Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

কুড়িগ্রামের চরে মসুর-মুগডাল-আমন ধান শস্যবিন্যাস : সমস্যা ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশে প্রায় এক মিলিয়ন হেক্টর চর জমি আছে। চরের কৃষি ব্যবস্থাপনা সমতল ভূমির চেয়ে বাস্তবিক কারণেই ভিন্ন হয়। যেহেতু প্রতি বছরই চর এলাকা বর্ষায় ডুবে যায় সেহেতু ফি বছরই এতে কিছু না কিছু পলি-বালু জমা হয়। অনেক সময়ই ঘূর্ণায়মান স্রোতের সঙ্গে বালুর স্তূপ পড়ে। ফলে একই জমিতে ফসলের খাদ্যোপাদানের মাত্রার ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ করা যায়। চরের বয়সের ওপর নির্ভর করে মাটির উর্বরতা। কারণ পুরনো চরগুলোতে দীর্ঘদিন চাষাবাদের ফলে মাটির  জৈবপদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
 
বিগত ২০১১ সাল থেকে KGF-World Bank এর আর্থিক সহায়তায় এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কুড়িগ্রামের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এসব চরে বছরে তিনটি ফসল উৎপাদনের প্রযুক্তি সুপারিশ করা হয়েছে। এসব প্রযুক্তির মধ্যে মসুর-মুগডাল-স্বল্পমেয়াদি আমন ধান শস্যবিন্যাস কুড়িগ্রামের চরে বিশেষভাবে উপযোগী বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বিশেষ করে যেসব চরের মাটিতে বালুর পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি সেসব চরের জন্য এ শস্য বিন্যাসটি খুবই উপযোগী। সে আলোকে কুড়িগ্রাম সদর, নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলার আটটি চরের ১০০০ কৃষককে সম্পৃক্ত করে ১০০০ বিঘা জমিতে এ শস্য বিন্যাসের ব্যাপকভিত্তিক চাষের সফলতা বিশ্লেষণ করা হয়।

কুড়িগ্রামের চরে মসুর-মুগডাল-স্বল্পমেয়াদি আমন ধান চাষে করণীয়
মসুরের চাষ
শীতকালে মসুরের চাষ করতে হয় বিধায় ভালো ফলনের জন্য নভেম্বর মাসের প্রথম দিকেই বীজ বপন করতে হবে। এজন্য মসুর চাষের পূর্বে স্বল্পমেয়াদি আমন ধানের চাষ করাই বাঞ্ছনীয়। কারণ চর এলাকার দীর্ঘ জীবনকাল বিশিষ্ট স্থানীয় ধানের জাত চাষ করা হলে মসুরের বীজ বপন করতে বিলম্ব হয়। বিলম্বে বীজ বপন করলে মসুরের শুটি ধরা পর্যায়েই বাতাসের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে বীজ পুষ্ট কম হয় এবং ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। তাছাড়া মাটির আর্দ্রতাও ক্রমে ক্রমে কমতে থাকায় খরার প্রাদুর্ভাবে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
 
বীজ বপন ও ফসল ব্যবস্থাপনা
বীজ বপনের পূর্বে ভালোভাবে জমি চাষ করে নিতে হয়। জমিতে জোঁ থাকার সময়ই বিঘাপ্রতি ৬ কেজি ইউরিয়া, ১১.৫০ কেজি টিএসপি, ৫.০ কেজি এমপি এবং ০.৫ কেজি বোরন মাটিতে মিশিয়ে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেমি. বজায় রেখে বীজ বপন করতে হবে। বিঘাপ্রতি ৫.৫০ কেজি বীজ নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহেই বপন করতে হবে। প্রতি কেজি বীজে ২-২.৫ গ্রাম ভিটাভেক্স মিশিয়ে বীজ শোধন করা উচিত। বীজ বপনের পর কমপক্ষে ২০-২৫ দিন জমিকে আগাছামুক্ত রাখতে হবে। মাটির আর্দ্রতা কমে গেলে সেচের প্রয়োজন হবে।

ফসল সংগ্রহ
বপন করার ১১০-১১৫ দিনের মধ্যেই মসুর পেকে যায়। নাগেশ্বরী উপজেলার চর বেরুবাড়ী ও কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার চর নিধিরামে বারি মসুর-৬ চাষ করে কৃষক পর্যায়ে ৬০০-৭০০ কেজি ফলন পাওয়া গেছে।

মুগডালের চাষ
মুগডাল খরিফ-১ মৌসুম বিশেষ করে মসুর/গম/আলু/অন্যান্য রবিশষ্য কাটার পর বপন করা হয়। বীজ বপনের ৬০-৬৫ দিনের মধ্যেই ফসল তোলা যায়। ফলে মুগডাল সংগ্রহের পর একই জমিতে আমন ধান চাষ করতে কোনো অসুবিধা হয় না।
 
বীজ বপন ও ফসল ব্যবস্থাপনা
বিগত ২০১১ সাল থেকেই বিভিন্ন চরে মুগডালের চাষ করে দেখা গেছে যে, মার্চ মাসের ২০-৩০ তারিখের মধ্যে বীজ বপন করতে পারলে বর্ষার পানির হঠাৎ বৃদ্ধির হাত থেকে ফসল রক্ষা করা সহজ হয়। জমি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করতে হবে। প্রতি কেজি বীজে ২.০-২.৫ গ্রাম ভিটাভেক্স মিশিয়ে বীজ শোধন করার পর বিঘাপ্রতি ৪.০ কেজি বীজ বপন করতে হবে। বীজ বপন করার পূর্বেই বিঘাপ্রতি ৫.০ কেজি ইউরিয়া, ১০.০ কেজি টিএসপি, ৫.০ কেজি এমপি ও ০.৫ কেজি বোরন মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বীজ বপনের সময় জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকতে হবে। প্রয়োজনে হালকা সেচ দিয়ে জমিতে জোঁ অবস্থা তৈরি করে বীজ বপন করতে হবে।
বীজ বপনের পর ২০-২৫ দিন পর্যন্ত জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে। খরিফ-১ মৌসুমে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশি হয়। জাবপোকা দেখা দিলে প্রতিরোধক হিসেবে প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি. এজোড্রিন কিংবা ক্যারাটে মিশিয়ে প্রতি সপ্তাহে একবার স্প্রে করা যেতে পারে। লেদাপোকা বা ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধে সিমবুশ বা রিপকর্ড একই হারে স্প্রে করা যেতে পারে।

 
গম-আলু চাষের পর মুগডাল উৎপাদনে করণীয়
গম কিংবা আলু চাষের পর মুগডাল চাষ করলে ৪.০ কেজি বীজের পরিবর্তে ২.৫-৩.০ কেজি বীজ বপন করলেই চলবে এবং কোন সার প্রয়োগের প্রয়োজন হবে না। কারণ গম বা আলু চাষের সময় যে সার প্রয়োগ করা হয় তার কিছুটা প্রভাব মাটিতে থেকে যায়। মুগডালের সারের মাত্রা দানাদার শস্যের তুলনায় অনেক কম। সারের মাত্রা বেশি হলে গাছে পাতার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেড়ে গিয়ে কার্বন-নাইট্রোজেনের ভারসাম্য নষ্ট হয়। ফলে শুটি বা ফল কম ধরে।
 
খরার সময় করণীয়
মুগডাল খারিফ-১ মৌসুমের ফসল হওয়ার কারণে খরায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মাটির রস কমে গেলে বিকেল বেলা রৌদ্রের প্রখর কমার পর সেচ দিতে হবে। কোনোভাবেই সকালে বা দিনের বেলায় সেচ দেয়া ঠিক হবে না।
 
এপ্রিল মাসে হঠাৎ তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে দ্রুত গাছের দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে। এরূপ ক্ষেত্রে গাছ তুলে পাতলা করে দিতে হবে এবং প্রতি বর্গমিটারে ৩০টি গাছের বেশি রাখা ঠিক হবে না।
 
ফসল সংগ্রহ
বিইউ মুগ-৪ বা বারি মুগ-৬ জাত দুটি ৬০-৬৫ দিনেই পরিপক্ব হয়। এর পাকা শুঁটি দুইবার সংগ্রহ করতে হয়। শুটি সংগ্রহ করার পর গাছ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। এতে করে মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। বিভিন্ন চরে উল্লিখিত জাত দুটির প্রতি হেক্টরে ফলন ১.০-১.৫ টন হয়ে থাকে।
 
স্বল্পমেয়াদি আমন ধানের চাষ
চর এলাকায় তিনটি ফসল চাষ করতে হলে স্বল্পমেয়াদি আমন ধানের চাষ করতে হবে। কারণ স্থানীয় দীর্ঘজীবী ধানের জাত, যেমন মালশিরা, গানজিয়া, জলঢেপা, শাইল কিংবা গুটি স্বর্ণার চাষ করা হলে শীতকালীন ফসল চাষ বিলম্বিত হবে। বিইউ ধান-১ ও ব্রি ধান-৫৬ জাত দুটি ২০১৩ সালে চর নিধিরাম ও চর বেরুবাড়ীতে চাষ করা হয়েছিল। চারা রোপণের পর ৯০-৯৫ দিনের মধ্যেই ধান পেকে যায় এবং ফসল সংগ্রহ করার পর শীতকালীন ফসল যেমন মসুর, গম, সরিষা কিংবা আলু যথাসময়ে চাষ করা সম্ভব হয়।
চারা রোপণ ও ফসল ব্যবস্থাপনা
বিঘা প্রতি ৩ কেজি ধানের বীজ বীজতলায় ফেলতে হবে। চারার বয়স ২০-২৫ দিন হলেই তা রোপণ করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি হওয়ার কারণে কোনোভাবেই ৩০ দিনের বেশি বয়সের চারা রোপণ করা সমীচীন হবেনা। রোপণের সময় সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০ সেমি. এবং গুছি থেকে গুছির দূরত্ব ১৫ সেমি. বজায় রাখতে হবে। প্রতি গোছাতে একটি বা দুটি চারা মাটির ২-৩ সেমি. গভীরে রোপণ করতে হবে। চরের মাটির উর্বরতা কম হওয়ায় সারের মাত্রা কিছুটা বেশি প্রয়োগ করা উচিত। তাছাড়া মাটিতে বালুর পরিমাণ বেশি থাকায় নাইট্রোজেনের অপচয় হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ফলে কিস্তিতে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে।
 
সাধারণত বিঘাপ্রতি ১৭-২০ কেজি ইউরিয়া, ১০-১৪ কেজি টিএসপি, ১৩-১৬ কেজি এমওপি, ১০-১৩ কেজি জিপসাম ও ০.৫ কেজি বোরণ প্রয়োগ করতে হয়। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার শেষ চাষের সময় মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সার চারা রোপণের ৭-১০ দিন পর প্রথম কিস্তি, ২০-২৫ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তি এবং ৪০-৪৫ দিন পর তৃতীয় কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য জমিতে প্রচুর রস থাকা প্রয়োজন। চারা রোপণের পর ২০-২৫ দিন পর্যন্ত জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
 
বিইউ ধান-১ ও ব্রি ধান-৫৬ জাত দুটি মাজরা, গান্ধি ও লেদা পোকায় আক্রান্ত হতে পারে। মাজরা পোকা দমনের জন্য ডায়াজিনন এবং লেদা ও গান্ধি পোকা দমনের জন্য ম্যালাথিয়নসহ একই গোত্রের অন্যান্য কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। কা- পচা বা পাতা ঝলসানো রোগ দেখা দিলে বেভিস্টিন প্রয়োগ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
 
বন্যা পরবর্তী ফসলের পরিচর্যা
প্রায় প্রতি বছরই কুড়িগ্রামের চর এলাকা বন্যায় ডুবে যায়। ধানের কুশি গজানো পর্যায়ে বা তৎপরবর্তীতে ধানগাছ বন্যায় কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিইউ ধান-১ ও ব্রি ধান-৫৬ জাত দুটি ১০-১২ দিন পানিতে সম্পূর্ণ ডুবে থাকার পরও ভালো ফলন দিয়ে থাকে। তবে চারা রোপণের পর পরই বন্যায় ডুবে গেলে এবং তা ৮-১০ দিনের বেশি স্থায়ী হলে ফসল সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর কয়েক দিন জমিতে হাঁটা চলা না করাই ভালো। গাছের পাতায় পলি জমে থাকলে তা বৃষ্টিতে কিংবা বাতাসে ঝরে পরবে। পানি সরে যাওয়ার পর বিঘা প্রতি ২ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে গাছের বৃদ্ধি ভালো হয়। বন্যায় গাছ ডুবে গেলে ধান পাকতে ৭-১০ দিন বিলম্ব হবে।
 
বন্যার সময় ‘ব্যাকআপ বা বীমা’ বীজতলা
কুড়িগ্রামের চরে সাধারণত জুলাই-আগস্ট মাসে বন্যা দেখা দেয়। লক্ষ করা গেছে যে, বিইউ ধান ১ ও ব্রি ধান-৫৬ জাত দুটি কুশি গজানো পর্যায়ে বা তৎপরবর্তীতে দুই সপ্তাহেরও বেশি সম্পূর্ণ ডুবে থাকলেও গাছের তেমন ক্ষতি হয় না। কিন্তু চারা রোপণের পর থেকে কুশি গজানোর আগে ৮-১০ দিনের বন্যায়ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে ফেলে। এরূপ ক্ষেত্রে বন্যার পানি ১০ দিনের বেশি দীর্ঘস্থায়ী হলে নতুন করে বীজতলায় চারা ফেলতে হবে। যদি বীজতলা তৈরি করার মত জমি পাওয়া না যায় তবে ‘দাপোগ’ বা ‘ভাসমান’ পদ্বতিতে বীজতলা তৈরি করতে হবে। বাড়ির উঠানে কিংবা কলার ভেলা/ বাশের মাচার ওপর চাটাই বিছিয়ে তার ওপর মাটির স্তর দিয়ে পানির উপর ভাসমান বীজতলা তৈরি করা যায়। বীজ অঙ্কুরোধগমের জন্য বপনের দুই দিন পূর্বে বীজ ভিজিয়ে ঢেকে রাখতে হবে এরং অঙ্কুরিত বীজ ছিটিয়ে বপন করতে হবে। দাপোগ বা ভাসমান পদ্ধতিতে গজানো চারা ১৫ দিনের মধ্যেই রোপন করতে হবে।
 
ফসল সংগ্রহ
ব্রি ধান৫৬ ও বিইউ ধান১ জাত দুটি চারা রোপণের পর ৯০-৯৫ দিনের মধ্যেই পরিপক্ব হয়। চর এলাকায় বিইউ ধান১ ও ব্রি ধান৫৬ এর ফলন হেক্টরপ্রতি ৩.৫-৪.০ টন পর্যন্ত পাওয়া যাবে।
 
ফসলের নাম   উৎপাদন খরচ (টাকা/হে.)  মোট আয় (টাকা/হে.)   নিটি আয়
মসুর                   ৪৫,৫০০/                              ৬৩,০০০/                  ১৭,৫০০/
মুগডাল                ৪৯,৫০০/                              ৭০,০০০/                   ২০,৫০০/
আমন ধান            ৫২,০০০/                               ৭০,০০০/                   ১৮,০০০/
মোট                    ১৪৭,০০০/                            ২০৩,০০০/                 ৫৬,০০০/
 
চরে মসুর-মুগডাল-আমন ধান শস্যবিন্যাসের আর্থিক বিশ্লেষণ
 
চরে মসুর-মুগডাল-আমন ধান শস্যবিন্যাস চাষ করে চরের কৃষকরা বছরে প্রতি হেক্টরে ৫৬,০০০ টাকা নিট আয় করতে পারেন। তবে যদি খরা দেখা দেয় কিংবা বন্যার সময় ব্যাকআপ-বীমা বীজতলা তৈরি করতে হয় তাহলে খরচ কিছুটা বেড়ে যাবে।
 
