কৃষিবিদ মো. আবু সায়েম
কাঁঠাল (ইংরেজি নাম-Jackfruit)) পৃথিবীর ফলসমূহের মধ্যে আকারে বৃহত্তম। ভারতীয় উপমহাদেশ বিশেষত বাংলাদেশ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ কাঁঠালের উৎপত্তি স্থান হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কার এটি অতি আদিম ফল। এ ছাড়া নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, চায়না, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াতেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কাঁঠালের চাষ হয়। পূর্ব আফ্রিকার উগান্ডা ও তানজানিয়া এবং সমগ্র ব্রাজিল ও ক্যারিবীয় দীপপুঞ্জের জ্যামাইকাতে কাঁঠাল পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সর্বত্রই কাঁঠাল পরিদৃষ্ট হয়। সাধারণত লালচে মাটি ও উঁচু এলাকায় এটি বেশি দেখা যায়। তবে মধুপুর ও ভাওয়ালের গড় এবং পার্বত্য এলাকায় সবচেয়ে বেশি চাষ হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ৭৬ হাজার ২৯৫ হেক্টর জমিতে কাঁঠাল চাষ হচ্ছে এবং মোট উৎপাদন ১৭ লক্ষ ৫১ হাজার ৫৪৯ টন (সূত্র : উদ্যানতত্ত¡ অনুবিভাগ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর)। বিশ্বে কাঁঠাল উৎপাদনে শীর্ষে ভারত, এরপরেই বাংলাদেশের অবস্থান।
কাঁঠালের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা
কাঁঠাল পুষ্টি সমৃদ্ধ। এতে আছে থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম, জিঙ্ক এবং নায়াসিনসহ বিভিন্ন প্রকার পুষ্টি উপাদান। অন্যদিকে কাঁঠালে প্রচুর পরিমাণে আমিষ, শর্করা ও ভিটামিন থাকায় তা মানব দেহের জন্য বিশেষ উপকারী।
কাঁঠালে চর্বির পরিমাণ নিতান্ত কম। এ ফল খাওয়ার কারণে ওজন বৃদ্ধির আশঙ্কা কম।
কাঁঠাল পটাশিয়ামের উৎকৃষ্ট উৎস। ১০০ গ্রাম কাঁঠালে পটাশিয়ামের পরিমাণ ৩০৩ মিলিগ্রাম। পটাশিয়াম উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
পাকা কাঁঠালে প্রচুর ভিটামিন ‘এ’ আছে, যা রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে।
কাঁঠালের অন্যতম উপযোগিতা হলো ভিটামিন ‘সি’। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দাঁতের মাঢ়িকে শক্তিশালী করে ভিটামিন ‘সি’।
কাঁঠালের বিদ্যমান আইসোফ্লাভোনস, এন্টিঅক্সিডেন্ট ও ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস আলসার, ক্যান্সার, উচ্চরক্তচাপ এবং বার্ধক্য প্রতিরোধে সক্ষম।
কাঁঠালে আছে বিপুল পরিমাণে খনিজ উপাদান ম্যাঙ্গানিজ, যা রক্তে শর্করা বা চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
কাঁঠালে বিদ্যমান ভিটামিন বি৬ হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং আয়রন দেহের রক্তাল্পতা দূর করে। ছয় মাস বয়সের পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি শিশুকে কাঁঠালের রস খাওয়ালে শিশুর ক্ষুধা নিবারণ হয় এবং অন্যদিকে প্রয়োজনীয় ভিটামিনের অভাব পূরণ হয়। গর্ভবতী মহিলারা কাঁঠাল খেলে স্বাস্থ্য স্বাভাবিক থাকে এবং গর্ভস্থ সন্তানের বৃদ্ধি স্বাভাবিক হয়। দুগ্ধদানকারী মা তাজা পাকা কাঁঠাল খেলে দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এ ফল আঁশালো বিধায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
সাংস্কৃতিক গুরুত্ব : কাঁঠাল বাংলাদেশের জাতীয় ফল। দেশের আনাচে-কানাচে কাঁঠালের সহজলভ্যতা বা প্রাপ্তিই এর প্রধান কারণ। গ্রামের শ্রমজীবী আপামর জনসাধারণের কাছে কাঁঠালের গুরুত্ব অপরিসীম। কাঁঠালের মতো এত বেশি পুষ্টি উপাদান আর কোনো ফলে পাওয়া যায় না। তাছাড়া কাঁঠালের দাম অন্যান্য ফলের তুলনায় কম হওয়াতে গরিব মানুষ এটা খেতে পারে। তাই কাঁঠালকে গরিবের ফল বলা হয়। তাই তো গ্রাম বাংলায় প্রচলিত আছে, ‘কাঁঠাল আর মুড়ি, হয় না এমন জুড়ি’। আবার ইচরে পাকা প্রবাদটি অপরিপক্ব কাঁঠাল পাকানো থেকেই এসেছে। গ্রাম বাংলায় পান্তা, দুধ, চিঁড়া বা খইয়ের সাথে পাকা কাঁঠাল কিংবা সিজা কাঁঠাল বা সিদ্ধ কাঁঠাল খাওয়ার প্রচলন আজও বিদ্যমান। ভারতের তামিলনাড়–– রাজ্যে উৎপাদিত ৩টি ফল আম ও কলার পাশাপাশি কাঁঠালও অন্যতম ফল হিসেবে বিবেচিত। উচ্চমাত্রায় শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ হওয়ায় শ্রীলঙ্কায় কাঁঠাল ধান বৃক্ষ (জরপব ঃৎবব) কিংবা গরিবের ফল নামে সুপরিচিত। নেপালে কিছু কিছু হিন্দু পরিবারের বিয়ে অনুষ্ঠানে মাংসের পরিবর্তে কাঁচা সবুজ কাঁঠালের সবজি পরিবেশন করা হয়ে থাকে।
উদ্ভিদতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্য, জাত ও চাষবাস : আমাদের দেশে চাষকৃত কাঁঠালের প্রজাতি হচ্ছে অৎঃড়পধৎঢ়ঁং যবঃবৎড়ঢ়যুষষঁং। কাঁঠালের পাতার বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে যবঃবৎড়ঢ়যুষষঁং নামকরণ করা হয়েছে। কাঁঠাল পৃথিবীর বৃহত্তম ফল। কখনও কখনও ৩০Ñ৩৫ কেজি, এমনকি ৪০ কেজি ওজনের কাঁঠাল দেখতে পাওয়া যায়। কাঁঠাল যৌগিক ফল (গঁষঃরঢ়ষব ভৎঁরঃ) অর্থাৎ অনেকগুলো ফুলের সমন্বয়ে এর সৃষ্টি। রোপণের ৭-৮ বছর পরেই ফল ধরা শুরু হয়, তবে ষোড়শী গাছেই সবচেয়ে বেশি ফল ধরে। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে ফুল আসে। সহবাসী উদ্ভিদ বিধায় একই গাছে পুরুষ ফুল (বোঁটা সরু ও দিঘল) ও স্ত্রী ফুল (বোঁটা মোটা, খাটো ও গোড়ায় রিং আকৃতি) আলাদাভাবে ধরে। সাধারণত মূল কাÐ ও প্রধান শাখা কাÐে স্ত্রী ফুল এবং শাখা কাÐের শীর্ষে পুরুষ ফুল ধরে। পরাগায়নের পর গাছতলায় পুরুষ মুচি পড়ে থাকলে দেখে অনেকে আবার সব কাঁঠাল পড়ে যাচ্ছে বলে বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন। একটি কাঁঠালের মধ্যে অসংখ্য কোষ বা কোয়া বা রোয়া থাকে, এগুলোই প্রকৃতপক্ষে একেকটি ফল। কোষের চারপাশে পাতলা ফিতার মতো চিটা বা চাকি থাকে। এই চিটা ও খোসাকে একত্রে ভুতি বা ভুতরো বা ছিবড়া বলে। খোসার ওপর ছোট বড় কাঁটা থাকে এবং কাঁটার সংখ্যা যত ফুলের সংখ্যাও তত হয়। স্থান ও জাতভেদে ফল পাকে মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়, ময়মনসিংহ এর জার্মপ্লাজম সেন্টারে সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এ পর্যন্ত ৯১টি জার্মপ্লাজম সংযোজিত হয়েছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত¡ গবেষণা কেন্দ্র এ পর্যন্ত বারি কাঁঠাল-১, বারি কাঁঠাল-২ ও বারি কাঁঠাল-৩ নামে তিনটি উচ্চফলনশীল জাত অবমুক্ত করেছে। সর্বশেষ জাতটিতে অমৌসুমে অর্থাৎ অক্টোবর-মে পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। হাজারী কাঁঠাল নামে অতি জনপ্রিয় একটি জাত রয়েছে, ছোট ছোট অনেক ফল ধরে থাকে। বাংলাদেশে চাষকৃত জাতগুলোকে তিন ভাগে ভাগ যায় যথা- ১। খাজা বা চাউলা (কোষ আকারে বড় হয়, ফ্যাকাশে হলুদ, পাকার পর কম রসালো, অপেক্ষাকৃত শক্ত বা কচ্কচে হয়, চিপলে সহজে রস বের হয় না, কাঁঠাল পাকার পরও সবুজাভ থাকে), ২। গিলা বা রসা বা রসখাজা (কোষ অত্যন্ত কোমল, মিষ্টি, রসালো, স্বাদ টক-মিষ্টি, অপেক্ষাকৃত ছোট কোয়া ও কাঁঠাল পাকার পর একটু লালচে-হলুদাভ হয়) এবং ৩। দোরসা (খাজা ও গিলা কাঁঠালের মাঝামাঝি বৈশিষ্ট্য)। ফল পরিপক্ব হতে ৪-৫ মাস সময় লাগে। কাঁচা ফলে লাঠি দিয়ে আঘাত করলে ঠন ঠন শব্দ আর পাকা ফলে আঘাত করলে ড্যাব ড্যাব শব্দ হয়। বাংলাদেশে প্রতিটি গাছে গড়ে ২৫-২০০টি কাঁঠাল ধরে এবং প্রতিটি ফলের ওজন ৩-২৫ কেজি। কাঁঠালকে ১১-১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও ৮৫-৯০% আপেক্ষিক আর্দ্রতাযুক্ত ঘরে একে ৩-৬ সপ্তাহ পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
কাঁঠালের বহুবিদ ব্যবহার : কাঁঠাল গাছকে বহুবিদ ব্যবহার উপযোগী গাছ (গঁষঃরঢ়ঁৎঢ়ড়ংব ঃৎবব) বলা হয়। এ থেকে পাওয়া যায় খাদ্য, কাঠ, জ¦ালানি, গো-খাদ্য, ওষুধ ও শিল্প উপকরণ। কাঁঠালের ফল কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থাতেই খাওয়া যায়। বসন্তকাল থেকে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত কাঁচা কাঁঠাল কান্দা বা এচোর সবজি হিসেবে খাওয়া যায়। পাকা ফল বেশ পুষ্টিকর, কিন্তু এর গন্ধ অনেকের কাছে ততটা আকর্ষণীয় নয়। তবু মৃদু অ¤øযুক্ত সুমিষ্ট স্বাদ ও স্বল্পমূল্যের জন্য অনেকে পছন্দ করেন। কাঁঠালের আঁটি বা বীজ তরকারির সাথে রান্না করে খাওয়া হয় অথবা পুড়িয়ে বাদামের মতো খাওয়া হয়। এর একটি সুবিধা হলো আঁটি অনেক দিন ঘরে রেখে দেয়া যায়। পাকা ফলের কোষ মানুষসহ পশুপাখি খেয়ে থাকে। এই কোষ নিংড়ে রস বের করে তা শুকিয়ে আমসত্বের মতো ‘কাঁঠালসত্ব’ ও তৈরি করা যায়। কোষ খাওয়ার পর যে খোসা ও ভুতি থাকে তা গবাদি প্রাণির একটি উত্তম খাদ্য। পাকা ফলের বোঁটার সাথে আঁঠালো অংশটি কুমড়াজাতীয় সবজির মাচায় ঝুলিয়ে দিলে ফলের মাছি পোকা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভ‚মিকা রাখতে পারে। ভুতি বা ছোবড়ায় যথেষ্ট পরিমাণ পেকটিন থাকায় তা থেকে জেলি তৈরি করা যায়। এমন কি শাঁস বা পাল্প থেকে কাঁচা মধু আহরণ করার কথাও জানা গেছে। কাঁঠাল গাছের পাতা গবাদি প্রাণীর মজাদার খাদ্য। পাতা পিঠা তৈরিতে কাঁঠালের পাতার ব্যবহার বহুল প্রচলিত। সোনালি হলুদ গুঁড়ি থেকে তৈরি হয় মূল্যবান আসবাবপত্র, যা উঁই পোকা প্রতিরোধী এবং ছত্রাক-ব্যাকটেরিয়া রোগ পচনরোধী। সার কাঠের গুঁড়া বা টুকরো রঙ শিল্পে ব্যবহৃত হয়। কাঁঠাল ফল ও গাছের আঁঠালো কষ কাঠ বা বিভিন্ন পাত্রের ছিদ্র বন্ধ করার কাজে ব্যবহৃত হয়।
কাঁঠালের রকমারি খাবার : কাঁঠালের প্রাথমিক অর্থনৈতিক গুরুত্ব হচ্ছে এর ফল যা কি না কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থাতেই ব্যবহার হয়ে থাকে। কাঁচা (সবুজ) অবস্থায় এটিকে মুরগির মাংসের বুনটের সাথে তুলনা করা হয়। ফলে নিরামিষ ভোজীদের কাছে কাঁচা কাঁঠাল মাংসের উত্তম বিকল্প। সত্যি বলতে কি কাঁচা কাঁঠাল বিশ^বাজারে সবজি মাংস বা ঠবমবঃধনষব সবধঃ হিসেবে পরিচিত। একদম ছোট অবস্থায় অর্থাৎ কোষ ও আঁটি গঠন হয়নি এমন ধরনের ফল দিয়ে আচার বা সবজি তৈরি করা যায়। এক্ষেত্রে পরাগায়নের পর পুরুষ মুচিও ব্যবহার করা যেতে পারে। ভালোভাবে মসলা দিয়ে রান্না করলে মুরগির মাংসের মতোই লাগে। কোষ ও আঁটি গঠন শুরু হলে বিভিন্ন সবজির সাথে রান্না করার জন্য খুবই উপযোগী। কোষ ও আঁটি পরিপূর্ণ হলে অর্থাৎ পরিপক্ব ফল চিপ্স করার উপযোগী বা অন্যান্য তরকারির সাথে রান্না করা যায়। পাকা ফলের কোষ সরাসরি খাওয়া হয়। আবার পাকা ফলের কোষ বা পাল্প থেকে ক্যান্ডি, ফ্লেক্স, চকলেট, পাপড়, বরফি, পিঠা, আইসক্রিম, জ্যাম-জেলি, হালুয়াসহ রকমারি খাবার তৈরি করা যায়। কাঁঠালে আঁটি অত্যন্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ। আঁটি রোদে শুকিয়ে নিয়ে ভেজে বা পুড়িয়ে বাদাম বা কাজু বাদামের মতো খাওয়ার প্রচলন সবচেয়ে বেশি। মিশ্র সবজি রান্নায় কাঁঠালের আঁটি দিয়ে উপাদেয় খাবার তৈরি করা হয়। সিদ্ধ করে কাঁঠাল আঁটির ভর্তা অত্যন্ত মুখরোচক খাবার। উচ্চ প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ এবং পানি ও তেল শোষণ করার ক্ষমতা থাকায় কাঁঠালের আঁটি থেকে তৈরি করা আটা গমের আটার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
বাণিজ্যিক সম্ভাবনা : বর্তমানে ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, চায়না, ব্রাজিলসহ বিশে^র অনেক দেশ কাঁচা কাঁঠাল ফ্রেস কাট সবজি (সরাসরি রান্নার উপযোগী), শুকনা কাঁঠাল, হিমায়িত কাঁঠাল কোষ বা ক্যানজাত করে স্থানীয় বাজার বা সুপার শপে সরবরাহসহ জাপান, কোরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারিত করছে। ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশ কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে উঠেছে। এর ফলে বছরব্যাপী কাঁঠাল হতে প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য শুকনা আকারে বা ক্যানে পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের দেশ থেকে পাকা কাঁঠাল সীমিত পরিসরে রপ্তানি হলেও ফ্রেস কাট সবজি হিসেবে বা ক্যানজাত করে স্থানীয় বাজার বা বিদেশে রপ্তানির কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। বর্তমানে ফল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ পরিস্থিতি খুবই দুর্বল। আমাদের উৎপাদিত কাঁঠালের সিংহভাগ সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার অভাবে নষ্ট হয়ে থাকে। যদিও সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই তবে ধারণা করা হয় ভরা মৌসুমে প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ ফল নষ্ট হয়। বিপুল সম্ভাবনাময় এ খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোক্তাগণ এগিয়ে এলে জাতীয় সমৃদ্ধিতে অসামান্য অবদান রাখতে পারবে। গ্রামীণ পর্যায়ে বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ হবে।
শেষকথা: আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে কাঁঠাল ওতোপ্রতভাবে জড়িত। সময় এসেছে কাঁঠাল রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আমাদের দেশে কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে আয়বর্ধন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খাদ্য উৎপাদনকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের যথেষ্ঠ সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাতকরণে ক্ষুদ্র বা মাঝারি বা ভারী শিল্প গড়ে তুলুন, আর্থিকভাবে লাভবান হউন এবং দেশের সমৃদ্ধিতে অবদান রাখুন। য়
ড. মো. মেহেদী মাসুদ
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। ছোট একটি দেশে জনসংখ্যা ১৬ কোটির উপরে। মোট জনসংখ্যার ৭৫ ভাগ লোকই গ্রামে বাস করে, যার শতকরা ৯০ ভাগ লোকই কৃষিজীবী। কৃষি হলো দেশের একক বৃহত্তম উৎপাদনশীল খাত, যা থেকে জিডিপির শতকরা ১৭.২২ ভাগ আসে এবং দেশের মোট শ্রমিক সংখ্যার এক বিরাট অংশই (৪৫%) এই কৃষি খাতভুক্ত। আয়তনের তুলনায় অত্যধিক জনসংখ্যার চাপ থাকা সত্তে¡ও বাংলাদেশ আজ দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই ক্ষেত্রে কৃষক, কৃষিজীবী ও কৃষিবিদদের অবদান কখনও অস্বীকার করা যাবে না। সুষম খাদ্য নিশ্চিত করতে হলে আমাদের ফলের উৎপাদন ও উন্নয়নের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশ একটি আর্দ্র ও উষ্ণমÐলীয় দেশ। এখানে আম, কলা, পেঁপে, সফেদা, আনারস, লিচু, কমলা, জাম্বুরা, পেয়ারা, নারিকেল, বাদাম, কাজুবাদাম, বেদানা, জাম, কাঁঠাল, খেঁজুর ইত্যাদি ফল ভালোভাবে জন্মে। তাই এসব ফলের চাষ করে স্বাস্থ্য, সুখ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনা সম্ভব। বাংলাদেশে বছরে ৩.৮০ লক্ষ হে. জমিতে মোট ৪৭.০ লক্ষ মেট্রিক টন ফল উৎপাদিত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ফলের বাৎসরিক চাহিদা রয়েছে ৬৭.১৭ লক্ষ মেট্রিক টন। উল্লেখ্য, আমাদের দেশে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ২০০ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন কিন্তু আমরা গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৭০-৮০ গ্রাম ফল ভক্ষণ করি। মোট চাহিদার শতকরা ৬৫ ভাগ ফল আমরা উৎপাদিত করি, বাকি ৩৫ ভাগের জন্য বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে আমাদের ফল আমদানি করতে হয়। অথচ বাংলাদেশ আবহাওয়ার প্রায় ৭০ প্রকারেরও বেশি জাতের ফল চাষের জন্য উপযোগী, যা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই বিরল। তাইতো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বলেছিলেন, “এদেশের মাটি খাঁটি সোনা, এখানে যে কোন বীজ পুঁতে রাখলে চারা গজাবেই”। তাই ফল চাষ সম্প্রসারণের উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টির অভাব দূরীকরণ, অধিক আয়ের সুরাহা, ফলের চাহিদা পূরণ ও পরিবেশের উন্নয়নে আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত জাতের ফল চাষ সম্প্রসারণ ব্যবস্থা জোরদার করা একান্ত প্রয়োজন। সারা দেশে সরকারি হর্টিকালচার সেন্টারসমূহ, নার্সারি, উদ্যান উন্নয়ন কেন্দ্রগুলো ফলের নতুন জাতের উদ্ভাবন এবং সম্প্রসারণে ভ‚মিকা পালন করে যাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প “বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন” সারা বছর বিভিন্ন ধরনের দেশি ও বিদেশি জাতের ফলের প্রচলন ও সম্প্রসারণে বিশেষ ভ‚মিকা পালন করে যাচ্ছে। পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ইচ্ছা ও নির্দেশনায় দেশি ও অপ্রচলিত ফল চাষ যেমন- টক কুল, তেঁতুল, আমলকী, জাম, কদবেল, দেশি আমড়া, বীজবিহীন লেবু, কাঁটাবিহীন লেবু প্রভৃতি সম্প্রসারণেও আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত প্রায় ৫ লক্ষ ভিয়েতনামি খাটো জাতের নারিকেল চারা, ভারত হতে ৬ হাজার ডিজে সম্পূর্ণা হাইব্রিড জাতের নারিকেল চারা এবং টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত ১১০০টি আরবি খেজুরের চারা আমদানি করা হয়েছে, জাতগুলো হলো- আজুয়া, মরিয়ম, বারহি, লুলু, সুলতানা, মেডজল, ডেগলেট নুর, নিমেশি, শিশি, আনবারাহ ইত্যাদি এবং সকল চারা সারা দেশে বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ ও উপক‚লীয় এলাকায় সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
স্মরণীয় অতীত থেকেই ফল প্রতিটি মানুষের সুখাদ্য হিসাবে সমাদৃত হয়ে আসছে। খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ বছর আগে খেঁজুরের চাষ এর সাক্ষ্য বহন করে। এছাড়া বিহারে দারভাংগার কাছে স¤্রাট আকবর কর্তৃক একলক্ষ আমগাছের বাগান ‘লাখ বাগ’ তৈরি, পর্তুগিজদের দ্বারা ভারতীয় উপমহাদেশে আনারস ও পেঁপের প্রর্বতন ইত্যাদি থেকেই বুঝা যায় ফলের প্রতি মানুষের কদর কিরূপ ছিল। বিভিন্ন পৌরাণিক সাহিত্য ও ধর্মীয় গ্রন্থাবলিতেও আমরা ফলের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পারি। পবিত্র হাদিস শরিফে আছে “ফলের গাছ লাগানো সদকায়ে জারিয়া” হিসেবে গণ্য হবে। খাদ্য গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য হলো সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম হয়ে বেঁচে থাকা। যে কোন খাবার খেয়ে পেট ভরানো যায় কিন্তু দেহের চাহিদা মিটিয়ে সুস্থ থাকা যায় না। বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন ঘাটতি পূরণ হলেও পুষ্টি সমস্যা অনেক প্রকট। ফলে এ দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ পুষ্টিহীনতার কারণে নানা ধরনের রোগের শিকার হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মা ও শিশুরাই এর শিকার বেশি। পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। অধিকাংশ ফলই সুস্বাদু, পুষ্টিকর, মুখরোচক এবং তৃপ্তিদায়ক। পুষ্টিকর খাবারের উপর নির্ভর করে আমাদের জীবনের অস্তিত্ব, কর্মক্ষমতা, মেধাবৃদ্ধি, উন্নতি ও সমৃদ্ধি। পুষ্টি সচেতনতা ও জ্ঞানের অভাবে সুষম খাদ্য গ্রহণের প্রতি আমরা মোটেই সজাগ নই। ফলে যারা পেট ভরে দুবেলা খেতে পায় না তারাই যে শুধু পুষ্টিহীনতার ভুুগছে তা নয়, সেই সাথে ধনীরাও অপুষ্টির শিকার থেকে অব্যাহতি পাচ্ছে না। অবশ্যই বর্তমানে মানুষজনের সচেতনতার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফল বাংলাদেশের অতি জনপ্রিয় ও উপযোগী উদ্যানতাত্তি¡ক ফসল, রঙ, গন্ধ, স্বাদ ও পুষ্টির বিবেচনায় আমাদের দেশি ফলসমূহ খুবই অর্থবহ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। ফলে সব ধরনের খাদ্যোপাদানই পাওয়া যায়। মানুষের জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের প্রধান উৎস হলো দেশীয় ফল। এছাড়া বর্তমানে পুষ্টি মানে সমৃদ্ধ বিভিন্ন ধরনের বিদেশি উন্নতজাতের ফলের চাষ অব্যাহত রয়েছে। যেমন- আম, ড্রাগন, মাল্টা, আরবি খেজুর, ভিয়েতনামি খাটো জাতের নারিকেল, থাই পেয়ারা, অ্যারভাক্যাডো ও পার্সিমন ইত্যাদি। বিভিন্ন ধরনের খাবারের মধ্যে ও ভিটামিন ও মিনারেলকে রোগ প্রতিরোধক খাদ্য উপাদান হিসাবে ধরা হয়। এ ধরনের পুষ্টি উপাদান তথা হরেক রকম ফল ভক্ষণে রোগ প্রতিরোধ ছাড়াও হজম, পরিপাক, বিপাক রুচিবৃদ্ধি ও কোষ্ঠ্যকাঠিন্য দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। ফল আমরা কাঁচা বা পাকা অবস্থায় সরাসরি খেয়ে থাকি। ফল রান্না ব্যতিত সবসময় খাওয়া যায় বিধায় এতে বিদ্যমান সবটুকু পুষ্টি পাওয়া যায়। বিভিন্ন ফলে ক্যান্সার প্রতিরোধকারী উপাদান এ্যান্থোসায়ানিন, লাইকোপেন ও এন্টি অক্সিডেন্ট উপস্থিত থাকায় মরণ ব্যাধি থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ফলের অবদান অনস্বীকার্য। মানুষের খাদ্য, ভিটামিন ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ধন, পরিবেশ দূষণ রোধ, কাঠের যোগান, পশুপাখির খাবার সর্বোপরি আয় বৃদ্ধিসহ বিভিন্নমুখী সুবিধা আমরা ফল গাছ থেকে পেয়ে থাকি। ফল উৎপাদন ও তা পরিমাণ মতো আহারের সুযোগের অভাবে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি ঘাটতি পূরণ এখনও সম্ভব হয়নি। (সুস্বাস্থ্যের জন্য জনপ্রতি প্রতিদিন গড়ে ২০০ গ্রাম ফল খাওয়ার প্রয়োজন হলেও বর্তমানে এ দেশের মানুষ মাত্র ৭৫-৮০ গ্রাম ফল খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে)। দেশে যেসব ফল উৎপাদন হয় তার প্রায় ৬০% উৎপাদিত হয় জুন-জুলাই ও আগস্ট মাসে, শীতকালে ফল প্রাপ্তির সুযোগ কম এবং এ সময় উৎপাদিত ফলের দামও বেশি। এজন্য এ সময়ে মানুষের মাঝে ভিটামিন ও মিনারেলস এর অভাব বেশি দেখা যায়। এ কারণে শীতকালে যেসব ফল (কুল, কলা, পেঁপে, তেঁতুল) উৎপাদন সুবিধা আছে সেগুলোর চাষাবাদে অধিক গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। এছাড়াও বাংলাদেশে চাষ উপযোগী বিদেশি জাতের ফল আবাদের পরিমাণ বাড়িয়ে পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস।
বিভিন্ন ফলের প্রাপ্যতা বা সরবরাহ সময়কাল বিভিন্ন সময়ে হয়ে থাকে। যেমন- কাঁঠাল পাওয়া যায় ফেব্রæয়ারি থেকে আগস্ট, আম পাওয়া যায় এপ্রিল থেকে আগস্ট, পেয়ারা মে, জুন, জুলাই এবং সেপ্টেম্বর-নভেম্বরে। আশার কথা হলো বর্তমানে এই চিত্র অনেকটা পরিবর্তিত হয়েছে যেমন- পেয়ারা সারা বছর পাওয়া যায়, আম ০৮ মাস পাওয়া যায়। সময় উপযোগী পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে ফল উৎপাদনে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এতে কিছুটা হলেও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে বলে বাংলার মানুষ আশার আলো দেখছে।
বছরব্যাপী ফল উৎপাদন পঞ্জিকা
পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ বলতে কি বুঝি-
পুষ্টি নিরাপত্তা বলতে আমরা বুঝি দেহের জন্য যে সকল উপাদান অতি প্রয়োজনীয় সেগুলো সঠিক পরিমাণে ও সঠিক সময়ে পাওয়াকে বুঝায়। অর্থাৎ আমাদের দেহের ক্ষয়পূরণ, বৃদ্ধি সাধন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য যে সকল উপাদান একান্ত প্রয়োজন সেগুলো সময়মতো পাওয়ার উপায়ই হলো পুষ্টি নিরাপত্তা। কিভাবে পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়-আমরা প্রতিদিন দানাদার জাতীয় খাবার বেশি গ্রহণ করি এবং শাকসবজি ও ফলমূল খুবই কম পরিমাণে গ্রহণ করে থাকি। এমনকি যতটুকু গ্রহণ করা দরকার তার অর্ধেকও গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। যেমন, প্রতিদিন ফলমূল ২০০ গ্রাম গ্রহণ করতে হয় কিন্তু আমরা গ্রহণ করি মাত্র ৭৫-৮০ গ্রাম। এর পিছনে যে সকল কারণ রয়েছে তা একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে- ফল উৎপাদনের পরিমাণ কম, বিদেশি ফলের প্রতি অতিমাত্রায় দুর্বলতা, দেশি ফলের প্রতি অনীহা সারাবছর ফল না পাওয়া দেশি ও বিদেশি উন্নত জাতের চারা/কলমের অভাব,
