আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ। ভালো উৎপাদনে
ভালো পুষ্টি আর ভালো পরিবেশেই উন্নত জীবন
মোঃ মেসবাহুল ইসলাম
আজ ১৬ অক্টোবর ২০২১। বিশ্ব খাদ্য দিবস। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এ দিবসটির গুরুত্ব অপরিসীম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) তার জন্মকাল ১৯৪৫ সাল থেকে ১৬ অক্টোবরকে বিশেষভাবে স্মরণ করে ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস’ হিসেবে উদ্যাপন করে আসছে। পৃথিবীর সব মানুষের জন্য সুষম খাদ্যের জোগান নিশ্চিতের মাধ্যমে ক্ষুধামুক্ত নির্মল পৃথিবী গড়ার কাজে FAO নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে Our actions are our future. Better production, better nutrition, a better environment and a better life. যার ভাবানুবাদ ‘আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ। ভালো উৎপাদনে ভালো পুষ্টি আর ভালো পরিবেশেই উন্নত জীবন।’
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন কৃষকদরদী নেতা। স্বাধীনতার পরপরই তিনি কৃষি উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি খাদ্য ও পুষ্টির ঘাটতি পূরণে গবেষণা, সম্প্রসারণ, শিল্প ও বাজার উন্নয়নে বিশেষ জোর দেন। তিনি ভূমির সুষম বণ্টনের জন্য ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে ভূমিস্বত্ব আইন জারি করে পরিবারপ্রতি ১০০ বিঘা পর্যন্ত সর্বোচ্চ সীমা আরোপ করেন। কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে কৃষকদের মাঝে খাসজমি বিতরণ, কৃষির উৎপাদন খরচ কমাতে ভর্তুকি মূল্যে সার, কীটনাশক, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করেন। কৃষির উন্নয়নে জাতির পিতা কর্তৃক গৃহীত কর্মপরিকল্পনা ও কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার কৃষি উন্নয়নে নানা ধরনের কৃষিবান্ধব নীতি ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কৃষির সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সার, বীজসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণের মূল্য হ্রাস করা হয়েছে। শতকরা ৫০ থেকে ৭০ ভাগ ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বিস্তৃত করার পাশাপাশি কৃষকদের ঋণ সুবিধা প্রদান, নগদ আর্থিক ও উপকরণ সহযোগিতা প্রদান, নিত্যনতুন উপযুক্ত জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং সম্প্রসারণ করা হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে জনসংখ্যার ঊর্ধ্বমুখী চাপ, কৃষিজমির পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বন্যা, লবণাক্ততা, খরা, উচ্চ তাপমাত্রা ও বৈরী প্রকৃতির প্রভাবেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে পাট ও কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, ধান ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আম ও আলু উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে। সম্প্রতি পেঁয়াজ উৎপাদনেও তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে।
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে একরপ্রতি উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বল্প উপকরণ সহায়তার মাধ্যমে অধিকতর খাদ্য উৎপাদন কৌশল বের করতে হবে। এ লক্ষ্যে ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থা, ক্রপ জোনিং, জীব প্রযুক্তি, লেজার প্রযুক্তি, দক্ষ ক্ষুদ্র সেচব্যবস্থা, মাটি পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক পুষ্টি উপাদানের জন্য এলাকাভিত্তিক নির্দিষ্ট পুষ্টি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার প্রতি অধিক মনোযোগ দিতে হবে। টেকসই কৃষি এমনভাবে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে হবে যেন তা সম্পদ সাশ্রয়ী, সামাজিকভাবে সহায়ক, বাণিজ্যিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশবান্ধব হয়। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে ফসলের অবশিষ্টাংশ, জৈবসার ব্যবহারের মাধ্যমে জৈব চাষকে জনপ্রিয় করার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা তখন এক বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। শস্য উৎপাদন থেকে ভোক্তাপর্যায় পর্যন্ত প্রায় ৩১ শতাংশ খাদ্যের অপচয় হয়ে থাকে। এ বিপুল পরিমাণ অপচয় যদি রোধ করা যায় তাহলে খাদ্যের জোগান অনেকাংশে টেকসই করা যাবে। গবেষণা কার্যক্রম এবং ব্যবস্থাপনায় আরও গতিশীলতা আনতে হবে। আশার কথা আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীগণ ২০৫০ সালের মধ্যে ধানের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করা যাবে মর্মে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
কৃষিশিক্ষা, গবেষণা এবং সম্প্রসারণের যে ভিত্তি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গড়েছিলেন তা আরও শক্তিশালী করার মাধ্যমে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় এবং বরেণ্য কৃষিবিজ্ঞানী মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর প্রজ্ঞাসম্পন্ন কর্মপ্রচেষ্টায় আজ কৃষি ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর সাফল্য অর্জিত হচ্ছে। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আন্তর্জাতিক ক্ষুধা মুক্তির সংগ্রামে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা, সুশীলসমাজ সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা উন্নত বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা রাখবে সে প্রত্যাশা আমাদের সবার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনসহ রূপকল্প ২০৪১ অনুযায়ী বাংলাদেশকে শান্তিপূর্ণ, সুখী সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর এ লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজন্ম লালিত স্বপ্নের সোনার বাংলার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, কৃষি হবে দুর্বার।
লেখক : সিনিয়র সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা। www.moa.gov.bd
উৎপাদনের অগ্রযাত্রায় আমাদের কৃষি
মোঃ হাসানুজ্জামান কল্লোল
কৃষির সবুজ মাঠে এখন সূর্যের আলো পড়ে আরো বেশি সোনালি আশায়। করোনাকালেও বোরো ধানের অধিকতর উৎপাদন আর কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সুফলে হাওড়সহ সারা বাংলার কৃষকের মুখে যখন আনন্দের হাসি সেই সময়ে উদ্যাপিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২১। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষকবান্ধব সরকার সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনা এবং ব্যাপক গবেষণা ও মাঠের কৃষককে নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মচাঞ্চল্য আমাদের কৃষিকে উৎপাদনের অগ্রযাত্রায় নিয়ে গেছে অনেকদূর। এর পেছনে রয়েছে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপির নেতৃত্বে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নে বিভিন্ন কর্মসূচি, প্রণোদনা, পুনর্বাসনসহ নানামুখী উদ্যোগ। বর্তমান সরকারের কৃষিতে ধারাবাহিক উন্নয়ন আজ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে বাস্তবে রূপদান করে চলেছে।
জনসাধারণের নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ সাংবিধানিক অধিকার। খাদ্য নিরাপত্তা, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা এবং জোগান টেকসই রাখতে বিশ্ববাসীর মনোজগৎ আলোড়িত করতে প্রতি বছরের মতো এ বছরও কৃষি মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) যৌথ উদ্যোগে ১৬ অক্টোবর সাড়ম্বরে উদ্যাপন করতে যাচ্ছে বিশ^ খাদ্য দিবস ২০২১। এবারের প্রতিপাদ্য Our actions are our future. Better production, better nutrition, a better environment and a better life. এর ভাবানুবাদ হচ্ছে- আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ। ভালো উৎপাদনে ভালো পুষ্টি আর ভালো পরিবেশেই উন্নত জীবন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বৈশ্বিক খাদ্য পুষ্টি অর্জনে এবারের প্রতিপাদ্য অত্যন্ত সময়োপযোগী।
কৃষি আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩.৪৭ শতাংশ। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০, রূপকল্প ২০৪১ এবং ডেল্টাপ্ল্যান-২১০০ এর আলোকে জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮, ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাসহ অন্যান্য পরিকল্পনা দলিলের আলোকে সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তর এবং সংস্থাগুলো নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। আজকের কৃষি চিত্র হয়ে উঠেছে ঐশ^র্যমণ্ডিত। গ্রামীণ জীবন হয়ে উঠেছে বর্ণিল। দেশে যুবসমাজ কৃষি পেশায় নিয়োজিত হওয়ায় কর্মসংস্থান সম্প্রসারিত হচ্ছে। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তে পুষ্টি নিরাপত্তার ধারাও অগ্রসরমান। কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য এসেছে। কৃষি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত ফসলের উন্নত জাত ও প্রতিকূলতা সহিষ্ণুজাত দেশে উচ্চমূল্যের ফসল কাজুবাদাম, কফি ও মাল্টা প্রভৃতি চাষের সম্প্রসারণ হচ্ছে। খোরপোশের কৃষি আজ বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ কৃষি অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ক্রমহ্রাসমান আবাদি জমির সাথে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বাড়তি চাপ মোকাবিলা করেও ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ৪৫৫.০৪ লাখ মেট্রিক টন দানা জাতীয় খাদ্য উৎপন্ন হয়েছে, শুধু দানাদার ফসল নয় শাকসবজি, আলু, ডাল, পেঁয়াজ, তেল, মাছ, মাংস, দুধ, ডিমসহ প্রায় সব পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রভূত উন্নতি হয়েছে (সারণি দ্রষ্টব্য)।
পাট রপ্তানিতে ও ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম স্থানে উঠে এসেছে। এ ছাড়াও ধান, পাট, পেঁয়াজ, সবজি, আলু, আম, পেয়ারা, চাসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান সূচকের ঊর্ধ্বক্রমে। বিগত অর্থবছরে USDA-এর তথ্য অনুসারে ধান উৎপাদনে ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৩য় স্থানে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মেনে কৃষি মন্ত্রণালয় এ বছর ৩৩.৬২ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন করে। গত বছরের থেকে ৭ লাখ মেট্রিক টন বেশি উৎপাদন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ পেঁয়াজ উৎপাদনে এ বছরে বিশ্বের ৩য় স্থান অধিকার করেছে।
সারণি : উৎপাদনের অগ্রযাত্রায় আমাদের কৃষি
ফসল | উৎপাদন (লাখ | মেট্রিক টন) |
২০০৯-১০ | ২০২০-২১ | |
চাল | ৩১৩.১৭ | ৩৮৬.০৭ |
পেঁয়াজ | ১৪.২৩ | ৩৩.৬২ |
শাকসবজি | ২৯.০৮ | ১৯৭.১৮ |
আলু | ৫২.৬৮ | ১০৬.১২ |
ডাল ফসল | ১.৯৬ | ৯.৩১ |
তেল ফসল | ৮.৪০ | ১১.৯৯ |
গম | ৮.৪৯ | ১২.৩৪ |
ভুট্টা | ৭.৩০ | ৫৬.৬৩ |
মাছ | ২৮.৯৯ | ৪৫.০৩* |
মাংস | ১২.৬০ | ৮৪.৪০ |
দুধ | ২৩.৭০ | ১১৯.৮৫ |
ডিম (বিলিয়ন) | ৫.৭৪ | ২০.৫৭ |
সংবিধানকে সমুন্নত রেখে আর এদেশের কাউকে পশ্চাতে রেখে নয় (No one will be left behind) নীতি অনুসরণ করেই অতি দরিদ্রসহ সব ধরনের দারিদ্র্য অবসান ঘটানোই এখন বিশ্বের বড় চ্যালেঞ্জ। সে লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ সবার সমন্বয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নত পরিবেশ, নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের নিমিত্তে সম্ভাব্য সব প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে নানামুখী কাজ বাস্তবায়ন হচ্ছে। সবার জন্য পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কৃষি খাতে বায়োটেকনোলজি, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা, সুষম সার ব্যবস্থাপনা, ফসল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন করে পুষ্টি গুণাগুণ অক্ষুণ্ন রেখে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের ওপরে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কৃষিপণ্য উৎপাদন থেকে রপ্তানি পর্যন্ত উত্তম কৃষি চর্চা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগের ফলে চলতি বছর ২০২০-২১ সালে ১৬২৩ মেট্রিক টন আম রপ্তানি হয়েছে যা গত বছরের তুলনায় ৫ গুণেরও বেশি। আগামী ৩-৫ বছরের মধ্যে প্রতি বছর ১ লাখ মেট্রিক টন আম রপ্তানির লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার রোডম্যাপ প্রণয়নের কাজ চলছে। সম্প্রতি মাননীয় কৃষিমন্ত্রী কৃষিপণ্য কেনাবেচায় মোবাইল অ্যাপ ‘সদাই’ এর উদ্বোধন করেন। এ অ্যাপটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস, কৃষিপণ্যের গুণগত মান নিশ্চিতে কাজ করবে। একই সাথে ভোক্তারা যাতে না ঠকে, প্রতারণার শিকার না হয় এবং নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত পণ্য পায় তাতে অ্যাপটি সহায়ক ভূমিকা রাখবে। দেশের রপ্তানি খাতকে সমৃদ্ধকরণে দেশব্যাপী ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে কৃষিপণ্য বা খাদ্যপণ্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করাসহ ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এ ছাড়াও উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার নিমিত্তে সব ধরনের সারে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি ও সুষ্ঠু বিতরণ অব্যাহত থাকায় কৃষকগণ নিজ এলাকা হতে সার সংগ্রহ করছেন। গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে DAP সার কেজিপ্রতি মাত্র ১৬ টাকায় কৃষক পর্যায়ে বিক্রি শুরু হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ৫০-৭০% ভর্তুকি প্রদান করে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণে প্রদত্ত ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যান্ত্রিকীকরণের সুফল পেতে সেই সাথে শুরু হয়েছে সমলয় চাষাবাদ (Synchronized cultivation) ব্যবস্থা। বর্তমান ও বিগত বোরো মৌসুমে উন্নত হারভেস্টারসহ কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার আমাদের ধান সংগ্রহে উপকারে এসেছে। কৃষি উপকরণ কার্ড ও ১০ টাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চালু করা হয়েছে যার মাধ্যমে কৃষকগণ ফসল উৎপাদনের ঋণ এবং কৃষি উপকরণ সহায়তা পেয়ে থাকেন। সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ, মানসম্পন্ন বীজ সরবরাহ কার্যক্রম অব্যাহত আছে। এ ছাড়াও কৃষি ও কৃষি সংশ্লিষ্টদের উৎসাহিত করার জন্য কৃষিক্ষেত্রে অসামান্য সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। গবেষণাগার, অবকাঠামো, উচ্চতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টির জন্য গবেষণা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো, কৃষি বিজ্ঞানীদের মেধাপাচার রোধ ও কৃষিশিক্ষায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনশীলতার বর্ধিষ্ণু ধারা অব্যাহত রাখার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পাশাপাশি কৃষিকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সাথে তালমিলিয়ে চলার জন্য প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলছে। সব কৃষকের জন্য স্মার্ট ডিজিটাল কার্ড প্রবর্তনের কাজ চলমান রয়েছে।
মুজিববর্ষের প্রাক্কালে করোনার নির্মম আঘাতে বিশ্ব যখন পর্যুদস্ত, ঘোর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মাঝে পুরো বিশ^ যখন স্থবির তখনো আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতি ইঞ্চি জায়গা চাষের আওতায় আনয়ন ও পারিবারিক পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ৩২টি করে সবজি-পুষ্টি বাগান স্থাপন করা হয়েছে। এতে ১ লাখ ৪১ হাজার ৭৯২ জন কৃষক ও তার পরিবার উপকৃত হবে। সেই সাথে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী স্মরণে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে আরো ১০০টি করে পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সেচ কাজে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলে ২০% হারে রিবেট প্রদান করা হচ্ছে। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় বিএডিসির মাধ্যমে পরিচালিত সেচযন্ত্রগুলোর (ভাড়াভিত্তিক) সেচ চার্জ ৫০% হ্রাস করেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সব ফসলে ৪% রেয়াতি সুদে ১৯৫০০ কোটি টাকা কৃষি ঋণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়। করোনার ঝুঁকি মোকাবিলা করে কৃষির অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে কৃষি খাতে বাড়ানো হয়েছে বরাদ্দ ও প্রণোদনার পরিমাণ।
‘ই-কৃষি’ প্রবর্তনের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা জোরদার করা হয়েছে। দেশে মোট ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি), কৃষি কল সেন্টার (১৬১২৩), এআইএসটিউব, কৃষি তথ্য বাতায়ন, কৃষক বন্ধু ফোন (৩৩৩১), ই-বুক, অনলাইন সার সুপারিশ, ই-সেচ সেবা, কৃষকের জানালা, কৃষকের ডিজিটাল ঠিকানা, ডিজিটাল কৃষি ক্যালেন্ডার, বীজতলা বিক্রয়ে ই-সেবা, কমিউনিটি রেডিওসহ বিভিন্ন মোবাইল এবং ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ও সফটওয়্যার ব্যবহৃত হচ্ছে। কৃষিতে সংযুক্ত তরুণ কৃষক, উদ্যোক্তারা তারুণ্যের অমিত শক্তির সঙ্গে তথ্য প্রযুক্তির এসব অপার সম্ভাবনার মিথস্ক্রিয়ায় বাংলার কৃষি হবে আরো সমৃদ্ধ।
জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা আজ এক দৃশ্যমান বাস্তবতা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটছে বাংলাদেশ। হাঁটছে- বাংলাদেশের শহিদের লাল রক্তে ভেজা সবুজ মাটিতে সোনালি স্বপ্ন চোখে কৃষক- বাংলার কৃষি- কৃষি মন্ত্রণালয় !!
