগ করা। খাবারগুলো মাটির পাত্রে অথবা প্লাস্টিকের চটের ওপর রাখলে ভালো হয়, কারণ মাছ খাবার খেল কিনা তা সঠিকভাবে জানতে পারা যাবে। যদি ২ দিন পরও খাবার দেখা যায় তাহলে মাছের খাবার কমিয়ে দিতে হবে। এক কেজি আদর্শ মাছের খাবার তৈরিতে গমের ভুসি ৩০০ গ্রাম, চালের কুঁড়া ২০০ গ্রাম, ফিশমিল ২০০ গ্রাম, আটা ১০০ গ্রাম, পূর্বে ভিজানো খৈল ২০০ গ্রাম প্রয়োজন। সেসঙ্গে ভিটামিন প্রিমিক্স ১ কেজি খাবারে ১ চা চামচ, লবণ ১ চা চামচ ও চিটাগুড় প্রয়োজনমতো (ম- প্রস্তুত করতে যতটুকু প্রয়োজন ১০০-২০০ গ্রাম) মিশাতে হবে।
মোহাম্মদ সুজন আলী
পঞ্চগড়
প্রশ্ন : পুকুরে শ্যাওলা জমে মাছ মারা যাচ্ছে। করণীয় কী?
উত্তর : কাপড় বা মশারি দিয়ে শ্যাওলার আস্তরণ তুলে ফেলতে পারলে ভালো। খড়ের দড়ি বেঁধে তা দিয়ে পুকুরের ওপরে টেনে এক কোণায় এনে তুলে ফেলতে হবে। অথবা শ্যাওলার স্তর একত্র করার পর ২০০-২৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দিলে তা নষ্ট হয়ে যাবে। এ ধরনের সমস্যায় তুঁতের ব্যবহার করা যেতে পারে। একরপ্রতি ২০-২৫টি ৫০ গ্রাম তুঁতে কাপড়ের পুঁটলিতে খুঁটিতে বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে রাখা। তাছাড়া শতকপ্রতি ০.৫ কেজি চুন প্রয়োগেও ফল পাওয়া যায়।
শামিম আহমেদ
রাজশাহী
প্রশ্ন : পুকুরে কীভাবে চুন প্রয়োগ করব?
উত্তর : সাধারণত চুন পানিতে গুলালে পানির তাপমাত্রা বেড়ে যায় অর্থাৎ পানি গরম হয়ে যায়। তাই পুকুরে পোনা থাকা অবস্থায় কখনোই সরাসরি পুকুরে চুন দেয়া যাবে না, চুন পানিতে গুলিয়ে ঠা-া করে পুকুরে দিতে হবে। সন্ধ্যার সময় পরিমাণমতো চুন একটি টিনের বালতি বা মাটির গর্তে পানি দিয়ে গুলিয়ে পরদিন সকালে উক্ত পানিতে গুলানো ঠা-া চুন একটি থালা দিয়ে পাড়সহ সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মারুফ*
* কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, সবাইকে হৈমন্তীয় শুভেচ্ছা। হেমন্ত বাংলা ঋতুচক্রের এক কাব্যিক উপাখ্যান। সংস্কৃতিতে ঐতিহ্যে হেমন্ত যেমন সুন্দরের কাব্য শশি তেমনি কৃষি ভুবনের চৌহদ্দিতে হেমন্ত কাজেকর্মে ব্যস্ততায় এক স্বপ্নিল মধুমাখা আবাহনের অবতারণা করে। সোনালি ধানের সম্ভার সুঘ্রাণে ভরে থাকে বাংলার মাঠ প্রান্তর। কৃষক মেতে ওঠে ঘাম ঝরানো সোনালি ফসল কেটে মাড়াই-ঝাড়াই করে শুকিয়ে গোলা ভরতে। সে সাথে শীতকালীন ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো শুরু করতে হবে এখনই। তাহলে আসুন আমরা জেনে নেই কার্তিক মাসে আমাদের করণীয় কাজগুলো।
আমন ধান
এ মাসে অনেকের আমন ধান পেকে যাবে তাই রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে। আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে প্রথমেই সুস্থ সবল ভালো ফলন দেখে ফসল নির্বাচন করতে হবে। এরপর কেটে, মাড়াই-ঝাড়াই করার পর রোদে ভালো মতো শুকাতে হবে। শুকানো গরম ধান আবার ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হবে এবং ছায়ায় রেখে ঠাণ্ডা করতে হবে। পরিষ্কার ঠাণ্ডা ধান বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ রাখার পাত্রকে মাটি বা মেঝের ওপর না রেখে পাটাতনের ওপর রাখতে হবে। পোকার উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে হলে ধানের সাথে নিম, নিসিন্দা, ল্যান্টানার পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে মিশিয়ে দিতে হবে।
গম
কার্তিক মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম বীজ বপনের প্রস্তুতি নিতে হয়। দো-আঁশ মাটিতে গম ভালো হয়। অধিক ফলনের জন্য গমের আধুনিক জাত যেমন- আনন্দ, বরকত, কাঞ্চন, সৌরভ, গৌরব, শতাব্দী, সুফী, বিজয়, বারি গম-২৭, বারি গম-২৮ রোপণ করতে হবে। বীজ বপনের আগে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। সেচযুক্ত চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৬ কেজি এবং সেচবিহীন চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৩ কেজি বীজ বপন করতে হবে। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার জমি তৈরির শেষ চাষের সময় এবং ইউরিয়া তিন কিস্তিতে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপনের ১৩-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ প্রয়োজন এবং এরপর প্রতি ৩০-৩৫ দিন পর ২ বার সেচ দিলে খুব ভালো ফলন পাওয়া যায়।
