বাংলাদেশ একটি আর্দ্র ও উষ্ণমণ্ডলীয় দেশ হওয়ায় এখানে শতাধিক প্রজাতির ফল জন্মে। আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, আনারস, লিচু, পেয়ারা, কুল, লেবু, নারিকেল, তরমুজ প্রধান ফল। এছাড়া সফেদা, খেজুর, তাল, কমলা, জাম্বুরা, লটকন, চালতা, আমলকী, বিলাতি গাব, লুকলুকি, আমড়া, বেল অপ্রধান ফলও জন্মে। অর্থনৈতিক দিক, কর্মসংস্থান ও পুষ্টি বিবেচনায় এসব ফল চাষের গুরুত্ব অপরিসীম। ফল চাষ ও পুষ্টি সম্পর্কে দিন দিন জনসচেতনতা বাড়ছে। এখনও মোট উৎপাদিত ফলের প্রায় ৫৩ শতাংশ ফল বাণিজ্যিক বাগান থেকে উৎপাদিত হয়, বাকি ৪৭ শতাংশ ফলের জোগান আসে বসতবাড়ি ও তৎসংলগ্ন জমি থেকে। কাজেই ফলসমৃদ্ধ দেশ গড়তে দুই জায়গাতেই ফল চাষে জোর দিতে হবে। পাশাপাশি মানসম্মত ফলের উৎপাদনের জন্য বাণিজ্যিক বাগানের পরিমাণ বাড়াতে হবে। বিগত ৫ বছরে আমের বাণিজ্যিক বাগান ও উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। নিরাপদ ফল উৎপাদনে এখনও বসতবাড়িতে ফল চাষ পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কিন্তু বছরের সব মাসে সেসব বাগান থেকে ফল পাওয়া যায় না। বছরব্যাপী ফলপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বসতবাড়ির পারিবারিক ফলবাগানে পরিকল্পিতভাবে ফলগাছ রোপণের কর্মসূচি নেয়া দরকার।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে নতুন ঘর বাড়ি তৈরির প্রয়োজনে এ পারিবারিক ফল বাগানের সংখ্যা যেমন কমে যাচ্ছে, তেমনি গ্রামীণ বনভূমি উজাড় হওয়ার ফলে স্বল্প প্রচলিত ফলের অনেক প্রজাতিও বিলুপ্ত হচ্ছে। তাই এসব প্রজাতির সংরক্ষণ ও দেশীয় ফল গ্রহণের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়নে বসতবাড়ির বাগান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমান সরকার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের সাথে সাথে পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কৃষিকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করে কৃষির উপকরণ খাতে ভর্তুকি প্রদান, কৃষি ঋণ বিতরণ ও নানামুখী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে দেশের মোট উৎপাদন বাড়াতে সচেষ্ট রয়েছে। দেশের মানুষের মধ্যে পুষ্টি সচেতনতা বৃদ্ধি ও সুষম খাবার গ্রহণের মাধ্যমে কর্মক্ষম জাতি তৈরি করার জন্য ফল সমৃদ্ধ দেশ গড়তে সরকারের লক্ষ্য অর্জনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে।
ফল উৎপাদনের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশের মোট ফল উৎপাদনের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ ফল বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ (মে-আগস্ট) এ চার মাসে উৎপাদিত হয় এবং এদের মধ্যে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারাই প্রধান। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসে উৎপাদিত হয় মোট ফলের ১৯% যার মধ্যে কুল, বেল, কলা, সফেদা অন্যতম। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে উৎপাদিত হয় ২১% যার মধ্যে আমড়া, কামরাঙা, কদবেল, চালতা অন্যতম। তবে কলা, পেঁপে, আনারস, কিছু কিছু জাতের পেয়ারা (বারি পেয়ারা-২, থাই পেয়ারা), নারিকেল সারা বছর উৎপন্ন হয়। নতুন ফলের মধ্যে মাল্টা, ড্রাগন ফ্রুট, স্ট্রবেরি ও বিভিন্ন জাতের কুল অন্যতম। সারা বছরে ফল প্রাপ্তি নিশ্চিত বা প্রধান মৌসুম ছাড়া অন্যান্য মৌসুমেও উৎপাদন বাড়ানো দরকার।
বর্তমানে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে বেশি চাষ হচ্ছে আম। তথ্য অনুযায়ী ১,৬৭,৭৬০ হেক্টর জমিতে প্রায় ২০,২৩,৯০২ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়েছে। প্রদর্শনী আকারে বাণিজ্যিক ফল বাগান স্থাপন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার কারণে কৃষক উৎসাহিত হয়ে নতুন নতুন বাগান সৃষ্টি করছে, ফলে আম শুধু উত্তরাঞ্চল নয় পাহাড়ি এলাকা থেকে শুরু করে লবণাক্ত অঞ্চল সাতক্ষীরা, অনাবাদি সিলেটসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যদিকে আমের প্রাপ্তিকে দীর্ঘতর করার জন্য বাণিজ্যিক বাগান করার সময় আগাম, মধ্যম ও নাবি জাতের বিষয়গুলো বিবেচনা করা হচ্ছে। যেমন আমের ক্ষেত্রে গৌড়মতি, বারি আম-৪ এর মতো নাবি জাতগুলো আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আম প্রাপ্তির সময়কে দীর্ঘায়িত করেছে। আগাম জাতের মধ্যে নীলউদ্দিন, গোলাপবাস, গোলাপখাস, রাজবৈশাখী, বৈশাখী, গোবিন্দ ভোগ আম চাষিদের আগাম ভালো বাজারমূল্য দিচ্ছে। হাঁড়িভাঙ্গা, ব্যানানা ম্যাংগো, সূর্যপুরী, তোতাপুরী উন্নত জাত বাগান সৃষ্টিতে উৎসাহিত করছে। পরিকল্পনা করে আমের সঠিক জাত নির্বাচন করে আমবাগান করলে বছরে ৭ মাস ধরে আম পাওয়া সম্ভব। আ¤্রপালি, হাঁড়িভাঙ্গা, গৌড়মতি, বারি আম-৪, বারি আম-১০ ফল বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে, স্বল্প পরিসরে আম রপ্তানি হচ্ছে। আমের ব্যাগিং, ফেরোমেন ফাঁদ ব্যবহার, হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট, উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনা বা সু-কৃষি (এঅচ) প্রযুক্তি দেশে আমের উৎপাদন আরও বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে এবং এ কার্যক্রমের আওতায় আম রপ্তানি কার্যক্রম জোরদার করা, আমভিত্তিক প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তোলা, বিভিন্ন দেশের উপযোগী কোয়ালিটি স্ট্যান্ডার্ড প্রণয়নসহ সব বাগানে উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনার প্রয়োগ করা ডিএই’র পরিকল্পনায় রয়েছে।
জাতীয় ফল কাঁঠালের উৎপাদন এলাকা বৃদ্ধি না পেলেও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এর মোট উৎপাদন ১৬,৯৪,৯০২ মেট্রিক টন। ‘ভিটামিন-এ’ সমৃদ্ধ এ ফলটির ছোট আকারের ফলসমৃদ্ধ গাছের সম্প্রসারণ, আগাম, নাবি ও বারোমাসি জাতের কাঁঠালের কলম উৎপাদন প্রযুক্তি এবং রোগবালাই পোকামাকড় দমনে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। লিচু এখন দিনাজপুর ছাড়িয়ে পাবনা, নাটোর, মেহেরপুর এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৭,২৩৫ হেক্টর জমিতে ১,৮০,৮৬২ মেট্রিক টন লিচু উৎপাদিত হয়েছে। লিচুর উন্নত জাতের মধ্যে বেদানা, বোম্বাই, চায়না-২, চায়না-৩, বারি লিচু-৩, বারি লিচু-৪ বাণিজ্যিক বাগানগুলোতে ব্যাপক চাষ হচ্ছে।
বরিশাল ছাড়াও নাটোর, নওগাঁসহ সারা দেশে ৩১৪৪০ হেক্টর জমিতে ৪১৩৪৪৩ মেট্রিক টন পেয়ারা উৎপাদিত হয়েছে। পেয়ারার বর্ষাকালীন জাত ও বারোমাসি জাতের সম্প্রসারণ সারা বছর পেয়ারা প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে। বারি মাল্টা-১, বাউ কুল, আপেল কুল, স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফ্রুট ফল বাংলাদেশে ফল চাষে নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। প্রকল্পের মাধ্যমে বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পঞ্চগড়সহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সর্বত্রই মাল্টার ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছে। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে মাল্টার ফল সংগ্রহ করা যায়। যে সময়ে বাংলাদেশে ফলের স্বল্পতা থাকে সে সময়ে ফল প্রাপ্তির নিশ্চয়তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
ফল চাষ সম্প্রসারণে ডিএই’র উদ্যোগগুলো
০১. উন্নত মানের চারা কলম উৎপাদন ও বিতরণ
হর্টিকালচার সেন্টারের মাধ্যমে ফলের চারা কলম উৎপাদন ও মাতৃবাগান সৃজন করে দেশি, বিদেশি, প্রচলিত অপ্রচলিত ফলের জার্মপ্লাজম সংরক্ষণ এবং ফল চাষিদের কাছে উন্নত মানের চারা কলম বিতরণ করে ফল চাষ সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্ভাবিত ফলের উন্নত ও আধুনিক জাতগুলো, স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত বিশেষ জাতগুলো, বিদেশি নতুন ফল ও নতুন জাতগুলোর চারা কলম উৎপাদন করে ফল চাষিদের কাছে বিতরণ করা হচ্ছে ও নতুন নতুন ফল বাগান স্থাপনে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে।
হর্টিকালচার সেন্টারগুলোতে দেশ বিদেশে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে উদ্ভাবিত নব প্রযুক্তি ও ফলের জাত যেগুলো এদেশের উপযোগী সেসব প্রযুক্তি, ফল অথবা জাতসহ দেশের ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিশেষ গুণসম্পন্ন অনন্য বৈশিষ্ট্যের ফল গাছের বীজ-চারা-কলম অথবা অঙ্গবিশেষ সংগ্রহ করে সেগুলোর মাতৃবাগান অথবা জার্মপ্লাজম সেন্টার সৃজন করে সেখান থেকে বীজ-চারা-কলম তৈরি করে চাহিদা মাফিক কৃষক, নার্সারি ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানকে সাশ্রয়ী মূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে এর পাশাপাশি দেশীয় বিলুপ্ত প্রায় ফলের অনেক প্রজাতির জার্মপ্লাজম এসব সেন্টারে রয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশের আবহাওয়ায় চাষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এমন বিদেশি ফল যেমন রাম্বুটান, জাবাটিকাবা, সৌদি খেজুর, আলুবোখারা, আঁশফল ও অ্যাভোকাডো নতুন নতুন ফলের মার্তৃবাগান সৃজন করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে চারা কলম উৎপাদন করে সারা দেশে এসব ফল সম্প্রসারণের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
০২. ফল মেলা, ফলদবৃক্ষ মেলা ও বৃক্ষরোপণ পক্ষ
প্রতি বছর দেশের মানুষকে ফলের উৎপাদন ও নিয়মিত ফল খাওয়ায় উৎসাহিত করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে ফল মেলার এবং প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় ফলদবৃক্ষ মেলা আয়োজন করা হয়। এতে সারা দেশ থেকে প্রদর্শনযোগ্য নানা রকমের ফল ও ফলের জাতগুলো সংগ্রহ করে মেলায় প্রদর্শন করা হয় এবং উৎপাদন প্রযুক্তি সম্পর্কে কৃষক, উদ্যান নার্সারি মালিক, উদ্যোক্তা, ছাদে ও বসতবাড়ির আঙিনায় বাগান করতে আগ্রহী জনসাধারণকে অবগত ও উৎসাহিত করা হয়। একই সাথে দেশব্যাপী বৃক্ষরোপণ পক্ষ উদযাপন করা হয়ে থাকে এবং ফলদ ও ঔষধি বৃক্ষরোপণের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়ন করা হয়। ফলদ ও ঔষধি বৃক্ষরোপণে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতি বছর সম্প্রসারণ কর্মী, কৃষক, নার্সারির মালিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বাড়ির ছাদে বাগান সৃজনকারীদের জাতীয় পর্যায় থেকে পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয়। এতে ফল চাষে কৃষকের মাঝে উৎসাহ বাড়ে।
০৩. বাণিজ্যিক ফল বাগান প্রতিষ্ঠা
সমন্বিত মানসম্পন্ন উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্প, ইনট্রিগ্রেটেড হর্টিকালচার অ্যান্ড নিউট্রিশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, কমলা উন্নয়ন প্রকল্প, বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প, সাইট্রাস ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, এসসিডিপি প্রজেক্টের ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় অনেক ফলের বাণিজ্যিক বাগান স্থাপন করা হয়েছে, যা দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে সারা দেশে ব্যাপক ফল বাগান সৃষ্টি হচ্ছে।
০৪. নতুন ফলের জাত সম্প্রসারণ
অমৌসুমে ফল প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য নতুন ফল ও বিভিন্ন ফলের নতুন জাত সম্প্রসারণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এখন দেশীয় বাউকুল, আপেলকুল, বিভিন্ন জাতের আনারস, রঙিন জামরুল ছাড়াও বিদেশি ও উচ্চ মূল্যের ফলের মধ্যে ড্রাগন ফ্রুট ও স্ট্রবেরি দেশের বিভিন্ন বাগানে উৎপাদন হচ্ছে। এরই মধ্যে অ্যাভোকাডো, ম্যাঙ্গোস্টিন, কিউই, লংগান, রাম্বুটান, জাবাটিকাবা, সৌদি খেজুর, আলুবোখারা, আঁশ ফল ও পিচফল প্রবর্তন করা হয়েছে। ড্রাগন ফ্রুট চাষে বাণিজ্যিক সফলতা এসেছে।
০৫. খাটো জাতের নারিকেল সম্প্রসারণ
বাংলাদেশের প্রচলিত নারিকেল জাতগুলো লম্বা হওয়ায় তা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহনশীল নয়, উপরন্তু এ গাছ অধিক ফলনশীল নয় এবং এর থেকে ফল সংগ্রহ করা কষ্টকর। ভারত থেকে ডিজে সম্পূর্ণা নামের ১০ হাজার হাইব্রিড নারিকেল চারা ও ভিয়েতনাম থেকে সিয়াম গ্রিন ও সিয়াম ব্লু নামের ২ লাখ ১০ হাজার খাটো জাতের নারিকেল চারা আমদানি করা হয়েছে যা উপকূলীয় এলাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে রোপণ করা হয়েছে।
০৬. পাহাড়ে ফল বাগান
আমাদের পাহাড়ি এলাকায় চাষ পদ্ধতি ছিল জুম নির্ভর। বর্তমানে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার পাহাড়গুলোতে ফল চাষ একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য রেখে চলেছে তেমনি ফলভিত্তিক অর্থনীতি পাহাড়ি জনগণের জীবন যাত্রায়ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। ডিএই পাহাড়ে বাগান সৃজনের জন্য ভর্তুকি মূল্যে চারা কলম বিতরণ করে আম, লিচু, কলা, পেঁপে, আনারস ও মাল্টার বাগান সৃজনে চাষিদের উৎসাহিত করছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আম্রপালি ও রাঙ্গুয়াই জাতের আম, লিচু, মাল্টা ও খাটো জাতের নারিকেল চাষের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটছে।
০৭. বসতবাড়িতে ফল গাছ রোপণ
দেশে ১ কোটি ৯৪ লাখ বসতবাড়ির আওতাধীন প্রায় ৪.৫ লাখ হেক্টর জমি রয়েছে। আমাদের দেশে উৎপাদিত মোট ফলের একটা বড় অংশ বসতবাড়ি থেকে আসে এবং পারিবারিক পুষ্টি ও বাড়তি আয় এ বাগান থেকেই অর্জন করা সম্ভব। সারা বছর যাতে বসতবাড়ির আঙিনায় লাগানো ফলগাছ থেকে নিরাপদ ফল পাওয়া যায় ও পারিবারিক পুষ্টি উন্নয়ন করা যায় সেজন্য ব্যাপকভাবে কৃষক-কিষাণীদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও চারা কলম দেয়া হচ্ছে। প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশের ৬১টি জেলার ২,৮১,০০টি বসতবাড়িতে এরই মধ্যে ৫ লক্ষাধিক ফলের চারা কলম রোপণ করা হয়েছে।
০৮. ছাদে ফলবাগান
শহর এলাকায় বাড়ির ছাদে বর্তমানে অনেকে আগ্রহী হয়ে ড্রাম বা টবে গাছ লাগিয়ে ফল বাগান করছেন। এতে নিজ হাতে করা ফল খাওয়া, পরিবেশ ঠাণ্ডা রাখা ও বাড়তি আয়ের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। ডিএই’র প্রতিটি মেট্রোপলিটন কৃষি অফিস মূলত ছাদে বাগান সৃজন কার্যক্রম ও সে সম্পর্কে কারিগরি পরামর্শ দিয়ে আসছে। এছাড়াও ঋঅঙ ডিএই এর সহায়তায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে এরূপ ছাদ বাগান ও অক্সিজেন ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ঢাকা শহরে ডিএই’র মাধ্যমে এ পর্যন্ত মোট ৬৫০০টি ছাদ বাগান করা হয়েছে।
০৯. রাস্তার ধারে তাল-খেজুর গাছ রোপণ
পরিবেশ ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তালগাছ রোপণ করা খুবই লাভজনক। এটি গুচ্ছমূলী বৃক্ষ এবং বেশ শক্ত। এজন্য মাটি আটকে রেখে ভাঙন ও জমির ক্ষয় রোধ করে। এছাড়াও ঝড় বৃষ্টি থেকে ঘরবাড়ি রক্ষা করে। এ গাছটি প্রায় ১৪০-১৫০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। ফলবতী হতে ১০-১৫ বছর সময় লাগে। একটি তালগাছ থেকে বছরে প্রায় ৪০০-৫০০টি ফল পাওয়া যায়। এদিক বিবেচনায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাস্তার ধারে তালগাছ রোপণ কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে।
১০. রপ্তানি ও বাজার সম্ভাবনা
আন্তর্জাতিক বাজারে সুস্বাদু হিমসাগর আমকে ছড়িয়ে দিতে ডিএই নেদারল্যান্ডসভিত্তিক সংস্থা সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়ার সহায়তায় ২০১৫ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে আম রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করে। সে কার্যক্রমে মেহেরপুর জেলায় ১৫টি আম বাগান নির্বাচন করা হয়। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সেসব বাগান থেকে প্রথমবার ১২০ মেট্রিক টন আম সংগ্রহ করে। চলতি বছর ২০০ মেট্রিক টন আমের অর্ডার আছে। নির্ধারিত বাগানগুলোতে আমের ব্যাগিং করা হয়েছে। কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে চাষি বাছাই করে উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি ব্যবহার করে আম রপ্তানি হচ্ছে।
১১. ফলসমৃদ্ধ দেশ গড়তে করণীয়
ফল উৎপাদন বাড়াতে ডিএই কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলোর পাশাপাশি ফল রপ্তানির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এবং বাংলাদেশকে ফলসমৃদ্ধ দেশ গড়তে যেসব উদ্যোগগুলোর আশু বাস্তবায়ন দরকার-
প্রতিটি জেলায় হর্টিকালচার সেন্টার স্থাপন করে এর মাধ্যমে সে এলাকার উপযোগী ও স্থানীয় ফলের মাতৃবাগান সৃজন ও চাষিদের মাঝে সুলভ মূল্যে ফলের চারা কলম সরবরাহের ব্যবস্থাকরণ;
বেসরকারি নার্সারিগুলো ফলের মানসম্মত চারা কলম উৎপাদন নিশ্চিতকরণ;
ফলের ক্রপ জোনিং করা; কারণ বিশেষ এলাকার মাটি ও আবহাওয়ার জন্য সে এলাকার ফলের উৎপাদন ও গুণগত মানের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায়। ফ্রুট জোনিং করা হলে বাণিজ্যিক বাগান ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত হবে;
ফল রপ্তানির জন্য উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ;
ফলের সংগ্রহোত্তর অপচয় কমানোর জন্য বাস্তবমুখী পদক্ষেপ ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ;
ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পকে আরও উৎসাহিতকরণ;
ফল সংরক্ষণের জন্য এলাকাভিত্তিক হিমাগার স্থাপনসহ পরিবহনের জন্য কুলিং ভ্যান ও প্যাকেজিং ব্যবস্থা উন্নতকরণ।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ক্ষুধা মুক্তি, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থা চালুকরণ এবং সবার জন্য স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা আমাদের ভবিষ্যৎ করণীয়। কাজেই ফলের আবাদ সম্প্রসারণ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ কৌশল সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিসহ ফল চাষের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পুষ্টি ঘাটতি পূরণ তথা খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমানে ফলের উৎপাদন এলাকা ও একরপ্রতি উৎপাদন উভয় ক্ষেত্রেই অগ্রগতি হয়েছে। অগ্রগতির ধারাটি অব্যাহত রাখতে পারলে আগামীতে ফল উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ফলসমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে এবং সবার জন্য যথাযথ পুষ্টি নিশ্চিত হবে।
কৃষিবিদ মো. গোলাম মারুফ*
*মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা
গাছ একটি আমানত, পরিবারের রক্ষা কবজ। মহানবী সা. নিজ থেকে গাছ রোপণ করেছেন। ধর্মীয় মতে, যদি তুমি জানো আগামীকাল কিয়ামত হবে তবুও আজ একটি গাছের চারা রোপণ কর। কেউ যদি একটি ফল গাছ রোপণ করে এবং সে গাছের ফল পশুপাখি কিংবা মানুষ খায় এমনকি চুরি করেও খায় তবুও সে গাছের মালিক সদকার সওয়াব পায়। কেউ গাছ রোপণ করে মারা গেলে তিনি মৃত্যুর পরও সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব পেতে থাকেন এর বিনিময়ে। ধর্মীয় এ অমূল্য বাণীগুলো থেকে বোঝা যায় বৃক্ষরোপণ করা কত বড় মহৎ, কল্যাণ, সওয়াব আর পরিবেশবান্ধব কাজ। নির্মল পরিবেশ রক্ষায় গাছের অবদান অপরিসীম। গাছহীন পরিবেশ মস্তকবিহীন দেহের সমান। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় একটি দেশে শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। পরিবেশ বলতে আমাদের আশপাশের দৃশ্য-অদৃশ্য বস্তু, যেমন- নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল, বায়ু, আলো, শব্দ, এসবের সমন্বিত প্রভাব, যা মানুষের এবং পুরো জীব জগতের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে। কথায় আছে, বলবো কিরে ভাই, সবার কাছে বলে যাই, যেই দেশে নাই তরু, সে দেশটা আসলেই মরু। এটি কিন্তু মধু ছন্দ কথা নয় আসল কথা।
