Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

কৃষিবান্ধব জাতির পিতা আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা

কৃষিবান্ধব জাতির পিতা আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা

কৃষিবিদ ড. মো. আখতারুজ্জামান
আমাদের জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠে বাঙালি, বহুধা অঁচলে অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ একজন বরেণ্য রাজনীতিবিদ, বাঙালির মুক্তির দিশারি এবং আধুনিক বাংলাদেশের অন্যতম রূপকার। তাইতো তিনি তাঁর স্বল্প কর্মকালীন সময়ে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ধর্ম, তথ্য প্রযুক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন, পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাকার বিষয়ে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধু একবাক্যে আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।


আমরা যাঁরা কৃষিবিদ বা কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে দেখি একজন কৃষিচিন্তক ও কৃষিবান্ধব রাষ্টনায়ক হিসেবে; তিনি ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন আমাদের কৃষিই পারে আমাদের দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর খাদ্য পুষ্টির জোগান দিতে কারণ এ দেশের মতো কৃষি উপযোগী উর্বর মাটি আবহাওয়া ও জলবায়ু পৃথিবীর কোথাও নেই। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বল্প কর্মকালীন সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে যুগান্তকারী যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সেসবের মধ্যে অন্যতম ছিল-২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ; গ্রাম্য সমাজভিত্তিক কৃষকের জন্য সুদমুক্ত ঋণের প্রবর্তন; স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ২২ লাখ কৃষককে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ; প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণ অভিযান চালুকরণ; প্রথম বাজেটেই কৃষিতে ভর্তুকির ব্যবস্থা গ্রহণসহ সার, কীটনাশক ও সেচ যন্ত্রাংশ সরবরাহ; প্রাইম সাপোর্ট হিসেবে ধান, পাট, আখ প্রভৃতি ফসলের ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ; গ্রাম্য সমাজভিত্তিক সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ; ১৯৭২-৭৩ সালের ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়ন বাজেটের মধ্যে কৃষি খাতে ১০১ কোটি টাকার বরাদ্দ রেখেছিলেন।


অধিকন্তু কৃষি নিয়ে বঙ্গবন্ধু অনেক আপ্তবাক্যের অবতারণা করে গিয়েছেন। কৃষি মন্ত্রণালয় বঙ্গবন্ধুর কৃষি বিষয়ক ৭১টি বাণী সম্বলিত একখানা পুস্তিকা প্রকাশ করেছে। এরই মধ্যে অধিকতর কলেবরে ১০০টি কৃষিবিষয়ক বাণী চিরসবুজ এবং মুজিব শতবর্ষের স্মারকগ্রন্থ চিরঞ্জীব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মোড়ক উন্মোচন করেছেন। কৃষি বিষয়ক বঙ্গবন্ধুর এসব অমীয় বাণীর প্রতিটি পরতে পরতে রয়েছেÑ কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদসহ গোটা কৃষির প্রতি তাঁর মমত্ববোধ এবং অনাগত কৃষি নিয়ে তাঁর সুদূরপ্রসারী ভাবনার অতলান্তিক গভীরতা। তিনি এ দেশের কৃষি ও কৃষক নিয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, ‘আমাদের সমাজে চাষিরা হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণি এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘দেশে কৃষি বিপ্লব সাধনের জন্য কৃষকদের প্রতি কাজ করে যেতে হবে। বাংলাদেশে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা হবে না। জনগণের ঐক্যবদ্ধ কিন্তু নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই দেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতির দ্রুত পুনর্গঠনের নিশ্চয়তা বিধান করা যাবে।’ এভাবেই যুগান্তকারী কৃষিবান্ধব কার্যক্রমের মাধ্যমে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে বাংলাদেশের কৃষিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। তিনিই দিয়েছিলেন, চাকরি ক্ষেত্রে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা। চাকরিতে প্রথম শ্রেণির মর্যাদাদানের পরে তিনি কৃষিবিদদের উদ্দেশ্যে জোর দিয়ে বলেছিলে, ‘আমি তোদের পদমর্যাদা দিলাম, তোরা আমার মান রাখিস।’ তাত্ত্বিক কৃষি শিক্ষার পাশাপাশি ব্যবহারিক কৃষির উপরে তিনি সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ব্যবহারিক কৃষি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘শুধু কাগজে-কলমে আর বই পড়েই কৃষি কাজ হয় না। গ্রামে যেয়ে আমার চাষি ভাইদের সঙ্গে বসে প্র্যাকটিক্যাল কাজ করে শিখতে হবে।’


ব্যবহারিক কৃষি শিক্ষার উপরে অধিকতর গুরুত্ব করে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসের ১৪ তারিখে ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরের ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড়রূপী সবুজ শ্যামলিমার আবরণে ঢাকা ৪৯ একর জমির উপরে জাপানি আন্তর্জাতিক সংস্থা জাইকার সহায়তায় গোড়াপত্তন করেছিলেন, কেন্দ্রীয় সম্প্রসারণ সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট বা সার্ডি। বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করতেন, কৃষির লাগসই এবং টেকসই কৃষি প্রযুক্তি জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য দক্ষ ও যোগ্য কৃষি সম্প্রসারণ বিশেষজ্ঞ তথা দক্ষ মানব সন্তান তৈরির কোনো বিকল্প নেই।        কালের বিবর্তনে এবং সময়ের প্রয়োজনীয়তায় কেন্দ্রীয় সম্প্রসারণ সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট বা সার্ডিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগি সংস্থা থেকে অবমুক্ত করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটা একক সহযোগী সংস্থা হিসেবে জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমি বা নাটার প্রবর্তন করেন। সবে নাটা এ বছর ০৭ জুন তারিখে করোনা কোভিডের মধ্যে শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পালন করলো, নাটার সপ্তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত  সিনিয়র সচিব জনাব মোঃ মেসবাহুল ইসলাম। এরই মধ্যে নাটা সাফল্যের পথ বেয়ে শিকড় থেকে শিখরে আরোহণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে সহসা এটি আন্তর্জাতিক মানের কৃষি প্রশিক্ষণের বিনয়ন বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিণত হবে। তেমনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন নাটার সপ্তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি জনাব ওয়াহিদা আক্তার, অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন), কৃষি মন্ত্রণালয় ও ড. শেখা মোহাম্মদ বখতিয়ার, নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলসহ আগত অন্যান্য অতিথিবৃন্দ। নাটা এখন শুধু দক্ষ    কৃষি বিশেষজ্ঞখ্যাত মানবসম্পদ উন্নয়নের সাথেই জড়িত নয়, এখানে এখন সাফল্যের সাথে পরিচালিত হচ্ছে নার্সভুক্ত কৃষি বিজ্ঞানীদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ এবং অপরপর সব বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তার অল ক্যাডার ফাউন্ডেশন ট্রেনিং কোর্স। সত্যি বলতে আজকের আধুনিক নাটার বীজ বপন করেছিলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং সেটাকে, আধুনিকায়ন করত: অধিকতর পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থায়ন করে যাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধুর যোগ্য তনয়া এবং বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সব সরকারের শাসনামলে; তাইতো বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার খ্যাতি পেয়েছে ‘কৃষিবান্ধব’ সরকার হিসেবে।


কৃষিবান্ধব জাতির পিতার আধুনিক বাংলাদেশ গঠনের স্বাপ্নিক চিন্তার পাশাপাশি ক্ষণজন্মা এই প্রবাদপুরুষ স্বমহিমায় দেশে বিদেশে নানাবিধ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। দরাজ কণ্ঠের সাহসী এই রাজনৈতিক নেতার জন্ম না হলে আজও আমরা স্বাধীনতার স্বাদ পেতাম কি না জানি না। কী এমন ছিল এই প্রজ্ঞাবান আর বরেণ্য রাজনীতিবিদের মধ্যে যাঁর ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ১৮ মিনিটের স্ক্রিপ্টবিহীন ভাষণটিকে বিশ^ ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর  ইউনেস্কোর একটি উপদেষ্টা কমিটি বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল’ রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করে। তখন সবে সেখানে বিশ্বের মাত্র ৪২৭টি ভাষণ নথিভুক্ত হয়েছিল। অথচ এই ভাষণ প্রদানের আগে দেশের আপামর জনসাধারণ কেউ এতটুকু আঁচ করতে পারেননি, কী এমন বলবেন সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে। অথচ প্রজ্ঞাবান এই মানুষটি অত্যন্ত কৌশলী হয়ে ওই দিন স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। আর এসব কারণেই বঙ্গবন্ধুর অনবদ্য সাবলীল ভাষণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। এটা বাঙালি হিসেবে আমাদের গর্ব ও অহংকারের জায়গা।


বঙ্গবন্ধুই আমাদের জাতির পিতা
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রাম ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান আর দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রম হারানোর বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হলো সেটার মহানায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বন্দী বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন না তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, এসব ভাবনা পদদলিত করে শুধু তাঁরই নামে এদেশের ৯৮ শতাংশ আমজনতার আবাল বৃদ্ধ বণিতা কামার কুমোর মুটে কুলি দিনমজুর তাঁদের স্ব স্ব জীবন বাজি রেখে ৭ মার্চের ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়ে যাঁর যা আছে তাই নিয়ে যেভাবে পারে সেভাবেই শত্রুর মোকাবেলা করে দেশকে স্বাধীন করেন।


বর্তমান সরকার জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনীতে বঙ্গবন্ধুকে সম্মাননা প্রদান করেছে। এটা একটা সাংবিধানিক স্বীকৃতি। কিন্তু বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামে তাঁর যে অবদান তাতে সংবিধানে নয়, জন মানুষের হৃদয়ে তিনি জাতির পিতা হিসেবে আছেন এবং থাকবেন। জাতির পিতাকে নিয়ে টানা হেঁচড়া বিষয়টি কিন্তু একমাত্র আমাদের দেশ ব্যতীত পৃথিবীর অন্য কোনো দেশেই নেই। প্রতিটি দেশেই তাদের জাতির পিতাকে সম্মান করে থাকেন। তাই আমাদেরও উচিত দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে জাতির পিতাকে জাতির পিতা হিসেবে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা।


১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ার সম্ভ্রান্ত শেখ পরিবারে জন্ম নেয়া খোকা নামের অজ গ্রামের সেই শিশুটি পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালির মুক্তির দিশারী। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ এবং জনগণের প্রতি মমত্ববোধের কারণে পরিণত বয়সে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, ইতিহাসে ঠাঁই করে নেন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার এবং জাতির পিতা হিসেবে।


শেখ মুজিব যেভাবে বঙ্গবন্ধু হলেন
১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কয়েকজন রাজনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা  পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত মর্মে শেখ মুজিবুর রহমানসহ মোট ৩৫ জনকে আসামি করে ১৯৬৮ সনের ২০ জুন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি শুরু হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক বঙ্গবন্ধুর কারণেই শুরু হয় ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান। সে সময় ছাত্র-জনতা স্লোগানে মুখরিত করে রব তোলেন, ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।’


অবশেষে নিরুপায় হয়ে আইয়ুব খান ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অভিযুক্ত সকল আসামিকে নিঃশর্ত  মুক্তি প্রদান করেন। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঢাকাস্থ রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল গণসংবর্ধনার আয়োজন করা হয় এবং ওই সভায় তৎকালীন ডাকসুর সভাপতি আওয়ামী সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ঢাকার ইতিহাসে এত বড় বিশাল জনসভা ইতঃপূর্বে আর কখনো হয়নি। উক্ত  মহাসমাবেশে ১০ লাখ লোকসমাগম হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এর পর থেকে বাংলার জনগণের কাছে শেখ মুজিবুর রহমান নাম ছাপিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিটি ক্রমেই জনপ্রিয় হতে থাকে।


তাই আসুন, আমরা দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে সম্মান করি এবং আমরা যাঁরা কৃষিবিদ বা কৃষিজাত পেশার সাথে  জড়িত তাঁরা নতশিরে বঙ্গবন্ধুকে প্রণতি জানাই।

মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমি (নাটা), গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭১১৮৮৪১৯১

 

বিস্তারিত
অপ্রচলিত জলজসম্পদের বাণিজ্যিক ব্যবহার ও সম্ভাবনা

অপ্রচলিত জলজসম্পদের বাণিজ্যিক ব্যবহার ও সম্ভাবনা
ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ
জলজসম্পদে আমাদের দেশ খুবই সমৃদ্ধ। আমাদের জলাশয়ে প্রায় ৮০০ প্রজাতির মিঠা ও লোনাপানির মাছ ও চিংড়ি রয়েছে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদন বর্তমানে মূলত চাষ নির্ভর এবং লোনাপানির মাছ আহরণ নির্ভর। মৎস্য খাতের উন্নয়ন ভাবনায় আমরা প্রধানত মাছ ও চিংড়িকে বিবেচনা করে থাকি। কিন্তু মাছ ও চিংড়ি ছাড়াও আমাদের জলাশয়ে বৈচিত্র্যময় জলজসম্পদ রয়েছে। দেশের জলজসম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষার লক্ষ্যে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বস¤পন্ন অপ্রচলিত জলজ প্রাণি যেমন-শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া, কুচিয়া, কুমির, কচ্ছপ, পটকাসহ সামুদ্রিক প্রাণির উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রজনন, চাষ ও সংরক্ষণ এখন সময়ের দাবি। আমাদের জলবায়ু ও পরিবেশ এসব প্রাণির প্রজনন ও প্রতিপালনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এসকল অপ্রচলিত কিন্তু অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ জলজসম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের আমিষ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এতে দেশের অর্থনীতি একদিকে যেমনি সমৃদ্ধ হবে পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে।


অপ্রচলিত মৎস্য বা জলজসম্পদ বিষয়ে গবেষণা এদেশে অত্যন্ত সীমিত। চাহিদা ও সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে অপ্রচলিত মৎস্যস¤পদ বিষয়ে গবেষণা জোরদার করা প্রায়োজন। অপ্রচলিত মৎস্যসম্পদের বাণিজ্যিক ব্যবহার ও সম্ভাবনার বিষয়ে নিম্নে আলোকপাত করা হলো।


শামুক-ঝিনুক চাষ
বাংলাদেশে শামুকের প্রায় ৪৫০টি প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্যে যে দুটি প্রজাতি সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় তা হলো
Pila globosa (আপেল শামুক)  ও Viviparus bengalensis (পন্ড স্নেইল)। সাধারণত শামুকের মাংসল অংশ খাদ্য হিসেবে ব্যবহƒত হয়ে থাকে। মানুষ ও মাছের খাদ্য হিসেবে শামুকের চাহিদা থাকায় বাংলাদেশে শামুক চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।


বাংলাদেশের স্বাদু এবং লবণাক্ত পানিতে প্রায় ১৬ প্রজাতির ঝিনুক পাওয়া যায়। সুদূর অতীত থেকে ঝিনুক হতে মুক্তা আহরণ করা হচ্ছে। প্রাকৃতিক এবং মনুষ্য সৃষ্ট কারণে জলাশয়ে ঝিনুকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ঝিনুকে আর আগের মত মুক্তা পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা কৃত্রিমভাবে স্বাদুপানির ঝিনুক থেকে মুক্তা উৎপাদন  কৌশল উদ্ভাবন করেছে। বিশেষ কৌশলে ঝিনুকে মেন্টাল টিস্যু ঢুকিয়ে অপেক্ষাকৃত কম গভীরতার পুকুরে লালন করা হয়। এতে ৮-১০ মাসেই ঝিনুকে ২ থেকে ৩ মিলিমিটার সাইজের মুক্তা উৎপাদিত হয়- যা রাইস পার্ল নামে পরিচিত। এ ছাড়া ঝিনুকে বিভিন্ন ধরনের ইমেজ মুক্ত উৎপাদন প্রযুক্তিও ইতোমধ্যে ইনস্টিটিউট থেকে উদ্ভাবন করা হয়েছে। প্রযুক্তিটি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মৎস্যচাষি বিশেষত গ্র্রামীণ মহিলাদের মাঝে সম্প্রসারিত করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জলজ পরিবেশে ভারসাম্য বজায় রাখা ও শামুক-ঝিনুকের চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহে শামুক-ঝিনুক চাষ বিষয়ক একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তাছাড়া সাগর উপকূলে প্রাপ্য শামুক-ঝিনুক আহরণ বা চাষের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে অবদান রাখা সম্ভব।


কাঁকড়া চাষ
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে কাঁকড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কাঁকড়া
(Mud crab, Scylla spp.) দেশের উপকূলীয় এলাকা হতে বহির্বিশ্বে রপ্তানি করা হয়। কাঁকড়ার অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটি গত এক দশকের অধিক সময় ধরে  কাঁকড়ার ওপর গবেষণা করে ফ্যাটেনিং কৌশল উদ্ভাবন করেছে যা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। ফ্যাটেনিং করা কাঁকড়া চীন, হংকং, তাইওয়ানসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইনস্টিটিউটের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি এবং লোনাপানি কেন্দ্র হতে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনে প্রাথমিক সফলতা অর্জিত হয়েছে।
কুচিয়া চাষ
সাধারণ জনগোষ্ঠীর কাছে কুচিয়া মাছের গুরুত্ব না থাকলেও দেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে এই মাছ ব্যাপক জনপ্রিয়। পুষ্টিমান বিবেচনায় কুচিয়ায় পুষ্টির পরিমাণ অন্যান্য মাছের তুলনায় অনেক বেশি। রক্ত শূন্যতা দূরীকরণ, উচ্চ রক্তচাপ ও ক্যান্সার প্রতিরোধে কুচিয়া মাছ খুবই উপকারী। এদেশে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে যে কুচিয়ার প্রজাতি পাওয়া যায়, সেটি হলো
Monopterus cuchia উপযুক্ত পরিবেশে নিয়ন্ত্রিত প্রজনন ও চাষাবাদ করতে পারলে একদিকে যেমন প্রাকৃতিক উৎস থেকে কুচিয়া আহরণের পরিমাণ কমবে তেমনি দেশে কুচিয়ার উৎপাদন বাড়বে। প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রিত প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কুচিয়ার পোনা উৎপাদন কৌশল বিএফআরআই থেকে ইতোমধ্যে উদ্ভাবন করা হয়েছে।
 

কচ্ছপ চাষ
বাংলাদেশে প্রায় ২৫ প্রজাতির কচ্ছপ আছে। তবে এদের মধ্যে ১১টি প্রজাতি মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহƒত হয়। এদেশে বিদ্যমান কচ্ছপের বিভিন্ন প্রজাতিসমূহের মধ্যে নরম খোলসধারী কচ্ছপ
(Aspiderestes gangeticus, A. huruma and Lissemys punctata)   চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। প্রণোদিত প্রজনন ও চাষ কৌশল উদ্ভাবনের মাধ্যমে কচ্ছপের প্রাচুর্যতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কচ্ছপ চাষ অনেকাংশে কৃত্রিম উপায়ে উৎপাদিত বাঁচ্চা ও সম্পূরক খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই এ চাষ ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে কচ্ছপের কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও সম্পূরক খাদ্য তৈরির কৌশল বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন।


কুমির চাষ
বর্তমানে বাংলাদেশে তিন প্রজাতির কুমির পাওয়া যায়, মিঠাপানির কুমির
(Crocodylus palustris), লোনাপানির কুমির (Crocodylus porosus) এবং ঘড়িয়াল (Gavialis gangeticus)| IUCN এর বাংলাদেশ রেড লিস্ট অনুসারে মিঠাপানির কুমির এখন বিলুপ্তপ্রায়, অপর ২টি প্রজাতিও বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে উদ্যোক্তা পর্যায়ে ময়মনসিংহ, কক্সবাজার ও বান্দরবনে ৩টি কুমিরের খামার গড়ে উঠেছে। প্রায় এক দশক পূর্বে মালয়েশিয়া থেকে আমদানীকৃত মিঠাপানির কুমির দেশে চাষ ও প্রজননের মাধ্যমে এখন রপ্তানি করা হচ্ছে। কুমিরের শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যায়। কুমিরের মাংস খাদ্য হিসেবে, চামড়া থেকে ব্যাগ, পার্স ও বেল্ট, হাড় থেকে সুগন্ধি, দাঁত থেকে গহনা এবং চোয়াল চাবির রিং তৈরিতে ব্যবহƒত হয়।


সাগর উপকূলে সী-উইড চাষ
সী-উইড সাগরের এক প্রকার তলদেশীয় জলজ উদ্ভিদ। সী-উইড বিশ্বব্যাপী একটি গুরুত্বপূর্ণ জলজ সম্পদ, পুষ্টিগুণের বিচারে যা বিভিন্ন দেশে খাদ্য ও শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, কেবল সেন্টমার্টিন নয় কক্সবাজার উপকূলের অনেক স্থানে সী-উইড চাষ সম্ভব। ইনস্টিটিউট পারিচালিত গবেষণা ফলাফল ও এশিয়ার অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের উপকূলে সী-উইড চাষের সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল।


লবস্টার, স্কুইড আহরণ ও মূল্য সংযোজিত পণ্য উৎপাদন
লবস্টার একটি মূল্যবান আকর্ষণীয় সামুদ্রিক খাদ্য। স্কুইড আমরা না খেলেও বিদেশে এদের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশে প্রাপ্ত স্কুইড প্রজাতির মধ্যে
Loligo edulis প্রজাতিটি বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ । স্কুইড মেদ কমায়, হাড় মজবুতসহ আর্থ্রাইটিস দূর করে। প্রতি ১০০ গ্রাম স্কুইডে প্রায় ৯২ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। মূল্য সংযোজিত পণ্য হিসেবে এদের আহরণ ও বাজারজাতকরণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের আলোচিত নীল-অর্থনীতিতে এ ধরনের মৎস্যস¤পদ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
 

রাজ কাঁকড়া
সামুদ্রিক আর্থোপড রাজ কাঁকড়া ষরারহম ভড়ংংরষ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে ২ প্রজাতির রাজ কাঁকড়া 
(Carcinoscorpius rotundicauda এবং Tachypleus gigas) পাওয়া যায়। রাজ কাঁকড়ার রক্তে হিমোগ্লোবিন থাকে না, নীল রক্তে ধসবনড়পুঃবং নামক বিশেষ রোগ বিনাশী উপাদান থাকে। যে কারণে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে বাণিজ্যিকভাবে রাজ কাঁকড়ার চাষ ও পরিচর্যা করা হয়। মূলত রক্ত সংগ্রহের পর এদের সাগরে ছেড়ে দেওয়া হয়। ঔষধি গুণাবলী ছাড়াও রাজ কাঁকড়ার ডিম একটি মূল্যবান খাবার। রাজ কাঁকড়া থেকে টেট্রডোটক্সিন আহরণ করে বিদেশে রপ্তানি করা যায়। অ্যানেসথেসিয়ায় টেট্রডোটক্সিন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় এবং উচ্চমূল্যে তা বাজারে বিক্রয় হয়। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ করা গেলে রাজ কাঁকড়া দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে।


পটকা মাছ
আমাদের দেশে পটকা মাছ
(Puffer fish) স্বাদুপানি ও  লোনাপানিতে পাওয়া যায়। পটকা মাছ সাধারণত টেট্রোডক্সিন (Tetrodotoxin-TTX) নামক বিষ বহন করে। পটকা মাছের বিষাক্ততা এলাকা ও ঋতুভেদে ভিন্নতর হয়। পটকা মাছ খেয়ে আমাদের দেশে অজ্ঞতার কারণে অনেক সময় মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে। অথচ অনেক সামুদ্রিক পটকা জাপান, কোরিয়া ও চীনে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও দামি মাছ হিসেবে পরিচিত। তাই সামুদ্রিক পটকা চাষ করে বিদেশে রপ্তানি করা যায়।  তাছাড়া, বিষাক্ত পটকা মাছের বিষ (TTX) অত্যন্ত দামি ও মেডিক্যাল চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। তাই পটকা মাছের বিষ পৃথক (Isolate) করে বিদেশে রপ্তানি করা যায়।

মহাপরিচালক, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ, মোবাইল নম্বর : ০১৬৭৬১৩৩৪৬৫, ই-মেইল : dgbfri@gmail.com

বিস্তারিত
বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টিতে প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন

বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টিতে প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন  

ডাঃ মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান১ ডাঃ মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান২

জাতির পিতা চেয়েছিলেন দেশকে আমদানী নির্ভর না করে উৎপাদন বৃদ্ধি করে দেশের উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করতে। প্রতিটি সেক্টরে যেন বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে তা ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। বাংলাদেশকে সোনার বাংলাদেশ গঠনের জন্য তিনি নিবেদিত ভাবে প্রতিটি দিক এবং সম্ভাবনাময় খাতগুলো নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার শত শত পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। তার ধারাবাহিকতায় আজ দেশের প্রতিটি ক্ষেত্র সম্মানজনক অবস্থানের কারণে বিশ্বের বুকে স্থান করে নিয়েছেন।    


