সাপের মতো দেখতে হলেও কুঁচিয়া এক প্রকার মাছ। ইহা বাংলাদেশে কুইচ্চা, কুঁইচা, কুঁচে, কুঁচো ইত্যাদি নামে পরিচিত। বাংলাদেশের হাওর, বাঁওড়, খাল-বিল, পচা পুকুর, ধানক্ষেতে এবং বন্যাপ্লাবিত অঞ্চলে কুঁচিয়া মাছ দেখতে পাওয়া যায়। কুঁচিয়া মাছের শরীর লম্বা বেলনাকৃতির। আপাতদৃষ্টিতে কুঁচিয়া মাছকে আঁশবিহীন মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ইহার গায়ে ক্ষুদ্রাকৃতির আঁশ বিদ্যমান যার বেশিরভাগ অংশই চামড়ার নিচে সজ্জিত থাকে।
খাদ্য হিসেবে কিছু কিছু উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কুঁচিয়া মাছকে অস্পৃর্শ মনে করে। যদিও ইহা শারীরিক দুর্বলতা, রক্তশূন্যতা, অ্যাজমা রোগ, ডায়াবেটিস, বাতজ্বর, পাইলসসহ অনেক রোগ সারাতে মহৌষধের মতো কাজ করে। তাছাড়া পরিবেশের খাদ্য জালে কুঁচিয়ার অনন্য অবদান রয়েছে। ধান ক্ষেতের ফসল অনিষ্টকারী পোকার লার্ভা, শামুক, কৃমি ইত্যাদি খেয়ে কুঁচিয়া কৃষকের উপকারী বন্ধু হিসেবে কাজ করে। অনেক পচা-গলা জৈবপদার্থ খেয়ে পরিবেশে মানবসমাজের বিশেষ বন্ধু হিসেবে ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের মানুষ যতই অপছন্দ করুক না কেন বিদেশে এ মাছের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, শুধুমাত্র ২০১৩-১৪ সালে জীবিত মাছ হিসেবে ৭,০১৭৫ টন কুঁচিয়া বিদেশে রফতানি করে বাংলাদেশ প্রায় ১.৫ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে।
বাংলাদেশের কোথাও কুঁচিয়া চাষ করা হয় না। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশে কোনোরূপ চাষ ছাড়াই প্রকৃতি থেকে বিপুল পরিমাণে কুঁচিয়া আহরণ করে প্রতি বছর বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে। তাই একদিকে পরিবেশ রক্ষায় কুঁচিয়া প্রকৃতি থেকে আহরণ নিষিদ্ধ করা যেমন জরুরি, অন্যদিকে কুঁচিয়া রফতানি করে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হাতছানি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর বিগত বছরগুলোর উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অর্থের লোভ পরিবেশের প্রয়োজনকে ছাপিয়ে দিন দিন কুঁচিয়া রফতানির পরিমাণ বেড়েই চলছে। প্রকৃতির ভারসাম্য ঠিক রেখে অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে এখনই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কুঁচিয়া চাষের প্রচলন করা খুবই জরুরি।
কুঁচিয়া খানিকটা রাক্ষুসে স্বভাবের মাছ। ইহা মাটিতে গর্ত করে বাস করতে অভ্যস্ত বিধায় কুঁচিয়া মাছ সহজেই জমির আইল, পুকুরের পাড়, বেড়িবাঁধ ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সুতরাং, কুঁচিয়ার নানাবিধ উপদ্রপের মোকাবিলা করে এর উৎপাদন বৃদ্ধি করার সবচেয়ে সহজ ও উপযোগী পদ্ধতি হলো হাপায় কুঁচিয়া চাষ করা।
হাপায় কুঁচিয়া চাষের সুবিধা
* যে কোনো জলাশয়ে হাপা স্থাপন করে সহজেই কুঁচিয়ার চাষ করা যায়।
* হাপায় স্বল্প পরিসরে সহজ ব্যবস্থাপনায় কুঁচিয়া চাষ করা সম্ভব।
* কুঁচিয়া মাটিতে গর্ত করে বা জলজ আগাছা বা আবর্জনার নিচে লুকিয়ে থাকে। এমনকি পুকুরের পাড় ছিদ্র করে এক পুকুর থেকে আরেক পুকুরে চলে যায়। ফলে কুঁচিয়া আহরণ করা সহজতর নয়। হাপায় চাষকৃত কুঁচিয়া সহজেই আহরণ করা যায়।
