তিনভাগ জল আর ১ ভাগ স্থলভিত্তিক বাংলার সিংহভাগ বাস্তবতা দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল। বৃহত্তর বরিশালের কথাই বলি। এখানে পানি আর পানি অথৈই পানি। বছরের ৬ থেকে ৭ মাস পানি বন্দি থাকে সিংহভাগ এলাকা। নিজেদের বাঁচার তাগিদে তারা উদ্ভাবন করেছে একটি বিশেষ প্রযুক্তিগত পদ্ধতি। ভাসমান এ পদ্ধতিকে তারা স্থানীয় ভাষায় বলে ধাপ পদ্ধতি বা বেড় পদ্ধতি। পানিতে ভাসমান বলে ভাসমান পদ্ধতি। আর কচুরিপানা টেপাপানা দিয়ে ধাপে ধাপে এ কাজটি সাজানো হয় বলে ধাপ পদ্ধতিও। দূর থেকে মনে হয় সবুজের জৈব গালিচা। দেখলে তখন মনে হয় অনিন্দ্য সবুজ সুন্দর ভুবন। সেখানে পুরুষ মহিলাদের সম্মিলিত বিনিয়োগে সৃষ্টি হচ্ছে দেশের এক প্রতিশ্রুত ইতিহাস আর সমৃদ্ধির হাতছানি। জোয়ারের পানিতে ভাসছে, আর ভাটায় জেগে উঠা উজানি চরে ভিন্নভাবে জেগে উঠেছে এসব। কৃষক দিনের পর দিন দেখে, শুনে, বুঝে প্রয়োজনে ভাসমান বা কচুরিপানার ধাপ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। মাটি ছাড়া পানিতে চাষাবাদের বিজ্ঞানীদের দেয়া কেতাবি নাম হাইড্রোপনিক পদ্ধতি। বরিশাল জেলার বানারীপাড়া, আগৈলঝাড়া উজিরপুর, পিরোজপুরের নাজিরপুর ও স্বরূপকাঠি উপজেলার বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে সবজি চাষ করছেন অগণিত কৃষকরা। বর্ষায় এসব এলাকার হাজার হাজার হেক্টর নিচু জমি জলে বন্দি থাকে। জলাবদ্ধতা আর কচুরিপানা অভিশাপ কৌশলের কারণে পরিণত হলো আশীর্বাদে। ধারণা করা হয় পদ্ধতিটি প্রথম বের করেন নাজিরপুরের কৃষকরা। সেখানেই শুরু হয় ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ।
এমনিতে সারা বছর নিচু জমিতে জোয়ার ভাটার কারণে জমি পানিতে জলাবদ্ধ থাকে। ভাসমান কচুরিপানা পানিতে ভেসে থাকত প্রায় বছরব্যাপী। সাধারণভাবে কচুরিপানা বহুমাত্রিক অসুবিধার কারণ। এ জঞ্জাল কচুরিপানাকে তারা ধাপে ধাপে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করে। তারপর সেসব ধাপের উপর টেপাপানা দিয়ে তৈরি করে ভাসমান বীজতলা। এভাবে ভাসমান ধাপের উপরে বিভিন্ন রকম সবজির দৌলা দিয়ে মনের মাধুরি দিয়ে সাজায় নান্দনিক ভাসমান বীজতলা। সেসব ভাসমান বীজতলায় কোনোটায় পেঁপে, লাউ, কুমড়া, শিম, বরবটি আবার অন্যগুলো টমেটো, বেগুন, করলা, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, সবুজ ফুলকপি, শসার চারা উৎপাদন এবং লাউশাক, লালশাক, পালংশাক, ডাঁটাশাক বা সাদা শাকের চাষও করেন। এসব ভাসমান বীজতলাগুলো যাতে ভেসে না যায়, সেজন্য তারা শক্ত বাঁশের খুঁটির সাথে বেঁধে রাখে। শুকনো মৌসুমে পানি সরে গেলে সেসব কচুরিপানার ধাপ জমিতে মিশে জৈব পদার্থের অতিরিক্ত জোগান দেয়। জমি হয় উর্বর। শুকনো মৌসুমে এখানকার মানুষরা চাষ করে বোরো ফসল। এত দিন তারা ভাসমান বীজতলায় কোনো রাসায়নিক সার ব্যবহার করত না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পরামর্শে অল্প পরিমাণ ইউরিয়া সার ব্যবহার করে ভালো ফল পাচ্ছেন। আগে যেখানে সবজির চারাগুলো ছিল কিছুটা লিকলিকে দুর্বল এখন আধুনিক ব্যবস্থা অবলম্বনে আর মানসম্মত বীজ ব্যবহারে শক্ত সবল স্বাস্থ্যবান চারার ফলনে সুফল পাচ্ছেন।
কেউ জানে না কখন থেকে শুরু এর পথচলা। ১৫০ বছরের ইতিহাস। একদিনে আসেনি। ইতিহাস ঘেঁটে যতদূর সম্ভব জানা গেছে বাবা দাদা চৌদ্দ পুরুষের ঐতিহ্যকে ধারণ করে লালন করে সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে ভাসমান চাষ পদ্ধতি আজকের একবিংশ শতাব্দীর এ প্রান্তে এসেও প্রাণবন্ত যৌক্তিক আবশ্যকীয় এবং অবশ্যই সমসাময়িক পরিবর্তিত জলবায়ুর অভিযোজন কৌশলে পরিবেশবান্ধব। সম্পূর্ণ স্থানীয় প্রযুক্তিতে বিল অঞ্চলের পতিত জমির পানিতে ভাসমান পদ্ধতিতে বিভিন্ন শাকসবজির চারা উৎপাদন ও চাষাবাদে ব্যাপক সফলতা পেয়েছে এ এলাকার কৃষকরা। এ পদ্ধতির সুফল ছড়িয়ে পড়ছে আকৃষ্ট করেছে পার্শ্ববর্তী উপজেলা ও জেলাগুলোর কৃষকদেরও। এসব গ্রামগুলোতে বৈশাখ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত থৈ থৈ করে পানিতে। ফলে এ সময় কৃষিকাজ না থাকায় আগে অলস সময় কাটাত। এ এলাকার মানুষরা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে নাজিরপুর উজিরপুর বানারীপাড়া স্বরূপকাঠির হাজারো পরিবারের সহস্র্রাধিক মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছেন ভাসমান ধাপের ওপর সবজি চারা ও সবজি মশলা উৎপাদন এবং ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে।
কৃষকরা নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরও স্বাবলম্বী করছেন। সবজির চারা পরিবহন ও কেনা-বেচার মাধ্যমে জীবন-জীবিকার নতুন প্রতিশ্রুত অধ্যায় রচিত হয়েছে কয়েক লাখ মানুষের। আগের অনাবাদি জমি বর্তমানে খুবই মূল্যবান হয়ে উঠেছে সে এলাকার লোকদের কাছে। জলসীমায় কৃষির এ বিশেষ চাষ পদ্ধতির কারণে সারাদেশে বরিশালের বিশেষ অঞ্চলগুলো পায়োনিয়ার হয়ে আছে সারাদেশে। সবশেষ এ চাষ পদ্ধতির প্রবর্তন করেন জেলার নাজিরপুর উপজেলা ও নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) উপজেলার কৃষকরা। আস্তে আস্তে এ চাষাবাদ ছড়িয়ে পড়ে বরিশাল, গোপালগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, খুলনা, যশোর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুরসহ পানিযুক্ত বিল এলাকায়। বিল এলাকা হওয়ায় বছরের বেশিরভাগ সময় এসব জমি পানিতে তলিয়ে থাকে। ফলে সেসব জমিতে কোনো ফসল চাষ করা সম্ভব হয় না। জমিগুলো কচুরিপানা, টেপাপানা, ক্ষুদেপানা, দুলালীলতা, কলমিলতা, শেওলা ও ফ্যানা ঘাসসহ বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদে ভরা থাকে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে কৃষকরা সম্মিলিত যৌক্তিক উদ্যোগের ব্যবস্থা নেন তারা। জমির পানিতে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া উদ্ভিদকে স্তূপ করে বিশেষ এ পদ্ধতিতে পানির উপরেই কৃষকরা ধাপের উপর প্রায় সব ধরনের শাকসবজির চারা ও শাকসবজি উৎপাদন করেন। নির্দিষ্ট কয়েক উপজেলার উৎপাদিত চারাই দক্ষিণাঞ্চলের চারার চাহিদা পূরণ করে অন্য অঞ্চলেও যায়। বর্তমানে সেসব বিল অঞ্চলে শত শত হেক্টর জলাবদ্ধ জমিতে অন্তত ২৫ হাজার কৃষক ও চারা ব্যবসায়ী চাষাবাদ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। আগে চারা বিক্রি করে খুব একটা লাভবান না হলেও বর্তমানে চারার দাম ভালো থাকায় কৃষকরা খুশি।
সময়কাল
এ অঞ্চলের ধানি জমিতে বাংলা বছরের অগ্রহায়ণ থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত বোরো ধানের চাষ হয়। এরপর জ্যৈষ্ঠ থেকে অগ্রহায়ণ মাস ৭ থেকে ৮ মাস পর্যন্ত ৭ থেকে ৮ ফুট পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে এসব জমি। তাই এ সময় এখানকার মানুষ বেকার হয়ে পড়েন। যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। আষাঢ় মাসে কচুরিপানা সংগ্রহ করে স্তূপ করা হয়। জলাভূমিতে প্রথমে কচুরিপানা এবং পর্যায়ক্রমে শ্যাওলা, দুলালীলতা, টোপাপানা, কুটিপানা, কলমিলতা, জলজ লতা স্তরে স্তরে সাজিয়ে ২ থেকে ৩ ফুট পুরু করে ধাপ বা ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়। ধাপ দ্রুত পচানোর জন্যও সামান্য পরিমাণ ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়। এ ধাপ চাষের উপযোগী করতে ৭ থেকে ১০ দিন প্রক্রিয়াধীন সময় রাখতে হয়। দক্ষতা আর কার্যক্ষমতা আর কারশিমার কারণে এলাকার চাষিরা এখন বর্ষা পেরিয়ে সুদিনে খালে ভাসমান শাকসবজির আবাদ করেন। সারা বছরের প্রাসঙ্গিক জোগান নিশ্চিত রাখেন।
বেডের আকার
একেকটি ভাসমান ধাপ বেড কান্দি ৫০ থেকে ৬০ মিটার (১৫০ থেকে ১৮০ ফুট) লম্বা ও দেড় মিটার (৫ থেকে ৬ ফুট) প্রশস্ত এবং ১ মিটারের কাছাকাছি (২ থেকে ৩ ফুট) পুরু বা উঁচু বীজতলা ধাপ তৈরি করে তার উপর কচুরিপানা এবং পর্যায়ক্রমে শ্যাওলা, দুলালীলতা, টেপাপানা, কুটিপানা, কলমিলতা, জলজলতা স্তরে স্তরে সাজিয়ে নারিকেলের ছোবড়ার গুঁড়া ও ক্ষুদ্রাকৃতির বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ পচিয়ে বীজতলার উপর ছড়িয়ে দেয়। সেখানেই বীজ বপন করে উৎপাদন করা হয় বিভিন্ন প্রজাতির শাক আর দৌলা বা মেদা সাজানো চারা, এমনকি অল্প জীবনকাল সম্পন্ন বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি। সারি সারি এসব বেড বা ধাপ জলজ বিলে অপরূপ রূপের মাধুরি ছড়িয়ে যেন নতুন এক সবুজের কারুকার্য খচিত মানচিত্র তৈরি করে।
দৌলা বা মেদা
ভাসমান বা ধাপ পদ্ধতিতে সরাসরি বীজ বপন সম্ভব না হওয়ায় কৃষকরা প্রতিটি বীজের জন্য এক ধরনের আধার তৈরি করেন। তারা এর নাম দিয়েছেন দৌলা বা মেদা। একমুঠো আধা পচা টেপাপানা বা ছোট কচুরিপানা, দুলালীলতা দিয়ে পেচিয়ে বলের মতো করে তার মধ্যে মধ্যে নারিকেল ছোবড়ার গুঁড়া দিয়ে তৈরি করা হয় দৌলা। সাধারণত নারীরা দৌলা তৈরির কাজ করেন। এ দৌলার মধ্যে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে গর্ত করে বিভিন্ন সবজির অঙ্কুরিত বীজ পুঁতে মাচানে বা রাস্তার পাশে শুকনো জায়গায় রাখা হয়। এর আগে ভেজা জায়গায় বীজ অঙ্কুরিত করে নেয়া হয়। দৌলাগুলো এভাবে ৩ থেকে ৭ দিন লাইন করে রাখা হয়। ৭ থেকে ১০ দিন পর গজানো চারাগুলো ভালোভাবে বেরিয়ে আসলে ধাপে স্থানান্তরের কার্যক্রম শুরু হয় এবং ধাপে স্থানান্তর করেন।
ধাপ কৌশল ও যত্ন
ধাপ তৈরির পর ধাপে জৈব উপকরণ দ্রুত পচাতে ব্যবহার করা হয় সামান্য পরিমাণ ইউরিয়া সার। এ ধাপ চাষের উপযোগী করতে সাত থেকে ১০ দিন প্রক্রিয়াধীন রাখতে হয়। একটি ধাপের মেয়াদকাল কম বেশি সাধারণত ৩ মাস। ধাপে অঙ্কুরিত চারা পরিপক্ব চারায় পরিণত হয় মাত্র ২০ থেকে ২২ দিনে। যে কারণে পুনরায় ব্যবহার করার জন্য ধাপগুলোর সামান্য পরিবর্তন করতে হয়। এরপর ৫ থেকে ৬ দিন পরপর ভাসমান ধাপের নিচ থেকে টেনে এনে নরম কচুরিপানার মূল বা শ্যাওলা টেনে এনে দৌলার গোড়ায় বিছিয়ে দেয়া হয়। এতে দৌলাগুলো একে অপরের সাথে গায়ে গায়ে লেগে থাকে, আর জীবনের সঞ্জিবনী শক্তি পায় এখান থেকে। এ যেন পরম মমতায় উদ্ভিদের যান্ত্রিক শক্তি প্রদানের ব্যবস্থা। এরপর শুধু চারাগুলোর বেড়ে উঠার গল্প। কিন্তু এযে তরতর করে চারাগুলোর বেড়ে উঠা, এজন্য করতে হয় নিয়মিত পরিচর্যা আর যত্নআত্তি। এর মধ্যে পড়ে প্রতিদিন ধাপে হালকা করে পানি সেচ দেয়া। যাতে করে চারার গোড়া শুকিয়ে না যায়, সজীব থাকে। আর অল্প পরিমাণ ইউরিয়া সার ছিটানো। এভাবে মাসাধিক কাল যত্ন শেষে বিক্রির জন্য তৈরি হয়। বীজতলার মালিকরা অপেক্ষা করেণ মহাজন ফড়িয়ার জন্য।
এভাবেই বীজ থেকে চারা উৎপাদন করা হয়। একটি অঙ্কুরিত বীজ বীজতলায় রোপণ করার ২০ থেকে ২২ দিনের মাথায় পূর্ণবয়স্ক চারায় রূপান্তরিত হয়। ১ সপ্তাহের মধ্যে কৃষক বা চারার পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যান এসব চারা। জৈবসারে উৎপাদিত এসব চারার উৎপাদন খরচ পড়ে ১ থেকে দেড় টাকা। ১ হাজার চারা আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। শাকসবজি বড় হলে চাষিরা ধাপ থেকে তুলে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। পুরনো ধাপ কিনে কৃষকরা এর স্বল্প জীবনকালীন বিভিন্ন শাকসবজির আবাদ করেন। তাছাড়া পানি কমে গেলে এসব ধাপ মাটির সাথে মিশে জৈবসার হিসেবে কাজে লাগে মাটির উর্বরা শক্তি বাড়ায়।
যেভাবে চাষ হয়
নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাটির পরিবর্তে পানিতে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সরবরাহ করে সবজি উৎপাদনের এটি একটি বিশেষ কৌশল। পানিতে ভাসমান এ পদ্ধতিতে সারা বছরই সবজি উৎপাদন করা সম্ভব। এতে রোগবালাই কম হয়। এমনকি বালাইনাশক তেমন ব্যবহার করতে হয় না। পানির উপর ভাসমান সবজি চাষ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে নিয়েছে ধাপ অঞ্চলের মানুষ। এক সময় দেউলিয়া অঞ্চল হিসাবে খ্যাত এলাকার অভাবি মানুষগুলো এখন বেশ সুখেই আছে। হাইলা কামলার পরিচয় মুছে গেছে উপজেলার হাজার লাখো মানুষের। তারা সবাই এখন একেকজন গর্বিত কৃষক পরিবারের প্রতিনিধি। অদম্য সাহস ও কঠোর পরিশ্রম নিয়ে কৃষিকাজে নেমে পড়েছে ভাটি অঞ্চলের মানুষগুলো। সবাই না হলেও দু-এক পরিবার বাদে অধিকাংশ পরিবার আজ তাদের পেশাগত পরিচয় পেয়েছে বিষমুক্ত সবজি চাষি হিসেবে। নিমজ্জিত জমির পানির ওপর ভাসমান পদ্ধতিতে বীজতলা এবং কান্দিবেড় পদ্ধতির চাষাবাদ উদ্ভাবন করে এসব জমিতে ২৩ থেকে ২৫ ধরনের শাকসবজির, মসলা এবং চারা উৎপাদন করা হচ্ছে। এখানে বছরে প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন সবজি উৎপন্ন হচ্ছে। এখানকার বিশালাকারের কুমড়া, বড় ও সতেজ বাঁধাকপি, ফুলকপি, মরমা, শিম, মুলা, বেগুন, টমেটো, শালগম, আলু, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা, ধুন্দুল, করলাসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি দিয়ে থরে থরে সাজানো নৌকাগুলো যখন সকালের সোনালি রোদে লাইন ধরে স্থানীয় বাজারগুলোতে যায় এবং বাজারে গিয়া নৌকায় নৌকায় বাজার বসায় সে অপরূপ দৃশ্য যে কোনো পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই।
চাষ এলাকা
নাজিরপুর, বানারীপাড়া উপজেলার দেউলবাড়ী দোবড়া ও মালিখালী, পদ্মডুবি, বিলডুমুড়িয়া, বেলুয়া, মনোহরপুর, মুগারঝোর, গাঁওখালী, বৈটাকাঠা, সাচিয়া, চিথলিয়া, কলারদোয়ানিয়া, যুগিয়া, গাওখালী, সোনাপুর, মেদা, পুকুরিয়া, পেনাখালী, মিঠারকুল, পদ্মডুবি, বিলডুমুরিয়া, গজারিয়া চামী ও গগন, প্রভৃতি এলাকায় ভূপ্রকৃতিগতভাবে অঞ্চলভেদে পানিবন্দি জলাবদ্ধ মানুষগুলো জলাভূমিতে বাণিজ্যিকভাবে ভাসমান ধাপের উপর শাকসবজির চারা উৎপাদন হয়। নাজিরপুরের পাশাপাশি নেছারাবাদ উপজেলার বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার বিশারকান্দি, মরিচবুনিয়া, উমারেরপাড়, কদমবাড়ী, মলুহারসহ বিভিন্ন গ্রামের জলাভূমিতে ব্যাপকহারে ধাপ চাষ হচ্ছে। এছাড়া গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া বর্নীর বিল, চান্দার বিল ও কোটালীপাড়ার বাইগ্যারবিলে এ পদ্ধতির চাষ হচ্ছে। এছাড়া সুনামগঞ্জ আর চাঁদপুর নেত্রকোনার বিস্তৃত অঞ্চল তো রয়েছেই।
ভাসমান পদ্ধতির এ চাষে নারী-পুরুষ-শিশু সবাই কাজ করে থাকে। পুরুষরা ধাপ তৈরি, চারা স্থাপন, পরিচর্যা ও উৎপাদিত চারা বিক্রির কাজ করেন। আর নারী ও শিশুরা বাড়িতে বসে চারা তৈরির প্রাথমিক স্তর বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটানো, দৌলা তৈরির কাজ করেন। তারা ঘরে বসে শ্যাওলা, নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে ছোট ছোট বল তৈরি করেন। স্থানীয় ভাষায় একে টেমা বা মেদা বা দৌলা বলা হয়। এর মধ্যে বীজ রেখে অঙ্কুরোদগম ঘটানো হয় যা ভাসমান ধাপের উপর স্থাপন করে পরিচর্যার পর নির্দিষ্ট সময় পরে চারায় পরিণত হয়। এছাড়া সে ধাপের উপর সরাসরি কিছু সবজির অঙ্কুরোদগম ঘটানো হয়। ধাপ চাষিরা লাউ, শিম, বেগুন, বরবটি, করলা, পেঁপে, টমেটো, শশা, পুঁইশাক, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, মরিচ, ও মশলার চারা তৈরি করেন। কেউ কেউ সে ধাপে হলুদ, মরিচ, আদা, লালশাক ও ঢেঁড়স আবাদ করেন। পাইকারি ক্রেতারা নদী পথে এসে ধাপ থেকে সরাসরি চারা কিনে সবজি আবাদকারীদের কাছে তা বিক্রি করেন।
আয় ব্যয়
সাধারণভাবে ৫০ থেকে ৬০ মিটারের একটি সারি, দল বা ধাপ তৈরি করতে খরচ হয় ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। এ ধরনের একটি ধাপ তৈরির জন্য একজন মানুষের ২৫০ টাকা মজুরি হিসেবে ৬ দিন ৮ থেকে বা ১০ ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হয়। ধাপের জন্য ১ হাজার টাকার কচুরিপানা, ১ হাজার টাকার দুলালীলতা, ১ হাজার টাকার টেপাপানার দরকার হয়। ধাপে একজন কৃষক একটি বেড থেকে প্রথম ২০ থেকে ২২ দিনের মধ্যে আয় করেন ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। ধাপে ৬ ইঞ্চি দূরত্ব করে ১টি চারা স্থাপন করলে ১টি সারিতে মোট ২ হাজার ৪৫০টি চারা রোপণ করা যায়। প্রতি চারা পাইকারি ৩ টাকা বিক্রি করা হয়। পুনরায় ধাপ প্রস্তুত না করে প্রথমবার ব্যবহৃত ধাপ আবার অন্য কৃষকের কাছে বিক্রিও করে দেয়া যায় বা দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা যায়। প্রথমবার ব্যবহৃত ধাপ বিক্রি হয় ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকায়। অনেকে ধাপ পদ্ধতি হতে বছরে একর প্রতি ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা লাভ করেন। ১০০ ফুট লম্বা একটি ধাপ তৈরি এবং চারা উৎপাদনে ৫ মাসে ব্যয় হয় ১৫ হাজার টাকা। ধাপ থেকে চারা বিক্রি করা হয় ২৫ হাজার টাকা।
এসব উপজেলার প্রায় ২৫ হাজার নারী শ্রমিক এ চারা উৎপাদনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। একজন ধাপ শ্রমিক প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা আয় করেন। প্রতিদিন মহিলারা গড়ে ১ হাজার থেকে ২ হাজার দৌলা তৈরি করতে পারেন। এ কাজে একজন নারী শ্রমিক প্রতিদিন গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পান। ঝড় ও জলোচ্ছ্ব্াস এ পদ্ধতির চাষাবাদে তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারে না। একধাপে এক মৌসুমে চারা উৎপাদন ও বিক্রি করে একরে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা লাভ থাকে।
প্রযুক্তিকে ফলপ্রসূ করতে হলে
