Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

নারিকেল পরিচিতি ও চাষ পদ্ধতি

নারিকেল বাংলাদেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল। এটা এমন এক বৃক্ষ যার প্রতিটি অঙ্গ জনজীবনে কোনো না কোনোভাবে কাজে আসে। এ গাছের পাতা, ফুল, ফল, কাণ্ড, শিকড় সব কিছুই বিভিন্ন ছোট-বড় শিল্পের কাঁচা মাল, হরেকরকম মুখরোচক নানা পদের সুস্বাদু খাবার তৈরির উপকরণ, পুষ্টিতে সমৃদ্ধ, সুস্বাদু পানীয়, রোগীর পথ্য এসব গুণে গুণাম্বিত এটি পৃথিবীর অপূর্ব গাছ, তথা ‘স্বর্গীয় গাছ’ হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত ও সুপরিচিত।


উৎপত্তিস্থান ও বিস্তার : নারিকেলের আদিস্থান প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ। এসব স্থান থেকেই পরবর্তীতে শ্রীলংকা, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, চীন, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া গিনি, ওশেনিয়া, আফ্রিকা, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, ঘানাসহ পৃথিবীর প্রায় ৯৩টা দেশে এর বিস্তার ঘটে। তবে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনস এবং ভারত নারিকেল উৎপাদনে অতি অগ্রগামী।     


পুষ্টিমান ও গুণাগুণ : ডাব ও নারিকেলের সব অংশই আহার উপযোগী, শাঁস (Copra/Carnel) অতি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। এতে প্রচুর পরিমাণ চর্বি, আমিষ, শর্করা, ক্যালসিয়াম, ভিটামিনস ও খনিজ লবণে ভরপুর। এতগুলো খাদ্য উপাদান একত্রে কোনো ফলে প্রাপ্তি একটা বিরল দৃষ্টান্ত। কিছু অসুখে ডাবের পানি রোগীদের অন্যতম পথ্য। এর মধ্যে ডায়রিয়া, কলেরা, জন্ডিস, পাতলা দাস্ত, পানিশূন্যতা পূরণে ডাবের পানির অবদান অন্যন্য। ঘন ঘন বমি ও পাতলা পায়খানার কারণে শরীর দুর্বল হয়ে পড়লে এ সময় স্যালাইনের বিকল্প হিসেবে ডাক্তার/কবিরাজরা ডাবের পানি পান অব্যাহত রাখতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অনেক ভিনদেশি, যারা এ দেশের মিনারেল পানি পানে সন্ধিহান হয়, সেখানে অবাধে তারা ডাবের পানি পেলে পরম তৃপ্তিতে তা পান করে।


নারিকেল এ দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল। এটি এমন একটি বৃক্ষ যার মূল, কাণ্ড, ফুল, ফল, পাতা সব অংশই জনজীবনে নানা কাজে ব্যবহার হয়। যা অন্য কোনো গাছ থেকে এ ধরনের সুবিধা পাওয়া যায় না। নারিকেল কেশতেল, ভোজ্যতেল, কোকো মিল্ক, শাঁস (Copra/Carnel) দিয়ে তৈরি মোরব্বা, পাঁপড়ি, মোয়া, নানাভাবে তৈরি পিঠা, পায়েশ, হালুয়া, কোকো মিল্ক দিয়ে নানা পদের সুস্বাদু খাবার সবাইকে আকৃষ্ট করে।


জাত : পূর্বে নারিকেল চাষ সম্প্রসারণে মাতৃগাছ নির্বাচন করে সেগুলো থেকে উন্নত জাতগুলোর (Open pollinated) বিস্তার ঘটানো হতো। পরবর্তীতে নারিকেল চাষে অগ্রগামী দেশগুলো (শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, পাপুয়ানিউগিনি)সঙ্করায়ণ/ক্রসিংয়ের (Hybridization) মাধ্যমে উন্নত জাত সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করে। এগুলো মূলত খাটো জাত (D X D), আংশিক খাটো (DXT) এবং লম্বা (Tall) এসব উদ্ভাবিত জাত বিভিন্ন চাহিদা বিবেচনায় এনে (ডাবের পানির জন্য, নারিকেলের ভেতরের আহার্য্য অংশের (Carnel/copra) প্রয়োজনে, নারিকেলভিত্তিক বিভিন্ন শিল্পকারখানার চাহিদা পূরণ ও এলাকার সৌন্দর্য আহরণের দিকগুলো বিবেচনায় এনে, নানা ধরন/আকারের, রঙ বেরঙের খাটো ও আংশিক খাটো জাতের নারিকেল উদ্ভাবন কাজ অব্যাহত রয়েছে এবং তা দ্রুত সর্বত্র বিস্তার ঘটছে।


বারী উদ্ভাবিত নারিকেল : বারী নারিকেল-১ এবং বারী নারিকেল-২ নামে তারা দুটা নারিকেলের জাত অবমুক্ত করেছে। জাত দুটাই ওপি (Open pollinated) লম্বা জাত (D×T) । এ জাত দুটো উপকূলীয় এলাকার ভেতরের অংশে সম্প্রসারণ যোগ্য।


গোত্র ও গাছের বিবরণ : নারিকেল, পাম (Palmae) পরিবারভুক্ত। তাল, খেজুর, সুপারি, পামঅয়েল, এগুলো সবই এ গোত্রীয়। এর রোপণ, পরিচর্যা, খাদ্যাভ্যাসে প্রচুর মিল। নারিকেলের বৈজ্ঞানিক নাম Cocos nucifera  এ পরিবারভুক্ত গাছের ডাল, শাখা, প্রশাখা নেই। কেবল কাণ্ডকে আকড়ে ধরে তা থেকে সরাসরি বের হওয়া লম্বা পাতাগুলোই জীবনধারণের জন্য এ গাছের একমাত্র অবলম্বন। একটা সুস্থ নারিকেল গাছের পাতা লম্বায় জাতভেদে ২.৫-৩.৫ মিটার হতে পারে। সুস্থ, সবল একটা গাছের পাতার সংখ্যা ৩০-৪০টা।


পাতাগুলো যত উপরমুখী হবে এবং সংখ্যায় তা যত বেশি হবে, গাছ সাধারণত তত বেশি ফুল-ফল দানে সক্ষম হবে। ভালো যত্ন ও সঠিক ব্যবস্থাপনায় কাণ্ড থেকে প্রতি মাসে একটা করে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পাতা বের হয় এবং সে পাতার গোড়ালি থেকে বয়স্ক গাছে ফুল-ফলের কাঁদি বের হয়। গাছের কচি পাতা বের হয় আকাশমুখী হয়ে, একবারে খাঁড়াভাবে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাতাগুলো নিচের দিকে হেলে পড়তে থাকে। পাতা গজানো থেকে আরম্ভ করে পরে তা একেবারে নিচে হেলে পড়ে গাছের কাণ্ডকে স্পর্শ করে। এ পথ পাড়ি দিতে একটা পাতার সময় লাগে প্রায় ৩ বছর। ঘন, সবুজ গজানো পাতাটা শেষ বয়সে হলুদ রঙ ধারণ করে, পরে তা শুকিয়ে যাওয়ার পূর্ব ঘোষণা দেয়।


এ পাতা হলুদ হয়ে শুকানোর আগ পর্যন্ত কোনো মতেই কেটে ফেলা যাবে না। এ গাছ ঠিক কলা গাছের মতো ‘রুয়ে কলা না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত’ খনার বচনটা এ গাছের জন্য একেবারে প্রযোজ্য। যেহেতু একটা সুস্থ গাছে প্রতি মাসে একটা করে পাতা বের হয় এবং তা প্রায় তিন বছরের মতো বাঁচে সে হিসাব করলে একটা ফলন্ত, সুস্থ, সবল গাছে ৩৫-৪০টা পাতা থাকার কথা। গাছে এ সংখ্যা ২৫টার নিচে থাকলে ধরে নিতে হবে গাছটা খাবার ও যত্নের অভাবে বড় কষ্টে আছে। পাতার সংখ্যা ২০টার নিচে নেমে গেলে গাছে ফুল ফল ধরা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে চলে যাবে।


জলবায়ু ও মাটি : ট্রপিক্যাল ও সাব ট্রপিক্যাল অংশে অবস্থিত দেশগুলোতে মূলত নারিকেল ভালো জন্মে। এ গাছের জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া অতি উপযোগী। নারিকেলের জন্য বার্ষিক গড় ২৭০ সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশি উপযোগী। তবে দিবা-রাত্রির তাপমাত্রার পার্থক্য ৬-৭০ সেলসিয়াস হলে নারিকেল গাছের জন্য ভালো হয়। বছরে কি পরিমাণ বৃষ্টিপাত হলো তা বড় কথা নয়, সারা বছর ধরে কিছু না কিছু বৃষ্টির পানি নারিকেল গাছ পেল তা-ই আসল কথা। বছরে ১০০-৩০০ সেমি. বৃষ্টিপাত নারিকেলের জন্য যথেষ্ট। বিশেষ করে উপকূলীয় উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়া নারিকেল চাষে অতি উপযোগী। অর্থাৎ সফলভাবে নারিকেল চাষ সম্প্রসারণের জন্য যেসব অনুকূল জলবায়ু দরকার তা সবই দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল কোস্টাল বেল্টে বিরাজ করছে। প্রাকৃতিক এ অবদানকে কাজে লাগিয়ে এ অঞ্চলে নারিকেল চাষ ব্যাপক সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া আমাদের সবারই কর্তব্য।


মাটি : নারিকেল যে কোনো ধরনের মাটিতে ফলানো যায়। শিলা, কাঁকরময়, লাভা, পিট, বালুময় স্থানেও বিশেষ ব্যবস্থায় নারিকেল চাষ উপযোগী করতে তেমন অসুবিধা নেই। যেহেতু, বয়স্ক নারিকেল গাছের শিকড় ৪ মিটার চওড়া এবং এক মিটার গভীরতায় সীমাবদ্ধ থাকে, সেহেতু তেমন প্রয়োজন পড়লে অনাকাক্ষিত এ পরিমাণ অংশের মাটি ও তাতে অন্যান্য বিদ্যমান পদার্থ অপসারণ (১.২মি.×১.২মি. ×১.২মি.) করে তাতে নারিকেল চারা লাগানো উত্তম হবে। এ গর্তের নিম্ন অংশে দু’টি স্তর/সারি নারিকেল ছোবড়া দিয়ে (সমান অংশ নিচে ও ছোবড়ার অসমতল অংশ উপরে রেখে) ভালোভাবে সাজিয়ে তার উপরিভাগে এক ভাগ বেলে দোঁ-আশ মাটি, (Top lose soil) এক ভাগ পচা গোবরের গুঁড়া, এক ভাগ ছাই এবং এক ভাগ কোকো ডাস্ট (নারিকেলের ছোবড়া থেকে প্রাপ্ত গুঁড়া) মিশ্রণ দিয়ে ৬০ সেমি. পর্যন্ত গর্তের তলার অংশ ভালোভাবে ভরাট করতে হবে।  


এ অংশে ৭০-৮০ গ্রাম ফুরাডান/বাসুডিন-১০জি বা অন্য কোনো উঁইপোকা নিধন করা কীটনাশক মিশানো ভালো হবে। এছাড়া মাটি এসিডিক (অম্ল) হলে ৫০০ গ্রাম ডলোচুন এবং তলার মাটি বেশি শক্ত হলে ৫০০ গ্রাম লবণ মিশাতে হবে।


স্বাভাবিক মাটির ক্ষেত্রে গর্তের সাইজ ১ মি.× ১ মি.×১ মি. হবে। তলার অংশ ৬০ সেমি. এর পরিবর্তে তা হবে ৫০ সেমি. এবং একইভাবে এ অংশ ভরাট করতে হবে। এরপর গর্তের অবশিষ্ট অংশ দো-আঁশ/বেলে দোঁ-আশ মাটিসহ সার দিয়ে ভরাট করে তথায় চারা লাগালে গাছ ভালোভাবে বাড়বে এবং তা থেকে আগাম ফুল-ফল ধরবে।


বংশবিস্তার : বীজ থেকে চারা উৎপাদন করে সব ধরনের পাম বৃক্ষের বংশবিস্তার করা হয়। তবে টিস্যু কালচার করেও একেক দফায় নারিকেলের কোটি কোটি চারা উৎপাদন করা সম্ভব। এভাবে চারা উৎপাদন করে বড় করে লাগানোর উপযোগী করতে ৩-৪ বছর সময় নিবে। এ প্রক্রিয়ায় চারা তৈরি কেবল গবেষণা কাজে ব্যবহার হয়। তাই পরিপক্ব বীজ নারিকেল থেকে চারা (Sexual propagation) উৎপাদন করা একমাত্র সহজ ও প্রচলিত জনপ্রিয় উপায়।


চারা উৎপাদন পদ্ধতি : নারিকেল চারা তৈরির জন্য যেখান সেখান থেকে বীজ নারিকেল সংগ্রহ করা উচিত হবে না। অজানা উৎস থেকে সংগৃহীত নারিকেল বীজ থেকে উৎপাদিত চারায় গাছ থেকে যে ডাব/নারিকেলের ফলন হবে তা নিম্ন মানের। যে গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা হবে তার মাতৃ গুণাগুণ (Genetical potenciality) জেনেই উন্নত মানের ও জাতের গাছ থেকে সুস্থ, ভালো মানের বীজ নারিকেল সংগ্রহ করে তা চারা উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা যাবে। যেহেতু নারিকেল চারা উৎপাদন কাজটি অতি সহজ, তাই নিজে ভালো জাতের বীজ লাগিয়ে চাহিদা মতো চারা তৈরি করে নেয়া ভালো। এলাকার পাড়া-পড়শীর কারও না কারও নারিকেল গাছে প্রচুর ফল দেয়, এমন সুলক্ষণা কিছুসংখ্যক মাতৃগাছ নির্বাচন করে তা থেকে পাকা বীজ নারিকেল কিনে, বেঁলেমাটিতে রেখে মাঝে মাঝে পানি দিলে কিছু দিনের মধ্যই চারা গজাবে। এ গজানো চারাগুলো ৮-৯ মাস পরেই লাগানোর উপযোগী হবে।  


জমি নির্বাচন ও চারা রোপণ
পানি জমে থাকে বা জমি স্যাঁতসেঁতে ভাব থাকে এমন স্থানে নারিকেল চারা রোপণ করা ঠিক হবে না। তবে এ ধরনের নিচু জমিতে (৬ মি.
×৭ মি.) দূরত্বে চারা লাগানোর জন্য ‘লে আউট প্লান’ করে নিতে হবে। এরপর দুই সারির মাঝে ৩ মিটার চওড়া এবং ৩০-৬০ সে. মিটার গভীর নালা কেটে নালার মাটি দুই ধারে উঠিয়ে উঁচু করে ৩ মিটার চওড়া উঁচু আইলে চারা রোপণের জন্য উপযোগী হবে। দুই সারির মাঝখানে অগভীর নালায় পানিতে জন্মে (কচুরলতি, পানিকচু, চিবিয়ে খাওয়া আখ) এমন ফসল আবাদ করা যাবে। এধরনের অগভীর জলভূমিতে বিদেশে (বিশেষ করে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া) এভাবে তৈরি উঁচু চওড়া আইলে বিভিন্ন ধরনের ফল চাষ এবং মধ্যভাগের নালায় মাছ চাষ ও জলজ ফসল আবাদ পদ্ধতি অতি জনপ্রিয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে বিশেষ করে বরিশাল এলাকায় এ পদ্ধতিতে চাষ প্রচলন আছে যা সর্জন পদ্ধতি নামে সুপরিচিত। বর্ষার পানি জমে না থাকলে উঁচু বা মাঝারি উঁচু, বন্যামুক্ত জমিতে নারিকেল লাগানোর জন্য অন্যান্য ফল বাগানের মতো আগেই একটা ‘লে আউট প্লান’ করে নিয়ে চারা রোপণের পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে হবে।


মাদা তৈরি : প্রকৃত খাটো জাতের জন্য (৬ মি.×৬ মি.) দূরত্ব, আংশিক খাটো জাতের (৬ মি. ×৭ মি.), এবং লম্বা বা আমাদের দেশি উন্নত জাতের ক্ষেত্রে (৭ মি.×৭ মি.) দূরত্বে নারিকেল চারা লাগানো ভালো। চারা রোপণের ২-৩ সপ্তাহ আগে ‘লে আউট প্লান’ অনুসরণ করে নির্ধারিত স্থানে গর্ত তৈরি করে নিয়ে তাতে সার প্রয়োগ করে নেয়া উত্তম হবে।


চারা রোপণ  
নির্বাচিত চারা বীজতলা থেকে খোন্তা বা শাবল দিয়ে সাবধানে যত্ন সহকারে উঠিয়ে নিতে হবে। কোনো মতেই চারা গাছ ধরে টেনে উঠানো যাবে না। চারা উঠানোর পর যতদূর সম্ভব এক সপ্তাহের মধ্যেই তা রোপণ কাজ শেষ করতে হবে। নারিকেল চারা গর্তে বসানোর পূর্বে খেয়াল রাখতে হবে যেন সরেজমিন থেকে চারাটা ২০-২৫ সেমি. নিচে বসানো হয় এবং নারিকেলের অংশটা মাটিতে সম্পূর্ণ না পুঁতে নারিকেলের উপরের অংশ কিছুটা (৩-৫ সেমি.) দেখা যায়। এ অবস্থায় সরেজমিন থেকে নিচে লাগানোর ফলে বর্ষাকালে বাইরের পানি এসে গাছের গোড়ায় বাইরের পানি এসে যেন জমতে না পারে এজন্য গাছের গোড়া থেকে ৪০-৫০ সেমি. দূরে বৃত্তাকারে ভালোভাবে সরেজমিন থেকে ১০-১৫ সেমি. উঁচু করে বাঁধ দিতে হবে। সচরাচর দেখা যায় ফলন্ত নারিকেল গাছের গোড়ার অংশ অস্বাভাবিকভাবে মোটা হয় এবং সেখান থেকে প্রচুর শিকড় ভেসে থাকে যা দৃষ্টিকটু।     


সমতল ভূমি থেকে ২০-২৫ সেমি. নিচে চারা লাগানো হলে এভাবে গোড়ার অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে গাছকে রক্ষা করা যাবে। তবে পুকুরপাড়, বাঁধের ধার ও ঢালুতে নারিকেল চারা লাগানোর প্রয়োজনে সমতল থেকে ২০ সেমি. স্তরের পরিবর্তে তা বাড়িয়ে ৩০ সেমি. নিচে চারা লাগাতে হবে।


সার প্রয়োগ : অন্যান্য গাছের তুলনায় নারিকেল গাছে সার ও পানি সেচ, নিষ্কাশন ব্যবস্থা ঠিকমতো হলে গাছের বাড়-বাড়ন্ত খুব বেশি বৃদ্ধি পায়। অন্য খাদ্যের তুলনায় এ গাছে পটাশ জাতীয় খাবারের চাহিদা তুলনামূলক বেশি (Potash loving plant) সাধারণত সুপারিশকৃত সার বছরে দু’বার (বর্ষার আগে ও পরে) সার প্রয়োগ প্রচলন আছে।

ক্রঃ নং

আইটেম

১ম বছর

২য় বছর

৩য় বছর

৪থ বছর ও ঊর্ধে

পচা গোবর/আবজনা পচা সার (কেজি)

৪০

২৫

২৫

৩০

ছাই (কেজি)

১০

১০

১০

১০

মুরগি লিটার পচা (কেজি)

১৬

১৬

১৬

১৬

হাড়ের গুঁড়া/শুটকি মাছের গুঁড়া (কেজি)

ইউরিয়া (গ্রাম)

৬০০

১২০০

১৪০০

১৬০০

টিএসপি (গ্রাম)

৩০০

৪০০

৬০০

৮০০

এমওপি (গ্রাম)

৪০০

৬০০

১০০০

১৫০০

ম্যাগনেশিয়াম সালফেট (গ্রাম)

১০০

১৫০

১৫০

১৫০

বোরন গ্রাম

৫০

১০০

১০০

১০০


চারা রোপণের ৩ মাস পর লাগানো চারার গোড়া থেকে ২০ সেমি. দূরে ২০ সেমি. চওড়া ও ১০ সেমি. গভীর করে যেসব সার প্রয়োগ করতে হবে তা হলো পচা গোবর বা আবর্জনা পচাসার  ১০ কেজি, ইউরিয়া ১২৫ গ্রাম,

টিএসপি : ১০০ গ্রাম এবং এমওপি সার ২৫০ গ্রাম। এ সারগুলো ৩ মাসের ব্যবধানে আরও দুইবার প্রয়োগ করতে হবে। তবে পরের প্রতিবার গাছের গোড়া থেকে কিছু দূরে (৫-৭) সেমি. গাছের গোড়ার চারদিকে নালা তৈরি করে একইভাবে প্রয়োগ ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিবার সার প্রয়োগ শেষে ২ বালতি পানি দিয়ে গোড়া ভালোভাবে ভেজাতে হবে। খাটো গাছের নারিকেল সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ, পানি সেচ, পানি নিকাশ ও পরিচর্যা গ্রহণ করলে চারা রোপণের ৩-৪ বছর থেকেই ফুল-ফল ধরা আরম্ভ করবে। চতুর্থ বছরে জন্য যে সার সুপারিশ করা গেল তা পরবর্তী বছরগুলোতে প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে। চারা রোপণের পর থেকে চার বছর পর্যন্ত বছর বছর যে পরিমাণ সার ব্যবহার করতে হবে তা নিম্নরূপ :
ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ও বোরন ৬ মাসের ব্যবধানে বছরে দুইবার প্রয়োগ যোগ্য।


