Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ

সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ
মোঃ বেনজীর আলম
অধিকতর দক্ষতা এবং শ্রম ও সময় সাশ্রয়ী উপায়ে কৃষি উৎপাদন, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজে মানুষ ও প্রাণিশক্তির ব্যবহার হ্রাস করে অধিক পরিমাণে যন্ত্রশক্তি ব্যবহারের প্রযুক্তি ও কলাকৌশল প্রয়োগের বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাকে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বলা হয়। যান্ত্রিকীকরণের ফলে কৃষি কাজে ব্যবহৃত উপকরণ, সময়, শ্রম ও অর্থের সাশ্রয় হয়, সেই সাথে ফসল আবাদের দক্ষতা, নিবিড়তা, উৎপাদনশীলতা ও শস্যের গুণগতমান বৃদ্ধি পায় এবং কৃষিকাজ লাভজনক ও কর্মসংস্থানমুখী হয়। এ ছাড়াও প্রতিকূল পরিবেশে যন্ত্রের ব্যবহার উৎপাদন নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সূচনা হয় কৃষকদের মাঝে সরকারিভাবে যন্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে। সদ্য স্বাধীন দেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় ১৯৭৩ সালে দ্রুততম সময়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো নামমাত্র মূল্যে ভর্তুকি দিয়ে ৪০ হাজার শক্তিচালিত লো-লিফট পাম্প, ২ হাজার ৯০০ গভীর নলকূপ এবং ৩ হাজার অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। আধুনিক কৃষিযন্ত্র সম্প্রসারণে এটি ছিল ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। সে ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা খোরপোশের কৃষিকে লাভজনক কৃষিতে রূপান্তর করার লক্ষ্যে ২০০৯-১২ সালে ১ম পর্যায়ে ১৫০ কোটি টাকা, ২০১৩-১৯ সালে ২য় পর্যায়ে ৩৩৯ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ রাজস্ব বাজেটে ১৬৮ কোটি টাকা এবং ২০২০-২০২৫ মেয়াদে ৩০২০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করে যান্ত্রিকীকরণ সম্প্রসারণে সুনজর অব্যাহত রেখেছে এবং বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হচ্ছে।
দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষিকে লাভজনক, বাণিজ্যিকীকরণ ও আধুনিকীকরণের জন্য “সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ” প্রকল্পটি গত ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং ৫ বছর মেয়াদের প্রকল্পটি জুন/২০২৫ পর্যন্ত চলবে। প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম হলো, উন্নয়ন সহায়তার (ভর্তুকি) মাধ্যমে ১২ ধরনের ৫১৩০০টি কৃষিযন্ত্র কৃষকের নিকট পৌঁছানোর ব্যবস্থা গ্রহণ ও এই যন্ত্রগুলোর সুষ্ঠু পরিচালনা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ধান আমাদের প্রধান ফসল। ধান চাষাবাদের জন্য কম্বাইন হারভেস্টার, রিপার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ও পাওয়ার থ্রেসার যন্ত্রগুলো প্রকল্পে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং উক্ত যন্ত্রগুলো উন্নয়ন সহায়তা (ভর্তুকির) মাধ্যমে প্রদান করা হবে। ভর্তুকি সুবিধাসহ আধুনিক যন্ত্রনির্ভর কৃষি প্রান্তিক পর্যায়ে পরিপূর্ণভাবে পৌঁছানো সময় সাপেক্ষ হলেও এই প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকের কাক্সিক্ষত কৃষিযন্ত্র কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। কম্বাইন হারভেস্টার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, রিপার ও রিপার বাইন্ডার, সিডার, বেড প্লান্টার, মেইজ শেলার, ড্রায়ার, পাওয়ার স্প্রেয়ার, পাওয়ার উইডার, পটেটো ডিগার, আলুর চিপস্ তৈরির যন্ত্র ও ক্যারোট ওয়াসার এই ১৩ রকমের যন্ত্র বিতরণ করা হবে। এই ১৩ রকমের প্রাপ্ত বরাদ্দ যন্ত্র কৃষকের চাহিদার তুলনায় খুবই কম। এগুলো সহজেই বিতরণযোগ্য। কিছুদিন আগেও এ আধুনিক যন্ত্র সম্পর্কে সকলের ধারণা ছিল না, সংশয় ও ভীতি ছিল। এখন সেটা নেই বললেই চলে।
মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মহোদয়ের একান্ত চেষ্টায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২০০ কোটি টাকা উন্নয়ন সহায়তার আওতায় ১২৪০টি কম্বাইন হারভেস্টার এবং অত্র প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৭৮৪টি কম্বাইন হারভেস্টার কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয় এবং হাওর এলাকায় কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেও কৃষক ধান কেটে ফসল ঘরে তুলেন নিশ্চিন্তে এবং ধান কাটতে সক্ষম হয়েছে এবং কৃষকের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ফলে দেশব্যাপী ধান কাটার মেশিন কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্রটি ক্রমেই সুপরিচিত হয়ে উঠেছে।
তাছাড়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে ১টি জাতীয় কর্মশালা, ১৪টি আঞ্চলিক কর্মশালা, ভিডিও চিত্র, লিফলেট এর মাধ্যমে যন্ত্রগুলো কৃষকের মাঝে সুপরিচিত হয়ে উঠেছে। সমলয় চাষ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে সুপরিচিত করা হয়েছে। এই  কৃষি যন্ত্রগুলো মাঠ পর্যায়ে কাজ করা কৃষক যন্ত্র সম্পর্কে ধারণা ও এর সফলতা যা দেখে সব শ্রেণির কৃষক যন্ত্র ক্রয়ে অনুপ্রাণিত হচ্ছে এবং কৃষকদের যন্ত্র ক্রয়ে আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ৫ বছরে ১৫০০০টি কম্বাইন হারভেস্টার বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। হাওর ও উপকূলীয় এলাকা দুর্যোগ প্রবণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এবং ৭০% ভর্তুকি থাকায় যন্ত্র ক্রয়ে আগ্রহ অনেক বেশি। সমতল এলাকায় ক্ষুদ্রও প্রান্তিক চাষিগণ পরিবারের সকলের সহযোগিতায় নিজেই চাষাবাদ করেন। তাছাড়া খ- খ- জমি যন্ত্র চলাচলে সুবিধা না থাকা, সমজাতীয় ফসল চাষ না হওয়া, আর্থিক সঙ্গতিসহ ভৌতিক সুবিধাদি না থাকা ইত্যাদি কারণে সফলভাবে যন্ত্র ব্যবহার সম্ভব নয়। তাই সমতলে ৩৪ লাখ হে. বোরো জমির ২৫%-৩০% যন্ত্রে ধান কাটালে কমপক্ষে ১০,০০০টি কম্বাইন হারভেস্টার প্রয়োজন। সমতল এলাকায়  কৃষকের রিপারের চাহিদা অনেক বেশি। প্রকল্পের মাধ্যমে ৬০০০টি রিপার বিতরণ করা যাবে।
রাইস ট্রান্সপ্লান্টার
রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের মাধ্যমে চারা রোপণ প্রযুক্তিটি নতুন। এ প্রযুক্তিতে যান্ত্রিকীকরণ সময় সাপেক্ষ। বর্তমানে ধানের চারা উৎপাদন ও রোপণ কাজ শ্রমিক নির্ভর, ব্যয়সাধ্য ও সময়ভিত্তিক। রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রের মাধ্যমে এ কাজটি স্বল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে বাস্তবায়ন সম্ভব। চারা তৈরি ও রোপণে যান্ত্রিকীকরণের প্রযুক্তিটি কৃষকগণ ব্যবহারে এখনও অভ্যস্ত হতে পারেনি। প্রযুক্তি কৃষকদের কাছে পরিচিত করা ও জনপ্রিয় করার প্রক্রিয়াটি প্রকল্পের মাধ্যমে চলমান রয়েছে। সমন্বিত খামার নির্বাচন, কৃষক দল গঠন, একক শস্যবিন্যাস তৈরি, জমির যৌথ ব্যবহারকারী কৃষক/উদ্যোক্তা তৈরি ও যন্ত্র উপযোগী ধানের চারা উৎপাদন কৌশল এসব কার্যক্রম ও কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ ও জনপ্রিয় করা হচ্ছে। ৫০০টি ট্রেতে চারা তৈরির যন্ত্র ও ১০ লক্ষ ট্রে বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে যা কৃষক/কৃষক গ্রুপ/সমবায় সমিতি/যৌথ গ্রুপদের, যা রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ব্যবহারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ফলে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে।
টেকসই কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২৮ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ চালক ও মেকানিক, কৃষি প্রকৌশলীগণ, মেকানিক্যাল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারগণ এবং উপজেলার স্প্রেয়ার মেকানিকগণ মেকানিকের দায়িত্ব পালন করবেন। কৃষি যন্ত্রপাতির মান নির্ধারণের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ “কৃষি যন্ত্রপাতি ট্রেনিং অ্যান্ড টেস্টিং সেন্টার” তৈরি হচ্ছে ফলে কৃষক মানসম্পন্ন কৃষিযন্ত্র কিনতে পারবে। টেকসই কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নিশ্চিত হবে। ইধহমষধফবংয অপপৎবফরঃধঃরড়হ ইড়ধৎফ এর সহায়তায় ওঝঙ সার্টিফিকেটধারী প্রতিষ্ঠান তৈরি হবে। বিদেশে যন্ত্র রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হবে। ১৮টি অঞও তে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও আবাসিক সুবিধাসহ সকল কৃষিযন্ত্রের সমন্বয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ৩০০টি উপজেলাতে যন্ত্র মেরামত ও প্রশিক্ষণের সুবিধা সম্বলিত উপকরণ সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা হবে।
কৃষিযন্ত্রের সুবিধাসমূহ
ফসল সংগ্রহোত্তর স্তরে প্রায় ১৪ শতাংশ (৫০ লক্ষ টন) শস্য বিনষ্টের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব। ফসল উৎপাদন খরচ প্রায় ২৫-৫০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। পিক মৌসুমে ৪৪% শ্রমিক সংকট থাকে। যান্ত্রিকীকরণের ফলে এ সংকট থাকবে না। ৪১% কৃষি শ্রমিক কৃষিকাজ করে জিডিপিতে ১৫.৯৬% অবদান রয়েছে। যান্ত্রিকীকরণের ফলে অর্ধেক শ্রমিক জিডিপিতে আরো বেশি অবদান রাখবে। যান্ত্রিকীকরণের ফলে কৃষকের দ্বিগুণ আয় হবে। সল্প সময়ে এবং সুষ্ঠুভাবে অধিক চাষাবাদ করা সম্ভব। শিক্ষিত বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান এ পথ সৃষ্টি হবে। আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণে সহজতর হবে। শস্যের নিবিড়তা বাড়বে। মধ্যবর্তী আয়ের দেশে পদার্পণ করবে (২২২৭ ডলার)। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী স্থিতিহার বাস্তবায়ন (আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা-লক্ষ্য-যান্ত্রিকীকরণ) হবে। কৃষি ব্যবস্থাকে যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে টেকসই ও লাভজনক করতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের রোডম্যাপ সারণি দ্রষ্টব্য।
কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সম্ভাবনা 
বাংলাদেশে বর্তমানে ৭০টি ফাউন্ড্রি, ২ হাজার যন্ত্রপ্রস্তুত কারখানা ও ২০ হাজার যন্ত্র মেরামত কারখানা রয়েছে, যা দেশের খুচরা যন্ত্রাংশ ৬০% চাহিদা পূরণ করছে। বর্তমানে একটি পূর্ণাঙ্গ কৃষিযন্ত্র আমদানি করতে কোন প্রকার ট্যাক্স দিতে হচ্ছে না। -১%- পরে রিবেট পাচ্ছে। বর্তমান সরকার টেকসই কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, বাজারজাতাকরণ ও বিপণনের মাধ্যমে ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রায় ২৭ ধরনের যন্ত্র দেশীয়ভাবে তৈরি বা অ্যাসেম্বল করছে ফলে যন্ত্রের খরচ কমছে। বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বাজার প্রায় ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের। কৃষি শ্রমিকের হার কমে আসা ও ফসল উৎপাদনে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও অন্যান্য কারণে এ বাজারের আকার বাড়ছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে তরুণদের ব্যাপক আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সহজ করে দিচ্ছে। দেশীয় অনেক প্রতিষ্ঠান কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। এই প্রকল্প ছোট বড় সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানকে আগ্রহী করে তুলেছে। কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহে ৪৭টি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ প্রকাশ করেছে। 
সারণি : কৃষি যান্ত্রিকীকরণের রোডম্যাপ
কৃষি যান্ত্রিকীকরণে চ্যালেঞ্জ
দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কৃষি শ্রমিকের অভাব; কৃষিযন্ত্র ব্যবহার উপযোগী জমির সাইজ বা আকার ছোট জমি; বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়োত্তর সেবা নিম্নমানের হওয়া; ডিজাইন, উৎপাদন, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে দক্ষ জনশক্তির অভাব; ফসল উৎপাদনে যান্ত্রিকীকরণে যে অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়েছে, উৎপাদন পরবর্তী প্রক্রিয়াজাতকরণে পিছিয়ে থাকায় বিপুল পরিমাণ ফসল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। প্রস্তুতকারক পর্যায়ে অত্যাধুনিক মানের যন্ত্রপাতি না থাকা এবং মানসম্পন্ন উপকরণের অভাব; সময়মতো প্রয়োজনীয় স্প্রেয়ার পার্টস না পাওয়া; দক্ষ মেকানিক, অপারেটর ও ওয়ার্কশপ না থাকা; কৃষকদের যন্ত্র ক্রয়ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
কৃষিতে শ্রমিকের পরিবর্তে যান্ত্রিকীরণের ব্যবহার করা গেলে বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। সময় কম লাগবে, ক্রপিং প্যাটার্নে একটি নতুন শস্য অনায়াসেই অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হবে সুতরাং সময় বাঁচবে অনেকগুণে। কৃষিকে ব্যবসায়িকভাবে অধিকতর লাভজনক ও বাণিজ্যিকভাবে টেকসই করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কোনো বিকল্প নাই। তাই কবিতার ছন্দে বলতে চাই-

‘যন্ত্র কমাবে কৃষির কাজ
শ্রম কমবে বারো মাস
দক্ষ কৃষক সফল কৃষি
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।’

লেখক : মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন : ০২৫৫০২৮৩৬৯, ই-মেইল :dg@dae.gov.bd

বিস্তারিত
পাট আঁশের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আমাদের করণীয়

পাট আঁশের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আমাদের করণীয়
ড. এটিএম মোরশেদ আলম
পাট একটি দ্বি-বীজপত্রী আঁশ উৎপাদনকারী ফসল। এটি বাংলাদেশের অন্যতম এবং ঐতিহ্যবাহী অর্থকরী ফসল যা সোনালী আঁশ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের পাট আঁশের মান পৃথিবীর অন্যান্য পাট উৎপাদনকারী দেশগুলোর চেয়ে অনেক ভাল এবং আঁশ উৎপাদনের দিক থেকে ভারতের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। উল্লেখ্য যে, পাট রপ্তানির ক্ষেত্রে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। এসব দিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশের পাটের খ্যাতি এখনও বিশ্বজোড়া। বর্তমানে গোটা বিশ্বে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্ব বাজারে পাটের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে এদেশের পাটচাষি কৃষকরা বিগত কয়েক বছর ধরে পাটের ভালো দাম পাচ্ছে। সুতরাং, পরিবেশ বান্ধব পাটের উৎপাদনশীলতা ও আঁশের ফলন বৃদ্ধির জন্য আমাদের আরও মনোযোগী এবং সচেষ্ট হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
পাট আঁশের উৎপাদন 
বাংলাদেশে খরিফ মৌসুমে পাট ফসলের চাষাবাদ হয়। পাট উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার ফসল যা ২৪-৩৫ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা এবং ৯০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা সম্পন্ন এলাকায় ভালো জন্মে। নদ-নদী বিধৌত এদেশের পলি মাটি পাট চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। তাই বাংলাদেশের মাটিতে পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট মানের পাট আঁশ উৎপন্ন হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৭.০-৮.০ লাখ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়ে থাকে এবং আবাদকৃত জমি হতে প্রায় ৮০.০-৯০.০ লাখ বেল পাটের আঁশ পাওয়া যায়। বিগত ৫ বছর পাটের আবাদকৃত জমির পরিমাণ, মোট উৎপাদন এবং আঁশের ফলন সারণি-১ দ্রষ্টব্য।
সারণি-১ তে বর্ণিত তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বিগত ৫ বছরে বাংলাদেশে পাট আবাদের পরিমাণ গড়ে ৭.০ লাখ হেক্টর, আঁশের মোট উৎপাদন গড়ে ৭৮.৩১ লাখ বেল বা ১৪.২১ লাখ টন এবং পাট আঁশের গড় ফলন ১১.১৭ বেল/হেক্টর বা ২.০৩ টন/হেক্টর। সুতরাং পাটের আবাদি জমির পরিমাণ বাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে। যদি পাটের আবাদ বাড়ানো যায় তাহলে আঁশের মোট উৎপাদনও বেড়ে যাবে।
পাট আঁশের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য করণীয়
(১) উচ্চফলনশীল জাতের পাটের আবাদ সম্প্রসারণ করা : বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের বিগত ১৩ (২০০৮-২০২১) বছরের শাসনামলে বিজেআরআই কর্তৃক পাট ও পাট জাতীয় আঁশ ফসলের  মোট ১৩টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। তন্মধ্যে দেশি পাটের ৬টি, তোষা পাটের ৩টি, কেনাফের ২টি এবং মেস্তার ২টি জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। এই ১৩টি উচ্চফলনশীল জাতগুলোর মধ্যে আগাম কর্তনোপযোগী বিজেআরআই তোষা পাট-৮ (রবি-১) এবং লবণাক্তসহিষ্ণু বিজেআরআই দেশি          পাট-১০ সর্বশেষ উদ্ভাবিত জাত যেগুলোকে যথাক্রমে ২০১৯ এবং ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে সারাদেশে চাষাবাদের জন্য জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক জাত হিসেবে অবমুক্ত করা হয়। উল্লিখিত জাতগুলোর কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সারণি-২ এ উল্লেখ করা হলো।
বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত এসব উচ্চফলনশীল জাতের পাট ও সমজাতীয় আঁশ ফসলের চাষাবাদ কৃষক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(২) ভালো গুণগত মানসম্পন্ন পাটবীজ সময়মতো কৃষকদের কাছে সরবরাহ নিশ্চিত করা : বাংলাদেশে প্রতি বছর ৫.০০-৫.৫০ হাজার মেট্রিক টন পাট বীজের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে মাত্র ১০০০ মেট্রিক টন পাট বীজ দেশে উৎপাদিত হয়। বাকি বীজ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে আমদানির মাধ্যমে বা অবৈধ পথে বাংলাদেশ প্রবেশ করে। এসব বীজ বেশির ভাগ সময়ই নিম্নমানের হয়ে থাকে। কিন্তু বিতরণ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে আমাদের দেশের পাটচাষিরা বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাতের ভালো বীজ সময়মতো না পাওয়ায় তারা সুলভ মূল্যে সহজপ্রাপ্য ভারতীয় বীজের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং ভারতীয় জাতের বীজ ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাতের পাট বীজ বপন মৌসুমের পূর্বেই কৃষকদের কাছে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
(৩) সঠিক সময়ে বীজ বপন করা : সঠিক সময়ে বীজ বপনের উপর পাট ফসলের আঁশের ফলন অনেকাংশে নির্ভর করে। পাট বীজ বপনের সঠিক সময় চৈত্র-বৈশাখ মাস। এ সময়ে দিনের দৈর্ঘ্য ১২-১৩ ঘণ্টা, তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সে.-৩৫ ডিগ্রি সে. এবং বাতাসের আর্দ্রতা ৬০% থেকে ৯০% থাকে যা পাট গাছের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য উপযোগী। এ সময়ের আগে বা বেশি পরে বীজ বপন করলে পাট গাছের দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং গাছে অকালে ফুল আসে। ফলে আঁশের ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সঠিক সময়ে পাটের বীজ বপন করতে হবে যাতে পাট গাছ দৈহিক বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট সুযোগ পায়।
(৪) অপ্রচলিত এলাকায় পাটের আবাদ সম্প্রসারণ করা : পলিথিন ও প্লাস্টিক দ্রব্যাদি আবিষ্কারের ফলে একসময় বিশ্বব্যাপী পাট পণ্যের চাহিদা কমতে থাকে। ফলে বিশ্ব বাজারে পাটের দাম কমে যায়। এ পরিস্থিতিতে কৃষকরা পাটের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হতে থাকে এবং একপর্যায়ে তারা পাট চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তখন পাটের চাষাবাদ কমতে কমতে প্রান্তিক জমিতে (গধৎমরহধষ ষধহফ) নেমে আসে। কিন্তু, সম্প্রতি পরিবেশ সচেতনতার কারণে মানুষের মাঝে পরিবেশবান্ধব পাট পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। ফলে বিশ্ব বাজারে পাট পণ্যের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ফলশ্রুতিতে পাটের মূল্যও বেশ বেড়ে যায়। এরই প্রভাবে আমাদের দেশের পাটচাষিরা বিগত কয়েক বছর থেকে পাটের ভাল মূল্য পাচ্ছে এবং কৃষকদের মাঝে পাট চাষের আগ্রহ বেড়ে গেছে। এমতাবস্থায়, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমিতে চাষাবাদ উপযোগী লবণাক্তসহিষ্ণু পাট জাতের চাষাবাদ সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তাহলে একদিকে যেমন উপকূলীয় অঞ্চলের পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় আসবে তেমনি কৃষক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে এবং পাটের উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।
পাট পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক তন্তু। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সচেতনতার ফলে পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে ধরে রাখার জন্য পাটের আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য আরও অধিক উচ্চফলনশীল ও স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন পাটের জাত উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। অপ্রচলিত এলাকায় ও অনাবাদি জমিতে পাটের আবাদ সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করতঃ  বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাতের পাটবীজ বপন মৌসুমের পূর্বেই কৃষকদের কাছে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্য পূরণের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পাটবীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রণীত রোডম্যাপ অতি দ্রুততার সাথে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন বলে পাট সংশ্লিষ্টরা সকলে মনে করেন।


লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট। মোবাইল : ০১৭৪০৫৫৯১৫৫, ই-মেইল : সড়ৎংযবফনলৎর@মসধরষ.পড়স

বিস্তারিত
রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং সম্ভাবনা ও করণীয়

রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং সম্ভাবনা ও করণীয়
মো. জিয়াউল হক
ইংরেজি রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং (জধরহধিঃবৎ ঐধৎাবংঃরহম) বাক্যটির সাথে সবাই কমবেশি পরিচিত। বাংলায় যা বৃষ্টির পানি সংগ্রহকে বুঝায়। রেইনওয়াটার সুপেয় ও নিরাপদ পানি। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীতে সুপেয় পানির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। পৃথিবীর দুই ভাগ-(২৯%) স্থল এবং বাকি পাঁচ ভাগ (৭১%) জল। পৃথিবীতে মোট পানিসম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৪০০ মিলিয়ন কিউবিক কিলোমিটার (মিসিকেএম)। তন্মধ্যে   সুপেয়/মিঠা/স্বাদু পানি ২.৫% এবং অপেয়/লবণ পানি ৯৭.৫%। অবস্থানগত দিক হতে সুপেয় পানি  ভূগর্ভে-৩০.৮%,  ভূ-উপরে ০.৩% ও বরফ ও অন্যান্য ৬৮.৯% (সূত্র: টঝএঝ-টহরঃবফ ঝঃধঃবং এবড়ষড়মরপধষ ঝঁৎাবু)। আবার বাংলাদেশে মোট পানি সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৪০৪ বিলিয়ন কিউবিক মিটার (বিসিএম)। তন্মধ্যে ভূগর্ভে প্রায় ৫৪.০৪ বিসিএম ও ভূউপরে প্রায় ১৩৫০ বিসিএম (ঋঅঙ)। উক্ত ভূপরিস্থ পানি নদ-নদীতে ১০১০ বিসিএম ও বার্ষিক বৃষ্টিপাত হতে ৩৪০ বিসিএম কৃষি খাতে (কৃষি, পশু ও মৎস্য) ৮৭%, গৃহস্থালিতে ১০% ও শিল্পে ৩% পানি ব্যবহৃত হচ্ছে। 
তৃতীয় খ্রিষ্টপূর্বের কোন এক সময়ে ব্যালুচিস্তান (পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরানের অংশ) এবং ভারতের কুচ প্রদেশে কৃষক সম্প্রদায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে কৃষি ও গৃহস্থালি কাজ সম্পাদন করে। পানি সম্পদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশেষ করে কৃষি উৎপাদন ও সেচের ওপর চাপ বেড়েছে। বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ এবং পানি সংকট নিয়ন্ত্রণ একটি ক্রমবর্ধমান কঠিন সমস্যা হয়ে উঠেছে। বিশ্বের মোট জন সংখ্যার ৪০% চাহিদার চেয়ে কম পানি পাচ্ছে। 
বাংলাদেশে মৌসুমি জলবায়ু বিরাজমান। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে জীবকুল ও পরিবেশের ওপর। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা, গলে যাচ্ছে হাজার বছরের হিমবাহ, বৃদ্ধি পাচ্ছে সমুদ্রের পানির উচ্চতা এবং উপকূলীয় এলাকায় ভূগর্ভে ও ভূ-উপরে লবণ পানির অনুপ্রবেশ ঘটছে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক জীববৈচিত্র্য ও স্বাদু পানির উৎস। ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও অন্যান্য চাহিদা মিটাতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বাড়ছে। তাই ভূগর্ভস্থ অধিক পানি উত্তোলনের ফলে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। 
স্বাদু ও নিরাপদ পানির উৎস বৃষ্টিপাত। বাংলাদেশের গড় বৃষ্টিপাত ২০৩০ মিলিমিটার (মিমি) এবং গড় তাপমাত্রা ২৫.৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ অসম তাপমাত্রার কারণেই অসম ও অনিশ্চিত বৃষ্টিপাত পতিত হয়। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত বিশ্লেষণ করলে দেখা যে, ৮২% বৃষ্টিপাত মে-সেপ্টেম্বরে (জ্যৈষ্ঠ-আশ্বিন) পতিত হয়। ডধঃবৎ অরফ ইধহমষধফবংয এর এক সমীক্ষায় দেখা যায়, শহরের সচ্ছল পরিবার গোসলে ৪১% পানি, কমোড ফ্ল্যাশ ও কাপড়চোপড় পরিষ্কারে ২২% এবং বাকি পানি রান্নাবান্নাসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হয়। ঢাকা ওয়াসার এক পরিসংখ্যানে জানা যায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে পারিবারিক মোট চাহিদার প্রায় ১৫-২০% মেটানো সম্ভব। সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্যহীনতা, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং ঘনবসতিপূর্ণ জনসংখার বৃদ্ধির মতো চলমান সমস্যাসমূহ মেটাতে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ একটি পুনঃব্যবহার (জব-টংব ড়ভ ৎধরহধিঃবৎ) পদ্ধতি।
বৃষ্টির পানি সংগ্রহ (জধরহধিঃবৎ ঐধৎাবংঃরহম) একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে বৃষ্টির পানিকে গড়িয়ে যেতে না দিয়ে পুনরায় ব্যবহারের নিমিত্ত পানির জলাধার/ট্যাংকে সংরক্ষণ করা। সাধারণত টিনের চালা/সসার (ঝধঁপবৎ) বা ভবনের ছাদে বৃষ্টির পতিত পানি সংগ্রহ করে পাইপের মাধ্যমে ভূতল বা ভূপৃষ্ঠের জলাধার/ট্যাংকে জমা করতে হবে। উক্ত সংরক্ষিত বৃষ্টির পানি প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যায়। যেমন- খাবার পানি, গৃহস্থালি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনা বা ছাদে সেচ প্রদান। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উদ্দেশ্য- ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ, যাতে একটি বাস্তুতন্ত্র হতে বিশুদ্ধ পানির অপসারণ তার প্রাকৃতিক প্রতিস্থাপন হার অতিক্রম না করে; বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণ যেখানে মানুষের পানির ব্যবহার কমিয়ে অন্যান্য কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া। পানি সংরক্ষণ বলতে বর্তমান এবং ভবিষ্যতে মানুষের চাহিদা মেটাতে পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক সম্পদ বিশুদ্ধ পানির পরিমাণ বজায়ে রাখতে সব নীতি, কৌশল ও কার্যক্রমকে বুঝায়। বৃষ্টির পানি প্রধানত দুইভাবে সংরক্ষণ করা হয়-১) ভূপৃষ্ঠস্থ জমির আইলে, নদ-নদী, খাল-নালা, হাওর-বাঁওড়, বিল, পুকুর ও বাড়ির ছাদে; ২) ভূগর্ভে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে পানির সংরক্ষণ করা। 
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) প্রাথমিক পর্যায়ে দেশের দুর্গম উপকূলীয় লবণাক্ত (ভূগর্ভে ও ভূউপর) এলাকায় ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষক/নৃ-গোষ্ঠী, যাদের বাড়িতে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাবার পানির কোন সুযোগ (নলকূপ) নেই, সেসকল এলাকায় নির্দিষ্ট আকার ও ডিজাইনের (ঝরুব ্ উবংরমহ) বৃষ্টির পানি সংগ্রহ অবকাঠামো (জধরহধিঃবৎ যধৎাবংঃরহম ংঃৎঁপঃঁৎবং) নির্মাণ করে থাকে। এ ছাড়াও কৃষকের দো/চার চালা টিনের ঘরে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের সরঞ্জামাদি সংযোজনের মাধ্যমে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। উপকূলীয় দুর্গম এলাকার হতদরিদ্র মানুষগুলো সবসময় দৃষ্টি সীমার বাহিরে থাকে। তাদের পক্ষে নলকূপ স্থাপন করে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি পান করা সম্ভব হয় না। তাই স্থানীয়ভাবে পুকুর ও ডোবার পানি পান করার ফলে পানিবাহিত রোগ দেখা দেয়। অপর দিকে, অনেক জায়গায় ভূগর্ভে মিঠা/স্বাদু পানি পাওয়া যায় না। তাই উপজেলা সেচ কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ অবকাঠামো বাস্তবায়ন করা হয়। ইতোমধ্যে বিএডিসির মাধ্যমে বাস্তবায়িত বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট (ডই) ‘সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প (আইএপিপি)’ এর আওতায় এলাকায় মোট ১৬০২টি ও চলমান বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট (ওঋঅউ) ‘স্মলহোল্ডার্স এগ্রিকালচারাল কম্পিটিটিভনেস প্রজেক্ট (এসএসিপি)’ এর আওতায় মোট ৫০২টি অর্থাৎ সর্বমোট ২১০৪টি অবকাঠামোর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেছে। এতে দুর্গম উপকূলীয় এলাকার প্রায় ১০০০০ হাজার মানুষের পানীয় জলের সমস্যা দূরীভূত করা সম্ভব হয়েছে। বৃষ্টির পানির সংরক্ষণাগার নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
ক) অবকাঠামো নির্মাণ ও ক্যাচমেন্ট এরিয়া নির্ণয় : উন্মুক্ত স্থানের বাড়ির ছাদে/সসারে অথবা ধাতব বা প্লাস্টিকের তৈরি ২৩ ফুট ী ১৬ ফুট আকারের টিনের চালায় (প্রয়োজনীয় উচ্চতায় আধা পাকাঘর) পতিত বৃষ্টির পানিকে গড়িয়ে মাটিতে পড়া রোধ করে পিভিসি (চড়ষুারহুষ ঈযষড়ৎরফব-চঠঈ) পাইপের মাধ্যমে সংগ্রহ করে সংরক্ষণাগার/ট্যাংকে সংরক্ষণ করা হয়। যা পরবর্তিতে পানি পান, গৃহস্থালি ও বাড়ির আঙ্গিনায় সবজি চাষসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হয়। 
খ) পানি সংরক্ষণাগার/ট্যাংকে পরিবহন : ভবনের ছাদ/টিনের চালার কার্নিশ বরাবর অর্ধবৃত্তাকার পিভিসি পাইপের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে সংরক্ষণাগার/ট্যাংকে জমা করা। 
গ) পানি পরিষ্কারের নিমিত্ত ছাঁকানো : বৃষ্টিপাতের প্রথম ফ্লাশিংয়ের পর পানি ছাঁকনির ভেতর দিয়ে প্রবেশ করিয়ে সংরক্ষণ ট্যাংকে জমা করানো হয়। বৃষ্টির পানিকে খাবারযোগ্য করার নিমিত্ত  নুড়ি, বালু ও নাইলনের নেট দিয়ে ছাঁকনি তৈরি করে সংরক্ষণাগার/ট্যাংকের মুখ স্থাপনে পলি, ধুলা, পাতা এবং জৈব পদার্থ প্রবেশরোধ করা।
ঘ) সংরক্ষণাগার/ট্যাংক স্থাপন ও পানি সংরক্ষণ : প্রতিটি অবকাঠামোর ক্যাচম্যান্ট এরিয়ার ওপরভিত্তি করে সংরক্ষণাগার/ট্যাংকের ভলিউম নির্ণয় করা হয়। ভবনের নিচে আরসিসি অবকাঠামো বা প্লাস্টিক ট্যাংক ব্যবহার করা যেতে পারে। বিএডিসির তৈরিকৃত অবকাঠামোতে ২০০০ লিটার ট্যাংক স্থাপন করা হয়।
বৃৃষ্টির পানি সংগ্রহ চ্যালেঞ্জগুলো : উপকূলীয় দুর্গম এলাকায় শিক্ষার অভাব; স্কিম/স্থান নির্বাচনে স্থানীয় প্রভাবশালীদের আধিপত্য; ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, ভূমিহীনদের অবকাঠামো নির্মাণের জায়গার সংকট; দুর্গম এলাকা সঠিক সুপারভিশন ও মনিটরিংয়ের সমস্যা; নির্মাণ পরবর্তী মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনায় অসচেতনতা; স্থানীয়ভাবে অথবা ইলেকট্রনিক ও প্রিন্টমিডিয়া প্রচার-প্রচারণার অভাব।
টিনের চালা/সসার/ভবনের ছাদে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে সুবিধাসমূহ : পানিসম্পদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সহায়তা করা; ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ও পাম্পিং খরচ হ্রাসকরণ; উচ্চমানের খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ পানি সরবরাহকরণ;  পার্বত্য অঞ্চলের বৃষ্টির পানি সংগ্রহ অত্যন্ত ফলপ্রসূ; মাটির ক্ষয়রোধ হ্রাসকরণ এবং জলাবদ্ধতা দূরীকরণ; কাপড় কাচায় ডিটারজেন্ট কম লাগে এবং ফেনা বেশি হয়; ভূপৃষ্ঠের গড়িয়ে পড়া (জঁহড়ভভ) পানি সংগ্রহের তুলনায় কম ব্যয়বহুল; বৃষ্টির পানি সংগ্রহের পদ্ধতি সহজ যা ব্যক্তিপর্যায়ে গ্রহণ করা যেতে পারে; বৃষ্টির পানি সংগ্রহ প্রক্রিয়াটি নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা সহজ; উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ত হ্রাস, ভারসাম্য রক্ষা এবং পানীয় জলের অভাব মিটানো; দ্বীপাঞ্চলে স্বাদু পানির দুষ্প্রাপ্যতা দূরীকরণের এবং গৃহস্থালিসহ কৃষিতে ব্যবহার বৃদ্ধিকরণ।
বৃষ্টির পানি সংগ্রহে সতর্কতা 
ক) বৃষ্টির পানি সংগ্রহের স্থান নির্বাচন: বৃষ্টির পানি সংগৃহীত স্থান বা নিকটবর্তী এলাকায় কোন শিল্প কারখানা হতে বায়ুম-লে অনেক সময় রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত হতে পারে। যা বৃষ্টির সময় পানির সাথে মিশে বৃষ্টির পানির গুণাগুণ নষ্ট বা এসিড বৃষ্টি হতে পারে। 
খ) বৃষ্টির পানি সংগ্রহের সময়: বৃষ্টির শুরুতে পানি দূষিত থাকতে পারে। কারণ সব অঞ্চলেই বায়ুম-লে কমবেশি ধূলিকণা, রোগজীবাণু ও দূষিত পদার্থ কমবেশি থাকতে পারে। তাই উচিত হবে বৃষ্টি শুরু কমপক্ষে ১০-১৫ মিনিট পর পানি সংগ্রহ করা।
গ) বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি : অনেক সময় বৃষ্টির পানি যে সকল চালা/ছাদে সংগ্রহ করা হয় এবং পরিবাহীর মাধ্যমে সংরক্ষণাগারে জমা হয় সেসব স্থানে পশুপাখির বিষ্ঠা/গাছের লতাপাতা ও অন্যান্য ময়লা আর্বজনা থাকতে পারে। তাই সরঞ্জামাদি স্বাস্থ্যসম্মত ও নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে।
পৃথিবীর পানিসম্পদের মধ্যে বৃষ্টির পানি সবচেয়ে বিশুদ্ধ, নিরাপদ এবং বিপদমুক্ত। এ পানিতে রাসায়নিক পদার্থ ও লবণ নেই, আছে ভিটামিন। বাংলাদেশে মৌসুমি জলবায়ুর কারণে প্রায় ৫ (পাঁচ) মাসের অধিককাল সারাদেশে বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। শুধু জীব ও পরিবেশ নয়, পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষায় পানি একটি অমূল্য সম্পদ। এ পানিসম্পদকে সঠিক ও যথাযথ ব্যবহার প্রতিটি নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। দেশের প্রতিটি অঙ্গকে বর্তমান সরকারের ভিশন-২০৪১ ও বাংলাদেশ বদ্বীপ (ইধহমষধফবংয উবষঃধ চষধহ-২১০০) পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যেতে হবে। তবেই দেশ সোনার বাংলায় পরিণত হবে বলে আশা করি। 
 
লেখক : সদস্য পরিচালক (ক্ষুদ্র সেচ), বিএডিসি। মোবাইল : ০১৭১৮৭৮১৯৭৯, ই-মেইল : পবসরনধফপ@মসধরষ.পড়স

বিস্তারিত
বৈচিত্র্যময় আমের দেশ বাংলাদেশ, স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় দরকার সঠিক পদক্ষেপ