লেখক : অতিরিক্ত সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল : এসডিজি গন্তব্যের অংশীদার
ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার১, ড. সুস্মিতা দাস২
কৃষিই বাংলাদেশের কৃষ্টির মূল ও দেশের সার্বিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। আর এ কারণে দেশের অর্থনীতিতে কৃষির অসামান্য অবদান ও সাফল্য সর্বজনস্বীকৃত এবং আজ বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও সমাদৃত। তাছাড়া বর্তমান সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান যা কৃষি উন্নয়ন ও কৃষক কল্যাণকে সর্বাধিক বিবেচনায় নিয়ে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলছে। টেকসই কৃষি উন্নয়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষি ক্ষেত্রে সময়োপযোগী পদক্ষেপ এবং দিকনির্দেশনায় খোরপোশের কৃষি আজ বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে খাদ্যশস্য উৎপাদন আজ সর্বোচ্চ এবং বিশ্ব দরবারে রোল মডেল। টেকসই খাদ্য নিরাপত্তাও প্রায় নিশ্চিত। কৃষিতে বাংলাদেশের মত অল্প সময়ে এত উন্নয়ন বিশ্বের খুব কম দেশেই হয়েছে। বর্তমানে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিশ্বে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে রয়েছে এবং ৭% এরও বেশি জিডিপি ধরে রেখেছে। এখন প্রয়োজন নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার নিশ্চিতকরণ।
Leaving no one behind নীতি অনুসরণ করে ২০১৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনে ‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ এজেন্ডা গৃহীত হয়। সারাবিশ্বের মানুষের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে ‘২০৩০ এজেন্ডা’ এমন একটি কর্মপরিকল্পনা যা বিশ্ব শান্তি জোরদার করবে এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যসহ সকল প্রকার বৈষম্যের অবসান ঘটাবে। অতি দারিদ্র্যসহ সব ধরনের দারিদ্র্যের অবসান ঘটানোই এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, আর এটাই হলো টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের নিমিত্তে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ অত্যাবশ্যক। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশও সম্মিলিতভাবে প্রতিবছর বিশ্ব খাদ্য দিবস পালন করে আসছে। ১৯৪৫ সালের ১৬ অক্টোবর দিনটিতে জাতিসংঘের অন্যতম একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান Food and Agriculture Organization (FAO) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মানুষের প্রধানতম মৌলিক চাহিদা হলো খাদ্য। মানবজাতির অস্তিত্বের প্রশ্নে খাদ্যের অপরিহার্যতা, এর ব্যাপ্তি, সীমাবদ্ধতা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যে ১৬ অক্টোবরকে প্রতি বছর বিশ্ব খাদ্য দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বিশ্ব খাদ্য দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য-Our actions are our future. Better production, better nutrition, a better environment and a better life’ ভাবানুবাদ আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ, ভালো উৎপাদনে ভালো পুষ্টি আর ভালো পরিবেশই উন্নত জীবন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও বৈশ্বিক খাদ্যপুষ্টির অর্জনে এবারের প্রতিপাদ্য অত্যন্ত সময়োপযোগী।
কৃষি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে যে সকল খাত সচল রেখেছে তার মধ্যে কৃষি খাত অন্যতম। কর্মসংস্থান ও রপ্তানি বাণিজ্যে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবজি ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের কাতারে। মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপি’তে কৃষিখাতের অবদান ১৩.৪৭%। বর্তমানে বিশ্বে গড় উৎপাদনশীলতা ৫.৩ টন এবং বাংলাদেশে প্রায় ৪.১৫ টন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ প্রণয়ন করেছেন। সরকারের গৃহীত পরিবেশবান্ধব কৃষি উন্নয়নমূলক ধারাবাহিক কার্যক্রমের ফলে দেশ আজ দানাশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
বর্তমানে বিশ^ব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাবে খাদ্য উৎপাদন অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত’। বিশ্বে বর্তমানে দ্রুত খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম রয়েছে সবার উপরে। কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম ও কৃষিবান্ধব সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ জনগণের দৈনন্দিন খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিত করেছে। করোনা মহামারির সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে’ কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে অধিক উৎপাদনে মনোযোগী করেছে। যার ফলে করোনার মধ্যেও ফসল উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে গৃহীত কার্যক্রমসমূহ স্বাধীনতা উত্তরকালে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। দেশের সামগ্রিক কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে অধিকতর গতিশীল, যুগোপযোগী ও কার্যকর করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক উদ্যোগের ফলে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল আইন ১৯৯৬ সালে এবং সর্বশেষ ২০১২ সালে সংশোধনের মাধ্যমে দেশে কৃষি গবেষণা ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে আরো সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করা হয়। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নেতৃত্বে জাতীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
কৃষি গবেষণায় প্রভূত উন্নতির ফলে বাংলাদেশের কৃষি আজ জীবিকা নির্ভর কৃষি থেকে বাণ্যিজিক কৃষিতে রূপান্তরিত হয়েছে। পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ কর্তৃক অসংখ্য লাগসই প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে যা দেশের সার্বিক কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি সহ দেশের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ করছে। পুষ্টিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর ধারাবাহিক গবেষণার ফলে ধানসহ বিভিন্ন ফলদ ও শাকসবজির সব মওসুমে পুষ্টিসমৃদ্ধ জাত বের হয়েছে। কৃষিবিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলে বর্তমানে সারা বছর বিভিন্ন শাকসবজি ও ফল-ফলাদির চাষ হচ্ছে যা দেশের সার্বিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তাছাড়া কৃষিবিজ্ঞানীরা কৃষি খাতে ৪র্থ শিল্পবিপ্লব প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। প্রিসিশন ফার্মিং নিশ্চিতকরণ, কৃষিতে ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার, ক্রপ মডেলিং, বায়োটেক গবেষণা, সংগ্রহোত্তর ক্ষতি হ্রাস, মলিকুলার ব্রিডিং, নিরাপদ খাদ্য, চাহিদা নিরূপণ, মূল্য সংযোজন, লবণাক্ততা/খরা/জলমগ্নতা ব্যবস্থাপনা, কৃষি বাণিজ্য, বীজ ব্যবস্থাপনা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ইত্যাদিতে ৪র্থ শিল্পবিপ্লব প্রযুক্তি ব্যবহার সরকারের পদক্ষেপের একটি অংশ। প্রকৃতি নির্ভর কৃষির ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস, আবহাওয়া ও রোগবালাইয়ের পূর্বাভাস, গুণগতমানের উন্নয়ন, ক্ষতিকারক কীটনাশক ও সারের ব্যবহার হ্রাস, সঠিক সময়ে কৃষককে সঠিক পরামর্শ প্রদান এবং কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিসহ ভবিষ্যত কৃষি বিকাশের মানদণ্ড নিরূপণে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছে।
১৫ বছর মেয়াদি জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি প্রকল্প (ঘঅঞচ) কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ২০০৮ সাল থেকে দেশব্যাপী খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। প্রকল্পটি শিশু ও নারীদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে দেশের গম, ডাল, তৈলবীজ, শাকসবজি, ফলমূল ও দুধ মাংস উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাথে তাল মিলিয়ে দেশের খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য মানসম্মত কৃষি গবেষণার কোন বিকল্প নেই। কৃষি গবেষণাকে আরো যুগোপযোগী করে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় আরো বেশি সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন। কৃষি মন্ত্রণালেয়ের উদ্যোগে এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সমন্বয়ে জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮ প্রণীত হয়েছে। এ নীতিতে কৃষিকে আরও আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত বিভিন্ন প্রযুক্তি সংযোজন করা হয়েছে। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কৃষি নীতিতে নতুন করে ন্যানো প্রযুক্তির মতো আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের উপর জোর দেয়া হয়েছে। এসব কিছুই ছিল জাতির পিতার স্বপ্নের কৃষি নীতির প্রতিফলন। এ নীতিতে কৃষি খাতের সমস্যা ও সম্ভাবনা, গবেষণা ও উন্নয়ন, কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষিতে সমবায়, কৃষি বিপণন, বিশেষায়িত কৃষি যেমন- ছাদে কৃষি, হাইড্রোফোনিক, অ্যারোফোনিক, সংরক্ষণমূলক কৃষি, ভাসমান কৃষি, প্রিসিশন কৃষি ইত্যাদি অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। তাছাড়া প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার, সংরক্ষণ, শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধি এবং উৎপাদনশীল টেকসই কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন কৃষি নীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে। কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে মেধা, দক্ষতা ও প্রজ্ঞার সমন্বয়ের উপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
ডেল্টা প্লান ২১০০ হচ্ছে বাংলাদেশের শতবর্ষমেয়াদি একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা। সামনের দিনে দীর্ঘমেয়াদি প্রযুক্তিগত, কারিগরি ও আর্থসামাজিক দলিল হিসেবে এ পরিকল্পনা বিবেচিত হবে। পরিকল্পনা প্রণয়নে দেশের ৮টি হাইড্রোলজিক্যাল অঞ্চলকে ভিত্তি হিসেবে ধরে প্রতিটি অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির মাত্রা চিহ্নিত করা হয়েছে যা কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি যেভাবে দুর্দান্ত ও দুর্বার গতিতে সম্মুখপানে এগিয়ে চলেছে, তাতে করে আগামী দিনে বাংলাদেশের কৃষি বিশ্ব সেরা স্থান দখল করবেই করবে। কৃষি উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছেন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা।
টেকসই উন্নয়নে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাকে ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত করার জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল হবে ক্ষুধামুক্ত নিরাপদ খাদ্য-পুষ্টি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের গর্বিত অংশীদার।
লেখক : ১নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল; ২প্রধান ডকুমেন্টেশন কর্মকর্তা, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল।
মোবাইল : ০১৭১১১০২১৯৮, ই-মেইল :susmitabarc@gmail.com
নিরাপদ ফসল উৎপাদন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
মোঃ আসাদুল্লাহ
জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) দারিদ্র্য দূরীকরণ, পৃথিবীর সুরক্ষা এবং সকলের জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণের সার্বজনীন আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের সঠিক পথে অগ্রসরের জন্য ‘এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার’ প্রাপ্তিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের পর এ পুরস্কার পাওয়া দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সফলতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। শেখ হাসিনাকে ‘জুয়েল ইন দি ক্রাউন অব দি ডে’ হিসেবেও অভিহিত করেন পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের সঞ্চালক এবং বিশ্বব্যাপী মহামারি করোনাভাইরাস চলাকালেও এসডিজি প্রচারণা কার্যক্রম চালাতে তাঁর নেতৃত্বের প্রশংসা করা হয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক এ পুরস্কার প্রাপ্তিতে এবং এ সাফল্যের অংশীদার হতে পেরে আমরা গর্বিত।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) আওতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধার অবসান, খাদ্যনিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে সাফল্য লাভের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সমতার আওতায় এনে উন্নয়নের স্রোতধারায় যুক্ত করার প্রত্যয় নিয়ে এসডিজি বাস্তবায়নের পথে কাজ করছে। এসডিজির ১৭টির মধ্যে ১০টি লক্ষ্যমাত্রা এবং এর অন্তর্গত ৩৩টি টার্গেটের সঙ্গে কৃষি খাতের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। জমির উৎপাদনশীলতা তথা ফলন বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের কৃষি খাতের সাফল্য বিশ্বের জন্য অনুকরণীয়। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের ৯৪তম হলেও বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বে ১১তম।
কৃষিজমি কমতে থাকা, জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। আজকের কৃষির যে উন্নতি এটা সম্ভব হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বল্পকালীন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কিছু নীতি ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্তে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা, বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রতীক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক পিতার অনুসৃত পথ অনুসরণ করে কৃষিকে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে নিয়ে এই খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এসকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক মহোদয়ের নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সকল প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে মাঠ পর্যায়ে সকল কাজের বাস্তবায়ন করার কারণেই এসেছে কৃষি ক্ষেত্রে অসাধারণ সফলতা।
প্রতি বছরের মতো এ বছরও ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস পালিত হচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য Our actions are our future. Better production, better nutrition, a better environment and a better life. এর ভাবানুবাদ আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ। ভালো উৎপাদনে ভালো পুষ্টি আর ভালো পরিবেশেই উন্নত জীবন। সময় বিবেচনায় উপযুক্ত প্রতিপাদ্য। এবারের খাদ্য দিবসের প্রেক্ষাপট অবশ্য অন্যান্যবারের তুলনায় আলাদা। বিশ্ব এক ভয়াবহ অদৃশ্য শত্রু কোভিড-১৯ নামক ভাইরাসজনিত রোগের সম্মুখীন। এই অতিমারি থেকে মুক্তি পায়নি বাংলাদেশও। রোগটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই, যারা শারীরিকভাবে ভিটামিনের অভাবজনিত কারণে আক্রান্ত তাদের প্রতি বেশি সংবেদনশীল। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে খাদ্যের কোন অভাব না থাকলেও সঠিক পুষ্টিজ্ঞানের অভাবে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে অসংখ্য মানুষ। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য মতে দেশের শতকরা ৭০ ভাগ পুরুষ এবং ৭৫ ভাগ মহিলা আয়রন স্বল্পতায় ভুগছে। ভিটামিন ‘এ’ এর ঘাটতি ৮৮% পরিবারে এবং ভিটামিন ‘সি’ এর ঘাটতি ৯০% পরিবারে বিদ্যমান। মহিলাদের মধ্যে জিংক স্বল্পতা ৫৭.৩% এবং ৫ বছরের নিচের শিশুদের জিংক স্বল্পতা ৪৪%। ন্যূনতম খাদ্যশক্তির চেয়ে কম পরিমাণে গ্রহণকারী জনসংখ্যার হার ১৯.৫%। কিন্তু এমনটি হবার কথা নয়। কারণ দেশে বিগত এক দশকে প্রায় প্রতিটি সেক্টরে অভাবনীয় সফলতার সাথে সাথে কৃষি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে এবং দানাজাতীয় খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি শাকসবজিও সবসময় সহজলভ্য। ফলের উৎপাদন ও প্রাচুর্যতা থাকায় বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে। মানুষের খাদ্যক্রয়ে যথেষ্ট আর্থিক ক্ষমতা রয়েছে। শুধু পুষ্টি বিবেচনা করে খাবার গ্রহণের সচেতনতার ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে। পুষ্টিবিদরা সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন সুষম খাবার গ্রহণের কথা বলেন। সুষম খাদ্যের অর্থই হলো দেহের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিবেলায় খাদ্যের প্রত্যেকটি উপাদান খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা।
পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পরিমিত পরিমাণ সবজি ও ফল খাওয়ার কোন বিকল্প নাই। সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইতোমধ্যে আমরা খাদ্য উৎপাদনে এগিয়ে গেলেও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে এখনো অনেক পিছিয়ে। এই ঘাটতি পুরণে কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। জনগণের কাক্সিক্ষত পুষ্টি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের নির্দেশনায় ডাল, তেল, ফল ও সবজি ফসল সম্প্রসারণে বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ হাতে নেয়া হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩৭৩৬.২১৯২০ লক্ষ টাকা খরিপ-১/২০২০-২১ মৌসুমে পারিবারিক কৃষির আওতায় সবজি-পুষ্টি বাগান স্থাপনের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বীজ/চারা ও সার সরবরাহ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। ফলে ৬৪ জেলার ৪৯১টি উপজেলার ৪৪৩১টি ইউনিয়নের ১ লক্ষ ৪১ হাজার ৭৯২ কৃষক পরিবার উপকার পাবে। ২০২০-২১ অর্থবছরে মুজিব শতবর্ষে ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি উৎসব’ উপলক্ষ্যে ১৫২৯১.০৭৩৬০ লক্ষ টাকার পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। যার ফলে ৬৪ জেলার ৪৯১টি উপজেলার ৪৫৯৭টি ইউনিয়ন এবং ১৪০টি পৌরসভার ৪ লক্ষ ৭৩ হাজার ৭ শত কৃষক পরিবার পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা উপকার ভোগ করবে। বসতবাড়ির বিদ্যমান সম্পদের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার, পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন হবে। বসতবাড়িতে পরিকল্পিত ফলগাছ লাগানো ও পরিচর্যার মাধ্যমে ফল-ফলাদির উৎপাদন বৃদ্ধি করা হবে। বাংলাদেশে প্রায় ২৫৩.৬০ লক্ষ বসতবাড়ি রয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ৫.৪০ লক্ষ হেক্টর জমি। এসকল বসতবাড়িতে শাকসবজি বাগান সৃজনের মাধ্যমে আমাদের পুষ্টির চাহিদার অনেকাংশ মেটানো সম্ভব। গৃহীত পদক্ষেপের ফলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আর্থিক সমৃদ্ধির পথকেও প্রসারিত করবে। তাছাড়া পতিত জমি চাষের আওতায় আনার ফলে শস্য নিবিড়তাও বৃদ্ধি পাবে।
কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয়েছে, তারই জের ধরে দেশে দেশে বাড়ছে পুষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা। বাংলাদেশে খাদ্য ও পুষ্টির যেন কোন অভাব না হয় সে বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষিবান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ প্রদান করেছেন ফসলের সর্বাধিক উৎপাদনের জন্য। এজন্য তার নির্দেশ “এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে”। এই নির্দেশনাকে পালনের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় খাদ্য উৎপাদন সর্বাধিক করার লক্ষ্যে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছেন। পদক্ষেপগুলো রীতিমতো বিশ্ব নজির হিসেবে ইতোমধ্যেই সমাদৃত হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংকটের এই ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশের এই অর্জন বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। গত অর্থবছরে দেশে প্রায় চার কোটি টন চাল উৎপাদন করে ইন্দোনেশিয়াকে টপকে বিশ্ব অবস্থানে তৃতীয় অবস্থানে চলে এসেছে। শাকসবজি বাজারে সারা বছরই সহজলভ্য। কৃষি নির্ভর বাংলাদেশ করোনাকালীন সময়ে কোনোরূপ খাদ্য সংকট যেন না হয় তার প্রস্তুতি নিয়েই ২০২০-২১ অর্থবছরে ফসলের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অনেক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রতি মৌসুমেই তার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই সমস্ত কার্যক্রমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের সকল পর্যায়ের কর্মচারীরা টেকসই সুষম খাদ্য উৎপাদন, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ, কৃষি পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। বিগত দুই বছরে করোনা অতিমারি সত্ত্বেও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর একটি মুহূর্তের জন্যও কৃষকের পাশ ছাড়েনি।
সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম হয়ে বেঁচে থাকাতে সুষম পুষ্টিকর খাদ্য প্রয়োজন হয়। সেই সাথে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও খাদ্য তালিকায় রকমারি ফল ও সবজি জাতীয় খাবারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। খাদ্য যেন স্বাস্থ্যসম্মত বা মানসম্মত হয় তার জন্য সারাদেশে আবাদকৃত ফসল ও ফলমূলের ক্ষতিকারক রোগবালাই থেকে ফসলকে রক্ষা করার জন্য বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, রোগবালাই দ্বারা ফসল আক্রান্ত হলে ফসল রক্ষার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে সঠিক কারিগরি পরামর্শদান ও সঠিক দমন ব্যবস্থা গ্রহণে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে কৃষককে সহায়তা দান, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসল উৎপাদন কলাকৌশল নিরূপণ, রোগবালাই সম্পর্কে জরিপ ও আগাম ব্যবস্থা গ্রহণে কৃষককে সতর্ক করাসহ উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে ফসল উৎপাদনের উপর কৃষক, কৃষি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী এবং রফতানিকারকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষায় বৃক্ষরোপণ অভিযান চলমান রয়েছে। সম্প্রতি ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরের বাগানে একটি ‘হানি লোকাস্ট’ বৃক্ষের চারা রোপণ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃক্ষটি শোভাবর্ধনকারী ও পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষাকারী।
