Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

অগ্রহায়ণ মাস। বাঙালি ঐতিহ্যের নবান্ন উৎসব। মুখরিত হয়ে আমন ফসল সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাহারি ফসল চাষে ব্যস্ত থাকে কৃষিজীবী ভাই-বোনেরা। আমাদের দেশে বৃহত্তর কৃষি ভুবনের উর্বর মাটিই জনগণের মৌলিক চাহিদার প্রয়োজনীয় উপাদান জোগান দেয়।
৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২২। স্বাস্থ্যকর মাটির গুরুত্বের উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা এবং মৃত্তিকা সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার প্রতি সবাইকে সচেতন করা বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস উদ্যাপনের মূল লক্ষ্য। মাটি ব্যবস্থাপনার ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা, সামগ্রিক মান সংরক্ষণ ও উন্নত রাখতে এবং সমাজকে উৎসাহিত করতে বর্তমান সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ বছর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২২ এর প্রতিপাদ্য Soil : Where Food Begins এর ভাবার্থ ‘মাটি : খাদ্যের সূচনা যেখানে’।
মাটির মাধ্যমে জীবনের শুরু ও শেষ হয়। মাটি ছাড়া খাদ্য নিরাপত্তা অকল্পনীয়। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর স্বপ্ন পূরণে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাপী বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না নির্দেশনায় নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। জাতীয়ভাবে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে মাটি, মাটির উর্বরতা, কৃষি জলবায়ু ও হাইড্রোলজির উপর ভিত্তি করে দেশব্যাপী ৩০টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চল গঠন করা হয়েছে। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক ও কৃষক গবেষণার মাধ্যমে পরিবেশ ও চাহিদা উপযোগী জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং সম্প্রসারণ করছেন। সাধারণভাবে বলা হয় বাংলাদেশের মাটি প্রায় দ্বিগুণ উর্বর ও উৎপাদনশীল। মাটির উৎপাদন ক্ষমতা একটি অর্জিত গুণ। যা মাটির উর্বরতা, আবহাওয়া, ফসল প্রযুক্তি, সার সেচ, বালাইমুক্ততা ও কৃষি জলবায়ুর সহযোগে নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য উৎপাদনে সক্ষম।
প্রিয় পাঠক, কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, জাতি সংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, সয়েল সাইন্স সোসাইটি অব বাংলাদেশ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সমন্বয়ে দিবসটি উদ্যাপিত হয়ে থাকে। এ উপলক্ষ্যে মাসিক কৃষিকথা বিশেষ সংখ্যা মুদ্রণ করা হচ্ছে। দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ও সম্মানিত কৃষি সচিব মহোদয়ের দিকনির্দেশনামূলক বাণী এবং মানসম্পন্ন ও তথ্যপ্রযুক্তি লেখা সংযোজন করা হয়েছে। এসব তথ্যসমৃদ্ধ লেখা যারা দিয়েছেন তাদের প্রতি রইল আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। আশা করি সময়োপযোগী লেখাসমূহ বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২২ সফল বাস্তবায়নে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যোগাবে।

বিস্তারিত
সূচিপত্র

৮২তম বর্ষ ড় ৮ম সংখ্যা ড় অগ্রহায়ণ-১৪২৯ (নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০২২)

সূচিপত্র

নিবন্ধ
    
    বিশ^ মৃত্তিকা দিবস-২০২২ এর গুরুত্ব    ০৯    
    মো: কামারুজ্জামান
    লোনা মাটিতে ধান চাষ প্রযুক্তি    ১১    
    মৃত্যুঞ্জয় রায়
    ফসল উৎপাদন ও শস্যনিবিড়তা    ১৩
    কৃষিবিদ সিকদার আনোয়ার
    শূন্য চাষে সার সুপারিশের ভিত্তিতে সরিষা উৎপাদনে আর্থিকভাবে লাভবান প্রযুক্তি ও সম্ভাবনা    ১৫    
    ড. মো: আজিজুল হক, ড. মো. আব্দুল মালেক, কামরুন্নাহার, সোহেল রানা, বাবুল আকতার
    বালাইনাশক ব্যবহারের গুরুত্ব এবং ব্যবহারের সচেতনতা     ১৭    
    ড. মোঃ আলতাফ হোসেন    
    রপ্তানিযোগ্য আলু চাষে কৃষকদের করণীয়    ১৯
    ড. মুহ: রেজাউল ইসলাম    
    সময় ও ব্যয় সাশ্রয়ী বারি সূর্যমুখী মাড়াইযন্ত্র উদ্ভাবন    ২১
    ড. মোহাম্মদ এরশাদুল হক    
    পাট পাতার ব্যবহার ও ঔষধিগুণ    ২২
    জাকারিয়া আহমেদ, সুুরঞ্জন সরকার
    বসতবাড়িতে সবজি বাগান ব্যবস্থাপনা    ২৪
    কৃষিবিদ মো: আনিছুর রহমান    
    মাছের খাদ্য তৈরির মেশিন (সাউ ফিড মিল-১) উদ্ভাবন    ২৬    
    মোঃ মাসুদ রানা
    ডেইরি খামার লাভজনক করতে সঠিক পরিকল্পনা ও পরিচর্যা    ২৭    
    ডা: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান

আগামীর কৃষি ভাবনা
    উদ্ভিজ আমিষ : প্রাণিজ মাংসের বিকল্প ব্যবহার    ২৯    
    মোঃ আখতারুজ্জামান
     অজৈব অভিঘাত ব্যবস্থাপনায় ন্যানোপার্টিকেলসের গুরুত্ব    ৩১
    ড. রিপন সিকদার
     কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ ও কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি    ৩৩
    কৃষিবিদ মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন, মো: শাহীদুল ইসলাম

উচ্চমূল্যের ফসল চাষাবাদ
    সম্ভাবনাময় টিউলিপ ফুলের উৎপাদন প্রযুক্তি    ৩৫
    ড. শামীম আহমেদ
সফল কৃষকের গল্প

    বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী ফল উৎপাদন    ৩৭
    ড. মো. জামাল উদ্দিন
নিয়মিত বিভাগ
    অগ্রহায়ণ মাসের তথ্য ও প্রযুক্তি পাতা    ৩৯    
    কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন    
    পৌষ মাসের কৃষি (১৬ ডিসেম্বর-১৪ জানুয়ারি)    ৪০
    কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম

 

বিস্তারিত
বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস-২০২২ এর গুরুত্ব

বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস-২০২২ এর গুরুত্ব
মো: কামারুজ্জামান
বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের উদ্দেশ্য মাটির স্বাস্থ্য, টেকসই ব্যবস্থাপনা ও অবক্ষয় সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। প্রকৃতপক্ষে, সব স্থলজ প্রাণীর জন্য মাটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই বছরের প্রতিপাদ্য ‘মাটি : খাদ্যের সূচনা যেখানে’ (Soils:Where Food Begins)। এ প্রতিপাদ্যের লক্ষ্য মাটির স্বাস্থ্য ও টেকসই ব্যবস্থাপনার ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিশ্বের সব মানুষের খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ ছাড়া বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস সুস্থ বাস্তুতন্ত্র এবং মাটির উন্নত স্বাস্থ্য সম্পর্কে সমাজের সবাইকে সচেতন ও উৎসাহিত করতে সাহায্য করে।
বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস (World Soil Day) প্রতি বছর ৫ ডিসেম্বর উদ্যাপন করা হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য সুস্থ মাটির গুরুত্বের উপর সংশ্লিষ্ট সবার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা এবং মৃত্তিকা সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার প্রচারণার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
২০০২ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব সয়েল সায়েন্স (IUSS) কর্তৃক মাটি নিয়ে প্রতি বছর একটি উৎসব বা অনুষ্ঠান করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক দিবস নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়। থাইল্যান্ড এর রাজার নেতৃত্বে এবং গ্লোবাল সয়েল পার্টনারশিপ এর কাঠামোর মধ্যে, FAO বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধির প্ল্যাটফর্ম হিসাবে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের আনুষ্ঠানিক যাত্রা বা সূচনাকে সমর্থন করে। ২০১৩ সালের জুন মাসে FAO সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস পালনের ধারণাটিকে অনুমোদন করা হয় এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৮তম অধিবেশনে এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদনের অনুরোধ জানানো হয়। ডিসেম্বর ২০১৩ সালে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ৫ ডিসেম্বর ২০১৪ কে প্রথম বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস হিসেবে মনোনীত করে। থাইল্যান্ডের প্রয়াত রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদেজ মৃত্তিকা সম্পদের গুরুত্ব প্রচার-প্রসারের জন্য সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। সবচেয়ে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ মৃত্তিকার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি, ভালোবাসা এবং আবেগ বিশ্বব্যাপী সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টিআকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। ৫ ডিসেম্বর থাইল্যান্ডের প্রয়াত রাজার জন্মদিনও বটে। ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ঘোষণার মাধ্যমে রাজার অনবদ্য কাজ ও স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। সেই থেকে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব এবং এর প্রচার-প্রচারণার দায়িত্ব পালন করে আসছে। সারা বিশ্বে দিনটিকে মাটির স্বাস্থ্য এবং এর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিজ্ঞানী, ছাত্র, কৃষকদেরকে অবহিত ও অনুপ্রাণিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য প্রতি বছর আলাদা আলাদা থিম (Theme) ব্যবহার করা হয়।
বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস মৃত্তিকা সম্পদের গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মৃত্তিকা সব স্থলজ প্রাণীর খাবারের প্রধান উৎস এবং বাস্তুতন্ত্রের ধারক ও বাহক। পৃথিবীর সকল জীব মাটি থেকে শুরু এবং মাটিতেই শেষ। এটি শুধু খাদ্য নয় ওষুধেরও প্রধান উৎস।
মানুষের জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তা নির্ভর করে মাটির স্বাস্থ্য ও টেকসই ব্যবস্থাপনার ওপর। মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য মাটির গুরুত্ব অপরিসীম। দেশে দিন দিন মানুষ বাড়ছে এবং শিল্পায়ন, নগরায়ন, বাড়িঘর নির্মাণ, রাস্তাঘাট তৈরিসহ নানা কারণে চাষের জমি কমছে। এ দুই সমস্যার সাথে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। অন্য দিকে মাটির উর্বরতা শক্তিও হ্রাস পাচ্ছে। এসব বিবেচনায় খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনাসহ শস্যের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। সেজন্য মাটির স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সচেষ্ট হতে হবে।
মাটি বাঁচলে পরিবেশ বাঁচবে, দেশ বাঁচবে। পরিবেশ বাঁচলে রক্ষা পাবে প্রাণী ও উদ্ভিদজগৎ। জীবিকা নির্বাহের জন্য সমস্ত জীব মাটির উপর নির্ভরশীল। মাটিতে হাজার হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ জন্মায়। উদ্ভিদ মাটি থেকে বিভিন্ন প্রকার পুষ্টি সংগ্রহ করে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী উদ্ভিদ থেকে তাদের পুষ্টি গ্রহণ করে। উদ্ভিদ থেকে মানুষ খনিজ, ভিটামিন এবং প্রোটিন গ্রহণ করে যা তাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন। অর্থাৎ খাদ্যের জন্য মানুষ মাটির উপর নির্ভরশীল।
যখন আমরা ফসল সংগ্রহ করি তখন ফসলের সাথে সাথে মাটির কিছু পুষ্টি উপাদানও আমরা নিয়ে যাই। একে বলা হয় মাটির পুষ্টি রপ্তানি। এর ফলে মাটিতে পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি দেখা দেয়। উদ্ভিদ মাটি থেকে যে পুষ্টি গ্রহণ করে তা সার বা অন্য কোন উপায়ে মাটিতে ফেরত দিতে হবে। এতে মাটির উর্বরতামান বজায় থাকবে।
পৃথিবীর খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য মাটি অত্যাবশ্যক। পৃথিবীর প্রায় ৯৫ ভাগ খাদ্য জোগান দেয় মাটি। সুস্থ মাটি পৃথিবীর ক্ষুধা দূর করতে এবং আমাদের জন্য স্বাস্থ্যকর একটি গ্রহ উপহার দিতে সক্ষম। মাটির পুষ্টির ভারসাম্যহীনতা একটি প্রধান বৈশ্বিক সমস্যা, যা পুষ্টির অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার, অপব্যবহার কিংবা অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে ঘটে থাকে। সারের অতিরিক্ত ব্যবহার বা অপব্যবহার বাস্তুতন্ত্রের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং জীব বৈচিত্র্যের ক্ষতি সাধনসহ গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন ও জলবায়ু পরিবর্তনে অবদান রাখে।
ক্রমবর্ধমান বিশ্ব জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানো একুশ শতকের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহের জন্য ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়োজন হবে। ক্রমবর্ধমান ভূমি ক্ষয়, মৃত্তিকা উর্বরতা হ্রাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কৃষি উৎপাদনের এই প্রয়োজনীয় বৃদ্ধি সহজসাধ্য নয়।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মাটির ক্ষয়, খাদ্য পরিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদির সমন্বিত প্রভাব বিশ্বব্যাপী ভবিষ্যতের খাদ্য উৎপাদনের জন্য উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ফসল উৎপাদনের ফলে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান মাটি থেকে ক্রমশ অপসারিত হয়। সার প্রয়োগের মাধ্যমে অপসারিত পুষ্টি উপাদানসমূহকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয় না এবং প্রতি বছর সময়ের সাথে সাথে, বারবার ফসল ফলানোর ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায়। ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদার সাথে তালমিলিয়ে চলার জন্য চাহিদা এবং উৎপাদনের মধ্যে ব্যবধান কমাতে হবে। খাদ্যের বর্ধিত চাহিদা মোকাবিলায় প্রচলিত ও আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাতে হবে। ভবিষ্যতে খাদ্য ও খাদ্যের জোগানে মাটির অবদান বজায় রাখার জন্য প্রযুক্তিগত উন্নতি এবং অন্যান্য উদ্ভাবনী পদ্ধতি ব্যবহারের প্রয়োজন হবে।
অসমহারে ও যথেচ্ছভাবে রাসায়নিক সার প্রয়োগ, জৈবসার ব্যবহার না করা বা কম করা, ফসল চাষের নিবিড়তা বৃদ্ধি, প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভূমি কর্ষণ, শস্যপর্যায় নীতিমালা অনুসরণ না করা, উফশী ও হাইব্রিড জাতের ফসলের আবাদ বৃদ্ধি, ফসলের অবশিষ্টাংশ জমিতে ব্যবহার না করা, মাটির অম্লমান নিয়ন্ত্রণ না করা, মাটি পরীক্ষা না করে রাসায়নিক সার প্রয়োগ ইত্যাদি মাটির স্বাস্থ্য বিনষ্টের প্রধান কারণ।
মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হওয়ার কারণে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়, পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়, উপকারী অণুজীবের সক্রিয়তা কমে যায়, মাটিতে পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্যহীনতা দেখা যায়, ফসলের ফলন ও গুণগতমান কমে যায় এবং ফসলের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়।
মাটির স্বাস্থ্য সংরক্ষণসহ ফসলের অধিক ফলনের জন্য মাটি পরীক্ষা  সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাটি পরীক্ষা ছাড়া জমিতে পরিমাণমতো সার দেয়া যায় না। তাই সার সুপারিশ প্রদানের জন্য মাটি পরীক্ষা অবশ্যই করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য, মাটির স্বাস্থ্য সংরক্ষণসহ ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) বিভাগীয় ও আঞ্চলিক গবেষণাগারে মাটি পরীক্ষা করে পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে সুষম সার সুপারিশ প্রদান করা হয়। মাটি পরীক্ষা করার ফলে মাটিতে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ, মাটির অম্লমান ও মাটিতে বিদ্যমান জৈব পদার্থের পরিমাণ জানা যায় এবং সর্বোপরি মাটিতে ফসলের চাহিদা অনুযায়ী পরিমাণমতো সুষম সার প্রয়োগ করা যায়।
সুষম সার প্রয়োগে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, সারের অপচয় কম হয়, ফসলের উৎপাদন খরচ কমে যায়, উপকারী অণুজীবের কার‌্যাবলী বৃদ্ধি পায়, পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্যতা বজায় থাকে, মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং সর্বোপরি ফসলের ফলন ও গুণগতমান বাড়ে।
এ দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় কৃষিই অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। জনগণের পুষ্টি ও নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ, কর্মসংস্থান ও আয়বর্ধক কর্মের সুযোগ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের কাঁচামাল সরবরাহের নিশ্চয়তা প্রদান করে কৃষি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর কৃষি বিপ্লবের ডাক কৃষকসমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তিনি কৃষির উন্নয়নে সার, কীটনাশক, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার কৃষির উন্নয়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

লেখক : মহাপরিচালক (ভা. প্রা.), মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ফোন : ৪১০২৫০৪১ ই-মেইল :zamansrdi@yahoo.com

 

বিস্তারিত
লোনা মাটিতে ধান চাষ প্রযুক্তি

লোনা মাটিতে ধান চাষ প্রযুক্তি
মৃত্যুঞ্জয় রায়
ধান বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফসল। উপকূলীয় অঞ্চলসহ সারাদেশেই বিভিন্ন পরিবেশে নানা জাতের ধান চাষ করা হয়। এ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের আয়তন বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ২০ শতাংশ এবং এ অঞ্চলে রয়েছে দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ আবাদি জমি। এ জমিতে প্রধানত আমন ধানের চাষ করা হয়। আমন মৌসুমে সাধারণত বৃষ্টির কারণে লবণাক্ততা দেখা যায় না, লবণাক্ততা দেখা যায় বোরো মৌসুমে।
সমস্যা হলো, অন্যান্য রবি ফসলের তুলনায় বোরো ধান চাষে পানি বেশি লাগে। শুষ্ক মৌসুমে উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক জমি স্বাদু পানির অভাবে পতিত পড়ে থাকে। এ মৌসুমে নদ-নদী ও খালের পানিও লবণাক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে বোরো ধানের লবণাক্ততা সহনশীলতার মাত্রাকেও অনেক সময় ছাড়িয়ে যায় (>৪ ডিএস/মিটার)। তাছাড়া সব জাত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে না। গবেষণায় বোরো ধানে লবণাক্ততাজনিত কারণে ফলন ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে প্রায় ২৩%।
এসব কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে বোরো ধান চাষ করা ঝুঁকিপূর্ণ। এর পরিপ্রেক্ষিতে লবণাক্ততা পরিস্থিতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে বিবেচনা করে উপকূলীয় অঞ্চলে বোরো ধান চাষ সম্প্রসারণের জন্য কিছু বিশেষ কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে, যেমন-(১) লবণাক্ততা সহনশীল জাতের চাষ, (২) বীজ বোনার সময় পরিবর্তন, (৩) স্বাদু বা স্বল্প লবণাক্ত পানি দ্বারা সেচের ব্যবস্থা করা। উপকূলীয় জমিতে এই তিনটি কৌশল অবলম্বন করে বোরো ধানের চাষ ও উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
লবণাক্ততা সহনশীল জাতের চাষ
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) কয়েকটি লবণাক্ততা সহনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে যেগুলো বোরো মৌসুমে উপকূলীয় লবণাক্ততাপ্রবণ এলাকায় চাষ করা যায়।
উপকূলীয় খুলনা অঞ্চলে বর্তমানে বোরো মৌসুম ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৯৭, ব্রি ধান৯৯, বিনা ধান-৮, বিনা ধান-১০, বিনা ধান-২৪ ইত্যাদি এবং আমন মৌসুম ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান২৩, ব্রি ধান৭৩, ব্রি ধান৭৮ ইত্যাদি জাতের চাষ হচ্ছে। অধিকাংশ জমিতে এখন এসএল-৮, শক্তি-২, সিনজেনটা-১২০১, সিনজেনটা-১২০৩, হীরা-১৯, এসিআই-৬, তেজগোল্ড, ছক্কা ইত্যাদি হাইব্রিড জাতের ধান চাষ করা হচ্ছে।  
সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, বরিশালসহ বন্যাপ্রবণ এলাকার কৃষকদের অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনতে এ জাতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বীজ বোনার সময় পরিবর্তন
বোরো ধানের বীজ বোনার সময় পরিবর্তন করে লবণাক্ততার প্রভাব কিছুটা কমানো যায়। খুলনার দাকোপ উপজেলায় এ বিষযে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। গবেষণায় ১৫ অক্টোবর থেকে ৩০ ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে ১৫ দিন পর পর তিনটি জাতের (ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৬৭ ও বিনা ধান-১০) বীজ ৬ বারে বপন করে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় ৪৫ দিন বয়সের চারা ২০ সেন্টিমিটার ী ২০ সেন্টিমিটার দূরত্বে সারি করে রোপণ করা হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট সুপারিশকৃত সারের মাত্রা অনুযায়ী সার প্রয়োগ করা হয়। গবেষণায় ১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে বপন করা বীজ থেকে তুলনামূলকভাবে ভালো ফলন পাওয়া যায়, ৩০ নভেম্বরে বোনা বীজ থেকে সবচেয়ে বেশি ফলন পাওয়া যায়। উল্লেখ্য ব্রি ধান ২৮ ও ব্রি ধান৬৭ জাতের জন্য ব্রি সুপারিশকৃত বীজ বোনার সময় যথাক্রমে ১৫-২৯ নভেম্বর ও ১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর। গবেষকদের অভিমত হলো, এ সময়ে বোরো ধানের বীজ বুনে এই তিনটি জাতের হেক্টর প্রতি ফলন ৬ টনের কাছাকাছি পাওয়া গেছে। কিন্তু দেরি করে বীজ বুনলে বোরো ফসল অধিক লবণাক্ততার ঝুঁকিতে পড়ে ও ফলন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
স্বাদু বা স্বল্প লবণাক্ত পানি দ্বারা সেচের ব্যবস্থা করাঅঈলোনা মাটিতে ধান চাষ প্রযুক্তি
মৃত্যুঞ্জয় রায়
ধান বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফসল। উপকূলীয় অঞ্চলসহ সারাদেশেই বিভিন্ন পরিবেশে নানা জাতের ধান চাষ করা হয়। এ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের আয়তন বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ২০ শতাংশ এবং এ অঞ্চলে রয়েছে দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ আবাদি জমি। এ জমিতে প্রধানত আমন ধানের চাষ করা হয়। আমন মৌসুমে সাধারণত বৃষ্টির কারণে লবণাক্ততা দেখা যায় না, লবণাক্ততা দেখা যায় বোরো মৌসুমে।
সমস্যা হলো, অন্যান্য রবি ফসলের তুলনায় বোরো ধান চাষে পানি বেশি লাগে। শুষ্ক মৌসুমে উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক জমি স্বাদু পানির অভাবে পতিত পড়ে থাকে। এ মৌসুমে নদ-নদী ও খালের পানিও লবণাক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে বোরো ধানের লবণাক্ততা সহনশীলতার মাত্রাকেও অনেক সময় ছাড়িয়ে যায় (>৪ ডিএস/মিটার)। তাছাড়া সব জাত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে না। গবেষণায় বোরো ধানে লবণাক্ততাজনিত কারণে ফলন ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে প্রায় ২৩%।
এসব কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে বোরো ধান চাষ করা ঝুঁকিপূর্ণ। এর পরিপ্রেক্ষিতে লবণাক্ততা পরিস্থিতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে বিবেচনা করে উপকূলীয় অঞ্চলে বোরো ধান চাষ সম্প্রসারণের জন্য কিছু বিশেষ কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে, যেমন-(১) লবণাক্ততা সহনশীল জাতের চাষ, (২) বীজ বোনার সময় পরিবর্তন, (৩) স্বাদু বা স্বল্প লবণাক্ত পানি দ্বারা সেচের ব্যবস্থা করা। উপকূলীয় জমিতে এই তিনটি কৌশল অবলম্বন করে বোরো ধানের চাষ ও উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
লবণাক্ততা সহনশীল জাতের চাষ
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) কয়েকটি লবণাক্ততা সহনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে যেগুলো বোরো মৌসুমে উপকূলীয় লবণাক্ততাপ্রবণ এলাকায় চাষ করা যায়।
উপকূলীয় খুলনা অঞ্চলে বর্তমানে বোরো মৌসুম ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৯৭, ব্রি ধান৯৯, বিনা ধান-৮, বিনা ধান-১০, বিনা ধান-২৪ ইত্যাদি এবং আমন মৌসুম ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান২৩, ব্রি ধান৭৩, ব্রি ধান৭৮ ইত্যাদি জাতের চাষ হচ্ছে। অধিকাংশ জমিতে এখন এসএল-৮, শক্তি-২, সিনজেনটা-১২০১, সিনজেনটা-১২০৩, হীরা-১৯, এসিআই-৬, তেজগোল্ড, ছক্কা ইত্যাদি হাইব্রিড জাতের ধান চাষ করা হচ্ছে।  
সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, বরিশালসহ বন্যাপ্রবণ এলাকার কৃষকদের অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনতে এ জাতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বীজ বোনার সময় পরিবর্তন
বোরো ধানের বীজ বোনার সময় পরিবর্তন করে লবণাক্ততার প্রভাব কিছুটা কমানো যায়। খুলনার দাকোপ উপজেলায় এ বিষযে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। গবেষণায় ১৫ অক্টোবর থেকে ৩০ ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে ১৫ দিন পর পর তিনটি জাতের (ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৬৭ ও বিনা ধান-১০) বীজ ৬ বারে বপন করে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় ৪৫ দিন বয়সের চারা ২০ সেন্টিমিটার ী ২০ সেন্টিমিটার দূরত্বে সারি করে রোপণ করা হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট সুপারিশকৃত সারের মাত্রা অনুযায়ী সার প্রয়োগ করা হয়। গবেষণায় ১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে বপন করা বীজ থেকে তুলনামূলকভাবে ভালো ফলন পাওয়া যায়, ৩০ নভেম্বরে বোনা বীজ থেকে সবচেয়ে বেশি ফলন পাওয়া যায়। উল্লেখ্য ব্রি ধান ২৮ ও ব্রি ধান৬৭ জাতের জন্য ব্রি সুপারিশকৃত বীজ বোনার সময় যথাক্রমে ১৫-২৯ নভেম্বর ও ১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর। গবেষকদের অভিমত হলো, এ সময়ে বোরো ধানের বীজ বুনে এই তিনটি জাতের হেক্টর প্রতি ফলন ৬ টনের কাছাকাছি পাওয়া গেছে। কিন্তু দেরি করে বীজ বুনলে বোরো ফসল অধিক লবণাক্ততার ঝুঁকিতে পড়ে ও ফলন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
স্বাদু বা স্বল্প লবণাক্ত পানি দ্বারা সেচের ব্যবস্থা করা
উপকূলীয় অঞ্চলে বোরো ধান চাষে একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো এ মৌসুমে সেচের উৎস নদ-নদী ও খালের পানি লবণাক্ত হয়ে পড়া। এমনকি মাটি ও নলকূপের পানিও লবণাক্ত হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত শুষ্কতা, তাপমাত্রা, কড়া রোদ ও বৃষ্টিবিহীন অবস্থার কারণে মাটিতে থাকা পানি অধিক হারে বাষ্প হয়ে উড়ে যাওয়ায় লবণাক্ততা বেড়ে যায়, অনেক সময় এতে মাটির উপরেও লবণের দানা বা স্তর দেখা যায়। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাগরের লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশের ফলে দিন দিন লবণাক্ত জমির পরিমাণ বাড়ছে। এ অবস্থায় জমিতে পানি ধরে রেখে বা সেচের মাধ্যমে বোরো ধানের চাষ করলে লবণাক্ততা কমে। সেক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে খাল সংস্কার করে সেসব খালে বৃষ্টির পানি মজুদ করে তা দিয়ে বোরো ধানে সেচের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে লবণাক্ততা সহনশীল জাতের চাষ করলে এসব এলাকার খাল বা নদীর পানিতে অথবা নলকূপের পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা সহনীয় থাকে সেসব এলাকায় লবণাক্ততা সহনশীল জাতের চাষ করে সেচ দিয়ে বোরো ধানের চাষ করা যায়। লবণাক্ততা সহনশীল নির্বাচিত জাতের বোরো ধান চাষ প্রযুক্তি সারণি দ্রষ্টব্য।লেখক : অতিরিক্ত পরিচালক (অব:), ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল- ০১৭১৮২০৯১০৭, ই মেইল-kbdmrityun @gmail.com
 