বৈচিত্র্যময় আমের দেশ বাংলাদেশ, স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় দরকার সঠিক পদক্ষেপ
ড. মোহাম্মদ রেজওয়ান মোল্লা১ 
ইফতেখার আহমেদ২
আম হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন চাষাবাদকৃত একটি ফল। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী আমের উৎপত্তিস্থল ও বিস্তার নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী ব্যভিলভ (১৯২৬) এর মতে আমের উৎপত্তিস্থল প্রাচীন ইন্দো-বার্মা অঞ্চল। এই অঞ্চলের অন্তর্গত হলো প্রাচীন হিমালয়ের পাদদেশ বিস্তৃত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া অঞ্চলসমূহ। যার মধ্যে রয়েছে প্রাচীন ভারতের পূর্বাংশ, বার্মা ও আন্দামান দীপপুঞ্জ যা বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চল হিসাবে বিবেচিত। আরও পূর্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, খ্রীষ্টপূর্ব ৪,০০০ বছর হতে এই সকল অঞ্চলের অন্তর্গত আসামের পাহাড়ি অঞ্চল ও আশপাশের এলাকায় আমের বন্য প্রজাতি জন্মাতে দেখা যায়। 
আমের মূল উৎপত্তিস্থল ইন্দো-বার্মা অঞ্চলের অন্তর্গত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান। সে আলোকে বাংলাদেশকেও আমের উৎপত্তিস্থল (সেন্টার অব অরিজিন) বিবেচনা করা যায়। মুখার্জি (১৯৯৭) এর মত অনুযায়ী টেক্সোনোমি ও মলিকুলার তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে উত্তর পশ্চিম মায়ানমার, বাংলাদেশ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতকে আমের বিবর্তনের মূল স্থান হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূবর্ অংশ মিয়ানমার, (প্রাচীনবার্মা) ও ভারতের পূর্বাঅঞ্চলের সহিত সংযুক্ত হওয়ায় এই অঞ্চলে আমের একটি বন্য প্রজাতি (উরীআম/খুদিআম) পাওয়া যায়। কোন ফসলের উৎপত্তিস্থল (অরিজিন) নির্ধারণের ক্ষেত্রে বন্য প্রজাতীয় প্রাপ্যতা/উপস্থিতি অন্যতম প্রধান মানদ- হিসাবে বিবেচনা করা হয়। 
রবিশংকর ও অন্যান্য (২০০০) ভারতকে আমের উৎপত্তিস্থল অরিজিন বিবেচনার ক্ষেত্রে আমের বৈচিত্র্যের প্রাচুর্যতাকেও মানদ- হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশেও উল্লেখযোগ্যভাবে আমের বৈচিত্র্য রয়েছে। 
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (২০১৭) এর রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫২টি বিভিন্ন জাতের আমের মধ্যে প্রধানত ৩১টি সমাকৃত জাতের বাণিজ্যিক চাষাবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের তথ্য মতে প্রায় ৮টি বহুল সমাদৃত ভৌগোলিক নির্দেশক আমের জাত রয়েছে। এগুলো হচ্ছে ফজলি, ল্যাংরা, গোপালভোগ, খিরসাপাত, আশ্বিনা, লক্ষণভোগ, সূর্যপুরী ও হাড়িভাঙ্গা। এ সকল জাতে বিভিন্ন জিনগত বৈশিষ্ট্যের মধ্য হতে স্বাদ, গন্ধ ও অন্যান্য মানগত বৈশিষ্ট্য ঐ নির্দিষ্ট এলাকার আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপর নিবিড়ভাবে নির্ভরশীল এবং এই জাতগুলোর ভৌগোলিক পরিবর্তনের কারণে এদের উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোও পরবর্তিত হয়ে যায়। 
বাংলাদেশের এই সকল ভৌগোলিক নির্দেশক ফসলের অবস্থান, চাষাবাদের ইতিহাস, ফসলগুলোর বিস্তারিত জিনগত বৈশিষ্ট্যায়নের (অঙ্গসংস্থানগত ও মলিকুলার) তথ্যের অপ্রতুলতার কারণে অন্যদেশ কর্তৃক বায়োপাইরেসির মাধ্যমে এই সকল ফসলের স্বত্বাধিকার বা প্যাটেন্ট লাভের সুযোগ রয়েছে। 
ইতোমধ্যে জামদানি, ফজলি আম, রংপুরে লাইম কে অন্য দেশ কর্তৃক ঐ দেশের সম্পদ হিসাবে স্বত্বাধিকার বা প্যাটেন্ট নেয়া হয়েছে। এই ধরনের বায়োপাইরেসি রোধকল্পে বাংলাদেশ সরকার দেরিতে হলেও আমাদের দেশীয় বিভিন্ন ফসলসহ অন্যান্য সম্পদের প্যাটেন্ট প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় খিরসাপাত আমকে ডিপার্টমেন্ট অব প্যাটেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড টেডমার্ক (ডিপিডিটি) কর্তৃক ভৌগোলিক নির্দেশক জাত হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে যা ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ঐ ফসলের ঐ জাতের সার্বভৌম অধিকার (ঝড়াবৎবরমহ ৎরমযঃ) প্রতিষ্ঠা করবে। 
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের এনএটিপি ফেজ-১ প্রকল্পের অর্থায়নে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) কর্তৃক বিভিন্ন ফসলের অবমুক্ত জাত এবং ওই সকল ফসলের ভৌগোলিক নির্দেশক জাতসমূহের অবস্থান, চাষাবাদের ইতিহাস, তাদের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য (অঙ্গসংস্থানগত ও মলিকুলার) সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরির লক্ষ্যে ঈযধৎধপঃবৎরুধঃরড়হ ড়ভ রসঢ়ড়ৎঃধহঃ ঢ়ষধহঃ মবহবঃরপ ৎবংড়ঁৎপবং শিরোনামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় বারি কর্তৃক উদ্ভাবিত নয়টি আমের জাতসহ নয়টি বহুল সমাদৃত ভৌগোলিক নির্দেশক জাতের অবস্থান, চাষাবাদের ইতিহাস ও বিস্তারিত বৈশিষ্ট্যায়ন (অঙ্গসংস্থানগত ও মলিকুলার) সম্পর্কিত গবেষণা কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। এই সকল তথ্য সম্বলিত একটি নিবন্ধ আন্তর্জাতিক সাময়িকী জার্নাল অব হর্টিকালচার অ্যান্ড ফরেস্ট্রিতে প্রকাশিত হয়েছে। নিবন্ধনটির তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় প্রতিটি জাতের অবস্থান ও চাষাবাদের ইতিহাসের পাশাপাশি আমের ১০২টি অঙ্গসংস্থানিক বৈশিষ্ট্যের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে যার মধ্যে ১৫টি গাছের, ২০টি পাতার, ২২ ফুলের, ৩৩টি ফলের, ১০টি স্টোন এবং ৫টি বীজ সংক্রান্ত। এ ছাড়াও ২৫টি মাইক্রোস্যাটেলাইট মার্কারের মাধ্যমে ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিটি জাতের স্বতন্ত্র অঙ্গসংস্থানিক ও ডিএনএ প্রোফাইল চিহ্নিত করা হয়েছে যা ঐ জাতের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিগণিত হয়। এ ছাড়াও ঐ সকল জাতগুলো জন্মস্থান সম্পর্কিত ইতিহাস উল্লেখ করা হয়েছে এবং তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সব চেয়ে পুরাতন গাছকে বিবেচনা করা হয়। ঐ এলাকার বয়োবৃদ্ধ লোকজনের নিকট থেকে জাতটির চাষাবাদের ইতিহাস সংগ্রহ করা হয়। এ ক্ষেত্রে সূর্যপুরী আমের ইতিহাস সংগ্রহের উদাহরণ উল্লেখ করা যায়। 
সূর্যপুরী বাংলাদেশের আমের একটি উল্লেখযোগ্য ভৌগোলিক নির্দেশক জাত। এই জাতের উৎপত্তিস্থল ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার হরিণমারি ইউনিয়নের অন্তর্গত হরিণমারি নয়াপাড়া গ্রামে। এই গ্রামের সব চেয়ে পুরানো গাছটির বয়স ২০০  বছর এবং এর বিস্তৃতি ২ একর জায়গার উপর। ধারণা করা হয় এই গাছ  থেকে আশেপাশের এলাকায় এই জাতের বিস্তারলাভ করেছে। এইভাবে প্রতিটি জাতে উৎপত্তিস্থল ও চাষাবাদের ইতিহাস সংক্রান্ত তথ্য এই নিবন্ধটিতে সন্নিবেশিত হয়েছে। যা ভবিষ্যতে এ সকল জাতের উপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণক হিসাবে বিবেচিত হবে। 
সুতরাং এই নিবন্ধটি বাংলাদেশের ৯টি অবমুক্তজাত ও ৯টি ভৌগোলিক নির্দেশক জাত হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এ ছাড়াও আরও যে সকল সমাদৃত ও নিবন্ধিত জাত রয়েছে তাদের ক্ষেত্রেও এই ধরনের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সম্বলিত প্রকাশনা প্রয়োজন, যা ভবিষ্যতে ঐ সকল জাতসমূহের উপর বাংলাদেশের জাত হিসাবে স্বত্বাধিকার লাভের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণক হিসাবে ভূমিকা পালন করতে পারে। 
আম হচ্ছে একটি খুবই সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও দৃষ্টি নন্দন জনপ্রিয় ফল। সমগ্র পৃথিবী জুড়েই এর চাষাবাদ হয় তবে ট্রপিকাল ও সাবট্রপিকাল অঞ্চলের চাষাবাদ বেশি হয়। এই সকল অঞ্চলেই বিভিন্ন ধরনের আমের চাষাবাদ দেখা যায় যা বিভিন্ন শ্রেণীর ভোক্তাদের চাহিদা পূরণে ফ্রেশ ফল হিসাবে অথবা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে মানুষের আর্থিক সঙ্গতি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মানুষ মৌলিক খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি অধিক পুষ্টিকর ও অন্যান্য গুণাগুণ সম্পন্ন খাদ্য গ্রহণের দিকে ঝুঁকছে। এর কারণে দেশীয় জাতের পাশাপাশি কৃষি বিজ্ঞানীরা পরিবেশের সহিত খাপখাওয়ানো সম্পন্ন ও মানুষের বিভিন্ন চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন জাত উদ্ভাবন করছেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত আমের ১৪টি জাত উদ্ভাবন করেছে। এই জাতগুলো বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী হওয়ায় সমগ্রদেশে এর চাষাবাদ হচ্ছে ও বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। পূর্বে এক সময় আমের উৎপাদন বৃহত্তর রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হলেও এখন দেশের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলেও আমের ব্যাপক চাষাবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে বারি আম-৩ এর চাষাবাদ সারাদেশ জুড়ে একটি বিপ্লব তৈরি করেছে। এ ছাড়াও আমের দীর্ঘ সময় চাহিদা সহজলভ্যতা বজায় রাখতে আমের নাবি জাত বারি আম-৪ উদ্ভাবন করেছে। মানুষের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের স্বাদের চাহিদার উপর ভিত্তি করে কাঁচামিঠা বারি আম-৯, ও দৃষ্টিনন্দন বারি আম-৭ উদ্ভাবন করেছে এবং সর্বশেষে সারা বছরব্যাপী আমের প্রাপ্যতা বজায় রাখার জন্য বারি আম-১১ উদ্ভাবন করেছে। 
বর্তমানে বাংলাদেশের আম পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও রপ্তানি হচ্ছে। ভবিষ্যতে বাণিজ্যিকভাবে আমের রপ্তানি আরও প্রসারিত হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে যদি বাংলাদেশের তার নিজস্ব জাতের উপর স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠার পূর্বে অন্যদেশ কর্তৃক ঐ জাতের উপর তার স্বত্বাধিকার নিশ্চিত করে তবে সেক্ষেত্রে নিবন্ধনকারী দেশকে বাণিজ্যিক সুবিধা লাভের অংশীদারী দিতে হবে। এতে দেশ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে বঞ্চিত হবে। তাই বাংলাদেশে আমের জনপ্রিয় দেশীয় জাতগুলো ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার দেশের স্থানীয় ও নিবন্ধিত জাতের উপর স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় অতিদ্রুত কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে আমরা আশাবাদী। 

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা,উদ্ভিদ কৌলিসম্পদ কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭১২৫৭০৪৪৩, ই-মেইল : ৎবুধিহনঃ@মসধরষ.পড়স

বিস্তারিত
পাহাড়ি কৃষিকে লাভজনক করার উপায়

পাহাড়ি কৃষিকে লাভজনক করার উপায়
ড. মো: জামাল উদ্দিন
কৃষির উন্নয়ন মানে অর্থনীতির উন্নয়ন। বর্তমান সময়ে    কৃষিভিত্তিক ব্যবসা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি হচ্ছে। কৃষক লাভজনক কৃষিকে খুঁজছে। লাভজনক কৃষি বলতে এমন একটি কৃষি ব্যবস্থাকে বুঝায় যা কৃষক সহজলভ্য টেকসই ও পরিবেশবান্ধব  প্রয়োজনীয় উপকরণ ব্যবহার করে মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করে তা খুচরা বা পাইকারি বাজারে এমনকি রপ্তানি করে অধিক মুনাফা অর্জন করতে পারে। কৃষি ব্যবস্থাপনার মূল নিয়ামক হচ্ছে কৃষির সাথে সম্পর্কযুক্ত কৃষি পণ্য উৎপাদন, প্রযুক্তির প্রয়োগ, বণ্টন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ ও ভোগ। আর এসব কিছুর সাথে অর্থনীতির একটা সম্পর্ক রয়েছে। তবে লাভজনক কৃষির প্রধান নিয়ামক সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা। এক সময় মানুষ কৃষি বলতে জমি চাষ করে ফসল উৎপাদনকে বুঝাতো। এখন কৃষি লাভজনক হচ্ছে কি না সেদিকে মানুষের খেয়াল বেশি। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল একটি কৃষি বৈচিত্র্যময় এলাকা যা দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এবং রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা নিয়ে গঠিত। কৃষির উন্নয়নের দিক থেকে অত্র অঞ্চলের গুরুত্ব অপরিসীম। ইহা দেশের এক দশমাংশ এলাকাজুড়ে অবস্থিত। যার আয়তন ১৩২৯৫ বর্গকিলোমিটার, জনসংখ্যা ১.৭ মিলিয়ন (প্রায়) এবং বসতবাড়ির সংখ্যা প্রায় ৩৪২৩৯০টি। 
পাহাড়ি এলাকায় মোট ফসলি জমি ২০১৩৬৩ হেক্টর এবং নিট চাষাধীন জমি ১২৯৯২২ হেক্টর। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (২০১৯) মতে পাহাড়ের বিভিন্ন ঢাল অনুসারে মোট ভূমি রয়েছে ১৩,২৪,৪২৮ হেক্টর। মোট অস্থায়ী পতিত জমি ২২৬৯৭ হেক্টর, স্থায়ী পতিত জমি ৮৫৬০৬ হেক্টর এবং শস্য  নিবিড়তা শতকরা ১৫৫ ভাগ। শস্যনিবিড়তা বৃদ্ধির সাথে লাভজনক কৃষির একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। শস্য    বহুমুখীকরণের মাধ্যমে শস্যনিবিড়তা বাড়ানো যেতে পারে। তাছাড়া পাহাড়ি অঞ্চলে শস্যের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো বড় চ্যালেঞ্জ। 
পাহাড়ি কৃষি সমতল কৃষি থেকে ভিন্ন। এখানে ভ্যালি এগ্রিকালচার এবং আপল্যান্ড তথা উচ্চভূমি কৃষিই পার্বত্য অঞ্চলের কৃষিকে প্রতিনিধিত্ব করে। ভ্যালি এগ্রিকালচার সমতল ভূমির কৃষির মতোই। আপল্যান্ড এগ্রিকালচার যেমন জুম চাষ এবং উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল চাষাবাদকে বুঝায়। ভ্যালি এগ্রিকালচারকে লাভজনক করতে হলে বিদ্যমান অলাভজনক শস্যপর্যায়ের পরিবর্তন আনয়ন জরুরি। বিশেষ করে তামাক চাষের পরিবর্তে লাভজনক শস্যপর্যায় প্রবর্তন করা যেতে পারে। তার জন্য তামাকের মতোই বিপণন সুবিধা বাড়াতে হবে। এক ফসলি জমিকে দু’ফসলি এবং দু’ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করার প্রচেষ্টা চালানো যেতে পারে। চার ফসলভিত্তিক শস্যপর্যায় প্রবর্তনের উপর গবেষণা প্রয়োজন। উচ্চমূল্য ফসলের আবাদ ব্যাপক আকারে সম্প্রসারণ করা জরুরি। পাহাড়ি এলাকা উপযোগী কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন সময়ের দাবি। কৃষকদের হাতে-কলমে এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারের উপর প্রশিক্ষণ প্রদানসহ ভর্তুকিমূল্যে এসব যন্ত্রপাতি কৃষকদের সরবরাহ করা যেতে পারে। ভ্যালি এগ্রিকালচারে নার্সারি একটি কম পুঁজিতে অধিক লাভজনক ব্যবসা। বছরজুড়ে এ ব্যবসা চালান যায়। এতে ব্যবসা এবং পরিবেশ দুটোই রক্ষা হয়। 
উচ্চ ভূমি কৃষিতে জুম চাষের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো অতীব জরুরি। জুমের প্রধান ফসল স্থানীয় প্রজাতির বিভিন্ন ধান, মারফা, ছোট আকারের জুম মিষ্টিকুমড়া, কাউন, তিলসহ আরও অনেক ফসল রয়েছে। এসব ফসলকে গবেষণার মূল ধারায় নিয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর যেতে পারে। যদিও কিছু কিছু ফসলের উপর বারি ইতোমধ্যে গবেষণা করছে। তবে এর ফলাফল দ্রুত কৃষকের মাঝে সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। জুমের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হলে জুমের সার ব্যবস্থাপনা ও বালাই দমনের উপর সমন্বিত পদ্ধতি উদ্ভাবন অপরিহার্য। আপল্যান্ড এগ্রিকালচারে মিশ্র ফলজ বাগান ইতোমধ্যে পাহাড়ি এলাকায় নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে। উৎপাদন ব্যবস্থাকে অধিক লাভজনক করতে হলে কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের কোন বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে অর্গানিক ফার্মিংয়ের সুযোগ রয়েছে। যোগাযোগব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে এলাকা উপযোগী এবং চাহিদানির্ভর পণ্য উৎপাদন করতে পারলে লাভজনক কৃষিতে রূপান্তর করা সহজতর হবে। যেমন : যেখানে যোগাযোগব্যবস্থা ভালো সেখানে অপেক্ষাকৃত বেশি পচনশীল কৃষিপণ্য উৎপাদন করা; যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ সেখানে অপেক্ষাকৃত কম পচনশীল কৃষি পণ্য উৎপাদন করা, আর যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব খারাপ সেখানে অপচনশীল বা মসলাজাতীয় বা ঔষধি গাছের বা বনজ গাছের বাগান করা যেতে পারে। 
কৃষি প্রযুক্তি প্রসারের কারণে পাহাড়ি অঞ্চলে দিন দিন কৃষি উৎপাদন বেড়ে চলেছে। কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনা সনাতনী পদ্ধতিতে চলে আসছে। বেশির ভাগ কৃষক উৎপাদিত পণ্য নিজেরাই বিছিন্নভাবে একাকী বাজারে বিক্রি করে। ফলে  দরকষাকষির ক্ষমতা হারায় এবং পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। দুর্গম উৎপাদন স্থল, দুর্বল কৃষক সংগঠন বা সংগঠন না থাকা, বৃহৎ বাজারে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের প্রবেশাধিকার সীমিত, পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে একই পণ্যের উপর বিভিন্ন জায়গায় চাঁদা প্রদান, পণ্যের দরকষাকষিতে মধ্যস্বত্বভোগী সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা, শস্য সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার জ্ঞানের স্বল্পতা, সংরক্ষণাগারের চরম অভাব, কালেকশন সেন্টার বা প্যাক-হাউজ না থাকা, পণ্যের মূল্য সংযোজন কার্যক্রম সীমিত, চাহিদা মোতাবেক পণ্য সরবরাহ নিরবছিন্ন না হওয়া, মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদনে স্বল্পতা এবং কৃষক-ব্যবসায়ী ও প্রাতিষ্ঠানিক সেবাদাতাদের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের অভাব লাভজনক কৃষির প্রধান অন্তরায়। কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেলে, সঠিক সময়ে এবং স্বল্পখরচে পণ্য বিক্রি করতে না পারলে কৃষি লাভজনক হবে না। তবে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের ওপর কাজ করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলতাও দেখা যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে উৎপাদনকেন্দ্রিক প্রকল্পের পাশাপাশি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ টেকসই আধুনিক বাজার ব্যবস্থাপনার উপর সমন্বিত মেগা প্রকল্প গ্রহণ জরুরি। 
কৃষি লাভজনক হবে কি না তা আবার খামারের আয়তন ও এর ব্যবস্থাপনার উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। কৃষি উৎপাদনের সহিত জড়িত সকল কৃষকের খামারের আয়তন এক রকম নয়। একটি আদর্শ খামারের আয়তনও বিভিন্ন হতে পারে। তবে বাংলাদেশের জন্য ৩-৪ একর জমি একটি আদর্শ খামার হিসাবে বিবেচিত। একটি আদর্শ কৃষি খামার এমন হতে হবে যেখানে উপকরণের সুষ্ঠু প্রয়োগের ফলে একক আয়তনে সর্বাধিক ফলন পাওয়া যাবে। উৎপাদিত আয় হতে কৃষক ও তার পরিবার সন্তোষজনকভাবে জীবিকা নির্বাহ করে লাভজনক ব্যবসায় রূপান্তর করতে পারে। খামারের আকার ও আয়তনের দিক থেকে দেখলে খামারকে দু’ভাবে দেখতে পারি যেমন : পারিবারিক খামার যা থেকে উৎপাদিত পণ্য নিজে এবং তার পরিবার মোটামুটি সন্তোষজনকভাবে জীবন নির্বাহ করতে পারে। এতে মূলধন বিনিয়োগ কম হয় এবং ঝুঁকি সম্ভাবনা থাকে না; বাণিজ্যিক খামার যার মূল লক্ষ্য হলো মুনাফা অর্জন করা। পার্বত্য অঞ্চলে এখন অনেক বাণিজ্যিক খামার গড়ে উঠেছে। এদেরকে রপ্তানিমুখী ও টেকসই লাভজনক করতে হলে অত্র অঞ্চলে একটি বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি।
কৃষি বা কৃষি খামারকে লাভজনক উপায়ে পরিচালিত করতে হলে কিছু পরিচালন নীতিমালা মেনে চলা অত্যাবশ্যক। যেমন : ক্রমহ্রাসমান আয় নীতি যা উৎপাদনের সকল উপাদানের পরিমাণ অপরিবর্তিত রেখে শুধু উপকরণের পরিমাণ বাড়ানো হলে প্রথমে উপকরণ বৃদ্ধির সাথে সাথে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট বৃদ্ধির পর প্রথমে প্রান্তিক উৎপাদন এবং পরে গড় উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকবে, এটাই ক্রমহ্রাসমান আয় নীতি। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে ফল বাগানে বা জমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার। একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা গেলেও পরে আর ফলন বৃদ্ধি হয় না। ফলে অলাভজনক হতে থাকে; ব্যয়নীতি যা খামারের উৎপাদনের লাভ-লোকসান নির্ধারণে এ নীতি ব্যবহার করা হয়। এ নীতি অনুসারে খামারে আরো মূলধন বিনিয়োগ করা যাবে যতক্ষণ পর্যন্ত মোট উৎপাদন খরচ মোট উৎপাদন আয়ের চেয়ে কম হয়। এর জন্য পরিবর্তনশীল খরচসহ যাবতীয় খরচের হিসাব রাখতে হবে; প্রতিস্থাপন নীতি যা দ্বারা কোন ফসল লাভজনক কিনা তা নির্ধারণ করা যায়। এ নীতি ব্যবহার করে কম লাভজনক ফসলের উৎপাদন বন্ধ রেখে অন্য লাভজনক ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। এ নীতি ২টি বিষয়ের উপর নির্ভর করে (ক) প্রতিস্থাপন অনুপাত যা প্রতিস্থাপিত ফসলের ফলনকে চাষকৃত ফসলের ফলন দিয়ে ভাগ করে ফলাফল পাওয়া যায়; (খ) মূল্য অনুপাত যা চাষকৃত ফসলের একক পরিমাণের মূল্যকে প্রতিস্থাপিত ফসলের একক পরিমাণের মূল্য দিয়ে ভাগ করতে হয়। এর ভাগফল যদি প্রতিস্থাপন অনুপাত মূল্য অনুপাতের চেয়ে ছোট হয় তবে লাভজনক। তখন উক্ত ফসলকে প্রতিস্থাপন করতে হবে। আর প্রতিস্থাপন অনুপাত মূল্য অনুপাতের চেয়ে বড় হয় তখন ফসল প্রতিস্থাপন করা যাবে না।
পাহাড়ি কৃষিকে অধিক উৎপাদনশীল ও লাভজনক করতে হলে যা খেয়াল রাখা দরকার তা হলো: উপকরণের উৎস ও সহজ প্রাপ্যতা নিশ্চিত হওয়া, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করা যেমন আম গাছে কীটনাশক প্রয়োগের পরিবর্তে ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা, উপকরণ যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা, পাহাড়ি এলাকার উপযোগী কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন এবং এর ব্যবহার বাড়ানো, সঠিক সময়ে পরিকল্পনামাফিক উৎপাদন কার্য পরিচালনা করা, আধুনিক প্রযুক্তি অনুসন্ধান ও গ্রহণের মানসিকতা তৈরি করা, শ্রমিকের সহজ প্রাপ্যতা ও জোগান নিশ্চিত করা, পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের সুযোগ অনুসন্ধান করা, উপযুক্ত বাজার খোঁজা, নিজের উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগা,  ই-মার্কেটিংয়ের পরিকল্পনা করা, সঠিক ব্যবসা পরিকল্পনা ঠিক করা, ব্যবসায়ী এবং সেবা প্রদানকারী সংস্থার সাথে নিবিড় যোগাযোগ বজায় রাখা, ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা ও সাহস সঞ্চয় করা, সর্বোপরি মানসম্মত পণ্য বাজারজাত করে ভোক্তা সন্তুষ্টি বিধান করতে পারলেই কেবল লাভজনক কৃষি আলোর মুখ দেখবে। আর এর জন্য সর্বাগ্রে দরকার টেকসই আধুনিক কৃষি বাজার ব্যবস্থাপনা। 


