Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

শ্রাবণ মাস। আমাদের ঋতুবৈচিত্র্যের সঙ্গে বারো মাস এবং প্রকৃতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মেঘ, বৃষ্টি, রৌদ্রছায়ায় পুরো আকাশে বহুমাত্রিক রূপ উদ্ভাসিত হয়। শ্রাবণ শেষেই হবে বর্ষার বিদায়। নদীমাতৃক সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা এ দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক কর্মকা-ের মূল চালিকাশক্তি কৃষি। এ সময় নিচু জমিতে পাট কাটা আর জাগ দেয়ার কাজ চলে। সে সাথে উফশী রোপা আমনের বীজতলা তৈরি, পাটের পোকামাকড় দমন এবং আগাম শীতকালীন সবজি শিম লাউয়ের বীজ রোপণের কাজে ব্যস্ত হয়ে ওঠে গ্রাম বাংলার কৃষক-কৃষাণীরা।   
কৃষি প্রধান বাংলাদেশে কৃষিতে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল জলবায়ু, খরা, লবণাক্ততা, পোকামাকড় এবং রোগবালাই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য বায়োইনফরমেটিক্স  একটি আধুনিক প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ফসলের জাত উন্নয়ন, রোগ প্রতিরোধ, জেনেটিক বৈচিত্র্য রক্ষা এবং পরিবেশগত স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সম্পর্কে কৃষিকথায় এবারের সংখ্যায় ‘কৃষিতে বায়োইনফরমেটিক্স-বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট’ নিবন্ধটিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 
এছাড়াও কৃষি বিশেষজ্ঞগণের সময়োপযোগী প্রবন্ধ, ফসল উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি, আগামীর কৃষি ভাবনা, কৃষিতে সফলতা ও নিয়মিত বিভাগ দিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের সংখ্যা। যারা এসব লেখা দিয়ে কৃষিকথা সমৃদ্ধ করেছেন তাদের সবার প্রতি রইল আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। আশা করি, কৃষিকথা জনসাধারণের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনুপ্রানিত করবে। 

বিস্তারিত
তুলা-ফসলের-আধুনিক-বালাই-ব্যবস্থাপনা

তুলা ফসলের আধুনিক বালাই ব্যবস্থাপনা
অসীম চন্দ্র শিকদার
বর্তমান সময়ে তুলা একটি লাভজনক এবং গুরুত্বপূর্ণ মাঠ ফসল। তুলা এবং তুলা উৎপাদনের উপর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাই তুলা উৎপাদনের জন্য আমাদের কৃষক ভাইদের অধীক যত্নবান ও আধুনিক কলাকৌশল গ্রহণ করতে হবে। তুলা চাষের বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে বালাই ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরিবেশকে দূষণমুক্ত রেখে আধুনিক সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম) পদ্ধতি গ্রহণ এখন সময়ের দাবী। তুলা চাষে আধুনিক বালাই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার (আইপিএম) ৫টি ধাপ নিয়ে নি¤েœ আলোচনা করা হলো।