বিস্তারিত
ফসল উৎপাদন ও শস্যনিবিড়তা

ফসল উৎপাদন ও শস্যনিবিড়তা
কৃষিবিদ সিকদার আনোয়ার
বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের জনগণ তাদের আয়ের বেশির ভাগ খাদ্যের জন্য ব্যয় করে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব সব নাগরিকের খাদ্যের মৌলিক চাহিদা নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ নিশ্চিত করা। জাতিসংঘের ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি-২) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে সব নাগরিকের জন্য খাদ্য জোগানে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বাংলাদেশের মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় ৮৬ লাখ ৪৪ হাজার ৪৯০ হেক্টর। মোট ফসলি জমি প্রায় ১৭৬ লাখ ৯৪ হাজার ৬৪১ হেক্টর যা জনসংখ্যার তুলনায় কম। আর তাই কৃষিতে শস্যনিবিড়তা (Cropping Intensity) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি নির্দিষ্ট জমিতে এক বছরে কয়টি ফসল উৎপাদন করা হয় শস্যনিবিড়তা তাই নির্দেশ করে। সাধারণত প্রাকৃতিক পরিবেশ, মৃত্তিকার গুণাগুণ, সেচ সুবিধাসহ কৃষি উপকরণের পর্যাপ্ততা,  মালিকের অনুপস্থিতি, অতিরিক্ত জমির মালিকানা, বর্গা চাষ, অকৃষি খাতে উপার্জন বৃদ্ধি, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিসহ নানাবিধ কারণের ওপর জমির শস্যনিবিড়তা হ্রাসবৃদ্ধি নির্ভর করে। মৃত্তিকা পরীক্ষা করে শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধি করে ফসল উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। দেশব্যাপী কৃষি অঞ্চলগুলোতে এক ফসলি, দুই ফসলি, তিন ফসলি শস্যবিন্যাস চলমান রয়েছে। চার ফসলি শস্যবিন্যাস মোট ফসলি জমির মধ্যে প্রায় ৬১ হাজার ৮২২ হেক্টর চাষাবাদ হচ্ছে। স্বাধীনতার পরবর্তী   ১৯৭১-৭২ সালে ফসলের নিবিড়তা ছিল ১৫৩.৭৪%। বর্তমানে বেড়ে হয়েছে ২০৫% (ডিএই ২০২০-২১)। কৃষি অঞ্চল হিসেবে ফসল নিবিড়তা সবচেয়ে বেশি বগুড়া অঞ্চল ও যশোরে  অঞ্চলে (২৩৬), সবচেয়ে কম স্বাভাবিকভাবেই রাঙ্গামাটি কৃষি অঞ্চলে (১৩৮)। এছাড়াও দেশের দক্ষিণাঞ্চল যেখানে নদ-নদী খাল-বিলের সংখ্যা বেশি সেসব (যেমন পটুয়াখালী (১৯৬), পিরোজপুর (১৬৫), খুলনা (১৭৬), ঝালকাঠি (১৮৩), সাতক্ষীরা (১৯৮), নোয়াখালী (১৭৩), বাগেরহাট (১৫৪), শরীয়তপুর (১৮৬) এবং বরিশাল (২০২)) জেলায় শস্যনিবিড়তা অপেক্ষাকৃত জাতীয় গড়ের চেয়ে কম। এক সময়কার প্রবাদ বাক্য “ধান নদী খাল, এই তিনে বরিশাল”। সেই বৃহত্তর বরিশালে অনেক আবাদযোগ্য জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হচ্ছে না। অথচ ২০১৯ সালের কৃষি শুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বরিশাল বিভাগে কৃষি খানার সংখ্যা সর্বাধিক ৬৬%। এখন বরিশাল নয় বরং উত্তরাঞ্চল বা পশ্চিমাঞ্চলকে বাংলাদেশের শস্যভা-ার বলা হয় যেখানে চাষাবাদ হয় মূলত ভূগর্ভস্থ পানির সেচ দিয়ে।
অনুরূপভাবে দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের জেলাগুলোতে বহু আগে থেকেই অনুপস্থিত ভূমি মালিকানার জন্য (Absentee land owner) কৃষি জমিতে সঠিক মাত্রায় চাষাবাদ হচ্ছে না। অনেক আবাদযোগ্য জমি পতিত অথবা সাময়িকভাবে পতিত পড়ে থাকে। পরিস্থিতি বিবেচনায়  কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে (Increasing Cropping in Sylhet Region Project) শস্যনিবিড়তা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়। সুনামগঞ্জ, সিলেট এবং  মৌলভীবাজারে ২০১৩-১৪ সালে শস্যনিবিড়তা ছিল যথাক্রমে ১৩০, ১৫১, এবং ১৫০। চার-পাঁচ বছরের ব্যবধানে ২০১৯-২০ সালে সুনামগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজারে  শস্যনিবিড়তা কিছুটা বেড়ে যথাক্রমে ১৩৭, ১৭৬ এবং ১৮০ তে দাঁড়িয়েছে। এসব জেলাগুলোতে শস্যনিবিড়তা আরো বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে শিল্পের মতো উপকরণ, প্রযুক্তি বা বিনিয়োগ বৃদ্ধি করলেই ক্রমাগত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেতে থাকে না, একটা পর্যায়ে গিয়ে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার কমতে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জমির প্রাপ্যতা বৃদ্ধির সুযোগ খুব একটা নেই বরং শিল্পায়ন, নগরায়ন, রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং অকৃষি খাতে ভূমি ব্যবহারের কারণে প্রতি বছর প্রায় এক শতাংশ হারে কৃষি জমির পরিমাণ কমছে। এটি কৃষির উপর একটি বড় চ্যালেঞ্জ যা মোকাবিলা করতে হলে জমির পূর্ণ ব্যবহার করা প্রয়োজন।
চলমান কোভিড-১৯সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষির অগ্রযাত্রায় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার দুটো বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন; ১) এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না এবং ২) ফসলের বহুমুখীকরণ। সময় এসেছে সুচিন্তিতভাবে দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলকে বিভিন্ন ফসলের আওতায় ভাগ করে চাষাবাদের আওতায় এনে  কাক্সিক্ষত মাত্রায় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করার। যেহেতু ধান বাংলাদেশের প্রধান ফসল একে বাদ দিয়ে শুধু অন্য ফসলের উন্নয়ন কখনই সময়োপযোগী হবে না। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য বাংলাদেশে মেধাসম্পন্ন জাতি গঠনে নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করা। তাই  বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কৃষি বিজ্ঞানীরা ২০৩০ সালের মধ্যে ১৯ কোটি জনসংখ্যার খাদ্য জোগানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে অঞ্চলভিত্তিক শস্যবিন্যাস উদ্ভাবন করে যাচ্ছে। অধিকাংশ চার ফসলি শস্যবিন্যাসগুলোতে দুইটি ধান থাকায় খাদ্য নিরাপত্তার ওপরও কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে না।
বাংলাদেশের  কৃষির মৌসুম ৩টি। যথা: ১) রবি মৌসুম; ২) খরিফ-১ মৌসুম; ৩) খরিফ-২ মৌসুম। দেশব্যাপী ১৪ টি কৃষি অঞ্চল রয়েছে। সাধারণত অঞ্চলের কৃষি পরিবেশ যেমন:প্রাকৃতিকরূপ, ভূমিরূপ, সেচ  ও দুর্যোগ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত অঞ্চলভিত্তিক চার ফসলি প্রায় ৭৪টি শস্যবিন্যাস উদ্ভাবন করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি কম ব্যবহার হয় সেক্ষেত্রে তিন মৌসুমে চার ফসলের শস্যবিন্যাস মসুর-মুগ-রোপা আউশ- রোপা আমন হতে পারে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল, স্বল্পমেয়াদি এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ জাত ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া এ ধরনের শস্যবিন্যাসে মুগডালের পড বা ফল তুলে গাছগুলো মাটির সাতে মিশিয়ে দিলে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং আমন ধানে কম ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। তবে মুগডালের গাছ মাটির সাথে মিশানোর ৪-৫ দিন পর আমন ধানের চারা লাগালে বেশি লাভ হয়। আর মুগডাল চাষে পানির তেমন প্রয়োজন হয় না এবং সঠিক সময় বপন ও রোপণ করা হলে বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে প্রায় ২৫-২৮ দিন অবশিষ্ট থেকে যায়। এক কথায় বলা যায়  উৎপাদনে সময় ও খরচ কম হয়।
দেশব্যাপী ১৪টি কৃষি অঞ্চলের মধ্যে রাঙ্গামাটি ছাড়া প্রায় সব অঞ্চলে চার ফসলি শস্যবিন্যাসে চাষ চলমান রয়েছে। যেমন : খুলনা অঞ্চলে  সবজি (শীত)-সবজি (শীত)-সবজি (গ্রীষ্ম)-সবজি (গ্রীষ্ম) আবার এভাবেও হতে পারে খেসারি-ফল বাগান (তরমুজ)-আউশ-রোপা আমন। সিলেটে অঞ্চলে সবজি (শীত)-সবজি (শীত)-সবজি (গ্রীষ্ম)-সবজি (গ্রীষ্ম); যশোরে অঞ্চলে  সবজি (শীত)-সবজি (শীত)-সবজি (গ্রীষ্ম)-সবজি (গ্রীষ্ম) অথবা সরিষা-বোরো-আউশ-রোপা আমন; ময়মনসিংহ অঞ্চলে একইভাবে  সবজি (শীত)-সবজি (শীত)-সবজি (গ্রীষ্ম)-সবজি (গ্রীষ্ম) আবার সবজি (শীত)-বোরো-পাট-রোপা আমন হতে পারে। কুমিল্লা অঞ্চলে সবজি (শীত)-সবজি (শীত)-তিল (গ্রীষ্ম)-বোনা আমন আবার সবজি (শীত)-সবজি (শীত)-পাট-রোপা আমন চলমান রয়েছে। রাজশাহী অঞ্চলে তিল-মুগ-রোপা আউশ-রোপা আমন অথবা আলু-মুগ-রোপা আউশ-রোপা আমন অথবা সরিষা-মুগ-রোপা আউশ-রোপা আমন আবার এমনও হতে পারে গম-ধৈঞ্চা-রোপা আউশ-রোপা আমন। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদ বিশেষ করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নিচে নামার প্রবণতা বিদ্যমান বিধায়  সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারিভাবে কৃষিতে ভূগর্ভস্থ পানি সেচের ব্যবস্থা নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। ভূউপরিস্থ পানি সেচের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনের প্রচেষ্টা জোরদার করার প্রয়োজন রয়েছে।
মানুষের খাদ্যের প্রাথমিক যোগানদাতা কৃষি।  শিল্প বা অন্য কোন সেক্টর থেকে খাদ্যের জোগান পাওয়া গেলেও ঐসব সেক্টর কৃষির উপর নির্ভর না করে মানুষকে খাদ্য সরবরাহ করতে পারে না। তাই কৃষি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহারের বিকল্প নেই। কেউ জমির যথাযথ ব্যবহার করতে না পারলে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে জমির মালিকানা অপরিবর্তিত রেখে তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তাতে অনুপস্থিত ভূস্বামীদের জমির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হতে পারে এবং এতে সার্বিকভাবে শস্যনিবিড়তা বৃদ্ধি পাবে।
কৃষি জমির সর্বোত্তম ব্যবহারের পূর্বশর্ত হচ্ছে কৃষিকাজকে লাভজনক এবং আনন্দদায়ক করা। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, চাষাবাদ পদ্ধতি আধুনিকীকরণ, নুতন জাত উদ্ভাবন, বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি,-এ সবই আনন্দদানের অনুষঙ্গ। উৎপাদিত শস্যের গুদামজাত বা বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে কৃষকদের মধ্যে সমিতি বা সমবায় সমিতি গড়ে দেয়া যেতে পারে। কর্তিত শস্য এসব সমিতির মাধ্যমে সরকারি সংগ্রহকেন্দ্রে পৌঁছানোর ব্যাবস্থা করা গেলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পেতে পারে। জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে         কৃষি মেলা, কৃষক সমাবেশ আরো আকর্ষণীয়  ও প্রতিযোগিতামূলক করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ছাড়াও সিআইপির ন্যায় এআইপি প্রবর্তন করার সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। জাতীয়ভাবে ঢাকায় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ইউনিয়ন, উপজেলা বা জেলাপর্যায়ে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ কৃষকদের/কৃষি বিজ্ঞানীদের অবদানকে স্বীকৃতি প্রদান করা প্রয়োজন।
কৃষিকে টেকসই,আধুনিক এবং নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিরাপত্তা বিধান কল্পে সমস্ত আবাদযোগ্য জমি চাষের আওতায় আনতে হবে এবং শস্যনিবিড়তা বৃদ্ধি করতে হবে। তবেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় সোনালি সকালের সূর্যোদয়ে উদ্ভাসিত হবে।

লেখক : সাবেক রেক্টর, বিসিএস প্রশাসন একাডেমি, ৭৪ কলাবাগান ২য় লেইন , ঢাকা, মোবা :  ০১৫৫২৩২৩৩৭১, ই-মেইল :sikder2119@gmail.com

বিস্তারিত
শূন্য চাষে সার সুপারিশের ভিত্তিতে সরিষা উৎপাদনে আর্থিকভাবে লাভবান প্রযুক্তি ও সম্ভাবনা

শূন্য চাষে সার সুপারিশের ভিত্তিতে সরিষা উৎপাদনে আর্থিকভাবে লাভবান প্রযুক্তি ও সম্ভাবনা
ড. মো: আজিজুল হক১ ড. মো. আব্দুল মালেক২ কামরুন্নাহার৩ সোহেল রানা৪ বাবুল আকতার৫
চাহিদার তুলনায় বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের মোট দেশজ উৎপাদন অনেক কম হওয়ায় প্রতি বছর ঘাটতি মোকাবিলায় বিদেশ হতে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয়। দেশে ভোজ্যতেলের প্রধান উৎস হলো সরিষা। তাই সরিষা উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটানো অপরিহার্য। বাংলাদেশে ধাননির্ভর রোপা আমন-পতিত- বোরো/আউশ শস্যবিন্যাসটি দেশে বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রচলিত। স্বল্প জীবনকালসম্পন্ন আমন ধান কর্তন করার পরপরই উচ্চফলনশীল স্বল্প জীবনকালীন সরিষা জাত বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯ ও বিনাসরিষা-১০ প্রভৃতি আবাদের মাধ্যমে সরিষা উৎপাদন বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এ জন্য সরিষা চাষাবাদ পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন আনার প্রয়োজন। বর্তমান চাষাবাদ পদ্ধতিতে রোপা আমনের জমি ‘জো’ আসলে চাষ করে সরিষা আবাদ করা হয়। তাছাড়া জলবায়ুর পরিবর্তনে প্রতিকূল আবহাওয়ায় অনেক সময়ে সরিষা বপনকালীন উপযুক্ত সময় যেমন অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ হতে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে আকস্মিক বৃষ্টিপাতের কারণে সরিষা বপনকাল বিলম্ব হয়ে যায় তখন কৃষক আর সরিষা বপনে আগ্রহ দেখায় না। শূন্য চাষে সরিষা আবাদের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। শূন্য চাষে সরিষা আবাদের জন্যে জমিতে ‘জো’ আনার প্রয়োজন হয় না ফলে বীজ বপনে তুলনামূলক বিলম্ব হয় না। এ জন্য বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, বিভিন্ন এলাকায় মৃত্তিকায় বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানের ভিত্তিতে গবেষণা পরিচালনা করে বিভিন্ন মাত্রায় প্রয়োজনমাফিক সুষম সার প্রয়োগের মাধ্যমে শূন্য চাষে সরিষা চাষাবাদের কলাকৌশল উদ্ভাবন করেছে।
চাষাবাদ পদ্ধতি
বীজ বপন : আমন ধান কর্তনের পরপরই জমিতে পর্যাপ্ত রস (৪৫-৫০% আর্দ্রতা) থাকা অবস্থায় (জমিতে চলাচল করলে পায়ের ছাপ পড়ে এমন আর্দ্রতায়) আমন ধানের সারির মাঝে সরিষা বীজ বিঘাপ্রতি ১.০ কেজি বপন করতে হবে। তবে সারি ছাড়াও ছিটিয়েও বপন করা যায়। যদি জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকে এবং বৃষ্টিপাতও না হয় সে ক্ষেত্রে বীজ বপনের একদিন পূর্বে একটি সেচ প্রয়োগ করে সরিষা বীজ বপন করতে হবে। অঞ্চলভেদে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ হতে ডিসেম্বরের ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত শূন্য চাষে সরিষার বীজ বপন করা যায়।
সার প্রয়োগ : শূন্য চাষে সরিষা আবাদে প্রয়োজনমাফিক সময়মতো সুষম সার প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। সরিষা বীজ বপনের আগেই ইউরিয়া ছাড়া টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, দস্তা ও বোরন সার ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সার দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম কিস্তি অবশ্যই বীজ বপনের ১০ দিন পর এবং দ্বিতীয় কিস্তি বীজ বপনের ২৫-৩০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে। সারণি -১ এ মৃত্তিকায় বিদ্যমান পুষ্টিমানের ভিত্তিতে প্রয়োগকৃত সারের  মাত্রা ও পরিমাণ প্রদান করা হল।
সেচ ও নিষ্কাশন : জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে প্রয়োজনমত সেচ প্রয়োগ করতে হবে। বীজ গজানোর পরে প্রয়োজনে ২০-২৫ দিনের মাঝে একবার এবং ৪০-৪৫ দিনের মাঝে দ্বিতীয়বার সেচ প্রয়োগ করতে হবে। বৃষ্টিপাত হলে সেচের প্রয়োজন নেই। তবে এঁটেল মাটির ক্ষেত্রে জমিতে রস কমে গেলে বা শুকিয়ে গেলে জমি শক্ত হয়ে যেতে পারে সে ক্ষেত্রে উপরের নিয়মে অবশ্যই প্রথম সেচ প্রদান করতে হবে। অতিরিক্ত সেচের পানি বা বৃষ্টির পানি যেন জমি থেকে বের হয়ে যেতে পারে এ জন্য নালার মাধ্যমে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
আগাছা দমন ও পাতলাকরণ : আগাছার উপদ্রব হলে চারা গজানোর ১৫-২০ দিনের মধ্যে নিড়ানি দিয়ে আগাছা দমন করতে হবে। চারা বেশি ঘন হলে প্রয়োজনমাফিক পাতলা করে দিতে হবে।
রোগ ও পোকামাকড় দমন : ছত্রাক ঘটিত অল্টারনারিয়া ব্লাইট রোগ সরিষা ফসলে ব্যাপক ক্ষতি করে। এ রোগ দেখা মাত্র রোভরাল-৫০ ঢ়ি ০.২% হারে (প্রতি লি. পানির সাথে ২ গ্রাম) পানিতে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে। সরিষা ফসলের প্রধান শত্রু জাবপোকার আক্রমণ দেখা যাওয়ার সাথে সাথে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ঊঈ প্রতি লি. পানির সাথে ২ মিলি. মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে। তবে সরিষা ক্ষেতে মৌমাছির আনাগোনার সময়ে কীটনাশক প্রয়োগ করা ঠিক নয়।
প্রযুক্তির উপযোগিতা : রোপা আমন পরবর্তী এবং আগাম পানি নেমে যায় এমন হাওর, বিল ও চর এলকার জমিসহ অন্যান্য সরিষা চাষযোগ্য জমির জন্য প্রযুক্তিটি বেশ উপযোগী।
ফলাফল : বিনার মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, বিনা উপকেন্দ্র, ঈশ্বরদী, পাবনা ও কৃষকের জমি অরোণকোলা, ঈশ্বরদীতে এবং বিনা উপকেন্দ্র বরিশালে এবং কৃষকের জমি বাবুগঞ্জ, বরিশালে শূন্য চাষে সরিষায় মৃত্তিকায় বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানের ভিত্তিতে বিভিন্ন মাত্রায় সার প্রয়োগের উপর গবেষণা পরিচালনা করে।  এতে দেখা যায় বিনা সরিষা-৯ আবাদে ঈশ্বরদীতে ১০০% মাত্রায় (প্রতি হেক্টরে ইউরিয়া ২৪২,  টিএসপি ১০৫, এমওপি ১২৬, জিপসাম ১০৭, বোরোনের জন্য বোরিক এসিড ১২ এবং দস্তার জন্য জিংক সালফেট হেপ্টা ৬ কেজি করে) সার প্রয়োগে লাভজনক (১.৫৮ ট/হে সরিষা) ফলন পাওয়া যায় এবং বরিশালে বিনা সরিষা-৯ আবাদে ১২৫% মাত্রায় (প্রতি হেক্টরে ইউরিয়া ৩০২,  টিএসপি ১৩১, এমওপি ১৫৮, জিপসাম ১৩৩, বোরোন ১২ এবং দস্তার জন্য জিংক সালফেট হেপ্টা ৬ কেজি করে) সার প্রয়োগে লাভজনক (১.৫৪ ট/হে সরিষা) ফলন পাওয়া যায় সারণি-১, ২, ৩ দ্রষ্টব্য।
প্রযুক্তিটির সুবিধা/লাভ : উপরোক্ত নিয়মে শূন্য চাষে সরিষা আবাদে বরিশাল ও  ঈশ্বরদী এলাকায় ৬০,১৩৩/- হতে ৭৭,৬১৯/- টাকা লাভ হয় যাতে আয়-ব্যয় অনুপাত দাঁড়ায় যথাক্রমে ২.১৭ ও ২.৮০। তাছাড়াও প্রযুক্তিটির প্রয়োগ-প্রসারে রোপা আমন পরবর্তী অধিক পরিমাণ পতিত জমি সরিষা আবাদের আওতায় আসবে এবং দেশে সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এ পদ্ধতিতে সরিষা চাষে কর্ষণজনিত সময় ও খরচ সাশ্রয় হয় এবং বীজ বপনেও বিলম্ব হয় না ফলে কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হয়। প্রতিকূল জলবায়ুতে অতি বৃষ্টিজনিত ক্ষতি হলে পুনরায় বপন করেও আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়। প্রযুক্তিটি সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে পুষ্টি নিরাপত্তায় ও সরকারের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনেও অবদান রাখবে।
সারণি-১: বিভিন্ন এলাকায় শূন্য চাষে সরিষা আবাদে প্রয়োগকৃত সারের মাত্রা ও পরিমাণ।
সারণি -২: শূন্য চাষে বিভিন্ন মাত্রায় সার প্রয়োগে সরিষা ও খড়ের গড় ফলন (ট/হে)
সারণি-৩: শূন্য চাষে সরিষায় বিভিন্ন মাত্রায় সার প্রয়োগে (বিনা সরিষা-৯) আয়-ব্যয় ও লাভ (টাকা)
দ্রষ্টব্য: সার, বীজ, সেচ, রোগ ও কীটনাশক এবং শ্রমিকজনিত ব্যয় মোট ব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সরিষা ও খড়ের মূল্য মোট আয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

লেখক : ১সিএসও ২পরিচালক (গবেষণা) ৩-৪এসও ৫এসএসও, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাকৃবি ক্যাম্পাস, ময়মনসিংহ। মোবাইলঃ ০১৭১৬৬২৭৩০৩ ই-মেইল : azizul_bina@yahoo.com