গ্রামাঞ্চলে ফল গ্রহণের অভ্যস্থতার অভাব,
ফল সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের সমস্যা
দেশের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প-
দেশের ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি, চাষ সম্প্রসারণ এবং জনগণের টেকসই পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প কাজ করে যাচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় প্রচলিত, অপ্রচলিত এবং অন্যান্য দেশি-বিদেশি সম্ভাবনাময় সব ধরনের ফলের চাষাবাদ বাড়িয়ে সারা বছর সমানভাবে ফলের সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের ৮টি বিভাগের ৪৮ টা জেলার ৩৬২ উপজেলা এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ৬০টা হর্টিকালচার সেন্টারের আওতাধীন উদ্যান ফসল উৎপাদনের জন্য অধিক উপযোগী স্থান প্রকল্প এলাকা হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। পার্বত্য ও দক্ষিণাঞ্চলীয় পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোকে এতে প্রাধান্য দিয়ে অন্যান্য জেলায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
- দেশের তিনটি পাহাড়ি জেলাসহ অন্যান্য জেলার অসমতল ও পাহাড়ি জমি, উপকূলীয় ও অন্যান্য অঞ্চলের অব্যবহৃত জমি এবং বসতবাড়ির চারপাশের জমিকে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের আওতায় এনে উদ্যান ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করার পাশাপাশি সমতল ভ‚মিতে অন্যান্য মাঠ ফসলের উৎপাদনের সুযোগ অক্ষুণœ রাখা।
- দেশীয় এবং রপ্তানিযোগ্য ফলের উৎপাদন ক্লাস্টার/ক্লাব ভিত্তিক বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানি নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা এবং উৎপাদিত ফলের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার আধুনিকীকরণ সাথে সাথে বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ সেবা সম্প্রসারণ করা।
- উৎপাদক ও অন্যান্য সুবিধাভোগীসহ ফল ব্যবসায়ীদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি, মানসম্মত ফল উৎপাদন প্রযুক্তি, ফলের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
- বিদ্যমান হর্টিকালচার সেন্টার সমূহের অবকাঠামো উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন এবং প্রস্তাবিত নতুন হর্টিকালচার সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে মানসম্পন্ন ও নতুন জাতের চারা/কলমের উৎপাদন বৃদ্ধি।
- প্রর্দশনী ও অন্যান্য টেকসই পদ্ধতির মাধ্যমে উদ্যান ফসলের আধুনিক প্রযুক্তিসমূহ চাষি পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা।
- দেশে প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফলের উৎপাদনের পাশাপাশি এদেশের আবহাওয়ায় উৎপাদনযোগ্য সম্ভাব্য বিদেশি ফল, সবজি ও মসলার চাষ সম্প্রসারণ ও উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
- দলীয় সভা, মাঠ দিবস, উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমণ, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া, টক শো ইত্যাদির মাধ্যমে চাষি ও অন্যান্য সুবিধাভোগীদের মাঝে সচেতনতা, দক্ষতা ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ঘটানো।
পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের সফলতা
নতুন বেশ কয়েকটি হর্টিকালচার সেন্টার স্থাপনের অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। আরও কয়েকটি হর্টিকালচার সেন্টার স্থাপনের লক্ষ্যে প্রকল্প কাজ করে যাচ্ছে, এতে করে সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজন উন্নত জাতের দেশি-বিদেশি ফলের চারা/কলম সহজেই পেতে পারবে এবং গড়ে উঠবে আধুনিক ফলের বাগান, সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের সুযোগ, আর এতে দূর হবে দারিদ্র্যতা।
মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর আক্ষেপ ছিল, আমরা বাগানের আম কেন শুধু ৪ মাস খেতে পারব, ৮ মাস কেন নয়। এ ক্ষেত্রে আশার আলো দেখা যাচ্ছে গৌড়মতি, রাংগুয়াই, বারি আম-১১ চাষের মাধ্যমে আম প্রাপ্তির সময়সীমা ৮ মাসে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে। বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প আমের এই সকল জাতগুলো সংগ্রহ করে আধুনিক প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়াও লিচু প্রাপ্তির সময়সীমা আরও দুই মাস বাড়ানোর লক্ষ্যে রাজশাহী অঞ্চল থেকে কাঁঠালি জাতের লিচুর কলম সংগ্রহ করে তা সম্প্রসারণের কাজও করে যাচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি এবং উত্তম কৃষি পদ্ধতি ব্যবহারের মাধমে আমের উৎপাদন ৩.৫ লক্ষ মে. টন থেকে ৩.৭৫ লক্ষ মে.টন বাড়ানো সম্ভব হবে এবং আম উৎপাদনের সময়সীমা ০৪ মাস থেকে ০৮ মাসে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে।
বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৫ লক্ষ ভিয়েতনামি খাটো জাতের নারিকেল চারা, ৬ হাজার ডিজে সম্পূর্ণা হাইব্রিড জাতের নারিকেল চারা এবং টিস্যু কালচার প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রবর্তিত বেশ কিছু আরবি খেজুরের চারা এদেশে এনে দক্ষিণাঞ্চলে বিশেষ করে উপক‚লীয় এলাকায় সম্প্রসারণ করা হয়েছে। আশার কথা হচ্ছে যে, ভিয়েতনামি খাটো জাতের নারিকেল গাছে ২৯ মাসে ফল ধরেছে। (রাজালাখ হটিকালচার সেন্টার, সাভার, ঢাকা)
প্রকল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো পাহাড়ি এলাকায় ফল চাষের আওতা বাড়ানো। এরই ধারাবাহিকতায় পাহাড়ি এলাকায় গড়ে উঠেছে কাঁঠাল, আমের বিভিন্ন জাতের বাগান, বাদ যায়নি থাই পেয়ারা, লেবু, লিচু, লটকন, ড্রাগন ফ্রুটস, বেদানা, কমলা, মাল্টা, রাম্বুটান, পার্সিমন ইত্যাদি জাতের ফলের বাগান। এতে পাহাড়ি এলাকায় বৃদ্ধি পেয়েছে সৌহার্দ্যতা, সৃষ্টি হয়েছে আত্মকর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত। পাহাড়ে গায়ে বুনো জাতের বৃক্ষরাজির পরিবর্তে দেখা মিলছে নতুন নতুন ফলের গাছ, যা সত্যিই অসাধারণ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে দেশি, অপ্রচলিত জাতের ফল বাগান তৈরি করার জন্য এক্ষেত্রে তিনি টক কুল, তেঁতুল, কাঁটাবিহীন লেবু, বীজবিহীন লেবু, জাম, জাম্বুরা, জলপাই ইত্যাদি ফল চাষাবাদের প্রতি অধিক আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এ ব্যাপারে বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এরমধ্যে বিলুপ্তপ্রায় দেশি, অপ্রচলিত জাতের ফলের চারা সংগ্রহ করে তা হর্টিকালচার সেন্টারে লালন-পালন করে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে।
কাক্সিক্ষত ফলাফল
ক) বর্তমানে বাংলাদেশে ৩ লক্ষ ৪৮ হাজার হেক্টর জমিতে ফলের চাষ করা হচ্ছে এবং তা থেকে প্রায় ৪৭ লক্ষ মে. টন ফল উৎপাদিত হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের অনুক‚ল প্রভাবে ফলের উৎপাদন প্রায় ১২ লক্ষ মে. টন বৃদ্ধি পাবে, যা শতকরা বৃদ্ধির হার হবে ২৫-৩০%। অতিরিক্ত এ উৎপাদিত ফল জাতীয় অর্থনীতিতে প্রায় ৬০০০ কোটি টাকা বাড়তি অবদান রাখবে।
খ) প্রকল্প এলাকায় ৩০০টা কৃষক দল গঠন করা হবে, তাতে প্রতি দলে ৩০ জন করে মোট ৯০০০ জন ফল চাষি প্রত্যক্ষভাবে এ প্রকল্পের সুফল ভোগ করবে। প্রায় এক লক্ষ ফল বাগানী এবং এক লক্ষ বাড়ির আঙ্গিনার কৃষক পরিবার প্রত্যক্ষভাবে প্রকল্প সুবিধা ভোগ করবে। এছাড়া আরও প্রায় ১২ লক্ষ পুরুষ-মহিলা ফল চাষে অনুরাগী পরিবার এতে সুবিধা ভোগের সুযোগ পাবে।
গ) গ্রামে গঞ্জে ও পাহাড়ি আদিবাসী এলাকায় পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং ফলচাষিদের মাথাপিছু আয় প্রায় ২৫% বৃদ্ধি পাবে।
ঘ) বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, মোটিভিশনাল ট্যুর, ফল মেলা ও উন্নত জাতের ফলের প্রর্দশনী বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষকদের কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে
ঙ) পাহাড়ি অঞ্চলে ফলের উৎপাদন এলাকা বাড়বে। কিষাণ-কৃষাণী বার মাসে ফল খাওয়া বিষয়ক পুষ্টি সচেতনতা আসবে এবং অধিক পুষ্টি সমৃদ্ধ ফল আহারের মাধ্যমে পুষ্টির অভাব দূর হবে।
চ) সর্বোপরি প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং তা সমষ্টিগত ভাবে দারিদ্র্যতার হার কমাতে এক অনন্য সহায়ক ভ‚মিকা রাখবে।
পাহাড়ি ও দক্ষিণ অঞ্চলের জেলাগুলো যেখানে কৃষির উন্নয়ন তথা ফল বাগানে ভরে যাওয়ার বিপুল সম্ভাবনাগুলো পূরণ হওয়ার দীর্ঘকাল অপেক্ষমাণ। বর্তমানে এ সুন্দর বিপুল সম্ভাবনাময়ী এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দীর্ঘ দিনের কৃষি মন্ত্রণালয়ের লালিত স্বপ্ন অচিরেই পূরণ হবে। সারা বছর ধরে ফলের বাসকেট তথা দেশে ফল উৎপাদনে উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র ভূমির উন্নয়ন মডেলের আদর্শে পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি উপযোগী বিশাল এলাকা ও দক্ষিণাঞ্চলের অব্যবহৃত অপর বৃহত্তর অংশ ফল চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে, দারিদ্র্যপীড়িত এসব এলাকার পিছিয়ে পড়া মানুষ সচ্ছলতার স্বাদ পাবে। আগামী ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে এদেশ সামিল হতে ফল উৎপাদন সেক্টরটি আভ্যন্তরীণ খাদ্য পুষ্টির অভাব পূরণ করে বহির্বিশ্বে তা রপ্তানিকারক দেশ হিসাবে সুপরিচিত হবে, দেশের সম্পদ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনবে।
সুতরাং পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদেরকে নতুন নতুন ফলের বাগান সৃষ্টি করতে হবে, যেখানে থাকবে আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষতা, থাকবে দেশি-বিদেশি উন্নত জাতের চারা/কলম। বসতবাড়ির আঙ্গিনায় ফলের গাছ রোপণ করতে সকলকেই সচেষ্ট হতে হবে পাশাপাশি দেশি প্রচলিত/অপ্রচলিত উন্নত জাতের ফলের বাগান গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশে ফল চাষের আওতা বাড়ানোর জন্য সমতল ভ‚মি ছাড়াও পাহাড়ি এলাকা, উপকূলীয় এলাকা, বসতবাড়ির আঙ্গিনায়, পুকুর পাড়ে, স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দিরের আঙ্গিনায়, শহরে বাসাবাড়ির ছাদে প্রভৃতি জায়গায় আধুনিক ফল বাগান গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। য়
প্রকল্প পরিচালক, বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৬২৬০৬৯৫
মো. মনজুরুল হান্নান
বাংলাদেশ উপ-উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের দেশ। উর্বর জমি ও উপযোগী আবহাওয়া এ দেশে ফল চাষের জন্য উত্তম। কাজেই ফল উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আর্থসামাজিক ও পুষ্টি নিরাপত্তাসহ জীবনযাত্রারমান উন্নয়ন করা সম্ভব। বাংলাদেশে প্রায় ৭০-৮০ রকমের প্রচলিত এবং অপ্রচলিত ফল উৎপাদন হয়ে থাকে। বর্তমানে দেশে ২ লক্ষ ৪৩ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ৪৫.২ লক্ষ মেট্রিক টন ফল উৎপাদন হয়। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, মাথাপিছু দৈনিক ফলের ন্যূনতম চাহিদা ১১৫ গ্রাম কিন্তু বর্তমানে প্রাপ্যতা ৭৮ গ্রাম। আন্তর্জাতিক ফল বাজারে বাংলাদেশের ফল রপ্তানির পরিমাণ তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। তবু প্রতি বছর পৃথিবীর ৪০টি দেশে বাংলাদেশের ফল রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানিকৃত উল্লেখযোগ্য ফলগুলোর মধ্যে কাঁঠাল, আম, আনারস, জারা লেবু, এলাচি লেবু, আমড়া, জলপাই, সাতকরা, তৈকর, কদবেল, আমলকী, তেঁতুল, বেল, কামরাঙ্গা ও চালতা উল্লেখযোগ্য। এ উপমহাদেশের অভিবাসীদের মাঝে বাংলাদেশী ফলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো থেকে ফল রপ্তানি করে বছরভিত্তিক বাংলাদেশের আয় নিম্নরূপ-
ফল রপ্তানির ক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যা সমূহ : চাহিদা সৃষ্টির লক্ষ্যে সঠিক পরিকল্পনা না থাকা। আমদানিকারক দেশের আমদানি শর্ত পূরণ করতে না পারা। উত্তম কৃষি পদ্ধতি ও কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে রপ্তানিযোগ্য ফল আবাদ না করা। রপ্তানিযোগ্য ফলের জাতের অভাব। রপ্তানিযোগ্য ফল উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডারগণের দক্ষতা ও সমন্বয়ের অভাব। বালাইমুক্ত ও নিরাপদ ফল উৎপাদনকে গুরুত্ব না দেওয়া। ফল সংগ্রহ কৌশল ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার অভাব।
সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার জন্য হিমাগার, প্যাকিং হাউজ, সঠিক পরিবহন ব্যবস্থার অভাব।
পরিবহনের জন্য অন্য দেশের তুলনায় এ দেশের অধিক বিমান ভাড়া। অ্যাক্রিডেটেড ল্যাবরেটরি, ঞৎধপবধনরষরঃু ব্যবস্থা অনুসরণ এবং উত্তম কৃষি পদ্ধতি সনদ প্রদানে সক্ষমতা না থাকা।
আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান অনুসরণ করে ফল উৎপাদন ও রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনায় রপ্তানিকারকদের মন-মানসিকতা তৈরি না হওয়া। রপ্তানি কাজে সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা ও সক্ষমতার অভাব।
বাংলাদেশের ফলের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় রপ্তানিযোগ্য ফল হলো আম। আম উৎপাদনে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০টি আম উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে অষ্টম স্থান অধিকারী দেশ। কিন্তু রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান নেই। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩২৫ মে:টন আম রপ্তানি করা হলেও আম আমদানি করা হয়েছে ৮০৬৫ মে:টন। ২০১৪-১৫ সালে আম মৌসুমে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে রপ্তানিকৃত আমের ১৫টি ঘড়হ ঈড়সঢ়ষরধহপব পাওয়া যায়। ফলের মাছি পোকা এবং মাত্রাতিরিক্ত গজখ-এর উপস্থিতির জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে আম রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। বাংলাদেশের আর একটি অন্যতম ফল হলো কাঁঠাল। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ ফলের উৎপাদন হয়েছে ১৬৯৪২০৯ মে:টন (ডিএই এর তথ্য)। তাজা কাঁঠালের চাইতে কাঁঠাল জাত খাদ্য অর্থাৎ প্রক্রিয়াজাত করে যদি কাঁঠাল রপ্তানি করা যায় তাহলে এ ফল থেকে আমরা বিরাট অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারব। কাঁচা কাঁঠাল সবজি হিসেবে প্রক্রিয়াজাত করা যেতে পারে। আমাদের দেশ থেকে খুবই অল্প পরিমাণে প্রক্রিয়াজাতকৃত ফল বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এর মধ্যে ক্যানডপাইন আপেল (আনারস) অন্যতম। তাজা ফল রপ্তানির পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাতকৃত ফল রপ্তানির দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। এখানে উল্লেখ করা যায়, বাংলাদেশ ড্রাইডফুড রপ্তানি করে হাজার কোটি টাকা আয় করছে এবং ড্রাইডফুডের দেশে এবং বিদেশের বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। মূলত ময়দায় তৈরি শুকনো খাবার ক্যাটাগরিতে এমন উচ্চ প্রবৃদ্ধি লক্ষ করা যাচ্ছে। ঠিক একইভাবে ফলের জুস, ক্যানড ফল, ড্রাইড ফল ইত্যাদির রয়েছে বিশ্বজুড়ে বিরাট বাজার। আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, আনারস, কলা, পেঁপে ও তরমুজ এর প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য দেশে এবং বিদেশে প্রচুর চাহিদা। আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় দশ হাজার মেট্রিক টন টমেটো কেচাপ ব্যবহার হয়। এর সিংহভাগ আসে বিদেশ থেকে। কাজেই বিকশিত করতে হবে ফল প্রক্রিয়াজাত শিল্পকে। এজন্য দরকার উদ্যোক্তা, লাগসই প্রযুক্তি এবং বিনিয়োগ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর তথ্য অনুযায়ী বিগত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত প্রধান প্রধান ফলের উৎপাদন ছিল নি¤œরূপÑ
দেশি ফলের পাশাপাশি বিদেশি ফল যেমন ড্রাগন ফ্রুট উৎপাদন ও রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। কৃষি মন্ত্রণালয় নিরাপদ ফল উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে ফল উৎপাদনে ইতিবাচক ধারার সূচনা হয়েছে। তাজা ও প্রক্রিয়াজাতকৃত ফল রপ্তানি তথা নিজ দেশে নিজ দেশের ফল নির্ভর বাজার সৃষ্টি করা এখন খুবই জরুরি। এজন্য নি¤েœর বিষয়গুলোর উপর চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে : মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দিকনির্দেশনা বাস্তবায়নে জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সকল “স্টেক হোল্ডার” সমন্বিত করে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা।
উত্তম কৃষি পদ্ধতি (এঅচ) যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করা। এজন্য “সার্টিফিকেশনবডি” প্রতিষ্ঠা করা।
অ্যাক্রিডেটেড ল্যাব প্রতিষ্ঠা করাসহ দক্ষ জনবল সৃষ্টি করা।
উৎপাদন অঞ্চল নির্বাচন করে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর মাধ্যমে রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্য উৎপাদন করা।
উৎপাদন ও সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে সকল কার্যক্রম রেকর্ড করা এবং তা সংরক্ষণ করা।
আধুনিক সুযোগ-সুবিধা যেমন ঠধঢ়ড়ৎ ঐবধঃ ঞৎবধঃসবহঃ, ঐড়ঃ ধিঃবৎ ঞৎবধঃসবহঃ, ঈড়ড়ষরহম ঝুংঃবস, ঝড়ৎঃবৎ, এৎধফবৎ সংবলিত আঞ্চলিক প্যাকিং হাউজ প্রতিষ্ঠা করা। উদ্ভিদ সংগনিরোধ কার্যক্রমকে আরও দক্ষ ও স্বচ্ছ করা। হার্ভেস্টিং ইকুইপমেন্ট ব্যবহার বৃদ্ধি করা।
জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে ফল উৎপাদনকারীদের উৎসাহিত করা।
উদ্যোক্তা এবং রপ্তানিকারকদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। উৎপাদন ও ফল প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ সহজলভ্য করা। ঐঅঈঈচ নীতিমালা অনুসরণ করা।
নিবিড় তদারকির মাধ্যমে রপ্তানিকারক দেশসমূহের ঈড়সঢ়ষরধহপব নিশ্চিত করা।
বৈদেশিক বাজার অনুসন্ধান কাজে বাংলাদেশ দূতাবাসের সংশ্লিষ্টতা বৃদ্ধি করা।
কৃষি পণ্য রপ্তানি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি করা। য়
কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন
আবদুর রশিদ, গ্রাম: দক্ষিণ মামগ্রাম, উপজেলা: বাগমারা, জেলা: রাজশাহী
প্রশ্ন: বেগুন গাছের গোড়া পচে যাচ্ছে এবং গাছ মারা যাচ্ছে। এ অবস্থায় কি করণীয়?
উত্তর: স্কেলোরোসিয়াম রফসি নামক ছত্রাকের আক্রমণ হলে বেগুন গাছে এ ধরনের রোগ হয়ে থাকে। বেগুন গাছের যে কোন বয়সে এ রোগটি হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত গাছ দেখা গেলে সাথে সাথে উঠিয়ে দূরবর্তী স্থানে মাটির নিচে পুঁতে ফেলা দরকার। আর অন্য বেগুন গাছগুলোতে মেনকোজেব ও কার্বেনডাজিম গ্রæপের ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম সঠিক নিয়মে মিশিয়ে আক্রান্ত বেগুন গাছে স্প্রে করলে এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
মো. মামুন, গ্রাম: দিয়ানা, উপজেলা: গোমস্তাপুর, জেলা: চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রশ্ন: মিষ্টিকুমড়ার পাতার সবুজ অংশ পোকায় খেয়ে ফেলছে। কি করলে প্রতিকার পাবো?
উত্তর: এ ধরনের সমস্যা কাটালে পোকা বা এপিল্যাকনা বিটল এর আক্রমণে হয়ে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় হাত দিয়ে কীড়া ও ডিম সংগ্রহ করে ধ্বংস করা যেতে পারে। আক্রমণ অধিক হলে ম্যালাথিয়ন গ্রæপের ২ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে এ পোকা দমন করা যায়।
মো. মাহবুব উল্লাহ, গ্রাম: বাকতা, উপজেলা: ফুলবাড়িয়া, জেলা: ময়মনসিংহ
প্রশ্ন: নারকেলে এক ধরনের পোকার আক্রমণে নারকেলের খোসাতে বেশ শক্ত দাগ এবং ফাটাফাটা দাগ দেখা যায়। কি করণীয়?
উত্তর: এ সমস্যাটি মাকড়ের আক্রমণে হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে নারকেল বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি গাছে সুষম সার প্রয়োগ করা দরকার। এসবের পাশাপাশি এবামেকটিন গ্রæপের ১.২৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করলে এ ধরনের মাকড়ের সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।
মো. রবিন, গ্রাম: পীড়ানচর, উপজেলা: শিবগঞ্জ, জেলা: চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রশ্ন: পটল গাছে এক ধরনের পোকার আক্রমণের কারণে পটলে ছিদ্র দেখা যাচ্ছে। আবার পটল পচেও ঝরে যাচ্ছে। এ অবস্থায় কি করবো?
উত্তর: জমিতে পড়ে থাকা পচা পটলগুলো সংগ্রহ করে দূরে সরিয়ে ফেলার পাশাপাশি জমিকে পরিষ্কার রাখতে হবে। ক্ষেতের মাঝে ফেরোমন ফাঁদ স্থাপন করা যেতে পারে। সেজন্য প্রতি ২.৫ শতক জমিতে ১টি করে ফেরোমন ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। এছাড়া ডেল্টামেথ্রিন গ্রপের যে কোন কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১মিলি মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে সুফল পাবেন।
নূরন্নবী হাওলাদার, গ্রাম: পদ্মনগর, উপজেলা: কুষ্টিয়া সদর, জেলা: কুষ্টিয়া
প্রশ্ন: লেবু গাছের পাতা সাদা হয়ে যাচ্ছে। পাতায় আঁকাবাকা গর্তের মতো দাগ দেখা যায়। কি করবো?
উত্তর: লেবু গাছে লিফ মাইনার নামক পোকার আক্রমণে এ ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। অল্প পরিমাণ পাতা আক্রান্ত হলে পাতাগুলো ছাঁটাই করে দূরবর্তী জায়গায় মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। এ পোকার আক্রমণ শরৎকাল ও গ্রীষ্মকালে বেশি হয়ে থাকে। এছাড়া ইমডাক্লোরপ্রিড গ্রæপের ০.২৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পর পর লেবু গাছের কচি পাতায় ৩-৪ বার স্প্রে করলে এ ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
শারমিন, গ্রাম: মৌতলা, উপজেলা: কালিগঞ্জ, জেলা: সাতক্ষীরা
প্রশ্ন: কামরাঙ্গা গাছের বাকল ও ডালে ছিদ্র দেখা যাচ্ছে এবং ছিদ্র থেকে ডালের গায়ে ঝুলে থাকা কাঠের গুড়া মতো দেখা যাচ্ছে। করণীয় কি?
উত্তর: এ সমস্যা মোকাবেলায় ডালে ঝুলে থাকা গুড়া মিশ্রিত মল পরিষ্কার করতে হবে। গর্তের মধ্যে কেরোসিন বা ন্যাপথেলিন দিয়ে ছিদ্রের মুখ বন্ধ করতে হবে। আর পোকায় খাওয়া বাকল চেছে কপারজাতীয় ছত্রাকনাশকের প্রলেপ দিতে হবে। এছাড়া কার্বোসালফানজাতীয় কীটনাশক ১০-১২ দিন পরপর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে। তবেই উপকার পাবেন।
রহিম শেখ, গ্রাম: কেরাদারি, উপজেলা: রাজারহাট, জেলা: কুড়িগ্রাম
প্রশ্ন: পানিকচুর পাতায় কালো ও হলুদ দাগ পড়ছে এবং কচুর কাÐ পচে যাচ্ছে। এ অবস্থায় কি করবো?