তুলার উপকারী পোকামাকড় ও প্রাণী সংরক্ষণ : লেডি বার্ড বিটল, ক্যারাবিড বিটল, মাকড়সা, ড্যামসেল ফ্লাই এবং কালো পেঁচার মতো কিছু পাখি তুলার ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে তুলা ফসল রক্ষা করে। তাই এদের তুলার উপকারী পোকামাকড় ও প্রাণী বলা হয়। এরা তুলার ক্ষতিকর পোকামাকড়-এর মথ, লার্ভা, ডিম খেয়ে তুলা ফসল রক্ষা করে। তাই এই সকল উপকারী পোকামাকড় ও প্রাণী সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। লেডি বার্ড বিটল-এর কীড়া একদিনে ২৫০ থেকে ৩০০টি তুলার জাবপোকা বা এফিড খেয়ে থাকে। উপকারী বোলতা ক্ষতিকর কীড়া বা লার্ভার উপর ডিম পারে। পরে ডিম ফোটে কীড়া বেড় হয়ে ক্ষতিকর লার্ভা/কীড়া খেয়ে থাকে। তাই কীটনাশক স্প্রে করার আগে ফসলে ক্ষতিকর পোকা ও উপকারী পোকার সংখ্যা নির্নয় করে নিতে হবে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় স্কাউটিং। যখন ক্ষতিকর পোকার সংখ্যা অর্থনৈতিক দারপ্রান্ত অতিক্রম করবে তখনই কীটনাশক/বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে। তুলা উন্নয়ন বোর্ডের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ তুলাচাষিদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।
বালাই সহনশীল জাতের চাষাবাদ : তুলার কোন জাত জ্যাসিড প্রতিরোধী, কিছু জাত বোলওয়ার্ম প্রতিরোধী। এছাড়া বিটি কটন প্রায় সকল প্রকার পোকামাকড় প্রতিরোধী। আবার কিছু কিছু জাত রোগ প্রতিরোধী। হাইব্রিড জাতের তুলাতে সাধারণত রোগ ও পোকার আক্রমণ কম দেখা যায়। তাই জমির প্রকৃতি ও অবস্থান বিবেচনা করে জাত নির্বাচন করতে হবে। এ ব্যাপারে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণের নিকট হতে সাহায্য পাওয়া যাবে। 
আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির ব্যবহার :  আধুনিক চাষাবাদ বলতে পরিচ্ছন্ন ও নিয়মতান্ত্রিক চাষাবাদ বুঝায়। যেমন- গভীর, ঝুর ঝুরা করে জমি চাষ করা, জমি ভালোভাবে আগাছা মুক্ত করা, প্রয়োজন হলে মাটি শোধন করা ইত্যাদি। এ ছাড়া সুস্থ সবল এবং ছত্রাকনাশক দ্বারা শোধন করা বীজ ব্যবহার,  সঠিক দূরত্বে বীজ বপন, পর্যাপ্ত জৈবসারসহ সুষম সার ব্যবহার, সময়মতো আগাছা দমন, সময়মতো চারা পাতলা এবং গ্যাপ পূরণ, সময়মতো রাসায়নিক সার পার্শ প্রয়োগ, প্রয়োজনে সেচ প্রয়োগ, পাতা কর্তন ও অঙ্গছাঁটাই ইত্যাদিও আধুনিক চাষাবাদ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। জমির অবস্থান ও প্রকৃতি অনুসারে আধুনিক ও হাইব্রিড জাতের তুলা বীজ নির্বাচন করতে হবে। বন্যাপ্রবণ অথবা চর অঞ্চলে আধুনিক জাতের তুলা চাষ করা বাঞ্ছনীয়। আর বন্যামুক্ত উর্বর  জমিতে হাইব্রিড জাতের তুলা চাষ করাই উত্তম।  
তুলা জমিতে প্রয়োজনের বেশি ইউরিয়া সার ব্যবহার করলে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। আবার ফসফেট বা পাটাশ সার প্রয়োজনের চেয়ে কম ব্যবহার করলেও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যেতে পারে এবং ফলনও কম হবে। তাই তুলা ফসলে সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করা জরুরি। জৈবসার মাটি ও তুলা ফসলের জন্য ভালো। এতে তুলার আঁশের মান উন্নত হয়। তাই যতটা সম্ভব তুলা জমিতে জৈবসার প্রয়োগ করতো হবে। তুলা ফসলের জন্য পটাশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সার; তাই চাহিদা মোতাবেক পটাশ সার প্রয়োগ এবং পটাশ সারের ফলিয়ার স্প্রে নিশ্চিত করতে হবে। সময়মতো জমিতে সেচ ও নিকাশের ব্যবস্থা নিতে হবে। ঘন ঘন জমি পরিদর্শন করতে হবে। এতে তুলা জমির তাৎক্ষণিক অবস্থা সহজে নজরে আসে এবং সে মতো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়। এতে ফসলের সাথে কৃষকের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে।