বিশ্বখাদ্য দিবস ২০২১ সফল হোক। সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রে সরকারি কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেলেই বিশ্ব খাদ্য দিবসের স্লোগান অনুযায়ী পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন ও জোগানের মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত জনপদ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
লেখক : মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ফোন : ৫৫০২৮৩৬৯, ইমেইল : dg@dae.gov.bd
মৎস্য খাত : আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ
কাজী শামস আফরোজ
আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ। ভালো উৎপাদনে ভালো পুষ্টি আর ভালো পবিবেশেই উন্নত জীবন। এ প্রতিপাদ্যে উদ্যাপন হচ্ছে এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২১। যা অত্যন্ত সময়োপযোগী। কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের গুরুত্ব অনুধাবন করেই স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে এক জনসভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘মাছ হবে দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ।’ বঙ্গবন্ধু কুমিল্লায় এক বিশাল জনসভায় বলেছিলেন, ‘...আমাদের মাটি আছে, আমার সোনার বাংলা আছে, আমার পাট আছে, আমার গ্যাস আছে, আমার চা আছে, আমার ফরেস্ট আছে, আমার মাছ আছে, আমার লাইভস্টক আছে। যদি ডেভেলপ করতে পারি, ইনশাআল্লাহ, এদিন থাকবে না।’
বঙ্গবন্ধুর চিন্তার ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং মৎস্যসম্পদের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ ও কার্যকর উন্নয়ন কৌশল বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ আজ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় মৎস্য খাতও একটি গর্বিত অংশীদার।
দেশের অর্থনীতিতে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে মৎস্য খাত
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা প্রতিপালনের মাধ্যমে মৎস্য খাত জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলছে। দেশের মোট জিডিপির ৩.৫২ শতাংশ, কৃষিজ জিডিপির ২৬.৩৭ শতাংশ এবং মোট রপ্তানি আয়ের ১.৩৯ শতাংশ মৎস্য খাতের অবদান। মৎস্য খাতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬.১০ শতাংশ (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২০)। মাথাপিছু দৈনিক মাছ গ্রহণের পরিমাণ চাহিদার চেয়ে (৬০ গ্রাম/দিন/জন) বৃদ্ধি পেয়ে ৬২.৫৮ গ্রামে উন্নীত হয়েছে (বিবিএস ২০১৬)। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৪ লক্ষ নারীসহ ১৯৫ লক্ষ বা ১২ শতাংশের অধিক লোক এ সেক্টরের বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়োজিত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেছে।
মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন
স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর ২০১৬-১৭ সালে বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের মৎস্যচাষকে একটি দায়িত্বশীল ও নির্ভরযোগ্য খাতে উন্নয়নের লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের পাশাপাশি বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থা এবং উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহ নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মৎস্য উৎপাদন হয়েছে ৪৫.০৩ লক্ষ মে.টন, যা ২০০৮-০৯ সালের মোট উৎপাদনের (২৭.০১ লক্ষ মে.টন) চেয়ে ৬৬.৭২ শতাংশ বেশি; ১৯৮৩-৮৪ সালে দেশে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ৭.৫৪ লক্ষ মে.টন। কাজেই ৩৭ বছরের ব্যবধানে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ছয় গুণ। এটি বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের অনন্য সাফল্য।
মৎস্য উৎপাদনে অনন্য সাফল্য : বিশ্বে বাংলাদেশের স্বীকৃতি
মানব সম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মৎস্য অধিদপ্তর ইতোমধ্যেই বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার ১৪২৩ এ স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হয়েছে। মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য আজ বিশ্বপরিমণ্ডলেও স্বীকৃত। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার The State of World Fisheries and Aquaculture 2020 এর প্রতিবেদন অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ ৩য় স্থান ধরে রেখে বিগত ১০ বছরের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির হারে দ্বিতীয় স্থানে উন্নীত হয়েছে এবং বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে ৫ম স্থান গত ছয় বছরের মতোই ধরে রেখেছে। পাশাপাশি বিশেষ সামুদ্রিক ও উপকূলীয় ক্রাস্টাশিয়ান্স ও ফিনফিস উৎপাদনে যথাক্রমে ৮ম ও ১২তম স্থান অধিকার করেছে। বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১ম; তেলাপিয়া উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে ৪র্থ এবং এশিয়ার মধ্যে ৩য় স্থান অধিকার করেছে।
মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে গৃহীত উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম
অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ে মৎস্যচাষ নিবিড়করণ : মৎস্য অধিদপ্তরের প্রশিক্ষিত ও দক্ষ সম্প্রসারণ কর্মীগণ মাছ চাষের আধুনিক প্রযুক্তি হস্তান্তরের লক্ষ্যে চাষি প্রশিক্ষণ, উন্নত প্রযুক্তি হস্তান্তর, লাগসই সম্প্রসারণ সেবা প্রদান, প্রদর্শনী খামার পরিচালনা ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রচলিত ও অপ্রচলিত মাছ চাষে ফলে সংশ্লিষ্ট সুফলভোগীদের আর্থসামাজিক অবস্থা উন্নয়নের পাশাপাশি খামার/ঘেরের উৎপাদনশীলতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও সমাজভিত্তিক মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনা: প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে পুকুর-ডোবা, খাল-বিল, বরোপিট, হাওর-বাঁওড় ও নদী-নালায় পলি জমে ভরাট হয়ে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ও অবাধ বিচরণের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এ সকল জলাশয় সংস্কার, পুনঃখনন ও খননের মাধ্যমে দেশীয় মাছের আবাসস্থল পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি জলাশয়ের পরিবেশ ও প্রতিবেশ উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার বহুমাত্রিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
বিপন্নপ্রায় মৎস্য প্রজাতির সংরক্ষণ, অবাধ প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে দেশের বিভিন্ন নদ-নদী ও অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে স্থাপিত প্রায় ৪৩২টি মৎস্য অভয়াশ্রম সুফলভোগীদের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রাচুর্য সমৃদ্ধকরণ ও প্রজাতি-বৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে পোনা অবমুক্তি ও বিল নার্সারি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
জাটকা সংরক্ষণ ও ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন : পৃথিবীর প্রায় দুই- তৃতীয়াংশের অধিক ইলিশ উৎপাদনে ইলিশের দেশ হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আসে শুধু ইলিশ থেকে। দেশের জিডিপিতে ইলিশের অবদান এক শতাংশের অধিক; যা একক প্রজাতি হিসেবে সর্বোচ্চ। সরকার নবায়নযোগ্য এ সম্পদের কাক্সিক্ষত উন্নয়নে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, ৬টি ইলিশ অভয়াশ্রম স্থাপন ও কার্যকর পরিচালনা, দরিদ্র জেলেদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আওতায় জাটকা ও মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ সময়ে জেলেদের ভিজিএফ প্রদানসহ বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে আয় বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।
কোভিড-১৯ কালীন মৎস্য সাপ্লাই চেইন উন্নয়ন : কোভিড-১৯ কালীন মৎস্যচাষিদের মাছ বাজারজাতকরণ গতিশীল করতে মৎস্য অধিদপ্তর স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় ভ্রাম্যমাণ মাছ বিক্রয় কেন্দ্র/গ্রোথ সেন্টারের মাধ্যমে মাছ বিক্রয়; অনলাইনে মাছ বাজারজাতকরণ কতিপয় ফলপ্রসূ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।
স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ মাছ সরবরাহে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেয়া হয়ে থাকে। যেমন : আইনি পরিকাঠামো তৈরি; উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলন ও ব্যবস্থাপনা; মৎস্য মাননিয়ন্ত্রণ ল্যাবরেটরি পরিচালনা; ব্লু-ইকোনমি এবং সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা।
নিরাপদ মৎস্য উৎপাদন, স্বাস্থ্যসম্মত মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য সরবরাহ এবং ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের সমন্বিত উদ্যোগে অর্জিত হবে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, রপ্তানি আয় প্রবৃদ্ধি ও অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর কাক্সিক্ষত আর্থসামাজিক উন্নয়ন। ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে মৎস্য অধিদপ্তর অঙ্গীকারবদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণের অগ্রযাত্রায় আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
লেখক : মহাপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর, রমনা, ঢাকা। ফোন : ৯৫৬২৮৬১, ইমেইল: dg@fisheries.gov.bd
প্রাণিজ আমিষ টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে উন্নত জীবন গঠন
ডা: শেখ আজিজুর রহমান১, ফয়সাল মেহেদী হাসান২
খাদ্য নিরাপত্তা ও পর্যাপ্ত পুষ্টি প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(১) অনুুচ্ছেদে জনগণের পুষ্টিস্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিকে রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। নাগরিকের কর্মক্ষম ও সুস্থ জীবন যাপনের প্রয়োজনে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে বাংলাদেশ সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ এ ঘোষিত ‘ক্ষুধা মুক্তি, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান’ অর্জনে টেকসই প্রাণিসম্পদ উৎপাদন ব্যবস্থাপনার কোন বিকল্প নেই। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়ার কার্যকর উদ্যোগ ও অঙ্গীকার প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব খাদ্য দিবস। বিশ্ব খাদ্য দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য-Our Actions are our future. Better production, better nutrition, a better environment and a better life. অর্থাৎ ‘আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ। ভালো উৎপাদনে ভালো পুষ্টি আর ভালো পরিবেশেই উন্নত জীবন।’
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রণীত রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়ন করতে সামগ্রিক কৃষি উন্নয়ন তথা প্রাণিসম্পদের টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন ও সবার জন্য সুষম পুষ্টির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। প্রাণিসম্পদ সেক্টর দেশের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি ও দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধিসহ গবাদিপশু-পাখির জাত সংরক্ষণ, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। চামড়াসহ বিভিন্ন উপজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও এ খাতের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সরকার নিরাপদ প্রাণিজ পুষ্টি উৎপাদনের লক্ষ্যে দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ খাত নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ উৎপাদন ও পুষ্টি নিরাপত্তার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। মানবসভ্যতা বিকাশের প্রতিটি স্তরে প্রাণিসম্পদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কৃষি কাজ শুরুর আগে পশু শিকারই মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন হলেও, সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে পশুকে ভূমি কর্ষণ, পরিবহন ও খাদ্য উৎপাদনসহ বিভিন্ন কাজে লাগানো হয়েছে। ৭০ এর দশকে পারিবারিক আমিষের চাহিদা পূরণ, জমি কর্ষণ ও পরিবহন শক্তিই ছিল পশুপাখির পালনের প্রধান উদ্দেশ্য। স্বাধীনতা পরবর্তীতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও উদ্যোগে ১৯৭৩ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে ১২৭টি হলস্টাইন ফ্রিজিয়ান ষাঁড় আনয়নের মাধ্যমে গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিও বহুমাত্রিক কার্যক্রম গ্রহণ করার ফলে দেশীয় গবাদিপশুর উন্নয়ন ঘটেছে। ৮০ এর দশক থেকে এই খাতে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে সূচিত হয়েছে উৎপাদনশীল গবাদিপশু-পাখির বাণিজ্যিক পালন পদ্ধতি। ফলে, সামগ্রিক প্রাণিসম্পদ খাত শিল্প খাতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গার্মেন্টের পর পোল্ট্রি শিল্প এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থান খাত, যেখানে প্রায় ৬০ লক্ষের অধিক মানুষ সরাসরি কর্মরত। বর্তমানে, জনসংখ্যার প্রায় ২০% প্রত্যক্ষ এবং ৫০% পরোক্ষভাবে প্রাণিসম্পদ খাতের উপর নির্ভরশীল। যার ফলশ্রুতিতে প্রতি বছর গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগিজাত উৎপাদন বেড়ে চলছে। বাংলাদেশ ছাগলের মাংস উৎপাদনে চতুর্থ এবং গবাদিপশু উৎপাদনে বিশ্বে ১২তম। ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন (এফএও) ও আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার ২০১৫ সালের তথ্য মতে বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল বিশ্বে অন্যতম সেরা মাংস ও চামড়া উৎপাদনকারী জাত। বিগত চার বছর ধরে দেশীয় গবাদিপশু দ্বারা দেশের কোরবানির চাহিদা পূরণ হয়েছে। সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নে বৃহৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছেন সবার আগে দরকার আমাদের টোটাল জরিপ। জরিপ ছাড়া কোনো পরিকল্পনাই সফল হবে না। স্বাধীনতা উত্তর ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে দেশে দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১০ লাখ মেট্রিক টন, ৫ লাখ মেট্রিক টন এবং ১৫০ কোটি, যা বর্তমানে ২০২০-২১ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে ১১৯.৮৫ লাখ মেট্রিক টন, ৮৪.৪০ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০৫৭.৬৪ কোটিতে উন্নীত হয়েছে।
উক্ত পরিসংখ্যানই বলে দেয়, পুষ্টিসমৃদ্ধ এসব খাদ্য উপাদানসমূহ মানুষের আগ্রহ ক্রমে বাড়ছে। এফএও এর সুপারিশ অনুযায়ী একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের দৈনিক ন্যূনতম ২৫০ মিলি দুধ ও ১২০ গ্রাম মাংস এবং বছরে ১০৪টি করে ডিম খাওয়া প্রয়োজন। যেখানে বর্তমানে দুধ, মাংস ও ডিমের প্রাপ্যতা যথাক্রমে ১৯৩.৩৮ মিলি/জন/দিন, ১৩৬.১৮ গ্রাম/জন/দিন এবং ১২১.১৮টি/জন/বছর। বিগত ১২ বছরে দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন যথাক্রমে ৫ গুণ, ৭ গুণ এবং ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তনসহ নানাবিধ কারণে দেশে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের রূপকল্প হচ্ছে প্রাণিসম্পদের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে সবার জন্য নিরাপদ, পর্যাপ্ত ও মানসম্মত প্রাণিজ আমিষ সরবরাহ করা। তাই দুধ, মাংস ও ডিমের প্রাপ্যতা বৃদ্ধির জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, ডেইরি শিল্পের বিকাশে ২০১৬ সাল থেকে দেশব্যাপী ৫% হারে স্বল্প সুদে বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের মাধ্যমে গাভী পালন করার জন্য ঋণ প্রদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বর্তমানে সারাদেশে গরু হৃষ্টপুষ্টকরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে বিদেশে মাংস রপ্তানির পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সরকার এফএমডি ও ক্ষুরারোগ মুক্ত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, মাংস ও মাংসজাত পণ্যের গুণগতমান নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্বমানের কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবরেটরি স্থাপন, গবাদিপশুর জাত উন্নয়নসহ নানা ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের জন্য মোট ১৭ প্রকারের টিকা উৎপাদন, বিতরণ ও প্রয়োগ করে আসছে। ই-প্রাণিসম্পদ সেবা, আইসিটি উন্নয়ন, উদ্ভাবনী কার্যক্রম, প্রাণিসম্পদ সহায়ক মোবাইল এ্যাপ এবং সফটওয়ারভিত্তিক রিপোর্টিং চালুর মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ায় অগ্রসরমান। সরকার কোভিড-১৯ ক্ষতিগ্রস্ত ডেইরি এবং পোল্ট্রি খামারিদের প্রণোদনা দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ৬ লাখ ৯৮ হাজার ৭৪ জন খামারিকে ৮৪৬ কোটি প্রণোদনা প্রদান করেছে। তাছাড়া সরকার প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন অব্যাহত রাখার নিমিত্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ৪% সুদে ৪৩ হাজার ৫০১ জন খামারিকে প্রায় ৮৫৭ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছেন। মহামারি করোনা ভাইরাসের ক্রান্তিকালীন সময়েও ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে সকলের জন্য নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ নিশ্চিত করা হয়েছে।
জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ মাংস ও ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিগত ১২ বছরে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রায় ৯১.২ লাখ বেকার যুবক, যুব-মহিলা, দুস্থ মহিলা, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষককে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালনবিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে ক্ষুদ্র খামারি ও কৃষকদের গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি লালন পালনের উপর প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা ও পরামর্শ সেবা প্রদান বৃদ্ধির লক্ষ্যে উপজেলা প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে প্রাণী চিকিৎসক কর্তৃক সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে। ভবিষ্যতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে যা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ জাতীয় পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ক্ষুধা দূরীকরণ, খাদ্য নিরাপত্তাসহ উন্নত সহজলভ্য পুষ্টির জোগান এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্য-২ বাস্তবায়ন প্রাণিসম্পদ খাতের উপর অর্পিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে কাক্সিক্ষত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও প্রাণিজ আমিষের পর্যাপ্ত জোগান আমাদের আশাবাদী করছে। আগামীতে নিরাপদ প্রাণিজ আমিষের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে প্রাণিসম্পদ সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
লেখক : ১মহাপরিচালক, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, ঢাকা, বাংলাদেশ। ২উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, পরিকল্পনা শাখা, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৩৪০৩২১৩, ই-মেইল : kfaysal_1971@yahoo.com
বাংলাদেশের জন্য টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের পথ ও পাথেয়
কৃষিবিদ মো: হামিদুর রহমান
চলতি বছর আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ‘মুজিববর্ষ’ উদ্যাপন করছি। বিশ্ব জুড়ে কোভিড-১৯ অতিমারির ভয়াবহ অবস্থা সত্ত্বেও বাঙালি জাতি এ বছরটিতে নানা বর্ণে ও মাত্রায় স্মরণ করছে মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা ও জাতির পিতার চিরস্মরণীয় অবদান খচিত জীবনালেখ্য। সংগতকারণেই সকল আয়োজনে ওঠে আসছে এ দেশ ও জনগণের শত সহস্র বছরের পেছনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ইতিহাসের সাক্ষ্য এই যে, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অপমৃত্যু ছিল এই গাঙ্গেয় বদ্বীপটিতে বসবাসকারী মানুষের এক অনিবার্য ললাট লিখন। সম্পূর্ণ প্রকৃতিনির্ভর কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা এবং শোষণ ও নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থাই ছিল এই ললাট লিখনের পশ্চাতভূমি। মাত্র ৭৮ বছর আগে ১৯৪৩ সালে ইতিহাসের ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষে অবিভক্ত বাংলায় প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে আত্মাহুতি দিতে হয়েছিল। ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসনামলের বাঙালি জাতির জীবনের এক মর্মন্তুদ বর্ণনা পাই আমরা জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায়..
“...চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে মেয়ে
মাতা কন ওরে চুপ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ চেয়ে!
ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,
বেলা বয়ে যায় খাইনিকো বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন,
কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,
স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়! কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছ কি?
কলি ও চুন কেন ওঠে নাকো তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?
আমরা তো জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছে খাস!
কত শত কোটি ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস।
এলো কোটি টাকা, এলো না স্বরাজ!