উত্তর: ফাইটোফথোরা কলোকোসিয়া নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। এ রোগ দমনের জন্য রোগমুক্ত এলাকা থেকে সুস্থ বীজ সংগ্রহ করতে হবে। জমিতে রোগ দেখা গেলে ফেনামিডন ও মেনকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে। এসবের সাথে সাথে ফসল সংগ্রহরে জমিতে পড়ে থাকা কচুর কাÐ ও পাতা ধ্বংস করে ফেলতে হবে। আর উল্লিখিত ছত্রাকনাশক ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করলে এ রোগ দমন করা যায়।
আখতারুজ্জামান রুবেল, গ্রাম: লখাইডাঙ্গা, উপজেলা: মনিরামপুর, জেলা: যশোর
প্রশ্ন: মাছের ছত্রাকজনিত রোগের ক্ষেত্রে কি করণীয়?
উত্তর: রুইজাতীয় ও অন্যান্য চাষযোগ্য মাছে এবং মাছের ডিম আক্রান্ত হয়। ছত্রাকজনিত রোগের লক্ষণগুলো হলো-পুচ্ছ পাখনা, ময়লাবর্ণ তুলার ন্যায় ছত্রাক দেখা যায়। চামড়ায়, মাছের ডিম আক্রান্ত হয়ে সাদাটে হয়ে যায়। পানির ¯্রােত যখন স্থির হয় কিংবা বদ্ধ জলায় অথবা হ্যাচারি ট্যাংকে যেখানে অনিষিক্ত ডিমের ব্যাপক সমাগম ঘটে সেখানে ছত্রাক রোগ দ্রæত ছড়ায়। এছাড়া প্রাকৃতিক জলাশয়ের প্রায় শতকরা ৯৮ ভাগ ডিম এ রোগ দ্বারা আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সমস্যা রোধে-হ্যাচারির প্রতিটি যন্ত্রপাতি ও ট্যাংক সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার করার পর শতকরা ১০ ভাগ ফরমালিন পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে। অনিষিক্ত ও মৃত ডিমগুলোকে দ্রæত হ্যাচারি থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। হ্যাচারিতে অধিক খাদ্য প্রয়োগ না করা। এসবের পাশাপাশি হ্যাচারিতে পালনকৃত ডিমগুলো ২৫০ পিপিএম ফরমালিন দিয়ে ধৌত করা। খাঁচা ও পেনে চাষকৃত আক্রান্ত মাছগুলোকে শতকরা ৩-৫ ভাগ ফরমালিন দিয়ে ২-৩ মিনিটের মতো গোসল করানো। আর বিকল্প হিসেবে শতকরা ৫ ভাগ লবণ পানিতে আক্রান্ত মাছগুলোকে গোসল করানো।
মো. মকবুল হোসেন, গ্রাম: যাদপপুর, উপজেলা: আলমডাঙ্গা, জেলা: চুয়াডাঙ্গা
প্রশ্ন: মাছের আইশ উঠে যাচ্ছে কি করবো?
উত্তর: এ সমস্যাটি ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে। এ রোগের লক্ষণগুলো হচ্ছে- মাছের আইশের গোড়ায় রস জমে আইশ ঢিলা হয়ে যায়। চামড়া উজ্জ্বলতা হারায় এবং মাছ অলসভাবে চলাফেরা করে। এ সমস্যার প্রতিকারে-চুন বা বিøচিং পাউডার দিয়ে পুকুর শোধন করতে হবে। এক কেজি ওজনের মাছে ১০ মিলিগ্রাম হারে সপ্তাহে ২ বার ক্লোরোমাইসন ইনজেকশন দিতে হবে। আর ১ লিটার পানিতে ২০ মিলিগ্রাম ক্লোরোমাইসন মিশিয়ে প্রতি ৪ দিন পর পর ২৪ ঘণ্টা মাছকে রাখতে হবে। তবেই মাছের ব্যাকটেরিয়াজনিত এ সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
আবদুল্লাহ সরকার, গ্রাম: সারানপুর, উপজেলা: গোদাগাড়ী, জেলা: রাজশাহী
প্রশ্ন: বাছুরের বয়স ২৫ দিন। দুর্গন্ধযুক্ত ও সাদা পাতালা পায়খানা হচ্ছে। এ অবস্থায় আমি কি করবো? পরামর্শ চাই।
উত্তর: বাছুরের সাদা উদরাময় রোগ হয়েছে। বাছুরকে সালফাডিন এস ভেট অথবা কট্টিম ভেট বোলাস খাওয়াতে হবে। এর সাথে ইলেকট্রোমিন অথবা রেনালাইট পাউডার খাওয়াতে হবে। এছাড়া বাছুরের খাবার পাত্র, পানির পাত্র প্রতিবার ব্যবহারের পর পরিষ্কার করতে হবে। তাহলে এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।
নূরে আলম তালুকদার, গ্রাম: ব্রাহ্মণগাঁ, উপজেলা: গৌরনদী, জেলা: বরিশাল
প্রশ্ন: আমার ব্রয়লার মুরগি আছে ৫০০টি। হঠাৎ করে স্ট্রোক করে মারা যাচ্ছে। এর সমাধান কি?
উত্তর: শেডে ফ্যান দিতে হবে। টিনের উপর বস্তা বা চট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে এবং ১ ঘণ্টা পর পর পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। পানির সাথে সিভিট ভেট ও ইলেকট্রোমিন পাউডার দিতে হবে। এ পদ্ধতি অনুসরণ করলে আপনি উপকার পাবেন।
কৃষির যে কোন প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান পেতে বাংলাদেশের যে কোন জায়গা থেকে যে কোনো মোবাইল থেকে কল করতে পারেন আমাদের কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ এ নাম্বারে। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত যে কোনো দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ সময়ের মধ্যে। তাছাড়া কৃষিকথার গ্রাহক হতে বার্ষিক ডাক মাশুলসহ ৫০ টাকা মানি অর্ডারের মাধ্যমে পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ এ ঠিকানায় পাঠিয়ে ১ বছরের জন্য গ্রাহক হতে পারেন। প্রতি বাংলা মাসের প্রথম দিকে কৃষিকথা পৌঁছে যাবে আপনার ঠিকানায়। য়
প্রফেসর ড. মাহবুব রব্বানী
মানব দেহের পুষ্টি চাহিদার বিবেচনায় বিশেষ করে ভিটামিন ও মিনারেলের অন্যতম উৎস হিসেবে সারা বিশ্বে ফল বিশেষভাবে সমাদৃত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। পুষ্টিমান, আকর্ষণীয়তা এবং বৈচিত্র্যতার গুণে বিশ্ব বাণিজ্যে ফল একটি আবশ্যিক পণ্য। সঙ্গত কারণে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে বিভিন্ন পালা-পার্বণ ও উৎসবের একটি অবিচ্ছিন্ন অনুসঙ্গ হচ্ছে ফল। দেশের চলমান অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় ফল শিল্পের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে, বিশেষ করে টাটকা এবং প্রক্রিয়াজাতকৃত বেশকিছু প্রধান ও অপ্রধান ফল দেশীয় বাজারের চাহিদাপূরণের পাশাপাশি রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে ভ‚মিকা রাখছে।
দেশের ফল রপ্তানির বর্তমান চালচিত্র : বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৪৫ লাখ টন ফল উৎপাদিত হয় তন্মধ্যে প্রায় ৫৩ শতাংশ আসে বাণিজ্যিক বাগান (ঙৎপযধৎফ) থেকে এবং বাকি ৪৭ শতাংশ ফলের জোগান আসে বসতবাড়ি ও তদসংলগ্ন জমি থেকে। দেশে ফলের বাণিজ্যিক বাগান বৃদ্ধি তথা মোট উৎপাদন বৃদ্ধি হলেও নানাবিধ কারণে রপ্তানির পরিমাণে বছরভিত্তিক তারতম্য লক্ষ করা যাচ্ছে, যা নি¤েœ উল্লেখিত ২০১২-২০১৬ পর্যন্ত দেশের ফল রপ্তানির সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যান থেকে অনুমেয়।
রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশের ফলের অবস্থান পার্শ্ববর্তী এবং প্রতিযোগী দেশসমূহের তুলনায় অনেক সীমিত। ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত বাংলাদেশে ফল রপ্তানির ক্ষেত্রে ক্রমহ্রাসমান ধারা বিদ্যমান। রপ্তানি হ্রাস-বৃদ্ধির নানাবিধ কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানসম্পন্ন ফল উৎপাদন এবং আমদানিকারক দেশের চাহিদা অনুযায়ী রপ্তানি প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণে ব্যর্থতা। বলাবাহুল্য মানসম্পন্ন ফল উৎপাদনের পাশাপাশি বর্তমান রপ্তানি পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জগুলোকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারলে দেশের ফল রপ্তানি বৃদ্ধিসহ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশের ফল হিসেবে ব্র্যান্ড-এর অপার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
রপ্তানি বাড়ানো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মানসম্পন্ন ফল উৎপাদন : ফলের মান বুঝাতে কোন একক বৈশিষ্ট্য নয় বরং অনেকগুলো কাক্সিক্ষত গুণের সমন্বয়কে বুঝায়। রপ্তানি বাজারে ফলের বৈচিত্র্যতা এবং জাত অনুযায়ী পৃথক পৃথক মানদÐ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মানসম্পন্ন ফল উৎপাদন করা এবং বিদেশি ভোক্তা পর্যন্ত এসব ফলের মান বজায় রাখা কোন একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না, সে জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীজনের (ঝঃধশবযড়ষফবৎ) দায়িত্বশীল ভ‚মিকা। যেমন:Ñ
উৎপাদন পর্যায় : মানসম্পন্ন ফলের নিশ্চয়তা বিধানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হচ্ছে উৎপাদনকারীর। রপ্তানি কেন্দ্রিক একটি আদর্শ ফল উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে উপযুক্ত জাত নির্বাচন করা থেকে শুরু করে সুকৃষি চর্চা (এঅচ), সমন্বিত ফসল ব্যবস্থাপনা (ওঈগ), সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (ওচগ), প্যাকেজিং এবং অর্গানিক ফার্মিং বিষয়গুলো সম্পৃক্ত থাকে। উৎপাদনকারীকে অবশ্যই সুকৃষি চর্চার প্রমাণপত্র (ঈবৎঃরভরপধঃরড়হ) নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে এবং রপ্তানির লক্ষ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত ফল হচ্ছে আম। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (উঅঊ) এর উদ্যোগে আম উৎপাদনে সুকৃষি চর্চা, ফ্রুট ব্যাগিং, ফেরোমন ফাঁদ, হট ওয়াটার ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে রপ্তানি কার্যক্রম জোরদার হচ্ছে। রপ্তানির তালিকায় অগ্রাধিকার অন্যান্য ফল কাঁঠাল, কলা, লেবু, নারিকেল, লিচু, আমড়া, তেঁতুলের ক্ষেত্রেও আমের মতো সুকৃষি চর্চা নিশ্চিত করার মাধ্যমে রপ্তানি বৃদ্ধির অপার সুযোগ রয়েছে।
ফলের যে সব জাত আন্তর্জাতিক বাজারে ভোক্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং উল্লেখযোগ্য চাহিদা রয়েছে সেগুলোকে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সকল স্তরে কোয়ালিটি স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখে রপ্তানি মান নিশ্চিত করতে হবে। সুস্বাদু হিমসাগর আমকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে (ঊট) রপ্তানির লক্ষ্যে মেহেরপুর জেলায় নির্দিষ্ট কিছু আম বাগানে উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। একই প্রক্রিয়া অন্যান্য ফলের বাণিজ্যিক জাতের ক্ষেত্রে প্রয়োগের চেষ্টা করা যায়। ফল বাগানে সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাসায়নিক সার নির্ভরতা যথা সম্ভব সর্বনি¤œ পর্যায়ে রেখে জৈবসারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। ফল বাগানে বালাইনাশক হিসেবে অপরিকল্পিতভাবে রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগ না করে জরুরি প্রয়োজনে পরিমিত এবং নির্দিষ্ট মাত্রায় রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগের পাশাপাশি সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা, বায়োকন্ট্রোল, বোটানিক্যাল কন্ট্রোল এসবের ব্যবহার বাড়াতে হবে। বিশ্ব বাজারে ‘অর্গানিক ফ্রুট’ এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বিধায় এটিকে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
হারভেস্ট ও সাপ্লাই চেইন পর্যায় : রপ্তানি ইস্যুতে ফলের পরিপক্বতার বিষয়টি অতীব জরুরি। কারণ উপযুক্ত পরিপক্ব পর্যায়ে সংগৃহীত ফলের সংগ্রহোত্তর জীবনকাল (ঝযবষভ ষরভব) দীর্ঘ হয় এবং অধিক পরিপক্ব বা কৃত্রিমভাবে পাকানো ফলের সংগ্রহোত্তর জীবনকাল সংক্ষিপ্ত হয়। উপযুক্ত পরিপক্বতার পর্যায়ে সংগৃহিত ফলকে স্বাস্থ্যবান্ধব ট্রিটমেন্ট করে লাগসই গ্রেডিং, প্যাকেজিং, স্টোরেজ এবং ট্রান্সপোর্টেশন নিশ্চিত করতে হবে। গ্রেডিংয়ের সময় বিভিন্ন আকার, আকৃতি এবং ভালো মন্দের মিশ্রণ ঘটানো যাবে না। প্যাকেজের গায়ে যথাযথ তথ্যাবলীসহ লেবেলিং থাকতে হবে। ফলের ধরন অনুযায়ী প্যাকেজিং করতে হবে যেন নাড়াচাড়ার কারণে আঘাত না লাগে। মনে রাখতে হবে ভালো প্যাকেজিং ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, পণ্যের মান সম্পর্কে ভালো ধারণা দেয় এবং ক্রেতাকে পণ্য কিনতে উৎসাহিত করে। ফলের সংগ্রহোত্তর জীবনকাল বাড়ানোর লক্ষ্যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু সংরক্ষণ (চৎবংবৎাধঃরাব) বস্তু পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, সোডিয়াম মেটাবাইসালফাইট, পটাশিয়াম মেটাবাইসালফাইট, সিলভার থায়োসালফেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। তবে সেটির প্রয়োগমাত্রা হতে হবে যথাযথ এবং সঠিক পদ্ধতিতে। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য বা রঞ্জক পদার্থ কোন অবস্থাতেই ব্যবহার করা যাবে না। সাপ্লাই চেইন এর সব পর্যায়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ (ঈড়ড়ষ পযধরহ) সুবিধা থাকতে হবে।
রপ্তানিকারক ও আমদানিকারক পর্যায় : ফল একটি পচনশীল পণ্য। তাই দ্রæততার সাথে রপ্তানির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা উচিত। রপ্তানি প্রক্রিয়ায় বিশেষভাবে করণীয় কাজ হচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং, লেবেলিং এবং সার্টিফিকেশন এসব। অবশ্যই ডিএই কর্তৃক ইস্যুকৃত ফাইটোসেনিটেশন সার্টিফিকেট সংযুক্ত করতে হবে কারণ ঊট সহ অনেক দেশই এ সার্টিফিকেট ছাড়া শিপমেন্ট গ্রহণ করে না। ফল রপ্তানিতে এয়ার শিপমেন্টই সর্বোত্তম। তবে বিমানে পর্যাপ্ত স্পেস, আলাদা বিমান ব্যবহার, যৌক্তিক ভাড়া নির্ধারণ, আপলোডিং এবং শিপমেন্ট নিশ্চয়তার বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। আমদানিকারক দেশ আমদানি নীতিমালার আলোকে যাবতীয় পরিদর্শন বা টেস্টিং কাজ সম্পন্ন করে দ্রæততম সময়ে বাজার/ভোক্তার কাছে ফল পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। অনেক নামকরা আমদানিকারক রয়েছে যারা ফল উৎপাদনকারী দেশে অফিস স্থাপন করে যাবতীয় নিয়মাবলি সম্পন্ন করে রপ্তানি প্রক্রিয়াকে সহজতর করে নেয়, এতে পণ্যের শিপমেন্ট যেমন দ্রæত হয় তেমনি পণ্যের মানও ভালো থাকে। প্রতিষ্ঠিত এবং নির্ভরযোগ্য আমদানিকারকদের জন্য বাংলাদেশে এ ধরনের সুবিধা প্রদান করা যায়।
ভোক্তা পর্যায় : ভোক্তাই হচ্ছেন রপ্তানি বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন। কারণ ভোক্তার সন্তুষ্টিই পণ্যের চাহিদা বাড়িয়ে দেয় যার ভিত্তিতে আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধি পায়। ভোক্তার সন্তুষ্টির অনুক‚লে কিছু মানদÐ রয়েছে যা সকল দেশ বা সব ধরনের ফলের ক্ষেত্রেই কমবেশি প্রযোজ্য। ফলের আকর্ষণীয় চেহারা, সুষম আকার, সংহতি, পরিপূর্ণ গঠন, সঠিক পরিপক্বতা, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রঙ, উজ্জ্বলতা, মিষ্টতা, সুঘ্রাণ, পর্যাপ্ত পুষ্টি উপাদান, রোগজীবাণুমুক্ত অবস্থা এসব বিবেচনায় রাখতে হয়। ফল উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যদি এসব গুণাবলি শতভাগ নিশ্চিত করা যায় এবং সাপ্লাই চেইন সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে ভোক্তা পর্যায়েও ফলের মান ভালো রাখা সম্ভব।
রপ্তানির লক্ষ্যে নিরাপদ ফল উৎপাদন : সরাসরি খাওয়া খাদ্যের মধ্যে ফল অন্যতম বিধায় এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয় এবং একই কারণে শুধু রপ্তানি বাণিজ্যে নয় অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যেও নিরাপদ ফলের চাহিদা এবং বাজারমূল্য অনেক বেশি। যেহেতু ফল টাটকা খাওয়া হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে খোসাসহ খাওয়া হয় সেহেতু ফলের মধ্যে কোনো প্রকার ক্ষতিকর জীবাণু, রাসায়নিক উপাদান বা হেভিমেটালের উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য নয়। স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রক্রিয়ার (ঝঙচ) মাধ্যমে হারভেস্টিং, ক্লিনিং, গ্রেডিং, প্যাকেজিং সম্পন্ন করে ফলকে ক্ষতিকর জীবাণুমুক্ত রাখার মাধ্যমে রপ্তানি মান বাড়ানো সম্ভব। প্রতিষ্ঠিত রপ্তানিকারক দেশসমূহের সুকৃষি চর্চার স্টান্ডার্ড যেমনÑ ঊঁৎড়এঅচ, ঞযধরএঅচ এর আদলে ইধহমষধএঅচ চালু করে বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা অর্জনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
ফল রপ্তানি বাড়াতে করণীয়
রপ্তানি পণ্য হিসেবে আরো বেশি ফলের অন্তর্ভুক্তি : বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মোট ১৩০ ধরনের ফলের সন্ধান পাওয়া গেছে অথচ রপ্তানি বাজারে অবস্থান রয়েছে মাত্র ১০-১৫ ধরনের ফলের। দেশের প্রধান এবং অপ্রধান ফলসমূহের পুষ্টিমূল্য, বহুমাত্রিক ব্যবহার এবং আকর্ষণীয় গুণাবলিসমূহ বিদেশি ক্রেতাদের কাছে প্রদর্শন এবং প্রচারণার মাধ্যমে আরো অনেক ধরনের ফলকে রপ্তানি বাজারে যুক্ত করার সুযোগ রয়েছে।
রপ্তানি বাজার নিয়ন্ত্রণ ও রপ্তানি নেটওয়ার্ক বাড়ানো : বাংলাদেশের ফল রপ্তানি যেমনি বহুধা বিভক্ত তেমনি বহুমাত্রিকও বটে। ফলের রপ্তানি বাজারকে কোয়ালিটি ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় এনে শুধু অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান এবং চ্যানেলের মাধ্যমে রপ্তানি কাজ সম্পাদন করা প্রয়োজন। রপ্তানি বাজারের মান বজায় রেখে ফল উৎপাদন না করে যে কোন উপায়ে উৎপাদিত ফলকে রপ্তানির জন্য বিবেচনায় আনা সমীচীন নয়। বাংলাদেশ থেকে ফল রপ্তানি করা হয় এমন দেশের সংখ্যাও অপ্রতুল। মানসম্পন্ন ফল উৎপাদনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজার যাচাই, প্রচারণা, প্রণোদনা, ভর্তুকি, এমনকি বিশেষ অভিজাত ফল বিনিময়ের মাধ্যমেও রপ্তানি নেটওয়ার্ক বাড়ানো যায়। বর্তমানে ফল রপ্তানিকৃত দেশসমূহে রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে সামষ্টিক চেষ্টা চালানো প্রয়োজন।
বাণিজ্যিক চাষের আওতায় জমির পরিমাণ বাড়ানো : বাংলাদেশে আবাদযোগ্য জমির মাত্র ২% ফল চাষের আওতায় রয়েছে যা বাড়ানো প্রয়োজন। বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে বেশি চাষ হচ্ছে আম, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানির লক্ষ্যে মানসম্পন্ন আম উৎপাদনে ডিএইর উদ্যোগে মেহেরপুর জেলায় ১৫টি আম বাগান নির্বাচন করে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে আম উৎপাদন কার্যক্রম চালু আছে। রপ্তানির জন্য অগ্রাধিকার অন্যান্য ফল কলা, কাঁঠাল, লেবুজাতীয় ফল, নারকেল, আমড়া, পেয়ারা, লিচুর ক্ষেত্রেও অনুরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। দেশে ১ কোটি ৯৪ লাখ বসতবাড়ির আওতাধীন প্রায় ৪.৫ লাখ হেক্টর জমি রয়েছে, যা বাণিজ্যিক ফল চাষ নেটওয়ার্কের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে কারণ নিরাপদ ফল হিসেবে বসতবাড়ির ফলের আলাদা কদর রয়েছে।
রপ্তানি পণ্য হিসেবে প্রক্রিয়াজাতকৃত ফলের অন্তর্ভুক্তি : আন্তর্জাতিক বাজারে টাটকা ফলের পাশাপাশি কিছুটা প্রক্রিয়াজাতকৃত (গরহরসধষষু ঢ়ৎড়পবংংবফ) ফল এবং ফলের বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পোস্ট হারভেস্ট প্রসেসিং ও প্রিজারভেশন ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে ফলের প্রক্রিয়াজাত পণ্য উৎপাদন করে বিদেশে বাংলাদেশের ফলের বাজার সম্প্রসারণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে আনারস, কাঁঠাল, ড্রাগন ফল, লিচু, বরই, মিষ্টি তেঁতুল ফল কাজে লাগানো যায়।
গবেষণা ও প্রশিক্ষণ : ফলের রপ্তানিযোগ্য জাত সৃষ্টিকরা, বিজ্ঞানসম্মত উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন, সংগ্রহোত্তর জীবনকাল বৃদ্ধির প্রযুক্তি, সঠিক পরিপক্বতার সূচক (গধঃঁৎরঃু রহফবীরহম) নির্ধারণ এবং প্রসেসিং প্রটোকল তৈরির গবেষণাকে আধুনিকীকরণ করা প্রয়োজন। এতে বাংলাদেশী পণ্যের ওপর বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা অর্জিত হবে। তাছাড়া মানসম্পন্ন ফল উৎপাদন ও রপ্তানির বিভিন্ন স্তরে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের ওপর অংশীজনদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
রপ্তানি বাজার জরিপ ও কাজের সমন্বয় : জরুরি ভিত্তিতে একটি নিবিড় জরিপের মাধ্যমে বাংলাদেশের ফল রপ্তানির সুযোগ ও সম্ভাবনাকে খুঁজে বের করার পদক্ষেপ নেয়া উচিত এবং একই সাথে রপ্তানির দুর্বল দিকগুলোকে চিহ্নিত করে তার দ্রæত সমাধানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এ ছাড়াও ফল উৎপাদন, সম্প্রসারণ, রপ্তানি ও উন্নয়নের সাথে সরাসরি জড়িত প্রতিষ্ঠানসমূহ ডিএই, এনবিআর, ইপিবি, হর্টেক্স ফাউন্ডেশন, ইন্ডাস্ট্রি ও এক্সপোর্টাসের মধ্যে কাজের সমন্বয় করতে হবে। বিদেশি ক্রেতাদের সাথে এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট লিংকেজ স্থাপন করে রপ্তানি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়। বাংলাদেশের ফল শিল্পের প্রতিযোগী দেশসমূহের ফল উৎপাদন এবং রপ্তানি ব্যবস্থার ওপর সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে নিজস্ব ব্যবস্থার উন্নয়ন করা যায়।
বাংলাদেশে ফল সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে ভেজাল মিশ্রণের অনির্ভরশীল তথ্য প্রকাশিত হয়, যার বিরূপ প্রভাবে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাজার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং বাজারব্যবস্থা ঠিক রাখার স্বার্থে এ ক্ষেত্রে ফল উৎপাদনকারী কৃষক, ফল ব্যবসায়ী এবং ভোক্তাদের মাঝে কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করা এবং অপপ্রচার রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। রপ্তানি পণ্যের মানের সাথে দেশের ভাবমূর্তি জড়িত রয়েছে বিধায় কোয়ালিটি এবং সেফটির বিকল্প চিন্তার কোনো সুযোগ নেই। সর্বোপরি বাংলাদেশের ফল শিল্পে কোয়ালিটি ও সেফটি সূচকের দৃশ্যমান অগ্রগতির মাধ্যমেই ফলের ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি হবে এবং ফল রপ্তানি বাড়বে বলে দৃঢ় আশা করা যায়। য়
* উদ্যানতত্ত¡ বিভাগ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী, মোবাইল : ০১৭১০৪০১৫২৫
মৃত্যুঞ্জয় রায়
বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পাহাড়ি অঞ্চল। পাহাড় ছড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের কিছু অংশে, ময়মনসিংহের দক্ষিণাংশে, সিলেটের উত্তরাংশে, কুমিল্লার পূর্বাংশে, নোয়াখালীর উত্তর পূর্বাংশে ও পার্বত্য চট্টগ্রামে। শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামেই আছে দেশের মোট জমির প্রায় ১০ শতাংশ জমি। এসব পাহাড়ের অনেকটা ভূমি বনাঞ্চল। বনের পাশাপাশি এসব পাহাড়ে রয়েছে কৃষি বা চাষাবাদের অপূর্ব সুযোগ। তিনটি পার্বত্য জেলায় যেখানে আমন ধানের চাষ হয় প্রায় ৫৬ হাজার হেক্টর জমিতে সেখানে বিভিন্ন রকম উদ্যান ফসলের চাষ হয় ৯৮ হাজার হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে কলা, ১১ হাজার হেক্টর জমিতে আম ও ৮ হাজার হেক্টর জমিতে আনারস চাষ উল্লেখযোগ্য। ভূমি বৈচিত্র্যের জন্য মাঠ ফসলের চেয়ে উদ্যান ফসল চাষের জন্য পাহাড় বেশি উপযোগী। উদ্যান ফসলের মধ্যে বহু রকমের ফল পাহাড়ে চাষ করা যায়। পাহাড়ে অন্তত কুড়ি রকমের ফল খুব ভালোভাবে চাষ করা যায়। কিছু নতুন বিদেশি ফল চাষেরও সম্ভাবনা রয়েছে। মাল্টা ও ড্রাগন ফল খুব ভালোভাবে হচ্ছে। বর্তমানে পাহাড়ে বেশ কয়েক রকমের ফলের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। ব্যাপকভাবে চাষ করা হচ্ছে আম, কলা, কাঁঠাল, লেবু ও আনারস। নতুন ফলের মধ্যে মাল্টা ও কমলা চাষ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। বান্দরবানের রামুতে চাষ করা হচ্ছে কাজুবাদাম। খাগড়াছড়িতে প্যাসন ফল চাষের সফলতাও দেখা গেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৮৯ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এর মধ্যে প্রায় ৭৮ শতাংশের অবস্থান চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে। অধিকাংশ আদিবাসী জুম চাষ অথবা সীমিত আকারে ফল চাষ করে নিজেদের খাদ্য যোগায়। কাজেই তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একদিকে যেমন খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, তেমনি তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য দরকার আয় বৃদ্ধি করা। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধির সহজ উপায় হলো পাহাড়ে ফলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ সম্প্রসারণ, উৎপাদিত সেসব ফলের উপর ভিত্তি করে প্রক্রিয়াজাত শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃজন, ফল ও ফলজাত পণ্য দেশ-বিদেশের বাজারে বিক্রির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ ইত্যাদি।
পাহাড়ে ফল চাষের গুরুত্ব
পাহাড়ে অনেক অনাবাদী বা পতিত জমি আছে। সেসব জমিতে সমতলের মতো ধান, গম, আলু করা যায় না। অথচ ফল চাষ করা যায়। পাহাড়ে ফলগাছের দুর্যোগজনিত ঝুঁকি কম।
পাহাড়ের মাটি ও আবহাওয়া অনেক রকমের ফল চাষের উপযোগী। অন্য ফসলের তুলনায় ফল চাষ অধিক লাভজনক। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আয় বাড়াতে ফল চাষ সাহায্য করতে পারে।
ফল পাহাড়ি জনগোষ্টীর পুষ্টির উত্তম উৎস।
পাহাড়ে ফল চাষের ফলে সেখানকার জনগোষ্ঠীর অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হতে পারে। সমুদ্র ও বিমান বন্দর কাছাকাছি থাকায় বিদেশে ফল রপ্তানির ভালো সুযোগ রয়েছে।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য সারা বছর ফলপ্রাপ্তি নিশ্চিত হয়।
পাহাড়ি এলাকার বসতবাড়িতে ফলের বাগান বা ফলগাছ লাগালে হাতের কাছেই ফল পাওয়া যায়। পাখিসহ অনেক জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে ফলগাছ সাহায্য করতে পারে। অনেক ফলের জার্মপ্লাজম সংরক্ষিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
পাহাড়ি এলাকার উপযোগী ফল ও ফলের জাত
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবনে বিভিন্ন ফলের মধ্যে বেশি হয় কাঁঠাল, আম, আনারস, কলা, লিচু, তরমুজ, পেঁপে, লেবুজাতীয় ফল বিশেষ করে মাল্টা, কমলা, বাতাবিলেবু ও অন্যান্য লেবু। সবচেয়ে বেশি হয় কলা ও কাঁঠাল। অতিরিক্ত পরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রাঙ্গামাটি অঞ্চল, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্রমতে, ২০১৫-১৬ সালে এ তিনটি জেলায় মোট ৫৭৭৬২৪ টন কলা, ২৬০১৯৮ টন কাঁঠাল, ১৭৪৯০৩ টন পেঁপে, ১৪৮১৩০ টন আম, ৩৪৭৭৪ টন লেবু, ৩১৭৭৯ টন লিচু, ৩০৭৮৭ টন বাতাবি লেবু, ১৮৮১৩ টন তরমুজ ও ২৯৫৪৫৬ টন অন্যান্য ফল উৎপাদিত হয়েছিল।
পাহাড়ি এলাকায় দুই রকমের স্থানে ফল চাষের সুযোগ রয়েছে- বসতবাড়ির আঙ্গিনায় ও পাহাড়ের ঢালে। বসতবাড়িতে চাষের জন্য আম, কাঁঠাল, বাতাবি লেবু, পেয়ারা, লিচু, তেঁতুল, পেঁপে, লটকন ইত্যাদি ফলগাছ লাগানো যায়।
পাহাড়ি ঢালে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের জন্য ভালো কলা, আনারস, মাল্টা, কমলা, পেঁপে, আম, কাঁঠাল ইত্যাদি। এছাড়া রাম্বুটান, ড্রাগন ফল, প্যাসন ফল, স্ট্রবেরি, কাজুবাদাম ইত্যাদি বিদেশি ফলেরও উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। নিচে পাহাড়ি এলাকায় চাষের উপযোগী ফলের তালিকা দেয়া হলো-
পাহাড়ে ফলচাষ সম্প্রসারণে করণীয় : সরকার ইতোমধ্যে পাহাড়ে বিশেষ করে তিনটি পার্বত্য জেলায় ফল চাষ সম্প্রসারণের নানামূখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যে কারণে বিগত দশকে পাহাড়ে ফলের উৎপাদন যথেষ্ট বেড়েছে। বিশেষ করে আমের উৎপাদনে এক অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে। আ¤্রপালি জাতের আম চাষে পাহাড়ে বিপ্লব ঘটেছে, তেমনি হাইব্রিড জাতের পেঁপে রেডলেডি চাষের ক্ষেত্রেও বিপ্লব ঘটেছে। পাহাড়ি অঞ্চলে ফলের চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধির চমৎকার সুযোগকে কাজে লাগাতে হলে আরও কিছু বাস্তবমুখী বিষয় বিবেচনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন-
পাহাড়ি অঞ্চলে ফল চাষ নিয়ে গবেষণা জোরদার করা দরকার। এ অঞ্চলের উপযোগী বিভিন্ন ফল ও আরও বেশি ফলেরজাত উদ্ভাবন করা দরকার। যে পাহাড়ে ও এলাকায় যে ফলের চাষ খুব ভালো হয় সে ধরনের ফল চাষ সম্প্রসারণে জোর দিতে হবে। ভালো হয়, যদি ফ্রুট জোনিং করা যায়। যে ফল যেখানে ভালো হয় সেখানে বেশ কিছুটা এলাকা জুড়ে শুধু সে ফলের বাণিজ্যিক চাষাঞ্চল গড়ে তোলা যায়। এতে সেসব ফলের বাজারজাত করা যেমন সুবিধা হয়, তেমনি সেই ফলভিত্তিক প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলা যায়।
উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য শুধু ফল নয়, ফলের জাত নির্বাচনে গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন আগাম জাত বারি আম ৫ ও নাবি জাত বারি আম ৪ জাতের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে আম প্রাপ্তির সময়কালকে দীর্ঘায়িত করা যেতে পারে। স্থানীয় জাতের জায়গায় যদি উন্নত জাতের কাঁঠাল ‘বারি কাঁঠাল ৩’ জাতটি সম্প্রসারণ করা যায় তাহলে ফলন বাড়তে পারে ৩-৪ গুণ, অসময়েও কাঁঠাল উৎপাদন করে অধিক লাভবান হওয়া যেতে পারে। তেমনি কলা চাষেও আধুনিক জাতের ব্যবহার করা উচিত। বাংলা কলা পাহাড়ে খুব পরিচিত ও জনপ্রিয় জাত। এ জাতের উন্নয়ন ঘটিয়ে উদ্ভাবন করা হয়েছে বারি কলা ৩ জাত। এ জাতের কলা চাষ করে হেক্টর প্রতি ৪০-৫০ টন কলা পাওয়া যেতে পারে যা পাহাড়ে কলা চাষের উৎপাদন বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে।
ফলের উন্নত জাত সমূহের চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সেসব জাতের চার কলম উৎপাদন ও তা সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। সরকারিভাবে হর্টিকালচার সেন্টার সমূহের মাধ্যমে ও বেসরকারি নার্সারি দ্বারা এ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যেতে পারে। ফলচাষিদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও থাকা দরকার।
পাহাড়ে লাগানো ফলগাছ সমূহের আধুনিক নিয়মে ব্যবস্থাপনা করা দরকার। পাশাপাশি উন্নত পদ্ধতিতে ফলগাছ লাগানো ও তার যতœ নেয়া দরকার। ইতোমধ্যে সেখানে যেসব আমগাছ লাগানো হয়েছে তার অধিকাংশই খুব ঘন করে লাগানো। এরূপ বাগানের গাছ কিছু সরিয়ে পাতলা করা উচিত।
পাহাড়ে ফলগাছে সেচ দেয়া এক অন্যতম প্রধান সমস্যা। পাহাড়ে যে বছর এপ্রিলে কম বৃষ্টি হয় বা হয় না সে বছর আম, লিচু ইত্যাদি ফল ঝরা বেড়ে যায়। ক্রমাগতভাবে পাহাড়ি বন উজাড়ের ফলে বৃষ্টি কম হয় ও পাহাড়ের ঝিরিসমূহে পানির সঞ্চয় থাকে না। ফলে ঝিরি বা পাহাড়ের খাদে জমা জলাশয়ের পানি থেকে পাম্প করে ফলগাছে সেচ দেয়া যায় না। এক্ষেত্রে অল্প পানি থাকলেও ড্রিপ সেচ পদ্ধতিতে ফলগাছের গোড়ায় সেচ দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
রোগ ও পোকা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা কৌশল অবলম্বন করা দরকার। আম ও অন্যান্য ফলে ফ্রুট ব্যাগিং করা যেতে পারে। আম ও পেয়ারায় সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করা যায়। সারা বছর ধরে আনারস উৎপাদনের জন্য হরমোন ব্যবহারসহ অন্যান্য ব্যবস্থাপনা কাজ করা যেতে পারে। অসময়ে ফলানো আনারসের দাম বেশি পাওয়ায় তা পাহাড়ি কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে।
ফলের প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তুলতে হবে এবং সেখান থেকে দেশের সব জায়গায় বিক্রির ব্যবস্থা বা নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিতে কাজুবাদাম চাষের ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের বর্তমান অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। কাজুবাদাম দামি ফল। একে প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করলে লাভ বেশি হতে পারে। এ আশায় রাঙ্গামাটিতে প্রক্রিয়াজাত শিল্প স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু সারাবছর সেখানে কাঁচামাল পাওয়া যায় না। তাহলে সে কারখানার শ্রমিকদের কিভাবে ধরে রাখা যাবে, শিল্প সচল কিভাবে থাকবে? তাই শিল্প স্থাপনে সেটা সারা বছর যাতে সচল থাকে এমন বিবেচনা ও পরিকল্পনা করতে হবে।
ফলগাছ থেকে শুধু ফল সংগ্রহ নয়, গাছের বহুমুখী ব্যবহারের দিকেও নজর দেয়া যেতে পারে। যেমন আনারস গাছের পাতা থেকে আঁশ উৎপাদন করে তা থেকে রশি বানানো ও বস্ত্র বয়ন, বিভিন্ন ক্র্যাফট সামগ্রী তৈরি করা যায়। অথচ আনারসের পাতা ফেলে দেয়া হয়।
ফলের উপযুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড় থেকে বাজারে ফল আনার জন্য যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ, সংগৃহীত ফলসমূহ বিক্রির পূর্ব পর্যন্ত তার সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সংগ্রহোত্তর অপচয় কমানো, সংরক্ষণ বা মজুদের যথাযথ সুবিধা গড়ে তোলা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে গুরত্ব দেয়া দরকার। য়
প্রকল্প পরিচালক, আইএফএমসি প্রকল্প, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৮-২০৯১০৭
ড. মো. শহীদুর রশীদ ভ‚ঁইয়া
বাংলাদেশে হরেক রকম ফলের আবাদ করা হচ্ছে এখন। এর মধ্যে যেমন দেশীয় ফল রয়েছে তেমনি আবার বিদেশি ফলও রয়েছে। দেশীয় ফলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফল হলো আম, কাঁঠাল, আনারস, কলা, কুল, পেয়ারা, বেল, জলপাই, তাল, লুকলুকি, আমলকী, জাম আর নানা রকম লেবু। আমাদের দেশে কলা আর পেয়ারা ছাড়া কোনো ফলই সারা বছর পাওয়া যায় না। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে এসব ফলের প্রাপ্তি। বিশেষ করে বৈশাখ থেকে বড় জোর শ্রাবণ মাস পর্যন্ত আমাদের এসব ফলের উৎপাদন হয়ে থাকে। যে কারণে প্রায় সারা বছরই বিদেশ থেকে প্রচুর ফল আমাদের আমদানি করতে হয়। এসব ফল আবার চড়া দামে কিনতে হয়। আমাদের দেশীয় ফলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করতে পারলে একদিকে যেমন উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে পারে অন্যদিকে কেবল মৌসুমে নয় অমৌসুমেও এর কোনো কোনোটা আবাদ উপযোগী হতে পারে।
সত্যি কথা বলতে গেলে আমাদের ফল গবেষণা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বেশ কিছু ফলের জাত অবশ্য গত দশ বছরে অবমুক্ত করা হয়েছে যার বেশির ভাগই দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা উত্তম জাত। ফলের বিভিন্ন জাতের মধ্যে সঙ্করায়ন করা কিংবা ফলে মিউটেশন ঘটিয়ে নতুন জাত উদ্ভাবন করার ঘটনা এ দেশে বেশ বিরল। কেবলমাত্র আমের দু’চারটি জাত উদ্ভাবন ছাড়া অন্যান্য ফলের ক্ষেত্রে আমাদের জাত উন্নয়ন গবেষণা বড় দুর্বল।
ফল গবেষণার কিছু বাড়তি অসুবিধা রয়েছে। এক, ফল গাছ আধিকাংশ ক্ষেত্রে দীর্ঘ দেহী হওয়ায় এদের মধ্যে সঙ্করায়ন করার কাজটি খানিকটা কঠিন। দুই, অধিকাংশ ফল গাছে ফল ধরতে সময় লাগে বলে ফলের জাত উদ্ভাবন করার জন্য সঙ্করায়ন পদ্ধতির দিকে গবেষকগণ কম আগ্রহী হন। আমাদের দেশে ফলের জাত উন্নয়ন গবেষণার আরো কিছু বাড়তি অসুবিধা রয়েছে। এক, ফল গবেষণার সাথে জড়িত গবেষকদের উদ্ভিদ প্রজনন ও আনুষঙ্গিক বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। দুই, যাদের এ বিষয়ক জ্ঞান বেশি রয়েছে পেশাগত প্রতিযোগিতার নেতিবাচক মনোভাবের কারণে তাদের এ বিষয়ক গবেষণা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সজাগ হলে এবং গোষ্ঠীগত পেশার চেয়ে জাতীয় উন্নয়নকে গুরুত্ব দিলে শেষোক্ত সমস্যা ঘটিয়ে ওঠা সম্ভব। আর তা পারলে ফল গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জনের দ্বারও উন্মোচিত হতে পারে। আম আমাদের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ফল ফসল। স্বাদে, গন্ধে, বর্ণে আমের বৈচিত্র্যও আমাদের কম নয়। তাছাড়া আমের নানান আকৃতি ও পাকার সময় কালেও বেশ বৈচিত্র্য রয়েছে। এসব বৈচিত্র্যকে বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন আম জাতে বিদ্যমান উত্তম বৈশিষ্ট্য দেওয়া নেওয়া করার জন্য আমে সঙ্করায়ন করার পদ্ধতি ইতোমধ্যে আমাদের দেশে চালু হয়েছে। আম অঙ্গজ প্রজননক্ষম একটি ফসল বলে সঠিক দু’টি পেরেন্ট জাতের মধ্যে সঙ্করায়ন করে পাওয়া হাইব্রিড গাছের মধ্য থেকে উত্তম হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন খুব কঠিন কাজ নয়। আর একটি- দু’টি উত্তম হাইব্রিড জাত পেলে অঙ্গজ বংশ বিস্তার করে এর গুণাগুণ ধরে রাখা সম্ভব দিনের পর দিন।
হাইব্রিড আম যে উত্তম হতে পারে তার প্রমাণ আম্রপালি, জাতটি। এটি ভারতে উদ্ভাবিত একটি হাইব্রিড আম। এই আম জাতটির আমাদের দেশেও বিস্তার ঘটানো হয়েছে। হাইব্রিড হলেও একেও পেরেন্ট হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের একাধিক জাতের সাথে সঙ্করায়ন করে নেয়া যেতে পারে। অতঃপর তা থেকে সৃষ্ট ভিন্ন রকম আম গাছের মধ্য থেকে উত্তম গাছকে অঙ্গজ বংশ বিস্তার করে রক্ষা করা সম্ভব। আর এর মধ্যেও পাওয়া যেতে পারে উত্তম আম জাত। এভাবে পাওয়া সম্ভব নানা আকার আকৃতি, বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদের আম। কাঁঠাল নিয়ে আমাদের বহুমাত্রিক গবেষণার সুযোগ রয়েছে। কাঁঠালের বিভিন্ন জাতের মধ্যে গুণগত মানের দিক থেকে নানা রকম বৈচিত্র্য রয়েছে। কাঁঠালের আকার আকৃতি, এর বর্ণ এবং দেহের কাঁটার আকার আকৃতি এদের তীক্ষèতায় বেশ পার্থক্য রয়েছে। কোয়ার আকার আকৃতি, এর পেলবতা, স্বাদ, গন্ধ, মিষ্টতার দিক থেকেও কাঁঠালে বিশাল বৈচিত্র্য রয়েছে।
এসব ছাড়া পরিপক্বতার দিক থেকে আগাম, মাঝারি ও নাবি বৈশিষ্ট্যের জন্যও এদের মধ্যে বৈচিত্র্য রয়েছে। ফলে এই বিশাল বৈচিত্র্য থেকে মানুষের চাহিদামাফিক গুণগত মানসম্পন্ন কয়েক রকমের কাঁঠালের জাত বাছাই করে এর চাষ বৃদ্ধি করার দিকে মনোযোগ দেয়ার সুযোগ ও প্রয়োজন দুটোই রয়েছে। এর জন্য উত্তম জাত বাছাই এবং এর বংশ বিস্তারের জন্য চারা উৎপাদন করার বিষয়ে আমাদের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কাঁঠালের টিস্যু কালচার করে চারা উৎপাদনকে আরো সহজতর করতে হবে। কাঁঠাল পর পরাগী ফসল। আশপাশের গাছের পরাগ রেণু উড়ে এসে ফুলের গর্ভমুÐে পতিত হয় বলে এর বীজ থেকে উৎপাদিত কাঁঠাল গাছের কাঁঠালের গুণাগুণ অক্ষত রাখা সম্ভব হয় না। সে কারণে টিস্যু কালচার থেকে কাঁঠালের চারা উৎপাদন সম্ভব হলেও এর উৎপাদন কৌশলকে আরো সহজতর করার গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
পেয়ারারও বেশ কিছু বৈচিত্র্যময় জাত রয়েছে আমাদের। পেয়ারার আকার আকৃতি এর বহিরাবরণ, এর ভেতরকার বীজের পরিমাণ, এর পেলবতা, স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। আমাদের বাজারে দু-তিন রকম জাতের পেয়ারার আধিক্য রয়েছে। তবে দিন দিন বর্ণিল মাংসল পেয়ারা কেবল হ্রাস পাচ্ছে বললে ভুল হবে বরং বিলুপ্তির মুখে পড়েছে বললে সঠিক হবে। বর্ণিল পেয়ারা এন্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ এবং এদের মানবিক বাড়তি আয়রনও রয়েছে। ফলে এসব পেয়ারার জাত সংগ্রহ করে ফিল্ড জিন ব্যাংকে সংরক্ষণ করা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া এখন আমরা পুষ্টির বিষয় বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি বলে বর্ণিল মাংসল পেয়ারার উৎপাদন কৌশল এবং এদের ব্যাপক বংশ বিস্তার ঘটানোর কাজটি করা খুব প্রয়োজন। তাছাড়া বর্ণিল পেয়ারার সাথে আমাদের বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করা সাধারণ পেয়ারার সঙ্করায়ন করা যেতে পারে। এতে ভিন্ন বর্ণের ও মানের পেয়ারার জাত উদ্ভাবনের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
কলা ফসলের জাত উদ্ভাবনে আমাদের গবেষণা হয়েছে সবচেয়ে কম। এর জেনোমিক গবেষণা হয়নি বললেই চলে। পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে নানা রকম পরিপ্লয়েড কলার জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে আন্তঃজাত সঙ্কয়ায়নের মাধ্যমে। এর ফলে কেবল যে নানা আকৃতির ও গুণমান বিশিষ্ট ফল উৎপাদিত হচ্ছে তাই নয় বরং রোগসহিষ্ণু জাতও পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। আমাদের পাহাড়ের কোনো কোনো কলা প্রজাতি রোগ ও কীটপতঙ্গ সহনশীল। এর অন্য বৈশিষ্ট্য উত্তম না হলেও এসব বৈশিষ্ট্য আমাদের আবাদি কলা জাতে স্থানান্তর করা যেতে পারে। সারা বছর ভিন্নতর স্বাদ বিশিষ্ট কলার জাত পেতে হলে কলার প্রজনন বিষয়ক গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। এক বছর দু’বছরেই ফল ধরে বলে কলা প্রজনন করাই যেতে পারে।
লেবুর ভালো বৈচিত্র্য রয়েছে আমাদের। নরসিংদী এলাকায় কলম্বো লেবু তো বিদেশেও রপ্তানি হয়। উত্তম চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারলে এর উৎপাদন বৃদ্ধি করা যেতে পারে। লেবুতে আমাদের পাহাড়ে দু-একটি বীজহীন লেবুর সন্ধান পাওয়া গেছে। দু’ভাবে এই লেবুকে কাজে লাগানো যায়। এক, অঙ্গজ বংশবিস্তারক্ষম এই লেবু জাতের অঙ্গজ উপায়ে চারা উৎপাদনকে উৎসাহিত করে বীজহীন লেবুর উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় যেমন পাহাড়ে তেমনি সমতল ভ‚মিতেও। দুই, বীজহীন লেবুর এই বৈশিষ্ট্যটি আমাদের অন্য লেবুতে স্থানান্তর করে গবেষণা চালানো যায় অবশ্যই। এর জন্য অবশ্যই প্রজননবিদের কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে ফল গবেষণা কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টির মাধ্যমে। প্রকৃত প্রজনন বিদদেরকে কাজ করার পরিবেশ দিতে পারলে বাংলাদেশেও তৈরি হতে পারে বৈচিত্র্যময় সব লেবুর জাত। তাছাড়া লেবুর কিছু রোগ বালাই বা কীট পতঙ্গ ব্যবস্থাপনা কৌশল উদ্ভাবনের জন্যও গবেষণা চলতে পারে।
বেল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফল। গুণেমানে এর তুলনা হয় না। বেল ফসলের জাতের মধ্যেও আমাদের বেল মানবিক জীববৈচিত্র্য এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। গাজীপুরের বেল তো এ দেশের এক বিখ্যাত সম্পদ। বিশালকৃতি, কম বীজ ও চমৎকার স্বাদ গন্ধসমৃদ্ধ এই বেলজাত আমাদের বেল উন্নয়নের পেরেন্ট স্টক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আমাদের দেশে অনেক ছোট বেল জাতও রয়েছে যাদের আঁশ কম আবার স্বাদ ও গন্ধও উত্তম। যদিও অধিকাংশ স্থানীয় বেল জাতগুলোর মান সন্তোষজনক নয়। বেলের বংশ বিস্তারের জন্য টিস্যু কালচার প্রণীত প্রটোকল উদ্ভাবন করা গেলে দেশে এ বেলের ব্যাপক প্রসার ঘটানো সম্ভব। এর টিস্যু কালচার কঠিন হবে তবে গবেষণা চালিয়ে গেলে তা অসম্ভব হওয়ার কোনো কারণ নেই।
আমাদের পানি ফলেরও অনেক বৈচিত্র্য রয়েছে। ফলের আকারে এরা ছোট, বড় ও মাঝারি তিন রকম রয়েছে। রয়েছে এদের ফলে বীজ ঘনত্বের তারতম্যও। কোনো কোনো জাতের বীজের গন্ধ এবং স্বাদ বেশ মন কাড়ে। ভীষণ আয়রন সমৃদ্ধ এই ফল। সরাসরি বড় জাতের বংশ বিস্তার করে এবং বড় জাতের বৈশিষ্ট্য অন্য জাতে স্থানান্তর করে পানিফলের চাষ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
তালের ক্ষেত্রে আমাদের কোন গবেষণাই বাস্তবে হয়নি। তালেরও স্বাদে গন্ধে বেশ পার্থক্য রয়েছে। তাল এক লম্বা সময়ের ফলন। তালগাছ পুরুষ না স্ত্রী হবে এটি জানতেও অপেক্ষা করতে হয় কত বছর। আনবিক কৌশল ব্যবহার করে আগাম তালগাছের লিঙ্গ নির্ধারণ করার গবেষণা চালানো দরকার। তাহলে স্ত্রী লিঙ্গিক চারা লাগিয়ে লাভবান হওয়ার বিস্তর সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
