Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। বর্ষার ঋতুর আগমন ঘটে আষাঢ় মাস দিয়েই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে আসে- বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে।’ সে সাথে গাছে গাছে নতুন পাতা, ফুল ও ফল। প্রকৃতি সেজে ওঠে নতুন সাজে। ফলদ বৃক্ষজাতীয় গাছের চারা লাগানোর উপযুক্ত সময় এটি। আমাদের দেশের আবহাওয়া, মাটি ও জলবায়ু ফল চাষের উপযোগী। বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্র্যে, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে ফলের সমারোহ দেখা যায়। জীবনচক্রের সব পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিতে দৈনিক পরিমিত পরিমাণে ফলমূল খাওয়া প্রয়োজন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রণীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানে পর্যাপ্ত পুষ্টি প্রাপ্যতা একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। জাতির পিতার দূরদর্শী নীতির আলোকে তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-২০৪১) সফলভাবে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
সুষম খাদ্যাভ্যাসের দ্বারাই সুস্থ জীবনযাপন সম্ভব। দ্বিতীয় জাতীয় পুষ্টিকণা জরিপ (২০১৯-২০২০) তথ্য অনুযায়ী অনুপুষ্টিকণা মানুষের খুব কম প্রয়োজন হয় কিন্তু সামান্য ঘাটতিতে অনেক বড় সমস্যার সম্মুখীন হয়। শিশুদের ছয় মাসের পর থেকে ২ বছর পর্যন্ত মায়ের দুধের পাশাপাশি ঘরে তৈরি সুষম খাদ্য দিতে হবে। কিশোর কিশোরীদের পুষ্টিকর খাবারের প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। পুষ্টিবিদদের মতে, বাংলাদেশের পুষ্টি উন্নয়নের মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্য গ্রহণের ধরনে কালের ধারায় বৈচিত্র্যতা এসেছে। ঐওঊঝ ২০২২ তথ্য মতে, শহরের (২৩২৪.৬ কি. ক্যালরি) তুলনায় গ্রামে (২৪২৪.২ কি. ক্যালরি) মাথাপিছু দৈনিক খাদ্যশক্তি  ভোগের মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রাণিজ আমিষ (মাংস, দুধ, ডিম ও মাছ) এবং  খাদ্যশস্য বহির্ভূত ফসল (শাকসবজি ও ফলমূল) ভোগের ক্ষেত্রে এ ধারা বিদ্যমান ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে মাথাপিছু দৈনিক ফলের চাহিদা ২০০ গ্রাম কিন্তু খাওয়া হচ্ছে প্রায় ৯৮-১০০ গ্রাম। দেশের ফলের চাহিদা অর্জনে কৃষি বিজ্ঞানীদের নতুন নতুন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন, দেশীয় ফলের আবাদের পাশাপাশি বিদেশি ফলের অভিযোজিতা ও মূল্যায়নের মাধ্যমে সম্ভাবনাময় ফলের জাত সম্প্রসারণ হচ্ছে। বর্তমানে ফল চাষের জমির পরিমাণ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলের সুষ্ঠু বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে রফতানি উপযোগী জাতের ব্যবহার, উত্তম কৃষি চর্চা (এঅচ) মেনে উৎপাদন, সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, আধুনিক প্যাকিং হাউজ নির্মাণ, অ্যাক্রিডিটেড ল্যাব স্থাপনসহ নানামুখী কাজ চলমান রয়েছে। এ সম্পর্কে           কৃষিকথায় “ফলের আমদানি কমিয়ে রপ্তানি বাড়াতে করণীয়” নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
এ ছাড়াও সময়োপযোগী তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত প্রবন্ধ, আগামী কৃষি ভাবনা, সফল কৃষকের গল্প ও নিয়মিত বিভাগ নিয়ে সাজানো হয়েছে এ পত্রিকাটি। যা জনসাধারণের দীর্ঘ ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনুপ্রাণিত করবে।

বিস্তারিত
সূচিপত্র

সূচিপত্র

নিবন্ধ/প্রবন্ধ
    
   ফলের আমদানি কমিয়ে রপ্তানি বাড়াতে করণীয়     ০৩    
    মৃত্যুঞ্জয় রায়
    গুড় ও লাল চিনির ঘাটতি পূরণে গ্রীষ্মকালীন রোপা আখ চাষ    ০৫
    নিতাই চন্দ্র রায়
    বীজ প্রযুক্তি গবেষণার বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ করণীয়    ০৭    
    ড. মোঃ আবু হেনা ছরোয়ার জাহান, ড. পরিমল চন্দ্র সরকার, মো. আরাফাত হোসেন
    স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়ন কৌশল    ১০
    ড. মো. জামাল উদ্দিন
    আমের সংগ্রহত্তোর গুণগত বৈশিষ্ট্য ও মাননিয়ন্ত্রণ    ১২    
    কৃষিবিদ খোন্দকার মোঃ মেসবাহুল ইসলাম        
    নিরাপদ মাংসের প্রাপ্যতা ও ভোগে করণীয়     ১৫
    মো. কাওছারুল ইসলাম সিকদার    
    লোনাপানির ভেটকি মাছের চাষ পদ্ধতি    ১৭
    মো: তোফাজউদ্দিন আহমেদ
    অনলাইনে কোরবানির জন্য সঠিক গরু কেনার কৌশল    ১৯
    ডা: সুচয়ন চৌধুরী
ফসল উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তি
    খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে খেতের আইলে ফসল চাষ    ২১    
    কৃষিবিদ মোঃ সুনাইন বিন জামান
    আধুনিক প্রযুক্তিতে পাটবীজ উৎপাদন সংরক্ষণ    ২৩
    সাদিয়া আফরিন জুই
আগামীর কৃষি ভাবনা
    কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানি খাতের সম্ভাবনা    ২৫    
    মোঃ মনজুরুল হান্নান
    প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ নদীমাতৃক বাংলাদেশে চরাঞ্চলের কৃষির সম্ভাবনা    ২৭
    মুহাম্মদ মালেক হুসাইন
সফল কৃষকের গল্প

    লটকন চাষ করে ভাগ্য বদল করছেন নরসিংদীর শত শত চাষি    ২৯    
    অপর্ণা বড়–য়া

নিয়মিত বিভাগ
    শ্রাবণ মাসের কৃষি (১৬ জুলাই- ১৫ আগস্ট)    ৩১
    কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম

বিস্তারিত
ফলের আমদানি কমিয়ে রপ্তানি বাড়াতে করণীয়

ফলের আমদানি কমিয়ে রপ্তানি বাড়াতে করণীয়
মৃত্যুঞ্জয় রায়
বিপর্যস্ত আবহাওয়া আর চারদিকে এত অসুখ-বিসুখের মধ্যেও ভালো খবর হলো এদেশের মানুষের মধ্যে ফল খাওয়ার আগ্রহ ও পরিমাণ বেড়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২-এর প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক ফল খাওয়া উচিত ২০০ গ্রাম। বিবিএস-এর জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে একজন মানুষের রোজ ফল খাওয়ার পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৫.৮০ গ্রাম। বর্তমানে এ দেশের মানুষের ফলমূল খাওয়া ২০১৬ সালের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। তাই বিবিএস-এর এই জরিপের তথ্য আমাদের জন্য সুসংবাদ বটে। এর অর্থ এ দেশের মানুষ এখন নিজেদের স্বাস্থ্যের কথা ভাবছে, ফল খাওয়ার দিকে ঝুঁকছে। পাশাপাশি ফলের উৎপাদনও বাড়ছে। এ দেশে ২০০৮-২০০৯ সালে ফলের উৎপাদন ছিল প্রায় ১ কোটি টন, বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২২ লাখ টনে, বিগত ১২ বছরে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ২২ শতাংশ।  
এক জরিপে দেখা যায় বয়স নির্বিশেষে দেশের প্রায় ৩৮ শতাংশ মানুষের রক্তে শর্করা বা চিনির পরিমাণ বেশি, দেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি লোকের ফ্যাটি লিভার রয়েছে। এর কারণে জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে আমাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা, বাড়ছে হৃদরোগসহ নানা রকম অসুখের ঝুঁকি। পাশাপাশি এই ঝুঁকি কমাতে পারে নিয়মিতভাবে নিরাপদ ফল ও শাকসবজি গ্রহণ করা।
বিদেশী ফলের আমদানি
মানুষের মধ্যে ফল খাওয়ার অভ্যাস বদলানো বা ফল খাওয়া বাড়ানোর পেছনে শুধু যে স্বাস্থ্য সচেতনতার বিষয়টি কাজ করছে তা নয়- এক্ষেত্রে এদেশে সারা বছর ধরে সাম্প্রতিক সময়ে দেশী-বিদেশী ফলের প্রাপ্যতাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আগে এ দেশে যে পরিমাণ ফল উৎপন্ন হতো তার প্রায় শতকরা ৫৬ ভাগ ফল পাওয়া যেত গ্রীষ্ম-বর্ষা ঋতুর চার মাসে। বাকি ৪৪ শতাংশ ফল পাওয়া যেত বছরের বাকি আট মাসে। শীতকালে দেশি ফল বলতে ছিল কুল, কলা-পেঁপেও পাওয়া যেত কম। তাই শীতকালে ফল খাওয়ার জন্য আমাদের নির্ভর করতে হতো বিদেশী ফল কমলা, আপেল, আঙুর, নাশপাতি, খেজুর ইত্যাদি ফলের ওপর। এ কারণে সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আট মাসে এ দেশে বিদেশী ফল আমদানি করা হয় বেশি, সবচেয়ে বেশি ফল আমদানি করা হয় সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি- এই পাঁচ মাসে।
বিদ্যমান বৈশ্বিক সংকটের কারণে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকায় ফল আমদানিতে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রিত শুল্ক আরোপ করে সরকার, বন্ধ করা হয় ফল আমদানিতে ব্যাংকের ঋণ সুবিধা। এর প্রভাবে ফলের আমদানি কমে ৩০ থেকে ৩৮ শতাংশ। কিন্তু আমদানি কমলেও মানুষের ফল কেনা ও খাওয়ার প্রতি তার তেমন কোনো বিরূপ প্রভাব লক্ষ করা যায়নি। বরং ফলের বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বিদেশী ফলের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ বেশি করে দেশী ফল কেনার দিকে ঝুঁকছে। আমরাও তা চাই- মানুষ বিদেশী ফল ছেড়ে দেশী ফল খাওয়া অভ্যাস করুক। যে পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের কথা ভেবে আমরা ফল খাই, বিদেশী ফল কখনো তা দেশী ফলের মতো পূরণ করতে পারে না। বরং বিদেশী ফলে নানারকম রাসায়নিক প্রিজারভেটিভ দেওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে তা খাওয়া পুষ্টিকর হয় না। মনে রাখা উচিত, বিদেশী ফল কখনোই দেশী ফলের মতো টাটকা না-বাসী বা অনেক দিন আগে গাছ থেকে পাড়া, গাছ থেকে পাড়ার পর যত দিন যায় সেসব ফলের পুষ্টিমানও তত কমতে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশে দুই ধরনের ফল আমদানি করা হয়- ‘তাজা ফল বা ফ্রেশ ফ্রুটস’ ও ‘শুষ্ক ফল বা ড্রাই ফ্রুটস’। ফ্রেশ ফ্রুট ক্যাটাগরিতে আছে আপেল, কমলা, মাল্টা, ম্যান্ডারিন, আনার বা বেদানা, আঙুর, নাশপাতি, ড্রাগন ফ্রুট, স্ট্রবেরী, কিউইসহ ৫২ রকমের ফল। ড্রাই ফ্রুটস ক্যাটাগরিতে আমদানি করা হয় খেজুর, কিসমিস, আলুবোখরা, বিভিন্ন প্রকার বাদাম ইত্যাদি। এসব ফল আমদানি করা হয় দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, নিউজিল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, ভুটান, মিসর, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, থাইল্যান্ড, তিউনিশিয়া, পোল্যান্ড, ব্রাজিল ইত্যাদি দেশ থেকে। এ দেশে সবচেয়ে বেশি ফল আসে ভারত থেকে।
প্রতি বছর এ দেশে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টন ফল আমদানি করতে ১০ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা চলে যায়। ডলারের এই আকালের দিনে বিদেশী মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যাওয়া ঠেকাতে সরকার অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি সব ধরনের ফল আমদানিকেও নিরুৎসাহিত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। এর ফলে দেশের বাজারে এখন বিদেশী ফলের প্রাপ্যতা গড়ে প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে। এই ঘাটতি পূরণ করতে এখন সারা বছরই এ দেশে ফল উৎপাদনের বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
দেশী ফলের রপ্তানি
আমরা যদি ফলের বাজারের দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে শীত কিংবা শরতেও দেখতে পাব, দোকানের ডালি ভরা টসটসে ডাশা পেয়ারা, তরমুজ, কলা, পেঁপে, আনারস, কুল, ড্রাগন ফ্রুট, স্ট্রবেরী ইত্যাদি ফল। এখন অনেক ফল অমৌসুমেও চাষ হচ্ছে। এমনকি গ্রীষ্মকাল ছাড়াও এখন অন্য মৌসুমে মিলছে দেশে উৎপাদিত আম, বাঙ্গি বা মেলন ও তরমুজ। ফলের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গবেষণা ও সম্প্রসারণে সত্যিই এক চমৎকার রূপান্তর ঘটেছে। দেশে বর্তমানে সবমিলিয়ে বছরে প্রায় ১ কোটি ২২ লাখ টন ফল উৎপাদিত হচ্ছে। বছরে ফলের ফলন বৃদ্ধির হারের দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাব মতে, বিশ্বে বাংলাদেশ কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম ও পেঁপে উৎপাদনে চতুর্দশতম। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বলেছে, বিগত বিশ বছরে বাংলাদেশে ফল চাষের উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ হারে, ফল চাষের জমি বেড়েছে বছরে ১০ শতাংশ হারে। গত ১০ বছরে এ দেশে আম ও পেয়ারার উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ, পেঁপের আড়াইগুণ, লিচুর ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া মাল্টার ১৫-২০ শতাংশ হারে ও কমলার ৫ শতাংশ হারে প্রতি বছর উৎপাদন বাড়ছে।
বিশ্বে অন্যতম রপ্তানিযোগ্য ফলগুলো হলো আম, ম্যাঙ্গোস্টিন, পেয়ারা, আনারস, অ্যাভোকেডো, পেঁপে ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক বাজারে ১ টন আমের জাতভেদে মূল্য ১২৪৩-১৪৬২ ইউএস ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি কেজি আমের পাইকারি দাম প্রায় ২.৫ ইউএস ডলার। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আম রপ্তানি করে চীন। এফএও-এর তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, চীন ২০২২ সালে সে দেশ থেকে আম রপ্তানি করে ৮ লাখ ৬৩ হাজার ৮৮৫ টন। গত বছর ভারত ও পাকিস্তান যথাক্রমে আম রপ্তানি করে ৭৮৪৮০ টন ও ১৪০৫০১ টন। বাংলাদেশে বছরে প্রায়            ২৪-২৫ লাখ টন আম উৎপাদিত হয়। সরকার ২০২৭ সালের মধ্যে বছরে ১ লাখ টন আম রপ্তানির পরিকল্পনা নিয়েছে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ২০২১ সালে বিশ্বে প্রায় ১৫০ কোটি ডলারের আম রপ্তানি বাণিজ্য হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে ২০১৮-২০১৯ সালে ৩১০ টন, ২০১৯-২০২০ সালে ২৮৩ টন, ২০২০-২০২১ সালে ১৬৩২ টন, ২০২১-২০২২ সালে ১৭৫৭ টন আম রপ্তানি করা হয়। ২০১১-২০২২ সালে রপ্তানিকৃত আমের মূল্য ছিল ১৭ কোটি টাকা। দেশে বর্তমানে প্রায় ২৪ লাখ টন আম উৎপাদিত হলেও এর প্রায় ৩০ শতাংশ বিভিন্ন পর্যায়ে নষ্ট হয়। সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে ফলের এই অপচয় কমাতে হবে।
বিশ্ববাজারে মোট ২১ জাতের আম বিভিন্ন দেশ থেকে রপ্তানি করা হয়। এগুলোর মধ্যে হিমসাগর জাতের আম এ দেশ থেকে বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে যা ইতোমধ্যে বিদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এমনকি দেশী জাত ছাড়া এখন কাটিমন, তোতাপুরী, নাম ডক মাই, মিয়াজাকি, অলফ্যানসো, কেইট, পালমার ইত্যাদি জাতের মতো বেশ কিছু বিদেশী জাতের আমও এ দেশে সীমিত আকারে চাষ করে সাফল্য পাওয়া গেছে। ইউরোপীয় বাজারে টমি অ্যাটকিনস, কেইট ও কেন্ট জাতের আমের বিপুল চাহিদা রয়েছে। রপ্তানিযোগ্য বেশ কিছু বিদেশী ফল বিশেষ করে ড্রাগন ফ্রুট চাষে যেন বিপ্লব ঘটে গেছে। এ ছাড়া স্ট্রবেরী, অ্যাভোকেডো, রাম্বুটান, ম্যাঙ্গোস্টিন, আলুবোখরা, রকমেলন, আঙুর ইত্যাদি ফল এদেশে চাষ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র অ্যাভোকেডোর বৃহত্তম আমদানিকারক। সে দেশে ১ টন (১০০০ কেজি) অ্যাভোকেডোর মূল্য প্রায় ৩৪০০ ইউএস ডলার। আগ্রহী ফল চাষিদের যদি উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা যায় তাহলে বাণিজ্যিক সম্ভাবনাময় এসব রপ্তানিযোগ্য ফল চাষেও এদেশে সফলতা আসতে পারে।
সারকথা
দেশের অনেক মানুষ জানেন যে, বিদেশী ফলের চেয়ে দেশী ফল বেশি টাটকা ও পুষ্টিকর, দামেও সস্তা। এক কেজি আপেলের দামে ৫ কেজি পেয়ারা কেনা যায়, ১ কেজি কমলার দামে কেনা যায় ১০টা বাতাবি লেবু। তাই দেশী ফল খাওয়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। যে ফল যে অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়ায় ভালো হয় সেখানে সেই ফলের নিবিড় চাষ সম্প্রসারণ করতে হবে। উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়াতে হবে। রপ্তানি বাড়াতে হলে প্রধান তিনটি পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত আন্তর্জাতিক বাজার যাচাই ও অনুসন্ধান করে কোন কোন ফল রপ্তানিযোগ্য ফল হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা যায় তা চিহ্নিত করে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, দ্বিতীয়ত চুক্তিভিত্তিক ফলচাষি নির্বাচন করে এলাকাভিত্তিক ফল চাষ করতে হবে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে এবং তৃতীয়ত আন্তর্জাতিক মানের অ্যাক্রিডিটেশন ল্যাবরেটরি স্থাপনের মাধ্যমে রপ্তানির জন্য মান যাচাই ও প্রত্যয়ন প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। পাশাপাশি বিদেশী ফলের আমদানি ও বিপণন সীমিত বা নিরুৎসাহিত করতে হবে।

লেখক: কৃষি বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশন ও অতিরিক্ত পরিচালক (অব:), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মোবাইল : ০১৭১৮২০৯১০৭, ই- মেইল : শনফসৎরঃুঁহ@মসধরষ.পড়স

 