টাকা দিতে নারে ভুখারি সমাজ।
মা’র বুক হতে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ খাও হে ঘাস!
হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ!...”
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের “রবীন্দ্রনাথের প্রতি” কবিতায় ফুটে উঠেছে অনাহার দুর্ভিক্ষ নিয়ে সংক্ষোভের আর এক বেদনাÑ বিধুর চিত্র।
“...আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি
প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়,
আমার বিনিদ্র রাতে সতর্ক সাইরেন ডেকে যায়...”
এসব বর্ণনা থেকে আমরা এদেশের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের শতসহস্র বছরের যাপিত জীবনের যে যন্ত্রণাকাতর প্রতিচ্ছবি পাই- সেটাই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করে। ঔপনিবেশিক শাসন- শোষণের যাঁতাকলে সৃষ্ট ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্তির আকাক্সক্ষা মূর্ত হয়ে ওঠে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার সংগ্রামী প্রত্যয়ের মধ্যে। এই সংগ্রামে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা ও মুক্তিযুদ্ধে ব্রতী করার অনন্য নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং আত্মনিয়োগ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এ কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এক সূত্রেগাঁথা এবং চির অবিভাজ্য এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা।
ক্ষুধামুক্তির পথ অন্বেষণ ও নীতি কাঠামোগত প্রস্তুতি
এ বছর যখন আমরা নানা বর্ণে ও বিভায় ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’ ও ‘মুজিববর্ষ’ উদ্যাপন করছি এবং এই উদ্যাপনের পরম্পরায় পেছন ফিরে দেখা এবং সম্মুখে এগিয়ে চলার কর্তব্য স্থির করছি-তখন ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্তি তথা টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের বিষয়টিই যে অন্যতম প্রধান এজেন্ডা হবে- সেটাই স্বাভাবিক। সংগতকারণেই বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ প্রণীত সংবিধানের অধ্যায় ১৫ (ক) তে মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা বর্ণনায় “অন্ন” তথা খাদ্যের বিষয়টির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং অধ্যায় ১৮ তে জনগণের “পুষ্টির স্তর উন্নয়নের” কথা বলা হয়েছে। জাতির পিতার নেতৃত্বে প্রণীত এই সংবিধানে দেশের সকল নাগরিকের জন্য মৌলিক অধিকার হিসেবে পর্যাপ্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণের নিশ্চয়তা বিধানের অঙ্গীকার করা হয়েছে।
এই অঙ্গীকারের প্রতিধ্বনি ব্যক্ত হয়েছে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ এর অভিলক্ষ-২এ। এ ছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও আদর্শের সার্থক উত্তরসূরী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে এ দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। যার অর্থ হলো বাংলাদেশের আপামর জনগণের জন্য একটি টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার বলয় রচনা করা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সকল করণীয় স্থির করা এবং তা সম্পাদনের অঙ্গীকার করা হয়েছে। সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ লক্ষ্য অর্জনে বিস্তারিত কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্তি তথা পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করতে সরকার ২০২১-২০৪১ মেয়াদে (চবৎংঢ়বপঃরাব চষধহ ২০৪১) প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে, এসডিজির এজেন্ডাসমূহে যা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সেই সাথে ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চতর মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করতে জুলাই ২০২০ থেকে জুন ২০২৫ মেয়াদের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।
আমাদের বর্তমান কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপি ইতঃপূর্বে খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় ২০১৩ সালে এ দেশে ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আইন’ প্রণয়ন ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠনে অবদান রাখেন। ভূমণ্ডলীয় পরিসরে নিরাপদ খাদ্যের সনদ গ্রহণযোগ্য করার জন্য অ্যাক্রিডিটেশন বোর্ডও গঠন করা হয় ২০১৫ সালে।
অতিসম্প্রতি ‘ জৈব কৃষি নীতি’ ও ‘উত্তম কৃষি চর্চা নীতি’ প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০১৮ সালে নবায়িত জাতীয় কৃষি নীতির উপর ভিত্তি করে ২০২০ সালে জাতীয় কৃষি নীতির বাস্তবায়ন পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে। ‘জৈব কৃষি নীতি’ ও ‘উত্তম কৃষি চর্চা নীতি’ সামগ্রিকভাবে কৃষি নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ সকল নীতি বাস্তবে রূপ দেয়ার সকল আয়োজন চলছে। তাই এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রয়োজন অনুযায়ী নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে পথ ও পাথেয় প্রস্তুতির কাজ অনেকাংশে সম্পন্ন হয়েছে।
লক্ষ্য অর্জনের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত পথগুলো হচ্ছেÑ ক) লক্ষ্য উদ্দেশ্যাবলী নির্ধারণ করা; খ) প্রয়োজনীয় নীতি কাঠামো প্রস্তুত করা; গ) উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ জনবল নিয়োগ করা; ঘ) প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে কার্যকর আন্তঃসমন্বয়ের কর্মধারা সৃজন ও চালু রাখা; ঙ) দক্ষ কৃষক ও তাদের সুগঠিত সংগঠন পরিচালনা করা; চ) কৃষকবান্ধব বাজারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা; ছ) কৃষি শিক্ষা, গবেষণা, সম্প্রসারণ, উপকরণ ও পণ্যের বাজারব্যবস্থা এবং দক্ষ কৃষক তাদের সংগঠনের কার্যক্রম সুদৃঢ় আন্তঃসমন্বয় করা এবং পাথেয়গুলো হচ্ছে- ক) নিরন্তর গবেষণালব্ধ প্রযুক্তি উদ্ভাবন; খ) গবেষণালব্ধ প্রযুক্তি/উদ্ভাবনসমূহের সফল প্রয়োগ; গ) বাজারব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন তথা কার্যকর সরবরাহ শেকল প্রতিষ্ঠা করা; ঘ) বাজারব্যবস্থার (উপকরণ ও পণ্যভিত্তিক) সাথে উৎপাদক কৃষক সাধারণের লাভবান হওয়ার উপযোগী কার্যকর সমন্বয় সাধন; ঙ) জনসাধারণের মধ্যে খাদ্য-পুষ্টি সচেতনতা সৃষ্টি; চ) জনগণের ক্রয়ক্ষমতার ক্রমবৃদ্ধির রাষ্ট্রীয় আয়োজন।
উল্লিখিত পথ ও পাথেয় অবলম্বন করে প্রণীত কর্ম-পরিকল্পনার বাস্তবায়ন বাংলাদেশের জনগণের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে নতুন গতিসঞ্চার করবে এবং আমরা পূর্ণাঙ্গভাবে অভীষ্ট লক্ষ্যপূরণে সফলকাম হবো।
লেখক : সদস্য, এপিএ পুল, কৃষি মন্ত্রণালয় ও প্রাক্তন মহাপরিচালক, ডিএই। মোবাইল : ০১৭১১৮০৩৬৯৫, ই-মেইল : hamidur2152@gmail.com
বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২১
র্যাচেল অদিতি রেমা
একটি দেশের নাগরিকগণের ৫টি মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্য অন্যতম। এই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ বর্তমান সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশ্বিক কর্মসূচি। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অন্যতম একটি লক্ষ্য হল খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আমরা কি খাই, কীভাবে খাই, খাবারটা কোথা থেকে আসে, খাবারের মান কেমন, নিজেদের আয় এবং রুচি অনুযায়ী আমাদের কি খেলে শরীর ভালো থাকবে- এগুলো আমাদের জীবনযাপনের অন্যতম চিন্তা। আমাদের সেই সব ভাবনার প্রায় সিংহভাগই থাকে নিজেদের বা নিজেদের প্রিয়জনদের জন্য সীমাবদ্ধ এবং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে আমাদেরকে সমগ্র বিশ্বের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা জরুরি। আমরা যদি এখন শুধু নিজেদের কথা ভেবেই থেমে থাকি তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে জীবন-মরণ সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। ভবিষ্যতের অনাগত শিশু বা বর্তমান শিশু প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কেমন হবে, পৃথিবী নামক গ্রহটাই তাদের বসবাসের উপযোগী থাকবে কি না, সেই প্রশ্নগুলোই আমাদের বর্তমান খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
বিশ্ব জুড়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এখন জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বিশেষ ঘটনা যার বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, কৃষির ফলন এবং উৎপাদনশীলতার উপর। এ সব কারণের পাশাপাশি প্রধান প্রধান ফসলের পুষ্টি উপাদানে পরিবর্তন যেমন- প্রোটিন এবং প্রয়োজনীয় খনিজ ও ভিটামিন এর পরিমাণ হ্রাসের জন্যও জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী বলে মনে করা হয়।
বিগত কয়েক দশকে পৃথিবীর আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলস্বরূপ চাষাবাদযোগ্য জমি সংরক্ষণ, সামাজিক বনায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যেই প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস’ পালিত হয়ে থাকে। ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ২০তম সাধারণ সভায় হাঙ্গেরির তৎকালীন খাদ্য ও কৃৃষিমন্ত্রী ড. প্যাল রোমানি বিশ্বব্যাপী এই দিনটি উদ্যাপনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৮১ সাল থেকে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিষ্ঠার দিনটিতে (১৬ অক্টোবর, ১৯৪৫) দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিবৃত্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশে এই দিনটি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়ে থাকে।
২০২১ সালের বিশ্ব খাদ্য দিবসটিকে করোনাভাইরাস অতিমারির মাঝে উদ্যাপিত হতে যাওয়া দ্বিতীয় বিশ্ব খাদ্য দিবস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। করোনা ভাইরাস অতিমারী বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টির সাথে সাথে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এক বিধ্বংসী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, যার ফলস্বরূপ ১০ কোটি মানুষ ইতোমধ্যেই ক্ষুধার তাড়নায় ভুগছে।
এই ধরিত্রীর উপর আমাদের স্বাস্থ্য, খাদ্য নির্বাচন ও খাদ্যগ্রহণ পদ্ধতির এক বিশাল প্রভাব রয়েছে। কৃষি এবং খাদ্য ব্যবস্থাপনার উপরও এর প্রভাব অপরিসীম। কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্যগ্রহণ পদ্ধতি পরিবর্তনে নতুন নতুন পদক্ষেপ উন্মোচন করার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে ফিরে আসার লক্ষ্যে, জাতিসংঘের মহাসচিব সেপ্টেম্বরে বিশ্বের প্রথম ‘খাদ্য ব্যবস্থাপনা সম্মেলন’ আহ্বান করেছেন। ২০৩০ সালের মাঝে এজেন্ডা-২০৩০ এর সফল বাস্তবায়নে কাউকে পেছনে না ফেলে আমাদের সবাইকে এই পরিবর্তনের অংশ হওয়ার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
‘আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ। ভালো উৎপাদনে ভালো পুষ্টি আর ভালো পরিবেশেই উন্নত জীবন’- এই মূল প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে বিশ্বব্যাপী ১৬ই অক্টোবর ২০২১ বিশ্ব খাদ্য দিবস পালন করা হবে। বাংলাদেশে প্রতি বছর কৃষি মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) যৌথ উদ্যোগে এই দিনটি নানা কর্মশালা ও কর্মসূচির মাধ্যমে উদ্যাপন করা হয়ে থাকে। এই বছরও বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২১ উদ্যাপন উপলক্ষ্যে সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন কর্মশালার পাশাপাশি একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন করার উদ্দেশ্যে মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো, বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২১-র প্রতিপাদ্য ও তাৎপর্য সম্বলিত পোস্টার, বিলবোর্ড, ভিডিও প্রচার, ৫-১৯ বছর বয়সী শিশু এবং কিশোরদের মাঝে খাদ্য যাত্রা নিয়ে পোস্টার প্রতিযোগিতা, কৃষিকথা ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ, পুষ্টি উপাদান অক্ষুণ্ন রেখে রন্ধন প্রণালী প্রদর্শনসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যথাযথভাবে দিবসটি উদ্যাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও বিশ্ব খাদ্য দিবস উদ্যাপনকে কেন্দ্র করে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইতালির রোমে জি-২০ গ্রিন গার্ডেনে বিশ্ব খাদ্য দিবস উদ্যাপন, কানাডার সিএন টাওয়ারে বিশেষ আলোকসজ্জা এবং আতশবাজি, আমেরিকায় ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে নাগরিকদের মাঝে কবিতা লিখন প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। এছাড়াও বিশ্ব খাদ্য দিবস নিয়ে আরও বিস্তারিত জানতে ঘুরে আসতে পারেন প্রদত্ত লিংকে : http://www.fao.org/world-food-day/en.
লেখক : ইন্টার্ন, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। মোবাইল : ০১৭১৬৮১৬০৫৮, ই-মেইল : rechel.rema@fao.org
টেকসই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে ব্রির পাঁচ দশক
ড. মো. শাহজাহান কবীর১, কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন২
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্তরণের ভিত্তি হচ্ছে কৃষি। আর বাংলাদেশে খাদ্যশস্য বলতে আমরা ধানকেই বুঝে থাকি। ধান এ দেশের মানুষের জীবনাচরণ, খাদ্যাভ্যাস ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিভিন্ন ধান উৎপাদন মওসুম ও পরিবেশ উপযোগী আধুনিক ধান এবং লাগসই ধান উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের লক্ষ্যে ১৯৭০ সালের ১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বা ব্রি। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশবাসীর খাদ্য চাহিদা পূরণ ও পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে তালমিলিয়ে ধানের ফলন, উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ব্রত নিয়ে এ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীগণ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
বিগত পাঁচ দশকে দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে অসামান্য অবদান রেখে চলছে ব্রি। অতীতের তীব্র খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশ বর্তমানে উদীয়মান অর্থনীতির নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। এক সময়ের তলাবিহীন ঝুড়ি এখন শক্ত ভিত্তির উদ্বৃত্ত খাদ্যের বাংলাদেশ; ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃৃতীয় এবং গড় ফলনের হিসেবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম। স্বাধীনতার পর আমাদের জাতীয় জীবনে অন্যতম অসামান্য অর্জন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। এই অর্জনের পেছনে রয়েছে দেশের বিজ্ঞানীদের প্রতি জাতির পিতার সুদূরপ্রসারী দিকনির্দেশনা, বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি, ধান বিজ্ঞানীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং কৃষকের নিরলস পরিশ্রম। এই অসামান্য অর্জন সম্ভব হয়েছে প্রধানত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উচ্চফলনশীল ধানের জাত ও আনুষঙ্গিক লাগসই চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কৃষকপর্যায়ে এসব প্রযুক্তির সফল প্রয়োগে।
১৯৭০-৭১ সালে দেশের ৭ কোটি ১২ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে চালের উৎপাদন ছিল এক কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন মাত্র। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গিয়ে বলেছিলেন-‘দুনিয়া ভরে চেষ্টা করেও আমি চাউল কিনতে পারছি না। চাউল পাওয়া যায় না। যদি চাউল খেতে হয় আপনাদের চাউল পয়দা করে খেতে হবে।’এটা ছিল আমাদের বর্তমান সাফল্যের অনুপ্রেরণা বা দিকনির্দেশনা। সেই নির্দেশনাকে ধারণ করে ১৯৯৬ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃৃত্বে গঠিত ‘দিন বদলের সরকার’ সার এবং জ¦ালানি তেলের দাম কমানো, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সেচ সুবিধা বৃদ্ধি, কৃষিতে প্রণোদনা প্রদান, সার বিতরণ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, দেশে হাইব্রিড ধানের প্রবর্তন, ব্রি ধান২৮, ২৯ এর ব্যাপক সম্প্রসারণ, ধানের উন্নতমানের বীজ সরবরাহ, সেচের জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ব্যবস্থাসহ ইত্যাদি নানামুখী কৃষকবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ফলে ১৯৯৯ সালে দেশ প্রথমবারের মতো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে প্রদান করা হয় জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) কর্তৃক মর্যাদাপূর্ণ সেরেস পদক। আবার ২০০৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করেন তখন খাদ্য ঘাটতি ছিল ২৬ লাখ মেট্রিক টন। তাই সরকার গঠন করেই তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে। প্রথম ক্যাবিনেট সভায় সারের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নেন। যেখানে ৮০ টাকার টিএসপির মূল্য ২২ টাকা ও ৭০ টাকার এমওপির মূল্য ১৫ টাকায় নামিয়ে এনে সুষম সার ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নেন। এ ছাড়া কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি প্রদান, ১০ টাকায় কৃষকের জন্য ব্যাংক হিসাব চালুকরণ, সেচ সুবিধা বৃদ্ধি, কৃষিতে প্রণোদনা প্রদান, সার বিতরণ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ফলশ্রুতিতে ২০১৩ সালে এসে দেশ শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাই অর্জন করেনি, খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হয়।
টেকসই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে বিভিন্ন ঘাতসহনশীল জাতসহ ব্রি এ পর্যন্ত ১০৬টি জাত উদ্ভাবন করেছে। খাদ্য নিরাপত্তাকে টেকসই করার জন্য স্থানভিত্তিক জাত উদ্ভাবনে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
গত ২০০৯-২১ পর্যন্ত তেরো বছরে ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলোর প্রতিটিই বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। যেমন- খরা, বন্যা, লবণসহিষ্ণু, জিংকসমৃদ্ধ, প্রিমিয়াম কোয়ালিটি, ডায়াবেটিক রাইসসহ অধিক উচ্চফলনশীল। পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় ব্রি এখন পর্যন্ত ১২টি লবণসহিষ্ণু, ৩টি খরাসহনশীল, ৩টি বন্যাসহনশীল, ২টি Tidal Submergence tolerant জাত ও ৩টি ঠাণ্ডাসহনশীল উদ্ভাবন করেছে। উচ্চতাপমাত্রা বা হিটশক ঝুঁকি এড়াতে উচ্চতাপমাত্রা সহনশীল একটি জাত ছাড়করণের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