ভাসমান প্রদ্ধতি প্রযুক্তি পরিবেশবান্ধব কৃষির জন্য আর্শীবাদ। এ কৌশলকে আরও ফলপ্রসূ প্রাণবন্ত করতে হলে আমাদের সম্মিলিতভাবে করতে হবে ০১. মানসম্মত বীজ ব্যবহার ও চাহিদাভিত্তিক বীজের দোকান, বীজ ব্যবসা; ০২. বীজ, সার, বালাইনাশক উপকরণের গুণগতমান নিশ্চিত করে স্থানীয় উপকরণ বাণিজ্য; ০৩. এলাকাভেদে বিএডিসির বীজ বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন; ০৪. চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পুঁজি ও সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা নিশ্চিতকরণ; ০৫. উৎপাদিত চারা এবং সবজির সুষ্ঠু বাজারজাতকরণ; ০৬. ভাসমান উৎপাদনের উপকরণসহ অন্যান্য উৎপাদিত পণ্য পরিবহনের জন্য উন্নত ব্যবস্থা চালু; ০৭. মধ্যসত্ত্বভোগী ফড়িয়া দালালের দৌরাত্ম্য যৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ ও কমানো; ০৮. সুধীজনের কার্যকর পৃষ্ঠপোষকতা; ০৯. এসব এলাকায় প্রয়োজনীয় হিমাগার স্থাপন ও ব্যবস্থা; ১০. কচুরিপানা চাষাবাদ করার কৌশল উদ্ভাবন; ১১. সরকারি বেসরকারি কোনো প্রয়োজনীয় সহায়তা বা পরামর্শ পাওয়ার উপযুক্ত উৎস ও কেন্দ্র; ১২. শুষ্ক মৌসুমে জলাশয়ের পরিবর্তে খালে বা পতিত জলসীমায় এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ কনটিনিউ করা; ১৩. সার্বিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিতকরা; ১৪. সংশ্লিষ্ট সবার যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বাড়ানোর পদক্ষেপ। এ কাজগুলো যথাযথভাবে করতে পারলে ভাসমান শাকসবজি চাষ আমাদের অনেক দূরের আলোকিত বাতিঘরে নিযে যাবে।
অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি না হলে এবং কোন বিপর্যয় না ঘটলে মৌসুমে ৪ থেকে ৫ বার চারা উৎপাদন করে বিক্রি করা সম্ভব। নিজস্ব উদ্ভাবনী ভাসমান ধাপ পদ্ধতির চাষে ভাটি অঞ্চলের চাষিরা ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি জমি পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের কৃষি খাতে যে ক্ষতির সম্ভাবনা আছে তা ভাসমান চাষ পদ্ধতি দিয়েই অনায়াসে মোকাবিলা করা সম্ভব। দেশের ৪৫ লাখ হেক্টর জল সীমার মধ্যে অর্ধেক বা তার অর্ধেক কিংবা তারও অর্ধেক বিল জলসীমাতেও যদি ভাসমান সবজির আবাদ করা যায় তাহলে আমরা ভাবতে পার কত অভাবনীয় উন্নয়ন আর বিস্তৃতি আমাদের ছায়ার মতো আগলে রাখবে কৃষি সমৃদ্ধিতে? যদি বানারপাড়া নাজিরপুরের ভাসমান চাষাবাদ পদ্ধতি ও কৌশল দেশের অন্য স্থানে গুরুত্ব দিয়ে পদ্ধতির চাষাবাদের বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে ফল আসতে বেশি সময় লাগবে না। আর সমন্বিত প্রচেষ্টায় ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদে কৃষক অধিকতর সফলতা পেলে ভাসমান চাষ পদ্ধতি বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। জীবনের আর্থসামাজিক পরিবর্তনে আসবে আশা জাগানিয়ার বাস্তব গল্প। যাতে জড়িয়ে আছে প্রযুক্তি দিয়ে প্রাকৃতিক চলমান বাস্তবতার সাথে সাথে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকার অন্যরকম স্বাদ, তৃপ্তি ও অবলম্বন। প্রাকৃতিক সমস্যা দূর করে এখানকার মানুষ প্রত্যয়ে প্রতিশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠা করেছে অনিন্দ্য সুন্দর সবুজ খয়েরি মাটি রঙের কাব্যগাঁথা। প্রকৃতির সাথে সংগ্রামরত মানুষের এভাবে বেঁচে থাকার উদাহরণ হতে পারে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জলাবদ্ধ এলাকার কৃষির ভাসমান কাব্যগাঁথার বাস্তবতা। পানি বন্দি বা ২ লাখ হেক্টর জলাবদ্ধ এলাকার মানুষের। বাঁচতে শেখার মন্ত্রে অনুপ্রাণিত করতে পারে এ জ্বলন্ত প্রমাণ। জরিপ ও অভিজ্ঞতা বলে এরকম আরও হাজার লাখ হেক্টর জমিকে খুব সহজেই ভাসমান চাষের আওতায় আনা সম্ভব। শুধু কি তাই বিশাল বাংলার যেখানে অবারিত জলরাশির সীমানা ৩ থেকে ৪ মাস খালি পড়ে থাকে সেখানে পরিবেশবান্ধব ভাসমান সবজির বীজতলা পদ্ধতি অনুসরণ করা যায় অনায়াসে। তখন অতিরিক্ত সমৃদ্ধির গতিতে এগোবে বাংলার কৃষি এবং অবশ্যই বাংলাদেশ। প্রতিকূল পরিবেশে এদেশের কৃষকদের ব্যতিক্রমী ও সৃজনশীল উদ্ভাবনী উদ্যোগই আমাদের ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা। আর এ আলোর পথের সহযাত্রী হতে পারলে আমরাও হব আলোকিত মানুষ সমৃদ্ধ বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক।
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
* উপপরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫
ফলগাছের দৈহিক কাঠামোকে সুগঠিত করা, আকার আকৃতি নিয়ন্ত্রণ করা, নতুন অঙ্গজ বৃদ্ধিকরণ, পুষ্পায়ন ও ফলধারণে গাছের অপ্রয়োজনীয় মূল, শাখা, প্রশাখা ও পাতা ছাঁটাই করা প্রয়োজন। ছাঁটাইকরণ সাধারণত গাছের জাত, বয়স, তেজ, ফুল ধারণ ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। ছাঁটাইকরণের প্রভাব বিভিন্ন গাছে বিভিন্ন ধরনের হয়। আমগাছ ছাঁটাই করলে একান্তর ক্রমিক ফলধরা সমস্যা অনেকাংশে কমে যায় এবং ফলন বৃদ্ধি পায়। কুলগাছ পত্রপতনশীল বৃক্ষ হওয়ায়, ডালপালা ছাঁটাইকরণ নিয়মিত প্রয়োজন। ফল সংগ্রহের পর যখন পাতা ঝরে যায়, তখন (এপ্রিল-মে) কুলগাছ ছাঁটাইয়ের উত্তম সময়। ছাঁটাইয়ের ফলে বিকশিত শাখা প্রশাখায় ফুলফল বেশি ধরে। এখানে উল্লেখ্য যে, লিচু, পেয়ারা, লেবু প্রভৃতি ফলদ গাছ নিয়মিত ছাঁটাই করলে ফলের ফলন ও গুণগতমান বৃদ্ধি পায় অথচ ফলচাষিরা ছাঁটাই না করে গাছকে বাড়তে দেয়ায় গাছ একটা ঝোপে পরিণত হয় এবং গাছের কেন্দ্রে আলো বাতাস ভালোভাবে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে ভেতরের পাতা খাদ্য তৈরি করতে পারে না বিধায় গাছের ফলন ও মান অনেক কমে যায়। এ ছাড়া তা পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। ফলচাষিদের ছাঁটাইকরণের কলাকৌশল ও উপকারিতা সম্পর্কে সচেতন করে ফলন ও গুণগত মানবৃদ্ধি করা সম্ভব।
সঠিক সার ব্যবস্থাপনা
উচ্চফলনশীল জাত চাষে প্রচুর পরিমাণে ভারসাম্যপূর্ণ সারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের দেশের কৃষকরা ফলগাছে সাধারণত কোনো প্রকার সারই ব্যবহার করেন না অথবা করলেও প্রয়োজনীয় পরিমাণে করেন না। এ কারণে ফলগাছের পুষ্টি জোগানে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয় এবং ক্রমাগত এ অবস্থা চলতে থাকায় মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমে যায়, যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া এরই মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। অথচ গাছের সুষম বৃদ্ধির জন্য সময়মতো সঠিক মাত্রায় সার ব্যবহার করতে হয়। ফল গাছের প্রজাতি ও জাত লাগানোর স্থানের মাটির উর্বরতার কারণে একই গাছের সারের মাত্রা তারতম্য হতে পারে। গাছের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সার প্রয়োগের মাত্রা ভিন্নতর হয়। ফল গাছের প্রজাতি, জাত, বয়স ও মাটির উর্বরতার ওপর ভিত্তি করে অনুমোদিত সার দুই ভাগে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথমবার বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে এবং দ্বিতীয়বার আশ্বিন মাসের শেষের দিকে প্রয়োগ করতে হবে। সাধারণত গাছের বয়স অনুসারে গোড়া থেকে ০.৫ থেকে ১.০ মিটার দূরত্বে সার প্রয়োগ করতে হয়। সঠিক সার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফলগাছের ফলন প্রচুর পরিমাণে বাড়ানো সম্ভব। কাজেই ফলন বৃদ্ধির জন্য সঠিক সময়ে পরিমাণমত সার প্রয়োগের জন্য ফলচাষিদের নিয়মিত পরামর্শ দিতে হবে।
প্রয়োজনীয় পানি সেচ ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থাকরণ
ফলগাছে প্রয়োজনীয় সেচের অভাবে ফুল ও ফল ঝরে যায়। খরা মৌসুমে ফলের প্রজাতি, মাটির গুণাগুণ ও আবহাওয়ার তারতম্য অনুসারে পানি সেচের প্রয়োজন এবং পরিমাণ ভিন্নতর হয়। চারা গাছে বেলে মাটিতে সপ্তাহে ২ থেকে ৩ বার এবং বেলে-দো-আঁশ মাটিতে ১ থেকে ২ বার সেচ দিতে হবে। ফল ধারণের পর নিয়মিত সেচ দিলে গুণগত মানসম্পন্ন ফলের ফলন বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, আমের মুকুল পূর্ণ ফোটা পর্যায়ে একবার এবং ফল মটরদানার আকৃতি ধারণ পর্যায়ে আর একবার, মোট দুইবার রূপান্তরিত বেসিন পদ্ধতিতে সেচ প্রয়োগ করলে অধিক মাত্রায় মানসম্পন্ন আম সংগ্রহ করা যায়। আবার বর্ষাকালে সেচের প্রয়োজন হয় না। তবে জলাবদ্ধতা থেকে গাছকে রক্ষার জন্য পানি সুনিষ্কাশনের ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এছাড়াও সেচের উপযুক্ত সময়টাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেমন আমে মুকুল হওয়ার আগে বৃষ্টিপাত বা পানি সেচ উভয়ই ক্ষতিকর এবং সেক্ষেত্রে কোনো কোনো সময় মুকুল না হয়ে তা সবুজ পাতায় পরিণত হয়। কাজেই ফলচাষিদের সেচ ও নিষ্কাশনের উপকারিতা সম্পর্কে অবহিত এবং প্রয়োগের মাধ্যমে গুণগত মানসম্পন্ন ফলের ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
সময়মতো রোগ ও পোকামাকড় দমন
রোগবালাই ও পোকামাকড় গাছের স্বাভাবিক জীবন চক্রে ব্যাঘাত ঘটায়। ফলগাছে বিভিন্ন বয়সে নানা ধরনের রোগবালাই ও পোকামাকড় দেখা যায়। তবে মানসম্পন্ন ফলের ফলন খুবই কম হওয়ার জন্য যেসব বিষয় দায়ী তাদের মধ্যে অন্যতম হলো পোকামাকড়ের আক্রমণ। উদাহরণস্বরূপ, আমের হপার পোকা আমের মুকুল শতকরা ১০০ ভাগ ধ্বংস করতে সক্ষম। কাজেই গুণগত মানসম্পন্ন ফলের ফলন বৃদ্ধির জন্য সময়মতো কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক স্প্রে করার পাশাপাশি সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন করতে হবে। এজন্য একদিকে যেমন কৃষকদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান দান করতে হবে অন্যদিকে সময়মতো স্বল্পমূল্যে প্রয়োজনীয় উপকরণের সরবরাহ বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে নিশ্চিত করতে হবে।
আগাছা দমন
গাছের চারিদিকে যেসব আগাছা থাকে সেগুলো তুলে ফেলা প্রয়োজন। কারণ এরা গাছের খাদ্য ও পানি গ্রহণে অংশীদার হয় বিধায় গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে এবং ফলন কমে যায়। বিভিন্ন নিরাপদ আগাছানাশক সহজ লভ্য করতে হবে।
গাছের ফুল ছাঁটাইকরণ
কলমের গাছ যে বছর লাগানো হয় সে বছর হতেই অনেক গাছে ফুল আসে কিংবা পূর্ণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হওয়ার পূর্বেই কিছু কিছু গাছে ফুল ধরতে দেখা যায়। এ ফুলগুলো যদি না ভেঙে দেয়া হয় তবে তাতে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এর ফলে গাছের শক্ত মজবুত কাঠামো তৈরি ব্যাহত হয় এবং আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না। এজন্য কলমের গাছ পূর্ণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়ার আগে ফুল এলে তা ভেঙে দিতে হবে এবং গাছ পূর্ণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়ার পরই ফুল ও ফল ধরতে দেয়া উচিত।
ফল পাতলাকরণ
বেশ কিছু ফল গাছে ফল পাতলাকরণ একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ফল পাতলা না করলে গাছ ভেঙে যাবে এবং মরেও যেতে পারে। কাজী পেয়ারার প্রতি ৫০টা পাতার জন্য একটা ফল রাখতে হবে অথবা ফল যখন মার্বেল আকারের হবে তখন কমপক্ষে শতকরা ৫০ ভাগ ফল ছাঁটাই করতে হবে। প্রতিটি থোকায় একটার বেশি ফল রাখা কোনো ক্রমেই উচিত নয়। অন্যদিকে পেঁপে গাছের প্রতিটা পত্রকক্ষে একটা ফল রাখাই উত্তম। কেননা জড়াজড়ি করে থাকার কারণে কিছুসংখ্যক ফলের আকৃতি স্বাভাবিক থাকে না। ফল পাতলাকরণের মাধ্যমে আকর্ষণীয় আকারের ফল পাওয়া যাবে এবং গাছটাও ভালো থাকবে।
ফল ঢেকে (ব্যাগিং) দেয়া
ব্যাগিংয়ের মাধ্যমে ফলকে পোকামাকড়, সূর্যকিরণ, ধুলাবালি, পাখি ইত্যাদি হতে রক্ষা করা যায় এবং ফলের আকার বড় ও রঙ আকর্ষণীয় হয়। ব্যাগিং ফল পাকার দেড় মাস পূর্বেই করতে হয় তবে তা ফলের প্রজাতি অনুযায়ী ভিন্নতর হবে। ব্যাগিং বাদামি কাগজ বা নীল পলিথিন বা বাটার পেপার দিয়ে করা যেতে পারে। পলিথিন দিয়ে ব্যাগিং করলে পলিথিনের গায়ে ছোট ছোট বেশ কিছু ছিদ্র করে দিতে হবে। ব্যাগিং সম্পর্কে চাষিদের জ্ঞান দান ও তা প্রয়োগের মাধ্যমে উন্নত গুণাগুণসম্পন্ন ফল উৎপাদন সম্ভব।
ফল সংগ্রহ ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা
ফল একটি পচনশীল দ্রব্য। উপযুক্ত পর্যায়ে ও সুষ্ঠুভাবে ফল সংগ্রহের ওপর ফলের পরিপক্বতা, গুণাগুণ ও সংরক্ষণ ক্ষমতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। অপরিণত অবস্থায় ফল সংগ্রহ করলে অম্লতার পরিমাণ বাড়ে এবং প্রকৃত স্বাদ ও গন্ধ পাওয়া যায় না। অপরপক্ষে বেশি পাকা অবস্থায় ফল সংগ্রহ করলে পোকা ও রোগজীবাণুর সংক্রমণ বেশি হয়, সংরক্ষণ ক্ষমতা কমে যায় এবং দূরবর্তী স্থানে পরিবহনে সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাই ফল পূর্ণতা প্রাপ্তির লক্ষণ দেখে সঠিক সময়ে সংগ্রহ করতে হবে।
সঠিক পদ্ধতিতে ফল সংগ্রহের অভাবে এর সংগ্রহোত্তর অপচয় বেশি হয়ে থাকে। আঘাত ও চাপ প্রাপ্তিতে ফলের সংরক্ষণশীলতা ও আহারোপযোগিতা কমে যায়। সঠিক পদ্ধতিতে যত্ন সহকারে ফল সংগ্রহ করা প্রয়োজন যেন ফলে কোনো আঘাত না লাগে বা ক্ষত সৃষ্টি না হয়। গাছের নিচে সাময়িকভাবে রাখতে হলেও খড় বিছিয়ে তার ওপর ফল রাখা উচিত। ফল সংগ্রহের পর সঠিকভাবে বাছাই, শ্রেণীবিন্যাস, মোড়কীকরণ ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহনের ব্যবস্থাকরণ আবশ্যক।
মানসম্পন্ন ফল উৎপাদন প্রযুক্তি
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র থেকে ফলের বেশ কিছু উৎপাদন কলাকৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে। উদ্ভাবিত উৎপাদন কলাকৌশলগুলোর মধ্য থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তি নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
হরমোন প্রয়োগ করে সারা বছর আনারস উৎপাদন : অমৌসুমে আনারস উৎপাদনের জন্য ৯ থেকে ১৩ মাস বয়সী গাছে ইথরেল (৩৯% সক্রিয় অংশ) ৫০০ পিপিএম (১.৩ মিলি/লিটার পানিতে) প্রয়োগ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
আমের হপার পোকা এবং অ্যানথ্রাকনোজ ও পাউডারি মিলডিউ রোগ দমন : আম গাছে ফুল আসার পর তা ফোঁটার পূর্বে একবার এবং ফল মটর দানার সমান হলে আর একবার সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের যে কোন কীটনাশক এবং টিল্ট নামক ছত্রাকনাশক একত্রে স্প্রে করে আমকে পোকা (ম্যাংগো হপার) এবং রোগের (অ্যানথ্রাকনোজ ও পাউডারি মিলডিউ) আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করার প্রযুক্তি অনুমোদন করা হয়েছে।
আমের সেচ প্রয়োগ পদ্ধতি : মডিফাইড বেসিন পদ্ধতিতে ফুল ফোঁটা অবস্থায় একবার এবং ফল মটর দানার সমান হলে আর একবার সেচ প্রদানের মাধ্যমে আমের ফল ঝরা বন্ধ করে গুণগতমানসম্পন্ন ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
পেয়ারার ফল ছাঁটাইকরণ : পেয়ারা গাছকে দীর্ঘদিন ফলবান রাখতে ও মানসম্পন্ন ফল উৎপাদন করার জন্য ফল ছোট থাকা অবস্থায় অর্থাৎ মার্বেল আকৃতি হলেই কমপক্ষে শতকরা ৫০ ভাগ ফল ছাঁটাই অনুমোদন করা হয়েছে।
ব্যাগিংয়ের মাধ্যমে কলার বিটল পোকা দমন : ছিদ্রযুক্ত পলিথিন দিয়ে কলার কাদি (bunch) ব্যাগিং করে কলার বিটল পোকা দমন করার পদ্ধতি অনুমোদন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মোচা থেকে কলা বের হওয়ার আগেই কাদির গায়ে বড় আকারের দুইমুখ খোলা বিশিষ্ট ছিদ্রযুক্ত পলিথিন ব্যাগের এক মুখ দিয়ে মোচাকে আবৃত করে কাদির সাথে আলতোভাবে বেধে দিতে হয় এবং নিচের দিকের মুখ খোলাই থাকে। কাদি সম্পূর্ণ বের হওয়ার একমাস পর ইচ্ছা করলে পলিথিন খুলে ফেলা যায়। তবে ফিলিপাইনের দাবাউ (Davao) এর কলাচাষিরা সারা বছরই কাদিতে ছিদ্রযুক্ত পলিথিন রেখে দেয়।
মানসম্পন্ন পেয়ারা উৎপাদন কৌশল : পেয়ারা ছোট অবস্থায় (মার্বেল আকার) বাদামিকাগজ বা ছিদ্রযুক্ত পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিয়ে বড় এবং আকর্ষণীয় রঙ এর মানসম্পন্ন পেয়ারা উৎপাদনের কৌশল অনুমোদন করা হয়েছে।
গরম পানিতে আম শোধন : গাছ থেকে আম সংগ্রহের পর পরই ৫৫ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রার গরম পানিতে ৫ মিনিট ডুবিয়ে শোধনের মাধ্যমে বোঁটা পচা ও অ্যানথ্রাকনোজ রোগ দমন করে আমের সংরক্ষণকাল অতিরিক্ত প্রায় দুই সপ্তাহে বাড়ানো যায় এবং সংগ্রহোত্তর অপচয় রোধ করা সম্ভব।
ফল ছিদ্রকারী পোকা দমন : ফলের ভোমরা পোকা (ফ্রুট-উইভিল/বোরার) এর আক্রমণে আম, কাঁঠাল, লিচু, ডালিম, কুল প্রভৃতি ফল আক্রান্ত হয়ে থাকে। এসব পোকায় আক্রান্ত ফল খাওয়ার উপযোগী থাকে না। আক্রান্ত ফল পোকাসহ নষ্ট করতে হবে। ফলের বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সুমিথিয়ন ৫০ ইসি বা লিবাসিড ৫০ ইসি ২ মিলিলিটার হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ১৫ দিন পর পর ২ থকে ৩ বার প্রয়োগ করতে হবে।
ফলের মাছি পোকা দমন : ফলের মাছি পোকা আম, পেয়ারা, কুল প্রভৃতি ফল আক্রমণ করে ক্ষতি করে থাকে। আক্রান্ত ফল কাটলে তার মধ্যে অসংখ্য কীড়া দেখা যায় এবং ফল খাওয়ার অযোগ্য হয়ে যায়। গাছের নিচে পড়ে থাকা ও আক্রান্ত ফল সংগ্রহ করে মাটির নিচে পুঁতে বা পুড়িয়ে ধ্বংস করতে হবে। অতিরিক্ত পাকার আগে ফল সংগ্রহ করতে হবে। বাদামি কাগজ বা ছিদ্রযুক্ত পলিথিন বা বাটার পেপার দিয়ে ফল ব্যাগিং অথবা ফেরোমন ট্র্যাপ ব্যবহার করতে হবে।
অ্যানথ্রাকনোজ রোগ দমন : অ্যানথ্রাকনোজ রোগের আক্রমণে ফল গাছের পাতা, কা-, মুকুল ও ফলে ধূসর বাদামি রঙের দাগ পড়ে। এ রোগে আক্রান্ত মুকুল ঝরে যায়, ফলের গায়ে কালচে দাগ হয় এবং ফল পচে যায়। এ রোগে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, ডালিম প্রভৃতি ফল আক্রান্ত হয়ে থাকে। গাছের নিচে ঝরে পড়া পাতা ও ফল সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোঁটার প্রতি লিটার পানিতে টিল্ট ২৫০ ইসি ০.৫ মিলিলিটার অথবা টপসিন এম নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
পাউডারি মিলডিউ রোগ দমন : পাউডারি মিলডিউ আম ও কুলের একটি মারাত্মক রোগ। এ রোগের আক্রমণে মুকুলে সাদা পাউডারের মতো আবরণ দেখা যায়। আক্রান্ত ফুল ও ফল গাছ হতে ঝরে পরে। আর্দ্র আবহাওয়ায় বিশেষ করে মেঘাছন্ন অবস্থায় এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। গাছে মুকুল আসার পর একবার এবং ফল মটরদানা আকারের হলে আর একবার থিওভিট প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম অথবা টিল্ট ২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলিলিটার মিশিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।
