বিভিন্ন শাকসবজির পুষ্টিমান ‘ নিরাপদ সবজি চাষ, পুষ্টি স্বাস্থ্য বারো মাস’
ড.সুরজিত সাহা রায়
দেহকে সুস্থ সবল ও কর্মক্ষম রাখতে নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ অপরিহার্য। আমাদের দেশে সারা বছর বিভিন্ন রকমের শাকসবজি পাওয়া যায়। রবি বা শীত মৌসুমে অধিকাংশ সবজি চাষের উপযোগী হওয়ায় মোট উৎপাদনের প্রায় ৬০% সবজি এ মৌসুমে হয়।
শাকসবজি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। এতে মানবদেহের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন, প্রয়োজনীয় খনিজ লবণ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। বাংলাদেশের শাকসবজির পুষ্টিমানের তালিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি বিভিন্ন পুষ্টি সরবরাহ করে। তাই পারিবারিক পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিরাপদ শাকসবজি আবাদের পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের শাকসবজি নির্ভর নিরাপদ খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। প্রধান প্রধান শাকসবজির পুষ্টি উপাদান (খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রাম) উল্লেখ করা হলো-
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে অধিক পুষ্টিসম্পন্ন উচ্চফলনশীল নিরাপদ সবজি উৎপাদন
ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার১ ড. সুস্মিতা দাস২
বাংলাদেশ গত একযুগে সবজি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটিয়েছে। ব্যাপক হারে কৃষি জমি হ্রাস পেলেও কৃষি মন্ত্রণালয়ের দূরদর্শী ও যুগোপযোগী উদ্যোগের ফলে উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)এর হিসাব মতে, প্রতিদিন একজন সুস্থ সবল মানুষের ২২০ গ্রাম সবজি গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু দেশে মাথাপিছু সবজি সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে মাত্র ১২৫ গ্রাম (সূত্র : এফএও, ডিএই)।FAO অনুযায়ী বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হারে সবজির আবাদি জমি বেড়েছে বাংলাদেশে। এক সময় দেশের কয়েকটি অঞ্চলে সবজির চাষ হতো কিন্তু বর্তমানে প্রায় সব এলাকায় সারা বছর সবজি চাষ হচ্ছে। সাধারণত শীত মৌসুমে উৎপাদিত সবজি এখন গ্রীষ্মকালেও পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী দেশে ৬০ ধরনের প্রায় ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ০.৪ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়। FAO অনুযায়ী সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন চীন ও ভারতের পরে এবং মোট উৎপাদন বৃদ্ধির বার্ষিক হারে বিশ্বে তৃতীয়।
জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য এসডিজিতে ১৭টি অভীষ্টের মধ্যে কৃষি সম্পর্কিত অন্যতম অভীষ্ট হলো অভীষ্ট-২ : ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন এবং টেকসই কৃষির প্রসার। ২০৩০ সালের মধ্যে ফসলের উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে। বর্তমান সরকার কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনের সাথে সাথে খাদ্য নিরাপত্তা বিধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলদেশের অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থানে কৃষির ভূমিকা অনেক। উৎপাদিত কৃষিপণ্য সঠিকভাবে রপ্তানি করতে পারলে আয় ও সক্ষমতা বাড়বে। তখন মানুষের নিরাপদ ও পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য গ্রহণের হারও বাড়বে।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যয়ে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সরকার শুরু থেকেই কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার প্রদান করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সময়োপযোগী নির্দেশনায় বরেণ্য কৃষি বিজ্ঞানী মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় আজ কৃষি ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে আমরা খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে এগিয়ে গেলেও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে এখনো পিছিয়ে। খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিরাপত্তা একে অপরের পরিপূরক। পুষ্টি নিরাপত্তা ব্যতীত খাদ্য নিরাপত্তা সম্ভব নয়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) ২০৩০ এর অন্যতম উদ্দেশ্য হল টেকসই কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন। বছরব্যাপী সবজিচাষ পারিবারিক পুষ্টি চাহিদার পাশাপাশি দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়ক হবে। এদেশের বর্ধিত জনগোষ্ঠীর পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পরিমিত পরিমাণ সবজি ও ফল খাওয়ার কোনো বিকল্প নাই। কারণ শাকসবজি খনিজসহ পুষ্টির সাথে অনেক বেশি জড়িত। এজন্য দরকার বসতবাড়ি আঙিনায় সারাবছর সবজি ও ফলের চাষ বৃদ্ধি করা। সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রে সরকারি কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেলেই পুষ্টিকর খাদ্য জোগানের মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত জনপদ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গুলো দ্বারা শাকসবজির গবেষণা ও উন্নয়ন করার কাজ অব্যাহত রয়েছে। সরকার ৯০ এর দশকের শেষের দিকে হাইব্রিড ফসলের সূচনা করে এবং এটি দেশে হাইব্রিড সবজি উৎপাদনের সূত্রপাত। বেসরকারি খাত বিশেষ করে লাল তীর, এসিআই, মেটালএগ্রো এবং আরো কিছু প্রতিষ্ঠান প্রধানত: হাইব্রিড ফসল নিয়ে গবেষণা করছে। বেসরকারি খাতের সবজির বীজ বেশিরভাগই উৎপাদনে প্রাধান্য পায়। আমাদের বিজ্ঞানীরা উল্লেখযোগ্য হাইব্রিড বীজ আবিষ্কারের গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে BARI হাইব্রিড বীজ জাতের উপর গবেষণা জোরদার করেছে। এর জন্য প্রয়োজন অধিক সংখ্যক দক্ষ সবজি প্রজননবিদ। যাদের পর্যাপ্ত উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা কাউন্সিল সবজিসহ কৃষিতে গবেষণার অগ্রাধিকার চিহ্নিত করার সাথে জড়িত। তদনুসারে, সবজিসহ নানামুখী গবেষণায় fund সংগ্রহ ও বিতরণ করে থাকে। উচ্চতর অধ্যয়ন এবং বৃত্তিমূলক দক্ষতা অর্জন প্রোগ্রামেরও আয়োজন করে। বর্তমানে BARC সবজি বৈচিত্র্যময় এলাকায় গবেষণা প্রকল্পে সহায়তা করছে। হাইব্রিড বীজ আমদানি করে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হচ্ছে সিড কোম্পানিগুলো। বেশি দামে বীজ সংগ্রহ করতে কৃষকের লাভের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। বিএআরআই এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন জাতের সবজি অবমুক্ত করেছে। হর্টেক্স ফাউন্ডেশন কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে সবজি রপ্তানির প্রচার করছে। সকল স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্ত করে সবজি উৎপাদনের প্রচারের জন্য বাংলাদেশ অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এগুলো হলো জাতীয় ও তৃণমূল পর্যায়ে সবজিমেলা, পুষ্টি অভিযান, খাদ্যমেলা ইত্যাদি। এগুলো সম্প্রসারণকর্মী ও চাষিদের মধ্যে জ্ঞান স্থানান্তর করতে সহায়তা করে।
শাকসবজি স্বাস্থ্যের জন্য উত্তম কিন্তু বাজারে সব উৎপাদিত শাকসবজি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়। কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ ছাড়া অনেকে শাকসবজি উৎপাদনে ক্ষতিকর মাত্রায় বালাইনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ফসল সংগ্রহোত্তর সংরক্ষণের অভাবে শাকসবজিতে বিভিন্ন জীবাণু পচন ধরে। শাকসবজি পরিষ্কারের জন্যও ব্যবহৃত হচ্ছে দূষিত পানি। তাই তা গ্রহণে আমাদের জন্য হয়ে উঠছে অনিরাপদ। অনেকে জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদের কথা বলেন। তবে মনে রাখা দরকার নিরাপদ শাকসবজি মানে শুধু জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা শাকসবজিকে বুঝায় না। জৈব শাকসবজি ও ক্ষেত থেকে তোলার পর খাবার টেবিলে আসা পর্যন্ত নানাভাবে অনিরাপদ হতে পারে।
বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা মডিউলে রাসায়নিক সার ও মাটিতে সংযোজিত অন্যান্য বস্তু ব্যবহার করার সময় বাগানি বা কৃষককে মাটি জীবাণুমুক্ত করা, ভারী ধাতুর উপস্থিতি পরীক্ষা করে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়টি সংকটপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সবজি চাষের ক্ষেত্রে মাটি শোধনের পাশাপাশি গ্রোয়িং মিডিয়ার গুণাগুণ ও স্বাস্থ্য রক্ষা করতে হবে। ভার্মিকম্পোস্ট, রান্নাঘর ও খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ দিয়ে বানানো সার, চা-কম্পোস্ট, ডিম খোসা ভাঙা মিশানো, নতুন মাশরুম কম্পোস্ট, নিমখৈল, সরিষাখৈল, ইত্যাদি ছাড়াও যে কোন বায়োলজিক্যাল কম্পোস্ট উৎস সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে ব্যবহার করতে হবে। রাসায়নিক পেস্টিসাইড ব্যবহারের ক্ষেত্রে বোতলের গায়ের নিয়মাবলি কঠোরভাবে পালন করতে হবে। বালাইনাশক ব্যবহারের পর পাতা ও ফল-জাতীয় সবজি আহরণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করতে হবে। পোকা দমনে ফ্লাইং ইনসেক্টের জন্য ফেরোমন ট্রাপ, সোলার লাইট ট্রাপ, আঠালো ট্রাপ, পেঁয়াজ পাতার ও ছোলা পেস্ট বা নির্যাস, রসুনের, গাঁদা ও চন্দ্রমল্লিকার ফুলের নির্যাস ভালো কাজ করবে।
মাননীয় কৃষিমন্ত্রী প্রায়শই বলেন, বাংলাদেশের জন্য এখন দুটি চ্যালেঞ্জ : জনগণের জন্য পুষ্টি ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ এবং উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করা। উৎপাদিত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে মূল্যসংযোজন ও রপ্তানি বাড়াতে পারলে দেশের বাজারও সম্প্রসারণ হবে। কৃষক তার ফসলের ন্যায্য দাম পাবে। আরো বাড়বে কৃষি উৎপাদন। নিশ্চিত হবে নিরাপদ ও পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্যের জোগান। লক্ষ্য পূরণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং কৃষি মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে কাজ করার পলিসি নির্ধারণ করতে হবে। আর এ জন্য কৃষি খাতের সকলের সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই। উল্লেখ্য, কৃষির উৎপাদন ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে দারিদ্রের হার ০.৪১ শতাংশ হ্রাস পায় এবং কৃষি বহির্ভূত খাতে উৎপাদন ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে দারিদ্র্য হ্রাস পায় ০.২ শতাংশ।World Vegetable Centre একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান যা বিএআরআই-এর সাথে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতা ছিল। এটি বাংলাদেশে প্রযুক্তি স্থানান্তর, সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। এই সহযোগিতা সবজির উন্নয়নে জোরদার করতে হবে।
একসময়ের ধারনা বাংলাদেশ বিভিন্ন কারণে অপুষ্টিতে ভুগবে। কিন্তু বর্তমানে উৎপাদিত ব্যাপক শাকসবজি খাদ্য চাহিদা পূরণ করে জনগণের পুষ্টিমান রক্ষা করছে এবং টেকসই উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। কর্মসংস্থানসহ গ্রামীণ অর্থনীতিতেও সবজি উৎপাদন ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। অধিক বাণিজ্যিকরণের জন্য প্রয়োজন নিরাপদ সবজি চাষ ও সঠিক রপ্তানিকরণ। সবজি সংরক্ষণ পদ্ধতি, কোল্ড চেইন ও ফসল সংগ্রহপরবর্তী ব্যবস্থাপনা, কীটপতঙ্গ ও রোগ ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপদ উৎপাদন পদ্ধতি, জেনেটিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং ব্যবহারী সবজির রপ্তানি বৃদ্ধি, মূল্যসংযোজনসহ অন্যান্য দিকে সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিকতা বাড়াতে হবে। Good Agricultural Practices(GAP) অনুযায়ী সবজি উৎপাদন ব্যবস্থা ও রপ্তানি ক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণ এবং সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। কৃষি মন্ত্রণালয় বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। বর্তমানে ঢাকার পূর্বাচলে খাদ্যপণ্য রপ্তানির জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানের মান পরীক্ষার গবেষণাগার স্থাপনের কাজ চলছে। সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট অংশীজনের আন্তরিকতা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ালে বাংলাদেশে অধিক পুষ্টি সম্পন্ন উচ্চফলনশীল নিরাপদ সবজি উৎপাদন ও রপ্তানিতে অভাবনীয় সাফল্য আসবে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের পথে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে।
লেখক : ১নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল; ২প্রধান ডকুমেন্টেশন কর্মকর্তা, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। মোবাইল : ০১৭১১১০২১৯৮, ইমেইল : susmitabarc@gmail.com
নিরাপদ সবজি উৎপাদন ও উত্তম কৃষি চর্চা
মোঃ বেনজীর আলম
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি কৃষি খাত। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্থিরমূল্যের ভিত্তিতে ১২.৫২ শতাংশ (২০১৫-১৬ বছরকে ভিত্তি ধরে, বিবিএস-ডিসেম্বর, ২০২১)। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও দিকনির্দেশনায় এবং বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য বিকশিত পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক, বর্তমান সরকারের সফল কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাকের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। এরই অংশ হিসেবে রূপকল্প ২০২১ এবং রূপকল্প ২০৪১ এর আলোকে জাতীয় কৃষিনীতি, কয়েকটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, ডেল্টাপ্ল্যান ২১০০সহ বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার। কৃষি ক্ষেত্রে সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে খোরপোশের কৃষি এখন বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে দেশে কৃষি ও কৃষিসংশ্লিষ্ট খাতে প্রভূত উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সম্প্রসারিত হয়েছে।
উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অঞ্চল বিশেষে এক ও দুই ফসলি জমিকে প্রায় তিন বা চার ফসলি জমিতে পরিণত করা হয়েছে। দেশে বর্তমানে ফসলের নিবিড়তা প্রায় ২১৬ শতাংশ। বিশ্বে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন অন্যান্য দেশের নিকট অনুকরণীয়। জনসংখ্যা-জমি অনুপাতে ফসল উৎপাদনের হার বিস্ময়কর। বিশ্বে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। নিবিড় সবজি চাষের মাধ্যমে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৯৭.১৮ লক্ষ টন শাকসবজি (আলু ছাড়া) উৎপাদন করে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। শীতকালীন বা গ্রীষ্মকালীন নয়, প্রায় সারা বছরই এখন সব ধরনের সবজি পাওয়া যায়। বিশ্বে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় হলেও এ খাতে এখনও রয়েছে বিভিন্নমুখী সমস্যা ও সম্ভাবনা। আধুনিক বিপণন অসুবিধাকে ব্যবহার করে মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকের নিকট থেকে কম দামে কিনে নিচ্ছেন কৃষিপণ্য। দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশেও চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষি পণ্য (প্রক্রিয়াজাতসহ) এখন বিশ্বের প্রায় ১৫০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। দেশি-বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে নিরাপদ সবজি আবাদের চর্চা বাড়ছে। বর্তমান সরকারের নীতিগত সমর্থন ও প্রত্যক্ষ পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়নে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে, পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও নিশ্চিতের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ ফল ও সবজির উৎপাদনের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কৃষি খাতে বায়োটেকনোলজি, পার্চিং, ফেরোমন ফাঁদ, আইপিএম, আইসিএম, উত্তম কৃষি চর্চা (GAP) ইত্যাদি ব্যবহার করে যথাসম্ভব নিরাপদ পণ্য সহজলভ্য করার প্রচেষ্টা হচ্ছে। উত্তম কৃষি পদ্ধতি হলো সামগ্রিক কৃষি কার্যক্রম, যা অনুসরণে নিরাপদ এবং মানসম্পন্ন খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত কৃষিজাত পণ্য সহজলভ্য এবং পরিবেশ, অর্থনীতি ও সামাজিক সুরক্ষা সুসংহত হয়। এটি একগুচ্ছ নীতি, বিধি ও প্রযুক্তিগত সুপারিশমালা যা মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ, পণ্যের মান উন্নয়ন ও কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য। সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও পরিবহনের বিভিন্ন স্তরে প্রয়োগ করা হয়।
বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্য চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্যের বাজার সৃষ্টি হয়েছে এবং খাদ্যসামগ্রী নিয়মিতভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে আমদানি ও রপ্তানি হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধানে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেশে দেশে খাদ্য আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। কৃষি উৎপাদনে নিরাপদ খাদ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ হলো প্রয়োগকৃত রাসায়নিকের অবশিষ্টাংশ, দূষণকারী বস্তুর উপস্থিতি, পোকামাকড়, রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব, বাহ্যিক সংক্রামক ইত্যাদি। এ ছাড়া খাদ্যে অন্যান্য বস্তু যথা- ভারী ধাতব বস্তু বা বিষাক্ত দ্রব্যের উপস্থিতি বিষয়ক বিপত্তি (Hazard) বা ঝুঁকি (Risk) খাদ্য শৃঙ্খলের যে কোনো পর্যায়ে ঘটতে পারে, তাই উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণের প্রত্যেক স্তরেই নিরাপদ খাদ্য সংক্রান্ত সমস্যা প্রতিরোধ বা দূরীভূত করা প্রয়োজন। খাদ্য শৃঙ্খলের সকল স্তরে সুনির্দিষ্ট অনুশীলনসমূহ সঠিকভাবে অনুসরণ করাই হচ্ছে উত্তম কৃষি চর্চার মূলভিত্তি। উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির লক্ষ্যে খাদ্য শৃঙ্খলের প্রতিটি স্তরে প্রত্যেক কর্মীকে তার নিয়ন্ত্রণাধীন বিষয়ে দায়িত্বশীল থাকা আবশ্যক। উৎপাদনকারীকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে উৎপাদিত পণ্যসমূহ খাদ্য হিসেবে ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ।
উত্তম কৃষি চর্চায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে উত্তম কৃষি চর্চা নীতিমালা ২০২০ অনুমোদন ও প্রকাশ করেছে। এই নীতিমালার আলোকে ‘বাংলাদেশ GAP’ বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থায় কমিটি গঠনের পর সেখানে কাজ শুরু করেছে। বাংলাদেশGAP বাস্তবায়নে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সনদপত্র প্রদানকারী সংস্থা (Certification Body বাCB) হিসেবে দায়িত্বপালন করবে। এই দপ্তরে ইতোমধ্যে CB কাঠামো গঠিত হয়েছে এবং তারা কাজ শুরু করেছে। যে সব এলাকা থেকে শাকসবজি ও ফলমূল রপ্তানির সম্ভাবনা বেশি সেসব এলাকাকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। আশা করা যায় বাংলাদেশে GAP বাস্তবায়িত হলে কৃষি পণ্যের রপ্তানি অনেক বৃদ্ধি পাবে এবং বাংলাদেশের কৃষি কৃষক পর্যায়সহ ব্যবসায়িক পর্যায়েও লাভজনক হবে।