গাছ যেভাবে উপকার করে
গাছ গ্রিন হাউস প্রভাবকে প্রশমিত করে, মাটিতে জৈবপদার্থ যোগ করে মাটির উর্বরতা বাড়ায়, মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা করে, বহুমুখী খাদ্যের জোগান দেয়, বিশুদ্ধ বাতাস দেয়, দূষিত বাতাস শোষণ করে এর বিষাক্ততা থেকে জীবজগৎকে রক্ষা করে, ওষুধের উপাদান সরবরাহ করে, জ্বালানি, খুঁটি ও গোখাদ্যের জোগান দেয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রশমিত করে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়ায়, চিত্তবিনোদনের উৎস হিসেবে কাজ করে, আসবাবপত্রের জন্য কাঠ সরবরাহ করে, মানুষের আপদকালে বীমা তুল্য কাজ করে, লবণাক্ততা কমায়। তাছাড়াও গাছ অক্সিজেন তৈরি করে, যা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যকীয়ভাবে প্রয়োজন; বাতাসের অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণের মাধ্যমে পরিবেশ নির্মল বিশুদ্ধ রাখে; মাটির বিষাক্ত পদার্থ ও মাটির অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ শুষে নিয়ে মাটিকে পরিষ্কার রাখে; বাতাস পরিষ্কার রাখে, বাতাসের ধূলিকণা ধরে নির্মল রাখে, তাপ কমায় এবং বায়ু দূষণকারী কার্বন-মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, শোষণ করে; ছায়া দেয়, মায়া দেয় এবং আবহাওয়া ঠা-া রাখে; মাটির ক্ষয় রোধ করে। গাছের শিকড় মাটিকে বেঁধে রাখে এবং গাছের পাতা বাতাসের গতি ও বৃষ্টির গতিকে দমিয়ে রাখে, যা মাটির ক্ষয়রোধে সহায়তা করে; যখন আবাসন গৃহে সৌন্দর্য বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হয়, তখন তার মূল্য অনেক বেড়ে যায়। তাই গাছ আবাসন সম্পদের মূল্য বাড়ায়; মাটিতে পানি ধরে রাখতে সাহায্য করে; মাটির ভেতরে পানির উচ্চতা বাড়াতে সাহায্য করে; প্রস্বেদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বায়ুম-লে যে পানি ছাড়ে তাতে পরিবেশ শীতল থাকে, মেঘ ও বৃষ্টির সৃষ্টি হয়; আমাদের বিভিন্ন বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে। গাছের মতো এত বহুমুখী উপকার আর কেউ কোনোভাবে কখনও করে না।
পরিবেশ রক্ষায় গাছ রোপণ
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। আমাদের রয়েছে সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন মাত্র ১০ ভাগ বনভূমি এবং ৭ ভাগ গ্রামে গঞ্জে রোপিত বা সৃজিত বনভূমি। পর্যাপ্ত বনভূমি না থাকায় আমরা যে সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছি বা সম্মুখীনÑ তা হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে এবং উত্তরাঞ্চল মরুময় হয়ে যাচ্ছে। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক বাড়ছে, বাতাসে জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর ক্লোরোফ্লোরো কার্বন, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। বায়ুম-লে ওজন স্তরে ফাটল সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ক্ষতিকর অতি বেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে চলে আসছে। তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে মেরু অঞ্চল, এন্টার্টিকা মহাদেশের বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে মরুময়তা, রাজশাহী বরেন্দ্র অঞ্চলে অনাবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, প্লাবন, দেরিতে বৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামী ২ দশকের মধ্যে বিশ্বের ৬০০ মিলিয়ন মানুষ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বর্তমানে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০৩০ সাল নাগাদ বেড়ে হবে ৩৪০ বিলিয়ন ডলার। গবেষকদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
অপরিকল্পিভাবে গাছ কাটার কুফল
ক্রমাগত গাছ কাটার ফলে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ বিলুপ্ত প্রায়। বাংলার হাজারো প্রজাতির পশুপাখি ও জলজপ্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ৫ হাজার প্রজাতির গাছের মধ্যে ১০০টির বেশি অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্ত। ৬৩২টি প্রজাতির পাখির মধ্যে ১২টি প্রজাতি এরই মধ্যে বিলুপ্ত, ৩০টি প্রজাতি বিলুপ্তের পথে। ১১০টি পশু প্রজাতির ৪০টির অস্তিত্ব নেই। ৭৮০টি প্রজাতির মাছের মধ্যে ৫৪টির অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। আশঙ্কার কথা ২০২০ সালের মধ্যে কৃষি উৎপাদন ৩০ ভাগ কমে যেতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার ২২ শতাংশ কৃষি জমি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
গাছ আমাদের কী দেয়
একটি গাছ ১ বছরে আমাদের যা দেয় তা হলো ১০টি এয়ারকন্ডিশনার সমপরিমাণ শীততাপ তৈরি করে, ৭৫০ গ্যালন বৃষ্টির পানি শোষণ করে এবং ৬০ পাউন্ডের বেশি ক্ষতিকারক গ্যাস বাতাস থেকে শুষে নেয়। ১ গ্রাম পানি বাষ্পীভবনে ৫৮০ ক্যালরি সৌরশক্তি ব্যয় হয়। ১টি বড় গাছ দিনে ১০০ গ্যালন পানি বাতাসে ছেড়ে দেয়। ১ হেক্টর সবুজ ভূমি থেকে উদ্ভিদ প্রতিদিন গড়ে ৯০০ কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং ৬৫০ কেজি অক্সিজেন দেয় সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকালে। ১টি মাঝারি আকৃতির আমগাছ ৪০ বছরে ১৪ লাখ টাকা মূল্যের অক্সিজেন তৈরি করে। ৫ হেক্টর পরিমাণ বনভূমি থাকলে এলাকার ৩-৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা কমে যায়, ভূমিক্ষয় রোধ এবং বাতাসে আর্দ্রতা বাড়ায়। বৃক্ষরাজি ৮৫-৯০% শব্দ শোষণ করে, শব্দ দূষণ থেকে আমাদের রক্ষা করে।
১ লাখ ইট পোড়াতে ২৫০০ মণ জ্বালানি কাঠ দরকার হয়। আমাদের দেশে প্রতি বছর রান্নার জন্য প্রায় ১০৭ কোটি মণ জ্বালানি কাঠ দরকার হয়। জরিপ বলে ফিনল্যান্ডে ৭৪%, মিয়ানমার ৬৪%, জাপানে ৬৩%, সুইডেনে ৫৫%, কানাডাতে ৪৫%, যুক্তরাষ্ট্রে ৩৪% এবং ভারতে ২০% আর বাংলাদেশে মাত্র ০৯% মতান্তরে ১৭% বনায়ন আছে। অথচ কমপক্ষে ২৫% বনভূমি থাকা প্রয়োজন। একজন সুস্থ মানুষের দৈনিক প্রায় ২৫০ গ্রাম সবজি এবং ১১৫ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে আমরা মাথাপিছু ৪০-৪৫ গ্রাম করে ফল খেতে পারছি। সাধারণত মানুষের মেধা বিকাশের শতকরা ৪০ ভাগ হয়ে থাকে মাতৃগর্ভে এবং অবশিষ্ট ৬০ ভাগ বিকাশ হয়ে থাকে জন্মের ৫ বছরের মধ্যে। ভিটামিন-এ’র অভাবে প্রতি বছর প্রায় ৩০-৪০ হাজার শিশু রাতকানা রোগে অন্ধত্বের শিকার হয়। অথচ পুষ্টি জোগান এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ফলগাছের রয়েছে ব্যাপক অবদান।
ইতিহাসের প্রমাণ করে, গাছ লাগিয়েছেন আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ (সা.)। স¤্রাট আকবর তৈরি করেছেন আ¤্রকানন যা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আজও বিরাজমান, স¤্রাট শাহজাহান তৈরি করেছেন লাহোরের সালিমারবাগ, ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান এখনও জলন্ত দৃষ্টান্ত। তাছাড়া প্রচলিত হয়ে আছে, কোনো ভালো উদ্যোগ বা কাজ শুরু করলে তার উদ্বোধন করা হয় গাছ লাগিয়ে। এক সময়ের ঘোড়া দৌড় আর মূল্যহীন কাজের আড্ডা ছিল ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি নারিকেল গাছের চারা রোপণ করে রেসকোর্স ময়দানের নতুন নাম দেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ১৮ ক মোতাবেক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও নিরাপত্তা বিধান করা হয়েছে সুস্পষ্টভাবে।
বৃক্ষ রোপণে চারা-কলম নির্বাচন
গাছ লাগানো কার্যক্রমে শুরুতেই ফলের আদর্শ চারা কলম নির্বাচন করতে হবে। আদর্শ চারার বৈশিষ্ট্য হলো কা- মোটা, খাটো ও মূলের বৃদ্ধি সুষম হতে হবে। তাছাড়া সঠিক বয়সের চারা ও রোগমুক্ত, সতেজ ও সুস্থ সবল চারা সংগ্রহ করতে হবে। বিশ্বস্ত সরকারি কিংবা বেসরকারি নার্সারি থেকে চারা কলম সংগ্রহ করতে হবে।
চারা-কলম রোপণের সময়, কৌশল
বর্ষাকাল সাধারণত আমাদের দেশে চারা-কলম রোপণের উৎকৃষ্ট সময়। রোপণের সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে সাধারণত সারা বছরই ফলের চারা-কলম লাগানো যায়। তবে বর্ষার আগে অর্থাৎ বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস এবং বর্ষার পরে সাধারণত ভাদ্র-আশ্বিন মাসে চারা রোপণের আদর্শ সময়। যে কোনো গাছের চারা রোপণ করার সর্বোত্তম সময় দিনের শেষভাগে অর্থাৎ পড়ন্ত বিকাল বেলায়। বর্ষার শুরুতে বা প্রথম বৃষ্টির পরপরই চারা লাগানো উচিত হবে না। কারণ প্রথম কয়েক দিন বৃষ্টির পরপরই মাটি থেকে গরম গ্যাসীয় পদার্থ বের হয়, যা চারা গাছের জন্য খুবই ক্ষতিকর এমনকি চারা মারা যায়। চারা-কলম রোপণের জন্য শুরুতেই সঠিক জায়গা নির্বাচন করা দরকার। যেখানে সরাসরি সূর্যের আলো পড়ে, বন্যামুক্ত উঁচু জায়গা যেখানে পানি জমে না সেসব জায়গা নির্বাচন করে জায়গাটি ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। নির্দিষ্ট দূরত্বে চারা রোপণের জন্য গর্ত করতে হবে। ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণের ক্ষেত্রে জাতওয়ারি দূরত্ব ও গর্ত তৈরি করতে ভিন্নতা রয়েছে। গর্ত খনন করার সময় নিচের মাটি একদিকে এবং ওপরের মাটি অন্যদিকে রাখতে হবে। গর্তের ওপরের মাটির সাথে চারা গাছের প্রকার ও জাতভেদে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিংক ও বোরন সার ব্যবহার করতে হবে। তবে অবশ্যই পচা গোবর বা যে কোনো ধরনের কম্পোস্ট সার মাটির সাথে খুব ভালোভাবে মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে। সার মেশানোর ১০-১৫ দিন পর চারা রোপণ করতে হয়। মাটি শুকনো হলে পানি দিয়ে হালকা ভিজিয়ে নিলে ভালো হবে। গর্তে মাটি ভালোভাবে বসিয়ে মাঝখানে কিছু উঁচু করে নিতে হবে।
রোপণের পর ব্যবস্থাপনা
বিশ্বস্ত স্বনামধন্য ভালো নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহের পরপরই ছায়াযুক্ত জায়গায় কয়েক দিন শুয়ে রাখতে হবে। এ অবস্থাকে চারা গাছের হার্ডেনিং বা সহিষ্ণুকরণ-শক্তকরণ বলা হয়। হার্ডেনিংয়ের ফলে চারা গাছের মরে যাওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে যায়। এ অবস্থায় মাঝে মধ্যে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে চারার গোড়ায় লাগানো মাটির চাকাটি যেন কোনোভাবেই ভেঙে না যায়। চারা লাগানোর আগে রোগাক্রান্ত, জীর্ণপাতা ও ডালপালা, অতিরিক্ত শেকড় ছেঁটে দিতে হবে। তারপর সতেজ, সবল, রোগমুক্ত, সোজা এবং কম শাখা প্রশাখা বিশিষ্ট চারা অর্থাৎ আদর্শ চারা নির্বাচন করতে হবে। চারায় সংযুক্ত পলিব্যাগ এমনভাবে অপসারণ করতে হবে যাতে চারার গোড়ার মাটির চাকা ভেঙে গুঁড়িগুঁড়ি না হয়ে যায়। চারার গোড়ার চারপাশে কোঁকড়ানো বা আঁকাবাঁকা শিকড় কেটে দিতে হবে। তারপর চারার গোড়ার মাটির চাকাসহ চারাটি গর্তে আস্তে আস্তে আলতো করে অত্যন্ত যত্ন সহকারে বসিয়ে দিতে হবে। বীজতলায় চারাটির যতটুকু অংশ মাটির নিচে ছিল রোপণের সময় ঠিক ততটুকু অংশ মাটির নিচে রাখতে হবে। তারপর চারার চারপাশে ফাঁকা জায়গায় প্রথমে ওপরের উর্বর মাটি এবং পরে নিচের মাটি দিয়ে ভালোভাবে পূরণ করে দিতে হবে। চারপাশের মাটি ভালোভাবে শক্ত করে চেপে ঠেসে দিতে হবে যাতে কোনো ফাঁকা জায়গা না থাকে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো লাগানো চারায় খুঁিট দেয়া। চারা যেন হেলে না পড়ে সেজন্য শক্ত খুঁটি মাটিতে পুঁতে চারার সাথে এমনভাবে বেঁধে দিতে হবে যেন চারা খুঁটির সাথে লেপ্টে লেগে না থাকে। চারা রোপণের পরপরই চারার গোড়ায় ও পাতায় পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। ছাগল, গরু, ভেড়া এসবের হাত থেকে চারাকে রক্ষা করার জন্য খাঁচা-বেড়া প্রোটেকশন দিতে হবে। নতুনকুঁড়ি বা পাতা বের না হওয়া পর্যন্ত সার প্রয়োগ করা ঠিক হবে না। ফলদ গাছের ক্ষেত্রে বাড়বাড়তি এবং বয়স আশানুরূপ না হওয়া পর্যন্ত ফুল ফল ভেঙে দিতে হবে।
চারা-কলম লাগানোর পর কোনো কারণে মারা গেলে দ্রুত নতুন চারা-কলম সে গর্তে রোপণ করতে হবে। রোপণকৃত চারা-কলমে পোকা বা রোগে আক্রান্ত হলে সাথে সাথে সমন্বিত বালাই দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। গাছের আকার আকৃতি সুন্দর ও ফলন বাড়ানোর জন্য অঙ্গ ছাঁটাই ও পাতলাকরণ, শাখা ডাল কাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সিকেচার দিয়ে নিয়মিতভাবে রোপণের দুই বছরের মধ্যে পার্শ্বশাখা, চিকন, নরম ও রোগাক্রান্ত শাখা কেটে দিতে হবে। সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে চারা বাড়ার সাথে সাথে প্রতি বছর সারের পরিমাণ ১০ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে। গাছে বছরে অন্তত দুইবার সার দিতে হয়। একবার বর্ষার আগে এবং আরেকবার বর্ষার পরে। সুষমসার অবশ্যই জৈব এবং রাসায়নিক সারের সমন্বয়ে দিতে হবে। বড় গাছের গোড়া থেকে কমপক্ষে ০১-০২ মিটার দূর পর্যন্ত গোড়ার কাছাকাছি অংশ যেন অক্ষত থাকে সেভাবে মাটি কোঁদাল দিয়ে ঝুরঝুরি করে সার ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। সার দেয়ার পরপর পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। শীতকালে নিয়মিত সেচ আর বর্ষাকালে নিকাশের ব্যবস্থা নিশ্চিত রাখতে হবে। শীতকালে গাছের গোড়ায় জৈব আবর্জনা দিয়ে মালচিং দিলে ভালো উপকার পাওয়া যায়, গাছের বাড়বাড়তি বেশি হয়, ফলন বাড়ে।
শেষ কথা
সাম্প্রতিক তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতি মিনিটে গড়ে ২১ হেক্টর বনভূমি উজাড় হচ্ছে। প্রতি বছর প্রায় ১৪.৬ মিলিয়ন হেক্টর বনাঞ্চল ধ্বংস হচ্ছে, যা আয়তনে বাংলাদেশের প্রায় সমান। এজন্য আমাদের প্রাণের পৃথিবীকে বাঁচাতে টিকাতে হলে প্রত্যেকেই কমপক্ষে একটি ফলদ, একটি বনজ ও একটি ঔষধি গাছ লাগিয়ে দেশে ৫১ কোটি বৃক্ষরোপণ অনায়াসে সম্ভব। আমরা ১৭ কোটি মানুষের সবাই যদি আমাদের জন্মদিনে, প্রিয়জনের বিয়ে বার্ষিকীতে, না ফেরার দেশে চলে যাওয়া প্রিয়জনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এবং ঈদে, পূজায়, বড়দিনে, বুদ্ধ পূর্ণিমায়, উৎসবে, পার্বণে, নববর্ষে আমরা সবাই বনজ, ফলদ, ভেষজ গাছের অন্তত ৩টি করে চারা-কলম রোপণ করে মানুষের উচ্চতা সমান টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে পারি তাহলে ভাবতে পারি কি অভাবনীয় সফলতা কল্যাণ বয়ে আসবে এ দেশটির। প্রাকতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে বৃক্ষ ও বনের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ, মমত্ববোধ বাড়াতে হবে জ্যামিতিক হারে। কেননা বৃক্ষই আমাদের জীবন এবং আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য স্রষ্টার অপূর্ব নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। প্রাণে যদি বাঁচতে চান, বেশি করে গাছ লাগান। নিয়মিত গাছের যত্ন নিন; গাছকে ভালো রাখুন, গাছও আপনাকে ভালো রাখবে। আপনি আপনারা সবাই ভালো থাকুন গাছের চারা-কলম রোপণ করে টিকিয়ে রেখে। একটাই পৃথিবী সবার দ্বারা সবার জন্য।
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
(কৃতজ্ঞতা : মোহাইমিনুর রশিদ)।
*পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা
ফল হলো নিষিক্ত ও পরিপক্ব ডিম্বাধার। অন্য কথায় ফল বলতে আমরা বুঝি আম, জাম, পেয়ারা, কলা, পেঁপে, কাঁঠাল, আনারস, আপেল, আঙুর আর লেবু এবং কমলালেবুকে। কেননা, চোখের সামনে এদের প্রায় সব সময় দেখি, হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। এসব ফল দেশের প্রায় সব এলাকাতে জন্মে। এসব ফলকে তাই আমরা বলি প্রচলিত ফল। এসব ফলের বাইরেও অনেক ফল পাওয়া যায়। এসব ফলকে বলা হয় অপ্রচলিত বা স্বল্প পরিচিত ফল। অর্থাৎ এসব ফলের অস্তিত্ব আছে, খুঁজলে পাওয়া যায় কিন্তু যখন তখন চোখে পড়ে না, দেশের সব এলাকায় জন্মে না, গাছের দেখা মেলে খুব অল্প। চাহিদা কম, প্রাপ্যতা কম, এদের অনেকে বনেবাদাড়ে নিতান্ত অনাদরে অবহেলায় বেড়ে ওঠে। প্রগতির ধারায় কেউ এদের পরিকল্পনায় আনে না। চাষাবাদ দূরে থাক প্রয়োজনীয় খাবার কিংবা পানিও অনেকের ভাগ্যে জোটে না। কোনো কোনোটার ঔষধিগুণ ও মানুষের জন্য উপকারী নিরামক, ধাতব ও অত্যন্ত প্রাণ রাসায়নিক দ্রব্যাদিতে সমৃদ্ধ হলেও মানুষের রসনাকে তৃপ্ত করতে পারছে না। অতীতে ফলের সংখ্যা হয়তো আরও বেশি ছিল। নানা কারণে এবং আমাদের অসচেতনতায় সেসব ফলের অনেকই দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এরা দিন দিন বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে।
অনাদিকাল ধরে যেসব ফল এদেশে চাষ হয়ে আসছে সেগুলোই আমাদের দেশি ফল। এ পর্যন্ত এ দেশে মোট ১৩০টি দেশি ফলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৬০টি বুনো ফল। তবে সেসব ফলও যথেষ্ট পুষ্টিসমৃদ্ধ ও সুস্বাদু। বাকি ৭০টি ফলের মধ্যে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, নারিকেল, লিচু, কুল, লেবু, আনারাস, কলা ও পেঁপে এ ১০টি এ দেশের প্রধান দেশি ফল।
দেশি ফল কোনোগুলো? এটা একটি বিতর্কিত প্রশ্ন বটে। সহজে উত্তর হলো যেসব ফলের উৎপত্তি ও চাষ এ দেশের ভূখণ্ডে বা এ অঞ্চলে সেসব ফলকে আমরা দেশি ফল বলতে পারি। তর্কটা সেখানেই, ফল তো দেশ চেনে না। তার উপযুক্ত জলবায়ু ও মাটি যেখানে সেখানে সে জন্মে থাকে। সে অর্থে যেসব ফলের উৎপত্তি আমাদের অঞ্চলে সেসব ফলের সংখ্যা খুবই কম। অধিকাংশ ফলই হাজার হাজার বছর আগে অন্যান্য দেশ থেকে এ দেশে এসে খাপ খাইয়ে নিয়েছে এবং কালক্রমে সেগুলো আমাদের ফলে পরিণত হয়েছে। সব বিদেশি ফল আবার এ দেশে ভালো ফল দেয় না। যেসব ফল অনায়াসে এ দেশে জন্মে ও ভালো ফলন দেয় সেসব ফলকে এখন আমরা দেশি ফল হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। দেশীয় এসব ফলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এসব ফল একরকম বিনা যত্নেই এ দেশের মাটিতে ভালো ফলে। সাধারণত এসব ফলের গাছের তেমন কোনো সার সেচ দেয়া হয় না। এ দেশের মাটি ও জলবায়ুতে খুব ভালোভাবে এসব ফলের গাছ মানিয়ে গেছে। ঝড়-বাতাস কিংবা বন্যা খরাও অনেক দেশি ফলের গাছকে সহজে মারতে পারে না। এ যে দেশি ফলের ব্যাপকভাবে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা বা ওয়াইড অ্যাডাপ্টিবিলিটি, তা কিন্তু অনেক বিদেশি ফলেরই নেই।
দেশি ফলের আর একটা সুবিধা হলো, বিদেশি ফলের বা উন্নত জাতের ফল গাছের মতো এসব ফল বা ফল গাছে অত বেশি রোগ পোকার আক্রমণ হয় না। তবে দেশি ফলে সবচেয়ে বেশি মেলে পুষ্টি। দেশি ফলের মতো এত বেশি পুষ্টি কখনও বিদেশি ফলে মেলে না। একটা ছোট্ট আমলকীতে যে পরিমাণ ভিটামিন সি আছে তা পাঁচটা বড় কমলাতে পাওয়া যাবে না। তাছাড়া আমাদের দেশে কলা, কুল, নারিকেল ছাড়া প্রায় সব ফলই জন্মে গ্রীষ্ম বর্ষার। কিন্তু দেশি অনেক ফল আছে যেগুলো অন্য মৌসুমেও জন্মে। তাই সারা বছর ধরেই বলতে গেলে ফল খাওয়ার একটা সুবিধা মেলে। শুধু পুষ্টি বা প্রাপ্যতার দিক দিয়ে নয়, এখন অনেক দেশি ফলের দাম বিদেশি ফলের চেয়ে কম নয়।
আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু, কলা, আনারস, পেঁপে, নারিকেল ও কুল এ ৯টি আমাদের দেশের প্রধান ও প্রচলিত দেশি ফল; এগুলোকে আমরা সবাই চিনি। অনেকেই হয়ত চিনি আরও কিছু অপ্রধান ও স্বল্প আকারে চাষকৃত ফল সফেদা, কামরাঙা, লটকন, আমড়া, বাতাবিলেবু, কদবেল, বেল, জলপাই, তাল, খেজুর, তেতুঁল, জাম, জামরুল, আমলকী, বাঙি, তরমুজ, পেয়ারা ফলকে। কিন্তু অনেকেই চিনি না লুকলুকি, ডেউয়া, ডেফল, করমচা, জংলিবাদাম, কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, গোলাপজাম, তুঁত, তিনকরা, সাতকরা, আদা জামির, জামির, মনফল, অরবরই, আঁশফল, তারকা ফল, গাব, বিলাতি গাব, আতা, শরিফা, কাউফল, তৈকর, ডালিম, চালতা, ডুমুর, বৈঁচি, টকআতা, পানিফল, সিঙ্গাড়াফল, জিলাপিফল, পদ্মফল, মাখনা, রুটিফল, বকুল, ফলসা, চুকুর, পাদফল, চিকান, পানকি চুনকি, টুকটুকি বা টাকিটাকি, বিলিম্বি, ডালিম, ক্ষুদিজাম ফলকে। এ ফলগুলোর অধিকাংশই এখন বিপন্ন। বসতবাড়িতে দু-একটি গাছ রয়েছে, বনে জঙ্গলেও কিছু আছে। অথচ পুষ্টি মানে এমনকি স্বাদ বৈচিত্র্যে এসব ফলের কোনো তুলনা হয় না। কেননা এক এক ফলের স্বাদ ও পুষ্টিগুণ এবং ভেষজ মূল্য এক এক রকম। অথচ এক রকম অবহেলা করেই আমরা আমাদের এসব ফলকে হারাতে বসেছি। তবে আমাদের সৌভাগ্য যে, এখনও অল্প স্বল্প হলেও এর অনেক ফলই দেশের মাটিতে টিকে আছে। এরই মধ্যে অনেক দেশি ফলকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তাই চাষের উদ্যোগ না নিলে বন থেকে বুনো ফল হিসেবেই হয়ত তা এদেশ থেকে অচিরেই হারিয়ে যাবে।
তবে এখন যেটা জরুরি এসব জার্মপ্লাজমকে দেশের মধ্যে টিকিয়ে রাখা। বিলুপ্ত হওয়ার আগেই পদক্ষেপ নেয়া দরকার। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্যানতত্ত্ব বিভাগে একটি ফলের জার্মপ্লাজম সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে, গবেষণাও চলছে সেখানে। ১৯৯১ সাল থেকে তরুণ মেধাবী ও বুদ্ধিদীপ্ত গবেষকদের নিরলস গবেষণার ফলে বিভিন্ন প্রজাতির ফলের জাত বের করা সম্ভব হয়েছে। এ জাতগুলোর মধ্যে আমের ২৫টি, পেয়ারার ১০টি, কুলের ৩টি, লেবুর ৪টি, জাম্বুরার ৫টি, লিচুর ৪টি, তেঁতুল ৩টি, কামরাঙা ৩টি, জলপাই, লটকন, আমলকী, ডুমুর, অরবরই, কদবেল, কাঁঠাল ও আমড়ার ১টি করে জাত, জামরুলের ৩টি ও সফেদার ৩টি জাত রয়েছে। এ জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার চারা ১৯৯১ সাল থেকে VFFP CARE-SHABGE এর মাধ্যমে উত্তরবঙ্গে ৯৯৭টি মাতৃগাছের বাগান তৈরি করে দিয়েছে এবং ২০০২ সাল থেকে World Vision Bangladesh এর মাধ্যমে ৭৯৫টি মিশ্রফলের বাগান স্থাপন করেছে। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশেষ করে YRFPProject-DAE, BRAC, PROSHIKA, CARITAS, BADC, DAE, CDCS, IDEA, CHEVRON, PARI, fh Bangldesh, NEElachol, Paragon group, MATI, CARE, FAO,UNDP I World Vision Bangladesh এর মাধ্যমে অসংখ্য বংশানুক্রমিক (PEDIGREE) মাতৃগাছ কৃষকের দোরগোড়ায় সম্প্রসারণ করে যাচ্ছে। বংশীয় মাতৃগাছের ক্ষেত্রে এ সেন্টারটি এদেশের মানুষের কাছে অতি পরিচিত, অনন্য।
বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার, বাকৃবি, ময়মনসিংহ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অতিরিক্ত লবণাক্ত মাটি, পাহাড়ি এলাকায় অম্লীয় মাটি, মঙ্গা এলাকায় বেলে মাটি ও বন্যা কবলিত উর্বর বেলে দো-আঁশ মাটিতে জার্মপ্লাজম সেন্টার কর্তৃক মুক্তায়িত ফলের অভিযোজন যাচাইয়ের ওপর গবেষণা করেছে। এ গবেষণাটি ড্যানিডার অর্থায়নে বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার কর্তৃক উদ্ভাবিত ১৬টি জাতের দেশের দক্ষিণাঞ্চলে, উত্তরাঞ্চলে এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ৮টি জেলার ১৫টি উপজেলার প্রত্যেকটিতে ৩০ শতাংশ জমির ওপর ১২৯৬০টি চারার সমন্বয়ে ৬০টি মিশ্রফল বাগান তৈরি ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এডাপটেশন ট্রায়াল করা হয়, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটেও গবেষণা চলছে। এ ইনস্টিটিউটেও ফলের বিভিন্ন প্রজাতির ফলের জাত নিবন্ধন করেছে। এ জাতগুলোর মধ্যে আমের ১৫টি, কাঁঠাল ৩টি, কলা ৪টি, পেঁপে ১টি, পেয়ারা ২টি, বাতাবিলেবু ৩টি, লেবু ২টি, নারিকেল ২টি, আমড়া ১টি, আমলকী ১টি, বিলাতি গাব ১টি, সফেদা ৩টি, কুলের ৪টি, কামরাঙা ২টি, তেঁতুল ১টি, লিচু ৫টি, জামরুল ২টি, জলপাই, কদবেল, বেলের ১টি করে জাত। এসব জাতগুলো বিভিন্ন বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্প্রসারণ হয়ে আসছে।
সরকারও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব ফলকে জনপ্রিয় ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর জাতীয় পর্যায়ে ফল প্রদর্শনীর আয়োজন করছেন। দেশের প্রতিটি বাড়িতে এ বৃক্ষরোপণ মৌসুমে বিলুপ্ত প্রায় অপ্রচলিত ফলের অন্তত একটি চারা রোপণ করা উচিত বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। তা হলে হয়তো খুব অল্প সময়েই জেগে উঠতে পারে হারানো ফলের হারানো রাজ্য, বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে অনেক ফল প্রজাতি। তবে তার আগে যেটা দরকার সেটা হল বিলুপ্ত প্রায় ফলগুলো চিহ্নিত করা এবং এগুলোর ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করা, যেগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পথে সেগুলো রক্ষা করার চেষ্টা করা। আর যেগুলো অবাঞ্ছিত হয়ে পড়ে আছে তাদের উপড়ে তোলার পথ খোঁজা।
শুধু সরকার দেশি ফল প্রসারের ক্ষেত্রে ভূমিকা নিলে তা পরিপূর্ণ হবে না, এজন্যই দরকার দেশের সব জনগণের সম্মিলিত কার্যকর অংশগ্রহণ। প্রয়োজন ও প্রাপ্তির ব্যবধানের কারণ একদিকে যেমন সচেতনতার অভাব অন্যদিকে রয়েছে উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা। তাই দেশের খাদ্যপুষ্টির চাহিদা পূরণসহ আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে দেশি ফলের উৎপাদন ও ব্যবহার অনস্বীকার্য। সুতরাং স্বাদে, গন্ধে, পুষ্টিতে শ্রেয়তর আমাদের বর্ণিল দেশীয় ফলগুলোর উৎপাদন দেশব্যাপী সারা বছর বাড়িয়ে তুলতে হবে। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রয়োজন উপযুক্ত সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থাপনা। এতে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ পরিসরে গড়ে উঠবে আরও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প। ফলে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি হবে আরও মজবুত ও গতিশীল, দেশবাসী পাবে খাদ্যে পুষ্টিমানসম্পন্ন একটি ভবিষ্যৎ।
প্রফেসর ড. এম. এ. রহিম*
ড. মো. শামছুল আলম (মিঠু)**
*উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ ও পরিচালক, জার্মপ্লাজম সেন্টার, বাকৃবি; **সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, বিনা, ময়মনসিংহ
বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু ফল চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রতিটি বাড়ির আঙিনায়, খেতের আইলে, নদ-নদী, খাল-বিলের পাড়ে পতিত জমিতে সর্বত্রই রয়েছে নানা রকম ফল গাছ। তাছাড়া পরিকল্পিতভাবে এখন মানুষ গড়ে তুলছে নানা রকম ফলের বাগান। এখন আর কেবল শখের বশে নয়, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দেশের নানা স্থানে আবাদ করা হচ্ছে নানা রকম ফলদ বৃক্ষ। এদেশে এ পর্যন্ত প্রায় ১৩০ রকম ফলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে আম, কাঁঠাল, লিচু, নারিকেল, পেয়ারা, কুল, লেবু, কলা, আনারস ও পেঁপে আমাদের দেশের প্রধান ও প্রচলিত ফল। এগুলো আমরা সবাই চিনি। দেশের প্রায় সর্বত্রই এসব ফল জন্মে। তাই এসব ফলকে আমরা প্রচলিত ফল বলি। আবার প্রায় ৭০ ধরনের ফল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে থাকে যা অপ্রচলিত ফল নামে পরিচিত। অপ্রচলিত মানে এসব ফলের অস্তিত্ব আছে, খুঁজলে পাওয়া যায় কিন্তু যখন তখন দেখা যায় না, দেশের সব এলাকাতে জন্মে না, কোনো কোনো এলাকাতে স্বল্প পরিসরে জন্মে। তবে এদের অনেকে বনে জঙ্গলে অনাদরে ও অবহেলায় বেড়ে ওঠে। এরা অবহেলিত হলেও গুরুত্বহীন নয়। এদের কোনো কোনোটায় ভিটামিন, খনিজ, পুষ্টিমান, ও ঔষধি গুণ অনেক বেশি। রোগব্যাধি আরোগ্যের ক্ষেত্রে এদের জুড়ি নেই। রোগের আরোগ্যের দিক থেকে বলা যায় যে ‘ঋতু ভিত্তিক দেশীয় ফলে, সকল রোগের আরোগ্য মেলে’। এ দেশের অপ্রচলিত ফলের মধ্যে প্রায়শই দেখা যায় যেমনÑ সফেদা, কামরাঙা, লটকন, বিলাতি আমড়া, বাতাবিলেবু, কদবেল, বেল, জলপাই, তাল, কালোজাম, করমচা, কাজুবাদাম, গোলাপজাম, আদা জামির, আঁশফল, দেশি গাব, বিলাতিগাব, আতা, শরিফা, কাউফল, খেজুর, জামরুল, আমলকী, টকলেবু, চালতা, ডুমুর, বৈচি, তেঁতুল, দেশি আমড়া, বকুল, বেতফল, ফলসা, জামরুল, বিলিম্বি, অরবরই, লুকলুকি, তৈকুর, ডেউয়া, সাতকরা, পানি ফল, কাগজিলেবু, মহুয়া, চাপালিশ, ইত্যাদি ফল। নানা কারণে এবং আমাদের অসচেতনতায় কিছু কিছু ফল এদেশ থেকে দিন দিন বিলুপ্তির পথে ধাবিত হচ্ছে। যেমন- বৈচি, লুকলুকি, আদাজামির, কাউফল, চালতা, টাকিটুকি, পানকি চুনকি, তিনকরা, সাতকরা, আঁশফল ইত্যাদি। উপকূলীয় অঞ্চলের একটি গবেষণা পত্রের ফল অনুযায়ী পটুয়াখালী জেলার সাতটি উপজেলায় ৪৫ ধরনের অপ্রচলিত ফলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে গড়ে প্রতিটি উপজেলাতে ৩৬ ধরনের অপ্রচলিত ফল পাওয়া গেছে।
ফল একটি অর্থকরী ফসল। অপ্রচলিত ফল আমাদের অনেক কাজে লাগে। যেমন- জ্বালানি কাঠ, নদীভাঙন রোধ, ঘরের আসবাবপত্র, বিল্ডিংয়ের পাইলিং করতে, মাছ ধরার জালের রঙ তৈরিতে, নৌকা তৈরিতে, উন্নত জাত উন্নয়নে রুটস্টক হিসেবে, ফলদ বৃক্ষের ব্যবহার আছে। পুষ্টি নিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন, পরিবেশের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে অপ্রচলিত ফলের অনেক অবদান আছে।
ফল ভেষজ বা ঔষধিগুণে সমৃদ্ধ। নিয়মিত ফল খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং সুস্থ সবল জীবন যাপন করা যায়। বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৮৮ ভাগ মানুষ ভিটামিন এ, ৯০ ভাগ মানুষ ভিটামিন সি এবং ৯৯ ভাগ মানুষ ক্যালসিয়ামের অভাবে ভোগে। আমাদের এ পুষ্টি ঘাটতি পূরণে ফল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ফল আমাদের শরীরে ভিটামিন, আঁশ ও খনিজ উপাদান সরবরাহ করে। ফল কম খাবারের জন্য বাংলাদেশে ভিটামিন, আঁশ ও খনিজ উপাদান অভাবজনিত অপুষ্টি যেমন- রাতকানা, অন্ধত্ব, রক্তস্বল্পতা, গলগ-, স্কার্ভি ও বেরিবেরি এর হার পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের চেয়ে বেশি। এসব পুষ্টি উপাদান রোগ প্রতিরোধ ছাড়াও খাদ্য দ্রব্য হজম, পরিপাক, বিপাক, খাবারে রুচি বৃদ্ধি, বদহজম কোষ্টকাঠিন্য দূর করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ফলে প্রায় সব ধরনের পুষ্টি বিদ্যমান। ফলকে রোগ প্রতিরোধক খাদ্য বলা হয়। শরীরের রোগ প্রতিরোধের জন্য আমরা ফলকে খাদ্য হিসেবে গুরুত্ব দেই না। পুষ্টিবিদরা একজন প্রাপ্ত বয়ষ্ক লোকের দৈনিক ১১৫ গ্রাম ফল খাওয়ার সুপারিশ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা গড়ে ৭৭ গ্রাম ফল গ্রহণ করে থাকি। যা আমাদের শরীরের চাহিদার তুলনায় অনেক কম।
ভিটামিন সি এর প্রধান উৎস ফল। অপ্রচলিত দেশীয় ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে। ভিটামিন সি শরীরকে মজবুত, ত্বককে মসৃণ, সর্দি কাশি থেকে রক্ষা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। পুষ্টিবিদরা একজন বয়স্ক লোকের দৈনিক ৩০ মি.গ্রাম ও শিশুদের ২০ মি. গ্রাম ভিটামিন সি গ্রহণ করার সুপারিশ করেছেন। অপ্রচলিত ফল রান্না না করে কাঁচা বা পাকা অবস্থায় খেলে পুরো ভিটামিন সি আমাদের শরীরে কাজে লাগে। শরীরের চাহিদা মতো প্রতিদিন ফল গ্রহণ করলে চোখ, দাঁত, মাড়ি, হাড়, রক্ত, ত্বকসহ শরীরের প্রতিটি অঙ্গে পুষ্টি জোগাতে সাহায্য করে এবং সুস্থ সবল দেহ নিয় দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। প্রায় সব অপ্রচলিত ফলে কম বেশি খনিজ উপাদান বিদ্যমান। যেমন- কাউ ফলে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ও ফসফরাস, খেজুরে ক্যালসিয়াম, আয়রন, কপার, ম্যাগনেসিয়াম ও সালফার, আমড়াতে ক্যালসিয়াম ও আয়রন, তালে ক্যালসিয়াম, আয়রন, পটাসিয়াম পাওয়া যায়। অপ্রচলিত ফলে প্রচুর পরিমাণে জলীয় অংশ থাকে। এ জলীয় অংশ পানির সমতা রক্ষা, খাদ্য দ্রব্য হজম, পরিপাক ও দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সচল রাখতে সাহায্য করে। জাম্বুরাতে ৯০ গ্রামেরও বেশি জলীয় অংশ থাকে। জামরুল, জলপাই ও কামরাঙাতে ৮০ গ্রাম থেকে ৯০ গ্রাম জলীয় অংশ থাকে। এছাড়া বেল ও পাকা তালে ৭০ ভাগের কাছাকাছি জলীয় অংশ থাকে। ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আঁশ থাকে। কালোজাম, বেল ও আতা ফলের প্রতি ১০০ গ্রাম এর মধ্যে ২ গ্রামের বেশি আঁশ থাকে। আমড়া ও জামরুলে ১ গ্রাম থেকে ২ গ্রাম এবং অন্যান্য ফলে ১ গ্রামের কম আঁশ থাকে। আমাদের মোট খাদ্যের শতকরা ১ ভাগ আঁশ থাকা উচিত। ফলে ক্যালোরির পরিমাণ কম থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম অপ্রচলিত ফলের মধ্যে পাকা তাল, কামরাঙা, বেল ও আতা ফলে ৫০ থেকে ১০০ ক্যালরি শক্তি থাকে। অন্যান্য অনেক ফলে ৫০ ক্যালরির কম খাদ্য শক্তি থাকে। ফলে ক্যালরি কম থাকায় স্থূলাকায়ত্ব, ডায়াবেটিস ও মেদ বহুল লোকরা অনায়াসে ফল খেতে পারে। অপ্রচলিত দেশীয় হলুদ রঙের ফলে প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিন (প্রাক ভিটামিন এ) থাকে। প্রাপ্ত বয়স্ক একজন লোকের দৈনিক ৭৫০ মাইক্রো গ্রাম ও শিশুদের ২৫০ থেকে ৩০০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন-এ এর প্রয়োজন। ফলে অল্প পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকে, যার পরিমাণ প্রতি ১০০ গ্রামে ১০ থেকে ৫০ গ্রাম। এছাড়া ফলে ভিটামিন বি২ থাকে।
বাংলাদেশে অপ্রচলিত ফলের বংশগতি বিভিন্নতা ও ফল জীববৈচিত্র্য বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলের জীববৈচিত্র্য যত বেশি থাকবে বংশগতির বিভিন্নতাও তত বেশি হবে। যেমন- আমাদের দেশের আমলকী, জলপাই ও তেঁতুলের স্বাদ এখনও টক। বর্তমানে গবেষকরা অপ্রচলিত ফলের উন্নয়ন ঘটিয়ে মিষ্টি আমলকী, চালতা, কামরাঙা, জলপাই, ও তেঁতুলের উন্নত জাত তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন। অপ্রচলিত ফলের উন্নয়ন কে প্রাধান্য দিয়ে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের পরিচালনায় ২০১১ সালে হেকেপ (উচ্চ শিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্প) এর আর্থিক সহযোগিতায় প্লান্ট বায়োটেক ল্যাব এবং ফলদ বৃক্ষের জার্মপ্লাজম সেন্টার গড়ে উঠেছে। জার্মপ্লাজম সেন্টারের আয়তন ৪ একরের বেশি। পবিপ্রবি জার্মপ্লাজম সেন্টারটি দক্ষিণ অঞ্চলের একমাত্র বৃহৎ ফলদ বৃক্ষের সংরক্ষণ, গবেষণা ও উন্নয়নের প্রতিষ্ঠান। এ সেন্টারটিতে রয়েছে ৬০ প্রজাতির ৬৪৬টির বেশি দেশি-বিদেশি ফলের মাতৃগাছ। এতে স্থান পেয়েছে প্রচলিত ফলদ বৃক্ষ, অপ্রচলিত ফলদ বৃক্ষ, বিলুপ্ত প্রায় অপ্রচলিত ফলদ বৃক্ষ এবং ফলদ ঔষধি গাছ। দেশীয় অপ্রচলিত ফলের গবেষণার ওপর এ পর্যন্ত ৮ জন ছাত্রছাত্রী এমএস ডিগ্রি অর্জন করেছেন। দেশীয় অপ্রচলিত ফলের ওপর পিএইচডি গবেষক মি. চিত্তরঞ্জন সরকার এর ৩টি গবেষণা প্রবন্ধ বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত এ সেন্টার থেকে তরুণ মেধাবী ও বুদ্ধিদীপ্ত গবেষকদের নিরলস গবেষণার চেষ্টায় মোট ৮টি অপ্রচলিত ফলের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। যেমন- পিএসটিইউ বিলাতিগাব-১ (বীজবিহীন), পিএসটিইউ বিলাতিগাব-২ (বীজবিহীন), পিএসটিইউ ডেউয়া-১ (মিষ্টি), পিএসটিইউ ডেউয়া-২(মিষ্টি), পিএসটিইউ বাতাবিলেবু-১ (মিষ্টি), পিএসটিইউ কামরাঙা-১ (মিষ্টি), পিএসটিইউ কামরাঙা-২ (মিষ্টি) ও পিএসটিইউ তেঁতুল-১ (মিষ্টি)। ভবিষ্যতে পবিপ্রবি এর জার্মপ্লাাজম সেন্টার দেশে ফল গবেষণায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কৃষকের সংরক্ষিত ফলের বৈচিত্র্যপূর্ণ অপ্রচলিত ফলের জাতগুলো (ল্যান্ড রেস) জার্মপ্লাজম সেন্টারে সংরক্ষণ করে মূল্যায়ন, বৈশিষ্ট্যায়ন ও উন্নয়ন ঘটিয়ে কাক্সিক্ষত গুণাগুণ সম্পন্ন নতুন জাত হিসেবে অবমুক্ত করা এবং সেসব জাতকে স্বীকৃতি ও সুরক্ষা করা প্রয়োজন। আশা করা যাচ্ছে, অপ্রচলিত ফলের মধ্যে থেকে কিছুকিছু নতুন জাত নির্বাচিত করা যাবে যে গুলো প্রচলিত চাষের আওতায় আসবে এমনকি বাণিজ্যিকভাবে চাষের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
প্রফেসর ড. মাহবুব রব্বানী*
*উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল বিশেষত ফল উৎপাদনে বাংলাদেশে বিগত এক যুগে এক ফল বিপ্লব সাধিত হয়েছে। বিগত ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ফলের মোট উৎপাদন বৃদ্ধি এবং হেক্টরপ্রতি উৎপাদনের হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। বাংলাদেশ বর্তমানে আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে রয়েছে। দেশব্যাপী বারি মাল্টা-১ এর সম্প্রসারণও উল্লেখ করার মতো। বাংলাদেশে বর্তমানে ১ লাখ ৩৮ হাজার হেক্টর জমি থেকে ৪৬ লাখ টন ফল উৎপাদিত হয় যা বর্তমান চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এ অবস্থায় আমাদের দেশে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। বাংলাদেশ হচ্ছে দেশীয় বৈচিত্র্যময় ফলের এক অফুরন্ত ভা-ার এবং প্রায় ৭০ প্রজাতির বিভিন্ন সুস্বাদু ও আকর্ষণীয় ফল এদেশে জন্মে, যার ক্ষুদ্র একটি অংশ বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয়। অঞ্চলভিত্তিক কিছু কিছু ফল খুবই ভালো হয়; বরিশালে আমড়া, পেয়ারা, কাউয়া, সফেদা, বিলাতিগাব, কদবেল; সিলেট, চট্টগ্রামে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে লেবু জাতীয় ফল, আনারস; নরসিংদীতে লটকন; রাজশাহী অঞ্চলে আম; তবে অধিকাংশ ফলই দেশে জন্মে। আবহাওয়া ও মাটির দিক থেকেও বাংলাদেশে বেশ বৈচিত্র্য দেখা যায়। ১৬ কোটি মানুষের জনবহুল এ দেশে অপুষ্টি একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। পুষ্টি ও সুষম খাবারের জন্য ফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা সুস্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাই ফলের উন্নয়ন তথা পুষ্টির প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে একটি সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর জাতি বিনির্মাণ করা সম্ভব। ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ পদার্থ এবং উপকারী ফাইটোক্যামিক্যালস থাকে, যা শরীরকে বিভিন্ন রোগবালাই থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। ফলের অধিক উৎপাদন এবং এর প্রক্রিয়াজাত দ্রব্য দানাজাতীয় খাদ্য শস্যের গ্রহণ পর্যাপ্ত পরিমাণে হ্রাস করবে।
ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর উষ্ণ এবং অবউষ্ণম-লীয় ফলের ওপর নিবিড় গবেষণা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে এবং ৩২টি বিভিন্ন ফল প্রজাতির ৭৬টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে, যার অধিকাংশই দেশে এবং কিছু কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে চাষাবাদের উপযোগী। বারি উদ্ভাবিত ফলের উন্নত জাতগুলোর চাষাবাদ সম্প্রসারণের মাধ্যমে বাংলাদেশে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি, ফলের উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ এবং রপ্তানি শক্তিশালী করা সম্ভব হবে। বিএআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত বারি মাল্টা-১, বারি আম-৩, বারি আম-৪, বারি পেয়ারা-২ দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত ও কৃষক কর্তৃক সমাদৃত হয়েছে, যার ফলে দেশে ফলের উৎপাদন বাড়ছে। ফলের কম উৎপাদনশীলতার কারণ হলো উন্নত জাতের পরিবর্তে স্থানীয় কম উৎপাদনশীল জাতগুলোর অধিক ব্যবহার; কেননা এরা অধিকাংশ বীজের গাছ, যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাব এবং উন্নত জাতের গুণগতমানসম্পন্ন চারা-কলমের অপ্রতুল উৎপাদন ও বিতরণ। বিএআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত অঞ্চলভিত্তিক ফলের নির্বাচিত জাতগুলোর বিবরণ হলো-