লেবুর ক্যাংকার রোগ দমন : এ রোগের আক্রমণে লেবু গাছের কচি পাতা, শাখা ও ফলে ধূসর বা বাদামি রঙের গুটি বসন্তের মতো দাগ পড়ে। আক্রান্ত ডগা ও শাখা ছাঁটাই করতে হবে এবং কাটা অংশে বর্দোপেস্টের (১০%) প্রলেপ দিতে হবে। বর্ষা শুরুর আগে এবং পরে বর্দো মিশ্রণ বা অনুমোদিত ছত্রাকনাশক যেমন- রিডোমিল এম-জেড বা ব্যাভিস্টিন প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে এবং টিল্ট ২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি লিটার মিশিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। সোডিয়াম অর্থো-ফিনাইল ফিনেট ২.৩% দ্রবণে লেবু পরিশোধনের মাধ্যমে লেবু ক্যাংকার মুক্ত করার প্রযুক্তি বিএআরআই-হর্টেক্স ফাউন্ডেশন কর্তৃক রপ্তানির জন্য অনুমোদন করা হয়েছে।
সুপারিশমালা
ক্রমপরিবর্তনশীল বিশ্ব প্রতিযোগিতামূলক রফতানিবাজার এবং বিশ্বায়নের উদীয়মান ও সম্ভাবনাময় বিশেষ করে niche market এর সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে ফল রফতানি বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে :
গুণগতমানসম্পন্ন ফল রফতানির উন্নয়নসাধন কল্পে হর্টেক্স ফাউন্ডেশনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক ও কারিগরিভাবে শক্তিশালীকরণ করা দ্রুত প্রয়োজন।
বর্তমান বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করে চুক্তিবদ্ধ-দলীয়-সমবায় চাষ পদ্ধতিতে উত্তম কৃষি পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক নির্দিষ্ট জোগান চেইন তৈরি করে উৎপাদিত পণ্যের গুণগতমান নিশ্চিত করে রফতানির লক্ষ্যে সরাসরি খামার থেকে বাজারে বিপণন ব্যবস্থা প্রতিস্থাপন করা প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদানুযায়ী বাংলাদেশের আবহাওয়ায় উৎপাদন উপযোগী জাত নির্বাচন করে এর সার্বিক মান উন্নয়নে বাস্তব এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রফতানি উপযোগী জাতগুলোর উন্নত উৎপাদন কলাকৌশল, সংগ্রহ ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, মোড়কীকরণ ও সংরক্ষণ প্রযুক্তিবিষয়ক গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
বিশ্ববাজারের চাহিদা মোতাবেক ফলের গুণগতমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ফল উৎপাদক, রফতানিকারক ও জোগান চেইনের অন্যান্য ব্যক্তিদের আধুনিক উৎপাদন কলাকৌশল, সংগ্রহকরণ, সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ প্রযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মোড়কীকরণের ওপর বাস্তবসম্মত প্রশিক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
উৎপাদন এলাকায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্যাক হাউজ স্থাপন, সার্বক্ষণিক পরিবীক্ষণ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যানবাহন ব্যবহার এবং সরবরাহ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।
রফতানির জন্য ফল পরিবহনে বিভিন্ন এয়ারলাইন্স এবং মালামাল বহনকারী কার্গো বিমানে পর্যাপ্ত স্থানের নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।
ফল রফতানি খাতকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মানের প্যাকেজিং ব্যবহারের ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে।
রফতানি উপযোগী নিরাপদ ফল উৎপাদন ও সুষ্ঠু বিপণনের জন্য ট্রেসাবিলিটি (Traceabilit) ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
ড. মো. আবদুল জলিল ভূঁঞা*
মিটুল কুমার সাহা**
* ব্যবস্থাপনা পরিচালক, **সহকারী মহাব্যবস্থাপক, হর্টেক্স ফাউন্ডেশন, সেচ ভবন (৪র্থ তলা), ২২ মানিক মিয়া এভিনিউ, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা-১২০৭
বিগত চার দশকে বাংলাদেশের বড় অর্জন হলো খাদ্য উৎপাদনে বিপ্লব। এই চার দশকে বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহার (HYV) এবং রাসায়নিক সার প্রয়োগের কারণে কৃষি খাতে এ বিপ্লবটা ঘটানো সম্ভব হয়েছে।
গত চার দশকে দেশের জনসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫ কোটি বা তারও বেশি। যদিও রাজনীতিবিদসহ দেশের কিছু বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিরাও বলছে দেশ আজ অভ্যন্তরীণ চাহিদার উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন করছে। তারপরও দেশের সাড়ে তিন কোটি মানুষ এখনও খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলে বেরিয়ে এসেছে।
বর্তমান প্রবন্ধটিতে খাদ্য ঘাটতি বা খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করা হবে না। ইস্যুটা অন্য জায়গায় অর্থাৎ অপরিকল্পিত জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি সম্পদের defective বণ্টন ব্যবস্থা দায়ী। প্রবন্ধটির আলোচ্য বিষয়ও এটা না।
বর্তমান প্রবন্ধে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদন করা হচ্ছে তা কি ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এবং প্রযুক্তিগুলো কতটুকু পরিবেশবান্ধব। অন্যভাবে বলতে গেলে ব্যবহৃত প্রযুক্তিগুলো আমাদের পরিবেশের ওপর কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া রাখছে কিনা? রেখে থাকলে এর থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজতে হবে। অপরদিকে ফসল উৎপাদনে যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলো পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি মানব দেহে ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। এগুলোর জন্য দায়ী কে তা খুঁজে বের করতে হবে এবং সর্বোপরি বেরিয়ে আসার উপায় বের করতে হবে। বর্তমান আলোচনার সম্পূর্ণটাই আমার ৩২ বছর চাকরিজীবনের প্রায় ২৬ বছর ধরে কৃষক সমাজের খুব কাছে থেকে কাজ করার অভিজ্ঞতার বর্ণনা মাত্র।
কলের লাঙল প্রযুক্তির ব্যবহার বনাম জমির স্বাস্থ্য এ দেশে ষাটের দশকের পূর্ব পর্যন্ত ফসল উৎপাদনের কৌশল ছিল প্রকৃতি নির্ভর। গরু এবং কাঠের তৈরি লাঙল দিয়ে জমি চাষ করা হতো। প্রকৃতিগতভাবেই জমি আবাদের জন্য গরু কিংবা মহিষ দিয়ে হাল চাষের সময় গরুর গোবর এবং মূত্র জমিতে পড়ে জৈব সার তৈরি করত যা ফসল উৎপাদনে সহায়ক পরিবেশ হিসেবে বিবেচিত হতো। এ প্রক্রিয়ায় যেহেতু জমিতে জৈব সার তৈরি হতো, সেহেতু এগুলো যেমন জমির স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর ছিল না তেমনি এসব জমি থেকে উৎপাদিত ফসল মানব স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতির কারণ হতো না।
বর্তমানে বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মিটাতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন করে সেগুলো সম্প্রসারণ কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং খাদ্য চাহিদা মিটে যাচ্ছে।
বর্তমানে যে প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার হচ্ছে তার মধ্যে প্রথম প্রযুক্তি হচ্ছে কলের লাঙল। এ প্রযুক্তিটা উদ্ভাবনের ও ব্যবহারের ফলে দুটি সুবিধা পাওয়া গেছে। প্রথমত, খুব অল্প সময়ে অধিক পরিমাণ জমি হাল চাষ করা সম্ভব এবং দ্বিতীয়ত, একজন মাত্র শ্রমিক ব্যবহার করে কিংবা কৃষক নিজেই তার জমি হাল চাষ করে ফেলছে।
অপরদিকে এ কলের লাঙল ব্যবহারের ফলে দুটো বিপরীত প্রভাব পাওয়া গেছে। প্রথমত, পূর্বে গরু দিয়ে হালচাষ করাকালীন গরু-মহিষের ত্যাগ করা মলমূত্র জমিতে জৈব সার হিসেবে কাজ করত। আর বর্তমানে কলের লাঙল দিয়ে জমি চাষ করার ফলে জৈব সার প্রাপ্তির পরিবর্তে ডিজেল এবং মবিল পড়ে জমিগুলো ক্রমে উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ফেলতে বসেছে। দ্বিতীয়ত, কলের লাঙল ব্যবহারে শ্রমিক কম ব্যবহারের ফলে বহু কৃষি শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। এদের জন্য গ্রামে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে এরা কাজের সন্ধানে শহরমুখী হচ্ছে এবং শহরগুলোতে জনসংখ্যাধিক্যের কারণে শহরগুলো পরিবেশবান্ধব অবস্থা হারিয়ে ফেলছে। সর্বোপরি এসব উদ্বৃত্ত কৃষি শ্রমিক শহরে এসে অনেকেই মানসম্মত কাজের জোগাড় করতে না পেরে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে শহরগুলোর সামাজিক পরিবেশও বিরূপ হয়ে পড়ছে। এত গেল একটি মাত্র প্রযুক্তির প্রভাব অর্থাৎ কলের লাঙলের ব্যবহার।
রাসায়নিক সার প্রযুক্তি : জমির স্বাস্থ্য বনাম মানব স্বাস্থ্য
এবার আসছি রাসায়নিক সারের ব্যবহার। এ প্রবন্ধের প্রারম্ভেই বলেছি যে, পূর্বে কৃষি জমিগুলো গরু দিয়ে হালচাষ করার মাধ্যমে যে পরিমাণ জৈব সার পেত তা বর্তমানে না পাওয়ার ফলে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। ফলে জমির উর্বরতা শক্তি বাড়ানোর জন্য রাসায়নিক সার প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। এ রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে শস্যদানার মধ্যে রাসায়নিক পদার্থের একটা ভিন্ন বা অতিরিক্ত মাত্রা যোগ হচ্ছে। এসব রাসায়নিক সার শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির বা চারা গজানোর জন্য ব্যবহার করা হলেও অতিমাত্রার কারণে মানবদেহে একটা বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।
কীটনাশক প্রযুক্তির ব্যবহার : ফসলের স্বাস্থ্য বনাম মানব স্বাস্থ্য
তারপর হচ্ছে কীটনাশক প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রভাব। ফসলে পোকার আক্রমণ হলে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যে কোনো কীটনাশকই বিষ জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ। পোকা বা পঙ্গপালের আক্রমণ এবং রোগবালাই থেকে ক্ষেতের ফসল ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এসব কীটনাশকের ব্যবহার। এখানে একটা বিষয় আমাদের সবার জানার জন্য উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। প্রতিটা কীটনাশকেরই একটা মেয়াদ আছে। অর্থাৎ ফসলে প্রয়োগের পর কীটনাশকের প্রভাবের কার্যকারিতা শেষ হতে একটা মেয়াদ থাকে। কিন্তু তারপরও উৎপাদিত শস্যের ভেতরে কীটনাশকের অস্তিত্ব রয়ে যায়, যেটাকে আমরা মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রা বলে থাকি। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে দেখা গেছে যে, কোন কোন ক্ষেতে কীটনাশক প্রয়োগের পর নির্ধারিত মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বেই ফসল কেটে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। ফলে এ ধরনের শস্য কিংবা সবজিগুলোতে অবশিষ্ট কীটনাশকের মাত্রা বেশি পরিমাণ থাকে যা মানব দেহের জন্য ক্ষতির কারণ।
এতক্ষণ আমি ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত কীটনাশকগুলোর মানবদেহের ওপর কিভাবে প্রভাব রাখে তা বললাম। এখন আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলার চেষ্টা করব কেন এমনটা হচ্ছে? অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, কোন ফসল উৎপাদনের জন্য কৃষক পর্যায় থেকে বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ায় যে মধ্যস্বত্বভোগী থাকে তারা ফসল বা বিভিন্ন শাকসবজির একটা ভালো দাম পাওয়ার লক্ষ্যে কৃষকদের কোন কোন ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার কীটনাশক ব্যবহারের পারমর্শ দিয়ে থাকে। কারণ যে কোন শাকসবজি বা ফল-ফলাদিতে কোন দাগ থাকলে শহরের বাজারগুলোতে দাম একটু কম পাওয়া যায়। কারণ এমন কিছু ভোক্তা আছেন যারা যে শাকসবজির ওপর কোন দাগ থাকলে সেটা কেনেন না। সুন্দর দাগহীন সবজি বা ফলমূল তাদের শর্তশূন্য পছন্দ। কিছু বাজে কৃষকসহ বাজারজাতকরণের কাজে থাকা মধ্যস্বত্বভোগীরা এই সুযোগটা নিয়ে থাকে। কারণ তারা শহুরের কিছু ভোক্তার দৃষ্টিভঙ্গিটা জেনে গেছে। কিন্তু শহরের সব ফ্যাশেনেবল ভোক্তারা এটা জানেন না বা জানতে চেষ্টা করেন না যে সুন্দর টসটসে শাকসবজি বা ফলমূলে কি পরিমাণ কীটনাশকের রেসিডিউয়াল প্রভাব অবশিষ্ট থাকে। এর জন্য দায়ী কে? উৎপাদনকারী কৃষক, বাজারজাতকরণে থাকা মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণী না শহরের ফ্যাশনেবল ভোক্তা? তবে এটা সত্য যে, শহুরে ফ্যাশনেবল ভোক্তাদের চয়েজ এবং এর ফলশ্রুতিতে বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ায় থাকা মধ্যস্বত্বভোগীদের চাহিদার কারণে কৃষকরা উচ্চমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করে থাকে। এখানে ভোক্তার আচরণে পরিবর্তন আসলেই অবস্থা কিছুটা পাল্টে যাবে বলে আমার মনে হয়।
কীটনাশক প্রযুক্তি ব্যবহার বনাম পরিবেশ
এত গেল মানবদেহের ওপর কীটনাশকের প্রভাব। এবার আলোচনা করতে চাচ্ছি পরিবেশ এবং পরিবেশের ভারসাম্যের ওপর কীটনাশক ব্যবহারের প্রভাব। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কীটপতঙ্গসহ প্রাণিকূলেরই অবদান রয়েছে। এখানে একটি প্রশ্ন, এভাবে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কি ঘটছে? একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা বর্ণনা করার চেষ্টা করছি।
ব্যাঙ একটা প্রাণী যাকে আমরা সবাই চিনি। ব্যাঙের প্রধান খাদ্য হচ্ছে ক্ষেতের পোকামাকড়। কাটনাশক প্রয়োগের ফলে ব্যাঙের প্রধান খাদ্য পোকামাকড় আর থাকছে না। পাশাপাশি অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ব্যাঙের অস্তিত্বও বিলীন হতে চলেছে। আবার কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মৃত পোকামাকড় খেয়ে অনেক পাখি জাতীয় প্রাণী বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আরও গভীর আলোচনায় যাওয়ার দরকার নেই। এতটুকুতেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়।
সেচ প্রযুক্তির ব্যবহার বনাম প্রাকৃতিক ভারসাম্য
এরপর আসছে সেচের ব্যবহার। প্রাকৃতিক কৃষি ব্যবস্থায় শস্য উৎপাদনে নদী-নালা, খাল-বিল কিংবা মাটির নিচ থেকে পানি উত্তোলন করে কৃষিকাজ করা হতো না। কেবল বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করেই কৃষি কাজ অর্থাৎ ফসল উৎপাদনের কাজটা সমাধা করা হতো। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য খাদ্য চাহিদা মিটাতে যেয়ে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন হতে থাকে। তার মধ্যে উচ্চফলনশীল জাতের বীজ ব্যবহার অন্যতম। উচ্চফলনশীল জাতের বীজ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদনে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। এখন উচ্চফলনশীল বীজ প্রযুক্তি ব্যবহার করে শুষ্ক মৌসুমেও শস্য উৎপাদন করা যাচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজন হয় প্রচুর পানির। সুতরাং শুষ্ক মৌসুমে ফসল উৎপাদনের জন্য নদী-নালা, খাল-বিলের পানির ব্যবহার শুরু হলো। ফলে যা হওয়ার তা হলো। নদীগুলো নাব্য হারাতে থাকল। খাল-বিল গুলো শুকিয়ে যাওয়ার কারণে মৎস্য সম্পদের ওপর প্রভাব পড়তে শুরু করল। অর্থাৎ মাছ উৎপাদন হ্রাস পেতে শুরু করল। ফলে প্রাকৃতিক উপায়ে মৎস্য চাষ বা মৎস্যসম্পদ আহরণের জায়গায় চাষ পদ্ধতিতে মৎস্য উৎপাদন শুরু হলো। সময়ের ব্যবধানে আরও নতুন নতুন বীজ প্রযক্তির উদ্ভাবন হতে থাকল। ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পানি অর্থাৎ নদী-নালা, খাল-বিলের পানি যখন অপর্যপ্ত হয়ে পড়ল তখন ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে ফসল উৎপাদনের জন্য সেচাবাদ শুরু করা হলো। একদিকে নতুন নতুন বীজ প্রযুক্তি উদ্ভাবন হচ্ছে এবং উচ্চফলনশীল বা হাইব্রিড জাতের বীজ দিয়ে ফসল উৎপাদন করতে প্রচুর পানির চাহিদা বেড়ে যেতে লাগল। পানি উত্তোলনও বাড়তে থাকল।
আর একটি মজার ব্যাপার হচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সুপেয় পানির চাহিদাও কিন্তু পাশাপাশি বাড়তে থাকে। ভূগর্ভস্থ পানিই হচ্ছে পানযোগ্য পানির প্রধান উৎস। অর্থাৎ এভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে ভূগর্ভের পানির স্তর নেমে যেতে থাকে। মাটিতে যে ন্যূনতম রস থাকা প্রয়োজন তা আর রইল না। দেশটাতে মরুভূমিকরণের একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।
উপরের এই সহজ এবং সরল আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, কৃষি ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মিটানো সম্ভব হচ্ছে। বিদেশ থেকে অপেক্ষাকৃত কম শস্য আমদানি করতে হচ্ছে। কৃষি পণ্য আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রা কম ব্যয় হচ্ছে। সর্বোপরি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে অবদান রাখা সম্ভব হচ্ছে। ফলে অন্যান্য সেক্টরের উন্নয়ন চাহিদা পূরণে সহায়ক হচ্ছে। কিন্তু দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের অবস্থা কি দাঁড়াচ্ছে? অর্থাৎ নতুন নতুন উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ হুমকির সম্মুখীন। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে কি তাহলে কৃষি খাতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বাদ দিতে হবে? না, আমি একথা বলছি না। এটা আমার প্রস্তাব না। এ রকম পদক্ষেপ নেয়া হলে দেশের লোক না খেয়ে মারা যাবে। দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খরচ করে খাদ্য আমদানি করতে হবে। অর্থাৎ সিংহভাগ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খরচ করে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটাতে হবে। ফলে অন্যান্য সেক্টরের উন্নয়ন চাহিদাগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। বর্তমানে আমরা যে বলছি দেশ মধ্যম আয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং ২০২১ সালের প্রত্যাশা অর্থাৎ দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে চাচ্ছি তা আদৌ সম্ভব হবে না। তাহলে প্রশ্নটা আসছে কেন এমনটা হচ্ছে এবং কি করা উচিত কিংবা কিভাবে এই সমস্যাটাকে মোকাবিলা করতে হবে।
এমনটা কেন হচ্ছে?