শুধু দুই বেলা দুমুঠো ভাত খেলেই হবে না। মেধাবী জাতি গঠনে পুষ্টিকর খাবার আমিষ ও স্নেহ জাতীয় খাবারের জোগান এবং অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য প্রাণিসম্পদ বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম কৃষিবিদদের ক্লাস ওয়ান মর্যাদা দিয়েছিলেন। বর্তমানে তাঁরই চিন্তার ফসল হিসাবে আজ আমরা আমিষের ঘাটতি থেকে বাড়তি অবস্থানে এসেছি। যখন দেশের জনসংখ্যা মাত্র ৭-৮ কোটি ছিল তখনই দেশে আমিষের ঘাটতি ছিল। বর্তমানে মানুষ প্রতিদিনই মাংস, দুধ, ডিম খেয়ে থাকেন। পুষ্টিহীনতার কারণে রোগগুলোর হাত থেকে এখন দেশের মানুষ নিরাপদ। গ্রামের মেয়েরাই কয়েকটি করে গরু ছাগল অনায়াসেই পালন করে তাদের সংসার চালিয়ে আসছেন। বর্তমানে মুসলমানদের ইদুল আজহার গবাদিপশু এখন আমাদের দেশের পশু দিয়েই চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মিল্ক ভিটা প্রতিষ্ঠা করে ডেইরি সেক্টরের অগ্রযাত্রাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছেন। তিনি ডেইরি জোনকে লাভজনক করার জন্য সকল পদক্ষেপও গ্রহণ করেছিলেন। সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় ভালো ভালো ব্রিড আমদানি করে এসব অঞ্চলকে দুগ্ধ অঞ্চল হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর তৈরি করা স্বপ্নের মিল্ক ভিটার মাধ্যমে খামারিরা দুধের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন। ঠিক তেমনি ভোক্তারা পাচ্ছেন ভালো মানের দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যসম্ভার। বর্তমানে বাংলাদেশের ডেইরি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে খামারিদের থেকে সবচেয়ে বেশি দামে এবং বেশি পরিমাণে দুধ সংগ্রহ করে থাকেন।  


বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলাদেশ যেন সব কিছুতেই বিদেশের ওপর নির্ভর না করে। তিনি স্বাধীনতার কথা বলার সাথে সাথে মুক্তির সংগ্রাম কথাটি বলেছেন। আমরা ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র বাংলাদেশ পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়েই তার স্বপ্নকে স্তব্ধ করে দেননি। তিনি মুক্তির জন্য প্রতিনিয়ত শ্রম ও মেধা এবং দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণ পর্যন্ত সর্বদা মানুষের মুক্তির ও পুষ্টির নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য সকল বিষয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।


গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখতে গবাদি প্রাণী পালনের জন্য তিনি প্রাণিসম্পদ সেক্টরকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সবার সম্মোলিত প্রয়াস এবং সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ দেশের অর্থনীতিতে এক বিরাট অবদান রেখে চলেছেন। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনে যথেষ্ট ভূমিকা রেখে চলেছেন। মানুষের সুস্থতার জন্য যে আমিষের প্রয়োজন তার সিংহভাগই পূরণ করছে প্রাণিসম্পদ সেক্টর। উন্নত আমিষ দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ভাল রেখেছে। বর্তমান করোনা মহামারীর কারণে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শানিত করতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে প্রাণিসম্পদ সেক্টর। নিয়মিত ডিম, দুধ এবং মাংস খাওয়ার ফলে দেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা বাংলাদেশের জন্য একটি প্রতিরোধী ব্যবস্থা।  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান প্রথম দেশে গরু পালন, ছাগল পালনকে একটি সম্মানজনক পেশা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাঁরই দূরদর্শী চিন্তাধারার কারণে দেশে বড় বড় খামার এবং ডেইরি শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের আমিষের চাহিদার পূরণে আমদানি নির্ভরতা থেকে রপ্তানিমুখি হয়েছে। দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।


প্রাণিসম্পদের উন্নতির জন্য দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট। এখান থেকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বাস্তবিক বিষয়ে গবেষণা হয়ে প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। পূর্বে গবাদি প্রাণীর অসংখ্য রোগবালাই এর কারণে অনেক প্রাণী মারা যেত, কিন্তু বর্তমানে ভ্যাকসিনের প্রয়োগ এবং বিজ্ঞানসম্মত খামার ও পরিচর্যায় রোগের প্রকোপ ও মৃত্যু অনেকাংশে কমানো সম্ভব হয়েছে।


বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন সবাইকে সাথে নিয়ে এগোতে। কেউ যেন বঞ্চিত না হয়। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে তাঁর কন্যা বর্তমান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সমান তালে উন্নয়নে শামিল করার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মাধ্যমে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। সমতল ভূমিতে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের প্রাণিসম্পদের মাধ্যমে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার জন্য প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদানসহ নানা উপকরণ সামগ্রী বিতরণ করে আসছেন। এতে করে তারা গরু ছাগল পালন করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।


বর্তমানে প্রাণিসম্পদের সকল উৎপাদিত পণ্য মানুষের জন্য নিরাপদ করা হচ্ছে।  শুধু উৎপাদন বাড়িয়ে সবার কাছে আমিষ পৌঁছে দিয়েই শেষ নয়। সে খাবারটি যেন মানুষের জন্য হুমকির কোন কারণ না হয় সে ব্যাপারেও কাজ করছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। বেশ কিছু রোগ প্রাণি থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভেটেরিনারি পাবলিক হেলথ সার্ভিস জোরদারকরণ প্রকল্প। এর মাধ্যমে জুনোটিক রোগে আক্রান্ত প্রাণীকে মেরে ফেলার পাশাপাশি খামারির ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন দেশের মানুষ এসব সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার পথ সৃষ্টি হচ্ছে পাশাপাশি খামারিরাও ঘুরে দাঁড়ানোর সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। অ্যানথ্রাক্স, যক্ষা, ব্রুসেলোসিস এবং জলাতঙ্কে আক্রান্ত আর কোন প্রাণিকে কেউ গোপনেও জবাই করতে পারবে না। এই ব্যাপারে আইনের কঠোর প্রয়োগ করা হবে মর্মে মাংশ প্রক্রিয়াজাতকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে নানা প্রশিক্ষণ এবং কর্মশালা পরিচালনা করছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।


করোনাকালীন সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের প্রণোদনার কাজটিও করছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। প্রাণিসম্পদের সবচেয়ে বড় প্রকল্প  প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য প্রায় ৬ লক্ষ খামারিকে ৯৮০ কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রাণিসম্পদের পক্ষ থেকে খামারিদের জন্য এত অনুদান দেয়া হয়নি। তাছাড়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৫৫০০টি ডেইরি গ্রুপের মাধ্যমে দেশের দুধের চাহিদা পুরণ করতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়।  ডিম ও মাংসে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংম্পূর্ণ, দুধে কিছুটা ঘাটতি আছে যার জন্য এলডিডিপির কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশের দুধের চাহিদা পুরণ করে রপ্তানি পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবে।


দেশের প্রাণিসম্পদের সবচেয়ে ক্ষতি হয় ছাগলের পিপিয়ার রোগের মাধ্যমে। বর্তমানে প্রাণিসম্পদ সেক্টরের এই ক্ষতি থেকে ছাগল-ভেড়াকে নিরাপদ রাখার জন্য পিপিয়ার এবং ক্ষুরারোগ নির্মূল প্রকল্পের মাধ্যমে বিনামূল্যে এসব রোগের টিকা প্রদান করে আসছে। এতে করে মারাত্মক এসব ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে রোগে  আক্রান্ত পশুর মৃত্যু হার কমানোর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। সারা দেশে এসব টিকা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে টিকা প্রদানকারী স্বেচ্ছাসেবী কর্মী নিয়োগ পেয়েছে। সঠিক  সময়ে ভ্যাকসিন সরবরাহ ঠিক থাকলে এক সময় আমরা এই রোগগুলোকে বিলুপ্ত করতে পারবো।


ছোট থেকে বড় যে কোন পরিসরে খামার করে লাভবান হওয়া যায়। গ্রামে একটি ডেইরি খামার একদিকে যেমন উদ্যোক্তার আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উপায়, ঠিক তেমনি এলাকার মানুষের তরল দুধের চাহিদা পূরণ করে পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মহিলাদের আর্থিক লাভবানের একমাত্র উপায় এই প্রাণিসম্পদ। বঙ্গবন্ধু এই সোনার বাংলা গড়তে পুষ্টি খাদ্যেসমৃদ্ধ মেধাবী জাতি গঠনের কোনো বিকল্প নেই। বর্তমানে আমিষ ও স্নেহজাতীয় খাবার গ্রহণের প্রবণতা বেশি হওয়ার মেধাবী ও সুস্থ স্বাভাবিক সন্তান জন্মদানের সংখ্যা আগের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা মেধাবী জাতি গঠনের জন্য একটি সুসংবাদ। গ্রামের মানুষের পুষ্টির জন্য কারো প্রতি নির্ভর করতে হয় না। মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার জন্য গ্রামের পরিবেশ এখন অনেকাংশে শহরে সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে।


জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলাদেশ গড়তে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া কাজ করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধাণমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ সেক্টর তার সর্বোচ্চ সাফল্যে পৌঁছাতে পারবে। মাঠপর্যায়ের কর্মচারী বৃদ্ধি করে জনগণকে উপযুক্ত সেবা প্রদানের মাধ্যমে দেশ উন্নয়নশীল থেকে উন্নত বিশ্বে পরিণত হবে।

 

১জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ২প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা (এলডিডিপি), উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল, ভোলাহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ মোবাইল : ০১৭২৩-৭৮৬৮৭৭, ই-মেইল : mmrdvm10@gmail.com

বিস্তারিত
কৃষি গবেষণায় অবদান : বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা

কৃষি গবেষণায় অবদান : বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা

১ড. মো. শাহজাহান কবীর, ২কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন দেশে মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার মধ্যে তিনি বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। বাস্তবায়ন করেছিলেন অনেক অসাধ্য কর্মসূচির। একটি রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় এমন কোনো বিষয় নেই যে তিনি স্পর্শহীন রেখেছেন। তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নের শক্ত ভিত রেখে গেছেন বলেই আজকে সবক্ষেত্রে এত সাফল্য।  
১৯৭১ সালের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে খরাজনিত দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে এক মারাত্মক পরিস্থিতির। দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে সরকারকে মুখোমুখি হতে হয় প্রচণ্ড সমস্যার। ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে আশানুরূপ বৃষ্টিপাত না হওয়ায় দেখা দেয় খরা। কিন্তু সরকার তা মোকাবিলা করেছিল। প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা ও অপূর্ণতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের প্রশংসা করতে হয় দুর্ভিক্ষ এড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সদ্ব্যবহারের।
জাতির পিতার সবচেয়ে বড়             কৃতিত্ব ছিল স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যে দেশকে একটি শাসনতন্ত্র উপহার দেয়া। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি জানি না রক্তাক্ত বিপ্লবের পর পৃথিবীর আর কোনো দেশে সঙ্গে সঙ্গে গণতান্ত্রিক শাসন চালু হয়েছে কি না।...নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছে কি না।’ প্রতিকূল অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সামাল দিতে বঙ্গবন্ধু ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর সূচনা করেছিলেন। নতুন কর্মসূচি গ্রহণের পর পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতার লক্ষণ ফুটে ওঠে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার গঠনের পরপরই কৃষিকে অগ্রাধিকারভুক্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন। সদ্য স্বাধীন দেশের ৩০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি পূরণে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক আমদানির মাধ্যমে এবং স্বল্প মেয়াদে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি-উপকরণ সরবরাহ করে এবং কৃষিঋণ মওকুফ, সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার ও খাসজমি বিতরণ করে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘একটা স্বল্প সম্পদের দেশে অনবরত কৃষি উৎপাদন-হ্রাসের পরিস্থিতি অব্যাহত থাকতে পারে না। দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধির সকল প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। চাষিদের ন্যায্য ও স্থিতিশীল মূল্য প্রদানের নিশ্চয়তা দিতে হবে।’
প্রাতিষ্ঠানিক কৃষি উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন, পুনঃসংস্করণ, উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য উন্নয়ন   কর্পোরেশনসহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন এবং পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সংসদে নতুন আইন পাস করে সেগুলো পুনর্গঠনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। বিদ্যমান বিভিন্ন  প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো ও কার্যক্রমের আমূল পরিবর্তন ও সংস্কারের মাধ্যমে এবং প্রযুক্তি চর্চায় মেধা আকর্ষণের যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথ ধরে তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন দীর্ঘ ২১ বছর পর সরকার গঠন করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার কর্মসূচি হিসেবে চিহ্নিত করেন। তখন দেশে খাদ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৪০ লাখ মেট্রিক টন। বাজেটে কৃষি গবেষণার জন্য একটি পয়সাও কোনো বরাদ্দ ছিল না। সে বছর ১২ কোটি টাকা শুধু কৃষি গবেষণার জন্য বরাদ্দ করা হয় এবং পরবর্তী বাজেটে ১০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ পায় কৃষি এবং আইসিটি এই দুই সেক্টর। শুরু থেকেই কৃষি গবেষণাকে সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। ফলে পরবর্তী পাঁচ বছরে উন্নয়ন-অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে অর্জিত হয় চমকপ্রদ সাফল্য। প্রথমবারের মতো দেশ খাদ্যে নির্ভরশীলতা অর্জন করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘সেরেস’ পদকে ভূষিত হন।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে দেশে ৪০ লাখ টন খাদ্য      উদ্বৃত্ত রেখে ক্ষমতা ছাড়ে আওয়ামী লীগ। ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বিএনপি-জামাত জোট সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আবারো দেশের কৃষিতে স্থবিরতা নেমে আসে। ২০০২ সালে দানাজাতীয় খাদ্যের উৎপাদন ২ কোটি ৬৮ লাখ টন থেকে নেমে আসে ২ কোটি ৬১ লাখ টনে। আবারো শুরু হয় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারা।
২০০৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বে যখন দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে তখন খাদ্য ঘাটতি ছিল ২৬ লাখ মেট্রিক টন। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিন বদলের সনদ’ অনুযায়ী ‘রূপকল্প ২০২১’ প্রণয়ন করা হয়। পাশাপাশি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয় কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে। প্রথম কেবিনেট সভায় সারের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। যেখানে ৯০ টাকার টিএসপির মূল্য ২২ টাকা ও ৭০ টাকার এমওপির মূল্য ১৫ টাকায় নামিয়ে এনে সুষম সার ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নেন। এছাড়া কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি প্রদান, ১০ টাকায় কৃষকের জন্য ব্যাংক হিসাব চালুকরণ, সেচ সুবিধা বৃদ্ধি, কৃষিতে প্রণোদনা প্রদান, সার বিতরণ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
ফলশ্রুতিতে ২০১৩ সালে এসে দেশ শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাই অর্জন করেনি, খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হয়। এসডিজি (ঝউএ) কে সামনে রেখে ২০০৯ সালে উন্নয়নের যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল তার গতি ও পরিধি সরকারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়াদে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রণীত হয় (২০১৪-১৮) সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। এরই অংশ হিসেবে রূপকল্প ২০২১ এবং রূপকল্প ২০৪১ এর আলোকে জাতীয়      কৃষিনীতি, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, ডেল্টাপ্লান ২১০০সহ নানা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার।
বর্তমান সরকারের আরেকটি বড় সাফল্য হলো কৃষি গবেষণাকে অগ্রাধিকার প্রদান। ফলে প্রতিটি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে ল্যাব উন্নয়নসহ নানামুখী গবেষণা পরিচালনা করার সুযোগ     সৃষ্টি করা হয়েছে। ২০০৮-০৯, ২০০৯-১০, ২০১০-১১, ২০১১-১২, ২০১২-১৩, ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ সালে মোট খাদ্যশস্য (চাল, গম, ভুট্টা) উৎপাদন হয়েছিল যথাক্রমে ৩২৮.৯৫, ৩৪২.৪৬, ৩৬০.৬৫, ৩৬৮.৩৯, ৩৭২.৬৬, ৩৮১.৭৪ এবং ৩৮৪.১৯ লাখ মে. টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৩২.১৫ লাখ টন ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৫৩.৪৪ লাখ মে. টন মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়। এতে পরিলক্ষিত হয় যে, খাদ্যশস্যের উৎপাদন প্রতি বছরেই ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।  
২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত নার্সভুক্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ফসলের ৬৩১টি উচ্চফলনশীল নতুন নতুন জাত এবং ৯৪০টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন উদ্ভাবন করেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত ব্রি কর্তৃক ধানের ৫৫টি জাত, বিএআরআই কর্তৃক বিভিন্ন ফসলের ২৫৮টি জাত, বিজেআরআই কর্তৃক পাটের ১৫টি জাত, বিএসআরআই কর্তৃক ইক্ষুর ৯টি জাত ও সুগার বিট, তাল ও স্টেভিয়ার ৪টি জাত, সিডিবি কর্তৃক তুলার ১০টি জাত এবং বিআইএনএ কর্তৃক বিভিন্ন ফসলের ৬৮টি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। জিএমও প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিটি বেগুনের ৪টি জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে এবং বিটি তুলার জাত উদ্ভাবনের কাজ চলমান রয়েছে। দেশি ও তোষা পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কারসহ পাঁচ শতাধিক ফসলের ক্ষতিকর ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করা হয়েছে। পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের ৫৪টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও উন্মুক্ত করা হয়েছে।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার সব সময়ই কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেট ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষি খাতে বরাদ্দ রাখা ১৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি খাতে ২২ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে যা জিডিপির ০.৭ শতাংশ এবং মোট বরাদ্দের ৪ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত বরাদ্দের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬.৮৩ শতাংশ। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে প্রণোদনা প্রদানে রাখা হয়েছে ২০০ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনা মহামারির প্রেক্ষিতে ৫ হাজার কোটি টাকার কৃষি প্রণোদনা স্কিম ও ৩ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম ঘোষণা করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ২৪ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। যা মূল বাজেটের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।
সরকার কৃষি খাতে যে বরাদ্দ দেয় কৃষি মন্ত্রণালয় আওতাধীন বিভিন্ন দপ্তর/ সংস্থাকে চার পদ্ধতিতে সে বরাদ্দ প্রদান করে, যেমন- রাজস্ব বরাদ্দ, প্রকল্প সহায়তা, কর্মসূচি সহায়তা ও থোক বরাদ্দ। রাজস্ব বরাদ্দের মাধ্যমে সংস্থার জনবলের বেতন-ভাতা, দৈনন্দিন পরিচালনা ব্যয় ও গবেষণা ব্যয় নির্বাহ করা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে যে বরাদ্দ প্রদান করা হয় তা মানবসম্পদ উন্নয়ন, ল্যাবসহ বিভিন্ন গবেষণা অবকাঠামো উন্নয়ন ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ব্যয় নির্বাহ করা হয়। কর্মসূচি বাস্তবায়নের আওতায় প্রদত্ত বরাদ্দে ল্যাবরেটরি নির্মাণ ও গবেষণা ব্যয় নির্বাহ করা হয়। এছাড়াও, বিশেষায়িত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে          কৃষি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা কোডে থোক বরাদ্দ প্রদান করা হয়ে থাকে।
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কৃষিকে আধুনিকীকরণ ও অধিকতর লাভজনক করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ২০১০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত প্রায় ৬৯ হাজার ৮৬৮টি কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে। সম্প্রতি প্রায় ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। চলমান কোভিড-১৯ সারা পৃথিবীর মানুষের জীবন-জীবিকাকে যেমন হুমকির মুখে ফেলেছে, তেমনি এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থাকেও ব্যাহত করছে। করোনার বিরূপ পরিস্থিতিতেও বিশ্বে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’- প্রতিশ্রুতির অন্যতম লক্ষ্য ও অঙ্গীকার হচ্ছে সবার জন্য পুষ্টিসম্মত ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধান করা।  এসডিজি ২০৩০, ভিশন ২০৪১ ও ডেল্টাপ্ল­ান ২১০০ কেবল সরকারের মহৎ পরিকল্পনাই নয় এগুলো অর্থনৈতিক মুক্তি চ্যালেঞ্জের ভিশন। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এগুলো বাস্তবায়ন হলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তব রূপ ধারণ করবে। য়

১মহাপরিচালক, ২ঊধ্বর্তন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। মোবাইল :০১৭১৬৫৪০৩৮০, ইমেইল :smmomin80@ gmail.com

বিস্তারিত
টেকসই কৃষি : প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয়

টেকসই কৃষি : প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয়
মো: কাওছারুল ইসলাম সিকদার

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে কৃষিতে করেছে প্রভূত উন্নতি। ঘনবসতিপূর্ণ ছোট এ ভূখণ্ডে কৃষি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম খাত। এ খাতের গুরুত্ব ব্যাখ্যা নয় বরং অনুধাবনের বিষয়। কৃষি উৎপাদন ধারা ক্রমে পরিবর্তিত হচ্ছে। সেইসাথে মানুষের খাদ্যাভ্যাসও পরিবর্তিত হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর চাহিদার নিরিখে শস্য, ফলমূল, শাকসবজি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিমের উৎপাদন বেড়েছে। দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হলো সচেতনতা, শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নতি, কৃষি পণ্যের প্রাপ্যতা এবং এর বাজারমূল্য। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাত্রা অনেকটা মৌসুমের উপরও নির্ভর করে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক   রাজনীতি, অর্থনীতি, ভবিষ্যৎ জনসংখ্যা, জলবায়ুগত পরিবর্তন, সম্পদের সীমাবদ্ধতার প্রেক্ষাপটে খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদতার নিশ্চয়তা বিধানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান অত্যাবশ্যক। সেইসাথে সরকারিভাবে কৃষি নীতি প্রণয়ন ও সময়ানুপযোগী বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরি।


বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষায় বিভিন্নমুখী অনিশ্চয়তার সম্মুখিন। প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নিলে টেকসই কৃষি উন্নয়ন সম্ভব হবে।


অনিশ্চিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য
টাকা হলে খাদ্য মিলবে এ ধারণাটি এখন আর সঠিক নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য কোনো একটি একক দেশের পক্ষে যেমনি জোগান দেয়া সম্ভব নয় তেমনি একক দেশ হতেও সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এই দেশে কোনো একটি ফসলের হানি ঘটলে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি করে তা পূরণ করতে হয়। বিশ্বের সকল দেশ সব কৃষিপণ্য উৎপাদন করতে সক্ষম নয়। কারণ কৃষি উৎপাদন একান্তভাবেই মাটি, পানি, বায়ু ও উপযোগী তাপমাত্রার উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ বিশ্বের প্রত্যেক অঞ্চল স্বতন্ত্র ফসল উৎপাদনের জন্য উপযোগী এবং এ সকল ফসলের উৎপাদন খরচও দেশ, মহাদেশ ও অঞ্চলভেদে ভিন্ন হয়। মূলত সংশ্লিষ্ট দেশের মানুষের পছন্দ ও খাদ্যাভ্যাসের ওপর ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট দেশ বা দেশের প্রদেশ নির্দিষ্ট জাতের কৃষিপণ্য উৎপাদন করে। আবার আমদানিকারক দেশ হতে রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী দেশের অবস্থানগত দূরত্ব, পরিবহণ খরচ, সমুদ্রবন্দরে সুবিধা প্রভৃতিও কৃষিপণ্য আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে। তাই কৃষিপণ্য আমদানির পরিমাণ বেশি হলে এর জোগানের ঘাটতিসহ উল্লিখিত বহুবিধ কারণে যথাসময়ে খাদ্য আমদানি করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়ে উঠে না। উদাহরণস্বরূপ করোনাকালে ভারত কর্তৃক পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় মিসর, মিয়ানমার, পাকিস্তান ও তুরস্ক থেকে বাংলাদেশকে পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। বিশেষ প্রয়োজনে তুরস্ক থেকে আকাশ পথে পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়েছে। পেঁয়াজ আকাশ পথে পরিবহণের কারণেও পণ্যের আমদানির খরচ বেড়ে যায় এবং ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাইরেও চলে যায়।


বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ তাদের চাহিদানুযায়ী নিজস্ব সম্পদের উপর ভিত্তি করে সর্বোচ্চ কৃষি উৎপাদন নিশ্চিতে প্রচেষ্টা চালায়। যদিও সেক্ষেত্রে পণ্যের উৎপাদন খরচ অনেকটা বেড়ে যায়।     কৃষিপণ্য উৎপাদনে কোনো দেশের যদি কোন একদিকে সম্পদের ঘাটতি থাকে তবে সে দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রে যে সম্পদের সহজলভ্যতা রয়েছে তার মাধ্যমে টেকসই কৃষি উৎপাদন নিশ্চিত করে এবং উৎপাদন খরচ কমিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালায়। কৃষিকে টেকসই করতে হলে অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে কৃষিজপণ্য উৎপাদনে সম্পদের সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে এবং ভবিষ্যৎ চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে দীর্ঘমেয়াদি নীতি ও সম্পদ বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। যাতে দেশের মানুষের প্রধান মৌলিক চাহিদা যে কোনো পরিস্থিতিতে মেটানো সম্ভব হয়।


কৃষির উন্নতি তথা অধিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ অত্যাবশ্যক। বর্তমানে চাষের জন্য কৃষকরা পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, সেচ ইঞ্জিন আমদানি করছে এবং ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করেছে। এসব উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে, পরনির্ভরশীল হয়ে নয় বরং দেশেই দেশি ও বিদেশি সহায়তায় কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরি করার মাধ্যমে। পাশাপাশি জৈবসারের উৎপাদন বাড়াতে হবে। রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। আমাদের বীজ উৎপাদনে স্বাবলম্বী হতে হবে। আর তা না করা হলে অনিশ্চিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বীজ, সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের স্বল্পতার কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। তাই কৃষি উপকরণ প্রস্তুত এবং কৃষি উৎপাদনে স্বাবলম্বীতা অর্জনে অগ্রাধিকার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ খাতের সকল বিনিয়োগ ও আমদানি-রপ্তানিতে কর ও বিদ্যমান করহীন বাধাসমূহ মুক্ত করতে হবে। এ খাতের বিকাশে কৃষককে ভর্তুকি দিতে হবে এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপনে উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিতে হবে, দিতে হবে প্রণোদনা। তবেই কৃষক স্বল্প খরচে উৎপাদন করতে সক্ষম হবে এবং দেশের কৃষি উৎপাদন টেকসই হবে। হবে গ্রামীণ অর্থনীতি সমৃদ্ধ।


কৃষি জমির সীমাবদ্ধতা
নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রসার এবং রাস্তা-ঘাট, সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ, স্কুল কলেজ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার কারণে বাংলাদেশে কৃষিজমির পরিমাণ কমছে। সেইসাথে শিল্পের দূষণ ও বর্জ্য কৃষি জমির উর্বরতা নষ্ট করছে। এ ছাড়া নদী-নালায় সারা বছর পর্যাপ্ত পানি প্রবাহ না থাকায় কৃষি জমির উর্বরতাও নষ্ট হচ্ছে এবং সেচের পানির অভাবে অনেক কৃষি জমি চাষের আওতায় আনাও সম্ভব হচ্ছে না। গ্রামীণ অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার আগমন এবং সে অর্থ বসতবাড়ি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণে কৃষিজমির ব্যবহার ঘটছে। ফলে কৃষি জমি অ-কৃষি জমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এসব কারণে একদিকে কৃষি জমির পরিমাণ ক্রমে কমছে এবং বিদ্যমান কৃষি জমি কৃষি কাজের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় টেকসই কৃষি উৎপাদন এবং ভবিষ্যৎ বাড়তি চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে কৃষি জমি সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার ও এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য বাড়িঘর, স্কুল-কলেজ, সামাজিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণে উলম্বমুখী উন্নয়নের বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যমান রাস্তাঘাট ও সড়ক নির্মাণে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ রক্ষায় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মৌসুমি জলাবদ্ধতা নিরসনে মাটি দ্বারা ভরাট হওয়া কালভার্ট, সেতুর তলদেশের মাটি সরিয়ে পানি চলাচলের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেচের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা মাটির নিচ দিয়ে পাইপের মাধ্যমে করে জমির অপচয় রোধ করতে হবে। নগরের বর্জ্য ও শিল্পের দূষণরোধে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে কৃষি জমির মাটি ও নদীনালার পানি দূষণমুক্ত থাকে। জেলা ও উপজেলাভিত্তিক স্যাটেলাইট টাউন/শহর প্রতিষ্ঠা করতে হবে যাতে আবাসনের জন্য গ্রামের কৃষি জমির দখল হয়ে না পড়ে। কৃষি জমি রক্ষায় গ্রামের ২৫% মানুষকে উপজেলা/জেলায় ফ্লাট/এপার্টমেন্ট করে স্থানান্তর করতে হবে।


জনসংখ্যা
বাংলাদেশের জনসংখ্যা বাড়ছে এবং তা ২০৫০ সাল পর্যন্ত তা বৃদ্ধি পাবে। জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার পূর্বের তুলনায় অনেক কমেছে। যা ২০২০ সালের প্রাক্কলন অনুযায়ী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭%। মূলত শিক্ষার অগ্রগতি, কর্মসংস্থানের জন্য শহর বা প্রবাসে অবস্থান, শিক্ষিত নারী ও পুরুষের কর্মসংস্থান, সন্তান গ্রহণের সংখ্যা হ্রাস পাওয়াই মূল কারণ। বর্তমানে বাংলাদেশে যুব শ্রেণির আধিক্য বিরাজমান রয়েছে। তবে এটির আধিক্য হয়তো ২৫-৩০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হবে। কারণ এরা যখন বৃদ্ধ হয়ে যাবে তখন বর্তমান প্রজন্ম কম সন্তান নেয়ার কারণে যুবক-যুবতীর সংখ্যা কমে যাবে। সমাজে কর্মক্ষম লোকের পরিমাণ হ্রাস পাবে। সেইসাথে  চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি, খাদ্যভোগের পরিবর্তন, উন্নত আবাসন এবং পরিবহণ ব্যবস্থা ইত্যাদির কারণে মানুষের গড় আয়ু দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তাই বর্তমানে কর্মক্ষম জনসংখ্যায় দেশ পরিবর্তিত হয়ে বৃদ্ধবহুল জনসংখ্যার দেশে পরিণত হবে। সেইসাথে নগরায়ণের হার বেড়ে যাবে। দেশের জেলা উপজেলায় স্যাটেলাইট টাউন তৈরি হবে। অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে দেশের মানুষ উন্নত নাগরিক সুবিধা পাবে।


জলবায়ুগত চ্যালেঞ্জ
মনুষ্য বসবাসের উপযোগী এ পৃথিবীর জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রাকৃতিক বনভূমি উজাড় হচ্ছে, অতিমাত্রায় ব্যবহার হচ্ছে ফুসিল ফুয়েল, ঘটেছে ব্যাপক শিল্পায়ন, নগরায়ন, যুদ্ধ বিগ্রহে ব্যবহৃত হচ্ছে গোলাবারুদ, যুদ্ধ জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি, পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা প্রভূত কারণে পৃথিবী তার ভারসাম্য দ্রুত হারিয়ে ফেলছে। পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ছে, জলোচ্ছ্বাস ঘূর্ণিঝড় এর মাত্রা ও প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি ও মানবসভ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে। শীতের তীব্রতা ও গ্রীষ্মের উষ্ণতা প্রকট হচ্ছে। মেরু অঞ্চল ধীরে ধীরে বরফশূন্য হয়ে পড়ছে। বিস্তীর্ণ সাইবেরিয়ায় এখন গ্রীষ্মে গম চাষের আওতায় চলে আসছে। সমুদ্রের উষ্ণতা বাড়ছে। উপকূলের নিম্নাঞ্চল সমুদ্রের পানির উচ্চতার কারণে প্লাবিত হচ্ছে। কৃষি জমিতে লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়ছে। নতুন নতুন জীবাণুর আবির্ভাব ঘটছে। যা মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ।


জলবায়ুগত তারতম্যের কারণে শত বছরের আঞ্চলিক ভিত্তিতে যে ধরনের কৃষি অর্থাৎ যে ধরনের ফসল উৎপাদিত হয়ে আসছিল তার স্থলে আজ অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন জাতের শস্য স্থান করে নিয়েছে। তাপমাত্রা বাড়ার কারণে প্রচলিত অঞ্চলভিত্তিক কৃষিকার্য আর সম্ভব হচ্ছে না। আবার উপকূলর্তী অঞ্চলে লবণাক্ততার কারণে শস্য উৎপাদনের প্রকৃতিরও আমূল পরিবর্তন হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ কোরিয়ার দক্ষিণাঞ্চল ডেইগু আপেল চাষের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। কিন্তু তাপমাত্রা বাড়ার কারণে সে অঞ্চলে এখন আর আপেল চাষ ভালো হয় না। তাই উত্তর দিকে যেখানে বেশি ঠাণ্ডা সেখানে আপেল চাষ স্থানান্তরিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বরিশালও ধান, নদী ও খালের জন্য একসময় বিখ্যাত ছিল। বরিশাল শস্য উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। এখন সেখানে ধান উৎপাদন হয় না বললেই চলে। বর্তমানে সেখানে তরমুজ চাষ ভালো হচ্ছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে ঠাণ্ডা তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল বিধায় গম উৎপাদন ভালো হতো কিন্তু বর্তমানে শীতের স্থায়িত্ব কমে যাওয়ায় এবং অমৌসুমি বৃষ্টির কারণে গমের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে এবং এর গুণগতমানও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কীটপতঙ্গের আক্রমণ ও রোগজীবাণু বাড়ছে। এজন্য জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব সরকারকে উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করে সহনীয় মাত্রায় রাখার প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। যাতে কৃষির ক্ষতি যতটা সম্ভব কমিয়ে রাখা যায় এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদতা রক্ষা করা যায়।


পরিশেষে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা একটি সমন্বিত উদ্যোগ এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা, সুশীলসমাজ ও ব্যবসা খাতের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। পরিবর্তিত জলবায়ু সুসামঞ্জস্য কৃষি (পষরসধঃব ংসধৎঃ ধমৎরপঁষঃঁৎব) ব্যবস্থাপনা করলে টেকসই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, ফসলের অভিযোজন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং গ্রিন হাউজ গ্যাস হ্রাসকরণ/নিয়ন্ত্রণ করে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন এবং উন্নয়নের লক্ষ্য নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি বর্তমান সরকারের ভিশন ২০২১, এসডিজি২০৩০, ভিশন ২০৪১ ও ডেল্টাপ্লান ২১০০ বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবরূপ ধারণ করবে। য়

অতিরিক্ত পরিচালক (উপসচিব), বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, মোবাই: ০১৫৫২৩৫৫৪৫৩, ই-মেইল : kawseru11173@gmail.com

বিস্তারিত
বঙ্গবন্ধু ও সবুজ বিপ্লবের উন্নয়ন সূচনা

বঙ্গবন্ধু ও সবুজ বিপ্লবের উন্নয়ন সূচনা
মোঃ মেসবাহুল ইসলাম

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকল প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে যখন ‘সোনার বাংলা’ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের নিজ বাসায় সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে নিহত হন। সে দিন তিনি ছাড়াও ঘাতকের বুলেটে নিহত হন তাঁর স্ত্রী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। এ ছাড়াও তাঁদের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনসহ নিহত হন আরো ১৬ জন। প্রতি বছরে ১৫ আগস্ট জাতীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে এ দিবসটি যথাযথ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর তাঁর পরিবারের সকল শহিদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।


মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বঙ্গবন্ধু কৃষিখাতে যে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন বর্তমানে তাঁর সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা অত্যন্ত দক্ষ হাতে তাঁর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সর্বদা সচেষ্ট। পিতার দেখানো পথে বাংলাদেশের কৃষিখাতকে পৌঁছে দিচ্ছেন উচ্চতার শিখরে।


কৃষিই এ দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত। এ দেশের জনসংখ্যার বেশির ভাগ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। কৃষির এরূপ দেখেই বেড়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু। খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন কৃষিকে অবলম্বন করা আধপেটা-একপেটা কৃষক আর তাদের দারিদ্র্যপীড়িত জীবন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ চিত্র দেখেছেন আর ছুটে বেড়িয়েছেন গ্রাম থেকে গ্রামে এসব বুভুক্ষু মানুষের অন্নসংস্থানে। দেখেছেন পাকিস্তানি শাসকদের বিমাতাসুলভ আচরণ। দেশের কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ১৯৫৪ সালে গঠিত যুক্তফ্রন্ট সরকারে বঙ্গবন্ধু কৃষি, ঋণ, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের জন্য একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য নিয়েই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি ও তাঁর দল নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেন। আলোচনার দ্বার বন্ধ হয়ে গেলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন। সে ডাকে সাড়া দেয় সর্বস্তরের মানুষ। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুকে আটক করে রাখা হয় পাকিস্তানের কারাগারে। দেশ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জন করে স্বাধীনতা। ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি এ দেশের শাসনভার তুলে নেন নিজ কাঁধে।


সদ্য স্বাধীন দেশটি তখন যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর অবকাঠামো আর নাজুক অর্থনীতিকে অবলম্বন করে বঙ্গবন্ধু শুরু করেন দেশ পুনর্গঠনের কাজ। সদ্য স্বাধীন দেশ পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান, অবকাঠামো, দক্ষ জনশক্তি এবং  নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। শুরুতেই  কৃষি ও কৃষকের জন্য ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ করতে হয় বঙ্গবন্ধুকে। পাকিস্তানি শাসকদের অবহেলার কারণে পূর্ববাংলায় তখন গড়পড়তা ১৫ লাখ টন খাদ্যশস্যের ঘাটতি দেখা দিত। ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের কারণে  কৃষক মাঠে ফসল ফলাতে সমস্যায় পড়ে। বহু কৃষককে ঘরবাড়ি ত্যাগ করতে হয় বলে অনেকেই চাষাবাদ করতে পারেনি। ছিল না ফসল আবাদ করার প্রয়োজনীয় বীজ, সার ও কীটনাশক। সেচ সুবিধার ঘাটতিও ছিল প্রকট। কৃষি ও কৃষক না বাঁচলে যে এ দেশ বাঁচবে না- এ কথা তিনি যথার্থ বুঝতে পেরেছিলেন। যার ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার গঠনের পর পরই বঙ্গবন্ধু উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদের প্রথম বৈঠকেই বঙ্গবন্ধু কৃষকদের জন্য এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। দেশের প্রথম অর্থ বাজেটে মোট উন্নয়ন ব্যয় ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে কৃষিখাতে ১০১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেন। কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৃষক যেন ঘুরে দাঁড়াতে পারে সে জন্য তিনি ১৩ মাসে কৃষকদের মাঝে ১০ কোটি টাকার তাকাভী ঋণ বণ্টন; ৫ কোটি টাকার সমবায় ঋণ বণ্টন; ৮৩ হাজার টন সার সংগ্রহ এবং ৫০ হাজার টন সার বণ্টন; ১৬ হাজার ১২৫ টন ধানের বীজ বণ্টন; ৩ হাজার মণ গমবীজ বণ্টন; এক হাজার ৭০০ মণ আলুবীজ বণ্টন; ৪৫৪ টন পাটবীজ বণ্টন; সেচের জন্য ২৯০০টি গভীর নলকূপ স্থাপন; তিন হাজারটি অগভীর নলকূপ স্থাপন; ৪০ হাজার শক্তিচালিত লো-লিফট পাম্প সরবরাহ; ৮০ লাখ একর জমিতে সেচের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ; বিএডিসিকে ২১টি ট্রাক্টর সরবরাহ; নামমাত্র মূল্যে ২১টি পাওয়ার টিলার সরবরাহ; নামমাত্র মূল্যে হালচাষের জন্য এক লাখ বলদ সরবরাহ; ভর্তুকি মূল্যে ৫০ হাজার দুগ্ধবতী গাভী সরবরাহ; একটানা তিন মাস খাদ্যশস্যসহ ৩০ কোটি টাকার রিলিফ বণ্টন।


জাতির পিতা খাসজমিসহ ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণযোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করার জন্য পরিবার প্রতি জমির সিলিং ১০০ বিঘা নির্ধারণ করে দেন। তিনি উন্নত বীজ, সার, সেচের নানা রকম পাম্প ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহের পাশাপাশি ১৯৭২ সালে ইউরিয়া, পটাশ ও টিএসপি সারের মণপ্রতি মূল্য নির্ধারণ করে দেন যথাক্রমে ২০ টাকা, ১৫ টাকা ও ১০ টাকা। সত্যিকার অর্থে বিশ্ববাজারে এসব সারের উচ্চমূল্য যেন কৃষকদের ফসলের জমিতে সার প্রয়োগে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্য সারে কৃষককে ভর্তুকি দেন বঙ্গবন্ধু। তা ছাড়া পাকিস্তানি আমলে রুজু করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা থেকে কৃষকদের রক্ষা করেন। তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরতরে রহিত করে দেন। দরিদ্র কৃষকদের রক্ষায় নিম্নমূল্যে রেশনপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা হয়। গরিব কৃষক পরিবারের সন্তান যেন সরকারি খরচে লেখাপড়া করতে পারে, সে ব্যবস্থাও করে দেয়া হয়। সরকার ইজারাদারি প্রথা বিলুপ্ত করে, ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রণালয় স্থাপন করে এবং সেলামি ছাড়া জমি বণ্টনের ব্যবস্থা করে। বিএডিসির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সরকার ভর্তুকি দিয়ে সার ও সেচযন্ত্র বিতরণের ব্যবস্থা করে। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তিনি সারের ব্যবহার ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে পেরেছিলেন।


জাতির পিতা উপলব্ধি করেছিলেন, সবুজ বিপ্লব তথা কৃষি বিপ্লব বাস্তবায়নে কঠোর পরিশ্রমী চাষিদের সঙ্গে সঙ্গে মেধাবী কৃষিবিদদেরও প্রয়োজন হবে। মেধাবী ছাত্রদের কৃষিশিক্ষায় আকৃষ্ট করার জন্য সরকারি চাকরিতে কৃষিবিদদের তিনি প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দিয়েছিলেন। তিনি আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উচ্চফলনশীল জাত  উদ্ভাবনের জন্য কৃষি গবেষণার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে কৃষি গবেষণার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাঝে সমন্বয়ের জন্য কোনো শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ছিল না। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর আইনগত কাঠামো দিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠানে রূপ দেন তিনি। আজকের স্বায়ত্তশাসিত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ১৯৭৩ এর অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে আইনগত কাঠামো পায়। পাশাপাশি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, কৃষি সস্প্রসারণ অধিদপ্তর, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত উন্নয়ন বঙ্গবন্ধুর হাত দিয়ে শুরু হয়।


পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সূচিত স্বৈরশাসন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ধারার অবসান ঘটিয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে দেশরত্ন শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। পিতার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কৃষিই দারিদ্র্য বিমোচনের সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার কর্মসূচি হিসেবে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন শুরু করেন। উন্নতজাত উদ্ভাবন ও বীজ সরবরাহ,  কৃষি উপকরণে প্রণোদনা প্রদান, কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি প্রদান, সারের সুষম ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, সমলয় (ঝুহপযৎড়হরুবফ) কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন, কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রবর্তন, ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলা, স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ প্রদান, কৃষি খাতের উন্নয়নে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ সুবিধা প্রদান, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও সেচ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে কৃষিজমির সম্প্রসারণ, কৃষকদের ডাটাবেজ তৈরীকরণ, প্রশিক্ষণ, শস্য বহুমুখীকরণ, উচ্চমূল্য ফসলের (কাজুবাদাম, কফি প্রভৃতি) চাষ, কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাতের সহায়ক পরিবেশ সৃজন, কৃষিপুনর্বাসন সহায়তা প্রদান, কৃষি গবেষণার মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য উপযুক্ত কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন, কৃষি গবেষণার জন্য এনডাউমেন্ট ফান্ড মঞ্জুর এবং উৎপাদন বৃদ্ধি ও মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার্থে জৈবসার ব্যবহার বৃদ্ধি ইত্যাদি কার্যক্রম প্রতি বছর অব্যাহতভাবে করা হচ্ছে। ফলে, কৃষি খাতে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশ আজ দানাদার শস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। পাশাপাশি সবজি, ফল ও অন্যান্য ফসল উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ দশটি দেশের তালিকায় অবস্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের সাফল্য সারা পৃথিবীতে বহুলভাবে প্রশংসিত ও নন্দিত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা। টেকসই ও লাভজনক কৃষিতে রূপান্তর করা। কাজুবাদাম, কফি প্রভৃতি উচ্চমূল্যের ফসল নিরাপদভাবে দেশের মাটিতে উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি করা। কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কৃষিকে শিল্পোন্নত দেশের মতো উন্নত ও আধুনিক করা। কৃষিখাতে সেন্সর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিংস (IoT), ড্রোন প্রভৃতি ৪র্থ শিল্প বিপ্লব প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে কৃষি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন অংশীজনের অংশগ্রহণে দেশের কৃষি খাত আরো এগিয়ে যাবে।  


মুজিববর্ষের প্রাক্কালে করোনার নির্মম আঘাতে বিশ্ব যখন পর্যুদস্ত, ঘোর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মাঝে পুরো বিশ্ব যখন স্থবির তখনও আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নির্দেশনা বাস্তবায়নে কৃষি মন্ত্রণালয় ও তাঁর অধীনস্থ সকল দপ্তর কৃষকের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছে সবসময়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা রূপকল্প ২০৪১ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ অর্জনসহ বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সরকার কৃষি খাতের সাফল্য অব্যাহত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।


সিনিয়র সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়, www.moa.gov.bd

বিস্তারিত
বিদীর্ণ করেছো বাংলাদেশের বুক

বিদীর্ণ করেছো বাংলাদেশের বুক

হাসানুজ্জামান কল্লোল

এক হিমালয় যেন শুয়ে আছেন সিঁড়িতে
তাকে ধারণ করতে গিয়ে সিঁড়ি নয়, বাড়ি নয় শুধু
ভোরের সমস্ত ভেজা ঘাস রক্তাক্ত-লাল বেদনায় কাঁদছে।
বিষাদ ফেলেছে জাল দোয়েলের নরম চোখে,
আহা দেখো সুবেহ সাদেকের আলোয় কী করুণ
সরোদের সুর-যেন বাংলাদেশ হারিয়েছে তার
সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ মানব-মুকুট।

সবুজের মাঝে লাল রঙের গর্বে যে পতাকা
ওড়ে প্রতিদিন, আগস্টের সকালে ধানমন্ডির লেকে
তার নুয়ে পড়া লজ্জিত ছায়া।
শোকের কফিনের সারি একে একে সারা দেশের
পবিত্র মাটিকে কাঁদিয়ে, ঘুমিয়ে পড়েছে।

জেনে রাখো, তোমরা শুধু একজন মানুষকে
হত্যা করোনি, হত্যা করেছো ইতিহাসের সফল
স্বপ্ন নায়ককে- ধানক্ষেতে হাঁটা সবুজ রাখাল রাজাকে।
তোমরা অজস্র বুলেট ছোড়োনি শুধু
তোমরা সহস্র স্বপ্নকে হত্যা করেছো
বিদীর্ণ করেছো বাংলাদেশের বুক।

অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ), কৃষি মন্ত্রণালয়, ই- মেইল : www.moa.gov.bd