পরিচর্যা : নারিকেল বাগান বিশেষ করে গাছের গোড়ার চারধার সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। প্রথম ২ বছর গাছের গোড়া থেকে ৬০-৭০ সেমি. দুর পর্যন্ত বৃত্তাকারে চারদিকের অংশে কচুরিপানা শুকিয়ে ছোট করে কেটে ৮-১০ সেমি. পুরু করে মালচিং দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে গাছের গোড়া ঠাণ্ডা থাকবে, আগাছা জন্মাবে না, মাটির রস সংরক্ষিত থাকবে এবং পরবর্তীতে এগুলো পচে জৈবসার হিসাবে কাজ করবে। তবে এভাবে মালচিং দেয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন তা একেবারে গাছের কা-কে স্পর্শ না করে, গাছের গোড়ার অংশ কমপক্ষে ৮-১০ সেমি. ফাঁকা রাখতে হবে। বিকল্প হিসাবে চীনাবাদামের খোসা, ধানের তুষ, আখের ছোবড়া, কাঠের গুঁড়া, নারিকেলের ছোবড়া, গাছের শুকনা পাতা, সমুদ্রের শ্যাওলা, বিভিন্ন খড়-কুটা, লতাপাতা মালচিং হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। মালচিং অবস্থায় অনেক সময় উঁই পোকাসহ অন্যান্য পোকা মালচিং ব্যবস্থাকে আবাসন হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এ জন্য সেভিন, ইমিটাপ, রিজেন্ট, ডারসবান ইত্যাদি দলীয় যে কোনো কীটনাশক দিয়ে ১০-১৫ দিন পর পর স্প্রে করা হলে পোকার আবাসন ধ্বংস হবে। গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকা অথবা মাটিতে রস কমে গেলে উভয় ক্ষেত্রেই নারিকেল গাছ অত্যন্ত কষ্ট পায়। এ জন্য বর্ষাকালে গাছ যেন কোনো মতেই জলাবদ্ধতার (Water lodging) কারণে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, এজন্য ঠিকমতো নালা কেটে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া খরা মৌসুমে নারিকেল বাগানের মাটিতে যেন পরিমিত রস থাকে এ জন্য ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে নিয়মিত সেচ দিতে হবে।


পোকামাকড় ও রোগবালাই : নারিকেল গাছে যে সব পোকামাকড়ের উপদ্রব সচরাচর দেখা যায় এগুলোর মধ্যে গণ্ডার পোকা, রেড পাম উইভিল, পাতা কাটা পোকা, কালো মাথা শুয়ো পোকা, লাল মাকড় (Red mite) ও উঁইপোকা অন্যতম। এছাড়াও এলাকা বিশেষে রয়েছে ইঁদুর ও কাঠ বিড়ালির আনাগোনা। এরা নারিকেলের কচি ফুল-ফল খায় কম, নষ্ট করে ৫-৭ গুণ বেশি। গণ্ডার পোকা ও উইভিল দমনে অর্গানো ফসফরাস দলীয় যে কোনো কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ৪-৫ গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করলে তা দমন করা যাবে এবং প্রতি লিটার পানিতে ১-১.৫ গ্রাম ওমাইট/ভার্টিমেক্স নামক মাকড়নাশক ব্যবহার করে রেড মাইট দমন করা যাবে।  
 

রোগবালাই : নারিকেলে রোগের মধ্যে কুঁড়ি পচা, ফল পচা, ফলঝরা, পাতায় দাগ পড়া, ছোটপাতা, কাণ্ডে রস ঝরা ও শিকড় পচা রোগ অন্যতম। কুঁড়ি পচা, ফল পচা ও ফল ঝরা রোগ দমনে প্রতি লিটার পানিতে ম্যানকোজেব দলীয় ছত্রাকনাশক দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ২-৩ বার স্প্রে করলে এসব রোগ দমন হবে।


নারিকেল গাছে ফল ঝরা সমস্যা ও সম্ভাব্য সমাধান : অনেক সময় ছোট অবস্থায় নারিকেল ফল ঝরে পড়ে। কখনও নারিকেলের ভেতরে শাঁস কম হয়, আবার কখনও ডাবে তেমন পানি থাকে না। এ ধরনের সমস্যা ও উহার সম্ভাব্য সমাধানের প্রধান দিকগুলো নিম্নরুপ


গাছ লাগানোর ৫-৭ বছর পর থেকেই গাছে ফুল-ফল ধরা আরম্ভ করে। প্রথম ২-৩ বছর গাছে ফুল-ফল ধরা ক্ষমতা অপূর্ণ থাকে। ফলে এ সময় ফুল-ফল বেশি ঝরে পড়া তেমন কোনো অস্বাভাবিকতা নয়।


নারিকেল গাছের কাছাকাছি অন্য কোনো ফলন্ত নারিকেল গাছ থাকলে প্রয়োজনীয় পরাগ রেণু প্রাপ্তি সম্ভাবনা বেশি থাকে। এজন্য আশপাশে ফলন্ত নারিকেল গাছ থাকা ভালো। অনেক সময় কচি ফলের প্রাথমিক অবস্থায় ভ্রুণ নষ্ট (Abortion)) হওয়ার কারণেও নারিকেল গাছে ফল ধরা ব্যাহত হয়।


শুকনা মৌসুমে অনেক দিন পর হঠাৎ বৃষ্টি হলে এবং এ বর্ষণ ৫-৭ দিন ধরে চলতে থাকলে ফুলে ফল ধরার জন্য পরাগায়ন সমস্যা হয়। এ সমস্যা দুইভাবে হতে পারে


প্রথমত : পুরুষ ফুলের পরাগ রেণু ধুয়ে পড়ে যাওয়া এবং স্ত্রী ফুলের আগায় পরাগ রেণু পড়ে তা পরাগায়ন সুবিধার জন্য যে মধু বা নেকটার থাকে তা ধুয়ে গেলে পরাগায়ন ক্ষমতা হারায়।


দ্বিতীয়ত : দীর্ঘ সময় অনাবৃষ্টি ও শুকনা হাওয়ার পর হঠাৎ বৃষ্টিপাতের ফলে তাপমাত্রার অনেক ব্যবধান (দীর্ঘ কাল গরমের পর হঠাৎ ঠাণ্ডা পড়া) সৃষ্টি হয়, যা ফুল থেকে ফল ধরতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। বেশি সময় ধরে শুকনা ঝড়ো বাতাসের প্রভাবেও নারিকেল গাছের পরাগ রেণু ঝরে পড়ে, মৌমাছির তৎপরতা এ ধরনের প্রতিকূল আবহাওয়ায় প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। যা পরাগায়নে প্রতিকূল প্রভাব পড়ে।


অনেক সময় দেখা যায় নারিকেল গাছের লাগানো জাতটা নিম্ন মানের, স্ত্রী-পুরুষ উভয় ফুল-ফল ধরার ক্ষমতা কম থাকে, যা জাতগত (Genetical)  কারণে হয়ে থাকে।
ফুল-ফল ধরাকালে নারিকেল গাছে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণের প্রভাব গাছে ফুল-ফল ঝরার অন্যতম কারণ। এজন্য নারিকেল গাছ যেন সব সময় রোগবালাইমুক্ত থাকে সে ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে হবে।


সর্বোপরি গাছে প্রয়োজনীয় খাবারের অভাব দেখা দিলে, বিশেষ করে পটাশ, বোরন ও ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি ও অন্যান্য অনু খাদ্যের ঘাটতি দেখা দিলে বয়স্ক গাছে ফল ধরার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়ে। এত গুণে গুণান্বিত এ উপকারী বৃক্ষ সম্প্রসারণে সবাই এগিয়ে আসবেন এবং আগে রোপিত গাছকে পরিচর্যা ও নিয়মিত খাবার পরিবেশন করে সুফল ভোগ করুন এটাই কাম্য।

 

এম এনামুল হক*
* মহাপরিচালক (অব.), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মোবাইল : ০১৯১৭০৫৫২০৫

বিস্তারিত
নিম বহুমুখী উপকারী একুশ শতকের ভেষজ বৃক্ষ

নিমের ইংরেজি নাম Neem, বৈজ্ঞানিক বা উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম  Azadirachta indica A.Juss., পরিবার Meliaceae। নিমকে নিম্ব, ভেপা, তামার আরও আরও অনেক নামে ডাকা হয়। নিম আমাদের এক বিশেষ উপকারী বন্ধু বৃক্ষ। নিমের জনপ্রিয়তা সে অনাদিকাল থেকে চলে আসছে। নিমের পাতা থেকে বাকল, শিকড় থেকে ফুল, ফল থেকে বীজ সবগুলোই আবশ্যকীয়ভাবে কাজে লাগে। নিমের গুণ অতুলনীয়। নিম অনেক দ্রুতবর্ধনশীল গাছ। নিম বহুবর্ষজীবী মাঝারি ধরনের চিরহরিৎ বৃক্ষ। পরিপক্ব বয়সে ১৫ থেকে ২০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। তবে শুকনো জায়গায় পত্রঝরা বৃক্ষের মতো আচরণ করে। গাছ সাধারণত গোড়ার ব্যাসার্ধ  ৬০-৮০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। গাছ বা মোটা ডালের বাকলের রঙ গাঢ় ও অমসৃণ হলেও অপেক্ষাকৃত কচি ডালের রঙ খয়েরি। গাছের বাকল অপেক্ষকৃত মোটা। ডালের চারদিকে ওপর নিচে করে ৩০ থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার লম্বা যৌগিকপত্র জন্মে। প্রতিটি পাতায় ১০ থেকে ১৭টি করে কিনারা খাঁজকাটা পত্রক থাকে। প্রতিটি পত্রক ৬ থেকে ৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। পাতায় জোড় এবং বিজোড় সংখ্যক পত্রক উভয়ই থাকতে পারে। সারা বছর পাতা গজায়। তবে বসন্তে পাতা ঝরাকালে বেশির ভাগ পাতা ঝরে যায়। ৪৫০ থেকে ১১৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত নিমগাছের জন্য উত্তম। তবে যেখানে বৃষ্টি কম সেখানেও নিম খুব ভালোভাবে বৃদ্ধি পায় যার প্রমাণ সৌদি আরবের পবিত্র নগরীর আরাফাতের ময়দান। নিম খরা সহনশীল। নিম ফল পাখির প্রিয় খাদ্য। বর্ষায় নিম ফল পাকলে শালিকসহ আরও অনেক পাখি এসে নিম গাছে ভিড় জমায়। নিম হিন্দুদের পবিত্র বৃক্ষ। দেবতার মূর্তি তৈরির কাজে নিম গাছের ব্যবহার বহুল প্রচলিত।


নিমের বহুবিধ গুণের কথা আমরা কমবেশি সবাই জানি। নিম একটি অভূতপূর্ব ঔষধি গাছ। প্রাণী ও উদ্ভিদকূলের জন্য এত উপকারী গাছ অদ্যাবধি আবিষ্কত হয়নি। এজন্য বলা হয় নিম পৃথিবীর সবচেয়ে দামি বৃক্ষ। নিমের এ গুণাগুণের কথা বিবেচনা করেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিমকে ‘একুশ শতকের বৃক্ষ’ বলে ঘোষণা করেছে। খ্রিস্টের জন্মের ৫ হাজার বছর পূর্ব থেকেই ভারত উপমহাদেশে নিমের অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। নিমের গুণাগুণ সম্পর্কে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের ধারণা থাকলেও নিম নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু হয়েছে হাল আমলে। ভারত উপমহাদেশে নিম নিয়ে গবেষণা শুরু হয় ১৯৪২ সালে। পশ্চিমা বিশ্বে গবেষণা  শুরু হয়েছে আরও অনেক পরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিম নিয়ে গবেষণা শুরু হয় ১৯৭২ সালে। বর্তমান সময়ে মানুষের মধ্যে নিম নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। নিমের ব্যবহার, এর চাষাবাদ নিয়ে মানুষের  আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে।


নিম বাংলাদেশের সর্বত্র দেখা গেলেও উত্তরাঞ্চলে বেশি পাওয়া যায়। বলা হয় এর আদি নিবাস বাংলাদেশ, ভারত আর মিয়ানমারে। এ গাছটি বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান সৌদি আরবে জন্মে। বর্তমানে এ উপমহাদেশেসহ উষ্ণ ও আর্দ্র অঞ্চলীয় সবদেশেই নিমগাছের বিভিন্ন প্রজাতি ছড়িয়ে আছে। সৌদি আরবের আরাফাত ময়দানে বাংলাদেশের নিম গাছের হাজার লাখো সংখ্যা আমাদের গর্বিত করে। কেননা এত দূরে বাংলাদেশের নিম সারি সারিভাবে দাঁড়িয়ে জানান দেয় বাংলার ঐতিহ্যের মূর্ত প্রতীক হয়ে। বলা হয় কেউ যদি নিমতলে বিশ্রাম নেয় কিংবা শুয়ে ঘুমায় তাহলে তার বিমার কমে যায় সুস্থ থাকে মনেপ্রাণে শরীরে অধিকতর স্বস্তি আসে। এজন্য ঘরের আশপাশে দু-চারটি নিমের গাছ লাগিয়ে টিকিয়ে রাখতে হয়।


নিম বা ইন্ডিয়ান লাইলাক (Indian Lilec) প্রাপ্ত বয়স্ক হতে প্রায় ১০ বছর সময় লাগে। এটি হচ্ছে সাধারণ নিম। এছাড়া আরও ২ প্রকার নিম আছে যা হচ্ছে মহানিম বা ঘোড়ানিম যার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Melia sempervirens এটি সাধারণ নিমের মতো বহু গুণে গুণান্বিত নয়। অপরটি হলো মিঠো নিম, এটি তেমন তেতো নয়, এর উদ্ভিদতান্তিবত নাম হচ্ছে Azadirachta Siamensis এটি আমাদের দেশের পাহাড়ি অঞ্চল মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে পাওয়া যায় এবং সবজি হিসেবেও এর বহুল ব্যবহার প্রচলিত।

নিম গাছ কেন লাগাব? কেননা- নিম একটি পবিত্র বৃক্ষ ও আমাদের দেশীয় গাছ; পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত মনীষীদের জীবনের  সাথে নিম জড়িত; নিম পরিবেশ রক্ষা, দারিদ্র্যবিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যাপক অবদান রাখে; নিম থেকে উৎপাদিত হয় প্রাকৃতিক প্রসাধনী, ওষুধ, জৈবসার ও কীটবিতাড়ক উপাদান; নিম স্বাস্থ্য রক্ষাকারী, রূপচর্চা, কৃষিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়; নিমকাঠ ঘূণে ধরে না, নিমের আসবাবপত্র ব্যবহারে ত্বকের ক্যান্সার হয় না; নিম পানি স্তর ধরে রাখে শীতল ছায়া দেয় ও ভাইরাসরোধী; উপকারিতা বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য  সংস্থা নিমকে ঘোষণা করেছে ‘একুশ শতকের বৃক্ষ’ হিসেবে; নিম শিল্প বিপ্লবের ফলে উদ্ভূত দূষণ নিয়ন্ত্রণ করে; নিম ঝড়-ঝাঞ্ঝা ও ঝড় থেকে আমাদের রক্ষা করে এবং নদীভাঙন ঠেকায়; নিমের সব অংশই  ব্যবহারযোগ্য ও উপকারী; নিম মাটির লবণাক্ততা রোধ করে এবং অম্ল ও ক্ষারের সমতা ফেরায়; নিম গাছ বাতাস শীতল রাখে এবং অন্যান্য গাছের  তুলনায় নিম গাছের নিচে তাপমাত্রা ১-২ ডিগ্রি কম থাকে; নিমপাতা গুঁড়া ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে উপকারী; নিমগাছ দ্রুতবর্ধনশীল এবং কাঠ খুব দামি; নিম যে কোনো মাটিতে জন্মে ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠে; নিম পরিবেশেবান্ধব ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অদ্বিতীয় ১০ বছর বয়সের দুটি নিম গাছের পাতা ও বীজ বিক্রি করে ৫ জনের পরিবারের সারা বছরের ভরণপোষণ সম্ভব; নিম ফুলের মধু অন্যান্য ফুলের মধুর তুলনায় অধিক পুষ্টিকর ও ঔষধিগুণ সম্পন্ন; নিম মাটির ক্ষয় ও মরুময়তা রোধ করে; কৃষি বনায়ন বা কৃষি জমির আইলে নিম গাছ লাগালে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হয়; নিম থেকে তৈরি ওষুধ, প্রসাধনী, জৈবসার ও কীট বিতাড়ক হিসেবে সারা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত; নিমের পাতা, ছাল-বাকল, বীজ ও কাঠসহ সব অংশই রফতানিযোগ্য; নিমগাছ গরু ছাগলে খায় না এবং বাঁচে ৪০০ বছরের অধিক; নিমের জৈবকীট বিতাড়ক ও সার, উপকারী কোনো কীট পতঙ্গ বা ব্যাকটেরিয়ার ক্ষতি করে না; নিমের তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বালানো যায়; নিম পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান বৃক্ষ।


রাসায়নিক উপাদান : নিমের ছাল, ফুল, ফল, বীজে ও তেলে বিভিন্ন ধরনের তিক্ত উপাদান যেমন: স্যাপোনিন, এলকালয়েড নিমবিডিন, নিম্বন, নিম্বিনিন, নিম্বডল, ট্রাইটারপেনয়েড, সালনিন, এজাডিরাকটিন, জৈব এসিড, মেলিয়ানোন, নিম্বোলাইড, কুয়ারসেটিন ও গ্লাইকোসাইড, ট্যানিন, মারগোসিন, এজমডারিন এসব থাকে। যা হরেক রকমের কাজে লাগে।


বীজ সংগ্রহ ও চারা উত্তোলন এবং বপন রোপণ : সাধারণত আামদের দেশে বর্ষার শুরুতে জুন থেকে আগস্টের মধ্যে বীজ সংগ্রহ করা হয়। তবে এর আগে বা পরেও বীজ সংগ্রহ করা যায়। নিমের বীজ খুব বেশি বড়ও না আবার ছোটও না। প্রতি কেজি বীজে মোট বীজের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫০০ থেকে ১৮০০টি। গাছ থেকে অথবা গাছের নিচ থেকে সরাসরি বীজ সংগ্রহ করতে হয়। এপ্রিল-মে মাসে পরিপক্ব নিম গাছে অসংখ্য ছোট ছোট সুগন্ধি সাদা ফুল দেখা যায়। জুন-জুলাই মাসে হলুদ রঙের ডিম্বাকৃতি পরিপক্ব ফল পাওয়া যায়, ফল ১২ থেকে ১৮ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। প্রতিটি ফলেই একটি করে বীজ থাকে। ফলের ত্বক ছড়িয়ে ছায়ায় শুকিয়ে ৩ সপ্তাহের মধ্যে পাত্রের মাটিতে বপন করতে হয়। ৩০ জুন থেকে বীজ বপন শুরু করা যায়। বীজ বপনের ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে চারা গজায়। বীজ অংকুরোদগমের হার শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ। নার্সারি বেডে, পলিথিনে বা সরাসরি জমিতে বীজ লাগানো যায়। ঠাণ্ডা আর কুসুম গরম পানিতে বীজ ভিজিয়ে অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বাড়ানো যায়। ১ বছরের চারা লাগানো ভালো। চারা লাগানোর আগে কাণ্ড মূল প্রয়োজনমতো ছাঁটাই করে লাগালে ভালো ফল পাওয়া যায়। সেপ্টেম্বরের দিকে চারা লাগানো ভালো। ৪৫ সেন্টিমিটার চওড়া ও প্রশস্ত গর্তে ২৫-৩০ কেজি জৈবসার, ৫০ গ্রাম টিএসপি ৫০ গ্রাম এমওপি মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে চারা রোপণ করতে হয়। চারা লাগানোর পর অবশ্যই নিয়মিত ও পরিমিত পানি দিতে হবে চারা টিকানোর জন্য। গোড়ার মাটি উঁচু করে খাঁচা দিয়ে বেড়া ঘেরা দিতে হবে মানুষের সমান লম্বা না হওয়া পর্যন্ত বিশেষ যত্ন করতে হবে। আগাছা যেন না জন্মে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।


সাধারণত নিমগাছ খোলামেলা জায়গায় বেশি দেখা যায়। রাস্তার আশপাশে, সমতল ভূমিতে ও নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় সব ধরনের মাটিতে নিমগাছ জন্মে। তবে বেলে, দো-আঁশ মাটিতে ভালো হয়। নিমগাছে মার্চ থেকে মে মাসে ফুল ফোটে। নিম ফল জুন থেকে আগস্ট মাসে পাকলে তখন বীজ সংগ্রহ করতে হয়। বীজ সংগ্রহ করার ২/৩ সপ্তাহের মধ্যে ব্যাগে বা মাটির পাত্রে বীজ বপন করতে হয়। বপন দেরি হলে গজানোর হার কমে যায়। নিম চারার বয়স ১ বছর হলে মূল জমিতে রোপণ করতে হয়। যে জমিতে লাগানো হবে তা আগাছাবিহীন ও পরিচ্ছন্ন হতে হবে। তবে বর্ষাকালে নিমের চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। গাছের গোড়ায় যাতে পনি না জমে সেজন্য গোড়া উঁচু করে দিতে হবে। আর পশু মানুষের আক্রমণে যেন চারা নষ্ট না হয় সেজন্য রোপণের পরপরই বেড়া ঘেরা দিতে হবে। নিমের স্কেল পোকা আর ছত্রাক মারাত্মক ক্ষতি করে। সমস্যা হলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হবে।


সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি : পাতা সংগ্রহ করে পরিষ্কার করে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। তারপর পাতার আর্দ্রতা কমে কিছুটা গাঢ় বর্ণ ধারণ করলে প্যাকেটজাত করতে হয়। পাতার প্যাকেট অবশ্যই সঠিক শনাক্তকরণ ব্যবহারবিধিসহ বাজারজাত করতে হবে। জুন আগস্টের দিকে নিম ফল পরিপক্ব হয়। বীজ পরিপক্ব হলে সংগ্রহ করতে হবে। তবে মাটিতে না পড়ার জন্য ঘন জাল দিয়ে গাছকে বেঁধে দিলে সবগুলো বীজই সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। এ অবস্থায় বীজকে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে আর্দ্রতা শতকরা ২ ভাগ থাকতে হবে। বীজ শুকানোর পর বায়ুরোধী করে প্যাকেট করে সংগ্রহ করতে হবে। নিমের ছাল কেটে টুকরো টুকরো করে নিতে হবে। এরপর ভালো করে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে আর্দ্রতা শূন্য করে বায়ুরোধী করে সংরক্ষণ করতে হবে।