* প্রতিকূল অবস্থায় সহজেই হাপাসহ কুঁচিয়া স্থানান্তর করা যায়।
* হাপায় কুঁচিয়া চাষে প্রাথমিক খরচ তুলনামূলক কম।
* হাপায় কুঁচিয়া মাছের পরিচর্যা করা সহজতর।
* গ্রামীণ মহিলারা সহজেই হাপায় কুঁচিয়া চাষ করে লাভবান হতে পারেন।
* বাজার মূল্যে এবং চাহিদার ওপর নির্ভর করে হাপায় চাষকৃত কুঁচিয়া যে কোনো সময়ে আহরণ করা যায়।
* বহুমালিকানাধীন পুকুরে প্রয়োজনে প্রত্যেক মালিক আলাদা আলাদাভাবে হাপায় কুঁচিয়া চাষ করতে পারেন।
* কুঁচিয়াা রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে বিধায় স্বল্প ব্যয়ে কুচিয়া চাষে ব্যাপক কর্মসংস্থানের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
চাষ পদ্ধতি
জলাশয় নির্বাচন এবং হাপা স্থাপন
হাপা স্থাপন করে যে কোনো পুকুরেই কুচিয়া চাষ করা সম্ভব। এমনকি যেসব জলাশয়ে ছয় মাস পানি থাকে বা পানি ধারণক্ষমতা কম এবং যেসব জলাশয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি সরবরাহ করা দুষ্কর সেসব জলাশয়েও সহজেই কুঁচিয়া চাষ করা যায়।
জলাশয় নির্বাচনের পর বাজারে সহজপ্রাপ্য গ্লাস নাইলনের হাপা জলাশয়ে স্থাপনের ব্যবস্থা নিতে হবে। কাঁকড়া বা অন্য কোনো জলজ প্রাণী দ্বারা হাপা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কুঁচিয়া সহজে বের হয়ে উন্মুক্ত জলাশয়ে চলে যাবে, সেজন্য ডাবল হাপা ব্যবহার করতে হবে। হাপা দুইটি এমন মাপে বানাতে হবে যেন জলাশয়ে স্থাপনের পর দুই হাপার মাঝে চারপাশে কমপক্ষে ১৫ সেমি. ব্যবধান থাকে। সাধারণত মাঝের হাপাটি দৈর্ঘ্যে ২.৫ মিটার, প্রস্থে ২.০ মিটার অর্থাৎ ৫ বর্গমিটার আকারের হলে ব্যবস্থাপনা সহজতর হয়। তবে হাপা আয়তাকার বা বর্গাকারও হতে পারে। প্রয়োজন অনুযায়ী হাপার আকার ছোট বড়ও করা যাবে।
হাপা জলাশয়ে স্থাপনের জন্য বরাক বাঁশ ব্যবহার করা উৎকৃষ্ট। বরাক বাঁশের খণ্ডগুলো হাপার উচ্চতার চেয়ে কমপক্ষে ১ মিটার বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয়। একটি হাপা স্থাপনের জন্য ৪ খণ্ড বরাক বাঁশের প্রয়োজন হবে এবং হাপার পরিমাণ বেশি হলে অতিরিক্ত প্রতি হাপার জন্য ২টি করে বাঁশের খণ্ড বেশি প্রয়োজন পড়বে। বাঁশের খণ্ডগুলো বিশেষ যত্ন সহকারে পুকুরে পুঁততে হবে যেন হাপা হেলে না পড়ে।
বাঁশ স্থাপনের পর প্রথমে নাইলনের রশি দিয়ে বড় হাপাটির ওপরে-নিচে প্রতিটি কোনা বাঁশের সঙ্গে টান টান করে শক্তভাবে বেঁধে দিতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে হাপার তলদেশ যেন জলাশয়ের মাটি থেকে কমপক্ষে ৫০ সেমি. উপরে থাকে। অতঃপর স্থাপিত বড় হাপার নিচের অংশের প্রতি কোনা থেকে সামান্য উপরে একটি করে ছোট ছিদ্র করেতে হবে। এবার ছোট হাপাটি বড় হাপার ভিতরে স্থাপন করতে হবে। এজন্য ছোট হাপার উপরিভাগের প্রতিটি কোনা লম্বা রশি দিয়ে বাঁশের সঙ্গে বাঁধতে হবে। হাপার নিচের কোনায় একইভাবে লম্বা রশি লাগিয়ে বড় হাপার নিচের দিকের কোনায় পূর্বে করা ছিদ্রের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে বের করে আনতে হবে এবং বাঁশের সঙ্গে ভালোভাবে বাঁধতে হবে।
কুঁচিয়া অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ পছন্দ করে বিধায় হাপা স্থাপনের পর হাপায় জলজ আগাছা হিসেবে হেলেঞ্চা দিতে হবে। এ হেলেঞ্চা কুঁচিয়াকে সরাসরি রোদের প্রভাব থেকে রক্ষা করবে।