বিস্তারিত
গুড় ও লাল চিনির ঘাটতি পূরণে গ্রীষ্মকালীন রোপা আখ চাষ

গুড় ও লাল চিনির ঘাটতি পূরণে গ্রীষ্মকালীন
রোপা আখ চাষ
নিতাই চন্দ্র রায়
আখ বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি অর্থকরী ফসল। একে বীমাকৃত ফসল বললেও ভুল  হবে না। খরা, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং রোগ-পোকার আক্রমণের  সাথে সংগ্রাম করে ভালোভাবে মাঠে  টিকে থাকতে পারে এই ঘাতসহিষ্ণু ফসল। আমাদের মনে রাখা উচিত, ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালের বন্যায় সারা দেশের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও মাঠের ফসল পানির নিচে তলিয়ে  গেলেও  একমাত্র আখই বন্যার ঘোলা জলের উপর মাথা  উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। বন্যার পানি সরে যাওয়ার সাথে সাথে কৃষক আখ মাড়াই ও নতুন গুড় বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে বাড়িঘর ও কৃষি যন্ত্রপাতি মেরামত করে। রবি ফসলের চাষ করে বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে  আবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হন। বন্যার সময় পশুখাদ্যের তীব্র অভাবও অনেকটা মেটানো হয়। ওই ভয়াবহ বন্যায় অনেক গরিব মানুষ সারাদিনে এক খ- আখ চিবিয়ে খেয়েও জীবন রক্ষা করে। আখের কোনো কিছুই ফেলানা যায় না। আখের মুথা জ¦ালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আখের সবুজ পাতা পশুর প্রিয় খাদ্য। ছোবড়া থেকে কাগজের ম- তৈরি করা হয়। শুকনা পাতা ঘর ছাওয়ার  কাজে ব্যবহার করা হয়।
দেশে বার্ষিক চিনির চাহিদা প্রায় ১৮ লাখ টন। গুড়ের চাহিদা কম করে হলেও ৯ লাখ টন। বর্তমানে দেশে গুড় উৎপাদিত হয়  আনুমানিক ৩ থেকে ৪ লাখ টন। বছরে গুড়ের ঘাটতি প্রায় সাড়ে ৫ থেকে ৬ লাখ টন। গুড়ের এই বিশাল ঘাটতি পূরণে মিল বহির্ভূত এলাকায় আখ চাষ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। তাই শুধু শীতকালে নয়; গ্রীষ্মকালেও আধুনিক পদ্ধতিতে রোপা আখের চাষ করতে হবে এবং চাষ এলাকাও ফলন বাড়াতে হবে।
বিশুদ্ধ বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে আখের ফলন শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ বাড়ানো যায়। তাই গ্রীষ্মকালীন রোপা আখের জন্য উন্নত জাতের উচ্চফলনশীল, রোগ-পোকামাকড় মুক্ত, প্রজনন বিশুদ্ধ, আর্দ্র গরমপানিতে শোধিত বীজ ব্যবহার করা উচিত। বীজের বয়স হওয়া উচিত ৯ থেকে ১০ মাস।
 গুড় ও লাল চিনি তৈরিতে গ্রীষ্মকালীন রোপা আখের জন্য উপযুক্ত জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঈশ^রদী ২/৫৪. লতারিজবা-সি, ঈশ^রদী-৩৪, ঈশ^রদী-৩৭, ঈশ^রদী-৩৮, ঈশ^রদী-৩৯ ও মিশ্রিমালা উল্লেখযোগ্য। চিবিয়ে খাওয়ার জন্য বনপাড়া গেন্ডারি, কিউ-৬৯, বিএসআরআই আখ-৪১, বিএসআরআই আখ-৪২ (রঙবিলাস) ও বিএসআরআই আখ ৪৭ জাত নির্বাচন করা যেতে পারে। গ্রীষ্মকালীন রোপা আখ চাষে জন্য অবশ্যই উঁচু দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি নির্বাচন  করতে হবে।
রোপা আখ চাষে বীজতলা ও পলিব্যাগ পদ্ধতি ছাড়াও -১. গাছ চারা পদ্ধতি; ২. পাশর্^কুশি (লেটারাল) পদ্ধতি; ৩. স্টকলেস চারা ও ৪. চোখ চারা পদ্ধতি থাকলেও কৃষকের কাছে  সাধারণ বীজতলা পদ্ধতিই অধিক জনপ্রিয়।
চৈত্রের মাঝামাঝি থেকে বৈশাখ মাসে ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া, মল্লিকবাড়ি ও শ্রীপুর চাষিরা বীজতলায় আখের চারা তৈরি করেন। ৭.২ মিটার দৈর্ঘ ১.২ মিটার প্রস্থের ৮টি বীজতলার চারা দিয়ে এক এক জমিতে রোপা আখের চাষ করা যায়। প্রতিটি বীজতলার মাটি ভালোভাবে চাষ করে ঝুরঝুরা করতে হবে। সুস্থ ও পোকামুক্ত চারার জন্য প্রতিটি বীজতলাতে ৭৫ কেজি পচা গোবর, ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০০ গ্রাম টিএসপিও ২৫০ গ্রাম এমওপি এবং ২০০ গ্রাম   রিজেন্ট-৩ জিআর প্রয়োগ করতে হবে। রোগের আক্রমণ হতে চারা আখ রক্ষার জন্য বীজখ-গুলো একটি মাটির পাত্রে ২৫ লিটার পানিতে ২৫ গ্রাম এমকোজিম মিশিয়ে  তাতে বীজখ-গুলো ২৫ মিনিটি শোধন করতে হবে। এতে আখ লাল পচা, কালো শীষ, ঢলে পড়া, আনারসগন্ধ               প্রভৃতি রোগ হতে রক্ষা পেতে পারে। বীজতলায় আখের চোখ পাশাপাশি রেখে ছত্রাক শোধিতকৃত বীজখ-গুলো মাটির সমান্তরালে এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যাতে প্রত্যেকটি বীজ খ-ের মাঝখানে কানি আঙুল পরিমাণ ফাঁকা থাকে। তারপর বীজখ-গুলোর ওপর বেড প্রতি ২০০ গ্রাম রিজেন্ট-৩ জিআর ছিটিয়ে আধা ইঞ্চি মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এতে উঁই পোকার আক্রমণ থেকে বীজখ-গুলো রক্ষা পাবে। তারপর বীজতলার ওপর হালকা করে আখের শুকনা পাতা বিছিয়ে সামান্য মাটি আধা ইঞ্চি মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। চারাগুলো গরু ছাগলের উপদ্রব থেকে রক্ষা  করার জন্য বীজতলার চার দিকে পলিথিনের জাল দিয়ে বেড়া দিতে হবে।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া, মল্লিকবাড়ি ও শ্রীপুর এলাকায় আমন ধান কাটার পর কৃষকের তেমন কাজ থাকে না। এ সময় তারা আখ থেকে লাল চিনি ও গুড় তৈরি শুরু করেন। আখের ওপরের দিকের ৩০ থেকে ৪৫ সেন্টিমিটার পরিমাণ অংশ কেটে আঁটি বেঁধে মাটির গর্তে সংরক্ষণ করেন। মাঝে মধ্যে সামান্য পানির ছিটা দিলে ১০ থেকে ২০ দিনের মধ্যে আখের চোখ ফোটতে শুরু করে। তখন মাটির গর্তে জাগ দেয়া মাথার বীজখ-ের পাতা ছড়িয়ে ধারালো দা দিয়ে  দু’চোখ করে কেটে বীজখ- তৈরি করা হয়।
সাধারণত  ময়মনসিংহ ও শ্রীপুর অঞ্চলে মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য জ্যৈষ্ঠে বৃষ্টিপাত শুরু হলে গ্রীষ্মকালীন রোপা আখের চারা মূল জমিতে রোপণ করা হয়। এ সময় মাঝে মধ্যে বৃষ্টি হয় বলে সেচের তেমন প্রয়োজন হয় না বললেই চলে। মূল জমিতে চারা রোপণের জন্য ৬০ সেন্টিমিটার দূরে কোদাল দ্বারা নালা তৈরি করতে হবে। নালায় একর প্রতি ৫ টন পচা গোবার বা আবর্জনা পচা সার প্রয়োগ করতে হবে। ১১০কেজি টিএসপি, ৬৬ কেজি জিপসাম ও ৩ কেজি দস্তা সার প্রয়োগ করে নালার মাটির সাথে কুপিয়ে উত্তমরূপে মিশিয়ে দিতে হবে। তারপর নালায় সেচ দিয়ে মাটি কাদাময় করে ধানের চারার মতো ১৫ সেন্টিমিটার দূরে দূরে আখের চারা লাগাতে হবে। উঁইপোকা আক্রমণের হাত থেকে রক্ষার জন্য একর প্রতি ৬.৬ কেজি হারে রিজেন্ট-৩ জিআর নালার মাটিতে চারা রোপণের আগেই সারের সাথে ব্যবহার করতে হবে। বীজতলার এক কোনায় ফাঁকা স্থান পূরণের জন্য একর প্রতি ১ হাজার চারা রেখে দিতে হবে। চারা রোপণের ৭ দিন পর আর একটি সেচ দিতে হবে। প্রতিটি সেচের পর জমির মাটি আলগা করে দিতে হবে। চারা রোপণের ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে মৃত চারার ফাঁকা স্থান বীজতলার রেখে দেয়া চারা দিয়ে পূরণ করতে হবে। ফাঁকা স্থান পূরণের সময় চারার ২/৩ অংশ অবশ্যই কেটে দিতে হবে।
ভালো চারার জন্য যেসব যত্ন করতে হবে তার মধ্যে রয়েছে- ১) রসের অভাব হলে মাঝে মধ্যে বীজকলায় সেচ দিতে হবে। ২) বীজতলায় রোগাক্রান্ত চারা দেখা দিলে সাথে সাথে তা তুলে ফেলতে হবে। চারাগুলো ৩/৪ পাতা বিশিষ্ট হলে ৭ দিন পর পর চারার পাতা ২ থেকে ৩ বার কেটে দিতে হবে।
চারা রোপণের ২৫ থেকে ৩০ দিন পর একর প্রতি ৫৫ কেজি ইউরিয়া ও ৩৩ কেজি এমওপি সার ও ১৩ কেজি রিজেন্ট ৩ জিআর  চারার চারদিকে রিং পদ্ধতিতে প্রয়োগ করে চারার গোড়ার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি ৫৫ কেজি ইউরিয়া ৩৩ কেজি এমওপি সার চারার চারদিকে একই পদ্ধতিতে প্রয়োগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সার উপরিপ্রয়োগের সময় জমিতে জো অবস্থা থাকতে সেচ প্রয়োগ করার পর জো অবস্থা সৃষ্টি হলেই সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
আখের ভালো ফলনের জন্য সময় মতো আগাছা দমন, মাটি আলগাকরণ, রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন, সার উপরিপ্রয়োগ, কুশি ব্যবস্থাপনা, আখের গোড়ায় মাটি দেয়া, শুকনা পাতা ছাড়ানো ও আখ বাঁধার মতো কাজগুলো যথাসময়ে সম্পন্ন করতে হবে।
ফুলবাড়িয়া উপজেলার কৃষকগণ লাল চিনি ও গুড় উৎপাদন করেন। তাদের একজন বলেন, প্রতি একর জমির আখ থেকে ১ হাজার ৯২০ কেজি লাল চিনি উৎপাদিত হয়। প্রতি কেজি লাল চিনির  বর্তমানে ১২০ টাকা কেজি পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে। সে হিসেবে প্রতি একর জমির উৎপাদিত লাল চিনি বিক্রি করে কৃষকের আয়  হয় ২ লাখ ৩০ হাজার ৪০০ টন। উৎপাদন খরচ ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা বাদ দিলে কৃষকের নিট লাভ দাঁড়ায় ৭০ হাজার ৪০০ টাকা, যা অন্য কোনো মাঠ ফসলে সম্ভব নয়। এ কারণে দিন দিন বাড়ছে ফুলবাড়িয়া, মল্লিকবাড়ি, গৌরিপুর, শ্রীপুর, মধুপুরের গড়অঞ্চল এবং গফরগাঁয়ের চর এলাকাসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে আখের চাষ, লালচিনি ও গুড় উৎপাদন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, মেধাবী জাতি গঠনে মিষ্টিজাতীয় খাবারের কোনো বিকল্প নেই। তাই মিল বহির্ভূত এলাকা বিশেষ করে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে গ্রীষ্মকালীন রোপা আখ চাষ, লাল চিনি ও গুড় উৎপাদন বৃদ্ধি কল্পে নিম্নলিখিত সুপারিশমালাগুলো জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর করা উচিত। সুপারিশগুলো হলো- ১) পূর্বের ন্যায় মিল বহির্ভূত এলাকায় আখ চাষ জোরদারকরণ প্রকল্প চালু করা যেতে পারে। ২) মিল জোন এলাকার মতো রোপা ও মুড়ি আখ চাষের ওপর কৃষকদের সমপরিমাণ ভর্তুকি দেয়া প্রয়োজন। এই ভর্র্তুকির টাকা যাতে প্রকৃত আখ উৎপাদনকারীগণ পান তাও নিশ্চিত করতে হবে। ৩) মিল বহির্ভূত লাল চিনি ও গুড় উৎপাদন এলাকার আখ ও গুড় উৎপাদকারী কৃষক, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের আখ চাষের উন্নত প্রযুক্তি, নিরাপদ লাল চিনি-গুড় উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের ওপর প্রতি বছর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ৪) মিল বহির্ভূত এলাকায় আর্দ্রগরম বাতাস শোধিত ভিত্তি বীজ উৎপাদন, বর্ধন ও বিতরণের জন্য বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ও বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ নিয়মিত  লাইন   থেকে লাইন বীজ ক্ষেত পরিদর্শন ও  রোগিং ছাড়া বীজক্ষেতের কোনো মূল্য নেই। ৫) দেশের গুড় উৎপাদন এলাকাগুলোতে ছোটছোট গুড় মিল স্থাপনের ব্যাপারে বিএসআরআয়ের কৃষি প্রকৌশল বিভাগকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি উৎপাদন করার উদ্যোগ নিতে হবে। ৬) কৃষি যন্ত্রপাতির মতো বিএসআরআই উদ্ভাবিত বিদ্যুৎ চালিত উন্নত আখ মাড়াই যন্ত্রের ওপর  শতকরা ৭০ ভাগ ভর্তুকি দেয়া যেতে পারে। ৭) গুড় এলাকায় বিষাক্ত হাইড্রোজের ব্যবহার বন্ধের জন্য ব্যাপক ভিত্তিতে বন ঢেঁড়স ও ঘৃত কুমারির চাষ এবং উলটকম্বল ও শিমুল গাছের চারা রোপণ করতে হবে। ৮) মিল এলাকার মতো গুড় এলাকার আখ চাষিদের মধ্যে অবশ্যই স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ প্রদান করা যেতে পারে। ৯) ভেজাল গুড় উৎপাদন ও বিপণন বন্ধে নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের ম্যাজিস্ট্রেটগণের সহাতায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে এবং দোষিদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন, পরিচালক (যোগাযোগ) কৃষাণ সীডস্, মফিজ উদ্দিন ইনডেক্স প্লাজা, ছোট বাজার, ময়মনসিংহ। মোবাইল: ০১৭২২৬৯৬৩৮৭; ই- মেইল : হবঃধরৎড়ু১৮@ুধযড়ড়.পড়স

 

বিস্তারিত
বীজ প্রযুক্তি গবেষণার বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ করণীয়

বীজ প্রযুক্তি গবেষণার বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ করণীয়
ড. মোঃ আবু হেনা ছরোয়ার জাহান১ ড. পরিমল চন্দ্র সরকার২ মো. আরাফাত হোসেন৩
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। কৃষিই এদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। ফসল উৎপাদনের প্রধান উপকরণ হলো মানসম্পন্ন বীজ। দেশে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা মিলে শতকরা ৩০ ভাগ মানসস্পন্ন বীজ সরবরাহ করছে। এর মধ্যে ধানে শতকরা ৪২ ভাগ, ভুট্টায় শতকরা ৫৬ ভাগ, পাটে শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ, ডালে শতকরা ১২ ভাগ, তৈলবীজে শতকরা ১৫ ভাগ, সবজিতে শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ এবং আলুতে শতকরা ১৬ ভাগ বীজ সরবরাহ করতে পারে (উৎস: কৃষি মন্ত্রণালয় ২০২১-২০২২)। বাকি বীজ কৃষকের। নিজে রাখে এবং বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানি বিদেশ থেকে আমদানি করে দেশের চাহিদা পূরণ করে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৮২ মেট্রিক টন প্রজনন ও মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। ফসল উৎপাদন আর সেই ফসলের বীজ উৎপাদন সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে থাকে। কৃষি পরিবেশ, উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, জীবনকাল প্রভৃতি কারনে এই ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। এজন্য বীজ উৎপাদনের জন্য বপন/রোপণ দূরত্ব, সার, সেচ ও বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে থাকে। এজন্য বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ প্রযুক্তি ফসল উৎপাদন ও সংরক্ষণ প্রযুক্তি থেকে ভিন্নতর। তাছাড়া এক মৌসুমে উৎপাদিত বীজ পরবর্তী মৌসুমে বা পরবর্তী বৎসরে ব্যবহার করতে হয় বিধায় অনেকসময় বীজ একটা দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করতে হয়। তাই মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণে বীজ প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
বীজ প্রযুক্তি
বীজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, পরীক্ষণ, মাননিয়ন্ত্রণ, বাজারজাতকরণ ও বিতরণ এবং বীজ উন্নয়নের সামগ্রিক বিষয়সমূহ বীজ প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন প্রযুক্তিসমূহ নিম্নরূপ-
মুগডালের বীজ উৎপাদন : সমন্বিত আগাছা দমনের মাধ্যমে মুগডালের মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন করতে হবে। জমি চাষের এক সপ্তাহ পূর্বে আগাছানাশক গ¬াইফোসেট প্রতি লিটার পানিতে ৭.৫ মিলিলিটার হারে ৫ শতক জমির জন্য ১০ লিটার মিশ্রণ প্রয়োগ করে পরবর্তীতে চারা গজানোর ২০ দিন পর একবার নিড়ানি দ্বারা আগাছা পরিষ্কার করলে ১.৫৭ টন/হেক্টর মানসম্পন্ন (শতকরা ৮০ ভাগের অধিক গজানো ক্ষমতাসম্পন্ন) মুগডালের বীজ পাওয়া যায়। আগাছানাশক গ¬াইফোসেট সব ধরনের আগাছা দমনের জন্য কার্যকরী। এই প্রযুক্তিতে মোট লাভ (এৎড়ংং গধৎমরহ) ১,৩৪,৮৫০ টাকা/হেক্টর এবং প্রতি এককে পরিবর্তনশীল ব্যয় (ঠধৎরধনষব পড়ংঃ) যদি ৫ টাকা বাড়ানো হয় তবে আয় বাড়বে ৩২ টাকা। প্রান্তিক আয়-ব্যয়ের অনুপাত (গধৎমরহধষ ইবহবভরঃ ঈড়ংঃ জধঃরড় (গইঈজ) ৬.৪ঃ১।
টমেটোর বীজ উৎপাদন : টমেটোর থোকা, টমেটো ফলের পরিপক্বতা ও ফল সংগ্রহোত্তর পরিপক্বতার সঠিক সময় নির্ধারণের মাধ্যমে মানসম্পন্ন টমেটো বীজ উৎপাদন করতে হবে। টমেটো থোকায় থোকায় গাছের গোড়া থেকে উপর দিক পর্যন্ত অবিরত ধরতে থাকে আবার একই থোকায় অনেকগুলো টমেটো ফল ধরে থাকে। তাই বীজের পরিপক্বতা বিভিন্ন থোকাতে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। বীজের জন্য গাছের নিচ থেকে টমেটো ফলের ২য়, ৩য় ও ৪র্থ থোকা থেকে অর্ধ-পরিপক্ব (ফলের চার ভাগের তিন ভাগ রঙিন) ফল বীজের জন্য নির্বাচন করতে হবে। কেননা এ ফল থেকে প্রাপ্ত বীজের মান অধিকতর ভালো হয়ে থাকে। তাছাড়া পরিপক্বতার অবস্থা ও সংগ্রহ পরবর্তী সময়ের ভিন্নতার দরুণ বীজের মানের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। অর্ধ-পরিপক্ব ফল সংগ্রহ করে সাথে সাথে তা থেকে বীজ সংগ্রহ করা উচিত নয়। ফলকে ০২ (দুই) দিন স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ঘরে রেখে দিয়ে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
করলা বীজ উৎপাদন : ভৌত ও রাসায়নিক পদ্ধতিতে বীজের সুপ্ততা ভেঙে এবং বপনের সঠিক সময় নির্ধারণের মাধ্যমে করলার মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন করা যায়। করলা বীজকে ১% পটাশিয়াম নাইট্রেট অথবা ১% বরিক এসিড অথবা স্বাভাবিক পানিতে ১৬ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখলে বীজের সুপ্ততা হ্রাস পায় এবং অংকুরোদগম হার বেড়ে যায়। ফলশ্রুতিতে বীজ হার কম লাগে এবং কৃষকের উৎপাদন খরচ কম পড়ে। মানসম্পন্ন করলা বীজ উৎপাদনের জন্য বর্ষা ঋতুর চেয়ে গ্রীষ্ম ঋতু অধিকতর ভাল। সময়মত বীজ শুকানো না গেলে বীজের মান ভাল হয় না। অক্টোবর মাসের থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত করলা বীজ বপন করে দেখা যায় যে, ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করলা বীজ বপন করা উত্তম। এই সময়ে বীজ বপন করে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বীজ সংগ্রহ করা হলে সবচেয়ে বেশি গজানো হার সম্পন্ন অধিক বীজ পাওয়া যায়। ফলে এদেশের কৃষকেরা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন।
ফ্রেশ কাউমিল্ক (গরুর দুধ) এর মাধ্যমে বীজ প্রাইমিং করে করোলা বীজের অংকুরোদগম বৃদ্ধি করা যায়। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ফ্রেশ কাউমিল্ক (গাভীর দুধ) ৮০ ভাগ +পানি ২০ ভাগ এর মিশ্রণে বীজ ১৮ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখার পর বীজ ধুয়ে ১ ঘণ্টা ছায়াযুক্ত স্থানে কক্ষ তাপমাত্রায় শুকানোর পর বপন করতে হবে। গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১ মিটার হলে প্রতি হেক্টরে খরচ ৫৭৬ টাকা এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১.৫ মিটার হলে প্রতি হেক্টরে খরচ ৩৮৪ টাকা প্রতি কেজি দুধের মূল্য ৮০ টাকা হারে এ পদ্ধতি বীজ গজানোর সময় ৩-৪ দিন কম লাগে। বীজ গজানোর শতকরা হার স্বাভাবিকের চেয়ে ২৫-৩০ ভাগ বেশি হয় ফলে হেক্টর প্রতি বীজের পরিমাণ কম প্রয়োজন হয়। বীজ গজানোর শতকরা হার ৯৫ ভাগের বেশি হয়ে থাকে।
মরিচের বীজ উৎপাদন : পরিপক্ব ফলের রং, শুকানোর ধরন এবং সঠিক পাত্রে সংরক্ষণের মাধ্যমে মরিচের মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন করা সম্ভব। পরাগায়নের ৬০-৭০ দিনের সময় অর্থাৎ গাছের বয়স যখন ১২৫-১৩৫ দিন হয় তখন ফল পরিপক্ব হয়। এই সময় মরিচের ফল হালকা লালচে রঙ ধারন করে। বীজে শুস্ক পদার্থের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে। তখন বীজের আর্দ্রতা থাকে ২৯% এবং বীজ গজানোর হার প্রায় ৯৬%। মরিচের ফল বোটাসহ সংগ্রহ করতে হবে। বীজ শুকানোর পদ্ধতি এবং গুদামে বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতিও বীজের মান নির্ণয়ে বিশেষ ভূমিকা রেখে থাকে। রৌদ্রে (৩২+২ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায়) ৬ দিন (প্রতিদিন ৬ ঘন্টা করে) মরিচ ফল শুকানো ভালো। আবার রৌদ্রে শুকানোর চেয়ে ৪০০ সে. তাপমাত্রায় ৩ দিন (চলমান) ওভেনে শুকানো বীজের মান ভালো হয়ে থাকে। ওভেনে শুকানো বীজের গজানোর হার ৮০% হয়ে থাকে। খোসা সহ বীজ শুকালে তা থেকে খোসা ছাড়ানো বীজের চেয়ে ভালো মানের বীজ পাওয়া যায়। মরিচ ফল শুকানোর পর বায়ুরোধী টিন অথবা প¬াস্টিক পাত্রে অথবা পলিথিন ব্যাগে সংরক্ষণ করতে হবে।
চাল কুমড়ার বীজ উৎপাদন : বীজের সুপ্ততা ভাঙা, গাছে ফলের অবস্থান, ফল সংগ্রহের সময় ও সংগ্রহোত্তর পরিপক্বতার সময়, ফলের আকার ও ফলে বীজের অবস্থান নির্ধারণের মাধ্যমে চালকুমড়ার মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন করা হয়। চালকুমড়া বীজ মাঠে বপনের পূর্বে ০.৪% পটাশিয়াম নাইট্রেট (প্রতি লিটার পানিতে ৪ গ্রাম পটাশিয়াম নাইট্রেট) এ ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখার পর অথবা ডিপ ফ্রিজে (তাপমাত্রা ৪-৫ ডিগ্রি সে.) ৪ দিন রেখে দেওয়ার পর বপন করলে বীজ গজানোর হার বৃদ্ধি পায়। চালকুমড়ার ফলের বৃদ্ধি ও ফলের ভিতরের বীজের পরিপক্বতা পৃথকভাবে হয়ে থাকে। তাই বীজের মান ফলের পরিপক্বতা আবার গাছের বিভিন্ন পর্বে ফলের অবস্থানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। লতা ও ফলের বোঁটা শুকালে বীজের জন্য ফল সংগ্রহ করতে হবে। গাছের ৩১ থেকে ৫০ পর্ব পর্যন্ত সংগৃহীত ফলের বীজের মান অধিকতর ভালো হয়ে থাকে। ফলের বোটার দিকের এক-তৃতীয়াংশ (১/৩ ভাগ) অংশের বীজের মান (গজানোর হার ৮১% এর অধিক) ভালো হয়ে থাকে। ফল সংগ্রহের সাথে সাথে বীজের অংকুরোদগম হার কম (৩০% এর নিচে) থাকে এবং কক্ষ তাপমাত্রায় ৫০ দিন পর্যন্ত এই হারের তেমন পরিবর্তন হয় না। তবে ৫০ দিন পর সুপ্ততা ভাঙ্গার কারনে অংকুরোদগম হার ক্রমশ বেড়ে সংরক্ষণের ৭ মাস পর ৮০% এর উপরে হয়ে থাকে।
মিষ্টি মরিচের বীজ উৎপাদন : সঠিক রোপণ সময়, রোপণ দূরত্ব, গাছের ফলের সংখ্যা ও ফল সংগ্রহের সময় নির্ধারণের মাধ্যমে মিষ্টিমরিচের মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন করা যায়। অক্টোবর মাস বীজতলায় মিষ্টি মরিচের বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। ১ মাস বয়সের চারা নভেম্বর পর্যন্ত রোপণ করা যায়, তবে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে চারা রোপণ উত্তম সময়। ১ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট বেডে ১ মাস বয়সী চারা লাগাতে হয়। এক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫০ সেমি. এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ৪০ সেমি.। প্রতি গাছে ৬-৮টি ফল রাখলে মানসম্পন্ন (৮৫% এর অধিক গজানোর ক্ষমতাসম্পন্ন) বীজ পাওয়া যায়। মিষ্টি মরিচ সম্পূর্ণ লাল রং ধারণ করলে সংগ্রহ করতে হয়। পরাগায়নের ৯০ দিনে ফল সংগ্রহ উপযোগী হয়ে থাকে। ফল সংগ্রহের পর ৩-৭ দিন স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ঘরে রেখে দিয়ে বীজ সংগ্রহ করলে বীজের মান ভালো হয়।
গমের বীজ উৎপাদন : রেইজ্ড বেড পদ্ধতিতে জমি চাষাবাদ, বীজ শোধন এবং বপন সঠিক সময় নির্ধারণের মাধ্যমে গমের মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন করা যায়। এই পদ্ধতিতে বেড প¬্যান্টার যন্ত্র দিয়ে চাষ করলে জমি চাষের সাথে সাথে বেড তৈরি, সারিতে বীজ বপন ও সার দেয়াসহ মাটি ঢেকে দেয়া সম্ভব হয়। জমির আর্দ্রতা শেষ হওয়ার পূর্বেই দ্রুত চাষ করা সম্ভব হয়। তাছাড়া দুই বেডের মাঝের নালায় কম সময়ে স্বল্প পরিমাণ পানি দিয়ে সেচ দেয়া সম্ভব হয়। এ পদ্ধতিতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস গাছের গোড়া পর্যন্ত পৌঁছায়। এতে গাছের বাড়-বাড়তি ভাল হয়। রোগবালাই বিশেষত ইঁদুরের উপদ্রব কম হয়। আগাছা দমন সহজ হয়। পানি ও সারের সুষ্ঠু ব্যবহারের ফলে গমের (বারি গম-২৬ জাতের) গাছ প্রতি গমের কুশি বেশি হয় এবং প্রতি কুশিতে বীজের সংখ্যা বেশি হয়। বীজ পুষ্ট হয়, বীজের ওজন অধিক হয়ে থাকে। ফলশ্রুতিতে একক জমি প্রতি বীজের ফলন অধিক হয়। বীজের আকার বড় হওয়ার কারণে বীজের মান তথা বীজ গজানোর হার বেশি হয়ে থাকে। ফলে কৃষকের বীজ হার কম লাগে। এবং বীজের উৎপাদন খরচ কমে যায়।
গম বীজ বোনার পূর্বে একটি ড্রাম অথবা বিস্কুটের টিনে ৫ কিলোগ্রাম গম বীজের সাথে ১২.৫ গ্রাম ভিটাভেক্স (প্রতি কেজিতে ২.৫ গ্রাম) নিয়ে টিনটি পাঁচবার ওপর নিচ করে ঝাকালে বীজের সাথে ভিটাভেক্স -২০০ ভালোভাবে মিশে যায়। গমের বীজ (জাত-সুফী) ২০ নভেম্বর বপন করলে বীজের ফলন অধিক (৩.৩৩ টন/হে.) হয়ে থাকে। সুফী জাতের গম বিজয় ও প্রদীপ জাতের চেয়ে আগাম পরিপক্ব হয়ে থাকে। ডিসেম্বর মাসের ৫ ও ২০ তারিখে বপনের তুলনায় ২০ নভেম্বর বপন করলে গমের ফলন বৃদ্ধির হার অধিক হয়ে থাকে। ২০ নভেম্বরে বপনকৃত গাছ থেকে সংগৃহীত বীজ টিনের পাত্রে রাখলে গজানো হার বেশি (প্রায় ৯৭%) হয়ে থাকে।
মুগবীজ উৎপাদন : বপন মৌসুম ও সময় নির্ধারণ, ন্যাপথালিন এসেটিক এসিড প্রয়োগ এবং পড উত্তোলনের সঠিক সময় নির্ধারণের মাধ্যমে গুণগতমান সম্পন্ন মুগবীজ উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় মুগ খরিফ-১ (মার্চ-মে) ও খরিফ-২ (আগস্ট-নভেম্বর) মৌসুমে চাষ করা যায়। ভাল মানের বীজ পেতে খরিফ-১ মৌসুমে মুগবিন চাষ করা উত্তম। তবে খরিফ-২ মৌসুমে অর্থ্যাৎ আগস্ট মাসে বপনকৃত মুগবিন থেকেও উন্নত মানের বীজ পাওয়া যায়। মুগবিন একটি ইনডিটারমিনেট টাইপ (ওহফবঃবৎসরহধঃব ঃুঢ়ব) ফসল। সে কারণে মানসম্পন্ন বীজ পেতে হলে প্রথমবারের সংগ্রহকৃত পড থেকে বীজ সংরক্ষণ করতে হবে। পরবর্তীতে উত্তোলিত পড থেকে প্রাপ্ত বীজের গজানোর ক্ষমতা এবং বীজের সতেজতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়। মুগের ফুল আসার পূর্বে (বপনের ৩০ দিনের সময়) ৩০ পিপিএম মাত্রায় ন্যাপথালিন এসেটিক এসিড গাছে একবার প্রয়োগ করলে একক জমি প্রতি বীজের উৎপাদন অধিক হয়ে থাকে।
ফেলন বীজ উৎপাদন : ভাল বীজ উৎপাদনের জন্য নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি হতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বপনকৃত ফসল থেকে বীজ সংগ্রহ করা দরকার। ফসল পরিপক্ব হলে প্রথমবারের (ঋরৎংঃ ভষধংয) গুটি থেকে সংগ্রহকৃত বীজই উত্তম। অতি বৃষ্টিতে বীজের মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই যদি প্রথম ফসল তোলার সময় বৃষ্টি হয় তবে দ্বিতীয় বারের তোলা ফসল হতে বীজ রাখতে হবে।
ঝাড়শিমের বীজ উৎপাদন : সমন্বিত সার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়ানো যায়; মাটির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ এবং মাটিস্থ উপকারী জীবাণুর কর্মক্ষমতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা যায়। ২৫-৩০ সেমি দূরত্বের সারিতে ১০-১৫ সেমি. দূরে দূরে বীজ লাগাতে হয়। আমাদের দেশে নভেম্বর মাস বীজ বপনের জন্য সবচেযে উত্তম সময়। তবে সুনিষ্কাশিত জমি হলে অক্টোবর মাসে রোপণ করতে পারলে আগাম শিমের দাম ভাল পাওয়া যায়। ইউরিয়া ১৫০-১৬০ কেজি; টিএসপি ১৫০-১৬০ কেজি; এমওপি ৯০-১০০ কেজি; জিপসাম ৮-২০ কেজি; বোরন ৬-৮ কেজি; যে কোন একটি জৈব সার ৩.০ টন বায়োচার বা ৩ টন ট্টাইকোকম্পোস্ট বা ৩.০ টন ভার্মিকম্পোস্ট বা ৫.০ টন পোল্ট্রি বিষ্ঠা। জমি তৈরির সময় সমুদয় গোবর, টিএসপি, এমপি ও অর্ধেক ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হয়। বাকি ইউরিয়া ১৫ দিন ও ৩০ দিন পর ২ বার উপরিপ্রয়োগ করা হয়। ঝাড় শিম বীজ পরিপক্ব হতে প্রায়  ১৩০-১৪০ দিন সময় দরকার হয়। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ঝাড়শিমের হেক্টর প্রতি ফলন ১.০-১.৫ মেট্রিকটন পাওয়া যায়।
সয়াবিন বীজ উৎপাদন : জিবেরেলিক এসিড এর প্রয়োগের মাধ্যমে সয়াবিনের মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন করা যায়। প¬ান্ট গ্রোথ রেগুলেটর (উদ্ভিদ বর্ধক হরমোন) গাছের ফলন বৃদ্ধিতে সহায়ক। জিবেরেলিক এসিড গাছের কা-, ফুল এবং মুকুলের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। পড গঠনের সময় জিবেরেলিক এসিড এর মাত্রা ১০০ পিপিএম (প্রতি লিটার পানিতে ১০০ মিলি গ্রাম) হারে স্প্রে করলে সয়াবিনের ফলন স্বাভাবিকের চেয়ে            ১৫-২০% বেশি হয়। হেক্টর প্রতি বীজের ফলন ১.৭-২.০ মে. টন হয়ে থাকে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে সয়াবিনের বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা শতকরা ৮৫ ভাগের বেশি হয়। কৃষকের ফলন শতকরা ১৫-২০ ভাগ বৃদ্ধি পায়।
বীজ সংরক্ষণ
বীজ পরিপক্ব হওয়ার পর শুকনা দিনে ফসল কাটতে হবে। ফসল কাটার পর দ্রুত বীজ মাড়াই করে রোদে শুকিয়ে এবং ঝেঁড়ে নিতে হবে। বীজ রোদে দিয়ে এমনভাবে শুকাতে হবে যেন বীজের আর্দ্রতা প্রায় শতকরা ৮-৯ ভাগের কাছাকাছি থাকে। শুকানোর পর বীজ ঠা-া করে বায়ুরোধী পাত্র যেমন টিনের পাত্র, প¬াস্টিক ড্রাম এবং মোটা পলিথিনসহ চটের ব্যাগে কক্ষ তাপমাত্রায় (২৬-৩২ ডিগ্রি সে.) ঘরের মধ্যে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ তুলনামূলক ভাবে ঠা-া এবং শুষ্ক ঘরে রাখা উত্তম। এভাবে সংরক্ষণ করলে পরবর্তী মৌসুম পর্যন্ত বীজের গুনগত মান অক্ষুন্ন রাখা সম্ভব। মাঝে মাঝে শুষ্ক এবং রৌদ্রোজ্জল দিনে বীজ শুকানো যেতে পারে।
সংরক্ষণকালে বালাই দমনের ক্ষেত্রে বীজ মাটির মটকাতে বা টিনের পাত্রে শুকনো নিমপাতাসহ বা ছাই মিশিয়ে ঘরের মাচায় সংরক্ষণ করতে হবে। প্রতি ২০ কেজি বীজের জন্যে ৬-৭ মুঠি শুকনো নিম পাতা বা ছাই তিন স্তর (তলায়, মাঝে এবং উপরে) মিশাতে হবে। তবে উপরের স্তর বেশি পুরু হবে। এভাবে বীজ সংরক্ষণ করলে বীজের অংঙ্কুরোদগম ক্ষমতা সন্তোষজনক থাকে।
কিন্তু চীনাবাদামের ক্ষেত্রে  আর্দ্র আবহাওয়ায় ২৫ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় চীনাবাদাম বীজের মাটির অভ্যন্তরেই অংঙ্কুরোদগম ঘটে। বাংলাদেশে এটি একটি বড় সমস্যা। ভাল বা গুনগত মানের বীজ পেতে হলে ফসল যথা সময়ে কাটতে এবং সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। চীনাবাদাম বীজ বায়ু নিরোধক পাত্রে যেমন পলিথিনযুক্ত চটের বস্তা বা দুই স্তর বিশিষ্ট পলিথিন বস্তায় ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড ব্যবহার করে বীজ সংরক্ষণ করে বীজের জীবন কাল প্রলম্বিত করা যায়। ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড কাপড়ের পুটলিতে বেঁধে একটি ছিদ্রযুক্ত ঢাকনাওয়ালা কৌটায় রাখতে হবে। তারপর বস্তায় (৪০ কেজি বস্তায়) প্রথমে অর্ধেক অংশ বাদাম বীজ দিয়ে ভরতে হবে। এই পর্যায়ে ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড কৌটাটি খাড়া করে স্থাপন করতে হবে। অতঃপর বস্তার বাকী অংশ বীজ দিয়ে ভর্তি করে মুখ ভালভাবে বন্ধ করতে হবে। এছাড়াও ঠা-া ঘর (কুলরুম) যেখানে তাপমাত্রা ১৮-২০ ডিগ্রি সে. এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৪০-৪৫% থাকে সেখানে ১ বৎসর থেকে ২ বৎসর পর্যন্ত শুকানো বীজ (৮-১০% বীজের আর্দ্রতা) সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা যায়। ডিপ ফ্রিজ বা অধিক ঠা-া ঘর যেখানে তাপমাত্রা ৩-৪ ডিগ্রি সে. এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৩০% এর নীচে থাকে সেখানে শুকানো বীজ (৭-৮% বীজের আর্দ্রতা) ৩-৫ বৎসর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
ভবিষ্যৎ করণীয় : বীজের কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা, ভৌত ও শারীরতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা এবং বীজের স্বাস্থ্য নিয়ে মৌলিক গবেষণা করা প্রয়োজন। উৎপাদনের প্রথম শর্তই হলো বীজের কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা বজায় রাখা। এজন্য জীব প্রযুক্তি বিষয়ক প্রযুক্তির সাহায্যে বীজের কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা সংক্রান্ত গবেষণা প্রয়োজন। শারীরতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতার উন্নয়নের জন্য মলিকুলার পর্যায়ে গবেষণা প্রয়োজন। শারীরতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে বীজের উৎপাদন বৃদ্ধি ও মান উন্নয়নের জন্য দায়ী কারনসমূহ উদঘাটনে গবেষণা প্রয়োজন। বীজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ পর্যায়ে রোগবালাই ও পোকামাকড় এর আক্রমণ ও প্রতিকার নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। জলবায়ূ প্রতিকূলতা সহনশীল বীজ উৎপাদন গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা সময়ের দাবি। ৪র্থ শিল্প বিপ¬বের প্রেক্ষাপটে বীজ গবেষণা ক্ষেত্রে ওড়ঞ, অও, অঁঃড়সধঃরড়হ, জড়নড়ঃরপং এবং চৎবপরংরড়হ অমৎরপঁষঃঁৎব এর উপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। বীজকে ফর্টিফাইড করার মাধ্যমে পুষ্টি উপাদান ও ভিটামিন সমৃদ্ধ বীজ উৎপাদনে গবেষণা প্রয়োজন। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে বীজের কাঙ্খিত মান উন্নয়নের জন্য জিনোম লেবেলে গবেষণা করা যুগের দাবী। এই প্রযুক্তি সময় সাশ্রয়ী। জিএমও শস্য এখন বাস্তবতা এবং আমরা সবাই জিএমও সয়াবিন ব্যবহার করছি। তাছাড়াও বীজের বাণিজ্যিকীকরণ এখন বাস্তবতা এবং বীজ ব্যবসা প্রতিযোগীতাপূর্ণ। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার জন্য বীজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ পর্যায়ে মাননিয়ন্ত্রণ নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন।
লেখক : ১মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ৩ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বীজ প্রযুক্তি বিভাগ, বিএআরআই, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭১৪৫৫২৫২১, ই-মেইল : নবষধষ.নধৎর@মসধরষ.পড়স