ঔষধি গুণাগুণ : উপমহাদেশের সুপরিচিত নাম নিম বসন্ত ও বায়ু শোধনকারী হিসেবে দুনিয়া সেরা। পূর্ব আফ্রিকায় এ গাছ মৌরোবিইনি নামে পরিচিত। কেননা এ গাছ দিয়ে অনেক রোগের উপশম হয়। রক্ত পরিষ্কারক, জীবাণুনাশক, চর্মরোগ, ব্রন, কৃমি ও ক্ষত আরও কত ব্যাধি থেকে পরিত্রাণ দেয়। শরীরে জ্বলাপোড়া, এলার্জি ও মুখের দুর্গন্ধনাশক। দাঁতের রক্তপড়া বন্ধ করে এবং দাঁতের মাঢ়ি সবল করে। তাছাড়া জন্ডিস প্রশমক। নিম দিয়ে অন্তত ৫০টি রোগ সারানো যায় বলে শতাব্দীর ইতিহাস সাক্ষী দেয়। কিছু উল্লেখযোগ্য রোগের কথা এমন-


- রক্ত পরিষ্কার ও চর্মরোগ :  কাঁচা  নিম পাতা ১০ গ্রাম ২ কাপ পানিতে জ্বাল করে ১ (এক) কাপ অবশিষ্ট থাকতে ছেঁকে নিয়ে প্রয়োজন মতো চিনি মিশিয়ে খেলে রক্ত পরিষ্কার হয় এবং চর্ম রোগ কমে যায়। এ নিয়মে প্রতিদিন ২ থেকে ৩ বার, নিয়মিত ১ থেকে ২ মাস সেবন করে যেতে হবে;
- কৃমি নিরসনে ৩ থেকে ৮ গ্রাম নিম ছাল চূর্ণ সামান্য পরিমাণ সৈন্ধব লবণসহ সকালে খালিপেটে সেবন করে গেলে কৃমির উপদ্রব হতে রক্ষা পাওয়া যায়। নিয়মিত ১ সপ্তাহ সেবন করে যেতে হবে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ১ থেকে ২ গ্রাম মাত্রায় সেবন করাতে হবে;


- খোস পাঁচড়া ও পুরনো ক্ষতে নিমপাতার সাথে সামান্য কাঁচা হলুদ পিষে নিয়ে আক্রান্ত স্থানে প্রলেপ আকারে ৭ থেকে ১০ দিন ব্যবহার করলে খোস পাঁচড়া ও পুরনো ক্ষতের উপশম হয়;


- নিমের প্রধান ব্যবহার চর্মরোগে চুলকানি বা খোস-পাঁচড়া হলে নিমের পাতা বা বাকল বেঁটে পরপর ৩/৪ দিন গায়ে মেখে ২ ঘণ্টা পর গোসল করে ফেললে সেরে যায়। বাকল পানিতে  সেদ্ধ করে সে পানি দিয়ে গোসল করলেও একই উপকার পাওয়া যায়। এসব ক্ষেত্রে গাছের বাকলের চেয়ে শেকড়ের বাকল বেশি উপকারী। এছাড়া নিমপাতা বেঁটে ছোট ছোট বড়ি করে রোদে শুকিয়ে প্রতিদিন সকালে একটি করে খেলে খোস পাঁচড়া সেরে যায়। নিমপাতা কড়াইতে ভেজে চূর্ণ করে ভাতের সাথে খেলেও একই উপকার পাওয়া যায়;


- বসন্ত রোগে রোগীকে নিমপাতার বিছানায় শোয়ালে জীবাণুনাশক হিসেবে ইনফেকশন হওয়া থেকে রক্ষা করে। নিমের এ জীবাণু ধ্বংসকারী গুণের জন্য ফোঁড়া কাটা পোড়ার ক্ষত দাগ, একজিমা, স্ক্যাবিস, খুসকিসহ বিভিন্ন জটিল চর্মরোগে নিমপাতা বাটা ও ছালের প্রলেপ দিলে অল্প সময়ে সেরে যায়;


- শ্বাসকষ্ট এবং দুর্বলতায় নিম ফুল উপকারী। এছাড়া বাতজ্বরে নিমতেল ব্যবহার সারা পৃথিবীতেই স্বীকৃত। নিম বীজের গুঁড়াও নিমতেলের মতো কার্যকরী, তবে বীজের গুঁড়া পানি ও অন্য তেলের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করতে হয়;


- বর্ষাকালে আলমারিতে রাখা কাপড় চোপড় বাজে গন্ধ হয়। এছাড়া এসব কাপড় চোপড় অনেক সময় পোকায় কেটে নষ্ট করে। এ সমস্যা থেকে রেহাই পেতে আলমারির এক কোণে কিছু শুকনো নিমপাতা ঝুলিয়ে রাখলে উপকার পাওয়া যায়;


- ফসলে পোকামাকড় দমনে নিম এখন বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। শুকনো নিমপাতা ধান চালের গোলায় বা ডাল, গমের পাত্রে রাখলে এসব খাদ্যশস্য পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। নিমপাতা বেটে ১:১০ অনুপাতে পানিতে মিশিয়ে পোকা আক্রান্ত ক্ষেতে প্রয়োগ করলে উপকার পাওয়া যায়; বীজ সংরক্ষণে নিমপাতা অব্যর্থ মহৌষধ;


- মুখে অরুচি হলে সুজির হালুয়ার সাথে অল্প নিমপাতা গুঁড়া মিশিয়ে কয়েক দিন খেলে মুখে রুচি ফিরে আসে;


- চাপা অম্লরোগে সকালে খালি পেটে ৪ থেকে ৫ গ্রাম নিমপাতা চূর্ণ কয়েক দিন খেলে উপকার পাওয়া যায়;


- কাঁচা হলুদ ও নিমপাতা বাটা চর্মরোগে খুব উপকার দেয়। নিমাপাতা হলুদ গুঁড়া আর গন্ধকচূর্ণ সরিষা তেলের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করলে খোস পাঁচড়া কমে যায়। সকালে ২ চামচ নিমপাতার রস ৭ দিন খেলেও খোস পাচড়া সেরে যায়।


- নিমপাতা চূর্ণ ১ ভাগ, কাঁচা হলুদ শুকিয়ে চূর্ণ করে ২ ভাগ এবং শুকনো আমলকী চূর্ণ ৩ ভাগ একসঙ্গে মিশিয়ে তার ১ গ্রাম প্রতিদিন সকালে খেলে এলার্জি সেরে যায়;
- ঘুষঘুষে জ্বর হলে ২৫০ মিলিগ্রাম নিমপাতা চূর্ণ এক বা দেড় রতি মকরধ্বজসহ মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খেলে কমে যায়;


- পিত বিকারে যদি দাঁতের মাঢ়িতে ঘায়ের সৃষ্টি হয় তাহলে নিমের বিচির তেল লাগালে কমে যায়;


- নিমপাতা বেঁটে ফোঁড়ায় প্রলেপ দিলে তা পেকে যায়, পরে শুকিয়ে যায়;


- রাতকানা রোগে নিমের ফুল ভাজা খেলে আস্তে আস্তে সেরে যাবে;


- যকৃৎ বা লিভারের ব্যথায় নিমছাল ১ গ্রামের সাথে কাঁচা হলুদ আধা গ্রাম এবং আমলকীর গুঁড়া ১ গ্রাম একসাথে মিশিয়ে খালিপেটে প্রতিদিন সকালে খেলে যকৃৎ ও লিভারের ব্যথা সেরে যাবে অনায়াসে;


- কামলা বা জন্ডিসে বাচ্চাদের জন্য ৫ থেকে ১৫ ফোঁটা বয়স্কদের জন্য ১ চা চামচ রস একটু মধু মিশিয়ে খালিপেটে খেতে হবে প্রতিদিন সকালে। এভাবে ২ সপ্তাহ খেলে জণ্ডিস সেরে যাবে;


- অজীর্ণ রোগে মুখে পানি এলে, ৪ থেকে ৫ গ্রাম নিমের ছাল ১ কাপ গরম জলে রাতে ভিজিয়ে রেখে সকালে ছেঁকে খালিপেটে খাওয়াতে হবে।


- ডায়াবেটিস রোগে ৫টি গোলমরিচ+১০টি নিমপাতা একত্রে সকালে খালি পেটে খেতে হবে। তবে খাবার দাবার ও চলাফেরা অবশ্যই শৃঙ্খলার মধ্যে রাখতে হবে;


- বেশি পরিমাণে প্রশ্রাব ও সাথে চুলকালে ৩/৪টি নিমপাতা+কাঁচা হলুদ এক টুকরো একত্রে বেঁটে সকালে খালি পেটে খেতে হবে।


নিমের শুকনো ছাল আর পাতা পুড়ে ধোঁয়া দিলে মশা দূর হয়;
- মাথার উকুন কমাতে নিম ফুল বেটে মাথায় ২/১ বার মাখলে উকুন মরে যায়;


- মাথা ধরায় নিমতেল মাথায় মাখলে মাথা ধরা কমে যায়; নিমের ডাল মেছওয়াক হিসেবে ব্যবহার করা হয় এতে দন্তরোগ মুখের দুগন্ধ ও ঘা মাঢ়ির অসুখ কমে;


- বলা হয়ে থাকে নিমতেল, বাকল ও পাতার নির্যাস ব্যবহারে ক্যান্সার, টিউমার, স্কিন ক্যান্সারে নিয়মিত ও পরিমিত সেবন করলে ভালো হয়;


- নিয়মিত নিমপাতার নির্যাস খেলে হৃদরোগে উপকার পাওয়া যায়। নিম নির্যাস ব্লাডপ্রেসার ও কোলস্টেরল কমায়। রক্ত পাতলা করে, হার্টবিট কমায়;


- বর্তমানে ব্যঞ্জরিত কসমেটিক সামগ্রী তৈরিতে নিমের অধিকতর ব্যবহার নতুন দিগন্তের দখিনা দুয়ার খুলে দিচ্ছে।


নিমের বাজার : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ঘোষিত একুশ শতকের বৃক্ষ এবং বর্তমান বিশ্বেও সবচেয়ে গুণধর আলোচিত ভেষজ নিম থেকে তৈরি হয় বিভিন্ন নিম সামগ্রী।

বাজারে নিমের যেসব পণ্য পাওয়া যায়-নিম চা, নিম ক্যাপসুল, নিম ডায়বেটিকস ক্যাপসুল, নিম চুল রক্ষাকারী ও খুশকিনাশক, নিম জৈবসার, নিম জৈববালাইনাশক, নিম পিওর অয়েল, নিম হারবাল বিউটি প্যাক, নিম হারবাল ফেসওয়াশ, নিম হারবাল কেশতেল, নিম শ্যাম্পু, নিম হারবাল টুথ পাউডার, নিমটুথ পেস্ট, নিম বেবি সোপ, নিম হারবাল হানি সোপ, বিউটি সোপ, স্কিন কেয়ার সোপসহ আরও অনেক নিম সামগ্রী।

এক একরের বয়স্ক পরিপক্ব নিম গাছ থেকে বছরে ৬/৭ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করা যায়।
 

কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*

* উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫

বিস্তারিত
বিনাচীনাবাদাম-৪ চাষাবাদ পদ্ধতি

চীনাবাদাম বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেলবীজ ফসল। তবে বাংলাদেশে চীনাবাদাম বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর খাদ্য তালিকায় উদ্ভিদ উৎস থেকে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য উপাদান। বর্তমানে বাংলাদেশে যা চীনাবাদাম উৎপাদিত হয় তা চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ মাত্র। এ চাহিদাকে সামনে রেখে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীগণের উন্নত জাত উদ্ভাবনের চেষ্টার অংশ হিসেবে চীনাবাদামের একটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছেনÑ যা ‘বিনাচীনাবাদাম-৪’ নামে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক বাণিজ্যিকভাবে সারাবছর চাষাবাদের জন্য ছাড়পত্র পায়। এ জাতটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলোÑ জাতটি খরাসহিষ্ণু ফলে চর এলাকায় চাষাবাদের জন্য উপযোগী। কলার রট, সার্কোস্পোরা লিফ স্পট ও মরিচা রোগ সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন। বাদাম ও বীজ মাতৃজাত ঢাকা-১ এর চেয়ে বড়, ফলে বাজারে চাহিদা বেশি থাকার ফলে কৃষক সহজেই বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে। শীত মৌসুমে হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ২.৬০ টন এবং খরিফ মৌসুমে ২.৪৭ টন।


বপনের সময় : বছরের যে কোনো সময় এর চাষ করা যায়, তবে রবি মৌসুমে মধ্য অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত (০১ কার্তিক হতে ১৫ ফাল্গুন) এবং খরিফ মৌসুমে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (আষাঢ়-আশ্বিন) পর্যন্ত বীজ বপন করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।


চাষ উপযোগী জমি : বেলে, বেলে, দো-আঁশ ও এঁটেল দো-আঁশ মাটিতে এ জাতের অধিক ফলন পাওয়া যায়। শুষ্ক জমি ছোলা চাষের জন্য বেশ উপযোগী।


জমি তৈরি, বপন পদ্ধতি ও বীজের পরিমাণ : তিন-চারটি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হয়। শেষ চাষের সময় নির্ধারিত পরিমাণ সার দিয়ে চাষ ও মই দিতে হবে। বীজ সারিতে বপন করতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ১২ ইঞ্চি (৩০ সেমি.) এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৬ ইঞ্চি (১৫ সেমি.) রাখতে হবে। বীজগুলো ১.০-১.৫ ইঞ্চি মাটির নিচে পুঁতে দিতে হবে। হেক্টরপ্রতি ১২৫-১৩০ কেজি (একরপ্রতি ১৭ কেজি) বীজের প্রয়োজন হয়।


সার প্রয়োগ : জমির উর্বরতার ওপর নির্ভর করে সারের মাত্রার তারতম্য হতে পারে। তবে সাধারণভাবে হেক্টর প্রতি ৬০-৮০ কেজি ইউরিয়া (একরপ্রতি ৯-১০ কেজি), ১০০-১২০ কেজি টিএসপি, এমপি ও জিপসাম (একরপ্রতি ১৪-১৫ কেজি) এবং ৩-৪ কেজি (একরপ্রতি ৫০০ গ্রাম) দস্তা সার প্রয়োগ করতে হয়। তবে বেলেমাটির ক্ষেত্রে বোরন ও মলিবডেনাম ১-১.৫ কেজিপ্রতি হেক্টরে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। জমি উর্বর হলে ইউরিয়া অর্ধেক প্রয়োগ করতে হবে এবং দস্তা সার প্রয়োগের প্রয়োজন নেই। সব প্রকার সার শেষ চাষের পূর্বে জমিতে ছিটেয়ে প্রয়োগ করতে হবে। অন্যদিকে জীবাণুসার ব্যবহার করলে ইউরিয়া প্রয়োগের প্রয়োজন নেই (জীবাণুসার একরপ্রতি ৩০০ গ্রাম)।


জীবাণুসার ব্যবহারের নিয়মাবলি : ক. সুস্থ সতেজ ও শুকনা বীজে পরিমাণমতো চিটাগুড় মিশিয়ে নিন যাতে বীজগুলো আঠালো মনে হয় (চিটগুড়ের অভাবে ঠাণ্ডাভাতের মাড় বা পানি ব্যবহার করুন)। খ. আঠালো বীজগুলোর সংগে জীবাণুসার ভালোভাবে মিশিয়ে নিন যাতে প্রতিটি বীজে কালো প্রলেপ পড়ে যায়। গ. কালো প্রলেপযুক্ত বীজ ছায়ায় সামান্য শুকিয়ে নিন যাতে বীজগুলো গায়ে গায়ে লেগে না থাকে। ঘ. জীবাণুসার মিশ্রিত বীজ রৌদ্রহীন বা খুবই অল্প রৌদ্রে বপন করে বীজগুলো মাটি দিয়ে তাড়াতাড়ি ঢেকে দিতে হবে। ঙ. ঠাণ্ডা, শুষ্ক, রোদমুক্ত জায়গায় জীবাণুসার এবং জীবাণুসার মিশ্রিত বীজ রাখতে হবে। জীবাণুসার উৎপাদনের ১৮০ দিনের মধ্যেই ব্যবহার করা উত্তম।


আগাছা দমন : চারা গজানোর ২৫-৩০ দিন পর নিড়ানি দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে হালকাভাবে আগাছা উঠিয়া ফেলতে হবে। শিকড়ে যেন কোনো প্রকার আঘাত না লাগে সেদিকে লক্ষ রাখা দরকার।


পানি সেচ : চীনাবাদাম চাষে স্বাভাবিক অবস্থায় সেচ দেয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে পানির অত্যধিক অভাব হলে একবার হালকা সেচ দেয়া যেতে পারে।


পোকামাকড় দমন : জমিতে বাদাম লাগানোর পরপর পিপিলিকা আক্রমণ করে রোপিত বাদামের দানা খেয়ে ফেলতে পারে। এজন্য বাদাম লাগানো শেষ হলেই ক্ষেতের চারদিকে সেভিন ডাস্ট ৬০ ডব্লিউপি ছিটিয়ি দিতে হবে। এছাড়া ক্ষেতের চারদিকে লাইন টেনে কেরোসিন তেল দিয়েও পিপিলিকা দমন করা য়ায়। অনুরূপভাবে, উঁইপোকা চীনাবাদাম গাছের এবং বাদামের যথেষ্ট ক্ষতি করে থাকে। এরা বাদাম গাছের প্রধান শিকড় কেটে দেয় অথবা শিকড়ের ভেতর গর্ত তৈরি করে। ফলে গাছ মারা যায়। উঁইপোকা মাটির নিচের বাদামের খোসা ছিদ্র করে বীজ খায়। পানির সঙ্গে কেরোসিন মিশিয়ে সেচ দিলে উঁইপোকা জমি ত্যাগ করে। অথবা উইপোকা দমনের জন্য ডায়াজিনন-১০ জি/বাসুডিন-১০ জি/ডারসবান-১০ জি যথাক্রমে হেক্টরপ্রতি ১৫, ১৪ ও ৭.৫ কেজি হারে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। বিছাপোকার আক্রমণের প্রথম অবস্থায় পাতার নিচে দলবদ্ধ বিছাগুলোকে হাত দিয়ে সংগ্রহ করে কোনো কিছু দিয়ে পিষে মেরে ফেলতে হবে।


রোগ দমন : চীনাবাদাম-৪ জাতটি পাতার দাগ এবং মরিচা রোগ সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন। তবে ছত্রাকের আক্রমণ বেশি হলে ২ গ্রাম ব্যাভিস্টিন-৫০ ডব্লিউপি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে জমিতে বিকালে স্প্রে করতে হবে। বপনের পূর্বে ৩.০ গ্রাম ভিটাভেক্স-২০০/প্রোভ্যাক্স/বেভিস্টিন ৫০ ডব্লিউপি দ্বারা প্রতি কেজি বীজ শোধন করলে রোগের আত্রমণ কম হবে। মরিচা রোগ দেখা দিলে ফলিকুলার নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সঙ্গে ১ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে।


ফসল সংগ্রহ, মাড়াই ও সংরক্ষণ : ভালো বীজ বা গুণগতমানের বীজ পেতে হলে ফসল যথাসময়ে উঠাতে হবে। ফসল সঠিক সময় তোলার জন্য ফসলের পরিপক্বতা সম্পর্কে যথাযথ ধারণা থাকা আবশ্যক। চীনাবাদাম বীজ খুবই স্পর্শকাতর বা সংবেদনশীল। যখন গাছের শতকরা ৮০-৯০ ভাগ বাদাম পরিপক্ব হবে তখনই চীনাবাদাম তোলার উপযুক্ত সময়। পরিপক্ব হলে বাদামের খোসার শিরা-উপশিরাগুলো স্পষ্টভাবে দেখা যায় এবং গাছের পাতাগুলো হলুদ রঙ ধারণ করে নিচের পাতা ঝড়ে পড়তে থাকে। বাদামের খোসা ভাঙার পর খোসার ভেতরে সাদা কালচে রঙ ধারণ করলেই বুঝতে হবে ফসল উঠানোর উপযুক্ত সময় হয়েছে। পরিপক্ব হওয়ার আগে বাদাম উঠালে তা ফল ও তেল কম হবে। আবার দেরিতে উঠালে বীজের সুপ্ততা না থাকার দরুন জমিতেই অংকুরিত হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে।


ক্ষেত থেকে তোলার পর বাদামের গায়ে লেগে থাকা মাটি বা বালু পরিষ্কার করতে হবে। তারপর আঁটিগুলো উপুর করে অর্থাৎ বাদামগুলো উপরের দিকে রেখে গাছের মাথা শুকনো মাটিতে বসিয়ে রৌদ্রে শুকাতে হবে। এতে করে বাদামের গায়ে লেগে থাকা পানি ঝড়ে যাবে। পরে গাছ থেকে বাদাম ছাড়িয়ে উজ্জ্বল রোদে দৈনিক ৭-৮ ঘণ্টা করে ৫-৬ দিন শুকাতে হবে। এ অবস্থায় বীজের আর্দ্রতা ৮-১০% হয়ে থাকে। এভাবে শুকানোর পর খোসাসহ বাদাম ঠাণ্ডা করে পলিথিন আচ্ছাদিত চটের বস্তায় মাচার ওপর সংরক্ষণ করতে হবে।


