নিরাপদ সবজি করব চাষ, পুষ্টি মিলবে বার মাস- শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে সবজি মেলা ২০১৯ জানুয়ারি ২৪-২৬ তারিখ শুরু হচ্ছে। কৃষিকথার গ্রাহক হয়েছিলাম ১৯৯৫ সালের দিকে আমি যখন ছাত্র। কৃষি তথ্য সার্ভিসের কর্তাব্যক্তিদের অনুরোধ ও আমার আগ্রহ মিলে আধুনিক কৃষির এক আশাব্যঞ্জক কৃষি সেক্টর ছাদবাগানে নিরাপদ সবজি চাষ বিষয়ক খুঁটিনাটি অনেকেই জানেন শুধু সবাইকে এর চাহিদা ও গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য এ লেখা।
ঢাকা শহরে কমপক্ষে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ ছাদ রয়েছে (সাড়ে চার হাজার হেক্টরের বেশি) যা দেশের কোন একটি উপজেলার সমান বা বেশি। যেখানে বাসস্থান, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, ব্যাংক, শপিংমল, কনভেনশন সেন্টার ইত্যাদি অধিকাংশ জায়গা দখল করে আছে। এই পরিমাণ জায়গা কোনো অবস্থাতেই ছোট করে দেখার উপায় নেই। ব্যক্তিপর্যায়ে বা একক প্রধানের বা সমিতির নিয়ন্ত্রণে বিধায় এসব স্থান সবুজের আওতায় বিশেষ করে সবজি-ফল চাষের আওতায় নিয়ে আসা অধিকতর সহজ ও নিরাপদ। বিল্ডিং কোডে ২০% সবুজ থাকার কথা রয়েছে (যা ছাদবাগান নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো ও পলিসি মেকারের ইচ্ছার প্রতিফলন) যেটি পুরোপুরি অনেক জায়গায় উপেক্ষিত থাকে। ঢাকা শহর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে অতি দ্রুত হিট আইল্যান্ডে (Heat Island) পরিণত হচ্ছে, যার পরিণাম পরবর্তী প্রজন্মকে ভোগ করতে হবে।
শহরের উত্তপ্ত আইল্যান্ড (Heat Island) নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব কমানোর উপায় :
প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের সবুজ ঢাকা
প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের সবুজ ঢাকা বাস্তবায়নই একমাত্র পারে ঢাকাকে বসবাসের যোগ্য রাখতে এবং তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান মেয়র জামাল মোস্তফা সবুজ কারিগর হিসেবে কৃষি তথ্য সার্ভিস, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ কারিগরি সহায়তা নিয়ে কাজ করছে বেশ কিছু শহুরে কৃষিসহায়ক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন- গ্রীন সেভার্স গাছ ও ফসলের হাসপাতাল নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে সেবা ও সবুজ করার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এ ছাড়াও প্রায় ২০০ প্রতিষ্ঠান ছাদবাগানের বীজ, জৈবসার, কলম ইত্যাদি প্রদানসহ তাদের কার্জক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ছাদবাগানের একটি আবশ্যকীয় ও জনপ্রিয় কম্পোনেন্ট হলো- নিরাপদ সবজি আবাদ, যা একটি চ্যালেঞ্জও। ছাদবাগানিদের নিরাপদ সবজি খাওয়ার আকাঙ্কা থেকে সবজি-ফসল চাষে শহুরে কৃষকদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে।
ছাদবাগান বিষয়ক গবেষণার হালচাল : ছাদবাগানে সবজি ও কৃষি ফসল আবাদ নিয়ে কৃষি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে যাচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ঢাকার মিরপুর-১০ এলাকায় ১০০টি পরিবার নিয়ে জরিপে দেখিয়েছে ছাদবাগানিদের ৪১% তরুণ, ৩০% মধ্যবয়সী এবং ২৮% বয়স্ক মানুষ। ফসলের মধ্যে অর্নামেন্টাল, ঔষধি, ছোট হার্বজাতীয় ফসলের চাষাবাদ করতে পছন্দ করেন। ২য় স্থানে ফল এবং ৩য় স্থানে সবজি আবাদের পরিমাণ। একটি পরিবারের উন্মুক্ত ও খালি স্থানে যে কোনো পাত্রে নিরাপদ সবজি চাষ পরিবারের চাহিদা মেটাতে সক্ষম।
সবজি চাষের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিরাপদ বা জৈবভাবে সবজি বা ফল চাষ করা । নিরাপদ সবজি চাষে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো জেনে রাখা ভালো-
মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা : ট্রাইকোডার্মা মিশ্রিত সার, বায়োচার ইত্যাদি মাটি শোধন বা হাইজিন করতে ভালো উপাদান।
জৈব সার : ভার্মি কম্পোস্ট, রান্নাঘর ও খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ দিয়ে বানানো সার, চা-কম্পোস্ট, ডিম খোসা ভাঙা মিশানো, নতুন মাশরুম কম্পোস্ট (পটাশ ও ফসফরাস আধিক্য), নিম খৈল, সরিষা খৈল ইত্যাদি ছাড়াও যে কোনো বায়োলজিক্যাল কম্পোস্ট (ব্যাকটেরিয়াবিহীন) ব্যবহার করা যেতে পারে।
রোগ-পোকামাকড় দমন : নিরাপদ সবজি চাষে রাসায়নিক পেস্টিসাইড ব্যবহার করতে হবে নিয়ম মেনে; শাকজাতীয় সবজিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার না করলেও চলে কিন্তু ফলজাতীয় সবজি চাষে সবজি আহরণের কমপক্ষে ২০ দিন আগে থেকে রাসায়নিক সার ব্যবহার না করা।
পোকা দমনে ফ্লাইং ইনসেক্টের জন্য ফেরোমন ট্রাপ, সোলার লাইট ট্রাপ (কারিগরি সহায়তার জন্য ডিএই, এআইএস, ফ্যাব-ল্যাব শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় যোগাযোগ করতে পারেন), আঠালো (Sticky trap) ট্রাপ, পেঁয়াজ পাতার ও ছোলা পেস্ট বা নির্যাস, রসুন, গাঁদা ও চন্দ্রমল্লিকার (সর্বাধিক কার্যকরী-ফুলের দোকানে ফেলে দেয়া ফুল সংগ্রহ করে) ফুলের নির্যাস ভালো কাজ করবে।
পার্চিং : ছাদবাগানে পাখি বসার জায়গা করে দেয়া ভালো। বাগানের ফল-সবজি তখনই পাখি খাবে যখন তা নিরাপদ ও বিষমুক্ত থাকবে। এরা অনেক পোকামাকড়ও খাবে। পাখিকেও খেতে দিন তাহলেই তো নিরাপদ সবজি ও ফসল উৎপাদনের সাথে সাথে টেকসই পরিবেশ রক্ষা হবে সবার জন্যই।
অলটারনেটিভ চাষাবাদ : একই স্থানে একই পরিবারের সবজি (পরিবর্তন করে চাষ) যেমন- টমেটো, বেগুন, আলু পাশাপাশি না করা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকলি ইত্যাদি একসাথে চাষ না করা।
মিশ্র-ফসল : একই সাথে একটি বেডে ফল গাছের ড্রামে বা প্লেন্টার বক্সে শাকসবজি, ঔষধি ও গাঁদা ফুল চাষে ফলন বাড়বে। উদাহরণস্বরুপ- টমেটো-গাদাফুল-গাজর-ব্রকলি-লেটুস-তুলসী/পুদিনা- এই ফরমেটে প্লান্টার বক্স বা পারমানেন্ট/সেমি-পারমানেন্ট বেডে লাগালে রোগ-পোকামাকড় আক্রমণ কম বা হবেই না। এতে নিরাপদ চাষাবাদে কোনো রাসায়নিক বিষ ব্যবহারের প্রয়োজন হবে না। একই স্থান থেকে বেশি উৎপাদন করার চেষ্টা করা কারণ সকল গাছ মাটির একই স্তর থেকে খাদ্য-উপাদান গ্রহণ করে না। এতে সারসহ অন্যান্য উপাদানের সঠিক ও টেকসই ব্যবহার ত্বরান্বিত করবে।
কোন জায়গা খালি না রাখা : আমাদের দেশে সব মৌসুমে সব স্থানে সব সবজি ও ফল চাষ করা সম্ভব শুধু সঠিক মানুষ ও প্রতিষ্ঠান থেকে পরামর্শ নিতে হবে। উদ্যানতত্ত্ব সেন্টার (হর্টিকালচার সেন্টার), কৃষি প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেখান থেকে যে কোনো সমস্যার সমাধান পাবেন। প্লাস্টিক বোতল না ফেলে যে কোনো সবজি-ফল-ফসলের বীজ চারা লাগান, নিজেই নিজের অক্সিজেন ফ্যাক্টরি স্থাপন করা যায়।
রাস্তায় সবজি লাগান : বাসা, এপার্টমেন্ট, রাস্তার আইল্যান্ডসহ সব খালিস্থানে শাকসবজির বীজ ফেলা, কেউ না কেউ তো খাবে, খাক না; নিজের শহরকে নিজেরাই সবুজে রঙিন করে তুলতে পারি।
ছোট ছোট বাগানই বাণিজ্যিক বাগান : কোটি মানুষের শহরে সকলে একটু একটু করে ফল-সবজি চাষ করতে থাকলে নিরাপদ ফসল আবাদ আন্দোলনে রূপ নেবে এবং সামগ্রিকভাবে একটি বৃহৎ সবজি কারখানা তৈরি হবে। অনলাইন পোর্টাল, ফেসবুকে গ্রুপ করে নিরাপদ সবজি চাষের তথ্য ও চাষাবাদের সব উপাদানের উৎস আদান-প্রদান করে বাণিজ্যিক বাগানে পরিণত করা যেতে পারে।
ছাদবাগান ব্যবস্থাপনা : সঠিকভাবে ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি এবং শহুরে কৃষি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা ও পরামর্শ নিয়ে ছাদবাগান করলে ছাদের ক্ষতি তো হয়ই না বরং টেকসই সবুজ আচ্ছাদন অক্সিজেন সরবরাহ করে বাসস্থান-অফিস ও প্রতিষ্ঠানকে আরো আরামদায়ক ও শান্তিময় রাখবে।
আধুনিক কৃষি পদ্বতিতে নিরাপদ আবাদ : বারান্দা, বেলকনি, ছাদ সব স্থানে মাটিবিহীন চাষাবাদ (হাইড্রোপনিক), অটো-সেচ ড্রিপ সেচ পদ্ধতিতে ভার্টিক্যাল গার্ডেন (৩ ফুট জায়গায় ২৪টি সবজি চাষ), আলাদা সেচ সুবিধাসহ ব্যারেল গার্ডেন, একত্রে মাছ-সবজি চাষ (একুয়াপনিক্স), বোতল-গার্ডেন, স্মার্ট ডিভাইস মেসেজ অপসনসহ ফার্মিং, ইনডোর ফার্মিং প্রোটেকটিভ চাষাবাদ ইত্যাদি আধুনিক ও নিরাপদ সবজি চাষ এখন এ দেশে অনেকেই করছে। সব ফার্র্মিংয়ের সহায়তার জন্য কৃষি প্রতিষ্ঠানগুলোতে যোগাযোগ করতে হবে।
ছাদবাগান বিষয়ক প্রশিক্ষণ : গবেষণায় জানা যায়, ঢাকা শহরের ৭৬% ছাদবাগানি প্রশিক্ষণ নিতে চায়। প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তার জন্য আপনার নিকটস্থ কৃষি অফিস হর্টিকালচার সেন্টার ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগসহ ফেসবুক গ্রুপগুলো পরামর্শ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রদান করা যায়।
সবজি মেলা : প্রতি বছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দেশব্যাপী সবজিমেলা করে থাকে যেখানে কৃষি সেক্টরের সব প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। মেলা ছাড়াও রোডশো, পরামর্শ বুলেটিন, ছাদবাগান লিফলেট ইত্যাদি ছাদবাগানি ও আগ্রহী শহুরে কৃষককে টেকসই নিরাপদ সবজি চাষে আরো উৎসাহিত করবে।
নিরাপদ ছাদবাগানের নিরাপত্তা : ছাদ কার্নিশ বা ব্যালকনিতে পটে বা টবে ফুল-ফল-সবজি আবাদে সতর্কতা অবলম্বন করুন যাতে বিল্ডিং বা এপার্টমেন্টের নিচ দিয়ে যাতায়াতকারী পথচারী দুর্ঘটনার শিকার না হন।
কৃষিকথা মোবাইল অ্যাপস এবং ১৬১২৩ : কৃষি তথ্য সার্ভিস কর্তৃক ব্যবস্থাপনায় একটি অনলাইন কৃষি সহায়তা পোর্টাল ও সবার জন্য উন্মুক্ত ফোন নম্বর- ১৬১২৩ এ ফোন করে কৃষি সংক্রান্ত সব সহযোগিতা পেতে পারেন।
কৃষিকথার প্রচার কার্যকরী হবে এ আশাবাদ ব্যক্ত করে নিরাপদ হোক সব ছাদ বাগানের চাষাবাদ।
সহযোগী অধ্যাপক ও ফ্যাব ল্যাব ম্যানেজার, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল-০১৭১১০৫৪২১৫
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১০% (৮.৪ মিলিয়ন) মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, WHO-2014| World Health Organization – Diabetes Country Profile, 2016 - এর মতে বাংলাদেশে ডায়াবেটিসে প্রতি বছর মারা যায় ৬০৬০ পুরুষ এবং ৪৭৬০ মহিলা যাদের বয়স ৩০-৬৯ বছরের মধ্যে। ৭০ বা তার ওপরের বয়সে মারা যায় ৮২২০ পুরুষ এবং ৭৩৯০ মহিলা। ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য জটিলতায় পুরুষ ৪.৬% এবং মহিলা ৭.৪% ভোগে।
বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। বর্তমানে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। কিন্তু পারিবারিক পর্যায়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যের সমন্বয়ে পরিপূর্ণ পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ এখনো একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী বর্তমানে দুই ধরনের অপুষ্টির শিকার। যেমন- খাদ্যের অভাবজনিত পুষ্টিহীনতা এবং জ্ঞানের অভাবে খাদ্যসংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগসমূহ, যেমন- ডায়াবেটিস, স্থূলতা, স্ট্রোক, হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, ক্যান্সার ইত্যাদি। জেনে রাখা জরুরি যে, খাদ্যসংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি রোগে মৃত্যুর হার অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর হারের চেয়ে বহুগুণ বেশি। খাদ্য তালিকায় শাকসবজি ও ফলমূল যোগ করে, খাবারে বৈচিত্র্যতা এনে, অনুপুষ্টির অভাব যাকে ‘হিডেন হাংগার’ বলে দূর করে এই অসংক্রামক রোগসমূহকে প্রতিরোধ করা যায়।
ডায়াবেটিস হলো একটি দীর্ঘমেয়াদি বিপাকে ত্রুটিজনিত রোগ। আমরা সারা দিন যেসব খাবার খাই তা পরিপাকের পর অধিকাংশই গ্লুকোজ হিসেবে রক্তে মিশে যায়। দেহকোষ গুলো আমাদের শরীরে শক্তি ও তাপ উৎপাদনের জন্য এই গ্লুকোজ গ্রহণ করে, আর এই কাজটি সম্পাদনের জন্য দেহকোষগুলোকে নির্ভর করতে হয় ইনসুলিন নামক এক প্রকার হরমোনের ওপর যা অগ্ন্যাশয় থেকে নিসৃত হয়। ডায়াবেটিস হলে অগ্ন্যাশয় থেকে এই ইনসুলিন নিঃসরণে ব্যাঘাত ঘটে বা কম নিঃসৃত হয় অথবা অকার্যকর হওয়ায় কোষে গ্লুকোজের ঘাটতি ঘটে এবং রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায়। এই অবস্থাকেই ডায়াবেটিস বলে। কারো রক্তে গ্লুকোজ সুনির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করলেই তাকে ডায়াবেটিস রোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় রক্তে গ্লুকোজ মাত্রা অভুক্ত অবস্থায় ৬.১ মি.মোল/লি. এবং গ্লুকোজ খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর ৭.৮ মি.মোল/লি. এর নিচে থাকতে হবে। আর যদি ডায়াবেটিস হয়ে যায়, তাহলে তা নিয়ন্ত্রণে আছে কি না সেটা বোঝা যাবে যদি রক্তে গ্লুকোজ মাত্রা অভুক্ত অবস্থায় ৪.৪-৬.১ মি.মোল/লি., খাবার খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর ৪.৪-৮.০ মি.মোল/লি. এর মধ্যে থাকে এবং হিমোগ্লোবিন এ১ সি-৭.০% এর নীচে থাকে। গর্ভকালীন সময়ে অভুক্ত অবস্থায় রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৫.৩ মি.মোল/লি. এবং খাবার খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর ৬.৭ মি.মোল/লি. এর নিচে থাকতে হবে। যাদের ডায়াবেটিস হয়েছে তাদের উচিত এটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা আর যাদের এখনো হয় নাই তাদের উচিত এটাকে প্রতিরোধ করা। কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিস হবে ৭ম বৃহত্তম মরণ ব্যাধি।
ডায়াবেটিস আজীবনের একটি অসংক্রামক রোগ। বংশগত, পরিবেশগত, অলস জীবন যাপন, অসম খাদ্যাভ্যাসের কারণে এ রোগ হতে পারে। এর চিকিৎসার মূল উপাদান হচ্ছে শিক্ষা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম এবং প্রয়োজনে ওষুধ। এগুলোর সমন্বয়ে শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করতে হবে, পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। রক্তের গ্লুকোজের প্রধান উৎস হলো খাবার দাবার। এজন্যই ডায়াবেটিস হলে খাদ্য সম্পর্কে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ডায়াবেটিস হলে মানুষ খুব চিন্তায় পড়ে যায়, এই বুঝি তার রিজিক চলে গেল। আসলে কি তাই? আসল কথা হলো খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা ডায়াবেটিস হওয়ার আগেও যেমন থাকে, ডায়াবেটিস হওয়ার পরেও ঠিক একই রকম থাকে। পুষ্টির কোনো তারতম্য হয় না। পার্থক্য হলো ডায়াবেটিস হলে খাবারের একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হয় এবং প্রতি দিনই কোনো না কোনো ব্যায়াম করতে হয়, যার উদ্দেশ্য হলো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাস্থ্যকে ভালো রাখা। ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য কেমন হবে সেটা সবারই জানা দরকার। যেসব খাবার খেলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা দ্রুত বেড়ে যায় সেসব খাবার যেমন- মিষ্টি জাতীয় খাবার, সাদা ভাত, সাদা রুটি, সিদ্ধ আলু ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে রেখে যেসব খাবার খেলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা দেরিতে এবং ধীরে ধীরে বাড়ে যেমন আঁশজাতীয় শাকসবজি, ফল, মাছ/মাংস, ডিম, দুধজাতীয় খাবার ইত্যাদি খাবারের তালিকায় যাতে থাকে সে দিকটা খেয়াল রাখতে হয়।
ডায়াবেটিস রোগীর খাবারে শাকসবজির গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। সারা বছরই এ দেশে নানা ধরনের শাকসবজি উৎপাদন হয়। প্রকৃতির এই নেয়ামতকে বিজ্ঞানসম্মত কাজে লাগিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা ও প্রতিরোধ করা যায়। ডায়াবেটিস রোগীর সুবিধার জন্য শাকসবজিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
১। শর্করা সম্বলিত সবজি যেমন- আলু, মিষ্টি কুমড়া, কাঁচা কলা, বরবটি, থোড়, মোচা, বিট, শিম, মাটির নীচের কচু, গাজর, কাঁকরোল, শিমের বিচি, কাঁঠালের বিচি, শালগম, ইঁচড়, ঢেঁড়স, বেগুন, মটর শুঁটি, কচুরমুখী, পাকা টমেটো।
২। শর্করাবিহীন শাকসবজি যেমন- সব ধরনের শাক, যেমনÑ লালশাক, পুঁইশাক, পালংশাক, কলমিশাক, ডাঁটাশাক, কচুশাক ইত্যাদি এবং সবজি যেমন ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, ওলকপি, কাঁচা টমেটো, কাঁচা পেপে, শসা, খিরা, উচ্ছে, করলা, ঝিঙা, চিচিঙা, পটোল, লাউ, চালকুমড়া, ডাঁটা, সজনা, ধন্দুল, ক্যাপসিকাম, কাঁচামরিচ, মাশরুম ইত্যাদি।
উপরোক্ত শাকসবজিগুলো প্রতিটি মৌসুমেই কোনটা না কোনটা উৎপাদিত হয়। ডায়াবেটিস রোগীর উচিত প্রতি দিন একই ধরনের শাকসবজি না খেয়ে পাঁচ মিশালী শাকসবজি খাওয়া। এতে করে সব ধরনের শাকসবজির ভিটামিন মিনারেলস শরীরের কাজে লাগবে, খাবারে বৈচিত্র্য আসবে, পেট ভরবে, মনে পরিতৃপ্তি আসবে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব জরুরি। বীজ যেমন- পরিবেশ পেলে গজিয়ে উঠে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও তেমনই নানা ধরনের রোগ হওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে হার্ট, কিডনি, লিভার, চোখ নষ্ট হয়ে যায়, নানা রকম ক্যান্সার হতে পারে, এমনকি শরীরের মাংসেও পচন ধরতে পারে। গর্ভকালীন সময়েও নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, গর্ভস্থ শিশু মৃত এবং প্রতিবন্ধী হতে পারে, অর্থাৎ ডায়াবেটিস, এহেনও কোনো রোগ বা জটিলতা নেই যেটা জন্মাতে সাহায্য করে না। আল্লাহ তায়ালা শাকসবজির ভেতর এতই নিয়ামত দিয়ে রেখেছেন যে সারা বছর যেসব শাকসবজি পাওয়া যায় তা দিয়েই এসব রোগ প্রতিরোধ করা যায়। প্রতি দিনের খাবারে আঁশযুক্ত শাকসবজি থাকতে হবে। বিভিন্ন প্রকার শাক, তরি-তরকারি যেমন শিম, বরবটি, মাশরুম, লাউ, কুমড়া, গাজর, কাঁচা কলা, ডাঁটা এগুলোর বাইরের আবরণ হচ্ছে সেলুলোজ, একে আঁশ ও বলা যায়। এগুলো হজম হয় না, রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়তে দেয় না, ওজনও বাড়ায় না। এগুলো খাদ্যনালীর আর্দ্রতা পরিশোষণ করে ক্ষুদ্রান্ত্র পার হয়ে মলের সাথে বৃহদন্ত্রে¿ উপস্থিত হয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং মলত্যাগে সাহায্য করে। সুতরাং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণসহ এসব খাবার কোষ্ঠকাঠিন্য এমন কি কোলন ক্যান্সারও দূর করে। রক্তস্বল্পতায় শাকসবজির গুরুত্ব অনেক। পালংশাক, লালশাক, পিয়াজ, গাজর, মুলা, বিট, মিষ্টি আলু, টমেটো, খোসাসহ আলু, কচুশাক, লেটুস পাতা, শিম, বরবটি ইত্যাদিতে লৌহ ও ফলিক এসিড রয়েছে। সবজির মধ্যে বীট রক্তশূন্যতা রোধে খুবই উপকারী। এতে রয়েছে পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, সালফার, আয়োডিন, লৌহ, কপার, ভিটামিন বি-২, বি-৬, বি-১২ এবং ভিটামিন সি। উচ্চমানের লৌহের জন্য এটি রক্তের লোহিত কণিকা সক্রিয় করতে ও উৎপাদন করতে সাহায্য করে। দেহে ফ্রেশ অক্সিজেন সরবরাহও করে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রক্তে কোলস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় যেটা হার্টের জন্য ক্ষতিকর। নায়াসিন কোলস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। এটা পাওয়া যায় আঁশযুক্ত সবুজ শাক সবজি, খোসাসহ আলুতে। তাছাড়া কাঁচা রসুনও খাওয়া যেতে পারে।