যান্ত্রিক দমন পদ্ধতি : তুলা ফসলে জ্যাসিড ও সাদা মাছির  আক্রমণ হলে আঠালো সাদা ও হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করে দমন করা যায়। আঠালো পদার্থ হিসেবে সাধারণত মবিল ব্যবহার করা হয়। সাদা মাছির ক্ষেত্রে আঠালো হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। বিঘা প্রতি ৪টি হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে। পাখি বসার জন্য তুলা জমিতে ডাল, বাঁশের কনচি পুঁতার ব্যবস্থা করতে হবে, অথবা হাতে প্রস্তুত ডেড পার্চিং ব্যবহার করতে হবে। এ সব ডালে বা পার্চিং-এ পাখি বসে সহজেই তুলার ক্ষতিকর মথ ও কীড়া খেয়ে ফসলের ক্ষতি অনেকটা কমিয়ে আনে। আলোর ফাঁদ ব্যবহার করে ক্ষতি কর পোকামাকড় দমনের ব্যবস্থা করতে হবে। আঁচা পোকার মথ প্রথমে পাতার নিচে ডিম পারে, ডিম ফোটে কীড়া পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ঝাঝরা করে ফেলে, পরে কুড়ি, ফুল ও ফলে আক্রমণ করে। হাত বাছাই করে আক্রান্ত পাতা  সংগ্রহ করে দমন করতে হবে। রৌদ্রের সময় তুলা গাছের কচি ডগা ঢলে পড়লে বুঝতে হবে বোলওয়ার্মের আক্রমণ হয়েছে। লক্ষণ দেখা মাত্র ডগা চিরে হাত দ্বারা কীড়া সংগ্রহ করে দমন করতে হবে। হাতজাল ব্যবহার করেও ক্ষতিকর পোকার মথ ধরে দমন করা যায়। ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে আঁচাপোকা ও বোলওয়ার্ম দমন করা যায়। সময়মতো পাতা ছাঁটাই ও অঙ্গ ছাঁটাই করলেও অনেক রোগ থেকে ফসলকে রক্ষা করা যায়। কারণ এতে পর্যাপ্ত আলো বাতাস ফসলের জমিতে প্রবেশ করতে পারে। 
রাসায়নিক দমন ব্যবস্থা : পোকার আক্রম অর্থনৈতিক ক্ষতির সীমা অতিক্রম করলেই কেবল রাসায়নিক দমনব্যবস্থা প্রয়োগ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ জ্যাসিডের অর্থনৈতিক ক্ষতির সীমা হলো গড়ে প্রতি পাতায় ২টি নিম্ফ এবং বোলওয়ার্মের ক্ষেত্রে  প্রতি চারটি গাছে গড়ে ১টি লার্ভা; এর বেশি হলেই কীটনাশক ব্যবহার করে দমনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর বালাই দমনের সর্বশেষ ব্যবস্থা হলো কীটনাশক/বালাইনাশক ব্যবহার করে বালাই দমন। তুলা ফসলের রোগের মধ্যে চারা গাছের রোগ, ঢলে পড়া রোগ, পাতায় দাগ পরা রোগ, বোল রট, স্টেম রট, এ্যানথ্রাকনোজ, ব্যাকটেরিয়াল ব্লাইট ইত্যাদি দেখা যায়। তুলা ফসল রোগে আক্রান্ত হওয়া মাত্র আক্রান্ত গাছ বা অংশ জমি থেকে তুলে ধ্বংস করতে হবে এবং ছত্রাক/ব্যাকটেরিয়ানাশক নির্ধারিত মাত্রায় ফসলে স্প্রে করতে হবে যাতে বাকি ফসল আক্রান্ত হতে না পারে। 
তুলা গাছের এক থেকে দেড় মাস বয়সে জ্যাসিড ও এফিডের আক্রমণ ঘটে থাকে। 
প্রাথমিক অবস্থায়  সাবান পানি স্প্রে করে দমন করা যায়। আক্রমণ সীমা অতিক্রম করলে যে কোন সিস্টেমিক জাতীয় কীটনাশক নির্ধারিত মাত্রায় পানিতে মিশিয়ে পাতার নিচে ও গাছের ডগায় স্প্রে করে ঐ সকল পোকা দমন করতে হবে। মনে রাখবেন জ্যাসিড ও এফিড-এর আক্রমণ কোনভাবেই অবহেলা করা যাবে না। আঁচা পোকা ও বোলওয়ার্মের ক্ষেত্রে কন্টাক্ট কীটনাশক নির্ধারিত মাত্রায় বিকেলের দিকে জমিতে স্প্রে করে করে দমন করতে হবে। কীটনাশক সব সময় মৃদু রৌদ্রে এবং বিকেলের দিকে প্রয়োগ করতে হবে।   