লেখক:
প্রফেসর ড. এম. আব্দুল করিম*
* কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর-১৭০৬
বিস্তারিত
ঢেমশি নতুন নয় ঐতিহ্যবাহী বহুমাত্রিক ফসল
ঢেমশি নামটি নতুন মনে হলেও এটি কিন্তু আমাদের ঐতিহ্যবাহী আদি ফসলের মধ্যে একটি। এক সময় এটির জনপ্রিয়তা গ্রহণযোগ্যতা অনেক ছিল। কালের ঢামাঢোলের মাঝে হারিয়ে যেতে বসেছিল। আবার কিছু মানুষের আন্তরিকতা প্রচেষ্টায় এবং ঢেমশির বৈশিষ্ট্যের কারণে আবারও আস্তে আস্তে জায়গা করে নিচ্ছে কৃষি ভুবনে। ঢেমশি আদি শীতকালের ফসল। ঢেমশির ইরেজি নাম বাকহুইট (Buckwheat)। এটির বৈজ্ঞানিক নাম Fagopyrum esculentum । আর পরিবার হলো Poaccae। যদিও গমের নামের সাথে মিল আছে কিন্তু গম পরিবারের এটি নয়। উদ্ভিদতাত্ত্বিক দিক দিয়ে গমের সাথে কোনো মিল নেই। বরং সরিষার সাথে বেশ মিল আছে। আসলে ঢেমশি বীজ বপন থেকে পাকা পর্যন্ত সরিষার সাথে মিল কাটার পর ধানের সাথে বেশি মিল আছে। তাহলে মোটামুটিভাবে সরিষা ও ধান দুটো ফসলের বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে ঢেমশি ফসল। এটির আদিবাস বৃহত্তর রাশিয়ার ইউক্রেনে। কালক্রমে দক্ষিণ এশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আবাদ হচ্ছে ব্যবহার হচ্ছে। বলা হয় পৃথিবীর ৫টি সেরা খাদ্যের মধ্যে ঢেমশি অন্যতম একটি। অথচ আমাদের দেশে এটি সবচেয়ে অবহেলিত ফসল। উন্নত দেশগুলোতে ঢেমশি খায় জ্ঞানী, বিজ্ঞ, বড়লোকরা। আর আমাদের দেশে খেত গরিব এবং তথাকথিত অশিক্ষিতরা। এটি শুধু খাদ্য নয় অনেক রোগের মহৌষধ হিসেবে কাজ করে ম্যাগনেটের মতো।
 
৬০ এর দশকে শুরু হওয়া ঢেমশি ৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আমাদের দেশের বিভিন্ন জেলায় চাষ হতো মোটামুটি পরিসরে। কিছু মানুষের অজ্ঞতা আর অবহেলার কারণে মহাউপকারী এবং গুরুত্বপূর্ণ এ ফসলটি হারিয়ে গেছে এবং প্রতিস্থাপিত হয়েছে জীবন ধ্বংসকারী আরও কত ফসল। বাংলাদেশ অর্গানিক প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন গুরুত্বপূর্ণ এ ফসলটি পুনরুদ্ধারে চেষ্টা করছে এবং পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী জেলায় ইতোমধ্যে চাষ শুরু করেছে। আস্তে আস্তে চাষের এলাকা, আবাদ ফলন উৎপাদন বাড়ছে।
 
এটি একটি অলৌকিক ফসল যাতে রয়েছে মানবদেহের জন্য অতিজরুরি অনেক পুষ্টি উপাদান। এতে রয়েছে ভাত, রুটি, মাছ, গোশত, দুধ, ডিম, সবজি এবং ফলের প্রায় সব পুষ্টি উপাদান, সে সাথে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ, অ্যামাইনো এসিড এবং ইলেকট্রলাইটস। এ ফসলটি চাষ করতে কোনো সার, পানি, বালাইনাশক এবং যত্ন লাগে না। ১ কেজি ধান ফলাতে শুধু পানিই লাগে প্রায় ৪ হাজার লিটার। আর এ কারণেই বাংলাদেশের মাটির নিচের পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে এবং যাচ্ছে। আধুনিক উন্নত ফসল ফলাতে গিয়ে অযাচিতভাবে ক্ষতিকারক রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহার করে মাটি, পানি, বাতাস এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। আর এ কারণেই পুকুর, খালবিল, নদীনালায় মাছ কমে যাচ্ছে, জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে, লাখ লাখ মানুষ অহরহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ।
 
পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট এবং সবচেয়ে দামি মধু এ ঢেমশির ফুল থেকেই উৎপাদন হয়। বিদেশের কোনো বাসায় বেড়াতে গেলে কেউ যখন ঢেমশির মধু নিয়ে যান তখন বাড়িওয়ালারা বেশ খুশি হন। ঢেমশি চাল, আটা, ছাতু, মধু এবং অন্যান্য খাদ্যপণ্য রফতানি করে বছরে শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। অপর দিকে, অতি সহজে ঢেমশিই পারে এ দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা এবং নিরাপদ খাদ্য প্রতিষ্ঠা করতে। মাটি, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশের উন্নয়ন এবং জীববৈচিত্র্য ফিরে আনা যাবে খুব সহজেই যদি আমরা আবার অবহেলিত ফসল ঢেমশি চাষ করি।
 
ঢেমশি স্বল্প জীবনকালসম্পন্ন একটি বিশেষ ফসল। অবহেলিত ফসলটি আমাদের ফসলের তালিকায় উল্লেখযোগ্য প্রধান ফসল হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে পারে শুধু এর বহুমাত্রিক যোগ্যতাও সাশ্রয়ী বৈশিষ্ট্যের জন্য। বছরের যে সময় জমি মোটামুটি পতিত থাকে বা ধান আবাদ করা যায় না সেসব জমিতে সে সময়ে সাথী বা মিশ্র ফসল হিসেবে সমন্বয় করতে পারে ঢেমশি। অন্যান্য ফসল যেখানে হয় না বা হতে সমস্যা সেখানে খুব অনায়াসে ঢেমশি ফলানো যায় । বীজ বপনের ৮০-৯০ দিনের মধ্যেই ফসল কাটা যায়। উৎপাদন খরচ নেই বললেই চলে। কেননা কোনো রাসায়নিক সারের প্রয়োজন নেই। পোকামাকড়ের আক্রমণ হয় না বলে বালাইনাশকের খরচ থেকে পুরোপুরি বেঁচে যাওয়া যায়। সেচের তেমন প্রয়োজন নেই। চরাঞ্চলের মাটি এবং বেলে দোআঁশ মাটিতে ভালো হয়। আগাছা দমনের প্রয়োজন পড়ে না কেননা এরা নিজেরাই আগাছা নষ্ট করে দেয়। সাধারণভাবে জৈবসার ব্যবহার করে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায়। ঢেমশি সাধারণ খাদ্যে, রোগীদের খাদ্য এবং শিশুদের খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয় করার সব ধরনের সুযোগ ও যোগ্যতা আছে। বর্তমানে উত্তরবঙ্গের ৭ হাজার একর জমিতে ঢেমশির আবাদ হচ্ছে। এটি দিন দিন আরো জনপ্রিয় হচ্ছে পরিধি পরিসর বাড়ছে।
ঢেমশি ঠিক ভাতের মতোই বরং পুষ্টিগুণ ভাতের চেয়ে অনেক বেশি। ঢেমশি খেলে যেসব উপকার পাওয়া যাবে তাহলো-
কম পরিমাণ শর্করা এবং অধিক পরিমাণ ফাইবার থাকায় রক্তে সুগারের পরিমাণ (ডায়াবেটিস) নিয়ন্ত্রণ করে;

হৃদরোগী এবং ডায়াবেটিস রোগীর জন্য একমাত্র আদর্শ এবং নিরাপদ খাদ্য;
প্রাকৃতিকভাবেই অধিক পরিমাণ আমিষ, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক সমৃদ্ধ
বিভিন্ন খাদ্যোপাদান আছে বলে শিশুর ওজন, উচ্চতা, মেধাশক্তি, পেশি শক্তি, হিমোগ্লোবিন লেভেল বৃদ্ধি করে;

০৪. বেশি পরিমাণ আমিষ থাকায় গর্ভবতী এবং দুগ্ধদানকারী মায়ের জন্য অতি জরুরি (শিশু প্রচুর দুধ পাবে); 
০৫. অধিক পরিমাণ ফাইবার থাকায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং মন ও দেহ সুস্থ সুন্দর থাকে;
০৬. হাঁড়ের ক্ষয়রোধ করে, মজবুত করে এবং হাঁড়ের স্বাস্থ্যের গঠন উন্নয়ন করে বলেই শরীরে কোনো ব্যথা থাকে না;
০৭. বিভিন্ন প্রকার ক্যান্সার প্রতিরোধ এবং নিরাময়ে সহায়তা করে;
০৮. সব বয়সীদের অ্যাজমা হাড়ক্ষয় রোগ কমাতে সাহায্য করে; হাড় মজবুত করে;
০৯. মেয়েলি রোগের একটি মহৌষধও বটে...।
পুষ্টির দৃষ্টিকোণ থেকেও ঢেমশি বেশ মূল্যবান ফসল। এতে আছে- শক্তি ৩৪৩ কিলোক্যালরি; শর্করা ৫৫%; আমিষ ২৪%; টোটাল ফ্যাট ১৭%; কোলস্টেরল ০ মিলিগ্রাম; ডায়টেরি ফাইবার ২৬%; সোডিয়াম ১ গ্রাম, পটাসিয়াম ৪৬০ মিলিগ্রাম (১০%), ক্যালসিয়াম ১৮ মিলিগ্রাম (২%), কপার ১.১, লৌহ ২.২০ (২৭.৫%) ম্যাঙ্গানিজ ১.৩, ফসফরাস ৩৪৭ মিলিগ্রাম, দস্তা ২.৪ মিলিগ্রাম (২২%)। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নিয়াসিন ৪৪%, পেনটোথেনিক এসিড, রাইবোফ্লেবিন ২২%, থায়ামিন বি১, ভিটামিন এসহ আরও অনেক পুষ্টি উপাদান।
ঢেমশির বীজ বোনার সময় হলো কার্তিক অগ্রহায়ণ মাস। ১০-১৫ দিন এদিক-সেদিক হলেও কোনো সমস্যা হয় না। কাটা হয় মাঘ-ফাল্গুন মাসে। বীজের হার প্রতি একরে ১২ কেজি। এক চাষ দিয়ে ছিটিয়ে বা লাইনে বুনা যায়। আবাদে উৎপাদনে তেমন কোনো সারের প্রয়োজন হয় না। শুধু পরিমাণ মতো জৈবসার জমিতে দিলেই চলবে। জীবনকাল ৮০ থেকে ৯০ দিন। দুই ফসলে মধ্য ফসল হিসেবে আবাদ করা যায়। সাধারণভাবে উৎপাদন একরপ্রতি ১ টন। ভালো ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে ফলন ২ মেট্রিক টন পর্যন্ত হতে পারে। কাটার পর গাছ জ্বালানি হিসেবে যতটুক ব্যবহার করা যায় তার চেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় গোখাদ্য হিসেবে। কেননা গাছে এবং বীজের তুষে বেশ পুষ্টি আছে সে কারণে গোখাদ্য হিসেবে অনেক পুষ্টিকর লাভবান। কোনো পোকামাকড়ের আক্রমণ নেই বলতে গেলে। উৎপাদন মৌসুমে সাধারণত কোনো সেচ লাগে না। লাগানোর ৩০ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে ফুল আসে। ফুল আসার আগ পর্যন্ত ঢেমশি পুষ্টিকর শাক হিসেবে খাওয়া যায়। শাক একটু টকস্বাদযুক্ত। ফুল আসার ১ দেড় মাসের মধ্যে পরিপক্ব হয় ফসল কাটা যায়। সাধারণত ভাত হিসেবে খাওয়া হয়। আর চালের মতো ভেজেও খাওয়া যায়।

 
জমি তৈরি করে শেষ চাষের আগে একরে ১২ কেজি বীজ ছিটিয়ে দিয়ে চাষ ও মই দিতে হয়। বপনের আগে পর্যাপ্ত পরিমাণ মতো শুধু গোবর সার দিতে হবে। কোনো রাসায়নিক সারের প্রয়োজন নেই। জমিতে রস না থাকলে ২০ দিন পরপর হালকা সেচ দিলে গাছের বাড়বাড়তি ভালো হয়। যেহেতু কোন বালাইয়ের আক্রমণ নেই তাই কোনো বালাইনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন নেই। ঢেমশি নিজেই আগাছা দমন করে। ঢেমশি একর প্রতি প্রায় ১ টন ফলন দেয় এবং মধু পাওয়া যায় প্রায় ১২০ কেজি। ঢেমশির বর্তমান বাজারমূল্য প্রতি টন ২৫ হাজার টাকা এবং মধু ৪০০ ৫০০ টাকা প্রতি কেজি। ঢেমশি থেকে ২৫ হাজার টাকা এবং মধু থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় করা যায় একরপ্রতি প্রতি মৌসুমে। বাংলাদেশ অর্গানিক প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন ঢেমশি কেনার নিশ্চয়তা দেয়। ঢেমশি ভাত রান্না করতে পানি কম লাগে এবং মাত্র ১০ মিনিটে সেদ্ধ হয়। সুতরাং পানি এবং জ্বালানি সাশ্রয় করে। ঢেমশির ভাত পরিমাণে বাড়ে, ১ কেজি চালের ভাত ৮ জন খেতে পারলে ঢেমশি ভাত খেতে পারবে ১২ জন।
 
পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও এবং নীলফামারী জেলায় ইতোমধ্যে চাষ শুরু করেছে। অন্যান্য জেলায় পরীক্ষামূলক আবাদ চলছে। দেখা যাচ্ছে লবণাক্ত এলাকায়ও ভালো বাড়বাড়তি এবং ফলন হয়। এটি একটি অলৌকিক ফসল যাতে রয়েছে মানদেহের জন্য অতিজরুরি অনেক পুষ্টি উপাদান। এতে রয়েছে ভাত, রুটি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, সবজি এবং ফলের প্রায় সব পুষ্টি উপাদান সে সাথে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ, অ্যামাইনো এসিড এবং ইলেকট্রালাইট। ঢেমশি হতে উৎপাদিত বিভিন্ন প্রকার খাদ্য খেলে অনেক উপকার পাওয়া যাবে। ৬০ এর দশকে শুরু হওয়া ঢেমশি ৯০ দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় চাষ হতো। সময়ের নানা পালা বদলে গুরুত্বপূর্ণ এ ফসলটির চাষ হারিয়ে গেছে। ঢেমশির চাষ বিশ্ব ভুবনে রাশিয়া, ইউক্রেন, কাজাখস্তান, ব্রাজিল, বেলারুশ, ফ্রান্স, লিথুয়ানিয়া, তানজানিয়া, লাটভিয়া, ভুটান, কোরিয়া, স্লোভেনিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, বসনিয়া হার্জেগোবিনা, চীন, পোল্যান্ড, কানাডা, জাপান, কোরিয়া এবং আমেরিকায় উল্লেখযোগ্য হারে আবাদ হচ্ছে। ঢেমশি চাল, আটা, মধু বিদেশে রফতানি করে শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। ঢেমশি চাষ, পুষ্টি তথ্য বা কেনাবেচার জন্য বাংলাদেশ অর্গানিক প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মু. আব্দুস ছালামের সাথে ০১১৯৮-১৩২৫৩৫ নাম্বারে যোগাযোগ করা যায়।
 
ঢেমশি আমাদের ফসল এবং জোর দিয়ে বলা যায় ঐতিহ্যবাহী মূল্যবান বহুমাত্রিক গুণসম্পন্ন ফসল। এটিকে আর অবহেলা করে নয় আরো গুরুত্বের সাথে গবেষণা, সম্প্রসারণ, প্রক্রিয়াজাতকরণসহ সংশ্লিষ্ট সব কাজে গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে, বাস্তবায়ন করতে হবে। কম শ্রমে কম খরচে অধিকতর প্রাপ্তির সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে ঢেমশিকে আরও গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় আনতে হবে। ঢেমশি দিয়ে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারব এ কথা নিশ্চিত। শুধু দেশেই নয় বিদেশের বাজারও অনায়াসে ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হব। দেশকে পুষ্টিতে তুষ্টিতে আরও সমৃদ্ধ বেগবান করতে পারব। ঢেমশি ভাতের সুবিকল্প হিসেবে, মেডিসিনাল মূল্যমান হিসেবে ব্যবহার সুপ্রাণিত স্বীকৃত। ঢেমশি ধানের মতো ৩ মাসে পাকার পর কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই, সিদ্ধ, শুকানোর কাজ শেষ করে ঢেঁকি বা চালের কলে ভাঙিয়ে ভাত রান্না করা যায়। অপরদিকে, ঢেমশিই পারে এ দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা এবং নিরাপদ খাদ্য প্রতিষ্ঠা করতে অতি সহজে। মাটি, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশের উন্নয়ন এবং জীববৈচিত্র্য ফিরে আনা যাবে খুব সহজেই, যদি আমরা আবার সে অবহেলিত ফসল ঢেমশি চাষ শুরু করি। ঢেমশি নিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে পারলে আরও বেশি সমৃদ্ধ হবে বাংলার কৃষি ও এ দেশের মানুষের পুষ্টি।
 
