বিশেষ জাতের ধান থেকে সুগন্ধি চাল তৈরি করা হয়। বাংলাদেশে এলাকাভিত্তিক প্রচুর সুগন্ধি ধান আবাদের প্রচলন আছে। দেশি জাতগুলোর চাল আকারে ছোট ও অনেকটা গোলাকার হয়। সুগন্ধি ধানের জাতগুলোর বেশির ভাগই আলোক সংবেদনশীল, দিনের দৈর্ঘ্য কমে গেলে হেমন্ত কালে ফুল ও দানা গঠন হয়। প্রধানত আমন মৌসুমে (খরিফ-২ তে) সুগন্ধি ধানের চাষ করা হয়। এ মৌসুমে প্রায় ১০% জমিতে সুগন্ধি ধানের আবাদ করা হয়। প্রধান পোলাও, বিরিয়ানি, কাচ্চি, জর্দা, ভুনা-খিচুড়ি, ফিরনি, পায়েশসহ আরও নানা পদের সুস্বাদু ও দামি খাবার তৈরিতে সুগন্ধি চাল বেশি ব্যবহার হয়। বিয়ে, পূজা-পার্বণ, সেমিনার, ওয়ার্কশপসহ সব ধরনের অনুষ্ঠানে সুগন্ধি চালের ব্যবহার অতি জনপ্রিয়। অনেক সচ্ছল পরিবারে, বনেদি ঘরে সাধারণ চালের পরিবর্তে সুগন্ধি (কাটারিভোগ, বাংলা মতি) সিদ্ধ চালের ভাত খাওয়ার রেওয়াজ অহরহ দেখা যায়।
ছক-১ : সুগন্ধি ধানের জাত ও তার বৈশিষ্ট্য
ক্রমিক নং |
জাত |
জাতের বৈশিষ্ট্য |
মৌসুম ও জীবনকাল ফলন |
ফলন (হেক্টরপ্রতি) |
১. |
ব্রিধান-৩৪ |
আলোক সংবেদনশীল, কালিজিরার মতো দানা ছোট, ফলন কালিজিরার দ্বিগুণ, গাছের উচ্চতা ১১৭ সেন্টিমিটার। |
আমন মৌসুমি, ধান পাকতে সময় লাগে ১৩৫ দিন, (১৯৯৭ সালে অবমুক্ত), উচ্চতা ১২৫ সেন্টিমিটার। |
৩.৫ টন |
২. |
ব্রিধান-৩৭ |
ধানের রঙ, চালের আকার কাটরিভোগের মতো, তবে কাটারিভোগের চেয়ে ৫-৭ দিন নাবি, ধানের আগায় শুঙ আছে। |
আমন মৌসুমি, ধান পাকতে সময় নেয় ১৪০ দিন, ১৯৯৮ সালে অবমুক্ত করা হয়। |
৩.৫ টন |
৩. |
ব্রিধান-৩৮ |
আলোক সংবেদনশীল, ধানের অগ্রভাগে শুঙ আছে, চালের আকার অপেক্ষাকৃত লম্বা ও সুগন্ধিযুক্ত, গাছের উচ্চতা ১২৫ সেন্টিমিটার। |
আমন মৌসুমি, ধান পাকতে সময় নেয় ১৪০ দিন ১৯৯৮ সালে অবমুক্ত করা হয়। |
৩.৫ টন |
৪. |
ব্রিধান-৫০ |
(বাংলা মতি) চাল লম্বা, চিকন ও সাদা। গাছের উচ্চতা ৮২ সেন্টিমিটার, ফলন খুব বেশি। |
বোরো মৌসুমে চাষ উপযোগী, এ জাতের জীবন কাল-১৫৫ দিন, ২০০৮ সালে অবমুক্ত করা হয়। |
৬ টন |
৫. |
ব্রিধান-৬৩ (সরু বালাম) |
অনেকটা পাকিস্তানি বাসমতির মতো লম্বা, সুগন্ধ নেই, তবে চাল মূল্যবান ও ভাতের স্বাদ বেশি। চাল সরু, রান্নার পর লম্বায় ভাতের আকার বাড়ে, গাছের উচ্চতা ৮৬ সেন্টিমিটার। |
বোরো মৌসুমে চাষযোগ্য, জীবন কাল ১৪৮-১৫০ দিন, এ জাত ২০১৪ সালে অবমুক্ত করা হয় । |
৬.৭ টন |
৬. |
বিনা ধান-৯ |
কালিজিরা ও ব্রি ধান-৩৮ এর চেয়ে ২৫-৩০ দিন আগে পাকে, এ দুটি (কালিজিরা ও ব্রি ধান৩৮) জাতের চেয়ে চাল চিকন লম্বা এবং ফলন বেশি। |
আমন মৌসুমি, জীবনকাল ১২৩ দিন, এ জাত ২০১২ সালে অবমুক্ত করা হয়। |
৩.৭ টন |
৭. |
বিনা ধান-১৩ |
সরু, লম্বা, সুগন্ধি চাল, কালিজিরা জাত থেকে উদ্ভাবিত, কালিজিরার তুলনায় বেশি উজ্জ¦ল, কিছুটা কালো বর্ণের। |
আমন মৌসুমি, জীবন কাল ১৩৮-১৪২ দিন, এ জাত ২০১৩ সালে অবমুক্ত করা হয়। |
৩.৫ টন |
চাইনিজ, ইটালিয়ান, ইন্ডিয়ান হোটেল/ রেস্টুরেন্ট, পাঁচ তারকা হোটেল/ মোটেল পর্যটন কেন্দ্রে প্রধানত সুগন্ধি চালের ভাত, পোলাও নানা পদের খাবার পরিবেশনে সুগন্ধি চাল ব্যবহার করা হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে এ দেশি অতি উন্নত মানের সুগন্ধি চালের জাতগুলো সম্বন্ধে ধারণা ও প্রচারণার অভাব দেখা যায়। এর ফলে নামি-দামি হোটেলে আমাদের জনপ্রিয় সুগন্ধি ধানের জাতগুলোর পরিবর্তে বিদেশি বাসমতি জাতের চাল ব্যবহার প্রচলন মাঝে মাঝে দেখা যায়। এ অবস্থার উন্নয়নে ও দেশি সুগন্ধি জাতগুলো যেন তারা নানা পদের খাদ্য তৈরিতে বেশি আগ্রহী হয়, সেজন্য সব ধরনের উদ্বুদ্ধকরণ ব্যবস্থা নেয়া অত্যাবশ্যক।
জাত
বিভিন্ন জেলায় অঞ্চলভিত্তিক প্রচুর সুগন্ধি ধানের জাত আছে। জাতগুলোর মধ্যে অধিকাংশই অতি সুগন্ধি। এ জাতগুলো প্রধানত চিনি গুঁড়া, কালিজিরা, কাটারিভোগ, তুলসীমালা, বাদশাভোগ, খাসখানী, বাঁশফুল, দুর্বাশাইল, বেগুন বিচি, কাল পাখরী অন্যতম। হালকা সুগন্ধযুক্ত জাতগুলোর মধ্যে পুনিয়া, কামিনী সরু, জিরাভোগ, চিনি শাইল, সাদাগুরা, মধুমাধব, গোবিন্দভোগ, দুধশাইল প্রধান।
প্রচলিত জাতগুলোর বেশির ভাগই হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ক্ষমতা তুলনামূলক অনেক কম। এজন্য সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রচলিত সুগন্ধি ধানের জাতগুলো উন্নয়নে ও নতুন উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনে তৎপর হয়। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে মোট ৫টি এবং বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে দুটি মিলে এ দেশে মোট ৭টি সুগন্ধি ধানের জাত অবমুক্ত করা হয়েছে। অবমুক্ত করা এসব ধানের জাত ও তার বৈশিষ্ট্য ছক-১ এ তুলে ধরা হলো। (ছক-১ দেখুন)।
দেশি সুগন্ধি চাল জনপ্রিয়করণ ব্যবস্থা
এ দেশে উদ্ভাবিত ও প্রচলিত সুগন্ধি ধানের জাতগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে যেভাবে জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা ছিল ততটা অনুসরণ করা হয়েছে বলে মনে হয় না। এ কারণে ঢাকাসহ সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরের নামি-দামি হোটেল মোটেল ও পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে এ দেশি সুগন্ধি চালগুলো থেকে তৈরি নানা পদের খাবার পরিবেশন অর্জন কাক্সিক্ষত মাত্রায় খুব একটা দেখা যায় না। উৎপাদক ও গবেষকদের এ চাল উৎপাদন এবং উদ্ভাবন তৎপরতার পাশাপাশি নামি-দামি হোটেল, রেস্তোরাঁ ও মোটেলে দেশি সুগন্ধি চাল ব্যাপকহারে জনপ্রিয়করণ ব্যবস্থা নেয়া সংশ্লিষ্ট সবারই কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে করণীয় দিকগুলোর কিয়দংশ তুলে ধরা হলো-
ক. গুরুত্বপূর্ণ হোটেল মোটেলগুলোর ও পরিবেশিত খাদ্যতালিকা নিরূপণ : ঢাকাসহ বড় বড় শহরস্থ নামি-দামি হোটেলগুলোর শুরুতেই একটা তালিকা তৈরি করে নেয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে তারা চাল দিয় যেসব খাদ্য আইটেম তৈরি করে পরিবেশন করে থাকে সেগুলো সংগ্রহ করে নিতে হবে। নির্ধারিত সার্ভে ফরম তৈরি করে নিয়ে তা পূরণ ব্যবস্থা করা হলে কাক্সিক্ষত তথ্য বেরিয়ে আসবে। এরপর দেশের দামি বাবুর্চিকে (টমি মিয়া) দিয়ে আমাদের উপযোগী সুগন্ধি চাল দিয়ে সব ধরনের রেসিপি তৈরি করে নিয়ে তার ছবিসহ উপকরণ বিবরণী উল্লেখ করে উন্নত মানের আকর্ষণীয় রঙিন পুস্তিকা তৈরি করে নিতে হবে। সে আলোকে হাতে-কলমে এ রেসিপির অনুসরণে খাদ্য তৈরি করে তালিকাভুক্ত নামি-দামি হোটেলে প্রশিক্ষণ আয়োজনের মাধ্যমে হাতে-কলমে গুরুত্বপূর্ণ উদ্বুদ্ধকরণ দিকগুলো তুলে ধরতে হবে। এছাড়াও হোটেলগুলোর তালিকাবহির্ভূত কিছু নতুন রেসিপি চিহ্নিত করে তা ওইসব দামি হোটেলগুলোতে জনপ্রিয় করার ব্যবস্থা একইভাবে নিতে হবে। এ কাজের দায়িত্ব এআইএস, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এমনকি কে.জি.এফ এর মাধ্যমে নতুন প্রকল্প সহায়তা আকারে জনপ্রিয় করার কর্মসূচি বাস্তবায়ন উদ্যোগ নিতে হবে।
খ. সুগন্ধি চালে তৈরি ফাস্ট ফুড : দেশ-বিদেশে আজ কাল নানা পদের আধা সিদ্ধ চালের সঙ্গে কিছু পরিমাণ ডাল, সবজি ও প্রক্রিয়াজাত মিট একত্রে মিশিয়ে ম্যালামাইন জাতীয় গ্লাসে বা মগে সংরক্ষণ করে তা সিল করে বিপণন করা হয়। ফাস্ট ফুড দোকান থেকে তা কিনে উপরের মোড়ক সরিয়ে তাতে পরিমাণমতো গরম পানি মেশানো হলে তা উপাদেয় পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে বিবেচিত। যুবক-যুবতী বিশেষ করে স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছে এ খাবার অতি জনপ্রিয়। সুগন্ধি চাল দিয়ে এ ধরনের ফাস্ট ফুডের অনুকরণে তা তৈরি ও বিপণনে কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নিলে সুগন্ধি চাল জনপ্রিয়করণে গুরুত্বপূর্ণ একনতুন মাত্রা যোগ হবে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এ ফাস্ট ফুড তৈরির রেসিপি তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করে তা উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানকে তা বাজারজাত করতে অনুপ্রাণিত করতে পারে।
গ. খাদ্য মেলার আয়োজন : এ উদ্বুদ্ধকরণ ব্যবস্থাকে বেগবান করতে হলে এলাকাভিত্তিক দিনব্যাপী কিছু সংখ্যক খাদ্য মেলার আয়োজন করার প্রয়োজন হবে। সেখানে বিদেশি মিশনসহ বিভিন্ন তালিকাভুক্ত হোটেল, রেস্তোরাঁ ও মোটেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণের জন্য দাওয়াত পত্র বা ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারীরা খাদ্য তৈরি প্রক্রিয়া ও দেশি সুগন্ধি চালের নানা গুণাগুণ সরেজমিন দেখে উদ্বুদ্ধ ও আকর্ষিত হবে।
ঘ. ভিডিও তৈরি করে তা সরবরাহ : দেশি সুগন্ধি চাল সংশ্লিষ্ট হরেক রকম খাবার ও এর তৈরি রেসিপির ভিডিও তৈরি করে নানা পদের আকর্ষণীয় খাবারগুলোর প্রচার উপযোগী দিকগুলো তা হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে সরবরাহ করে তাদের এ খাবার পরিবেশনে আকৃষ্ট করার ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশি সুগন্ধি চালের উপকারী ও আকর্ষণীয় দিকগুলো সুন্দরভাবে ভিডিওতে তুলে ধরে প্রচারের সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
ঙ. রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে সুগন্ধি চালের তৈরি খাদ্য পরিবেশন : রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যেন দেশি সুগন্ধি চালের তৈরি নানা পদের আকর্ষণীয় খাদ্য পরিবেশিত হয় সে বিষয়ে উদ্বুদ্ধকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও যেন একই পন্থা অবলম্বন করতে সক্রিয় হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
চ. বিভিন্ন গণমাধ্যম ব্যবহার : দেশি সুগন্ধি চাল ব্যবহার জনপ্রিয়করণের লক্ষ্যে গণমাধ্যম ব্যবহারের সব ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। সে মতে সরকারি/বেসরকারি রেডিওগুলোতে যেন সুগন্ধি চাল ও তা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাবারের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়, তার সুব্যবস্থা নিতে হবে। একইভাবে বিভিন্ন টেলিভিশনে কৃষি বিষয়ক সংশ্লিষ্ট সব অনুষ্ঠানে এমনকি টকশোতে দেশি সুগন্ধি চাল ও তা থেকে তৈরি খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে ব্যাপক প্রচার ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে হবে।
ছ. ওয়ার্কশপ ও সেমিনার আয়োজন : দেশি সুগন্ধি চালের ওপর আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয়ভাবে সেমিনার/ওয়ার্কশপ আয়োজনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে থাকবে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী, সম্প্রসারণবিদ, নামি-দামি হোটেলের বাবুর্চি, ম্যানেজার, উৎপাদনকারী ও বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তিবর্গ। আলোচনায় যেসব সুপারিশমালা উঠে আসবে সে আলোকে উৎপাদনকারীরা প্যাকিং, গ্রেডিং, লেবেলিংয়ের মান উন্নয়ন এবং তা থেকে নিত্যনতুন সুস্বাদু খাবার তৈরি ও পরিবেশন জনপ্রিয়করণে সংশ্লিষ্ট কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে।
সুগন্ধি চাল আমদানি ও রপ্তানি পরিস্থিতি
এ দেশে সুগন্ধি চালের অভ্যন্তরীণ চাহিদার পাশাপাশি উৎপাদিত সুগন্ধি চালের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা বিদেশিদের কাছে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রচলিত জাতগুলোর আকার ও আকর্ষণীয় সুগন্ধকরণে বিভিন্ন দামি খাবার তৈরিতে উপযোগিতা সুবিধার দিকগুলো বিবেচনায় এ দেশি সুগন্ধি চালের চাহিদা বহির্বিশ্বে প্রচুর রয়েছে। পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভারতের লম্বা-সরু বাসমতি চালের বিদেশে যে একচেটিয়া বাজার ছিল তা কিছুটা হলেও ম্লান হয়েছে বলা যায়। বিচিত্র স্বাদ ও রুচির পরিবর্তন আনয়নে বিকল্প চাল হিসেবে এ দেশি সুগন্ধি চালের প্রতি আগ্রহ বিদেশিদের মাঝে বৃদ্ধি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বৈধ ও অবৈধ পথে এমন কি যাত্রীদের বিদেশ ভ্রমণকালে কয়েক কেজি সুগন্ধি চাল, এমনকি কাটারিভোগ জাতের সুগন্ধি চিড়া সঙ্গে নেয়ার আগ্রহ অহরহ লক্ষ করা যায়। এ চাহিদা পূরণে সাধারণ রপ্তানিকারকদের পাশাপাশি স্বনামধন্য দেশি প্রক্রিয়াজাতকারকরাও পিছিয়ে নেই। তাদের হরেক পণ্যের সঙ্গে এ দেশি সুগন্ধি চাল সুন্দরভাবে প্যাকিং করে তা রপ্তানি করতে সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে।
সুগন্ধি চাল রপ্তানির জন্য সরকারিভাবে বিদেশি বাজার সৃষ্টির বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা একান্ত দরকার। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মেলায় সুগন্ধি চাল ও তা থেকে উৎপাদিত হরেক রকম খাবার প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করা হলে বিদেশি ক্রেতারা এ দেশি সুগন্ধি চালের প্রতি আরও আগ্রহী হবে। আমাদের বিদেশি মিশনগুলো দেশের বৈচিত্র্যময় সুগন্ধি চাল জনপ্রিয় করার বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে সরকারিভাবে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। এ সুগন্ধি চালের রকমারি খাবার উপস্থাপন করেও তারা ভোজন বিলাসীদের বিভিন্নভাবে আকৃষ্ট করতে পারে। ইউএন মিশনে বাংলাদেশের প্রায় ১০ হাজার ডিফেন্স অফিসিয়াল কর্মরত আছে। তাদের প্রদত্ত দায়িত্ব পালন ছাড়াও তারা বাংলাদেশী কালচার ও এদেশে উৎপাদিত পণ্য বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয়করণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এদেশি সুগন্ধি চাল ও তা থেকে তৈরি রকমারি খাবার প্রচলন ব্যবস্থা নিয়ে তারাও অনন্য অবদান রাখতে পারে।
যেহেতু সুগন্ধি চাল একটা নন- পেরিশেবল আইটেম, সেলফ লাইফ ৫-৭ মাসেরও বেশি, এ জন্য ‘জলজ পথে’ কম খরচে দেশি সুগন্ধি চাল রপ্তানি সুবিধাকে কাজে লাগানো সহজ। রপ্তানির জন্য সুন্দর আকর্ষণীয় মোড়ক ব্যবহার ও তাতে বাংলাদেশের উপযোগী ব্র্যান্ড ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে। পাশাপাশি এ সুগন্ধি চালের গুণাবলি ও বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার তৈরির সংক্ষিপ্ত নিয়মাবলি সংবলিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্যাকেটের উপরে বা ভেতরে ছোট ফোল্ডার আকারে প্রদানের ব্যবস্থা নিয়ে ক্রেতা সাধারণকে সহজেই আকৃষ্ট করা যাবে।
চাল মিলিং করা
এ দেশের প্রচলিত জাতের সুগন্ধি চাল মিলিং ব্যবস্থায় তেমন কোনো সমস্যা নেই। পাশাপাশি ঢেঁকি ছাঁটা সুগন্ধি চাল তৈরি করার প্রচলন এখনও মাঝে মাঝে দেখা যায়। দেশি পুরাতন মিল যা এ্যাংগেল বার দিয়ে তৈরি তাতেও দেশি সুগন্ধি চাল তৈরি করতে তেমন একটা অসুবিধা হয় না। তবে বাসমতি ধরনের সুরু-লম্বা চাল (বাংলা মতি, ব্রিধান-৬৩) মিলিং করা এ দেশের পুরনো মডেলের মিলিং যন্ত্র (এ্যাংগের বার বিশিষ্ট) দিয়ে সম্ভব হয় না। এ ধরনের বহু পুরানো মিলিং যন্ত্র ভরত অনেক আগেই সরকারিভাবে বাতিল করে আধুনিক অটো রাইস মিল সর্বস্তরে চালু করেছে। এ দেশে আধুনিক অটো রাইস মিল প্রচলন শুরু হলেও তার পাশাপাশি পুরাতন মডেলের চালের মিল এখনও রয়ে গেছে। বর্তমানে রাইস ব্রান থেকে ভোজ্যতেল উৎপাদন প্রচলন বাড়ছে। পুরনো মডেলের রাইস মিল দিয়ে এ ব্রান প্রাপ্তি সম্ভব হয় না। এসব গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা বিবেচনায় ভারতের মোত একই পন্থা অবলম্বন করে পুরনো রাইস মিলগুলোর পুনর্বাসন উদ্যোগ নেয়া জরুরি।