রাসায়নিক ব্যবহারে সতর্কতা : বালাইনাশক ব্যবহারের পূর্বে বোতল বা প্যাকেটের গায়ের নির্দেশিকা পড়তে হবে এবং তা মেনে চলতে হবে। নিরাপত্তামূলক পোশাক পরিধান এবং নাকে মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। চোখে চশমা ব্যবহার করতে হবে। খালি পেটে স্প্রে কাজ করা যাবে না এবং কীটনাশক প্রয়োগের সময় পানাহার করা যাবে না। বালাইনাশক ব্যবহারের পর সাইন বোর্ড/লাল কাপড়/বালাইনাশকের প্যাকেট/বোতল টাঙিয়ে দিতে হবে। বালাইনাশক ছিটানো জমির পানি যাতে মুক্ত জলাশয়ে না যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। স্প্রে-মেশিন ব্যবহারের পর মুক্ত জলাশয়ে ধৌত করা যাবে না। স্প্রে-কাজ করার পরই সাবান দিয়ে ভালোভাবে গোসল করবেন। মনে রাখবেন বালাইনাশক একধরনের বিষ। বালাইনাশক ফসলকে রক্ষা করলেও মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। বালাইনাশক ব্যবহারে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের সঙ্গে উপকারী পোকামাকড়ও মারা যায়। তাই বালাইনাশক ব্যবহারের পূর্বে স্কাউটিং করে নেয়া জরুরি।
সঠিকভাবে আধুনিক বালাই ব্যবস্থাপনার  সকল ধাপ কৃষক ভাইরা যদি পালন করেন তবে তুলা ফসলের বালাই নিয়ন্ত্রণে সর্বোত্তম ফলাফল পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশের ক্ষতি যেমন রক্ষা পাবে, তেমনি কৃষি শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও কমবে আর উৎপাদন খরচও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। 
চাষির মঙ্গল তুলা চাষে
দেশের মঙ্গল বস্ত্রশিল্পে

লেখক : কটন ইউনিট অফিসার (অব:), তুলা উন্নয়ন বোর্ড, মোবাইল নং ০১৫৫২-৩৬২৯০১, ১০৪/১ (বি-২), শেরেবাংলা রোড (কাটাসুর), জাফরাবাদ, মোহাম্মদপুর-১২০৭। 

বিস্তারিত
সম্পাদকীয়
বিস্তারিত
সূচিপত্র
সূচিপত্র
নিবন্ধ/প্রবন্ধ
 
 কৃষিতে বায়োইনফরমেটিক্স : বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট ৬
ড. মোঃ আবদুল আউয়াল
 বীজের দাগ রোগ ও পরিবেশবান্ধব প্রতিকার ৮
ড. এ এইচ এম আসাদুর রহমান, ড. মোহাম্মদ মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম
 কাজুবাদামের উন্নত চাষাবাদ কৌশল ১১
কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী
 পাট আঁশের মান উন্নয়নে পলিথিন ব্যবহার প্রযুক্তি ১৪
ড. মোঃ আবুল ফজল মোল্লা
 ফলের পুষ্টি দেহের তুষ্টি ১৫
মৃত্যুঞ্জয় রায়
 চীনাবাদামের গুরুত্ব ও খরিফ-২ মৌসুমে চাষাবাদ পদ্ধতি ১৭
ড. এম. মনজুরুল আলম ম-ল
 ফল রপ্তানিতে আধুনিক প্যাকিং হাউজ ও ল্যাবের স্মার্ট কার্যক্রম ২০
ড. শামীম আহমেদ, এ. কে. আজাদ ফাহিম
 সঠিক সময়ে গাছ রোপণ ও সংরক্ষণ ২৩
কৃষিবিদ মো. বশিরুল ইসলাম
আগামীর কৃষি ভাবনা
 পাহাড়িদের খাদ্যে বাঁশকোড়লের ব্যবহার টেকসই করতে করণীয় ২৫
  মো: কাওছারুল ইসলাম সিকদার
 
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ
 বাণিজ্যিক ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির ধকল (ঝঃৎবংং) ব্যবস্থাপনা ২৭
মোঃ শাহরিয়ার হায়দার, ড. মোঃ আব্দুল মালেক 
 
কৃষির সফলতা
 ব্রি হাইব্রিড ধান৮ ফলনে করেছে বাজিমাত ২৯
কৃষিবিদ ড. এম আব্দুল মোমিন
নিয়মিত বিভাগ
 প্রশ্নোত্তর ৩০
কৃষিবিদ ড. আকলিমা খাতুন
 ভাদ্র মাসের কৃষি (১৬ আগস্ট-১৫ সেপ্টেম্বর) ৩২
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
বিস্তারিত
কৃষিতে-বায়োইনফরমেটিক্স-বাংলাদেশ-প্রেক্ষাপট

কৃষিতে বায়োইনফরমেটিক্স
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
ড. মোঃ আবদুল আউয়াল