লেখক: ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (কৃষি অর্থনীতি), আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, বারি, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম-৪৩৩০, ই-মেইল: ফৎলধসধষঁফফরহ২০১৮@মসধরষ.পড়স, মোবাইল: ০১৮১৫৪২৫৮৫৭

বিস্তারিত
ছাদ বাগানে সবজি চাষ

ছাদ বাগানে সবজি চাষ
কৃষিবিদ মোঃ শামীম সেখ
ছাদবাগান হচ্ছে মানব সৃষ্ট সবুজ আচ্ছাদন টবে বা ড্রামে রোপণকৃত গাছ। যা কোন আবাসিক, বাণিজ্যিক বা  কলকারখানার ছাদে করা হয় ফলে শহুরে কৃষি নামক এক নতুন শব্দ আমাদের শব্দ ভান্ডারে যুক্ত হচ্ছে। ছাদ কৃষির শুরটা সৌখিন। বাণিজ্যিক উৎপাদন অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্ভব না হলেও ধীরে ধীরে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শহরাঞ্চলে পারিবারিক বাগানে সবজি চাষ এখন আর কেবল সৌখিনতা নয় বরং পারিবারিক প্রয়োজন। সবজিতে প্রচুর পুষ্টি উপাদান রয়েছে, যা মানবদেহের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় খাদ্য উপকরণ জোগান দিয়ে থাকে। খাদ্যোপযোগী সবজিতে জলীয় অংশ, আমিষ, শর্করা, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ক্যারোটিন, ভিটামিন বি-১, ভিটামিন বি-২, অন্যান্য খনিজ পদার্থ ও খাদ্যশক্তি থাকে। এ নিবন্ধে ছাদ বাগানে সারাবছর চাষাবাদ করা যায় এমন সবজি চাষ ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
লাউ
লাউ ছাদ বাগানে সারা বছর চাষাবাদ করা যায়। হাইব্রিড জাতের হাজারি লাউ, বারি লাউ-৪, ডায়না, হাই গ্রিন, নাইস গ্রিন, ময়না, রওনক, সুপার, গ্রিন ম্যাজিক, সুলতান, নবাব, স¤্রাট, বাদশাহ, মধুমতি জাতগুলো মোটামুটি ছাদ বাগানের জন্য উপযোগী। বর্তমানে ছাদবাগানীদের জন্য বিভিন্ন কোম্পানির ছোট ছোট বীজের প্যাকেট পাওয়া যায়। তবে ছাদবাগানে চাষের জন্য হাইব্র্রিড জাত উত্তম। 
চারা তৈরি ও রোপণ
প্রথমে বীজ রোদে শুকিয়ে ঠান্ডা করে নিতে হবে। এরপর ১০-১২ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে দিতে হবে। শেষ ১০ মিনিট ২ গ্রাম/লিটার পানিতে কার্বেন্ডাজিম দিয়ে শোধন করে নিতে হবে এর পর বীজগুলো ভিজা কাপড়/ টিস্যুতে  পেঁচিয়ে বীজ ফেটে শেকড় বের হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, খেয়াল রাখতে হবে কাপড় বা টিস্যু যেন সব সময় ভেজা থাকে। বীজ ফেটে শেকড় বের হলে তা পটে/টবে বপন করতে হবে। সাধারণত অর্ধেক মাটি ও অর্ধেক জৈবসার, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম এমওপি, ২০০ গ্রাম হাড়ের গুঁড়া মিশ্রিত মাটি দিয়ে পট ভর্তি করতে হবে। প্রতি পটে ২-৩টি বীজ বপণ করতে হবে। চারা একটু বড় হলে দুটি চারা রেখে অবশিষ্ট চারা উপরে ফেলতে হবে।
আন্তঃপরিচর্যা 
চারা একটু বড় হয়ে মাচার উপর উঠলে লাউয়ের ডগা কেটে ফেলতে হবে। যাতে পাশ থেকে ডগা বের হতে পারে। দ্বিতীয় বার বের হওয়া ডগার মাথা আবারো ৯-১০ পাতা বের হবার পর কেটে ফেলতে হবে। তবেই স্ত্রী ফুলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। মাছি পোকা, পাতা ছিদ্রকারী পোকা, সাদা মাছি, জাবপোকা, থ্রিপস  পোকা ইত্যাদি শোষক পোকার আক্রমণে লাউ গাছে মোজাইক ভাইরাস হতে পারে। গাছের পাতা কিছুটা কুঁকড়ে যায় ও  হলুদ-সবুজ ছোপ ছোপ দেখায়। ফলের রং ও আকৃতি নষ্ট হয়ে যায়। এ রোগ প্রতিকার সম্ভব নয়, তাই গাছ তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। বাহক পোকা দমন করার জন্য ১০-১৫ দিন অন্তর অন্তর জৈব বালাইনাশক স্প্রে করতে হবে। যেমন নিমতেল, সাবান পানি, তামাক পাতা ভিজানো পানি ইত্যাদি। এ ছাড়াও মাছি পোকার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ফেরোমন ফাঁদ টানিয়ে দিতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে ছাদ বাগানের লাউগাছের গোড়ার মাটি কোনোভাবেই আলগা করা যাবে না এবং খুব সকালে ও বিকেলে মাটির উত্তাপ কমে গেলে গাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে। লাউ গাছে ডাউনি মিলডিউ এবং পাউডারি মিলডিউ রোগ দেখা যায়। তবে শোষক পোকা নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে পারলে এর আশঙ্কা অনেক কমে যায়। যদি এ ধরনের রোগ দেখা দেয় তবে সালফার আছে এমন ছত্রাকনাশক ১০ থেকে ১৫ দিন ব্যবধানে দুইবার ¯েপ্র করলে পরবর্তীতে আক্রান্তের হার কমে যায়।
শিম   
জুলাই-আগস্ট মাসে শিমের বীজ বপনের উত্তম সময় তবে প্রজাতিভেদে ছাদবাগানে সারা বছর শিম চাষ করা যায়। বারি শিম ৭, বারি উৎপন্ন বারোমাসি বেগুনী শিম, বিইউ শিম ৩, ইপসা শিম ১, ইপসা শিম ২ সারা বছর চাষ করা যায়। তবে খাটো জাতের শিমগুলো ছাদ বাগানের জন্য বেশি উপযোগী।
চারা তৈরি ও রোপণ
শিমের চারা তৈরির জন্য বীজ ১০-১২ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে দিতে হবে। এর পর বীজগুলো ভেজা কাপড়/ টিস্যুতে  পেঁচিয়ে বীজ ফেটে শেকড় বের হওয়া পর্যন্ত  অপেক্ষা করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন কাপড় বা টিস্যু সব সময় ভেজা থাকে। বীজ ফেটে শেকড় বের হলে তা পটে/ টবে  বপন করতে হবে। সাধারণত অর্ধেক মাটি ও অর্ধেক জৈবসার ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম এমওপি, ২০০ গ্রাম হাড়ের গুঁড়া মিশ্রিত মাটি দিয়ে পট ভর্তি করতে হবে। প্রতি পটে ৪-৫টি বীজ বপন করতে হবে। চারা একটু বড় হলে তিনটি চারা রেখে বাকি চারা উপড়ে ফেলতে হবে।
আন্তঃপরিচর্যা
চারা একটু বড় হয়ে মাচার উপর উঠলে গাছ ঝোপালো করার জন্য মাথা থেকে সামান্য একটু ছেঁটে দিতে হবে। শিমের সবচেয়ে ক্ষতিকর পোকা হলো ফল ছিদ্রকারী পোকা, থ্রিপস পোকা ও জাবপোকা। চারা অবস্থায় পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকা মারাত্মক ক্ষতি করে। লাল ক্ষুদ্র মাকড়ও অনেক সময় বেশ ক্ষতি করে থাকে। এ ছাড়াও শিমের সবচেয়ে মারাত্মক রোগ দু’টি হলো মোজাইক ও অ্যানথ্রাকনোজ। এ রোগ প্রতিকার সম্ভব তবে আক্রান্ত গাছ তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলে আবার নতুন গাছ লাগানো ছাদবাগানীদের জন্য উত্তম। বাহক পোকা দমন করার জন্য ৭-১০ দিন অন্তর অন্তর জৈব বালাইনাশক স্প্রে করতে হবে। যেমন নিমতেল, সাবান পানি, তামাক পাতা ভিজানো পানি ইত্যাদি। 
করলা
করলা আমাদের দেশের অতি পরিচিত একটি সবজি, প্রায় সব ছাদ বাগানে করলা চাষ করা হয়। বাংলাদেশে করলার বেশ কয়েকটি উচ্চফলনশীল জাত রয়েছে। এসব জাতের মধ্যে বারি করলা-১ এবং বিএডিসির গজ করলা উল্লেখযোগ্য এসব ছাড়াও করলার আছে বেশ কয়েকটি হাইব্রিড জাত যেমন : বুলবুলি, টিয়া, প্যারট, কাকলি, তাজ-৮৮, গ্রিনস্টার, গৌরব,  প্রাইড-১,    প্রাইড-২, গ্রিন রকেট, হীরক, মানিক, জয়, রাজা, প্রাচী ইত্যাদি।
করলার চারা তৈরির জন্য বীজ  ২০-২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে বীজগুলো ভেজা কাপড়/টিস্যুতে পেঁচিয়ে ফেটে শেকড় বের হওয়া পর্যন্ত  অপেক্ষা করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে কাপড় বা টিস্যু সব সময় ভেজা থাকে। বীজ ফেটে শেকড় বের হলে তা পটে/টবে  বপন করতে হবে। সাধারণত অর্ধেক মাটি ও অর্ধেক জৈবসার ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম এমওপি, ২০০ গ্রাম হাড়ের গুঁড়া মিশ্রিত মাটি দিয়ে পট ভর্তি করে। প্রতি পটে ৪-৫টি বীজ বপন করা প্রয়োজন। চারা একটু বড় হলে তিনটি চারা রেখে বাকি চারা উপড়ে ফেলতে হবে।
রোগবালাই দমন 
করলা গাছে মাছি পোকা, পামকিন বিটলসহ বিভিন্ন পোকা ও ভাইরাসজনিত মোজাইক রোগ, পাউডারি মিলডিউসহ বিভিন্ন বালাইয়ের আক্রমণ দেখা দিতে পারে । পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে বাঁচতে সেক্স ফেরোমন ও বিষটোপ ফাঁদের যৌথ ব্যবহার করা যেতে পারে। বাহক পোকা দমন করার জন্য ৭-১০ দিন অন্তর অন্তর জৈব বালাইনাশক স্প্রে করতে হবে। যেমন নিমতেল, সাবান পানি, তামাক পাতা ভিজানো পানি ইত্যাদি। 
মোটামুটি এভাবেই ছাদ বাগানে টমেটো, পেঁপে, ঝিঙা, কুশি, বরবটি, ধুন্দল ইত্যাদি চাষ করা যায়, তবে চাষ করা সময় কিছু সাধারণ নিয়ম মানলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। সকল ধরনের সবজি গাছে ১০-১৫ দিন অন্তর অন্তর জৈব বালাইনাশক স্প্রে করতে হবে। দিনে দুইবার সকালে ও বিকালে পরিমিত পরিমাণ পানি দিতে হবে। কোন গাছের গোড়ায় আঘাত করা যাবে না। ফেরোমন ট্রাপ ও জৈব বালাইনাশক সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। নির্ধারিত সময়ে সঠিক নিয়মে হস্ত পরাগায়ন করতে হবে। মিষ্টি কুমড়া সকাল ৯.৩০ ঘটিকা, করলা সূর্য উঠার পর থেকে সকাল ১১.০০ ঘটিকা, শসা সূর্য উঠার পর থেকে সকাল ১১.৩০ ঘটিকা, লাউ দুপুরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত, ঝিঙা বিকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হস্ত পরাগায়নের সব থেকে উত্তম সময়। নিরাপদ সবজি উৎপাদনের জন্য ছাদ বাগানে সবসময় জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করুন, রাসায়নিক কীটনাশক ও বালাইনাশক যতটা সম্ভব পরিহার করুন। শহুরে জীবনে পারিবারিক পুষ্টি বিবেচনায় নিরাপদ সবজি উৎপাদনে ছাদবাগান অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। 

লেখক : প্রকল্প পরিচালক, নগর কৃষি উৎপাদন সহায়ক (পাইলট) প্রকল্প, মোবাইল : ০১৭১৭০৩৩৯৩২, ইমেইল: শনফংযধসরসংযধরশয@মসধরষ.পড়স

বিস্তারিত
স্বাদুপানির ঝিনুকে মুক্তা চাষ : গবেষণায় অর্জিত সাফল্য
স্বাদুপানির ঝিনুকে মুক্তা চাষ : গবেষণায় অর্জিত সাফল্য
ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ
মুক্তা একটি দামি রত্ন ও আভিজাত্যের প্রতীক। প্রধানত মুক্তা অলংকার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, এ ছাড়া মুক্তাচূর্ণ ওষুধ ও প্রসাধন শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ঝিনুকের খোলস দিয়ে বিভিন্ন রকমের দৃষ্টিনন্দন দ্রব্যাদি তৈরি করা যায়। ঝিনুক পোল্ট্রি ফিড, মাছের খাবার ও বহির্বিশ্বে মানুষের খাবার হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। 
বাংলাদেশের উষ্ণ আবহাওয়া ও জলাশয় মুক্তাচাষ উপযোগী। এটি একটি নারী ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে খুব সহজেই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। এসব দিক বিবেচনা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) কর্তৃক ‘মুক্তা চাষ প্রযুক্তি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ নামে একটি উন্নয়ন প্রকল্প ২০১২-১৯ মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হয়।
প্রকল্পের আওতায় গবেষণা, প্রশিক্ষণ, মাঠভিত্তিক প্রদর্শনী, সেমিনার ইত্যাদি কর্মসূচি পরিচালিত হয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে ইনস্টিটিউট হতে নি¤েœাক্ত সফলতা অর্জিত হয় : 
জরিপের মাধ্যমে বাংলাদেশে মুক্তা উৎপাদনে সক্ষম ৭ প্রজাতির ঝিনুক শনাক্তকরণ।
  স্বাদুপানির ঝিনুকে সফলভাবে মুক্তা (জরপব ঢ়বধৎষ) উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন।
  ঝিনুকে ইমেজ মুক্তা বা ডিজাইন মুক্তা তৈরির কৌশল উদ্ভাবন।
  দেশীয় ঝিনুকে ৪ রঙের যেমন-কমলা, গোলাপি, ছাই ও সাদা রঙের মুক্তা উৎপাদন করা হয়েছে।
  দেশীয় যন্ত্রপাতির মাধ্যমে গোল মুক্তা এবং ডিজাইন মুক্তার প্রধান উপাদান নিউক্লি উৎপাদনে সফলতা অর্জন।
  উৎপাদিত মুক্তার পোস্ট হারভেস্ট ট্রিটমেন্ট পদ্ধতি উদ্ভাবন এবং এর মাধ্যমে মুক্তার ঔজ্জ্বল্য এবং স্থায়িত্ব বৃদ্ধি।
  মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুকের প্রজনন ও পোনা উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন।
  ইনস্টিটিউট থেকে এরই মধ্যে মুক্তা চাষ বিষয়ে ২২২০ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান।
  দেশের ৪০টি জেলার ৮২টি উপজেলায় বর্তমানে ১৫০ জন চাষি মুক্তা চাষ (মূলত : ইমেজ মুক্তা) করছেন।
মুক্তা চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ : সম্প্রতি মাঠপর্যায়ে মুক্তা চাষের ব্যাপক চাহিদা লক্ষ করা যাচ্ছে। বর্তমানে ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, নেত্রকোনা, ঝিনাইদহ, সিলেট, পিরোজপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লাসহ দেশের ৪০টি জেলার ৭৫টি উপজেলার মোট ১০৭ জন প্রান্তিক খামারি মুক্তা চাষে সম্পৃক্ত হয়েছেন। এ ছাড়া আরও অনেকে মুক্তা চাষে আগ্রহী হয়েছেন এবং প্রশিক্ষণের জন্য ইনস্টিটিউটে যোগাযোগ করছেন।
প্রশিক্ষণ প্রদান : ইনস্টিটিউট কর্তৃক বাস্তবায়িত ‘মুক্তা চাষ প্রযুক্তি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ প্রকল্পের আওতায় এ যাবত মোট ২২২০ জনকে মুক্তা চাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। প্রশিক্ষণে গ্রামীণ বয়স্ক মহিলাসহ বিপুলসংখ্যক নারী অংশগ্রহণ করেছেন। অনেক জেলায় নারীরা এখন মুক্তা চাষ করছেন এবং স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছেন। প্রশিক্ষণ মূল্যায়নে দেখা গেছে, নারীরা ঝিনুক অপারেশন পদ্ধতি সহজে আয়ত্ত করতে পারে।
মুক্তা বাজারজাতকরণ
 দেশে উৎপাদিত মুক্তার বাজার এখনও তেমনভাবে গড়ে উঠেনি। কোনো কোনো চাষি মুক্তা উৎপাদন করে অলংকারের দোকানে সরবরাহ করেছেন। এসব মুক্তা পরবর্তীতে অলংকারে ব্যবহার করে অধিক মূল্যে বিক্রয় করা হচ্ছে। তা ছাড়া, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তাচাষিগণ নিজস্ব উদ্যোগে অনলাইন/অফলাইনের মাধ্যমে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদিত ইমেজ মুক্তা ও মুক্তাজাত অলংকার বিক্রি করছেন। তন্মধ্যে বেশ কয়েকজন চাষি নিজস্ব উদ্যোগে পার্শ্ববর্তী একটি দেশে নিজেদের খামারে উৎপাদিত ইমেজ মুক্তা ও মুক্তাজাত অলংকার বিক্রি করছেন। উল্লেখ্য, চাষি পর্যায়ে একটি ভালো মানের ইমেজ মুক্তা উৎপাদনে খরচ হয় মাত্র ১৫ থেকে ৩০ টাকা, ১ বছর পর তা ২৫০-৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। ইমেজ মুক্তার অলংকারে তার বিভিন্ন মান অনুযায়ী ৫০০-১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তা ছাড়া গোল মুক্তা/ইমেজ মুক্তা উৎপাদনে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত নিউক্লি এবং ইমেজ এখন চাষিরা নিজেরাই তৈরি ও বিক্রয় করছেন, যা পূর্বে উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো।
আড়ংয়ের সাথে চুক্তি সম্পাদন : সম্প্রতি আড়ং দেশের মুক্তা চাষিদের সাথে তাদের খামারে উৎপাদিত মুক্তা ক্রয় সংক্রান্ত একটি চুক্তি সম্পাদন করেছে। ফলে আড়ংয়ের নির্দিষ্ট ডিজাইন অনুযায়ী খামারিরা মুক্তা উৎপাদন করছে। অদূর ভবিষ্যতে আড়ংয়ের বিভিন্ন আউটলেটে বাংলাদেশের মুক্তার অলংকার বিক্রি হবে। 
মুক্তা চাষি সমিতি গঠন : বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরামর্শে মুক্তা চাষিরা ইতোমধ্যে ‘বাংলাদেশ মুক্তা চাষ ফাউন্ডারস অ্যাসোসিয়েশন’ নামে ১টি সমিতি গড়ে তুলেছেন। দেশে মুক্তা উৎপাদন ও বিপণনের লক্ষ্যে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা করাই এ সমিতির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। সমিতির বিভিন্ন সদস্য এখন নিজেরাই অনেককে হাতে-কলমে মুক্তা উৎপাদনে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তাছাড়া সমিতির মাধ্যমে নিজেদের উৎপাদিত মুক্তা, মুক্তার তৈরি অলংকার এবং কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত ডিজাইন/ইমেজ বাজারজাত করা হচ্ছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট আশা করছে দেশের বিশাল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং নারীর ক্ষমতায়নে মাছ চাষের মতো গ্রামীণ অর্থনীতিতে মুক্তা চাষও অদূর ভবিষ্যতে নতুন মাত্রা যুক্ত করবে।
 
লেখক : মহাপরিচালক, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ। 
ফোন : ০৯১৬৫৮৭৪, ই-মেইল : ফমনভৎর@মসধরষ.পড়স
বিস্তারিত
সবুজ ঘাস সংরক্ষণ সাইলেজ