বাংলাদেশ এখন টেকসই খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ভিশন ২০২১, দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১ ও ডেল্টাপ্ল্যান ২১০০ সরকারের মহৎ পরিকল্পনা শুধু নয়, এটি অর্থনৈতিক মুক্তি চ্যালেঞ্জের ভিশন। এগুলো বাস্তবায়ন হলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তব রূপ লাভ করবে। তবে বাংলাদেশের মানুষের মননে ও স্বাস্থ্যে আরও উন্নত হতে হবে। এর জন্য নিয়মিত ও পরিমিত সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে। জনগণের পুষ্টি নিরাপত্তা বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় শাকসবজি ও অন্যান্য ফসল উৎপাদন করে টেকসই খাদ্য ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সরকারের গৃহীত সকল পদক্ষেপকে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে নিতে বদ্ধ পরিকর।
লেখক : মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ফোন : ৫৫০২৮৩৬৯। ই-মেইল : dg@dae.gov.bd
সবজি চাষের বিপ্লব ও পুষ্টি স্বয়ংসম্পূর্ণতার বাংলাদেশ
মোঃ আসাদুল্লাহ১ ড. শামীম আহমেদ২
‘পুষ্টি ও সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ সবজি চাষ’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে শেষবারের মতো হয়ে যাওয়া জাতীয় সবজি মেলা ২০২০ এর সফলতার ধারাবাহিকতায় সবজি চাষ ও উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ আজ এক সাফল্যের উদাহরণ। অন্যান্য ফসলের তুলনায় বর্তমানে সবজি উৎপাদন কৃষকের জন্য অত্যন্ত সুখকর। কারণ অন্যান্য ফসলের তুলনায় সবজিতে ফলন ও আয় দুটোই বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে গত ১০ বছরে সবজি উৎপাদন প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। যার ফলে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে, কৃষকের ও শ্রমিকের আয় বেড়েছে, নারীদের ক্ষমতায়ন হচ্ছে, ভূমিহীনদের কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে এবং কৃষকের অভাব অনেকটাই কমেছে।
আয়তনের দিক দিয়ে ছোট দেশ হলেও বাংলাদেশে সবজি উৎপাদনে বিপুল সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বর্তমানে সবজি উৎপাদনে চীন ও ভারতের পরে বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। যশোর, কুমিল্লা, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, জামালপুর, রংপুর, জয়পুরহাট, নাটোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরসহ কয়েকটি জেলায় সবজি উৎপাদনের বিপ্লব ঘটেছে, যা মাত্র চার দশক আগেও ছিল অনুপস্থিত। এর ফলে শিক্ষিত যুবসমাজ নতুন নতুন প্রযুক্তি ও ইনোভেটিভ ধ্যানধারণা নিয়ে সবজি উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে। পাহাড় ও উপকূলীয় অঞ্চলে সবজি চাষ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় বাড়ির আঙিনা, বাঁধ, ঘেরের পাড়ে এমনকি মাছ চাষের জলাশয়গুলোর ওপর বাউনি দিয়ে লতানো সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে। পাহাড়ে জুম পদ্ধতিতে এবং বসতভিটায় সবজি চাষের ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু হাওর আঞ্চলে সবজির আবাদের বিপুল সম্ভাবনা এখনো রয়ে গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণের অধিদপ্তরের সূত্র মতে এ বছর বাংলাদেশে ৯.৬৫ লাখ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হচ্ছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে উৎপাদন লক্ষমাত্রা ২০০.১৯ লক্ষ মে. টন। শীত, গ্রীষ্ম, সারা বছর চাষ হয় এবং কিছু বিদেশি জাত মিলে বাংলাদেশে প্রায় ১৪২ ধরনের সবজি চাষ হয়। সবচেয়ে বেশি যে সমস্ত সবজি বাংলাদেশে চাষ হয় তাদের মধ্যে টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, চাল কুমড়া, পটোল, ঝিঙা, করলা, লাউ, চিচিঙ্গা, কাঁকরোল, কাঁচামরিচ, ধুন্দুল, মিষ্টি কুমড়া, ঢেড়স, শসা, ক্ষীরা, মুলা, শিম, গাজর, পুঁইশাক, লালশাক, বরবটি, সজিনা, শিম, ধনে পাতা, মটরশুঁটি, কাঁচা পেঁপে ইত্যাদি।
কৃষি হচ্ছে আমাদের অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক খাত, এ খাত থেকে জিডিপির আনুমানিক ১৪ শতাংশ আসে। মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৬৩ শতাংশ এর সঙ্গে জড়িত। মোট সবজির ৩০ শতাংশই উৎপাদন হয় গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে যার পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখ টন এবং বাজার মূল্য প্রায় ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
শীতকাল বিভিন্ন শাকসবজি চাষের জন্য বেশ উপযোগী। এ সময় নানা ধরনের শাকসবজির চাষ হয়। আর এর উৎপাদন অনেক বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু গ্রীষ্মকালীন শাকসবজির চাষ করা একটু কষ্টসাধ্য। কারণ এ সময় রোদ, বৃষ্টি, খরা, শিলাবৃষ্টিসহ নানান ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। সেজন্য একটু সতর্কতার সাথে এ সময় বিভিন্ন সবজির চাষ করতে হয়। এ সময় গ্রীষ্মকালীন ফুলকপি, গ্রীষ্মকালীন টমেটো, বরবটি, পটোল, শসা, ঝিঙা, করলা, কাঁকরোল, চিচিঙ্গা, গীমাকলমি, পুঁইশাক, মুখিকচু, মানকচু, মৌলভীকচু, পানিকচু, সজিনা, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া এসবের চাষ করা যায়।
গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি ফাল্গুন-চৈত্র মাস থেকে শুরু করে আশ্বিন মাস পর্যন্ত চাষ করা যায়। তবে আগাম চাষ করতে পারলে বাজারমূল্য বেশি পাওয়া যায়। শাকসবজি চাষে প্রধান কাজটি হলো জমি নির্বাচন ও জমি তৈরি আলো বাতাস চলাচলের সুবিধা, সেচের সুবিধা, অতি বৃষ্টির সময় জমি থেকে পানি বের করার সুবিধে আছে এরকম উর্বর দো-আঁশ মাটি সবজি চাষের জন্য অত্যন্ত ভালো। শাকসবজি অত্যন্ত নাজুক প্রকৃতির ফসল। সেজন্য একটু যতেœর সাথে এর চাষ করতে হয়। সবজির জমি খুব মিহি ও ঝুরঝুরেভাবে তৈরি করতে হয়। জমি সমতলভাবে তৈরি করতে হয়। এজন্য প্রতিটা চাষের পর পরই ভালোভাবে মই দিলে জমিতে বড় কোনো ঢেলা থাকবে না। বেড় করে শাকসবজি চাষের ব্যবস্থা নিলে সেচ ও পরিচর্যার সুবিধা হয়, আর ফলনও বেশি হয়। জমি তৈরির সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব বা আবর্জনা পচা সার দিতে হবে। জমিতে রসের অভাব থাকলে সেচ দিয়ে জো এলে তারপর চাষ মই দিয়ে জমি তৈরি করে বীজ বুনতে হয়। আবার অনেক রকমের সবজি মাদাতে লাগাতে হয় যেমন- শসা, ঝিঙা, চিচিঙ্গা, কাঁকরোল, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া এসব। এগুলোর প্যাকেটে চারা তৈরি করে নির্দিষ্ট দূরত্বে মাদা তৈরি করে চারা লাগাতে হয়। চারা লাগানোর পর গাছগুলো বড় হতে থাকলে বাউনি বা মাচা তৈরি করে দিতে হয়। মাদাতে চারা লাগানোর আগে পরিমাণমতো সুষম হারে রাসায়নিক সারও দিতে হবে।
শাকসবজি চাষে সারের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। পরিমাণমতো গোবর, টিএসপি, এমওপি সার শেষ চাষের সময় ভালোভাবে জমিতে মিশিয়ে দিতে হয়। ইউরিয়া সার চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর প্রথম উপরিপ্রয়োগ করতে হয়। দ্বিতীয় বার উপরিপ্রয়োগ করতে হয় আরও ১৫ দিন পর। লাউ বা কুমড়াজাতীয় অন্যান্য সবজির বেলায় মাদা তৈরি করে প্রতি মাদায় গোবর ১৫ কেজি, সরিষার খেল ৫০০ গ্রাম, ইউরিয়া ২৫০ গ্রাম, টিএপি ২৫০ গ্রাম এবং এমওপি ২৫০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হয়। শুধু জৈবসার ব্যবহার করেও ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে জৈবসার সঠিকভাবে তৈরি করতে হবে। গোবর বা কম্পোস্ট জৈবসার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। শাকসবজি চাষে যে বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো বীজ বপন/চারা রোপণ-আধুনিক জাতের ফসলের ভালো বীজ জমিতে উপযুক্ত জো অবস্থায় বপন করতে হয়। বীজ বপন বা চারা রোপণের কাজ বিকালে করা ভালো।
গাছের গোড়ায় আগাছা হলেই তা সাথে সাথে তুলে পরিষ্কার করে দিতে হবে। রোগ বা পোকার আক্রমণ হলে দমনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বীজ বপনের পর পরই পিঁপড়া বীজ নিয়ে যেতে না পারে সেজন্য সেভিন পাউডার বীজতলার চারদিকে লাইন করে ছিটিয়ে দিতে হয়। ফল জাতীয় সবজি যেমন বেগুন, মিষ্টিকুমড়া এসব গাছে বা থোকায় অতিরিক্ত ফল থাকলে সেগুলো পুষ্টির অভাবে ঠিকমতো বাড়তে পারে না। এতে ফল আকারে ছোট, বিকৃত ও নিম্নমানের হয়। ফল ছোট থাকেই ফল পাতলাকরণের কাজ সম্পন্ন করলে গাছের ফল ধারণক্ষমতা বাড়ে। ঢলে পড়া ও গোড়াপচা রোগ থেকে চারাকে রক্ষার জন্য আগেই মাটি শোধন করা ভালো। চারা গজানোর পর গোড়াপচা রোগ দেখা দিলে বীজতলায় পানির পরিমাণ কমাতে হবে। দ্রুত পানি নিষ্কাশন করে অথবা শুকনো বালু বা ছাই ছিটিয়ে দিয়ে আর্দ্রতা অর্থাৎ পানির পরিমাণ কমানো যেতে পারে। একই সাথে ডাইথেন এম-৪৫ অথবা কপার অক্সিক্লোরাইড প্রয়োগ করে রোগের বৃদ্ধি রোধ করা যায়।
বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে দেশের কৃষি উৎপাদকরা সামগ্রিকভাবে চরম সংকটকাল অতিক্রম করছে। কৃষি উৎপাদকেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যা উৎপাদন করে তা সে গ্রীষ্মকালীন সবজি, ধান, পাট, ডিম, দুধ, মুরগি যাই হোক না কেন, তার কোনটিরই উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছে না। অবশ্য ভোক্তা পর্যায়ে এ সবকিছুরই মূল্য যথেষ্ট বেশি। তার মানে টাকা যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। এ সমস্যা সমাধানে সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। ইউনিয়ন পরিষদ ভিত্তিক গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন সবজি ক্রয়ের স্থান নির্ধারণ করতে পারে; যেখানে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন সবজি একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর রাখবে; স্কুল, কলেজ ও খেলার মাঠগুলোও আপৎকালীন সময়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেখান থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় সবজিসমূহ সরাসরি কিনে ঢাকা ও অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোতে সরবরাহ করা যেতে পারে। এ ছাড়াও স্থানীয় কৃষি অফিস, বিএডিসি ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সমন্বয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারভিশনে উপজেলা অনুযায়ী একটি করে টিম গঠন করে একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে সবজি ক্রয় করে, বড় বড় শহরগুলোতে পাঠানোরে ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বড় বড় সুপারশপগুলোকে সবজি উৎপাদন জেলায় গিয়ে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সবজি কেনার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে। এইখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সহায়তা করতে পারে।
একমাত্র কৃষি খাতের সফলতার উপর আমাদের ১৭ কোটি জনগণের বাঁচামরা নির্ভর করে। আর এই খাতের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে দেশের প্রায় এক কোটি কৃষক পরিবারসহ ছোটবড় অসংখ্য কৃষি উৎপাদকেরা যারা শুধু ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য জোগান দিয়ে যাচ্ছে না, বেশ কিছু রপ্তানিযোগ্য পণ্যেরও জোগান দিয়ে যাচ্ছে। কৃষক ও কৃষি সমৃদ্ধিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সব সময় কৃষকের সাথে থাকবে, কৃষকের পাশে থাকবে। য়
লেখক : ১সাবেক মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ২অতিরিক্ত উপপরিচালক (কন্দাল, সবজি ও মসলা জাতীয় ফসল), হর্টিকালচার উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই), খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল : ০১৭১১১৭৪৩৪৫, ইমেইল: ashamim.uni@gmail.com
পুষ্টি নিরাপত্তায় সবজিঃ আগামী দিনের কৌশল ও সম্ভাবনা
কৃষিবিদ মোঃ শাহজাহান আলী বিশ্বাস
সুস্থ-সবলভাবে বেঁচে থাকতে পুষ্টিকর খাবার খেতেই হবে। এর চাহিদা পূরণে শাকসবজির অবদান অনন্য। শাকসবজিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থসহ অন্যান্য অনেক পুষ্টি উপাদান। সে সাথে আঁশে ভরপুর। এসব পুষ্টি উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, খাবারে রুচি আনে। আমরা শুধু মাছ, মাংসসহ আমিষ জাতীয় খাবারের দিকে ঝুঁকে থাকি। সবজিও যে শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা অনেকেই আমলে নেই না। কিন্তু শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির সরবরাহ নিশ্চিত করতে সবজি গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। রঙিন শাকসবজিতে রয়েছে এন্টি অক্সিডেন্ট। শরীরের নানা রকম জৈবিক কর্মকা- পরিচালনা, শরীর ও বুদ্ধির বিকাশেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সবজি।
বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ু সবজি উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। দেশের প্রায় সর্বত্র সারা বছর ধরে এমন কোনো না কোনো সবজি উৎপন্ন হচ্ছে। বাংলাদেশে আলুসহ প্রায় ১৫৬ প্রজাতির শাকসবজি উৎপন্ন হয়ে থাকে। রবি মৌসুমে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ হেক্টর জমিতে এবং খরিপ মৌসুমে প্রায় পৌনে চার লাখ হেক্টর জমিতে এসব সবজির আবাদ হচ্ছে। এই দুই মৌসুম মিলিয়ে যে সবজি উৎপন্ন হয়, তার পরিমাণ আলুসহ প্রায় ৩০৩.৩২ লাখ মে. টন (সূত্র : ডিএই, আগস্ট ২০২১)। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সমভূমি জমি, বাড়ির আঙ্গিনা, বাড়ির ছাদে, পানিতে, মাচায়, ঘরের চালে, চর ভূমিতে, উপকূলীয় অঞ্চলে, ভাসমান ও হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সবজি চাষের মাধ্যমে এর পরিধি আরও বাড়ার সুযোগ আছে। এসব জায়গায় সবজি উৎপাদন বৃদ্ধিতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার যা মাঠে এখন চলমান। সুস্থ সবল বীজ আর যতেœ দেশের সব ধরনের মাটিতেই নানা রকম সবজি ফলানো সম্ভব হয়। গবেষণা বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন নতুন উদ্ভাবিত জাতের সবজি কৃষকপর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে সবজির চাষের পরিধি আরও বৃদ্ধি পাবে।
একসময় ভালো স্বাদের সবজির জন্য শীতকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। টমেটো, লাউ, কপি বা নানা পদের শাক শীতকাল ছাড়া বাজারে মিলতো না। গ্রীষ্মকাল ছিল সবজির আকালের সময়। গত এক যুগে পরিস্থিতি বদলে গেছে। এখন প্রায় সারা বছর ২০ থেকে ২৫ জাতের সবজি খেতে পারছে দেশের মানুষ। তুলনামূলকভাবে দেশে সব ধরনের সবজির দামও কমেছে। বিশেষ করে, নানা জাতের শাক এখন শুধু বাজারে নয়, অলিগলিতে ভ্যানে করে বিক্রি হচ্ছে। গত দশকে সবজি চাষে বাংলাদেশে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। বাংলাদেশে সবজির আবাদি জমির পরিমাণ ৫ শতাংশ হারে বেড়েছে। এই হার বিশ্বে সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (এফএও)।
সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ ব্যাপক সফলতা অর্জন করলেও গ্রহণের দিক থেকে একেবারেই নিচের সারিতে অবস্থান করছে। মাথাপিছু চাহিদা অনুযায়ী সবজি গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিদিন একজন সুস্থ সবল মানুষের ২২০ গ্রাম সবজি গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু দেশে মাথাপিছু সবজি সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে মাত্র ১২৫ গ্রাম (সূত্র : এফএও, ডিএই)। সংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি বছর সবজির অপচয় রোধ, চাষাবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি এবং নিজেদের সবজি খাওয়ার অভ্যাস না পাল্টালে সবজি গ্রহণের দিক দিয়ে পিছিয়েই থাকতে হবে। সম্প্রতি সবজির উৎপাদন বৃদ্ধির এক আশাব্যঞ্জক চিত্র বিভিন্ন গবেষণা ও সমীক্ষায় উঠে এসেছে। যেমন- সবজির আবাদি জমির হার বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ প্রথম, উৎপাদন বৃদ্ধির হারের দিক থেকে তৃতীয়। সবজি উৎপাদনের এই ব্যাপক অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষের গড়ে প্রতিদিন প্রতি জনের সবজি খাওয়ার পরিমাণ কম। আমরা যদি অনুমোদিত মাত্রায় সবজি খেতে চাই, তাহলে সবজি উৎপাদন ও খাওয়ার অভ্যাস প্রায় দ্বিগুণ করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে আমরা সবজি উৎপাদনে যে অগ্রগতি অর্জন করেছি, তাতে সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে।
শাকসবজি পচনশীল তবে কিছু প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে এর সংরক্ষণ করা বা মেয়াদ বৃদ্ধি করা সম্ভব। কোন পণ্যের প্রক্রিয়াকরণ করা হলে সেই পণ্যের প্যাকেজিং করা অত্যাবশ্যকীয়। প্রক্রিয়াকরণ ও প্যাকেজিং পণ্যের গুণগতমান বৃদ্ধি করে, সেলফলাইফ বৃদ্ধি করে ও মূল্য সংযোজন ঘটিয়ে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি করে। সময় ও অর্থ সাশ্রয়ী, পুষ্টি ও গুণাগুণ অক্ষুণœ, রেডি-টু-কুক, কাটাকুটির ঝামেলামুক্ত, সহজে বহনযোগ্য ফ্র্রেশকাট শাকসবজির বাজার ক্রমেই সম্প্র্রসারিত হচ্ছে। ফ্রেশকাট শাকসবজির আন্তর্জাতিক বাজারও ক্রমশ সম্প্রসারণশীল। সবচেয়ে বেশি ফ্রেশকাট ব্যবহার করা হয় আমেরিকায় যার আর্থিক মূল্যমান ৪.৪ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে ফ্রেশকাট সবজি ও ফলের রপ্তানি বাজার সীমিত আকারে হলেও শুরু হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে বেশ কয়েকটি কোম্পানি আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে ফ্রেশকাট সবজি রপ্তানি শুরু করেছে।
একবিংশ শতাব্দীতে আরও দ্রুত নগরায়ণ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি ফলে নির্দিষ্ট কৃষি জমির বাণিজ্যিক ভার্টিক্যাল চাষাবাদ ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই, যা অবশ্যই নগর কৃষির অন্তর্গত। ভবিষ্যতের জন্য একমাত্র মাধ্যম হবে নগর ভার্টিক্যাল কৃষি ফার্ম। বাণিজ্যিকনগর কৃষি আরো টেকসই করা সম্ভব, এতে সেচের পানির অপচয় ৪০-৬০% কমিয়ে এনে ৩-৪ গুণ ফলন বাড়ানো যায় যেখানে হাইড্রোপনিক্যালি পুষ্টি উপাদানসমৃদ্ধ পানিকে অটোমেটিক এবং জলবায়ু-নিয়ন্ত্রিত বিল্ডিংয়ে সংরক্ষণ করে পুনরায় ব্যবহার করা হয়। বাণিজ্যিকনগর ভার্টিক্যাল ডিভাইজ, গ্রিনহাউজ হাইড্রোপনিক, একুয়াপনিক্স, ছাড়াও স্মার্ট ফার্মিং ডিভাইজ, স্বয়ংক্রিয় সেচসমৃদ্ধ ভার্টিক্যাল লাইন ডিভাইজ, স্বয়ংক্রিয় ছাদবাগান ঠা-াকরণ ডিভাইস ইত্যাদি ব্যবহার করে টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বিদেশি ব্রাসেলস স্প্রাউট, লেটুস, লাল টমেটো, কালো টমেটো, শসা, লালশাক, ডাঁটাশাক, ধনিয়াপাতা, ক্যাপসিকাম, চাইনিজ বাঁধাকপি, ছাড়াও সালাদ অনুসঙ্গ পুদিনা, সেলেরি, পেঁয়াজপাতা সবজি চাষাবাদ এখন আমাদের দেশেই সম্ভব।
গবেষণায় জানা যায়, ঢাকা শহরের ৭৬% ছাদ-বাগানি প্রশিক্ষণ নিতে চায়। প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তার জন্য নিকটস্থ কৃষি তথ্য সার্ভিস, কৃষি অফিস, হর্টিকালচার সেন্টার ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগসহ ফেসবুক গ্রুপগুলো পরামর্শ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রদান করে। অনলাইন পোর্টাল করে, ফেসবুকে গ্রুপ করে ফসল/ফল সমস্যা সম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদান করা যেতে পারে। সম্প্রতি নগর কৃষি পাইলট প্রকল্প চালু করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় শুরুতে ঢাকা শহরে প্রায় ৬০০ ছাদবাগান টার্গেট করে কাজ শুরু করেছে। বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা মডিউলে রাসায়নিক সার ও মাটিতে সংযোজিত অন্যান্য বস্তু ব্যবহার করার সময় বাগানি বা কৃষককে মাটি জীবাণুমুক্ত করা, ভারী ধাতুর উপস্থিতি পরীক্ষা করে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়টি সংকটপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সবজি চাষের ক্ষেত্রে মাটি শোধনের পাশাপাশি গ্রোয়িং মিডিয়ার গুণাগুণ ও স্বাস্থ্য রক্ষা করতে হবে।