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ, যেখানে দেশের ৪২% প্রান্তিক জনগণের জীবিকা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তবে কৃষিতে প্রতিনিয়ত নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, যেমন- পরিবর্তনশীল জলবায়ু, খরা, লবণাক্ততা, পোকামাকড় এবং রোগবালাই। এ সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ প্রয়োজন, যেখানে বায়োইনফরমেটিক্স (ইরড়রহভড়ৎসধঃরপং) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বায়োইনফরমেটিক্স হলো একটি আধুনিক প্রযুক্তি যা জীববিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি ও গণিতের সম্মিলনে গঠিত। এটি জীববিজ্ঞান বিষয়ক বিশাল তথ্যসমূহকে সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিশাল ডিএনএ ডেটা বিশ্লেষণ করে জিনোমের নকশা উন্মোচন করা, জিনোমের মধ্যেকার জিনসমূহ শনাক্ত করা, জিনের কার্যকারিতা নিরূপণ করা, প্রোটিনের স্ট্রাকচার প্রেডিকশন করা এবং জিন এক্সপ্রেশন ডেটার বিশ্লেষণও বায়োইনফরমেটিক্সের মাধ্যমে করা হয়। কৃষি ক্ষেত্রে বায়োইনফরমেটিক্সের ব্যবহার ফসলের জাত উন্নয়ন, রোগ প্রতিরোধ, জেনেটিক বৈচিত্র্য রক্ষা এবং পরিবেশগত স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। 
বাংলাদেশে কৃষি ক্ষেত্রে বায়োইনফরমেটিক্সের প্রয়োগ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তবে এরই মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ সম্পন্ন হয়েছে ও কিছু নতুন প্রস্তাবনা গ্রহণ করা হয়েছে। 
পাটের জিনোম সিকুয়েন্স আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের    কৃষিতে বায়োইনফরমেটিক্সের প্রথম প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম ও তার গবেষণা দলের নিরলস প্রচেষ্টায় ২০১০ সালে প্রথম তোষা পাটের জিনোম উন্মোচিত হয়। এরপর একে একে দেশি পাট, মহিষ, ইলিশ, কাঁঠাল, পাটের রোগের জন্য দায়ী ছত্রাকের জিনোম আবিষ্কৃত হয়। এ সকল জিনোম থেকে ডাটা মাইনিং ও বায়োইনফরমেটিক্সের টুলস ব্যবহার করে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যভিত্তিক জিনের শনাক্তকরণ সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশের নার্সভুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কাজ চলমান। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এগিয়ে রয়েছে। এ ছাড়া ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এ ধরণের অনেক গবেষণার সাথে জড়িত। 
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে মিলে ফসল ও প্রাণীর জেনোমিক গবেষণা পরিচালনা করছে। এর মধ্যে ধান, পাট, গম এবং মাছের জেনোমিক গবেষণা উল্লেখযোগ্য। 
বাংলাদেশের জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেম (নার্স) ভুক্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ফসলের জাত উন্নয়নে বায়োইনফরমেটিক্স ব্যবহার করছে যা অধিক ফলনশীল, নতুন রোগ প্রতিরোধী ও খরা, লবণাক্ততাসহনশীল জাত উদ্ভাবনে মূল ভূমিকা পালন করছে। কৃষি ক্ষেত্রে ফসলের রোগ শনাক্তকরণ ও প্রতিরোধে বায়োইনফরমেটিক্সের ব্যবহার বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে ফসলের রোগ শনাক্তকরণের জন্য জেনেটিক মার্কার এবং বায়োইনফরমেটিক্স ভিত্তিক ডাটাবেস ব্যবহৃত হচ্ছে। অতি সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক গমের ব্লাস্ট রোগ নির্ণয়ে পয়েন্ট অফ কেয়ার টেস্টিং উদ্ভাবন করেছে, যা বাণিজ্যিকিকরণের প্রচেষ্টা চলছে। এ উদ্ভাবনের ফলে দ্রুততম সময়ে ও মাঠপর্যায়ে এ রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে। 