 
 লেখক:
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম
* উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫
বিস্তারিত
হাপায়-কুঁচিয়া-মাছের-চাষ
সাপের মতো দেখতে হলেও কুঁচিয়া এক প্রকার মাছ। ইহা বাংলাদেশে কুইচ্চা, কুঁইচা, কুঁচে, কুঁচো ইত্যাদি নামে পরিচিত। বাংলাদেশের হাওর, বাঁওড়, খাল-বিল, পচা পুকুর, ধানক্ষেতে এবং বন্যাপ্লাবিত অঞ্চলে কুঁচিয়া মাছ দেখতে পাওয়া যায়। কুঁচিয়া মাছের শরীর লম্বা বেলনাকৃতির। আপাতদৃষ্টিতে কুঁচিয়া মাছকে আঁশবিহীন মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ইহার গায়ে ক্ষুদ্রাকৃতির আঁশ বিদ্যমান যার বেশিরভাগ অংশই চামড়ার নিচে সজ্জিত থাকে।
 
খাদ্য হিসেবে কিছু কিছু উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কুঁচিয়া মাছকে অস্পৃর্শ মনে করে। যদিও ইহা শারীরিক দুর্বলতা, রক্তশূন্যতা, অ্যাজমা রোগ, ডায়াবেটিস, বাতজ্বর, পাইলসসহ অনেক রোগ সারাতে মহৌষধের মতো কাজ করে। তাছাড়া পরিবেশের খাদ্য জালে কুঁচিয়ার অনন্য অবদান রয়েছে। ধান ক্ষেতের ফসল অনিষ্টকারী পোকার লার্ভা, শামুক, কৃমি ইত্যাদি খেয়ে কুঁচিয়া কৃষকের উপকারী বন্ধু হিসেবে কাজ করে। অনেক পচা-গলা জৈবপদার্থ খেয়ে পরিবেশে মানবসমাজের বিশেষ বন্ধু হিসেবে ভূমিকা রাখে।
 
বাংলাদেশের মানুষ যতই অপছন্দ করুক না কেন বিদেশে এ মাছের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, শুধুমাত্র ২০১৩-১৪ সালে জীবিত মাছ হিসেবে ৭,০১৭৫ টন কুঁচিয়া বিদেশে রফতানি করে বাংলাদেশ প্রায় ১.৫ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে।
 
বাংলাদেশের কোথাও কুঁচিয়া চাষ করা হয় না। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশে কোনোরূপ চাষ ছাড়াই প্রকৃতি থেকে বিপুল পরিমাণে কুঁচিয়া আহরণ করে প্রতি বছর বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে। তাই একদিকে পরিবেশ রক্ষায় কুঁচিয়া প্রকৃতি থেকে আহরণ নিষিদ্ধ করা যেমন জরুরি, অন্যদিকে কুঁচিয়া রফতানি করে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হাতছানি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর বিগত বছরগুলোর উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অর্থের লোভ পরিবেশের প্রয়োজনকে ছাপিয়ে দিন দিন কুঁচিয়া রফতানির পরিমাণ বেড়েই চলছে। প্রকৃতির ভারসাম্য ঠিক রেখে অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে এখনই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কুঁচিয়া চাষের প্রচলন করা খুবই জরুরি।
 
কুঁচিয়া খানিকটা রাক্ষুসে স্বভাবের মাছ। ইহা মাটিতে গর্ত করে বাস করতে অভ্যস্ত বিধায় কুঁচিয়া মাছ সহজেই জমির আইল, পুকুরের পাড়, বেড়িবাঁধ ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সুতরাং, কুঁচিয়ার নানাবিধ উপদ্রপের মোকাবিলা করে এর উৎপাদন বৃদ্ধি করার সবচেয়ে সহজ ও উপযোগী পদ্ধতি হলো হাপায় কুঁচিয়া চাষ করা।
 
হাপায় কুঁচিয়া চাষের সুবিধা
* যে কোনো জলাশয়ে হাপা স্থাপন করে সহজেই কুঁচিয়ার চাষ করা যায়।
* হাপায় স্বল্প পরিসরে সহজ ব্যবস্থাপনায় কুঁচিয়া চাষ করা সম্ভব।
* কুঁচিয়া মাটিতে গর্ত করে বা জলজ আগাছা বা আবর্জনার নিচে লুকিয়ে থাকে। এমনকি পুকুরের পাড় ছিদ্র করে এক পুকুর থেকে আরেক পুকুরে চলে যায়। ফলে কুঁচিয়া আহরণ করা সহজতর নয়। হাপায় চাষকৃত কুঁচিয়া সহজেই আহরণ করা যায়।
* প্রতিকূল অবস্থায় সহজেই হাপাসহ কুঁচিয়া স্থানান্তর করা যায়।
* হাপায় কুঁচিয়া চাষে প্রাথমিক খরচ তুলনামূলক কম।
* হাপায় কুঁচিয়া মাছের পরিচর্যা করা সহজতর।
* গ্রামীণ মহিলারা সহজেই হাপায় কুঁচিয়া চাষ করে লাভবান হতে পারেন।
* বাজার মূল্যে এবং চাহিদার ওপর নির্ভর করে হাপায় চাষকৃত কুঁচিয়া যে কোনো সময়ে আহরণ করা যায়।
* বহুমালিকানাধীন পুকুরে প্রয়োজনে প্রত্যেক মালিক আলাদা আলাদাভাবে হাপায় কুঁচিয়া চাষ করতে পারেন।
* কুঁচিয়াা রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে বিধায় স্বল্প ব্যয়ে কুচিয়া চাষে ব্যাপক কর্মসংস্থানের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
 
চাষ পদ্ধতি
জলাশয় নির্বাচন এবং হাপা স্থাপন
হাপা স্থাপন করে যে কোনো পুকুরেই কুচিয়া চাষ করা সম্ভব। এমনকি যেসব জলাশয়ে ছয় মাস পানি থাকে বা পানি ধারণক্ষমতা কম এবং যেসব জলাশয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি সরবরাহ করা দুষ্কর সেসব জলাশয়েও সহজেই কুঁচিয়া চাষ করা যায়।
 
জলাশয় নির্বাচনের পর বাজারে সহজপ্রাপ্য গ্লাস নাইলনের হাপা জলাশয়ে স্থাপনের ব্যবস্থা নিতে হবে। কাঁকড়া বা অন্য কোনো জলজ প্রাণী দ্বারা হাপা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কুঁচিয়া সহজে বের হয়ে উন্মুক্ত জলাশয়ে চলে যাবে, সেজন্য ডাবল হাপা ব্যবহার করতে হবে। হাপা দুইটি এমন মাপে বানাতে হবে যেন জলাশয়ে স্থাপনের পর দুই হাপার মাঝে চারপাশে কমপক্ষে ১৫ সেমি. ব্যবধান থাকে। সাধারণত মাঝের হাপাটি দৈর্ঘ্যে ২.৫ মিটার, প্রস্থে ২.০ মিটার অর্থাৎ ৫ বর্গমিটার আকারের হলে ব্যবস্থাপনা সহজতর হয়। তবে হাপা আয়তাকার বা বর্গাকারও হতে পারে। প্রয়োজন অনুযায়ী হাপার আকার ছোট বড়ও করা যাবে।
 
হাপা জলাশয়ে স্থাপনের জন্য বরাক বাঁশ ব্যবহার করা উৎকৃষ্ট। বরাক বাঁশের খণ্ডগুলো হাপার উচ্চতার চেয়ে কমপক্ষে ১ মিটার বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয়। একটি হাপা স্থাপনের জন্য ৪ খণ্ড বরাক বাঁশের প্রয়োজন হবে এবং হাপার পরিমাণ বেশি হলে অতিরিক্ত প্রতি হাপার জন্য ২টি করে বাঁশের খণ্ড বেশি প্রয়োজন পড়বে। বাঁশের খণ্ডগুলো বিশেষ যত্ন সহকারে পুকুরে পুঁততে হবে যেন হাপা হেলে না পড়ে।
বাঁশ স্থাপনের পর প্রথমে নাইলনের রশি দিয়ে বড় হাপাটির ওপরে-নিচে প্রতিটি কোনা বাঁশের সঙ্গে টান টান করে শক্তভাবে বেঁধে দিতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে হাপার তলদেশ যেন জলাশয়ের মাটি থেকে কমপক্ষে ৫০ সেমি. উপরে থাকে। অতঃপর স্থাপিত বড় হাপার নিচের অংশের প্রতি কোনা থেকে সামান্য উপরে একটি করে ছোট ছিদ্র করেতে হবে। এবার ছোট হাপাটি বড় হাপার ভিতরে স্থাপন করতে হবে। এজন্য ছোট হাপার উপরিভাগের প্রতিটি কোনা লম্বা রশি দিয়ে বাঁশের সঙ্গে বাঁধতে হবে। হাপার নিচের কোনায় একইভাবে লম্বা রশি লাগিয়ে বড় হাপার নিচের দিকের কোনায় পূর্বে করা ছিদ্রের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে বের করে আনতে হবে এবং বাঁশের সঙ্গে ভালোভাবে বাঁধতে হবে।

 
কুঁচিয়া অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ পছন্দ করে বিধায় হাপা স্থাপনের পর হাপায় জলজ আগাছা হিসেবে হেলেঞ্চা দিতে হবে। এ হেলেঞ্চা কুঁচিয়াকে সরাসরি রোদের প্রভাব থেকে রক্ষা করবে।
 
মজুদপূর্ব মাছের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে সনাতন পদ্ধতিতে কুঁচিয়া সংগ্রহের ফলে আঘাতজনিত কারণে মাছের শরীরে ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে। সময়মতো উপযুক্ত ব্যবস্থা না গ্রহণ করলে এ ক্ষত মাছের মৃত্যুর কারণও হতে পারে। তাই ৪০-৫০ গ্রাম ওজনের কুঁচিয়ার সংগ্রহের পরই পাঁচ পিপিএম পটাসিয়াম পারমাঙ্গানেট দিয়ে ১ ঘণ্টা গোসল করিয়ে মাছগুলোকে পর্যবেক্ষণ হাপায় কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। পরে সুস্থ, সবল মাছগুলোকেই কেবলমাত্র মজুদ করতে হবে।
 
পোনা মজুদ
মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ অর্থাৎ ফাল্গুন মাসে প্রকৃতি থেকে ৪০-৫০ গ্রাম ওজনের কুঁচিয়া মাছের পোনা সংগ্রহ করে মজুদপূর্ব যথাযথ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা করার পর প্রতি বর্গমিটারে ৪০টি হারে সুস্থ সবল পোনা হাপায় মজুদ করতে হবে। মজুদের ২৪ ঘণ্টা পূর্ব থেকে পোনা মাছকে খাবার প্রয়োগ না করাই উত্তম।
 
খাদ্য ব্যবস্থাপনা
খানিকটা রাক্ষুসে স্বভাবের হলেও কুঁচিয়া সম্পূরক খাদ্য গ্রহণ করে। চাষকালীন পুরো সময়জুড়ে কুঁচিয়া মাছকে প্রতিদিন দেহ ওজনের ৩-৫% খাবার প্রয়োগ করতে হবে। মাছের আকার এবং জলবায়রু ওপর, বিশেষতঃ তাপমাত্রার তারতম্যের ওপর ভিত্তি করে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করা উচিত। গবেষণায় দেখা যায়, কুঁচিয়া ২০ থেকে ৩৫০ সে. পর্যন্ত তাপমাত্রায় খাবার গ্রহণ করে। তবে ২৫ থেকে ৩০০ সে. তাপমাত্রায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কুঁচিয়ার সম্পূরক খাদ্য হিসেবে অটো রাইসমিলের কুঁড়া, মুরগির নাড়িভূঁড়ি, ফিশমিল এবং কেঁচো মিশিয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে। পুকুরের পানিতে খাবার সহজে দ্রবীভূত হওয়া রোধ কল্পে কুঁচিয়ার খাবারের সঙ্গে আটা যুক্ত করা ভালো। এতে হাপার পানির গুণাগুণ স্থিতিশীল থাকে। খাবার অপচয় রোধে ফিডিং ট্রেতে খাবার সরবরাহ করা উত্তম। বাজার থেকে মাছের উচ্ছিষ্টাংশ সংগ্রহ করে কুঁচিয়ার খাবারের সঙ্গে যুক্ত করলে খাদ্য খরচ অনেকাংশে কমে যাবে। এছাড়া শামুক-ঝিনুকের মাংস কুচি কুচি করে কেটে কুঁচিয়ার খাদ্যের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যায়। তবে শামুক-ঝিনুকের মাংস যোগ করলে মুরগির নাড়িভূড়ি ব্যবহার করা প্রয়োজন পড়ে না। প্রয়োজনে কুঁচিয়ার খাদ্যে ১% ভিটামিন প্রিমিক্স যোগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। সম্পূরক খাদ্য ছাড়াও হাপায় মাছের জীবিত পোনা, জীবিত শামুক ইত্যাদি সরবরাহ করলে ভালো উৎপাদন আশা করা যায়। নিম্ন ছকে কুঁচিয়ার ১০০০ গ্রাম সম্পূরক খাদ্য তৈরির জন্য বিভিন্ন উপকরণের তালিকা দেয়া হলো-
সারণি-১. কুঁচিয়ার ১০০০ গ্রাম সম্পূরক খাদ্যে বিভিন্ন উপকরণের পরিমাণ

 
খাদ্যের উপকরণ      পরিমাণ (গ্রাম)
ফিশমিল                     ৬০০
কুঁড়া                        ২৫০
মুরগির নাড়িভূড়ি             ১০০
আটা                        ৫০
মোট=                       ১০০০
        
কুঁচিয়ার রোগবালাই ব্যবস্থাপনা
যেহেতু কুঁচিয়া মাটিতে গর্ত করে এবং ময়লা আর্বজনার মধ্যে বসবাস করে এবং চামড়ায় আঁশ অদৃশ্য থাকে তাই কুঁচিয়া সহজেই রোগ এবং পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। এজন্য কুচিয়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। সাধারণত কুঁচিয়া মাছ নিম্নলিখিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
 
১. ক্ষত রোগ বা আলসার ডিজিজ
অন্যান্য মাছের মতো ক্ষত রোগ বা আলসার ডিজিজ কুঁচিয়ার অন্যতম প্রধান রোগ হিসেবে বিবেচিত। এ রোগের আক্রমণে কুঁচিয়া শরীরে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়-
*প্রাথমিক পর্যায়ে মাছের গায়ে ছোট ছোট লাল দাগ দেখা দেয়।
*ক্রমান্বয়ে লাল দাগের স্থলে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়।
*লেজের অগ্রভাগে এ রোগের আক্রমণ হলে লেজ খসে পড়ে।
*মাছ খাদ্য গ্রহণ করে না এবং পর্যায়ক্রমে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়।
*আক্রান্ত মাছকে পানি থেকে উঠে আগাছার ওপর অলসভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
 
প্রতিকার বা নিয়ন্ত্রণ
*মাছ মজুদের আগে পুকুর ও হাপা জীবাণুমুক্ত করতে হবে। এজন্য পুকুরে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
*আক্রান্ত মাছকে ০.১-০.২ মি.গ্রাম/কেজি হারে রেনামাইসিন অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশান প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে সপ্তাহ অন্তর ২য় ডোজ প্রয়োগ করতে হবে।

