প্রতিদিন আমরা যে খাবার খাই, তার তিন ভাগের এক ভাগ আসে মৌমাছির পরাগায়ন থেকে। পরিসংখ্যানের দিক থেকে, কীটপতঙ্গের মাধ্যমে যেসব উদ্ভিদের পরপরাগায়ন হয় তাতে শুধু মৌমাছির অবদানই ৮০% (অন্তত ১ লাখ ৩০ হাজার উদ্ভিদ)। বর্তমানে মানুষ খাবার হিসেবে যে ফলমূল, শাকসবজির ওপর বেশি নির্ভরশীল সেগুলোর ৭০% উৎপন্ন হয় মৌমাছির পরাগায়নের মাধ্যমে। পৃথিবীতে প্রতি বছরে যে পরিমাণ খাদ্য মৌমাছির পরাগায়নের মাধ্যমে উৎপাদিত হয় সেগুলোর আর্থিক মূল্য আনুমানিক ২২ হাজার কোটি ডলার। এ অর্থনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে বিশ্বব্যাপী ১৪০ কোটি মানুষের জীবিকা। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাবারের জোগান দিতে প্রয়োজন বাড়তি উৎপাদন। মৌমাছির সহায়তা ছাড়া যা এক প্রকার অসম্ভব। তাই মৌমাছির জীবন হুমকির মুখে পড়লে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাও হুমকির মুখে পড়বে। আর একটি মৌচাকে যত মৌমাছি বাস করে তার চারপাশে ৪ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে যত ফুল ফোটে, একদিনে সেগুলোতে ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ ও পরাগায়ন করতে সাহায্য করে এসব মৌমাছি। মৌমাছির মাধ্যমে পরাগায়ন হয় এমন ফল ও সবজির তালিকা অনেক লম্বা। যেসব ফল ও সবজি উৎপাদনে মৌমাছির প্রত্যক্ষ ভ‚মিকা আছে সেগুলোর মধ্যে আলু, পেঁয়াজ, সরিষা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মটরশুঁটি, মরিচ, পেঁপে, বাদাম, তরমুজ, কমলা, আঙুর, কুমড়া, লেবু, গাজর, লিচু, আপেল, আম, শিম, টমেটো অন্যতম। রাজশাহী, দিনাজপুর, ঈশ্বরদী, পাবনা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর প্রভৃতি জেলায় লিচু, আম, সরিষার মধু প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়। গোপালগঞ্জ আবার কালোজিরা ও ধনিয়া মধুর জন্য বিখ্যাত। মধুর জন্য নাম রয়েছে টাঙ্গাইলের লালমাটির মধুপুর এলাকার মধুপুর, মুক্তাগাছা, ফুলবাড়ীয়া, ঘাটাইল, সখীপুর, ভালুকা ও জামালপুর সদর উপজেলায় আনারস, কাঁঠাল, কলা, সরিষা, তিল, তিসি, জলপাই, লিচু, আম, পেঁপে, কুল, আদা, হলুদ, মিষ্টিকুমরা, লাউ, শিম, আলু, কাসাভা, কপি, গাজর, মুলাসহ বিভিন্ন কৃষিজ ফসল বাণিজ্যিকভিত্তিতে উৎপাদন করা হয়। ফলে এসব এলাকায় রয়েছে অনেক মৌচাষি। বীজ ও ভালো ফসল উৎপাদনে পরাগায়ন অত্যাবশ্যক, বীজ ফসলের মাঠে কীটপতঙ্গ দ্বারা পরাগায়ন অধিক কার্যকর।
প্রাচীনকাল থেকেই মৌমাছি মানুষের কাছে সামাজিক পতঙ্গ হিসেবে পরিচিত কারণ এরা দলবদ্ধভাবে বাস করে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন এর মতে, গবেষণা থেকে প্রাপ্ত যে মৌমাছিরা ফুলের পরাগায়ন ঘটিয়ে বনজ, ফলদ ও কৃষিজ ফসলের উৎপাদন ২৫-৩০% বাড়িয়ে দেয়। উৎপাদিত বাড়তি ফসলের মূল্য মোট উৎপাদিত মধু ও মোমের মূল্যের ১৫ থেকে ২০ গুণ বেশি। মৌমাছিকে তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে এনে মৌচাকের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পালন করাই মূলত মৌমাছি পালন। একটি মৌচাকে গড়ে প্রায় ২০ হাজার মৌমাছি থাকে। একটি চাকে সাধারণত ৩ শ্রেণির মৌমাছি থাকে একটি রানী মৌমাছি যা প্রজননে অংশ নেয়; ড্রোন বা পুরুষ মৌমাছি, কর্মী মৌমাছি। রানী মৌমাছি সবচেয়ে বড় প্রকৃতির। একটি চাকে একটি মাত্র রানী মৌমাছি থাকে। এর একমাত্র কাজ ডিম পাড়া। পুরুষ মৌমাছি মধ্যম আকৃতির ও এদের চোখ বড় কিন্তু হুল নেই, একমাত্র কাজ রানীর সাথে মিলিত হওয়া। শ্রমিক মৌমাছি সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির। এদের চোখ ছোট, কিন্তু হুল আছে। রানী ও পুরুষ বাদে অবশিষ্ট সকল সদস্যই শ্রমিক মৌমাছি। এরা নানা দলে ভাগ হয়ে চাকের যাবতীয় কাজ যথা- চাক নির্মাণ করা, ফুলের মিষ্টি রস ও পরাগরেণু সংগ্রহ করা, মধু তৈরি করা, চাকের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা, চাকে বাতাস দেয়া চাক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ইত্যাদি কার্যক্রম সম্পন্ন করে।
বাংলাদেশে পাঁচটি প্রজাতির মৌমাছি দেখা যায়- Apis mellifera, A. cerana, A. dorsata, A. florea এবং Triogona. এর মধ্যে অ্যাপিস মেলিফেরা প্রজাতির চাষাবাদ আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে লাভজনক। ইউরোপীয় জাতের অঢ়রং সবষষরভবৎধ আকারে মাঝারি ও শান্ত প্রকৃতির, তাই এদের বাক্সে লালন-পালন করা যায়। অ. পবৎধহধ, অ. ভষড়ৎবধ অন্ধকার স্থান যেমন- গাছের ফোকর, দেয়ালের ফাটল, আলমারি, ইটের স্ত‚প ইত্যাদি স্থানে এরা চাক বাঁধে। চাকপ্রতি মধুর উৎপাদন প্রতিবারে গড়ে প্রায় ৪ কেজি। অ. ফড়ৎংধঃধ প্রজাতির মৌমাছি পালন করা যায় না কারণ খুব হিংস্র স্বভাবের, বন-জঙ্গলে এদের চাক দেখা যায়, সুন্দরবনে এদের বেশি দেখা যায়। পাহাড়ি এলাকাতে ঞৎরড়মড়হধ (ংঃৎরহমষবংং নবব নামে পরিচিত) প্রজাতি প্রকৃতিতে পাওয়া যায়।
ফসল ও পরাগায়নের ধরন অনুযায়ী মৌমাছির বাসা নির্বাচন করা হয়। বাঙ্গি ফসলে ১০টি ফুলের জন্য একটি মৌমাছি যথেষ্ট। শসা, তরমুজ, মিষ্টিকুমড়া আর লাউয়ের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ ফুলের জন্য একটি মৌমাছির উপস্থিতির প্রয়োজন হয়। বাঁধাকপি, ফুলকপি প্রভৃতি ফসলের ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি ফসলের (বীজ) জন্য দুটি বা তিনটি মৌমাছির বাসা মাঠের উপযুক্ত স্থানে বসিয়ে দিলেই পরাগায়ন নিশ্চিত হয়। মুলার ক্ষেত্রে যেহেতু ফুল একেবারেই আকর্ষণীয় নয়, সেজন্য মাঠে অধিক সংখ্যক কীটপতঙ্গের উপস্থিতির প্রয়োজন হয়। তাই প্রতি হেক্টর মুলার জমিতে তিন-চারটি মৌমাছির বাসা মাঠে বসিয়ে দিলে বীজের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পায়। পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কমসংখ্যক মৌমাছির উপস্থিতির প্রয়োজন হয়। এক থেকে ১০ হেক্টর পেঁয়াজের ফসলের (বীজ) মাঠে একটি মৌমাছির বাসা বসিয়ে দিলেই চলে। গাজরে একই সঙ্গে বায়ু পরাগায়ন ও কীটপতঙ্গ পরাগায়ন সম্পন্ন হয়। তবে মৌমাছি গাজরের পরাগায়নে সবচেয়ে কার্যকর ভ‚মিকা রাখে। প্রতি হেক্টর গাজরের জমিতে একাধিক মৌমাছির বাসা স্থাপন করলে ভালো কাজ হয়। ধান সাধারণত বায়ু পরাগায়নে নির্ভরশীল। ধান ক্ষেতের পাশে মৌ বাক্স বসালে ধানের ফলন অন্য ক্ষেতের চেয়ে বেশি হয়।
আবহমানকাল থেকে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ বাংলাদেশের নিজেস্ব খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে মধু অন্যতম। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ তবে পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন করতে মধু গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারে। কারণ মধু শর্করা জাতীয় খাদ্য হলেও বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন, এনজাইম ও খনিজ পদার্থ থাকে। একে সব রোগের মহাষৌধ বলা হয়। মধুতে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান থাকে। মধু দেহে তাপ ও শক্তি জুগিয়ে শরীরকে সুস্থ রাখে। মধুতে যে ডেক্সট্রিন ও শর্করা থাকে তা সহজেই হজম হয়, সরাসরি রক্তে প্রবেশ করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে কাজ করে। প্রাকৃতিকভাবে মধুর বড় একটি উৎস সুন্দরবন, যার কেওড়া ও খলিসা ফুল মৌমাছিদের প্রথম পছন্দ। ঈধহধফরধহ ঐড়হবু ঈড়ঁহপরষ এর তথ্য অনুযায়ী এক পাউন্ড মধু উৎপাদনে মৌমাছিদের প্রায় ২০ লাখ ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করতে হয়, যার জন্য প্রায় ৮০,০০০ কিমি. পথ অতিক্রম করতে হয়। একটি মৌমাছি তার জীবনে এক চা চামচ পরিমাণ মধু সংগ্রহ করে। মধু ছাড়াও মৌমাছি থেকে পাওয়া অন্যান্য পণ্যের মাঝে রয়েছে মোম, পরাগরেণু, প্রোপোলিস, রাজকীয় জেলি, মৌবিষ ইত্যাদি।
বাংলাদেশে মৌ চাষের বর্তমান প্রেক্ষাপট
* দেশে মধু উৎপাদনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত আছে প্রায় ১৮ হাজার মৌচাষি।
* চাষি ছাড়াও বিভিন্নভাবে মধু শিল্পে কর্মরত আছেন প্রায় ২ লাখ মানুষ।
* ২০১৯-২০ অর্থবছরে সারাদেশে মৌ চাষের আওতায় জমির পরিমাণ ৮৯,০৩৭ হেক্টর।
* বর্তমানে ২ হাজার মৌ খামার ও ৫৬,৬৮৮ টি মৌবাক্স স্থাপিত রয়েছে।
* বাংলাদেশে বর্তমানে ৭টি মৌচাষিদের সংগঠন রয়েছে।
* বর্তমানে মাত্র ১,১৫১ জন সক্রিয় মৌখামাড়ি মৌ পালনের সাথে সম্পৃক্ত আছেন।
* প্রকল্পের তত্ত¡াবধানে নতুন পুরাতন মিলিয়ে আরও ৭০,০০০ কৃষককে মৌ চাষের সাথে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।
* বর্তমানে উৎপাদিত মধুর পরিমাণ প্রায় ৭০০-৮০০ মেট্রিক টন।
* ৭ টি বেসরকারি মধু প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র রয়েছে।
* মাত্র ৩টি মৌপালন বাক্স তৈরির ছোট কারখানা ও ২টি মৌমাছি পালন আনুষঙ্গিক সরবরাহকারী রয়েছে।
বিভিন্ন ফসলের মাঠে স্থাপিত মৌ বাক্স থেকে মধু উৎপাদন (কেজি)
মৌ চাষ সম্পর্কিত ডিএই এর ভিশন : আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মৌ চাষ কার্যক্রম গ্রহণে আগ্রহী লক্ষ জনগোষ্ঠীকে মৌ চাষে উদ্বুদ্ধকরণসহ অধিক মধু উৎপাদনের মধ্য দিয়ে দেশে খাঁটি মধুর চাহিদা পূরণ, সফল পরাগায়নের মাধ্যমে ফল ও ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি তথা দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে অবদান রাখা সম্ভব।
* মৌপরাগায়নের মাধ্যমে বিভিন্ন মাঠ ফসলের উৎপাদন ১৫-৩০% এ বৃদ্ধি।
* কৃষিকে বাণিজ্যকীকরণে ও বহুমুখীকরণে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন।
* প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ।
* টেকসই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন ও বজায় রাখা।
* মধু ও অন্যান্য পণ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে বৈদেশিক মুনাফা অর্জন এর মাধ্যমে জিডিপিতে অবদান।
* দেশে মধু ও মৌপণ্যভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠায় প্রত্যক্ষ ভ‚মিকা পালন।
* জৈব বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা।
মৌ চাষের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প : কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের আওতায় বাস্তবায়নাধীন কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ (৩য় পর্যায়) প্রকল্প। প্রকল্পে মৌ চাষ সম্পৃক্ত হওয়ায় অতিরিক্ত ১৫-৩০% ফলন বৃদ্ধিসহ মধু উৎপাদন এবং পরিবেশবান্ধব চাষাবাদ উৎসাহিত হবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে ২০০০ আধুনিক মৌবাক্স বিতরণ করা হয়েছে। প্রকল্পের মৌ চাষ সম্পর্কিত কর্মপরিকিল্পনাগুলো হলো-
* আধুনিক পদ্ধতিতে মৌপালন ও এর সাহায্যে সঠিক সময়ে উপযুক্ত পরাগায়নের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন ১৫-৩০% বৃদ্ধি;
* পরিবেশবান্ধব উৎপাদন কৌশল সম্পর্কে কৃষকদের অবহিত করা;
* কৃষকদের জমিতে মৌবক্স স্থাপনে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধি;
* ডিএই এর মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের মৌচাষ সম্পর্কিত জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি।
মৌ চাষের সম্ভাবনার ক্ষেত্রসমূহ
Tridge.com এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ব বাজারে প্রতি কেজি মধুর দাম ৩.৫৩ মার্কিন ডলার; মোট উৎপাদিত মধুর পরিমাণ ১.৭৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন (২০১৬); মধু উৎপাদনে প্রথম চীন (২৭.৫%), রপ্তানিতে প্রথম নিউজিল্যান্ড (১১.১%) ও আমদানিতে প্রথম আমেরিকা (২০.৯%); বিশ্ব বাজারের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান রপ্তানিতে ৮৩তম ও আমদানিতে ৬৬তম। কিন্তু আশার কথা ঞৎরফমব.পড়স এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে জাপানে রপ্তানি হয়েছে ৬৪.৫% মধু আর বিশ্বে মোট রপ্তানিকৃত মধু থেকে আয় ১,৫৩,৪২,০০০ মার্কিন ডলার এবং আমদানিতে মোট ব্যয় ১১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে শিল্পায়নে ও কারুশিল্পে প্রোপোলিস ও মম এর চাহিদা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এক প্যাকেট (৬০০ গ্রাম) পরাগরেণুর খুচরা বাজার মূল্য ৩০০০-৪০০০ টাকা। রাজকীয় জেলি, মৌ বিষ এর বাজার এর আমাদের দেশে এখনও তৈরি হয়ে ওঠেনি, তবে বিশ্ব বাজারে এর গুরুত্ব অনেক। আমাদের দেশের বর্তমান মাঠ ফসল, শস্য চক্র ও সময় বিবেচনা করে মধু উৎপাদন ৪০-৫০ হাজার মে. টন পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।
পর্যাপ্ত ফসলি জমি ও চারণভ‚মির অভাব ও বৈশ্বিক জলবায়ুর প্রভাবে বিশ্বেই মৌমাছির স্বাভাবিক কর্মচাঞ্চল্য বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে মানসম্পন্ন মধু ও মোমের উৎপাদন বাড়াতে মৌ-রানীর (রানী মৌমাছি) কৃত্রিম প্রজনন করা হয়। যদিও রানী প্রজননের ক্ষেত্রটি এদেশে নতুন। কৃত্রিম মৌ প্রজনন পদ্ধতিতে রানী মৌমাছির সংখ্যা যেমন বাড়ানো যায়, তেমনি প্রাকৃতিক উপায়ে মৌ চাষকে সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে দেশের মানুষ গ্রহণ করলে দেশের বেকার সমস্যা অনেকখানি দূর হবে। প্রজননকৃত রানী সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত ডিম দিতে সক্ষম, যেখানে প্রচলিত বা সনাতন পদ্ধতিতে রানী ৬-৭ মাস পর্যন্ত ডিম দিতে পারে। বর্তমানে কৃত্রিম প্রজননকৃত একটি রাণির আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য প্রায় ২৪০০ টাকা বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তবে গবেষণার মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে আমাদের দেশীয় আবহাওয়া-উপযোগী রানী উৎপাদন করতে পারলে বাঁচবে সময় ও অর্থ। সমগ্র দৃষ্টিতে গ্রামের স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোর জন্য মৌমাছি পালন এখন একটি লাভজনক ক্ষেত্র। এ বিষয়ে বেকার ও দরিদ্র্যজনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই গ্রামীণ আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব।
মৌপালনের চ্যালেঞ্জসমূহ : আমদানিকৃত মধুর তুলনায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মধুর পাইকারি বাজারমূল্য অনেক কম। ভারত থেকে আমদানিকৃত মধু দেশীয় বাজারের ৭৩.৭% দখল করে আছে (tridge.com) । সকল কৃষক পর্যায়ে মৌপালনের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি রয়েছে। সেই সাথে আগ্রহী মৌচাষিদের আর্থিক সামর্থ্যও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। মাঠে বিদ্যমান মৌবাক্সে বিভিন্ন প্রকার শত্রু ও রোগের আক্রমণে মৌমাছি কলোনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সারাদেশে মধু ও মৌপণ্য পরিবহন হয়রানি, জটিলতা, স্থানীয় চক্র ইত্যাদি অতিক্রম করে বাজারজাত করতে কৃষককে হিমশিম খেতে হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মাঠপর্যায়ে আধুনিক পদ্ধতিতে মৌচাষ সংক্রান্ত কার্যক্রম গ্রহণ করায় দেশে মধু উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মৌচাষিদের প্রশিক্ষণ ও মৌবাক্স বিতরণ ছাড়াও সারা বাংলাদেশে মৌচাষিদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। প্রতিটি কৃষি অফিস থেকে স্থাপিত মৌবাক্স পর্যবেক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। মৌচাষি ও শিল্পকারখানার মাঝে সমন্বয় ও সহযোগিতা কার্যক্রম চলছে। মৌমাছি পালন সংক্রান্ত কোনো তথ্য জানতে হলে উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
ড. মোঃ আবদুল মুঈদ
মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, ফোন : ৯১৪০৮৫০, ইমেইল : dg@dae.gov.bd
কথাসূত্র
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ২০২০ বছরটি ‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে উদ্যাপনের রাষ্ট্রীয় ও নাগরিক আয়োজন চলছে। এ আয়োজনে বঙ্গবন্ধুর জীবন সংগ্রাম, রাজনৈতিক মতাদশর্, স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তথা প্রত্যাশা, প্রাপ্তি ও ভবিষ্যৎ করণীয় বিষয়ে বিপুল কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এ সব কার্যক্রম বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বর্তমান প্রজন্ম যেমন আত্মনিরীক্ষণের সুযোগ পাবে এবং কর্তব্য স্থির করবে তেমনি নতুন প্রজন্ম জাতির পিতার মানব প্রেম, দেশ প্রেম, অন্যায় অত্যাচার- নিপীড়নের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রাম, অপরিমেয় সাহস এবং বিপুল ও মহীয়ান আত্মত্যাগ সম্পর্কে জানতে পারবে। সেই সাথে এই দেশ ও এদেশের জনগণের কল্যাণে সূচিত নানা উদ্যোগ সম্পর্কে অবহিত হবে। এভাবে ‘মুজিববর্ষ’ উদ্যাপন সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে আগামী দিনের উন্নয়ন অভিলক্ষ্যসমূহ অর্জনে ব্রতী হতে অনুপ্রাণিত করবে। আমরা এদেশের কৃষিবিদ সমাজ আমাদের বোধে ও বিশ্বাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ও অনুপ্রেরণা চির অটুট রাখতে তাঁকে স্মরণ করব-নানা আয়োজনে-যার অন্যতম হলো-কৃষিবিদ দিবস উদ্যাপন।
কৃষিবিদ দিবস ও তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য
বাংলাদেশ কিম্বা বিদেশি কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে - কৃষি, পশুচিকিৎসা, পশুপালন, কৃষি অর্থনীতি, মৎস্য, কৃষি প্রকৌশল এমনকি কৃষি বনায়ন ইত্যাদি বিষয়ে ¯œাতক ডিগ্রি অর্জনকারী বাংলাদেশের পেশাজীবীরা কৃষিবিদ হিসেবে পরিচিত। প্রকৌশল বা চিকিৎসক পেশায় নিয়োজিতদের মতো কৃষিবিদরাও বিশেষজ্ঞ পেশাজীবী গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের শিক্ষা, গবেষণা, সম্প্রসারণসহ নানামুখী উন্নয়ন কাজে নিয়োজিত থেকে জনগণের জন্য খাদ্য নিরাপত্তার বলয় রচনা ও সুরক্ষা এবং সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রভূত অবদান রাখার সুবাদে কৃষিবিদগণ এদেশে আজ এক মর্যাদাবান পেশাজীবী হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু নিরেট সত্য এই যে, এই মর্যাদা অর্জনের পথ মোটেই মসৃণ বা সুগম ছিল না। একদিকে লাগাতারভাবে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশ ও উন্নয়নে মেধা, দক্ষতা ও সৃজনময় কর্মকুশলতার নিরবচ্ছিন্ন প্রয়োগজনিত চ্যালেঞ্জ অন্যদিকে পেশাজীবী হিসেবে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে মর্যাদা অর্জন ও রক্ষার নিরন্তর লড়াইয়ের পথ ধরেই এগোতে হচ্ছে কৃষিবিদদের।