তাজা শাকসবজি আমাদের প্রক্রিয়াজাত করে খেতে হয় অর্থাৎ রান্না করে খেতে হয়। রান্নার ওপরও ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে শর্করার বাড়া-কমা অনেকটা নির্ভর করে। যেমন- আলুর চিপস বা ফ্রেন্সফ্রাইয়ের চেয়ে সিদ্ধআলু খেলে শর্করার পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। গাজর কাঁচা না খেয়ে সিদ্ধ অবস্থায় খেলে শর্করার পরিমাণ দ্রুত বেড়ে যায়। শর্করা সংবলিত সবজিগুলো অনেকক্ষণ ধরে রান্না করলে সহজে হজম হয়ে শোষণ হয় এবং দ্রুত রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। শাকসবজি যেগুলো কাঁচা ও টাটকা খাওয়া যায় সেগুলো কাঁচা অবস্থায় খেলেই উপকার বেশি পাওয়া যায়। যেগুলো খোসাসহ রান্না করা যায় সেগুলো খোসাসহ রান্নাই ভালো। তবে সবজি বেশি সিদ্ধ না করে একটু কাঁচা কাঁচা করে রান্না করা উচিত। এতে স্বাদ, গন্ধ, রঙ এবং ভিটামিন অটুট থাকে।
বর্তমানে অপুষ্টির সমস্যা নিরসনে সারা বিশ্বে ড্রাগ বেসড অ্যাপ্রোচের তুলনায় ফুড বেসড অ্যাপ্রোচ অধিক টেকসই বলে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ এর মাধ্যমে নিজস্ব উৎপাদিত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, কর্ম সংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন, পরিবেশ উন্নয়ন এবং চিকিৎসা খাতে ব্যয় কমিয়ে দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়নে ফুড বেসড অ্যাপ্রোচের ভূমিকা অপরিসীম। সুতরাং আসুন আমরা সকলে মিলে কৃষি উৎপাদনে স্বয়ং সম্পূর্ণতার পাশাপাশি খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিত করে একটি সুস্থ জাতি গঠনে সহায়তা করি।
‘স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ শাকসবজি ও ফল খাই,
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এর তুলনা নাই’।
খালেদা খাতুন
প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা, বারডেম, শাহবাগ, ঢাকা, ফোন : ০১৭০৩৭৯৬২৬৯
পুষ্টির দিক থেকে মানবদেহের জন্য শাকসবজির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করার পাশাপাশি শাকসবজি দেহের রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই শরীরের চাহিদামতো শাকসবজি খেলে নানা রকম রোগ-ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং শরীর সুস্থ থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, শাকসবজি খাওয়ার ফলে ক্যান্সার, কিডনি রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, বহুমূত্র ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম থাকে। গবেষকরা আরও জানিয়েছেন, যারা পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি খেয়ে থাকে তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর আশঙ্কাও কমে যায়। শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে আঁশ থাকে। এই আঁশ খাদ্য দ্রব্য হজম, পরিপাক ও বিপাক প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। শাকসবজিতে বিদ্যমান আঁশ মলাশয়ের ক্যান্সার, বহুমূত্র, স্থূলকায়ত্ব, হৃদরোগ, রক্তচাপ, মূত্রনালির পাথর ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে দেহকে সুস্থ ও সতেজ রাখে। তাছাড়া শাকসবজি শিশুদের অপুষ্টিজনিত রাতকানা, অন্ধত্ব, রিকেট, বিভিন্ন প্রকার চর্মরোগ, স্কার্ভি, মুখ ও ঠোঁটের কোণে ঘা, রক্তশূন্যতা দূরীকরণে কার্যকর ভূমিকা রাখে। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, অপুষ্টি ও দেহের রোগ প্রতিরোধে শাকসবজির ভূমিকা অপরিসীম।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যা বসবাস করে ৯৯৩ জন। যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এত বিপুল জনগোষ্ঠীর দানা জাতীয় খাদ্যের চাহিদা, শাকসবজি ফল এবং পুষ্টি চাহিদা পূরণ অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। আমাদের দেশে নানা প্রকার শাকসবজি উৎপন্ন হয় । এদের মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, টমেটো ও আলু, গাজর, বেগুন, মুলা, লাই, শিম, ধনেশাক, লালশাক প্রভৃতি অন্যতম। এসব শাকসবজিতে মানব দেহের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন এ, বি, সি এবং ক্যালসিয়াম, লৌহ, আয়োডিন প্রভৃতি অতি প্রয়োজনীয় খনিজ লবণ রয়েছে। তাছাড়া শাকসবজি থেকে কিছু পরিমাণে লৌহ পদার্থ এবং যথেষ্ট পরিমাণে শর্করা জাতীয় পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়।
শাকসবজি সংরক্ষণ করার একটি অন্যতম প্রধান উপায় হচ্ছে প্রক্রিয়াকরণ এবং প্যাকেজিং। শাকসবজি পচনশীল তবে কিছু প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে এর সংরক্ষণ করা বা মেয়াদ বৃদ্ধি করা সম্ভব। কোন পণ্যের প্রক্রিয়াকরণ করা হলে সেই পণ্যের প্যাকেজিং করা অত্যাবশ্যকীয়। প্রক্রিয়াকরণ ও প্যাকেজিং পণ্যের গুণগতমান বৃদ্ধি করে, সেলফলাইফ বৃদ্ধি করে ও মূল্য সংযোজন ঘটিয়ে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি করে। শাকসবজির স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিমান বজায় রেখে তাজা সবজি ও ফলকে খোসা বা ছাল বা বাকল ছাড়িয়ে ব্যবহার উপযোগী টুকরা করে কোনো প্যাকেট বা মোড়কে সুসজ্জিত অবস্থায় ভোক্তার নিকট উপস্থাপনকেই বলা হয় ফ্রেশকাট।
ফ্রেশকাটের বৈশিষ্ট : পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত শাকসবজি ও ফলমূল, খোসা ছাড়ানো, কাটা ও বাছাইকৃত, সরাসরি রন্ধন ও খাওয়ার উপযোগী, আধুনিক মোড়কীকরণকৃত, নিশ্চিন্ত ব্যবহার।
ফ্রেশকাটের প্রয়োজনীয়তা : সময় সাশ্রয়ী, সহজে রন্ধনযোগ্য, সহজ সংরক্ষণ, অপচয় হ্রাস, পরিবেশবান্ধব।
ফ্রেশকাটের সুবিধা : সময় ও অর্থ সাশ্রয়ী, পুষ্টি ও গুণাগুণ অক্ষুণ্ন, রেডি-টু-কুক, বাছাইকৃত ও কাটাকুটির ঝামেলামুক্ত, সহজে বহনযোগ্য।
বাংলাদেশ বিশ্বের একটি জনবহুল দেশ। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমাদের দেশ মধ্য আয়ের দেশে উন্নিত হওয়ার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। শাকসবজি উৎপাদনে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৩য় স্থানে। বাংলাদেশে বার্ষিক প্রায় ৪০ লক্ষ মেট্রিক টন শাকসবজি (আলু ব্যতীত) ও ৪৮ লক্ষ মেট্রিক টন ফলমূল উৎপাদিত হয় (বিবিএস)। বাংলাদেশে প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদিত হলেও প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও অন্যান্য সীমাবদ্ধতার কারণে বিপণন পর্যায়ে প্রচুর পরিমাণ শাকসবজি ও ফলমূল নষ্ট হচ্ছে, যা প্রায় শতকরা ২৫-৩০ ভাগ। এজন্য বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের অভ্যন্তরীণ ভোগ, ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি রপ্তানি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা গ্রহণ করা আবশ্যক। এ প্রেক্ষিতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কর্তৃক ফ্রেশকাট শাকসবজি ও ফলমূল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন কার্যক্রম সম্প্রসারণ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে শাকসবজি ও ফলমূলের উৎপাদন পরবর্তী ক্ষতি কমিয়ে কৃষকদের আর্থিকভাবে লাভবান করা সম্ভব। অন্যদিকে কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখাও সম্ভব। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও শহরায়নের ফলে মানুষের বহুমুখী খাদ্যাভ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে উন্নত বিশ্বে প্রক্রিয়াজাতকরণ ফ্রেশকাট শাকসবজি ও ফলমূলের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নত বিশ্বে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ও ব্যবসা হিসেবে প্রসার লাভ করেছে। আমাদের দেশেও বর্তমানে প্রক্রিয়াজাতকৃত ফ্রেশকাট শাকসবজির বাজার ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে শাকসবজির বর্তমান অবস্থা :
ফ্রেশকাট সবজি ও ফলের প্রেক্ষাপট :
পাশ্চাত্য এশিয়ার কিছু দেশে কিছু পূর্ব হতে এ ধরনের ফ্রেশকাট সবজি ও ফলের বাজার সম্প্রসারণ হলেও আমাদের দেশে এটি একটা নতুন ধারণা। তবে ক্রমশ পরিবতিত আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এ ধরনের পণ্যের প্রসার বর্তমান সময়ে কার্যকরী হতে পারে। কারণ ধীর গতিতে হলেও আমাদের নিম্নরূপ সামাজিক পরিবর্তন দৃশ্যমান-
একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি;
মধ্য আয়ের জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি;
খাবার তৈরির সময় কমে যাচ্ছে;
সহজ ভোগ্য খাবারের চাহিদা বৃদ্ধি;
রেস্তোরা ও ফাস্ট ফুড শপের কার্যক্রম ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে;
মানুষ ক্রমশ ফ্যাশন প্রবণ হয়ে ঊঠছে;
রপ্তানি বাজার :
ফ্রেশকাট শাকসবজির আন্তর্জাতিক বাজার ক্রমশ সম্প্রসারণশীল। থাইল্যান্ড বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ রপ্তানিকারক দেশ। রপ্তানির পরিমাণ বছরে প্রায় ২,০০০ টনের বেশি। সবচেয়ে বেশি ফ্রেশকাট ব্যবহার করা হয় আমেরিকায় যার যার আর্থিক মূল্যমান ৪.৪ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে ফ্রেশকাট সবজি ও ফলের রপ্তানি বাজার সীমিত আকারে হলেও শুরু হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে বেশ কয়েকটি কোম্পানি আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে ফ্রেশকাট সবজি রপ্তানি শুরু করেছে।
বাংলাদেশ থেকে ফ্রেশকাট রপ্তানি বাজারে প্রবেশ ও সম্প্রসারণের অনুকূল দিকসমূহ
ব্যবহৃত কীটনাশকের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ; অনুজীবের সংক্রামক নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ গ্রহণ; খাদ্যের আদর্শমান নির্ধারণ ও যথাযথ পরিদর্শন ল্যাব সুবিধার সৃষ্টি; আমদানিকারক দেশের খাদ্য আইনের সাথে সংগতি বিধান; ক্রেতার চাহিদা মাফিক মান বজায় রাখা; আন্তর্জাতিক সংস্থা যথা ডঐঙ, ঋঅঙ এর নির্দেশিতমানের সাথে সংগতি রাখা; বহির্বিশ্বের ন্যায় আমাদের দেশেও ‘রেডি টু কুক-রেডি টু ফুড’ প্রক্রিয়াটির প্রচলন বর্তমানে সময়ের দাবি। বর্তমানে রাজধানীসহ বড় বড় শহরসমূহে ব্যাপক হারে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি কর্মমুখী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নগরায়ণ ও শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের ব্যস্ততা বাড়ছে। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের মানুষও ব্যাপক হারে আধুনিক বিপণন ব্যবস্থার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। পরিবারের কর্মব্যস্ত মানুষের পক্ষে প্রতিদিন বাজার থেকে কৃষি পণ্য ক্রয় ও বাজারজাত করে আহার উপযোগী করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাই সকলেই হাতের নাগালের মধ্যে সহজলভ্য ও প্রস্তুতকৃত পণ্য ক্রয়ে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে। বর্তমানে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের আওতায় ফ্রেশকাট শাকসবজি ও ফলমূল বিপণন সম্প্রসারণ কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের ৫টি জেলা যথা- ঢাকা, নরসিংদী, খুলনা, রংপুর ও কুমিল্লা জেলায় ফ্রেশকাট শাকসবজি ও ফলমূল বিপণন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা মহনগরীর বিভিন্ন সুপারসপ, স্কুল-কলেজ ও কর্মব্যস্ত এলাকায় কর্মজীবীদের সুবিধার্থে কর্মসূচির আওতায় সৃষ্ট উদ্যোক্তা কর্তৃক কুল চেম্বার সমৃদ্ধ ভ্যানের মাধ্যমে ফ্রেশকাট শাকসবজি বিপণন করা হচ্ছে।য়
‘ফ্রেশকাট শাকসবজি ও ফলমূল করলে ব্যবহার
কর্মজীবী মানুষের সুবিধা অপার’
তৌহিদ মোঃ রাশেদ খান
সহকারী পরিচালক ও কর্মসূচি পরিচালক ফ্রেশকাট শাকসবজি ও ফলমূল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন কার্যক্রম সম্প্রসারণ কর্মসূচি কৃষি বিপণন অধিদপ্তর খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৭৭০৫৫১২৩৭
শাকসবজি খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো কিন্তু সচরাচর আমরা যেসব শাকসবজি খাচ্ছি তা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ভালো, কতটা নিরাপদ? কি ধনী, কি গরিব দেশ-পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বর্তমানে বাণিজ্যিক শাকসবজি উৎপাদনে ক্ষতিকর রাসায়নিক বালাইনাশক ও রাসায়নিক সার উচ্চ মাত্রায় যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর সাথে বাড়ছে শাকসবজি সংগ্রহের পর তাতে বিভিন্ন জীবাণুর উপস্থিতি ও পচন, শাকসবজি পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহৃত দূষিত পানি ইত্যাদি। বিভিন্ন পর্যায়ে শাকসবজি গ্রহণ আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে। উৎপাদন পর্যায়ে, সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে, বিপণন পর্যায়ে এমনকি শাকসবজি রান্না ও খাওয়ার সময়ও তা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য নানা কারণে অনিরাপদ হয়ে উঠছে।
তাই শাকসবজি খাওয়া এখন স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ভালো তা ভাবতে হচ্ছে। অনেকেই এসব ঝুঁকির কথা ভেবে শাকসবজি খাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। আর যাদের টাকা আছে তাদের অনেকেই এখন খুঁজছেন বিষমুক্ত নিরাপদ শাকসবজি। এক কথায় অধিকাংশ স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ এখন দিন দিন আগ্রহী হয়ে উঠছে জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা শাকসবজির দিকে। তবে মনে রাখা দরকার যে, নিরাপদ শাকসবজি মানে শুধু জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা শাকসবজিকে বুঝায় না। জৈব শাকসবজি ক্ষেত থেকে তোলার পর খাবার টেবিলে আসা পর্যন্ত নানাভাবে অনিরাপদ হতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, কোথায় মিলবে নিরাপদ শাকসবজি, কে দেবে তার নিশ্চয়তা? আর কৃষকরা তা উৎপাদন করলেও কে দেবে তার উপযুক্ত মূল্য? এসব নানারকম চ্যালেঞ্জের মধ্যেও এখন আমাদের দ্রুত এগিয়ে যেতে হচ্ছে জৈব পদ্ধতিতে নিরাপদ শাকসবজি উৎপাদনের দিকে। সরকারও নিরাপদ শাকসবজি উৎপাদনের ওপর জোর দিয়ে বেশ কিছু প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
উন্নত বিশ্বের প্রায় সব মানুষ এখন নিরাপদ সবজি বা অর্গানিক ভেজিটেবলের সন্ধান করছেন। বাংলাদেশেও এখন বিভিন্ন সুপার শপে অর্গানিক ভেজিটেবলের বিপণন শুরু হয়েছে। অর্গানিক ভেজিটেবল বা জৈব সবজির দামও অপেক্ষাকৃত বেশি। তবে আমাদের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে আগে দরকার খাদ্য, বেশি পরিমাণে সবজি উৎপাদন। জৈব পদ্ধতিতে সবজি চাষে ফলন হয় কম। সেজন্য বাণিজ্যিকভাবে জৈব পদ্ধতিতে সবজি চাষ করলে তা আমাদের খাদ্য ঘাটতি পূরণে সহায়ক হবে না। সেক্ষেত্রে জৈব শাকসবজির দাম যদি কিছুটা বেশি পাওয়া যায় তাহলে অনেক কৃষক তা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠবে। স্বল্প পরিসরে বিশেষ করে বসতবাড়িতে আমরা প্রত্যেকে অন্তত জৈব পদ্ধতিতে শাকসবজি উৎপাদন করে নিজেরা সেসব সবজি খাওয়া অভ্যাস করতে পারি। রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি করে বাণিজ্যিকভিত্তিতেও জৈব পদ্ধতিতে শাকসবজি উৎপাদন করা সম্ভব।
জৈব পদ্ধতিতে সবজি চাষের ধারণা : রাসায়নিক সার, বালাইনাশক, আগাছানাশক, হরমোন ইত্যাদি বাদ দিয়ে ফসলচক্র, সবুজ সার, কম্পোস্ট, জৈবিক বালাই দমন এবং যান্ত্রিক চাষাবাদ ব্যবহার করে শাকসবজি চাষই হলো জৈব সবজি উৎপাদন। অর্থাৎ এ পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয় এবং কোনো রাসায়নিক দ্রব্য চাষ কাজে ব্যবহার করা হয় না। এতে ফসল দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না ও নিরাপদ শাকসবজি উৎপাদন অনেকটা নিশ্চিত হয়।
জৈব চাষাবাদের ইতিহাস : জৈব চাষাবাদের ধারণার উৎপত্তি আসলে আদিম। সুপ্রাচীন কাল থেকে এ পদ্ধতিতেই চাষাবাদ হয়ে আসছে। বিগত শতকে চাষাবাদে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হয়। রাসায়নিক সার ব্যবহার করে ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লব ঘটিয়ে ফলন বাড়ানো হয়। ক্ষুধাময় বিশ্বে সে সময় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ছিল এক বড় চ্যালেঞ্জ। সে প্রেক্ষিতে হয়ত সেটাই ঠিক ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষের বোধোদয় হয় যে, রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারে চাষের ফলে পেটের ক্ষুধা মিটছে ঠিকই কিন্তু পাশাপাশি এর ফলে মানুষের অসুস্থতা বাড়ছে। তাই ১৯৯০ সাল থেকে জৈব পদ্ধতিতে উৎপন্ন দ্রব্যের বাজার দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। জৈব পদ্ধতিতে উৎপন্ন দ্রব্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় জৈব পদ্ধতিতে চাষকৃত এলাকাও বাড়তে থাকে। পৃথিবীর প্রায় ৩ কোটি ২২ লক্ষ হেক্টর জমিতে এখন জৈব পদ্ধতিতে ফসল চাষ হচ্ছে। এটা পৃথিবীর মোট আবাদি জমির ০.৮%। পাশাপাশি স্থানীয় জাতের জৈব পদ্ধতিতে আবাদ হয়েছে ৩ কোটি হেক্টরে।