বিস্তারিত
স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়ন কৌশল

স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়ন কৌশল
ড. মো. জামাল উদ্দিন
বহুমুখী কৃষি পণ্য উৎপাদন ও কৃষির সাফল্যের জন্য বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ একটি রোল-মডেল। উল্লেখযোগ্য বৈচিত্র্যময় কৃষিপণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের জন্য একটি হাব হয়ে উঠতে পারে। তার জন্য দরকার স্মার্ট কৃষি ও তার সফল বাস্তবায়ন। স্মার্ট কৃষি বলতে খামারে ইন্টারনেট অব থিংস, সেন্সর, লোকেশন সিস্টেম, অটোমেশন, রোবটিক্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তির ব্যবহারকে বোঝায়। যদিও সবগুলোর ব্যবহার আমাদের দেশে ধীরে ধীরে পূর্ণতা পাবে। তবে স্মার্ট ফার্মিং এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো শস্যের গুণমান ও পরিমাণ বৃদ্ধি করা এবং ব্যবহৃত মানবশ্রমকে অপটিমাইজ করা।
স্মার্ট কৃষির তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো টেকসই কৃষি উৎপাদনশীলতা এবং আয় বৃদ্ধি করা; জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এবং স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করা এবং যেখানে সম্ভব গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাস অথবা অপসারণ করা। স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়নের জন্য স্মার্ট কৃষিতে ব্যবহৃত প্রযুক্তিগত সুবিধা বাড়াতে হবে সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ, যথার্থ সেচ এবং সুনির্দিষ্ট উদ্ভিদ পুষ্টি; গ্রিনহাউসে জলবায়ু ব্যবস্থাপনা এবং নিয়ন্ত্রণ; সেন্সর-মাটি, জল, আলো, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা ব্যবস্থাপনার জন্য সফটওয়্যার প্লাটফরম; অবস্থান সিস্টেম- জিপিএস, স্যাটেলাইট, যোগাযোগ ব্যবস্থা- মোবাইল সংযোগ; রোবট; বিশ্লেষণ এবং অপটিমাইজেশান প্লাটফরম, আর এই সমস্ত প্রযুক্তির মধ্যে সংযোগ হলো ইন্টারনেট অব থিংস যা প্রাপ্ত ডেটার ওপর ভিত্তি করে খামার পরিচালনা করে থাকে। এসব ব্যবস্থার জন্য কৃষকরা তাদের খামারের প্রক্রিয়াগুলো নিরীক্ষণ করতে পারে এবং দূর থেকে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। গ্রামীণ পর্যায়ে কৃষককদের সংগঠন ভিত্তিক কৃষির বিভিন্ন ডিজিটাল প্রযুক্তি ও আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও প্রচারণার মাধ্যমে আরো দক্ষ করে তোলা দরকার।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়নে যেসব বিষয় লক্ষ্য রাখা দরকার তা হলো- প্রতি একর জমিতে ফসলের উৎপাদনশীলতা প্রায় দ্বিগুণ করা (যদিও সব ফসলে দ্বিগুন করা সম্ভব না যেমন ধান); উৎপাদন ব্যবস্থাপনা দ্রুততর করা; সরবরাহ ব্যবস্থাকে স্মার্ট ও তরান্বিত করা;  লাগসই প্রযুক্তি ও  কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ব্যবস্থা ও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা; চাষাবাদ থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ সবক্ষেত্রে স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার যেমন রিমোট কন্ট্রোল, অটোমেশন, অপারেটেড রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার বীজবপণ যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো, ড্রোন ব্যবহার, স্মার্ট সয়েল ময়েশ্চার সেনসর ব্যবহার, পিএইচ সেনসর, আইওটি ভিত্তিক স্মার্ট কৃষি খামার ব্যবস্থাপনা, রিমোট সেনসিং এবং জিআইএস প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্ষতিকর পোকামাকড় ও রোগের পূর্বাভাস প্রদান ও দমন ব্যবস্থাপনা, রোবটিক্স (ক্ষেত্র বিশেষে) ইত্যাদি ব্যবহারে কম খরচে অধিক ফলন বৃদ্ধি নিশ্চিত করা দরকার।
স্মার্ট সেচ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে নির্দিষ্ট ল্যান্ডস্কেপ চাহিদা মেটাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি দেওয়ার সময়সূচী এবং সঠিক ও প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, আর্দ্রতা কমে যাওয়া, এবং কৃষি জমিতে ভূগর্ভস্থ পানির যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণ উদঘাটন ও সম্ভাব্য সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন।  বোরো ধান চাষে অধিক পরিমাণে সেচের প্রয়োজন হয়। বিকল্প ভেজানো এবং শুকানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে বোরো ধানে পানির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা; বিভিন্ন সবজি চাষে সঠিকভাবে ড্রিপ সেচ পদ্ধতিটি স্থাপন ও পানি সেচ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে প্রথাগত সেচ পদ্ধতির চেয়ে ৮০% পর্যন্ত পানির সাশ্রয় করা সম্ভব। স্প্রিংকলার সেচ পদ্ধতি, ঘরে বসে ডিজিটাল সেচ যন্ত্র পরিচালনা এবং মালচিং পদ্ধতির মাধ্যমে জমিতে আর্দ্রতা বৃদ্ধি করার জন্য স্মার্ট সেচ ব্যবস্থার অনুসন্ধান ও অনুশীলন জরুরি।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও উত্তরাঞ্চলে খরার প্রবণতাসহ দেশের নিম্নাঞ্চলে আকস্মিক ও নিয়মিত বন্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার কারণে এসব অঞ্চলে ফসল চাষ করা দিনদিন কঠিন হয়ে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন
মোকাবিলায় লবণাক্ত, খরা, জলমগ্ন সহিষ্ণু ধান, গম, পাট, সরিষা বা তেল জাতীয় ফসল, বিভিন্ন সবজির জাত উন্নয়ন করা এবং জাতসমূহ দ্রুত কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছানো দরকার। এক্ষেত্রে গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ ও কৃষি বিভাগ যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে ও রাখতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ফসলের চাষ পদ্ধতির পরিবর্তনও প্রয়োজন, যেমন দক্ষিণাঞ্চল ও বন্যাপ্রবণ এলাকায় সর্জন পদ্ধতি, ভাসমান বেডে সবজি চাষ, টিলা পদ্ধতিতে সবজি চাষ এবং উত্তরাঞ্চলে কৃষি জমিতে মালচিং ব্যবহার, বিকল্প ভেজানো এবং শুকানো (অডউ), ড্রিপ সেচ ব্যবস্থা, পাহাড়ি অঞ্চলে জিরো টিলেজ পদ্ধতি ও ফলগাছে মালচিং পদ্ধতি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এছাড়া গ্রিন হাউজ এর মধ্যে বিভিন্ন সবজি সারাবছর চাষ করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তার জন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ উপযুক্ত জায়গায় গ্রিণ হাউস স্থাপনের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
দেশের জনসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। জমির পরিমাণ কমছে। বর্ধিত এ জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বল্প জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চত করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশণা অনুযায়ী এক ইঞ্চি জমিও ফাঁকা রাখা যাবে না। এক্ষেত্রে প্রতি ইঞ্চি জমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে আমাদের শস্য নিবিড়তা বাড়াতে হবে অর্থাৎ একই জমিতে এক বছরে যত সংখ্যক বেশি ফসল চাষ করা যায় তা করতে হবে। যেমন আন্তঃফসল, সাথী ফসল ও মাল্টিলেয়ারে ফসল চাষ করা যেতে পারে, এতে জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হবে এবং মোট উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। এক্ষেত্রে জমির স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে পর্যাপ্ত জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। তাই জৈব সার উৎপাদনে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া দরকার। আবাদযোগ্য জমি, চলতি পতিত জমি, স্থায়ী পতিত জমি ও প্রাতিষ্ঠানিক পতিত জমির আপগ্রেড তথ্য জিআইএস এর মাধ্যমে সংগ্রহ করে ডাটবেস তৈরি করে স্বল্প মেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়ন করতে পারলে সুফল মিলবে বেশি। সরকারের নানামূখী পদক্ষেপের কারনে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এসব কার্যক্রম গ্রহন করতে দেখা গেছে, যা আশাব্যাঞ্জক।
স্মার্ট বাজার ব্যবস্থাপনা স্মার্ট কৃষিরই একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। একটি ছাড়া অন্যটি অচল। স্মার্ট ফার্মিংয়ে তথ্যের দক্ষ ও ন্যায়সংগত প্রবাহকে সক্ষম করে তোলার জন্য সরবরাহ শৃঙ্খলের সব অ্যাক্টরের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ তৈরি করে দেওয়া দরকার। তাতে অ্যাক্টরদের ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় থাকে। পুরো সরবরাহ-শৃঙ্খল জুড়ে লাভকে আরও সুষমভাবে পুনর্বণ্টন করার সুযোগ করে দিয়ে একটি উইন-উইন পরিবেশ বজায় থাকবে। সাপ্লাই চেইন (যেমন প্রসেসর এবং ভোক্তাদের), তারা তাদের গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে তাদের উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে পারে। গ্রাহকদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করা কৃষিব্যবসায়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা ভবিষ্যতে টেকসই ক্ষমতা পাবে এবং স্মার্ট ফার্মিং এটির অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। সুষ্ঠু ও দক্ষ বাজার ব্যবস্থাপনা থাকলে কৃষক ন্যায্য মূল্য পাবে। তারা ফসল চাষাবাদে অধিক আগ্রহী হবে।
কৃষির বাণিজ্যিক উৎপাদন এলাকায় কোল্ড চ্যাম্বার বা সবজি সংরক্ষণাগার বা মাল্টি-পারপাস সংরক্ষণাগার স্থাপন করা গেলে সবজির অপচয় কমবে এবং কৃষক লাভবান হবে। সেসব এলাকায় পর্যাপ্ত হিমাগার থাকলে ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প-কারখানা গড়ে উঠলে এবং বৈদেশিক বাজার তৈরি করা গেলে কৃষক পণ্য বিক্রয় করে কৃষক অধিক লাভবান হবে। তাই দেশীয় বাজার ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি আমাদের কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানি করার আরো উদ্যোগ গ্রহন করা দরকার।         কৃষি প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে। তার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা যেমন দরকার তেমনি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণীয় সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দরকার। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও ক্রমহ্রাসমান জমির সমস্যা থেকে উত্তরণ পেতে স্মার্ট ভার্টিকেল গ্রিকালচার ফার্মিং, স্মার্ট রুপটপ ফার্মিং, পারিবারিক পুষ্টি বাগান ব্যাপকভাবে চালু করা যেতে পারে। যদিও সরকারের এসব বিষয় বহুমুখী প্রকল্প চলমান রয়েছে। তার সঠিক বাস্তবায়নও হচ্ছে। সহজ কথায় দেশের স্বল্প সম্পদকে বা জমিকে যতখানি স্মার্টলি ব্যবহার করা যাবে ততই কৃষি স্মার্ট হয়ে উঠবে। বর্তমানে দেশ হতে আম, কাঁঠাল, আলু, বিভিন্ন সবজি, হিমায়িত চিংড়ি ইত্যাদি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। আমাদের স্মার্ট ওয়েব ও মোবাইল এপস উদ্ভাবন এবং অন্যান্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে সাপ্লাই চেইন সংক্ষিপ্তকরণ, কৃষক এবং ভোক্তার ক্রয়/বিক্রয় ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ এবং স্মার্ট কৃষি বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়ন সহজ হবে। এসডিজি-২০৩০ কে সামনে নিয়ে ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ এ উল্লিখিত কৃষির ছয়টি হটস্পট (হটস্পটগুলো হচ্ছে: উপকূলীয় অঞ্চল, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল, হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, নদী ও মোহনা অঞ্চল এবং নগরাঞ্চল) চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় যেসব স্মার্ট পরিকল্পনা বা কর্মকৌশলসমূহ রয়েছে তা স্মার্টলি বাস্তবায়ন করতে পারলে স্মার্ট কৃষি পূর্ণতা পাবে। সে সাথে অর্থনীতিও স্মার্ট হয়ে উঠবে আর ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইনচার্জ, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বারি, শাসনগাছা, কুমিল্লা-৩৫০০, মোবাইল : ০১৮১৫৪২৫৮৫৭, ই-মেইল : লধসধষঁফফরহ১৯৭১@ুধযড়ড়.পড়স