১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ এর প্রতিষ্ঠা এবং ষাটের দশকের মধ্যভাগে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ২ দফা ভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে এ লড়াইয়ের সূচনা হয়। এ লড়াইয়ে সর্বশক্তি দিয়ে যুক্ত হন ঢাকাস্থ তৎকালীন তেজগাঁও কৃষি কলেজের (বর্তমান শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্ররা।
দুই দফা দাবির অন্তর্ভুক্ত ছিল
*কৃষি গ্রাজুয়েটদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশকালে গেজেটেড পদমর্যদা প্রদান।
*সমমর্যদার পেশাজীবীদের সাথে একীভ‚ত বেতন স্কেল ও সংগতিপূর্ণ টেকনিক্যাল পে প্রদান।
এই দুই দফা বাস্তবানের দাবিতে ১৯৬৪ সালের ১৭ জুন থেকে ছাত্র ধর্মঘট শুরু হয় যা লাগাতারভাবে ১৭২ দিন অব্যাহত থাকে। ৪৭ জন ছাত্র ও ৫ জন পথচারীকে এ আন্দোলনের দায়ে দীর্ঘ দিন জেল খাটেন। মলয় বৈশ্য নামে একজন ছাত্রকে আত্মাহুতি দিতে হয় এ আন্দোলনে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয় ৪৭ জন ছাত্রকে। এই অবস্থায় ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ময়মনসিংহ শহরে সুধীসমাজ, অভিভাবকবৃন্দ ও প্রাদেশিক সরকারের প্রশাসনের সাথে চলমান আলোচনার এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে ছাত্রদের বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার ও তাদের দাবি মেনে নেয়ার ব্যাপারে নমনীয় মনোভাব পোষণ করায় ৭ ডিসেম্বর ১৯৬৪ সালে ১৭২ দিনের ছাত্র ধর্মঘটের অবসান হয়। কিন্তু মূল দাবি অর্জিত না হওয়ায় ছাত্রদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভ ও দুই দফা আদায়ের সংগ্রাম অব্যহত থাকে। ১৯৬৯ সালে দেশজুড়ে সূচিত ছাত্রদের ঐতিহাসিক ১১ দফা দাবিভিত্তিক আন্দোলনের সাথে কৃষি শিক্ষার্থীদের ২ দফা দাবিও অন্তর্ভুক্ত হয়। যা এ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা, শাসন-শোষণ-ত্রাসনের মুক্তিদূত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি কারারুদ্ধ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৬ দফাভিত্তিক স্বাধিকার আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। তুমুল গণআন্দোলন ও ছাত্র আন্দোলনের প্রবল প্রবাহে সূচিত গণঅভ্যুত্থানে সামারিক স্বৈরাচার আইয়ুব শাহীর পতন ঘটে। শেখ মুজিব করামুক্ত হন। ছাত্র জনতা তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভ‚ষিত করে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অনন্য বিজয় সত্তে¡ও পাকিস্তানী স্বৈরশাসক কর্তৃক আওয়ামীলীগের নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যদের সমন্বয়ে সরকার গঠন করতে না দেয়ার পরিণতিতে শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাসব্যাপী চলমান এ সর্বপ্লাবী যুদ্ধে গৌরবময় বিজয় অর্জনের পর ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রæয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। ঐ দিন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সমাজের সহসভাপতি মোঃ নজিবর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ আব্দুর রাজ্জাক বর্তমান মাননীয় মন্ত্রী কৃষি মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নেতৃত্বে পরিচালিত তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নেতৃবৃন্দ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে কাছে কৃষি গ্রাজুয়েটদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশপদে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা এবং টেকনিক্যাল পে প্রদানের দাবি জানালে জাতির জনক তা প্রসন্নচিত্তে মেনে নেন এবং অচিরেই সরকারি প্রজ্ঞাপন জারির মধ্য দিয়ে তা বাস্তবায়ন করেন। এই ঐতিহাসিক অর্জনের স্মৃতিময় ১৩ ফেব্রæয়ারি দিনটি কৃষিবিদ সমাজের জন্য এক গৌরবদীপ্ত দিন, স্মৃতির মনিকোঠায় অক্ষয়, অবিস্মরণীয়, এক স্বর্ণজ্জ্বোল দিন।
এই অর্জনের দীর্ঘকাল পরে ২০১১-১২ মেয়াদে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ এর কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি ১৩ ফেব্রæয়ারি দিনটি প্রতি বছর কৃষিবিদ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সিদ্ধান্তের আলোকে ২০১২ সাল থেকে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ ১৩ ফেব্রæয়ারি দিনটি মর্যাদার সাথে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ‘কৃষিবিদ দিবস’ হিসাবে পালন করে আসছে।
কৃষি ক্ষেত্রে অর্জন : কৃষিবিদদের অবদান
পলিবিধৌত গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ পরিচয়ে খ্যাত কৃষি প্রধান আমাদের এই প্রিয় মাতৃভ‚মি বৃটিশ ও পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনামলে দুর্ভিক্ষ মহামারীর করাল গ্রাসে পতিত হয়েছে বার বার। প্রাণহানি ঘটেছে লক্ষ লক্ষ মানুষের। সিংহভাগ মানুষ প্রজন্ম ধরে দারিদ্র সীমার নিচে বাস করতে বাধ্য হয়েছে। ঐ সময়ের কৃষিকে নিতান্তই নিয়তি নির্ভর মানধাত্মার আমলের পারিবারিক অভিজ্ঞতাভিত্তিক খোরপোষমুখী কৃষি ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করা হতো।
১৯৩৮ সালে ঢাকার তেজগাঁয়ে কৃষি কলেজ এবং ১৯৬১ সালে ময়মনসিংহে পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুবাদে এ দেশে সীমিত পরিসরে উচ্চতর কৃষি শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং জ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর কৃষির প্রবর্তন ঘটে। এ সময়ে ধীরে ধীরে সরকারি পর্যায়ে কৃষি শিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণ সেবা বিস্তারের কর্মসূচি চালু হয়। যা মূলত খোরপোষমুখী সনাতন কৃষি ব্যবস্থার আধুনিক রূপান্তরের প্রাথমিক প্রণোদনা হিসেবে কাজ করে। কথিত ৫৮ হাজার গ্রাম আর ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশে স্বাধীনতা লাভের বছর কালে অর্থাৎ ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ গ্রামে বাস করতে এবং তারা শতভাগ কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল। মূলত প্রকৃতি নির্ভর ফসল চাষই ছিল কৃষকদের মূল পেশা। ধান, পাট, সীমিত পরিসরে ডাল, রবিশস্য, আখ ইত্যাদি ছিল চাষাবাদের আওতায়। সবজি, ফল বা মসলা জাতীয় ফসলের বাণিজ্যিক আবাদ ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। সচ্ছল কৃষক পরিবারগুলোও প্রধানত মাটির দেয়াল দেয়া ছনের বা টিনের ঘরে বাস করতেন। সারা বছর জামা গায় দেয়া ও সবসময় জুতা স্যান্ডেল পরার সামর্থ্য তাদের ছিল না।
কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাঙালি জাতির চিরাআরাধ্য মহানায়ক কৃষক সন্তান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এ দেশের কৃষক সমাজের কল্যাণ সাধনে আত্মনিয়োগ করেন। কৃষিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে প্রণয়ন করেন রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা। আধুনিক কৃষিকে ধারণ ও লালন করার যোগ্য কাঠামো-অবকাঠামো তৈরিতে মনোযোগী হন। কৃষিশিক্ষা, গবেষণা, সম্প্রসারণ ও উপকরণ বিতরণ কার্যক্রম সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আয়োজন করেন। এ সময় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির সৃষ্টি হয়। আধুনিকায়ন হয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, পাট গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের। মৎস্য ও পশু সম্পদ ও চা উন্নয়ন ক্ষেত্রেও নতুন নতুন উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হয়। কৃষি গ্রাজুয়েটদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশ পদে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দান এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেধাবী জনবলের জোগান দেয়- যা জাতির জনকের দূরদৃষ্টিপ্রসূত উন্নয়ন ভাবনারই একটি উজ্জ্বল দিক। কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা ঘোষণা কালে তিনি বলেছিলেন, ‘আন্দোলন করছিস বলে আমি দাবি মেনে নিলাম তা নয়, আমি চাই ভালো ছাত্রছাত্রী কৃষি পড়–ক’ আমি তোদের দাবি মেনে নিলাম তোরা আমার মুখ রাখিস।’
কৃষিবিদ সমাজ তাদের প্রতিভা, মেধা ও কর্মদক্ষতা, সর্বোচ্চ অঙ্গীকার ও আন্তরিকতার সাথে প্রয়োগ করে জাতির জনকের প্রত্যাশা পূরণে ব্রতী হন। সেই থেকে এদেশের কৃষিবিদগণ বিভিন্ন ফসলের শত শত জাত উদ্ভাবন ও প্রবর্তন এবং উন্নত চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছেন। আর সেই কারণেই বাংলাদেশের ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে ২০১৯ সালে প্রায় ১৭ কোটি জনগণের জন্য ৪ কোটি ৬০ মেট্রিক টন দানা জাতীয় খাদ্য শস্য উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। এদেশে প্রতি বছরে ঘটিত মরা কার্তিকের অনটন কেটে গেছে। প্ররাভূত হয়েছে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাও। আজ এদেশের প্রতি ইঞ্চি জমি ভরে উঠেছে ফসলের বৈচিত্র্যে। শত শত উচ্চফলনশীল ফসল সংযুক্ত হয়েছে শস্য বিন্যাসে। সবজি, ফল ও মসলা উৎপাদনেও বিপুল অগ্রগতি হয়েছে। শস্যের গড় নিবিড়তা শতকরা ২০০ ভাগ ছুঁই ছুঁই করছে। কৃষি ক্ষেত্রে লাগাতরভাবে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। প্রাকৃতিক বৈরিতার সাথে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী কৃষি প্রযুক্তি কৃষি উৎপাদন কৌশল প্রবর্তনে কৃষক ও কৃষিবিদ সমাজ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। একই ভাবে প্রাণিসম্পদ ও মৎস খাতেও প্রভ‚ত উন্নতি হয়েছে। গ্রামে গ্রামে পোলট্রি ফার্ম, গাভি পালন, গরু মোটাতাজাকরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে পশু সম্পদের এবং পুকুর, বিল, বাওড় এবং মুক্ত জলাশয়ে মাছ চাষের কার্যক্রম বিস্তৃত হওয়ায় এ খাতে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। সম্প্রতি সমুদ্র জয়ের ফলে মেরিন ফিশারিজ খাতের উন্নয়নে বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি বসতবাড়িতে ফল ও সবজি চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় পারিবারিক পুষ্টির প্রাপ্যতা বেড়েছে। দেশে কৃষি শিক্ষা, গবেষণা, সম্প্রসারণ সেবা যেমন সম্প্রসারিত হচ্ছে তেমনি প্রয়োজনীয় উন্নত প্রযুক্তি ও মানসম্পত উপকরণের যোগানও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। বহু সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এসব কাজে যুক্ত হয়েছে এসব সংস্থায় কর্মরত রয়েছেন কৃষিবিদগণ। কৃষি ব্যবস্থায় যান্ত্রিকীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের ছোঁয়া লেগেছে। যা কৃষকের জীবন যাপনে এবং কৃষি ব্যবস্থায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। কৃষি পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বহির্বাণিজ্য এক নুতন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। এখন কৃষকের ঘরবাড়ি, পোশাক পরিচ্ছদ, শিক্ষা দীক্ষা, বিনোদনসহ জীবন যাত্রার সর্বত্রই লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। এই উজ্জ্বল অর্জনের মহানায়ক যদি হয় কৃষক তাহলে সহনায়ক নিশ্চয় এদেশের কৃষিবিদ সমাজ। এর সাথে যুক্ত রয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের উদার ও কৃষিবান্ধব কার্যক্রম নীতি সমর্থন। কৃষকের সহায়তায় ব্যাপক উৎপাদন প্রণোদনার কর্মদ্যোগ জাতির জনক কর্তৃক প্রথম শ্রেণির মর্যাদা প্রাপ্তির ১৩ ফেব্রæয়ারি দিনটিকে কৃষিবিদ দিবস হিসেবে পালনের তাৎপর্য এখানেই। কৃষি ক্ষেত্রে অর্জনের এই ধারা অব্যাহত রাখার জন্য কৃষিবিদদের ভ‚মিকা ভবিষ্যতে আরো শানিত ও জোরদার করার উপায় অন্বেষণ এবং সে লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ ও তা বাস্তাবায়নের আয়োজনই হোক এ দিবস পালনের মূল অনুপ্রেরণ।
উপসংহার
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্র্তৃক কৃষিবিদ পেশাজীবীদের সরকারি চাকরিতে প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদা দেয়ার দিন থেকে ৪৭ বছর দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমরা জাতির পিতা ঘোষিত ঐ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের তাৎপর্য পর্যালোচনা করি তা হলে সহজেই উপলব্ধি করতে পারি যে, সিদ্ধান্তটি কতটা যুগান্তকারী ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিল। ঐ সিদ্ধান্তের প্রথম প্রত্যাশা ছিল কৃষি শিক্ষায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা আসবে যা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবে রূপ নিয়েছে আর প্রধান লক্ষ্য ছিল কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার খোল নলচে বদলে ফেলে এমন অগ্রগতি অর্জন করবে যা এদেশের মানুষকে ক্ষুধা থেকে মুক্তি দেবে, দারিদ্র্য জয়ে সবচেয়ে বড় সহায়ক হবে। এদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বার্ষিক ১৯৭১ সালে গড় আয় ছিল ১৭০ ডলার যা আজ প্রায় ২০০০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। দানা জাতীয় খাদ্য উৎপাদনে অর্জিত হয়েছে স্বনির্ভরতা। সবজি, ফল, মাছ, মাংস, ডিম, দুধসহ প্রায় সকল প্রকার কৃষি পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। এর বাইরে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের প্রায় সকল সূচকে আমাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। এই উন্নতি অর্জনে এদেশের কৃষিবিদসমাজ নিরলসভাবে কাজ করছে, অবদান রাখছে।
আমরা এই অবদান আরো সূদৃঢ় করতে চাই, অর্থবহ করতে চাই জাতির কল্যাণে ও জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে। বিশেষ করে কৃষক সমাজের সমৃদ্ধি ও মর্যাদা উন্নয়নে ও সুরক্ষায়। এই হোক মুজিব বর্ষে কৃষিবিদ দিবস উদ্যাপনের মূল প্রেরণা।
জয় বাংলা
জয় বঙ্গবন্ধু
কৃষিবিদ দিবস অর্থবহ হোক
মুজিববর্ষ সার্থক হোক
কৃষিবিদ মো: হামিদুর রহমান
সম্মানিত সদস্য, এপিএ পুল, কৃষি মন্ত্রণালয়, সাবেক মহাপরিচালক, ডিএই, মোবাইল : ০১৭১১৮০৩৬৯৫, ই-মেইল : hamidur2152@gmail.com
মুরগির শেষ পরিণতি যদি মাংস হয় তবে ডিম হবে আগের ধাপ। মাংস খেলে প্রাণী হত্যা হয় কিন্তু অনিষিক্ত (অর্থাৎ যে ডিমে বাচ্চা হবে না) ডিম খেলে প্রাণী হত্যা হবে না, বাংলাদেশের অনেক নিরামিষাশী শুধু এই যুক্তিতেই ডিম খায়, অনেকে মুরগির ডিম বেশি পছন্দ করেন যেহেতু তার আঁশটে গন্ধ কম।
মুরগির ডিমের খোসা পাতলা মসৃণ এবং আঁশটে গন্ধ কম। হাঁসের ডিমে উল্টো, উপরন্ত আকারে বড়, কুসুমও বড়। বাজারে বিভিন্ন ধরনের ডিম পাওয়া যায়। হাঁসের ডিম, দেশি মুরগির ডিম এবং উন্নত জাতের মুরগির ডিম, সাধারণ মানুষ বলে লেয়ার মুরগির ডিম ইত্যাদি। চাহিদা সবচেয়ে বেশি দেশি মুরগির ও হাঁসের ডিম, দামও সবচেয়ে বেশি। লেয়ার মুরগির ডিমের উৎপাদন যথেষ্ট হওয়ায়, দাম সবচেয়ে কম। লেয়ার মুরগির ডিম উৎপাদন হয় সেরা মুরগিদের বিজ্ঞানীদের নির্দেশ মতো সেরা খাদ্য উৎপাদনগুলো খাইয়ে। কিন্তু একটা দেশি মুরগি কী খাচ্ছে? আমরা কেউ জানি না। একটা লেয়ার ডিমের ওজন ৪০-৬০ গ্রাম, সেখানে দেশি মুরগির ডিম ২০-৩০ গ্রাম। এক কথায় দেশি মুরগির ডিম কিনে আপনি ঠকছেন।
ডিম গঠন প্রক্রিয়া
মুরগির বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিম্বাশয়ের ডিম্বাণুগুলো আকারে বড় হতে থাকে। ডিম্বাণুগুলোর ভেতরে আস্তে আস্তে কুসুম জমা হয়ে পূর্ণাঙ্গ কুসুমে পরিণত হয়। এক একটি কুসুম ভাইটালিন মেমব্রেন নামক এক প্রকার পাতলা পর্দা দ্বারা আবৃত থাকে। বোঁটার সাহায্যে ডিম্বাশয়ের সঙ্গে ঝুলানো থাকে। মুরগি যখন বয়স্কা হয় তখন কয়েকটি ডিম্বাণু পর পর শীঘ্র বড় হয়ে পূর্ণ কুসুমে পরিণত হয়। কুসুমের পূর্ণতার পর থলির শিরা উপশিরা বিহীন নির্দিষ্ট স্থানে ফাটল ধরার পরে ঐ স্থান দিয়ে বের হয়ে আসে। এই প্রক্রিয়াকে কুসুমক্ষরণ (ovulation) বলে। ডিম্বাশয় নালির প্রথম ভাগ এই নির্গত কুসুমটিকে ধরে ফেলে এবং পরে ডিম্বাশয় নালির বাকি অংশগুলোর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। নিষিক্তকরণের পরক্ষণ থেকেই কোষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। মুরগির দলে মোরগ না রাখলেও ডিম পাড়ার কোন ব্যাঘাত বা ডিমের সংখ্যার তারতম্য হয় না, কুসুমটি নিষিক্তকরণ হোক তা না হোক উহা যখন ডিম্বাশয়নালির বাকি অংশ দিয়ে আস্তে আস্তে অগ্রসর হয় তখন ওটা ডিমের সাদা অংশ, খোসার পর্দা, খোসা ইত্যাদি সংগ্রহ করে পূর্ণাঙ্গ ডিমে পরিণত হয়। ওভাবে পূর্ণ ডিমটি তৈরি হতে ২৪-২৫ ঘণ্টা সময় লাগে। একটি ডিম কুসুম, ভ্রƒণ, ঘন সাদা অংশ, পাতলা সাদা অংশ, চ্যালেজা, খোসার আবরণ, বায়ুকোষ ও খোসা নিয়ে গঠিত। সম্পূর্ণ ডিমটার আছে জল ৬৩.৬%, আমিষ-১২.৮৩, খনিজ ১০.৭০, স্নেহ ১০৬ খনিজ পদার্থ এবং ভিটামিন। এ জন্য ডিমকে Nature’s multivitamin বলে।
ডিম নষ্ট হওয়ার কারণ
ডিমের মোটা মাথাটায় কিছুটা জায়গা জুড়ে বাতাস থাকে। এই বাতাসে অক্সিজেন কমে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়ে গেলেই ডিম পচে যায়। আরেকটি কারণ হলো- ডিমের খোসায় অজস্র ফুটা থাকে, ঐ ফুটা দিয়ে যেমন বাতাস ঢোকে, বাতাসের সঙ্গে জীবাণু ঢুকে যায়। ঐ জীবাণুই ডিমকে পচিয়ে দেয়। ডিমের টাটকাভাব পরিবেশের উপর নির্ভর করে ঠাÐায় যেমন টাটকা থাকে, গরমে তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়।
ডিম সংরক্ষণ
ডিমের মূল গুণাগুণ বজায় রাখতে সঠিক নিয়মে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। দিনে ৩-৪ বার ডিম সংগ্রহ করতে হবে। গরমকালে ডিম সংগ্রহের পরই যতটা সম্ভব ঠাÐা জায়গায় জড়ো করতে হবে। কিছু দিনের জন্য রাখতে চাইলে ১২.৮ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় এবং মাসের পর মাস ডিম রাখতে চাইলে ১.৭-০.৬ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। ঠাÐা ঘরের আর্দ্রতা হবে ৮৫%।