২. পরজীবীজনিত রোগ
আণুবীক্ষণিক বিভিন্ন প্রকার ক্ষুদ্রজীব থেকে শুরু করে জোক পর্যন্ত কুঁচিয়ার শরীরে বাস করতে পারে। কুঁচিয়ার শরীরে পরজীবীর আক্রমণের ফলে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা যায়-
*মাছ অস্বাভাবিকভাবে চলাচল বা লাফালাফি করতে থাকে।
*মাছ খাবার গ্রহণ করা বন্ধ করে দেয় ফলে ক্রমান্বয়ে মাছ দুর্বল হয়ে পড়ে।
*কোন কোন পরজীবীর আক্রমণে মাছের চামড়ায় ছোট ছোট সাদা দাগ দেখা দেয়।

প্রতিকার বা নিয়ন্ত্রণ
*আক্রান্ত মাছকে ৫০ পিপিএম ফরমালিন বা ২০০ পিপিএম লবণ পানিতে ১ মিনিট ধরে গোসল করাতে হবে।
*আক্রান্ত পুকুরের হাপা ৫০ পিপিএম ফরমালিন বা ২০০ পিপিএম লবণ পানিতে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা ডুবিয়ে রেখে পরে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে কড় কড়া রোদে ১-২ দিন ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে।
*পুকুরের পানি সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন করে তলদেশে প্রতি শতাংশে ৫০০ গ্রাম হারে লবণ বা ১ কেজি হারে চূর্ণ প্রয়োগ করতে হবে
 
৩. পুষ্টিহীনতাজনিত রোগ
শুধু জীবাণু বা পরজীবীর কারণেই মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবও মাছের পর্যাপ্ত বৃদ্ধির অন্তরায়। পুষ্টিহীনতাজনিত রোগের লক্ষণগুলো নিম্নরূপ হয়ে থাকে-
*মাছের বৃদ্ধিহার কমে যায়।
*শরীরের তুলনায় মাছের মাথা বড় হয়ে যায়।
*অস্বাভাবিক হারে মাছের ওজন কমতে থাকে এবং মাছ চলাচলের শক্তি হারিয়ে ফেলে।
*ধীরে ধীরে মাছ মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়।

প্রতিকার বা নিয়ন্ত্রণ
*গুণগত মানসম্পন্ন পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ খাদ্য চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে হবে।
 
৪. ভাইরাসজনিত রোগ
কুঁচিয়া মাছ ভাইরাসজনিত কারণেও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে Iridovirus প্রকৃতির ভাইরাস দ্বারা সাধারণত বেশি আক্রান্ত হয়। এ ভাইরাস শ্বাসযন্ত্রে আক্রামণ করে বিধায় প্রাথমিক পর্যায়ে রোগের লক্ষণ বাহ্যিকভাবে তেমন প্রকাশ পায় না। তারপরও নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দ্বারা এ রোগ শনাক্ত করা সম্ভব-
*আক্রান্ত মাছ দুর্বল ও ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করে ঔজ্জ্বল্য হারায়।
*আক্রান্ত দুর্বল মাছে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়
*আক্রান্ত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে ব্যাপক মড়ক দেখা দেয়।
 
প্রতিকার বা নিয়ন্ত্রণ
ভাইরাসজনিত রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিকার না থাকলেও পুকুরে সঠিক পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ রোগের আক্রমণ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
 
আহরণ ও উৎপাদন
মাছের ওজন এবং বাজারের চাহিদার ওপর নির্ভর করে কুঁচিয়া আহরণ করতে হবে। সঠিক ব্যবস্থাপনায় ছয় মাস চাষ করলে কুঁচিয়া গড়ে ২০০-২৫০ গ্রাম হয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা যায়, হাপায় মজুদকৃত মাছের ৯৫ থেকে ৯৭% পর্যন্ত আহরণ করা সম্ভব। সেই হিসেবে প্রতি বর্গমিটারে ৯-১০ কেজি মাছের উৎপাদন পাওয়া যাবে। নিম্নে ছকে হাপায় কুঁচিয়া চাষের আয়-ব্যয়ের বিশ্লেষণ দেয়া হলো-

সারণি ২ : হাপায় কুঁচিয়া চাষের আয়-ব্যয়ের বিশ্লেষণ  
    
হাপায় কুঁচিয়া চাষে সতর্কতা
হেলেঞ্চা প্রয়োগের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন হেলেঞ্চার সঙ্গে কোনো প্রকার ক্ষতিকর পরজীবী চলে না আসে।
 
হাপায় হেলেঞ্চার পরিমাণ বেশি হলে মাঝে তা কমিয়ে দিতে হবে। নতুবা হাপার ইকোসিস্টেমে নাইট্রোজেনে আধিক্যের কারণে মাছের গায়ে ফোসকা পড়ে পরে ঘায়ে পরিণত হতে পারে।
 
পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি হলেও কুঁচিয়ার গায়ে ফোসকা পড়তে পারে।
কাঁকড়া বা অন্য কোন জলজ প্রাণী যেন হাপা ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে নিয়মিত হাপা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
 
আয়-ব্যয়ের খাত                                   পরিমাণ (টাকা)
হাপা তৈরি, বাঁশ ক্রয় এবং স্থাপনের উপকরণ          ১২০০.০০
পোনার মূল্য (২০০টি @ ৫/- প্রতিটি)                   ১০০০.০০
খাদ্য খরচ (৯০ কেজি @ ৫৫/- প্রতি কেজি)            ৪৯৫০.০০
বিবিধ খরচ                                             ৫০০.০০
হাপা প্রতি মোট ব্যয়=                                ৭.৬৫০.০০
মাছের বিক্রয় মূল্য ৪৭.৫০ কেজি @ ২৫০/- প্রতি কেজি   ১১,৮৭৫.০০
হাপা প্রতি মোট আয়=                                  ৪,১২৫.০০
আয়-ব্যয়ের অনুপাত=                                  ১.৫৫ ঃ ১
 
প্রাকৃতিক দুর্যোগ হাপা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে দিকে লক্ষ্য করতে হবে।
সামাজিক সমস্যা হিসেবে মাছ যাতে চুরি না হয় সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে
পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে, রাক্ষুসে স্বভাবের কারণে এক মাছ অন্য মাছকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
আঘাতপ্রাপ্ত, ক্ষতিগ্রস্ত এবং পুষ্টিহীন মাছের বাজারমূল্য অনেক কম।

দ্বিতীয়বার হাপা কুঁচিয়া চাষে ব্যবহারের  আগে ভালোভাবে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে।
 
লেখক:
. ডুরিন আখতার জাহান*
জোনায়রা রশিদ**
* ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ
বিস্তারিত
রপ্তানিযোগ্য আমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে করণীয় ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশে উৎপাদিত ফলের মধ্যে আম সবচেয়ে জনপ্রিয় সুস্বাদু ফল। এটি  দেশের সর্বত্র জন্মে। বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার, স্বাদ-গন্ধ ও পুষ্টিমানে  ইহা একটি আদর্শ ফল এবং এ জন্য আমকে ‘ফলের রাজা’ বলা হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৭,৪৬৬ হেক্টর জমি থেকে ৮,৮৯,১৭৬ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়  (বিবিএস, ২০১২)।  আমে প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিন থাকে। তাছাড়া এই ফলে অন্যান্য ভিটামিন ও খনিজ উপাদান যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। কাঁচা আম ফালি বা আমচুর, চাটনি হিসেবে খাওয়া হয়। পাকা আম থেকে জুস, আমসত্ত্ব, জ্যাম, জেলি ইত্যাদি তৈরি হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ, ভেষজ চিকিৎসায়, আসবাবপত্র ও জ্বালানি হিসেবে আম কাঠের ব্যবহারসহ রয়েছে বিশেষ অর্থনৈতিক গুরুত্ব। বর্তমান সরকার আম গাছের পরিচিতি, ফলের জনপ্রিয়তা, জাতীয় সঙ্গীতে আমের স্থান এবং দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে আম বাগানের নিবিড় সম্পর্ক থাকায় আম গাছকে ১৫/১১/২০১০  জাতীয় বৃক্ষ ঘোষণা করেন।
 
আম রপ্তানির গুরুত্ব
এক দেশের পণ্য অন্য দেশে বিক্রি করা হলে তাকে রপ্তানি বলা হয়। আর যখন আম নামের পণ্য বিদেশের বিভিন্ন দেশে বিক্রি করা হয় তখন তাকে আম রপ্তানি বলে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের শর্ত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন। আর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের  অন্যতম উপায় হলো বিদেশে আম রপ্তানি। আম রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার দ্বারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি সঞ্চারিত হয়। তাই একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আম রপ্তানির গুরুত্ব অপরিসীম। বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন ছাড়াও আম রপ্তানির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলো নিম্নরূপ-
ক) দেশে আমের উৎপাদন বৃদ্ধি;
খ) আমের তালিকায় নতুন জাতের সংযোজন;
গ) বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশের আমের পরিচিতি;
ঘ) অধিক কর্মসংস্থান;
ঙ) দেশের জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন;
চ) বিদেশের বাজারে লেনদেন ক্ষমতা ও সুনাম বৃদ্ধি এবং
ছ) দেশের ঐতিহ্যবাহী আম শিল্পকে উন্নত করা ইত্যাদি।
 
আম রপ্তানির  সমস্যা
বিশ্বের প্রধান দশটি আম উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ  অষ্টম (এফএও-২০১১) স্থানে থাকলেও আম রপ্তানিকারক দেশ হিসাবে কোন  অবস্থানে নেয় (সিআইএ ওয়ার্ল্ডবুক-২০১১)। কারণ রপ্তানিযোগ্য আমের কিছু শর্ত ও বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক যেমন- প্রতিটি আম রোগের জীবাণু, পোকামাকড়, হেভি মেটাল ও দাগ মুক্ত হওয়া। তাছাড়া আমের ওজন ২০০-৩৫০ গ্রাম, চামড়া রঙিন, শাঁস দৃঢ় ও অল্প মিষ্টতা থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু দেশীয় আমে উপরোক্ত বিষয়গুলোর অনেকটা অভাব পরিলক্ষিত হয় বিধায় সেই আমগুলোকে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া আম রপ্তানির সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য সমস্যাগুলো নিম্নরূপ-
 
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ;
আমের প্রাপ্তিকাল খুবই সীমিত;
হট ওয়াটার ট্রিটমেন্টের সুবিধা না থাকা । ফলে আম উজ্জ্বল, বেশি দিন স্থায়ী হওয়ার পাশাপাশি ফ্রুটফ্লাই মুক্ত করা যায় না;
আম পাকানো ও সংরক্ষণকাল বৃদ্ধিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক বস্তুর ব্যবহার;
সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা যেমন- প্যাকেজিং ও পরিবহন সন্তোষজনক নয়;
কৃষক ও রপ্তানিকারকদের সম্পর্ক না থাকা এবং এ ব্যাপারে কোন তথ্য না জানা;
বিদেশি আমদানিকারকদের আমাদের দেশ সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত না থাকা;
গবেষণা ও  সম্প্রসারণ কার্যক্রম যথেষ্ট শত্তিশালী না হওয়া;
কোয়ালিটি স্ট্যান্ডার্ড না জানা;
ফাইটো স্যানিটারি সার্টিফিকেট নিতে ঝামেলা/হয়রানি/দুর্নীতি;
এয়ার কার্গো কম এবং
সরকারি সহযোগিতা, নীতিমালা ও লোন পর্যাপ্ত নয়।            

রপ্তানিযোগ্য আমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে করণীয়
বাংলাদেশে উৎপাদিত ৮,৮৯,১৭৬ মেট্রিক টন আমের বেশির ভাগই দেশের ক্রেতারা ক্রয় করে থাকেন। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে সীমিত পরিমাণে আম বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ল্যাংড়া, ফজলি, হিমসাগর এবং আশ্বিনা জাতের আম রপ্তানি হয়ে থাকে। বারি আম-২ এবং বারি আম-৭ বিদেশে রপ্তানির জন্য সম্ভাবনাময় জাত। তাছাড়া ২০১৫ সাল থেকে ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাতী ও বারি আম-৩ WalMart এর চাহিদার তালিকায় রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে আম আমদানিকারক দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, সৌদিআরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমান। তবে উল্লিখিত দেশের প্রবাসী বাংলাদেশীরাই প্রধানত  সব আমের প্রধান ক্রেতা। উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি ও পরিচর্যার মাধ্যমে রপ্তানির উপযোগী আমের উৎপাদন বৃদ্ধি করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। রপ্তানিযোগ্য আমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে করণীয় বিষয়গুলো নিম্নরূপ-

 
সার ও সেচ প্রয়োগ এবং রোগ বালাই দমনে আধুনিক কলাকৌশল অর্থাৎ সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় ও সঠিক পদ্ধিতে সার, সেচ ও বালাইনাশক ব্যবহারের মধ্যেমে আমের অধিক ফলন নিশ্চিত করা। এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণকে কৃষি গবেষণার সঙ্গে সমন্বয় করে  আম চাষি-ব্যবসায়ীদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
 
সঠিক পরিমাণ রাসায়নিক সার ব্যবহারের পাশাপাশি বেশি বেশি করে জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানো অর্থাৎ জৈব প্রযুক্তি নির্ভর আম উৎপাদনে উৎসাহিত করা।
চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট জেলায় আম চাষের ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া  দরকার। তাছাড়া রাস্তার দুই ধারে এবং স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে আম গাছ লাগাতে হবে।
আগে থেকে জন্মানো গুটি আমের গাছগুলোকে না কেটে টপ-ওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে ভালো জাতে পরিবর্তন করে আমের উৎপাদন বাড়ানো।
সরকারি ও বিএডিসির উদ্যান নার্সারিগুলোকে আরও উন্নত মানের এবং ভালো জাতের চারা কলম সরবরাহের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
আমের প্রাপ্তিকাল বাড়াতে হবে যাতে করে দীর্ঘ সময় ধরে আম পাওয়া যায়।
আম পাকানো ও সংরক্ষণকাল বৃদ্ধিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক বস্তুর ব্যবহার বন্ধ করা।
হট ওয়াটার ট্রিটমেন্টের সুবিধা  থাকা। এতে আম উজ্জ্বল, বেশিদিন স্থায়ী হওয়ার পাশাপাশি ফ্রুটফ্লাই মুক্ত হবে।
আম সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্যাকিং ও পরিবহন বিষয়ে উন্নত প্রশিক্ষণ দেয়া।
রপ্তানির সহিত সংশ্লিষ্ট আম উৎপাদনকারী, আম সরবরাহকারী এবং আম রপ্তানিকারকদের সরকারি সহযোগিতা প্রদান করা, তাদের নিবন্ধন করা ও সমিতির আওতায় এসে স্বমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন।
স্থিতিশীল বাজার ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার। এ ব্যাপারে জনগণ ও সরকারকে সমান দায়িত্ব নিতে হবে। বিদেশে অনেক দেশে আম চাষি সমিতি আছে- এ সমিতিই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে যাতে করে কোন চাষি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
আম ব্যবসায়ীদের বিদেশ ভ্রমণের মাধ্যমে আমের আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টি করতে হবে।
আম সংরক্ষণের জন্য কোল্ডস্টোরেজ তৈরি, হিমায়িত পরিবহন, দ্রুত স্থানান্তরকরণ, বাছাই, প্যাকেজিং এবং গুণগতমান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকতে হবে।
সমবায় ভিত্তিতে আম সংরক্ষণ স্থাপনার ব্যবস্থা করা।
অধিক গবেষণা করে বিদেশিদের চাহিদা অনুযায়ী জাত উদ্ভাবন করা।
বিদেশ থেকে আম আমদানি নিরুৎসাহিত করতে হবে।

আম রপ্তানির সম্ভাবনা
এদেশের মাটি, জলবায়ু ও ভৌগলিক অবস্থান উপযোগী হওয়ায় এবং শ্রমিকের সহজলভ্যতা থাকায় গুণগতভাবে উৎকৃষ্ট আম উৎপাদন সম্ভব। আন্তর্জাতিক বাজারে আমের  স্থায়ী রপ্তানি বাজার রয়েছে এবং এথনিক ও নিচি মার্কেটের সুবিধাও রয়েছে। বিধায় বর্তমানে বিদেশে আম রপ্তানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আমদানি রপ্তানি ব্যুরো এবং হর্টেক্স ফাউন্ডেশনকে সক্রিয় হতে হবে। আম রপ্তানির জন্য নিচের বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ-
 