বারি আম-২ প্রতি বছর ফলদানকারী একটি রঙিন উচ্চফলনশীল মাঝ মৌসুমি জাত। গাছ বড় ও খাঁড়া। ফাল্গুন মাসে গাছে মুকুল আসে এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষের দিকে ফল আহরণ উপযোগী হয়। ফল ডিম্বাকৃতির, গড় ওজন ২৫০ গ্রাম। ফলের শাঁস গাঢ় হলদে, মধ্যম রসালো, আঁশহীন, মধ্যম মিষ্টি। হেক্টরপ্রতি ফলন ২২ টন। জাতটি রপ্তানিযোগ্য। সারা বাংলাদেশে চাষোপযোগী।
বারি আম-৪ প্রতি বছর ফলদানকারী একটি উচ্চফলনশীল নাবি হাই্িব্রড জাত। ফলের আকার বড় ৬০০ গ্রাম, ফলের শাঁস উজ্জ্বল হলদে, মধ্যম রসালো, আঁশহীন, খুব মিষ্টি, ফলন ১৫-১৬ টন-হেক্টর এবং সারা দেশে চাষোপযোগী। তবে লবণাক্ত, খরাপ্রবণ এবং পাহাড়ি অঞ্চলে চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
বারি আম-৫ নিয়মিত ফলদানকারী উচ্চফলনশীল আগাম জাত। গাছ বড় ও খাঁড়া। ফাল্গুন মাসে গাছে মুকুল আসে এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম দিকে ফল আহরণ উপযোগী হয়। ফল মাঝারি (২৩০ গ্রাম), ডি¤¦াকার, উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের ও খেতে মিষ্টি । হেক্টরপ্রতি ফলন ১৫-২০ টন। জাতটি রপ্তানিযোগ্য। যশোর অঞ্চলে চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
বারি আম-৭ প্রতি বছর ফলদানকারী রঙিন উচ্চফলনশীল মাঝ মৌসুমি জাত। গাছ বড় ও মধ্যম খাঁড়া। ফাল্গুন মাসে গাছে মুকুল আসে এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ থেকে আষাঢ় মাসের প্রথম দিকে ফল আহরণ উপযোগী হয়। ফল গোলাকার, লাল আভাসহ হলুদ বর্ণের, গড় ওজন ২৮৫ গ্রাম। ফলের শাঁস হলদে, মধ্যম রসালো, আঁশহীন, মধ্যম মিষ্টি। হেক্টরপ্রতি ফলন ২০-২৫ টন। জাতটি রপ্তানিযোগ্য। রাজশাহী অঞ্চলে চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
বারি আম-১১ বছরে তিনবার ফলদানকারী একটি ব্যতিক্রমী জাত। নভেম্বর, ফেব্রুয়ারি ও মে মাসে গাছে মুকুল আসে এবং মার্চ-এপ্রিল, মে-জুন এবং জুলাই-আগস্ট মাসে ফল আহরণ উপযোগী হয়। ফল আয়তাকার, ফলের গড় ওজন ৩১৭ গ্রাম। এক বছরে গাছ প্রতি ফল ২৩টি এবং গড় ফলন ২.২ টন-হেক্টর। ফলের শাঁস গাঢ় হলুদ বর্ণের। ফল পাকা অবস্থায় হলুদ বর্ণের। বাংলাদেশের সব এলাকায় চাষ উপযোগী।
বারি কাঁঠাল-২ নিয়মিত ফলদানকারী একটি উচ্চফলনশীল অমৌসুমি (জানুয়ারি-এপ্রিল) জাত। ফল মাঝারি (৬.৯৫ কেজি) ও দেখতে আকর্ষণীয়। ফলের শাঁস হালকা হলুদ বর্ণের, সুগন্ধযুক্ত ও মধ্যম রসালো এবং খুব মিষ্টি। খাদ্যোপযোগী অংশ ৬০%। অমৌসুমে কাঁঠাল উৎপাদনের জন্য সারা বাংলাদেশে চাষের জন্য উপযোগী, পাহাড়ি এলাকায় চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
বারি কাঁঠাল-৩, বারি কাঁঠাল-২ (জানুয়ারি থেকে এপ্রিল) এর চেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ফল সংগ্রহ করা যায় (সেপ্টেম্বর থেকে জুন)। উচ্চফলনশীল (২৪৫টি-গাছ এবং ১৩৩২ কেজি-গাছ)। ফল মাঝারি আকারের (৫.৪৩ কেজি) এবং লালচে সবুজ রঙের। ফলের শাঁস মাঝারি নরম, হালকা হলুদ রঙের, মধ্যম রসালো, খুব মিষ্টি এবং সুগন্ধযুক্ত। গড় ফলন ১৩০-১৩৫ টন-হেক্টর। প্রায় সারা বছর কাঁঠাল উৎপাদনের জন্য সারা বাংলাদেশে চাষের জন্য উপযোগী তবে পাহাড়ি এলাকায় চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
বারি কলা-১ উচ্চফলনশীল এ জাতটি ২০০০ সালে উদ্ভাবিত হয়। গাছ অমৃতসাগর জাতের গাছের চেয়ে খাট, অথচ ফলন দেড় থেকে দুই গুণ বেশি। প্রতি কাঁদির ওজন প্রায় ২৫ কেজি, কাঁদিতে ৮-১১টি ফানা থাকে। উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে এ জাতের কাঁদিতে ১৫০-২০০টি কলা পাওয়া যায়। হেক্টরপ্রতি ফলন ৫০-৬০ টন, ফলের গড় ওজন ১২৫ গ্রাম, পাকা কলার রঙ উজ্জ্বল হলুদ এবং খেতে সুস¦াদু। বাংলাদেশের সব এলাকায় চাষ উপযোগী।
বারি কলা-৩ একটি উচ্চফলনশীল জাত এবং ফলন ৫০ টন/হেক্টর। কলার একটি কাঁদির ওজন ২৩ কেজি। প্রতিটি ফলের ওজন ১৪৪ গ্রাম, খুব মিষ্টি এবং সাধারণ রোগ বালাই সহনশীল। চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকার জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। সারা বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য উপযোগী।
বারি কলা-৫ উচ্চফলনশীল কাঁচা কলার জাত। শাঁস দৃঢ় ও হালকা হলুদ বর্ণের। কলা আকারে লম্বা খোসা মধ্যম মোটা। প্রতি কাঁদিতে কলার সংখ্যা ৯৩ থেকে ৯৭টি। কলা রান্না করার পর খুবই সুস্বাদু। কাঁদির গড় ওজন ২০.৩৮ কেজি। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ৫১ মেট্রিক টন। সারা দেশে চাষোপযোগী।
বারি পেয়ারা-২ একটি উচ্চফলনশীল জাত। জাতটি বর্ষাকালে এবং শীতকালে দুইবার ফল দেয়। তবে সঠিক পরিচর্যা করা হলে প্রায় সারা বছর ফল দিতে পারে। ফল আকারে বেশ বড় ও গোলাকার, শাঁস সাদা, খেতে কচকচে, সুস্বাদু ও মিষ্টি ফলন ৩০ টন/হেক্টর। সারা বাংলাদেশে চাষোপযোগী, লবণাক্ত ও খরাপ্রবন ও পাহাড়ি অঞ্চল চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। এছাড়া ছাদ বাগানে চাষোপযোগী।
বারি পেয়ারা-৪ (বীজবিহীন)- উচ্চফলনশীল, নিয়মিত ফল ধারণকারী, পেঁয়ারার একটি নাবি জাত। জাতটিতে জুন মাসে ফুল আসে এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ফল সংগ্রহের উপযুক্ত হয়। ফল সম্পূর্ণ বীজমুক্ত, কচকচে ও মিষ্টি স¦াধযুক্ত। ফলের গড় ওজন ২৮৪ গ্রাম, ফলের গাত্র মসৃণ, পরিপক্ব অবস্থায় হলদে সবুজ, শাঁস সাদা এবং খেতে খুবই সুস্বাদু। ফল সাধারণ তাপমাত্রায় ৮-১০ দিন সংরক্ষণ করা যায়। পাঁচ বছরের গাছে গড়ে ২৯৬টি ফল ধারণ করে, যার ওজন ৮৪ কেজি এবং হেক্টরপ্রতি ৩২ টন ফল পাওয়া যায়। সারা দেশে চাষোপযোগী।
বারি লিচু-১ নিয়মিত ফলদানকারী উচ্চফলনশীল আগাম জাত। মাঘের প্রথম সপ্তাহে গাছে ফুল আসে এবং জ্যৈষ্ঠের প্রথম সপ্তাহে ফল আহরণ উপযোগী হয়। ফলের গড় ওজন ২০ গ্রাম, ফল ডিম্বাকার ও রঙ লাল। শাঁস মাংসল, রসালো ও মিষ্টি। রাজশাহী ও পাবনা অঞ্চলের জন্য উপযোগী। হেক্টরপ্রতি ফলন ১০-১২ টন।
বারি লিচু-৪ নিয়মিত ফলদানকারী উচ্চফলনশীল মাঝ মৌসুমি জাত। ফলের রঙ আকর্ষণীয় গাড় লাল। ফলের গড় ওজন ২৭ গ্রাম, সুস্বাদু, খুব রসালো এবং খুব মিষ্টি। ফলন ১০-১৩ টন/হেক্টর, জাতটি রপ্তানিযোগ্য এবং বিশেষভাবে দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলের জন্য উপযোগী। দেশের উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে চাষাবাদের জন্য উপযোগী।
বারি লিচু-৫ নিয়মিত ফলদানকারী উচ্চফলনশীল জাত। ফলের রঙ আকর্ষণীয় উজ্জ্বল লাল। ফলের গড় ওজন ২১ গ্রাম, সুস্বাদু এবং মিষ্টি। পাহাড়ি অঞ্চল চাষাবাদের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
শাহী পেঁপে উচ্চফলনশীল একলিঙ্গী জাত। কাণ্ডের খুব নিচু থেকে ফল ধরা শুরু হয়। ফল ডিম্বাকৃতির, ফলপ্রতি বীজের সংখ্যা ৫০০-৫৫০টি। রঙ গাঢ় কমলা থেকে লাল। ফল মিষ্টি ও সুস্বাদু। গাছ প্রতি ফলের সংখ্যা ৪০-৬০টি। হেক্টরপ্রতি ফলন ৪০-৬০ টন। দেশের সর্বত্র চাষ উপযোগী।
বারি লেবু-২ সারা বছর ফল উৎপাদকারী উচ্চফলনশীল জাত। গাছ বড় ও ছড়ানো। প্রধান মৌসুমে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে গাছে ফুল আসে এবং আষাঢ় থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত ফল আহরণ করা যায়। গাছ প্রতি বছরে ১৮৬টি ফল হয়। ফলের শাঁস সাদা, খুব রসালো এবং অল্প টক। প্রতিটি ফলে ৪৪টি বীজ থাকে। হেক্টরপ্রতি ফলন ১২ টন। দেশের সর্বত্র চাষের উপযোগী। সারা বাংলাদেশের জন্য চাষোপযোগী, তবে পাহাড়ি অঞ্চল, লবণাক্ত এবং চরাঞ্চলে চাষাবাদের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। এছাড়া ছাদ বাগানে চাষোপযোগী।
বারি লেবু-৩ নিয়মিত ফলদানকারী উচ্চফলনশীল নাবি জাত। বছরে দুইবার ফল দেয়, ফলের আকার মাঝারি (৫০-৬০ গ্রাম), ফলের স্বাদ হালকা টক। ফলন ১০ টন/হেক্টর। সারা দেশে চাষোপযোগী। তবে পাহাড়ি অঞ্চল, লবণাক্ত এবং চরাঞ্চলে চাষাবাদের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
বারি আমলকী-১ উচ্চফলনশীল নিয়মিত ফলদানকারী জাত। ফল বড় (৩০ গ্রাম), চ্যাপ্টা এবং হালকা সবুজ। শাঁস সাদা, মধ্যম রসালো, কচকচে, অল্প কষ্টিভাব সংবলিত এবং সুস্বাদু। খরা ও লবণাক্ত এলাকায় চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। সারা বাংলাদেশের জন্য চাষোপযোগী, তবে পাহাড়ি অঞ্চল, লবণাক্ত অঞ্চল এবং খরাপ্রবণ উত্তরাঞ্চল চাষাবাদের জন্য বিষেশভাবে উপযোগী।
বারি সফেদা-৩ বছরে দুইবার ফল ধারণকারী উচ্চফলনশীল জাত। ফল গোলাকার, মাঝারি (১১৭ গ্রাম), ফল খেতে খুব মিষ্টি। সারা বাংলাদেশে চাষোপযোগী, তবে খরাপ্রবণ ও লবণাক্ত দক্ষিণাঞ্চলে চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
বারি কুল-১ উচ্চফলনশীল জাত। ফল আকারে মাঝারি আকারের (২৩ গ্রাম), ফলের দুই প্রান্ত সুচালো, পাল্প রসালো, মিষ্টি। ফলন ১০-১২ টন/হেক্টর। রপ্তানিযোগ্য জাত। সারা দেশে চাষোপযোগী তবে বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল এবং খরাপ্রবণ উত্তরাঞ্চলে চাষোপযোগী।
বারি কুল-৪ উচ্চফলনশীল নিয়মিত প্রচুর ফলদানকারী একটি জাত। পাকা ফল দেখতে আকর্ষণীয় হলুদাভ সবুজ রঙের, ফলের গড় ওজন ৩৬ গ্রাম, ফল ডিম্বাকৃতি এবং খোসা পাতলা, রসালো এবং মিষ্টি। বীজ ছোট এবং দুই প্রান্ত ভোঁতা, গাছ প্রতি ফলের সংখ্যা ৫৫৫০টি এবং গাছ প্রতি ফলন ২০০ থেকে ২২০ কেজি। সারা দেশে চাষোপযোগী তবে লবণাক্ত ও পাহাড়ি অঞ্চল চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
বারি আঁশফল-২ উচ্চফলনশীল নিয়মিত ফলদানকারী খাটো জাত। ফল তুলনামূলকভাবে বড় (৯.০ গ্রাম), বাদামি রঙের, শাঁস সাদা, কচকচে এবং খুব মিষ্টি। সারা দেশে চাষোপযোগী, তবে খরাপ্রবণ অঞ্চলে চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
বারি বেল-১ উচ্চফলনশীল, নিয়মিত ফলদানকারী। ফল সংগ্রহকাল মধ্য মার্চ থেকে মধ্য জুন। শাঁস হলুদ রঙের, তিতাবিহীন। উৎপাদন গাছ প্রতি ৩৪ কেজি (৬ বছরের বয়সী গাছ)। সারা বাংলাদেশের জন্য চাষোপযোগী, তবে খরাপ্রবণ অঞ্চলে চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
বারি কামরাঙা-১ উচ্চফলনশীল নিয়মিত ফলদানকারী জাত। গাছ মাঝারি, মধ্যম খাঁড়া ও ঝোপালো। বছরে তিনবার ফল দেয় (জুলাই-আগস্ট, নভেম্বর-ডিসেম্বর এবং ফেব্রুয়ারি)। ফল মাঝারি (৯৭ গ্রাম), লম্বাটে, হালকা হলুদ। শাঁস সাদা, রসালো, কচকচে এবং মিষ্টি । হেক্টর প্রতি ফলন ৩৫ টন। জাতটি রপ্তানিযোগ্য। সারা বাংলাদেশে চাষোপযোগী, তবে লবণাক্ত ও খরাপ্রবণ অঞ্চলে চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
বারি কামারাঙা-২ উচ্চফলনশীল নিয়মিত ফলদানকারী জাত। বছরে ৩ বার ফল দেয়। ফল মাঝারি (১০০ গ্রাম), ডিম্বাকৃতির, হালকা হলুদ, রসালো এবং মিষ্টি স্বাদের। সারা বাংলাদেশের জন্য চাষোপযোগী, তবে খরা ও লবণাক্তসহিষ্ণু অঞ্চলে চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
বারি মাল্টা-১ উচ্চফলনশীল জাত। ফলের আকার মাঝারি (১৪৬ গ্রাম), খুব রসালো (৩৩.৭%), মিষ্টি। ফলন ২০ টন/হেক্টর। সারা দেশে চাষোপযোগী তবে লবণাক্ত ও পাহাড়ি অঞ্চলে চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। এছাড়া ছাদ বাগানে চাষোপযোগী।
বারি কমলা-১ উচ্চফলনশীল ও নিয়মিত ফলদানকারী জাত। ফলের আকার বড় এবং প্রায় গোলাকৃতির। ফলের গড় ওজন ১৯০ গ্রাম। ফলের খোসা ঢিলা, ফল রসালো ও খুব মিষ্টি। ফলন ২০-২৫ টন/হেক্টর। উত্তর পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকায় এবং পঞ্চগড়ও কুড়িগ্রাম এ চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
বারি কমলা-৩ নিয়মিত ফলদানকারী উচ্চফলনশীল আগাম জাত। গাছ মাঝারি, খাড়া ও মধ্যম ঝোপালো। জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মাসে গাছে ফুল আসে এবং মধ্য নভেম্বর মাসের শুরু থেকে ফল আহরণ উপযোগী হয়। ফল পাকার পর গাঢ় কমলা রঙ ধারণ করে। ফলের আকার বড় এবং প্রায় গোলাকৃতির। ফলের খোসা ঢিলা, শাঁস রসালো ও মিষ্টি। ফলের গড় ওজন ১৯০ গ্রাম। বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পঞ্চগড় জেলার জন্য উপযোগী।
বারি বাতাবিলেবু-৩ উচ্চফলনশীল মাঝ মৌসুমি জাত। গাছ মাঝারি, মধ্যম খাঁড়া। জানুয়ারি মাসে গাছে ফুল আসে এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ফল আহরণ উপযোগী হয়। ফল উপবৃত্তাকার, পাকা ফলের রঙ সবুজাভ হলুদ এবং গড় ওজন ১০৭৫ গ্রাম। শাঁস গোলাপি, খুব রসালো, নরম, খুব মিষ্টি ও সম্পূর্ণ তিতাবিহীন। ফলের কোষ খুব সহজে আলাদা করা যায়। গাছ প্রতি ১০০-১১০টি ফল ধরে যার ওজন ১০০-১২০ কেজি। হেক্টরপ্রতি ফলন ২৫-৩০ টন। সারা বাংলাদেশের জন্য চাষোপযোগী, তবে পাহাড়ি অঞ্চল ও লবণাক্ত এলাকায় চাষ করা সম্ভব।
বারি বাতাবিলেবু-৫ নিয়মিত ফলদানকারী উচ্চফলনশীল। গাছটির পাতা তুলনামূলকভাবে অনেক বড় ও ঝোপালো। ফলের গোলাকার ও বড় (ফলের গড় ওজন ৮৭৫ গ্রাম)। ফল দেখতে উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের এবং টিএসএস ৯.০৫%। ফল সাধারণত এককভাবে ধরে। আট বছর বয়সী প্রতিটি গাছে গড় ফলের সংখ্যা ১৮টি এবং ফলন ১৬.০৪ কেজি এবং ১০.০৩ টন/হেক্টর/বছর। সারা বাংলাদেশের জন্য চাষোপযোগী, তবে পাহাড়াঞ্চল ও লবণাক্ত এলাকায় চাষ করা সম্ভব।
বারি সাতকড়া-১ ফল মধ্যম আকৃতির (৩২২ গ্রাম), পাকা অবস্থায় হালকা হলুদাভ রঙের হয় এবং ফলন ১০ টন/হেক্টর। বৃহওর সিলেট অঞ্চলে ও পাহাড়ি অঞ্চল চাষাবাদোপযোগী। বিদেশে রপ্তানিযোগ্য।
বারি তৈকর-১ নিয়মিত ফলদানকারী উচ্চফলনশীল জাত। গাছ মাঝারি, মধ্যম ছড়ানো ও বেশ ঝোপালো। বছরে দুইবার ফল দেয়। প্রথমবার ফুল আসে মধ্য শ্রাবণ থেকে মধ্য আশ্বিন (আগস্ট-সেপ্টেম্বর) মাসে এবং দ্বিতীয়বার ফুল আসে মধ্য মাঘ থেকে মধ্য ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারি) মাসে। প্রথমবার ফল সংগ্রহের উপযোগী হয় মধ্য কার্তিক থেকে মধ্য পৌষ (নভেম্বর-ডিসেম্বর) মাসে এবং দ্বিতীয়বার ফল সংগ্রহের উপযোগী হয় মধ্য চৈত্র থেকে মধ্য জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল-মে) মাসে। ফল চ্যাপ্টা-গোলাকৃতির, আকারে বড়। কচি ফলের রঙ সবুজ, পরিপক্ব বা পাকা ফলের রঙ হলুদ। হেক্টরপ্রতি ফলন ৭০-৭৫ টন। বৃহত্তর সিলেট জেলার জন্য উপযোগী।
বারি আমড়া-১ খাটো প্রকৃতির জাত। সারা বছর ফল ধরে, ফল ছোট আকৃতির, টক-মিষ্টি স্বাদযুক্ত । ফলন ১৫-১৭ টন/হেক্টর। সারা বাংলাদেশের জন্য চাষোপযোগী, লবণাক্ত দক্ষিণাঞ্চলে চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। এছাড়া ছাদ বাগানে চাষোপযোগী।
বারি আমড়া-২ নিয়মিত ফলদানকারী উচ্চফলনশীল জাত। গাছ লম্বাকৃতির, ফল বড় আকৃতির, টক-মিষ্টি স্বাদযুক্ত। ফলন ১৭ টন/হেক্টর। সারা বাংলাদেশের জন্য চাষোপযোগী, তবে লবণাক্ত দক্ষিণাঞ্চলে চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
বারি ড্রাগনফল-১ ফল গোলাকার, হালকা গোলাপি রঙের এবং শাঁস গাঢ় গোলাপি বর্ণের। ফলের গড় ওজন ৩৭৫.১১ গ্রাম। চার বছর বয়সী গাছের গড় ফলন ২০.৬০ টন/হেক্টর। সারা বাংলাদেশের জন্য চাষোপযোগী, তবে খরাপ্রবণ অঞ্চলে চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
বারি জামরুল-১ উচ্চফলনশীল, নিয়মিত ফলদানকারী মিষ্টি জাত। গাছটি ছড়ানো প্রকৃতির। ফল মাঝারি আকারের পরিপক্ব ফল দেখতে আকর্ষণীয় সবুজাভ মেরুন বর্ণের, খেতে কচকচে। ছয় বছর বয়সী গাছ প্রতি ফলের সংখ্যা ৪০০টি যার ওজন ২৪ কেজি। ফলন ১০ টন/হেক্টর। সারাদেশে চাষোপযোগী।
বারি লটকন-১ মাঝ মৌসুমি উচ্চফলনশীল জাত। গাছ মাঝারী, মধ্যম খাঁড়া ও ঝোপালো। ফাল্গুন মাসে গাছে ফুল আসে এবং শ্রাবণ মাসে ফল আহরণ করা যায়। নয় বছর বয়স্ক গাছে ৩৩৫০টি ফল ধরে যার ওজন ৫০ কেজি। ফল মাঝারি। শাঁস নরম, রসালো, অম্লমধুর স্বাদযুক্ত, এবং মিষ্টি গন্ধযুক্ত। হেক্টরপ্রতি ফলন ১৪ টন। সারা দেশে চাষোপযোগী পাহাড়ি অঞ্চল ও লবণাক্ত অঞ্চলে বিশেষভাবে চাষোপযোগী । বারি বিলাতিগাব-১ নিয়মিত ফলদানকারী উচ্চফলনশীল জাত। গাছ প্রতি ফলের সংখ্যা ৩৭২টি, ফল বড় (৪০০ গ্রাম), গোলাকার ও আকর্ষণীয় উজ্জ্বল লাল বর্ণের। ফলের শাঁস ধূসর বর্ণের সুগন্ধযুক্ত এবং মিষ্টি। ফলন ৩০-৩৫ টন/হেক্টর। সারা বাংলাদেশের জন্য চাষোপযোগী, তবে খরা ও লবণাক্ত অঞ্চলে চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী
বারি নারিকেল-১ উচ্চফলনশীল এবং লম্বা জাত। পূর্ণ বয়স্ক প্রতিটি গাছে ফলের সংখ্যা ৬৫-৭৫টি। ফল ডিম্বাকার, পরিপক্ব ফলের ওজন ১২০০-১৩০০ গ্রাম, পানির পরিমাণ ২৭০-২৯০ মিলি.। জাতটি কা- ঝরা রোগ সহনশীল। সারা দেশে চাষোপযোগী। তবে সমুদ্রতীরবর্তী ও লবণাক্ত দক্ষিণাঞ্চলে চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী
বারি নারিকেল-২ উচ্চফলনশীল এবং লম্বা জাত। পূর্ণ বয়স্ক প্রতিটি গাছে ফলের সংখ্যা ৬৫-৭৫টি। ফল ডিম্বাকার, পরিপক্ব ফলের ওজন ১৫০০-১৭০০ গ্রাম, পানির পরিমাণ ৩৩০-৩৪৫ মিলি., তেলের পরিমাণ ৫০-৫৫%। পাতার দাগ রোগ সহনশীল। বাংলাদেশের জন্য চাষোপযোগী, তবে সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল এবং লবণাক্ত দক্ষিণাঞ্চলে চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
বারি জলপাই-১ ফল আকারে বড়, গড় ফলের ওজন ৪৬ গ্রাম এবং খাদ্যোপযোগী অংশ ৮৪.৯৯%। প্রতি শাখায় ফলের সংখ্যা বেশি (৮টি-প্রতি শাখা)। নিয়মিত ফলদানকারী ও ফলের শীর্ষভাগ সুচালো। ছয় বছর বয়সী গাছের ফলন ১২৫ কেজি/গাছ। বাংলাদেশের জন্য চাষোপযোগী, খরা, পাহাড়ি অঞ্চল এবং লবণাক্ত এলাকায় চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী
বারি কদবেল-১ নিয়মিত বা প্রতি বছর ফল ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ও উচ্চফলনশীল। এর গাছের শাখা প্রশাখা বেশ বিস্তৃত, পাতাগুলো সতেজ ও ঝোপালো। ফল সংগ্রহের সময় অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে। ফল গোলাকার, তুলনামূলকভাবে বড় আকারের হয়। ফলের শাঁস নরম ও টক-মিষ্টি স্বাদযুক্ত, কম রসালো, অল্প আঁশযুক্ত। পাঁচ বছর বয়সী প্রতি গাছে গড়ে ফলের সংখ্যা ১১৩টি ও ফলন প্রায় ৩৯ কেজি। বাংলাদেশের জন্য চাষোপযোগী, লবণাক্ত ও পাহাড়ি অঞ্চলে চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী বারি তেঁতুল-১ (মিষ্টি তেঁতুল)- নিয়মিত ফলদানকারী উচ্চফলনশীল জাত। গাছ মাঝারি, মধ্যম ঝোপালো ও ছড়ানো। এপ্রিল-মে মাসে গাছে ফুল আসে এবং মার্চ মাসে ফল সংগ্রহের উপযোগী হয়। ফল মাঝারি (৩২ গ্রাম)। শাঁস নরম, আঠালো এবং মিষ্টি। বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকায় চাষযোগ্য। হেক্টরপ্রতি ফলন ১০-১২ টন। পাহাড়ি অঞ্চলে বিশেষভাবে চাষোপযোগী ।
বারি স্ট্রবেরি-২- উচ্চফলনশীল নিয়মিত ফল দানকারী জাত। ফল সংগ্রহ মধ্য ডিসেম্বর থেকে মধ্য এপ্রিল। ফল আকর্ষণীয় গাঢ় লাল রঙের, তুলনামূলক দৃঢ় এবং সুগন্ধযুক্ত। ফল বড়, প্রান্তভাগ সরু এবং গাছপ্রতি ফল ধরে ৩৭টি। সারা দেশে চাষোপযোগী।
ড. মদন গোপাল সাহা*
ড. বাবুল চন্দ্র সরকার**
*মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ ০১৫৫২৪৫০১৬২; **প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বারি, গাজীপুর; মোবাইল : ০১৭১৬০০৯৩১৯
বহুতল বিশিষ্ট শস্য বিন্যাসকে বহুস্তর শস্য বিন্যাস অথবা বহুধাপ বিশিষ্ট শস্য বিন্যাসও বলা হয়ে থাকে। এটি এক ধরনের আন্তঃফসল চাষ পদ্ধতি (Multi Storied Fruit Garden)। একই জমিতে একই সময়ে বিভিন্ন উচ্চতার বিভিন্ন ফল চাষ করাকেই বলে বহুস্তর বিশিষ্ট শস্য বিন্যাস। ফল বাগানের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি ব্যবহার হয়ে থাকে, যেখানে অতি ঘন চাষ পদ্ধতির ব্যবহার করে সূর্যের আলোর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। বিভিন্ন উচ্চতার, বয়সের এবং গাছের শিকড়ের গঠনসহ অন্য সব বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে এ চাষ পদ্ধতির সমন্বয় ঘটানো হয়। ভূমির উল্লম্ব (ভার্টিকাল) ব্যবহার সর্বোত্তমভাবে নিশ্চিত করাই হলো এ ধরনের চাষ পদ্ধতির অন্যতম উদ্দেশ্য। এ পদ্ধতিতে সবচেয়ে লম্বা আকার (Canopy) গাছের বৈশিষ্ট্য হলো অতি সূর্যালোক ও বাষ্পীয় ভবনের চাহিদা এবং সবচেয়ে খাটো আকার গাছের চাহিদা হলো ছায়া এবং অতি আর্দ্রতার। সাধাণত লম্বা গাছ প্রখর সূর্যালোক পছন্দ করে বিধায় উপরের স্তরে থাকে এবং খাটো আকারের গাছ ছায়া পছন্দ করে সেগুলো নিচের স্তরে থাকবে।
