Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও পরিবেশ সুরক্ষায় ফল গাছ রোপণ

(জাতীয় ফলদ বৃক্ষ রোপণ পক্ষ-২০১৯ উপলক্ষ্যে কৃষি তথ্য সার্ভিস কর্তৃক আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় ‘ক’ গ্রুপে প্রথম স্থান অধিকারী)

প্রারম্ভিকা : বন্ধু একটু দাঁড়া
    এই শহরে বুনে দে আজ
    ফলদ গাছের চারা।
    পুষ্টি ঘাটতি দূর হবে,
    জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে
    রক্ষা পাবে ধরা।’
অফুরন্ত সৌন্দর্যের এক মধুর নিকুঞ্জ আমাদের এই পৃথিবী। এই ধরাকে হাজারো কবির কবিতার রূপসী উপমা, প্রেমিকের প্রেমপত্র, বোবার দুর্বোধ্য ভাষা, কথকের মুক্ত মঞ্চ করে তুলেছে প্রাণপ্রদায়ী বৃক্ষরাজি, কখনো ফুল গাছ, ঔষধি গাছ, কখনো ফলজ গাছ হিসেবে। ফলদ গাছসমূহ পরিবেশকে যেমন সুশীতল করে তেমনি মানুষের তৃষ্ণা মেটায়, কখনো মনের তৃষ্ণা, কখনো মুখের তৃষ্ণা। ফলদ গাছ পুষ্টিমান নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি, ইহা পরিবেশ গঠনে ও সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন-ফল ভিটামিন ও মিনারেলের বৃহৎ জোগানদাতা। ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদরোগ ও অঙ্গপ্রতঙ্গের প্রদাহ কমাতে ফল কার্যকরী। আবার, অক্সিজেন সরবরাহসহ পরিবেশ রক্ষার বিভিন্ন কাজেও ফলদ গাছ অন্যান্য গাছের মতো সচলভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। ফলজ গাছ অন্যান্য গাছের তুলনায় বেশি জরুরি কারণ, এটি একদিকে পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও অন্যদিকে পরিবেশ সুরক্ষিত রাখে। তাই ফলগাছ রোপণ অতীব জরুরি।
ফলগাছের পরিচিতি : বাংলাদেশে ফল উৎপাদন মৌসুমভিত্তিক। অধিকাংশ ফল উৎপাদন হয় মধু মাসে। বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ মাসে মোট ফল উৎপাদনের ৫৪ ভাগই উৎপাদিত হয়।  বাকি শতকরা ৪৬ ভাগ উৎপাদন হয় অবশিষ্ট ৮ মাসে। মধু মাসে আম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস বেশি ফলন হয়। আম আমাদের জাতীয় গাছ। আমাদের দেশে ৮৩ প্রজাতির ফল গাছ রোপণ করা হয় ফলন বিবেচনায়। পেয়ারাসহ কিছু ফলের উৎপাদনস্থল ও পুষ্টি উপাদান নি¤েœর ছকে দেয়া হয়েছে।
ফলের উপকারিতা ও পুষ্টিমান নিশ্চিতকরণে ফলগাছ রোপণের গুরুত্ব : বাংলাদেশের আবহাওয়া গ্রীষ্ম ও অবগ্রীষ্ম ম-লীয় যা ফল গাছ রোপণে অত্যন্ত উপযোগী। কিন্তু বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফল চাষ বর্তমানে একজন পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ফলের চাহিদা ২০০ গ্রাম বিপরীতে  এর প্রাপ্যতা হলো মাত্র ৭৪.৪২ গ্রাম। (তথ্য সূত্র : কৃষি তথ্য সার্ভিস)। ‘বাংলাদেশে ১.৩৭ লাখ হেক্টর জমি থেকে প্রায় ৪৩.৪৭ লাখ মেট্রিক টন ফল উৎপাদিত হয় যা আমাদের চাহিদার মাত্র ৩৭.২২% পূরণ করতে পারে।’ (বিবিএস-২০১২)। এমতাবস্থায়, ফলের গাছ অধিক হারে লাগানো দরকার।        ‘বৃক্ষ নেই,
    প্রাণের অস্তিত্ব নেই,
    বৃক্ষহীন পৃথিবী যেন প্রাণহীন মহাশ্মশান।’
পরিবেশ রক্ষায় ফল গাছ অন্যান্য গাছের মতোই ভূমিকা রাখে। মাটি উর্বর করে, বৃষ্টির পরিমাণ বাড়ায়, পরিবেশের রঙ ও সৌন্দর্য বাড়ায়। তাই ফল গাছ লাগানো উচিত এতে ফলের চাহিদা মিটবে, অন্যদিকে পরিবেশও স্বচ্ছ থাকবে, সুরক্ষিত থাকবে।
হাদিসে বলা হয়েছে,
‘কোনো মুসলমান যদি একটি গাছ লাগান এবং তা থেকে কোনো ফল মানুষ বা পশু ভক্ষণ করে, তবে তা উৎপাদনকারীর জন্য সাদকাহ স্বরূপ গণ্য হবে।’ (সহিহ বুখারী)
পুষ্টি চাহিদা পূরণে ফল : ‘ফল শরীরের জন্য ভালো’- এমনটাই বলেছেন হার্ভার্ড স্কুল পাবলিক হেলথের একদল গবেষক বহু অনুসন্ধান করে। তারা দেখেন যে, আপেল, আঙুর, ব্লুবেরি      প্রভৃতি ফল বিশেষভাবে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। ২৯ আগস্ট, ২০১৩ তারিখে প্রকাশিত ‘ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী-
১. ফলে আছে ভিটামিন, খনিজ লবণ, মিনারেল, আঁশ ও কিছু ফাইটোকেমিক্যাল এগুলো রক্তচাপ ও কোলস্টেরল কমায়। পাশাপাশি এসব উপাদান ক্যান্সার, হৃদরোগ, অঙ্গপ্রতঙ্গের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
২. ফলে প্রচুর অ্যান্টি-অ্যক্সিডেন্ট থাকে। চিনি অত্যন্ত ৩৫ শতাংশ কম থাকে ফলে তাই এর উপকারিতা বেশি।
৩. চিনি খাওয়ার সঙ্গে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আঁশযুক্ত ফল খেলে শে^তসার-শর্করা পরিপাকতন্ত্রের মধ্য দিয়ে ধীরে অতিক্রম করে। তাই ফলে গ্লাইসেমিক ইনডেক্সের পরিমাণ বেশি হয় না।
৪. ফলে একই সাথে খনিজ পদার্থ, বিভিন্ন ভিটামিন, পিগমেন্ট কাজ করে। ফলে একই সাথে প্রায় সবগুলো উপাদান কমবেশি পরিমাণে হলেও উপস্থিত থাকে। (সূত্র : প্রথম আলো)।
ফলের উপকারিতা অপরিসীম। ফল আমাদের পুষ্টি চাহিদা মেটায়। তাই আমাদের পুষ্টিচাহিদা মেটাতে ফলের উৎপাদন বাড়ানো দরকার আর এজন্য ফলগাছ রোপণ জরুরি।
পরিবেশের সুরক্ষায় ফলগাছ : অন্যান্য গাছের মতো ফলগাছও পরিবেশের প্রাণরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন-
মাটিকে মজবুত ও দৃঢ় করে, মাটির ক্ষয়রোধ করে, পরিবেশে অক্সিজেন সরবরাহ করে, অতি বিষাক্ত গ্যাস ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড পরিবেশ থেকে শোষণ করে পরিবেশকে বিশুদ্ধ রাখে, খরার প্রবণতা কমায়, বৃষ্টির পরিমাণ বাড়ায়, পরিবেশের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে ফলে, অতিরিক্ত তাপ অনুভব হয় না, পরিবেশকে সুশীতল রাখে, বাতাসে জলীয় বাষ্পের ক্ষমতা বাড়ায়, দেশের আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে, পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে এবং পানি স্ফীতির হাত থেকে রক্ষা করে, পরিবেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করে।
ফলের গাছ আমাদের পরিবেশকে সাজাতে সাহায্য করে। এরাই মানুষের জীবনকে মৃত্যুঞ্জয়ী মহিমায় বিকশিত হতে সাহায্য করেছিল। এক কথায়, ফলের গাছ বিদীর্ণ শঙ্কাতুর পৃথিবীর পরিবেশকে যেমন রক্ষা করছে তেমনি পুষ্টি উপাদান অর্থাৎ,   ভিটামিন, মিনারেল, শর্করা, আমিষ ইত্যাদির এক বিরাট অংশ হিসেবে কাজ করছে। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন :
‘দাও ফিরিয়ে অরণ্য
লও এ নগর।’
সরকারি তথ্য মতে, ‘বাংলাদেশে ১৭% বনভূমি আছে, বিপরীতে ২৫% বনভূমি থাকা দরকার।’ যদি ফলের চারা রোপণ বাড়ানো যায় তাহলে, বনাঞ্চলের পরিমাণও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে। (সূত্র : বাংলাপিডিয়া)
বিজ্ঞানীদের মতে, ‘যদি তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসও বেড়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশের প্রায় ১৭% অঞ্চল (ভূমি) সমুদ্রতলে ডুবে যাবে।’ তাই পরিবেশের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ফলদ গাছ অন্যান্য গাছের সাথে বা কিছু গাছের বিকল্প হিসেবে লাগানো যেতে পারে। (সূত্র : নফহবংি ২৪) কৃষিকথা (অওঝ)
‘প্রতি বছর গড়ে নদীভাঙনে ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়।’ (সূত্র : অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১২) যেসব অঞ্চলে নদীভাঙন ঘটে (৪০টি নদ- নদীতে) সেখানে অন্যান্য গাছের পরিবর্তে নদীর পাড়ে ফলগাছ লাগানো হলে একদিকে যেমন নদীর পাড়গুলো দৃঢ় হবে মাটি ক্ষয় রোধ পাবে, অন্যদিকে নদীতীরবর্তী অঞ্চলসমূহের মানুষের পুষ্টি চাহিদাও মিটাবে।
সার্বিকভাবে, ফলগাছ ‘পরিবেশ’-এর জন্য কল্যাণপ্রার্থী। তাই, এর কল্যাণ বৃদ্ধিতে এর রোপণ বৃদ্ধি করা জরুরি।
ফলগাছ রোপণ : কৃষি প্রধান বাংলাদেশে ফলের বাহারে বাংলার ভুবন মাতোয়ারা হলেও ফলের চাষ পর্যাপ্ত নয়। তাই ফলগাছ রোপণ বাড়ানো উচিত। বাংলাদেশে বিভিন্ন ফলগাছ চাষের শতকরা আবাদি জমির পরিমাণ কলা ৩২%, আনারস ৯%, কাঁঠাল ৮%, তরমুজ ৭%, আম ২৫%, পেয়ারা ২% ও অন্যান্য ফল ১৭%। (তথ্য সূত্র : বণিক বার্তা, ৩ এপ্রিল ২০১৮)।
এই ফল চারা রোপণে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তবে সব প্রতিবন্ধকতা প্রতিহত করে ফলগাছ রোপণ বাড়াতে হবে। কারণ আমাদের বেঁচে থাকার অন্যতম অন্যান্য উপাদানগুলোর মধ্যে   সুরক্ষিত পরিবেশ একটি যা রক্ষায় ফলগাছ অসামান্য অবদান রাখে। যেমন:
* ঞৎবব চবড়ঢ়ষব ড়ৎম-এর মতে ১ একর পরিপক্ব ফলগাছ, ২৬০০০ মাইলের মধ্যে উৎপন্ন ঈঙ২কে শোষণ করতে পারে।
* ‘৫ হেক্টর পরিমাণ বনভূমি থাকলে এলাকার ৩-৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা কমে যায়, ভূমি ক্ষয় রোধ এবং বাতাসে আর্দ্রতা বাড়ায়। বৃক্ষরাজি ৮৫-৯০% শব্দ শোষণ করতে পারে।’ বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন ব্যাপকহারে বাড়ছে ও এর ফলে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ বিশে^ ১২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এজন্য ফলগাছ রোপণ বাড়ানো উচিত। (কৃষিকথা, আষাঢ় ১৪২৪)
ফলগাছ রোপণ বৃদ্ধিতে যা করণীয় :
১. সর্বসাধারণকে ফলের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানানো;
২. ফলগাছ এর উপকারিতা তুলে ধরা;
৩. সচেতনতা বৃদ্ধি করা ও গণমাধ্যমগুলোর এর গুরুত্ব প্রচারণা বাড়ানো;
৪. অনাবাদি বা আবাদি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার কীভাবে করা যায় তা সাধারণ মানুষকে বোঝানো।
৫. সরকারি নানা পদক্ষেপ ও কর্মসূচির আয়োজন করা।
৬. ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ফলগাছ রোপণের প্রয়োজনীয়তা প্রচার।
৭. ‘ফলের চারা রোপণ করুন, পুষ্টির অভাব দূর করুন’-এর মতো স্লোগান জনগণের বিশ^াসে পরিণত করা।
এভাবে ফলগাছ রোপণ বাড়িয়ে আমরা নিজেদের প্রাণের অস্তিত্বকে বসুধার মাঝ থেকে লুটিয়ে পৃথিবীকে নবরূপে সাজিয়ে তুলতে সক্ষম হবো।
উপসংহার : বিশ^রাজালয়ে বিশ^বীণা এখন আর বনে-উপবনে নিত্য সঙ্গীত মধুরিমা ছড়াতে পারে না কারণ পল্লবিত, মঞ্জুরিত গাছের খোঁজ পাওয়াই তো বিরল। আবার এই দৃশ্য ফেরাতে বৃক্ষরাজির সমারোহ যেমন বাড়ানো উচিত, তেমনি নতুন দৃশ্যের সংযোজন ঘটাতে অর্থাৎ, বিপর্যয়গ্রস্ত পরিবেশকে বাঁচাতে ও পুষ্টিসমৃদ্ধ জাতি গঠনে ফলগাছ রোপণ অতি জরুরি। ফলগাছ একসাথে পরিবেশ সুরক্ষায় যেমন নিবেদিত প্রাণ, তেমনি পুষ্টিচাহিদা পূরণেও এরা আমাদের অন্যতম ভরসাস্থল। তাই ফল গাছ রোপণে আমাদের সচেতন হতে হবে। আমাদের কামনা, আণবিক বোমার বিদীর্ণ শঙ্কাতুর পৃথিবীতে একদিন মানুষের জীবনে ফলগাছ রোপণ বৃদ্ধির চেতনায় আসবে প্রাণের বন্যা, সৌন্দর্য ও সুষমা। সবশেষে চেতনায় উজ্জীবিত রাখতে চাই,
‘মরু বিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে হে প্রবল প্রাণ
ধূলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে হে কোমল প্রাণ’।

তাসনীম তিশা

দশম শ্রেণী, শহীদ আব্দুর রব সেরেনিয়াবাত সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বরিশাল, মোবাইল : ০১৭২০২০১৬২৯