আধুনিক পদ্ধতিতে ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডিম সংরক্ষণ করা গ্রামীণ পরিবেশে সম্ভব নয়, কারণ এতে যে প্রযুক্তি ও আধুনিক সরঞ্জামের প্রয়োজন তা আমাদের নেই। তাই সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতিকে এড়িয়ে দেশিয় উপযোগী পদ্ধতি ব্যবহারের দিকে নজর রাখা দরকার, যাতে করে গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষের পক্ষে তা প্রয়োগ করা সম্ভব হয়। (ক) সোডিয়াম সিলিকেট দ্বারা সংরক্ষণ-ভালো ডিম বাছাই করে তরল সোডিয়াম সিলিকেটে সংরক্ষণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে ১ কেজি সোডিয়াম সিলিকেট ১০ লিটার পানিতে ভালোভাবে গুলে তরল করা হয়। এই তরলে ১৫ ডজন ডিম সংরক্ষণ করা যায়। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় আড়াই মাস পর্যন্ত ডিম ভালো থাকে।
(খ) চুনের পানি দ্বারা সংরক্ষণ- এ পদ্ধতিতে ১ কেজি চুন ২০ লিটার পানিতে গুলে ১০ মিনিট থিতাল হয়। চুনের পানিতে ডিম ডুবিয়ে রাখা হয়। এ উপায়ে ২ মাস পর্যন্ত ডিম সংরক্ষণ করা যায়।
(গ) তেল দ্বারা সংরক্ষণ- এ পদ্ধতিতে বর্ণ, স্বাদ ও গন্ধহীন নারিকেল বা সয়াবিন তেল ব্যবহার করা হয়। তেলে ডিমগুলো ডুবিয়ে পরে অন্য পাত্রে উঠিয়ে রাখা হয়। এ পদ্ধতিতে ডিম পাড়ার পর পরই সংরক্ষণ করতে হয়। এভাবে প্রায় এক মাস পর্যন্ত ডিমের গুণাগুণ অক্ষুণœ রাখা সম্ভব। প্যারাফিন ডিমে মাখিয়ে এটাই করা সম্ভব।
(ঘ) গরম পানি দ্বারা সংরক্ষণ- এ পদ্ধতিতে ১৩০ ডিগ্রি ফারেনহাইট গরম পানিতে ১৫ মিনিট অথবা ১৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট গরম পানিতে ৩-৫ মিনিট ডিম রেখে তারপর অন্য পাত্রে উঠিয়ে রাখা ভালো। এতে এক মাস পর্যন্ত ডিমের গুণাগুণ অক্ষুণœ থাকে।
এ গুলো ছাড়াও আধুনিক সংরক্ষণ পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে হিমায়িত শুষ্ক ডিম। ডিমকে পুরোপুরি শুকনো করার ব্যবস্থা এখন আরও বেশি চালু। স্থানান্তর করতে জায়গা যেমন কম লাগে ঠিক তেমনি ঠাÐা ঘরের কোন দরকার পড়ে না। তবে প্রক্রিয়ার মূলধন বেশি লাগে।
ডিম বিপণন প্রণালি
ডিম উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছতে বেশ কিছু দিন সময় প্রয়োজন হয় অথবা বাজারমূল্য একেবারে কমে গেলে অতিরিক্ত ডিম অনেক দিন রাখতে হয়, এ জন্য খামারি, ব্যবসায়ীদের সংরক্ষণ পদ্ধতি বিষয়ে সঠিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত ডিম প্রাপ্যতা সকল ভোক্তারই প্রত্যাশা।
ডা: মনোজিৎ কুমার সরকার
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, কাউনিয়া, রংপুর, মোবাইল : ০১৭১৫২৭১০২৬, ই-মেইল :dmonojit66@gmail.com
বাংলাদেশে ডিজিটাল কৃষির প্রবর্তন কাজটি কয়েক দশক আগেই শুরু হয়েছে। দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহের আলোকে একাধিক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ডিজিটাল কৃষি পদ্ধতি প্রচলনের জন্য যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও আইটি বিষয় প্রবর্তনের জন্য প্রচন্ড চাপ রয়েছে। প্রাসংগিক এসব কারণে কৃষিবিদ হিসাবে আমার আগ্রহ সৃষ্টি হলে আমি টিভিসহ স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি কোর্সসমূহের ডিজিটাল রূপান্তরের জন্য দশকব্যাপী সংগৃহিত ও নিজের তৈরি আইটি সামগ্রী বিশ্লেষণ করার প্রয়াশ নেই। দেশের প্রায় ৮-১০টি টেলিভিশন চ্যানেলের ১৫-২০ মাসের বিভিন্ন প্রোগ্রাম প্রায় ৭ হাজার গিগাবাইট চিএ ও ভিডিও তথ্য বিশ্লেষণ করে যে চিত্র পাওয়া গেছে তাতে বলা যায় কৃষি অনুষ্ঠান প্রচারে সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রাধান্য রয়েছে। পাশাপাশি পর্যায়ে রয়েছে চ্যানেল আই। কৃষি অনুষ্ঠান স্পন্সরের অভাবে বেসরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে প্রচার কম বলে জানা গেছে টেলিভিশনভিত্তিক প্রাপ্ত বিশ্লেষিত তথ্য (চিএ ১ ও ২) পর্যালোচনাতে। দেশের কৃষির উন্ন্য়নের সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে এই নিবন্ধে উল্লেখ করা হলো।
বাংলাদেশের কৃষির প্রধান প্রধান চালিকা প্রতিষ্ঠান হলো কৃষি সম্প্রসারণ, উন্নয়ন ও গবেষণা অধিদপ্তরসমূহ। এর মধ্যে বিগত প্রায় অর্ধদশকে দেশের প্রায় ৮-১০টিভি চ্যানেলে যে সব প্রোগ্রাম করা হয়েছে তার কৃষি বিভাগ-অঞ্চলভিত্তিক ও বিষয়ভিত্তিক তথ্য ২টি পাইগ্রাফ চিত্রে উপস্থাপন করা হলো। প্রথম চিত্রে দেখা যাবে যে সবচেয়ে বেশি টেলিভিশন প্রোগ্রাম হয়েছে ঢাকা অঞ্চলে (২৫%), দ্বিতীয় যশোর (১৮%)। এর কারণ বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে তা কিন্তু কৃষির জন্য তেমন আশাপ্রদ নয়।
ঢাকায় টেলিভিশন প্রোগ্রাম বেশি হওয়ার কারণ রাজধানীভিত্তিক সরকারি-বেসরকারী নন-টেকনিক্যাল প্রদর্শনীমূলক প্রোগ্রাম, টেলিভিশন টিম ঢাকার বাইরে যেতে চায় না। তাই যা এদের অধিকংশ প্রোগ্রামই কৃষকের সরাসরি তেমন কাজে আসে না।
দ্বিতীয়ত: যশোর অঞ্চলে টেলিভিশন প্রোগ্রাম বেশি (১৮%) হওয়ার কারণ এলাকাটি অনেক বড়, ৭টি জেলা। এর মধ্যে ঝিনাইদা ও মেহেরপুর এই ২টি জেলাতেই প্রায় ১১%, অন্যান্য ৫ জেলা মিলে মাত্র ৭%। অঞ্চল ভিত্তিতে টেলিভিশন প্রোগ্রাম সবচেয়ে কম ২% করে সিলেট, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও রাংগামাটি। বিগত ২-৩ দশকে ডিজিটাল কৃষির জন্য যে পরিমাণ কর্মসূচি-ব্যয় আগ্রহ দেখানো ও প্রচার করা হয়েছে তার বিপরীতে এই প্রাপ্তি যথেষ্ট নয়। এ জন্য টিভি অনুষ্ঠান বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। প্রতিটি কৃষি অঞ্চলে প্রতিটি বড় চ্যানেলের কৃষি সম্প্রসারণ ইউনিট থাকতে হবে। বিশেষ করে ফসলের রোগ-পোকা দমন বিষয়ে সঠিক টেকনিক্যাল ও কারিগরি দিকসমূহ বিবেচনায় রেখে অব্যাহত রিপোর্টিং করতে হবে। বর্তমানে অঞ্চলভিত্তিক রিপোর্টিং এ বিশেষ করে পেষ্টিসাইড প্রেসক্রিপশনে নন-কৃষি গ্রাজুয়েট ব্যাক্তিকেও অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় যা দেশের বর্তমান পেষ্টিসাইড আইনের অনুক‚লে নয়।
উপস্থাপক কৃষিবিদ হলে তিনি প্রকৃত সমস্যা উল্লেখ করে প্রশ-উত্তর ব্যাখ্যা করতে পারেন। দেশের অনেক গ্রামীণ অঞ্চলে বলতে শুনা যায যে ‘ব্যাপক পোকার আক্রমণ, অথচ রোগের ঔষধ ছিটিয়ে কোন কাজ হচ্ছে না বা কৃষি বিভাগ উদ্যোগ নিচ্ছে না। ইত্যাদি গয়রহ ভাষা তো আছেই। এখানে উল্লেখ করা যায় যে এলাকাভেদে যেমন খুলনা অঞ্চলে উপপরিচলকগণ এবং রাংগামাটিতে কৃষি তথ্য সার্ভিসের আঞ্চলিক কৃষিবিদ অফিসারের টেলিভিশন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ বেশ সন্তোষজনক।
এখানে প্রদত্ত দ্বিতীয় পাইগ্রাফটিতে টেলিভিশন প্রোগ্রামের বিষয়ভিত্তিক প্রচারণার ধারা দেখানো হয়েছে। দেশের প্রায় ৮টি চ্যানেলের ২০ মাসের বিভিন্ন প্রোগ্রাম তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অনুষ্ঠান ছাড়াও রয়েছে কৃষি সংবাদ ও টক শো। টেলিভিশন প্রোগ্রামের বিষয়ভিত্তিক প্রচারণার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে সমন্বিত মিশ্র খামার ফসল (২৫%)। সবচেয়ে কম হচ্ছে ধানসহ দানা ফসল (১০%)। দ্বিতীয় বেশি প্রোগ্রাম হচ্ছে উদ্যান ফসল (২২%)। উপকরণের মধ্যে অন্যান্য উপকরণসহ পেষ্টিসাইডের প্রোগ্রাম হচ্ছে প্রায় ১৭%। নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তার জন্য পেষ্টিসাইড অনুষ্ঠান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তেল-ডাল সহ মাঠ ফসলের অনুষ্ঠান কম, প্রায় ১১%। তবে আাগের মতই প্রদর্শণী ও সভা-সম্মেলনের অনুষ্ঠান বেশি, প্রায় ১৫%।
দেশে কৃষি ফসলের গুরুত্বের নিরিখে টৈলিভিশন অনুষ্ঠানের অনুপাত বেশ বৈষম্যপূর্ণ। যেমন দেশে ধান-দানা ফসল চাষের ব্যাপকতা প্রায় ৮০% অথচ অনুষ্ঠান মাএ ১০%। অপরদিকে সমন্বিত মিশ্র খামার ফসল এলাকা ৫% এর বেশি হবে না অথচ এর অনুষ্ঠান প্রায় ২৫%। দেশের প্রায় সব ফসলের, পরিবেশের ও জনস্বাস্থ্যের জন্য পেষ্টিসাইড ব্যবহার একটি বড় ইসু। অথচ পেষ্টিসাইড অনুষ্ঠান অন্যান্য প্রধান প্রধান উপকরণ সহ মাত্র ১৭%। অনুষ্ঠানের এ অসম অনুপাতের জন্য একটি অন্যতম কারণ হতে পারে যে মিশ্র খামারজাতীয় ফসলের রিপোর্টিং এর চেয়ে উচ্চ প্রযুক্তির আধুনিক ধান বা পেষ্টিসাইডের অনুষ্ঠান অধিক জ্ঞান ও দক্ষতা সাপেক্ষ। দ্বিতীয় কারণ হিসাবে রয়েছে সরকারি অগ্রাধিকার ও দেশের কৃষি পরিস্থিতি।
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার উৎপাদন হার বাড়িয়ে ধান চাষ আরও লাভজনক করতে টেলিভিশন অনুষ্ঠানের কোন বিকল্প নাই। পেষ্টিসাইড বিষয়ক অনুষ্ঠানের একটি বড় সমস্যা হলো এর জেনেরিক নাম বলা। জেনেরিক নামে পেষ্টিসাইড সুপারিশ করলে ডিলার কোয়ালিটি ব্যতিরেকে তার সবচেয়ে বেশি লাভালাভের পণ্যগুলো কৃষককে দিয়ে দেয়, অথচ তার কাছে আরও ভালো পণ্য ছিলো। পেষ্টিসাইড প্রদানে টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ট্রেড বা সঠিক পণ্যনামে প্রেসক্রিপশন দিয়ে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। যেমন বিগত কয়েক বছর ধরে ধানের বøাষ্ট রোগ দমনের জন্য টেলিভিশনে বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ট্রুপার নামে প্রেসক্রিপশন দিয়ে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে, জেনেরিক নাম (ট্রাইস্ইাক্লাজোল) বলে তা সম্ভব ছিলো না। কারণ ট্রাইস্ইাক্লাজোলএর আরও কম কার্যকর অথচ কমিশন বেশি এমন পণ্য থাকতে পারে। একইভাবে পেঁয়াজ ও সরিষার মহামারি রোগ দমনকারী ছত্রাকনাশক জেনেরিক নামের ইপ্রোডিয়ন এর চেয়ে রোভরাল নাম জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তবে জেনেরিক নামের বদলে ট্রেড নামে বিশেষ করে ইলেকট্রোনিক মাস মিডিয়ায় পরামর্শ দিতে বেশ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। এতে অসুবিধা হয়না কারণ একাধিক কোম্পানীর পণ্যে একই ট্রেড নাম থাকার উদাহরণ রয়েছে। যেটা প্রয়োজন সেটা হল যিনি প্রেসক্রিপশন দিবেন তাকে বিভিন্ন পণ্যেও অত্যাবশ্যক গুণাবলী ও পরিস্থিতি ভিত্তিক উপযোগিতা জানতে হবে।
এলাকাভেদে সকল পর্যায়ে বিশেষ করে উপজেলা পর্র্যায়ে মহিলা কৃষিবিদ এবং উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণের অংশগ্রহণ ও তথ্যপ্রদান ও কৃষকসংলাপ বেশ সন্তোষজনক, যদিও ঢাকা রিজিয়ন ভিত্তিক বেশি। এখানে বলা দরকার যে বর্তমান লেখাটি ২০১৫-১৭ বছরের তথ্যভিত্তিতে প্রণীত। ২০১৭-১৯ বছরের তথ্যভিত্তিক লেখাটি সামনে আসছে যেখানে আরও প্রগ্রেসিভ ফলাফলের আভাস রয়েছে।
ডিজিটাল কৃষির টেলিভিশন অনুষ্ঠান প্রচারের মধ্যে সরকারি মাধ্যমগুলো ব্যাপ্তিতে বেশি হলেও এর একটি বড় সমস্যা হলো এর প্রচার সময় ঠিক থাকে না। সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন সময় যা মনে রেখে রেখে অনুষ্ঠান দেখা স¤ভব হয় না। তাই অনুষ্ঠান ঠিকই হয় তবে সে কার্য সুফলতা পায় না। কৃষকের উপযুক্ত বা অবসর সময়টি বিবেচনা করে অনুষ্ঠান সাজাতে হবে। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ও বিশেষজ্ঞের একজন কৃষিবিদ হতে হবে। এভাবে সুপারিশকৃত পদ্ধতিতে টিভি অনুষ্ঠান প্রচার করা হলে কৃষি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, সম্প্রসারণ, উন্নয়ন ও গবেষণা কাজ অনেক সাবলীলভাবে সহজে ও কম ব্যয়ে কৃষক-কৃষি উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। দেশে কম্পিউটার পদ্ধতির এ্যাপস, কল সেন্টার, প্ল্যন্ট ডক্টর কার্যক্রম, কৃষক মাঠ স্কুল কার্যক্রম সুচারুভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব। প্রতিবেশি দেশসমূহের কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন প্রোগ্রামসমূহ এভাবে এগিয়ে গিয়ে কৃষককে সহায়তা করতে পেরেছে। সুযোগ পেলে আমরাও পারবো, এ আশা রাখি।
দেশের বর্তমান কৃষি উন্নয়ন হার অব্যাহত রাখতে ডিজিটাল পদ্ধতি অবদান রেখে যাচ্ছে। উপরে বর্ণিত সমস্যা সমাধান করে বিষয়বস্তু, সময়, উপস্থাপক ও বিশেষজ্ঞের (মাঠে কর্মরত) সুসমন্বয় করে আরও অধিক সুফল অর্জন সম্ভব।
প্রফেসর ড. মো. সদরুল আমিন
কৃষি বিশেষজ্ঞ, সাবেক হা মো. দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দিনাজপুর, ই-মেইল :sadrulamin47@gmail.com, মোবা : ০১৭১৫০৫৭৫০৬
পৃথিবীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে খাবারের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সমতল চাষাবাদের জায়গাও কমে আসছে। তাই এই চাহিদা পূরণের জন্য আমাদের কম জায়গায় বেশি খাদ্য উৎপাদন এর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের পুষ্টি ও আমিষের চাহিদা পূরণে মৎস্য সম্পদের রয়েছে বিরাট ভ‚মিকা। খাদ্য উৎপাদনের মধ্যে মৎস্য উৎপাদন একটি অন্যতম লাভজনক পেশা। কিন্তু মৎস্য চাষের জন্য প্রয়োজন জলাশয় বা পুকুর, যা দেশে দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। তাই পুকুর বা জলাশয় ছাড়া মাছ চাষের উপায় বের করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এর অনেক উপায়ের মধ্যে একটি আধুনিক মৎস্য চাষ পদ্ধতি রাস (RAS)।
এই পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হলো অল্প জায়গায় অধিক মান সম্মত মাছ উৎপাদন। এই পদ্ধতিতে পুকুরের পরিবর্তে একাধিক বিভিন্ন আকৃতির ট্যাংক ব্যাবহার করে মাছ চাষ করা হয়। এই পদ্ধতিতে একই পানি পুনরায় ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন রকম ফিল্টার ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটি শহরে অল্প জায়গায় এমনকি বাড়ির ছাদেও স্থাপন করা সম্ভব। এটি একটি সার্কুলার পানি প্রবাহ মেশিন যেটিতে একই পানি দিয়ে দীর্ঘদিন মাছ চাষ করা সম্ভব। কম জায়গায় নিরাপদ মাছ চাষ করে নিজের চাহিদা মেটাতে ভালোবাসেন এমন শৌখিন মাছ চাষিদের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে এই সার্কুলার ওয়াটারে মাছ চাষ মেশিন। মূলত চায়নিজ বিজ্ঞানীরা এই মেশিন বা প্রক্রিয়াটির উদ্ভাবক হলেও বর্তমানে প্রযুক্তিটি বিশে^র বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এটি স্থাপনে প্রাথমিক বিনিয়োগের পরিমান কিছুটা বেশি লাগলেও পরবর্তী ব্যবস্থাপনা ব্যয় সাশ্রয়ী এবং দীর্ঘস্থায়ী।
এই জলজ উৎপাদন প্রক্রিয়াকে একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাছ উৎপাদন প্রক্রিয়া বলা যায়। এই আধুনিক উৎপাদন প্রক্রিয়া বর্তমান সময়ের এই বিপুল আমিষের চাহিদা মেটাতে বিরাট ভ‚মিকা রাখতে পারে। বর্তমান সময়ের সকল মাছ চাষ পদ্ধিতির মধ্যে রাস সবচেয়ে দ্রæত বৃদ্ধি লাভের একটি পরিক্ষিত পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে দেশি শিং, দেশি-বিদেশি মাগুর, পাবদা, টেংরা বা গুলশা, টেলাপিয়া, পাংগাস, চিংড়ি, ভেটকি ইত্যাদি নানা প্রজাতির মাছ চাষ করা যায়। এই পদ্ধতিতে বিশুদ্ধ পানিতে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মাছ চাষ করা হয়। এটি মূলত ঘরের ভেতরে ট্যাংকের মধ্যে অধিক ঘনত্বে এবং একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাছ উৎপাদন প্রক্রিয়া। যেখানে মাছ চাষের জন্য উপযুক্ত জলাশয় বা পানি নেই, সেখানেও এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়। এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ খুবই লাভজনক কিন্তু এর প্রধান সমস্যা হলো শুরুতে অধিক বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়।
এই পদ্ধতিতে সাধারণত নিম্নলিখিত মেশিনারি ব্যাবহার হয়ে থাকে। যেমন- ১) কালচার ট্যাংক ২) মেক্যানিকাল ফিল্টার ৩) বায়োলজিক্যাল ফিল্টার ৪) প্রোটিন স্কিমার ৫) ইউভি স্টেরিলাইজার ৬) পানির পাম্প ৭) অক্সিজেন জেনারেটরসহ আরো অনেক যন্ত্রপাতি ।
কিছু মেশিন প্রস্তুতকারী ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কয়েকটি ধাপে এই ধরনের প্রজেক্ট তৈরি করে দেবার কাজ করে থাকেন। যেমন- ১) মেশিন বিক্রয় ২) খরিদ্দারের চাহিদা অনুযায়ী প্ল্যান্ট ডিজাইন করা ৩) কন্সটাকশন বা স্থাপনা তেরির কাজ ৪) পরামর্শ সেবা ইত্যাদি। শুধুমাত্র মেশিন ক্রয় করে রাস স্থাপনার কাজ যে কারো পক্ষে অসম্ভব একটি কাজ। একটি প্রজেক্ট ডিজাইন করতে কি কি মেশিন দরকার এবং কোন মেশিনের কি ধরনের ক্যাপাসিটি লাগবে তা নির্ণয় করার জন্য অনেকগুলো ক্যালকুলেশনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সঠিক ক্যাকুলেশন ও ডিজাইনের উপর নির্ভর করে প্রকল্পের সাফল্য এবং আয়-ব্যয়।
মেশিন দেশি-বিদেশি হতে পারে, কিন্তু প্রজেক্ট এর ডিজাইন ও সঠিক পরামর্শ না পেলে সাধারণ চাষিদের জন্য এই প্রকল্প স্থাপনা এবং পরিচালনা সম্ভব নয়। একটি নতুন প্রকল্প শুরুর প্রথম কয়েকটি মাস খুবই ঝুঁকিপূর্ণ সময়। এই সময় ব্যাক্টেরিয়া তৈরির জন্য ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ সময় দিতে হয়। এই সময় অভিজ্ঞতা না থাকলে ১ সপ্তাহের মধ্যে মাছ মারা যাবার সম্ভাবনা শতভাগ। তাই এই প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন লোকের মাধ্যমে প্রকল্প ডিজাইন করে কাজে হাত দিলে সফল ভাবে মাছ চাষ শুরু করা যাবে। মনে রাখতে হবে, যারা পুকুরে মাছ চাষে অভিজ্ঞ তারা এই পদ্ধতি মাছ চাষ করতে হলে এই পদ্ধতির উপর প্রশিক্ষণ নিতে হবে, অন্যথায় অতিরিক্ত খাবার দেওয়া ও অব্যবস্থাপনার জন্য মাছ মরে যেতে পারে। কেউ পোনা ব্যাবসায়ী বা পুকুরের চাষিদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে এই পদ্ধতিতে চাষ করতে গেলে সমস্যায় পরবেন।