ব্রি উদ্ভাবিত লবণাক্ততা সহনশীল জাতগুলো সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের মোট লবণাক্ত এলাকার প্রায় ৩৫ ভাগ ধান চাষের আওতায় এসেছে এবং এ থেকে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১২%। খরাপ্রবণ এলাকায় খরাসহিষ্ণু জাতগুলো সম্প্রসারণের মাধ্যমে ১২% আবাদ এলাকা বৃদ্ধি পেয়েছে যেখান থেকে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১০%। জলমগ্নতা সহনশীল জাতগুলো সম্প্রসারণের মাধ্যমে ২৬% এলাকা চাষের আওতায় এসেছে যেখানে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৯%। উপকূলীয় এলাকায় ধানের আবাদ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে উদ্ভাবিত জোয়ার-ভাটাসহনশীল জাত (ব্রি ধান৭৬, ৭৭) সম্প্রসারণের ফলে প্রায় ৫৭০০০ হে. জমি এই ধান চাষের আওতায় এসেছে। সর্বোপরি, ২০১৮-১৯ সালে উচ্চফলনশীল ধানের জাতগুলো দেশের শতকরা ৮০ ভাগ জমিতে চাষ করা হয়েছে এবং এ থেকে পাওয়া গেছে দেশের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৯১ ভাগ। ঘাতসহনশীল ও অনুকূল পরিবেশ উপযোগী জাতগুলোর আবাদ সম্প্রসারণের ফলে ২০১০-১৯ পর্যন্ত ৬.০ লাখ টন হারে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং উৎপাদন বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) এবং বর্তমান সরকারের ভিশন ২০২১ এবং ২০৪১ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে ব্রি ইতোমধ্যে Rice Vision -২০৫০ প্রণয়ন করেছে। রাইস ভিশন বাস্তবায়নের পাশাপাশি ২০৩০ সালের মধ্যে উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে ব্রি (Doubling Rice Productivity) নামে একটি স্ট্র্যাটেজিক প্লান তৈরি করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, উৎপাদনের গতিশীলতা অব্যাহত থাকলে চালের উৎপাদন ২০৩০ সালে ৪৬.৯, ২০৪০ সালে ৫৪.১ এবং ২০৫০ সালে ৬০.৯ মিলিয়ন টন এ উন্নীত হবে। ফলে আমরা ২০৩০ সালে ৪.২, ২০৪০ সালে ৫.৩ এবং ২০৫০ সালে ৬.৫ মিলিয়ন টন চালে উদ্বৃত্ত থাকব। মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশনায় আমরা পুষ্টি নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে কাজ করে যাচ্ছি। কেননা, দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টির অধিকাংশ ক্যালরি, প্রোটিন ও মিনারেল আসে ভাত থেকে। ভাত তাদের কাছে সহজলভ্য। সাধারণ মানুষ দুধ, ডিম ও মাংসসহ অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার কিনতে না পারলেও ভাত নিয়মিত খেতে পারছে। তাই ভাতের মাধ্যমে কিভাবে পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করা যায় সেই লক্ষ্যে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা। চাল ছেঁটে যাতে চালকে অনিরাপদ করতে না হয় সেজন্য ব্রি ইতোমধ্যে প্রিমিয়াম কোয়ালিটি সম্পন্ন জাত যেমন- ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৯০ প্রভৃতি উদ্ভাবন করেছে। এসডিজিকে সামনে রেখে ব্রি বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে ৬টি জিংকসমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবন করেছে, পাশাপাশি অন্যান্য পুষ্টি উপাদান যেমন- প্রোটিন, আয়রন, এন্টি-অক্সিডেন্ট, গাবা ও বিটা ক্যারোটিনসমৃদ্ধ জাতসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর ধান উদ্ভাবন করেছে। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে জিংকসমৃদ্ধ জাত বঙ্গবন্ধু ধান১০০ অবমুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া শরীরের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদানগুলো দেহের প্রয়োজন অনুসারে চালে সংযোজন, সরবরাহ বা পরিমাণে বৃদ্ধি করে উদ্ভাবনকৃত জাতগুলো অবমুক্তকরণের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। চাল প্রক্রিয়াজাত করে পুষ্টিসমৃদ্ধ ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে কাজ করছে ব্রি।
গবেষণায় দেখা গেছে, যদি ১% প্রোটিনের পরিমাণ চালে বৃদ্ধি করা যায়, তবে মানব শরীরে ৬.৫% বেশি চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে। ব্রি পুরানো ধানের জাতগুলোর প্রোটিনের মাত্রা ছিল মাত্র ৮ থেকে ৯% তবে নতুন জাতগুলোর প্রোটিনের পরিমাণ ৯ থেকে ১০%। ভবিষ্যতে ব্রি’র লক্ষ্য ১২-১৩% প্রোটিনসমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবন করা যাতে চাল থেকে প্রতিদিনের প্রোটিন চাহিদার কমপক্ষে ৮০% পূরণ সম্ভব হয়। আগে ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলোতে আয়রনের পরিমাণ ছিল ৩ থেকে ৫ পিপিএম। ব্রি ধান৮৪ তে আয়রনের পরিমাণ ১০ পিপিএম। ব্রির ‘হেলদিয়ার রাইস’গবেষণা কর্মসূচির অধীনে এখন ৪৫ পিপিএম জিংক এবং ১৫ পিপিএম আয়রন সমৃদ্ধ দ্বৈত সুবিধার নতুন জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা যাতে মানব শরীরের মোট চাহিদার কমপক্ষে ৮০% জিংক এবং ৫০% আয়রনের চাহিদা চালের মাধ্যমে পূরণ করা যায়।
এ ছাড়া আমরা জানি ভিটামিন-এ এর ঘাটতি এখনো বাংলাদেশের একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা। দেশের প্রি-স্কুল এবং স্কুল-বয়সী শিশুদের ২০% এর বেশি এবং গ্রামাঞ্চলে ২৫% গর্ভবতী মহিলা ও স্তন্যদানকারী মা এই সমস্যায় ভোগেন। অবমুক্তির অপেক্ষায় থাকা ভিটামিন এ সমৃদ্ধ ধান গোল্ডেন রাইস আমাদের এই সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখবে। আশা করা যাচ্ছে, গোল্ডেন রাইস অনুমোদিত ও অবমুক্ত হলে ভিটামিন এ চাহিদার ৩০-৫০% পর্যন্ত পূরণ করতে পারবে।
আগামী ১ অক্টোবর ২০২১ ব্রির ৫০ বছরপূর্তি। আমরা দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকার করতে চাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য নেতৃত্বে বর্তমান সরকার ঘোষিত ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, এসডিজি-২০৩০, ডেল্টা প্লান-২১০০সহ সকল মাইলফলক অর্জনে ব্রি অতীতের ন্যায় ভবিষ্যতেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনে কাজ করে যাবে।
লেখক : ১মহাপরিচালক, ২ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। মোবাইল : ০১৭১৬৫৪০৩৮০
ই-মেইল :smmomin80@gmail.com
বাংলাদেশে খাদ্যের নিরাপদতা ও উত্তম কৃষি চর্চা
প্রফেসর ড. মো: আব্দুল আলীম
প্রাথমিকভাবে খাদ্যের জোগান আসে কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্যসম্পদ এই তিনটি উৎস থেকে। এ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্যসম্পদের ভূমিকা অপরিসীম। নানা প্রতিকূলতার মাঝে এবং বিগত বছরগুলোতে গবেষণায় উদ্ভাবিত নতুন নতুন উন্নত জাত ও উৎপাদন পদ্ধতির প্রযুক্তিগুলো কৃষক বা খামারিদের মাঝে পৌঁছে দেয়ার ফলে দৃশ্যমান ফসল, ফল, শাকসবজি, প্রাণী ও মৎস্যের উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার মাত্রা প্রশংসনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষির সকল শাখা (কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্যসম্পদ) উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ বিশে^র দরবারে স্বীকৃতি পেয়েছে। কাঁঠাল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশে^ ২য়, ধান, সবজি ও পেঁয়াজ উৎপাদনে ৩য়, আম ও আলু উৎপাদনে ৭ম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম আর মৌসুমি ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশে^ বর্তমানে দশম। এছাড়াও অভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে মাছ উৎপাদনে ৩য়, ইলিশ উৎপাদনে ১ম, ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশে^ ২য়, ছাগলের সংখ্যা ও মাংস উৎপাদনে ৪র্থ, গবাদিপশু উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশে^ ১২তম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে একজন মানুষ তার সুস্থতার জন্য কমপক্ষে প্রতিদিন মোট ৪০০ গ্রাম সবজি ও ফল (ফল জাতীয় সবজি ২০০ গ্রাম, পাতা জাতীয় সবজি ১০০ গ্রাম এবং ফল ১০০ গ্রাম) খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু HIES ২০১৬ এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে গড়ে এক জন মানুষ প্রতিদিন ১৬৭.৩ গ্রাম সবজি (গ্রাম এলাকায় ১৬৪.৮ গ্রাম এবং শহরে ১৭৪.১ গ্রাম) এবং ফল মাত্র ৩৫.৮ গ্রাম/দিন (গ্রাম ৩২.২ গ্রাম এবং শহর ৪৫.২ গ্রাম) গ্রহণ করে থাকে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী গড়ে এক জনের ১ দিনে মোট ফল ও সবজি গ্রহণের পরিমাণ মাত্র ২০৩.১ গ্রাম, যা প্রয়োজনের তুলনায় ও ডঐঙ এর নিদের্শনার প্রায় অর্ধেক। এ কারণে ফল ও শাকসবজি উৎপাদন দ্বিগুণ করার পাশাপাশি নিরাপদতা ও পুষ্টি বিষয়ে কার্যকরীভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি করা আবশ্যক।
এখানে উল্লেখ্য যে, পুষ্টি সমৃদ্ধ কোন খাবার নিরাপদ না হলে তা কোন কাজে আসবে না বরং বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টি বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই যে কোনো খাবার নিরাপদ হওয়া বাঞ্ছনীয়। দানাদার শস্য বিশেষ করে ধান উৎপাদনে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখার জন্য The Prime Minister, Mother of Humanity, Jononetri Sheikh Hasina declared to put, “Every inch of land under food production”. মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে’ এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে কৃষি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
খাদ্যের নিরাপদতা
খাদ্যের নিরাপদতা (Food Safety) হল এক বা একাধিক বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ যা ভোক্তার স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য খাদ্যকে খাদ্যের বিভিন্ন বিপত্তি (Hazard) থেকে রক্ষা করে (খাদ্যকে দূষিত করতে পারে কিংবা রোগ সৃষ্টি করতে পারে তথা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক খাদ্যস্থিত যেকোনো কিছুকে খাদ্য বিপত্তি (Food Hazard) বলা হয়)। যেমন : ভৌত খাদ্য বিপত্তি, জৈবিক খাদ্য বিপত্তি, রাসায়নিক খাদ্য বিপত্তি এবং এলার্জি সৃষ্টিকারী খাদ্য বিপত্তি। খাদ্য বিপত্তি নিরসনকল্পে প্রতিকারমূলক নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি প্রতিরোধমূলক নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে, খাদ্য সংশ্লিষ্ট বিপত্তি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে খাদ্য উৎপাদনকারী থেকে শুরু করে খাদ্য পরিবহন, সংরক্ষণ, বিতরণ, বিপণন এবং খাদ্য ব্যবসার সাথে জড়িত খাদ্যকর্মীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
মানুষের জীবনে মৌলিক চাহিদাগুলো যথা- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মধ্যে প্রথম প্রয়োজনীয় হচ্ছে খাদ্য। বাকি সবগুলোর সাথে আপস করা গেলেও খাদ্য ছাড়া বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব। জন্মলগ্ন থেকেই একটি শিশুর প্রাথমিক চাহিদা থাকে খাদ্য; যা তার বেড়ে উঠার জন্য অপরিহার্য। আর সেই খাদ্য যদি নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ না হয়, তাহলে শিশুটির স্বাভাবিক বৃদ্ধি যেমন ব্যাহত হয়, তেমনি তার মেধা বা মননশীলতারও বিকাশ ঘটে না। শিশুটি তখন জাতির কাছে মানবসম্পদে পরিণত না হয়ে বোঝায় রূপ নেয়। অর্থাৎ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, তথা রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার সাথে খাদ্যের নিরাপদতা জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। এক কথায় বলা যায়, একটি সুস্থ-সবল জাতি গঠনের পূর্বশর্ত হলো জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা ও সুষম পুষ্টি নিশ্চিত করে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি। এরই অংশ হিসেবে প্রাথমিক খাদ্য উৎপাদনের সাথে জড়িত বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি দপ্তর/সংস্থার সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে খাদ্যের প্রাথমিক উৎপাদন (Primary Production) যাতে নিরাপদ হয় সে বিষয়ে নীতি ও কর্মকৌশল প্রণয়নে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাথে নিরলসভাবে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য অংশীজন প্রতিষ্ঠানের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কার্যকর নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির প্রচলন ও নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে খাদ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় HACCP, GMP, GHP, ISO 22000 ইত্যাদি মান ও গাইড লাইনস অনুসরণের জন্য নির্দেশনা প্রদান করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চা নীতিমালা ২০২০ প্রণয়ন করে মাঠপর্যায়ে প্রয়োগের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
উত্তম কৃষি চর্চা
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) এর মতে উত্তম কৃষি চর্চা হলো : Good Agricultural Practices (GAP), as defined by FAO, are a “collection of principles to apply for on-farm production and post production processes, resulting in safe and healthy food and non-food agricultural products, while taking into account economic, social and environmental sustainability.” নিরাপদ এবং মানসম্পন্ন খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত কৃষিজাত পণ্য সহজলভ্য করার মাধ্যমে পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সামাজিক সুরক্ষা সুসংহত করার ক্ষেত্রে উত্তম কৃষি চর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উত্তম কৃষি চর্চা পদ্ধতিগুলো খামার ও সরবরাহ শৃঙ্খলে প্রয়োগ করার ফলে খাদ্য উৎপাদন, সংগ্রহ, পরিবহন, সংরক্ষণ, বিপণন, বিতরণ এবং সংগ্রহোত্তর প্রক্রিয়াকরণ পর্যায়ে নিরাপদ ও মানসম্পন্ন খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। সে সাথে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ, পণ্যের আন্তর্জাতিক মান অর্জন ও কাজের পদ্ধতিগত উন্নয়ন সাধন সম্ভব হয়।
খাদ্য শৃঙ্খলের সকল স্তরে সুনির্দিষ্ট অনুশীলনসমূহ সঠিকভাবে অনুসরণ করাই উত্তম কৃষি চর্চার মূলভিত্তি। বিশ^ব্যাপী খাদ্যসামগ্রী আমদানি ও রপ্তানি নির্ভরতার ফলে খাদ্য শৃঙ্খলে ভারী ধাতুর উপস্থিতি, কীটনাশকের অবশিষ্টাংশের উপস্থিতি, জীবাণু সংক্রমণ এবং বিস্তৃতির আশঙ্কা থাকে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি। এ প্রেক্ষাপটে নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধানে বিভিন্ন দেশ খাদ্য আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ করেছে। কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ফসলে প্রয়োগকৃত রাসায়নিকের অবশিষ্টাংশ, দূষণকারী বস্তু বা ভারী ধাতু বা বিষাক্ত দ্রব্যের উপস্থিতি, পোকামাকড়, রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব, বাণিজ্যিক সংক্রামক এবং খাদ্যে অন্যান্য পদার্থের উপস্থিতি খাদ্য শৃঙ্খলের যে কোন পর্যায়ে ঘটতে পারে। তাই খাদ্য শৃঙ্খলের প্রত্যেক স্তরেই নিরাপদ খাদ্য সংক্রান্ত ঝুঁকি চিহ্নিতপূর্বক প্রতিরোধ বা দূরীভূত করা প্রয়োজন। উত্তম কৃষি চর্চা বাস্তবায়নের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ কারণ উৎপাদনের সকল স্তরে খাদ্যমান, ঝুঁকি নিরসন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা এবং কল্যাণ সাধন নিশ্চিত করা হয়। সেই কারণেই আন্তর্জাতিক ধারার সাথে সামঞ্জস্য রেখে উত্তম কৃষি চর্চা বাংলাদেশে অনুসরণ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অচিরেই একটি সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা তৈরি ও যথাযথভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে এ নীতিমালা বাস্তবায়ন, পরিচালনা ও সুফল নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
প্রাথমিক উৎপাদন পর্যায় থেকে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত না হলে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে কখনোই খাদ্য নিরাপদ করা সম্ভব নয়। তাই উত্তম কৃষি চর্চা অত্যন্ত জরুরি। উত্তম কৃষি চর্চার (Good Agriculture Practices, GAP) পাশাপাশি উত্তম মৎস্য চর্চা (Good Aquaculture Practices, GAP) ও উত্তম পশু পালন চর্চা (Good Animal Husbandry Practices, GAHP) না হলে কাক্সিক্ষত ফলাফল তথা খাদ্যের নিরাপদতা অধরাই রয়ে যাবে।
লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, খাদ্য মন্ত্রণালয়। মোবাইল: ০১৭৩২২৫২২২৯, ই-মেইল: maalim07@yahoo.com
উচ্চমূল্য ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, পুষ্টি নিরাপত্তা
অর্জন ও পরিবেশ সুরক্ষায় বিএআরআই
ড. মো. নাজিরুল ইসলাম১, ড. নির্মল চন্দ্র শীল২, ড. রীনা রানী সাহা৩, ড. মুহাম্মদ সামসুল আলম৪
বিশ্ব খাদ্য দিবস ক্ষুধামুক্তি, পুষ্টি নিরাপত্তা, নিরাপদ ও সুষম খাদ্য, খাদ্যের অধিকার সম্পর্কে মানুষের মনকে জাগরিত করে, প্রেরণা জোগায় ও সংশ্লিষ্ট কর্মে উদ্বুদ্ধ করে এবং বস্তুনিষ্ঠ প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে জীবনধারণের জন্য খাদ্যের গুরুত্বকে উপস্থাপন করে স্বমহিমায়। সময়ের দাবির প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্যগুলো রচিত হয় বাস্তবতায় ও সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনায়। ঐতিহ্যগত ধারায় এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ। ভালো উৎপাদনে ভালো পুষ্টি আর ভালো পরিবেশই উন্নত জীবন’ প্রণিধানযোগ্য।
খাদ্য দিবসটি বিশ্বের আপামর মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি এবং দূষণমুক্ত পরিবেশ সুনিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আমাদের বর্তমান দায়িত্ব-কর্তব্য ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেশনা নিয়ে এসেছে তাৎপর্যপূর্ণ দক্ষতায় ও উন্নত চিন্তায়। প্রায় সতের কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশ আজ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। বিশেষত চাল ও আলু উৎপাদনে আমরা খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশের মর্যাদা অর্জন করেছি। অন্যান্য ফসল উৎপাদনেও বাংলাদেশের অগ্রগতি অসামান্য যেমন- আমরা সবজি ও পেঁয়াজ উৎপাদনে ৩য়, আম উৎপাদনে ৭ম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম, কাঁঠাল উৎপাদনে ২য়, পেঁপে উৎপাদনে ১৪তম। বাস্তবতা এই যে, কৃষিপণ্য উৎপাদনে এমন অভাবনীয় অগ্রগতি সত্ত্বেও জনসংখ্যা আধিক্যের কারণে পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির বিবেচনায় আমাদের এখনও অনেক ঘাটতি রয়েছে।
খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় বিএআরআই এর অবদান
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশের সর্ববৃহৎ বহুবিধ ফসলের গবেষণা প্রতিষ্ঠান। দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন ও পরিবেশ সুরক্ষায় এ প্রতিষ্ঠানের অবদান অসামান্য। ১৯৭২ সাল থেকে শুরু করে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিএআরআই বিভিন্ন ফসলের ৫৯০টি উচ্চফলনশীল জাত ও ৫৭৬টি উৎপাদন প্রযুক্তিসহ মোট ১১৬৬টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। বিশেষত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)-এর প্রথম ধাপের পাঁচ বছরে (২০১৬-১৭ হতে ২০২০-২১) বিএআরআই বিভিন্ন ফসলের ১১০টি উচ্চফলনশীল জাত ও ১৩৮টি ফসল উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। উদ্ভাবিত জাতগুলো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘাতসহনশীল ও উৎপাদন প্রযুক্তিগুলো বৈরী পরিবেশে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াকরণ, জৈবিক প্রক্রিয়ায় বালাই দমন, সমন্বিত উপায়ে মৃত্তিকা ও উদ্ভিদ পুষ্টি উপাদান ব্যবস্থাপনা, চার ফসলভিত্তিক ফসল ধারা প্রবর্তন, সেচের পানি ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি, কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, দেশের ব্যবহার উপযোগী কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন এবং কৃষি প্রযুক্তি বিস্তারের সহায়ক কৃষি প্রযুক্তি ভাণ্ডার, মোবাইল অ্যাপস, ও জিআইএস ম্যাপিং সংক্রান্ত প্রযুক্তিসমূহ উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি এক অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, দেশে কৃষকপর্যায়ে আবাদকৃত ফসলের জাতসমূহ বেশির ভাগই বিএআরআই উদ্ভাবিত জাত।
ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে বিএআরআই এর কার্যক্রম