১৯৩০ সালে জৈব কৃষির জন্য আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৩৯ সালে লর্ড নর্থবোর্ন তার লেখা খড়ড়শ ঃড় ঃযব খধহফ (১৯৪০) বইয়ে প্রথম ড়ৎমধহরপ ভধৎসরহম শব্দ ব্যবহার করেন। রাসায়নিক সারের উপর ক্রমেই কৃষকদের নির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে এই আন্দোলন শুরু হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রথম সুপার ফসফেট সার তৈরি শুরু হয় এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যামোনিয়া থেকে উদ্ভূত সারসমূহ তৈরি শুরু হয়। কম পরিমাণে ব্যবহার করতে হয়, তাড়াতাড়ি কাজ করে অর্থাৎ খুব শক্তিশালী, দামে সস্তা এবং পরিবহনে সুবিধা হওয়ায় রাসায়নিক সার দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। অনুরূপভাবে ১৯৪০ সালের প্রথম দিকে রাসায়নিক বালাইনাশকের এমন অগ্রগতি ঘটে যে ওই দশকের শেষের দিকে রাসায়নিক বালাইনাশকের যুগ শুরু হয়। স্যার আলবার্ট হাওয়ার্ডকে জৈব কৃষির জনক বলে বিবেচনা করা হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে জে.আই.রডেল, যুক্তরাজ্যে লেডি ইভ বেলফোর এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আরও অনেকে জৈব কৃষির ওপর কাজ করেন।
শুরু থেকে এ পর্যন্ত পৃথিবীর মোট কৃষি উৎপাদনের শতকরা খুব নগন্য অংশই জৈব পদ্ধতি ব্যবহার করে করা হয়েছে। পরিবেশ সচেতনতা এবং প্রয়োজন সাধারণ মানুষের কাছে জৈব কৃষির চাহিদা ক্রমেই বাড়িয়ে তুলছে। বাড়তি মূল্য এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি ভর্তুকি কৃষকদেরকে জৈব কৃষির প্রতি আকর্ষণ করছে। উন্নয়নশীল দেশে প্রথাগত চাষ পদ্ধতিকে জৈব পদ্ধতিতে চাষের সাথে তুলনা করা যেতে পারে কিন্তু তাদের প্রত্যয়নপত্র নেই। যাহোক ইউরোপে জৈব কৃষি পদ্ধতির ব্যবহার বৃদ্ধি চোখে পড়ার মতো। আন্দোলন শুরুর মাধ্যমে জৈব কৃষি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির অনেক আগে থেকেই ভারতবর্ষে বেশ উন্নত জৈব পদ্ধতির চাষ হতো। ভারতীয় প্রাচীন গ্রন্থে জৈব কৃষির বিভিন্ন পদ্ধতির বর্ণনা আছে। ভারতে এখনও অনেক গ্রামে এসব পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ‘সঞ্জীবন’ পদ্ধতি এরূপ একটি জৈব কৃষি পদ্ধতির উদাহরণ।
জৈব পদ্ধতিতে নিরাপদ সবজি উৎপাদনের প্রযুক্তি : কম খরচে কিভাবে জৈব পদ্ধতিতে নিরাপদ চাষ করা যায় সেটাই জৈব কৃষির প্রধান বিবেচ্য বিষয়। কেননা, জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত পণ্যকেও বাজারে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। আবার স্বল্প উপকরণ ব্যবহারের ফলে তুলনামূলকভাবে উৎপাদনও কম হয়। তাই জৈব খামার ব্যবস্থাপনায় যাওয়ার আগে খামারে আয়-ব্যয়ের একটা হিসেব কষে ও বাজারে বিক্রির সুযোগ কোথায় কোথায় আছে তা করতে হবে। পাশাপাশি জৈব সবজি বা অর্গানিক ভেজিটেবল কেন ক্রেতারা কিনবেন সে বিষয়েও প্রচারণা চালাতে হবে। মানুষ যত বেশি স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সচেতন হবে, তত বেশি জৈব সবজি কেনার দিকে ঝুঁকবে। জৈব সবজি চাষে যেসব প্রযুক্তি অনুসরণ করা যেতে পারে তা হল-
সবজির এমন কিছু জাত আছে যেগুলো কম উপকরণ ব্যবহার করলেও ভালো ফল দেয় ও রোগ-পোকার আক্রমণ কম হয়। বিশেষ করে স্থানীয় বা দেশি জাতগুলোর এরূপ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এরূপ জাত খুঁজে জৈব পদ্ধতিতে চাষ করতে হবে।
নেট হাউস তৈরি করে তার ভেতরে শাকসবজি চাষ করে কীটনাশক ছাড়াই অনেক পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব সার, সবুজ সার, খামারজাত সার ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে।
বায়োফার্টিলাইজার (রাইজোবিয়াম, অ্যাজোটোব্যাকটার) ও বালাই দমনে বায়োএজেন্টসমূহকে (ট্রাইকোগ্রামা, ব্রাকন) ব্যবহার করতে হবে। বালাই দমনে বিভিন্ন গাছ-গাছড়া থেকে তৈরি করা বালাইনাশক ব্যবহারে উৎসাহিত হতে হবে। কিছু জৈব কীটনাশককে জৈব কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে যাদের নাম দেয়া হয়েছে ‘গ্রিন পেস্টিসাইড’। যেমন- নিমবিসিডিন, নিমিন এবং স্পিনোসাড। সাধারণভাবে জৈব কীটনাশকসমূহ অজৈব কীটনাশকের চেয়ে কম বিষাক্ত এবং পরিবেশ বান্ধব। যে তিনটি প্রধান জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করা হয় তারা হলো- বি টি (একটি ব্যাক্টেরিয়াল টক্সিন), পাইরিথ্রাম এবং রোটেনন। অল্প বিষাক্ত জৈব বালাইনাশকসমূহের মধ্যে রয়েছে নিম, সাবান, রসুন, সাইট্রাস ওয়েল, ক্যাপসেসিন (বিতারক), বেসিলাস পোপিলা, বিউভেরিয়া বেসিয়ানা ইত্যাদি। বালাইনাশকের প্রতি পোকার প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠার আশঙ্কা থাকায় এসব জৈব বালাইনাশক পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করা উচিত। এগুলোর পাশাপাশি- আগাছা দমনে কোন আগাছানাশক ব্যবহার না করে নিড়ানি ও হাত দিয়ে আগাছা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আন্তঃফসল ও মিশ্র ফসলের চাষ করতে হবে। শস্য বহুমুখীকরণ করতে হবে। হিসাব করে সবজির বপন বা রোপণ সময় আগাম বা নাবি করতে হবে। যুক্তিসঙ্গতভাবে সেচ ব্যবস্থাপনা করতে হবে। প্লাবন সেচ না দিয়ে ঝাঝরি দিয়ে বা কলসি ভরে পানি গাছের গোড়ায় ঢেলে সেচ দিতে হবে। প্রয়োজনে খরার সময় মালচিং করতে হবে। পরিণত হওয়ার সূচক মেনে অর্থাৎ উপযুক্ত সময়ে সবজি তুলতে হবে। শাকসবজি তোলার পর তা ধোয়া বা পরিষ্কার করার জন্য জীবাণুমুক্ত পানি ব্যবহার করতে হবে। বাছাই করে জীবাণুযুক্ত বা পচন ধরা শাকসবজি আলাদা করে বাদ দিয়ে প্যাকিং করতে হবে। প্যাকিং সামগ্রী জীবাণুমুক্ত হতে হবে। যতটা সম্ভব ক্ষেত থেকে শাকসবজি সংগ্রহের পর দ্রুত বাজারজাত করতে হবে। শাকসবজি খাওয়ার আগে জীবাণুমুক্ত পরিষ্কার পানিতে ভালো করে ধুয়ে কাটতে হবে।
মৃত্যুঞ্জয় রায়
প্রকল্প পরিচালক, সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনা কম্পোনেন্ট, খামারবাড়ি, ঢাকা, মোবা : ০১৭১৮২০৯১০৭
করার পূর্ব পর্যন্ত শাকসবজি নাড়াচাড়াসহ কিছু ব্যবস্থাপনা এবং কৌশলাদি যার মাধ্যমে শাকসবজির গুণগতমান রক্ষা করা সম্ভব হয়। তাজা পণ্যের গুণগতমান বজায় রাখা, তাদের সংরক্ষণের মেয়াদ বাড়ানো এবং তুলনামূলক অপচয় কমানোর জন্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তিসমূহ ব্যবহৃত হয়। ভোক্তার নিকট আকর্ষণীয়ভাবে পণ্য উপস্থাপনের জন্য সংগ্রহোত্তর কলাকৌশল প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উত্তমভাবে সংগ্রহোত্তর কার্যাদি সম্পাদনে অনেক ধাপ রয়েছে যা সতর্কতার সঙ্গে অনুসরণ করা প্রয়োজন।
প্যাকহাউস স্থাপন
বাণিজ্যিকভাবে উত্তম কৃষি পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে হলে মাঠের পাশে একটি প্যাকহাউস স্থাপন অত্যন্ত জরুরি। সবজির সব ধরনের সংগ্রহোত্তর কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য একটি প্যাকহাউস এর গুরুত্ব অপিরিসীম।
একটি প্যাকহাউসের অবস্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে-
যতদূর সম্ভব এটি যাতে কৃষি খামারের কাছাকাছি হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
পণ্য এবং পণ্যের প্যাকেটগুলো পরিবহনে উঠানো ও নামানোর সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে।
বাজার এবং পরিবহন টার্মিনালে যাতে সহজেই প্রবেশ করা যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
নিকটস্থ বাজারে সরবরাহের জন্য কেবলমাত্র বাছাইকরণ ও প্যাকেজিং এর প্রয়োজন হয় কিন্তু দূরবর্তী বাজারের জন্য আরো অতিরিক্ত কিছু সংগ্রহোত্তর কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়। এছাড়া যে সকল সবজি পণ্য তাৎক্ষণিকভাবে বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্য পরিবহন করা হবে সেগুলো সংরক্ষণাগারে রাখার প্রয়োজন হয় না।
মূলত একটি সাধারণ প্যাকহাউসে শাকসবজি সংগ্রহোত্তর যে সকল ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় তা হলো-
১. ফল ও সবজি/পণ্য গ্রহণ।
২. সটিং অথবা বাছাইকরণ
৩. পণ্য ঠাণ্ডাকরণ
৪. গ্রেডিং অথবা শ্রেণিকরণ
৫. পরিষ্কারকরণ
৬. প্যাকেজিং
৭. পরিবহন ও বাজারজাতকরণ
৮. সংরক্ষণ
সবজি বা পণ্য গ্রহণ
প্যাকহাউসে সবজি আসার পর জাত এবং উৎপাদনের স্থানসহ ওজন নথিবদ্ধ করা।
সবজি বাজারজাতকরণের জন্য বিশেষ করে উন্নত বাজারে সরবরাহ করার ক্ষেত্রে নথি ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে উপযুক্ত মেশিনের সাহায্যে বালাইনাশকের উপস্থিতির মাত্রা পরীক্ষা করে জানা প্রয়োজন।
বাজারজাতকরণের সময় পণ্যেও লেভেলিং এ নমুনা পরীক্ষার ফলাফল উল্লেখ করলে উন্নত মার্কেটে পণ্য সরবরাহ করার ক্ষেত্রে তা সহায়ক হবে।
বিভিন্ন সংগ্রহোত্তর কার্যক্রম শুরু করার পূর্বে পণ্যকে সূর্যের আলো ও তাপ থেকে দূরে রাখতে হবে, বড় প্যাকেজিং এর কারণে শারীরিক ক্ষত এবং মাটি ও আবর্জনা ইত্যাদির সংস্পর্শ হতে রক্ষা করতে হবে যাতে জীবাণুদ্বারা সংক্রামিত হতে না পারে।
সর্টিং অথবা বাছাইকরণ
সর্টিং কার্যক্রমের মাধ্যমে পণ্যে ৪০-৬০% মূল্য সংযোজন করা সম্ভব।
সর্টিং এর মাধ্যমে নিম্নলিখিতভাবে সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমানো যায়-
ক) রোগের সংক্রমণ হতে সুস্থ পণ্যকে পৃথক রাখা সম্ভব।
খ) ক্ষতযুক্ত ও পাকা ফলের সহিত ভালো ফল/সবিজ রাখতে উৎপাদিত ইথিলিনের দ্বারা ভালো সবজিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক্ষেত্রে সর্টিং ও গ্রেডিং এর মাধ্যমে পণ্যেও শারীরতাত্ত্বিক পরিবর্তন ও শারীরিক ক্ষতের পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়।
সংগ্রহের পর অতিরিক্ত পাকা, কাটা ও ফাটা, ত্রুটিপূর্ণ বা অন্যভাবে আঘাতপ্রাপ্ত, পরিপক্ব ও অপরিপক্ব ফসল বাছাই করে নিতে হয়। নতুবা সঠিক বাজার মূল্য পাওয়া যায় না।
পণ্য ঠাণ্ডাকরণ
প্যাকহাউসে সবজি সর্টিং করার পরের কাজ হচ্ছে সবজি ঠাণ্ডাকরণ। স্বচ্ছ ও পরিষ্কার পানিতে বরফ কুচি মিশিয়ে তারপর এতে সবজি রাখলে সবজি আন্তঃতাপমাত্রা লক্ষণীয়ভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব। গবেষণায় দেখা গেলে, এভাবে ঠাণ্ডা করলে সবজির আন্তঃতাপমাত্রা প্রায় ১৩-১৭ ডিগ্রি পর্যন্ত নামিয়ে আনা যায়।
ঠাণ্ডাকরণের মাধ্যমে শ্বসনের হার কমিয়ে আনা যায় এবং ফল ও সবজির জীবনকাল বেড়ে যায়।
গ্রেডিং অথবা শ্রেণিকরণ
গ্রেডিং স্ট্যান্ডার্ড হচ্ছে পণ্য বাণিজ্যের বিশ্বজনীন প্রতীক। গ্রেডের মান অনুযায়ী বাজারে পণ্যেও চাহিদা নির্ধারিত হয় এবং সেই অনুযায়ী প্যাকহাউসের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
সর্টিংকৃত পণ্যসমূহ নির্দিষ্ট আকার, ওজন ও পরিপক্বতার ওপর ভিত্তি করে গ্রেডিং বা শ্রেণিকরণ করা হয়। সর্টিং এর পরে বা প্যাকেজিং এর ঠিক পূর্বে গ্রেডিং করা প্রয়োজন।
পরিষ্কারকরণ
বাজারে উচ্চ মূল্য পাওয়ার জন্য সবজি বা পণ্য পরিষ্কার করতে হবে।
পরিষ্কার করার মাধ্যমে সবজিতে জীবাণুর সংক্রমণ, শারীরিক ক্ষত এবং পরিবহন খরচ হ্রাস করা যায়।
নিম্নলিখিতভাবে সবজি বা পণ্য পরিষ্কার করতে হবে
বেগুন ও টমেটোর বোঁটা, সরিষা পাতার মূল, ফুলকপি ও বাঁধাকপির পাতা ও বাড়তি শিকড় ছাঁটাই করতে হবে। বাঁধাকপির ক্ষেত্রে ৩-৪টি মোড়ানো পাতা রাখতে হবে।
পরিষ্কার নরম কাপড় দিয়ে টমেটো, বেগুন বা শসা মুছে নিতে হবে।
পরিষ্কার পানি দিয়ে সবজির সাথে লেগে থাকা মাটি ও অন্যান্য আবর্জনা ধৌত করতে হবে।
পরিষ্কারকরণের সময় সর্টিং এর কাজও করা যায়।
পণ্য যেন কোনোভাবেই সরাসরি মাটির সংস্পর্শে না আসে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ মাটি হলো বিভিন্ন জীবাণুর অন্যতম উৎস, যার সংস্পর্শে রোগের সৃষ্টি হয়।
প্যাকেজিং অথবা পণ্যের মোড়কীকরণ
প্যাকহাউসের প্রধান কাজ হলো পণ্যকে প্যাকেজিং করা। যা সতেজ পণ্যকে ক্ষত হওয়া ও বাহিরের আঘাত থেকে রক্ষা করে। দুর্বল ও অনুপোযুক্ত প্যাকেজিং ব্যবস্থার কারণে পণ্য গন্তব্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে পরিবহন ও হ্যান্ডলিং এর সময় সবচেয়ে বেশি সংগ্রহোত্তর ক্ষতি হয়।
বাজারে বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজিং দ্রব্য বা কন্টেইনার পাওয়া যায়। সবজির প্রকৃতি, বাজারে দূরত্ব, যানবাহনের ধরন এবং রাস্তার অবস্থার উপর নির্ভর করে প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল কেমন হবে তা নির্ধারণ করতে হবে।
সতেজ সবিজ বা ফল পরিবহনের ক্ষেত্রে প্যাকেজিং এর জন্য কাঠের বাক্স বা প্লাস্টিক ক্রেটস-ই অধিকতর উপযোগী। তবে এই পাত্রসমূহ ব্যবহারের ক্ষেত্রে লাইনার হিসেবে মুদ্রণবিহীন নিউস পেপার, পরিষ্কার কলার পাতা ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে।
সবজির উত্তম প্যাকেজিং-এর জন্য আবশ্যিক কার্যক্রম
সবজি প্যাকেজিং এর জন্য পরিষ্কার পাত্র ব্যবহার করতে হবে।
যদি যান্ত্রিকভাবে সবজির প্যাকেট হ্যান্ডলিং এর ব্যবস্থা না থাকে, তবে সেক্ষেত্রে একক প্যাকেটের ওজন ৪০ কেজির নিচে হতে হবে, যাতে করে একজন শ্রমিক একাই একটি প্যাকেট সহজে তুলতে বা নামাতে পারে।
পাত্রের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী সবজি ভরতে হবে। কারণ ধারণক্ষমতার বেশি হলে সবজিতে চাপজনিত ক্ষত সৃষ্টি হবে। আবার পরিমাণ কম হলে কম্পনজনিত (ভাইব্রেশন) ক্ষত সৃষ্টি হবে।
একটি পাত্রে কেবলমাত্র একই ধরনের পরিপক্বতা বিশিষ্ট সবজি বা পণ্য রাখতে হবে।
প্যাকেজিং পাত্রে সবজিকে এমনভাবে রাখতে হবে যাতে নড়াচড়া করতে না পারে।
সবজিকে ভরার সময় পাত্রকে মৃদুভাবে নড়াচড়া করতে হবে যাতে করে পাত্রের ভেতরের ফাঁকা স্থান সবজি দ্বারা পূর্ণ হয়।
প্যাকেজিং এর পর পাত্রকে সঠিকভাবে বেঁধে দিতে হবে।
অতঃপর প্যাকেটকৃত সব্জি বাজারজাতকরণের পূর্বে শীতল স্থানে রাখতে হবে।
পরিবহন
পরিবহন বাজারজাতকরণের অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ কাজের মাধ্যমে পণ্যের স্থানগত উপযোগ সৃষ্টি হয়। যে কাজের মাধ্যমে উৎপাদকের নিকট হতে ক্রেতার নিকট পণ্য পৌঁছে দিয়ে স্থানগত উপযোগ সৃষ্টি করা হয় তাকে পরিবহন বলে। অর্থাৎ পরিবহন হলো পণ্য উৎপাদনের স্থান হতে ক্রয়ের বা ব্যবহারের স্থানে স্থানান্তর করা এবং এভাবে পণ্যের সময়মতো ও স্থানগত উপযোগ সৃষ্টি হয়।
পরিবহন দুভাবে পণ্য বণ্টন প্রণালিতে সাহায্য করে। যাদের একটি হলো উৎপাদিত পণ্যের কাঁচামাল শিল্পে পৌঁছে দিয়ে এবং অন্যটি হলো শিল্প উৎপাদিত পণ্য ক্রেতা বা ভোক্তার নিকট পৌঁছে দিয়ে। পরিবহন ব্যবস্থা পণ্য মূল্যের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। পণ্য পরিবহন যত সহজ, দ্রুত ও সহজ হবে, পণ্যের মূল্যও তত হ্রাস পাবে। ফলে ক্রেতারা স্বল্প মূল্যে তাদের কাক্সিক্ষত পণ্যটি ক্রয় করতে পারবে। পণ্যসামগ্রী যে স্থানে উৎপাদিত হয়, সে স্থানে ভোগ হবে এমন নয়। উৎপাদনের স্থান হতে ভোগ স্থানের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এখানে পরিবহন উৎপাদক এবং ভোক্তার নিকট পৌঁছিয়ে দেয় ফলে তাদের মধ্যে যে স্থানগত বাধা থাকে, তা দূর হয়। ক্রেতাদের মাঝে যথোপোযুক্ত সময়ে সরবরাহ করার জন্য পণ্য উৎপাদন করা হয়। বিপণনকারীর মূল লক্ষ্য থাকে ক্রেতাদের হাতের নাগালে পণ্য নিরাপদে সরবরাহ করা। পরিবহনের মাধ্যমে উৎপাদকের নিকট হতে বিভিন্ন হাত ঘুরে পণ্যটি চূড়ান্ত ভোক্তার নিকট সরবরাহ করা হয়। ফলে বিপণনের উদ্দেশ্য অর্জিত হয়।
ভোক্তার সন্তুষ্টি বিপণনকারীর মূল উদ্দেশ্য। পণ্য হতে ক্রেতাদের প্রত্যাশা পূরণ হলে ভোক্তারা সন্তুষ্ট হয়। তবে ক্রেতারা শুধুমাত্র পণ্যের গুণগত মান, আকার, পরিমাণ ইত্যাদির দ্বারা সন্তুষ্ট হয় না। তারা পণ্যটি হাতের নাগালে পাওয়ারও প্রত্যাশা করে। ক্রেতাদের এরূপ প্রত্যাশা পূরণ কেবলমাত্র পরিবহনের দ্বারাই সম্ভব।
পণ্য বিভিন্ন পথে পরিবাহিত হয়। এগুলো হলো স্থলপথ (সড়ক ও রেল পরিবহন), আকাশ পথ (বিমান পরিবহন) এবং জল পথ (নৌপরিবহন ও সামুদ্রিক পরিবহন)।
পণ্য পরিবহনে অনুসরণীয়
পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত গাড়ির অবশ্যই লাইসেন্স থাকতে হবে এবং চালকেরও ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকতে হবে।
যে সকল কর্মীরা মালামাল গাড়িতে উঠানো নামানোর কাজে অংশগ্রহণ করবে তাদের অবশ্যই জীবাণুমুক্ত এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নিয়ম অনুসরণ করতে হবে।
পরিবহনের সময় অবশ্যই সবজির ধরন, পরিমাণ, তারিখ, সবজি উৎপাদনকারীর নাম ও ঠিকানা এবং পরিবহন চালকের নাম লিপিবদ্ধ করতে হবে এবং নিয়মিত এর রেকর্ড রাখতে হবে।
সবজি পরিবহনের ক্ষেত্রে পরিবহনকারী যান পরিবহনের পূর্বে এবং পরে নিয়মিত পাম্প এর পানির মাধ্যমে ভালোভাবে পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
খেয়াল রাখতে হবে যানবাহন এর ভেতরে যেন ইঁদুর, তেলাপোকা, পিঁপড়া ইত্যাদি না থাকে এবং কোনো প্রকার মলমূত্র বা অন্য কিছুর খারাপ গন্ধ না থাকে।
খোলা ভ্যানে পরিবহন করলে উপরে অবশ্যই ছাউনি থাকেত হবে। তা না হলে বৃষ্টির পানি, রোগ বালাই ও ধুলাবালি দ্বারা সবজির গুণাগুণ নষ্ট হতে পারে।
একই পরিবহনে সবজির সাথে অন্য কোনো দ্রবাদি যেমন- রাসায়নিক সার, কীটনাশক/বালাইনাশকের প্যাকেট ইত্যাদি যেন পরিবহন না করা হয় সে দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
গাড়ি অতিরিক্ত বোঝাই দেওয়া যাবে না।
কন্টেইন বা প্যাকেজ সঠিকভাবে সারিবদ্ধভাবে করতে হবে।
পুরো প্যাকেজ লোড সম্পূর্ণ হালকা রঙিন ত্রিপল দিয়ে ঢাকতে হবে।
বাংলাদেশে প্যাকেজিং সন্তোষজনক নয় যদিও এই প্যাকেজিং পদ্ধতির যথেষ্ট উন্নয়ন ঘটানো সুযোগ আছে তাতে পণ্যের গুণাগুণ নিয়ন্ত্রণ ও সংগ্রহোত্তর ক্ষতি অনেক কমানো যায়। এজন্য নি¤œলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হবে।
প্রচলিত বাঁশের তৈরি প্যাকেজ এর পরিবর্তে প্লাস্টিক ক্রেট, ওভেন প্লাস্টিকের বস্তা, প্লাস্টিকের নেট ব্যাগ এবং ঢেউখেলানো ফায়ার বোর্ডের কার্টুন ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্যাকেজটি শক্ত হওয়া দরকার
প্যাকেজ অধিক বড় হওয়া উচিত নয় বাংলাদেশে ব্যাপারিরা সাধারণত বড় প্যাকেজ ব্যবহার করে। যাতে করে ৩০০-৬০০ কেজি ধরে এতে পণ্যের ক্ষতি হওয়ায় সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে।