বর্তমানে জেমস্ মার্টিন অধিকারী নামে একজন উদ্যোক্তা বাংলাদেশে রাস এর মেশিনারি তৈরির কাজ হাতে নিয়েছেন। তিনি ১৯৯৬ সন থেকে দীর্ঘদিন বাংলাদেশে বিভিন্ন মেশিন তৈরীর কাজ করে আসছেন। বর্তমানে তার তৈরি রুটি মেশিন বাংলাদেশ আর্মি ও পুলিশ বাহিনী ব্যবহার করে আসছে। এই মেশিন আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন হওয়ায় বিদেশ থেকে প্রচুর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। তিনি শুরুর দিকে ঝজঅঈ (ঝড়ঁঃযবৎহ জবমরড়হধষ অয়ঁধপঁষঃঁৎব ঈবহঃবৎ) এর জঅঝ বিষয়ক অনেক গবেষণামূলক বই পড়ে এবং আমেরিকার ও টারকির বর্তমান সময়ের আধুনিক রাস মেশিনারির উপর পড়াশুনা করে এই কাজে হাত দেন। বিগত দিনের তার বায়োলজিক্যাল ইটিপি প্ল্যান্ট, ডবিøউটিপি প্ল্যান্ট এ হাতে কলমে কাজ করার অভিজ্ঞতা ও মেশিন ডিজাইন ও মেনুফেকচারিং এর অভিজ্ঞতা তাকে এই কাজে সাফল্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও জেমস মার্টিন অধিকারী ইন্ডস্ট্রিয়াল ইলেকট্রিক সার্কিট ডিজাইন ও পিএলসি অটোমেশনে সমানভাবে দক্ষ। যে কারণেই তিনি কোন টিম ওয়ার্ক ছাড়া একাই সকল ডিজাইন সঠিক ও সফলভাবে করে থাকেন। রাস এর মেশিন ডিজাইন ও প্রজেক্ট ডিজাইনেও এর ব্যতিক্রম হবে না।
চীনা বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘রাস’ পদ্ধতির মাছ চাষ অন্য যে কোনো শিল্পকারখানার তুলনায় কোনো অংশেই কম লাভজনক নয়। স্থাপনা গড়ার পর প্রথম বছরেই উঠে আসতে পারে বিনিয়োগের সমান লাভ। যে কারণে চীনাদের এমন উদ্যোগগুলো সরেজমিন ঘুরে দেখতে ছুটছেন বাঙালি উদ্যোক্তারা। চীনের জানসান এলাকার ‘রাস’ পদ্ধতির উপকরণ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানই ওয়াটার এ্যাকুয়াকালচার ইকুইপমেন্ট টেকনলজির প্রধান লিও হি বলছেন, মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের ঝুঁকি এড়াতে ‘রাস’ একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি।
কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন
ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, ব্রি, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৭১৬৫৪০৩৮০, ইমেইল- smmomin80@gmail.com
আমরা ১৪২৫ বঙ্গাব্দের শেষ অংশে চলে এসেছি। চৈত্র মাসে রবি ফসল ও গ্রীষ্মকালীন ফসলের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম এক সাথে করতে হয় বলে বেড়ে যায় কৃষকের ব্যস্ততা। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, কৃষিতে আপনাদের শুভ কামনাসহ সংক্ষিপ্ত শিরোনামে জেনে নেই এ মাসে কৃষির গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো।
বোরো ধান
যারা শীতের কারণে দেরিতে চারা রোপণ করেছেন তাদের ধানের চারার বয়স ৫০-৫৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ক্ষেতে গুটি ইউরিয়া দিয়ে থাকলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে না। সার দেয়ার আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে। এলাকার জমিতে যদি সালফার ও দস্তা সারের অভাব থাকে এবং জমি তৈরির সময় এ সারগুলো না দেয়া হয়ে থাকে তবে ফসলে পুষ্টির অভাবজনিত লক্ষণ পরীক্ষা করে শতাংশ প্রতি ২৫০ গ্রাম সালফার ও ৪০ গ্রাম দস্তা সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ধানের কাইচ থোড় আসা থেকে শুরু করে ধানের দুধ আসা পর্যন্ত ক্ষেতে ৩/৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে। পোকা দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আলোর ফাঁদ পেতে, পোকা ধরার জাল ব্যবহার করে, ক্ষতিকর পোকার ডিমের গাদা নষ্ট করে, উপকারী পোকা সংরক্ষণ করে, ক্ষেতে ডাল-পালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ধানক্ষেত বালাই মুক্ত করতে পারেন। এসব পন্থায় রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা না গেলে শেষ উপায় হিসেবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক বালাইনাশক, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
গম
দেরিতে বপন করা গম পেকে গেলে কেটে মাড়াই, ঝাড়াই করে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। শুকনো বীজ ছায়ায় ঠাণ্ডা করে প্লাস্টিকের ড্রাম, বিস্কুটের টিন, মাটির কলসি ইত্যাদিতে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
ভুট্টা (রবি)
জমিতে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ গাছের মোচা খড়ের রঙ ধারণ করলে এবং পাতার রং কিছুটা হলদে হলে মোচা সংগ্রহ করতে হবে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে শুকনো আবহাওয়ায় মোচা সংগ্রহ করতে হবে। সংগ্রহ করা মোচা ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে।
ভুট্টা (খরিফ)
গ্রীষ্মকালীন ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এ মাসে বীজ বপন করতে হবে। খরিফ মৌসুমের জন্য ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৫ এসব। শতাংশপ্রতি বীজ লাগবে ১০০-১২০ গ্রাম। প্রতি শতাংশ জমিতে ইউরিয়া ৩৬৫ গ্রাম, টিএসপি ২২২ গ্রাম, এমওপি ১২০ গ্রাম, জিপসাম ১৬০ গ্রাম এবং দস্তা সার ১৬ গ্রাম সার দিতে হবে ।
পাট
চৈত্র মাসের শেষ পর্যন্ত পাটের বীজ বপন করা যায়। পাটের ভালো জাতগুলো হলো ও-৯৮৯৭, বিজেআরআই তোষা পাট-৪, বিজেআরআই তোষা পাট-৫, বিজেআরআই তোষা পাট-৬, বিজেআরআই দেশি পাট-৫, বিজেআরআই দেশি পাট-৬, বিজেআরআই দেশি পাট-৭, বিজেআরআই দেশি পাট-৮। পাট চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করে। আড়াআড়িভাবে ৫/৬টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। সারিতে বুনলে প্রতি শতাংশে ২৫ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বুনলে আরেকটু বেশি অর্থাৎ ৩০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। পাটের জমিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার (প্রায় ১ ফুট) এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৭ সেন্টিমিটার (প্রায় ৩ ইঞ্চি) রাখা ভালো। ভালো ফলনের জন্য প্রতি একরে ৭০ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি, ১২ কেজি এমওপি, ১৮ কেজি জিপসাম এবং প্রায় ৪.৫ কেজি জিংকসালফেট সার প্রয়োগ করতে হবে।
অন্যান্য মাঠ ফসল
রবি ফসলের মধ্যে চিনা, কাউন, আলু, মিষ্টিআলু, চিনাবাদাম, পেঁয়াজ, রসুন যদি এখনো মাঠে থাকে তবে দেরি না করে সাবধানে তুলে ফেলতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে এ সময়ে বা সামান্য পরে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেজন্য পচনশীল ফসল তাড়াতাড়ি কেটে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।
শাকসবজি
গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি চাষ করতে চাইলে এ মাসেই বীজ বপন বা চারা রোপণ শুরু করতে হবে। সবজি চাষে পর্যাপ্ত জৈবসার ব্যবহার করতে হবে। এ সময় গ্রীষ্মকালীন টমেটো, ঢেঁড়স, বেগুন, করলা, ঝিঙা, ধুন্দুল, চিচিঙ্গা, শসা, ওলকচু, পটোল, কাঁকরোল, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লালশাক, পুঁইশাক এসব সবজি চাষ করতে পারেন ।
গাছপালা
এ সময় বৃষ্টির অভাবে মাটিতে রসের পরিমাণ কমে আসে। এ অবস্থায় গাছের গোড়ায় নিয়মিত পানি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আম গাছে হপার পোকার আক্রমণ হলে অনুমোদিত কীটনাশক যেমন- সিমবুস/ফেনম/ডেসিস/ফাইটার ২.৫ ইসি প্রভৃতি প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে হবে। আম গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার পূর্বেই একবার এবং এর একমাস পর আর একবার প্রতি লিটার পানির সাথে ১.০ মিলি সিমবুস/ফেনম/ডেসিস/ ফাইটার ২.৫ ইসি মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপাল ভালোভাবে ভিজিয়ে ¯েপ্র করতে হবে। এ সময় আমে পাউডারি মিলডিউ ও এ্যান্থ্রাকনোজ রোগ দেখা দিতে পারে। টিল্ট, রিডোমিল গোল্ড, কানজা বা ডায়থেন এম ৪৫ অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। কলা বাগানের পার্শ্ব চারা, মরা পাতা কেটে দিতে হবে। পেঁপের চারা রোপণ করতে পারেন এ মাসে। নার্সারিতে চারা উৎপাদনের জন্য বনজ গাছের বীজ বপন করতে পারেন। যাদের বাঁশ ঝাড় আছে তারা বাঁশ ঝাড়ের গোড়ায় মাটি ও জৈবসার প্রয়োগ করতে পারেন।
প্রাণিসম্পদ
শীতকাল শেষ হয়ে গরম পড়ার সময়টিতে পোল্ট্রি খামারি ভাইদের বেশ সতর্ক থাকতে হবে। কারণ শীতকালে মোরগ-মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কমে যায়। সে কারণে এ সময় রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। তাই আগ থেকেই টিকা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এ সময় ভিটামিন সি ও ভিটামিন ই এর অভাব দেখা দিতে পারে। সে জন্য খাবারের সাথে ভিটামিন সরবরাহ করতে হবে। চৈত্র মাসে বেশ গরম পড়ে, তাই গবাদিপশুর এ সময় বিশ্রাম দিতে হবে। আপনার গবাদিপশুকে ছায়ায় রাখতে হবে এবং বেশি বেশি পানি খাওয়াতে হবে, সে সাথে নিয়মিত গোসল করাতে হবে। গবাদিপশুর গলাফুলা, তড়কা, বাদলা রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
মাছের আঁতুর পুকুর তৈরির কাজ এ মাসে শেষ করতে হবে। পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলে নিচ থেকে পচা কাদা তুলে ফেলতে হবে এবং শতাংশপ্রতি ১ কেজি চুন ও ১০ কেজি গোবর বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করতে হবে। পানি ভর্তি পুকুরে প্রতি শতাংশে ৬ ফুট পানির জন্য ১ কেজি চুন গুলে ঠাণ্ডা করে দিতে হবে।
সুপ্রিয় পাঠক প্রতি বাংলা মাসেই কৃষিকথায় কৃষি কাজের জন্য অনুসরণীয় শিরোনামে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়ে থাকে। এগুলোর বিস্তারিত ও তথ্যবহুল বিশ্লেষণের জন্য আপনার কাছের কৃষি বিশেষজ্ঞ, মৎস্য বিশেষজ্ঞ ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে জেনে নিতে হবে। এছাড়া কৃষি বিষয়ক যে কোনো সমস্যায় আপনার মোবাইল থেকে ১৬১২৩ নম্বরে কল করে নিতে পারেন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। আপনাদের সবাইকে নববর্ষের অগ্রিম শুভেচ্ছা।
(১৫ মার্চ-১৩ এপ্রিল)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪, মেইল: editor@ais.gov.bd
কৃষি বিষয়ক
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরন করুন।
মোছাঃ নাঈমা সুলতানা, গ্রাম: পায়রাবন্দ, উপজেলা: মিঠাপুকুর, জেলা: রংপুর
প্রশ্ন: গমের ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়?
উত্তর: গমের শীষ বের হওয়ার সময় ১ বার এবং ১২ থেকে ১৫ দিন পর আরেকবার প্রতি শতক জমিতে ৬ গ্রাম নাটিভো ৭৫ ডব্লিউ জি অথবা নভিটা ৭৫ ডব্লিউ জি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতক জমিতে ভালোভাবে স্প্রে করতে হয়। এতে শুধু ব্লাস্ট রোগকে রোধ করে না। বরং গমের পাতা ঝলসানো রোগ, বীজের কালো দাগ এবং মরিচা রোগও দমন হয়। আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, সেটি হলো ছত্রাকনাশক স্প্রে করার সময় অবশ্যই হাতে গ্লাবস ও মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। যাতে ছত্রাকনাশক শরীর ও শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবশ করতে না পারে। ।
মো. করিম আহমেদ, গ্রাম: তাম্বুলখানা, উপজেলা: ফরিদপুর সদর, জেলা: ফরিদপুর
প্রশ্ন: মসুরের জাবপোকা দমনে কী করণীয়? জানাবেন।
উত্তর: জাবপোকা মসুরের পাতা, কাণ্ড, ফুল ও ফলে আক্রমণ করে। আর সেগুলো থেকে রস চুষে খায়। এতে করে গাছের বাড়বাড়তি কমে যায়। ফলনও আশানুরূপ হয় না। এ সমস্যা দূরীকরণে ডায়মেথয়েট জাতীয় কীটনাশক যেমন টাফগর ৪০ ইসি বা অন্য যেকোন ডায়মেথয়েট গ্রুপের কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে উপকার পাবেন।
সুমন মজুমদার, গ্রাম: নারায়ণপুর, উপজেলা: কেশবপুর, জেলা: যশোর
প্রশ্ন: ছোলা গাছের গোড়া পচা রোগ দমনে কী করতে হবে? জানাবেন।
উত্তর: স্কে¬রোশিয়াম রলফসি নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে। এ রোগে শিকড় ও কাণ্ডের সংযোগস্থলে কালো দাগ পড়ে। গাছ টান দিলে সহজেই উঠে আসে। মাঠে ঢলে পড়া রোগ দেখা দিলে কার্বেনডাজিম গ্রুপের ব্যাভিস্টিন বা নোইন এবং প্রোভেক্স ২০০ ডব্লিউ পি ১ গ্রাম হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে বিকালে গাছের গোড়ায় ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। তাহলে আপনি উপকার পাবেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে পরের বছরে রোগ প্রতিরোধী জাত বারি ছোলা ৫ এবং বারি ছোলা ৯ চাষ করা, সুষম সার প্রয়োগ এবং বীজশোধন করা এসব ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই আপনি উল্লিখিত এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন।
মো. খাইরুল আলম, গ্রাম: এলাইগা, উপজেলা: পীরগঞ্জ, জেলা: ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন: কচু গাছের পাতা ঝলসানো রোগ দমনে কী করণীয়?
উত্তর: এ রোগের সবচেয়ে বড় উৎস হলো আক্রান্ত বীজ। কারণ সাধারণত বীজে এ রোগের মাইসেলিয়াম থাকে। সে কারণে সুস্থ বীজ ব্যবহার করা জরুরি। কচু গাছের রোগে আক্রান্ত পাতা ছেটে ফেলা এবং ফসল সংগ্রহের পর জমিতে থাকা করম ও পাতা ধ্বংস করতে হবে। আর জমিতে রোগ দেখা দিলে ছত্রাকনাশক যেমন সিকিউর/ডায়থেন এম ৪৫ বা রিডোমিল গোল্ড নামক ছত্রাকনাশক ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে নিয়মমাফিক স্প্রে করলে এ রোগ দমন করা যাবে। আশাকরি এসব ব্যবস্থা নিলে আপনার সমস্যার সমাধান হবে।
ঝর্ণা বেগম, গ্রাম: ভাণ্ডারদহ, উপজেলা: পাটগ্রাম, জেলা: লালমনিরহাট
প্রশ্ন: গাঁদা ফুল পচা সমস্যায় কী করব?
উত্তর: গাঁদা ফুলে ছত্রাকের আক্রমণের কারণে ফুল পচা রোগ হয়। পাপড়ির ভাঁজে ভাঁজে ছত্রাকের অগণিত স্পোর দেখা যায়। ফলে পুরো ফুলটি কালো হয়ে পচে যায়। ইপ্রোডিয়ন গ্রুপের যেমন রোভরাল প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর স্প্রে করলে এ রোগ দমন করা যায়।
সাহেব আলী, গ্রাম: বিষ্ণুগ্রাম, উপজেলা: পাইকগাছা, জেলা: খুলনা
প্রশ্ন: বাণিজ্যিকভিত্তিতে সজিনা কাটিং লাগানোর নিয়ম সম্পর্কে জানাবেন।
উত্তর: বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাগান করার ক্ষেত্রে ৪ মিটার ী ৪ মিটার দুরত্বে ষড়ভূজ পদ্ধতিতে রোপন করা দরকার। সেজন্য জমি ভালোভাবে চাষ করে ৫০ সে.মি. ী ৫০ সে.মি. ী ৫০ সে.মি. আকারের গর্ত তৈরি করতে হয়। তারপর সজিনার কলম চারা লাগানোর ২০-৩০ দিন আগে প্রতি গর্তে ৪০ কেজি পচা গোবর, ৫০ গ্রাম করে ইউরিয়া, টিএসপি. ও এমওপি. ১০০ গ্রাম এবং জিপসাম, বোরাক্স ও জিঙ্ক সালফেট ১০ গ্রাম দিতে হয়। এরপর গর্তের মাটি উপরে-নীচে ভালোভাবে মিশিয়ে রেখে দিতে হবে। পরবর্তীতে সার দেওয়ার ২০-৩০ দিন পরে গাছ লাগাতে হবে। এছাড়া রাসায়নিক সার না দিয়ে প্রতি গর্তে ৪০-৫০ কেজি পঁচা গোবর সার গর্তের মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে উক্ত গর্তে সাথে সাথে গাছ লাগানো যায়। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে, কাটিং গর্তে লাগানোর সময় প্রতিটি কাটিং এর তিন ভাগের এক ভাগ গর্তের মাটির নিচে রাখতে হবে। কাটিং লাগানোর সময় গর্তের মাটির সাথে ৩/৪টি নিম পাতা এবং ১০ গ্রাম সেভিন ৮৫ ডব্লিউপি গর্তের মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে কাটিং লাগালে মাটিতে পোকা-মাকড়েরর আক্রমণ কম হয়। গর্তে কাটিং লাগানোর পর কাটিং এর মাথায় আলকাতরা দিয়ে দিতে হবে কারণ এতে করে সজিনা কাটিং এর মাথা শুকিয়ে যাবে না।
মৎস্য বিষয়ক
মো: পারভেজ, গ্রাম: বারইখালি, উপজেলা: মাগুরা, জেলা: মাগুরা
প্রশ্ন: মাছ বড় হচ্ছে না। কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে?
উত্তর: হ্যাচারি বা যে কোন উৎস থেকে অপরিপক্ব বা পুষ্টিহীন বা খারাপ মানের পোনা আনলে বা পুকুরে মাছের পোনা বেশি ঘনত্ব ছাড়লে এ সমস্যা হতে পারে। তাই পোনা সংগ্রহের আগে পোনার গুণগত মান সর্ম্পকে খোঁজ নিয়ে বিশ^স্ত কোন হ্যাচারি থেকে সংগ্রহ করতে হয়। তবে দৈনিক সম্পূরক খাদ্য অর্থাৎ মানসম্পন্ন খাবার দিলে, সার প্রয়োগ করলে এবং পানি ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো করতে পারলে এ সমস্যার সমাধান হয়। মাছের ঘনত্ব বেশি থাকলে কমিয়ে দিতে হবে। শতকপ্রতি ৪০ থেকে ৫০টি মাছ যেমন মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে সিলভার কার্প, কাতল/বিগহেড শতকপ্রতি ২০টি, রুই ১২টি, মৃগেল/মিরর কার্প/কার্পিও ১০টি, গ্রাসকার্প ২টি, সরপুটি ৬টি পুকুরে ছাড়া যেত পারে। পুকুরে মাছের মোট ওজনের ৩% থেকে ৫% হারে সম্পূরক সুষম খাদ্য প্রতিদিন প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরের পানি ঘোলা হলে শতকপ্রতি চুন ০.৫ কেজি এবং ইউরিয়া সার শতকপ্রতি ১০০ গ্রাম হারে দিতে হবে। তবেই আপনি লাভবান হবেন।
মো. ফারাবি, গ্রাম: উত্তর চরটিটিইয়া, উপজেলা: বরহানুদ্দিন, জেলা: ভোলা
প্রশ্ন: পুকুরে পাঙ্গাস মাছ হঠাৎ মারা যাচ্ছে। কী করব?
উত্তর: সাধারণত গ্যাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত কারণে মাছ মারা যায়। পুকুরে মাছের ঘনত্ব কমিয়ে দিতে হবে। কারণ অনেক সময় মাছের ঘনত্ব বেশি হলে অক্সিজেন স্বল্পতার কারণেও মাছ মারা যায়। সেজন্য হররা টেনে দিতে হবে। সম্ভব হলে পানি ঢুকাতে হবে। জিওলাইট ২৫০ গ্রাম প্রতি শতকে দিতে হবে। অক্সিটেট্রাসাইক্লন ১০ মিলিগ্রাম ১ কেজি খাবারের সাথে মিশিয়ে ৭ দিন পরপর ৩ বার দিলে ভাল ফল পাওয়া যায়। পুুকরের পাড়ে যদি বড় গাছ থাকে তাহলে গাছের ডাল ছেঁটে দিতে হবে যাতে করে পাতা পুকুরে না পড়ে। তাছাড়া পুকুরের চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। পুকুরে যাতে পর্যাপ্ত সূর্যেও আলো পৌঁছাতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। এসব ব্যবস্থা নিলে আপনি উপকার পাবেন।
প্রাণিসম্পদ বিষয়ক
সজীব সরকার, গ্রাম: মদনপুর, উপজেলা: চাঁদপুর সদর, জেলা: চাঁদপুর
প্রশ্ন: আমার ভেড়ার বয়স ২ বছর। ভেড়ার মুখে, পায়ে ও দুই ক্ষুরের মাঝে ফোস্কা পড়েছে। জ¦র হয়েছে এবং মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। এঅবস্থায় কী করণীয়?
উত্তর: ফিটকিরি বা পটাশের পানি দিয়ে আক্রান্ত ভেড়ার মুখ ও পায়ের ঘা ধুয়ে দিতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিহিস্টামিন ও ব্যথানাশক ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে সুস্থ অবস্থায় ভেড়াকে নিয়মিত টিকা প্রদান করতে হবে।
সাইদুর রহমান, গ্রাম: বড়বাড়িয়া, উপজেলা: চারঘাট, জেলা: রাজশাহী
প্রশ্ন: আমার ছাগলের ২ মাস গর্ভকালীন সময়ে গর্ভপাত ঘটেছে। কী করণীয় ?