বাংলাদেশের কৃষির জন্য জলবায়ু পরিবর্তন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ফসলের জেনেটিক বৈচিত্র্য রক্ষা এবং নতুন জাত উদ্ভাবনে বায়োইনফরমেটিক্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যা বিভিন্ন আবহাওয়াগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে। 
বাংলাদেশে কৃষিতে বায়োইনফরমেটিক্সের প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রথমত, বায়োইনফরমেটিক্সের জন্য উচ্চমানের তথ্যপ্রযুক্তি ও জীববিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, যা বাংলাদেশে এখনও সীমিত। এক্ষেত্রে, বায়োইনফরমেটিক্স গবেষণায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন, যাতে উন্নত প্রযুক্তি ও জ্ঞান বিনিময় করা যায়। এ ছাড়াও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্য পুস্তকে বায়োইনফরমেটিক্সকে সংযুক্ত করা ও উচ্চশিক্ষায় বায়োইনফরমেটিক্স কোর্স চালু করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, বায়োইনফরমেটিক্স গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক ল্যাবরেটরি এবং কম্পিউটিং অবকাঠামোর অভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ। উন্নতমানের হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার এবং ডাটাবেস সিস্টেমের অভাব গবেষণা কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে এই ক্ষেত্রে এখনও পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুবিধা নেই। বাংলাদেশে বায়োইনফরমেটিক্স গবেষণার উন্নয়ন এখন সময়ের দাবি। এজন্য ডেটা সেন্টার এবং ক্লাউড সিস্টেম উন্নয়ন করা যেতে পারে। তৃতীয়ত, গবেষণা এবং উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন না থাকায় বায়োইনফরমেটিক্সের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। সরকারি এবং বেসরকারি খাতে গবেষণা কার্যক্রমে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। চতুর্থত, বাংলাদেশে বায়োইনফরমেটিক্সের উপর পর্যাপ্ত শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের সুযোগ নেই। ফলে, এই শাখায় দক্ষ জনবলের অভাব দেখা দেয়। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বায়োইনফরমেটিক্স কোর্স এবং গবেষণা কার্যক্রম বাড়ানো প্রয়োজন। আবার, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বায়োইনফরমেটিক্স গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে। এটি গবেষকদের গবেষণা কাজে সহায়তা করবে এবং   কৃষিতে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সহায়ক হবে। পঞ্চমত, বাংলাদেশে এ ধরনের গবেষণায় সুস্পষ্ট নীতি ও পরিকল্পনা নেই। সেজন্য, বায়োইনফরমেটিক্স গবেষণার জন্য একটি সুস্পষ্ট নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত, যা কৃষির উন্নয়নে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশের কৃষিতে বায়োইনফরমেটিক্সের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সঠিক ও যুগোপযোগী নীতি গ্রহণ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন অপরিহার্য। এসবের মাধ্যমে     কৃষি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য নিম্নোক্ত অগ্রগতি সম্ভব হবে। যেমন-