এ ধরনের প্রচার প্রচারণা ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে এ দেশের উৎপাদিত সুগন্ধি চালের ব্যবহার ও বাজার প্রসারিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বিধায় তার ইচ্ছা বাস্তবায়নে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবারই দেশের ও দশের বৃহত্তর স্বার্থে তৎপর হওয়া অত্যাবশ্যক।
কৃষিবিদ এম এনামুল হক*
*মহাপরিচালক (অব:), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। পাটের ব্যবহারিক উপযোগিতা, অর্থনৈতিক গুরুত্ব ইত্যাদি বিবেচনা করে পাটকে ‘সোনালী আঁশ’ বলে অভিহিত করা হয়। পাট ও পাট জাতীয় আঁশ ফসল সারা বিশ্বে তুলার পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক আঁশ ফসল হিসেবে অবস্থান করছে। আট থেকে ১০ মিলিয়ন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাট ও এ জাতীয় আঁশ ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৫-৬% আসে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে। এ ফসল নিজেই মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭.৫-৮.০ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করা হয় যা থেকে প্রায় ৮০ লাখ বেল পাট আঁশ উৎপন্ন হয়ে থাকে। বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় শতকরা ১০-১২ ভাগ পাট চাষ এবং পাটশিল্প যেমন প্রক্রিয়াকরণ, আঁশ বাঁধাই, গুদামজাতকরণ, স্থানান্তর ও বিপণন ইত্যাদি কাজের সাথে জড়িত।
বাংলাদেশে প্রধানত দুই প্রকার পাট ফসল চাষ হয়। একটি তোষা ও অন্যটি দেশি বা সাদা পাট। দেশি পাটের পাতার স্বাদ তিতো এবং ফলগুলো গোলাকার এবং খাঁজকাটা। এ পাট নিচু জমিতে উৎপাদন করা যায় এবং পরিপক্ব অবস্থায় কয়েক ফুট পানির নিচে থাকতে পারে। তবে তোষা পাটের পাতার স্বাদ তিতো হয় না এবং এর ফল লম্বা ক্যাপসুলের মতো হয়, আগা চোখা। এ পাট কোনো অবস্থাতেই গোড়ায় পানি জমা সহ্য করতে পারে না তাই নিচু জমিতে এ পাট চাষ করা য়ায় না ।
সাধারণত দেশি পাট ১৫ মার্চ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত এবং তোষা পাট ১৫ এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যন্ত বপন করার উপযুক্ত সময়। তবে জাতভেদে এ সময়ের কিছু পার্থক্য দেখা যায়। যদি কোনো পাটের জাত তার উপযুক্ত সময় এর চেয়ে আগাম বপন করা হয় তবে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয় এবং শেষ পর্যন্ত ফলন কমে যায়। যখন পাটের জাত সময় মতো বপন করা হয়, তখন সাধারণত ফুল আসে আগস্ট মাস, অর্থাৎ তখন দিনের আলোর দৈর্ঘ্য কমতে শুরু করে। পাট হলো একটি খাটো দিন দৈর্ঘ্য ফসল। তাই পাট ফসলও অন্যান্য স্বল্প দৈর্ঘ্য দিনের ফসলের ন্যায় ফটো পিরিয়ড (আলোক দৈর্ঘ্য) সংবেদনশীল।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, খরা বা অন্য কোনো বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয় এমন কোনো পরিবেশে পাট চাষ করলে, সেই পাট ফসলে আগাম বা অপরিপক্ব অবস্থায় ফুল চলে আসে। নিচু জমিতে বপন করা পাটে অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগাম বৃষ্টি/বন্যার সময় যখন চাষিরা আগাম পাট বপন করে অর্থাৎ উপযুক্ত সময়ের আগেই, তখন ওই পাট ফসলের জমিতে ১-২ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন গাছেই ফুল দেখা দেয়। বিশেষ করে এ আগাম ফুল দিনের স্বল্প আলোক দৈর্ঘ্যরে তারতম্যের জন্যই হয়ে থাকে।
আগাম ফুল আসার মূল কারণগুলো হলো-
১. পাট জাতের উপযুক্ত সময়ের পূর্বে বপন করা ।
২. লম্বা খরা, শুষ্ক বায়ু প্রবাহ, কোনো কারণে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া, মাটির দুর্বল উর্বরতাশক্তি, জলাবদ্ধতা, মেঘাচ্ছন্ন-আবহাওয়া, দিনরাতের তাপমাত্রার পার্থক্য খুবই কমে যাওয়া ইত্যাদি।
আগাম ফুল পাট ফসলের ওপর প্রভাব-
১. পাটের গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়।
২. শাখা-প্রশাখা জন্মানো শুরু হয়।
৩. খুবই দ্রুততার সাথে ফলন ও আঁশের মান খারাপ হয়।
বাংলাদেশে মার্চের শেষে দিনের দৈর্ঘ্য হয় প্রায় ১২ ঘণ্টা এবং এপ্রিলের মাঝা মাঝি অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল এ দৈর্ঘ্য হয় ১২.৫ ঘণ্টার ওপরে। মার্চের শেষে দেশি এবং মধ্য সময়ে তোষা পাট জাত বপন করলে অপরিপক্ব অবস্থায় ফুল আসার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। অনেক সময় মাঠের মধ্যে কিছু গাছে এদিক সেদিক আগাম ফুল দেয়া যায়। এটা আঁশ উৎপাদনের জন্য তেমন প্রভাব ফেলে না। কারণ আগাছা পরিষ্কার বা গাছ পাতলাকরণের সময় সেগুলো তুলে ফেলা হয় অথবা এ অবস্থাতেই বাড়তে দেয়া যায় মধ্য আগস্ট পর্যন্ত ফসল প্রয়োজনীয় ফুল আসা শুরু হয়। এ সময় দিনের দৈর্ঘ্য কমতে শুরু করে এবং কমতে কমতে ১২.৫ থেকে ১২ ঘণ্টায় পৌঁছায়। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত দেশি ও তোষা (আঁশ উৎপাদনের জন্য) পাটের জাত ও প্রকৃত বপন সময় ছক-১ এ দেখান হলো।
পাটের দেশি তোষা উভয় জাতই স্বল্প দিন দৈর্ঘ্যরে ফসল। দিন দৈর্ঘ্য ১২.৫ ঘণ্টা বা তার নিচে হলেই পাট ফসলে আগাম ফুল আসবে। লম্বা দিন দৈর্ঘ্য যেমন ১২.৫ ঘণ্টা বা তার বেশি হলে ফুল আসা বিলম্বিত হয়। দিন দৈর্ঘ্য ১০-১২ ঘণ্টা হলে ৩০-৩৫ দিন বয়সের যে কোনো পাট গাছে ফুল চলে আসে। এরূপ দিন দৈর্ঘ্যর প্রভাব দেশি পাটের চেয়ে তোষা পাটে বেশি পরিলক্ষিত হয়।
পূর্বে দেখা গেছে, দেশি জাত সি-৬ এবং ডি-১৫৪ যদি মধ্য বা শেষ মার্চের পূর্বে বপন করা হতো তবে আগাম ফুল দেখা দিত এবং তোষার জাত ও-৪ যদি মধ্য এপ্রিলের পূর্বে বপন করা হতো তবে অপরিপক্ব ফুল দেখ দিত (আহমেদ, ১৯৮৯)। বাংলাদেশে মার্চের শেষ পর্যন্ত দিনের দৈর্ঘ্য প্রায় ১২ ঘণ্টা থাকে এবং এটা মধ্য এপ্রিলের সময়েই বৃদ্ধি পেয়ে ১২.৫ ঘণ্টার ওপরে চলে যায়। তাই দেশি পাট মার্চের শেষ সময় থেকে এবং তোষা পাট মধ্য এপ্রিল থেকে বপন শুরু করলে এ অপরিপক্ব আগাম ফুল এর প্রভাব থাকে না। যদিও ফসলের মাঠে এদিক-সেদিক কিছু গাছে ফুল দেখা দিলেও তা আঁশ উৎপাদনে তেমন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে না।
অপরিপক্ব বয়সের ফুলের জন্য দায়ী বিষয়গুলো
১. যেহেতু পাট স্বল্প দিবা দৈর্ঘ্য সহিষ্ণু ফসল, তাই দেশি পাটের কিছু জাত মধ্য-মার্চের পূর্বে এবং কিছু জাত শেষ মার্চের পূর্বে বপন করলে আগাম ফুল দেয়। তেমনি তোষার ও-৪ জাতটি যদি মধ্য এপ্রিলের পূর্বে বপন করা হয় তবে গাছে ফুল আসে।
২. তোষা জাতের পাটের ফসলের শতকরা কিছু গাছ অপরিপক্ব অবস্থায় ফুল দেখা দিয়ে থাকে। তবে সেগুলো জাতের সাথে কৌলিক বিশুদ্ধতায় ভিন্ন হয়, সেগুলো পাতার চেহারা দেখে চেনা যায় আবার অনেক সময় পার্থক্য করাও কঠিন হয়। এগুলো সাধারণত লোকাল জাতের সাথে বা বীজ উৎপাদনের সময় স্বল্প দূরত্বে থাকায় ক্রস পলিনেশনের ফলে তৈরি হয়ে থাকে। এ রকম অনেক সময় প্রজনন বীজের মধ্যেও পাওয়া যায়।
৩. উচ্চ উর্বরতা ও আর্দ্রতা থাকা, মাটিতে পাট বীজ বপন করলে স্বাস্থ্যগত কারণেই গাছের জন্ম ও বৃদ্ধি দ্রুত হয় এবং সাথে সাথে আগাম ফুলও দেখা দেয়, যা ক্রিটিক্যাল ফটোপিরিয়ডে পরে বপন করলে দেখা যায় না।
বোর্স (১৯৭৪-৭৬) এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, দেশি ও তোষা উভয় পাটের ফুলই দিবারাত্রির তাপমাত্রার পার্থক্যের জন্য তাপমাত্রাগুলো যেমন ৩২/২৭, ২৭/২৭, ২৪/২৪ ডি.সে. এর সাথে রাতের তাপমাত্রাখান ১৭ ডি.সে. পার্থক্য বিবেচনা করা হয়। এ অবস্থায় প্রায় ২০ দিন আগেই ফুল চলে আসে। অথচ ৯ ঘণ্টা ফটোপিড়িয়ড এ ফুল চলে আসে যা বাংলাদেশর সাধারণ স্বল্প দৈর্ঘ্য দিন ১০ ঘণ্টার চেয়ে অনেক কম।
ওয়াসেক (১৯৮২) প্রতিবেদন করেছেন যে, পানির স্বল্পতার প্রভাব পাটের বেশি ফুল আসাকে বিলম্বিত করে, যেখানে খরা আরো বেশি প্রভাব ফেলে। আবার গোট্রিজ (১৯৬৯) বলেছেন পানির স্বল্পতা পাটে দ্রুত ফুল আসাকে প্রভাবিত করে। জোহানসেন (১৯৮৫) বলেন পাটের আঁশের ফলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক হলো পাট ফসলের ফুল ধরার সময়টি। কারণ ফুল আসার সাথে সাথে পাট গাছের কাণ্ডের উপরি অংশে শাখা প্রশাখার বিস্তার ঘটে এবং প্রধান কাণ্ডের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। পাটের স্বল্প দিবা দৈর্ঘ্যর ফুল আসা সাধারণত নির্ভর করে দেশি পাটের জন্য প্রায় ১২ ঘণ্টা এবং তোষা পাটের জন্য ১২.৫ ঘণ্টা। তিনি আরও বলেন তাপমাত্রার বৃদ্ধি বিশেষ করে রাত্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে পাট ফসলে দ্রুত ফুল আসে। বিশেষ করে রাতের তাপমাত্রা যদি ২০ ডি. সে. এর কম হয় তবে মাটি থেকে চারা গজানো এবং ছোট বয়সের পাট গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ফলে অল্প বয়সেই ফুল আসার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
অনেকের মতে, বীজের বয়স পাট ফসলে ফুল আসার জন্য দায়ী। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, ১-২ বছরের পুরাতন বীজ অথবা নতুন বীজ, যে কোনো বীজ যদি তার অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা ভালো থাকে (৮০% এর উপরে) তবে কোনো ফুল আসে না এবং সমান বৃদ্ধি ও ফলন হয়। বিজেআরআই এর উদ্ভাবিত অনেক জাত আছে যেমন বিজেআরআই দেশি পাট-৫, ও-৯৮৯৭, বিজেআরআই তোষা পাট-৪, বিজেআরআই তোষা পাট-৫ ইত্যাদি মাঠে বপন করার পর কিছু আগাম ফুল হলেও তা আঁশের ফলনে বা গাছের বৃদ্ধিতে বা আঁশের গুণগতমানে তেমন কোনো ব্যঘাত ঘটায় না।
শুধু পাট নয় অন্য যে কোনো ফসলের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, গাছের বৃদ্ধির সময় যে কোনো কারণে যদি বৃদ্ধিতে বাধার প্রভাব পরে তবে গাছ দ্রুততার সাথে প্রজনন পর্যায়ে চলে যায় এবং গাছে ফুল দেখা দেয়।
অপরিপক্ব বয়সের ফুলের প্রভাব থেকে প্রতিকার পাওয়ার উপায়
পাট ফসলের আঁশ উৎপাদনের সময় আগাম/অপরিপক্ব বয়সে ফুল আসা খুবই বিপদজ্জনক। কখনো কখনো এ কারণে পাটের ফলন ও আঁশের মান খারাপ হয় এবং কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক কথায় বলতে গেলে পাটের আগাম ফুলের প্রভাব দূর করতে হলে উপযুক্ত সময়ে বীজ বপন করতে হবে। তাছাড়া জমির দুর্বল উর্বরতা, জলাবদ্ধতা, খরা, শুষ্ক বায়ু প্রবাহ, দিবা রাত্রির তাপমাত্রার পার্থক্যের পরিমাণ বেশি হওয়া, মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া ইত্যাদি। এমনকি যদি দিনের আলোক দৈর্ঘ্য তার পরিমিত মাত্রা ছাড়িয়ে য়ায়, তখনও ফুল দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এটা সাধারণত মে, জুন এমন কি জুলাই মাসেও হতে পারে। অতএব, প্রকৃত অর্থে পাট ফসল কে আগাম বা অপরিপক্ব বয়সের ফুল থেকে রক্ষা করতে হলে বিশুদ্ধ পাট জাতের বীজ ব্যবহার করতে হবে এবং উপযুক্ত সময় বীজ বপন করতে হবে। বৃষ্টি না হলে বা কমে হলে, বীজ বপনের পর অন্তত এক বার জমিতে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। অতিরিক্ত উর্বর না হলেও মোটামুটি উর্বরতা সমৃদ্ধ জমিতে পাট ফসল চাষ করতে হবে। তবেই আমাদের দেশের পাটচাষিদের মানের আশা পূরণ হবে। উচ্চফলন ও ভালোমানের আঁশে কৃষকের মাচা ভরে উঠবে, কৃষক ভাইয়েরা অর্থিকভাবে লাভবান হবেন।
কৃষিবিদ ড. মো. মাহবুবুল ইসলাম*
*মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রধান, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা-১২০৭। মোবাইল : +৮৮০১৫৫২৪১৬৫৩৭
বাংলাদেশে একটি নতুন কৃষি প্রযুক্তি চালু হয়েছে, যা কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের কোনো কোনো জেলায় কৃষক ব্যবহার করে ব্যাপক সুফল পেয়েছেন। প্রযুক্তিটির নাম মাটির গভীরে ইউরিয়া প্রয়োগ প্রযুক্তি বা Urea Deep Placement (UDP) Technology এটি প্রায় ২০ বছর আগে চালু হলেও গত ৫ বছর ধরে দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলসহ ২২টি জেলায় ব্যাপকভাবে কৃষকরা ব্যবহার করে লাভবান হয়েছেন।
মাটির গভীরে সারপ্রয়োগ প্রযুক্তি কী? এটি মূলত ছিটিয়ে ইউরিয়া ব্যবহারের একটি অত্যন্ত কার্যকর বিকল্প। এ পদ্ধতির মর্মকথা হচ্ছে মাটির গভীরে সার (গুটি ইউরিয়া) প্রয়োগ, যার মাধ্যমে সার সাশ্রয় হয় ও ফসলের ফলন বৃদ্ধি পায়। এ পদ্ধতির দুইটি ধাপ। প্রথমে একটি মেশিনের (ব্রিকেট মেশিন) মাধ্যমে প্রচলিত গুঁড়া ইউরিয়াকে গুটি ইউরিয়ায় রূপান্তর এবং দ্বিতীয়ত মাটির ৩-৪ ইঞ্চি নিচে গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ।
গুটি ইউরিয়া : গুটি ইউরিয়া কোনো নতুন সার নয়। এটি গুঁড়া ইউরিয়া সারেরই রূপান্তর। বাংলাদেশেই উদ্ভাবিত একটি মেশিনের (ব্রিকেট মেশিন) মাধ্যমে গুটি ইউরিয়া সহজেই তৈরি করা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে দুই সাইজের গুটি ইউরিয়া তৈরি করা হয়। আউশ ও আমন মৌসুমের জন্য ১.৮ গ্রাম এবং বোরো মৌসুমের জন্য ২.৭ গ্রাম ওজনের গুটি। গুটি ইউরিয়ায় গুঁড়া ইউরিয়ার মতোই ৪৬ ভাগ নাইট্রোজেন বিদ্যমান।
গুটি ইউরিয়া ব্যবহার কেন লাভজনক : গুটি ইউরিয়া বাজারে প্রচলিত গুঁড়া ইউরিয়ার তুলনায় অনেক বেশি লাভজনক। কারণ গুটি ইউরিয়া ব্যবহারে ধানের ফলন ১৫-২৫% বৃদ্ধি পায়, ইউরিয়া সার তিন ভাগের এক ভাগ লাগে তথা ২০-২৫% খরচ সাশ্রয় হয় এবং আগাছা দমনের খরচ ৩০-৫০% ভাগ কমে যায়। এক হেক্টর জমিতে গুটি ইউরিয়া ব্যবহারে ধানের ফলন অন্তত ১০০০ কেজি বাড়ে। অর্থাৎ কৃষক অতিরিক্ত ফলনের মাধ্যমে বাড়তি ১৫০০০ টাকা (প্রতি কেজি ধান ১৫ টাকা করে) আয় করতে পারবে।
গুটি ইউরিয়া প্রতি হেক্টরে আউশ আমন ধানে মাত্র ১১২ কেজি এবং উফশী বোরো ধানে ১৭০ কেজি প্রয়োগ করতে হয়। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের ফার্টিলাইজার গাইড ২০১২ অনুযায়ী গুঁড়া ইউরিয়া আউশ ও আমন ধানে অন্তত প্রতি হেক্টরে গড়ে ২০০ কেজি ও বোরো ধানে ৪৩৪ কেজি প্রয়োগ করতে হয়। বোরো ধানে যদি ৪০০ কেজি গুঁড়া ইউরিয়াও প্রয়োগ করা হয় তাহলে কৃষকের খরচ পড়বে ৬৪০০ টাকা (প্রতি কেজি ১৬ টাকা করে) অথচ গুটি ইউরিয়া ১৭০ কেজি প্রদানে খরচ পড়ে মাত্র ৩০৬০ টাকা (প্রতি কেজি ১৮ টাকা করে)। অতএব, গুটি ইউরিয়া ব্যবহারে হেক্টরপ্রতি সাশ্রয় হয় ৩৩৪০ টাকা।
গুটি ইউরিয়ার উপকারিতা : গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের উপকারিতা অনেক। গুটি ইউরিয়া একবার প্রয়োগ করলেই চলে, ধান পাকা পর্যন্ত আর প্রয়োগ করতে হয় না। গুটি ইউরিয়া ব্যবহৃত জমিতে ঘাস বা আগাছা কম হয়। খড়ে পুষ্টিমান বেশি থাকে। পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের উপদ্রব কম হয়। গুটি ইউরিয়া গুঁড়া ইউরিয়ার মতো তিনভাবে অপচয় হয় না। অর্থাৎ বাতাসে উবে যায় না, মাটির গভীরে চুইয়ে অপচয় হয় না এবং পানির সাথে বিলে বা নদী-নালায় চলে যায় না। ফলে পরিবেশ ভালো থাকে। সার কম লাগে বিধায় ভরা মৌসুমে সারের অভাব থাকে না। ইউরিয়া সার ২০-২৫% কম লাগে এবং ধানের ফলন ১৫-২৫% বৃদ্ধি পায়। কৃষক লাভবান হয়।
গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ পদ্ধতি : গুটি ইউরিয়া কিভাবে ব্যবহার করতে হয়। গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের পূর্বশর্ত হচ্ছে লাইনে চারা রোপণ। চারা রোপণের ৭ দিনের মধ্যে মাটি শক্ত হওয়ার আগে জমিতে ২-৩ সেমি. পানি থাকা অবস্থায় গুটি ইউরিয়া মাটির ৩-৪ ইঞ্চি নিচে প্রয়োগ করতে হয়। জমিতে ২০×২০ সেমি. (৮×৮ ) দূরত্বে লাইন থেকে লাইন এবং চারা থেকে চারার দূরত্বে ধানের চারা বোপণ করতে হবে। এরপর প্রতি চার গোছার মাঝখানে একটি করে গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে। গুটি ইউরিয়া হাতেও প্রয়োগ করা যায়। তাছাড়া বারি (BARI) ও আইএফডিসি উদ্ভাবিত প্রয়োগ যন্ত্র (Applicator) দিয়েও প্রয়োগ করা যায়।