উত্তর: অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা করে অনেক সময় সুফল পাওয়া যায়। তবে আক্রান্ত ছাগলকে পাল থেকে সরিয়ে দেওয়াই উত্তম।
(মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক প্রশ্ন কৃষি কল সেন্টার হতে প্রাপ্ত)
কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন
উপপ্রধান তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল নং ০১৭১১১১৬০৩২, ঃ taufiquedae25@gmail.com
বাঙালীর ভোজন বিলাসিতার পৃথিবী জুড়ে খ্যাতি রয়েছে। এই ভোজন বিলাসিতার নানাবিধ মসলার সমন্বয়ে রন্ধনশৈলীর উপস্থাপনা যে কোন মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় যে হারে মসলার ব্যবহার করে থাকি বিশ্বের অন্যান্য দেশে তা লক্ষণীয় নয়। আবার খাবারকে রুচিশীল ও মুখরোচক করতে মসলার বিকল্প হয় না। পেঁয়াজকে শুধু মসলা বললে ভুল হবে। কারণ পেঁয়াজ একাধারে মসলা এবং সবজিও বটে। ভাতের সঙ্গে খালি পেঁয়াজ, ছালাদ ও ঝাল মুড়িতে কাঁচা পেঁয়াজ এবং আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা, ডিম ভর্তা, শুঁটকি ভর্তা এমনকি ডিম ভাজিতেও এর ব্যবহার সমাদৃত। তাছাড়া অধিক হারে পেঁয়াজ ব্যবহার করে মসলা হিসেবে বেটে পেস্ট বানিয়ে ব্যবহার তরকারিকে সু-স্বাদু ও রসালুতে পরিণত করে। পেঁয়াজ পাতায় বেশি পরিমাণে ভিটামিন এ থাকে। তাই পাতা সবজি হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া পেঁয়াজের ডাটা ও পাতা ভিটামিন সি ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ। পেঁয়াজ ব্যবহৃত খাবার দ্রুত হজমকারক ও রুচিবর্ধক।
বাংলাদেশে সাধারণত ৩টি পদ্ধতিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়-
১. জমিতে সরাসরি বীজ বপন করে,
২. কন্দ/বাল্ব সরাসরি রোপণ করে,
৩. বীজতলা থেকে তৈরি চারা সংগ্রহ করে অন্যত্র রোপণ করে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কৃষি আবহাওয়া আর বাংলাদেশের কৃষি আবহাওয়া এক নয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেমন ভারত, উজবেকিস্তান, মিসরসহ আরো কিছু দেশে ২-৩ ও খরিপ মৌসুমে পেঁয়াজ চাষ হয়। কিন্তু আমাদের দেশে রবি মৌসুমে পেঁয়াজ চাষ হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছে ২৩.৩০৫ লক্ষ মে.টন। সনাতনী পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করায় প্রতি বছর উৎপাদন থেকে সংরক্ষণ পর্যায়ে মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০-৩৫% পেঁয়াজ বিভিন্ন উপায়ে নষ্ট হয়। সে হিসাবে ৭.০০-৮.১৫ লক্ষ মে.টন পেঁয়াজ নষ্ট হয়। পেঁয়াজ সংগ্রহের/উঠানোর উপযুক্ত সময় হল লেট ফেব্রুয়ারি- মার্চ মাস। তাছাড়া এ বছর লেট ফেব্রুয়ারি- মার্চ মাসে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হওয়ায় নিচু ও মাঝারি নিচু, মাঝারি উঁচু জমির পেঁয়াজে অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে পানি জমে যায়। ফলে ভেজা পেঁয়াজ জমি হতে উত্তোলন করতে হয়। এতে পেঁয়াজে জলীয় অংশের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে সংরক্ষণকালীন সময়ে পেঁয়াজের একটি বড় অংশ দ্রুত পচে নষ্ট হয়ে যায়। এই দ্রুত পচে যাওয়ার পরিমাণ যদি ৫% হয় তাহলে আরো প্রায় ১.১৬ লক্ষ মে.টন পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। তাহলে মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ হয় ১৪.০০-১৪.৮৪ লক্ষ মে.টন। কিন্তু আমাদের দেশে পেঁয়াজের মোট চাহিদা রয়েছে ২৪-২৫ লক্ষ মে.টন। ফলে বর্তমান অর্থবছরে প্রায় ১০-১১ লক্ষ মে.টন পেঁয়াজের ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র মতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০.৯১ লক্ষ মে.টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ২.৩০ লক্ষ মে.টন পেঁয়াজ ইতোমধ্যে আমদানি হয়েছে।
পেঁয়াজ পচে যাওয়ার ভয়ে চাষিরা ভরা মৌসুমেই কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করেছে। এ কারণে মৌসুম পরবর্তী সময়ে চাহিদার তুলনায় দেশিয় পেঁয়াজ কম পরিমাণে সংরক্ষিত ছিল। ফলে বর্তমানে দেশিয় পেঁয়াজ কৃষকের নিকট সংরক্ষিত নেই বললেই চলে। কিছু মুনফাভোগীদের নিকট অল্প পরিমাণে পেঁয়াজ সংরক্ষিত আছে এবং তারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বেশি মুনাফার বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করছে। একদিকে যেমন কৃষক তার ন্যায্যমূল্য পায়নি এবং ভোক্তাও ন্যায্যমূূল্যে এ মসলাটি ক্রয় করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এজন্য সরকারের উচিত এই পচনশীল দ্রবটি সারা বছর সংরক্ষণের জন্য প্রতিটি জেলায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অধীন কোল্ডস্টোরেজ করে কৃষকের উৎপাদিত পেঁয়াজের সংরক্ষণ করা এবং অমৌসুমে ভোক্তার নিকট ন্যায্যমূল্যে বিতরণ করা এবং পেঁয়াজ চাষিদের তালিকা প্রণয়নপূর্বক প্রণোদনা প্রদান এবং চাহিদাভিত্তিক এ সকল ফসলের আবাদ নিশ্চিত করা।
সে হিসেবে শুধুমাত্র রবি মৌসুমে পেঁয়াজ চাষাবাদ করে বাড়তি ১০-১১ লক্ষ মে.টন উৎপাদন করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) বর্ষা মৌসুমে পেঁয়াজ আবাদের জন্য ৩টি জাত অবমুক্ত করেছে। সেগুলো হলো বারি পেঁয়াজ ২, বারি পেঁয়াজ ৩, বারি পেঁয়াজ ৫। এই জাতগুলো ফেব্রুয়ারি মাসে বীজতলায় বপণ করে মার্চ মাসে মূল জমিতে রোপণ করে জুন-জুলাই মাসে সংগ্রহ করা যায়। আবার জুলাইতে বীজতলায় বপণ করে আগস্ট মাসে মূল জমিতে রোপণ করে নভেম্বর মাসে সংগ্রহ করা যায়। এ জন্য বর্ষামৌসুমে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আবাদ সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ করতে হবে। কিন্তু এ সময় বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ায় ও তাপমাত্রা বেশি থাকায় সময়োপযোগী জাত অবমুক্ত করতে হবে। তাহলে সংগ্রহোত্তর ও সংরক্ষণকালীন অপচয় বাদ দিয়ে অতিরিক্ত প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানো সম্ভবপর হবে।
বিগত ৫ (২০১৫-২০১৯) বছরে সর্বোচ্চ পেঁয়াজ আবাদকৃত ৫টি জেলার গড় বৃষ্টিপাতের তথ্য:
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত কন্দ পেঁয়াজ আবাদ হয়েছিল ২৭৭৩৫ হেক্টর কিন্তু বর্তমান অর্থবছরে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত আবাদ হয়েছে ২২৪৩৮ হে.। সে অর্থে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল এবং রবি মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টিপাতের কারণে কন্দ পেঁয়াজ আবাদ দেরিতে শুরু হয়েছে। বাজারে সাধারণত লেট নভেম্বর থেকে মুড়ি/কন্দ পেঁয়াজ উঠতে শুরু করে। কিন্তু এবার একটু বিলম্ব হওয়ার কারণে নতুন পেঁয়াজের সরবরাহ না থাকায় দাম বাড়ার একটি কারণ ।
আমাদের দেশে সাধারণত পেঁয়াজের স্থানীয় জাত যেমন তাহেরপুরী, ফরিদপুরী, ঝিটকা বীজ ব্যবহৃত হয়। এগুলো জাতের গড় ফলন ৭-১০ মে.টন/হে.। মেহেরপুর জেলায় ভারতের সুখ সাগর জাতের পেঁয়াজ আবাদ হয়। এর গড় ফলন ৩৫-৪০ মে.টন/হে.। কিন্তু এজাতের পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা কম থাকায় জাতটি কৃষক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর মধ্যে লালতীর সীড লিমিটেডের কয়েকটি পেঁয়াজের জাত যেমন লালতীর কিং, লালতীর হাইব্রিড এবং লালতীর ২০ জাতটি রয়েছে। এগুলোর ফলন ১২-১৫ মে.টন/হে.। এদের সংরক্ষণ ক্ষমতা দেশি জাতের সংরক্ষণ ক্ষমতার চাইতে কম। এ কারণে এই উন্নত জাতগুলোও যথাযথভাবে সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ হচ্ছে না। তবে অনেকাংশেই এই জাতগুলো সম্প্রসারণ হচ্ছে।
গত ৫ বছরে পেঁয়াজের মোট আবাদকৃত জমি, উৎপাদন ও গড় ফলনের তথ্য:
ডিএই এর তথ্য মতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের পেঁয়াজের মূল্য কম হওয়ার কারণে ২০১৮-১৯ এ আবাদ কম হয়েছে। পেঁয়াজ উচ্চমূল্যের মসলাজাতীয় ফসল। সাধারণত স্থানভেদে ১ একর পেঁয়াজ আবাদ করতে প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। সংগ্রহোত্তর মৌসুমে ১ একর পেঁয়াজ থেকে প্রায় ৮০-৮৫ হাজার টাকা পাওয়া যায়। তবে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা গেলে অফ মৌসুমে আরো বেশি মুনাফা সংগ্রহ করা যায়। পেঁয়াজ সংরক্ষণ ব্যবস্থা উন্নত হলে চাষিরা পেঁয়াজ চাষে উৎসাহিত হবে। সে ক্ষেত্রে কৃষকরা সংরক্ষণের মাধ্যমে উচ্চমূল্য পাবে এবং আবাদের পরিমাণ বাড়াতে বেশি বেশি উৎসাহবোধ করবেন।
সংরক্ষণ পদ্ধতি
পেঁয়াজ ভালো করে শুকানোর পর গুদামজাত করতে হবে। গুদাম ঘর ঠাণ্ডা ও বায়ু চলাচলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাযুক্ত হতে হবে। মাঝে মাঝে গুদাম ঘর পরীক্ষা করে পচা ও রোগাক্রান্ত পেঁয়াজ বেছে সরিয়ে ফেলতে হবে। ঠাণ্ডা গুদাম ঘরে তাপমাত্রা হতে হবে ৩৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট এবং ৬৪% আর্দ্রতাযুক্ত হতে হবে। কাঁচা পেঁয়াজ কাগজের ব্যাগে ছিদ্র করে রেখে ৩ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। তবে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য আধুনিক উন্নত পদ্ধতি হলো ‘জিরো এনার্জি স্টোরেজ’ পদ্ধতি। মূলত বাঁশ ও কাঠ দিয়ে ওই স্টোরেজ তৈরি করা হয়। দু’পাশের অংশে এক ধরনের ওষুধ দিয়ে শোধন করে নেওয়া হয়। তার পরেই সেখানে পেঁয়াজ রাখা হয়। সে ক্ষেত্রে পেঁয়াজ দীর্ঘ দিন সংরক্ষণ করা যাবে এবং পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
সুপারিশ
* আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও সংরক্ষণ করা।
* সংগ্রহোত্তর ও সংরক্ষণকালীন অপচয় ৫% এর নিচে
নামিয়ে আনতে হবে।
* উৎপাদন/ভরা মৌসুমে কৃষককে ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি
নিশ্চিত করতে হবে।
* বর্ষামৌসুমে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আবাদ সম্প্রসারণ
ও জনপ্রিয়করণ করতে হবে।
* উন্নত ও ভালো গুণাগুণ সম্পন্ন বীজ ব্যবহার করতে
হবে।
কৃষিবিদ হুমায়ুন কবীর
ডালেরপুষ্টি
মুহাম্মদ মালেক হুসাইন
ডাল ফসলে আছে পুষ্টি
দূর হবে সকল অপুষ্টি।
যদি চান এ দেশের পুষ্টি নিরাপত্তা
বাড়ান ডাল ফসলের উৎপাদন, ভক্ষণ ও উৎকর্ষতা।
আছে কৃষি গবেষণার ডালের জাত বায়োফর্টিফাইড
অধিক আয়রন ও জিংক মিলে দিবে রোগের বিরুদ্ধে ফাইট।
ডালে আছে উচ্চ মাত্রার দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় আঁশ
শরীরে গ্রহণ করলে প্রয়োজনীয় মাত্রার আঁশ,
নিবেন সুস্থ শ্বাস।
অদ্রবণীয় আঁশের রয়েছে কর্মক্ষমতা
দূর করবে সকল কোষ্ঠ কাঠিন্যতা।
দ্রবণীয় আঁশ দূর করে রক্তের কোলেস্টোরল
হৃৎপিণ্ড তথা হার্ট ও লিভার থাকবে সুস্থ সবল।
কাজেই বেশি করে ডাল খাই
সুস্বাস্থ্য, পুষ্টি ও সুস্থতা বাড়াই।
প্রতিদিনের খাদ্যে থাকুক ডালের বিভিন্ন পদের খাবার
বাঙালীয়ানা খাদ্যাভ্যাস জেগে উঠুক আবার।
ডালের অধিক পুষ্টি ও আমিষ যদি চাই
বিভিন্ন ধরনের ডাল মিলে মিশে খাই।
চাষির প্রেরণা
মো: জুন্নুন আলী প্রামাণিক
হিমেল হাওয়া লুকায় শূন্যে গরম বাতাস বয়,
কৃষক এখন মাঠের মাঝে ঘরের ভিতর নয়।
চাষের দায়িত্ব মাথায় নিয়ে অনেক ভাবনা তার,
ফসলে উদিত লক্ষণ দেখে ঘুচায় দুঃখ ভার।
বাড়ন্ত বোরোর আজব গতি অন্তরে আশার সুখ,
খরার মৌসুমে যান্ত্রিক সেচে চাষির উজ্জ্বল মুখ।
অনেক প্রকার ধানের ক্ষেতে নজর ফিরায় ঘুরে,
উন্নত জাতের ফলন মেলা অবশ্য কাটার পরে।
সময়মাফিক সেবার দ্বারা প্রচুর ফসল আসে,
খেয়াল খুশির সুযোগ নেই নিয়ম মানার চাষে।
অবস্থা মতন ব্যবস্থা নিতে হয় না চাষির দেরি,
সোনার ফসল উঠলে যাবে বাড়ির উঠান ভরি।
নীরব মাটিতে ছড়িয়ে আছে বিচিত্র ফসল যত,
কলাই পাকার সাথেই গম সুমিষ্ট কুমড়া শত।
পিয়াজ রসুন কাউন চীনাবাদাম ক্ষেতের ভারে,
সাজানো সকল ফসল মেলা কৃষক রয়েছে ধারে।
বিচিত্র চাষের আসরে পাট চাষের কল্পনা করে,
চাষের উপর চাষের দ্বারা জমির উদর খুঁরে।
করলা পটোল টমেটো শসা চিচিঙ্গা ঢেঁড়স ঝিঙা,
কাঁচায় পাকায় রঙের ছটা টমেটো বেজায় রাঙ্গা।
শাকের অভাব হয় না মোটে প্রত্যেক মাসেই শাক,
প্রকৃতি নিঝুম নীরব ক্ষণে কোকিল পাখির ডাক।
বাড়তি রোদের প্রভাব পড়ে ফসল ক্ষেতের মাঝে,
ধানের থোড়ের মাথায় শিষ সকাল বিকাল সাঁঝে।
বোরোর অধিক ফলন হলে চাষির দুঃখ কাটে,
ফসল তোলার আনন্দে মেতে নতুন প্রেরণা জোটে।
১বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ডাল গবেষণা উপকেন্দ্র, বারি, গাজীপুর, ০১৯১৫৮৫৬৪০৪, ২ গ্রাম : বিদ্যাবাগীশ, ডাকঘর ও উপজেলা : ফুলবাড়ী, জেলা : কুড়িগ্রাম, মোবাইল : ০১৭৩৫২০২৭৯৮
বাংলাদেশে ডিজিটাল কৃষির প্রবর্তন কাজটি কয়েক দশক আগেই শুরু হয়েছে। দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহের আলোকে একাধিক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ডিজিটাল কৃষি পদ্ধতি প্রচলনের জন্য যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও আইটি বিষয় প্রবর্তনের জন্য প্রচন্ড চাপ রয়েছে। প্রাসংগিক এসব কারণে কৃষিবিদ হিসাবে আমার আগ্রহ সৃষ্টি হলে আমি টিভিসহ স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি কোর্সসমূহের ডিজিটাল রূপান্তরের জন্য দশকব্যাপী সংগৃহিত ও নিজের তৈরি আইটি সামগ্রী বিশ্লেষণ করার প্রয়াশ নেই। দেশের প্রায় ৮-১০টি টেলিভিশন চ্যানেলের ১৫-২০ মাসের বিভিন্ন প্রোগ্রাম প্রায় ৭ হাজার গিগাবাইট চিএ ও ভিডিও তথ্য বিশ্লেষণ করে যে চিত্র পাওয়া গেছে তাতে বলা যায় কৃষি অনুষ্ঠান প্রচারে সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রাধান্য রয়েছে। পাশাপাশি পর্যায়ে রয়েছে চ্যানেল আই। কৃষি অনুষ্ঠান স্পন্সরের অভাবে বেসরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে প্রচার কম বলে জানা গেছে টেলিভিশনভিত্তিক প্রাপ্ত বিশ্লেষিত তথ্য (চিএ ১ ও ২) পর্যালোচনাতে। দেশের কৃষির উন্ন্য়নের সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে এই নিবন্ধে উল্লেখ করা হলো।
বাংলাদেশের কৃষির প্রধান প্রধান চালিকা প্রতিষ্ঠান হলো কৃষি সম্প্রসারণ, উন্নয়ন ও গবেষণা অধিদপ্তরসমূহ। এর মধ্যে বিগত প্রায় অর্ধদশকে দেশের প্রায় ৮-১০টিভি চ্যানেলে যে সব প্রোগ্রাম করা হয়েছে তার কৃষি বিভাগ-অঞ্চলভিত্তিক ও বিষয়ভিত্তিক তথ্য ২টি পাইগ্রাফ চিত্রে উপস্থাপন করা হলো। প্রথম চিত্রে দেখা যাবে যে সবচেয়ে বেশি টেলিভিশন প্রোগ্রাম হয়েছে ঢাকা অঞ্চলে (২৫%), দ্বিতীয় যশোর (১৮%)। এর কারণ বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে তা কিন্তু কৃষির জন্য তেমন আশাপ্রদ নয়।
ঢাকায় টেলিভিশন প্রোগ্রাম বেশি হওয়ার কারণ রাজধানীভিত্তিক সরকারি-বেসরকারী নন-টেকনিক্যাল প্রদর্শনীমূলক প্রোগ্রাম, টেলিভিশন টিম ঢাকার বাইরে যেতে চায় না। তাই যা এদের অধিকংশ প্রোগ্রামই কৃষকের সরাসরি তেমন কাজে আসে না।
দ্বিতীয়ত: যশোর অঞ্চলে টেলিভিশন প্রোগ্রাম বেশি (১৮%) হওয়ার কারণ এলাকাটি অনেক বড়, ৭টি জেলা। এর মধ্যে ঝিনাইদা ও মেহেরপুর এই ২টি জেলাতেই প্রায় ১১%, অন্যান্য ৫ জেলা মিলে মাত্র ৭%। অঞ্চল ভিত্তিতে টেলিভিশন প্রোগ্রাম সবচেয়ে কম ২% করে সিলেট, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও রাংগামাটি। বিগত ২-৩ দশকে ডিজিটাল কৃষির জন্য যে পরিমাণ কর্মসূচি-ব্যয় আগ্রহ দেখানো ও প্রচার করা হয়েছে তার বিপরীতে এই প্রাপ্তি যথেষ্ট নয়। এ জন্য টিভি অনুষ্ঠান বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। প্রতিটি কৃষি অঞ্চলে প্রতিটি বড় চ্যানেলের কৃষি সম্প্রসারণ ইউনিট থাকতে হবে। বিশেষ করে ফসলের রোগ-পোকা দমন বিষয়ে সঠিক টেকনিক্যাল ও কারিগরি দিকসমূহ বিবেচনায় রেখে অব্যাহত রিপোর্টিং করতে হবে। বর্তমানে অঞ্চলভিত্তিক রিপোর্টিং এ বিশেষ করে পেষ্টিসাইড প্রেসক্রিপশনে নন-কৃষি গ্রাজুয়েট ব্যাক্তিকেও অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় যা দেশের বর্তমান পেষ্টিসাইড আইনের অনুক‚লে নয়।
উপস্থাপক কৃষিবিদ হলে তিনি প্রকৃত সমস্যা উল্লেখ করে প্রশ-উত্তর ব্যাখ্যা করতে পারেন। দেশের অনেক গ্রামীণ অঞ্চলে বলতে শুনা যায যে ‘ব্যাপক পোকার আক্রমণ, অথচ রোগের ঔষধ ছিটিয়ে কোন কাজ হচ্ছে না বা কৃষি বিভাগ উদ্যোগ নিচ্ছে না। ইত্যাদি গয়রহ ভাষা তো আছেই। এখানে উল্লেখ করা যায় যে এলাকাভেদে যেমন খুলনা অঞ্চলে উপপরিচলকগণ এবং রাংগামাটিতে কৃষি তথ্য সার্ভিসের আঞ্চলিক কৃষিবিদ অফিসারের টেলিভিশন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ বেশ সন্তোষজনক।
এখানে প্রদত্ত দ্বিতীয় পাইগ্রাফটিতে টেলিভিশন প্রোগ্রামের বিষয়ভিত্তিক প্রচারণার ধারা দেখানো হয়েছে। দেশের প্রায় ৮টি চ্যানেলের ২০ মাসের বিভিন্ন প্রোগ্রাম তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অনুষ্ঠান ছাড়াও রয়েছে কৃষি সংবাদ ও টক শো। টেলিভিশন প্রোগ্রামের বিষয়ভিত্তিক প্রচারণার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে সমন্বিত মিশ্র খামার ফসল (২৫%)। সবচেয়ে কম হচ্ছে ধানসহ দানা ফসল (১০%)। দ্বিতীয় বেশি প্রোগ্রাম হচ্ছে উদ্যান ফসল (২২%)। উপকরণের মধ্যে অন্যান্য উপকরণসহ পেষ্টিসাইডের প্রোগ্রাম হচ্ছে প্রায় ১৭%। নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তার জন্য পেষ্টিসাইড অনুষ্ঠান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তেল-ডাল সহ মাঠ ফসলের অনুষ্ঠান কম, প্রায় ১১%। তবে আাগের মতই প্রদর্শণী ও সভা-সম্মেলনের অনুষ্ঠান বেশি, প্রায় ১৫%।