পরিবহনের সময় বিভিন্ন রকমের প্যাকেজিং একসেসরিজ যেমন বাটিং, মোড়া, ফোমনেট, পেপার, পাতা, লতা, ইত্যাদি ব্যবস্থা করতে হবে।
বাজারজাতকরণে উৎসাহিত করার জন্য প্যাকেজে লগেট বা অন্যান্য তথ্য সংরক্ষিত ট্যাগ লেভেল থাকতে হবে।
পরিবহনের সময় সবজি বস্তা বা ক্রেট এর ওপর বসে অথবা দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করা যাবে না। পরিবহন যানে পণ্যদি উঠনো নামানোর সময় যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করা এবং সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে কিনা তা তদারকি করা।
পণ্যসামগ্রী খুব শক্ত করে বাঁধা যাতে তা নড়াচড়া করতে না পারে এবং পরিবহন যানের জায়গা সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চত করা;
পণ্যের প্যাকেটগুলো এমনভাবে সাজানো যাতে নিচের পণ্য সামগ্রীর কোনো ক্ষতি না হয়;
গাড়ি চালককের যতেœর সাথে গাড়ি চালাতে হবে যাতে পণ্যে তেমন ঝাঁকুনি না লাগে;
পরিবহনকালে অবাধ বাতাস চলাচলের সুবিধা থাকতে হবে যাতে বাইরের আলো-বাতাস পণ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশের সুযোগ পায় এবং পণ্যের শ্বসনজনিত গ্যাস ইথাইলিন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি সহজেই বের হয়ে যেতে পারে।
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত কাভার্ডভ্যানে সবজি পরিবহনের সর্বোত্তম পন্থা।
নির্বাচিত সবজির সংরক্ষণ সংক্রান্ত তথ্য
ফল ও সবজির গুণগত মান রক্ষা ও সংগ্রহোত্তর অপচয় রোধে সংরক্ষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফল ও সবজি যেসব কারণে সংরক্ষণ করা হয় বা সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়, তা সাধারণত নি¤œরূপ
মাঠ থেকে সংগ্রহের পর বাজারজাতকরণের পূর্বে ও বাজারজাতকরণের সুবিধার্থে;
খুচরা বাজারেও সরবরাহের আগে সাময়িক সংরক্ষণের জন্য;
বৈদেশিক বাজারে রপ্তানির পূর্বে গুণগতমান অক্ষুন্ন রাখার উদ্দেশ্যে;
পচন থেকে রক্ষা করে প্রয়োজনমতো ভবিষ্যতে বা অমৌসুমে বিক্রি বা ব্যবহারের উদ্দেশ্যে।
সংরক্ষণাগার এর পরিচর্যা
সংরক্ষণাগার অবশ্যই ময়লা ও রোগ জীবাণুমুক্ত, শুষ্ক এবং বাতাস চলাচলের সুবিধাযুক্ত ঠা-া জায়গা হতে হবে।
মেঝের ওপর ফসল রাখা যাবে না। ফল ও শাকসবিজ ক্রেটের মাধ্যমে মেঝে থেকে ১ ফুট উপরে তাকের মধ্যে সাজিয়ে স্টোর করতে হবে। এতে করে সংগ্রহোত্তর রোগ বালাই বা কীটপতঙ্গ থেকে ফসলকে অনেকাংশে রক্ষা করা যাবে।
উত্তম গুণাগুণ সম্পন্ন পণ্য সংরক্ষণ করা;
ক্ষতযুক্ত বা রোগজীবাণুযুক্ত পণ্যকে সংরক্ষণ না করা;
সংরক্ষণের আগে পণ্যকে অবশ্যই প্রাক শীতলীকরণ করা;
যে পাত্রে পণ্য সংরক্ষণ করা হবে সেই পাত্রটির মধ্য দিয়ে যাতে সহজে বায়ু চলাচল করতে পারে সে ব্যবস্থা রাখা;
দুইটি সংরক্ষণ পাত্রের মধ্যে অবশ্যই কিছু ফাঁকা জায়গা রাখতে হবে;
যখন বিভিন্ন ধরনের পণ্য একসঙ্গে সংরক্ষণ করা হবে তখন লক্ষ্য রাখতে হবে যে পণ্যগুলো যেন একই ধরনের তাপমাত্রা ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা সহ্য ক্ষমতা সম্পন্ন হয়;
নির্বাচিত ফল ও সবজি সংরক্ষণের উপযুক্ত তাপমাত্রা ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা
বাংলাদেশে কৃষি পণ্যের বাজারজাতকরণ একটি প্রধান সমস্যা। অনুন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, মধ্যস্বত্বভোগী সম্প্রদায়ের উপস্থিতিতে কৃষি পণ্যের সুষ্ঠু বাজারজাতকরণ সম্ভব হয় না। ফলে কৃষকরা তাদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয় এবং সামগ্রিকভাবে কৃষি উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। কৃষিতে পণ্য অধিক উৎপাদিত হলে উৎপাদিত দ্রব্য স্থানান্তরের জন্য পরিবহন তথা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়। কৃষির উন্নতি অবনতির সাথে পরিবহন তথা যোগাযোগ ব্যবস্থা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের সাথে শহরের বা হাটবাজারের কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে উপযুক্ত যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা নাই। যার ফলে পচনশীল পণ্য সহজেই নষ্ট হয় এবং কৃষকরা অনেক কৃষিপণ্যের উপযুক্ত দাম থেকেও বঞ্চিত হয়। কৃষকরা যাতে তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় সেজন্য বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে এবং মধ্যস্বত্বভোগীর প্রভাব থেকে কৃষকদের মুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের এক অঞ্চলের ভোক্তারা অন্য অঞ্চলের পণ্য বা সেবা ভোগের অধিকার লাভ করেছে। এতে একদিকে ক্রেতারা যেমন তাদের পণ্য ভোগের সুবিধা পাচ্ছে, তেমনি উৎপাদকের উৎপাদিত পণ্যেও বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে।
প্রফেসর ড. এম. এ. রহিম১ ড. মো. শামছুল আলম২
১পরিচালক, বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার, বা.কৃ.বি., ময়মনসিংহ, মোবাইল : ০১৭১১৮৫৪৪৭১ ২এস. এস. ও., উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, বিনা
বাংলাদেশ জনসংখ্যার অনুপাতে ক্ষুদ্র দেশ হওয়া সত্ত্বেও এই বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন মেটানোর জন্য খাদ্য উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। আজ সারা বিশ্বের ‘খাদ্য নিরাপত্তা’ অর্জনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীর পুষ্টি অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এখনও পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রে প্রতি তিনজন শিশুর খর্বাকৃতি অথবা বয়সের অনুপাতে কম ওজন। এদিকে ১৫-৪৯ বছরের নারীদের ক্ষেত্রে ক্রনিক এনার্জির অভাবজনিত সমস্যায় আক্রান্ত নারীর সংখ্যা (১৭ শতাংশ) কমে আসলেও অন্যদিকে ২৪ শতাংশ নারী অধিক ওজন সম্পন্ন (Over weight/obesity)। যার ফলে অসংক্রামক ব্যাধিতে (Noncommunicable Disease) আক্রান্ত ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে এবং ফলশ্রুতিতে অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও (৬৮ শতাংশ) উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশের মানুষের জন্য অপুষ্টি একটি মারাত্মক জাতীয় সমস্যা। এ দেশের নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোর-কিশোরী অধিকাংশ মানুষই ওপরে বর্ণিত অপুষ্টির/অতিপুষ্টি/অনুপুষ্টির অভাবজনিত অপুষ্টির শিকার। তবে শিশু, কিশোর-কিশোরী ও মহিলারাই বেশি অপুষ্টিতে ভুগছে।
বাংলাদেশ পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি দারিদ্র্র্য বিমোচন ও স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নের মাধ্যমে জনগোষ্ঠীর মাঝে বিরাজমান পুষ্টি অবস্থা উন্নয়নেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করে চলেছে। তারপরও অপুষ্টি সমস্যা, অতি পুষ্টি ও অনুপুষ্টির অভাবজনিত জনস্বাস্থ্য সমস্যা বিরাজমান এবং এর ফলশ্রুতিতে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী সৃষ্টিকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। এসব পুষ্টি সমস্যা নিরসনে বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়ন অর্জনের জন্য ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যার ৮টি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পূর্বশর্ত হচ্ছে পুষ্টি অবস্থার উন্নতি। জনগোষ্ঠীর সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ জীবন নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যগ্রহণ অত্যাবশ্যক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সংজ্ঞানুযায়ী স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য (Healthy Diet) গ্রহণই প্রতিদিনের খাবারের মাধ্যমে শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করার মাধ্যমে শরীরের সঠিক গঠন, বৃদ্ধি ও ক্ষয় পূরণ করার মধ্য দিয়ে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারে। পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন, টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে পুষ্টি অবস্থার টেকসই উন্নয়ন অর্জন নিশ্চিত করা সম্ভব।
Healthy Diet এর সংজ্ঞানুযায়ী প্রতিদিনের খাবারে যেমন ৫৫-৬৫ শতাংশ এনার্জি শস্যজাতীয় খাবার থেকে গ্রহণ করতে হবে তেমনি চর্বি জাতীয় খাবার থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। পাশাপাশি একজন প্রাপ্ত বয়স্কের প্রতিদিনের খাবারে ৪০০ গ্রাম শাকসবজি/ফলমূল খেতে হবে কিন্তু আমাদের জনপ্রতি খাদ্য গ্রহণের তথ্যানুযায়ী (HIES 2016) ২০১৬) এখনও ২০০ গ্রাম সবজি ও ফলমূল গ্রহণ করে থাকে, যা পর্যাপ্ত নয়। একজন পূর্ণবয়স্ক লোক গড়ে ১৬৭ গ্রাম সবজি খায়। এর সাথে আলু ও মিষ্টি আলু যোগ করলেও প্রতিদিন গড় পরিমাণ ৬৫ গ্রামের বেশি হয় না আর ৩৬ গ্রাম ফল অর্থাৎ প্রয়োজনের তুলনায় আমরা খুব অল্প পরিমাণ শাকসবজি আর ফলমূল খাই।
বাংলাদেশ সবজি উৎপাদনে বিশ্বের তৃতীয় স্থানে তবু বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি ফলমূল খায় না। আমাদের দেশে বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন রকমের শাকসবজি পাওয়া যায়। তাই প্রতিদিনের খাবারে সবজির বিভিন্ন রকম আইটেম রাখা খুব কঠিন ব্যাপার না। তবে বেশির ভাগ লোকই প্রতিদিন শাক বা সবজির যে কোনো ১টি আইটেম খেয়ে থাকেন, যা আমাদের সব ধরনের পুষ্টি সরবরাহ করে না। বাংলাদেশের শাকসবজির পুষ্টিমাণের তালিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে একেক ধরনের শাকসবজি একেক ধরনের পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে থাকে, তাই বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির সংমিশ্রণ খাদ্যে বিভিন্ন পুষ্টি নিশ্চিত করে।
আমাদের দেশে শীতকালে নানা প্রকার শাকসবজি উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, টমেটো, আলু, গাজর, বেগুন, মুলা, লাউ, শিম, ধনেশাক, লালশাক প্রভৃতি অন্যতম। শীতকালীন শাকসবজি অতি প্রয়োজনীয় একটি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু খাদ্য। এতে মানব দেহের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন এ এর উৎস, ভিটামিন বি সমূহ, সি এবং ক্যালসিয়াম, লৌহ, জিঙ্ক প্রভৃতি অতি প্রয়োজনীয় খনিজ লবণ রয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন শিমজাতীয় সবজিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে উদ্ভিজ প্রোটিন আছে। তাছাড়া গাঢ় সবুজ ও হলুদ রঙের শীতকালীন শাকসবজি বিশেষ করে গাজর, টমেটো, বাঁধাকপি, মুলাশাক, লালশাক ও পালংশাকে প্রচুর পরিমাণে সে সব ক্যারোটিন থাকে, যা ভিটামিন এ এর উৎস। ফলে এসব ক্যারোটিন হতে আমাদের দেহে ভিটামিন ‘এ’ তে রূপান্তর করতে পারে।
পুষ্টিগুণের দিক থেকে শীতকালীন শাকসবজির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করার পাশাপাশি শাকসবজি দেহের রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই শরীরের চাহিদা মতো শাকসবজি খেলে নানা রকম রোগব্যাধি যেমন প্রতিরোধ করা সম্ভব তেমনি শরীরকে রোগ থেকে রক্ষা করে শরীর সুস্থ রাখে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, শাকসবজি খাওয়ার ফলে ক্যান্সার, কিডনি রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, বহুমূত্র ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম।
গবেষকরা আরও জানিয়েছেন, যারা পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি খেয়ে থাকে তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর আশঙ্কাও কমে যায়। শীতকালীন শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে আঁশ থাকে। এই আঁশ গ্রহণকৃত খাদ্য দ্রব্যের মধ্যস্থিত কোলস্টেরল/চর্বিসহ অনেক ক্ষতিকর রাসায়নিকের সাথে যৌগ তৈরি করে শরীর থেকে নিষ্কাশন করার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। শাকসবজিতে বিদ্যমান আঁশ মলাশয়ের ক্যান্সার, বহুমূত্র, স্থুলকায়ত্ব, উচ্চ রক্তচাপ, মূত্রনালীর পাথর ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে দেহকে সুস্থ ও সতেজ রাখে।
তাছাড়া শীতকালীন শাকসবজি শিশুদের অপুষ্টিজনিত রাতকানা, অন্ধত্ব, রিকেট, বিভিন্ন প্রকার চর্মরোগ, স্কার্ভি, মুখ ও ঠোঁটের কোণে ঘা, রক্তশূন্যতা দূরীকরণে কার্যকর ভূমিকা রাখে। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, অপুষ্টি ও দেহের রোগ প্রতিরোধে শাকসবজির ভূমিকা অপরিসীম। শিশুদের সম্পূরক খাদ্য তৈরির ক্ষেত্রে উল্লেখিত ভিটামিন আর মিনারেলস শরীরের চাহিদানুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য শাকসবজিও পরিমাণমতো ব্যবহার করা যেতে পারে।
শীতে হরেক রকম সবজির প্রাচুর্য দেখা যায়, সারা বছর তার কিয়দাংশ পাওয়া যায় না। শুধু সহজলভ্যতায় নয় এসব সবজির পুষ্টিগুণও অধিক। শীতের প্রতিটি সবজিতেই প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, মিনারেলস, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা থাকে। তাই সুস্থ ও সুন্দর থাকার জন্য এসব শাকসবজি প্রচুর পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত।
Healthy Diet এর সংজ্ঞা অনুযায়ী একজন শিশুর প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ গ্রাম শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে শাকসবজি খাওয়ার পরিমাণ উৎপাদনের সাথে সাথে বাড়ছে কিন্তু এখনও WHO সুপারিশ অনুযায়ী পর্যাপ্ত নয়। পৃথিবীর আর কোনো দেশের মানুষ সম্ভবত এত কম পরিমাণ শাকসবজি খায় না। বস্তুত আমাদের খাদ্য তালিকায় ভাত জনপ্রিয়তার শীর্ষে। সে তুলনায় শাকসবজির কদর একেবারেই কম। ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম, লৌহ ও ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ লালশাক, পালংশাক, মুলাশাক কিংবা দেশীয় যে কোনো শাকের মাত্র ৫০ গ্রাম আমাদের দৈনন্দিন পুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট। বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু শাকসবজি চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। শাকসবজি আবাদের সুবিধা হলো ফসলি মাঠে যেমন শাকসবিজ চাষ করা যায়, তেমনি জমির আইল বা রাস্তার ধারে, পুকুর পাড়ে এক টুকরো জায়গায়, বসতবাড়ির আঙিনায়, ঘরের চালে, দালানের ছাদে, টবে বিভিন্ন শাকসবজি উৎপাদন সম্ভব। কাজেই অধিক পরিমাণে পুষ্টিসমৃদ্ধ শাকসবজির চাষ করে তা পরিমাণমতো খাওয়ার মাধ্যমে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক তথা জাতীয় সমস্যা দূরীকরণে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন এবং আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ-সবল ও অপুষ্টিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিশ্চিত করা সম্ভব।
অধ্যাপক নাজমা শাহীন
পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭৪৭৭৯৯৫৬২
শাকসবজি সঠিকভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। তাই অধিক জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা মিটানোর জন্য সারা বছরই আমাদের শাকসবজি চাষ ও সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। ডিএই, হর্টিকালচার উইংয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০১৭-১৮ সালে বাংলাদেশে মোট সবজি (আলুসহ) উৎপাদিত হয়েছে ২,৬২,৩০,৯২৭ মেট্রিক টন এবং চাহিদা রয়েছে ১,৪৬,০০০০০ মেট্রিক টন অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় ১,১৬,৩০৯২৭ মেট্রিক টন অতিরিক্ত সবজি উৎপাদিত হয়েছে। এফএও এর ২০১৬-১৭ প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রাপ্ত বয়স্ক একজন মানুষের প্রতিদিন গড়ে ২৫০ গ্রাম শাকসবজি (আলুসহ) খাওয়া দরকার কিন্তু বর্তমানে এই দেশের মানুষ গ্রহণ করছে মাত্র ১২৫ গ্রাম। এই বিশাল ব্যবধানকে কমিয়ে আনার জন্য শাকসবজি উৎপাদনের মৌসুম বা সময় দীর্ঘ করতে হবে বা বাড়াতে হবে ও আমাদের খাদ্যাভাস পরিবর্তন করতে হবে। রবি মৌসুমে সবচেয়ে বেশি শাকসবজি উৎপাদিত হয়ে থাকে যা আমাদের চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু মৌসুমে বাজারমূল্য খুব কম হওয়ায় ও অধিকাংশ শাকসবজি দ্রুত পচনশীল হওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। অন্য দিকে দ্রুত পচনশীল বলে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় না এবং প্রচুর অপচয় হয়ে থাকে। তাই পুষ্টিমান অক্ষুন্ন রেখে অসময়ে শাকসবজি সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে আমরা শাকসবজির অপচয় রোধ ও আমাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারি। তবেই আমরা আমাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারব। তাছাড়া বিভিন্ন কারণে উৎপাদিত পণ্যের গুণগতমান নষ্ট হয়। নিয়ম অনুযায়ী ফসল সংগ্রহ ও স্থানান্তর না করলে পণ্যের মান ও বাজারমূল্য কমে যায়। পণ্য ঘষা খেলে বা ক্ষত হলে বা থেঁতলে গেলে বাদামি ও কাল দাগ হয়ে উজ্জ্বলতা হারায়। ক্ষত হলে বিনষ্টকারী জীবাণু অনুপ্রবেশের সুবিধা হয়, যা পণ্যকে পচাতে ত্বরান্বিত করে। এসব কারণে পণ্যের শ্বসনের হার বেশি বেড়ে যায় এবং সংরক্ষণের সময়কাল কমে যায়। শাকসবজি সংগ্রহকালে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে সবজিতে আঘাত না লাগে। কারণ আঘাতপ্রাপ্ত শাকসবজিতে শ্বসন ও প্রস্বেদন ক্রিয়া বেড়ে যায়, ইথিলিন বেশি উৎপন্ন হয় ফলে সবজির ওজন কমে যায়, সাথে সাথে রোগজীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং গুণগতমান হ্রাস পায়।
শাকসবজি সংরক্ষণের পদ্ধতি
পচনশীল বলে অধিকাংশ শাকসবজি আমরা মাঠ থেকে সংগ্রহ করার সাথে সাথে কিংবা কয়েক দিনের ভেতরে খেয়ে ফেলি। সময় মতো না খেলে এগুলো পচে নষ্ট হয়। তাই মৌসুমে উৎপাদিত শাকসবজি দেরিতে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে দ্রুত পচনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আমরা সংরক্ষণ কৌশল অবলম্বন করতে পারি। উদ্ভিদের (পাতা, ফুল, ফল) বিপাক প্রক্রিয়াগুলো বিভিন্ন জারক দ্রব্যের নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই কোনো প্রকারে জারক দ্রব্যের এবং জীবাণুর কার্যকারিতা নষ্ট করে দিতে পারলেই পচনশীল দ্রব্য দ্রুত পচনের হাত থেকে রক্ষা পায়। এজন্য আমরা বিভিন্ন সংরক্ষণ পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকি।
