উত্তরাঞ্চলে অর্থকরী ফসল কফি চাষের প্রেক্ষিত ও সম্ভাবনা
কৃষিবিদ ড. মুহ: রেজাউল ইসলাম১ কৃষিবিদ মো: রাসেল সরকার২
কফি এক ধরনের বেরী (ইবৎৎু) জাতীয় ফল যার বীজ থেকে তৈরি হয় পানীয় কফি। সারাবিশে^ প্রচলিত উষ্ণ পানীয়ের মধ্যে চা এবং কফির জনপ্রিয়তাই সর্বাধিক। চায়ের জনপ্রিয়তা দক্ষিণ এশিয়াসহ গোটা প্রাচ্যে সর্বাধিক কিন্তু কফির জনপ্রিয়তা ও চাহিদা আমেরিকা, ইউরোপ গোটা আরববিশ^সহ প্রায় সমগ্র বিশে^। ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈড়ভভবব ঙৎমধহরুধঃরড়হ এর তথ্যমতে, সারাবিশে^ ১০.৪০ মিলিয়ন টন কফি উৎপাদন হয় এবং মোট উৎপাদিত কফির ৩৫% ব্রাজিলে উৎপন্ন হয়ে থাকে। পেট্রোলিয়ামের পরপরই বিশে^ সবচেয়ে বেশি বিক্রীত পণ্য হচ্ছে কফি। বর্তমানে সমগ্রবিশে^ দৈনিক ২২৫ কোটি কাপ কফি পান করা হয় এবং প্রতি বছর ৫.৫% হারে কফির আন্তর্জাতিক বাজার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক কফি অর্গানাইজেশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর ১ অক্টোবর বিশ^ব্যাপী কফি দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। ১৯৮৩ সালে মান্না দে’র গাওয়া “কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই”- গানটি এপার-ওপার দুই বাংলায় পানীয় হিসেবে কফিকে সুপরিচিত এবং জনপ্রিয় করে তোলে। বিগত এক দশকে বাংলাদেশে কফির চাহিদা অনেক বেড়েছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ৮৫৫ টন কফি আমদানি করা হয় । বর্তমানে দেশে বার্ষিক কফির চাহিদা প্রতি বছর প্রায় ১০-১২% হারে বাড়ছে। কফি বর্তমানে আমাদের শহুরে কালচারের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
উদ্ভিদতাত্তি¡ক পরিচিতি
কফি জঁনরধপবধব পরিবারভুক্ত একটি চিরহরিৎ, গুল্মজাতীয় ও বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। ঈড়ভভবব গণের অনেকগুলো প্রজাতি রয়েছে যার মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে প্রধানত দুটি প্রজাতির চাষাবাদ করা হয়। একটি ঈড়ভভবধ পধহবঢ়যড়ৎধ যা রোবাস্টা নামে পরিচিত, অন্যটি ঈড়ভভবধ অৎধনরপধ যা অ্যারাবিকা কফি নামে পরিচিত। দুটো প্রধান প্রজাতিরই উৎপত্তিস্থল আফ্রিকা। এ ছাড়াও আমাদের উপমহাদেশে কফির একপ্রকার প্রজাতি আছে যা “বাংলা কফি” (ঈড়ভভবধ নবহমধষবহংরং) নামে পরিচিত। ভারতের আসাম, হিমালয়, উত্তরাখÐ, উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার প্রভৃতি এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে রাস্তার ধারে কিংবা বনে-জঙ্গলে দেখতে পাওয়া যায়।
গাঢ় সবুজ রঙের ডিম্বাকৃতি পত্রবিশিষ্ট কফি গাছে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা রঙের মৃদু সুগন্ধি ফুল ফুটে যা কয়েক দিনের মধ্যেই ফলে পরিণত হয় এবং সবুজ ফলগুলো পাকলে শুরুতে হলুদাভ ও পরে গাঢ় লাল বর্ণ ধারণ করে। সাধারণত অ্যারাবিকা জাতের কফি ফল পাকতে ৬-৮ মাস সময় লাগে, অপর দিকে রোবাস্টা জাতের কফি ৯-১১ মাস পর্যন্ত সময় নেয়। গাছ লম্বায় প্রায় ২৫-৩০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতাবিশিষ্ট হতে পারে। ফল সংগ্রের সুবিধার্থে কফি গাছের ডালপালা ছাঁটাই করে সর্বোচ্চ ২ মিটার পর্যন্ত উঁচু রাখা হয়। একটি কফি গাছ থেকে প্রায় ২৫-৩০ বছর ধরে ফল পাওয়া যায়। কফি গাছের বংশবিস্তার মূলত বীজ দিয়েই হয়ে থাকে। চারা রোপণের প্রায় ২ বছরের মধ্যেই কফির ফল সংগ্রহ করা যায়।
পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা
কফির মূল উপাদান ক্যাফেইন ছাড়াও ভিটামিন বি১, ভিটামিন বি২, ভিটামিন বি৫, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম এবং সামান্য প্রোটিন থাকে। অ্যারাবিকার তুলনায় রোবাস্টা কফিতে ৪০-৫০% বেশি ক্যাফেইন বিদ্যমান থাকে যার ফলে এতে তিক্ততার পরিমাণ বেশি এবং তুলনামূলক কম সুগন্ধযুক্ত। অ্যারাবিকায় ক্যাফেইনের মাত্রা অল্প থাকায় এর তিক্ততা কম কিন্তু সুমিষ্ট গন্ধযুক্ত এবং স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় ফলে এর জনপ্রিয়তা অধিক। বর্তমানে সারাবিশে^ প্রায় ৭০টিরও বেশি দেশে কফির চাষ হচ্ছে যার দুই-তৃতীয়াংশই অ্যারাবিকা জাতের কফি। নিয়মিত এবং পরিমিত পরিমাণে কফি পান হৃৎপিÐের গতি বাড়ায় ফলে শরীরে উদ্যম ও উৎসাহ তৈরি হয়। কফি ডায়াবেটিসসহ কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করে। এছাড়া, আলঝেইমার (স্মৃতিভ্রংশ) রোগ প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখে। কফিতে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে যা আমাদের শরীর থেকে নানা ধরনের ক্ষতিকর টক্সিক পদার্থ বের করে লিভারকে সুরক্ষিত রাখে।
কফি চাষের উপযোগিতা
কফি চাষের জন্য উষ্ণ (২০-৩০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা) ও আর্দ্র জলবায়ু এবং বার্ষিক ১৫০-২০০ সেমি. বৃষ্টিপাত উপযুক্ত। কুয়াশা ও আর্দ্রতা কফি গাছের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তবে ফল পাকার সময় শুষ্ক আবহাওয়া প্রয়োজন। মৃদু অ¤øধর্মী (পিএইচ ৫.৫-৬.৫) এবং লৌহ, পটাশ, নাইট্রোজেন ও জৈবসমৃদ্ধ উর্বর লালচে দো-আঁশ মাটি কফি চাষের পক্ষে আদর্শ। সাধারণত ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের ঢালে ঢালে কফি চাষ করা হয়। এইসব ঢালে সূর্যের কিরণ তির্যকভাবে পড়ে বিধায় ছায়া প্রদানকারী গাছ লাগানোর প্রয়োজন হয় না। তবে সমতলে চাষাবাদ করা হলে তীব্র সূর্যালোকের হাত থেকে কফি গাছকে রক্ষার জন্য বাগানের মধ্যে ছায়া প্রদানকারী যেমন- ইপিল-ইপিল, একাশিয়া, কলা প্রভৃতি গাছ লাগানো যায়।
বাংলাদেশে কফি চাষের প্রেক্ষাপট
কয়েক দশক পূর্বেও ভিয়েতনামে কোন কফি চাষ হতো না, কিন্তু বর্তমানে ভিয়েতনাম বিশে^র ২য় সর্বোচ্চ কফি উৎপাদনকারী দেশ। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ কফি বেল্টের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এখানকার আবহাওয়া ও জলবায়ু কফি চাষের উপযুক্ত। এ ছাড়াও দিন দিন কফির চাহিদা ও জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় এই অঞ্চলের অনেক দেশেই বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ১২৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় পার্বত্য জেলাগুলোতে কফি চাষ শুরু করে। খাগড়াছড়িতে ৮টি উপজেলায় ১৩৫০ একর জমিতে ২০,০০০ কফি চারা রোপণ করা হয়। ২০০১ সালের দিকে খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে কফি চাষ আরম্ভ হয় যা ইতোমধ্যেই সাফল্যের মুখ দেখছে। ২০১১ সালে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় একটি বেসরকারি সংস্থা ৫০০ চারা দিয়ে কফি চাষ শুরু করে এবং বর্তমানে মোট গাছের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার। কয়েক বছর পূর্বে সিলেট, মৌলভীবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠিত চা বাগানগুলোতে রাবার চাষে সরকারি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় এবং দেশে কফির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বিবেচনা করে অনেকে কফি চাষের দিকে ঝুঁকছেন। মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার মথিউরা চা বাগানের ৪৪ একর জায়গায় ১০,০০০ কফি চারা রোপণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও, টাঙ্গাইলের মধুপুরে কফির চাষ হচ্ছে।
উত্তরাঞ্চলে কফি চাষ
২০০৯ সালের দিকে নীলফামারী জেলার কৃষক আবদুল কুদ্দুসের হাত ধরে উত্তরবঙ্গে কফি চাষের যাত্রা শুরু হয় । কফি চাষের সম্ভাবনা ও প্রাপ্তি সম্পর্কে আবদুল কুদ্দুস জানান যে. ২০০৯ সালে ঢাকায় নার্সারি সমিতির সভায় গিয়ে প্রথম কফি চারার খবর পাই। ২০১৪ সালে কক্সবাজারের জাহানারা অ্যাগ্রো থেকে ১৫০টি গাছ এনে তিনি তার নার্সারির দুই শতক জমির মধ্যে তিন ফুট পর পর চারা রোপণ করেন। এ নার্সারি ব্যবসায়ী ও কৃষক জানান, শুধু কিশোরগঞ্জ নয়, পুরো উত্তরাঞ্চলে কফি চাষ করা সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন সরকার ও কৃষি বিভাগের কার্যকরি উদ্যোগ। তাহলে কফি চাষ বাণিজ্যিকভাবে শুরু করা সম্ভব। এতে দেশের গন্ডি পেরিয়ে কফি আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ করা যেতে পারে। এতে স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠবে। পরবর্তীতে নীলফামারীর আরও তিনটি উপজেলায় এবং রংপুরের তারাগঞ্জে কফি চাষ ছড়িয়ে পড়ে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে নীলফামারী জেলায় বেশ কিছু কফি বাগান সৃজনের কাজ শুরু হয়েছে।
উত্তরাঞ্চলে কফি চাষের সম্ভাবনা
মৃত্তিকা গবেষণা উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (ঝজউও) এর তথ্য মতে, সমগ্র উত্তরবঙ্গ, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের প্রায় সবকটি জেলা এবং ঢাকা বিভাগের অধিকাংশ জেলার মাটি সামান্য অ¤øধর্মী হওয়ায় তা কফি চাষের অনুক‚ল। উত্তরাঞ্চলের বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত বরেন্দ্রভূমি এবং মধুপুর ও ভাওয়াল গড়ের লালচে মাটি যথেষ্ট লৌহ, পটাশ, নাইট্রোজেনসমৃদ্ধ যা কফি চাষের পক্ষে আদর্শ। এ ছাড়াও তিস্তা অববাহিকায় অবস্থিত উত্তরের জেলাগুলোতে মাটি ঈষৎ অ¤øধর্মী হওয়ায় তা কফি চাষে সহায়ক। আবহাওয়া ও মৃত্তিকাগত সম্ভাবনা ছাড়াও এদেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে : (১) উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো এখনো যথেষ্ট শিল্পসমৃদ্ধ না হওয়ায় প্রচুর নারী শ্রমিক পাওয়া যায়। (২)আংশিক ছায়াযুক্ত বসতবাড়ির আশেপাশে পতিত জমিতে, রাস্তার পাশে, রেললাইনের ধারে, কফি গাছ লাগানোর সুযোগ রয়েছে। (৩) সামাজিক বনায়নের অংশ হিসেবে বিভিন্ন পতিত জমি, সরকারি খাসজমিতে কফি সম্প্রসারণের মাধ্যমে বার্ষিক আয়ের সুযোগ রয়েছে। (৪) কফি গাছ ছোট থাকা অবস্থায় বাগানের মধ্যে সাথী মিশ্র ফলন হিসেবে আদা, হলুদ প্রভৃতি মসলাজাতীয় ফসল চাষ করা যেতে পারে। (৫) উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্রভূমিসহ অনেক জায়গা এখনো পতিত অবস্থায় কিংবা এক ফসলি জমি হিসেবে শস্যবিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব জমির সর্বোচ্চ ব্যবস্থায় নিশ্চিত করতে কফি চাষ সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। (৬) একেকটি কফি গাছে যে পরিমাণ ফুল আসে তাতে গাছ প্রতি ১০০ গ্রাম মধু সংগ্রহ করা যায়। (৭) বীজ ও মধু ছাড়াও কফি গাছের অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে শ্যাম্পুও তৈরি করা সম্ভব।
দেশে কফির চাহিদা যে হারে বাড়ছে সেই হারে কফি উৎপাদন হচ্ছে না বিধায় প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে কফি আমদানি করতে হয়। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের কফি আমদানি ব্যয় ছিল ৯৩৮০০ মার্কিন ডলার যা বিগত বছরের তুলনায় প্রায় ২২.৮% বেশী। দেশে কফির উৎপাদন বাড়িয়ে এবং আমদানী নির্ভরতা কমিয়ে দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব। এক্ষেত্রে কফি চাষের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে কৃষি বিজ্ঞানীদের সুপারিশ অনুযায়ী অঞ্চল বাছাইপূর্বক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের সময়োপযোগী নানান উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ আর সঠিক কর্মপরিকল্পনায় দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং পাশাপাশি পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে। সঠিক পরিকল্পনা এবং যথাযথ বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশে কফি চাষ সম্প্রসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে তা নতুন অর্থকরী ফসল হিসেবে এদেশে তথা উত্তরাঞ্চলে সম্ভাবনার নব দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।য়
১আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রংপুর অঞ্চল, মোইল : ০১৭১৬৬৯৭১৯৬ ই-মেইল : ৎবুধঁ১০১৭১৬৬@মসধরষ.পড়স
২কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার, তারাগঞ্জ, রংপুর, মোবাইল : ০১৭১৭৪৫২৫৩৩
কম্বাইন হারভেস্টারের নিরাপদ সংরক্ষণ ও দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহার
ড. মোহাম্মদ এরশাদুল হক
সুচিন্তিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও তার সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষিকে লাভজনক ও রিস্ক ফ্রি করা যায়। বর্তমান করোনাভাইরাস জনিত আপদকালীন সময়ে কৃষি ক্ষেত্রে সদাশয় সরকারের ২০০ কোটি টাকা উন্নয়ন সহায়তা প্রধান খাদ্যশস্য বোরো ধান সংগ্রহকে করেছে নিশ্চিত, লাভজনক ও নিরাপদ। কৃষকদের বিনিয়োগ ও সরকারের সহায়তা দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই করতে প্রয়োজন হারভেস্টার যন্ত্রগুলোর সঠিক যতœ ও রক্ষণাবেক্ষণ। ২০১৫ সালে দেশে শস্য কাটার ক্ষেত্রে মাত্র ১% যান্ত্রিকীকরণ লক্ষ্য করা গেলেও কৃষি মন্ত্রণালয়ের রোডম্যাপ অনুযায়ী আগামী ২০২১ সাল নাগাদ দেশের ফসল কর্তনে যান্ত্রিকীকরণ ৩০% এ উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রণোদনাসহ আগামী পাঁচ বছরে আরো ১৫৫০০টি কম্বাইন হারভেস্টার প্রদানসহ নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করছে। আমরা জানি, প্রচলিত পদ্ধতিতে হাতে কাটা-মাড়াই করতে এক একর জমির জন্য ১৮-২৫ জন শ্রমিকের প্রয়াজন হয়। এ ছাড়া বোরো মৌসুমে ধান ছাড়াও যেমন গম, ভুট্টা, আলু, সবজি ও ফলও সংগ্রহ করতে হয়। ফলে বোরো সংগ্রহের সময়টিতে বিশেষ করে ধান সংগ্রহে চোখে পড়ার মতো কৃষি শ্রমিকের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। এই শ্রমিক সমস্যা সমাধানে কম্বাইন হারভেস্টার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
ছোট ও কম দামি কম্বাইন নিয়ে এ দেশে কম্বাইনের মাঠ পর্যায়ে যাত্রা শুরু হয়। সে পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যান্ডের এক হাজারের উপরে কম্বাইন মাঠে রয়েছে। হারভেস্টারগুলোর ২৫-৩০ ভাগ জীবনকাল কমেছে নতুন হারভেস্টারের প্রথম লোড দেয়ার নীতিমালা না মানা ও প্রথম সার্ভিসিং (৫০ ঘণ্টা পর) না করার কারণে; ৩৫-৪০ ভাগ জীবনকাল হারিয়েছে সংরক্ষণকালীন নিয়ম না মানার ফলে আর ৩০-৪০ ভাগ হারভেস্টার কর্মক্ষমতা হারিয়েছে স্পেয়ার পার্টসের অভাবে। অর্থাৎ মানসম্পন্ন যন্ত্র, প্রশিক্ষিত চালক ও স্পোয়ার পার্টসসহ ক্রমাগত কারিগরি সহায়তা না হলে হারভেস্টার তার অর্থনৈতিক লাইফ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। আমাদের দেশে প্রধানত দুই ধরনের কম্বাইন হারভেস্টার রয়েছেঃ ১) হোল ফিডটাইপ যেখানে খড় সহ আস্ত ধান গাছটিই যন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করে বিধায় খড় কেটে যায় ২) হেড ফিডটাইপ যেখানে শুধু ধানের শীষ যন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করে বিধায় খড় আস্ত থাকে। হোল ফিড সিসটেম চালানো সহজ ও সমস্যাও কম হয় কিন্তু আমাদের দেশে ধানের খড়ের নানাবিধ ব্যবহার ও বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে বিধায় হেড ফিড সিসটেম বেশি জনপ্রিয়। সরকারের উন্নয়ন সহায়তায় বিশ^মানের ইয়ানমার, কুবোতা, ডেডং, ওয়ার্ল্ড, লাকি স্টার, সাইফেং এর মত ব্রান্ডকে নির্বাচন করা হয়েছে ।
কম্বাইন হারভেস্টার একটি উচ্চ প্রযুক্তির নলেজ বেইজড মেশিন যেখানে যন্ত্রের পাশাপাশি যন্ত্রচালককেও দক্ষ ও জ্ঞান সম্পন্ন হতে হয়। কারন ধানের জাত, ঘনত্ব, ধান খাড়া কিংবা হেলানো এসব অবস্থায় যন্ত্রের বিভিন্ন অংশের সেটিংস পরিবর্তন করতে হয়। শুকনো ধান ক্ষেতে যে গতিতে যন্ত্র চালনা করা যায় বৃষ্টি পরবর্তী ভেজা ক্ষেতে যন্ত্র চালনার গতি কমাতে হয় ও বিশেষ খেয়াল রাখতে হয় যাতে থ্রেসিং চেম্বারে জ্যাম না লাগে। যন্ত্র সরবরাহকালীন সময়ে সাধারণত বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান সব ইঞ্জিন অয়েল, গিয়ার অয়েল ও হাইড্রোলিক অয়েল সরবরাহ করে থাকে। যন্ত্রগুলো চালনার প্রথম ৫০ ঘণ্টার যতœ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নো লোড ও হাফ লোডে প্রত্যেক গিয়ারে ৪ ঘণ্টা করে চালিয়ে তারপর ফুল লোডে চালাতে হবে এবং প্রথম ৫০ ঘণ্টা চালনা পূর্ণ হলে সকল অয়েল ফেলে দিতে হয়। এসময় খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, অয়েলগুলোর সাথে লোহার কুচি ও নানা অপদ্রব্য বের হয়ে আসছে। এরপর নিয়মিত (১৫০-২০০ ঘণ্টা) বিরতিতে কম্বাইন হারভেস্টারে লুব্রিকেন্ট চেক করা ও ঘাটতি পূরণ করা খুবই জরুরি কেননা এটা যন্ত্রের রক্তের মতো কাজ করে। ধানের ক্ষেতে পার্চিং এর খুটি বা অন্য কোন খুটি/ধাতব দÐ আছে কি-না। এ বিষয়গুলো নিশ্চিত হয়ে মাঠে নামতে হবে। সাধারণত যন্ত্রের সাথে সরবরাহকৃত ম্যানুয়ালে এসব লেখা থাকে। যন্ত্র পরিচালনার সুবিধার্থে বাংলায় ব্যবহারবিধি বা ম্যানুয়াল সরবরাহের উদ্যোগ নিতে হবে। উন্নত হারভেস্টারগুলোর ড্যাস বোর্ডে কতগুলো মিটার আছে এবং কতগুলো সিগনাল লাইট জ¦লে। এসব মিটার ও সিগনাল লাইট সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা চালকের অবশ্যই ধাকতে হবে। কতগুলো হারভেস্টারে নিরাপত্তার জন্য চালককে সহায়তা করতে সেন্সর যুক্ত করা হয়েছে কিন্তু সেন্সরগুলো কখন কী সিগনাল দিচ্ছে তা সম্পর্কে ধারণা না থাকলে দুর্ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক নয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগ এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি প্রকৌশলী ও তাদের প্রশিক্ষণ সুবিধাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। সাম্প্রতিক গুরুত্ব বিবেচনায় গণমাধ্যম বিশেষ করে টিভি চ্যানেলগুলোতে এ যন্ত্র চালনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্ভাব্য সমস্যার তথ্যভিত্তিক প্রামাণ্য চিত্র এবং অভিজ্ঞ কৃষি প্রকৌশলীর মাধ্যমে অনলাইন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