জনসাধারণের মাঝে সবজি আবাদ ও গ্রহণ বৃদ্ধি করতে কৃষি মন্ত্রণালয় প্রতি বছর রাজধানীতে জাতীয় পর্যায়ে সবজি মেলার আয়োজন করে থাকে। মেলায় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সবজি উৎপাদন প্রযুুক্তি তুলে ধরে। যা নতুন নতুন সবজি সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ ছাড়াও পরিবর্তিত জলবায়ুতে পুষ্টি নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য বিমোচনে বছরব্যাপী নিরাপদ সবজি চাষের গুরুত্ব প্রচারে সেমিনার এবং মেলার উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে কৃষি মন্ত্রণালয়। এই সেমিনার ও মেলার আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সবজি চাষ, ব্যবহার, বাণিজ্যিকীকরণ, মূল্য সংযোজন বিষয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করবেন সেই তথ্য প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে গণমাধ্যম, সম্প্রসারণকর্মী ও কৃষি তথ্য সার্ভিসের প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে পৌঁছাতে পারলে দেশের সকল মানুষ সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ হবে এবং পুষ্টি নিরাপত্তাকে বিবেচনায় রেখে সবজি গ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষি সেক্টরে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপ্রবণ অবস্থানে আছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান প্রভাবগুলো-মাটি ও পানিতে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ, জলমগ্নতা, উপকূলীয় বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং উপকূলীয় জলোচ্ছ্বাস। দক্ষিণাঞ্চলের নিচু এলাকাসমূহ উপকূলীয় বন্যা ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে বর্ষা মৌসুমে সাধারণত জুন থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত নিমজ্জিত থাকে। দেশের নিচু ও হাওর এলাকাসমূহে রবি মৌসুমে বোরো-পতিত-পতিত ফসল বিন্যাসের আওতায় কৃষকরা একক ফসল হিসেবে শুধু বোরো ধানের আবাদ করেন। এর ফলশ্রুতিতে স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার মান বেশ দুর্দশাপূর্ণ এবং তারা প্রতিনিয়ত দরিদ্রতা ও অপুষ্টির সাথে লড়াই করছে। সে কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চল, হাওর এলাকা ও অন্যান্য জলাবদ্ধ এলাকার সমস্যাকবলিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার উন্নতির লক্ষ্যে স্থায়ী কৃষি উৎপাদনের জন্য ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ কৃষি প্রযুক্তিসমূহ উন্নতকরণ এবং এগুলোর সম্প্রসারণ অপরিহার্য।
এছাড়াও নিরাপদ শাকসবজি উৎপাদন এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তর, সংস্থা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। শস্যের বৈচিত্র্য কৃষি উন্নয়নের প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশের জনগণের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিরাপত্তা বিধানকল্পে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁঁকি এড়ানোর জন্য বছরব্যাপী সবজি উৎপাদনের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদার সাথে মিল রেখে দেশের জনগণের দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার টেকসই রূপ দিতে নিরাপদ সবজি উৎপাদন ও সহজলভ্য করতে কৃষি তথ্য সার্ভিস কাজ করে যাবে। য়
লেখক : পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, ফোন : ৫৫০২৮২৬০; ই-মেইল : dirais@ais.gov.bd
কৃষিতে অর্জন অনেক। আরও যেতে হবে বহুদূর
ড. জাহাঙ্গীর আলম
পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তান ছিল একটি নবীন রাষ্ট্র। তার একাংশ ছিল পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান। অবহেলা, নিগৃহ ও বৈষম্যের যাঁতাকলে পিষ্ট একটি প্রদেশ। তখন এর অর্থনীতি ছিল চরম দারিদ্র্যের মধ্যে নিমজ্জিত। রোগ, শোক আর খাদ্যাভাব ছিল পূর্ব বাংলার মানুষের নিত্যসঙ্গী। এরপর অনেক সংগ্রাম-প্রতিরোধ শেষে, অনেক রক্ত ঝরিয়ে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ২০২১ সালে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করেছি। এটি ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের ৫০তম বার্ষিকী। কৃষি খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি আর আমদানি বৃদ্ধির জন্য বছরটি ছিল বেশ আলোচিত। তবে সার্বিক বিবেচনায় ২০২১ সালে কৃষি খাতের সম্প্রসারণ ঘটেছে। বেড়েছে কৃষি/জিডিপির আকার। নতুন ভিত্তি বছর অনুযায়ী জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান হিসাব করা হয় ১৪৪ ধরনের শস্যের তথ্য আমলে নিয়ে, যেটি আগের হিসেবে ছিল ১২৪। কৃষি খাতে মোট মূল্যসংযোজন (জিভিএ) বর্তমান মূল্যে বিগত বছরে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৬১ বিলিয়ন টাকা। যেটি আগের হিসেবে ছিল ৩ হাজার ৮৪৬ বিলিয়ন টাকা। বিশে^র খাদ্য সূচকে কয়েক ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। পুষ্টি গ্রহণের দিক থেকেও অব্যাহত রয়েছে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। ফলমূল ও শাকসবজির উৎপাদন দ্রুত বাড়ছে। গত ৫০ বছরে সবজির উৎপাদন বেড়েছে ৫ গুণ। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশে^ তৃতীয়। প্রধান অর্থকরী ফসল পাটের উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ^বাজারে পাটের চাহিদা বৃদ্ধি ও দেশের অভ্যন্তরে কাঁচাপাটের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সুদিন ফিরে আসার স্বপ্ন দেখছে গ্রামের কৃষক।
গত ২ বছর করোনার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকা- ছিল অনেকটা স্থবির। এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে অর্থনীতি। জেগে উঠেছে ঝিমিয়ে পড়া মানুষ। বেড়েছে কর্মব্যস্ততা। করোনায় জীবনহানির ভয় এখন অনেকটাই কম। ভ্যাকসিন কার্যক্রম চলছে পুরোদমে। গণহারে টিকা নিচ্ছেন দেশের জনগণ। সংক্রমণের হার নেমে এসেছে নিচে। বাংলাদেশ পৃথিবীর একটি শীর্ষ ঘনবসতির দেশ। কিন্তু করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণের হার অপেক্ষাকৃত কম। এটি বর্তমান সরকারের বড় সাফল্য। এখন অর্থনৈতিক কর্মকা-ে প্রাণ ফিরে আসায় দ্রুত বৃদ্ধি পাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হার। আয় বাড়বে সাধারণ মানুষের। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় ২ বছর অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে দেশের সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক সংকট এখনো দৃশ্যমান। এরই মাঝে তারা অনেকটা চিঁড়া-চ্যাপটা হয়ে আছেন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাতে। বাজারে মোটা চালের কেজি উঠেছে ৫০ টাকায়, ৭০ টাকা ছুঁয়েছে সরু চালের দাম। ডালের কেজি ১৩০ টাকা। বহুল ব্যবহৃত ভোজ্যতেল সয়াবিনের লিটার ১৫০ টাকা। চিনি প্রতি কেজি ৮৫ টাকা। চলমান সমস্যার গভীরতা অনুধাবন করে আমদানি শুল্ক হ্রাস করছে সরকার। অবারিত করা হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি। আমরা কৃষি পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলে অহরহ গর্ব করে থাকি। তা সত্যও বটে। কিন্তু বড় ধরনের আমদানি নির্ভরতা এখনো রয়ে গেছে আমাদের। ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রাথমিক পণ্যের আমদানি খরচ ছিল ১৯৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে যায় ৭২৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত তার পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৪২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। চাল আমদানির পরিমাণ ২০১৬-১৭ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল কম, যথাক্রমে ১৩৩ হাজার এবং ২০৬ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু ২০১৭-১৮ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে তা অনেক বৃদ্ধি পেয়ে যথাক্রমে ৩৯ লাখ এবং সাড়ে ১৩ লাখ টনে এসে দাঁড়ায়।
২০২০-২১ অর্থবছরে আমাদের চাল ও গম আমদানি করতে হয়েছে ৬৭.০২ মিলিয়ন মেট্রিক টন। তার সঙ্গে যোগ করতে হবে ২৪ লাখ মেট্রিক টন ভুট্টা। প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, গত ১২ বছর ধরে কৃষি খাতে উৎপাদন বেড়েছে প্রতি বছর গড়ে ৩.৯ শতাংশ হারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সার্বিকভাবে কৃষিপণ্যের আমদানির রাশ টেনে ধরা তেমন সম্ভব হয়নি। চাল আমদানিতে এখন বিশে^ দ্বিতীয় বাংলাদেশ। এর উপরে আছে চীন। নিচে ফিলিপিন, নাইজেরিয়া ও সৌদি আরব। দেশের অভ্যন্তরে আরও দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি করা ছাড়া আমদানি প্রতিস্থাপন সম্ভবও নয়। কেউ কেউ বলে থাকেন, চাল উৎপাদনে আমরা বড় ধরনের উদ্বৃত্ত অবলোকন করছি। প্রশ্ন হচ্ছে, তারপরও চালের এত বেশি মূল্যবৃদ্ধির হেতু কী? কেন আমরা এত বেশি পরিমাণে আমদানি করছি চাল। পক্ষান্তরে আলুর বাজারে এত মূল্য হ্রাস কেন? নিঃসন্দেহে তা অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে বড় সাফল্য ও উদ্বৃত্তের জন্য। অতএব পর্যাপ্ত উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ স্বয়ম্ভরতা অর্জন করাই হলো দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রধান কৌশল।
ডালের বর্তমান উৎপাদন প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টন। এর মধ্যে মুগ এবং মসুরি ডালের হিস্যা প্রায় ৬০ শতাংশ। বাকি খেসারি, ছোলা, মাসকলাই, মটর, অড়হর ও ফেলন। মসুরি ডালের উৎপাদন ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যান্য ডালের উৎপাদন অনেকটাই স্থবির হয়ে আছে। লেথারজিক রোগের আশঙ্কায় খেসারির ভোগ ও উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। ডাল প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার। এটি গরিবের মাংস। এর ব্যবহার সার্বজনীন। বছরে আমদানি করা হয় ৮ থেকে ৯ লাখ টন ডাল। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই মসুরি ডাল। বাকি ছোলা ও অন্যান্য। ডাল আমদানি খরচ ২০০৯-১০ অর্থবছরে ছিল ৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা ৫৯০ মিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধি পায়। প্রধান রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে আছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নেপাল ও ভারত। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার ডাল মোটা। বর্তমান বাজার দর ৯০ টাকা প্রতি কেজি। নেপাল থেকে আমদানিকৃত সরু ডালের বর্তমান বাজারমূল্য ১৩০ টাকা কেজি। গত বছরের তুলনায় এবার ডালের দাম বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। তাতে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের। বাংলাদেশে ডাল উৎপাদন বৃদ্ধির বড় অন্তরায় এখানকার আবহাওয়া। অধিক বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা ডাল চাষের জন্য ক্ষতিকর। তবে আমাদের পরিবেশ ও আবহাওয়া উপযোগী নতুন জাতের ডাল উদ্ভাবন ও তা সম্প্রসারণের মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে ডাল উৎপাদনে ঘাটতি মেটানো সম্ভব।
সম্প্রতি মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষে রয়েছে ভোজ্যতেল। ১ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৫০ টাকা। পাম অয়েল ও সূর্যমুখী তেলের দামও অনেক চড়া। দেশে উৎপাদিত ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধির হার অপেক্ষাকৃত কম। সরিষা, তিল, তিসি ও রাইস ব্র্যান তেলের ক্ষেত্রে তেমন বাড়েনি দাম। মূল্যবৃদ্ধির জোর ধাক্কা লেগেছে আমদানিকৃত তেলের উপর। করোনার অভিঘাতে বিদেশে সয়াবিন ও পাম অয়েলের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে আমদানি মূল্য ও পরিবহন খরচ। তাতে বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম। বাংলাদেশে তেলবীজের মোট উৎপাদন ৫ লক্ষ ৬০ হাজার টন। বার্ষিক চাহিদা রয়েছে ২২ লাখ ৩৮ হাজার ৬০৮ টন তেলবীজের। উৎপাদিত তেলবীজের ৬৪ শতাংশ সরিষা। বাকি ৩৬ শতাংশ হিস্যা রয়েছে সয়াবিন, বাদাম, তিল, তিসি ও সূর্যমুখীর। বছরের পর বছর ভোজ্যতেলের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৩ সালে জনপ্রতি দৈনিক ভোজ্যতেল ভোগের পরিমাণ ছিল ১১.৮ গ্রাম। ২০২০ সালে তা ২২ গ্রামে উন্নীত হয়। তাতে বৃদ্ধি পায় ভোজ্যতেলের মোট চাহিদা ও আমদানি।
২০০৯-১০ অর্থবছরে ভোজ্যতেল ও তেলবীজ আমাদানির মোট খরচ ছিল ১১৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৪১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এই পরনির্ভরতা হ্রাসের জন্য দরকার তেলবীজের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানো। এ ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে আবাদি জমির স্বল্পতা। বোরো ধান এবং অন্যান্য উচ্চমূল্যের শস্যের সঙ্গে তেল ফসলের প্রতিযোগিতা। বর্তমানে সরিষা ও সয়াবিনের স্বল্প মেয়াদি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। তা প্রচলিত শস্য বিন্যাসে অভিযোজন করা সম্ভব। তাছাড়া চালের কুড়া থেকে এবং ভুট্টা থেকে তেল উৎপাদনের সম্প্রসারণ ঘটছে। আগামীতে ভোজ্যতেলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং আমদানি হ্রাস পাবে।
বর্তমানে বহুল আলোচিত একটি ভোগ্যপণ্য হচ্ছে চিনি। এর খুচরা মূল্য প্রতি কেজি ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। এই পণ্যটির বাজার এখন পুরোটাই বেসরকারি খাতের নিয়ন্ত্রণে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ সুগার এন্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের আওতায় পরিচালিত চিনিকলগুলো থেকে এবার ডিসেম্বর পর্যন্ত উৎপাদিত হতে পারে মাত্র ৩০ হাজার টন চিনি। এটুকু সেনাবাহিনী, পুলিশসহ বিভিন্ন খাতে রেশন হিসেবে সরবরাহ করার কাজেই লেগে যাবে। বাজারে চিনির মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য হস্তক্ষেপ করার মতো চিনি সরকারের হাতে নেই। সুতরাং বাজারের উচ্চমূল্য অবদমনে সরকারের সরাসরি প্রভাব খুবই সামান্য। দেশে সরকারি চিনিকলগুলোর সংখ্যা ১৫টি। এর মধ্যে ৬টি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে গত নভেম্বরে। বাকি ৯টি চলছে ঢিমে তালে। চিনিকলগুলো বন্ধ করে দেয়ার প্রধান কারণ ক্রমাগত লোকসান।
গত ৫ বছরে ৪০ বিলিয়ন টাকা লোকসান দিয়েছে সরকারি চিনিকলগুলো। তদুপরি এদের রয়েছে ৮০ বিলিয়ন টাকা ব্যাংক ঋণ। এগুলো লোকসানে থাকার কারণ হলো চিনির বেশি উৎপাদন খরচ। মিলভেদে প্রতি কেজি খরচ গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। কিন্তু তা বিক্রি করতে হয় ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে। এ ছাড়া প্রক্রিয়াকরণ লোকসান, অতিরিক্ত কর্মচারীর সংখ্যা, দুর্নীতি, ইক্ষু থেকে চিনি আহরণের নিম্নতম হার মিলগুলো লোকসানে থাকার অন্যতম কারণ। বাংলাদেশে চিনি আহরণের গড় হার ৫ শতাংশের উপরে। ভারতে এর পরিমাণ ১০ শতাংশের উপরে। আমাদের কম চিনি আহরণের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিলম্বে ইক্ষু ক্রাসিং, ভালো জাতের ইক্ষু আবাদ না করা এবং যথাযথভাবে জমিতে সার প্রয়োগ না করা। দেশের কৃষকগণ ইক্ষু উৎপাদনে অনেকটাই নিরুৎসাহিত তাদের লাভ কমে যাওয়ায়। তাতে ইক্ষুর আবাদি এলাকায় দারুণ ভাটা পড়েছে। উৎপাদন ও ফলন হ্রাস পাচ্ছে। মাসের পর মাস কৃষকগণ চিনিকল থেকে তাদের প্রদত্ত ইক্ষুর মূল্য বুঝে পাচ্ছেন না। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পাচ্ছেন না প্রয়োজনীয় উপকরণ সহায়তা। চিনিকলের শ্রমিকরা পাচ্ছেন না তাদের নিয়মিত বেতন। আমাদের রাষ্ট্রীয় খাতের চিনিকলগুলো অনেক পুরনো। সরকারি ১৫টির মধ্যে ১২টি স্বাধীনতার আগে এবং ৩টি পরে প্রতিষ্ঠিত। প্রয়োজনীয় আধুনিকায়নের (বিএমআরআই) অভাবে এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা নেমে এসেছে অনেক নিচে। সরকারি চিনিকলগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২ লাখ টনের উপরে। সেক্ষেত্রে ২০১৯-২০ অর্থবছরে চিনির মোট উৎপাদন হয়েছিল ৩৭ হাজার টন। এবার তা আরও নেমে এসেছে ৩০ হাজার টনে। ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে ইক্ষুর আবাদি এলাকা ছিল ১.৮ লাখ হেক্টর। এখন তা ০.৭৪ লাখ হেক্টর। দেশে মোট চিনির চাহিদা কম বেশি প্রায় ২০ লাখ মেট্রিক টন। তার মাত্র ১.৫ শতাংশ সরবরাহ করছে সরকারি চিনিকলগুলো। বাকি চিনির চাহিদা মেটাতে হয় আমদানির মাধ্যমে। ওই আমদানির পুরোটা বেসরকারি খাতের কব্জায়। এমতাবস্থায় সাধারণ ভোক্তাদের স্বার্থে চিনির মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি করা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। সে জন্য বন্ধ চিনিকলগুলো দ্রুত চালু করার ব্যবস্থা নেয়া দরকার। আধুনিকায়নের মাধ্যমে এদের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা দরকার। তাছাড়া চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প হিসেবেও এসব কারখানা গড়ে তোলা দরকার এবং উৎপাদনে বহুমাত্রিকতা আনয়ন করা দরকার।
বাংলাদেশে কৃষির উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আমদানিও করতে হচ্ছে অনেক। তা প্রতিস্থাপনের জন্য উৎপাদনের পরিমাণ আরও বাড়ানো প্রয়োজন। কৃষকদের সহায়তা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছেন। প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন। কৃষি খাতে উদার ভর্তুকির ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে দেশের গরিব কৃষকদের জন্য বরাদ্দকৃত ভর্তুকির টাকা পুরোপুরি খরচ করা হয় না। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রদত্ত প্রণোদনার টাকা কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে বিলম্ব হয় অনেক। এসব ক্ষেত্রে অনীহা ও অদক্ষতা থাকতে পারে। তা খতিয়ে দেখা উচিত। কৃষি ও কৃষকদের কল্যাণে উপকরণ ও নগদ সহায়তা বাড়ানো উচিত। তাদের জন্য উৎপাদিত পণ্যের লাভজনক মূল্য নিশ্চিত করা উচিত। তাতে ত্বরান্বিত হবে কৃষির সার্বিক উৎপাদন। হ্রাস পাবে আমদানি। ন্যায্যমূল্যে কৃষিপণ্য ক্রয় করতে সক্ষম হবেন দেশের গরিব ভোক্তাগণ। এর জন্য একটি সমন্বিত কৃষিনীতি প্রণয়ন করা একান্ত দরকার।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও শিক্ষাবিদ। মোবাইল: ০১৭১৪২০৪৯১০, ই-মেইল:alamj52@gmail.com
কৃষিবিদ দিবস ও কৃষির অগ্রযাত্রা
কৃষিবিদ কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী
কৃষিবিদ দিবসের প্রাক্কালে স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে জানাই বিন¤্র শ্রদ্ধা। ১৯৭৩ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহে বাকসু (Bangladesh Agricultural Central students Union- BAUCSU)
আয়োজিত এক সমাবেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষিবিদদের চাকরির ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদা ঘোষণা দেন। কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদা ঘোষণাকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আন্দোলন করছিস বলে আমি দাবি মেনে নিলাম তা কিন্তু নয়, আমি চাই ভালো ছাত্র-ছাত্রী কৃষি পড়ুক। আমি তোদের দাবি মেনে নিলাম তোরা আমার মুখ রাখিস।”
কৃষিতে মেধাবী ও অগ্রসর চিন্তার মানবসম্পদ গড়ে তুলতে এবং কৃষি শিল্প, গবেষণা ও সম্প্রসারণে তথা সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নে এক সুদূরপ্রসারী ও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