ফল ফসলের জাত উদ্ভাবন গবেষণার পাশাপাশি উদ্ভাবিত জাতসমূহের আবাদ প্রযুক্তি সম্পর্কিত গবেষণাও গুরুত্বপূর্ণ। নতুন উদ্ভাবিত জাতের চাষাবাদ পদ্ধতি, এদের রোগ ও পোকামাকড় দমনসহ ফলের সংগ্রহ পরবর্তী ব্যবস্থাপনাজনিত গবেষণা নতুন জাতের সফলতা অর্জন করার জন্যই আবশ্যক। তাছাড়া ফল ফসলের চারা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবনও এক জরুরি বিষয়। কম দামে অল্প স্থানে উত্তম চারা উৎপাদন ফলের জাত প্রসারের জন্য এক আবশ্যক বিষয়। ফলের উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন ও এদের আধুনিকায়নের গবেষণা দেশে চলছে। অধিকাংশ ফল যেহেতু কোনো রকম প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়াই সরাসরি বপন করা হয় বলে রাসায়নিক বালাইনাশকের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিতে ফল চাষকে উৎসাহিত করার জন্যও গবেষণা প্রয়োজন। বিশেষ করে সমন্বিত বালাইনাশক এবং বীজ বালাইনাশক ব্যবহার উৎসাহিত করার জন্য গবেষণা কর্মকাÐে জোর দেয়া দরকার। য়
প্রফেসর জেনিটিকস অ্যান্ড প্লান্ট ব্রিডিং বিভাগ, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা। রঢ়নংপঋপ২০০৯@মসধরষ.পড়স ০১৭৫৮৯৩৫২৬৪
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মহসীন
ফল মানবজাতির জন্য প্রকৃতির অমূল্য উপহার। বন্য পরিবেশ থেকে আদিম মানুষ যখন স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে তখন তাদের পছন্দের প্রথম খাবার ছিল ফল। বাংলাদেশের গ্রীষ্ম ও অবগ্রীষ্মমÐলীয় আবহাওয়া ফল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। দেশের উৎপাদন বিবেচনায় গ্রীষ্মকাল হলো ফলের মৌসুম। প্রায় ৭০ রকমের ফল জন্মে থাকে এ দেশে; যে সব আবাদি ফল উৎপাদিত হয় তার প্রায় ৫৪% বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ও শ্রাবণ এ চার মাসেই পাওয়া যায়। এ সময় আম, কাঁঠাল, জাম, লিচু, তরমুজ, বাঙ্গি, আনারস, আমলকী, আতা, করমচা, জামরুল, বেল, গাব, কাঁচা তালসহ আরো অনেক ফল পাওয়া যায়। বাকি ৪৬% ফল পাওয়া যায় অন্য ৮ মাসে। তখন ফলের সরবরাহ চাহিদার তুলনায় অনেক কম থাকে। কলা সারা বছরই পাওয়া যায়। পেয়ারাও প্রায় সারা বছরের ফল হয়ে গেছে। ভিটামিন, খনিজ পদার্থ এবং আঁশসমৃদ্ধ কিছু ফল বাংলাদেশে সহজেই উৎপাদন হয়, যেমনÑ নারিকেল, আমড়া, কুল, বরই, মাল্টা, কমলা, আমলকী, কামরাঙা, জাম্বুরা, বিলিম্বি, ডালিম, তাল, লটকন, কদবেল, অরবরই, চুকুর, করমচা, কাউ, সফেদা, কাঠলিচু, সাতকরা, গন্ধরাজ লেবু, কাগজি লেবু, জারা লেবু, গোলাপজাম, চালতা, টিপা ফল, ডেউয়া, ডুমুর, ডেফল, নোনা, ফলসা, আঁশফল, বেতফল, বৈঁচি, পানিফল, লংগান, আতা, শরিফা ইত্যাদি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, বাংলাদেশের মানুষের দানাজাতীয় শস্য গ্রহণের পরিমাণ ৪১৬ গ্রাম থেকে নেমে এসেছে ৩৬৭ গ্রামে, আবার মাথাপিছু ফল গ্রহণের পরিমাণও বেড়েছে, যা ইতিবাচক (তথ্যসূত্র. চৎবষরসরহধৎু ৎবঢ়ড়ৎঃ ড়হ ঐড়ঁংবযড়ষফ ওহপড়সব ধহফ ঊীঢ়বহফরঃঁৎব ঝঁৎাবু-২০১৬, ঐওঊঝ ২০১৬)।
ফল গ্রহণের পরিমাণ, নিচের ছক থেকে সহজই পাওয়া যায় (গ্রাম/মাথাপিছু/প্রতিদিন)-
সূত্র : ঐওঊঝ-২০১৬, ইইঝ
দেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় কৃষি ক্ষেত্রের অবিশ্বাস্য উন্নতি হয়ে যা বিশ্বে দৃষ্টান্ত। মাত্র ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই উন্নয়নশীল দেশটিতে এখন ১৬ কোটিরও বেশি লোকের বসবাস। যা কিনা সমগ্র বিশ্বে এক বিরল উদাহরণ। এ দেশেই সবচেয়ে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জিত হয়েছে কৃষি খাতে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও ক্রমহ্রাসমান কৃষিজমির বিপরীতমুখী চাপ সত্তে¡ও বাংলাদেশের বর্তমান খাদ্যশস্য উৎপাদন ১৯৭২-৭৩ সালের তুলনায় প্রায় চার গুণ বেড়েছে। ফলের উৎপাদনও সমানতালে এগিয়ে চলেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বৈশ্বিক কৃষি উৎপাদন বিষয়ক প্রতিবেদন হতে জানা যায় যে, বিশ্বে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে আছে। মোট ফল উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বে ২৮তম স্থানে আছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব মতে, দেশে আম, কাঁঠাল, কলা, লিচু, পেয়ারা ও আনারসের মতো দেশি ফল উৎপাদন দ্রæত হারে বাড়ছে। সংস্থাটির ২০১৫ সালের প্রধান ফসলের পরিসংখ্যান বিষয়ক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশে বর্তমানে ১৮ প্রজাতির ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে এবং উৎপাদনও বাড়ছে। বিবিএস এর হিসাবে গত বছরগুলোতে দেশে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়েছে পেয়ারার। যার প্রভাব এবার বাজারেও পাওয়া গেছে। এই ফলটি এবার সারা বছর পাওয়া গেছে। বলা যায় পেয়ারা চাষে দেশে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বা ডিএই’র হিসেবে দেশে ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রতি বছর ফল উৎপাদন প্রায় ৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। আম, পেয়ারা ও কুল বা বরইয়ের বেশ কয়েকটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা গত পাঁচ বছরে ৮৪টি ফলের নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন। ডিএই এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রমের ফলে হেক্টরপ্রতি ফলন আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। বারি-৩ আম বা আম্রপালির মতো জাতগুলো দেশের তিন পার্বত্য জেলায় ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। থাই পেয়ারা ও বারি-৮ জাতের পেয়ারার সম্প্রসারণ ব্যাপকভাবে হয়েছে বলেই দেশে ফলের উৎপাদন প্রতি বছর প্রায় ৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। গত আট বছরে আম, কাঁঠাল, কলা, লিচু, পেয়ারা ও আনারসের মতো দেশি প্রচলিত ফলের পাশাপাশি অপ্রচলিত ফল উৎপাদনও দ্রæতহারে বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। বিবিএস এর প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে ১৮ প্রজাতির ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে এবং উৎপাদন বাড়ছে।
বিবিএসের হিসাবে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে প্রায় ২ লাখ টন লিচু, ৪ লাখ ৭০ হাজার টন পেঁপে, ৪০ হাজার টন কমলা, ৩ লাখ ৭০ হাজার টন আনারস ও ১ লাখ ৫৫ হাজার টন কুল উৎপাদিত হয়েছে। আর মোট ফল উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ১ কোটি টন। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে বর্তমানে ৪৫ প্রজাতির ফল বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে মোট ১ কোটি টন ফল উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেড়েছে আমের উৎপাদন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে আম উৎপাদিত হয়েছিল ১২ লাখ ৫০ হাজার টন। আর এ বছর তা বেড়ে ১৫ লাখ টন ছাড়িয়েছে।
উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৯৬-২০০১, ২০০৯-২০১৪ এবং ২০১৪ থেকে চলমান তৃতীয় মেয়াদ অবধি তার দূরদর্শী নেতৃত্বে গঠিত সরকার বাস্তবসম্মত কৃষিনীতি এবং তদানুযায়ী বাজেটসহ অন্যান্য কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছে। দেশকে কৃষি উন্নয়নের জন্য বিশ্বে এক রোল মডেল হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের প্রথম (১৯৯৬-২০০১) মেয়াদেই কৃষিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন দেশের আরেক মাটি মানুষের রাজনীতিক ও বাংলার অগ্নিকন্যা খ্যাত মতিয়া চৌধুরীকে। তিনি তার সততা, জ্ঞান, মেধা, দক্ষতা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়নে সমর্থ হন। সেই সঙ্গে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপন্ন করে দেশকে দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সমর্থ হন।
বর্তমান সরকারের দূরদর্শী নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনায় দেশে ফলের প্রচুর সরবরাহ আছে বলেই জনসাধারণ ইচ্ছামতো ফল খেতে পারছেন। কিন্তু প্রতিদিন যে পরিমাণ ফল খাওয়া দরকার সে পরিমাণ ফল প্রকৃতপক্ষে দেশের সব মানুষ খাচ্ছেন না। বিশেষ করে শিশু ও কিশোরদের ফাস্টফুড বা কৃত্রিম জুসের প্রতি আসক্তি অনেক বেশি। যার জন্য পুষ্টিহীনতায় বা স্থুলতায় ভুগছে উল্লেখযোগ্য নাগরিক।
খাদ্য গ্রহণের প্রধান উদ্দেশ্য হলো সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম হয়ে বেঁচে থাকা। যে কোনো খাবার দিয়ে পেট ভরানো যায় সত্য কিন্তু এতে দেহের পুষ্টির চাহিদা সম্পূর্ণভাবে পূরণ হয় না, যার ফলে শিশুকালে শিশুরা সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। মানুষের খাদ্যকে মূলত তাপ ও শক্তিদায়ক, শরীর বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরক এবং রোগ প্রতিরোধক এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। ফলকে রোগ প্রতিরোধক খাদ্য বলা হয়। ফল আমাদের শরীরে রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তোলে। ফলের মধ্যে রয়েছে দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদন। বিশেষত বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের সবচেয়ে সহজ ও সস্তা উৎস হলো ফল। ফল রান্না ছাড়া সরাসরি খাওয়া যায়। আবার এসব পুষ্টি উপাদান অবিকৃত অবস্থায় দেহ কর্তৃক গৃহীত হয়, যা বিভিন্ন রোগের হাত থেকে রক্ষা করে স্বাভাবিক জীবনযাপনে মানুষকে সহযোগিতা করে।
শরীরে পুষ্টি উপাদান পাওয়ার অন্যতম প্রাকৃতিক উপায় হচ্ছে ফল খাওয়া। এ জন্য প্রতিদিন এ দেশের প্রতিজন লোকের ফল খাওয়া দরকার ২০০-২৫০ গ্রাম। কিন্তু গড়ে খাওয়া হচ্ছে মাত্র ৩৫-৪০ গ্রাম। অর্থাৎ প্রয়োজনের তুলনায় ফল গ্রহণের পরিমাণ অনেক কম। এই কম খাওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। প্রকৃত কারণ পুষ্টি জ্ঞানের অভাব। দৈনিক ১০০-১৫০ গ্রাম করে ফল খাবার মতো পর্যাপ্ততা দেশে আছে। শুধু পুষ্টি সম্পর্কে উদাসীনতার কারণে ফল গ্রহণের পরিমাণ কম। ফলশ্রæতিতে শুধু ভিটামিনের অভাবে দেশের মানুষ অনেক ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পরিসংখ্যানে জানা যায়, যেমন ভিটামিন এ’র অভাবে ৮৮%, সি’র অভাবে ৮৭% বি’র অভাবে ৯৬%, ক্যালসিয়ামের অভাবে ৯৩% লোক প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো এসব ভিটামিনের অভাবজনিত রোগে ভুগছে। দেশের ৭০% পুরুষ এবং ৭৫% মহিলা আয়রন স্বল্পতায় ভুগছে। মহিলাদের মধ্যে জিংক স্বল্পতা ৫৭.৩০% এবং পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের জিংক স্বল্পতা ৪৪%। এসব রোগ থেকে সহজেই মুক্ত থাকা যায় নিয়মিত ফল গ্রহণ করলে। তবে ফল খাওয়ারও নিয়ম আছে, যা মেনে চলতে পারলে দেহ বেশি পুষ্টি উপাদান শোষণ করতে পারে।
ড. স্টিফেন কার লিওন গবেষণা করে দেখেছেন যে, যে কোনো প্রধান আহারের আগে ফল খেলে বেশি পুষ্টি উপাদান শোষিত হয়। আমাদের দেশে উৎপাদিত ফলগুলো পুষ্টিগুণে ভরপুর। আমরা যদি পুষ্টি শিক্ষায় ভালোভাবে শিক্ষা পেতে পারি তবে যে পরিমাণ ফল আমাদের দেশে উৎপাদন হয় বা উৎপাদনের সক্ষমতা আছে তা উৎপাদন করে সঠিক ব্যবস্থাপনা ও বাজারজাত করতে পারলে জনপুষ্টি অনেকখানিই পূরণ হতে পারে। এর ফলে উপযুক্ত মেধাসহ পরিপূর্ণ কর্মক্ষম মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে সকলে এবং দেশ পাবে সবদিকে শক্তিশালী এক জাতি। য়
মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
প্রফেসর ড. এম. এ. রহিম১ ড. মোঃ শামছুল আলম (মিঠু)২
ফল হলো নিষিক্ত ও পরিপক্ব ডিম্বাধার। অন্য কথায় ফল বলতে আমরা অনেকেই বুঝি আম, জাম, পেয়ারা, কলা, পেঁপে, কাঁঠাল। এসব ফল দেশের প্রায় সব এলাকাতে জন্মে। এসব ফলকে তাই আমরা বলি প্রচলিত ফল। এসব ফলের বাইরেও অনেক ফল পাওয়া যায়। এসব ফলকে বলা হয় অপ্রচলিত বা স্বল্প পরিচিত ফল। অর্থাৎ এসব ফলের অস্তিত্ব আছে, খুঁজলে পাওয়া যায় কিন্তু যখন তখন চোখে পড়ে না, দেশের সব এলাকায় জন্মে না, গাছের দেখা মেলে খুব অল্প। অনাদিকাল ধরে যেসব ফল এদেশে চাষ হয়ে আসছে সেগুলোই আমাদের দেশি ফল। এ পর্যন্ত এ দেশে মোট ১৩০টি দেশি ফলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৬০টি বুনো ফল। তবে সেসব ফলও যথেষ্ট পুষ্টিসমৃদ্ধ ও সুস্বাদু। বাকি ৭০টি ফলের মধ্যে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, নারিকেল, লিচু, কুল, লেবু, আনারাস, কলা ও পেঁপে এই ১০টি এ দেশের প্রধান দেশি ফল।
কিন্তু বিদেশি ফল কোনগুলো? সহজে উত্তর হলো- যেসব ফলের উৎপত্তি ও চাষ এ দেশের ভ‚খÐে বা এ অঞ্চলে নয়, বিদেশেই সেসব ফলের উৎপত্তি ও বাণিজ্যিক ভাবে চাষাবাদ করা হয়, সেসব ফলকে আমরা বিদেশি ফল বলতে পারি। তর্কটা সেখানেই, ফল তো দেশ চেনে না। তার উপযুক্ত জলবায়ু ও মাটি যেখানে, সেখানে সে জন্মে থাকে। সে অর্থে যেসব ফলের উৎপত্তি আমাদের অঞ্চলে, সেসব ফলের সংখ্যা খুবই কম। অধিকাংশ ফলই হাজার হাজার বছর পূর্বে অন্যান্য দেশ থেকে এ দেশে এসে খাপ খাইয়ে নিয়েছে এবং কালক্রমে সেগুলো আমাদের ফলে পরিণত হয়েছে। সব বিদেশি ফল আবার এ দেশে ভালো ফল দেয় না। আবার এমন অনেক বিদেশি ফল আছে যেগুলো বাংলাদেশে সার্থকভাবে চাষ করা সম্ভব। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, এ ফলগুলোর পরিবেশিক চাহিদার সাথে বাংলাদেশের জলবায়ুর কোন মিল নেই কিন্তু সৌভাগ্যবশত এ ফলগুলোর এমন অনেক জাত আছে যা বাংলাদেশের জলবায়ুতে সাফল্যের সাথে জন্মানো সম্ভব। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত অনেকগুলো বিদেশি ফল প্রবর্তন করা হয়েছে। তারমধ্যে অ্যাভোকেডো, ম্যাঙ্গোস্টিন, স্ট্রবেরি, কিউই, রাম্বুটান, লংগান, ল্যাংসাট, জাবাটিকাবা, শান্তল, আপেল, পিচফল, আলুবোখারা, পার্সিমন, এগ ফ্রুট, সাওয়ার সপ, নাশপাতী, প্যসন ফ্রুট, ড্রাগন ফ্রুট এবং ডুরিয়ান অন্যতম। এদের মধ্যে কিউই, আপেল ও ডুরিয়ান ছাড়া প্রায় সব ফলই এদেশে গবেষণা প্রতিষ্ঠান গুলোত কমবেশি হচ্ছে এবং কোন কোনটা থেকে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যাচ্ছে। যা দেখে অনেকে কিছু কিছু ফলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ শুরু করেছে এবং কিছু ফলের বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করার চিন্তা-ভাবনা করছে। এ দেশে প্রবর্তনকৃত কিছু বিদেশি ফলের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো-
ড্রাগন ফল : ড্রাগন ফলের (ঐুষড়পবৎবঁং ংঢ়.) উৎপত্তিস্থল সেন্ট্রাল আমেরিকা। বাংলাদেশে এ ফল ২০০৭ সালে প্রথম প্রর্বতন করেন। এ সেন্টারের পরিচালক প্রফেসর ড. এম. এ. রহিম এ ফলের জাত নিয়ে আসেন থাইল্যান্ড, ফ্লোরিডা ও ভিয়েতনাম থেকে। ড্রাগন ফল এ দেশের জলবায়ু ও মাটিতে দারুণভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এখন এ সেন্টার থেকে এ ফলটি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বংশ বিস্তার করা হচ্ছে। এ সেন্টার থেকে ড্রাগন ফলের ৪টি জাত (বাউ ড্রাগন ফল-১; বাউ ড্রাগন ফল-২; বাউ ড্রাগন ফল-৩ ও বাউ ড্রাগন ফল-৪) জাতীয় বীজ বোর্ড থেকে নিবন্ধন করেছে এবং সেখান থেকে তারা চারা তৈরি ও স¤প্রসারণ করছেন। স¤প্রসারণের কাজ গুলো বিভিন্ন বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অসংখ্য বংশানুক্রমিক (চঊউওএজঊঊ) মাতৃগাছ কৃষকের দোরগোড়ায় স¤প্রসারণ করছে। বংশীয় মাতৃগাছের ক্ষেত্রে এ সেন্টরটি এদেশের মানুষের কাছে অতি পরিচিত, অনন্য। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) থেকে নিবিড়ভাবে গবেষণার ফলে বারি ড্রাগন ফল -১ নামে ১টি জাত নিবন্ধন করেছে। ড্রাগন ফলের বেশ কিছু জার্মপ্লাজম জনাব কামরুজ্জামান, সাবেক বছরব্যাপী ফল উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক, কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর এর মাধ্যমে নাটোরের মডার্ন হর্টিকালচার সেন্টারে সংগ্রহ করেছে এবং সেখান থেকে তারা চারা তৈরি ও স¤প্রসারণ করছেন।
স্ট্রবেরি : স্ট্রবেরি মূলত যেখানে শীতকাল মৃদুভাবাপন্ন ও গ্রীষ্মকাল শুষ্ক সেখানে স্ট্রবেরি ভালো জন্মে। কিন্তু বর্তমানে অনেক উষ্ণমÐলীয় জাত উদ্ভাবিত হওয়ায় নাতিশীতোষ্ণ ও উষ্ণমÐলেও এর চাষ হচ্ছে। উষ্ণমÐলীয় জাতগুলি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় সাফল্যজনকভাবে জন্মানো সম্ভব। প্রাথমিক পরীক্ষায় বাংলাদেশে এর চাষ সফল হয়েছে। স্ট্রবেরির ফল দেখতে কিছুটা লিচুর মতোই কিন্তু আকারে ছোট। স্ট্রবেরির কিছু জাত এ দেশের জলবায়ু ও মাটিতে ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে বলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাবি স্ট্রবেরি-১; রাবি স্ট্রবেরি-২ ও রাবি স্ট্রবেরি-৩ নামে ৩টি জাত নিবন্ধন করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) থেকে বুদ্ধিদীপ্ত গবেষণার ফলে বারি স্ট্রবেরি-১ নামে ১টি জাত ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে বাউ স্ট্রবেরি-১ নামে ১টি জাত নিবন্ধন করেছে। উক্ত জাতগুলো এদেশের বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করা হচ্ছে।
রাম্বুটান : রাম্বুটান দক্ষিণ-পূর্র্ব এশিয়ার একটি অন্যতম প্রধান ফল। একে অনেকে ঐধরৎু খরঃপযর আবার অনেকে য়ঁববহ ড়ভ ভৎঁরঃং বলে থাকেন। ফলটি দেখতে লিচুর মতোই কিন্তু খোসার উপর খয়েরি রঙের লম্বা লম্বা লোম থাকে। ইহা একটি অত্যন্ত সুস্বাদু ও মুখরোচক ফল। রাম্বুটানের আদি জন্মস্থান সম্ভবত মালয়দ্বীপ অথবা থাইল্যান্ডে। শীতকালে মৃদু শীত অথবা প্রায় সারা বছরই উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু বিদ্যমান এমন স্থানে রাম্বুটান সবচেয়ে ভালো জন্মে। বাংলাদেশের জলবায়ুতে সার্থকভাবে রাম্বুটানের চাষ করা সম্ভব। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে বাউ রাম্বুটান-১ নামে ১টি জাত নিবন্ধন করেছে। উক্ত জাতটি এদেশের বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করার জন্য বীজ, গুটিকলম, জোড়কলম ও কুঁড়ি সংযোজনের মাধ্যমে এর বংশবিস্তার করা হচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এর উপর গবেষণা চলছে। কিছু ব্যক্তিগত নার্সারিতে ও ব্যক্তি উদ্যোগে এ ফলের সংগ্রহ কাজ চলছে। এ ছাড়া ধোবাউড়া উপজেলায় ডা. ওসমান সাহেবের বাড়িতে একশটি বড় রাম্বুটানের গাছ আছে সে গাছ থেকে ফল ও হচ্ছে। তবে সে ফলের বীজ বড় ও ফলের আকার ছোট।
অ্যাভোকেডো : অ্যাভোকেডো একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর ফল। এ ফলটির বিশেষ আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এতে শর্করার পরিমাণ কম অথচ তেলের পরিমাণ অনেক বেশি। তাই অনেকে একে মাখন ফল বলে থাকেন। পুষ্টি সমস্যা নিরসনেএ ফল উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারবে। এ ফলে প্রায় ৮৮% চর্বি থাকে কিন্তু কোলেস্টেরল মুক্ত। মধ্য আমেরিকা অ্যাভোকেডোর আদি জন্মস্থান। বর্তমানে বাংলাদেশে অ্যাভোকেডোর গাছ প্রথম প্রবর্তন হয় মধুপুরের জলছত্র মিশনের তৎকালীন একজন ফাদারের মাধ্যমে। বর্তমানে চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও অন্যান্য পার্বত্য এলাকায় সীমিত আকারে এর চাষ হচ্ছে।
কাজুবাদাম : কাজুবাদাম একটি ‘নাট’ জাতীয় ফল। অনেকে এটিকে ফল না বলে বাদাম বলতে অধিক পছন্দ করেন। আসলে বাদামও এ ধরনের নীরস ফল। বর্তমানে এ ফলটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের উঁচু অঞ্চলে সীমিত আকারে উৎপাদিত হচ্ছে। কাজুবাদামকে একটি অর্থকরী ফসল হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। বৃক্ষ জাতীয় ফলের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কাজুবাদামের স্থান তৃতীয়। দক্ষিণ আমেরিকা (ব্রাজিল) কাজুবাদামের আদি জন্মস্থান। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে বাউ কাজুবাদাম -১ নামে ১টি জাত নিবন্ধন করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ভালো জাত অবমুক্ত করার জন্য নিবিড়ভাবে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে ।
আঙ্গুর : আঙ্গুর পৃথিবীর প্রাচীনতম ফলসমূহের মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর বেশিরভাগ মদ তৈরি করা হয় আঙ্গুর থেকে। আঙ্গুর ফল সবার কাছেই সুপরিচিত এবং সমাদৃত। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সীমিত আকারে নি¤œ মানের আঙ্গুর উৎপন্ন হয়ে থাকে। নওগাঁ জেলায় একজন কৃষক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আঙ্গুর চাষ শুরু করেছে। বর্তমানে পৃথিবীর অনেক উষ্ণমÐলের দেশেই উৎকৃষ্ট মানের আঙ্গুর উৎপন্ন হচ্ছে। সে দিক থেকে বাংলাদেশে উৎকৃষ্ট মানের আঙ্গুর চাষের প্রচুর সম্ভাবনা হয়েছে। বাংলাদেশে এখনও কোন আঙ্গুরের জাত নেই।
ম্যাঙ্গোস্টিন : ম্যাঙ্গোস্টিন এমন একটি ফল যা স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয়। তাই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় একে অনেকে ফলের রানী বলে আখ্যায়িত করেছেন। ম্যাঙ্গোস্টিনের আদি জন্মস্থান হচ্ছে মালয়েশিয়া। বাংলাদেশে সাফল্যজনকভাবে এর চাষ করা সম্ভব। সুনিষ্কাশিত গভীর দোঁআশ মাটি এর জন্য সবচেয়ে উপযোগী, তবে যেকোন মাটিতেই ম্যাঙ্গোস্টিন চাষ করা যায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টারে একটি গাছে এই বছর সর্ব প্রথম ফল ধরেছে। শীতের শেষে ফুল ফোটে ও বর্ষাকালে ফল পাকে। ফল গোলাকার, দেখতে দেশি গাবের মত। পাকা ফলে সাদা রসাল কোয়া থাকে এবং সহজেই ফল থেকে খোসা ছাড়ানো যায়। ফলের ভক্ষণযোগ্য প্রতি ১০০ গ্রামে ২১ কিলোক্যালরি শক্তি, ১.৩ ভাগ আমিষ, ৪.৮ ভাগ শর্করা, ০.৩ ভাগ খনিজ লবণ, ১২ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম ও সামান্য পরিমাণ ভিটামিন সিও ক্যারোটিন থাকে।