বিস্তারিত
বালাইনাশক ব্যবহারের গুরুত্ব এবং ব্যবহারের সচেতনতা

বালাইনাশক ব্যবহারের গুরুত্ব এবং ব্যবহারের সচেতনতা
ড. মোঃ আলতাফ হোসেন
বালাইনাশক বলতে আমরা সাধারণভাবে ওইসব বস্তুকে বুঝে থাকি যা দ্বারা কৃষিজাত দ্রব্য যেমন- ফসল, মাছ এবং গৃহপালিত পশু-পাখি ইত্যাদির উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, পরিবহন ও বাজারজাতকরণের সময়ে ক্ষতিকর রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ এবং আগাছার উপদ্রব থেকে কৃষি পণ্যগুলোকে সুরক্ষা করে থাকে। বালাইনাশক যে সকল জীব বা জীবাণুর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয় তাদের নাম অনুসারে সার্বিকভাবে এদের শ্রেণীবিন্যাস করা হয়, যেমন- আগাছানাশক (আগাছা দমনের জন্য), কীটনাশক (কীটপতঙ্গ দমনের জন্য), ইঁদুরনাশক (ইঁদুরজাতীয় প্রাণী দমনের জন্য), ছত্রাকনাশক (ছত্রাকজনিত রোগ দমনের জন্য), ব্যাকটেরিয়ানাশক (ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ দমনের জন্য) ইত্যাদি। আবার রাসায়নিক গঠনের উপর ভিত্তি করে বালাইনাশককে- জৈব, অজৈব, কৃত্রিম, জৈবিক ইত্যাদি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। জৈবিক বালাইনাশককে আবার অনুজৈবিক, জৈব রাসায়নিক এবং উদ্ভিজ্জ এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়।
বালাইনাশক ব্যবহারের গুরুত্ব
কৃষি ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে যদি বালাইসমূহের বিরুদ্ধে কোনো রকম প্রতিরোধ এবং প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তাহলে ৭০% পর্যন্ত ফলন নষ্ট হতে পারে। আগাছার কারণে গড়ে ৩০-৩৫%, পোকামাকড়ের কারণে ২০-২৫% এবং রোগবালাইয়ের কারণে গড়ে ১৫-২০% পর্যন্ত ফলন নষ্ট হতে পারে। সুতরাং, এখান থেকে বোঝা যায় বালাইকে দমন করে ফসলকে সুরক্ষা করার জন্য বালাইনাশকের গুরুত্ব কতটা অপরিহার্য।
বালাইনাশক ব্যবহারের প্রধান সুবিধা হচ্ছে ফসলের আগাছা, রোগ ও পোকামাকড় দমনের মাধ্যমে ফসলের ফলন ও গুণগতমান বৃদ্ধি পায়। মানুষ গাছপালা, মাছ ও প্রাণিসম্পদের রোগ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন জীবাণুর বাহককে (যেমন- মশা, জাবপোকা, সাদামাছি, থ্রিপস ও অন্যান্য) দমন করে রোগের হাত থেকে কৃষিপণ্য ও জীবনকে সুরক্ষা করা যায়। এসব ব্যবস্থাপনার ফলে- কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, গুণাবলী উন্নত হয় এবং ক্ষতিকর সৃষ্টিকারী বিভিন্ন বালাই দমন হয়।
আমেরিকায় এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বালাইনাশকের জন্য একগুণ টাকা খরচ করলে, বিনিময়ে চার গুণ টাকার উৎপাদন ফেরত পাওয়া যায় এবং বালাইনাশক ব্যবহার না করলে ফসলের গড়ে ১০% ফলন কমে যায়। যদি বালাইনাশকের ব্যবহার বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে ফসলের উৎপাদন ও গুণগতমান কমে যাবে, ফলশ্রুতিতে দাম বেড়ে যাবে এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট বহু মানুষের চাকরি হারাবে, পৃথিবীতে ক্ষুধার্থ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে, এমনকি দুর্ভিক্ষও দেখা দিতে পারে। সুতরাং, বালাইনাশক ব্যবহার এবং কৃষিপণ্য উৎপাদন একে অপরের সাথে জড়িত। অর্থাৎ কাক্সিক্ষত কৃষি উৎপাদনের জন্য বালাইনাশক ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যথেচ্ছ বালাইনাশক ব্যবহারের চ্যালেঞ্জসমূহ
সাধারণত বালাইনাশক হচ্ছে রাসায়নিক পদার্থ-যার উপাদান হচ্ছে অক্সিজেন, ক্লোরিন, সালফার, ফসফরাস, নাইট্রোজেন, ব্রোমিন এবং সেই সাথে ভারী ধাতু যেমন- আর্সেনিক, কপার, সালফেট, সীসা, পারদ ইত্যাদি। বালাইনাশক মাত্রই বিষাক্ত, এরা বালাইকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত করে মেরে ফেলে এবং বিভিন্নভাবেই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। যখনই বালাইনাশক কৃষি জমি, বাগান অথবা যেখানেই প্রয়োগ করা হউক না কেন সেটা আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের সংস্পর্শে আসে।     প্রয়োগকৃত বালাইনাশক যেমন- কীটনাশকের শতকরা ৯৮ ভাগ এবং আগাছানাশকের শতকরা ৯৫ ভাগই বাতাসে, পানিতে এবং মাটিতে মিশে যায়।
বালাইনাশক কৃষি জমিতে ব্যবহারের ফলে দীর্ঘসময় পরিবেশে থাকে এবং সেগুলোর মাইক্রো ফোঁটাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ায় এবং বাতাসের গুণগতমানের অবনতি ঘটিয়ে বাতাসকে দূষিত করে এবং ওই এলাকার জনসাধারণের শ্বাসের মাধ্যমে গিয়ে মানুষকে অসুস্থ করে। বড় ফোঁটাগুলো প্রয়োগকৃত ফসলে এবং মাটিতে পড়ে। এখন ফসলে পড়ে থাকা বালাইনাশক ফসলের ক্ষতিকর ও উপকারী উভয় ধরনের জীবকেই ধ্বংস করে এবং ফসল কর্তৃকও শোষিত হয়। শোষিত বালাইনাশক ফসলের দানায় ও ফলের মধ্যে অবশেষ হিসেবে থেকে যায়, ফলশ্রুতিতে মৌমাছিসহ অন্যান্য পরাগায়নকারী কীটপতঙ্গ যারা ফুল ও ফল থেকে মধু নেয় ও পরাগায়ন ঘটায় তারাও মারা যেতে পারে।
মাটিতে পড়ে থাকা বালাইনাশক মাটিকে দূষিত করে এবং মাটিতে বসবাসকারী নন-টারগেট জীব যেমন- উপকারী ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, কেঁচো ইত্যাদিকে মেরে ফেলে। এসব উপকারী জীব মাটির জৈব পদার্থকে ভাঙতে সহায়তা করে এবং পানি ও পুষ্টি শোষণ করে সেগুলোকে উদ্ভিদের গ্রহণ উপযোগী করে, যা উদ্ভিদ শোষণ করে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। যথেচ্ছা বালাইনাশক ব্যবহার করার কারণে অনিচ্ছাকৃত পরিণতি হিসেবে মাটির ওইসব উপকারী অনুজীব ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং পুষ্টি সরবরাহ বিঘিœত হয়ে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। আবার, বালাইনাশক যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে উদ্ভিদ কর্তৃক কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণও কমে যেতে পারে। ফলশ্রুতিতে উদ্ভিদ মারাও যেতে পারে। এছাড়াও ফসলে ও মাটিতে পড়ে থাকা বালাইনাশক পানি ও বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে জলাশয়ে গিয়ে জলজ উদ্ভিদ, মাছ ও জলজ প্রাণীকে ধ্বংস করে। অর্থাৎ বালাইনাশক ব্যবহারে সামগ্রীক পরিবেশই দূষিত হয় এবং আমরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ক্ষতিগ্রস্ত হই।
বালাইনাশক ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্যের উপর স্বল্পমেয়াদি ক্ষতির প্রভাব পড়ে, আবার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির প্রভাবও পড়ে- যা ঘটতে কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর লাগে। স্বল্পমেয়াদি প্রভাবের মধ্যে রয়েছে- চোখ জ্বালাপোড়া করা, চামড়ায় জ্বালাপোড়া, ফুসকুড়ি ও ফোসকা পড়া ইত্যাদি। আবার, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি বিষক্রিয়ায় বালাইনাশকের অবশেষ দীর্ঘসময়ে শরীরে জমা হয়ে জৈববিবর্ধনের কারণে দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি হ্রাস, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, বন্ধ্যাত্ব, জন্মগত ত্রুটি, ভ্রƒণের মৃত্যু, টিউমার, রক্ত ও ¯œায়ুবিক রোগ, ক্যান্সার, কিডনি ও লিভার নষ্ট হওয়া, অন্তঃস্রাবী গ্রন্থির ঐক্যনাশ ইত্যাদি সমস্যা সৃষ্টি হয়- যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। বালাইনাশক ব্যবহারের কারণে বিভিন্ন গ্রিনহাউজ গ্যাসের উৎপাদনও বেড়ে যায়, যা জলবায়ু পরিবর্তনসহ পৃথিবীর উষ্ণায়নকে ত্বরান্বিত করে।
বালাইনাশকের পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে করণীয়
বালাইনাশক একদিকে যেমন আমাদের খাদ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণকে বালাইয়ের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত করছে আবার অন্যদিকে পরিবেশ দূষণ করে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিও সৃষ্টি করছে। এমতাবস্থায়, বালাইনাশক ব্যবহার করে ফসল সুরক্ষার উদ্দেশ্য এমন হতে হবে যেন বালাইয়ের আক্রমণের কারণে ফসল বিনষ্টের মাত্রা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে থাকে এবং পরিবেশের প্রতি ক্ষতিকর প্রভাবও সর্বনিম্ন হয়। সুতারাং বালাইনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব বা দূষণ প্রতিরোধে যেসব পদক্ষেপগুলো নিতে হবে সেগুলো হলো-
বালাইনাশক ব্যবহারের সময় উপযুক্তভাবে ‘ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ’ ব্যবহার করতে হবে। কোনো ফসলে বা এলাকায় ঘনঘন স্প্রে না করে পুনরায় স্প্রে করার জন্য নির্ধারিত নির্দিষ্ট সময় দিতে হবে। কৃষি শ্রমিকসহ যারা বালাইনাশক নিয়ে কাজ করেন তাদেরকে বালাইনাশকের ব্যবহার ও সংরক্ষণ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে যেন তারা সঠিক নিয়ম মেনে বালাইনাশক ব্যবহার করতে পারেন। রাসায়নিক বালাইনাশকের বিকল্প হিসেবে যেসকল সহজলভ্য পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি রয়েছে, সেগুলোর ব্যবহারকে প্রাধান্য দিতে হবে। যেমন- চাষপদ্ধতিগত পরিচর্যা বা কৌশল, জৈব বালাই ব্যবস্থাপনা (যেমন- বালাইয়ের  প্রাকৃতিক শত্রু, ফেরোমন ফাঁদ এবং অনুজীবীয় বালাইনাশক ইত্যাদি), বালাই প্রতিরোধী জাত এবং ট্রান্সজেনিক ফসল প্রভৃতি।
চাষপদ্ধতিগত পরিচর্যার মধ্যে রয়েছে একাধিক ফসলের চাষ, ফসল পরিবর্তন, পোকামাকড় ও রোগের আক্রমণের ব্যাপকতার সময় বুঝে বপন বা রোপণ সময়ের পরিবর্তন, ফাঁদ ফসলের চাষ ইত্যাদি। জৈব বালাই ব্যবস্থাপনার মধ্যে রয়েছে উপকারী জীবসমূহ ফসল ক্ষেতে অবমুক্ত করা। যেমন- ক্ষতিকর পোকামাকড়ের বিভিন্ন ধরনের প্রিডেটর ও প্যারাসিটয়েড ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিমভাবে বংশবৃদ্ধি করে মাঠে অবমুক্তকরণ। জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করা যেমন- পোকামাকড়ের দেহে রোগ সৃষ্টিকারী ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি; ভেষজ বালাইনাশক ব্যবহার করা। যেমন- কেনোলা তেল, নিমতেল, নিমবীজ নির্যাস ইত্যাদি। কৌলিতাত্ত্বিকভাবে পরিবর্তিত বালাই প্রতি প্রতিরোধী ফসলের জাত চাষ করা। যেমন- বিটি ফসল ও অন্যান্য জিএমও ফসল ইত্যাদি। নির্দিষ্ট প্রজাতির শত্রুপোকা দমনের জন্য তাদের পুরুষদেরকে বন্ধ্যাকরণ করে সেগুলো মাঠে অবমুক্ত করে ওই পোকার প্রজননকে নিয়ন্ত্রণ করা, যদিও প্রযুক্তিটি ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ।
বিগত দুই দশকে জৈব বালাইনাশকের উন্নয়নে দর্শনীয় অগ্রগতি হয়েছে এবং মাঠে প্রয়োগ কৌশলও পরিশ্রুত হয়েছে। সারা পৃথিবীতে ট্রান্সজেনিক ফসল শতাধিকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ট্রান্সজেনিক ফসল উদ্ভাবনের মধ্যদিয়ে উন্নত উন্নয়নশীল দেশে বালাইনাশকের ব্যবহারও যথেষ্ট পরিমাণে কমে এসেছে। সুতরাং, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা কর্মসূচিতে জৈব বালাইনাশকভিত্তিক কৌশলকে কার্যকরী করে সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগানো গেলে বালাইয়ের আক্রমণের দ্বারা ফসল বিনষ্টের পরিমাণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে আসবে এবং টেকসই                  এগ্রো-ইকোসিস্টেম সুনিশ্চিত হবে।

লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কীটতত্ত্ব বিভাগ, ডাল গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী, পাবনা। মোবাইল : ০১৭২৫-০৩৪৫৯৫, ই-মেইল : hossain.draltaf@gmail.com

বিস্তারিত
রপ্তানিযোগ্য আলু চাষে কৃষকদের করণীয়

রপ্তানিযোগ্য আলু চাষে কৃষকদের করণীয়
ড. মুহ: রেজাউল ইসলাম
আলু বাংলাদেশে বহুল ব্যবহৃত একটি অন্যতম জনপ্রিয় সবজি এবং রপ্তানিযোগ্য একটি অর্থকরী ফসল। গত বছর প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ মে: টন এদেশে আলু উৎপাদিত হয়। অর্থাৎ প্রতি বছর যে পরিমাণ  আলু  উৎপাদন হয় তা হিমাগারে সংরক্ষণের ধারণ ক্ষমতা থেকে অনেক বেশি। এ ছাড়া খাদ্য হিসেবে আলুর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে, ফলে প্রতি বছরই আলুর মৌসুম শুরুর আগে শুধু কৃষকরাই নয়, অনেক নতুন  নতুন তরুণ উদ্যোক্তারা বাণিজ্যিকভাবে আলু চাষের দিকে ঝুঁঁকে পড়ছেন। কারণ আলু চাষে স্বল্প সময়ে লাভ অনেক  বেশি।
রপ্তানিযোগ্য আলু চাষ শুরু করার পূর্বেই  যদি কয়েকটি বিষয় গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়, তাহলে আলুর কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া সম্ভব এবং কৃষক ভাইয়েরা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে। রপ্তানিযোগ্য আলু চাষে প্রয়োজনীয় বিবেচ্য বিষয়সমূহ হলো-জমি নির্বাচন, বিশ^স্ত উৎস হতে আলুবীজ সংগ্রহ, মাটি শোধন, বীজ শোধন, সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, আলু উত্তোলন করা যা নি¤েœ ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করা হলো-
জমি ও জাত নির্বাচন : বেলে বা বেলে দো-আঁশ মাটিতে আলু ভালো হয়। সূর্যের আলো প্রচুর পড়ে এমন উঁচু বা মাঝারি উঁচু জমি আলু চাষের জন্য বেশ উপযোগী। জমিতে পানি সেচ দেয়া ও পানি নিষ্কাশনের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকাও দরকার। এ জন্য জমি সমতল করতে হয়। যেহেতু আলু মাটির নিচের ফসল, তাই জমি গভীর চাষ দিতে হয়। জমি চাষ দেয়ার পর ৭ থেকে ১৫ দিন রোদে ফেলে শুকিয়ে নিতে হয়। এতে মাটির নিচে থাকা বিভিন্ন পোকা, পোকার কীড়া ও পুত্তলি এবং রোগজীবাণু রোদের তাপে নষ্ট হয়। আড়াআড়ি  কয়েকটি চাষ দিয়ে মাটি এমনভাবে ঝুরঝুরে করতে হয় যেন মাটির মধ্যে বাতাস সহজে  চলাচল করতে পারে, এতে আলুর টিউবার গঠনের কাজটি সহজ হয়। চূড়ান্তভাবে জমি তৈরির আগেই সব আগাছা ও  আগের ফসলের  অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ করে দূরে কোথাও পুঁতে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। তিন বছর পর পর শতকপ্রতি ৪ কেজি ডলোচুন প্রয়োগ করলে আরও ফলন পাওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশে রপ্তানিযোগ্য আলুর জাতগুলো হচ্ছে-সানসাইন, প্রাডা, সান্তানা, কুইন এ্যানি, কুম্বিকা, ডোনাটা, ডায়মান্ট, গ্রানোলা, বারি আলু-৬২, মিউজিকা, বারি আলু-৯০ ইত্যাদি নির্বাচন করা যেতে পারে।
মাটি শোধন : জমি তৈরির আগে মাটি শোধন করে নিতে পারলে ভালো হয়। এতে আলুর ঢলে পড়া রোগ প্রতিরোধ করা যায়।  শেষ চাষের আগে বিঘাপ্রতি ৪ থেকে ৫ কেজি ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে চাষ দিয়ে সেচ দিতে হয়। ব্লিচিং পাউডার জমির মাটির সাথে মেশানোর পর জমিতে অবশ্যই জো অবস্থা থাকতে হয়। এভাবে ২৮ থেকে ৩০ দিন জমি ফেলে রাখতে হয়। এতে জমির মাটি শোধন হয় অর্থাৎ মাটির বিশেষ বিশেষ রোগ জীবাণু ধ্বংস হয়।
আলু বীজ সংগ্রহ : বিশ্বস্ত কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে আলুবীজ সংগ্রহ করতে হয়। বীজ আলু যদি খারাপ হয় তাহলে আলু চাষের সব আয়োজনই বিফলে যেতে পারে। তাই এমন উৎস থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হয় যেন আলুর বীজ খারাপ হলে তার জন্য জবাবদিহিতা থাকে।
বীজ শোধন : বীজ সংগ্রহের পর বীজ শোধন করতে হয়।  কার্বেন্ডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক বীজ আলু শোধনে ব্যবহার করলে ১ গ্রাম ছত্রাকনাশক ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১ কেজি কাটা বীজ আলু ৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখলে বীজবাহিত ছত্রাকঘটিত রোগজীবাণু ধ্বংস হয়। আলুর ঢলে পড়া ও গোড়া পচা রোগ প্রতিরোধে প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে স্ট্রেপটোমাইসিন মিশ্রিত করতে হয়। বীজ আলু সংগ্রহের পর কাটার আগে আলো-বাতাস চলাচল করে এমন পরিষ্কার সমতল জায়গায় বস্তা খুলে আলু বের করে এক থেকে দেড় ফুট উঁচু স্তূপ বা হিপ করে ছড়িয়ে রাখতে হয়। মাঝে মধ্যে ওলট-পালট করতে হয়।
বীজ বপন/রোপণ : বীজআলু লম্বালম্বি দুই ভাগ করে সমভাবে কাটতে হয়, যাতে কর্তিত দু’অংশে কমপক্ষে দুটি করে চোখ থাকে। এই অংশের ওজন ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম এবং ৩ থেকে ৪ সেন্টিমিটার ব্যাসবিশিষ্ট হতে হয়। অনেকেই চোখের সাথে আলুর অংশ কম রেখে বাকিটুকু খাবার হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন, এটা ঠিক নয়। কর্তিত অংশের সাথে যতটুকুই থাকুক সবটুকুই রাখতে হয়। বীজ কাটার সময় চাকু বা বঁটির দুই পাশ জীবাণুনাশকে ভেজানো কাপড়ের টুকরো দিয়ে মাঝে মধ্যে মুছে নিতে হয় যেন রোগজীবাণু এক আলু থেকে অন্য আলুতে ছড়াতে না পারে। আলুর কাটা অংশ উপরের দিকে করে মাটিতে ছড়িয়ে বিছিয়ে রাখতে হয়। কখনোই গাদাগাদি করে রাখা উচিত নয়। রাখার স্থানে আলো এবং বাতাস চলাচল ব্যবস্থা থাকতে হয়। এভাবে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা রেখে দিলে কাটা অংশের ওপরে একটি শক্ত কালচে ধরনের স্তর পড়ে, যাকে সোবারাইজেশন বলে। এই অংশ ভেদ করে কোনো রোগজীবাণু ঢুকতে পারে না। কাটা অংশে ছাই ব্যবহার করা যেতে পারে, তাতে অতিরিক্ত হিসেবে পটাশিয়াম সরবরাহ করা হয়। আবার পোকার বিকর্ষক হিসেবেও এটি কাজ করে।
আলু রোপণের সময় : আলু রোপণের উপযুক্ত সময় হলো নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শেষ পর্যন্ত। দিন পেছালে শীতে গাছের বৃদ্ধি কমে, গাছ খুব বেশি বড় হওয়ার আগেই টিউবার গঠন কাজ শুরু হয়ে যায়। এতে টিউবার সংখ্যা কমে যায়। শীতে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের টিউবার গঠন ভালো হয়। ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত আলুবীজ রোপণ করা যায়, তবে ফলনও আনুপাতিক হারে কমে যায়।
সার ব্যবস্থাপনা
জৈব সার : আলু চাষে কম্পোস্ট সার ব্যবহার না করা ভালো। কারণ যেসব কম্পোস্টের উপাদান হিসেবে শাকসবজির উচ্ছিষ্টাংশ বা গাছ-গাছড়ার বা যেকোনো জৈব জিনিসের পচনশীল অংশ ব্যবহার করা হয় সেসবের সাথে ঢলে পড়া রোগের রোগজীবাণু থাকতে পারে, যা এই রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। এ জন্য কম্পোস্টের পরিবর্তে ভালোভাবে পচানো শুকনো গোবর সারই জৈবসার হিসেবে ব্যবহার করা ভালো। সবচেয়ে ভালো হয় বায়োগ্যাস প্লান্ট থেকে সংগ্রহ করা শুকনো সার।
রাসায়নিক সার :  আলু চাষে একর প্রতি ইউরিয়া ১১২ কেজি, টিএসপি ৭৫ কেজি, এমওপি ১১২ কেজি, জিপসাম ৪০ কেজি, জিংক সালফেট ৫ কেজি এবং বোরণ সার ৪ কেজি ব্যবহার করতে হয়। অর্ধেক ইউরিয়া, অর্ধেক এমওপি ও সম্পূর্ণ টিএসপি এক সাথে মিশিয়ে বীজ আলু বপনের পাশে সারের নালায় দিতে হয়। বাকি সার রোপণের ৩৫ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে উপরিপ্রয়োগ করতে হয়। আর জিপসাম, জিংক সালফেট এবং বোরণ সার শেষ চাষের সময় ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। যেসব অঞ্চলের মাটিতে ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি আছে সেসব অঞ্চলে ম্যাগনেশিয়াম সার শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হয়।
উপরি সার প্রয়োগ : উপরি সার প্রয়োগের পর আলুর সারিতে বা গাছের গোড়ায় উঁচু করে (প্রায় ২০ সেন্টিমিটার) মাটি তুলে দিতে হয়। ভেলির গোড়া চওড়া রাখার জন্য ১৫ সেন্টিমিটার প্রস্থের ছোট কোদাল ব্যবহার করতে হয়। মাটি তোলার সময় লক্ষ রাখতে হয় যেন কোদালের সাথে প্রয়োগকৃত সার উঠে না আসে।
সেচ :  আলু চাষে সেচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোপণের সময় জমির জো অবস্থা থাকতে হয় এবং রোপণের পর ১ থেকে ২টি গাছ যখন মাটির ওপরে উঠে আসে তখন প্রথমবার সার উপরিপ্রয়োগের পর একটি হালকা সেচ দিতে হয়। এটি সাধারণত রোপণের ৭ দিনের মধ্যে দিতে হয়। এবপর মাটির প্রকার ও প্রয়োজন অনুযায়ী ৩ থেকে ৫ বার সেচ দিতে হয়। তবে টিউবার গঠনের শুরুর সময় অর্থাৎ ৪০ থেকে ৪৫ দিনের সময় মাটিতে রস না থাকলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে বা ফলন কমে যেতে পারে। সুষম সেচের জন্য তাই নিয়মিত জমি পরিদর্শন করতে হয়।
এছাড়াও নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শনের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে আবহাওয়া গরম, ঠা-া, কুয়াশা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আবহাওয়া বিষয়ে আগাম সতর্কতা বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। আবহাওয়া প্রতিকূলে হলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ছত্রাক নাশক (ম্যানকোজেব ও মেটালেক্সিল+ ম্যানকোজেব) অনুমোদিত মাত্রায় বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে  প্রতিরোধ করতে হবে যা  আক্রান্ত হওয়ার পর তা বেশ দুরূহ বিশেষ করে বিলম্বিত ধসা বা মড়ক রোগ। আলু রপ্তানির ক্ষেত্রে অবশ্যই চাষাবাদ সংক্রান্ত তথ্যাদি রেজিস্টারে লিপি করে রাখতে হবে। এতে করে আলু রপ্তানিযোগ্য কোম্পানির কাছে ভালো দামে বিক্রি করা সম্ভব। কৃষক কিংবা উদ্যোক্তাসহ সবাই অনেক বেশি লাভবান হতে পারবেন। রপ্তানিযোগ্য আলু ৯০ থেকে ১০০ দিনের মধ্যে সংগ্রহ করা যায়। আর বীজ  আলু ৭২ থেকে ৭৫ দিন এবং খাবার আলু ৮০ থেকে ৮৫ দিনের মধ্যে ক্ষেত থেকে তুলতে হয়। জাতভেদে বাংলাদেশে আলুর ফলন একরপ্রতি ৭ থেকে ১০ টন পর্যন্ত হতে পারে ।

লেখক : জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার, ডিএই, গাইবান্ধা। ই-মেইল-rezaul0171669@gmail.com,  মোবাইল-০১৭১৬৬৯৭১৯৬

 