বঙ্গবন্ধুর অবদান, অনুপ্রেরণা তথা বঙ্গবন্ধু ঘোষিত সবুজ বিপ্লবের চেতনা চির জাগরুক রাখতে এ দেশের কৃষিবিদ সমাজ ২০১১ সাল হতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ এর উদ্যোগে প্রতি বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি নানা আয়োজনে উদ্যাপন করে আসছে। কৃষিবিদ দিবসের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কৃষিবিদগণ কৃষির ব্যাপক সাফল্য ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে সর্বোচ্চ মেধা ও আন্তরিকতার সাথে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
উল্লেখ্য যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের হাল ধরেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অসামান্য দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বে বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন যেটিকে আমরা বঙ্গবন্ধুর কৃষি বিপ্লব হিসেবেই জানি। ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বেতার ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “কৃষক ভাইদের প্রতি আমার অনুরোধ, কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে সবুজ বিপ্লব সফল করে তুলুন। বাংলাদেশকে খাদ্যে আত্মনির্ভর করে তুলুন।”
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্তির জন্য কৃষি উন্নয়নের বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
* প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) কৃষিতে শতকরা ৩১ ভাগ অর্থের সংস্থান রাখেন এবং ১ম ৫০০ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেটের ১০১ কোটি টাকা কৃষিতে বরাদ্দ রেখেছিলেন।
* সমবায় চাষ ব্যতিরেকে পরিবার প্রতি ১০০ বিঘা জমির সিলিং নির্ধারণ করেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন এবং ১৪ এপ্রিল ১৯৭২ পর্যন্ত সকল খাজনা মওকুফ করা হয়।
* কৃষিতে বঙ্গবন্ধু পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়।
* ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে খাসজমি বিতরণের ব্যবস্থা করেন। দশ লক্ষাধিক ঋণগ্রস্ত কৃষকের সার্টিফিকেট মামলা সুদসহ মওকুফ করা হয়। উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ দিয়ে দশ লাখ একর জমির ফসল রক্ষার ব্যবস্থা করেন। বাইশ লক্ষ কৃষককে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। ফিলিপাইন হতে সংগ্রহ করে উফশী ধানের বীজ ওজ-৮ কৃষকের মাঝে বিতরণ করেন এবং আধুনিক সেচযন্ত্রের প্রবর্তন করেন।
* এ ছাড়া কৃষি উন্নয়নের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকসহ বিভিন্ন কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানসমূহ স্থাপন ও পুনর্গঠন করেন। এভাবে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশে যে সবুজ বিপ্লবের সূচনা করেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এরই ধারাবাহিকতায় দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এরই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের কৃষির যে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে সেটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশংসিত হচ্ছে। তিনি খাদ্য ঘাটতির দেশকে খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে রূপান্তরিত করেছেন। মূলত আজকের কৃষির যে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে তার পেছনে রয়েছে বর্তমান সরকারের গৃহীত জনকল্যাণমুখী পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কর্মসূচি দক্ষতার সাথে বাস্তবায়ন। এখানে যুক্তিসঙ্গতভাবে উল্লেখ করা যায়।
২০০৮ সালে দিন বদলের সনদ/২৩ দফা নির্বাচনী ইশতেহারের ৭ নং দফায় ২০১৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। ২০১৮ সালের ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহারের ৫ নং দফায় পুষ্টিসম্মত ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা এবং ১৫ নং দফায় আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা-যান্ত্রিকীকরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার কর্তৃক দেশের কৃষি উন্নয়নে যুগোপযোগী পদক্ষেপের কারণে ফসল উৎপাদনে ২০০৮-২০০৯ সাল হতে ২০২০-২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে (সারণি দ্রষ্টব্য)। এ ছাড়া বিগত দশ বছরে ফলের উৎপাদন ১০৩ লক্ষ মেট্রিক টন হতে ১২২ লক্ষ মেট্রিক টন উন্নীত হয়েছে।
ফসল,মাছ, মাংস উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থানের পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে ৩য়, সবজি উৎপাদনে ৩য়, পেঁয়াজ উৎপাদনে ৩য়, পাট উৎপাদনে ২য়, পাট রপ্তানিতে ১ম, চা উৎপাদনে ৪র্থ, আলু ও আম উৎপাদনে ৭ম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম। ডিম এবং মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ডিম ও মাংসের জনপ্রতি চাহিদা ও প্রাপ্যতা ১০৪টি/জন/বছর এবং ১০৪.২৩টি/বছর/জন। মাংসের চাহিদা ও প্রাপ্যতা ১২০ গ্রাম/দিন/জন এবং ১২৬ গ্রাম /দিন/জন।জনপ্রতি বার্ষিক মাছ গ্রহণ ও চাহিদা ২৩ কেজি (গ্রহণ) এবং ২১.৯০ কেজি (চাহিদা)।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে টেকসই, আধুনিক এবং লাভজনক রপ্তানিমুখী কৃষি উন্নয়নের জন্য কৃষি সংশ্লিষ্ট যুগোপযোগী আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যেমন: জাতীয় কৃষি নীতি-২০১৮, জাতীয় জৈব কৃষি নীতি-২০১৭, জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতি-২০২০, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নীতি-২০২০, বাংলাদেশ উত্তম কৃষিচর্চা নীতিমালা-২০২০সহ বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া বীজ আইন-২০১৮, বালাইনাশক আইন-২০১৮, সার ব্যাবস্থাপনা (সংশোধন) আইন-২০১৮সহ বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া মাননীয় কৃষিমন্ত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক এমপির নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় কোভিড-১৯ এর অভিঘাতসহ বিভিন্ন আপদকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় একটি সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা-২০২০ প্রণয়ন করা হয়েছে এবং দক্ষতার সাথে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
কৃষিতে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে, টেকসই আধুনিক এবং লাভজনক রপ্তানিমুখী কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় জাত উদ্ভাবন, সার ব্যবস্থাপনা, কৃষি প্রণোদনা/পুনর্বাসন, খামার যান্ত্রিকীকরণ, উন্নয়ন সহায়তা (ভর্তুকি), প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, কৃষকের বাজার, সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ সুবিধা সম্প্রসারণ, কৃষি পণ্যের রপ্তানি সহায়তা ইত্যাদি জনকল্যাণমুখী পরিকল্পনা ও কর্মসূচি দক্ষতার সাথে বাস্তবায়ন করছে। রূপকল্প-২০২১, এসডিজি, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ বাস্তবায়নে কৃষি মন্ত্রণালয় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পৃথিবীর সর্বাধিক জনঘনত্বের দেশ বাংলাদেশ। ক্রমহ্রাসমান কৃষি জমি হতে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ক্রমবধ্যমান জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধান করাই এ সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে এ দেশের কৃষিবিদ সমাজ তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে এটাই কৃষিবিদ দিবসের অঙ্গীকার ও প্রত্যয়। য়
লেখক : সাবেক পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১২৫০১৪৯২, ই-মেইল : chakrobortykc@gmail.com
মেধাবী জাতি গঠনে পারিবারিক পুষ্টি বাগান
ড. মোঃ আকরাম হোসেন চৌধুরী
দেশের মানুষের সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন- “গ্রামে গ্রামে বাড়ির পাশে বেগুন গাছ লাগিও, কয়টা মরিচ গাছ লাগিও, কয়টা লাউ গাছ ও কয়টা নারিকেলের চারা লাগিও। বাপ-মারে একটু সাহায্য কর। কয়টা মুরগি পালো, কয়টা হাঁস পালো। জাতীয় সম্পদ বাড়বে।” (বাণী চিরসবুজ, কৃষি মন্ত্রণালয়, জুন ২০২১, পৃষ্ঠা নং ১৪২)। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা করোনা মহামারিকালীন দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বলেছেন- ‘এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি থাকবে না’। কৃষিবান্ধব সরকার দেশের প্রতিটি বসতবাড়ি আবাদের আওতায় আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যা বাস্তবায়নের ফলে দেশের সবজি পুষ্টি চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে।
সবজি সুস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ সুষম খাদ্য তালিকায় অপরিহার্য অংশ। বিভিন্ন প্রকার সবজি খেলে শরীরের প্রতিদিনের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ হয় যা শরীরকে সুস্থ সবল ও কার্যক্ষম রাখতে সহায়ক। সবজিতে চর্বি ও শর্করার হার অত্যন্ত কম থাকায় শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে এটাকে ভাল খাদ্য হিসাবে বলা হয়ে থাকে। উপরন্তু সবজি জাত খাবারে কোলেস্টরেল না থাকায় হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপজনিত শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি অনেকাংশে কম। তাই বিশ্বব্যাপী মানুষের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্য তালিকায় সবজির গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এ প্রবণতা উন্নত বিশ্বে স্বল্পোন্নত বিশ্বের তুলনায় অধিকতর লক্ষনীয়। এইসব দেশে মাথাপিছু প্রতিদিন সবজি গ্রহণের পরিমাণ দেশভেদে আমাদের মত দেশের তুলনায় অনেক বেশি। তাইতো মেধা ও বুদ্ধি বৃত্তির অধিকতর বিকাশসহ শারীরিক সক্ষমতার বিচারে ঐসব দেশের নাগরিকরা আমাদের থেকে অনেক অগ্রগামী। এ অবস্থার অবসানকল্পে আমাদের খাদ্য তালিকায় মানবদেহের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় দু’টি খাদ্য উপাদান, বিভিন্ন প্রকার খনিজ লবণ ও ভিটামিন এর পর্যাপ্ত প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণের জন্য এগুলোর সবচেয়ে সহজলভ্য উৎস বিভিন্ন প্রকারের সবজির অন্তর্ভুক্তির কোন বিকল্প নেই। আমাদের শর্করা তথা ভাত নির্ভর খাদ্যভাস পরিবর্তন করে খাদ্য তালিকায় বৈচিত্রময় শাকসবজিকে প্রাধান্য দিতে হবে।
বাংলাদেশে প্রায় আড়াই কোটি বসতবাড়ি রয়েছে। এসকল বসতবাড়িগুলো অনাবাদি অবস্থায় পতিত পরে থাকে বছরের পর বছর। এসকল জমি চাষের আওতায় আনা গেলে দেশে মানুষের পারিবারিক পুষ্টিচাহিদা মেটানোর পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের সক্ষম হবে। করোনাকালীন খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন এবং পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় পারিবারিক পুষ্টিবাগান স্থাপন প্রকল্প’ কাজ করছে। মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক এমপি বলেছেন- ‘পুষ্টিচাহিদা পূরণ আজ আমাদের সামনে বিশাল চ্যালেঞ্জ।’ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় পারিবারিক পুষ্টিবাগান স্থাপন প্রকল্প’ সেই চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
প্রকল্পটি দেশের ৬৪টি জেলার ৪৯২টি উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রায় ২৫৩.৬০ লক্ষ বসতবাড়ি রয়েছে, যার পরিমাণ ৫.৪০ লক্ষ হেক্টর। দেশের বসতবাড়ির গড় আয়তন ০.০২ হেক্টর। কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১৫১.৫৩ লক্ষ এবং আবাদযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ ২.২৩ লক্ষ হেক্টর। প্রকল্পের আওতায় সকল শ্রেণির কৃষক-কৃষানি যাদের বসতভিটা অনাবাদি পরে আছে সেই সকল জমি পরিকল্পিত উপায়ে চাষাবাদের আওতায় আনা হচ্ছে। বর্তমান সরকারে যুগান্তরকারী উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম হলো গৃহহীনদের জন্য গৃহ নির্মাণ ও গৃহের সংস্থান। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের জন্য নির্মিত গৃহের বসতভিটায় পারিবারিক পুষ্টিবাগান স্থাপনের মাধ্যমে হত দরিদ্র মানুষের পুষ্টি চাহিদা পুরণে প্রকল্পটি কাজ করছে। ৬,৮৩,৫৬০টি কৃষক পরিবার এই প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি উপকৃত হবে এবং ৪৫৫৪টি ইউনিয়ন ও ৩৩০ পৌরসভার প্রায় ৪১ লক্ষ কৃষক-কৃষানি পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে।
প্রকল্প মেয়াদকালে পারিবারিক সবজি পুষ্টিবাগান প্রদর্শনী স্থাপন করা হবে ৪,৮৮,৪০০টি, স্যাঁতস্যেতে জমিতে কচু জাতীয় সবজি চাষ প্রদর্শনী স্থাপন করা হবে ৭৩৮০টি এবং ছায়াযুক্ত স্থানে/বসতবাড়িতে আদা/হলুদ চাষ প্রদর্শনী স্থাপন করা হবে ৭৩৮০টি। সকল প্রদর্শনীর সফল বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের ৫,০৩,১৬০টি বসতবাড়ির অনাবাদি/পতিত জমি বছরব্যাপী সবজি চাষাবাদের আওতায় আসবে। বসতবাড়িতে কালিকাপুর মডেল অনুসরণে সবজি চাষাবাদের ফলে প্রতিটি বসতবাড়িতে প্রতি মৌসুমে প্রায় ১০টি সবজি চাষ করা সম্ভব হবে। তিনটি মৌসুমে উৎপাদন করতে পারবে প্রায় ২৫-৩০ প্রকারের সবজি। যা পারিবারিক পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বর্তমানে বাংলাদেশে সবজির গড় উৎপাদন ২৫-৩০ টন/হে.। এই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এই প্রকল্পের মাধ্যমে বছরে কেবল বসতবাড়ির অনাবাদি এবং পতিত জায়গার পরিকল্পিত ব্যবহারের মাধ্যমে ৮১,৬২৫ মেট্রিক টন (২৫ টন/হে. বিবেচনায়) বাড়তি সবজি উৎপাদন হবে। প্রতিটি বসতবাড়িতে ১ (এক) বছরে মোট সবজি উৎপাদন করা যাবে প্রায় ৩৬০ হতে ৩৯০ কেজি। কেজিপ্রতি বাজারমূল্য ৩০ টাকা হলে মূল্য হিসেবে প্রতি পরিবারের অর্থনৈতিক সাশ্রয় ১০,৮০০/- টাকা হতে ১১,৭০০/-টাকা। পারিবারিক পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি এই অর্থনৈতিক সাশ্রয় পরিবারগুলো অন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় করতে পারবে।
আমাদের খাদ্য জগতে বিভিন্ন প্রকারের সবজিই সম্ভবত একমাত্র খাদ্য, শরীর গঠনে যার ইতিবাচক ছাড়া কোন নেতিবাচক প্রভাব নেই। তবে মানের দিক দিয়ে সেই সবজি হতে হবে নিরাপদ। খাদ্য নিরাপত্তার সাথে পুষ্টি নিরাপত্তার কার্যকর ভাবে সংযোগ ঘটাতে না পারলে খাদ্য নিরাপত্তা অর্থহীন হয়ে যাবে। আমাদের সংবিধানের ১৮(১) ধারায় বলা হয়েছে জনগণের পুষ্টিস্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন। তাই বাংলাদেশ সরকার উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলকে খাদ্য সুরক্ষার পাশাপশি পুষ্টি সুরক্ষার মূল ক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত করেছে।
বিবিএস ২০১৫ অনুযায়ী মোট ফসলি জমির পরিমাণ ৭.৯৩ মিলিয়ন হেক্টর যার মধ্যে সবজি ফসলের দখলে মাত্র ২.৬৩% এর কিছু উপরে। এ থেকে অনুমান করা যায় কত অল্প পরিমাণ জমি থেকে আমাদের ক্রমবর্ধিষ্ণু বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য সবজির চাহিদা মেটানো হচ্ছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস,২০১৭) তথ্য অনুযায়ী মাত্র ০.৪১ মিলিয়ন হেক্টর জমি থেকে ৪.০৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন (আলু বাদে) সবজি উৎপাদিত হয়েছে। সেই হিসাবে প্রতিদিন প্রতিজনের জন্য প্রায় ৭০ গ্রাম সবজি উৎপাদিত হয়েছে। কিন্তু এই পরিমাণ কখনোই মাথাপিছু প্রাপ্যতা হিসাবে ধরা যাবে না কারণ বিভিন্ন মাধ্যমের হিসাব মতে গড়ে যদি চার ভাগের এক ভাগও সংগ্রোহত্তর পর্যায়ে নষ্ট হয়ে যায় তা’হলেও তা ৫৪-৫৫ গ্রামে নেমে আসে। সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে পরিমাণ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু সেটা যে ঋঅঙ কর্তৃক অনুমোদিত মাথাপিছু প্রতিদিন ২২০ গ্রাম এর তিন ভাগের এক ভাগের বেশি নয় তা মনে হয় বলাই যায়। সেক্ষেত্রে উৎপাদন বর্তমানের তিনগুণ বা তারও বেশি বৃদ্ধি করতে হবে।
কাক্সিক্ষত খাদ্য পুষ্টি নিরাপত্তার লক্ষ্য অর্জন করতে আমাদের যেতে হবে বহুদূর। এর জন্য প্রয়োজন সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য উন্নত জাতের বীজ, সার ও অন্যান্য পরিচর্যা নিশ্চিতকরণ; কারিগরি জ্ঞান, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনে উত্তম কৃষি চর্চা (এঅচ) গ্রহণ; পর্যাপ্ত পোস্টহারভেস্ট হ্যান্ডলিং অবকাঠামো (প্যাক-হাউজ, কুল স্টোর, রেফ্রিজারেটেড ট্রান্সপোর্ট) নির্মাণ; খাদ্যে দূষক এবং অবশিষ্টাংশ কার্যকরভাবে নিরীক্ষণের জন্য আইন প্রয়োগ; খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর এবং টেকসই সমন্বয় জরুরি; পর্যাপ্ত সংখ্যায় স্বীকৃত খাদ্য পরীক্ষার ল্যাব তৈরি করা; খাদ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আধুনিক কোর্স/পাঠ্যক্রম চালু; শর্করা তথা ভাত নির্ভর খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে সুষম খাবার গ্রহণের নিমিত্ত বেশি বেশি শাকসবজি খাবার হিসেবে গ্রহণে উৎসাহিত করা; আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সুরক্ষা মান মেনে চলার মাধ্যমে রফতানি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া; খাদ্যের গুণমান, খাদ্য সুরক্ষা, খাদ্য প্রস্ততি, খাদ্য স্বাস্থ্যবিধি, রান্না ইত্যাদি সম্পর্কিত সচেতনতামূলক প্রচারণা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা; আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত খাদ্য মানের উপর ভিত্তি করে বিদ্যমান আইনগুলোকে আধুনিকায়ন করা; দূষক, টক্সিন এবং অবশিষ্টাংশের জন্য স্থানীয় এবং আমদানিকৃত উভয় পণ্যগুলোর পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা; ফার্মের উৎপাদিত পণ্যের সুরক্ষার জন্য উত্তম-কৃষি চর্চা (এঅচ) বিষয়ে ব্যাপক উৎসাহমূলক প্রচারণা আবশ্যক; উৎপাদনকারী এবং মধ্যস্থতাকারী মধ্যে কার্যকর সংযোগ স্থাপন ও উৎপাদন পর্যায়ে সঠিক মূল্য নিশ্চিত করা; পুষ্টি এবং খাদ্য সুরক্ষা বার্তাগুলো বেশি বেশি প্রচারের ব্যবস্থা করা; সারাদেশে খাদ্য সুরক্ষা সচেতনতা কার্যক্রমের ব্যাপক প্রচারণার ব্যবস্থা করা, খাদ্য সরবরাহ চেইনে খাদ্য সুরক্ষা ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে খাদ্যে দূষকের মাত্রা এবং হুমকির পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত সংযোজন করতে হবে; পরিবেশ বান্ধব এবং নিরাপদ উদ্ভিদ সুরক্ষা ব্যবস্থা যেমন জৈব কীটনাশক, ফেরোমন ফাঁদ, জৈব চাষের অনুশীলন ইত্যাদিকে উৎসাহিত করতে হবে; আধুনিক ল্যাব স্থাপনের মাধ্যমে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থাসহ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর সমাবেশ ও পাইকারি বাজার স্থাপন করা, সবজি ফসলের জন্য বিশেষায়িত শীতল আধুনিক স্টোরেজ প্রতিষ্ঠা করা; বড় পাইকারি বাজারের আশপাশে বড় আকারের বহুমুখী স্টোরেজ সুবিধা সৃষ্টি ও তা কার্যকর করা ইত্যাদি।
সার্বিক বিবেচনায় এসব কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারলে দেশের মানুষের নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পুরণের মাধ্যমে গড়ে উঠবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণহীন সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ।
লেখক : প্রকল্প পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), অনাবাদি জমি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন প্রকল্প, ডিএই। মোবাইল : ০১৭১১০৭১৯৭৩, ই-মেইল : akrambdp2100@gmail.com
সবজি : পুষ্টি নিরূপণ ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে করণীয়
ড. ফেরদৌসী ইসলাম১ ড. একেএম কামরুজ্জামান২