সংরক্ষণকালে ব্যবস্থাপনা
কম্বাইন হারভেস্টারের ব্যবহারের পর যখন প্রায় ৪-৫ মাস যন্ত্রগুলোর কোন কাজ থাকবে না তখন প্রত্যেক যন্ত্রের জন্য স্বল্পখরচের হলেও সংরক্ষণাগার তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। সংরক্ষণাগারে রাখার পূর্বে কয়েকটি কাজ করতে হবে যথাঃ ১) হারভেস্টারের বাইরের অংশ ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে যাতে কোন কাঁদা ও মবিল গায়ে লেগে না থাকে; ২) কুলার সিটেমের রাবার ট্র্যাকের কাদা পরিষ্কার করতে কোন ধরনের ধারালো বা মেটালিক বস্তু ব্যবহার করা যাবে না; ৩) থ্রেসিং সিলিন্ডার, ভাইব্রেশন চালুনি, অগার ও সাইড কভার খুলে ভেতরকার সকল শস্য (ধান) ও খড় বের করে পরিষ্কার করতে হবে; ৪) সংরক্ষণের সময় অগারের মুখ, গ্রেইন ট্যাংকের মুখ ও অন্যান্য ছিদ্র পুরাতন সুতি কাপড় দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে; ৫) হাইড্রোলিক অয়েল, গিয়ার অয়েল, ইঞ্জিন অয়েল ও অন্যান্য লুব অয়েল চেক করতে হবে, মান হারালে পরিবর্তন বা প্রয়োজনে পরিপূর্ণ করতে হবে; ৬) রেডিয়েটর চেক করতে হবে ও কোলেন্ট অর্থাৎ ভালো মানের পরিষ্কার পানি দ্বারা পূর্ণ করতে হবে; ৭) ইলেক্ট্রিক লাইন চেক করতে হবে ও প্রয়োজনে মেরামত করতে হবে যাতে কোনোভাবেই বডি আর্থিং বা লিক না থাকে; ৮) সকল চেইন, বিয়ারিং, কাটারবার ও অন্যান্য চলমান অংশে লুব্রিকেন্ট দিতে হবে; ৯) সম্ভব হলে পুরো হারভেস্টারে মরিচা প্রতিরোধী জেল মাখিয়ে রাখতে হবে; ১০) সকল গ্রিজিং পয়েন্টে ভালো মানের গ্রিজ ব্যবহার করে রাখতে হবে, নিম্নমানের গ্রীজ ভালোর চেয়ে ক্ষতি বেশি করবে; ১১) সকল বেল্ট টেনশন চেক করতে হবে; ১২) হারভেস্টারের সকল নাট-বোল্ট টাইট দিতে হবে; ১৩) এয়ার ক্লিনার ফিল্টার, ফুয়েল ফিল্টার ও হাইড্রলিক ফিল্টার চেক করে পরিষ্কার বা মানসম্মত নতুন ফিল্টার দিয়ে বদল করতে হবে; ১৪) কাটারবার অংশটি ও রিল সিস্টেমের রিলটি ইটের ফ্লোরের ত্রিপল বিছিয়ে এর উপর নামিয়ে রাখতে হবে। অত:পর হারভেস্টারকে একটি সংরক্ষিত উঁচু ও ইট বিছানো কক্ষে সংরক্ষণ করতে হবে। হারভেস্টারটি একটি বড় ত্রিপাল বা প্লাস্টিক কভার দ্বারা ঢেকে রাখতে হবে।
সংরক্ষণকালে কয়েকটি কাজ নিয়মিত করতে হবে যথাঃ ১) প্রতি ৭-১০ দিনে হারভেস্টার বের করে স্টার্ট দিয়ে কমপক্ষে ১০ মিনিট চালাতে হবে। অন্যথায় এর ব্যাটারি, ইলেক্ট্রিক সিস্টেম ও ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হবে; অল্প সময় চালালে প্রতিবার চালনার পরে ব্যাটারির কালো টার্মিনালটি খুলে রাখতে হবে ও স্টার্টের আগে লাগিয়ে নিতে হবে; ২) ইঁদুর যাতে ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য ইঁদুর মারার বিষটোপ বা গ্যাস ট্যাবলেট ব্যবহার করতে হবে, মনে রাখতে হবে বর্তমান হারভেস্টারগুলোর ইলেক্ট্রিক সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্থ হলে ওয়ারেন্টি পাওয়া যাবে না এবং কোন কোন ক্ষেত্রে মেরামত করাও কষ্টকর; ৩) কোনভাবেই সংরক্ষণাগারে হারভেস্টারে যাতে পানি প্রবেশ না করে কেননা পানি মেটালে মরিচা ধরায়, বিয়ারিং নষ্ট করে, কাটারবারের কার্যক্ষমতা কমায়।
কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহারের পূর্বে করণীয়
প্রত্যেক চালক মাঠে নামার আগে নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। হারভেস্টারগুলো মাঠে নামানোর পূর্বে আবারো কিছু বিষয় নিশ্চিত হতে হবে; যথাঃ ১) হারভেস্টার ভালো ভাবে পরিষ্কার করে সকল চলমান অংশে লুব্রিকেটিং অয়েল ও গ্রিজ সরবরাহ করতে হবে; ২) ফুয়েল ট্যাংক, রেডিয়েটর ট্যাংক, লুব অয়েল সাম ও হাইড্রলিক ট্যাংক পরীক্ষা করে দেখে ট্যাংক পরিমাণমতো পূর্ণ করতে হবে এবং এদের সংশ্লিষ্ট লাইন চেকআপ করতে হবে; ৩) সকল ফিল্টার পরিষ্কার বা পরিবর্তন করতে হবে; ৪) সকল চেইন ও বেল্টের টান পরীক্ষা করতে হবে; ৫) ব্যাটারি টার্মিনাল সংযোগ দিয়ে প্রত্যেক ইলেকট্রিক লাইনের সংযোগ ও ব্যাটারিসহ অন্যান্য সকল সিগনালের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখতে হবে; ৬) অগার, গ্রেইন ট্যাংকের মুখ ও অন্যান্য ছিদ্র যে কাপড় দিয়ে বন্ধ ছিল তা খুলে দিতে হবে; ৭) ফুয়েল পাম্প, হাইড্রোলিক পাম্প ও অয়েল পাম্পের কার্যকারিতা ঠিক করে নিতে হবে; কাটার বারের বেøডগুলোর মধ্যেকার নির্ধারিত ফাঁক চেক করতে হবে ও প্রয়োজনীয় লুব্রিকেন্ট দিতে হবে; ৮) কোন রকম লোড ছাড়া আইডল অবস্থায় স্টার্ট দিয়ে ইঞ্জিন ও হারভেস্টারের বিভিন্ন অংশ কাজ করছে কি না তা পরখ করে নিতে হবে; ৯) সম্ভব হলে কোম্পানির প্রশিক্ষিত মেকানিক দিয়ে দুর্বল ও নষ্ট পার্টসগুলো মেরামত করে নিতে হবে; ১০) ফিল্টারসমূহ, বেল্ট ও অন্যান্য জরুরি কিছু স্পেয়ার পার্টস সংগ্রহ করে রাখতে হবে; ১১) নিজে না চালালে প্রশিক্ষিত, সৎ ও সিনসিয়ার চালক নিয়োগ দিতে হবে; ১২) একাধিক মেকানিকের নাম্বার চালকের সাথে রাখা যাতে যে কোন প্রয়োজনে মেকানিকের পরামর্শ নেয়া যায় বা ডাকা যায়; ১৩) বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন এলাকায় যোগাযোগ করে কমিশন এজেন্টের মাধ্যমে জমির মালিকদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে যাতে এক এলাকার জমিতে পরিকল্পিতভাবে সমজাতের ধান চাষ করে, অন্যথায় অনেক সময় জমিতে হারভেস্টার ডুকানোর জায়গা পাওয়া যায় না।
আমাদের দেশে সরকারের এই উন্নয়ন সহায়তা ও তার ইতিবাচক প্রভাব কম্বাইন হারভেস্টারভিত্তিক যান্ত্রিকীকরণের পথে সঠিক অগ্রযাত্রার ইঙ্গিত বহন করছে। চালক, মালিক, মেকানিক ও সরবরাহকারীদের যথাযথ দায়িত্ব পালন ও অন্যান্য সীমাবদ্ধতা দূর করা গেলে দীর্ঘমেয়াদে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সুফল ঘরে তোলা যাবে। অন্যান্য সেক্টরের মতো কৃষি সেক্টরও উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবে। য়
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, এফএমপি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৭১২৬৩৫৫০৩, ই-মেইল : ংযধফঁষভসঢ়ব@মসধরষ,পড়স
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বরেন্দ্র অঞ্চলে টেকসই সেচ অভিযোজন পরিকল্পনা
ড. মো: আকরাম হোসেন চৌধুরী (সাবেক এমপি)
ভৌগোলিকভাবে অবস্থানগত দিক থেকে বরেন্দ্রভ‚মি বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলজুড়ে অবস্থিত রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের আওতাধীন ১৬টি জেলা নিয়ে গঠিত। বাংলাদেশকে নিয়ে যে ৩০টি এগ্রো-ইকোলজিক্যাল জোন গঠিত হয়েছে তাদের অন্যতম তিনটি এগ্রো-ইকোলজিক্যাল জোন (২৫, ২৬ এবং ২৭) বরেন্দ্র ভ‚মির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এ অঞ্চলের ৪৭% উচ্চ ভ‚মি, ৪১% মধ্যম উচ্চ ভ‚মি এবং ১২% সমান ভ‚মি। খরাপ্রবণ বরেন্দ্রভ‚মির বৈশিষ্ট্য হলো সমদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৪০ মিটার উপরে এবং যে সমস্ত উচ্চ মধ্য ও সমতল ভ‚মি রয়েছে সেগুলোর উচ্চতা ১৯.৮ মিটার থেকে ২২.৯ মিটার পর্যন্ত।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের উপক‚লীয় অঞ্চলগুলো আগামী ৫০-১০০ বছরের মধ্যে পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছেন আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। আবহাওয়ার তাপমাত্রাজনিত কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অতিরিক্ত বেড়ে গেলেও বরেন্দ্রভ‚মির উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার চেয়েও বেশি হওয়ায় এ অঞ্চল বন্যাকবলিত হওয়ার আশঙ্কা তেমন নেই। তবে উপক‚লীয় অঞ্চলগুলো বন্যাতে তলিয়ে গেলে দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল তথা বরেন্দ্র ভ‚মিতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত শরণার্থীদের (ঈষরসধঃব জবভঁমব) ভিড় বাড়বে বলে সবাই আশঙ্কা করে থাকেন। স্বাভাবিক কারণেই তখন আমাদের খাদ্য সঙ্কট মোকাবিলায় নানান ধরনের উন্নত সমন্বিত কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বরেন্দ্র ভ‚মির আপামর মানুষের অনেক করণীয় আছে। যার কতিপয় শর্ত আন্তর্জাতিক প্যারিস চুক্তিতেও বর্ণিত আছে। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী আমাদের দেশের আবহাওয়ার তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি করা যেতে পারে। অন্যদিকে অবশ্যই ২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে এই বৃদ্ধি সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। সমীক্ষায় দেখা যায় শুধুমাত্র কৃষি ক্ষেত্র থেকে আমাদের দেশে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ হয় বছরে ৮৬.৫৬ মিলিয়ন টন (সূত্র: ঙঁৎ ডড়ৎষফ উধঃধ, টহরাবৎংরঃু ড়ভ ঙীভড়ৎফ)।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবিলা কিছুটা সহজ হবে যদি আমরা এই নিঃসরণকে ঘবঃ তবৎড় ঊসরংংরড়হং অর্থাৎ শূন্য নিঃসরণে আনতে সক্ষম হই। আর তা বাস্তবায়ন করতে হলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে যে সমস্ত দুর্যোগ সৃষ্টি হচ্ছে যেমন- বন্যা, প্লাবন, খরা এবং অন্যান্য দুর্যোগজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় অভিযোজন বা স্বাঙ্গীকরণ (অফধঢ়ঃধঃরড়হ) পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) অবদানের কারণে আজকে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা বছরে ৪৫ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে পারছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, বিএমডিএ পরিচালিত প্রায় ১৫ হাজার ৫০০ গভীর নলক‚পসহ শত শত পাতকুয়া এবং সোলার পাম্প চালিত লো-লিফ্ট পাম্পের (এলএলপি) মাধ্যমে সেচ সেবা প্রদান। উল্লেখিত গভীর নলক‚প, পাতকুয়া এবং সোলার পাম্প চালিত এলএলপির মাধ্যমে বিএমডিএ বরেন্দ্র অঞ্চলের ২৭ লাখ হেক্টর কৃষি জমির থেকে প্রায় ৫ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় আনতে পেরেছে।
এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া দরকার, বরেন্দ্র অঞ্চলে উল্লেখিত ৪৫ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন করার ক্ষেত্রে যে সেচের পানি ব্যবহার করা হয় তার ৯৬%ই আসে ভ‚গর্ভস্থ উৎস থেকে এবং বাকি ৪% আসে ভ‚পরিস্থ উৎস হতে। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রয়োজন মেটাতে বরেন্দ্র অঞ্চলে আরো খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। এক্ষেত্রে যদি আমরা ভ‚গর্ভস্থ পানির উপর নির্ভর করে থাকি তাহলে একসময় পানির অভাবে খাদ্য উৎপাদনে বিপর্যয় ঘটবে। আর এটি হবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে। সে কারণে এখনই সময় বিএমডিএসহ এ অঞ্চলবাসীর সতর্ক হওয়া এবং আগামী প্রজন্মের কথা ভাবা। এজন্য খাদ্য উৎপাদনের স্বার্থে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি থেকে ফসল তথা কৃষকের জীবনযাত্রারমান অব্যাহত রাখতে অভিযোজন বা স্বাঙ্গীকরণ পরিকল্পনা গ্রহণ (অফধঢ়ঃধঃরড়হ চষধহ ভড়ৎ অপঃরড়হ) এবং কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে সেচ আমরা ব্যবহার করছি সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অভিযোজন বা স্বাঙ্গীকরণ (অফধঢ়ঃধঃরড়হ) পরিকল্পনা হতে পারে ভ‚গর্ভস্থ (টহফবৎমৎড়ঁহফ ডধঃবৎ) পানি উত্তোলনের পরিমাণ কমিয়ে ফেলে ভ‚পরিস্থ (ঝঁৎভধপব ডধঃবৎ) পানির ব্যবহারের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। এক্ষেত্রে প্রথম ধাপেই বিএমডিএ-কে ভ‚পরিস্থ পানির ব্যবহার ৪% থেকে ৩০% এ উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে ভ‚গর্ভস্থ ৫০% এবং ভ‚পরিস্থ ৫০% পানির ব্যবহারে যেতে হবে। বিএমডিএ প্রতিষ্ঠানের একক উদ্যোগে এ কাজ সহজ নাও হতে পারে। তবে সব সেক্টর বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলো যেমন- পানি, কৃষি, বন ও পরিবেশ, ভ‚মি, মৎস্য ও প্রাণী, স্থানীয় সরকার, কৃষি, অর্থ এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে এটি সহজেই করা সম্ভব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যাদের জন্য করা হচ্ছে অর্থাৎ কৃষক বা স্থানীয় জনগণ সকলকেই এই পরিকল্পনার সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। কেননা তাদের সহযোগিতা পাওয়া গেলেই কেবল স্থানীয়ভাবে এ ধরনের অভিযোজন বা স্বাঙ্গীকরণ (অফধঢ়ঃধঃরড়হ) পরিকল্পনা সফল হবে।
বছর পাঁচেক আগে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডবিøউএম) এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে একটি সুপারিশমালা প্রকাশিত হয়েছিল যার মূলকথা হচ্ছে, খাদ্য উৎপাদনের স্বার্থে বিএমডিএ-কে ভ‚গর্ভস্থ এবং ভ‚পরিস্থ উভয় উৎস থেকে যুগৎপদভাবে সেচের পানি ব্যবহার করতে হবে (ঈড়হলঁহপঃরাব ঁংব ড়ভ নড়ঃয ঃযব ংঁৎভধপব ধহফ মৎড়ঁহফধিঃবৎ) সে কারণে বিএমডিএর উদ্দেশ্য হবে সকল প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর সাথে (যেমন- পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, ভ‚মি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়) যৌথভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এবং হাওড়-বাঁওড় উন্নয়ন বোর্ডের ধারায় বরেন্দ্র উন্নয়ন বোর্ড (যার চেয়ারম্যান হবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং নিজেই) গঠন করা এবং সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ও সচিব এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত বোর্ডের মাধ্যমে এই অভিযোজন বা স্বাঙ্গীকরণ (অফধঢ়ঃধঃরড়হ) পরিকল্পনা একটি যৌথ মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় গৃহীত ও বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই বরেন্দ্র অঞ্চল এবং বিএমডিএ সারা দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলতে পারবে এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন- কৃষি, পানি, বিদ্যুৎ, ভ‚মি, মৎস্য ও প্রাণী, বন ও পরিবেশ, অর্থ ও পরিকল্পনা ইত্যাদি বিভাগগুলোকে সমন্বয়ের মাধ্যমে বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য একটি লাগসই এবং টেকসই অভিযোজন বা স্বাঙ্গীকরণ (অফধঢ়ঃধঃরড়হ) পরিকল্পনা গ্রহণ করা উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্তকরণে বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য একটি স্বতন্ত্র বরেন্দ্র উন্নয়ন বোর্ড ও যৌথ মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণের এখনই সময়। য়
চেয়ারম্যান, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজশাহী, মোবাইল : ০১৭৭৭৭১৯৩৪৫, ই-মেইল : পযধরৎসধহ@নসফধ.মড়া.নফ
জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি
(১৫ মে- ১৪ জুন)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
জ্যৈষ্ঠ আসে প্রতি মাসে মজার মজার মৌসুমি ফল নিয়ে। এসব ফল বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় শরীরে পুষ্টি উন্নয়নে সহায়ক হবে। আর এই মাসে প্রিয় পাঠক, চলুন এক পলকে জেনে নেই জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি ভুবনের কাজগুলো।
বোরো ধান
জমির ধান শতকরা ৮০ ভাগ পেকে গেলে ধান সংগ্রহ করে কেটে মাড়াই, ঝাড়াই করে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে।
শুকনো বীজ ছায়ায় ঠাÐা করে প্লাস্টিকের ড্রাম, বিস্কুটের টিন, মাটির কলসি এসবে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
আউশ ধান
এখনো আউশের বীজ বোনা না হয়ে থাকলে অতিদ্রæত বীজ বপন করতে হবে। চারার বয়স ১২ থেকে ১৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের প্রথম কিস্তি হিসেবে একরপ্রতি ১৮ কেজি ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এর ১৫ দিন পর একই মাত্রায় দ্বিতীয় কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সারের কার্যকারিতা বাড়াতে জমিতে সার প্রয়োগের সময় ছিপছিপে পানি রাখাসহ জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
আমন ধান
নিচু এলাকায় বোরো ধান কাটার ৭-১০ দিন আগে বোনা আমনের বীজ ছিটিয়ে দিলে বা বোরো ধান কাটার সাথে সাথে আমন ধানের চারা রোপণ করলে বন্যা বা বর্ষার পানি আসার আগেই চারা সতেজ হয়ে ওঠে এবং পানি বাড়ার সাথে সাথে সমান তালে বাড়ে।
চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর সামান্য পরিমাণ ইউরিয়া ছিটিয়ে দিলে চারা তাড়াতাড়ি বাড়ে, ফলন ভালো হয়।
এ মাসের মধ্যেই রোপা আমনের জন্য বীজতলা তৈরি করতে হবে।
জমি উর্বর হলে সাধারণত কোনো রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না, তবে অনুর্বর হলে প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ২ কেজি জৈবসার মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
প্রতি বর্গমিটার জমির জন্য ৮০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
বীজ বোনার আগে অংকুরিত করে নিলে তাড়াতাড়ি চারা গজায়, এতে পাখি বা অন্য কারণে ক্ষতি কম হয়।