সবুজ ঘাস সংরক্ষণ সাইলেজ
ডা: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান 
বাংলাদেশের প্রাণিস¤পদ খাত ক্রমশ বর্ধমান। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের সফল অংশীদার। এই খাতে মানুষের আত্মকর্মসংস্থান বাড়ছে। দেশের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা এখন দেশের উৎপাদিত গবাদীপ্রাণি থেকেই পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। দেশের চারণভূমির পরিমাণ দিন দিন ক্রমশই কমছে। দানাদার খাদ্যের দামও ক্রমাগত বাড়ছে। এমন অবস্থায় খামারিদের প্রাণি খাদ্য বিশেষ করে ঘাস যাওয়ানোর জন্য ঘাস সংরক্ষণ করার প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষাকালে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ঘাসের অভাব পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে সাইলেজ। 
সাইলেজ আধুনিক খামারিদের কাছে খুবই পরিচিত পদ্ধতি। সাইলেজ মূলত সবুজ ঘাস সংরক্ষণ করার একটি পদ্ধতি। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে সবুজ ঘাসের পুষ্টি উপাদান সঠিক রেখে বায়ুশূন্য অবস্থায় সবুজ ঘাসকে ভবিষ্যতের জন্য প্রক্রিয়াজাত করে রাখার প্রক্রিয়াকে সাইলেজ বলা হয়। 
সাইলেজের উপকারিতা :্ সাইলেজ পুষ্টিকর একটি গোখাদ্য প্রস্তুত প্রক্রিয়া যার বহুবিধ উপকারিতা রয়েছে। ভালভাবে পচন করা হলে সাইলেজের শর্করা খাবারকে পরিপাকযোগ্য এসিডে পরিণত, যা গরুর খাদ্যের রূপার এবং পুষ্টিগুণ বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি সাইলেজে ব্যবহৃত সকল পুষ্টি উপাদান খাবারকে নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করে। প্রাকৃতিক ভাবে চরে যাওয়া ঘাসের চেয়ে অনেক বেশি খাদ্য উপাদান পাওয়া যায়। এতে শক্তির অপচয় অনেক কম হবে। দুগ্ধবতী গাভীর শারীরিক এবং দুধ উৎপাদনের প্রয়োজনে প্রচুর পরিমাণে শক্তি, আমিষ ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন। ভাল মানস¤পন্ন সাইলেজের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ শক্তি, প্রোটিন, ভিটামিন, ফাইবার রয়েছে যা গাভীর দুধ উৎপাদন অনেকাংশে বাড়িয়ে দিতে পারে। পরিপাক ক্রিয়া স্বাভাবিক ও ভাল রাখে।
চারণ ভূমিতে চড়ানোর ফলে ঘাসের উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায় অন্যদিকে সাইলেজ বানানোর ফলে জমিতে ঘাসের উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটে। মাঠ থেকে বেশি মাত্রায় ঘাস সংগ্রহ করে সাইলেজ বানানো হলে ঘাস সংকটকালীন সময়ে গরুর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। শুকনো খড় বা ঘাস রাখার জন্য বেশি জায়গার প্রয়োজন হয়, অন্যদিকে সাইলেজ সংরক্ষণে অল্প জায়গার প্রয়োজন হয়। সাইলেজে পরিপাকযোগ্য এনার্জির পরিমাণ বেশি প্রতি কেজিতে ৯-১২ মেগাজুল এনার্জি পাওয়া যায়। 
সাইলেজের মধ্যে এনার্জি, আমিষ ও প্রয়োজনীয় ফ্যাট বিদ্যমান থাকায় গাভীর পরিপাক ক্রিয়া স্বাভাবিক ও দুধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। সাইলেজ সঠিক মাত্রায় খাওয়ানো হলে প্রজনন প্রক্রিয়া ভাল থাকে। বর্ষা মৌসুমে সবুজ ঘাসে ময়েশ্চার বেশি থাকার কারণে শুকাতে সমস্যা হয়, আর শুকনো হলে পুষ্টিমান কমে যায়। তাই সারাবছর সঠিক পুষ্টিমান সমৃদ্ধ ঘাস গরুকে খাওয়াতে সাইলেজ হতে পারে উত্তম প্রক্রিয়া। কাঁচা ঘাসের তুলনায় এই প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করে রাখা ঘাসের গুণগত ও খাদ্যমান বেশি। দেশীয় ঘাস যেমন : দূর্বা, বাকসা, আরাইল, সেচি, দল ইত্যাদি, গাছের পাতা যেমন: ধৈঞ্চা, ইপিল-ইপিল উন্নত জাতের ঘাস যেমন: নেপিয়ার, পাকচং, জার্মান, ভূট্টা, সুদান, পারা, সরগম ইত্যাদি সাইলেজ তৈরি করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।।
সাইলেজ তৈরি
সাইলেজ তৈরি হয় একটি পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতি অনুসরণ করে। প্রতিটি ধাপ সতর্ক থেকে সাইলেজ উৎপাদন করলে তার গুণগত মান অনেক ভাল হয় এবং বেশিদিন সংরক্ষণ করে খাওয়ানো যায়। 
ধাপ-১ : ফুল আসার আগে একই পরিপক্বতার ঘাসগুলো কেটে নিতে হবে। সবুজ ঘাসের মধ্যে সবচেয়ে ভালো সাইলেজ হয় ভুট্টার। কারণ এই সাইলেজে কান্ড, পাতার সাথে ভুট্টাও থাকে যার ফলে দানাদার খাদ্যের চাহিদাও পূরণ হয়। এজন্য আধা কাঁচা ভুট্টা থাকার সময় সংগ্রহ করা ভালো।
ধাপ-২ : ঘাসগুলোকে একদিন রোদে শুকিয়ে নিতে হবে যেনো ভেজাভাবটা না থাকে। নেপিয়ার ঘাস কাটার পর এতে উৎু গধঃঃবৎ (উগ) থাকে ১৫-২০%। একদিন রোদে শুকানো হলে তা ৩০% এর কাছাকাছি হয়। যা সাইলেজ তৈরির জন্য উপযুক্ত। অন্যদিকে গাছের পাতা কিংবা আগাছা ৪ ঘণ্টা রোদে শুকিয়ে নিলেই ৩০% উষ্ণ থাকে। কা-টি আর্দ্র কিন্তু ভেজা না। হাতে নিয়ে চাপ দিলে আগের অবস্থানে যাবে না।
ধাপ-৩ : ঘাস ১-৩ ইঞ্চি পরিমাণ ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নিতে হবে। বেশি পরিমাণে কাটার জন্য বাজারে মেশিন আছে যাকে চপার মেশিন বলে।
ধাপ-৪ : ফার্মেন্টেশন বা গাঁজন প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করার জন্য চিনি জাতীয় উপাদান যুক্ত করতে হবে। এজন্য লালিগুড় বা মোলাসেস ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া লাল চিনিও ব্যবহার করা যায়। (বি.দ্র. ভুট্টা, জার্মান ঘাসে পর্যাপ্ত পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট থাকার কারণে মোলাসেস প্রয়োগ করার প্রয়োজন পড়ে না) প্রতি ১০০ কেজি ঘাসের জন্য ২-৩% বা ২-৩ কেজি মোলাসেস প্রয়োগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মোলাসেসের সাথে একই পরিমাণ পানি যুক্ত করতে হবে। 
ধাপ-৫ : এবার সংরক্ষণের জন্য সিলো বা পাত্র ঠিক করতে হবে। এজন্য স্টিক ব্যাগ বা বস্তা, ড্রাম ব্যবহার করা যায়। তাছাড়া মাটিতে পুঁতেও সংরক্ষণ করা যায়।
স্টিক ব্যাগ, ড্রামে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যাগটি যেন কোনোরকম ছেঁড়া না হয়। প্রথমে মোলাসেস এবং পানি মিশ্রিত দ্রবণের অর্ধেক পরিমাণ ঘাসে প্রয়োগ করতে হবে। তারপর সেই ঘাস ব্যাগে কয়েকধাপে ভরতে হবে। এক ধাপ ভরার পর ভালোভাবে চাপ দিতে হবে যেন ঘাসগুলোর মাঝে ফাঁকা না থাকে, ফাঁকা থাকলে সেখানে বাতাস থেকে যাবে, যার ফলে সাইলেজ ভালো না হওয়ার কারণে বেশিদিন ঠিক থাকবে না। তারপর মোলাসেস মিশ্রিত পানি আবার খানিকটা প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে কয়েকধাপে ব্যাগ কিংবা ড্রামে ভালোভাবে ভরে শক্তভাবে মুখ বন্ধ করে রাখতে হবে যেনো বাতাস প্রবেশ না করতে পারে।
মাটিতে পুতেও সাইলেজ করা যায় এজন্য উঁচু স্থান নির্বাচন করে প্রয়োজনীয় পরিমাণ গর্ত করে কয়েকধাপে সমপরিমাণে মোলাসেস এবং পানি মিশ্রিত ঘাস পা দিয়ে ভালোভাবে চাপ দিয়ে ক¤েপক্ট করতে হবে। তারপর উপরে আবার পলিথিন দিয়ে শক্ত করে বেঁধে মাটি চাপা দিতে হবে।
ধাপ-৬ : উক্ত প্রক্রিয়াটি ১-২ দিনের মাঝে শেষ করতে হবে। সাইলেজ আরও পুষ্টিসমৃদ্ধ করার জন্য অব্যবহৃত কলা, কলার খোসা, মিষ্টি আলু, আখের খোসা ও যুক্ত করা যায়। ভালোভাবে সাইলেজ তৈরি করলে সর্বোচ্চ ১০-১২ বছর সংরক্ষণ করা যায় এবং পুষ্টিগুণাগুণ অক্ষুণœ থাকে। 
সবুজ ঘাস এর সাইলেজ বানানোর ক্ষেত্রে সবুজ ঘাসের শতকরা ৩-৪ ভাগ চিটাগুড় মেপে একটি চাড়িতে নিতে হবে। তারপর ঘন চিটাগুড়ের মধ্যে ১:১ অথবা ৪:৩ পরিমাণে পানি মিশালে ইহা ঘাসের উপর ছিটানো উপযোগী হবে। ঝরনা বা হাত দ্বারা ছিটিয়ে এ মিশ্রণ ঘাসে সমভাবে মিশাতে হবে। 
সাইলোর তলায় পলিথিন দিলে আগে বিছিয়ে নিতে হবে। পলিথিন না দিলে পুরু করে খড় বিছাতে হবে। এরপর দু’পাশে পলিথিন না দিলে ঘাস সাজানোর সাথে সাথে খড়ের আস্তরণ দিতে হবে। স্তরে স্তরে সবুজ ঘাস এবং শুকনো খড় দিতে হবে। প্রতি পরতে ৩০০ কেজি সবুজ ঘাস এবং ১৫ কেজি শুকনো খড় দিতে হবে। ৩০০ কেজি ঘাসের পরতে পূর্বের হিসাবে ৯-১২ কেজি চিটাগুড় ও ৮-১০ কেজি পানির মিশ্রণ ঝরনা বা হাত দিয়ে সমভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। খড়ের মধ্যে কোন চিটাগুড় দিতে হবে না। এভাবে পরতে পরতে ঘাস ও খড় সাজাতে হবে। যত এঁটে ঘাস সাজানো হবে তত সুন্দর সাইলেজ তৈরি হবে। সাইলো ভর্তি করে মাটির উপরে ৪-৫ ফুট পর্যন্ত ঘাস সাজাতে হবে। ঘাস সাজানো শেষ হলে খড় দ্বারা পুরু করে আস্তরণ দিয়ে সুন্দর করে পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। সর্বশেষে ৩-৪ ইঞ্চি পুরু করে মাটি দিতে হবে। স¤পূর্ণ ঘাস এক দিনেই সাজানো যায়। তবে বৃষ্টি না থাকলে প্রতিদিন কিছু কিছু করেও কয়েক দিনব্যাপী সাইলেজ তৈরি করা যায়। নিচু জায়গায় সাইলো করা যাবে না। তাতে পানি জমে সাইলেজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
সাইলেজ ব্যবহারের নিয়ম : সাইলেজ স্বভাবিক ঘাসের মতই প্রাণিকে খাওয়ানো যায়। সাইলেজ সবুজ ঘাসের চাহিদা পূরণ করে। সব বয়সের প্রাণিকে সহজে খাওয়ানো যায়। অল্প করে অভ্যাস করিয়ে বেশি করে খাওয়ানো যায়। সঠিক ভাবে পরিচর্যার পাশাপাশি নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণ সাইলেজ খাওয়ানো হলে গরুর মাংশ উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। নিয়মিত ঠিকাদান, কৃমিমুক্ত রাখা এবং দানাদার খাবারের সাথে সাইলেজ খাওয়ানোর ফলে খুব চমৎকার ফলাফল পাওয়া যায়। গরুর ওজন অনুযায়ী ২-৩% হারে সাইলেজ দিনে ২-৩ বার খাওয়ানো যায়। সাইলেজের মধ্যে কোন রাসায়নিক বা ইউরিয়া না থাকায় এতে খাওয়ানো কোন সতর্কতা বা ঝুঁকিও নেই। সাইলেজের মধ্যে ঘাসের সকল উপাদান এবং দানাদের উপাদান সংমিশ্রণ থাকার ফলে পর্যাপ্ত এনার্জি, প্রোটিন, ফ্যাটসহ অন্যান্য উপকরণ থাকায় দুধ উৎপাদন বৃদ্ধিসহ প্রজনন ক্ষমতা ভাল রাখে। নিয়মিত সাইলেজ সঠিক নিয়মে খাওয়ালে গরু যথাসময়ে হীটে না আসা, গর্ভধারন না হওয়া, বাচ্চা প্রসবে বিলম্ব হওয়া ইত্যাদি কোন সমস্যা থাকেনা। বাছুরকে অল্প অল্প করে সাইলেজ খাওয়ালে বাছুরের পরিপাক ক্রিয়া স্বাভাবিক হয় এবং বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। এভাবে সংরক্ষিত ভুট্টা/ঘাস প্রতি ১০০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১০ কেজি হিসাবে ব্যবহার করা যায়।
বাংলাদেশে সাইলেজের নতুন মার্কেট
সাইলেজের পুষ্টি এবং উপকারিতা জেনে খামারিরা নিজেরা সাইলেজ উৎপাদনে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া দেশের কিছু কিছু কোম্পানি আধুনিক নিয়মে সাইলেজ উৎপাদন করে খামারিদের প্রয়োজনে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করছে। ইয়ন বায়ো সাইয়েন্স লিমিটেডসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং নতুন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তরা সাইলেজের বাণিজ্যিকীকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। সাইলেজ অন্য খাবারের তুলনায় অনেকটা সাশ্রয়ী বিশেষ করে শুকনো খড় খাওয়ানো চেয়ে সাইলেজ খাওয়ানো অনেক ভাল এবং খামারিরা এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে লাভবান হচ্ছে। 
বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ সেক্টরে সাইলেজ অনেক পুরনো একটি পদ্ধতি। কিন্তু পূর্বে সাইলেজের এমন উপকারিতা খামারিরা আয়ত্ত করতে পারেননি। বর্তমানে তথ্যপ্রবাহের অবাধ ব্যবহার এবং সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সাইলেজের বাণিজ্যিক রূপ দাঁড়িয়েছে যা দেশের প্রাণিস¤পদ খাতকে এগিয়ে নিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। খামারিরা লাভবান হতে পারবেন। উন্নত প্রযুক্তির সফলতা মানুষ পাবে। সঠিক নিয়মে উৎপাদিত প্রাণিস¤পদ পণ্য মানুষ খেয়ে হবেন ধন্য। 

লেখক : প্রাণিস¤পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা (এনএটিপি-২), উপজেলা প্রাণিস¤পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল, গোমস্তাপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ। মোবাইল-০১৭১৬-১২৬৩২৪, ই-মেইল : সসৎফাস১০@মসধরষ.পড়স 

বিস্তারিত
মানসম্পন্ন বীজ সরবরাহে, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী

মানসম্পন্ন বীজ সরবরাহে, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী
কৃষিবিদ মো: ইউছুফ ভূঁঞা
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে প্রথম জাতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (১৯৭৩-৭৮) আওতায় বীজের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে ১৯৭৪ সালের ২২ জানুয়ারি বীজ অনুমোদন সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ২২ নভেম্বর ১৯৮৬ তারিখে এর “বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী’’ নামকরণ করা হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উৎপাদিত ও বাজারজাতকৃত নিয়ন্ত্রিত ফসলের (ধান, গম, পাট, আলু, আখ, মেস্তা ও কেনাফ) বীজের প্রত্যয়ন ও মান নিয়ন্ত্রণে সংস্থাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। জাতীয় বীজনীতির আলোকে দেশে একটি শক্তিশালী বীজ শিল্প গড়ে তোলার নিমিত্তে এর প্রত্যয়ন সেবা ফসলের জাত পরীক্ষাপূর্বক ছাড়করণ/নিবন্ধন থেকে শুরু করে মাঠ পরিদর্শন ও প্রত্যয়ন, পরীক্ষাগারে ও কন্ট্রোল খামারে বীজের মান পরীক্ষা, প্রত্যয়ন ট্যাগ ইস্যুকরণ, মার্কেট মনিটরিং এবং বীজ আইন ও বিধিমালা লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ পর্যন্ত সম্প্রসারিত। সংস্থাটির সকল কারিগরি কর্মকা- জাতীয় বীজনীতি, ১৯৯৩; বীজ আইন, ২০১৮; বীজ বিধিমালা ২০২০ ও জাতীয় বীজ বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে।
লক্ষ্য : মানসম্পন্ন বীজের নিশ্চয়তা ।
উদ্দেশ্য : উচ্চ গুণাগুণসম্পন্ন ও প্রতিকূলতা সহিষ্ণু জাতের মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও বিতরণে উৎপাদনকারীদের প্রত্যয়ন সেবা প্রদান এবং মার্কেট মনিটরিং কার্যক্রম জোরদারকরণের মাধ্যমে বীজের মান নিশ্চিতকরণ।
সফলতা
জাত ছাড়করণ/ নিবন্ধন : বিগত ১৩ বছরে নোটিফাইড ফসল যথা: ধানের ইনব্রিড ৭০টি ও হাইব্রিড ১৪৮টি, গম ১১টি, পাট ৯টি, আলু ৬১টি ও আখ ৮টিসহ মোট ৩০৭টি জাত ছাড়করণ/নিবন্ধন করা হয়। 
মাঠ প্রত্যয়ন : উল্লেখিত সময়কালে অত্র সংস্থা কর্তৃক নোটিফাইড বীজ ফসলের মাঠ প্রত্যয়নকৃত জমির পরিমাণ ৪,৩৩,২১৭ হে. এবং মাঠ পরিদর্শনকৃত জমির পরিমাণ ৩,৯৮,৫৩৩ হে.। পূর্বের তুলনায় অধিক পরিমাণ বীজ ফসলের জমি প্রত্যয়নের আওতাভুক্ত হওয়ায় দেশের পাবলিক এবং প্রাইভেট সেক্টরে বীজের মান সার্বিকভাবে উন্নত হয়েছে। বিগত ১৩ বছরে সংস্থা কর্তৃক ১৫,৭৫,১৯৭ মে.টন বীজ প্রত্যয়ন করা হয়েছে। ধানের ১১৭৬৮৭২৯৫টি, গমের ৩৭০৬২৯৮টি, পাটের ১১৫১৫৩৫০টি ও আলুর ১৪৫৮৪২৫০টি সহ মোট ২৪৪০৫১৭৩৪টি প্রত্যয়ন ট্যাগ বিতরণ করা হয়।
গ্রোআউট টেস্ট : জাতের বিশুদ্ধতা পরীক্ষার জন্য কন্ট্রোল খামারে ধানের ১৩৬৪৪টি, গমের ২৪৭৬টি, পাটের ১৫৬১টি এবং আলুর ৩৪২৯টিসহ মোট ২০৮৪৭টি প্রি-পোস্ট কন্ট্রোল ও গ্রোআউট টেস্ট সম্পাদন করা হয়। এতে চাষিপর্যায়ে মানসম্পন্ন বীজের প্রাপ্তি, উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে।
ভবন নির্মাণ, যন্ত্রপাতি ও যানবাহন সংগ্রহ : সংস্থায় ৪টি আঞ্চলিক বীজ পরীক্ষাগার ও ১টি জাত পরীক্ষাগার ভবন, ১টি কম্পিউটার ল্যাব, ১টি প্রশিক্ষণ কক্ষ ও ১টি ডরমিটরি ভবন নির্মাণ করা হয়। ভ্রাম্যমাণ বীজ পরীক্ষাগার কর্মসূচির আওতায় ১টি ভ্রাম্যমাণ বীজ পরীক্ষাগার মিনিবাস ক্রয়সহ কারিগরি যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হয়েছে। নির্মিত পরীক্ষাগারসমূহের জন্য ঊখওঝঅ ঃবংঃ শরঃ, ঝঢ়বপঃৎড় চযড়ঃড়সবঃবৎ, চঈজ (চড়ষুসবৎধংব ঈযধরৎ জবধপঃরড়হ) গধপযরহব, ঊষবপঃৎড়ঢ়যড়ৎবংরং ঁহরঃ, ডধঃবৎ ঢ়ঁৎরভরপধঃরড়হ ঁহরঃ, এবষ উড়পঁসবহঃধঃরড়হ গধপযরহব সহ উঘঅঋরহমবৎঢ়ৎরহঃরহম সংক্রান্ত অন্যান্য উন্নতমানের ল্যাব যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও স্থাপন করা হয়। জাত পরীক্ষাগারের জন্য একটি জেনারেটর সংগ্রহ করা হয়। তাছাড়া, আইএপিপি প্রকল্পের অর্থায়নে দুটি পিকআপ ভ্যান ক্রয় এবং পটুয়াখালী জেলায় নতুন বীজ পরীক্ষাগার ভবন স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হয়েছে। বীজমান উন্নয়নে মাঠ প্রত্যয়ন আধুনিকায়ন ও জোরদারকরণ কর্মসূচির অর্থায়নে মাঠ প্রত্যয়ন সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি এবং মাঠপর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তাগণের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় ও রেফারেন্স বই সংগ্রহ করে মাঠপর্যায়ের অফিসসমূহে বিতরণ করা হয়। 
ই-কৃষি সেবা সম্প্রসারণ : কৃষিবান্ধব সরকারের রূপকল্প-২০২১ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে সংস্থার স্ট্যাটিক ওয়েবসাইটটিকে সম্প্রতি ডায়নামিক ওয়েবসাইটে রূপান্তর করে অনলাইনে রিপোর্টিং ও ডাটাবেইজ সংরক্ষণ  শুরু হয়েছে। তাছাড়া, ভ্রাম্যমাণ বীজ পরীক্ষাগার কর্মসূচির আওতায় বীজ পরীক্ষার ফলাফল সরাসরি সংশ্লিষ্ট কৃষকগণকে মোবাইল এসএমএস, ইমেইল (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) এর মাধ্যমে পৌঁছে দেয়ার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। 
প্রকল্প বাস্তবায়ন : বীজমান উন্নয়নে মাঠ প্রত্যয়ন আধুনিকায়ন ও জোরদারকরণ কর্মসূচি (জুলাই/২০১২-জুন/২০১৫), ভ্রাম্যমাণ বীজ পরীক্ষাগার কর্মসূচি (জুলাই/২০১৩-জুন/২০১৫) ইন্টিগ্রেটেড এগ্রিকালচারাল প্রডাক্টিভিটি প্রজেক্ট (আইএপিপি)-এসসিএ সাবকম্পোনেন্ট (জুলাই/২০১১-জুন/২০১৬), ভ্রাম্যমাণ বীজ পরীক্ষাগারের মাধ্যমে বীজ পরীক্ষা কার্যক্রম জোরদারকরণ কর্মসূচি এবং নিম্ন উৎপাদনশীল ধানের জাত প্রত্যাহারের জন্য জাত পরীক্ষণ কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। বীজ প্রত্যয়ন কার্যক্রম জোরদারকরণ প্রকল্প চলমান রয়েছে যার অগ্রগতি সন্তোষজনক। ইন্টিগ্রেটেড এগ্রিকালচারাল প্রডাক্টিভিটি প্রজেক্ট (আইএপিপি) এর অর্থায়নে খরাপ্রবণ উত্তরাঞ্চলের রংপুর জেলায় আঞ্চলিক বীজ পরীক্ষাগারে এবং দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পটুয়াখালী জেলায় স্থাপিত নতুন বীজ পরীক্ষাগারে বীজ পরীক্ষণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। দেশব্যাপী ট্যাগ এর ভেজালনিরোধ লক্ষ্যে বীজ প্রত্যয়ন ট্যাগ আধুনিকায়ন ও বিতরণ জোরদারকরণ কর্মসূচি চালু রয়েছে। এই কর্মসূচির আওতায় আধুনিক নতুন ট্যাগের বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো-রঙিন, নিরাপত্তা কালিতে লেখা মুদ্রিত এবং পেনিট্রেটিং কালিতে মুদ্রিত ক্রমিক নম্বর।
স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা :  মাঠ প্রত্যয়নের মাধ্যমে ২৫% বীজ ফসলের এলাকা বৃদ্ধি; টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এর ০২ নং অভীষ্ট : ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন এবং টেকসই কৃষির প্রসার অর্জনে চিহ্নিত প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন; রাজস্ব খাত এবং নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার প্রশিক্ষণ (দেশে ও বিদেশে), বীজ প্রযুক্তি মেলা, সেমিনার, ওয়ার্কসপ আয়োজন এবং অডিও/ভিডিও ডকুমেন্টরি, সফটওয়্যার, ই-বুক, ই-লাইব্রেরি, মোবাইল অ্যাপস ইত্যাদির মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন; ছাড়পত্র প্রদানের ভিত্তিতে সকল শূন্য পদে কর্মকর্তা এবং কর্মচারী নিয়োগ এবং পদায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ; মাঠ প্রত্যয়ন ও বীজ প্রত্যয়ন সেবাকে ডিজিটাল সার্ভিসে রূপান্তর করা; বীজের প্রত্যয়ন ট্যাগের আধুনিকায়ন; কোভিড-১৯ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ;
মধ্য মেয়াদি পরিকল্পনা : কেন্দ্রীয় বীজ পরীক্ষাগারকে ইস্ট এক্রিডেটেড ল্যাবরেটরি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা; সকল বীজ ফসলের বীজবাহিত রোগের জন্য সিড প্যাথোলজিক্যাল স্ট্যান্ডার্ড নির্ণয় করা; ডালজাতীয় ফসল, তেল জাতীয় ফসল এবং ভুট্টাকে নোটিফাইড ফসলের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করে মাঠ প্রত্যয়ন সেবা এবং প্রত্যয়ন ট্যাগ প্রদান চালু করা; কেন্দ্রীয় এবং আঞ্চলিক বীজ পরীক্ষাগারে ডিহিউমিডিফাইড স্টোরেজ সুবিধা চালু; ডিইউএস পরীক্ষগার এবং ডিএনএ ফিঙ্গার প্রিন্টিং টেস্ট আধুনিকায়ন ।
বীজনীতি, ১৯৯৩ এর আলোকে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী কে -
বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী বিলুপ্ত করে বীজ প্রত্যয়ন অধিদপ্তর গঠন; 
বিসিএস (কৃষি) : মৃত্তিকা এর ন্যায় বিসিএস (কৃষি): বীজ প্রত্যয়ন ক্যাডার সৃষ্টি এবং বীজ প্রত্যয়ন অধিদপ্তরের জন্য পদ সৃজন; আধুনিক আইসিটি ল্যাব স্থাপন; প্রদত্ত সকল সেবাকে  ই-সার্ভিসে রূপান্তর; সকল কর্মকর্তা কর্মচারীদের ডাটাবেইজ তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ। ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন এবং টেকসই কৃষির প্রসার অর্জনে চিহ্নিত প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন; ০৫টি বিভাগে (ঢাকা, খুলনা, সিলেট, বরিশাল ও ময়মনসিংহ) আঞ্চলিক বীজ প্রত্যয়ন অফিস ও বীজ পরীক্ষাগার অফিস বিল্ডিং এবং ৫২টি জেলায় জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিস বিল্ডিং স্থাপন করা; রপ্তানিযোগ্য প্রধান প্রধান সবজি ফসল যেমন- বেগুন, টমেটো, কুমড়া ও লাউ জাতীয় সবজি বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে মাঠ প্রত্যয়নসেবা এবং প্রত্যয়ন ট্যাগ প্রদান চালু করা; দেশের সকল নদীবন্দর, স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর এবং বিমানবন্দরে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সীর নিজস্ব জনবলের মাধ্যমে বীজ পরীক্ষা করা।