বিস্তারিত
সেচ কাজে ইঁদুর দ্বারা ক্ষতি ও এর প্রতিকার

ক্ষুদ্রাকার হলেও ইঁদুর নামক প্রাণীটির ক্ষতিকর দিকটি বিশাল। আমাদের দেশে প্রতি বছরই এই প্রাণীটির নিধনের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষ অভিযান চালানো হয়, যাকে আমরা ইঁদুর নিধন অভিযান নামে আখ্যায়িত করি। এই অতিতুচ্ছ প্রাণীটি দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্তরাই প্রাণীটির নিধনের গুরুত্ব টের পান। এদের ক্ষতির ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত।
ইঁদুরের সামনে একজোড়া করে খুব তীক্ষè দাঁত আছে, যা জন্মের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাড়তেই থাকে। আর এই সদাবর্ধিষ্ণু দাঁতকে স্বাভাবিক অবস্থায় রাখার জন্য ইঁদুর সর্বদা     কাটাকুটি করতে থাকে। ফলে ইঁদুর যা খায় তার চেয়ে চার-পাঁচগুণ খাবার নষ্ট করে থাকে। তাই ইঁদুরের ক্ষতি  এত ভয়াবহ।
ইঁদুর যে শুধু ফসলেরই ক্ষতি করে তা নয়। বইখাতা, কাপড়, আসবাবপত্র, বিছানাপত্র ইত্যাদি কেটে নষ্ট করে। এরা মাঠের দানাজাতীয়, শাকসবজি, মূলজাতীয়, ফলজাতীয় ফসলের ক্ষতি করে থাকে। আবার গুদাম ঘরে সংরক্ষিত ফসলেরও মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। এরা মানুষ ও পশুপাখির মধ্যে প্লেগ, জন্ডিস, টাইফয়েড, চর্মরোগ, আমাশয়, জ্বর, কৃমিসহ প্রায় ৬০ প্রকার রোগজীবাণুর বাহক ও বিস্তারকারী। এ ছাড়া এরা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও সেচ-নালা গর্ত করে নষ্ট করে, অনেক সময় বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি কেটে অগ্নিকা-ের সূত্রপাত ঘটায়। এজন্য ইঁদুর দমন অত্যন্ত জরুরি।
ইঁদুরের ক্ষতিকারক প্রজাতি : বাংলাদেশে প্রায় ১৩ প্রজাতির ক্ষতিকারক ইঁদুরের প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। তিনটি ইঁদুরের প্রজাতি দশমিনা বীজ বর্ধন খামারে পাওয়া গেছে। প্রজাতিগুলো হচ্ছে-
* মাঠের বড় কালো ইঁদুর
(Bandicotabengalensis)
* মাঠের কালো ইঁদুর (Bandicotaindica)
* গেছো ইঁদুর (Rattusrattus)
মাঠের কালো ইঁদুর বাংলাদেশে কৃষি ফসল, গুদাম, গ্রাম ও শহর এলাকাসহ সর্বত্র একটি প্রধান ক্ষতিকারক বালাই। সেন্টমার্টিন দ্বীপে এদের সংখ্যাই বেশি হলেও ঘরের ইঁদুর ও গেছো ইঁদুরের বাংলাদেশের সর্বত্র উপস্থিতি রয়েছে।।
ইঁদুরের আচরণ বা স্বভাব : এদের দুই জোড়া অনবরত বৃদ্ধি কর্তন দাঁতগুলোর আকার স্বাভাবিক রাখার জন্য এরা সবসময়   কাটাকাটি করতে হয়।
* যে কোনো পরিবেশে নিজেকে খাপখাইয়ে চলতে ও বংশবিস্তার করতে পারে;
* কিছু প্রজাতি আরোহন এবং সাঁতারে পটু;
*  ইঁদুরের ঘ্রাণশক্তি প্রবল;
* এরা খাদ্যের স্বাদ বুঝতে পারে;
* এরা রঙ নির্ণয় করতে পারে না;
* ইঁদুর সাধারণত রাতে চলাচল করে এবং দিনে লুকিয়ে থাকে;
* নতুন জিনিসের প্রতি অনীহা প্রকাশ করে। যেমন- ফাঁদ বা বিষটোপের প্রতি লাজুকতা।
বর্ষা মৌসুমে নিম্নভূমি প্লাবিত হলে এবং ফসলের জমিতে বৃষ্টির পানি জমলেই ইঁদুর গিয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উঁচু গ্রামীণ সড়ক, বেড়িবাঁধ ও পুরনো  স্থাপনায় ইঁদুরের দল গিয়ে আশ্রয় নেয়। এ অবকাঠামোগুলো কাটাকাটি করে ইঁদুর বাসা তৈরি করে। বর্ষা এলে জোয়ার-ভাটার পানির মতো ইঁদুরও বেড়িবাঁধগুলোর জন্য অভিশাপ হয়ে আসে। জোয়ার ও পানি ফসলের মাঠ ডুবিয়ে দিলে ইঁদুর এসে সেচনালা, বেড়িবাঁধ ও গ্রামীণ সড়ক ফুটো করে সেখানে আশ্রয় নেয়। সেচনালার (ইৎবধশরহম ড়ভ পধহধষ) মধ্য দিয়ে যখন পানি প্রবাহিত হয় তখন অতি মাত্রায় চুঁয়ানোর (ঝববঢ়ধমব) জন্য সেচনালায় ফাটল দেখা দেয়। আর ওই ফুটো/ফাটল দিয়ে পানি প্রবেশ করে সেচনালা, বেড়িবাঁধ ও সড়কগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার সেচ যন্ত্রের কন্ট্রোল বক্সের ক্ষতি করে।
পানির একমাত্র অংশ কার্যকরিভাবে ব্যবহার করা হয়। বাকি পানি  সেচিত ক্ষেত্রগুলোতে ফসলের জন্য হারানো হয়। অর্থাৎ কোনো উৎস (নদী, ভালো) থেকে নেওয়া সম্ভব পানি উদ্ভিদের মূলজোন পৌঁছায় না। পানির অংশ খালের মাধ্যমে এবং ক্ষেতের মধ্যে পরিবহনের সময় হারিয়ে যায়। অবশিষ্ট অংশ রুটজোন মধ্যে সংরক্ষিত এবং অবশেষে গাছপালা দ্বারা ব্যবহৃত হয়।
যে কারণে ক্ষেতের পানির অপচয় হয় তার মধ্যে খাল/বাঁধে
ইঁদুরের সারি গর্ত অন্যতম।
প্রতিকার :
ি সেচনালার আকৃতি অপরিবর্তিত রেখে ইঁদুর বা অন্য কোনো প্রাণী গর্ত অথবা বসে যাওয়া (উবঢ়ৎবংংরড়হ) বা ভেঙে যাওয়া সেচনালা বাঁশের খুঁটি পুঁতে চিহ্নিত করতে হবে। গর্ত, বসে যাওয়া ও ভাঙা স্থানসমূহ এঁটেল মাটি দিয়ে ভর্তি করে তা ভালোভাবে পিটিয়ে (ঈড়সঢ়ধপঃ) তলানি পরিষ্কার, ভাঙা   সেচ-নালা মেরামত করতে হবে।
ি আবার ভূগর্ভস্থ সেচনালা বা বারিড পাইপলাইনের মাধ্যমে আমরা ইঁদুর বা অন্যকোনো প্রাণীর দ্বারা সেচনালার ক্ষতি এড়াতে পারি।
ি সাধারণত দুইভাবে ইঁদুর দমন করা যেতে পারে।
*     রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন
*     পরিবেশ সম্মতভাবে ইঁদুর দমন
*     রাসায়নিক পদ্ধতি : বিভিন্ন ধরনের বিষ ব্যবহার করে ইঁদুর দমনকে রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন বলে। দুই ধরনের বিষ সাধারণত পাওয়া যায়। তীব্র বা তাৎক্ষণিক বিষ এবং দীর্ঘ স্থায়ী বিষ।
১. তীব্র বিষ : জিঙ্ক ফসফাইডের বিষটোপ প্রস্তুত করার জন্য প্রতি ৪০ ভাগ আটা ময়দার সাথে ১ ভাগ বিষ ও ৩ ভাগ গুড় এবং পরিমাণ  মতো তেল মিশিয়ে ছোট ছোট বড়ি তৈরি করে জায়গায় জায়গায় রেখে দিতে হবে। বিষটোপ ব্যবহার করার আগে কিছুদূর অন্তর অন্তর ৩ থেকে ৪ দিন বিষ ছাড়া টোপ সন্ধ্যার আগে রেখে দিতে হবে। জিংক ফসফাইড খাবার সাথে সাথে ইঁদুর মারা যায়। এই ফাঁকা বিষটোপ কয়েক দিন খাওয়ার পরে সেইসব জায়গায় বিষটোপ প্রয়োগ করতে হবে। তীব্র বিষ টোপ ব্যবহারে কিছু কিছু অসুবিধা আছে তাহলে জিঙ্ক      ফসফাইড দ্বারা তৈরি করা বিষটোপ ইঁদুর পরিমিত মাত্রায় খাওয়ার আগে অল্প কিছুটা মুখে দিয়ে পরখ করেও অসুস্থ হয়ে পড়ে কিন্তু মরে না।
২. দীর্ঘ স্থায়ী বিষ : দীর্ঘ স্থায়ী বিষ হচ্ছে রেকুমিন, ব্রোডইফেকুন।  দীর্ঘ স্থায়ী বিষ দিয়ে  তৈরিকৃত বিষটোপ ইঁদুর খাওয়ার পর ইঁদুরের রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা ধীরে ধীরে লোপ পায়,
ফলে ইঁদুরের নাক, মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে এবং ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে মারা যায়। এ ধরনের বিষ খাওয়ার
সাথে সাথে ইঁদুর মারা যায় না।
৩. বিষ বাষ্প প্রয়োগ : গ্যাস বড়ি ব্যবহারের মাধ্যমে বিষটোপ প্রয়োগ করে গর্তের ইঁদুর মারা খুবই কার্যকর। মাঠ ফসলের ক্ষেত্রে থোড় থেকে পাকা অবস্থা পর্যন্ত গ্যাস বড়িগুলো  হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড।
পরিবেশ সম্মতভাবে দমন : পরিবেশ সম্মতভাবে ইঁদুর দমন হলো পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে  অর্থাৎ কোনো রকম বিষ ব্যবহার না করে ইঁদুর দমন। যেমন-
১. ফাঁদপাতা : বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে ইঁদুর দমন করা যায়। যেমন- বাঁশ, কাঠের, টিন ও লোহার তার দ্বারা তৈরি ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে।
২. পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা :
ক. ইঁদুর নোংরা স্থান পছন্দ করে বিধায় বাড়িঘর,          ক্ষেতখামার, পুকুরপাড়, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, নদীরপাড় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখতে হবে।
খ. খাদ্যগুদাম এবং খড়ের গাদা মাটির সাথে তৈরি না করে।
গ. বিভিন্ন রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বাড়ি বা গুদাম ঘরে ইঁদুর যাতে প্রবেশ করতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. প্রাণী সংরক্ষণ : পেচা, গুঁইসাপ, বেজি, শিয়াল, বিড়াল ইত্যাদি প্রাণীগুলোকে (ইঁদুর যাদের প্রধান খাদ্য) সংরক্ষণ করলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ ইঁদুর সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে।
বাস্তুসংস্থান ঠিক রাখতে ইঁদুরের সম্পূর্ণ নিধন ঠিক নয়। কাজেই, সেচ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা আনতে সেচনালাসমূহ, বাঁধসমূহ রক্ষণাবেক্ষণে ইঁদুরের ভারসাম্যপূর্ণ দমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং এ কাজটি আমাদের খুবই সুচারুভাবে করতে হবে।

 ইফফাত আরা

সহকারী প্রধান প্রকৌশলী (মিশু), বিএডিসি, কৃষি ভবন, ঢাকা, মোবা: ০১৭১৭৮৫১৫৭৯, ই-মেইল :ace1milisu@gmail.com

 

 

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর (আশ্বিন-১৪২৬)

কৃষি বিষয়ক
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
মো: বাবুলু শেখ, গ্রাম: লাউযুথি, উপজেলা: ঠাকুরগাঁও সদর, জেলা: ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন: কুমড়া গাছের পাতায় এক ধরনের পোকার আক্রমণ হয়েছে। এ পোকা পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ফেলছে এবং পাতার শিরাগুলো শুধু বাদ দেয়। কী করব?
উত্তর:  কুমড়া গাছের পাতায় কুমড়ার কাঁঠালে পোকা আক্রমণ করলে এ ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। এ পোকার আক্রমণে আক্রান্ত পাতা শুকিয়ে যায়। সে কারণে সব সময় ক্ষেত পরিষ্কার রাখা দরকার। এছাড়া পোকার আক্রমণ কম হলে পোকা সংগ্রহ করে দমন করা যেতে পারে। তবে পোকার আক্রমণ বেশি হলে অর্থাৎ পোকার আক্রমণে শতকরা ১০ ভাগ পাতা পোকা দ্বারা আক্রান্ত হলে প্রতি লিটার পানিতে ফেনপ্রোপাথ্রিন গ্রুপের যেমন ডেনিটল ১০ ইসি ১ মিলি অথবা কার্বারিল গ্রুপের যেমন সেভিন ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিকভাবে স্প্রে করলে উপকার পাবেন।
মোছা: রহিমা বেগম রহমান, গ্রাম: সরফরাজপুর, উপজেলা:  চৌগাছা, জেলা: যশোর
প্রশ্ন: আখের উঁইপোকা দমনে কী করণীয়? জানাবেন।
উত্তর:  আখের জমিতে উইপোকা দমনের জন্য বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। সেগুলো হলো-মুড়ি আখ চাষ না করা, আক্রান্ত জমি পানিতে ডুবিয়ে রাখা, জমির মাঝে মাঝে উঁইপোকা ধরার ফাঁদ তৈরি করে রেখে পোকা ধ্বংস করা। উঁইপোকার আক্রমণ যদি বছর বছর হয়ে থাকে তবে হেক্টরপ্রতি ক্লোরপাইরিফস গ্রুপের যেমন ডার্সবান ১১.২৫ লিটার ব্যবহার করা। এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে আখের উঁইপোকার সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন।
মো. জহুরুল ইসলাম, গ্রাম: তৈলটুপি, উপজেলা: হরিণাকু-ু, জেলা: ঝিনাইদহ
প্রশ্ন: তুলা গাছের তুলার বোল বা গুটি ছিদ্র করে এক ধরনের পোকার আক্রমণ হয়েছে। এ সমস্যার সমাধান জানাবেন।  
উত্তর: তুলার বোলে এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে তুলার গোলাপি গুটি পোকা। এ পোকার আক্রমণ কম থাকলে আক্রান্ত জমির তুলা সংগ্রহের পর তুলাগাছ গোড়াসহ উঠিয়ে পুড়ে ফেলতে হবে। কিন্তু পোকার আক্রমণ যদি বেশি হয়ে থাকে তবে সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের যে কোন কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।    
মো: আসগর আলী, গ্রাম: বামনডাঙ্গা, উপজেলা: আশাশুনি, জেলা: সাতক্ষীরা
প্রশ্ন: বেগুনের ঢলে পড়া রোগ দমনের পরামর্শ চাই।
উত্তর:  বেগুনের ঢলে পড়া রোগ হলে আক্রান্ত গাছের পাতা হলুদ হয়ে যায়। এ রোগে বেগুন গাছের এক প্রান্ত ঢলে পড়ে এবং পরবর্তীতে সম্পূর্ণ গাছটি ঢলে পড়ে ও মারা যায়। এ সমস্যা রোধে বেগুন গাছের জমিতে শস্য পর্যায় অবলম্বন করা দরকার। দুই একটি গাছ এ অবস্থায় দেখা দিলে তা তুলে ফেলে গর্তে পুঁতে রাখা দরকার। পরবর্তীতে কার্বেনডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন নোইন দ্বারা বীজ শোধন করলে এ রোগ কম হবে। এছাড়া জমি চাষের আগে প্রতি শতক জমিতে ১ থেকে ২ কেজি ডলোচুন ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়। আর যদি রাসায়নিকভাবে দমনের প্রয়োজন হয় তবে আক্রান্ত গাছে কপারহাইড্রক্সাইড গ্রুপের যেমন চ্যাম্পিয়ন ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যাবে।   
মো.  রবিন মিয়া, গ্রাম: পিরোজপুর, উপজেলা: মেহেরপুর সদর, জেলা: মেহেরপুর
প্রশ্ন:  পান গাছে এক ধরনের কালো মাছি পোকা আক্রমণ করেছে। এ অবস্থায় কী করণীয়?
উত্তর: পান গাছের কালো মাছি পোকা পূর্ণ বয়স্ক ও কীড়া উভয় অবস্থায় ক্ষতি করে থাকে। পান পাতার রস চুষে খায় এবং পাতা হালকা বাদমি রঙের হয়। সেজন্য পোকার আক্রমণ হলে আক্রান্ত পাতা ধ্বংস করা দরকার। পানের বরজ ও আশপাশ পরিষ্কার রাখাও জরুরি। কিন্তু পোকার আক্রমণ বেশি হলে টলস্টার ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিকভাবে স্প্রে করলে এ পোকা দমন করা সহজ হবে।  
মো. খাইরুল আলম, গ্রাম: এলাইগা,  উপজেলা: পীরগঞ্জ, জেলা: ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন: আমার নারকেল গাছের নারকেলের ভেতরে পানি বা শাঁস থাকে না। কখনও পানি থাকে কিন্তু শাঁস থাকে না। কী করব জানাবেন।  
উত্তর:  নারকেলের এ সমস্যাটিকে বন্ধ্যা বা চিটা নারকেল বলে। এ সমস্যার প্রতিকারে প্রতি গাছে ৫০ গ্রাম বরিক এসিড ও এমোনিয়াম মলিবডেট গাছে প্রয়োগ করলে সুফল পাওয়া যায়। তাছাড়া সুষম সার ব্যবহার করাও দরকার। এসব ব্যবস্থা নিলে অবশ্যই আপনি উপকার পাবেন।
মো: মাহবুব আলী, গ্রাম : সাকোয়া, উপজেলা : বোদা, জেলা : পঞ্চগড়
প্রশ্ন : আমার কচুক্ষেতে কুচ গাছের পাতায় শুকনো দাগ পড়ে এবং ফসলের ফলন কমে যায়। কি করবো জানাবেন।
উত্তর : কচুর পাতার এ সমস্যাকে পাতায় দাগপড়া বা লিফস্পট রোগ বলে। এটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগের আক্রমণে কচু পাতায় শুকনো ছোট ও মাঝারি আকারের দাগ দেখা যায়। রোগের আক্রমণ বেশি হলে পুরো গাছটাই পুড়ে যায়। ফলে ফসলের ফলন কমে যায়। এ রোগ দমনের জন্য রোগমুক্ত স্থান হতে সুস্থ-সবল চারা বা করম সংগ্রহ করা দরকার। এছাড়া জমিতে রোগ বেশি দেখা দিলে প্রপিকানাজল গ্রুপের যেমন টিল্ট ০.৫ মিলি প্রতিলিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করলে এ রোগ দমন করা সম্ভব হবে। পরিষ্কার চাষাবাদ ও শস্য পর্যায় অবলম্বন করেও এ রোগ কমানো সম্ভব।
মৎস্য বিষয়ক
(মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক প্রশ্ন কৃষি কল সেন্টার হতে প্রাপ্ত)
মো: আমিনুল ইসলাম, গ্রাম: শরীফ সুন্দর, উপজেলা: পীরগাছা, জেলা: রংপুর
প্রশ্ন: অতি গরমে মাছ মারা যাচ্ছে কী করব?
উত্তর:  পানি কম হওয়াতে এ সমস্যা হয়। কারণ তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় মাছ দুর্বল হয়ে মারা যায়। এজন্য পানির পরমিাণ বাড়াতে হবে অর্থাৎ সেচে মাধ্যমে দিনে পানি ২ থেকে ৩ বার ঢুকাতে হবে। এ ব্যবস্থা নিলে উপকার পাবেন।   
মো: ওয়াহিদুর রহমান, গ্রাম: সুরগ্রাম উপজেলা: গোপালগঞ্জ সদর, জেলা: গোপালগঞ্জ
প্রশ্ন: চিংড়ির ফুলকা পচা রোগ হয়েছে। কী করব?  
উত্তর: চিংড়ি ঘেরের তলার পচা কাদা মাটি উঠিয়ে ফেলতে হবে। জিওলাইট ব্যবহার করতে হবে। প্রতি ২ মাস অন্তর অক্সিফ্লো ৫০ গ্রাম প্রতি বিঘা প্রয়োগ করতে হবে। এসব ব্যবস্থা নিলে আপনি উপকৃত হবেন।   
প্রাণিসম্পদ বিষয়ক
মিজানুর রহমান, গ্রাম: ফুলগাছ, উপজেলা: লালমনিরহাট সদর, জেলা: লালমনিরহাট
প্রশ্ন: আমার টার্কির বয়স ৪ সপ্তাহ। অতিরিক্ত জ্বর, সাদাটে চুনের মতো ডায়রিয়া হচ্ছে। ঝিমাচ্ছে। কী করব?
উত্তর: এ রোগের নাম গামবোরো। এটি ভাইরাসজনিত রোগ যার নির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা নেই। তবে যেহেতু গামবোরো রোগের ফলে রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং অন্যান্য রোগের সংক্রমণ খুব সহজেই হয়, তাই নি¤œলিখিত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। সিপ্রোফ্লক্সাসিন ১ মিলি প্রতি লিটার খাবার পানিতে বা এমাক্সিলিন ১ গ্রাম ২ লিটার খাবার পানিতে এবং ভিটামিন সি ১ গ্রাম ৩ লিটার খাবার পানিতে মিশিয়ে খাওয়ালে সুফল পাবেন।       
রাজু রায়হান, গ্রাম: বাঘাবাড়ি, উপজেলা: শাহজাদপুর, জেলা: সিরাজগঞ্জ
প্রশ্ন: আমার ভেড়া দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। ভেড়ার পেট বড় হয়ে যাচ্ছে। চোয়ালের নিচে থলের মতো তরল পদার্থ জমে আছে। এমতাবস্থায় কী করণীয় ?
উত্তর: আপনার এ সমস্যা রোধে ফেসিমেক্স বা ফেসিনিল বা ফ্লুকোনিল যে কোন একটি ট্যাবলেটের অর্ধেক ১ দিন খাওয়াতে হবে। তাহলেই আপনি উপকৃত হবেন।

কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন

উপপ্রধান তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল ০১৭১১১১৬০৩২, ই-মেইল :taufiquedae25@gmail.com