ডুরিয়ান : ডুরিয়ানের বৈজ্ঞানিক নাম উঁৎরড় ুরনবঃযরহঁং গঁৎৎ। ইহা ইড়সনধপধপবধব পরিবারভুক্ত। ইহা মাঝারি থেকে বৃহৎ আকারের চিরহরিৎ বৃক্ষ। ফল দেখতে অবিকল একটি ক্ষুদ্রকার কাঁঠালের মতো, কিন্তু ফলের কাঁটা দীর্ঘ ও খুবই শক্ত। পাকা ফলে চাপ দিলে খোসা লম্বালম্বি পাঁচটি খÐে আলাদা হয়ে যায়। ভেতরে মাত্র কয়েকটি বড় কোয়া থাকে। সাধারণত বীজ দিয়ে ইহার বংশবিস্তার করা হয়, তবে অঙ্গ (ইনাচিং) ও কুড়ি (ফর্কাট) সংযোজন করেও চারা তৈরি করা যায়। বীজের চারা রোপণের ৮-১০ বছর পর ফল ধারণ করে। কোন কোন গাছ পরাগায়নের ব্যাপারে স্ব-অসঙ্গত, এজন্য এক সাথে একাধিক জাতের গাছ লাগানো উচিত। বাংলাদেশে ডুরিয়ান নিয়ে গবেষণা চলছে কিন্তু এখনও কোন সফলতা আসেনি।
নাশপাতি : শীত প্রধান জলবায়ুর ফল। সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলে অতি সীমিত আকারে ইহার চাষ হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে নাশপাতি জন্মানো সম্ভব হয়েছে যদিও ইহার ফলন বা ফলের মান খুব সন্তোষজনক হয়নি। সিলেটে যে জাতের চাষ হয় তা সম্ভাবত চ. শযধংরধহধ প্রজাতির, ইহা অনেকটাা বুনো ধরণের, ফল নাশপাতি আকৃতির।
পার্সিমন : জাপানের দক্ষিণাঞ্চল ও চীন পার্সিমনের উৎপত্তিস্থান। ইহা জাপানের অন্যতম প্রধান ফল। আমাদের দেশের গাব একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। পার্সিমনের গাছ একটি পত্রমোচক মাঝারি আকারের বৃক্ষ, ফল দেখতে টমেটোর মতো, পাকা অবস্থায় হলুদ বা কমলা, ফুলের বৃত্তি স্থায়ীভাবে ফলের সাথে সংযুক্ত থাকে। ইহার কোন কোন জাতের গাছ কেবলমাত্র স্ত্রীফুল (ঢ়রংঃরষষধঃব পড়হংঃধহঃং)। কোন কোনটা কেবলমাত্র পুরুষ ফুল (ংঃধসরহধঃব পড়হংঃধহঃং) এবং অন্যান্যগুলো পুরুষ ও স্ত্রী (ংঃধসরহধঃব ংঢ়ড়ৎধফরপং) উভয় প্রকার ফুল উৎপাদন করে। সব জাতেই বিশেষ ধরনের আবহাওয়ায় বীজ হীন ফল উৎপাদন করে। বাংলাদেশে জুলাই-সেপ্টেম্বরে ফল পাকে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টারে ৩টি বড় গাছ আছে,যা থেকে ২০১০ সাল থেকে ফল দিচ্ছে।
প্যাশন ফল : গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক জায়গাই এখন শৌখিন ফলচাষি টবে, বাড়িতে ও নার্সারির মালিকরা সীমিত আকারে প্যাশন ফলের চাষ করছেন। পাকা ফল কেটে পানি-চিনিতে শরবত করে খাওয়া যায়। প্যাশন ফলের শরবতের স্বাদ ‘ট্যাং’ ড্রিংকসের মতো। সেজন্য প্যাশন ফল এ দেশে ধীরে ধীরে ‘ট্যাং ফল’ অর্থাৎ শরবতি ফল নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। লতানো বর্ষজীবী এ গাছটি তার অবলম্বনকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে যে, তার জন্য বিজ্ঞানীরা এ ফলের নাম দিয়েছেন ‘প্যাশন ফল’। এ ফলের উৎপত্তি দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন অঞ্চলে, বিশেষ করে ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে ও উত্তর আর্জেন্টিনাতে এর ফলের আদি নিবাস বলে ধারণা করা হয়।
রুটিফল : ব্রেড ফ্রুট (ইৎবধফ ভৎঁরঃ) ফলের বাংলা নাম দেয়া হয়েছে রুটি ফল। আঠারো শতকের শেষ দিকে বৃটিশ নাবিকেরা দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের তাহিতি দ্বীপ থেকে রুটি ফলকে এ উপমহাদেশে নিয়ে আসেন। তাহিতির লোকেরা তখন রুটিফলকেই প্রধান খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত। এখনো বেশ কিছু দেশে রুটি ফল প্রধান খাদ্য। এ ফল থেকে রুটি তৈরি করে খাওয়া হয় বলেই এরূপ নাম। ১৯৮২ সালে সার্ক মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে যোগ দেয়ার সময় শ্রীলংকার কৃষিমন্ত্রী শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে রুটি ফলের কয়েকটি চারা এ দেশে নিয়ে আসেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট চত্বরে সেগুলো লাগানো হয়েছিল। এখন সেসব গাছে দিব্যি ফল ধরছে। রুটি ফলের আর একটি বড় গাছ আছে আসাদগেটে, হর্টিকালচার সেন্টারে। সে গাছেও নিয়মিত ফল ধরেছে। কুমিল্লার কোর্টবাড়িতে অবস্থিত বার্ড এ ব্রেডফ্রুট এর ফল পাওয়া যাচ্ছে। রুটি ফলের গাছ বড় বৃক্ষ, ফলের ব্যাস ১০-৩০ সেন্টিমিটার। ফলের গায়ে কাঁঠালের মতো কাঁটা কাঁটা আছে। ফল বীজবিহীন ও বীজধারী, দুই রকমই আছে।
লংগান : লিচুর সহোদর এ ফলটি লিচু যখন ফুরিয়ে যায় তখন তার তেষ্টা মেটায়। বিভিন্ন দেশে ফলটি রপ্তানি করেও বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। থাইল্যান্ড, ভারত, মালয়েশিয়া, চীন ও সম্প্রতি তাইওয়ানে লংগানের চাষ হচ্ছে। লংগান শব্দটি এসেছে ‘লংইয়ান’ চীনা শব্দটি থেকে। যার অর্থ হল ‘ড্রাগনের চোখ’। ভারত আর বাংলাদেশের বাঙ্গালিদের কাছে এটি ‘আঁশফল’। বাংলাদেশের কোন কোন এলাকায় এর নাম কাঠলিচু। বরিশালে এর নাম নাড়িয়া লিচু। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে বাউ লংগান -১ও বাউ লংগান -২ নামে ২টি জাত নিবন্ধন করেছে।
শানতোল : শানতোল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি পরিচিত ফল। শানতোলকে কেউ কেউ বুনো ম্যাংগোস্টিন বলেও ডাকেন। বাংলাদেশে এ ফলের চাষ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টারে ও হর্টিকালচার সেন্টার, কল্যাণপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের খামারে বেশ কয়েকটি শানতোলের গাছে সফলভাবে ফল ধরছে। দেশের অন্যান্য স্থানেও চাষ সম্ভব। শানতোল ফলের আলাদা একটা সুগন্ধ আছে। যা প্রথমেই যে কোন ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে পারে। তাই নতুন ধরনের এ ফলটির বাজার ভালো পাওয়া যেতে পারে এবং বিদেশে রপ্তানিও করা যেতে পারে। শানতোলের শাঁস সিরাপে সংরক্ষণ করা যায়, জ্যাম বিদেশে রপ্তানিও করা যেতে পারে। এ হিসেবে শানতোল ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পও গড়ে উঠতে পারে।
আলুবোখরার গাছ ও ফল : আলুবোখরা পিচ ও চেরি ফলের নিকট আত্মীয়। আলুবোখরা আদি জন্মস্থান উত্তর আমেরিকা ও জাপান। বড় গাছ ঠাÐা সইতে পারে। গ্রীষ্মকালে (জুন মাসে) ফল পাকে। আলু বোখরার গাছ বড় হতে একটু সময় নেয়। একটু বেশি বয়স না হলে গাছে ফল ধরে না। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বারি) এর উপর গবেষণা চলছে। কিছু ব্যক্তিগত নার্সারিতে ও ব্যক্তি উদ্যোগে এ ফলের গাছ সংগ্রহ কারতে দেখা গেছে।
টক আতা : টক আতা দেখতে মোটেই আতা বা শরিফার মতো নয়। গায়েু গোটা গোটা দাগ নেই, আছে ফলের গা ভর্তি ক্ষুদে ক্ষুদে কাঁটা। ফল পাকলে অবশ্য কাঁটার অনেকটাই মিলিয়ে যায়। ফলটি সারা বিশ্বেই কম বেশি পরিচিত এর ক্রিমের মতো সাদা নরম রসাল সুস্বাদু শাঁসের জন্য। শাঁস সুগন্ধযুক্ত ও টক স্বাদের। শ^াসে প্রচুর ভিটামিন সমৃদ্ধ।
এ দেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় তথা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে টক আতার গাছ আছে। কেউ চাষে করে না, জঙ্গলে হয়। টক আতার আদি বাসভ‚মি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বারি) এর উপর গবেষণা চলছে।
জাবটিকাবা : জাবটিকাবার আদি নিবাস ব্রাজিল। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে ১৯৫৬ সালে বর্তমান হর্টিকালচার সেন্টার কল্যাণপুর ছিল বিএডিসি ফার্ম। তৎকালে প্রায় ১০০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এ ফার্মের কোয়ার্টার সংলগ্ন এলাকায় পথের ধারে তিনটি জাবটিকার চারা রোপণ করেন তৎকালীন ফার্মের জনৈক উদ্যানতত্ত¡বিদ জনাব আঃ সামাদ। কোথা থেকে কিভাবে তিনি এ চারা সংগ্রহ করেছিলেন তা কেউ আর এখন বলতে পারেন না। এখন আর শুধু কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারেই নয়, জাবাটিকার গাছ ফল দিচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত¡ বিভাগের জার্মপ্লাজম সেন্টারে,কল্যাণপুর হর্চিকালচার সেন্টারের ফলবাগানে ও দেশে আরও অনেক শৌখিন ফল প্রেমিকদের বাগানে।
সরকারও সা¤প্রতিক বছরগুলোতে এসব ফলকে জনপ্রিয় ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর জাতীয় পর্যায়ে ফল প্রদর্শনীর আয়োজন করছেন। দেশের প্রতিটি বাড়িতে এই বৃক্ষ রোপণ মৌসুমে অন্তত একটি ফলের চারা রোপণ করা উচিত বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। প্রয়োজন ও প্রাপ্তির ব্যবধানের কারণ একদিকে যেমন সচেতনতার অভাব অন্যদিকে রয়েছে উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা। তাই দেশের খাদ্যপুষ্টির চাহিদা পূরণসহ আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিদেশি ফলের প্রবর্তন, গবেষণা, উন্নয়ন, উৎপাদন ও ব্যবহার অনস্বীকার্য। সুতরাং স্বাদে, গন্ধে, পুষ্টিতে শ্রেয়তর বর্ণিল বিদেশি ফলগুলোর উৎপাদন দেশব্যাপী সারা বছর বাড়িয়ে তুলতে হবে। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রয়োজন উপযুক্ত সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থাপনা। এতে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ পরিসরে গড়ে উঠবে আরো প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প। ফলে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি হবে আরো মজবুত ও গতিশীল, দেশবাসী পাবে খাদ্যে পুষ্টিমানসম্পন্ন একটি ভবিষ্যৎ। য়
১উদ্যানতত্ত¡ বিভাগ ও পরিচালক, জার্মপ্লাজম সেন্টার, বাকৃবি, ময়মনসিংহ। ২সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার, উদ্যানতত্ত¡ বিভাগ, বিনা মোবাইল : ০১৭১১১২৪৭২২, mithuhort@yahoo.com
আবদুর রশিদ, গ্রাম: দক্ষিণ মামগ্রাম, উপজেলা: বাগমারা, জেলা: রাজশাহী
প্রশ্ন: বেগুন গাছের গোড়া পচে যাচ্ছে এবং গাছ মারা যাচ্ছে। এ অবস্থায় কি করণীয়?
উত্তর: স্কেলোরোসিয়াম রফসি নামক ছত্রাকের আক্রমণ হলে বেগুন গাছে এ ধরনের রোগ হয়ে থাকে। বেগুন গাছের যে কোন বয়সে এ রোগটি হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত গাছ দেখা গেলে সাথে সাথে উঠিয়ে দূরবর্তী স্থানে মাটির নিচে পুঁতে ফেলা দরকার। আর অন্য বেগুন গাছগুলোতে মেনকোজেব ও কার্বেনডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম সঠিক নিয়মে মিশিয়ে আক্রান্ত বেগুন গাছে স্প্রে করলে এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
মো. মামুন, গ্রাম: দিয়ানা, উপজেলা: গোমস্তাপুর, জেলা: চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রশ্ন: মিষ্টিকুমড়ার পাতার সবুজ অংশ পোকায় খেয়ে ফেলছে। কি করলে প্রতিকার পাবো?
উত্তর: এ ধরনের সমস্যা কাটালে পোকা বা এপিল্যাকনা বিটল এর আক্রমণে হয়ে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় হাত দিয়ে কীড়া ও ডিম সংগ্রহ করে ধ্বংস করা যেতে পারে। আক্রমণ অধিক হলে ম্যালাথিয়ন গ্রুপের ২ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে এ পোকা দমন করা যায়।
মো. মাহবুব উল্লাহ, গ্রাম: বাকতা, উপজেলা: ফুলবাড়িয়া, জেলা: ময়মনসিংহ
প্রশ্ন: নারকেলে এক ধরনের পোকার আক্রমণে নারকেলের খোসাতে বেশ শক্ত দাগ এবং ফাটাফাটা দাগ দেখা যায়। কি করণীয়?
উত্তর: এ সমস্যাটি মাকড়ের আক্রমণে হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে নারকেল বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি গাছে সুষম সার প্রয়োগ করা দরকার। এসবের পাশাপাশি এবামেকটিন গ্রুপের ১.২৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করলে এ ধরনের মাকড়ের সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।
মো. রবিন, গ্রাম: পীড়ানচর, উপজেলা: শিবগঞ্জ, জেলা: চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্রশ্ন: পটল গাছে এক ধরনের পোকার আক্রমণের কারণে পটলে ছিদ্র দেখা যাচ্ছে। আবার পটল পচেও ঝরে যাচ্ছে। এ অবস্থায় কি করবো?
উত্তর: জমিতে পড়ে থাকা পচা পটলগুলো সংগ্রহ করে দূরে সরিয়ে ফেলার পাশাপাশি জমিকে পরিষ্কার রাখতে হবে। ক্ষেতের মাঝে ফেরোমন ফাঁদ স্থাপন করা যেতে পারে। সেজন্য প্রতি ২.৫ শতক জমিতে ১টি করে ফেরোমন ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। এছাড়া ডেল্টামেথ্রিন গ্রপের যে কোন কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১মিলি মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে সুফল পাবেন।
নূরন্নবী হাওলাদার, গ্রাম: পদ্মনগর, উপজেলা: কুষ্টিয়া সদর, জেলা: কুষ্টিয়া
প্রশ্ন: লেবু গাছের পাতা সাদা হয়ে যাচ্ছে। পাতায় আঁকাবাকা গর্তের মতো দাগ দেখা যায়। কি করবো?
উত্তর: লেবু গাছে লিফ মাইনার নামক পোকার আক্রমণে এ ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। অল্প পরিমাণ পাতা আক্রান্ত হলে পাতাগুলো ছাঁটাই করে দূরবর্তী জায়গায় মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। এ পোকার আক্রমণ শরৎকাল ও গ্রীষ্মকালে বেশি হয়ে থাকে। এছাড়া ইমডাক্লোরপ্রিড গ্রুপের ০.২৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পর পর লেবু গাছের কচি পাতায় ৩-৪ বার স্প্রে করলে এ ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
শারমিন, গ্রাম: মৌতলা, উপজেলা: কালিগঞ্জ, জেলা: সাতক্ষীরা
প্রশ্ন: কামরাঙ্গা গাছের বাকল ও ডালে ছিদ্র দেখা যাচ্ছে এবং ছিদ্র থেকে ডালের গায়ে ঝুলে থাকা কাঠের গুড়া মতো দেখা যাচ্ছে। করণীয় কি?
উত্তর: এ সমস্যা মোকাবেলায় ডালে ঝুলে থাকা গুড়া মিশ্রিত মল পরিষ্কার করতে হবে। গর্তের মধ্যে কেরোসিন বা ন্যাপথেলিন দিয়ে ছিদ্রের মুখ বন্ধ করতে হবে। আর পোকায় খাওয়া বাকল চেছে কপারজাতীয় ছত্রাকনাশকের প্রলেপ দিতে হবে। এছাড়া কার্বোসালফানজাতীয় কীটনাশক ১০-১২ দিন পরপর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে। তবেই উপকার পাবেন।
রহিম শেখ, গ্রাম: কেরাদারি, উপজেলা: রাজারহাট, জেলা: কুড়িগ্রাম
প্রশ্ন: পানিকচুর পাতায় কালো ও হলুদ দাগ পড়ছে এবং কচুর কা- পচে যাচ্ছে। এ অবস্থায় কি করবো?
উত্তর: ফাইটোফথোরা কলোকোসিয়া নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। এ রোগ দমনের জন্য রোগমুক্ত এলাকা থেকে সুস্থ বীজ সংগ্রহ করতে হবে। জমিতে রোগ দেখা গেলে ফেনামিডন ও মেনকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে। এসবের সাথে সাথে ফসল সংগ্রহরে জমিতে পড়ে থাকা কচুর কা- ও পাতা ধ্বংস করে ফেলতে হবে। আর উল্লিখিত ছত্রাকনাশক ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করলে এ রোগ দমন করা যায়।
আখতারুজ্জামান রুবেল, গ্রাম: লখাইডাঙ্গা, উপজেলা: মনিরামপুর, জেলা: যশোর
প্রশ্ন: মাছের ছত্রাকজনিত রোগের ক্ষেত্রে কি করণীয়?
উত্তর: রুইজাতীয় ও অন্যান্য চাষযোগ্য মাছে এবং মাছের ডিম আক্রান্ত হয়। ছত্রাকজনিত রোগের লক্ষণগুলো হলো-পুচ্ছ পাখনা, ময়লাবর্ণ তুলার ন্যায় ছত্রাক দেখা যায়। চামড়ায়, মাছের ডিম আক্রান্ত হয়ে সাদাটে হয়ে যায়। পানির ¯্রােত যখন স্থির হয় কিংবা বদ্ধ জলায় অথবা হ্যাচারি ট্যাংকে যেখানে অনিষিক্ত ডিমের ব্যাপক সমাগম ঘটে সেখানে ছত্রাক রোগ দ্রুত ছড়ায়। এছাড়া প্রাকৃতিক জলাশয়ের প্রায় শতকরা ৯৮ ভাগ ডিম এ রোগ দ্বারা আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সমস্যা রোধে-হ্যাচারির প্রতিটি যন্ত্রপাতি ও ট্যাংক সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার করার পর শতকরা ১০ ভাগ ফরমালিন পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে। অনিষিক্ত ও মৃত ডিমগুলোকে দ্রুত হ্যাচারি থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। হ্যাচারিতে অধিক খাদ্য প্রয়োগ না করা। এসবের পাশাপাশি হ্যাচারিতে পালনকৃত ডিমগুলো ২৫০ পিপিএম ফরমালিন দিয়ে ধৌত করা। খাঁচা ও পেনে চাষকৃত আক্রান্ত মাছগুলোকে শতকরা ৩-৫ ভাগ ফরমালিন দিয়ে ২-৩ মিনিটের মতো গোসল করানো। আর বিকল্প হিসেবে শতকরা ৫ ভাগ লবণ পানিতে আক্রান্ত মাছগুলোকে গোসল করানো।
মো. মকবুল হোসেন, গ্রাম: যাদপপুর, উপজেলা: আলমডাঙ্গা, জেলা: চুয়াডাঙ্গা
প্রশ্ন: মাছের আইশ উঠে যাচ্ছে কি করবো?
উত্তর: এ সমস্যাটি ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে। এ রোগের লক্ষণগুলো হচ্ছে- মাছের আইশের গোড়ায় রস জমে আইশ ঢিলা হয়ে যায়। চামড়া উজ্জ্বলতা হারায় এবং মাছ অলসভাবে চলাফেরা করে। এ সমস্যার প্রতিকারে-চুন বা ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পুকুর শোধন করতে হবে। এক কেজি ওজনের মাছে ১০ মিলিগ্রাম হারে সপ্তাহে ২ বার ক্লোরোমাইসন ইনজেকশন দিতে হবে। আর ১ লিটার পানিতে ২০ মিলিগ্রাম ক্লোরোমাইসন মিশিয়ে প্রতি ৪ দিন পর পর ২৪ ঘণ্টা মাছকে রাখতে হবে। তবেই মাছের ব্যাকটেরিয়াজনিত এ সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
আবদুল্লাহ সরকার, গ্রাম: সারানপুর, উপজেলা: গোদাগাড়ী, জেলা: রাজশাহী
প্রশ্ন: বাছুরের বয়স ২৫ দিন। দুর্গন্ধযুক্ত ও সাদা পাতালা পায়খানা হচ্ছে। এ অবস্থায় আমি কি করবো? পরামর্শ চাই।
উত্তর: বাছুরের সাদা উদরাময় রোগ হয়েছে। বাছুরকে সালফাডিন এস ভেট অথবা কট্টিম ভেট বোলাস খাওয়াতে হবে। এর সাথে ইলেকট্রোমিন অথবা রেনালাইট পাউডার খাওয়াতে হবে। এছাড়া বাছুরের খাবার পাত্র, পানির পাত্র প্রতিবার ব্যবহারের পর পরিষ্কার করতে হবে। তাহলে এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।
নূরে আলম তালুকদার, গ্রাম: ব্রাহ্মণগাঁ, উপজেলা: গৌরনদী, জেলা: বরিশাল
প্রশ্ন: আমার ব্রয়লার মুরগি আছে ৫০০টি। হঠাৎ করে স্ট্রোক করে মারা যাচ্ছে। এর সমাধান কি?
উত্তর: শেডে ফ্যান দিতে হবে। টিনের উপর বস্তা বা চট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে এবং ১ ঘণ্টা পর পর পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। পানির সাথে সিভিট ভেট ও ইলেকট্রোমিন পাউডার দিতে হবে। এ পদ্ধতি অনুসরণ করলে আপনি উপকার পাবেন।
কৃষির যে কোন প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান পেতে বাংলাদেশের যে কোন জায়গা থেকে যে কোনো মোবাইল থেকে কল করতে পারেন আমাদের কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ এ নাম্বারে। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত যে কোনো দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ সময়ের মধ্যে। তাছাড়া কৃষিকথার গ্রাহক হতে বার্ষিক ডাক মাশুলসহ ৫০ টাকা মানি অর্ডারের মাধ্যমে পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ এ ঠিকানায় পাঠিয়ে ১ বছরের জন্য গ্রাহক হতে পারেন। প্রতি বাংলা মাসের প্রথম দিকে কৃষিকথা পৌঁছে যাবে আপনার ঠিকানায়।
কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন*
*উপপ্রধান তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫ : taufiquedae25@gmail.com
ছাদে বাগান সৃষ্টি করে তা থেকে সুফল আহরণ করার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাস্থ্য সচেতনতা ও নিরাপদ ফল সবজি প্রাপ্তি সুবিধা নিশ্চিত করণে অনেকেই ছাদে বাগান তৈরি অনুপ্রেরণা পাচ্ছে। বয়স্ক নর-নারী অবসর বিনোদনের প্রয়োজনে ছাদ বাগান সৃষ্টিতে অনেকে আগ্রহী হয়। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা ছাদ বাগান করে গাছপালার সংস্পর্শে এসে বিচিত্র আনন্দের স্বাদ গ্রহণ করে। অনেক বৃক্ষ প্রেমিক পরিকল্পিতভাবে নিজ হাতে ছাদে বাগান করে সৃষ্টির আনন্দ ও গাছপালার প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন। একটা সুন্দর ছাদ বাগান দিতে পারে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও সারা বছর ধরে পরিবারের চাহিদামতো নিরাপদ ফল-সবজি।
ছাদের আকার ও অবস্থান : ছাদের আকার ছোট, মাঝারি বা বড় হতে পারে। এ আকার বিবেচনায় ছাদের কোন অংশে, কি কি, কত সংখ্যক বিভিন্ন ফল, সবজি, মসলা ও ঔষধি গাছ চাষ করা যাবে তা শুরুতেই নির্ধারণ করা প্রয়োজন। নির্ধারিত ছাদ কত তলা বিশিষ্ট, আশপাশে কত তলা বিশিষ্ট বিল্ডিং বা বড় আকারের গাছপালা আছে, সারা দিনে সেখানে আলো-বাতাস বা রোদ পাওয়ার সুবিধা বিবেচনায় বাগান সৃষ্টি করতে হয়। ছাদের অবস্থান অতি উঁচু হলে ঝড়-বাতাসের প্রভাব বেশি পড়ে। এজন্য বেশি লম্বা আকারের ফল গাছ ছাদে রোপণ করা ঠিক হবে না। এমন অবস্থানে গাছ হেলে পড়া, ডাল ভেঙে যাওয়া, ফল ঝরে পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এজন্য এক্ষেত্রে গাছকে ছেঁটে রেখে বেশি ওপরের দিকে বাড়তে না দেয়া ভালো।
এছাড়া যেসব গাছ কম উচ্চতা বিশিষ্ট ও পাশের্^ বেশি বাড়ে তা দিয়ে ছাদ বাগান সাজানো প্রাধান্য দেয়া উচিত। একই কারণে কলা, পেঁপে এ ধরনের লম্বা আকারের গাছ অতি উঁচু ছাদে রোপণ না করাই উত্তম। ছাদে রোদের তাপ বা প্রচ-তা সরেজমিনের তুলনায় বেশি। সরাসরি রোদ পড়া এবং তার প্রতিবিম্ব প্রতিফলনের কারণে এমনটা হয়। এ জন্য ছাদ বাগান সৃষ্টিতে ৫০-৭০% রোদ প্রতিরোধী ঘন নেট ৭-৮ ফুট ওপরে ফিট করে ছাদের গাছের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
ছাদে বাগান স্থাপন উপযোগী করা : প্রথমে অনেকেই ছোট বড় নানা প্রকার টবে গাছ লাগিয়ে ছাদ বাগান শুরু করে। তবে এ ব্যবস্থায় খুব একটা সফলতা আনা সম্ভব হয় না। এ জন্য ছাদে রোপিত গাছের শিকড় যেন বেশি ছড়াতে পারে এবং বেশি সংখ্যক গাছ রোপণ করা যায় অথচ ছাদের কোনো ক্ষতি হয় না এ ব্যবস্থা শুরুতেই নেয়া দরকার।