কেন এমনটা হচ্ছে? এর উত্তর খোঁজার জন্য কয়েকজন বিশেষজ্ঞের প্রবন্ধ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত সার বের করে এখানে উপস্থাপন করার একটু চেষ্টা করা হলো।
ক. কোন নতুন প্রযুক্তি দেশে আনার পূর্বে বা দেশেই উদ্ভাবিত কোন প্রযুক্তি মাঠে সম্প্রসারণের পূর্বে ব্যবহারকারী কৃষকদের জন্য প্রযুক্তিগুলো দক্ষতার সাথে ব্যবহারের যথাযথ সচেতনতা সৃষ্টির কার্যক্রম নেয়া হয় না। যদিও নেয়া হয়ে থাকে তবে তা বৃহৎ কৃষক সমাজে তুলনায় অপ্রতুল।
খ. সরকারের পাশাপাশি এনজিও এবং প্রাইভেট কোম্পানিগুলোও উন্নত কৃষি প্রযুক্তি আমদানি, উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের কাজে জড়িত রয়েছে। এনজিওগুলো এ বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন। কিন্তু তাদের কাজের পরিধি সীমিত। অর্থাৎ এনজিওগুলো মূলত এলাকাভিত্তিক কার্যক্রম হাতে নিয়ে থাকে। অপরদিকে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর আসল আগ্রহ মুনাফা।
গ. আবার দেখা যায় যে, গ্রামের একজন কৃষক একই জমিতে কয়েক ধরনের ফসল উৎপাদন করে থাকে। তারা কৃষি অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তাদের কাছে বহুমাত্রিক সমস্যার সমাধান চেয়ে থাকে। যা আনেক সময় মাঠ কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে দিতে সক্ষম হন না।
উপরের সারসংক্ষেপ থেকে একটি সত্য বেরিয়ে আসছে যে, কৃষকদের অজ্ঞতাটা কাজ করলেও দায়ী কিন্তু কৃষকটি না। প্রযুক্তি আমদানি ও সম্প্রসারণের দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর দায়বদ্ধতাটা এখানে দায়ী বলে আমার মনে হয়।
উপরের আলোচনা থেকে একটা সত্য বেরিয়ে আসছে যে এক সময় উচ্চফলনশীল প্রযুক্তির ব্যবহারটা তাগিদবোধ থেকেই হয়েছে। কিন্তু দায়বদ্ধতার অভাব, যে কোন প্রযুক্তি মাঠে নিয়ে যাওয়ার পূর্বে কৃষকদের প্রস্তুত না করা এবং সর্বোপরি প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর একমাত্র মুনাফা অর্জনের আগ্রহটা পরিবেশের ওপর অতিরিক্ত বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেছে। এই প্রসঙ্গে যে প্রস্তাবটা হচ্ছে তা হলো পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থা চাই। অর্থাৎ যেসব প্রযুক্তি পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব রাখছে সেই প্রযুক্তিগুলো পরিহার করে ( যে ক্ষতি হয়েছে তা হয়ে গেছে) পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিগুলো কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারিত করতে হবে।
শেষ কথা
এতক্ষণ যে বিষয়টার ওপর আলোকপাত করলাম তা হচ্ছে উৎপাদন পর্যায়ে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব। এবার আলোচনা করব উৎপাদনের পরবর্তী স্তরের গল্প। অর্থাৎ পরিবেশটাকে বিরূপ করছে এমন সব প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদিত ফসল, সবজি বা ফলমূল আমরা খাচ্ছি সেগুলো স্বাস্থ্যবান্ধব কিনা? আর যদি স্বাস্থ্যবান্ধব না হয়ে থাকে তবে কিভাবে উৎপাদিত ফসলাদি তার স্বাস্থ্যবান্ধব চরিত্র হারাচ্ছে?
ইদানিং খবরের কাগজ পড়লেই দেখা যাচ্ছে যে, ব্যবসায়ীরা শাকসবজি, ফলমূল এবং মাছ ইত্যাদির পচনরোধ কল্পে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করছে। এসব শাকসবজি এবং ফলমূল খেয়ে মানুষ বিভিন্ন ধরনের রোগের ঝুঁকির আওতায় রয়েছে। এসব রাসায়নিক দ্রব্যের মধ্যে ফরমালিন এবং কার্বাইড সর্ব মহলে পরিচিতি লাভ করেছে। ফরমালিন এমন একটা রাসায়নিক পদার্থ যা প্রোটিন জাতীয় দ্রব্যাদির পচন রোধ করে। এজন্য মাছেই এ রাসায়নিক পদার্থটা ব্যবহার করা হচ্ছে বেশি। এভাবে ফরমালিনযুক্ত মাছ খেতে থাকলে মানুষের শরীরে মাত্রাধিক্য ফরমালিন জমা হবে। ফলে জীবাণু এবং ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী ওষুধ মানবদেহে কাজ করবে না বলে বিশেষজ্ঞরা মত ব্যক্ত করে আসছেন। কেবল তা-ই না, অত্যাধিক ফরমালিন জমা হওয়ার কারণে মানুষের মৃত্যুর পরও দেহে পচন ধরবে বলে মনে হয় না। বিষয়টাক এইভাবে একটু দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে। একজন মানুষ মারা গেল যার শরীরে মাত্রাধিক্য ফরমালিন রয়েছে। তাকে কবর দিয়ে আসা হলো। কিন্তু মৃত মানুষটার দেহে কিছুতেই পচন ধরছে না। দীর্ঘ সময় ধরে অপচনশীল অবস্থায় রয়ে যাচ্ছে। ফলে যা হবে কবরগুলো রিফিল করা সম্ভব হবে না। তাহলে নতুন নতুন কবরস্থান বানাতে হবে। কৃষি জমি কমার আরও একটা Window Open হবে। অবস্থাটা একটু চিন্তা করুন তো?
এটাতো গেল শাকসবজি ফলমূল এবং মাছ পচন রোধের পদক্ষেপ। আবার ফলমূল পাকানোর জন্য অন্য ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে। অর্থাৎ দুটো পদক্ষেপই রয়েছে ব্যবসায়ীদের হাতে। তাদের ইচ্ছামতো বাজারজাত করছে কিংবা মজুত করে রাখছে। ফলে এসব উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্যের মূল্যও তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে। এর জন্য উৎপাদনকারী অর্থাৎ কৃষক যে দায়ী না তা নিশ্চিত করে বলা যায়। দায়ী যারা ব্যবসা করছে তারা। এসব ব্যবসায়ীরা যে বোকার স্বর্গে বাস করছে তাও নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ একজন ফল ব্যবসায়ী ফলে পচন রোধের জন্য রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে বেশি মুনাফা করল। আর মনে মনে ভাবল আমি কিংবা আমার ছেলেমেয়ে তো আর খেল না। আবার সে যখন মাছ কিনে খাচ্ছে সেটা কি খাচ্ছে তা মনে হয় তাদের এখনও বোধগম্য হয়নি। তারা তো আর প্রিন্স কিংবা প্রিন্সেস না যে তাদের খাবার চাটার্ড করা প্লেনে করে সুদূর আমেরিকা থেকে আসে? সুতরাং তাদের বোকা আখ্যায়িত করা ছাড়া কি উপাধি দেয়ার আছে?
কৃষিবিদ খুরশীদ আলম*
* সাবেক যুগ্ম পরিচালক (গবেষণা, মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ), বিআরডিবি, (khurshidalam_55@yahoo.com)
পান একটি অর্থকারী ফসল। আমাদের দেশে পানের বরজ খুব বেশি দেখা না গেলেও এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। দেশে বিদেশে রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা। এতে অনেক ঔষধি গুণ বিদ্যমান। কিন্তু রোগবালাই পান উৎপাদনের একটি প্রধান অন্তরায়। পানে গোড়া পচা, ঢলে পড়া, পাতা পচা, অ্যানথ্রাকনোজ, সাদা গুঁড়া ইত্যাদি রোগ দেখা যায়। এ রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে ফলন অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। তাই পানের কয়েকটি মারাত্মক রোগের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১. রোগের নাম : কাণ্ড পচা/গোড়া পচা (Stem rot/Collar rot/Foot rot)
রোগের কারণ : স্ক্লেরোসিয়াম রফসি (Sclerotium rolfsii) নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : ছত্রাকগুলো প্রধানত মাটি বাহিত এবং অন্যান্য শস্য আক্রমণ করে। মাটিতে জৈব সার বেশি ও খড়কুটা থাকলে এবং পানি সেচের মাধ্যমে আক্রান্ত ফসলের জমি হতে সুস্থ ফসলের মাঠে বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষণ :
গাছের যে কোনো বয়সে এ রোগ হতে পারে।
গ্রীষ্মকালে মাটির ওপর শায়িত লতায় এ রোগ হয়। গাছের গোড়ায় আক্রমণ করে। গোড়ায় লক্ষ করলে দেখা যাবে মাটির কাছের একটি বা দুটি পর্ব মধ্য কালো বর্ণ ধারণ করেছে। উপরে লতার পাতা হলুদ হয়ে যায় ও ঝড়ে পড়ে। মাটি সংলগ্ন লতার ওপর সাদা সুতার মতো ছত্রাক মাইসেলিয়া দেখা যায়। পরে হালকা বাদামি থেকে বাদামি সরিষার ন্যায় এক প্রকার অসংখ্য দানার মতো স্কে¬রোাসিয়া দেখা যায়। মাটি সংলগ্ন ডাঁটা পচে যায় এবং গাছ ঢলে পড়ে মরে যায়।
রোগের প্রতিকার :
রোগাক্রান্ত লতা-পাতা বরজ থেকে তুলে পুড়ে ফেলতে হবে।
রোগ প্রতিরোধী পানের জাত ব্যবহার করতে হবে। গভীর ভাবে জমি চাষ দিয়ে রোদ্রে ভালো করে শুকিয়ে নিতে হবে। নতুন বরজ তৈরির ক্ষেত্রে সুস্থ সবল রোগমুক্ত পানের লতা সংগ্রহ করতে হবে।
পানের বরজ সবসময় আগাছা মুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
ট্রাইকোডারমা কম্পোস্ট সার প্রতি গাছে ৫ গ্রাম হারে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
লতা রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন দ্বারা লতা শোধন করে নিতে হবে। বরজে রোগ দেখা দিলে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
২. রোগের নাম : শিকড় পচা (Root rot)
রোগের কারণ : রাইজোকটোনিয়া সোলানি (Rhizoctonia solani) নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : মাটি, ফসলের পরিতক্ত অংশ ও পানির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষণ :
গাছের শিকড়সহ মাটির নিচের সব অংশই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় পাতা মলিন হয়ে ঢলে পড়ে। পরে লতা ঈষৎ বিবর্ণ হয়ে মরে যায়। এ অবস্থায় শিকড় লাল বর্ণ দেখায় এবং ভেঙে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে যায়।
রোগের প্রতিকার :
সম্ভব হলে মাটি শোধন করতে হবে।
রোগাক্রান্ত লতা-পাতা বরজ থেকে তুলে পুড়ে ফেলতে হবে। রোগ প্রতিরোধী পানের জাত ব্যবহার করতে হবে। নতুন বরজ তৈরির ক্ষেত্রে সুস্থ সবল রোগমুক্ত পানের লতা সংগ্রহ করতে হবে।
পানের বরজ সবসময় আগাছা মুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
লতা রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন দ্বারা লতা শোধন করে নিতে হবে। বরজে রোগ দেখা দিলে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
৩. রোগের নাম : ঢলে পড়া (Wilt)
রোগের কারণ : ফিউজারিয়াম অক্সিস্পোরাম (Fusarium oxysporum) নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : ছত্রাকগুলো প্রধানত মাটি বাহিত এবং অন্যান্য শস্য আক্রমণ করে এবং পানি সেচের মাধ্যমে আক্রান্ত ফসলের জমি হতে সুস্থ ফসলের মাঠে বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষণ :
গাছের গোড়ায় আক্রমণ করে। গাছের উপরের পাতা হলুদ হয়ে যায়।
কাণ্ডের ভাস্কুলার টিস্যু আক্রমণ করে। গোড়ার দিকে কাণ্ড লম্বালম্বিভাবে ফাটালে ভেতরে দাগ দেখা যায়। পরে গাছ ঢলে পড়ে। আক্রমণ বেশি হলে গাছ মরে যায়।
রোগের প্রতিকার :
রোগাক্রান্ত গাছ তুলে এবং ফসল সংগ্রহের পর পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
গাছের গোড়ার চতুর্দিকের পৃষ্ঠের মাটি নেড়ে শুষ্ক করে দিলে এ রোগ অনেকাংশে দমন হয়।
লতা রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন দ্বারা লতা শোধন করে নিতে হবে। রোগ দেখা দিলে প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
৪. রোগের নাম : গোড়া-লতা ও পাতা পচা (Foot rot/vine rot and leaf rot)
রোগের কারণ : ফাইটোফথোরা প্যারাসাইটিকা (Phytophthora parasitica) নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : কম ম্যাগনেসিয়াম ও বেশি লবণাক্ত মাটিতে রোগের প্রকোপ বেশি। অবিরত বৃষ্টিপাত হলে এবং আর্দ্র আবহাওয়ায় এ রোগ বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষণ :
প্রাথমিক অবস্থায় পাতায় পানি ভেজা হলুদাভ বাদামি রঙের দাগ দেখা যায়। ধীরে ধীরে দাগ বিস্তৃত হয়ে বড় হতে থাকে। দাগ পাতার কিনারা হতেও শুরু হতে পারে। অবিরত বৃষ্টিপাত স্থলে রোগটি পাতা হতে বোঁটায় এবং লতায় সংক্রমিত হয়।
আক্রান্ত পাতা ও লতায় এক প্রকার কালো দাগ পড়ে। ওই দাগের মাঝখানে বিবর্ণ হয়ে পচে যায়।
আক্রান্ত পাতা ঝরে পড়ে। পরে গাছের শিকড়, লতা ও পাতা পচে এক প্রকার দুর্গন্ধ নির্গত করে।
আক্রমণ বেশি হলে গাছ মারা যায়।
রোগের প্রতিকার :
রোগাক্রান্ত গাছের পাতা তুলে পুড়ে ফেলতে হবে।
রোগমুক্ত লতা বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
রোগ প্রতিরোধী জাত বারি পান-২ চাষ করতে হবে। ঘন ঘন সেচ প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ট্রাইকোডার্মা জীবাণু সার ৫ গ্রাম হারে প্রতি গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে।
বরজে রোগ দেখা দিলে রিডোমিল গোল্ড অথবা কমপেনিয়ন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়াসহ সব গাছে ১০ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার ¯েপ্র করতে হবে।
৫. রোগের নাম : ক্ষত বা পাতার দাগ (Anthracnose)
রোগের কারণ : কোলেটোট্রিকাম পাইপারিস (Colletotrichum piperis) নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকলে দ্রুত রোগ বাড়ে।
রোগের লক্ষণ :
প্রথমে পাতায় বিক্ষিপ্তভাবে ছোট ছোট ফোস্কার মতো অসম দাগ পড়ে।
দাগগুলো কিনারা থেকে ভেতরের দিকেই বেশি দেখা যায়। দাগগুলো হালকা বাদামি থেকে গাঢ় বাদামি হয় এবং চারিদিকে হলুদ বর্ণের হয়।
দাগগুলো ক্রমশ বড় হতে থাকে। অনেক দাগ এক সঙ্গে মিলিত হয়ে বড় দাগ বা ক্ষতের সৃষ্টি করে।
পরে প্রতিটি দাগের মাঝখানে কালো ও চারিপাশে হলুদ বর্ণ ধারণ করে।
দাগগুলোর মাঝখানটা শুকিয়ে যায় এবং সমগ্র পাতা নষ্ট হয়ে পড়ে।
বেশি দাগ হলে পাতা খসে পড়ে।
রোগের প্রতিকার :
রোগাক্রান্ত লতা-পাতা বরজ হতে তুলে পুড়ে করতে হবে। নতুন বাগানের জন্য রোগমুক্ত লতা রোপণ করতে হবে । রোগ প্রতিরোধী জাত বারি পান-১ ও বারি পান-২ চাষ করতে হবে। বরজে রোগ দেখা দিলে টিল্ট ২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে গাছে ১০ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
৬. রোগের নাম : সাদা গুড়া (Powdery mildew)
রোগের কারণ : অয়িডিয়াম পাইপারিস (Oidium piperis)
রোগের বিস্তার : গরম ও শুষ্ক আবহাওয়া এবং ৫০ থেকে ৬০% বাতাসের আর্দ্রতায় এ রোগ দ্রুত বৃদ্ধি পায় ।
রোগের লক্ষণ :
পাতার নিচের পিঠ সাদা থেকে হালকা বাদামি গোলাকৃতি পাউডার লাগানো দাগ পড়ে। পরে দুই পিঠেই দাগ হয়।
দাগগুলো ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং সব পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। দাগ পড়া এলাকাটি পরে বাদামি রঙের হয়, শুকনো ও ভঙ্গুর হয়।
কচি পাতা আক্রান্ত হলে সে পাতা আর বাড়ে না এবং বিকৃত হয়ে যায়। আক্রান্ত পাতা বিবর্ণ হয়ে গাছ থেকে ঝরে পড়ে। লতার বৃদ্ধি বাধা প্রাপ্ত হয়।
রোগের প্রতিকার :
রোগমুক্ত গাছ থেকে লতা সংগ্রহ করতে হবে।
ফসল সংগ্রহের পর অবশিষ্টাংশ এবং আর্বজনা পুড়ে ফেলতে হবে। দ্রুতবেগে পানি স্প্রে করলেও রোগের প্রকোপ কমে যায়। রোগ দেখা দিলে থিউভিট ৮০ ঢ়ি অথবা কুমুলাস ডিএফ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে। রোগের আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ব্যভিস্টিন ১ গ্রাম অথবা টিল্ট ২৫০ ইসি ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে।
ড. কে. এম. খালেকুজ্জামান*
* ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব), মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, শিবগঞ্জ, বগুড়া। মোবাইল: ০১৯১১-৭৬২৯৭৮
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান উল্লেখযোগ্য। স্থির মূল্যে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ছিল ১.৮৭% এবং প্রবৃদ্ধির হার ২.৮৩%। মোট কৃষিজ জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান প্রায় ১৪.০৮%। তাছাড়া ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রাণিসম্পদ খাতে উৎপাদিত কাঁচা ও প্রক্রিয়াজাত পণ্য রফতানি আয় ছিল প্রায় ৯০৬০.৬৯ কোটি টাকা (সূত্র : এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো, ২০১৩-১৪)। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০% সরকারি এবং ৫০% পরোক্ষভাবে প্রাণিসম্পদ খাতের ওপর নির্ভরশীল। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ভিশন হচ্ছে দেশে দুধ, মাংস ও ডিম উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আমিষের চাহিদা পূরণপূর্বক মেধাবী, স্বাস্থ্যবান ও বুদ্ধিদীপ্ত জাতি গঠন করা। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর আধুনিক-লাগসই প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং সম্প্রসারণ সম্পর্কিত কাজ করে যাচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ে সম্পাদিত প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন কার্যাবলি ও সাফল্যগুলো নিম্নে উপস্থাপন করা হলো।
১. দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন ও জনপ্রতি প্রাপ্যতা বৃদ্ধি
দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন এবং জনপ্রতি প্রাপ্যতা বৃদ্ধির জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদফতর নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। বিগত ২০০৫-০৬ অর্থবছরে দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ২২.৭০ লাখ মেট্রিক টন, ১১.৩০ লাখ মেট্রিক টন, ৫৪২.২০ কোটি টি। বর্তমান সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং ভিশন ২০২১ এর আলোকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ অধিদফতর কর্তৃক কার্যকরী ও ফলপ্রসূ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে বিগত ২০১৩-১৪ অর্থবছর শেষে দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন বেড়ে যথাক্রমে ৬০.৯০ লাখ মেট্রিক টন, ৪৫.২০ লাখ মেট্রিক টন ও ১০১৬.৮০ কোটিতে উন্নীত হয়েছে।