পরামর্শ/সতর্কতা : ১. এলাকায় উপযোগী জাত বাছাই করা। ২. বপনের আগেই বীজের গজানোর হার পরীক্ষা করা। ৩. একই জমিতে বার বার চীনাবাদাম চাষ না করা। প্রয়োজনে এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তা বা কৃষিকর্মীর সঙ্গে যোগযোগ করা।

 

ড. এম. মনজুরুল আলম মণ্ডল*
* প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার, বিনা, ময়মনসিংহ, মোবাইল : ০১৭১৬৭৪৯৪২৯

 

বিস্তারিত
বাংলাদেশ থেকে আলু রপ্তানি

আলু এখন আমাদের দেশে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় একটি ফসল। স্বল্পমেয়াদি এ ফসলটির উৎপাদন আয় অন্যান্য ফসলের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। সাম্প্রতিক কয়েক বছরের আলু আবাদের অবস্থা তথা আলুর ফলন ও উৎপাদন এলাকা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে আনুপাতিক হারে উভয়টিই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী দেশে ৪০ লাখ টন আলুর চাহিদার বিপরীতে গড়ে প্রায় ৮০ লাখ টন আলু উৎপাদিত হচ্ছে। অবশ্যই এটা শুভ লক্ষণ কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে আমাদের দরিদ্র আলু চাষিরা এর সুফল তেমন একটা পাচ্ছে না, পাচ্ছে কোল্ডস্টোর মালিক, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। উৎপাদন মৌসুমে আলুর ন্যায্যমূল্য না পাওয়া কিংবা ন্যায্যমূল্যের আশায় বিকল্প হিসেবে কোল্ডস্টোরে সংরক্ষণ করতে না পেরে আলুর চাষিরা অনেক সময় তা পানির দরে বিক্রি করে দেয় ফলে অনিশ্চিত লাভের কারণে অনেক আলু চাষি সম্ভাবনাময় এ ফসলটির চাষের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। পত্রিকায় দেখা গেছে, হিমাগারের সামনে আলুবহনকারী ট্রাকের দীর্ঘলাইন এবং এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণীর হিমাগার মালিকদের অসাধু রমরমা ব্যবসা। বর্তমান সরকার একটি কৃষিবান্ধব সরকার তাই সরকারের উচিত আলু চাষিদের তথা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে উদ্বৃত্ত আলু বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তাছাড়া আলুর নানাবিদ ব্যবহার ও শিল্পের প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যেগী হতে হবে।


বাংলাদেশ থেকে আলু রপ্তানি : ১৯৯৮ সনে এটিডিপি (এ্যাগ্রোবেজ্ড টেকনোলজি ডেভেলপমেন্টের প্রোগ্রাম) একটি মার্কেটিং মিশন বাংলাদেশ থেকে সিংঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে ফ্রেশ আলু রপ্তানির সম্ভাব্যতা যাচাই করে এবং ১৯৯৯ সনে এটিডিপির উদ্যোগে প্রথম ১২৬ টন আলু উল্লিখিত দেশে রপ্তানি করা হয়। ২০০৫, ২০০৬ সনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আলু রপ্তানি করা হয়। ২০০৭ সনে রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার টনে। ২০১১ সনে বাংলাদেশ থেকে ৭টি প্রাইভেট কোম্পানির মাধ্যমে প্রায় ২০ হাজার টন আলু রপ্তানি করা হয়েছে (বাসস, ঢাকা)। সাম্প্রতিককালে থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়াও বাংলাদেশ থেকে আলু আমদানি শুরু করেছে। শুধুমাত্র মালয়েশিয়ায় আলুর চাহিদা রয়েছে ১০ লাখ টন, সিঙ্গাপুর ও শ্রীলংকায় প্রতিটিতে চাহিদা রয়েছে ৩ লাখ টন করে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (EPB) হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে ২০১৪-১৫ সনে ২৭২ কোটি টাকার আলু বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে যার মধ্যে শুধু মালয়েশিয়ায় রপ্তানি করা হয়েছে ১০৪ কোটি টাকার আলু এবং রাশিয়ায় ৭২ কোটি টাকার আলু। বিএডিসির অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ড. শেখ আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ পটোটো এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন’। যা বিদেশে আলু রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে।


আলু সংরক্ষণের অবস্থা : গত দুই বছরে আলুর উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৮৫ লাখ টনে পৌঁছে। উৎপাদিত এ আলুর সর্বোচ্চ ২২-২৫ লাখ টন ৩২৫টি হিমাগারে সংরক্ষণ করা যায়। প্রতি মাসে ৩.৫ লাখ টন আলুর ব্যবহার হিসাব করলে বছরে প্রায় ৪০ লাখ টন আলুর প্রয়োজন হয়। বাকি ৩০-৪০ লাখ টন চাষির ঘরেই থেকে যায়।


রপ্তানিযোগ্য আলুর বৈশিষ্ট্য : আমাদের দেশে উৎপাদিত সব জাতের এবং সব আকারের আলুই আমদানিকারক দেশের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং শ্রীলংকায় গ্রানুলা জাতের আলুর কদর বেশি। সাম্প্রতিককালে মালয়েশিয়ায় ডায়মন্ট ও কার্ডিনাল জাতের আলু রপ্তানি করা হয়েছে। ১০০ গ্রাম থেকে ১৫০ গ্রাম ওজন এবং ৪০-৬০ মি.মি আকারের উজ্জ্বল রঙ ও ভাসাভাসা চোখ (shallow eyed tuber) ও অধিক সুপ্তকাল (Longer dormancy) বিশিষ্ট মসৃণ ত্বকের আলু রপ্তানির জন্য বেশি উপযোগী। আলু রপ্তানির সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হচ্ছে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাস কারণ আমদানিকারকরা হিমাগারে সংরক্ষিত আলুর চেয়ে ফ্রেশ আলু বেশি পছন্দ করে। আলু সংগ্রহের পর হতে কিছু দিনের মধ্যে আলুর আকারের মধ্যে কিছু অস্বাভাবিক অবস্থা (deformations) দেখা যায়, বিশেষ করে হিমায়িত আলু নির্দিষ্ট তাপমাত্রার নিচে রাখলে রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে মিষ্টতা (Sweetness) বৃদ্ধি পায় ও অন্যান্য গুণগতমানের অবনতি ঘটে। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন সংগ্রহের সাথে সাথে (Harvest Period) আলু যাতে করে বিদেশে রপ্তানি করা যায় এ ব্যাপারে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।


রপ্তানিযোগ্য আলুর আবাদ : আগাম রপ্তানির জন্য এমনভাবে আলু রোপণ করা দরকার যাতে করে ফেব্রুয়ারির ১ম সপ্তাহ হতে আলু সংগ্রহ করা যায়। নভেম্বরের ১ম সপ্তাহ হতে শুরু করে শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত কয়েক ধাপে রোপণ করলে ফেব্রুয়ারির ১ম সপ্তাহ হতে সংগ্রহ শুরু করে মার্চের ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত আলু উঠানো যায়। এরূপ রোপণের ফলে দীর্ঘ সময় কাঁচা আলু সংরক্ষণ না করেও ফ্রেশ অবস্থায় রপ্তানি করা যায়।


আলু রপ্তানি বৃদ্ধিতে করণীয়
▪ আলু রপ্তানির জন্য নির্দিষ্ট চুক্তিবদ্ধ চাষি জোন (
Contract growing zone) গঠন করা।
▪ রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাত উপযোগী আলুর জাত ছাড়করণ ও কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয় করা।
▪ কাঁচা আলু রপ্তানির ক্ষেত্রে ইনসেনটিভ বোনাস বাড়িয়ে ১০-৩০% করা।
▪ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (
Expert Promotion Bureau), হরর্টেক্স ফাউন্ডেশন (Hortex Foundation) ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনকে (BADC) কাঁচা আলু রপ্তানির ক্ষেত্রে কারিগরি সহায়তা প্রদান।
▪ নতুন নতুন কোম্পানি যাতে আলু রপ্তানিতে উদ্যোগী হয় এজন্য সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করা।

 

ড. মো. শাফায়েত হোসেন*

* উপব্যবস্থাপক (বীপ্রস), বিএডিসি, ঢাকা

বিস্তারিত
মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের উপায়

বীজের পর মাটি হচ্ছে কৃষির অন্যতম ভিত্তি। উপযুক্ত মাটি না হলে অর্থাৎ ফসলের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সমৃদ্ধ মাটি না হলে কাক্সিক্ষত ফসল পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় আবাদি জমির পরিমাণ খুবই কম। তাই এ জনগোষ্ঠীর  খাদ্য চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের মাধ্যমে অধিক ফসল আবাদের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এজন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক তা হলো-


১. ভূমি ক্ষয় রোধ
মাটির উপরিভাগ সাধারণত ৭"-৮" ইঞ্চি গভীরতা পর্যন্ত ফসলের পুষ্টি উপাদান থাকে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, পানি প্রবাহ, বাতাসের গতিরোধ ইত্যাদি কারণে উপরিভাগের মাটি স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে সঞ্চিত পুষ্টি উপাদান বিনষ্ট হয়ে মাটির উর্বরতা হ্রাস পায়। তাই বৃষ্টি ও বন্যার পানি গড়ানের সময় যাতে জমির উপরিভাগের মাটি অপসারিত না হয় এবং নালা ও খাদের সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।


২. সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ
 ফসল পুষ্টির জন্য মাটি থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদান গ্রহণ করে বিধায় বিভিন্ন ফসল আবাদের ফলে মাটির উর্বরতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। বিভিন্ন ফসল মাটি থেকে বিভিন্ন পরিমাণে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে থাকে। তাই ঘাটতি পূরণের জন্য জমিতে জৈব ও রাসায়নিক সারের সমন্বয়ে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করা উচিত।

 

৩. জৈব পদার্থ ব্যবহার
 মাটির ভৌতিক ও রাসায়নিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য জৈব পদার্থের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি উদ্ভিদের খাদ্যোপাদান সরবরাহ, মাটির অম্ল ও ক্ষারত্বের তারতম্য রক্ষা এবং রাসায়নিক কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। তাই জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ গোবর সার, কম্পোস্ট, খামারজাত সার ইত্যাদি প্রয়োগ করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের প্রচেষ্টা নেয়া উচিত। সবুজ সার ও বিভিন্ন ফসলের অবশিষ্টাংশ মাটিতে মিশিয়ে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। আদর্শ মাটিতে কমপক্ষে ৫% জৈব পদার্থ থাকা উচিত। কিন্তু আমাদের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ খুবই কম। সুতরাং যত বেশি পারা যায় জমিতে জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে।

 

৪. উপযুক্ত শস্য বিন্যাস অনুসরণ
 জমিতে প্রতি বছর একই ফসল বা একই ধরনের ফসলের চাষ করলে একটি নির্দিষ্ট স্তরের নির্দিষ্ট পুষ্টি, উপাদান নিঃশোষিত হয়ে উর্বরতা বিনষ্ট হয়। তাই পর্যায়ক্রমে গুচ্ছমূল জাতীয় ফসলের পর প্রধান মূলজাতীয় ফসল, একবীজপত্রীর পর দ্বিবীজপত্রীর ফসল এবং অধিক খাদ্য গ্রহণকারীর পর অল্প খাদ্য গ্রহণকারী ফসল আবাদ করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ করা যেতে পারে। মাটি, প্রভৃতি এবং ভৌগোলিক অবস্থান ভেদে উপযুক্ত শস্য বিন্যাস অনুসরণ করতে হবে।


৫. ডালজাতীয় ফসলের চাষ
 বিভিন্ন ধরনের ফসল মাটি থেকে অধিক পরিমাণ নাইট্রোজেন গ্রহণ করে। ফলে মাটি দ্রুত এর অভাব দেখা দেয়। জমিতে মাঝে মধ্যে ডাল জাতীয় ফসলের চাষ করে এ ঘাটতি অনেকাংশে পূরণ করা যায়। কারণ এগুলো শিকড়ের শুঁটিতে রাইজোবিয়াম নামক ব্যাকটোরিয়া বসবাস করে এবং বায়ু থেকে নাইট্রোজেন আহরণপূর্বক গুটিতে সঞ্চয় করে ও পরিণামে মাটির উর্বরতা বাড়ায়।


৬. জমিকে বিশ্রাম দেয়া  
 দীর্ঘদিন ধরে কোনোরূপ বিশ্রাম ছাড়া নিবিড় চাষাবাদ করা হলে মাটির ভৌত রাসায়নিক ও জৈব গুণাবলির অবনতি ঘটে। তাই কয়েক বছর পর অন্তত এক মৌসুমের জন্য জমি পতিত রেখে বিশ্রাম দেয়া প্রয়োজন। অবশ্য এ সময়ে জমিতে সবুজ সারের চাষ বা নিয়মিত পশু চারণের ব্যবস্থা করলে ভূমির উর্বরতা আরও বৃদ্ধি পায়।

৭. মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব নিয়ন্ত্রণ
মাটির অম্লত্ব ও ক্ষরত্ব অতিরিক্ত বেড়ে গেলে উর্বরতা হ্রাস পায় এবং ওই অবস্থায় অনেক খাদ্যোপাদানে ফসলের গ্রহণ উপযোগী হয় না। তাই প্রয়োজনে জৈবসার প্রয়োগে অম্লত্ব ক্ষারত্ব কমাতে হবে।


৮. চাষাবাদ পদ্ধতির উন্নয়ন
 ত্রুটিপূর্ণ চাষাবাদ পদ্ধতি মাটির উর্বরতা বিনষ্ট করে। কিন্তু উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করে ভূমির উর্বরতা সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা সম্ভব। জমি সব সময় একই গভীরতায় কর্ষণ করলে ওই গভীরতার নিচে একটা শক্ত স্তরের সৃষ্টি হয় এবং ওই স্তরের নিচ থেকে খাদ্যোপাদান আহরণ করতে পারে না। তাই ভূমি কর্ষণের গভীরতা ও অন্যান্য আবাদ প্রক্রিয়া মাঝে মাঝে পরিবর্তন করা উর্বরতা সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য সহায়ক।


৯. সুষ্ঠু পানি সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা
সুষ্ঠু সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে মাঠের উর্বরতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই জমিতে পরিমিত সেচ দেয়া ও অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন।

 

১০. ক্ষতিকারক রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন
 মাটিতে অনেক সময় ক্ষতিকর রোগ ও কীটের জীবাণু বা ডিম থাকে এবং ফসল উৎপাদনকালে সেগুলো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। পর্যায়ক্রমে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে জমি চাষ করলে এবং মাটি রোদে শুকিয়ে নিলে সেগুলো বিনষ্ট হয়ে যায় এবং মাটির উন্নয়ন সাধিত হয়। প্রয়োজনে সঠিক সময়ে সঠিক কৌশলে উপযুক্ত বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে।


১১. আগাছা দমন
আগাছা মাটি থেকে খাবার গ্রহণপূর্বক ভূমির উর্বরতা খর্ব করে ও শস্য উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটায়। তাই জমিতে কখনও আগাছা জন্মিতে না দেয়া ও সর্বদা পরিষ্কার রাখা আবশ্যক।


১২. মৃত্তিকা জীবাণু সংরক্ষণ
মাটিতে অসংখ্য হিতকর জীবাণু থাকে এবং এরা ফসফরাস, লৌহ প্রভৃতি অদ্রবণীয় পদার্থসমূহকে পানিতে দ্রবণীয় পদার্থে রূপান্তর ও বায়ু থেকে মাটিতে নাইট্রোজেন সংযুক্ত করে ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। তাই মাটিকে এমনভাবে পরিচর্যা করা দরকার যেন মৃত্তিকা জীবাণুসমূহের বসবাসের পরিবেশ সমুন্নত থাকে।


১৩. পাক মাটি ও বোঁদ মাটি ব্যবহার
 সাধারণত বৃষ্টিপাত ও বন্যার পানির সাথে মাটির উপরিভাগের পুষ্টি উপাদান ও জৈব পদার্থ অপসারিত হয়ে পথিমধ্যে পুকুর, ডোবা, নালা প্রভৃতির তলদেশে জমা হয়। এভাবে জমাকৃত মাটিকে পাক মাটি বা বোঁদ মাটি বলে এবং এটা খুবই উর্বর হয়। শুষ্ক মৌসুমে ওই মাটি কেটে আবাদি জমিতে মিশিয়ে দিলে মাটির উৎকর্ষ সাধিত হয়। তাই ফসল আবাদের লক্ষ্যে উপরিউক্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণের মাধ্যমে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন।

 

অরুণ কুমার বিশ্বাস*

* অবসরপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা, ৫১, পশ্চিম টুটপাড়া মেইন রোড, খুলনা-৯১০০

বিস্তারিত
আমের ভালো ফলন নিশ্চিত করতে করণীয়

বাংলাদেশে আম হলো ফলের রাজা এবং গাছ হলো জাতীয় আমগাছ। আম সাধারণত উষ্ণ ও অবউষ্ণম-লীয় অঞ্চলের জন্মে। ইন্দো-বার্মা অঞ্চলে আমের উৎপত্তিস্থল বলে ধারণা করা হয় তবে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে আম সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল কারণ এ ফল বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার, পুষ্টিমান ও স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়। বাংলাদেশে প্রায় সব অঞ্চলে আম জন্মে কিন্তু দেশের উরাঞ্চলে এর বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক চাষ হয়ে থাকে। আম চাষিরা প্রতি বছর অনেক ক্ষতির শিকার হয়ে থাকেন সাধারণত দুই প্রকারের সমস্যার কারণে যথা- ১. প্রাকৃতিক কারণ (যেমন- ঝড়, শিলাবৃষ্টি, খরা প্রভৃতি) এবং (আ) রোগ ও পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয়ে। সঠিক পরিচর্যা ও রোগ-পোকামাকড় দমন করে প্রথম ক্ষতি আংশিক এবং দ্বিতীয় ক্ষতি প্রায় সম্পূর্ণ রূপে সমাধান করা সম্ভব। নিচে তা পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হলো-
ফলন্ত আম গাছের পরিচর্চা : আম গাছের ফলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ফলন বাড়ানোর জন্য নিম্নলিখিত পরিচর্চাগুলো করা একান্ত প্রয়োজন।

 

পরগাছা দমন : আমগাছে একাধিক জাতের আগাছা জন্মাতে দেখা যায়, যা গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যের প্রতি ক্ষতিকর। পরগাছাসমূহে শিকড়ের মতো এক প্রকার হস্টোরিয়া হয়, যা গাছের মধ্যে প্রবেশ করে রস শোষণ করে এবং দুর্বল করে। পরগাছার পাদুর্ভাব বেশি হলে গাছের পাতার আকার ছোট হয় ও ফ্যাকাসে হয় এবং অনেক সময় গাছ মারা যায়। এর ফলে গাছের ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। তাই ভালো ফলন পেতে হলে অবশ্যই পরগাছা অপসারণ করতে হবে।
 

সার প্রয়োগ : গাছের বৃদ্ধি ও ফল উৎপাদনের জন্য সারের ব্যবহার একান্ত প্রয়োজন। ফলন্ত গাছের আকার, বয়স ও মাটির উর্বরতার ওপর সারের পরিমাণ নির্ভর করে। দুপুর বেলা যতটুকু স্থানে ছায়া পড়ে সেটুকু স্থানে মাটি কুপিয়ে সার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে।


সেচ প্রয়োগ : সাধারণত জমির ওপর স্তরে প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান থাকে বা সার হিসেবে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয় তাই আম বাগানের ওপরের ২-৩ মিটার অংশকে জমির পানি সংরক্ষণ স্তর হিসেবে ধরা হয়। তাই শুষ্ক মৌসুমে আম বাগানে পানি সেচ দেয়া দরকার। আমের গুটি মটর দানারমতো হওয়ার পর থেকে ১৫-২০ দিন পর পর ২-৩ বার সেচ দিলে আমের গুটি ঝরা বন্ধ হয়।


বয়স্ক টক আমগাছকে মিষ্টি আমগাছে রূপান্তরকরণ : বাগানের কোনো গাছের আমের গুণাগুণ খারাপ হলে সে গাছকে নষ্ট না করে ভিনিয়ার কলমের মাধ্যমে উন্নতি সাধন করা য়ায়। বয়স্ক গাছের ২-৩টি ডাল কেটে দিলে সেখান থেকে নতুন শাখা বের হলে তার পর নতুন শাখাতে ভিনিয়ার কলম করে নিতে হবে। এভাবে ৩-৪ বারে কাজ সম্পন্ন করতে হবে।


পুরনো বাগান নবায়ন : আম বাগানের বয়স বেশি হলে ফল ধারণ কমে যায়, তাই এ ক্ষেত্রে গাছ কেটে না ফেলে পুরনো গাছের ভারি শাখা কেটে দিলে সেখানে নতুন শাখা বের হবে এবং গাছ নবায়ন হয়ে যাবে। এভাবে ২-৩ বছরে বাগান নবায়ন করা যায়।


ফসল সংগ্রহ : ফল ধরার ৩-৫ মাসের মধ্যেই জাতভেদে ফল পাকা শুরু করে। বাণিজ্যিকভাবে কখনো সম্পন্ন পাকা অবস্থায় আম গাছ থেকে পাড়া ঠিক নয়। গাছের ফল দুই চারটি পাকা শুরু করলে বাঁশের কোটার মাথায় থলে সদৃশ্য জালতি লাগিয়ে আম পাড়তে হবে যেন আঘাত না লাগে। গাছের নিচে সাময়িক ভাবে রাখতে হলে খড় বিছিয়ে তার ওপর রাখতে হবে। নিম্নোক্ত লক্ষণ দেখে ফল সংগ্রহ করতে হবে : ১. আমের বোঁটার নিচে হলুদ বর্ণ ধারণ করলে। ২. পানিতে দিলে ডুবে যাবে। ৩. কষ বের হলে দ্রুত শুকে যাবে। ৪. দুই একটি পাকা আম গাছ থেকে ঝরে পড়বে।