খাদ্য নিরাপত্তা : বায়োইনফরমেটিক্স গবেষণার মাধ্যমে খাদ্য ফসলের জিনোম তথ্য ব্যবহার করে উচ্চফলনশীল, খরা, লবণাক্ততা, রোগ এবং পোকামাকড় প্রতিরোধী ফসলের জাত উদ্ভাবন সম্ভব, যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এটি দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে সহায়তা করবে।
ফসলের উন্নয়ন : বায়োইনফরমেটিক্সের মাধ্যমে ফসলের জিনোমিক বিশ্লেষণ করা সম্ভব। এটি উচ্চফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং প্রতিকূল পরিবেশসহনশীল ফসলের জাত উন্নয়নে সহায়তা করে। বাংলাদেশের ধান, গম, পাট, এবং আলুর মতো প্রধান ফসলের জিনোমিক ডেটা বিশ্লেষণ করে, নতুন এবং উন্নত জাত উন্নয়ন করা যেতে পারে।
রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা : ফসলের রোগ নির্ণয় এবং প্রতিরোধে বায়োইনফরমেটিক্স বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ফসলের রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর জিনোমিক তথ্য বিশ্লেষণ করে, তাদের কার্যপ্রণালী এবং প্রতিরোধের উপায় বের করা যায়। এটি কৃষকদের জন্য কার্যকরী রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণে সহায়তা করে। এ ছাড়া, এটি ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং         কৃষকের আয় বৃদ্ধি করতে সহায়ক হবে।
মাটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা : মাটির স্বাস্থ্য এবং উর্বরতা বাড়াতে বায়োইনফরমেটিক্স ব্যবহার করা যায়। মাটির মাইক্রোবিয়াল কমিউনিটির জিনোমিক বিশ্লেষণ করে মাটির স্বাস্থ্য মূল্যায়ন এবং উন্নত করার উপায় বের করা যায়। মাটির পুষ্টি উপাদানের অভাব নির্ধারণ এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরিবেশগত স্থায়িত্ব : বায়োইনফরমেটিক্সের মাধ্যমে পরিবেশগত সমস্যার সমাধান এবং কৃষি ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বায়োইনফরমেটিক্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এর মাধ্যমে নতুন জাতের উদ্ভাবন ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব হবে।
মাছ চাষ : বায়োইনফরমেটিক্স ব্যবহার করে মাছের জিনোমিক ডেটা বিশ্লেষণ করে উন্নত প্রজাতির মাছ উদ্ভাবন এবং তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।
প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন : গবাদি পশুর জিনোমিক তথ্য বিশ্লেষণ করে তাদের স্বাস্থ্য ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা যায়। বিশেষ করে গরু ও ছাগলের ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রে বায়োইনফরমেটিক্সের সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। যদিও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে সঠিক নীতি গ্রহণ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে এই খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সম্ভব। বায়োইনফরমেটিক্সের ব্যবহার করে ফসলের জাত উন্নয়ন, রোগ প্রতিরোধ এবং পরিবেশগত স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এভাবে বায়োইনফরমেটিক্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষি খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