শাকসবজি সংরক্ষণ মূলত চার প্রকার। যথা-
১) টাটকা অবস্থায় সংরক্ষণ : শাকসবজি সংরক্ষণের জন্য হিমাগারে নিম্ন তাপমাত্রা ও উচ্চআর্দ্রতায় রাখা যায়। এতে সবজির স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিমান প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। তবে এটা খুব ব্যয়বহুল ও হিমাগারের সংখ্যাও পর্যাপ্ত নেই। যেমন- টমেটো, আলু, মিষ্টি আলু, গাজর, মটরশুঁটি ইত্যাদি হিমাগারে সংরক্ষণ করা যায়।
২) শুকিয়ে সংরক্ষণ : সতেজ ও রসাল হওয়ার কারণে শাকসবজিতে দ্রুত পচন ধরে। তাই শুকিয়ে শাকসবজিতে পানির পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারলে এগুলো সহজে জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয় না ও দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। যেমন- সজিনা পাতা, ধনিয়া পাতা, বিলাতি ধনিয়া, মাশরুম, শিমের বিচি ইত্যাদি ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করে অসময়ে চাহিদা মেটানো সম্ভব। পাকা শিমের বিচি ও বরবটির বিচি শুকিয়ে সারা বছর সংরক্ষণ করা যায়। শিমের বিচি ভেজে খাওয়া যায় ও ভেজে গুঁড়া করে ডাল হিসেবেও রান্না করে খাওয়া যায়। পটোলের পাতা দিয়ে বড়া, স্যুপ ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। পটোলের পাতা ঔষধিগুণ সম্পন্ন বিধায় শুকিয়ে গুঁড়া করে সারা বছর সংরক্ষণ করে খাওয়া যায়।
৩) ব্ল্যানচিং পদ্ধতিতে সংরক্ষণ : প্রায় সব সবজি যেমন ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, মুলা, আলু, মিষ্টিআলু ইত্যাদিকে ছোট করে কেটে ব্ল্যানচিং করে রেখে প্রায় ৩-৫ মাস সংরক্ষণ করা যায়। ব্ল্যানচিং হলো একটি পাত্রে পানি ফুটিয়ে তার মধ্যে কাটা সবজি ৩-৪ মিনিটের জন্য ছেড়ে দিতে হবে। তারপর আধাসিদ্ধ সবজিগুলো ছাঁকনিতে ঢেলে পানি ঝরিয়ে এবং পরে তাতে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ঠাণ্ডা করে সম্পূর্ণ পানি ঝরিয়ে অন্য একটি পাত্রে ঢালতে হবে। সবজিগুলো সম্পূর্ণভাবে ঠাণ্ডা হলে বায়ুরোধক পাত্রে ভরে ডিপফ্রিজে সংরক্ষণ করা যায় অথবা ব্ল্যানচিং করা সবজিগুলো সূর্যের আলোতে শুকিয়ে ও বায়ুরোধক পাত্রে সংরক্ষণ করা যায়।
৪) প্রক্রিয়াজাত করে সংরক্ষণ : প্রক্রিয়াজাত করেও শাকসবজি সংরক্ষণের বহু পদ্ধতি প্রচলিত আছে। প্রক্রিয়াজাত করার দরুন শাকসবজির মূল গঠন পরিবর্তিত হয় এবং পচন থেকে রক্ষা করার জন্য কোনো না কোনো মাধ্যম বা রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করতে হয়। শাকসবজি প্রক্রিয়াজাত করে দীর্ঘদিন ঘরে রেখে খাওয়া যায়। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রক্রিয়াজাত করে এটি একটি ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠায় এবং গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন তথা আত্মকর্মসংস্থানে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। শাকসবজি প্রক্রিয়াজাতকরণ বা সংরক্ষণের কয়েকটি মাধ্যম সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো।
ক. চিপস : আলু ও কাঁচাকলা ও মাশরুম ইত্যাদি সবজিকে পাতলা স্লা্ইস করে কেটে রোদে শুকিয়ে চিপস তৈরি করা যায়। যা দিয়ে মুখরোচক খাবার তৈরি করে বাচ্চাদের আকৃষ্ট করা যায় এবং সারা বছর এর প্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভব।
খ. চিনি ও লবণের দ্রবণে শাকসবজি সংরক্ষণ : ক্যাপসিকাম, মাশরুম, কচি শসা ইত্যাদি চিনি ও লবণের দ্রবণে সংরক্ষণ করা যায়।
গ. রস আকারে সংরক্ষণ : টমেটোর রস তৈরি করে সংরক্ষণ করা যায়।
ঘ. জ্যাম, জেলি : চুকুর, আলু, মিষ্টিআলু, মিষ্টিকুমড়া ইত্যাদির জ্যাম জেলি তৈরি করা যায়।
ঙ. আচার, সস, চাটনি : বেগুন, টমেটো ইত্যাদির আচার, সস, চাটনি করা যায়। অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর বেগুনের আচার করে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। টমেটোর সস সর্বজন স্বীকৃত ও বহুল প্রচলিত, যা অনেক দিন সংরক্ষণ রাখা যায়।
চ. মোরব্বা : চালকুমড়া, পেঁপে ইত্যাদির মোরব্বা করা যায়।
ছ. বিভিন্ন ডাল ও মিষ্টিকুমড়া দিয়ে বড়ি বানিয়ে সংরক্ষণ করা যায়।
বিভিন্ন শাকসবজি সংরক্ষণ কৌশল
মিষ্টিকুমড়া : ১০০-১২০ দিনের পাকা মিষ্টিকুমড়া সারা বছর সংরক্ষণ করা যায়। এ ছাড়া ও পাকা মিষ্টিকুমড়া দিয়ে বড়ি তৈরি করে ও ভালোভাবে শুকিয়েও অসময়ের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য সংরক্ষণ করা যায়।
চালকুমড়া : এটি রবি ও খরিপ দুমৌসুমেই মাচা, চালা ও ভূমিতে জন্মে। পাকা চালকুমড়া বাড়িতে কয়েক মাস বা দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। চালকুমড়ার বোঁটার কাটা মাথায় মোম লাগিয়ে সংরক্ষণ মেয়াদ আরও বাড়ানো যায়। পাকা চালকুমড়া দিয়ে মোরব্বা তৈরি করে রেখেও অসময়ের জন্য সংরক্ষণ করা যায়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন উপায়ে ও নিরাপদ পানি ব্যবহার করে এসব পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করলে পুষ্টিমান বজায় থাকবে।
বাঁধাকপি : সাধারণত হিমায়িত গুদামে ৩ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। এ ছাড়া শীতকালে সাধারণ তাপমাত্রায় বাতাস চলাচল উপযোগী ছায়াযুক্ত স্থানে প্রায় ৩-৪ সপ্তাহ সংরক্ষণ করা যায়।
ফুলকপি : জমি থেকে ফসল তোলার প্রায় ৭ দিন আগে নেপথালিন অ্যাসেটিক এসিড পাতায় ছিটিয়ে পরে ঠাণ্ডা স্থানে রাখলে প্রায় এক থেকে দেড় মাস ফুলকপি ভালো অবস্থায় থাকে।
টমেটো : মৌসুমে সংরক্ষণের সময় পাকা টমেটো মেঝেতে খড় বিছিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। অনেক সময় খাঁচায় খড় বিছিয়ে টমেটো ঢেকে রাখা যায়। এভাবে স্থানীয় জাতের ক্ষেত্রে ৫-৭ সপ্তাহ ও হাইব্রিড জাতের টমেটোর ক্ষেত্রে ২০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। এ ছাড়াও টমেটো দিয়ে প্রক্রিয়াজাতকৃত সস, চাটনি করে সারা বছর সংরক্ষণ করা যায়। আর তাজা টমেটো হিমাগারে রেখেও দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। অসময়ে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করে ও চাহিদা মেটানো সম্ভব।
কুমড়াজাতীয় সবজি : বারোমাসী জাত রোপণ করে অসময়ে বিভিন্ন কুমড়াজাতীয় সবজি পাওয়া যায়।
গোলআলু : স্বল্প খরচে কৃষকপর্যায়ে আলু সংরক্ষণের বিভিন্ন কৌশল রয়েছে। বিভিন্ন কৌশলগুলো হলো:
আলু তুলনামূলকভাবে ঠাণ্ডা এবং বায়ু চলাচল করে এমন কোনো কক্ষে বা স্থানে রাখা যায়। সংরক্ষিত আলু ১০-১৫ সেন্টিমিটার (৪-৬ ইঞ্চি) উঁচু করে মেঝেতে বিছিয়ে রাখতে হবে। এছাড়া বাঁশের তৈরি মাচায়, ঘরের তাকে বা চৌকির নিচেও আলু বিছিয়ে রাখা যেতে পারে। সংরক্ষিত আলু ১০-১৫ দিন পর পর নিয়মিত পরিদর্শন ও বাছাই করে রোগাক্রান্ত, পোকাক্রান্ত ও পচা আলু আলাদা করে নিতে হবে।
আলু সুপ্তাবস্থায় গুদামজাতকরণ : ফসল পরিপক্ব হওয়ার সময় থেকে আলুর সুপ্তাবস্থা আরম্ভ হয়। আলুর সুপ্তাবস্থা ফসল পরিপক্ব হওয়ার পর থেকে প্রায় ২-৩ মাস পর্যন্ত থাকে। সচরাচর ব্যবহৃত পাত্রে যেমন- ঝুড়ি বা ডোল ব্যবহার করা যেতে পারে। গুদামজাতকরণ পাত্রের তলদেশ এমনভাবে তৈরি হতে হবে যাতে বাতাস ঢুকতে পারে এবং আলুর স্তূপের ভেতর বায়ু চলাচল করতে পারে। ঘরের মেঝেতে রাখার ক্ষেত্রে আলুর স্তূপ যাতে ১ মিটার (৩ ফুট) গভীর বা ২ মিটারের (৬ ফুট) বেশি প্রশস্ত না হয় এবং যথেষ্ট বায়ু চলাচলের সুযোগ থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। রাতে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থাও করতে হবে। কারণ এ সময় বাতাস সবচেয়ে ঠা-া থাকে এবং আলু হতে অতিরিক্ত তাপ বের হয়ে যায়। সাধারণত উচ্চফলনশীল জাত ২-৩ মাসের বেশি গুদামজাত করার জন্য উপযুক্ত নয়। দেশি জাতের আলুর সুপ্তাবস্থা ৪-৫ মাস পর্যন্ত থাকে। এসব জাত কৃষকপর্যায়ে বেশি সময় সংরক্ষণ করা সম্ভব এবং কোনো কোনো জাতের আলু প্রায় ৬ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
বালু দিয়ে ঢেকে রাখা
পরিষ্কার শুকনো বালু দিয়ে আলু ঢেকে ও সংরক্ষণ করা যায়। এক্ষেত্রে আলু-বালু-আলু পর্যায়ক্রমিকভাবে স্তর করে রাখা যায়। এ ব্যবস্থায় টিউবার মথের আক্রমণ হতে আলু রক্ষা পায় এবং অংকুর শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত গুদামে নিরাপদে রাখা যায়। ছোট আকারের বীজ আলুও মাটি দিয়ে তৈরি পাত্রে রেখে ঘরের ঠা-া স্থানে সফলভাবে গুদামজাত করা যায়।
বীজ আলুর গুদামজাত
বীজ হিসেবে রাখা আলুর অংকুর গজানো শুরু হলেই আলাদাভাবে গুদামজাত করতে হবে। যেখানে দিনের আলো পড়ে এমন স্থানে তাক বা মেঝের ওপর ২-৩টি স্তরে আলু গুদামজাত করা যায়। দিনের প্রখর আলো গোলআলুর অংকুরকে ১০-১৫ মিলিমিটারের বেশি দীর্ঘ হতে বাধা দেয়। অংকুর ছোট থাকলে বীজ আলু আরও কিছুদিন নিরাপদ রাখা ও গুদামজাত করা যায়।
অহিমায়িত অবস্থায় খাবার আলু সংরক্ষণ
আমাদের দেশে অহিমায়িত অবস্থায় সাধারণত কৃষকের নিজ ঘরে, বৈঠকখানায় বা যে কোনো চালা ঘরে ২-৩ মাস পর্যন্ত আলু সংরক্ষণ করা যায়। তবে সাময়িকভাবে এসব ঘরে সংরক্ষণের বিষয়ে কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করলে সংরক্ষিত আলুর অপচয় কম হয়। যে ঘরে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা ভালো এবং অক্সিজেনের অভাব ঘটে না সেখানে অহিমায়িত অবস্থায় আলু সংরক্ষণ করা যায়।
অহিমায়িত গুদামঘর নির্মাণ কৌশল
সম্প্রতি ‘কৃষি বিপণন অধিদপ্তর’ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষামূলকভাবে খাবার আলু সংরক্ষণের জন্য অহিমায়িত গুদাম নির্মাণ করেছে, যা বেশ কার্যকর। অল্প খরচে গুদামঘর বিশেষভাবে তৈরি করা যেতে পারে। ১০ মিটার (প্রায় ৩০ ফুট) দৈর্ঘ্য ও ৫ মিটার (প্রায় ১৫ ফুট) প্রস্থ এবং ৩ মিটার (প্রায় ৯ ফুট) উঁচু আকারের ছনের বা টিনের ঘরে মাটি থেকে ৪৫-৫০ সেমি. (প্রায় ১.৫ ফুট) উচ্চতায় শক্ত করে বাঁশের মাচা তৈরি করে ২ থেকে ২.৫ মিটার (প্রায় ৬-৮ ফুট) দূরে দূরে ছিদ্রযুক্ত টিনের চোঙা বা বাঁশের তৈরি চোঙা স্থাপন করার পরে মাচার ওপরে চোঙার চারদিকে আলু সংরক্ষণ করতে হবে। সংরক্ষণের আগে আলু বাছাই করতে হবে, যাতে অপরিপক্ব, পোকা খাওয়া ও কাটা আলু না থাকে। মাচার নিচের ফাঁকা জায়গা এবং চোঙার মধ্য দিয়ে সহজেই বাতাস চলাচল করতে পারবে। এতে আলু ভালো থাকে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের কোনো অসুবিধা হয় না। গুদাম ঘরের নিচে স্যাঁতসেঁতে থাকতে পারবে না। সূর্যের আলো ও বৃষ্টির পানি যাতে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বর্ণিত আকারের অহিমায়িত একটি গুদামঘরে ১০০-১৫০ টন আলু সাময়িকভাবে সংরক্ষণ করা যায়। অহিমায়িত গুদাম সম্ভব হলে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বি করে নির্মাণ করলে দক্ষিণের বাতাস গুদামের সমস্ত অংশে প্রবাহিত হতে পারে। এতে সংরক্ষিত আলুর গুণাগুণ ভালো থাকে। বসতবাড়িতে আলু সংরক্ষণের জন্য প্রতিটি ১০ মিটার (প্রায় ৩০ ফুট) দৈর্ঘ্য এবং ৫ মিটার (প্রায় ১৫ ফুট) প্রস্থ ও ৩ মিটার (প্রায় ৯ ফুট) উচ্চতা আকারের বাঁশ, কাঠ, টিন, শন ইত্যাদি দ্বারা তৈরি ঘরের মেঝে পাকা করে এবং গ্যাস নির্গমনের ও বায়ু চলাচলের জন্য সুব্যবস্থা রেখে ঘর নির্মাণ করলে সর্বোচ্চ প্রায় এক লক্ষ পাঁচ হাজার টাকা খরচ হতে পারে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি আলুচাষিরা বাজারমূল্য বিশ্লেষণ করে লাভজনক সময়ে আলু বিক্রয় করে অধিক আয় নিশ্চিত করতে পারবে এবং স্বল্প খরচে এ ধরনের ঘর নির্মাণে অন্যা আলুচাষিরাও উদ্বুদ্ধ হবে। ফলে দেশের আলু সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং আলুর ক্ষতি হ্রাস পাবে। এভাবে আলু সংরক্ষণ করলে অপচয় রোধ হবে ও সারা বছর সংরক্ষণ করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা মিটিয়ে আলু চাষিগণ আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন।
কৃষিবিদ মিজানুর রহমান১ কৃষিবিদ সাবিনা ইয়াসমিন২
১পরিচালক ২উপজেলা কৃষি অফিসার (এলআর), সংযুক্তঃ মোবা : ০১৬৮৮০৫৪৭৮৬, হর্টিকালচার উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি এ দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৫ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিগত ৪০ বছরে খাদ্য নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৪.৭৯%। সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি প্রণয়ন ও সময়োপযোগী বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে দেশ আজ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু সবজি চাষের জন্য সহায়ক। শাকসবজিতে সাধারণত বিভিন্ন খনিজ লবণ এবং ভিটামিন প্রচুর পরিমাণে থাকে। এ জন্য শাকসবজিকে রোগ প্রতিরোধক খাদ্য বলা হয়। এতে ক্যালরি ও আমিষের পরিমাণ খুব কম। গাঢ় হলুদ ও সবুজ শাকসবজিতে বেশি পরিমাণে ক্যারোটিন বা প্রাক ভিটামিন ‘এ’ থাকে, যা খাওয়ার পর ক্ষুদ্রান্তে ভিটামিন ‘এ’ তে রূপান্তরিত হয়। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিদিন আহারে সবজির ব্যবহার জনপ্রিয় করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে চাষকৃত প্রচলিত অপচলিত সবজির সংখ্যা প্রায় ৯০টি যার মধ্যে ৩০-৩৫টিকে প্রধান সবজি ধরা যায়। এ দেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ৮.৫ মিলিয়ন হেক্টর। দেশের শতকরা ৯.৩৮ ভাগ জমি সবজি চাষের জন্য ব্যবহার হচ্ছে যার মাধ্যমে মাথাপিছু ১২৫ গ্রাম সবজি সরবরাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে। একজন সুস্থ সবল মানুষের জন্য প্রতিদিন ২২০ গ্রাম (সূত্র : এফএও, ডিএই) সবজি গ্রহণ করা প্রয়োজন। খাদ্যতালিকায় সবজির গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তির অধিকতর বিকাশসহ শারীরিক সক্ষমতা অর্জনের জন্য মানবদেহের অতীব প্রয়োজনীয় দু’টি খাদ্য উপাদান বিভিন্ন প্রকার খনিজ লবণ ও ভিটামিনের সবচেয়ে সহজলভ্য উৎস হলো বিভিন্ন প্রকারের সবজি। বাংলাদেশে অপুষ্টি একটি অন্যতম সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে সুষম খাবারের নিশ্চয়তা দিতে বিভিন্ন প্রকারের শাকসবজি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই বছরব্যাপী নিরাপদ সবজি উৎপাদন করার মাধ্যমে সারা বছরের খাদ্যেও নিরাপত্তা ও পুষ্টি চাহিদা মেটানো সম্ভব। তাই সারা বছরের পুষ্টি নিরাপত্তায় সবজির ভূমিকা অপরিসীম।
সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবজি চাষে রাসায়নিক সার প্রয়োগ ও পোকামাকড় দমনে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। তাছাড়া অতি লাভের আশায় বাজারে বিক্রির জন্য সবজি সংগ্রহ মাঠে কীটনাশক প্রয়োগ করে অল্প সময়ের মধ্যে সবজি সংগ্রহ করে বিক্রি করা হয়ে থাকে। সঠিক সময়ে কীটনাশক প্রয়োগ ও প্রয়োগমাত্রা সম্পর্কে ধারণা না থাকার দরুন নিরাপদ সবজি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকারক উপাদান মানুষের দেহে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টির কারণ। জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার, সঠিকমাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ, উপযুক্ত সময় ও নির্ধারিত মাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহার এবং সঠিক সময়ে সবজি সংগ্রহের মাধ্যমে নিরাপদ সবজি উৎপাদনের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। তাই বছরব্যাপী নিরাপদ সবজি উৎপাদনের মাধ্যমে সারা বছরের পুষ্টি চাহিদা পূরণে সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।
বাংলাদেশের উর্বর মাটি ও জলবায়ু সবজি চাষের জন্য বিশেষভাবে সহায়ক। উন্নত ও সুস্থ সবল বীজ, সঠিক পরিচর্যা ও জৈব প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে প্রায় সব ধরনের মাটিতেই নিরাপদ সবজি উৎপাদন করা যেতে পারে। তাই আমাদের নিরাপদ সবজি উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে। বছরব্যাপী নিরাপদ সবজি চাষাবাদ বাড়াতে হবে। নিবিড় সবজি চাষের মাধ্যমে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ কোটি ৫৯ লাখ ৫৪ হাজার টন সবজি উৎপাদন করে বিশ্বে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। আলু উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান ৮ম। ২০০৬ সনে শাকসবজির উৎপাদন ছিল ২০ লাখ ৩৩ হাজার টন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষি ক্ষেত্রে সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে খোরপোষের কৃষি আজ বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে দেশে কর্মসংস্থান সম্প্রসারিত হচ্ছে। অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
নিরাপদ সবজি উৎপাদনে রাসায়নিক ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে কতিপয় বিষয়ে খেয়াল রাখা জরুরি
- রাসায়নিক দ্রব্যের সঠিক ব্যবহার অনুসরণ;
- সবজি আবাদি জমির পরিবেশকে রাসায়নিক সংক্রমণ হতে সুরক্ষা করা;
- সঠিক রাসায়নিক গ্রহণযোগ্য মাত্রায় ব্যবহার;
- সেচ ব্যবস্থাপনায় পানির ঝুঁকি মূল্যায়ণ ও নিয়ন্ত্রণ;
- সেচের রাসায়নিক এবং ক্রয়Ñবিক্রয় সংক্রান্ত তথ্যসমূহ সংরক্ষণ
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সারা দেশে বছরব্যাপী নিরাপদ সবজি উৎপাদনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এগুলো হলো:
- নিরাপদ সবজি উৎপাদনে চাষিদের প্রশিক্ষণ দান;
- নিরাপদ সবজি উৎপাদনের কলাকৌশল হাতেকলমে দেখানো;
- নিরাপদ সবজি উৎপাদনের প্রদর্শনী স্থাপনের মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ;
- জৈব কৃষি তথা ফেরোমন ফাঁদ, আইপিএম, আইসিএম উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কৌশলের মাধ্যমে যথাসম্ভব বালাইনাশকের ব্যবহার নিশ্চিত করা;