ভালো চারা পাওয়ার জন্য বীজতলায় নিয়মিত সেচ দেয়া, অতিরিক্ত পানি নিকাশের ব্যবস্থা করা, আগাছা দমন, সবুজ পাতা ফড়িং ও থ্রিপসের আক্রমণ প্রতিহত করাসহ অন্যান্য কাজগুলো সতর্কতার সাথে করতে হবে।
জ্যৈষ্ঠ মাসে আউশ ও বোনা আমনের জমিতে পামরী পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। পামরী পোকা ও এর কীড়া পাতার সবুজ অংশ খেয়ে গাছের অনেক ক্ষতি করে। আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে হাতজাল, গামছা, লুঙ্গি, মশারি দিয়ে পামরী পোকা ধরে মেরে ফেলে আক্রমণ কমানো যায়। তাছাড়া আক্রান্ত গাছের গোড়া থেকে ৫ সেন্টিমিটার (২ ইঞ্চি) রেখে বাকি অংশ কেটে কীড়া ও পোকা ধ্বংস করা যায়। আক্রমণ যদি বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
পাট
পাটের জমিতে আগাছা পরিষ্কার, ঘন ও দুর্বল চারা তুলে পাতলা করা, সেচ এসব কাজগুলো যথাযথভাবে করতে হবে।
ফাল্গুনি তোষা জাতের জন্য একরপ্রতি ৪০ কেজি ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। মাটিতে রস না থাকলে বা দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে হালকা সেচ দিতে হবে এবং বৃষ্টির কারণে পানি জমে থাকলে তা নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। পাটশাক যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর। তাই নিড়ানির সময় তোলা অতিরিক্ত পাটের চারা ফেলে না দিয়ে শাক হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
এ মাসে পাটের বিছাপোকা এবং ঘোড়াপোকা জমিতে আক্রমণ করে থাকে। বিছাপোকা দলবদ্ধভাবে পাতা ও ডগা খায়, ঘোড়াপোকা গাছের কচিপাতা ও ডগা খেয়ে পাটের অনেক ক্ষতি করে থাকে। বিছাপোকা ও ঘোড়াপোকার আক্রমণ রোধ করতে পোকার ডিমের গাদা, পাতার নিচ থেকে পোকা সংগ্রহ করে মেরে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। জমিতে ডালপালা পুঁতে দিলে পোকা খাদক পাখি যেমনÑ শালিক, ফিঙ্গে এসব পোকা খেয়ে আমাদের দারুণ উপকার করে। আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
তুলা
আগামী আষাঢ়-শ্রাবণ মাস তুলাবীজ বপনের উপযুক্ত সময়। আপনার যদি তুলাচাষ উপযোগী উঁচু জমি থাকে এবং আপনি তুলাচাষে আগ্রহী হোন তাহলে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নিকটবর্তী অফিস/ইউনিট অফিস যোগাযোগ করূন।
শাকসবজি
মাঠে বা বসতবাড়ির আঙ্গিনায় গ্রীষ্মকালীন শাকসবজির পরিচর্যা সতর্কতার সাথে করতে হবে। এ সময় সারের উপরিপ্রয়োগ, আগাছা পরিষ্কার, গোড়ায় বা কেলিতে মাটি তুলে দেয়া, লতাজাতীয় সবজির জন্য বাউনি বা মাচার ব্যবস্থা করা খুব জরুরি।
লতানো সবজির দৈহিক বৃদ্ধি যত বেশি হবে তার ফুল ফল ধারণক্ষমতা তত কমে যায়। সেজন্য বেশি বৃদ্ধি সমৃদ্ধ লতার ১৫-২০ শতাংশের কেটে দিলে তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল ধরবে।
কুমড়াজাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন অধিক ফলনে দারুণভাবে সহায়তা করবে। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন হাতপরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে।
এ মাসে কুমড়াজাতীয় ফসলে মাছি পোকা দারুণভাবে ক্ষতি করে থাকে। এ ক্ষেত্রে জমিতে খুঁটি বসিয়ে খুঁটির মাথায় বিষটোপ ফাঁদ দিলে বেশ উপকার হয়। এ ছাড়া সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করেও এ পোকার আক্রমণ রোধ করা যায়।
সবজিতে ফল ছিদ্রকারী পোকা, জাবপোকা, বিভিন্ন বিটল পোকা সবুজ পাতা খেয়ে ফেলতে পারে। হাত বাছাই, পোকা ধরার ফাঁদ, ছাই ব্যবহার করে এসব পোকা দমন করা যায়। তা ছাড়া আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলে এবং সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে। মাটির জো অবস্থা বুঝে প্রয়োজনে হালকা সেচ দিতে হবে। সে সাথে পানি নিকাশের ব্যবস্থা সতর্কতার সাথে অনুসরণ করতে হবে।
বিবিধ
বাড়ির কাছাকাছি উঁচু এমনকি আধা ছায়াযুক্ত জায়গায় আদা হলুদের চাষ করতে পারেন।
মাঠের মিষ্টি আলু, চীনাবাদাম বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই তুলে ফেলতে হবে।
গ্রীষ্মকালীন মুগডালের চাষও এ মাসে করতে পারেন।
পতিত বা আধা ছায়াযুক্ত স্থানে অনায়াসে লতিরাজ বা পানিকচু বা অন্যান্য উপযোগী কচুর চাষ করতে পারেন।
যারা সবুজ সার করার জন্য ধইঞ্চা বা অন্য গাছ লাগিয়ে ছিলেন, তাদের চারার বয়স ৩৫-৪৫ দিন হলে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। সবুজ সার মাটিতে মেশানোর ৭-১০ দিন পরই ধান বা অন্যান্য চারা রোপণ করতে পারবেন।
গাছপালা
আগামী মাসে চারা লাগানোর জন্য জায়গা নির্বাচন, গর্ত তৈরি ও গর্ত প্রস্তুতি, সারের প্রাথমিক প্রয়োগ, চারা নির্বাচন এ কাজগুলো এ মাসেই শেষ করে ফেলতে হবে।
উপযুক্ত মাতৃগাছ থেকে ভালোবীজ সংগ্রহ করে নারকেল, সুপারির বীজ বীজতলায় এখন লাগাতে পারেন।
প্রাণিসম্পদ
এ সময়ে প্রাণিচিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে হাঁস- মুরগির ভ্যাকসিন দিতে হবে। এ ছাড়া হাঁসÑ মুরগির কৃমির জন্য ওষুধ খাওয়ানো, ককসিডিয়া রোগ হলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং জরুরিভাবে অন্যান্য প্রতিষেধক টিকা দিয়ে দিতে হবে।
মুরগি ও হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর কাজটি ভরা বর্ষার আগেই সেরে ফেলতে হবে।
বর্ষার নিয়মিত এবং পরিমিত গো-খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করাসহ অন্যান্য কাজগুলো সঠিকভাবে করতে হবে। গবাদিপশুর গলাফোলা, ডায়রিয়া, ক্ষুরারোগ, নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য রোগের ব্যাপারে টিকা দেয়াসহ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
মাছ প্রজননে আগ্রহী চাষিভাইদের স্ত্রী-পুরুষ মাছ (ব্রæড ফিশ), পিটুইটারি গ্রন্থি, হাপা এবং ইনজেকশনের সরঞ্জামাদি প্রস্তুত রাখতে হবে।
আঁতুড় পুকুর বন্যায় ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে পাড় উঁচু করে বেঁধে দিতে হবে। আঁতুড় পুকুরে পোনার আকার ১ ইঞ্চি হলে সাবধানে ধরে চারা পুকুরে ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
নিয়মিত তদারকী, রাক্ষুসে মাছ তোলা, আগাছা বা জংলা পরিষ্কার, খাবার দেয়া, সার দেয়া, সম্পূরক খাবার দেয়া, জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা এসব প্রাষঙ্গিক কাজগুলো নিয়মিত করতে হবে।
এ ছাড়া যে কোনো সমস্যায় উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আপনাদের কল্যাণে ও সফলতার জন্য আমরা এক মাস আগেই আগামী মাসের কৃষির করণীয় দিকগুলো স্মরণ করিয়ে দেই। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি-মৎস্য-প্রাণী বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নিলে আরো বেশি লাভবান হবেন। য়
সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, টেলিফোন:০২৫৫০২৮৪০৪, ইমেইল : editor @ais.gov.bd
আখের রোগ : শিকড় গিঁট
ড. মোঃ ইকবাল
বাংলাদেশে আখ একটি অন্যতম প্রধান শিল্প জাতীয় ফসল
ইহা একটি চিনি জাতীয় ফসল যা থেকে সাদা চিনি ও গুড় হয় উৎপাদন
অ্যালকোহল এবং কাগজও ইহা হতে উৎপাদন হয় বাংলাদেশে
যা থেকে ০.২ মিলিয়ন টন চিনি ও ০.৩ মিলিয়ন টন গুড় পাওয়া যায় বছর শেষে
আখের উৎপাদন কম হওয়ার পেছনে আছে অনেক কারণ
যার মধ্যে বিভিন্ন রোগ বালাই করে ক্ষতি সাধন।
আখের রোগ বালাই এর মাঝে শিকড় গিঁট অন্যতম
যার জন্য দরকার এর প্রয়োজনীয় প্রতিকার সারধন।
আখেরও কৃমি রোগ হয়, জানিও সবাই
তাই তার প্রতিকারও ঠিক জানা চাই।
তার মাঝে একটি হলো শিকড় গিঁট,
যার মাঝে বাস করে এক ধরনের কীট।
গাছ হয় খর্বাকৃতি, পারে না বাড়িতে
ফলনও কমে যায় অনেকটা তাতে।
এলাকা ভেদে এর প্রকোপ কম বেশি হয়,
বালু জাতীয় মাটিতে এর বিস্তার বেশি হয়।
সারা পৃথিবীব্যাপী এই রোগ বেশি দেখা যায়,
আখ ছাড়া অন্য ফসলেও এই রোগ হয়।
সারা বছরে এই রোগের আক্রমণ হয়,
এই রোগ বেশি হয় সাধারণত কর্তন সময়।
আখের মিলজোনে এই রোগের আক্রমণ বেশি,
আখের কৃমি রোগের মাঝে এই রোগ ক্ষতিকারকও বেশি।
প্রতিকারে প্রতি হেক্টর জমিতে ৪০ টন প্রেসমাড দিন,
অথবা হেক্টরে ৩০ টন আখের ছোবড়া দিন।
বিস্তারিত জানতে হলে আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে আসুন,
আখের ফলন বৃদ্ধিতে সবিশেষ অবদান রাখুন।
বৈশাখী উপহার
মো: জুন্নুন আলী প্রামানিক
বৈশাখ আসে বৈশাখ যায় নববর্ষের প্রথম মাস,
শ্যামল হাসি প্রকৃতি মাঝে রূপবৈচিত্র্যে ফসল চাষ।
পল্লীর বৃক্ষ পল্লবে ভরে ফলফলাদি গাছের শাখে,
নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে কৃষকগণ প্রস্তুত থাকে।
বোরোর পাকা ধানের ক্ষেতে আনন্দঘন শুভেচ্ছা বাণী,
বৈশাখী বায়ু প্রেরণা দেয় আশীর্বাদের মঙ্গল ধ্বনী।
বাড়ন্ত ফলে হলুদ আভা পরিপক্বতা মধুর স্বাদে,
রঙিন পাখি গাছের ডালে তীব্রতাপের বৈশাখী রোদে।
প্রকৃতি রাঙ্গা আলোয় হাসে প্রখরতার ভয়াল তেজে,
গাছের ছায়া পরম বন্ধু শীতলতার মায়ায় সাজে।
হঠাৎ করে আকাশ ভরা মুষলধারে ঝড়ের খেলা,
মেঘের দৌড়ে বিরতি নাই শিলাবৃষ্টির ক্ষতির পালা।
বৈশাখে মেলা বৈশাখে খেলা প্রাণচঞ্চল শোভার মাঝে,
আনন্দে ভরে চাষির মন সারাদিবস মাঠের মাঝে।
ক্ষেতের শস্য সবজি ফল কর্মমুখর চাষির হাতে,
ভাবনা কাটে প্রচুর পেয়ে আশা ভরসা সহায় দিতে।
পুরনো সব দুঃখব্যথা বৈশাখী জলে বিধৌত হয়।
চলার পথ কলুষ শূন্য নবউদ্যমে কৃষির জয়।
নতুন ফল নতুন ধান শাকসবজি নতুন সব,
বিশ্রাম নেই পাখির কণ্ঠে চব্বিশ ঘণ্টা সুরের রব।
অনেক কিছু বৈশাখ দেয় উপহারের ভাÐার খুলে,
সকাল সন্ধ্যা আনন্দ গীতি দুঃখদৈন্য অজান্তে ভুলে।
বৈশাখ স্বপ্ন বৈশাখ রতœ সুফলনের ঐতিহ্য পথে,
সাজিয়ে এসে কাঁদিয়ে যায় পুষ্পপল্লব ছড়িয়ে দিতে।
সম্মুখপানে সকল মাসে জমজমাট ফসল তাই,
কল্যাণ সব ছড়িয়ে আছে কোনক্রমেই বিরাম নাই।
১সাবেক পরিচালক, বিএসআরআই, শান্তনীড়, ফ্ল্যাট নং-২০৩, বাসা নং-১৩/১৪, রোড নং-২, মনসুরাবাদ, আদাবর, ঢাকা, মোবাইল : ০১৯৩৫৭১৯৯১৭। ২গ্রাম : বিদ্যাবাগীশ, ডাকঘর ও উপজেলা : ফুলবাড়ী, জেলা : কুড়িগ্রাম, মোবাইল : ০১৭৩৫২০২৭৯৮
টেকসই মৎস্য উৎপাদনে মুক্ত জলাশয় সংরক্ষণ ও উন্নয়ন
মো: কাওছারুল ইসলাম সিকদার
বাংলাদেশ হলো পানি দ্বারা বেষ্টিত এক বৃহৎ বদ্বীপ। যার উপর দিয়ে অসংখ্য স্রোতধারা ভারত, নেপাল, ভুটান ও চীন হতে উৎপন্ন হয়ে নদীরূপে দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নদী পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ অসংখ্য ছোট নদী ও এর শাখা-প্রশাখা জালের মতো বিস্তৃত হয়ে আছে বাংলার বুক জুড়ে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও চীন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পানি সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ। এর কারণ বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতমালা হিমালয়; যেখানে শীতে বরফ জমে আর গ্রীষ্মে তা গলে নিকটবর্তী দেশগুলোর জমিকে করছে সবুজ শ্যামল এবং নদ-নদী খাল বিলকে করছে মাছের দ্বারা সমৃদ্ধ। বাংলার জন্য এ পানি আশীর্বাদ হলেও এর সহজপ্রাপ্যতার কারণে মূলত এটি বাংলার জন্য সৃষ্টিকর্তার কতবড় কৃপা তা আমরা অনুধাবন করতে পারিনি। তবে সময়ের পরিক্রমায় উজান হতে যখন দিন দিন পানির প্রবাহ কমে আসছে তখন আমরা পানির যে অত্যাবশ্যকীয় উপলব্ধি করতে সক্ষম হচ্ছি। বাস্তবিকভাবে পানিই হলো বাংলার প্রাণ ও সমৃদ্ধির অন্যতম প্রধান উপাদান। এ কারণেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ ঘনত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠীর এ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে। পানির প্রাচুর্যতার কারণে বাংলাদেশ এক সময় অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য সম্পদ উৎপাদনে সমৃদ্ধ হলো। বর্তমানে বদ্ধজলাশয়ে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের চাহিদা মিটিয়ে মৎস্য আজ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
মুক্ত জলাশয় বলতে দেশের নদ-নদী, হাওড়-বাঁওড়, খাল-বিল এবং বর্ষায় প্লাবিত জমি যেখানে মাছ প্রাকৃতিক উৎস থেকে খাদ্য গ্রহণ করে বড় হয় এবং বংশ বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশ পূর্বে অসংখ্য নদী-নালা, হাওড়-বাঁওড়, খাল-বিল, পুকুর-ডোবায় ভরপুর ও সমৃদ্ধ ছিল। এছাড়া দেশে রয়েছে কাপ্তাই লেক এবং সুন্দরবন এলাকাসহ অসংখ্য মুক্ত জলাশয়। দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ জেলার প্রায় ৪১১টি হাওড় রয়েছে। যার আয়তন প্রায় ৮০০০ বর্গকিলোমিটার। এ ছাড়া দেশে রয়েছে প্রায় ৮৭টি বাঁওড়। যার আয়তন প্রায় ৫৪৮৮ বর্গকিলোমিটার। বড় বাঁওড়গুলো যশোর অঞ্চলেই বেশি। বাঁওড়গুলো স্থানীয়ভাবে বিল হিসেবে পরিচিত। দেশে বিদ্যমান প্রসিদ্ধ বিলগুলো হলো চলন বিল, আড়াইল বিল, গোপালগঞ্জ, খুলনা বিল। ১৯ শতকের শুরুর দিকে চলন বিলের আয়তন ছিল প্রায় ১০৮৫ বর্গকিলোমিটার। যা বর্তমানে কমে ৩৬৮ বর্গ কিলোমিটার। তবে সারা বছর জলমগ্ন থাকে মাত্র ৮৫ বর্গকিলোমিটার। দেশে বিদ্যমান ৩১০টি নদীর দীর্ঘ প্রায় ২৪০০০ কিমি.। বর্ষায় দেশের ৫০-৭০% জমি প্লাবিত হয়। এ ছাড়া দেশে পুকুর-ডোবার সংখ্যা প্রায় ১.৩০ মিলিয়ন।
অপর দিকে বদ্ধ জলাশয় হলো পুকুর, ডোবা যেখানে মানুষ কৃত্রিমভাবে খাদ্য সরবরাহ করে অল্প জায়গায় নিবিড় পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লাভবান হওয়ার জন্য মূলত বদ্ধ পানিতে মাছের চাষ করা হয়। বাংলাদেশের বদ্ধ পানিতে মাছ চাষে ব্যাপক সফলতা অর্জন হয়েছে। বিশেষ করে তেলাপিয়া ও পাঙ্গাশ মাছের উৎপাদনে প্রভ‚ত সাফল্য অর্জিত হচ্ছে। দেশে অভ্যন্তরীণভাবে মৎস্য সম্পদে স্বাবলম্বী হলেও মৎস্য উৎপাদনের উৎস পরিবর্তিত হচ্ছে দ্রæত। মৎস্যের চাহিদা মেটাতে মুক্ত জলাশয়ের চেয়ে বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষে বিনিয়োগ ক্রমাগত বাড়ছে। দেশে মুক্ত জলাশয়ের পরিমাণ ৪০৪৭৩১৬ হেক্টর (৮৪.৭৫%) এবং বদ্ধ জলাশয়ের পরিমাণ ৫২৮৩৯০ হেক্টর (১৫.২৫%)। ১৯৬০ সালে দেশে উৎপাদিত মৎস্যের মধ্যে ৯০% ছিল মুক্ত জলাশয়ের। যা ২০১০-১১ তে ৪২% এবং ২০১৪-১৫ তে মাত্র ২৮% নেমে এসেছে। ২০১৪-১৫ সালে দেশের মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৬,৮৪,২৪৫ মেট্রিক টন। যার মধ্যে মুক্ত জলাশয়ের মাছ ১০,২৩,৯৯১ (২৮%) মেট্রিক টন এবং বদ্ধ জলাশয়ে চাষের মাছ ২০,৬০,৪০৮ (৫৫%) মেট্রিক টন। যা সমুদ্রের মাছের পরিমাণ ৫৯৯৮৪৬ (১৬%) মেট্রিক টন। নিবিড় পদ্ধতিতে মাছ চাষের কারণে মাছের উৎপাদনের হারও অনেক বেড়ে গেছে। অপর দিকে মুক্ত জলাশয়ে সারা বছর পানির প্রবাহ না থাকায় এবং নদ-নদী, খাল বিলে শুষ্ক মৌসুমে পানির উচ্চতা কমে যাওয়ায় মাছের চলাচল ও বংশবৃদ্ধির জন্য অন্তরায় হয়ে পড়েছে। সে সাথে প্রতি বছর পলিতে ভরাট হয়ে দেশের নদীনালা, খালবিল, শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই এসব জলাশয়ের আয়তন প্রতিনিয়ত কমছে। মৎস্য বিচরণ ক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে। সে সাথে জীবন ও জীবিকার জন্য অধিকমাত্রায় জেলেরা মৎস্য আহরণ করছে। এ ছাড়া সেচের জন্য ভূপরিস্থ পানি উঠিয়ে নেয়াসহ জমিতে সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণেও মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন এবং উৎপাদনের হার ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। মুক্ত জলাশয় ও বদ্ধ জলাশয়ে উৎপাদন শতকরা হার টেবিলে দ্রষ্টব্য। মুক্ত জলাশয়ের মাছ অধিক নিরাপদ, সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। তাই এ মাছের চাহিদাও বেশি কিন্তু যোগান কম। বদ্ধ পানিতে উৎপন্ন মাছের তুলনায় মুক্ত জলাশয়ে উৎপন্ন মাছের বাজারমূল্যও কয়েক গুণ বেশি। মুক্ত জলাশয়ের অনেক প্রজাতি এর মধ্যে বিলুপ্ত প্রায়। শুকনো মৌসুমে একদিকে পানি কমে যাওয়া অপর দিকে ইজারা গ্রহীতা কর্তৃক সম্পূর্ণ মাছ ধরে বিক্রি করার কারণে মা মাছ সংরক্ষণও সম্ভব হচ্ছে না। মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আমাদের বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে নদ-নদীর খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়ে সারা বছর পানির প্রবাহ রক্ষার জন্য খনন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। যাতে করে শুকনো মৌসুমেও মাছের চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত পানির উচ্চতা নিশ্চিত করা যায়। মা মাছের সংরক্ষণের জন্য মুক্ত জলাশয়ের নির্দিষ্ট পরিমাণ এলাকা সংরক্ষণ করতে হবে। যান্ত্রিক উপায়ে গভীরভাবে খনন করে মাছের জন্য হাওড়-বাঁওড়ের বিভিন্ন স্থানে অভয়াশ্রম তৈরি করতে হবে যেখানে সারা বছর পর্যাপ্ত পানি থাকবে এবং সংরক্ষিত স্থানসমূহে মাছ ধরা ও প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। উল্লেখ্য, পলি জমে ভরাট হওয়ার কারণে চলনবিলের পরিধি ১০৮৫ বর্গকিমি.। বর্তমানে সেখানে সারা বছর মাত্র ৮৫ বর্গকিমি. এলাকায় পানি থাকে। এটি কয়েক দশক পরে হয়তো শুকিয়ে যাবে। যদি না খনন করে বিলের পরিধি ও এর পানি সারা বছর সংরক্ষণ করা না হয়। এ বিল শুকিয়ে গেলে ওই অঞ্চলের মানুষ পানি ও মৎস্য উভয় সম্পদই হারাবে। সেইসাথে পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে। তা দেশের সব মুক্ত জলাশয়গুলো সরকারি উদ্যোগে খনন করে পানি, মৎস্য ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে। এ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে ইলিশ মাছ সংরক্ষণের জন্য যেমনি নির্দিষ্ট সময় নদীতে জেলেদের মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে তেমনি মুক্ত সকল জলাশয়েও বর্ষায় কয়েক মাস মাছ ধরা নিষিদ্ধ রাখতে হবে। যাতে করে মা মাছ ডিম ছাড়তে পারে এবং মাছের পোনা বড় হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়। বর্ষায় ৪-৬ মাস দেশের প্রায় ৫০-৭০% ভাগ এলাকা প্লাবিত থাকে। এ বিস্তীর্ণ এলাকায় ন্যূনতম দু-মাস যদি মাছ চাষ বন্ধ রাখা যায়, তবে মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন অনেক বাড়ানো সম্ভব হবে। সে সাথে মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক যদি দেশের নদ-নদী, হাওড়-বাঁওড় ও বিলগুলোতে বর্ষার শুরুতে মাছের পোনা ছাড়ে তবে মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদনের হারও বৃদ্ধি পাবে। বর্ষার শুরুতে দেখা যায় গ্রামের খাল বিলে খরা জাল দিয়ে মাছের পোনাগুলো ধরে ফেলা হয়। এটি রোধ করা না গেলে প্রাকৃতিক উৎসে মৎস্যর উৎপাদন বাড়ানো দুষ্কর।