১. বিদেশে বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে বাজার অনুসন্ধান করা;
২. বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের আমের মৌসুমে আম উৎপাদনকারী জেলাগুলো পরিদর্শন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা;
৩. সরকারি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা প্রেরণের মাধ্যমে বাজার অনুসন্ধান করা;
৪. বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে দেশীয় আম বাগান পরিদর্শন করানো;
৫. আম রপ্তানি করার জন্য প্যাকেজিং সামগ্রির ওপর ভর্তুকি প্রদান করা;
৬. পরিবহন বিমানের ব্যবস্থা ও ভাড়ার হার সহনীয় রাখা;
৭. বিদেশে রপ্তানির জন্য শুল্ক না নেয়া;
৮. আমকে বিদেশে সম্প্রসারণ করার জন্য সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং
৯. আম রপ্তানির জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করা।
 
লেখক:
ড. মো. জমির উদ্দিন*
* ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা,  আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
বিস্তারিত
বাংলাদেশের মাটি পরিবেশ ও কৃষি খাদ্য নিরাপত্তার নিয়ামক
একটি গানের দুটি লাইন দিয়ে লেখাটি শুরু করতে চাচ্ছি- ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদেরই বসুন্ধরা, তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা, সে যে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে যে স্মৃতি দিয়ে ঘেরা, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।’ সত্যিই, এত সুন্দর মাটি, জলবায়ু ও পরিবেশ পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বাংলাদেশের মাটি, খাঁটি সোনার চেয়েও খাঁটি। কোনো বীজ যদি এ মাটির সংস্পর্শে আসতে পারে তা থেকে কম বেশি ফলন পাওয়া যাবেই। প্রয়োজনমতো পরিচর্যা ও ফসলের জাত যদি ভালো হয় তাহলে তো কথাই নেই। ভূমণ্ডলীয় অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ। অপরদিকে গাঙ্গেয় বদ্বীপ হওয়ার কারণে এর মাটি খুবই উর্বর। তবে এ উর্বরতা দিনে দিনে কমতে শুরু করেছে। মাটিতে যে পরিমাণ জৈবপদার্থ থাকা দরকার নিবিড় চাষাবাদের ফলে তা দিন দিন কমে যাচ্ছে। কৃষি বাংলাদেশের একটি অন্যতম অর্থনৈতিক খাত। এ দেশের জিডিপির প্রায় ২২% আসে কৃষি খাত থেকে। কর্মসংস্থান ও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে কৃষির অবদান অনস্বীকার্য। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সবুজ বিপ্লবের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার সম্প্রসারণ, কৃষিতে ভর্তুকি এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশ এগিয়ে যেতে থাকে। উল্লেখযোগ্য, সফলতাও আসতে থাকে এ খাতে। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে ১০ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের বিপরীতে এখন উৎপাদন প্রায় তিন গুণেরও বেশি। দানাশস্য উৎপাদনে দেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও সর্বস্তরের জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা প্রদান নানা কারণে সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, বাজারদর মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকা, খাদ্যের সুষম বণ্টন ইত্যাদি যেমন জরুরি তেমনি সর্বস্তরের জনগণের সচেতনতার ওপর খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা অনেকটা নির্ভরশীল। কেবলমাত্র ধান বা দানাশস্যভিত্তিক খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন একটি দুরূহ ব্যাপার। উচ্চমূল্যের ফসলসহ শস্য বহুমুখীকরণের দিকে নজর দিতে হবে ও উৎপাদিত শস্য সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। একজন মানুষের খাদ্যাভ্যাসের সাথে তার খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। পেট ভর্তি ভাত কিংবা রুটি খেতে সমর্থ একজন লোককে খাদ্য ও পুষ্টির দিক থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ বলা যায় না। একজন শিশু বা প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের সুস্থ সবল দেহ নিশ্চিত করার জন্য দৈনন্দিন যে পরিমাণ পুষ্টি সংবলিত আহার প্রয়োজন, খাদ্য তালিকায় তা অন্তর্ভুক্ত থাকা বাঞ্চনীয়। প্রচুর খাবার সরবরাহ থাকলেই খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপদ পরিস্থিতি বলা যায় না। ওই খাবার আহারোপযোগী এবং মানুষের ক্রমক্ষমতার মধ্যে থাকতে হবে।
 
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করণীয়
১. খাবারের অপচয় রোধ : UNEP Ges World Resources Institute এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের মোট উৎপাদিত খাদ্যশস্যের এক তৃতীয়াংশ উৎপাদন এবং ভোক্তাপর্যায়ে অপচয় হয় যার মূল্যমান ১ ট্রিলিয়ন ডলার। ক্যালরি মূল্যমানে তা রূপান্তরিত করলে প্রতি ক্যালরির এক-চতুর্থাংশ খাদ্য অপচয় হয়। বাংলাদেশও এর আওতাভুক্ত। আমাদের দেশে বিভিন্ন পরিবারে বিভিন্নভাবে খাবারের অপচয় হয়ে থাকে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও উৎসব আয়োজনে, সঠিক হিসাবে খাবার প্রস্তুত ও বিতরণ সম্ভব হলে বার্ষিক কয়েক লাখ টন খাদ্য মজুদ বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। সচেতনতার অভাবে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য পোকায় নষ্ট করে অথবা ইঁদুরের পেটে যায়। সঠিক প্রযুক্তিতে খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ করা হলে ওই খাদ্যদ্রব্য দেশের খাদ্য মজুদ পরিস্থিতি বৃদ্ধি করে খাদ্য নিরাপাত্তায় ভূমিকা রাখতে পারে।
 
২. চাষাবাদে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার : কৃষক ভাইদের বিভিন্ন ফসল চাষাবাদের সময় ফসলের জাত বাছাই থেকে শুরু করে সময়মতো বীজ বপন, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা, সময়মতো সেচ ও নিকাশ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে। ফসলের রোপণ থেকে শুরু করে শস্যকর্তন, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পর্যন্ত গবেষণালব্ধ উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেষ্ট হলে হেক্টরপ্রতি ১৫-২০% উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব হবে। ওই বাড়তি উৎপাদন দেশের খাদ্য মজুদ বৃদ্ধি বা খাদ্য নিরাপত্তায় সম্পূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমানে শিক্ষার হার বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় যান্ত্রিক চাষাবাদের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন প্লান্টার, হারভেস্টার, থ্রেশার ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলের সময়মতো বপন, রোপণ পরিচর্যা ও কর্তন নিশ্চিত করতে পারলে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তায় অবদান রাখা সম্ভব হবে। পরিবেশসম্মত চাষাবাদের দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে। ফসল উৎপাদনে জৈবসারের ব্যবহার, রোগ ও পোকার হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে আইপিএম পদ্ধতি ব্যবহারে আমাদের মনোযোগী হতে হবে।

৩. শস্য বহুমুখীকরণ : বর্তমানে শস্যের জাতীয় গড় নিবিড়তা ১৯০%। অর্থাৎ দেশের ফসলি জমিতে বছরে দুটিরও কম ফসল ফলে। স্বল্পমেয়াদি ফসলের নিবিড় চাষাবাদের দিকে নজর দিলে এর নিবিড়তা ২০০% এরও বেশি উন্নীত করা সম্ভব হতে পারে। সারা বছর অথবা ফসল উৎপাদন মৌসুমে কৃষকের জমিতে এক ধরনের ফসল চাষ না করে বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করে আয় বৃদ্ধি করা যেতে পারে। সব সময় একটি শস্য চাষ লাভজনক না-ও হতে পারে। কোনো মৌসুমে একটি জমি থেকে একটি শস্যের আশায় দীর্ঘদিন বসে না থেকে, ওই জমি থেকে মিশ্র ফসল, আন্তঃফসল অথবা পর্যায়ক্রমিক ফসল হিসেবে অতিরিক্ত এক বা একাধিক ফসল তুলে নেয়াকে আমরা শস্য বহুমুখীকরণ বলতে পারি। একজন কৃষক তার জমির শ্রেণীভেদে শস্য বহুমুখীকরণের বিভিন্ন পরিকল্পনা নিতে পারেন যেমন ধান ক্ষেতের আলে সবজি চাষ, আমন মৌসুমে ধানের সাথে ক্রমিক ফসল হিসেবে ডালজাতীয় ফসল, বিনা চাষে আলু, বিনা চাষে রসুন, সরিষা ছায়াযুক্ত স্থান বা ফল বাগানে আদা হলুদের চাষ, আলু, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি ইত্যাদি ফসলের সাথে স্বল্পমেয়াদি আন্তঃফসল লালশাক, ধনেপাতা ইত্যাদির চাষ। বাড়ির আঙিনায় বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও ফলমূলের চাষ। আখক্ষেতে শাকসবজি ডাল ও তেলজাতীয় আন্তঃফসল চাষ। মোট কথা নিজের খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিকভাবে নিজে এবং দেশকে লাভবান করার পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে কৃষকরা স্বাবলম্বী হতে পারেন।
৪. উন্নত পদ্ধতিতে সংরক্ষণ : খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের একটি প্রধান উপাদান হলো উৎপাদিত খাদ্যপণ্য উন্নত পদ্ধতিতে সংরক্ষণ। কৃষি পণ্যের উপযুক্ত বাজারমূল্য প্রাপ্তির জন্য সঠিক তাপমাত্রায় ভালোভাবে শুকিয়ে তা উপযুক্তস্থানে বা পাত্রে সংরক্ষণ করা বাঞ্ছনীয়। যেমন- ধানের বেলায় শতকরা জলীয় অংশের পরিমাণ থাকবে ১০-১২%, ডাল, তেল ও পেঁয়াজ ইত্যাদির বেলায় তা ভিন্ন। সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণের মাধ্যমে পণ্যের অপচয় যেমন কম হয় তেমনি ভালো বাজারমূল্য নিশ্চিত হওয়ার কারণে খাদ্য নিরাপত্তায় ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে।

 
ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ঘটিয়ে যেমন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হচ্ছে, তেমনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য সাশ্রয় করে রফতানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। উন্নত পদ্ধতিতে শস্য উৎপাদন, সংরক্ষণ ও শস্য বহুমুখীকরণের মাধ্যমে আমরা আমদানি নির্ভরতা কাটিয়ে রফতানিমুখী হতে পারি। এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কায় চাল রফতানির মাধ্যমে আমরা এর শুভসূচনা করতে পেরেছি। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের কৃষি ও কৃষকবান্ধব নীতি প্রশংসার দাবিদার। মাটির উর্বরতা সংরক্ষণের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশসম্মত চাষাবাদের ওপর মনোযোগী হলে আমরা আরও এগিয়ে যাব এবং এদেশ হবে সত্যিকারের সোনার বাংলা। আমরা হয়ে উঠব স্বয়ংসম্পূর্ণ সমৃদ্ধ জাতি।
 
লেখক:
মোহাম্মদ মহসীন*
* প্রকল্প লিয়াজোঁ অফিসার, খাদ্য নিরাপত্তা ময়মনসিংহ-শেরপুর প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা
বিস্তারিত
ফার্মেন্টেড ডেইরি প্রোডাক্ট
ফার্মেন্টেড ডেইরি প্রোডাক্ট বলতে দুধকে বিশেষ ধরনের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার গাঁজানো প্রক্রিয়া দ্বারা উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রীকে বুঝায়। ফার্মেন্টেড ডেইরি প্রোডাক্ট সাধারণত দুধ বা দুধের উপজাত দ্রব্য থেকে তৈরি করা হয়।
বিশ্বের মানবজাতির জন্য ১০টি মারাত্মক চ্যালেঞ্জকে চিহ্নিত করা হয়েছে, এর মধ্যে ক্ষুধা এবং অপুষ্টি সপ্তম স্থানে রয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের চাহিদা আমাদের অবশ্যই পূরণ করতে হবে। তা না হলে আমাদের প্রজন্ম দুর্বল ও মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। দেশের এ বিশাল পুষ্টি চাহিদা মেটাতে দেশেই উৎপাদিত দুধ, দই ও অন্যান্য ফার্মেন্টেড ডেইরি প্রোডাক্ট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
 
যত দূর জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৯০০০ বছর আগে থেকেই মানুষ গাভীর দুধ খেতে শুরু করে এবং দুধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এজন্য গাভীকে মানবজাতির পালক মাতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। পাঁচ শতাব্দী আগে হিপোক্রিটস দুধকে ওষুধের পিতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ভারত বর্ষে আগে থেকে প্রচলন ছিল বা আছে, বিয়ের পর মেয়ে জামাইকে গাভী উপহার দেয়ার। এর পেছনে বৈজ্ঞানিক যুক্তি হলো- মেয়ে, জামাই ও নাতি-নাতনির মেধা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা।
 
দুধ ও দুধজাতীয় খাদ্যের উপকারিতা
১. দুধে ল্যাকটোজ মানব ব্রেনের খাদ্য, যা মেধাকে সমৃদ্ধ করে; ২. দুধে থাকা ক্যালসিয়াম মানুষের হাড় বা অস্থি গঠনে সহায়তা করে; ৩. দুধের প্রোটিন, ক্যাসিইন উচ্চ রক্তচাপ কমাতে ও ঘুম বা প্রশান্তি আনতে সহায়তা করে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের রাতে ঘুমানোর আগে ২৫০ মিলি. দুধ পান করা উচিত। প্রতিদিন ২৫০ মিলি. দুধ পান না করলে ৫০ বছর বয়সের পর মেরুদ- বাঁকা হয়ে যায়; ৪. দুধে থাকা চর্বি- ক. ক্যান্সার প্রতিরোধী; খ. রক্তনালির ভঙ্গুরতা বা শক্ত হয়ে যাওয়া থেকে প্রতিরোধ করে; গ. ডায়াবেটিক প্রতিরোধী; ঘ. শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে; ঙ. শরীরের সঠিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করে; চ. শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কমাতে সাহায্য করে।  
 
দুধের চর্বি ও প্রোটিন হৃদরোগের কারণ নয় বরং হৃদরোগ হতে বাধা দেয়।
বাংলাদেশে যেসব ফার্মেন্টেড ডেইরি প্রোডাক্ট পাওয়া যায় তা হলো-
১. দই
২. লাচ্চি
৩. মাঠা
৪. বোরহানি
৫. এসিডোফিলাস মিল্ক
৬. ফার্মেন্টেড হে ড্রিংক (ঘোল)   
৭. পনির
১. দই : ফার্মেন্টেড ডেইরি প্রোডাক্টের মধ্যে দই সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ও প্রিয় খাদ্য। দই তৈরির সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। তবে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই দই একটি প্রিয় ও উপকারী খাদ্য হিসেবে পরিচিত। বিশ্বের শতায়ু, দীর্ঘজীবী ব্যক্তিদের খাদ্য তালিকায় দই বা দধির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। উজবেকিস্তান ও চেকোশ্লোভিয়ার মানুষের গড়  আয়ু ১৩৫ বছর। এর  পেছনে কারণ হলো এসব দেশের মানুষ প্রতিদিন দই খায়।
 
 দই দুধের Lactic fermentation-এর ফলে তৈরি হয়। সব শ্রেণীর মানুষ দই পছন্দ করে। কেউ দই প্রতিদিন খেয়ে থাকেন। পুষ্টিমান বিবেচনায়  দই একটি সম্পূর্ণ খাদ্য। যেসব মানুষ দুধ হজম করতে পারে না তারা সহজেই দই হজম করতে পারেন। দই তৈরিতে ব্যবহৃত উপকারী ব্যাকটেরিয়া কর্তৃক উৎপাদিত উপজাত মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বেশ কিছু উপকার করে। যেমন-উচ্চরক্তচাপ কমায়। রক্তের কোলস্টেরল কমাতে সাহায্য করে এবং দেহ কোষের মিউটেশন প্রতিরোধ করে। দই খেলে মনে প্রশান্তি আসে, মেজাজ ফুরফুরে হয়। এজন্য প্রতিদিন রাতে দই খাওয়া দরকার। যে কোনো বিশেষ ভোজে দধি পরিবেশন না করলে সে ভোজের ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে যায়। 
 
দই তৈরি পদ্ধতি : দই সাধারণত দুই প্রকার-টক দই ও মিষ্টি দই পাকপ্রণালিতে বা সালাদে ব্যবহার করা হয়। খুব টক না হলে খাদ্যের সঙ্গে খাওয়া যায়। পক্ষান্তরে মিষ্টি দই সরাসরি খাওয়া যায়।
 
১ কেজি দই প্রস্তুত উপকরণ  
১. দুধ ১ কেজি 
২. চিনি ১২০ গ্রাম
৩. বীজ দই (আগের দিনের বানানো দই) - ২ চা চামচ                                                     
৪. মাটির হাঁড়ি/কাপ ১টি
 দই তৈরিতে যেসব ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয়-
 
Streptococcus lactis
Streptococcus thermophilus
Streptococcus cremoris
Lactobacillus bulgaricus
Lactobacillus plantarum.
 