খাদ্য, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য এই তিনটি শব্দ একটি আরেকটির সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। সুস্থ, স্বাস্থ্যবান ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য নিরাপদ পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্যের বিকল্প নাই। তাই সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ মনের জন্য প্রতিদিন পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্যে গ্রহণ করা প্রয়োজন। দেহের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে হলে একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির জন্য সুষম খাদ্য নির্বাচন, খাদ্যের সহজলভ্যতা ও পুষ্টিমূল্য বজায় রেখে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক গড়ে ২২০ গ্রাম সবজি গ্রহণ করা উচিত কিন্তু প্রকৃত পক্ষে আমরা গ্রহণ করছি মাত্র ১২৫ গ্রাম (সূত্র: এফএও, ডিএই)। প্রয়োজনের তুলনায় কম খাদ্য গ্রহণের মূল কারণ হলো পর্যাপ্ত উৎপাদনের স্বল্পতা। এ ছাড়াও পরিমিত পরিমাণে সবজি গ্রহণের অভ্যাসও গড়ে তুলতে হবে। বছরব্যাপী সবজি চাষ পারিবারিক পুষ্টি চাহিদার পাশাপাশি দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়ক হবে। শাকসবজির পারিবারিক চাহিদা মেটাতে খুব একটা বেশি জমির প্রয়োজন হয় না। আমাদের বাড়ির আনাচে কানাচে পড়ে থাকা জমিগুলো পরিকল্পিতভাবে পুষ্টিসমৃদ্ধ শাকসবজি চাষের আওতায় আনা হলে তা থেকে সারা বছর পরিবারের সবার চাহিদা পূরণের মাধ্যমে অপুষ্টিজনিত রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রে সরকারি কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেলেই পুষ্টিকর খাদ্য জোগানের মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত জনপদ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিরাপত্তা একে অপরের পরিপূরক। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (SDG)-২০৩০ এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো টেকসই কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন। বিগত এক দশকে দেশের প্রায় প্রতিটি সেক্টরে অভাবনীয় সফলতার সাথে সাথে কৃষি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে এবং দানাজাতীয় খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের কৃষি যখন নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণের দিকে ধাপে ধাপে এগোচ্ছিল, তখনই বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে দেখা দিলো কোভিড-১৯। এই কোভিড-১৯ কে মোকাবিলা করার জন্য এবং মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য শাকসবজি গ্রহণের গুরুত্ব অপরিসীম।
সবজির পুষ্টি
শাকসবজি হলো ভিটামিন, খনিজ এবং আঁশ সমৃদ্ধ সাশ্রয়ী মূল্যের খাদ্য যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়। শাকসবজি প্রতিরক্ষামূলক খাদ্য এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সরবরাহের মাধ্যমে ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, কোষ্ঠকাঠিন্য এর মতো অনেক কঠিন/গুরুত্বপূর্ণ রোগ প্রতিরোধ করে। একজন প্রাপ্তবয়স্কের জন্য ২২০০ শপধষ (একজন ব্যক্তির/দিনের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা) পেতে দানাজাতীয় শস্য, মাছ, মাংস, শাকসবজি, ফলমূল, তেল ইত্যাদি বিভিন্ন অনুপাতে বিভিন্ন খাবার গ্রহণ করা উচিত। অপুষ্টিকর খাদ্য, অতিরিক্ত রান্না করা, বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রীর পুষ্টিকর মূল্য সম্পর্কে অজ্ঞতা, বাংলাদেশের অপুষ্টিজনিত ব্যাধিগুলোর কারণ হিসাবে চিহ্নিত। সবজি পুষ্টিমান ও কার্যকলাপ সারণি দ্রষ্টব্য।
‘খাদ্য ও পুষ্টিতে স্বয়ম্ভরতা অর্জন ও পুষ্টি সমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সবজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সবজি বিভাগ ৮০টির বেশি প্রচলিত ও অপ্রচলিত সবজির উপর গবেষণা করে এ পর্যন্ত মোট ৩৪টি সবজির ১৩৪টি উন্নত জাত (ওপি-১১১ ও হাইব্রিড-২৩) উদ্ভাবন করেছে। তাছাড়া প্রধান প্রধান সবজির উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তি, অমৌসুমে সবজির আবাদ, নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে আবাদ, প্রটেকটিভ নেট হাউজ এ সারা বছর নিরাপদ সবজি উৎপাদন প্রযুক্তি, হাইড্রোপনিক চাষাবাদ প্রযুক্তি, জৈব চাষাবাদ প্রযুক্তি এবং বীজ উৎপাদনের প্রযুক্তিসহ মোট ৫২টি সবজি উৎপাদনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। বর্তমানে সবজি বিভাগ নতুন নতুন ওপি, হাইব্রিড জাত উন্নয়ন, নিরাপদ শাকসবজির উৎপাদন, অমৌসুমের জাত উদ্ভাবন, লবণাক্ততা, বন্যা, খরা, উচ্চ তাপসহনশীল জাত উদ্ভাবন, কীটপতঙ্গ, রোগ নিয়ন্ত্রণ, মাটি এবং পানি ব্যবস্থাপনা এবং পোস্ট হারভেস্ট প্রযুক্তি বাবস্থাপনা বিষয়ক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। দরিদ্র ও অসহায় জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত প্রাকৃতিকভাবে সমস্যাসংকুল এলাকার (যেমন: পাহাড়, উপকূলীয়, হাওর ও বরেন্দ্র এলাকাসমূহ) ঝুঁকি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কাজ করছে। এই ধরনের গবেষণা বিদ্যমান প্রযুক্তিগুলোকে উন্নত ও উপযোগী করবে, ফলন পার্থক্য কমাবে, বৈচিত্র্য বাড়াবে। প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, কৃষিকাজে বৃষ্টি ও নদীর পানির ব্যবহার, রোগ ও বালাই নিয়ন্ত্রণ, উচ্চমূল্য ফসলের জাত উন্নয়ন ও ফসল সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তির জন্য উদ্ভাবিত জাতের উপযোগী কৃষি উপকরণ প্রযুক্তি, যান্ত্রিকীকরণ ইত্যাদি নিশ্চিত করবে। এ ধরনের গবেষণা প্রতিকূল পরিবেশ সহিষ্ণু, স্বল্পমেয়াদি শস্যজাত উন্নয়ন ও প্রচলনের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষি জমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতি মোকাবিলা করে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বর্তমানে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে রোল মডেল।
বাংলাদেশে উৎপাদিত সবজির গুণগতমান বজায় রেখে পুষ্টিকর সবজি বিভিন্ন দেশে রপ্তানির হচ্ছে। কিন্তু এই রপ্তানি আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। গুণগত মানসম্পন্নভাবে উৎপাদিত সবজি স্থানীয় বাজারে বিক্রির অতিরিক্ত অংশ কিছুটা বেশি লাভ পেতে বিদেশের বাজারে রপ্তানি করা যায়। এটি বাংলাদেশের জন্য রেমিট্যান্স আদায়ের অন্যতম উপায় হতে পারে। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৬০ প্রকারের বেশি সবজি ৪০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি হয়। গত ১০ বছরে বাংলাদেশী সবজির রফতানি ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
সবজির রফতানি কে বেগবান করার জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে তা হলো- রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী, দীর্ঘ দিন সংগ্রহ উপযোগী বিভিন্ন সবজির রফতানিযোগ্য উন্নত জাত উদ্ভাবন। সারাবছর উৎপাদন উপযোগী জাত উদ্ভাবন। প্রটেকটিভ শেড-নেট হাউজে সারাবছর গুণগত মানসম্পন্ন, উচ্চমূল্যের নিরাপদ সবজি উৎপাদন। সবজি উৎপাদনে উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ। সবজির সংগ্রহের উপয্ক্তু সময় নির্ধারণ করা। পরিপক্ব টমেটোতে ১-গঈচ প্রয়োগের মাধ্যমে সংরক্ষণকাল বাড়ানো। ব্লানিচং পদ্ধতির মাধ্যমে গাজরের সংরক্ষণকাল বাড়ানো। এনজাইম নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে মটরশুঁটির সংরক্ষণকাল বাড়ানো। পরিপক্ব সবুজ কলার ২০+২ক্ক সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় এবং ৮৫-৯০% আর্দ্রতায় প্রতি লিটারে ৪০০ মাইক্রো গ্রাম ১-MCP প্রয়োগ করে পরিপক্বতার প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করা এবং ৩০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ কাল বৃদ্ধি করা। রপ্তানিযোগ্য সবজির জন্য নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা। সবজির রফতানিকে বেগবান করার জন্য যে পদক্ষেপগুলো নিতে হবে তা হলো- রপ্তানির জন্য সবজির ক্রপ জোনিং করা। বাংলাদেশ এঅচ স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহার করা। চুক্তিবদ্ধ চাষ (contract farming ) পদ্ধতিতে বাংলাদেশ GAP স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহার Adaptive trial করা। উন্নত সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার উপর গবেষণা এবং উন্নত প্যাকেজিংয়ের ব্যবস্থাপনা ও শীতাতাপ (Cooi temperature) ব্যবস্থাপনার উপর গবেষণা করা। রপ্তানির পূর্বে স্বল্পসময় বা দীর্ঘসময় সংরক্ষণের জন্য ভিন্ন ভিন্ন তাপমাত্রায় কোল্ড চেম্বার রাখার উপর গবেষণা অব্যাহত রাখা ।
সর্বোপরি আমরা কি খাচ্ছি এবং সেটি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য কতটুকু দরকার, সে খাবার থেকে কতটুকু পুষ্টি অথবা শক্তি পাব সেটির দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। জাতীয় সবজি মেলা ২০২২ সাফল্য কামনা করছি এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত করার জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউশনন হবে ক্ষুধামুক্ত নিরাপদ খাদ্য পুষ্টিসমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার গর্বিত অংশীদার।
লেখক : ১মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সবজি বিভাগ, বিএআরআই। মোবাইল : ০১৭১৪০০৪৩০৩, ই-মেইল :cso.geg.hrc@gmail.com ২প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সবজি বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭৫৪১১২০৫০, ই-মেইল :akmqs@gmail.com
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনালি ফসল পাটের বহুমুখী ব্যবহার ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন
কৃষিবিদ ড. মুহ: রেজাউল ইসলাম১ কৃষিবিদ মোঃ অহিদুল ইসলাম২
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, পাটের গবেষণার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ এবং পাট উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করা হলে জাতীয় অর্থনীতিতে পাট সম্পদ সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারে। বঙ্গবন্ধুর ৬ ও ১১ দফা আন্দোলনের একটি প্রধান অংশ জুড়েই ছিল পাটের কথা। পাট বাংলাদেশের ঐতিহ্যময় আঁশ উৎপাদনকারী অর্থকরী ফসল। পাট চাষ ও পাট শিল্পের সাথে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জড়িত। স্বাধীনতার পরেও দেড় যুগ ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাটের অবস্থান ছিল প্রথম ও অগ্রগণ্য। পাটের মাধ্যমেই বাংলাদেশ সমগ্র বিশে^ পরিচিতি পেয়েছে এবং এ দেশে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ সম্ভবপর হয়েছে। অনুকূল জলবায়ুর কারণে বাংলাদেশে বিশে^ও সর্বোৎকৃষ্ট মানের পাট উৎপাদিত হয়।
বিশে^ পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ২য় হলেও রপ্তানিতে ১ম স্থান দখল করে নিয়েছে। এর মূলে রয়েছে বিশ^ব্যাপী পলিথিন ও সিনথেটিকের ব্যবহারের পরিবর্তে পাটজাত মোড়কের ব্যবহারে আগ্রহ। কাঁচাপাট রপ্তানিতে অনেক দিন থেকেই শীর্ষস্থান বাংলাদেশের দখলে। বিগত ৫ দশকে পাটের ফলন ক্রমান্বয়ে বেড়েছে, তবে মূল্যের দিক থেকে বর্তমান দশকে পাট সবচেয়ে ভালো সময় পার করছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আবাদি জমি না বাড়লেও ফলন ও উৎপাদন দুটোই বাড়াতে উন্নত পাটের জাত ও উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন আমাদের কৃষকগণ এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়।
পাটের উন্নত জাত উদ্ভাবনে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ২য় প্রধান রপ্তানিখাত হলো পাট ও পাট জাতপণ্য, ৭৫২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০২০)।
বাংলাদেশে প্রায় ৭.০-৮.০ লাখ হেক্টর জমিতে পাট উৎপাদিত হয় এবং এ চাষে প্রায় ৩.০-৩.৫ মিলিয়ন কৃষক জড়িত আছে। পাটের চাষ মূলত আঁশ ফসলের জন্য কৃষকগণ করে থাকেন। ফলে পাটবীজ উৎপাদন তাদের কাছে কম গুরুত্ব পায়। আবার পাটের বীজ উৎপাদিত হয় রবি মৌসুমে যখন মূল্যবান সবজি উৎপাদনের সময়। উল্লেখিত জমিতে পাট চাষের জন্য প্রতি বছর কৃষকদের ৪,৫০০-৫,৫০০ মে. টন পাটের বীজ প্রয়োজন হয়। সত্তরের দশক বা তার পূর্বে এদেশে দেশি (Corchorus capsularis) ও তোষা (Corchorus olitorius) পাট চাষের অনুপাত ছিল ৮০:২০ অর্থাৎ ৮০ ভাগ দেশি এবং ২০ ভাগ তোষা পাট। বর্তমান চিত্র এর ঠিক বিপরীত। অর্থাৎ ৮০ ভাগের বেশি আবাদ হচ্ছে তোষা জাতের পাট। বর্তমানে দেশি, তোষা ও কেনাফ (Hibiscus cannabinus)- মেস্তার (Hibiscus sabdariffa) অনুপাত ৮:৮৫:৭। যেহেতু পূর্বে দেশি পাটের চাষ বেশি হতো এবং দেশি পাট শুধু আমাদের দেশেই উৎপাদিত হতো, সেহেতু আমাদের পাট বীজের ঘাটতি ছিল না। কিন্তু বর্তমানে তোষা পাটের চাষ বেশি হওয়ায়, পাটবীজের অপ্রতুলতা দেখা দিয়েছে। সরকারি, বেসরকারি ও এনজিও মিলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ১৫-২০% মানসম্মত পাটবীজ সরবরাহ হয়ে থাকে। অবশিষ্ট পাট বীজ আমদানি বা বিভিন্ন পন্থায় কৃষক পর্যায়ে পৌঁছে যার গুণগত মান অনেক সময় বজায় থাকে না। এজন্য বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের স্বনির্ভর হওয়ার প্রচেষ্টা চলছে।
একদিকে সোনালি আঁশ অন্যদিকে রূপালী কাঠি-দুইয়ে মিলে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে পাট। পাটকাঠির ছাই থেকে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপিয়ারের কালি, আতশবাজি, ফেসওয়াশের উপকরণ, মোবাইলের ব্যাটারি, প্রসাধনী ইত্যাদি পণ্য তৈরি করা হয়।
পাট একটি প্রাকৃতিক তন্তু ও পরিবেশবান্ধব আঁশ ফসল। পাটের আঁশ থেকে সেলুলোজ সংগ্রহ করে এক ধরনের বায়োডিগ্রেডেবল শিট তৈরি করা হয়েছে। এর থেকে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এক ধরনের পলিথিন ব্যাগ উদ্ভাবন করা হয়েছে যা ‘সোনালি ব্যাগ’ নামে পরিচিত। এ সোনালি ব্যাগ ৪-৫ মাস পরে সহজে পচে যায়, মাটিতে সারের কাজ করে এবং পরিবেশেরও কোনো ক্ষতি করে না। পাটের তৈরি পলিমারের ব্যাগ সাধারণ পলিব্যাগের চেয়ে দেড় গুণ টেকসই ও মজবুত। ইদানীং সোনালি ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদন ধীরে ধীরে বাড়ছে।
পাট তথা প্রাকৃতিক তন্তু কিভাবে জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশসমৃদ্ধ করে, তা ইতোমধ্যেই উন্নত বিশ্ব অনুধাবন করে নিয়েছে। এক হেক্টর জমিতে প্রতি মৌসুমে (১০০ দিন) পাট গাছ প্রায় ১৫ টন কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে, সেই সাথে প্রায় ১১ টন অক্সিজেন নিঃসরণ করে পরিবেশকে বিশুদ্ধ রাখে। এ ছাড়া ঝরে পড়া পাতা ও মূল হতে মাটিতে প্রায় ৮ মে.টন জৈব পদার্থ যোগ করে থাকে। পাট গাছের মূল মাটিতে প্রায় ১০ থেকে ১৫ সেমি. গভীরে প্রবেশ করে মাটিতে থাকা অজৈব তরল খাদ্য মাটির উপরে নিয়ে আসে। এর ফলে অন্যান্য অগভীর মূল বিশিষ্ট ফসলসমূহের চাষাবাদে মাটির পুষ্টির সমস্যা হয় না এবং মাটির গুণাগুণও ঠিক থাকে। এমনকি পাট পঁচানো পানি জমির জন্য উপকারী। একইভাবে পাটের তৈরি বস্ত্র-সামগ্রী ব্যবহারের পর মাটিতে ফেললে তা পচে মাটির জৈব পদার্থের (সবুজ সার) পরিমাণ বৃদ্ধি করে। এটি বৃক্ষ-ফসলের জীবনধারণ ও বৃদ্ধিতে সহায়তা। বাঁশ ও কাঠের বিকল্প হিসেবে পার্টিকেল বোর্ড, কাগজের ম- তৈরিতেও পাট কাঠি ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে পাট কাঠি থেকে উৎপাদিত কার্বনের গুণগত মান সর্বাধিক। তাই বিশ্ব বাজারের চাহিদা ও মূল্য দুটিই বাড়ছে। এছাড়া পলিমারের মিশ্রণে পাট থেকে আবিষ্কার করা হয়েছে পাটের ঢেউটিন যা জুটিন নামে পরিচিত।BMW কোম্পানি পাট দিয়ে তৈরি করছে পরিবেশবান্ধব ‘গ্রিনকার’ যার চাহিদা এখন সবচেয়ে বেশি। ইউরোপ-আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বে গাড়ির কুশন ও অভ্যন্তরীণ ডেকোরেশনে কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। কাজেইToyota,Mitsubishi I GM Motors ইত্যাদি গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি তৎপর হয়ে উঠেছে এবং তারা পাটের আঁশ ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পাট শুধু আঁশের উদ্দেশ্যে চাষ করা হয় না। মেস্তা পাটের মাংসল বৃতি (শাঁস) থেকে জ্যাম, জেলি, জুস, আচার, রোজেলা চা উদ্ভাবন করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (উল্লেখ্য যে, পাট পাতা এবং মেস্তার বৃতি থেকে উৎপাদিত পানীয় ‘চা’ এর কোনো ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই বলে জানা যায়)। ‘রোজেলা চা’ এ রয়েছে উচ্চমাত্রায় অ্যান্টি অক্সিডেন্ট যা ক্যানসার প্রতিরাধী। এছাড়া এটা রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে; কোলেস্টেরল কমায়; হার্টঅ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায় ইত্যাদি। বিজেআরআইসহ কিছু প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে এই পানীয় ‘চা’ ব্যবহার শুরু করেছে।
পাটের বহুবিধ ব্যবহারের পাশাপাশি শাক হিসেবেও পাটপাতা খাওয়া যায়। দেশি পাটপাতা স্বাদে তিতা, আর তোষা পাট অনেকটা মিষ্টি লাগে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত দেশি পাটশাকের পুষ্টিসমৃদ্ধ ৩টি জাত রয়েছে, যথা : বিজেআরআই দেশি পাটশাক-১, বিজেআরআই দেশি পাটশাক-২ (ম্যাড়ালাল) এবং বিজেআরআই দেশি পাটশাক-৩ (ম্যাড়াসবুজ)। এই জাতগুলো শাকের জন্যই চাষ করা হয়। দিন নিরপেক্ষ বলে এ জাতগুলো দেশের সব ধরনের জমিতে প্রায় সারা বছর চাষ করা যায়। এমনকি মৃদু লবণাক্ত এলাকাতেও চাষ করা যায়। রোগবালাই ও প্রতিকূল পরিবেশ সহনশীল এই জাতসমূহ অল্প যত্ন ও কম খরচে চাষ করে ২৫-৩০ দিন পর কয়েক বার শাক খাওয়া যায়। পাটশাকে রয়েছে আমিষ, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, প্রোটিন, আয়রন, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি, ক্যারোটিন এবং খাদ্য আঁশ। এ সকল উপাদান মানুষের শরীরে হাড় ভালো রাখে ; হজমে সাহায্য করে; খাবারে রুচি বাড়ায়; কোষ্ঠ কাঠিন্য দূর করে; রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়; রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে; কোলেস্টেরল কমায়; হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়; বাতব্যথা দূর করে; উচ্চমাত্রার অ্যান্টি অক্সিডেন্ট শরীরে ক্যানসার প্রতিরোধী হিসেবে কাজ করে ইত্যাদি। এ ছাড়া এর ফলিক অ্যাসিড ত্বক ও চুল সতেজ রাখে। তাই এই সকল রোগের জন্য পাটশাক একটি গুরুত্বপূর্র্ণ পথ্য।
পাট শিল্পের পুনরুজ্জীবন ও আধুনিকায়নের ধারা বেগবান করা, পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন বাস্তবায়ন, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে প্রতি বছর ৬ মার্চ পাট দিবস উদ্যাপিত হয়। সরকারের পাটবান্ধব নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণের ফলে পাট চাষিরা বর্তমানে পাটের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন এবং পাট চাষে দিন দিন আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে দেশে উৎপাদিত ১৯টি পণ্যের মোড়কে পাটের ব্যাগ/বস্তা ব্যবহারের নির্দেশ প্রদান করে আইন প্রণয়ন করেছে।
পাট বাংলাদেশের পরিচিতির অন্যতম অনুষঙ্গ। দেশের প্রায় ২.৫-৩.০ মিলিয়ন মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ খাতের সাথে জড়িত। সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশ সচেতনতার কারণে বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা ও দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা নতুন করে পাট চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