লেখক : পরিচালক, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী, গাজীপুর। ফোন : ৪৯২৭২২০১, ইমেইল : ফরৎবপঃড়ৎ@ংপধ.মড়া.নফ

বিস্তারিত
বাংলাদেশে কৃষি খাতের সম্ভাবনা

বাংলাদেশে কৃষি খাতের সম্ভাবনা 
ড. রফিকুল আলম খান
কৃষির নিরন্তর সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষিক্ষেত্রে সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে খোরপোশের কৃষি আজ বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হয়েছে। যার ফলে দেশ আজ দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখন প্রয়োজন একটি টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা। ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি করা এবং নতুন নতুন এলাকা চাষের আওতায় আনা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান দুই শর্ত। নতুন নতুন স্বল্পমেয়াদি জাত চাষের মাধ্যমে এক ও দুই ফসলি জমি অঞ্চল বিশেষে প্রায় চার ফসলি জমিতে পরিণত করা হয়েছে ফলে দেশে বর্তমানে ফসলের নিবিড়তা ২০৫%। সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে বাংলাদেশে  কৃষি খাতের সম্ভাবনাকে ফলপ্রসূ করা যাবে। 
কৃষিখাতে সময়োপযোগী পরিকল্পনাগুলো হচ্ছে: ১. এক ও দুই ফসলি জমি অঞ্চলভেদে চার ফসলি জমিতে পরিণত করা এবং ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি করা; ২. পরিবর্তিত জলবায়ুতে চাষের উপযোগী এবং ঘাত সহিষ্ণু জাত সম্প্রসারণ; ৩. মানসম্পন্ন উচ্চফলনশীল আধুনিক জাতের বীজ ব্যবহার করে ফসলের ফলন ১৫-২০% পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব; ৪. টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্বল্প জমি থেকে অধিক ফসল উৎপাদন করা সম্ভব; ৫. বীজ বপনের সময় আউশে এবং খরার সময় আমনে সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করলে নতুন নতুন এলাকা আউশ এবং আমনের আওতায় আনা সম্ভব; ৬. যান্ত্রিক চাষাবাদের মাধ্যমে সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের সাথে সাথে একই জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদন সম্ভব; ৭. জমির উর্বরতা বৃদ্ধি ও মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার লক্ষ্যে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে কম্পোস্ট, ভার্মিকম্পোস্ট, খামারজাত সার, সবুজসার ও অন্যান্য জৈবসারের ব্যবহার জনপ্রিয়করণ; ৮. ক্ষতিকর রোগ ও পোকামাকড় দমনের জন্য পার্চিং, আলোক ফাঁদ, ফেরোমন ট্র্যাপ, ফল ব্যাগিং কৌশল, ধানক্ষেতে হাঁসের চাষ নিশ্চিতকরণ; ৯. সাশ্রয়ী সেচের জন্য সোলার পাম্প ব্যবহার এবং এডব্লিউডি, ফিতাপাইপ, পাকা সেচনালা, বারিড পাইপ, মিনিপুকুর ও পাতকুয়া খনন এবং সর্বোপরি ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, ১০. বসতবাড়ি; শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ, রাস্তার ধার, অফিসসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর আশেপাশের পরিত্যক্ত প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় নিয়ে আসার জন্য পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ; ১১. হাওর, বিল ও জলাবদ্ধ এলাকায় ভাসমান কৃষি প্রযুক্তির বিস্তার ঘটিয়ে সবজি ও মসলা ফসল উৎপাদন করা; ১২. দেশের তিনটি পাহাড়ি ঝিলসহ অন্যান্য জেলার অসমতল ও পাহাড়ি জমিকে উন্নত কৃষি ব্যবস্থা আওতায় এনে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা; ১৩. ছাদ বাগান স্থাপনসহ নগর কৃষির উন্নয়ন; ১৪. নদীভাঙন, চরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা দরিদ্র মানুষের জন্য চাহিদাভিত্তিক জন্য একাধিক প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। চরাঞ্চলে ডাল, তেল, সয়াবিন, মিষ্টিআলু, ফেলন, সূর্যমুখী, ধনিয়া চীনাবাদাম ভুট্টা কালিজিরা, তরমুজসহ কুমড়াজাতীয় ফসল ভাল জন্মে। চরের অতি দরিদ্র মানুষের মধ্যে কৃষি খাসজমি বিতরণ করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
কৃষি শিক্ষা, গবেষণা ও কৃষি সম্প্রসারণ সেবা প্রদানে রয়েছে দক্ষ জনবল। জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমি কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দক্ষতার উন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধনে কাজ করে যাচ্ছে। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একাডেমিকে আরও এগিয়ে নিতে জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমি (নাটা) আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের কাজ চলমান। এ লক্ষ্য পূরণ হলে এটি হবে দক্ষিণ এশিয়ার একটি অন্যতম প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার অব এক্সিলেন্স’, হবে প্রশিক্ষণ আয়োজনের একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান।
কৃষকদের উৎপাদন খরচ নিম্নপর্যায়ে রাখতে সরকার সার, সেচকাজে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ ও ইক্ষুচাষে উন্নয়ন সহায়তা প্রদানের নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে ও করোনাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষি খাতে সরকারি প্রণোদনা ও কৃষি উপকরণে ভর্তুকি দিয়ে সহজলভ্য করা প্রয়োজন।
এ ছাড়াও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে শহরমুখী দ্রুত ধাবমান মানুষগুলোর স্ব-স্ব অবস্থান থেকে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করা; ডিজিটাল কৃষি তথা  ‘ই-কৃষির’ কার্যক্রম জোরদারকরণ; পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ ও টেকসই উৎপাদনক্ষম উত্তম কৃষি কার্যক্রম ব্যবস্থাপনা জোরদারকরণ; পর্যাপ্ত হিমাগার স্থাপন করে কৃষকের কষ্টার্জিত ফসল, সবজি ও ফলমূল সংরক্ষণের ব্যবস্থাকরণ; কৃষি সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়সমূহ যেমন, কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং সর্বোপরি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সমূহের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বয়সাধন জোরদার করা প্রয়োজন; প্রশাসনিকভাবে মধ্যস্বত্বভোগীর দাপট কমিয়ে সমবায়ভিত্তিতে কৃষকের জমি থেকে কৃষিপণ্য ক্রয়, গ্রোথসেন্টার বা কালেকশন পয়েন্টে নিয়ে আসা পরে সেখান থেকে নগর বিক্রয়কেন্দ্র বা কৃষকের বাজারে অবাধে বিক্রির সুযোগ সৃষ্টি করা; কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পসহ বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল জোগান দেয় কৃষি; বাণিজ্যিকভাবে বঃযহরপ সধৎশবঃ এ আমরা এযাবৎ ফল ও সবজি রপ্তানি করে আসছি কিন্তু ংঁঢ়বৎ সধৎশবঃ এ ঢুকতে পারছিলাম না। আশার কথা সম্প্রতি ইতালি, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ংঁঢ়বৎ সধৎশবঃ এ সবজি ছাড়াও আম, চিংড়ি রপ্তানি শুরু হয়েছে; দক্ষিণ কোরিয়ার মতো প্রথাগত চাষাবাদের পরিবর্তে ‘স্মার্ট ফার্মিং’ সংক্রান্ত জ্ঞান ও প্রযুক্তিকে বাংলাদেশে কাজে লাগানো যেতে পারে; ফুল চাষ বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় খাত। এর বাণিজ্যিক বিকাশে বিদ্যমান ম্যানুয়াল পদ্ধতির পরিবর্তে স্মার্ট প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটানো।  
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ২০১৮, এসডিজি ২০৩০, ভিশন২০৪১ ও ডেল্টাপ্লান ২১০০ বাস্তবায়নে  কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সব দপ্তর সংস্থা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সময়োচিত নীতি, কৌশল এবং কার্যকর কর্মকা-ের মাধ্যমেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়ন সম্ভপর হবে। 

লেখক : উপপরিচালক (এলআর), সংযুক্ত: পরিকল্পনা, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও আইসিটি উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর,      খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৫৭৬৫৩২৭, ইমেইল : ফৎ.ৎধভরয়ঁবফধব@মসধরষ.পড়স

বিস্তারিত
বাংলাদেশে ঔষধি গুণসম্পন্ন ঋষি মাশরুম চাষের সম্ভাবনা

বাংলাদেশে ঔষধি গুণসম্পন্ন ঋষি মাশরুম চাষের সম্ভাবনা
ড. মোছা: আখতার জাহান কাঁকন
ঋষি মাশরুম  বিশ্বে ঔষধি মাশরুম হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে চীন, জাপান ও মালয়েশিয়াতে হারবাল মেডিসিন হিসেবে এই মাশরুমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ঋষি মাশরুম দিয়ে ক্যান্সার, টিউমার, হৃদরোগসহ বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগের ওষুধ তৈরি করা হয়। এ ছাড়া কসমেটিকস শিল্পে পেস্ট, সাবান, লোশন, শ্যাম্পু, ম্যাসেজ ওয়েল, এমনকি চা, কফি, চকলেট তৈরিতেও ইহার ব্যবহার বিশ্বে প্রচুর। মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট কর্তৃক উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন হওয়ায় এ মাশরুম বাংলাদেশে খুব সহজেই চাষ করা যায়। বর্তমানে অত্র সেন্টারে এই মাশরুমের ৯টি স্ট্রেইন রয়েছে যাহা বাংলাদেশের আবহাওয়ায় গ্রীষ্মকালে (মার্চ-অক্টোবর) চাষ উপযোগী। ইহার সংরক্ষণ ক্ষমতা ও বাজারমূল্য অনেক বেশি হওয়ায় বর্তমানে এই মাশরুম আমাদের দেশে বাণিজ্যিক আকারে চাষ করা সময়ের দাবি। 
বৈশিষ্ট্য : ঔষধি গুণসম্পন্ন। সবজি হিসেবে এই মাশরুম খাওয়া যায় না। ফ্রুটিং বডি কাষ্টল প্রকৃতির। বাজারমূল্য অত্যন্ত বেশি। গ্রীষ্মকালীন মাশরুম।
ঋষি মাশরুমের মরফোলজি 
মাইসেলিয়াম প্রথমে সাদা বর্ণ ধারণ করে পরবর্তীতে ধীরে ধীরে হাল্কা হলুদ বর্ণে পরিণত হয়। প্রাইমরডিয়া সাদা-বাদামি বর্ণের কিছুটা শক্ত। প্রাইমরডিয়া যখন লম্বা হয়ে হরিণের শিংয়ের মতো ধারণ করে তখন তাকে এন্টলার (অহঃষবৎ) বলে। এন্টলারের বর্ণ কালচে লাল হয়ে থাকে। ইহা ১.০০-৮.০০ সেমি. পর্যন্ত লম্বা ও ১.০০-৩.০০ সে.মি. ব্যাসবিশিষ্ট। তরুণ পিলিয়াসকে কন্ক  বলে। এন্টলারের অগ্রভাগে হাতের তালুর মতো কন্ক ছড়াতে দেখা যায়। ইহার বর্ণ লাল এবং এর কিনারা সাদা-হলুদাভ হয়ে থাকে। ইহা ৫.০০-৮.০০ সেমি. ব্যাসের হয়ে থাকে। এন্টলার ও কন্ক পরিপক্ব হয়ে কাষ্টল প্রকৃতির ফ্রুটিং বডি ধারণ করে। এন্টলার উহার স্টাইপ  এবং কন্ক উহার পিলিয়াস  হয়ে থাকে। স্টাইপ পিলিয়াসের কিনারা বরাবর যুক্ত থাকে। পরিপক্ব ফ্রুটিং বডি অর্ধবৃত্তাকার ও কিডনির মতো। এর উপরের স্তর গাঢ় লাল, চকচকে উজ্জ্বল এবং নিচের অংশ হাল্কা বাদামি ও অসংখ্য লালচে স্পোর  ধারণ করে। 
ঋষি মাশরুম চাষের অনুকূল পরিবেশগত অবস্থা 
ঋষি মাশরুমের চাষ প্রণালী প্রযুক্তি 
ঋষি মাশরুম চাষ করার জন্য নিম্নোক্ত ধাপগুলো বিবেচনা করা হয়।
জাত বা স্ট্রেইন নির্বাচন : মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ঋষি মাশরুমের ৯টি স্ট্রেইন  আছে। স্ট্রেইনগুলো যথা : এষ-১, এষ-২, এষ-৩, এষ-৪, এষ-৫, এষ-৬, এষ-৭ এষ-৮ এষ-৯. সবগুলি স্ট্রেইন আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়ায় খুবই উপযোগী এবং চাষ করে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। 
চাষ প্রযুক্তি নির্বাচন : বিশ্বে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ঋষি মাশরুমের চাষ করা হয়। যেমন : ব্যাগ কাল্টিভেশন, লগ কাল্টিভেশন, বোতল/পট কাল্টিভেশন, ট্যাংক কাল্টিভেশন, জিন সাউ প্রযুক্তি  প্রভৃতি। মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রযুক্তি মতে বাংলাদেশে কাঠের গুঁড়া দিয়ে ব্যাগ কাল্টিভেশনের মাধ্যমে  ঋষি মাশরুম চাষ করা হয়। 
মাশরুমের বীজ উৎপাদন : পিওর কালচার থেকে মাদার কালচার প্রস্তুত পর্যন্ত প্রণালী ওয়েস্টার মাশরুমের অনুরূপ। তবে বড় সাইজের স্পন প্যাকেট ইনোকুলেশনের জন্য পাটকাঠি/বাঁশের কাঠিতে তৈরি মাদার কালচার ব্যবহার করলে মাইসেলিয়াম পরিপূর্ণ হতে সময় কম লাগে।
ঋর্ষি মাশরুমের বাণিজ্যিক স্পন তৈরির জন্য সাবস্ট্রেট ও  সাপ্লি­মেন্ট নির্বাচন 
ঋষি মাশরুমের স্পন সাবস্ট্রেট হিসেবে মিক্সড কাঠের গুঁড়া ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া উহার সহিত সাপ্লি­মেন্ট হিসেবে গমের ভূষি, চালের কুড়া, ভুট্টার পাউডার প্রভূতি ব্যবহার করা যায়। মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউিট কর্তৃক প্রযুক্তি মতে কাঠের গুড়া ও গমের ভূসি দিয়ে অত্যন্ত সহজে স্পন তৈরি করা যায় এবং ফলনও অনেক বেশি হয়। 
সাবস্ট্রেট ফরমুলেশন ও স্পন তৈরি : উল্লেখিত উপাদানগুলি (ফরমুলেশন-১ অথবা ফরমুলেশন-২) নিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে পিপি ব্যাগে ৫০০ অথবা ১০০০ গ্রাম করে ভরে প্ল­াস্টিক নেক দ্বারা বেঁধে কাঠের লাঠি দ্বারা প্যাকেটের মুখে গর্ত করে দিতে হবে। অতঃপর কটন স্টপার দিয়ে মুখ বন্ধ করে ব্রাউন পেপার দিয়ে ঢেকে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেধে দিতে হবে। তারপর অটোক্লেভ মেশিনে ১২০০ সে. তাপমাত্রায় ১.৫ কেজি/সে.মি.২ প্রেসারে ২.০ ঘন্টা রেখে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। অতঃপর প্যাকেট ঠান্ডা হলে ল্যাবরেটরিতে ক্লীনবেঞ্চে জীবাণুমুক্ত অবস্থায় মাদার কালচার দিয়ে উক্ত প্যাকেটে ইনোকুলেশন করতে হবে। ইনোকুলেশনকৃত প্যাকেটকে গ্রোথ চেম্বারে ইনকিউবেশন পিরিয়ডের জন্য রেখে দিতে হবে। এভাবে ২৫-৩০ দিন রাখার পর মাইসেলিয়াম দ্বারা প্যাকেট পূর্ণ হবে যা পরবর্তীতে চাষ ঘরে ব্যবহৃত হবে। তবে ফরমুলেশন-২ এর ক্ষেত্রে সময় কিছুটা কম লাগে।
প্যাকেট কর্তন : ঋষি মাশরুমের স্পন প্যাকেট বিভিন্ন ভাবে কর্তন করা যেতে পারে। মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রযুক্তি মতে সাইড ওপেনিং ও টপ ওপেনিং এই দুই পদ্ধতিতেই চাষ করা হয়। সাইড ওপেনিং এর ক্ষেত্রে চাষ ঘরে প্যাকেট বসানোর পূর্বে মাইসেলিয়াম পূর্ণ স্পন প্যাকেট হতে নেক, তুলা, ব্রাউন পেপার ইত্যাদি খুলে প্যাকেটের মুখ রাবার ব্যান্ড দিয়ে শক্ত করে বেধে দিতে হবে। অতঃপর কোনাযুক্ত প্যাকেটের এক পাশে মাঝ বরাবর ০.৫-১.০ সেমি. করে বর্গাকারে পিপি কেটে ব্লে­ড দিয়ে সাদা অংশ চেঁছে ফেলতে হবে। এরপর র‌্যাকে সারি সারি করে বসিয়ে দিতে হবে। তবে বোতলে চাষ অথবা প্যাকেট মাটিতে পুতে দেয়ার ক্ষেত্রে টপ ওপেনিং করাটাই ভাল। এক্ষেত্রে বোতলে অথবা প্যাকেটের উপরের দিক দিয়ে ওপেনিং করে চাষ ঘরে বসিয়ে পরিচর্যা করতে হয়।
পরিচর্যা : চাষ ঘরে র‌্যাকে মাশরুমের স্পন সাজিয়ে পরিচর্যা করলে মাশরুমের ফলন ভাল পাওয়া যায়। এ অবস্থায় চাষের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা বজায় রাখার জন্য দিনে ৩-৫ বার পানি ¯েপ্র করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেনো কোন অবস্থায় আর্দ্রতার পরিমাণ কমে না যায়। এভাবে পরিচর্যা করলে ৩-৭ দিনের মধ্যেই সাদা শক্ত পিনহেড দেখা যাবে। ইহা ৫-১০ দিনের মধ্যে আঙুলের মত লম্বা হয়ে লালচে বর্ণের হবে যাকে এন্টলার বলা হয়। এই এন্টলার পর্যায়টি ১০-১৫ দিনের মধ্যে উহার অগ্রভাগ হাতের তালুর মত চ্যাপ্টা ধারণ করবে যাকে কন্ক বলে। ইহার কিনারা সাদা-হলদে ভাব হয়ে থাকে। এই অবস্থায় চাষ ঘরের আলো ও বায়ু চলাচলের অবস্থা বাড়িয়ে দিতে হবে। এতে কন্ক দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে লালচে কিডনি আকার ধারণ করবে, কনক্রে এই পরিপক্বতাই মাশরুমের ফ্রুটিংবডি। খেয়াল রাখতে হবে যেনো চাষ ঘরে অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের করার জন্য ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা থাকে। এ ছাড়া চাষ ঘর সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন রাখতে হবে।
বোতলে চাষ পদ্ধতি : বোতলে চাষের ক্ষেত্রে উপরোক্ত উপাদানগুলি (ফরমুলেশন-১ অথবা ফরমুলেশন-২) ভাল করে মিশিয়ে ৫০০ গ্রাম করে প্ল­াস্টিক বোতলে ভরে কাঠের লাঠি দ্বারা ছিদ্র করে কটন স্টপার দিয়ে মুখ বন্ধ করে ব্রাউন পেপার দিয়ে ঢেকে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেধে দিতে হবে। তারপর অটোক্লেভ মেশিনে ১২০০ সে. তাপমাত্রায় ১.৫ কেজি/সি.মি.২ প্রেসারে ২.০ ঘন্টা জীবাণুমুক্ত করতে হবে। অতঃপর বোতল ঠান্ডা হলে ল্যাবরেটরিতে ক্লীনবেঞ্চে জীবানুমুক্ত অবস্থায় মাদার কালচার দিয়ে ইনোকুলেশন করতে হবে। ইনোকুলেশনকৃত বোতলকে গ্রোথ চেম্বারে ইনকিউবেশন পিরিয়ডের জন্য রেখে দিতে হবে। এভাবে ৩৫-৪০ দিন রাখার পর মাইসেলিয়াম দ্বারা পূর্ণ হবে এবং বোতলের মুখ খুলে দিয়ে চাষ ঘরে রেখে ঠিকমত পরিচর্যা করলে ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে ভাল ফলন পাওয়া যায়। 
সংগ্রহ ও ফলন : প্যাকেট চাষ ঘরে বসানোর ৩৫-৪০ দিনের মধ্যেই মাশরুম সংগ্রহ করা যায়। পরিপক্ব ফ্রুটিং বডি সংগ্রহের উপযোগী লক্ষণ হলো উহার কিনারার বৃদ্ধি থেমে গিয়ে সাদা-হলুদাভ থেকে সম্পূর্ণ লাল বর্ণ ধারণ করে এবং অসংখ্য লালচে স্পোর পরতে দেখা যায়। পরিপক্ব ফ্রুটিং বডি তুলে নেওয়ার পরে প্যাকেটের কাটা স্থান হতে দ্বিতীয় বার ফলন পাওয়া যায়। নিয়মিত পরিচর্যা করলে প্রতি প্যাকেট হতে ২-৩ বার ফলন পাওয়া সম্ভব। একটি ৫০০ গ্রাম ওজনের প্যাকেট হতে গড়ে ৫০-৬০ গ্রাম এবং ১০০০ গ্রাম ওজনের প্যাকেট হতে গড়ে ৭০-৯০ গ্রাম মাশরুম পাওয়া যায়।
সংরক্ষণ : ঋষি মাশরুম সংগ্রহ করে রোদে বা ড্রায়ারে  শুকাতে হবে। এরপর পিপি ব্যাগে ভরে সিলিং করে অনেক দিন সংরক্ষণ করা সম্ভব। শুকনা ঋষি মাশরুম বায়ুরোধী অবস্থায় ২ থেকে ৩ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। এ ছাড়া পাউডার করেও অনেক দিন রাখা যায়। ১ কেজি শুকনা ঋষি মাশরুম পেতে জাতভেদে ৩.০-৩.৫কেজি তাজা মাশরুম লাগে।