বিস্তারিত
সময় ও ব্যয় সাশ্রয়ী বারি সূর্যমুখী মাড়াইযন্ত্র উদ্ভাবন

সময় ও ব্যয় সাশ্রয়ী বারি সূর্যমুখী মাড়াইযন্ত্র উদ্ভাবন
ড. মোহাম্মদ এরশাদুল হক
সূর্যমুখী আমাদের দেশে একটি গৌণ তেল ফসল কিন্তু এটি বিশ্বের দ্বিতীয় ভোজ্যতেল ফসল। আলোক ও তাপমাত্রা অসংবেদনশীলতার জন্য এটি বাংলাদেশে রবি ও খরিপ দুই মৌসুমেই চাষ করা যায়। দেশের ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে সূর্যমুখী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। প্রতি বছর দেশে তেল/তেলবীজের ঘাটতি পূরণের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে তেল/তেলবীজ আমদানি করতে হয়। আমদানির পরিমাণ কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা বাচাতে হলে আরোও বেশি তেলবীজ ফসলের চাষ করতে হবে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তেলবীজ গবেষণা কেন্দ্র সূর্যমুখীর বেশ কয়েকটি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। ফসলটি আমাদের দেশের উত্তরবঙ্গে রোপা আমন কাটার পর সহজেই চাষ করা যায়। এছাড়া লবণাক্ততাসহিষ্ণু বৈশিষ্ট্য আছে বলে উপকূলীয় এলাকায়ও এর চাষাবাদের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তেলের গুণাগুণের দিক থেকে সূর্যমুখী তেল অন্যান্য ভোজ্যতেলের চেয়ে উন্নত। এ কারণে এ ফসলের চাষ ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সূর্যমুখীর বীজ হতে উৎকৃষ্টমানের ভোজ্যতেল পাওয়া যায়। সূর্যমুখীর বীজে শতকরা ৪০-৪৫ ভাগ তেল আছে। ঘানির সাহায্যে গড়ে শতকরা ৩০-৩৩ ভাগ এবং এক্সপেলারের সাহায্যে ৩৩-৩৮ ভাগ তেল নিষ্কাশন করা যায়। বীজ ছাড়ানোর পর মাথাগুলো গরুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। খৈলে শতকরা ৪-৬ ভাগ নাইট্রোজেন থাকে বলে এটি একটি উৎকৃষ্ট জৈবসার। খৈলের ভেষজ গুণও রয়েছে। ফসল কর্তনের পর সূর্যমুখীর গাছ ও পুষ্পস্তবক জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এতসব সুবিধার পরেও যে সব কারণে সূর্যমুখী চাষ বাংলাদেশে প্রসার লাভ করেনি তার মধ্যে একটি হলো হাতে মাড়াই করা। সূর্যমুখী বপনের ৬৫-৭০ দিন পরে ফুলের বীজ যখন পুষ্ট হয় তখন গাছ থেকে পুষ্পস্তবক সংগ্রহ করে রোদে ২/১ দিন ছড়িয়ে দিতে হবে। এসময় মাথাগুলো কিছুটা নরম হয়ে যায় তখন শক্ত বাশের বা কাঠের লাঠি দিয়ে সূর্যমুখীর মাথার পেছনে আঘাত করলে বেশির ভাগ বীজ ঝরে পড়ে। অবশিষ্ট বীজ হাত দিয়ে ছাড়িয়ে নিতে হয়। এভাবে একটা একটা করে পুষ্পস্তবক হাতে মাড়াই করা যেমন সময় সাপেক্ষ তেমনি কষ্টকর। সূর্যমুখীর দানা বের করে আনতে এ কারণে খরচও বেড়ে যায়। এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে প্রান্তিক কৃষকের কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ একটি শক্তিচালিত সূর্যমুখী মাড়াইযন্ত্র উদ্ভাবন করেছে।
যন্ত্রটির বৈশিষ্ট্য : যন্ত্রটি স্থানীয় প্রকৌশল কারখানায় তৈরি করা যায়। যন্ত্রটি চালানোর জন্য একজন লোকই যথেষ্ট। বাছাইকৃত সূর্যমুখী দিয়ে উচ্চমাত্রার ফলাফল পাওয়া যায়। মাত্র ৪.৫ অশ্বশক্তির ডিজেল ইঞ্জিন দিয়ে যন্ত্রটি চালানো যায়। মাঠ থেকে পরিপক্ব সূর্যমুখীর হেড সংগ্রহ করে সাথে সাথেই এই যন্ত্র দ্বারা মাড়াই করা যায়। এমএস অ্যাঙ্গেলবার, এমএস রড, এমএস শীট, এমএস ফ্লাটবার, এমএস রোলার, ভি-পুলি, বিয়ারিং ইত্যাদি দিয়ে যন্ত্রটি তৈরি।
যন্ত্রের বিবরণ : যন্ত্রটি ইঞ্জিনচালিত মাড়াইযন্ত্র। দৈর্ঘ্য ১৫০০ মিমি.; প্রস্থ ১৩০০ মিমি.; উচ্চতা ১৫০০ মিমি.; ওজন ১২৫ কেজি (ইঞ্জিন ছাড়া);  মাড়াই রোলারের গতিবেগ ৩৫০-৪০০ আরপিএম; হপারের ধারণক্ষমতা ১০-১৫ কেজি; কার্যকরী ক্ষমতা ৬০০-১০০০ কেজি/ঘণ্টা; বর্তমান বাজারমূল্য টাকা ৫০০০০.০০ (ইঞ্জিন ছাড়া)। যন্ত্রটির মাড়াইয়ের কার্যক্ষমতা ৬০০-১০০০ কেজি/ঘণ্টা এবং দানা ভাঙ্গার হার ০%।
কার্যপ্রণালী : যন্ত্রটি ব্যবহারের জন্য একটি পরিষ্কার ও সমতল স্থান নির্বাচন করতে হবে। বেল্টের সাহায্যে ডিজেল ইঞ্জিনের সাথে যন্ত্রটিকে সংযোগ দিতে হবে। ইঞ্জিন চালু করলে যন্ত্রটি চালু হবে। যন্ত্রের মাড়াই চেম্বারে সিলিন্ডারের ঘূর্ণন ও তাতে পেগের (দ-) আঘাতে বীজ ছাড়ানোর কাজ হয়ে থাকে। যন্ত্রের উপরের হপারের সংরক্ষিত পুষ্পস্তবকগুলো নিচের হপারে নিয়ে আস্তে আস্তে প্রবেশ পথ দিয়ে প্রবেশ করাতে হবে। ক্রমাগত আঘাত ও ঘর্ষণে পুষ্পস্তবক থেকে দানাগুলো আলাদা হয়ে নিচের দিকে পড়বে। নিচের দিকে পড়ার সময় চালুনির মাধ্যমে দানা থেকে অপদ্রব্যগুলো আলাদা হয়ে যাবে। যন্ত্রটি প্রতিবার ব্যবহারের আগে ও পরে অবশ্যই ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, এফএমপি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বিএআরআই, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭১২৬৩৫৫০৩  ই-মেইল : ধৎংযধফঁষভসঢ়ব@মসধরষ.পড়স

বিস্তারিত
পাট পাতার ব্যবহার ও ঔষধিগুণ

পাট পাতার ব্যবহার ও ঔষধিগুণ
জাকারিয়া আহমেদ১ সুরঞ্জন সরকার২
পাট একটি বর্ষজীবী উদ্ভিদ। বিশ্বের অনেক জায়গায় পাট উৎপাদিত হয়; তার মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত ও চীন উল্লেখযোগ্য। পাট প্রধানত আঁশ উৎপাদনে চাষ করা হয়, যার কচি সুস্বাদু ও রসালো পাতা সবজি হিসেবেও খাদ্যে ব্যবহৃত হয়। তাই পাট আঁশ ও রান্না উভয়ই উদ্দেশ্যেই কাজে লাগে। পাটজাতীয় উদ্ভিদগুলো খাদ্য ও ঔষধ হিসেবেও সমানভাবে কার্যকর, নিরাপদ, মাদকমুক্ত, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হীন। সাশ্রয়ী মূল্যের কারণে সাধারণত উন্নত এবং উন্নয়নশীল উভয় দেশেই এসমস্ত ঔষধি গাছের প্রতিনিয়ত চাহিদা বাড়ছে। প্রসাধনী, সুগন্ধি ও রংয়ে ঔষধি উদ্ভিদের নির্যাস বিশেষ ভূমিকা আছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত।
বিশ্বে পাট পাতার ব্যবহার
বিজ্ঞানলব্ধ গবেষণা থেকে জানা যায় যে শুষ্কপাটের পাতা চায়ের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ফিলিপাইনে সাধারণত বাঁশের অঙ্কুর ও অলিটোরিয়াসের জাতের পাটের পাতা একসাথে মিশিয়ে শাক হিসেবে খাওয়া হয়। অন্যদিকে উত্তর আফ্রিকায় ও মধ্যপ্রাচ্যে মালুখিয়া নামে পরিচিত কচি পাটপাতা সবুজ শাক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া পাটপাতা লেবানন, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, জর্ডান এবং তিউনিসিয়ার রান্নাতেও ব্যবহৃত হয়। তুরস্ক এবং সাইপ্রাসে, পাটপাতা মোলোখিয়া নামে পরিচিত যা কি না মোলোচা হিসাবে এক ধরনের মুরগির স্টু রান্নাতে ব্যবহৃত হয়। ফারাওদের সময় থেকে পাটপাতা একটি প্রধান মিসরীয় খাবার। জাপানে পাটের শুকনো পাতা কফি এবং চায়ের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইউরোপে স্যুপ তৈরিতে পাটের পাতা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ইউরোপে স্যুপ তৈরিতে পাটের পাতা ব্যবহার করা হয়।
পাটের পুষ্টিমান
প্রায় সারা বছরই আমাদের দেশে পাটশাক পাওয়া যায়। পাটের পাতা শুধু শাক হিসেবেই নয় বরং পাটের পাতায় রয়েছে প্রচুর পুষ্টিগুণ যেমন- প্রচুর পরিমাণ আয়রন, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন ই, কে,সি, বি-৬ ও নিয়াসিন। প্রতি ১০০ গ্রাম পাটপাতায় ক্যালরির পরিমাণ ৭৩ কিলোজুল, আমিষ ৩.৬ গ্রাম, লোহা ১১ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ২৯৮ মিলিগ্রাম ও ক্যারোটিন ৬৪০০ (আইইউ) আরো রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও খাদ্যআঁশ।
পাট পাতার ব্যবহার ও ঔষধিগুণ
পাট একটি সুপরিচিত বাস্ট ফাইবার উদ্ভিদ কিন্তু বৈজ্ঞানিক তথ্য অপ্রতুলতার জন্য ঔষধ হিসেবে খুবই কম পরিচিত। গাছের প্রতিটি অংশই ঔষধ হিসেবে কার্যকর। আয়ুর্বেদী শাস্ত্র মতে এই গাছের ভেষজ গুণকে অসাধারণ মূল্য দেয়া হয়। পাটগাছ, বিশেষ করে পাতা ও বীজ নৃতাত্ত্বিক ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পাটপাতা শারীরিক অসুস্থতা যেমন- রেচক বা কোষ্টকাঠিন্য, মাথাব্যথা, চিকেনপক্স বা গুটিবসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং গুঁড়াকৃমি চিকিৎসায় পাটগাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করা হয়। পাটপাতার জলীয় অথবা অ্যালকোহলিক নির্যাস, যার মধ্যে পলিস্যাকারাইড ও অলিগোস্যাকারাইড জৈব পদার্থগুলো সমৃদ্ধ থাকে, মানব ত্বকের জন্য প্রসাধনী বা চুলের ময়েশ্চারাইজার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নি¤েœ পাট পাতার ব্যবহার ও ঔষধিগুণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
অন্ত্রের রোগ নিরাময় : পাটশাক, খাওয়ার রুচি বাড়িয়ে মুখের স্বাদ ফিরিয়ে আনে ও মেদ বৃদ্ধির আশঙ্কা কমায়। এর তেতো স্বাদ মুখের লালাক্ষরণ বৃদ্ধি করে কার্বোহাইড্রেডকে ভাঙতে সাহায্য করে হজমে সহায়তা করে। পাটপাতাতে ঔষধি গুণাগুণ থাকার কারণে এটি তিক্ত টনিক হিসেবে পাকস্থলী প্রশমক, কোষ্টকাঠিন্য দূরীকারক, পাকস্থলীয় বায়ুনাশক বা রক্তনালির সংকোচক রোধক এবং অন্ত্রের অ্যান্টিসেপটিক ঔষধ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। প্রাচীন ভারতবর্ষীয়রা পাটগাছকে ছাই করে, মধুর সাথে মিশিয়ে অন্ত্র পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহার করে। পাতার গুঁড়া, ৫-১০টি বীজদানা, গুঁড়া হলুদের সাথে সমান অংশে মিশিয়ে, আমাশা নিরাময়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। দেখা গেছে, এক গ্রাম পাটপাতা শুকনা আধকাপ পানিতে ভিজিয়ে কিছুক্ষণ পরে পাটপাতার পানি ছেঁকে খেলে আমাশয় রোগ ভালো হয়। তাছাড়া দেড় গ্রাম পরিমাণ পাট পাতার গুঁড়া ভাতের সাথে খেলে বারবার টয়লেটে যাওয়ার প্রবণতা অনেকখানি কমে যায়। এছাড়াও এক গ্রাম পাতা গুঁড়া এবং এক গ্রাম হলুদ গুঁড়া একসাথে মিশিয়ে ঠা-া পানির সাথে দিনে দু’বার করে খেলে রক্ত আমাশয় ভালো হয়। গবেষণায় প্রমাণিত যে, দেড় থেকে দুইগ্রাম পাটের বীজের গুঁড়া, এক চামচ মধু ও সিকি চামচ আদার রস একসাথে মিশিয়ে সামান্য ঠা-া পানির সাথে তিন ঘণ্টা পর পর খেলে পেট খারাপ ভাল হয়; শুকনো গুঁড়া পাটের পাতা দুই গ্রাম ও এক গ্লাস কুসুম কুসুম গরম পানির সাথে সকালে বাসিপেটে খেলে কোষ্ঠ পরিষ্কার হয়। ৫০ মিলি. গরম পানিতে দুই গ্রাম পাট পাতা সারারাত ভিজিয়ে রেখে সকালে ছেঁকে নিয়ে খালিপেটে খেলে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই লিভারের দোষ ভালো হয়। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০ থেকে ২৫ মিলি. টাটকা কচি পাতার রস আধকাপ পানিতে মিশিয়ে সামান্য গরম করে একবার সকালে ও আর একবার বিকেলে খেলে অগ্নিমন্দা ভালো হয়।
অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে শরীর রক্ষায় : গবেষকরা লাইকোপিন নামক একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাট শাকে পেয়েছে, যা খেলে শরীরে সৃষ্ট প্রদাহ কমে এবং অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে শরীরের কোষগুলোকে রক্ষা করে বা শারীরি প্রদাহ কমায়। একটি ঢাকনাযুক্ত পাত্রে ত্রিশ থেকে চল্লিশ গ্রাম কচি পাটপাতা কুচি কুচি করে কেটে ১৭০ মিলিলিটার পানি দিয়ে সিদ্ধ করে, চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মিলিলিটার পরিমাণ হলে নামিয়ে ঠা-া করতে হবে। ঠা-া ঘন সুপটি ছেঁকে সবটুকুই রোগীকে একসাথে খাইয়ে দিতে হবে। দিনে দুইবার করে তিন দিন খেলেই জ্বর কমে যাবে। অলিটোরিয়াস জাতীয় পাটপাতা থেকে ছয়টি ফেনোলিক অ্যান্টিঅক্সিডেটিভ জৈবযৌগ পাওয়া গিয়েছে যেগুলো নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স (এনএমআর) ও ফাস্ট অ্যাটম বোমবাটমেন্ট ভর স্পেকট্রোমেট্রি (এফএবি-এমএস) দ্বারা পরীক্ষিত; যেমন: ৫-ক্যাফেওয়েলকুইনিক অ্যাসিড বা ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড, ৩,৫-ডিকাফেওয়েলকুইনিক অ্যাসিড, কোয়ারসেটিন-৩-গ্যালাটোসাইড,কোয়ারসেটিন-৩-গ্লুকোসাইড, কোয়ারসেটিন-৩-(৬-জিকোসিডন) এবং কোয়ারসেটিন-৩-(৬-ম্যালোনিলগ্যাল্যাক্টোসাইড)। গবেষণা করে দেখায় যায় যে, ৫-ক্যাফেওয়েলকুইনিক অ্যাসিড একটি অন্যতম প্রধান ফেনোলিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। ২০ গ্রাম অলিটোরিয়াস জাতীয় পাটপাতা বাতাসে শুকিয়ে পানিতে ১:২০ অনুপাতে সাধারণ তাপমাত্রায় তিন দিন ভিজিয়ে রাখার পর সংগৃহীত নির্যাসটি সুপারঅক্সাইড অ্যানায়ণ র‌্যাডিকাল স্ক্যাভেঞ্জিং-এর বিরুদ্ধে প্রায় ৯০% প্রতিরোধে গড়ে। তাই পাটশাক মানবদেহে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা বাড়ায় এবং রোগ প্রতিরোধ করে।
হাড়ের ক্ষয় রক্ষায় : পাটশাকে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম ও অন্যান্য উপাদান পর্যাপ্ত পরিমাণে গবেষণায় পাওয়া গেছে এবং এই ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম হাড় সুগঠিত করে এবং হাড়ের ক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করে, আয়রন ও সোডিয়াম হাড় গঠন ও ক্ষয়পূরণ করে হাড়ের ভঙ্গুরতা রোধ বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
ক্যান্সার প্রতিরোধ : বেশি করে গাছের পাতা ও ফল খেলে বিশেষত গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল এলাকায় ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস পায়। জাপানের গবেষকেরা পাটের পাতা থেকে দুটি অ্যান্টিটিউমার বর্ধিতকরণ যৌগ শনাক্ত করেছেন, যা হলো ফাইটোল এবং মনো-গ্যালাক্টোসিলডিয়াসিলগ্লিসারল। গবেষণালব্ধ প্রমাণ থেকে পাওয়া যায় যে, গরম জলে সিদ্ধ পাট পাতার জুস অ্যান্টিটিউমার বর্ধিতকারী উপাদানের সক্রিয়তা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং গরম জলে সিদ্ধ পাট পাতার জুস টিউমার বর্ধিতকারী রাসায়নিকের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে কার্যকর। অনেক গবেষক এআরএইচ-৭৭ কোষে অলিটোরিয়াস জাতের পাটপাতার ও বীজের নির্যাসের দেহের অভ্যন্তরীণ সাইটোটক্সিক প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেছেন, যেখানে দেখা যায় পাতার নির্যাসে উচ্চ মাত্রার সমুদয় ফেনল উপাদান এবং ফ্রি-রেডিক্যাল স্ক্যাভেঞ্জিং প্রক্রিয়ার (এফআরএসএ) সাথে সম্পর্কিত। পাতার নির্যাসে উচ্চ ফেনল উপাদান এবং উচ্চতর এফআরএসএ (আইসি-৫০) ২৩গ্রাম/এমএল এবং বীজের নির্যাসে এফআরএসএ (আইসি-৫০) ১৭ গ্রাম/এমএল আছে। পাতার নির্যাস ও বীজের নির্যাস উভয়ই ৪৮ ঘণ্টা পরে কোষে সাইটোটক্সিক প্রভাব ফেলে যা কোষে এর উচ্চ সাইটোটক্সিসিটি প্রদর্শন করে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ পাটশাকে উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম লবণ থাকায় রক্তসঞ্চালন ও রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। এর জন্য উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা দূর হয়। তাছাড়া পাট বীজ থেকে কর্চোরি, কর্কোরজেনিন, ক্যাপসুলারিন, কর্কোরিটিন, অলিটোরিসাইড, কর্কোসুলারিন এবং কর্কোটক্সিন নামক বেশ কিছু জৈবযৌগ পাওয়া যায়। আহরিত এই জৈবযৌগ কার্ডিওটোনিক ওষুধ হিসাবে কাজ করে। এটি সোডিয়াম-পটাশিয়াম এটিপিসকে বাধা দান করে কার্ডিয়াক পেশির সংকোচন শক্তির উপর কাজ করে। পাটশাক রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে সহায়তা করে থাকে এবং নিয়মিত পাটশাক খেলে হার্টঅ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে।
অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল কার্যকারিতা পেট্রোলিয়াম ইথার দ্বারা প্রক্রিয়াজাত পাটশাকের নির্যাস, বিভিন্ন প্রকার ব্যাকটেরিয়া যেমন- ই. কোলি স্ট্যাফিলোকক্কাস অরিয়াস এবং ইয়ারসিনিয়া এন্টারোকোলিটিকা প্রভৃতি এর বিরুদ্ধে কাজ করে। ইথাইল অ্যাসিটেট এবং পানি দ্বারা প্রক্রিয়াজাত পাটশাকের নির্যাস ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া যেমন- জিওট্রিকাম কনডিডাম এবং বোট্রিটিস সিনেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে। পাটশাকের মিথানোলিক নির্যাস পাতার ব্যাকটেরিয়ারোধী ও ছত্রাকরোধী হিসেবে কাজ করে। এটি গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া যেমন- ব্যাসিলাস সাবটিলিস, স্ট্যাফিলোকক্কাস অরিয়াস, বিটা-হেমোলাইটিক স্ট্রেপ্টোকক্কাস, ব্যাসিলাস সেরিয়াস এবং স্ট্রেপ্টোকক্কাস পাইরপজেন, গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া যেমন- শিগেলা বয়ডি, সালমোনেলা টাইফি, ই. কোলি, ভিব্রিও মিমিকাস এবং ইস্ট ও ছত্রাক যেমন- ক্যান্ডিডা অ্যালবিকানস, স্যাকারোমাইসিস সেরেভিসিয়া এবং ব্যাসিলাস মেগাটেরিয়াম প্রভৃতির বিরুদ্ধে বেশ কার্যকর। মেথিসিলিন-সংবেদনশীল এবং মেথিসিলিন-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া স্ট্যাফিলোকাস অরিয়াসের পাঁচটি অ্যান্টিবায়োটিকের সাথে অলিটোরিয়াস জাতীয় পাট পাতার ইথানল নির্যাসটি সিপ্রোফ্লক্সাসিন এবং অ্যাম্পিসিলিন/ক্লোক্সাসিলিন মিশ্রণের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল সম্ভাবনাকে সমন্বিত করে এবং এস অরেয়াসে জেন্টামাইসিন, স্ট্রেপ্টোমাইসিন এবং এরিথ্রোমাইসিনকে প্রতিরোধী করে।
নতুন ওষুধ তৈরির জন্য ওষুধের মূল রাসায়নিক উপাদান পাটগাছ ও পাটগাছের পাতা থেকে পাওয়া যেতে পারে। পাটের রাসায়নিক উপাদান উৎপত্তি স্থান ও গাছের বিভিন্ন অংশের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। পাটের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যযুক্ত শুদ্ধ অনেক রাসায়নিক যৌগ এখনও বিশদভাবে অধ্যয়ন করা হয়নি। এখন পর্যন্ত, জীবন্ত কোষের মধ্যে সংঘটিত প্রক্রিয়ার অধীনে পৃথক পৃথক যৌগগুলোর ক্রিয়া করার প্রক্রিয়া সম্পর্কিত ফার্মাকোকিনেটিক্স গবেষণা সীমিত আকারে প্রচেষ্টা করা হয়েছে। পাটশাকের বিষাক্ততা ও নিরাপত্তার বিষয়গুলোর ওপর গবেষণার জন্য জোর দেওয়া উচিত। পাট থেকে আহরিত যৌগ মানবদেহে বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ দুটি উপায়ে ব্যবহার করে আরও অনেক নতুন রাসায়নিক যৌগের চিকিৎসার সম্ভাবনাগুলো বিস্তারিতভাবে অন্বেষণ করা সম্ভব।

লেখক : ১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কারিগরি শাখা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা-১২০৭। মোবাইল : ০১৯৬৯৬৯৯৮৫১, ই-মেইল :zakariaahmed70@gmail.com

বিস্তারিত
বসতবাড়িতে সবজি বাগান ব্যবস্থাপনা

বসতবাড়িতে সবজি বাগান ব্যবস্থাপনা
কৃষিবিদ মো: আনিছুর রহমান
বর্তমান সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে   কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান বৈশি^ক পরিস্থিতির খাদ্য নিরাপত্তার মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা ‘এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না। আর এ জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে কৃষির প্রতিটি সুযোগ নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। বসতবাড়ির আঙ্গিনায় বা আশেপাশের জমিতে সারা বছর ধরে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ধরনের যে শাকসবজি চাষ করা হয় তাকে বসতবাড়ির সবজি বাগান বলে। বসতবাড়ির সবজি বাগান থেকে পরিবারের সদস্যদের সবজি খাবারের ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করাসহ বাড়তি সবজি বিক্রি করে আয় করা যায়।
বসতবাড়িতে সবজি চাষের গুরুত্ব : সারা বছর বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি চাষ করা যায়। সারা বছর টাটকা ও বিষমুক্ত শাকসবজি খাওয়া যায়। পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ হয়। পুষ্টির দিক থেকে প্রায় সকল শাকসবজি উন্নত মানসম্পন্ন হয়ে থাকে। বাড়ির কিশোর-কিশোরীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। পতিত জমির সর্বত্তোম ব্যবহার হয়। বস্তা পদ্ধতিতে অল্প জায়গায় সারা বছর ধরে সবজি চাষ করা যায়। বাড়তি শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না। উৎপাদন সহজ ও তুলনামূলকভাবে খরচ কম। প্রয়োজন মতো সবজি পাওয়া যায় এবং ক্রয় করার দরকার হবে না।
বসতবাড়িতে সবজি চাষের সুযোগ ও সম্ভাবনা : বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বসতবাড়িতেই ফসলের উপযোগী ইকো-সিস্টেম রয়েছে। বাংলাদেশে আনুমানিক ১৭.৫ মিলিয়ন বসতবাড়ি রয়েছে যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ শাকসবজি ও ফল উৎপাদন করে সংশ্লিষ্ট পরিবারের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এর মধ্যে মাত্র ১৩ ভাগ গৃহচত্বর সবজি চাষের আওতায় এসেছে। বসতবাড়িতে পরিকল্পিত লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সবজির বাগান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পারিবারিক খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন, পারিবারিক পুষ্টি পূরণ করা সম্ভব। পরিবারের সকল সদস্যের শ্রম, সময় উৎপাদন কাজে লাগিয়ে স্ব-স্ব কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার সম্ভাবনাও আছে। এমনকি বসতবাড়ির সবজি বাগানের মাধ্যমে বিদ্যমান সম্পদের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার করে পরিবেশ সংরক্ষণেরও অসীম সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমান সরকার একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মাধ্যমেও পুষ্টি চাহিদা পূরণে কাজ করছে। এ ছাড়াও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ইউনিয়ন পর্যায়ে সবজি বাগান সৃজনের প্রকল্প চলমান রয়েছে।
বছরব্যাপী সবজি চাষের মডেল
আমাদের দেশের কৃষক ও কৃষিবিদগণ বসতবাড়িতে বছরব্যাপী সবজি উৎপাদনের বহু মডেল আবিষ্কার করেছেন। যেমন-কালিকাপুর মডেল, গয়েশপুর সবজি উৎপাদন মডেল, সৈয়দপুর মডেল, রংপুর, লেবুখালী মডেল, পটুয়াখালী, পালিমা মডেল, টাঙ্গাইল, ঈশান গোপালপুর মডেল, ফরিদপুর, বরেন্দ্র মডেল, রাজশাহী, গোলাপগঞ্জ মডেল, খাগড়াছড়ি মডেল, নারিকেলি মডেল ইত্যাদি। প্রতিটি মডেলেই বাড়ির যথাস্থানে সবজি চাষ করে জমির সুষ্ঠু ব্যবহার করা সম্ভব।
কালিকাপুর মডেলে সবজি বিন্যাস সবজি বাগানের পাঁচ খ- জমিতে বা বেডে যে পাঁচটি সবজি সারা বছর বিন্যাস অনুসরণ করা হয়, এখানে সেগুলোর একটি তালিকা দেওয়া হলোঃ
১. প্রথম খ-ের বিন্যাস    :    মুলা/টমেটো/লালশাক/ লালশাক-ঢেঁড়স
২. ২য় খ-ের বিন্যাস    :    লালশাক + বেগুন- লালশাক-ঢেঁড়স
৩. তৃতীয় খ-ের বিন্যাস    :    পালংশাক-রসুন/লালশাক-উাঁটা- লালশাক
৪. চতুর্থ খ-ের বিন্যাস    :     বাটিশাক-পেঁয়াজ/গাজর-কলমিশাক, লালশাক
৫. পঞ্চম খ-ে বিন্যাস    :     বাঁধাকপি- লালশাক-করলা- লালশাক
তবে কালিকাপুর সবজি মডেলে শুধু বসতবাড়ির উন্মুক্ত স্থানের কথা বলা হয়েছে। বসতবাড়ির অন্যান্য স্থানগুলো পতিত থাকে। এ সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে পরবর্তীতে সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বিএআরআই, পাবনার বিজ্ঞানীরা বসতবাড়ি ৯টি উৎপাদন একক বিবেচনা করে সারা বছর ৩৩ রকমের সবজি ও ফল উৎপাদনের মডেল উদ্ভাবন করেন যা বর্তমানে গয়েশপুর সবজি উৎপাদন মডেল হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। এই মডেলটিই বর্তমানে প্রচলিত। গয়েশপুর সবজি উৎপাদন মডেল সারণি-১ দ্রষ্টব্য।
এই মডেলের সাথে আরো কিছু যোগ করা যেতে পারে। যেমন কোন বসতবাড়িতে উল্লেখিত স্থানগুলো না থাকলে অতি স্বল্প স্থানেও একটির উপরে আরেকটি সবজি অর্থাৎ ভার্টিক্যাল সবজী