 

বিস্তারিত
ইঁদুরের লাজুকতা

(নজরুলের চা স্টলে মালেক মেম্বরের প্রবেশ, ডান হাতে চা বিস্কুট খাচ্ছে, বাম হাতে খবরের কাগজ নিয়ে পড়ছেন)।
মালেক মেম্বর:-কৃষকরা আর কী করবে? বছরের বৈরী জলবায়ু, অসময়ে ঝড়, বৃষ্টি, বন্য, খরা, লেগেই আছে, কিভাবে ফসল ফলাবে? কী খেয়ে বাঁচবে?
হাফিজ (কৃষক ):- (ইঁদুরে কাটা ধান গাছ হাতে নিয়ে) আমার ধান গাছ সব ইঁদুরে কেটে ফেলেছে, এই ধানগুলোই আমার সম্বল, সারা বছরের খাবার জোগায় এই জমি থেকে, এ বছর আমি কি খেয়ে বাঁচবো? বউ বাচ্চারে কি খাওয়াবো? হাই হাই রে আমি এখন কি করবো? ইঁদুরকে আমি কিভাবে মারব? (মাথা থাপড়াতে থাপড়াতে বসবে)।
মালেক মেম্বর:-বসেন ভাই বসেন, চা খান (হাতের ইশারা করবে)।
রাজ্জাক (কৃষক):-(ইঁদুরে খাওয়া নারিকেল নিয়ে) আমার বাগানের সব নারিকেল ইঁদুর খেয়ে ফেলেছে, আমার সংসার চলে নারিকেল বেচে, আমি ছেলের পড়ার খরচ কি করে জোগাবো? শালার বেটা ইঁদুর, ধরতে পারলে তোকে আমি ভত্তা বানাবো ভত্তা (বসবে)।
মালেক মেম্বর:-থামেন চাচা, বসেন। (হাতের ইশারা করবে)
আয়সা (কিষানি):-(লাউয়ের ডগা নিয়ে) আমার স্বাদের লাউ গাছ ইঁদুর কেটে ফেলেছে, মেয়ের বাড়ি থেকে বিচি এনে লাগাইচি, লকলক করে বেড়ে উঠছে, কেবলে ফুল ফুটতে শুরু করেছে,্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্ এখন দেখি লাউ গাছের ডগা মরা, ছোট ছেলে লাউ ভাজি দিয়ে পেট ভরে ভাত খায়, ছেলেকে আমি এখন কি খাওয়াবো, কি খাওয়াবো (বসবে)?
মালেক মেম্বর:- বসেন ভাবি, ব্যবস্থা একটা করতেই হবে। (হাতের ইশারা করবে)
শিখন (ছাত্র):-মেম্বর চাচা, ইঁদুর আমার বই কেটে কুটিকুটি করেছে? আবার কারেন্টের তার কেটেছে, বাল্ব জ্বলছে না। আমি এখন কিভাবে পড়ালেখা করবো? (হাত দিয়ে দেখিয়ে) এইটা আমার নাটকের বই, এইটা আমার গল্পের বই, এইটা কবিতার বই, এইটা ইংরেজি বই, সব কেটে ফেলেছে। ইঁদুর তোকে আমি খুন করবো খুন! (বসবে)।
মালেক মেম্বর:-বস বাবা বস, নজরুল একটা বিস্কুট দে।                                                                            
নাজিবুল (ব্যবসায়ী):- ইঁদুর আমার গুদাম ঘরে ঢুকে বস্তা কেটে গম, ছোলা, বাদাম খেয়েছে, শুধু খেয়েই ক্ষান্ত হয়নি ছিটাইছে, প্রসাব করেছে, পায়খানা করেছে, লোম ঝেড়েছে, সবকিছু নষ্ট করেছে, মেম্বর সাব, ইঁদুর আমাদের শেষ করে ফেলেছে, কিভাবে ইদুর মারবো একটা ব্যবস্থা করেন (বসবে)।
 নজরুল:- (চা বিস্কুট খেতে দিবে) ভাই, গরম গরম চা খান, আর মাথা ঠা-া করেন।
মালেক মেম্বর:- আপনারা থামেন, থামেন, আপনাদের সমস্যা আমি বুঝতে পারছি, তবে শুনুন, একটু পরেই      উপসহকারী কৃষি অফিসার আসবে তাকে বললে ভা..আ..লো...একটা পরামর্শ পাওয়া যাবে।
(হাতে ডাইরি, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ইমদাদের প্রবেশ)
ইমদাদ (উপসহকারী কৃষি অফিসার):- (আসতে না আসতেই অভিযোগ)
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা:- স্যার, ইঁদুর আমার ধান কেটেছে, আমার নারিকেল খেয়েছে, আমার লাউয়ের ডগা কেটেছে, আমার গুদামের মাল কেটেকুটে নষ্ট করেছে, স্যার, ইঁদুর আমার বই কেটেছে ।
ইমদাদ:- থামুন, থামুন, আপনারা থামুন! আমার কথা মনোযোগ সহকারে শুনুন। ইঁদুর খুব চালাক প্রাণী তাকে দমন করতে হলে সবাই মিলে সমন্বিতভাবে এদের দমন করতে হবে। যেমন- ধরুন (১) লোহার কেঁচিকল কাঠের বাক্স টোপ (খাদ্য) দিয়ে ইঁদুর ধরে মারা যায়। (২) ইঁদুরের গর্তে পানি ঢেলে বা শুকনো মরিচ পুড়িয়ে ধোঁয়া দিয়ে ইঁদুর মারা যায়।(৩) ইঁদুর চলার পথে তালের তাড়ি রাখলে ইঁদুর খেয়ে পাগল হয়ে যায় তখন লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারা যায়। (৪) আবার টিনের ১ বর্গফুট বোর্ডের মাঝ খানে ইঁদুরের পছন্দের খাবার রেখে চারদিকে সুপারগ্লু আঠা লাগিয়ে রেখে ইঁদুর মারা যায়।
রাজ্জাক :- স্যার ইঁদুরের পছন্দের খাবার কি?
ইমদাদ:- এই ধরুন শুঁটকি মাছ, নারিকেল, চিনাবাদাম, ভুট্টা, বিস্কুট, চানাচুর আর ও অনেক কিছু। আরো শুনুন ভাই বাড়ির আশেপাশে ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখতে হবে। বাড়িতে বিড়াল, কুকুর, পেচা এরা বাস করলে ইঁদুর ভয়ে পালায়। শুনুন ভাই আপনার গোড়া থেকে ২ ফুট উপরে ১ ফুট চওড়া টিনের পাত লাগান তাহলে ইঁদুর ওঠতে পারবে না।
হাফিজ :- আর কি পদ্ধতি আছে স্যার?
ইমদাদ :- ভাই শুনুন ইঁদুরের গর্তে গ্যাস বড়ি (ফসটক্সিন ট্যাবলেট) দিয়ে মারা যায়। এছাড়াও  জিংকফসফাইড,  রোমা, ব্রমাপয়েন্ট, ল্যানির‌্যাট, র‌্যাটকিল এসব রাসায়নিক বিষটোপ ব্যবহার করে আমরা সহজেই ইঁদুর দমন করতে পারি। হাফিজ ভাই আরো একটা কথা শুনুন, ফাঁদ দিয়ে তাজা ইঁদুর ধরে তার মলদ্বার সেলাই করে ছেড়ে দিলে বাড়ির সকল ইঁদুরকে কামড়িয়ে ঘরছাড়া করবে। ঘরের মধ্যে গোলমরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে রাখলে ইঁদুর ঘরে থাকে না। এজন্য বর্ষকালে ঘরের ইঁদুর মারা সহজ হয়। আর ১টি পদ্ধতি আছে তাহলো লম্বা টিনের কৌটার মধ্যে ইঁদুরের পছন্দের খাবার রেখে মাটি থেকে হেলানোভাবে কাঠের বাটাম কৌটার মাথায় সংযোগ করে রাখলে ইঁদুর বাটাম বেয়ে উপরে উঠে কৌটার ভেতর লাফ দেবে কিন্তু উঠতে পারবে না। এভাবেও অনেক ইঁদুর দমন করা যায়।
ক্ষতিগ্রস্তরা:-ঠিক আছে স্যার, ধন্যবাদ স্যার, আজকেই ইঁদুর মারা শুরু করবো, চল্ চল্ আমরা বাড়ি যাই।
“দ্বিতীয় দৃশ্য”
হাফিজ :-ইঁদুর চলার পথে বিস্কুট, চানাচুর, বাদাম, নারিকেল, ছোলা, মাছ ভাজা, এগুলো দিয়ে রাখি , দেখি ইঁদুর কেমন করে খায়?
ইঁদুর:- (লান্টু, বন্টু, ফটা, শন্টু, পন্টু, কনা ও চখা ৬-৮ বছরের ছেলে মেয়ে ইঁদুরের চরিত্রে অভিনয়)
লাল্টু:- আমাদের পথে এত সুন্দর সুন্দর খাবার কে রেখেছে রে, ভা..রি মজার খাবার ।
বল্টু:- খাবার দেখে জিবায় পানি আসছে, একটু খাই।
কটা:- আহ্ কি সুন্দর গন্ধ, কত দিন এমন খাবার খাই না।
শন্টু:- এই খাস না, খাস না, পেট ব্যথা হতে পারে।
পল্টু:- নতুন খাবার, বিষ দেওয়া থাকতে পারে।
কণা:- নতুন খাবার দেখলে নতুন বউয়ের মতো খেতে আমার লজ্জা করে।
চখা:- এই শোন শোন, খাবারটা পরীক্ষা করা দরকার। চল্ চল্ আজকে যাই, কালকে ডাক্তার ভাইকে সাথে নিয়ে আসব।
হাফিজ :-(পরের দিন একই ভাবে খাবার দিয়ে রাখবে)। আজকে একইভাবে খাবার দিয়ে রাখলাম, দেখি ইঁদুর বেটা কি  করে ?
ডা: ছক্কা (ইঁদুর) :-কই রে, কোন খাবার,  কোথায় পরীক্ষা করতে হবে?
বল্টু:-আসেন ডা: ভাই, এইযে এইযে, খাবার। পরীক্ষা করে দেখেন  তো বিষ টিষ আছে নাকি?
ডা: ছক্কা:-(কাঁচের পাত্রে খাবার নিয়ে পানি ঢালবে, কাঠি দিয়ে নাড়বে) খাবারে বিষ টিষ তো দেখছি না নিঃসন্দেহে খাওয়া যাবে, তোরা কই গেলি এই শন্টু এই পল্টু তাড়াতাড়ি খা, পাটি দে, নাচো, গাও, আনন্দ করো।
লাল্টু:- এই কটা, এই চখা বেশি করে খা, ফুরে গেলে পাবি না।
কণা:- তোমরা নাচো গাও, মজা করে খাও। আর ড্যান্স করো (সবাই আনন্দ ফুর্তি করবে)।
“তৃতীয় দৃশ্য”
হাফিজ :-(পূর্বের দুই দিনের মতো তৃতীয় দিনেও একই রকম টাটকা খাবারের সাথে  জিংকফসফাইড ২% মেশানো থাকবে)
আজ খাবারে বিষ মিশিয়ে দিয়েছি, দেখি ইঁদুর মরে কি না? একদিকে ইঁদুরের জ্বালা অন্যদিকে বউয়ের ঘনঘনানি, বলুন তো ভাই সব, আমি এখন কি করি?
শন্টু:- কি মজা! কি মজা! আজ পেট ভরে খাব, ক্ষুধা লাগিচে।
কণা:-আজ লজ্জাও নাই ভয়ও নাই মন ভরে খাব, আহ্ কি সুন্দর গন্ধ!
পল্টু:-এই বল্টু, তাড়াতাড়ি খা, গৃহস্থ চলে আসতে পারে।
বল্টু:-খাচ্ছিই তো, কত খাবো?
চখা:-আহ্ কি স্বাদ, কোন দিন খাইনি।
লাল্টু:-এই কটা, কিছু রাখ, দাদির জন্যে নিয়ে যাবনি।
কটা:-রাখ তোর দাদি, আমার ই হচ্ছে না।
(সকল ইঁদুর কাড়াকাড়ি করে খাবে, নাচবে, গান গাইবে,....খাবার শেষ না হতেই)
বল্টু:-আমার পেট ব্যথা করছে, বমি আসছে, (বমির ভাব করবে)।
পল্টু:-ও বাবা আমার মাথা ঘুরছে, পড়ে গেলাম, পড়ে গেলাম, আমাকে ধরো (পড়ে যাবে)।
কণা:- চোখে দেখতে পাচ্ছি না, ঝাপসা লাগছে, কে কোথায় আছো, বাঁচাও.বাঁচাও.. বাঁচাও.. (অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে)।
চখা:-আমার বুক জ্বলছে, পানি দাও, পানি.পানি..পানি...(্্্্্উল্টে পড়ে যাবে)।
কটা:-(হাত, পা কাঁপাবে) আমার হাত পা ঝিনঝিন করছে, বল পাচ্ছি না আ.আ..আ...        (মরে যাবে)।
লাল্টু:-ওমা, মাগো, আমার গলা জ্বলছে, বাতাস দাও, বাতাস.বাতাস..(শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে)।
শন্টু:-আমার মুখ পুড়ে গেল, ডাক্তার সাহেব, আমার চিকিৎসা করেন, আমি মরিতে চাহি না এই সুন্দর ভুবনে, মানবের তরে আমি বাঁচিবারে চাই ..চাই..চা.ই (মরে যাবে)।
(মৃত ইঁদুরের লাশগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে থাকবে, খাবারগুলো ছড়ানো ছিটানো থাকবে, হাফিজের প্রবেশ)।
 হাফিজ:- কেমন লাগছে ইঁদুর ছা, আমার ধান খাইছিস, পাট কেটেছিস, ফল খাইছিস, খা খা জনমের মতো খা। তোরে চৌদ্দ গোষ্ঠী মেরে শেষ করে ফেলবো (ইমদাদের প্রবেশ)।
 ইমদাদ:- দেখলেন তো হাফিজ ভাই, ইঁদুর মারা কত কষ্ট, ইঁদুর খুব চালাক প্রাণী, তাই এদের দমন করতে বেশি কৌশলী হতে হয়। এখন মাটিতে গর্ত করে মরা ইঁদুর আর উচ্ছিষ্ট খাবার পুঁতে ফেলুন। হাঁস-মুরগি মরবে না, পরিবেশ ও রক্ষা পাবে।  ‘সমাপ্ত’

  মোঃ মাজেদুল ইসলাম (মিন্টু)
উপসহকারী কৃষি অফিসার, উপজেলা কৃষি অফিস, পাবনা সদর, পাবনা, মুঠোফোন:-০১৭১৭৪৬৬৯৯৮, ই-মেইল :
Pubna@ais.gov.bd

 

বিস্তারিত
জনস্বাস্থ্যে ইঁদুরের প্রভাব ও সচেতনতা

ইঁদুর জাতীয় প্রাণী বা Rodent (ইঁদুর, কাঠবিড়ালি ও সজারু) এ্যান্টার্টিকা মহাদেশ বাদে পৃথিবীর প্রতিটি মহাদেশে এদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। United States Department of Agriculture (USDA) এর তথ্য মতে, ‘গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা বিশ্বের অন্যতম ইঁদুর উপদ্রব এবং বংশবিস্তারকারী এলাকা। বাংলাদেশ আবার এদের মধ্যে অন্যতম। এখানকার উপকূলীয় লোনা ও মিঠাপানির মিশ্রণের এলাকাগুলো ইঁদুরের বংশবিস্তারের জন্য বেশ অনুকূল। ফসলের মাঠ ছাড়াও এ অববাহিকায় অবস্থিত হাট-বাজার ও শিল্পাঞ্চলগুলোতেও ইঁদুরের দাপট বেশি পরিলক্ষিত হয়’। অনেক জায়গায় ইঁদুর জাতীয় প্রাণী জন-মানব ও তাদের পালিত গবাদি প্রাণী বা পোষা প্রাণীর কাছাকাছি বসবাস করে। অন্যান্য জায়গায় বিশেষ করে উপশহর এলাকায় রোডেন্ট বন্যজীবন ও মানুষের মধ্যে বন্ধন সৃষ্টি করে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যে মানুষের মধ্যে জুনোটিক রোগ বিস্তার করে। মেরুদ-ী প্রাণী ও মানুষের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে বিস্তারযোগ্য রোগ ও সংক্রমণকে জুনোসিস (Zoonoses) কখনওবা জুনোটিক রোগ বলে অভিহিত করা হয় (বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০০৬)। কুকুরের মাধ্যমে জলাতঙ্ক জুনোটিক রোগের অন্যতম উদাহরণ। জুনোটিক রোগগুলো মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রায় হয়ে থাকে এবং কিছু কিছু সময় মৃত্যুর কারণও হতে পারে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার (ডঐঙ) তথ্য মতে, মানুষের রোগের শতকরা ৬১ ভাগ উৎস জুনোটিক রোগ।


ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর উপদ্রবে বিশে^র অনেক দেশ অতীষ্ঠ। জনস্বাস্থ্যে ও এমনকি প্রাণী স্বাস্থে এর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। ইঁদুর ৬০টির বেশি রোগের জীবাণু বহন, সংরক্ষণ ও বিস্তার করে থাকে। অনেক ধরনের জুনোটিক রোগ, নানা প্রকার চর্মরোগ, কৃমিরোগ, ইঁদুর কামড়ানো জ্বর, জন্ডিস রোগের    জীবাণু ইঁদুর দ্বারা বিস্তার ঘটে। এসব রোগের জীবাণু ইঁদুরের মলমূত্র, লোমের মাধ্যমে বিস্তার ঘটে।
 

ইঁদুর বাহিত কিছু রোগ ও তার লক্ষণ
হানট্যান
(Hontaan) ভাইরাস বা রক্তক্ষরা জ¦র : পৃথিবীর অনেক শহরে ইঁদুরের দেহে হানট্যান ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। এ ভাইরাস পোষক হতে পোষকে আক্রান্ত লালা, মূত্র এবং মলের মাধ্যমে বিস্তার ঘটে থাকে। কিছু স্ট্রেইনের মানুষের ওপর অল্প-বিস্তর প্রভাব রয়েছে। অন্যগুলো নানা রকম লক্ষণসহ প্রধান অসুস্থতার কারণ হতে দেখা দিতে পারে।
 

টিক টাইফাস (Rikettsia conori) : কুকুর এ রোগের জন্য প্রধান ভা-ার, কিন্তু ইঁদুরও গুরুত্বপূর্ণ বাহক। এ রোগে আক্রান্ত টিকে (এক প্রকার কীট) কামড়ানোর ফলে মানুষে এ রোগের সংক্রমণ ঘটে। সমস্ত এশিয়াতে টিক এ রোগের বিস্তারে জড়িত।