আখ
এখন আখের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। ভালোভাবে জমি তৈরি করে আখের চারা রোপণ করা উচিত। আখ রোপণের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব ৯০ সেমি. থেকে ১২০ সেমি. এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৬০ সেমি. রাখতে হবে। এভাবে চারা রোপণ করলে বিঘাপ্রতি ২২০০-২৫০০ চারার প্রয়োজন হয়।
ভুট্টা
ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে এবং জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হবে। ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি ভুট্টা-৬, বারি ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৮, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৯, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১০, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১১ এসব।
সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল
কার্তিক মাস সরিষা চাষেরও উপযুক্ত সময়। সরিষার প্রচলিত জাতগুলোর মধ্যে টরি-৭, রাই-৫, কল্যাণীয়া, সোনালি, সম্পদ, বারি সরিষা-৬, বারি সরিষা-৭, বারি সরিষা-৮ উল্লেখযোগ্য। জাতভেদে সামান্য তারতম্য হলেও বিঘাপ্রতি গড়ে ১ থেকে ১.৫ কেজি সরিষার বীজ প্রয়োজন হয়। বিঘাপ্রতি ৩৩-৩৭ কেজি ইউরিয়া, ২২-২৪ কেজি টিএসপি, ১১-১৩ কেজি এমওপি, ২০-২৪ কেজি জিপসাম ও ১ কেজি দস্তা সারের প্রয়োজন হয়। সরিষা ছাড়াও অন্যান্য তেল ফসল যেমন- তিল, তিসি, চিনাবাদাম, সূর্যমুখী এ সময় চাষ করা যায়।
আলু
আলুর জন্য জমি তৈরি ও বীজ বপনের উপযুক্ত সময় এ মাসেই। হালকা প্রকৃতির মাটি অর্থাৎ বেলে দো-আঁশ মাটি আলু চাষের জন্য বেশ উপযোগী। ভালো ফলনের জন্য বীজ আলু হিসেবে যে জাতগুলো উপযুক্ত তাহলো ডায়মন্ড, মুল্টা, কার্ডিনাল, প্যাট্রেনিজ, হীরা, মরিণ, অরিগো, আইলশা, ক্লিওপেট্রা, গ্রানোলা, বিনেলা, কুফরীসুন্দরী এসব। প্রতি বিঘা জমি আবাদ করতে ২০০-২৭০০ কেজি বীজ আলুর দরকার হয়।
এক বিঘা জমিতে আলু আবাদ করতে ৪৫ কেজি ইউরিয়া, ৩০ কেজি টিএসপি, ৩৩ কেজি এমওপি, ২০ কেজি জিপসাম এবং ২ কেজি দস্তা সার প্রয়োজন হয়। তবে এ সারের পরিমাণ জমির অবস্থাভেদে কম-বেশি হতে পারে। তাছাড়া বিঘাপ্রতি ১.৫ টন জৈবসার ব্যবহার করলে ফলন অনেক বেশি পাওয়া যায়। আলু উৎপাদনে আগাছা পরিষ্কার, সেচ, সারের উপরিপ্রয়োগ, মাটি আলগাকরণ বা কেলিতে মাটি তুলে দেয়া, বালাইদমন, মালচিং করা আবশ্যকীয় কাজ। সময়মতো সবগুলো কাজ করতে পারলে খরচ কমে আসে, ফলন বেশি হয়।
মিষ্টি আলু
নদীর ধারে পলি মাটিযুক্ত জমি এবং বেলে দো-আঁশ প্রকৃতির মাটিতে মিষ্টি আলু ভালো ফলন দেয়। তৃপ্তি, কমলা সুন্দরী, দৌলতপুরী আধুনিক মিষ্টি আলুর জাত। প্রতি বিঘা জমির জন্য তিন গিঁটযুক্ত ৭৫০-৮০০ খ- লতা প্রয়োজন হয়। বিঘাপ্রতি ১.৫ টন গোবর/জৈবসার, ৫ কেজি ইউরিয়া, ১৫ কেজি টিএসপি, ২০ কেজি এমওপি সার দিতে হবে। আলুর মতো অন্যান্য পরিচর্যা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যাবে।
ডাল ফসল
ডালকে বলা হয় গরিবের আমিষ। আমিষের ঘাটতি পূরণ করতে ডাল ফসল চাষে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। মুসুর, মুগ, মাসকলাই, খেসারি, ফেলন, অড়হর, সয়াবিন, ছোলাসহ অন্যান্য ডাল এসময় চাষ করতে পারেন। এজন্য উপযুক্ত জাত নির্বাচন, সময়মতো বীজ বপন, সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ, পরিচর্যা, সেচ, বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করতে হবে। সরকার ডাল ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সহজ শর্তে কৃষি ঋণ প্রদান করছেন।