উচ্চমূল্য ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে বিএআরআই এসডিজি-এর কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বছরভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির মাধ্যমে উক্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প সহায়তায় কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়ন করে চলেছে। তা ছাড়া রাজস্ব বাজেটের আওতায় চলমান গবেষণা কর্মসূচির মাধ্যমে মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন, চারা কলম উৎপাদন ও বিতরণ ইত্যাদি বিষয়ের উপর গবেষণা চলমান রয়েছে। বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্যের মর্মার্থ ও যথার্থতা তখনই সার্থক হবে যখন বিএআরআইসহ অন্যান্য কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের স্ব স্ব কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রমগুলো সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে। নিম্নে সম্মিলিত প্রয়াসের প্রধান প্রধান কার্যক্রমগুলো উল্লেখ করা হলো।
১. উত্তম কৃষি চর্চা (এঅচ) কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ফসল, মাটি, মাছ ও অন্যান্য কৃষিজ পণ্যে রাসায়নিক বালাইনাশকের উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য অ্যাক্রিডেশন প্রাপ্ত পেস্টিসাইড রেসিডিউ এনালাইসিস ল্যাবরেটরি চলমান রয়েছে। উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব গবেষণাগার ও মৃত্তিকা বিজ্ঞান গবেষণাগার অ্যাক্রিডেশন পর্যায়ে উন্নীত করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
২. বিএআরআই কৃষি জমিতে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার হ্রাস করার জন্য অধিক জনপ্রিয় ফেরোমোন ট্রাপ উদ্ভাবনসহ সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনার ২৫টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। তাছাড়া, প্রকল্প সহায়তায় ১৩টি গ্রুপের ৬৬টি জৈববালাইনাশক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বাংলাদেশে ব্যবহারের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় উক্ত বালাইনাশকগুলো কৃষকপর্যায়ে সম্প্রসারণ ও গ্রহণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। মৃত্তিকার স্বাস্থ্য সংরক্ষণের জন্য ফসল ও ফসল বিন্যাসের জন্য সমন্বিত উদ্ভিদ পুষ্টি উপাদান ব্যবস্থাপনাজনিত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। স্বল্প সময়ে অধিক উদ্ভিদ পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ভার্মিকম্পোস্ট, ট্রাইকোকম্পোস্ট-এর প্রণালী সময়সাশ্রয়ী ও সহজতর করা হয়েছে। ইউরিয়া সার ব্যবহার হ্রাস করার জন্য শিম জাতীয় ফসলের জন্য ৩৫টি অনুজীব সার উদ্ভাবিত হয়েছে। তাছাড়া জমিতে ফসফরাসের সহজলভ্যতা বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন সবজি ও মসলা ফসলের জন্য মাইকোরাইজা অণুজীব সার উদ্ভাবন করা হয়েছে।
৩. দেশের দরিদ্র ও অপুষ্টিপ্রবণ এলাকা চিহ্নিতকরণ ও কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য বিএআরআই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় ১৩টি জেলার ৬৯টি উপজেলা চিহ্নিত করে উক্ত এলাকায় কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য সুপারিশ প্রণয়ন করেছে। বর্তমানে উক্ত এলাকার কৃষকের জন্য নতুন জাত উদ্ভাবন, কৃষি বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন, পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন ও গ্রহণের সক্ষমতা বৃদ্ধি, মানুষের কর্মসংস্থান, বিকল্প আয় ইত্যাদি বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য অত্র প্রতিষ্ঠান ডিএই, ডিএএম ও বারটানের সাথে যৌথভাবে কাজ করছে।
৪. পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পরিপূরণ ও কৃষকদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য বিএআরআই-এর সরেজমিন গবেষণা বিভাগ দেশব্যাপী মোট ১০টি হোমস্টেড মডেল উদ্ভাবন করেছে। প্রতিকূল পরিবেশ উপযোগী আরও তিনটি মডেল উদ্ভাবনের কাজ চলছে। এসডিজি অ্যাকসেলারেশন অ্যাকশনের আওতায় উক্ত মডেল অনুসরণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রকল্প সহায়তায় কৃষকদের বসতবাড়িতে পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন করছে।
৫. প্রতিকূল পরিবেশ যেমন জলমগ্ন এলাকায় উচ্চমূল্য ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য “ভাসমান বেডে সবজি চাষ” প্রকল্পের সহায়তায় গবেষণা ও প্রযুক্তি বিস্তার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ লক্ষ্যে বিএআরআই ও ডিএই যৌথভাবে কাজ করছে।
৬. সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় বিএআরআই বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচির সহায়তায় দেশের কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও ফলাফল প্রদর্শনীর মাধ্যমে উদ্ধুদ্ধ করছে। তাছাড়া মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে কৃষকদের মাঝে ১৫ লক্ষ চারা/কলম/কাটিং বিতরণ করা হয়েছে।
৭. দেশের জন্য উপযোগী কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন ও বিস্তারের জন্য প্রকল্প সহায়তায় গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিএআরআই এ পর্যন্ত ৪৫টি কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করেছে যার মধ্যে পিটিওএস যন্ত্রটি দ্বারা একই সাথে নির্দিষ্ট গভীরতায় ভূমিকর্ষণ, বীজ বপন ও কর্ষিত ঝুরঝুরে মাটি দ্বারা জমি সমতলকরণের কাজে ব্যবহার করা যায়।
৮. কৃষি জমি থেকে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাস করার জন্য বিএআরআই গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করেছে। এ লক্ষ্যে ব্রি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কেজিএফ-এর সাথে সমন্বিত গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তাছাড়া এসিআইএআর-এর সহায়তায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সংরক্ষণশীল কৃষি পদ্ধতি অবলম্বন, স্বল্পকর্ষণ, ইউরিয়া ব্রিকেট, গুটি ইউরিয়া ও নিমকোটেড ইউরিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাসের প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। ন্যানোফার্টিলাইজার ও ন্যানোপেস্টিসাইড-এর ব্যবহার বৃদ্ধি করার জন্য গবেষণা কার্যক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে যাতে করে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার হ্রাস করার মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ রোধ করা যায়।
৯. বিভিন্ন ধরনের ফসলের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ, চরিত্রায়ন, মূল্যায়ন ও সংরক্ষণের কাজ চলছে। বিএআরআই কর্তৃক ২০২০ সাল পর্যন্ত সংগৃহীত জার্মপ্লাজমের সংখ্যা ১১৪০৫ যা ২০৩০ সাল নাগাদ ১৫০০০-এ উন্নীতকরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
১০. কৃষিতে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য বিএআরআই স্বল্পমেয়াদি (৭টি), মধ্যমেয়াদি (৪টি) ও দীর্ঘমেয়াদি (১৬টি) কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে যা কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক সুপারিশক্রমে স্বল্পমেয়াদি কর্মসূচিগুলোর অনুকূলে অর্থছাড় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাবনাগুলো এসডিজি-এর জাতীয় কর্মপরিকল্পনার দলিলে তালিকাভুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে উক্ত কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করে, সুখীসমৃদ্ধ, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত বাংলাদেশ গড়ার ২০৪১ সালের রূপকল্প বাস্তবায়নে সম্মিলিত প্রয়াস একান্ত প্রয়োজন। বিশ্ব খাদ্য দিবসের মর্মার্থ উপলব্ধি করে উপরোক্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য এ মহতি দিবসে নিম্নরূপ প্রত্যয় ব্যক্ত করছি-
যদি সুস্থ-সবল, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ চাই
সকলে তবে পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ ফসল ফলাই।
উচ্চমূল্য ফসল চাষে খাদ্য, পুষ্টি ও সমৃদ্ধি তিন-ই আসে।
গুরুত্ব দেই তবে ডাল-তেল, শাকসবজি, ফলমূল চাষে। য়
লেখক : ১মহাপরিচালক, ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ৩পরিচালক (পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন), ৪পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ), উইং বিএআরআই, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭১৮২০১৪৯৯, ই-মেইল : nirmal_shil@yahoo.com
উৎপাদনের অগ্রযাত্রায় আমাদের কৃষি
মোঃ হাসানুজ্জামান কল্লোল
কৃষির সবুজ মাঠে এখন সূর্যের আলো পড়ে আরো বেশি সোনালি আশায়। করোনাকালেও বোরো ধানের অধিকতর উৎপাদন আর কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সুফলে হাওড়সহ সারা বাংলার কৃষকের মুখে যখন আনন্দের হাসি সেই সময়ে উদ্যাপিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২১। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষকবান্ধব সরকার সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনা এবং ব্যাপক গবেষণা ও মাঠের কৃষককে নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মচাঞ্চল্য আমাদের কৃষিকে উৎপাদনের অগ্রযাত্রায় নিয়ে গেছে অনেকদূর। এর পেছনে রয়েছে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপির নেতৃত্বে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নে বিভিন্ন কর্মসূচি, প্রণোদনা, পুনর্বাসনসহ নানামুখী উদ্যোগ। বর্তমান সরকারের কৃষিতে ধারাবাহিক উন্নয়ন আজ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে বাস্তবে রূপদান করে চলেছে।
জনসাধারণের নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ সাংবিধানিক অধিকার। খাদ্য নিরাপত্তা, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা এবং জোগান টেকসই রাখতে বিশ্ববাসীর মনোজগৎ আলোড়িত করতে প্রতি বছরের মতো এ বছরও কৃষি মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) যৌথ উদ্যোগে ১৬ অক্টোবর সাড়ম্বরে উদ্যাপন করতে যাচ্ছে বিশ^ খাদ্য দিবস ২০২১। এবারের প্রতিপাদ্য ‘ঙঁৎ ধপঃরড়হং ধৎব ড়ঁৎ ভঁঃঁৎব. ইবঃঃবৎ ঢ়ৎড়ফঁপঃরড়হ, নবঃঃবৎ হঁঃৎরঃরড়হ, ধ নবঃঃবৎ বহারৎড়হসবহঃ ধহফ ধ নবঃঃবৎ ষরভব.’ এর ভাবানুবাদ হচ্ছেÑ আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ। ভালো উৎপাদনে ভালো পুষ্টি আর ভালো পরিবেশেই উন্নত জীবন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বৈশি^ক খাদ্য পুষ্টি অর্জনে এবারের প্রতিপাদ্য অত্যন্ত সময়োপযোগী।
কৃষি আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩.৪৭ শতাংশ। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০, রূপকল্প ২০৪১ এবং ডেল্টাপ্ল্যান-২১০০ এর আলোকে জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮, ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাসহ অন্যান্য পরিকল্পনা দলিলের আলোকে সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তর এবং সংস্থাগুলো নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। আজকের কৃষি চিত্র হয়ে উঠেছে ঐশ^র্যমণ্ডিত। গ্রামীণ জীবন হয়ে উঠেছে বর্ণিল। দেশে যুবসমাজ কৃষি পেশায় নিয়োজিত হওয়ায় কর্মসংস্থান সম্প্রসারিত হচ্ছে। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তে পুষ্টি নিরাপত্তার ধারাও অগ্রসরমান। কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য এসেছে। কৃষি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত ফসলের উন্নত জাত ও প্রতিকূলতা সহিষ্ণুজাতসহ দেশে উচ্চমূল্যের ফসল কাজুবাদাম, কফি ও মাল্টা প্রভৃতি চাষের সম্প্রসারণ হচ্ছে। খোরপোশের কৃষি আজ বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের কৃষি অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ক্রমহ্রাসমান আবাদি জমির সাথে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বাড়তি চাপ মোকাবিলা করেও ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ৪৫৫.০৪ লাখ মেট্রিক টন দানা জাতীয় খাদ্য উৎপন্ন হয়েছে, শুধু দানাদার ফসল নয় শাকসবজি, আলু, ডাল, পেঁয়াজ, তেল, মাছ, মাংস, দুধ, ডিমসহ প্রায় সব পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রভূত উন্নতি হয়েছে (সারণি দ্রষ্টব্য)।
পাট রপ্তানিতে ও ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশে^ প্রথম স্থানে উঠে এসেছে। এ ছাড়াও ধান, পাট, পেঁয়াজ, সবজি, আলু, আম, পেয়ারা, চাসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান সূচকের ঊর্ধ্বক্রমে। বিগত অর্থবছরে টঝউঅ-এর তথ্য অনুসারে ধান উৎপাদনে ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৩য় স্থানে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মেনে কৃষি মন্ত্রণালয় এ বছর ৩৩.৬২ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন করে। গত বছরের থেকে ৭ লাখ মেট্রিক টন বেশি উৎপাদন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ পেঁয়াজ উৎপাদনে এ বছরে বিশ্বের ৩য় স্থান অধিকার করেছে।
সংবিধানকে সমুন্নত রেখে আর এদেশের কাউকে পশ্চাতে রেখে নয় (ঘড় ড়হব রিষষ নব ষবভঃ নবযরহফ) নীতি অনুসরণ করেই অতি দরিদ্রসহ সব ধরনের দারিদ্র্য অবসান ঘটানোই এখন বিশ্বের বড় চ্যালেঞ্জ। সে লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ সবার সমন্বয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নত পরিবেশ, নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের নিমিত্তে সম্ভাব্য সব প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে নানামুখী কাজ বাস্তবায়ন হচ্ছে। সবার জন্য পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কৃষি খাতে বায়োটেকনোলজি, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা, সুষম সার ব্যবস্থাপনা, ফসল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন করে পুষ্টি গুণাগুণ অক্ষুণ্ন রেখে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের ওপরে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কৃষিপণ্য উৎপাদন থেকে রপ্তানি পর্যন্ত উত্তম কৃষি চর্চা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগের ফলে চলতি বছর ২০২০-২১ সালে ১৬২৩ মেট্রিক টন আম রপ্তানি হয়েছে যা গত বছরের তুলনায় ৫ গুণেরও বেশি। আগামী ৩-৫ বছরের মধ্যে প্রতি বছর ১ লাখ মেট্রিক টন আম রপ্তানির লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার রোডম্যাপ প্রণয়নের কাজ চলছে। সম্প্রতি মাননীয় কৃষিমন্ত্রী কৃষিপণ্য কেনাবেচায় মোবাইল অ্যাপ ‘সদাই’ এর উদ্বোধন করেন। এ অ্যাপটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস, কৃষিপণ্যের গুণগত মান নিশ্চিতে কাজ করবে। একই সাথে ভোক্তারা যাতে না ঠকে, প্রতারণার শিকার না হয় এবং নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত পণ্য পায় তাতে অ্যাপটি সহায়ক ভূমিকা রাখবে। দেশের রপ্তানি খাতকে সমৃদ্ধকরণে দেশব্যাপী ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে কৃষিপণ্য বা খাদ্যপণ্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করাসহ ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এ ছাড়াও উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার নিমিত্তে সব ধরনের সারে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি ও সুষ্ঠু বিতরণ অব্যাহত থাকায় কৃষকগণ নিজ এলাকা হতে সার সংগ্রহ করছেন। গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে উঅচ সার কেজিপ্রতি মাত্র ১৬ টাকায় কৃষক পর্যায়ে বিক্রি শুরু হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ৫০-৭০% ভর্তুকি প্রদান করে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণে প্রদত্ত ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যান্ত্রিকীকরণের সুফল পেতে সেই সাথে শুরু হয়েছে সমলয় চাষাবাদ (ঝুহপযৎড়হরুবফ পঁষঃরাধঃরড়হ) ব্যবস্থা। বর্তমান ও বিগত বোরো মৌসুমে উন্নত হারভেস্টারসহ কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার আমাদের ধান সংগ্রহে উপকারে এসেছে। কৃষি উপকরণ কার্ড ও ১০ টাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চালু করা হয়েছে যার মাধ্যমে কৃষকগণ ফসল উৎপাদনের ঋণ এবং কৃষি উপকরণ সহায়তা পেয়ে থাকেন। সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ, মানসম্পন্ন বীজ সরবরাহ কার্যক্রম অব্যাহত আছে। এ ছাড়াও কৃষি ও কৃষি সংশ্লিষ্টদের উৎসাহিত করার জন্য কৃষিক্ষেত্রে অসামান্য সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। গবেষণাগার, অবকাঠামো, উচ্চতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টির জন্য গবেষণা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো, কৃষি বিজ্ঞানীদের মেধাপাচার রোধ ও কৃষিশিক্ষায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনশীলতার বর্ধিষ্ণু ধারা অব্যাহত রাখার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পাশাপাশি কৃষিকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সাথে তালমিলিয়ে চলার জন্য প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলছে। সব কৃষকের জন্য স্মার্ট ডিজিটাল কার্ড প্রবর্তনের কাজ চলমান রয়েছে।
মুজিববর্ষের প্রাক্কালে করোনার নির্মম আঘাতে বিশ^ যখন পর্যুদস্ত, ঘোর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মাঝে পুরো বিশ^ যখন স্থবির তখনো আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতি ইঞ্চি জায়গা চাষের আওতায় আনয়ন ও পারিবারিক পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ৩২টি করে সবজি-পুষ্টি বাগান স্থাপন করা হয়েছে। এতে ১ লাখ ৪১ হাজার ৭৯২ জন কৃষক ও তার পরিবার উপকৃত হবে। সেই সাথে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী স্মরণে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে আরো ১০০টি করে পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সেচ কাজে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলে ২০% হারে রিবেট প্রদান করা হচ্ছে। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় বিএডিসির মাধ্যমে পরিচালিত সেচযন্ত্রগুলোর (ভাড়াভিত্তিক) সেচ চার্জ ৫০% হ্রাস করেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সব ফসলে ৪% রেয়াতি সুদে ১৯৫০০ কোটি টাকা কৃষি ঋণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়। করোনার ঝুঁকি মোকাবিলা করে কৃষির অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে কৃষি খাতে বাড়ানো হয়েছে বরাদ্দ ও প্রণোদনার পরিমাণ।
‘ই-কৃষি’ প্রবর্তনের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা জোরদার করা হয়েছে। দেশে মোট ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি), কৃষি কল সেন্টার (১৬১২৩), এআইএসটিউব, কৃষি তথ্য বাতায়ন, কৃষক বন্ধু ফোন (৩৩৩১), ই-বুক, অনলাইন সার সুপারিশ, ই-সেচ সেবা, কৃষকের জানালা, কৃষকের ডিজিটাল ঠিকানা, ডিজিটাল কৃষি ক্যালেন্ডার, বীজতলা বিক্রয়ে ই-সেবা, কমিউনিটি রেডিওসহ বিভিন্ন মোবাইল এবং ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ও সফটওয়্যার ব্যবহৃত হচ্ছে। কৃষিতে সংযুক্ত তরুণ কৃষক, উদ্যোক্তারা তারুণ্যের অমিত শক্তির সঙ্গে তথ্য প্রযুক্তির এসব অপার সম্ভাবনার মিথস্ক্রিয়ায় বাংলার কৃষি হবে আরো সমৃদ্ধ।
জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা আজ এক দৃশ্যমান বাস্তবতা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটছে বাংলাদেশ। হাঁটছে- বাংলাদেশের শহিদের লাল রক্তে ভেজা সবুজ মাটিতে সোনালি স্বপ্ন চোখে কৃষক- বাংলার কৃষি- কৃষি মন্ত্রণালয় !!