ফল সংরক্ষণ : আম পচনশীল ফল। বেশি পাকা অবস্থায় সংগ্রহ করলে সংরক্ষণকাল কম হয়। অধিকাংশ জাতের আম ১৩-১৭ ডিগ্রি সে. তাপমাএায় ও ৮৫-৯০% আপেক্ষিক আর্দ্রতায় বাঁশের ঝুড়ি, বাস্কেট, খড় বিছানো স্থানে ৪-৭ সপ্তাহ সংরক্ষণ করা যায়।
 

২. রোগ দমন
অ্যানথ্রাকনোজ

এ রোগ আমের পাতা ও ফলে হয়ে থাকে। এটি কোলিটোট্রিকাম গোলেসপোরিওডিস
(Colletotrichum gloeosporioides) নামক এক প্রকার ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে। এ রোগের কারণে আমের ফলন শূন্যের কাছাকাছি আসতে পারে।


লক্ষণগুলো : ১. এ রোগ নতুন পাতা, পুষ্পমঞ্জরি ও ফলে দেখা যায়। ২. পাতায় ধূসর-বাদামি ছোট কৌষিক দাগ পড়ে এবং পরে সব পাতায় ছড়িয়ে পড়ে ও এক পর্যায় পাতা ঝরে পড়ে। ৩. ফলের ওপর প্রথমে গাঢ় বাদামি দাগ পড়ে। ৪. দাগগুলো পরে বড় হয়ে কাল বর্ণ ধারণ করে। ৫. আক্রমণ মারাত্মক হলে পরবর্তীতে সম্পূর্ণ আম পচে যায়।


অনুকূল অবস্থা : ১. তাপমাএা ২৫-২৮ ডিগ্রি সে.। ২. আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৭০-৮০%। ৩. অধিক বৃষ্টিপাত। ৪. ঘন কুয়াশা ও আকাশ মেঘাচ্ছন এ রোগের প্রকোপ বাড়ায়।


দমন ব্যবস্থা : ১. ফল সংগ্রহের পর বাগানের অবশিষ্টাংশ ধ্বংস করতে হবে। ২. স্বাস্থ্যবান চারা রোপণ করতে হবে। ৩. বোর্দো মিক্সচার ০.৩% হারে ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে (ফুল ধরার পূর্বে ও পরে এবং ফল সংগ্রহের পূর্বে)। ৪. ব্যাভিসটিন ডবলিউ/পি ০.২ % হারে অথবা ডাইথেন-এম ০.৩ % হারে দুই বার (ফুল ধরার আগে ও পরে ) স্প্রে করতে হবে।

 

আমের বোঁটা ও ফল পচা
রোগের কারণ : এ রোগ বোট্রিওডিপ্লডিয়া থিয়োব্রোমি
(Botryodiplodia theobromae) নামক এক প্রকার ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে। এ রোগ আমের বোঁটা ও ফলে হয়ে থাকে।


রোগের লক্ষণগুলো : ১. প্রথমে বোঁটার চারদিকে কিছু জায়গা জুড়ে কাল দাগ পড়ে। ২. পরবর্তীতে আমের অধিকাংশ ও সর্বশেষ অংশ পচে কাল রঙ ধারণ। ৩. আক্রান্ত স্থানে চাপ দিলে ভেতর থেকে পচা কাল গন্ধযুক্ত আমের রস বের হয়ে আসে।


রোগ দমন : ক. যে কোনো একটি পদ্ধতিতে রোগ দমন করবেন : ১. ডাইথেন-এম-৪৫, ০.৩ % হারে ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। ২. রিডোমিল ০.১ % হারে ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। ৩. রোভরাল ০.১ % হারে ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। খ. আম হারভেস্ট করার পর ৪৩ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ৫ মিনিট ৬% বোরাক্স দ্রবণে চুবাতে হবে। গ. ফল সংগ্রহ করার পর ডালপালা, অবশিষ্টাংশ ধ্বংস করতে হবে।


আমের পাউডারি মিলডিউ
রোগের কারণ : এ রোগ ওডিয়াম মেংগিফেরা
(Oidium mangiferae) নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।


রোগের লক্ষণগুলো : ১. পুষ্পমঞ্জরি ও উহার সংলগ্ন কচিপাতা এবং ছোট ফলের ওপর সাদা-ধূসর পাউডার দেখা যায়। ২. সাধারণত সংক্রামণে পুষ্পমঞ্জরির অগ্রভাগ ক্ষত শুরু করে নিচের দিকে ধাবিত হয় এবং কুঁচকে যেয়ে ডাই-বেক লক্ষণ প্রকাশ পায়। ৩. ফল অপরিপক্ব অবস্থায় ঝরে পড়ে এবং বিকৃত ও বিবর্ণ হয়।


দমন ব্যবস্থা : ১. আমের বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। ২. ছত্রাকের গঠন ধ্বংস করতে মাঝে মাঝে গাছে পানি স্প্রে করতে হবে। ৩. থিয়োভিট ০.৩ % হারে ফুল ফোটার পূর্বে এক বার ও পরে দুই বার স্প্রে করতে হবে। ৪. ম্যালাথিয়ন ০.২ % হারে ফুল ফোটার পর একবার ও গুটি আসার পর ১৫ দিন পর পর দুই বার স্প্রে করতে হবে।
 

৩. পোকামাকড় দমন
আমের শোষক পোকা/ আমের হপার

এই পোকার তিনটি প্রজাতি ক্ষতি করে থাকে। নিম্নে ক্ষতির প্রকৃতি ও দমনব্যবস্থা দেয়া হলো।
ক্ষতির প্রকৃতি : আমের অনিষ্টকারী পোকার মধ্যে এ পোকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিসাধন করে থাকে। আমের পাতা ও বোঁটায় এরা ডিম পাড়ে। এজন্য আক্রান্ত পাতা ও ফুল শুকিয়ে যায় এবং গুটি আসার আগেই ফুল ঝরে য়ায়। এতে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। এ পোকার আক্রমণের অন্যতম লক্ষণ হলো, আক্রান্ত গাছের নিচে দিয়ে হাঁটলে পোকা লাফিয়ে গায়ে পড়ে।


দমন ব্যবস্থা : এ পোকা দমন করতে হলে মুকুল আসার আগে অথবা মুকুল আসার মুহূর্ত থেকে নিম্নলিখিত কীটনাশক স্প্রে করতে হবে : ডায়াজিনন ৬০ ইসি বা লেবাসিড ৫০ ইসি চা চামচের ৪ চামচ ৮.৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর দুই বার স্প্রে করতে হবে। অথবা ম্যালাথিয়ন বা এমএসটি ৫৭ ইসি উপরোক্ত মাত্রায় স্প্রে করতে হবে।


ফলের মাছি বা আমের মাছি পোকা
ক্ষতির প্রকৃতি : এ পোকার কীড়া পাকা আমের মধ্যে প্রবেশ করে শাঁস খেয়ে ফেলে। এতে ফল পচে যায় ও ঝরে পড়ে। আক্রান্ত আম কাটলে অসংখ্য পোকা দেখা য়ায়। পোকার আক্রমণ বেশি হলে গাছের সব আম খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায়।


দমন ব্যবস্থা : আম পাকার আগে যখন পূর্ণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ডিপটেরেক্স চা চামুচের ৪ চামচ ৮.৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর দুই বার স্প্রে করতে হবে। অথবা ডায়াজিনন ৫০ ইসি ২মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে ফলে স্প্রে করতে হবে (ওই সময়ে ফল খাওয়া যাবে না)।


আমের বিছা পোকা
ক্ষতির প্রকৃতি : এ পোকার কীড়া আমগাছের পাতা খেয়ে ফেলে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে গাছ পত্রশূন্য হয়ে যায় এবং ফুল-ফল হয় না বা হলেও ঝরে পড়ে। তবে কোনো গাছ একবার আক্রান্ত হলে বার বার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।


দমন ব্যবস্থা : আক্রান্ত গাছে ডাইমেক্রন ১০০ ইসি ৩০০ মিলি বা ডায়াজিনন ৫০ ইসি ৪০০ মিলি বা সুমিথিয়ন ৫০ ইসি ৪৫৪ মিলি ২২৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

 

কৃষিবিদ এম এ মজিদ*

* পিএইচডি গবেষক, রাবি। প্রভাষক, কৃষিশিক্ষা বিভাগ, নাটোর সিটি কলেজ, নাটোর। ০১৭২২৪০৩২২০

বিস্তারিত
গলদা চিংড়ির ব্রুড ও পোনা উৎপাদনে করণীয়

কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে গলদা চিংড়ি চাষ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক খাতে পরিণত হয়েছে। তাই রপ্তানি পণ্য হিসেবে এর গ্রহণযোগ্যতা প্রতিনিয়ত দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। লক্ষণীয় যে, দেশের রপ্তানিকৃত মোট চিংড়ির মধ্যে গলদার অবদান শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ।
মাটি ও পানির গুণাগুণ তথা অনুকূল জলবায়ুর কারণে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে শীর্ষস্থানীয় একটি গলদা চিংড়ি উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। উচ্চ বাজার মূল্য, দেশে-বিদেশে ব্যাপক চাহিদা, এছাড়া স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় এই পণ্যের চাষ দেশব্যাপী উত্তরোত্তর সম্প্রসারিত হচ্ছে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথ করেছে সুপ্রশস্ত।


সাম্প্রতিককালে কোনো কোনো অঞ্চলে ভাইরাসঘটিত সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে কিছু চিংড়ি চাষি বাগদার পরিবর্তে গলদা চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ে। প্রাকৃতিক উৎসের পোনা দ্বারা গলদার চাষ শুরু হলেও ক্রমবর্ধমান দ্রুতগতিতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এর চাষ সম্প্রসারিত হয়। চাষের এলাকা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে ক্রমান্বয়ে চাহিদাও বেড়ে যায় অবিশ্বাস্য স্বল্প সময়ে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গলদা চিংড়ির হ্যাচারি স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এরই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ১৯৮৬ সনে প্রথম গলদা চিংড়ি হ্যাচারি প্রতিষ্ঠিত হয়।


নির্বিচারে প্রাকৃতিক পোনা সংগ্রহের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে ২০০০ সনে সরকার প্রাকৃতিক উৎস হতে গলদা পোনা সংগ্রহের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলশ্রুতিতে দেশে গলদা চিংড়ি হ্যাচারি শিল্পের বিস্তার ত্বরান্বিত হয়। বর্তমানে দেশে মোট ৮০টি গলদা হ্যাচারি রয়েছে, যা সম্প্রতিপ্রাপ্ত এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়।
গুণাগত মানসম্পন্ন গলদা পোনা উৎপাদনের একমাত্র লক্ষ্য হলো উন্নত গুণাবলির ব্রুড উৎপাদন। গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে মূলত ব্রুড প্রতিপালন করা হয় না। হ্যাচারি ব্যবস্থাপকেরা মধ্যস্বত্ব ভোগীদের কাছ থেকে ডিমওয়ালা মা চিংড়ি সংগ্রহ করে পোনা উৎপাদন করে থাকেন। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, একটি গলদা চিংড়ি হ্যাচারি এক মৌসুমে গড়ে ৫২০টি  ডিমওয়ালা মা গলদা চিংড়ি ব্যবহার করে থাকে। প্রাপ্ত এই তথ্য মোতাবেক ডিমওয়ালা মা চিংড়ির বার্ষিক মোট চাহিদা দাঁড়ায় ৪২,১২০টি। লক্ষণীয় যে, উক্ত চাহিদা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, হ্যাচারিতে ব্যবহৃত মা চিংড়ির শতকরা মাত্র ১৫ ভাগ প্রাকৃতিক উৎস এবং বাকি ৮৫ ভাগ চাষকৃত ঘের বা পুকুর থেকে সংগৃহীত হয়।


মৎস্য বিজ্ঞানীদের সূত্র থেকে জানা যায়, চাষের উৎস হতে সংগৃহীত ব্রুড চিংড়ি বছরের পর বছর ক্রমাগত ব্যবহারের কারণে অন্তঃপ্রজনন সমস্যা দেখা দেয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, থাইল্যান্ডে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া, অন্তঃপ্রজননজনিত কারণে নব্বইয়ের দশকে তাইওয়ানের গলদা চিংড়ির বার্ষিক উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। অন্তঃপ্রজননজনিত কারণে হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, বেঁচে থাকার হার ইত্যাদি হ্রাস পেতে থাকে। ফলে গলদা চিংড়ির বার্ষিক উৎপাদন হার ক্রমে কমে যায়। ফলে গলদা চিংড়ির বার্ষিক উৎপাদন হার কমে যায়।

বাংলাদেশে কার্পজাতীয় মাছের হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনার অন্তঃপ্রজননজনিত সমস্যার কারণে উদঘাটন সম্ভব হলেও অদ্যাবধি গলদা চিংড়ির হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনার কৌলিতাত্ত্বিক গুণাবলি নিরূপণে কোনো গবেষণা পরিচালিত হয়নি।


এ কথা সর্বজনবিদিত যে, বাংলাদেশের বেশির ভাগ গলদা চিংড়ি হ্যাচারি ব্যবস্থাপক গুণগতমান সম্পন্ন পোনা উৎপাদনের উদ্দেশ্যে প্রাকৃতিক উৎস  থেকে ডিমওয়ালা গলদা চিংড়ি সংগ্রহ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। লক্ষণীয় যে, অতিআহরণ প্রাকৃতিক  আবাসস্থল নষ্ট, দূষণ ইত্যাদি কারণে প্রাকৃতিক উৎসের ডিমওয়ালা গলদা চিংড়ি অনেকটা দুষ্পাপ্য হয়ে পড়েছে। ফলে অনেক হ্যাচারি ব্যবস্থাপক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রাকৃতিক উৎসের ডিমওয়ালা গলদা চিংড়ি সংগ্রহ করতে পারেন না। অপরপক্ষে, চাহিদা বেশি থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই সরবরাহ ও হ্রাস পায়। এ অবস্থায় এদের বাজারমূল্যও হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। প্রায় লক্ষ করা যায়, হ্যাচারি ব্যবস্থাপকগণ অসাধু মধ্যস্বত্ব ভোগীদের কারণে বাধ্য হয়ে ঘের বা পুকুরে উৎপাদিত ডিমওয়ালা গলদা চিংড়ি ব্যবহার করেন। ব্রুড হিসেবে প্রতিপালনের জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়মমাফিক এদের কোনো পরিচর্যা করা হয় না। তাই চাষকৃত উৎসের এসব চিংড়ি হতে কাক্সিক্ষত মানের কোনো পোনা উৎপাদন সম্ভব হয় না। ফলে অনেক হ্যাচারি  ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এমনও দেখা যায়, বারবার ক্ষতির কবলে পড়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গলদা হ্যাচারি বন্ধ হয়ে গেছে। উপরন্তু, বছরের পর বছর এ ধরনের নিম্নমানের ব্রুড ব্যবহারের ফলে অন্তঃপ্রজনন সমস্যা দেখা দিতে পারে, তা, সুনিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তাই অন্তঃপ্রজনন সমস্যামুক্ত পোনা উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রাকৃতিক উৎস হতে সংগৃহীত ব্রুড অথবা এর সমকক্ষ কৌলিতাত্ত্বিক গুণগতমানসম্পন্ন ব্রুড ব্যবহার করা একান্ত অপরিহার্য।


তবে এ কথাও অনস্বীকার্য যে, প্রাকৃতিক উৎস হতে নির্বিচারে গলদা পোনা ধরার পাশাপাশি খাবারের জন্য চিংড়ির অতিআহরণ এবং এভাবে ডিমওয়ালা চিংড়ি সংগ্রহ করা অব্যাহত থাকলে প্রকৃতিতে ডিমওয়ালা চিংড়ি মজুদের ওপর যে ঋণাত্মক প্রভাব পড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সংশ্লিষ্ট বিষয়টি পর্যালোচনা করে নিঃসন্দেহে বলা যায়, হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদনের জন্য প্রাকৃতিক উৎস হতে ব্যাপকভাবে গলদা ব্রুড সংগ্রহ করা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয় এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে গলদা চিংড়ির প্রাকৃতিক মজুদ সংরক্ষণের পাশাপাশি হ্যাচারিতে গুণগতমানসম্পন্ন পিএল উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রাকৃতিক ব্রুডের সমকক্ষ ব্রুড উৎপাদনের কলাকৌশল উদ্ভাবন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।


গুণগতমান সম্পন্ন গলদা ব্রুড উৎপাদন কৌশল
সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে গুণগতমান সম্পন্ন গলদা ব্রুড উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবনের গবেষণা কার্যক্রম গৃহীত হয়েছে। এই গবেষণামূলক কর্মসূচিতে গলদা চিংড়ির ব্রুড প্রতিপালনের জন্য কতিপয় খাদ্য উপাদানের সমন্বয়ে বিশেষ গুণাবলি সম্পন্ন এক ধরনের খাদ্য তৈরি করা হয়। গুণগতমান সম্পন্ন ব্রুড উৎপাদনে এই খাদ্য দেশীয় বাণিজ্যিক কোম্পানি কর্তৃক উদ্ভাবিত চিংড়ি খাদ্যের তুলনায় উন্নত ও অধিক কার্যকর যা, সংশ্লিষ্ট মৎস্য বিজ্ঞানীদের  অভিমত থেকে জানা গেছে।


গুণগতমান সম্পন্ন ব্রুড উৎপাদন উদ্ভাবিত গলদা চিংড়ির খাবারের ফর্মুলা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-
এক. অটোকুঁড়া, মিশ্রণের হার ১১.৫০%। দুই. গমের ভুসি (মিহি) মিশ্রণের হার ১০%। তিন. ভুট্টা মিশ্রণের হার ১২%। চার. সরিষার খৈল মিশ্রণের হার ১০% পাঁচ. সয়াবিন খৈল মিশ্রণের হার ১০%। ছয়. মিট অ্যান্ড বোন মিল মিশ্রণের হার ৩০%। সাত. ফিশ প্রোটিন কনসেনট্রেড মিশ্রণের হার ১০%। আট.  ক্যালসিয়াম মিশ্রণের হার ৫.৩০%। নয়. ভিটামিন মিনারেল প্রিমিক্স মিশ্রণের হার ১%। দশ. বাইন্ডার মিশ্রণের হার ০.২০%।


উক্ত গবেষণামূলক কার্যক্রমে গলদা ব্রুড প্রতিপালনের জন্য বিশেষ নিয়মাবলি অনুসরণ করা হয়। লক্ষ্য করা যায়, গবেষণালব্ধ খাদ্য প্রয়োগ করে ও সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলি মেনে প্রাকৃতিক উৎস হতে সংগৃহীত কিশোর চিংড়ি, পুকুরে পরিমিত মজুদ ঘনত্বে চাষ করে উন্নতমান সম্পন্ন ব্রুড উৎপাদন সম্ভব।
উৎপাদিত ব্রুডের গুণগতমান পরীক্ষার জন্য হালদা নদী ও বাগেরহাট জেলার একটি ঘের হতে ডিমওয়ালা চিংড়ি সংগ্রহ করে একটি গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে তিন উৎসের ব্রুডের প্রথম প্রজন্মের পোনা উৎপাদন করা হয়।


পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, গবেষণা পুকুরে উৎপাদিত ডিমওয়ালা গলদা চিংড়ির গুণাগুণ হালদা নদী হতে সংগৃহীত ডিমওয়ালা গলদা চিংড়ির সমকক্ষ।
হ্যাচারিতে মূলত বিভিন্ন উৎসের প্রথম প্রজন্মের ব্রুড হতে দ্বিতীয় প্রজন্মের পোনা উৎপাদন করা হয়। দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রত্যেক ব্রুড উৎসের পোনার বেঁচে থাকার হার ও উৎপাদন খুবই কম থাকে, যা বাস্তব অন্তঃপ্রজনন সমস্যারই ইঙ্গিতবহ।


সুপারিশমালা তথা গলদা চিংড়ি হ্যাচারি ব্যবস্থাপকদের এ ক্ষেত্রে যা যা করণীয়
এক. গলদা চিংড়ি হ্যাচারি ব্যবস্থাপকগণ প্রাকৃতিক উৎস হতে সংগৃহীত কিশোর চিংড়ি উপযুক্ত পুকুরে মজুদ করে সুষম খাদ্য প্রয়োগের মাধ্যমে গুণগতমান সম্পন্ন ব্রুড উৎপাদন করবেন, মূলত তাদের নিকট এটিই প্রত্যাশা। এছাড়া প্রতি মাসে অমাবস্যা ও পূর্ণিমার ভরা জোয়ারে নদীর পানি দ্বারা পুকুরের শতকরা ৫০-৮০ ভাগ পানি পরিবর্তন করে নেয়া জরুরি। পুকুরের পানির গভীরতা সারা বছর ৩ ফুট থেকে ৫ ফুট থাকা বাঞ্ছনীয়।


দুই. গলদা চিংড়ি হ্যাচারি ব্যবস্থাপকগণ বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস হতে সংগৃহীত পোনা ভিন্ন ভিন্ন পুকুরে চাষ করে যথাযথ পরিকল্পনামাফিক প্রজননের মাধ্যমে উৎপাদিত ব্রুড়ের কৌলিতাত্ত্বিক উন্নয়ন ঘটাতে পারেন।


তিন. গলদা চিংড়ি হ্যাচারি ব্যবস্থাপকগণ নিজেদের ব্রুডের উৎপাদিত পোনা ভবিষ্যৎ ব্রুড উৎপাদনে ব্যবহার করবেন না এটাই শ্রেয়। নিজেদের ব্রুডের উৎপাদিত পোনা দ্বারা ভবিষ্যত ব্রুড উৎপাদনের পূর্বে অবশ্যই তাদের কৌলিতাত্ত্বিক গুণাবলি পরীক্ষা করা বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে ব্রুডের তুলনায় উৎপাদিত পোনার কৌলিতাত্ত্বিক অবনমন ঘটলে তা হতে ব্রুড উৎপাদন কোনো অবস্থারই কাক্সিক্ষত নয়। চার. গুণগতমান সম্পন্ন ব্রুড উৎপাদনের কৌশল সম্পর্কে গলদা চিংড়ি হ্যাচারি ব্যবস্থাপকদের প্রশিক্ষণ প্রদান একান্তই অপরিহার্য।