বিস্তারিত
আমের সংগ্রহত্তোর গুণগত বৈশিষ্ট্য ও মাননিয়ন্ত্রণ

আমের সংগ্রহত্তোর গুণগত বৈশিষ্ট্য ও মাননিয়ন্ত্রণ
কৃষিবিদ খোন্দকার মোঃ মেসবাহুল ইসলাম
আম ক্লাইমেক্টেরিক জাতীয় ফল সংগ্রহত্তোর অবস্থায় শারীরবৃত্তীয় ও গুণগত কার্যক্রম চলমান থাকা বৈশিষ্ঠ্যের জন্য দ্রুত পচনশীল হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক বাজারে আমের চাহিদা প্রচুর। আম সংগ্রহ করার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাজারজাতকরণ বা ব্যবহৃত না হলে দ্রুত পেকে যাওয়া, গুণগত মানের অবনতি হয় এবং গন্ধ ও স্বাদসহ পুরো ফলটিই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এছাড়া গ্রীষ্মম-লীয় ফল হওয়ায় নিম্ন তাপমাত্রায় আম সংরক্ষণ করলে বেশ কিছু শারীরবৃত্তীয় রোগ এবং আমের খোসায় ঠা-াজনিত ক্ষতের সৃষ্টি হয়, পরবর্তীতে যা শাঁসেও ছড়ায় এবং পচন ধরে আম খাওয়ার অনুপযুক্ত হয়ে যায়।  
নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় সংগৃহীত পরিপক্ব আম দ্রুত পাকে এবং খুব কম সময়ে নষ্ট হয়ে যায় বা অনুজীবের দ্বারা রোগে আক্রান্ত হয়। অনুজীবের সংক্রমণ দ্রুত পাকা আমের নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ এবং সংগ্রহ স্থান থেকে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবহন ও সরবরাহ সীমিত করার জন্য দায়ী।
সংগ্রহত্তোর ব্যবস্থাপনায় আমের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণের প্রভাবকসমূহ
পরিপক্বতা : ফল হিসেবে আমের বৃদ্ধি ও পরিপক্বতার সময়ে আকৃতি, দৃঢ়তা ও রং এর ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে, যখন উদ্বায়ী যৌগগুলো কিছু ক্ষেত্রে আবদ্ধ ও কিছু ক্ষেত্রে মুক্ত হয়। শর্করাসমূহ এবং ফলের রং আমের পরিপক্বতার অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য সূচক হিসেবে কাজ করে। আম ফলের পরিপক্বতা ছয়টি পর্যায়ে দৃশ্যমান হয়।
পর্যায়-১ (অপরিপক্ব) বোঁটার কাছে সরু, খোসা বা ত্বক খসখসে ও রুক্ষ ও শক্ত; পর্যায়-২ (অকালপক্ব) বোঁটার কাছে ফলের উপরের অংশ সরু, কিন্তু পর্যায়-১ এর তুলনায় ত্বক কিছুটা অসমতল কিন্তু শক্ত; পর্যায়-৩ (আগাম পরিপক্ব) বোঁটার কাছে ফলের উপরের অংশ ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে সমতল, মসৃণ ত্বক ও ফলের নীচের দিক সামান্য বাঁকা; পর্যায়-৪ (কাঙ্খিত পরিপক্ব) ফলের গঠন উপরে-নিচে সম্পূর্ণ, নিচের দিকে (নাকের অংশ) সম্পূর্ণ ও ত্বক সামান্য মসৃণ; পর্যায়-৫(পরিপক্ব) ফল পাকার পর্যায়ে উপনীত তবে প্যাকিং এর জন্য বেশি পাকা, ফল সম্পূর্ণরূপে গঠিত, রং; পর্যায়-৫(অতি পরিপক্ব) : ফল সম্পূর্ণ পাকা, রং গাঢ়, শাঁস নরম, বোঁটার কাছে পচন শুরু হয়।
সাধারণভাবে, আম পাকা এবং আমের গুণগত মান নির্ভর করে আমের পরিপক্বতা পর্যায়ের উপর এবং এজন্য আমের  সংগ্রহকালের প্রভাব ব্যাপক। বাণিজ্যিক পরিস্থিতিতে যেখানে সংরক্ষণ, পরিবহন ও আমের জীবনকাল জড়িত সেখানে সবুজ অবস্থায় পরিপক্ব পর্যায়ে ফল সংগ্রহ করা উচিত, যখন আম শারীরবৃত্তীয়ভাবে পুষ্ট এবং ক্লাইমেকট্রিক পর্যায় শুরুর আগের ধাপে থাকে। বর্তমানে বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি আমের পরিপক্বতা ও গুণগতমান নির্ণয়ের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, স্পেকট্রোস্কোপি বা ইনফ্রারেড এর কাছাকাছি আলো ব্যবহার করে এবং ইলেক্ট্রনিক নোজ ব্যবহার করে উদ্বায়ী ও গ্যাস ক্রোমাটোগ্রাফি দ্বারা আমের পরিপক্বতা নির্ণয় করা হয়।
ফলের পুষ্টি ও স্বাদ : আমে আমিষ, শর্করা, খনিজ ও ভিটামিনসহ প্রায় সব প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। আমে প্রতি ১০০ গ্রামে (শাঁসে) ৭৬৫ আন্তর্জাতিক একক ভিটামিন এ থাকে, যা এ সময়ের অন্য ফলের চেয়ে অনেক বেশি। ভিটামিন এ রাতকানা রোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত উপকারী। এছাড়া প্রতি ১০০ গ্রাম আমের শাঁসে ২৭.৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি থাকে। ভিটামিন এ ও সি উভয়ই অ্যান্টি অ্যক্সিডেন্ট হিসেবে শরীরের মুক্ত যৌগগুলোর (ফ্রি র‌্যাডিকেল) কার্যক্রম প্রতিরোধ করে ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
যে কোন ফলের স্বাদ শর্করা ও ফলের মধ্যকার অম্ল বা  এসিডের সাথে সম্পর্কিত। আমের প্রধান দ্রবণীয় শর্করার মধ্যে রয়েছে গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ এবং সুক্রোজ। আম পাকার পর্যায়ে ফ্রুকটোজ ও গ্লুকোজের চেয়ে সুক্রোজ বেশি কার্যকর থাকে। অন্যদিকে, অপরিপক্ব আমে প্রচুর জৈব এসিড বিশেষত সাইট্রিক এসিড উপস্থিত থাকে। আম পাকার প্রাথমিক পর্যায়ে যখন অ্যালানিন এর পরিমাণ বৃদ্ধি পায় তখন এই সাইট্রিক এসিড এর পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। আবার যখন আম ঘরের সাধারণ তাপমাত্রায় কিংবা নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়, তখন আমের মধ্যকার দ্রবণীয় কঠিন পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ও বিভিন্ন এসিডের পরিমাণ ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। তাই, আমের মধ্যকার শুষ্ক পদার্থ ও শর্করার সাথে আমের গুণগতমানের বিশেষ সম্পর্কের জন্য ভোজ্য অংশ বা শাঁসের স্বাদে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।  
ফলের দৃঢ়তা : আম যতই পাকার পর্যায়ে যায় ততই তার দৃঢ়তা হারায়, যা ফলের সংরক্ষণ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। কখনো কখনো এই দৃঢ়তা ফলের সংরক্ষণকালীন সূচক হিসেবে বিবেচিত হয়। বর্তমানে ফলের দৃঢ়তা পরিমাপের জন্য অনেক উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তি বা কৌশল ব্যবহার করা হয়। সাধারণভাবে পেনেট্রোমিটার ব্যবহার করে আমের শাঁস ও আঁটির দৃঢ়তা পরিমাপ করা হয়। এতে কাঁচা বা অপরিপক্ক (বেশি শক্ত), আধা পাকা বা পরিপক্ব (কম শক্ত) এবং কাঙ্খিত পরিপক্ব বা পাকা (নরম) আমের দৃঢ়তা বুঝা যায়। অর্থাৎ আম কৃত্রিমভাবে পাকানো হলে, এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা করলে তা জানা যেতে পারে। ঔধৎরসড়ঢ়ধং এবং করঃঃযধবিব (২০০৭) সঠিকভাবে ফলের দৃঢ়তা পরিমাপের জন্য একটি দ্রুত কার্যকর পদ্ধতির বর্ণনা করেছেন, যা আমের কোষ প্রাচিরের কাঠামোর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। কম তাপমাত্রায় আম সংরক্ষণ দৃঢ়তা বজায় রাখার জন্য উপকারী। অন্য একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, ১৪ক্ক  ডিগ্রি সেলসিয়াস (বি. দ্র. : ক্ক দিয়ে নির্দিষ্ট তাপমাত্রার সামান্য কম বা বেশি তাপমাত্রা বুঝায়) তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা পাকা আম সংরক্ষণের ১৪ দিন পরে দ্রুত দৃঢ়তা হারিয়ে নরম হয়ে যায়। আবার, অন্য আরেকটি পরীক্ষায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, ক্ক৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা আমের দৃঢ়তা, একই সংরক্ষণ সময়ে ১৪ক্ক  ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বেশি অনুকূল অর্থাৎ আমের দৃঢ়তা বেশি থাকে।
শ^সন ও ইথিলিন : আমে সাধারণত উচ্চ হারে শ^সন হয় এবং ফল পাকার সময় ইথিলিন নিঃসরণ করে। এর ফলে আমের সংরক্ষণকালীন সময় কমে যায়। আম সংগ্রহ করার পরপরই শ্বসনের মাত্রা বেড়ে যায়। যদি আমে সামান্য আঘাতও লাগে বা ক্ষত সৃষ্টি হয় তাহলে শ্বসনের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। একটি পরীক্ষায় সাধারণ কক্ষ তাপমাত্রায় (২৫ক্ক  ডিগ্রি সেলসিয়াস). ১৭ দিনের আম সংরক্ষণকালে ইথিলিনের উৎপাদনের পরিমাণ ১৩ হসড়ষ/শম/য সর্বোচ্চ দেখা গেছে। ঝেং ও অন্যরা (২০০৭) আরেকটি পরীক্ষায় দেখতে পান যে, সাধারণ কক্ষ তাপমাত্রায় (২৫ক্ক  ডিগ্রি সেলসিয়াস) ১০ মিনিটের জন্য ৫ মিমি অক্সালিক এসিড দ্রবণে ডুবিয়ে রাখলে ইথিলিন উৎপাদনের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে অক্সালিক এসিড প্রয়োগ করে আমের অভ্যন্তরস্থ ইথিলিন উৎপাদন কমিয়ে রাখা যায়। এতে আম পাকতে সময় নেয় বা দেরি হয়। আবার (১৩ক্ক  ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রায় হিমাগারে রাখা আমের অভ্যন্তরস্থ বিপাক প্রক্রিয়া ধীর হয় যায় বলে ইথিলিন উৎপাদন হার কমে গিয়ে আমের পাকার সময় কিছুটা দীর্ঘ হয়। তাই, বাংলাদেশে হিমাগারে আম সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে পরিপক্ব আম সংগ্রহ, বাছাই, মোড়কীকরণ ও পরিবহন এবং হিমাগারের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় সংগ্রহ থেকে শুরু করে হিমাগারে রাখা এবং পরবর্তীতে বাজারজাত করার ক্ষেত্রে তাপমাত্রাসহ অন্যান্য বিষয়গুলো সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না বলে দীর্ঘদিন আম সংরক্ষণ সম্ভব হয় না।  
ঠা-াজনিত ক্ষত : আম নিম্ন তাপমাত্রার প্রতি অতি সংবেদনশীল। ৭-১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচের তাপমাত্রায় আমের ত্বক এবং পরবর্তীতে শাঁস সহজেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়, যা পরিপক্বতা, জাতের ভিন্নতা ও সময়কালের উপর নির্ভর করে। ঠা-াজনিত ক্ষতের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে খোসায় গর্ত হওয়া, অসমানভাবে পাকা, কটু গন্ধ হওয়া এবং খোসা ও শাঁস পঁচে যাওয়া। তাই, আমের দীর্ঘ সময় সংরক্ষণের জন্য ঠা-াজনিত ক্ষতই প্রধান সমস্যা বা সীমাবদ্ধতা। একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, ৫ক্ক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আম সংরক্ষণ করা হলে ৩ সপ্তাহ পরে আমে ঠা-াজনিত ক্ষত দেখা দেয়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন ঠা-াজনিত ক্ষত সম্ভবত ফলের ত্বকের কোষ প্রাচিরের কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটায়। তাই হিমাগারে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখলেও ৩ সপ্তাহের বেশি সময়ের পরে পরিপক্ব আম সংরক্ষণ সম্ভব হয় না।
ফল পচা  : আম ফল পচনশীল, বিশেষ করে পরিপক্ব ফল সংগ্রহ করলে, ফলে কোন আঘাত লেগে ক্ষত সৃষ্টি হলে বা ত্বক ফেটে গেলে, নিম্ন তাপমাত্রায় ঠা-াজনিত ক্ষত হলে বা ফলে ব্যাকটেরিয়াজনিত কালো দাগ (ব্ল্যাক স্পট) বা ছত্রাকজনিত (অ্যানথ্রাকনোজ) রোগের সংক্রমণ হয়। পরিবেশের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বেশি থাকলে আম ফলের শ^সন হার বেড়ে যায়। এতে আমে পচন ধরে ও পুরো ফলই পচে যেতে পারে। আম সংগ্রহকালে ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে, যা সংরক্ষণকালে বা পরিবহনকালে আমে পচন ধরায় এ কারণে আমের বাজার মূল্য কমিয়ে দেয়।
সংগ্রহত্তোর সতর্কতা : আম সংগ্রহ করার পরে সতর্কতার সাথে নাড়াচাড়া করা উচিত। সংগ্রহ পরবর্তী বাছাই, পরিষ্কারকরণ ও মোড়কীকরণ আমের জীবনকাল বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সঠিকভাবে সংগ্রহ পরবর্তী ব্যবস্থাপনাগুলো সম্পন্ন না হলে ফলের ওজন কমে যাওয়া, ত্বকের রং গাঢ় হওয়া, শাঁসের রং বাদামি হওয়া বা ছত্রাকের সংক্রমণ ত্বরান্বিত হয়। এজন্য সাবধানে ডাল থেকে বোঁটাসহ আম সংগ্রহ করা উচিত। আম মাটিতে পড়ে যেন ফেটে না যায়, বোঁটা ভেঙ্গে কষ বের না হয়, কোনভাবেই যেন আমের কষ ত্বক বা খোসায় না লাগে সেসব বিষয়ের দিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। সংগ্রহ করার পর বোঁটা ভেঙে আমগুলোকে ৪-৫ ঘণ্টা উপুর করে রাখলে কষ ঝরে যায় এবং আমের খোসায় লাগে না। এরপর আমের আকার ও রংয়ের ভিত্তিতে বাছাই করে শ্রেণিকরণ ও বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে প্লাস্টিক ক্রেট বা ফাইবার বোর্ডের বাক্সে নরম কাগজে মোড়কীকরণ করে পরিবহনের জন্য প্রস্তুত করতে হয়।         
গরম পানিতে শোধন : ৫৫-৫৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার গরম পানিতে কাক্সিক্ষত পরিপক্ব আম ৫-৭ মিনিট ডুবিয়ে রাখলে আমের শ^সন বাধাগ্রস্ত ও অভ্যন্তরস্থ বিপাক প্রক্রিয়া ধীর হওয়ার কারণে আম পাকার সময় ১০-১৪ দিন পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করা যায়। জামব্রানো ও ম্যাটেরানো ১৯৯৮ সালে এক পরীক্ষায় দেখেন যে, পরিপক্ব আম ৩৮ বা ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানিতে ৩০ মিনিট ডুবিয়ে রেখে সংরক্ষণ করলে ঠা-াজনিত ক্ষত থেকে আম রক্ষা পায়। আবার ম্যাককোলাম ও অন্যরাও ১৯৯৩ সালে প্রায় একই রকম একটি পরীক্ষার ফলাফলে দেখেছিলেন যে, ৩৮ক্ক  ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২৪ বা ৪৮ ঘণ্টা ডুবিয়ে রেখে ৫ক্ক  ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করলে আম ১১ দিন পর্যন্ত ঠা-াজনিত ক্ষতের লক্ষণ ছাড়াই সংরক্ষণ করা যায়। বাংলাদেশে হাঁড়িভাঙ্গা আমের সংরক্ষণ ক্ষমতা সবচেয়ে কম বলে মনে করা হয়। হাঁড়িভাঙ্গাসহ অন্যান্য জাতের আম পুষ্ট বা পরিপক্ব হওয়ার শুরুতেই ৫৫-৫৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানিতে ৫-৭ মিনিট ডুবিয়ে রাখার পর তুলে শুকিয়ে ১০-১২ দিন পর্যন্ত সাধারণ কক্ষ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়, এতে রোগ ও পোকার আক্রমণও হয় না। তবে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় দীর্ঘদিন হিমাগারে আম সংরক্ষণের সময়কাল নির্ধারণে আরো গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
অতিবেগুনি রশ্মির ব্যবহার : অতিবেগুনি রশ্মির বিকিরণ ব্যবহার করে ছত্রাক ও ব্যকটেরিয়ার উপর সরাসরি রোগজীবাণু প্রতিরোধি কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের কারণে অনেক ফলের বিশেষ করে আমে জীবনকাল বা শেল্ফ লাইফ বৃদ্ধি পায়। সম্প্রতি আম ফলের উপর অতিবেগুনি রশ্মি ব্যবহার করে বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, এ রশ্মি প্রয়োগে আমের অভ্যন্তরস্থ এনজাইমগুলোর কার্যক্ষমতা ও গুণগত মান বৃদ্ধি এবং জীবনকাল দীর্ঘায়িত করে। অনুরূপ আরেকটি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, আম সংরক্ষণের ১০ মিনিট আগে অতিবেগুনি রশ্মির প্রয়োগ আমের পচন কমানোর কার্যকর পদ্ধতি এবং গুণগত মান রক্ষার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। উপরন্তু, অতিবেগুনি রশ্মির প্রয়োগ টাটকা আমের সকল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা উন্নয়নেও একটি উত্তম কৌশল বলে বিবেচিত।
নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ : সংগ্রহ পরবর্তী আমের মধ্যকার শারীরবৃত্তীয় বিপাক প্রক্রিয়া ধীর করতে, গুণগত মান বজায় রাখতে, পচন কমাতে এবং সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়াতে নিম্ন তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আম সংরক্ষণ বেশ কার্যকর পদ্ধতি। ঠা-াজনিত ক্ষত এড়িয়ে আমের জন্য সর্বোত্তম তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে রাখা ও কার্বেন্ডাজিম জাতীয় যেকোন ছত্রাকনাশকযুক্ত পানিতে আম শোধন করে শুকিয়ে সংরক্ষণ করলে ফল দেরিতে পাকে ও রোগযুক্ত আমের জীবনকাল দীর্ঘায়িত হয়।   
নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে আম সংরক্ষণ
নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সংরক্ষণের শর্ত হলো-অক্সিজেন ও কার্বনডাই অক্সাইড এর ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ এবং/অথবা অনুপাত নিয়ন্ত্রণ। আম সংরক্ষণে তাপমাত্রা, অক্সিজেন ও কার্বনডাই অক্সাইড এবং আমের ভিন্ন ভিন্ন জাতের উপর এগুলোর প্রভাব নিয়ে বিভিন্নভাবে গবেষণা চলমান রয়েছে। সেসব গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে যে, ১২ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২ বা ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত এবং অক্সিজেন ও কার্বনডাই অক্সাইড-এর ঘনত্বের উপর নির্ভর করে সর্বোচ্চ ৩৮দিন পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন জাতের আম সংরক্ষণ করা সম্ভব। আসলে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ আমের ছত্রাকজনিত পচনের বিস্তার রোধ বা সীমিত করে, গুণগত মান বজায় রাখে (রং উজ্জ্বল করে, সুস্বাদু করে, মোট দ্রবণীয় কঠিন পদার্থের পরিমাণ বাড়ায়) এবং সংগ্রহ পরবর্তী জীবনকাল বৃদ্ধিতে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। ২০০৭ সালে একটি পরীক্ষায় দেখেছেন যে, নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে (৩% অক্সিজেন+৯৭% নাইট্রোজেন) বা ৩% অক্সিজেন+১০% কার্বনডাই অক্সাইড+৮৭% নাইট্রোজেন) আম পাকার সময় দেরি করিয়ে দেয় এবং আমের গুণগত মান উন্নত করে।
আম সংরক্ষণে জীবনকাল বৃদ্ধি এবং সুগন্ধ, স্বাদ ও গঠন পরিবর্তন রোধে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ অক্সালিক এসিড, স্যালিসাইলিক এসিড বা ভোজ্য আবরণের প্রলেপ গুণগতমান নিশ্চিতের পাশাপাশি শ^সন ও রোগজীবাণুজনিত পচন নিয়ন্ত্রণে আধুনিক পদ্ধতি হিসেবে বিশেষভাবে কার্যকর বলে বর্তমান সময়ে প্রমাণিত হয়েছে।  
সম্প্রতি আম পাকার সাথে সম্পর্কিত জিন (ঢ়ঞঐগঋ ও ঊঞজ-১) নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করা হচ্ছে। দেখা গেছে যে, আম পাকার সময় শাঁসে (মেসোকার্পে) এদের মাত্রা বেড়ে যায়। আবার আমের কোষে ক্ষত সৃষ্টি হলে গঊঞজ১ সজঘঅ  জিনদ্বয়-এর মাত্রা ক্ষণস্থায়ীভাবে বেড়ে যায়। অর্থাৎ এইসব জিনের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে আম পাকার সময় নির্ধারণ করা সম্ভব হতে পারে। তাই এগুলোর কার্যকারিতা ও ফলাফল আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আমের জীবনকাল বা সংরক্ষণকাল বৃদ্ধির জন্য জেনেটিক রূপান্তরে কাজে লাগালে ভবিষ্যতে আম শিল্পে বিপ্লব ঘটাতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

লেখক : উদ্যান বিশেষজ্ঞ, সংযুক্তঃ সরেজমিন উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২০৭। মোবাইল : ০১৮১৮৭১৯৪৫৩, ই-মেইল : সংনধযঁষ৬৫@মসধরষ.পড়স

বিস্তারিত
নিরাপদ মাংসের প্রাপ্যতা ও ভোগে করণীয়

নিরাপদ মাংসের প্রাপ্যতা ও ভোগে করণীয়
মো. কাওছারুল ইসলাম সিকদার
আমিষ জাতীয় খাবার বলতে আমরা মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ও ডালজাতীয় খাবারকেই বুঝি। এ দেশে একসময়  প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন মাছের প্রাচুর্য থাকলেও কখনই মাংসের প্রাচুর্যতা ছিল না। বিশেষ করে রেড মিট বা লাল মাংস (গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া) এদেশের মানুষেরা কালে-ভদ্রে খেতো।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে মাংসের চাহিদা দ্রুত বাড়তে থাকে। সরকার পশু পালনকে উৎসাহিত করার জন্য স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ প্রদান করে। ফলে দেশে পশু পালন ও মাংসের ভোগ বাড়তে থাকে। দেশে পশু খামারের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থা এবং সরকারি/বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন দেশ হতে আমদানিকৃত উন্নত পশুর মাধ্যমেই মূলত এদেশে উন্নত সংকর জাতের গরুর প্রচলন ঘটে।
শহরাঞ্চলের মানুষেরাই গরুর মাংস বেশি ভোগ করে। শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মানুষের আয় ও আর্থিক সচ্ছলতার কারণে গ্রামের তুলনায় ভোগ বেশি। সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে পশুখাদ্য আমদানি মূল্য ও পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। বেড়ে যায় ঔষধের মূল্য। দেশে গরু খামারে প্রয়োজনীয় শ্রমিকে অপ্রাপ্যতা ও উচ্চ মজুরির কারণেও পালন অলাভজনক হয়ে পড়ছে। তাই কমছে মাংস উৎপাদনের ঊর্ধ্বমুখী গতিধারা, বাড়ছে দাম যা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্রেতাদের নাগালের বাহিরে। শরীর গঠন, প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের জন্য মাংসের বিকল্প নেই। মাংস তথা আমিষজাতীয় খাদ্যের অভাবে দৈহিক গঠন ও উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়। অপুষ্টি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। উন্নত দেশ ও জাতি গঠন বাধা গ্রস্ত হবে। তাই অর্থনৈতিক সার্থেই পশু পালন এবং মাংস উৎপাদনে সরকারি প্রণোদনা বৃদ্ধি করতে হবে।
নিরাপদ মাংস উৎপাদনের সমস্যাসমূহ
চারণক্ষেত্রের আয়তন হ্রাস : দেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় খাদ্য চাহিদা বাড়ছে এবং সর্বত্র কৃষি কাজ হচ্ছে। তাই গরুর চারণক্ষেত্র দিন দিন কমছে। বাংলাদেশে ঘাসের অপর্যাপ্তার কারণে কৃত্রিম উপায়ে পশুখাদ্য তৈরি করে তা পশুকে খাওয়ানো হচ্ছে। যার কারণে মাংসের গুণগত মান ও স্বাদ প্রত্যাশা অনুযায়ী হচ্ছে না। এ জন্য উন্নত মানের মাংস পেতে হলে পশুর জন্য বিস্তীর্ণ চারণভূমি তৈরি করে উন্নত প্রোটিনসমৃদ্ধ ঘাসের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য যে সকল চরে এখনো মানব বসতি গড়ে উঠেনি সেখানে চারণভূমি তৈরি করের পশু পালনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
পশু খাদ্যের উচ্চমূল্য : গরু একটি তৃণভোজী প্রাণী বলা হলেও অধিক মাংস ও দুদ্ধ উৎপাদনের জন্য একে উচ্চ পুষ্টিসমৃদ্ধ কনসেনটরেট খাদ্য প্রদান করা হয়। এই খাদ্যের বেশির ভাগ আমদানিকৃত এবং পশুখাদ্য মিলে অন্যান্য খাদ্য উপকরণ আনুপাতিক হারে মিশিয়ে পশুখাদ্য তৈরি করা হয়। বর্তমানে যে উন্নত জাতের গরুর পালন হচ্ছে, তার জন্য চাই অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ উন্নত জাতের ঘাস ও অন্যান্য খাদ্য। উচ্চমূল্যের কারণে যা সংগ্রহ করা সাধারণ কৃষক বা খামারির জন্য দুঃসাধ্য। জীবাস্ম জ্বালানির ঊর্ধ্বমূল্যের কারণে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিবহনে খরচ বেড়ে গেছে। সেইসাথে বিদ্যুতের উপর সরকারের ভর্তুকি হ্রাসে প্রতিনিয়ত বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। এতে খামারের ব্যবহৃত বিদ্যুৎ এবং মাংস সংরক্ষণ খরচ বাড়ছে। নিরাপদ ও টেকসই মাংস উৎপাদনে পশু খামার লাভজনক পর্যায়ে রাখতে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।  
পশু খাদ্য উৎপাদনক্ষেত্রের সংকোচন : দেশের প্রায় সর্বত্রই কলকারখানার বর্জ্য দ্বারা মাটি, পানি ও বায়ু দূষিত হয়ে পড়ছে। সার্বিকভাবে দেশে প্রাকৃতিক পানির প্রবাহ ও বর্ষার স্থায়িত্ব কমছে। উজান হতে পানির প্রাপ্যতা কমে যাওয়ায় বৃষ্টির পনির উপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। এতে করে মানবসৃষ্ট ও কলকারখানায় তৈরি বর্জ্যে মাটি পানি ও বাতাস দ্রুত দূষিত হয়ে পড়ছে। দূষিত স্থানে উৎপন্ন ঘাস খাদ্য হিসেবে গ্রহণের কারণে পশুর খাদ্যও অনিরাপদ হচ্ছে। আর অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের কারণে পশুর মাংসও অনিরাপদ হয়ে পড়ছে। যা মানব দেহে দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন প্রকারের জটিল রোগ তৈরি করছে। দেশে পশুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় সর্বত্র পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। যত্রতত্র পশু জবাইয়ের কারণে পশুর রক্ত, মলমূত্র, হাড় ও চামড়া প্রভৃতি আশপাশের মানববসতি, ক্ষেত-খামার ও নদী নালায় ছড়িয়ে পড়ছে। রক্তের মাধ্যমে দ্রুত জীবাণুর বিস্তার ও পশু মলমূত্র অন্যান্য উপকরণ মাটি, পানি ও বায়ুকে দূষিত করছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।
প্রাণী পালনের ব্যবস্থাপনা সংকট : প্রাণী কল্যাণে উন্নত ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। দেশের প্রাণী পালনের জন্য যে উপযুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন তা অনেকাংশেই রক্ষা করা সম্ভব হয় না। উন্নত জাতের পশুপালনে উন্নত বাসস্থান, পরিচ্ছন্নতা, নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা, আলো, বাতাস, খাদ্য প্রয়োজন। সেইসাথে প্রয়োজন উন্নত পরিবহন, চিকিৎসা, বিশুদ্ধ বাতাস, পানি ও নিরাপদ খাদ্য। এগুলো সংস্কার করা সম্ভব না হলে নিরাপদ মাংস ও দুধ উৎপাদন সম্ভব হবে না। গরুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে যথাযথ ঔষধ নির্বাচন ও ডাক্তারি পরামর্শ গ্রহণ জরুরি।
কসাইদের প্রশিক্ষণের অভাব : দেশে সরকারিভাবে অদ্যাবধি আধুনিক কসাইখানা তৈরি হয়নি। যার কারণে দেশের সর্বত্র প্রচলিত পদ্ধতিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অনিরাপদ উপকরণ দিয়ে পশু জবাই হচ্ছে। দেশে যত পশু জবাই ও বিক্রয় হয় তার ৯৫% অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ প্রচলিত পদ্ধতিতে জবাই হয়। মাত্র ৫% পশু নিরাপদতার দিকসমূহ বিবেচনা করে বেসরকারিভাবে নির্মিত উন্নত কসাইখানায় জবাই হয়। মাংস অতি উচ্চঝুঁকিপূর্ণ খাদ্য বিধায় তা দ্রুত জীবাণু দ্বারা সংক্রামিত হয়। অথচ পশু জবাইয়ের পর অনিরাপদ পানি, উপরকরণ ও পরিবহন ব্যবহার হচ্ছে। মাংস অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে, খোলা অবস্থায়, উচ্চতাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় সারাদিন দোকানে ঝুলিয়ে বিক্রি হচ্ছে। অথচ মাংসের নিরাপদতা রক্ষায় পরীক্ষাপূর্বক সুস্থ সবল পশু জবাই, পশু জবাইয়ের পর ডাক্তার দিয়ে পুনরায় পরীক্ষা এবং জীবাণুমুক্ত উপকরণ দিয়ে মাংস কাটা, নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় পরিবহন, সংরক্ষণ ও বিক্রয় করা প্রয়োজন।  
পশু বিপণন সমস্যা : পশু খামারিরা পশু পালন করে মূলত কোরবানি ঈদে বিক্রয়ের জন্য। বছরের অন্যান্য সময়ে কসাইদের নিকট পশু বিক্রয়ে উপযুক্ত মূল্য পাওয়া যায় না। কোরবানি ঈদে চাহিদা বেশি থাকে তাই একসাথে অনেক পশু বিক্রয় করা যায় এবং দামও ভালো পাওয়া যায়। কিন্তু পশু হাটে পৌঁছাতে স্থানীয় প্রভাশালী চক্র, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ, উচ্চপরিবহন খরচ ও পশুর হাটের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও অবকাঠামোর অভাবের কারণে পশু খামারিদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বর্তমানে অনেক খামারে বেশ বড় জাতের পশু লালনপালন করা হচ্ছে। এ সকল পশুর ক্রেতা সাধারণত উচ্চবিত্ত শ্রেণির, যারা অনলাইনে পশু ক্রয় করে।
দেশে উচ্চগুণগত মানসম্পন্ন নিরাপদ মাংসের ক্রেতা কম। এর কারণ মূলত উচ্চমূল্য। এমনিতেই দেশে মাংসের দাম আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের তুলনায় বেশি। যারা নিরাপদ মাংস প্রকিয়াজাতকরণ ও বিপণনের সাথে সম্পৃক্ত তাদের মাংসের দাম খোলা বাজারের মাংসের দামের তুলনায় আরো বেশি। নিরাপদ মাংস আন্তর্জাতিক বাজারের দামের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। মূলত সরকারি নির্দেশনা এবং বাধ্যবাদকতার অভাবে দেশে নিরাপদ মাংস ব্যবস্থাপনা অদ্যাবধি গড়ে উঠেনি। তাই নিরাপদ মাংস উৎপাদনে প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং আইনি পদক্ষেপ।
নিম্নমূল্যের লাল মাংস আমদানি ও ব্যবহার : অবকাঠামোগত দুর্বলতার জন্য আমদানিকৃত মাংস পরিবহন, সংরক্ষণ, বিপণন ও রান্না পর্যন্ত (ঈড়ড়ষ পযধরহ) শীতলীকরণ ব্যবস্থা সর্বত্র বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। নিম্নমূল্যের মাংসের চাহিদার কারণে আমদানিকারকগণও যথাযথ গুণগত মানের মাংস আমদানি ও সরবরাহ করছে না। সেইসাথে জনসাধারণে অসচেতনতা, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নজরদারির অভাব এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে দেশে নিরাপদ মাংস আমদানি ও বিপণন হচ্ছে না। নিরাপদ মাংস সরবরাহ ও বিপণনে হোটেল রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সকল মাংস আমদানিকারকদের অধিকতর স্বচ্ছতা অবলম্বন করা উচিত। যাতে ভোক্তা সাধারণ কোন ধরনের মাংস খাচ্ছে তা অবহিত হতে পারে। সেই সাথে মাংস বিপণন ও সংরক্ষণে আধুনিক প্রযুক্তির পরিবহন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই নিরাপদ মাংস ব্যবস্থপনার উন্নতি ঘটবে।
মাংস যাতে অনিরাপদ না হয় সেজন্য জবাইয়ের পূর্বে ও পরে নি¤েœাক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে :
   জবাইয়ের পূর্বে গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নিতে হবে এবং নিরোগ শরীরের পশু জবাই করতে হবে। লক্ষ করতে হবে যেন পশুটির স্বাভাবিক শাস-প্রশ্বাস চলে, শরীরের তাপমাত্রা যথাযথ থাকে এবং মুখ থেকে কোনোরূপ অনাকাক্সিক্ষত ফেনা বের না হয়।
    পশুটিকে জবাই করার  ১২-২৪ ঘণ্টা পূর্ব হতে খাবার প্রদান বন্ধ রাখতে হবে তবে পর্যাপ্ত পানি পান করাতে হবে।
    পশুটিকে যত্নসহকারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও পরিচর্যা করতে হবে, পশুটিকে বিরক্ত করা যাবে না।
    দ্রুত ও ধারালো ছুড়ি দিয়ে জবাই করতে হবে। জবাইকালে শরীরে কোন রকম জখম যেন না ঘটে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
    পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত পরিবেশে জবাই করতে হবে ও মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণে নিরাপদ ছুরি ও অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করতে হবে এবং যতটা  সম্ভব হাতের স্পর্শ পরিহার করতে হবে।
    মাংস কাটার পর দ্রুত সংরক্ষণে ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে উচ্চতাপমাত্রায় রান্না করে সংরক্ষণ বা -১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর ফ্রিজিং করে দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
    মাংস একস্থান হতে অন্যস্থানে স্থানান্তরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জীবাণুমুক্ত পরিবেশে নিম্নতাপমাত্রায় (ফ্রিজিং ভেন) পরিবহন করতে হবে।
    যারা মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, বিপণনে নিয়োজিত তাদের হাতে গ্লাভস, মাথায় ক্যাপ, শরীরে পরিচ্ছন্ন এপ্রোণ পরিধান করতে হবে।
    মাংস ধরার পূর্বে ও পরে ভালোভাাবে নিরাপদ জীবাণুুমুক্ত পানিতে তরল সাবান দ্বারা হাত ধুয়ে নিতে হবে।
    মাংস ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণকারীকে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যবহৃত আংটি, চেইন বা অন্যকোন অলঙ্কার থাকলে তা খুলে কাজ করতে হবে। যাতে অলঙ্কারের মাধ্যমে মাংসে ভৌত, রাসায়নিক ও জীবাণুু সংক্রমণ না ঘটে।
    বিপণনে মাংস ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর নি¤েœ রাখতে হবে।
    কোন রকম রাসায়নিক উপকরণ বা সংরক্ষক (চৎবংবৎাধঃরাব) ব্যবহার করা যাবে না।
    বিপণনের স্থান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, উচ্চসূর্যালোক মুক্ত, ধুলাবালু হীন ও বৃষ্টি ও বাতাস হতে মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। যাতে মাংসের গুণগত মান ক্ষুণœ না হয়।
    মাংসকে অবশ্যই তরল বর্জ্য, পশু পাখি ও কীটপতঙ্গ হতে মুক্ত রাখতে হবে।
    মাংস সংরক্ষণ কাজে ব্যবহৃত উপকরণ ও ডাস্টবিন নিয়মিত জীবাণুমুক্ত উপাদান দিয়ে পরিষ্কার করে রাখতে হবে।
 