লেখক : অতিরিক্ত সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা।
খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় প্রতিকূলতা সহিষ্ণু উন্নত জাত উদ্ভাবন
ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম
সারা বিশ্বের মানুষের ক্ষুধা নিবারণের লক্ষ্যে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ১৯৪৫ সাল থেকে ১৬ অক্টোবরকে বিশ্ব খাদ্য দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। পরবর্তীতে ১৯৮১ সাল থেকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিবৃত্তির লক্ষ্যে এবং সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশের সরকার ও জনগণকে নিয়ে প্রতিপাদ্যভিত্তিক বিশ্ব খাদ্য দিবস পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য `Our actions are our future. Better production, better nutrition, a better environment and a better life' অর্থাৎ আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ। ভালো উৎপাদনে ভালো পুষ্টি আর ভালো পরিবেশই উন্নত জীবন। সে প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের জোগান নিশ্চিতকরণ, উন্নত জীবনযাপন এবং পরিবেশ উন্নয়নে এখনও বিরাট চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপের পাশাপাশি প্রতি বছর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে বিশ্ব খাদ্য দিবস পালিত হচ্ছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জনসংখ্যা সাড়ে ৭ কোটি থেকে দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে প্রায় ১৬ কোটি ৯১ লাখ এবং প্রতি বছর ২০-২২ লাখ লোক জনসংখ্যা যোগ হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যা যদি ১.৩৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন জনসংখ্যা প্রায় ২৩ কোটি হবে । এই বাড়তি জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা জোরদারকরণ আবশ্যক।
বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার্বিক দিকনির্দেশনায় বিনার কৃষি বিজ্ঞানীরা উন্নত জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। পরিবেশকে বিঘ্নিত না করে দেশের খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করার পাশাপাশি খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে বিনা কাজ করে যাচ্ছে। বিনা এ যাবৎ ১৮টি ফসলের ১১৭টি উচ্চফলনশীল ও প্রতিকূলতা সহিষ্ণু জাতসহ অর্ধশতাধিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। তন্মধ্যে বিনা উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল বন্যাসহিষ্ণু বিনাধান-১১ ও বিনাধান-১২; লবণাক্ততাসহিষ্ণু ধানের জাত বিনাধান-৮, দ্বৈত লবণাক্ততা ও বন্যাসহিষ্ণু বিনাধান-২৩; লবণাক্ততাসহিষ্ণু চীনাবাদামের জাত বিনা চীনাবাদাম-৫,৬, ৭, ৮, ৯, ১০; লবণাক্ততাসহিষ্ণু সয়াবিনের জাত বিনাসয়াবিন-২, ৩, ৫ ও বিনাতিল-২; খরাসহিষ্ণু ধানের জাত বিনাধান-৭, ১৯, ২১; খরাসহিষ্ণু মুগ এবং মসুরের জাত বিনামুগ-৮ ও বিনামসুর-৯; পানি ও সার সাশ্রয়ী বিনাধান-১৭; জিংকসমৃদ্ধ বিনাধান-২০, সাময়িক জলাবদ্ধতাসহিষ্ণু বিনাসরিষা-৯ এবং পরিবেশবান্ধব জীবাণুসার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিনা উদ্ভাবিত জাতগুলো ধানের ক্ষেত্রে ৬ লাখ হেক্টর, ডালের ক্ষেত্রে ৫ লাখ হেক্টর এবং তেলজাতীয় ফসলের ক্ষেত্রে ০.৫ লাখ হেক্টর জমি চাষাবাদ হয়েছে।
হাওড় তথা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা, বরেন্দ্র অঞ্চলে খরা এবং দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ার কারণে এ দেশে ধানের উৎপাদন সন্তোষজনক না হওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে আকস্মিক বন্যা, অতি বন্যা, জোয়ারের বন্যা, পাহাড়ি ঢলের বন্যার কারণে আবাদি জমি ক্রমাগত কমে যাচ্ছে, বিশেষ করে ধান চাষ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের জেলাসমূহ বিশেষ করে রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর জেলায় বন্যার কারণে ধান চাষ দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ১৪০ লাখ হেক্টর এবং ধান চাষের আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ১১০ লাখ হেক্টর। বন্যাকবলিত জমির পরিমাণ ২৬ লক্ষ হেক্টর, যা মোট আবাদি জমির প্রায় ২৪% এবং জোয়ারের পানির কারণে বন্যাকবলিত প্রায় ১৬ লাখ হেক্টর। বাংলাদেশে এরকম প্রায় ২০ লাখ হেক্টর আকস্মিক বন্যাপ্রবণ এলাকা রয়েছে যেখানে এই জাতের ধান চাষে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) কর্তৃক উদ্ভাবিত জলমগ্নতাসহিষ্ণু ধানের জাত বিনাধান-১১ ও বিনাধান-১২ যা প্রায় ২৫ দিন পর্যন্ত সম্পূর্ণ জলমগ্ন থাকলেও স্বাভাবিক ফলন দিতে সক্ষম। যা ২০-২৫ দিন জলমগ্নতা সহ্য করার পরও বন্যা আক্রান্ত জমিতে হেক্টর প্রতি ফলন ৪.০-৪.৫ টন এবং বন্যামুক্ত স্বাভাবিক জমিতে ৫.০-৫.৫ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। আমন মৌসুমে বিনাধান-১১ জাতটি ১১০-১১৫ দিনে ও বিনাধান-১২ জাতটি ১২০-১২৫ দিনে পাকে। বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের জেলাসমূহে প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ অর্থাৎ ১৩ লক্ষ হেক্টর জমি ধান চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে এবং বন্যাপ্রবণ এলাকায় এ জাত দু’টির গড় ফলন প্রায় ৫ টন যা চালে হেক্টরপ্রতি ৩.৫ টন পাওয়া যাবে। এ হিসেবে প্রায় অতিরিক্ত ৪৫ লাখ টন চাল উৎপাদিত হবে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নবদিগন্তের সূচনা করবে।
খরা কৃষির অন্যতম সাধারণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়। প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্নপর্যায়ের খরায় আক্রান্ত হয়। গাছের বৃদ্ধির পর্যায়ে গড় বৃষ্টিপাতের অভাব মাটিতে পানিশূন্যতা সৃষ্টি করে, যা গাছের ক্ষতি করে। আমন ধানের প্রায় ৩ লাখ হেক্টর আবাদযোগ্য জমির ৮০% জমিতে চাষ করা হয়, যা বিভিন্ন পর্যায়ের খরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সমস্যা দূরীকরণের লক্ষ্যে বিনা খরাসহিষ্ণু ধানের জাত বিনাধান-৭, বিনাধান-১৯, বিনাধান-২১ উদ্ভাবন করেছে। এ ছাড়াও বিনাধান-১৭ ধানের জাতটি ৪০% পানি ও ৩০% সার সাশ্রয়ী। লবণাক্ত এলাকা ছাড়া দেশের সকল রোপা আমন অঞ্চল বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা, রাজশাহীসহ ঢাকা, কুমিল্লা, যশোর, কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে জাতটির গড় ফলন ৬.৮ টন/হেক্টর এবং সর্বোচ্চ ফলন ৮.০ টন/হেক্টর।
বাংলাদেশের ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৭০ ভাগ অঞ্চল সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১ মিটার উচ্চতার মধ্যে অবস্থিত। এতে বন্যার আশঙ্কা প্রবল। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ২০৫০ সাল পর্যন্ত ১ মিটার বাড়তে পারে। যার প্রভাবে প্রায় ৩০০০ মিলিয়ন হেক্টর জমি স্থায়ীভাবে হারিয়ে যেতে পারে এবং সার্বিক উৎপাদন শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ কমে যেতে পারে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় জোয়ার-ভাটা এবং জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সমুদ্রের লোনা পানি কৃষি জমিতে প্রবেশ করায় আবাদি জমি ক্রমাগত লবণাক্ত হয়ে পড়ছে ও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করছে। ফলে আবাদি জমি ফসল চাষের আওতায় আনা যাচ্ছে না। এ সকল জমিতে বিনা উদ্ভাবিত লবণাক্ততাসহিষ্ণু ধানের জাত বিনাধান-৮, বিনাধান-১০ ও বিনাধান-২৩ কৃষির উৎপাদন অব্যাহত রাখবে। এর মধ্যে বিনাধান-২৩ এমন একটি ধানের জাত, যা ৮ ডেসি সিমেন/মিটার মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করতে পারবে এবং ১৫ দিন পর্যন্ত জলমগ্ন থাকলেও স্বাভাবিক ফলন দিতে সক্ষম। দ্বৈত লবণাক্ততা এবং বন্যাসহিষ্ণু এ জাতটি সম্প্রসারণের মাধ্যমে ১০ লক্ষ হেক্টর লবণাক্ততা ও ২৬ লক্ষ হেক্টর বন্যা আক্রান্ত আমন ধানের জমির প্রায় শতকরা ২০-৩০ ভাগ অর্থাৎ ৭-১০ লক্ষ হেক্টর জমি চাষের আওতায় আনা যায় তবে চালের ফলন হেক্টরপ্রতি ৩.০ টন হিসেবে অতিরিক্ত প্রায় ২০-৩০ লক্ষ টন চাল উৎপাদিত হবে বলে আশা করা যায়।
এ ছাড়াও বিনা উদ্ভাবিত অন্যান্য প্রতিকূলতা সহনশীল ডাল, তেল, মসলা ও সবজিজাতীয় ফসলের উচ্চফলনশীল জাত চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে দেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারবে।
বর্তমান কোভিড-১৯ মহামারিতে সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হলেও বর্তমান সরকারের সঠিক ও কার্যকর পদক্ষেপের ফলে এই মহামারিতেও দেশের উন্নয়নের যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। দেশে এমন দুর্যোগকালেও ধানসহ বিভিন্ন ফসলের বাম্পার ফলনের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। তবে করোনা-উত্তর বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য খাদ্য সংকট মোকাবিলায় সবাইকে আরও সচেষ্ট হতে হবে। কৃষি উৎপাদনে পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রেখে আবাদযোগ্য জমিগুলোর জন্য বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, পোকামাকড় ও রোগ সহনশীল ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে টিকে থাকতে পারে এমন জাত উদ্ভাবন ও ব্যাপক সম্প্রসারণের কাজ চলমান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ মতে দেশের আবাদযোগ্য প্রতি ইঞ্চি জমিতে উন্নত প্রযুক্তি অনুসরণ করে মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন ফসলের আবাদ নিশ্চিত করতে হবে। এক ফসলি দুই ফসলি জমিগুলোকে চার ফসলি জমিতে পরিণত করে শস্যের নিবিড়তা ১৯৪% থেকে উন্নীত করতে হবে। ফলশ্রুতিতে উৎপাদন দ্বিগুণ ও আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে।
পরিশেষে, বাংলাদেশের জনগণ জীবনধারণের জন্য কৃষির উপর নির্ভর করে। এ দেশের শতকরা ৬০% এরও বেশি লোক কৃষি কাজের মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে এবং কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে কৃষি। বিনা উদ্ভাবিত জাত ও প্রযুক্তি এবং অপেক্ষমান জাত ও প্রযুক্তি ক্ষুধা নিবারণ, খাদ্য এবং পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন করবে এবং আমাদের দেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত লাভ করতে পারবে।
লেখক : মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ। ফোন : ০৯১৬৭৮৩৪, ইমেইল : dg@bina.gov.bd
খাদ্য নিরাপত্তা ও বিপণন ব্যবস্থাপনা
কাজী আবুল কালাম
মানুষ ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য খাবার গ্রহণ করে। এটি তার মৌলিক অধিকার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ প্রতিবেলায় যে খাবার খাচ্ছে, তা সহজলভ্য কি না এবং তা নিরাপদ কি না? বাংলাদেশ ইতোমধ্যে দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। তবে একটি বিষয় ভেবে দেখতে হবে; তা হচ্ছে দেশের প্রতিটি মানুষ কি সহজে খাবারের নাগাল পাচ্ছে? এ বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, খাদ্যের উৎপাদন পরবর্তী যে ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ খাদ্যের বিপণন ব্যবস্থাপনা যথাযথ হলে ভোক্তা তথা মানুষের নিকট তা সহজেই পৌঁছে যায়।
দেশের স্বাধীনতার পর থেকেই কৃষি, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তাকে প্রাধান্য প্রদান করে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন নীতি কৌশল এবং বাস্তবানুগ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের ফলে বাংলাদেশ দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও খাদ্যের নিরাপদতা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এর পাশাপাশি সকল জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করাসহ পুষ্টি স্তর উন্নয়নও অন্যতম প্রধান কাজ। সরকার বহুমাত্রিক উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নতির লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। কৃষিকাজ বাংলাদেশের সিংহভাগ জনগণের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। আধুনিক জাত ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ বছরব্যাপী নানা রকম ফলমূল ও শাকসবজি উৎপাদিত হচ্ছে, যা দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে (এসডিজি) সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকার সকল প্রকার দারিদ্র্য দূরীকরণ, ক্ষুধা অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন, পুষ্টি উন্নয়ন এবং টেকসই কৃষির সম্প্রসারণ (এসডিজি-২) কাজ এগিয়ে নিয়ে চলেছে।
যেকোনো বিপণন ব্যবস্থাপনার মূল বিষয় হলো উৎপাদক, উৎপাদন সম্পৃক্ত অংশীজন, উৎপাদন পরবর্তী অংশীজন এবং সর্বশেষে ভোক্তার কাছে পণ্যটি পৌঁছে দেয়া। কৃষিপণ্য বিপণন ব্যবস্থাপনাও এর ব্যতিক্রম নয়। আর সে লক্ষ্যেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে উৎপাদক, বিক্রেতা ও ভোক্তা সহায়ক কৃষি বিপণন ব্যবস্থা এবং কৃষি ব্যবসা উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখা। এজন্য কৃষিপণ্যের চাহিদা ও জোগান নিরূপণ, মজুদ ও মূল্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, বাজার অবকাঠামো জোরদারকরণ, কৃষিপণ্যের বিপণন ব্যবস্থাপনায় সহায়তা প্রদান, কৃষক দল গঠন, উৎপাদক ও বিক্রেতার সাথে ভোক্তার সংযোগ স্থাপন, কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণে সহায়তা প্রদান, কৃষিপণ্য রপ্তানিতে সহায়তা প্রদান, কৃষিপণ্য ও কৃষি উপকরণের মজুদ বা গুদামজাতকরণ, পণ্যের গুণগতমান, মেয়াদ, মোড়কীকরণ ও সঠিক ওজনে ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিবীক্ষণ ইত্যাদি কাজে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সম্পৃক্ত রয়েছে।
মানুষ সহজে খাবার পাচ্ছে কি না; তা নির্ণয়ের জন্য কয়েকটি অনুষঙ্গ বিবেচনা করতে হয়। তা হলো : প্রাপ্যতা (availability), অভিগম্যতা (accessibility), ব্যবহার (utilization) ও টেকসই (stability)। এ সকল অনুষঙ্গই কৃষি বিপণনের সঙ্গে সর্বোতভাবে সম্পৃক্ত। খাদ্যের নিরাপদতার প্রথম শর্তই হলো খাদ্যের প্রাপ্যতা। খাদ্যের প্রাপ্যতা বলতে বোঝাবে খাদ্যের সরবরাহ, উৎপাদন, মজুদ পরিস্থিতি, খাদ্য আমদানি ইত্যাদি। এর সঙ্গে খাদ্যের সংগ্রহোত্তর ক্ষতির বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হয়। বিপণন ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে করা হলেই কেবল ভোক্তার কাছে খাদ্যের প্রাপ্যতা সহজলভ্য হবে। শুধু খাদ্যের প্রাপ্যতা থাকলেই হবে না, এর অভিগম্যতাও গুরুত্বপূর্ণ। অভিগম্যতা আবার কয়েকভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- বাস্তবিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক। অর্থাৎ ভোক্তার বিশেষ করে অরক্ষিত পরিবারের (vulnerable household) ক্ষেত্রে খাদ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় (নিজস্ব উৎপাদন বা বাজারের মাধ্যমে) অবকাঠামোগত উপস্থিতি নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ এর ব্যাঘাত ঘটতে পারে যদি বাজারের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হয়। এ বিষয়টি দেখা যেতে পারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পল্লী এলাকাতে। তবে শহরের ক্ষেত্রে খাবারের নিরবচ্ছিন্ন বাজার সরবরাহ শৃঙ্খলের অবাধ প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। এক্ষেত্রে বিপণন নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। অপরদিকে অর্থনৈতিক অভিগম্যতার মূলকথাই হলো ভোক্তার আয় এবং পণ্যের মূল্য। বিপণন ব্যবস্থাপনার মূল চ্যালেঞ্জই হলো এ জায়গায়। অর্থাৎ কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি এবং ভোক্তার যৌক্তিক মূল্যে খাদ্য ক্রয়ের সুযোগ সৃষ্টি। সামাজিক অভিগম্যতা অনেকাংশে নির্ভর করে ব্যক্তির একক পর্যায়ে অভিগম্যতা ও খাবারের ভোগবাদিতা; বিশেষ করে পরিবারের মধ্যে লিঙ্গ, গোত্র, বয়স, স্বাস্থ্যগত অথবা সামাজিক বিষয়াদি ইত্যাদি অভিগম্যতার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। তৃতীয় অনুষঙ্গটি হলো খাবারের ব্যবহার। একজনের পুষ্টি অবস্থা বিবেচনা করা হলে এ বিষয়টি সঠিকভাবে উপলব্ধি করা যায়। একটি পরিবারের হয়তোবা সামর্থ্য আছে প্রয়োজন অনুযায়ী খাবার কেনার; কিন্তু ক্রয়কৃত খাবারের সম্পূর্ণ ব্যবহারের অক্ষমতা রয়েছে। এক্ষেত্রে খাবারের মান ও পরিমাণ, খাবার প্রস্তুতি, খাবার গ্রহণের সংস্কৃতি, খাবার সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হয়। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এ ক্ষেত্রেও ফল, সবজি, প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করে খাবারের বৈচিত্র্যতা আনয়ন করে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। চতুর্থ অনুষঙ্গটি হলো বর্ণিত ৩টি অনুষঙ্গের ধারাবাহিক সক্ষমতা বা টেকসই খাবারের নিশ্চয়তা প্রদান করা। এ বিষয়টি অনেকাংশেই সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এক্ষেত্রেও সময়ের পরিক্রমায় উৎপাদন ব্যয়, ক্রয়মূল্য ও বিক্রয়মূল্যের মধ্যবর্তী ব্যবধান, দর, পরিমাণ, জোগান-চাহিদা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বাজারের স্থিতাবস্থা রক্ষা তথা খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় ভূমিকা পালন করে।