সুবিধা : বহুস্তর বিশিষ্ট ফল বাগানে বিভিন্ন বিন্যাসের মাধ্যমে যেসব সুবিধা পাওয়া যায় তা নিম্ন
এ ধরনের চাষ পদ্ধতির ব্যবহারের মাধ্যমে একক জমিতে অধিক আয় পাওয়া যায়। একই জমি থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফসল আহরণ করা যায়।
চাষে ফলন ঝুঁকি কমায় এবং সারা বছর নিয়মিতভাবে ফলের সরবরাহ পাওয়া যায়।
কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করে।
বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন- অতি বৃষ্টি, ভূমিক্ষয় বা ভূমিধসের প্রভাব কমাতে সাহায্য করে।
ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয়।
মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
একই জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফল চাষ করার ফলে একক জমিতে ফলন বাড়ে এবং পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় থাকে।
বহুস্তর বিশিষ্ট চাষ পদ্ধতির কিছু উদাহরণ
নারিকেল-পেয়ারা-আনারস#নারিকেল-পেঁপে-আনারস # নারিকেল-জলপাই-আনারস # নারিকেল-কাঁঠাল-কফি-পেঁপে-আনারস # নারিকেল-কলা-কচু # নারিকেল-আম-পেঁপে-ঢেঁড়স-মুলা-লালশাক/ডাঁটাশাক # নারিকেল-গোল মরিচ-আম-মাল্টা-পেঁপে-ঢেঁড়স-মুলা-লালশাক/ডাঁটাশাক #নারিকেল/সুপারি-চুই-মাল্টা/লেবু-আদা/হলুদ
বহুস্তর বিশিষ্ট ফল বাগানের নিচে ছায়া সহনশীল ফসলের নাম
আনারস; মরিচ; হলুদ; আদা; মিষ্টিআলু; কুল; মসলা চাষ; বকফুল; জগডুমুর; ডেওয়া; লেবু; আতা ফল; শরিফা; গাব-বিলাতি গাব; জামরুল; বেল; কদবেল; কামরাঙা; সফেদা; জাম্বুরা; লুকলুকি; কাউ ফল ; বেদেনা; তেঁতুল ইত্যাদি
বহুস্তর বিশিষ্ট মিশ্র ফল বাগানের বিবেচ্য বিষয়গুলো
১. বহুবর্ষজীবী ফল গাছ নির্বাচন : বহুবর্ষজীবী ফল গাছ নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা প্রয়োজন : ক. সূর্যালোক পছন্দ করে; খ. স্থানীয় আবহাওয়া উপযোগী; গ. দ্রুতবর্ধনশীল; ঘ. বহুবিধ ব্যবহার; ঙ. হালকা ছায়া প্রদান; বহুবর্ষজীবী ফল গাছ, যেমন- নারিকেল, আম, কাঁঠাল, মাল্টা, জাবাটিকাবা, লিচু, পারসিমন ইত্যাদি
২. বর্ষজীবী ফল নির্বাচন : নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনায় এনে এক বর্ষজীবী ফল গাছ নির্বাচন করা প্রয়োজন
ক. দ্রুতবর্ধনশীল; খ. আংশিক ছায়া পছন্দকারী; গ. খাটো জাত; ঘ. অধিক ফলন; ঙ. সহজে ফল আহরণ করা যায়; বর্ষজীবী ফল গাছ : যেমন- আনারস, কলা, পেঁপে।
৩. মৌসুমি ফসল নির্বাচন : মৌসুমি ফসল নির্বাচনে বিবেচ্য বিষয়গুলো
ক. ভালো জাত;
খ. কভার ক্রপ হিসেবে কাজ করবে;
গ. অঞ্চলভেদে মৌসুম অনুযায়ী উপযোগী ফসল নির্বাচন;
ঙ. দ্রুতবর্ধনশীল ও অধিক ফলন নিশ্চিত করবে; যেমন- চেরি টমেটো বিভিন্ন প্রকার শাকসবজি ও মসলা।
৪. অতিরিক্ত ফল গাছ অপসারণ : রোপণকৃত বাগানে গাছের বৃদ্ধির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। বাগানে গাছ বেশি ঘন থাকলে গাছের বাড়-বাড়ন্ত কমে যাবে। রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশি হয় এবং ফলন কমে যায়। তাই বাগানের সারিতে অতিরিক্ত গাছ অপসারণ করা প্রয়োজন। তবে খেয়াল রাখতে হবে অপসারণের সময় অন্য গাছ যেন আঘাতপ্রাপ্ত না হয়।
৫. আন্তঃপরিচর্যা : সময়মতো ডাল ছাঁটাই, আগাছা পরিষ্কার, সার ও বালাইনাশক প্রয়োগ এবং সেচ ও পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়।
বহুস্তর বিশিষ্ট মিশ্র ফল বাগানের অন্তরায় : খরা; অর্থের অভাব; কারিগরি জ্ঞানের অভাব; সময়মতো উপকরণ না পাওয়া; রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ; সেচের অভাব; শ্রমিক স্বল্পতা।
মানবদেহের পুষ্টির চাহিদা পূরণে ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের মাথাপিছু দৈনিক ফলের চাহিদা ২০০ গ্রাম এবং এ চাহিদা পূরণে বহুস্তরী ফল বাগান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কাক্সিক্ষত পুষ্টির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। অল্প জমি থেকে অধিক ফলন প্রাপ্তির জন্য বহুস্তরী ফল বাগানের বিকল্প নেই। বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামীণ লোকজন তাদের ফল উৎপাদন এবং কাজ করার জন্য বসতবাড়ির আশপাশের জায়গাগুলোকে বেছে নেয়। বাংলাদেশের জনসংখ্যার খাদ্য পুষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এ দেশের বসতবাড়িতে বহুস্তরী মিশ্র ফল বাগান গড়ে তুলতে পারলে পুষ্টি উন্নয়নের পাশাপাশি অধিক আয়ের পথ তৈরি হবে এবং সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হবে।
ড. মো. মেহেদী মাসুদ*
*প্রকল্প পরিচালক, বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা
বছরে দেশে প্রায় ৪৫ লাখ মেট্রিক টন ফল উৎপাদিত হয়। এর প্রায় অর্ধেক ফল আমরা ভালো ফল হিসেবে খেতে পারি। বাকি অর্ধেক নষ্ট হয় বিভিন্ন বালাইজনিত ক্ষতি ও সংগ্রহের পর অপচয় বা নষ্ট হওয়ার কারণে। কৃষকের উৎপাদিত এত কষ্টের ফল এভাবে নষ্ট হওয়া মেনে নেয়া যায় না। ফলের বালাইজনিত ক্ষতি কমানোর ওপর যেমন জোর দিতে হবে, তেমনি সংগ্রহোত্তর ক্ষতিও ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে।
সব ফসলের মতো ফলেরও বালাই আছে। বিভিন্ন রোগ, পোকামাকড়, ইঁদুর, বাদুড়, কাঠবিড়ালি, শিয়াল, খরগোশ, আগাছা, পরগাছা ফল ও ফলগাছের ক্ষতি করে। ক্ষতিকর এসব জীবই বালাই। ফলের বালাই নিয়ন্ত্রণে সাধারণত ফলচাষিরা ক্ষতিকর রাসায়নিক বালাইনাশকের ওপরই বেশি নির্ভর করেন। অন্যান্য ফসলে বালাইনাশকের ব্যবহারে যতটা না জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, ফলে বালাইনাশক ব্যবহারে ক্ষতি হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। কেননা ফল আমরা সরাসরি গাছ থেকে পেড়ে কাঁচা ও পাকা খাই, রান্না বা প্রক্রিয়াজাত করার পর খাই না। তাই রাসায়নিক বালাইনাশক সরাসরি আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। এজন্য অন্য ফসলের আগে ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা করা দরকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা যেমন জটিল তেমনি গবেষণালব্ধ তথ্যের অভাব রয়েছে। অন্য ফসল বলতে একক ফসলকে বুঝায়। তাই সেসব ফসলের বালাইও সীমিত। কিন্তু ফল আছে শত রকমের। তাই বালাইয়ের সংখ্যাও অসংখ্য। ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার বিষয়টিও সেজন্য খুব সহজ নয়। তবে বিভিন্ন ফলের বালাই সুনির্দ্দিষ্ট, কিছু বালাই একাধিক ফলে আক্রমণ করে। সেজন্য ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থানার কিছু সাধারণ নীতি অনুসরণ করলে বালাইমুক্ত ফল উৎপাদন করা খুব কঠিন নয়।
ফলের বালাই ব্যবস্থাপনায় এত বালাইনাশকের ওপর নির্ভরতা? বালাইনাশক বাজারে সুলভ, চাইলেই হাতের কাছে পাওয়া যায়, সহজে ব্যবহার করা যায় এবং দ্রুত ফল দেয়। অধিকাংশ ফলচাষি এসব কথা বিশ্বাস করেন। পক্ষান্তরে আইপিএম বা সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার ধারণাটি সাধারণ চাষিদের কাছে ততটা বোধগম্য নয়, অনেক কৌশল সম্পর্কে তারা জানেন না ও সেসব কৌশলের কার্যকারিতা সম্পর্কে বেশ অনাস্থা রয়েছে। বাণিজ্যিক ফলচাষিরা চান রোগ ও পোকামুক্ত সুদর্শন ফল, তাতে যতবার যত বালাইনাশক দেয়া লাগে তারা তা দেন। সেজন্য ফলচাষিদের কাছে আইপিএম ধারণার গ্রহণযোগ্যতা এখনও বালাইনাশকের মতো হয়ে ওঠেনি। তবে পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে ভবিষ্যতে ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষত যদি বিদেশে ফল রপ্তানি করতে হয় তাহলে সেসব দেশের ক্রেতারা ক্ষতিকর রাসায়নিক দেয়া ফল কিনবে না। তাছাড়া উপর্যুপরি ক্ষতিকর রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে পাঁচটি ঘটনা ঘটছে। ঘটনাগুলো হলো- অধিকাংশ বালাইয়ের পুনরুজ্জীবন লাভ, পুনরুত্থান, নতুন বালাইয়ের আবির্ভাব, মানুষের স্বাস্থ্য নষ্ট ও পরিবেশের স্থায়ী ক্ষতি। তাই মানসম্মত ও লাভজনক ফল উৎপাদনে এখন ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই।
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিরাপদ ফল উৎপাদনে যেসব কৌশলগুলো গ্রহণ করা যায়-
বালাই সহনশীল জাতের ফল চাষ : এটি সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার একটি উপাদান সত্য, তবে ফলের ক্ষেত্রে এ উপাদানের কার্যকারিতা কম। কেননা এ দেশে ফলের যত জাত উদ্ভাবিত হয়েছে সেসব জাতের বালাই সহনশীলতা বা প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পর্কিত তথ্য খুব বেশি নেই। তবু যা আছে তার ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নেয়া যায়। বিশেষ করে যেসব এলাকায় যদি কোনো নির্দ্দিষ্ট বালাইয়ের আক্রমণ নিয়মিতভাবে প্রতি বছর বা মৌসুমে ঘটতে থাকে তাহলে নতুন বাগান করার ক্ষেত্রে সেই বালাই প্রতিরোধী জাতের চারা বা কলম সংগ্রহ করে তা লাগাতে হবে। অ্যানথ্রাকনোজ রোগ প্রতিরোধী জাতের পেয়ারা চাষ করে এ রোগের আক্রমণ থেকে পেয়ারা রক্ষা করা যেতে পারে। বাউ পেয়ারা ১, বাউ পেয়ারা ২, বাউ পেয়ারা ৩, মুকুন্দপুরী ও কাঞ্চননগর জাতে এ রোগের আক্রমণ কম হয়। অন্য দিকে স্বরূপকাঠি ও কাজী পেয়ারাতে এ রোগ বেশি হয়।
জৈবিক পদ্ধতিতে ফলের বালাই নিয়ন্ত্রণ : এটা হলো সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মূল ভিত্তি। প্রকৃতিতেই বালাই নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে। শুধু সেসব ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো দরকার। প্রকৃতিতে প্রায় সব বালাইয়েরই কম-বেশি প্রাকৃতিক শত্রু রয়েছে। এসব প্রাকৃতিক শত্রুর কেউ পরভোজী, কেউ পরজীবী আবার কেউবা বালাইয়ের দেহে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু। ফলবাগানে কোনো রাসায়নিক বালাইনাশক প্রয়োগ না করলে এসব উপকারী প্রাকৃতিক শত্রুদের সংখ্যা বাড়ে ও প্রকৃতির নিয়মে তারাই বিভিন্নভাবে বালাইদের নিয়ন্ত্রণ করে রাখে। এতে পরিবেশের মধ্যে শত্রু-মিত্রর ভারসাম্য বজায় থাকে। এজন্য বালাই চাষির কোনো ক্ষতি করতে পারে না।
ফল বাগানে বন্ধু জীবদের বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে; মরিচের গুঁড়া, আদা ও রসুনের রস জৈব পদার্থগুলো স্প্রে করে বিভিন্ন পোকাকে বিতাড়িত করা যায়; প্রাকৃতিক বা জৈবিক বালাইনাশকও আছে, যেমন- বাইকাও। রাসায়নিক বালাইনাশকের চেয়ে জৈবিক বা প্রকৃতিক বালাইনাশক ব্যবহারে অগ্রাধিকার দিতে হবে; ট্রাইকোডার্মা বা ট্রাইকো কম্পোস্ট ব্যবহার করা।
আধুনিক নিয়মে ফল চাষ : ফল চাষের যত ভালো প্রযুক্তি আছে সব মেনে ফল চাষ করাই হলো আধুনিক নিয়মে ফল চাষ। এতে সুস্থ সবল গাছ হয়, গাছের বৃদ্ধি ও তেজ ভালো থাকে। স্বভাবত সেসব গাছ প্রাকৃতিকভাবে অনেক বালাই প্রতিরোধ করতে পারে। এজন্য ফলগাছের উন্নত চাষাবাদ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে যেসব বিষয়াদি বিবেচনা করা যায় তাহলো এলাকার উপযোগী উন্নত জাতের ফলগাছ লাগানো। সঠিকভাবে সঠিক সময়ে ও সঠিক মাত্রায় সার দেয়া। অতিরিক্ত ইউরিয়া সার ফলগাছে দেয়া চলবে না। আগাছা ও পানি ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করা। নিয়মিত গাছ ছাঁটাই করা। আক্রান্ত ফল ও গাছের আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে ধ্বংস করা।
যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ : ফলের বালাই নিয়ন্ত্রণে হাত বা যে কোনো যন্ত্রের ব্যবহারই হলো যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা। এর মাধ্যমে বালাইগুলো বিতাড়িত হয়, মরে যায় অথচ উপকারী জীবের কোনো ক্ষতি হয় না। যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে যেসব বিষয়াদি বিবেচনা করা যায়- ফলের মাছি পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ বা বিষটোপ ফাঁদ ব্যবহার। কাইরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করা। গাছ যখন দুর্বল বা আঘাতপ্রাপ্ত হয় তখন তা থেকে কাইরোমোন নিঃসৃত হয় যা অনেক পোকাকে আকৃষ্ট করে। কৃত্রিমভাবে এরূপ কাইরোমোন ব্যবহার করে ফাঁদ তৈরি করে পোকাদের আকৃষ্ট ও ফাঁদে আটকে মারা যায়। আলোক ফাঁদ ব্যবহার। বর্ণফাঁদ ব্যবহার করা। ইঁদুরের কল বা ফাঁদ ব্যবহার করা। গাছের তলার মাটি চষে দেয়া। পাখি ও বাদুড় তাড়ানোর জন্য আওয়াজ সৃষ্টিকারী টিন-যন্ত্রের ব্যবস্থা করা। ব্যাগিং বা ফল ব্যাগ দিয়ে ঢেকে দেয়া। মালচিং করা। করাত বা দা দিয়ে কেটে আক্রান্ত অংশ সরিয়ে ফেলা।
রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা : রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা হলো কোনো না কোনো রাসায়নিক দ্রব্য বিশেষ করে বালাইনাশক ব্যবহার করে বালাই নিয়ন্ত্রণ। বর্তমানে বিভিন্ন জৈব ও জৈব রাসায়নিক দ্রব্যও ব্যবহার করা হচ্ছে। রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে যেসব বিষয়াদি বিবেচনা করা যেতে পারে- এসিটিক এসিড, লবঙ্গের তেল, ফ্যাটি এসিড প্রভৃতি স্প্রে করা। সালফার ও চুন প্রয়োগ করা। বোর্দো মিশ্রণ প্রয়োগ করা। সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে বুদ্ধিমত্তার সাথে বালাইনাশকের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার করা। যে কোনো বালাইনাশক ব্যবহারের আগে তার লেবেল বা ব্যবহারের নির্দেশনা পড়ে নিতে হবে। বালাইনাশক সাধারণত কারখানায় তৈরি করা কৃত্রিম রাসায়নিক দ্রব্য হয়। কিছু বালাইনাশকের কার্যকারিতা ব্যাপক, একই বালাইনাশক বহু রকমের বালাইকে মেরে ফেলতে পারে। কিছু বালাইনাশকের কার্যকারিতা পোষক বা বালাই সুনির্দ্দিষ্ট। কেবলমাত্র নির্দ্দিষ্ট বালাইকে তারা মারতে পারে। এরূপ বালাইনাশক ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিছু বালাইনাশকের অবশেষ ক্রিয়া দ্রুত শেষ হয়ে যায়, কিছু বালাইনাশকের অবশেষ ক্রিয়া থাকে অনেক দিন। অবশেষ স্বল্পক্রিয়াসম্পন্ন বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে। কোনো তীব্র বিষাক্ত বালাইনাশক ব্যবহার করা যাবে না।
ফলের আইপিএম বাস্তবায়ন কৌশল
ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনাকে ফলপ্রসূ করার জন্য যেসব কৌশলগুলো ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করতে হবে-
ফলের বালাইগুলো চেনা ও সে সম্পর্কে তথ্য জানা : সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নের প্রথম কাজই হলো কোন ফলগাছে ও ফলে কী কী রোগ, পোকা ও অন্যান্য বালাইয়ের আক্রমণ ঘটে সে সম্পর্কে তথ্য নেয়া। যথাসম্ভব সেসব বালাইগুলো শনাক্তকরণে দক্ষতা অর্জন করা। সেসব বালাই দ্বারা কী ক্ষতি হচ্ছে সেসব লক্ষণ চেনাও দরকার। পাশাপাশি কোনো বালাইয়ের আক্রমণ কোন স্তরে ও কোন পরিস্থিতিতে বাড়ে তাও জানতে হবে।
নিয়মিত ফলগাছ পর্যবেক্ষণ : দ্বিতীয় ধাপ হলো ফলগাছ অন্তত সপ্তাহে একবার পর্যবেক্ষণ করা। ফলগাছে উপস্থিত রোগ, পোকামাকড় (শত্রু ও বন্ধু পোকা) ও অন্যান্য বালাই পরিস্থিতি জরিপ করে কোনো বালাইয়ের তীব্রতা কত তা নির্ণয় করা দরকার। নমুনায়ন করেও এ কাজ করা যায়। এ কাজে চাক্ষুষ পদ্ধতি সবচেয়ে ভালো। বিভিন্ন ফাঁদ পেতেও বালাই জরিপ কাজ করা যায়।
সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন : ফল ও ফলগাছের বালাই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বালাই ব্যবস্থাপনার প্রাপ্য সব কলাকৌশল বিবেচনা করে সর্বোত্তম কৌশল নির্বাচন করাই হলো সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এ সময় বিবেচনা করা দরকার কোন কৌশলটি প্রয়োগ করলে সবচেয়ে সহজে করা যাবে, খরচ কম হবে ও স্থানীয়ভাবে পাওয়া যাবে। অবশ্যই সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনাকে কার্যকর করতে শুধু একটি কৌশলের ওপর নির্ভর করা উচিত হবে না, একাধিক কৌশলকে ব্যবহার করতে হবে। সবশেষে প্রয়োগের জন্য রাখতে হবে রাসায়নিক ব্যবস্থাপনাকে।
কার্যকারিতা মূল্যায়ন : সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার প্রতিটি কৌশল প্রয়োগের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে তার ফল যাচাই করতে হবে ও তার তথ্য রাখতে হবে। এতে পরবর্তীতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ আরও বেশি আস্থার সাথে করা যাবে।
মৃত্যুঞ্জয় রায়*
*উপপ্রকল্প পরিচালক, আইএফএমসি প্রকল্প, খামারবাড়ি, ঢাকা
আম একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় সুস্বাদু ফল। স্বাদে, গন্ধে, বর্ণে ও পুষ্টিমানে আমের বিকল্প শুধু আম তাই আমকে ফলের রাজা বলা হয়। আম সাধারণত কাঁচা, পাকা এমনকি ফ্রোজেন অবস্থায়ও খাওয়া যায়। এছাড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে আম থেকে আমসত্ত্ব, জুস, পিওরি, আচার, চাটনি এসব তৈরি করা যায়। ফল হিসেবে খাওয়ার পাশাপাশি আইসক্রিম, বেকারি পণ্য ও কনফেকশনারিতেও পাকা আম ব্যবহার হয়ে থাকে। আমে প্রচুর পরিমাণ আঁশ, ভিটামিন সি, প্রো ভিটামিন এ, ক্যারোটিন ও বিভিন্ন প্রকার পলিফেনল নামক উপাদান থাকে। বাংলাদেশে মূলত রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, যশোর, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও পার্বত্য জেলাগুলো বাণিজ্যিকভাবে আমের চাষ হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ মে. টন আম উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত আম এসব এলাকা থেকে সারা দেশেই আম সাপ্লাই হয়ে থাকে। আমে রয়েছে উচ্চ জলীয় অংশ এবং নরম গঠন ফলে খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। তাই আমের পচন রোধে অস্বাদু ব্যবসায়ীরা ধাবিত হচ্ছে রাসায়নিক ব্যবহারের দিকে। আমের পুষ্টিমান ও গুণাগুণ বজায় রেখে কিভাবে নিরাপদ আম ভোক্তার কাছে পৌঁছানো যায় সে লক্ষ্যে আম বাগান থেকে শুরু করে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত প্রতিটা ধাপেই বিজ্ঞানভিত্তিক বিশেষ ব্যবস্থাপনা ও কৌশল অবলম্বন করা উচিত। এভাবেই আমের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমানো সম্ভব।
আমের জাত
আমাদের দেশে জনপ্রিয় কতগুলো আমের জাত রয়েছে যেমন- গোপালভোগ, ল্যাংড়া, হাঁড়িভাঙা, ক্ষীরসাপাতি, হিমসাগর, ফজলি ও আশ্বিনা এসব। এ জাতগুলো ইদানীং বাণিজ্যিকভাবেও চাষাবাদ হচ্ছে। তাছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারি থেকে অদ্যবধি ১১টি বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন আমের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এদের মধ্যে বারি আম-২, বারি আম-৩, বারি হাইব্রিড আম-৪ উল্লেখযোগ্য।
আমের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব
বাগান থেকে আম ভোক্তার কাছে যেতে পরিমাণের পাশাপাশি গুণেমানেরও অপচয় হয়ে থাকে। এক গবেষণায় আছে আমের সংগ্রহোত্তর অপচয় প্রায় ৩১%। এসব অপচয়গুলো মূলত গাছ থেকে আম সংগ্রহের ভুল পদ্ধতি, রুক্ষভাবে ফল হ্যান্ডলিং, অনুন্নত প্যাকেজিং ও পরিবহন ব্যবস্থাপনার কারণে হয়ে থাকে। গাছে থাকা অবস্থায় ফলের রোগ ও পোকামাকড় দমনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবেও সংগ্রহ পরবর্তী পর্যায়ে অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটার গোড়া পচা রোগে আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে থাকে। নিরাপদ খাদ্য ও খাদ্যের গুণগতমান সম্পর্কে ভোক্তাদের সচেতনতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভোক্তাদের কাছে ভালো গুণাগুণসম্পন্ন উচ্চমানের নিরাপদ আমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং এজন্য তারা অতিরিক্ত মূল্য দিতেও প্রস্তুত। ভোক্তার পরিবর্তিত রুচি ও জীবনযাত্রার মানের সাথে সঙ্গতি রেখে ফলের যথাযথ সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। ক্রেতাদের ভালো গুণাগুণসম্পন্ন নিরাপদ ফলের চাহিদা পূরণের জন্য আমের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার ওপর আরও বেশি মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন।