অধিক ফলন লাভে করণীয় : গুটি ইউরিয়া ব্যবহারে অধিক ফলন পেতে হলে অন্যান্য যা করণীয় তা হচ্ছে ভালো জাতের ফলন সম্পন্ন বীজ ব্যবহার, অন্যান্য প্রয়োজনীয় সার ব্যবহার, সময়মতো সেচ প্রয়োগ, বেলে মাটিতে ব্যবহার না করা, সময়মতো পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন। শুধু ধান নয়, শাকসবজি ও অন্যান্য ফসলেও ব্যবহার করা যায়।
বর্তমানে অন্তত ১২০০ ব্রিকেট মেশিনের মাধ্যমে আইএফডিসির উদ্যোগে দেশে প্রায় ২ লাখ টন গুটি ইউরিয়া উৎপাদন ও ব্যবহার হচ্ছে। ফলে গুঁড়া ইউরিয়া ব্যবহার আস্তে আস্তে হ্রাস পাচ্ছে।
গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে দেশ ও কৃষক অনেক লাভবান হচ্ছে। ইউরিয়া ব্যবহার হ্রাস পাওয়ায় ইউরিয়া সার সাশ্রয় হচ্ছে ও ধান উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সার আমদানি ও চাল আমদানি ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে।
এখন সময় এসেছে এই সার সাশ্রয়ী, লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিটি সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার। এতে কৃষক লাভবান হবে ও দেশের কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এ ব্যাপারে ব্যাপকভাবে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের এখনই সময়।
কৃষিবিদ মাহমুদ হোসেন*
*মহাব্যবস্থাপক (অব.), বিএডিসি, মোবা. ০১৮৩৭৩৫৩৯৭০
বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের প্রায় ৮০% জনগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি অনেকটাই কৃষিনির্ভর। বিভিন্ন কৃষি পণ্য উৎপাদনের জন্য যেসব অনুকূল পরিবেশগত উপাদান প্রয়োজন তার সবই এখানে আছে। কৃষি পণ্যের মধ্যে বাংলাদেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের ফল একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। দেশীয় ফলের পাশাপাশি বিদেশি ফলেরও সাফল্যজনক আবাদ চলছে। আমাদের দেশে সারা বছরই কোনো না কোনো ফল পাওয়া যায়। কোনো কোনো ফলের আবাদ হয় সারা বছর। তবে অধিকাংশ ফলই মৌসুমি। মৌসুমি ফলের মধ্যে ইতোমধ্যে কয়েকটি ফলের আবাদ অন্য ঋতুতেও শুরু হয়েছে। ফলভেদে পুষ্টিগুণ, ঔষধিগুণ, ঘ্রাণ, বর্ণ, স্বাদ এসবের ভিন্নতা আমাদের দেশের ফলে এনেছে বৈচিত্র্য।
স্বাস্থ্য সংরক্ষণে পৃথিবীতে যত খাবার আছে সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বের দিক দিয়ে ফলের স্থান সবার ওপরে। কার্বহাইড্রেট ও প্রোটিনের উপযুক্ত মাত্রায় অবস্থিতির পাশাপাশি আছে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ লবণের সুষম অবস্থান। তাই শরীর সুস্থ ও সবল রাখতে ফলের প্রয়োজনীয়তার কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কাজেই সারা বছর ফলের আবাদ ও প্রাপ্যতার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। ফলের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানুষের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় উপকারী পুষ্টি উপাদানের অধিকাংশই বিভিন্ন ফলে আছে। প্রাকৃতিকভাবেই অধিকাংশ ফলে চর্বি ও সোডিয়াম কম থাকে, কোলেস্টেরল থাকে না বললেই চলে। ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে পটাসিয়াম, খাদ্য আঁশ, ভিটামিন সি ও ফলিক এসিড। ধারণ করা হয়, শরীরের জন্য উপকারী হাজারও রকমের যৌগ ফলে থাকে, যা এখন পর্যন্ত নির্নীত হয়নি।
ফলে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান যেভাবে আমাদের শরীরে কাজ করে তাহলো পটাসিয়ামসমৃদ্ধ ফল গ্রহণ করলে নিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ বজায় থাকে এবং কিডনিতে পাথর জন্মানোর ঝুঁকি কমে যায়। পটাসিয়ামসমৃদ্ধ ফলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কলা, কমলা, বরই, পিচফল ও বিশুষ্কিত খেজুর। ফলের খাদ্য আঁশ রক্তের কোলস্টেরল কমায় এবং ফলশ্রুতিতে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যায়। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য কমিয়ে থাকে। খাদ্যে আঁশ পেতে হলে ফলের জুস না খেয়ে পুরো ফল খাওয়ার ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। ভিটামিন সি দৈহিক কোষ বৃদ্ধি ও মেরামতে ভূমিকা রাখে। দেহের জখম নিরময় ও দাঁত সুস্থ রাখতে কাজ করে। দেহের মুক্ত রেডিক্যাল প্রশমনে এটি এন্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল হলো কমলা, আম, আপেল ও আঙুর। ফলিক এসিড দেহের লাল রক্তিকনিকা তৈরিতে ফলেট ভূমিকা রাখে। গর্ভবর্তী মেয়েদের জন্য এটি খুবই গুরত্বপূর্ণ। ফলেটসমৃদ্ধ ফল হলো- কমলা ও কলা। প্রোটিন দেহকোষ তৈরি ও ক্ষয়পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এনজাইম, জিন ও হরমোন তৈরিতে প্রোটিন সহযোগিতা করে। প্রোটিনসমৃদ্ধ ফল হচ্ছে খেজুর, ডুমুর ও চীনাবাদাম। কিছু কিছু চর্বি শরীরে উপকারী ভূমিকা রাখে এবং এরা অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড সরবরাহ করে। এ ধরনের চর্বি অধিকাংশ ফলে আছে। চর্বি শরীরে ভিটামিন এ, ডি ও ই-এর শোষণে ভূমিকা রাখে। যেসব ফলে অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড থাকে সেগুলোর মধ্যে জলপাই, চীনাবাদাম ও বিভিন্ন ধরনের বীজ উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশে ১৩০টিরও বেশি ফল আছে। তার মধ্যে কিছু বেশি উল্লেখযোগ্য ফল হলো আম, আনারস, কাঁঠাল, কালজাম, নারিকেল, কলা, পেয়ারা, লিচু, জলপাই, আঙুর, বাতাবিলেবু, খেজুর, তাল, বেল, তরমুজ, বরই, তেঁতুল, আমড়া, পেঁপে, কমলা এসব। ফল খেলে আমাদের যেসব উপকার হয়
ক. শরীরে সুস্থতা প্রদান করে গ্রহণযোগ্য ওজন বজায় রাখতে সহায়তা করে; হৃদরোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে; কোলস্টেরল ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কাজ করে; বয়স বাড়ার সাথে হাড়ের যে ক্ষয় হয় তা কমিয়ে দেয়; কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়; মানসিক অস্থিরতা ও বিষণœতা প্রশমনে ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া ফল চাষে জন্য যথেষ্ট উপযোগী।
বিভিন্ন চিত্তাকর্ষক বর্ণ ও ঘ্রাণ আমাদের ফলে এনেছে বিশষে ধরনের বৈশিষ্ট্য। বর্ণভেদে মানবদেহে ফলের উপকারেও ভিন্নতা রয়েছে। কয়েকটি বর্ণের ফলের কার্যকারিতা এমন-
নীল বা বেগুনি-লাল : এ বর্ণের ফলে স্বাস্থ্য সুরক্ষার সাথে জড়িত বিভিন্ন মাত্রায় ফাইটোকেমিক্যাল যেমন এনথোসায়ানিন ও ফিনোলিক থাকে। এসব যৌগ এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। নীল বা বেগুনি-লাল বর্ণের ফল ব্যবহারে- কিছু কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে; মূত্রাশয় নালি ভালো থাকে; স্মৃতিশক্তি উন্নত হয়। লাল বা বেগুনি-লাল বর্ণের ফলের মধ্যে রয়েছে: কালজাম, বিশুষ্কিত বরই, বেগুনি-লাল বর্ণের ডুমুর, বেগুনি-লাল বর্ণের আঙুর ও কিশমিশ। সবুজ ফলে লিউটিন ও ইনডোল ফাইটোকেমিক্যাল থাকে। এ বর্ণের ফলের উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে- কিছু কিছু ক্যান্সার প্রতিরোধ করে; দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে; হাড় ও দাঁত শক্ত রাখে। সবুজ ফলের মধ্যে সবুজ আপেল, সবুজ আঙুর, লেবু, সবুজ নাশপাতি ও অ্যাভোকেডো উল্লেখযোগ্য। সাদা ফল : সাদা ও বাদামি ফল বিভিন্ন মাত্রায় ফাইটোমিক্যাল বহন করে। রসুনে এলিসিন এবং মাশরুমে সেলেনিয়াম থাকে। এ নিয়ে যথেষ্ট গবেষণার সুযোগ রয়েছে। এ ধরনের ফল থেকে যেসব উপকার পাওয়া যেতে পারে তা হলো- হৃৎপি- সুস্থ থাকে; কোলস্টেরল মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে; কিছু কিছু ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করে। উল্লেখযোগ্য সাদা ফল হচ্ছে- কলা, বাদামি নাশপাতি, খেজুর ও সাদা পিচফল।
হলুদ বা কমলা ফল : এ বর্ণের ফল বিভিন্ন মাত্রায় এন্টিঅক্সিডেন্ট যেমন ভিটামিন ‘সি’ বহন করে। অন্যান্য এন্টিঅক্সিডেন্ট হলো- ক্যারোটিনয়েড ও বায়োফ্লাভোনয়েড। এগুলোর উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হলো- হৃৎপি- ভালো রাখে; দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে; রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে; কিছু কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। হলুদ বা কমলা বর্ণের ফলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- হলুদ আপেল, হলুদ ডুমুর, লেবু, আম, কমলা, পেঁপে, পিচ, হলুদ নাশপাতি, আনারস, হলুদ তরমুজ, মিষ্টিকুমড়া ও হলুদ টমেটো। লাল ফল : এ ধরনের ফলে বিদ্যমান ফাইটোকেমিক্যাল হলো- লাইকোপেন ও এনথোসায়ানিন। লাল ফলের উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হলো- হৃৎপি- ভালো রাখে; স্মৃতিশক্তি উন্নত রাখে; মূত্রনালী ভালো রাখে; কিছু কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। উল্লেখযোগ্য লাল ফল হচ্ছে : লাল আপেল, লাল কমলা, লাল আঙুর, লাল নাশপাতি, তরমুজ, স্ট্রবেরি ও টমেটো। তবে উৎপাদিত ফলের অধিকাংশই মৌসুমি। ফলকে সারা বছর ব্যবহার উপযোগী করতে প্রয়োজন উপযুক্ত সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থাপনা। এতে কৃষির ভিত হবে মজবুত ও বহুমুখী। উৎপাদিত ফলের অপচয় বহুলাংশে হবে রোধ। কৃষক পাবে উৎপাদিত ফলের উপযুক্ত বাজার। দেশে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ পরিসরে গড়ে উঠবে আরও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প এবং সে সাথে ঘটবে অব্যবহৃত বা অপর্যাপ্তভাবে ব্যবহৃত শ্রমের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি। জাতীয় কৃষিনির্ভর অর্থনীতি হবে মজবুত ও গতিশীল।
আমাদের দেশে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কর্মকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ফল ও ফলজাত পণ্য। কাজেই ফলের আবাদ বাড়ানো ও বহুমুখী করা খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের জন্য অনুকূল পরিবেশ বয়ে আনবে। ফল প্রক্রিয়াজাতকরণের কথা বিবেচনা করলে, গাছে পরিপক্ব পাকা ফল নির্বাচন করা দরকার। উন্নতমানের প্রক্রিয়াজাতকৃত পণ্য পেতে এ বিষয় অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। ফল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য আমাদের দেশে থাকা সহায়ক উপাদানসমূহ হচ্ছে-
১. মৌসুমে ফলের সহজপ্রাপ্যতা ও স্বল্প বাজার মূল্য;
২. অন্যান্য দেশের তুলনায় অব্যবহৃত প্রচুর শ্রমের উপস্থিতি ও তার স্বল্পমূল্য;
৩. দেশে ও বিদেশে প্রক্রিয়াজাতকৃত পণ্যের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার ও জনপ্রিয়তা;
৪. এ কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পানি, যা দেশের সর্বত্রই পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে;
৫. মোড়কীকরণ সামগ্রী ও প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াজাতকরণ রাসায়নিক দ্রব্য এখন আমাদের দেশে সহজেই পাওয়া যায়;
৭. সরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রবর্ধনের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে বিধায় ক্ষুদ্র পরিসরে খাদ্য বা ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
ফল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি হচ্ছে-এসেপসিস বা খাদ্য থেকে অনুজীবকে দূরে সরিয়ে রাখা; খাদ্য থেকে অনুজীব অপসারণ; অবায়বীয় অবস্থার সৃষ্টি; শুষ্কীকরণ; নিম্ন তাপমাত্রার প্রয়োগ; উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োগ; রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার; তেজস্ক্রিয় রশ্মির ব্যবহার; অনুজীবের যান্ত্রিক বিনাশকরণ। সংরক্ষিত ফল : বিভিন্ন পদ্ধতিতে খাদ্য সংরক্ষণের যেসব মূলনীতিগুলো অনুসৃত হয়।
ক. অনুজৈবিক কার্যকলাপে বাধা দেয়া অথবা বিলম্ব ঘটানো;
১. অনুজীবকে দূরে সরিয়ে রেখে; ২. অনুজীব অপসারণ করে, যেমন- ছাঁকার মাধ্যমে;
৩. অনুজীবের জন্ম বা কার্যকলাপ চালাতে বাধাপ্রদান, যেমন- নিম্ন তাপমাত্রা প্রয়োগ, রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে; ৪. অনুজীবকে মেরে ফেলা, যেমন- উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োগ, তেজস্ক্রিয় রশ্মির ব্যবহারের সাহায্যে।
খ. খাদ্যে স্ব-বিয়োজনে বাধাপ্রদান বা বিলম্বিত করা;
১. খাদ্যস্থিত উৎসেচক ধ্বংস বা নিষ্ক্রিয় করা, যেমন ব্লাঞ্চিং করে; ২. রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বাধাপ্রদান বা বিলম্বিত করা, যেমন-এন্টিঅক্সিডেন্ট ব্যবহারে অক্সিডেশন রোধ করা।
গ. কীটপতঙ্গ, পোকামাকড়, প্রাণী বা যান্ত্রিক কারণে খাদ্য নষ্ট হওয়া রোধ করা।
পরিপক্ব কাঁচাফল যেমন- আম, জলপাই, আমড়া এসব ব্যবহার উপযোগী টুকরা করে ১৫-২০% খাবার লবণের দ্রবণে ফুডগ্রেড মোটা প্লাস্টিকের ড্রামে সংরক্ষণ করা যায়। দ্রবণের সাথে ফলের ওজন অনুপাতে প্রতি কেজি ফলের জন্য ১-২ গ্রাম কেএমএস যোগ করলে সংরক্ষণে যথেষ্ট ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। পাকা আম, টমেটো, আনারস, পাকা পেঁপে পাল্প হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। পাল্প ফুটিয়ে ঘন করে ০.০৫% হারে কেএমএস যোগ করে জীবাণুযুক্ত ফুডগ্রেড মোটা প্লাস্টিকের ড্রামে পুরিয়ে সম্পূর্ণ বায়ুরোধী করে ঢাকনা বন্ধ করে নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। ফুটন্ত অবস্থায় ভরার কারণে ঠাণ্ডায় পাল্প স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে ড্রামের ভেতরের উপরিভাগে শূন্যাবস্থার সৃষ্টি হয়, যা অনুজীবের কার্যকলাপ চালানোর প্রতিকূল অবস্থা সৃষ্টি করে। ফলে পাল্প অনেক দিন ভালো থাকে।
খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে এসব পদ্ধতিগুলো কখনও এককভাবে এবং অধিকাংশ সময় সমন্বিতভাবে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফল থেকে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে যেসব খাদ্যসামগ্রী তৈরি করা হয় সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-চাটনি, আচার, সস, জ্যাম বা জেলি, স্কোয়াশ, জুস, ফ্রুটক্যান্ডি, ফ্রুটলেদার এসব।
চাটনি : চাটনি উৎপাদনে ফল বা ফলের টুকরার সাথে এমন পরিমাণে চিনি যোগ করা হয় যাতে চাটনির শেষ অবস্থায় টিএসএস দাঁড়ায় ৫০-৭০%। বিএসটিআই এর আদর্শ মান হচ্ছে চাটনিতে টিএসএস থাকবে কমপক্ষে ৬০%। চাটনির মিষ্টির তীব্রতা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় আনার জন্য এসিড, বিশেষ করে সাইট্রিক এসিড যোগ করা হয়। ফলের টকের মাত্রা ও ভোক্তার রুচির ওপর নির্ভর করে সাইট্রিক এসিডের পরিমাণ। চিনির উচ্চ ঘনমান চাটনিতে সংরক্ষক হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া তাপ প্রয়োগে চাটনিতে পানির পরিমাণ এতই কমানো হয় যে, অনুজীব জন্মাতে ও বংশবৃদ্ধি করতে বেশ প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হয়। চিনি দীর্ঘসময় ধরে তাপের সান্নিধ্যে থাকলে চিনিতে ক্যারামেলাইজেশন ঘটতে পারে এবং এতে চিনি ও চাটনির স্বাভাবিক প্রকৃতি ও রূপ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুরুতে কত চিনি যোগ করতে হবে, তা নির্ভর করে ফলের টকমাত্রার ওপর। প্রয়োজনের তুলনায় কম চিনি যোগ করলে চাটনি অল্প সময়েই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। চাটনিতে চিনি যেহেতু সংরক্ষক হিসেবে কাজ করে, সেহেতু তেল যোগ করার প্রয়োজন নেই। (চলবে)।
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
*উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫
বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ- এই দুই মাস গরমকাল। ঋতুচক্রে গরমকাল হলেও, ফলের বিবেচনায় এই দুই মাসকে বলা হয় মধুঋতু, জ্যৈষ্ঠ মাস হলো মধুমাস। মধুমাসে কত ফলই না ফলত তখন গাঁয়ের এ বাগানে ও বাগানে, এ বাড়িতে ও বাড়িতে। এক কথায় পুরো গ্রীষ্মকালটাই ছিল যেন এক ফলের মহোৎসব। গ্রামে গেলেও সেই দুরন্ত কৈশোরের মতো এখন আর সেসব ফল পাব কিনা সন্দেহ। কেননা, গাঁয়ের সেসব জঙ্গলও নেই, থাকলেও সেসব জঙ্গলে এখন বাসা বেধেছে ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি, মেহগিনি গাছেরা - সেই ঢাকি জাম, ক্ষুদিজাম, হামজাম, চালতা, চুকুর, বেল, বিলিম্বি, বৈঁচির গাছ উধাও।
আদিকালের ফল
পৃথিবীতে মানুষ সবচেয়ে প্রাচীন যে ফলের চাষ করে তা হল ডুমুর, এরপর খেজুর। আজ থেকে প্রায় ৯৫০০ বছর পূর্বে ডুমুর চাষের তথ্য পাওয়া যায়, এরপর ৯০০০ বছর পূর্বে প্রথম খেজুর গাছ রোপণ করার রেকর্ড প্রাচীন নথিপত্রে রয়েছে। ডালিমও অত্যন্ত প্রাচীন ফল। প্রায় ৫৫০০ বছর পূর্বে বিভিন্ন প্রাচীন সাহিত্য ও নথিপত্রে এ ফলের নাম পাওয়া যায়। ৪৫০০ বছর আগে চাষ শুরু হয় আঙ্গুরের। ৪০০০ বছর আগে আমের উৎপত্তি হয়েছিল এ উপমহাদেশেই। আজ থেকে প্রায় ৩০০০ বছর পূর্বে লিখিত ওল্ড টেস্টামেন্টে আঙুর, জলপাই ও ডুমুর ফলের উল্লেখ পাওয়া যায়। আঙুর চাষের উপযুক্ত ভূমির উল্লেখ রয়েছে প্রাচীন পুস্তক কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে অর্থশাস্ত্র লিখিত হয়।
বৈশ্বিক ফল
এশিয়ার দেশগুলোতে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় ফলের যে বৈচিত্র্য রয়েছে তা বিশ্বের আর কোথাও নেই। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রায় ৪০০ রকমের ফল জন্মে। এর মধ্যে বেশির ভাগ ফলই জন্মে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল, ভুটান, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ ও মালদ্বীপে রয়েছে ফল উৎপাদনের জন্য বৈচিত্র্যময় আবহাওয়া। যে কারণে নানা রকম ফলের বৈচিত্র্যও বেশি। প্রায় ৫০ রকম ফলের আদি নিবাস বা জন্মস্থান দক্ষিণ এশিয়া। এর মধ্যে অন্তত ২০টি ফল এসব এলাকার দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে আবাদ করা হয়। এসব ফলকে বলা হয় প্রচলিত ফল। এসব ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়। এ দেশে যত ফল আছে তার সবই চাষ করা হয় না। অনেক ফল আছে বুনো। স্বাদ বৈচিত্র্যে সেসব ফলও অনন্য। সেগুলোও খাওয়া হয়। এ অঞ্চলে যত ফল জন্মে তার প্রায় ৫৫ শতাংশ ফলই চাষ করা হয় না বা গাছ লাগানো হয় না। ওসব ফলের গাছ এমনি এমনি বা আপনা আপনি বনে বাদাড়ে জন্মে, পাখি খায় ও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বীজ ছড়ায়। তাই অনেকেই সেসব ফলের খোঁজ বা পরিচয় জানেন না। এসব ফলকে তাই বলা হয় অপ্রচলিত ফল।
দক্ষিণ এশিয়ায় আবাদকৃত ফলের সিংহভাগই উৎপাদিত হয় বা গাছ লাগানো হয় বসতবাড়িতে ও তার আশপাশে। স্বল্প কিছু প্রধান ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়। আম, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, লেবু, আনারস, ডুরিয়ান, রাম্বুটান ইত্যাদি এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক ফল। তবে এক এক দেশে এক এক ফলকে বেশি চাষ করা হয়। যেমন মালয়েশিয়ায় বেশি হয় ডুরিয়ান, রাম্বুটান, আম ও পেয়ারা; ভারতে বেশি হয় নানা রকমের লেবু ও আম, ইন্দোনেশিয়ায় বেশি হয় কাঁঠাল ও আতা শরিফা, শ্রীলংকায় নারিকেল, আম ও লেবু; নেপালে লেবু ও আম, ভিয়েতনামে আম, লেবু ও লংগান; ফিলিপিনে আম; চীনে লেবু; বাংলাদেশে আম, কাঁঠাল, কলা, লিচু, পেয়ারা ইত্যাদি।
বাংলাদেশের ফল
আমাদের দেশি ফল অর্থাৎ বাংলাদেশের ফল কোনগুলো? এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন বটে। সহজ উত্তর হলো যেসব ফলের উৎপত্তি ও চাষ এ দেশের ভূখ-ে বা এ অঞ্চলে সেসব ফলকে আমরা দেশি ফল বলতে পারি। ফল তো দেশ চেনে না। ফল তার উপযুক্ত জলহাওয়া ও মাটি পেলেই সেখানে জন্মে থাকে। সে অর্থে যেসব ফলের উৎপত্তি আমাদের অঞ্চলে সেসব ফলের সংখ্যা খুবই কম। অধিকাংশ ফলই হাজার হাজার বছর পূর্বে অন্যান্য দেশ থেকে এ দেশে এসে খাপখাইয়ে নিয়েছে এবং কালক্রমে সেগুলো আমাদের ফলে পরিণত হয়েছে। সব বিদেশি ফল আবার এ দেশে ভালো ফল দেয় না। যেসব ফল অনায়াসে এ দেশে জন্মে ও ভালো ফলন দেয় সেসব ফলকে এখন আমরা দেশি ফল হিসেবে বিবেচনা করতে পারি।
আম, কলা, ফলসা, কাঁঠাল, বেল, আমলকী, পাতিলেবু ইত্যাদি ফলকেই বিজ্ঞানীরা এ দেশের ফল বলে মনে করেন। লিচু, গাব, পিচ, আঁশফল, কমলা এসেছে চীন থেকে। পেয়ারা, পেঁপে, আতা, আনারস, সফেদা, ডালিম ইত্যাদি ফলের আদিনিবাস আমেরিকা। কিন্তু এগুলো এ দেশে এত দীর্ঘদিন ধরে জন্মাচ্ছে যে তা এখন আমাদের দেশি ফলে রূপান্তরিত হয়েছে। চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং ভারতবর্ষে এসেছিলেন ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে। তিনি এ দেশে ঘুরে তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে এ দেশে আম, ডালিম, কলা, কুল, আমলকী, কাঁঠাল, গাব, কদবেল, মিষ্টি লেবু তথা কমলা ইত্যাদি ফল দেখেছেন বলে উল্লেখ করেন। তার মানে সুদূর অতীতে কোনো কোনো ফল এ দেশে এলেও সেগুলো এখন আমাদের দেশি ফলে পরিণত হয়েছে। এ ধারা অনন্তকাল ধরে অব্যাহত থাকবে। কেননা, বিগত দশকেই এ দেশে বিদেশ থেকে আসা ও চাষ হওয়া প্রায় ৩০টি ফলকে ইতোমধ্যেই তালিকাভুক্ত করেছি।
ফল বিজ্ঞানীরা ৭০টি ফল বাংলাদেশে আছে বলে জানিয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ১৫টি ফল অবৃক্ষ লতানো প্রকৃতির। তবে এ পর্যন্ত ১৩০টি ফলকে দেশি ফল হিসেবে শনাক্ত ও তার বর্ণনা তৈরি করতে আমি সক্ষম হয়েছি। এর মধ্যে ৬০টি বুনো ফল। বাংলাদেশের প্রধান ফল ১০টি, বর্তমানে বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে এমন গুরুত্বপূর্ণ ফলের সংখ্যা ১৮টি। প্রধান ফলগুলো হলো আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু, কলা, কুল, নারিকেল, লেবু, আনারস, পেঁপে, বাঙ্গি ও তরমুজ। বাকি সব অপ্রচলিত বা অপ্রধান ফল। অপ্রধান ফলের মধ্যে অন্যতম হলো জাম, গোলাপ জাম, জামরুল, তেঁতুল, কদবেল, বেল, সফেদা, কামরাঙা, লুকিলুকি, আঁশফল ইত্যাদি।
এসব দেশি ফলের মধ্যে অনেক ফলের আবার অনেক জাতও এ দেশে রয়েছে। এজন্য প্রথমেই দরকার দ্রুত নানা রকম ফলের ও তাদের জাতসমূহের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা। এক তথ্য সূত্রে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ১০১টি আমের জাত, ৬টি লিচুর জাত, ২১টি বরই ও কুলের জাত, ২৫টি কলার জাত এবং ১টি করে জামরুল ও ডালিমের জাত সংগৃহীত হয়েছে। তবে বেশ কিছু আধুনিক ও উচ্চফলা জাত এর মধ্যে উদ্ভাবিত হয়েছে। এ পর্যন্ত ভারতে সংগৃহীত হয়েছে ১১০৬টি আমের জাত, ১০৭টি পেঁপের জাত, ২৪টি আনারসের জাত, ৩৬৩টি কলার জাত ও ৩টি প্রজাতির ১২৩ জাতের পেয়ারা। আর কত রকমের লেবু যে সে দেশে পাওয়া গেছে! এ পর্যন্ত ভারতে মোট ৪৫১ রকম বা জাতের লেবুর জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করা হয়েছে। হরেক রকমের লেবু আছে আমাদের দেশেও। অন্তত ৫০ রকমের লেবু শুধু সিলেট অঞ্চলেই আছে। লেবুর মতই অন্যান্য ফলের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করতে হলে সেসব ফলের সম্ভাব্য উৎপাদন এলাকা সম্পর্কেও একটা ধারণা থাকা দরকার। যেমনÑ আম ভালো হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ, লেবু হয় সিলেটে, আনারস হয় মধুপুর ও সিলেটে, কাঁঠাল হয় গাজীপুরের শ্রীপুরে, কাউফল হয় বাগেরহাটে, সফেদা হয় সাতক্ষীরা ও খুলনায়, পেয়ারা হয় পিরোজপুরে ইত্যাদি। তবে এ ফলগুলোর অধিকাংশই এখন বিপন্ন। বসতবাড়িতে দু-একটি গাছ রয়েছে, বনে জঙ্গলেও কিছু আছে। অথচ পুষ্টি মানে এমনকি স্বাদ বৈচিত্র্যে এসব ফলের কোনো তুলনা হয় না। কেননা, এক এক ফলের স্বাদ ও পুষ্টিগুণ এবং ভেষজ মূল্য এক এক রকম। অথচ এক রকম অবহেলা করেই আমরা আমাদের এসব ফলকে হারাতে বসেছি। তবে আমাদের সৌভাগ্য যে, এখনো অল্প স্বল্প হলেও এর অনেক ফলই দেশের মাটিতে টিকে আছে।
দেশীয় এসব ফলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এসব ফল এক রকম বিনা যতেœই এ দেশের মাটিতে ভালো ফলে। সাধারণত এসব ফলের গাছে তেমন কোনো সার ও সেচ দেয়া হয় না। এ দেশের মাটি ও জলবায়ুতে খুব ভালোভাবে এসব ফলের গাছ মানিয়ে গেছে। ঝড়বাতাস কিংবা বন্যা খরাও অনেক দেশি ফলের গাছকে সহজে মারতে পারে না। বরেন্দ্র এলাকার শুকনো খটখটে মাটির বুকে যেমন বরই গাছকে ফল ভরা মাথা নিয়ে হাসতে দেখেছি তেমনি কুয়াকাটার পাশে গঙ্গামতির নোনা বালু চরের জঙ্গলেও সমুদ্রের মধ্যে গোটবরইয়ের গাছকে দেখেছি ফলে ভরা। এই যে দেশি ফলের ব্যাপকভাবে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা বা ওয়াইড অ্যাডাপ্টিবিলিটি, তা কিন্তু অনেক বিদেশি ফলেরই নেই। দেশী ফলের আর একটা সুবিধে হলো, বিদেশি ফলের বা উন্নত জাতের ফলগাছের মতো এসব ফল বা ফলগাছে অত বেশি রোগ পোকার আক্রমণ হয় না। তবে দেশী ফলে সবচেয়ে বেশি যেটা মেলে তা হলো পুষ্টি। দেশি ফলের মতো এত বেশি পুষ্টি কখনো বিদেশি ফলে মেলে না। একটা ছোট্ট আমলকীতে যে পরিমাণ ভিটামিন সি আছে তা পাঁচটা বড় কমলাতে পাওয়া যাবে না।
গ্রীষ্মের ফল
বাংলাদেশ আবহাওয়া উষ্ণপ্রধান দেশ। এ দেশে তাপমাত্রা সাধরণত ১০ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকে। বছরব্যাপী কম বেশি বৃষ্টিপাত হয়, গ্রীষ্মের পর থেকে বৃষ্টি শুরু হয় যা, পুরো বর্ষাকালজুড়ে বজায় থাকে। বর্ষার পর বর্তমানে শরতেও প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। এজন্য শরৎ-হেমন্ত ঋতুকে এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এ দেশের মাটি উর্বর। তাই অনেক ধরনের ফল এ দেশে জন্মে। তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত অনুকূলে থাকলে সে বছর বিভিন্ন ঋতুতে প্রচুর ফল উৎপাদন হয়। এ দেশে বেশিরভাগ ফল উৎপাদিত হয় গ্রীষ্ম-বর্ষাকালের চার মাসে। ফাল্গুনে আমসহ অনেক ফলগাছে ফুল আসে, বৈশাখ থেকে বৃষ্টির বারিধারায় মাটি সিক্ত হয়, তাপদাহ শেষে জলের পরশে ফলের পরিপুষ্টি ঘটে। জ্যৈষ্ঠে তাপ বৃদ্ধিতে পুষ্ট ফলের ভেতরে টক অম্ল মধুর রসে পরিণত হয়। ফলের খোসার রঙ বদলে যায় ও ফলে মিষ্টতা আসে। যেসব কারণে গ্রীষ্মঋতুতে জন্মানো প্রায় সব ফলই হয় মিষ্টি, সুঘ্রাণযুক্ত ও সুদর্শন। হয়তো ফল রসিকরা এ জন্য গ্রীষ্ম ঋতু বিশেষ জ্যৈষ্ঠ মাসকে ‘মধুমাস’ নামে অভিহিত করে থাকেন।
গ্রীষ্ম বলা হলেও আসলে এ মৌসুমে উৎপাদিত অনেক ফলের বিস্তৃতি থাকে বর্ষাকাল পর্যন্ত। নাবি জাতের আম বর্ষা ঋতু এমনকি ভাদ্র মাস পর্যন্ত পাওয়া যায়। অথচ আম গ্রীষ্মকালের প্রধান ফল। এ দেশে উৎপাদিত ফলের প্রায় ৬০ শতাংশ উৎপাদন হয় বৈশাখ থেকে শ্রাবণের মধ্যে অর্থাৎ চার মাসে। বাকি ৪০ শতাংশ ফল উৎপাদিত হয় বাকি আট মাসে। এজন্য গ্রীষ্ম মৌসুমকে বলা হয় ফলের মাস। গ্রীষ্মকালে এ দেশে পেয়ারা, পেঁপে, কলা, নারিকেল, সফেদা, তালশাঁস, লেবু, আম, কামরাঙা, ড্রাগন ফল, ডেউয়া, জাম, কাঁঠাল, তৈকর, প্যাশন ফল, কাজুবাদাম, গোলাপজাম, বাঙ্গি, চুকুর, লিচু, আঁশফল, তরমুজ, ফলসা, করমচা, গাব, হামজাম, বৈঁচি, লুকলুকি, জামরুল, গাব, বেতফল, মুড়মুড়ি, খেজুর, ননিফল, আতা, শরিফা ইত্যাদি ফল পাওয়া যায়। ফলের মাসে এ পল্লীবাংলার ঘরে ঘরে বসে নানা রকম ফলাহারের আয়োজন। জ্যৈষ্ঠ মাসে হয় জামাই ষষ্ঠী অনুষ্ঠান যে অনুষ্ঠানের প্রধান উপকরণ নানা রকমের প্রচুর ফল। গ্রামের হিন্দু রমণীরা বৈশাখ মাস জুড়ে নানা রকম ব্রত পালন করেন। এসব ব্রতের অন্যতম অনুষঙ্গ নানা রকম ফল।
বাড়িতে বাড়িতে এ ঋতুতে তৈরি করা হয় ফল থেকে নানারকম খাদ্য সামগ্রী। চাঁপাইনবাবগঞ্জে পাকা আমের গোলা দিয়ে যবের ছাতু খাওয়া, গাজীপুরে পাকা কাঁঠালের গোলা দিয়ে চিতোই পিঠা খাওয়া, আমসত্ব বানানো, আমের পলশি শুকানো ইত্যাদি এ দেশের অন্য এক ফল সংস্কৃতির স্বাক্ষর বহন করে।
শেষ কথা
অনেক ফলই এখন বন উজাড়ের ফলে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে দেশে বাঙ্গি, তরমুজ, কলা, পেয়ারা, কুল, আম, আনারস ছাড়া আর কোনো ফলের দেখা হয়তো সহজে মিলবে না। যেমন এখন ইচ্ছে করলেও পাকা বেত ফলের নস্যি রঙের রসালো শাঁসের ফলগুলোকে লবণ মরিচের গুঁড়া দিয়ে ঝেঁকে খেতে পারি না, যেমন খুঁজে পাই না ঢাউস আকারের রসালো শাঁসের ভুতিজাম আর পুঁতি দানার মতো বুটিজামকে, তেমনি হয়তো কদিন পরেই পাব না লুকলুকি, মাখনা, কাউয়াডুলি, পানিজাম, পানকি চুনকি, আইকা গোটা, হামজাম ও ডেউয়াকে। এক আমলকীর মধ্যে লুকিয়ে আছে পাঁচ কমলার ভিটামিন সি, অথচ সেই আমলকীকে হেলা করে কোলে তুলে নিচ্ছি কমলা সুন্দরীকে। আফসোস, বড়ই আফসোস হয়- দেশের মাটিতে দেশের মানুষের কাছেই দেশি ফলেরা উপেক্ষিত। কেউ হাসপাতালে রোগী দেখতে গেলে তাই জাম্বুরা নেন না, সঙ্গে নেন কমলা আপেল। দেশেই যাদের পুষ্টির এত রতœভা-ার সে দেশের মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগবে এটা মেনে নিতে কষ্ট হয়। তবে আশার কথা, দেশে এখন আম, পেয়ারা আর কুল চাষে এক নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। ২০১৪-১৫ সালে এ দেশে প্রায় ১ কোটি টন ফল উৎপাদিত হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সূত্র মতে, ২০১৩ সালের বৈশ্বিক পরিসংখ্যানে বিশ্বে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। বিশ্বে বাংলাদেশ আম উৎপাদনে সপ্তম ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে উঠে এসেছে। বিশ্বে ফল উৎপাদনে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ইতালি, স্পেন, মেক্সিকো, ইরান, ফিলিপাইন, ফ্রান্স শীর্ষ ফল উৎপাদনকারী দশটি দেশ। বিশ্বে মোট ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ২৮তম। এটাও তো কম সুখের কথা নয়।
মৃত্যুঞ্জয় রায়*
*উপ প্রকল্প পরিচালক, আইএফএমসি প্রকল্প, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা
টমেটো একটি সুস্বাদু, স্বাস্থ্যকর এবং উচ্চ পুষ্টি মানের সবজি। এটি লাইকোপেন, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, আয়রন ও পটাসিয়াম সমৃদ্ধ। উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বে টমেটো ২য় সর্বোচ্চ উৎপাদনকারী সবজি। ২০১২ সনে বিশ্বে ১৬১.৪ মিলিয়ন টন টমেটো উৎপন্ন হয় এবং উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে ১ম চীন, ২য় ভারত, ৩য় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে ২৬৩১৬ হেক্টর জমিতে ২,৫০,৯৪৭ মেট্রিক টন টমেটো উৎপাদিত হয় এবং দিন দিন উৎপাদন বাড়ছে (বিবিএস ২০১৩)। উৎপাদন বাড়লেও বাংলাদেশে এ সবজির সংগ্রহোত্তর ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩২.৯% (হাসান, ২০১০)। অধিক ঠা-ায় সংরক্ষণ করলে টমেটোর টাটকাভাব ও বুনটের মান নষ্ট হয়ে যায়। যেহেতু বাংলাদেশে শীত মৌসুমে অধিক টমেটো উৎপাদিত হয় এবং এ উৎপাদনের ফলে সরবরাহ বেড়ে চাহিদা কমে যায়, ফলে প্রচুর টমেটো নষ্ট হয়। এর পরিণামে উৎপাদনকারী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টমেটো একটি পচনশীল সবজি এবং সংরক্ষণকাল কম থাকায় মৌসুমের দিকে টমেটোর দাম বেড়ে যায়। তাই টমেটো প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এর সংরক্ষণ কাল এবং সারা বছর সরবরাহ বাড়ানো যায়। টমেটো প্রক্রিয়াজাত করে কেচাপ, সস, পুরী, পেস্ট ও জুস তৈরি করা যায়। আমেরিকাতে প্রায় বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত টমেটোর ৮০-৯০% টমেটো প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সংরক্ষণ করে সারা বছর সরবরাহ সহজলভ্য করা হয়। প্রক্রিয়াজাতকরণ শুধু সংরক্ষণকালই বাড়ায় না বরং মূল্য সংযোজন ও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে।