স্ক্রাব টাইফাস(Orientia  tsutsugamushi) :  সমস্ত এশিয়াজুড়ে নানা রকম ইঁদুর জাতীয় প্রাণীরা (রোডেন্ট) এ রোগের প্রধান ভা-ার বা আধার। ট্রম্বিকিউলিড গণভুক্ত বিভিন্ন প্রকার মাকড়ের শূককীট যা    ‘চিগার’ (ঈযরমমবৎং) নামে পরিচিত, তাদের কামড়ে মানুষের মধ্যে রোগ সংক্রমিত হয়। প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করা হলে মানুষের মৃত্যু হার কম হবে।


মিউরিন টাইফাস (Rickettsia typhi) : সমস্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে এর প্রাদুর্ভাবের রিপোর্ট রয়েছে। ফ্লি (ঋষবধ) পোকার কামড়ে এ রোগের বিস্তার ঘটে অথবা আক্রান্ত মলের অথবা দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া ফ্লির মাধ্যমে। এ রোগের কারণে মানুষের মধ্যে বৃহৎ পরিসরে রোগের লক্ষণ দেখা দিলেও মানুষ মৃত্যু হার অনেক কম।


কুইন্সল্যান্ড টিক টাইফাস অথবা স্পটেড জ¦র(Rickettsia australis): অস্ট্রেলিয়া পূর্ব উপকূল ধরে নি¤œ অবস্থান পর্যন্ত এ রোগ দেখা যায় এবং ওীড়ফরফ টিকস এ রোগ বহন করে। এ রোগ জীবাণুর প্রাকৃতিক ভা-ার হলো মারসুপাইয়াল মাইস, ব্যান্ডিকোটস, পুশাম (চড়ংংঁসং), ইঁদুর এবং মাইস (সরপব)। এ রোগের কারণে মানুষের মাঝে ব্যাপক লক্ষণ দেখা গেলেও মৃত্যু হার কম।


লেপটোস্পাইরোসিস (খবঢ়ঃড়ংঢ়রৎড়ংরং): খবঢ়ঃড়ংঢ়রৎধ গণভুক্ত নানা রকম স্পাইরোকিটস (ঝঢ়রৎড়পযধবঃবং) জুনোটিক রোগের জীবাণু মাঠের কালো ইঁদুর বহন ও বিস্তার করে। প্রায় সকল ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর প্রজাতিরা পোষক হিসেবে কাজ করে। একটি খোলা স্থানে ইঁদুরের প্রস্রাব দ্বারা দূষিত পানি, আর্দ্র মাটি অথবা উদ্ভিদের সংস্পর্শে আসলে মানুষে সংক্রমণ ঘটে। অধিকাংশ প্রজাতির মৃত্যু হার কম হয়। এ রোগের লক্ষণ ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের অনুরূপ হয় এবং কয়েক দিন হতে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত টিকে থাকে। লেপটোস্পাইরোসিস রোগের লক্ষণকে অনেকে আবার ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গু জ¦র ভেবে ভুল করে। যারা রোপণকৃত গাছপালা অথবা মাঠে কাজ করে তাদের এ রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
ইঁদুরের প্র¯্রাব বাহিত লেপ্টোস্পাইরা নামক এক ধরনের রোগের প্রকোপ বাড়ছে বাংলাদেশে। পত্রিকান্তে জানা যায়, সাধারণ জ¦র, সর্দি-কাশি, জন্ডিস ও গায়ে রেশ উঠা এ রোগের লক্ষণ হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগটি সঠিকভাবে শনাক্তে ব্যর্থ হচ্ছেন চিকিৎসকরা।


ইঁদুর কামড়ানো জ¦র বা র‌্যাট বাইট ফিভার (ঝঢ়রৎরষষঁং সরহড়ৎ) : ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর কামড়ানোর দ্বারা এ রোগের বিস্তার ঘটে থাকে। স্পাইটোকিটসের (ঝঢ়রৎড়পযধবঃব) কারণে এ রোগ হয়। পৃথিবীর সর্বত্র এ রোগ দেখা যায়। অনেক সপ্তাহ পর্যন্ত এ রোগ সুপ্তবস্থায় থাকে এবং উপসর্গ সাধারণত ক্ষত সেরে ওঠার/শুকানোর পর দেখা যায়।
প্লেগ (ণবৎংরহরধ ঢ়বংঃরং) : এটি একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। প্রাথমিকভাবে এ রোগ শনাক্ত করা গেলে এন্টিবায়োটিক দ্বারা চিকিৎসা করা যায়। এ রোগের জীবনচক্র হলো-

 

স্তন্যপায়ী প্রাণী ফ্লি (পোকা) স্তন্যপায়ী প্রাণী    
ইঁদুর জাতীয় প্রাণীরা এ রোগের প্রাথমিক পোষক। ইতিহাস থেকে জানা যায়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি ঘটার পরও প্লেগ পৃথিবীব্যাপী পূর্বের ন্যায় মহামারি হিসেবে দেখা দিতে পারে। যদিও পৃথিবী অনেকাংশে এটি স্বাস্থ্যের জন্য একটি বিরাট সমস্যা হিসেবে বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে। এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়াতে ২০ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সর্বশেষ এ রোগ মহামারি আকারে অবতীর্ণ হয়েছিল। ১৯৫০ সালে প্লেগের কারণে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্য মিজোরামে দুর্ভিক্ষ ও এমনকি সরকার পরিবর্তনের হাওয়া লাগিয়েছিল। ১৯৯৪ সালে ভারতের সুরাটে এবং ২০০৭ সালে ভারতের মিজোরাম ও মিয়ানমারে এ রোগের কারণে ব্যাপক খারাপ অবস্থা বিরাজ করেছিল।
সালমোনেলোসিস (ঝধষসড়হবষষড়ংরং): পৃথিবীব্যাপী সালমোনেলা (ঝধষসড়হবষষধ) ব্যাকটেরিয়া দ্বারা মানুষে সংক্রমণ হয়। সাধারণত এ রোগে আক্রান্ত ইঁদুর ও মাইসের মল দ্বারা দূষিত পানি অথবা খাদ্য গলাধ ঃ করণের মাধ্যমে হয়ে থাকে। কিন্তু সঠিকভাবে প্রস্তুত নহে এরূপ খাদ্য খেলেও এ রোগ হতে পারে। অনেক প্রজাতির বিভিন্ন রকমের মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে।

 

টক্সোপ্লাজমোসিস (ঞড়ীড়ঢ়ষধংসড়ংরং) : এ রোগের কারণ ঈড়পপরফরধহ বর্গের ঞড়ীড়ঢ়ষধংসধ মড়হফর প্রজাতি। এ রোগের প্রাথমিক পোষক গৃহপালিত বিড়াল। ইঁদুর ও মাইসসহ (সরপব) অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণী এ রোগের মধ্যবর্তী পোষক।
লাসা জ¦র (খধংংধ ঋবাবৎ) : লাসা জ¦র সর্বপ্রথম আবিষ্কার হয় ১৯৬৯ সালে নাইজেরিয়ার বোর্নো প্রদেশের লাসা শহরে। লাসা ভাইরাসের এক ধরনের জীবাণুর সংক্রমণে রোগটি হয়। যেকোনোভাবে ন্যাটাল মাল্টিম্যামেট ইঁদুরের মলমূত্রের সংস্পর্শে এলে মানুষ লাসার ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। এছাড়াও  ফাটা বা ক্ষত হওয়া ত্বক অথবা শ্লেষা নিঃসরক ঝিল্লির মাধ্যমে এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে লাসা জ¦রের জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে। ২০১৮ সালে নাইজেরিয়ায় প্রাণঘাতী লাসা জ¦রে প্রায় ৯০ জনের অধিক লোক মারা যায়।
অন্যদিকে ইঁদুর তিন ধরনের কৃমি বহন করে যেমন- নেমাটোড (কেঁচো কৃমি), ট্রিমাটোড (চ্যাপ্টা কৃমি) এবং সিসটোড (ফিতাকৃমি)। এসব কৃমি বিভিন্ন ধরনের রোগ ছড়ায়, যেমন- অহমরড়ংঃৎড়হমুষঁং পধহষড়হবহংরং ও ঈধষড়ফরঁস নবঢ়ধঃরপঁস রোগ। শিশুরা এসব রোগে আক্রান্ত হলে মানসিক ভারসাম্যহীন বা হাবাগোবা হয়।

 

আমাদের করণীয়
ইঁদুরের নোংরা জায়গা পছন্দ, তাই ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বাড়িতে আবর্জনা ফেলার বিন সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে এবং ঢেকে রাখতে হবে। বাড়িতে ইঁদুর প্রবেশের পথ বন্ধ করে দিতে হবে এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বাড়ির আশপাশের ঝোপ-ঝাড়-আগাছা, ছাদ ঘেঁষে উঠা গাছ বা বেয়ে উঠা লতাজাতীয় গাছ পরিষ্কার করতে হবে। পোষা প্রাণী এবং খাঁচায় পোষা পাখি থেকে পতিত ফল, বীজ ও অন্যান্য বর্জ্য নিঃসরণ করতে হবে। খাবারসামগ্রী ভালোভাবে মুখ বন্ধ করে পাত্রে রাখতে হবে। ইঁদুরের সংস্পর্শে আসা খাদ্য বা পানীয় ফেলে দিতে হবে। থালা-প্লেট ব্যবহারের পূর্বে গরম পানি ও ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। খাবার তৈরি, খাবার খাওয়া, পানীয় পানের আগে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে। নির্দিষ্ট জায়গায় ইঁদুরের সক্রিয় উপস্থিতি দেখা গেলে সেখানে জুতা পরতে হবে এবং সেখানে শোয়া বা ঘুমানো যাবে না। ইঁদুর বা মাউস যদি কাউকে কামড় দেয় প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে আক্রান্ত স্থান সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে এবং দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। যেখানে সারা বছর খাদ্য, বাসস্থান ও পানির নিশ্চয়তা প্রদানের স্থায়ী পরিবেশ রয়েছে সেখানে ইঁদুরের সংখ্যা বেশি। যেমন শহরে গ্রামের চেয়ে ইঁদুরের সংখ্যা বেশি। শহরের ডাস্টবিন ইঁদুরকে সারা বছর খাদ্য ও বাসস্থানের স্থায়ী নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। ড্রেন ও ছিদ্র পাইপ ইঁদুরকে পানির নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। ঘর-বাড়িতে বছরের নির্দিষ্ট কোন সময় নয়, সারা বছর ইঁদুর দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। বসতবাড়িতে বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে মশা নিধনের মতো ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি নেয়া যেতে পারে।


আন্তঃপ্রতিষ্ঠান যোগাযোগ বৃদ্ধি
সরকারের জনস্বাস্থ্য (চঁনষরপ ঐবধষঃয) বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণে ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ চঁনষরপ ঐবধষঃয (ওচঐ) ও ঘধঃরড়হধষ ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ চৎবাবহঃরাব ধহফ ঝড়পরধষ গবফরপরহব (ঘওচঝঙগ) কাজ করে যাচ্ছে। অন্যদিকে ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ ঊঢ়রফবসরড়ষড়মু, উরংবধংব ঈড়হঃৎড়ষ ধহফ জবংবধৎপয (ওঊউঈজ) জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত রোগের অতন্ত্র জরিপ, প্রাদুর্ভাব অনুসন্ধান ও গবেষণা কাজ পরিচালনা করে। এছাড়া দেশে আন্তর্জাতিক পরিম-লের প্রতিষ্ঠান ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈবহঃৎব ভড়ৎ উরধৎৎযড়বধষ উরংবধংব জবংবধৎপয, ইধহমষধফবংয (ওঈউউজ,ই) রোগ নির্ণয় ও  চিকিৎসা প্রদান করে যাচ্ছে। অপরদিকে প্রাণী চিকিৎসা বিষয়ে এ দেশে অনেকগুলো শিক্ষা-গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান। জনস্বাস্থ্য ও কৃষিতে অনিষ্টকারী ক্ষতিকর এ প্রাণী নিয়ন্ত্রণে  কৃষি সংশ্লিষ্ট শিক্ষা-গবেষণা-সম্প্রসারণ প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে মানুষ ও প্রাণী চিকিৎসা সম্পূর্ণ আলাদা একটি ক্ষেত্র। বিদ্যমান ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য বিষয়ে মানুষের চিকিৎসক, প্রাণী চিকিৎসক এবং কৃষি বিশেষজ্ঞ/সম্প্রসারণবিদদের মাঝে আন্তঃযোগাযোগ বা জ্ঞান বিনিময়ের ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ ঘাটতি রয়েছে। মহামারি বিষয়ে গবেষণাসহ অংশীজনের মাঝে আন্তঃযোগাযোগ বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি।
ইঁদুরের উপদ্রব বেশি হলে সম্ভাব্য সব রকম দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করেই ইঁদুর দমন করা উচিত। ইঁদুর দমনের জন্য কোন একটি একক পদ্ধতি খুব বেশি কার্যকর নয়,  এক্ষেত্রে একাধিক বা সমন্বিত দমন পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। ইঁদুর দমনের সফলতা নির্ভর করে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর। অতএব, সম্মিলিতভাবে ইঁদুর দমন করলেই কেবল ইঁদুরের উপদ্রব কমিয়ে ইঁদুরের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পাবে ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত হবে।

কৃষিবিদ মো. আবু সায়েম

অতিরিক্ত উপপরিচালক (এলআর), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর। মোবাইল নম্বর-০১৭১৯৫৪৭১৭৯। ইমেইল- ংধুবসফধব@ুধযড়ড়.পড়স

 

বিস্তারিত
মাঠের শাকসবজি ও ফলে ইঁদুরের ক্ষতি এবং দমন ব্যবস্থাপনা

ইঁদুর স্তন্যপায়ী, সর্বভুক ও নিশাচর  প্রাণী। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে ফসলের জন্য ক্ষতিকর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে ইঁদুর মানুষের প্রধান শত্রু। মানুষের আশপাশে থেকেই এরা মাঠে, গুদামে, বাসাবাড়িতে, অফিস আদালতে প্রতিনিয়ত ক্ষতি করে চলেছে। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যেখানে ইঁদুরের সমস্যা নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (১৯৬৭) হিসাব মতে, ইঁদুর প্রতি বছর বিশ্বের ৩ কোটি ৩৩ লক্ষ টন খাবার নষ্ট করে। এশিয়ায় ইঁদুর বছরে ১৮ কোটি মানুষের ১২ মাসের খাবার নষ্ট করে। বাংলাদেশে প্রায় ৫০-৫৪ লক্ষ লোকের এক বছরের খাবার ইঁদুরের কারণে নষ্ট হয়। ইঁদুর দ্বারা বছরে ফসল ও অন্যান্য  জিনিসপত্রের প্রায় ১.৫-২.০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। তাছাড়াও ইঁদুর প্লেগসহ প্রায় ৬০ প্রকার রোগ ছড়ায়।  শাকসবজি ও ফলে প্রধানত  দুই জাতের ইঁদুর বেশি ক্ষতি করে থাকে যাহা মাঠের কালো ইঁদুর ও গেছো ইঁদুর/ ঘরের ইঁদুর নামে   পরিচিত।


মাঠের কালো ইঁদুর বা ছোট ব্যান্ডিকুট ইঁদুর

(Lesser bandicoot rat, Bandicota  bengalensis(Gray)
সব রকমের কৃষিজাত ফসলেই এদের পাওয়া যায়। এছাড়া শহর এলাকা, ঘর বাড়ি এবং গুদামেও এদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। মাঠের কালো ইঁদুর মাঠ ফসলে সব চেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। এরা মাঝারি আকৃতির, ওজন প্রায় ১৫০-৩৫০ গ্রাম, পশম কালো ধূসর রঙের। মাথা ও শরীরের মোট দৈর্ঘ্যরে তুলনায় লেজ কিছুটা খাটো। ফলগাছ ছাড়া সকল ধরনের কৃষিজাত ফসলে এরা প্রত্যক্ষভাবে আক্রমণ করে ক্ষতি করে থাকে। ইঁদুর মাঠ ও গুদামে উভয় স্থানেই গর্ত করে, ফসল কেটে, খেয়ে, গর্তে নিয়ে, গুদামে খেয়ে, পায়খানা প্রস্রাব ও পশম, মাটি ও শস্যের সাথে মিশিয়ে ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে।


গেছো ইঁদুর/ ঘরের ইঁদুর

(House/ roof rat) Rattus rattus
গেছো ইঁদুর সাধারণত মাঝারি ধরনের, লম্বাটে, লালচে বাদামি বর্ণের হয়ে থাকে। পূর্ণ বয়স্ক অবস্থায় এদের ওজন প্রায় ১০০- ১৫০ গ্রাম। শরীরের নিচের দিকটা সাদাটে বা হালকা বর্ণের। দেহের দৈর্ঘ্য ৭-২২ সেমি. মাথা ও শরীরে মোট দৈর্ঘ্যরে তুলনায় লেজ লম্বা। লেজের দৈর্ঘ্য ৫-২৩ সেমি.। এই জাতের ইঁদুর গুদাম জাত শস্য, ঘরে রাখা খাদ্যশস্য, ফলমূল, তরিতরকারি ইত্যাদির ক্ষতি সাধন করে থাকে। এরা মাটিতে গর্ত না করে ঘরের মাচায় বা গুপ্ত স্থানে, গাছে বাসা তৈরি করে বংশবৃদ্ধি করে। এদেরকে সাধারণত মাঠে কম দেখা যায়, তবে বাড়ির আশপাশে, উঁচু এলাকায় ও নারিকেল জাতীয় গাছে বেশি দেখা যায়।

 

সবজি ফসলে ইঁদুরের ক্ষতি
ইঁদুর সব রকম সবজিতে আক্রমণ করে থাকে তবে চারা গাছ ও পরিপক্ব অবস্থায় বেশি ক্ষতি করে থাকে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, মরিচ, ব্রোকলি এবং বেগুনের চারা ইঁদুরের দ্বারা ক্ষতি হয়। মাঠের কালো ইঁদুর (Bandicota  bengalensis) জমিতে গর্ত করে এবং গাছের  লতা পাতা কেটে দেয় ও গর্তে নিয়ে জমা করে পরবর্তী পর্যায়ে যখন ফল ধরে তখন ফল খেয়ে নষ্ট করে ও ফল পচে যায় এবং খাবার অনুপযোগী হয়ে পরে। গেছো ইঁদুর বা জধঃঃঁং   ৎধঃঃঁং  এদের বেশি ক্ষতি করে থাকে। টমেটো, বাঁধাকপি ইত্যাদি সবজির ও অনেক ক্ষতি করে থাকে।