২. দারিদ্র্যবিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরাসরি গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সাথে দেশের প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। দারিদ্র্যবিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি প্রাণিসম্পদ বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর লাখ লাখ বেকার যুবক, যুব মহিলা, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষককে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালনে সম্পৃক্ত করে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যবিমোচনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিগত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর কর্তৃক মোট ১০.১৫ লাখ জন (বেকার যুবক, যুব মহিলা, দুস্থ মহিলা, ভূমিহীন ও প্রান্তিক) কৃষককে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালনে প্রশিক্ষণ প্রদান করে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব ঘোঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া নতুন উদ্যোক্তা উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে, যা বাস্তবায়ন হলে বেসরকারি পর্যায়ে প্রাণিসম্পদের ব্যাপক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ফলে দেশে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য হ্রাসকরণে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে।
৩. প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে আধুনিক পদ্ধতিতে পালন, ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তির সম্প্রসারণ
ক. স্বাস্থ্যসম্মত ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণ
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লাভজনকভাবে মাংস উৎপাদনকে লক্ষ রেখে গরু মোটাতাজাকরণ প্যাকেজ প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। এর ফলে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গরু নির্বাচন, কৃমিমুক্তকরণ, পুষ্টি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাত্র ৪ থেকে ৬ মাসের মধ্যে অধিক মাংসবিশিষ্ট গরু বাজারজাত করে খামারিরা অধিক লাভবান হচ্ছেন।
খ. ক্ষুদ্র খামারিদের জন্য বাণিজ্যিক লেয়ার ও ব্রয়লার পালন মডেল
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সহায়তায় ক্ষুদ্র খামারি পর্যায়ে বাণিজ্যিক লেয়ার ও ব্রয়লার পালন মডেল অনুযায়ী মুরগি পালন করে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণসহ অর্থনৈতিক লাভবান হচ্ছে। এছাড়াও অধিদফতর কর্তৃক বিভিন্ন সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে গত এক দশকে পোলট্রি সেক্টরে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বর্তমানে দৈনিক ১৪০০ মেট্রিক টন মুরগির মাংস ও ১ কোটি ৫০ লাখ পিস ডিম বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে যা অভ্যন্তরীণ চাহিদার ১০০% পূরণ করার জন্য যথেষ্ট (সূত্র : সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, সিপিডি)।
গ. স্ল্যাট-স্টল পদ্ধতিতে ছাগল পালন
বাংলাদেশে সাধারণত উন্মুক্ত অবস্থায় ছাগল পালন করা হয়ে থাকে এবং ছাগলের জন্য বিশেষ কোনো ঘর তৈরি করা হয় না। এর ফলে ছাগল প্রায়শই নিউমোনিয়া ও বিভিন্ন প্যারাসাইটিক রোগে আক্রান্ত হয়, ফলে উৎপাদন মারাত্মক হারে ব্যাহত হয়। এসব সমস্যা রোধে এবং উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক সø্যাট পদ্ধতিতে বাসস্থান ও সম্পূর্ণ আবদ্ধাবস্থায় স্টলফিডিং প্রযুক্তির সম্প্রসারণে অধিদফতর কাজ করে যাচ্ছে।
ঘ. গ্রামীণ পরিবেশে হাঁস পালন প্রযুক্তি
নদীমাতৃক কৃষিনির্ভর এ দেশে প্রাচীনকাল থেকেই পারিবারিকভাবে হাঁস পালন হয়ে আসছে। তবে বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তিতে বছরব্যাপী আবদ্ধ বা অর্ধআবদ্ধ অবস্থায় উন্নত জাতের খাকি ক্যাম্পবেল, জিন্ডিং, ইন্ডিয়ান রানার প্রভৃতি হাঁস আদর্শ ব্রুডিং ও সুষম খাদ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পালনে অধিক লাভবান হওয়া সম্ভব। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে পালিত হাঁস মাত্র ১৮ থেকে ২০ সপ্তাহ থেকে ডিম পাড়া আরম্ভ করে এবং গড়ে বছরে ২৫০ থেকে ৩০০টি ডিম পাওয়া যায়।
ঙ. পারিবারিক পর্যায়ে কোয়েল-ককরেল- খরগোশ পালন প্রযুক্তি
জনবহুল এ দেশের খাদ্য ও পুষ্টি ঘাটতি মেটাতে প্রয়োজন খাদ্যের বৈচিত্র্যময়তা। এ লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ খাতে নতুন সংযোজন হয়েছে খরগোশ, ককরেল এবং কোয়েল পালন। দ্রুত বর্ধনশীল, স্বল্প পুঁজি ও অধিক লাভজনক হওয়ায় এ সেক্টর দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।
৪. প্রাণিসম্পদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খাদ্য ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ
গবাদিপশু ও পাখি পালনে অন্যতম বড় সমস্যা হলো পশু খাদ্যের অপ্রতুলতা। ফলে পশুখাদ্যের বিকল্প অনুসন্ধান ও পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। প্রকৃতির ভাণ্ডারের কিছু সম্ভাবনাময় খাদ্য যা নির্দিষ্ট কিছু প্রযুক্তি ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। নিম্নে তা উপস্থাপিত হলো-
ক. ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র (ইউ. এম. এস)
ইউ. এম. এস ইউরিয়া, মোলাসেস এবং খড় (স্ট্র) এর একটি মিশ্রিত খাবার যা গরুকে প্রতিদিন শুকনা খড়ের পরিবর্তে চাহিদা মতো খাওয়ালে বাড়ন্ত ষাঁড়ের ক্ষেত্রে দৈনিক ৭০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজন বৃদ্ধি পায় এবং গাভীর ক্ষেত্রে দৈনিক ১.০ থেকে ১.৫ কেজি দানাদার খাদ্য কম প্রদান করেও ১.৫ থেকে ২.০ লিটার দুধ বেশি পাওয়া যায়। এটিতে খড়, ইউরিয়া এবং মোলাসেসের অনুপাত যথাক্রমে ৮২ঃ৩ঃ১৫।
খ. গোখাদ্য হিসেবে অ্যালজি উৎপাদন ও ব্যবহার
ক্লোরেলা ও সিনেডেসমাস প্রজাতির অ্যালজি অধিক প্রোটিন ও ভিটামিন সমৃদ্ধ পশুখাদ্য বিধায় আমিষ জাতীয় খাদ্য যেমন- খৈল, ফিশ মিল প্রভৃতি এমনকি কাঁচা ঘাসের পরিবর্তে অ্যালজি পানি ব্যবহার লাভজনক। ১০ বর্গমিটার আয়তনবিশিষ্ট কৃত্রিম পুকুরে ১৫ থেকে ২০ লিটার পরিমাণ অ্যালজির বীজ, ১০০ গ্রাম ডালের ভুসি ভেজানো, ১ লিটার পানি, প্রতিদিন ২ থেকে ৩ গ্রাম ইউরিয়া ও ২০০ লিটার টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করে প্রতিদিন প্রায় ৫০ লিটার অ্যালজির পানি উৎপাদন করা যায়। এ পানি গরু-ছাগলকে সাধারণ পানির পরিবর্তে বা খড়, ভুসি ইত্যাদির সাথে মিশিয়েও খাওয়ানো যায়।
গ. সাইলেজ পদ্ধতিতে সবুজ ঘাস সংরক্ষণ
বর্ষা মৌসুমে অথবা যখন ঘাস উদ্বৃত্ত থাকে তখন সাইলেজ পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ বায়ুনিরোধক অবস্থায় সবুজ ঘাস সংরক্ষণ করা যায়। এর ফলে শুকনো-খরা মৌসুমের জন্য কাঁচা ঘাস যেমন জমা থাকে তেমনি ঘাসের পুষ্টিগুণও বৃদ্ধি পায়। উঁচু জায়গায় ৩ থেকে ৪ ফুট গভীরতা বিশিষ্ট কোনাবিহীন গোলাকার গর্তে পলিথিন এমনভাবে বিছাতে হবে যেন সাইলেজকে পুরোপুরি মুড়িয়ে পানি রোধক করা যায়। অতঃপর সবুজ ঘাস ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি পরিমাণ করে কেটে গর্তে এঁটে সাজাতে হবে। ঘাসে পানির পরিমাণ বিবেচনা করে ৫ থেকে ১০% শুকনো খড় পড়তে পড়তে সাজাতে হবে এবং ৩ থেকে ৪% চিটাগুড় ১ঃ১ অনুপাতে পানির সাথে মিশিয়ে প্রতি পরতে ছিটিয়ে দিতে হবে। এভাবে উপরে ৪ থেকে ৫ ফুট পর্যন্ত ঘাস সাজিয়ে খড় দ্বারা পুরু আস্তরণে ঢেকে পলিথিন দিয়ে ভালোভাবে মুড়িয়ে এর উপরে ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি পুরু করে মাটি লেপে দিতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে গো-খাদ্যের অভাব হলে প্রতি ১০০ কেজি ওজনের জন্য ১০ কেজি সাইলেজ দৈনিক ব্যবহার করে গোখাদ্য সমস্যা কিছুটা হলেও মেটানো সম্ভব।
ঘ. গোখাদ্য হিসেবে কলাগাছের সংরক্ষণ ও ব্যবহার
প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে কলা উৎপাদিত হলেও কলাগাছের খুব নগণ্য অংশই গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সারা বছরের মাঝে বর্ষা মৌসুমেই কলা উৎপাদনের পরিমাণ বেশি হওয়ায় কলাগাছ বৃষ্টির কারণে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে গোখাদ্য হিসেবে এর উপযোগিতা ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি হওয়ায় সাইলেজ পদ্ধতিতে ‘কলাগাছ সংরক্ষণ ও ব্যবহার’ প্রযুক্তিটি গোখাদ্য সমস্যা সমাধানে নতুন দিক উন্মোচন করেছে।
৫. প্রাণিসম্পদের চিকিৎসা উন্নয়নে প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ
* গবাদিপশুর কৃমিরোগ দমন মডেল
* পিপিআর রোগের সমন্বিত চিকিৎসা
* ELISA ভিত্তিক ক্ষুরারোগ নির্ণয় পদ্ধতি
* পিপিআর ও রিন্ডারপেস্ট রোগ নির্ণয়ে ঊওঝঅ পদ্ধতি
* বাণিজ্যিক খামারে মুরগির জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা
* পিপিআর ও সালমোনেলা ভ্যাকসিন উদ্ভাবন ও ব্যবহার ইত্যাদি।
এছাড়াও অধিদফতরের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দফতর এবং জেলা প্রাণি হাসপাতালগুলো থেকে কৃষক ও খামারিদের রুগ্ণ গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির চিকিৎসা, টিকা প্রদান এবং বিভিন্ন পরামর্শ সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে। এ সেবা কার্যক্রম সেবা কর্মীদের মাধ্যমে গ্রামীণ পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে প্রায় ৬ কোটি ২৭ লাখ রুগ্ণ পশুপাখিকে চিকিৎসা সেবা ও ১৭ কোটি ৭১ লাখ পশুপাখিকে রোগ প্রতিরোধের জন্য ১৭ প্রকারের টিকা প্রদান করা হয়েছে।
৬. প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে সম্প্রসারণমূলক কার্যক্রম
ক. কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম সম্প্রসারণ ও গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন
প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সারা দেশে মোট ৩,২৬৪টি কৃত্রিম প্রজনন উপকেন্দ্র/পয়েন্টের মাধ্যমে (ডিসেম্বর-২০১৪) দেশব্যাপী গবাদিপশুর কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে গবাদিপশুর জাত উন্নয়নের জন্য প্রায় ২৯ লাখ ৭৪ হাজারটি গাভীকে কৃত্রিম প্রজনন করা হয়েছে। আলোচ্য অর্থবছরে গবাদিপশুর কৃত্রিম প্রজনন ফি ও ছাগি প্রজনন ফি বাবদ মোট ৬ কোটি ৫০ লাখ ৪০ হাজার ৭৭৭ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। এছাড়া দেশের প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি পূরণের জন্য আবহাওয়া উপযোগী সংকর জাতের বিফ ক্যাটল উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি প্রকল্প চলমান আছে, যা দেশের মাংস উৎপাদন বৃদ্ধি ও জনপ্রতি মাংসের প্রাপ্যতা বাড়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
খ. প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশনে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার
প্রাণিসম্পদ বিভাগের কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশন করার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে এবং অধিদফতরের ওয়েবসাইটটি (www.dls.gov.bd) চালু রয়েছে। Local Area Network (LAN), e-livestock, online monthly/quarterly report প্রদান, টেন্ডার, চাকরির বিজ্ঞপ্তি, বদলির আদেশ এবং অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সর্বশেষ তথ্য ওয়েবসাইটে নিয়মিত দেয়া হচ্ছে। এছাড়া এসএমএস গেটওয়ে সিস্টেমের(SMS Gateway System) মাধ্যমে ডিজিস সার্ভিলেন্স কার্যক্রম চলমান আছে। এটি ব্যবহার করে অতি দ্রুত মাঠ পর্যায় থেকে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের একটি সার্ভিলেন্স কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে দ্রুত এ রোগ নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণের ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে।
গ. গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির চিকিৎসা প্রদান ও রোগ নিয়ন্ত্রণ
অধিদফতরের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দফতর এবং জেলা প্রাণি হাসপাতালগুলো থেকে কৃষক ও খামারিদের রুগ্ণ গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির চিকিৎসা, টিকা প্রদান এবং বিভিন্ন পরামর্শ সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে। এ সেবা কার্যক্রম সেবা কর্মীদের মাধ্যমে গ্রামীণ পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে প্রায় ৬ কোটি ২৭ লাখ রুগ্ণ পশু পাখিকে চিকিৎসা সেবা ও ১৭ কোটি ৭১ লাখ পশুপাখিকে রোগ প্রতিরোধের জন্য টিকা প্রদান করা হয়েছে।
ঘ. চিড়িয়াখানার জীববৈচিত্র্য উন্নয়ন ও চিত্তবিনোদন
ঢাকা চিড়িয়াখানার প্রাণি বৈচিত্র্য উন্নয়নে এবং স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের চিত্তবিনোদনে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর নানাবিধ কার্যক্রম এরই মধ্যে গ্রহণ করেছে। এ চিড়িয়াখানায় বর্তমানে ১৪৩ প্রজাতির ২৩৭৪টি পশুপাখি ও অ্যাকুয়ারিয়াম ফিশের মাধ্যমে চিড়িয়াখানাটির জীব বৈচিত্র্য সমৃদ্ধশালী করা হয়েছে। গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ঢাকা চিড়িয়াখানায় প্রায় ৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। তাছাড়া ঢাকা ও রংপুর চিড়িয়াখানা দুটিকে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে ডিজিটাল সার্ভে করা হয়েছে। সামাজিক কার্যক্রম স্বরূপ অটিস্টক শিশুসহ সব প্রকার প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের চিড়িয়াখানায় প্রবেশ ফি সম্পূর্ণ মওকুফ করা হয়েছে।
ঙ. মানবসম্পদ উন্নয়ন ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার
ঝিনাইদহ সরকারি ভেটেনারি কলেজে ৫ বছর মেয়াদি ভেটেনারি গ্র্যাজুয়েশন কোর্সের শিক্ষা কার্যক্রম ২০১৩-১৪ শিক্ষা বর্ষ থেকে শুরু হয়েছে। এ কলেজে প্রতি শিক্ষা বর্ষে মোট ৬০ জন ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হচ্ছে এবং তাদের শিক্ষা কার্যক্রম নিয়মিতভাবে চলছে। ‘সিরাজগঞ্জ সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ স্থাপন’ প্রকল্পের আওতায় ভেটেরিনারি শিক্ষার প্রসারে নতুন একটি সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম চলমান আছে। এছাড়াও প্রাণিসম্পদ খাতে সাব-প্রফেশনাল জনবল সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘এস্টাবলিসমেন্ট অব ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি প্রজেক্ট’ প্রকল্পের আওতায় ৫টি প্রাণিসম্পদ ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট স্থাপনের কার্যক্রম চলমান আছে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি শিক্ষা বর্ষে ২০০ জন ছাত্রছাত্রী প্রাণিসম্পদের ওপর ডিপ্লোমা কোর্সে অধ্যয়ন করতে পারবে।
চ. ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রজেক্ট (NATP)
বিশ্ব ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ সেবা উপজেলা থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিকেন্দ্রীকরণ এবং খামারি/কৃষকের চাহিদামত প্রযুক্তি নির্ভর সেবা কার্যক্রম সম্প্রসারণের উদ্দেশে গ্রামে গ্রামে Common Interest Group (CIG), Producer Organization (PO), ইউনিয়ন পর্যায়ে Community Extension Agent for Livestock (CEAL) এবং উপজেলা পর্যায়ে প্রাণিসম্পদ বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য NATP প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় ১,২৮০ জন সিল (কমিউনিটি এক্সটেনশন এজেন্ট ফর লাইভস্টক) ইউনিয়ন পর্যায়ে খামারিদের বিভিন্ন প্রকার চাহিদামাফিক সেবা প্রদান করছে। ৭৩২টি ফিয়াক (ফার্মারস ইনফরমেশন অ্যান্ড এডভাইজ সেন্টার) হতে বছরে প্রায় ২.৩০ লাখ খামারির বিভিন্ন সমস্যা সমাধান বিষয়ক পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে।
ছ. প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম
প্রাণিসম্পদের অধিদফতরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বেকার যুবক ও যুব মহিলা, দুস্থ পরিবার, ভূমিহীন, প্রান্তিক চাষিদের আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে আয়ের সুযোগ সৃষ্টি ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৯৬-৯৭ থেকে ১৯৯৯-২০০০ পর্যন্ত ‘প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রমে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্প (১ম পর্যায়)’-এর মাধ্যমে ২৫.০৪ কোটি টাকা ও ২০০০-০১ থেকে ২০০৪-০৫ পর্যন্ত ‘প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রমে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্প (২য় পর্যায়)’-এর মাধ্যমে ৮.৬৭ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ২০০৩-০৪ থেকে ২০০৫-০৬ সন পর্যন্ত ‘দারিদ্র্যবিমোচনে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম (ছাগল, ভেড়া ও হাঁস-মুরগি) কর্মসূচি’-এর মাধ্যমে ৪৪০টি উপজেলায় ৩২.৯৮ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। নতুন প্রণীত কার্যনির্দেশিকা-২০১১ অনুসারে পুনঃক্ষুদ্রঋণ বিতরণ কার্যক্রম চলমান আছে।