টমেটো জুস টমেটো থেকে উৎপাদিত দেহ সতেজকারী পুষ্টিকর কোমল পানীয়। বিভিন্ন দেশে বিমানযাত্রীদের জন্য এটি একটি জনপ্রিয় পানীয়। জার্মান বিমানযাত্রীদের মাঝে ২০০৮ সনে ১৭ লাখ লিটারের বেশি টমেটো জুস সরবরাহ করা হয়। টমেটো থেকে টমেটো জুস তৈরির মাধ্যমে একদিকে যেমন সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমানো যায় অন্যদিকে চাহিদা ও মূল্যের ভারসাম্য রক্ষা করে সারা বছর পুষ্টিকর এ জুসের সরবরাহ বাড়ানো যায়। তাছাড়া উৎপাদনকারী উৎপাদিতপণ্যের সঠিক মূল্য পায়। উন্নত বিশ্বে টমেটো জুসের ব্যাপক ব্যবহার থাকলেও বাংলাদেশে এর ব্যবহার নেই বললেই চলে। অথচ এ জুস তৈরির পদ্ধতি অত্যন্ত সহজ এবং বাসাবাড়িতে অতি সহজে তৈরি করা যায়। টমেটো জুস উৎপাদনের মাধ্যমে টমেটোর অপচয়রোধ করে সঠিক ববহার নিশ্চিত হবে এবং সারা বছর সরবরাহসহ উৎপাদনকারীদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হবে। তাছাড়া নিজ বাসাবাড়িতে অতি সহজে টমেটো জুস তৈরি এবং ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে।
জুস প্রস্তুত প্রণালি :
সম্পূর্ণ পাকা এবং লাল রঙ বিশিষ্ট টমেটো নির্বাচন, সহজ ও অসম পাকা টমেটো বাদ দিতে হবে।
টমেটো উত্তমরূপে ধুয়ে ধুলাবালু পরিষ্কার এবং ছোট ছোট করে কাটতে হবে।
নরম করার জন্য ৭০-৯০০ সে. তাপে ৫ মিনিট তাপ দেয়া ও কাঠের দণ্ড দিয়ে পাল্পিং করে লোহার চালুনি দিয়ে ছাল ও বীজ জুস থেকে আলাদা করতে হবে।
জুসের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে ০.৫% লবণ, ২% চিনি, ০.৪% সাইট্রিক এসিড যোগ করা
বা
১ লিটার জুসে ১০ গ্রাম চিনি, ৫ গ্রাম লবণ ও ১ গ্রাম সাইট্রিক এসিড যোগ করা (সাইট্রিক এসিডের পরিবর্তে লেবুর রস দেয়া যেতে পারে)।
উপাদানসমূহ উত্তমরূপে মিশানো এবং কয়েক মিনিট ৫৫০ তাপে তাপ দেয়া।
অধিক সময় সংরক্ষণের জন্য ১ গ্রাম/ লিটার এ সোডিয়াম বেনজোয়েট যোগ করা। প্রথমে এক চামচ জুস চামচ দিয়ে উঠিয়ে তাতে সোডিয়াম বেনজোয়েট মিশিয়ে পরে তা সম্পূর্ণ অংশে মিশিয়ে দিতে হবে, যেন সমভাবে মিশ্রিত হয়। (টিএসএস ৫% হতে হবে)
উত্তপ্তাবস্থায় জীবাণুমুক্ত বোতল ভর্তিকরণ বা প্যাকেজিং করা
গরম পানিতে বোতলকে জীবাণুমুক্তকরণ (৩০ মিনিট)
ঠা-করণ ও লেবেলিংকরণ
গুদামে সংরক্ষণ
পুষ্টিমান
১. টমেটো জুস বিটা ক্যারোটিন (১০৯৪ আইইউ/কাপ) ও খনিজসমৃদ্ধ পানীয়। এতে উচ্চমাত্রার পটাসিয়াম (৫৫৮ মি. গ্রাম/কাপ) থাকে। যা উচ্চরক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। বিটা ক্যারোটিন চোখের দৃষ্টি বাড়াতে সহায়তা করে।
২. টমেটো জুস উচ্চমাত্রার লাইকোপেনসমৃদ্ধ। লাইকোপেন তাপে স্থায়ী ও সহজলভ্যতা বাড়ে। তাই প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় তাপের ফলে লাইকোপেনের পরিমাণ ২-৩ গুণ বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা যায়, টাটকা ১ কাপ টমেটোতে ৫ মি. গ্রাম লাইকোপেন থাকে অথচ ১ কাপ প্রক্রিয়াজাত টমেটো জুসে ২১ মিলি. গ্রাম লাইকোপেন থাকে। এ লাইকোপেন একটি পিগমেন্ট এবং শক্তিশালী এন্টি অক্সিডেন্ট। লাইকোপেন দেহকে ক্যান্সার ও হৃদরোগ হতে রক্ষা করে। উচ্চমাত্রা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হওয়ায় দেহে উৎপাদিত ফ্রি র্যাডিক্যাল নষ্ট করে এবং দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে ফ্রি র্যাডিক্যালের ক্ষতি হতে রক্ষা করে।
৩. ব্রিটিশ নিউট্রিশন জার্নাল মোতাবেক প্রতিদিন ১০০ মিলি টমেটো জুস পান করলে ৫-৯% কোলস্টেরল কমে এবং রক্তের জমাট বাধার প্রবণতা কমায়।
৪. এ ছাড়াও টমেটো জুসে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ভিটামিন বি, ভিটামিন সি, ফলিক এসিড বিদ্যমান, যা সহজেই শরীর কর্তৃক গৃহীত হয়ে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজ সম্পাদন করে এবং দ্রুত দেহের ক্লান্তি, ট্রেস ও দুর্বলতা দূর করে।
৫. বোতল বা টিন জাতীয় পাত্রে সংরক্ষণ করে দীর্ঘ সময় পান করা যায় এবং শক্তি ও রুচিবর্ধক পানীয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
মো. সাইফুল ইসলাম*
*উপজেলা কৃষি অফিসার (এলআর), খামারবাড়ি, ঢাকা ও পিএইচডি ফেলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সালনা, গাজীপুর
আদা বাংলাদেশের মানুষের কাছে খুব প্রয়োজনীয় মসলা ফসল হিসেবে পরিচিত। উত্তরবঙ্গে এ মসলা ফসলটির চাষের বিস্তৃতি সবচেয়ে বেশি। অল্প ছায়াযুক্ত জায়গায় আদা ভালো হয়। পরিমাণে কম লাগলেও এটি ছাড়া তরিতরকারি ইত্যাদি কল্পনা করা যায় না। এতে অনেক ঔষধিগুণ বিদ্যমান। কিন্তু রোগবালাই আদা উৎপাদনের একটি প্রধান অন্তরায়। আদার রাইজোম রট, পাতা ঝলসানো, পাতায় দাগ, ব্যাক্টিরিয়াজনিত কন্দ পচা ও ঢলে পড়া ইত্যাদি রোগ দেখা যায়। তবে রাইজোম রট আদার বেশি ক্ষতি করে। এ রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে ফলন অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। তাই আদার কয়েকটি মারাত্মক রোগের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১. রোগের নাম : কন্দ পচা
রোগের কারণ : পিথিয়াম এফানিডারমেটাম নামক ছত্রাক এবং ব্যাক্টিরিয়া ও রাইজোম ফ্লাইও আদা পচার সাথে জড়িত।
রোগের বিস্তার : আক্রান্ত রাইজোম, মাটি, পানি ও ব্যবহৃত কৃষি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে রোগের বিস্তার ঘটে।
রোগের লক্ষণ
১. গাছের গোড়ায় কন্দতে প্রথমে পানি ভেজা দাগ দেখা যায়।
২. পরে ওই স্থানে পরম পচন দেখা যায়।
৩. ক্রমান্বয়ে কন্দের বেশি বেশি অংশ পচে যায়।
৪. আক্রান্ত গাছের শিকড়ও পচতে শুরু করে এবং গাছ টান দিলে সহজেই উঠে আসে।
৫. আক্রান্ত কন্দ থেকে এক ধরনের গন্ধ বের হয়। এ গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে রাইজোম ফ্লাই নামক পোকা আদায় আক্রমণ করে।
৬. গাছের ওপরের অংশে পাতা হলুদ হয়ে যায়। পাতায় কোনো দাগ থাকে না।
৭. পরে গাছ ঢলে পড়ে ও শুকিয়ে মারা যায়।
৮. রাইজোম পচে যাওয়ার ফলে ফলন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
রোগের প্রতিকার
১. আক্রান্ত গাছ মাটিসহ উঠিয়ে গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে।
২. আক্রান্ত গাছ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
৩. রোগবিহীন কন্দ সংগ্রহ করে বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
৪. আক্রান্ত জমিতে শস্য পর্যায় অনুসরণ করতে হবে।
৫. মাঠে যথাযথ পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৬. স্টেবল বিচিং পাউডার প্রতি হেক্টরে ২০ কেজি হারে শেষ চাষের সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
৭. রিডোমিল গোল্ড বা ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ওই দ্রবণের মধ্যে বীজ আদা আধা ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে শোধন করে উঠিয়ে ছায়ায় শুকিয়ে নিয়ে জমিতে রোপণ করতে হবে।
৮. অর্ধকাঁচা মুরগির বিষ্ঠা (৩-৫ টন/হে.) আদা বপনের ২১ দিন আগে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
৯. রোগ দেখা দেয়া মাত্রই রিডোমিল গোল্ড প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে (০.২%) অথবা সিক্যুয়র প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর গাছের গোড়ার মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
২. রোগের নাম : আদা হলুদ হওয়া
রোগের কারণ : ফিউজারিয়াম অক্সিমপরাসম এফএসপি. জিনজিবেরি এবং ফিউজারিয়াম সোলানি নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : আক্রান্ত রাইজোম, মাটি, পানি ও ব্যবহৃত কৃষি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে রোগের বিস্তার ঘটে।
রোগের লক্ষণ
১. আদার নিচের পাতার কিনারায় হলুদাভ হয়ে সম্পূর্ণ পাতায় ছড়িয়ে পড়ে।
২. আক্রান্ত গাছ উইল্ট হয়ে শুকিয়ে যায় কিন্তু গাছ হেলে পড়ে না।
৩. আদার কন্দে ভাস্কুলার সিস্টেমে ক্রিমি ডিসক্লারেশন দেখা যায় এবং কন্দ পচতে থাকে।
রোগের প্রতিকার
১. আক্রান্ত গাছ রাইজোমসহ সম্পূর্ণরূপে তুলে ধ্বংস করতে হবে
২. বীজ আদার জন্য শুধু সুস্থ ও নিরোগ গাছ নির্বাচন।
৩. আক্রান্ত জমিতে আদা চাষ না করে অন্য ফসলের চাষ করা।
৪. জমি স্যাঁতসেঁতে ভাব রাখা যাবে না।
৫. প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে ওই দ্রবণের মধ্যে বীজ আদা আধা ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে শোধন করে উঠিয়ে ছায়ায় শুকিয়ে নিয়ে জমিতে রোপণ করতে হবে।
৬. আদা লাগানোর ঠিক আগে মুহূর্তে জমিতে স্টেবল ব্লিচিং পাউডার হেক্টরপ্রতি ২০ কেজি ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
৭. রোগ দেখা দেয়া মাত্রই ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর গাছের গোড়ার মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
৩. রোগের নাম : পাতা ঝলসানো
রোগের কারণ : কোলেটোট্রিকাম জিঞ্জিবারিস নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : আক্রান্ত পাতা, বায়ু ইত্যদি।
রোগের লক্ষণ
১. প্রথমে পাতার ওপর ছোট, গোল, হালকা হলুদ বর্ণের দাগ পড়ে।
২. পরবর্তীতে অনেকগুলো দাগ একত্রিত হয়ে পাতার সব অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং পাতা ঝলসে যায়।
৩. ঝলসানো পাতার ওপর বিন্দু বিন্দু কালো দাগ দেখা যায় যেগুলো ছত্রাকের অ্যাসারভুলাস।
৪. ডগা আক্রান্ত হয়ে পাতার মাঝখানটা ভেঙে ঝুলে পড়তে দেখা যায়।
৫. ফলে গাছের ও রাইজোমের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পাতা শুকিয়ে মারা যায়।
রোগের প্রতিকার
১. জমির ময়লা আবর্জনা পুড়ে ফেলতে হবে।
২. রোগ প্রতিরোধী জাত নির্বাচন করতে হবে।
৩. রোগমুক্ত জমি থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
৪. শস্য পর্যায় অনুসরণ করতে হবে।
৫. আদার কন্দ সংরক্ষণের আগে প্রতি লিটার পানির সঙ্গে ১ গ্রাম ব্যভিস্টিন মিশিয়ে ৬০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে এবং ৪৮ ঘণ্টা পর সংরক্ষণ করতে হবে। আদার কন্দ লাগানের আগে ও একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
৬. রোগের আক্রমণ দেখা দিলে টিল্ট ২৫০ ইসি ০.৫ মিলি হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতার উভয় পৃষ্ঠায় স্প্রে করতে হবে।
উপরোক্ত রোগ ছাড়াও আদায়
৪. ব্যাক্টিরিয়াজনিত কন্দ পচা-আরউইনিয়া ক্যারোটোভোরা (Erwinia carotovora) দ্বারা,
৫. পাতায় দাগ-ফাইলোস্টিক্টা জিঞ্জিবারি (Phyllosticta zingiberi) দ্বারা এবং
৬. ঢলে পড়া-রালস্টোনিয়া সোলানেসিয়ারাম (Ralstonia solanacearum) দ্বারা হয়ে থাকে।
ড. কে এম খালেকুজ্জামান*
* ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব), মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, শিবগঞ্জ, বগুড়া। মোবাইল : ০১৯১১-৭৬২৯৭৮, ইমেইল :zaman.path@gmail.com
টমেটো জুস তৈরি পুষ্টিমান ও ব্যবহার
(১৮ পৃষ্ঠার পর)
পুষ্টিমান
১. টমেটো জুস বিটা ক্যারোটিন (১০৯৪ আইইউ/কাপ) ও খনিজসমৃদ্ধ পানীয়। এতে উচ্চমাত্রার পটাসিয়াম (৫৫৮ মি. গ্রাম/কাপ) থাকে। যা উচ্চরক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। বিটা ক্যারোটিন চোখের দৃষ্টি বাড়াতে সহায়তা করে।
২. টমেটো জুস উচ্চমাত্রার লাইকোপেনসমৃদ্ধ। লাইকোপেন তাপে স্থায়ী ও সহজলভ্যতা বাড়ে। তাই প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় তাপের ফলে লাইকোপেনের পরিমাণ ২-৩ গুণ বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা যায়, টাটকা ১ কাপ টমেটোতে ৫ মি. গ্রাম লাইকোপেন থাকে অথচ ১ কাপ প্রক্রিয়াজাত টমেটো জুসে ২১ মিলি. গ্রাম লাইকোপেন থাকে। এ লাইকোপেন একটি পিগমেন্ট এবং শক্তিশালী এন্টি অক্সিডেন্ট। লাইকোপেন দেহকে ক্যান্সার ও হৃদরোগ হতে রক্ষা করে। উচ্চমাত্রা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হওয়ায় দেহে উৎপাদিত ফ্রি র্যাডিক্যাল নষ্ট করে এবং দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে ফ্রি র্যাডিক্যালের ক্ষতি হতে রক্ষা করে।
৩. ব্রিটিশ নিউট্রিশন জার্নাল মোতাবেক প্রতিদিন ১০০ মিলি টমেটো জুস পান করলে ৫-৯% কোলস্টেরল কমে এবং রক্তের জমাট বাধার প্রবণতা কমায়।
৪. এ ছাড়াও টমেটো জুসে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ভিটামিন বি, ভিটামিন সি, ফলিক এসিড বিদ্যমান, যা সহজেই শরীর কর্তৃক গৃহীত হয়ে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজ সম্পাদন করে এবং দ্রুত দেহের ক্লান্তি, ট্রেস ও দুর্বলতা দূর করে।
৫. বোতল বা টিন জাতীয় পাত্রে সংরক্ষণ করে দীর্ঘ সময় পান করা যায় এবং শক্তি ও রুচিবর্ধক পানীয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। য়
উন্নত জাতের গাভী এবং উচ্চ দুধ উৎপাদনে সক্ষম গাভী প্রসব করবে অথবা করেছে এমন অবস্থায় খামারিরা প্রায়ই অভিযোগ করেন তার গাভী প্রসব করার পরে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারছে না। মনে হচ্ছে যেন মারা গেছে, হাত-পা ছেড়ে দিয়েছে। তখন দ্রুত অভিজ্ঞ ভেটেরিনারিয়ানের কাছে যেতে হয়। পরে চিকিৎসায় গাভী সুস্থ হয়ে ওঠে। এই রোগের নাম মিল্ক ফিভার বা দুগ্ধজ্বর । এটি এখন একটি রোগ যার নামেই ফিভার (জ্বর) উল্লেখ আছে, কিন্তু আসলে এ রোগে কোনো জ্বর দেখা যায় না।
বাংলাদেশের আবহাওয়ায় এ রোগ খুবই পরিচিত। বিশেষত যারা উন্নত জাতের এবং ভালো মানের সংকর জাতের গাভী লালন পালন করেন। প্রতিবার প্রসবের সময় বা আগে পরে না হলেও প্রায় ক্ষেত্রে এ সমস্যা দেখা যায়। যার কারণে কিছু মানুষ গাভী পালনে ভয় পায়। এ রোগ একটি মেটাবোলিক রোগ, যা সাধারণত ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত কারণেই হয়ে থাকে।
এটি পুষ্টি উপাদান ঘাটতিজনিত রোগ। সঠিকভাবে শরীরের কার্য সম্পাদন করতে যে পরিমাণ ক্যালসিয়াম প্রয়োজন তার অভাব হলে এ রোগ হয়।
প্রসবের সময় ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হয় অনেক বেশি পরিমাণে। যার কারণে গাভী হঠাৎ পড়ে যায় এবং ঘাড়ের ওপর মাথা দিয়ে বসে থাকে।
রোগের কারণ
ক. রক্তে ক্যালসিয়াম কমে গেলে এই রোগ হতে পারে। সাধারণত ১০০ সি সি রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ থাকতে হয় ৯ মিলিগ্রামেরও বেশি। কোনো কোনো বিশেষ কারণে এই মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যেতে পারে, এমনকি তা ৩-৪ মিলিগ্রামে নেমে আসে। আর তখনই এই রোগের সৃষ্টি হয়।
খ. প্রসবের সময় জরায়ুতে যদি ফুল আটকে থাকে বা কোনো কারণে যদি জরায়ু বাইরের দিকে চলে আসে, কিংবা জরায়ুর কোনো স্থানে যদি বাচ্চা আটকে থাকে, তাহলেও এ মিল্ক ফিভার হতে পারে।
গ. কিছু হরমোনের বৈরী কার্যক্রমের কারণেও হতে পারে। যেমন এড্রেনালিন গ্রন্থির রস নিঃসরণের তারতম্যের কারণেও এ রোগ হতে পারে।
ঘ. গাভীর দেহে বিভিন্ন খনিজের ঘাটতির ফলে স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার জন্যও এ রোগ হতে পারে।
ঙ. প্রসবের পর পালান একবারে খালি করে দুধ দোহন করা হলেও এ রোগ হতে পারে।
গাভী গর্ভকালীন নিজের রক্ত থেকে ক্যালসিয়াম বাচ্চার (ফিটাসের) দেহে পাঠায়। প্রায় প্রতি ঘণ্টায় ০২৫ বা প্রতিদিন ১০ গ্রাম এবং প্রসবের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতি ঘণ্টায় ১ গ্রাম বা সারা দিনে সর্বোচ্চ ৩০ গ্রাম ক্যালসিয়াম প্রসবকালীন দুধে বের হয়। এই কারণেই গর্ভকালীন এবং প্রসবোত্তর উপযুক্ত পরিমাণে ক্যালসিয়ামের সরবরাহ না থাকলেই এ রোগ বেশি হয়।