বাগান করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, বস্তায় সবজি চারা রোপণ করে পাকা বসতবাড়ির বারান্দায় এমনকি টয়লেটের স্লাবের উপর রেখে বস্তায় সবজি চাষ করা যেতে পারে। একে বস্তা পদ্ধতি বলে।
সবজি চাষে জায়গা নির্বাচন
সবজি রোপণ বা বপণের জন্য বসতবাড়ির বিভিন্ন স্থান নির্বাচনকে হোমস্টেড স্পেস প্লানিং বা বসতবাড়ি স্থান পরিকল্পনা বলে। বসতবাড়িতে সবজি চাষের জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো কোন স্থানে কোন সবজিটি করতে হবে। জায়গা নির্বাচনের জন্য কতকগুলো বিবেচ্য বিষয় আছে। সবজি চাষের জন্য এই বিষয়গুলো অবলম্বন করতে হবে। যেমন- বসতবাড়ির উঁচু জায়গা (যেখানে বৃষ্টি/বন্যার পানি দাঁড়ায় না এবং নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা আছে)। জমিতে পানি সেচ দেওয়ার জন্য ও নিষ্কাশনের সুবিধা থাকতে হবে। সারাদিনই কমবেশি সূর্যের আলো পড়ে এমন জমি সবজি চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। বড় গাছ বা বাড়ির ঘরের ছায়া যাতে জমিতে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সবজি চাষের জন্য এঁটেল দো-আঁশ ও বেঁলে  দো-আঁশ মাটি নির্বাচন করতে হবে। বস্তা এমন জায়গায় স্থাপন করতে হবে যেখানে সূর্যের আলো পড়ে।
দেশের ৬৮ হাজার গ্রামে যে বসতবাড়ি আছে সেই বসতভিটার সম্ভাব্য সকল স্থানে সবজি বপন ও রোপণ করলে আমরা নিজেদের পুষ্টির প্রয়োজন মেটাতে পারি, তদুপরি অতিরিক্ত সবজি বিক্রি করে আয় করতে পারি। টেকসই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় বসতবাড়িতে সবজি বাগান ব্যবস্থাপনার ক্ষুদ্র প্রয়াস।

লেখক : টেকনিক্যাল এডভাইজার (সবজি ও ফল বিশেষজ্ঞ), সহযোগী সংস্থা, মোবাইল : ০১৭৩০০৭৩৩১২, ই-মেইল : anisurbd07@yahoo.com

বিস্তারিত
মাছের খাদ্য তৈরির মেশিন (সাউ ফিড মিল-১) উদ্ভাবন

মাছের খাদ্য তৈরির মেশিন (সাউ ফিড মিল-১) উদ্ভাবন
মোঃ মাসুদ রানা
আমরা মাছে ভাতে বাঙালি, বাংলাদেশেরে ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা বিধান, পুষ্টির জোগান, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও মূল্যবান বৈদশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে মৎস্য সেক্টর সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সহায়ক শক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কৃষিবান্ধব বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বে মাছ উৎপাদনে রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। আমরা স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় এবং স্বাদু পানির মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারে দ্বিতীয় স্থান দখল করে আজ বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছি যার স্বপ্নদ্রষ্টা বাঙালির মুক্তির নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ জলাশয়ে মাছ চাষ হয়। মাছ চাষের সবচেয়ে বেশি খরচ (মোট উৎপাদন খরচের প্রায় ৬০%) হয় মাছের খাদ্য সরবরাহে, যা জোগান দিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিরা হিমশিম খেয়ে যায়। মাছ চাষের ক্ষেত্রে মাছের খাদ্যের নিরবছিন্ন সরবরাহ থাকা অত্যন্ত জরুরি কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়ই বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থায় মৎস্য ও পশু খাদ্যের জোগান কমে যায়। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এ বিপদকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। মাছের খাদ্যের মূল্য দিন দিন গুণিতক হারে বাড়ছে কিন্তু সেই তুলনায় মাছের দাম বাড়ছে না ফলে অনেক মাছচাষি মৎস্য চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে যে স্থান দখল করেছে তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে মাছের খাদ্যের খরচ কমানো তথা উৎপাদন খরচ কমানোর বিকল্প কিছু নাই।
মাছ চাষের খাবারের খরচ কমানোর পাশাপাশি খামারিরা যেন নিজের খামারের প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজে উৎপাদন করতে পারে সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে উদ্ভাবন করা হয় মাছের খাদ্য তৈরির মেশিন (সাউ ফিড মিল-১)। মেশিনটি উদ্ভাবনের যাত্রা শুরু ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে এবং কাজ সমাপ্ত করতে মোট সময় লাগে প্রায় এক বছর ছয় মাস। মাছচাষিদের খাবারের সরবরাহ ও খরচ কমাতে মেশিনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নিরাপদ মাছ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন নিরাপদ মৎস্য খাদ্য, যা  এখন সময়ের দাবি। যেহেতু খামারি মাছের খাদ্যের কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিজেই খাদ্য উৎপাদন করবে সেক্ষেত্রে খাদ্য যেমন নিরাপদ হবে তেমনি ঐ খাদ্য প্রয়োগ করে উৎপাদিত মাছও নিরাপদ হবে।
উদ্ভাবিত মেশিনটির বিশেষত্ব হলো একই মেশিন দিয়ে খামারি মাছের ভাসমান ও ডুবন্ত উভয়  প্রকার খাদ্য তৈরি করতে পারবে পাশাপাশি মেশিনটি দিয়ে ০.৫ মিলি থেকে ৫ মিলি আকারের সকল প্রজাতির মাছ ও চিংড়ির খাদ্য তৈরি করা যাবে। শেকৃবি উদ্ভাবিত মেশিনটি দিয়ে মাছের খাদ্যের পাশাপাশি হাঁস, মুরগি, কবুতরসহ অনান্য যেকোন পাখির খাদ্য তৈরি করা সম্ভব, যা মৎস্য সেক্টরের পাশাপাশি পোলট্রি শিল্পে খুলে দেবে এক অপার সম্ভাবনার দুয়ার।
মেশিনটিতে অ্যাডভান্সড মিলিং টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে ফলে এটি একটানা ১০-১২ ঘণ্টা খাদ্য উৎপাদন করতে পারবে, যেখানে ঘণ্টায় ৭০-৮০ কেজি খাবার উৎপাদন করা সম্ভব। উৎপাদিত খাদ্যের নমুনার গবেষণায় দেখা যায় খাবারভেদে আমিষের পরিমাণ ২০-৩৫ শতাংশ এবং ময়েশ্চারের পরিমাণ ১০-১৩ শতাংশ, চর্বির পরিমাণ ৪-৬ শতাংশ, ফাইবারে পরিমাণ ১০-১৪ শতাংশ, অ্যাশের পরিমাণ ১৮-২৩ শতাংশ এবং ক্যালসিয়ামের পরিমাণ ১-৩ শতাংশ। গবেষক উৎপাদিত মৎস্য খাদ্যের গুণগত মান ও উৎপাদন খরচ হিসেব করে দেখেছেন কার্প মাছের ২২ শতাংশ  আমিষযুক্ত গ্রোয়ার বা ১-৩ মিলি আকারের খাবার উৎপাদন খরচ ৩৮-৪০ টাকা/কেজি কিন্তু একই খাবার খামারিকে যেকোন কোম্পানির কাছে থেকে ৫৮-৬০ টাকা/কেজি ক্রয় করতে হয় সাথে পরিবহন খরচ ও সময় তো আছেই। একইভাবে মেশিনটি দিয়ে যেকোন মাছের খাদ্য তৈরিতে প্রায় ৪০% কম খরচ হবে। মাঝে মধ্যে খামারিকে ৭-১০ দিন আগে টাকা পরিশোধ করেও খাবার না পাওয়ার ঘটনা অহরহ আছে, এই সব সমস্যার সহজ সমাধান দিতে পারে শেকৃবি উদ্ভাবিত খাদ্য তৈরির এই মেশিনটি। মেশিনটি সেটআপ করতে ৬-১০ লক্ষ টাকা লাগবে, যা নির্ভর করবে খামারির প্রয়োজনের ওপর, যদি কেউ দিনে ৫০০-৬০০ কেজি খাদ্য উৎপাদন করতে চান তার খরচ হবে ৬ লক্ষ টাকা আর যার দিনে ১ মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন করা দরকার মেশিনটি সেটআপ করতে তার খরচ হবে ১০-১১ লক্ষ টাকা অর্থাৎ মেশিনটির সেটআপ খরচ নির্ভর করছে খামারির উৎপাদন চাহিদার উপর।
শেকৃবি উদ্ভাবিত মাছের খাদ্য তৈরির মেশিনটি মাছ চাষিদের অধিক মুনাফা অর্জনে অগ্রনী ভূমিকা রাখবে যা মৎস্য সেক্টর তথা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে।

লেখক : উদ্ভাবক (সাউ ফিড মিল-১) এবং সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ফিশিং অ্যান্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল : ০১৭৪৫-৬২৬১৫৩,  ই-মেইল : ranadof.bd@gmail.com

বিস্তারিত
ডেইরি খামার লাভজনক করতে সঠিক পরিকল্পনা ও পরিচর্যা

ডেইরি খামার লাভজনক করতে সঠিক
পরিকল্পনা ও পরিচর্যা
ডা: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
ডেইরি খামার করে সফল হয়েছে এমন খামারি অসংখ্য। আবার সঠিক পরিকল্পনার অভাবে অনেককেই খামার গুটিয়ে নিতে দেখা গিয়েছে। খামারকে লাভজনক করার জন্য খামার স্থাপনের জন্য কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যত সঠিকভাবে পরিকল্পনা করা হবে খামার ততটা সফল হবে। খামার স্থাপনের জন্য অবশ্যই স্থান নির্বাচন করা, মার্কেটের অবস্থা, খাদ্যমূল্য ও চারণভূমি ইত্যাদি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে। ডেইরি খামারের দুধ বিক্রি কিভাবে হবে এবং ক্রেতা কারা, দাম কেমন ইত্যাদি সম্ভাব্যতা আগেই দেখতে হবে। আবহাওয়াগত পরিবর্তনের কারণে জাতের ভিন্নতার সুফল পাওয়া যায়। একটি সফল খামার স্থাপনের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
স্থান ও জাত নির্বাচন : স্থান নির্বাচনের জন্য বাজারের অবস্থান, রাস্তা এবং ঘাসের প্রাপ্ততা ইত্যাদি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে। বর্তমানে শহরে খামার করার পরিবেশ থাকলে খামার লাভজনক হয়। কারণ শহরে দুধের দাম বেশি অথচ গ্রামে খাবারের দাম শহরের দামের একই পরিমাণ। যেসকল খামারি শহর এলাকায় ডেইরি খামার করেছেন তারা বেশির ভাগ খামারি সফল হয়েছেন। শহরের বাজারে দুধ বিক্রির চ্যানেল ইতোমধ্যে তৈরি করা থাকে, ফলে খুব সহজেই দুধ ভাল দামে বিক্রি করা যায়। জাত নির্বাচন ডেইরি খামারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেমন-
হলিস্টিন ফ্র্রিজিয়ান গরুর বৈশিষ্ট্য : বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে বাংলাদেশের বেশি দুধ দেয় হলিস্টিন ফ্রিজিয়ান জাতের গাভী। কালো- সাদা রঙের সুন্দর গঠন, মাথা ছোট, ঘাড় লম্বা, শরীরের পেছনের অংশ যথেষ্ট ভারী আর সামনের দিক সরু লম্বাটে হবে। গরু হবে অনেক উচা লম্বা, জিভ সাদা, চোখ উজ্জ্বল। গরুর ওলানের আকার বড় এবং নরম ঢিলেঢালা হবে। আমাদের দেশীয় আবহাওয়ায় সঠিক খামার ব্যবস্থাপনার মধ্যে দিয়ে বর্তমানে ৪০-৫০ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয় এই জাতটি।
শাহীওয়াল গরুর বৈশিষ্ট্য : ধীর ও শান্ত প্রকৃতির, মোটাসোটা ভারী দেহ, ত্বক পাতলা ও শিথি। পা ছোট, শিং ছোট ও পুর, এজাতের গাভীর শিং নড়ে, মাথা চওড়া। গাভীর ওলান বড়, চওড়া, নরম ও মেদহীন, বাঁটগুলো লম্বা, মোটা ও সমান  আকৃতি বিশিষ্ট। ষাঁড়ের দৈহিক ওজন ৫০০ -৫২০ কেজি এবং গাভীর ২৫০ - ৪০০ কেজি পর্যন্ত হয়। শাহীওয়াল গাভী দুধ উৎপাদনের জন্য একটি উৎকৃষ্ট জাত। এ জাতের গাভী গ্রামীণ অবস্থায় পালনে ৩০০ দিনে প্রায় ২১৫০ লিটার দুধ দেয়।
জার্সি জাতের গরু চেনার উপায় : লম্বা দেহ, ভারী নিতম্ব ও খাটো পা চূঁড়া হতে কোমড় পর্যন্ত পিঠ একদম সোজা থাকে, মুখবন্ধনী কালো ও চকচকে হয়, মাথা ও ঘাড় বেশ মানানসই, শরীর মেদহীন। গায়ের রং লাল বা মেহগিনি রং বিশিষ্ট। বিশেষ করে মুখের দিকে একটি ঢালাও রঙের উপর সাদা সাদা দাগ যুক্ত থাকে। সাদা দাগগুলো খুব কমও হতে পারে আবার খুব বেশিও হতে পারে। জিহ্বা ও লেজ কালো। শিং পাতলা এবং সামনের দিকে সামান্য বাঁকানো থাকে। একটি প্রাপ্ত বয়স্ক জার্সি জাতের গাভীর ওজন ৪০০ কেজি থেকে ৫০০ কেজি হয়। প্রাপ্ত বয়স্ক ষাঁড় ৫৪০ থেকে ৮২০ কেজি হয়ে থাকে। জন্মের পর বাছুরের ওজন প্রায় ২৫ থেকে ২৭ কেজি পর্যন্ত হয়।
গাভীর দুধের উৎপাদন যেভাবে বাড়ানো যায় : গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ ও গুণগতমান জাতের ওপর নির্ভর করে। গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ দুধের উপাদান যেমন- মাখন, আমিষ, খনিজ পদার্থ সবই বিভিন্ন জাতের গাভীতে কম বেশি হতে পারে। বংশগত ক্ষমতার কারণে দেশীয় জাতের গাভীর দুধের মাখনের পরিমাণ বেশি থাকে কিন্তু এরা দুধ উৎপাদন করে কম। খাদ্য গাভীর দুধ উৎপাদন ও দুধের গুণগতমানের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। অধিক পরিমাণ খাদ্য খাওয়ালে বেশি দুধ পাওয়া যায়। তবে খাদ্য অবশ্যই সুষম হতে হবে। গাভীকে সুষম খাদ্য না খাওয়ালে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায় এবং দধের গুণগতমানও কমতে বাধ্য। কারণ খাদ্যে বিদ্যমান উপাদানগুলো ভিন্ন অবস্থায় দুধের মাধ্যমে নিঃসৃত হয়। খাদ্যে দুধের মাখনের উপস্থিতির পরিমাণ কম বেশি করতে পারে। যে ধরনের খাদ্য খাওয়ালে গাভীর দুধের মাখনের হার কম হতে পারে তাহলো- মাত্রাতিরিক্ত দানাদার খাদ্য; পিলেট জাতীয় খাদ্য; অতিরিক্ত রসালো খাদ্য এবং মিহিভাবে গুঁড়া করা খড়।
গাভীর দুধে মাখনের পরিমাণ কমে গেলে খাদ্য পরিবর্তন করে প্রয়োজনীয় সুষম খাদ্য খাওয়াতে হবে। দুধে খনিজ পদার্থ ও খাদ্যপ্রাণের পরিমাণ গাভীর খাদ্যের মাধ্যমে বাড়ানো যায়। গাভীকে সুষম খাদ্য না দিলে দুধে সামান্য মাত্রায় আমিষ ও শর্করা জাতীয় উপাদান পাওয়া যায় এবং দুধ উৎপাদনের পরিমাণ কমে যায়। দুধ দোহন বিশেষ করে দোহন কাল, দোহনের সময়, দুধ দোহন প্রক্রিয়া, বিভিন্ন বাঁটের প্রভাব ইত্যাদি গাভীর দুধের পরিমাণ ও মানকে প্রভাবিত করে। গাভীর দুধ দেয়ার পরিমাণ আস্তে আস্তে ৫০ দিনে বেড়ে সর্বোচ্চ হয়। ওলানে দুধের চাপের ওপর দুধের পরিমাণ ও উপাদান নির্ভর করে। দুগ্ধদান কালের ৯০ দিন পর থেকে দুধে মাখন ও আমিষের হার আংশিক বাড়ে। একই গাভীকে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দোহন করলে দুধে মাখনের পরিমাণ বেশি পাওয়া যায়। তাই সকালের দুধের চেয়ে বিকেলের দুধে মাখনের পরিমাণ বেশি থাকে। তাই গাভীকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২-৩ বার দোহন করা উচিত। এতে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ বাড়তে পারে।
প্রসবকালে গাভীর সুস্বাস্থ্য আশানুরূপ দুধ উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাভী থেকে বেশি দুধ পেতে হলে গর্ভকালে সুষ্ঠু পরিচর্যা ও সুষম খাদ্য দেয়া প্রয়োজন। প্রসবের দুই মাস আগে গাভীর দুধ দোহন অবশ্যই বন্ধ করে দিতে হবে। মোট দুধ উৎপাদনের ৪০% ওলানের সামনের অংশের বাঁট এবং ৩০% পেছনের অংশের বাঁট থেকে পাওয়া যায়। গাভীর ওলানের বাঁট অবশ্যই সুস্থ থাকতে হবে। রক্ষণাবেক্ষণ, বাসস্থান, গাভীর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ ও গুণগতমানের হ্রাস-বৃদ্ধির জন্য অনেকাংশে দায়ী। পারিপার্শ্বিক অবস্থা গাভীর জন্য আরামদায়ক হওয়া উচিত। দোহনের সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন না করলে অর্থাৎ দুধ দোহন ক্রটিপূর্ণ হলে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ ও গুণগতমান কমতে পারে।
প্রতিকূল আবহাওয়া দুধ উৎপাদনের জন্য ক্ষতিকর। শীত মৌসুম দুধাল গাভীর জন্য আরামদায়ক। এ মৌসুমে দুধ উৎপাদনের এবং দুধে মাখনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, গরমকাল, বর্ষাকাল, আর্দ্র আবহাওয়ায় গাভীর দুধের উৎপাদন ও গুণগতমান কমে যায়। গাভীর প্রজননের সময় দুধ উৎপাদন কমে যায়। গাভীকে বাচ্চা প্রসবের ৬০-৯০ দিনের মধ্যে বীজ দিতে হবে। কোনোক্রমেই ৬০ দিনের আগে প্রজনন করানো উচিত নয়। গাভীর শরীরে ৫০% এবং দুধে প্রায় ৮৭% পানি থাকে। তাই গাভীকে ইচ্ছামতো পানি পান করার ব্যবস্থা করলে দুধ উৎপাদন বেশি হয় এবং দুধে মাখনের পরিমাণ বেশি থাকে।
গাভীর বড় ওলানের পরিচর্যা : অধিক দুধ উৎপাদনকারী গাভীর দৈহিক আকার যেমন বড় হয় তেমনি বড় হয় তার ওলানও। এসব গাভী যত্নসহকারে পরিচর্যা করতে হয়। উঠা-বসার সময় শেডের কনক্রিটের মেঝেতে ঘষা লেগে ওলানে ক্ষত সৃষ্টি হয়। আর তাতে গোবর বা মূত্র লেগে রোগ-জীবাণুর আক্রমণে গাভী অসুস্থ হয়। ওলানে সমস্যা দেখা দিলে দুধ উৎপাদন কমে যায়। ম্যাসটাইটিস রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করলে কখনও কখনও ওলানের এক বা একাধিক বাঁট কেটে ফেলতে হয়। তখন দুধ উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে আসে।
গাভীর ওলানে আঘাতজনিত সমস্যা এড়াতে কনক্রিটের পরিবর্তে বালুর মেঝে অধিক স্বাস্থ্যসম্মত বলে অভিমত দিয়েছে ডেইরি বিজ্ঞানীরা। এ বালুর মেঝে তৈরি করতে হবে বিশেষ প্রক্রিয়ায়। প্রায় দেড় মিটার সমপরিমাণ গভীর করে মাটি শেডের মেঝে থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এরপর কমপক্ষে দুইস্তরে বড় বড় টায়ার বসাতে হবে। টায়ারের ওপর বিছিয়ে দিতে হবে পরিষ্কার বালু। বালু অবশ্যই কাঁকর, ইটের টুকরা, লোহার টুকরা বা অন্যান্য যে কোনো ধারালো বস্তুমুক্ত হতে হবে। রোগের সংক্রমণমুক্ত এলাকা থেকে এ বালু সংগ্রহ করতে হবে। বালুর মেঝে নরম হওয়ায় গাভী উঠে দাঁড়ানো কিংবা বসার সময় কোনো ধরনের আঘাত পাবে না। ওলানের আঘাতজনিত সমস্যা থেকে রক্ষা পাবে। এ মেঝের সুবিধাজনক দিক হচ্ছে গাভীর চোনা সহজেই ঝুরঝুরে বালুতে পড়ে শুকিয়ে যাওয়া। তবে বালি যেন ভেজা না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এজন্য দিনে কমপক্ষে দুইবার গোবর পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। সব বালু সপ্তাহে কমপক্ষে তিনদিন উলটপালট করে দিতে হবে। ওপরের বালু নিচে এবং নিচের বালু ওপরে উঠে এলে রোগ-জীবাণু বংশবৃদ্ধি করতে পারবে না, রোগ বাসা বাঁধার সুযোগ পাবে না। ছয় মাস পরপর শেডের পুরনো বালু ফেলে দিয়ে নতুন বালু দিতে হবে।
ডেইরি খামার লাভজনক করার জন্য উপরোক্ত বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝতে হবে। বর্তমানে উন্নত জাত ও আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করার ফলে গাভীর দুধ উৎপাদন বেড়েছে। আর খুব বেশি দেরি নেয় যখন আমাদের দেশের দুধের চাহিদা দেশের গাভী থেকে পূরণ করা সম্ভব হবে।

লেখক : ডা: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, প্রাণিস¤পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, উপজেলা প্রাণিস¤পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল, গোমস্তাপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ। মোবাইল : ০১৭২৩৭৮৬৮৭৭, ই-মেইল : mmrdvm10@gmail.com