বাংলাদেশের পাট শিল্পের অভিজ্ঞতা শতবর্ষ পুরনো। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জিন কোড আবিষ্কারের কৃতিত্বও দেখিয়েছেন। বাংলাদেশ উন্মোচিত জীবন রহস্যের তথ্যকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে স্বল্প জীবনকালসমৃদ্ধ, প্রতিকূল পরিবেশ, রোগবালাই ও পোকামাকড় সহনশীল, বাজারের বিভিন্ন চাহিদামাফিক পণ্য উৎপাদন উপযোগী পাটের জাত উদ্ভাবনের গবেষণা এগিয়ে চলছে।
পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনতে বিজেআরআই নিরলসভাবে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পাটের কৃষি বিষয়ক গবেষণা ও উন্নয়নে উৎকর্ষতা অর্জনই হলো বিজেআরআই এর ভিশন। আর পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের উচ্চফলনশীল জাত এবং টেকসই চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবন, উন্নয়ন, হস্তান্তরের মাধ্যমে কৃষক ও সংশ্লিষ্ট উপকারভোগীদের উপার্জন বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন, আত্মসামাজিক উন্নয়ন এবং পরিবেশের উন্নয়ন করা হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য।
লেখক : ১জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার, ডিএই, গাইবান্ধা। মোবাইল-০১৭১৬৬৯৭১৯৬, ইমেইল-rezaul0171669@gmail.com ২বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পাট গবেষণা আঞ্চলিক কেন্দ্র, রংপুর, মোবাইল-০১৭২৩-৩৭২৯০২; ই-মেইল : wahid@bjri.gov.bd
নিউটন মন্ডলের পানিকচু চারা ভারতে রপ্তানি হচ্ছে
কৃষিবিদ শারমিনা শামিম১ মোঃ আবদুর রহমান২
কচু, আমাদের দেশে অপ্রচলিত সবজিগুলোর একটি। একসময় এ সবজিটি বসতবাড়ির অনাবাদি পতিত জমিতে অযতেœ অবহেলায় চাষ হতো। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদার বিবেচনায় বৈচিত্র্যময় ফসলের আবাদ বৃদ্ধি পাওয়ায় এ ফসলটি এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
পানিকচু চাষ, চারা উৎপাদন ও বিক্রির মডেলে পরিণত হয়েছেন খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার ঘোনা মাদারডাঙা গ্রামের নিউটন মন্ডল। তিনি মিল শ্রমিকের কাজ ছেড়ে ২০০৮ সালে মাত্র ২০ শতাংশ জমিতে পানিকচু চাষের মাধ্যমে কৃষি কাজ করে আজ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। উপজেলা কৃষি অফিসের সূত্র মতে, নিউটন ২০১৫ সালে উপজেলা কৃষি অফিসের পরমর্শ গ্রহণ করে দ্বিতীয় শস্য বহুমুখীকরণ প্রকল্পের এসএফজি হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে কৃষক দল গঠন করেন। পরবর্তীতে নিউটন ২০১৭-১৮ অর্থবছর হতে ৫০ শতাংশ জমি লিজ গ্রহণ করে ৪০০০টি পানিকচু চারা রোপণ করেন। এতে তার অর্থ ব্যয় হয় ১০-১২ হাজার টাকা। এ বছর লতি, কচু ফুল ও পানিকচু বিক্রি করে তিনি ৩,৮৪,০০০/- টাকা আয় করেন, যার মধ্যে লতি ও ফুল বিক্রি করেন ২০-২৫ হাজার টাকার। নিউটন ইতোমধ্যে ১ লাখ কচুর চারা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠিয়েছেন এবং এ চারা সম্প্রসারণের জন্য আলাদাভাবে প্লটও তৈরি করেছেন। তার উৎপাদিত পানিকচুর চারা এখন দেশের বিভিন্ন জেলাতে বিক্রি হওয়া ছাড়াও ভারতে রপ্তানি করছেন।
বর্তমানে তিনি থাই পেয়ারার চাষও শুরু করেছেন এবং গত অর্থবছরে ৫০ হাজার টাকার পেয়ারা বিক্রি করে এলাকায় সাড়া জাগিয়েছেন। ২০১৯ সাল হতে নিউটন তার এক সহযোগীকে নিয়ে খুলনা সাতক্ষীর মহাসড়কের বরাতিয়া গ্রামে সাড়ে ৮ বিঘা জমি লিজের মাধ্যমে এনপিএন এগ্রো নামে নার্সারি গড়ে তুলেছেন যার প্রাথমিক পুঁজি ছিল ৭ লাখ টাকার মতো। এ নার্সারিতে তিনি ভারতীয় জাতের আপেল, কমলা, রাম্বুতান, ত্বীন ফল, চুঁই এর চারা, বিভিন্ন প্রজাতির আম, লাল কাঁঠালসহ সর্বশেষ প্রযুক্তির বিভিন্ন ফল ও সবজির চারা কলম বিক্রি করেন। নিউটন মন্ডলের মতে, গত দুই বছরে তিনি ২৭ লাখ টাকার চারা/কলম বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছলতা লাভ করছেন। এ বছর নিউটন ৪০০ শতক জমিতে পানিকচু চাষ করছেন এবং এখান থেকে ফুল, লতি ও কচু চারা ও কচু বিক্রির মাধ্যমে ৩০ লাখ টাকা আয় করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও তিনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কন্দাল ফসল উন্নয়ন প্রকল্পভুক্ত এলাকায় পানিকচুর চারা সরবরাহ করছেন। নিউটন খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, মুন্সীগঞ্জসহ অন্যান্য এলাকায় চুঁইয়ের ক্ষেত, ত্বীন ফল, ড্রাগন বাগান তৈরি ও পানিকচু চাষে সহায়তা ও পরামর্শ প্রদান করেছেন। এ ছাড়াও তিনি কৃষিকাজের আয় দিয়ে একটি গরুর খামার ও পানের বরজ তৈরি করেছেন। পানি কচুর চাষ বৃদ্ধি করা হলে নিচু জমির সর্বোত্তম ব্যবহার এবং পুষ্টির চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে পাশাপাশি জৈব কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহারে কৃষকদের আগ্রহ বাড়বে বলে আশা করা যায়।
কচুর পুষ্টিগুণাগুণ
কৃষিবান্ধব বর্তমান সরকারের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নে কচু ফসলটি এখন অনেক বেশি সম্ভবনাময়। আগাগোড়া খাওয়া যায় এ সবজির পুষ্টিগুণ অবাক করার মতো। কচুর মূল উপাদান হলো আয়রন (ঋব), যা রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রেখে শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহ ঠিক রাখে। প্রতি ১০০ গ্রাম কচুশাকে ৩৯ গ্রাম প্রোটিন, ৬.৮ গ্রাম শর্করা, ১৫ গ্রাম চর্বি, ২২৭ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১০ মিলিগ্রাম আয়রন ও ৫৬ মিলিগ্রাম খাদ্যশক্তি থাকে। কচুর শাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ,বি,সি, ক্যালসিয়াম। ভিটামিন এ জাতীয় খাদ্য রাতকানা প্রতিরোধ করে আর ভিটামিন সি শরীরের ক্ষত সারাতে সাহায্য করে। তাই শিশুদের ছোট বেলা থেকেই কচুশাক খাওয়ানো উচিত। কচুতে আছে নানা রকমের ভিটামিন যা গর্ভবতী মা ও শিশুর জন্য দারুন উপকারী। কচু দামেও বেশ সস্তা, তাই দরিদ্র্য পরিবারের গর্ভবতী মহিলারা ভিটামিন ও আয়রনের চাহিদা পূরণের জন্য কচু খেতে পারেন। কচুর ডাঁটায় প্রচুর পরিমাণে পানি থাকে, তাই গরমের সময় কচুর ডাঁটা রান্না করে খেলে শরীরের পানির ঘাটতি পূরণ হয়। কচুশাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে আঁশ থাকে যা হজমে সহায়তা করে। জ্ব¡রের সময় রোগীকে দুধকচু রান্না করে খাওয়ালে জ্বর দ্রুত ভালো হয়। কচুতে আছে প্রচুর ফাইবার, ফোলেট ও থায়ামিন যা মানব শরীরের জন্য অনেক দরকারী উপাদান। কচু খেলে রক্তের কোলেস্টেরল কমে তাই উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য ওল কচুর রস বেশ উপকারী। নিয়মিত কচু খেলে কোলন ক্যান্সার ও ব্রেষ্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। কচুতে আছে অক্সলেট নামক উপাদান। তাই কচুশাক বা কচু খেলে অনেক সময় গলা চুলকায়। তাই কচু রান্না করার সময় লেবুর রস বা সিরকা ব্যবহার করা উচিত। তবে যাদের শরীরে অ্যালার্জির সমস্যা আছে তাদের কচু না খাওয়াই ভালো।
বাংলাদেশে পানি কচুর বিভিন্ন নাম রয়েছে যেমন- লতিরাজ, নারিকেল কচু, জাত কচু, বাঁশ কচু ইত্যাদি। পলি দোআঁশ ও এটেল মাটি পানিকচু চাষের জন্য উপযুক্ত। লতি লম্বায় ৯০-১০০ সেমি. সামান্য চ্যাপ্টা, সবুজ। লতি সিদ্ধ করলে সমানভাবে সিদ্ধ এবং গলা চুলকানি মুক্ত হয়। বোঁটা ও সংযোগস্থলের উপরিভাগের রং বেগুনী। জীবনকাল ১৮০-২১০ দিন। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই এর চাষাবাদ করা যায়। আগাম ফসলের জন্য কার্তিক (মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য নভেম্বর)। নাবি ফসলের জন্য মধ্য ফাল্গুন থেকে মধ্য বৈশাখ (মার্চ-এপ্রিল) মাসে লাগানো যায়। দক্ষিণাঞ্চলে বৎসরের যে কোন সময় লাগানো যায়। প্রতি শতকে প্রায় ১৫০টি লতা রোপণ করা প্রয়োজন। জমি ভালোভাবে তৈরি করে লাইন থেকে লাইন ২ ফুট (৬০ সেমি.) এবং গাছ থেকে গাছ ১.৫ ফুট (৪৫ সেমি.) রাখতে হবে।
কচু চাষের জন্য সারের পরিমাণ সারণি দ্রষ্টব্য। গোবর, টিএসপি এবং এমওপি সার জমি তৈরির শেষ সময়ে প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া ২-৩ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হয়। তবে প্রথম কিস্তি রোপণের ২০-২৫ দিনের মধ্যে প্রয়োগ করা দরকার।
আন্তঃপরিচর্যা : পানিকচুর গোড়ায় দাঁড়ানো পানি রাখতে হবে এবং দাঁড়ানো পানি মাঝে মাঝে নাড়িয়ে দিতে হবে। লতিরাজ জাতের জন্য দাঁড়ানো পানির গভীরতা ৮-১০ সেমি. হওয়া দরকার। কচুতে বালাই নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনা করতে হবে। এ ছাড়াও কচুতে পাতার উপর বেগুনি থেকে বাদামি রঙয়ের গোলাকার দাগ পড়ে। পরবর্তীতে এ সমস্ত দাগ আকারে বেড়ে একত্র হয়ে যায় এবং পাতা ঝলসে যায়। পরে তা কচু ও কন্দে বিস্তার লাভ করে। উচ্চ তাপমাত্রা, আর্দ্র আবহাওয়া ও পর পর ৩-৪ দিন বৃষ্টি থাকলে এ রোগের মাত্রা খুব বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম রিডোমিল এম জেড-৭২ ডব্লিউ অথবা ডায়থে এম-৪৫ মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ৩ থেকে ৪ বার প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োগ করার আগে ট্রিকস মিশিয়ে নিতে হয়। লতি ২৫-৩০ টন/হেক্টর ও কা- ১৮-২০ টন/হেক্টর ফলন হয়ে থাকে। রোপণের ২ মাস পর থেকে ৭ মাস পর্যন্ত লতি ফসল সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।
লেখক : ১কৃষিবিদ শারমিনা শামিম, আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খুলনা। মোবা : ০১৭১৬-৭৬৮৮২১; ২মোঃ আবদুর রহমান, এআইসিও, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খুলনা। মোবা : ০১৯৪৩-৫১৭৫০৬, ই-মেইল : khulna@ais.gov.bd
প্রাণিখামারঃজাতীয় অর্থনীতিকে গতিশীল রাখবে
কৃষিবিদ ডক্টর এস এম রাজিউর রহমান
ঈদুল আজহার কোরবানির বাজারে গরু বিক্রয়ের জন্য দেশে অধিকাংশ প্রাণীসমূহ বছরব্যাপী বা মৌসুম কেন্দ্রীক গরু মোটাতাজাকরণ করা হয়। আর কিছু খামার বছরব্যাপী রেডমিট উৎপাদনের জন্য সচল থাকে। যা, দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ, বেকারত্ব দূর করা, উদ্যোক্তা তৈরিসহ গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখতে প্রাণিসম্পদ খাত অপরিসীম অবদান রেখে চলেছে। এ খাতের বিকাশের মাধ্যমে দেশীয় চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। করোনা মহামারিকালেও প্রাণিসম্পদ খাতের উৎপাদন, সরবরাহ, পরিবহন ও বিপণন অব্যাহত রাখা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্র ও অনলাইন বাজার পরিচালনার মাধ্যমে খামারিদের উৎপাদিত মাংস, দুধ ও ডিম ন্যায্যমূল্যে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। নগদ প্রণোদনা প্রদান, স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় আর্থিক প্রণোদনা বিতরণ, উপকরণ সহায়তাসহ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের পাশে দাঁড়িয়েছে সরকার। ফলে প্রাণিসম্পদ খাতে কর্মসংস্থানের সৃষ্টির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভবপর হবে।
প্রাণী খামারগুলোর সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
ঈদুল-আজহার জন্য গড়ে ওঠা প্রাণী খামারগুলো বাংলাদেশের গ্রামের অর্থনীতিকে গতিশীল করে। প্রান্তিক খামারিরা চার-ছয় মাস করে বছরে দুই-তিনটা সার্কেল গরু মোটাতাজা করে থাকে। এ সময় কোরবানির পশুগুলো খুব যত্নে লালন পালন করা হয়। সব খরচ বাদ দিয়েও একটি গরুতে অন্তত ১০-১৫ হাজার টাকা আয় থাকে। গবেষকরা বলছেন, ঈদুল-আজহায় গবাদিপশু বিক্রি করে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ হাতে নগদ টাকা পায়।
করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে অনলাইন প্লাটফর্মে গবাদিপশু ক্রয়-বিক্রয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালে গত বছরের তুলনায় প্রায় ৫ গুণ বেশি গবাদিপশু অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিক্রি হয়েছে। ২০২১ সালে অনলাইনে মোট ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৫৭৯টি গবাদিপশু বিক্রি হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য ২৭৩৫ কোটি ১১ লাখ ১৫ হাজার ৬৭৮ টাকা। গত বছর অনলাইন প্ল্যাটফর্মে গবাদিপশু বিক্রি হয়েছিল ৮৬ হাজার ৮৭৪টি, যার আর্থিক মূল্য ছিল ৫৯৫ কোটি ৭৬ লাখ ৭৪ হাজার ৮২৯ টাকা। প্রতি বছর গড়ে ৫০-৫৫ হাজার কোটি টাকার মতো কোরবানির পশু বেচা-বিক্রি হয়। অল্পসময়ে আর্থিক আয় তুলনামূলক বেশি হওয়ায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে অনেকে এসব খামারের দিকে ঝুঁকছেন। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রেও এ খাত বড় ভূমিকা রাখছে।
চামড়া শিল্প জাতীয় অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। চামড়াকে কেন্দ্র করে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। জিডিপিতে চামড়া শিল্পের অবদান প্রায় ০.৪০ শতাংশ। মোট রপ্তানি আয়ে এ খাতের অবদান ৩.৩২ শতাংশ। তৈরি পোশাক শিল্পের পর রপ্তানি আয় অর্জনের ক্ষেত্রে এ খাতের স্থান কখনও দ্বিতীয়, কখনও তৃতীয়। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুসারে এ খাতের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন উৎসাহব্যঞ্জকভাবে বর্ধিষ্ণু। এ খাত থেকে ২০১১-১২ সালের ৩৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের আয় ২০২০-২১ সালে প্রায় চারগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,২৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এ শিল্পের অধীনে আছে ট্যানারিসহ, অসংখ্য জুতা, ব্যাগ, বেল্ট ও সুদর্শন সরঞ্জামাদি তৈরির কারখানা। তাতে সরাসরিভাবে নিয়োজিত রয়েছে লাখ-লাখ শ্রমিক-কর্মচারী।
ওমাসম (তৃতীয় পাকস্থলীর) আর পিজল (পেনিস) এখন নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে। গরু জবাইয়ের পর এক সময় নদী খালে ফেলে দেয়া হতো এসব উচ্ছিষ্ট। যা পরিবেশও দূষণ করত। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্র জানায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১১৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা মূল্যের ওমাসম রপ্তানি হয়। করোনা সঙ্কটেও ৩২০ কোটি টাকার ওমাসম বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়। বহির্বিশ্বে বেড়েই চলছে দেশের গরু-মহিষের ওমাসম ও পিজলের চাহিদা। এ থেকে তৈরি হয় উন্নত মানের স্যুপ ও সালাদ যা চীন,হংকং, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে বেশ জনপ্রিয় খাবার। রপ্তানির জন্য ওমাসম ও পিজলের সংগ্রহের ব্যাপ্তি শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় দেশব্যাপী সংগ্রহযোগ্য বিশাল পরিমাণের ওমাসম ও পিজলের বৃহদাংশ রপ্তানি প্রক্রিয়ায় না আসতে পারায় বিপুল পরিমাণ রপ্তানি আয় ও কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। গরু-মহিষ জবাইয়ের পরে চামড়া, ওমাসম ও পিজল লবণ দিয়ে সংগ্রহ করা হয়। এসব সংরক্ষণের জন্য আমাদের প্রতি বছর ১ লাখ মেট্রিক টন লবণ প্রয়োজন হয়। এদিকে এসময় লবণের কৃত্রিম সঙ্কট হয়। জাতীয় অর্থনীতিতে লবণ শিল্পখাত প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১২০০ কোটি টাকার অবদান রাখছে। বাংলাদেশের প্রায় ১০-১৫ লক্ষ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লবণ শিল্পের উপর নির্ভরশীল।
এ বছর পবিত্র ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য প্রস্তুত ছিল এক কোটি ১৯ লাখ গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়াসহ অন্যান্য গবাদিপশু। কিন্তু এবার সারা দেশে কোরবানি হয়েছে ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি গবাদিপশু। অর্থাৎ প্রায় ২৮-২৯ লাখ গবাদিপশু (২৪%) অবিক্রিতই থেকে গেছে। কোরবানির জন্য সারা বছর গরুসহ অন্যান্য গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ করেও বিক্রি করতে পারেননি খামারি বা ব্যবসায়ীরা। আবার গবেষকরা বলছেন, ঈদুল-আজহায় পশু বিক্রির জন্য অধিক বিনিয়োগে লাভ বেশি হলেও ঝুঁকি থাকে, আবার সবার ক্ষেত্রে এই বিনিয়োগ করা সম্ভব নয়।
চ্যালেঞ্জ উত্তোরণের উপায়
গবাদিপশু উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাত, বর্জ্যব্যবস্থাপনা, কাঁচা চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণসহ ট্যানারিতে পৌঁছা পর্যন্ত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অসংখ্য অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। ফলশ্রুতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিভিন্ন পর্যায় ও উপখাতের সাথে সংশ্লিষ্ট বিপুল জনগোষ্ঠী।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী হাউজহোল্ড অনুপাতে ২০২১ সালে গরু-মহিষ কোরবানির সংখ্যা চট্টগ্রাম বিভাগে বেশি হলেও ছাগল-ভেড়া কোরবানির সংখ্যা যথাক্রমে ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগে বেশি। অপরপক্ষে গরু-মহিষ কোরবানি সংখ্যা ময়মনসিংহ বিভাগে কম। আবার হাউজহোল্ড অনুপাতে গরু-মহিষ কোরবানি সংখ্যা সবচেয়ে বেশি রংপুর বিভাগে। আর সবচেয়ে কম দেখা যাচ্ছে বরিশাল বিভাগে। উক্ত তথ্য অনুযায়ী আমরা গবাদিপশু উৎপাদন কর্মসূচির পরিকল্পনা উন্নয়ন ও পরিমার্জন করতে পারি। এখানে প্রতিটি বিভাগে কোরবানির সংখ্যা কমবেশি হওয়ার পেছনে কারণ সমূহ কি রয়েছে তা উদঘাটন করা প্রয়োজন। এর জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কর্মরত ব্যক্তিবর্গ, প্রান্তিক ও অগ্রজ খামারি এবং ফড়িয়াসহ উপকরণ সরবরাহের সহিত জড়িত ব্যবসায়ীবৃন্দকে সমীক্ষার আওতায় এনে, প্রকৃত কারণসমূহ উদঘাটন করে একটি টেকসই গুণগতমানের কার্যক্রম হাতে নেয়া যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, রংপুর বিভাগে কোরবানির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি (প্রতিটি হাউজহোল্ডে ১.৪৬)। এর পেছনে এক বা একাধিক কারণ থাকতে পারে যেমন উক্ত এলাকায় গবাদিপ্রাণী বাণিজ্যিকভাবে লালন পালন হচ্ছে; খামারি প্রাণিসম্পদ পালনে বেশি সচেতন; দারিদ্র্যের কারণে গরু-মহিষ/ভেড়া ছাগল উক্ত সময় বেশি-বেশি করে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে; ধর্মীয় সংবেদনশীলতার মাত্রা; আর্থিক সঙ্গতি বেশি থাকা; উৎপাদন খরচ কম থাকায় বাজার দর কম থাকা ইত্যাদি। আবার বরিশাল বিভাগে হাউজহোল্ড অনুপাতে কোরবানির প্রাণীর সংখ্যা সবচেয়ে কম (০.০১)। এখানেও বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে যা আমাদের এই সমীক্ষার মাধ্যমে উদঘাটন করতে হবে। উক্ত সমীক্ষার আলোকে অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে টেকসই প্রাণিসম্পদ কার্যক্রম শুরু করতে হবে।
২০৩০ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে স্বপ্নের উন্নত দেশের সম্মান পেতে হলে; প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের দরকার টেকসই পরিকল্পনা। সেক্ষেত্রে গবাদিপশু উৎপাদন, কোরবানির পশু প্রস্তুতকরণ, অনলাইন প্ল্যাটফর্র্মে বিপণন কার্যক্রম পরিচালনা, খামারি উদ্বুদ্ধকরণ ও উদ্যোক্তা তৈরি, খোরপোষ কৃষিকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর, কোরবানীর পশুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কাঁচা চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা, সরকারি-বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্ব (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ-পিপিপি), সুসংগঠিতভাবে দেশীয় বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধনসহ প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কার্যক্রমের সম্প্রসারণ এবং বাজার ব্যবস্থা মনিটরিং শক্তিশালীকরণ এর দিকে নজর দিতে হবে। এসব সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও যথাযথ বাস্তবায়ন এবং সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অর্জিত হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা আর তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বের একটি স্বপ্নের উন্নত বাংলাদেশ।