লেখক : উপসচিব, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, সেক্টর ০৫, রোড ০৩, বাসা ৫৮, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০; মোবাইল : ০১৫৫২৩৫৫৮৫৩; ই- মেইল : কধংিবৎঁষ১১৭৩@মসধরষ.পড়স

বিস্তারিত
লোনাপানির ভেটকি মাছের চাষ পদ্ধতি

লোনাপানির ভেটকি মাছের চাষ পদ্ধতি
মো: তোফাজউদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সাগর উপকূলের স্বল্প লোনাপানির মাছের মধ্যে ভেটকি একটি সুস্বাদু, জনপ্রিয় এবং বাণিজ্যিকভাবে অতিব গুরুত্বপূর্ণ মাছ। অধিক লবণাক্ততা ও তাপমাত্রা সহনশীল হওয়ায় উপকূলীয় ঘেরে এ মাছ চাষের জনপ্রিয়তা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ মাছ উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ, ক্ষতিকারক চর্বি নেই। উপকূলীয় এলাকায় চিংড়ি ও অন্যান্য মাছের সাথে এ মাছ মিশ্রভাবে চাষ হচ্ছে। বিদেশে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ব্যাপক চাহিদা ও বাজারমূল্য বেশি থাকায় চিংড়ি চাষের পাশাপাশি অন্যান্য অল্প লোনাপানির এই মাছচাষ চাষিদের জন্য সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। বিদ্যমান সাধারণ চাষ পদ্ধতি দ্বারা এ মাছের উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি করার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে যা তাদের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। দেশের উপকূলীয় সকল অংশে সমভাবে এ মাছ চাষের সম্প্রসারণ ঘটে নাই তবে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট জেলায় এ মাছ চাষ শুরু হয়েছে। বর্তমানে উপকূলীয় অঞ্চলের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাদুপানির পুকুরে অন্যান্য মাছের সাথে এ মাছচাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কোরাল মাছের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও উচ্চ বাণিজ্যিক সম্ভাবনার কারণে এ মাছের প্রনোদিত (ওহফঁপব ইৎববফরহম) প্রজননের জন্য সরকার নানাবিধ উদ্যোগ ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছেন এবং এ মাছের চাষ ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ কাজ করছে।
ভেটকি মাছের পরিচিতি : ভেটকি মাছ  (খধঃবং পধষপধৎরভবৎ) এশিয়া অঞ্চলে  ঝবধ নধংং , অস্ট্রেলিয়ায় বারামুন্ডি (ইধৎৎধসঁহফর) এবং বাংলাদেশে ‘কোরাল’ ও ‘ভেটকি’ এবং স্থানীয়ভাবে ’পাতাড়ি’ নামে পরিচিত। খধঃরফধব পরিবারের চবৎপরভড়ৎসবং বর্গের ও খধঃবং গণের অন্তর্ভুক্ত এ মাছটির দেহ লম্বাটে, পার্শ্বীয়ভাবে চাপা, নিচের চোয়াল উপরের চোয়ালের তুলনায় সামান্য বড়। এটি একটি লবণাক্ত পানির মাছ হলেও স্বাদু পানিতেও বড় হয়। এদের চোখ সোনালি-বাদামি বর্ণের। ভেটকি মাছের দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ ১.৫-২.০ মিটার হয়ে থাকে এবং ওজন সর্বোচ্চ ৫৫-৬০ কেজি হতে পারে।  ভেটকি মাছ উচ্চ প্রজননক্ষম (ঐরময ঋবপধহফরঃু) হওয়ায় বছরে প্রায় ৬০-৭০ লক্ষ ডিম দেয়। এটি অভিপ্রয়াণশীল (গরমৎধঃড়ৎু) ও উচ্চ লবণাক্ততা সহিষ্ণু প্রজাতির মাছ।
ভেটকি মাছের আবাসস্থল
া    বাংলাদেশে দক্ষিণাঞ্চলে বঙ্গোপসাগর এবং চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও পটুয়াখালীর সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় নদী মোহনায় এবং চিংড়ির ঘেরে ভেটকি পাওয়া যায়।
া    ভেটকি মাছ সাধারণত মোহনা এবং লোনা পানির পরিবেশকে তাদের নার্সারি গ্রাউন্ড ও খাদ্যের উৎস হিসাবে ব্যবহার করে।
া    নদীর মুখে ও উপকূলীয় এলাকায় যেখানে লবণাক্ততা   ৩০-৩২ পিপিটি এবং গভীরতা ১০-১৫ মিটার সেখোনে পরিপক্ব ভেটকি মাছ পাওয়া যায়।
া    ভেটকি মাছ ঈধঃধফৎড়সড়ঁং স্বভাবের অর্থাৎ তাদের জীবনের বেশিরভাগ সময় মিঠা পানিতে কাটে এবং বংশবৃদ্ধির জন্য নোনা পানিতে পাড়ি জমায়। ভেটকি মাছের পোনাগুলো উপকূলীয় নদী স্রােতে পাওয়া যায় এবং বড় ভেটকি মাছ  সাগর ও নদী-মোহনায় পাওয়া যায়। তাদের সমগ্র জীবনচক্র কাটে নোনা ও স্বল্প লোনা এবং স্বাদু পানিতে। এ মাছ বিস্তৃত (ডরফব জধহমব) লবণাক্ততার মধ্যে বেঁচে থাকতে পারে। ভেটকি মাছ সাধারণত গাছের গুঁড়ি বা অন্যান্য বস্তুর নিচে লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে।
পুকুরে ভেটকি মাছচাষের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ব্যতিক্রম বিষয় রয়েছে। সাধারণত রুই জাতীয় মাছের (শতকে ১০-২০টি) সাথে এ মাছচাষ করা যাবে। রুই জাতীয় মাছের আকার       ১০০-২০০ গ্রাম (এর ছোট নয়) হলে তার সাথে ভেটকি মাছের পোনা মজুদ করা যাবে। একটি পুকুরে ভেটকি মাছের ছাড়ার পরিমাণের উপর খাবার সরবরাহ নির্ভর করে। খাবার কোথা থেকে, সংগ্রহ করতে পারবেন এ বিষয়গুলো নিশ্চিত হয়ে তার পরে মজুদ ঘনত্ব ঠিক করতে হবে। সাধারণভাবে বাহির থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে জীবন্ত ছোট মাছ সরবরাহ করতে পারলে শতকে ১০-১৫টি (৪-৫ ইঞ্চি) পোনা মজুদ করা যেতে পারে। যদি বাহির থেকে বাড়তি ছোট মাছ সরবরাহ না করা হয় তাহলে শতকে ১-২টি পোনা মজুদ করাই ভাল।  
চাষের পুকুর প্রস্তুতি : ভেটকি মাছের একক চাষের তেমন প্রচলন নাই। সাধারণত রুইজাতীয মাছের সাথে মিশ্র চাষ পদ্ধতিতে চাষ করা যায়। কার্পজাতীয় মাছের চাষের জন্য যেভাবে পুকুর প্রস্তুত করতে হয় সেভাবেই ভেটকি মাছচাষের জন্য পুকুর প্রস্তুত করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে পুকুরের পাড়ে যেন কোন সুড়ং বা গর্ত না থাকে। পুকুরের পানি প্রবেশের পথ মজবুত নেট দিয়ে বা বাশের বানা দিয়ে আটকিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় ভেটকি মাছ তার মজবুত তিক্ষè দাত দিয়ে জাল কেটে বেরিয়ে যেতে পারে। পুকুর প্রস্তুতের পর ১০০ গ্রামের বড় আকারে কার্পজাতীয় মাছ মজুদ করে ভেটকি মাছের পোনা মজুদ করতে হবে। অর্থাৎ ভেটকি মাছের থেকে কার্পের পোনা অবশ্যই বড় হতে হবে।
পোনা সংগ্রহ এবং মজুদপূর্ব প্রতিপালন :  আধা লবণাক্ত পানির এ মাছ জীবনের সকল পর্যায়ে অক্সিজেনে প্রতি বেশ স্পর্শ কাতর। এ জন্য এ মাছের পোনা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সংগ্রহ ও পরিবহন করতে হয়। কার্পজাতীয় মাছের থেকে এসব প্রজাতির মাছের পোনা পরিবহন বেশ কষ্ট কর। একটু অসর্তক হলেই পরিবহনের সময় অনেক পোনার ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। আলোচিত মাছের পোনা পরিবহন কিছুটা দুরূহ কাজ। এ জন্য উৎস থেকে ছোট পোনা সংগ্রহ করে একটি ছোট নার্সারি পুকুরে রেখে কিছু দিন পালন করে মজুদ পুকুরে ছাড়লে ভাল হয়। এর ফলে নির্দিষ্ট আকারের পোনা প্রাপ্তি সহজ হয় এবং পরিবহনজনিত মৃত্যুহার কমানো যায়। পোনা প্রতিপালন কাজটি খুব জটিল কঠিন নয়। মূল চাষের পুকুরের কাছাকাছি একটি পৃথক ছোট নার্সারি পুকুর হলে ভাল হয়, না থাকলে এ কাজটি চাষের পুকুরের এক অংশ নেট দিয়ে (ওহঢ়ড়হফ ঘঁৎংবৎু) ঘিরে তার মধ্যে ১ মাস চাষ করে নেয়া যেতে পারে। এ কাজটি একটি লাইনোনের বড় হাপার (১৫/৩০ ফুট) ভিতরেও করা যেতে পারে। এখানে খাবার হিসাবে ভেটকি মাছের জন্য ছোট ধানি পোনা (২০০০-২৫০০ লাইনের) সরবরাহ করতে হবে। এভাবে ৩০-৪০ দিন লালন করে চাষের পুকুরে ছেড়ে দেয়া যায়। এভাবে পোনা প্রতি পালন করে পুকুরে মজুদ করলে পোনা বাচার হার বেশি পাওয়া যায়। পুকুরে মাছচাষে সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ করা যায়।
পরিবহন পাত্রের পানির তাপমাত্রা ও রাসায়নিক গুণাগুণ পুকুরের পানির তাপমাত্রা ও রাসায়নিক গুণাগুণের পার্থক্য থাকে। এজন্য পোনা পরিবহন পাত্র থেকে পুকুরে ছাড়ার আগে পুকুরের পানির সাথে অভ্যস্থ করে নিতে হবে। এ উদ্দেশ্যে পরিবহন পাত্র হতে পোনা পুকুরে ছাড়ার আগে পুকুর হতে পরিবহন পাত্রে অপর একটি পাত্র দিয়ে পানি মিশাতে হবে। অক্সিজেন ব্যাগের ক্ষেত্রে ব্যাগ পুকুরের পানিতে ভাসিয়ে রাখতে হবে এবং ধীরে ধীরে বাধন খুলে পূর্বের ন্যায় পরিবেশে খাপখাওয়াতে হবে।
পোনা অবমুক্তকরণ : পোনা ছাড়ার আগে পুকুরের পানিতে তাৎক্ষণিক অক্সিজেন সরবরাহের জন্য সোডিয়াম পারকার্বনেট ৩০ শতকে ০.৫ কেজি হারে পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। এর পাশাপাশি জীবাণুনাশক পরিমাণমতো পানিতে ভালভাবে গুলিয়ে পুকুরে ছিটিয়ে দিলে পোনার বাচার হার ভাল হবে। এ কাজটি পোনা ছাড়ার পরও করা যেতে পারে। পোনা অভ্যস্থ করার পর পাত্রের মুখ কাত করে ধরে বাহিরের থেকে ভিতরের দিকে স্রােতের ব্যবস্থা করলে পোনা স্রােতের বিপরিতে ধীরে ধীরে পুকুরে চলে যাবে। পোনা সাধারণত সকালে অথবা বিকালে ছাড়তে হবে।
মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা
চাষের মাছের ভাল বর্ধনের জন্য নিয়মিত পরিমিত খাবার প্রয়োগ একান্ত প্রয়োজন। ভেটকি মাছ সম্পূরক খাবার খায় না কেবল জীবন্ত মাছ খেয়ে বড় হয়। ভেটকি মাছচাষের জন্য আমরা দুভাবে জীবন্ত মাছের ব্যবস্থা করতে পারি।
া    পৃথক নার্সিারি পুকুরে কম দামের রুই জাতীয় মাছের রেণু যেমন, সিলভার, মৃগেল, বাটা মাছের পোনা প্রতি পালন করে ভেটকি মাছের চাহিদা অনুযায়ী আকারের (১.৫-২ ইঞ্চি) পোনা ধরে চাষের পুকুরে ছাড়া যেতে পারে। প্রতি দিন এভাবে পোনা দেয়া যেতে পারে। তবে ৬ থেকে ৭ দিন পরপর নার্সারি পুকুর থেকে পরিমাণ মত পোনা ধরে চাষের পুকুরে ছেড়ে দিয়েও চাষ করা যায়। এতে উৎপাদন খরচ কিছুটা বেশি পড়ে। তবে এ পদ্ধতি অনুসরণ করলে চাষের পুকুরে কিছু পোনা আকারে বড় হয়ে যায় যা ভেটকি মাছে আর ধরে খেতে পারে না। এ বড় আকারের পোনা বিক্রয় করে বাড়তি আয় পাওয়া যায়।
২) ভেটকি মাছের পুকুরে দেশি তেলাপিয়া, টিতপুটি, চোখকুনি, দাড়কানি, মলা, কানপোনা প্রভৃতি ছোট প্রজাতির কিছু মা মাছ চাষের পুকুরে মজুদ করলে পুকুরে এসব প্রজাতির মাছ পোনা উৎপাদন করে যা ভেটকির খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। ছোট প্রজাতির এ সব মাছের দ্রুত বৃদ্ধি ও বংশ বিস্তারের জন্য অটোকুড়া বা পাউডার জাতীয় খাবার দিতে হয়। আর এটাই ভেটকি মাছচাষের সর্বোত্তম পদ্ধতি। ছোট মাছের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকলে ভেটকি মাছ বৃদ্ধি পায় না এবং বড়গুলো ছোটদের ধরে খেয়ে ফেলে। এ কারণে অনেক সময় চাষি মজুদ সংখ্যার অনুরূপ সংখ্যক মাছ আহরণ করতে ব্যর্থ হন। পর্যাপ্ত খাবার না সরবরাহ করলে উৎপাদিত মাছের আকারেও ব্যাপক তারতম্য হতে দেখা যায়।
৩) উপরে আলোচিত দুটি পদ্ধতির সমন্বয়েও ভেটকি মাছের খাবারের সংস্থান করা যেতে পোরে। আর যে চাষির জন্য যে পদ্ধতি সহজ হবে সেভাবে তিনি এ মাছচাষের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করতে পারেন। গুরুত্বপূর্ণ হল ভেটকি মাছের জন্য খাদ্যের সংস্থান করা ব্যতিরেকে চাষে নামা ঠিক নয়। তবে ঘনত্ব কম হলে বাহির থেকে ছোট পোনা সরবরাহ না করলেও কিছু ভেটকি মাছচাষ করা যায়।
এক কেজি ভেটকি মাছ উৎপাদন করতে কত কেজি পোনা মাছ লাগে তা নিয়ে বিস্তর মত পার্থক্য আছে। বেশির ভাগ চাষির মতে ২-৩ কেজি জীবন্ত পোনা খাওয়ালে ১ কেজি ভেটকি মাছ উৎপাদন করা যায়।
বিঃদ্রঃ কোন কোন মাছ চাষি মরা মাছ খাইয়ে বিশেষ করে খাল বিলের দেশি পুঁটি মাছ বাজার থেকে সংগ্রহ করে ভেটকি মাছচাষের চেষ্টা করছেন এবং প্রাথমিকভাবে কিছুটা সফলতাও লাভ করেছেন বলে আমাদের নজরে এসেছে।
মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণ  
উপরে বর্ণিত পদ্ধতিতে নিয়মিত খাদ্য এবং পরিচর্যা চালিয়ে গেলে মোটামুটি ৭-৮ মাস চাষ করলে মাছ বাজারে বিক্রয় উপযোগী হয় তবে যেহেতু এ মাছ রাক্ষুসে প্রজাতির সে জন্য সকল মাছে সমভাবে খাবার গ্রহণ করতে পারে না এ জন্য উৎপাদিত মাছের মধ্যে ছোট বড় হতে দেখা যায়। একই সময়ে কিছু মাছ ২-৩ কেজি আকারের হয় আবার কিছু কিছু                ৭০০-৯০০ গ্রামের হতে দেখা যায়।
আহরণের পর আমাদের দেশে মাছের সঠিক যতেœর অভাবে মাছে গুণগত মানের ক্ষতি হয়, কারণ মাছের সজিবতা দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। আলোচ্য মাছের ভেতর নোনা ট্যাংরা আমাদের চাষের অন্যান্য প্রজাতির মাছের ন্যায় বাজারজাত করা যেতে পারে। তবে ভেটকি, ভাঙন, পারশে এবং খরশোলা মাছ বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। মাছ আহরণের সাথে সাথে বাজারে নিতে হবে অথবা দ্রুত বরফায়িত করতে হবে। মাছ বাজারে প্রেরণের সময় ক্যারেটে করে পরিবহন করা উত্তম। বেশি বড় আকারের পাত্রে অধিক ঘনত্বে পরিবহন করা উচিত নয়। মাছ ধরা বা পরিবহনের সময় মাছ যাতে আঘাত প্রাপ্ত না হয় সে দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। কারণ আঘাতপ্রাপ্ত মাছ বেশি সময় সজীবতা থাকে না এবং মাছের গায়ের রং নষ্ট হয়ে যায়।
সতর্কতা : ভেটকি মাছচাষের পুকুরের পানি প্রবেশের রাস্তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ভেটকির চোয়ালে খুব ধারাল দাঁত থাকে যা দ্বারা সাধারণ নেট কেটে বের হয়ে যেতে পারে। এ জন্য পানি প্রবেশের পাইপের মুখে মজবুত নেট দিয়ে শক্তভাবে আটকাতে হবে। বানা দিয়ে আটকানো থাকলেও চলবে তবে পানির এ প্রবেশ বা বাহিরে বের হওয়ার পথ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
উল্লেখ্য সঠিক পদ্ধতিতে ১৫ বিঘার আয়তনের একটি পুকুরে ৩-৪ ইঞ্চি আকারের ভেটকি মাছ চাষ করলে ২২৮০টি পোনা মজুদ করা যায়। তাতে ১ বছরে ০.৮ কেজি থেকে ৩.৫ কেজি আকারের ১৭২১টি মাছ পাওয়া যেতে পারে এবং কেজি প্রতি ৪০০ টাকা করে বিক্রয় করা সম্ভব।