বক্স তৈরি করা : বেশির ভাগ ছাদ বাগানি ছাদের কিনারগুলো ২-৩ ফুট চওড়া ও ২-৩ ফুট উঁচু করে বক্স তৈরি করে নিয়ে সেগুলো পটিং মিডিয়া দিয়ে ভরাট করে তাতে গাছ রোপণ করে থাকে। অনেকে নিচে ৮-১২ ইঞ্চি ফাঁক রেখে ঢালাই করে নিয়ে মজবুত করে এ বক্স বানিয়ে নেয়। কেউবা বক্সের নিচের অংশ ২-৩ ইঞ্চি উঁচু করে এ অংশ ঢালাই করে তার ওপর সরাসরি ইটের পাতলা গাঁথনি দিয়ে কম খরচে অনুরূপ লম্বা বক্স বানিয়ে নেয়। বিকল্প ব্যবস্থায় টিনের/প্লাস্টিকের স্টাকচার তৈরি করে অথবা জাহাজ ভাঙা বাথটবের আকারের পাত্র সংগ্রহ করে তা বক্স/টবের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করে।
পটিং মিডিয়া দিয়ে বক্স/টব ভরাট করা : সাধারণত নার্সারি থেকে গোবর মেশানো ভিটে মাটি সংগ্রহ করে তা গাছ রোপণের কাজে ব্যবহার করা হয়। যেহেতু ফসলি জমির মতো ছাদ বাগানে লাগানো গাছের শিকড় ছড়ানোর সুযোগ কম, এ জন্য ভালো মানের পটিং মিডিয়া দিয়ে এবং এ নিচের অংশে পানি নিষ্কাশন ও সহজভাবে গাছের শিকড় ছড়ানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বক্সের বিভিন্ন স্তর যেভাবে উপযোগী করা যেতে পারে তা নি¤œরূপ :
ক. তলার প্রথম অংশ : তৃতীয় গ্রেডের ইটের কম দামি ছোট আকারের খোয়া/টুকরা দিয়ে ৩-৪ ইঞ্চি ভরাট করা;
খ. তার ওপরের স্তরে ২-৩ ইঞ্চি পুরু করে কাঠ কয়লা দিয়ে এ দ্বিতীয় স্তর ভরাট করা;
গ. ৩য় স্তর ২-৩ ইঞ্চি পুরু করে নারিকেলের ছোবড়ার টুকরা অথবা নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে সাজানো;
ঘ. ৪র্থ স্তর ২-৩ ইঞ্চি পুরু মোটা বালু (সিলেট স্যান্ড) বা ক্ষুদ্র পাথর কুচি/ইটের চিপস দিয়ে ভরাট করা;
ঙ. শেষের বা ওপরের অংশ ২-২.৫ ফুট ভালো মানের পটিং মিডিয়া দিয়ে ভরাট করা হলে ছাদ বাগানের গাছের জন্য বেশি উপযোগী হবে।
পটিং মিডিয়া তৈরির পদ্ধতি : বিদেশে প্রধানত পিটমস, পিটসয়েল ও জৈব পদার্থ (কম্পোস্ট) দিয়ে তৈরি রেডিমেড পটিং মিডিয়া বিভিন্ন স্থানীয় নার্সারিতে পাওয়া যায়। এমন কি কোন ধরনের গাছ রোপণ করা হবে তার জন্য ভিন্নতর মিডিয়া পাওয়া যায়। ভালো মানের মিডিয়া তৈরিতে এ দেশে যা পাওয়া যায় তার একটা আনুপাতিক হার নিম্নে দেয়া হলো :
ক. কোকোডাস্ট বা নারিকেলের ছোবড়ার গুঁড়া - ২৫%
খ. মোটা বালু (সিলেট স্যান্ড) - ১০%
গ. ভিটে মাটি (যা নার্সারিতে পাওয়া যায়) - ২৫%
ঘ. আর্বজনা পচা/পচা গোবর - ৩০%
ঙ. তৃতীয় গ্রেডের ইটের ক্ষুদ্র চিপস/খোয়া - ১০%
এগুলো ভালোভাবে মিশিয়ে বক্স/টবের অবশিষ্ট অংশ ভরাট করে তাতে গাছ লাগানো হলে গাছ দ্রুত বাড়বে, বেশি ফলন পাওয়া যাবে। মিডিয়ার সাথে কিছু পরিমাণ করাত কলের গুঁড়া, ভার্মি কম্পোস্ট অথবা নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত কম্পোস্ট ব্যবহার করা এবং তার সাথে কিছু হাড়ের গুঁড়া ও খৈল মেশানো ভালো।
ছাদে গাছ রোপণ : ছাদে বাগান তৈরিতে নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে উন্নত জাতের সুস্থ-সবল চারা/কলম সংগ্রহের গুরুত্ব অপরিসীম। এ বাগানে যেসব দীর্ঘমেয়াদি ও মধ্য মেয়াদি ফল গাছ রোপণ করা হবে তা বারোমাসী জাতের হলে ভালো হয়। অন্যথায় ৫-৬ মাস একাধারে ফল পাওয়া যায় এমন জাতের গাছ রোপণ করা উচিত। খুব কম সময় ধরে ফল পাওয়া যায় (লিচু) এমন গাছ ছাদের জন্য নির্বাচন করা ঠিক না। বাগানকে এমনভাবে সাজাতে হবে যেন তা সব সময় কোনো না কোনো গাছে ফুল ফল ধরা অবস্থা বিরাজ করে।
ছাদ বাগানের জন্য উপযোগী ফল গাছের মধ্যে : আম, বিদেশি কাঁঠাল (আঠা, ভোতাবিহীন রঙ্গিন জাত যা রোপণের দুই বছর পর ফল দেয়), পেয়ারা, বারোমাসী লেবু (কাগজি, সিডলেস, এলাচি), মাল্টা, কমলা, থাই বাতাবি, কুল (টক ও মিষ্টি), ডালিম, শরিফা, সফেদা, আমলকী, বারোমাসী আমড়া, জামরুল, অরবরই, বিলিম্বি, করমচা, ড্রাগন অন্যতম।
শাকসবজির : বেগুন, টমেটো, ঢেঁড়স, চুকুর, ক্যাপসিকাম, শিম, বরবটি, শসা, করলা, লাউ, ধুন্দল, বারোমাসী সজিনা, লালশাক, ডাঁটাশাক, পুঁইশাক, কলমিশাক, ব্রোকলি, মুলা।
মসলা জাতীয় : মরিচ, ধনেপাতা, বিলাতি ধনিয়া, পুদিনা, কারিপাতা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, গোলমরিচ, পাম।
ঔষধিগুণ বিশিষ্ট : অ্যালোভেরা, তুলসী, থানকুনি, চিরতা, স্টিভিয়া, গাইনোরা।
ফুল জাতীয় : গোলাপ, বেলী, টগর, জুঁই, গন্ধরাজ, জবা, টিকোমা, জারবেরা, শিউলি, এলামন্ডা, বগুনভিলা ও বিভিন্ন মৌসুমি ফুল।
গাছের রোপণ ও পরিচর্যা : উন্নত কাঙিক্ষত জাতের কলম করা গাছ রোপণ করে গাছে কাঠি বা খুঁটি দিয়ে সোজা করে রাখতে হবে। তাতে গাছ হেলে পড়া বা নড়ে গিয়ে দুর্বল হওয়া রোধ হবে। প্রয়োজনে গাছের অপ্রয়োজনীয় কিছু ডাল বিশেষ করে ওপরের দিকে বেশি বাড়ন্ত ডাল কমিয়ে গাছকে বেশি উঁচু না করে পাশে বাড়তে সহায়তা দিতে হবে। গাছের আকার বেশি ছোট হলে অপেক্ষাকৃত ছোট টবে বা সিমেন্টের পরিত্যক্ত তৈরি ব্যাগে কিছু সময় সংরক্ষণ করে পরবর্তীতে বড় হলে তা পর্যায়ক্রমে বক্স/বড় টবে রোপণ করা ভালো। টবে সংরক্ষিত গাছ সরাসরি ছাদে না রেখে নিচে এক সারি ইটের ওপর বসানো দরকার। তাতে টবের অতিরিক্ত পানি সহজে বের হবে, ছাদের জন্য ভালো হবে। ড্রামে সংরক্ষিত গাছে রোদের তাপে বেশি গরম হয়। এজন্য চট/ছালা দিয়ে ড্রামের চারধার ঢেকে দিলে তা অনেকটা রোধ হবে। গাছে পানি সেচ দেয়ার ফলে উপরিভাগের মাটি শক্ত হয়ে চট ধরে। মাঝে মাঝে নিড়ানি দিয়ে ওপরের স্তর ভেঙে দেয়া হলে তা রোধ হবে। এ ব্যবস্থায় আগাছা দমন করা যাবে ও ভেতরে বায়ু চলাচল সুবিধা হবে। খরা মৌসুমে দীর্ঘমেয়াদি বড় গাছের গোড়ার চার ধারে শুকনা কচুরিপানা বা খড়কুটা, শুকনো পাতা দিয়ে মালচিং দেয়া হলে রস সংরক্ষিত থাকবে, ঘাস গজানো রোধ হবে এবং পরে এগুলো পচে খাদ্য হিসেবে কাজে লাগবে।
গাছের অবস্থান নির্ণয় : কোন কোন গাছ বেশি রোদ পছন্দ করে (কাগজি লেবু, ড্রাগন ফল) কোন গাছ আধা ছায়ায় ভালো হয় (এলাচি লেবু, জামরুল), আবার কোনো গাছ ছায়া পছন্দ করে (লটকন, রামবুটান)। এজন্য ছাদ বাগান থেকে বেশি সুফল পেতে ছাদে রোদের/আলো-বাতাস প্রাপ্তি অবস্থা বুঝে গাছের অবস্থান চূড়ান্ত করা প্রয়োজন।
পানি সেচ : অতিরিক্ত পানি দেয়া এবং অতি কম দেয়া উভয়ই গাছের জন্য ক্ষতিকর। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বেশি পানি দেয়ার ফলে বিভিন্ন রোগে গাছ আক্রান্ত হয়, এমনকি মারা যায়। এ জন্য গাছের গোড়া শুকালেই কেবল পানি দেয়া যাবে, গোড়া ভেজা থাকলে কোনো মতেই তাতে পানি দেয়া যাবে না। কিছু গাছ বেশি পানি গ্রহণ করে (ড্রাগন, নারিকেল) অনেক গাছে পানি কম লাগে (শিম, মরিচ, বেগুন)। বৃষ্টি বা নালায় জমে থাকা পানি গাছ বেশি পছন্দ করে, বিশুদ্ধ পানি নহে। তবে সকাল বেলা গাছে পানি সেচ দেয়া উত্তম।
পোকা ও মাকড় দমন : প্রাথমিক অবস্থায় শুরুতে সীমিত সংখ্যক পোকা বা তার ডিমের গুচ্ছ দেখা যায়। নিয়মিত ছাদ বাগান পরীক্ষা করে দেখা মাত্র পোকা বা পোকার ডিমগুলো সংগ্রহ করে মেরে ফেলা ভালো। পাতার নিচে ভাগে পোকামাকড় অবস্থান করে। অনেক ক্ষেত্রে বয়স্ক পাতায় পোকামাকড় বেশি দিন আশ্রয় নেয়। এ জন্য পাতা হলুদ হওয়া মাত্র পাতার বোটা রেখে তা ছেঁটে দিতে হয়। অতি ঝাল ২-৩ গ্রাম মরিচের গুড়া এক লিটার পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন ছেঁকে নিয়ে তাতে ২ গ্রাম ডিটারজেন্ট পাউডার ও এক চা চামচ পিয়াজের রস একত্রে মিশিয়ে ৮-১০ দিনের ব্যবধানে স্প্রে করলে জৈব পদ্ধতি অবলম্বনে গাছকে পোকার হাত থেকে নিরাপদ রাখা যায়। মাইট বা ক্ষুদ্র মাকড় খালি চোখে দেখা যায় না। লিচু, মরিচ, বেগুন, গাঁদা ফুলে মাইটের উপদ্রব বেশি দেখা যায়। মরিচের গুড়া পদ্ধতিতেও এ মাকড় দমন করা যায়। যেহেতু পোকামাকড়ের অবস্থান পাতার নিচে এ জন্য এ অংশ ভালোভাবে স্প্রে করে পোকা দমনে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। কীটনাশক ব্যবহার কালে খেয়াল রাখতে হবে যেন তার টকসিসিটি কম সময় থাকে (ডেকামেথ্রিন দলীয় হতে পারে তবে ইমিডাক্লোরোপ্রিড দলীয় নয়)।
সার প্রয়োগ : মাছ, মাংস ও তরকারি ধোয়া পানি গাছে ব্যবহার করলে গাছের খাবারের অভাব কিছুটা পূরণ হয়। এছাড়াও মিশ্র সার, হাড়ের গুড়া মাঝে মাঝে এবং অনুখাদ্য (দস্তা, বোরন, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ) বছরে একবার প্রয়োগ করা ভালো। মাছের কাঁটা, হাড়ের টুকরা, ডিমের খোসা, তরিতরকারির পরিত্যক্ত অংশ, পাতা, একটা ড্রামে পঁচিয়ে নিয়ে ছাদ বাগানে ব্যবহার করা ভালো। কয়েক বছরের বয়স্ক গাছের গোড়ার চারধারে সাবধানে কিছু মাটি উঠিয়ে ফেলে নতুন ভাবে পটিং মিডিয়া দিয়ে ভরাট করা হলে গাছের স্বাস্থ্য ফেরানো সহজ হয়। সম্ভব হলে গাছকে ছাঁটাই করে কিছু মাটিসহ উঠিয়ে নিয়ে সার মিশ্রিত মাটি পরিবর্তন করার ব্যবস্থা নেয়া যায়। এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা ছাড়া আগানো উচিত হবে না। জেনে শুনে তা করা যেতে পারে। অপেক্ষাকৃত ছোট টব থেকে বড় টবে গাছ অপসারণ করার মাধ্যমে গাছকে স্বাস্থ্যবান করা যায়। যারা ছাদ বাগানে অভিজ্ঞ তাদের বাগান পরিদর্শন করে ও সফলতার দিকগুলো জেনে বা দেখে শিখে তা নিজ বাগানে প্রয়োগ করা উত্তম। ফুল-ফল ঝরা রোধে ও ফল ধরা বাড়াতে নানা প্রকার অনুখাদ্য/হরমোন (সিলভামিক্স, লিটোসেন, ফ্লোরা প্রয়োগ করে অনেকে সুফল আহরণ করে থাকে।
একটা সুন্দর ছাদ বাগান দিতে পারে পরিবারের সুস্থ পরিবেশ ও নিরাপদ চাহিদামতো প্রতিদিনের তাজা খাবার। এক তথ্য মতে যাদের ছাদ বাগান আছে তাদের পরিবারে শান্তি, যাদের নেই তাদের তুলনায় বেশি। আসুন আমরা যার যতটুকু সুবিধা আছে তথায় ভালোবাসার পরশে পরিচর্যায় প্রতি ছাদ বাগানকে সুন্দর সফলভাবে গড়ে তুলি ও তা থেকে নির্মল সুফল আহরণ করি।
এম. এনামুল হক
সাবেক মহাপরিচালক, ডিএই এবং সদস্য বিশেষজ্ঞ পুল (APA), কৃষি মন্ত্রণালয়, মোবাইল নং-০১৯১৭০৫৫২০৫
খাদ্য গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য হলো সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম হয়ে বেঁচে থাকা। যে কোনো খাবার খেয়ে পেট ভরানো যায়, কিন্তু তাতে দেহের চাহিদা মিটিয়ে সুস্থ থাকা যায় না। বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন ঘাটতি পূরণ হলেও পুষ্টি সমস্যা অনেক বড় আকারে বিরাজিত রয়েছে। ফলে এ দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ পুষ্টিহীনতার কারণে নানা ধরনের রোগের শিকার হয়ে অহরহ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মা ও শিশুরাই এর শিকার বেশি। পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। অধিকাংশ ফলই সুস্বাদু, পুষ্টিকর, মুখরোচক এবং তৃপ্তিদায়ক। অতি জরুরি খাবারের অভাব কেবল দানাদার খাদ্য দিয়ে পূরণ হয় না। পুষ্টিকর খাবারের ওপর নির্ভরও করছে আমাদের জীবনের অস্তিত্ব, কর্মক্ষমতা, মেধাবৃদ্ধি, উন্নতি ও সমৃদ্ধি। পুষ্টি সচেতনতা ও জ্ঞানের অভাবে সুষম খাদ্য গ্রহণের প্রতি আমরা মোটেও সজাগ নই। ফলে যারা পেট ভরে দুইবেলা খেতে পায় না তারাই যে শুধু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে তা নয়; সে সঙ্গে ধনীরাও অপুষ্টির শিকার থেকে অব্যাহতি পাচ্ছে না।
ফল বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় ও উপকারী উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল। রঙ, গন্ধ, স্বাদ ও পুষ্টির বিবেচনায় আমাদের দেশীয় ফলসমূহ খুবই অর্থবহ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। ফলে সব ধরনের খাদ্যোপাদানই পাওয়া যায়। মানুষের জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন ও খনিজ পদার্থেরও অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে দেশীয় ফল। বিভিন্ন ধরনের খাবারের মধ্যে ভিটামিন ও মিনারেলকে রোগ প্রতিরোধ খাদ্য উপাদান হিসেবে ধরা হয়। এ ধরনের পুষ্টি উপাদান তথা হরেক রকম ফল ভক্ষণে রোগ প্রতিরোধ ছাড়াও হজম, পরিপাক, বিপাক, রুচি, বৃদ্ধি ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফল আমরা কাঁচা বা পাকা অবস্থায় সরাসরি খেয়ে থাকি। ফল রান্না ব্যতীত সরাসরি খাওয়া সম্ভব বিধায় এতে বিদ্যমান সবটুকু পুষ্টি পাওয়া যায়। বিভিন্ন ফলে ক্যান্সার প্রতিরোধকারী উপাদান অ্যান্থোসায়ানিন, লাইকোপেন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপস্থিত থাকায় মরণনাশক রোগব্যাধি থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে।
সুষম খাদ্য বিবেচনায় এনে আমরা মূলত ৬ ধরনের খাবার প্রতিদিন আহার করে থাকি। এগুলো হলো (১) শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট (২) আমিষ বা প্রোটিন (৩) স্নেহ বা তেল/চর্বি এবং (৪) ভিটামিনস (৫) খনিজ লবণ (মিনারেলস) ও পানি। ফলে সব ধরনের খাদ্যোপাদানই পাওয়া যায়। তবে ভিটামিন ও খনিজ লবণের পরিমাণ খুব বেশি। এ ছাড়া ফল থেকে পাওয়া স্বেতসার, প্রোটিন ও স্নেহ জাতীয় উপাদানগুলো সহজেই হজম করা যায়।
ফল বলতে আমরা নিষিক্ত ও পরিপক্ব ডিম্বককেই বুঝি। আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু, কলা, আনারস, পেঁপে, নারকেল, লেবু ও কুল- এ ১০টি আমাদের দেশের প্রধান ও প্রচলিত ফল; এগুলোকে আমরা সবাই চিনি। কেননা, চোখের সামনে এদের প্রায় সব সময় দেখি, হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। এসব ফল দেশের প্রায় সব এলাকাতে জন্মে। এসব ফলকে তাই আমরা বলি প্রচলিত ফল। এসব ফলের বাইরেও অনেক ফল পাওয়া যায়। এসব ফলকে বলা হয় অপ্রচলিত বা স্বল্প পরিচিত ফল। অপ্রচলিত শব্দটির অর্থ হচ্ছে যার প্রচলন নেই অর্থাৎ এসব ফলের অস্তিত্ব আছে, খুঁজলে পাওয়া যায় কিন্তু যখন তখন চোখে পড়ে না, দেশের সব এলাকায় জন্মে না, গাছের দেখা মেলে খুব অল্প। চাহিদা কম, প্রাপ্যতা কম, এদের অনেকে বনে-জঙ্গলে নিতান্ত অনাদরে অবহেলায় বেড়ে ওঠে। প্রগতির ধারায় কেউ এদেরকে পরিকল্পনায় আনে না। চাষাবাদ দূরে থাক-প্রয়োজনীয় খাবার কিংবা পানিও ভাগ্যে জোটে না। কোনো কোনোটার ঔষধিগুণ ও মানুষের জন্য উপকারী নিয়ামক, ধাতব ও অত্যন্ত প্রাণ রাসায়নিক দ্রব্যাদিতে সমৃদ্ধ হলেও মানুষের রসনাকে তৃপ্ত করতে পারছে না বলে এরা অপ্রচলিত।
আবার কিছু কিছু ফল আছে যেগুলোর স্বাদ অনেকের কাছে ভালো লাগে আবার অনেকের কাছে ভালো লাগে নাÑ যেমন ডেউয়া। কলা বা আমের মতো সর্বজনীন আবেদন নিয়ে টেবিলে আসতে পারছে না বলে এরা অচ্ছুত হয়ে পড়েছে। তাই এরা অপ্রচলিত।
প্রাপ্যতার নিরিখে বিচার করেও কিন্তু ফলের প্রচলনের সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়। যদি যথেষ্ট পাওয়া যেত, তা হলে মানুষ হয়তো খেতেও পারত প্রচুর আর তখনই কোন একটা ফল তার অপ্রচলিয়তার গ্লানি মুছে ফেলে প্রচলিত ফলের কোঠায় উঠে এসে কৌলিন্য লাভে সক্ষম হতো। এমনটা হয়েছে কুলে ও পেয়ারার ক্ষেত্রে। এ ফলগুলো ১০ বছর আগেও ব্যাপক হারে আবাদ হতো না। কিন্তু নিকট অতীতে, ভালো কিছু জাত এসেছে বলে (যেমন আপেল কুল, বাউকুল, কাজী পেয়ারা, বাউ-৫ পেয়ারা, থাই পেয়ারা ইত্যাদি। এগুলো কৌলিন্যের বিভা পেতে শুরু করেছে। এখন এদের পরিকল্পিত চাষ হচ্ছে। বাগান হচ্ছে, যত্ন আত্তি করা হচ্ছে-অধিক পরিমাণে বাজারে আসছে, বড় বড় মানুষের রসনা তৃপ্ত করতে সক্ষম হচ্ছে। আর অপ্রচলিত থেকে প্রচলিত হওয়ার পথ পেয়েছে। লটকন এ ধরনের ফলের একটি উদাহরণ। চালতা, করমচা, লুকলুকি, ফলসা ও তেঁতুলের মতো ফলগুলো কিন্তু সবারই পরিচিত। কিন্তু টক বলেই বোধ হয় এদের চাহিদা বাড়ছে না, আর তাই অপ্রচলিত। এ ছাড়া আরো কিছু অপ্রচলিত ফল যেমন- টাকিটুকি, পানকি, চুনকি, লুকলুকি, উড়িআম, বৈঁচি, চামফল, নোয়াল, রক্তগোটা, মাখনা, আমঝুম, মুড়মুড়ি, তিনকরা, সাতকরা, তৈকর, আদা জামির, ডেফল, কাউফল, বনলেবু, চালতা ইত্যাদি।
অপ্রচলিত ফলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এসব ফল এক রকম বিনা যত্নেই এ দেশের মাটিতে ভালো জন্মে। সাধারণত এসব ফলের গাছে তেমন কোনো সার দেয়া হয় না। এ দেশের মাটি ও জলবায়ুতে খুব ভালোভাবে এসব ফলের গাছ মানিয়ে গেছে। ঝড়-বাতাস কিংবা বন্যা খরাতেও এ ফলের গাছকে মারতে পারে না। এই ফলের ব্যাপকভাবে খাপখাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা বা ওয়াইড অ্যাডাপ্টিবিলিটি, কিন্তু অনেক বিদেশি ফলেরই নেই। এ ফলের আর একটা সুবিধে হলো, বিদেশি ফলের বা উন্নত জাতের ফল গাছের মতো এসব ফল বা ফল গাছে অত বেশি রোগ-পোকারও আক্রমণ হয় না। তবে এ ফলে সবচেয়ে বেশি মেলে পুষ্টি। এ ফলের মতো এত বেশি পুষ্টি কখনো বিদেশি ফলে মেলে না। একটা ছোট্ট আমলকীতে যে পরিমাণ ভিটামিন সি আছে তা পাঁচটা বড় কমলাতে পাওয়া যাবে না। এমনকি কোনো কোনো অপ্রচলিত ফল ফলনের দিক দিয়ে প্রচলিত অনেক ফলের চেয়ে ভালো। ডেউয়া, কদবেল, আমলকী অনেকেই খেতে চায় না। কিন্তু এর মধ্যে যে পরিমাণ ভিটামিন সি আছে তা আপেল, কমলা বা আম, কাঁঠাল থেকে পাওয়া যাবে না। অপ্রচলিত ফলের অধিকাংশই সাধারণত টক স্বাদের। তাই এসব ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি। আর এ ভিটামিনটি দেহে জমা রাখার কোনো নিয়ম নেই। তাই প্রতিদিনের ভিটামিন সি প্রতিদিনই কাঁচা ফল খেয়ে সংগ্রহ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে অপ্রচলিত ফল, এর যোগান বেশ ভালোভাবেই দিতে পারে। কাঁঠালের চেয়ে ডেউয়ার মধ্যে আমিষের সাথে মিলছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি। অন্যান্য পুষ্টি তো আছেই। সেই সাথে আছে এসব ফলের বিভিন্ন রোগ সারানোর অদ্ভুত ক্ষমতা। আমলকী, হরীতকী, বহেড়ার মতো কবিরাজি ফল প্রচলিত কোন ফলের মধ্যে কি আছে? তাছাড়া আমাদের দেশে কলা, কুল, নারিকেল ছাড়া প্রায় সব ফলই জন্মে গ্রীষ্ম -বর্ষায়। কিন্তু অপ্রচলিত অনেক ফল আছে যেগুলো অন্য মৌসুমেও জন্মে। তাই সারা বছর ধরেই বলতে গেলে ফল খাওয়ার একটা সুবিধে মেলে। শুধু পুষ্টি বা প্রাপ্যতার দিক দিয়ে নয়, এখন অনেক অপ্রচলিত ফলের দাম বিদেশি ফলের চেয়ে কম নয়। এজন্য একদিকে প্রধান ফলের চাষ ও উৎপাদন বাড়াতে হবে এ কথা যেমন সত্য তেমনি আমাদের বৈচিত্র্যময় ফলের ভাণ্ডারকেও ধরে রাখতে হবে। এটাও লক্ষ রাখতে হবে, আজকের একটি অপ্রচলিত ফল আবার আগামী দিনের প্রচলিত ফল হিসেবে গণ্য হয়ে উঠতে পারে। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, সুস্বাস্থ্যের জন্য জনপ্রতি প্রতিদিন গড়ে ১১৫ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন হলেও বর্তমানে এ দেশের মানুষ দৈনিক মাত্র ৭৬ গ্রাম ফল খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। প্রয়োজন ও প্রাপ্তির এ ব্যবধানের কারণ একদিকে যেমন সচেতনতার অভাব অন্যদিকে রয়েছে উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা। তাই খাদ্য পুষ্টি চাহিদা পূরণসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে স্বাদে, গন্ধে, পুষ্টিতে শ্রেয়তর আমাদের অপ্রচলিত ফলগুলোর উৎপাদন দেশব্যাপী সারা বছর যৌক্তিকভাবে এবং পরিকল্পিত উপায়ে বাড়িয়ে তুলতে হবে।
এজন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহকে বিবেচনা করা যেতে পারে-
অপ্রচলিত ফলের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ, সংরক্ষণ, মূল্যায়ন ও সম্প্রসারণ করা।
প্রচলিত চাষব্যবস্থা পরিবর্তন করে পরিকল্পনা মতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্দিষ্ট ফলের জন্য নির্দিষ্ট উৎপাদন এলাকা গড়ে তুলতে হবে। যেমন- বরিশালে আমড়া, সাতক্ষীরায় ক্ষীরনী, সিলেটে লেবু, বাগেরহাটে কাউফল ইত্যাদি। সেসব অঞ্চলেই এসব ফলভিত্তিক শিল্প কারখানা ও প্রক্রিয়াজতকরণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। বিদ্যমান শিল্পকারখানাগুলোর আধুনিকীরণ করতে হবে। অপ্রচলিত ফলের প্রতি গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
প্রফেসর ড. এম. এ. রহিম* ড. মো: শামছুল আলম মিঠু**
*পরিচালক, বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার, বাকৃবি, ময়মনসিংহ, মোবাইল : ০১৭১১৮৫৪৪৭১; **ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্যান তত্ত্ব বিভাগ, বিনা, ময়মনসিংহ। মোবাইল : ০১৭১১১২৪৭২২
বাংলাদেশে হরেক রকম ফলের আবাদ করা হচ্ছে এখন। এর মধ্যে যেমন দেশীয় ফল রয়েছে তেমনি আবার বিদেশি ফলও রয়েছে। দেশীয় ফলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফল হলো আম, কাঁঠাল, আনারস, কলা, কুল, পেয়ারা, বেল, জলপাই, তাল, লুকলুকি, আমলকী, জাম আর নানা রকম লেবু। আমাদের দেশে কলা আর পেয়ারা ছাড়া কোনো ফলই সারা বছর পাওয়া যায় না। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে এসব ফলের প্রাপ্তি। বিশেষ করে বৈশাখ থেকে বড় জোর শ্রাবণ মাস পর্যন্ত আমাদের এসব ফলের উৎপাদন হয়ে থাকে। যে কারণে প্রায় সারা বছরই বিদেশ থেকে প্রচুর ফল আমাদের আমদানি করতে হয়। এসব ফল আবার চড়া দামে কিনতে হয়। আমাদের দেশীয় ফলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করতে পারলে একদিকে যেমন উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে পারে অন্যদিকে কেবল মৌসুমে নয় অমৌসুমেও এর কোনো কোনোটা আবাদ উপযোগী হতে পারে।
সত্যি কথা বলতে গেলে আমাদের ফল গবেষণা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বেশ কিছু ফলের জাত অবশ্য গত দশ বছরে অবমুক্ত করা হয়েছে যার বেশির ভাগই দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা উত্তম জাত। ফলের বিভিন্ন জাতের মধ্যে সঙ্করায়ন করা কিংবা ফলে মিউটেশন ঘটিয়ে নতুন জাত উদ্ভাবন করার ঘটনা এ দেশে বেশ বিরল। কেবলমাত্র আমের দু’চারটি জাত উদ্ভাবন ছাড়া অন্যান্য ফলের ক্ষেত্রে আমাদের জাত উন্নয়ন গবেষণা বড় দুর্বল।