দেশে কৃষি ফসলের গুরুত্বের নিরিখে টৈলিভিশন অনুষ্ঠানের অনুপাত বেশ বৈষম্যপূর্ণ। যেমন দেশে ধান-দানা ফসল চাষের ব্যাপকতা প্রায় ৮০% অথচ অনুষ্ঠান মাএ ১০%। অপরদিকে সমন্বিত মিশ্র খামার ফসল এলাকা ৫% এর বেশি হবে না অথচ এর অনুষ্ঠান প্রায় ২৫%। দেশের প্রায় সব ফসলের, পরিবেশের ও জনস্বাস্থ্যের জন্য পেষ্টিসাইড ব্যবহার একটি বড় ইসু। অথচ পেষ্টিসাইড অনুষ্ঠান অন্যান্য প্রধান প্রধান উপকরণ সহ মাত্র ১৭%। অনুষ্ঠানের এ অসম অনুপাতের জন্য একটি অন্যতম কারণ হতে পারে যে মিশ্র খামারজাতীয় ফসলের রিপোর্টিং এর চেয়ে উচ্চ প্রযুক্তির আধুনিক ধান বা পেষ্টিসাইডের অনুষ্ঠান অধিক জ্ঞান ও দক্ষতা সাপেক্ষ। দ্বিতীয় কারণ হিসাবে রয়েছে সরকারি অগ্রাধিকার ও দেশের কৃষি পরিস্থিতি।
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার উৎপাদন হার বাড়িয়ে ধান চাষ আরও লাভজনক করতে টেলিভিশন অনুষ্ঠানের কোন বিকল্প নাই। পেষ্টিসাইড বিষয়ক অনুষ্ঠানের একটি বড় সমস্যা হলো এর জেনেরিক নাম বলা। জেনেরিক নামে পেষ্টিসাইড সুপারিশ করলে ডিলার কোয়ালিটি ব্যতিরেকে তার সবচেয়ে বেশি লাভালাভের পণ্যগুলো কৃষককে দিয়ে দেয়, অথচ তার কাছে আরও ভালো পণ্য ছিলো। পেষ্টিসাইড প্রদানে টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ট্রেড বা সঠিক পণ্যনামে প্রেসক্রিপশন দিয়ে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। যেমন বিগত কয়েক বছর ধরে ধানের বøাষ্ট রোগ দমনের জন্য টেলিভিশনে বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ট্রুপার নামে প্রেসক্রিপশন দিয়ে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে, জেনেরিক নাম (ট্রাইস্ইাক্লাজোল) বলে তা সম্ভব ছিলো না। কারণ ট্রাইস্ইাক্লাজোলএর আরও কম কার্যকর অথচ কমিশন বেশি এমন পণ্য থাকতে পারে। একইভাবে পেঁয়াজ ও সরিষার মহামারি রোগ দমনকারী ছত্রাকনাশক জেনেরিক নামের ইপ্রোডিয়ন এর চেয়ে রোভরাল নাম জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তবে জেনেরিক নামের বদলে ট্রেড নামে বিশেষ করে ইলেকট্রোনিক মাস মিডিয়ায় পরামর্শ দিতে বেশ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। এতে অসুবিধা হয়না কারণ একাধিক কোম্পানীর পণ্যে একই ট্রেড নাম থাকার উদাহরণ রয়েছে। যেটা প্রয়োজন সেটা হল যিনি প্রেসক্রিপশন দিবেন তাকে বিভিন্ন পণ্যেও অত্যাবশ্যক গুণাবলী ও পরিস্থিতি ভিত্তিক উপযোগিতা জানতে হবে।
এলাকাভেদে সকল পর্যায়ে বিশেষ করে উপজেলা পর্র্যায়ে মহিলা কৃষিবিদ এবং উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণের অংশগ্রহণ ও তথ্যপ্রদান ও কৃষকসংলাপ বেশ সন্তোষজনক, যদিও ঢাকা রিজিয়ন ভিত্তিক বেশি। এখানে বলা দরকার যে বর্তমান লেখাটি ২০১৫-১৭ বছরের তথ্যভিত্তিতে প্রণীত। ২০১৭-১৯ বছরের তথ্যভিত্তিক লেখাটি সামনে আসছে যেখানে আরও প্রগ্রেসিভ ফলাফলের আভাস রয়েছে।
ডিজিটাল কৃষির টেলিভিশন অনুষ্ঠান প্রচারের মধ্যে সরকারি মাধ্যমগুলো ব্যাপ্তিতে বেশি হলেও এর একটি বড় সমস্যা হলো এর প্রচার সময় ঠিক থাকে না। সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন সময় যা মনে রেখে রেখে অনুষ্ঠান দেখা স¤ভব হয় না। তাই অনুষ্ঠান ঠিকই হয় তবে সে কার্য সুফলতা পায় না। কৃষকের উপযুক্ত বা অবসর সময়টি বিবেচনা করে অনুষ্ঠান সাজাতে হবে। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ও বিশেষজ্ঞের একজন কৃষিবিদ হতে হবে। এভাবে সুপারিশকৃত পদ্ধতিতে টিভি অনুষ্ঠান প্রচার করা হলে কৃষি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, সম্প্রসারণ, উন্নয়ন ও গবেষণা কাজ অনেক সাবলীলভাবে সহজে ও কম ব্যয়ে কৃষক-কৃষি উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। দেশে কম্পিউটার পদ্ধতির এ্যাপস, কল সেন্টার, প্ল্যন্ট ডক্টর কার্যক্রম, কৃষক মাঠ স্কুল কার্যক্রম সুচারুভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব। প্রতিবেশি দেশসমূহের কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন প্রোগ্রামসমূহ এভাবে এগিয়ে গিয়ে কৃষককে সহায়তা করতে পেরেছে। সুযোগ পেলে আমরাও পারবো, এ আশা রাখি।
দেশের বর্তমান কৃষি উন্নয়ন হার অব্যাহত রাখতে ডিজিটাল পদ্ধতি অবদান রেখে যাচ্ছে। উপরে বর্ণিত সমস্যা সমাধান করে বিষয়বস্তু, সময়, উপস্থাপক ও বিশেষজ্ঞের (মাঠে কর্মরত) সুসমন্বয় করে আরও অধিক সুফল অর্জন সম্ভব।
প্রফেসর ড. মো. সদরুল আমিন
কৃষি বিশেষজ্ঞ, সাবেক হা মো. দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দিনাজপুর, ই-মেইল : sadrulamin47@gmail.com, মোবা : ০১৭১৫০৫৭৫০৬
ফুলের পরাগধানী থেকে পরাগরেণু স্থানান্তরিত হয়ে ফুলের গর্ভমুণ্ডে পতিত হওয়াকে পরাগায়ন (Pollination) বলে। পরাগায়ন দুই ধরনের- (১) স্ব-পরাগায়ন (Self-pollination) (২) পর-পরাগায়ন (Cross-pollination)। স্ব-পরাগায়নের ক্ষেত্রে পরাগরেণু একই ফুলের গর্ভমুÐে অথবা একই গাছে অন্য একটি ফুলের গর্ভমুÐে পতিত হয় কিন্তু পর-পরাগায়নের ক্ষেত্রে পরাগরেণু একই প্রজাতির অন্য একটি গাছের ফুলের গর্ভমুণ্ডে অথবা একই গাছের অন্য একটি ফুলের গর্ভমুÐে পতিত হয়। পরাগায়নের মাধ্যমে নিষেকের ফলশ্রæতিতেই ফুলের গর্ভাশয় ফলে পরিণত হয় এবং ডিম্বকসমূহ বীজে পরিণত হয়। সুতরাং ফল ও বীজ তৈরির জন্য পরাগায়ন অত্যাবশ্যক প্রক্রিয়া। আর এ অত্যাবশ্যক প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়ে থাকে কীটপতঙ্গ, পাখি, বিভিন্ন ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণী, বাতাস, পানি এবং মহাকর্ষীয় বল ইত্যাদি বাহকের মাধ্যমে। এসব বাহকের মধ্যে শুধু কীটপতঙ্গ দ্বারাই পরাগায়ন নির্ভর করে পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ বেশি ফসলের উৎপাদন। যার অধিকাংশই ফল, সবজি, তেল, আমিষ, নাট, মসলা, কফি এবং কোকো জাতীয় ফসল।
কীটপতঙ্গ হচ্ছে মাঠ ও উদ্যান ফসলের জন্য সবচেয়ে সাধারণ এবং কার্যকরী পরাগায়নকারী (Pollinator)। এদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মৌমাছি, মাছি, বিটল, প্রজাপতি, মথ, বোলতা ইত্যাদি।
গবেষণায় দেখা যায়, শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি পুষ্পধারণকারী উদ্ভিদের পরাগায়ন নির্ভর করে কীটপতঙ্গ তথা বিভিন্ন প্রজাতির মধু সংগ্রহকারী মাছির ওপর। পৃথিবীতে ২৫০০০ এর বেশি প্রজাতির মধু সংগ্রহকারী মাছি আছে। যার মধ্যে রয়েছে মৌমাছি, ভ্রমর, স্টিংলেস-বি, সলিটারি-বি ইত্যাদি।
আবার এই মাছিগুলোর মধ্যে মৌমাছি পৃথিবীর ৭০% চাষাবাদকৃত ফসলকে পরাগিত (চড়ষষরহধঃব) করে থাকে। চাষাবাদকৃত ফসলের জন্য মৌমাছি হচ্ছে খুবই দক্ষ পরাগায়নকারী। এদের দেহের বিভিন্ন অংশ যেমন- বক্ষ, পা ইত্যাদি রোমে আবৃত যা পরাগরেণু ধারণ ও বহনের জন্য পরিবর্তিত হয়েছে এবং এরা দীর্ঘ সময় ধরে ফুলে ফুলে অবিরাম ঘুরে বেড়িয়ে পরাগায়ন ঘটাতে পারে এবং বিভিন্ন জলবায়ুতে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
সম্প্রতি বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে যে, সমগ্র পৃথিবীব্যাপীই পরাগায়নকারী কীটপতঙ্গের (চড়ষষরহধঃড়ৎ) সংখ্যা এবং বৈচিত্র্যতা কমে যাচ্ছে যা কৃষি উৎপাদন সংরক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। পলিনেটরের আবাসস্থল কমে যাওয়া, ভ‚মি ব্যবহারের পরিবর্তন, একই ফসলের চাষ (গড়হড়পঁষঃঁৎব) বৃদ্ধির প্রকটতা, আধুনিক কৃষি উপকরণ যেমন- সার, বালাইনাশকসহ রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার বৃদ্ধি ও যথেচ্ছা ব্যবহার এবং জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে তাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক কীটপতঙ্গ পলিনেটর কমে যাওয়ার একটি নির্দেশক হচ্ছে যে, প্রয়োজনীয় সব কৃষিপরিচর্যা করা সত্তে¡ও ফসলের ফলন ও গুণগত মান কমে যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে দেখা যায় যে, ভারতের হিমাচল প্রদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে, উত্তর পাকিস্তানে এবং চীনের কিছু কিছু অংশে সব কৃষিপরিচর্যা করা সত্তে¡ও ফলজাতীয় শস্য যেমন- আপেল, আলমন্ডস, চেরি এবং নাশপাতির উৎপাদন ও গুণগতমান কমে যাচ্ছে।
পলিনেটরের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন ফসলের ফলন ও গুণগতমান কী পরিমাণ কমেছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। যদিও টেকসই কৃষি উন্নয়নের জন্য বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশসহ হিমালয়ান অঞ্চলে (ভারত, পাকিস্তান, ভুটান ইত্যাদি) শস্যের পরাগায়নের জন্য নিয়ন্ত্রিত মৌমাছির ব্যবহার নেই বললেই চলে। তবে একটু সুখের কথা বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এখন কিছু ফসলের যেমন- সরিষা চাষকৃত এলাকায় এবং লিচু বাগানে নিয়ন্ত্রিত মৌচাষ কার্যক্রম খুব স্বল্প আকারে হলেও শুরু করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, হিমালয়ান অঞ্চলে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে মৌমাছি পালন করে তাদের দ্বারা পরাগায়ন ঘটিয়ে বিভিন্ন ধরনের ফলের ফলধারণ ও গুণগতমান বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ফল ঝরে পড়া কমে গেছে। উদাহরণস্বরূপ- আপেল, পিচ, পাম, সাইট্রাস, স্ট্রবেরি ইত্যাদি ফলের ফলধারণ বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে- ১০, ২২, ১৩, ২৪ এবং ১১২% এবং ফলের ওজন বেড়েছে যথাক্রমে- ৩৩, ৪৪, ৩৯, ৩৫ এবং ৪৮%। আবার দেখা গেছে, মৌমাছি পরাগায়নের দ্বারা লেবু জাতীয় ফলের রস ও মিষ্টতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের সবজি জাতীয় ফসল যেমন- বাঁধাকপি, ফুলকপি, মুলা, লেটুস ইত্যাদি ফসলের ফলধারণ বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে- ২৮, ২৪, ২৩ এবং ১২% এবং বীজধারণ বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে- ৪০, ৩৭, ৩৪ এবং ৯%। গবেষণায় আরো দেখা গেছে, নিয়ন্ত্রিত মৌমাছি পরাগায়ন তেলবীজ জাতীয় ফসল যেমন- সরিষা ও রাইজাতীয় ফসল এবং সূর্যমুখীতে জাতভেদে ২০-৪০% পর্যন্ত ফলন বৃদ্ধি করে এবং এছাড়াও বীজে তেলের পরিমাণ ও বীজের অংকুরোদগম হার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয়। মসলা জাতীয় ফসল যেমন- পেঁয়াজ বীজ, ধনিয়া, কালিজিরা, মৌরি, শলুক, ফিরিঙ্গি ইত্যাদি ফসলের ফলন গড়ে ২০-৩০% বেড়ে যায় এবং বীজের সজীবতা ও অংকুরোদগম হারও বৃদ্ধি পায়।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপ এবং জাপানে মৌমাছি একটি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। দীর্ঘ সময় থেকেই বিভিন্ন ফসল যেমন- আপেল, আলমন্ডস, নাশপাতি, পাম, কুমড়াজাতীয় ফসল এবং বিভিন্ন ধরনের চেরিতে পরাগায়নের জন্য নিয়ন্ত্রিত উপায়ে মৌমাছি ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং ফসলের উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ পরাগায়নই নিশ্চিত করে সর্বোচ্চ সংখ্যক ফলধারণ এবং সর্বোচ্চ ফলন। বিভিন্ন উৎপাদন উপকরণ যেমন- হরমোন, ভিটামিন, সার, আগাছানাশক, ছত্রাকনাশক, কীটনাশক ইত্যাদি প্রয়োগ আসলে ফসলের ফলন বৃদ্ধি করে না, যেটা করে- ফলন ঘাটতি (ণরবষফ ষড়ংং) রোধ করে মাত্র।
বাংলাদেশেও মৌমাছির চাষ করে বিভিন্ন ধরনের ফল, সবজি, তেলবীজ এবং মসলা জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- রবি মৌসুমে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে তেল জাতীয় ফসল যেমন- সরিষা চাষ হয়, মসলা জাতীয় ফসল যেমন- পেঁয়াজ বীজ, ধনিয়া, কালিজিরা, মৌরি ইত্যাদি এবং অনেক এলাকায় লিচু, কুল ইত্যাদি ফলের চাষ হয়। এসব এলাকায় সংশ্লিষ্ট ফসলের পুষ্পায়নকালে নিয়ন্ত্রিতভাবে মৌচাষ করলে একদিকে যেমন ফসলের ফলন ও গুণগতমান বৃদ্ধি পাবে অন্যদিকে উৎপাদিতমধু পুষ্টি চাহিদা পূরণে বিরাট ভ‚মিকা রাখবে বা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানসহ জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সহায়তা করবে।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে কৃষিকাজে জমি তৈরি থেকে শুরু করে ফসল সংগ্রহত্তোর বিভিন্ন কাজে মহিলারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মহিলাদের যদি মৌমাছি পালন ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত মৌমাছি পরাগায়নে সম্পৃক্ত করা যায় তাহলে একদিকে যেমন তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে অধিকতর ভালো পরাগায়নের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন ও গুণগতমান বৃদ্ধির পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তায় আরো সহায়ক ভ‚মিকা পালন করবে।
সুতরাং কৃষি উন্নয়ন প্যাকেজে মৌমাছি পরাগায়নকে ‘দ্বৈত লাভের পথ’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে অর্থাৎ একদিকে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে মধু উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি চাহিদা মেটানো। বর্তমানে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান মৌচাষকে অগ্রসর করছে কুটির শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে মধু বিক্রয়ের মাধ্যমে জনগণের আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে। কিন্তু মৌচাষকে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এগিয়ে নিতে হবে। মৌমাছিকে প্রথমেই বিবেচনা করতে হবে পরাগায়নকারী (চড়ষষরহধঃড়ৎ) হিসেবে এবং দ্বিতীয়ত বিবেচনা করতে হবে মধু উৎপাদক হিসেবে।
পরিশেষে বলা যায়, কৃষির সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে কীটপতঙ্গ পরাগায়ন তথা মৌমাছির পরাগায়নের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে এবং তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য আবাসস্থলের সংরক্ষণ, মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশকের প্রয়োগ নিরুৎসাহিতকরণ, গাছের পুষ্পায়নকালে বালাইনাশক ব্যবহার না করা, আইপিএমের বহুল প্রচার ও প্রসার, সচেতনতা বৃদ্ধি, কৃষি উন্নয়ন কর্মসূচিতে পরাগায়নের জন্য মৌচাষ কার্যক্রমকে অন্তর্ভুক্তিকরণ, নিয়ন্ত্রিত মৌমাছি পরাগায়নকে ঘিরে গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রমকে নিবেদিতভাবে হাতে নিয়ে টেকসই কৃষি উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তিত আবহাওয়ায় কৃষি উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে অবশ্যই কীটপতঙ্গ পরাগায়ন বিশেষ করে মৌমাছি দ্বারা ফসলে পরাগায়নের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে এবং এদের সংরক্ষণ, গবেষণা ও সম্প্রসারণের জন্য প্রকল্পসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যা আগামীর কৃষি উন্নয়নের টেকসই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক ভ‚মিকা পালন করবে।
ড. মোঃ আলতাফ হোসেন
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কীটতত্ত¡ বিভাগ, ডাল গবেষণা কেন্দ্র, ঈশ্বরদী, পাবনা। মোবাইল নং- ০১৭২৫-০৩৪৫৯৫, ই-মেইল : hossain.draltaf@gmail.com
পৃথিবীতে প্রায় ৪০,০০০ প্রজাতির গাছে মৌমাছি দ্বারা পরাগায়ন ঘটে। এই পরাগায়নের ফলে গাছের জীববৈচিত্র্য রক্ষা হয়। পরাগায়নে পরাগরেণুর একটি অন্যতম উপাদান, যা বাতাস বা অন্য কোন প্রাণী দ্বারা পুরুষ ফুল থেকে স্ত্রী ফুলে স্থানান্তরিত হয়। যে সকল গাছের পরাগায়ন বায়ু দ্বারা সম্পাদিত হয় সে পরাগরেণুগুলো সাধারণত খুবই ক্ষুদ্র, হালকা এবং শুষ্ক থাকে। কিন্তু যেসব গাছের পরাগায়ন পতঙ্গ দ্বারা সম্পাদিত হয় সেসব গাছের পরাগরেণু সাধারণত অমসৃণ ও আঠালো থাকে। এই অমসৃণ ও আঠালো পরাগরেণু পতঙ্গের দেহের বিভিন্ন অংশ দ্বারা স্ত্রী ফুলে স্থানান্তরিত হয়ে থাকে। কৃষিজ ফসলের শতকরা ৭০ ভাগ শুধুমাত্র মৌমাছি দ্বারা পরাগায়িত হয়।
মৌমাছির দেহ সাধারণত : অতি ক্ষুদ্র লোম দ্বারা আবৃত থাকে। মৌমাছি যখন ফুলে ফুলে বিচরণ করে তখন তাদের শরীরের ক্ষুদ্র লোম পরাগরেণু আটকিয়ে যায়। পরবর্তীতে মৌমাছি এই পরাগরেণুসমূহকে এন্টিনা দ্বারা তাদের একত্র করে বল তৈরি করে তাদের পেছনের জোড়ার পায়ে এক ধরনের বিশেষ থলেতে রাখে, যা ঢ়ড়ষষড়হ ংধপ নামে পরিচিত। এই পোলেন বল তৈরি করার সময় তারা পোলেনের সাথে এনজাইম এবং নেক্টার মিশ্রিত করে থাকে। ১টি ফ্লাইটের একটি মৌমাছি তাদের চড়ষষড়হ ঝধপ এ ১৬ থেকে ২৪ মিলিগ্রাম পোলেন বহন করে যাতে প্রায় ৩০ লক্ষ থেকে ৪০ লক্ষ পরাগরেণু থাকে। আর এই পোলেন বলের ওজন ১টি মৌমাছির শরীরে ওজনের প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ।
একটি মৌকলোনিতে পোলেন মৌমাছির (লার্ভা) বাচ্চাদের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পোলেন মূলত: প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, মিনারেল এবং অন্যান্য উপাদানের উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হয়, যা মৌমাছির জীবনচত্রæ সম্পন্ন করার জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। একটি মৌকলোনিতে বছরে ৩০-৫০ কিলোগ্রাম পোলেন এর প্রয়োজন হয়। মৌচাষিরা সাধারণত পোলেন ট্র্যাপ ব্যবহার করে ফ্রেশ পোলেন সংগ্রহ করে। তবে আমাদের দেশে এটির ব্যবহার প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন এ বিষয়ে গবেষণা করছে এবং একটি মৌকলোনি থেকে প্রতি বছর প্রায় ৫০০-৭০০ গ্রাম পোলেন উৎপাদন সম্ভব। বাংলাদেশের প্রতিটি মৌকলোনি থেকে পোলেন সংগ্রহ করলে বার্ষিক ২৫ থেকে ৩০ টন পোলেন উৎপাদন সম্ভব।