- সঠিক সময় ও গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ কৃষককে উদ্বুদ্ধ করা;
- বছরব্যাপী সবজি উৎপাদন সম্পর্কে কৃষককে পরামর্শ প্রদান।
সবজির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সবজি চাষে রাসায়নিক সারের ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এ ছাড়াও পোকামাকড় দমন ও রোগবালাইয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য নানারকম বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়। সঠিক মাত্রার যথাযথ ব্যবহার না করা এবং উপযুক্ত বালাইনাশক ব্যবহার না করার দরুন অনেক ক্ষেত্রে সবজি আর নিরাপদ থাকছে না। অনিরাপদ সবজি পুষ্টির পরিবর্তে মানুষের শরীরে বিভিন্ন রোগ ছড়াচ্ছে এবং দেশের বাইরে রপ্তানি ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করছে। নিরাপদ সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রে রাসায়নিক ব্যবহার পরিহার করতে হবে যেন মাটি, পানি ও বায়ু দূষণ না হয়, এমনকি কৃষক ভাইদের স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দিতে হবে। তাই আইপিএম, আইসিএম উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির সম্প্রসারণে জোর দিতে হবে। মাটির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য জমিতে জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে। তা ছাড়া কম্পোস্ট সার, কেঁচোসার প্রয়োগ করলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। বালাইনাশকের ক্ষেত্রে নিম, নিশিন্দা, বিষকাটালী ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে কৃষকের স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে না।
পরিবর্তিত জলবায়ুতে নিরাপদ শাকসবজি উৎপাদন এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার, উচ্চমূল্যের ফসল চাষ, সর্জান পদ্ধতিতে সবজি চাষ, ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ, ছাদ কৃষি, মাশরুম চাষসহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্প (ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্প/বাংলাদেশের শাকসবজি, ফল ও পান ফসলের পোকামাকড় ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনায় জৈব বালাইনাশক ভিত্তিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ) কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
সর্জান পদ্ধতিতে সবজি চাষ
সাধারণত যে জমি জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয় বা বছরের বেশির ভাগ সময় পানি জমে থাকে সে জমিতে সর্জান পদ্ধতিতে সবজি চাষ করা যায়। পাশাপাশি দু’টি বেডের মাঝের মাটি কেটে উঁচু বেড তৈরি করে ফসল চাষ করাই সর্জান পদ্ধতি। মধ্য জানুয়ারি থেকে মাধ্য মার্চ (মাঘ-ফাল্গুন) মাসে সর্জান বেড তৈরি করা যায়।
ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষি সেক্টরে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপ্রবণ অবস্থানে আছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান প্রভাবগুলো-মাটি ও পানিতে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ, জলমগ্নতা, উপকূলীয় বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং উপকূলীয় জলোচ্ছ্বাস। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে ভবিষ্যতে এ অবস্থার আরও অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যা দেশে স্থায়ী কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। দক্ষিণাঞ্চলের নিচু এলাকাসমূহ উপকূলীয় বন্যা ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে বর্ষা মৌসুমে সাধারণত জুন থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত নিমজ্জিত থাকে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল নিচু ও হাওর এলাকাসমূহে রবি মৌসুমে বোরো-পতিত-পতিত ফসল বিন্যাসের আওতায় কৃষকরা একক ফসল হিসেবে শুধু বোরো ধানের আবাদ করেন। এর ফলশ্রুতিতে স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার মান বেশ দুর্দশাপূর্ণ এবং তারা প্রতিনিয়ত দরিদ্রতা ও অপুষ্টির সাথে লড়াই করছে। সে কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চল, হাওর এলাকা ও অন্যান্য জলাবদ্ধ এলাকার সমস্যাকবলিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার উন্নতির লক্ষ্যে স্থায়ী কৃষি উৎপাদনের জন্য ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ কৃষি প্রযুক্তিসমূহ উন্নতকরণ এবং এগুলোর সম্প্রসারণ অপরিহার্য।
ছাদ কৃষি
গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী জনগণ টাটকা শাকসবজি গ্রহণের সুযোগ পেলেও শহরের বিপুল জনগোষ্ঠী সেই সুযোগ থেকে প্রায় বঞ্চিত। তাই ছাদ বাগানে নিরাপদ সবজি উৎপাদনের মাধ্যমে নগরজীবনে সারা বছরের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে। শহরের ভবনগুলোতে ছাদবাগান স্থাপনের ফলে একদিকে যেমন শহরের জনগণ টাটকা ও নিরাপদ সবজি খেতে পারছে অন্যদিকে এটি ভবনের অতিরিক্ত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখাসহ নির্মল পরিবেশ নিশ্চিতে অবদান রাখছে।
মাশরুম চাষ
মাশরুম বাংলাদেশে অত্যন্ত সম্ভাবনাময়, পুষ্টিকর, সুস্বাস্থ্য ও ঔষধিগুণ সম্পন্ন সবজি, মাশরুম একটি স্বল্প ক্যালরিযুক্ত খাবার হলেও এতে রয়েছে অতি উন্নতমানের আমিষ যা কোনো উদ্ভিদজাত খাবারে তো নয়ই, অনেক প্রাণিজ আমিষের থেকেও দুষ্কর। তাই মাশরুম মানসম্পন্ন আমিষের একটি বিকল্প উৎস হিসেবে বিবেচিত। বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদের বৈচিত্র্য সেই সাথে নানা ধরনের ঔষধিগুণের সমারোহের কারণে সবজি হিসেবে মাশরুম অনন্য। তাই বছরব্যাপী নিরাপদ সবজি হিসাবে সারা বছর মাশরুম চাষের মাধ্যমে পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে।
সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিপ্লব সাধন করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে শাকসবজি রপ্তানি হচ্ছে। কৃষি পণ্য রপ্তানি থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬৭৩.৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে। বাংলাদেশ থেকে আলু, হিমায়িত সবজি, করলা, মুখীকচু, কচু, কচুরলতি, মিষ্টিকুমড়া, শিম বিচি, পটোল, কাঁচামরিচ, লাউ, চাল কুমড়াসহ অনেক সবজি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। শস্যের বৈচিত্র্যতা কৃষি উন্নয়নের প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশের জনগণের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিরাপত্তা বিধানকল্পে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁঁকি এড়ানোর জন্য নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য বছরব্যাপী সবজি উৎপাদনের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। নিরাপদ সবজি উৎপাদনকে ভবিষ্যৎ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদার সাথে মিল রেখে বিভিন্ন মেয়াদি পদক্ষেপ নেয়া অতীব জরুরি। দেশের জনগণের দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার টেকসই রূপ দিতে নিরাপদ সবজি উৎপাদনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
কৃষিবিদ অমিতাভ দাস
মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা, ইমেইল : dg@dae. gov.bd
টেকসই ফসল উৎপাদনে গুণগত মানসম্পন্ন বীজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। শুধু গুণগত মানসম্পন্ন বীজই কেবল শতকরা ১৫-২০ ভাগ উৎপাদন বাড়িয়ে দিতে পারে। এটি সবজিসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। ফসলের ফলন ও উৎপাদনের সাথে গুণগত মানসম্পন্ন বীজ নিবিড়ভাবে জড়িত। কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অনু বিভাগের তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ সালে বাংলাদেশে সবজি বীজের মোট কৃষি তাত্ত্বিক চাহিদা ছিল ২,২৯১ মে. টন (যদিও প্রকৃত চাহিদা ৪,৫০০ মে. টন); যার শতকরা ৩.২০ ভাগ (৭৩ মে. টন) সরকারি সংস্থা তথা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) বীজ বিতরণ করে, যেখানে বেসরকারি সংস্থাগুলো প্রায় শতকরা ৮০.৮০ ভাগ (১,৮৫৪ মে. টন) বীজ বিতরণ করে এবং বাকি শতকরা ১৬ ভাগ কৃষক তার নিজের সংরক্ষিত বীজ ব্যবহার করে। কৃষকের নিজের চাহিদামতো বীজ যদি নিজে সঠিকভাবে উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে পারে তাহলে একদিকে বীজের মান নিশ্চিত করা যায় অন্য দিকে অন্যের উপর নির্ভর করতে হয় না এবং খরচও কম হয়। এজন্য কৃষক পর্যায়ে সবজি বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হলো।
জাত ও বীজ নির্বাচন : যে কোনো ফসল চাষ করার আগে সে ফসলের সবচেয়ে ভালো জাতের বীজ সংগ্রহ করতে হবে। স্থানীয় চাহিদাও বিবেচনা রাখতে হবে। বীজের মধ্যে অন্য জাতের মিশ্রণ যেন না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শুধুমাত্র রোগ-জীবাণু মুক্ত, স্পষ্ট এবং চকচকে বীজই চাষের জন্য ব্যবহার করতে হবে। সরাসরি বীজ বপন করে চাষ করা হয় যেসব শাকসবজি তা হলো মুলা, লালশাক, ডাঁটা, ঢেঁড়স, পুঁইশাক, কুমড়া, শিম জাতীয় ইত্যাদি। অন্য দিকে চারা উৎপাদন করে যেসব সবজি চাষ করা হয় তার মধ্যে বাঁধাকপি, ফুলকপি, বেগুন ও টমেটো উল্লেখযোগ্য।
বীজতলার স্থান নির্বাচন : বীজতলার জমি অপেক্ষাকৃত উঁচু হওয়া প্রয়োজন যাতে বৃষ্টি বা বন্যার পানি দ্রুত নিষ্কাশন করা যায়। ছায়াবিহীন, পরিষ্কার এবং বাতাস চলাচলের উপযোগী স্থানে বীজতলা করা প্রয়োজন। পানির উৎসের কাছাকাছি হওয়া উচিত। বীজতলার মাটি বেলে দোআঁশ বা দোআঁশ এবং উর্বর হওয়া উচিত।
বীজতলা তৈরি : একক বীজতলা বা হাপোর বা বেড সাধারণত ১ মিটার চওড়া ও ৩ মিটার লম্বা হবে। জমির অবস্থা ভেদে দৈর্ঘ্য বাড়ানো কমানো যেতে পারে। পাশাপাশি দুটি বীজতলার মধ্যে কমপক্ষে ৬০ সেমি. গভীর করে ঝুরঝুরা ও ঢেলা মুক্ত করে তৈরি করতে হবে। বীজতলা সাধারণত ১০-১৫ সেমি. উঁচু করে তৈরি করতে হবে। মাটি, বালি ও পচা গোবর সার বা কম্পোস্ট মিশিয়ে বীজতলার মাটি তৈরি করতে হবে। মাটি উর্বর হলে রাসায়নিক সার না দেয়াই ভালো। উর্বরতা কম হলে প্রতি বেডে ১০০ গ্রাম টিএসপি সার বীজ বপনের অন্তত এক সপ্তাহ আগে মিশাতে হবে। যারা বাণিজ্যিকভাবে চারা উৎপাদন করেন তাদের জন্য ইট-সিমেন্ট দিয়ে স্থায়ী বীজতলা তৈরিই শ্রেয়।
বীজতলার মাটি শোধন : বীজ বপনের পূর্বে বীজতলার মাটি বিভিন্ন পদ্ধতিতে শোধন করা যায়। এতে অনেক মাটিবাহিত রোগ, পোকামাকড় আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে দমন করা যায়। যেমন-সৌরতাপ ব্যবহার করে, জলীয়বাষ্প ব্যবহার করে, ধোঁয়া ব্যবহার করে, রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে, কাঠের গুঁড়া পুড়িয়ে বা পোলট্রি রিফিউজ ব্যবহার করে। তবে সবচেয়ে সহজ ও কার্যকরী পদ্ধতি হলো সৌরতাপ ব্যবহার করে বীজতলার মাটি শোধন করা। এক্ষেত্রে বীজ বপনের ১২-১৫ দিন পূর্বে বীজতলার মাটি যথাযথভাবে তৈরি করে ভালোভাবে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। পরে স্বচ্ছ অথবা রঙিন পলিথিন দিয়ে বায়ু নিরোধক করে ঢেকে রাখতে হবে। এতে সারা দিনের সূর্যালোকে পলিথিনের ভেতরে বীজতলার মাটির তাপমাত্রা যথেষ্ট বৃদ্ধি পাবে ও অনেকাংশে মাটিবাহিত রোগজীবাণু দমন করবে। এছাড়াও অনেক ক্ষতিকারক পোকামাকড় ও আগাছা দমন হয়।
বীজ শোধন : বীজতলায় বপনের পূর্বে সবজি বীজ কয়েকটি পদ্ধতিতে শোধন করা যায়। যেমন- এগুলোর মধ্যে গুঁড়া রাসায়নিক ওষুধ দ্বারা বীজ শোধন পদ্ধতি বর্তমানে সর্বাধিক প্রচলিত ও কম ঝামেলাপূর্ণ। প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম ভিটাভেক্স-২০০ ব্যবহার করে ভালোভাবে ঝাকিয়ে বীজ শোধন করা যায়। বীজ শোধনের ফলে বিভিন্ন সবজির অ্যানথ্রাকনোজ, পাতায় দাগ, ব্লাইট ইত্যাদি রোগ ও বপন পরবর্তী সংক্রমণ রোধ সম্ভব হয়।
বীজের অঙ্কুরোদগম বা গজানো পরীক্ষা : শাকসবজির বীজ বপনের পূর্বে গজানো পরীক্ষা করে নেয়া প্রয়োজন। এজন্য ছোট থালা বা বাটি নিয়ে তার ওপর বালি পানি দিয়ে ভিজিয়ে ৫০-১০০টি বীজ কয়েক দিন রেখে অঙ্কুরোদগমের শতকরা হার বের করে নিতে হবে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, মুলা, মিষ্টিকুমড়া ইত্যাদির ক্ষেত্রে কমপক্ষে শতকরা ৭৫ ভাগ এবং গাজর, পালংশাক, ঢেঁড়স ইত্যাদির ক্ষেত্রে কমপক্ষে শতকরা ৫৫-৬০ ভাগ বীজ গজানোর ক্ষমতা থাকতে হবে। অঙ্কুরোদগম হার বের করার মাধ্যমে মূল্যবান বীজের সঠিক পরিমাণ, চারার সংখ্যা ইত্যাদি নির্ধারণ করা সহজ হয়।
বীজ বপন : বীজতলায় সারি করে বা ছিটিয়ে বীজ বপন করা যায়, তবে সারিতে বপন করা উত্তম। সারিতে বপনের জন্য প্রথমে নির্দিষ্ট দূরত্বে (৪ সে.মি.) কাঠি দিয়ে ক্ষুদ্র নালা তৈরি করে তাতে বীজ ফেলে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। ছোট বীজের বেলায় বীজের দ্বিগুণ পরিমাণ শুকনো ও পরিষ্কার বালু বা মিহি মাটি বীজের সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে মাটিতে বীজ বপন করতে হবে। শুকনা মাটিতে বীজ বপন করে সেচ দেয়া উচিত নয়, এতে মাটিতে চটা বেঁধে চারা গজাতে ও বাতাস চলাচলে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে। তাই সেচ দেয়া মটির ‘জো’ অবস্থা এলে বীজ বপন করতে হবে। যেসব বীজের আবরণ শক্ত, সহজে পানি প্রবেশ করে না, সেগুলোকে সাধারণত বোনার পূর্বে পরিষ্কার পানিতে ১৫-২০ ঘণ্টা অথবা শতকরা একভাগ পটাশিয়াম নাইট্রেট দ্রবণে এক রাত্রি ভিজিয়ে বপন করতে হয় (যেমন- লাউ, চিচিংগা, মিষ্টিকুমড়া, করলা, উচ্ছে ও ঝিঙ্গা)।
চারা উৎপাদনের বিকল্প পদ্ধতি : প্রতিকূল আবহাওয়ার বীজতলায় চারা উৎপাদনের জন্য বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে সবজির চারা কাঠের বা প্লাস্টিকের ট্রে, পলিথিনের ব্যাগে, মাটির টবে, গামলায়, থালায়, কলার খোলে উৎপাদন করা যায়। কোনো কোনো সময় কুমড়া, শিম জাতীয় সবজির চারা রোপণ করা প্রয়োজন দেখা যায়। কিন্তু এসব সবজি রোপণজনিত আঘাত সহজে কাটিয়ে উঠতে পারে না। ছোট আকারের পলিথিনের ব্যাগে বা উপরে উল্লিখিত অন্যান্য মাধ্যমে এদের চারা উৎপাদন করলে সহজে শেকড় ও মাটিসহ চারা রোপণ করা যায়। ইদানীংকাল মাটিবিহীন অবস্থান কেকোডাস্ট দিয়ে রোগমুক্ত চারা তৈরি করা হচ্ছে।
বীজতলায় আচ্ছাদন : আবহাওয়া এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে বীজতলার ওপরে আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে হবে যেন বৃষ্টির পানি ও অতিরিক্ত সূর্যতাপ থেকে বীজতলাকে রক্ষা করা যায়। আচ্ছাদন বিভিন্নভাবে করা যায়। তবে কম খরচে বাঁশের ফালি করে বীজতলার প্রস্থ বরাবর ৫০ সেমি. পরপর পুঁতে নৌকার ছৈ এর আকার তৈরি করে বৃষ্টির সময় পলিথিন দিয়ে এবং প্রখর রোদে চাটাই দিয়ে বীজতলার চারা রক্ষা করা যায়।
চারার যত্ন : চারা গজানোর পর থেকে ১০-১২ দিন পর্যন্ত হালকা ছায়া দিয়ে অতিরিক্ত সূর্যতাপ থেকে চারা রক্ষা করা প্রয়োজন। পানি সেচ একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচর্যা। তবে বীজতলার মাটি দীর্ঘ সময় বেশি ভেজা থাকলে অঙ্কুরিত চারা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। চারার শিকড় যথেষ্ট বৃদ্ধি পেলে রোদ কোনো ক্ষতি করতে পারে না তখন এটি বরং উপকারী। চারা গজানোর ১০-১২ দিন পর বীজতলায় প্রয়োজনমতো দূরত্ব ও পরিমাণে চারা রেখে অতিরিক্ত চারাগুলো যত্ন সহকারে উঠিয়ে দ্বিতীয় বীজতলায় সারি করে রোপণ করলে মূল্যবান বীজের সাশ্রয় হবে।
দ্বিতীয় বীজতলায় চারা স্থানান্তরকরণ : জমিতে চারা লাগানোর পূর্বে মূল বীজতলা থেকে তুলে দ্বিতীয় বীজতলায় সবজি চারা রোপণের পদ্ধতি অনেক দেশেই চালু আছে। দেখা গেছে ১০-১২ দিনের চারা দ্বিতীয় বীজতলায় স্থানান্তরিত করা হলে কপি গোত্রের সবজি, বেগুন ও টমেটো চারার শিকড় বিস্তৃত ও শক্ত হয়, চারা অধিক সবল ও তেজী হয়। চারা উঠানোর আগে বীজতলায় পানি দিয়ে এরপর সূচালো কাঠি দিয়ে শিকড়সহ চারা উঠাতে হয়। উঠানো চারা সাথে সাথে দ্বিতীয় বীজতলায় লাগাতে হয়। বাঁশের সূচালো কাঠি বা কাঠের তৈরি সূচালো ফ্রেম দিয়ে সমান দূরত্বে সরু গর্ত করে চারা গাছ লাগানো হয়। লাগানোর পর হালকা পানি দিতে হবে এবং বৃষ্টির পানি ও প্রখর রোদ থেকে রক্ষার জন্য পলিথিন বা চাটাই দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
বীজতলায় চারার রোগ দমন : অঙ্কুরোদগমরত বীজ আক্রান্ত হলে তা থেকে আদৌ চারা গজায় না। গজানোর পর রোগের আক্রমণ হলে চারার কাণ্ড মাটি সংলগ্ন স্থানে পচে গিয়ে নেতিয়ে পড়ে। একটু বড় হওয়ার পর আক্রান্ত হলে চারা সাধারণত মরে না কিন্তু এদের শিকড় দুর্বল হয়ে যায়। চারা এভাবে নষ্ট হওয়াকে ড্যাম্পিং অফ বলে। বিভিন্ন ছত্রাক এর জন্য দায়ী। বীজতলার মাটি সব সময় ভেজা থাকলে এবং মাটিতে বাতাস চলাচলের ব্যাঘাত হলে এ রোগ বেশি হয়। এজন্য বীজতলার মাটি সুনিষ্কাশিত রাখা রোগ দমনের প্রধান উপায়। প্রতিষেধক হিসেবে মাটিতে কপার অক্সিক্লোরাইড বা ডায়থেন এম-৪৫ দুই গ্রাম এক লিটার পানিতে মিশিয়ে বীজতলার মাটি ভালোকরে ভিজিয়ে কয়েক দিন পর বীজ বপন করতে হবে। এছাড়াও কাঠের গুঁড়া পুড়িয়ে, সৌরতার, পোলট্রি রিফিউজ ও খৈল ব্যবহার করেও ড্যাম্পিং অফ থেকে চারাকে রক্ষা করা যায়।
চারা কষ্টসহিষ্ণু করে তোলা : রোপণের পর মাঠের প্রতিকূল পরিবেশ যেমন ঠা-া আবহাওয়া বা উচ্চতাপমাত্রা, পানির স্বল্পতা, শুষ্ক বাতাস এবং রোপণের ধকল ও রোপণকালীন সময়ে চারায় সৃষ্ট ক্ষত ইত্যাদি যাতে সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারে সেজন্য বীজতলায় থাকাকালীন চারাকে কষ্ট সহিষ্ণু করে তোলা হয়। যেকোন উপায়ে চারার বৃদ্ধি সাময়িকভাবে কমিয়ে যেমন বীজতলায় ক্রমান্বয়ে পানি সেচের পরিমাণ কমিয়ে বা দুই সেচের মাঝে সময়ের ব্যবধান বাড়িয়ে চারাকে কষ্ট সহিষ্ণু করে তোলা যায়। কষ্ট সহিষ্ণুতা বর্ধনকালে চারার শে^তসার (কার্বোহাইড্রেট) জমা হয় এবং রোপণের পর এই স্বেতসার দ্রুত নতুন শিকড় উৎপাদনে সহায়তা করে। ফলে সহজেই চারা রোপণজনিত আঘাত সয়ে উঠতে পারে।