ফল গবেষণার কিছু বাড়তি অসুবিধা রয়েছে। এক, ফল গাছ আধিকাংশ ক্ষেত্রে দীর্ঘ দেহী হওয়ায় এদের মধ্যে সঙ্করায়ন করার কাজটি খানিকটা কঠিন। দুই, অধিকাংশ ফল গাছে ফল ধরতে সময় লাগে বলে ফলের জাত উদ্ভাবন করার জন্য সঙ্করায়ন পদ্ধতির দিকে গবেষকগণ কম আগ্রহী হন। আমাদের দেশে ফলের জাত উন্নয়ন গবেষণার আরো কিছু বাড়তি অসুবিধা রয়েছে। এক, ফল গবেষণার সাথে জড়িত গবেষকদের উদ্ভিদ প্রজনন ও আনুষঙ্গিক বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। দুই, যাদের এ বিষয়ক জ্ঞান বেশি রয়েছে পেশাগত প্রতিযোগিতার নেতিবাচক মনোভাবের কারণে তাদের এ বিষয়ক গবেষণা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সজাগ হলে এবং গোষ্ঠীগত পেশার চেয়ে জাতীয় উন্নয়নকে গুরুত্ব দিলে শেষোক্ত সমস্যা ঘটিয়ে ওঠা সম্ভব। আর তা পারলে ফল গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জনের দ্বারও উন্মোচিত হতে পারে। আম আমাদের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ফল ফসল। স্বাদে, গন্ধে, বর্ণে আমের বৈচিত্র্যও আমাদের কম নয়। তাছাড়া আমের নানান আকৃতি ও পাকার সময় কালেও বেশ বৈচিত্র্য রয়েছে। এসব বৈচিত্র্যকে বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন আম জাতে বিদ্যমান উত্তম বৈশিষ্ট্য দেওয়া নেওয়া করার জন্য আমে সঙ্করায়ন করার পদ্ধতি ইতোমধ্যে আমাদের দেশে চালু হয়েছে। আম অঙ্গজ প্রজননক্ষম একটি ফসল বলে সঠিক দু’টি পেরেন্ট জাতের মধ্যে সঙ্করায়ন করে পাওয়া হাইব্রিড গাছের মধ্য থেকে উত্তম হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন খুব কঠিন কাজ নয়। আর একটি- দু’টি উত্তম হাইব্রিড জাত পেলে অঙ্গজ বংশ বিস্তার করে এর গুণাগুণ ধরে রাখা সম্ভব দিনের পর দিন।
হাইব্রিড আম যে উত্তম হতে পারে তার প্রমাণ আম্রপালি, জাতটি। এটি ভারতে উদ্ভাবিত একটি হাইব্রিড আম। এই আম জাতটির আমাদের দেশেও বিস্তার ঘটানো হয়েছে। হাইব্রিড হলেও একেও পেরেন্ট হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের একাধিক জাতের সাথে সঙ্করায়ন করে নেয়া যেতে পারে। অতঃপর তা থেকে সৃষ্ট ভিন্ন রকম আম গাছের মধ্য থেকে উত্তম গাছকে অঙ্গজ বংশ বিস্তার করে রক্ষা করা সম্ভব। আর এর মধ্যেও পাওয়া যেতে পারে উত্তম আম জাত। এভাবে পাওয়া সম্ভব নানা আকার আকৃতি, বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদের আম। কাঁঠাল নিয়ে আমাদের বহুমাত্রিক গবেষণার সুযোগ রয়েছে। কাঁঠালের বিভিন্ন জাতের মধ্যে গুণগত মানের দিক থেকে নানা রকম বৈচিত্র্য রয়েছে। কাঁঠালের আকার আকৃতি, এর বর্ণ এবং দেহের কাঁটার আকার আকৃতি এদের তীক্ষèতায় বেশ পার্থক্য রয়েছে। কোয়ার আকার আকৃতি, এর পেলবতা, স্বাদ, গন্ধ, মিষ্টতার দিক থেকেও কাঁঠালে বিশাল বৈচিত্র্য রয়েছে।
এসব ছাড়া পরিপক্বতার দিক থেকে আগাম, মাঝারি ও নাবি বৈশিষ্ট্যের জন্যও এদের মধ্যে বৈচিত্র্য রয়েছে। ফলে এই বিশাল বৈচিত্র্য থেকে মানুষের চাহিদামাফিক গুণগত মানসম্পন্ন কয়েক রকমের কাঁঠালের জাত বাছাই করে এর চাষ বৃদ্ধি করার দিকে মনোযোগ দেয়ার সুযোগ ও প্রয়োজন দুটোই রয়েছে। এর জন্য উত্তম জাত বাছাই এবং এর বংশ বিস্তারের জন্য চারা উৎপাদন করার বিষয়ে আমাদের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কাঁঠালের টিস্যু কালচার করে চারা উৎপাদনকে আরো সহজতর করতে হবে। কাঁঠাল পর পরাগী ফসল। আশপাশের গাছের পরাগ রেণু উড়ে এসে ফুলের গর্ভমু-ে পতিত হয় বলে এর বীজ থেকে উৎপাদিত কাঁঠাল গাছের কাঁঠালের গুণাগুণ অক্ষত রাখা সম্ভব হয় না। সে কারণে টিস্যু কালচার থেকে কাঁঠালের চারা উৎপাদন সম্ভব হলেও এর উৎপাদন কৌশলকে আরো সহজতর করার গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
পেয়ারারও বেশ কিছু বৈচিত্র্যময় জাত রয়েছে আমাদের। পেয়ারার আকার আকৃতি এর বহিরাবরণ, এর ভেতরকার বীজের পরিমাণ, এর পেলবতা, স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। আমাদের বাজারে দু-তিন রকম জাতের পেয়ারার আধিক্য রয়েছে। তবে দিন দিন বর্ণিল মাংসল পেয়ারা কেবল হ্রাস পাচ্ছে বললে ভুল হবে বরং বিলুপ্তির মুখে পড়েছে বললে সঠিক হবে। বর্ণিল পেয়ারা এন্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ এবং এদের মানবিক বাড়তি আয়রনও রয়েছে। ফলে এসব পেয়ারার জাত সংগ্রহ করে ফিল্ড জিন ব্যাংকে সংরক্ষণ করা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া এখন আমরা পুষ্টির বিষয় বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি বলে বর্ণিল মাংসল পেয়ারার উৎপাদন কৌশল এবং এদের ব্যাপক বংশ বিস্তার ঘটানোর কাজটি করা খুব প্রয়োজন। তাছাড়া বর্ণিল পেয়ারার সাথে আমাদের বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করা সাধারণ পেয়ারার সঙ্করায়ন করা যেতে পারে। এতে ভিন্ন বর্ণের ও মানের পেয়ারার জাত উদ্ভাবনের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
কলা ফসলের জাত উদ্ভাবনে আমাদের গবেষণা হয়েছে সবচেয়ে কম। এর জেনোমিক গবেষণা হয়নি বললেই চলে। পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে নানা রকম পরিপ্লয়েড কলার জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে আন্তঃজাত সঙ্কয়ায়নের মাধ্যমে। এর ফলে কেবল যে নানা আকৃতির ও গুণমান বিশিষ্ট ফল উৎপাদিত হচ্ছে তাই নয় বরং রোগসহিষ্ণু জাতও পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। আমাদের পাহাড়ের কোনো কোনো কলা প্রজাতি রোগ ও কীটপতঙ্গ সহনশীল। এর অন্য বৈশিষ্ট্য উত্তম না হলেও এসব বৈশিষ্ট্য আমাদের আবাদি কলা জাতে স্থানান্তর করা যেতে পারে। সারা বছর ভিন্নতর স্বাদ বিশিষ্ট কলার জাত পেতে হলে কলার প্রজনন বিষয়ক গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। এক বছর দু’বছরেই ফল ধরে বলে কলা প্রজনন করাই যেতে পারে।
লেবুর ভালো বৈচিত্র্য রয়েছে আমাদের। নরসিংদী এলাকায় কলম্বো লেবু তো বিদেশেও রপ্তানি হয়। উত্তম চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারলে এর উৎপাদন বৃদ্ধি করা যেতে পারে। লেবুতে আমাদের পাহাড়ে দু-একটি বীজহীন লেবুর সন্ধান পাওয়া গেছে। দু’ভাবে এই লেবুকে কাজে লাগানো যায়। এক, অঙ্গজ বংশবিস্তারক্ষম এই লেবু জাতের অঙ্গজ উপায়ে চারা উৎপাদনকে উৎসাহিত করে বীজহীন লেবুর উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় যেমন পাহাড়ে তেমনি সমতল ভূমিতেও। দুই, বীজহীন লেবুর এই বৈশিষ্ট্যটি আমাদের অন্য লেবুতে স্থানান্তর করে গবেষণা চালানো যায় অবশ্যই। এর জন্য অবশ্যই প্রজননবিদের কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে ফল গবেষণা কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টির মাধ্যমে। প্রকৃত প্রজনন বিদদেরকে কাজ করার পরিবেশ দিতে পারলে বাংলাদেশেও তৈরি হতে পারে বৈচিত্র্যময় সব লেবুর জাত। তাছাড়া লেবুর কিছু রোগ বালাই বা কীট পতঙ্গ ব্যবস্থাপনা কৌশল উদ্ভাবনের জন্যও গবেষণা চলতে পারে।
বেল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফল। গুণেমানে এর তুলনা হয় না। বেল ফসলের জাতের মধ্যেও আমাদের বেল মানবিক জীববৈচিত্র্য এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। গাজীপুরের বেল তো এ দেশের এক বিখ্যাত সম্পদ। বিশালকৃতি, কম বীজ ও চমৎকার স্বাদ গন্ধসমৃদ্ধ এই বেলজাত আমাদের বেল উন্নয়নের পেরেন্ট স্টক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আমাদের দেশে অনেক ছোট বেল জাতও রয়েছে যাদের আঁশ কম আবার স্বাদ ও গন্ধও উত্তম। যদিও অধিকাংশ স্থানীয় বেল জাতগুলোর মান সন্তোষজনক নয়। বেলের বংশ বিস্তারের জন্য টিস্যু কালচার প্রণীত প্রটোকল উদ্ভাবন করা গেলে দেশে এ বেলের ব্যাপক প্রসার ঘটানো সম্ভব। এর টিস্যু কালচার কঠিন হবে তবে গবেষণা চালিয়ে গেলে তা অসম্ভব হওয়ার কোনো কারণ নেই।
আমাদের পানি ফলেরও অনেক বৈচিত্র্য রয়েছে। ফলের আকারে এরা ছোট, বড় ও মাঝারি তিন রকম রয়েছে। রয়েছে এদের ফলে বীজ ঘনত্বের তারতম্যও। কোনো কোনো জাতের বীজের গন্ধ এবং স্বাদ বেশ মন কাড়ে। ভীষণ আয়রন সমৃদ্ধ এই ফল। সরাসরি বড় জাতের বংশ বিস্তার করে এবং বড় জাতের বৈশিষ্ট্য অন্য জাতে স্থানান্তর করে পানিফলের চাষ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
তালের ক্ষেত্রে আমাদের কোন গবেষণাই বাস্তবে হয়নি। তালেরও স্বাদে গন্ধে বেশ পার্থক্য রয়েছে। তাল এক লম্বা সময়ের ফলন। তালগাছ পুরুষ না স্ত্রী হবে এটি জানতেও অপেক্ষা করতে হয় কত বছর। আনবিক কৌশল ব্যবহার করে আগাম তালগাছের লিঙ্গ নির্ধারণ করার গবেষণা চালানো দরকার। তাহলে স্ত্রী লিঙ্গিক চারা লাগিয়ে লাভবান হওয়ার বিস্তর সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
ফল ফসলের জাত উদ্ভাবন গবেষণার পাশাপাশি উদ্ভাবিত জাতসমূহের আবাদ প্রযুক্তি সম্পর্কিত গবেষণাও গুরুত্বপূর্ণ। নতুন উদ্ভাবিত জাতের চাষাবাদ পদ্ধতি, এদের রোগ ও পোকামাকড় দমনসহ ফলের সংগ্রহ পরবর্তী ব্যবস্থাপনাজনিত গবেষণা নতুন জাতের সফলতা অর্জন করার জন্যই আবশ্যক। তাছাড়া ফল ফসলের চারা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবনও এক জরুরি বিষয়। কম দামে অল্প স্থানে উত্তম চারা উৎপাদন ফলের জাত প্রসারের জন্য এক আবশ্যক বিষয়। ফলের উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন ও এদের আধুনিকায়নের গবেষণা দেশে চলছে। অধিকাংশ ফল যেহেতু কোনো রকম প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়াই সরাসরি বপন করা হয় বলে রাসায়নিক বালাইনাশকের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিতে ফল চাষকে উৎসাহিত করার জন্যও গবেষণা প্রয়োজন। বিশেষ করে সমন্বিত বালাইনাশক এবং বীজ বালাইনাশক ব্যবহার উৎসাহিত করার জন্য গবেষণা কর্মকাণ্ডের জোর দেয়া দরকার।
ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া
প্রফেসর জেনিটিকস অ্যান্ড প্লান্ট ব্রিডিং বিভাগ, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা। রঢ়নংপঋপ২০০৯@মসধরষ.পড়স ০১৭৫৮৯৩৫২৬৪
বাংলাদেশে হরেক রকম ফলের আবাদ করা হচ্ছে এখন। এর মধ্যে যেমন দেশীয় ফল রয়েছে তেমনি আবার বিদেশী ফলও রয়েছে। দেশীয় ফলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফল হলো আম, কাঁঠাল, আনারস, কলা, কুল, পেয়ারা, বেল, জলপাই, তাল, লুকলুকি, আমলকী, জাম আর নানা রকম লেবু। আমাদের দেশে উৎপাদিত ফলের বেশিরভাগ আসে কয়টি ফল থেকে। এদের মধ্যে কলা আর পেয়ারা ছাড়া কোনো ফলই সারা বছর পাওয়া যায় না। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে এসব ফলের প্রাপ্তি। বিশেষ করে বৈশাখ থেকে বড় জোর শ্রাবণ মাস পর্যন্ত আমাদের এসব ফলের উৎপাদন হয়ে থাকে। যে কারণে প্রায় সারা বছরই বিদেশ থেকে প্রচুর ফল আমাদের আমদানি করতে হয়। এসব ফল আবার চড়া দামে কিনতে হয়। আমাদের দেশীয় ফলের নতুন নতুন উদ্ভাবন করতে পারলে একদিকে যেমন উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে পারে অন্যদিকে কেবল মৌসুমে নয় অমৌসুমেও এর কোনো কোনোটা আবাদ উপযোগী হতে পারে।
সত্যি কথা বলতে গেলে আমাদের ফল গবেষণা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বেশ কিছু ফলের জাত অবশ্য গত দশ বছরে অবমুক্ত করা হয়েছে যার বেশির ভাগই দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা উত্তম জাত। ফলের বিভিন্ন জাতের মধ্যে সঙ্করায়ন করা কিংবা ফলে মিউটেশন ঘটিয়ে নতুন জাত উদ্ভাবন করার ঘটনা এ দেশে বেশ বিরল। কেবলমাত্র আমের দু’চারটি জাত উদ্ভাবন ছাড়া অন্যান্য ফলের ক্ষেত্রে আমাদের জাত উন্নয়ন গবেষণা বড় দুর্বল।
ফল গবেষণার কিছু বাড়তি অসুবিধা রয়েছে। এক, ফল গাছ আধিকাংশ ক্ষেত্রে দীর্ঘ দেহী হওয়ায় এদের মধ্যে সঙ্করায়ন করার কাজটি খানিকটা কঠিন। দুই, অধিকাংশ ফল গাছে ফল ধরতে সময় লাগে বলে ফলের জাত উদ্ভাবন করার জন্য সঙ্করায়ন পদ্ধতির দিকে গবেষকগণ কম আগ্রহী হন। আমাদের দেশে ফলের জাত উন্নয়ন গবেষণার আরো কিছু বাড়তি অসুবিধা রয়েছে। এক, ফল গবেষণার সাথে জড়িত গবেষকদের উদ্ভিদ প্রজনন ও আনুষঙ্গিক বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। দুই, যাদের এ বিষয়ক জ্ঞান বেশি রয়েছে পেশাগত প্রতিযোগিতার নেতিবাচক মনোভাবের কারণে তাদের এ বিষয়ক গবেষণা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সজাগ হলে এবং গোষ্ঠীগত পেশার চেয়ে জাতীয় উন্নয়নকে গুরুত্ব দিলে শেষোক্ত সমস্যা ঘটিয়ে ওঠা সম্ভব। আর তা পারলে ফল গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জনের দ্বারও উন্মোচিত হতে পারে। আম আমাদের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ফল ফসল। স্বাদে, গন্ধে, বর্ণে আমের বৈচিত্র্যও আমাদের কম নয়। তাছাড়া আমের নানান আকৃতি ও পাকার সময় কালেও বেশ বৈচিত্র্য রয়েছে। এসব বৈচিত্র্যকে বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন আম জাতে বিদ্যমান উত্তম বৈশিষ্ট্য দেওয়া নেওয়া করার জন্য আমে সঙ্করায়ন করার পদ্ধতি ইতোমধ্যে আমাদের দেশে চালু হয়েছে। আম অঙ্গজ জনমক্ষম একটি ফসল বলে সঠিক দু’টি পেরেন্ট জাতের মধ্যে সঙ্করায়ন করে পাওয়া হাইব্রিড গাছের মধ্য থেকে উত্তম হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন খুব কঠিন কাজ নয়। আর একটি- দু’টি উত্তম হাইব্রিড জাত পেলে অঙ্গজ বংশ বিস্তার করে এর গুণাগুণ ধরে রাখা সম্ভব দিনের পর দিন।
হাইব্রিড আম যে উত্তম হতে পারে তার প্রমাণ আম্রপালি, আম জাতটি। এটি ভারতে উদ্ভাবিত একটি হাইব্রিড আম। এই আম জাতটির আমাদের দেশেও বিস্তার ঘটানো হয়েছে। হাইব্রিড হলেও একেও পেরেন্ট হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের একাধিক জাতের সাথে সঙ্করায়ন করে নেয়া যেতে পারে। অতপর তা থেকে সৃষ্ট ভিন্ন রকম আম গাছের মধ্য থেকে উত্তম গাছকে অঙ্গজ বংশ বিস্তার করে রক্ষা করা সম্ভব। আর এর মধ্যেও পাওয়া যেতে পারে উত্তম আম জাত। এভাবে পাওয়া সম্ভব নানা আকার আকৃতি, বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদের আম। কাঁঠাল নিয়ে আমাদের বহুমাত্রিক গবেষণার সুযোগ রয়েছে। কাঁঠালের বিভিন্ন জাতের মধ্যে গুণগত মানের দিক থেকে নানা রকম বৈচিত্র্য রয়েছে। কাঁঠালের আকার আকৃতি, এর বর্ণ এবং দেহের কাঁটার আকার আকৃতি এদের তীক্ষèতায় বেশ পার্থক্য রয়েছে। কোয়ার আকার আকৃতি, এর পেলবতা, স্বাদ, গন্ধ, মিষ্টতার দিক থেকেও কাঁঠালে বিশাল বৈচিত্র্য রয়েছে।
এসব ছাড়া পরিপক্বতার দিক থেকে আগাম, মাঝারি ও নাবি বৈশিষ্ট্যের জন্যও এদের মধ্যে বৈচিত্র্য রয়েছে। ফলে এই বিশাল বৈচিত্র্য থেকে মানুষের চাহিদামাফিক গুণগত মানসম্পন্ন কয়েক রকমের কাঁঠালের জাত বাছাই করে এর চাষ বৃদ্ধি করার দিকে মনোযোগ দেয়ার সুযোগ ও প্রয়োজন দুটোই রয়েছে। এর জন্য উত্তম জাত বাছাই এবং এর বংশ বিস্তারের জন্য চারা উৎপাদন করার বিষয়ে আমাদের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কাঁঠালের টিস্যু কালচার করে চারা উৎপাদনকে আরো সহজতর করতে হবে। কাঁঠাল পর পরাগী ফসল। আশপাশের গাছের পরাগ রেণু উড়ে এসে ফুলের গর্ভমু-ে পতিত হয় বলে এর বীজ থেকে উৎপাদিত কাঁঠাল গাছের কাঁঠালের গুণাগুণ অক্ষত রাখা সম্ভব হয় না। সে কারণে টিস্যু কালচার থেকে কাঁঠালের চারা উৎপাদন সম্ভব হলেও এর উৎপাদন কৌশলকে আরো সহজতর করার গবেষণা চালিয়ে যায়ার প্রয়োজন রয়েছে।
পেয়ারারও বেশ কিছু বৈচিত্র্যময় জাত রয়েছে আমাদের। পেয়ারার আকার আকৃতি এর বহিরাবরণ, এর ভেতরকার বীজের পরিমাণ, এর পেলবতা, স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। আমাদের বাজারে দু-তিন রকম জাতের পেয়ারার আধিক্য রয়েছে। তবে দিন দিন বর্ণিল মাংসল পেয়ারা কেবল হ্রাস পাচ্ছে বললে ভুল হবে বরং বিলুপ্তির মুখে পড়েছে বললে সঠিক হবে। বর্ণিল পেয়ারা এন্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ এবং এদের যবনিক বাড়তি আয়রনও রয়েছে। ফলে এসব পেয়ারার জাত সংগ্রহ করে ফিল্ড জিন ব্যাংকে সংরক্ষণ করা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া এখন আমরা পুষ্টির বিষয় বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি বলে বর্ণিল মাংসল পেয়ারার উৎপাদন কৌশল এবং এদের ব্যাপক বংশ বিস্তার ঘটানোর কাজটি করা খুব প্রয়োজন। তাছাড়া বর্ণিল পেয়ারার সাথে আমাদের বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করা সাধারণ পেয়ারার সঙ্করায়ন করা যেতে পারে। এতে ভিন্ন বর্ণেরও মানের পেয়ারার জাত উদ্ভাবনের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
কলা ফসলের জাত উদ্ভাবনে আমাদের গবেষণা হয়েছে সবচেয়ে কম। এর জেনোমিক গবেষণা হয়নি বললেই চলে। পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে নানা রকম পরিপ্লয়েড কলার জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে আন্তঃজাত সঙ্কয়ায়নের মাধ্যমে। এর ফলে কেবল যে নানা আকৃতির ও গুণমান বিশিষ্ট ফল উৎপাদিত হচ্ছে তাই নয় বরং রোগসহিষ্ণু জাতও পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। আমাদের পাহাড়ের কোনো কোনো কলা প্রজাতি ভষণ রকম রোগ ও কীটপতঙ্গ সহনশীল। এর অন্য বৈশিষ্ট্য উত্তম না হলেও এসব বৈশিষ্ট্য আমাদের আবাদি কলা জাতে স্থানান্তর করা যেতে পারে। সারা বছর ভিন্নতর স্বাদ বিশিষ্ট কলার জাত পেতে হলে কলার প্রজনন বিষয়ক গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। এক বছর দু’বছরেই ফল ধরে বলে কলা প্রজনন করাই যেতে পারে।
লেবুর ভালো বৈচিত্র্য রয়েছে আমাদের। নরসিংদী এলাকায় কলম্বো লেবু তো বিদেশেও রপ্তানি হয়। উত্তম চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারলে এর উৎপাদন বৃদ্ধি করা যেতে পারে। লেবুতে আমাদের পাহাড়ে দু-একটি বীজহীন লেবুর সন্ধান পাওয়া গেছে। দু’ভাবে এই লেবুকে কাজে লাগানো যায়। এক, অঙ্গজ বংশবিস্তারক্ষম এই লেবু জাতের অঙ্গজ উপায়ে চারা উৎপাদনকে উৎসাহিত করে বীজহীন লেবুর উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় যেমন পাহাড়ে তেমনি সমতল ভূমিতেও। দুই, বীজহীন লেবুর এই বৈশিষ্ট্যটি আমাদের অন্য লেবুতে স্থানান্তর করায় গবেষণা চালানো যায় অবশ্যই। এর জন্য অবশ্যই প্রজননবিদের কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে ফল গবেষণা কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টির মাধ্যমে। প্রকৃত প্রজনন বিদদেরকে কাজ করার পরিবেশ দিতে পারলে বাংলাদেশেও তৈরি হতে পারে বৈচিত্র্যময় সব লেবুর জাত। তাছাড়া লেবুর কিছু রোগ বালাই বা কীট পতঙ্গ ব্যবস্থাপনা কৌশল উদ্ভাবনের জন্যও গবেষণা চলতে পারে।
বেল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফল। গুণেমানে এর তুলনা হয় না। বেল ফসলের জাতের মধ্যেও আমাদের বেল যানিক জীববৈচিত্র্য এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। গাজীপুরের বেল তো এ দেশের এক বিখ্যাত সম্পদ। বিশালকৃতি, কম বীজ ও চমৎকার স্বাদ গন্ধসমৃদ্ধ এই বেলজাত আমাদের বেল উন্নয়নের পেরেন্ট স্টক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আমাদের দেশে অনেক ছোট বেল জাতও রয়েছে যাদের আঁশ কম আবার স্বাদ ও গন্ধও উত্তম। যদিও অধিকাংশ স্থানীয় বেল জাতগুলোর মান সন্তোষজনক নয়। বেলের বংশ বিস্তারের জন্য টিস্যু কালচার প্রণিত প্রটোকল উদ্ভাবন করা গেলে দেশে এ বেলের ব্যাপক প্রসার ঘটানো সম্ভব। এর টিস্যু কালচার কঠিন হবে তবে গবেষণা চালিয়ে গেলে তা অসম্ভব হওয়ার কোনো কারণ নেই।
আমাদের পানি ফলেরও যানিক বৈচিত্র্য রয়েছে। ফলের আকারে এরা ছোট, বড় ও মাঝারি তিন রকম রয়েছে। রয়েছে এদের ফলে বীজ ঘনত্বের তারতম্যও। কোনো কোনো জাতের বীজের গন্ধ এবং স্বাদ বেশ মন কাড়ে। ভীষণ আয়রন সমৃদ্ধ এই ফল। সরাসরি বড় জাতের বংশ বিস্তার করে এবং বড় জাতের বৈশিষ্ট্য অন্য জাতে স্থানান্তর করে পানিফলের চাষ বৃদ্ধি করা সম্ভব। তালের ক্ষেত্রে আমাদের কোন গবেষণাই বাস্তবে হয়নি। তালেরও স্বাদে গন্ধে বেশ পার্থক্য রয়েছে। তাল এক লম্বা সময়ের ফলন। তালগাছ পুরুষ না স্ত্রী হবে এটি জানতেও অপেক্ষা করতে হয় কত বছর। আনবিক কৌশল ব্যবহার করে আগাম তালগাছের লিঙ্গ নির্ধারণ করার গবেষণা চালানো দরকার। তাহলে স্ত্রী লিঙ্গিক চারা লাগিয়ে লাভবান হওয়ার বিস্তর সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
ফল ফসলের জাত উদ্ভাবন গবেষণার পাশাপাশি উদ্ভাবিত জাতসমূহের আবাদ প্রযুক্তি সম্পর্কিত গবেষণাও গুরুত্বপূর্ণ। নতুন উদ্ভাবিত জাতের চাষাবাদ পদ্ধতি, এদের রোগ ও পোকামাকড় দমনসহ ফলের সংগ্রহ পরবর্তী ব্যবস্থাপনাজনিত গবেষণা নতুন জাতের সফলতা অর্জন করার জন্যই আবশ্যক। তাছাড়া ফল ফসলের চারা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবনও এক জরুরি বিষয়। কম দামে অল্প স্থানে উত্তম চারা উৎপাদন ফলের জাত প্রসারের জন্য এক আবশ্যক বিষয়। ফলের উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন ও এদের আধুনিকায়নের গবেষণা দেশে চলছে। অধিকাংশ ফল যেহেতু কোনো রকম প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়াই সরাসরি বপন করা হয় বলে রাসায়নিক বালাইনাশকের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিতে ফল চাষকে উৎসাহিত করার জন্যও গবেষণা প্রয়োজন। বিশেষ করে সমন্বিত বালাইনাশক এবং বীজ বালাইনাশক ব্যবহার উৎসাহিত করার জন্য গবেষণা কর্মকাণ্ডে জোর দেয়া দরকার।
ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া*
*প্রফেসর জেনিটিকস অ্যান্ড প্লান্ট ব্রিডিং বিভাগ, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলানগর, ঢাকা