আরও কিছু কারণে এই ক্যালসিয়াম হ্রাস পায় যথা-
প্রথমত : গাভীর পাকান্ত্র থেকে শোষিত ও অস্থি থেকে বের হয়ে আসা ক্যালসিয়ামের পরিমাণ ফিটাস ও কলোস্ট্রামের চাহিদার পরিমাণ অপেক্ষা অধিক কম হলে এ রোগ হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় এবং কলস্ট্রাম পিরিয়ডে পাকান্ত্রে সুষ্ঠুভাবে ক্যালসিয়াম শোষিত না হলে। আর যেসব কারণে সুষ্ঠুভাবে ক্যালসিয়াম শোষিত হয় না তাহলো-
খাদ্যে ক্যালসিয়ামের অভাব
ক্ষুদ্রান্তে অদ্রবণীয় ক্যালসিয়াম অক্সালেটের সৃষ্টি
অন্ত্র প্রদাহ
ক্যালসিয়াম ফসফরাসের অনুপাতের তারতম্য
ভিটামিন ডি-এর অভাব ইত্যাদি।
এপিডেমিওলজি
প্রি-ডিসপোজিং ফ্যাক্টরস (pre disposing factors))
বয়স : সাধারণত বয়স্ক গাভীতে বেশি দেখা যায়। ৪-৫ বার প্রসবের পর এর প্রাদুর্ভাব বাড়ে। কারণ বৃদ্ধ বয়সে একদিকে অস্থি থেকে ক্যালসিয়াম মবিলাইজেশন হ্রাস, অন্য দিনে পাকান্ত্রে ক্যালসিয়াম শোষণ হ্রাস পায়। উচ্চ ফসফরাস যুক্ত খাদ্য ভিটামিন ডি কে তার মেটাবলাইটে বাধা প্রদান করে ফলে রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ হ্রাস পায়।
জাত : জার্সি জাতের গাভী এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। আকারে ছোট কিন্তু বেশি দুধ দেয় বলেই এ সমস্যা হতে পারে।
পুষ্টি : একটানা ৪৮ ঘণ্টা অনাহারে বা নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করলে ক্যালসিয়ামের অভাব হতে পারে।
সময়কাল : ঘাস খাওয়ানোর চেয়ে ঘরে বেঁধে খাওয়ালে এ সমস্যা বেশি হতে পারে।
হরমোন : প্রসব ও ইস্ট্রাস পিরিয়ডে ইস্ট্রোজেন হরমোন বৃদ্ধি পায়। যার ফলে ক্যালসিয়াম মেটাবলিজমে বাধা পায়।
প্রাদুর্ভাব ও সংবেদনশীলতা (Occurance & susceotibility)
বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশেই অধিক দুধ উৎপাদনকারী গাভী এবং অনেক সময় ছাগী, ভেড়ী ও মহিষেরও এ রোগ হয়।
দুগ্ধজ্বর বিক্ষিপ্ত প্রকৃতির রোগ তবে খামারভুক্ত গাভীর এ সমস্যা ২৫-৩০ ভাগ হওয়ার ইতিহাস রয়েছে।
প্রাদুর্ভাবের পর্যায় : সাধারণত তিন পর্যায়ে রোগটির লক্ষণ প্রকাশ পায় : ১. গর্ভাবস্থার শেষ কয়েক দিন, ২. প্রসবকালীন ও ৩. প্রসবোত্তর (৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত)।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব : এ রোগের ফলে গাভীর সাময়িক দুধ উৎপাদন হ্রাস পায়। ফলে খামারি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দ্রুত চিকিৎসা নিলে ভালো হয়ে যায়, তবে যদি বেশি দেরি করা হয় তাহলে যে কোনো সমস্যা হতে পারে।
এ রোগে মৃত্যুর হার কম।
রোগের লক্ষণ : এ রোগের নামে জ্বর থাকলেও আসলে জ্বর হয় না। তবে নিম্নোক্ত সমস্যা পরিলক্ষিত হয়।
গাভীর তাপমাত্রা হ্রাস পায় অনেক সময় স্বাভাবিক থাকে।
দুগ্ধজ্বরে আক্রান্ত গাভীর উপসর্গগুলোকে তিনভাবে ভাগ করা যায়-
প্রথম পর্যায়
মৃদু উত্তেজনা ও অনৈচ্ছিক পেশি খিঁচুনি।
স্নায়ুবিক দুর্বলতা, অতিসংবেদনশীলতা, ক্ষুধামন্দা ও দুর্বলতা।
হাঁটতে ও খাদ্য গ্রহণে অনিচ্ছা, পরবর্তীতে পিছনের পাদ্বয় শক্ত হয় এবং টলমল করে হাঁটে।
হৃদগতি বৃদ্ধি পায় এবং দেহের তাপমাত্রা সামান্য কিছু বৃদ্ধি পায়।
এসব উপসর্গ সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য থাকে এবং অলক্ষিতভাবে চলে যায়।
এ পর্যায়ে রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নেমে আসে
দ্বিতীয় পর্যায়
গাভী মাটিতে শুয়ে পড়ে এবং আর উঠে দাঁড়াতে পারে না।
গাভী শুয়ে মাথা ও ঘাড় বাঁকিয়ে ফ্লাঙ্কের ওপর রাখে।
আংশিক পক্ষাঘাত ও অবসাদ প্রকাশ পায় এবং রক্তে ক্যালসিয়াম অধিক মাত্রায় হ্রাস পায়।
সূক্ষ্ম পেশি কম্পন এবং গভীর ও দ্রুত হৃদগতি থাকে।
গাভীর দেহের প্রান্ত বিশেষ করে কান ও নাক ঠা-া থাকে এবং দেহের তাপমাত্রা ৯৬-১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট থাকে।
তৃতীয় পর্যায়
প্রাণী অবসাদগ্রস্ত থাকে, দেহের এক পাশে মাথা গুঁজে শুয়ে থাকে। এ বিশেষ ভঙ্গি দুগ্ধজ্বরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
পেট ফেঁপে যায়।
চিকিৎসাবিহীন গাভীর মৃত্যু ঘটে।
রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ সর্বনিম্নে নেমে যায় (১ সম/ফষ) ।
প্রসব পূর্ব ও প্রসবকালীন
প্রসবের পূর্বে দুগ্ধজ্বর হলে প্রসব আরম্ভ হয়ে বন্ধ হয়ে যায়।
প্রসবের জন্য কোনো কোথ দেয় না।
জরায়ুর নিষ্ক্রিয়তার ফলে প্রসবে বিঘ্ন ঘটে।
প্রসব হলে হাইপোক্যালসেমিয়ায় জরায়ুর নির্গমন ঘটে।
রোগ নির্ণয় : সাধারণত নিম্নোক্ত বিষয়ের ওপর নির্ভর করে রোগ নির্ণয় করতে হয়।
ক. রোগের ইতিহাস নিয়ে এবং এর ওপর ভিত্তি করে-
গর্ভাবস্থায় ও প্রসবের ইতিহাস, প্রাপ্ত বয়স্ক গাভী বিশেষ করে ৫-৯ বছর বয়সে এ রোগ বেশি হয়।
সাধারণত প্রসবের ১৫ মিনিট পরে গাভী, ৩০ মিনিট পরে বকনা এবং প্রসববিঘ্ন যুক্ত গাভী ৪০ মিনিট পর দাঁড়ায়। এ সময়ের মধ্যে বাচ্চা প্রসবের পর না দাঁড়ালে মিল্ক ফিভার রোগ সন্দেহ এবং পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
রোগের লক্ষণের সাথে প্রকাশিত উপসর্গ মিলিয়ে রোগ নির্ণয় করা হয়।
রক্তের ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ম্যাগনেসিয়াম নির্ণয় করেও এ রোগ নির্ণয় করা হয়।
চিকিৎসা
রোগের লক্ষণ প্রকাশের সাথে সাথে অভিজ্ঞ ভেটেরিনারিয়ানের পরামর্শ নিন। তাহলে দ্রুতই এ রোগের সমাধান করা যাবে। যেমন চিকিৎসা দেয়া হয়-
১. যত দ্রুত সম্ভব ক্যালসিয়াম বোরো গ্লুকোনেট সলুশন ইনজেকশন দিতে হবে। ৪৫০ কেজি দৈহিক ওজনের গাভীকে ৫০০ মিলি ক্যালসিয়াম বোরো গ্লুকোনেট যার মধ্যে প্রায় ১০৮ গ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে, অর্ধেক মাত্রা ত্বকের নিচে এবং বাকি অর্ধেক শিরায় ৫-১০ মিনিট ধরে দেয়া হয়।
২. সঠিকভাবে সঠিক মাত্রায় ক্যালসিয়াম রক্তে গেলেই গাভী দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে।
৩. যদি মাত্রা অপর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম সলুশন দিয়ে চিকিৎসা করলে গাভী সুস্থও হয় না এবং দাঁড়াতেও পারে না। অথবা সাময়িকভাবে পশু সুস্থ হলেও পুনরায় একই সমস্যার সম্মুখীন হয়। অপরদিকে ক্যালসিয়াম সল্যুশন অতিরিক্ত মাত্রায় এবং দ্রুত শিরায় দিলে প্রাণীর মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে।
বর্তমানে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং ম্যাগনেসিয়াম গ্লুকোজ সমন্বয়ে সলুশন বাজারে পাওয়া যায়। দুগ্ধজ্বরে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের মাত্রা হ্রাস পায় কিন্তু ম্যাগনেসিয়াম মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তাই দুগ্ধজ্বরের চিকিৎসার ওষুধ নির্বাচনের জন্য সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ
প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। দুইভাবে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়-
১. খাদ্য সংশোধন ((Feed correction))
২. প্রি ডিস্পোজিং ফ্যাক্টরস সংশোধন (Predisposing factors correction)
প্রথমত : খাদ্য সংশোধন, হতে পারে এমন-
গাভীকে শুষ্ক অবস্থায় ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য সরবরাহ করা।
তবে শুধু ক্যালসিয়াম দেয়া যাবে না কারণ
দেহকে সম্পূর্ণ পাকান্ত্রের ক্যালসিয়াম শোষণের ওপর নির্ভরশীল করে তোলে। এতে অস্থির ক্যালসিয়াম মবিলাইজেশন প্রায় নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে।
০ খাদ্যে পরিমাণ মতো ফসফরাস সরবরাহ।
০ গাভীর কনসেন্ট্রেট খাদ্যে শতকরা ১৫ ভাগ মনো সোডিয়াম ফসফেট মিশিয়ে খাওয়ালে এ রোগ প্রতিহত হয়।
দ্বিতীয়ত : প্রি ডিস্পোজিং ফ্যাক্টরস সংশোধন-
বয়স : বয়স্ক গাভীর প্রর্যাপ্ত পরিচর্যা নিতে হবে।
জাত : জার্সি জাতের এই রোগ প্রতিরোধের জন্য বিশেষ যত্ন ও ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।
গাভীর শুষ্ক ও প্রসবকালীন এবং প্রসবোত্তর সুষম পুষ্টির ব্যবস্থা করা।
একটু সচেতন হয়ে আমরা গাভীর ব্যবস্থাপনা করলেই এ রোগ হতে সহজেই আমাদের প্রাণীকে রক্ষা করতে পারব। আর রোগ দেখা দিলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নিয়ে দ্রুত সুস্থ করা যায়। ফলে আমাদের দুগ্ধ উৎপাদন ও স্বাভাবিক থাকবে আমরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারব।
মো. মোস্তাফিজুর রহমান*
*শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্স অনুষদ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর মোবাইল : ০১৭৬৪১২৫০১৫
চাষি ভাইয়েরা মাছ চাষের পুকুর আশা করি এর মধ্যেই তৈরি করে ফেলেছেন। বড় মাছের পরিচর্যা করার সময় বিশেষভাবে কয়েকটি বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। পুকুরের মাছকে যেন উপযুক্ত পরিমাণে প্রাকৃতিক ও পরিপূরক খাদ্যের জোগান দেয়া হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি করার জন্য প্রয়োজন মতো নাইট্রোজেন ও ফসফেট ঘটিত সার পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে। এ সারের সঙ্গে জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগের প্রয়োজন। প্রথম কিস্তিতে প্রায় ৬০ শতাংশ সার প্রয়োগ করে, সারের অবশিষ্ট অংশ প্রতি মাসে পুকুরে সমান হারে প্রয়োগ করলে সারা বছরই পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের জোগান থাকে। তারপর প্রতিদিন পুকুরের মাছকে সুষম পরিপূরক খাদ্য দিতে হবে। পরিপূরক খাদ্য পানিতে মিশিয়ে গোলা করে কাঠের পাত্রে রেখে পুকুরের পানির বিভিন্ন স্তরে দিতে হয়। সন্ধ্যার সময় পাত্রগুলো তুলে পরীক্ষা করে দেখতে হবে, তা থেকে মাছ কতটুকু খেয়েছে। তারপর পরিপূরক খাদ্যের পরিমাণ কমানো অথবা বাড়ানো যেতে পারে।
পুকুরের পানিতে সর্বদা দ্রবীভূত অক্সিজেনের জোগান থাকা চাই। এর জন্য মাঝে মধেই পুকুরের পানিতে স্রোতের সৃষ্টি করতে হয়। পুকুরের সব রকম পচনক্রিয়া বন্ধ করতে হয়। তা হলেই দ্রবীভূত অক্সিজেনের জোগান অব্যাহত থাকবে।
মাছকে নিয়মিত তাড়া দিতে হবে। এ কাজ করতে গেলে পুকুরে মাসে অন্তত ২-৩ বার জাল টানতে হবে। পানির অম্লত্ব সর্বদা কম রাখতে হবে। পুকুরের পানি অম্ল হলে পুকুরে ১০-২০ কেজি চুন প্রতি বিঘায় প্রয়োগ করতে হবে।
এছাড়াও পুকুরে মাছের মজুতের হার কখনোই বিঘাপ্রতি ৭০০টির বেশি হওয়া উচিত নয়। তারপর যদি মিশ্র মাছের চাষ করেন, তবে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের অনুপাতও সঠিক রাখা প্রয়োজন। যেমন পুকুরের উপরের স্তরের মাছ শতকরা ৩০টি থাকা চাই, মাঝের স্তরের মাছ শতকরা ৪০টি এবং পুকুরের নিচের স্তরের মাছ শতকরা ৩০টি থাকা চাই।
পুকুরের পানির গভীরতা খুব বেশি হলে সে পুকুরে মাছের ভালো ফলন হবে না। সাধারণত বড় মাছের পুকুরে ৫-১০ ফুট পানি থাকলেই মাছের ভালো ফলন পাওয়া যায়।
পুকুরটি এমন হবে যেন পুকুরে যথেষ্ট আলো-বাতাস খেলতে পারে। কোনো নালা-নর্দমার পানি যেন পুকুরে এসে না পড়ে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
প্রজনন ঘটানোর সময় সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন। মাছের প্রজনন ঘটানোর সময় বেশ কয়েকটি সতর্কতা গ্রহণ করা দরকার। ডিম তোলার মাছ ভালোভাবে বাছাই করতে হবে যেন মাছগুলো রোগগ্রস্ত না হয় এবং মাছের বয়স অন্তত ২ বছরের বেশি হয়। সিলভার কার্প, গ্রাসকার্পের ক্ষেত্রে মাছের বয়স ৩ বছরের বেশি হলে ভালো। কাতলা ৩ বছর বয়সের হলে ভালো হবে।
মাছকে ইনজেকশন দেয়ার সবক‘টি সাজসরঞ্জাম সংগ্রহ করে নিন। তার মধ্যে উৎকৃষ্ট মানের পিটুটারি গ্ল্যান্ড আগে থেকেই সংগ্রহ করে নিতে হবে। বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে পিটুটারি গ্ল্যান্ড সংগ্রহ করলে লোকসানের কোনো আশঙ্কা থাকে না।
এ সময় প্রজননক্ষম মাছের পরিচর্যার কাজ চালিয়ে যান। যারা এখনই ডিম তোলার কাজ আরম্ভ করতে চান, তারা আপাতত কম মাছ দিয়ে এ কাজ আরম্ভ করুন। কারণ গরমের কারণে সময় বেশি মাছ দিয়ে ডিম তোলার কাজ আরম্ভ করলে মাছের ও ডিম পোনা উভয়েরই ক্ষতি হতে পারে।
জিওল মাছের চাষ যেসব জলাশয়ে করা হয়েছে তা পরিষ্কার করে জিওল মাছের চাষ করুন। কয়েকটি প্রজাতির জিওল মাছের চাষ করা যেতে পারে যেমন- কই, মাগুর, শিংগি, শাল, শোল, ল্যাটা ইত্যাদি। সুতরাং এ রকম জলাশয় আপনার কাছে থাকলে আপনি এ বছর জিওল মাছের চাষ করার কাজে হাত দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করুন। এর জন্য আপনাকে জিওল মাছের পোনা সংগ্রহ করে নিতে হবে। বর্ষা নামলেই বিভিন্ন প্রজাতির জিওল মাছ ডিম পাড়বে। সেগুলো সংগ্রহ করে পুকুরে চাষ করা সম্ভব। তাছাড়া ইনজেকশন দিয়ে জিওল মাছের চারা পোনাও উৎপাদন করা যেতে পারে। পুকুরের পানির গভীরতা খুব বেশি হতে হবে না। পুকুরের তলদেশে পাঁক থাকলেও ক্ষতি হবে না। বিঘাপ্রতি ৩-৮ হাজার জিওল মাছের পোনা পুকুরে দেবেন। পরিপূরক খাদ্য হিসেবে কুঁড়ো, সরিষার খৈল ও শুঁটকি মাছের গুঁড়া সমান সমান মিশিয়ে মাছকে খাওয়াবেন। পুকুর ফেলে না রেখে তাতে জিওল মাছের চাষ করলে আপনি কম খরচে ভালো লাভ তুলতে পারবেন।
মাছের রোগও প্রতিকার : চারা পোনার রোগ মৌসুমের শুরুতেই চোখে পড়তে পারে। যেমন- গায়ে ঘা, পোনার গায়ে কালগুটি রোগ কিংবা সাদাগুটি রোগ। সব সময় পোনাগুলোর প্রতি লক্ষ রাখুন। রোগের লক্ষণ দেখামাত্র প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে। মাছের পোনার কালগুটি রোগ হলে রোগাক্রান্ত পোনাগুলোকে প্রতি লিটার পানিতে ৩ এমজি পিকারিক এসিড গুলে ওষুধের মিশ্রণে ১ ঘণ্টা ডুবিয়ে রাখতে হবে। তারপর সেগুলোকে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে আবার পুকুরে ছাড়বেন। তাতে পোনার কালগুটি রোগের নিরাময় হবে। মাছের পোনার সাদাগুটি রোগ হলে চারাগুলোকে প্রতি ৫ লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার ফরমালিন গুলে ওষুধ মিশ্রণ তৈরি করে তাতে ৭-১০ দিন প্রতিদিন ১ ঘণ্টা করে ডুবিয়ে রাখতে হবে। ফলে চারার সাদাগুটি রোগ শেষ হয়ে যাবে। তখন সেগুলোকে পানিতে ধুয়ে আবার পুকুরে ছাড়বেন।
চারার গায়ে ঘা হলে সেগুলোকে প্রতিলিটার পানিতে ১ গ্রাম কেএমএনও-৪ গুলে পোনা ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখুন। তারপর সেগুলোকে পুকুরে দেবেন।
বড় মাছের পুকুরেও কয়েকটি রোগ এ সময় দেখা যাবে। যেমন- মাছের কানকোয় ও গায়ে অসংখ্য আরগুলাস উপদ্রব হতে পারে। এটা দমন করার জন্য পুকুরে নুভান নামক একটি ওষুধ প্রতিবিঘায় ১৩০ মিলিলিটার হারে প্রয়োগ করবেন। ওষুধটি প্রয়োগ করে কয়েক দফা জাল টেনে ওষুধটি পানির সাথে মিশিয়ে দিন। ১৫ দিন পর আরগুলাস দমন না হলে পুনরায় একই হারে ওষুধটি প্রয়োগ করবেন।
এছাড়া বড় মাছের গায়ে ক্ষতরোগ হতে পারে, ফুলকা ও পাখনায় পচন রোগ দেখা যেতে পারে, কিংবা চোখ ফুলা রোগও দেখা যেতে পারে। এ রোগগুলো দমনের জন্য সালফাজল অ্যাসিড অথবা সালফাজিন নামক ওষুধের যে কোনো একটি ১০০ গ্রাম প্রতি কেজি পরিপূরক খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে পুকুরের মাছকে ৫-৭ দিন খেতে দিন। মাছের রোগের নিরাময় হবে। তারপর পুকুরে ১৩-২০ কেজি চুন প্রতি বিঘা হারে প্রয়োগ করবেন। পুকুরের পানিকে শোধন করার জন্য বিঘাপ্রতি ৬৫০ গ্রাম কেএমএনও-৪ ওষুধ পানিতে গুলে পুকুরে দিন।
উপসংহার : এখনই সারা বছরের মাছ চাষের কাজ আরম্ভ করতে হবে। এ সময় আপনি যেভাবে পুকুর তৈরি করবেন এবং পুকুর সংস্কারের যেসব ব্যবস্থা নেবেন তার উপরই সারা বছরের মাছের ফলন নির্ভর করবে।
আফতাব চৌধুরী*
*সাংবাদিক, ব্লক-এ, শাহজালাল উপশহর, সিলেট
ক.