মূল জমিতে চারা রোপণ : বীজতলায় বীজ বপনের নির্দিষ্ট দিন পর চারা মূল জমিতে রোপণ করতে হয়। সবজির প্রকারভেদে চারার বয়স ভিন্নতর হবে। কপি জাতীয় সবজি, টমেটো, বেগুন ইত্যাদির চারা ৩০-৪০ দিন বয়সে রোপণ করতে হয়। চারা উঠানোর পূর্বে বীজতলার মাটি ভিজিয়ে নিতে হবে। যত্ন করে যতদূর সম্ভব শিকড় ও কিছু মাটিসহ চারা উঠাতে হবে। মূল জমিতে চারা লাগানোর পরপরই গোড়ায় পানি দিতে হবে এবং কয়েক দিন পর্যন্ত নিয়মিত সেচ দিতে হবে। চারা সাধারণত বিকাল বেলায় লাগানো উচিত।
রোপণ দূরত্ব ও পৃথকীকরণ : সঠিক রোপণ ও পৃথকীকরণ দূরত্ব বজায় না রাখলে বীজের কাক্সিক্ষত মান ও বিশুদ্ধতা রক্ষা হয় না। লাগানোর সময় এগিয়ে এনে বা পিছিয়ে নিয়েও বীজের জমি পৃথকীকরণ করা যায়। মনে রাখতে হবে স্বপরাগায়িত ফুলেরও শতকরা ৫ ভাগ পরপরাগায়ন হওয়ার সুযোগ রয়েছে, এমনকি শতকরা ৫০ ভাগ পর্যন্ত পরপরাগায়ন হয়ে যেতে পারে, ফলে বীজের বিশুদ্ধতা বজায় থাকে না। স্বপরাগায়িত সবজিগুলো হচ্ছে বেগুন, টমেটো, ঢেঁড়স, বরবটি, শিম ইত্যাদি। আর পরপরাগায়িত সবজির তালিকায় রয়েছে কুমড়া, কপি জাতীয়, লালশাক, ডাঁটা, মুলা, পুঁইশাক, পালংশাক ইত্যাদি।
বিশেষ পরিচর্যা : কপি জাতীয় ফসলের বীজ উৎপাদনে গৌন পুষ্টি উপাদান যেমন- বোরন ও মলিবডেনামের প্রতি সংবেদনশীল। তাই পরিমাণ মত সার দিতে হবে।
মুলা, ফুলকপি, বাঁধাকপির বীজদ- প্রতিকূল আবহাওয়ায় যেন হেলে না পড়ে সেজন্য কাঠি বা ঠেকনা দিতে হবে।
টমেটো-বেগুনের ক্ষেত্রে ভালো গাছ দেখে ফুল ফোটার পূর্বেই এদের ফুল ব্যাগ দ্বারা ঢেকে দেয়া যেতে পারে যাতে পরপরাগায়ন ঘটে জাতের বিশুদ্ধতা নষ্ট না হয়।
ফুলকপির প্রপুষ্পমঞ্জুরিটি বা ভক্ষণ অংশ শক্ত আকারের হয় তখন প্রপুষ্পমঞ্জুরিটি মাঝের অংশটি কেটে তুলে নিলে তাড়াতাড়ি ফুল ফুটতে সাহায্য করে। বাঁধাকপির ক্ষেত্রেও ভক্ষণযোগ্য অংশের গ্রোয়িং পয়েন্ট রেখে আড়াআড়ি কেটে নিলে ফুল তাড়াতাড়ি ফুটে। মৌমাছি যাতে ভিড়তে পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে (মৌবাক্স স্থাপন করা যেতে পারে)।
মুলার বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে জমি থেকে সমস্ত মুলা উঠিয়ে জাতের বিশুদ্ধতা, আকৃতি, রোগবালাই ইত্যাদি বিবেচনা করে মুলা বাছাই করতে হবে। বাছাইকৃত মুলার মূলের এক-তৃতীয়াংশ এবং পাতার দুই-তৃতীয়াংশ কেটে ফেলতে হবে। মূলের কাটা অংশ ডায়থেন এম-৪৫ (২ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে) এর দ্রবণে ডুবিয়ে নিতে হবে। পরে সারি পদ্ধতিতে ৪০ী৩০ সেমি. দূরত্বে মুলা গর্তে স্থাপন করে পাতার নিচ পর্যন্ত মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এতে অধিক পরিমাণে উন্নতমানের বীজ পাওয়া যাবে।
কুমড়া জাতীয় সবজিতে একই গাছে ভিন্নভাবে স্ত্রী-পুরুষ ফুল বা স্ত্রী-পুরুষ আলাদা গাছ হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কৃত্রিম বা হাত পরাগায়ন এক কার্যকর পদ্ধতি। ফুল ফোটার সময় জানা কৃত্রিম পরাগায়নের পূর্বশর্ত। সাদা ফুল যেমন- লাউ, চিচিঙ্গা সাধারণত বিকেল হতে সন্ধ্যার মধ্যে ফোটে, তবে ব্যতিক্রম- কাঁকরোল, পটোল সাদা ফুল হওয়ার পরও সকালে ফোটে। আবার রঙিন ফুল যেমন- চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, করলা, ধুন্দল সাধারণত ভোর হতে সকাল ৯ টার মধ্যে ফোটে তবে ব্যতিক্রম ঝিঙ্গা রঙিন ফুল হওয়ার পরও বিকেলে ফোটে। এক্ষেত্রে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল ফোটার আগেই পেপার ব্যাগ দ্বারা বেঁধে রাখতে হবে যাতে অন্য জাতের পুরুষ ফুলের রেণু দ্বারা পরাগায়িত হতে না পারে এবং ফুল ফুটলে স্ত্রী ফুল পরাগায়িত করে আবার ব্যাগ দ্বারা স্ত্রী ফুল ৩-৪ দিন বেঁধে রাখা ভালো।
কাঁকরোল/করলার বীজ হতে প্রচুর পুরুষ গাছ পাওয়া যায়। তাই স্ত্রী-পুরুষ গাছের কন্দমূল (শিকড়) আলাদাভাবে চিহ্নিত করে রেখে পরবর্তী বছর চাষ করা যায়। বীজতলায় কিংবা সরাসরি জমিতে শাখা-কলম বা কাটিং লাগিয়েও চারা উৎপাদন করা যায়।
ডাঁটা-লালশাকের ক্ষেত কাটানটে আর পালংশাকের জমিতে বথুয়া আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
বীজের জমি যেন রোগে আক্রান্ত না হয় সেজন্য কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শক্রমে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। সবজিতে ঢলে পড়া রোগ (ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া বা কৃমি ঘটিত), ভাইরাসজনিত রোগ, ক্ষুদেপাতা রোগ, ঢেঁড়সের জমিতে হলুদ শিরা রোগ, টমেটোর নাবি ধসাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত সব গাছই জমি থেকে তুলে ফেলতে হবে।
মুলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পালংশাক ইত্যাদি বীজ হিসেবে রেখে দিলে জাব পোকার আক্রমণ দেখা যেতে পারে। কুমড়ার মাছি পোকা-পামকিন বিটল, বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা, ফুলকপি-বাঁধাকপির সরুই পোকা বা ডায়মন্ড ব্যাক মথ ইত্যাদি পোকা দমনে আইপিএম বা সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার আলোকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বীজ উৎপাদনে রোগিং বা বিজাত বাছাই : বীজ ফসলের জাতের বিশুদ্ধতা বজায় রাখার লক্ষ্যে বীজ উৎপাদন প্লট থেকে অন্য জাত, আগাছা, অস্বাভাবিক খাটো বা লম্বা গাছ, পোকা ও রোগাক্রান্ত গাছ চিহ্নিত করে শিকড়সহ তুলে ফেলার পদ্ধতিই হলো রোগিং বা বিজাত বাছাইকরণ। বাছাই ১ম বার গাছ বাড়ার সময় ও ফুল আসার আগে, ২য় বার বাছাই ফসলে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ফুল আসলে এবং ৩য় বাছাই বীজ ফসল কাটার পূর্বে করতে হবে।
বীজ ফসল/ফল চিহ্নিতকরণ, ফলের পরিপক্বতার লক্ষণ ও সংগ্রহ : ভালো বীজের জন্য সুপরিপক্ব ও নিরোগ ফল দরকার। ক্ষেতের যেসব ফল সব দিক দিয়ে ভালো মনে হবে, সেসব ফলের বোঁটায় রঙিন ফিতে বা ফলে থলে বেঁধে চিহ্ন দিয়ে রাখতে হবে। যে বীজেই হোক না কেনো ভালোভাবে বীজফল পাকার পর তা সংগ্রহ করতে হবে। যথা সময়ে বীজ সংগ্রহ করতে না পারলে বীজের মান খারাপ হয়ে যায়। মুলা, কপি, পুঁইশাক, গিমাকলমি, ঢেঁড়স, লালশাক, ডাঁটা বা শিম ইত্যাদির ক্ষেত্রে বীজ বেশি পেকে গেলে গাছে শুকিয়ে ঝরে যায়। এ ধরনের শাকসবজির ক্ষেত্রে ফল পাকার সাথে সাথে গাছ কেটে শুকিয়ে বীজ বের করে নিতে হয়। সঠিক পরিপক্বতা দেখে সবজি ফল সংগ্রহ করতে হবে।
বেগুন ফলের পরিপক্বতার লক্ষণ : সুস্থ ও স্বাভাবিক ফলের রঙ বাদামি বা বাদামি বর্ণ ধারণ করে ফলের ত্বক শক্ত হয়ে আসে তখনই ফল সংগ্রহের সময়।
টমেটো ফলের পরিপক্বতার লক্ষণ : সুস্থ ও স্বাভাবিক ফল গাঢ় লাল রঙ হলে ফল সংগ্রহ করতে হবে।
শিম ফলের পরিপক্বতার লক্ষণ- শিমের শুটির ত্বক শুকিয়ে কুঁচকে যাবে বীজগুলো স্পষ্ট হবে।
লাউ ফলের পরিপক্বতার লক্ষণ- দুই উপায়ে বুঝা যায়- প্রথমত ফল নাড়ালে ভেতরে বীজের শব্দ পাওয়া যাবে। দ্বিতীয়ত ফলের খোসা শুকিয়ে যাবে ও শক্ত হবে কিন্তু ফলের ভেতরে শুকাবে না।
শসা/খিরা ফলের পরিপক্বতার লক্ষণ- ফল হলুদ বা বাদামি রঙ ধারণ করে। পরিপক্ব বীজ সহজে মাংস থেকে আলাদা হয়।
মিষ্টিকুমড়া ফলের পরিপক্বতার লক্ষণ- ফল হলুুদ বা হলুদাভ-কমলা রঙ হয়। ফলের বোটা খড়ের রঙ ধারণ করে গাছ মরতে শুরু করে।
কাঁকরোল/করলা/উচ্ছে ফলের পরিপক্বতার লক্ষণ- ফল হলুদ বা হলদে বাদামি রঙ ধারণ করে। পরিপক্ব বীজ সহজে মাংস থেকে আলাদা করা যায়।
ঝিঙ্গা ফলের পরিপক্বতার লক্ষণ- ফল বাদামি রঙ ধারণ করে। ফল নাড়ালে ভেতরে বীজের শব্দ পাওয়া যায়।
চিচিঙ্গা ফলের পরিপক্বতার লক্ষণ- ফল পাকলে হলদে-কমলা রঙ ধারণ করে এবং ফলগুলো হাতে ধরলে নরম মনে হবে।
বীজ ফসল মাড়াই, ঝাড়াই ও বাছাই/গ্রেডিংকরণ : লাউ, ঝিঙ্গা, ধুন্দুল, বেগুন পরিপক্ব হলে সংগ্রহের পর বীজের সংগ্রহত্তোর পরিপক্বতার জন্য ফল ২-৩ সপ্তাহ, শসা, খিরা, করলা/উচ্ছে সংগ্রহের পর ৭-১০ দিন এবং কুমড়া ফল সংগ্রহের পর ৪-৭ সপ্তাহ ছায়াযুক্ত স্থানে রেখে দিতে হবে। এ সকল বীজ ফলগুলো লম্বালম্বিভাবে কেটে হাত দিয়ে বীজ বের করে নিতে হবে। বীজ বের করার সাথে সাথে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে প্রথমে হালকা রোদে বা ছায়ায় শুকাতে হবে। বেগুনের ক্ষেত্রে পাকা বেগুন ভালোভাবে ধুয়ে নিয়ে রোদে শুকাতে হবে। তারপর লাঠি দিয়ে বালিশের মতো নরম হওয়া পর্যন্ত আস্ত বেগুন পিটিয়ে ভেতরের বীজ আলগা করে নিতে হবে। তারপর বেগুন চিরে ভেতরের বীজগুলোকে পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে। টমেটোর বেলায় বাছাইকৃত ফলগুলো আড়াআড়িভাবে কেটে পাত্রের ওপর হাত দিয়ে চেপে বীজ বের করে নিয়ে ২০º-২১º সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ২৪-৩৬ ঘণ্টা ফারমেন্টেশনে রাখতে হবে। এ সময় মাঝে মাঝে নাড়তে হবে। পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে প্রথমে ছায়ায়, পরে ক্রমান্বয়ে প্রখর রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। বীজ হালকা শুকানোর পর কুলায় ঝেড়ে বেছে কুঁচকানো, বিকৃত, দাগযুক্ত, বিসদৃশ বীজগুলো থেকে ঝকঝকে পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
বীজ শুকানো : সবজি বীজ প্রাথমিকভাবে ছায়ায় শুকানোর পর ক্রমান্বয়ে তীব্র রোদে শুকাতে হবে। সবজি বীজে আর্দ্রতা বা জলীয় পদার্থের পরিমাণ যদি শতকরা ৮ ভাগের নিচে থাকে তাহলে কোনো পোকামাকড় ও রোগ জীবাণু সহজে ক্ষতি করতে পারে না। নিকটস্থ উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার সহযোগিতায় উপজেলা কৃষি অফিস হতে ময়েশ্চার মিটারেও বীজের আর্দ্রতা মাপা যেতে পারে। কম তাপমাত্রায় অনেক সময় ধরে বীজ শুকালে বীজের তেজ যেমন নষ্ট হয় তেমনি অধিক তাপমাত্রায় অল্প সময়ের মধ্যেই শুকালে সজীবতা নষ্ট হতে পারে। টমেটো বীজ মাঝারি গতিতে শুকায়, কপি ও মুলার বীজ ধীরে শুকায় আবার লাউয়ের বীজ তাড়তাড়ি শুকায়। কাজেই সব বীজেই একই ভাবে একই সময় ধরে শুকানো ঠিক নয়। তবে যে বীজেই হোক না কেন বীজ ভালোভাবে শুকিয়ে কটকটে ও ঝনঝনে করে রাখতে হবে।
বীজ সংরক্ষণ : আর্দ্রতারোধক পাত্রে শুকনা বীজ সংরক্ষণ করা উত্তম। বীজ রাখার পাত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। সবজি বীজ রাখার জন্য মোটা পলিথিন ব্যাগ, বায়ুরোধী টিন বা অ্যালুমিনিয়াম পাত্র, রঙিন কাঁচের বোতল বা প্লাস্টিকের বয়ামে বীজ সংরক্ষণ করা যেতে পারে। পাত্রের নিচে এক খণ্ড কাঠ কয়লা বা নারিকেলের খোলের কয়লা রাখতে হবে। এসব কয়লা বাতাসের আর্দ্রতা শুষে নেয়। এতে মাপমতো কার্ড বোর্ড কেটে কয়েকটি ছিদ্র করে পাত্রের তলায় কয়লা খণ্ডের ওপর বসাতে হবে। এরপর বীজগুলো ছোট খামে ভরে প্রয়োজনীয় তথ্য লিখে ওই বয়ামে রাখতে হবে। এরপর ঢাকনা টেপ, গ্রিজ দিয়ে বায়ুরোধী করে পাত্রের মুখ বন্ধ করতে হবে। রোদে শুকানো বীজ ২/৩ ঘণ্টা ছায়ায় ঠাণ্ডা করে বীজ পাত্রে রাখতে হবে। বসতবাড়িতে নিম, বিষ কাটালি, নিশিন্দা বা ল্যান্টানার পাতা ছায়ায় শুকিয়ে শুকনো বীজের সাথে পাত্রে মিশিয়ে রাখলে গুদামের পোকামাকড় থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। পাত্র বায়ুরোধী করতে বীজ পলিব্যাগে নিয়ে এমনভাবে বন্ধ করতে হবে যাতে লুজ না থাকে। আর পলিব্যাগের মুখ আগুনে পুড়িয়ে বন্ধ করা যায়। বীজ রাখার পর পাত্রের গায়ে একটি ট্যাগে বীজের নাম, জাতের নাম, সংরক্ষণ তারিখ, সংরক্ষণকারীর নাম, বীজ অংকুরোদগমের হার লিখে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। বীজ পাত্র মাচায় রাখা ভালো, যাতে পাত্রের তলা মাটির সংস্পর্শে না আসে। গুদামে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সংরক্ষিত বীজ মাঝে মাঝে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। বীজের আর্দ্রতা বেড়ে গেলে বীজ পুনরায় রোদে শুকিয়ে ঠা-া করে সংরক্ষণ করতে হবে।
কৃষিবিদ মো. আবু সায়েম
অতিরিক্ত উপপরিচালক (এলআর), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা, মোবাইল নম্বর-০১৭১৯৫৪৭১৭৯। ইমেইল-sayemdae@yahoo.com
তিতির শোভাবর্ধনকারী গৃহপালিত পাখি হলেও বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে পালনের যথেষ্ট সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। এটাকে অনেকেই চীনা মুরগি বলে। প্রায় ৭০০ বছর আগে তিতির প্রথমে জন্মস্থান আফ্রিকায় গৃহপালিত পাখি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ৩০০ বছর আগে ব্রিটিশ শাসন আমলে ভারতবর্ষে আসে। তিতির খাদ্য ও উৎপাদন খরচ কম। তাই তিতির পালন লাভজনক। তিতিরের মাংস ও ডিম সুস্বাদু। ইহা খাওয়া হালাল। তিতির প্রায় বিপন্ন হচ্ছে। তিতির খুব শান্ত। তিতির পালন খুব সহজ।
পরিচিতি
বাংলাদেশের তিতির ধূসর পালক। পালকে সাদা ফোটা ফোটা দাগ থাকে। এ ছাড়াও হালকা ধূসর ও সাদা রঙের তিতির আছে। ডিমের রঙ ঘন বাদামি, ছোট ছোট দাগ থাকে, লাটিম আকৃতির ও ওজন ৩৮-৪৪ গ্রাম। পুরুষ তিতির মাথার মুকুট স্ত্রীর চেয়ে বড়। পায়ের রঙ কালচে। পূর্ণাঙ্গ পুরুষের ওজন ১.৫-২ কেজি, স্ত্রীর ওজন ১-১.৫ কেজি। ডিম প্রাকৃতিক ও কৃত্রিমভাবে ফুটানো যায়। শতকরা ৭০ ভাগ বাচ্চা ফুটে। ইনকিউবেটরে বাচ্চা ফুটানো ভালো। ডিম ফুটতে ২৭-২৮ দিন সময় লাগে। ডিম দেশি মুরগি দিয়েও ফুটানো যায়। ডিমের খোসা শক্ত। ডিম ছোট। প্রজনন মৌসুম হচ্ছে মার্চ-অক্টোবর মাস পর্যন্ত। তিতির অলস; নড়াচড়া ধীরে ধীরে করে।
সুবিধা
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। প্রাকৃতিক খাদ্য খায় বলে খাদ্য খরচ কম। উন্নতমানের ঘর দরকার হয় না। খুব বেশি জিনিসপত্র লাগে না। ডিম ভাঙার সম্ভাবনা কম থাকে। দৈহিক বৃদ্ধি দ্রুত হয়। ৬-৭ মাস বয়সে ডিম পাড়ে। বছরে ১০০-১২০টি ডিম দেয়। ৫-৬ মাসে খাওয়া (১-১.৫ কেজি হয়) ও বিক্রির উপযোগী হয়। দেশি মুরগির সাথে একত্রে পালন করা যায়। তিতির খোলামেলা পরিবেশে, আবদ্ধ ও অর্ধআবদ্ধ অবস্থায় পালন করা যায়। তিতির সারা বছর পালন করা যায়।
অসুবিধা
বাচ্চার মৃত্যুর হার খুব বেশি। ডিমে তাপ দেয়ার ক্ষেত্রে মা তিতির যতœশীল হলেও ১-২টি ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার পর অবশিষ্ট ৬-৭টি ডিম রেখে চলে যায়। অর্থাৎ ডিমে আর তাপ দেয় না। এরা ঝোপঝাড়, জঙ্গল পছন্দ করে বলে শিয়াল, কুকুর, চিল, বাজপাখি, বেজি, সজারু ইত্যাদি প্রাণী এদের ধরে খায়। লিটারে পালনের ক্ষেত্রে বাচ্চাগুলো লিটারের ময়লা খায়। ফলে পেটে সমস্যা হয়। বাচ্চাদের লাইসিন ও সালফারযুক্ত এমাইনো এসিড বেশি প্রয়োজন হয়। তবে মেঝেতে লিটার না দিয়ে পাটের বস্তা ব্যবহার করতে হয়।
পালন পদ্ধতি
তিতির মুক্ত, অর্ধমুক্ত ও আবদ্ধ অবস্থায় পালন করা যায়। আবদ্ধ অবস্থায় পালনের জন্য ঘর নির্মাণ করা হয়। তিতিরের ঘর বাঁশ, বেত, কাঠ, টিন, ছন, খড় ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা যায়। ২-৩ ফুট ওয়াল করে ওপরে নেট দিয়ে টিনের চালের ঘর তৈরি করলে দীর্ঘদিন টেকসই হয়। ঘর আলো বাতাস পূর্ণ স্থানে করতে হয়। ঘর প্রতিদিন পরিষ্কার রাখতে হয়। স্যাঁতসে্যঁতে যাতে না হয়।
০-৪ সপ্তাহের বয়সের তিতির জন্য ০.৫ বর্গফুট ও ৫-৮ সপ্তাহের বয়সের প্রতিটি তিতির জন্য ০.৭ বর্গফুট, ৯-১৩ সপ্তাহের তিতির জন্য ১ বর্গফুট, পূর্ণবয়স্কের জন্য ২-২.৫ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন। তিতির খাঁচায় পালন করা যায় না।
খাদ্য
দেশি মুরগির মতো সব খাবার তিতির খায়। মুক্ত পালনের ক্ষেত্রে বাইরে পড়ে থাকা খাদ্য খায়। দানাদার শস্য, ভাত, শাকসবজির উচ্ছিষ্টাংশ, ভুসি, কুঁড়া, ঘাস, লতাপাতা,
পোকামাকড় ইত্যাদি কুড়িয়ে খায়। আবদ্ধ ও অর্ধমুক্ত পালনের জন্য ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির ক্রয় করা খাদ্য বা ফিডার খাওয়াতে হয়। দৈনিক ১১৮-১২১ গ্রাম খাদ্য খায়। বাড়ন্ত তিতিরের সাপ্তাহিক খাদ্য ও পানি গ্রহণের পরিমাণ নিচের তালিকায় দেয়া হলো ঃ
খাদ্য প্রস্তুতকরণ
তিতির খাদ্যের স্টার্টার (০-৪ সপ্তাহ) মিশ্রণ হচ্ছে- গমচূর্ণ ৩০%, ভুট্টাচূর্ণ ১৮%, চালের কুঁড়া ১৪%, তিলের খৈল ৯%, ফিসমিল ১৮%, নারিকেলের খৈল ১১%, ঝিনুকচূর্ণ ১%, লবণ ০.৬% ও ভিটামিন ও মিনারেলস ০.৪%। দৈহিক ওজন, খাদ্য গ্রহণ ও খাদ্য রূপান্তর দক্ষতার (ঋঈজ) ভিত্তিতে তিতিরের উৎকর্ষতার বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ ঃ
তাপমাত্রা ব্যবস্থাপনা
তিতির বাচ্চা ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারে না। এজন্য বাচ্চাকে ব্রুডিংয়ে প্রথম সপ্তাহে বেশি তাপ দিতে হয়। ১ম থেকে ৩য় সপ্তাহ পর্যন্ত ব্রুডিং তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ৪র্থ থেকে ৫ম সপ্তাহ পর্যন্ত ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখতে হয়। এরপর স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখা যায়। ব্রুডারে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য হিটার বা বাল্ব ব্যবহার করা যেতে পারে। ব্রুডার হাউজ মুরগির ব্রুডার হাউজের মতো তৈরি করতে হয়।
রোগবালাই
তিতিরের রোগবালাই কম হয়। গোলকৃমি হলে ডিম উৎপাদন কমে ও পাতলা মল ত্যাগ করে। রক্ত আমাশয় হলেÑ রক্ত মিশ্রিত মলত্যাগ করে, ওজন কমে, মুখম-ল ফ্যাকাশে হয়। ট্রাইকোমোনিয়াসিস হলেÑ ওজন কমে, ঝুঁটি কালো হয়, মুখ থেকে লালা ঝরে।
মুরগির খামারের সম্প্রসারণের কারণে ও খাওয়ার অভ্যাস কম থাকার জন্য তিতির পালন দেশে কমে যাচ্ছে। অথচ মুরগির চেয়ে এর রোগবালাই কম হয়, ডিম বেশি পাড়ে, ওজন বেশি হয়, উৎপাদন খরচ কম ও দেখতে সুন্দর। এজন্য তিতির পালন করা লাভজনক। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিতির নিয়ে গবেষণা হচ্ছে ও তিতিরের একটি খামার আছে। এখান থেকে বাচ্চা নিয়ে অনেকেই তিতির পালন করছে। তিতির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
সহকারী অধ্যাপক, শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ, ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল, মোবাইলঃ ০১৭১১-৯৫৪১৪৩
কৃষি বিষয়ক
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
মো. সিরাজুল ইসলাম
গ্রাম: তাম্বুলখানা, উপজেলা: ফরিদপুর সদর, জেলা: ফরিদপুর
প্রশ্ন: সরিষার কাণ্ড পচা রোগ দমনে কি করণীয়?