গলদা চিংড়ি আমাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি রপ্তানি পণ্য এর মাধ্যমে দেশ পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতার দিকে এগোচ্ছে দ্রুতগতিতে। তাই প্রকৃতিতে এই পণ্যের মজুদ তথা সংরক্ষণ অতীব জরুরি। পুকুরে গলদা চিংড়ির গুণগতমান সম্পন্ন ব্রুড উৎপাদনে উদ্ভাবিত খাদ্য ও প্রতিপালন পদ্ধতি ব্যবহার চিংড়ি হ্যাচারির জন্য যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ডিমওয়ালা মা চিংড়ির জোগান নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক উৎসের চিংড়ি ব্রুডের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় ও প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখবে।

 

দলিল উদ্দিন আহমদ*
*প্রাবন্ধিক ও অবসরপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকর্তা, মোবাইল : ০১৭২৪০৫০৪০৩

বিস্তারিত
কবিতা ১৪২২ (কৃষিকথা)

 

নিম বিষয়ক কথকতা
কৃষিবিদ এ এইচ ইকবাল আহমেদ*

১.
টক ঝাল মিষ্টি কার কাছে না পছন্দ
কখনো নোনতা হলে অত্যন্ত উত্তম
তিক্ত স্বাদ কিংবা তিক্ত কথা একদম
তালিকার নিচে; ওতে নাই দ্বিধা দ্বন্দ্ব।

উভয়ের মাঝে তিক্ততা যখন বাড়ে
কথাচ্ছলে বলে ‘জন্মকালে দেয় নাই
মুখে কেউ মধু’ পিত্ত জ্বলা কথা তাই
এড়াতে অনেকে সরে পড়ে চুপিসারে॥

নিমরাজি হয়ে তবু লাজে কিছু বলা:
হেন উপকার নাই তিক্ত নিমগাছে
কবিরাজি আর বহুগুণ তার আছে
জানা চাই ওর গুণপনা ষোলোকলা।

হোক না দুর্নাম নিম তিক্ততার জন্য
ঘর গেরস্থালি কাজে তবু তা অনন্য॥

২.
নিপুণ দৃশ্যের স্নিগ্ধতা ছড়ায় নিম
পরিবেশ করে তোলে অনিন্দ সুন্দর
খরতাপে পোড়ে যখন বাহির অন্তর
তখন এ তরু ছায়ায় শান্তি অসীম।

যদিও তিতায় ভরা নিম গাছটায়
মশক উকুন আর যত জীবাণুর
নাশকারী গুণ তার শরীরে প্রচুর;
দন্তরোগ দূর হয় নিমের শাখায়॥

নিম ক্ষত কম্পজ্বর বসন্ত তাড়ায়
গোলাঘর রয় ভালো শুকনা গুঁড়ায়
ফসল সামালে ব্যাধির ধকল খৈলে।

আঁধারে প্রদীপ আলো দেয় নিম তৈলে
পিছলকরণে চলে ঢেকি ঘানি চাকা
গ্রামে গঞ্জে নিম তাই স্বার্থে বেঁচে থাকা॥
৩.
যতখানি জানি নিম ইতিহাস পাঠে
যুগ যুগ ধরে তার বাস ভূভারতে।
জগন্নাথ গড়া হয় কৃষ্ণনিম কাঠে
সুভদ্রা রক্তিমে বলরামের শুভ্রতে।

নিমতলে জন্ম নেন চৈতন্য নিমাই
মিষ্টভাষে খ্যাত ওই গৌরঙ্গ বেষ্ণব।
এমন বিচিত্র কথা লোকমুখে পাই
ধর্মকর্মে নিমগাছ হয়েছে বান্ধব॥

নিমাই কল্যাণে পাই নতুন জগত
বৈষ্ণব সাহিত্য তার মেলেছে পাখা
ভানুসিংহ রচে তাই কাব্য পদাবলি।

নানাজন হতে আসে ভিন্ন ভিন্ন মত
যেমন মেলছে নিম চারিদিকে শাখা
ভক্তিরস দেয় তিক্তরে জলাঞ্জলি॥

৪.
আরাফাত ময়দান তার আশ পাশ
শাখা মেলে ছায়া দেয় সিøগ্ধ নিমগাছ।
খরতাপে উষ্ণ হলে দুপুর বেলায়
হাজিগণ তৃপ্ত হন নিমের তলায়।

মুসল্লির কাছে প্রিয় নিমের দাঁতন
ওজুর প্রারম্ভে ঘষে মনের মতন।
শরীরে রোগের জন্য নিমেমেশা পানি
দুদ- আরাম দিয়ে নাশে চুলকানি॥

আমাদের চারপাশে যত গাছ আছে
এমন পরম বন্ধু তুচ্ছ তার কাছে।
ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে জনপ্রিয়তায়
দ্রব্যগুণে নিম রয় সবার মাথায়।

মহতি কল্যাণ নিত্য যার কাছে পাই
বিধাতার দান তার গুণ বলে যাই॥

*পরিচালক (অব.), বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি। মোবাইল : ০১৫৫৮৩০১৯০৮

বিস্তারিত
ঢলে পড়া রোগ নিয়ন্ত্রণে বেগুনের গ্রাফটিং প্রযুক্তি

ঐতিহ্য এবং বংশীয়ক্রমে বেগুনের উৎপত্তিস্থল ভারতীয় উপমহাদেশ। নামে গুণহীনতা পরিচয় থাকলেও পুষ্টি ধারণের দিক দিয়ে অন্যান্য সবজির তুলনায় চর্বি বা স্নেহজাতীয় পদার্থে প্রথম, ভিটামিন বি২ (রিবোফ্লাবিন)  ধারণে দ্বিতীয় এবং আমিষে তৃতীয় অবস্থান ধারণ করে। তাই পুষ্টিগত উপাদানের বিবেচনায় বেগুনের গুরুত্ব মোটেই কম নয়। বেগুন অত্যন্ত রুচিশীল, সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর সবজি। বাংলাদেশে প্রায় ৮৯ ধরনের শাকসবজি চাষ করা হয়। প্রধানতম ০৯টি সবজির মধ্যে  বেগুন অন্যতম। বেগুন উৎপাদনে মাঠ পর্যায়ে ঢলে পড়া রোগটি ক্যান্সারের মতো প্রভাব বিস্তার করে। ফলে কৃষকরা প্রতি বছর মারাত্মক অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ঢলে পড়া রোগটি মূলত মাটি বাহিত যা ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক এমনকি নেমাটোড বা কৃমি আক্রান্ত হতে পারে। স্যাঁতসেঁতে মাটি ও আর্দ্র আবহাওয়া ঢলেপড়া রোগের জন্য সহায়ক। ঢলে পড়া রোগের ফলে আক্রান্ত গাছের পাতা প্রথমে আংশিক ও পরে সম্পূর্ণ নেতিয়ে পড়ে এবং তিন চার দিনের মধ্যেই গাছটি মারা যায়। মাঠে অল্প বয়সে এ রোগ দেখা দিলে ফল ধরার আগে অধিকাংশ গাছ মারা যেতে পারে। মাটিবাহিত ফলে ঢলেপড়া রোগ নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন।


কিছু কিছু বন বেগুনের প্রজাতিতে এ রোগের উচ্চতর প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রতিরোধী গুণাগুণটি আবাদি বেগুনে এখনও সফলভাবে সংযোজন বা সংস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। এসব বন বেগুন বাংলাদেশের সর্বত্রই জন্মায়। এ বন বেগুন গাছের সাথে জোড়কলমের মাধ্যমে বেগুন গাছকে মাটি বাহিত রোগ থেকে রক্ষা করা যায় এবং উচ্চফলন নিশ্চিত করা সম্ভব।


বেগুনে জোড়কলম/গ্রাফটিং করার উদ্দেশ্য
১.     বেগুনের ঢলেপড়া, শিকড় গিঁট ও অন্যান্য মাটিবাহিত     রোগ কমিয়ে আনা
২.     বন বেগুনের মূল সবল হওয়ায় বেশি পরিমাণে খাদ্য দ্রব্য গ্রহণ, ফলে ফলন বেশি হয়।
৩. ফসলের জীবন কাল বৃদ্ধি হয়।

 

বীজতলা তৈরি ও বীজ বপন
●     ২ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১ মিটার প্রস্থ আকারের বীজতলা তৈরি করতে হবে।
●     বীজতলায় পরিমিত সার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
●    লাইনে বীজ বপন করে, গুঁড়া মাটি দিয়ে উপরিভাগ পাতলা করে ঢেকে দিতে হবে।
●     রাত্রে পলিথিন সিট দ্বারা বীজতলা ঢেকে রাখতে হবে।
●     বীজতলায় ঝরনা দিয়ে মাঝে মাঝে হালকাভাবে পানি দিতে হবে।
●     বন বেগুনের বীজ বপন করার ১৫-২০ দিন পর ভালোজাতের বেগুন বীজ বপন করতে হবে।
●     বন বেগুনের চারা ১.৫ ইঞ্চি লম্বা হলে তখন প্রতিটি চারা পলিব্যাগে স্থানান্তর করতে হবে। এদেরকেই গ্রাফটিংয়ের রুট স্টক বা আদি জোড় হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। পূর্বেই অর্ধেক পচা গোবর ও অর্ধেক মাটি, বা বালি ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে পলিব্যাগ ভর্তি করতে হবে।

 

রুট স্টক বা আদি জোড় নির্বাচন
●     পলিথিন ব্যাগে থাকা বন বেগুনের চারা ৪৫-৫০ দিন বা ৪-৫ পাতা বিশিষ্ট হলে এবং কান্ডের ব্যাস ২-৩ মি. মি. হলে জোড়কলম করার উপযুক্ত হয়।
সায়ন বা উপজোড় নির্বাচন
●     বেগুনের চারা ৩০-৩৫ দিন বা ২-৩ পাতা বিশিষ্ট হলে জোড়কলম করার উপযুক্ত হয়।
রুট স্টক বা আদি জোড় তৈরি
●     বন বেগুনের চারাসহ পলিথিন ব্যাগটি নিয়ে ধারাল ব্লেডের সাহায্যে চারার গোড়া থেকে ৫-৬ সেমি. ওপরে বা ওপর থেকে ২-৩ পাতার নিচে আড়াআড়িভাবে কেটে ফেলতে হবে।
●     আদি জোড় থেকে সব পাতা ছেঁটে দিতে হবে।
●     কাণ্ডের কাটা মাথাকে প্রায় ১ সেমি গভীর করে ২ ভাগে লম্বালম্বিভাবে চিড়তে হবে।

 

সায়ন বা উপজোড় তৈরি
●     বেগুনের চারা বীজতলা থেকে উঠিয়ে গোড়ার মাটি ধুয়ে পরিষ্কার করে অল্প পানিসহ পাত্রে গোড়ার অংশ ডুবিয়ে রাখতে হবে।
●     বেগুনের চারার মাথার ওপরের অংশের প্রায় ৫-৬ সেমি. নিচে কাটতে হবে।
●     উপজোড়ের বড় পাতাগুলো ছেঁটে দিতে হবে।
●     কাটা অংশের নিচের দুই পাশ থেকে প্রায় ১ সেমি আড়াআড়িভাবে ইংরেজি ‘ভি’ অক্ষরের আকৃতির মতো করে কাটতে হবে।

 

বেগুনের জোড়কলম লাগানোর পদ্ধতি
১.     বেগুনের চারার ‘ভি’ অক্ষরের আকৃতির মাথাটি বন বেগুন চারার কাটা স্থানে ঢুকিয়ে দিতে হবে।
২.     পরে পলিথিন স্ট্রিপ বা প্লাস্টিক ক্লিপ বা প্লাস্টিক টিউব দিয়ে জোড়াটি ভালোভাবে আটকে দিতে হবে।
৩.     পরবর্তীতে গাছের ওপরের অংশে পানি ছিটাতে হবে।
৪.     জোড়ার স্থানে যেন পানি না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৫.     কলম করার কাজ বিকেলে করাই উত্তম।

 

কলমের পরিচর্যা
●     গাছ, বাশের শলা দ্বারা খাঁচা তৈরি করে পলিথিন ও চট বা কালোকাপড় দিয়ে খাঁচা ঢেকে দিতে হবে।
●     পলিথিন ও চটের ছাউনির মধ্যে নিচে খড় বিছিয়ে তার ওপর কলম রাখতে হবে এবং এ খড় দিনে কমপক্ষে তিনবার ভিজিয়ে দিতে হবে।
●     কলম করার পর আর্দ্রতা বাড়ানোর জন্য ৭ দিন পর্যন্ত প্রতিদিন ৩-৪ বার কুয়াশার মতো করে পানি ছিটিয়ে আবার ঢেকে রাখতে হবে।
●     বৃষ্টি না হলে রাতে খাঁচায় আচ্ছাদন খুলে দিতে হবে।
●     দিনের বেলায় গাছ ঢেকে রাখতে হবে।
●     এক সপ্তাহ পর পলিথিন সরিয়ে শুধু চট বা কালোকাপড় দিয়ে আবার ১ সপ্তাহ ঢেকে রাখতে হবে।
●     কলম করার ১৫-২০ দিন বা ২-৩ সপ্তাহ পর গাছ মাঠে লাগানো উপযুক্ত হয়।
●     চারা লাগানোর আগে খাঁচা থেকে বের করে ৭ দিন ছায়ায় রেখে তারপর মূল জমিতে লাগাতে হবে।

 

জোড়কলম করা গাছ মাঠে লাগানো
●     জোড়কলম করা গাছ মাঠে লাগানোর ৩-৪ ঘণ্টা আগে ঝাজরি দিয়ে পানি দিয়ে মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে। গাছ লাগানোর সময় পলিথিন ব্যাগটি ব্লেড দিয়ে দুই পাশ থেকে কেটে সরিয়ে ফেলতে হবে। বেগুন চাষের জন্য নির্ধারিত পদ্ধতিতে জমি তৈরি করে নির্ধারিত দূরত্বে গোড়ার মাটিসহ চারা রোপণ করতে হবে।

 

সাবধানতা
●     রোপণকৃত চারায় প্রতি ১-২ সপ্তাহ পর পর বন বেগুনের গাছ থেকে গৃজানো ডালপালা কেটে দিতে হবে।
●     গাছ লাগানোর সময় ক্লিপ না খুলে ২-৩ সপ্তাহ পরে ক্লিপ খুলে নেয়া ভালো।
●     বেগুন গাছের কোনো ডালপালা মাটি স্পর্শ যাবে না তাই খুঁটির ব্যবস্থা করতে হবে।
●     কলম করা গাছে ফল ধরা ও ফসল তোলা সাধারণ গাছ হতে ১০-১৫ দিন দেরি হতে পারে।


উল্লেখ্য যে, ঢলেপড়া রোগ নিয়ন্ত্রণে গ্রাফটিং পদ্ধতি টমেটো ফসলের জন্যও একই পদ্ধতি অবলম্বন করে সহজেই চাষ করা যায়।

 

মোহাইমিনুর রশিদ*

*আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, সিলেট। মোবাইল: ০১৭১৮৪২৯৪৫৯

 

বিস্তারিত
প্রাণিদেহে বিভিন্ন ধরনের বিষক্রিয়া ও করণীয়

শস্যক্ষেত ও ঘরবাড়ির বিভিন্ন প্রকার কীটপতঙ্গ ধ্বংস করার জন্য কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার করা হয়। শস্যক্ষেত ছাড়াও কীটনাশক ওষুধ পশুপাখির দেহের বহিঃপরজীবী (যেমন উকুন, আঠালি, মাইটস, মাছি ইত্যাদি) ধ্বংস করার জন্য ব্যবহার করা হয়। প্রধানত যেসব উপায়ে পশুর কীটনাশক পদার্থ দ্বারা বিষক্রিয়া ঘটে তা হলো-
১. শস্যক্ষেত বিভিন্ন প্রকার কীটনাশক ওষুধ স্প্রে করা হয় এবং সেসব জমির শস্য বা ঘাস খেয়ে।
২. পশুর খাদ্যে কোনভাবে কীটনাশক পদার্থ মিশে গেলে তা খেয়ে।
৩. পশুর বহিঃদেশের পরজীবী বিনাশের জন্য ব্যবহৃত বিষ স্প্রে বা ডিপিং করার সময় তার ঘনত্ব বেশি হলে।
৪. শত্রুতাবশত চামড়ার লোভে পশুকে বিশ খাওয়ালে।

 

প্রধানত তিন শ্রেণির কীটনাশক পদার্থ ব্যবহার হয়।
১. অর্গানোফসফেট ২. কার্বামেট ৩. ক্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বন।
অর্গানোফসফেট কম্পাউন্ডস ও কার্বামেট উভয় ধরনের কীটনাশক পদার্থ পশুর দেহে একই প্রক্রিয়ায় বিষক্রিয়া ঘটায়। উভয় ধরনের কীটনাশক প্রাণিদেহে কোলিন এস্টারেজ এনজাইম সৃষ্টি হ্রাস করে এবং প্যারাসিম্প্যাথেটিক স্নায়ুর উত্তেজনায় পশুর দেহে লালাক্ষরণ, ডায়রিয়া ও পেশির আড়ষ্ঠতা ইত্যাদি উপসর্গ সৃষ্টি করে।
কীটপতঙ্গের কবল থেকে ফসল রক্ষার জন্য এবং পশুর দেহের বিভিন্ন বহিঃপরজীবী বিনাশের জন্য এই শ্রেণির পদার্থ বিভিন্ন নামে বাজারে পাওয়া যায় যেমন-প্যারাথিওন, ম্যালাথিওন, ডায়াজিনন, কোমাফস ইত্যাদি (এগুলো হচ্ছে অর্গানোফসফরাস কম্পাউন্ড)। আবার কার্বামেট কীটনাশক হিসেবে বাজারে পাওয়া যায় সেভিন, ফুরাডন, বেগল ইত্যাদি। উভয় ধরনের কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় পশুদেহে শ্বাসকষ্ট, লালাক্ষরণ, পেশির আড়ষ্ঠতা ও সংকুচিত অক্ষিতারা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। চোখের মনির সাড়া খুবই দুর্বল অথবা থাকবে না। কার্বামেট জাতীয় কীটনাশক গোলকৃমি, ব্লু ফ্লাই ও অন্যান্য মাছির কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ব্যবহার হয়। ডিপিং ও ডাস্ট হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়। ৪-৫% ম্যালাথিয়ন ডাস্টিং এর জন্য ব্যবহৃত হয়। এক কেজি ছাইয়ের সাথে ৪০সষ ম্যালাথিয়ন মিশিয়ে তা ডাস্টিং এর জন্য ব্যবহার করা হয়। আবার ৫% ঝবারহ ধূলিম্লানের মাধ্যমে উকুন নিধনে বেশ কার্যকর। দশ লিটার পানিতে ১সষ ডায়াজিনন মিশিয়ে ভেড়াকে ডিপিং করা হয়। ব্রিটেনে ঝযববঢ় ঝপধনরবং এ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে একবার এবং শরৎকালে একবার মোট দুইবার প্রতিটি মেষকে ডিপিং করা বাধ্যতামূলক।


রোগ নির্ণয়
* বিষযুক্ত ঘাস বা খাদ্য খাওয়ার ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপসর্গ (শ্বাসকষ্ট, লালাক্ষরণ, পেশির আড়ষ্ঠতা, সংকুচিত অক্ষিতারা, অধিক গা ঘামা) পরীক্ষা করে এই বিষক্রিয়া শনাক্ত করা যায়।
* রক্তে কোলিন এস্টারেজ হ্রাস মাত্রা এবং প্রস্রাবে অর্গানোফসফরাস কম্পাউন্ড বৃদ্ধি মাত্রা নির্ণয় করে এই বিষক্রিয়া শনাক্ত করা যায়।
* সন্দেহজনক খাদ্য বিশ্লেষণ করে অর্গানোফসফরাস শনাক্ত করা যায়।

 

অর্গানোফসফরাস কম্পাউন্ড ও কার্বোমেট পদার্থের বিষক্রিয়ায় করণীয়
যেসব কীটনাশক ওষুধে অর্গানিকফসফেট থাকে এদের বিষক্রিয়ায় চিকিৎসা হিসেবে অ্যাট্টোপিন দেয়া হয়। বলা যেতে পারে অ্যাট্রোপিন সালফেট অর্গানোফসফরাস বিষক্রিয়ায় একটি যথাযথ ও অনুমোদিত চিকিৎসা মানুষ ও পশুপাখি উভয়ের ক্ষেত্রেই। পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তির প্যারাথিন জাতীয় অর্গানিক ফসফেট কীটনাশক ওষুধের বিষক্রিয়া চিকিৎসার জন্য ০.৮ মিলিগ্রাম অ্যাট্রোপিন সালফেট ইন্ট্রামাসকুলার ইনজেকশন দেয়া হয়। যদি আধ ঘণ্টার মধ্যে অ্যাট্রোপিনে কোন ফল পাওয়া না যায় ও বিষক্রিয়ার লক্ষণগুলো যেমন উদরাময়, বমি, চোখের তারার সংকোচন, অধিক গা ঘামা ও মুখ দিয়ে অধিক লালা পড়া প্রভৃতি লক্ষণ সুস্পষ্ট হয় তখন দুই মিলিগ্রাম অ্যাট্রোপিন সালফেট ইন্ট্রামাসকুলার ইনজেকশন প্রতি ঘণ্টায় দিতে হবে যতক্ষণ না পর্যন্ত দেহে অ্যাট্রোপিনের ক্রিয়ার সঠিক প্রকাশ ঘটে। অ্যাট্রোপিন সালফেট একটি এন্টিকোলিনার্জিক ওষুধ যা স্থানীয় বাজারে অ্যাট্রোপিন ও অ্যাট্রোপিন সালফেট (এডরুক, কেমিস্ট ল্যাব.) নামে পাওয়া যায়। চোখের মনি সংকুচিত থাকলে অ্যাট্রোপিন ইনজেকশন শিরায় দিতে হবে।