দেশে বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও মুক্ত জলাশয়ের এখনো বহু প্রজাতির মাছ বিদ্যমান এবং এসব মাছ যথামাত্রায় বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত সময় ও উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। যাতে করে মা মাছ সারা বছর প্রতিটি মৎস্য বিচরণ ক্ষেত্রের অভয়াশ্রমে অবস্থান করতে পারে। উল্লেখ্য, বিশেষজ্ঞদের অভিমত অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়কে বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনার আওতায় এনে এসব জলাশয় থেকে মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে বর্তমান সরকার হাওড়ের মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন। যার ফলে মাছের উৎপাদন বাড়বে এবং গ্রামবাংলায় এ খাতে নিয়োজিত মানুষের আয়ও বাড়বে। সর্বোপরি দেশের মানুষের প্রোটিনের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ হবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। য়
অতিরিক্ত পরিচালক (উপসচিব), বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, মোবাইল : ০১৫৫২৩৫৫৮৫৩, ই-মেইল : kawserul1173@gmail.com
গবাদি প্রাণির ক্ষুরারোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার কৌশল
ডাঃ মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
যে সমস্ত রোগ সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি হয় সেসব রোগের মধ্যে ক্ষুরারোগ অন্যতম। বর্তমানে ক্ষুরারোগ তার চিরায়ত সময় ছাড়াও যে কোন সময় এই রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ে হাজির হয়। শীতকালে এই রোগের প্রাদুর্ভাব কম থাকার ইতিহাস থাকলেও এই বছর শীতে সারাদেশে ব্যাপক হারে এই রোগের সংক্রমণ লক্ষণীয় ছিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য বাছুরের মৃত্যুর একমাত্র কারণ হয়েছে এই ক্ষুরা রোগ। যেহেতু ভাইরাসজনিত রোগ তাই এই টিকা ছাড়া নির্মূল করা সম্ভব নয়। এ রোগে অক্রান্ত শতকরা ২০টি বাছুর ও ২টি গরু মৃত্যুবরণ করে। তাছাড়া বেঁচে থাকা আক্রান্ত প্রাণির উৎপাদন ক্ষমতা, মাংস ও দুধ সবকিছুই নি¤œ মানের হয়ে যায়।
ক্ষুরারোগের (ঋগউ) এর পরিচয়
ক্ষুরারোগ ইংরেজি নাম ঋড়ড়ঃ ধহফ গড়ঁঃয উরংবধংবং যার ল্যাটিন নাম অঢ়ঃযধব এটি সাধারণত বিভক্ত ক্ষুর বিশিষ্ট পশুর অত্যন্ত ছোঁয়াচে প্রকৃতির ভাইরাসজনিত রোগ। ক্ষুরারোগের ভাইরাসটি পিকরনা ভিবিডি গোত্রের অন্তর্গত অ্যাফথো ভাইরাস (অঢ়যঃযড়ারৎঁং) জেনাসের অন্তর্গত ঋড়ড়ঃ ধহফ গড়ঁঃয উরংবধংবং ভাইরাস। এটা সিংগেল স্ট্যান্ডেড আর এন এ ভাইরাস (জঘআরৎঁং) অতি ক্ষুদ্র আকৃতির একটি ভাইরাস খুব দ্রæত বর্ধনশীল। ইকোসাহেড্রাল সিমেট্রি এর জিনসো প্রায় ৮০০০ নিউক্লিওটাইড থাকে। অ, ঙ,ঈ, ঝঅঞ-১, ঝঅঞ-২, ঝঅঞ-৩ ও অংরধ-১. এর প্রতিটি স্ট্রেন পরিবর্তনশীল সে জন্যই একটি স্ট্রেন অন্য স্ট্রেনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করে না। ক্ষুরারোগের ভাইরাস শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। প্রায়ই রোগের লক্ষণ স্পষ্ট হওয়ার আগেই যে কোন নিঃসরণে এবং শ্বাস ত্যাগের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ভাইরাস বের হয়।
রোগের সুস্থাবস্থা
অন্যান্য ভাইরাসজনিত রোগগুলোর মতো এই রোগেরও ভাইরাসের সুপ্তকাল রয়েছে। ভাইরাস দেহে প্রবেশের সাথে সাথে লক্ষণ প্রকাশ শুরু হয় না। এক্ষেত্রে ক্ষেত্র বিশেষ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা ভেদে এই সুপ্তাবস্থা কম বেশি হতে পারে। আর এই সময়টা নির্ভর করে এটি সেরোটাইপের কোনটি দেহে প্রবেশ করেছে তার উপর। মাত্রা ও প্রবেশের পথের উপরও নির্ভর করে। আর এই সুপ্তাবস্থা কমপক্ষে ২-৩ দিন ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এবং সর্বোচ্চ ১০-১৪ দিন হতে পারে। তবে পরীক্ষামূলকভাবে দেখা যায় যে, ১৮-২৪ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যেও রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
রোগের বিস্তৃতি
ক্ষুরারোগ বিশ্বব্যাপী মারাত্মক ভাইরাসজনিত রোগ। ১৪১৪ খ্রিষ্টাব্দে ইতালিতে প্রথম ক্ষুরারোগ শনাক্ত করা হয়। এক একটি ভাইরাসজনিত রোগের রোগ ছড়ানোর ধরন এক এক রকম। ক্ষুরারোগ আক্রান্ত প্রাণীর শরীরে ফোস্কার অভ্যন্তরে তরলের মধ্যে ভাইরাস বিকাশ লাভ করে। তারপর ভাইরাসটি প্রাণীর লালা, প্রসাব, গোবর, চামড়া, দুধ, শ্বাস ত্যাগের মাধ্যমে নির্গত হয়। ভাইরাস দ্বারা খাদ্যদ্রব্য দূষিত হয়। শ্বাসপ্রশ্বাস ও খাবারের ও সংস্পর্শের মাধ্যমে অসুস্থ প্রাণী থেকে সুস্থ পশুতে রোগ সংক্রমিত হয়। পাখি এই ভাইরাস ছড়াতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। সংক্রমিত গরুর দ্বারা সংবেদনশীল গরুর প্রজনন বা নিষিক্তকরণের সময়। বাজার হতে আক্রান্ত গরু ক্রয় করলে তা সুস্থ না হওয়ার আগে অন্য খামারে রাখলে সেই খামারের সুস্থ প্রাণীও আক্রান্ত হতে পারে। সংক্রমিত বন্যপ্রাণীর সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংস্পর্শে রোগের উচ্চস্তরে ভাইরাস রক্তে এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। বাতাসের মাধ্যমে এই ভাইরাস এক অঞ্চল হতে অন্য অঞ্চলে প্রায় ৬২ মাইল পর্যন্ত ছড়াতে পারে। এমনকি সমুদ্র পার হয়েও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। ক্ষুরারোগ মৃত প্রাণীকে খোলা মাঠে ফেলে রাখলে শিয়াল কুকুর, শুকুন ইত্যাদি শাবহারী পশু-পাখির মাধ্যমে ভাইরাস ছড়াতে পারে। আরও একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো সেই পশু-পাখির দেহে ভাইরাস কোন পরিবর্তন না হয়ে পুনরায় মলমূত্রের মাধ্যমে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। রোগাক্রান্ত প্রাণীর ব্যবহৃত গবাদি ও প্রাণিজাত দ্রব্যের (চামড়া, মাংস, দুধ) মাধ্যমে একস্থান অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি দেশ হতে অন্য দেশেও চলে যায়। আক্রান্ত গাভীর দুধের মাধ্যমেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। উল্লেখযোগ্য হলো পাশচুরায়ন পদ্ধতিও দুধ পাউডার করার পদ্ধতিতেও এই ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করা যায় না। এমনিভাবে বাটার, বাটার ওয়েল, বীজ ক্যাসিন ইত্যাদি দুধজাত খাদ্যদ্রব্য এর বাহক হিসেবে কাজ করে।
আক্রান্ত প্রাণীর ধরন ও লক্ষণ
সাধারণত বিভক্ত ক্ষুর বিশিষ্ট প্রাণীর রোগ বলে পরিচিত। এই রোগ গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, শুকর, চিড়িয়াখানার প্রাণীর মধ্যে হরিণ, হাতি প্রভৃতি। এই পর্যন্ত ৭০টি প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে এই রোগের উপস্থিতির প্রমান মিলেছে। এ গবেষণা থেকে জানা গেছে আক্রান্ত প্রাণীর শতকরা হিসেবে ১০০% গরু, ২৩% মহিষ, ৫% ছাগল/ ভেড়া আক্রান্ত প্রাণীর শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা জ্বর (১০৪-১০৬)০ঋ , কাঁপুনি, খুড়িয়ে চলা, ফেনাযুক্ত আঠালো লালা ঝরা, খাবার খেতে অনীহা, গর্ভপাত, পায়ে, মুখে বা জিহŸায় এবং ওলানের বাটে ফোস্কা এবং ক্ষত, বাছুরের ক্ষেত্রে লক্ষণ দেখা দেয়ার আগেই বাছুর মারা যেতে পারে, দুগ্ধবতী প্রাণীর দুধ উৎপাদন কমে যায়।
ভেড়ীর বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোতে অনীহা দেখা যায়। বন্যপ্রাণিদের ভেসিকল তৈরি, পায়ে ও মুখে ঘাঁ হয়। ওয়ার্থহগ এর সিং খুলে যায়, কার্পাল জয়েন্ট এ লেসন পাওয়া যায়। ঝঅঞ- টাইপ দ্বারা আবিতকার বন্য প্রাণী হরিণ, ভাল্লুক, এন্টিলোপ আক্রান্ত হয়।
ময়নাতদন্তে প্রাপ্ত ফলাফল : ময়নাতদন্ত করলে যে সকল চিহ্ন দেখে বুঝা যায় তা হলো- ক. অপ্রাপ্ত বয়স্ক প্রাণীর মুখের, হৃদপিন্ডের এবং ঐচ্ছিক পেশির ক্ষয় হয়। খ. চামড়া ও হৃৎপিÐের মাংস পেশিতে যে পান করে তা জিংকার নেক্্েরাসিস নামে পরিচিত। গ. বাচ্চা গরুর হৃৎপিÐের মাংসে বাঘের গায়ের কাল দাগের মতো চিহ্ন পাওয়া যায়। তাই একে টাইগার হাট ভিজিটও বলা হয়। ঘ. মুখ, খাদ্যনালা-অন্ত্রে ফোসকা এবং পচনের চিহ্ন পাওয়া যায়। ঙ. গাভীর স্তনের বাটে ঘা হয় ব্যক্টরিয়ার আক্রমণের উপস্থিতি পাওয়ায় পচন রস নিঃসৃত হয়। চ. শ্বাসনালা ও গলবিল এবং এলভিওলাস এ চিহ্ন পাওয়া যায়।
রোগ নির্ণয় পদ্ধতি
রোগ নির্ণয়ের যতো বেশি নমুনা সংগ্রহ করা যায় ততোই ভালো। এক্ষেত্রে রোগের নিশ্চিত হওয়া অনেক সহজ হয়। নমুনা প্রেরণের ক্ষেত্রে নি¤েœাক্ত বিষয়গুলো লক্ষণীয়। ইপিডেমিওলজিক্যাল তথ্যাদি ও রোগের লক্ষণসমূহের বিস্তারিত তথ্য। আক্রান্ত পালের অনেকগুলো প্রাণীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে হবে। নমুনাকে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় (মূলত শীতল অবস্থায়, গতিল বরফ পানির মধ্যে রাখতে হবে এবং দ্রæত ল্যাবরেটরিতে প্রেরণ করতে হবে। প্রত্যেক নমুনা আলাদা আলাদা বোতলে, অনমনীয় বালু দ্বারা নমুনার নাম ও অন্যান্য তথ্যাদি লিখে পাঠাতে হবে।
চিকিৎসা
ভাইরাসজনিত রোগের কোন সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে রোগাক্রান্ত প্রাণীর সুষ্ঠ পরিচর্যা ও প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক বিশেষ ব্যবস্থায় সুফল পাওয়া যায়। প্রথমে প্রাণীটিকে আলাদা করে শুষ্ক জায়গায় রাখতে হবে। মুখের ঘা এর জন্য ফিটকিরির পানি ১০ গ্রাম (২ চা চামচ) ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে মুখ পরিষ্কার করতে হবে। অথবা ০.০১% কগহঙ৪ পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট দিয়ে মুখ ধুয়ে দিতে হবে দিনে ২ থেকে ৩ বার। মাছির উপদ্রব কমাতে হবে। শরীরের অন্যান্য ক্ষত স্থান জীবাণুনাশক দ্বারা পরিষ্কার করতে হবে। প্রচুর লালা ক্ষরণের দরুন প্রাণীর দুর্বল হয়ে পড়ে এজন্য ৫% বা অবস্থা অনুসারে ডেক্সট্রোজ স্যালাইন ১০০০ ঈঈ / ৫০-১০০ কেজি হিসেবে ২-৩ দিন দিতে হবে। দ্রæত অভিজ্ঞ ভেটেরিনারিয়ানের পরামর্শ নিয়ে পশুতে অ্যান্টিবায়োটিক এবং ভিটামিন প্রয়োগ করতে হবে।
এ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে মনোভ্যালেন্ট, ট্রাইভ্যালেন্টসহ আরো কিছু টিকা বাজারে পাওয়াই যায়। বর্তমানে সরকারি পর্যায়ে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল এ এই রোগের টিকা পাওয়া যায়। যেহেতু দেশের সরকারি ভাবে টিকার সরবরাহ খুবই কম, তাই বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানি এই ক্ষুরারোগের টিকা বাজারে নিয়ে এসেছে। তাই প্রথমে সরকারি অফিসে যোগাযোগ করে না পেলে তখন নিকটস্থ ফার্মেসিতে এফ এনএফ, ইনসেপ্টা, ওয়ান ফার্মাসহ অন্যান্য কোম্পানির টিকা তাদের নিয়ম মেনে (চামড়ার নিচে) প্রয়োগ করা উত্তম। টিকা প্রয়োগের পদ্ধতি টেবিল দ্রষ্টব্য।
ক্ষুরারোগের পরিবর্তনশীল স্ট্রেইন এর কারণে শুধু টিকা প্রয়োগ করে এই রোগের প্রাদুর্ভাব কমানো কঠিন। ক্ষুরারোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য জীব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এই জীব নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে এই রোগের মহামারী রূপ হতে রক্ষা পাওয়া যাবে। প্রাণীর আবাসস্থল হতে হবে স্যাঁতসেতে মুক্ত, শুষ্ক পরিবেশ, সঠিকভাবে আলো বাতাস সম্পন্ন। নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে, গবাদি প্রাণীর ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, খাবার পাত্র ও পানির পাত্র পরিষ্কার করে জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। খামারে প্রবেশাধিকার ঠিক রাখতে হবে। সবাইকে ঢালাওভাবে খামারে প্রবেশ করতে দেয়া যাবে না। কারণ মানুষ বা যানবাহন এর মাধ্যমেও এই রোগের ভাইরাস ছড়াতে পারে। বিশেষত বাজার হতে পশু কিনে নিয়ে আসার পর সরাসরি তাকে খামারে অন্য প্রাণীদের সাথে রাখা যাবে না। আগে একটা নির্দিষ্ট স্থানে রেখে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। যদি কোন রোগ দেখা যায় তাহলে তার উপযুক্ত চিকিৎসা নিয়ে তারপর খামারে প্রবেশ করাতে হবে। এতে করে অন্যান্য প্রাণী আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ কম থাকে। এক খামারের কর্মচারী বা ব্যবস্থাপক অন্য খামারে না যাওয়া। খামারের প্রবেশের আগে ভালোভাবে মুখে মাস্ক ব্যবহার করা, যেন বায়ুর মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করতে না পারে। যদিও এটা মানুষের ক্ষতি করে না কেবলমাত্র গবাদি প্রাণীর রোগ। কোন খামার আক্রান্ত হলে খামার ও আঙ্গিনার চারদিকে সংরক্ষিত স্থানে পায়ে হাঁটার সরু পথগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। যেন রোগ সেখান হতে অন্যত্র ছড়াতে না পারে। একই খামারে একাধিক প্রজাতির প্রাণী পালন পরিহার করা।
আমদানিকৃত গরু বাংলাদেশে প্রবেশের সময় সর্বোচ্চ সতর্কতার ব্যবস্থা করা । কোন রোগাক্রান্ত প্রাণী যেন আসতে না পারে সেই জন্য সংশ্লিষ্ট মহলকে সজাগ হওয়া । আবহাওয়া ও ঋতুর পরিবর্তনের সময় যথাপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বিশেষত গবাদিপ্রাণীর আবাসস্থল উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখার ব্যবস্থা করা। প্রচারমাধ্যমে এই রোগের ভয়াবহতা তুলে ধরে তা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকারের ব্যবস্থা প্রচার করে জনসচেতনতার ব্যবস্থা করা। সঠিক সময়ে ভালো মানের পর্যাপ্ত ভ্যাকসিনের (টিকার) ব্যবস্থা করা। ক্ষুরারোগে আক্রান্ত হয়ে কোন পশু মারা গেলে তাকে ৬ ফুট মাটির গভীরে পুঁতে ফেলা। য়
প্রাণিস¤পদ স¤প্রসারণ কর্মকর্তা (এলডিডিপি), উপজেলা প্রাণিস¤পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল, ভোলাহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ মোবাইল : ০১৭১৬১২৬৩২৪
বারোমাসি সজিনার আধুনিক চাষ প্রযুক্তি
কৃষিবিদ মোঃ মোসারফ হোসেন
পুষ্টি ও ওষুধি গুণাগুণের বিবেচনায় সজিনা বর্তমানে বসতবাড়ির জন্য আদর্শ সবজি বা গাছ। সজিনার ইংরেজি নাম উৎঁস ঝঃরপশ এবং এর বৈজ্ঞানিক নাম গধৎরহমধ ড়ষবভবৎধ উৎপত্তিস্থল পাক-ভারত উপমহাদেশ হলেও শীত প্রধান এলাকা ছাড়া সব জায়গায়ই এটি পাওয়া যায়। বারোমাসি সজিনা গাছ সারা বছরই ফল দেয়। গাছে সব সময় ফুল ও কচি ফল হতে দেখা যায়।
সজিনার পুষ্টিগুণ
পুষ্টি বিজ্ঞানীরা সজিনা গাছকে অলৌকিক গাছ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এর পাতায় আট রকম অত্যাবশ্যক এমাইনো এসিডসহ ৩৮% আমিষ থাকে যা বহু উদ্ভিদে নাই। সজিনার পাতা পুষ্টিগুণের আধার। এছাড়া শুকনো সজিনার পাতায় উচ্চ মাত্রায় পুষ্টি থাকে। সজিনার বীজের তেলে সে এসিড থাকে তা বহু রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। এ গাছের প্রতি গ্রাম পাতায় গাজরের চারগুণ বেশি ভিটামিন এ, দুধের চেয়ে ৪ গুণ বেশি ক্যালশিয়াম, কলার চেয়ে ৩ গুণ বেশি পটাসিয়াম, কমলালেবুর চেয়ে সাতগুণ বেশি ভিটামিন, দইয়ের চেয়ে ২ গুণ বেশি প্রোটিন আছে। বিজ্ঞানীরা আরও বলেন, সজিনা পাতায় ৪২% আমিষ, ১২৫% ক্যালসিয়াম, ৬১% ম্যাগনেসিয়াম, ৪১% পটাশিয়াম, ৭১% লৌহ, ২৭২% ভিটামিন-এ এবং ২২% ভিটামিন -সিসহ দেহের আবশ্যকীয় বহু পুষ্টি উপাদান থাকে। ফলে এটি অন্ধত্ব, রক্তস্বল্পতাসহ বিভিন্ন ভিটামিন ঘাটতিজনিত রোগের বিরুদ্ধে বিশেষ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
সজিনার পাতাকে এন্টি-অক্সিডেন্টের খনি বলা হয়। ৪৬ রকমের এন্টি-অক্সিডেন্ট বিদ্যমান। এরমধ্যে ভিটামিন-সি, বিটা ক্যারোটিন, কিউরেকটিন এবং ক্লোরোজেনিক এসিড বিদ্যমান। উল্লেখ্য, এসব উপাদানই মানবদেহের জন্য উপকারী। বিশেষ করে ক্লোরোজেনিক এসিড রক্তের চাপ ও শর্করা কমাতে সাহায্য করে। এতে প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক থাকে এবং পালং শাকের চেয়ে তিনগুণ বেশি আয়রন বিদ্যমান, যা এ্যানেমিয়া দূরীকরণে বিশেষ ভ‚মিকা পালন করে থাকে। সজনে শরীরে কোলস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণেও অন্যতম অবদান রাখে। ৩ মাসের ব্যবহারে এটি কোলস্টেরল লেভেল অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পারে।
বারোমাসি সজিনার ইতিহাস : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইংয়ের যশোর হর্টিকালচার সেন্টারে ২০১৯ সালে বারোমাসি সজিনার চাষাবাদ উৎপাদন ও বিতরণ শুরু হয়। চকঝ-২ জাতের এ সজিনার চারা গবেষণার মাধ্যমে চট্টগ্রামের রাইখালীতে অবস্থিত কৃষি গবেষণা কেন্দ্র হতে বারোমাসি সজিনার জাতটি সর্বপ্রথম উদ্ভাবন হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইঅজও) থেকে পরবর্তীতে তা জাত হিসেবে অবমুক্ত হয়।