উত্তর: সরিষার কাণ্ড পচা রোগটি বীজ ও মাটিবাহিত। সে কারণে জমিতে সরিষা বীজ বপনের আগে ভালো উৎস থেকে বীজ ক্রয় করা এবং জমির মাটি ভালোভাবে চাষ করা দরকার। যদি সরিষার আবাদকৃত জমিতে আগের বছরে এ রোগ হয়ে থাকে তবে জমি গভীরভাবে চাষ করা। তারপরও যদি জমিতে এ রোগ দেখা দেয় তবে ইপ্রোডিয়ন গ্রুপের যেমন: রোভরাল ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করা। স্প্রে করতে হবে সরিষা গাছের বাড়ন্ত পর্যায়, ফুল ও পড ধরার পর্যায়ে তাহলে সরিষার কাণ্ড পচা রোগটি হবে না। আপনি লাভবান হবেন।
আব্দুল আহাদ
গ্রাম: খাটুরিয়া, উপজেলা: গোবিন্দগঞ্জ, জেলা: গাইবান্ধা
প্রশ্ন: চীনাবাদাম গাছের পাতায় লোহার মরিচার মতো দাগ পড়া রোগের প্রতিকার করব কিভাবে?
উত্তর: চীনাবাদামের এ রোগটিকে চীনাবাদামের মরিচা রোগ বলে। এ রোগটি পাকসিনিয়া এরাচিডিস নামক ছত্রাকের কারণে হয়ে থাকে। সাধারণত বয়স্ক বাদাম গাছে এ রোগটি বেশি হয়ে থাকে। আর এতে বাদামের ফলন প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ কমে যায়। এ রোগ দমনে যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হয় সেগুলো হলো-পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জমিতে চাষাবাদ ও রোগ প্রতিরোধী বাদামের জাত যেমন: ঝিঙা বাদাম চাষ করা। তারপরও যদি এ রোগের আক্রমণ দেখা যায় তবে প্রপিকোনাজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক টিল্ট/কন্টাফ/ক্রিজল ০.৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করতে হবে। ১৫ দিন পরপর কমপক্ষে তিন বার ছত্রাকনাশক স্প্রে করলে এ রোগের প্রকোপ কমে যাবে। আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখা দরকার সেটি হলো স্প্রের কাজটি অবশ্যই বিকেল বেলা করতে হবে নাহলে উপকারী পোকা মৌমাছি মারা যাবে এবং ফসলের পরাগায়ন ব্যাহত হবে।
মো. আসাদুজ্জামান
গ্রাম: লাউযুতি, উপজেলা: ঠাকুরগাঁও সদর, জেলা: ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন: মিষ্টিআলুর পাতায় এক ধরনের দাগ পড়ে গাছের আকার ছোট হয়ে যাচ্ছে। কী করব?
উত্তর: মিষ্টিআলুর পাতার এ রোগকে ফিদারি মোটল রোগ বলে। এ রোগটি ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে। জাবপোকার মাধ্যমে এ ভাইরাসটি ছড়ায়। সে কারণে বাহক পোকা অর্থাৎ জাবপোকা দমন করতে ইমিডাক্লোরপ্রিড গ্রুপের যেমন এডমায়ার, ইমিটাফ প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি মিশিয়ে সঠিক নিয়মে বিকেলের দিকে প্রতি ১৫ দিন পর পর তিন বার স্প্রে করতে হবে। তাহলে এ রোগ নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব হবে। এ রোগ হলে মিষ্টিআলুর ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়।
ইছাহাক আলী
গ্রাম: সাকোয়া উপজেলা: বোদা, জেলা: পঞ্চগড়
প্রশ্ন: পটোল গাছ থেকে কিভাবে শাখা কলম তৈরি করা যায়? জানাবেন।
উত্তর: এক বছর বয়সী ভালো পটোল গাছের যেকোনো শাখার মাঝামাঝি অংশ থেকে শাখা কলম তৈরি করা যায়। সে ক্ষেত্রে এক মিটার বা দুইহাত লম্বা পরিমাণ শাখা পটোল গাছ থেকে সংগ্রহ করে রিং বা চুড়ি আকার তৈরি করে পিট বা মাদায় লাগানো হয়। পটোলের শাখা কলম ৫০ পিপিএম ইনডোল বিউটারিক এসিড বা আইবিএ দ্রবণে ৫ মিনিট ডুবিয়ে রেখে মাদায় বা পিটে লাগালে তাড়াতাড়ি বা বেশি সংখ্যক মূল গজায়। আর এভাবে পটলের উন্নতমানের শাখা কলম তৈরি করে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
মো. রুবেল ইসলাম
গ্রাম: খাটুরিয়া, উপজেলা: ডোমার, জেলা: নীলফামারী
প্রশ্ন: চন্দ্রমল্লিকা ফুলে সাধারণত কি কি ধরনের রোগ হয়ে থাকে? প্রতিকার কী?
উত্তর: চন্দ্রমল্লিকা ফুলে সাধারণত পাউডারি মিলডিউ ও পাতায় দাগ পড়া রোগ হয়ে থাকে। পাউডারি মিলডিউ রোগ হলে চন্দ্রমল্লিকার পাতার ওপরে সাদা থেকে ধূসর গুঁড়ার মতো আবরণ পড়ে। পাতা আস্তে আস্তে কুঁকড়িয়ে বিকৃত হয়ে যায়। আর বেশি আক্রমণ হলে গাছ শুকিয়ে মারা যায়। গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এ রোগ বেশি হয়। সে জন্য সঠিক রোপণ দূরত্ব অনুসরণ করা দরকার এছাড়া রোগের আক্রমণ বেশি হলে কার্বেনডাজিম গ্রুপের ব্যভিস্টিন বা সালটাফ ১/২ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়। চন্দ্রমল্লিকা ফুল গাছের পাতায় দাগ পড়া রোগের ক্ষেত্রে নিচের পাতায় প্রথমে হলদে দাগ পড়ে। রোগের আক্রমণ বেশি হলে পাতার দাগগুলো বাদামি থেকে কালো দাগে পরিণত হয়। এ রোগ দমনেও কার্বেনডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন ব্যাভিস্টিন ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করা যায়।
সুমন মজুমদার
গ্রাম: নারায়ণপুর, উপজেলা: কেশবপুর, জেলা: যশোর
প্রশ্ন: লিচু গাছের পাতায় মাকড়ের আক্রমণ হলে কী করণীয়।
উত্তর: লিচু গাছের পাতা, ফুল ও ফলে মাকড়ের আক্রমণ দেখা যায়। মাকড় আক্রমণ করলে পাতা কুঁকড়িয়ে যায় এবং পাতার নিচের দিক লাল মখমলের মতো হয়ে যায়। পাতা দুর্বল হয়ে মারা যায়। আক্রান্ত ডালে ফুল, ফল ও পাতা হয় না। এমনকি আক্রান্ত ফুলে ফল হয় না। রোগ দমনে ফল সংগ্রহের সময় মাকড় আক্রান্ত পাতা ডালসহ ভেঙে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। মাকড় দমনে মাকড়নাশক এবামেকটিন গ্রুপের যেমন ভার্মিটেক/এবাটিন/এ্যামবুশ প্রতি লিটার পানিতে ১-২ মিলি মিশিয়ে সঠিক নিয়মে নতুন পাতায় ১৫ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
মৎস্য বিষয়ক
ইমতিয়াজ আহমেদ
গ্রাম: ধল্লাপাড়া, উপজেলা: ঘাটাইল, জেলা: টাঙ্গাইল
প্রশ্ন: চিংড়ি মাছের মাথা হলুদ হয়ে গেছে কি করব?
উত্তর: ভাইরাসের আক্রমণে এ রোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে। এ রোগে চিংড়ির মাথা হলুদ বর্ণ ধারণ করে। চিংড়ির দেহ, ফুলকা, যকৃতও হলুদ হয়ে যায়। এ রোগের প্রকৃত কোনো চিকিৎসা নেই। এজন্য রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভালোভাবে মেনে চললে এ সমস্যার অনেকটুকু দূর করা যায়।
মো: সবুর আলী, গ্রাম: মাছহাড়ি, উপজেলা: কাউনিয়া, জেলা: রংপুর
প্রশ্ন: মাছের সেপরোলে গনিয়াসিস রোগ দেখা যাচ্ছে। এর প্রতিকার কী?
উত্তর: এটি ছত্রাকজনিত রোগ। সেপ্রোলেগনিয়া প্রজাতি এ রোগের কারণ। কার্পজাতীয় মাছে এ রোগটি বেশি হয়ে থাকে। আক্রান্ত মাছের ক্ষতস্থানে তুলার মতো ছত্রাক দেখা দেয় এবং পানির স্রোত যখন স্থির হয়ে যায় কিংবা বদ্ধ জলায় অথবা হ্যাচারি ট্যাংকে যেখানে অনিষিক্ত ডিমের ব্যাপক সমাগম ঘটে তাতে ছত্রাক রোগ দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে। হ্যাচারিতে লালনকৃত ডিমগুলোকে ২৫০ পিপিএম ফরমালিন দিয়ে ধৌত করতে হবে। খাঁচা ও আক্রান্ত মাছগুলোকে শতকরা ৫ ভাগ লবণ পানিতে ১ মিনিট গোসল করাতে হবে।
প্রাণিসম্পদ বিষয়ক
সুব্রত কুমার সরকার
গ্রাম: কেওয়াপূর্বখ-, উপজেলা: উল্লাপাড়া, জেলা: সিরাজগঞ্জ
প্রশ্ন: আমার ছাগলের বয়স আড়াই বছর। বিভিন্ন জায়গার মাংস শক্ত হয়ে গেছে। দাঁতে কপাট লাগে এবং খিচুনি দেখা দেয়। কোনো শব্দ শুনলে চমকে উঠে। এমতাবস্থায় কী করণীয়?
উত্তর: সাধারণত এ রোগের চিকিৎসায় তেমন ফল হয় না। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করতে পারলে ক্ষতস্থান অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে এবং মাংসে এটিএম ইনজেকশন দিতে হবে। এ ছাড়া উচ্চমাত্রায় পেনিসিলিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হবে। মাংসপেশি শিথিল করার জন্য ক্লোরাল হাইড্রেট ও ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ইনজেকশন দিতে হবে। খাসি করানো বা অন্য কোনো অস্ত্রোপচারের আগে ধনুষ্টংকার রোগের টিকা দিতে হবে। তাছাড়া যে কোনো অস্ত্রোপচার স্বাস্থ্যসম্মতভাবে করতে হবে।
সহিদুল ইসলাম
গ্রাম: আলালিতাড়ি, উপজেলা: গাইবান্ধা সদর, জেলা: গাইবান্ধা
প্রশ্ন: আমার হাঁসের বাচ্চার বয়স ৮ সপ্তাহ। ডায়রিয়া হচ্ছে, শ্বসনতন্ত্রে গোলযোগ দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় কি করণীয়?
উত্তর: আপনার হাঁসের যে সমস্যার কথা লিখেছেন তার সমাধানের জন্য কট্টাভেট সাসপেনশন দিতে হবে সাথে ইলেকট্রোলাইট পাউডার অথবা স্যালাইন দিতে হবে।
(মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক প্রশ্ন কৃষি কল সেন্টার হতে প্রাপ্ত)
কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন
উপপ্রধান তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল নং ০১৭১১১১৬০৩২,taufiquedae25@gmail.com
নতুন পাতার বর্ণিল রঙে প্রকৃতিকে রাঙাতে ঋতুরাজ বসন্ত এসেছে আমাদের মাঝে। নতুন প্রাণের উদ্যমতা আর অনুপ্রেরণা প্রকৃতির সাথে আমাদের কৃষিকেও দোলা দিয়ে যায় উল্লেখযোগ্যভাবে। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন ফাল্গুনের শুরুতেই আসুন সংক্ষিপ্তভাবে জেনে নেই বৃহত্তর কৃষি ভুবনে করণীয় দিকগুলো।
বোরো ধান
ধানের চারার বয়স ৫০-৫৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরি প্রয়োগ করতে হবে। সার দেয়ার আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে। ধানের কাইচ থোড় আসা থেকে শুরু করে ধানের দুধ আসা পর্যন্ত ক্ষেতে ৩/৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে। পোকা দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে (আলোর ফাঁদ পেতে, পোকা ধরার জাল ব্যবহার করে, ক্ষতিকর পোকার ডিমের গাদা নষ্ট করে, উপকারী পোকা সংরক্ষণ করে, ক্ষেতে ডাল-পালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করে) ধানক্ষেত বালাইমুক্ত রাখতে হবে। এ সময় ধান ক্ষেতে উফরা, ব্লাস্ট, পাতাপোড়া ও টুংরো রোগ দেখা দেয়। জমিতে উফরা রোগ দেখা দিলে যেকোন কৃমি নাশক যেমন ফুরাডান ৫ জি বা কিউরেটার ৫ জি প্রয়োগ করতে হবে। ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলে ইউরিয়া সারের উপরি প্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে এবং একরপ্রতি ১৬০ গ্রাম ট্রুপার বা জিল বা ন্যাটিভ বা ব্লাসটিন ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে দু’বার প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে পাতাপোড়া রোগ হলে অতিরিক্ত ৫ কেজি/বিঘা হারে পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে এবং জমির পানি শুকিয়ে ৭-১০ দিন পর আবার সেচ দিতে হবে। টুংরো রোগ দমনের জন্য এর বাহক পোকা সবুজ পাতা ফড়িং দমন করতে হবে।
গম
এ মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম পাকা শুরু হয়। গম শীষের শক্ত দানা দাঁত দিয়ে কাটলে যদি কট কট শব্দ হয় তবে বুঝতে হবে গম কাটার সময় হয়েছে। সকালে অথবা পড়ন্ত বিকেলে ফসল কাটা উচিত। বীজ ফসল কাটার পর রোদে শুকিয়ে খুবই তাড়াতাড়ি মাড়াই ঝাড়াই করে ফেলতে হবে। সংগ্রহ করা বীজ ভালো করে শুকানোর পর ঠা-া করে সংরক্ষণ করতে হবে।
ভুট্টা (রবি)
জমিতে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ গাছের মোচা খড়ের রঙ ধারণ করলে এবং পাতার রঙ কিছুটা হলদে হলে মোচা সংগ্রহ করতে হবে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে শুকনো আবহাওয়ায় মোচা সংগ্রহ করাই উত্তম। সংগ্রহ করা মোচা ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। মোচা সংগ্রহের পর উঠানে পাট/পলিথিন বিছিয়ে তার উপর শুকানো যায় অথবা জোড়া জোড়া বেঁধে দড়ি বা বাঁশের সাথে অথবা টিনের চাল বা ঘরের বারান্দায় ঝুলিয়ে শুকানোর কাজটি করা যায়।
ভুট্টা (খরিপ)
খরিফ মৌসুমে ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এখনই বীজ বপন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় যতœ নিতে হবে। ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি ভুট্টা-৬, বারি ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-২, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৩, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৫।
পাট
ফল্গুনের মাঝামাঝি থেকে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত পাটের বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। ফাল্গুন মাসে বপন উপযোগী পাটের ভালো জাতগুলো হলো সিসি-৪৫, বিজেআরআই দেশী পাট শাক-১ (বিজেসি-৩৯০), ফাল্গুনী তোষা (ও-৯৮৯৭), বিজেআরআই তোষা পাট-৪ (ও-৭২)। পাট চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করে আড়াআড়িভাবে ৫/৬টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। সারিতে বুনলে প্রতি শতাংশে ২৫ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বুনলে আরেকটু বেশি অর্থাৎ ৩০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। পাটের জমিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার (প্রায় ১ ফুট) এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৭ সেন্টিমিটার (প্রায় ৩ ইঞ্চি) রাখা ভালো। ভালো ফলনের জন্য প্রতি একরে ৭০ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি, ১২ কেজি এমওপি, ১৮ কেজি জিপসাম এবং প্রায় ৪.৫ কেজি জিংক সালফেট সার প্রয়োগ করতে হবে।
শাকসবজি
এ মাসে বসতবাড়ির বাগানে আগাম গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি জমি তৈরি করে ডাঁটা, কমলিশাক, পুঁইশাক, করলা, ঢেঁড়স, বেগুন, পটোল চাষের উদ্যোগ নিতে হবে। মাদা তৈরি করে চিচিঙ্গা, ঝিঙা, ধুন্দুল, শসা, মিষ্টিকুমড়া, চাল কুমড়ার বীজ বুনে দিতে পারেন। সবজি চাষে পর্যাপ্ত জৈবসার ব্যবহার করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে জৈব সার ব্যবহার করলে সবজি ক্ষেতে রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না।
গাছপালা
আমের মুকুলে অ্যানথ্রাকনোজ রোগ এ সময় দেখা দেয়। এ রোগ দমনে গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার পূর্ব পর্যন্ত আক্রান্ত গাছে প্রোপিকোনাজল অথবা মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক পরিমাণ পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২ বার স্প্রে করতে হবে। এছাড়া আমের আকার মটর দানার মতো হলে গাছে ২য় বার স্প্রে করতে হবে। এ সময় প্রতিটি মুকুলে অসংখ্য হপার নিম্ফ দেখা যায়। আম গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার পূর্বেই একবার এবং এর একমাস পর আর একবার সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক পানির সাথে মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপাল ভালোভাবে ভিজিয়ে ¯েপ্র করতে হবে। কাঁঠালের ফল পচা বা মুচি ঝরা সমস্যা এখন দেখা দিতে পারে। কাঁঠাল গাছ এবং নিচের জমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আক্রান্ত ফল ভেজা বস্তা জড়িয়ে তুলে মাটিতে পুঁতে ধ্বংস করতে হবে। মুচি ধরার আগে ও পরে ১০ দিন পর পর ২/৩ বার বোর্দ্রাে মিশ্রণ বা মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। বাডিং পদ্ধতিতে বরই গাছের কলম করতে পারেন। এজন্য প্রথমে বরই গাছ ছাঁটাই করতে হবে এবং পরে উন্নত বরই গাছের মুকুল ছাটাই করে দেশি জাতের গাছে সংযোজন করতে হবে।
প্রাণিসম্পদে করণীয়
এ সময় মুরগির রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। সে কারণে প্রয়োজনীয় টিকা প্রদান করতে হবে। খাবারের সাথে ভিটামিন সি ও ভিটামিন ই সরবরাহ করতে হবে। গবাদিপশুকে প্রয়োজনীয় ভ্যাক্সিন দিতে হবে এবং কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে। গবাদিপশুকে উন্নত খাবার যেমন-সবুজ ঘাষ, ইউরিয় মোলাসেম স্ট্র, ইউরিয়া মোলাসেম ব্লক এসব খাওয়াতে হবে।
মৎস্যসম্পদে করণীয়
মাছ চাষের জন্য পুকুর তৈরি ও সংস্কার করার উপযুক্ত সময় এখন। পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলে নিচ থেকে পচা কাদা তুলে ফেলতে হবে এবং শতাংশপ্রতি ১ কেজি চুন ও ১০ কেজি গোবর বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করতে হবে। পানি ভর্তি পুকুরে প্রতি শতাংশে ৬ ফুট পানির জন্য ১ কেজি চুন গুলে ঠাণ্ডা করে দিতে হবে। এছাড়া শতাংশপ্রতি ১০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি একসাথে মিশিয়ে পানি ভর্তি পুকুরে দিতে হবে। শীতের পর এ সময় মাছের বাড়বাড়তি দ্রুত হয়। তাই পুকুরে প্রয়োজনীয় খাবার দিতে হবে এবং জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
সুপ্রিয় পাঠক, কৃষিকথায় প্রতি বাংলা মাসেই কৃষি কাজে অনুসরণীয় কাজগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়। এগুলোর বিস্তারিত ও তথ্যবহুল বিশ্লেষণের জন্য আপনার কাছের কৃষি বিশেষজ্ঞ, মৎস্য বিশেষজ্ঞ ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে জেনে নিতে হবে। আমাদের সকলের আন্তরিক প্রচেষ্ঠা কৃষিকে নিয়ে যাবে সাফল্যের শীর্ষে। আবার কথা হবে আগামী মাসের কৃষিকথায়। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন
তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, মোবা: ০১৯১১০১৯৬১০ ই-মেইল-ioag@ais.gov.bd