বিস্তারিত
বঙ্গবন্ধু : জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে

বঙ্গবন্ধু : জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে
ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার১, ড. সুস্মিতা দাস২
‘জীবন মরণের সীমানা
ছাড়ায়ে রয়েছ দাঁড়ায়ে’
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের এই উক্তির যথার্থই খুঁজে পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করলে। যার ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত আমাদের সোনার বাংলা আজকে বিশ্বের মানচিত্রে গর্ব ও সম্মানের সাথে জায়গা করে নিয়েছে। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। ১৯৭৫ সালে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করার পরও তিনি বাঙালির অন্তরের গভীর সত্তায় মিশে আছেন। তাই তো আগস্ট আসলে বাঙালি প্রতি বছর শ্রদ্ধার সাথে বঙ্গবন্ধুর মহাপ্রয়াণকে বেদনাবিধুর চিত্তে স্মরণ করে। সারা জাতি শোকাকুল হয়ে উঠে। নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাঙালি জাতি এই কান্ডারি ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ কিংবদন্তি নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। যিনি দীর্ঘ সংগ্রাম মুখর জীবনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেন বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম ও জাতীয়তাবাদের প্রতীক।  
বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম ও নিষ্ঠা ছিল আকাশচুম্বী। শৈশব থেকেই সেসব লক্ষণ তাঁর মধ্যে দেখা যায়। তিনি যে ত্যাগী নেতা হবেন তা ছাত্রজীবনেই সবাই উপলব্ধি করেছিল। বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্ট গঠন, ১৯৬৬ ছয় দফা, ১৯৬৮ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯ গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ নির্বাচন-দীর্ঘ ২৪ বছরের সংগ্রাম-আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা।
বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চে ঘোষণা দেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তাঁর আহ্বানে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার নিরস্ত্র জনগণ ঘরে ঘরে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে দুর্গ গড়ে তুলেছিল। তিনি ২৬ মার্চ ১৯৭১ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এরপর দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ মহান শহীদ ও ২ লাখ মা বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান লাভ করে।
১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নতুন বাংলাদেশকে শক্ত ভিত্তির ওপর স্থাপন করেন। এক কোটি বাঙালি-শরণার্থীর পুনর্বাসন, তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে ফেরত পাঠানো, দশ মাসের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান প্রণয়ন, একশোরও বেশি রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়, জাতিসংঘ, ন্যাম, ওআইসি, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনালসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভসহ বঙ্গবন্ধু সরকারের উল্লেখযোগ্য কাজের স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
বঙ্গবন্ধু আজন্ম ভালোবেসেছেন কৃষি ও কৃষককে। তাইতো তিনি কৃষিবিপ্লবের রূপকার হিসেবে তাঁর জাতীয় কর্মকাণ্ডে কৃষিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন। বাংলাদেশে ক্ষুধামুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে কৃষিতে আজকের সাফল্য বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তবায়ন মাত্র। বঙ্গবন্ধুর চেতনা ও দর্শন ছিল এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, মজুর ও সাধারণ মানুষের ভাগ্যের ও জীবনের মান উন্নয়ন করা। এ জন্য স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে সবার আগে তিনি দেশ গড়ার প্রারম্ভেই কৃষির উন্নয়ন কাজে হাত দেন। এ দেশের কৃষিজীবী মেহনতি মানুষের কল্যাণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা পরবর্তী নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেন। বঙ্গবন্ধু ভাবতেন সবার আগে দরকার খাদ্যের। আর খাদ্যের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য আমাদেরই উৎপাদন করতে হবে। খাদ্যের নিশ্চয়তা না দিতে পারলে সব উন্নয়ন কার্যক্রম বিফলে যাবে। সেই চিন্তা থেকেই বঙ্গবন্ধু কৃষিবিষয়ক বিদ্যমান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো ও কার্যক্রমের আমূল পরিবর্তন ও সংস্কারের মাধ্যমে এবং প্রযুক্তিচর্চায় মেধা আকর্ষণের যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর সময় প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (জুলাই ১৯৭৩- জুন ১৯৭৮ সন) প্রণয়ন করা হয়। এতে কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করায় এদেশের সার্বিক কৃষি ব্যবস্থাসহ কৃষি গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল। বাংলাদেশ প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বঙ্গবন্ধু সরকার শতকরা ৩১ ভাগ অর্থ কৃষিখাতে ব্যয় করেছিলেন। কিন্তু সরকারি বিনিয়োগের হার পরবর্তী পাঁচশালা পরিকল্পনাগুলোতে ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে আসে। এই সংকোচন নীতির ফলে কৃষিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনের হার প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অর্জিত ৩ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে তৃতীয় ও চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যথাক্রমে ১ দশমিক ৭ শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ৮৬ শতাংশে নেমে আসে। বঙ্গবন্ধুর বাস্তব ও গতিশীল পদক্ষেপের ফলে মাত্র দু’বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে কৃষিতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছিল ৭ শতাংশ যা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর পরবর্তী বছরগুলোতে দ্রুত হ্রাস পেয়েছিল।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে গবেষণার জন্য কৃষিবিদ তথা কৃষি গবেষকদের বঙ্গবন্ধু সরকারই প্রথম সংগঠিত করে কৃষি গবেষণার কাজে হাত দেন। ফলে এদের মধ্য থেকে আজ অনেক স্বনামধন্য কৃষি বিজ্ঞানী সৃষ্টি হয়েছে যারা কৃষির বহুমুখী উন্নয়নে সার্বিক অবদান রাখছে। বলা যায় স্বাধীনতা উত্তরকালে কৃষি সেক্টরে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) কৃষি মন্ত্রণালয় অধীন একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা যা মহামান্য রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের এক অধ্যাদেশ বলে ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক উদ্যোগের ফলে বিএআরসি প্রতিষ্ঠিত হয় যা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একটি মাইলফলক বলা যেতে পারে। দেশের সামগ্রিক কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে অধিকতর গতিশীল, যুগোপযোগী ও কার্যকর করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল আইন ১৯৯৬ সালে এবং সর্বশেষ ২০১২ সালে সংশোধনের মাধ্যমে দেশে কৃষি গবেষণা ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে আরো সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করা হয়। বিএআরসি কৃষি মন্ত্রণালয় আওতাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ কৃষি (ফসল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ) সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও সংস্থার সাথে কাজ করে। কৃষি গবেষণালব্ধ ফলাফল বা প্রযুক্তি সম্প্রসারণের কর্মকাণ্ড বিএআরসিতে চলমান রয়েছে এবং কীটনাশক, সার, বীজ ইত্যাদি কৃষি উপকরণের মান নির্ধারণসহ নীতি প্রণয়ন সরকারকে পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে এবং হচ্ছে। বিএআরসি গত ১০ বছরে নোটিফাইড ৭টি ফসলের (ধান, গম, আলু, ইক্ষু, পাট, কেনাফ ও মেস্তা) ফলন ও মান নিশ্চিতপূর্বক বিভিন্ন কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত ১৭০টিরও বেশি জাত ছাড় করেছে। দক্ষ কৃষি বিজ্ঞানী তৈরির লক্ষ্যে ফেলোশিপের জন্য আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৫১,৮৮৬ জন বিজ্ঞানী/কর্মকর্তাকে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। বিএআরসি ১৯৭৯ সাল থেকে সার সুপারিশমালা  ‘হাতবই’ প্রণয়ন করে আসছে যা সার ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি কৃষি যান্ত্রিকীকরণ রোডম্যাপ ২০২১, ২০৩১ ও ২০৪১ প্রণয়ন করেছে। পাশাপাশি জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমভুক্ত ১২টি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবন নিয়ে ‘১০০ কৃষি প্রযুক্তি এটলাস’ প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এই প্রতিষ্ঠানটি দেশে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা তথা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে।
কৃষি গবেষণা ও প্রশিক্ষণে গৌরবময় ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি)-কে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২১ এ ভূষিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্র্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর মাহেন্দ্রক্ষণে বিএআরসির এই প্রাপ্তি কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে।
বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করে তাঁর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কৃষিতে অভাবনীয় সফলতা এসেছে। তিনি তাঁর সততা, জ্ঞান, মেধা, দক্ষতা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষিকে বিশ্ব দরবারে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কৃষির এই দুর্বার অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমরা সবাই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের সমন্বিত, আন্তরিক এবং কার্যকর পদক্ষেপ কৃষির বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে সত্যিকারের একটি স্বনির্ভর সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।
বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তাঁর আদর্শ আমাদের চিরন্তন প্রেরণার উৎস। তাইতো তাঁর মহাপ্রস্থানের দিনে কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলায়ে বলতে চাই-
‘তোমার আসন শূন্য আজি হে বীর পূর্ণ করো,
ঐ যে দেখি বসুন্ধরা কাঁপল থরোথরো।
দুর্গম পথ সগৌরবে তোমার চরণচিহ্ন রবে সগৌরবে।’

১নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা কাউন্সিল; ২প্রধান ডকুমন্টেশন কর্মকর্তা, বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা কাউন্সিল
মোবাইল : ০১৭১১১০২১৯৮, ই-মেইল :susmitabarc@gmail.com  

 

বিস্তারিত
পুষ্টি নিরাপত্তা ও পরিবেশ রক্ষায় ফলদ বৃক্ষরোপণ

পুষ্টি নিরাপত্তা ও পরিবেশ রক্ষায় ফলদ বৃক্ষরোপণ
কৃষিবিদ মো. আফতাব উদ্দিন১ কৃষিবিদ সাবিনা ইয়াসমিন২

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার অন্যতম ভিত্তি ছিল কৃষি। বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা অর্জনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধু তাই সর্বপ্রথমে সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, কৃষির উন্নতি ছাড়া এ দেশের মানুষের মুক্তি আসতে পারে না। কৃষকরাই এ দেশের প্রাণ। বঙ্গবন্ধুর এসব বাস্তবধর্মী ও কৃষক দরদি নীতির ফলে কৃষি ক্ষেত্রে অগ্রগতির যে ধারা সূচিত হয়েছিল, তারই ফলে আজ কৃষি ক্ষেত্রে শক্তিশালী ধারা সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান সরকার যে কল্যাণধর্মী ও কৃষকবান্ধব উন্নয়ন নীতি কৌশল গ্রহণ করেছে, তা বঙ্গবন্ধুর  কৃষি ভাবনারই প্রতিফলন। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষি খাতে উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। স্বাধীনতার ঠিক পরে ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয় ১ কোটি ১০ লাখ টন; এর মধ্যে ধান উৎপাদন হয় মাত্র ৯৩ লাখ টন। তখন সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য এই পরিমাণ খাদ্য পর্যাপ্ত ছিল না। স্বাধীনতার ৫০ বছরের ব্যবধানে আজ দেশের মানুষ বেড়ে আড়াইগুণ হয়েছে, আবাদি জমি কমেছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। অন্যদিকে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে তিন গুণেরও বেশি, খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ আজ স্বনির্ভর। পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের উন্নয়নে প্রতিনিয়ত কাজ করা হচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে নারিকেল চারা রোপণ করে দেশে ফলদ বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব মানুষের মাঝে তুলে ধরেছিলেন এবং তিনি কৃষি সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে স্বাধীনতা উত্তর সময়ে ফল গবেষণা, সম্প্রসারণ কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত ফল উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশ আম উৎপাদনে ৭ম, কাঁঠাল উৎপাদনে ২য় অবস্থানে রয়েছে। এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। প্রতিটি ইঞ্চি জায়গার সদ্ব্যবহার করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। কৃষিপণ্য বহুমুখীকরণ, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ এর মাধ্যমে কৃষিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য।  
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ফলের গুরুত্ব ও অবদান অপরিসীম। বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের চাহিদাপূরণ, শারীরিক বৃদ্ধি ও  দেহের ক্ষয় রোধ, মেধার বিকাশ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, সর্বোপরি দেশের জনগণের দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান ও আয়বৃদ্ধিসহ নানাবিধ সুবিধা আমরা ফল থেকে পাই। ফলদ বৃক্ষ রোপণে যেমন খাদ্যের চাহিদা পূরণ হবে, একই সাথে সুস্বাস্থ্যের জন্য জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন সরবরাহ, পরিবেশ দূষণ কমানো,  প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে ফলদ বৃক্ষের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে পরিবেশ বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় পক্ষ থেকে প্রতিবছর ৫ জুন বিশ^ পরিবেশ দিবস উপলক্ষ্যে জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান আয়োজন করা হয়। এ বছর মুজিবর্ষে দেশকে সবুজে শোভিত করে ফেলতে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে জাম, আমড়া, ডুমুর ও সোনালু বৃক্ষের চারা রোপণ করে জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ২০২১ উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ হওয়ায় এখানে প্রায় ১৩০ রকমের ফল উৎপাদিত হয় যার মধ্যে কমপক্ষে ৭০টি বৃহত্তর পরিসরে চাষ করা হয়। এক্ষেত্রে প্রচলিত এবং অপ্রচলিত ফলগুলোকে বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে ও ফল চাষকে লাভজনক করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দক্ষ জনবল দেশব্যাপী কৃষি সেবা প্রদান করে যাচ্ছে।  ফলের চাষ সম্প্রসারণ করে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য প্রতি বছরই সরকারি উদ্যোগে ফলদ বৃক্ষরোপণ পক্ষ বাস্তবায়ন ও বিনামূল্যে ফলের চারা/কলম বিতরণ করা হয়। এছাড়াও প্রচারণা ও উদ্বুদ্ধকরণের জন্য ৩ দিনব্যাপী জাতীয় ফল মেলা ও বাংলাদেশের মোট ৪৯২টি উপজেলায় ৩ দিনব্যাপী ফল ও বৃক্ষমেলা আয়োজন করা ও চারা/কলম বিতরণ করা হয়ে থাকে। এসব কার্যক্রমের প্রভাব হিসেবে বাংলাদেশে উত্তরোত্তর ফল উৎপাদন ও ফলের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ফল গ্রহণের হারও  আশানুরূপভাবে বাড়ছে।
ফলদ ও ঔষধি বৃক্ষরোপণ পক্ষ বাস্তবায়ন
জলবায়ু পরিবর্তন ও দ্রুত নগরায়নের মারাত্মক প্রভাব থেকে  বাংলাদেশের জনগণকে ফলদ ও ঔষধি বৃক্ষ রোপণে উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) প্রতি বছর  ১৬-৩০ জুন পর্যন্ত মোট ১৫ দিন ফলদ বৃক্ষ রোপণ পক্ষ উদ্যাপন করে থাকে এবং ৩ মাসব্যাপী সারাদেশে ফলদ বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের হর্টিকালচার উইং ফলদ বৃক্ষ রোপণ পক্ষ উপলক্ষ্যে ইউনিয়ন পর্যায়ে ব্লক ভিত্তিক ফলদ ও ঔষধি বৃক্ষ রোপণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে থাকে। সেই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে কাজ করে থাকে মাঠ পর্যায়ের সরেজমিন উইং এর কর্মকর্তাগণ। অপর পক্ষে, হর্টিকালচার উইং এর আওতাধীন সেন্টারসমূহ উন্নত ও মানসম্পন্ন উদ্যানতাত্ত্বিক চারা/কলম উৎপাদন করে ফ্রি বা সরকারি মূল্যে বিতরণ করে থাকে। এ উপলক্ষ্যে ডিএই এর কৃষি প্রযুক্তি সেবা প্রদানের সর্বনিম্ন ইউনিট-ইউনিয়ন পর্যায়ের কৃষি ব্লকের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রত্যেক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরাসরি কাজ করে থাকে। তাছাড়াও সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাতে আরও কর্মকর্তাগণ একই দায়িত্ব পালন করে থাকে। হর্টিকালচার উইং হতে প্রদত্ত টার্গেট অনুযায়ী তাদের স্ব স্ব ব্লকে অবস্থিত সরকারি ও বেসরকারি স্কুল, কলেজ, অফিস ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে অংশীজনদেরকে উদ্বুদ্ধকরণে ফলদ ও ঔষধি চারা/কলম রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকছে। এই মহৎ কাজে এগিয়ে আসেন উপজেলা কৃষি অফিস, উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, জাতীয় সংসদের সদস্যবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ এবং তাদের সকলের সার্বিক সহযোগিতায় প্রতি বছর ফলদ বৃক্ষ রোপণ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়। ফলশ্রুতিতে, সারা বাংলাদেশে প্রতি বছরই প্রায় ১ কোটি (+/-) চারা/কলম রোপণ করা হয়ে থাকে। তারই সুফল হিসেবে আমরা ফলের মৌসুমে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফল পেয়ে থাকি। ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিগত বছরগুলোর উৎপাদন মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। শুধু উৎপাদনই নয়, ফল রপ্তানিতেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৭২৯২৮০ হেক্টর জমিতে ১২৩.৮৯ লক্ষ মেট্রিক টন ফল উৎপাদন হয় (সূত্র: বার্ষিক প্রতিবেদন, হর্টিকালচার উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর)।
ফল উৎপাদন বৃদ্ধিতে উন্নত জাতের চারা/কলম উৎপাদন     নিশ্চিতকরণ
করোনা মহামারিকালে চারা/কলম উৎপাদন করে স্থানীয় চাহিদা মিটাতে কাজ করে যাচ্ছে হর্টিকালচার উইং এর বিভিন্ন ক্যাটাগরীর মোট ৭৬টি হর্টিকালচার সেন্টারের কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ। বিভিন্ন ধরনের উন্নত ও এক্সোটিক প্রজাতির ফলের চারা/কলম উৎপাদন বৃদ্ধি করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) বিভিন্ন ফলের চারা/কলম উৎপাদন ও বিপণন করে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার রাজস্ব সরকারি তহবিলে জমা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি এর সকল লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সেন্টারসমূহকে হর্টিকালচার উইং বিভিন্ন দিকনির্দেশনা প্রদান করছে ও কাজের অগ্রগতি তদারকি করছে। ফলে সরকারি সেন্টারসমূহ হতে সরকার নির্ধারিত মূল্যে অর্থাৎ স্বল্পমূল্যে চারা-কলম ক্রয় করে রোপণ করে এই দেশে সার্বিক ফল উৎপাদন বৃদ্ধি করাসহ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে হর্টিকালচার উইং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
যদি সুস্থ থাকতে চান প্রতিদিন অন্তত ভিটামিন এ বা সি সমৃদ্ধ একটি বা দুইটি করে ফল খান। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ফল খাওয়া প্রয়োজন প্রায় ২০০ গ্রাম। পুষ্টি চাহিদা পূরণে প্রতি বছরই উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলের প্রাপ্যতা ও বছরব্যাপী সমভাবে বণ্টিত নয়। তাই আমাদেরকে পরিকল্পনামাফিক বিভিন্ন মৌসুমি ফলের চারা/কলম বসতবাড়িতে ও বাণিজ্যিকভাবে রোপণ করতে হবে। আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের ফল বিভিন্ন সময়ে পাওয়া যায়। সেজন্য বিভিন্ন সময়ে ফল পাওয়া যায় এমন ধরনের ফলের চারা নির্বাচন করে প্রতিটি বাড়ির চারপাশে  ও বাগানে রোপণ করলে সারা বছরই ফল প্রাপ্তির মাধ্যমে এই দেশের জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও পুষ্টি চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। তবে বর্ষাকাল বৃক্ষরোপণের উপযুক্ত সময় তাই এই সময় পরিকল্পনা করে বিভিন্ন ধরনের ফলের উন্নত মানের ও জাতের চারা/কলম রোপণ করা উচিত। সেই সাথে অবশ্যই সারা বছর প্রয়োজনীয় আন্তঃপরিচর্যা করতে হবে। তাহলেই কৃষি কাজে সফলতা আসবে। প্রয়োজনীয়ক্ষেত্রে কৃষি বিশেষজ্ঞ এর পরামর্শ নিতে হবে।

১পরিচালক, হর্টিকালচার উইং, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা, মোবাইল: ০১৭১৮৬২৪২২৯, ২উপজেলা কৃষি অফিসার, সংযুক্ত: হর্টিকালচার উইং, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা, মোবাইল: ০১৬৮৮০৫৪৭৮৬

 

বিস্তারিত
ধানের বাদামি গাছফড়িং দমনে ব্যবস্থাপনা

ধানের বাদামি গাছফড়িং দমনে ব্যবস্থাপনা
কৃষিবিদ তুষার কান্তি সমদ্দার

ধান আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য। তাই এর সাথে দেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঘন বসতিপূর্ণ এ দেশের জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে, অপরদিকে, বাড়িঘর, কলকারখানা, হাট-বাজার, সড়ক-জনপথ স্থাপন এবং নদী ভাঙন ইত্যাদি কারণে আবাদি জমির পরিমাণ প্রতিনিয়ত কমছে। তদুপরি রয়েছে খরা, বন্যা, জোয়ার-ভাটা, লবণাক্ততা, শৈত্যপ্রবাহ ও শিলাবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এসব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে বেশি ধান উৎপাদন করে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের লক্ষ্য। উফশী ধান নিবিড় ও উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদের কারণে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। সাধারণত পোকার প্রজাতি, পোকার সংখ্যা, উপদ্রুত এলাকার সামগ্রিক পরিবেশ ইত্যাদির উপর ক্ষতির মাত্রা নির্ভর করে। ক্ষতিকর পোকার আক্রমণের জন্য রোপা আমন মৌসুমে শতকরা প্রায় ১৮ ভাগ ধানের ফলন নষ্ট হয়। ধান ফসলের একটি মারাত্মক কাণ্ড শোষক পোকা হচ্ছে বাদামি গাছফড়িং। এই পোকার আক্রমণ ধান গাছের চারা অবস্থা থেকে শুরু করে ধান পাকার পূর্ব পর্যন্ত সকল পর্যায়ে হতে পারে। আউশ, আমন ও বোরো এই তিন মৌসুমেই এই পোকার আক্রমণ হতে পারে।
জীবন বৃত্তান্ত
মৌসুমের শুরুতে লম্বা পাখা বিশিষ্ট পূর্ণবয়স্ক বাদামি গাছফড়িং পাতার খোলে এবং পাতার মধ্য শিরায় ৮-১৬টি ডিম গুচ্ছাকারে পাড়ে। ডিমের রং হলুদ এবং দেখতে অনেকটা কলার কাঁদির মতো। ডিমগুলোর উপর পাতলা চওড়া একটা আবরণ থাকে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে ৭-৯ দিন সময় লাগে। সদ্য ফোটা বাচ্চাগুলো দেখতে পূর্ণবয়স্ক পোকার মতো তবে আকারে খুবই ছোট। বাচ্চাগুলো ৫ বার খোলস বদলানোর পর পূর্ণবয়স্ক পোকায় পরিণত হয়। এতে ১৩-১৫ দিন সময় লাগে। পূর্ণবয়স্ক বাদামি গাছফড়িং ৩-৫ মিলি মিটার লম্বা হয়ে থাকে। পূর্ণবয়স্ক পোকার গায়ের রং বাদামি। বাদামি গাছফড়িং ছোট পাখা ও লম্বা পাখা বিশিষ্ট এই দুই ধরনের হতে পারে। এর স্ত্রী পোকাগুলো সাধারণত গাছের গোড়ার দিকে বেশি থাকে। গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে লম্বা পাখা বিশিষ্ট ফড়িং এর সংখ্যাও বাড়তে থাকে, যারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় উড়ে যেতে পারে। পূর্ণবয়স্ক বাদামি গাছফড়িং প্রায় ৩ সপ্তাহ বেঁচে থাকতে পারে এবং এক জোড়া পোকা থেকে ২-৩ মাসের মধ্যে হাজার হাজার পোকা জন্ম নিতে পারে।
ক্ষতির অনুকূল পরিবেশ
বাদামি গাছফড়িং আলো-বাতাস পছন্দ করে না। এদের বংশ বৃদ্ধি এবং বেঁচে থাকার জন্য আর্দ্র ও ছায়াযুক্ত স্থান খুবই পছন্দ। ঘন করে গাছ লাগালে, জমিতে অধিক নাইট্রোজেন সার ব্যবহার করলে, জমিতে পর্যাপ্ত আগাছা থাকলে এবং সব সময় জমিতে পানি জমে থাকলে এ পোকার আক্রমণ বেশি হয়।
ক্ষতির লক্ষণ
বাচ্চা ও পূর্ণবয়স্ক উভয় অবস্থায় বাদামি গাছফড়িং ধান গাছের গোড়ায় বসে গাছের রস চুষে খায় ফলে গাছ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এক সাথে অনেকগুলো পোকা রস চুষে খাওয়ার ফলে পাতা প্রথমে হলদে ও পরে শুকিয়ে মারা যায়। আক্রমণ বেশি হলে দূর থেকে বাজ পড়ার মতো (হপার বার্ন) মনে হয়। ধানের শীষ আসার সময় বা তার আগে হপার বার্ন হলে কোন ফলনই পাওয়া যায় না। তবে ধানের দানা শক্ত হওয়ার পর ধান গাছ আক্রান্ত হলে ক্ষতি কম হয়।
বাদামি গাছফড়িং-এর প্রাকৃতিক শত্রু
এমন অনেক বন্ধু পোকামাকড় আছে যারা ধানের জমিতে প্রাকৃতিকভাবেই গাছফড়িং দমন করে থাকে। বাদামি গাছফড়িং-এর যেসব প্রাকৃতিক শত্রু আছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মাকড়সা, মিরিডবাগ, লেডিবার্ড বিটল, ক্যারাবিড বিটল, ড্যামসেল ফ্লাই এর বাচ্চা, মাইক্রোভেলিয়া, মেসোভেলিয়া  ইত্যাদি পরভোজী। ব্যাঙ বাদামি গাছফড়িংকে দমিয়ে রাখতে সাহায্য করে।
দমন ব্যবস্থাপনা
জমিতে আলোক ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। চারা রোপণের দূরত্ব বাড়িয়ে দিতে হবে। থোড় আসার আগ পর্যন্ত আক্রান্ত জমিতে হাঁস ছেড়ে দিলে পোকা কিছুটা দমন করা যায়। লাইন ও লোগো পদ্ধতিতে ধানের চারা রোপণ করতে হবে। উর্বর জমিতে ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে হবে। জমি আগাছামুক্ত রাখা প্রয়োজন। আক্রান্ত জমি থেকে ৫-৬ দিনের জন্য পানি বের করে দিয়ে স্যাঁতসে্যঁতে অবস্থা দূর করতে হবে। জমির অধিকাংশ গাছে যদি ৩-৪টি পেট মোটা ডিমওয়ালা পূর্ণবয়স্ক বাদামি গাছফড়িং বা ৮-১০টি নিম্ফ অথবা উভয়ই দেখতে পাওয়া যায় তাহলে যে কোন একটি অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। কীটনাশক  অবশ্যই গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে।
পোকামাকড় দমনের ক্ষেত্রে কোন পদ্ধতি কোন ক্ষেতে কার্যকরী হবে সেটি নিয়মিতভাবে ক্ষেত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নির্বাচন করতে হবে। শুধু একটি মাত্র পদ্ধতিই কোনো ক্ষেত্রে পোকা দমনের ব্যাপারে যথেষ্ট নাও হতে পারে। প্রয়োজনে একটির বেশি পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। সুতরাং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ধানের পোকামাকড় দমন করা সম্ভব। য়
প্রধান তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, ফোন : ৫৫০২৮৩৭২, ই-মেইল : cio@ais.gov.bd