লেখক : মুখ্য প্রশিক্ষক, এটিআই সাটুরিয়া, মানিকগঞ্জ। সংযুক্ত: ফোকাল পারসন, মাশরুম চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন ও দারিদ্রহ্রাসকরণ প্রকল্প, মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, সাভার, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৮১৩৭১১৩, ই-মেইল : শধশড়হ.ংসফঢ়@মসধরষ.পড়স

বিস্তারিত
বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের সম্ভাবনা ও সফলতা


বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের সম্ভাবনা ও সফলতা
ড. মোঃ নুর আলম চৌধুরী
বাংলাদেশে পেঁয়াজ একটি উচ্চমানের গুরুত্বর্পূণ অর্থকরী মসলা ফসল। এর উৎপত্তিস্থল ইরান, পশ্চিম ভারত উপমহাদেশে এবং মধ্য এশিয়া বলে ধরা হয়। বর্তমানে অধিকাংশ দেশেই কম বেশি পেঁয়াজ এর আবাদ পরিলক্ষিত হলেও চীন (২৫%) এবং ভারতে (২৩%) বিশ্বের মোট উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। পুষ্টিমানের দিক থেকে ইহা যথেষ্ট পুষ্টিসমৃদ্ধ। পেঁয়াজে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ফাইটোকেমিকেলস, পলিফেনল, হলুদ পেঁয়াজের ফ্লাভেনয়েড, লাল পেঁয়াজের এন্থোসায়ানিন এবং আরও ২৫ ধরনের বিভিন্ন জটিল যৌগ যা আমাদের নানা ধরনের রোগ প্রতিরোধ ও উপশমে সহায়তা করে। পেঁয়াজ এমন একটি ফসল যা কৃষক তার ঘরে রেখে প্রয়োজনে বাজারে বিক্রি করে পরিবারের অন্যান্য প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করে। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষাবাদ বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষকদের পারিবারিক আয় বৃদ্ধিসহ পেঁয়াজের ঘাটতি (১১-১২ লাখ. মে.টন) অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব। 
আমাদের দেশে প্রায় ২.১৬ লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় ২৩.৭৬ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়। যার গড় ফলন ১১ টন/হেক্টর (কৎরংযর উরধৎু, উঅঊ, ২০২০)। উৎপাদিত পেঁয়াজের প্রায় শতভাগ শীতকালে উৎপাদিত হয়। উৎপাদন ও আমদানি বিবেচনায় এদেশের বাৎসরিক পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৩৫ লাখ টন। এ ৩৫ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে মোট দেশজ উৎপাদন ২৩-২৪ লাখ টন হলেও সংগ্রহোত্তর ২৫-৩০% অপচয়ের ফলে ব্যবহার উপযোগী উৎপাদন দাঁড়ায় ১৭-১৮ লাখ টন। বিগত বছরে প্রায় ১১-১২ লক্ষ টন পেঁয়াজের ঘাটতি ছিল, যা  বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়েছিল। ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে যথাক্রমে প্রায় ১১ ও ১২ লাখ টন, যার মূল্য প্রায় ৫-৬ হাজার কোটি টাকা। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষাবাদ এবং এর আওতায় জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করে উল্লেখিত ঘাটতি সহজেই মেটানো সম্ভব। কারণ শীতকালীন পেঁয়াজ শুধু শীতকালেই চাষাবাদ করা সম্ভব। কিন্তু গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ সারা বছর চাষ করা যায়, (রবি মৌসুমে এবং খরিফ-১ ও খরিফ-২)। বর্তমানে পেঁয়াজের চাষে এলাকা বৃদ্ধি ও উন্নত জাত ব্যবহারের কারণে ফলন বৃদ্ধি পাওয়ায় ঘাটতি কমিয়ে বর্তমান দাড়িয়েছে বছরে প্রায় ৪-৫ লাখ মেট্রিক টন। 
গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের সম্ভাবনা
আমাদের দেশে পাহাড়ি এলাকায় সমতল ভূমিতে, ছাদ বাগানে, বসতবাড়িতে এবং আন্তঃফসল হিসেবে অন্য ফসলের সাথে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। আমাদের দেশের মোট আয়তনের ১ দশমাংশ জমি পাহাড়ি এলাকায় । পাহাড়ি এলাকায় মোট জমির ৬ শতাংশ সমতল জমি বিদ্যমান। এই সমতল জমিতে সহজেই আমরা গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করতে পারি। তাছাড়া লেট খরিপে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করে হেক্টরপ্রতি ৩০-৩৫ টন ফলন পাওয়া  সম্ভব। ইক্ষু একটি দীর্ঘ মেয়াদি ফসল। বাংলাদেশে প্রায় (১.৫১ লাখ) হেক্টর জমিতে আখ চাষ হয়ে থাকে (বিবিএস, ২০১৯)। ইক্ষু লাগানো থেকে কর্তন করা পর্যন্ত প্রায় ১৪ মাস সময় লাগে। এই সময়ে আমরা সহজেই ইক্ষুর সাথে আন্তঃফসল হিসাবে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করতে পারি। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ একটি স্বল্প মেয়াদি ফসল। চারা লাগানোর ৬৫-৭০ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করা যায়। কাজেই ইক্ষু রোপণের পর থেকে মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করে ঘাটতি মেটানোসহ ইক্ষু চাষির অতিরিক্ত আয় করা সম্ভব। এ ছাড়া আদা, হলুদ ও মরচিসহ ভুট্টা ও মুখিকচুর সাথে আন্ত:ফসল হিসাবে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করে অতিরিক্ত পেঁয়াজ উৎপাদন এবং অতিরিক্ত আয় করা সম্ভব।
বসতবাড়িতে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। বসতবাড়ির আশেপাশে মাত্র ৫ মি. ও ২মি. (১০ হাত ও ৪ হাত) পরিমাণ জায়গা থাকলে একই জমিতে ফেব্রুয়ারি (মাঘ) মাসে চারা রোপণ করে ১৫-২০ কেজি, জুন (জ্যৈষ্ঠ) মাসে চারা রোপণ করে ১৫-২০ কেজি এবং সেপ্টেম্বর মাসে চারা রোপণ করে ২০-২৫ কেজি ফলন পাওয়া যায়। এ হিসাবে সারা বছর বারি পেঁয়াজ ৫ জাতের চাষ করে সর্বমোট ৬০-৬৫ কেজি ফলন পাওয়া যায়। একটি পরিবারের ৪-৫ জন সদস্যর জন্য মাসে গড়ে ৪ কেজি পেঁয়াজ কন্দের প্রয়োজন হয়। সে হিসাবে একটি পরিবারের বার্ষিক পেঁয়াজের চাহিদা ৪৮ কেজি। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনের এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশের প্রতিটি পরিবার নিজেদের বার্ষিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অতিরিক্ত উৎপাদিত পেঁয়াজ বিক্রি করেও আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে। বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ (কৃষি ডাইরি ডিএই, ২০২১) বসতবাড়ি আছে। প্রয়োজনীয় বীজ সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে এবং গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনের এই প্রযুক্তিটি যদি বাংলাদেশের ৫০ লাখ বসতবাড়িতে নিবিড় ভাবে সম্প্রসারণ করা যায় তবে ৫০০০ হেক্টর জমি পেঁয়াজ চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে। এতে প্রায় ৩ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হবে। ফলে প্রতিটি পরিবার তাদের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন, মহিলাদের কর্মসংস্থান ও পরিবারের আয়ও বৃদ্ধি করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। রুফটপ গার্ডেনিং বা ছাদ কৃষি আমাদের দেশে ক্রমশঃ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এক জরিপে দেখা গেছে যে ঢাকা সিটিতে বিল্ডিংয়ের উপর যে ছাদ তার আয়তন প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমির সমান। সেখানে সফলভাবে ছাদ বাগানে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। ছাদ বাগানে ১ মিটার ও ০.৬ মিটার আকারের ৪টি ট্রেতে ৭০-৮০ দিন পর ২.৫-৩.০ কেজি গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদন করা সম্ভব যা ৪-৫ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের মাসিক পারিবারিক চাহিদা মেটানো সম্ভব। 
গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের সফলতার গল্প
মোঃ কুতুব উদ্দিন, গ্রাম : ঘাগুরদুয়ার, উপজেলা : শিবগঞ্জ, জেলা : বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, শিবগঞ্জ, বগুড়া থেকে কোকোপিটে উৎপাদিত বারি পেঁয়াজ-৫ এবং বারি মরিচ-২ এর চারা আন্তঃফসল হিসেবে ১৫ শতক জমিতে রোপণ করে (খরিফ-১)  ৮০ দিন পর পেঁয়াজ সংগ্রহ করেন এবং ফলন পান প্রতি শতাংশে প্রায় ১.৫ মণ এর বেশি। তিনি জমিতে মোট ২০ মণ পেঁয়াজ পেয়েছিলেন। উক্ত পেঁয়াজ থেকে ছোট আকৃতির (১০-২০ গ্রাম) প্রায় ৬ মণ পেঁয়াজ রেখে দিয়েছিলেন পরবর্তী মৌসুমে মুড়ি পেঁয়াজ করার জন্য। বাকি পেঁয়াজ প্রতি মণ ৮৫০/- (আটশত পঞ্চাশ) টাকা হিসাবে মোট ১১৯০০/- (এগারো হাজার নয়শত) টাকায় বিক্রয় করেন। বারি মরিচ-২ থেকে প্রায় ২০ হাজার টাকার মরিচ বিক্রি করেন। পরবর্তীতে তিনি তার সংরক্ষিত ছোট আকৃতির পেঁয়াজ মুড়ি পেঁয়াজ করার জন্য আন্তঃফসল হিসেবে কলা এবং বেগুনের জমিতে খরিপ-২ তে  রোপণ করেন (১৪/১০/২০২১ইং তারিখে)।  ৮৮ দিন পর ফসল সংগ্রহ করেন। পাতাসহ পেঁয়াজ বিক্রি করেন ২২০০০/- টাকার। প্রতিটি পেঁয়াজের গড় ওজন ছিল ২৫০-৩৫০ গ্রাম, পাতাসহ গড় ওজন ছিল ৩৫০-৪৫০ গ্রাম। বাল্ব  পেঁয়াজ হিসেবে ১২ মণ পেঁয়াজ এবং প্রতি মণ ১২০০/- টাকা হিসাবে মোট ১৪,৪০০/- টাকায় বিক্রয় করেন । আন্তঃফসল হিসেবে ১৫ শতক জমিতে ৭ মাসে ২১৯০০/- (একুশ হাজার নয়শত) টাকা খরচ বাদে আন্তঃফসল হিসেবে শুধু পেঁয়াজ এবং মরিচ ফসল তার মোট আয় হয় ৪৬,৪০০ (ছেচল্লিশ হাজার চারশত) টাকা মাত্র। 
এ ছাড়াও বগুড়া, জয়পুরহাটের অধিকাংশ কৃষক পেঁয়াজ চাষ করে সফল হয়েছে। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ অতি উচ্চমূল্যের লাভজনক একটি অর্থকরী ফসল। চারা রোপণের ৭০-৮০ দিন পর সবুজ অবস্থায় সংগ্রহ করা যায় বলে, অনেক ফসলের সাথে আন্তঃফসল হিসেবে লাভজনকভাবে চাষ করা সম্ভব। বাংলাদেশের সকল পেঁয়াজ উৎপাদন এলাকায় সহজেই গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করা সম্ভব। মাননীয় কৃষিমন্ত্রী এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীন মসলা গবেষণা কেন্দ্র ও বিএডিসি যৌথভাবে কৃষক পর্যায়ে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের দ্রুত সম্প্রসারণের জন্য কাজ করছে। কৃষকদের যথা সময়ে বীজ প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পেঁয়াজের উপযুক্ত বাজারমূল্য নিশ্চিত করতে পারলে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ দ্রুত সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে। ফলে আমাদের দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি পূরণ করে অতিরিক্ত পেঁয়াজ বিদেশে রপ্তানি করার সুযোগ তৈরি হবে।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা কেন্দ্র, শিবগঞ্জ, বগুড়া। মোবা: ০১৭১১২৪৬৩৫২, ই-মেইল: ফসহধষধস@ুধযড়ড়.পড়স

বিস্তারিত
তথ্য ও প্রযুক্তি পাতা
তথ্য ও প্রযুক্তি পাতা
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন
বোরো ধান
 জমির ধান শতকরা ৮০ ভাগ পেকে গেলে রিপার/কম্বাইন হারভেস্টারের মাধ্যমে কম খরচে, স্বল্প সময়ে ধান সংগ্রহ করুন।
 কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে প্রতি ঘন্টায় প্রায় ৪ বিঘা জমির ধান কাটা ও মাড়াই করা যায়।
হাত/রিপার দিয়ে সংগৃহীত ধান পাওয়ার থ্রেসার দিয়ে মারাই করুন। এতে সময় ও খরচ বাঁচবে। 
আউশ ধান 
 চারার বয়স ১২ থেকে ১৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের প্রথম কিস্তি হিসেবে একরপ্রতি ১৮ কেজি ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করুন। এর ১৫ দিন পর একই মাত্রায় দ্বিতীয় কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। 
ইউরিয়া সারের কার্যকারিতা বাড়াতে জমিতে সার প্রয়োগের সময় ছিপছিপে পানি রাখাসহ জমি আগাছা মুক্ত রাখুন।
আমন ধান
এ মাসের মধ্যেই রোপা আমনের জন্য বীজতলা তৈরি করুন এবং বন্যাকালীন সময়ে চারা নষ্ট হয় বিধায় অধিক পরিমাণ চারা উৎপাদন করুন। 
 লবণাক্ত এলাকার জন্য ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৪, ব্রি ধান৭৩; অলবণাক্ত জোয়ারভাটা এলাকার জন্য ব্রি ধান৭৬, ব্রি ধান৭৭, ব্রি ধান৭৮; জলমগ্ন এলাকার জন্য ব্রি ধান৫১, ব্রি ধান৫২, ব্রি ধান৭৯; খরা প্রবণ এলাকার জন্য ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৭১; স্বল্পমেয়াদি হিসেবে ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৭৫; জিংক সমৃদ্ধ ধানের জন্য ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৭২ এছাড়া অধিক ফলনের জন্য ব্রি হাইব্রিড ধান৪, ব্রি হাইব্রিড ধান৬ আবাদ করুন।
খরাপ্রবণ এলাকায় রোপা আমন ধানক্ষেতে মিনি পুকুর খনন করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিন।
জ্যৈষ্ঠ মাসে আউশ ও বোনা আমনের জমিতে পামরী পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে হাতজাল, গামছা, লুঙ্গি, মশারি দিয়ে পামরী পোকা ধরে মেরে ফেলুন। তাছাড়া আক্রান্ত গাছের গোড়া থেকে ৫ সেন্টিমিটার (২ ইঞ্চি) রেখে বাকি অংশ কেটে দিন। আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করুন।
পাট
পাটের জমিতে আগাছা পরিষ্কার, ঘন ও দুর্বল চারা তুলে পাতলা করা, সেচ এসব কাজগুলো যথাযথভাবে করুন। 
 ফাল্গুনি তোষা জাতের জন্য একরপ্রতি ৪০ কেজি ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করুন। 
 মাটিতে রস না থাকলে বা দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে হালকা সেচ দিন এবং বৃষ্টির কারণে পানি জমে থাকলে তা বের করার ব্যবস্থা নিন। 
এ মাসে পাটের বিছা পোকা এবং ঘোড়া পোকা জমিতে আক্রমণ করে থাকে। এদের আক্রমণ রোধ করতে পোকার ডিমের গাদা, পাতার নিচ থেকে পোকা সংগ্রহ করে মেরে বা পুরিয়ে ফেলুন। আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করুন।
শাক-সবজি
লতানো সবজির দৈহিক বৃদ্ধি যত বেশি হবে তার ফুল ফল ধারণ ক্ষমতা তত কমে যায়। সেজন্য বেশি বৃদ্ধি সমৃদ্ধ লতার ১৫-২০ শতাংশের কেটে দিন এতে তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল ধরবে। 
কুমড়া জাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন অধিক ফলনে দারুণভাবে সহায়তা করবে। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন হাত পরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে।
এ মাসে কুমড়া জাতীয় ফসলে মাছি পোকা দারুণভাবে ক্ষতি করে থাকে। এক্ষেত্রে জমিতে খুঁটি বসিয়ে খুঁটির মাথায় বিষটোপ ফাঁদ দিলে বেশ উপকার হয়। এ ছাড়া সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করেও এ পোকার আক্রমণ রোধ করা যায়। 
বিবিধ
বাড়ির কাছাকাছি উঁচু এমনকি আধা ছায়াযুক্ত জায়গায় আদা হলুদের চাষ করুন। 
মাঠের মিষ্টি আলু, চিনাবাদাম বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই তুলে ফেলুন। 
গ্রীষ্মকালীন মুগডালের চাষও এ মাসে করতে পারেন। 
পতিত বা আধা ছায়াযুক্ত স্থানে অনায়াসে লতিরাজ বা পানি কচু বা অন্যান্য উপযোগী কচুর চাষ করুন।
সবুজ সার করার জন্য ধইঞ্চা বা অন্য গাছের বয়স  ৩৫-৪৫ দিন হলে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিন। সবুজ সার মাটিতে মেশানোর ৭/১০ দিন পরই ধান বা অন্যান্য চারা রোপণ করতে পারবেন।
গাছপালা
আগামী মাসে চারা লাগানোর জন্য জায়গা নির্বাচন, গর্ত তৈরি ও গর্ত প্রস্তুতি, সারের প্রাথমিক প্রয়োগ, চারা নির্বাচন এ কাজগুলো এমাসেই শেষ করতে হবে। 
নারকেল, সুপারির উপযুক্ত মাতৃগাছ থেকে ভালোবীজ সংগ্রহ করে বীজতলায় এখন লাগাতে পারেন।
 