পঁচাত্তর বছর আগে বাংলায়
মর্মন্তুদ মন্বন্তরে ভরে যায় লাশে
লক্ষাধিক ভিটাছাড়ে খাবার তালাশে
গ্রামীণ কাঠামোগুলো মাটিতে মিলায়।
বেণিয়ার কষাঘাতে পঙ্গু মেরুদণ্ড
দুইযুগে করে ক্ষত পাকিস্তানি লাঠি
শোষণের যাঁতাকলে তামা হয় মাটি
সোনার দেশের গতি হয়ে যায় প-।
একাত্তরে যুদ্ধজয়ী বিপ্লবী জনতা
গোবাদিতে মাছে ধানে সবজি কি ফলে
তামা মাটি ভরে তোলে সোনার ফসলে
দ্বিতীয় বিপ্লব হাসে পেয়ে সফলতা।
তার সাথে তথ্য দিয়ে সুদীর্ঘ বছরে
সেবা দেয় কৃষিকথা গ্রামে ও শহরে ॥
খ.
ধান সেতো প্রাণ বুনি ফসলের মাঠে
তাড়া তাই খানা নাই মাতি নিয়ে কাজ
ফসলের কিছু হলে ভালে পড়ে ভাঁজ
ভোর থেকে সাঁজে কাজে শরীরটা টাটে।
ঘরের তেনার হাত দশখানা লাগে
পশুপাখি মানুষের জোগাতে খোরাক
ধরাবাঁধা কাজকামে থাকে না ফারাক
সবকিছু সারা হয় বিজলির আগে ।
রাতে ঘুম গাঢ় হয়ে নেমে এলে চোখে
মশার সারিন্দা সাথে উলুসের হানা
শিয়ালে ইঁদুরে চোরে শানায় বাহানা
হল্লায় তাড়িয়ে সব ঘুমাই পলকে।
শ্রমে ঘামে কাজ করি দূরে ঠেলে ক্লেশ
যারে নিয়ে স্বপ্ন দেখি সে আমার দেশ ॥
গ.
বৈশাখে গরম ঢালে দোজকের শ্বাস
জমিন ফেটে চৌচির খালে পানি নাই
নির্জলা নদীরা ধূ ধূ বালিতে বোঝাই
পথেঘাটে চারিদিকে চলে হা হুতাস।
ধানের সবুজ চারা ধূসর কাতর
অগ্নিঝরা তাপ যেন ফসলের মাঠে
ফুঁসে দাপিয়ে বেড়িয়ে বারবেলা কাটে
এ সময়ে বেড়ে যায় পানির কদর।
বিকালে হঠাৎ কালো মেঘ ও তুফান
তেড়ে আনে শিলাবৃষ্টি হিরা যেন ঝরে
ক্ষতি করে প্রাণ ঘর শস্য অফুরান
দুনিয়া শীতল হয় মাঠ জলে ভরে।
সজীব ধানের চারা পাতা নেড়ে নাচে
বৈশাখী পূর্ণিমা রাত জোছনায় ভাসে॥
ঘ.
ফাল্গুনে শুকনা মাঠে বোনা আমনের
নিচু খেতে চারাগুলো ঝিম মেরে থাকে।
পাল্লা দিয়ে বাড়ে জলে অঘ্রাণে তা পাকে
গ্রামেগঞ্জে দোলা লাগে পৌষ পার্বণের।
খরিফে আউশ বোনা অথবা খোঁচায়
খরা ও বৃষ্টির ছাঁটে বাড়ে তাড়াতাড়ি
উফশী রোপণ হলে য বলিহারি
ফসল তেলার আগে কভু বানে খায়।
এখন বছরজুড়ে ভরামাঠ ধানে
আউশ আমন বোরো তিনটি মৌসুমে
উফশী ও হাইব্রিড কৃষকেরে টানে
ভরা থাকে গোলা-ঝোলা আনন্দে কুটুমে।
খরা বন্যা মঙ্গা ছিল সেকালে আকাল
আধুনিক ধানের চাষে খুলেছে কপাল॥
কৃষিবিদ এ এইচ ইকবাল আহমেদ*
* পরিচালক (অব.), বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি। সেল ০১৫৫৮৩০১৯০৮ (ahiqbal.ahmed@yahoo.com)
মাসুম
ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : ধান গাছের পাতায় ছোট ছোট দাগ হচ্ছে, পাতা হলুদ হয়ে যাচ্ছে। কী করণীয়?
উত্তর : এটি ধানের একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগের কারণে পাতায় তিলের মতো ছোট ছোট বাদামি দাগ হয়। সব পাতা দাগে পরিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে এবং গাছটি মরে যেতে পারে।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয় -
* জমিতে জৈবসার প্রয়োগ করা,
* ইউরিয়া ও পটাশ এর উপরিপ্রয়োগ করা,
* পর্যায়ক্রমে জমিতে সেচ দেয়া ও শুকনো রাখা,
* রোগ বেশি মাত্রায় দেখা দিলে কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন নোইন ৫০ ডব্লিউপি ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা,
* আক্রান্ত জমিতে শিষ বের হওয়ার পর ৬০ গ্রাম পটাশ ও ৬০ গ্রাম থিওভিট ২০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করলে দাগ রোগ কমে,
* পরবর্তীতে ছত্রাকনাশক ব্যাভিস্টিন দিয়ে বীজ শোধন করে বপন করা।
শফিকুল
পিরোজপুর
প্রশ্ন : কচি নারিকেল/ডাব কালো হয়ে ঝরে যাচ্ছে। কী করণীয় ?
উত্তর : নারিকেল গাছের ছত্রাক রোগের জন্য নারিকেলের বাড রট রোগটি দেখা যায়। এর জন্য করণীয় Ñ
* গাছ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা,
* আক্রান্ত নারিকেল সংগ্রহ করে পুঁতে ফেলা,
* আক্রান্ত গাছে প্রতি লিটার পানিতে কুপ্রাভিট ৪ গ্রাম অথবা ডাইথেন এম-৪৫ ২ গ্রাম অথবা বর্দোমিক্সার (১%) মিশিয়ে স্প্রে করা।
আলমগির কবির
খুলনা
প্রশ্ন : বেগুন গাছের পাতা কোঁকড়ানো কী করলে এ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে?
উত্তর : বেগুন গাছের পাতা কোঁকড়ানো ভাইরাসজনিত রোগের লক্ষণ। রোগের আক্রমণ শুরু হয় বীজতলায় সাদা মাছি আক্রমণ করলে। এজন্য বীজতলা ৫০ সেমি. ছিদ্রযুক্ত নেট অথবা সাধারণ মশারির নেট দিয়ে সাদা মাছি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বাড়ন্ত গাছে রোগ দমনের জন্য কেরোসিন মিশ্রিত পানি (প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি.) অথবা ১-২ গ্রাম গুঁড়া সাবান প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করলে এ রোগের বাহক পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ফলে রোগ ছড়াতে পারে না। রোগের আক্রমণ বেশি হলে রগর/টাফগর/পারফেকথিয়ন/রক্সিন নামক কীটনাশক ব্যবহার করে সাদা মাছি দমন করতে হবে। আক্রান্ত গাছ তুলে আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং আক্রান্ত জমিতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি শোধন না করে অন্য জমিতে ব্যবহার করা যাবে না।
সাঈদ
মোক্তারপাড়া, নওগাঁ
প্রশ্ন : আমার বড় ভাই ৫ কাঠা জমিতে মিষ্টিকুমড়ার চাষ করেছেন। কিন্তু জালি অবস্থায় মাছি পোকার আক্রমণে ফল পচে যাচ্ছে। প্রতিকার জানাবেন।
উত্তর : আপনার প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ। মিষ্টি কুমড়ার ক্ষতিকর পোকা দমনে প্রথমে হাত বাছাই বা ছাই ছিটিয়ে পোকা দমন করতে পারলে ভালো হয়। তা না হলে ফেরোমন ব্যবহার করতে পারেন। তারপরও শেষ পর্যন্ত প্রতিকার না হলে কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। যেহেতু মিষ্টিকুমড়ার ডগা সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয় তাই কীটনাশক না দেয়াই ভালো। এরপরও যদি কাজ না হয় তাহলে ইমিটাফ/টাবগর/ক্লোরোপাইরিফস নামক কীটনাশক পরিমাণ মতো স্প্রে করতে পারেন বা ক্ষতির মাত্রা বেশি হলে ক্ষতিকর পোকা শনাক্ত করে বা নমুনা নিয়ে আপনার নিকটস্থ উপজেলা কৃষি অফিসে বা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার সহায়তা নিয়ে আপনি সঠিকভাবে পোকা দমন করে উপকৃত হতে পারেন।
মো. হায়দার আলী
দুরাকুটি, লালমনিরহাট
প্রশ্ন : আমার টমেটো গাছ ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে ঢলে পড়ে। প্রতিকার জানালে খুশি হবো।
উত্তর : আপনার প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ। আক্রান্ত টমেটো গাছের কা- ২ ইঞ্চি আকারে টুকরো করে কেটে চিরে ২ ভাগ করে কাচের গ্লাসে পরিষ্কার পানিতে ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখুন। পানি সাদাটে ঘোলা রঙ ধারণ করলে বুঝতে হবে টমেটো গাছ ব্যাকটেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগে আক্রান্ত হয়েছে। জমিতে পানি বা রসের আধিক্য রোধ করতে হবে। কোনো ছত্রাকনাশক স্প্রে করে সুফল পাওয়া যাবে না। আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। গ্লাসের পানির রঙ অপরিবর্তিত থাকলে বুঝতে হবে টমেটো গাছ ছত্রাকজনিত ঢলে পড়া রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে রিডোমিল গ্লোড এমজেড ৬৮ ডব্লিউজি অথবা থিয়োভিট ৮০ ডব্লিউজি মিশিয়ে ৭ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।
মেহেদি হাসান
মিঠাপুকুর, রংপুর
প্রশ্ন : আমার ডালিম গাছে ফল আসছে কিন্তু বড় হচ্ছে না। আমি এখন কী করব জানালে উপকৃত হবো।
উত্তর : ডালিম গাছে যেসব ফুল আসছে সেগুলোতে সঠিকভাবে পরাগায়ন হচ্ছে না বা একেবারেই পরাগায়ন হচ্ছে না। এজন্য সুষম সার প্রয়োগ এবং নিয়মিত সেচ না দিলে ফুল ফুটলেও তা ঝরে যায়। এছাড়া জোরে বাতাস বইলে পরাগায়ন ঠিকভাবে না হওয়ায়ও ফুল ঝরে যেতে পারে। গাছের বয়স ৫ বছরের বেশি হলে সুষম সার হিসেবে গোবর বা কম্পোস্ট সার ১০-১৫ কেজি, ইউরিয়া ২৫০ গ্রাম, এমওপি ২৫০ গ্রাম এবং ১৫০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হয়। সার প্রয়োগের পর ও ফুল আসার সময় গাছের গোড়ায় সেচ প্রদান করে মাটির রস যেন জো অবস্থায় থাকে সে ব্যবস্থা করতে হয়। সুষম সার ব্যবহারের পরও যদি ফুল ঝরা অব্যাহত থাকে, তাহলে ফুল ফোটার আগে প্রতি লিটার পানিতে সর্বোচ্চ ১ গ্রাম পরিমাণ বোরিক এসিড মিশিয়ে স্প্রে করে ফুল ঝরা কমানো যেতে পারে।
কার্নপ চন্দ্র
রংপুর
প্রশ্ন : পোনা উৎপাদন ও নার্সারির ব্যবস্থাপনা কিভাবে করব?
উত্তর : পুকুর উত্তমরূপে প্রস্তুত করে ৫-৭ দিন বয়সী রেণু পোনা প্রতি শতাংশে ১০ গ্রাম (৭-৮ হাজার) হারে মজুত করতে হবে। নার্সারি পুকুর ক্ষতিকর সাপ, ব্যাঙ ও অন্যান্য প্রাণী থেকে রক্ষা করার জন্য পুকুরের পাড় ১ মিটার উঁচু জাল দিয়ে ঘিরে দিতে হবে। রেণু মজুতের পর ৩৫-৪০% প্রোটিনযুক্ত কমার্শিয়াল ফিড, খামারে প্রস্তুতকৃত খাদ্য বা নার্সারি ফিড প্রথম ৫ দিন (১-৫ দিন) পোনার দেহ ওজনের ২ গুণ হারে, পরবর্তী ৫ দিন (৬-১০ দিন) ৩ গুণ হারে, এর পরবর্তী ৫ দিন (১১-১৫ দিন) ৪ গুণ হারে এবং এর পরবর্তী ৫ দিন (১৬-২০ দিন) ৫ গুণ হারে বরাদ্দকৃত খাদ্য প্রতিদিন তিনবারে দিতে হবে। খাদ্যের পাশাপাশি প্রতিদিন সার প্রয়োগ (প্রতি শতকে গোবর ২০০ গ্রাম, ইউরিয়া ৫ গ্রাম ও টিএসপি ৩ গ্রাম) করতে হবে। ২৫-৩০ দিন পরে পোনা চাষের পুকুরে ছাড়ার উপযোগী হবে।
হাসান উদ্দিন
জামালপুর
প্রশ্ন : মাছের সুষম খাবার তৈরি ও প্রয়োগ পদ্ধতি জানাবেন।
উত্তর : পুকুরের মাছের ওজনের ৩%-৫% হারে ভালো কোম্পানি ফিড প্রতিদিন প্রয়োগ অথবা খৈল, চালের কুঁড়া, গমের ভুষি ১০০ কেজি মাছের জন্য ৩ কেজি খাবার (১.৫ কেজি একদিন পূর্বে ভিজিয়ে রাখা খৈল ও ১.৫ কেজি গমের ভুষি বা চালের কুঁড়া) মিশিয়ে ছোট ছোট ম- তৈরি করে পুকুরে প্রয়োগ করা। খাবারগুলো মাটির পাত্রে অথবা প্লাস্টিকের চটের ওপর রাখলে ভালো হয় কারণ মাছ খাবার খেল কি না তা সঠিকভাবে জানতে পারা যাবে। যদি ২ দিন পরও খাবার দেখা যায় তাহলে মাছের খাবার কমিয়ে দিতে হবে। এক কেজি আদর্শ মাছের খাবার তৈরিতে গমের ভুষি ৩০০ গ্রাম, চালের কুঁড়া ২০০ গ্রাম, ফিসমিল ২০০ গ্রাম, আটা ১০০ গ্রাম, পূর্বে ভিজানো খৈল ২০০ গ্রাম সাথে ভিটামিন প্রিমিক্স ১ কেজি খাবারে ১ চা চামচ, লবণ ১ চা চামচ ও চিটাগুড় প্রয়োজন মতো (ম- প্রস্তুত করতে যতটুকু প্রয়োজন ১০০-২০০ গ্রাম) মিশাতে হবে।
সুমন
দিনাজপুর
প্রশ্ন : গরুকে পাগলা কুকুর কামড় দিয়েছে। কী করব?
উত্তর : কামড়ানো জায়গা পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দ্রবণ দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে। রেবিসিন ১০ সিসি ১০০ কেজি ওজনের জন্য ১ম দিন ৪ সিসি, ৭ম দিন ৩ সিসি এবং ২১তম দিন ৩ সিসি ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হবে।
জান্নাত
নোয়াখালী
প্রশ্ন : আর্থ্রাইটিস/গিরা ফোলা রোগে কী করব?
উত্তর : লক্ষণ : পায়ের গিরা ফুলে যায়, পানি জমে থাকে, ব্যথা হয়, খুঁড়িয়ে হাঁটে।
* অ্যাসিটাইল স্যালিসাইলিক এসিড প্রতিবার ১ গ্রাম করে দিনে ২-৩ বার খাওয়ানো যেতে পারে।
* পর্যাপ্ত বিশ্রাম, নিয়মিত হালকা ব্যায়াম, পর্যাপ্ত সুষম খাদ্য এবং ওষুধ প্রয়োগ করে এ রোগের চিকিৎসা করা যায়।
* অ্যাসিটাইল স্যালিসাইলিক এসিড প্রতিবার ১ গ্রাম করে দিনে ৩ বার খাওয়ার পর দেয়া যেতে পারে।
* ডিসপিরিন ট্যাবলেট ০.৩ গ্রাম হিসেবে দিনে ৩ বার খাওয়ার পর দেয়া যেতে পারে।
ইমরান
রংপুর
প্রশ্ন : গরুর চোখে পানি অথবা ছানি দেখা গেলে করণীয় কী?