মজুদপূর্ব মাছের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে সনাতন পদ্ধতিতে কুঁচিয়া সংগ্রহের ফলে আঘাতজনিত কারণে মাছের শরীরে ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে। সময়মতো উপযুক্ত ব্যবস্থা না গ্রহণ করলে এ ক্ষত মাছের মৃত্যুর কারণও হতে পারে। তাই ৪০-৫০ গ্রাম ওজনের কুঁচিয়ার সংগ্রহের পরই পাঁচ পিপিএম পটাসিয়াম পারমাঙ্গানেট দিয়ে ১ ঘণ্টা গোসল করিয়ে মাছগুলোকে পর্যবেক্ষণ হাপায় কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। পরে সুস্থ, সবল মাছগুলোকেই কেবলমাত্র মজুদ করতে হবে।
পোনা মজুদ
মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ অর্থাৎ ফাল্গুন মাসে প্রকৃতি থেকে ৪০-৫০ গ্রাম ওজনের কুঁচিয়া মাছের পোনা সংগ্রহ করে মজুদপূর্ব যথাযথ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা করার পর প্রতি বর্গমিটারে ৪০টি হারে সুস্থ সবল পোনা হাপায় মজুদ করতে হবে। মজুদের ২৪ ঘণ্টা পূর্ব থেকে পোনা মাছকে খাবার প্রয়োগ না করাই উত্তম।
খাদ্য ব্যবস্থাপনা
খানিকটা রাক্ষুসে স্বভাবের হলেও কুঁচিয়া সম্পূরক খাদ্য গ্রহণ করে। চাষকালীন পুরো সময়জুড়ে কুঁচিয়া মাছকে প্রতিদিন দেহ ওজনের ৩-৫% খাবার প্রয়োগ করতে হবে। মাছের আকার এবং জলবায়রু ওপর, বিশেষতঃ তাপমাত্রার তারতম্যের ওপর ভিত্তি করে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করা উচিত। গবেষণায় দেখা যায়, কুঁচিয়া ২০ থেকে ৩৫০ সে. পর্যন্ত তাপমাত্রায় খাবার গ্রহণ করে। তবে ২৫ থেকে ৩০০ সে. তাপমাত্রায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কুঁচিয়ার সম্পূরক খাদ্য হিসেবে অটো রাইসমিলের কুঁড়া, মুরগির নাড়িভূঁড়ি, ফিশমিল এবং কেঁচো মিশিয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে। পুকুরের পানিতে খাবার সহজে দ্রবীভূত হওয়া রোধ কল্পে কুঁচিয়ার খাবারের সঙ্গে আটা যুক্ত করা ভালো। এতে হাপার পানির গুণাগুণ স্থিতিশীল থাকে। খাবার অপচয় রোধে ফিডিং ট্রেতে খাবার সরবরাহ করা উত্তম। বাজার থেকে মাছের উচ্ছিষ্টাংশ সংগ্রহ করে কুঁচিয়ার খাবারের সঙ্গে যুক্ত করলে খাদ্য খরচ অনেকাংশে কমে যাবে। এছাড়া শামুক-ঝিনুকের মাংস কুচি কুচি করে কেটে কুঁচিয়ার খাদ্যের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যায়। তবে শামুক-ঝিনুকের মাংস যোগ করলে মুরগির নাড়িভূড়ি ব্যবহার করা প্রয়োজন পড়ে না। প্রয়োজনে কুঁচিয়ার খাদ্যে ১% ভিটামিন প্রিমিক্স যোগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। সম্পূরক খাদ্য ছাড়াও হাপায় মাছের জীবিত পোনা, জীবিত শামুক ইত্যাদি সরবরাহ করলে ভালো উৎপাদন আশা করা যায়। নিম্ন ছকে কুঁচিয়ার ১০০০ গ্রাম সম্পূরক খাদ্য তৈরির জন্য বিভিন্ন উপকরণের তালিকা দেয়া হলো-
সারণি-১. কুঁচিয়ার ১০০০ গ্রাম সম্পূরক খাদ্যে বিভিন্ন উপকরণের পরিমাণ
খাদ্যের উপকরণ পরিমাণ (গ্রাম)
ফিশমিল ৬০০
কুঁড়া ২৫০
মুরগির নাড়িভূড়ি ১০০
আটা ৫০
মোট= ১০০০
কুঁচিয়ার রোগবালাই ব্যবস্থাপনা
যেহেতু কুঁচিয়া মাটিতে গর্ত করে এবং ময়লা আর্বজনার মধ্যে বসবাস করে এবং চামড়ায় আঁশ অদৃশ্য থাকে তাই কুঁচিয়া সহজেই রোগ এবং পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। এজন্য কুচিয়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। সাধারণত কুঁচিয়া মাছ নিম্নলিখিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