লেখক : তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৯১১০১৯৬১০, ই-মেইল : সধহুঁৎথ১৯৮০@ুধযড়ড়.পড়স
বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর

প্রশ্নোত্তর 
কৃষিবিদ মোঃ আবু জাফর আল মুনছুর
কৃষি বিষয়ক
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
১। নাম : চন্দন, উপজেলা : সখিপুর, জেলা : টাংগাইল 
প্রশ্ন : শসার ঢলে পড়া রোগ হলে করণীয় কী?
উত্তর : আক্রান্ত গাছ তুলে নষ্ট বা পুড়ে ফেলা। যে জমিতে এ রোগ হয় একই ফসল ২/৩ বছর চাষ করা যাবে না। আক্রান্ত গাছের গোড়ায় ১% বর্দোমিকচার বা ৪০ গ্রাম অক্রিবিট ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা বা ২ গ্রাম ব্যাকটল/ব্যাকট্রোবান ১ লি: পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
২। নাম : আমিনুল ইসলাম, উপজেলা : যশোর সদর, জেলা : যশোর
প্রশ্ন : ধান বীজে বা দানায় দাগ হলে করণীয় কী?
উত্তর : আক্রমণ বেশি হলে ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে প্রোপিকোনাজল গ্রুপের যেমন- টিল্ট ২৫০ ইসি/কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রতি ৭ দিন পর পর বিকেলে স্প্রে করতে হবে ২/৩ বার। জমিতে ইউরিয়া সার ব্যবহার কমাতে হবে।
৩। নাম : শাহীন, উপজেলা : মান্দা, জেলা : নওগাঁ
প্রশ্ন : আমের ব্লাইট বা পোড়া রোগ হলে করণীয় কী?
উত্তর : আক্রান্ত গাছে ১% বর্দোমিকচার বা ৪ গ্রাম কপারব্লু/প্রাউড ১ মিলি/২ গ্রাম মেটারিল প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলা। রোগ প্রতিরোধ জাত ব্যবহার করা।
৪। নাম : জুয়েল গাজী, আমতলী, জেলা : বরগুনা
প্রশ্ন : ধান গাছের পাতার উপরের অংশ শুকিয়ে যায় করণীয় কী?
উত্তর : ব্যাকটেরিয়াল লিফ ব্লাইটের জন্য এ সমস্যা হয়ে থাকে। পটাশ সার দিতে হবে এবং চ্যাপিয়ন নামক ছত্রাকনাশক দিতে হবে।
৫। নাম : শরিফুল ইসলাম, বেলাবো, জেলা : নরসিংদী
প্রশ্ন : ধানের কা-ের ভেতর থেকে মাঝ পাতা ও শীষের গোড়া কেটে দেয়, করণীয় কী? 
উত্তর : ধানের সাকারা পোকার আক্রমণ হলে এমন হয়। সমন্বিত উপায়ে পোকা দমন করতে হবে। যেমন-কঞ্চি পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করা এবং কার্বোসালফান গ্রুপের ওষুধের ব্যবহার করতে হবে।
৬। নাম : রশিদুল, উপজেলা : কটিয়াদী, জেলা : নওগাঁ
প্রশ্ন : লিচুর ফল ছিদ্রকারী পোকা আক্রমণ করণীয় কী?
উত্তর : আক্রমণ বেশি হলে ট্রেসার-০.৪ মিলি, সাইপারমেথ্রিন ১ মিলি বা ২ মিলি সুমিথিয়ন বা ডায়াজিনন ৬০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এ ছাড়া নিমতেল বা বাইকাও ২ মিলি/লি: পানিতে গুলে স্প্রে করতে হবে।
৭। নাম : নওফেল, দুর্গাপুর, জেলা : রাজশাহী
প্রশ্ন : বেগুনের ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ, করণীয় কী?
উত্তর : জমিতে ফেরোমন ফাঁদের ব্যবহার করতে হবে চারা রোপণের ২/৩ সপ্তাহের মধ্যে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে জৈব বালাইনাশক স্পেনোসেড  ট্রেসার ৪ সি.লি/১০ লিটার) স্প্রে করতে হবে। গাছের ফুল আসার পর হতে প্রতি ২ সপ্তাহ অন্তর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।
প্রাণী বিষয়ক
১। নাম : মো: আল মামুন, গ্রাম : চিথুলিয়া, পো:+উপজেলা : সাঘাটা, জেলা : গাইবান্ধা 
প্রশ্ন : ভেড়ার খামারে সংক্রামক রোগের প্রতিরোধ করার উপায় কী কী হতে পারে?
উত্তর : জন্মের সাথে সাথে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের তেমন কোন ক্ষমতা থাকে না। তাই মায়ের উৎপাদিত শাল দুধ বাচ্চাকে এন্টিবডির মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রদান করতে পারে। ভেড়ার বাচ্চার অন্ত্রে ১২ ঘণ্টার পর থেকে শাল দুধে বিদ্যমান এন্টিবডি শোষণের হার কমতে থাকে। এ কারণে জন্মের পর ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত বাচ্চাকে শাল দুধ খাওয়াতেই হবে। মায়ের শাল দুধের প্রদত্ত রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি দিন স্থায়ী হয় না। ভেড়ার বাচ্চার ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানার সাথে রক্তও আসতে পারে। এমতাবস্থায় বাচ্চাকে দিনে বারবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে এবং দুর্বল বাচ্চাকে বোতলের মাধ্যমে দুধ না খাইয়ে ফিডারে দুধ খাওয়াতে হবে।
২। নাম : রেজভীব সুলতানা, গ্রাম : গুপ্তপাড়া, উপজেলা : মিঠাপুকুর, জেলা : রংপুর
প্রশ্ন : মুরগীর ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিকের প্রত্যাহারকাল এ বিষয়ে জানতে চাই।  
উত্তর : আপনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করছেন। এর উত্তর সারণি দ্রষ্টব্য।
৩। নাম : মোছলেউদ্দিন, গ্রাম : দড়িনারিচা, পো:+উপজেলা : ঈশ্বরদী, জেলা : পাবনা
প্রশ্ন : ব্রয়লার খামারে মুরগির শারীরিক বৃদ্ধি ঠিক রাখতে করণীয় কী?
উত্তর : ব্রয়লার মুরগির খামার স্থাপনের সময় স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে খামার স্থাপন করতে হবে। খামারে যাতে আলো ও বাতাস ঠিকমতো চলাচল করতে পারে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
খামারে পালন করা ব্রয়লারকে খাদ্য প্রদানের সময় ভালোভাবে খেয়াল করতে হবে খাদ্যে যেন কোন প্রকার ময়লা কিংবা রোগের জীবাণু না থাকে। আর খাদ্য প্রদানের পাত্র নিয়মিতভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
খামারে ব্রয়লার মুরগির জন্য যেসব খাদ্য উপকরণ ব্যবহার করা হবে সেগুলো যেন মুরগির পরিপাকে কোন বাধার সৃষ্টি না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এমন সমস্যায় মুরগির শারীরিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
ব্রয়লার মুরগির খামারকে নিয়মিত জীবাণুমুক্ত ও পরিষ্কার রাখতে হবে। এতে করে খামারের মুরগিগুলো সহজেই কোন রোগের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারবে না। ফলে শারীরিক বৃদ্ধি স্বাভাবিক হবে।
ব্রয়লার মুরগির খামারের জন্য যে ওষুধ ব্যবহার করা হবে সেই ওষুধের গুণগত মান পরীক্ষা করাতে হবে। তারপরেই সেই ওষুধকে ব্রয়লার মুরগির খামারে ব্যবহার করতে হবে। 
(প্রাণী বিষয়ক প্রশ্ন উত্তর কৃষি তথ্য সার্ভিস কল সেন্টার থেকে প্রাপ্ত)
এ ছাড়া যে কোনো পরামর্শের জন্য নিকটস্থ কৃষি, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ অফিসারের সাথে যোগাযোগ করুন ও কৃষি কল সেন্টার ১৬১২৩ নম্বরে কল করুন।

লেখক : তথ্য অফিসার (পিপি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৭১৪১০৪৮৫৩; ই-মেইল : রড়ঢ়ঢ়@ধরং.মড়া.নফ

বিস্তারিত
আষাঢ় মাসের কৃষি (১৫ জুন-১৫ জুলাই)
আষাঢ় মাসের কৃষি 
(১৫ জুন-১৫ জুলাই)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
আষাঢ় মাস। বর্ষা ঋতুর আগমন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আষাঢ় কবিতায় বর্ষাকালে গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন। এসময় খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর, ডোবা ভরে ওঠে নতুন পানির জোয়ারে। গাছপালা ধুয়ে মুছে সবুজ প্রকৃতি মন ভালো করে দেয় প্রতিটি বাঙালির। সাথে আমাদের কৃষিকাজে নিয়ে আসে ব্যাপক ব্যস্ততা। প্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন আসুন আমরা সংক্ষিপ্ত আকারে জেনে নেই আষাঢ় মাসে কৃষির আবশ্যকীয় কাজগুলো।
আউশ ধান 
আউশ ধানের ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য যত্ন নিতে হবে। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রোগ ও পোকামাকড় দমন করতে হবে। বন্যার আশঙ্কা হলে আগাম রোপণ করা আউশ ধান শতকরা ৮০ ভাগ পাকলেই কেটে মাড়াই-ঝাড়াই করে শুকিয়ে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
আমন ধান
আমন ধানের বীজতলা তৈরির সময় এখন। পানিতে ডুবে না এমন উঁচু খোলা জমিতে বীজতলা তৈরি করতে হবে। বন্যার কারণে রোপা আমনের বীজতলা করার মতো জায়গা না থাকলে ভাসমান বীজতলা বা দাপগ পদ্ধতিতে বীজতলা করে চারা উৎপাদন করা যায়।
বীজতলায় বীজ বপন করার আগে ভালো জাতের মানসম্পন্ন বীজ নির্বাচন করতে হবে। রোপা আমনের অনুকূল পরিবেশ উপযোগী উন্নত জাত, যেমন বিআর১০, ব্রি ধান৩০, ব্রি ধান৩২, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৮, ব্রি ধান৩৯, ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭২, ব্রি ধান৭৫, ব্রি ধান৭৯, ব্রি ধান৮০, ব্রি ধান৮৭, ব্রি ধান৯০, ব্রি ধান৯১, ব্রি ধান৯৩, ব্রি ধান৯৪, ব্রি ধান৯৫, ব্রি হাইব্রিড ধান৪, ব্রি হাইব্রিড ধান৬, বিনা ধান-৭, বিনা ধান-১১, বিনা ধান-১৬, বিনা ধান-১৭, বিনা ধান-২২, বিনা ধান-২৩ প্রতিকূল পরিবেশ উপযোগী উন্নত জাত চাষ করতে পারেন; 
খরাপ্রবণ এলাকাতে নাবি রোপার পরিবর্তে যথাসম্ভব আগাম রোপা আমনের (ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৯, ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬৬, ব্রি ধান৭১ এসব), লবণাক্ত ও লবণাক্ত জোয়ারভাটা অঞ্চলে ব্রি ধান৭৩, ব্রি ধান৭৮, অলবণাক্ত জোয়ারভাটা অঞ্চলে ব্রি ধান৭৬, ব্রি ধান৭৭ এবং জলাবদ্ধতা সহনশীল জাত ব্রি ধান৭৯ চাষ করা যেতে পারে;
ভালো চারা পেতে প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ২ কেজি গোবর, ১০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ১০ গ্রাম জিপসাম সার প্রয়োগ করা যায়।
আষাঢ় মাসে রোপা আমন ধানের চারা রোপণ শুরু করা যায়; 
মূল জমিতে শেষ চাষের সময় হেক্টরপ্রতি ৯০ কেজি টিএসপি, ৭০ কেজি এমওপি, ১১ কেজি দস্তা এবং ৬০ কেজি জিপসাম  দেয়া প্রয়োজন; জমির এক কোণে মিনিপুকুর খনন করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে পারেন যেন পরবর্তীতে সম্পূরক সেচ নিশ্চিত করা যায়।
ভুট্টা
পরিপক্ব হওয়ার পর বৃষ্টিতে নষ্ট হওয়ার আগে মোচা সংগ্রহ করে  ঘরের বারান্দায় সংগ্রহ করতে পারেন। এক্ষেত্রে মোচা থেকে দানা সংগ্রহ করতে প্রয়োজনে ভুট্টা মারাই যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। রোদ হলে শুকিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মোচা পাকতে দেরি হলে মোচার আগা চাপ দিয়ে নিম্নমুখী করে দিতে হবে, এতে বৃষ্টিতে মোচা নষ্ট হবে না।
পাট
পাট গাছের বয়স চারমাস হলে ক্ষেতের গাছ কেটে নিতে হবে। পাট গাছ কাটার পর চিকন ও মোটা গাছ আলাদা করে আঁটি বেঁধে দুই/তিন দিন দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে। পাতা ঝরে গেলে ৩/৪ দিন পাট গাছগুলোর গোড়া একফুট পানিতে ডুবিয়ে রাখার পর পরিষ্কার পানিতে জাগ দিতে হবে। 
পাট পচে গেলে পানিতে আঁটি ভাসিয়ে আঁশ ছাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে পাটের আঁশের গুণাগুণ ভালো থাকবে। ছাড়ানো আঁশ পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে বাঁশের আড়ে শুকাতে হবে। যেসব জায়গায় জাগ দেয়ার পানির অভাব সেখানে রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পচাতে পারেন। এতে আঁশের মান ভালো হয় এবং পচন সময় কমে যায়।
পাটের বীজ উৎপাদনের জন্য ১০০ দিন বয়সের পাট গাছের এক থেকে দেড় ফুট ডগা কেটে নিয়ে দুটি গিঁটসহ ৩/৪ টুকরা করে ভেজা জমিতে দক্ষিণমুখী কাত করে রোপণ করতে হবে। রোপণ করা টুকরোগুলো থেকে ডালপালা বের হয়ে নতুন চারা হবে। পরবর্তীতে এসব চারায় প্রচুর ফল ধরবে এবং তা থেকে বীজ পাওয়া যাবে।
শাকসবজি
এ সময়ে উৎপাদিত শাকসবজির মধ্যে আছে ডাঁটা, গিমাকলমি, পুঁইশাক, চিচিঙ্গা, ধুন্দুল, ঝিঙা, শসা, ঢেঁড়স, বেগুন। এসব সবজির গোড়ার আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং প্রয়োজনে মাটি তুলে দিতে হবে। এ ছাড়া বন্যার পানি সহনশীল লতিরাজ কচুর আবাদ করতে পারেন; উপকূলীয় অঞ্চলে ঘেরের পাড়ে গিমাকলমি ও অন্যান্য ফসল আবাদ করতে পারেন; সবজি ক্ষেতে পানি জমতে দেয়া যাবে না। পানি জমে গেলে সরানোর ব্যবস্থা নিতে হবে; তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল ধরার জন্য বেশি বৃদ্ধি সমৃদ্ধ লতাজাতীয় গাছের ১৫-২০ শতাংশের লতাপাতা কেটে দিতে হবে। কুমড়াজাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন করতে হবে। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন ভোরবেলা হাত পরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে।
আগাম জাতের শিম এবং লাউয়ের জন্য প্রায় ৩ ফুট দূরে দূরে ১ ফুট চওড়া ও ১ ফুট গভীর করে মাদা তৈরি করতে হবে। মাদা তৈরির সময় গর্তপ্রতি ১০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম সরিষার খৈল, ২ কেজি ছাই, ১০০ গ্রাম টিএসপি ভালোভাবে মাদার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর প্রতি গাদায় ৩/৪টি ভালো সবল বীজ রোপণ করতে হবে। এ ছাড়াও আগাম শীতকালীন সবজি উৎপাদনে টানেল টেকনোলজি ব্যবহার করা যেতে পারে।
গাছপালা
এ সময়টা গাছের চারা রোপণের জন্য খুবই উপযুক্ত। বসতবাড়ির আশপাশে, খোলা জায়গায়, চাষাবাদের অনুপযোগী পতিত জমিতে, রাস্তাঘাটের পাশে, পুকুর পাড়ে, নদীর তীরে গাছের চারা বা কলম রোপণের উদ্যোগ নিতে হবে; এ সময় বনজ গাছের চারা ছাড়াও ফল ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ করতে পারেন; ফলের চারা রোপণের আগে গর্ত তৈরি করতে হবে; সাধারণ হিসাব  অনুযায়ী এক ফুট চওড়া ও এক ফুট গভীর গর্ত করে গর্তের মাটির সাথে ১০০ গ্রাম করে টিএসপি ও এমওপি সার মিশিয়ে, দিন দশের পরে চারা বা কলম লাগাতে হবে; বৃক্ষ রোপণের ক্ষেত্রে উন্নত জাতের রোগমুক্ত সুস্থ-সবল চারা বা কলম রোপণ করতে হবে; চারা শুধু রোপণ করলেই হবে না। এগুলোকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। চারা রোপণের পর শক্ত খুঁটি দিয়ে চারা বেঁধে দিতে হবে। এরপর বেড়া বা খাঁচা দিয়ে চারা রক্ষা করা, গোড়ায় মাটি দেয়া, আগাছা পরিষ্কার, সেচনিকাশ নিশ্চিত করতে হবে; নার্সারি মালিক যারা তাদের মাতৃগাছ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি খুব জরুরি। সার প্রয়োগ, আগাছা পরিষ্কার, দুর্বল রোগাক্রান্ত ডালপালা কাটা বা ছেঁটে দেয়ার কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে হবে।
প্রাণিসম্পদ
বর্ষাকালে হাঁসমুরগির ঘর যাতে জীবাণুমুক্ত ও আলো-বাতাসপূর্ণ থাকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে; এ মাসে হাঁস- মুরগির কৃমি, কলেরা, রক্ত আমাশায়, পুলরাম রোগ, সংক্রমণ সর্দি দেখা দিতে পারে।             চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে; বর্ষাকালে গবাদিপশুকে সংরক্ষণ করা খড়, শুকনো ঘাস, ভুসি, কুঁড়া খেতে দিতে হবে। সে সাথে কাঁচা ঘাস খাওয়াতে হবে। মাঠ থেকে সংগৃহীত সবুজ ঘাস ভালোভাবে পরিষ্কার না করে খাওয়ানো যাবে না; বর্ষাকালে গবাদিপশুর গলাফোলা, তড়কা, বাদলা, ক্ষুরারোগ মহামারি আকারে দেখা দিতে পারে। এ জন্য প্রতিষেধক টিকা দিতে হবে; এ সময় ডাইরিয়া এবং নিউমোনিয়া রোগে গবাদিপশুকে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। তাই গবাদিপশুকে ঠান্ডামুক্ত ও শুষ্ক জায়গায় রাখতে হবে। এ ছাড়াও যেকোনো পরামর্শের জন্য উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
মৎস্য সম্পদ
বর্ষা মৌসুমে পুকুরের পাড় উঁচু করে দিতে হবে; বন্যার সময় পুকুরে মাছ আটকানোর জন্য জাল, বাঁশের চাটাই দিয়ে ঘেরা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে; আষাঢ় মাস মাছের পোনা ছাড়ার উপযুক্ত সময়। মাছ চাষের জন্য মিশ্র পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন; পুকুরে নিয়মিত খাবার দিতে হবে এবং জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে; বড় পুকুরে, হাওরে, বিলে, নদীতে খাঁচায় মাছ চাষ করতে পারেন;  মাছ চাষের যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, এ সময় বীজ ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় কৃষি উপকরণগুলো বন্যামুক্ত উঁচু বা নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। আপনাদের আগাম প্রস্তুতির জন্য আগামী মাসে উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর বিষয়ে সংক্ষিপ্তভাবে জানিয়ে দেয়া হয়। বিস্তারিত জানার জন্য স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি-মৎস্য-প্রাণী বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন। 
 
লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪; ই-মেইল : বফরঃড়ৎ@ধরং.মড়া.নফ
বিস্তারিত