উত্তর : সিলভার নাইট্রেট দানা ১-২টি ১০০সষ ঐ২০ তে মিশিয়ে সলিউশন করে দিনে ২ বার ৩-৪ দিন খাওয়াতে হবে। অথবা
* অটো থেরাপি (রস থেকে রক্ত সংগ্রহ করে মাংসে দেওয়া) দেয়া হয়। অথবা
* Crystal Silvernitrate-0.1% Eye Drop চোখে ৩-৪ ফোঁটা ৫-৭ দিন প্রয়োগ করতে হবে। Auto hemotherap গরুর রক্ত নিয়ে আবার পুশ করে দেয়া ৩-৫ দিন পর পর ৩টা ডোজ।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মারুফ*
* সহকারী তথ্য অফিসার (শ. উ.), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, জ্যৈষ্ঠ মাসে পাকা ও মিষ্টি ফলের মৌ মৌ গন্ধে মাতোয়ারা বাংলার দিক প্রান্তর। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, তরমুজ, বাঙ্গিসহ মৌসুমি ফলের সুভাষিত ঘ্রাণ আমাদের রসনাকে আরো বাড়িয়ে দিয়ে যায়। এছাড়াও মৌসুমি ফলের প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তৈরি আচার, চাটনি, জ্যাম, জেলি জ্যৈষ্ঠের গরমে ভিন্ন স্বাদের ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হয়। আর এই মধুমাসে প্রিয় পাঠক, চলুন একপলকে জেনে নেই জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি কথা।
বোরো ধান
আউশ ধান
* এখনো আউশের বীজ বোনা না হয়ে থাকলে এখনই বীজ বপন করতে হবে।
* চারার বয়স ১২ থেকে ১৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের প্রথম কিস্তি হিসেবে হেক্টরপ্রতি ৪৫ কেজি ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। এর ১৫ দিন পর একই মাত্রায় দ্বিতীয় কিস্তি উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
* ইউরিয়া সারের কার্যকারিতা বাড়াতে জমিতে সার প্রয়োগের সময় ছিপছিপে পানি রাখাসহ জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
আমন ধান
পাট
* পাটের জমিতে আগাছা পরিষ্কার, ঘন ও দুর্বল চারা তুলে পাতলা করা, সেচ এসব কাজগুলো যথাযথভাবে করতে হবে।
* ফাল্গুনি তোষা জাতের জন্য হেক্টরপ্রতি ১০০ কেজি ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
* মাটিতে রস না থাকলে বা দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে হালকা সেচ দিতে হবে এবং বৃষ্টির করনে পানি জমে থাকলে তা নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
* পাটের শাক যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর। তাই নিড়ারিন সময় তোলা অতিরিক্ত পাটের চারা ফেলে না দিয়ে শাক হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
* এ মাসে পাটের বিছাপোকা এবং ঘোড়া পোকা জমিতে আক্রমণ করে থাকে। বিছা পোকা দলবদ্ধভাবে পাতা ও ডগা খায়, ঘোড়া পোকা গাছের কচি পাতা ও ডগা খেয়ে পাটের অনেক ক্ষতি করে থাকে। বিছা পোকা ও ঘোড়া পোকার আক্রমন রোধ করতে পোকার ডিমের গাদা, পাতার নিচ থেকে পোকা সংগ্রহ করে মেরে বা পুরিয়ে ফেলতে হবে। জমিতে ডালপালা পুতে দিলে পোকা খাদক পাখি যেমন শালিক, ফিঙ্গে এসব পোকা খেয়ে আমাদের দারুন উপকার করে। আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
শাক-সবজি
বিবিধ
* বাড়ির কাছাকাছি উঁচু এমনকি আধা ছায়াযুক্ত জায়গায় আদা হলুদের চাষ করতে পারেন।
* মাঠের মিষ্টি আলু, চিনাবাদাম বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই তুলে ফেলতে হবে।
* গ্রীষ্মকালীন মুগডালের চাষও এ মাসে করতে পারেন।
* পতিত বা আধা ছায় যুক্ত স্থানে সুযোগ থাকলে অনায়াসে লতিরাজ বা পানি কচু বা অন্যান্য উপযোগী কচুর চাষ করতে পারেন।
* যারা সবুজ সার করার জন্য ধইঞ্চা বা অন্য গাছ লাগিয়ে ছিলেন, তাদের চারার বয়স ৩৫-৪৫ দিন হলে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। সবুজ সার মাটিতে মেশানোর ৭/১০ দিন পরই ধান বা অন্যান্য চারা রোপণ করতে পারবেন।
গাছপালা
প্রাণিসম্পদ
* এ সময়ে প্রাণিচিকৎসকের সাথে পরামর্শ করে হাঁস মুরগির ভ্যাকসিন দিতে হবে।
* বাজারে রাণীক্ষেতের জন্য নবিলিস এনডি ল্যাসুটা, এনডিএলএস, সিভেক নিউ এল, আইজোভ্যাক এনডি কিল্ড, নিউক্যাভাক, ইমোপস্টে, নিউক্যাসেল ল্যাসুটা এসব। এছাড়া গামবোরো রোগে নবিলিস ২২৮, সিভেক গামবো এল, আইজোভ্যাক গামবো-২এসব। আর বসন্ত রোগে সিভেক এফপিএল, নবিলিস, ওভোড্রিপথেরিন এসব পাওয়া যায়।
* এছাড়া হাঁস মুরগির কৃমির জন্য ওষুধ খাওয়ানো, ককসিডিয়া রোগ হলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহাণ এবং জরুরিভাবে অন্যান্য প্রতিষেধক টিকা দিয়ে দিতে হবে।
* মুরগি ও হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর কাজটি ভরা বর্ষার আগেই সেরে ফেলতে হবে।
* বর্ষা আসার আগেই গবাদি পশুর আবাসস্থল পরিপাটি করে পুনঃসংস্কার, আশপাশ পরিষ্কার করা, জমে থাকা পানির দ্রুত নিকাশের ব্যবস্থা, বর্ষার নিয়মিত এবং পরিমিত গো-খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করাসহ অন্যান্য কাজগুলো সঠিকভাবে করতে হবে।
* গবাদি পশুর গলাফোল, ডায়রিয়া, ক্ষুরারোগ, নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য রোগের ব্যাপারে টিকা দেয়াসহ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আপনাদের কল্যাণে ও সফলতার জন্য আমরা এক মাস আগেই আগামী মাসের কৃষির করণীয় দিকগুলো স্মরণ করিয়ে দেই। আমাদের বিশ্বাস সুষ্ঠভাবে কার্যক্রম বাস্তবায়নে আপনাদের প্রাথমিক প্রস্তুতি নিতে এগুলো বিশেষভাবে সহায়তা করে থাকে। এরপরও যদি আরও নতুন কোন তথ্য প্রযুক্তি বা কৌশল জানার থাকে তাহলে স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি-মৎস্য-প্রাণি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নিলে আরো বেশি লাভবান হবেন।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন, তথ্য অফিসার (কৃষি)
কৃষি তথ্য সার্ভিস
পরিশ্রমী আত্মপ্রত্যয়ী মো. আকবর আলী রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলায় কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের গোগ্রাম ইউনিয়নের রানীনগর ব্লকে কর্মরত উপসহকারী কৃষি অফিসার। প্রায় ৩০ বছর ধরে কৃষির সঠিক দিকনির্দেশনা আর কৃষির উন্নত প্রযুক্তিগুলো বরেন্দ্রের মাটিতে সম্প্রসারিত করে পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনে পেয়েছেন ব্যাপক সাফল্য। ইতোমধ্যে কৃষি সংশ্লিষ্ট উচ্চপর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ তার মাঠভিত্তিক কার্যক্রম সরেজমিন পরিদর্শন করে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। থেমে নেই তার নতুন বিপ্লবের অগ্রযাত্রা। সরকারি দায়িত্ব পালনে নেই কোনো অবহেলা, নেই কর্তৃপক্ষের কোনো নির্দেশ পালনে কার্পণ্যতা। সার্বক্ষণিক চিন্তা কৃষি-কৃষক ও কৃষি উন্নয়নে নিবেদিত প্রাণ হয়ে বেঁচে থাকা। তার প্রবল ইচ্ছা কৃষকের পেঁয়াজ বীজের দুষ্প্রাপ্যতা ও ব্যাপক কল্পে অর্থ উপার্জনের পথে তাকে সম্পৃক্ত করে তোলে। পাশাপাশি সৎ উপায়ে জীবন-জীবিকার পথ অন্বেষণে স্বাবলম্বী হওয়া। কথা হচ্ছিল এমন একজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার সাথে।
প্রশ্ন : পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের উদ্যোগ আপনি কেন এবং কিভাবে নিলেন?
উত্তর : মা মাটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। গ্রামাঞ্চলের মাটি, সোনার চেয়ে খাঁটি। গ্রামের সহজ সরল কৃষক-কৃষাণীরা অক্লান্ত পরিশ্রমে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে ফসল উৎপাদন করলেও সফলতা অর্জন করতে পারে না, শুধুমাত্র ভিত্তি বা প্রত্যয়িত বীজের অভাবে। তখন থেকেই চিন্তা ভালোমানের বীজ উৎপাদন করে কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করা, এতে কৃষক উপকৃত হবে পাশাপাশি নিজেরও আর্থিক সচ্ছলতা আসবে। সরকারি পেঁয়াজ বীজের স্বল্পতা, বিশ্বস্ত বীজ বিক্রয় কেন্দ্রের কেনা বীজে বেশির ভাগ কৃষকই প্রতারিত হয়ে থাকেন। এসব বিবেচনায় ১৯৯৬ সালে প্রায় ১ বিঘা জমিতে নিজেই পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন শুরু করি। উৎপাদিত বীজ থেকে স্থানীয় কৃষকের চাহিদা মিটিয়ে ব্যয় বাদে প্রায় ৩০ হাজার টাকা লাভ করি। সেই থেকে শুরু হলো সরকারি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অবসর সময়ে অর্থ উপার্জনের টার্নিং পয়েন্ট। এরপর থেকে প্রতি বছর খরচ-খরচা বাদে ৪-৫ লাখ টাকা উপার্জন করে আসছি।
প্রশ্ন : এ বছর আপনি আপনার ব্লকে কতটুকু বীজ উৎপাদন করেছেন এবং কতজন কৃষককে এ বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করেছেন?
উত্তর : তিনি জানান, রানীনগর ব্লকে মোট আবাদি জমি হচ্ছে প্রায় ২২২০ হেক্টর। গত বছর যেখানে মাত্র ৫০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন হয়েছিল। এবার কিন্তু প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে কৃষকেরা পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন করেছেন। কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, গত বছর আমি নিজে ৮ বিঘা জমিতে পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন করে আয়-ব্যয় বাদে প্রায় ৫ লাখ টাকা উপার্জন করি। তা দেখে এবার এলাকায় অনেক কৃষকই আগ্রহী হয়ে বীজ উৎপাদনের ব্যবস্থা নিয়েছে। আশা করি আমার মতো তারাও বেশ লাভবান হবেন। বাবুল ডিলার, শুভ, ভুলু, জিয়া, আবু বক্কর, মুর্শেদ, হাসান, নাসিম, আজাহারসহ এ পর্যন্ত ব্লকের প্রায় ১৮০ জন আদর্শ পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনকারী কৃষককে বীজ উৎপাদনের কলাকৌশল সম্পর্কে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এছাড়া ইউনিয়ন কৃষি কমপ্লেক্সে নিয়মিত রুটিন মাফিক কাজের পাশাপাশি উপজেলার বিভিন্ন ব্লকের প্রায় ৮০০ জন পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনকারী কৃষককে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছি। প্রশিক্ষণ প্রদানের ফলে এবার উপজেলায় প্রায় ১,২৫০ হেক্টর জমিতে কৃষকেরা পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন করেছে, যেখানে গত বছর গোটা উপজেলায় মাত্র ২-৩শত হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন করা হয়েছিল। ফলে এ দিক থেকে এটা একটা বিরাট সাফল্য বলে আমি মনে করি।
প্রশ্ন : পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনের কলাকৌশল সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতার কথা কিছু বলুন?
উত্তর : এ বছর আমি নিজের ১২ বিঘা জমিতে পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন করেছি। স্থানীয় দুটি জাত, জাত দুটি হচ্ছে- তাহেরপুরী ও তাহেরপুরী কিং। স্থানীয় জাত হলেও জাত দুটি রোগ প্রতিরোধী এবং ফলনশীল। নিজ জেলা ও জেলার বাইরে এ দুটি বীজের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা খুবই বেশি।
চাষাবাদ কৌশল : পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের জন্য পানি সেচ সুবিধা আলো-বাতাস ঠিকমতো থাকে এরকম উর্বর দো-আঁশ ও এঁটেল মাটি নির্বাচন করে কমপক্ষে ৪-৫টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে তৈরি করে নিতে হবে।
জমি তৈরির সময় পর্যাপ্ত পচা গোবর বা আবর্জনা পচা সার ও শেষ চাষে বিঘাপ্রতি ইউরিয়া সার ৩৫ কেজি, টিএসপি সার ২৭ কেজি, এমওপি সার ২০ কেজি, জিপসাম সার ১ কেজি, বোরন সার ২ কেজি ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
বীজ হিসেবে পেঁয়াজের বাল্ব/কন্দ ব্যবহার হয়ে থাকে আর বিঘাপ্রতি ৫-৬ মণ বীজ লাগে। (মণপ্রতি তাহেরপুরী বীজেরমূল্য ২৩০০ ও তাহেরপুরী কিং বীজের মূল্য ২৭০০ টাকা। ১২ বিঘা জমিতে দুই জাতের বীজ লেগেছে মোট ১২০ মণ যার মূল্য প্রায় ৩ লাখ টাকা।
পুরো নভেম্বর মাস বীজ উৎপাদনের জন্য কন্দ/বাল্ব রোপণের উপযুক্ত সময়। জমির আকার অনুসারে প্লট করে প্রতি প্লটে ৩-৪টি সারি বা লাইন করে নিতে হবে। লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ২৫ সেমি. বা ১০ ইঞ্চি। প্রতি সারিতে ১৫ থেকে ২০ সেমি. বা ৬-৮ ইঞ্চি দূরে দূরে (মাতৃ বাল্ব) বীজ বা কন্দ রোপণ করতে হবে।
বীজ রোপণের ৩০ দিন পর প্রতি বিঘায় ১ম দফায় ৬০ কেজি ইউরিয়া ও ২০ কেজি এমওপি সার একত্রে এবং ৬০ দিন পর ২০ কেজি ইউরিয়া ও ১০ কেজি এমওপি সার একত্রে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে হালকাভাবে পানি সেচ দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।
পেঁয়াজের জীবন চক্র যাতে ব্যাহত না হয় তার জন্য ঘন ঘন ক্ষেত পরিদর্শন করে দুর্বল ও রোগাক্রান্ত গাছগুলো উঠিয়ে ফেলতে হবে। ছত্রাকজনিত পাপল ব্লচ রোগ দমনে ১০-১২ দিন পর পর রোভরাল/রিডোমিল এম জেড-৭২ একত্রে স্প্রে করে দিতে হবে।
বীজ/বাল্ব রোপণ থেকে বীজ সংগ্রহ পর্যন্ত ১৬৫ থেকে ১৭০ দিন সময় লাগে।
জনাব আকবর আলী জানান, এ পর্যন্ত তার ১২ বিঘায় বীজ খরচ ৩ লাখ টাকা, চাষ, সেচ, লেবার ও আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা সর্বমোট ৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বিঘাপ্রতি ১০০ থেকে ১২০ কেজি বীজ পাওয়া যাবে। গড়ে বিঘাপ্রতি ১২৫ কেজি মানসম্মত বীজ পেলে এবং প্রতি কেজি গড়ে ২০০০ টাকা দরে বিক্রি হলে ৩০ লাখ টাকা পাওয়া যাবে, যা খরচ বাদে তার ২০-২২ লাখ টাকা লাভ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
প্রশ্ন : বীজ উৎপাদন কৌশল ও উৎপাদিত বীজ সরবরাহে কৃষক সমাজ কতটুকু অনুপ্রাণিত ও উপকৃত হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : এক কথায় বলা যায়, শতভাগ না হলেও আশি ভাগ কৃষক বর্তমানে পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের সাথে জড়িত। বর্তমানে উপজেলার প্রায় ৪-৫ হাজার কৃষক এখন প্রায় ১২৫০ হেক্টর জমিতে বীজ উৎপাদন করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে এবং আশা করি লাভবান হবেন। তিনি আরও জানান, নিজ এলাকা ছাড়াও সাঁথিয়ার রব্বানী, ওসমান ও ওহাব পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনকারী চাষি এবং ফরিদপুরের সালতা থানার হারুন অর রশিদ পেঁয়াজ চাষি ইতোমধ্যে তার সাথে পেঁয়াজের বীজ ক্রয়ের জন্য যোগাযোগ স্থাপন করে রেখেছে।
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জনাব আকবর আলীকে শুধু ব্লকের কৃষকেরাই চিনে তা নয়, জেলা উপজেলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের কৃষকেরা পেঁয়াজ আকবর হিসেবে তাকে চিনে। সে প্রতি বছর ৪-৫ লাখ টাকা আয় করে থাকে। মেধা ও শ্রমের বিনিময়ে/অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী আকবর আলী তার দুই সন্তানকে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে গড়ে তুলেছেন। পরিশ্রমই সৌভাগ্যের সোপান, শ্রম কখনও বিফলে যায় না। মেধা, শ্রম ও কৃষির উন্নত প্রযুক্তিকে সতর্কতার সাথে কাজে লাগিয়ে অনায়াসে যে কেউ আকবর আলীর মতো বীজ শিল্পের উন্নয়নের পাশাপাশি সচ্ছলভাবে জীবন-জীবিকার পথে অগ্রসর হতে পারবে।
তুষার কুমার সাহা*
* এআইসিও, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী
উন্নয়নের স্বপ্ন আর কর্মে, নতুনকে কর বরণ; নবীন আলোকে নব আনন্দে, শুভ হোক নববর্ষের আগমন। সময়ের আবর্তনে বাংলা ১৪২৩ সাল আমাদের দোরগোড়ায় উপস্থিত। বাংলা নববর্ষকে বরণ করতে দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান নানা রঙে, নানা ঢঙে আয়োজন করে বৈশাখী অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য এই বৈশাখী মেলা বা বৈশাখী আয়োজন। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রেও নব উদ্যম, নব প্রেরণার সঞ্চার হয়। এ সময় কৃষকের ঘরে আসে নতুন ধান আর মনে আসে আনন্দ ও খুশির বান। কৃষক-কৃষাণী সারা বছরের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন আর স্বপ্ন দেখেন আরও উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির। তাদের এ স্বপ্ন পূরণে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার নানাভাবে, নানা কৌশলে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশ তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধির পানে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ধান উৎপাদনে চতুর্থ, মাছে চতুর্থ, সবজিতে তৃতীয়, আমে সপ্তম, আলুতে অষ্টম এবং ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ স্থান লাভে সক্ষম হয়েছে। শুধু তাই নয়, ফসলের জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান এখন সবার শীর্ষে। এ গৌরবময় অর্জন অব্যাহত রাখতে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। নববর্ষের সূচনালগ্নে আমাদের আহ্বান- ওহে নবীন ওহে প্রবীণ জাগাও মনে জাগরণ, নববর্ষে শপথ নাও করতে কৃষির উন্নয়ন।
সুপ্রিয় পাঠক ও চাষি ভাইয়েরা, আপনারা জানেন কৃষিকথা চলতি সংখ্যাটির মাধ্যমে ৭৬তম বছরে পদার্পণ করল। কৃষিকথা এমনই একটি ম্যাগাজিন, যা দেশের প্রত্যন্ত এলাকার কৃষক-কৃষাণীদের অত্যন্ত প্রিয়। ম্যাগাজিনটি এখন আর শুধু প্রিন্ট মিডিয়া হিসেবেই পরিচিত নয়, ইলেকট্রনিক মিডিয়া হিসেবেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। কৃষির আধুনিক ও লাগসই প্রযুক্তি কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে কৃষির উন্নয়নই এ ম্যাগাজিনটির মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। গবেষণালব্ধ জ্ঞান বিস্তারে ম্যাগাজিনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। ম্যাগাজিনটিতে সাধারণত মাঠ ফসল, উদ্যান ফসল, ফুল, ফল, উদ্ভিদ সংরক্ষণ, মৃত্তিকা, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, বন, পরিবেশ, খাদ্য ও পুষ্টিবিষয়ক নিবন্ধ, গল্প, কবিতা, নাটিকা, প্রশ্নোত্তর, আগামী মাসের কৃষি প্রভৃতি সহজ সরল ভাষায় সবার বোধগম্য করে প্রকাশ করা হয়। প্রকাশিত লেখার মাধ্যমে লেখক, পাঠক, গবেষক, কৃষক, কৃষিকর্মী সবার মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হয়। শুধু তাই নয়, কৃষিকথা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীদের জন্য হ্যান্ড বুক হিসেবে কাজ করে। কৃষিকথার মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রযুক্তি জ্ঞান কৃষকের মাঠে বাস্তবায়ন করে দেশের কৃষি আজ উচ্চশিখরে আসন লাভে সক্ষম হয়েছে। দেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে কৃষিকথার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
অতএব, আসুন আমরা কৃষিকথার ৭৬তম বছরে পদার্পণ এবং নববর্ষ ১৪২৩ এর আগমনকে স্বাগত জানাই। একই সাথে নববর্ষে নব নব কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষিকথাসহ দেশের কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে এগিয়ে যাই। কৃষিকথার লেখক, পাঠক, গ্রাহক, শুভানুধ্যায়ী সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।