বিপণন ক্রেতার চাওয়া এবং লাভজনকভাবে তার নিকট দ্রব্যটি পৌঁছে দেয়াকে প্রাধান্য দেয়। এ বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বিপণন ব্যবস্থাপনা পুরোটাই ক্রেতাকেন্দ্রিক। ক্রেতার চাহিদা মোতাবেক উৎপাদন করা প্রয়োজন। বিপণন ব্যবস্থা তখন টেকসই হবে যখন এখানে অন্তর্ভুক্ত সকল অংশীজন লাভ করতে সক্ষম হবে। কৃষি বিপণন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষক কর্তৃক উৎপাদিত পণ্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর মাধ্যমে ভোক্তার নিকট পৌঁছে দেয়া এবং উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে মূল্য ও চাহিদা বিষয়ে তথ্য প্রদান করা গুরুত্বপূর্ণ। বিপণন ব্যবস্থাপনায় আরও যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো: বাজার অবকাঠামো, পণ্য পরিবহন, পণ্য সংরক্ষণের সুবিধা এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত বাজার কারবারি, আড়তদার ও খুচরা বিক্রেতা। কৃষকের পণ্য উৎপাদনের নিমিত্ত ব্যবহৃত উপাদানসমূহ স্থানান্তরের জন্য সম্পাদিত সকল ক্রিয়াকর্মও কৃষি বিপণনের অংশ (আচারিয়া ও আগারওয়াল, ১৯৮৮)। কারণ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উপকরণাদিও কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণের জন্য ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের কৃষক ছোট আয়তনের জমির মধ্যে আবাদ করে এবং তার দৃষ্টিও সীমাবদ্ধ থাকে স্থানীয় বাজারের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ের সুযোগ প্রাপ্তির উপর। পক্ষান্তরে স্থানীয় বাজারসমূহ সংগঠিত নয়। ফলে বাজারকারবারি, ফড়িয়া বা মধ্যস্বত্বভোগীরা খুব সহজেই কৃষকের পণ্য ক্রয় করে এবং উক্ত পণ্য একাধিক স্তর পরিভ্রমণ করে ভোক্তার নিকট পৌঁছে। সংগতকারণেই ভোক্তা পণ্যের উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে বেশি দামে ক্রয় করতে বাধ্য হয়। কৃষিপণ্যের বিপণন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্প্রতি ৪ আগস্ট ২০২১ মাননীয় কৃষিমন্ত্রী কৃষিপণ্য কেনাবেচায় মোবাইল অ্যাপ ‘সদাই’ এর উদ্বোধন করেন। এ অ্যাপটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস, কৃষিপণ্যের গুণগত মান নিশ্চিতে কাজ করবে। একইসাথে, ভোক্তারা যাতে না ঠকে, প্রতারণার শিকার না হয় এবং নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত পণ্য পায়-তাতে অ্যাপটি সহায়ক ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণসহ সামগ্রিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে নেয়া হচ্ছে যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
বৈশ্বিকভাবে ৬৯০ মিলিয়ন মানুষ এখনও অপুষ্টিতে ভুগছে, প্রায় ২ বিলিয়ন মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নেই এবং প্রায় ৩ বিলিয়ন মানুষ খাদ্যের বৈচিত্র্যতা এনে সুষম খাবার খেতে পারে না। স্বাস্থ্যসম্মত ও ক্রিয়াশীল জীবনের জন্য প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার। কিন্তু পৃথিবীর ৩ বিলিয়ন অর্থাৎ প্রায় ৪০% মানুষের পুষ্টিকর খাবার সংগ্রহের সক্ষমতা নেই (এফএও, ইফাদ, ইউনিসেফ, ডব্লিউএফপি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০২০)। পুষ্টিকর খাবার সংগ্রহের অক্ষমতার জন্য কৃষিপণ্যের মূল্য একমাত্র প্রতিবন্ধকতা নয়। এ জন্য প্রয়োজন সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই খাদ্য ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন। পুষ্টিকর খাবার প্রস্তুতিতে যে সমস্যা আছে তা দূর করতে হবে, খাবারের বৈচিত্র্য আনতে হবে, প্রক্রিয়াজাতকরণ খাবার খেতে হবে, পুষ্টিকর খাবার বিষয়ে জ্ঞানের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এসব বিষয়ে সরকারের নীতি ও কৌশল প্রণয়নে বিবেচনা করতে হবে।
বাংলাদেশের মানুষের এখন খাবারের প্রাপ্যতা থাকলেও মূল চ্যালেঞ্জের জায়গাটি হলো নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের জোগান দেয়া। জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়নও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ প্রেক্ষাপটে নিরাপদ খাবার উৎপাদনের জন্য উত্তম কৃষি চর্চার কোনো বিকল্প নেই। এ ছাড়া বিপণন ব্যবস্থাপনার যে কোনো পর্যায়ে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান অক্ষুণ্ন রাখার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।
আশা করা যায় সবার প্রচেষ্টায় এবং সরকারের যথাযথ নীতি ও কৌশল প্রণয়নের মাধ্যমে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিসহ দেশের মানুষের খাদ্যের নিরাপত্তা বিধান ও নিরাপদ খাবার সরবরাহের মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী ও কর্মক্ষম জাতিতে পরিণত করা সম্ভব হবে।
লেখক : পরিচালক, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭২৭৫৩১১০০, ই-মেইল : kaziabulkalam@gmail.com
বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২১ এর প্রতিপাদ্য ও কৃষির যত প্রণোদনা
কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী
বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণের ফলে এক বহুমাত্রিক সংকটকাল অতিক্রম করছে সমগ্র বিশ্ব। দেশে দেশে খাদ্য ও পুুষ্টির অনিশ্চয়তাসহ নানাবিধ সমস্যা সঙ্কুল সময় অতিক্রম করছে বিশ্বের মানবসভ্যতা। এ রকম পরিস্থিতিতে ১৬ অক্টোবর ২০২১ অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও উদ্যাপিত হচ্ছে বিশ্ব খাদ্য দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ। ভালো উৎপাদনে ভালো পুষ্টি আর ভালো পরিবেশেই উন্নত জীবন।’
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর মাহেন্দ্রক্ষণে স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই বঙ্গবন্ধুর অসামান্য দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কৃষি দর্শন অনুসরণপূর্বক সময়োপযোগী কর্মসূচি ও পরিকল্পনা যথাযথভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার দক্ষতার সাথে বাস্তবায়ন করার ফলে কৃষিতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। এমন কি করোনা সংকট মোকাবিলা করেও এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে, যা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে।
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। এ বছর বিশ্বখাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য মূলত কৃষিবান্ধব সরকারের নীতি ও পরিকল্পনার সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে ফসলের উৎপাদনশীলতা, উৎপাদন ও কৃষকের আয় বৃদ্ধি, শস্য বহুমুখীকরণ, পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন, লাভজনক কৃষি ও দক্ষ প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন। শুধু তাই নয়, জাতীয় কৃষি নীতির ৮ অনুচ্ছেদে- কৃষি পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা; ৯ অনুচ্ছেদে- বিশেষ আঞ্চলিক কৃষি; ১০ অনুচ্ছেদে- বিশেষায়িত কৃষি; ১১ অনুচ্ছেদে- নিরাপদ খাদ্য ও কৃষিপণ্য উৎপাদন এবং ১৫ অনুচ্ছেদে- প্রণোদনা ও কৃষি পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছে। তাই প্রাসঙ্গিকভাবে বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্যের সাথে সংগতিপূর্ণ হওয়ায় শুধু ২০২০-২১ সালে কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত কৃষি প্রণোদনা ও কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি তুলে ধরা হলো।
২০২০-২১ সালে কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক সর্বমোট ৪৫৮,৮৭,১৯,৯৭৩/- টাকার (চারশত আটান্ন কোটি সাতাশি লাখ উনিশ হাজার নয়শত তিয়াত্তর) কৃষি প্রণোদনা/পুনর্বাসন সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। উপকারভোগী ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যা ছিল মোট ৭৪,৪৯,৫৪১ জন (চুয়াত্তর লাখ ঊনপঞ্চাশ হাজার পাঁচশত একচল্লিশ)। মূলত গুরুত্বপূর্ণ ফসলগুলোর আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া, পারিবারিক পুষ্টি নিরাপত্তা, কৃষক পরিবারের আয় বৃদ্ধি, কৃষি পরিবেশ সুরক্ষা, সর্বোপরি করোনা সংকট মোকাবিলা করে কৃষি অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার প্রয়াসে বিশাল এই কর্মযজ্ঞ অত্যন্ত সুচারুরূপে ও দক্ষতার সাথে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিচালনা ও নির্দেশনায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত হয়েছে। ফলে উৎপাদন ও আয় বেড়েছে, পুষ্টি নিরাপত্তার অগ্রগতি হয়েছে, যা এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
রবি, খরিফ-১, খরিফ-২ এই তিন মৌসুমব্যাপী কৃষি প্রণোদনা/ কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে। ২০২০-২১ বছরের কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচিগুলো ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের বিনামূল্যে বীজ, সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ বিতরণ করা হয়। মাঠ পর্যায়ে কৃষি পুনর্বাসন কমিটির মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে বিপুল সংখ্যক কৃষক/কৃষানির কাছে বিনামূল্যে সঠিক সময়ে কৃষি উপকরণগুলো পৌঁছে দেয়া হয়। ২০২০-২১ সালের কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচি সারণি দ্রষ্টব্য।
এ সকল কৃষি প্রণোদনা/কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা ছাড়াও আরো কিছু কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষকদেরকে নানাবিধ সহায়তা প্রদান করে কৃষি মন্ত্রণালয়। যেমন : ১) মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনায় ঝড়ো হাওয়া, শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত ৬টি জেলায় ৪৮৬৬৫ জন কৃষক/ কৃষানিদেরকে ১৬,৩৬,৮৫,৫৫৫ টাকার অর্থ সহায়তা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট/মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে প্রদান করা হয়। ২) করোনাকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৪% রেয়াতি সুদে বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। ৩) কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে কৃষক/কৃষানিদেরকে সমতলে ৫০% এবং হাওড় ও উপকূলীয় এলাকায় ৭০% ভর্তুকিতে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। ৪) সেচের ক্ষেত্রেও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। ৫) পতিত জমিতে সবজি চাষের জন্য প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার বাড়ির অব্যবহৃত জমিতে ১০০টি করে পুষ্টি বাগান স্থাপন করা হবে। এতে সারা দেশে সবজি, ফল ও মসলা জাতীয় ফসলের প্রায় পাঁচ লাখ পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপিত হবে। বর্তমান সরকার কর্তৃক গৃহীত এ সকল কর্মসূচি ও কর্মপরিকল্পনা দক্ষতার সাথে যথাসময়ে বাস্তবায়নের ফলে কৃষির সার্বিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। ফলশ্রুতিতে কৃষি মন্ত্রণালয় বার্ষিক কর্মসম্পাদনে জাতীয়ভাবে ২য় স্থান অর্জন করেছে। অতি সম্প্রতি জাতিসংঘ কর্তৃক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ‘এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার’ প্রদান করা হয়েছে। এ সকল অগ্রগতি ও অর্জন ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।
‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার
কৃষি হবে দুর্বার।’
লেখক : সাবেক পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১২৫০১৪৯২, ই-মেইল : chakrobortykc@gmail.com
অগ্রহায়ণ মাসের কৃষি
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
বাঙালির ঐতিহ্য নবান্ন উৎসবের সময় অগ্রহায়ণ মাস। কৃষি ভুবনে জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদতার একটি নিশ্চিত মৌসুম। তাহলে আসুন আমরা জেনে নেই অগ্রহায়ণ মাসের কৃষিতে আমাদের করণীয় কাজগুলো।
আমন ধান
এ মাসে প্রায় আমন ধান পেকে যাবে। তাই রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে। ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকায় আমন ধান শতকরা ৮০ ভাগ পাকলে কেটে ফেলা ভালো। আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে সুস্থ সবল ভালো ফসল কেটে, মাড়াই-ঝাড়াই করার পর রোদে ভালোমতো শুকাতে হবে। শুকানো গরম ধান আবার ঝেড়ে পরিষ্কার করে এবং ছায়ায় রেখে ঠাণ্ডা করতে হয়। পরিষ্কার ঠাণ্ডা ধান বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে।
বোরো ধান
বোরো ধানের বীজতলা তৈরির উপযুক্ত সময়। রোদ পড়ে এমন উর্বর ও সেচ সুবিধাযুক্ত জমি বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হয়। যেসব এলাকায় ঠাণ্ডার প্রকোপ বেশি সেখানে শুকনো বীজতলা তৈরি করতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রতি দুই প্লটের মাঝে ২৫-৩০ সেমি. নালা রাখতে হবে। বোরো মওসুমের পানি সাশ্রয়ী জিংকসমৃদ্ধ জাত ছাড়াও এলাকাভিত্তিক আধুনিক উচ্চফলনশীল ও ব্রি হাইব্রিড ধানের জাত নির্বাচন করতে পারেন। বীজ বপন করার আগে ৬০-৭০ ঘণ্টা জাগ দিয়ে রাখতে হবে। এ সময় ধানের অঙ্কুর গজাবে। অঙ্কুরিত বীজ বীজতলায় ছিটিয়ে বপন করতে হবে। প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ৮০-১০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
গম
অগ্রহায়ণের শুরু থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ পর্যন্ত গম বোনার উপযুক্ত সময়। এরপর গম যত দেরিতে বপন করা হবে ফলনও সে হারে কমে যাবে। দো-আঁশ মাটিতে গম ভালো হয়। অধিক ফলনের জন্য এলাকাভিত্তিক ও ঘাতসহিষ্ণু আধুনিক উচ্চফলনশীল গমের জাত বপন করতে হবে।
ভুট্টা
ভুট্টা গত মাসে আবাদ না করে থাকলে এ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে জমি তৈরি করে এলাকাভিত্তিক ও ঘাতসহিষ্ণু আধুনিক উচ্চফলনশীল জাতের বীজ বপন করতে হবে।
সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল
তেল ফসলের মধ্যে সরিষা অন্যতম। তাছাড়া বাদাম, সূর্যমুখী এসব আবাদ করতে পারেন।
আলু
উপকূলীয় অঞ্চলে এ মাসেও আলু আবাদ শুরু করা যায়। অন্যান্য স্থানে রোপণকৃত আলু ফসলের যত্ন নিতে হবে।
শাকসবজি
ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, মুলা এসব বড় হওয়ার সাথে সাথে চারার গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। চারার বয়স ২-৩ সপ্তাহ হলে সারের উপরি প্রয়োগ করতে হয়। সবজি ক্ষেতের আগাছা, রোগ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করা প্রয়োজন।
গাছপালা
এবারের বর্ষায় রোপণ করা ফল, ঔষধি বা বনজ গাছের যত্ন নেয়া প্রয়োজন। গাছের গোড়ায় মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। প্রয়োজনে গাছকে খুঁটির সাথে বেঁধে দেয়া যেতে পারে।
প্রাণিসম্পদ
হাঁস-মুরগির ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর ভালো সময় এখন। তাছাড়া সামনে শীতকাল আসছে। শীতকালে পোল্ট্রিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যায় এজন্য সতর্কতা দরকার। গবাদিপ্রাণির রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে প্রাণী চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
এ সময় বার বার জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে মৎস্যবিদদের সাথে পরামর্শ করে চুন বা তুঁতে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, সংক্ষেপে আগামী তথা অগ্রহায়ণ মাসের কৃষি উপস্থাপন করা হলো। বিস্তারিত কৌশল জানার জন্য স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বা উপজেলা কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের সম্মিলিত অংশগ্রহণই নিয়ে আসবে কৃষির কাঙ্ক্ষিত সাফল্য।
লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪, ই-মেইল : editor@ais.gov.bd