জাতটির বৈশিষ্ট্য : এ জাতটি মাটিতে চারা রোপণের ৬ মাসের মধ্যে গাছে ফল বা ডাটা ধরবে এবং সারা বছরই তা পাওয়া যাবে। একটি পূর্ণবয়স্ক গাছে বছরে মোট ১৬০০টি পর্যন্ত ফল ধরবে।
পলিমাটি সজিনা চষের জন্য সর্বোত্তম। এটি জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। কাটিং রোপণের জন্য উত্তম সময় এপ্রিল থেকে মে মাস। প্রতিটি লম্বা সজিনার ফলে ১০-১৫টি বীজ থাকে, এগুলো তিন শিরাবিশিষ্ট এবং ত্রিভুজাকৃতির। বীজ থেকে বংশবিস্তার সম্ভব হলেও অঙ্গজ বা কাটিং (ঈঁঃঃরহম) থেকে নতুন চারা তৈরি করাই সহজ এবং উত্তম।
চারা তৈরি : বীজ থেকে চারা তৈরির ক্ষেত্রে গাছ থেকে পরিপক্ব সজিনা সংগ্রহ করে মে মাসে সজিনা বীজ ডাঁটা থেকে আলাদা করা হয়। সংগৃহীত বীজ হালকা রোদ্রে শুকিয়ে বীজ হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। জুন-জুলাই মাসে সিডবেড ভালোভাবে কুপিয়ে পচা গোবর দিয়ে বেড প্রস্তুত করা হয়। সিড বেডের আকার ১ মিটার প্রস্থ ও জমির আকার অনুযায়ী লম্বা করা যেতে পারে। তবে বেডের চতুর্দিকে পানি নিষ্কাশনের জন্য ৩০-৫০ সেমি. আকারে ড্রেন রাখতে হবে। অতঃপর বীজ, বেডে ১০-১৫ সেমি. দূরে দূরে লাইন করে বপন করতে হবে। ৫০-৬০ দিন বয়সের চারা মাঠে লাগানোর উপযুক্ত হয়। চারা গজানোর থেকে শুরু করে চারা উঠানো পর্যন্ত সীডবেড আগাছামুক্ত ও সেচ প্রদান করতে হবে। কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই দমনের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে বীজ থেকে তৈরি চারার ফল আসতে ৩-৪ বছর সময় লাগে।
কাটিং হতে চারা তৈরি : কাটিং থেকে চার তৈরি করাই উত্তম। এক্ষেত্রে অল্প যতেœ দ্রæত ফলন পাওয়া যায়। বয়স্ক গাছ থেকে প্রæনিং এর সময় যে ডাল কেটে ফেলা হয় তা থেকে রোগ ও পোকামাকড়মুক্ত সতেজ ও স্বাস্থ্যবান শক্ত ডাল ২.৫-৩ ফুট (৭৫-৯০ সেমি.) লম্বা ও ৩-১৬ সেমি. ব্যাসবিশিষ্ট ডাল নির্বাচন করা উত্তম। প্রস্তুতকৃত কাটিং সরাসরি মূল জমিতে রোপণ করা হয়। কাটিং রোপণের জন্য উত্তম সময় এপ্রিল থেকে মে মাস।
কাটিং রোপণ পদ্ধতি : এক্ষেত্রে জমি ভালোভাবে চাষ করে ২০ ইঞ্চি ী ২.৫ ফুট আকারের গর্ত করতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে যে, কাটিং গর্তে লাগানোর সময় প্রতিটি কাটিং এর তিন ভাগের এক ভাগ গর্তের মাটির নিচে রাখতে হবে। কাটিং লাগানোর সময় গর্তের মাটির থেকে ৩-৪টি নিমপাতা এবং ১০ গ্রাম সেভিন ৮৫ ডবিøউপি গর্তের মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে কাটিং লাগালে মাটিতে পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়। গর্তে কাটিং লাগানোর পর কাটিংয়ের মাথায় আলকাতরা দিয়ে প্রলেপ দিতে হবে। এতে কাটিংয়ের মাথা শুকিয়ে যাবে না।
সার প্রয়োগ : সজিনার ভালো ফলন পাওয়ার জন্য প্রতি গর্তে পচা গোবর/কম্পোস্ট ৪০-৫০ কেজি, টিএসপি ৫০ গ্রাম, ইউরিয়া ১০ গ্রাম, এমওপি/পটাশ- ১০০ গ্রাম, জিপসাম- ১০ গ্রাম, দস্তাসার-১০ গ্রাম ও বোরন সার- ১০ গ্রাম সার প্রয়োগ করতে হবে।
প্রয়োগ পদ্ধতি : সজিনার কলম চারা রোপণের জন্য ২০-৩০ দিন আগে প্রতি গর্তে উপরোক্ত সার মাটির সাথে মিশিয়ে ঢেকে রেখে দিতে হবে। এছাড়া রাসায়নিক সার না দিয়ে প্রতি গর্তে ৪০-৫০ কেজি পচা গোবর সার গর্তের মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে উক্ত গর্তে সাথে সাথে চারা লাগানে যায়।
গাছ লাগানোর পর সার প্রয়োগ : প্রতি গাছের জন্য ৪০-৫০ কেজি পচা গোবর, ৫০০ গ্রাম করে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি. এবং জিপসাম, বোরাক্স ও জিঙ্ক সালফেট ৫০ গ্রাম করে সার দুপুর বেলায় সূর্যের আলো গাছের উপর পড়লে, গাছ যে পরিমাণ জায়গায় ছায়া প্রদান করে, সেই পরিমাণ জায়গায় গাছের চতুর্দিকের মাটি কোদাল দিয়ে ভালোভাবে কুপিয়ে সার মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর প্রতি বছরে প্রতি গাছের জন্য ৪০-৫০ কেজি পচা গোবর ঠিক রেখে ৫০০ গ্রাম করে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সার এবং জিপসাম, বোরাক্স ও জিঙ্ক সালফেট সার ২০ গ্রাম করে বর্ধিত হরে প্রয়োগ করতে হবে।
পরিচর্যা : সজিনা গাছের তেমন একটা পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। শুধু গরু ছাগলের উপদ্রব ঠেকানো সম্ভব হলেই গাছগুলো বড় হয়ে ওঠে এবং তাতে ভালো ফলন হয়। মাটির উপর সার ও কীটনাশকের খুব একটা প্রয়োজন হয় না।
সজিনার মাথা কাটা বা ঝোপালোকরণ : গাছ ১ মিটার উচ্চতা হলেই প্রথম ডগা কাটতে হবে। গাছকে বেশি লম্বা হতে না দিয়ে ২-৩ বার মাথা কেটে দিলে গাছে বেশি ফল ধরে ও দ্রæত বড় হবে। চারা রোপণ করলে প্রথমে ১০ সেমি. আগা কাটতে হবে। দ্বিতীয় বার ডগা বের হলে তা ২০ সেমি. পর কেটে ফেলতে হবে। পছন্দসই ডগা রেখে বাকিগুলো সব কেটে ফেলতে হবে। এতে করে গাছের আকৃতি ঝোপালো, ফলন বেশি এবং ফল সংগ্রহ সুবিধা হবে। নতুবা লম্বা ডালে অল্প সজিনা হবে যা পাড়তে গেলে ডাল কাটতে হবে।
ফলন ও বার্ষিক আয় : একটি পূর্ণবয়স্ক গাছে বছরে ১৬০০টি পর্যন্ত সজিনার ফল বা ডাটা উৎপাদন হবে। বারোমাসি চারা লাগানোর ৬ মাস পর থেকে ফল ধরবে এবং তা সারা বছর পাওয়া যাবে। সাধারণত বছরে ২০টি ফলে ১ কেজি সজিনা হয়। এ হিসেবে ১টি গাছ থেকে বছরে ২ মণ সজিনা উৎপন্ন হবে। যা বিক্রি করে ৬৮০০ টাকা পাওয়া যেতে পারে। বাণিজ্যিকভাবে চাষ করলে ১ বিঘা জমিতে ৪০টি গাছ রোপণ করে ১,৫৬ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।
সাথী ফসল : সজিনা গাছকে বাউনি বৃক্ষ হিসেবে ব্যবহার করে গাছআলু চাষ করা যায়। শীতের পূর্বেই গাছআলু সংগ্রহ করে নিলে বসন্তে সজিনার ফলন শুরু হয়। সজিনা লাগালে স্থায়ী ফসল হিসেবে শীতকালীন সবজি যেমন- ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, ব্রোকলি, টমেটো, ধনিয়া ও হলুদের চাষ করা যায়।য়
পরিচালক (অব.), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল ঃ ০১৬৭৬৭১৩২৮০
পরিবেশ সুরক্ষায় সুন্দরবনের ব্লু কার্বন
ড. আসম হেলাল উদ্দীন আহম্মেদ সিদ্দীকি
সুন্দরবন হচ্ছে অক্সিজেনের কারখানা। যা মানবদেহের ফুসফুসের ন্যায় কাজ করে। বায়ুমÐলে কার্বন ডাই-অক্সাইড গাছ গ্রহণ করে বিশুদ্ধ অক্সিজেন ত্যাগ করে। পৃথিবীর বায়ুমÐলকে গ্রহণ উপযোগী করে তোলে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা উষ্ণায়ন প্রশমন করে থাকে। বায়ুমÐলের কার্বন- ডাই-অক্সাইড পরিবর্তিত করে পাতার মাধ্যমে সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় জৈব যৌগে রূপান্তরের পদ্ধতিই হলো কার্বনের আত্মীকরণ। অন্য কথায় সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় অন্ধকার দশার পরিবেশ থেকে গৃহীত কার্বন ডাই-অক্সাইড উদ্ভিদ কোষে অবস্থিত রাইবুলোজ ডাই ফসফেট এর সঙ্গে বিক্রিয়া করে ফসফোগিøসারিক অ্যাসিড উৎপন্ন করে; যা পরপর কয়েকটি ধাপের মাধ্যমে শর্করা জাতীয় খাদ্য তৈরি করে। এভাবে সবুজ উদ্ভিদ কোষে ঈঙ২ এর কার্বন কোষসহ যৌগ অঙ্গীভূত হওয়াকে কার্বন আত্মীকরণ বুঝায়।
প্রতিনিয়ত বায়ুমÐলে ঈঙ২ এর পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। সুন্দরবনের বিশাল আয়তনের বনভূমির গাছপালা, প্রকৃতির সবুজ বৃক্ষ, সায়ানো ব্যাকটেরিয়া এবং বøু গ্রিন এ্যালজি বাতাসে ঈঙ২ এর আত্মীকরণের মাধ্যমে শর্করা উৎপাদন করে কার্বন আত্মীকরণ করে থাকে। যা বনভ‚মি তথা গাছপালা এবং পরিবেশ সুরক্ষায় সহায়ক। কার্বন আত্মীকরণ বিশ্লেষণে জানা যায় মূলের মোট ওজনের ৪৩-৪৫ শতাংশ, কাÐের মোট ওজনের ৪২.৪-৪৩.০৫ শতাংশ এবং পাতার মোট ওজনের ৪২.০৯-৪২.৫ শতাংশ কার্বন থাকে। নিচে সারণি-১ এ কার্বন আত্মীকরণ বিশ্লেষণের তথ্য প্রদর্শিত হয়েছে। সুন্দরবনের মাটিতে জৈব কার্বন প্রিমনসুনে ০.৫১% এবং বর্ষার পর মৌসুমে ০.৬৫%। এক গবেষণা তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায় সুন্দরবনে মাটির উপর ৩৬.২৪ ঞম (ঞবৎধমৎধস) কার্বন এবং মাটির নিচে ৫৪.৯০ ঞম কার্বন সব মিলে ৯১.১৯ ঞম কার্বন সঞ্চিত আছে।
সুন্দরবনের কম লবণাক্ত অঞ্চলের মিঠা পানির বনে সুন্দরী গাছ বেশি পরিমাণে কার্বন আত্মীকরণ করে থাকে। যার মাত্রা ৫৪.৬০ ঞম কার্বন। অপর পক্ষে তীব্র লবণাক্ত অঞ্চলের বনের কার্বনের পরিমাণ খুবই কম মাত্র ১৯.৯০ ঞম কার্বন । ধারণা করা হচ্ছে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে মিঠাপানি এলাকার বনভূমির কার্বন আত্মীকরণের পরিমাণ ২২.৪২ ঞম কমে যাবে এবং লবণাক্ত এলাকায় ৮.২০ ঞম কার্বন বৃদ্ধি পাবে।
এ বিষয়ে আরো তথ্য পাওয়া গেছে যে আগামী ২১১৫ সালের মধ্যে সুন্দরবনের কম এবং তীব্র লবণাক্ত এলাকায় ৫১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার কার্বন হারিয়ে যাবে এবং ৫৮.২৮ ঞম কার্বন হাওয়া হয়ে যাবে।
জৈব কার্বন ম্যানগ্রোভ এবং জলাভূমিতে নিপতিত থেকে বøু কার্বন ভাÐার নামে বৈষ্ণিক কার্বন আত্মীকরণের মাধ্যমে উপক‚লীয় বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ করছে। ফলে বন ধ্বংস ও উজাড় করণের কিছুটা হলেও নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে। জৈব কার্বন ডাই অক্সাইড, বাই কার্বনেট প্রভৃতি আকারে সঞ্চিত হয়ে সামুদ্রিক বায়ুমÐলের ভারসাম্যতা আনায়নে সহযোগিতা করে থাকে। বায়ুমÐল হতে কার্বন আত্মীকরণের মাধ্যমে বনভূমিতে এবং বনভূমি হতে পাতা ও শিকড়ের মাটিতে নিপতিত হয় আবার বনভূমি হতে কিছু পরিমাণ কার্বন পুনরায় বায়ুমÐলে ফিরে যায় চক্রাকারে।
সুন্দরবনসহ বনভূমির বাতাস কার্বন আত্মীকরণের বিশাল আধার। সুন্দরবনের বনভূমির কম লবণাক্ত অঞ্চলে সুন্দরী বৃক্ষ সমৃদ্ধ এলাকায় আত্মীকরণকৃত কার্বনের পরিমাণ ৪৫.৬০ ঞম এবং মৃদু লবণাক্ত অঞ্চলের সুন্দরী, বাইন ও কাঁকড়া সমৃদ্ধ এলাকায় আত্মীকরণকৃত কার্বনের পরিমাণ ৩০.৬৯ ঞম এবং তীব্র লবণাক্ত অঞ্চলের গেওয়া-গরান সমৃদ্ধ এলাকায় আত্মীকরণকৃত কার্বনের পরিমাণ ১৪.৯০ ঞম । সারণি-২ এ সুন্দরবনের আত্মীকরণকৃত মোট কার্বনের পরিমাণের তথ্য প্রদর্শিত হয়েছে।
সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের এক গবেষণা তথ্যে জানা যায় বিভিন্ন অবস্থানে বিভিন্ন প্রজাতির ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের মাটির উপর, মাটির নিচে কার্বনের শতকরা মোট অবদানের ব্যপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। মোট কার্বন পার হেক্টরে বিভিন্ন অবস্থানে বিভিন্ন ম্যানগ্রোভ প্রজাতির মধ্যে তারতম্য ঘটে। এখানে উল্লেখ্য সুন্দরবনের কম লবণাক্ত এলাকার উদ্ভিদরাজি তুলনামূলকভাবে অন্য এলাকার চেয়ে বেশি কার্বন আত্মীকরণ করে থাকে। বৈষ্ণিক অর্থনীতিতে সুন্দরবনের বøু কার্বন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ সুন্দরবন হতে বায়ুমÐলীয় কার্বন আত্মীকরণের মূল্য ২.২৬ বিলিয়ন ইউ এস ডলার প্রতি বছর। সুন্দরবনের মাটির উপর, মাটির নিচে এবং মোট বøু কার্বন স্টক ৯১.১৯ ঞম । যা কম লবণাক্ত এলাকার বনভূমিতেই সর্বাধিক। গাছ ও কাঠের মধ্যে কার্বন সংগৃহীত থাকে যা বায়ুমÐলের উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। সুতরাং কার্বন আত্মীকরণে বনভূমি তথা গাছ-পালার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ আলোচনা হতে স্বভাবতই বলা চলে সুন্দরবনের বøু কার্বন বাংলাদেশ তথা বিশ্ববাসীর এক অমূল্য সম্পদ।য়
বিভাগীয় কর্মকর্তা, ম্যানগ্রোভ সিলভিকালচার বিভাগ, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, খুলনা, মোবাইল : ০১৭১৮৫০৩৪৪৯
ই-মেইল : dhelalrobfri@yahoo.com
কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টিন
সৈয়দ মুনিরুল হক
করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে চলছে অস্থিরতা। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জানিয়েছে আগামীতে খাদ্য সংকট হতে পারে। আমাদের মাননীয় কৃষি মন্ত্রী মহোদয় করোনা পরবর্তী খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নিরন্তন কাজ করছেন। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দেশের প্রতি ইঞ্চি জমিকে আবাদের কাজে লাগানোর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিকনির্দেশনা রয়েছে। সরকারি নির্দেশনা মেনে পতিত জমিতে কৃষি সম্প্রসারণের কার্যকরি উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে।
বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির কারণে দানাদার খাদ্যশস্যের পাশাপাশি শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদনে দেশে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। কিন্তু উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য রপ্তানির এক বিশাল সম্ভাবনা থাকলেও সেই সুযোগ আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। আমাদের দেশে কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে এখনো অর্গানিক ফার্মিং/ ঈড়হঃৎধপঃ ফার্মিং এর ব্যাপক প্রসার ঘটেনি। ঈড়হঃৎধপঃ ঋধৎসরহম ছাড়া কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত তাতে কী কী ইনপুট (সার, কীটনাশক ইত্যাদি) কী মাত্রায়, কখন প্রয়োগ করা হচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয় না। তাছাড়া মাটি পরীক্ষা করা হয়না বিধায় কোন গরপৎড়/গধপৎড় বষবসবহঃ এর ঘাটতি রয়েছে কিনা তারও সঠিক তথ্য নেই । ফলে গজখ (গধীরসঁস জবংরফঁব খরসরঃ) মাত্রা না জানার জন্য উন্নত বিশ্বে আমাদের উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্যে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
কীটনাশক মানেই বিষ। কৃষকের কাছে কীটনাশক মানেই আক্রান্ত পোকামাকড় মেরে অধিক ফসল পাওয়ার এক ওষুধ। তাই তারা ক্ষেতে পোকামাকড় দেখা মাত্রই কীটনাশক প্রয়োগ করে। অনেক সময় সবজি উত্তোলনের দিনও কীটনাশক ব্যবহার করা হয় । কীটনাশক অবশিষ্টাংশ (জবংরফঁব) বিষক্রিয়ায় আমাদের দেহে নানা জটিল ও দুরারোগ্য রোগ সৃষ্টি হয়। অসতর্কভাবে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ধ্বংস হচ্ছে অ্যাকোয়াটিক ইকোসিস্টেম। মাছেও এখন কীটনাশকের উপস্থিতি রয়েছে। উন্নত বিশ্ব অনেক আগে থেকেই স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন ফলে তারা কৃষি ক্ষেত্রে ঙৎমধহরপ ফার্মিং এর ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে । আশার কথা হলো কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর মাধ্যমে কৃষিজ পণ্য রপ্তানির উদ্দেশ্যে সরকার সম্প্রতি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ উদ্যোগের দরুন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর কাজ নিবিড় তত্ত¡াবধানে পরিচালিত হবে। ফলে কৃষিজ পণ্য উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়া জবপড়ৎফ শববঢ়রহম করা সম্ভব হবে।
উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত পণ্য রপ্তানিতে চষধহঃ ছঁধৎধহঃরহব জঁষবং ২০১১ ্ চষধহঃ ছঁধৎধহঃরহব ঙৎফরহধহপব ২০১৮ সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতাও অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। অধিকাংশ সময়েই দেখা যায় আমরা যে দেশে কৃষিজাত পণ্যে রপ্তানি করব সেই দেশের চযুঃড়ংধহরঃধৎু জবয়ঁরৎসবহঃ সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই। তাছাড়া ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঝঃধহফধৎফ ড়ভ চযুঃড়ংধহরঃধৎু গবধংঁৎবং (ওঝচগ) এঁরফবষরহব মেনে যে ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঞৎধফব পরিচালিত হয় সেই বিষয়ে রপ্তানিকারকরাও অধিকাংশ অজ্ঞ। চযুঃড়ংধহরঃধৎু জবয়ঁরৎসবহঃ ঈড়সঢ়ষু না করতে পারায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমাদের নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। যেমন রাশিয়ায় আলু রপ্তানির বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্তে¡ও রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে যা আজও চালু করা যায়নি। সম্প্রতি ফিজির একদল বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশে সফর করে আলুর প্রতি আগ্রহ দেখালেও তাদের চযুঃড়ংধহরঃধৎু জবয়ঁরৎসবহঃ পূরণ করতে না পারায় আলু রপ্তানির সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।
এজন্য উৎপাদিত কৃষি পণ্যে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশের বিষক্রিয়া পরীক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন । কীটনাশক অবশিষ্টাংশ সম্পর্কে ঋঅঙ/ডঐঙ এর যৌথ বাস্তবায়নে ঈড়ফবী অষরসবহঃধৎরঁং ঈড়সসরংংরড়হ এর নির্দিষ্ট নীতিমালা আছে । বাংলাদেশ যেহেতু এর স্বাক্ষর দাতা একটি দেশ কাজেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রবেশ করতে হলে চবংঃরপরফব জবংরফঁব খবাবষ সম্পর্কে গবেষণা করা দরকার। রপ্তানির পাশাপাশি আমদানি পণ্যেও চবংঃরপরফব জবংরফঁব অহধষুংরং করা দরকার । বর্তমানে নিরাপদ খাদ্য প্রবিধানমালা, ২০১৭ অনুযায়ী গজখ এর সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা (ঢ়ঢ়স) নির্ধারণ করা আছে।