জ. প্রাণিসম্পদের উৎপাদনের ওপর জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলা
বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে গবাদিপ্রাণীর ওপর বর্ধিত তাপমাত্রার পীড়নের ফলে উৎপাদন সরাসরি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে চারণভূমি হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে উপকূলীয় এলাকায় নতুন জেগে ওঠা চর কিংবা সরকারের খাস জমিতে সমবায়ের ভিত্তিতে চারণভূমি স্থাপনের জন্য নীতিমালা প্রণয়নের কাজও এগিয়ে চলছে। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ‘কম্প্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম ফেজ-২ (সিডিএমপি-২)’ আমব্রেলা প্রকল্পের প্রাণিসম্পদ অংশের কার্যক্রমের আওতায় দুর্যোগ ও জলবায়ু বিষয়ক একটি অ্যাকশন প্লান তৈরি করা হয়েছে, সচেতনতামূলক কৃষক সভা ও উন্নয়নমূলক ডেমন্সট্রেশন কার্যক্রমের আওতায় ২ হাজার ৪০০ কৃষককে সচেতনতা মূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে, কর্মকর্তাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু অভিযোজন বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান এর আওতায় ৫০০ জন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে, আইসিটি সেল স্থাপন ও জলবায়ু বিষয়ক কন্ট্রোল রুম স্থাপন কার্যক্রম চলমান আছে। দুর্যোগ প্রতিরোধে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় দক্ষ কর্মী তৈরি করা কার্যক্রমের আওতায় ৬০ জন কর্মী তৈরি করা হয়েছে। ইনটিগ্রেটেড রেজিলিয়েন্ট মডেল ভিলেজ স্থাপন করা এবং প্রাণিসম্পদ টেকনোলজি ট্রান্সফারের মাধ্যমে ডিজাস্টার প্রুফ ভিলেজ তৈরির আওতায় ১০টি মডেল ভিলেজ স্থাপন করা হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কারিগরি সহায়তায় বন অধিদফতর কর্তৃক বাস্তবায়িত ‘কমিউনিটি বেসড্ এডাপ্টেশন টু ক্লাইমেট চেঞ্জ (সবিএসিসি)’ প্রকল্পের কার্যক্রমের আওতায় উপকূলীয় ৪টি ইউনিয়নে নির্বাচিত সুফলভোগীদের (৫৫০ জন) প্রতিকূল পরিবেশে পশুপাখি পালনে খাপখাইয়ে নেয়ার সক্ষমতা অর্জন বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
অজয় কুমার রায়*
*মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব), প্রাণিসম্পদ অধিদফতর, বাংলাদেশ, ঢাকা, মোবাইল : ০১৭১১১৬৪০৯৬
বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট পুকুর-ডোবা। স্বল্পায়তনের এ পুকুর-ডোবাগুলোতে সারা বছরই পানি থাকে না। এগুলোর অধিকাংশই হাজামজা অবস্থায় পড়ে আছে। একটু উদ্যোগ নিলেই পরিত্যক্ত এসব স্বল্পায়তনের জলাশয়গুলোতে অতি সহজেই লাভজনকভাবে মাছ চাষ করা যায়।
সাম্প্রতিক এক জরিপে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৯৭ লাখ পুকুর ও ডোবা রয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে, স্বল্প পরিসর বিশিষ্ট অগভীর পুকুর-ডোবাগুলো প্রচলিত রুইজাতীয় মাছ চাষের অনুপযোগী, কেননা ক্ষুদ্রায়তনের এ জলাশয়গুলোতে সারা বছর পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি না থাকার কারণে রুই জাতীয় মাছের স্বাভাবিক বর্ধন প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। তাছাড়া এদের বৃদ্ধির হারও তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় মাছের সার্বিক উৎপাদনের পরিমাণও চলে আসে প্রায় শূন্যের কোটায়। তাই মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বাণিজ্যিক সুবিধার দিক লক্ষ রেখে এসব পুকুর-ডোবায় বিদেশি প্রজাতির দ্রুতবর্ধনশীল মাছ যেমন সিলভারকার্প, গ্রাসকার্প, মিররকার্প, নাইলোটিকা ও থাই সরপুঁটি (রাজপুঁটি) চাষের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
এ মাছগুলো দ্রুতবর্ধনশীল ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যেই এগুলো বাজারজাত করার মতো পরিপুষ্টতা অর্জন করে।
উপরন্তু বিদেশি প্রজাতির এ মাছ খেতেও অত্যন্ত সুস্বাদু। প্রতিকূল পরিবেশে অগভীর জলাশয়ে কম অক্সিজেনযুক্ত পানিতে এরা বেঁচে থাকতে পারে। তাছাড়া সব ধরনের প্রাকৃতিক খাবার ও সম্পূরক খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত। সর্বোপরি, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ এ মাছ চাষের জন্য খুবই অনুকূল। এছাড়া তুলনামূলক স্বল্প খরচে ও সহজ ব্যবস্থাপনায় চাষ করাও সম্ভব।
আধুনিক প্রযুক্তি সমন্বিত সুষ্ঠু চাষ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলে স্বল্পায়তনের এসব পুকুর-ডোবায় চাষকৃত গ্রাসকার্প ও মিররকার্প অনধিক চার-পাঁচ মাসের মধ্যে গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম এবং থাইসরপুঁটি (রাজপুঁটি) ২০০ গ্রাম ওজনে উন্নীত হয়ে থাকে।
অপর এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, এসব পুকুর-ডোবায় পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনায় মাছ চাষ করে প্রতি শতাংশে উৎপাদন খরচ সর্বোচ্চ ১২০ টাকার বিনিময়ে ৩০০ টাকার মতো আয় করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে খরচ বাদে প্রতি শতাংশে প্রকৃত আয় থাকবে সর্বনিম্নে ১৮০ টাকা।
নিম্নে এ প্রজাতির মাছ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হলো-
পুকুরের আয়তন ৫ থেকে ৪০ শতাংশ হতে পারে। এ ধরনের পুকুরের গভীরতা সাধারণত সাড়ে চার থেকে ৬ ফুট হয়ে থাকে। পোনা ছাড়ার আগে পুকুর নিয়মমাফিক প্রস্তুত করে নিতে হয়।
প্রথমেই পুকুরের পাড় মেরামত, অবাঞ্ছিত আগাছা পরিষ্কার ও রাক্ষুসে মাছ অপসারণ প্রয়োজন। শুকনো মৌসুমে পুকুরের তলার মাটি লবণ দিয়ে কর্ষণ করে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হয়। চুন প্রয়োগে পুকুরের তলার বিষাক্ত গ্যাস দূরীভূত হয়, উপরন্তু পানিতে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়াও হয় ত্বরান্বিত। চুন প্রয়োগের সাত দিন পর প্রতি শতাংশে ৪ কেজি গোবর, ১৫০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা উত্তম।
প্রস্তুতকৃত পুকুরে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাকৃতিক খাদ্য মজুদ আছে এ নিশ্চয়তা পাওয়ার সাথে সাথে প্রতি শতাংশে ১.৫ ইঞ্চি থেকে ২ ইঞ্চি আকারের ৪০ থেকে ৫০টি উপরোক্ত যে কোনো প্রজাতির পোনা ছাড়া যেতে পারে।
মাছের খাদ্য সরবরাহ
পুকুরে যে পরিমাণ মাছ আছে তার সর্বমোট ওজনের শতকরা ৪ থেকে ৬ ভাগ হারে চালের কুঁড়া কিংবা গমের ভুসি সম্পূরক খাদ্য হিসাবে প্রতিদিন সকালে ও বিকালে দুইবার ছিটিয়ে দিতে হবে। প্রতি মাসে একবার জাল টেনে মাছের গড় ওজন নির্ধারণ করে খাবারের পরিমাণ ক্রমশ বাড়ানো বাঞ্ছনীয়।
পুকুরে খাবারের ঘাটতি দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতি শতাংশে ১৫০ থেকে ২০০ গ্রাম টিএসপি এবং ওই পরিমাণ ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। গ্রাসকার্প ও থাইসরপুঁটি সাধারণত নরম ঘাস ও সবুজ উদ্ভিদ খেতে পছন্দ করে তাই এদের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ক্ষুদেপানা টোপাপানা, নেপিয়ার ঘাস ও কলাপাতা ইত্যাদি প্রতিদিন সামান্য পরিমাণে হলেও সরবরাহ করা গেলে মাছের আনুপাতিক উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে সন্তোষজনকভাবে। গ্রাসকার্প জলজ আগাছাকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করায় কচুরিপানা বা অন্যান্য জলজ আগাছা এখন আর কোনো অবাঞ্ছিত উপকরণ নয় বরং মাছের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত অপরিহার্য।
আসুন আমরা কালবিলম্ব না করে বাংলাদেশের এ প্রাকৃতিক পরিবেশকে কাজে লাগাই। পরিত্যক্ত পুকুর-ডোবাগুলোতে বিদেশি প্রজাতির মাছ চাষ করে পারিবারিক চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি আয়ের পথ সুগম করি।
দলিল উদ্দিন আহমদ*
* সাবেক মৎস্য কর্মকর্তা, প্রযত্নে মনি ফার্মেসি, ফতুল্লা রেলস্টেশন, ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ, মোবাইল- ০১৭২৪০৫০৪০৩
বৃক্ষ রোপণ করি
আবুল হোসেন আজাদ*
বাড়ির সামনে উঠোন কোণে আনাচ কানাচ ভরি,
আর দেরি নয় এসো সবাই বৃক্ষ রোপণ করি।
ফলদ বনজ ঔষধি গাছ লাগাই নিজ হাতে
ঘেরা বেড়া দিয়ে রাখি নষ্ট না হয় যাতে।
বৃক্ষ দেবে কাঠ ফল ওষুধ অক্সিজেনও দেবে।
আমাদের ত্যাগ করা শেষে কার্বনডাইঅক্সাইড নেবে।
এই বৃক্ষই বড় হলে আসলে বিপদ ঘাড়ে,
বিক্রি করে আসবে টাকা লাগবে উপকারে।
তারই সবুজ শ্যামলিমায় ভরবে বাংলাদেশ,
চারিপাশে উঠবে গড়ে সুস্থ পরিবেশ।
ডালে ডালে গাইবে পাখি বাঁধবে তাদের বাসা
ঠেকাবে সে ঝড়ঝাপটা যখন সর্বনাশা।
আলসেমিটা ঝেড়ে ফেলে আজই ক’টি চারা
লাগিয়ে দিই ফাঁকা স্থানে মনে করে তাড়া।
পরিবেশের ভারসাম্যটা গাছই রক্ষা করে,
দেবে ছায়া শীতল বাতাস প্রাণটা সবার ভরে॥
গাছেই ধন
কৃষিবিদ একেএম এনামুল হক**
গাছ রোপণে সঠিকভাবে যত্ন করে যাবে,
হারিয়ে যাওয়া ধনটুকু গাছ থেকেই পাবে।
গাছ মোদের অর্থের খনি সবাই খেয়াল করি,
চল মোরা গাছ লাগিয়ে সোনার বাংলা গড়ি।
গাছকে যদি সন্তানের মতো যত্ন করে যাই,
অন্য কাজে হেরে গেলেও গাছ দিবে ঠাঁই।
গাছ হলো বড় সম্পদ কোন ভয় নাই,
সকল কাজে ব্যর্থ হলেও গাছে লাভ পাই।
গাছ মানুষের উপকারী বন্ধু জীবন চলার পথে,
ভালোবাসা দিয়ে গড়ে নাও সুখ দুঃখের সাথে।
গাছ যখন শিশু বেলায় জন্মায় মাটির বুকে,
সবাই চলো আদর দিয়ে জড়িয়ে নেই বুকে।
গাছ তাপ কমিয়ে মোদের ছায়ায় রাখে,
গাছ কত বড় বন্ধু একবার ভেবে দেখ।
গাছ দেশের সম্পদ, টাকা ফলে থাকে,
সুন্দরভাবে বরণ করি অন্য কাজের ফাঁকে।
সোনার মাটি
নাহিদ বিন রফিক***
শহীদ গাজীর পূণ্যভূমি
সোনার মাটি সোনার দেশ
বেজায় ফলন দিচ্ছ তুমি
সম্ভাবনার নেইকো শেষ।
ফল-বনায়ন হচ্ছে কেবল
আশেপাশে, বনে বনে
মাছ, মুরগি, গাভী নিয়ে
মহাব্যস্ত জনে জনে।
ঘর-উঠোনে কাজ পড়েছে
কৃষাণীরা নেইতো বসে
চতুর কাজের ফাঁকে ফাঁকে
শাড়ি, চুড়ি বায়না কষে।
সব ফসলের হচ্ছে চাষ
মাঠের পরে মাঠ
পণ্য বিকে অর্থ পেলে
গরম হবে হাট॥
* শিশু সাহিত্যিক, গ্রাম-বেচনা, পো-শাঁখরা কোমরপুর, জেলা-সাতক্ষীরা, মোবাইল : ০১৭১৫৪৬৭৪৭৫;
** অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, মোবাইল : ০১৯১৬৯৩৩০৫৯;
*** টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস, বরিশাল।
খলিলুর রহমান
ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন : আম গাছের ডাল, পাতা ও ফলে কালো ফোসকার মতো দাগ পড়ে। করণীয় কী?
উত্তর : আপনার আম গাছ অ্যানথ্রাকনোজ নামক রোগে আক্রান্ত। এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগের প্রতিকার বা করণীয় হলো -
- আক্রান্ত অংশগুলো সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলা।
- আম বাগান পরিষ্কার রাখা।
- বছরে দুইবার সুষম সার প্রয়োগ করা।
রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি প্রাফিকোলাজল (টিল্ট) বা ১ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম (ব্যাভিস্টিন বা নোইন) মিশিয়ে ১২ থেকে ১৫ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।
পলাশ চন্দ্র
নীলফামারী
প্রশ্ন : পাট গাছের কচি পাতা ও ডগা পোকা কেটে দিচ্ছে। কী করণীয়?
উত্তর : পাটের ঘোড়া পোকার কীড়া গাছের কচি পাতা কুঁড়ি, ডগা খায়। এ পোকার আক্রমণ হতে রক্ষা পেতে আক্রান্ত পাতা কীড়াসহ নষ্ট করতে হবে। ক্ষেতে ডাল পুঁতে পোকা খেকো পাখি বসার ব্যবস্থা করতে হবে।
আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত যে কোনো একটি বালাইনাশক যেমন- ডায়াজিনন, সেভিন, রিপকর্ড, ক্যারাটে ব্যবহার করতে হবে।
মো. ফাইজ উদ্দিন
কুলিয়ারচর, কিশোরগঞ্জ
প্রশ্ন : ছোট ছোট কুমড়া হলুদ হয়ে পচে ঝরে যাচ্ছে। এখন কী করব?
উত্তর : কুমড়া ফলের মাছি পোকার আক্রমণে ৫০ থেকে ৭০ ভাগ ফল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মাছি পোকা মিষ্টিকুমড়ার প্রধান শক্র।
আক্রান্ত পল দেখা মাত্র তা তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
সেক্স ফেরোমন এবং বিষটোপ ফাঁদের যৌথ ব্যবহারে সফলভাবে এ পোকা দমন করা যায়। আক্রমণ বেশি হলে ডিপটেরক্স ৫০ ইসি ১.০ মিলি বা ২ মিলি সবিক্রন, সাইপামেথ্রিন ১ মিলি. প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে।
মো. কাদের
ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : কলাগাছের পাতাগুলো গুচ্ছাকারে বের হচ্ছে এবং কচি পাতার কিনারা ওপরের দিকে বাঁকানো ও হলুদ রঙের। প্রতিকার কী ?
উত্তর : কলাগাছের গুচ্ছমাথা ভাইরাসজনিত রোগ। আক্রান্ত গাছ দেখামাত্র গোড়াসহ তুলে পুড়ে বা পুঁতে ফেলতে হবে।
ভাইরাসের বাহক পোকা (জাবপোকা, থ্রিপস) দমনের জন্য ইমিডাক্লোরপ্রিড জাতীয় (এসাটাফ, টিডো, এডমায়ার) কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
মো. আবদুল বারেক
লালপুর, নাটোর
প্রশ্ন : লালশাক পাতার নিচে সাদা বা হলুদ দাগ দেখা যায়, পরে পাতা মরে যায়। কী করণীয়।
উত্তর : লালশাক বা ডাঁটার মরিচা রোগের লক্ষণ। এ রোগ গাছের শিকড় ছাড়া সব অংশে আক্রমণ করে।
প্রতিকার ● পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করা।
● ফসলের পরিত্যক্ত অংশ পুড়ে নষ্ট
করা।
● সুষম সার ব্যবহার করা।
● রোগ দেখা দিলে ছত্রাশনাশক হিসাবে
প্রকিকোনাজল (টিল্ট) ০.৫ মিলি
প্রতি লিটার পানি সহযোগে স্প্রে করা।
আরমান হোসেন
নোয়াখালী
প্রশ্ন : পুকুরে পোনা মজুদ সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : বিশ্বস্ত নার্সারি বা ভালো উৎস থেকে মানসম্পন্ন পোনা সংগ্রহ করতে হবে। সাধারণত পলিথিন ব্যাগ, পাতিল বা ড্রামে করে পোনার স্বাস্থ্যগত অবস্থা, পরিবহন দূরত্ব ও সময়, পানির তাপমাত্রা ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে পোনা পরিবহন করে পুকুরের পানির সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে পোনা মজুদ করতে হয়। পোনাকে শোধন বা ব্যাক্টেরিয়ার হাত থেকে রক্ষার জন্য ২০ লিটার পানিতে ১ মুটি লবণ মিশ্রিত করে পানির মিশ্রণে জালের মধ্যে পোনা নিয়ে ১ মিনিট রেখে তারপর পুকুরে ছাড়তে হবে।
রবিউল ইসলাম
নীলফামারী
প্রশ্ন : ভালো পোনা কোথায় পাওয়া যাবে এবং কীভাবে চেনা যায়?
উত্তর : ভালো মানের পোনার জন্য সরকারি হ্যাচারি বা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বেসরকারি হ্যাচারি থেকে ভালো মানের ব্রুড মাছ ব্যবহার করে উৎপাদিত পোনা সংগ্রহ করতে হবে।
ভালো পোনা চকচকে থাকবে (উজ্জ্বল বর্ণের) হবে। পোনার লেজ ধরলে যে পোনা ঝাঁকি দেবে বা নড়াচড়া করবে সেটি সুস্থ সবল পোনা। পোনার গায়ে কোনো স্পট থাকবে না। পাতিলের পানি হাত স্রোতের সৃষ্টি করলে ভালো পোনা উল্টোদিকে সাঁতার কাটবে। পুকুরে ছাড়ার সময় ভালো পোনা বের হয়ে যাবে আর ভালো না হলে নড়াচড়া কম করবে এবং ভেতরে রয়ে যাবে।
মো. মিজানুর রহমান
জামালপুর
প্রশ্ন : কৈ চাষ ব্যবস্থাপনা কীভাবে করব?
উত্তর : পুকুর ২০ থেকে ২৫ শতাংশ এবং ১ থেকে ১.৫ মিটার গভীর জলাশয়ে কৈ চাষ করলে ভালো হয়। পুকুর প্রস্ততির সময়ে ১ কেজি চুন, ৮ থেকে ১০ কেজি গোবর, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও টিএসপি দিতে হবে। ২০০ থেকে ২৫০টি শতাংশ হারে চারা পোনা মজুদ করতে হবে। মাছের মোট ওজনের ৪ থেকে ৫% হারে ৩ বারে খাবার দিতে হবে। সম্পূরক খাদ্য ৩৫ থেকে ৪০% প্রোটিনযুক্ত হলে ভালো হয়। ফিশমিল ২০%+ সরিষা/-সয়াবিন খৈল ৩৫%+ চালের কুঁড়া ৪০%+ আটা ৪%+ ভিটামিন ও খনিজ ১% হারে মিক্স করতে হবে। পরিচর্যা ঠিকমতো করলে ৬ মাসে ওজন হবে গড়ে ৪০থেকে ৫০ গ্রাম এবং বিক্রি করা যায়। ১২ থেকে ১৩ কেজি- শতাংশ উৎপাদন হয়ে থাকে।
রানা আহমেদ
বগুড়া
প্রশ্ন : পানির পিএইচ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়?
উত্তর : পুকুর বা খামার তৈরির সময় চুন ১ কেজি-শতক হারে ৩ থেকে ৫ ফুট পানির গভীরতায় প্রয়োগ করতে হবে। মজুদ পরবর্তীতে ২৫০ থেকে ৫০০ গ্রাম-শতক হারে প্রয়োগ করতে হবে। পানির পিএইচ পরীক্ষা করে যদি ৬ এর নিচে থাকে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
চুনের পরিবর্তে জিওটক্স-জিওলাইট ২৫০ গ্রাম-শতাংশে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
এছাড়াও বায়োকেয়ার প্রতি ৭ দিন অন্তর ৮০ থেকে ১২০ মিলি./শতক হারে দিতে হবে প্রতিষেধক হিসেবে। আর নিরাময়ের জন্য পর পর ২ দিন ১২০ থেকে ১৬০ মিলি./শতক হারে প্রয়োগ করতে হবে।
মাসুম
বগুড়া
প্রশ্ন : গরুকে কুকুর কামড় দিয়েছে। কী করব?
উত্তর : কামড়ানো জায়গা ভালো করে পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেন্ট দ্রবণ দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে। রেবিসিন ১০ সিসি ১০০ কেজি ওজনের জন্য ১ম দিন ৪ সিসি, ৭ম দিন ৩ সিসি এবং ২১তম দিন ৩ সিসি ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হবে।
ফিরোজ
রাজশাহী
প্রশ্ন : গরুর বেবিসিওসিস রোগে করণীয় কী?
উত্তর : অ্যান্টিবায়োটিক স্ট্রেস্টোপি, ডায়াভিন, বেবিসিন, কেবিনিল, ব্যাপকিওর যে কোনো একটি ১০০ কেজি ওজনের জন্য ২ মিলি দিতে হবে।
নাজমুল হক
দিনাজপুর
প্রশ্ন : গরুর গায়ে ঘা হয়েছে। কী করণীয় ?