আম ফলের পরিপক্বতার পর্যায়
পরিপক্ব আমের খোসা ও শাঁসে সুন্দর রঙ ধারণ করে এবং পাকার পরে ফলের মিষ্টি গন্ধ ও পরিপূর্ণ স্বাদ পাওয়া যায়। আমের পরিপক্বতা নিরুপণের ক্ষেত্রে- ফলের আকৃতি বোঁটা সংলগ্ন আমের কাঁধ মোটামুটি সমান হয়ে যাবে এবং ফলের পার্শ্বদেশ পুষ্ট হবে; খোসার প্রকৃতি আমের খোসার ওপর সাদা পাউডারের মতো আবরণ পড়বে; খোসার বর্ণ গাঢ় সুবজ থেকে পরিবর্তিত হয়ে হালাকা সুবজ বর্ণ ধারণ করবে এবং শাঁসের খোসা ফলের শাঁস হালকা ক্রিম থেকে হলুদ বর্ণ ধারণ করবে।
আম সংগ্রহের উপযুক্ত সময়
পরিপক্ব আম গাছ থেকে সংগ্রহ করার অনুমোদিত উপযুক্ত সময় হলো সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে আম পাড়লে আমের কষ কম বের হয়। মনে রাখতে হবে, বৃষ্টি হওয়ার পর পরই আম সংগ্রহ করা ঠিক নয়।
আম সংগ্রহের পদ্ধতি
সাধারণত ঠুসির সাহায্যে গাছ থেকে আম সংগ্রহ করা উচিত। একটি চিকন লম্বা বাঁশের মাথায় নেটের ব্যাগ দিয়ে ঠুসি তৈরি করা হয়। গাছের শাখা থেকে ঠুসির সাহায্যে আম সংগ্রহ করে সরাসরি সংগ্রহ পাত্রে স্থানান্তর করা যায়। সংগ্রহ পাত্রটিতে পরিষ্কার প্লাস্টিক বা চটের বস্তা লাইনার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে যাতে ফলের গায়ে ক্ষত সৃষ্টি না হয়। মাঠে ফল সংগ্রহের পাত্র হিসেবে প্লাস্টিক ক্রেট-ই উত্তম। জীবাণু দ্বারা সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষার জন্য সংগ্রহের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি এবং ফল সংগ্রহের পাত্র অবশ্যই পরিষ্কার-পরিছন্ন থাকতে হবে।
- গাছ থেকে আম পাড়া এবং বাগানে আম হ্যান্ডলিংয়ের সময় ফলের অপচয় ও অবনতি কমানোর কলাকৌশল-
- অনুজীবের অনুপ্রবেশ ও সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য আম পাড়ার আগে শ্রমিকদের হাতমুখ অবশ্যই ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
- ফলের গায়ে যাতে কষ লেগে না যায় সেজন্য ২-৩ সেন্টিমিটার বোঁটাসহ আম পাড়তে হবে।
- ক্ষত থেকে আমকে রক্ষার জন্য সংগ্রহপাত্রের ভেতরে দিকে পরিষ্কার প্লাস্টিক, চটের বস্তা বা পুরনো খবরের কাগজ বিছিয়ে নিতে হবে।
- ছিদ্র বা ক্ষতযুক্ত আম অবশ্যই আলাদা করে নিতে হবে।
- আম ভর্তি পাত্র অত্যন্ত যতেœর সাথে মাটিতে রাখতে হবে। কোনোভাবেই সংগৃহীত আম সরাসরি মাটির ওপর ঢালা যাবে না। মাটির সংস্পর্শে এলে ফলগুলো অনুজীব দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে। এজন্য মাটিতে পাতলা ত্রিপল অথবা মোটা কাপড় বিছিয়ে তার ওপর সংগৃহীত আম ঢালতে হবে।
- সংগৃহীত আমগুলোকে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে।
আমের সংগ্রহোত্তর কার্যক্রম
১. ছাঁটাইকরণ বা ট্রিমিং : আমের ছাঁটাইকরণ বলতে ফলের সাথে লেগে থাকা বোঁটার ১ সেমি. রেখে বাড়তি অংশ কেটে ফেলতে হবে।
২. আমের কষ অপসারণ : তাজা কষ আম থেকে বের করে দেয়াকে কষ অপসারণ বলে। কাজটি করার জন্য সাধারণত একটি ধারালো পরিষ্কার কাঁচি বা প্রুনিং শেয়ারের সাহায্যে ফলের বোঁটা আমের কাঁধ বরাবর কেটে ফেলতে হবে। অতঃপর বোঁটা ছাঁটাইয়ের পর আমগুলোকে বিশেষভাবে তৈরি একটি প্লাস্টিক বা স্টিলের জালযুক্ত যাকের ওপর উপুর করে ৩০ মিনিটের জন্য রাখতে হবে, যাতে কষ ভালোভাবে বের হয়ে যায়। কখনই চট বা বস্তার ওপর আম উল্টা করে রাখা যাবে না। এতে ফলের গোড়ার অংশে কষ লেপটে যাবে। তাছাড়া বোঁটা ছাঁটাইয়ের সাথে সাথে আমগুলোকে ১% ফিটকিরির দ্রবণে (৫০ লি. পানিতে ৫০০ গ্রাম ফিটকিরির পাউডার মেশাতে হবে) ১ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। ফিটকিরি আমের কষকে জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে ক্রেটে ফল ভরে ক্রেটসহ আমকে ফিটকিরির দ্রবণে ডুবিয়ে দিতে হবে। অতঃপর ১ মিনিট পর ফলগুলো তুলে গায়ের পানি শুকিয়ে নিয়ে প্যাকেট করতে হবে।
৩. সর্টিং বা গ্রেডিং : আম সংগ্রহের পর গুণগতমানের ওপর ভিত্তি করে আমগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে হবে। ভালো গুণাগুণসম্পন্ন নিরাপদ আমগুলো পরিপক্ব, উত্তম গঠন বিশিষ্ট, পরিষ্কার, রোগ ও পোকামাকড় মুক্ত এবং যান্ত্রিক ক্ষত যেমনÑ কাটা ছিদ্র, থেঁতলানো ইত্যাদি মুক্ত হতে হবে। এছাড়াও ফলগুলো অনুজীব, রাসায়নিক এবং বাহ্যিক দূষণ মুক্ত হতে হবে। অন্যদিকে ত্রুটিযুক্ত (ফলের সিসিড ফ্লাই, ফ্রুট ফ্লাই এবং থ্রিপস আক্রান্ত আম;) ফল সংগ্রহের পূর্বে গাছে থাকা অবস্থায় সৃষ্ট ক্ষত যেমন- স্ক্যাব কিংবা সুটি মোল্ড আক্রান্ত আম; ফল সংগ্রহ ও পরবর্তী হ্যান্ডলিংজনিত ক্ষত যেমন- কষের দাগ, থেঁতলানো, ঘর্ষণ ও চাপজনিত ক্ষত, কাটা ও ছিদ্রযুক্ত আম এবং অপরিপক্ব অবস্থায় পাকানো) আমগুলো সাধারণত বাতিল হিসেবে গণ্য হবে।
সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে আমের রোগ নিয়ন্ত্রণ
সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে আমের দুইটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ হলো অ্যানথ্রাকনোজ ও স্টেম অ্যান্ড রট। সুবজ থাকা অবস্থায় আমে এ দুইটি রোগ শনাক্ত করা যায় না। শুধুমাত্র ফল পাকার পর এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। আমের সংগ্রহ পূর্ব এবং সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রোগ দুইটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। রোগ দুইটি দমনের জন্য গরম পানিতে আম শোধন করা সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। গরম পানিতে শোধনের ক্ষেত্রে সবুজ পরিপক্ব আমকে ৫২-৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় জাতভেদে ৫-১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হয়। এ তাপমাত্রা সীমার মধ্যে রোগের জীবাণু মারা যায় কিন্তু ফলের কোনো ক্ষতি হয় না। যদি পানির তাপমাত্রা ৫২ ডিগ্রি সে. এর নিচে নেমে যায় তবে এ পদ্ধতির কার্যকারিতা কমে যায়। আবার তাপমাত্রা ৫৫ ডিগ্রি সে. এর ওপরে উঠে গেলে আমের চামড়া-খোসা ঝলসে যায়। কাজেই সঠিকভাবে আম শোধনের জন্য পানির তাপমাত্রা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বজায় রাখা আবশ্যক।
আম প্যাকেজিং ও পরিবহন
১. প্যাকেজিং : পরিবহন ও পরবর্তী হ্যান্ডলিং কার্যক্রমের সময় ফলের গুণগতমান বজায় রাখার জন্য যথাযথভাবে প্যাকেজিং করা আবশ্যক। প্যাকেজিং উপাদান এমন হতে হবে (শক্ত কনটেইনার যেমন- প্লাস্টিক ক্রেট, বাঁশের ঝুড়িও, কার্টন বা ফাইবার বোর্ডের বাক্স) যা প্যাকেটের ভেতরের পণ্যকে পর্যাপ্ত সুরক্ষা দেবে, সহজভাবে হ্যান্ডলিং করা যাবে, ভোক্তার কাছে আকর্ষণীয় হবে এবং ভেতরের পণ্য সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য ভোক্তার জ্ঞাতার্থে লিপিবদ্ধ করা যাবে। প্লাস্টিক ক্রেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়াবলি-পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা : প্রতিবার ব্যবহারের পর সাবান কিংবা ডিটারজেন্ট দিয়ে ক্রেটগুলোকে পরিষ্কার করতে হবে, হ্যান্ডলিং : পরিবহনে পণ্যসহ ক্রেটগুলো উঠনো, সাজানো এবং নামানোর সময় সতর্কতার সাথে নাড়াচাড়া করতে হবে। ক্রেটগুলোকে কোনোভাবেই ওপর থেকে ফেলা যাবে না এবং সর্টিং-গ্রেডিংয়ের সময় খালি ক্রেটগুলোকে বসার সিট হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না।
ক্রেট গুদামজাতকরণ : খালি ক্রেটগুলোকে পরিষ্কার জায়গায় রাখতে হবে যাতে পোকামাকড় ও ইঁদুর এগুলোর ক্ষতি করতে না পারে। এছাড়া রাসায়নিক দ্রব্য ও খামার যন্ত্রপাতি থেকে ক্রেটগুলোকে আলাদা রাখতে যাতে জীবাণু দ্বারা সংক্রামিত না হয়। বাইরে খোলা পরিবেশে ক্রেটগুলোক রাখা যাবে না। তাছাড়া ফল বা সবজি পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ক্রেটে কোনোভাবেই সার, কীটনাশক বা অন্য কোনো রাসায়নিক দ্রব্য রাখা যাবে না।
২. আম পরিবহন
পরিবহনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো ফলকে ভালো অবস্থায় সর্বশেষ বাজারে সরবরাহ করা, যেখানে ভোক্তারা এটি কিনবে। সরবরাহ চেইনের বিভিন্ন পয়েন্টে যেমন মাঠ থেকে কালেকশন সেন্টার বা প্যাকহাউস, প্যাকহাউস-কালেকশন সেন্টার থেকে পাইকারি বাজার এবং পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজার।
আম পরিবহনের ক্ষেত্রে আম ভর্তি কনটেইনারগুলো সাবধানতার সাথে ওঠানামা করতে হবে। কোনোভাবেই এগুলোকে জোরে ফেলা যাবে না কিংবা একটির ওপর আরেকটি নিক্ষেপ করা যাবে না। গাড়িতে সাজানো বা স্টেকিংয়ের সময় স্টেকের নিচের কনটেইনারগুলোকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। পরিবহনের ওপর আমের প্যাকেটগুলো এমনভাবে সাজাতে হবে যেন মাঝখানে বায়ু চলাচলের জন্য ফাঁকা জায়গা থাকে। প্রয়োজনে হালকা রঙের ত্রিপল বা কাপড় ব্যবহার করতে হবে, যেগুলো তাপ শোষণ করে না।
ট্রাক থেকে ফল ভর্তি ক্রেট বা প্যাকেট নামানো এবং বাজারের একস্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবহনের কাজে চার চাকার হস্তচালিত টলি ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে খুবই সুবিধাজনক এবং পণ্যের ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম হয়। ফল পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত গাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে হবে।
পাইকারি ও খুচরা বাজারে আম হ্যান্ডলিং ব্যবস্থাপনা
পাইকারি ও খুচরা বাজারগুলো মূলত কৃষক, ফড়িয়া ও অন্য বেপারিদের পণ্য কেনাবেচার আউটলেট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কাজেই এসব বাজারে ফল হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে কতগুলো মৌলিক বিষয়ের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে : আমের ক্রেট বা প্যাকেটগুলো গাড়ি থেকে সাবধানতার সাথে নামাতে হবে যেন কোনো প্রকার যান্ত্রিক ক্ষতি না হয়। সর্টিং টেবিলের ওপর রেখে ফলগুলো পুনঃবাছাই করতে হবে এবং ক্ষতযুক্ত ফলগেুলোকে আলাদা করতে হবে। বিশেষ বাজারের চাহিদার প্রতি লক্ষ্যে রেখে ফলের আকার, আকৃতি, বর্ণ ও পরিপক্বতার ওপর ভিত্তি করে আমগুলোকে পুনঃগ্রেডিং করতে হবে। খুচরা বিক্রেতার দোকানে আমগুলোকে পরিষ্কার তাক কিংবা পরিষ্কার পাত্রের মধ্যে রেখে প্রদর্শন করতে হবে। দিনশেষে অবিক্রীত আমগুলো ভালো বায়ু চলাচলযুক্ত ঘরে সংরক্ষণ করতে হবে।
সর্বোপরি আম সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনায় উন্নত আম পাড়ার যন্ত্রের (ঠুসি) ব্যবহার, স্টেকিং উপযোগী প্লাস্টিক ক্রেট ব্যবহার, কাচির সাহায্যে যত্নসহকারে বোঁটা কাটা, আধুনিক পদ্ধতিতে কষ অপসারণ এবং গরম পানিতে শোধন করে ট্যাপের পানিতে ঠাণ্ডা করে আমের উপরিভাগের পানি শুকিয়ে সংরক্ষণ করলে আমের সংগ্রহোত্তর অপচয় সহজেই মোকাবেলা করা সম্ভব। (কৃতজ্ঞতা : গত ২৪, ২৫ জানুয়ারি, ২০১৭ ফসল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রবন্ধটি লেখা, এজন্য তৎকালীন অতিরিক্ত পরিচালক, কৃষিবিদ কৃষ্ণ চন্দ্র হোড় এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা)।
কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ*
*আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, সিলেট
আরবি খেজুর পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম ফল। প্রধানত পূর্ব ও উত্তর আফ্রিকা দেশগুলোতে এ ফলের চাষ প্রচলন বেশি। অনেকের মতে ইরাক অথবা মিসর খেজুর ফলের আদি স্থান। প্রাচীনকাল থেকে খেজুর ফলের বাগান সৃষ্টি করা এবং তা থেকে প্রাপ্ত খাদ্য ও ফলের উৎস হিসেবে খেজুর মানুষের জীবন ধারণের অন্যতম অবলম্বন ছিল। আরব দেশগুলোর মরুভূমি এলাকায় যেখানে অন্য কোনো গাছপালা জন্মানো সহজ হয় না সেখানে খেজুর বাগান সৃষ্টি করে মরুদ্যান সৃষ্টি করা হতো। আরবি খেজুর যেসব দেশে বেশি চাষ হয় তার মধ্যে মিসর, সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, আলজেরিয়া, সুদান, ওমান, লিবিয়া ও তিউনেশিয়া অন্যতম। অধুনা চীন, ভারত ও আমেরিকার কিছু অংশে সফলভাবে খেজুর চাষ করা হচ্ছে। রমজান মাসে সৌদি খেজুর দিয়ে ইফতারি করার প্রচলন মুসলিম দেশগুলোতে আছে। বাংলাদেশসহ সব মুসলিম দেশ প্রচুর খেজুর আমদানি করে অথবা নিজেদের উৎপাদন থেকে রমজান মাসে প্রচুর খেজুরের চাহিদা পূরণ করে থাকে।
বাংলাদেশের বৃহত্তর ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশালসহ সারা দেশে কম-বেশি খেজুর চাষ করা হয় মূলত রস ও গুড় তৈরির কাজে। দেশি জাতের খেজুর গাছে যে পরিমাণ ফল ধরে তা উন্নত মানের নয়, তাই ফল হিসেবে খাওয়ার তেমন প্রচলন নেই। গত ১৫-২০ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকার কিছু আগ্রহী চাষি সীমিত আকারে খেজুর চাষ করে সফল হয়েছে। তারা বীজ থেকে তৈরি বাগান করায় তাতে জাতের গুণাগুণ রক্ষা হয় না। আধুনিক সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও পরাগায়নে সক্ষমতার অভাবে খেজুর গাছ থেকে তারা কম ফলন পায়।
ডিএই সরকারিভাবে প্রথম আরব দেশ থেকে উন্নত জাতের খেজুর কলম আমদানি করে বিভিন্ন জেলার হর্টিকালচার সেন্টারগুলোতে এজাতের খেজুরের বাগান সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে কিছু সংখ্যক গাছ ফুল ধরা অবস্থায় এনে ফেব্রুয়ারি-২০১৭ মাসে রোপণ করা হয়েছে, তাতে ফল ধরা আরম্ভ করেছে। অচিরেই বাংলাদেশ আরবি খেজুর উৎপাদনে সফলতা অর্জন করবে।
আবহাওয়া ও মাটি : পর্যাপ্ত রোদ, কম আর্দ্রতা, শুকনা ও কম বৃষ্টিপাত, উষ্ণ আবহাওয়া এ ফল চাষের জন্য উপযোগী। বেশি শীত এবং সাময়িক জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ত সহিষ্ণু গুণাগুণ এ গাছের আছে। ফুল ফোটা ও ফল ধরার সময় বেশি বৃষ্টিপাত ভালো না। একই কারণে এ দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় এবং পার্বত্য জেলাগুলোতে সৌদি খেজুর চাষ সম্প্রসারণ করার সুযোগ আছে। বেলে-দো-আঁশ মাটি এ জাতের খেজুর চাষের জন্য বেশি উপযোগী। তবে মাটি অনুকূল না হলে রোপণের আগে গর্তের মাপ র্৬দ্ধর্৬ দ্ধর্৩ তৈরি করে তাতে জৈবপদার্থ ও বেলে মাটি দিয়ে তা ভরাট করে নিয়ে খুব সহজেই মাটিকে উপযোগী করে নেয়া যায়। পানি নিকাশের সুবিধাযুক্ত উচ্চ জমি এ ফল চাষের জন্য উপযোগী। মাটির উপরের স্তরে র্৬-র্৭ ফুটের মধ্যে হাডপ্যান থাকলে গর্ত তৈরিকালে শাবল দিয়ে ভেঙে দিতে হবে।
পুষ্টিমান : খেজুর অতি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ফল। এতে প্রচুর প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেলস ও ক্যালোরি সমৃদ্ধ। সুষম খাদ্য হিসেবে খেজুরের জুড়ি নেই। এ ফলের ঔষধিগুণ খুব বেশি। আহারে হজম শক্তি বাড়ায়, রক্ত স্বল্পতা, কোষ্ঠকাঠিন্য, এলার্জি ও ক্যান্সার রোধক হিসেবে কাজ করে। খেজুর দেহে শক্তি জোগায়, হার্টকে সুস্থ রাখে, দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে, দেহের হাড় ও দাঁতকে মজবুত রাখে। রক্তশূন্যতা, গলাব্যথা, ডায়রিয়া, সুস্থ গর্ভধারণে এ ফল অতি উপকারী।
জাত : পৃথিবীতে প্রায় এক হাজারের বেশি খেজুরের জাত রয়েছে। সৌদি দেশগুলোতেই এ জাতের সংখ্যা চার শতাধিক। যেহেতু তাল ও লটকন গাছের মতো খেজুরের পুরুষ-স্ত্রী গাছ আলাদাভাবে জন্মায়, এজন্য বীজ থেকে তৈরি গাছে প্রাকৃতিকভাবে নতুন জাতের সৃষ্টি হয়। তবে বীজ থেকে তৈরি চারায় প্রকৃত জাতের গুণাগুণ থাকে না। ফল ধরতে বেশি সময় লাগে, ফলের পরিমাণ ও মান আশাপদ হয় না। যেসব জাতের খেজুরের জনপ্রিয়তা বেশি এগুলোর মধ্যে বারহি, মেডজল, সামরান, খাতরাই, জাহেদি, খালাস, মরিয়ম, নিমেশি, আনবারাহ, জাম্বেলি, শিশি, লুলু, সুলতানা, আজুয়া, ইয়াবনি, ডিগলিটনূর, আসমাউলহাসনা অন্যতম। ডিএই এ পর্যন্ত ১৭টি আধুনিক উন্নত জাতের খেজুর কলম আমদানি করে বিভিন্ন জেলার হটিকালচার সেন্টারে বাগান সৃষ্টি করছে।
বংশবিস্তার : আরব দেশগুলো আগে পছন্দমতো জাতের কা- থেকে গজানো সাকার বা চারা সংগ্রহ করে তা দিয়ে বাগান সৃষ্টি করতেন। এছাড়া বীজের চারা দিয়েও খেজুর বাগান সৃষ্টি করার প্রচলন ছিল। তবে অধুনা টিস্যুকালচার পদ্ধতি অবলম্বনে উন্নত জাতগুলোর প্রচুর কলম তৈরি করে তা ব্যবহার জনপ্রিয়তা বেড়ে চলেছে। পুরনো পদ্ধতিতে কা- থেকে চারা কম পাওয়া যেত। বীজ থেকে তৈরি চারার গাছে ফল দিতে প্রায় ৬ বছর সময় লাগে। খেজুর গাছের কা- থেকে প্রাপ্ত চারা এবং টিস্যুকালচারের মাধ্যমে তৈরি চারা রোপণের ৩ বছর পর থেকেই গাছে ফুলফল ধরা শুরু হয়। এখন টিস্যুকালচারের মাধ্যমে খেজুর চারা উৎপাদন কাজে কিছু প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত থাকার কারণে উন্নত জাতের বাগান সৃষ্টি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অন্যান্য দেশগুলোও এর সুফল ভোগ করছে। এ দেশে ১৫-২০ বছর ধরে অনেকেই সীমিত আকারে খেজুর চাষ করছে তা বীজের তৈরি চারা দিয়ে, এতে ভালো জাতের প্রকৃত গুণাগুণ বজায় থাকে না, ফলের মান ও ফলন ভালো হয় না।
জমি নির্বাচন ও রোপণ : পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত অপেক্ষাকৃত উঁচু প্রচুর আলো-বাতাস পায় এমন জমি খেজুর বাগানের জন্য নির্বাচন করা দরকার। বাগান তৈরির জন্য ২০ ফুট দূরত্বে সারি করে ২০ ফুট দূরে দূরে চারা রোপণের জন্য খেজুর বাগান নকশা তৈরি করে নেয়া প্রয়োজন। এক বা দুই সারি গাছ লাগানোর প্রয়োজনে ১৫-১৭ ফুট দূরত্ব দিলেই চলবে। বর্ষাকালে ১০-১২ ইঞ্চি পানি জমে থাকে এমন নিচু স্যাঁতসেঁতে জমিতে সর্জান পদ্ধতি অবলম্বনে বাগান সৃষ্টি করা সহজ। এ ক্ষেত্রে দুই সারির মাঝে ৭-৮ ফুট চওড়া এবং ২-৪ ফুট গভীর নালা কেটে উভয় পাশে গর্তের মাটি উঠিয়ে দিয়ে ১০-১২ ফুট চওড়া উঁচু বেড তৈরি করে নিয়ে সে বেডে খুব সহজেই সফলভাবে খেজুর বাগান সৃষ্টি করা যায়। বরিশাল জেলার রহমতপুর হর্টিকালচার সেন্টারে এ পদ্ধতি অবলম্বনে ৭২টি খেজুর গাছ বিশিষ্ট খেজুর বাগান সৃষ্টি করা হয়েছে। এ বাগানের গাছের বাড়-বাড়ন্ত খুব উৎসাহজনক, যা আগামী দিনে উপকূলীয় জেলাগুলোতে আরবি খেজুর চাষ সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য মডেল হিসেবে কাজ করবে।
গর্ত তৈরি ও তা ভরাটকরণ : রোপিত গাছের শিকড় যেন ঠিকমতো ছড়াতে পারে এজন্য ৬ ফুট চওড়া ও ৩ ফুট গভীর করে গর্ত তৈরি করে নিয়ে তা এক সপ্তাহ রোদে রেখে গর্তে সার ও মাটি দিয়ে পুনরায় ভরাট করে নেয়া প্রয়োজন। তৈরিকৃত গর্তে খড়কুটা দিয়ে ভরাট করে তা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলে গর্তের মাটি শোধন করা যাবে। খেজুর চারা রোপণের আগে যেসব সার ও উপাদান মিশানো প্রয়োজন তা হলো মোটাবালু (সিলেট স্যান্ড) ৩০%, পচা গোবর বা আবর্জনা পচা সার ৪০% এবং ভিটে মাটি বা বেলে দো-আঁশ মাটি ৩০%। এছাড়াও এতে আরও মেশাতে হবে ১০-১৫ কেজি কোকোডাস্ট বা নারিকেলের ছোবড়ার গুঁড়া, সমপরিমাণ কেঁচো সার। হাড়ের গুঁড়া ১ কেজি, ইউরিয়া-৩০০ গ্রাম, টিএসপি-৪০০ গ্রাম, এমওপি-৫০০ গ্রাম। এছাড়া জিঙ্ক সালফেট, ম্যাগসালফেট, ফেরাস সালফেটে ও বোরন- প্রতি গাছে ১০০ গ্রাম করে মোট ৪০০ গ্রাম মেশানো প্রয়োজন। রোগবালাই প্রতিহত করার জন্য উপযোগী ছত্রাক নাশক ও দানাদার কীটনাশক ১০০ গ্রাম করে মোট ২০০ গ্রাম মেশাতে হবে। এসব একত্রে মিশেয়ে গর্ত ভরে পানি দিয়ে কয়েক দিন ভিজিয়ে রাখতে হবে। এভাবে গর্ত ভরাট করার দুই সপ্তাহ পর তা গাছ রোপণের জন্য উপযোগী হবে।