বিস্তারিত
ফল চাষে সার ব্যবস্থাপনা

ফল চাষে সার ব্যবস্থাপনা

ড. নির্মল চন্দ্র শীল

 

মাত্র দুটি বর্ণ সমন্বয়ে গঠিত শব্দ ফল কিন্তু দেহের পুষ্টিসাধন ক্ষয়পূরণ, বৃদ্ধি বিকাশ, রোগ নিরাময়, বিপাকীয় ক্রিয়াদি প্রতিপালনে এর গুরুত্ব অপরিসীম ও অতুলনীয়। দেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ভিটামিন ও মিনারেলের সর্বোত্তম প্রাকৃতিক উৎস হচ্ছে ফল। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (Immunity power) বৃদ্ধিতে ফলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অধিকন্তু ফলে এন্থোসায়ানিন ও লাইকোপেন থাকাতে প্রাণঘাতি মরণব্যাধি ক্যান্সার ও করোনাসহ অন্যান্য রোগ নিরাময়ে ভূমিকা রাখতে সক্ষম।


দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্যে কৃষিবান্ধব বর্তমান সরকার বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বছরব্যাপী ফলের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে জাতীয় কৃষি নীতি-২০১৮ এ আগাম ও  নাবী (Late) ফলের জাত উদ্ভবানের জন্য গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত ৩৬ প্রজাতির বিভিন্ন ফলের ৯২টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। ওই জাতগুলোর মধ্যে বেশ কিছু জাত বারোমাসী, নাবী, অমৌসুমী এবং খরা ও লবণাক্ততাসহিষ্ণু যা দেশের ফল উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।


নতুন বাগান স্থাপন, বসতবাড়ির আঙিনায় ও রাস্তার দুইধারে ফল গাছ রোপণের কর্মকাণ্ড উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। তাছাড়া আমাদের দেশে মৌসুমভিত্তিক ফলের প্রাপ্যতা বেশি; বছরের অন্যান্য সময়ে ফলের প্রাপ্যতা খুবই অপ্রতুল যেমন- মোট ফলের মধ্যে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১৯ শতাংশ, মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৬০ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২১ শতাংশ উৎপাদিত হয়। বছরব্যাপী ফল উৎপাদন, পুষ্টিমান নিয়ন্ত্রণ, আকার-আকৃতি, স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ আকর্ষণীয়করণ ও মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ফলচাষে সুষম সার ব্যবস্থাপনা ও যথাযথ পানি সেচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


ফলগাছে সার প্রয়োগের নীতি
ফল গাছ মাটি থেকে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান আহরণ করে থাকে। গাছের বৃদ্ধি বিকাশ, ফুল-ফল ধারণ ও মানসম্মত ফল উৎপাদনে এবং বলশালী চারা/কলম প্রাপ্তির জন্য প্রতি বছর অন্তত দুবার মাটি পরীক্ষার ভিত্তিতে সার প্রয়োগ আবশ্যক। নিম্নে ফল গাছে সার প্রয়োগের কতিপয় সাধারণ নীতিমালা উল্লেখ করা হলো।


ফল গাছে সাধারণত  বর্ষা মৌসুম শুরু হবার আগে মে-জুন মাসে ১ বার এবং বর্ষাকাল শেষ হবার পরে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে আর একবার সার প্রয়োগ বিধেয়। গাছের ক্যানোপি এরিয়া যতদূর বিস্তৃত হয় অর্থাৎ গাছের ছায়া যে দূরত্ব পর্যন্ত  পৌঁছায় ওই দূরত্বে সারপ্রয়োগ করতে হবে কারণ গাছের জন্য খাদ্য শোষণকারী মূলসমূহ প্রধানত ওই দূরত্বে বিচরণ করে। ছোট গাছের বেলায় ওই দূরত্ব গাছের গোড়া থেকে চারিদিকে ০.৫-১ মিটার এবং বড়গাছের বেলায় ১-১.৫ মিটার হয়ে থাকে। ওই দূরত্বে গাছের গোড়ার চারিদিকের মাটি আলতোভাবে কুপিয়ে কিংবা চারিদিকে ৫০ সেমি. গভীর গর্ত (Trench) তৈরি করে সার প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পর গাছের চতুর্দিকে একটি আইল (band) তৈরি করে দিতে হবে যাতে সেচ ও বৃষ্টির পানি সার দ্রব্য ধুইয়ে অপচয় করতে না পারে। সাধারণত একবীজপত্রী উদ্ভিদের (নারিকেল, সুপারি, তাল ইত্যাদি) ক্ষেত্রে গর্ত পদ্ধতিতে এবং দ্বিবীজপত্রী (আম, কাঁঠাল, পেয়ারা ইত্যাদি) উদ্ভিদের ক্ষেত্রে মাটি কুপিয়ে সার দ্রব্য ছিটিয়ে প্রয়োগ করা উত্তম। সার দ্রব্য প্রয়োগের পর মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে বা মাটি দ্বারা গর্ত ঢেকে দিতে হবে। অতঃপর হালকা সেচ প্রয়োগ বিধেয়। সার প্রয়োগের পর খড়/বিছালী ইত্যাদি দ্বারা জাবড়া (মালচিং) প্রয়োগ করতে হবে যাতে সার ও পানির কার্যদক্ষতা বৃদ্ধি পায়। জিংক সার, ফসফেট সার ও জৈবসার একত্রে  মিশ্রিত করে প্রয়োগ করা যাবে না। সাধারণত রাসায়নিক সার প্রয়োগের সপ্তাহ খানেক আগে জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে। অতঃপর মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট (জিংক, বোরন ইত্যাদি) সার ব্যতীত অন্যান্য সার প্রয়োগ করতে হবে। কিছু ঝুর ঝুরে মাটির সাথে সুপারিশ মোতাবেক প্রয়োজনীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সার মিশিয়ে তা গর্তে বা ইতঃপূর্বে কোদাল দ্বারা কোপানো মাটিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। সার দ্রব্য কাচি পাতা, কাণ্ড কিংবা ভিজা পল্লবে যাতে কোনো প্রকারে না পড়ে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। পাহাড়ি এলাকায় ডিবলিং পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। যেহেতু ফলগাছে প্রতি বছর সার প্রয়োগ করা হয় তাই ফসফরাস, জিংক, সালফার ইত্যাদি পুষ্টি উপাদানের অবশেষ থেকে যেতে পারে। এমতাবস্থায় মাটি পরীক্ষার ভিত্তিতে সারের মাত্রা নির্ধারণপূর্বক সার প্রয়োগ করতে হবে।

 

 


সার প্রয়োগের সময়
ফল গাছে বছরে কমপক্ষে ২ বার সার প্রয়োগ করতে হয়।  প্রধান প্রধান ফল গাছে সার প্রয়োগের সময়সূচি সারণি-১ দ্রষ্টব্য। সুপারিশ মোতাবেক সার প্রয়োগ করলে সুফল পাওয়া যেতে পারে।


সিঞ্চন পদ্ধতিতে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সার প্রয়োগ বহুবর্ষজীবী ফলগাছে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট (জিংক, বোরন, ম্যাঙ্গানিজ, মলিবডেনাম, কপার ইত্যাদি) সার সিঞ্চন পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা উত্তম। বাংলাদেশের ফলগাছে প্রধানত জিংক ও বোরন-এর অভাব পরিলক্ষিত হয়। সারণি-২ মোতাবেক সুপারিশ অনুযায়ী স্প্রে দ্রবণ প্রস্তুত করতে হবে।


প্রয়োগ পদ্ধতি
মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সার সুপারিশ মোতাবেক প্রধানত বছরে ২ বার স্প্রে করা যেতে পারে। একবার ফুল ধারণের পর (এপ্রিল-মে মাসে ফলগাছ ভেদে ভিন্ন হতে পারে) আর একবার ফল সংগ্রহের পর (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে)। প্রথম বার স্প্রে করার পর ১৫ দিন আর একটি স্প্রে দিতে হবে। তদ্রুপ, দ্বিতীয় বার স্প্রে করার পর ১৫ দিন পর আর একটি  স্প্রে দিতে হবে। সাধারণত ফল বাগানের জন্য হেক্টরপ্রতি ৩০০-৪০০ লিটার স্প্রে দ্রবণ প্রয়োজন হতে পারে।


স্প্রে করার নিয়ম
মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সার  স্প্রে করার পূর্বে উক্ত সারের অভাবজনিত লক্ষণ আছে কি না সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।
সাধারণত মাটিতে প্রয়োগ করা হয়ে থাকলে অভাব প্রকট নাও হতে পারে। পড়ন্ত বিকেলে যখন সূর্য্যের তেজ কমে যায় তখন গাছের পাতার নিচের দিকে  স্প্রে করতে হবে যেন পাতা ভিজে কিন্তু পাতা থেকে ফোঁটা ফোঁটা সার দ্রবণ ঝরে না পড়ে। দ্রবণ প্রস্তুত করার পূর্বে হিসেব সঠিক কি না তা যাচাই করে নিতে হবে। দ্রবণ স্প্রে করার পর অবশিষ্ট (যদি থাকে) ফেলে দিতে হবে কারণ স্প্রে দ্রবণ মজুদ (ঝঃড়ৎব) করা যাবে না।


মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের অভাবজনিত কতিপয় লক্ষণ
বোরনের অভাব হলে পেঁপে, কাঁঠাল, পেয়ারা প্রভৃতি ফলের আকার বিকৃত (উবভড়ৎসবফ) হয়। আম, লিচু প্রভৃতি ফলের ফুল, ফল ঝরে পড়ে, বাড়ন্ত লিচু ফেটে যেতে পারে। জিংকের অভাবে লেবু জাতীয় উদ্ভিদের পাতার মধ্য শিরা সবুজ থাকে কিন্তু শিরার মধ্যবর্তী অংশ সাদাটে হয়ে যায়। তীব্র ঘাটতিতে গাছের বৃদ্ধি থেমে যায় এবং পাতা ছোট হয়ে গুচ্ছ পাতা তৈরি করতে পারে। ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং গুণগতমান উন্নয়ন ও ফল সংগ্রহোত্তর জীবনকাল বৃদ্ধিতে সুষম সার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ একান্ত আবশ্যক।

মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা,পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন উইং, বিএআরআই, গাজীপুর; মোবাইল : ০১৭১৮২০১৪৯৯, ই-মেইল :: nirmal_shil@yahoo.com

 

বিস্তারিত
মুজিববর্ষে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী : দ্যুতিময় কৃষি

মুজিববর্ষে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী : দ্যুতিময় কৃষি

কৃষিবিদ মোঃ আসাদুল্লাহ১ কৃষিবিদ মো. আবু সায়েম২

স্বাধীনতার অর্ধশত বছরের মাইলফলকে বাংলাদেশ। তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ পাওয়া ছোট্ট এই ব-দ্বীপটি আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে। ১৯৭৩ সালে মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল যেখানে ৭০ ডলার, ২০২১ সালে সেটি ২ হাজার ২২৭ ডলারে, বাংলাদেশি মুদ্রায় তা বছরে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৭৩ টাকা। গত বছর করোনা শুরুর আগেও মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৬৫ ডলার। করোনার ধকলে থেমে থাকেনি অর্থনীতির চাকা। মাথাপিছু আয়সহ অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে ঊর্ধ্বগতি এসেছে। একমাত্র কৃষিখাতের ঈর্ষণীয় সাফল্যের সুবাতাসের কারণ বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান। স্বাধীনতার পর দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল, বর্তমানে এ হার ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ। ১৯৭২-৭৩ সালে জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল ৫৮ দশমিক ০৪ শতাংশ, ২০১৯-২০ সালে জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান কমলেও মোট অবদান বেড়েছে প্রায় ৬ গুণ। এক দশক ধরে আমাদের অর্থনীতি রয়েছে উচ্চ প্রবৃদ্ধির পথে। আর ঠিক এ সময়েই জাতি উদ্যাপন করছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তি তথা সুবর্ণজয়ন্তী। মুজিববর্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ৪৬তম শাহাদতবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারের সব শহিদের    গভীরভাবে স্মরণ করছি এবং জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
স্বাধীনতার পর ৫০ বছরে নির্দিষ্ট হারে আবাদি জমি কমে যাওয়া, একই সাথে জনসংখ্যা আড়াই গুণ বৃদ্ধি পেলেও ফসল উৎপাদন বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। বর্তমানে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন সাড়ে তিন গুণ, সবজি পাঁচ গুণ, ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে আঠারো গুণ আর আলুর উৎপাদন বেড়েছে বারো গুণ। দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দুটি ফসল হতো। বর্তমান দেশে বছরে গড়ে দুটি ফসলের উৎপাদন হচ্ছে। আয়তনে ছোট ও ঘন-বসতিপূর্ণ হলেও স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরে সীমিত সাধ্য নিয়েই কৃষিখাতে অন্তত দশটির অধিক ক্ষেত্রে বিশ্বে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। কৃষিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পাট রপ্তানিতে ১ম, পাট ও কাঁঠাল উৎপাদনে ২য়, ধান ও সবজি উৎপাদনে ৩য়, আম ও আলু উৎপাদনে ৭ম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম এবং সামগ্রিক ফল উৎপাদনে বিশ্বে ২৮তম স্থানে। এরই মধ্যে দেশি ও তোষা পাট, পাটসহ পাঁচ শতাধিক ফসলের ক্ষতিকর একটি ছত্রাক ও ধৈঞ্চার জীবনরহস্য উন্মোচিত হয়েছে। ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম, দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল ও কালিজিরা চাল। ২০১৩ সালে বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেন বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনের দিক থেকেও বাংলাদেশ শীর্ষ স্থানে রয়েছে। ধানের লবণাক্তসহিষ্ণু ১৩টি জাত, খরা সহনশীল ১০টি জাত, জলমগ্নতাসহিষ্ণু ৬টি জাত, উপকূলীয় জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের উপযোগী ৩টি, হাওর অঞ্চলের উপযোগী ১১টি জাত, জিঙ্কসমৃদ্ধ ৭টি, কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) সমৃদ্ধ ৩টি এবং সুগন্ধি ৯টি জাতের উদ্ভাবন করে বিশ্বে অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশে ধান বিজ্ঞানীরা। ২০১৩ সালে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিটি বেগুনের ৪টি জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এছাড়া বিটি তুলা উদ্ভাবনের কাজ ও আলুর নাবি ধ্বসা রোগের প্রতিরোধী জিন প্রতিস্থাপনের কাজ এগিয়ে চলছে।
কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এখন সময়ের দাবি। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে সেচযন্ত্রের ব্যবহার ছিল প্রায় ১ লাখ, বর্তমানে প্রায় ১৬ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১৫ লাখ ৮৫ হাজার অধিক সেচযন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। ৭৬ দশমিক ১৬ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেয়া হচ্ছে যা কিনা মোট আবাদি জমির শতকরা ৮৬ দশমিক ৫৭ ভাগ। স্বাধীনতা উত্তরকালে যান্ত্রিক চাষাবাদ ছিল না বললেই চলে। হালের গরু দিয়েই চাষাবাদ হতো। কয়েক দশকে আগেও শারীরিক শ্রম দিয়েই জমি চাষ ও মাড়াই হতো। বর্তমানে সিংহভাগ জমিই   কৃষিযন্ত্রের মাধ্যমে চাষ হচ্ছে। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কৃষি যান্ত্রিকীকরণ কর্মসূচির ও ৫০-৭০ শতাংশ ভর্তুকির ফলে দেশে কৃষি জমি চাষে প্রায় ৯০%, সেচকাজে ৯৫%, আগাছাদমনে ৬৫%, কীটনাশক প্রয়োগে ৮০% এবং ফসল মাড়াইয়ের কাজে ৭০% যান্ত্রিকীকরণ সম্ভব হয়েছে। টেকসই যান্ত্রিকীকরণে সৌরশক্তির ব্যবহারও বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে।
ভিশন ২০২১ তথ্য-প্রযুক্তি খাতে এনেছে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কৃষিতে এর ছোঁয়া ব্যতিক্রম নয়। দেশে ডিজিটাল কৃষি তথা ই-কৃষির প্রচলন করা হয়েছে। কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি কল সেন্টারের (১৬১২৩) মাধ্যমে কৃষকেরা সরাসরি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করছে। কৃষকদের কৃষি আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনে সহজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছে। ইন্টারেকটিভ কৃষি বিষয়ক ওয়েবসাইটগুলো বিপুল তথ্য ভাণ্ডারের উৎস হিসেবে কাজ করছে। ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে অনলাইন সার সুপারিশসহ অন্যান্য পরামর্শ গ্রহণ অনেক সহজ হয়েছে। গ্রামপর্যায়ে কৃষিবিষয়ক পরামর্শ সেবা দেয়ার জন্য ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ই-পুর্জির মাধ্যমে আখ চাষিদের আখের মূল্য পরিশোধ করা হচ্ছে। কৃষকের একাউন্টে সরাসরি ভর্তুকির টাকা প্রেরণ, ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলা, মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সরকারি গুদামে ধান-চাল ক্রয়, এছাড়াও কৃষিভিত্তিক অনেক ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ও সফটওয়ার ব্যবহার হচ্ছে। এক যুগ আগেও অনেকের কাছে এসব কথা স্বপ্নের মতো মনে হতো, কিন্তু বাস্তব স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে গেছে। জাতীয় ও আঞ্চলিক রেডিও স্টেশন হতে কৃষি বিষয়ক কার্যক্রম প্রচারের পাশাপাশি ১৮টি কমিউনিটি রেডিও হতে কৃষি বিষয়ক তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। বিটিভির পাশাপাশি বেসরকারি চ্যানেলগুলোতে কৃষি বিষয়ক সংবাদ ও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান নিয়মিত সম্প্রচার হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন- ফেসবুক, ইউটিউব, বিভিন্ন পেইজে অথবা গ্রুপেও আধুনিক কৃষি তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বিটিআরসি তথ্য মতে ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটির কিছু বেশি, এর মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। ক্যাটালিস্টের এক পরিসংখানে দেখা যায়, ৮৪ শতাংশ গ্রামীণ কৃষক মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। করোনা অতিমারির সময় সরাসরি কৃষকের উৎপাদিত পণ্য কেনাবেচার জন্য বাংলাদেশে সর্বপ্রথম উন্মুক্ত কৃষি মার্কেটপ্লেস ‘ফুড ফর ন্যাশন’ চালু করা হয়।
কৃষি বিপ্লবের এ বুনিয়াদ রচনা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর স্পর্শধন্য ২১ দফার বেশ কয়েকটি দফাই ছিল কৃষি ও কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নের অন্যতম দাবি। বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেছিলেন, মেধাবীরা কৃষি শিক্ষায় আসলে এবং শিক্ষা শেষে গবেষণা ও সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন সেক্টরে প্রবেশ করে আমূল পাল্টে দিতে পারে পুরাতন কৃষি। তাই ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি চাকরি ক্ষেত্রে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লব তথা কৃষি বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের মর্মকথা ছিল উৎপাদন বাড়াও। তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের কৃষি বিপ্লব সাধনের জন্য কৃষকদের কাজ করে যেতে হবে। বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না।’ খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘খাদ্যের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য আমাদেরই উৎপাদন করতে হবে। আমরা কেন অন্যের কাছে খাদ্য ভিক্ষা চাইব। আমাদের উর্বর জমি, আমাদের অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ, আমাদের পরিশ্রমী মানুষ, আমাদের গবেষণা সম্প্রসারণ কাজে সমন্বয় করে আমরা খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করব। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার।’ পিতার অনুসরণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সততা, আন্তরিকতা ও কৃষকদের প্রতি গভীর মমত্ববোধ উৎসারিত কৃষিবান্ধব নীতি কৌশল খাদ্যে স্বয়ম্ভরতার ঊর্ধ্বগতি বিপ্লবের রূপান্তরিত হয়েছে। পুষ্টি নির্ভর মেধাবী জাতি গঠনে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। করোনা সংক্রমণের কারণে যখন দেশের সবকিছু স্থবির, তখনও সচল  কৃষির চাকা। দুঃসময়ে কৃষিই দেখাচ্ছে সম্ভাবনার পথ। মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপি বলেছেন, চলতি বোরো মৌসুমে গত ৫০ বছরের সকল রেকর্ডকে ভেঙ্গে ২ কোটি ৭ লাখ মেট্রিক টনের অধিক ফলন হয়েছে যার আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এমন কি কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্ব বাজার মন্দাভাব থাকলেও এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত কৃষিপণ্য রপ্তানি আয় ৯.১% বেড়ে ৮২৪ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। শুধু করোনাই নয় গত ৫০ বছরে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস বন্যা, শীত, খরা, তাপদাহসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলিয়ে কৃষি বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এসেছে বিস্ময়কর সাফল্য ও অভাবনীয় উন্নতি। এক সময় বলা হতো দুধে-ভাতে বাঙালি কিংবা মাছে-ভাতে বাঙালি। এখন শুধু দুধে-ভাতে কিংবা মাছে-ভাতে সীমিত নয়, পুষ্টিতে বাঙালি হিসেবে এদেশ বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত হচ্ছে ও পরিচিতি লাভ করছে।
১মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ২অতিরিক্ত উপপরিচালক (এলআর), ডিএই ও প্রেষণে পিএইচডি গবেষক, মোবাইল : ০১৭১৯৫৪৭১৭৯, ই-মেইল  : sayemdae@yahoo.com

 

বিস্তারিত
কবিতা ১৪২৮(শ্রাবণ)

জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি
কৃষিবিদ মোঃ হামিদুর রহমান

বঙ্গবন্ধু, তব জন্মদিন হতে
আজি শতবর্ষ পরে,
তোমাকে স্মরিছে বাঙালি জাতি
পরম শ্রদ্ধাভরে।

বাংলা নামের এ বদ্বীপটির
উদার শোভিত শ্যামলিমা,
নজর কেড়েছে বিশ্ববাসীর
ঐশ্বর্যের এরই মহিমা।

এসেছে মোগল, এসেছে পাঠান
এসেছে বর্গী, ইংরেজ,
পাকহানাদার নিপীড়কদল
দেখিয়েছে কত তেজ।

শাসনের নামে করেছে পীড়ন
বহু শতাব্দী ধরে,
নিঃস্ব করেছে এদেশটিকে
তীব্র শোষণ করে।

অবশেষে তুমি বিধাতার বরে
ত্রাতা বেশে এলে বাংলায়,
অমিত সাহসে হানলে আঘাত
কে আর তোমাকে সামলায়?