উত্তর : ইঞ্জেকশন এস্টাভেট ৫ সিসি করে রোজ ১ বার ৩ দিন মাংসে দিতে হবে (১০০ কেজির জন্য)।
ইঞ্জেকশন রেনামাইসিন খঅ প্রতি ৫০ কেজি গরুর দেহের ওজনের জন্য ৫ সিসি করে রোজ ১ বার ৩ দিন মাংসে পুশ করতে হবে।
মিজানুর রহমান
পাবনা
প্রশ্ন : গরু ছাগলের নিউমোনিয়া হলে কী করণীয়?
উত্তর : অ্যান্টিবায়োটিক ট্রেপ্টোপি ১০০ কেজি ওজনের জন্য ২.৫ গ্রাম ৩ থেকে ৪ দিন এবং অক্সিলিন ভেট এল এ ১০০ কেজি ওজনের জন্য ১০ মিলি করে ৩ থেকে ৪ দিন দিতে হবে।
আক্রমণাত্মক ছাগল অতি দ্রুত অন্যান্য ছাগল হতে আলাদা করে নিতে হবে। আক্রমণাত্মক ছাগলকে স্যাঁতস্যাতে স্থান থেকে দূরে রাখতে হবে।
আইয়ুব
গাজীপুর
প্রশ্ন : মুরগির বসন্ত প্রতিরোধে কী করণীয়?
উত্তর : ফাউল পক্স ভ্যাক্সিন (Fowl pox Vaccive) ৩ সিসি পানির সাথে মিশিয়ে সুচ ওই দ্রবণে ডুবিয়ে মুরগির বাচ্চার ডানাতে খোঁচা দিতে হবে। ৩১ থেকে ৩৫ দিনের বাচ্চার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ৩ সিসি দিয়ে ২০০ বাচ্চাকে টিকা দেয়া যায়। ৪ থেকে ৫ দিন বয়সের বাচ্চার ক্ষেত্রে একই নিয়মে পিজিয়ন পক্স ভ্যাকসিন দিতে হবে।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মারুফ*
* কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আপনাদের সবার জন্য শুভকামনা। কৃষির এ ক্ষতি মোকাবিলায় আমাদের নিতে হবে বর্ষায় বিশেষ ব্যবস্থাপনা। কৃষির ক্ষতিকে পুষিয়ে নেয়া এবং প্রয়োজনীয় কাজগুলো যথাযথভাবে শেষ করার জন্য ভাদ্র মাসে কৃষিতে করণীয় বিষয়গুলো সংক্ষিপ্তভাবে জেনে নেব-
আমন ধান
এ সময় আমন ধান ক্ষেতের অন্তর্বর্তীকালীন যত্ন নিতে হবে। ক্ষেতে আগাছা জন্মালে তা পরিষ্কার করতে হবে। আগাছা পরিষ্কার করার পর ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। আমন ধানের জন্য প্রতি হেক্টর জমিতে ২০০ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োজন হয়। এ সার তিন ভাগ করে প্রথম ভাগ চারা লাগানোর ১৫ থেকে ২০ দিন পর, দ্বিতীয় ভাগ ৩০ থেকে ৪০ দিন পর এবং তৃতীয় ভাগ ৫০ থেকে ৬০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে। নিচু জমি থেকে পানি নামতে দেরি হয়। পানি নেমে গেলে এসব জমিতে এখনও আমন ধান রোপণ করা যাবে। দেরিতে রোপণের জন্য বিআর ২২, বিআর ২৩, বিনাশাইল, নাইজারশাইল বা স্থানীয় উন্নত ধান বেশ উপযোগী। এ ক্ষেত্রে প্রতি হেক্টর জমিতে ১৭৫ কেজি ইউরিয়া, ১৩০ কেজি টিএসপি এবং ৬০ কেজি এমওপি সার প্রয়োজন। ইউরিয়া ছাড়া অন্য দুটি সার জমি তৈরি করার সময় প্রয়োগ করতে হবে। দেরিতে চারা রোপণের ক্ষেত্রে প্রতি গুছিতে ৫ থেকে ৭টি চারা দিয়ে ঘন করে রোপণ করতে হবে।
আমন মৌসুমে মাজরা, পামরি, চুঙ্গি, গলমাছি পোকার আক্রমণ হতে পারে। এছাড়া খোলপড়া, পাতায় দাগ পড়া রোগ দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে নিয়মিত জমি পরিদর্শন করে, জমিতে খুঁটি দিয়ে, আলোর ফাঁদ পেতে, হাতজাল দিয়ে পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাছাড়া সঠিক বালাইনাশক সঠিক মাত্রায়, সঠিক নিয়মে, সঠিক সময় শেষ কৌশল হিসাবে ব্যবহার করতে হবে।
পাট
বন্যায় তোষা পাটের বেশ ক্ষতি হয়। এতে ফলন যেমন কমে তেমনি বীজ উৎপাদনেরও সমস্যা সৃষ্টি হয়। এতে পরবর্তী মৌসুমে বীজ সঙ্কট দেখা দেয়। এ সমস্যা সমাধানে বিশেষ যত্নে ভাদ্রের শেষ পর্যন্ত দেশি পাট এবং আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত তোষা পাটের বীজ বোনা যায়। বন্যার পানি উঠে না এমন সুনিষ্কাশিত উঁচু জমিতে জো বুঝে প্রতি শতাংশে লাইনে বুনলে ১০ গ্রাম আর ছিটিয়ে বুনলে ১৬ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। জমি তৈরির সময় শেষ চাষে শতক প্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬৫০ গ্রাম টিএসপি, ৮০ গ্রাম এমওপি সার দিতে হবে। পরে শতাংশপ্রতি ইউরিয়া ৩০০ গ্রাম করে দুই কিস্তিতে বীজ গজানোর ১৫ থেকে ২০ দিন পরপর জমিতে দিতে হবে।
আখ
এ সময় আখ ফসলে লালপচা রোগ দেখা দিতে পারে। এক ধরনের ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়। লালপচা রোগের আক্রমণ হলে আখের কাণ্ড পচে যায় এবং হলদে হয়ে শুকিয়ে যেতে থাকে। এজন্য আক্রান্ত আখ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং জমিতে যাতে পানি না জমে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া রোগমুক্ত বীজ বা শোধন করা বীজ ব্যবহার করলে অথবা রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করলে লালপচা রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
তুলা
ভাদ্র মাসের প্রথম দিকেই তুলার বীজ বপন কাজ শেষ করতে হবে। বৃষ্টির ফাঁকে জমির জো অবস্থা বুঝে ৩ থেকে ৪টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করে বিঘা প্রতি প্রায় ২ কেজি তুলা বীজ বপন করতে হয়। লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ৬০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ৩০ থেকে ৪৫ সেন্টিমিটার বজায় রাখতে হয়। তুলার বীজ বপনের সময় খুব সীমিত। তাই হাতে সময় না থাকলে জমি চাষ না দিয়ে নিড়ানি বা আগাছানাশক প্রয়োগ করে জমি আগাছামুক্ত করে ডিবলিং পদ্ধতিতে বীজ বপন করা যায়। বীজ গজানোর পর কোদাল দিয়ে সারির মাঝখানের মাটি আলগা করে দিতে হবে। সমতল এলাকার জন্য সিবি-৯, সিবি-১২, হীরা হাইব্রিড রূপালী-১, ডিএম-২, ডিএম-৩ অথবা শুভ্র জাতের চাষ করতে পারেন। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড়ি তুলা-১ এবং পাহাড়ি তুলা-২ নামে উচ্চফলনশীল জাতের তুলা চাষ করতে পারেন।
শাকসবজি
ভাদ্র মাসে লাউ ও শিমের বীজ বপন করা যায়। এজন্য ৪ থেকে ৫ মিটার দূরে দূরে ৭৫ সেমি. চওড়া এবং ৬০ সেমি. গভীর করে মাদা বা গর্ত তৈরি করতে হবে। এরপর প্রতি মাদায় ২০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম টিএসপি এবং ৭৫ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। মাদা তৈরি হলে প্রতি মাদায় ৪ থেকে ৫টি বীজ বুনে দিতে হবে এবং চারা গজানোর ২ থেকে ৩ সপ্তাহ পর দুই-তিন কিস্তিতে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৭৫ গ্রাম এমওপি সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
এ সময় আগাম শীতকালীন সবজি চারা উৎপাদনের কাজ শুরু করা যায়। সবজি চারা উৎপাদনের জন্য উঁচু এবং আলো বাতাস লাগে এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে। জমি ভালোভাবে কুপিয়ে বা চাষ দিয়ে মাটি ঝুর ঝুরে করতে হবে। চাষের সময় ১ বর্গমিটার জমির জন্য ১০ কেজি জৈবসার এবং ৩০০ গ্রাম টিএসপি মাটির সঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে। জমি তৈরি হয়ে গেলে এক মিটার চওড়া এবং জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বা করে বেড তৈরি করতে হবে। দুই বেডের মাঝখানে ৬০ সেমি. ফাঁকা রাখতে হবে। এতে যে নালা তৈরি হবে তার গভীরতা হবে ১৫ সেমি.। বীজতলা হয়ে গেলে সেখানে উন্নত জাতের ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, টমেটো এসবের বীজ বুনতে পারেন।
গাছপালা
ভাদ্র মাসেও ফলদ বৃক্ষ এবং ঔষধি গাছের চারা রোপণ করা যায়। বন্যায় বা বৃষ্টিতে মৌসুমের রোপিত চারা নষ্ট হয়ে থাকলে সেখানে নতুন চারা লাগিয়ে শূন্যস্থানগুলো পূরণ করতে হবে। এছাড়া এ বছর রোপণ করা চারার গোড়ায় মাটি দেয়া, চারার অতিরিক্ত এবং রোগাক্রান্ত ডাল ছেঁটে দেয়া, বেড়া ও খুঁটি দেয়া, মরা চারা তুলে নতুন চারা রোপণসহ অন্যান্য পরিচর্যা করতে হবে। ভাদ্র মাসে আম, কাঁঠাল, লিচু গাছ ছেঁটে দিতে হয়। ফলের বোঁটা, গাছের ছোট ডালপালা, রোগাক্রান্ত অংশ ছেঁটে দিলে পরের বছর বেশি করে ফল ধরে এবং ফল গাছে রোগও কম হয়।
প্রাণিসম্পদ
পোলট্রি শেডে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করতে হবে। আর টিন শেডে চটের ছালা রেখে মাঝে মাঝে পানি দ্বারা ভিজিয়ে দিতে হবে। ভেজা আবহাওয়া ও মাঝে মাঝে গরম পোলট্রি ক্ষেত্রে গামবোরো রোগের সংক্রমণ বৃদ্ধি করে। এ রোগে মুরগির পালক নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। গা গরম ও কাঁপুনি দেখা দেয়। সাদা পানির মতো পাতলা পায়খানা দেখা যায়। মুরগি সহজে নড়ে না। এমনিতে ভাইরাসজনিত এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। তবে আছে সতর্কতা ও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। প্রতিরোধ ব্যবস্থাগুলো হলো- খামার জীবাণুমুক্তকরণ, ভ্যাকসিন প্রয়োগ, বায়োসিকিউরিটি এসব। বায়োসিকিউরিটির জন্য খামারকর্মীদের জীবাণুমুক্ত জুতা ও এপ্রোন পরে খামারে ঢোকা, কম বয়সী বাচ্চার বেশি যত্ন নেয়া, শেডে জীবাণুনাশক পনি স্প্রে করা, মুরগির বিষ্ঠা ও মৃত মুরগি খামার থেকে দূরে মাটিতে পুঁতে ফেলা, পোলট্রি শেডের ঘরের মেঝে কস্টিক সোডার পানির দ্রবণ দিয়ে ভিজিয়ে পরিষ্কার করা।
পতিত জমিতে নেপিয়ার, বাজরা, খেসারি, গটর, ইপিল ইপিল, গিনি ঘাস লাগানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো জায়গায় যদি পানি জমে থাকে সে এলাকায় জন্মানো ঘাস গবাদিপশুকে খাওয়ানো যাবে না। কারণ এত গাভী বা গরুর রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। গরু ও ছাগলকে নিয়মিত গোসল করার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকলে অসুখ-বিসুখ কম হয়। গোয়াল ঘরের গোবর চনা নিয়মিত পরিষ্কার করা দরকার। আর গরুর গায়ের আটালি, মাছি, জোঁক, পোকামাকড় বেছে দিতে হবে। তড়কা, বাদলা, গলাফুলা রোগ যাতে না হয় সেজন্য উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বা ভেটেরিনারি সার্জনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা বুদ্ধিমানের কাজ।
মৎস্যসম্পদ
পুকুরে নতুন মাছ ছাড়ার সময় এখন। মাছ ছাড়ার আগে পুকুরের জলজ আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। পুকুর জীবাণুমুক্ত করে সঠিক সংখ্যক সুস্থ সবল পোনা মজুদ করতে হবে। যেসব পুকুরে মাছ আছে সেসব পুকুরে জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা দরকার। রোগের আক্রমণ থেকে মাছ রক্ষা করতে স্থানীয় উপজেলা মৎস্য অফিসের সহায়তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মৎস্য অফিসের সহায়তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি পুকুরে পাঙ্গাশ মাছের চাষ, ধানক্ষেতে মাছ চাষ, প্লাবিত এলাকায় ঘেরের মাধ্যমে রাজপুঁটি ও চিংড়ির চাষ, পুকুরে রুই জাতীয় ও চিংড়ির মিশ্র চাষ এবং প্লাবিত এলাকায় খাঁচায় মাছ চাষ করা যেতে পারে।
বন্যার কারণে ভেসে যাওয়া পুকুরের মাছ পুকুরে রাখতে- ভেসে যাওয়া পুকুরগুলোর ১৫ থেকে ২০ মিটার দূরত্বে একটি চটের ব্যাগে ৫ থেকে ৭ কেজি ধানের কুঁড়া বা গমের ভুসি ৫০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার পানির নিচে একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে। তবে ব্যাগটিতে অবশ্যই ছোট ছোট ছিদ্র করে দিতে হবে। এতে খাবার পেয়ে মাছ পুকুরেই অবস্থান করবে।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, বর্ষণসিক্ত শুভ্রতা ছড়ানো স্বচ্ছ প্রকৃতি সবুজ শ্যামলিমার সীমাহীন প্রান্তর, কাশবনের আলোড়ন সবই প্রকৃতির দান। সে সঙ্গে বন্যা, প্লাবন আমাদের নিত্য সহচর। সব কৃষক ভাইয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আমাদের কৃষিকে নিয়ে যাবে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। সবার জন্য নিশ্চিত সব কৃষি উৎপাদন কামনা করে এ মাসের কৃষি এখানেই শেষ করলাম। সবাই ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*
* সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ একজন কৃষি অনুরাগী ব্যক্তিত্ব। কৃষি বিষয়ের কলেজ শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা এবং লেখালেখির প্রতি বিশেষ আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি একজন কৃষি লেখক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন বলা যায়। মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত তার কয়েকটি পাঠ্যপুস্তকও প্রকাশিত হয়েছে বলে আমি জানি। তিনি কৃষি, কৃষকের জীবন-জীবিকা এবং দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি নিয়ে ভাবেন। তার এই ভাবনার ফসল হিসেবে প্রকাশিত কয়েকটি বইয়ের পরিচিতি এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-
১. কৃষি উৎপাদন প্রযুক্তি : এ বইটিতে লেখক বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন খরচ কমিয়ে কৃষিকে কীভাবে লাভবান করা যায় সে প্রচেষ্টাকে প্রাধান্য দিয়ে সহজলভ্য লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে অত্যন্ত সহজ সরলভাবে আলোচনা করেছেন। বইটিতে ফল, ফুল, মসলা ফসল, ধান, ডাল জাতীয় ফসল, তেল জাতীয় ফসল এবং আঁশ জাতীয় ফসলের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রযুক্তি, সার, মাটি ও সেচের সাশ্রয়ী প্রযুক্তি এবং বিষাক্ত খাদ্য, ফল-শাকসবজির পুষ্টি, জেনেটিক খাদ্য ও ভেষজ উদ্ভিদ সম্পর্কিত বিষয় সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। বইটি কৃষি সংশ্লিষ্ট সবার উপকারে আসবে বলে মনে করি। ২৩৮ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ৩২০ টাকা।
২. কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি : কৃষিতে কৃত্রিম উপগ্রহের ব্যবহারসহ কৃষির আধুনিক তথা ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার সংবলিত বইটিতে যেসব বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কৃষিতে বায়োটেকনোলজি, ফলন বাড়াতে হাইটেক ও সফটওয়ার, অর্গানিক ফার্মিং প্রযুক্তি, কৃষিতে তথ্য প্রযুক্তি, জলবায়ু পরিবর্তনে কৃষি প্রযুক্তি, চার ফসল মডেলে ফসল উৎপাদন প্রভৃতি। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তিতে আগ্রহীদের জন্য বইটি খুবই সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি। ১৪৪ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ২৪০ টাকা।
৩. হাঁস মুরগির মাছ গবাদিপশুর খামার : পোলট্রি, মাছ, গরু, ছাগল, মহিষের খামার বর্তমানে লাভজনক। কিন্তু সঠিক পদ্ধতি না জানার কারণে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হন। খামারিদের এ সমস্যার কথা বিবেচনা করে লেখক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খামার স্থাপন, লেয়ার ফার্ম, ব্রয়লার ফার্ম, কোয়েল, কবুতর, হাঁস ও রাজহাঁস পালন, মাছ ও চিংড়ি চাষ, গবাদিপশু পালন, গরু মোটাতাজাকরণ প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন। বইটি অনুসরণ করলে খামারিরা উপকৃত হবেন বলে আশা করা যায়। ১৭৬ পৃষ্ঠার এ বইটির মূল্য ধরা হয়েছে ২৭০ টাকা।
উল্লিখিত ৩টি বইয়ের প্রকাশক জামাল উদ্দিন আহমেদ, দি রয়েল পাবলিশার্স, ৩৬ বাংলাবাজার, দোতলা, ঢাকা-১১০০। বই ৩টি প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি, ২০১৫। বইগুলো পেতে হলে কৃষি তথ্য সার্ভিসের বিক্রয় কেন্দ্র অথবা লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। লেখকের মোবাইল নম্বর-০১৭১১৯৫৪১৪৩। আমি বই ৩টির বহুল প্রচার ও সাফল্য কামনা করি।
মো. মতিয়ার রহমান*
* সহকারী সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
ফল আমাদের মৌলিক চাহিদা খাদ্যের একটি বড় অংশ পূরণ করে, তাছাড়া ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে খনিজ পদার্থ এবং ভিটামিন। ঔষধি গুণাবলি থাকায় ফল প্রকৃতপক্ষে আমাদের স্বাস্থ্য-পুষ্টি রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফল তথা ফল বৃক্ষ আমাদের দৈনন্দিন পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় জীবনে অসীম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
আবহমানকাল থেকেই ফল ও ফলদ বৃক্ষ পশুপাখি ও মানুষের পরম বন্ধু। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুসহ অন্যান্য ফলদ বৃক্ষ শুধু নৈসর্গিক শোভাই বৃদ্ধি করে না; বরং ক্ষুধা নিবারণ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, অর্থ পুষ্টি সরবরাহ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই মানবজাতির অস্তিত্বের কারণেই অন্যান্য বৃক্ষের পাশাপাশি ফলদ বৃক্ষ রোপণ ও এর যথাযথ পরিচর্যা একান্তভাবে প্রয়োজন।
বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু ফল চাষের জন্য খুবই উপযোগী। আমাদের রয়েছে ১৩০টিরও বেশি ঐতিহ্যবাহী দেশীয় ফল। এসব দেশি ফলে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের পরিমাণ বিদেশি ফলের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়, যা থেকে আমরা সহজেই দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করতে পারি। দেশের উত্তরাঞ্চলের মতো অন্যান্য অঞ্চলেও আম, লিচুসহ অন্যান্য ফল চাষ করে আমরা অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করতে পারি।
মানুষের খাদ্য পুষ্টি ও জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় অক্সিজেন সরবরাহ ছাড়াও ফল গাছ পশুপাখির খাবার ও আশ্রয়স্থল, ছায়া প্রদান, কাঠ, জ্বালানি, আসবাবপত্র, যানবাহন, কুটিরশিল্প, রোগের ওষুধ ও পথ্য প্রদান করে। এছাড়াও ফল ব্যবসায় পারিবারিক আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষাসহ সার্বিক পরিবেশ সংরক্ষণে দারুণভাবে সহায়তা করে।