বিস্তারিত
উদ্ভিজ আমিষ : প্রাণিজ মাংসের বিকল্প ব্যবহার

উদ্ভিজ আমিষ : প্রাণিজ মাংসের বিকল্প ব্যবহার
মোঃ আখতারুজ্জামান
উদ্ভিদভিত্তিক মাংস। এই শব্দগুলোর সাথে তাৎক্ষণিকভাবে যা মনে আসে তা হলো টফু এবং সয়া মিট বা কাঁঠালের ইচর। উদ্ভিদ উৎসের এসব খাদ্য বর্তমানে মাংসের বিকল্প হিসেবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। উদ্ভিদভিত্তিক মাংস এমন কিছু যা উদ্ভিদ বা ছত্রাক থেকে উদ্ভূত প্রাণীজ মাংসের স্বাদ এবং পুষ্টির বিকল্প।
উদ্ভিদভিত্তিক মাংস ও প্রাণীজ মাংস এর মধ্যে দুটি প্রধান পার্থক্য হলো : পুষ্টি এবং সংবেদনশীল বৈশিষ্ট্য।
পুষ্টির ক্ষেত্রে উদ্ভিদজাত মাংসকে এমনভাবে তৈরি করা হয়ে থাকে যাতে প্রাণিজ মাংসের বেশ কয়েকটি উপাদান এতে বিদ্যমান থাকে। যার মধ্যে প্রোটিন, ফ্যাট, বি-ভিটামিন এবং আয়রন উল্লেখযোগ্য। উদ্ভিদভিত্তিক মাংসে শূন্য কোলেস্টেরল থাকলেও কিছু স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে এবং তাতে প্রাণী উৎসের মাংসের চেয়ে বেশি সোডিয়াম থাকে। অন্যদিকে, উদ্ভিদভিত্তিক বিকল্পগুলোর মধ্যে প্রায়শই সমস্ত প্রাণিজ খাদ্যের উপাদান থেকে একটি উপাদান বেশি থাকে তা হলো ফাইবার। বেশির ভাগ প্রাপ্তবয়স্কদের তাদের ফাইবার খাওয়ার জন্য প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় গড়ে ন্যূনতম ১৫ গ্রাম ফাইবার প্রয়োজন। তাই উদ্ভিদভিত্তিক বিকল্পগুলো বেশি খাওয়া হলে এই প্রয়োজনীয়তা পূরণ করার পথে সহায়ক হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা প্রতিনিয়ত প্রাণিজ মাংস না খেয়ে মাঝে মাঝে উদ্ভিদভিত্তিক মাংস সাপ্তাহিক মেনুতে নিয়মিত সংযোজনের জন্য পরামর্শ দেন। যা লালমাংসের পরিমাণ হ্রাস করতে সহায়তা করবে।
পশ্চিমা বিশ্বে মাংসের বিকল্প হিসেবে পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ কাঁঠাল দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে যা প্রোটিনে সমৃদ্ধ। সিঙ্গাপুরভিত্তিক ফুড টেক স্টার্টআপ “কারানা ফুডস” জীববৈচিত্র্য এর ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং কাঁঠাল থেকে তৈরি মাংসের বিকল্পের মাধ্যমে কৃষক, ভোক্তা এবং শেফদের উন্নয়নে কাজ করছে। “কারানা ফুডস” এর প্রধান টেকসই উপদেষ্টা আনিয়ামাডালিনস্কা বলেন, এটি  একটি সত্যিই সুস্বাদু উদ্ভিদভিত্তিক বিকল্প। কাঁঠালের স্বাদ এবং বহুমাত্রিক গুণাগুণ “কারানা” এর পণ্যকে অনন্য করে তোলে। শেফরা রান্নায় সৃজনশীল হয়ে কাঁঠালকে আকর্ষণীয় খাবারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করছেন যা গ্রাহকদের অবাক করে। যেহেতু এই ফল উৎপাদন সহজ এবং একটি কাঁঠাল গাছ থেকে বছরে ২০০টি পর্যন্ত কাঁঠাল পাওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তাই খাদ্য ঘাটতি পূরণে কাঁঠাল চাষের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। প্রতিদিনের খাদ্যে পর্যাপ্ত প্রোটিন পাওয়া অনেক চ্যালেঞ্জিং। ভালো স্বাস্থ্যের জন্য প্রতিদিন প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে উদ্ভিদভিত্তিক মাংস হিসেবে কাঁঠাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
উদ্ভিদভিত্তিক মাংস পরিবেশের উপর অল্প বিরূপ প্রভাব ফেলে বিধায় উন্নত বিশ্বে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। উন্নত বিশ্বের দুটি সর্বাধিক জনপ্রিয় বিকল্প মাংস দ্বারা প্রস্তুত বার্গার হলো ইম্পসিবল বার্গার (ওসঢ়ড়ংংরনষব ইঁৎমবৎ) এবং বিয়ন্ড বার্গার (ইবুড়হফ ইঁৎমবৎ) যা ৪০ হাজার রেস্তোরাঁ এবং মুদি দোকানগুলোতে বিক্রি হয়। তারা উদ্ভিদ উৎসের উপাদান ব্যবহার করার সময়, প্রোটিনের মূল উপাদানগুলোর মধ্যে ভিন্নতা তৈরি করে।
বিয়ন্ড বার্গার মটর, মুগডাল এবং ভাতের মতো উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয় তবে ইম্পসিবল বার্গারে ঘন সয়া প্রোটিন, নারকেল তেল এবং সূর্যমুখী তেল অন্তর্ভুক্ত থাকে। তবে অন্যতম প্রধান পার্থক্য হলো ইম্পসিবল বার্গার মাংসের বিকল্প হিসেবে মাংসের স্বাদকে বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে। চর্বিযুক্ত গরুর মাংসের বার্গার এবং ইম্পসিবল বার্গারের সাথে ক্যালোরি গণনার ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে সমান, তবে সকল উদ্ভিদভিত্তিক মাংসেও পর্যাপ্ত পরিমাণে সোডিয়াম এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে। সুতরাং, বর্তমানে নিশ্চিত করছে যে উদ্ভিদভিত্তিক খাবারগুলি ভবিষ্যতের খাদ্য হবে।
বহু বছর ধরে উদ্ভাবনের পরে ব্র্যান্ডগুলো কাঁঠাল, সয়াবিনের শিকড় এবং মটর প্রোটিনের মতো উদ্ভিদের উপাদানগুলো থেকে তৈরি খাদ্য মাংসের বিকল্প তৈরি করতে পারছে। উদ্ভিদভিত্তিক মাংসের চাহিদা থাকার সবচেয়ে উৎসাহজনক লক্ষণ হলো বড় মাংস উৎপাদনকারীরা উদ্ভিদভিত্তিক বিকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করছেন। হোয়াইট ক্যাসেল তার রেস্তোরাঁগুলোতে ইম্পসিবল বার্গার নিয়ে এসেছে, বার্গার কিং তার প্রায় ৭৩০০ রেস্তোরাঁগুলোতে বিয়ন্ড বার্গারের জায়গা দিয়েছে এবং ওয়েন্ডির মতো অনন্য ব্র্যান্ড মাংসের বিকল্প নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। সুপারমার্কেটগুলোতে সাধারণ মাংস বিভাগে উদ্ভিদভিত্তিক মাংস প্রতিস্থাপন শুরু করার সাথে সাথে একইভাবে বিক্রয়ও বাড়বে বলে আশা করা যায়। উদ্ভিদভিত্তিক মাংস খাওয়া বেশির ভাগ লোকেরা নিরামিষাশী নয়, তারা সার্বজনীন ভোক্তা খাদ্যের বৈচিত্র্য চান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, গবেষণার একটি ক্রমবর্ধমান ফলাফল লাল মাংস সেবনকে হৃদরোগ, ক্যান্সার এবং ডায়াবেটিসের মতো সমস্যার সাথে যুক্ত করেছে। জাতিসংঘের মতে মাংসের উৎপাদন, বনাঞ্চল, জমির অবনতি এবং জলের দূষণের দিকে পরিচালিত করে। জলবায়ু পরিবর্তন যেমন বিশ্বজুড়ে কৃষিক্ষেত্রকে হ্রাস করে, জাতিসংঘ দেশগুলোকে মাংস উৎপাদনে বিনিয়োগের পরিবর্তে অধিক পুষ্টিকর ফসল বাড়িয়ে তাদের খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে আরও টেকসই করতে উৎসাহ দিচ্ছে।
সমস্ত প্রোটিন অ্যামিনো অ্যাসিড দ্বারা গঠিত, যদিও প্রতিটি অ্যামিনো অ্যাসিডের পরিমাণ প্রোটিন উৎসের ভিত্তিতে পরিবর্তিত হয়। প্রাণিজ প্রোটিনগুলো সম্পূর্ণ, তবে উদ্ভিদের প্রোটিনগুলো সম্পূর্ণ নয়। মোট প্রায় ২০টি অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে যা মানবদেহ প্রোটিন তৈরিতে ব্যবহার করে। এই অ্যামিনো অ্যাসিডগুলো প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। দেহ নিজ থেকে অপ্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি করতে পারে তবে প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি করতে পারে না, যা খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহণ করা দরকার।
সুস্বাস্থ্যের জন্য, দেহের সঠিক অনুপাতে প্রয়োজনীয় সমস্ত অ্যামিনো অ্যাসিডের প্রয়োজন। মাংস, মাছ, হাঁস-মুরগি, ডিম এবং দুগ্ধের মতো প্রাণিজ প্রোটিনের সম্পূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয় কারণ এগুলোতে দেহে কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে। বিপরীতে, উদ্ভিদ প্রোটিন উৎস যেমন : শিম, মসুর এবং বাদামগুলো অসম্পূর্ণ হিসাবে বিবেচিত হয়। কারণ এগুলোতে দেহের প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিডগুলোর এক বা একাধিক অভাব রয়েছে। তবে সয়া প্রোটিনকে সম্পূর্ণ প্রোটিন হিসেবে গণ্য করে।
উদ্ভিদে প্রচুর পুষ্টিগুণ পাওয়া যায় যা প্রাণী হতে আসা খাদ্যে পাওয়া যায় না। অতএব, উভয় খাদ্য সুষম পরিমাণে খাওয়া প্রয়োজনীয় সমস্ত পুষ্টি গ্রহণের সেরা উপায়। ভিটামিন বি ১২, ভিটামিন ডি, ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, ডিএইচএ, হিম-আয়রন এবং দস্তা প্রাণীর প্রোটিন উৎসগুলোতে বেশি থাকে। আবার মাংস বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে। লাল মাংস একটি উচ্চ মানের প্রোটিন উৎস। বেশ কয়েকটি পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণা লাল মাংস সেবনকে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং প্রাথমিক মৃত্যুর ঝুঁকির সাথে সংযুক্ত করেছে।
গবেষণায় দেখা যায়, নিরামিষাশীদের শরীরের ওজন, কোলেস্টেরল এবং রক্তচাপের মাত্রা কম থাকে যার কারণে লাল মাংস ভোজীদের তুলনায় তাদের হৃদরোগ থেকে স্ট্রোক, ক্যান্সার এবং মৃত্যুর ঝুঁকি কম থাকে।
উদ্ভিদের প্রোটিনযুক্ত উচ্চ খাদ্যগুলো আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে। ২০ বছরেরও বেশি বয়সী ১২ লাখ পুরুষ এবং মহিলাকে অনুসরণ করে একটি পর্যবেক্ষণ গবেষণায় দেখা গেছে যে অধিক বাদাম খাওয়া ওজন হ্রাসের সাথে যুক্ত ছিল।
এ ছাড়াও, প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় মটরশুঁটি, ছোলা, মসুর বা ডাল পরিপূর্ণতা বাড়াতে পারে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং ওজন হ্রাস হতে পারে। সুতরাং বলা যায় নিরামিষাশী থাকা লোকেরা সাধারণ জনগণের চেয়ে বেশি স্বাস্থ্য সচেতন হন।
উদ্ভিদভিত্তিক মাংস বেছে নেয়ার পক্ষে একটি যুক্তি রয়েছে তা হলো পরিবেশগত দায়বদ্ধতা। হার্ভার্ড গবেষকরা নোট করেছেন যে ‘মাংস ও দুগ্ধ গ্রহণ কমানো জরুরি প্রয়োজন’ এবং পশুর উৎসর পরিবর্তে উদ্ভিদ উৎস থেকে প্রোটিন পেতে পরিবেশের জলবায়ু ও তাপমাত্রার ঝুঁকি হ্রাস করার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণভাবে সহায়তা করবে। আন্তর্জাতিক প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট অনুসারে, প্রাণিসম্পদ পালন পৃথিবীর ভূমি পৃষ্ঠের ৪৫% ব্যবহার করেছে এবং ২০১১ সালে বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউজ গ্যাসের ১৮% এরও বেশি অবদান রেখেছে। উদ্ভিদ উৎস হতে তৈরি একটি বার্গার যে পরিমাণ জমি ব্যবহার করে তৈরি করা যায় সে সাইজের একটি প্রাণী উৎস হতে তৈরি বার্গারের ক্ষেত্রে ১৪ গুণ বেশি জমি ব্যবহার করতে হয়। একটি সুইমিং পুলের সমান পরিমাণ পানি ব্যবহার করে উদ্ভিদ উৎসের ৬০,৮৩৭টি বার্গার তৈরি করা যায় আর প্রাণী উৎসের মাত্র ৩১২টি বার্গার তৈরি করা যায়।
জাতিসংঘের মতে, মাংস শিল্পটি গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন (এঐএ) বৃহত্তম সর্বাধিক উৎস। ক্যালোরির ভিত্তিতে গরুর মাংস বায়ুম-লে তোফুর চেয়ে ১৭.৭ গুণ বেশি পরিমাণে এঐএ, শিমের চেয়ে ৫০ গুণ বেশি এঐএ এবং বাদামের চেয়ে প্রায় ১৮০ গুণ বেশি এঐএ নিঃসরণে অবদান রাখে।
জাতিসংঘের মতে, মাংসের উৎপাদন বনাঞ্চল, জমির অবক্ষয় এবং জলের দূষণের দিকেও নিয়ে যায়। একক ক্যালোরি মাংস উৎপাদন করতে জল থেকে ফসল, জমি পর্যন্ত প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ প্রয়োজন। যদি সেই প্রাণিসম্পদ গুলোর পরিবর্তে উদ্ভিদভিত্তিক খাবারের জন্য ব্যবহার করা হয়, পৃথিবী কম জমিতে আরও বেশি ক্যালোরি তৈরি করতে সক্ষম হবে।
বর্তমানে, প্রাণিসম্পদের জন্য বিশ্বের কৃষিক্ষেত্রের ৮০% জমি প্রয়োজন। এই জমির কিছু অংশ উদ্ভিদভিত্তিক খাবারগুলোর জন্য ব্যবহার করা হলে পৃথিবীর জনগণকে খাওয়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় ফসলের জমির পরিমাণ হ্রাস করা সম্ভব এবং কৃষকদের ল্যান্ডস্কেপগুলো পুনরায় ফসল উৎপাদনে ব্যবহার করা সম্ভব।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, তুলা উন্নয়ন বোর্ড। মোবাইল : ০১৮১৯৭২৪৬৭০, ই-মেইল : ed@cdb.gov.bd

 

বিস্তারিত
অজৈব অভিঘাত ব্যবস্থাপনায় ন্যানোপার্টিকেলসের গুরুত্ব

অজৈব অভিঘাত ব্যবস্থাপনায় ন্যানোপার্টিকেলসের গুরুত্ব
ড. রিপন সিকদার
উদ্ভিদ তার জীবনচক্রে বিভিন্ন পরিবেশগত অভিঘাত মোকবিলা করে বেড়ে ওঠে যা উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আবাদযোগ্য জমি হ্রাস, পানিসম্পদ হ্রাস, নগরায়ন, বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সমস্যা অদূর ভবিষ্যতে কৃষির উৎপাদনের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। অজৈব অভিঘাত কৃষিতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ যা ফসলের বৃদ্ধি, বিকাশ এবং ফলনকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করে। উদ্ভিদকে প্রভাবিত করে এমন প্রধান প্রধান অজৈব অভিঘাতের মধ্যে খরা, লবণাক্ততা, তাপ, ঠা-া, ভারী ধাতু, বন্যা, রাসায়নিক বিষাক্ততা, অত্যধিক আলো, এবং অতিবেগুনি রশ্মি অন্যতম। এসব চ্যালেঞ্জ থেকে কৃষি খাতকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন কৃষিতে ক্রমাগত নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন যা প্রয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন অভিঘাতপূর্ণ অবস্থায়ও ফসলের সম্ভাব্য ফলন নিশ্চিত করবে। যদিও অন্যান্য প্রযুক্তি যেমন- উদ্ভিদ প্রজনন বিদ্যা, রাসায়নিক সারের ব্যবহার, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কৃষিকে যেমন উন্নত করেছে তেমনি এ প্রযুক্তিগুলোর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই, ক্রমবর্ধমান বিশ্ব খাদ্য চাহিদা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ন্যানো-প্রযুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  
কৃষিখাতের উন্নয়নের জন্য ন্যানোটেকনোলজি একটি অভিনব সম্ভাবনাময় উদ্ভাবনী পদ্ধতি যা বিভিন্ন জৈব ও অজৈব অভিঘাতের বিরুদ্ধে সহনশীলতা প্রদানের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে। পরিবর্তিত জলবায়ু, দূষিত পরিবেশ এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার যুগে টেকসই কৃষির লক্ষ্য অর্জনের জন্য কৃষিতে ন্যানোটেকনোলজির প্রয়োগ একটি লাগসই বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে। ন্যানোটেকনোলজিতে জৈবিকভাবে সক্রিয় ১-১০০ ন্যানোমিটার আয়তনের ন্যানোপার্টিকেল (এনপি) ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এনপিগুলোর নির্দিষ্ট ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য আছে যার মাধ্যমে উদ্ভিদ কোষে সরাসরি প্রবেশ করতে সক্ষম এবং উদ্ভিদও দ্রুত এই পার্টিকেলসগুলো সংশ্লেষণ করতে পারে। এনপি মাটিতে অথবা পাতায় প্রয়োগ করা যায়। এনপিগুলো উদ্ভিদে প্রয়োগ করা হলে উদ্ভিদ মূলের এপিডার্মিস বা পাতার বায়বীয় পৃষ্ঠের মাধ্যমে এপোপ্লাস্টিক অথবা সিমপ্লাস্টিক পথে কোষে প্রবেশ করে। উপকারী এনপিগুলো উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশে পৌঁছানোর পর সালোকসংশ্লেষণের হার, বায়োমাসের পরিমাণ, ক্লোরোফিলের পরিমাণ, চিনির মাত্রা (সুক্রোজ, ফ্রকটোজ ইত্যাদি), অসমোলাইট (প্রোলিন, ফ্রি এমিনো এসিড, সলিউবল সুগার ইত্যাদি), কার্বহাইড্রেটের পরিমাণ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমূহের (অ্যাসকরবেট পারঅক্সিডেজ, ক্যাটালেজ, পারঅক্সিডেজ, সুপার অক্সাইড ডিজমিউটেজ ইত্যাদি) কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উদ্ভিদের অভিঘাতজনিত ক্ষতি প্রশমন করে থাকে। পাশাপাশি এনপিগুলো নাইট্রোজেন বিপাকেও (হরঃৎড়মবহ সবঃধনড়ষরংস) সহায়তা প্রদান করে যা উদ্ভিদ কোষে ক্লোরোফিল ও প্রোটিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। তবে উল্লেখ্য যে, ন্যানোপার্টিকেলের আকার, আকৃতি, পৃষ্ঠের বৈশিষ্ট্য, স্থায়িত্ব, রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য, বিশুদ্ধতা, উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং প্রয়োগের মাত্রার ওপরও এদের কার্যক্ষমতা নির্ভর করে। এ ছাড়াও, উদ্ভিদের প্রজাতি থেকে প্রজাতি এবং পরিবেশের পরিবর্তনের কারণেও ন্যানোপার্টিকেলগুলোর ভৌত ও রাসায়নিক গঠনের পরিবর্তন হতে পারে। কার্বন ন্যানোটিউব, মাল্টিওয়ালড কার্বন ন্যানোটিউব, ধাতব ন্যানোপার্টিকেলস (যেমন- সিলভার ও গোল্ড), স্ফটিক পাউডার ন্যানোপার্টিকেলস (যেমন- আয়রন, কোবাল্ট ও কপার) এবং ধাতব অক্সাইড ন্যানোপার্টিকেলস (যেমন- আয়রন অক্সাইড, টাইটেনিয়াম ডাই-অক্সাইড, জিংক অক্সাইড, সিলিকন ডাই-অক্সাইড, কিউপ্রিক অক্সাইড, সেরিয়াম অক্সাইড, ক্যালসিয়াম কার্বোনেট) হলো কিছু উল্লেখযোগ্য উপকারী এনপিগুলো, যা অজৈব অভিঘাতের হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করে থাকে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ অজৈব অভিঘাত (অনরড়ঃরপ ংঃৎবংং) ব্যবস্থাপনায় ন্যানোপার্টিকেলসের ভূমিকা নি¤েœ আলোচনা করা হলো:
লবণাক্ততাজনিত প্রভাব : লবণাক্ততা একটি প্রধান অজৈব অভিঘাত যা ফসলের বৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতাকে হ্রাস করে এবং টেকসই ফসল উৎপাদনের একটি প্রধান অন্তরায়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী আবাদযোগ্য জমির প্রায় ২০ ভাগ লবণাক্ততার সম্মুখীন এবং এই পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। লবণাক্ততার সমস্যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সোডিয়াম ক্লোরাইড (ঘধঈষ) এর কারণে দেখা দেয়। লবণাক্ততা উদ্ভিদে প্রাথমিকভাবে অসমোটিক এবং আয়োনিক অভিঘাত সৃষ্টি করে। অসমোটিক অভিঘাত উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় পানি এবং খনিজ পদার্থ গ্রহণের ক্ষমতা হ্রাস করে। অতিরিক্ত সোডিয়াম এবং ক্লোরিন আয়ন গ্রহণের ফলে অক্সিডেটিভ অভিঘাত সৃষ্টি হয়। লবণাক্ততাজনিত সৃষ্ট অজৈব অভিঘাতের ফলে উদ্ভিদের গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তিক প্রক্রিয়াগুলোতে (যেমন- সালোকসংশ্লেষণ, প্রোটিন সংশ্লেষণ, লিপিড বিপাক ইত্যাদি) নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। ন্যানোপার্টিকেলের ব্যবহার লবণাক্ত পরিবেশে উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান ব্যবহারের দক্ষতা বাড়াতে পারে। এনপিগুলো নির্দিষ্ট জিনের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি, অসমোলাইটসমূহ পুঞ্জীভূত, প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান এবং অ্যামাইনো এসিড সরবরাহের মাধ্যমে লবণাক্ততাজনিত অভিঘাত মোকাবিলা করতে সাহায্য করে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, লবণাক্ত পরিবেশে সিলিকন ডাই-অক্সাইড নামক ন্যানোপার্টিকেল প্রয়োগে স্কোয়াশের প্রস্বেদন হার, পানি ব্যবহারের দক্ষতা এবং কার্বনিক এনহাইড্রেজ নামক এনজাইমের কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢেঁড়সের পাতায় টাইটেনিয়াম অক্সাইড প্রয়োগের ফলে সালোকসংশ্লেষণ এবং বিভিন্ন এনজাইমের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। আমের চারার পাতায় জিংক অক্সাইড এবং সিলিকনের সম্মিলিত প্রয়োগের মাধ্যমে কার্বন এসিমিলেশন এবং পুষ্টি উপাদান গ্রহণের মাত্রা উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধির মাধ্যমে সার্বিক বৃদ্ধিতে ধনাদত্মক প্রভাব ফেলেছে।  
খরাজনিত প্রভাব : পরিবশগত অজৈব অভিঘাতগুলোর মধ্যে খরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিঘাত যা ফসল উৎপাদন ও ফলনের জন্য হুমকিস্বরূপ। এটি বিভিন্ন কারণে ঘটে থাকে তন্মধ্যে কম বৃষ্টিপাত, লবণাক্ততা, উচ্চ ও নিম্ন তাপমাত্রা, উচ্চ আলোর তীব্রতা অন্যতম। খরা প্রকৃতপক্ষে একটি বহুমাত্রিক অজৈব অভিঘাত যা উদ্ভিদের শরীরবৃত্তিয়, জৈব-রাসায়নিক এবং আণবিক বৈশিষ্ট্যর পরিবর্তন ঘটায়।
উদ্ভিদের খরাজনিত ক্ষতির বিরুদ্ধে গৃহীত বিভিন্ন কৌশলগুলোর মধ্যে ন্যানোপার্টিকেলসের ব্যবহার অত্যন্ত কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে। যেমন- উদ্ভিদের পাতায় আয়রন অক্সাইড ন্যানোপার্টিকেলস সরবরাহের ফলে খরাজনিত ক্ষতির প্রভাব হ্রাসের মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। এনপিগুলো উদ্ভিদের পাতায় কার্বন এসিমিলেশনের মাধ্যমে সালোকসংশ্লেষণের পরিমাণ বৃদ্ধি করে যা খরাসৃষ্ট অজৈব অভিঘাতকে প্রশমিত করে। উদ্ভিদের মূলে অ্যাকুয়াপরিনসের পরিমাণ বৃদ্ধি, আন্তঃকোষীয় পানির বিপাকের পরিবর্তন, অসমলাইটসমূহের পরিমাণ বৃদ্ধি, আয়নিক হোমিওসটেসিস ইত্যাদি হলো খরাসৃষ্ট অসমোটিক চাপ প্রশমিত করার প্রধান কলাকৌশল যা এনপিগুলো করে থাকে।
তাপমাত্রাজনিত প্রভাব : বায়ুম-লীয় তাপমাত্রা পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ফসলের বৃদ্ধি ও ফলনের উপর ঋণাত্মক প্রভাব ফেলছে। আইপিসিসি ২০১৪ অনুযায়ী, একবিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ বায়ুর তাপমাত্রা প্রতি দশকে ০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়ে বিদ্যমান স্তরের তুলনায় ১.৮-২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। তাপীয় অভিঘাত রিঅ্যাকটিভ অক্সিজেন স্পেসিস (রিঅ্যাকটিভ অক্সিজেন স্পেসিস এক ধরনের অস্থায়ী অণু যা অক্সিজেন ধারণ করে এবং কোষের অন্যান্য সাথে সহজেই বিক্রিয়া প্রদর্শন করে) এর কার্যক্রম বাড়িয়ে দেয় যা উদ্ভিদে অক্সিডেটিভ অভিঘাত সৃষ্টি করে, যার ফলস্বরূপ লিপিড ঝিল্লির অবক্ষয়, কোষীয় ঝিল্লির অবক্ষয়ের মাধ্যমে প্রোটিনের অবক্ষয় ত্বরান্বিতকরণ এবং সালোকসংশ্লেষণ ও ক্লোরোফিলের পরিমাণ হ্রাস করে। নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এবং দীর্ঘ তাপতরঙ্গ দ্বারা সৃষ্ট তাপীয় অভিঘাত থেকে উদ্ভিদকে রক্ষা করতে ন্যানো প্রযুক্তি কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমন- কম ঘনত্বের সেলেনিয়াম ন্যানোপার্টিকেল প্রয়োগের ফলে উদ্ভিদের পানি ব্যবহারের দক্ষতা এবং ক্লোরোফিলের পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে তাপীয় অভিঘাতের প্রভাব হ্রাস পায়। টাইটেনিয়াম ডাইঅক্সাইড ন্যানোপার্টিকেলস পাতার পত্ররন্ধ্র নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাপজনিত ক্ষতি হ্রাস করে। ন্যানো জিংক অক্সাইড অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অসমোপ্রোট্যাকট্যান্ট বৃদ্ধির মাধ্যমে মুগ ফসলের তাপীয় অভিঘাত প্রশমনের মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।  
ন্যানোটেকনোলজি, একটি বহুমাত্রিক কৌশল বা পন্থা যা বিগত কয়েক বছরে কৃষিসহ ওষুধ, শিল্প, পরিবেশ, ইলেকট্রনিক্স ইত্যাদির মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। ন্যানোপ্রযুক্তি কৃষির একটি হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে যা খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এনপিগুলো উদ্ভিদের বৃদ্ধি, বিকাশ এবং ফলন বৃদ্ধিতে কার্যকরি এবং জৈব ও অজৈব অভিঘাতসমূহ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে বলে প্রমাণিত হয়েছে। সর্বোপরি, কৃষিক্ষেত্রে ন্যানোটেকনোলজির ব্যবহার গবেষণাগার হতে মাঠপর্যায়ে স্থানান্তর ও বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে কৃষির সর্বস্তরে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।

লেখক : উপব্যবস্থাপক (উন্নয়ন), মহাব্যবস্থাপক (বীজ) দপ্তর, বিএডিসি, ঢাকা; মোবাইল : ০১৬২৭৩৩৮৭২৭, ই-মেইল :sikderripon@gmail.com

বিস্তারিত
কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ ও কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি

কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ ও কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি
কৃষিবিদ মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন১ মো: শাহীদুল ইসলাম২
কৃষক চায় তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য, ভোক্তা চায় কম মূল্য আর ব্যবসায়ী চায় কম মূল্যে ক্রয় করে বেশি মূল্যে বিক্রি। এই তিন মূল্য সমন্বয় করে সকলকে সন্তুষ্ট করা বেশ কঠিন কাজ। ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য বিভিন্ন রকম যুক্তি দেখায়। বাস্তবে কৃষকের প্রাপ্ত মূল্য আর খুচরা মূল্যের মধ্যে ব্যবধান অনেক। ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফা লাভের মানসিকতা থেকে এটা হয়। তাই প্রায়ই ক্রেতাগণ সরকারের নিকট সহনীয় দাম নির্ধারণের দাবি উঠায়। কৃষি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়াটা আধুনিক বাজার ব্যবস্থাপনার ধারণার মধ্যে পড়ে। এ জন্য মূল্য কমিশন গঠনেরও অনেকে প্রস্তাব করেন। মূলত ফড়িয়াদের দৌরাত্ন্য এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের যোগসাজসই কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার অন্যতম কারণ। মৌসুমে জোগান বেশি থাকলে কৃষি পণ্যের দামও কমে যায়। কিন্তু অমৌসুমে উৎপাদিত পণ্যে কৃষক ভালো দাম পায়। তাই কৃষকদের অমৌসুমে ফসল উৎপাদনের উপর বেশি জোর দিতে হবে। দুর্গম উৎপাদনস্থল, বিক্রেতা বেশি ক্রেতা কম, পরিবহন সংকট, পাহাড়ি পথ, ভঙ্গুর রাস্তাঘাট, রোগ ও পোকা আক্রান্ত পণ্য, অপরিষ্কার পণ্য, বাসি বা থেঁতলানো বা আঘাতপ্রাপ্ত পণ্য-এসব কারণেও অনেক সময় কৃষক ন্যায্যমূল্য পান না।
বিদ্যমান বাজারব্যবস্থায় একটি কৃষি পণ্য উৎপাদিত হওয়ার পর কৃষক থেকে ফড়িয়া/বেপারি/পাইকারি ব্যবসায়ী সরাসরি ক্রয় করে থাকেন। ফড়িয়া/বেপারি/পাইকারদের মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীও বলা য়ায়। তারা ক্রয়কৃত পণ্যটি সরাসরি আড়তে তোলে। আড়তদার কমিশন রেখে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পণ্য বিক্রয় করে থাকেন। কৃষক পর্যায়ের অভিযোগ তারা ফড়িয়া/বেপারি/পাইকার/আড়তদারদের যোগসাজশের কারণে তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না। কৃষকদের সংগঠন না থাকার কারণে তাদের দরকষাকষির সুযোগ থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে সংগঠন থাকলেও তা দুর্বল প্রকৃতির। ব্যবসায়ীরা সংখ্যায় কম হলেও নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া থাকে। এ কারণে কৃষক তার ইচ্ছামতো দাম হাঁকাতে পারে না। বেশির ভাগ কৃষিপণ্য যেহেতু পচনশীল, তাই বেশি দিন ধরে রাখা যায় না। আবার ধরে রাখার মতো সংরক্ষণাগার/হিমাগারের ব্যবস্থা না থাকার কারণে অনেকটা বাধ্য হয়ে কৃষক তড়িঘড়ি করে অথবা আগাম কৃষি পণ্য বিক্রি করে দেয়। ফলে ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে কৃষক বঞ্চিত হয়।  
কৃষি পণ্যের বাজারমূল্য নির্ধারণ
কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতের জন্য বাংলাদেশ সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান ও গম সংগ্রহ করে থাকেন। একইভাবে ভারতের কেরালা রাজ্যেও আনারস বিক্রির উপর রাজ্য সরকার কর্তৃক একটা নির্দিষ্ট দাম নির্ধারণ করে দেয়। ফলে ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়েই সন্তুষ্ট থাকতে দেখা যায়। সেখানে কেরালা পাইনঅ্যাপেল সিটি নামে একটি বৃহৎ আকার মার্কেট রয়েছে। সেখান থেকে পুরো ভারতসহ পাকিস্তানের কিছু রাজ্যে আনারস সররবাহ করা হয়। “কেরালা পাইনঅ্যাপেল কৃষক সমবায় সমিতি” নামে ১০০০ সদস্যের রেজিস্ট্রার্ড একটি শক্তিশালী কৃষক সংগঠন রয়েছে। সংগঠনকে শক্তিশালীকরণে রাজ্য সরকার যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। শক্তিশালী কৃষক সংগঠনের মাধ্যমে কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ সেখানকার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমাদের দেশেও কৃষক সংগঠন শক্তিশালীকরণের মধ্য দিয়ে ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা যেতে পারে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাষায় কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। সুতরাং কৃষক ফসলের ন্যায্যমূল্য পাক, এটাই হোক সবার অঙ্গীকার।
সরকারিভাবে কৃষি পণ্যের সমর্থনমূল্য নিশ্চিতকরণ
কৃষি মূল্যনীতির অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে পণ্যের ন্যূনতম সমর্থনমূল্য নির্ধারণ করা। এটা প্রতি বছরই সরকারিভাবে নির্ধারণ করা দরকার। কৃষকের জন্য উৎপাদিত পণ্যের ন্যূনতম মুনাফা নিশ্চিত করা এর উদ্দেশ্য। ভারতে বর্তমানে ২৩টি কৃষিপণ্যের সমর্থনমূল্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। নির্ধারিত মূল্যের নিচে যাতে বাজারদর নেমে না যায় সে জন্য সরাসরি  কৃষকদের কাছ থেকে উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করে নেয় সরকার।
২০১৮-১৯ সালের বাজেটে ভারত সরকার বিভিন্ন কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেছে উৎপাদন খরচের ওপর শতকরা ৫০ শতাংশ মুনাফা হিসাব করে। মোট উৎপাদিত পণ্যের শতকরা ১৫ শতাংশ ক্রয় করা হচ্ছে এরূপ পূর্বনির্ধারিত মূল্যে। বাংলাদেশে ন্যূনতম সমর্থন মূল্য নির্ধারণের ব্যবস্থা থাকা দরকার। তবে প্রচলন আছে ধান-চাল ও গমের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণের। এটা সাধারণত উৎপাদন খরচের ওপর ৬ থেকে ১০ শতাংশ মুনাফা দেখিয়ে নির্ধারণ করা হয়। এর পরিধিও সীমিত। মোট উৎপাদনের মাত্র ৪/৫ শতাংশ খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা হয় উৎপাদন মৌসুমে। তার বেশির ভাগ ক্রয় করা হয় স্থানীয় ব্যবসায়ী ও চাতালের মালিকদের কাছ থেকে। কৃষক তাতে সরাসরিভাবে লাভবান খুবই কম হয়। ফলে আমাদের দেশে প্রচলিত উৎপাদিত পণ্যের সংগ্রহ মূল্য স্থানীয় বাজারে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। তাতে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয় কৃষক। অনেক সময় উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে কৃষক তার উৎপাদন খরচটুকুও ঘরে নিয়ে আসতে পারে না।
কৃষিপণ্যের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণের জন্য কিছু নিয়ম প্রচলিত আছে। সেক্ষেত্রে আগের বছরের পণ্যমূল্য, উৎপাদন খরচ, খোলা বাজারে পণ্যমূল্যের চালচিত্র, আন্তর্জাতিক বাজারদর, সরকারি মজুদ ও মূল্যস্ফীতির হার ইত্যাদি প্রধান বিবেচ্য বিষয়। আমাদের দেশে বর্তমানে ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয় মূলত উৎপাদন খরচের ওপর ভিত্তি করে।
কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ ও সংগ্রহমূল্য নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন দেশে রয়েছে ‘এগ্রিকালচারাল প্রাইস কমিশন’। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে এখন কৃষিমূল্য কমিশন কার্যকর রয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতের উদাহরণ আমাদের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। সেখানে কৃষিমূল্য কমিশন স্থাপিত হয়েছে ১৯৬৫ সালে। এখনও তা অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এতে একজন চেয়ারম্যান এবং দু’জন সদস্যসহ প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য লোকবল রয়েছে। এ কমিশনের কাজ হলো পণ্যের উৎপাদন, ন্যূনতম সমর্থন মূল্য এবং কৃষিপণ্যের রফতানি মূল্য নির্ধারণ ও আমদানি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ পেশ করা। মাঠের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং কৃষি উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে কমিশন তাদের সুপারিশ পেশ করে থাকে। তাদের সুপারিশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবাই মেনে নেয়। বাংলাদেশে এরূপ একটি প্রাইস কমিশন গঠনের দাবি দীর্ঘদিনের। আমাদের জাতীয় কৃষিনীতিতেও একটি প্রাইস কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।
কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে করণীয়
কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সরাসরি বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নির্দিষ্ট এলাকাভিত্তিক কৃষক সংগঠন তৈরি করে গ্রুপ মার্কেটিং এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে কৃষকদের সংঘবদ্ধ হতে হবে। মাঠ পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্মীরা উৎপাদনের পিছনে যে পরিমাণ শ্রম ও সময় ব্যয় করেন তার কিছুটা সময় ফসল বিক্রয়ে সহায়তা প্রদান করতে হবে। কৃষি পণ্য বিপণনে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সহায়তা করে থাকে। তাই কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের জনবলকাঠমো উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত দরকার। সে পরিকল্পনাও সরকারের রয়েছে। ইতোমধ্যে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী এ ব্যাপরে বেশ উৎসাহী পদক্ষেপ গ্রহণও করেছেন।
কৃষকদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য উৎপাদন খরচ কমানোর দিকে প্রথম নজর দেয়া দরকার। সে সাথে ব্যবসায়ী আর কৃষকদের মাঝে যোগাযোগ স্থাপন করা প্রয়োজন। মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেট ভঙ্গ করতে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ দরকার। কৃষক-গবেষক-সম্প্রসারণ কর্মী-ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংযোগ সাধন অতীব জরুরি। কৃষির বিভিন্ন প্রকল্পে কৃষক প্রশিক্ষণে স্থানীয় ব্যবসায়ীকে অন্তর্ভুক্ত করে আধুনিক বাজার ব্যবস্থাপনার উপর পাঠদান দেওয়া যেতে পারে। এতে কৃষক ও ব্যবসায়ী আধুনিক বাজারজাতকরণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করবে। নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের জন্য কৃষকের দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়ানো, সংগঠন তৈরি ও শক্তিশালীকরণ, নেতৃত্বের উন্নয়ন, গ্রুপ বা সমবায়ভিত্তিক মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি অভ্যস্তকরণ, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের বৃহৎ বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণ, মিডিয়াতে বাজার তথ্য সম্প্রচার, পণ্য পরিবহনকালীন চাঁদা বন্ধকরণ, অপচয় কমানো, প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতকরণ, ব্লক বা ইউনিয়ন পর্যায়ে পর্যাপ্ত কালেকশন সেন্টার স্থাপন, ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি ও বিপণন সেবা চালুকরণ, উপজেলা পর্যায়ে সংরক্ষণাগার বা প্যাক-হাউজ স্থাপন এবং জেলা পর্যায়ে কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করা প্রয়োজন। প্রক্রিয়াজাতকারীদের সাথে কনটাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে চাহিদাভিত্তিক পণ্য উৎপাদন করলে ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি সহজ হবে।
বর্তমান বিশ্ব যখন মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাসী তখন বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতা মোকাবিলা করতে হলে পণ্যের উপযুক্ত ও আধুনিক প্রক্রিয়াজাতের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি, কৃষিপণ্য উৎপাদন ও বিপণন খরচের খাতগুলো চিহ্নিত করে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করতে হবে। এতে করে একদিকে যেমন নিজস্ব পণ্যের উপযুক্ত মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে অন্যদিকে ক্রেতা সকলও অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে ক্রয় করতে পারবে। ফলশ্রুতিতে ব্যক্তি, দেশ ও জাতি সকলেই উপকৃত হবে।

লেখক : ১বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পরিকল্পনা, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও আইসিটি উইং, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইলঃ ০১৬৭৫৭৫১৩২২; ই-মেইল : jahangrhossaindae@gmail.com ২সহকারী পরিচালক, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইলঃ ০১৯১২২৮৩৮৬৭; ই-মেইল :shahid.bc.bd@gmail.com

বিস্তারিত
সম্ভাবনাময় টিউলিপ ফুলের উৎপাদন প্রযুক্তি

সম্ভাবনাময় টিউলিপ ফুলের উৎপাদন প্রযুক্তি
ড. শামীম আহমেদ
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান একটি দেশ। তবে কিছু কিছু সমাদৃত কৃষি পণ্যের বাজার বিশ্বব্যাপী থাকলেও আবহাওয়া ও পরিবেশগত কারণে সেটা বাংলাদেশে জন্মানো সম্ভব হতো না। তেমনই একটি ফুলের নাম টিউলিপ। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশের কিছু কিছু স্থানে এই টিউলিপের আবাদ দেখে অনেকের মনে টিউলিপ নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কেওয়া পূর্বখ-  গ্রামের কৃষক দেলোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রীর প্রচেষ্টায় ২০২১ সালে নেদারল্যান্ডের এক টিউলিপ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রাপ্ত এক হাজার একশত (১১০০) বাল্ব নিয়ে তিনি প্রথম তার ‘মৌমিতা ফ্লাওয়ার্স’ নামের খামারে এই ফলের চাষ শুরু করেন। এবারো তিনি পরীক্ষামূলকভাবে টিউলিপের চাষাবাদ করেছেন। এছাড়াও বৃহত্তর কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চল কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প এর আওতায় যশোরের ঝিকরগাছার গদখালীতে মো. ইসমাইল হোসেন পাচশতক জমিতে এবার টিউলিপের আবাদ করেন। দেশের শীতার্ত অঞ্চল হিসেবে খ্যাত ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়েও কেজিএফ এর সহায়তায় টিউলিপের আবাদ হয়েছে। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার শারিয়াল জোত ও দর্জিপাড়া গ্রামে প্রথম উদ্যোক্তা পর্যায়ে শুরু হয়েছে টিউলিপের আবাদ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশেও টিউলিপের আবাদ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এখন প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ, কারিগরি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ সহায়তা। টিউলিপের চাষ ব্যবস্থাপনা সাধারণ ফসলের চাষ ব্যবস্থাপনা হতে কিছুটা ভিন্ন।      
টিউলিপ উদ্ভিদ “খরষরধপবধব” পরিবারের অন্তর্গত “ঞঁষরঢ়ধ খ.” এর বংশ। প্রকৃতপক্ষে, টিউলিপ হল বসন্ত-প্রস্ফুটিত বহুবর্ষজীবী যা বাল্ব থেকে জন্মায়। প্রজাতির (বৈচিত্র্য) উপর নির্ভর করে, টিউলিপ গাছ ১০ সেমি. থেকে ৭০ সেমি. উচ্চতার মধ্যে হতে পারে। যখন এটিতে ফুল আসে, তখন সাধারণত ৬টি পাপড়িসহ একটি কাপ বা ডিমের মতো আকৃতির হয়। টিউলিপ ফুলের পাপড়ি বিভিন্ন ধরণের বা প্রজাতির উপর নির্ভর করে বিভিন্ন প্যাটার্নসহ একক রঙ থেকে বহু রঙের হয়ে থাকে। টিউলিপ ফুল কমলা, গোলাপী, চেরি, ম্যাজেন্টা, স্যামন, ক্রিমসন, বেগুনি, এপ্রিকট, লিলাক, মাউভ, নীল, হলুদ, ভায়োলেট, পোড়ামাটির মতো অনেক রঙ লাল, স্কারলেট, চকোলেট, বাদামী অনেক শেডসহ বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে।
টিউলিপের জাত
সারা বিশ্বে টিউলিপের অনেক উন্নত জাত থাকলেও মূলত টিউলিপের তিনটি শ্রেণী রয়েছ। প্রারম্ভিক ফুল আসা টিউলিপ, মাঝামাঝি ফুল আসা টিউলিপ, দেরিতে ফুল আসা টিউলিপ। ভারতে প্রাথমিক ফুলের টিউলিপের প্রধান জাতগুলো হলো; সিঙ্গেল আর্লি, ডাবল আর্লি, ডুক ভ্যান টোল এবং মিড সিজন টিউলিপ; বিজয়, মেন্ডাল। শেষ ঋতু টিউলিপের জাতগুলি হল হাইব্রিডাইজ, লিলি ফুলযুক্ত, রেমব্রান্ট, বিজব্লোমেন, ডাবল লেট, প্যারটস, ডারউইন এবং ডারউইন হাইব্রিড। টিউলিপা স্টেলাটা এবং টি. আইচিসোনি হিমালয় অঞ্চলে জন্মে।
টিউলিপ চাষের উপযোগী আবহাওয়া
টিউলিপ সম্পূর্ণ রোদে বা আংশিক ছায়ায় জন্মানো যায়।  তবে টিউলিপের বৃদ্ধি ও গুণাগুণ অব্যহত রাখতে দিনের তাপমাত্রা প্রয়োজন ২০-২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও রাতে ৫-১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সকালে সরাসরি সূর্যের আলো উপযোগী হলেও মধ্যাহ্নের সময় (১২টা থেকে ৪টা) আংশিক ছায়া প্রয়োজন। টিউলিপ তুষারপাতের ক্ষেত্রে যেমন খুব সংবেদনশীল তেমনি গরম জলবায়ুতে টিউলিপ বাড়ানো একটু কঠিন। সেক্ষেত্রে টিউলিপ ফুল জন্মানোর জন্য গ্রিনহাউজ এবং পলিহাউজের মতো সুরক্ষিত নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ সবচেয়ে উপযোগী।
টিউলিপ চাষের জন্য প্রয়োজনীয় মাটির বৈশিষ্ট্য
সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে সেচের পানির সুনিষ্কাশিত জমিতে টিউলিপ বাল্ব ভালো জন্মে। তাই টিউলিপের ভাল বৃদ্ধি এবং ফলনের জন্য সুনিষ্কাশিত হালকা বেলে দোআঁশ মাটি প্রয়োজন। ভারী মাটির ক্ষেত্রে, ভাল পচনশীল কম্পোস্ট বা পিট মস বা অন্যান্য জৈব পদার্থ যোগ করলে ফসল বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। বাণিজ্যিকভাবে জন্মানো টিউলিপের জমির উর্বরতা নিশ্চিত করতে মাটি পরীক্ষা করা খুব জরুরি। মাটির পিএইচ (ঢ়ঐ) ৬.০ থেকে ৭.০ অর্থাৎ কিছুটা অম্লিয় থেকে নিরপেক্ষ মাটি অধিক উপযোগী। মাটিকে সূক্ষ্মভাবে চাষ দিতে হবে এবং আগাছা অপসারণ করে জমি তৈরি করতে হবে।
টিউলিপের বংশবিস্তার ও রোপণ কাল ও দূরত্ব
টিউলিপ বাল্বলেট ও বাল্ব দ্বারা বংশবিস্তার করে থাকে। বীজ দ্বারাও বংশবিস্তার করা সম্ভব। মাঝারি থেকে মাঝারি উঁচু যে জমিগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১১০০-১৮০০ মিটার উঁচু সেই সব জমিতে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসের আর যেই জমিগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ মিটারের বেশি উচুতে রয়েছে সেই জমিতে নভেম্বর-ডিসেম্বর হতে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাল্ব রোপণের আদর্শ সময়। নিয়মিত কাট ফ্লাওয়ার (ঈঁঃ ঋষড়বিৎ) প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে দুই সপ্তাহ অন্তর অন্তর বাল্ব গুলো লাগালে অধিক লাভবান হওয়া সম্ভব। বাল্বের আকার ও আকৃতির উপর নির্ভর করে এর রোপণ গভীরতা নির্ভর করে। সাধারণত রোপণ পিটগুলো বাল্বের উচ্চতার ২ থেকে ৩ গুণ হওয়া উচিত। সাধারণভাবে, টিউলিপ বাল্ব ১৫ সেমি ী ১০ সেমি. ব্যবধানে ৫ থেকে ৮ সেমি. গভীরে রোপণ করতে হবে। টবে করার উদ্দশ্যে ১৫ সেন্টিমিটার পাত্রে ৩ থেকে ৫টি বাল্ব লাগনো ভালো। দিনের মধ্যানে (১২টা থেকে বিকেল ৪টা) আংশিক ছায়া ফুলের দীর্ঘায়ুর জন্য উপকারী। একটি ভালো মানের টিউলিপ গাছ পেতে ১০-১২ সেমি. আকারের বাল্ব রোপণ উপাদান হিসেবে বেছে নেয়া উচিত।
টিউলিপ চাষে সেচ ব্যবস্থাপনা
টিউলিপ চাষে সেচ ব্যবস্থাপনা মাটির ধরন, জলবায়ু ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। গ্রিনহাউজ এবং পলিহাউজ চাষের ক্ষেত্রে বিকল্প দিনে (অষঃবৎহধঃব ফধু) সেচ দিলে ভালো। যেসব এলাকায় পানির বড় সমস্যা সেখানে ড্রিপ সেচ ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে। সেচের পানির উত্তম নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকতে হবে, তা না হলে গাছে পচন ধরতে পারে এবং পানিবাহিত বিভন্ন রোগ হবার আশঙ্কা থাকে। ফুলের উন্নত মান এবং ফলনের জন্য উদ্ভিদ বৃদ্ধির পুরোটা সময় জুড়ে মাটির পর্যাপ্ত আর্দ্রতা বজায় রাখতে হবে।
টিউলিপ চাষে আগাছা ও সার ব্যবস্থাপনা
সুস্থ টিউলিপ চাষের জন্য মাঠকে আগাছামুক্ত রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ম্যানুয়ালভাবে অথবা  উপযুক্ত আগাছানাশক ব্যবহার করে যে কোনো আগাছার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর্দ্রতা হ্রাস থেকে রক্ষা করতে এবং আগাছা নিয়ন্ত্রণ করতে টিউলিপ গাছগুলিকে মালিচং করতে হবে।
শুকনো গোবর সার এবং কম্পোস্ট টিউলিপ চাষের জন্য চমৎকার জৈবসার। ভালোভাবে পচা ফার্মইয়ার্ড সার (ঋগণ) ৩-৫ কেজি প্রতি বর্গমিটার মাটিতে ভালোভাবে মেশাতে হবে। টিউলিপ চাষের ক্ষেত্রে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টসমৃদ্ধ দ্রবণ মাল্টিপ্লেক্স এক বা দুইবার ৫০ পিপিএম পরিমাণ স্প্রে করলে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়। অজৈব সার হিসেবে ঘচক ৫-১০-৫ হিসাবে, ৫% নাইট্রোজেন (ঘ), ১০% ফসফরাস (চ) এবং ৫% পটাশিয়াম (ক) সহ জমিতে ব্যবহার করা উচিত।
টিউলিপ চাষে বালাই ব্যবস্থাপনা
টিউলিপ ফুলে থ্রিপসের আক্রমণ হয় খুব বেশি। এক্ষেত্রে রোগর (০.০৫%) স্প্রে করলে তা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ব্যাভিস্টিন (০.১%) বা ডাইথেন এম-৪৫ (০.২%) দিয়ে বাল্ব পচা রোগ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এছাড়া টিউলিপ ফসল এফিড দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে।
সেক্ষেত্রে এন্ডোসালফান, ম্যালাথিয়ন, অ্যালডিকার্বসের সুপারিশকৃত ডোজ এই পোকা নিয়ন্ত্রণে উপকারী। ফিউযারিয়াম (ঋঁংধৎরঁস) সংক্রমণ গাছে একটি টক গন্ধ সৃষ্টি করে, যা টিউনিকের উপর একটি সাদা ছাঁচের উপস্থিতি হিসেবে দেখা যায়। এই ছত্রাকের আক্রমনে বাল্ব ফাঁপা এবং ওজনে হালকা হয়ে যায়। এই রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য ০.২% বেনোমিল দিয়ে মাটি ভিজানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
টিউলিপ ফুল সংগ্রহ
টিউলিপ চাষে সাধারণত মধ্য-পাহাড় অঞ্চলে ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল এবং উঁচু-পাহাড় অঞ্চলে এপ্রিল জুনে ফুল ফোটা শুরু করে। ফুলের পাপড়িতে ২৫%-৫০% রঙ বিকশিত হলে দুটি পাতাসহ স্ক্যাপগুলো কেটে ফেলতে হবে।
যখন বাল্ব সংগ্রহের কথা আসে, তখন টিউলিপ গাছের পাতা হলুদ হতে শুরু করলে বা ফুল ফোটার ৪৫ দিন পর সেগুলো কাটা উচিত। পুরনো বাল্বের গায়ে লেগে থাকা আঁশ এবং শিকড় সরিয়ে ফেলতে হবে। এই বাল্বগুলো ছায়াযুক্ত বাতাসে শুকানো উচিত। ফুল প্রাইমোডিয়ার সঠিক বিকাশের জন্য সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে টিউলিপ বাল্বগুলি ৭-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৭-৮ সপ্তাহের জন্য সংরক্ষণ করা উচিত। এই বাল্বগুলি যেন স্যাঁতসেঁতে বা আর্দ্র অবস্থায় সংরক্ষণ করা না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
টিউলিপ ফুলের জাত ও আকারভেদে এর ফলন ভিন্ন হয়ে থাকে। নেদারল্যান্ডসসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে টিউলিপের আধুনিক চাষাবাদ ব্যাপক ভাবে হচ্ছে। সেখানে শতভাগ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফুল ও বাল্ব সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত ফুল সরাসরি মাঠ থেকে প্যাকেটজাত করে চলে যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন ফুল বাজারে। পাশাপাশি মাট থেকে সংগ্রহ করা বাল্বগুলো মাঠেই পরিষ্কার করে মাটি আলাদা করে রপ্তানি করা হচ্ছে পরবর্তি বছর চাষাবাদের জন্য। বাংলাদেশেও এই টিউলিপ আবাদের যেই সম্ভাবনা ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে তা আরো সম্প্রসারণের জন্য এই ফুলের চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে অনেক গবেষণা প্রয়োজন। প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ ও প্রকল্প  সহায়তার। তবেই হয়তো সম্ভব এই বিদেশী সম্ভাবনাময় অধিক লাভের টিউলিপ ফুলের সফল উৎপাদন।

লেখক : উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, কৃষি মন্ত্রণালয়, ঢাকা, মোবাইল : ০১৭১১১৭৪৩৪৫, ইমেইল: ashamim.uni@gmail.com