যেসব কৃষিজাত পণ্য বিদেশ হতে আমদানি করা হয় তার মাধ্যমে রোগজীবাণু ও পোকামাকড় যা আমাদের দেশে নেই বা থাকলেও ঙভভরপরধষষু ঈড়হঃৎড়ষষবফ অবস্থায় আছে সেসব জীবাণু ও পোকামাকড় আমাদের দেশে অনুপ্রবেশ করে ফসলের জন্য যেন মারাত্মক ক্ষতির/ধ্বংসের কারণ হতে না পারে তা প্রতিরোধ করাই হচ্ছে প্লান্ট কোয়ারেন্টিন। এই জন্য চবংঃ জরংশ অহধষুংরং (চজঅ) করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঝঃধহফধৎফং ড়ভ চযুঃড়ংধহরঃধৎু গবধংঁৎবং (ওঝচগ) এর অধিকাংশ গাইডলাইনই চজঅ সংক্রান্ত যা অনুসরণ করে এই ব্যাপারে সারা বছর গবেষণা কার্যক্রম চালু রাখা দরকার। বাংলাদেশে অল্প কয়েকটি ফসলের চজঅ কার্যক্রম ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। তবে এই কাজের ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। কারণ আমদানির জন্য আমদানি অনুমতিপত্রে (ওচ) পরিবর্তিত বাস্তব অবস্থার উপর রোগজীবাণু ও পোকামাকড় সংক্রমণের ফসলভিত্তিক সঠিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আমদানি অনুমতিপত্রে অতিরিক্ত শর্তাবলীতে সংযোজন বিয়োজন করাটা অত্যন্ত জরুরি।
বিদেশে পণ্যে রপ্তানির জন্য পণ্যের ক্যাটাগরি এবং দেশ ওয়ারি টার্গেট ঠিক করে রপ্তানির জন্য সেই রপ্তানিকারী দেশের ওসঢ়ড়ৎঃ জবয়ঁরৎসবহঃ প্রতিপালন করা সম্ভব হলেই কেবল সেই পণ্যে রপ্তানির সুযোগ থাকবে। অপরদিকে যেসব পণ্যের রপ্তানিকারী দেশের ওসঢ়ড়ৎঃ জবয়ঁরৎসবহঃ বর্তমানে বাস্তব সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতিপালন করা যাচ্ছে না সেগুলোর ব্যাপারে অতি দ্রæত রপ্তানি বৃদ্ধির স্বার্থে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। সেই লক্ষ্যে দ্রæত অন্তত পক্ষে একটি হলেও অপপৎবফরধঃবফ খধনড়ৎধঃড়ৎু স্থাপন অপরিহার্য। অপপৎবফরধঃবফ খধনড়ৎধঃড়ৎু স্থাপনের জন্য ল্যাবরেটরি সংশ্লিষ্ট জনবলের সুস্পষ্ট কার্যপরিধি ও প্রয়োজনীয় অর্গানোগ্রাম নির্ধারণ করাও দরকার। এই ব্যাপারে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কোয়ারেন্টিন অর্গানোগ্রাম অনুসরণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র হিসাবে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সমুদ্র বন্দর ও হজরত শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাধ্যমে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যে রপ্তানির নিমিত্তে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সংবলিত একটি প্যাকিং হাউজ নির্মাণ করা যেতে পারে। যার মাধ্যমে পণ্যের দ্রæত ওহংঢ়বপঃরড়হ ও পরীক্ষা করে গ্রেডিং, সর্টিং, প্যাকেজিং এর মাধ্যমে চযুঃড়ংধহরঃধৎু জবয়ঁরৎসবহঃ পূরণ সাপেক্ষে রপ্তানি কার্যক্রম বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।
বিজ্ঞান এবং তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাভারস্থ পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের খাদ্য ও বিকিরণ জীববিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ‘‘কীটনাশক সংক্রান্ত গবেষণা ও পরিবেশের অবশিষ্টাংশ পরিবীক্ষণ ” শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে শাকসবজি সংগ্রহ করে কীটনাশক অবশিষ্টাংশের বিষক্রিয়ার মাত্রা পরীক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু সে সময় দেশের জন্য গ্রহণযোগ্য গধীরসঁস জবংরফঁব খরসরঃ(গজখ) বা অপপবঢ়ঃধনষব উধরষু ওহঃধশব (অউও) মাত্রা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান বাস্তবতায় গজখ নির্ণয়ের জন্য সহায়ক ল্যাবরেটরি হিসাবে পরমাণু শক্তি কমিশনের ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ ঋড়ড়ফ জধফরধঃরড়হ ্ ইরড়ষড়মু(ওঋজই) এর ল্যাব অথবা ইধহমষধফবংয অমৎরপঁষঃঁৎধষ জবংবধৎপয ওহংঃরঃঁঃব(ইঅজও) ল্যাবে ক্রস চেক অহধষুংরং করা যায় কি না সেটাও চিন্তা করা যেতে পারে। বর্তমান সরকার বাংলাদেশে “নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ” নামে একটি সংস্থা গঠন করেছে । যেখানে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কোডেক্স ফুড কোড অনুযায়ী খাদ্যদ্রব্যের সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বে আমাদের শাকসবজি-ফলমূল রপ্তানি করতে হলে আমাদের অবশ্যই আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মেনেই রপ্তানি করতে হবে। এই ক্ষেত্রে যে অঞ্চলের শাকসবজি, ফলমূল রপ্তানি করা হবে সেই এলাকাসহ আশপাশের এলাকায় চবংঃ জরংশ অহধষুংরং করে ওঝচগ অনুযায়ী ঘড়ঃরভরপধঃরড়হ করতে হবে। উৎপাদন পর্যায় থেকে শুরু করে রপ্তানি করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে মনিটরিং, জবপড়ৎফ কববঢ়রহম সহ সুনির্দিষ্ট ভাবে গজখ সহ তাদের ওসঢ়ড়ৎঃ জবয়ঁরৎসবহঃ অনুযায়ী পণ্যটি ঈড়সঢ়ষু করে তারপর রপ্তানি করতে হবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে পেস্টিসাইড রেসিডিও ল্যাব স্থাপন করা যথেষ্ট ব্যয়বহুল এবং রেসিডিও অ্যানালাইসিসের কাজ অত্যন্ত সূ² । যা করতে অত্যন্ত দক্ষ প্রশিক্ষিত জনবল দরকার। প্রায় প্রতিটি দেশেই ঘচচঙ (ঘধঃরড়হধষ চষধহঃ চৎড়ঃবপঃরড়হ ঙৎমধহরুধঃরড়হ) স্বাধীন স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে কাজ করে আসছে। অন্যান্য দেশের আলোকে আমাদের প্ল্যাট কোয়ারেন্টিনসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনার বর্তমান ব্যবস্থাকে পুর্নবিন্যাস করার ব্যাপারে নীতি নির্ধারকগণের সক্রিয় বিবেচনা প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাপী কোয়ারেন্টিন সার্ভিস পুরোপুরি জবমঁষধঃড়ৎু ঝবৎারপব যা আন্তর্জাতিক বিধিবিধান, আমদানি-রপ্তানি নীতি, ওঝচগ জঁষবং, ওঝঞঅ জঁষবং সহ ঝধহরঃধৎু ্ চযুঃড়ংধহরঃধৎু অমৎববসবহঃ(ঝচঝ) সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকা আবশ্যক। এ ব্যাপারে দক্ষ জনবল তৈরি করা যেমন সময়সাপেক্ষ তেমনি দক্ষ জনবলকে সঠিকভাবে পদায়ন ও পরিচালনা করাও আবশ্যক। উন্নত যন্ত্রপাতির সাথে সাথে দক্ষ জনবল, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও কাজের জন্য সময়মতো প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ, সুনির্দিষ্ট অর্গানোগ্রাম কাঠামো নিশ্চিতকরণ করা হলে তা কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি বাড়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টিনের বর্তমান ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি স্বতন্ত্র ওয়েবসাইট পরিচালনা করা অত্যন্ত জরুরি যেন আমদানি ও রপ্তানিকারকরা এ সংক্রান্ত সকল তথ্য এক জায়গায় পেতে পারেন। সেই সাথে প্রয়োজন পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন।
করোনাকালীন সময়ের অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে যে কোনো অজানা জীবাণু কিভাবে জীবন ও জীবিকাকে লÐভÐ করে দিতে পারে। তাই দেশের ঐঁসধহ ছঁধৎধহঃরহব, চষধহঃ ছঁধৎধহঃরহব, অহরসধষ ছঁধৎধহঃরহব ধহফ ঋরংয ছঁধৎধহঃরহব এর কার্যক্রমকে অবিলম্বে জোরদার করা দরকার। যদি কোন ভাবে কোন অজানা পোকামাকড়, রোগ জীবাণু দেশে প্রবেশ করে আমাদের প্রধান শস্য ধান গাছে একবার আক্রমণ করে একটি মৌসুমে ধানের উৎপাদন পুরোপুরি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কাজেই বর্তমান বাস্তবতায় কোয়ারেন্টিন এর গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতীয় কোয়ারেন্টিন দিবস পালনসহ ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট মহল এই ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করে দ্রæত যুগোপযোগী ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এটাই প্রত্যাশা।য়
কোয়ারেন্টিন প্যাথোলজিস্ট, সমুদ্র বন্দর, চট্টগ্রাম, মোবাইল: ০১৭৫১৬৪৬৬১১, ই-মেইল : syedhq74@gmail.com
সময় জেনে পরাগায়ন : লাউ কুমড়ার অধিক ফলন
কৃষিবিদ মেহেদী হাসান খান
সাধারণত যৌন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কুমড়াগোত্রীয় ফসলের বংশবিস্তার হয়ে থাকে। কিন্তু বেশির ভাগ কুমড়াগোত্রীয় ফসলের ফুল অসম্পূর্ণ হওয়ায় পরাগায়নের জন্য অন্য মাধ্যম যেমন কীটপতঙ্গের প্রয়োজন হয়। পরাগায়ন ঠিকমতো না হলে ফল শুকিয়ে পচে বা ঝরে গিয়ে প্রায় ৯৫% ফলন কমে যেতে পারে। তখন হাত পরাগায়নের মাধ্যমে কৃত্রিম উপায়ে পরাগায়ন করিয়ে দিতে হয়। এজন্য কুমড়াগোত্রীয় ফুল কখন ফোটে এবং হাত পরাগায়ন কখন করতে হয় সে বিষয়ে আমাদের জানা প্রয়োজন।
প্রথমে যে ফসলটি নিয়ে আলোচনা করব সেটি হচ্ছে শসা। শসার পুরুষ ফুল ফোটা বা বন্ধ হওয়া দিনের আলোর দৈর্ঘ্যরে সাথে সম্পর্কযুক্ত। পুরুষ ফুল সাধারণত সকালে ফোটে এরং পরাগরেণু দুপুর ২.০০টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ কর্মক্ষম থাকে এবং বেলা বাড়ার সাথে সাথে নিস্ক্রিয় হতে থাকে। শশার স্ত্রীফুলও সকালে ফোটে তবে ফুল ফোটার ২ ঘণ্টার মধ্যে পরাগায়ন করতে হবে। কেননা গর্ভমুÐ খুব কম সময়ের জন্য কর্মক্ষম থাকে।
তিতা স্বাদযুক্ত করলার ফুল ভোর ৪.০০টা থেকে সকাল ৭.৩০টা এর মধ্যে ফুটতে শুরু করে এবং সকাল ৬.০০ টা থেকে সকাল ৯.৫৫টা পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে ফুটে যায়। পুরুষ ফুলের পরাগধানী সকাল ৬.০০টা থেকে সকাল ৮.৫৫টা পর্যন্ত পরাগরেণু উন্মুক্ত করে। তাই সকাল ৬.০০টা থেকে সকাল ৯.০০টার মধ্যে করলার কৃত্রিম পরাগায়ন করতে হবে। গর্ভমুÐের ধারণক্ষমতা সাধারণত ফুল ফোটার ৮ ঘণ্টা আগে থেকে ফুল ফোটার ১২ ঘণ্টা পর পর্যন্ত সক্রিয় থাকে।
বিভিন্ন মিনারেল সমৃদ্ধ লাউ ফসলের ফুল সকাল ৯.০০টা থেকে ফুটতে শুরু করে এবং বিকাল ৪.০০টা থেকে রাত ৮.০০টার মধ্যে সম্পূর্ণ ফুল প্রস্ফুটিত হয়। পরাগধানী সকাল ১১.০০টা থেকে ২.০০টার মধ্যে পরাগরেণু উন্মুক্ত করে। লাউ ফুল ফোটার পর অল্প সময় খোলা থাকে ফলে লাউয়ের পরাগায়ন বিকাল ৪.০০টা থেকে সন্ধ্যা ৭.০০টার মধ্যে করতে হবে।
আরেকটি সুস্বাদু ফল খরমুজের ফুল ফোটার সময় সকাল ৫.৩০টা থেকে সকাল ৬.৩০টা।পরাগধানী সাধারণত সকাল ৫.০০টা থেকে ৬.০০টার মধ্যে পরাগরেণু উন্মুক্ত করে এবং রেণু সকাল ৫.০০টা থেকে দুপুর ২.০০টা পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকে। গর্ভমুÐের ধারণক্ষমতা ফুল ফোটার ২ ঘণ্টা আগে থেকে ৩ ঘণ্টা পর পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। ফলে খরমুজের কৃত্রিম পরাগায়ন সকাল ৫.০০টা থেকে সকাল ৮.০০টার মধ্যে করতে হবে।
গ্রীষ্মকালীন সুস্বাদু ফল তরমুজ। তরমুজের শীর্ষ থেকে ৪র্থ থেকে ১২তম পাতায় প্রথম পুরুষ ফুল ফোটে এবং পরবর্তীতে কিছুদিন পর স্ত্রী ফুল এবং উভলিঙ্গ ফুল ফোটে। তরমুজ ফুল সাধারণত সকাল ৫.৩০টা থেকে সকাল ৭.০০টার মধ্যে ফোটে। খুব সকালে পরাগায়ন করে দিলে ফল ধারণ বৃদ্ধি পায়। এজন্য সকাল ৫.৩০টা থেকে ৭.০০টার মধ্যে পরাগায়ন করে দিতে হবে। রেণু সাধারণত তাজা অবস্থায় ভাল কাজ করে। রুম তাপমাত্রায় সাধারণত ৫ ঘণ্টা ভাল থাকে। ৩০ ঘণ্টা পর রেণু পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়।
পটোলের ফুল সাদা। পটোলের পুরুষ এবং স্ত্রী গাছ আলাদা। পটোল একটি উচ্চমাত্রার পর-পরাগায়ন ফসল। এজন্য স্ত্রী এবং পুরুষ গাছের অনুপাত হতে হবে ৯:১ অথবা ১০:১। পুরুষ ফুল স্ত্রী ফুলের ১৫ থেকে ২৯ দিন পর জন্মায়। তাই পুরুষ গাছ স্ত্রী গাছের চেয়ে ১৫-২০ দিন আগে রোপণ করতে হয়। পটোল ফুলের কৃত্রিম পরাগায়ন ভোর ৫.০০টা থেকে সকাল ৮.০০টার মধ্যে করতে হয়।
ঝিঙে ফুল বিকালের দিকে ফোটে। ফুল ফোটার সময় সাধারণত বিকাল ৫.০০টা থেকে রাত ৮.০০টার মধ্যে। পরাগধানী পরাগরেণু বিকাল ৫.০০টা থেকে ৮.০০টা এর মধ্যে উন্মুক্ত করে। পরাগরেণুর কর্মক্ষমতা ফুল ফোটার দিন সবচেয়ে বেশি থাকে এবং ২-৩ দিন পর্যন্ত এটা স্থায়ী হয়। গর্ভমুÐের ধারণক্ষমতা ফুল ফোটার ৬ ঘণ্টা আগে থেকে ফুল ফোটার ৮৪ ঘণ্টা পর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তবে ফুল ফোটার দিন বিকাল ৫.০০টা থেকে রাত ৮.০০টার মধ্যে ঝিঙে ফুলের পরাগায়ন করিয়ে দিতে হবে।
সন্ধ্যা ৭.০০টা থেকে রাত ৮.০০টার মধ্যে ফুটতে শুরু করে চিচিঙ্গা ফুল এবং স্ত্রী ফুল ১ থেকে ২ ঘণ্টার মধ্যে সম্পূর্ণ ফুটে যায়। পুরুষ ফুলের ফুটতে ১৯ মিনিট থেকে ৩৩ মিনিট সময় লাগে। বিকাল ৪.০০টা থেকে ৫.০০টার মধ্যে পরাগধানী ফাটতে শুরু করে এবং ৩ ঘণ্টার মধ্যে অর্থাৎ সন্ধ্যা ৭.০০টা থেকে রাত ৮.০০টার মধ্যে পরাগরেণু উন্মুক্ত হয়। চিচিঙ্গা ফুলের কৃত্রিম পরাগায়ন সকাল ৬.০০টা থেকে সকাল ৯.০০ টার মধ্যে করতে হবে।
কাঁকরোলের পুরুষ এবং স্ত্রী ফুল আলাদা গাছে ধরে এবং পুরুষ গাছে কুড়ি ধারনের ১৫দিন পরে ফুল ফোটে এবং স্ত্রী গাছে ফোটে ১০ দিন পর। তাই পুরুষ গাছ আগে লাগাতে হয়। কাঁকরোল পুরুষ ফুল ভোর ৪.০০ টার সময় ফুটতে শুরু করে। স্ত্রী ফুল সকাল ৬.০০টা থেকে ৬.২০টার মধ্যে ফুটতে শুরু করে। সকাল ৫.০০টা থেকে ৬.০০টার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফুল ফোটে। ফুল ফোটার ১২ ঘণ্টার মধ্যে পরাগায়ন করলে ৬৪% পর্যন্ত ফল ধারণ করে। ১২ ঘণ্টার উপরে গেলে ফল ধারণ ১৭% এর নিচে চলে আসে। এজন্য ফুল ফোটার সাথে সাথে পরাগায়ন করে দিতে হবে।
মিষ্টি কুমড়া ফুল ভোর ৩.০০টা থেকে ভোর ৪.০০টা পর্যন্ত ফুটতে শুরু করে এবং ভোর ৫.০০টা থেকে ৬.০০ টার মধ্যে সর্বোচ্চ ফুল ফোটে। ফুল সাধারণত ৩ ঘণ্টা ৩০ মিনিট ফুটন্ত অবস্থায় থাকে। ফুটন্ত ফুল সকাল ৮.০০টা থেকে বন্ধ হওয়া শুরু করে এবং ১১.০০টার মধ্যে সম্পূর্ণ ফুল বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য মিষ্টি কুমড়ার কৃত্রিম পরাগায়ন সকাল ৮.০০টার মধ্যে করতে হবে।
চাল কুমড়ার পুরুষ ফুল সাধারণত ভোর ৪.৩৩টা থেকে ভোর ৪.৪৫টা নাগাদ ফুটতে শুরু করে এবং ২০ মিনিট থেকে ৩০ মিনিট এর মধ্যে সম্পূর্ণ ফুল ফুটে যায়। স্ত্রী ফুল ভোর ৪.২০টা থেকে ভোর ৪.৩০টা নাগাদ ফুটতে শুরু করে এবং ২০ মিনিট থেকে ২৫ মিনিট এর মধ্যে সম্পূর্ণ ফুল ফুটে যায়। পরাগধানী সাধারণত রাত ১.৪৫টা থেকে ২.৪০টা এর মধ্যে ফাটতে শুরু করে এবং গর্ভমুÐের ধারণক্ষমতা ফুল ফোটার ৬ ঘণ্টা আগে থেকে শুরু করে ১৬ ঘণ্টা পর পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। পরাগরেণু ফুল ফোটার ২০ ঘণ্টা পর পর্যন্ত সজীব থাকে। চাল কুমড়ার কৃত্রিম পরাগায়ন সকাল ৯.০০টার মধ্যে করতে হয়।
তবে কৃত্রিম পরাগায়নের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে সেটি হচ্ছে পুরুষ এবং স্ত্রী ফুল দুটি যেন একই সময় ফুটেছে এমন ফুল নির্বাচন করা হয়। বড় ক্ষেত হলে স্প্রে মেশিনে পানি নিয়ে পরাগরেণু মিশিয়ে স্প্রে করা অথবা ড্রপার দিয়ে ফুলে পানির ফোটা দেয়া। তাহলে ফল ধারণ বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া যদি ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম পাথুরে চুন এবং ৩ গ্রাম বোরন সার মিশিয়ে পরপর ৩ দিন বিকালে গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত সম্পূর্ণ ভিজিয়ে দেয়া হয় তাহলে পুরুষ ফুলের সংখ্যা কমে যাবে স্ত্রী ফুলের সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং ফলন বৃদ্ধি পাবে।
কাজেই আমরা যদি সঠিক সময় নির্ধারণ করে কুমড়াগোত্রের ফসলগুলোর কৃত্রিম পরাগায়ন করতে পারি তাহলে অধিক ফলন পাবো এবং আর্থিকভাবে আমাদের কৃষক ভাইয়েরা লাভবান হবেন। য়
উপজেলা কৃষি অফিসার, দাকোপ, খুলনা। মোবাইল : ০১৭৩৯-৫৭৫২২৫, ই-মেইল : mehedi32aeo@gmail.com
করোনাকালে খাদ্য নিরাপত্তা : প্রয়োজন অংশীজনের অংশগ্রহণ
মো: কামরুল ইসলাম ভূইয়া
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের উহানে শুরু হয়েছিল কোভিড-১৯ এর প্রকোপ। তারপর থেকে এই এক বছরে বিশ্বের প্রতিটি দেশ করোনাক্রান্ত হয়েছে। গত এপ্রিলে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এই পরিস্থিতিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক সংকট ও চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর পাশাপাশি সর্বক্ষণ আতঙ্ক-ভয় এবং উৎকণ্ঠা নিয়ে কাটছে মানুষের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত। করোনার বিস্তার ঠেকাতে বিশ্বব্যাপ কঠোর লকডাউনে মানুষকে বেছে নিতে হয়েছে প্রায় গৃহবন্দিত্বের জীবন।
প্রবাদ আছে বিপদ কখনও একা আসে না। এই মহামারি সাথে আরেকটি মহাদুর্যোগের আশঙ্কাও যুক্ত হয়েছিল। সেটি হলো বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন ও ফুড সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা। এমনকি খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছিল জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডবিøউএফপি)সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং কৃষি-অর্থনীতি বিশেষজ্ঞগণ। এফএওর ‘স্টেট অব ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ২০২০’ রিপোর্ট অনুযায়ী কোভিড-১৯ সংক্রমণের শুরু আগেই বিশ্বে খালি পেটে বা আধপেটা খেয়ে রাতে ঘুমাতে যায় এমন ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৬৯ কোটি (৬৯০ মিলিয়ন)। শতকরা হিসেবে যা বিশ্ব জনসংখ্যার ৮.৯ ভাগ। আর চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হিসাবে ২০১৯ সালে বিশ্বে ৭৫ কোটি মানুষ, প্রতি ১০ জনে ১ জন, চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ছিল।
এই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছিল, জরুরি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ না করলে কোভিড-১৯ মহামারির বিরূপ প্রভাব খাদ্য ও ক্ষুধার উপরেও পড়বে। বিদ্যমান এই বিশাল ক্ষুধার্ত মানুষের সাথে বছরের (২০২০) শেষে আরও ৮-১৩ কোটি ক্ষুধার্তমুখ নতুন করে যুক্ত হবে। তা ছাড়া এই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বিশ্বব্যাপী অপুষ্টি ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা বাড়াবে। বিশেষ করে যুদ্ধসংঘাত, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক সংকট, খাদ্যসংকট বিদ্যমান আর শরণার্থী থাকা অঞ্চল ও দেশগুলোতে খাদ্য সংকট ও নিরাপত্তাহীনতা প্রকটতর হবে। কঠোর লকডাউনের কারণে বাণিজ্য ও পণ্য চলাচল বন্ধ হয়ে বিশ্বে অর্থনৈতিক স্থবিরতা, কাজ ও উপার্জন হারানো, পর্যটনের আয় হারানো, রেমিট্যান্স কমে যাওয়া এবং খাদ্য উৎপাদন ও ফুড সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হয়ে এই পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে সতর্ক করেছিল সংস্থাগুলো।
খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ ছিল সম্ভাব্য খাদ্যসংকট ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার দেশের তালিকায়। ২০১৯ সালের এপ্রিলে ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২০’ তীব্র খাদ্যসংকটে থাকা বিশ্বের ৫৫টি দেশের যে তালিকা করে; তার মধ্যে বাংলাদেশও ছিল। করোনার পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়, বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশ সম্ভাব্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে।
এসব বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের শুরু হতেই সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার নির্দেশনা প্রদান করেন, “এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যা যা করা দরকার করতে হবে”। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে করোনাকালে কৃষি উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি তা আরও বৃদ্ধিতে নেয়া হয় কার্যকর নানা পদক্ষেপ।
করোনার বিস্তার ঠেকাতে গত মার্চে দেশে জারি করা হয় কঠোর লকডাউন। কিন্তু বোরো ধান কাটাসহ অন্যান্য কৃষিকাজের তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌসুম। আগাম বন্যা ও কৃষিশ্রমিক সংকটের কারণে হাওড়ের ধান ঘরে তোলা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল চরম অনিশ্চয়তা। তাই কৃষি উপকরণ ও কৃষিপণ্য পরিবহণ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি দ্রæততার সাথে ধান কাটতে উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ধানকাটার যন্ত্রপাতি বিতরণ ও হাওড় অঞ্চলসহ সারাদেশে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কৃষিশ্রমিকের যাতায়াতের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ফলে অত্যন্ত সফলভাবে সারা দেশের ফসল সুষ্ঠুভাবে ঘরে তোলা সম্ভব হয়েছিল।
ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে জোর দেয়া হয়েছিল আউশ ও আমন উৎপাদন বৃদ্ধিতে। বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে আউশের আবাদ বিগত অর্থবছর থেকে ২ লাখ হেক্টর এবং উৎপাদন প্রায় ৭ লক্ষ মেট্রিক টন বৃদ্ধি করা হয়। তা ছাড়া কৃষকদের জন্য ৪ শতাংশ সুদে সর্বমোট প্রায় ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কৃষিঋণের ব্যবস্থা করা হয়।
ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে ২৬২ কোটি টাকার চারা, বীজ ও কৃষি উপকরণ বিতরণ করা হয়। আমন উৎপাদন আশানুরূপ না হওয়ায় বোরো উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এই বছর ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ বাড়ানো হবে। ২ লক্ষ হেক্টর জমিতে উচ্চফলনশীল হাইব্রিড ধান চাষের জন্য ৭৬ কোটি টাকার হাইব্রিড বীজ বিনামূল্যে এবং বোরো ধান বীজে ২৫% হারে ভর্তুকি প্রদান করা হয়েছে। সেচের মূল্য ৫০% হ্রাস করা হয়েছে। এ ছাড়া পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের জন্য ২৫ কোটি ১৬ লক্ষ টাকার প্রণোদনা প্রদান করা হয়েছে। শুধু উৎপাদন নয়, করোনায় কৃষিপণ্যের বিপণন ও সরবরাহ সচল রাখতে নেয়া হয় কার্যকর উদ্যোগ।
এবার আসি খাদ্য নিরাপত্তা প্রসঙ্গে। এফএওর ‘কমিটি অন ওয়ার্ল্ড ফুড সিকিউরিটি’ এর মতে, একটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য শুধু পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদনই যথেষ্ট নয়, বরং খাদ্যের সরবরাহ, প্রাপ্যতা, ব্যবহার, দামের স্থিতিশীলতা এবং খাদ্যে সাধারণ মানুষের প্রবেশযোগ্যতাও জড়িত আছে। আরও বিস্তৃত পরিসরে দেখলে, সক্রিয় ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য পছন্দমাফিক পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের নিশ্চয়তাও এর সাথে জড়িত।
উৎপাদনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই সরকারের এসব উদ্যোগের ফলে বিগত এক বছরে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রেখেছে। চাল উৎপাদন ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৩ কোটি ৬৫ লাখ ৩৬ হাজার টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে ৩ কোটি ৮৭ লাখ টনে পৌঁছেছে। করোনার মধ্যেও বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে ইন্দোনেশিয়াকে টপকে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। এ ছাড়া ডাল, তেলজাতীয়, শাকসবজি ও ফলমূলের উৎপাদনও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
এত গেল বাংলাদেশের হিসাব। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে করোনার কারণে খাদ্য উৎপাদন, বাণিজ্য, ব্যবহার ও মজুদে খুব একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। এফএওর ‘ক্রপস প্রসপেক্টস ও ফুড সিচুয়েশন’ ডিসেম্বর ২০২০ প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে ২৭৪১ মিলিয়ন টন, যা আগের বছরের তুলনায় ১.৩ শতাংশ বেশি। ব্যবহার হয়েছে ২৭৪৪ টন, যা আগের বছরের তুলনায় ১.৯ ভাগ বেশি। লেনদেন হয়েছে ৪৫৫ মিলিয়ন টন, যা আগের বছরের তুলনায় ৩.৪ ভাগ বেশি। মজুদ আছে ৮৬৬ মিলিয়ন টন, যা আগের বছরের তুলনায় ০.৭ ভাগ কম।
তারপরও বিশ্বব্যাপী ‘খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা’ বেড়েছে। বেড়েছে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পূর্বাভাস অনুযায়ী ইতোমধ্যে পৃথিবীর অনেক দেশেই করোনার কারণে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডবিøউএফপি) নভেম্বর ২০২০ সালের দেখতে পায়, তাদের পূর্বাভাস বাস্তবে পরিণত হয়েছে: ২০২০ সালের শেষে ১৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ বিশ্বব্যাপী নতুন করে ‘চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায়’ ভুগছে। যা কোভিডপূর্ব সময়ের তুলনায় শতকরা ৮২ ভাগ বৃদ্ধি। বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ‘তীব্র ক্ষুধা’ বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ গুণ ।
বাংলাদেশেও খাদ্যে প্রাপ্যতা, সরবরাহ ও ব্যবহারে করোনার খুব একটা প্রভাব পড়েনি। তারপরও, তাদের ভাষ্য মতে, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাংলাদেশেও কিছুটা বেড়েছে: প্রথমত কোভিড-১৯ এর প্রভাবে মানুষের আয় কমেছে, রেমিট্যান্স হ্রাস পেয়েছে, দ্বিতীয়ত: ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও দফায় দফায় দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় ৫০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি খাত ও অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে ৮ লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উপস্থিতিকেও অন্যতম কারণ হিসেবে দেখিয়েছে। এই শরণার্থীদের চাপে কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কর্মসংস্থান কমেছে। বাংলাদেশে প্রধান খাদ্য চালের দাম কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্যনিরাপত্তার কিছুটা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
কিন্তু চালের বাজার বিশ্বব্যাপীই কিছুটা বেড়েছে। এফএওর ‘ফুড প্রাইস মনিটরিং ও অ্যানালাইসিস’ ডিসেম্বর ২০২০ বুলেটিন বলছে, বিগত ১ বছরে গড়ে ভিয়েতনামে ৪৬%, থাইল্যান্ডে ১৫%, ইউএসএতে ১০% বেড়েছে। ভারতে চালের দাম স্থিতিশীল থাকলও বাংলাদেশে সহনীয়পর্যায়ে কিছুটা বেড়েছে, যা শতকরা হিসেবে ১.৭ ভাগ। তবে সরকার চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিদেশ থেকে চাল আমদানির করছে। চাল আমদানির শুল্ক কমিয়ে ২৫% করা হয়েছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রাইভেট সেক্টরকেও চাল আমদানির সুযোগ দেয়া হয়েছে। আমদানির ফলে ইতোমধ্যে চালের বাজার অনেকটা স্থিতিশীল অবস্থায় চলে এসেছে।
সব মিলিয়ে আমরা যদি দেখি, এখন পর্যন্ত সরকার দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সফল হয়েছে। এক বছরে সরকার খাদ্য নিয়ে দেশের মানুষকে বড় কোন সমস্যায় পড়তে দেয়নি। এতদসত্তে¡ও, আমাদের আত্মতুষ্টিতে থাকার খুব সুযোগ নেই। কারণ, এফএওর ‘ক্রপস প্রসপেক্টস ও ফুড সিচুয়েশন’ ডিসেম্বর ২০২০ প্রতিবেদন অনুযায়ী যে ৪৫টি দেশের খাদ্য ক্ষেত্রে বিদেশি সহযোগিতা প্রয়োজন, তার মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। আফ্রিকার ৩৪টি, এশিয়ার ৯টি ও ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ২টি দেশ এ তালিকায় রয়েছে।
তা ছাড়া করোনার প্রকোপের এক বছর অতিক্রান্ত হলেও ভাইরাসটি পূর্বের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছে। পাওয়া যাচ্ছে করোনার নতুন ধরন বা স্ট্রেইন। সুখবর হচ্ছে মানবদেহে ভ্যাকসিনের প্রয়োগ শুরু হয়েছে। অন্য দিকে এই সুখবরের মধ্যে হতাশার জল ঢেলে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিøউএইচও)। সংস্থাটি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে যে, চলমান করোনাই শেষ নয়, সামনে আরও ভয়াবহ মহামারি আসতে পারে। সেজন্য বিশ্বকে প্রস্তুতি নিতে হবে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সরকার খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। তার সাথে প্রয়োজন আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ। প্রয়োজন অংশীজনের অংশগ্রহণ য়
সিনিয়র তথ্য অফিসার, কৃষি মন্ত্রণালয়, ই-মেইল : নুঁধহশধসৎঁষ@মসধরষ.পড়স, মোবাইল : ০১৬৭২৮৯৭৭৮৯
প্রশ্নোত্তর
কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন
কৃষি বিষয়ক
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
মোঃ জুবায়ের হোসেন, গ্রাম: কালিগঞ্জ, উপজেলা: জলঢাকা, জেলা: নীলফামারী
প্রশ্ন: ভুট্টা গাছের মোচা এক ধরনের পোকা ছিদ্র করে ফেলে। এতে ভুট্টার বেশ ক্ষতি হয়। কী করণীয় ?
উত্তর: আপনার সমস্যা সমাধানের জন্য জমি ভালোভাবে চাষ করতে হবে এবং চাষকৃত জমি হতে পোকার পিউপা সংগ্রহ করে নষ্ট করতে হবে। মোচা ছিদ্রকারী পোকার লার্ভাগুলো সাধারণত মোচার উপরের দিকে অবস্থান করে। এজন্য আক্রান্ত মোচা থেকে লার্ভা সংগ্রহ করে সেগুলো নষ্ট করে ফেলতে হবে। আক্রমণের শুরুতে জৈব বালাইনাশক এইচএনপিভি (ঐঘচঠ) প্রতি লিটার পানিতে ০.২ গ্রাম হারে প্রয়োগ করলে সুফল পাওয়া যায়। আর পোকার আক্রমণ যদি বেশি হয় তবে ট্রেসার ৪৫ এসসি ০.৪ মিলি বা সাকসেস ২.৫ এসসি ১.৩ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে পারেন। এছাড়া ভলিয়ামফ্লাক্সি ৩০০ এসসি ০.৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে অথবা এবামেকটিন বেনজোয়েট গ্রæপের যেমন প্রোক্লেম ৫ এসজি, সাহাম৫ এসজি, হেক্লেম৫ এসজি বা অন্য নামের ১ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করলে সুফল পাবেন।
মোঃ আক্কাছ আলী, গ্রাম: নিন্দুয়ার, উপজেলা: বালিয়াডাঙ্গী, জেলা: ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন: পুদিনা পাতার নিচে ছোট ময়লাযুক্ত এবং বাদামি ফোস্কার মত দাগ দেখা যায় । এ সমস্যা রোধে কী করণীয়?
উত্তর: পুদিনা পাতার এ রোগটিকে পুদিনা পাতার রাস্ট রোগ বলে। এ রোগ প্রতিরোধে ফসলের পরিত্যক্ত অংশ, আগাছা এবং আবর্জনা পুড়ে ফেলতে হবে। এছাড়া জমিতে পর্যাপ্ত সূর্যালোক ও বাতাসের ব্যবস্থা করাও দরকার। পাশাপাশি জমিতে শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হয়। যদি পুদিনা গাছে রাস্ট রোগ দেখা দেয় তবে হেক্সাকোনাজল গ্রæপের ছত্রাকনাশক যেমন-কনটাফ ৫ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি অথবা প্রোপিকোনাজোল গ্রæপের ছত্রাকনাশক যেমন-টিল্ট ২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার গাছে ¯েপ্র করতে হবে। আশাকরি উপকার পাবেন।
জাহাঙ্গীর আলম গ্রাম: খালিশপুর, উপজেলা: পাবনা সদর, জেলা: পাবনা
প্রশ্ন ঢেঁড়সের গোড়া ও কাÐ পচা রোগের প্রতিকার কী ?
উত্তর: এ রোগটি ম্যাক্রোফোমিনা ফেসিওলিনা ছত্রাকের আক্রমণে হয়ে থাকে। এ রোগ প্রতিরোধে রোগ প্রতিরোধী জাত যেমন-বারি ঢেঁড়স ১ চাষ করতে হবে। আর যদি কোনো কারণে এ ধরনের রোগ দেখা দেয় তবে মেনকোজেব গ্রæপের ছত্রাকনাশক যেমন-ডাইথেন এম ৪৫ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে অথবা কপার অক্্িরক্লোরাইড গ্রæপের ছত্রাকনাশক যেমন-সানভিট ৫০ ডবিøউপি প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। এসব ব্যবস্থা নিলে আপনি উপকার পাবেন।
মো. আলমগীর কবির, গ্রাম: নকিপুর, উপজেলা: শ্যামনগর, জেলা: সাতক্ষীরা
প্রশ্ন: পাট গাছের কাÐ পচা রোধে কী করবো ?
উত্তর: পাট গাছের কাÐ পচা রোগ প্রতিরোধে যেসব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হয় সেগুলো হলো-আক্রান্ত গাছ দেখামাত্র তুলে ফেলা । সুস্থ ও রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা। সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার এবং রোগের আক্রমণ বেশি হলে মেনকোজেব গ্রæপের যে কোন ছত্রাকনাশক ২.৫ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করা। এসব ব্যবস্থা নিলে পাট গাছের কাÐ পচা রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
মোঃ আকবর হোসেন, গ্রাম: পাটগা মুন্সিপাড়া, উপজেলা: রাণীশংকৈল, জেলা: ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন: করলার পাতাগুলো গুচ্ছাকার হয়ে যায়। কী করলে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে ?
উত্তরঃ করলার এ সমস্যা মাইকোপ্লাজমার কারণে হয়ে থাকে। আর এ রোগটি বাহক পোকার মাধ্যমে ঘটে থাকে। সেজন্য বাহক পোকা ধ্বংস করার জন্য বালাইনাশক এসাটাফ কিংবা ইমিডাক্লোরপ্রিড গ্রæপের টিডো বা এডমায়ার সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে আপনি উপকার পাবেন। এসবের পাশাপাশি আক্রান্ত গাছ দেখামাত্র তুলে ফেলে নষ্ট করা দরকার। আর সবসময় রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা প্রয়োজন। আর কোনভাবেই ক্ষেতের আশেপাশে আগাছা রাখা যাবে না। এসব সতর্কতা মেনে চললে আপনি উপকার পাবেন।
আরিফুল ইসলাম, গ্রাম: জাতুকর্ণপাড়া, উপজেলা: বানিয়াচং, জেলা: হবিগঞ্জ
প্রশ্ন: শিমে সাদা তুলার মতো কি যেন পরে। এতে ফসলের ক্ষতি হয়। কী করণীয় জানাবেন।
উত্তর: আপনার শিম গাছে ছত্রাকের আক্রমণের ফলে প্রাথমিক অবস্থায় কাÐে পানি ভেজা সাদা তুলার মত ছত্রাকের উপস্থিতি দেখা যায়। এটি পাতা, ফুল ও ফলে বিস্তার লাভ করে। এ সমস্যা সমাধানে রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। বপনের পূর্বে প্রতি কেজি বীজ ২.৫ গ্রাম প্রভেক্স দিয়ে শোধন করে জমিতে বপন করতে হবে। রোগের প্রাথমিক অবস্থায় প্রতি লিটার পানিতে রোভরাল ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া আপনি ফলিকুর বা কন্টাফ ২ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করলেও উপকার পাবেন।
মৎস্য বিষয়ক
মোঃ হাবিবুর রহমান, গ্রাম: নারায়ণপুর, উপজেলা: কেশবপুর, জেলা: যশোর
প্রশ্ন: মাছের শরীরে সাদা ফুটকি রোগ দেখা যাচ্ছে কী করবো?
উত্তর: এটি একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। এ রোগে মাছের মাথা, পৃষ্ঠদেশ ও পাখনায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোলাকার সাদা দাগ বা ফুটকি দেখা যায়। মাছের দেহে অতিরিক্ত পিচ্ছিল পদার্থ জমা হয়। মাছ অলসভাবে চলাফেরা করে ও খাদ্য গ্রহণ করে না। বেশি আক্রান্ত মাছ দ্রæত মারা যায়। এজন্য পুকুর প্রস্তুতির সময় পরিমিতি পরিমাণ চুন প্রয়োগ করতে হবে। নিরাময় পুকুরের প্রতি শতাংশে ১ মিটার গভীরতার জন্য ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম পটাশিয়াম প্যারম্যাঙ্গানেট বা পটাশ পানিতে গুলে নিয়ে পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। এছাড়া আক্রান্ত মাছকে ২ থেকে ৩% লবণ পানিতে ৩০ মিনিট বা ৫% অ্যামোনিয়াম সালফেট দ্রবনে ১ মিনিট ডুবিয়ে রেখে পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে। এসব ব্যবস্থা নিলে আপনি উপকার পাবেন।
মোঃ আশরাফুল ইসলাম, গ্রাম: সাকোয়া, উপজেলা: বোদা, জেলা: পঞ্চগড়
প্রশ্ন: মাছের ফুলকা পচা রোগ হয়েছে কী করবো ?
উত্তর: এক শ্রেণীর ছত্রাক মাছের ফুলকার মধ্যে ঢুকে রক্ত চলাচল বন্ধ করে দেয়। ফলে ফুলকার বাহিরের অংশে খাদ্য ও অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এটি ছত্রাক সংক্রমণে সৃষ্ট একটি রোগ। এ রোগে ফুলকায় পচন ধরে এবং আস্তে আস্তে খমে পড়ে। এ রোগে আক্রান্ত মাছ সাধারণত বাঁচে না। প্রাথমিক অবস্থায় ১ লিটার পানিতে ৫ মিলিগ্রাম তুতে মিশিয়ে আক্রান্ত মাছকে ৫ মিনিট ডুবিয়ে রেখে পুকুরে ছেড়ে দিলে ভাল ফল পাওয়া যায়। এছাড়া পুকুরে অতিরিক্ত জৈব পদার্থ জমতে দেয়া যাবে না এবং পূর্বাহ্ণে পরিমিত মাত্রায় চুর প্রয়োগ করতে হবে।
প্রাণিসম্পদ বিষয়ক
মোঃ জহিরুল ইসলাম, গ্রাম: চালাকচর, উপজেলা: মনোহরদী, জেলা: নরসিংদী
প্রশ্ন: আমার বাছুরের বয়স ১২ দিন। নাভী ফুলে গেছে। জ¦র আছে, নাভীতে পুঁজ হয়েছে। এ অবস্থায় কী করণীয় ?