* গরুর প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ০.২৫ মিলিগ্রাম এবং মেষ ও ছাগলের প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য এক মিলিগ্রাম হিসেবে এক-তৃতীয়াংশ শিরায় এবং অবশিষ্টাংশ পেশির মধ্যে ইনজেকশন দিতে হয়। উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে ৪-৫ ঘণ্টা পর পর ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত এই ওষুধ প্রয়োগ করা যায়। তবে অতি তীব্র অবস্থায়  এই চিকিৎসা কার্যকর নাও হতে পারে। অ্যাট্রোপিন সালফেট স্নায়ুর প্রান্তে জমায়েত অ্যাসিটাইল কোলিনের ক্রিয়া বন্ধ করে দেয়।


গবাদিপশুতে ব্যবহার উপযোগী হিসেবে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে অ্যাট্রোপিন ইনজেকশন (Atropine injection, Bremer Pharma) । এছাড়া এন্টিকোলিনার্জিক ও এন্টিস্পাজমোডিক ড্রাগ হিসেবে টেকনো ড্রাগ অ্যাট্রোভেট ইনজেকশন বাজারজাত করছে। অ্যাট্রোভেট গরু, মহিষ, ঘোড়া, কুকুর ও বিড়ালের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। অ্যাট্রোভেট এর কাজ হচ্ছে অনৈচ্ছিক পেশির সংকোচন হ্রাস করা, চোখের তারা প্রসারিত করা।


* অর্গানোফসফরাস বিষক্রিয়ার ক্ষেত্রে গরু ও শূকরে অ্যাট্রোপিন (Bremer Pharma) প্রতি ১০০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৬০ মিলিলিটার, ছাগল ও ভেড়ায় ১০ মিলিলিটার প্রতি ১০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ব্যবহার করা হয়। কুকুর ও বিড়ালে ৩ মিলিলিটার প্রতি ১০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ব্যবহার করতে হবে। প্রথম ডোজের তিন ভাগের এক ভাগ শিরার মধ্যে এবং ২/৩ ভাগ মাংসে ইনজেকশন দিতে হবে। প্রয়োজনে আধা ঘণ্টা পর পর বা অবস্থার ওপর নির্ভর করে পুনরায় মাংসে অ্যাট্রোপিন ইনজেকশন করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না আসে।


* হায়োসিন বিউটাইল ব্রোমাইড একটি কোয়াটারনারি অ্যামোনিয়া। এটি অ্যাট্রোপিনের মতো এন্টিকোলিনার্জিক হিসেবে কাজ করে। তবে অ্যাট্রোপিনের চেয়ে কম শক্তিশালী ও ক্রিয়া অল্পক্ষণ স্থায়ী হয়। হায়োসিন বিউটাইল ব্রোমাইড বাজারে বুটাপেন বাসকন ১০,২০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট আকারে পাওয়া যায়। ট্যাবলেট হিসাবে ২০সম মানুষের ক্ষেত্রে দিনে চারবার মুখে খাওয়ানো হয়।


* অ্যাক্টিভেটেড চারকোল গরুর জন্য ০.৯ কেজি এবং ছাগল/ ভেড়ার জন্য ০.৫ কেজি পানির সাথে মিশিয়ে স্টমাক টিউবের সাহায্যে খাওয়াতে হবে। বাজারে অ্যাক্টিভেটেড চারকোল VetDtox নামে বিক্রি হয়। VetDtox প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ০.৭৫ গ্রাম হিসেবে খাওয়াতে হয়। Activated charcoal এটি পাকস্থলীতে বিষ শোষণ বন্ধ করে। সায়ানাইড ছাড়া প্রায় সব বিষক্রিয়ায় চারকোল ব্যবহার হয়।


* ত্বকে লেগে বিষক্রিয়া হলে সাবান ও পানি দিয়ে ত্বক উত্তমরূপে ধুয়ে দিতে হবে।


* অর্গানোফসফরাস বিষক্রিয়ায় ক্যালসিয়াম বোরোগ্লুকোনেট ও ডেক্সটোজ স্যালাইন শিরায় ইনজেকশন দেয়া যায়। ক্যালসিয়াম প্রিপারেশন হিসেবে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে ক্যালম্যাফস (Calmaphos, Bremer Pharma), ক্যাল-ডি-ম্যাগ (Cal-D-Mag injection, Renata Ltd), সানক্যাল ভেট (Sancal Vet I/M, Novartis Ltd) সানক্যাল ভেট মাংসপেশিতে ১৫ মিলি করে প্রয়োগ করা হয়। ক্যালমাফস গরু ও ঘোড়াতে ১৫০সষ শিরার মধ্যে আস্তে আস্তে ইনজেকশন করতে হবে। বাছুর, ছাগল ও ভেড়াতে ৫০সষ শিরার মধ্যে আস্তে আস্তে ইনজেকশন করতে হবে। শিরায় প্রয়োগের আগে ইনজেকটেবল সলিউশনকে শরীরের তাপমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখার জন্য হালকা গরম করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ওধুধের ঈষদুষ্ণ পানির ভেতর অল্প কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখার পর ব্যবহার করতে হবে। শিরায় প্রয়োগের ক্ষেত্রে ওষুধ অত্যন্ত ধীরগতিতে প্রয়োগ করতে হয়। পেশির খিচুনি ও কম্পন তীব্র আকার ধারণ করলে ডায়াজিপাম ইন্ট্রামাসকুলার বা ইন্ট্রাভেনাস ইনজেকশন দেয়া যায় এবং প্রয়োজন হলে ৪ ঘণ্টা পর পর আবার দেয়া যায়। ডায়াজিপাম বাজারে ট্যাবলেট, ইনজেকশন ও সাপোজিটরি আকারে পাওয়া যায়। এই ওষুধ বাংলাদেশের বাজারে জি ডায়াজিপাম (G-Diazepam), Relaxen, Sedil, Fizepam ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। জি-ডায়াজিপাম প্রতি ট্যাবলেটে ৫ মিলিগ্রাম ডায়াজিপাম এবং প্রতি ২ মিলিলিটার এম্পুলে ১০ মিলিগ্রাম ডায়াজিপাম থাকে।


* লবণ মিশ্রিত ঈষদুষ্ণ পানি খাওয়ালে গরু বা মহিষে বমি হতে পারে যার মাধ্যমে বিষ পেট থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।


*Stomach tube পাকস্থলীতে ঢুকিয়ে সেখানকার বিষাক্ত পানি বের করা যেতে পারে।


* এসিড জাতীয় বিষ খেলে চুনের পানি, চকগুঁড়ো বা মিল্ক অব ম্যাগনেশিয়া খাইয়ে দিতে হবে।


* ক্ষারজাতীয় বিষ হলে লেবুর রস, ভিনেগার বা তেঁতুল গোলা পানি খাওয়াতে হবে। অথবা Tartaric acid ১০% চায়ের লিকারের সাথে খাওয়াতে হবে।


*  ফসফরাস জাতীয় বিষ হলে এক মগ পানিতে কয়েকটা পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দানা ফেলে দিয়ে পানি ভালো করে গুলে গরু/মহিষকে খাওয়াতে হবে।


* শরীর থেকে পানি বের করার ওষুধ Frusemide প্রয়োগ করলে রক্ত মিশ্রিত বিষ প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে আসবে। তবে পশুকে বেশি করে পানি ও ওরস্যালাইন খাওয়াতে হবে।


* ধুতরা পয়েজনিং এর ক্ষেত্রে গরম পানি, রঙ চা, রঙ কফি Antidote প্রতিবিষ হিসেবে কাজ করে।


*বেশি অ্যালকোহল বা মদ খেলে লেবুর রস বা কালোকফি Antidote হিসেবে কাজ করে।


* কেরোসিনের বিষক্রিয়ায় বমি করানো যাবে না। মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। লিকুইড প্যারাফিন ২৫০সষ খেতে দিলে রক্তে কেরোসিনের শোষণ বাধাগ্রস্ত হবে। পেনিসিলিন জাতীয় ওষুধ দিতে হবে যাতে নিউমোনিয়া বা অন্যকোনো সংক্রমণ না হতে পারে।


* পশুর শরীরে খিঁচুনি থাকলে সঙ্গাহীন অবস্থায় বমি করানো  যাবে না। কিছু বিষ যা প্রবেশের সময় মুখ, মুখগহবর ও অনুনালিতে প্রদাহের সৃষ্টি করে এই সব ক্ষেত্রে বমি করানো উচিত নয়। কারণ বমি করার সময় উল্লিখিত পদার্থগুলো পুনরায় ক্ষতিসাধন করে ক্ষতের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।


অর্গানোফসফরাস কম্পাউন্ড (ম্যালাথিয়ন, ডায়াজিনন, কোমাফস) এর মতো ক্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বন নামক কীটনাশক দ্বারাও গৃহপালিত পশুর বিষক্রিয়া হতে দেখা যায়। প্রধানত ডিডিটি, বেনজিন হেক্সাক্লোরাইড, লিন্ডেন, অ্যালড্রিন, ডায়ালড্রিন, ক্লোরডেন, টক্সোফেন, আইসোডিন, এনড্রিন ও হেপ্টাক্লোর ইত্যাদি ক্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বন কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। খাদ্য গ্রহণ, শ্বাস গ্রহণ ও ত্বকের মাধ্যমে এই গ্রুপের কীটনাশক দেহে প্রবেশ করে।  বেনজিন হেক্সাক্লোরাইড, অ্যালড্রিন, ডায়ালড্রিন ও ক্লোরডেন সহজেই ত্বকের মাধ্যমে প্রবেশ করে। প্রাপ্ত বয়স্ক পশু অপেক্ষা বাড়ন্ত বয়সী পশু অধিক সংবেদনশীল।


এই গ্রুপের কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় পশুর একদম ক্ষুধা থাকে না। পেশির কম্পন, খিঁচুনি ও পক্ষাত দেখা যায়। ত্বকের মাধ্যমে বিষক্রিয়া ঘটলে সাবান পানি দিয়ে স্থানটি উত্তমরূপে পরিষ্কার করে নিতে হবে। খাদ্যের মাধ্যমে বিষক্রিয়া হলে অ্যাক্টিভেটেড চারকোল বড় গাভীকে (৪০০ কম boly weight) দুই কেজি পর্যন্ত ড্রেঞ্জের মাধ্যমে খাওয়াতে হবে। পরে প্রত্যহ খাদ্যের সাথে ১ কেজি করে মিশিয়ে দুই সপ্তাহ খাওয়াতে হবে। সোডিয়াম ফেনোবারবিটোল প্রতিটি বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত গাভীকে প্রত্যহ ৫ গ্রাম করে একমাস খায়ালে দেহ থেকে ক্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বন দ্রুত নিঃসরণ ঘটে। এক্ষেত্রে ক্লোরাল হাইড্রেট ব্যবহার করা যায়।


বলদ গরুর এলড্রিন বিষক্রিয়ায় ক্লোরাল হাইড্রেট ৩০ গ্রাম এবং ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ৬০ গ্রাম পর্যন্ত পানিতে মিশিয়ে খাওয়ালে ও ক্যালসিয়াম বোরোগ্লুকোনেট ২৫০সষ শিরায় ইনজেকশন করে এবং ২সম অ্যাট্রোপিন সালফেট হিসেবে মাংসপেশির মধ্যে ৫ ঘণ্টা পর পর ৩টি ইনজেকশন দেয়া যেতে পারে। এছাড়া ক্লোরাল হাইড্রেট, ক্যালসিয়াম বোরোগ্লুকোনেট ও অ্যাস্ট্রিনজেন্ট মিকশ্চার দিয়ে চিকিৎসায় সুফল পাওয়া গেছে।


ক্যালসিয়াম বোরোগ্লুকোনেট বাজারে ক্যাল-ডি-ম্যাগ (Cal-D-Mag injection Renata Ltd) নামে পাওয়া যায়, যা গরু/ মহিষকে ২০০সষ হিসেবে শিরায় ও ছাগল/ ভেড়াকে ২৫সষ শিরায় অত্যন্ত ধীরগতিতে প্রয়োগ করতে হবে। Cal-D-Mag এর বোতল ঈষদুষ্ণ পানির ভেতরে অল্প কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখার পর ব্যবহার করতে হবে।


* সুস্থ স্নায়বিক উপসর্গে পশুকে সিডেটিভ (Sedative) জাতীয় ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করতে হয়। সিডেটিভ প্রয়োগের উদ্দেশ্য হচ্ছে উদ্বেগ অস্থিরতার উপশম।


*ক্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বন বিষক্রিয়ায় লারগ্যাকটিল (Largactil-Chlorpromazire hydrochloride) ব্যবহার করা যায়। ক্লোরপ্রোমাজিন হাইড্রোক্লোরাইড সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ব্যবহার করা নিষেধ। বিশেষ করে যেসব ক্ষেত্রে অ্যালকোহল, নারকোটিক, বারবিচ্যুরেট বা অন্যান্য স্নায়ু অবসন্নকারী ওষুধের প্রভাবে চেতনহীন থাকে। ল্যারগ্যাকটিল ২৫,৫০ অথবা ১০০ মিলিগ্রাম ক্লোরপ্রোমাজিন হাইড্রোক্লোরাইড ট্যাবলেট এবং প্রতি ২ মিলিলিটার এম্পুলে ৫০ মিলিগ্রাম ক্লোরপ্রোমাজিন ইনজেকশন আকারে পাওয়া যায়।
 

* ক্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বন বিষক্রিয়ায় ব্যবহৃত ফেনোবারবিটল বাজারে ফেনোবারবিটোন ৩০ অথবা ৬০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট আকারে পাওয়া যায়। স্বল্পমাত্রার ফেনোবারবিটোন অস্থিরতা উপশমকারী এবং উচ্চমাত্রা নিদ্রাকারক হিসেবে কাজ করে। গরুকে এনড্রিল বিষক্রিয়ায় বা ক্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বন বিষক্রিয়ায় প্রতিদিন ৫ গ্রাম হিসেবে এক মাস খাওয়াতে হয়।


মানুষের ক্ষেত্রে এনড্রিল বিষক্রিয়ায় করণীয়
এজাতীয় পদার্থ পান করলে এর ঘ্রাণ পাওয়া যাবে। পান করার ঘণ্টা খানেকের মধ্যে মাথাব্যথা, ঘাম বের হওয়া, অতিরিক্ত লালা, পেটে কামড় দেয়া ব্যথা, বমি, পাতলা পায়খানা, খিঁচুনি, দৃষ্টি  ঘোলা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়। রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠাতে হবে। হাসপাতাল বেশি দূরে হলে নিম্নের কাজগুলো করা যেতে পারে-
* রোগীর গায়ের কাপড়-চোপড় খুলে সমস্ত শরীর ধুয়ে ফেলতে হবে
* বমি করাতে হবে এই জন্য স্বল্প গরম লোনা পানি পান করাতে হবে অথবা তিতা কোনো দ্রব্য মুখের মধ্যে দিয়েও বমি করানো যেতে পারে (যথা সিরাপ- ইপিফাক)।
* শ্বাসনালি পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা করতে হবে এবং রোগীকে খোলামেলা বাতাসে রাখতে হবে।
* ডেক্সটোজ স্যালাইন দিতে হবে।
* চোখের মনি সংকুচিত থাকলে শিরায় অ্যাট্রোপিন ইনজেকশন দিতে হবে।

 

গবাদিপশুকে ইউরিয়া বিষক্রিয়ায় করণীয়
* গরুর প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য খাদ্যে ০.৩৩ গ্রাম ইউরিয়া রক্তে অ্যামোনিয়ার মাত্রা বৃদ্ধি করে আবার ০.৪৪ গ্রাম ইউরিয়া/কেজি দৈহিক ওজনের ক্ষেত্রে ১০ মিনিটের মধ্যে বিষক্রিয়ার উপসর্গ হিসেবে পেটে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, ফেনাযুক্ত লালাঝরা, মাংসপেশির কম্পন, হাঁটতে অসম্মতি দেখা যাবে এবং ১-১.৫ গ্রাম/ কেজি পশুর মৃত্যু ঘটায়। ইউরিয়া বিষক্রিয়া দেখা গেলে আক্রান্ত প্রাণীকে প্রচুর পরিমাণে ঠাণ্ডা পানি (২০-৪০ লিটার) খাওয়াতে হবে। ছাগল ও ভেড়াকে ০.৫-১ লিটার ভিনেগার এবং গরুকে ২-৪ লিটার ভিনেগার খাওয়াতে হবে। মাংসপেশির কম্পনের ক্ষেত্রে ২০০ মিলিলিটার ক্যাল-ডি-ম্যাগ শিরায় ইনজেকশন করতে হবে। ডিহাইড্রেশনের ক্ষেত্রে ৫% ডেক্সট্রোজ স্যালাইন শিরায় প্রয়োগ করা যেতে পারে।

 

মো. আকতার হোসেন*
*প্রশিক্ষক, ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমী, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম, মোবাইল: ০১১৯৮০৮৯৫৭০

বিস্তারিত
ফাল্গুন মাসের কৃষি (১৪২২ কৃষিকথা)

ঋতুরাজ বসন্ত এসেছে আমাদের মাঝে। পত্রবিহীন গাছগুলো সজ্জিত হয়েছে নব পল্লবে। পাতা ঝড়ানো দিনগুলোকে পেছনে ফেলে প্রকৃতিতে লেগেছে নানা রঙের ছোঁয়া। ঘনকুয়াশার চাদর সরিয়ে প্রকৃতিকে নতুনভাবে সাজাতে, বাতাসে ফুলের সুবাস ছড়িয়ে দিতে ফাল্গুন আসে নতুনভাবে নতুন রূপে। নতুন প্রাণের উদ্যমতা আর অনুপ্রেরণা প্রকৃতির সাথে আমাদের কৃষিকেও দোলা দিয়ে যায় উল্লেখযোগ্যভাবে। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন ফাল্গুনের শুরুতেই আসুন সংক্ষিপ্তভাবে জেনে নেই বৃহত্তর কৃষি ভুবনে করণীয় দিকগুলো।
 

বোরো ধান

  • ধানের চারার বয়স ৫০-৫৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে;
  • সার দেয়ার আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে;
  • ক্ষেতে গুটি ইউরিয়া দিয়ে থাকলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে না;
  • ধানের কাঁইচ থোড় আসা থেকে শুরু করে ধানের দুধ আসা পর্যন্ত ক্ষেতে ৩/৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে;
  • পোকা দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে (আলোর ফাঁদ পেতে, পোকা ধরার জাল ব্যবহার করে, ক্ষতিকর পোকার ডিমের গাদা নষ্ট করে, উপকারী পোকা সংরক্ষণ করে, ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করে) ধানক্ষেত বালাই মুক্ত রাখতে হবে;
  • এ সময় ধানক্ষেতে উফরা, ব্লাস্ট, পাতাপোড়া ও টুংরো রোগ দেখা দেয়;
  • জমিতে উফরা রোগ দেখা দিলে যে কোনো কৃমিনাশক যেমন ফুরাডান ৫ জি বা কিউরেটার ৫ জি প্রয়োগ করতে হবে;
  • ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে এবং হেক্টরপ্রতি ৪০০ গ্রাম ট্রুপার বা জিল বা নেটিভ ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে দুইবার প্রয়োগ করতে হবে;
  • জমিতে পাতাপোড়া রোগ হলে অতিরিক্ত ৫ কেজি/বিঘা হারে পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে এবং জমির পানি শুকিয়ে ৭-১০ দিন পর আবার সেচ দিতে হবে;
  • টুংরো রোগ দমনের জন্য এর বাহক পোকা সবুজ পাতাফড়িং দমন করতে হবে।

গম

  • এ মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম পাকা শুরু হয়।
  • গম শিষের শক্ত দানা দাঁত দিয়ে কাটলে যদি কট কট শব্দ হয় তবে বুঝতে হবে গম কাটার সময় হয়েছে।
  • মাঠে অবস্থিত গম ফসল বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হলে কাটার আগে মাঠে যে জাত আছে সে জাত ছাড়া অন্য জাতের গাছ সতর্কতার সাথে তুলে ফেলতে হবে। নয়তো ফসল কাটার পর বিজাত মিশ্রণ হতে পারে।
  • সকালে অথবা পড়ন্ত বিকালে ফসল কাটা উচিত।
  • বীজ ফসল কাটার পর রোদে শুকিয়ে খুবই তাড়াতাড়ি মাড়াই ঝাড়াই করে ফেলতে হবে। সংগ্রহ করা বীজ ভালো করে শুকানোর পর ঠাণ্ডা করে সংরক্ষণ করতে হবে।

ভুট্টা (রবি)

  • জমিতে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ গাছের মোচা খড়ের রঙ ধারণ করলে এবং পাতার রঙ কিছুটা হলদে হলে মোচা সংগ্রহ করতে হবে;
  • বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে শুকনো আবহাওয়ায় মোচা সংগ্রহ করে ফেলতে হবে।
  • সংগ্রহ করা মোচা ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে;
  • মোচা সংগ্রহের পর উঠানে পাট বিছিয়ে তার ওপর শুকানো যায় অথবা জোড়া জোড়া বেঁধে দড়ি বা বাঁশের সাথে ঝুলিয়ে আবার অনেকে টিনের চালে বা ঘরের বারান্দায় ঝুলিয়ে শুকানোর কাজটি করে থাকেন। তবে যেভাবেই শুকানো হোক না কেন বীজ ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে।
  • ভুট্টার দানা মোচা থেকে ছাড়ানো অনেক কষ্টের কাজ। খুব অল্প খরচে ভুট্টা মাড়াইযন্ত্র কিনে অনায়াসে মোচা থেকে ভুট্টা ছাড়াতে পারেন।