চির নিপীড়িত বাঙালি জনেরা
তোমারই মন্ত্র-দীক্ষায়,
স্বাধীন মুক্ত একজাতি হলো
বীরত্ব দেখিয়ে দুনিয়ায়।

সবার বক্ষে এঁকে দিলে তুমি
চির চাওয়া সেই স্বপ্ন,
ক্ষুধা দারিদ্র্যের হবে অবসান
আসবে সুখের লগ্ন।

এই স্বপ্ন রূপায়নে আজ
হয়েছে বিপুল অর্জন,
তোমারই কন্যা কান্ডারি দ্যাখো
সাথে আছে তাঁর জনগণ।

পরপার হতে চেয়ে দেখ তুমি
তব জন্মের শতবর্ষে,
কৃতজ্ঞ জাতি কত আয়োজনে
স্মরিছে তোমাকে হর্ষে।

তুমি বাংলার সর্বকালের
সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তÍান,
বাঙালির প্রাণে রবে তুমি জানি
চিরকাল চির অম্লান।


প্রিয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু
কাজী আনিছুর রহমান


ঘুমিয়ে আছে জাতির পিতা উঠবে না কোনোদিন,
    যাকে দেশটি লিখে দিলেও শোধ হবে না ঋণ।
ঘাতকের বুলেটে ১৫ আগস্ট করেছে মৃত্যুবরণ,
    প্রতি কাজে বাঙালি তাঁকে করেছে আজও স্মরণ।
আসবেনা আর সেদিন কভু বাজবেনা তালি হাতে,
    কাটবে না আর অবসর কভু শিশু-কিশোরের সাথে।
দিবেনা আর উত্তাল ভাষণ করবেনা নতশির,
    রেসকোর্স ময়দানে হবে না কভু লক্ষ জনতার ভিড়।
তুমি সৃষ্টির সেরা আদম সন্তান নও তুমি নিঃস্ব
    চির জাগ্রত ভাষণে তুমি কাঁপিয়ে দিয়েছো বিশ্ব।
বাঙালির মুক্তির চেতনায় ভেসেছিল তোমার বুক,
    জীবনের বিনিময়ে এনে দিলে তুমি বাঙালির স্বাধীনতার সুখ।
কালরাতে ভেসে এলো বিরহের বাঁশি,
    নীরবে ঘুঁচে গেলো এতিম বাঙালির হাসি।
হারিয়ে গেছে অচেনা দেশে আসবে না ফিরে আর,
     সে যে মোদের জাতির পিতা তুলনা নেই তাঁর।
আজ তোমার শত জন্মবার্ষিকীতে করেছি বরণ,
    যতদিন আছে বাংলার মানুষ করিবে তোমাকে স্মরণ।

১সদস্য, এপিএ পুল, কৃষি মন্ত্রণালয় ও প্রাক্তন মহাপরিচালক, মোবাইল : ০১৭১১৮০৩৬৯৫২আদর্শ কৃষক, গ্রাম ও পো: গছানী, উপজেলা : দশমিনা, জেলা : পটুয়াখালী, মোবাইল : ০১৭৮২৯৯০৯৮৪

 

বিস্তারিত
বঙ্গবন্ধুর কৃষি ভাবনা ও বিপণন ব্যবস্থাপনা

বঙ্গবন্ধুর কৃষি ভাবনা ও বিপণন ব্যবস্থাপনা
মোহাম্মদ ইউসুফ

‘কৃষকরা তাঁদের উৎপাদিত ফসলের
বিনিময়ে পাবে ন্যায্যমূল্য’
      -বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন কৃষির উন্নতি ছাড়া এ দেশের মানুষের মুক্তি আসতে পারে না। ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাদ্যের জোগানদাতাদের বঙ্গবন্ধু তাই সর্বদাই সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন নিজের মনের মণিকোঠায়। তিনি যেমন তাদের ভালোবেসেছিলেন, তেমন তাদের ভালোবাসাও পেয়েছেন সর্বক্ষণ। কৃষকদের প্রতি ভালোবাসার টান ছিল বলেই তিনি তাদের মঙ্গলের জন্য কাজ করে গেছেন নিবিড়ভাবে। কৃষকরা যেন তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় সে ভাবনা থেকেই পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচন উপলক্ষ্যে ২৮ অক্টোবর, ১৯৭০ বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে চাষিদের ন্যায্য ও স্থিতিশীল মূল্য প্রদানের তাগিদ দেন। আর বঙ্গবন্ধুর এই স্বপ্ন পূরণে অন্যতম অংশীদার কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকে  কৃষি বিপণন অধিদপ্তর  কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রদান এবং উৎপাদক, বিক্রেতা ও ভোক্তা সহায়ক কৃষি বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।   
পঞ্চাশের দশক থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পার্লামেন্টে কৃষক ও কৃষি উন্নয়নের কথা বলতেন অত্যন্ত জোরালোভাবে। ১৯৫৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষি ও সমবায় মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করে দেশের কৃষি উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখেন। স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার গঠনের পরপরই বঙ্গবন্ধু উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদের প্রথম  বৈঠকেই নিয়েছিলেন কৃষকদের জন্য এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। দেশের জন্য দ্রুত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু দেশের স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদদের নিয়ে গঠন করেন প্রথম পরিকল্পনা কমিশন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে প্রথম বাংলাদেশের বাজেট পেশ করেন। বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়ন খাতের মধ্যে ১০১ কোটি টাকা রাখেন কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে।   
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমন্বিত ও সমবায়ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল, যদি সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে তোলা না যায় তাহলে আমাদের কৃষি উন্নয়ন ব্যাহত হবে, আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব না। আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ব। কো-অপারেটিভ সোসাইটির মাধ্যমে চাষাবাদ করা হলে আমাদের কৃষির উৎপাদন এবং সার্বিক উন্নয়ন দুটিই মাত্রা পাবে। অধিক শস্য উৎপাদনের জন্য আমাদের সবার সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু কৃষি সমবায়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং সমবায়ের আন্দোলনকে কৃষি বিপ্লব বাস্তবায়নের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সমবায় নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনাগুলো বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা পরবর্তীকালে যে সবুজ বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন তা বর্তমান করোনা পরিস্থিতি এবং পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রেক্ষাপটে টেকসই খাদ্য উৎপাদন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে এবং আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করে। উৎপাদক, বিক্রেতা ও ভোক্তা সহায়ক কৃষি বিপণন ব্যবস্থা এবং কৃষি ব্যবসা উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখার নিমিত্ত কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে। কৃষি বিপণন তথ্য ব্যবস্থাপনা ও কৃষি ব্যবসা উন্নয়নের ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। কৃষক ও কৃষিপণ্যের বাজার সংযোগ সৃষ্টি ও সুষ্ঠু সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।   কৃষিপণ্য উৎপাদন এবং বিপণন ও ব্যবসা সম্পর্কিত অর্থনৈতিক গবেষণা অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে। কৃষিপণ্য উৎপাদন ও ব্যবসায় নিয়োজিত  কৃষক, কৃষি ব্যবসায়ী, প্রক্রিয়াজাতকারী, রপ্তানিকারক ও ব্যবসায়ী সমিতিসমূহের  সাথে নিবিড় সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে কৃষিপণ্যের আধুনিক বিপণন ব্যবস্থা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সুষ্ঠু বিপণনের স্বার্থে কৃষিপণ্য উৎপাদন এলাকায় বাজার অবকাঠামো, গুদাম, হিমাগার, কুলচেম্বার ইত্যাদি নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনা জোরদারকরণ করা হচ্ছে। কৃষিপণ্য ও কৃষি উপকরণের মজুদ বা গুদামজাতকরণ, পণ্যের গুণগতমান, মেয়াদ, মোড়কীকরণ ও সঠিক ওজনে ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিবীক্ষণ করা হচ্ছে। ফসলের সংগ্রহত্তোর ক্ষতি হ্রাস, প্রক্রিয়াজাতকরণ, উদ্যোক্তা তৈরি ইত্যাদি বিষয়ে    কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।
কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকল্পে গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের সর্বনিম্ন মূল্য ও যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কার্যক্রমে সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। কৃষিপণ্যের অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কৃষিভিত্তিক শিল্প ও ব্যবসার উন্নয়ন, উৎসাহ প্রদান, প্রসার এবং চুক্তিভিত্তিক বিপণন ব্যবস্থার কার্যপদ্ধতি উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। কৃষি ব্যবসায়ী সংগঠন, সমিতি, সংস্থা, কৃষিভিত্তিক সংগঠন ও সমবায় সমিতিসমূহকে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে তালিকাভুক্তকরণ এবং প্রয়োজনে জাতীয় এবং জেলা পর্যায়ে কৃষিভিত্তিক সংগঠনসমূহের ফেডারেশন অথবা কনসোর্টিয়াম গঠনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে সুপার শপে সংরক্ষিত কৃষিপণ্যের গুণগতমান, নির্ধারিত মূল্য ও বিপণন কার্যক্রম পরিদর্শন, পরিবীক্ষণ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। কৃষিপণ্য ও কৃষি উপকরণের বিপণন কার্যক্রম সংক্রান্ত মান সংরক্ষণ, পরিদর্শন ও পরিবীক্ষণ করা হচ্ছে।
কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রদান এবং তাঁদের বিপণন কার্যক্রমে সরাসরি সম্পৃক্ত করার অংশ হিসেবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এবং কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায় নিরাপদ শাকসবজির বিপণনে ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউর সেচ ভবন প্রাঙ্গণে চালু করা হয়েছে ‘কৃষকের বাজার’। ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে কৃষকের বাজার উদ্বোধন করেন মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় প্রতি শুক্রবার ও শনিবার সকাল ৭টা থেকে এ বাজার শুরু হয়। কৃষকরা তাদের নিজের ক্ষেতের উৎপাদিত নিরাপদ বিষমুক্ত ফসল এ বাজারে বিক্রি করেন। নিরাপদ উপায়ে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে এ বাজার স্থাপন করা হয়েছে।
সাভার, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী ও মুন্সীগঞ্জ থেকে চাষিরা কোনো মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াই মাঠ থেকে সবজি সরাসরি কৃষকের বাজারে আনছেন। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের নিজস্ব রেফ্রিজারেটেড ট্রাকের মাধ্যমে কৃষকদের পরিবহণ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এবং বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সবজির গুণগত মান নিশ্চিত করছে। বাংলাদেশের প্রত্যেক জেলায় কৃষকের বাজার স্থাপনের লক্ষ্যে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কাজ করছে। এ লক্ষ্যে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। পরবর্তীতে বৃহৎ পরিসরে একটি প্রকল্প প্রণয়ন করা হবে। কৃষকের বাজার স্থাপনে কর্মসূচি এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী দাতা প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসতে পারে। কৃষকের বাজার স্থাপনে দেশের ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক বরাবর কৃষি বিপণন অধিদপ্তর হতে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। ৪২টি জেলায় ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এবং কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে নিরাপদ সবজি বিপণনে কৃষকের বাজার স্থাপিত হয়েছে। প্রান্তিক কৃষক সরাসরি বিক্রয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করায় পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন এবং ভোক্তা সাধারণ এ ধরনের বাজার থেকে নিরাপদ সবজি ক্রয় করে তাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করছেন।  
প্রান্তিক কৃষকেরা যাতে ন্যায্যমূল্য পেতে পারে এবং সেই সাথে ভোক্তারা যাতে তাদের চাহিদা মোতাবেক সহজে ও স্বল্প সময়ে এবং সঠিক মূল্যে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য ও কৃষিপণ্য পেতে পারে সে লক্ষ্যে একটি উন্মুক্ত অনলাইন প্লাটফর্ম ‘ফুড ফর ন্যাশন’ চালু করা হয়েছে। মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক ২৩ মে ২০২০ এ প্লাটফর্র্মটি উদ্বোধন করেন। এ প্ল­্যাটফর্মটি তৈরি ও সমন্বয়ের কাজ করেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের এটুআই, উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠাকরণ প্রকল্প (আইডিয়া), কৃষি মন্ত্রণালয় এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের  অধীনস্থ কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। কৃষক, বাজারজাতকারী, আড়তদার, বিপণনকারী আর প্রাতিষ্ঠানিক ভোক্তা একই প্লাটফর্মে পণ্যের দাম আর মানের যাচাই করতে পারবেন। এর পাশাপাশি তারা সরাসরি বাণিজ্যিক যোগাযোগেরও সুযোগ পাবেন। দেশব্যাপী সহজ ও মোবাইল বান্ধব ইন্টারফেসের এ প্লাটফর্মে ক্রেতা-বিক্রেতা রেজিস্ট্রেশন করে কৃষি জাতীয় সকল ভোগ্য ফসল বা সবজির ক্যাটাগরি নির্বাচন করে বিজ্ঞাপন দিতে পারবেন ও কিনতে পারবেন। এছাড়াও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ‘সদাই’ মোবাইল এ্যাপস এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে কার্যক্রম  শুরু করা হয়েছে। গুগল প্লে-স্টোর থেকে মোবাইল এ্যাপসটি ডাউনলোড করে ক্রেতা এবং বিক্রেতাগণ রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত কৃষক বিপণন দলের সদস্য এবং উদ্যোক্তাগণ এ এ্যাপসটি ব্যবহার করে তাদের পণ্যের বিপণন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন।  
১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বল্পতম সময়ে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করে কৃষিকে ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ গড়ার যে ব্যাপক কর্মকাণ্ড শুরু করেছিলেন তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর কৃষকপ্রীতির কথা মনে রেখেই বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার কৃষকদের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি নানা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছে। এ সকল পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ আজ দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা আজ বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। এই সফলতা বজায় রাখতে আমাদের নিরলসভাবে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। আজ বঙ্গবন্ধু নেই, আছে তাঁর দর্শন, আদর্শ ও দিকনির্দেশনা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা দেশের উন্নয়নে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব, এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব), কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, ফোন: ০২-৫৫০২৮৪৫৫; ই-মেইল: dg@dam.gov.bd

বিস্তারিত
ডিজিটাল প্রযুক্তির ভিত্তি রচনায় বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ও কৃষির উন্নয়ন

ডিজিটাল প্রযুক্তির ভিত্তি রচনায় বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ও কৃষির উন্নয়ন

ড. মো. আমজাদ হোসেন১  ড. সমজিৎ কুমার পাল২

বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সাধনা ছিল এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন কৃষিনির্ভর এই বাংলাদেশে কৃষিই দেশের মানুষের মুক্তি এনে দিতে পারে। তাই কৃষির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি। আজকের বাংলাদেশ ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সার্বিক উন্নতির দিকে এগিয়ে চলেছে তারও সূত্রপাত করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু তাঁকে হত্যা করার মাধ্যমে তখন সেই সম্ভাবনার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী  শেখ হাসিনার হাতে বাস্তবায়িত হতে চলেছে যার সার্বিক দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুরই সুযোগ্য দৌহিত্র জনাব সজীব ওয়াজেদ জয়।
কৃষি প্রধান বাংলাদেশের কৃষিই আমাদের অর্থনীতির মূলভিত্তি। কৃষিকে ঘিরেই এদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। তাছাড়া দারিদ্র্যবিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে কৃষির অবদানই সবচেয়ে বেশি। এদেশের বেশির ভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। বঙ্গবন্ধু মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন এদের উন্নতি না হলে দেশের উন্নতি হবে না, স্বাধীনতার সুফল আসবে না। তাই তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল কৃষিকে প্রাধান্য দেয়া। ১৯৭২ সাল থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত (১৯৭৫) তাঁর কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলেই এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি কৃষি গবেষণাকে মনেপ্রাণে প্রাধান্য দিতেন বলেই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত ঈশ্বরদীস্থ  ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট পুনর্গঠিত করে ১৯৭৩ সালেই ‘বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট’ স্থাপন করেন। ঐ বছরেই গাজীপুরে ধান গবেষণার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। ঐ সালেই রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে গঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল যা পরবর্তীতে জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমের সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব পালন করে। এ সময়ই তিনি কৃষি সংক্রান্ত অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি ও বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো ও কার্যক্রম সংস্কার ও জোরদার করার মাধ্যমে কৃষি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা এবং তার উৎকর্ষ সাধনে অনন্য অবদান রাখেন। ইক্ষু চাষ বাড়ানোর এবং চিনি শিল্পের উন্নয়নের জন্য তিনি ‘নিবিড় ইক্ষু উন্নয়ন প্রকল্প’ ও ‘খামার আধুনিকীকরণ প্রকল্প’ গ্রহণ করেন। তিনি নতুন চিনিকল স্থাপন ও বিদ্যমান কয়েকটি চিনিকলের যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপন ও  আধুনিকায়নেরও উদ্যোগ নেন।
স্বাধীনতার পর পাট ও চিনিকল এবং টেক্সটাইল কারখানা রাষ্ট্রীয়করণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এটি ছিল ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত। এর প্রাথমিক ফলাফলও ছিল সত্যিই চমকপ্রদ। স্বাধীনতার প্রথম বছরের মধ্যেই দেশে পাটকলগুলো তাদের সক্ষমতার ৫৬ শতাংশ উৎপাদন করতে শুরু করেছিল।
বিশ্বে প্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটে ১৭৬০ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কারের মাধ্যমে। এরপর দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের আবির্ভাব হয় বিদ্যুৎ উদ্ভাবনের মাধ্যমে। ইলেকট্রনিক্স আর তথ্যপ্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে শুরু হয় তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। ১৯৬০ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কারের ফলে বিশ্বজুড়ে সৃষ্টি হয় নতুন প্রাণের সঞ্চার। এ সময়ই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম। বঙ্গবন্ধু এ সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের প্রধান শক্তি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারে উদ্যোগী হন। পাশাপাশি বাঙালিকে বিজ্ঞানমনস্ক জাতি হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। তাঁরই সার্থক শুরু ছিল আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নে (আইটিইউ) বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভ এবং বেতবুনিয়ায় ভূউপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে। তাঁরই প্রচেষ্টায় ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ আইটিইউ এর সদস্যপদ পায়। এ সংস্থা স্যাটেলাইট অরবিট বা ফ্রিকোয়েন্সি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ড করে থাকেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেতবুনিয়া ভূউপগ্রহ উদ্বোধন করেন যা এদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি মাইলফলক। এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ এবং মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ভিত্তি রচিত হয়েছিল। রচিত হয়েছিল ডিজিটাল বিপ্লবের মূল ভিত্তি। এরই ধারাবাহিকতায় মূলত ইন্টারনেট এর মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস, নিজে চলা গাড়ি, ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিং, ন্যানো টেকনোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োটেকনোলজি, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্সসহ কৃষির নানাবিধ ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ করে বিশ্বে এখন বিশাল পরিবর্তন এসেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি হয়েছে ডিজিটাল নির্ভর । বাংলাদেশও এগিয়ে চলেছে সমান তালে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি কৃষিতেও এর প্রয়োগ এনে দিয়েছে এক বিশাল পরিবর্তন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কৃষি গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্র, গবেষণালব্ধ নতুন জাত ও প্রযুক্তি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে দ্রুততম সময়ে পৌঁছানো, কৃষি বিপণনে এবং বাজার ব্যবস্থায় এনে দিয়েছে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। আজ দেশের কৃষকসমাজ জানতে পারছে কৃষি আবহাওয়ার হঠাৎ পরিবর্তনের খবর, ফলে হাওড়সহ যে কোনো উপদ্রুত এলাকায় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছে, কোনো বিশেষ জমির জন্য উপযুক্ত সারের মাত্রা, ফসল নির্বাচন, উত্তম কৃষি চর্চা, ফসল সংগ্রহোত্তর করণীয়, বিপণনসহ নানাবিধ কার্মকাণ্ড। কৃষিতে এসব প্রযুক্তি প্রয়োগের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে কম খরচ, দ্রুত গ্রহণযোগ্যতাসহ আরো অনেক দিক। বাংলাদেশ এখন খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। উৎপাদিত কৃষি পণ্য সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে এখন ব্যাপকভাবে ডিজিটাল মাধ্যম, মোবাইল পেমেন্ট সিস্টেম প্রভৃতি ব্যবহৃত হচ্ছে। ফেসবুকের মাধ্যমেও হাজার হাজার তরুণ গড়ে তুলছেন নিজেদের কর্মসংস্থান।
বঙ্গবন্ধু যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তাঁকে হত্যার পর অর্থাৎ ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত প্রযুক্তির উন্নয়নে দেশে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ১৯৯২-৯৩ সালে বাংলাদেশকে বিনামূল্যে সাবমেরিন কেবল লাইনে অর্থাৎ সাউথ ইস্ট এশিয়া-মিডল    ইস্ট-ওয়েস্ট এশিয়ায় (সিমিইউই) সংযুক্ত করার একটি সুযোগ আসে। তবে তৎকালীন সরকার তা করতে দেয়নি। ফলে পিছিয়ে যায় দেশ।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর ১৯৯৮-৯৯ সালের বাজেটে তিনি কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেন, মোবাইল ফোন সহজলভ্য করেন। ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে সচল করেন। ঐ সময়ই দেশে প্রোগ্রামার তৈরির উদ্যোগ নেন তিনি। বাংলাদেশ থেকে সফটওয়্যার রপ্তানির উপায় উদ্ভাবনের জন্য টাস্কফোর্স গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু পরে তা আবার থেমে যায়। ২০০৮ সালে দেশবাসীকে “ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখান বঙ্গবন্ধুকন্যা । ২০০৯ সালের শুরুতেই সরকার গঠন করে ঘোষণা করেন ভিশন-২০২১ ও ২০৪১। উন্নয়নকে টেকসই করতে ভিশন-২০৩১ এবং শতবর্ষব্যাপী ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ । ভিশন-২০২১ এর মূল উপজীব্য ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। এর বাস্তবায়নে বিগত কয়েক বছরে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই ঠিক ৪৩ বছর পর ২০১৮ সালের ১২ মে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে বিশ্বের ১৯৮টি দেশের মধ্যে ৫৭তম দেশ হিসেবে মহাকাশে জায়গা নিল বাংলাদেশ। দেশের স্যাটেলাইট টেলিভিশনসহ সম্প্রচার মাধ্যম এখন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট এর ব্যবহার হচ্ছে, আর সব ক’টি চ্যানেলে প্রদর্শিত হচ্ছে কৃষির কর্মকাণ্ড ।
শেষ পর্যন্ত নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অনুযায়ী বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করছেন শেখ হাসিনা। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জনের যে স্বপ্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেখিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সর্বোপরি ডিজিটাল মার্কেটিং এর ব্যাপারে প্রয়োজনীয়  অবকাঠামো নির্মাণ  করতে হবে। দেশে এখন বিনিয়োগের উত্তম সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। হাইটেক পার্ক অত্যাধুনিক ল্যাবসহ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। শিক্ষিত তরুণদের মাঝে বিরাজমান বেকারত্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য দক্ষতা উন্নয়ন এবং কৃষি যান্ত্রিকীকরণে এর ব্যবহারের জন্য উদ্যোক্তা তৈরির দিকেও মনোযোগ দেয়া যেতে পারে। কৃষক ও অন্যান্য ব্যবহারকারীদের ডিজিটাল তথ্যে প্রবেশের সুযোগ, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং দক্ষতার উন্নয়ন করা যেতে পারে। অধিক উন্নত আইসিটি যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। যেমন: এচঝ, এওঝ, জঋওউ (জধফরড় ঋৎবয়ঁবহপু ওফবহঃরভরবৎ), জবসড়ঃব ংবহংরহম ঝসধৎঃ ফবারপব ভড়ৎ ঢ়ৎবপরংরড়হ ধমৎরপঁষঃঁৎব কৃষি তথ্যের জন্য বৃহৎ ডাটাবেজ প্রস্তুত, ব্যবস্থাপনা এবং বিশ্লেষণের সুযোগ বাড়ানো যেতে পারে। এভাবেই গড়ে উঠবে আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা। আর আমরাও উচ্চকণ্ঠে উচ্চারণ করবো ‘সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এই দেশে’।

১মহাপরিচালক ২পরিচালক (গবেষণা), বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী, পাবনা, ফোন : ০৭৩২৫৬৫৩৬২৮, ই-মেইল : dg-bsri.gov.bd

 

বিস্তারিত
কৃষিবান্ধব জাতির পিতা আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা

কৃষিবান্ধব জাতির পিতা আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা

কৃষিবিদ ড. মো. আখতারুজ্জামান
আমাদের জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠে বাঙালি, বহুধা অঁচলে অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ একজন বরেণ্য রাজনীতিবিদ, বাঙালির মুক্তির দিশারি এবং আধুনিক বাংলাদেশের অন্যতম রূপকার। তাইতো তিনি তাঁর স্বল্প কর্মকালীন সময়ে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ধর্ম, তথ্য প্রযুক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন, পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাকার বিষয়ে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধু একবাক্যে আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।
আমরা যাঁরা কৃষিবিদ বা কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে দেখি একজন কৃষিচিন্তক ও কৃষিবান্ধব রাষ্টনায়ক হিসেবে; তিনি ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন আমাদের কৃষিই পারে আমাদের দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর খাদ্য পুষ্টির জোগান দিতে কারণ এ দেশের মতো কৃষি উপযোগী উর্বর মাটি আবহাওয়া ও জলবায়ু পৃথিবীর কোথাও নেই। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বল্প কর্মকালীন সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে যুগান্তকারী যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সেসবের মধ্যে অন্যতম ছিল-২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ; গ্রাম্য সমাজভিত্তিক কৃষকের জন্য সুদমুক্ত ঋণের প্রবর্তন; স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ২২ লাখ কৃষককে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ; প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণ অভিযান চালুকরণ; প্রথম বাজেটেই কৃষিতে ভর্তুকির ব্যবস্থা গ্রহণসহ সার, কীটনাশক ও সেচ যন্ত্রাংশ সরবরাহ; প্রাইম সাপোর্ট হিসেবে ধান, পাট, আখ প্রভৃতি ফসলের ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ; গ্রাম্য সমাজভিত্তিক সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ; ১৯৭২-৭৩ সালের ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়ন বাজেটের মধ্যে কৃষি খাতে ১০১ কোটি টাকার বরাদ্দ রেখেছিলেন।
অধিকন্তু কৃষি নিয়ে বঙ্গবন্ধু অনেক আপ্তবাক্যের অবতারণা করে গিয়েছেন। কৃষি মন্ত্রণালয় বঙ্গবন্ধুর কৃষি বিষয়ক ৭১টি বাণী সম্বলিত একখানা পুস্তিকা প্রকাশ করেছে। এরই মধ্যে অধিকতর কলেবরে ১০০টি কৃষিবিষয়ক বাণী চিরসবুজ এবং মুজিব শতবর্ষের স্মারকগ্রন্থ চিরঞ্জীব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মোড়ক উন্মোচন করেছেন। কৃষি বিষয়ক বঙ্গবন্ধুর এসব অমীয় বাণীর প্রতিটি পরতে পরতে রয়েছেÑ কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদসহ গোটা কৃষির প্রতি তাঁর মমত্ববোধ এবং অনাগত কৃষি নিয়ে তাঁর সুদূরপ্রসারী ভাবনার অতলান্তিক গভীরতা। তিনি এ দেশের কৃষি ও কৃষক নিয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, ‘আমাদের সমাজে চাষিরা হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণি এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘দেশে কৃষি বিপ্লব সাধনের জন্য কৃষকদের প্রতি কাজ করে যেতে হবে। বাংলাদেশে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা হবে না। জনগণের ঐক্যবদ্ধ কিন্তু নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই দেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতির দ্রুত পুনর্গঠনের নিশ্চয়তা বিধান করা যাবে।’ এভাবেই যুগান্তকারী কৃষিবান্ধব কার্যক্রমের মাধ্যমে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে বাংলাদেশের কৃষিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। তিনিই দিয়েছিলেন, চাকরি ক্ষেত্রে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা। চাকরিতে প্রথম শ্রেণির মর্যাদাদানের পরে তিনি কৃষিবিদদের উদ্দেশ্যে জোর দিয়ে বলেছিলে, ‘আমি তোদের পদমর্যাদা দিলাম, তোরা আমার মান রাখিস।’ তাত্ত্বিক কৃষি শিক্ষার পাশাপাশি ব্যবহারিক   কৃষির উপরে তিনি সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ব্যবহারিক কৃষি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘শুধু কাগজে-কলমে আর বই পড়েই কৃষি কাজ হয় না। গ্রামে যেয়ে আমার চাষি ভাইদের সঙ্গে বসে প্র্যাকটিক্যাল কাজ করে শিখতে হবে।’
ব্যবহারিক কৃষি শিক্ষার উপরে অধিকতর গুরুত্ব করে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসের ১৪ তারিখে ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরের ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড়রূপী সবুজ শ্যামলিমার আবরণে ঢাকা ৪৯ একর জমির উপরে জাপানি আন্তর্জাতিক সংস্থা জাইকার সহায়তায় গোড়াপত্তন করেছিলেন, কেন্দ্রীয় সম্প্রসারণ সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট বা সার্ডি। বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করতেন, কৃষির লাগসই এবং টেকসই কৃষি প্রযুক্তি জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য দক্ষ ও যোগ্য কৃষি সম্প্রসারণ বিশেষজ্ঞ তথা দক্ষ মানব সন্তান তৈরির কোনো বিকল্প নেই। কালের বিবর্তনে এবং সময়ের প্রয়োজনীয়তায় কেন্দ্রীয় সম্প্রসারণ সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট বা সার্ডিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগি সংস্থা থেকে অবমুক্ত করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটা একক সহযোগী সংস্থা হিসেবে জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমি বা নাটার প্রবর্তন করেন। সবে নাটা এ বছর ০৭ জুন তারিখে করোনা কোভিডের মধ্যে শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পালন করলো, নাটার সপ্তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত সিনিয়র সচিব জনাব মোঃ মেসবাহুল ইসলাম। এরই মধ্যে নাটা সাফল্যের পথ বেয়ে শিকড় থেকে শিখরে আরোহণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে সহসা এটি আন্তর্জাতিক মানের কৃষি প্রশিক্ষণের বিনয়ন বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিণত হবে। তেমনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন নাটার সপ্তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি জনাব ওয়াহিদা আক্তার, অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন), কৃষি মন্ত্রণালয় ও ড. শেখা মোহাম্মদ বখতিয়ার, নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা  কাউন্সিলসহ আগত অন্যান্য অতিথিবৃন্দ। নাটা এখন শুধু দক্ষ    কৃষি বিশেষজ্ঞখ্যাত মানবসম্পদ উন্নয়নের সাথেই জড়িত নয়, এখানে এখন সাফল্যের সাথে পরিচালিত হচ্ছে নার্সভুক্ত কৃষি বিজ্ঞানীদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ এবং অপরপর সব বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তার অল ক্যাডার ফাউন্ডেশন ট্রেনিং কোর্স। সত্যি বলতে আজকের আধুনিক নাটার বীজ বপন করেছিলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং সেটাকে, আধুনিকায়ন করত: অধিকতর পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থায়ন করে যাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধুর যোগ্য তনয়া এবং বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সব সরকারের শাসনামলে; তাইতো বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার খ্যাতি পেয়েছে ‘কৃষিবান্ধব’ সরকার হিসেবে।
কৃষিবান্ধব জাতির পিতার আধুনিক বাংলাদেশ গঠনের স্বাপ্নিক চিন্তার পাশাপাশি ক্ষণজন্মা এই প্রবাদপুরুষ স্বমহিমায় দেশে বিদেশে নানাবিধ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। দরাজ কণ্ঠের সাহসী এই রাজনৈতিক নেতার জন্ম না হলে আজও আমরা স্বাধীনতার স্বাদ পেতাম কি না জানি না। কী এমন ছিল এই প্রজ্ঞাবান আর বরেণ্য রাজনীতিবিদের মধ্যে যাঁর ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ১৮ মিনিটের স্ক্রিপ্টবিহীন ভাষণটিকে বিশ^ ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর  ইউনেস্কোর একটি উপদেষ্টা কমিটি বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল’ রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করে। তখন সবে সেখানে বিশ্বের মাত্র ৪২৭টি ভাষণ নথিভুক্ত হয়েছিল। অথচ এই ভাষণ প্রদানের আগে দেশের আপামর জনসাধারণ কেউ এতটুকু আঁচ করতে পারেননি, কী এমন বলবেন সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে। অথচ প্রজ্ঞাবান এই মানুষটি অত্যন্ত কৌশলী হয়ে ওই দিন স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। আর এসব কারণেই বঙ্গবন্ধুর অনবদ্য সাবলীল ভাষণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। এটা বাঙালি হিসেবে আমাদের গর্ব ও অহংকারের জায়গা।
বঙ্গবন্ধুই আমাদের জাতির পিতা
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রাম ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান আর দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রম হারানোর বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হলো সেটার মহানায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বন্দী বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন না তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, এসব ভাবনা পদদলিত করে শুধু তাঁরই নামে এদেশের ৯৮ শতাংশ আমজনতার আবাল বৃদ্ধ বণিতা কামার কুমোর মুটে কুলি দিনমজুর তাঁদের স্ব স্ব জীবন বাজি রেখে ৭ মার্চের ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়ে যাঁর যা আছে তাই নিয়ে যেভাবে পারে সেভাবেই শত্রুর মোকাবেলা করে দেশকে স্বাধীন করেন।
বর্তমান সরকার জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনীতে বঙ্গবন্ধুকে সম্মাননা প্রদান করেছে। এটা একটা সাংবিধানিক স্বীকৃতি। কিন্তু বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামে তাঁর যে অবদান তাতে সংবিধানে নয়, জন মানুষের হৃদয়ে তিনি জাতির পিতা হিসেবে আছেন এবং থাকবেন। জাতির পিতাকে নিয়ে টানা হেঁচড়া বিষয়টি কিন্তু একমাত্র আমাদের দেশ ব্যতীত পৃথিবীর অন্য কোনো দেশেই নেই। প্রতিটি দেশেই তাদের জাতির পিতাকে সম্মান করে থাকেন। তাই আমাদেরও উচিত দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে জাতির পিতাকে জাতির পিতা হিসেবে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ার সম্ভ্রান্ত শেখ পরিবারে জন্ম নেয়া খোকা নামের অজ গ্রামের সেই শিশুটি পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালির মুক্তির দিশারী। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ এবং জনগণের প্রতি মমত্ববোধের কারণে পরিণত বয়সে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, ইতিহাসে ঠাঁই করে নেন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার এবং জাতির পিতা হিসেবে।
শেখ মুজিব যেভাবে বঙ্গবন্ধু হলেন
১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কয়েকজন রাজনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা  পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত মর্মে শেখ মুজিবুর রহমানসহ মোট ৩৫ জনকে আসামি করে ১৯৬৮ সনের ২০ জুন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি শুরু হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক বঙ্গবন্ধুর কারণেই শুরু হয় ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান। সে সময় ছাত্র-জনতা স্লোগানে মুখরিত করে রব তোলেন, ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।’
অবশেষে নিরুপায় হয়ে আইয়ুব খান ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অভিযুক্ত সকল আসামিকে নিঃশর্ত  মুক্তি প্রদান করেন। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঢাকাস্থ রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল গণসংবর্ধনার আয়োজন করা হয় এবং ওই সভায় তৎকালীন ডাকসুর সভাপতি আওয়ামী সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ঢাকার ইতিহাসে এত বড় বিশাল জনসভা ইতঃপূর্বে আর কখনো হয়নি। উক্ত  মহাসমাবেশে ১০ লাখ লোকসমাগম হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এর পর থেকে বাংলার জনগণের কাছে শেখ মুজিবুর রহমান নাম ছাপিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিটি ক্রমেই জনপ্রিয় হতে থাকে।
তাই আসুন, আমরা দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে সম্মান করি এবং আমরা যাঁরা কৃষিবিদ বা কৃষিজাত পেশার সাথে  জড়িত তাঁরা নতশিরে বঙ্গবন্ধুকে প্রণতি জানাই।


মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমি (নাটা), গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭১১৮৮৪১৯১

 

বিস্তারিত
শরীর সুস্থ রাখতে বয়স অনুযায়ী খাদ্য মেনু পরিকল্পনা

শরীর সুস্থ রাখতে বয়স অনুযায়ী খাদ্য মেনু পরিকল্পনা
খালেদা খাতুন

জীবনকে সুন্দর, সুখময় ও সার্থক করে তুলতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন সুস্থ, সবল ও সতেজ দেহ। আর এজন্য যথাযথ পুষ্টির দরকার। একটি সমাজের সর্বাঙ্গীণ অবস্থার ওপর ওই সমাজের সদস্যদের পুষ্টির মান নির্ভরশীল। জন্মের পর মানুষের প্রথম প্রয়োজন খাদ্য। এ খাদ্যই পুষ্টির বাহক। যেসব খাদ্য দেহের, বৃদ্ধি, গঠন, ক্ষয়পূরণ ও জনশক্তির বিকাশ ঘটায় তাদের পুষ্টিকর খাদ্য বলা হয়। এ ধরনের খাদ্য যখন দেহের সুস্থতা আনে, তখন বলা হয় পুষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ, পুষ্টি হলো একটি জৈবিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে খাদ্য শারীরিক বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ এবং শক্তি উৎপাদনের কাজ করে থাকে। খাদ্যে ৬টি প্রধান পুষ্টি উপাদান থাকে। এগুলো হলো-কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিনস, মিনারেল এবং পানি। এ পুষ্টি উপাদানগুলোই শরীরের বিপাককে সচল রাখে, সর্বপ্রকার কাজের শক্তি জোগায় এবং শরীর সুস্থ রাখতে সহায়তা করে।
বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হলো ক্ষুধা, অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা, কৃষি উন্নতিতে মনোযোগ দেয়া, কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক উৎপাদনে উৎসাহ দেয়া, গ্রামীণ মানুষের অবদানে উৎসাহ প্রদান, প্রযুক্তির সমৃদ্ধিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ছড়িয়ে দেয়া। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, মানবস্বাস্থ্য উন্নয়ন, কৃষি সমৃদ্ধি, খাদ্যের সুরক্ষা, টেকসই উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য খাদ্যবাহিত ঝুঁকি রোধ এ বিষয়গুলোকে লক্ষ রেখে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি গৃহীত ও বাস্তবায়ন হচ্ছে।
ঘঁঃৎরঃরড়হ রং ড়হব ড়ভ ংবাবৎধষ ভধপঃড়ৎং ংঁঢ়ঢ়ড়ৎঃরহম বিষষহবংং. পুষ্টি বিষয়টির মধ্যে শারীরিক স্বাস্থ্য, মানসিক ও আত্মিক স্বাস্থ্য, সামাজিক ও গণস্বাস্থ্য, সামাজিক পরিবেশ এবং পেশাগত স্বাস্থ্য এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত। তাই একটি রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নের একটি প্রধানতম নিয়ামক হলো পুষ্টিকর খাদ্য।
সুস্থ থাকা ও সার্বিকভাবে কাজ করার জন্য এবং দেহের প্রতিটি কোষ, কলা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জন্য সুষম খাবার প্রয়োজন। উপযুক্ত পুষ্টিকর খাবারের অভাবে সহজেই মানুষ রোগাক্রান্ত হতে পারে। এছাড়া ইনফেকশন, অবসাদ ও দুর্বল কার্যক্ষমতা দেখা দেয়। যেমন-গর্ভবতী মায়ের সুষম খাবার না খেলে গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি ঠিকমতো হয় না। ফলে, মা ও শিশু দু’জনেই নানা প্রকার পুষ্টিহীনতায় ভুগে। স্তন্যদাত্রী মায়ের শিশুকে পর্যাপ্ত দুধ সরবরাহের জন্য অতিরিক্ত খাবার না দিলে শিশু পর্যাপ্ত দুধ থেকে বঞ্চিত হয়। ঠিক তেমনি শিশুদের ক্ষেত্রেও সুষম খাদ্যের অভাবে তাদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ও কিশোর-কিশোরীদের ঠিকমতো বেড়ে ওঠা ব্যাহত হয় এবং নানা রকম পুষ্টিহীনতার উপসর্গ দেখা দেয়। এছাড়াও বৃদ্ধাদের সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকা এবং অসুস্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে রোগ অনুযায়ী যথার্থ সুষম খাবার প্রয়োজন। এ সুষম খাবারে শরীরের চাহিদা অনুযায়ী সব ধরনের পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকা বাঞ্ছনীয়।
সুষম খাবার মানুষের বয়স, ওজন, উচ্চতা, কাজের ধরন, আবহাওয়া ও অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল। খাবারের মেনু পরিকল্পনা যে বিষয়ের ওপর নির্ভর করে তা হলো- ১. উপযুক্ত পুষ্টিজ্ঞান; ২. পরিবারের সদস্যদের পছন্দ, রুচি; ৩. খাদ্য উপাদান; ৪. দেশের অর্থনীতি; ৫. খাদ্য সরবরাহ; ৬. খাবারের পর্যাপ্ততা; ৭. খাদ্য বিনিময় সম্পর্কে ধারণা; ৮. মৌলিক খাদ্যগোষ্ঠী সম্পর্কে ধারণা; ৯. আবহাওয়া; ১০. দুর্যোগ ও ১১. সংস্কৃতি। এছাড়া পরিবারের সদস্যদের ওপর ভিত্তি করে মেনু পরিকল্পনা করতে হয়। যেমন-ক. শিশুর জন্য পরিপূরক খাবার; 
খ. গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়ের খাবার; গ. কিশোর-কিশোরীদের খাদ্য; ঘ. প্রাপ্তবয়স্কদের সহজপাচ্য খাদ্য; ঙ. রোগীর রোগ অনুযায়ী পথ্য।
শিশুর পরিপূরক খাবার
মাতৃগর্ভ থেকেই শিশুর পুষ্টি শুরু হয়। কাজেই গর্ভে থাকা শিশুর পুষ্টি ও মায়ের সুস্থতার জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে পুষ্টি চাহিদা অনেকটা বেড়ে যায়। যেমন-গর্ভকালীন হরমোনের ক্ষরণ বৃদ্ধি পাওয়ায় মায়ের জরায়ু, স্তন্য, নাভীরজ্জু ইত্যাদি অঙ্গের বৃদ্ধি ও বিপাক ক্রিয়ার গতি বৃদ্ধি পায়। তাই এসব কার্যকলাপের জন্য ক্যালোরি চাহিদা বেশি থাকে। এছাড়া গর্ভস্থ সন্তানের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গ, গ্রন্থি, কলা ও কোষের গঠন ও বৃদ্ধির জন্য এবং মায়ের শিশুর পর্যাপ্ত রক্ত গঠনের জন্য অতিরিক্ত প্রোটিন (চৎড়ঃবরহ) প্রয়োজন হয়। এজন্য জৈব মূল্যের চৎড়ঃবরহ যেমন-মাছ, মাংস, ডিম, লৌহ ও ফলিক এসিডের জন্য কলিজা,  ভিটামিন ‘সি’ এর জন্য লেবু, আমলকী, পেয়ারা, কাঁচামরিচ ইত্যাদি খাওয়া যায়। শিশুর হাড়, দাঁত, নখ, চুল যাতে ঠিকমতো গঠন হয় এবং মায়ের হাড় ক্ষয় বা পাতলা না হয় তার জন্য ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ভিটামিন ‘ডি’ এর প্রয়োজন হয়। আর যদি এসবের অভাব হয় তাহলে মায়ের হাড় থেকে ভ্রƒণের দেহে এসব ব্যবহৃত হয়। ফলে মা ও শিশু দুজনেরই হাড় দুর্বল হয়। অনেক শিশুকে দেখা যায়, একটু দৌড়ালেই তাদের পা ব্যথা হয়। এজন্য গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত দুধ, ছোট মাছ, ভিটামিন ‘ডি’ এর জন্য কডলিভার অয়েল, সবুজ ও রঙিন শাকসবজি খেতে হয় এবং প্রায় প্রতিদিন সকাল থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত অন্তত ১৫-২০ মিনিট রোদে থাকতে হয়, যাতে চামড়ায় সরাসরি রোদ লাগে। এতে শরীরে ভিটামিন ‘ডি’ তৈরি হয়। থাইরয়েড হরমোনের ক্ষরণ বৃদ্ধির জন্য আয়োডিনযুক্ত খাবার খেতে হয়। গর্ভবতী অবস্থায় সব ধরনের পুষ্টি চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং এ চাহিদা মেটানো কঠিন কিছু নয়। সুষম খাদ্য তালিকার মাধ্যমে এ সময়ে ক্যালোরি, প্রোটিনসহ অন্যান্য মৌসুমি শাকসবজি ও ফলমূল অবশ্যই খেতে হয়। স্তন্যদানকারী মায়ের খাবারের চাহিদা বিশেষ করে ক্যালোরি, প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ লবণের চাহিদা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়। কারন, বুকের দুধ নিঃসৃত করার কাজটি করতে তাকে প্রচুর শক্তি ক্ষয় করতে হয়। প্রায় প্রতিদিন ৬৫০-৮৫০ মিলিলিটার দুধ উৎপাদন করতে হয় তাকে। এরজন্য অতিরিক্ত ২০০-৪০০ ক্যালোরি প্রয়োজন হয়। তাই দৈহিক স্তন্যদানকারী মায়ের খাদ্য প্রায় ৭০০-১০০০ ক্যালোরি সরবরাহ থাকা উচিত। অবশ্য শিশুর বয়স ৬ মাস পেরিয়ে গেলে যখন বুকের দুধের পরিমাণ কমে যায় তখন ক্যালোরির পরিমাণও কমে যায়। বুকের দুধে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে উৎকৃষ্টমানের প্রোটিন, ক্যালোরি, ভিটামিন ও মিনারেলস।
জন্ম থেকে ৬ মাস পর্যন্ত শিশুর ওজন বৃদ্ধির হার পার্থক্য দেখা দেয়। এর কারণ ৬ মাস বয়সের পর শিশুর বিশেষ পুষ্টি চাহিদা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব। মাতৃগর্ভ থেকে যেসব উপাদান নিয়ে শিশু জন্ম নেয় তা ৬ মাস পর্যন্ত মায়ের দুধের মাধ্যমে শিশুকে নানা রকম অপুষ্টির হাত থেকে রক্ষা করে। তাই পরবর্তীতে বাড়তি চাহিদা পূরণের জন্য মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি পরিপূরক খাবার দেয়া হয়। এ খাবার দেয়ার উদ্দেশ্য হলো-পারিবারিক খাবারে অভ্যস্থ করানো যাতে শিশুর পুষ্টি চাহিদা অনুযায়ী তার সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকে।
কিশোর-কিশোরীদের পুষ্টিকর খাদ্য
জন্মের পর থেকে শিশুর যে বর্ধন প্রক্রিয়া চলে তা প্রায় ১৮/১৯  বছর চলতে থাকে। এ সময় পুষ্টির চাহিদাও বেশি থাকে। কৈশোরে যদি এ চাহিদা পূরণ না হয়, তার দেহ গঠন ও বর্ধন যথাযথভাবে হয় না। বরং নানারকম অপুষ্টির লক্ষণ দেখা দিবে এবং দুর্বল ও অপুষ্ট হওয়ায় সংক্রামক ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হবে। ফলে সারা জীবনই দুর্বল ও রোগা হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। অবশ্য কৈশোরে সবার পুষ্টি চাহিদা এক রকম হয় না। এটা নির্ভর করে-১. ছেলেমেয়ে ভেদে; ২. বয়সভেদে; ও ৩. আকৃতি ভেদে।
এসব বিষয় অনুযায়ী পুষ্টি চাহিদা ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় হয়। তবে কৈশোরে ছেলেমেয়েদের খাবারে  যেসব বিষয়গুলো থাকবে সেগুলো হলো- ১. কর্মশক্তি জোগাবার জন্য খাবার ক্যালোরি বহুল হতে হবে। ২. ক্ষয়পূরণ ও দ্রুত বৃদ্ধি গঠনের জন্য খাবারে প্রয়োজনীয় প্রোটিন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান থাকতে হবে। ৩. যেহেতু এ সময় হাড়ের বর্ধন হয় এজন্য ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন ‘ডি’সহ অন্যান্য ভিটামিনের ও খনিজ লবণের প্রাচুর্যতা থাকতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের খাবারে বেশ যত্নশীল হতে হয়। কারণ এ সময়ে তাদের ছেলেমেয়ে ভেদে বেশ কিছুটা শারীরিক পরিবর্তন হয়।
প্রাপ্ত বয়স্কদের সহজপাচ্য খাদ্য
প্রাপ্ত বয়স্কদের পুষ্টি চাহিদা নির্ভর করে- ১. লিঙ্গ; ২. বয়স; ৩. ওজন; ৪. উচ্চতা; ৫. শারীরিক পরিশ্রম এবং ব্যক্তি কোন ধরনের রোগে আক্রান্ত ইত্যাদি বিষয়ের ওপর।
৬০ বছর বয়স হলেই তাকে বৃদ্ধ বলা হয়। ৪০-৪৫ বছর হতে দেহের বিভিন্ন গ্রন্থি ও কার্যক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। ত্রুটিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাসের দরুন যদি কারো কোনো একটি খাদ্য উপাদানের অভাব থাকে বা দীর্ঘদিন চলতে থাকে, তবে তার প্রভাব বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহে ফুটে ওঠে। বর্তমানে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হয়েছে, যার ফলে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। কাজেই দেশে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা নেহায়েতই কম নয়। জীবনের বিভিন্ন সময়ের মতো বার্ধ্যকেও সুষম খাবার তৈরি করতে খাদ্যের মৌলিক গোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করতে হয়। এ সময় অনেকেরই অরুচি ও পরিপাকে অসুবিধার দরুন খাদ্য গ্রহণে আগ্রহ কমে যায়। দাঁতও সব থাকে না বা থাকলে হয়তো শক্ত খাবার খাওয়ার মতো অবস্থায় থাকে না। আবার এ বয়সে হাড়ের ক্ষয়জনিত রোগেও ভোগেন তারা। তাই এসব বিষয়ের ওপর খেয়াল রেখে খাবার এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে করে খাবার নরম ও সহজপাচ্য হয় এবং ক্যালসিয়াম ও  লৌহজাতীয় উপাদানসমৃদ্ধ হয়। ক্যালসিয়ামের জন্য দুধ ও দুধের তৈরি খাবার যেমন- ছানা, পনির, পায়েস, দই এসব খাওয়া যায়। ছোট মাছও খাওয়া ভালো। লৌহের জন্য মাঝে মাঝে কলিজা দেয়া যেতে পারে। কোষ্ঠকাঠিন্যর জন্য মৌসুমি শাকসবজি ও ফল খাওয়া যেতে পারে। ওজন বেশি থাকলে বাড়তি ওজন কমিয়ে ফেললে ভালো হয়। দৈনিক হাঁটাচলা ও কিছুটা শারীরিক পরিশ্রম সুস্থ থাকার জন্য আবশ্যক। এ বয়সে আলগা লবণ ও লবণাক্ত খাবার, চিনি-মিষ্টি, মধু, মিষ্টান্ন, মিষ্টি ফল কম খাওয়া উচিত। মদ, ধূমপান, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন বাদ দেয়া উচিত।
বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। বর্তমানে দেশের সব জেলাতেই খাদ্যের সব মৌলিক উপাদান সংবলিত খাবারের প্রাচুর্যতা রয়েছে। নিরাপদ ও সুস্থ পৃথিবী গড়তে আরো কিছু বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।  যেমন- খাদ্যের মৌলিকগোষ্ঠী সম্পর্কে পর্যাপ্ত পুষ্টিজ্ঞান; শুধু একই ধরনের খাবার না খাওয়া; খাদ্যের প্রাপ্যতা অনুযায়ী সুষম খাবার তৈরি; বেশি দামি খাবারকে বেশি পুষ্টিকর মনে না করা; পরিবারের আয় অনুযায়ী অল্পদামি খাবার দিয়ে সুষম খাবার তৈরি করা; খাবার তৈরির আগে ও খাবারের সময় সাবান দিয়ে হাত ধোয়া; শাকসবজি সঠিক নিয়মে ধোয়া এবং সঠিক উপায়ে রান্না করা; নিয়মিত কৃমির ওষুধ খাওয়া।
পরিশেষে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সাফল্যমণ্ডিত হতে হলে আমাদের এ খাতকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সবাইকে সচেতন হতে হবে।