১. ক্ষত রোগ বা আলসার ডিজিজ
অন্যান্য মাছের মতো ক্ষত রোগ বা আলসার ডিজিজ কুঁচিয়ার অন্যতম প্রধান রোগ হিসেবে বিবেচিত। এ রোগের আক্রমণে কুঁচিয়া শরীরে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়-
*প্রাথমিক পর্যায়ে মাছের গায়ে ছোট ছোট লাল দাগ দেখা দেয়।
*ক্রমান্বয়ে লাল দাগের স্থলে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়।
*লেজের অগ্রভাগে এ রোগের আক্রমণ হলে লেজ খসে পড়ে।
*মাছ খাদ্য গ্রহণ করে না এবং পর্যায়ক্রমে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়।
*আক্রান্ত মাছকে পানি থেকে উঠে আগাছার ওপর অলসভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
প্রতিকার বা নিয়ন্ত্রণ
*মাছ মজুদের আগে পুকুর ও হাপা জীবাণুমুক্ত করতে হবে। এজন্য পুকুরে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
*আক্রান্ত মাছকে ০.১-০.২ মি.গ্রাম/কেজি হারে রেনামাইসিন অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশান প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে সপ্তাহ অন্তর ২য় ডোজ প্রয়োগ করতে হবে।
২. পরজীবীজনিত রোগ
আণুবীক্ষণিক বিভিন্ন প্রকার ক্ষুদ্রজীব থেকে শুরু করে জোক পর্যন্ত কুঁচিয়ার শরীরে বাস করতে পারে। কুঁচিয়ার শরীরে পরজীবীর আক্রমণের ফলে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা যায়-
*মাছ অস্বাভাবিকভাবে চলাচল বা লাফালাফি করতে থাকে।
*মাছ খাবার গ্রহণ করা বন্ধ করে দেয় ফলে ক্রমান্বয়ে মাছ দুর্বল হয়ে পড়ে।
*কোন কোন পরজীবীর আক্রমণে মাছের চামড়ায় ছোট ছোট সাদা দাগ দেখা দেয়।
প্রতিকার বা নিয়ন্ত্রণ
*আক্রান্ত মাছকে ৫০ পিপিএম ফরমালিন বা ২০০ পিপিএম লবণ পানিতে ১ মিনিট ধরে গোসল করাতে হবে।
*আক্রান্ত পুকুরের হাপা ৫০ পিপিএম ফরমালিন বা ২০০ পিপিএম লবণ পানিতে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা ডুবিয়ে রেখে পরে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে কড় কড়া রোদে ১-২ দিন ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে।
*পুকুরের পানি সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন করে তলদেশে প্রতি শতাংশে ৫০০ গ্রাম হারে লবণ বা ১ কেজি হারে চূর্ণ প্রয়োগ করতে হবে
৩. পুষ্টিহীনতাজনিত রোগ
শুধু জীবাণু বা পরজীবীর কারণেই মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবও মাছের পর্যাপ্ত বৃদ্ধির অন্তরায়। পুষ্টিহীনতাজনিত রোগের লক্ষণগুলো নিম্নরূপ হয়ে থাকে-
*মাছের বৃদ্ধিহার কমে যায়।
*শরীরের তুলনায় মাছের মাথা বড় হয়ে যায়।
*অস্বাভাবিক হারে মাছের ওজন কমতে থাকে এবং মাছ চলাচলের শক্তি হারিয়ে ফেলে।
*ধীরে ধীরে মাছ মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়।
প্রতিকার বা নিয়ন্ত্রণ
*গুণগত মানসম্পন্ন পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ খাদ্য চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে হবে।
৪. ভাইরাসজনিত রোগ