প্রাচীন গ্রিকে পোলেন বলকে মোম মনে করা হতো এবং প্রাচীন মিসরে একে জীবনদানকারী পাউডার মনে করা হতো, যা অৎরংঃড়ঃষব এর বই ঐরংঃড়ৎরধ ধহরসধষরঁস এ উল্লেখ করা হয়েছে। ঐরঢ়ঢ়ড়পৎধঃবং তার রোগীদের পোলেন খাওয়ার পরামর্শ দিতেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে পোলেন এর রোগ সারানোর ক্ষমতা রয়েছে। পোলেনের আরেক নাম হচ্ছে বি ব্রেড এবং প্রাচীনকালে একে ব্রি ব্রেডই বলা হতো। ঔড়যহ জধু তার বই ঐরংঃড়ৎরধ চষধহঃধৎঁস (১৬৮৬) এ প্রথম ঢ়ড়ষষবহ শব্দটি ব্যবহার করেন যার গ্রিক অর্থ ঋরহব চড়ফিবৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ঢ়ড়ষষবহ অত্যন্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বি পোলেন মৌমাছির পা থেকে সংগ্রহ করা ছাড়াও মৌমাছির চাক হতে সংগ্রহ করা যায়। বি ব্রেড হিসেবে মৌচাকের মধ্যে যে পোলেন থাকে তা দ্রæত নষ্ট হয় না। কিন্তু মৌমাছির পা থেকে সংগ্রহকৃত পোলেন সঠিকভাবে প্রক্রিয়া না করলে তার গুণগতমান দ্রæত নষ্ট হয়। বিশেষ করে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হয়। যেহেতু পোলেন একটি পুষ্টিমান সম্পন্ন দ্রব্য সেহেতু মানুষ এটিকে খাবার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। গাছ ভেদে পোলেন এর রং, স্বাদ এবং গন্ধ বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। পোলেনের রং সাধারণত সাদা থেকে কালো পর্যন্ত হয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হলুদ, হলদে কমলা এবং হলদে বাদামি বর্ণের হয় থাকে। স্বাদ কখনো টক, টকমিষ্টি বা তেতো হয়ে থাকে। এটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফুড সাপ্লিমেন্ট হিসাবে ব্যবহার করা হয়। পোলেনকে যত শুকানো হবে এটি ততো বেশি দিন ভালো থাকবে। ফ্রেশ পোলেন শুকানোর প্রক্রিয়া বিলম্ব হলে একে অবশ্যই ফ্রিজ বা রেফ্রিজারেটরে রাখতে হবে। খধপঃড়নধপরষষঁং এবং ইরভরফড়নধপঃবৎরঁস জেনেরা ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পোলেন এ লক্ষ্য করা যায় এবং এই ব্যাকটেরিয়া পোলেন ফার্মেন্টেশনে এ সহায়তা করে।
বি পোলেন বিভিন্ন ভাবে খাওয়া যায়। সাধারণত : এটি মধু বা রয়েলজেলির সাথে মিশিয়ে খাওয়া হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পোলেন মধু ও পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়া হয়। পোলেন পানিতে মেশালে ফুলে যায় এবং এটি সহজে হজম হয়। প্রথমবার পোলেন খাওয়ার ক্ষেত্রে আপনাকে পরীক্ষা করে নিতে হবে যে ঐ পোলেন এর প্রতি আপনার কোনো অ্যালার্জি আছে কি না। যদি অ্যালার্জি থাকে তাহলে অন্য ফুলের পোলেন খেতে হবে। যারা পোলেন সেবন করেন তার সাধারণত খাবার আধা ঘণ্টা আগে পোলেন সেবন করবেন এবং এর পরিমাণ ১ টেবিল চামচ যা প্রায় ১৫ গ্রাম এর মতো হয়ে থাকে। যারা নিরামিষভোগী তাদের খাবারে পুষ্টিমান ঠিক রাখতে অবশ্যই পোলেন সেবন করা উচিত। যেহেতু পোলেন এ ফ্লাভেনয়েড এবং ফাইটোস্টেরল থাকে যা এন্টিঅক্সিডেন্ট, এন্টিইনফ্লামেটারি হিসাবে কাজ করে সেহেতু এনেমিয়া, আর্টিওস্কেলেরোসিস, অষ্টিওপসিস এবং অ্যালার্জির চিকিৎসায় ব্যবহার করা যায়। সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে পোলেন সেবন করা উচিত। বি পোলেন মুরগি, পাখি এবং মৌমাছির ক্রান্তিকালীন খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যায়। সর্বোপরি এটি বলা যায় যে পোলেন মানবদেহের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ খাবার।
অন্যান্য উপাদান ২৯% এর মধ্যে রয়েছে : ফ্লাভেনয়েড : কমপক্ষে ৮ প্রকার। ক্যারেটিনয়েডস : কমপক্ষে ১১ রকমের। ভিটামিন যেমনÑ ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, পেনটোযিনিক এসিড, নিকোটনিক এসিড, থিয়ামিন, রিভোক্ল্যাবিন (ই২) এবং পাইরিডক্সিন (ই৬) ইত্যাদি বিদ্যমান। খনিজ পদার্থ : প্রধান উপাদান যেমনÑ ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, সালফার, ফসফরাস। গৌন উপাদানগুলো হলোÑ অ্যালুমিনিয়াম, বোরন, ক্লোরিন, কপার, আয়োডিন, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক ইত্যাদি। ফ্রি এমিনো এসিড সব ধরনের, নিউক্লিক এসিড ও নিউক্লিওসাইডস উঘঅ, জঘঅ এবং অন্যান্য। এনজাইম : একশত এর অধিক। গ্রোথ হরমোনস : অক্সিন, ব্রাসিনস, জিবেরিলন, কাইনিন এবং অন্যান্য গ্রোথ ইনহিবিটরস)।
বি পেলেন এর উপকারিতা বৈজ্ঞানিকভাবে পরিলক্ষিত হয়
* মানুষের বন্ধ্যাত্ব নিবারণে ব্যবহার করা হয়;
* যকৃতের রোগ নিরাময়ে খুবই কার্যকর;
* উচ্চ রক্তচাপ, স্নায়ু ও হরমোন সংক্রান্ত রোগে উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা রাখে;
* পরাগ অন্ত্রের ক্রিয়াকলাপের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনে;
* জৈবিক উদ্দীপক হিসেবেও কাজ করে;
* কোষ্ঠকাঠিন্যে পরাগ খুবই কার্যকরি;
* ক্ষুধা বৃদ্ধিকরণ হিসেবে কাজ করে;
* রক্তে হিমোগ্লোবিন ও লোহিতকণিকা বৃদ্ধি পায়।
ড. মোহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন
প্রফেসর, কীটতত্ত¡ বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়, মোবাইল : ০১৭৭৫৩৫৫৭৮৭, ই-মেইল :sakhawat_sau@yahoo.com
পাটের গবেষণা ও উন্নয়নে উৎকর্ষ অর্জনের রূপকল্প এবং পাটের কৃষি, কারিগরি শিল্প ও জুট টেক্সটাইল বিষয়ক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও হস্তান্তরের মাধ্যমে কৃষক ও পাটসংশ্লিষ্ট উপকারভোগীদের উপার্জন বৃদ্ধি, দারিদ্র, হ্রাস, আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং পরিবেশ রক্ষা করার অভিলক্ষ্যকে সামনে নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে অ্যাক্টের মাধ্যমে দেশের অন্যতম প্রাচীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বর্তমান বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে বিজেআরআই-এ পাটের কৃষি গবেষণা, কারিগরি গবেষণা ও জুট টেক্সটাইল গবেষণা নামে তিনটি উইংয়ের মোট ১২টি গবেষণা বিভাগ এবং পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ বিভাগসহ মোট ১৩টি বিভাগ রয়েছে। এ ছাড়াও কৃষকদের সময়োপযোগী চাহিদা ও প্রয়োজন মোতাবেক পাটের অঞ্চলভিত্তিক কৃষি গবেষণার জন্য মানিকগঞ্জে পাটের কৃষি পরীক্ষণ কেন্দ্র এবং চারটি আঞ্চলিক পাট গবেষণা কেন্দ্র এবং তিনটি পাট গবেষণা উপকেন্দ্র এবং নসিপুরে (দিনাজপুর) প্রতিষ্ঠিত একটি বীজ উৎপাদন ও গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। পাট, কেনাফ ও মেস্তা ফসলের দেশি/বিদেশি বীজ সংরক্ষণ ও উন্নত জাত উদ্ভাবনে গবেষণা কাজে ব্যবহারের জন্য তৎকালিন ইন্টারন্যাশনাল জুট অর্গানাইজেশনের আর্থিক সহযোগিতায় ১৯৮২ সালে বিজেআরআইতে একটি জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ জিন ব্যাংকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত পাট ও সমগোত্রীয় আঁশ ফসলের প্রায় ৬০০০ জার্মপ্লাজম সংরক্ষিত আছে। বিজেআরআই বর্তমানে তিনটি ধারায় তার গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে-
(১) পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন, এর উৎপাদন ব্যবস্থাপনা এবং বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত গবেষণা,
(২) পাটের শিল্প গবেষণা তথা মূল্য সংযোজিত বহুমুখী নতুন নতুন পাট পণ্য উদ্ভাবন এবং প্রচলিত পাট পণ্যের মানোন্নয়ন সংক্রান্ত গবেষণা এবং
(৩) পাটের টেক্সটাইল তথা পাট এবং তুলা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম আঁশের সংমিশ্রণে পাট জাত টেক্সটাইল পণ্য উৎপাদন সংক্রান্ত গবেষণা।
বিজেআরআাই-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
পাটের কৃষি গবেষণার মাধ্যমে উন্নত উচ্চফলনশীল পাট, কেনাফ ও মেস্তার জাত উদ্ভাবন, লবণাক্ততা, নিম্ন তাপমাত্রা সহনশীল ও আলোক অসংবেদনশীল এবং রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন, উন্নত কৃষিতাত্তি¡ক ব্যবস্থাপনা, উন্নত সার ব্যবস্থাপনা এবং পাট পচনের উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা।
পাটের শিল্প গবেষণার মাধ্যমে পাটের বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন নতুন নতুন পণ্য তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং প্রচলিত পাটজাত দ্রব্য সামগ্রীর মানোন্নয়নপূর্বক বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক পাট পণ্য উৎপাদনে পাট শিল্পকে কারিগরি সহায়তা প্রদান করা।
* পরিবর্তিত অর্থনৈতিক অবস্থায় পাটের ভ‚মিকা নিরূপণ, নবউদ্ভাবিত পাট ও পাটজাত পণ্যের অর্থনীতি ও বিপণন গবেষণার মাধ্যমে উহার গ্রহণযোগ্যতা যাচাই এবং পাটের বাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বাধাসমূহ চিহ্নিত করে তা দূর করার উপায় নির্ধারণ।
* কৃষক, প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনাবিদগণের পাটসংক্রান্ত জ্ঞান ও চিন্তাভাবনার বিনিময় এবং বিকাশের লক্ষ্যে নিয়মিত সেমিনার, কর্মশালা এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা।
* পাট ও সমশ্রেণির আঁশ ফসলের কৃষি, কারিগরি ও অর্থনৈতিক গবেষণা নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়ন ও পরিচালনা এবং আঁশজাত ফসল উৎপাদন এবং গবেষণার ফলাফল সম্প্রসারণ।
* উন্নতমানের কৌলিতাত্তি¡ক বিশুদ্ধতাসহ প্রজনন পাট বীজ উৎপাদন, সরবরাহ এবং সীমিত আকারে মান ঘোষিত (টিএলএস) উন্নতমানের পাট বীজ উৎপাদন, সংগ্রহ; নির্বাচিত চাষি, স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান এবং বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত এজেন্সির কাছে বিতরণ।
* পাট ও সমশ্রেণির আঁশ ফসল, পাটজাত পণ্য ও আনুষঙ্গিক বিভিন্ন সমস্যা সংক্রান্ত গবেষণার লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গবেষণা কেন্দ্র, উপকেন্দ্র, পাইলট প্রজেক্ট এবং খামার স্থাপন।
* ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত নতুন জাতের পাটের প্রদর্শন এবং এই সব জাতের পাট উৎপাদনের উদ্দেশ্যে কৃষক প্রশিক্ষণের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রকল্প এলাকা নির্বাচন এবং কৃষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
* পাট ও সমশ্রেণির আঁশ ফসলের চাষের উন্নত পদ্ধতি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মচারী এবং চাষিদের প্রশিক্ষণ এবং পাট সংক্রান্ত কারিগরি গবেষণালব্ধ প্রযুক্তি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট পাট পণ্য উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য কার্যাদি সম্পাদন।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে কৃষি গবেষণা সংক্রান্ত কার্যক্রম ও অর্জন
বিজেআরআই প্রতিষ্ঠার পর থেকে মোট ৫০টি পাট ও পাট জাতীয় আঁশ ফসলের উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও অবমুক্ত করা হয়েছে। তন্মধ্যে ২২টি (৯টি দেশি পাট, ৮টি তোষা পাট, ৩টি কেনাফ ও ২টি মেস্তা) উন্নত জাত বর্তমানে কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদের জন্য সুপারিশ করা হচ্ছে। সুপারিশকৃত এই ২২টি উচ্চফলনশীল জাতের মধ্যে বর্তমান সরকারের সময়কালে ১১টি জাত (দেশি পাটের-৪টি, তোষা পাটের-৩টি, কেনাফের-২টি এবং মেস্তার-২টি) উদ্ভাবিত হয়েছে। দেশে পাট বীজের অভাব দূরীকরণে বিজেআরআই পাট বীজ উৎপাদনের জন্য ‘নাবী পাট বীজ উৎপাদন’ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। স্বাভাবিক নিয়মে বীজ উৎপাদনে যেখানে প্রায় ৮-৯ মাস সময়ের প্রয়োজন হয় এবং ফলনও হয় কম, সেখানে নাবী পদ্ধতিতে মাত্র ৪-৫ মাসে দ্বিগুণ এরও বেশি (প্রায় ৫০০-৬০০ কেজি/হেঃ) ফলন পাওয়া যায়। ফলে কৃষক পর্যায়ে এ প্রযুক্তিটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বীজের ঘাটতি পর্যায়ক্রমে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। তাছাড়া ‘নিজের বীজ নিজে করি’ শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। পাট ও পাট জাতীয় ফসলের কৃষিতাত্তি¡ক ব্যবস্থাপনা, সার ব্যবস্থাপনা, রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা, পাটভিত্তিক শষ্য পর্যায় এবং পাট পচন প্রক্রিয়ার ওপর ৭৫টি উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
বর্তমানে কৃষি গবেষণার বিভিন্ন বিভাগে পাটের জার্মপ্লাজম ক্যারেক্টারাইজেশন, জাত উন্নয়ন, বালাই ব্যবস্থাপনা, কৃষিতাত্তি¡ক ব্যবস্থাপনা, সার ব্যবস্থাপনা, পাট ভিত্তিক শস্য পর্যায় উদ্ভাবন, উন্নত পচন পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে মোট ১১১টি গবেষণা পরীক্ষণ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তোষা পাটের একটি অগ্রবর্তী লাইন জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক জাত হিসাবে বিজেআরআই তোষা পাট-৮ নামে ছাড়করণ করা হয়েছে। পাট, কেনাফ ও মেস্তার ৯০টি জার্মপ্লাজমের চারিত্রিক গুণাগুণ মূল্যায়ন করা হয়েছে, এই জার্মপ্লাজমগুলো উন্নত জাত উদ্ভাবনে ব্যবহার করা যাবে। জিন ব্যাংকে সংরক্ষিত জার্মপ্লাজমগুলো হতে গত বছর ৫০০টি জার্মপ্লাজমের বীজবর্ধন করে জিন ব্যাংকে সংরক্ষণ করা হয়েছে, যা পরবর্তীতে মূল্যায়ন কাজে ব্যবহার করা হবে। পাটের ২২টি জার্মপ্লাজমের মলিকুলার বৈশিষ্ট্যায়ন/চরিত্রায়ন করা হয়েছে। দেশি, তোষা ও কেনাফের বিভিন্ন জাতের মোট ১৭০০ কেজি প্রজনন বীজ উৎপাদন করা হয়েছে যার মধ্য থেকে চাহিদা অনুযায়ী বিএডিসি ও অন্যান্য প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানকে মোট ৬৫৭.২৯ কেজি সরবরাহ করা হয়েছে। তাছাড়া, প্রজনন বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে ৭৪.৪০ কেজি নিউক্লিয়াস বীজ উৎপাদন করা হয়েছে। চ‚ড়ান্ত মাঠ পরীক্ষণের মাধ্যমে ১১টি নতুন ছত্রাকনাশক কার্যকরী হিসাবে ভালো পাওয়া গেছে এবং কৃষকের ব্যবহারের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাট পচনের জন্য অনুজীব সংগ্রহ করা হয়েছে এবং তাদের পাট পচন গুণাগুণ নির্ণয়করণ কার্যক্রম চলছে। পানি স্বল্প এলাকায় পাটের রিবনিং করার জন্য ‘অটো-জুট পাওয়ার রিবনার’ উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং এর আধুনিকায়ন কার্যক্রম চলমান আছে। অতি অল্প সময়ে পাট ফসল কর্তনের জন্য ‘বিজেআরআই মাল্টিফাংশন জুট হার্ভেস্টার’ উদ্ভাবন করা হয়েছে। স্বল্প পানি এলাকায় পাটের রিবন রেটিং প্রযুক্তি সম্পর্কে কৃষক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত পাট ও সমজাতীয় আঁশ ফসলের নতুন জাতসমূহকে মাঠপর্যায়ে কৃষকদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত বিজেআরআই এর আঞ্চলিক ও উপকেন্দ্রের মাধ্যমে ১১৯৫টি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন আঞ্চলিক/উপকেন্দ্রের মাধ্যমে ১২.০০ টন মান ঘোষিত বীজ (টিএলএস) উৎপাদন করা হয়েছে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে কারিগরি গবেষণা সংক্রান্ত কার্যক্রম ও অর্জন
কারিগরি গবেষণা উইংয়ের বিদ্যমান বিভাগগুলোর মাধ্যমে নতুন পাট পণ্য প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং প্রচলিত পাট পণ্যের মানোন্নয়নের বিষয়ে গত ০১ বছরে ৪৪টি গবেষণা কর্মসূচি পরিচালনা করা হয়েছে। নদীর বাঁধ নির্মাণ, রাস্তার উপরিভাগের মাটির ক্ষয়রোধ, পাহাড়ের ঢাল রক্ষার জন্য নবউদ্ভাবিত ‘ন্যাচারাল এডিটিভ ট্রিটেড জুট জিও-টেক্সটাইল’ প্রযুক্তিটি একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে বিজেএমসির নিকট হস্তান্তরের করা হয়েছে। প্রযুক্তিটি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতি বছর দেশের প্রায় ২০০ (দুইশত) কোটি টাকার সিনথেটিক জিও টেক্সটাইল আমদানি সাশ্রয় এবং প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। অপ্রচলিত দ্রব্য লিচু পাতা থেকে সহজলভ্য পরিবেশ বান্ধব ৪টি প্রাকৃতিক রঙ উদ্ভাবন করা হয়েছে, যা দ্বারা পাট বস্ত্র ও সুতি বস্ত্রকে রঞ্জিত করা যায়। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে পাটজাত দ্রব্যকে ক্ষুদ্র শিল্পের মাধ্যমে রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। ওয়ার্প-এ তুলা এবং ওয়েফ্ট-এ পাটের সুতা ব্যবহার করে জুট-কটন ইউনিয়ন ফেব্রিক তৈরি করে তা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মূল্য সংযোজিত পণ্য যেমন-সেমিনার ব্যাগ, এক্সিকিউটিভ ব্যাগ, লেডিস ব্যাগ, জায়নামাজ ইত্যাদি প্রস্তুত করে ও প্রদর্শন করা হচ্ছে। পাটজাত দ্রব্যের বহুমুখী ব্যবহার, রপ্তানিযোগ্য পাটজাত পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে হালকা পাটবস্ত্র তৈরির নিমিত্তে চিকন সুতা (১০০ টেক্স) উৎপাদনের পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল তৈরির লক্ষ্যে পাট আঁশ এবং পাটের কাপড় দিয়ে রিইনফোর্সট কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল তৈরি করা হয়েছে। পাট ও সুতি বস্ত্রের জন্য স্বল্প মূল্যের বিøচিং পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। পাট সুতাকে রাসায়নিক প্রক্রিয়াজাত করে উলের ন্যায় সুতা তৈরি করা হয়েছে, যা দ্বারা স্বল্প মূল্যে স্যোয়েটার/কার্ডিগান তৈরি করা সম্ভব। বহুমুখী টেক্সটাইল শিল্পে ব্যবহারের জন্য, পাটের তন্তুর সাথে কলাগাছের আঁশ মিশ্রিত করা হয়েছে, এ জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কলা গাছের আঁশের নমুনা সংগ্রহ করে রাসায়নিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে উহার আঁশের গুণাগুণ নির্ণয় করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, কলাগাছের আঁশের আলফা-সেলুলোজের মান যথেষ্ট ভালো এবং তার পরিমাণ প্রায় ৫৯.৭৫% যা পাট তন্তুর আলফা-সেলুলোজের পরিমাণের প্রায় কাছাকাছি। পাট থেকে উন্নত মানের বিভিন্ন ধরনের পরিবেশবান্ধব কম্পোজিট যেমনÑ ঢেউটিন, চেয়ার-টেবিল, বেঞ্চ, দরজার পাল্লা ইত্যাদি তৈরির পদ্ধতি উদদ্ভাবন করা হয়েছে। পাটের কাপড়ে সাথে পলিমার রেজিন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক পদার্থ সংমিশ্রিত করে কক্ষ তাপমাত্রায় যা সহজেই হাতে তৈরি করা যায়। পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিতকরণ ও টেক্সটাইল শিল্পে ব্যবহারের জন্য পাটবস্ত্রকে বিভিন্ন কেমিক্যাল দ্বারা ট্রিটমেন্ট করে অগ্নিরোধী পাট বস্ত্র তৈরি করা হয়। পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পাট থেকে লাভজনক ও উন্নতমানের পাল্প তৈরি করা হয়েছে। পাল্প থেকে কাগজ, মাইক্রো-ক্রিস্টালাইন সেলুলোজ (এমসিসি) ও কার্বক্সিমিথাইল সেলুলোজ (সিএমসি) তৈরি করা হয়েছে। পাট পাতা অনেক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। এটি একটি মৌসুমি ফসল বিধায় পাতাকে প্রক্রিয়াজাত করে সংরক্ষণ ও চা উৎপাদনে সহজ প্রযুক্তি উৎদ্ভাবন করা হয়েছে। পাট পণ্যের ডাইং-এর কন্ডিশন অপটিমাইজ-করার জন্য কস্টিক সোডা, পানি ও বিভিন্ন ডাই দ্বারা পাট পণ্য রঞ্জনের জন্য অপটিমাম মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