লেখক : জাতীয় প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি বিশেষজ্ঞ, জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থা। মোবাইল : ০১৭১৭৯৭৯৬৯৭, মেইল :smrajiurrahman@yahoo.com
বরেন্দ ও খরাপ্রবন এলাকায় বসতবাড়ির পুকুরে সমন্বিত মৎস্য চাষ
ড. মোহাঃ সাইনার আলম
বাংলাদেশ বিশ্বে একটি নেতৃস্থানীয় মৎস্য উৎপাদনশীল দেশ। বিশেষত বিগত দুই দশকে মৎস্য উৎপাদনে লক্ষণীয় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইতোমধ্যে রুইজাতীয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, কৈ, শিং-মাগুর ও পাবদা-গুলশা মাছের উৎপাদনে এক নীরব বিপ্লব সাধিত হয়েছে। দেশে পুকুর-দীঘিতে হেক্টর প্রতি বার্ষিক গড় উৎপাদন ৫.০ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু বরেন্দ্র অঞ্চলটি একটি অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাদপদ ও পরিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে পরিগণিত হওয়ায় মাছচাষের ঈপ্সিত সম্প্রসারণ হয়নি বলেই এসব এলাকার পুকুরের উৎপাদনশীলতায় প্রতীয়মান হয়। এ এলাকায় হেক্টর প্রতি বার্ষিক গড় উৎপাদন ৪.০ মেট্রিক টন। তবে পুকুর-দীঘিতে সমৃদ্ধ বরেন্দ্র এলাকায় লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে হেক্টরপ্রতি মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে পারিবারিক পুষ্টিচাহিদা পূরণ ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। মৎস্যচাষে ঈপ্সিত উন্নয়নে সরকার গৃহীত অন্যান্য পদক্ষেপের পাশাপাশি বসতবাড়ির পুকুরে সমন্বিত মাছ চাষ সম্প্রসারণ হতে পারে একটি লাগসই প্রযুক্তি।
বরেন্দ্র এলাকায় অধিকাংশ চাষির বাড়ির আশেপাশে এবং রাস্তার ধারে অসংখ্য ছোট-বড় পুকুর-ডোবা রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় বরেন্দ্র এলাকার প্রায় ৮০ শতাংশ পুকুর বসতবাড়ির পাশে অবস্থিত। এ সব মৌসুমী পুকুর-ডোবা বা জলাশয়ে বছরে গড়ে ৫-৭ মাস পানি থাকে এবং গড় গভীরতা ৪-৬ ফুট। বসতবাড়ি সংলগ্ন অধিকাংশ পুকুরের উৎপত্তি মূলত বাড়ি তৈরির উদ্দেশ্যে সৃষ্ট গর্ত থেকে। তা ছাড়া খরা প্রবণ এলাকা হওয়ায় এতদাঞ্চলের অধিকাংশ পরিবার এসব পুকুর-ডোবার পানি গৃহস্থালির বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে থাকে। বিগত দুই দশকে মৎস্য অধিদপ্তরাধীন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মসূচির মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণমূলক কার্যক্রম গ্রহণের ফলে বর্তমানে অধিকাংশ জলাশয়ে মাছচাষ অগ্রসরমান রয়েছে।
পারিবারিক বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের (যেমন- পুকুর-ডোবা, শস্য ক্ষেত, শাকসবজির ক্ষেত, গবাদি পশু-পাখি, ফলমূল ও বনজ গাছ, ইত্যাদি) সমন্বয় ঘটিয়ে বসতবাড়ি সংলগ্ন ছোট-বড় পুকুরে কার্পজাতীয় মাছ ও অধিক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন ছোট মাছের মিশ্রচাষ করা যায়। এর ফলে পারিবারিক স¤পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হয়, তুলনামূলকভাবে কম খরচে মাছ উৎপাদন করা যায় এবং পুকুর ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণে পরিবারের সকল কর্মক্ষম সদস্যগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। সমন্বিত ও পরিবেশবান্ধব মৎস্যচাষ ব্যবস্থাপনা দেশীয় ছোট মাছের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অনন্য ভূমিকা রাখে।
বরেন্দ্র ও খরা প্রবণ এলাকায় দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ ও দ্রুত বর্ধনশীল জাতের চাষ ব্যবস্থাপনা বেশ উপযোগী ও লাগসই প্রযুক্তি হিসেবে ইতোমধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কম বিনিয়োগ ও স্বল্প সময়ে ফলাফল প্রাপ্তি এসব প্রযুক্তি সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। বসতবাড়ির পুকুরে কার্পের সাথেও দেশীয় ছোট মাছ চাষ করা যায়। এসব এলাকার জন্য লাগসই মাছ চাষ পদ্ধতিসমূহ হলো- কার্পজাতীয় মাছের মিশ্রচাষ; কার্প ও ছোট মাছের মিশ্রচাষ ; দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছের চাষ (শিং-মাগুর, গুলশা-টেংরা, পাবদা, গলদা চিংড়ি, মলা-ঢেলা, ইত্যাদি); দ্রুত বর্ধনশীল তেলাপিয়া, কার্পিও, সরপুঁটি ও বাটা মাছের চাষ ; পাঙ্গাশ ও কৈ মাছের চাষ; কার্প জাতীয় মাছের পোনা উৎপাদন; বসতবাড়ির পুকুরে সমন্বিত মাছ চাষ ইত্যাদি।
ছোট মাছের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে মলা, ঢেলা, দারকিনা, ইত্যাদি মাছে অধিক পরিমাণে অনুপুষ্টি বিদ্যমান। ছোট মাছের মাথা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও হাড় ক্যালসিয়াম, ভিটামিন এ, আয়রন ও জিঙ্ক সমৃদ্ধ এবং মাছের পুরোটা খাওয়া হয় বিধায় অনুপুষ্টি বেশি পাওয়া যায়। বসতবাড়ির পুকুরে কার্প-ছোট মাছের মিশ্রচাষে ৫-৭ মাসে প্রতি শতাংশে ১৪-২০ কেজি মাছ পাওয়া সম্ভব। পারিবারিক চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত মাছ বিক্রি করে পারিবারিক আয় বৃদ্ধি করা যায়। মনে রাখবেন, মাছ চাষের ক্ষেত্রে একটি আদর্শ পুকুরের বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো- আয়তকার পুকুর, পানির বর্ণ সবুজাভ বা বাদামি সবুজ, দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি ও গভীরতা ৪-৬ ফুট। পর্যাপ্ত সূর্যালোক নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে পুকুর পাড়ে কোন গাছপালা না থাকাই উত্তম।
মাছের মিশ্রচাষ তথা সব ধরনের মাছচাষের ক্ষেত্রে মূল কার্যক্রমসমূহ মূলত তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত; যেমন: মুজদ-পূর্ব ব্যবস্থাপনা, মজুদকালীন ব্যবস্থাপনা ও মজুদ-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা। পুকুর প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থাপনাই হলো মজুদ-পূর্ব ব্যবস্থাপনা। এতে মূলকাজ ৭টি। পুকুরের পাড় ও তলা মেরামত এবং তলা সমতলকরণ; ঝোপ-জঙ্গল ও জলজ আগাছা দমন; রাক্ষুসে ও অচাষকৃত মাছ দূরীকরণ; পুকুরে পানি প্রবেশ করানোর মাধ্যমে গভীরতা বাড়ানো; পুকুর প্রস্তুতকালীন চুন প্রয়োগ ও সার প্রয়োগ; পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য পরীক্ষা; পানির উপযুক্ততা পরীক্ষা।
ভালো পোনা ভালো উৎপাদনের চাবিকাঠি। মজুদকালীন ব্যবস্থাপনায় পোনা মজুদের সময় সাধারণভাবে ৬টি ধাপ অনুসরণ করা হয়: পুকুরে চাষযোগ্য পোনার জাত নির্বাচন; ভাল ও খারাপ পোনা চেনা; মজুদ ঘনত্ব নির্ধারণ; পোনা পরিবহন; পোনা অভ্যস্থকরণ ও মজুদ; পোনা বেঁচে থাকার হার পর্যবেক্ষণ। মজুদ-পরবর্তী ব্যবস্থাপনার ওপর মাছের উৎপাদন বহুলাংশে নির্ভরশীল। মৎস্যচাষ ব্যবস্থাপনায় চাষকালীন সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ; মজুদ পরবর্তী সার প্রয়োগ; মজুদ পরবর্তী চুন প্রয়োগ; পানির গুণাগুণ পরীক্ষা ও গুণগতমান সংরক্ষণ; নমুনায়ন, মাছ আহরণ, বাজারজাতকরণ ও পুনঃমজুদ এসব পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে।
মাছের উৎপাদন ব্যবস্থায় সকল স্তরে উত্তম চাষ ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করতে হবে। বাড়ি বা খামারে তৈরি নিরাপদ খাদ্য ব্যবহারে অগ্রাধিকার দিতে হবে। মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য পুকুরে বিদ্যমান প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি সাধারণভাবে চালের কুড়া, গমের ভুষি, ভুট্টা চুর্ণ, সরিষার খৈল, ফিশমিল, খুদিপানা ইত্যাদি মাছের সম্পূরক খাদ্য হিসেবে সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও বাজারে প্যাকেটজাত পিলেট বা দানাদার স¤পূরক খাদ্য পাওয়া যায়। গ্রাসকার্প ও সরপুঁটির খাদ্য হিসেবে পুকুরে নিয়মিত খুদিপানা, কুঁটিপানা, নরম ঘাস, কলাপাতা, পেঁপে পাতা, আলুর পাতা, সজনে পাতা, নেপিয়ার ঘাস, শীতকালীন শাকসবজি ইত্যাদি দিতে হবে। মলা মাছের খাদ্য হিসেবে মিহি চালের কুড়া (অটো রাইস পলিশ) শুকনো অবস্থায় পানির উপরে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিমাণ ঠিক রাখার জন্য নিয়মিত সার প্রয়োগ করতে হয়। পানির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য কোন অবস্থাতেই পুকুরে কাঁচা গোবর বা হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা ব্যবহার করা যাবে না। গোবর অন্তত ৭ দিন গর্তে রেখে বায়বীয় পচনের পর কম্পোস্ট সার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। পচানোর সময় এর সাথে সামান্য পরিমাণ চুন মেশানো যেতে পারে। এ ছাড়াও মাছ চাষকালীন সময়ে পুকুরে বিভিন্ন কারণে মাছ রোগাক্রান্ত হতে পারে যেমন- খাদ্য ও পুষ্টির অভাব, দূষিত পরিবেশ এবং পরজীবী ও রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর সংক্রমণ। মনে রাখবেন রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। মাছের রোগ প্রতিরোধের জন্য সুষম খাদ্য প্রয়োগ, জৈবসার কম দেয়া এবং শীতের শুরুতে প্রতি শতাংশে অবস্থাভেদে ৩০০ থেকে ৫০০ গ্রাম হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। সচারচর দেখা যায় বসতবাড়ির আশপাশের পরিত্যক্ত পুকুর-ডোবা মশা-মাছি, সাপ-ব্যাঙ, কীটপতঙ্গ ও ক্ষতিকর প্রাণির উপযুক্ত আবাসস্থল এবং যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগব্যাধি ছড়াতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এসব পুকুর-ডোবা বিজ্ঞানভিত্তিক মাছচাষের আওতায় আনা হলে মশা-মাছি ও রোগ-জীবাণুর উপদ্রব বহুলাংশে হ্রাস পাবে।
সরকারের উন্নয়ন দর্শন বাস্তবায়নের মাধ্যমে মৎস্য সেক্টরে অর্জিতব্য প্রধান লক্ষ্যসমূহের মধ্যে মৎস্যচাষে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয় বৃদ্ধির বিষয়টি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। মৎস্যখাতে নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে বসতবাড়ি সংলগ্ন পুকুরে মাছ ও চিংড়ি চাষ, পোনা প্রতিপালন, মৎস্য আহরণ, খুচরা বিক্রয়, মাছ শুটকীকরণ, মৎস্য খাদ্য প্রস্তুতকরণ, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি অন্যতম। এ ছাড়া জাল বুনন, মাছ ধরার ফাঁদ তৈরি, মাছ চাষে উদ্বুদ্ধকরণ ও গণসচেতনতা সৃষ্টি, ইত্যাদি ক্ষেত্রেও নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। মৎস্যচাষের মত আয় বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রমে নারীদের অংশগ্রহণে অগ্রাধিকার প্রদানের ফলে মাছের উৎপাদন বাড়ার সাথে সাথে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদাপূরণ ও আয় বৃদ্ধি অনেকাংশেই নিশ্চিত হচ্ছে। সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টার মূল স্রোতধারায় নারীদের সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মৎস্যচাষ বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে সমাজের সুবিধা-বঞ্চিত, বিশেষ করে দরিদ্র ও দুঃস্থ নারীদের, যাদের পুকুর/ডোবা আছে বা মাছ চাষ করার জন্য অনুরূপ কোন উৎসে অংশগ্রহণের সুযোগ আছে। উন্নয়ন প্রকল্পাধীন এলাকায় পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, পুকুরে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে চাষিদের মাছ খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে ২৮ শতাংশ, যেখানে পুরুষ মৎস্যচাষির (২৭%) চেয়ে নারী মৎস্যচাষির (৩৯%) বেলায় মাছ খাওয়ার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য বেশি হয়েছে।
পরিশেষে জীবনধারণের জন্য আমিষের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর আমিষের চাহিদা পূরণে মাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে প্রাণিজ আমিষের মধ্যে মাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ আমিষ পাওয়া যায়। বসতবাড়িতে মাছ ও শাকসবজির সমন্বিত চাষ ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের মাধ্যমে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা মেটানো সম্ভব। খরাপ্রবণ এলাকার আপামর জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা পূরণে অন্যতম ও সহজ উপায় হতে পারে পর্যাপ্ত পরিমাণে মাছ ও বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির উৎপাদন ও গ্রহণ। এ সমন্বিত চাষ ব্যবস্থাপনায় হতে পারে পারিবারিক পুষ্টি সমস্যা সমাধান নিরসনে টেকসই ও উত্তম পন্থা।
লেখক : উপপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর, রংপুর বিভাগ, রংপুর। মোবাইল : ০১৭১৬৭৩০৬৬৬, ই-মেইল :sainardof@yahoo.com
কবিতা, সবুজ পাতা
কৃষিবিদ মোঃ রাকিবুল ইসলাম২
একদা এক শীতের সকালে
ঘুম ভাঙে এলার্ম ঘড়ির শব্দে
সেই যান্ত্রিক জীবন, জীবনের প্রতিটি বাঁকে
ভাবনার পলেস্তারা উঁকি দেয় মনের জানালায়
হারিয়ে যাই শৈশবকালে
মাটির কাছে, সবুজ পাতার কাছে
আপন নিরালায়।
খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান সকল মৌলিক চাহিদা বর্তমান
তবুও শান্তি খুঁজি পাখির কাছে, ফুলের কাছে
অবসর খুঁজি মাটির কাছে।
সুস্থ-সুন্দর জীবন-যাপন করতে চাইলে
ব্যস্ত শহরের কোলাহলে
ভেজাল খাদ্যের ভিড়ে
নিরাপদ সবজি ডাইনিং টেবিলে চাইলে
করতে হবে চাষ পরিবারের সবাই মিলে
ছাদ, বারান্দা কিংবা বসতবাড়ির আঙিনায়।
পরিবারের সঠিক পুষ্টির চাহিদা পূরণে
লালশাক, পালংশাক, বেগুন, টমেটো
লাউ, উচ্ছে, কুমড়া, শশা চাষে
এন্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিনস, মিনারেলস
পুষ্টি ভান্ডার থাকবে বার মাসে
সুস্থ-সবল নতুন প্রজন্মের সন্ধানে।
সবুজ কচি পাতায়, পুষ্পমঞ্জরির শোভা
আত্মতৃপ্তির বহমান ধারা
মাটির গন্ধে মিশে একাকার
কোথায় এমন বসুন্ধরা!
ফুলে-ফুলে মধুকর গুঞ্জন
লোকালয়ে পাখির কলতান
পরম মমতায়, আপন পরিচর্যায়
আমার সুশোভিত সবজি বাগান।
২কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার, টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ, মোবাইল: ০১৭১৯-১৭২৯৫৫, ই-মেইল : aeotungipara.gov@gmail.com
কবিতা, সবজি : অর্থে তুষ্টি দেহে পুষ্টি
কৃষিবিদ আবু হেনা ইকবাল আহমেদ১
ক.
ভাত রুটি চিনি আলু শর্করায় ভরা
মাছ মাংস ডাল ডিমে আমিষ-ই কড়া।
স্বাস্থ্যের সুরক্ষাদানে জরুরি সবজি
খেতে হয় বেশি করে ডুবিয়ে কবজি।
সঠিক পদ্ধতি মেনে সবজি ফলালে
খনিজ ও খাদ্যপ্রাণ দেয় সমতালে।
সবজির পুষ্টিমান জমিতে যা রয়
ধোয়া ও রান্নার ভুলে ঘটে অপচয় ।
উন ভাতে দুন বল সর্বলোকে কয়
যদি বাহারি সবজি সাথে যোগ হয়।
সময় সার ও সেচ বেশি লাগে ধানে
তারচে’ কমে সবজি ঘরে অর্থ আনে।
অর্থে তুষ্টি দেহে পুষ্টি একসাথে পেতে
নিরাপদ সবজির চাষ চাই খেতে।
খ.
ফলন বাড়াতে যেয়ে সবজির খেতে
সার বিষ দেয়া হয় মহানন্দে মেতে।
জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কৃষি রসায়ন
ঘটায় বিপদ সাথে পুষ্টির পতন।
বেশি দিলে ইউরিয়া নাইট্রেট রূপে
মাটি পানি ও শরীরে ক্ষতি করে চুপে।
সব বিষে সব কীট সহজে মরে না
ওই বিষ প্রাণীদেহে ছড়ায় যাতনা।
নিরাপদ কৃষিকাজ জানাটা জরুরি
ইন্টারনেটে এখন তা আছে ভূরি ভূরি।
রয়েছে মাঠের কাছে কৃষিকর্মী যারা
দিতে পারে পরামর্শ ভালো যা-ই তারা।
অর্থ পুষ্টি স্বাস্থ্য তুষ্টি পাবার সুবাদে
রীতিনীতি মানা হোক সবজি আবাদে।
১পরিচালক (অব.), বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, কৃষি মন্ত্রণালয়। মোবাইল: ০১৬১৪৪৪৬১১১;ahiqbal.ahmed@yahoo.com
প্রশ্নোত্তর
কৃষিবিদ মোঃ আবু জাফর আল মুনছুর
কৃষি বিষয়ক
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
মো: আরাফাত হোসেন, উপজেলা : ফরিদগঞ্জ, জেলা : চাঁদপুর
প্রশ্ন: শিমের গায়ে ও পাতায় কালো কালো দাগ এবং এর ফলে কচি শিমের আকার ছোট হয়। এখন করণীয় কী?
উত্তর: এটা একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগে আক্রান্ত গাছ হতে বীজ সংগ্রহ করা যাবে না। জমি পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বারবার একই জমিতে একই ফসল চাষ করা যাবে না। শুকনো আবহাওয়ায় বীজ বপন করতে হবে। বীজ বোনার আগে প্রোভেক্স দ্বারা বীজ শোধন করতে হবে। গাছে রোগের লক্ষণ দেখা গেলে টিল্ট ২৫০ ইসি ০.৫ মিলি বা ডাইথেন-এম ৪৫ ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
আবু বক্কর, উপজেলা : মধুখালী, জেলা : ফরিদপুর
প্রশ্ন: সরিষা ফুলে কালো ছোট ছোট পোকার উপদ্রব হওয়ার জন্য সরিষা হচ্ছে না। প্রতিকার কী?
উত্তর: জাবপোকা সরিষার পাতা, পুষ্পমঞ্জরী, ফুল ও ফল থেকে রস চুষে খায়। ফলে গাছ দুর্বল হয়ে বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। সাধারণত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে ফুল ও ফল আসার সময় আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। আক্রমণ দেখা মাত্র ৫০ গ্রাম নিমবীজ ভেঙে ১ লিটার পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে ২-৩ গ্রাম গুঁড়া সাবান মিশিয়ে ছেঁকে ৭ দিন অন্তর ২ বার ছিটাতে হবে। স্বল্পমেয়াদি জাতে (বারি সরিষা-১৪, ১৫ ও ১৭) নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বপন করলে পোকার আক্রমণ কম হয়। পোকার আক্রমণ বেশি হলে ম্যালথিয়ন ৫৭ ইসি বা এডমায়ার ২০০ এম এল ০.৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে বিকেল ৩ টার পর ১০ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।
মো : শিহাব ম-ল, থানা : আত্রাই, জেলা: নওগাঁ
প্রশ্ন: লাউ গাছ ফেটে রসের মতো বের হয়। লাল লাল আঠার মতো রস বের হচ্ছে। করণীয় কী?
উত্তর : এ রোগ হলে সাধারণত পানি ভেজা দাগ দেখা যায়, কা- ফেঁটে লালচে রঙের আঠার মতো বের হয়। এটা ছত্রাকজনিত একটা রোগ। একে লাউয়ের গামি স্টেম ব্লাটইট বা গ্যামোসিস রোগ বলে। এর প্রতিকার হলো : ক্ষেত থেকে আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলতে হবে। রোগমুক্ত বীজ বা চারা ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত জমি থেকে বীজ রাখবেন না। রোগের আক্রমণ বেশি হলে কপার জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন-সানভিট/ব্লিটক্স/হেমক্সি প্রতি লিটারে ২-৩ গ্রাম মিশিয়ে ৭-১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। এ ছাড়াও মেনকোজেব+মেটালক্সিল জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন-রিডোমিল গোল্ড/মেটারিল/নিউবেন একই নিয়মে ব্যবহার করতে পারেন।
মৎস্য বিষয়ক
মো: নজরুল ইসলাম, গ্রাম: লাউথুতি, উপজেলা: ঠাকুরগাঁও, জেলা: ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন: পুকুরের পানির রঙ সবুজ হয়ে গিয়েছে; কী করব?
উত্তর : সাধারণত পুকুরের পানির রঙ সবুজ হয় অতিরিক্ত খাদ্য বা সার প্রয়োগের কারণে। খাদ্যে অতিরিক্ত আমিষ, ফসফরাস থাকলেও হতে পারে। অতিরিক্ত শেওলার জন্য পানির রঙ ঘন সবুজ হয়ে যায়। ফলে রাতের বেলায় পিএইচ মান বেড়ে যায়। অতিরিক্ত অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে ভোর রাতে মাছ পানির ওপর ভেসে উঠে এবং বেশি সময় ধরে এ অবস্থা চলতে থাকলে মাছ মারা যায়। এ সমস্যা সমাধানে : মাছ খাবি খেলে তাৎক্ষণিকভাবে পুকুরের পানি সরবরাহ করতে হবে। সেই সাথে পুকুরের খাদ্য ও সার প্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে। প্রতি শতকে ৫-৮ গ্রাম গ্রানুলার অক্সিজেন প্রয়োগ করতে হবে। সম্ভব হলে ঘাসের দড়ি দিয়ে চাপিয়ে নিয়ে উঠিয়ে ফেলতে হবে। অথবা সবুজ স্তরের জন্য প্রতি শতকে ১৫ গ্রাম (৩-৫ গভীরতায় তুঁতে পাতলা কাপড়ে ছোট ছোট পুঁটলায় বেঁধে পানি পৃষ্ঠের আধা ফুট নিচে খুঁটির মাধ্যমে বেধে দিতে হবে। তুঁতে প্রয়োগের ৩ দিন পর পুকুরে ২০ কেজি/একর হারে জিওলাইট অথবা প্রতি শতকে ৫০০ গ্রাম পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
প্রাণী বিষয়ক
রীতা রানি মন্ডল, গ্রাম : ভরতখালী সাঘাটা, জেলা : গাইবান্ধা
প্রশ্ন : আমার একটি ক্রস বকনা বাছুর আছে। বয়স ২ বছর। কম খাবার খায় কিন্তু দুর্বল ও পেট অনেক মোটা। এ থেকে প্রতিকার কী?