পদ্ধতি- ক. একটি সিলভারের পাতিলে দুধ ও চিনি নিয়ে চুলায় জ্বাল দিতে হবে এবং অনবরত নাড়তে হবে যাতে নিচে লেগে না যায়।
খ. দুধ ঘন হয়ে ৭০০-৮০০ গ্রাম হলে চুলা থেকে নামাতে হবে।
গ. দুধ কুসুম গরম থাকা অবস্থায় এর সঙ্গে চা চামচের ২ চামচ বীজ দই যোগ করে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
ঘ. দুধ গরম থাকা অবস্থাতেই একটি পরিষ্কার মাটির পাতিলে-প্লাস্টিকের কাপে দুধ ঢেলে ওই পাত্রটির মুখ ঢেকে দিতে হবে।
ঙ. কাপগুলোকে পুরনো লেপ, কাথা বা ছালা দিয়ে জড়িয়ে কোনো গরম জায়গায় রেখে দিতে হবে। যাতে দুধের তাপ বের হয়ে না যায়।
চ. শীতকালে দই তৈরি হতে ১২-১৪ ঘণ্টা সময় লাগে, গরমকালে ৬-৭ ঘণ্টা এ অবস্থায় রেখে দিলেই দুধ জমে দই তৈরি হবে।
 
দইয়ের পুষ্টিমান
১. দইয়ের মধ্যে দুধের সব পুষ্টিগত গুণাগুণ বিরাজমান।
২. যারা দুধ হজম করতে পারেন না তারাও সহজেই দই খেয়ে হজম করতে সক্ষম।
৩. দই পেট ঠাণ্ডা রাখে।
৪. নিয়মিত দই সেবনে কর্মজীবনী বৃদ্ধি করে।

দই সংরক্ষণ পদ্ধতি : যদি গরম জায়গায় রাখা হয়, তবে দই জমার পরে খুব দ্রুত টক হয়ে যায়। তাই দুধ জমার সাথে সাথেই ঠাণ্ডা  জায়গায় দইয়ের পাতিল রেখে দিতে হবে। ফ্রিজে ৪-৫ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এক সপ্তাহ পর্যন্ত দই ভালো থাকে। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় গরমকালে এক দিন ও শীতকালে প্রায় দুই দিন পর্যন্ত দই খাওয়ার উপযোগী থাকে।
 
২. লাচ্চি : লাচ্চি সতেজক হিসেবে খুবই উপকারী পানীয়। এটি দই, চিনির সিরাপ ও গোলাপের নির্যাস দিয়ে  তৈরি করা হয়। গরমকালে বরফ সহকারে পরিবেশন করা হয়। লাচ্চি পলিপ্যাকে সরবরাহ করা যেতে পারে। ঢাকা, বগুড়া, রাজশাহী, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় লাচ্চি খাওয়ার প্রচলন রয়েছে।
 
৩. মাঠা : মাঠা  সাধারণত বাটারযুক্ত দুধ দিয়ে তৈরি করা হয়। মাঠার স্বাদ টক। এতে অল্প লবণ (০.৫%) মিশানো হয়, ফলে সুস্বাদু হয়ে থাকে।
মাঠা স্বাস্থ্যের জন্য খুব উপকারী। প্রতিদিন এক গ্লাস মাঠা খাওয়া প্রয়োজন।

৪. বোরহানি : বোরহানি টক দই, পানি, লবণ, বিভিন্ন মসলা ও কিছু গাছ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। বোরহানি খুবই সুস্বাদু ও উপকারী। বিশেষ করে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। বোরহানি ঢাকা জেলার খুবই প্রচলিত পানীয়। বোরহানি তৈরির সময় অবশ্যই বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করতে হবে।
 
৫. এসিডোফিলাস দুধ : এসিডোফিলাস দুধ একটি নতুন ফারমেন্টেড ফুড। স্বর ছাড়া (Skim milk)) দুধ Acidophilus দুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে Strawberry এবং চকোলেট সুগন্ধি (Flavor) ব্যবহার করা হয়।
 
৬. ফারমেন্টেড হে পানীয় : ফারমেন্টেড হে পানীয়- চানা যিবু-এর সঙ্গে ৮% চিনি ও ০.৫% mixed culture মিশিয়ে প্রস্তুত করা হয়। এ পানীয় বোতলজাত করার সময় ৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পাঁচ মিনিট গরম করতে হয়। পানীয়টির স্বাদ বৃদ্ধি করতে কৃত্রিম সুগন্ধি (Flavor)  ব্যবহার করা হয়।
 
৭. চিজ-পনির : বাংলাদেশে ‘ঢাকা চিজ’ একটি বিখ্যাত চিজ, যা সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়ে থাকে। এ পনির তৈরির সময় বাছুরের (Calves) Abomasum (Fourth stomach) শুকিয়ে ব্যবহার করা হয়। স্থানীয়ভাবে একে মোয়া বলে। এ পনির তৈরির সময় তুলনামূলকভাবে শক্ত প্রকৃতির হয় কিন্তু ২-৩ সপ্তাহ পরে কক্ষ তাপমাত্রায় রেখে দিলে পেকে যায়। পনির স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী।
বাংলাদেশে প্রতিনিয়তই ফারমেন্টেড ডেইরি ফুডের চাহিদা বেড়েই চলছে। এর প্রধান কারণ ক. দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি খ. মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি গ. জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইদানীং এসব ফারমেন্টেড ডেইরি ফুডস ওষুধ হিসেবে মূল্যায়িত বা বিবেচিত হচ্ছে। তাই ফারমেন্টেড ডেইরি ফুডস শিল্পের একটি বিশাল বাণিজ্যিক গুরুত্ব রয়েছে বাংলাদেশে।
 
লেখক:
কৃষিবিদ ডা. মনোজি কুমার সরকার*
* ভেটেরিনারি সার্জন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস, কাউনিয়া, রংপুর
 
বিস্তারিত
কবিতা
আমার দেশের চাষি
আবুল হোসেন আজাদ*
কার সে কায়িক পরিশ্রমে
ফুল ফসল আজ মাঠে,
কার উৎপন্ন কৃষি পণ্যে
ভরা বাজার হাটে।
রোদে পুড়ে বৃষ্টি ভিজে
সারা বেলা খেটে,
সুখে দুখে বারোটা মাস
কার বলো যায় কেটে।
ধান আলু পাট গম সরিষা
আধুনিক প্রযুক্তিতে,
ফলায় ফসল চাষিরা যে
গ্রীষ্ম বর্ষা শীতে।
ষোলো কোটি বাংলাদেশের
জনগণের জন্য,
জোগায় তারা কঠিন শ্রমে
সবার মুখে অন্ন।
ওরা হলো সহজ সরল
আমার দেশের চাষি,
সে অনন্য দেশের গর্ব
তাকে ভালোবাসি।
 
 
কৃষিবিষয়ক গান
অপু বড়ুয়া**
সবজি খেলে কব্জি বাড়ে
স্বাস্থ্য ভালো হয়
কাজে কামে মন খুশি রয়
জানিবে নিশ্চয়
তা বিজ্ঞজনে কয়।
আমড়া আম পেয়ারা কুলে
সি ভিটামিন আছে
এসব খেলে স্কার্ভি রোগ
আসে না আর কাছে।
কচুশাকে চোখের আলো
দূর করে দেয় নিকশ কালো
সুন্দর মন সুস্থ দেহ
জীবন আলোকময়।
মুরুং চলে  থুরুং নিয়ে
পাহাড়ে জুম চাষে
ক্ষেত খামারে ধান সবজি
ফলায় বারো মাসে।
বাগান বাড়ি পুকুর পাড়ে
থর থরিয়ে সবজি বাড়ে
সংসারে হয় বাড়তি আয়
থাকে না আর ভয়
জয়তো জগৎময়।
 
নিউ রাইস ফর আফ্রিকা (নেরিকা)
 মোহাম্মদ নূর আলম গন্দী***
 
নেরিকার জন্মস্থান যদিও আফ্রিকায়
থিতু হতে যাচ্ছে এবার বাংলার সীমানায়।
নেরিকার জীবনকাল সবার চেয়ে অল্প
আমনে মাত্র ১০০-১১০ দিন
এ নয় কোনো গল্প।
২০ দিনের চারা যদি করা যায় রোপণ
শতকে ফলন পাবে এক মণ।
নেরিকার রয়েছে প্রচ- জীবনীশক্তি
খরা রোগ পোকা তারে
সদা করে ভক্তি।
নেরিকা খায় সুষম সার
বাংলার মাঠে ফলে
বছরে তিন বার।
নেরিকার চালে আছে অধিক পুষ্টি
প্রাণিকুল খেয়ে পাবে
দেহ মনে তুষ্টি।
তোমার কল্যাণে বেঁচে গেছে যত
কালো নাঙ্গা আর ভুখা
সত্যিই তুমি নিউ রাইস ফর আফ্রিকা।
 
* কবি ও শিশু সাহিত্যিক, গ্রাম- বৈচনা ডাকঘর- শাঁখরা কোমরপুর, উপজেলা ও জেলা- সাতক্ষীরা। ** প্রকৌশলী, (গীতিকার-বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন) বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ, বান্দরবান। *** উপসহকারী কৃষি অফিসার, ব্লক চরপুক্ষিয়া, উপজেলা কৃষি অফিস, কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ।
বিস্তারিত
জ্বালানি সাশ্রয়ে ইউসুফ উদ্ভাবিত চুলা অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে
গৃহস্থালি রান্নার কাজে জ্বালানি সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। রান্নার কাজে গ্যাস বা এলপিজি দেশের রাজধানী ছাড়া কয়েকটি বিভাগীয় শহরের অল্পবিস্তর প্রয়োজন মেটাতে পারলেও সিংহভাগ জনগণের রান্নার জ্বালানি মেটাতে হয় কাঠ বা খড়ি দিয়ে। আর গ্রামাঞ্চলে এখনও গবাদিপশুর বর্জ্য দিয়ে পাটখড়ির সাহায্যে ঘুটে বা মুঠে দিয়ে রান্নার কাজ চালানো হয়ে থাকে। গবাদিপশুর বিষ্ঠা বা গোবর এখনও ফসলি মাঠে একমাত্র জৈব সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কাঠের ওপর চাপ কমিয়ে আধুনিক চুলা আমাদের জ্বালানি সাশ্রয়সহ জৈব সারের ঘাটতি লাঘবে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। খুলনা শহরের বয়রা এলাকার মো. ইউসুফ আধুনিক প্রযুক্তির চুলা উদ্ভাবন করেছেন যা দিয়ে গ্রামাঞ্চলসহ শহরের আধুনিক রান্নাঘরে অনায়াসেই অল্প পরিমাণে জ্বালানি কাঠ দিয়ে রান্নাবান্নার কাজ করা যায় এবং ধোঁয়ামুক্ত পরিবেশে গৃহিণীরা রান্নার কাজ সম্পন্ন করতে পারেন। মো. ইউসুফ উদ্যোমী এক ব্যক্তি। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলায়। জীবিকার প্রয়োজনে খুলনায় এসেছিলেন। খুলনার শিল্পাঞ্চলখ্যাত খালিশপুরে মিলে চাকরিও পেয়েছিলেন। নিজের জীবনটা যখন সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরি হয়েছিলেন তখনই মিলটি লোকসানের বোঝা নিয়ে কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দেয়। দিশেহারার মতো হয়ে যান ইউসুফ। জীবন চালাতে তখন কাপড়ের ছিদ্র মেরামতের রিপুর কাজ শুরু করেন। সাংসারিক রান্নার প্রয়োজনে বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে একটি চুলা তৈরি করে নিয়েছিলেন। কিছু দিন না যেতেই নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। নিজে নিজেই মেরামত করে সেটিকে ঠিক করেন তিনি। এ কাজের মাধ্যমেই চুলা তৈরি ও বিপণনের প্রতি উৎসাহিত হন ইউসুফ। প্রযুক্তির চুলার বিষয়ে খোলামেলা কথা হয় তার সঙ্গে।
 
প্রশ্ন : চুলার বিষয়ে আগ্রহী হলেন কেন?
উত্তর : চাকরি হারানোর পর জীবিকার তাগিদে কাপড় রিপুর কাজ শুরু করি, কিন্তু এ কাজে    সাংসারিক প্রয়োজন না মেটায় নতুন কাজ খুঁজতে থাকি। এ সময় নিজের চুলা মেরামত করতে গিয়ে চুলার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি।
 
প্রশ্ন : কবে থেকে চুলা তৈরি শুরু করেছেন?
উত্তর : আমি ২০০০ সাল থেকে মূলত চুলা তৈরির কাজ শুরু করেছি। সেটিকে আধুনিক রূপ দিয়ে ২০০২ সাল থেকে উন্নত চুলার রূপ দিয়েছি। এ সময় থেকে চুলা বিক্রির কাজও শুরু করেছি।
 
প্রশ্ন : আপনি কত ধরনের চুলা তৈরি করেন?
উত্তর : আমি তিন ধরনের চুলা তৈরি করি। ছোট, মাঝারি ও বড় চুলা। এসব চুলা আবার তিনভাবে তৈরি করে থাকি। চিকন স্ট্রাকচার, মাঝারি স্ট্রাকচার ও মোটা স্ট্রাকচার। ছোট চুলা ৪ থেকে ৫ জনের রান্নার জন্য, মাঝারি চুলা ৫ থেকে ১০ জন ও বড় চুলা ১০ থেকে ২০ জনের রান্নার জন্য। এছাড়া হোটেল বা মেসের জন্য আলোচনা করে বড় চুলা তৈরি করে থাকি।
 
প্রশ্ন : একটি চুলা বানাতে কয় দিন সময় লাগে?
উত্তর : ছোট চুলা বানাতে ১৫ দিন সময় লাগে, বড় চুলা বানাতে ২০ দিন পর্যন্ত সময় লাগে।
 
প্রশ্ন : আপনি চুলা কিভাবে তৈরি করে থাকেন?
উত্তর : ক্রেতা কত বছর মেয়াদি, কোন আকারের চুলা তৈরি করতে চান সেটিকে বিবেচনায় এনে চুলা তৈরির কাজ শুরু করি। প্রথমে স্ট্রাকচার রড-সিমেন্ট দিয়ে তৈরি হয়, পরে মাটি ও অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে সেটিকে তরল করে সপ্তাহখানেক শুকিয়ে কাদা বানিয়ে টব তৈরি করা হয়। এবার ওই স্ট্রাকচারের ভেতর টবটি বসিয়ে  দেয়া হয়। স্ট্রাকচার ও টবের মাঝখানের ফাঁকে নিজস্ব তৈরিকৃত কিছু পদার্থ প্রয়োগ করে পরে সিমেন্ট বালু দিয়ে পুনরায় সেটিকে লেপে চুলা  তৈরির কাজ শেষ করে থাকি।
 
প্রশ্ন : আপনি এ পর্যন্ত কতটি চুলা তৈরি করেছেন?
উত্তর : আমি এখন পর্যন্ত ৩ হাজারের বেশি প্রযুক্তির চুলা তৈরি করেছি। দেশের ১৭টি জেলার বিভিন্ন পেশার ব্যক্তির নিকট এসব চুলা বিক্রি করেছি।
 
প্রশ্ন : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
উত্তর : আমাদের দেশের সাধারণ মানের চুলায় গৃহিণীরা যে পরিমাণ কাঠ অপচয় করেন সেক্ষেত্রে আমার এ প্রযুক্তির চুলায় শতকরা প্রায় ৩৪ ভাগ জ্বালানির সাশ্রয় হবে। ফলে দেশের বনজ সম্পদ ও পরিবেশ অনেকাংশে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে। ভবিষ্যতে আমার এ তৈরিকৃত প্রযুক্তির চুলাকে দেশীয় ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত করতে ইচ্ছুক।
 