বিস্তারিত
বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী ফল উৎপাদন

বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী ফল উৎপাদন
ড. মো. জামাল উদ্দিন
দেশে ফলের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। কৃষির নব নব উদ্ভাবন, সরকারের বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ এবং মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপি এর সঠিক নির্দেশনায় কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। মৌসুমি ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এটি দেশের জন্য অত্যন্ত গৌরবের! বর্তমানে মৌসুমি ফলের উৎপাদন প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন ছাড়িয়েছে। দেশীয় ফলের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানিনির্ভর ফলও দেশে চাষ হচ্ছে। তার মধ্যে রয়েছে মাল্টা, ড্রাগন ফল, কাজুবাদাম, কফি, বেরি, স্ট্রবেরি, রাম্বুটান, অ্যাভোকাডো, লংগান ও রকমেলন দেশজুড়ে কমবেশি চাষাবাদ হচ্ছে। এসব ফলই বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী ফল হিসাবে বিবেচিত। এসব ফলের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে সবুজ মাল্টা (বারি মাল্টা-১) ও  লাল রঙের ড্রাগন ফল ভোক্তাদের বেশ দৃষ্টি কেড়েছে। চাহিদাও বেশ। দামেও বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ফলের  চেয়ে কম। স্বাদ ও মিষ্টতা বিদেশি ফলের চেয়ে কোন অংশে কম নহে। পরিপক্ব সবুজ মাল্টা অত্যন্ত সুস্বাদু, রসালো ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন একটি ফল। ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ ফলগুলোর মধ্যে মাল্টা অন্যতম। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষের কাছে এটি সমান জনপ্রিয়। ড্রাগন ফলও পুষ্টিসমৃদ্ধ একটি ফল। এ ফলে যে রঙিন পিগমেন্টেশন থাকে তা দেহের পুষ্টির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এসব বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী ফসলের চাষাবাদ করে কৃষক সফল হয়েছে। আজকের আলোচনা মাল্টা এবং ড্রাগন ফলকে নিয়ে চাষির  সফলতা।
মাল্টা ও ড্রাগন ফল আমদানিনির্ভর বিদেশি ফল হিসাবে পরিচিত ছিল এতদিন। কৃষির বৈপ্লবিক পরিবর্তনে ফল দুটো দেশেই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এ দুটো ফলের উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। বারি মাল্টা-১ ও বারি মাল্টা-২ এবং বারি ড্রাগন ফল-১ নামে নিয়মিত ফলনদানকারী জাতসমূহ অবমুক্ত হয়েছে বেশ আগেই। সে সাথে অন্যান্য বিদেশী ফলের জাত হিসাবে বারি স্ট্রবেরির তিনটি জাত, রাম্বুটান এর একটি, অ্যাভোকাডোর একটি জাত এবং লংগান এর দুটো উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে।
বিশ্বের সর্বমোট উৎপাদিত লেবুজাতীয় ফলের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ হচ্ছে মাল্টা এবং আমদানিকৃত বিদেশি ফলের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাল্টা ও ড্রাগন ফল। ফল দুটো আমদানিতে প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে। আমদানি ব্যয় বাড়লে রিজার্ভের উপর চাপ পড়ে। বর্তমান বৈশ্বিক সংকটে আমদানি ব্যয় কমাতে বিশ্বের অনেক দেশ বেশ তৎপর। জাতীয় দৈনিকের সূত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদেশি ফল আমদানি করতে হয়েছে ৮ লাখ ২৪১ মেট্রিক টন। মোট আমদানির ৭৭ শতাংশই হচ্ছে আপেল ও মাল্টা। মাল্টা খাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বে ১৪তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশে খুচরা পর্যায়ে বছরে ফলের বাজারের আকার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বলে ধারণা করছে জাতীয় এক দৈনিক পত্রিকা। দেশে বছরের পাঁচ মাস, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি চলে বিদেশি ফল। এ সময়ে দেশীয় ফলের সরবরাহ কম থাকে। উৎপাদন বাড়লে পর্যায়ক্রমে এসব ফলের  আমদানি নির্ভরতা কমবে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্টজনেরা।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে মাল্টা ও ড্রাগন ফলের সম্ভাবনার কথা জানতে গিয়ে ফটিকছড়ি উপজেলার চৌকস কৃষি কর্মকর্তা হাসানুজ্জমান বলেন মাল্টা ও ড্রাগন ফল গাছের এক একটি ফল যেন এক একটি ডলার। মনে হয় গাছেই বৈদেশিক মুদ্রা ঝুলছে। এটি তার সঠিক উপলব্ধি। তিনি বলেন কৃষকের চাহিদার আলোকে তাদের প্রচেষ্টায় ফটিকছড়িতে অনেক মাল্টা ও ড্রাগন ফলের বাগান গড়ে তুলেছেন। কৃষকেরা লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছেন। এমনই একজন মাল্টা চাষি ফটিকছড়ির ইসলামপুরের শাহ আলম মুন্সি। তিনি জানান, তিন বছর আগে ২ একর জমিতে ৫৫০টি বারি মাল্টা-১ এর গ্রাফট কলম রোপণ করেছিলেন। প্রথম বছরে মাল্টার সাথে আন্তঃফসল হিসেবে কলা, পেঁপে ও মরিচ চাষ করেছিলেন। সেখান থেকে বাড়তি আয়ও পেয়েছিলেন। তিন বছর বয়সী তাঁর প্রতিটি মাল্টা গাছ থেকে গড়ে ১৫-২০ কেজি মাল্টা সংগ্রহ করে বেশ লাভবান হয়েছেন। তাঁরমতে পরিপক্ব অবস্থায় মাল্টা সংগ্রহ করে বিক্রি করলে দাম ও চাহিদা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। সে সাথে দেশের মানুষ তাজা ও ভালো মানের মাল্টা খেতে পারবে বলে তিনি মনে করেন। গত ৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সম্মানিত মহাপরিচালক মোঃ বেনজীর আলম উক্ত বাগান পরিদর্শন করেন বলে জানান ফটিকছড়ি উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা।
রামগড়ের গ্রীন টাচ্ এগ্রো বাগানের স্বত্ববাধিকারী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহমুদুল হাসান মাল্টা ও ড্রাগন ফলকে বৈদেশিক মুদ্রা ফল হিসাবে আখ্যায়িত করে বলেন টেকসইভাবে এ ফল দুটো টিকিয়ে রাখতে হলে রাজশাহীর আমের মতো সংগ্রহের সঠিক সময় বেঁধে দেয়া জরুরি এবং চাষিদের একটি সমন্বিত উদ্যোগ থাকা দরকার যাতে নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্দিষ্ট দামে এ মাল্টা বিক্রি করা যায়। আইনজীবী মাহমুদুল হাসান এর বাগানে ৮৫০টি বারি মাল্টা-১ ও বারি মাল্টা ২ থেকে ২০২০ সালে প্রায় ৬.৫ লক্ষ টাকা আয় করেন। তার বাগানের বারি ড্রাগন ফল-১ স্থানীয়ভাবে প্রতিকেজি ২৫০-৩০০ টাকায় বিক্রি করতে পেরে বেশ সন্তুষ্ট।  হাফছড়ির সফল কৃষি উদ্যোক্তা মো: আতিয়ার রহমান ১০০০টি বারি মাল্টা-১ এর গাছ থেকে গত বছর ৮ টন বারি মাল্টা-১ সংগ্রহ করেছিলেন। পাইকারি এসব মাল্টা প্রতি কেজি ৮০-১০০ টাকায় বিক্রি করেন। তার মতে অনেক ডাক্তারও বিদেশি হলুদ মাল্টার পরিবর্তে দেশীয় এ সবুজ মাল্টা খেতে পরামর্শ দেন। তিনি জানান, সবুজ মাল্টার প্রচারণা বাড়ালে বিদেশি হলুদ মাল্টার চেয়ে বাজার চাহিদা বৃদ্ধি পাবে।
দেশে সবচেয়ে বেশি মাল্টা উৎপাদন হয় মাগুরা জেলায়। জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে মাল্টা উৎপাদনে দ্বিতীয় শীর্ষ রাজশাহী জেলা। এখানে ৬৭৭ টন মাল্টা উৎপাদন হয়েছিল। এরপর ছিল টাঙ্গাইল (৪৫৬ টন), রাঙামাটি (৪০৮ টন), বান্দরবান (৩৩১ টন) ও যশোর (৩০২ টন), দিনাজপুরে ২৮৩ টন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২৫৮ টন, খাগড়াছড়িতে ২৬৬ টন এবং পিরোজপুরে ২০৮ টন। তবে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে মাল্টার উৎপাদন (ফসল-উত্তর ক্ষতি বাদে) ১০ হাজার টন ছাড়িয়েছে বলে প্রাথমিক তথ্যে উঠে এসেছে। প্রতি কেজি মাল্টার গড় দাম ৮০ টাকা হিসাবে ফলটির বাজার ৮০ কোটি টাকা। যা বর্তমান ডলারের বিনিময় মূল্য ১০০.০৯ টাকা ধরে হিসাব করলে এ পরিমাণ মাল্টা আমদানি করতে ডলার খরচ পড়বে ৭৯ লক্ষ ৯৫ হাজার ১৬১ ডলার!  উল্লেখ্য, এই সাইট্রাস জাতটি মাঠ পর্যায়ে গ্রহণের আগে বাংলাদেশ ২০০০ কোটি টাকা (২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) সাইট্রাস ফল আমদানি করেছিল, কিন্তু এখন এটির আমদানি ব্যয় ১৫০০ কোটি টাকা হ্রাস পেয়েছে অর্থাৎ প্রতি বছর ৫০০ কোটি টাকা (৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) সাশ্রয় হয়েছে বলে শীর্ষ এক ইংরেজি দৈনিকে সংবাদ প্রচার রয়েছে। এটি একটি একক সাইট্রাস ফলের জন্য আশ্চর্যজনক সাফল্য। অনুরূপভাবে দেশে গত ছয় বছরে ড্রাগন ফলের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৩১ গুণ। গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়েছে ঝিনাইদহ জেলায়। মোট ১৫১ হেক্টর জমিতে জেলাটিতে ৩ হাজার ৩৫৩ টন ড্রাগন ফল উৎপাদন হয়েছে, যা দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৩৯ শতাংশ। এছাড়া যশোর জেলায় উৎপাদন হয়েছে ৫১ হেক্টর জমিতে ৯৬৫ টন। নাটোর জেলায় ৪০ হেক্টর জমিতে ৬৪০ টন, চট্টগ্রাম জেলায় ৫৫ হেক্টর জমিতে ৪১৮ টন ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় ১৭ হেক্টর জমিতে ৩৯৫ টন ড্রাগন ফল উৎপাদন হয়েছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ৬৫ হেক্টর জমিতে ৩৪৮ টন ড্রাগন ফল উৎপাদন হয়েছে। সবমিলিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৯৫ হেক্টর জমিতে ৮ হাজার ৬৫৯ টন ড্রাগন ফল উৎপাদন হয়। প্রতি কেজি ড্রাগন ফলের গড় দাম ২৮০ টাকা হিসাবে ফলটির বাজার ২৪২ কোটি ৪৫ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। যা বর্তমান ডলারের বিনিময় মূল্য ১০০.০৯ টাকা ধরে হিসাব করলে এ পরিমাণ ড্রাগন ফল আমদানি করতে ডলার খরচ পড়বে ২ কোটি ৪২ লক্ষ ৩০ হাজার ৫৩৬ ডলার।  
দেশে বিদেশি ফলের উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে হলে মৌসুমে আমদানিকৃত ফলের উপর শুল্ক আরোপ করার কথাও বলেন অনেক বিশেষজ্ঞ। এ প্রসংগে সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কারপ্রাপ্ত খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ির সফল কৃষি উদ্যোক্তা হ্লাচিং মং চৌধুরী বলেন এ ফল দুটো চাষে কৃষকদের আগ্রহ টেকসই ভাবে ধরে রাখতে মাল্টার বেলায় আগস্টের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এবং ড্রাগন ফলের ক্ষেত্রে মে থেকে ডিসেম্বর প্রথম সাপ্তাহ পর্যন্ত আমদানি বন্ধ রাখা দরকার। তবে এ সময়ে দেশের চাহিদার তুলনায় এসব ফলের দেশজ উৎপাদন কম হলে আমদানির বিকল্প থাকে না বলে আমদানিকারকদের অভিমত রয়েছে। হ্লাচিং মং চৌধুরী আরো জানান চলতি বছর ৭ হাজার মাল্টা গাছ থেকে ১৭-১৮ টন মাল্টা বিক্রি করেন। এসবের বেশির ভাগই বারি মাল্টা-১। তিনি পাইকারি দরে ঢাকার কাওরান বাজারে বেশির ভাগ মাল্টা বিক্রি করেন। বাগানে মাল্টা ছাড়াও ২-৩ জাতের প্রায় ৫০০টি ড্রাগন ফলের গাছ রয়েছে যা থেকে চলতি বছর সাড়ে তিন টন ড্রাগন ফল সংগ্রহ করেন পাহকারি দামে বিক্রি করে বেশ লাভবান হয়েছেন।
বারি মাল্টা-১ ও ড্রাগন ফলের সামগ্রিক উৎপাদন বাড়াতে এর উপর কৃষকদের বারির বিজ্ঞানী ও কৃষি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কার্যকর প্রশিক্ষণ প্রদান; বারি মাল্টা-১ এর পরিপক্বতার লক্ষণ ও সংগ্রহের উপযুক্ত সময়ের উপর বিভিন্ন মিডিয়াতে ব্যাপক প্রচারণা চালানো; উত্তম কৃষি চর্চা প্রয়োগ; ফল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনাসহ ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তির জন্য সুষ্ট বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে অচিরেই এ দুটো ফল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী হিসাবে আবির্ভূত হবে। সে সাথে বারি উদ্ভাবিত ফলের জাত মাঠ পর্যায়ে দ্রুত বিস্তারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করলে অচিরেই এসব ফলের আমদানি নির্ভরতা কমবে।

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, বারি, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম-৪৩৩০, মোবাইল : ০১৮১৫৪২৫৮৫৭  ইমইেল: jamaluddin1971@yahoo.com

 

বিস্তারিত
অগ্রহায়ণ মাসের তথ্য ও প্রযুক্তি পাতা

অগ্রহায়ণ মাসের তথ্য ও প্রযুক্তি পাতা
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন
আমন ধান
    আমন ধান পেকে গেলে রোদেলা দিন দেখে রিপার/কম্বাইন হারভেস্টারের মাধ্যমে কম খরচে, স্বল্প সময়ে ধান সংগ্রহ করুন।
    ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় আমন ধান শতকরা ৮০ ভাগ পাকলে দ্রুত সংগ্রহ করুন।
    আমন ধান কাটার পরপরই জমি চাষ দিয়ে রাখুন, এতে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে মাটির রস কম শুকাবে।
    উপকূলীয় এলাকায় রোপা আমন কাটার আগে রিলে ফসল হিসেবে খেসারি আবাদ করুন।
বোরো ধান
    বোরো ধানের বীজতলা তৈরির জন্য রোদ পড়ে এমন উর্বর ও সেচ সুবিধাযুক্ত জমি নির্বাচন করে চাষের আগে প্রতি বর্গমিটার জায়গার জন্য ২-৩ কেজি জৈবসার দিয়ে ভালোভাবে জমি তৈরি করুন।
    পানি দিয়ে জমি থকথকে কাদা করে এক মিটার চওড়া এবং জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বা করে ভেজা বীজতলা তৈরি করুন।
    যেখানে ঠা-ার প্রকোপ বেশি সেখানে শুকনো বীজতলা তৈরি করুন। এক্ষেত্রে প্রতি দুই প্লটের মাঝে ২৫-৩০ সেমি. নালা রাখুন।
    রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের মাধ্যমে চাষের জন্য ট্রেতে চারা তৈরি করুন।
    সেচের পানির ঘাটতি থাকে এমন এলাকায় আগাম জাত হিসেবে ব্রি ধান৬৭ এবং ব্রি ধান৬৮, ব্রি ধান৭৪, ব্রি ধান৮১, ব্রি ধান ৮৪ ও ব্রি ধান৮৬, ব্রি ধান৮৮, বিনাধান২৪, এসএল৮এইচ প্রভৃতি চাষ করুন।
    উর্বর জমি ও পানি ঘাটতি নাই এমন এলাকায় ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৬০, ব্রি ধান৬৮, ব্রি ধান৭৪, ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, ব্রি ধান ৯৭, ব্রি ধান৯৯, বঙ্গবন্ধু ধান১০০, ব্রি ধান১০১, ব্রি ধান১০২, ব্রি হাইব্রিড ধান১, ব্রি হাইব্রিড ধান২ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৩, ব্রি হাইব্রিড ধান৫ এসব চাষ করুন।
    হাওর অঞ্চলের নিচু এলাকায় ব্রি ধান৬৭ চাষ করুন।
    লবণাক্ত এলাকায় ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৯৭, ব্রি ধান৯৯, বিনাধান-১০ চাষ করুন।
গম
    অগ্রহায়ণের শুরু থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ পর্যন্ত গম বোনার উপযুক্ত সময়। এরপর গম যত দেরিতে বপন করা হবে ফলনও সে হারে কমে যাবে।  
    অধিক ফলনের জন্য গমের আধুনিক জাত যেমন- বারি গম-২৪, বারি গম-২৫, বারি গম-২৮, বারি গম-৩০, বারি গম-৩২, বারি গম-৩৩ অথবা ডাব্লিউএমআরআই গম-১, ডাব্লিউএমআরআই গম-২, ডাব্লিউএমআরআই গম-৩ আবাদ করুন।  
    বীজ বপনের আগে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক দ্বারা বীজ শোধন করে নিন।
    গজানোর ক্ষমতা শতকরা ৮০ ভাগ বা তার বেশি হলে বিঘাপ্রতি ১৬ কেজি বীজ বপন করুন।
    সেচসহ চাষের ক্ষেত্রে শেষ চাষের সময় প্রতি শতক জমিতে ৩০-৪০ কেজি জৈবসার, ৬০০-৭০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫৫০-৬০০ গ্রাম টিএসপি, ৪০০-৪৫০ গ্রাম এমওপি, ৪৫০-৫০০ গ্রাম জিপসাম প্রয়োগ করুন।
    খরচ ও সময় কমাতে বেড প্লান্টারের মাধ্যমে বীজ বপন করুন।
    তিন পাতা বয়সে প্রথম সেচের পর দুপুর বেলা মাটি ভেজা থাকা অবস্থায় প্রতি শতাংশে ৩০০-৪০০ গ্রাম ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করুন। উল্লেখ্য যে, সেচ ছাড়া চাষের ক্ষেত্রে সমস্ত ইউরিয়া শেষ চাষের সময় অন্যান্য সারের সাথে প্রয়োগ করতে হবে।
    গমে তিনবার সেচ দিলে ফলন বেশি পাওয়া যায়। বীজ বপনের ১৭-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ, ৫০-৫৫ দিনে দ্বিতীয় সেচ এবং ৭৫-৮০ দিনে ৩য় সেচ দিন।
ভুট্টা
    ভুট্টা গত মাসে আবাদ না করে থাকলে এ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে জমি তৈরি করে বীজ বপন করুন।
    ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৯, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১০, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১১, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১২, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৩ এসব।
    এক শতাংশ জমিতে হাইব্রিড বীজ বপনের জন্য ৮০-৯০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
    সাধারণভাবে হাইব্রিড ভুট্টা চাষের জন্য প্রতি শতাংশ জমিতে ইউরিয়া ২-২.২৫ কেজি, টিএসপি ৯৫০-১০০০ গ্রাম, এমওপি ৭০০-৯০০ গ্রাম, জিপসাম ৯৫০-১০০০ গ্রাম, দস্তা ৪০-৬০ গ্রাম, বরিক এসিড ২০-৩০ গ্রাম এবং ১৬-২০ কেজি জৈবসার প্রয়োগ করুন।
সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল
    সরিষা গাছে ফুল আসার সময় শতাংশপ্রতি ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করুন। উপরি সার প্রয়োগের পর হালকা একটি সেচ দিন।
    মাটিতে রস কমে গেলে ২০-২৫ দিন পর আবারো একটি সেচ দিন।
আলু
    উপকূলীয় অঞ্চলে এ মাসেও আলু আবাদ শুরু করা যায়।
    অন্যান্য স্থানে রোপণকৃত জমিতে মাটির কেইল বেঁধে দিন এবং কেইলে মাটি তুলে দিন।
    সারের উপরিপ্রয়োগসহ প্রয়োজনীয় সেচ দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করুন।
শাকসবজি
    ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, মুলা এসব বড় হওয়ার সাথে সাথে চারার গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। চারার বয়স ২-৩ সপ্তাহ হলে সারের উপরিপ্রয়োগ করুন।
    সবজি ক্ষেতের আগাছা, রোগ ও পোকা-মাকড় নিয়ন্ত্রণ করুন। এক্ষেত্রে সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ ব্যবহার করতে পারেন। এতে পোকা দমনের সাথে সাথে পরিবেশও ভালো থাকবে।
    জমিতে প্রয়োজনে সেচ প্রদান করুন।
    টমেটো গাছের অতিরিক্ত ডাল ভেঙে দিয়ে খুটির সাথে বেঁধে দিন।
    ঘেরের বেড়িবাঁধে টমেটো, মিষ্টিকুমড়া, শিম চাষ করুন।
বিবিধ
    অধিক লাভবান হতে উচ্চমূল্যের ফসল আবাদ করুন ।
    স্বল্পকালীন ও উচ্চফলনশীল জাত নির্বাচন করুন অধিক ফসল ঘরে তুলুন।
    শ্রম, সময় ও খরচ সাশ্রয়ে আধুনিক কৃষি যন্ত্রের মাধ্যমে আবাদ করুন।

লেখক : তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৯১১০১৯৬১০, ই-মেইল :manzur_1980@yahoo.com

 

বিস্তারিত
পৌষ মাসের কৃষি (১৬ ডিসেম্বর-১৪ জানুয়ারি)

পৌষ মাসের কৃষি
(১৬ ডিসেম্বর-১৪ জানুয়ারি)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
পৌষ মাস। ঘন কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে শীতের আগমন। শীতকাল কৃষির জন্য একটি নিশ্চিত মৌসুম। সুপ্রিয়  কৃষিজীবী ভাইবোন, নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসল উৎপাদনে শীতের মাঝেও মাঠের কাজে সহায়তার জন্য আসুন সংক্ষেপে আমরা জেনে নেই এ মাসে সমন্বিত কৃষির সীমানায় কোন কাজগুলো আমাদের করতে হবে।
বোরো ধান
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন যারা এখনও বোরো ধানের বীজতলা তৈরি করেননি তাদের জন্য পরামর্শ- বীজতলায় ব্রি ধান২৮/স্বল্পমেয়াদি জাতের পরিবর্তে ব্রি ধান৮৮ এবং বঙ্গবন্ধু ধান ব্রি ধান২৯ এর পরিবর্তে ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, বঙ্গবন্ধু ধান১০০, ব্রি ধান১০১, ব্রি ধান ১০২ চাষ করুন। তুলনামূলক অল্প সময়ে অধিক ফলন ঘরে তুলুন। জলবায়ু পরিবর্তনে অতিরিক্ত ঠা-ার সময় বীজতলা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢেকে রাখা যায় এবং বীজতলার পানি সকালে বের করে দিয়ে আবার নতুন পানি দেয়া যায়। সে সাথে প্রতিদিন সকালে চারার ওপর জমাকৃত শিশির ঝরিয়ে দিতে হবে। বীজতলায় সব সময় নালা ভর্তি পানি রাখতে হয়। চারাগাছ হলদে হয়ে গেলে প্রতি বর্গমিটারে ৭ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এরপরও যদি চারা সবুজ না হয় তবে প্রতি বর্গমিটারে ১০ গ্রাম করে জিপসাম দিলে সুফল পাওয়া যায়।
গম
গমের জমিতে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ এবং প্রয়োজনীয় সেচ দিতে হবে। চারার বয়স ১৭-২১ দিন হলে গমক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করে একরপ্রতি ১২-১৪ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয় এবং সেচ দিতে হয়। সেচ দেয়ার পর জমিতে জো এলে মাটির ওপর চটা ভেঙে দিতে হবে। গমের জমিতে যেখানে ঘনচারা রয়েছে সেখান থেকে কিছু চারা তুলে পাতলা করে দেয়া ভাল।
ভুট্টা
ভুট্টাক্ষেতের গাছের গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে। গোড়ার মাটির সাথে ইউরিয়া সার ভালো করে মিশিয়ে দিয়ে সেচ দিতে হয়।
আলু
চারা রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর অর্থাৎ দ্বিতীয়বার মাটি তোলার সময় ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হয়। দুই সারির মাঝে সার দিয়ে কোদালের সাহায্যে মাটি কুপিয়ে সারির মাঝের মাটি গাছের গোড়ায় তুলে দিতে হবে।  ১০-১২ দিন পরপর এভাবে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে না দিলে গাছ হেলে পড়বে এবং ফলন কমে যাবে।
তুলা
তুলা সাধারণত ৩ পর্যায়ে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। শুরুতে ৫০% বোল ফাটলে প্রথম বার, বাকি ফলের ৩০% পরিপক্ব হলে দ্বিতীয় বার এবং অবশিষ্ট ফসল পরিপক্ব হলে শেষ অংশের তুলা সংগ্রহ করতে হবে।
ডাল ও তেল ফসল
মসুর, ছোলা, মটর, মাষকলাই, মুগ, তিসি পাকার সময় এখন। সরিষা বেশি পাকলে রোদের তাপে ফেটে গিয়ে বীজ পড়ে যেতে পারে, তাই এগুলো ৮০ ভাগ পাকলেই সংগ্রহের ব্যবস্থা নিতে হবে।
শাকসবজি
ফুলকপি, বাঁধাকপি ইত্যাদি শীতকালীন সবজি নিয়মিত যত্ন নেয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন শাক যেমন- লালশাক, মুলাশাক, পালংশাক একবার শেষ হয়ে গেলে আবার বীজ বুনে দেয়া যেতে পারে।
প্রাণিসম্পদ
এ সময় গর্ভবতী গাভীর প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে। সদ্য ভূমিষ্ঠ বাছুরকে গাভীর ওলানের শাল দুধ অবশ্যই খাওয়াতে হবে। কার্তিক মাসে জন্ম নেয়া গরু মহিষের বাছুরকে এ সময় কৃমির ওষুধ খাওয়াতে হবে। দুধালো গাভীর ওলান প্রদাহ রোগ, বাছুরের ডায়রিয়া, শীত ও কুয়াশার জন্য নিউমোনিয়া রোগ হতে পারে। তাই এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। গবাদি পশুকে তড়কা, ক্ষুরারোগ, বাদলা, গলাফুলা এবং মোরগ-মুরগির রানীক্ষেত ও হাঁস-মুরগির কলেরা রোগের প্রতিষেধক টিকা দিয়ে নিতে হবে।   শীতের তীব্রতা বেশি হলে পোলট্রি ও গবাদিপ্রাণির শেডে অবশ্যই মোটা চটের পর্দা লাগাতে হবে এবং বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
 শীত মৌসুমে মাছ খাবার কম খায় এবং শরীরের বৃদ্ধিও কম হয়। তাই পুকুরে সার ব্যবহার কমিয়ে ফেলা উচিত। এই সময় রুই জাতীয় বড় মাছ জীবিত অবস্থায় এক স্থান হতে অন্য স্থানে পরিবহন সুবিধাজনক। তাই আগামী গ্রীষ্ম/বর্ষায় রুই জাতীয় মাছকে কৃত্রিম উপায়ে ডিম ফুটাতে ইচ্ছুক মৎস্য চাষীগণ প্রজননক্ষম বয়ঃপ্রাপ্ত মাছ সংগ্রহ করে মজুদ পুকুরে রেখে দেয়া প্রয়োজন। মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে মাসে অন্তত একবার জাল টেনে পরীক্ষা করতে হবে। পানির গুণগত মান ঠিক রাখতে এবং মাছের পরিবেশ বজায় রাখার জন্য কলি চুন ব্যবহার করা প্রয়োজন।
(প্রাণিসম্পদ ও মৎস্যসম্পদ বিষয়ে চাষিদের করণীয় সম্পর্কে তথ্যসমূহ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত)
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, শীতকাল  শুকনো মৌসুমে প্রতি ফসলে চাহিদামাফিক সেচ প্রদান নিশ্চিত করতে পারলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে। কৃষির যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য আপনার নিকটস্থ উপজেলা কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন। এছাড়াও যেকোনো প্রশ্নের সমাধান পেতে বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা ও যে কোনো মোবাইল নাম্বার থেকে কল করতে পারেন কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি কল সেন্টার ১৬১২৩ নম্বরে। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা। য়

লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা,  টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪, মেইল :editorais.gov.bd

কৃতসা অ.মু-০২ নভেম্বর ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ, ১৭ কার্তিক ১৪২৯ বঙ্গাব্দ, ৫৯,৪০০ কপি

বিস্তারিত