উত্তর: নাভীর ক্ষতস্থান টিংচার আয়োডিন দ্বারা পরিষ্কার করতে হবে। নাভী পেকে গেলে একটু কেটে সম্পূর্ণ পুঁজ বের করে ফেলতে হবে। পরে জীবাণুনাশক পানি দ্বারা পরিষ্কার করে কাটা জায়গার মধ্যে টিংচার আয়োডিনযুক্ত গজ ঢুকাতে হবে। একদিন পরপর এইভাবে পরিষ্কার করে গজ ঢুকাতে হবে। এছাড়া পেনিসিলিন অথবা স্ট্রেপটোমাইসিন ইনজেকশন দিতে হবে।
মো: আবুল হোসেন, গ্রাম: ধল্লাপাড়া, উপজেলা: ঘাটাইল, জেলা: টাঙ্গাইল
প্রশ্ন: আমার মুরগিগুলোর ডায়রিয়া হচ্ছে। পায়ু স্থানের আশেপাশে ময়লা লেগে আছে। কী করণীয় ?
উত্তর: আপনার মুরগিগুলোর গামবোরো রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। এই রোগ যাতে না হয় এজন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ১০ থেকে ২১ দিন বয়সে গামবোরো রোগের টিকা প্রদান করতে হয়। আর রোগে আক্রান্ত হলে দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যাকটেরিযার সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য এনফ্লক্স ভেট সলিউশন অথবা কট্রাভেট পাউডার এবং সাথে ইলেকট্রোমিন পাউডার খাওয়াতে হবে।
(মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক প্রশ্ন কৃষি কল সেন্টার হতে প্রাপ্ত)য়
উপপ্রধান তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, ফোন নং: ০২-৫৫০২৮৪০০, ই মেইল:taufiquedae25@gmail.com
স্বাধীনতার ৫০ বছরে খাদ্য নিরাপত্তায় মানসম্পন্ন বীজ উন্নয়ন
কৃষিবিদ শেখ মোঃ মুজাহিদ নোমানী
খাদ্যশস্য উৎপাদনে যে ক’টি উপকরণ একান্ত প্রয়োজন তারমধ্যে বীজ হচ্ছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। বীজ হচ্ছে ফসলের প্রাণ। ভালো বীজের গুণাগুণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে ভালো ফসল উৎপাদন তথা খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি। আর তাই ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞা দিয়ে বুঝেছিলেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে খাদ্যের সংস্থান করা অর্থাৎ দেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা। আর অধিক ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন মানসম্পন্ন ভালো বীজ, সার ও সেচের সঠিক ব্যবস্থাপনা। বঙ্গবন্ধু হাতে নিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত সোনার বাংলার কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি ও পুরাতন কৃষি অবকাঠামোসমূহ পুনর্গঠন উন্নয়ন প্রকল্প। আর তাই ১৯৭৩-৭৮ মেয়াদের বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় চালু করা হলো ‘দানাশস্য বীজ প্রকল্প’ এবং বিএডিসিকে দায়িত্ব প্রদান করা হলো ধান, পাট ও গমবীজ ফসলের বীজ উৎপাদনের জন্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তার বিচক্ষণতা অসীম ও দূরদর্শিতায় অনুধাবন করেছিলেন, তাই কবির ভাষায় বলতে চাই “ভালো বীজে ভালো ফসল, সুধী জনে কয়, প্রত্যায়িত বীজই ভালো বীজ, জানিবে নিশ্চয়। ২০ ভাগ বেশি ফলন পাইতে হলে ভাই, প্রত্যায়িত বীজ ছাড়া আর যে উপায় নাই।”
খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে তাই ১৯৭৩ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড গঠনের পরপরই ১৯৭৪ সালের ২২ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করলেন তৎকালীন ‘বীজ অনুমোদন সংস্থা’ তথা আজকের ‘বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি’। যার অন্যতম প্রধান কাজ হলো বিএডিসি কর্তৃক উৎপাদিত বীজ ফসলের মাঠমান ও বীজমান যাচাইপূর্বক প্রত্যয়ন দেয়া।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৩-৭৪ সাল হতে ‘দানাশস্য বীজ প্রকল্প’ এর আওতায় বীজপ্রযুক্তি ও বীজমান নিশ্চিতকরণে বিএডিসি ও তৎকালীন বীজ অনুমোদন সংস্থার তদারকীতে মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও সরবরাহের এক বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। ফলে ১৯৭৪-৭৫ সাল হতে এ কার্যক্রমের আওতায় উন্নত জাতের মানসম্পন্ন প্রত্যায়িত বীজের উৎপাদন ও আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৭৫-৭৬ সালে শস্য উৎপাদন ৮৭ লক্ষ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ২৩ লক্ষ মেট্রিক টনে, যা বঙ্গবন্ধু নিজ চোখে দেখে যেতে পারেননি। কারণ কিছু দুর্বৃত্ত সেনা অফিসারদের নৃশংসতায় শাহাদতবরণ করতে হয়েছে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে বীজমান উন্নয়ন ও নিশ্চিতকরণের পথিকৃৎ সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতা
মহান স্থপতি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণ পরবর্তী বাংলাদেশে সার ও বীজ সংকটের ইতিহাস (১৯৭৫-১৯৯৫)
কৃষি ও বীজের ক্ষেত্রে এর পরের ইতিহাস অত্যন্ত করুণ ও নির্মমতায় ভরা। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণের পর থেকে বীজমান নিশ্চিতকরণে ছিল না কোনো উন্নয়ন, ছিল না কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা। ফলে সরকারি প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে থেকে অনেক কষ্ট করে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ১ (এক) ব্যাগ বীজ আর ২-১ ব্যাগ সারের জন্য কৃষককে যেতে হয়েছে দূর-দূরান্তের এক বাজার থেকে অপর বাজারে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে সংগ্রহ করতে হয়েছে উচ্চমূল্যে (৭০-৭৫ টাকা প্রতি কেজি) এক বস্তা ইউরিয়া সার ও ৫-১০ কেজি এক ব্যাগ সরকারি বীজ। প্রচÐ সার সংকটে ১৯৯৫ সালে মার্চ মাসে পুলিশের গুলিতে সারা দেশে ১৮ জন কৃষককে প্রাণ দিতে হয়েছে। ফলে পরিমাণ মতো বীজ ও সার না পেয়ে আর সেচ দিতে না পেরে ফসল পায়নি কৃষক। ফলে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়েছে প্রচুর পরিমাণ ধান, পাট, গম, আলু ও সবজি ফসলের বীজসমূহ। আর তাই ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত দেশের খাদ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছিল ৩০-৪০ লক্ষ টনে।
বীজমান উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার অবদান
১৯৭৪ সালে ‘বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি, বীজ প্রত্যয়নের সৃষ্টি’ যেমন সে সময়ে সঠিক ও যথার্থ প্রমাণিত হয়েছে ঠিক তেমনিভাবে দেশরতœ জননেত্রী শেখ হাসিনার ১৯৯৬-২০০১ প্রথমবার এবং ২০০৮ থেকে অদ্যাবধি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কৃতিত্বপূর্ণ রাষ্ট্র পরিচালনায় বীজমান উন্নয়ন ও নিশ্চিতকরণে উন্নয়নমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তাই বাংলাদেশের বীজ সেক্টর আজ সুসংহত ও বিকশিত। আর তাই সুলভমূল্যে মানসম্পন্ন বীজ আজ চাষীর দোরগোড়ায়। খাদ্য উৎপাদনবৃদ্ধিতে মানসম্পন্ন বীজের উন্নয়নে বর্তমান সরকারের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত কিছু বিবরণ নি¤েœ উপস্থাপন করা হলো-
১. বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বীজ উৎপাদনে সম্পৃক্তকরণ : বর্তমান সরকার রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পরপরই বাংলাদেশের বীজ সেক্টরে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ১৯৯৭ সাল থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে মৌলভিত্তিক ও প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন ও সম্প্রসারণে সম্পৃক্ত করার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ফলে বাংলাদেশের বীজ উৎপাদন, মাননিয়ন্ত্রণ, প্রত্যয়ন ও বাজারজাতকরণে শুরু হয় ব্যাপক কর্মকাÐ। তারই ফলে আজ প্রায় ১০,০০০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিএডিসি, ডিএইসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান দানাদার ফসলের বীজ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে নিয়োজিত যার পরিমাণ ২৫-৩০%। তবে বীজ সরবরাহের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, বেসরকারি খাত মূলত উচ্চ মুনাফার বীজ যেমন হাইব্রিড ধান ৯২.৪২%, ভুট্টা ৯৮.৮৫%, পাট ৯৫.৩৭%, শাকসবজি ৯৬.২১% এবং আলু ৭২.২৬% বীজের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, যা বর্ণিত ফসলের ব্যাপক উৎপাদন বৃদ্ধিতে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। পাশাপাশি মানসম্পন্ন ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদনেও বেসরকারি খাত ব্যাপক অবদান রাখতে শুরু করেছে। দেশে বর্তমানে গড়ে উঠেছে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় শতাধিক সফল বীজ শিল্প প্রতিষ্ঠান। মানসম্পন্ন প্রত্যায়িত বীজ আজ চাষির দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে নির্বিঘেœ। চাষিরা আজ সময়মতো তাদের স্বাধীনতা, তাদের পছন্দ অনুযায়ী মানসম্পন্ন বীজ ক্রয় করছে আর মনের আনন্দে ফসল ফলাচ্ছে।
২. গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ব্রিডার বীজ প্রত্যয়ন কর্মসূচি : ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত গবেষণা কেন্দ্রগুলো বিভিন্ন ফসলের উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন, গবেষণা ও জাত সংরক্ষণের পাশাপাশি ব্রিডার বীজ উৎপাদন ও প্রত্যয়ন আসছিল। যা হতে পরবর্তীতে বিএডিসি কর্তৃক ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করা হতো। উল্লেখ্য যে, গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের উৎপাদিত বীজকে নিজেরাই প্রত্যয়ন করার ফলে এক দিকে যেমন পক্ষপাতিত্বের সুযোগ থাকে তেমনি সর্বোচ্চ মানের বিষয়ে বীজ ব্যবহারকারীর মনেও কিছুটা দ্বিধা-দ্ব›দ্ব দেখা দেয়। এ সমস্যা নিরসনের পাশাপাশি ভিত্তি বীজের উৎস নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে এবং ব্রিডার বীজের মানকে শতভাগ নিশ্চিত রাখার স্বার্থে জাতীয় বীজ বোর্ডের সিদ্ধান্তক্রমে ১৯৯৭ সাল হতে ব্রিডার বীজ প্রত্যয়নের দায়িত্ব প্রদান করা হয় বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সিকে। বীজমান নিশ্চিতকরণের প্রথমবারের মতো মৌল, ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ‘প্রত্যয়ন ফি’ গ্রহণপূর্বক সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বীজ প্রত্যয়নের সেবা প্রদানে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক উদ্ভাবিত আমন ধানের জাত বাউধান২ এর প্রত্যয়নের মাধ্যমে প্রথম বারের মতো ব্রিডার বীজ ফসল প্রত্যয়ন কর্মকাÐ শুরু হয়। বংলাদেশে যা বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের একটি অন্যতম সাফল্য।
৩. নতুন বীজ আইন ও বীজ বিধি প্রণয়ন : বীজ মান নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নে শেখ হাসিনার সরকার ২য় মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে প্রথমেই জারি করলেন বীজ আইন (সংশোধন) ১৯৯৭, বীজ বিধি ১৯৯৮ এবং সর্বশেষ বীজ আইন ২০১৮। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কৃষি মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিলেন ব্রিডার বীজ ফসল প্রত্যয়নের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করে ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বীজের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি করা এবং কঠোর মার্কেট মনিটরিংয়ের মাধ্যমে বীজমান নিশ্চিত করে যথাসময়ে সুলভমূল্যে প্রয়োজনীয় মানসম্পন্ন বীজের সরবরাহ অক্ষুণœ রাখতে। বীজের মান ভালো হওয়ায় দেশে আজ খাদ্যশস্যের ফলন ও উৎপাদন দুটোই অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দেশ আজ খাদ্য দানাজাতীয় উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
৪. সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ফি গ্রহণপূর্বক প্রত্যয়ন সেবা প্রদান : প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে শুরু করে ১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি বিনামূল্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যথা বিএডিসি, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উৎপাদিত ধান, গম ও পাট বীজ প্রত্যয়ন করে আসছিল। এতে বিনামূল্যে পাওয়া প্রত্যয়ন সেবার প্রতি যথাযথ মূল্যায়ন করা বা গুরুত্ব দেয়া হতো না। ১৯৯৭ সাল থেকে সব সরকারি বেসরকারি বীজ উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মৌল, ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বীজ প্রত্যয়ন, বীজ পরীক্ষা ও জাত ছাড়করণে নির্ধারিত ফি প্রদান সাপেক্ষে বীজ প্রত্যয়ন সেবা গ্রহণের জন্য জাতীয় বীজ বোর্ড এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত প্রদান করে। এতে একদিকে যেমন বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতে থাকে অপরদিকে ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদনের জমি ও বীজের পরিমাণ এবং ফসলের ফলন বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে সরকারের রাজস্ব আয়ও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ ১৯৯৭ সালে যেখানে প্রত্যয়ন ফি বাবদ রাজস্ব আয় ছিল মাত্র ২,০০০ টাকা সেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আয় দাঁড়িয়েছে ৬২.৩০ লাখ টাকা।
৫. বীজমান নিয়ন্ত্রণ ও নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রকল্প গ্রহণ : বীজ শিল্প ও বীজমান উন্নয়ন কার্যক্রম আরো সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে এরই মধ্যে যে সব প্রকল্প ও কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে সেগুলে হলো-
ক. বীজ মাননিয়ন্ত্রণ প্রকল্প : বিগত ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৪ বছর মেয়াদি এই বীজমান নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। বীজমান নিয়ন্ত্রণের সর্বপ্রথম ধাপ হচ্ছে প্রতিটি বীজ ফসলের মাঠমান ও বীজমান নির্ধারণ এবং সেই মানের ওপর ভিত্তি করেই মানসম্পন্ন বীজ তথা মৌল, ভিত্তি, প্রত্যায়িত ও মানঘোষিত বীজের মানসমূহ মাঠ পরিদর্শনকালে ও বীজ পরীক্ষাগারে বীজ পরীক্ষার মাধ্যমে সুনিশ্চিত হয়ে প্রত্যয়ন ট্যাগ সরবরাহ ও সংযোজন করা হয়ে থাকে বাজারজাতকরণের পূর্ব মুহূর্তে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু থেকে অদ্যবধি কৃষি মন্ত্রণালয়ের জাতীয় বীজ বোর্ডের বিভিন্ন সভায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির যাচাই অন্তে অবশেষে ২০০৯ সালে ৭০তম সভায় মোট ০৫টি নোটিফাইড ও ডাল, তেল, মসলা, সবজিজাতীয় মোট ৮০টি নন-নোটিফাইড ফসলের মান নির্ধারণ করে ২০ ডিসেম্বর ২০১০ বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত হয়, যা বীজমান নিশ্চিতকরণে ও বীজের উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।
খ. ঐতিহাসিক রিভিজিট বাস্তবায়নের মাধ্যমে অফিস ও জনবল বৃদ্ধি : ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ‘বীজ অনুমোদন সংস্থা’ স্থাপনের ঠিক ৪০ বছর পর ২০১৪ সালের জুন মাসে বীজমান উন্নয়ন ও নিশ্চিতকরণের জন্য ঐতিহাসিক রিভিজিট অনুমোদন করেন। ফলে পূর্বের ৩০টি ফিল্ড অফিসারের অফিসসহ ৬৪ জেলায় বীজ প্রত্যয়ন অফিস স্থাপন করে পদমর্যাদা বাড়িয়ে উপপরিচালক পদের সমপর্যায়ে ৬৪ জন জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিসারের পদ, পূর্বের ০৪টি, আঞ্চলিক অফিসের পরিবর্তে ০৭টি বিভাগে ০৭ জন করে আঞ্চলিক ও সহকারী আঞ্চলিক বীজ প্রত্যয়ন অফিসারের পদ বৃদ্ধি করে ০৭টি আঞ্চলিক বীজ পরীক্ষাগার স্থাপনসহ ৬৪ জেলায় ১২৮ জন বীজ প্রত্যয়ন অফিসারের পদ সৃষ্টি করে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির মোট ২২৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্থলে সর্বমোট ৫৬৯ জন জনবল বৃদ্ধির সাংগঠনিক অবকাঠামোর ঐতিহাসিক অনুমোদন প্রদান করেন।
ঘ. ভ্রাম্যমাণ বীজ পরীক্ষাগারের মাধ্যমে বীজ পরীক্ষা : বীজমান উন্নয়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক সহযোগিতা ও নির্দেশনায় আজ কৃষকের দোরগোড়ায় উপস্থিত বীজ পরীক্ষা। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই অত্যাধুনিক ব্যয়বহুল ভ্রাম্যমাণ বীজ পরীক্ষাগার ক্রম করে দেশের বিভিন্ন বিভাগ/জেলায় গিয়ে মাত্র ৩০ টাকায় ধান, গম ও পাট বীজের বিশুদ্ধতা, অংকুরোদগম ক্ষমতা ও আর্দ্রতা পরীক্ষা করে তা সরাসরি মোবাইলে এসএমএস করে বীজ পরীক্ষার ফলাফল জানিয়ে দেওয়া হয়। এতে কৃষকরা জমিতে বীজ বপনের আগেই বীজের সঠিক মান নিশ্চিত হয়ে বীজ বা ফসল উৎপাদনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
ঙ. আধুনিক প্রত্যয়ন ট্যাগ চালুকরণ কর্মসূচি : সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উৎপাদিত বীজের মান নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে গাজীপুরের টাঁকশালে অত্যাধুনিক মেশিন স্থাপন করে সেখান হতে কঠোর নিরাপত্তায় প্রত্যয়ন ট্যাগ ছাপিয়ে প্রতিটি আঞ্চলিক অফিসে সরবরাহ করা হয়েছে, সরবরাহকৃত আধুনিক প্রত্যয়ন ট্যাগে ইঙ্ক জেট প্রিন্টার মেশিনের মাধ্যমে প্রত্যয়ন ট্যাগে সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি প্রিন্ট করে জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিসে সরবরাহ করা হচ্ছে এ কর্মসূচির মাধ্যমে যা অত্যন্ত সফল ও কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। উল্লেখ্য, আধুনিক এই ট্যাগে সংযুক্ত গোপন নিরাপত্তা চিহ্ন টঠখ (টষঃৎধ ঠরড়ষবঃ খরমযঃ) মেশিন ছাড়া খালি চোখে দেখা যায় না, ফলে এই প্রত্যয়ন ট্যাগ নকল করা সহজ নয় এবং কেউ নকল করলে তা ধরা পড়ে যাবে।
চ. বীজ প্রত্যয়ন জোরদারকরণ প্রকল্প ও নি¤œ উৎপাদনশীল ধানের জাত প্রত্যাহার কর্মসূচি : জুলাই ২০১৮ থেকে জুন ২০২৩ পর্যন্ত ৫ বছর মেয়াদি ৭৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকার এ প্রকল্পের কাজ দ্রæতগতিতে এগিয়ে চলছে। এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অনুমোদিত নতুন সাংগঠনিক কাঠামো (রিভিজিট) অনুসারে নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির অবকাঠামো উন্নয়ন, বীজ পরীক্ষাগার সম্প্রসারণ, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য মানসম্পন্ন প্রত্যায়িত বীজের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি। তাছাড়াও মাঠ পরিদর্শন ও মার্কেট মনিটরিং কর্মকাÐ সম্প্রসারণের মাধ্যমে উচ্চ মানসম্পন্ন বীজের সহজ লভ্যতা বৃদ্ধি, প্রি-পোস্ট ও গ্রো আউট-টেস্টের মাধ্যমে জাতের বিশুদ্ধতা নিশ্চিতকরণ, জাত ছাড়করণে উটঝ (উরংঃরহপহবংং টহরভড়ৎসরঃু ধহফ ঝঃধনরষরঃু) টেস্টসমূহ জোরদারকরণ ও কঠোরভাবে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ফলে মানসম্পন্ন বীজের প্রতিটি ধাপে বীজমান নিশ্চিত করায় মানসম্পন্ন বীজের চাহিদা ও উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে বিপুলভাবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ আজ ধান উৎপাদনে ৪র্থ স্থান থেকে ৩য় স্থান, আলু উৎপাদনে ৮ম হতে ৭ম স্থান এবং সবজি উৎপাদনে ৩য় স্থান অর্জন করেছে। পরিণত হয়েছে চাল, আলু ও সবজি রপ্তানিকারক দেশে। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে এই অভাবনীয় সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার সুদূরপ্রসারী কৃষিবান্ধব নীতি প্রণয়ন, মানসম্পন্ন বীজের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধিতে বিভিন্ন প্রকল্প-কর্মসূচি গ্রহণ, কৃষি উপকরণে ভর্তুকি প্রদান এবং সর্বোপরি জনবল ও সাপোর্ট সার্ভিস বৃদ্ধির মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য। সবশেষে বলা যায় ভালো বীজেই সুস্থ জীবন। স্বাধীনতার ৫০ বছরে খাদ্য নিরাপত্তায় মানসম্পন্ন বীজের উৎপাদন ও ব্যবহার বহুগুণে বৃদ্ধির ফলে আমরা গর্ব ভরে বলতে পারি “বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার বীজ উন্নয়নে অবদান, ভালো বীজের ব্যবহারে বাড়ছে দেশের মান।” য়
উপপরিচালক, (অব:প্রাপ্ত), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মোবাইল : ০১৭১৮৭৩৯৮৫৫, ই-মেইল : হড়সধহর১৯৬১@মসধরষ.পড়স