দেশের পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সম্মানিত পরিবেশবিদরা যেভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন মো. ইউসুফের চিন্তাভাবনা তাদের এ আন্দোলনকে কিছুটা হলেও এগিয়ে দিতে পারে। তার উদ্ভাবিত এ প্রযুক্তির চুলা আরও আধুনিককায়নের মাধ্যমে জ্বালানি সাশ্রয়সহ পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখুক এটাই আমাদের কাম্য।
 
লেখক:
মো. আবদুর রহমান*
* এআইসিও, কৃষি তথ্য সার্ভিস, আঞ্চলিক কার্যালয়, খুলনা
বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর

আবদুল মোতালেব

সিরাজগঞ্জ

প্রশ্ন : লিচু গাছে কখন সেচ দিতে হবে?
উত্তর : চারা গাছের বৃদ্ধির জন্য শুকনো মৌসুমে ১০ থেকে ১৫ দিন পর পর সেচ দিতে হবে। ফলন্ত গাছের বেলায় সম্পূর্ণ ফুল ফোঁটা পর্যায়ে একবার, ফল মটর দানার মতো হলে একবার এবং ১৫ দিন পর তার একবার মোট তিনবার সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। সার প্রয়োগের পর সেচ দেয়া একান্ত দরকার। আবার বর্ষার সময় যাতে গাছের গোড়ায় পানি জমে না থাকে তার জন্য পানি নিকাশের ব্যবস্থা নিতে হবে।
 
সাগর
পঞ্চগড়
প্রশ্ন : মরিচের পাতা কুঁকড়ে গেছে, গাছ খাটো হয়ে গেছে। করণীয় কী?
উত্তর : ভাইরাস দ্বারা মরিচ গাছ আক্রান্ত হলে পাতা কুঁকড়ে যায় এবং শুরু হয়। গাছ খর্বাকৃতির হয়।
প্রতিকার : ১. আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। ২. সাদা মাছি এ রোগের বাহক। তাই সাদা মাছি দমনের জন্য ডায়াজিনন ৬০ ইসি বা রগর ২ মিলি. প্রতি লিটার পানির সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

মো. ইলিয়াস
সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম
প্রশ্ন : পেঁপে গাছ লাগাতে প্রতি গর্তে কী পরিমাণ সার দিতে হবে।
উত্তর : চারা রোপণের ১৫ থেকে ২০ দিন আগে বেডের মাঝ বরাবর ২ মিটার দূরত্বে ৬০x৬০x৪৫ সেমি. আকারের গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্ত প্রতি ১৫ কেজি পচা গোবর, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম জিপসাম, ২০ গ্রাম বরিক এসিড এবং ২০ গ্রাম জিংক সালফেট সার প্রয়োগ করে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মেশাতে হবে। সার মিশ্রিত মাটি দ্বারা গর্ত পূরণ করে সেচ দিতে হবে।
 
প্রশ্ন : বেগুন গাছ পাতায় ছোট ছোট চক্রাকারে দাগ দেখা যায়, ফল পচে যায় ও গাছ মরে যায়। প্রতিকার কী?
উত্তর : এক ধরনের ছত্রাক এর আক্রমণে বেগুন গাছে এ রোগ দেখা দেয়। পুষ্টির অভাবে এবং শুষ্ক গরম আবহাওয়ায় এ রোগ বেড়ে যায়।
 
প্রতিকার : ১. সুস্থ রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে। ২. সেচ বা বৃষ্টির পর গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দিতে হবে। ৩. রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ব্যাভিস্টিন/নোইন গুলিয়ে গাছের গোড়ায় মাটি ভালোভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে। ৪. ফসল সংগ্রহের পর মুড়ি গাছ না রেখে সব গাছ, ডালপালা, পাতা ইত্যাদি একত্র করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
 
মোসা. লাকী খাতুন
কেরানীগঞ্জ, ঢাকা
প্রশ্ন : গোলাপ ফুলে বিছা পোকা পাতা ও ফুলের পাঁপড়ি খেয়ে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। প্রতিকার কী?
উত্তর : বিছা পোকার আক্রমণে পাতা, ফুল শুকিয়ে ঝরে যায়। আংশিক আক্রান্ত ফুলের বাজার মূল্য কম হয়।
১. আক্রমণের প্রথম পর্যায়ে আক্রান্ত পাতা, ফুল কীড়াসহ সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে।
২. আক্রমণ বেশি হলে কুইনালফস ২৫ ইসি/কিনালক্স ২৫ ইসি বা ফেনিট্রোথিয়ন জাতীয় কীটনাশক ২.০ মিলি./লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পরপর ২ বার স্প্রে করতে হবে।
 
মো. শাহাজাহান
লালমনিরহাট
প্রশ্ন : গমের ক্ষেতে প্রচুর ইঁদুর আক্রমণ হচ্ছে। ইঁদুরে হাত থেকে গম ফসল রক্ষার উপায় কী?
উত্তর : ইঁদুর গমের একটি প্রধান শত্রু। গম ক্ষেতে বিশেষ করে শিষ আসার পর ইঁদুরের উপদ্রব বেশি দেখা যায়।
প্রতিকার : ১. ইঁদুরের গর্তে পানি ঢেলে মেরে ফেলা।
২. ফাঁদ পেতে ইঁদুর মারা।
৩. ছোট ছোট কাগজের টুকরার মধ্যে ১ গ্রাম করে জিংক ফসফাইড জাতীয় ইঁদুরনাশক ভর্তি করে ইঁদুরের গর্তের মুখের সামান্য ভেতরে প্রয়োগ করে গর্তের মুখ মাটি দিয়ে আলতোভাবে বন্ধ করে দেয়া।
৪. ইঁদুর চলাচলের পথে কাগজে ল্যানিরেট বা অন্য কোনো ইঁদুরনাশক রেখেও ইঁদুর দমন করা যায়।

মো. রফিকুল ইসলাম
ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : মনোসেক্স তেলাপিয়া নার্সিংয়ের পদ্ধতি কী?
উত্তর : নার্সিং পুকুরের আয়তন ১০ থেকে ১২ শতাংশ এবং পানির গভীরতা ১ মিটার রাখা আবশ্যক। পুকুর শুকিয়ে সব রাক্ষুসে মাছ ও মৎস্যভূক প্রাণী নির্মুল করতে হবে। নিষ্কাশন সম্ভব না হলে মিহি ফাঁসের জাল টেনে অবাঞ্ছিত প্রাণী দূর করা যেতে পারে। পুকুরে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। চুন প্রয়োগের ১ সপ্তাহ পরে প্রতি শতাংশে ৩ থেকে ৪ কেজি গোবর, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া  ও ১০০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে। নার্সারি পুকুরের প্রতি শতাংশে ১২০০ থেকে ১৫০০ টি হারে পোনা মজুদ করা যেতে পারে। মজুদকৃত পোনাকে ৬ সপ্তাহ নার্সারি পুকুরে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে (২৫ থেকে ১০% প্রতি সপ্তাহে কমবে)। এভাবে ৬ সপ্তাহ লালনের পর পোনা যখন ১৫ থেকে ২০ গ্রাম ওজনের হবে তখন তা বিক্রি বা চাষের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
 
মো. সুমন মিয়া
যশোর
প্রশ্ন : ঘেরের প্রস্তুত প্রণালি সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : ঘের শুকিয়ে তলদেশের  পচা কাদা অপসারণ এবং তলদেশ সমান করতে হবে। পাড় উঁচু করে বাঁধতে হবে। ঘেরের পাড়সহ তলায় চুন ভালোভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে প্রতি শতকে ১ কেজি হারে। ঘেরের তলদেশ চাষ দিয়ে আবর্জনা পরিষ্কার করতে হবে। ছোট মেসসাইজের নাইলন জাল দিয়ে ঘেরের চারপাশের বেড়া (৩ ফুট উঁচু) দিতে হবে। পানি প্রবেশ পথ ও জরুরি পানি নির্গমন পথ করতে হবে এবং তাতে স্ক্রিন বা বানা (বাঁশের পাটা ও নাইলনের জাল দিয়ে তৈরি) দিতে হবে। চুন প্রয়োগের ৫ থেকে ৭ দিন পরে প্রয়োজনমতো পানি প্রবেশ করিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে ইউরিয়া ১৫০ থেকে ২০০ গ্রাম/শতক, টিএসপি ৭৫ থেকে ১০০ গ্রাম/শতক হারে। এরপর ব্লিচিং পাউডার সব ঘেরে ছিটিয়ে দিয়ে পানি জীবাণুমুক্ত করতে হবে। অনেক সময় ঘেরের এককোণায় বাঁশের ফ্রেমের সঙ্গে একটি নার্সারি তৈরি করতে বলা হয়। হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা বা গোবর ব্যবহার করা যাবে না।
 
বিজয় কুমার
লালমনিরহাট
প্রশ্ন : পুকুর নির্বাচনে প্রয়োজনীয় শর্তগুলো কী কী?
উত্তর : * পুকুরের পাড় আগাছা ও ঝোপঝাড় মুক্ত হবে, যাতে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা সূর্যের আলো পুকুরে পড়তে পাড়ে। * আয়তন ১০ থেকে ৫০ শতাংশ এবং গভীরতা ৬ থেকে ৯ ফুট হতে হবে (প্রাকৃতিক পানি  ৬/৭ মাস থাকে)। * পুকুর বাড়ির কাছে একক মালিকানার হতে হবে। *পানির সরবরাহ ব্যবস্থা ভালো থাকতে হবে। *পুকুরের মাটি দোআঁশ ধরনের সর্বোত্তম।
 
আতাউর রহমান
রংপুর
প্রশ্ন : গরুর পেট ফেঁপে গেছে। কী করণীয় ?
উত্তর : তৎক্ষণাৎ আধা কেজি পরিমাণ আদা ভাঙা বাটা দিয়ে খাওয়াতে হবে।
গ্যাসনাশক যেমন অ্যান্টিজাইমোটিক/ কারমিনেটিভ জাতীয় ওষুধ সরাসরি রুমেনে প্রয়োগ (তীব্র হলে) অথবা মুখ দিয়ে খাওয়াতে হবে। অক্সিটেট্টাসাইক্লিন ইনজেকশন মাংসপেশিতে দিলে ভালো কাজ করে। তীব্র প্রকৃতির ক্ষেত্রে বাম দিকের প্যারালাম্বার ফোসা ছিদ্র করে গ্যাস বের করা যায়।
 
জাহিদ হোসেন
শেরপুর
প্রশ্ন : গরুর কাঁধে ঘা হয়েছে। কী করণীয়?
উত্তর : * আইডারমেকটিন (Ivermection) ০.২ মি. গ্রাম/ কেজি হিসেবে চামড়ার নিচে ২৮ দিন অন্তর দুইবার ইনজেকশন দিতে হবে।*নেগুভন ১-২% সলুসন দিয়ে আক্রান্ত স্থান ধুয়ে দিতে হবে।          
*পাশাপাশি যে কোনো একটি অ্যান্টিহিস্টাসিনিক ইনজেকশন দিলে ভালো কাজ করে।
*দ্বিতীয় পর্যায়ের জীবাণু সংক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সালফার ড্রাগ অথবা অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দিতে হবে।

 
রাকিব রায়
দিনাজপুর
প্রশ্ন : ইউএমএস তৈরির পদ্ধতি জানতে চাই।
উত্তর : ইউএমএস তৈরির প্রথম শর্ত হলো সর্বদা এর গঠন সঠিক রাখতে হবে। ১০০ কেজি ইউএমএস তৈরি করতে হলে ৮২ কেজি শুকনা খণ্ড, ১৫ কেজি চিটাগুড় ও ২ থেকে ৩ কেজি ইউরিয়া মিশাতে হবে। খড়গুলো পলিথিন বিছিয়ে তার ওপর মাঝারিভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। বালতিতে ৫ লিটার পানির সঙ্গে ৩ কেজি ইউরিয়া মিশিয়ে নিতে হবে। এবার মিশ্রণটি খড়ের ওপর অর্ধেক ছিটিয়ে দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে মিশ্রণ যেন কোনোভাবেই পলিথিনে আটকে না থাকে। এভাবে তৈরি ইউএমএস ৩ দিনের বেশি সংরক্ষণ না করাই ভালো।
 
লেখক :
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মারুফ
* কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, ই-মেইল : masum.maroof@gmail.com
বিস্তারিত
বৈশাখ-মাসের-কৃষি
সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। বৈশাখ বাংলা বছরের প্রথম মাস অর্থাৎ আর একটি নতুন বছরের সূচনা। গত বছরের দুঃখ, বেদনা, যন্ত্রণা, কষ্ট, অসফলতা সব দূর করে আমাদের প্রত্যাশা নতুন বছরটি যেন সবার জীবনে হাসি, আনন্দ, সফলতা, উচ্ছ্বাস আর সমৃদ্ধি বয়ে আনে। এ মাসে চলতে থাকে আমাদের ঐতিহ্যবাহী মেলা, পার্বণ, উৎসব, আদর, আপ্যায়ন। নতুন আবাহান আর প্রত্যাশার মাঝে সুজন কৃষক ফিরে তাকায় দিগন্তের মাঠে। প্রিয় পাঠক আসুন এক পলকে জেনে নেই বৈশাখে কৃষির করণীয় দিকগুলো।
 
বোরো ধান
যারা এবার দেরিতে বোরো ধানের চারা রোপণ করেছেন তাদের জমিতে চারার বয়স ৫০ থেকে ৫৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। তবে কেউ যদি দানাদার ইউরিয়ার পরিবর্তে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করে থাকেন তবে ইউরিয়ার উপরিপ্রয়োগের প্রয়োজন নেই।  জমিতে আগাছা পরিষ্কার করা, সেচ দেয়া, বালাই দমন এসব কাজ সঠিকভাবে করতে হবে। থোড় আসা শুরু হলে জমিতে পানির পরিমাণ দ্বিগুণ বাড়াতে হবে। ধানের দানা শক্ত হলে জমি থেকে পানি বের করে দিতে হবে। এ মাসে বোরো ধানে মাজরা পোকা, বাদামি গাছ ফড়িং, সবুজ পাতা ফড়িং, গান্ধি পোকা, লেদা পোকা, ছাতরা পোকা, শীষকাটা লেদা পোকা, ছাতরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণ হতে পারে। পোকা দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পোকার আক্রমণ রোধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আলোর ফাঁদ পেতে, পোকা ধরার জাল ব্যবহার করে, ক্ষতিকর পোকার ডিমের গাদা নষ্ট করে, উপকারী পোকা সংরক্ষণ করে, ক্ষেতে ডাল-পালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ধানক্ষেত বালাই মুক্ত করা দরকার। এসব উপায়ে পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা না গেলে শেষ উপায় হিসেবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক বালাইনাশক, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায়, সঠিক নিয়মে প্রয়োগ করতে হবে। এ সময় ধান ক্ষেতে উফরা, বাদামি দাগ রোগ, ব্লাস্ট, পাতাপোড়া ও টুংরো রোগসহ অন্যান্য রোগ হতে পারে। জমিতে উফরা রোগ দেখা দিলে যে কোনো কৃমিনাশক যেমন ফুরাডান ৫জি বা কিউরেটার ৫জি প্রয়োগ করতে হবে। ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রেখে হেক্টরপ্রতি ৪০০ গ্রাম ট্রুপার বা জিল বা নেটিভ ১০ থেকে ১৫ দিনের ব্যবধানে দুইবার প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে পাতাপোড়া রোগ হলে অতিরিক্ত ৫ কেজি-বিঘা হারে পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে এবং জমির পানি শুকিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন পর আবার সেচ দিতে হবে। আর টুংরো রোগ দমনের জন্য এর বাহক পোকা সবুজ পাতা ফড়িং দমন করতে হবে।

গম ও ভুট্টা (রবি)
মাঠ থেকে কাটার পর এ দুটি দানাদার ফসল এরই মধ্যে বাড়ির আঙিনায় চলে আসার কথা। ভালোভাবে সংরক্ষণ করা না হলে ক্ষতি হয়ে যাবে অনেক। সংরক্ষণ কৌশলে ভালোভাবে বীজ শুকানো, উপযুক্ত পাত্র নির্বাচন, বায়ুরোধী করে সংরক্ষণ, বীজ পাত্রকে মাটি বা মেঝ থেকে আলাদাভাবে রেখে সংরক্ষণ করতে হবে। সংরক্ষণ পাত্রে শুকনো নিমপাতা, বিষকাটালি পাতা রেখে দিলে সহজেই পোকার আক্রমণ রোধ করা যাবে।
 