লেখক : সাবেক ডিভিশনাল ডেপুটি ডাইরেক্টর, মৎস্য অধিদপ্তর, খুলনা বিভাগ, খুলনা, মোবাইল : ০১৭৫১৯৩৯৯৩২, ই-মেইল : ঃড়ভধু২০১০@মসধরষ.পড়স

বিস্তারিত
অনলাইনে কোরবানির জন্য সঠিক গরু কেনার কৌশল

অনলাইনে কোরবানির জন্য সঠিক গরু কেনার কৌশল
ডা: সুচয়ন চৌধুরী
কোরবানির এ সময়ে প্রতি বছর গরুর বাজারগুলো থাকে জমজমাট। কিন্তু গত কয়েক বছর থেকে তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর অনলাইন বাজার থেকে পশু ক্রয়ের প্রবণতা বেড়েছে অনেক। ক্রেতারা অনলাইনেই অনেকে পছন্দ করে কিনে নিচ্ছেন তাদের পছন্দের পশুটি। খামারিরাও দিনের পর দিন যত্ন করে তৈরি করা গরুটি সঠিক মূল্যে তুলে দিচ্ছে ক্রেতার হাতে। তবে এই ব্যবস্থায় গরু ক্রয়ের ক্ষেত্রে সঠিক সুস্থ গরুটি যাচাই-বাছাই করে ক্রয় করা খুব জরুরি। সুস্থ গরু যাচাই-বাছায়ের কিছু বিষয় জানা থাকলে অনলাইনে কেনাকেটা করে প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যাবে। তাই সেই বিষয়ে আপনাদের কিছু কৌশল নিয়ে আজকে আলোচনা করব।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনলাইনে ছবি দেখেই পছন্দ করেন আপনার কোরবানির গরুটি। অনেক বিক্রতা ভিডিও দিয়েও ক্রেতাকে             আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন। ক্রেতাকে শুধুমাত্র ছবি দেখে বা ভিডিও দেখে গরু ক্রয় করা উচিত নয়। অনলাইনে ছবি দেখে পছন্দ হলে ক্রেতার সাথে কথা বলে গরুটি স্বচক্ষে দেখে নেয়া উচিত। ছবি/ভিডিও এবং সরাসরি গরু দেখে নি¤েœাক্তভাবে গরুর সুস্থতা নিশ্চিত হওয়া যায়।
ছবিতে বা ভিডিও দেখে প্রথমে উপযুক্ত গরু নির্বাচন করতে হবে। চেষ্টা করতে হবে সব দিকের ছবি দেখে কিনতে। বিশেষ করে সামনের পেছনের ডানের বামের সম্পূর্ণ ছবি অবশ্যই থাকতে হবে। খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখতে হবে যে, গরুটি তার চার পায়ের উপর সমানভাবে ভর করে দাঁড়িয়েছে কিনা। যদি তার কোন পায়ে সমস্যা থাকে বা ব্যথা থাকে তাহলে গরুটি ঐ পায়ের উপর কম ভর দিবে এবং অন্যান্য পায়ের উপর বেশি ভর দিয়ে দাঁড়াবে।
ছবি জুম করে প্রতিটি পা এবং পায়ের ক্ষুর আলাদা আলাদাভাবে চেক করে নিতে হবে। অসুস্থ গরুর মূলত পায়ের ক্ষুরের মাঝখানে ঘাঁ বা ক্ষত থাকতে পারে।
সুস্থ গরুর একটি লক্ষণ হলো নাকের উপরে (গুুঁধষব) বিন্দু বিন্দু ঘামের মতো ফোঁটা থাকে অথবা সেটা কিছুটা আর্দ্র থাকে। যদি পশুর শরীরে জ্বর বা অন্য কোন অসুস্থতা থাকে তাহলে এই স্থানে শুষ্ক হয়ে যায়।
সুস্থ গরুর চোখগুলো হবে উজ্জ্বল। চোখের পাতা থাকবে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রসারিত। চোখের আশপাশে কোন ধরনের ক্ষত বা পানির ধারার চিহ্ন থাকবে না। চোখে কোন ধরনের ঝিমুনি ভাব থাকবে না। গরুর চোখের মনির চার পাশের অংশটি হালকা গোলাপী বর্ণের হয় । তবে সেটা যদি লাল দেখা যায় তাহলে ধরে নিতে হবে চোখে কোন ধরনের প্রদাহ আছে। যা অসুস্থতার লক্ষণ।
গায়ের পশম যদি উস্কখুসকো হয় তাহলে এই গরুটিকে শতভাগ পছন্দের তালিকায় রাখা ঠিক হবে না। এই সময় গরু লেজের আগায় পশম নেই অথবা লেজে ক্ষত রয়েছে ভালোভাবে খেয়াল করে দেখতে হবে।
গরু বাছাইয়ের সময় সামনের দুই পায়ের মাঝখানে বুকের নিচের অংশটি খেয়াল করতে হবে। এই স্থান কোন অস্বাভাবিক ফোলা আছে কি না। আর সামনের পা দুইটি অধিক প্রসারিত আছে কিনা। যদি বুকে কোন ধরনের ব্যথা বা সমস্যা থাকে তাহলে গরু তার সামনের পা দুটি একটু বাহিরমুখি করে রাখার চেষ্টা করবে।
পেটের নিচের অংশটিও খেয়াল করতে হবে। যদি এটি অস্বাভাবিক ভাবে ঝুলে থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে এই গরুর শরীরে চর্বির পরিমাণ বেশি হবে। একইভাবে পেছনের দিকে লেজের নিচের অংশে যেখানে অধিক মাংস থাকে সেখানে যদি বেশি ঝুলে থাকে তাহলেও এই গরুর শরীরে অধিক চর্বি থাকবে।
গরুর শ্বাস প্রশ্বাস লক্ষ্য করতে হবে। যদি শ্বাস গ্রহণ ও নিঃশ্বাস ত্যাগ ছন্দময় হয় তাহলে এটি পশুর সুস্থতার ইঙ্গিত দেয়। তবে শ্বাস-প্রশ্বাস যদি খুব দ্রুত বা খুব ধীরে হয় তাহলে এটি পশুর অসুস্থতা নির্দেশ করে। যদি সরাসরি দেখেন তাহলে খেয়াল করতে হবে শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় যে বাতাস ত্যাগ করছে তা খুব গরম কিনা? শরীরে জ্বর থাকলে             শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় গরম হাওয়া বের হবে।
পশুর পাকস্থলী তথা পেটের আকার শরীরে সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। পেট খুব বড় হলে ভুঁড়ির কারণে লাইভ ওয়েটে পাওয়ার ওজনের তুলনায় প্রকৃত ভক্ষণযোগ্য মাংসের পরিমাণ অনেক কম হবে।তাছাড়া পেটে গ্যাস জমে যদি পেট ফুলে সেটি পশুর অসুস্থতা নির্দেশ করে।
শরীর খুব বেশি বড় ও নাদুশ-নুদুশ থলথলে হলে সেই পশু থেকে ভালো মাংস পাওয়া সম্ভব না। ঐ পশুর শরীরে চর্বির পরিমাণ বেশি থাকবে। তাছাড়া কেউ যদি অসাধু উপায়ে মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ দিয়ে পশু মোটাতাজাকরণ করে থাকে তাহলে ঐ পশুটি প্রাণবন্ত হয় না। অর্থাৎ আপনি পশুটির ভিডিও দেখলেই তা বুঝে যাবেন।
পশুটির কান জোড়া খেয়াল করতে হবে। কানে কোন ধরনের কাটা ছেড়া, ফাটা আছে কি না, তবে এই ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয় তা হলো সুস্থ পশুর কানগুলো থাকবে খাড়া এবং পরিবেশের যে কোন শব্দে সে সাড়া দেবে। আর যদি অসুস্থ পশু হয় তাহলে তার কান নিস্তেজ হয়ে ঝুলে পড়তে পারে। আর অসুস্থ পশুটি কান নাড়াতে অনীহা প্রকাশ করবে।
গরুর বয়স সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য পশুটির দাঁতের ছবি প্রয়োজন। নিচের পাটিতে মাঝ বরাবর দুইটি বড় দাঁত থাকে (চবৎসধহধহঃ ওহপরংংড়ৎ ঞববঃয) তাহলে পশুটি দুই বছর পার করেছে। দুই থেকে তিন বছরের গরু মোটামুটি মাংসের গুণগত মান ভাল থাকে। তাছাড়া এই বয়সে শরীরে চর্বির পরিমাণও কম থাকে।
খেয়াল করতে হবে নাক, মুখ পরিষ্কার আছে কিনা? নাকে সর্দি থাকলে সেটা পশুর অসুস্থতা নির্দেশ করে। তাছাড়া মুখে অস্বাভাবিকভাবে লালা ঝরলে ধরে নেয়া যায় মুখে কোন ধরনের ঘাঁ বা অন্য কোন ধরনের সমস্যা আছে।
পশুর শরীরে কোন ক্ষত আছে কিনা তা পশুর বিভিন্ন দিক থেকে তোলা ছবি জুম করে দেখে নিশ্চিত হতে হবে। তবে কেনার পরও কিছু বিষয়ে আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে। অনলাইনে গরু কেনার পর ডেলিভারি দেওয়ার সময় বিক্রেতা যাতে কোন ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিতে না পারে সে জন্য আপনি যে পশুটি পছন্দ করেছেন তার রঙ, বুকের বেড়, দৈর্ঘ্য, উচ্চতা এবং নির্দিষ্ট কোন শনাক্তকরণ চিহ্ন যা পশুর দেহে বিদ্যমান তা নির্দিষ্ট করে রাখতে হবে।
তাই সঠিক নিয়ম জেনে কোরবানির পশু ক্রয় ও জবাই করা উচিত। এতে করে দেশের প্রকৃত খামারিরা উপকৃত হবে এবং চারপাশের পরিবেশ থাকবে দুর্গন্ধ ও দূষণ মুক্ত।

লেখক : উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল, মানিকছড়ি, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা। মোবাইল : ০১৭১৮৬৩০২৬৮, ই-মেইল : ঁষড়.সধহরশপযধৎর.ফষং@মসধরষ.পড়স

বিস্তারিত
আধুনিক প্রযুক্তিতে পাটবীজ উৎপাদন সংরক্ষণ

আধুনিক প্রযুক্তিতে পাটবীজ উৎপাদন সংরক্ষণ
সাদিয়া আফরিন জুই
বাংলাদেশের অন্যতম আঁশ ফসল পাট, কেনাফ ও মেস্তা। বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্ত্বপূর্ণ পাটের দুটি প্রজাতি-দেশী ও তোষা। দেশী পাটের ফল গোলাকার এবং তোষা পাটের ফল লম্বা। বীজ ফসলের জন্য আধুনিক পদ্ধতিতে পাট বীজ উৎপাদন বলতে নাবীতে পাট বীজ উৎপাদনকেই বোঝানো হয়। পাটবীজ উৎপাদনের জন্য অনেক সময় আঁশ ফসলের একাংশের গাছ না কেটে বীজ উৎপাদন করলে বন্যা বা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বীজের মানের সাথে ফলনও কমে যায়। তাই সবকিছু বিবেচনায় নাবীতে পাটবীজ উৎপাদনের ব্যবস্থা নেয়া লাভজনক। নাবী মৌসুমে অর্থাৎ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে পাটবীজ উৎপাদনে নি¤েœর পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা হয়।
বীজ বপন পদ্ধতি : সরাসরি বীজ বপন পদ্ধতিতে ভাল বীজ পেতে হলে দেশী পাটবীজ শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি (মধ্য জুলাই থেকে মধ্য আগস্ট) এবং তোষা পাটের বীজ ১৫ই ভাদ্র (৩০শে আগস্ট) এর মধ্যে বপন করতে হবে। যে সব স্থানে বৃষ্টিপাত  তুলনামূলকভাবে কম হয় সেসব স্থানে এইপদ্ধতিতে সহজেই বীজ উৎপাদন করা যায়। সরাসরি বীজ বপন পদ্ধতিতে জমিতে দেরিতে বীজ বপন করে পাট গাছের দৈহিক পর্যায়ের বৃদ্ধির সময় কমিয়ে ফুল, ফল ও বীজ পর্যায়ের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে পাট গাছের লম্বায় বৃদ্ধি কম হলেও অধিক সংখ্যক ডালপালাসহ পরিপুষ্ট ফল ও বীজ উৎপাদন করা সম্ভব। দেশের উত্তাঞ্চলের জেলাসমূহে (রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী ও বগুড়া) শীত আগে আসার জন্য ১৫ দিন আগে বীজ বপন করতে হবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অর্থাৎ যশোর, কুষ্টিয়া অঞ্চলে ভাদ্রের শেষ পর্যন্ত বীজ বপন করা যায়।
বীজের হার : সারিতে বপন করলে প্রতি হেক্টরে ৪ কেজি অর্থাৎ প্রতি শতাংশ জমিতে ১৬ গ্রাম তোষা বীজ এবং প্রতি হেক্টরে ৫ কেজি অর্থাৎ প্রতি শতাংশ জমিতে ২০ গ্রাম দেশী বীজ বপন করতে হবে। আর ছিটিয়ে বপন করলে প্রতি হেক্টরে ৫ কেজি অর্থাৎ প্রতি শতাংশ জমিতে ২০ গ্রাম তোষা বীজ এবং প্রতি হেক্টরে ৬ কেজি অর্থাৎ প্রতি শতাংশ জমিতে ২৪ গ্রাম দেশি পাটের বীজ বপন করতে হবে। কেনাফ সারিতে বপন করলে প্রতি হেক্টরে ১২ কেজি অর্থাৎ প্রতি শতাংশ জমিতে ৫০ গ্রাম  বীজ  বপন করতে হবে।
সার প্রয়োগ : জমির উর্বরতা বুঝে শেষ চাষের সময় একর প্রতি ১৫-২০ কেজি (প্রতি শতাংশে ১৫০-২০০ গ্রাম) ইউরিয়া, ৩০ কেজি (প্রতি শতাংশে প্রায় ৩০০ গ্রাম) টিএসপি, ৮ কেজি (প্রতি শতাংশে ৮০ গ্রাম) এমপি সার প্রয়োগ করতে হবে। চারা গজানোর ২০/২৫ দিন পর প্রথম নিড়ি দিয়ে একর প্রতি         ১৫-২০ কেজি (প্রতি শতাংশে ১৫০-২০০ গ্রাম) ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে এবং ৪৫-৫০ দিন পর একর প্রতি ১৫-২০ কেজি (প্রতি শতাংশে ১৫০-২০০ গ্রাম) ইউরিয়া সার তৃতীয়বার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
কা- বা ডগা রোপণ পদ্ধতি : সাধারণত মধ্য আষাঢ় (জুন মাসের শেষ সপ্তাহ) থেকে শ্রাবণ মাসের মধ্যে ডগা রোপণ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। যে বছর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেশি হতে থাকে বা নাবীতে বপনের জন্য যখন কৃষকের হাতে কোন বীজ  থাকে না সে বছর আঁশ ফসল থেকে বেছে কা- ও ডগা কেটে নিয়ে বীজ উৎপাদন করা যায়। কেননা বৃষ্টির দিনেও কা- ও ডগা রোপণ করা যায়, কেবল জমিতে পানি না দাঁড়ালেই চলে। পাট আঁশ ফসলের জমি থেকে ১০০দিন বয়সের  সুস্থ সবল গাছ বেছে নিতে হবে। যে সমস্ত গাছে ফুল আসেনি সেই সকল গাছ থেকে কাটিং সংগ্রহ করতে হবে। কাটিং ধারালো ছুরি দিয়ে তেরছা ভাবে কেটে নিতে হবে, কাটিং ৫-৬ ইঞ্চি লম্বা হবে এবং প্রতি কাটিং-এ ২/৩টি কুড়ি থাকবে। ডগা কাটার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে কাটা জায়গা থেঁতলে না যায়। থেঁতলানো অংশ মাটিতে পুঁতলে সহজে পচে যায় এবং শিকড় গজায় না।
ডগা রোপণের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেদিন ডগা সংগ্রহ করা হয়েছে সেদিনই উহা যেন রোপণ করা হয়। তবে মেঘলা দিনে বা পড়ন্ত রোদে ডগা রোপণ করা উত্তম। ডগা বা কা- উত্তর-দক্ষিণ দিকে সারি করে এবং উত্তর দিকে ৪৫ ডিগ্রি কোণে বা কাত রোপণ করতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৪০ সেমি. বা দেড় ফুট এবং ডগা থেকে ডগার দূরত্ব ১৫ সেমি. বা প্রায় ৬ ইঞ্চি হতে হবে। প্রতিটি ডগার প্রায় ৬ সেমি. বা ৩ ইঞ্চি পরিমান অংশ মাটির নিচে পুতে দিতে হবে।
চারা রোপণ পদ্ধতি : চারা রোপণ পদ্ধতিতে প্রথমে বীজতলায় বীজ বপন করে চারা উৎপন্ন করা হয়। ৩মি.ী১মি. আকারের বীজতলায় আষাঢ় (মধ্য জুন-মধ্য জুলাই) মাসের মধ্যে ৫০-১০০ গ্রাম বীজ বপন করতে হবে। ইতোমধ্যে জমির জো বুঝে ৪-৫টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি নরম করে মূল জমি প্রস্তুত করতে হয়। বীজ তলার চারার বয়স ২৫-৪০ দিন হলে চারাগুলো রোপণের জন্য উপযুক্ত হয়। আষাঢ় মাসে বপনকৃত বীজ থেকে উৎপাদিত চারা ভাদ্র মাসের শেষ পর্যন্ত রোপণ করা যায়। বীজতলা থেকে চারা তুলে নিয়ে প্রথমে ছায়ায় রাখতে হবে। প্রতিটি চারার ডগার ২/৩টি কচিপাতা রেখে অন্যান্য সব পাতার বোটা বাদে বাকি অংশ কাঁচি দিয়ে কেটে দিতে হবে। বীজতলা থেকে যেদিন চারা তুলা হবে ঐদিনই মূল জমিতে চারা রোপণ করা ভালো। মূল জমিতে সারি করে চারা রোপণ করতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৪০ সেমি. বা ১.৫ ফুট এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ১৫ সেমি. বা প্রায় ৬ ইঞ্চি রাখতে হবে। মেঘলা দিনে অথবা সন্ধ্যার আগে যখন রোদ থাকে না তখন চারা রোপণ করা ভালো।
পাট বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ : পাট ও কেনাফ বীজ ফসল অতিরিক্ত পাকলে বিশেষ করে তোষা ফল ফেটে বীজ ঝড়ে যায়। আর কম পাকলে বীজ চিটা হবার আশঙ্কা থাকে। দেশী ও তোষা উভয় ক্ষেত্রেই শতকরা ৬০-৭০ ভাগ ফল বাদামি রং ধারণ করলে গাছের গোড়া সহ কেটে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। তবে ২/৩ কিস্তিতে বীজ সংগ্রহ করলে বীজের মান ভালো হয়। বপন সময়ের উপর নির্ভর করে ফসল কর্তনে প্রায় ১২০-১৪০ দিন সময় লাগে। পাকা ফলসহ গাছ কাটার জন্য শুকনা দিন বেছে নিতে হবে। বৃষ্টি ভেজা দিনে পাকা ফলসহ গাছ না কাটাই উত্তম। বীজ ফসল কর্তনের সময় জমিতে মরা ও শুকনা গাছগুলো বাদ রেখে বীজ ফসল সংগ্রহ করতে হবে। মরা ও রোগাক্রান্ত গাছ একই সাথে কর্তন করলে সমস্ত বীজ রোগ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। কারণ, বীজ ফসলের ক্ষেত্রে বীজের পরিমাণের চেয়ে গুণগত মান অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ফলসহ গাছ সংগ্রহ করার পর গাছ বা ডগা ৩/৪ দিন রোদে ভালোভাবে শুকাতে হবে। প্রতি দিন শুকানো শেষে গাছগুলো ঠা-া হলে পলিথিন বা কোন আবরণ দিয়ে ঢেকে রাতের কুয়াশা বা বৃষ্টি থেকে গাছগুলোকে রক্ষা করতে হবে। বীজ মাড়াই করে, পর পর ৫/৬ দিন পূর্ণ রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে পাটবীজ সংরক্ষণ করা উচিত। প্রতি দিন শুকানো শেষে বীজগুলোকে ঠা-া করে পলিথিন, চট বা ত্রিপল দিয়ে ভালো করে রাতে ঢেকে রাখতে হবে যেন কুয়াশা বা বৃষ্টিতে না ভিজে। ভালোভাবে শুকানোর পর শুকনো বীজকে দুই দাঁতের ফাঁকে নিয়ে চাপ দিলে যদি কট করে বীজটি ভেঙে যায়, তাহলে বুঝতে হবে বীজ ভালোভাবে শুকানো হয়েছে। বীজ অবশ্যই ত্রিপল বা চট জাতীয় কোন কিছুর উপর শুকাতে হবে। অন্যথায় বীজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভ্রুণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। শুকানোর পর বীজের আর্দ্রতা সাধারণত শতকরা ৮-৯ এর কাছাকাছি থাকে। বীজ ভালোভাবে সংরক্ষণের জন্য বীজের আর্দ্রতা শতকরা ৯ এর নিচে থাকা উচিত। আমাদের দেশে ক্ষুদ্র চাষির সংখ্যা বেশি এবং তাদের বীজের পরিমাণও কম। সে জন্য টিনের কৌটা, প্লাস্টিকের ক্যান ইত্যাদি বায়ুরোধী পাত্রে তারা বীজ সংরক্ষণ করতে পারে। তবে বীজের পরিমাণ বেশি হলে প্লাস্টিক বা টিনের ড্রামে তা সংরক্ষণ করা যাবে। একটি বিষয় সব সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোন ভাবেই পাটবীজ সংরক্ষণের পাত্রে বাতাস প্রবেশ করতে না পারে। পরিমাণে কম বীজ কখনও বড় কোন ড্রাম বা পাত্রে রাখা ঠিক হবে না।   
যদি বায়ুরোধী পাত্র না পাওয়া যায় তখন মাটির কলসী, হাড়ি বা মটকায় বীজ রাখা যেতে পারে। তবে এসব পাত্রে বীজ রাখার পূর্বে মাটির কলসী, হাড়ি বা মটকাকে আলকাতরা বা রঙয়ের প্রলেপ দিতে হবে অথবা বীজ রাখার পূর্বে মোটা পলিথিন দিয়ে ভালোভাবে ঐ পাত্র মুড়ে দিতে হবে যাতে মাটির পাত্রটি বায়ুরোধী হয়। বড় কোন পাত্রে অল্প পরিমাণ বীজ রাখা ঠিক হবে না। এতে পাত্রের খালি অংশের আর্দ্রতা বীজের গুণগত মান খারাপ করতে পারে।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ক্রপ ম্যানেজমেন্ট শাখা, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া এভিনিউ ঢাকা। মোবাইল : ০১৭৬৮৬৬৫৪৫৬, ই- মেইল : ংধফরধন্সৎঁ@মসধরষ.পড়স

বিস্তারিত
খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে খেতের আইলে ফসল চাষ

খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে খেতের আইলে ফসল চাষ
কৃষিবিদ মোঃ সুনাইন বিন জামান
কয়েক বছর ধরে চলমান করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্যের উৎপাদন বিঘিœত হয়েছে। তার উপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য সরবরাহ হ্রাস পেয়েছে। খাদ্যশস্যের আমদানি মূল্য হু হু করে বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আগত বছরে বিশাল এক খাদ্য ঘাটতি ও দুর্ভিক্ষের আশংকা করছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে বলেছেন এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। তিনি বলেছেন, ‘দরকার হলে অনাবাদি জমিতে একটা ফল, সবজি বা কাঁচামরিচের গাছ লাগান। সেখান থেকেও কিন্তু অল্প কিছু হলেও পাওয়া যাবে।‘ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট যে সামনের বছরগুলোতে আগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতি ইঞ্চি জমির সদ্ব্যব্যবহার আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আমাদের কৃষি ব্যবস্থার বহুবিধ সমস্যার একটি অন্যতম সমস্যা হলো কৃষি জমির ক্ষুদ্রায়তন ও             খ--বিখ-তা। প্রতি বছরই তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন আইল। কথিত আছে, বাংলাদেশের সকল কৃষি জমির আইল একত্রিত করলে তার আয়তন গিয়ে দাঁড়াবে সমগ্র বগুড়া জেলার সমান। যদি তাই হয়, তাহলে হিসাব মতে প্রায় ২ লক্ষ ৯২ হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি অবস্থায় পড়ে রয়েছে (বগুড়া জেলার আয়তন ২৯২০ বর্গ কিমি, ১ বর্গ কিমি=১০০ হেক্টর, অতএব ২৯২০ী১০০=২,৯২০০০ হেক্টর) যা একটু সচেষ্ট হলেই আবাদের আওতায় আনা সম্ভব হবে আইল ফসল চাষ করার মাধ্যমে। এক্ষত্রে খেতের চতুর্পাশ্বের আইলের মধ্যে যেটা সচারচর হাঁটা চলায় ব্যবহৃত হয় তা রেখে অন্য তিন পাশের আইলে বিভিন্ন ফসল চাষ করা যেতে পারে। ক্ষেতের আইলে যে ফসল চাষ করা হয় তাই আইল ফসল।
আইল ফসল চাষ  
প্রতি ইঞ্চি জমির সঠিক ও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে; পারিবারিক পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে; উৎপাদন বাড়বে; মাধ্যমে স্বল্প খরচে কৃষক বাড়তি আয় ঘরে তুলতে পারবে; আইলে ফসল চাষ করার মাধ্যমে মূল ফসলের রোগ ও পোকার বিকল্প পোষক কমানো যাবে; কৃষক নিয়মিত জমি পরিদর্শনে উৎসাহিত হবে; আইল ফসল জমির বেড়া হিসেবে কাজ করবে যা মূল জমির মধ্য দিয়ে মানুষ, গরু, ছাগলের অনাকাক্ষিত বিচরণ বন্ধ করবে; আইল সুগঠিত হওয়ায়  খেতে ব্যবহারকৃত উপকরণের (সেচ, সার) সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হবে; নিয়মিত আইল ফসল চাষ করলে মূল জমিতে ইঁদুরের উৎপাত কমবে; উপকারি পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল, সংরক্ষণ ও বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে; আইল ফসলে পোকা খেকো পাখি বসতে পারবে এবং ক্ষতিকর পোকামাকড় ধরে খাবে; জমিতে উপকারি পরভোজী ও পরজীবী পোকার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে যার ফলে রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার কমানো যাবে।
আইলে চাষ করার জন্য নির্বাচিত ফসলসমূহের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা বাঞ্ছনীয় তা হলো : ১. স্বল্প জীবনকাল বিশিষ্ট হবে। ২. দ্রুত বর্ধনশীল হবে যেন মূল ফসলের পূর্বেই সংগ্রহ করা যায়। ৩. অবশ্যই রঙিন ফুল বিশিষ্ট হবে। ৪. কম ছায়াদানকারী হবে যেন মূল ফসলের ক্ষতি না হয়। এ ছাড়াও খেতের আইলে চাষ উপযোগী ফসলসমূহের বর্ষপঞ্জি টেবিল দ্রষ্টব্য।
ক্ষেতের মূল ফসলের সাথে মিল রেখে আইলে চাষ উপযোগী ফসল নির্বাচন করে বপন/রোপণ করতে হবে। উদাহরণসরূপ-
ক) মূল ফসল ধান হলে আইল ফসল হিসেবে মূল ফসলের সাথে মিল রেখে : বোরো মৌসুমে- শিম, টমেটো, বেগুন, শসা, লালশাক, পালংশাক, ধনিয়া প্রভৃতি ফসলের চাষ করা যেতে পারে; রোপা আউশ মৌসুমে- লাউ, মিষ্টিকুমড়া, করলা, কাঁকরোল, ঝিঙ্গা, বরবটি, ঢ়েঁড়স, বেগুন প্রভৃতি ফসলের চাষ করা যেতে পারে; রোপা আমন মৌসুমে- মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, করলা, বরবটি, ঢ়েঁড়স, আগাম শিম, আগাম টমেটো প্রভৃতি ফসলের চাষ করা যেতে পারে।
খ) মূল ফসল সবজি হলে আইল ফসল হিসেবে মূল ফসলের সাথে মিল রেখে : শীত মৌসুমে- শিম, টমেটো, বেগুন, লাউ, শসা, সরিষা, করলা প্রভৃতি ফসলের চাষ করা যেতে পারে; গ্রীষ্ম মৌসুমে- করলা, কাঁকরোল, ঝিঙা, বরবটি, ঢ়েঁড়স, বেগুন প্রভৃতি ফসলের চাষ করা যেতে পারে।  
আইল ফসল চাষের পদ্ধতি/নিয়মাবলি : খেতের উঁচু থেকে মাঝারি উঁচু আইল নির্বাচন করতে হবে; আইল চিকন হলে বা নিচু হলে বাইরে থেকে নরম কাদামাটি ব্যবহার করে আইল উঁচু ও চওড়া করে নিতে হবে; আইলের গঠন ঠিক রেখে উপরের মাটি ভালোভাবে কুপিয়ে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে; আইল ফসলের বীজ আইলে ছিটিয়ে বপন করা যাবে অথবা পলিব্যাগে চারা উৎপাদন করে নিয়ে রোপণ করতে হবে; নির্দিষ্ট দূরত্ব ও আকার বজায় রেখে মাদায়/গর্তে সুস্থ-সবল চারা রোপণ করতে হবে; মাদায়/গর্তে সুপারিশকৃত জৈব ও অজৈব সার ব্যবহার করতে হবে।
আন্তঃপরিচর্যা : সময়ে সময়ে ফসল মাত্রানুযায়ী জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগ করতে হবে; আইলে ঘাসসহ অন্যান্য আগাছা হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে তাই নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হবে; প্রয়োজন অনুযায়ী পরিমিত সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। পানির অপচয় রোধে মাদায় লাগানো ফসলের গোড়া ঝাঁঝরি দিয়ে ভিজিয়ে দেয়া যেতে পারে। এ ছাড়া মাটির আর্দ্রতা সংরক্ষণে খড়, কচুরিপানা, চটের বস্তা মালচিং হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে; লতানো সবজির ক্ষেত্রে চারা ১.৫-২ ফুট লম্বা হওয়ার পর খুঁটি/মাচা/বাউনি/জাংলা স্থাপন করতে হবে। খুঁটি বা মাচায় গাছ ভালোভাবে বাড়তে পারে, পর্যাপ্ত আলো-বাতাস পায় এবং পরিচর্যা করা সহজ হয় যার ফলে ফলন ভালো হয়। জাবপোকা, থ্রিপস, মাছি পোকা, ফলছিদ্রকারী পোকা এবং ছত্রাকজনিত ও ভাইরাসজনিত বিভিন্ন রোগ দেখা দিলে সবজির জমিতে যে পদ্ধতিতে বালাই দমন করা হয় একইভাবে আইল ফসলেও সেই পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। তাছাড়া পোকা দমনে হলুদ আঠালো ফাঁদ, বিষটোপ, নিম তেলের ব্যবহার এবং রোগ দমনে ভেজষ বালাইনাশক যেমন পেঁয়াজের নির্যাস (ঢলে পড়া রোগ দমনে), পেঁপে পাতার নির্যাস (পাউডারি মিলডিউ রোগ দমনে), গাঁদা ফুলের শিকড়ের নির্যাস (কৃমি দমনসহ পোকা বিতারণে) ব্যবহার করা যেতে পারে।
অধিকাংশ আইল ফসল বীজ বপন বা চারা রোপণের ৫০-৫৫ দিনের পর থেকে সংগ্রহ করা শুরু হয়। যেমন বরবটি, করলার বীজ বপনের ৫০-৬০ দিন পর থেকেই ফল সংগ্রহ করা যায়। আবার লাউ, মিষ্টিকুমড়ার ফুল পরাগায়নের ২০-২৫ দিনের মধ্যে ফল সংগ্রহ করা যায়। জাতভেদে শসার বীজ বপনের ৩০-৩৫ দিনের মধ্যে গাছে ফুল আসতে শুরু করে এবং ফুল ফোটার            ১৫-২০ দিনের মধ্যেই ফল আহরণের উপযুক্ত হয়ে যায়।
সাধারণত জাতভেদে প্রতি ২০ মিটারের আইল থেকে ২০-১২০ কেজি পর্যন্ত বা এর চেয়েও বেশি ফলন পাওয়া যেতে পারে। যেমন-
লাউ/মিষ্টিকুমড়ার ক্ষেত্রে একটি ২০ মিটারের আইলে ২ মিটার পর পর মোট ১০টি লাউ গাছ লাগানো সম্ভব। জাতভেদে প্রতিটি লাউ গাছে গড়ে ১০-১২টি করে মোট লাউ পাওয়া যাবে ১০০-১২০টি। প্রতিটি লাউয়ের ওজন গড়ে ১.২ কেজি করে হলে ২০ মিটারের একটি আইল থেকে গড়ে ৩-৩.৫ মন ফলন পাওয়া সম্ভব। একই পরিমাণ আইল থেকে মিষ্টিকুমড়ার ফলন (গাছ প্রতি গড়ে ৮টি করে ধরলে) প্রায় ৫.৫-৬ মন পাওয়া সম্ভব।
অনুরূপভাবে করলার ক্ষেত্রে একটি ২০ মিটারের আইলে ১.৫ মিটার পর পর প্রায় ১৩-১৪ টি করলার চারা লাগানো সম্ভব। প্রতিটি করলা গাছে জাতভেদে গড়ে ২৫-৩০টি করে করলা ধরে এবং পাশাপাশি ফলের মাছি পোকার আক্রমণ প্রতিহত করতে পারলে ১৩টি গাছ থেকে ২৫-৩০ কেজি ফলন পাওয়া সম্ভব।
বরবটির ক্ষেত্রে একটি ২০ মিটারের আইলে ৭০ সেমি পর পর প্রায় ৩০টি মাদা করা যাবে এবং প্রতি মাদায় ৩টি করে বরবটির চারা রোপণ করা যাবে। জাতভেদে প্রতিটি বরবটি গাছ থেকে ৬০-৭০টি করে বরবটি পাওয়া যাবে। ৫০-৬০ দিন পর থেকে বরবটি সংগ্রহ শুরু করে ২.৫-৩ মাস পর্যন্ত ফল সংগ্রহ করা যায়। প্রতি ২০ মিটারে প্রায় ৫০-৬০ কেজি বরবটির ফলন পাওয়া যায়।   
পরিশেষে বলা যায়, মূল ফসল এবং মৌসুম ঠিক রেখে খেতের আইলে চাষ করার জন্য পূর্ব থেকেই ফসল নির্বাচন করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে পলিব্যাগে চারা তৈরি করে নেয়া যেতে পারে।         ১৫-২০ দিনের চারা সহজেই আইলে মাদা করে লাগানো যাবে। আইল ফসলের জন্য মূল ফসলের কোন ক্ষতি হয় না উপরন্ত জমিতে উপকারী পোকামাকড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় যা মূল ফসলের পরাগায়ন থেকে শুরু করে ক্ষতিকর বালাইয়ের উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। সুতরাং জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে এবং  কৃষকের আয়বর্ধনে সময়মতো, সঠিক পদ্ধতিতে আইল ফসল চাষ করা বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে অতীব জরুরি।  

লেখক : কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার, শিবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। মোবাইল : ০১৭৪৭০২৫১২৬, ই-মেইল : ঃংঁহধরহ@মসধরষ.পড়স

বিস্তারিত
কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানি খাতের সম্ভাবনা

কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানি খাতের সম্ভাবনা
মোঃ মনজুরুল হান্নান
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ব-দ্বীপ। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের বাহিত পলিমাটিই সৃষ্টি করেছে এ ব-দ্বীপ। আমাদের উর্বর মাটি ও প্রাকৃতিক পানির সহজলভ্যতার কারণে সাড়া বছর বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। মাঠ ফসলের বহুমুখিতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর অন্যতম শস্য ভা-ার। আধুনিক জাতের ফল ও সবজি উৎপাদন বাংলাদেশকে দিয়েছে অনন্যমাত্রা। কিছু কিছু মৌসুমি সবজি এখন প্রায় সারা বছর পাওয়া যাচ্ছে। দেশের মোট আয়তনের ৭০.১০% জমিই হলো আবাদযোগ্য জমি। শ্রমশক্তির ৩৫.২০% এখনও কৃষির উপর নির্ভরশীল। জনসংখ্যার ২০% মানুষই হলো নবীন যুবক শ্রেণীর। এ নবীন শ্রেণী সম্পৃক্ততার কারণেই কৃষি বহুমাত্রিক রূপ পেয়েছে এবং খোরপোষ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।
কৃষিপণ্যের বিশ্ববাজার দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঋঅঙঝঞঅঞ, ঝঃধঃরংঃধ এবং এষড়নধষ গধৎশবঃ ওহংরমযঃ এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালের কৃষিপণ্যের বিশ্ববাজার মূল্যমান ছিল ১৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে তাজা ফল ও সবজি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যমানের। প্রক্রিয়াজাতকৃত ফল ও সবজির মূল্যমান ছিল ২৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। হালকা নাশতা বা স্ন্যাকসের বাজার ছিল অত্যন্ত তেজী। ২০২০ সালের স্ন্যাকসের বাজার পরিমাণ ছিল ৪৯৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যমানের। এত বড় বিশ্ববাজারে আমাদের দেশ থেকে মাত্র ১১৬২.২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যমানের কৃষিপণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হয়েছে (সূত্র ইপিবি)। বিশ্ববাজারে জবধফু ঃড় ঈড়ড়শ এবং জবধফু ঃড় ঊধঃ পর্যায়ের কৃষিপণ্যের ব্যপক চাহিদা রয়েছে। তাজা ফলমূল ও শাকসবজি রপ্তানির পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য উৎপাদন ও রপ্তানিকে উৎসাহিত করার কোন বিকল্প আমাদের হাতে নেই। কারণ খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পণ্যের পুষ্টিমান, ‍সুস্বাদুতা এবং সংরক্ষণ জীবনকাল বাড়ানো সম্ভব। কাজেই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং তারুণ্য শক্তির সংমিশ্রণে বাংলাদেশের কৃষিতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বিশ্ব উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে তুলনা করলে পাট ও কাঁঠাল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। উৎপাদন পর্যায়ে                তৃতীয় অবস্থানে আছে পেঁয়াজ, সবজি এবং ধান। একইভাবে আলু ও আম উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে আমাদের অবস্থান সপ্তম।
সারা পৃথিবীতে তাজা কৃষিপণ্যের চাহিদা তুলনামূলকভাবে কমে যাচ্ছে কিন্তু বাড়ছে প্রক্রিয়াজাতকৃত পণ্যের চাহিদা। এরমধ্যে জবধফু ঃড় ঈড়ড়শ এবং জবধফু ঃড় ঊধঃ পণ্যের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাজা শাকসবজি এবং ফলমূল রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এ রপ্তানি কাক্সিক্ষত পর্যায়ে যেতে পারছে না। বহির্বিশ্ব বাজারকে লক্ষ্য করে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এখনো গড়ে উঠেনি। আধুনিক প্যাকহাউজ, এ্যাক্রিডেটেড ল্যাবরেটরি, সুশৃঙ্খল সরবরাহ ব্যবস্থা, অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থার অবকাঠামো, ঐড়ঃ ডধঃবৎ ঞৎবধঃসবহঃ চষধহঃ বা ঠধঢ়ড়ঁৎ ঐবধঃ ঞৎবধঃসবহঃ চষধহঃ এর অনুপস্থিতি, স্বল্প পরিসরে অরৎ ংঢ়ধপব সুবিধা, দক্ষ জনশক্তির অনুপস্থিতি, মার্কেট ইন্টেলিজেন্স, এঅচ, ঐঅঈঈচ, প্যাকেজিং ব্যবস্থার আধুনিকায়ন না হওয়া এবং সেই সাথে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে আমরা কাক্সিক্ষত পর্যায়ে তাজা বা প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্যসামগ্রী রপ্তানি করতে পারছি না। আমাদের কাছের দেশ ভিয়েতনাম। ভিয়েতনাম নিজের উৎপাদিত কৃষিপণ্য এবং আমদানিকৃত              কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানি করে যাচ্ছে। তাদের এ খাতে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি পক্ষান্তরে আমরা মাত্র ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যমানের কৃষিপণ্য রপ্তানি করে থাকি। কাজেই কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পকে এখনই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
কৃষিপণ্য রপ্তানি উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে একযোগে কাজ করতে হবে। করণীয়সমূহকে চিহ্নিত করে পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করা গেলেই আমরা কৃষিপণ্য রপ্তানি খাতকে সম্মানজনক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারব। আমাদের এখন নজর দিতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা ও দক্ষতা উন্নয়ন করে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার উপর। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ফসলের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ অবকাঠামো নির্মাণ করা প্রয়োজন। কৃষিপণ্য উৎপাদন শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড এবং ফরওয়ার্ড লিংকেজের উন্নয়ন ও প্রসার ঘটানো সময়ের দাবি। দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজার ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যকে বন্ড লাইসেন্সের সুবিধা প্রদান করা এবং দূতাবাসের বাণিজ্যিক কাউন্সিলরকে বাণিজ্য সম্প্রসারণে তৎপর হতে হবে। ফল ও সবজির প্যাকেজিংকে শুল্কমুক্ত করে অন্য দেশের সাথে মূল্য প্রতিযোগিতামূলক করা প্রয়োজন। সমুদ্রপথে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত জাহাজ প্রবর্তন করা যেতে পারে। কৃষিপণ্য হতে বৈচিত্র্যময় খাদ্যসামগ্রী উন্নয়নে গবেষণা জোরদার করা প্রয়োজন এবং কৃষিপণ্যের জন্য নিবেদিত পরিবহন ব্যবস্থার প্রচলন করা প্রয়োজন। কৃষিপণ্য রপ্তানি বৃদ্ধিতে বিমানের ‘কার্গো স্পেস’ বৃদ্ধি ও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সে সাথে উত্তম কৃষি চর্চা ও ফসলের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মাধ্যমে নিরাপদ ও গুণগত মানসম্পন্ন কৃষিপণ্য উৎপাদন করা যেতে পারে। তাহলেই কৃষিপণ্যের ‘কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং’ করা সম্ভব হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুশাসন হলো­- ‘কৃষি উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে এবং সেই সাথে বিদেশে আমাদের পণ্যের সুনাম বৃদ্ধি করতে হবে’। কৃষিবান্ধব সরকারের সুচিন্তিত পরিকল্পনা অব্যাহত রাখতে সংশ্লিষ্টদের কৃষিপণ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানি উন্নয়নে একযোগে কাজ করলে আমরা কাক্সিক্ষত সফলতা অবশ্যই অর্জন করতে পারবে।

লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হর্টেক্স ফাউন্ডেশন। মোবাইল : ০১৭১১-৫৬৫৭৩১, ই-মেইল : যড়ৎভবী@যড়ৎঃবী.ড়ৎম

 

বিস্তারিত
প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ নদীমাতৃক বাংলাদেশে চরাঞ্চলের কৃষির সম্ভাবনা

প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ নদীমাতৃক বাংলাদেশে
চরাঞ্চলের কৃষির সম্ভাবনা
মুহাম্মদ মালেক হুসাইন
নদী ব্যবস্থা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। বৃহত্তর নদীগুলো চাষের জন্য জলের প্রধান উৎস এবং বাণিজ্যিক পরিবহনের প্রধান ধমনী হিসেবে কাজ করে। নদীগুলো মাছও সরবরাহ করে যা প্রোটিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। যেহেতু জল কৃষির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, মারাত্মক বন্যার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বর্ষাকালে নেট চাষযোগ্য জমির ৬০% এরও বেশি, প্রায় ৯১,০০০ বর্গকিলোমিটার (৩৫,০০০ বর্গ মাইল) চাষ করা হয় এবং প্রায় ৪০% জমি চাষ করা হয় শুষ্ক শীতের মাসগুলোতে।
চর অঞ্চল
বাংলাদেশের নদীর হাইড্রো-মরফোলজিক্যাল গতিশীলতার উপজাত হিসেবে অথবা নদীর তীরের মাটির ক্ষয় এবং বৃদ্ধি (ংড়রষ বৎড়ংরড়হ ধহফ ধপপৎবঃরড়হ) এর ফলে চর তৈরি হয়। চর দুই ধরনের হতে পারে যথা- দ্বীপ চর (রংষধহফ পযধৎং) ও সংযোগ চর (ধঃঃধপযবফ পযধৎং)। নদনদীর ভাঙাগড়ার প্রক্রিয়ায় নদীর প্রবাহখাতে দ্বীপচর হিসেবে অথবা নদীতীরে সংযুক্ত ভূভাগ হিসেবে বালুচর গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের চরগুলো অত্যধিক ক্ষয়কার্য এবং বন্যাপ্রবণ। স্যাটেলাইট ইমেজ বিশেষজ্ঞদের মতে প্রায় ৭৫% চর এক থেকে নয় বছর স্থায়ী এবং মাত্র ১০% চর আঠার বছর বা তার চেয়ে বেশি বছর স্থায়ী হয়। ধারাবাহিক উপগ্রহ চিত্রের একটি সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, যমুনা নদীর তীরবর্তী এলাকার ৯৯ শতাংশেরও বেশি ভূমি ছিল চর। ১৯৭৩ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময় একই বিশ্লেষণে আরও দেখা গিয়েছে যে, এ সকল চরের প্রায় ৭৫ ভাগই এক থেকে নয় বছরের মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়েছে এবং প্রায় ১০ ভাগ চর আঠার বছর কিংবা তার অধিক সময়কাল পর্যন্ত টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে। মূল ভূখন্ডের চেয়ে অস্থায়ী চর সাধারণত কম উৎপাদনশীল। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে অধিকাংশ চরের জমি আকস্মিক বন্যাকবলিত হয়ে ভেঙে, বালি মাটি দ্বারা ঢেকে বা ক্ষয় হয়ে যাওয়ায় ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। সীমিত ভূভাগের এ দেশে গড়ে ওঠা চরগুলো প্রায়ই নতুন বসতি স্থাপনের এবং নতুন কৃষিজমি তৈরির সুযোগ করে দেয়। এশিয়া ও নিকট প্রাচ্য অঞ্চলের জন্য সেচ সহায়তা প্রকল্প (ঞযব ওৎৎরমধঃরড়হ ঝঁঢ়ঢ়ড়ৎঃ চৎড়লবপঃ ভড়ৎ অংরধ ধহফ ঃযব ঘবধৎ ঊধংঃ-ওঝচঅঘ)- ইসপান নামক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান    কর্তৃক পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যে সকল চর তাদের উৎপত্তির প্রথম চার বছরে ক্ষয়প্রাপ্ত বা ভাঙনের শিকার হয় না, সে সকল চরে এ চার বছরের শেষদিকে কৃষিকাজ কিংবা বসতি স্থাপন শুরু করা যেতে পারে।
১৯৯৩ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে চরভূমির মোট পরিমাণ ছিল প্রায় ১,৭২২ বর্গ কিমি. বা ১,৭২,২০০ হেক্টর। দেশের ৭টি অঞ্চলের ৩১টি জেলায় মোট ১১০টি উপজেলায় প্রায় ১৬ শতাংশের ওপর এবং ১০৬টি উপজেলায় ৮-১৫ শতাংশের আংশিক চরাঞ্চল বিরাজমান। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট ভূমির প্রায় ১০ শতাংশ চর ভূমি বলে প্রতীয়মাণ এবং এর পরিমাণ প্রায় ৮ (আট) লাখ হেক্টর। বাংলাদেশের বৃহৎ চরাঞ্চলের মধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, পাবনা, নাটোর, মাদারীপুর, বরিশাল ও ভোলা জেলার চর এলাকা। এ ছাড়াও রয়েছে মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার চর এলাকা।
চরের জনসংখ্যা ও বসতি  
১৯৮৪ সালের হিসেবের তুলনায় ১৯৯৩ সালে চরের জনসংখ্যা ৪৭ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৩ সালের এক হিসেব অনুযায়ী চরসমূহের মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৬,৩১,০০০। এর বেশির ভাগই (প্রায় ৬৫ শতাংশ) যমুনা নদীর বিভিন্ন চরের অধিবাসী। একই সময়কালে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ছিল প্রায় ২৬ শতাংশ। এসকল হিসেব থেকে দেখা যাচ্ছে যে, মানব বসতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চরসমূহের গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪% চরাঞ্চলে বসবাস করে যারা অত্যন্ত দরিদ্রপীড়িত। সে হিসেবে প্রায় ৬৪ লাখ মানুষ চরে বাস করে। তীব্র নদীভাঙন, বন্যা, খরাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বেকারত্ব এসব মোকাবিলা করেই বছরের প্রায় পুরো সময়টা ধরে চরের মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়। ভৌগোলিক বিচার-বিশ্লেষণে চরাঞ্চল বাংলাদেশের উচ্চমাত্রার দারিদ্র্য প্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত।
চরের কৃষির সমস্যাসমূহ
কৃষিতে আমাদের বিরাট সাফল্য থাকলেও এটি সত্য যে চরের সব আবাদি জমি উৎপাদনের আওতায় এখনো আনা সম্ভব হয়নি। যদিও চর এলাকায় পর্যাপ্ত নদীর পানি ও ভূ-গর্ভস্থ পানি সহজলভ্য তবুও সেচ দিয়ে ফসল চাষ এর সুবিধা খুব কম এলাকায় রয়েছে। তাই দ্বীপচর এবং সংযুক্ত চরগুলি সংলগ্ন মূল ভূভাগ এলাকার তুলনায় কম উৎপাদনক্ষম; বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) রিপোর্ট অনুযায়ী, তুলনামূলকভাবে নদীর ভাটি অঞ্চলে সৃষ্ট চরগুলির মাটি অধিকতর উর্বর। কিন্তু যমুনা নদীর চরসমুহে শস্য নিবিড়তা অনেক কম। এখানে অনেক বড় এলাকা বিরানভূমি হিসেবে পতিত থাকে। যার কারনে উত্তরবঙ্গের জনগোষ্ঠী দারিদ্র ও মঙ্গাপীড়িত। অথচ উক্ত জমি চাষের আওতায় আনা সম্ভব; চরাঞ্চল উপযোগী আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি না থাকায় চরাঞ্চলে বিস্তীর্ণ ভূমির তুলনায় কৃষি উৎপাদন অনেক কম। এ ছাড়া চর এলাকায় ফসল উৎপাদন উপকরণ সহজলভ্য নয় এবং কৃষকের কারিগরী জ্ঞানের অভাব রয়েছে। এ ছাড়া চর এলাকার বিদ্যমান ফসল ধারায় ফসলের চাহিদা অনুযায়ী যৌক্তিক সুষম মাত্রার সার প্রয়োগ না করা, এলাকা উপযোগী উচ্চ ফলনশীল জাত ও উন্নত উৎপাদন কলাকৌশল ব্যবহার না করার ফলে             কৃষকেরা ফলন কম পাচ্ছেন; চরের শিক্ষাব্যবস্থা যথাযথ পরিমাণে না থাকায় অধিকাংশ চরবাসী নিরক্ষর। তাই তাদের সচেতনতা কম। উচ্চমাত্রায় দরিদ্রতা থাকায় অপুষ্টিজনিত নানা জটিলতায় ভুগে। এমনকি বিদ্যুৎব্যবস্থা না থাকায় আধুনিক ও যান্ত্রিক চাষাবাদ কৌশল প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
চরের চাষাবাদ বিস্তারে করণীয়
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশের কৃষিতে দৃশ্যমান, যার কারনে কখনো অসময়ে বৃষ্টিপাতের কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে, আবার বৃষ্টির সময়ে অনাবৃষ্টিতে খরা হচ্ছে। কাজেই আগামীর কৃষি খুবই চ্যালেঞ্জ প্রবণ। বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় এবং দারিদ্র্যপীড়িত বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে এই চরাঞ্চলের কৃষির উন্নয়ন করেত হবে, যেখানে রয়েছে মোট চাষজমির ১০ ভাগ। বিশেষজ্ঞদের ভাষায় চরের জমি হলো ‘হিডেন ডায়মন্ড’। চরে যেমন হাজারো সমস্যা রয়েছে, তেমনি রয়েছে সম্ভাবনার শত দুয়ার। চর সংলগ্ন নদীতে সারাবছর পানি থাকে বলে চরে বসবাসকারী অনেক সম্প্রদায়ই বছরের বেশিরভাগ সময় মৎস্য আহরণে নিয়োজিত থাকে।
* বহু চরে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ঘাস জন্মায়। এ সকল তৃণভূমি গবাদিপশুর জন্য উত্তম চারণভূমি হিসেবে ব্যবহৃত করে মাংস উৎপাদনে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব; চরের কৃষি জমিতে অধিক উৎপাদন করতে হলে প্রথমেই দরকার উপযুক্ত ফসল ও তার জাত, সঠিক ফসলধারা ও এরপর সঠিক পরিচর্যা; ফসল ধারায় সুষম সার প্রয়োগ, এলাকা উপযোগী উচ্চফলনশীল জাত ও উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব; চরাঞ্চলের মাটির ধরন, জলবায়ু নিরিখে উপযোগী ফসলের বিস্তার ঘটিয়ে একটি টেকসই ও উপযোগী ফসলধারা প্রবর্তন করা যাতে কৃষকেরা দীর্ঘস্থায়ী ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করতে পারে। যেহেতু চরের নিম্নভূমি বর্ষাকালে প্লাবিত হয়। তাই সেই জমিতে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফসল করা সম্ভব হয় না। পানি দ্রুত সরে গেলে সেখানে মাসকলাই ছিটিয়ে দেয়া যেতে পারে।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দরকার উপযুক্ত গবেষণা ও প্রযুক্তি জ্ঞান যা কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। চরাঞ্চল কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চরাঞ্চল উপযোগী ফসলের জাত উন্নয়ন এবং উন্নত চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে চরের কৃষিকে এগিয়ে নেয়া; চরাঞ্চলকে বিদ্যুতায়িত করার ব্যবস্থা গ্রহণ। সেক্ষেত্রে সোলার একটি উত্তম বিকল্প। তাই চরাঞ্চলে সোলারসেচ ব্যবস্থা প্রসার করা। সরকারের প্রকল্প গ্রহণ বা সহজ ঋণ ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে তা সম্প্রসারণ করা সম্ভব; চরাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার করা। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা; যেহেতু আমাদের দেশ একটি নিম্নভূমির বেসিন। তাই উজানের          নদ-নদীর ঝাটকাবান (ভষধংযভষড়ড়ফ) জনিত ফসলহানি রক্ষায় আবহাওয়া বিভাগের পূর্ব সতর্কীকরণ ব্যবস্থা চালু করা দরকার। ঝাটকাবান যেহেতু কম সময়ে অবস্থান করে তাই পর্যাপ্ত নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকলে এর ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব।
সর্বপরি এ কথা বলা যায় যে, যে হারে সমভূমির চাষের জমি কমছে তাতে চরাঞ্চলের কৃষিকে এগিয়ে নেয়া খুবই জরুরি এবং অদূর ভবিষ্যতে চরাঞ্চল কৃষি জিডিপিতে বড় ভূমিকা রাখবে।   