চারা রোপণ : খেজুরের চারা সমতল থেকে এক ফুট ওপরে রোপণ করতে হবে। এজন্য গর্ত ভরাট করা মাটি উঠিয়ে মধ্যভাগ উঁচু করে নিতে হবে। এরপর ক্রমান্বয়ে তা বাইরের দিক ঢালু করে নালা বরাবর মিলাতে হবে। গাছ রোপণ করা হলে গাছের গোড়া থেকে ২.৫ ফুট দূরে বৃত্তাকার করে ১০-১২ ইঞ্চি চওড়া ও ১২ ইঞ্চি গভীর নালা তৈরি করে এ নালার মাটি বাইরের দিক সুন্দরভাবে বৃত্তাকারে উঁচু আইল বেঁধে দিতে হবে। গাছ রোপণ শেষে নালায় ৮-১০ দিনের ব্যবধানে পানি দিয়ে নালা ভর্তি করে দিতে হবে। গাছ এ নালার পানি শুষে নেবে।
সেচ ও নিকাশ : বর্ষাকালে যেন বাগানে কোনো মতেই পানি না জমে এজন্য পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা রাখতে হবে। খরা মৌসুমে নিয়মিত গাছের গোড়ায় সেচ দিয়ে ভেজাতে হবে। মাটিতে রসের অবস্থা বুঝে ৭-১৫ দিনের ব্যবধানে নালা ভর্তি করে পানি সেচ দিয়ে গাছের রসের অভাব দূর করতে হবে। ভালোভাবে গাছের বৃদ্ধি, বেশি উন্নত মানের ফল প্রাপ্তি, প্রয়োজনীয় পানি সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে। বয়স্ক খেজুর গাছের শিকড় গোড়া থেকে প্রায় ৪-৫ ফুট বৃত্তাকারে চারদিকে ৩-৪ ফুট গভীরতায় প্রবেশ করে। এজন্য শুকনা মৌসুমে এ শিকড় ছড়ানো এলাকায় রসের অভাব দূরীকরণের ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
মালচিং ও ট্রেনিংপ্রুনিং : শুকনা মৌসুমে গাছের গোড়ার চারধারে ২-৩ ফুট দূর পর্যন্ত বৃত্তাকারে খড়, লতাপাতা বা কচুরিপানা দিয়ে মালচিং দিতে হবে। তাতে মাটির রস সংরক্ষিত থাকে এতে ঘন ঘন সেচ দেয়ার প্রয়োজন হবে না। মালচিং দেয়ার ফলে গাছের গোড়ার চারদিক আগাছামুক্ত থাকবে, পরিবেশ অনুকূল হবে, পরে এসব লতা-পাতা পচে জৈবসার হিসেবে কাজ করবে। গাছ বড় হলে উপরি ঊর্ধ্বমুখী গাছের পাতা রেখে নিচে ঝুলে পড়া পুরনো মরা পাতাগুলো কা-ের গোড়া থেকে ৭-৮ ইঞ্চি ছেড়ে ছেঁটে দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়াও উপরের দিকের অফলন্ত ফলের ছড়া ও ফুল-ফলের শক্ত ঢাকনা সাবধানে অপসারণ করতে হবে। সাথে সাথে কাটা অংশে ছত্রাকনাশক বা বোর্দ মিক্সার পেস্ট দিয়ে প্রলেপ দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।
পরিচর্যা : গাছ রোপণ করে তা কাঠি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে সম্ভাব্য সোজা রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথম কয়েক বছর পাতা শুকালে তা কেটে দিতে হবে। কোন মতেই গাছের কাঁচা পাতা কাটা যাবে না। তবে বছরে একবার ফল সংগ্রহ শেষে নিচের দিকে ঝুলে পড়া বয়স্ক অপ্রয়োজনীয় পাতা অপসারণ করতে হবে। গাছের গোড়া ও কা- থেকে গজানো শাখা বাড়তে দিলে গাছে ফলদান ক্ষমতা কমে যাবে। তবে চারা সংগ্রহের প্রয়োজনে গোড়ার কাছাকাছি গজানো কিছু সাকার রেখে অবশিষ্ট সাকারগুলো নিয়মিত ছেঁটে দিতে হবে। সংগৃহীত চারা বেশি ছায়ায় সংরক্ষিত থাকার কারণে চারা রোপণের পর সূর্যের তাপে খেজুর চারা ঝলসে না যায় এজন্য রোপণের প্রথম ১০-১৫ দিন উত্তর-পূর্ব দিক উন্মুক্ত রেখে পাতলা ছালা দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক ভালোভাবে ঢেকে দিয়ে গাছকে হালকা ছায়া দেয়া প্রয়োজন হবে। বিকল্প ব্যবস্থায় গাছগুলোকে ১৮ ইঞ্চি বিশিষ্ট মাটির টবে উপযোগী পটিং মিডিয়া দিয়ে আধাছায়ায় ২-৩ মাস সংরক্ষণ করে পরে সেগুলো বাগানে রোপণ উপযোগী হবে।
সার প্রয়োগ : আরবি খেজুর গাছে ৪ মাসের ব্যবধানে নিয়মিত সার প্রয়োগ করা জরুরি। তাতে গাছ ভালোভাবে বাড়বে, বেশি ফল দানে সক্ষম হবে। নারিকেল, সুপারির মতো এরা পামী গোত্রীয় বলে পটাশ পছন্দ করে। বিভিন্ন বয়সের গাছে যে সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন তা হলো-
প্রতি বছরের জন্য সুপারিশকৃত সারগুলো ৩ ভাগে ভাগ করে নিয়ে প্রতি ডোজ মে-জুন মাসে একবার এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ও ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে আরও দুইবার প্রয়োগ করা যেতে পারে। এছাড়াও অনু খাদ্যগুলো বিশেষ করে জিঙ্কসালফেট, ম্যাগসালফেট, ফেরাল সালফেট ও বোরন ও আইরোল বছরে একবার করে গাছের বয়স বিবেচনায় প্রতিষ্ঠাতে ২০০-৩০০ গ্রাম করে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। সার প্রয়োগ করার পরপরই ভালোভাবে সেচ দিতে হবে। গাছের গোড়া ছেড়ে যে অংশে শিকড় ছড়ায় সে অংশে সার প্রয়োগ ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন সার প্রয়োগকালে গাছের শিকড় কম আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ভালো ব্যান্ডের ঘচক বা ঘচকঝ মিশ্র সার ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে গাছের প্রথম অবস্থার তুলনায় নাইট্রোজেন জাতীয় সার প্রয়োগ কিছু বেশি প্রয়োজন হয়। ফুল-ফল ধরা আরম্ভ করলে পটাশ ও ফসফরাসের পরিমাণ বাড়াতে হবে। অনেকে অনুখাদ্যসমৃদ্ধ কোনো কোনো সার পানিতে গুলে যায় এমন সার প্রয়োগ করে গাছকে সুস্থ রাখে।
পোকা ও রোগ দমন : নারিকেল, তাল ও খেজুর গাছের শিকড়ের অগ্রভাগ নরম ও মিষ্টি, যা উঁই পোকাসহ মাটিতে অবস্থানকারী বিভিন্ন পোকা ও নিমাটোডকে আকৃষ্ট করে। এ জন্য মাটিতে ব্যবহার উপযোগী দানাদার কীটনাশক ও তরল কীটনাশক (ইমিডাক্লোরোপিড/ডার্সবান) দু-তিন মাসের ব্যবধানে নিয়মিত ব্যবহার করে মাটিতে অবস্থানকারী পোকা দমন ব্যবস্থা নিতে হবে। খেজুর গাছেও রাইনো বিটেল (গ-ার পোকা), রেড পাম উইভিল, স্কেল পোকার উপদ্রব বেশি দেখা যায়। এজন্য বাগান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং ইমিডাক্লোরোপিড অথবা ক্লোরোপাইরিফস দলীয় কীটনাশক দিয়ে ২-৩ সপ্তাহের ব্যবধানে কচি পাতা ও পাতার গোড়ার অংশ ভালোভাবে স্প্রে করে গাছকে রক্ষা করা যাবে। খেজুর গাছে মাইটের উপদ্রব মাঝে মধ্যে দেখা যায়। এ জন্য ২-৩ সপ্তাহের ব্যবধানে মাইটনাশক ব্যবহার করে গাছকে সুস্থ রাখা উচিত হবে।
রোগ : মাটিতে অবস্থানকারী ছত্রাক, প্রুনিং করার কারণে ক্ষত স্থানে রোগ এবং গজানো পাতার পুরো অংশে কাল-বাদামি দাগ পড়া রোগের আক্রমণ খেজুর গাছে বেশি দেখা যায়। এজন্য ম্যানকোজেভ/কার্বোন্ডাজিম বা বোর্দমিক্সচার দিয়ে ছত্রাকনাশক দিয়ে ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে নিয়মিত পাতা, কা- ও মাটিতে স্প্রে করে গাছকে সুস্থ রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে।
খেজুর গাছে পরাগায়ন : খেজুর গাছের পুরুষ ও স্ত্রী গাছ আলাদাভাবে জন্মে। এজন্য সুস্থ, বড় ও ভালো মানের খেজুর ফলের জন্য ফুটন্ত স্ত্রী ফুলের ছড়া বের হওয়ার সাথে সাথে পুরুষ গাছের পরাগরেণু দিয়ে সময়মতো পরাগায়ন করা অত্যাবশ্যক। সুস্থ সবল বড় আকারের পুরুষ ফুল দানে সক্ষম এমন গাছ থেকে পুরুষ ফুল সংগ্রহ করে সাধারণ ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হলে তা দুই বছর পর্যন্ত পরাগায়নের কাজে ব্যবহার করা যায়। তবে তাজা পরাগ রেণু ব্যবহার করা ভালো। সৌদি খেজুর গাছে জানুয়ারি-মার্চ মাসে ফুল ফুটে। উভয় প্রকার ফুলের কাঁদি একটা শক্ত আবরণ দিয়ে ঢাকা থাকে। আবরণের ভেতরে ফুল বড় হয়ে পরাগায়নের উপযোগী হলে বাইরের আবরণটা আস্তে আস্তে ফাটা শুরু হয়। এ অবস্থায় পুরুষ ফুলের কাঁদির আবরণ অপসারণ করে নিয়ে হালকা রোদে শুকিয়ে নিয়ে এ পরাগ রেণু সাবধানে আলাদা করে নিয়ে কাগজে মুড়িয়ে তা পলিথিন কভার দিয়ে ফ্রিজের নরমাল চেম্বারে সংরক্ষণ করতে হয়।
এরপর স্ত্রী খেজুর গাছের ফুলের কাঁদি বড় হয়ে বাইরের শক্ত আবরণে ফাটল ধরা আরম্ভ করলে তা পরাগায়ন করার উপযোগী হয়। এ সময় ফাটল ধরা শক্ত আবরণ ধারালো ছুরি দিয়ে অপসারণ করে ছড়ার ভেতরের অংশ বের করে দামি নরম তুলি বা ব্রাশ দিয়ে সামান্য পরিমাণ পরাগ রেণু দিয়ে স্ত্রী ফুলে এ পরাগ রেণু হালকাভাবে ছুয়ে বা ঝেড়ে দিতে হয়। এ ছাড়া পুরুষ ফুলের দু-একটা ছাড়া স্ত্রী ফুলের আগায় বেঁধে রাখতে হয়। পরাগায়ন করা ফুলের ছড়া পাতলা ব্রাউন কাগজের ঠোঙা দিয়ে হালকাভাবে ঢেকে দিতে হয়। এর ৩-৪ সপ্তাহ পর আবরণটা সরিয়ে ফেলতে হয়। পরাগায়নকালে ছড়ার কাছাকাছি খেজুরের ছুঁচালো কাঁটাগুলো সিকেচার দিয়ে অপসারণ করে নিলে কাঁটার আঘাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বাগানে প্রতি ১৫-২০টা স্ত্রী গাছের জন্য একটা করে পুরুষ গাছ রাখার কারণে বাতাসের ও মৌমাছি বা উপকারী কীটপতঙ্গের মাধ্যমে পরাগায়ন কাজ সমধা হয়। এতে ৬০-৮০% পর্যন্ত ফল ধরানো সম্ভব।
ফল সংগ্রহ : পরাগায়ন করার ৩-৪ মাস পর খেজুর ফল সংগ্রহের উপযোগী হয়। কতগুলো জাতের পুষ্ট কাঁচা-পাকা ফল উভয় অবস্থায় খাওয়া যায়। অন্য জাতের ফল পরিপক্ব অবস্থায় বাদামি/গাঢ় বাদামি/কালো রঙ ধারণ করলে তা সংগ্রহ, সংরক্ষণ বা প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবহার বা বাজারজাত করা হয়। একটা সুস্থ সবল গাছ থেকে বছরে জাতভেদে ৭০-১৫০ কেজি খেজুর ফল পাওয়া যায়। উত্তম ব্যবস্থাপনায় কোনো কোনো জাতের গাছে প্রায় ৩০০ কেজি পর্যন্ত ফল দিয়ে থাকে। পরাগায়নের পর ৭-১০টা সুস্থ সবল কাঁদি রেখে অবশিষ্ট কাঁদিগুলো শুরুতেই অপসারণ করা দরকার। এ ব্যবস্থায় অবশিষ্ট কাঁদিগুলো থেকে বেশি আকর্ষণীয় বড় আকারের ফল পাওয়া নিশ্চিত হবে। খেজুর ফল ধীরে ধীরে বড় হওয়া আরম্ভ করলে তা ফলের ভারে ঝুলে পড়ে। এ ফলন্ত ছড়া পাতার ডগায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফল বড় হতে বাধা সৃষ্টি করে, তাতে ফলন কমে যায়। খেজুর ফলের থোকা যেন অবাধে আংশিকভাবে ঝুলতে পারে এজন্য কাঁটা পরিষ্কার করে দিয়ে ফলকে অবাধে বাড়তে দেয়া দরকার। খেজুরের ভারে একেকটা কাঁদি যেন ভেঙে না পড়ে এজন্য কাঁদির ফুল ধরা শুরু অংশে হালকাভাবে দড়ি বেঁধে দিয়ে ফলের কাঁদিকে উপরের ডালায় বেঁধে দিলে ভেঙে যাওয়া বা বেশি ঝুলে পড়া রোধ ব্যবস্থা নিতে হয়। ফল কিছুটা বড় হলে এক ধরনের মাছি পোকা ও পাখির উপদ্রব বাড়তে থাকে। এজন্য ঘন মশারি দিয়ে ঢিলা ব্যাগ তৈরি করে ফলগুলোকে সুন্দরভাবে ঢেকে দিতে হয়।
এছাড়া লম্বা ব্যাগের নিচে ফল পুষ্ট হলে বা পাকলে নিচে জমা হয় এবং নিচের গিট ফুলে ফল গ্রহণ করা হয়। বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের সহায়তায় আরব দেশ থেকে উন্নত জাতের খেজুর কলম সংগ্রহ করে আধুনিক প্রযুক্তি অবলম্বনে এ জাতের খেজুর ডিএই’র আওতাধীন বিভিন্ন হর্টিকালচার সেন্টারে ও আগ্রহী কৃষক পর্যায়ে বাগান সৃষ্টির যে মহতি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তার সফলতা বয়ে আনুক এবং এ দেশে হাইভ্যালু অতি লাভজনক খেজুর ফল চাষ সম্প্রসারণের গতি বেগবান হোক পরিশেষে এটাই একান্তভাবে কাম্য।
এম এনামুল হক*
*মহাপরিচালক (অব.), ডিএই এবং ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট (হর্টিকালচার) বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প; মোবাইল ০১৯১৭০৫৫২০৫
পুকুরে মাছ চাষে বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়। পানি দূষিত হয়, অক্সিজেন কমে যায়, গ্যাস সৃষ্টি হওয়াসহ নানা সমস্যার জন্য মাছের বিভিন্ন রোগ ও মড়ক দেখা যায়। ফলে মাছের উৎপাদন কমে যায়। এসব সমস্যা হওয়ার আগেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিলে মাছের উৎপাদন বাড়ানো যায়।
১. খাবি খাওয়া : অক্সিজেনের অভাবে মাছ পানিতে খাবি খায়। পানির ওপর ভেসে ওঠে। মাছকে খুব ক্লান্ত দেখায়। পানিতে সাঁতারকাটা, বাঁশ দিয়ে পানির ওপর পেটানো, হররা টেনে তলের গ্যাস বের করে দেয়া, পুকুরে পাম্প বসিয়ে ঢেউয়ের সৃষ্টি করা। নতুন পানি সরবরাহ করেও অক্সিজেন বাড়ানো যায়। প্রতি শতাংশে ১ কেজি চুন ও কৃত্রিম অক্সিজেন দেয়া যেতে পারে।
২. কার্বন-ডাই-অক্সাইডজনিত পানি দূষণ : পানিতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেড়ে গেলে মাছের দেহে বিষক্রিয়া হয় এবং শ্বাসকষ্ট হয়। খাবি খাওয়া প্রতিকারের মতো। তবে মাছ ছাড়ার আগে পুকুর তৈরির সময় অতিরিক্ত কাদা সরাতে হবে।
৩. অ্যামোনিয়াজনিত সমস্যা : অ্যামোনিয়া বেড়ে গেলে পানির রঙ তামাটে অথবা কালচে রঙের হয়। মাছের ছোটাছুটি বেড়ে যায়। মাছের মজুদ ঘনত্ব কমাতে হবে। সার ও খাদ্য প্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে। নতুন পানি সরবরাহ করতে হবে।
৪. নাইট্রোজেনজনিত সমস্যা : নাইট্রাইটের পরিমাণ বেড়ে গেলে মাছের দেহে অক্সিজেন সঞ্চালন বাধা প্রদান করে। বিষাক্ততার সৃষ্টি করে। এতে মাছের দেহ বাদামি রঙ ধারণ করে। মাছ খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে দেয়।
প্রতিকার : মাছের ঘনত্ব কমাতে হবে। পুকুরে ২৫০ মিলিগ্রাম/লিটার হারে লবণ দিতে হবে।
৫. পিএইচ জনিত সমস্যা : পানিতে পিএইচ বা অম্লমান কমে গেলে মাছের দেহ থেকে প্রচুর পিচ্ছিল পদার্থ বের হয়। মাছ খাদ্য কম খায়। পিএইচ বেশি হলে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন কমে যায় এবং মাছের খাদ্য চাহিদা কমে যায়। দেহ খসখসে হয়। মাছ রোগাক্রান্ত হয়।
প্রতিকার : পিএইচ কম হলে চুন, ডলোমাইড বা জিপসাম ১ থেকে ২ কেজি-শতাংশ প্রয়োগ করতে হবে। পিএইচ বেশি হলে পুকুরে তেঁতুল বা সাজনা গাছের ডাল তিন-চার দিন ভিজিয়ে রেখে পরে তুলে ফেলতে হবে। তেঁতুল পানিতে গুলে দেয়া যেতে পারে।
৬. পানির ওপর সবুজ স্তর : পুকুরের পানির রঙ ঘন সবুজ হয়ে গেলে বা পানির ওপর শ্যাওলা পড়লে খাদ্য ও সার প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। প্রতি শতাংশে ১২ থেকে ১৫ গ্রাম তুঁতে বা কপার সালফেট অনেক ভাগ করে ছোট ছোট পোটলায় বেঁধে ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার পানির নিচে বাঁশের খুঁটিতে বেঁধে রাখতে হবে। শতাংশপ্রতি ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ গ্রাম চুন প্রয়োগ করতে হবে।
পানির ওপর লাল স্তর : পুকুরের পানির ওপর লাল স্তর পড়লে ধানের খড়ের বিচালি বা কলা গাছের শুকনো পাতা পেঁচিয়ে দড়ি তৈরি করে পানির ওপর দিয়ে ভাসিয়ে নিলে পরিষ্কার হয়।
৭. পানির ঘোলাত্ব : পানি ঘোলা হলে মাছ খাদ্য কম খায়, চোখে দেখে না, প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয় না, প্রজননে সমস্যা হয় ও রোগবালাই বেশি হয়। প্রতি শতাংশে ৮০ থেকে ১৬০ গ্রাম ফিটকিরি দিতে হবে। পুকুর তৈরির সময় জৈবসার বেশি দিলে স্থায়ীভাবে ঘোলা দূর হয়। কলাপাতা ও কুচরিপানা রাখলেও ঘোলা কমে।
৮. পানির ক্ষারত্ব : পানি ক্ষারীয় হলে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি কম হয়। মাছের দৈহিক বৃদ্ধি কমে যায়। পুকুর তৈরির সময় ও পরে শতাংশ প্রতি ১ থেকে ২ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হয়। এছাড়াও ছাই ব্যবহার করলেও পানির ক্ষারত্ব নিয়ন্ত্রণ থাকে।
৯. রোগবালাই : মাছের রোগবালাই প্রতিরোধের জন্য যেসব ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন তা হলো ১. পুকুরের পরিবেশ ও পানির গুণাগুণ ঠিক রাখা, ২. জলজ আগাছামুক্ত রাখা, ৩. পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়ার ব্যবস্থা করা, ৪. অনাকাক্সিক্ষত জলজপ্রাণী অপসারণ করা, ৫. অতিরিক্ত কাদা সরানো, ৬. দুই-তিন বছর পর পর পুকুর শুকানো, ৭. চুন প্রয়োগ করা, ৮. মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা, ৯. প্রাকৃতিক খাদ্য পরীক্ষা করা, ১০. হররা টানা, ১১. পাখি বসতে না দেয়া, ১২. জাল শোধন করে ব্যবহার করা, ১৩. রোগাক্রান্ত মাছ অপসারণ করা, ১৪. সব সময় ঢেউয়ের ব্যবস্থা করা।
কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ*
*কৃষি প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, কৃষিশিক্ষা, শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ, ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল; বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত লেখক। মোবাইল : ০১৭১১-৯৫৪১৪৩
বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর আমাদের দেশে হাজার হাজার গবাদি পশুপাখি মারা যায়। এর ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয় খামারিরা। যা জাতীয় অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। বাংলাদেশের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের জন্য সেটা আরও মারাত্মক। প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো অনাকাক্সিক্ষতভাবে ঘটে যায়। পূর্বপ্রস্তুতি না থাকলে সেগুলো মোকাবিলা করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। একটু সতর্ক হলে সময় নিয়ে প্রস্তুতি নেয়া যায়। আমাদের দেশে মূলত দুইটি দুর্যোগ খুব মারাত্মক। একটি হলো ঘূর্ণিঝড় আরেকটি হলো বন্যা। গবাদি পশুপাখির দুর্যোগ মোকাবিলা পূর্বপ্রস্তুতিতে কী কী হতে পারে।
০১. খামারের চাল মজবুত করে বাঁধা
দুর্যোগকালীন প্রচ- বাতাস যাতে খামারের চাল উড়িয়ে নিতে না পারে সেজন্য খামার এবং খামারের চাল শক্ত করে বাঁধতে হবে। পরে মাটিতে শক্ত করে খুঁটি পুঁতে শক্ত দড়ি দিয়ে খামারের চাল বেঁধে দিতে হবে।
০২. পানি চলাচলের বিকল্প ব্যবস্থা
বর্ষাকালে বৃষ্টি বা বন্যার পানি যাতে জমে না থাকে সে জন্য পানি চলা চলের জন্য বিকল্প নালা তৈরি করে রাখতে হবে। কারণ হঠাৎ করে পানি বাড়তে শুরু করলে নালা তৈরি করার সময় পাবেন না। বৃষ্টির পানি শুষে নেয়ার জন্য খামারের চারপাশে সবজি চাষ করা যায়।
০৩. জলাশয়ের চারদিক ঘেরা
খামার যদি নদী,হ্রদ বা জলাশয়ের নিকটবর্তী হয় তা হলে যেদিক থেকে পানি খামারকে প্লাবিত করতে পারে সেদিকে উঁচু করে বাঁধ তৈরি করতে হবে যাতে বন্যার সময় খামার বন্যার ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকে।
০৪. খামার সংস্কার
খামারের দরজা, জানালা দেয়াল সময় থাকতে ঠিক করে নিতে হবে। আবাসন, খাবার পাত্র, পথ রাস্তা, স্টোর এসব ঠিকমতো সুরক্ষা করতে হবে।
০৫. খামারের ক্ষতিকর রাসায়নিক অপসারণ
খামারে আশপাশে কোথাও কোনো ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ কীটনাশক, জীবাণুনাশক, ইঁদুরনাশক থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। পুকুর বা অন্য জলাশয়ে এসব রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত পানি প্রবেশের সম্ভাবনা আছে তা চারপাশে উঁচু করে দিতে হবে। যাতে বৃষ্টি বা বন্যার পানি সেখানে ঢুকতে না পারে। এসব পদার্থ গবাদি পশুর মারাত্মক ক্ষতি, এমন কি মৃত্যু কারণও হতে পারে।
০৬. দুর্যোগকালীন গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সংগ্রহ
দুর্যোগকালীন বা দুর্যোগ পরবর্তী যেসব জিনিস প্রয়োজন হতে পারে তার একটি তালিকা তৈরি করে দুর্যোগের আগেই সংগ্রহ করে রাখতে হবে। কারণ বিপদের সময় এ সব জিনিস নাও পাওয়া যেতে পারে অথবা পাওয়া গেলেও অধিক পয়সা খরচ হতে পারে। প্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের নাম ও মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে রাখতে হবে।
০৭. গবাদি পশুকে টিকা প্রদান
গবাদি পশুপাখিকে প্রয়োজনীয় সব টিকা দিয়ে রাখতে হবে। কারণ দুর্যোগের পরে গবাদি পশুর বিভিন্ন ছোঁয়াছে রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু টিকা পশুপাখিকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করবে।
বিপদকালীন স্থানান্তরের ক্ষেত্রে, কোন পশুগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে তার একটি তালিকা তৈরি করে রাখতে হবে। তাছাড়া পশুগুলো চিহ্নিত করে রাখতে হবে। যাতে দুর্যোগ পরবর্তী পশু হারিয়ে গেলে সহজে খুঁজে পাওয়া যায়। গরুর জন্য প্রয়োজনীয় দড়ি, খামার এবং পানি প্রস্তুত রাখতে হবে এবং যদি সম্ভব হয় গাভী স্থানান্তরের সময় সেসব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করতে হবে।
০৮. আশ্রয়ণ কেন্দ্রে স্থানান্তর
দুর্যোগকালীন গবাদি পশু আশ্রয়ণ কেন্দ্রে স্থানান্তর করবে না কি বাইরে ছেড়ে দিতে হবে সেটা আশ্রয়ণ কেন্দ্রের দূরত্ব ও অবস্থার ওপর নির্ভর করবে। যদি পর্যাপ্ত জায়গা থাকে তাহলে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া যেতে পারে। অন্যথায়, বাইরে ছেড়ে দিতে হবে। পোষা কুকুর-বিড়াল থাকলে সেগুলো নিজের কাছে রাখাই উত্তম।
০৯. আগে মানুষ না কি পশু?