প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা, বারডেম, শাহবাগ, ঢাকা, মোবাইল ০১৭০৩৭৯৬২৬৯, ইমেইল : birdem@yahoo.com

 

বিস্তারিত
পাট বীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন

পাট বীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন
কৃষিবিদ কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী

স্বাধীনতার মহান স্থপতি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম শাহাদাতবার্ষিকীতে জানাই অশেষ বিনম্র শ্রদ্ধা। একই সাথে ১৫ আগস্ট ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞে শহীদ বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুনেছা মুজিবসহ সকল শহীদের প্রতি জানাই গভীর  শ্রদ্ধা।
বাঙালি জাতির অবিস্মরণীয় মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরপরই কৃষি ও কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নে সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন এবং আজকের কৃষির যে অভূতপূর্ব  সাফল্য অর্জিত হয়েছে, বাংলাদেশ যে দানাদার খাদ্যে  স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে তার মূলভিত্তিটাই স্থাপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু  ‘সবুজ বিপ্লব’ আন্দোলনের মাধ্যমে।
‘পাট বীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন বিষয়ক আলোচনার শুরুতে বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব অর্থকরী ফসল পাটবিষয়ক বঙ্গবন্ধুর কয়েকটি উক্তি স্মরণ করতে চাই। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের মাটি আছে, আমার সোনার বাংলা আছে, আমার পাট আছে, আমার গ্যাস আছে, আমার চা আছে, আমার ফরেস্ট আছে, আমার মাছ আছে, আমার লাইভস্টক আছে। যদি ডেভেলপ করতে পারি, ‘ইনশাআল্লাহ, এদিন থাকবে না।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘এ যাবত বাংলার সোনালী আঁশ পাটের প্রতি ক্ষমাহীন অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়েছে। বৈষম্যমূলক বিনিয়োগ হার এবং পরগাছা ফড়িয়া-বেপারীরা পাটচাষিদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করেছে। পাটের মান, উৎপাদন হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। পাট ব্যবস্থা জাতীয়করণ, পাটের গবেষণার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ এবং পাট উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করা হলে জাতীয় অর্থনীতিতে পাট সম্পদ সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারে।’ স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শূন্য হাতে হাল ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অসামান্য দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বে বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন, সেটিকে আমরা বঙ্গবন্ধুর কৃষি দর্শন বা কৃষি ভাবনা হিসেবেই জানি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার প্রকৃত অর্থেই কৃষি ও কৃষকবান্ধব সরকার। তাঁর নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় বঙ্গবন্ধুর দেখানো সবুজ বিপ্লবের পথ ধরেই কৃষির অসাধারণ সাফল্য অর্জিত হয়েছে, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবেও প্রসংশিত হচ্ছে।
কৃষি উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় কৃষি মন্ত্রণালয় বহুমুখী কর্মসূচি কৃষি ও কৃষকের কল্যাণে বাস্তবায়ন করছে। পাট বীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন তেমনই একটি কর্মসূচি যা আগামী তিন বছরে বাস্তবায়নের রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে।
পাট বাংলাদেশের একটি পরিবেশবান্ধব প্রধান অর্থকরী ফসল। কারণ পাট মাটিতে জৈবপদার্থ যুক্ত করে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাট ও পাটজাত দ্রব্য পরিবেশবান্ধব অর্থাৎ পরিবেশ দূষণ রোধ করে। পাটভিত্তিক শস্যবিন্যাস উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে এবং ঈড়২ শোষণ করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করে।
এছাড়াও পাট বৃহৎ শিল্পের ও হস্তশিল্পের কাঁচামাল, পাট রপ্তানি আয়ের অন্যতম উৎস। প্রায় ৪০ লাখ কৃষক পাটচাষে সম্পৃক্ত এবং পাট কর্মসংস্থানে সাহায্য করে। পাটখড়ি এবং পাটের পাতার বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে পাট চাষের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তোষাপাটের উন্নত জাত কৃষকের নিকট গ্রহণযোগ্য জাত ও তোষা পাটের প্রয়োজনীয় বীজের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা।
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইঔজও) কর্তৃক উদ্ভাবিত- দেশী পাট (ঈযড়ৎপযড়ৎঁং পধঢ়ংঁষধৎরবং) এর ৯টি, তোষা পাট (ঈড়ৎপযড়ৎঁং ড়ষরঃড়ৎরঁং) এর ৮টি, কেনাফ (ঐরনরংপঁং পধহহধনরহঁং) এর ৪টি, মেস্তা (ঐরনরংপঁং ঝধনফধৎরভভধ) এর ৩টি জাত রয়েছে। এছাড়া বিজেআরআই উদ্ভাবিত ৩টি দেশী পাটশাক জাত এবং বিনা উদ্ভাবিত ১টি বিনা পাটশাকের জাত আছে।
বাংলাদেশে মূলত তোষা পাটের ক্ষেত্রে প্রায় ৯০% জমিতে ইন্ডিয়া থেকে প্রতি বছর আমদানিকৃত জেআরও-৫২৪ জাতের চাষ হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে কমবেশী প্রায় ৩০০০ মে. টন জেআরও-৫২৪ জাতের তোষা পাটবীজ ভারত থেকে আমদানি করা হয়। এ ছাড়াও বিগত ৩-৪ বছর ধরে প্রায় ১০০০ টন মেস্তার বীজ আমদানি করা হয়।
২০১৮ সালে বিজেআরআই তোষা পাট-৮ (রবি-১) নামে একটি উচ্চফলনশীল উন্নত জাতের তোষাপাট উদ্ভাবিত হওয়ায় এবং ইতোমধ্যে কৃষক কর্তৃক জাতটি গ্রহণযোগ্য হওয়ায় কৃষি মন্ত্রণালয় আগামী ৩-৪ বছরের মধ্যে তোষাপাট বীজের আমদানি নির্ভরতা কাটিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য একটি রোডম্যাপ প্রস্তুত করেছে এবং মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর নির্দেশনায় রোডম্যাপ বাস্তবায়নের কৌশল ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন তোষাপাট বীজ উৎপাদন, বীজ বর্ধিতকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং কৃষক পর্যায়ে দ্রুত সম্প্রসারণের দায়িত্ব পালন করবে। রোডম্যাপ অনুযায়ী ব্রিডার পাটবীজ উৎপাদন করবে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ব্রিডার বীজ হতে ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করবে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন এবং কৃষক পর্যায়ে জাত সম্প্রসারণ, কৃষক পর্যায়ে বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ, কৃষক প্রশিক্ষণ প্রদান করবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
পাট বীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য বিজেআরআই কর্তৃক আগামী ৩ বছরে ৪০০ কেজি ব্রিডার বীজ এবং বিএডিসি কর্তৃক ৪৫ মে. টন ভিত্তিবীজ, ৪০৫০ মে. টন প্রত্যায়িত/টিএলএস বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। মূলত বছরে ৪৫০০ হতে ৫০০০ মে. টন পাট বীজের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৬ থেকে ৭ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে শতকরা ৮৮ ভাগ তোষাপাট এবং শতকরা ১২ ভাগ জমি দেশী পাটের চাষ করা হয়।
এখানে আরও উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশের ১ বিঘা জমিতে ১ কেজি বীজ ছিটিয়ে বপন করা হয় এবং পরবর্তীতে দুই মাস বয়স হলে পাটক্ষেত বাছাই করে পাতলা করে দেয়া হয়। কিন্তু বীজ বপন যন্ত্রের ব্যবহার করে ৮০% অঙ্কুরোদগম ক্ষমতাসম্পন্ন ভালো বীজ সারিতে বপন করলে বিঘাপ্রতি কাক্সিক্ষত পাটগাছের সংখ্যা (৩ লাখ) ঠিক থাকে এবং ৭৭৫ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে বছরে প্রায় ১০০০ মে. টন তোষা পাট বীজ কম লাগবে। এছাড়া পাটবীজ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য আরও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে যেগুলো বাস্তবায়ন করে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের নির্দেশনা প্রদান করেছেন মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপি। চ্যালেঞ্জগুলো নিম্নরূপÑ
(১)  দক্ষতা এবং দ্রুততার সাথে কৃষকপর্যায়ে উন্নতজাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করা।
(২)  পাটের ছাল ছাড়ানোসহ পাট উৎপাদনে যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি করা, পাট জাগ দেয়া, আঁশ ছাড়ানো, পাটের উপজাত, পাটকাঠি, পাট পাতার ব্যবহারে (উদ্ভাবনী) প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করা।
(৩)  চাহিদাভিত্তিক পাটের উন্নতজাত উদ্ভাবনে গবেষণা জোরদারকরণ।
(৪)   পাটবীজ উৎপাদন এলাকা এবং পাটের আঁশ উৎপাদন এলাকা চিহ্নিত করে পাট ফসলভিত্তিক লাভজনক ক্রপিং প্যাটার্ন উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন করা।
আশা করা যায় পাটবীজের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের রোডম্যাপ বাস্তবায়িত হলে পাটের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। গ্রামীণ অর্থনীতি আরো শক্তিশালী হবে।
‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার
কৃষি হবে দুর্বার।’
পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন : ৫৫০২৮২৬০, ই-মেইল : diris@is.gov.bd

 

বিস্তারিত
লবণাক্ততা ও জোয়ারভাটা সহিষ্ণু বিনাধান-২৩ এর চাষাবাদ প্রযুক্তি

লবণাক্ততা ও জোয়ারভাটা সহিষ্ণু বিনাধান-২৩ এর চাষাবাদ প্রযুক্তি

ড. এম. মনজুরুল আলম মণ্ডল

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল জোয়ারভাটাপ্রবণ হওয়ায় প্রতি বছর নিচু এলাকার বিরাট অংশের আমন ধান নষ্ট হয়ে কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি করে। জোয়ারভাটাপ্রবণ এলাকায় আমন ধান চাষ উপযোগী জাত উদ্ভাবনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের বিজ্ঞানীগণ গবেষণার মাধ্যমে জোয়ারভাটা ও আকস্মিক বন্যাসহিষ্ণু আমন ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন, যা জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক বিনাধান-২৩ নামে সমস্ত বাংলাদেশে আকস্মিক বন্যাপ্রবণ এলাকা এবং জোয়ার ভাটাপ্রবণ এলাকায় চাষের জন্য অনুমোদন পায়। বিনাধান-২৩ জাতটি ৮ ডিএস/মি মাত্রার লবণাক্তা ও ১৫ দিন পর্যন্ত জলমগ্নতা সহ্য করতে পারে। এছাড়া জাতটি স্বল্পমেয়াদি বিধায় এ জাতটি কর্তন করে পরবর্তী রবি ফসল সঠিক সময়ে চাষ করা যায়।  এটি উচ্চফলনশীল ও উন্নত গুণাগুণসম্পন্ন রোপা আমন জাত। গাছ শক্ত বলে হেলে পড়ে না। পূর্ণবয়স্ক গাছের উচ্চতা ১১০-১১৬ সেমি.। পাতা গাঢ় সবুজ ও খাড়া। চাল সাদা রঙের, লম্বা ও মাঝারি চিকন। রান্নার পরে ভাত ঝড়ঝড়ে হয় ও খেতে সুস্বাদু। স্বাভাবিক অবস্থায় এর জীবনকাল ১১৫-১২৫ দিন এবং জলমগ্ন অবস্থায় ১৫ দিন ডুবে থাকলে জীবনকাল ১৩০-১৩৫ দিন। যথোপযুক্ত পরিচর্যায় জলমগ্ন অবস্থায় প্রতি হেক্টরে ৪.৫ টন (একরে ৫০ মণ) এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ৫.৮ টন (একরে ৬৫ মণ) ফলন দেয়।
বিশেষ গুণ : বিনাধান-২৩ উচ্চফলনশীল এবং এর জীবনকাল তুলনামূলকভাবে অনেক কম বলে শস্য নিবিড়তা বাড়ানোর জন্য খুবই কার্যকর। আগাম পাকা জাত হিসেবে এ জাতটি চাষ করে সঠিক সময়ে তেল ও ডাল ফসল চাষ করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া গম ও আলুর  চাষ ও ভালভাবে করা যায়। ফলে এসব ফসলের উৎপাদনও বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।
আঞ্চলিক উপযোগিতা : লবণাক্ত, জোয়ারভাটা ও বন্যাকবলিত এলাকাসহ মাঝারি-উঁচু থেকে নিচু জমি এ ধানের চাষের জন্য উপযুক্ত। এ ছাড়া রোপা আমন অঞ্চল বিশেষ করে আকস্মিক বন্যাপ্রবণ এলাকা যেখানে বন্যার পানি এসে ১৫ দিনের মধ্যেই নেমে যায়। বেলে দো-আঁশ এবং এটেল দো-আঁশ জমি বিনাধান-২৩ চাষের জন্য উপযোগী।
চাষাবাদ পদ্ধতি : জাতটির চাষাবাদ পদ্ধতি অন্যান্য উফশী রোপা আমন জাতের মতোই। তবে এর জীবনকাল কম বিধায় ভাল ফলন পেতে হলে চারার বয়স ও পরিচর্যার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। নিম্নে জাতটির চাষাবাদ প্রযুক্তি দেয়া হলো।
বীজ বপনের সময় ও বীজের হার : জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ (শ্রাবণ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ) হতে আগস্টের শেষ সপ্তাহ (ভাদ্র মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ) এর মধ্যে বীজতলায় বীজ বপন করতে হবে। প্রতি হেক্টর জমি চাষের জন্য ২৫-৩০  কেজি বা এক একর জমির জন্য ১০-১২ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। উপযুক্ত ফলন নিশ্চিত করতে হলে ভারী, পুষ্ট ও রোগবালাই মুক্ত বীজ বাছাই করতে হবে। বপনের আগে বীজ শোধন করা ভাল। প্রতি কেজি বীজের জন্য ২ গ্রাম ব্যাভিস্টিন বা অন্য কোন উপযোগী বীজ শোধক ছত্রাকনাশক পরিমাণমতো প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১২ ঘণ্টা রেখে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে বীজ শোধন করা যায়।
চারার বয়স ও রোপণ পদ্ধতি : ২০-২৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। বেশি বয়সের চারা লাগালে ফলন কমে যায়, তাই ৪ সপ্তাহের বেশি বয়সের চারা রোপণ করা কোন অবস্থাতেই উচিত নয়। বীজতলায় চারা করার পর লাইন করে চারা রোপণ করলে ফলন বেশি হয়। ২-৩টি সুস্থসবল চারা একত্রে এক গুছিতে রোপণ করতে হবে। সারি হতে সারির দূরত্ব ২০ সেমি. এবং সারিতে গুছির দূরত্ব ১৫ সেমি. থাকা ভাল।
সার ব্যবস্থাপনা
সারের পরিমাণ সারণি : ১ দ্রষ্টব্য। রোপণের জন্য জমি তৈরির শেষ চাষের আগে সম্পূর্ণ টিএসপি, এমওপি, জিপসাম এবং দস্তা সার জমিতে সমভাবে ছিটিয়ে চাষের মাধ্যমে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সারের অর্ধেক পরিমাণ চারা রোপণের ৭-৮ দিন পর এবং বাকি অর্ধেক ৩০-৩৫ দিন পর উপরিপ্রয়োগ করতে হবে অথবা এক-তৃতীয়াংশ চারা রোপণের ৭-৮ দিন পর, এক-তৃতীয়াংশ চারা রোপণের ১৮-২০ দিন পর এবং শেষ তৃতীয়াংশ চারা রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর জমির উর্বরতার ওপর নির্ভর করে প্রয়োগ করতে হবে। অনুর্বর জমিতে হেক্টরপ্রতি দস্তাসার ৪ কেজি (একরপ্রতি ১.৬ কেজি) হারে দেয়া যেতে পারে। ইউরিয়া সার প্রয়োগের ২/১ দিন আগে জমির অতিরিক্ত পানি বের করে দিতে হবে এবং প্রয়োজন হলে আগাছা দমন করতে হবে। জমির উর্বরতা ও ফসলের অবস্থায় ওপর নির্ভর করে সারপ্রয়োগ মাত্রার তারতম্য করা যেতে পারে।
বন্যাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য সার : আকস্মিক বন্যায় জমি ডুবে গেলে সারের মাত্রা ও প্রয়োগপদ্ধতি ভিন্নতর হবে। সে ক্ষেত্রে জমি তৈরির সময় সার প্রয়োগের পরিমাণ সারণি-২ দ্রষ্টব্য।
যদি ধান গাছের প্রাথমিক বৃদ্ধিপর্যায়ে বন্যা হয়, তাহলে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার ১০ দিন পরে প্রথম কিস্তিতে হেক্টরপ্রতি ৪৫ কেজি (একরে ১৮ কেজি) ইউরিয়া সার এবং হেক্টরপ্রতি ২৩ কেজি (একরে ৯ কেজি) এমওপি (পটাশ) সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম কিস্তির ২০-২৫ দিন পর হেক্টরপ্রতি ৪৫ কেজি (একরে ১৮ কেজি) ইউরিয়া দ্বিতীয়বার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। তবে জমির উর্বরতার অনুযায়ী ইউরিয়া সারের মাত্রা কমবেশি হতে পারে।
পরিচর্যা : এই জাতের ধানের পরিচর্যা অন্যান্য উফশী জাতের মতোই। তবে এর জীবনকাল কম বিধায় চারা রোপণের পর আগাছা দেখা দিলে দ্রুত আগাছা পরিষ্কার ও মাটি নরম করতে হবে। বর্ষা মৌসুমের শেষে ফসল পাকার কিছু দিন আগে পানির অভাব দেখা দিলে সেচের প্রয়োজন হতে পারে তবে ধান পাকার ১০-১২ দিন আগে জমির পানি শুকিয়ে ফেলা ভাল।
রোগ ও পোকামাকড় দমন : পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা দিলে প্রচলিত তরল বা দানাদার কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ছাড়া খোল ঝলসানো, ব্যাক্টেরিয়াল লিফব্লাইট বা পাতা ঝলসানো ও অন্যান্য রোগ দেখা দিলে উপযুক্ত ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে। খোল ঝলসানো, কাণ্ড পচা রোগ দেখা দিলে ফলিকুর, স্কোর বা বেনলেট মাত্রা অনুযায়ী প্রয়োগ করা যেতে পারে। মাজরা পোকার আক্রমণ হলে দানাদার কীটনাশক (মার্শাল ৬জি/কুরাটার ৫জি) মাত্রা অনুযায়ী প্রয়োগ করা যেতে পারে। এছাড়া ব্লাস্ট রোগ দমনের জন্য ট্রুপার মাত্রা অনুযায়ী প্রয়োগ করা যেতে পারে এবং প্রয়োজনে নিকটস্থ কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তার উপদেশ মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিনাধান-২৩ চাষে সতর্কতা : বিনাধান-২৩ চাষে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। যেমন : (১) ১৫ দিন  জলমগ্ন থাকার পর বন্যার পানি জমি থেকে সরে যাওয়ার পরে গাছের শিকড় পচে কালো রং ধারণ করবে। এ অবস্থায় কমপক্ষে ৭ দিন জমিতে নামা যাবে না। ৭ দিন পর যখন নতুন চারা/কুশি গজাবে তখন জমিতে সার প্রয়োগসহ অন্যান্য পরিচর্যা করা যাবে। (২) জমি থেকে বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর গাছের পাতায় পলি কিংবা বালু জমতে পারে। ফলে পাতার স্টোমাটা বন্ধ হয়ে পাতা জ্বলে সাদা হয়ে যেতে পারে। তাই বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর পরিষ্কার পানি স্প্রে মেশিনের সাহায্যে গাছের পাতা ধুয়ে পরিষ্কার করে দিতে হবে। (৩) বন্যার পানি সরে যাওয়ার ১০-২০ দিন পর জলজ আগাছাসহ অন্যান্য আগাছা এবং ধানের পচা পাতা পরিষ্কার করে দিতে হবে। (৪) যে সব এলাকায় বন্যার পানি এসে ১০-১৫ দিনের মধ্যে পানি নেমে যায় এবং ক্ষেতে কোন পানি জমে থাকে না এমন জমিতে বিনাধান-২৩ চাষ করা যাবে। (৫) বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর জমিতে ১০-২৪ সেমি. (৪-১২ ইঞ্চি) পানি থাকা স্বাভাবিক। তবে দীর্ঘদিন ৩৫-৪০ সেমি. (১৪-১৬ ইঞ্চি) এর বেশি পানি থাকে, এমন জমিতে এ জাতটি চাষ করা যাবে না।
ফসল কর্তন, মাড়াই ও বীজ সংরক্ষণ : ভাল ফলন পাওয়ার জন্য সঠিকভাবে ধান কর্তন ও বীজ সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোগমুক্ত, পরিপুষ্ট ও বিশুদ্ধ বীজ ভাল ফলনের পূর্বশর্ত। এ জন্য ক্ষেতে যে স্থানে ভাল ফলন হয়েছে সে স্থান থেকে আগেই ভিন্ন জাতের গাছ তুলে ফেলতে হবে। অতঃপর ধান কর্তন করে এমন ভাবে মাড়াই ও ঝাড়াই করতে হবে যাতে অন্য জাতের ধান মিশ্রণ ঘটতে না পারে। ধান মাড়াই করার সময় তিন বারি দিয়ে যে পুষ্ট বীজ পাওয়া যায় তাই বীজ হিসাবে রাখতে হবে। বীজ ভালভাবে শুকিয়ে নিয়ে (১২-১৪% আর্দ্রতা) টিন, প্লাস্টিক অথবা মাটির তৈরি মটকার উভয় পাশে এনামেল পেইন্ট দিয়ে ৬-৮ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। উল্লেখ্য, বীজ সংরক্ষণের পাত্রটি বায়ু নিরোধক অবস্থায় রাখা প্রয়োজন এবং পাত্রটিতে বীজ রাখার পর ফাঁকা স্থান অন্য কিছু দিয়ে ভরে রাখা প্রয়োজন। ফলে কীটপতঙ্গের বংশবৃদ্ধি ও পোকার ক্ষতি থেকে বীজ রক্ষা পাবে। তাছাড়া নিমপাতা শুকিয়ে অথবা নিমের তেল বীজের সাথে মিশিয়ে রাখলে পোকার আক্রমণ হয় না ফলে বীজ ভাল থাকে।

চিফ সায়িন্টিফিক অফিসার, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ, মোবাইলঃ ০১৭১৬৭৪৯৪২৯। ই-মেইল : mmamondal@gmail.com

 

বিস্তারিত