লেখক : বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ডাল গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর, মোবাইল নম্বর : ০১৯১৫৮৫৬৪০৪, ইমেইল- সসধষবশ০৮@ুধযড়ড়.পড়স

বিস্তারিত
লটকন চাষ করে ভাগ্য বদল করছেন নরসিংদীর শত শত চাষি

লটকন চাষ করে ভাগ্য
বদল করছেন
নরসিংদীর শত শত চাষি
অপর্ণা বড়–য়া
নরসিংদীর পাহাড়ি এলাকার বাগানগুলোতে এখন শুধু সোনালি লটকনের সমারোহ। এক সময়ের বনজ ফল হিসেবে পরিচিতি থাকলেও বর্তমানে লটকন লোভনীয় ফল হয়ে দেশে-বিদেশে বৃহৎ বাজার অর্জন করেছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে নতুন নতুন বাগান। ভাগ্য বদলেছে অসংখ্য বেকার যুবক-কৃষকের। কৃষি জমি ও বাড়ির আঙ্গিনায় চাষাবাদ হওয়া সুস্বাদু লটকন এখন দেশের সীমানা পেড়িয়ে রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও। দেশ-বিদেশের বাজারগুলোতে এর চাহিদাও রয়েছে ব্যাপকহারে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে লটকন ফল উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে বলে দাবি করছে লটকন আবাদকারী কৃষকরা। কম খরচ আর অল্প পরিশ্রমে ফলন ও মূল্য দুটোই ভালো হওয়ায় লটকন এখন চাষিদের কাছে অন্যান্য ফসলের তুলনায় অর্থনৈতিক ভাবে লাভজনক ফল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বিদেশ ফেরত বহু বেকার যুবকও লটকনের চাষ করে তাদের মুখে ফুটিয়েছে অর্থনৈতিক সাফল্যের হাসি। লটকনে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন‘বি-২’ ও ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে। এ ছাড়া ফলটি ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ। যার ফলে মানবদেহে দৈনিক যে পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’র প্রয়োজন হয়, মাত্র তিন-চারটি লটকন সে চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট।  টক আর মিষ্টিতে ভরপুর এখানে উৎপাদিত ফলটি হাজারো চাষিদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। তাই অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে এখানকার কৃষকরা শুরু করেছে এর আবাদ।
লটকন ফলনে তেমন কোনো খরচ নেই। স্ত্রী গাছ লাগিয়ে দিলেই হয়। সময়ে সময়ে একটু পরিচর্যা করতে হয়। গোড়ার চারদিকে জৈবসার দিলে ফলন ভালো হয়। লটকন গাছের রোগবালাই তেমন দেখা যায় না। ফল সংগ্রহের ৬০দিন আগে গাছ প্রতি ৫০ গ্রাম পটাশ পানির সঙ্গে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় দিলে ফলের মিষ্টতা ও আকার বৃদ্ধি পায়। প্রতি মৌসুমে এখানকার লটকন চাষিরা প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার মেট্রিকটন লটকন উৎপাদন করছে। নরসিংদীর উৎপাদিত লটকন     দেশে-বিদেশে প্রায় ১২০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা বাজারমূল্য ধরে রেখেছে বলে কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকরা জানিয়েছেন।
বেলাব উপজেলার লাখপুর গ্রামের লটকন চাষি রাসেল মিয়া বলেন, স্থানীয় বাজার ছাড়াও লটকনের ফলন ধরার পর জমিতেই পাইকারি বিক্রি করে দেয়া যায়। পাইকাররা বাগান কিনে দেশে বিদেশের বাজারে পাঠিয়ে থাকেন।
বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল-মে) মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে খরিপ মৌসুমে ১ হাজার ৬৭৩ হেক্টর জমিতে লটনকনের বাগান করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লটকন চাষ হয়েছে শিবপুরে। প্রতি কেজি লটকন স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে। কামারটেক, চৈতন্য, জয়মঙ্গল, রায়পুরা ও বেলাবরের বিভিন্ন বাজারে প্রতিদিন প্রায় ৫০ থেকে ৮০ লাখ টাকার লটকন বিক্রি করে থাকে। বেলাব উপজেলার কৃষক আহসান উল্লাহ ভূঁইয়া জানান, দিনে দিনে আমাদের এলাকায় লটকনের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাপারীরা এখন লটকন কিনে বিদেশও পাঠাচ্ছে। লটকন ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, নরসিংদীর বাজারগুলোতে লটকন মৌসুমে প্রতিদিন কাকডাকা ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত প্রায় ৫০ লাখ টাকা এবং বাগান থেকেও প্রায় ৩০ লাখ টাকার লটকন বিক্রি করা হয়ে থাকে।
২০০৮ সাল থেকে দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয় এখানকার সু-স্বাদু এ লটকন ফল। কিন্তু ২০২০ সালে করোনা মহামারি কারণে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট সাময়িক বন্ধ থাকায় লটকন দেশের বাইরে রপ্তানি করা যায়নি। তবে বর্তমানে সঙ্কট কেটে যাওয়ায় আবারো লটকন বিদেশে রপ্তানি শুরু হবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা। নরসিংদীর কৃষি সম্প্রসার অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার শিবপুর, বেলাব ও রায়পুরা উপজেলার লাল মাটিতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও খনিজ উপাদান বিদ্যমান। তাই এখানে লটকনের ফলন ভালো হয়। আবার চাষিরাও লটকন আবাদে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। এ কারণে লটকের আবাদ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। লটকন বাগানের মালিকেরা জানান, বিনাশ্রমে ও বিনাব্যয়ে লটকন ফল চাষে যে লাভ পাওয়া যায়, তা অন্য কোনো ফল-ফসল বা শাকসবজি চাষে কল্পানাও করা যায় না।
স্থানীয় লকটন চাষিরা জানান, একসময় ঝোপ-জঙ্গল ও বাড়ির আঙ্গিনায় লটকন গাছ রোপণ করতেন। প্রায় ৩০ বছর আগে প্রথম বেলাবো উপজেলার লাখপুর গ্রামে অপ্রচলিত ফল লটকনের আবাদ শুরু হয়। এরপর থেকে বেলাব ও শিবপুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের লালমাটির এলাকায় লটকন চাষের প্রসার ঘটতে থাকে। দিন দিন মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে খাদ্য ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ লটকনের চাহিদা বাড়তে থাকে। বাজারে ব্যাপক চাহিদা ও লাভজনক হওয়ায় প্রতি বছরই লটকনের চাষে ঝুঁকছেন কৃষক। বিশেষ করে বেলাব ও শিবপুর উপজেলায় গত ৩০ বছরে বাণিজ্যিকভাবে লটকনের প্রসার ঘটেছে। দুই উপজেলার প্রায় পরিবারের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি লটকন। লটকন চাষ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরানোর পাশাপাশি, বেকার সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে পেয়েছেন অনেকে।
লটকন চাষি ও স্থানীয় কৃষি অফিস জানায়, গাছের গোড়া থেকে শুরু করে প্রধান কা-গুলোতে ছড়ায় ছড়ায় ফলন হয় এই লটকনের। লটকন গাছ রোপণের তিন বছরের মধ্যে ফলন আসে। ফল দেয় টানা ২০ থেকে ৩০ বছর।  লটকনের বাজারজাত নিয়েও দুশ্চিন্তা নেই চাষিদের। কারণ মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লটকন কাঁচা থাকা অবস্থায় বাগান কিনে নেন। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পাকা লটকন বাগান থেকে সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করেন। মৌসুমী ফল লটকন বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রায়পুরার মরজাল ও শিবপুর উপজেলা সদরে বসত বাজার।
বেলাব উপজেলার আমলাব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও লটন চাষি মো. নুরুল হাসান জানান, তার ২৯ কানি জমিতে একটি লকটন বাগান রয়েছে। বাগানটিতে ৭০০ লটকন গাছ রয়েছে। বাগানটি এবার তিনি পাইকারের কাছে ১২ লাখ টাকা বিক্রি করছেন।  বাজার দর-দাম ভালো, প্রতি মণ লটকন বাজারে আকার বেধে বিক্রি হচ্ছে ২৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকায়।
নরসিংদীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপপরিচালক ড. মো. ছাইদুর রহমান বলেন, লটকন চাষ বৃদ্ধিতে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চারা উৎপাদন করাসহ কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে । তাছাড়া লটকনে রোগবালাইয়ের তেমন সংক্রমণ না হওয়ায় উৎপাদন খরচ কম ফলনও ভালো হয়। বাজারে লটকনের ন্যায্য দাম পাওয়ায় লটকনচাষিও লাভবান হচ্ছেন।
বর্তমানে আগাম জাতের কিছু লটকন পাওয়া যায়। যার খুচরা মূল্য প্রতি কেজি ৯০-১০০ টাকা।

লেখক : কৃষি তথ্য কেন্দ্র সংগঠক (সংযুক্ত), আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিস, ঢাকা, মো:- ০১৯১১৮৪০১৬৬, ই-মেইল : নধৎঁধধ@ুসধরষ.পড়স

বিস্তারিত
শ্রাবণ মাসের কৃষি (১৬ জুলাই-১৫ আগস্ট)

শ্রাবণ মাসের কৃষি
(১৬ জুলাই-১৫ আগস্ট)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
শ্রাবণ হলো বর্ষার সমাপ্তি। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে আষাঢ়ের একটানা বর্ষণের পর শ্রাবণ আসে মায়াবী জলকণার পরশ নিয়ে। বৃষ্টির সহনীয়তায় প্রকৃতিকে সাজায় বর্ণাঢ্য সাজে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মৌসুমি বায়ু এ মাসে সক্রিয় অবস্থায় থাকে না। ফলে শ্রাবণ মাসে কাঙ্খিত বৃষ্টির দেখা হয় না। তারপরও খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে কৃষিজীবি ভাইবোনেরা ব্যস্ত থাকে কৃষি কাজে। আর এ প্রসঙ্গে জেনে নেবো কৃষির বৃহত্তর ভুবনে কোন কোন কাজগুলো করতে হবে আমাদের।
আউশ  
এসময় আউশ ধান পাকে। শিষের অগ্রভাগের ৮০% ধানের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ এবং শিষের নিচের অংশ ২০% ধানের চাল আংশিক শক্ত ও স্বচ্ছ হলে ধান ঠিক মতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। বীজ ধানের জন্য নির্বাচিত জমির আইলের পাশের ৬ ফুট বাদ দিয়ে ভেতরের অংশ হতে আলাদাভাবে ধান সংগ্রহ করা উচিত। রোগা ও পোকা আক্রান্ত জমি থেকে কোনোক্রমেই বীজ সংগ্রহ করা উচিত নয়। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে ধান কাটা উচিত। ফসল কর্তন ও পরিবহনে যাতে সংমিশ্রণ না ঘটে সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
কাটার পর ধান মাঠে ফেলে না রেখে যথা সম্ভব মাড়াই করা উচিত। মাটি থেকে বীজ যাতে আর্দ্রতা শুষে নিতে না পারে তার জন্য  কাঁচা খলার ওপর ধানমাড়াই করার সময় চাটাই, মোটা চট, ত্রিপল বা পলিথিন বিছিয়ে দিতে হবে। আধুনিক বীজ মাড়াই যন্ত্রের সাহায্যে বীজ মাড়াই করলে বীজের গুণাগুণ ভালো থাকে। এভাবে ধান মাড়াই করলে ধানের রঙ উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকে। ধান মাড়াইয়ের সময় যাতে অন্য জাতের বীজ মিশ্রিত না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে এবং সে জন্য মেঝে বা খলা থেকে অন্য জাতের ধান যতদূর সম্ভব দূরে রাখতে হবে। মাড়াই করা ধান অন্তত ৪ থেকে ৫ দিন রোদে ভালোভাবে  শুকানোর পর ঝেড়ে গোলাজাত করতে হবে।
সংগৃহীত বীজ ভালোভাবে ঝাড়াই করে অপরিপক্ব বীজ, রোগাক্রান্ত বীজ, খড়কুটা, ধুলাবালু ভালোভাবে পরিষ্কার করে বড় বড় পুষ্ট দানা বাছাই করে নিতে হবে। বীজ সংরক্ষণের আগে পর পর কয়েকবার রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে যেন বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগের নিচে থাকে। দাঁত দিয়ে কাটলে যদি কট করে শব্দ হয় তাহলে বুঝতে হবে বীজ ঠিকমতো শুকিয়েছে।
যে পাত্রে বীজ রাখা হবে তাতে যেন কোনো ছিদ্র না থাকে।  অল্প পরিমাণ বীজ রাখার জন্য তেলের ড্রাম কিংবা বিস্কুট বা কেরোসিনের টিন প্রভৃতি ধাতব পাত্র ব্যবহার করা ভালো।
ধাতব পাত্র ব্যবহার করা সম্ভব না হলে, মাটির মটকা, কলস বা পলিথিন যুক্ত চটের বস্তা অথবা চটের বস্তায় পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক ড্রাম ব্যবহার করা যেতে পারে। মাটির পাত্র হলে পাত্রের বাহিরের গায়ে আলকাতরার প্রলেপ দিতে হবে। পাত্রে বীজ রাখার আগে পাত্রগুলো আর্দ্রতামুক্ত করার জন্য ভালো করে রোদে শুকিয়ে নেয়া প্রয়োজন। রোদে শুকানো বীজ ঠা-া করে পাত্রে ভরতে হবে। পাত্রটি সম্পূর্ণ বীজ দিয়ে ভরাট করে রাখতে হবে। যদি বীজের পরিমাণ কম হয় তবে বীজের ওপর কাগজ বিছিয়ে তার ওপর শুকনো বালি দিয়ে পাত্র পরিপূর্ণ করতে হবে। এবার পাত্রের মুখ ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে যাতে পাত্রের মধ্যে বাতাস ঢুকতে না পারে।
সংরক্ষণ করা বীজ মাঝে মধ্যে পরীক্ষা করা দরকার যাতে কোনো প্রকার পোকামাকড় বা ইঁদুর ক্ষতি করতে না পারে। দরকার হলে মাঝে বীজ শুকিয়ে নিতে হবে। এতে বীজের আর্দ্রতা সঠিক থাকবে। প্রতি টন গুদামজাত বীজে ৩টি ফসটক্সিন ট্যাবলেট সর্বনিম্ন ৭২ ঘণ্টা ব্যবহারে গুদামের সব ধরনের পোকামাকড় মারা যায়। তবে জৈব বালাই ব্যবস্থাপনাই শ্রেয়।
টন প্রতি ধানে ৩.২৫ কেজি নিম, নিশিন্দা বা বিষকাটালি পাতার গুঁড়া, শুকনা তামাক দিয়ে গোলাজাত করলে পোকার আক্রমণ হয় না। এসব পাতা পোকামাকড় প্রতিরোধক।
আমন ধান
শ্রাবণ মাস আমন ধানের চারা রোপণের ভরা মৌসুম। চারার বয়স ৩০-৪০ দিন হলে জমিতে রোপণ করতে হবে।
রোপা আমনের অনুকূল পরিবেশ উপযোগী উন্নত জাত, যেমন বিআর১০, ব্রি ধান৩০, ব্রি ধান৩২, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৮, ব্রি ধান৩৯, ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭২, ব্রি ধান৭৫, ব্রি ধান৭৯, ব্রি ধান৮০, ব্রি ধান৮৭, ব্রি ধান৯০, ব্রি ধান৯১, ব্রি ধান৯৩, ব্রি ধান৯৪, ব্রি ধান৯৫, ব্রি ধান১০৩, ব্রি হাইব্রিড ধান৪, ব্রি হাইব্রিড ধান৬, বিনা ধান৭, বিনা ধান১১, বিনা ধান১৬, বিনা ধান১৭, বিনা ধান২২, বিনা ধান২৩ প্রতিকূল পরিবেশ উপযোগী উন্নত জাত চাষ করতে পারেন; খরাপ্রবণ এলাকাতে নাবি রোপার পরিবর্তে যথাসম্ভব আগাম রোপা আমনের (ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৯, ব্রি ধান৫৬,   ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬৬, ব্রি ধান৭১ এসব), লবণাক্ত ও লবণাক্ত জোয়ারভাটা অঞ্চলে ব্রি ধান৭৩, ব্রি ধান৭৮, অলবণাক্ত  জোয়ারভাটা অঞ্চলে ব্রি ধান৭৬, ব্রি ধান৭৭ এবং জলাবদ্ধতা সহনশীল জাত ব্রি ধান৭৯ চাষ করা যেতে পারে;
চারা রোপণের ১২-১৫ দিন পর প্রথমবার ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এর ১৫-২০ দিন পর দ্বিতীয়বার এবং তার ১৫-২০ দিন পর তৃতীয়বার ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করলে চারা লাগানোর ১০ দিনের মধ্যে প্রতি চার গুছির মাঝে ১.৮ গ্রামের ১টি গুটি ব্যবহার করতে হবে।
পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য ধানের ক্ষেতে বাঁশের কঞ্চি বা ডাল পুঁতে দিতে পারেন যাতে পাখি বসতে পারে এবং এসব পাখি পোকা ধরে খেতে পারে।
পাট
ক্ষেতের অর্ধেকের বেশি পাট গাছে ফুল আসলে পাট কাটতে হবে। এতে আঁশের মান ভালো হয় এবং ফলনও ভালো পাওয়া যায়।
পাট পচানোর জন্য আঁটি বেঁধে পাতা ঝরানোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং জাগ দিতে হবে। ইতোমধ্যে পাট পচে গেলে আঁশ ছাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পাটের আঁশ ছাড়িয়ে ভালো করে ধোয়ার পর ৪০ লিটার পানিতে এক কেজি তেঁতুল গুলে তাতে আঁশ ৫-১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে, এতে উজ্জ্বল বর্ণের পাট পাওয়া যায়। যেখানে জাগ দেয়ার পানির অভাব সেখানে রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পচাতে পারেন। এতে আঁশের মান ভালো হয় এবং পচন সময় কমে যায়।
বন্যার কারণে অনেক সময় সরাসরি পাট গাছ থেকে বীজ উৎপাদন সম্ভব হয় না। তাই পাটের ডগা বা কা- কেটে উঁচু জায়গায় লাগিয়ে তা থেকে খুব সহজেই বীজ উৎপাদন করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
পাটের ভালো বীজ পেতে হলে দেশী পাট বীজ এ মাসে বপন করতে হবে। সারিতে বপন করলে প্রতি শতাংশ জমিতে ১৬ গ্রাম তোষা এবং ২০ গ্রাম দেশী বীজ বপন করতে হবে। আর ছিটিয়ে বপন করলে শতাংশে ২০ গ্রাম তোষা এবং ২৪ গ্রাম দেশী পাটের বীজ বপন করতে হবে।
তুলা
রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চলে আগাম শীত আসে, সে জন্য এসব অঞ্চলে এ মাসের মধ্যে তুলার বীজ বপন করতে হবে।
শাকসবজি
বর্ষাকালে শুকনো জায়গার অভাব হলে টব, মাটির চাড়ি, কাঠের বাক্স এমনকি পলিথিন ব্যাগে সবজির চারা উৎপাদনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ মাসে সবজি বাগানে করণীয় কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে মাদায় মাটি দেয়া, আগাছা পরিষ্কার, গাছের গোড়ায় পানি জমতে না দেয়া, মরা বা হলুদ পাতা কেটে ফেলা, প্রয়োজনে সারের উপরিপ্রয়োগ করা।
লতাজাতীয় গাছের বৃদ্ধি বেশি হলে ১৫-২০ শতাংশ পাতা ও লতা কেটে দিলে তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল ধরবে। কুমড়াজাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন অধিক ফলনে দারুণভাবে সহায়তা করবে। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন ভোর বেলা হাত পরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে। গত মাসে শিম ও লাউয়ের চারা রোপণের ব্যবস্থা না নিয়ে থাকলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। শিম ও লাউয়ের বীজ পচা কচুরিপানার স্তূপে বপন করে অতপর মূল মাদায় স্থানান্তর করতে পারেন। মাদার দূরত্ব হবে ৩ ফুট, ১ ফুট চওড়া ও ১ ফুট গভীর করে মাদা তৈরি করতে হবে। সবজিক্ষেতে বালাই আক্রমণ দেখা দিলে জৈব বালাই ব্যবস্থাপনা যেমন- ফেরোমন ট্রাপ ব্যবহার করা যেতে পারে। পাতায় দাগপড়া রোগ দেখা দিলে অনুমোদিত মাত্রায় ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। বর্ষাকালীন সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতকালীন শাকসবজি চাষের প্রস্তুতি নিতে হবে।
গ্রীষ্মকালীন টমেটো ফসল মাঠে থাকলে গাছ বেঁধে দিতে হবে। এ মাসে নাবী পাট বীজ ফসলের সাথে সাথী ফসল হিসাবে সবজি চাষ করা যেতে পারে।
আগাম রবি সবজি যেমন : বাঁধাকপি, ফুলকপি, লাউ, টমেটো, বেগুনের বীজতলা তৈরি, বীজ বপন শুরু করা যেতে পারে।
গাছপালা
এখন সারা দেশে গাছ রোপণের কাজ চলছে। ফলদ, বনজ এবং ঔষধি বৃক্ষজাতীয় গাছের চারা বা কলম রোপণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে একহাত চওড়া এবং একহাত গভীর গর্ত করে অর্ধেক মাটি এবং অর্ধেক জৈবসারের সাথে ১০০ গ্রাম টিএসপি এবং ১০০ গ্রাম এমওপি ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। সার ও মাটির এ মিশ্রণ গর্ত ভরাট করে রেখে দিতে হবে। দশ দিন পরে গর্তে চারা বা কলম রোপণ করতে হবে। ভালো জাতের মানসম্পন্ন চারা রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের পর গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে এবং খুঁটির সাথে সোজা করে বেঁধে দিতে হবে। গরু ছাগলের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য রোপণ করা চারার চারপাশে খাঁড়া বা বেড়া দিতে হবে।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, কৃষিক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের জন্য আধুনিক কৃষির কৌশলগুলো যেমন অবলম্বন করতে হবে তেমনি সকল কাজ করতে হবে সম্মিলিতভাবে। যা কৃষিকে নিয়ে যাবে উন্নতির শিখরে। আর কৃষির যে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য আপনার নিকটস্থ উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন। এছাড়া কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ এ নম্বরে যে কোন মোবাইল অপারেটর থেকে কল করে নিতে পারেন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ।

লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪; ই-মেইল :

 

বিস্তারিত