শাকসবজি
শীতকালীন শাকসবজি চাষের উপযুক্ত সময় এখন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বীজতলায় উন্নতজাতের দেশি-বিদেশি ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, বাটিশাক, টমাটো, বেগুন এসবের চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলায় বীজ বপন করতে হবে। আর গত মাসে চারা উৎপাদন করে থাকলে এখন মূল জমিতে চারা রোপণ করতে পারেন। রোপণের পর আগাছা পরিষ্কার, সার প্রয়োগ, সেচ নিকাশসহ প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে। তাছাড়া লালশাক, মুলাশাক, গাজর, মটরশুঁটির বীজ এ সময় বপন করতে পারেন।
অন্যান্য ফসল
অন্যান্য ফসলের মধ্যে এ সময় পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, ধনিয়া, কুসুম, জোয়ার এসবের চাষ করা যায়। সাথী বা মিশ্র ফসল হিসেবেও এসবের চাষ করে অধিক ফলন পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে আধুনিক চাষাবাদ কৌশল অবলম্বন করতে হবে।
প্রাণিসম্পদ
সামনে শীতকাল আসছে। শীতকালে পোলট্রিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যায় এবং রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, বসন্ত রোগ, কলেরা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। এসব রোগ থেকে হাঁস-মুরগিকে বাঁচাতে হলে এ মাসেই টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। গত মাসে ফুটানো মুরগির বাচ্চার ককসিডিয়া রোগ হতে পারে। রোগ দেখা দিলে সাথে সাথে চিকিৎসা করাতে হবে।
গবাদিপ্রাণীর আবাসস্থল মেরামত করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। গবাদিপ্রাণীকে খড়ের সাথে তাজা ঘাস খাওয়াতে হবে। ভুট্টা, মাসকালাই, খেসারি রাস্তার ধারে বা পতিত জায়গায় বপন করে গবাদিপ্রাণীকে খাওয়ালে স্বাস্থ্য ও দুধ দুটোই বাড়ে। রাতে অবশ্যই গবাদিপ্রাণীকে বাহিরে না রেখে ঘরের ভেতরে রাখতে হবে। তা নাহলে কুয়াশায় ক্ষতি হবে। গবাদিপ্রাণীকে এ সময় কৃমির ওষুধ খাওয়াতে হবে। এছাড়া তড়কা, গলাফুলা রোগের বিষয়ে সচেতন থাকলে মারাত্মক সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
মৎস্যসম্পদ
এ সময় পুকুরে আগাছা পরিষ্কার, সম্পূরক খাবার ও সার প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাও জরুরি। রোগ প্রতিরোধের জন্য একরপ্রতি ৪৫-৬০ কেজি চুন প্রয়োগ করতে পারেন। অংশীদারিত্বের জন্য যেখানে যৌথ মাছ চাষ সম্ভব নয় সেখানে খুব সহজে খাঁচায় বা প্যানে মাছ চাষ করতে পারেন। এছাড়া মাছ সংক্রান্ত যে কোনো পরামর্শের জন্য উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, শীতকাল আমাদের কৃষির জন্য একটি নিশ্চিত মৌসুম। যতবেশি যৌক্তিক বিনিয়োগ করতে পারবেন লাভও পাবেন তত বেশি। শুকনো মৌসুম বলে মাটিতে রস কম থাকে। তাই যদি প্রতি ফসলে চাহিদামাফিক সেচ প্রদান নিশ্চিত করতে পারেন তাহলে দেখবেন আপনার জমির ফলন কতখানি বাড়ে। একমাত্র কৃষির মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করতে পারি। আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আধুনিক কৃষির সব ক’টি কৌশল যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা আমাদের কাক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছতে পারবো। এছাড়া কৃষির যে কোনো সমস্যায় আপনার কাছের উপজেলা কৃষি অফিস, উপজেলা মৎস্য অফিস ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের পরামর্শ নিতে পারেন। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা। কৃষির সমৃদ্ধিতে আমরা সবাই গর্বিত অংশীদার।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*
* সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