কুমড়া জাতীয় সবজিতে ইঁদুরের ক্ষতির ধরণ
মিষ্টিকুমড়া, করলা, তরমুজ, বাঙি, লাউ, শশা ইত্যাদি কুমড়া জাতীয় সবজি ক্ষেতে ইঁদুর প্রথমে এলোমেলোভাবে গর্ত করে মাটি উঠিয়ে ডিবি করে এবং গাছের লতা পাতা কেটে দেয় ও গর্তে নিয়ে জমা করে। পরবর্তী পর্যায়ে গাছে ফল ধরলে  ইঁদুর ফল খেয়ে ক্ষত সৃষ্টি করে ও ফল পচে নষ্ট হয়ে যায়। এভাবে ইঁদুর সবজি ক্ষেতে ক্ষতি করে থাকে। মাঠের কালো ইঁদুর সবজি ক্ষেতে প্রধানত বেশি ক্ষতি করে থাকে।


আলু ও মিষ্টিআলুতে ইঁদুরের ক্ষতির ধরন
গোলআলুর ক্ষেতে গাছের অংগজ বৃদ্ধির সময় ইঁদুর প্রথমে মাঠে ২/১টি গর্ত করে মাটি উপরে উঠিয়ে ক্ষতি করে থাকে। ইঁদুর আলুর মাটির ওপরের কা- ও ডগা কেটে  দেয়। আলু ধরার সময় ইঁদুর গাছের শিকড় কেটে দেয়। তারপর আলু যখন বড় হয় তখন ইঁদুর মাটির নিচের আলু গর্ত করে  খেয়ে  ক্ষতি করে থাকে। সাধারণত ইঁদুর আলুর শতকরা ৫-৭ ভাগ ক্ষতি করে থাকে। মিষ্টিআলুর ক্ষেতে ইঁদুরের আক্রমণ আলু থেকে বেশি দেখা যায়। মিষ্টিআলুর ক্ষেত লতায় ঢেকে যায় ফলে ইঁদুর প্রচুর সংখ্যক গর্ত করে ডগা ও লতা কেটে গর্তে নিয়ে যায়। ক্ষেতে গর্ত করে মাটির ঢিবি তৈরি করে। অর্ধ পরিপক্ব মিষ্টিআলু কামড়িয়ে খেয়ে ক্ষত সৃষ্টি  করে প্রচুর পরিমাণে ক্ষতি করে থাকে। ফলে মিষ্টিআলুর ফলন কমে যায়।

 

ফলে ইঁদুরের ক্ষতি  
নারিকেল, কমলালেবু, জম্বুরা, আনারস, পেঁপে ইত্যাদি ফলে ইঁদুর অনেক ক্ষতি করে। বিভিন্ন ফলের চারা গাছ এবং পরিপক্ব ফলে অর্থনৈতিকভাবে অনেক ক্ষতি হয়ে থাকে। পেঁপে ও নারিকেলের চারা ইঁদুর দ্বারা অনেকটা ক্ষতি হয়। চারা অবস্থায় ক্ষতির  পরিমাণ প্রায় ৪০-৫০% পর্যন্ত হয়ে থাকে। কমলালেবু, জাম্বুরা, মাল্টা ফলের শাস খেয়ে ফেলে যার ফলে খাবারের অনুপযোগী হয়ে যায়।

 

নারিকেলের ক্ষয়ক্ষতির নমুনা
সাধারণত গেছো ইঁদুর নারিকেলের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। একটি জরিপে দেখা গিয়েছে যে, পরিপক্ব নারিকেলের চেয়ে কচি ডাবে ক্ষতির পরিমাণ বেশি। ফলে ডাব ছিদ্র যুক্ত হয়ে যায় এবং গাছ থেকে মাটিতে ঝরে পড়ে। এতে নারিকেল পরিপক্ব হতে পারে না এবং ফলন অনেক কমে যায়। বাংলাদেশে দক্ষিণ অঞ্চল বরিশাল, খুলনায় নারিকেলের বেশি ক্ষতি পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত জরিপে দেখা গেছে, গড়ে বছরে গাছপ্রতি ১৫-২০টি নারিকেল ইঁদুর দ্বারা ক্ষতি বা নষ্ট হয় যার আনুমানিক মূল্য     ২৫০-৪০০ টাকা।

 

আনারসে ক্ষতির ধরন  
দুই ধরনের ইঁদুর আনারসের ক্ষতি করে থাকে। সাধারণত আনারসের নিচের দিকে যেখান থেকে পাকা আরম্ভ করে সেখান থেকে ২-৩ ব্যাসার্ধের বাঁকানো গর্ত করে আনারসের ক্ষতি করে থাকে। ইঁদুর কোনো কোনো সময়  চিবিয়ে আনারসের ক্ষতি করে থাকে। ফলে বাজারে এর দাম কমে যায় এবং আনারসের ছত্রাক রোগ হয়ে পচে নষ্ট হয়। এভাবে আনারসে প্রায় শতকরা ৬-৯ ভাগ ক্ষতি করে থাকে।

 

সমন্বিত ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা  
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুধাবন করা প্রয়োজন যে, ইঁদুর দমন একটি পরিবেশগত কৌশল যে ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা, কিন্তু কোন প্রজাতিকে ধ্বংস করা নয়। ইঁদুর দমনের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, ইঁদুরের মৌলিক চাহিদা যেমন খাদ্য ও বাসস্থান সম্পর্কে জানা এবং এই সব উপাদানগুলো সীমিত করা যা ইঁদুরের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
ইঁদুর দমন পদ্ধতিসমূহকে আমরা সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। (ক) পরিবেশসম্মতভাবে ইঁদুর দমন বা অরাসায়নিক পদ্ধতি (খ) বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইঁদুর দমন বা রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুুর দমন ।


ক) পরিবেশ সম্মতভাবে দমন : কোন রকম বিষ ব্যবহার না করে অর্থাৎ পরিবেশের কোন ক্ষতি না করে ইঁদুর দমনই হলো পরিবেশসম্মতভাবে ইঁদুর দমন বা অরাসায়নিক পদ্ধতি। বিভিন্ন ভাবে এটা করা যায়। যেমন-
 

পরিদর্শন ও সজাগ দৃষ্টির মাধ্যমে
ইঁদুর দমনের সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এ সমস্যা সম্বন্ধে সর্বদা সজাগ থাকা যার অর্থ হচ্ছে ঘর বাড়িতে বা ক্ষেত খামারে ইঁদুরের উপস্থিতি, গতিবিধি এবং আক্রমণের তীব্রতার ওপর সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখা এবং নিয়মিত পরিদর্শন করা। ইঁদুরের উপস্থিতির কোন চিহ্ন দেখা মাত্র তাকে খুঁজে বের করে যে কোন উপায়ে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করা উচিত। এ পরিদর্শন কোন এলাকার ইঁদুর দমন পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 

আশ্রয়স্থল কমানো/বাসস্থান ব্যবস্থাপনা
*গভীর চাষাবাদ, ফসলি জমি ও আইলের উপর আগাছা পরিষ্কার করেও ইঁদুরের সংখ্যা কমানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়।
*ফসলের অমৌসুমে আশেপাশের আগাছা পরিষ্কার করে ইঁদুরের খাদ্য ও বাসস্থানের উৎস কমিয়ে ইঁদুরের  সংখ্যা কমানো যায়। আগাছা পরিষ্কার করার ফলে শিকারী প্রাণীর জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং ইঁদুর অন্য স্থানে চলে যায়।
*ফসল কাটার পর ধানের অবশিষ্টাংশ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে বা সরিয়ে ইঁদুরের সংখ্যা সীমিত করা যায়।


ধাতব পাত দ্বারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে ফল গাছে ইঁদুর দমন : নারিকেল গাছসহ অন্যান্য গাছে ইঁদুর দমনের ক্ষেত্রে ধাতব পাত দ্বারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে ফল গাছে সাফল্যজনকভাবে ইঁদুর দমন করা যায়। এক্ষেত্রে টিনের পাত লাগানোর পূর্বে গাছকে ইঁদুর মুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব কমপক্ষে ৫ ফুট বা ২ মিটার ব্যবধান হতে হবে। যাতে ইঁদুর অন্য গাছ থেকে ডাল বেয়ে টিন লাগানোর গাছে না আসতে পারে। নারিকেল, সুপারি গাছসহ ফল উৎপাদনকারী গাছের গোড়া হতে ২ মিটার ওপরে গাছের খাড়া কা-ের চারিদিকে  টিনের পাত শক্তভাবে আটকিয়ে দিতে হয়। ইঁদুর গাছের গোড়া (নিচ) থেকে উপরে উঠতে গিয়ে টিনের পাত কিছুটা মসৃণ হওয়ার বাধা প্রাপ্ত হয়ে ফসকে পড়ে যায় ফলে উপরে উঠতে পারে না। এই পদ্ধতি অরাসায়নিক হওয়ায় পরিবেশ দূষণমুক্ত, অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী ও লাভজনক। সাধারণত এ পদ্ধতি ব্যবহারে ১টি নারিকেল গাছে ১০০-১৫০ টাকা খরচ হয়। একবার টিনের পাত লাগালে ৪-৫ বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকে।


জৈব নিয়ন্ত্রণ বা পরভোজী প্রাণীর মাধ্যমে ইঁদুর দমন : জীবিত কোনো প্রাণীকে অন্য কোনো জীবিত প্রাণী দ্বারা নিয়ন্ত্রণকেই জৈব নিয়ন্ত্রণ বলে। অন্যান্য প্রাণীর মতো ইঁদুর জাতীয় প্রাণীরও পরভোজী প্রাণী আছে, তন্মধ্যে বিড়াল, বনবিড়াল, কুকুুর, খেকশিয়াল, পাতিশিয়াল, বাজপাখী, চিল, পেঁচা, বেজি, সাপ, গুঁইসাপ ইত্যাদি প্রাণী  ইঁদুর খায়। এ সব উপকারী পরভোজী প্রাণী মেরে ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে।


নিবিড়ভাবে ফাঁদ পাতার মাধ্যমে  ইঁদুর দমন : নিবিড়ভাবে বিভিন্ন রকমের জীবন্ত ও মরণ ফাঁদ ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করা যায়। ফাঁদে ইঁদুরকে আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন ধরনের খাদ্য টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সহজে স্থানীয় ভাবে পাওয়া যায় এমন খাদ্যই টোপ হিসাবে ব্যবহার করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ শুঁটকি মাছ, বিস্কুট, আলু, পাউরুটি ইত্যাদি।
 

ফাঁদ স্থাপনের কৌশল
*সাধারণত যেখানে ইঁদুর দেখা যায় এবং যেখান দিয়ে ইঁদুর চলাফেরা করে যেমন দেয়ালের পার্শ্ব, চালের উপর, গাছের ওপর বা গর্তের কাছাকাছি সেখানে ফাঁদ স্থাপন করা উচিত।
*সতেজ গর্তে কাঁচা গোবরের মিশ্রণ (২০-৩০%) দিয়েও  ইঁদুর দমন করা যায়।


*গর্তে পানি  ও ধোঁয়া দিয়ে ইঁদুর দমন করা যায়
(খ) রাসায়নিক দমন বা ইঁদুরনাশক দিয়ে দমন  (ঈযবসরপধষ ঈড়হঃৎড়ষ গবঃযড়ফ) পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই বহু যুগ ধরে রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন চলে আসছে। বিষক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে রাসায়নিক পদ্ধতিকে মূলত দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে, (ক) তীব্র বা তাৎক্ষণিক বিষ (অপঁঃব ঢ়ড়রংড়হ) (খ) বহুমাত্রা বা দীর্ঘমেয়াদি বিষ (ঈযৎড়হরপ ঢ়ড়রংড়হ)।
ক. তীব্র বা তাৎক্ষণিক বিষ (অপঁঃব ঢ়ড়রংড়হ)
যে সমস্ত বিষ খেলে ইঁদুরের মৃত্যু ঘটায় তাদেরকে তীব্র  বিষ বলা হয়। যেমন-জিংক ফসফাইড, বেরিয়াম কার্বনেট, আরসেনিক ট্রাইঅক্সাইড, ব্রোমেথিলিন ইত্যাদি। একমাত্র ‘জিংক ফসফাইড’ সরকার অনুমোদিত তাৎক্ষণিক বা তীব্র বিষ। এ ধরনের বিষটোপ ইঁদুরের পাকস্থলীতে এসিডের সংস্পর্শে এসে এক প্রকার বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি করে। এ গ্যাস লিভার ও কিডনিকে অকেজো করে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ করে ইঁদুরের মৃত্যু ঘটায়।
বিষটোপ তৈরিও খুব সহজ। তাই অতি সহজে কৃষক ভাইয়েরা জিংক ফসফাইড বিষটোপ ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করতে পারে। এই বিষ থেকে তৈরি বিষটোপ খেয়ে ইঁদুর সাথে সাথেই মারা যায়। কিন্তু এই বিষটোপের প্রধান অসুবিধা হলো বিষটোপ লাজুকতা। বিষটোপ ব্যবহারের পূর্বে ২-৩ দিন বিষহীন টোপ ব্যবহার করে ইঁদুরকে টোপ খেতে অভ্যস্ত করে নিলে ইঁদুর দমনে সফলতার হার অনেক বেড়ে যায়। তবে কোনো ক্রমেই পর পর দু-তিন রাত বিষটোপ ব্যবহারের পর ঐ স্থানে এক মাস আর এ বিষ ব্যবহার না করাই ভালো।
(খ) দীর্ঘমেয়াদি বিষ  (ঈযৎড়হরপ ঢ়ড়রংড়হ)
যে সমস্ত বিষ খেলে ইঁদুর তাৎক্ষণিকভাবে বিষক্রিয়ায় মারা না গেলেও ধীরে ধীরে অসুস্থ বা দুর্বল হয়ে ২-১৪ দিনের মধ্যে মারা যায় তাদেরকে  দীর্ঘমেয়াদি বিষ বলা হয়। সকল দীর্ঘমেয়াদি বিষই রক্তজমাট বাঁধার ক্ষমতাকে ব্যাহত করে প্রধানত শরীরের ভেতরে বা বাইরে অনবরত রক্তক্ষরণের মাধ্যমে ইঁদুর দুর্বল হয়ে মারা যায়। ইঁদুর এ ধরনের বিষ খেয়ে আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে গর্তের ভেতর মারা যায়, সেজন্য মৃত ইঁদুর সচরাচর চোখে পড়ে না। এ ধরনের বিষ খেলে সহসা কোনো আক্রান্ত লক্ষণ ধরা পড়ে না বিধায় পরিবারের অন্যান্য ইঁদুররাও এ ধরনের বিষটোপ খেতে কোনো কুণ্ঠা/দ্বিধাগ্রস্ত হয় না। ফলে একসাথে অনেক ইঁদুর মারা যাবার সম্ভাবনা থাকে। এ ধরনের বিষটোপে বিষটোপ লাজুকতা দেখা যায় না। পরীক্ষামূলকভাবে মাঠে এ জাতীয় বিষ দ্বারা শতকরা নব্বই ভাগ ইঁদুর মারা সম্ভব। এদেশে ল্যানির‌্যাট,  ক্লের‌্যাট, ব্রোমাপয়েন্ট নামে বিভিন্ন কীটনশকের দোকানে পাওয়া যায়।

 

বিষটোপ প্রয়োগ পদ্ধতি
মাঠে যেখানে ইঁদুরের উপস্থিতি বুঝা যায় সেখানে বা ইঁদুর চলাচলের রাস্তায় বা সতেজ গর্তের আশপাশে জিংক ফসফাইড বিষটোপ কোন পাত্রে রেখে দিতে হবে। তাই জমির উপরে বিষটোপ না দিয়ে ৩-৪ গ্রাম বিষটোপ  একটি কাগজ দিয়ে পুঁটলি বেঁধে সতেজ গর্তের মুখ পরিষ্কার করে গর্তের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে হবে। তবে সব সময় লক্ষ রাখতে হবে কাগজটি যেন কখনো মাটির নিচে চাপা না পড়ে। এরপর গর্তের মুখ হালকাভাবে মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। জমির উপর ও গাছে বিষটোপ ব্যবহারের সময় বেইট স্টেশনের ভেতর প্রয়োগ করলে সফলতা অনেক বেশি হয়।


এভাবে বিষটোপ প্রয়োগের সুবিধা হলো (১) এই বিষটোপ  ইঁদুর বেশি খায় (২) অন্য কোন প্রাণী যেমন পাখি, বিড়াল, কুকুর বা অন্যান্য পোষা প্রাণী এই বিষটোপ খেতে পারে না। এতে অপ্রত্যাশিত প্রাণীর মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকেনা। তাছাড়া পরিবেশ দূষণের সম্ভাবনাও খুব কম। মৃত ইঁদুর গর্তের ভেতর থাকে বলে মৃত ইঁদুর খেয়ে কাক, চিল ও বিড়াল মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এই পদ্ধতির সফলতা প্রায় ২৫% বেশি। তাছাড়া কৃষক ভাইদের তেমন কোন বাড়তি খরচ নেই। তাই গর্তের ভেতরের ইঁদুর সফলভাবে দমনের জন্য এই পদ্ধতি বেশ লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা সহজেই এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন।


গ্যাসবড়ি দিয়ে ইঁদুর দমন
বিষটোপ ছাড়া এক প্রকার গ্যাস বড়ি দিয়েও ইঁদুর দমন করা যায়। যেমন-এ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট। এই ট্যাবলেট বাজারে ফসটক্সিন, কুইকফিউম, কুইকফস, এলুমফস, এগ্রিফস, গ্যাসটক্সিন নামে পরিচিত। ইঁদুর আছে এমন  গর্তের  মুখের মাটি  সরিয়ে  প্রতিটি সতেজ গর্তের ভিতর একটি করে বড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে গর্তের মুখ ভালোভাবে বন্ধ করে দিতে হবে।
বেশির ভাগ ইঁদুর গর্তে বাস করে বলে সম্পূর্ণভাবে দমন বা নির্মূল করা সম্ভব হয় না। তাই এদের সংখ্যা কমিয়ে মূল্যবান ফসল রক্ষা করে খাদ্যাভাব দূর করার চেষ্টা করতে হবে। কোন  নির্দিষ্ট  একক  পদ্ধতি  ইঁদুর  দমনের  জন্য  যথেষ্ট নয়। ইঁদুর  দমনের  সফলতা  নির্ভর  করে  সকলের  সম্মিলিত  প্রচেষ্টা এবং বিভিন্ন সময়োপযোগী পদ্ধতি ব্যবহারের  উপর। অতএব সম্মিলিত এবং সময়োপযোগী দমন পদ্ধতি প্রয়োগ করলেই ইঁদুরের উপদ্রব কমানো সম্ভব।

 

ড. মোঃ শাহ আলম

প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা,অনিষ্টকারী মেরুদন্ডী প্রাণী বিভাগ, বিএআরআই, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৯১১৮৫৭৫৮৬, alamvpd@gmail.com