ভুট্টা (খরিফ)
খরিফ ভুট্টার বয়স ২০ থেকে ২৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। মাটিতে রসের ঘাটতি থাকলে হালকা সেচ দিতে হবে, জমিতে আগাছা পরিস্কার করতে হবে এবং একই সঙ্গে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে।
 
পাট
বৈশাখ মাস তোষা পাটের বীজ বোনার উপযুক্ত সময়। ও-৪ বা ফাল্গুনী তোষা ভালো জাত। স্থানীয় বীজ ডিলারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জাতগুলো সংগ্রহ করতে পারেন। দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটিতে তোষা পাট ভালো হয়। বীজ বপনের আগে প্রতি কেজি বীজ ৪ গ্রাম ভিটাভেক্স বা ১৫০ গ্রাম রসুন পিষে বীজের সঙ্গে মিশিয়ে শুকিয়ে নিয়ে জমিতে সারিতে বা ছিটিয়ে বুনতে হবে। সারিতে বুনলে প্রতি শতাংশে ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বুনলে আরেকটু বেশি অর্থাৎ ৩৫ থেকে ৪০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। ভালো ফলনের জন্য  শতাংশপ্রতি ৮০০ গ্রাম ইউরিয়া, ২০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি সার শেষ চাষের সময় মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। জমিতে সালফার ও জিংকের অভাব থাকলে জমিতে সার দেয়ার সময়  শতাংশপ্রতি ৪০০ গ্রাম জিপসাম ও ৫০  কেজি দস্তা সার দিতে হবে। শতাংশপ্রতি ২০ কেজি গোবর সার ব্যবহার করলে রাসায়নিক সারের পরিমাণ অনেক কম লাগে।
 
আগে বোনা পাটের জমিতে আগাছা পরিষ্কার, ঘন চারা তুলে পাতলা করা, সেচ এসব কাজগুলো যথাযথভাবে করতে হবে। এ সময় পাটের জমিতে উড়চুঙ্গা ও চেলা পোকার আক্রমণ হতে পারে। সেচ দিয়ে মাটির উপযোগী কীটনাশক দিয়ে উড়চুঙ্গা দমন করতে হবে। চেলা পোকা আক্রান্ত গাছগুলো তুলে ফেলে দিতে হবে এবং জমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। পোকা ছাড়াও পাটের জমিতে কা- পচা, কালপট্টি, নরম পচা, শিকড় গিট, হলদে সবুজ পাতা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। নিড়ানি, আক্রান্ত গাছ বাছাই, বালাইনাশকের যৌক্তিক ব্যবহার করলে এসব রোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।
 
শাকসবজি
এ মাসে বসতবাড়ির বাগানে জমি তৈরি করে ডাঁটা, কমলিশাক, পুঁইশাক, করলা, ঢেঁড়স, বেগুন, পটোল চাষের উদ্যোগ নিতে হবে। তাছাড়া মাদা তৈরি করে চিচিঙা, ঝিঙা, ধুন্দুল, শসা, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়ার বীজ বুনে দিতে পারেন। আগের তৈরি করা চারা থাকলে ৩০ থেকে ৩৫ দিনের সুস্থ সবল চারাও রোপণ করতে পারেন। এ সময়ের অধিকাংশ সবজিই লতানো, তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাচা তৈরি করে নিতে হবে। লতানো সবজির দৈহিক বৃদ্ধি যত বেশি হবে তার ফুল ফল ধারণ ক্ষমতা তত কমে যায়। সেজন্য গাছের বাড়বাড়তি বেশি হলে লতার-গাছের ১৫ থেকে ২০ শতাংশের পাতা লতা কেটে দিতে হবে। এতে গাছে তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল ধরবে। কুমড়া জাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন অধিক ফলনে দারুণভাবে সহায়তা করবে। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন ভোর বেলা সদ্য ফোটা পুরুষ ফুল সংগ্রহ করে পাপড়িগুলো ফেলে দিয়ে পরাগমু-টি স্ত্রী ফুলের গর্ভমু-ে ঘষে হাতপরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে। এ মাসে কুমড়া জাতীয় ফসলে মাছি পোকা দারুণভাবে ক্ষতি করে থাকে। এক্ষেত্রে জমিতে খুঁটি বসিয়ে খুঁটির মাথায় বিষটোপ ফাঁদ দিলে বেশ উপকার হয়। এছাড়া সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করেও এ পোকার আক্রমণ রোধ করা যায়। গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করতে চাইলে বারি টমেটো ৪, বারি টমেটো ৫, বারি টমেটো ৬, বারি টমেটো ১০, বারি টমেটো ১১, বারি হাইব্রিড টমেটো ৪, বারি হাইব্রিড টমেটো ৫, বা বিনা টমেটো ১, বিনা টমেটো ২-এর চাষ করতে পারেন। গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করতে হলে পলিথিনের ছাওনির ব্যবস্থা করতে হবে সে সঙ্গে এ ফসলটি সফলভাবে চাষের জন্য টমেটোটোন নামক হরমোন প্রয়োগ করতে হবে। স্প্রেয়ারের সাহায্যে প্রতি লিটার পানিতে ২০ মিলি টমেটোটোন মিশিয়ে ফুল আসার পর ফুলের গায়ে ৫ থেকে ৭ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে। একটু বেশি যতœ এবং পরিচর্যা করলে অভাবনীয় ফলাফল পাওয়া যায়।

গাছপালা
এ মাসে আমের মাছি পোকাসহ অন্যান্য পোকার জন্য সতর্ক থাকতে হবে। মাছি পোকা দমনের জন্য সবজি খেতে যে রকম বিষটোপ ব্যবহার করা হয় সে ধরনের বিষটোপ বেশ কার্যকর। ডিপটরেক্স, ডারসবান, ডেনকাভেপন সামান্য পরিমাণ দিলে উপকার পাওয়া যায়। এ সময় কাঁঠালের  নরম পঁচা রোগ দেখা দেয়। এলাকায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব থাকলে ফলে রোগ দেখা দেয়ার আগেই ফলিকুল ০.০৫% হারে বা ইন্ডোফিল এম-৪৫ বা রিডোমিল এম জেড-৭৫ প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৩ বার স্প্রে করতে হবে। নারিকেলের চারা এখন লাগাতে পারেন। ভালো জাতের সুস্থ সবল চারা ৬ থেকে ৮ মিটার দূরে লাগানো যায়। গর্ত হতে হবে দৈর্ঘে ১ ফুট, প্রস্থে ১ ফুট এবং গভীরতায় ১ ফুট। নারিকেলের চারা রোপণের ৫ থেকে ৭ দিন আগে প্রতি গর্তে জৈবসার ১০ কেজি, টিএসপি ৭৫০ গ্রাম, এমওপি ৫৫০ গ্রাম এবং জিপসাম ৫০০ গ্রাম ভালোভাবে গর্তের মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। বীজতলা থেকে যেদিন চারা উঠানো হবে সেদিনই জমিতে চারা রোপণ করা সবচেয়ে ভালো। অন্যথায় যতদ্রুত সম্ভব চারা রোপন করতে হবে। চারা রোপণের সময় চারাটিকে এমনভাবে গর্তে বসিয়ে মাটি চাপা দিতে হবে যাতে নারিকেলের পিঠের কেবল ইঞ্চিখানেক মাটির উপরে ভেসে থাকে এবং বাকিটা মাটির নিচে থাকে। গ্রামের রাস্তার পাশে পরিকল্পিতভাবে খেজুর ও তালের চারা এখন লাগাতে পারেন। যত্ন, পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে ২ থেকে ৩ বছরেই গাছগুলো অনেক বড় হয়ে যাবে। ভালো ফলনের জন্য এ সময় বৃক্ষ জাতীয় গাছের বিশেষ করে ফল গাছের প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে হবে। মাতৃগাছের পরিচর্যা, আগাছা দমন, প্রয়োজনীয় সেচ দিলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে। বৃষ্টি হয়ে গেলে পুরাতন বাঁশ ঝাড় পরিষ্কার করে কম্পোস্ট সার দিতে হবে এবং এখনই নতুন বাঁশ ঝাড় তৈরি করার কাজ হাতে নিতে হবে। যারা সামনের মৌসুমে গাছ লাগাতে চান তাদের এখনই জমি নির্বাচন, বাগানের নকশা প্রস্তুত এবং অন্যান্য প্রাথমিক কাজগুলো সেরে রাখতে হবে।
 
প্রাণিসম্পদ
গরমকালে মুরগি পালনে যেসব সমস্যা দেখা দেয় তাহলো খাদ্য গ্রহণ, ব্রয়লারের দৈহিক ওজন বৃদ্ধির হার, লেয়ার ও ব্রিডারের ডিম উৎপাদনসহ ডিমের খোসার গুণগতমান কমে যায় এবং খামারে মুরগি মারা যাওয়ার হার বেড়ে যায়। সে কারণে ব্রুডার হাউসের শেডে বাচ্চা তোলার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি ও গ্লুকোজ খাওয়াতে হবে। আর লেয়ার হাউস ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে শেডের চাল বা ছাদে তাপ বিকিরণ করতে পারে এমন সাদা, অ্যালুমিনিয়িাম রঙ দেয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত গরমে পাইপ বা ঝরনার মাধ্যমে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ক্ষুদ্র খামারের ক্ষেত্রে চালের ওপরে পাটের চট দিয়ে পানি ছিটাতে হবে। প্রচ- গরমে খাবারের পানির সঙ্গে বরফ মেশানো দরকার।
 
হাঁস মুরগির রোগ প্রতিরোধে নিয়মিত ভ্যাকসিন বা টিকা দেয়া জরুরি। সেজন্য মুরগির রানীক্ষেত, ব্রংকাইটিস, ফাউলপক্ষ, ফাউল কলেরা, ম্যারেক্স এবং হাঁসের প্লেগ ও কলেরা রোগের টিকা দেয়ার জন্য উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
 
গোখাদ্যের জন্য নেপিয়ার, বাজরা, প্যারা, ভুট্টা, ইপিল ইপিল এর চাষ করার ভালো সময় এখন। বাড়ির আশপাশে, পুকুর পাড়ে, রাস্তার ধারে, পতিত জায়গায় গোখাদ্যের চাষ করে লাভবান হওয়া যায়। গ্রীষ্মের তাপদাহে গবাদি পশুর জন্য অতিরিক্ত খাবার, বিশ্রাম, ঘরে আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা, বেশি পানি খাওয়ানোসহ অন্যান্য কার্যক্রম সঠিকভাবে করতে হবে। এ সময় গবাদি পশুর তড়কা ও গলাফুলা রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য টিকা প্রদানসহ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে হবে।
 
মৎস্যসম্পদ
বৈশাখ মাস পুকুরে মাছ ছাড়ার উপযুক্ত সময়। ভালোভাবে পুকুর তৈরি করে অর্থাৎ সেচ, কাদা সরিয়ে, চুন প্রয়োগ করে, আগাছা পরিষ্কার, পানি দেয়া, পানি পরীক্ষা, পুকুর পাড়ে নিত্য পাতা ঝরা গাছ ছাঁটাই বা কেটে ফেলাসহ অন্যান্য কাজগুলো করতে হবে। এরপর প্রতি শতকে মিশ্রচাষের জন্য ৩০ থেকে ৪০টি ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি বড় সুস্থ সবল পোনা ছাড়তে হবে। পানির ৩ স্তরের কথা বিবেচনা করে তেলাপিয়া, সরপুটি, নাইলোটিকা, কার্পজাতীয় মাছ, রুই, কাতল, মৃগেল কালো বাউস এবং সম্ভব হলে চিংড়ি পোনাও ছাড়া যাবে। পোনা সংগ্রহের সময় বিশ্বস্ত উৎস থেকে পোনা সংগ্রহ করতে হবে।
 
প্রিয় পাঠক, বৈশাখ আসে আমাদের জন্য নতুন আবাহনের সৌরভ নিয়ে। সঙ্গে আঁচলে বেঁধে নিয়ে আসে কালবৈশাখীকে। কালবৈশাখীর থাবা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কৃষিতে আগাম বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সুবিবেচিত লাগসই কৌশল আর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সব বাধা ডিঙিয়ে আমরা কৃষিকে নিয়ে যেতে পারব সমৃদ্ধির ভূবনে। আবার কথা হবে আগামী মাসের কৃষিকথায়। আপনাদের সবার জন্য আবারও নতুন বছরের শুভ কামনা। কৃষির সমৃদ্ধিতে আমরা সবাই গর্বিত অংশীদার।
 
লেখক:
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন
* সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
বিস্তারিত
সম্পাদকীয়
 
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি। এ জন্য কৃষির সার্বিক উন্নয়নে সুপরিকল্পিতভাবে কৃষি গবেষক, সম্প্রসারণবিদ, কৃষিকর্মী, কৃষক-কৃষাণী সবাইকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।  বোরো মৌসুমে ধানের ফলন বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সেচ ও সার প্রয়োগ এবং সঠিকভাবে ফসলের যত্ন-পরিচর্যা আমাদের সবাইকে সমন্বিতভাবে চালিয়ে যেতে হবে। ধানের পাশাপাশি প্রচলিত অপ্রচলিত নানা ধরনের ফসলের চাষাবাদ করে দেশের খাদ্যশস্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে হবে। দেশে ইদানীং এমন  অনেক চর জেগে উঠেছে যেখানে ধান, সবজি ও ডাল ফসলের চাষ হচ্ছে। পদ্মা ও যমুনা নদীতে বড় বড় অনেক চর জেগেছে । এসব চরে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসল ফলানো হচ্ছে। এতে প্রতি বছর দেশের আবাদি জমি বিভিন্ন কারণে যে এক শতাংশ হারে হ্রাস পাচ্ছে তার গতি কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব হচ্ছে বলে আমরা মনে করি। কুড়িগ্রামের চরে মসুর-মুগডাল-আমন ধান শস্যবিন্যাসের মাধ্যমে চাষাবাদ করে সুফল পাওয়া যাচ্ছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশে প্রায় এক মিলিয়ন হেক্টর চর জমি আছে। যেহেতু চর এলাকার মাটির গুণাগুণ, পরিবেশ ও প্রতিবেশ অন্যান্য অঞ্চল থেকে ভিন্ন তাই চরের কৃষি ব্যবস্থাপনাও ভিন্ন। এজন্য এখানকার কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে যুগোপযোগী করে তোলা একান্ত প্রয়োজন।
 
চাষি ভাইয়েরা, আমাদের দেশে এমন অনেক খাদ্য-ফসল আছে যেগুলো সম্পর্কে আমরা অনেকেই ওয়াকিবহাল নই। এসব ফসলের মধ্যে ঢেমশি এমনই একটি দানাজাতীয় ফসল যা খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। দেশের উত্তরাঞ্চলে এক সময় ঢেমশি যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। এ ফসলটির চাষাবাদ আবার ফিরে আসছে। এ বিষয়টিকে অনেকেই আশার আলো হিসেবেই দেখছেন। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন অপ্রচলিত ফসল যেমন-ঢেমশি, কাসাবা, জোয়ার, বাজরা, সরগম প্রভৃতি নিয়মিত খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় তাহলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে অনেকটাই সহায়ক হবে।
 
প্রিয় পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী বন্ধুরা, আপনারা হয়তো জেনে খুশি হবেন যে, আগামী বৈশাখে কৃষিকথা ৭৫ বছরে পদার্পণ করবে। এ উপলক্ষে বৈশাখ সংখ্যাটিকে বিশেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সংখ্যাটিতে খ্যাতনামা কৃষিবিদ, কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষি গবেষক, সম্প্রসারণবিদ প্রমুখের তথ্য ও প্রযুক্তিভিত্তিক লেখা ছাপা হবে। আমরা আশা করি কৃষিকথার ৭৫ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে আয়োজিত কর্মকাণ্ডে সবাই শরিক হবেন এবং দেশ ও জাতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখবেন।
 
 
বিস্তারিত