উত্তর : আপনার বকনা বাছুরের কৃমি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কৃমিনাশক ঔষধ খাওয়াতে হবে। কৃমিনাশক হিসেবে নাইট্রাক্রিনিল গ্রুপের ইনজেকশন প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ ছাড়া রুচি বৃদ্ধির জন্য প্রোবায়োটিক (বায়োগাট/বায়োলাক্স পাউডার ইত্যাদি) সঙ্গে জাইমোভেট পাউডার/ডিজিমিক্স পাউডার খাওয়া যেতে পারে।
কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিবিষয়ক প্রশ্ন কৃষি কল সেন্টার হতে প্রাপ্ত)
কৃষির যে কোন প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান পেতে বাংলাদেশের যে কোন জায়গা থেকে যে কোনো মোবাইল থেকে কল করতে পারেন কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি কল সেন্টার ১৬১২৩ নাম্বারে।
লেখক : তথ্য অফিসার (পিপি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৭১৪১০৪৮৫৩; ই-মেইল : iopp@ais.gov.bd
চৈত্র মাসের কৃষি (১৫ মার্চ-১৩ এপ্রিল)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
আমরা ১৪২৮ বঙ্গাব্দের শেষ মাসে চলে এসেছি। চৈত্র মাসে বসন্ত ঋতু নতুন করে সাজিয়ে দেয় প্রকৃতিকে। চৈতালী হাওয়ায় জানান দেয় গ্রীষ্মের আগমন। রবি ফসল ও গ্রীষ্মকালীন ফসলের প্রয়োজনীয় কাজ করতে বেড়ে যায় কৃষকের ব্যস্ততা। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, বৈশি^ক মহামারি করোনা সচেতনতা নিয়ম মেনে এগিয়ে নিতে হবে এ মাসের কৃষির গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো।
বোরো ধান
যারা শীতের কারণে দেরিতে চারা রোপণ করেছেন তাদের ধানের চারার বয়স ৫০-৫৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ক্ষেতে গুটি ইউরিয়া দিয়ে থাকলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে না। সার দেয়ার আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে। এলাকার জমিতে যদি সালফার ও দস্তা সারের অভাব থাকে এবং জমি তৈরির সময় এ সারগুলো না দেয়া হয়ে থাকে তবে ফসলে পুষ্টির অভাবজনিত লক্ষণ পরীক্ষা করে শতাংশপ্রতি ২৫০ গ্রাম জিপসাম ও ৪০ গ্রাম দস্তা সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ধানের কাইচ থোড় আসা থেকে শুরু করে ধানের দুধ আসা পর্যন্ত ক্ষেতে ৩/৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে। পোকা দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আলোর ফাঁদ পেতে, পোকা ধরার জাল ব্যবহার করে, ক্ষতিকর পোকার ডিমের গাদা নষ্ট করে, উপকারী পোকা সংরক্ষণ করে, ক্ষেতে ডাল-পালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ধানক্ষেত বালাই মুক্ত করতে পারেন। এসব পন্থায় রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা না গেলে শেষ উপায় হিসেবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক বালাইনাশক, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
গম
দেরিতে বপন করা গম পেকে গেলে কেটে অথবা কম্বাইন হারভেস্টার এর মাধ্যমে কেটে মাড়াই, ঝাড়াই করে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। শুকনো বীজ ছায়ায় ঠান্ডা করে প্লাস্টিকের ড্রাম, বিস্কুটের টিন, মাটির কলসি ইত্যাদিতে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
ভুট্টা (রবি)
জমিতে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ গাছের মোচা খড়ের রঙ ধারণ করলে এবং পাতার রং কিছুটা হলদে হলে মোচা সংগ্রহ করতে হবে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে শুকনো আবহাওয়ায় মোচা সংগ্রহ করতে হবে। মোচা থেকে দানা সংগ্রহ করতে প্রয়োজনে ভুট্টা মারাই যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। সংগ্রহ করা মোচা ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে।
ভুট্টা (খরিফ)
গ্রীষ্মকালীন ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এ মাসে বীজ বপন করতে হবে। খরিফ মৌসুমের জন্য ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৭ প্রভৃতি। শতাংশপ্রতি বীজ লাগবে ১০০-১২০ গ্রাম। প্রতি শতাংশ জমিতে ইউরিয়া ৩৬৫ গ্রাম, টিএসপি ২২২ গ্রাম, এমওপি ১২০ গ্রাম, জিপসাম ১৬০ গ্রাম এবং দস্তা সার ১৬ গ্রাম সার দিতে হবে ।
পাট
চৈত্র মাসের শেষ পর্যন্ত পাটের বীজ বপন করা যায়। পাটের ভালো জাতগুলো হলো ফাল্গুনী তোষা ও-৯৮৯৭, বিজেআরআই তোষা পাট-৫, বিজেআরআই তোষা পাট-৮ (রবি-১), বিজেআরআই দেশি পাট-৭, বিজেআরআই দেশি পাট-৮, বিজেআরআই দেশি পাট-৯, সিভিএন-১, বিজেআরআই কেনাফ-২, বিজেআরআই মেস্তা এইচএম-২৪, বিজেআরআই মেস্তা-২। পাট চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করে আড়াআড়িভাবে ৫/৬টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। সারিতে বুনলে প্রতি শতাংশে ২৫ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বুনলে আরেকটু বেশি অর্থাৎ ৩০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। পাটের জমিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার (প্রায় ১ ফুট) এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৭ সেন্টিমিটার (প্রায় ৩ ইঞ্চি) রাখা ভাল। ভাল ফলনের জন্য প্রতি একরে ৭০ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি, ১২ কেজি এমওপি, ১৮ কেজি জিপসাম এবং প্রায় ৪.৫ কেজি জিংকসালফেট সার প্রয়োগ করতে হবে।
অন্যান্য মাঠ ফসল
রবি ফসলের মধ্যে চিনা, কাউন, আলু, মিষ্টি আলু, চিনাবাদাম, পেয়াজ, রসুন যদি এখনো মাঠে থাকে তবে দেরি না করে সাবধানে তুলে ফেলতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে এ সময়ে বা সামান্য পরে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেজন্য পচনশীল ফসল তাড়াতাড়ি কেটে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।
শাকসবজি
গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি চাষ করতে চাইলে এ মাসেই বীজ বপন বা চারা রোপণ শুরু করা প্রয়োজন। সবজি চাষে পর্যাপ্ত জৈবসার ব্যবহার করতে হবে। এ সময় গ্রীষ্মকালীন টমেটো, ঢেঁড়স, বেগুন, করলা, ঝিঙা, ধুন্দুল, চিচিঙ্গা, শসা, ওলকচু, পটোল, কাঁকরোল, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লালশাক, পুঁইশাক এসব সবজি চাষ করতে পারেন ।
গাছপালা
এ সময় বৃষ্টির অভাবে মাটিতে রসের পরিমাণ কমে আসে। এ অবস্থায় গাছের গোড়ায় নিয়মিত পানি দেয়ার ব্যবস্থা করা যায়। আম গাছে হপার পোকার আক্রমণ হলে অনুমোদিত কীটনাশক যেমন- সিমবুস/ফেনম/ডেসিস/ফাইটার ২.৫ ইসি প্রভৃতি প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে হবে। আম গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার পূর্বেই একবার এবং এর একমাস পর আর একবার প্রতি লিটার পানির সাথে ১.০ মিলি সিমবুস/ফেনম/ডেসিস/ ফাইটার ২.৫ ইসি মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপাল ভালোভাবে ভিজিয়ে ¯েপ্র করা প্রয়োজন। এ সময় আমে পাউডারি মিলডিউ ও এ্যান্থ্রাকনোজ রোগ দেখা দিতে পারে। টিল্ট, রিডোমিল গোল্ড, কানজা বা ডায়থেন এম ৪৫ অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। কলা বাগানের পার্শ্ব চারা, মরা পাতা কেটে দিতে হবে। পেঁপের চারা রোপণ করতে পারেন এ মাসে। নার্সারিতে চারা উৎপাদনের জন্য বনজ গাছের বীজ বপন করতে পারেন। যাদের বাঁশ ঝাড় আছে তারা বাঁশ ঝাড়ের গোড়ায় মাটি ও জৈবসার প্রয়োগ করা ভালো।
প্রাণিসম্পদ
শীতকাল শেষ হয়ে গরম পড়ার সময়টিতে পোল্ট্রি খামারি ভাইদের বেশ সতর্ক থাকতে হবে। কারণ শীতকালে মোরগ-মুরগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কমে যায়। সে কারণে এ সময় রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। তাই আগ থেকেই টিকা প্রদানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এ সময় ভিটামিন সি ও ভিটামিন ই এর অভাব দেখা দিতে পারে। সে জন্য খাবারের সাথে ভিটামিন সরবরাহ করতে হবে। চৈত্র মাসে বেশ গরম পড়ে, তাই গবাদিপশুর এ সময় বিশ্রাম দিতে হবে। আপনার গবাদিপশুকে ছায়ায় এবং বেশি বেশি পানি খাওয়াতে হবে, সে সাথে নিয়মিত গোসল করাতে হবে। গবাদিপশুর গলাফুলা, তড়কা, বাদলা রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
মৎস্যসম্পদ
মাছের আঁতুর পুকুর তৈরির কাজ এ মাসে শেষ করতে হবে। পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলে নিচ থেকে পচা কাদা তুলে ফেলতে হবে এবং শতাংশ প্রতি ১ কেজি চুন ও ১০ কেজি গোবর বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করতে হবে। পানি ভর্তি পুকুরে প্রতি শতাংশে ৬ ফুট পানির জন্য ১ কেজি চুন গুলে ঠান্ডা করে দিতে হবে।
সুপ্রিয় পাঠক প্রতি বাংলা মাসে কৃষিকথায় কৃষি কাজের জন্য অনুসরণীয় শিরোনামে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়ে থাকে। এগুলোর বিস্তারিত ও তথ্যবহুল বিশ্লেষণের জন্য আপনার কাছের কৃষি বিশেষজ্ঞ, মৎস্য বিশেষজ্ঞ ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে জেনে নিতে হবে। এ ছাড়া কৃষি বিষয়ক যে কোনো সমস্যায় আপনার মোবাইল থেকে ১৬১২৩ নম্বরে কল করে নিতে পারেন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। আপনাদের সবাইকে নববর্ষের অগ্রিম শুভেচ্ছা। য়
লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা, টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪, মেইল: editor@ais.gov.bd
টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত চারা ব্রোকলি ও বাঁধাকপি চাষ
মো: হুসাইন আহমেদ
এপেক্স বায়োটেক পরীক্ষামূলকভাবে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে ব্রোকলি ও বাঁধাকপির ৫০০টি চারা উৎপাদন করেছে এবং মাঠে চারা রোপণ করা হয়েছে।
টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত চারা বালাইনাশক/ কীটনাশক ব্যবহার করা লাগে না। দ্রুত বর্ধনশীল হয়। ওজন বেশি হয়। অধিক সংখ্যক চারা উৎপাদন করা সম্ভব। মোজাইক ভাইরাস আক্রমণ প্রতিরোধী হয়।
ব্রোকলির জাত পরিচিতি
ব্রোকলি আমাদের দেশে নতুন সবজি। কাজেই এখন পর্যন্ত তেমন কোন ভালো জাত আমাদের দেশে নেই। উন্নত বিশ্বের বেশ কয়েকটি জাত যেমন- প্রিমিয়াম ক্রস, গ্রিন কমেট, জুপিটার প্রভৃতি জাতের ব্রোকলি চাষ করা যায়। লালতীর সিডস লিমিটেড ‘লিডিয়া’ নামে ব্রোকলির একটি জাত বাজারজাত করছে, যা আমাদের দেশের আবহাওয়া উপযোগী। জাতটি দ্রুত বর্ধনশীল, মাঝারি আকৃতির, তাপসহিষ্ণু ও রোগ প্রতিরোধী, দেখতে আকর্ষণীয় ও খেতে সুস্বাদু।
ব্রোকলির বপন/রোপণ প্রযুক্তি
আমাদের দেশের আবহাওয়ায় ব্রোকলি চাষের উত্তম সময় হলো আশ্বিন থেকে পৌষ মাস। চারা রোপণের আগে বিঘাপ্রতি (৩৩ শতক) প্রায় ৫০ গ্রাম বীজ বপন করে বীজতলায় চারা তৈরি করতে হবে। এরপর মূল জমিতে চাষের জন্য বিঘা প্রতি ৬ হাজার চারা রোপণ করতে হবে। প্রায় ৪ থেকে ৫ সপ্তাহ বয়সের চারা সারি থেকে সারি ২২ ইঞ্চি ও চারা থেকে চারা ১.৫ ফুট দূরত্বে রোপণ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। পাশাপাশি দুটি বেডের মাঝে ১ ফুট চওড়া এবং ৬ ইঞ্চি গভীর নালা রাখতে হবে।
ব্রোকলি চাষে সার ব্যবস্থাপনা
ব্রোকলির ভালো ফলন পাওয়ার জন্য প্রতি শতাংশ (ডেসিমাল) জমির জন্য সার প্রয়োগ করতে হবে।
পচা গোবর/কম্পোস্ট ৬০ কেজি, এ ছাড়াও ৭৬০ গ্রাম খৈল প্রয়োগ করা যেতে পারে। টিএসপি ০.৭৬ কেজি, ইউরিয়া ০.৪৫, এমওপি/পটাশ ০.৬১ কেজি, জিপসাম ০.৩২-০.৪ কেজি, দস্তা সার ০.০৫ কেজি, বোরন ০.০৪ কেজি প্রয়োগ করা যেতে পারে যা এলাকা বা মৃত্তিকাভেদে কমবেশি হতে পারে।
উপরোক্ত সার মূল জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে। বিঘাপ্রতি ২ কেজি হারে রুটোন বা অন্য কোন শিকড় বর্ধনকারী হরমোন প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির সময় জিংক ও বোরন না প্রয়োগ করে চারা লাগানোর ২০ থেকে ২৫ দিন পর প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১০ গ্রাম লিবরেল জিংক ও ২০ গ্রাম লিবরেল বোরন একত্রে মিশিয়ে স্প্রে করা যায়। তবে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈবসার ব্যবহার করা উত্তম।
ব্রোকলি সংগ্রহ ও পরবর্তী করণীয়
চারা রোপণের দুই মাসের মধ্যে ব্রোকলির অগ্রীয় প্রোপুষ্পমঞ্জরি খাওয়ার জন্য সংগ্রহ করা যায়। তবে সঠিক মানের জৈব হরমোন ব্যবহার করলে প্রায় ১০ দিন আগে ফসল সংগ্রহ করা যায়। প্রায় তিন ইঞ্চি কা-সহ ধারালো ছুরি দিয়ে ফুল কেটে সংগ্রহ করতে হয়। এর ১০ থেকে ১২ দিন পর পর্যায়ক্রমে বোঁটাসহ কক্ষীয় প্রোপুষ্পমঞ্জরি সংগ্রহ করতে হয়। সঠিক পরিচর্যা করলে বিঘাপ্রতি ৫০-৬৫ মণ ফলন পাওয়া যায়।
বাঁধাকপি
বাঁধাকপি (ঈধননধমব) রবি মৌসুমের একটি প্রধান সবজি ফসল, বৈজ্ঞানিক নাম (ইৎধংংরপধ ড়ষবৎধবধ াধৎ পধঢ়রঃধঃধ)। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই বাঁধাকপি চাষ হয়ে থাকে। এদেশে বাঁধাকপির যে সকল জাতগুলো রয়েছে প্রায় সব হাইব্রিড ও বিদেশি জাত। যে সকল জাতের বাঁধাকপি চাষ করা হয়ে থাকে তার সব জাতের বীজ এদেশে উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। যে সব জাতের বীজ উৎপাদন করা যায় সে জাতগুলো হলো বারি উদ্ভাবিত জাত। বারি বাঁধাকপি-১ (প্রভাতী), বারি বাঁধাকপি-২ (অগ্রদূত), বারি চীনাকপি, ইপসা বাঁধাকপি-১ এসব উন্নত জাত।
প্রতি ১০০ গ্রাম বাঁধাকপিতে ৯১.৯ গ্রাম পানি, ১.৮ গ্রাম আমিষ,০.১ গ্রাম চর্বি, ০.৬ গ্রাম খনিজ, ১.০ গ্রাম আঁশ, ৪.৬ গ্রাম শ্বেতসার রয়েছে। খনিজ লবণের মধ্যে আছে ক্যালসিয়াম ৩৯ মিগ্রা, ম্যাগনেসিয়াম ১০ মিগ্রা, ফসফরাস ৪৪ মিগ্রা, লৌহ ০.৮ মিগ্রা, সোডিয়াম ১৪.১ মিগ্রা, কপার ০.০৮ মিগ্রা ও সালফার ৬৭ মিগ্রা।
বাঁধাকপি উৎপাদন প্রযুক্তি : আগাম জাতের জন্য শ্রাবণ-ভাদ্র থেকে ভাদ্র-আশ্বিন, মধ্যম আশ্বিন-কার্তিক, কার্তিক-অগ্রহায়ণ এবং নাবি জাতের জন্য অগ্রহায়ণ-মধ্য পৌষ থেকে পৌষ-মধ্য মাঘ। গভীরভাবে ৪-৫টি চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে তৈরি করতে হবে। বীজ বপনের ৩০-৩৫ দিন পর বা ৫/৬টি পাতা বিশিষ্ট ১০-১৫ সেন্টিমিটার লম্বা চারা সাধারণত বিকেল বেলা জমিতে রোপণ করতে হয়। তবে সুস্থ ও সবল হলে চারা এক-দেড় মাস বয়সের চারা রোপণ করা যায়। রোপণের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৪ ইঞ্চি এবং প্রতি সারিতে চারা থেকে চারার দূরত্ব ১৮ ইঞ্চি দিলে ভালো হয়। এ হিসেবে প্রতি শতকে ১৫০টির মতো চারার প্রয়োজন হয়। আঙ্গিনায় ৫ মিটার লম্বা একটা বেডের জন্য ২০-২২টি চারার প্রয়োজন হয়। বেডে দুই সারিতে চারাগুলো লাগাতে হবে। আঙ্গিনায় লাগানোর জন্য যেহেতু কম চারার দরকার হয় সেজন্য কোন বিশ্বস্ত-নার্সারি থেকে চারা কিনে লাগানো ভালো। তবে একটা বেডে বাঁধাকপির চারা তৈরি করে অল্পদিনের মধ্যেই তা বিক্রি করে যেমন অধিক লাভবান হওয়া যায় তেমনি নিজের প্রয়োজনও মেটানো যায়। জাতভেদে শতকপ্রতি ১.৫-২ গ্রাম বীজের প্রয়োজন।
সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা
শতকপ্রতি কম্পোস্ট সার ১২৫ কেজি, ইউরিয়া ১ কেজি, টিএসপি ০.৮ কেজি, পটাশ ০.৬ কেজি। সম্পূর্ণ গোবর ও টি এসপি সার জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া ও এমওপি সার ২ কিস্তিতে চারা রোপণের ২০ থেকে ২৫ দিন পর একবার এবং ৩০-৪০ দিন পর আর একবার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সার দেওয়ার পরপর হালকা সেচ দিতে হবে। বাঁধাকপি গাছের সারির মাঝে সার দেয়ার পর সারির মাঝখানের মাটি তুলে দুইপাশ থেকে গাছের গোড়ায় টেনে দিন। এতে সেচ ও নিকাশের সুবিধা হয়। খেয়াল রাখতে হবে জমিতে যেন পানি বেশি সময় ধরে জমে না থাকে।
আন্তঃপরিচর্যা : নিয়মিত জমি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সেচ ও সার দেবার পর জো আসা মাত্র নিড়িয়ে আগাছা বাছাই করা প্রয়োজন। চারা গজানোর ২০-২৫ দিন পর আগাছা দমন করতে হবে। গাছ খুব ঘন থাকলে পাতলা করে দিতে হবে। চারা অবস্থা থেকে রসুন গঠনের পূর্ব পর্যন্ত ২ থেকে ৩ বার নিড়ানি দিয়ে জমির আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। অতি বৃষ্টির কারণে জমিতে পানি বেশি জমে গেলে নালা তৈরি করে তাড়াতাড়ি পানি সরানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
পোকামাকড় : কপির লেদাপোকা-সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমন ওস্তদ ২০ মিলিলিটার অথবা ম্যাজিক অথবা কট ১০ মিলিলিটার) প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০-১২ দিন পরপর ২/৩ বার। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
কপির কাটুইপোকা আক্রমণ বেশি হলে কারটাপ জাতীয় কীটনাশক (কেয়ার ৫০ এসপি অথবা সানটাপ ৫০ এসপি ২০ মিলি/৪ মুখ) অথবা ল্যামডা-সাইহ্যালোথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (ক্যারাটে ২.৫ ইসি অথবা ফাইটার প্লাস ২.৫ ইসি ১৫ মিলি/ ৩ মূখ) ১০ লিটার প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পরপর ২/৩ বার। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। জাবপোকা দমনে সাদা রং এর আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করা প্রয়োজন। আক্রমণ বেশি হলে ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক (যেমন এডমায়ার অথবা টিডো ৭-১০ মিলিলিটার/২মুখ) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পরপর ২/৩ বার। ওষুধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
রোগবালাই : মোজাইক ভাইরাস রোগ জমিতে সাদা মাছি দেখা গেলে (বাহক পোকা) ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক (যেমন- এডমায়ার অথবা টিডো ১০ মিলি. ২ মুখ) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে। বাঁধাকপির অল্টারনারিয়া জনিত পাতার দাগ রোগ- ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক (যেমন: রিডোমিল গোল্ড ২০ গ্রাম) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সবজি বিষাক্ত থাকবে। গোড়া পচা রোগ/ ডেমপিং অফ- কার্বেন্ডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন : এমকোজিম ৫০; অথবা গোল্ডাজিম ৫০০ ইসি ১০ মিলি/ ২ মুখ ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭ দিন পরপর ৩ বার গাছের গোড়ায় ও মাটিতে স্প্রে করুন। আক্রমণ বেশি হলে প্রথম থেকে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম রোভরাল মিশিয়ে স্প্রে করুন।
সতর্কতা : বালাইনাশক/কীটনাশক ব্যবহারের আগে বোতল বা প্যাকেটের গায়ের লেবেল ভালো করে পড়া প্রয়োজন এবং নির্দেশাবলি মেনে চলতে হবে। ব্যবহারের সময় নিরাপত্তা পোশাক পরিধান করতে হবে। ব্যবহারের সময় ধূমপান এবং পানাহার করা যাবে না। বালাইনাশক ছিটানো জমির পানি যাতে মুক্ত জলাশয়ে না মেশে তা লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। বালাইনাশক প্রয়োগ করা জমির ফসল কমপক্ষে সাত থেকে ১৫ দিন পর বাজারজাত করতে হবে।
ফল জাতভেদে শতকপ্রতি ফলন ১৫০-১৮০ কেজি হয়ে থাকে। ছায়ায় সংরক্ষণ করা ভালো। মাঝে মাঝে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। বেশি দিন সংরক্ষণ এর জন্য হিমাগারে রাখতে হবে। এই বছর টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত ব্রোকলি ও বাঁধাকপির চারা প্রদর্শনী মাঠ ভালো ফলাফল পাওয়ায় আগামী বছর থেকে কৃষকদের ব্রোকলি ও বাঁধাকপির চারা দেওয়া হবে। য়
লেখক : সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, এপেক্স বায়োটেক, বায়োটেকনোলজি বিভাগ (টিস্যু কালচার), গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা। মোবাইল: ০১৭৪২-০৪৬৭৭০।