কুঁচিয়া মাছ ভাইরাসজনিত কারণেও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে Iridovirus প্রকৃতির ভাইরাস দ্বারা সাধারণত বেশি আক্রান্ত হয়। এ ভাইরাস শ্বাসযন্ত্রে আক্রামণ করে বিধায় প্রাথমিক পর্যায়ে রোগের লক্ষণ বাহ্যিকভাবে তেমন প্রকাশ পায় না। তারপরও নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দ্বারা এ রোগ শনাক্ত করা সম্ভব-
*আক্রান্ত মাছ দুর্বল ও ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করে ঔজ্জ্বল্য হারায়।
*আক্রান্ত দুর্বল মাছে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়
*আক্রান্ত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে ব্যাপক মড়ক দেখা দেয়।
প্রতিকার বা নিয়ন্ত্রণ
ভাইরাসজনিত রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিকার না থাকলেও পুকুরে সঠিক পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ রোগের আক্রমণ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
আহরণ ও উৎপাদন
মাছের ওজন এবং বাজারের চাহিদার ওপর নির্ভর করে কুঁচিয়া আহরণ করতে হবে। সঠিক ব্যবস্থাপনায় ছয় মাস চাষ করলে কুঁচিয়া গড়ে ২০০-২৫০ গ্রাম হয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা যায়, হাপায় মজুদকৃত মাছের ৯৫ থেকে ৯৭% পর্যন্ত আহরণ করা সম্ভব। সেই হিসেবে প্রতি বর্গমিটারে ৯-১০ কেজি মাছের উৎপাদন পাওয়া যাবে। নিম্নে ছকে হাপায় কুঁচিয়া চাষের আয়-ব্যয়ের বিশ্লেষণ দেয়া হলো-
সারণি ২ : হাপায় কুঁচিয়া চাষের আয়-ব্যয়ের বিশ্লেষণ
হাপায় কুঁচিয়া চাষে সতর্কতা
হেলেঞ্চা প্রয়োগের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন হেলেঞ্চার সঙ্গে কোনো প্রকার ক্ষতিকর পরজীবী চলে না আসে।
হাপায় হেলেঞ্চার পরিমাণ বেশি হলে মাঝে তা কমিয়ে দিতে হবে। নতুবা হাপার ইকোসিস্টেমে নাইট্রোজেনে আধিক্যের কারণে মাছের গায়ে ফোসকা পড়ে পরে ঘায়ে পরিণত হতে পারে।
পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি হলেও কুঁচিয়ার গায়ে ফোসকা পড়তে পারে।
কাঁকড়া বা অন্য কোন জলজ প্রাণী যেন হাপা ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে নিয়মিত হাপা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
আয়-ব্যয়ের খাত পরিমাণ (টাকা)
হাপা তৈরি, বাঁশ ক্রয় এবং স্থাপনের উপকরণ ১২০০.০০
পোনার মূল্য (২০০টি @ ৫/- প্রতিটি) ১০০০.০০
খাদ্য খরচ (৯০ কেজি @ ৫৫/- প্রতি কেজি) ৪৯৫০.০০
বিবিধ খরচ ৫০০.০০
হাপা প্রতি মোট ব্যয়= ৭.৬৫০.০০
মাছের বিক্রয় মূল্য ৪৭.৫০ কেজি @ ২৫০/- প্রতি কেজি ১১,৮৭৫.০০
হাপা প্রতি মোট আয়= ৪,১২৫.০০
আয়-ব্যয়ের অনুপাত= ১.৫৫ ঃ ১
প্রাকৃতিক দুর্যোগ হাপা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে দিকে লক্ষ্য করতে হবে।
সামাজিক সমস্যা হিসেবে মাছ যাতে চুরি না হয় সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে
পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে, রাক্ষুসে স্বভাবের কারণে এক মাছ অন্য মাছকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
আঘাতপ্রাপ্ত, ক্ষতিগ্রস্ত এবং পুষ্টিহীন মাছের বাজারমূল্য অনেক কম।
দ্বিতীয়বার হাপা কুঁচিয়া চাষে ব্যবহারের আগে ভালোভাবে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে।
লেখক:
ড. ডুরিন আখতার জাহান*
জোনায়রা রশিদ**
* ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