ভুট্টা (খরিফ)

  • খরিফ মৌসুমে ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এখনই বীজ বপন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় যতœ নিতে হবে।
  • ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি ভুট্টা-৬, বারি ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-২, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৩, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৫ এসব।

পাট

  • ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত পাটের বীজ বপনের উপযুক্ত সময়;
  • পাটের ভালো জাতগুলো হলো ও-৯৮৯৭, ওএম-১, সিসি-৪৫, বিজেসি-৭৩৭০, সিভিএল-১, এইচসি-৯৫, এইচ এস-২৪;
  • স্থানীয় বীজ ডিলারদের সাথে যোগাযোগ করে জাতগুলো সংগ্রহ করতে পারেন;
  • পাট চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করে আড়াআড়িভাবে ৫/৬টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে।
  • সারিতে বুনলে প্রতি শতাংশে ১৭ থেকে ২০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বুনলে আরেকটু বেশি অর্থাৎ ২৫-৩০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়।
  • পাটের জমিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৭-১০ সেন্টিমিটার রাখা ভালো;
  • ভালো ফলনের জন্য শতাংশপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬০০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম এমওপি সার শেষ চাষের সময় মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে;
  • জমিতে সালফার ও জিংকের অভাব থাকলে জমিতে সার দেয়ার সময় ৪০০ গ্রাম জিপসাম ও ২০ গ্রাম দস্তাসার দিতে হবে;
  • চারা গজানোর ১৫ থেকে ২০ দিন পর শতাংশপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করেত হবে। এর ৩০ থেকে ৪০ দিন পর দ্বিতীয়বারের মতো শতাংশপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।  

শাকসবজি

  • এ মাসে বসতবাড়ির বাগানে জমি তৈরি করে ডাঁটা, কমলিশাক, পুঁইশাক, করলা, ঢেঁড়স, বেগুন, পটোল চাষের উদ্যোগ নিতে হবে; মাদা তৈরি করে চিচিঙ্গা, ঝিঙা, ধুন্দুল, শসা, মিষ্টিকুমড়া, চাল কুমড়ার বীজ বুনে দিতে পারেন;
  • সবজি চাষে পর্যাপ্ত জৈবসার ব্যবহার করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে জৈবসার ব্যবহার করলে সবজিক্ষেতে রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না।

গাছপালা

  • আমের মুকুলে অ্যানথ্রাকনোজ রোগ এ সময় দেখা দেয়। এ রোগ দমনে গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার পূর্ব পর্যন্ত আক্রান্ত গাছে টিল্ট-২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি অথবা ২ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া আমের আকার মটর দানার মতো হলে গাছে ২য় বার স্প্রে করতে হবে;
  • এ সময় প্রতিটি মুকুলে অসংখ্য হপার নিম্ফ দেখা যায়। আম গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার আগেই একবার এবং এর একমাস পর আর একবার প্রতি লিটার পানির সাথে ১.০ মিলি সিমবুস/ফেনম/ডেসিস ২.৫ ইসি মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপালা ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
  • কাঁঠালের ফল পচা বা মুচি ঝরা সমস্যা এখন দেখা দিতে পারে। এ রোগের হাত থেকে মুচি বাঁচাতে হলে কাঁঠাল গাছ এবং নিচের জমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আক্রান্ত ফল ভেজা বস্তা জড়িয়ে তুলে মাটিতে পুঁতে ধ্বংস করতে হবে। মুচি ধরার আগে ও পরে ১০ দিন পর পর ২/৩ বার বোর্দ্রাে মিশ্রণ বা ডায়থেন এম ৪৫ অথবা রিডোমিল গোল্ড প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া ফলিকুর নামক ছত্রাকনাশক প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছে ফুল আসার পর থেকে ১৫ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে;
  • বাডিং পদ্ধতিতে বরই গাছের কলম করতে পারেন। এজন্য প্রথমে বরই গাছ ছাঁটাই করতে হবে এবং পরে উন্নত বরই গাছের মুকুল ছাঁটাই করে দেশি জাতের গাছে সংযোজন করতে হবে;
  • কলা, পেঁপে বাগানে পরিচর্যা বা যতেœর প্রয়োজনীয় কাজগুলো দেরি না করে এখনই সম্পন্ন করে ফেলুন।

প্রাণিসম্পদ

  • রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। সে কারণে প্রয়োজনীয় টিকা প্রদান করতে হবে;
  • তাছাড়া ভিটামিন সি ও ভিটামিন ই এর অভাব ও দেখা দিতে পারে। তাই খাবারের সাথে ভিটামিন সরবরাহ করতে হবে;
  • গবাদিপশুকে প্রয়োজনীয় ভ্যাক্সিন দিতে হবে এবং কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে।
  • গবাদিপশুকে উন্নত খাবার যেমন-সবুজ ঘাস, ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র, ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক এসব খাওয়াতে হবে।
  • যে কোনো সমস্যা সমাধান করেত উপজেলা পশুসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।

মৎস্যসম্পদ

  • মাছ চাষের জন্য পুকুর তৈরি ও সংস্কার করার উপযুক্ত সময় এখন;
  • পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলে নিচ থেকে পচা কাদা তুলে ফেলতে হবে এবং শতাংশপ্রতি ১ কেজি চুন ও ১০ কেজি গোবর বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করতে হবে;
  • পানি ভর্তি পুকুরে প্রতি শতাংশে ৬ ফুট পানির জন্য ১ কেজি চুন গুলে ঠাণ্ডা করে দিতে হবে। এছাড়া শতাংশপ্রতি ১০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি একসাথে মিশিয়ে পানি ভর্তি পুকুরে দিতে হবে;
  • শীতের পর এ সময় মাছের বাড়বাড়তি দ্রুত হয়। তাই পুকুরে প্রয়োজনীয় খাবার দিতে হবে এবং জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে;
  • মাছ যদি রোগাক্রান্ত হয় তাহলে প্রতি শতাংশ হিসেবে ১ কেজি করে পাথুরে চুন ছিটিয়ে দিতে হবে। এরপরও যদি না কমে তাহলে ২ সপ্তাহ পর পর আরও ২/১ বার দিতে হবে।

সুপ্রিয় পাঠক প্রতি বাংলা মাসেই কৃষির সব কয়টি শাখার জন্য অনুসরণীয় শিরোনামে সংক্ষেপে কৃষিকথায় আলোচনা করা হয়ে থাকে। যৌক্তিক সীমাবদ্ধতার জন্য প্রতিটি বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করা সম্ভব হয় না। শুধুমাত্র আপনাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় করণীয় কাজগুলো। এগুলোর বিস্তারিত ও তথ্যবহুল বিশ্লেষণের জন্য আপনার কাছের কৃষি বিশেষজ্ঞ, মৎস্য বিশেষজ্ঞ ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে জেনে নিতে হবে। আমাদের সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা কৃষিকে নিয়ে যাবে সাফল্যের শীর্ষে। আবার কথা হবে আগামী মাসের কৃষিকথায়। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা।

 

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*
* তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর ১৪২২ কৃষিকথা

আকরাম হোসেন
নওগাঁ

প্রশ্ন : আমার ধানের চারা (বীজতলায়) হলুদ হয়ে যাচ্ছে। চারা বড় হচ্ছে না। এখন কী করতে পারি?
উত্তর : বোরো ধানের জন্য বীজতলার পানি ১-২ ইঞ্চি রাখতে হবে।
-পলিথিনের ছাউনি দিয়ে বীজতলা ঢেকে রাখতে হবে।
-শৈত্যপ্রবাহের সময় বীজতলার পানি সকালে বের করে দিয়ে নতুন পানি দিতে হবে।
-প্রতিদিন সকালে কুয়াশার পানি রশি টানা দিয়ে সরিয়ে দিতে হবে।
- ঠাণ্ডা সহনশীল জাত যেমন- ব্রি-ধান৩৬, ব্রি- ধান৫৫ চাষ করতে হবে।

 

গোলাম রাব্বানী
রংপুর

প্রশ্ন : আমার আলু গাছের বয়স ২০-২৫ দিন। পাতাগুলো প্রথমে কিনারা দিয়ে বাদামি দাগ হয় পরে ভেতরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাড়াতাড়ি দাগগুলো বাড়তে থাকে আর পরে কালো কালো হয়ে যায়। এখন কী করব?
উত্তর : আপনার আলু গাছে ছত্রাকজনিত রোগ হয়েছে, যাকে আগাম ধসা রোগ বলা হয়।
-এ রোগ প্রতিরোধে আপনি সুষম সার ও পরিমিত সেচ দিন।
-ঘন কুয়াশার কারণে এ রোগ বেশি ছড়াতে পারে সে ক্ষেত্রে প্রতিরোধক হিসেবে বর্দো মিক্সচার অথবা ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক (ডায়থেন এম-৪৫) ২-৩ গ্রাম রোভরাল ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর স্প্রে করুন।

 

মামুন
যশোর

প্রশ্ন : আমার আমগাছে মুকুল আসে কম এবং ঝরে পরে ও নষ্ট হয়। গাছের বয়স ৪-৫ বছর এ ক্ষেত্রে আমি কী করতে পারি জানাবেন কী?
উত্তর : ঘন কুয়াশায় আমের মুকুল নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে এ রকম আবহাওয়ায় বর্দো মিক্সচার বা মনিফার জাতীয় ছত্রাকনাশক ২ গ্রাম করে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। আমের মুকুল আসার ২ মাস আগে থেকেই সেচ ও সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। কিন্তু বছরে দুইবার সঠিক সময়ে কিস্তিতে সার দিলে আবার পরের বছর ভালো ফলন পাওয়া যাবে। মুকুল ঝরে পড়া থেকে রক্ষা পেতে মুকুল আসার আগেই যদি গাছে ১ মিলিলিটার রিপকর্ড/৩২.৫ মিলিলিটার কম্প্যানিয়ন নামক ছত্রাকনাশক স্প্রে করা যায় তাহলে মুকুল ঝরা রোধ করা সম্ভব।

 

সাইদুর রহমান
সিরাজগঞ্জ

প্রশ্ন : সরিষা গাছের পাতা কুঁকড়ে যায়। কালো কালো দেখা যাচ্ছে। পাতা, কা-, ডগা শুকিয়ে যাচ্ছে। গাছে ছোট ছোট পোকা আছে।  এ পোকা কীভাবে দমন করা যাবে?
উত্তর : সরিষা গাছে সাধারণত জাবপোকার আক্রমণে পাতা কা- ডগা শুকিয়ে যায়। পাতাও কুঁকড়ে যায়। জাবপোকা এক ধরনের রস নিঃসরণ করে তাতে শুঁটিমোল্ড জন্মে এবং কালো দেখায়। এ পোকা দমনে যা করতে হবে তাহলোÑ
-ভাট পাতা পিষে রস করে ১:১০ অনুপাতে মিশ্রণ তৈরি করে ছেঁকে ৭ দিন পর পর স্প্রে করা।
-নিমের বীজ ৫০ গ্রাম ১ লিটার পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে তা স্প্রে করা।
-১ লিটার পানিতে ৩ থেকে ৫ গ্রাম গুঁড়া সাবান মিশিয়ে স্প্রে করা।
-আলোক ফাঁদ ব্যবহার করা।
-প্রতি গাছে ৫০টির বেশি পোকা থাকলে প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলিলিটার ম্যালাথিয়ন বা সুমিথিয়ন  বা ডায়াজিনন মিশিয়ে বিকালে স্প্রে করা।
- আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটারে ০.৫ মিলি লিটার এডমায়ার বা তিতো মিশিয়ে স্প্রে করা।

 

শহীদুল ইসলাম
জামালপুর

প্রশ্ন : পেঁয়াজ গাছের পাতায় হালকা বাদামি বা কালো দাগ পড়ে। গাছ ওপর থেকে মরে আসছে, করণীয় কী?
উত্তর : এটা পেঁয়াজের ছত্রাকজনিত রোগ। স্যাঁতসেঁতে কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে করণীয় হলো-
-আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশ পুড়ে ফেলা।
-অতিরিক্ত সেচ দেয়া বন্ধ করা।
-বীজ শোধন করে বপন করা।
-রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ইপ্রোডিয়ন (ইতারাল, রোভরাল) এককভাবে অথবা ২ গ্রাম রোভরাল+২ গ্রাম রিডোমিল গোল্ড একত্রে মিশিয়ে স্প্রে করা।

 

সজীব
পাবনা

প্রশ্ন : হাঁসের প্লেগ হলে করণীয় কী?
উত্তর : সুস্থ হাঁসগুলোকে আলাদা করে ফেলতে হবে। অসুস্থগুলোকে মাটিতে পুঁতে ধ্বংস করতে হবে। ডাক প্লেগ, ঠিকা ১০০ মিলিলিটার পানির সঙ্গে ১ মিলিলিটার মিশিয়ে বুকের মাংসে দিতে হবে। ৬ মাস পর পর ৩ সপ্তাহ বা তদূর্ধ্ব বয়সের হাঁসকে দিতে হবে।

Ciprofloxacin Igm/litre Antibiotic injection অথবা Tablet renamycin Icc ওজন অনুযায়ী সেবন করাতে হবে। আক্রান্তগুলোকে আলাদা করে সুস্থদের ভ্যাক্সিনেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। সুস্থ অবস্থায় টিকা দিতে হবে।
-২৮ দিন বয়সের হাঁসের ক্ষেত্রে
Renamycin 100, 0.5cm/ Indigenous Duck DPV টিকা ১০০ সিসি পানিতে গুলিয়ে ১ সিসি পরিমাণ বুকের মাংসে দিতে হবে।
লক্ষণ দেখা দিলে আক্রান্তগুলো আলাদা করে ফেলতে হবে। মারা গেলে মাটির ২-৩ ফুট নিচে গভীরে পুঁতে ফেলতে হবে।

হরবোল
নাটোর

প্রশ্ন : গাঁট ফোলা রোগে করণীয় কী?
উত্তর : জীবাণুর সংক্রমণ রোধে সালফার ড্রাগস কিংবা অক্সিটেট্টাসাইক্লিন জাতীয় ড্রাগস ব্যবহার করতে হবে।
-ব্যথার জন্য ব্যথানাশক ইনজেকশন মাংসপেশিতে দিতে হবে।
-পাশাপাশি যে কোনো একটি অ্যান্টিহিস্টামিনিক ইনজেকশন দিতে হবে।
-করটিফোস্টেরয়েড ইনজেকশন দিলেও সুফল পাওয়া যায়।

 

শরীফ
জামালপুর

প্রশ্ন : গরুর কাঁধে ঘা হয়েছে। কী করণীয়?
উত্তর : আইভারমেকটিন (
Ivermectin) ০.২ মি. গ্রাম/ কেজি হিসেবে চামড়ার নিচে ২৮ দিন অন্তর দুইবার ইনজেকশন দিতে হবে।
০ নেগুভন ১-২% সলুশন দিয়ে আক্রান্ত স্থান ধুয়ে দিতে হবে। পাশাপাশি যে কোনো একটি অ্যান্টিহিস্টাসিনিক ইনজেকশন দিলে ভালো কাজ করে।
০ দ্বিতীয় পর্যায়ের জীবাণু সংক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সালফার ড্রাগ অথবা অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দিতে হবে।

আবু রায়হান
জয়পুরহাট

প্রশ্ন : পুকুরের পানিতে কতটুকু প্রাকৃতিক খাদ্য আছে তা কীভাবে জানব?
উত্তর : হাতের তালু পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে বা সেক্কি ডিস্ক (
Secchi disk) নামক যন্ত্রের সাহায্যে এ পরীক্ষা করা যায়। হাত কনুই পর্যন্ত ডুবিয়ে যদি হাতের তালু পরিষ্কার দেখা যায় তাহলে পুকুরে মাছের খাবার খুবই কম আছে বলে ধরে নিতে হবে। আর যদি না দেখা যায় এবং পানির রঙ সবুজ থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে পুকুরের পানিতে পর্যাপ্ত খাবার আছে। একইভাবে সেক্কি ডিস্ক যন্ত্রটি ১ থেকে ২ ফুট পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে এই পরীক্ষা করা যায়।


সুজন দেবনাথ
ময়মনসিংহ

প্রশ্ন : পুকুরের পানির ওপর সবুজ (ব্লুম) বা বাদামি বর্ণের আস্তরণ দেখা যায় কীভাবে সমাধান করা যায়? অনেক সময় লাল আস্তরও দেখা যায়।
উত্তর : কাপড় বা মশারি দিয়ে আস্তরণ তুলে ফেলতে পারলে ভালো যদি কাপড় বা মশারি দিয়ে সম্ভব না হয় তাহলে খড়ের দড়ি বেঁধে তা দিয়ে পুকুরের উপরে টেনে এক কোণায় এনে তুলে ফেলতে হবে। অথবা ব্লুম বা সত্বর একত্র করার পর ২০০-২৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দিলে তা নষ্ট হয়ে যাবে।
তুঁতের ব্যবহার : একরপ্রতি ২০-২৫টি ৫০ গ্রাম তুঁতের কাপড়ের পুঁটুলি বেঁধে খুঁটিতে বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে রাখা। শতকপ্রতি ০.৫ কেজি চুন প্রয়োগেও ফল পাওয়া যায়।


রেজাউল করিম
নাটোর

প্রশ্ন : মাছের ফুলকা পচা রোগ হলে কী করব?
উত্তর : প্রতি শতাংশে আধা কেজি চুন ৭ দিন পর পর দিতে হবে। চুন ১ কেজি/শতক হারে প্রয়োগ করতে হবে। ঘাযুক্ত মাছগুলো পুকুর থেকে তুলে ২০ লিটার পাত্রে পানি নিয়ে তাতে ২০০ গ্রাম লবণ মিশিয়ে পানিতে মাছগুলোকে ৫ মিনিট রাখতে হবে। অন্য একটি পাত্রে একই পরিমাণ পানি নিয়ে ৫ গ্রাম পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট মিশিয়ে ৫ মিনিটের জন্য মাছগুলোকে রাখতে হবে তারপর পুকুরে ছাড়তে হবে।
প্রতি কেজি খাবারের সাথে
teramycin ট্যাবলেট (৩ মিলিগ্রাম) একটি করে এক সপ্তাহ খাওয়াতে হবে।

 

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মারুফ*

*সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫

 

বিস্তারিত
সম্পাদকীয় মাঘ ১৪২২

নিম। ছোট্ট একটি নাম। নাম ছোট হলেও গুণে সমৃদ্ধ। ভেষজ গুণে গুণান্বিত এ গাছের রয়েছে পরিবেশ বিশেষ করে বাতাস বিশুদ্ধ ও ঠাণ্ডা রাখার গুণাবলি। এ কারণে প্রত্যেক বসতবাড়িতে, মানুষের চলাচলের পথের পাশে, মরুর দেশে নিমগাছ থাকা বাঞ্ছনীয়। নিম মানুষের বিভিন্ন রোগবালাইয়ে যেমন উপকারী তেমনি ফসলের রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনের জন্যও উপকারী। বীজ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নিমপাতার ভূমিকা অতুলনীয়। নিমের ফুল, ফল, পাতা, ছাল, শিকড় সবই ওষুধিগুণে ভরা। এ ছাড়া নিমের কাঠ ঘরের খুঁটি, চেয়ার ও টেবিল প্রভৃতি আসবাবপত্র নির্মাণ করার জন্য খুবই উপযোগী। শুধু ভেষজ গুণই নয়, কণ্টকবিহীন এ বৃক্ষটির শাখা ও পত্রবিন্যাস অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। প্রাকৃতিক শোভাবর্ধনকারী এ বৃক্ষটি শহর অঞ্চলের জন্য খুবই উপযোগী। নিমের বহুবিধ  গুণাগুণের কথা বিবেচনা করেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিমকে ‘একুশ শতকের বৃক্ষ’ বলে ঘোষণা করেছে। বিশ্ব পরিবেশ বিপর্যয় রোধে নিমগাছ অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। নিম এমনই একটি বৃক্ষ যা পৃথিবীর সর্বত্রই জন্মাতে পারে। নিমের এহেন গুণের কথা বিবেচনা করে প্রত্যেককেই বেশি করে নিমের চারা রোপণ করা উচিত।


প্রিয় চাষি ভাইয়েরা, আপনারা জানেন বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। অন্যান্য ফসল ও সম্পদেও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আশার কথা, মিঠাপানির মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম স্থান লাভ করেছে। এ অবস্থার আরো উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার মিঠাপানির মৎস্য এবং সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ আহরণের মাত্রা বৃদ্ধির কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, এ বছর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ‘ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ’ প্রযুক্তিকে ‘বিশ্ব গুরুত্বপূর্ণ কৃষি ঐতিহ্য পদ্ধতি (জিআইএএইচএস) হিসেবে মনোনীত করেছে। এ ছাড়া আর একটি উৎসাহব্যঞ্জক বিষয় হলো কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ বছরই প্রথম তিন দিনব্যাপী ‘জাতীয় সবজি মেলা’ উদযাপন করা হচ্ছে। দানাদার খাদ্য ফসলের পাশাপাশি হরেক রকম শাকসবজি উৎপাদন ও গ্রহণের মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনই সবজি মেলার মূল উদ্দেশ্য। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ সফল করতে এবং নিজেদের খাদ্য ও পুষ্টির জোগান নিশ্চিত করতে আসুন সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালাই, দেশকে আরো সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাই।

 

বিস্তারিত

COVID19 Movement Pass Online Police Clearance BD Police Help line Expatriate Cell Opinion or Complaint NIS Bangladesh Police Hot Line Number Right to Information PIMS Police Cyber Support for Women BPWN Annual Training Workshop Achievement & Success PHQ Invitation Card
Press Release Recruitment Information Procurement / Tender Notice Legal Instrument Innovation Corner Detective Magazine Bangladesh Football Club Diabetes-Covid19 Exam Results Accident Info Important Forms

Apps

icon icon icon icon icon icon