বিস্তারিত
কার্তিক মাসের কৃষি

ঋতু চক্রের কার্তিক মাসে হেমন্তের আগমন। হেমন্তে বাংলার রোদের তেজ কমে গরমের তীব্রতা কমতে শুরু করে।
সোনালী ধানের সম্ভার সুঘ্রাণে ভরে থাকে বাংলার মাঠ প্রান্তর। কৃষক মেতে ওঠে ঘাম ঝরানো সোনালী ফসল কেটে মাড়াই ঝাড়াই করে শুকিয়ে গোলা ভরতে। সাথে সাথে শীতকালীন ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো শুরু করতে। তাহলে আসুন আমরা জেনে নেই কার্তিক মাসে সমন্বিত কৃষির সীমানায় কোন কাজগুলো আমাদের করতে হবে।

 

আমন ধান
এ মাসে অনেকের আমন ধান পেকে যাবে তাই রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে। আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে প্রথমেই সুস্থ সবল ভালো ফলন দেখে ফসল নির্বাচন করতে হবে। এরপর কেটে, মাড়াই-ঝাড়াই করার পর রোদে ভালোমতো শুকাতে হবে। শুকানো গরম ধান ঝেড়ে পরিষ্কার করে ছায়ায় রেখে ঠা-া করে বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ রাখার পাত্রটিকে মাটি বা মেঝের উপর না রেখে পাটাতনের উপর রাখতে হবে। পোকার উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে ধানের সাথে নিম, নিসিন্দা, ল্যান্টানার পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে মিশিয়ে দিতে হবে।

 

গম
কার্তিক মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম বীজ বপনের প্রস্তুতি নিতে হয়।  দো-আঁশ মাটিতে গম ভাল হয়। অধিক ফলনের জন্য গমের আধুনিক জাত যেমন- বারি গম-২৫, বারি       গম-২৮, বারি গম-২৯, বারি গম-৩০, বারি গম-৩১, বারি গম-৩২, বারি গম-৩৩ এবং লবণাক্ততাসহিষ্ণু বিনা গম-১ রোপণ করতে পারেন। বীজ বপনের আগে অনুমোদিত   ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। সেচযুক্ত চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৬ কেজি এবং সেচবিহীন চাষের জন্য বিঘা প্রতি ১৩ কেজি বীজ বপন করতে হবে। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার জমি তৈরির শেষ চাষের সময় এবং ইউরিয়া তিন কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপনের ১৩-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ প্রয়োজন এবং এরপর প্রতি ৩০-৩৫ দিন পর ২ বার সেচ দিলে খুব ভালো ফলন পাওয়া যায়।

 

আখ
এখন আখের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। ভালোভাবে জমি তৈরি করে আখের চারা রোপণ করা উচিত। আখ রোপণের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব ৯০ সেমি. থেকে ১২০ সেমি. এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৬০ সেমি. রাখতে হয়। এভাবে চারা রোপণ করলে বিঘাপ্রতি ২২০০-২৫০০টি চারার প্রয়োজন হয়।

 

ভুট্টা
ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এ সময় যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে এবং জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হবে। ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো খই ভুট্টা, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৯, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৬, বারি মিষ্টি ভুট্টা-১, বারি বেবি কর্ণ-১ এসব। খরা প্রধান এলকা ও সাদা দানার ক্ষেত্রে বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১২ ও বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৩ আবাদ করতে পারেন।

 

সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল
কার্তিক মাস সরিষা চাষেরও উপযুক্ত সময়। সরিষার প্রচলিত স্বল্পমেয়াদি জাতগুলোর মধ্যে বারি সরিষা-১৪, বারি  সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৭, বিনাসরিষা-৪. বিনাসরিষা-৯ ইত্যাদি এবং দীর্ঘমেয়াদি জাতগুলোর মধ্যে বারি সরিষা-১১, বারি সরিষা-১৬ উল্লেখযোগ্য। জাতভেদে সামান্য তারতম্য হলেও বিঘাপ্রতি গড়ে ১ থেকে ১.৫ কেজি সরিষার বীজ প্রয়োজন হয়। বিঘাপ্রতি ৩৩-৩৭ কেজি ইউরিয়া, ২২-২৪ কেজি টিএসপি, ১১-১৩ কেজি এমওপি, ২০-২৪ কেজি   জিপসার ও ১ কেজি দস্তা সারের প্রয়োজন হয়। সরিষা ছাড়াও অন্যান্য তেল ফসল যেমন- তিল, তিসি, চিনাবাদাম, সূর্যমুখী এ সময় চাষ করা যায়।

 

আলু
আলুর জন্য জমি তৈরি ও বীজ বপনের উপযুক্ত সময় এ মাসেই। হালকা প্রকৃতির মাটি অর্থাৎ বেলে দো-আঁশ মাটি আলু চাষের জন্য বেশ উপযোগী। আগামজাত ও ভালো ফলনের জন্য যে জাতগুলো উপযুক্ত তাহলো বারি আলু-১৩ (গ্রানোলা), বারি আলু-২৯ (কারেজ), বারি আলু-৪১, বারি আলু-৭৪ (বারসেলোনা) এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ ও খাবার উপযোগী হিসেবে বারি আলু-২৫, বারি আলু-২৮, বারি আলু-৩৫, বারি আলু-৩৬, বারি আলু-৪৬, বারি আলু-৭৬, বারি আলু-৭৭, বারি আলু-৭৮, বারি আলু-৭৯ ইত্যাদি এসব। প্রতি একর জমি আবাদ করতে ৬০০ কেজি বীজ আলুর দরকার হয়। এক একর জমিতে আলু আবাদ করতে ১৩০ কেজি ইউরিয়া, ৯০ কেজি টিএসপি, ১০০ কেজি এমওপি, ৬০ কেজি জিপসাম এবং ৬ কেজি দস্তা সার প্রয়োজন হয়। তবে এ সারের পরিমাণ জমির অবস্থাভেদে কম-বেশি হতে পারে। তাছাড়া একরপ্রতি ৪-৫ টন জৈবসার ব্যবহার করলে ফলন অনেক বেশি পাওয়া যায়। আলু উৎপাদনে আগাছা পরিষ্কার, সেচ, সারের উপরিপ্রয়োগ, মাটি আলগাকরণ বা কেলিতে মাটি তুলে দেয়া, বালাই দমন, মালচিং করা আবশ্যকীয় কাজ। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বিনা চাষে মালচিং দিয়ে আলু আবাদ করা যায়।

 

মিষ্টি আলু
নদীর ধারে পলি মাটিযুক্ত জমি এবং বেলে দো-আঁশ প্রকৃতির মাটিতে মিষ্টি আলু ভালো ফলন দেয়। কমলা সুন্দরী, বারি মিষ্টি আলু-৪, বারি মিষ্টি   আলু-৫, বারি মিষ্টি আলু-৮, বারি মিষ্টি আলু-১১, বারি মিষ্টি আলু-১২, বারি মিষ্টি আলু-১৪   বারি মিষ্টি আলু-১৫ ও বারি মিষ্টি আলু-১৬ আধুনিক মিষ্টি আলুর জাত। প্রতি বিঘা জমির জন্য তিন গিঁটযুক্ত ২২৫০-২৫০০ খ- লতা পর্যাপ্ত। বিঘাপ্রতি ৪-৫টন গোবর/জৈবসার, ১৬ কেজি ইউরিয়া, ৪০ কেজি টিএসপি, ৬০ কেজি এমওপি সার দিতে হবে।

 

ডাল ফসল
মুসুর, মুগ, মাসকলাই, খেসারি, ফেলন, অড়হর, সয়াবিন, ছোলাসহ অন্যান্য ডাল এসময় চাষ করতে পারেন। এজন্য উপযুক্ত জাত নির্বাচন, সময় মত বীজ বপন, সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ, পরিচর্যা, সেচ, বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করতে হবে।

 

শাকসবজি
শীতকালীন শাকসবজি চাষের উপযুক্ত সময় এখন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বীজতলায় উন্নতজাতের দেশী-বিদেশী ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, বাটিশাক, টমাটো, বেগুন এসবের চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলায় বীজ বপন করতে হবে। আর গত মাসে চারা উৎপাদন করে থাকলে এখন মূল জমিতে চারা রোপণ করতে পারেন। মাটিতে জোঁ আসার সাথে সাথে শীতকালীন শাকসবজি রোপণ করতে হবে। এ মাসে হঠাৎ বৃষ্টিতে রোপণকৃত শাকসবজির চারা নষ্ট হতে পারে। এ জন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। রোপণের পর আগাছা পরিষ্কার, সার প্রয়োগ, সেচ নিকাশসহ প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে। তাছাড়া লালশাক, মুলাশাক, গাজর, মটরশুটির বীজ এ সময় বপন করতে পারেন।

 

প্রাণিসম্পদ
সামনে শীতকাল আসছে। শীতকালে পোল্ট্রিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যায়। রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড,  বসন্ত রোগ, কলেরা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। এসব রোগ থেকে হাঁস-মুরগিকে বাঁচাতে হলে এ মাসেই টিকা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। গত মাসে ফুটানো মুরগির বাচ্চার ককসিডিয়া রোগ হতে পারে। রোগ দেখা দিলে সাথে সাথে চিকিৎসা করাতে হবে।

 

গবাদিপ্রাণির আবাসস্থল মেরামত করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। গবাদি প্রাণীকে খরের সাথে তাজা ঘাস খাওয়াতে হবে। ভুট্টা, মাসকালাই, খেসারি রাস্তার ধারে বা পতিত জায়গায় বপন করে গবাদি প্রাণীকে খাওয়ালে স্বাস্থ্য ও দুধ দুটোই বাড়ে। রাতে অবশ্যই গবাদি প্রাণীকে বাইরে না রেখে ঘরের ভিতরে রাখতে হবে। তা না হলে কুয়াশায় ক্ষতি হবে। গবাদি প্রাণীকে এ সময় কৃমির ওষুধ খাওয়াতে হবে। এছাড়া তড়কা, গলাফুলা রোগের বিষয়ে সচেতন থাকলে মারাত্মক সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
 

মৎস্যসম্পদ
এ সময় পুকুরে আগাছা পরিষ্কার, সম্পূরক খাবার ও সার প্রয়োগ করতে হবে। জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাও জরুরি। রোগ প্রতিরোধের জন্য একরপ্রতি  ৪৫-৬০ কেজি চুন প্রয়োগ করতে পারেন। অংশদারিত্বের জন্য যেখানে যৌথ মাছ চাষ সম্ভব নয় সেখানে খুব সহজে খাঁচায় বা প্যানে মাছ চাষ করতে পারেন। এছাড়া মাছ সংক্রান্ত যে কোনো পরামর্শের জন্য উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।


সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, শীতকাল আমাদের কৃষির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য মৌসুম। শুকনো মৌসুম বলে এ সময় মাটিতে রস কম থাকে। তাই ফসলে চাহিদামাফিক সেচ প্রদান নিশ্চিত করতে পারলে আপনার জমির ফলন অনেক বেড়ে যাবে। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আধুনিক কৃষির সব কটি কৌশল সঠিক সময়ে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছতে পারব। কৃষির যে কোন সমস্যায় ১৬১২৩ নম্বরে কল করে নিতে পারেন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা।

 

কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম


সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। টেলিফোন :০২৫৫০২৮৪০৪, মেইল: fardousi30@gmail.com

বিস্তারিত
মাঠের ধান ফসল ইঁদুর থেকে রক্ষার আধুনিক প্রযুক্তি

ইঁদুর এক পরিচিত স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং সবচেয়ে পুরনো মেরুদ-ী বালাই যা মানুষের সাথে নিবিড়ভাবে সহাবস্থান করে। ইহা আমাদের বিভিন্ন ফসল যেমন- ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা, বিভিন্ন ফল ও শাকসবজির ক্ষতি করছে, গুদামজাত শস্যে মলমূত্র ও লোম সংমিশ্রণ করছে, আমাদের বাসাবাড়ির আসবাবপত্র, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, জামা-কাপড়, বিছানাপত্র এবং বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষতি করছে, পাশাপশি বাঁধ, রেললাইন, জাহাজ, বন্দর,   মাতৃসদন, এরোপ্লেন, সেচের নালাসহ সর্বত্র ইঁদুরের বিচরণ রয়েছে। এক কথায় কোন সম্পদই ইঁদুরের হাত থেকে রেহাই পায় না। বিভিন্ন রোগের ধারক এবং বাহক হিসেবে ইঁদুর মানুষ ও গবাদিপশুতে মারাত্মক রোগ বালাই ছড়াচ্ছে। পোকা মাকড়ের তুলনায় ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ করা আপাতত খুব কঠিন মনে হলেও অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় সঠিক জ্ঞান এবং কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ইহার সংখ্যা লাগসইভাবেই কমিয়ে আনা সম্ভব। ইঁদুর দ্বারা ফসলের যে ক্ষতি  হয় তা কমানো গেলে একদিকে যেমন খাদ্য নিরাপত্তা  নিশ্চিত হবে আবার অন্যদিকে আয়ও বাড়বে।  

 

ইঁদুর দ্বারা প্রাথমিক ক্ষতি হয় ধান, গম, বাদাম ও নারিকেল ফসলে। অন্যান্য ফসল যেমন- আলু, ডাল, সবজি, ফলমূলেরও ক্ষতি  করে। এশিয়ায় ফসল কর্তনের পূর্বে শতকরা ৫-১০ ভাগ ক্ষতি হয়। পাঁচ ভাগ ক্ষতি ধরা হলে এর পরিমাণ হয় প্রায় ৩৫ মিলিয়ন টন ধান যা উন্নয়নশীল দেশের ২৮০ মিলিয়ন মানুষের এক বছরের খাবারের সমান। ফিলিপাইনে উৎপাদিত ধানের ২০ শতাংশ ইঁদুর খেয়ে ফেলে ও নষ্ট করে। লাওসে এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৫ শতাংশ (ইরি)। বাংলাদেশে ইঁদুরের আক্রমণে বৃষ্টিনির্ভর ও সেচ সুবিধাযুক্ত ধানের জমিতে ফসল কাটার পূর্বে শতকরা ৫-১৭ ভাগ ক্ষতি হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় জলী আমন ধান (শতকরা ৩২-৩৭ ভাগ)।

 


বিভিন্ন ধরনের ইঁদুরের মধ্যে কালো ইঁদুর, মাঠের বড় কালো ইঁদুর, নরম পশমযুক্ত মাঠের ইঁদুর ও ছোট লেজযুক্ত ইঁদুর ধানের ক্ষতি করে। এদের মধ্যে কালো ইঁদুর মাঠে ও গুদামে এবং মাঠের বড় কালো ইঁদুর নিচু জমিতে বেশি আক্রমণ করে।
 

ইঁদুরের বাসস্থানসমূহ
মাঠের কালো ইঁদুর ও মাঠের বড় কালো ইঁদুর গ্রীষ্ম মৌসুমে সাধারণত ফসলের ক্ষেত ও গ্রামের বিভিন্ন স্থানে গর্তে থাকে এবং গর্তের মুখ বন্ধ রাখে ও মাটি স্তূপ করে রাখে। একটি গর্তে একটি মাত্র ইঁদুর থাকে। বর্ষার সময় নি¤œভূমি প্লাবিত হলে এবং ফসলের জমিতে বৃষ্টির পানি জমলেই ইঁদুর গিয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়। জমিতে পানি থাকে বলে ইঁদুর মাঠের উঁচু স্থানে, রেল সড়ক ও মহাসড়ক, উঁচু গ্রামীণ সড়ক, বেড়িবাঁধ, পুরোনো স্থাপনা, পুকুরের পাড়ে এবং ধানের জমির পাশে কচুরিপানার দলে অল্প জায়গায় অবস্থান করে।
এ অবকাঠামোগুলো কাটাকাটি করে ইঁদুর বাসা তৈরি করে। ফলে বেড়িবাঁধগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় জোয়ার এবং বন্যার পানি ফসলের মাঠ ও গ্রামীণ সড়ক ডুবিয়ে দিয়ে মারাত্মক ক্ষতি করে।

 

ধান ফসলে ইঁদুরের ক্ষতি
সাধারণত আগাম পরিপক্ব ধানের জমিতে ইঁদুরের আক্রমণ বেশি হয়। ইঁদুর ধান গাছের কুশি তেঁরছা কোণে (৪৫ ডিগ্রি) কেটে দেয়। গাছে শীষ বের হলে শীষ বাঁকিয়ে নিয়ে কচি ও পাকা শীষগুলো কেটে দেয়। ধান পাকলে ধানের ছড়া কেটে মাটির নিচে সুড়ঙ্গ করে জমা রাখে। ইঁদুর ধান ফসলে তিন মৌসুমেই আক্রমণ করতে পারে। তবে আমন মৌসুমে নিরাপদ আশ্রয়স্থল, পর্যাপ্ত খাদ্য এবং পানি সহজলভ্য হওয়া এবং মৌসুমের শেষভাগে বৃষ্টিপাত কম ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ সময়ে ইঁদুরের প্রজনন খুব বেশি হয়। ফলে ইঁদুরের সংখ্যা অন্যান্য মৌসুমের তুলনায় বেড়ে যায়। ইঁদুরের প্রজনন শুরুর পূর্বেই ইঁদুর নিধন করা দরকার। তাই আমন মৌসুমে ইঁদুর দমনের উপযুক্ত সময় ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক। কারণ এ সময়ে মাঠে ইঁদুরের সংখ্যা কম থাকে। মাঠে প্রচুর খাদ্য না থাকায় ইঁদুর সহজেই এ সময় বিষটোপ খেয়ে থাকে। আমন ফসল ক্ষতি করার আগেই ইঁদুর মারতে পারলে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি কম হয় এবং  ফসলের ক্ষতিও অনেক কম হয়ে থাকে। ধান রোপণের সময় ও রোপণের ৪৫-৫০ দিনের মধ্যে ধানের জমি ও আশপাশের এলাকার ইঁদুর দমনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

 

ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা
ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতির ধরন, এর ব্যাপকতা ও দমন প্রক্রিয়া অন্যান্য বালাই থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও কৌশলগত। তাই স্থান কাল পাত্রভেদে কৌশলের সঠিক ও সমন্বিত দমন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ইঁদুর দমন করতে হবে। এতে করে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি, ইঁদুর বাহিত রোগ ও পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমানো সম্ভব হবে। তবে ইঁদুরকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন। এককভাবে ইঁদুর  দমন ফলত খুব বেশি কার্যকর হয় না। সবাই মিলে একযোগে বেশি জায়গার ইঁদুর মারলে ফসল রক্ষা পায় ও ইঁদুরের সংখ্যা পরবর্তীতে বাড়তে পারে না। এজন্যই প্রতি বছর সরকারিভাবে ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালনা করা হয়ে থাকে এবং সচেতনতা বাড়িয়ে এটাকে সামাজিকভাবে আরো অংশগ্রহণমূলক করতে হবে। গ্রামে, শহরে, জমিতে সর্বত্রই একযোগে ইঁদুর  নিধন করতে হবে। যৌথভাবে এলাকাভিত্তিক ইঁদুর দমন করলে একক খরচ কমার পাশাপাশি সামগ্রিক ফলাফল দৃশ্যমান হয়। এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পরিবেশসম্মত ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম বর্তমান সময়ে বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার ধারণার ওপর ভিত্তি করে এটি পরিচালিত হচ্ছে। এখানে নিরাপত্তা, আর্থিক লাভ এবং স্থায়ী দমন ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। আমাদের দেশে ইঁদুর দমন পদ্ধতিকে       প্রধানত  তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ১) অরাসায়নিক পদ্ধতিতে দমন ২) রাসায়নিক পদ্ধতিতে দমন এবং ৩) জৈবিক পদ্ধতিতে দমন।  

 

অরাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন  
অরাসায়নিক পদ্ধতি হলো ভৌত ও যান্ত্রিক কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ইঁদুরের আক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা, যেমন-
*গর্ত খুঁড়ে ইঁদুর বের করে মেরে ফেলা ।
*ইঁদুরের গর্তে পানি ঢেলে এবং মরিচের ধোঁয়া দিয়ে ইঁদুর বের করে মেরে ফেলা।
*জমির আইল চিকন (যেমন ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি), আগাছা এবং আবর্জনা ময়লা মুক্ত রাখা।
*বাঁশের, কাঠের, লোহার ও মাটির তৈরি বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করা। যেমন- কেচিকল (করষষ ঃৎধঢ়), বাঁশের কল, বাঁশের ফাঁদ, জীবন্ত ইঁদুর ধরার ফাঁদ, মাটির ফাঁদ, মাটির চিটাগুড়ের ফাঁদ, তারের ফাঁদ। ধানের জমিতে ইঁদুর দমনের ক্ষেত্রে জীবন্ত ফাঁদ (ষরাব ঃৎধঢ়) সবচেয়ে কার্যকর। ফাঁদে টোপ হিসেবে শামুকের মাংস, ধান, নারিকেলের শাঁস, কলা ও শুঁটকি মাছ ব্যবহার করলে ইঁদুর বেশি ধরা পড়ে। তাছাড়া  ধান বা চালের সাথে নারিকেল তেল টোপ হিসেবে ব্যবহার করলে বেশ কার্যকরী ফলাফল পাওয়া যায় । ব্যাপকভাবে ফাঁদ ব্যবহার কষ্টসাধ্য হলেও ইহার মাধ্যমে ইঁদুরের সংখ্যা দ্রুত কমিয়ে আনা যায়। প্রত্যেক দিন এক বৃহৎ এলাকাজুড়ে ফাঁদ পাততে হবে এবং এটি বেশ কয়েক দিন অব্যাহত রাখতে হবে। ফাঁদ যেহেতু দীর্ঘ দিন ধরে ব্যবহার করা যায়, তাই বার বার রাসায়নিক বিষ ক্রয়ের তুলনায় খরচ কম হয় । কেচিকল দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায় এবং রাসায়নিক ব্যবহরের তুলনায় সাশ্রয়ী।
*কার্ডবোড (৩০ী৩০ সেমি), কাঠ বা লোহার সিটে ইঁদুরের আঠা মাখিয়ে আক্রান্ত ধানের জমিতে ইঁদুরের চলাচলের রাস্তায় পেতে রাখলে ইঁদুর আটকে মারা যায়।
*ধান কাটার পর উন্মুক্ত ফেলে না রেখে দ্রুত বস্তাবন্দি করতে হবে।
*একই এলাকার ধান ফসল একই সময়ে লাগানো ও কর্তন করা।
*পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে ইঁদুরের প্রকোপ কমানো যায়। বাড়ি-ঘর ও ধান ক্ষেতের আশপাশের ঝোপঝাড়, জলাশয়ের কচুরিপানা পরিষ্কার রাখা।
*ধান ক্ষেতের চারদিকে এক মিটার উচ্চতায় পলিথিন দ্বারা ঘিরে দিয়ে ইঁদুরের আক্রমণ প্রতিরোধ করা।  
* বিভিন্ন যান্ত্রিক উৎপীড়ক (রিপেলেন্ট) যেমন- জমিতে ভিডিও ফ্লিম টানিয়ে, মানুষের প্রতিকৃতি জমিতে দিয়ে অথবা আলট্রা শব্দ সৃষ্টি করে জমি থেকে ইঁদুরকে সাময়িক সরিয়ে রাখা যায়। ইঁদুর তাড়ানোর নতুন পদ্ধতি হিসেবে আমন ধান ক্ষেতে পলিথিনের ঝা-া উড়িয়ে সুফল পাচ্ছেন অনেক এলাকার  কৃষক। বাতাসের কারণে পলিথিন পৎ পৎ শব্দ করে উড়ে আর ইঁদুর মনে করে কেউ আসছে, তাই ভয়ে পালিয়ে যায়। অবশ্য বায়ুপ্রবাহ মন্থর হলে কৌশলটি ভালোভাবে কাজ করবে না। বেশি সময় ধরে একই উৎপীড়ক ব্যবহার করলে উহার কার্যকারিতা কমে যায়।

 

ফাঁদ ফসল (Trap Crop) চাষ করে ইঁদুর দমন
আগে পাকে এমন স্বল্প জীবনকালের ধান(যেমন ব্রি ধান ৬২) চাষ করে ইহাকে ফাঁদ ফসল হিসেবে ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করা যায়। এমন একটি কার্যকর ফাঁদ কৌশল হলো ট্র্যাপ ব্যারিয়ার সিস্টেম (ঞৎধঢ় ইধৎৎরবৎ ঝুংঃবস) যা ধানের জমিতে ব্যবহার করা যায়। একটি টোপ (ষঁৎব) ফাঁদ ফসল (আগাম পাকে) চাষ করে ইঁদুর ঢুকতে না পারে এরকম বেড়া দিয়ে এটাকে ঘিরে দিয়ে বেড়ার মাঝে মাঝে ফাঁদ তৈরি করে ফাঁকের ভেতরের দিকে এক সাথে অনেক ইঁদুর ধরা পড়ে এ রকম জীবন্ত ফাঁদ পেতে রাখতে হবে। ইঁদুর খাবারের আকর্ষণে ফাঁদ দিয়ে ভেতরে ঢুকার চেষ্টা করলে ধরা পড়বে। এই পদ্ধতির সফলতা পেতে হলে কাছাকাছি  সময়ে (১৫ দিনের মধ্যে) আশপাশের সকল কৃষক  জমি লাগাতে হবে এবং বেড়ার টোপ ফসল আগাম পাকতে হবে। এই টোপ ফাঁদ বেড়া পদ্ধতি তৈরি করতে যে খরচ হবে তা সকল কৃষক ভাগ করে নিবে। কোনো এলাকায় প্রতি বছর ইঁদুরের দ্বারা ১০ ভাগের বেশি ক্ষতি হলে ট্র্যাপ ব্যারিয়ার সিস্টেম গ্রহণ করা দরকার।
রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন  
রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমনে তিন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য যেমন- ১) একমাত্রা বিষটোপ ২) দীর্ঘমেয়াদি বিষটোপ এবং ৩) বিষ গ্যাসবড়ি ব্যবহার করা হয়

১) একমাত্রা বিষটোপ
ইঁদুর একবার খেলেই সঙ্গে সঙ্গে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়। এরূপ সর্বাধিক পরিচিত বিষটোপ হচ্ছে গমে মিশ্রিত জিংক ফসফাইড(<২%)। এটি ব্যবহারের কৌশল হলো জিংক ফসফাইড ছাড়া শুধু গম কয়েকদিন দিয়ে অভ্যাস করে হঠাৎ একদিন জিংক ফসফাইড মিশ্রিত গম প্রদান করা। এক্ষেত্রে সমস্যা হলো বিষটোপ লাজুকতা দেখা দিতে পারে যদি মৃত ইঁদুরগুলো সরিয়ে ফেলা না হয়। বিষটোপ লাজুকতা হলো-  বিষটোপ খেয়ে ইঁদুর মরে পড়ে আছে, এটা দেখে জীবিত ইঁদুরের ঐ বিষটোপের প্রতি খাওয়ার অনিহা।

 

২) দীর্ঘমেয়াদি বিষটোপ (Anticoagulant)
ইঁদুর খেলে সঙ্গে সঙ্গে  মারা যায় না। ইঁদুরের শরীরে বিশেষ প্রতিক্রিয়া হয় এবং কিছুদিন অর্থাৎ ২ থেকে ১৪ দিন পর মারা যায়। এক্ষেত্রে ল্যানির‌্যাট, স্টর্ম, ব্রমাপয়েন্ট, ক্লের‌্যাট ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। দীর্ঘমেয়াদি বিষটোপ রক্তের জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে ব্যহত করে। ফলে ইঁদুরের দেহে সৃষ্ট বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ ক্ষতের জন্য অনবরত রক্তক্ষরণ হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে ২ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে ইঁদুর দুর্বল হয়ে গর্তের মধ্যে মারা যায়। এখানে বিষটোপ লাজুকতা দেখা যায় না। ইঁদুর অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী তাই প্রতিদিন একই ধরনের বিষ টোপ ব্যবহার না করে তা মাঝে মাঝে পরিবর্তন করে দিতে হবে।

৩) বিষ গ্যাসবড়ি
গ্যাস বড়ি বিষাক্ত গ্যাস উৎপন্ন করার মাধ্যমে ইঁদুর মেরে ফেলে। ইঁদুরের গর্তে বিষাক্ত অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড বড়ি দিয়ে গর্তের মুখ ভালো করে বন্ধ করে দিলে ইঁদুর মারা যায়। ধান ক্ষেতে ইঁদুর দমনে এটি বেশ কার্যকরী। এ জন্য নতুন সচল গর্তে গ্যাসবড়ি দিয়ে আশপাশের সকল গর্তের/নালার মুখ মাটি দিয়ে শক্ত করে বন্ধ করে দিতে হবে।
আমাদের দেশের কৃষক একমাত্রা এবং দীর্ঘমেয়াদি বিষের পার্থক্য সঠিকভাবে বুঝতে পারে না। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একমাত্রা বিষ প্রয়োগ করে, কারণ ইঁদুর মরা অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। আবার একমাত্রা বিষ প্রয়োগের কারণে ইঁদুরের যে আচরণগত পরিবর্তন  (যেমন- বিষটোপ লাজুকতা) হয় সে বিষয়ে তাদের ধারণা কম। অপরদিকে দীর্ঘমেয়াদি বিষ ইঁদুর দমনে ভালো কাজ করে এবং ইঁদুর সংখ্যা কার্যকরভাবে কমিয়ে আনে, কিন্তু মরা ইঁদুর দেখতে না পওয়ায় কৃষকের কাছে ফলাফল ততটা দৃশ্যমান হয় না। কারণ বিষে আক্রান্ত ইঁদুর গর্তের ভেতরে গিয়ে মারা যায়। তাই এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

 

বিষটোপ প্রয়োগের স্থান
ইঁদুর নতুন মাটি বের করেছে এ ধরনের সচল গর্তের ভিতরে বিষটোপ দিতে হবে। একটি গর্তে অনেকগুলো মুখ থাকতে পারে, তবে যে গর্তের মুখে নতুন মাটি পাওয়া যাবে শুধু সেই গর্তের ভেতর বিষটোপ দিতে হবে। একটি গর্তে জিংক ফসফাইডের বিষটোপের একটি টুকরা (কেক) অথবা বড়ি প্রয়োগের পর গর্তের সকল মুখ ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে। ল্যানির‌্যাট ছোট পাত্রে বা মোটা কাগজের পোটলা তৈরি করে সচল গর্তের মুখে রাখতে হবে।

 

জৈবিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন
জৈবিক পদ্ধতি হলো ইঁদুর দমনে অন্য জীবের সাহায্য নেয়া। ইঁদুরভোজী প্রাণীদের রক্ষা এবং বংশবিস্তারের যথাযথ ব্যবস্থা করলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ ইঁদুর সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে। পেচা, শিয়াল, বেজি, বন বিড়াল, সাপ, গুঁইসাপ, বিড়াল জাতীয় প্রাণীর প্রধান খাদ্য হচ্ছে ইঁদুর। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে একজোড়া পেচা চার মাসের একটি প্রজনন চক্রে ৪ থেকে ৬টি বাচ্চার লালন-পালনে ৫০-৭০ গ্রাম ওজনের প্রায় ৩০০০ থেকে ৫০০০ পর্যন্ত ইঁদুর ভক্ষণ করতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইসরাইল, জর্ডান, মালয়েশিয়া ও হাঙ্গেরি মাঠ ফসলের ইঁদুর দমনে পেঁচার ব্যবহার করছে। এজন্য তারা পেচার প্রাকৃতিক পরিবেশকে সংরক্ষণের পাশাপাশি এর প্রজনন ও প্রতিপালন কার্যক্রমকে কৃষক পর্যায়ে উৎসাহিত করছে। পেচার বসবাসকে উৎসাহিত করার জন্য জমিতে পেচার ঘর (ঘবংঃ নড়ী) এবং রাতে পেচা বসার জন্য টাওয়ারের ব্যবস্থা করছে এবং কাক্সিক্ষত মাত্রার সুফলও পাচ্ছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা মাঠের সেচ নালার ওপর দিয়ে ১৫ মিটার অন্তর অন্তর ১০-১২ ফিট উচ্চতায় পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের (খুঁটি) ব্যবস্থা করে দেখা গেছে এতে রাতের বেলায় পেচা বসে এবং খুঁটিকে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার (ডধঃপয ঞড়বিৎ) হিসাবে ব্যবহার করে। এই পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে রাতের বেলায় পেচা বসে মাঠের ইঁদুর নীরবে নিঃশব্দে ধরে খায় এবং দিনের বেলায় এটি পার্চিং এরও কাজ করে। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি পেচার প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে কোন এলাকায় কোন প্রজাতির পেচা বেশি তার সঠিক তথ্য জানা নেই। অনেকে পেচাকে অলক্ষণের প্রতীক মনে করে। কিন্তু পেচা মানুষের কোন ক্ষতি করে না বরং নীরবে-নিভৃতে ইঁদুর দমন করে মাঠের ফসলকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করছে। তাই জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের সংরক্ষণ ও বংশ বিস্তারের সুযোগ করে দিতে হবে।

 

 

১,৩প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বিআরআরআই, গাজীপুর-১৭০১, মোবাইল : ০১৭১৫০১১৩৫১, ই-মেইল :Shamiulent@gmail.com

 

বিস্তারিত
মুরগির খামারে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ

ইঁদুর মুরগির খামারের মূল অবকাঠামো নষ্ট করে খামারের স্থায়িত্বকাল কমিয়ে ফেলে। খামারের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি যেমন পানি পাত্র, খাদ্য পাত্র, স্প্রে মেশিন ইত্যাদি যাবতীয় কাঠের, প্লাস্টিকের, রাবারের জিনিসপত্র কেটে নষ্ট করে ফেলে। পানি সরবরাহ পাইপ কেটে পানি সরবরাহ বিঘœ ঘটায়। বৈদ্যুতিক তার কেটে শর্ট সার্কিটের কারণে আগুন ধরে সমগ্র খামার পুড়ে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।


ইঁদুর মুরগির খাবার খেয়ে অর্থনৈতিক ক্ষতি করে। ১০০টি ইঁদুর বছরে ১ টন খাদ্য খেয়ে ফেলতে পারে। তাছাড়া ইঁদুর যতটুকু খায় তার ১০ গুণ খাবার ইঁদুরের বিষ্ঠাজনিত কলুষের কারণে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়।


ইঁদুর দ্বারা প্রায় সব ধরনের সংক্রামক রোগ যেমন রানীক্ষেত, গামবোরো, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা (বার্ড ফ্লু), মাইকোপ্লাজমোসিস, সালমোনেলসিস, কোলিব্যাসিলোসিস, ইনফেকসাস করাইজা,   এসক্যারিওসিস, উকুন আটুলি, মাইট ইত্যাদি রোগ খামারে সংক্রামিত হয়ে খামারের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।
ইঁদুর ছোট মুরগির বাচ্চাকে মেরে ফেলতে এবং ডিম খেয়ে ফেলতে পারে। তাছাড়া ইঁদুরের উপদ্রবে মুরগির ডিম পাড়া কমে যায়।
খামারে ইঁদুরের উপস্থিতি নির্ণয়


বাংলাদেশে প্রায় ৮০ শতাংশ মুরগির খামারে ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। ইঁদুরের দৌড়াদৌড়ি, কিচিরমিচির শব্দ, কাঠ প্লাস্টিক দ্রব্যাদিতে চিবানোর চিহ্ন, পায়খানা, গন্ধ, গর্ত সর্বোপরি স্বচক্ষে দেখার মাধ্যমে খামারের ইঁদুরের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া যায়।


ইঁদুরের বংশবিস্তার
ইঁদুরের প্রজনন ক্ষমতা অত্যাধিক। স্ত্রী ইঁদুর ৮-১০ সপ্তাহে প্রজনন ক্ষমতা লাভ করে। এদের গর্ভধারণ কাল ২০-২১ দিন। ইঁদুর বছরে ৮-১০ বার বাচ্চা দেয় এবং প্রতিবারে ৫-৬টি বাচ্চা প্রদান করে। হিসাব করে দেখা যায়, সুবিধাজনক পরিবেশে এক জোড়া ইঁদুর হতে ৩ বছরে ২ কোটি ইঁদুর জন্ম নিতে পারে।

 

ইঁদুরের স্বভাব
অতি অল্প সময়ের মধ্যে ইঁদুর দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে খামারে প্রকাশ্যে উৎপাত শুরু করে। খাদ্য ও পানি পাত্রের চারপাশে এদের বেশি দেখা যায়। এরা দেওয়াল ঘেঁষে দৌড়াদৌড়ি করে। ইঁদুর লাফ দিয়ে ৩ ফুট উঁচুতে এবং ৪ ফুট দূরে যেতে পারে। ১/৪ ইঞ্চি ব্যাসের ছিদ্র দিয়ে ছোট ইঁদুর সহজে খামারে যাতায়াত করতে পারে। সন্ধ্যার পর এদের উৎপাত বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এরা নতুন বস্তুর প্রতি খুবই সংবেদনশীল। সহজে নত­­ুন বস্তুর নিকট যায় না।

 

ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম- তাই খামার নির্মাণে আধুনিক প্রকৌশল প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে যেন খামারটি ইঁদুর মুক্ত থাকে।     * আমরা জানি ১/৪ ইঞ্চি ব্যাসের ছিদ্র দিয়ে ইঁদুর সহজে চলাফেরা করতে পারে তাই সকল দরজা জানালা ভেন্টিলেটর দেয়াল নেট ইত্যাদি তৈরি এবং সংরক্ষণ করতে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। 

      
*দরজার তলদেশ, ত্রুটিপূর্ণ জানালা সেটিংসের ফাঁক, পানির পাইপ প্রবেশের ছিদ্র, ড্রেন ইত্যাদির প্রতিও বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। খামারের চারপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে যেন মুরগির উচ্ছিষ্ট খাদ্য খামারের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থাকে।
*নির্মাণসামগ্রী, ভাঙা ইটের স্তূপ, পুরাতন খাদ্যের বস্তা, নির্মাণকালীন গর্ত, ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতে হবে।
*খামারের সিলিং যেন কোনভাবেই ইঁদুরের নিরাপদ বাসস্থান না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
*খাদ্য রাখার স্থান বা গুদাম বিশেষভাবে সংরক্ষিত রাখতে হবে যেন কোনভাবেই ইঁদুর বাসা বাঁধতে না পারে।
সারাবিশ্বে পোলট্রি শিল্প ইঁদুর দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে এবং পোলট্রি উৎপাদনকারীদের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। পোলট্রি শিল্পে ইঁদুর দ্বারা অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকে লক্ষ্য রেখে মুরগির খামারিদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে যাতে সমন্বিতভাবে ইঁদুর দমনে অংশগ্রহণ করে এবং খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইঁদুর বর্তমানে পোলট্রি ফার্মে ছোট বাচ্চা ও ডিম খয়ে ফার্মের মালিকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতির ধরন, এর ব্যাপকতা ও দমন প্রক্রিয়া অন্যান্য বালাই থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও কৌশলগত। তাই স্থান কাল পাত্রভেদে কৌশলের সঠিক ও সমন্বিত দমন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ইঁদুর দমন করতে হবে। এতে করে ইঁদুর বাহিত রোগ ও পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমানো সম্ভব হবে। তথাপি ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে ইঁদুর নিধনে নিম্নোক্ত সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ইঁদুর মারার যন্ত্র (¯œ্যাপ ট্রাপ): খামারে ইঁদুরের সংখ্যা কম প্রতীয়মান হলে তা দমনে ইঁদুর মারার যন্ত্র ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া যায়। বেশির ভাগ যন্ত্রই খাঁচা আকারে যাতে    একমুখী পথ থাকে যে দিক দিয়ে শুধু প্রবেশ করা যায় কিন্তু বের হওয়া যায় না। এসব যন্ত্রে ইঁদুরের সুস্বাদু খাদ্য যেমন টাটকা মাছ মাংস, শুঁটকি, রুটি, বিস্কুট টোপ হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। ইঁদুর ঐ সব খাবার খেতে খাঁচায় প্রবেশ করবে কিন্তু বের হতে পারবে না। যন্ত্রগুলো খামারের অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে দেওয়াল ঘেঁষে স্থাপন করতে হবে। উল্লেখ করা হয়েছে যে ইঁদুর নতুন বস্তুর প্রতি খুবই সংবেদনশীল। তাই ইঁদুর মারার যন্ত্রগুলো খামারে দিনের পর দিন ব্যবহার করতে হবে যেন ইঁদুরগুলোর ভয় কেটে যায়। তারপর সেটিতে টোপ ব্যবহার করে ইঁদুর মারতে হবে। তাছাড়া খামারে ইঁদুরের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য সহজলভ্য হলে তাদের পেট ভরা থাকবে, সেক্ষেত্রে ইঁদুর যন্ত্রের টোপ-খাদ্যের প্রতি আকৃষ্ট নাও হতে পারে।


আঠালো বোর্ড (গ্লু বোর্ড) : বিশেষ আঠাযুক্ত পাটাতন ইঁদুর মারার জন্য বেশ কার্যকর। ইঁদুর এই পাটাতনের সংস্পর্শে আসলেই আঠার সাথে আটকে যায়। আঠাযুক্ত পাটাতন সর্বদা পরিষ্কার স্থানে রাখতে হবে। কারণ ধুলা মাটি কিংবা লিটার লাগলে আঠার কার্যকারিতা লোপ পায়। আঠাযুক্ত পাটাতন ধরার সময় অবশ্যই রাবারের গ্লোভস পরিধান করতে হবে।
 

শিকারী প্রাণী (প্রিডেটরস) : ইঁদুর ধরার জন্য পোষা প্রাণী বিড়ালের জুড়ি নেই। তবে ইঁদুরের বংশবৃদ্ধি এত দ্রুত হয় যে একাধিক বিড়াল রাখার প্রয়োজন হতে পারে। তবে সতর্ক থাকতে হবে যেন বিড়াল নিজেই বিভিন্ন সংক্রামক রোগের বাহক না হয়।
বিষটোপ ব্যবহার : ইঁদুর মারার বিষ মুরগি এবং খামারের কর্মীদের জন্যও বিষ। তাছাড়া ইহা পরিবেশবান্ধবও নয়। তাই বিষটোপ ব্যবহারের চিন্তা প্রথমেই না করে বিকল্প পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা উচিত। বিষটোপ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ইঁদুর নিয়ন্ত্রণে বিশ^ব্যাপী অনুমোদিত কয়েকটি বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের নাম নিম্নে দেওয়া হলো।
বাংলাদেশে ব্যবহৃত কয়েকটি বিষাক্ত তীব্র বিষ বা একমাত্রা বিষ (জিংক ফসফাইড), দীর্ঘ স্থায়ী বিষ (যেমন-ল্যানির‌্যাট, ব্রমাপয়েন্ট, ক্লেরাট) এবং গ্যাস বড়ি (অ্যালুমিনিয়াম  ফসফাইড)।
বিভিন্ন পদ্ধতির সমন্বয় করে সম্মিলিত উপায়ে ইঁদুর দমন করলেই মুরগির খামারে ইঁদুরের উপদ্রব কমানো সম্ভব।

 

ডা. শাহ মোঃ বায়েজীদ রব্বানী (বাহালুল)

সহকারী পরিচালক, এনএটিপি-২, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বাংলাদেশ, কৃষি খামার সড়ক, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল : ০১৭১২০৮০৪৪৪,Email : bahalulvet@gmail.com

 

বিস্তারিত
জাতীয় ইদুর নিধন অভিযান ২০১৯

কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। আমাদের মোট শ্রমশক্তির ৪৮ ভাগ কৃষিতে নিয়োজিত। গ্রামের উন্নয়নের কথা বলতে গেলে প্রথমে আসে কৃষি   উন্নয়ন-কৃষিভিত্তিক শিল্প, বাণিজ্য ও সেবা খাতের উন্নয়ন। বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটির অধিক এবং এটি বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশ। সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য  মাত্রায় বেড়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন-বন্যা, খরা, সিডর, আইলা ইত্যাদি এবং সেই সাথে ফসলের বালাই ও ইঁদুরের আক্রমণের ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, যা অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে অন্তরায়। এ ছাড়াও কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ফলে উৎপাদনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে।


ইঁদুর প্রাণীটি ছোট হলেও ক্ষতির ব্যাপকতা অনেক। এ প্রাণী প্রতিনিয়তই কৃষকের কষ্টার্জিত ফসলের ক্ষতি করছে যেমন- মাঠের শস্য কেটেকুটে নষ্ট করে, খায় এবং গর্তে জমা করে। এরা যে কোনো খাদ্য খেয়ে বাঁচতে পারে। যে কোনো পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে। অল্প বয়সে বাচ্চা দিতে পারে। ইঁদুরের বিচরণ ক্ষেত্র ফসলের ক্ষেত থেকে শুরু করে বাড়ির শোবার ঘর, অফিস আদালত পর্যন্ত সর্বত্র। আর তাই এদের ক্ষতির দিকটি অনেক বিস্তৃত। এরা মাঠের ফসল, গুদামজাত শস্য, ফল, শাকসবজি, সংরক্ষিত বীজ, কাপড়-চোপড়, কাগজ, লেপ তোষক ইত্যাদি কাটাকুটি করে ক্ষতি করে। ২০১৩ সালের এক গবেষণা মতে এশিয়ায় ইঁদুর বছরে যা ধান-চাল খেয়ে নষ্ট করে তা ১৮ কোটি মানুষের এক বছরের খাবারের সমান। আর শুধু বাংলাদেশে ইঁদুর ৫০-৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট করে। এরা যে শুধুই কাটাকুটি করে আমাদের ক্ষতি করে তা নয়, এরা মানুষ ও পশু পাখির মধ্যে প্লেগ, জন্ডিস, টাইফয়েড, চর্মরোগ, আমাশয়, জ্বর, কৃমিসহ প্রায় ৬০ প্রকার রোগ জীবাণুর বাহক ও বিস্তারকারী। একটি ইঁদুর প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৭ গ্রাম খাদ্য খেয়ে থাকে। এরা যা খায় তার ৪-৫ গুণ নষ্ট করে। বাংলাদেশের ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এই অনিষ্টকারী মেরুদ-ী প্রাণী দমন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


ইঁদুর স্তন্যপায়ী, সর্বভুক ও নিশাচর প্রাণী। ইঁদুরের উপরের ও নিচের চোয়ালের সামনের জোড়া দাঁত চোয়ালের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকায় এবং এই জোড়া দাঁতের কোন রুট ক্যানেল না থাকায় সামনের কর্তন দাঁতগুলো অনবরত সারা জীবন বাড়তে থাকে। আর এই সদা বর্ধিষ্ণু দাঁতকে স্বাভাবিক অবস্থায় রাখার জন্য ইঁদুর সর্বদা কাটাকুটি করতে থাকে। ফলে ইঁদুর যা খায় তার চেয়ে চার-পাঁচগুণ বেশি খাবার নষ্ট করে থাকে। তাই ইঁদুরের ক্ষতি এত ভয়াবহ। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪১০০ টির মতো স্তন্যপায়ী প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে যার মধ্যে ১৭০০ টির মত ইঁদুরের প্রজাতি। প্রজাতি ভেদে ইঁদুর ১৫-৪১ সেমি. লম্বা এবং ওজনে ১৫-৩২৬ গ্রাম হয়ে থাকে। আমাদের দেশে যে সকল প্রজাতির ইঁদুর দেখা যায় সেগুলো মধ্যে নরওয়ে বা বাদামি ইঁদুর, বাতি বা সোলাই ইঁদুর, মাঠের কালো ইঁদুর, মাঠের বড় কালো ইঁদুর, মাঠের নেংটি ইঁদুর, নরম পশমযুক্ত ইঁদুর এবং প্যাসিফিক ইঁদুর উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে নরওয়ে বা বাদামি ইঁদুর ঘরের ও গুদামজাত শস্যের ক্ষতি করে থাকে, ঘরের ইঁদুর বা গেছো ইঁদুর গুদামজাত শস্য, ফলজাতীয় ফসল এবং আসবাবপত্রের ক্ষতি করে, বাতি বা সোলাই ইঁদুর ঘরের বইপত্র, কাপড়-চোপড় এবং শস্যদানা নষ্ট করে থাকে, মাঠের কালো ইঁদুর সব ধরনের মাঠ ফসল ও গুদামজাত ফসলের ক্ষতি করে থাকে, মাঠের বড় কালো ইঁদুর বোনা আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি করে, মাঠের নেংটি ইঁদুর মাঠের দানাজাতীয় ফসল পাকার পর ফসলের ক্ষতি করে থাকে, নরম পশমযুক্ত ইঁদুর ধান, গম ভুট্টার ক্ষতি করে থাকে এবং প্যাসিফিক ইঁদুর ফলদবৃক্ষ বিশেষ করে নারকেল গাছের ক্ষতি করে থাকে। বাংলাদেশে ইঁদুরের আক্রমণে বছরে আমন ধানের ৫-৭ %, গম ফসল ৪-১২%, গোল আলু ৫-৭%, আনারস ৬-৯ % নষ্ট হয়। গড়ে মাঠ ফসলের ৫-৭% এবং গুদামজাত শস্য ৩-৫% ক্ষতি করে থাকে।


কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক গত পাঁচ বছরে ইঁদুর নিধন অভিযান কর্মসূচি বাস্তবায়নের সুফল এই অভিযানের ফলে রক্ষা পাওয়া আমন ফসলের পরিমাণ ছকে বর্ণিত হয়েছে।
সারাবিশে^ পোলট্রি শিল্প ইঁদুর দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে এবং পোলট্রি উৎপাদনকারীদের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। পোলট্রি শিল্পে ইঁদুর দ্বারা অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকে লক্ষ্য রেখে মুরগির খামারিদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে যাতে সমন্বিতভাবে ইঁদুর দমনে অংশগ্রহণ করে এবং খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইঁদুর বর্তমানে পোলট্রি ফার্মে ছোট বাচ্চা ও ডিম খেয়ে ফার্মের মালিকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতির ধরন, এর ব্যাপকতা ও দমন প্রক্রিয়া অন্যান্য বালাই থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও কৌশলগত। তাই স্থান কাল পাত্রভেদে কৌশলের সঠিক ও সমন্বিত দমন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ইঁদুর দমন করতে হবে। এতে করে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি, ইঁদুর বাহিত রোগ ও পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমানো সম্ভব হবে।


ইঁদুর নিধন অভিযান ২০১৯ এর উদ্দেশ্য
*কৃষক, কিষানি, ছাত্রছাত্রী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান,  আইপিএম/আইসিএম ক্লাবের সদস্য, সিআইজি, ডিএই এর বিভিন্ন কৃষক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহসহ সর্বস্তরের জনগণকে ইঁদুর দমনে উদ্বুদ্ধ করা।
*ইঁদুর দমনের জৈবিক ব্যবস্থাসহ লাগসই প্রযুক্তি কৃষি কর্মীগণের মাধ্যমে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছানো।
*ঘরবাড়ি, দোকানপাট, শিল্প কারখানা ও হাঁস-মুরগীর খামার ইঁদুরমুক্ত রাখার জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।
*আমন ফসল ও অন্যান্য মাঠ ফসলে ইঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা।
*গভীর ও অগভীর নলকূপের সেচের নালার ইঁদুর মেরে পানির অপচয় রোধ করা।
*রাস্তাঘাট ও বাঁধের ইঁদুর নিধনের জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।
*ইঁদুর বাহিত রোগের বিস্তার রোধ করা এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা।


অভিযানের সময় ও উদ্বোধন
১০ অক্টোবর ২০১৯ জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান উদ্বোধনের আয়োজন করা হয়েছে। এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছেÑ ‘আসুন, সম্পদ ও ফসল রক্ষায় সম্মিলিতভাবে ইঁদুর নিধন করি।’ এক মাসব্যাপী ইঁদুর নিধন অভিযান সারাদেশে একযোগে পরিচালনা করা হয়। জাতীয় পর্যায়ে ইঁদুর নিধন অভিযান, ২০১৯ এর উদ্বোধনের পর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের  অঞ্চল,  জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে উদ্বোধন করা হবে। গত বছরের অভিযানের কার্যাবলীর উপর ভিত্তি করে  বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সর্বোচ্চসংখ্যক ইঁদুর নিধনকারীদের মাঝে পুরস্কার প্রদান করা হয়। অঞ্চল, জেলাপর্যায়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট জেলার সংসদ সদস্য/ চেয়ারম্যন, পার্বত্য জেলা পরিষদ/জেলা পরিষদ প্রশাসক/উপজেলা চেয়ারম্যন/ পৌরসভার চেয়ারম্যান/মেয়র অথবা তার মনোনীত ব্যক্তি দ্বারা করা হয়। উপজেলা পর্যায়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্য/ উপজেলা চেয়ারম্যান/ তার মনোনীত প্রতিনিধি দ্বারা করা হয়।


ইঁদুর নিধনে পুরস্কার প্রদান
মাসব্যাপী অভিযান বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাপ্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা পর্যায়ে পুরস্কার দেয়া হয়ে থাকে। অঞ্চলে অতিরিক্ত পরিচালকগণ নিজ অঞ্চলের পুরস্কার  পাবারযোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য যাচাই বাছাইপূর্বক মনোনয়নের তালিকা সদর দপ্তরে প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে সদর দপ্তরে প্রেরিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে জাতীয় ও অঞ্চল পর্যয়ের পুরস্কারের প্রার্থীদের প্রাথমিক মনোনয়ন প্রদান করেন, যা কমিটির মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়। যারা পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হন তাদের ক্রমানুসারে ১টি ক্রেস্ট, ১টি সনদপত্র ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নগদ অর্থ প্রদান করা হয়।


ইঁদুরের সমস্যা দীর্ঘদিনের, এ সমস্যা পূর্বে যেমন ছিল, বর্তমানেও রয়েছে। ইঁদুর চালাক প্রাণী এবং এখানে বিষটোপ ও ফাঁদ লাজুকতার সমস্যার কারণে ইঁদুর দমন পদ্ধতি পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন পদ্ধতির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। ইঁদুর সর্বদা খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য স্থান পরিবর্তন করে তাই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সঠিক স্থানে ও সময়ে একযোগে দমন পদ্ধতি গ্রহণ না করা হলে দমন ব্যবস্থা ততটা কার্যকর হয় না (মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও গণচীনে নির্দিষ্ট দিনে ও নির্দিষ্ট সময়ে এভাবে ইঁদুর নিধন করা হয়)। ইঁদুর দমনের কলাকৌশল অধিকসংখ্যক কৃষকের নিকট পৌঁছানোর জন্য প্রত্যেক উপসহকারী     কৃষি কর্মকর্তা তার ব্লকের কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এ কর্মসূচিতে  ইঁদুর দমন প্রযুক্তি সম্পর্কিত তথ্য সংক্ষিপ্ত আকারে পুস্তিকায় সংযোজন করা হয়েছে। এছাড়া সরকার অনুমোদিত ব্রমাডিওলোন ও জিংক  ফসফাইড গ্রুপের ইঁদুরনাশক (যেমন-ল্যানির‌্যাট, ব্রমাপয়েন্ট, রেটক্স, জিংক  ফসফাইড ইত্যাদি) বিষটোপ যথেষ্ট পরিমাণে বালাইনাশক ডিলারের দোকানে মজুদ রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের সম্প্রসারণকর্মীগণ এলাকার চাষি, ছাত্রছাত্রীসহ সর্বস্তরের জনগণকে নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে একযোগে ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালনা করে এই কর্মসূচি সফল করবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

 

কৃষিবিদ এ জেড এম ছাব্বির ইবনে জাহান

পরিচালক, উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, ফোন : ৯১৩১২৯৫, ই-মেইল : dppw@dae.gov.bd

 

 

 

 

বিস্তারিত