কিছু কিছু সময় এমন সময় আসে যখন নিজের প্রাণের তাগিদে পোষা পশুপাখিগুলোকে ছেড়ে যেতে হয়। সেক্ষেত্রে পশুপাখিগুলোর জন্য পর্যাপ্ত খাবার এবং পানি সরবরাহ রেখে যেতে হবে। কম পক্ষে দুই দিনের খাবার-পানি রাখতে হবে। সাধারণত দুই একদিনের মধ্যে দুর্যোগকালে প্রাথমিক উদ্যোগ নেয়া হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে পশু মারা যায় বা অসুস্থ হয়ে যায়। তবে যেগুলো বেঁচে থাকে সেগুলোকে উদ্ধারের পর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হয়।
এভাবে দুর্যোগ মোকাবিলায় পূর্বপ্রস্তুতি আপনার গবাদি পশু, পোষা প্রাণী বা পাখিকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে। সাথে সাথে দেশও মারাত্মক অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে।
কৃষিবিদ ডা. সুচয়ন চৌধুরী*
*ভেটেরিনারি সার্জন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, রাঙ্গামাটি সদর; uchayan_chy@yahoo.com
কৃষিবিদ এ এইচ ইকবাল আহমেদ*
ক.
কাঁঠাল পেয়ারা কুল আতা বেল আম
খেজুর শরিফা কলা লিচু পেঁপে জাম
তরমুজ আনারস জামরুল গাব
ডালিম আমড়া তাল নারিকেল ডাব।
ডেউয়া বেতস লেবু মালটা ডুমুর
অড়বরই সফেদা চালতা আঙ্গুর
লটকন জলপাই কমলা আমড়া
করমচা কদবেল ফলসা জাম্বুরা।
বহেরা, চুকুর ফুটি বৈঁচি আমলকী
আলুবোখারা মাখনা পিচ হরিতকি
অ্যাভোকাডো নাশপাতি কাজু পানিফল
তেঁতুল বিলিম্বি কাউ কদ শানতোল
কামরাঙা চাপালিশ তুঁত লুকলুকি
শালুকসহ নানান ফল দেয় উঁকি॥
খ.
পুষ্টিগুণে ভরা ফল স্বর্গের আহার
পৃথিবীর বড় ফল কাঁঠাল এদেশে
জাতীয় ফলের মান পেয়েছে অক্লেশে
ফল বিচি খোসা ভুতি ফেলা নয় তার।
ভিটামিন মিনারেল ফলে থাকে ঠাঁসা
কোন ফলে থাকে স্নেহ কোনটাতে আঁশ
কোনটায় পানি ভরা পেকে গেলে শাঁস
খাবারে ফলের স্থিতি স্বাস্থ্য হয় খাসা।
ফল খেয়ে জল পান স্বাস্থ্য করে নাশ
ফল খেলে বল পায় রোগী বা সবলে
ধন্বন্তরী অনুপান ভরা থাকে ফলে
স্বর্গ কি মর্তের শোভা যত ফল গাছ।
পরিবেশ অক্সিজেন রকমারি কাজে
ফল গাছ তাই চাই আমাদের মাঝে॥
গ.
আম গাছ আমাদের জাতীয় উদ্ভিদ
ফলের রানী আমের হাজার ধরন
স্বাদে গন্ধে রূপে করে হৃদয় হরণ
এ ফলের ব্যবহার আছে নানাবিধ।
ইতিহাস হয়ে আছে আম আমাদের
স্বাধীনতা ডুবেছিল পলাশি কাননে
বাহান্নতে আমতলা ভাষা আন্দোলনে
মুজিবনগরে তারে ছিনে আনি ফের।
কাঁচা পাকা আম দিয়ে হয় নানা পদ
গরমে আমের টক জুড়ায় পরাণ
টসটসে পাকা আমে মনহারি ঘ্রাণ
আমাদের জন্য আম অমূল্য সম্পদ।
আমের আদিমভূমি আমাদের দেশ
আম নিয়ে কথামালা তাই যে অশেষ॥
ঘ.
আষাঢ়ে বর্ষার শুরু বারিধারা ঝরে
প্রকৃতি শীতল হয় উষ্ণতার পরে।
নরোম মাটিতে স্নেহে রোপে ছোট চারা
একটি খুঁটিতে তারে রাখা চাই খাড়া।
ঘের বেড়া দিতে হবে চারা রোপা হলে
পশু ও মানুষ তারে যেনবা না দলে
অনেকের অকারণ স্বভাব রয়েছে
আগা টেনে ছিঁড়ে এনে ছুঁড়ে ফেলে হেসে।
স্বর্গ ভরা ফল গাছ স্নিগ্ধ পরিমলে
নরক উষ্ণতা ভরা বৃক্ষদাবানলে।
ফলের মধুর রসে মুগ্ধ থাকে মন
সুস্থ ও স্বাস্থ্যের জন্য তাই তা আপন।
ফল তাই প্রিয়তর সকল ধর্মের
ঋষিদের ফল চাই পবিত্র কর্মের॥
*পরিচালক (অব.), বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী, কৃষি মন্ত্রণালয়। সেল : ০১৫৫৮৩০১৯০৮। 01558301908| ahiqbal.ahmed@yahoo.com
আকিব উদ্দিন শেখ, গ্রাম : গজেন্দ্রপুর, উপজেলা : ডুমুরিয়া, জেলা : খুলনা
প্রশ্ন : তরমুজের কাণ্ড ও পাতায় জাব পোকার আক্রমণ দেখা যায়, কীভাবে প্রতিকার করা যাবে?
উত্তর : তরমুজের জাব পোকা দেখতে খুবই ক্ষুদ্র। এদের পাখাসহ বা পাখাহীন উভয় অবস্থায় দেখা যায়। এটি ফসলের বাড়বাড়তির যে কোনো পর্যায়ে আক্রমণ করতে পারে। এ পোকা গাছের কচি কা-, ডগা ও পাতার রস শুষে খায়। ফলে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। জাব পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য আধাভাঙা নিমবীজের নির্যাস (৫০ গ্রাম এক লিটার পানিতে ১২ ঘণ্টা ভেজানোর পর মিশ্রণটি ছাঁকতে হবে) আক্রান্ত গাছে ১০ দিন পরপর ৩ বার ¯েপ্র করতে হবে। লেডি বার্ড বিটলের পূর্ণাঙ্গ পোকা ও কীড়া এবং সিরফিড ফ্লাই নামক বন্ধু পোকাগুলোর কীড়া জাব পোকা খেয়ে প্রাকৃতিকভাবে এ পোকা দমন করে। তাই প্রকৃতিতে এসব পোকা সংরক্ষণ করতে হবে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে এ পোকা দমনের জন্য সুমিথিয়ন অথবা ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি ২ মিলি-লিটার মাত্রায় স্প্রে করতে হবে।
মো. নজিবুর রহমান, গ্রাম : খলিশাখালী, উপজেলা : কালিয়া, জেলা : নড়াইল
প্রশ্ন : পানের পাতায় কালো মাছি পোকার আক্রমণ হয়েছে। এর প্রতিকার কী?
উত্তর : কালো মাছি পোকার আক্রমণের ফলে পান গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। আক্রান্ত পাতা বিবর্ণ হয়ে যায়। মাছির সংখ্যা বেশি হলে কচি পাতা কুঁকড়ে, ছোট হয়ে যায়। পাতার নিচ দিকে পোকার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এ পোকার আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে পানের বরজ ও এর আশপাশের জায়গা সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। পানে আক্রমণ দেখা দিলে পোকাসহ আক্রান্ত পাতা তুলে পোকা মেরে ফেলতে হবে। বরজ পরিষ্কার রাখতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে এদের দমনের জন্য মারশাল ২০ ইসি ১ মিলি-লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। তবে স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সেই পান খাওয়া বা বিক্রি করা যাবে না।
মো. সবুজ হোসেন, গ্রাম : হেমরাজপুর, উপজেলা : সুজানগর, জেলা : পাবনা
প্রশ্ন : পেয়ারায় সাদা মাছি পোকার আক্রমণ হয়েছে। কীভাবে দমন করব?
উত্তর : সাদা মাছি পোকার আক্রমণ হলে পেয়ারা গাছের পাতায় অনেক সাদা বা হলদেটে দাগ পড়ে। সাধারণত শীতকালে এদের আক্রমণে পাতায় সাদা সাদা তুলার মতো দাগ দেখা যায়। এরা পাতার রস শুষে নেয় বলে গাছ দুর্বল হয়ে যায়। রস শুষে নেয়ার সময় পাতায় মধু সদৃশ বিষ্ঠা ত্যাগ করে এবং এর ওপর শুটিমোল্ড নামক ছত্রাক জন্মে। এর ফলে পাতার খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়। এ পোকার আক্রমণ দেখা দিলে আক্রান্ত পাতা ও ডগা ছাঁটাই করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে। সাদা আঠাযুক্ত বোর্ড স্থাপন করে বা আলোর ফাঁদ ব্যবহার করে আক্রমণ কমানো যায়। ভালো ফল পেতে প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম সাবানের গুঁড়া গুলে নিয়ে পাতার নিচে সপ্তাহে ২-৩ বার ভালো করে স্প্রে করতে হবে। আক্রমণ খুব বেশি হলে ২ মিলি রগর-রক্সিয়ন ৪০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে করতে হবে।
মো. মোখলেসুর রহমান, গ্রাম : পীরহাটি, উপজেলা : ধুনট, জেলা : বগুড়া
প্রশ্ন : ঢেঁড়সের পাতায় হলুদ ও সবুজ ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায় এবং পাতার শিরাগুলো স্বচ্ছ ও হলুদ হয়ে যায়। এর প্রতিকার কী?
উত্তর : এটি ঢেঁড়সের ভাইরাসজনিত খুব ক্ষতিকর রোগ। ভাইরাসের আক্রমণে এ রোগ হলে গাছের বাড়-বাড়তি ব্যাহত হয়। সাদা মাছি বা হোয়াইট ফ্লাই এ রোগের প্রধান বাহক। এটি অসুস্থ গাছ থেকে ভাইরাস নিয়ে সুস্থ গাছে ছড়িয়ে দেয়। ফলে জমির অধিকাংশ গাছে রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। একবার কোনো গাছে ভাইরাসের আক্রমণ ঘটলে সে গাছ আর সুস্থ করে তোলা যায় না। কাজেই প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা এ রোগের জন্য জরুরি। সব সময় রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। বীজ শোধন করার জন্য ভিটাভেক্স ৩ গ্রাম-১ লিটার পানিতে মিশিয়ে দিতে হবে। ভাইরাস প্রতিরোধী জাত যেমন বারি ঢেঁড়স-১ ব্যবহার করতে হবে। জমিতে সুষম সার ব্যবহার করতে হবে। কৃষি যন্ত্রপাতি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। জমি যেন আগাছামুক্ত থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এ রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে আক্রান্ত গাছ তুলে নিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। আর বাহক পোকা সাদা মাছি দমনের জন্য অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করা যায়। এ পোকা ধ্বংস করার জন্য সবিক্রন-ম্যালাথিওন ২০ মিলি.-১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। তবে কীটনাশক স্প্রে করার ১৫ দিনের মধ্যে সেই ঢেঁড়স যেন খাওয়া বা বিক্রি করা না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
মর্জিনা বেগম, গ্রাম : তাম্বুল খানা, উপাজেলা : ফরিদপুর, জেলা : ফরিদপুর
প্রশ্ন : আমার ২০টি দেশি মুরগি আছে। সব মুরগি ঝিমায়। এদের প্রচুর কাশি হয়েছে। আমি এ ব্যাপারে পরামর্শ চাই।
উত্তর : আপনার মুরগির ইনফেকশাস করাইজা হয়েছে। আপনি টাইলোভেট পাউডার অথবা মাইক্রোনিড পাউডার প্রতি ২.৫ গ্রাম হিসেবে ১ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ৪-৫ দিন খাওয়াবেন। আপনি একটি এইচ ভেট বোলাস অথবা ফাস্ট ভেট বোলাস প্রতি অর্ধেক পরিমাণ নিয়ে ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে দিনে ২ বার করে ৪ দিন খাওয়াবেন।
সজল হাওলাদার, গ্রাম : মুন্সির তালুক, উপজেলা : উজিরপুর, জেলা : বরিশাল
প্রশ্ন : আমার বাছুরের বয়স ১ মাস। এর ওজন ২০-৩০ কেজি। বাছুরের পায়খানার সাথে কৃমি পড়ছে। আমি এ ব্যাপারে পরামর্শ চাই।
উত্তর : আপনি আপনার বাছুরকে নিউট্রেক্স সিরাপ ৩০ মিলি অথবা এলমেক্স ভেট বোলাস অর্ধেক পরিমাণে খাওয়াবেন। ১৪ দিন পর আবার সমপরিমাণ খাওয়াবেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সুষম খাবার, আবাসন এসব ভালোভাবে দেখে শুনে রাখতে হবে। আর যে কোনো প্রয়োজনের উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার সাথে পরামর্শ করে কাজ করলে লাভ বেশি হবে খরচ কম হবে।
মো. সিহাব অধিকারী, গ্রাম : ফুলবাড়ী, উপজেলা : গোবিন্দগঞ্জ, জেলা : গাইবান্ধা
প্রশ্ন : কাতলা মাছের ফুলকার ওপর বাদামি গুটি দেখা যাচ্ছে ও ফুলকা পচে যাচ্ছে , কিছু মাছ মারাও যাচ্ছে, কী করব?
উত্তর : এ রোগের নাম মিক্সোবলিয়াসিস। মিক্সোবলাস প্রজাতির এক ধরনের এককোষী প্রাণী রুই জাতীয় মাছের বিশেষ করে কাতলা মাছের ফুলকার ওপর সাদা বা বাদামি গুটি তৈরি করে। এতে করে ওই গুটির প্রভাবে ফুলকায় ঘা দেখা যায় ও ফুলকা খসে পড়ে। শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যাঘাত ঘটার কারণে মাছ অস্থিরভাবে ঘোরাফেরা করে ও শেষ রাতের দিকে ব্যাপক মড়ক দেখা যায়। অদ্যাবদি এ রোগের কোনো চিকিৎসা সরাসরি আবিষ্কৃত হয়নি। তারপরও শতক প্রতি ১ কেজি হারে চুন দিলে পানির অ¤¬ত্ব দূর হয়ে পরজীবীগুলো অদৃশ্য হয়ে যায় ও মাছ নিষ্কৃতি লাভ করে।
দেলোয়ার হোসেন, গ্রাম : চরপারা, উপজেলা : নান্দাইল, জেলা : ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : মাছ পেট ফুলে মারা যাচ্ছে, কী করব?
উত্তর : অ্যারোমনাডস জাতীয় ব্যাকটেরিয়া এ রোগের কারণ। এ রোগে মাছের দেহের রঙ ফ্যাকাসে হয়ে পানি সঞ্চালনের মাধ্যমে মাছের পেট ফুলে উঠে। ফলে মাছ ভারসাম্যহীনভাবে চলাফেরা করে ও পানির ওপর ভেসে থাকে, ফলে অচিরেই মাছ মারা যায়। আক্রান্ত মাছকে ২০০ মিলিগ্রাম ক্লোরামফেনিকল পাউডার এক কেজি খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
সুপ্রিয় পাঠক বৃহত্তর কৃষির যে কোনো প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান পেতে বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো মোবাইল থেকে কল করতে পারেন আমাদের কল সেন্টার এর ১৬১২৩ এ নাম্বারে। শুক্রবার ও সরকারি ছুটি ব্যতিত যে কোনো দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ সময়ের মধ্যে।
তাছাড়া কৃষিকথার গ্রাহক হতে বার্ষিক ডাক মাশুলসহ ৫০ টাকা মানি অর্ডারের মাধ্যমে পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৬ এ ঠিকানায় পাঠিয়ে ১ বছরের জন্য গ্রাহক হতে পারেন। প্রতি বাংলা মাসের প্রথম দিকে কৃষিকথা পৌঁছে যাবে আপনার ঠিকানায়।
কৃষিবিদ ঊর্মি আহসান*
*উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (এলআর) সংযুক্ত, কৃষি তথ্য সার্ভিস,খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে কখনও কখনও শ্রাবণ মাসে খাল-বিল, নদী-নাল, পুকুর ডোবা ভরে যায়, ভাসিয়ে দেয় মাঠ-ঘাট, প্রান্তর। তিল তিল করে করা কষ্টের কৃষি তলিয়ে যেতে পারে সর্বনাশা পানির নিচে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভাটির টানে এ পানির সিংহভাগ চলে যায় সমুদ্রে। কৃষি কাজে ফিরে আসে ব্যস্ততা। আর এ প্রসঙ্গে জেনে নেব কৃষির বৃহত্তর ভুবনে কোন কোন কাজগুলো করতে হবে আমাদের।
আউশ
এ সময় আউশ ধান পাকে। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে পাকা আউশ ধান কেটে মাড়াই-ঝাড়াই করে শুকিয়ে বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে।
বীজ ধান হিসেবে সংরক্ষণ করতে হলে লাগসই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করলে ভবিষ্যতে ভালো বীজ পাওয়া যাবে।
আমন ধান
শ্রাবণ মাস আমন ধানের চারা রোপণের ভরা মৌসুম। চারার বয়স ৩০-৪০ দিন হলে জমিতে রোপণ করতে হবে।
রোপা আমনের আধুনিক এবং উন্নত জাতগুলো হলো বিআর ২২, বিআর ২৩, বিআর ২৫, ব্রি ধান৩০, ব্রি ধান৩১, ব্রি ধান৩২, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৭, ব্রি ধান৩৮, ব্রি ধান৩৯, বিনাশাইল, নাইজারশাইল, বিনাধান ৪ এসব।
উপকূলীয় অঞ্চলে সম্ভাব্য ক্ষেত্রে উপযোগী উফশী জাতের (ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৪৪, ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৪, ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬২ এসব) চাষ করতে পারেন।
খরা প্রকোপ এলাকায় নাবি রোপা আমনের পরিবর্তে যথাসম্ভব আগাম রোপা আমন (ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৪) চাষ করতে পারেন। সে সাথে জমির এক কোণে গর্ত করে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে পারেন।
চারা রোপণের ১২-১৫ দিন পর প্রথমবার ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এর ১৫-২০ দিন পর দ্বিতীয়বার এবং তার ১৫-২০ দিন পর তৃতীয়বার ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করলে চারা লাগানোর ১০ দিনের মধ্যে প্রতি চার গুছির জন্য ১৮ গ্রামের ১টি গুটি ব্যবহার করতে হবে।
পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য ধানের ক্ষেতে বাঁশের কঞ্চি বা ডাল পুঁতে দিতে পারেন যাতে পাখি বসতে পারে এবং এসব পাখি পোকা ধরে খেতে পারে।
পাট
ক্ষেতের অর্ধেকের বেশি পাট গাছে ফুল আসলে পাট কাটতে হবে। এতে আঁশের মান ভালো হয় এবং ফলনও ভালো পাওয়া যায়;
পাট পচানোর জন্য আটি বেঁধে পাতা ঝরানোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং জাগ দিতে হবে;
এরই মধ্যে পাট পচে গেলে আঁশ ছাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে;
পাটের আঁশ ছাড়িয়ে ভালো করে ধোয়ার পর ৪০ লিটার পানিতে এক কেজি তেঁতুল গুলে তাতে আঁশ ৫-১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে, এতে উজ্জ্বল বর্ণের পাট পাওয়া যায়;
যেখানে জাগ দেয়ার পানির অভাব সেখানে রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পচাতে পারেন। এতে আঁশের মান ভালো হয় এবং পচন সময় কমে যায়;
বন্যার কারণে অনেক সময় সরাসরি পাট গাছ থেকে বীজ উৎপাদন সম্ভব হয় না। তাই পাটের ডগা বা কা- কেটে উঁচু জায়গায় লাগিয়ে তা থেকে খুব সহজেই বীজ উৎপাদন করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
তুলা
রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চলে আগাম শীত আসে, সেজন্য এসব অঞ্চলে এ মাসের মধ্যে তুলার বীজ বপন করতে হবে।
শাকসবজি
বর্ষাকালে শুকনো জায়গার অভাব হলে টব, মাটির চাড়ি, কাঠের বাক্স এমনকি পলিথিন ব্যাগে সবজির চারা উৎপাদনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ মাসে সবজি বাগানে করণীয় কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে মাদায় মাটি দেয়া, আগাছা পরিষ্কার, গাছের গোড়ায় পানি জমতে না দেয়া, মরা বা হলুদ পাতা কেটে ফেলা, প্রয়োজনে সারের উপরিপ্রয়োগ করা।
লতা জাতীয় গাছের বাড়-বাড়তি বেশি হলে ১৫-২০ শতাংশ পাতা লতা কেটে দিলে তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল ধরবে।
কুমড়া জাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন বেশি ফলনে দারুণভাবে সহায়তা করবে। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন ভোরবেলা হাতপরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে।
গত মাসে শিম ও লাউয়ের চারা রোপণের ব্যবস্থা না নিয়ে থাকলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। আগাম জাতের শিম এবং লাউয়ের জন্য প্রায় ৩ ফুট দূরে দূরে ১ ফুট চওড়া ও ১ ফুট গভীর করে মাদা তৈরি করতে হবে।
গাছপালা
এখন সারা দেশে গাছ রোপণের কাজ চলছে। ফলদ, বনজ এবং ঔষধি বৃক্ষজাতীয় গাছের চারা বা কলম রোপণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে একহাত চওড়া এবং একহাত গভীর গর্ত করে অর্ধেক মাটি এবং অর্ধেক জৈবসারের সাথে ১০০ গ্রাম টিএসপি এবং ১০০ গ্রাম এমওপি ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। সার ও মাটির এ মিশ্রণ গর্ত ভরাট করে রেখে দিতে হবে। ১০ দিন পরে গর্তে চারা-কলাম রোপণ করতে হবে।
ভালো জাতের স্বাস্থ্যবান চারা রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের পর গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে এবং খুঁটির সাথে সোজা করে বেঁধে দিতে হবে।
গরু ছাগলের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য রোপণ করা চারার চারপাশে বেড়া দিতে হবে।
প্রাণিসম্পদ
আর্দ্র আবহাওয়ায় পোলট্রির রোগবালাই বেড়ে যায়। তাই খামার জীবাণুমুক্তকরণ, ভ্যাকসিন প্রয়োগ, বায়োসিকিউরিটি এসব কাজগুলো সঠিকভাবে করতে হবে
আর্দ্র আবহাওয়ায় পোলট্রি ফিডগুলো অনেক সময়ই জমাট বেঁধে যায়। সেজন্য পোলট্রি ফিডগুলো মাঝে মাঝে রোদে দিতে হবে।
বর্ষাকালে হাঁস-মুরগিতে আফলাটক্সিনের প্রকোপ বাড়ে। এতে হাঁস-মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এজন্য সূর্যমুখীর খৈল, সয়াবিন মিল, মেইজ গ্লুটেন মিল, সরিষার খৈল, চালের কুঁড়া এসব ব্যবহার করা ভালো।
গবাদিপশুকে পানি খাওয়ানোর ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ দূষিত পানি খাওয়ালে নানা রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
গো খাদ্যের জন্য রাস্তার পাশে, পুকুর পাড়ে বা পতিত জায়গায় ডাল জাতীয় শস্যের আবাদ করতে হবে।
গরু, মহিষ ও ছাগল ভেড়াকে যতটা সম্ভব উঁচু জায়গায় রাখতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
চারা পুকুরের মাছ ৫-৭ সেন্টিমিটার পরিমাণ বড় হলে মজুদ পুকুরে ছাড়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।
সাথে সাথে গত বছর মজুদ পুকুরে ছাড়া মাছ বিক্রি করে দিতে হবে।
পানি বাড়ার কারণে পুকুর থেকে মাছ যাতে বেরিয়ে না যেতে পারে এজন্য পুকুরের পাড় বেঁধে উঁচু করে দিতে হবে অথবা জাল দিয়ে মাছ আটকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
পানি বেড়ে গেলে মাছের খাদ্যের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ সময় পুকুরে প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আমাদের সবার সম্মিলিত, আন্তরিক ও কার্যকরী সতর্কতা এবং যথোপযুক্ত কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে এ মাসের কৃষির সমস্যাগুলো মোকাবিলা করে ভালো উৎপাদন সম্ভব। সেজন্য আধুনিক কৃষির কৌশলগুলো যেমন অবলম্বন করতে হবে তেমনি সকল কাজ করতে হবে সম্মিলিতভাবে। আর কৃষির যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য আপনার নিকটস্থ উপজেলা কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন অথবা কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ এ নম্বরে যে কোনো মোবাইল অপারেটর থেকে কল করে নিতে পারেন বিশেষজ্ঞে পরামর্শ। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা কৃষিকে নিয়ে যাবে উন্নতির শিখরে।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*
*তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা; loag@ais.gov.bd