আমাদের প্রধান খাদ্য চাল, যাতে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ, কিন্তু পুষ্টির জন্য ফলমূলের চাহিদা এখনও রয়েছে। যদিও বাংলাদেশে এখন প্রচুর পরিমাণে ফল উৎপাদিত হচ্ছে। দেশীয় ফল বেশি করে উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করে প্রচুর পমিাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। তাই এ বছর ফলদ বৃক্ষ রোপণ পক্ষ উৎযাপন উপলক্ষে শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি তথ্য সার্ভিস কর্তৃক রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে, তার জন্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। ফলদ বৃক্ষ রোপণ পক্ষের মূল প্রতিপাদ্য হলো দিন বদলের বাংলাদেশ, ফল বৃক্ষে ভরবো বাংলাদেশ। এ প্রতিপাদ্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, সময়োপযোগী ও যথাযথ হয়েছে। এ ধরনের সচেতনতামূলক বৃক্ষ রোপণ বিষয়ক রচনা প্রতিযোগিতা অব্যাহত রাখলে নতুন প্রজন্ম তথা ছাত্রছাত্রীদের বৈচিত্র্যময় ফল সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা প্রদানসহ তাদের ফলদ বৃক্ষ রোপণে প্রচ-ভাবে উৎসাহিত করবে।
কত রকমের ফল যে এদেশে জন্মে তার কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা না থাকলেও বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলেন ১০০, কেউ কেউ বলে ২৫০ প্রকার দেশি ফল বাংলাদেশে রয়েছে। নিম্নে কিছু দেশি ফলের নাম উল্লেখ করা হলো-
অতি পরিচিত ফল : আম, জাম, ক্ষুদেজাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, ডালিম, জামরুল, কুল, আনারস, আমড়া, কামরাঙা, জলপাই, কলা, পেঁপে, নারিকেল, তাল, খেজুর, বেল, কদবেল, সফেদা, ডুমুর, তরমুজ, বাঙি।
কম পরিচিত ফল : ডেওয়া, লটকন, সাতকরা, পানিফল, আতা, আতা, শরিফা, আমলকী, বৈঁচি, করমচা, কাউফল, জগডুমুর, ফলসা, গোলাপজাম, আঁশফল, বিলিম্বি, বিলাতিগাব, বেতফল, চালতা
অপরিচিত ফল : তুঁতফল, জামির, প্যাসান, হাসঝুম, তারকাফল, তৈকর, পানকি, চুনকি, অরবরই, পিচফল, চুকুর, লুকলুকি, মাখনা।
বিলুপ্ত ফল : বাংলাদেশের প্রাচীনকালের অনেক ফল হারিয়ে গেছে। এ জাতীয় ফলের মধ্যে রয়েছে টাকিটুকি, মুড়মুড়ি, মনু ইত্যাদি। বিলুপ্তি হওয়ার পথে রয়েছে আরও প্রায় অর্ধশতাধিক ফল।
ফলের প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান বিশেষ করে খনিজ পদার্থ এবং ভিটামিন রয়েছে, যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। নিচে সারণিতে ১১টি দেশীয় কম পরিচিত ফলের পুষ্টি উপাদানের তথ্য দেয়া হলো-
বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য চাল। বর্তমানে চালের ঘাটতি না থাকলেও এখনও পুষ্টি ঘাটতি রয়েছে। ফলে অপুষ্টির কারণে প্রতি বছর অনেকে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, এমনকি পুর্ষ্টির অভাবে অনেক শিশু অকাল মৃত্যুবরণ করছে। দেশীয় ফলে রয়েছে অনেক ঔষধিগুণ। বেশি বেশি ফল খেলে অপুষ্টি ও রোগ হতে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
নিম্নে পাঁচটি অতি পরিচিত ফলের ঔষধি গুণাবলি সম্পর্কে সংক্ষেপে বর্ণনা দেয়া হলো-
০১. আম : ফলের রাজা আম। এ ফলের পাতা, ফল, আঠা পথ্য হিসেবে কাজ করে। কচি আম পাতার রস বমিভাব দূর করে, মাঢ়ি শক্ত করে, দাঁতের রক্ত পড়া বন্ধ করে। চুলকানিতে আমের আঠা লাগালে ৩ থেকে ৪ দিনের ভেতর সেরে যায়। অকালপক্বতা, নখকুনিতে, পোড়া ঘায়ে, পাঁচড়ায়, উদরাময়ে, বহুমূত্রে, গলাব্যথায় আমের পাতা, কুঁশি, ছাল, শিকড়, ফলের আঁটি অব্যর্থ মহৌষধের মতো কাজ করে।
০২. জাম : কথায় আছে, জাম খেলে রক্ত পরিষ্কার হয়। আসলেই তাই কারণ লৌহ অভাবজনিত রোগে জাম অত্যন্ত উপকারী। রক্ত আমাশয়, শ্বাসকষ্ট, হাত-পা জ্বালা রোধে, জ্বরে কাশিতে জামের রস মধুর সাথে মিশিয়ে বা সামান্য লবণ দিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়। পরিমিত জাম খেলে চেহারার লাবণ্য বাড়ে, চামড়া উজ্জ্বল ও মসৃণ হয়।
০৩. পেঁপে : কথায় আছে, ‘প্রতিদিন পেঁপে খাও, বাড়ি থেকে বদ্যি তাড়াও’। পেঁপে বহুল পরিচিত বহুমুখী ব্যবহারগুণ সম্পন্ন একটি ফল। কাশির সাথে রক্ত যাওয়া, রক্ত অর্শ, মূত্রনালির ক্ষতে, দাঁত ও একজিমা রোগে, কোষ্ঠকাঠিন্য, কৃমি দমনে বেশ ফলদায়ক। শরীরের ঝিমানিভাবে রোধ করে, চামড়া উজ্জ্বল ও মসৃণে পেঁপের গুণাগুণ সুপ্রমাণিত।
০৪. বাতাবিলেবু : দন্তব্যথা, দন্তশূল, মাঢ়ি ফোলা, রক্ত পড়া সমস্যা সমাধানে বাতাবিলেবুর বিকল্প নেই। কারণ এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি, যা দাঁত সম্পর্কীয় রোগ ‘স্কার্ভি’ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে। তাছাড়া পেট ফাঁপা, বুক পেটের ব্যথা, অগ্নিমন্দা উপশমে বাতাবিলেবুর জুড়ি নেই।
০৫. বেল : ধর্মীয় দৃষ্টিতে বেল পবিত্র ফল। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে বেল পাতা ব্যবহার করা হয়। বেল পাতার রস জন্ডিস, আমাশয়, শ্বাসকষ্ট এসবে ভালো ফল দেয়। ডায়রিয়া, সর্দিজ্বর, ক্ষুধামন্দা দূর করতে এবং পাকস্থলী, মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ডের শক্তি বৃদ্ধিতে অত্যন্ত উপকারী।
ফলের পুষ্টি উপাদান (খাদ্যাপযোগী প্রতি ১০০ গ্রামে)
ক্রমিক নং |
ফলের নাম |
জলীয় অংশ (গ্রাম) |
খাদ্যশক্তি (কিলোক্যালরি |
ক্যালশিয়াম (মি.গ্রাম) |
লৌহ (মি.গ্রাম) |
ভিটামিন বি-১ (মি.গ্রাম) |
ভিটামিন-সি (মি.গ্রাম) |
০১ |
জলপাই |
৮২.০ |
৭০ |
২২ |
৩.১ |
০.০৩ |
৩৯ |
০২ |
আমলকী |
৯১.৪ |
১৯ |
৩৪ |
১.২ |
০.০২ |
৪৬৩ |
০৩ |
তেঁতুল |
৮৩.৬ |
৬২ |
২৪ |
- |
০.০১ |
৬ |
০৪ |
জগডুমুর |
৮৮.১ |
৩৭ |
৮০ |
১.১ |
০.০৬ |
৫ |
০৫ |
লটকন |
- |
৯১ |
- |
০.৩ |
০.০৩ |
- |
০৬ |
জামরুল |
৮৯.১ |
৩৯ |
১০ |
০.৫ |
০.০১ |
৩ |
০৭ |
ডেওয়া |
- |
৬৬ |
৫০ |
০.৫ |
০.০২ |
১৩৫ |
০৮ |
ক্ষুদেজাম |
- |
১১ |
২২ |
৪.৩ |
০.০৯ |
৬০ |
০৯ |
কদবেল |
৮৫.৬ |
৪৯ |
৫৯ |
০.৬ |
০.৮০ |
১৩ |
১০ |
পানিফল |
৮৪.৯ |
৬৫ |
১০ |
০.৮ |
০.১৮ |
১৫ |
১১ |
কামরাঙা |
৮৮.৬ |
৫০ |
১১ |
১.২ |
০.১২ |
৬১ |
উল্লিখিত ফলগুলোর ঔষধি গুণাবলি বিশ্লেষণ করলে অনুধাবন করা যায় যে শরীর স্বাস্থ্য সুস্থ-সবলও নীরোগ রাখতে হলে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ফল যুক্ত করা আবশ্যকীয়।
এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘দিন বদলের বাংলাদেশ, ফল বৃক্ষে ভরবো দেশ’ সেহেতু ফল চাষ বৃদ্ধির জন্য বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারকে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিম্নবর্ণিত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
- কৃষিবিদদের মাধ্যমে ফলচাষি-কৃষকদের ফল চাষ প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
- সরকারি প্রতিষ্ঠানে উন্নত জাতের কলম-চারা উৎপাদন করে স্বল্পমূল্যে সরবরাহ করতে হবে।
- সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ফল বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে করে তারা অন্যদের ফলপ্রসূ প্রশিক্ষণ দিতে পারেন।
- কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হতে নতুন নতুন ফলের জাত উদ্ভাবন করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
- বাংলাদেশের আবহাওয়ায় খাপ খাওয়াতে পারে এমন ফলের চারা বিদেশ থেকে সংগ্রহ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ফলচাষিদের সরবরাহ করতে হবে।
- হর্টিকালচার সেন্টারসমূহে উন্নত জাতের ফলের মাতৃবাগান সৃষ্টি করতে হবে, যাতে করে সহজেই ভালো জাতের সায়ন সংগ্রহ করা যায়।
- বেসরকারি নার্সারি মালিকদের সহজ শর্তে স্বল্পসুদে কৃষি ঋণ প্রদান করতে হবে।
- দিন দিন আবাদি জমি কমে যাওয়ায় পাহাড়ি এলাকায় ফল বাগান সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করতে হবে।
- ফরমালিনবিহীন ফল বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে সরকারকে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
* সর্বোপরি সর্বস্তরের জনগণকে বিশেষ করে ছাত্রছাত্রী, কৃষক-কৃষাণীদের বাড়ির আঙিনায় ফল গাছ রোপণ উৎসাহিত করতে সচেতনতামূলক লাগসই কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
উপসংহার
আমাদের প্রতিদিন ১১৫ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমরা পাই ৪০ থেকে ৪৫ গ্রাম। ফলে প্রচুর পরিমাণে খনিজ পদার্থ ও ভিটামিন রয়েছে যা আমাদের স্বাস্থ্য-পুষ্টিতে এবং বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে। কিন্তু পরিমিত ফল গ্রহণ না করায় আমাদের পুষ্টি সমস্যা রয়েইে যায়। তাই সবার শরীর নিরোগ রাখতে দৈনিক পরিমিত পরিমাণ ফল খাওয়া প্রয়োজন। পরিমিত ফল খেতে হলে শুধু ফল বাজারেরর ওপর নির্ভর করলেই চলবে না। কারণ বর্তমানে দেখা যাচ্ছে বাজারে যেসব ফল পাওয়া যায় তা অনেক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত নয়। কার্বাইড বা ইথনল দ্বারা পাকানো এবং তার অধিকাংশই ফরমালিন মিশ্রিত। যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। তাই প্রত্যেকেই প্রতি বছর নিজ নিজ বাড়ির আঙিনায় বিভিন্ন দেশীয় ফলদ বৃক্ষ এবং ঔষধিগুণ সম্পন্ন ফলগাছ বেশি করে রোপণ করতে হবে। সেই সাথে যেসব ফল বিলুপ্তির পথে বাংলাদেশের ফলের ঐতিহ্য রক্ষার্থে অবশ্যই বিলুপ্তিপ্রায় ফল গাছ রোপণ করে তাদের বংশ রক্ষা করতে হবে। তাছাড়া ফলের বাগান সৃষ্টি করে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান করা যায়। বর্তমানে অন্যান্য ফসলের চেয়ে ফল বাগান করে তুলনামূলকভাবে আর্থিকভাবে বেশি লাভবান হওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে মেহেরপুর, ঈশ্বরদী, রাজশাহী, যশোর অঞ্চলে আম, কাঁঠাল, লিচুর প্রচুর পরিমাণ বাগান সৃষ্টি হচ্ছে যা আমাদের ফলের চাহিদা পূরণে সহায়ক হচ্ছে।
এখন জুন মাস। ফলদ বৃক্ষ রোপণের এখনই উপযুক্ত সময়। আসুন আমরা সবাই মিলে অঙ্গীকার করি প্রত্যেকের বাড়িতে পাঁচটি করে ফলের গাছ রোপণ করব, বর্তমান প্রতিকূল ও বৈরী অবস্থায় নিজে বাঁচব, অন্যকে বাঁচাতে সাহায্য করব। ফলে ফলে ভরে উঠুক বাংলাদেশ, এ হোক আমাদের অঙ্গীকার।
কাদির হাসান*
বৃক্ষ নেই, প্রাণের অস্তিত্ব নেই,
বৃক্ষহীন পৃথিবী যেন প্রাণহীন মহাশ্মশান।
অফুরন্ত সৌন্দর্যের এক মধুর নিকুঞ্জ আমাদের এ পৃথিবী। এ বিশ্বকে সুশীতল ও বাসযোগ্য করে রাখার ক্ষেত্রে বৃক্ষের অবদান অনস্বীকার্য। আবার মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য যেসব মৌলিক চাহিদা রয়েছে তার অধিকাংশই পূরণ করে বৃক্ষ। তাই মানবজীবনে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে উদ্ভিদের জুড়ি নেই। পরিবেশবিদদের মতে, একটি দেশের মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে বনভূমি রয়েছে মাত্র ১৫ থেকে ১৭ ভাগ। তাছাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সংরক্ষণ, পরিবেশ দূষণ কমানো, প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ প্রভৃতি কারণে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
বনায়ন বা বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা
বিশ্বের বনভূমি উজাড় হতে হতে অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বিশ্ব পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। মানবজীবনের সঙ্গে বৃক্ষের সম্পর্ক সুগভীর। তাই বৃক্ষকে মানবজীবনের ছায়াস্বরূপ বলা হয়। নিচে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তার কয়েকটি দিক উল্লেখ করা হলো-
১. বৃক্ষ প্রাণীজগতে খাদ্য দেয়। মানুষ ও পশু-পাখি বৃক্ষের ফুল-ফল এবং পাতা-পত্র খেয়ে জীবন ধারণ করে।
২. বৃক্ষ জীবনদানকারী অক্সিজেন দেয়। বৃক্ষ প্রাণীকুলের ত্যাগ করা বিষাক্ত কার্বনডাই অক্সাইড গ্রহণ করে। ফলে প্রাণীরা এ জগতে বেঁচে থাকতে পারে।
৩. বৃক্ষ হতে আমরা রসালো অনেক ফল পাই। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কলা ইত্যাদি।
৪. গাছপালা দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে। ফলে বাতাসে জলীয়বাষ্প ধারণক্ষমতা বাড়িয়ে আবহাওয়াকে শীতল করে ও প্রচুর বৃষ্টিপাতে সাহায্য করে।
তাই একটি সুখী ও সুন্দর জীবনের জন্য সবাইকে এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হওয়া উচিত যে, লাগাব বৃক্ষ, তাড়াব দুঃখ
চলো সবাই গাছ লাগাই/না হয় জীবন রক্ষা নাই। আমাদের দেশে তিন ধরনের বৃক্ষ রয়েছে। যেমন- ফলদ, বনজ এবং ভেষজ বৃক্ষ। তার মধ্যে ফলদ বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা এরা আমাদের খাদ্য, পুষ্টি, ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করে। তাছাড়াও আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
ফলদ বৃক্ষ রোপণ অভিযান : ফলদ সম্পদকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদের দেশে প্রতি বছরই বৃক্ষ রোপণ অভিযান পরিচালনা করা হয়। সপ্তাহ, পক্ষকাল বা মাসব্যাপী এ অভিযান চলে। এ সময় পরিকল্পিত উপায়ে বৃক্ষ রোপণ করা হয়। সাধারণত প্রতি বছর বর্ষাকালে সরকারের বন বিভাগের উদ্যোগে বৃক্ষ রোপণ অভিযান চালানো হয়। এ সময় জনগণ নিকটস্থ নার্সারি থেকে বিনামূল্যে অথবা স্বল্পমূল্যে ফলদ গাছের চারা সংগ্রহ করে থাকেন। অভিযান চলাকালে আমাদের জীবনে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা ও চারা রোপণের পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করতে হবে। নিঃসন্দেহে বৃক্ষ রোপণ অভিযান একটি মহৎ প্রচেষ্টা। তাই আমাদের অধিক পরিমাণে ফলদ বৃক্ষ রোপণ করতে হবে এবং দেশের মানুষকে বৃক্ষ রোপণে সজাগ করে তুলতে হবে।
মানবজীবনে ফলের গুরুত্ব : মানবদেহের পুষ্টি চাহিদা পূরণ, মেধার বিকাশ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। ফল আমাদের চিরায়ত ঐত্যিহের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পুষ্টিবিদদের মতে, জনপ্রতি প্রতিদিন ১১৫ থেকে ১২৫ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমরা খেতে পারছি মাত্র ৪০ থেকে ৪৫ গ্রাম। এর মূল কারণ চাহিদার তুলনায় জোগানের স্বল্পতা। তাই ফলদ বৃক্ষ রোপণ পক্ষে দেশি ফলের চারা রোপণ ও উৎপাদনে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। ফলের দেশ-বাংলাদেশ। আমাদের দেশে প্রায় ৭০ রকমের ফল জন্ম। দেশি ফলগুলো রঙ, রসে, স্বাদে অনন্য। প্রতিটি দেশীয় ফলেই রয়েছে অনেক পুষ্টিমান আর বহুমুখী ব্যবহার। তবে বিদেশি ফলের আধিক্যে আমাদের চিরচেনা উপাদেয় আর সুস্বাদু দেশি ফলগুলো অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে। এজন্য প্রচলিত অপ্রচলিত সব ধরনের দেশি ফলের আবাদ বাড়িয়ে, উৎপাদন বৃদ্ধি করে বছরব্যাপী আমাদের খাদ্য তালিকায় এদের স্থান করে দিতে হবে।
তাই আমাদের উচিত বেশি করে ফলের চারা রোপণ করা। তাহলেই আমাদের দেশ ফলে ভরপুর হয়ে উঠবে।
উপসংহার : অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কেবল বৃক্ষ রোপণ সপ্তাহ পালন করে সরকারিভাবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জনসেবা করলেই দেশ সবুজ হয়ে যাবে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এ কর্মসূচি পালন করে আসা হচ্ছে। অথচ বৃক্ষ রোপণ অভিযান এখনো আশানুরূপ নয়। একে সফল করতে হলে দেশব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, এমনকি স্কুল, কলেজে পাঠ্যপুস্তকে এর গুরুত্ব নির্দেশ করে আরও অধিকহারে প্রবন্ধ রচনা লিখতে হবে।
মো. সৈকত রায়হান*
শ্রাবণ মাস। ঋতু পরিক্রমায় বর্ষাকাল হিসেবে বিবেচিত। তবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে ঋতুচক্রে কখনও কখনও কিছুটা তারতম্য ঘটে থাকে। যেমন-আগাম বন্যা, নাবি বন্যা, খরাসহ নানা-রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ অপ্রত্যাশিতভাবে আবির্ভূত হয় আমাদের কৃষি ভুবনে। নানা অভিযোজন কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে এসব মোকাবিলা করে কৃষি কর্মকাণ্ডের গতিধারা অব্যাহত রেখে আমাদের কৃষক-কৃষাণিরা কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এজন্য তাদের সাধুবাদ না জানিয়ে পারা যায় না। এক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সময়োপযোগী দিকনির্দেশনামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং কৃষি তথ্য সার্ভিসের বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণে সহযোগিতা প্রদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কৃষক, কৃষিবিদ, কৃষি গবেষক, সম্প্রসারণবিদ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, দেশ এগিয়ে যাবে’। আমরাও চাই কৃষির সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির মাধ্যমে দেশ আরও এগিয়ে যাক।
শ্রাবণের বাদল দিনে আউশের সুঘ্রাণ, নতুন পানিতে প্লাবিত মাঠ-ঘাটে মাছ ধরার আনন্দ, আমনের সবুজ পাতায় দখিনা বাতাসের মর্মর ধ্বনি, পাটের আঁশ ছাড়ানো আর শুকানোর আনন্দে কৃষকের ঘরে ঘরে বয়ে যায় খুশির জোয়ার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর গ্রামীণ জনমানুষের সুখ-সমৃদ্ধিতে এভাবেই ভরে থাকুক আমাদের এ সোনার বাংলাদেশ- এটাই আমাদের একান্ত কামনা।
চাষি ভাইয়েরা, আপনারা জানেন, এ বছর আষাঢ়ের মাঝামাঝি প্রবল বর্ষণের কারণে দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকা আকস্মিকভাবে প্লাবিত হওয়া এবং নদীভাঙনে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসেও এ ধরনের আকস্মিক দুর্যোগ আবির্ভূত হতে পারে। প্রাকৃতিক কারণেই আমাদের দেশে খরিফ-১ ও খরিফ-২ অর্থাৎ চৈত্র থেকে আশ্বিন এ সাত মাস কৃষির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য এ সময় আমাদের সতর্কতার সঙ্গে যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করার পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। আমরা আশা করি এ ব্যাপারে কৃষক ভাইয়েরা সচেতন থেকে দেশের কৃষির উন্নয়ন, অগ্রগতি অব্যাহত রাখবেন।