জুট-টেক্সটাইল উইং-এ বিদ্যমান বিভাগের মাধ্যমে নতুন পাট পণ্য প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং প্রচলিত পাট, তুলা ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক তন্তু সংমিশ্রণে পণ্যের উৎপাদন ও মানোন্নয়নের বিষয়ে ০৮টি গবেষণা কর্মসূচি পরিচালনা করা হয়েছে। পাট-তুলা মিশ্রিত সুতা দিয়ে পাঞ্জাবি তৈরি করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এই কাপড় সব বয়সী মানুষের জন্য ব্যবহার উপযোগী হওয়ার কারণে পাটের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। পাট, তুলা ও ভেড়ার পশম মিশ্রিত আঁশ দিয়ে কম্বল তৈরি করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এই কম্বল শীত প্রধান এলাকায় (উত্তরবঙ্গ) মানুষের জন্য ব্যবহার উপযোগী হওয়ার কারণে পাটের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে কৃষক লাভবান হবে এবং অন্যদিকে পরিবেশ রক্ষা পাবে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে দেশীয় ভেড়ার পশমের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে।
জিনোম গবেষণায় সাফল্য : জীব প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বে সর্বপ্রথম দেশি ও তোষা পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কার করা হয়েছে এবং পাটসহ পাঁচশতাধিক ফসলের ক্ষতিকারক ছত্রাক গধপৎড়ঢ়যড়সরহধ ঢ়যধংবড়ষরহধ-এর জীবনরহস্য উন্মোচন করা হয়েছে। উন্মোচিত জিনোম তথ্য ব্যবহার করে উচ্চফলনশীল, বিভিন্ন প্রতিক‚লতা সহনশীল এবং পণ্য উৎপাদন উপযোগী পাট জাত উদ্ভাবনের জন্য বর্তমান সরকার ‘পাটবিষয়ক মৌলিক ও ফলিত গবেষণা’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। উক্ত আবিষ্কারের ফলে পাটের বিভিন্ন প্রতিক‚লতা সহনশীল (লবণাক্ততা, খরা, বিভিন্ন পোকামাকড় ও রোগজীবাণু সহনশীল ইত্যাদি), কম লিগনিন সমৃদ্ধ উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ২৮% জমি লবণাক্ততার কারণে পতিত থাকে। এছাড়া উত্তরাঞ্চলের একটি ব্যাপক এলাকা খরাপ্রবণ। প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে ওই সকল পতিত জমিতে পাটচাষ সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে। ফলে পতিত/ব্যবহার অনুপযোগী জমি আবাদের আওতায় আসবে। এছাড়া কম লিগনিন সমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবন সম্ভব হলে বস্ত্র শিল্পে তুলার বিকল্প হিসাবে অথবা তুলার সাথে সংমিশ্রণে পাটের ব্যবহারে প্রভূত উন্নতি সাধিত হবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
* দেশে পাট উৎপাদন স্থিতিশীল রাখতে সমুদ্র উপক‚লর্তী লবণাক্ত অঞ্চলে পাট চাষ সম্প্রসারণ এবং লবণাক্ততা সহিষ্ণু পাট জাত উদ্ভাবনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
* পণ্যভিত্তিক ও কাগজের মÐ তৈরির জন্য সারা বছর চাষ উপযোগী পাট ও পাট জাতীয় আঁশ ফসলের জাত উদ্ভাবন করা। বিভিন্ন বায়োটিক (রোগজীবাণু ও পোকামাকড়) এবং এবায়োটিক (স্বল্প তাপমাত্রা, খরা ইত্যাদি) প্রতিক‚লতা সহনশীল পাট ও পাট জাতীয় আঁশ ফসলের উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা।
* অনুর্বর জমি ব্যবহারের জন্য কাঁটাবিহীন মসৃণ কাÐ বিশিষ্ট কেনাফ ও মেস্তার জাত উদ্ভাবন করা।
* জীব প্রযুক্তি (বায়োটেকনোলজি) ব্যবহারের মাধ্যমে রোগ জীবাণু ও পোকামাকড় সহনশীল উচ্চফলনশীল পাট ও পাট জাতীয় আঁশ ফসলের জাত উদ্ভাবন করা।
* গবেষণায় এবং কৃষকের মাঠে ফলনের পার্থক্য হ্রাস করে পাটের সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
* পাটের উৎপাদন খরচ হ্রাস এবং স্থানোপযোগী (লোকেশন স্পেসিফিক) পাট পচন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা।
* জাতীয় বীজ কর্মসূচির সহায়তার জন্য সরকারি ও বেসরকারি বীজ উৎপাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠানকে চাহিদা অনুযায়ী প্রজনন বীজ সরবরাহ করা। পাট বীজের অভাব দূরীকরণে পর্যাপ্ত পরিমাণ পাটের মান ঘোষিত বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ করা।
* বর্তমানে ফরিদপুর, যশোর ছাড়াও বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে ব্যাপক পাটের আবাদ হয়। কিন্তু উক্ত রাজশাহী অঞ্চলের পাট ও পাট জাতীয় আঁশ ফসলের দেখাশোনা করার কোনো কেন্দ্র সেখানে নেই। অতএব, উক্ত এলাকায় বিজেআরআই-এর একটি নতুন গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের ব্যবস্থা করা।
* পাটের আরো সুক্ষ্ম সুতা (লো-কাউন্ট) উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা।
* প্রচলিত ও বহুমুখী পাটজাত পণ্যের মান উন্নয়নপূর্বক উৎপাদন খরচ হ্রাস করা।
* শুধুমাত্র পাট এবং পাটের সাথে অন্যান্য আঁশের (তুলা, পলিয়েস্টার, এ্যাক্রাইলিক ইত্যাদি) মিশ্রণে নতুন নতুন বহুমুখী পাটজাত পণ্য উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা।
* পাট ও উলের সংমিশ্রণে সুতা (ব্লেন্ডেড ইয়ার্ন) উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা।
* পাটের বায়োকম্পোজিট প্লাস্টিক দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা।
* পাট আঁশে ধুলাবালি যাতে মিশ্রিত হতে না পারে তার জন্য আঁশ শুকানো ও পচানোর প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা।
* পাট আঁশের কেমিক্যাল প্রসেসিং প্ল্যান্ট স্থাপন, স্মল স্কেল ওয়েট প্রসেসিং প্ল্যান্ট স্থাপন, মিনি স্পিনিং প্ল্যান্ট স্থাপন করে আধুনিক গবেষণার মাধ্যমে যুগোপযোগী পণ্য সামগ্রী প্রস্তুত করা।
* বিজেআরআই উদ্ভাবিত বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন প্রযুক্তির বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা।
পরিশেষে পাট একটি শিল্পজাত ফসল হওয়ায় এর সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগ, প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়সমূহের মধ্যে ও আন্তঃযোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে দৃঢ় সমন্বিত প্রচেষ্টা নিতে হবে।
কৃষিবিদ ডঃ মোঃ মাহবুবুল ইসলাম
পরিচালক, (পরিকল্পণা প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ), বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া এভেনিউ, ঢাকা-১২০৭। মোবাইলঃ +৮৮০১৫৫২৪১৬৫৩৭, ই-মেইল--mahbub-agronomy@yahoo.com
ফুল। দুই অক্ষরের একটি সুন্দর শব্দ। ফুল সৌন্দর্যের প্রতীক। ফুল পবিত্রতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতীক। জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীসহ যে কোনো উপলক্ষ্যে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাতে আমরা ফুল উপহার দেই। ফুল নিয়ে যুগে যুগে রচিত হয়েছে অনেক কাব্য ও সাহিত্য। কবি বলেছেন, জোটে যদি মোটে একটি পয়সা, খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি, দুইটি যদি জোটে তার একটি ফুল কিনে নিও ওহে অনুরাগী। অতীতে ফুলের উৎপাদন ও ব্যবহার ছিল খুব সীমিত। বর্তমানে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও বাণিজ্যিকভিত্তিতে ফুলের উৎপাদন ও বিপণন হচ্ছে এবং ফুলের ব্যবহারও অনেক বেড়েছে।
বাংলাদেশে ফুল চাষ
বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভিত্তিতে ফুল উৎপাদনের শুভ সূচনা শুরু হয় ১৯৮৩ সালে যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা গ্রামে। সে সময়ে একজন ফুল অনুরাগী উদ্যোগী কৃষক জনাব শের আলী মাত্র ০.৮৩ ডেসিম্যাল জমিতে ফুল চাষ শুরু করেন। আজ বাংলাদেশের ২৪টি জেলায় প্রায় ৩,৫০০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুলের চাষ হচ্ছে। ফুল উৎপাদনে জড়িত আছেন প্রায় ১৫,০০০ কৃষক এবং ফুল উৎপাদন ও বিপণন ব্যবসায়ে অন্তত ১.৫০ লাখ মানুষ সরাসরি নিয়োজিত রয়েছেন। ফুল সেক্টরের কার্যক্রমের মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন করছেন প্রায় ৭ লাখ মানুষ। ফুল শিল্পের সম্প্রসারণের ফলে আজকাল ফুলের ব্যবহারও অনেক বেড়েছে। এখন বিয়ে শাদিতো বটেই, অন্যান্য জাতীয় অনুষ্ঠান যেমন-মাতৃভাষা দিবস, ভ্যালেনটাইনস ডে, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ জাতীয় ও সামাজিক জীবনের অনেক ক্ষেত্রে যেমন-বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিন, পূজা পার্বণে ফুলের ব্যবহার অনিবার্য হয়ে পড়েছে।
ফুলের উৎপাদন এলাকা
ফুলের বহুবিধ ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুলের উৎপাদন গত এক যুগে অনেক বেড়েছে। বর্তমানে দেশের ২৪টি জেলায় প্রায় ৩৫২০ হেক্টর জমিতে ফুলের উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে খুলনা বিভাগে সর্বোচ্চ ২৬০০ হেক্টর (৭৪%) জমিতে ফুলের চাষ হয়। ২য় স্থানে রয়েছে ঢাকা বিভাগ ৬৯০ হেক্টর (২০%) এবং ৩য় স্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ ১২১ হেক্টর (৩.৪৪%)। এছাড়া রংপুর বিভাগে ৪২ হেক্টর (০.২৯%)। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে মূল উৎপাদনের প্রায় ১৫০০০ হাজার কৃষক জড়িত। এদের মধ্যে খুলনা বিভাগে ১১২৫০ জন (৭৫%), ঢাকা বিভাগে ৩০০০ জন (২০%)। বাকি ৫% কৃষক রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগে ফুল চাষে নিয়োজিত।
ফুলের বিভিন্ন জাত ও উৎপাদন
বিভিন্ন জাতের ফুল উৎপাদনের হিসাবে দেখা যায়, সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় গøাডিওলাস ৯৯১৪ টন যার টাকার মূল্য মার্কেট শেয়ার ৩১%। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে গোলাপ ১১১৩২ টন (২৪%), রজনীগন্ধা ১০৮১৪ টন (১৭%), ম্যারিগোল্ড ১২৬২৪ টন (৮%) অন্যান্য ফুলের মার্কেট শেয়ার মোট ২০%। বার্ষিক হিসাবে ২০১৪-১৫ সালে ফুল উৎপাদন হয়েছে ৫৭,০০০ টন এবং বিক্রয়লব্ধ টাকা হচ্ছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ আয় হয় গøাডিওলাস থেকে প্রায় ২২৩ কোটি টাকা।
ফুল শিল্পের বর্তমান অবস্থা
ফুল শিল্প বিকাশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গত ২০০৯-১০ থেকে ২০১৪-১৫ সালের হিসাবে গড় প্রবৃদ্ধি অত্যন্ত উৎসাহ ব্যঞ্জক। ফুল উৎপাদনের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ২০%, বিক্রীত মূল্যের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ২৬%, খুচরা বাজারে বিক্রয়ের গড় প্রবৃদ্ধি ২০%, তবে উৎপাদন এলাকা বৃদ্ধি হার মাত্র ১৫% যা অপেক্ষাকৃত কম। সার্বিকভাবে ফুল শিল্পের বিকাশের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে- ফুল চাষ ধান ও শাকসবজির তুলনায় অনেক বেশি লাভজনক। ফুলের উৎপাদন ও বাজার সম্প্রসারণের অন্যতম প্রধান কারণগুলো হচ্ছে- ফুলের চাহিদার ব্যাপক বৃদ্ধি, হেক্টরপ্রতি অধিক লাভ, ফুলের নতুন জাত ও প্রযুক্তি গ্রহণ, অর্থনৈতিক উন্নতি, অন্যান্য জেলায় ফুলের চাষ বৃদ্ধির সুযোগ, শহরের মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে খাদ্য ও মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ফুল ক্রয়ের ব্যাপক অভ্যাস ও উৎসাহ। প্রায় ২০ লাখ লোক ফুলচাষে জড়িত। অধিকাংশ ফুল ঢাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিক্রি হয়। ঢাকার শাহবাগ ও আগারগাঁওয়ে পাইকারি ফুলবাজার রয়েছে। এখান থেকে খুচরা বিক্রেতারা ফুল কিনে ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়েন। কেন্দ্রীয় ফুলবাজার নির্মাণের দাবি বহু আগে থেকেই করে আসছেন ফুল বিক্রেতারা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘বাজার অবকাঠামো, সংরক্ষণ ও পরিবহন সুবিধার মাধ্যমে ফুল বিপণন ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ শীর্ষক প্রকল্পের’ মাধ্যমে ঢাকার গাবতলীতে একটি ফুলের পাইকারি বাজার নির্মাণ করা হচ্ছে।
ফুল শিল্পের চ্যালেঞ্জসমূহ
ফুলের ব্যাপারে মানুষ খুবই সংবেদনশীল, একটু ময়লা ও ধুলাবালু লাগলে সেই ফুল আর বিক্রি হয় না। সামান্য সূর্যের তাপেও ফুলের সৌন্দর্য ¤øান হয়। ফলে ফুল বিক্রির করে ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হন সংশ্লিষ্টরা। ফুল শিল্পের এসব সুযোগ ও সম্ভাবনার মধ্যেও ফুল শিল্প বর্তমানে যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন তা হচ্ছে ফুল উৎপাদন প্রযুক্তির ওপর অনেক কৃষকের জ্ঞানের অভাব, অতিরিক্ত মূলধন ব্যয়, বাংলাদেশে ফুলের বীজ ও চারার অপ্রাপ্যতা এবং এ ব্যাপারে ভারত থেকে আমদানি নির্ভরতা, গ্রিনহাউস নির্মাণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অপ্রাপ্যতা, ফুল চাষের জন্য বিশেষ কম্পাউন্ড সারের অভাব, ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলোতে স্থায়ী পাইকারি ফুলের বাজারের অভাব, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন উৎপাদন প্রযুক্তির অভাব, কৃষক থেকে খুচরা বিক্রেতা পর্যায়ে ২০% ফুল বিনষ্ট হওয়া, ফুল নিয়ে প্রয়োজনীয় গবেষণার অভাব ও একটি জাতীয় ফুলনীতি না থাকা। আধুনিক পদ্ধতিতে ফুলের গ্রেডিং, প্যাকেজিং ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। নেই ফুল পরিবহনের জন্য বিশেষায়িত যানবাহন।
ফুল শিল্পের বিকাশে নেয়া পদক্ষেপসমূহ
বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় ফুল শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। ফুল উৎপাদন প্রযুক্তির ওপর ব্যাপক প্রশিক্ষণের আয়োজন, ফুলের বীজ ও চারা আমদানির ওপর শুল্ক মওকুফ, ঢাকাসহ বড় বড় শহরে ফুলের স্থায়ী পাইকারি বাজার স্থাপন, পরিবহনকালে ফুল জাতে বিনষ্ট না হয় তার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থা চালু, যশোরে ফুলের জন্য বিশেষায়িত হিমাগার স্থাপন, দক্ষিণাঞ্চলের ফুল উৎপাদনকারী এলাকাগুলোতে বাজারের অবকাঠামো উন্নয়ন, বাংলাদেশ ব্যাংক, বেসরকারি ব্যাংক ও ক্ষুদ্র ঋণদান সংস্থা কর্তৃক ঋণের সুযোগ বৃদ্ধি, সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ফুল সেক্টরে মহিলা উদ্যোক্তাদের অধিক অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি জাতীয় ফুলনীতি প্রণয়ন। ইউএসএআইডির সহযোগিতায় গদখালীর পানিসারা গ্রামে একটি ফুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে যেখানে কোল্ডস্টোরেজ সুবিধার মাধ্যমে ফুল ও ফুলের বীজ সংরক্ষণ করা যাবে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাধ্যমে পানিসারা গ্রামে একটি অ্যাসেম্বল সেন্টার গড়ে তোলা হচ্ছে যেখানে ফুলচাষি ফুল বিক্রয় করতে পারবেন। এছাড়াও চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ এবং ঢাকার সাভারে আরও তিনটি অ্যাসেম্বল সেন্টার নির্মাণ করা হচ্ছে।
ফুলের রাজধানী যশোরের গদখালী
যশোর সদর থেকে প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার দূরে ঝিকরগাছার এই গদখালী গ্রাম। খুব ভোরেই এখানে জমে উঠে বাংলাদেশের বৃহত্তম ফুলের বাজার। ঢাকাসহ নানা জায়গার ব্যবসায়ীরা এসে ট্রাক বা পিকআপ ভর্তি করে ফুল নিয়ে যান আর এসব ফুল বিক্রি হয় সারাদেশে বিশেষ করে শহর এলাকাগুলোতে। পানিসারায় ফুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র ও ফুলবাজার গড়ে তোলা হচ্ছে। এখানে আধুনিক পদ্ধতিতে ফুল গ্রেডিং ও প্যাকেজিং করা হবে। এরপর এসব ফুল কুলিং চেম্বারে সংরক্ষণ করা হবে। ফুল কুলিং চেম্বারে রেখে চাষিরা ফুলের ক্রেতাদের সঙ্গে দরদাম করতে পারবেন। গøাডিওলাসসহ বিভিন্ন ধরনের ফুলের বীজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে এখানে।
বিদেশ থেকে আসছে বিশেষজ্ঞ চাষিরা
ভারত ও চীন থেকে বিশেষজ্ঞ চাষিদের আনা হচ্ছে স্থানীয় কৃষকদের সহায়তার জন্য বিশেষ করে পলি হাউসগুলো তৈরিতে আবার বিএডিসি যে গবেষণা করে সেখানেও তারা সহায়তা করেন। নিত্যনতুন জাতের ফুলের চাষের জন্য আলাদা জ্ঞানের দরকার হয় এবং সেটি তারা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পাচ্ছেন। এর ফলে ফুলের বাজার এখন গোলাপ, গাঁদা আর রজনীগন্ধার ওপর নির্ভরশীল নেই।
ফুল চাষে বিনিয়োগ নিরাপদ
ফুলের বাজার এখন প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার। ধান ও পাটের চেয়ে ফুলেই বেশি লাভ। এখন ফুলের চাহিদাও অনেক বেড়েছে। গ্রামের সবাই জানে তার আগেই প্রচুর ফুল সরবরাহ করতে হবে। সঙ্গতকারণেই দামও বাড়বে। এ ধরনের আরও কিছু দিবস আছে যেগুলোতে ফুলের ব্যবহার দিন দিন বাড়বে। তাই ফুল চাষে বিনিয়োগ নিরাপদ। এসব বিষয় মাথায় রেখেই ফুল চাষ এবং নিত্যনতুন ফুলের জাত নিয়ে সরকারি-বেসরকারি গবেষণাও শুরু হয়েছে। আর এতসব উদ্যোগের কারণেই অন্য ফসলের চেয়ে ফুল চাষেই চার পাঁচ গুণ বেশি লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। ফলে গদখালীর ফুলের সুবাসও ছড়িয়ে পড়ছে দেশ দেশান্তরে।
১দেওয়ান আসরাফুল হোসেন, ২মো. রশিদুল ইসলাম
১প্রকল্প পরিচালক, বাজার অবকাঠামো, সংরক্ষণ ও পরিবহন সুবিধার মাধ্যমে ফুল বিপণন ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, ডিএএম, ০১৭২৭৩০৭০৬৪, dewanahossain@gmail.com, ২সহকারী পরিচালক, ডিএএম, ০১৬৮৯০৪৮১৭২, rashidul609@gmail.com