লেখক : মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা-১২০৭। মোবাইল-০১৭১৩৫১৬২১৭, ই-মেইল-maawal70@gmail.com

বিস্তারিত
বীজের-দাগ-রোগ-ও-পরিবেশবান্ধব-প্রতিকার
বীজের দাগ রোগ ও 
পরিবেশবান্ধব প্রতিকার
ড. এ এইচ এম আসাদুর রহমান১ ড. মোহাম্মদ মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম২
বীজের দাগ ধানের একটি জটিল রোগ যা উৎপাদন মওসুম, এলাকার বিভিন্নতা এবং আক্রমণকারী রোগজীবাণুগুলোর উপর নির্ভর করে বিভিন্ন লক্ষণ প্রদর্শন করে। এই গুরুতর রোগকে প্রশমিত করার জন্য, রোগজীবাণুর সুনির্দিষ্ট শনাক্তকরণ প্রয়োজন। জেনেটিক সম্পদের ভালো ব্যবহার, উন্নত কৃষি পদ্ধতির ব্যবহার, রাসায়নিক বা জৈবিক এজেন্ট দিয়ে বীজ শোধনের সাথে জড়িত একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনার কৌশল অবলম্বন করতে হবে এই রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য।
ধানবীজের দাগ রোগ বিশ্বব্যাপী ধানচাষিদের জন্য একটি বিশেষ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে; কেননা এটি ধানের ফলন এবং গুণগতমান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিভিন্ন কারণে ধানবীজে দাগ হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগজীবাণুর সংক্রমণ, পরিবেশ বিপর্যয়জনিত অভিঘাত এবং অনুপযুক্ত স্টোরেজ ব্যবস্থাপনা। ধানের বীজের মানের জন্য উদ্ভুত বায়োটিক হুমকির মধ্যে রয়েছে পোকামাকড় ও রোগজীবাণুগুলোর বালাইনাশক প্রতিরোধী নতুন নতুন স্ট্রেন এবং এবায়োটিক হুমকির মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত ও অনুপযোগী স্টোরেজ ব্যবস্থাপনা।
ধানবীজে দাগপড়া রোগের লক্ষণ
বীজের দাগ রোগের লক্ষণ বাহ্যিকভাবে ধানের তুষ বা খোসার উপর এবং অভ্যন্তরীণভাবে চাল বা কার্নেলের উপর কিংবা উভয়ের উপরই দেখা যেতে পারে। প্রধান প্রধান লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে ধানের উপর বাদামি বা কালো বা কালচে বাদামি ডোরা দাগ, ফাঁপা হালকা ওজনের শীষ বা প্যানিকেল, এবং অপুষ্ট দানাসহ সংক্রমিত প্যানিকেল। আক্রমণের তীব্রতার উপর নির্ভর করে ধান/স্পাইকলেটের উপর বিচ্ছিন্নভাবে ছোট ছোট দাগ পড়া থেকে শুরু করে পুরো ধানই বিবর্ণ হয়ে যেতে পারে। বীজের দাগ রোগ থেকে ধানের বীজপচা, খোল-পচাজাতীয় বিভিন্ন রোগ, শীষ জলসানো, দানার দাগ এবং চাড়াপচা রোগের বিস্তার ঘটতে পারে। বীজের দাগরোগ বীজের অবয়ব তথা বীজের আকার-আকৃতির উপর প্রভাব ফেলে। 
ধানবীজের দাগপড়া রোগের কারণ
ধানবীজে দাগপড়ার জন্য অনেকগুলো ফ্যাক্টর দায়ী হতে পারে যেমন ধান গাছ হেলেপড়া, মাটি ও জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব এবং রোগজীবাণুর সংক্রমণ। জলবায়ুর আকস্মিক পরিবর্তনের ফলে নতুন রোগজীবাণুর আবির্ভাব বা একসময়ের দুর্বল রোগজীবাণু হঠাৎকরে তীব্র আক্রমণকারী জীবাণুরূপে আবির্ভূত হয়ে ধানের ফলনে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করতে পারে। ধানের শীষ বেরোনো ও দানার গঠন পর্যায়ে উচ্চ আর্দ্রতা, পরাগায়নের সময় উচ্চ তাপমাত্রা এবং প্রবল বায়ুপ্রবাহ, পরিপক্ব পর্যায়ে বৃষ্টিপাত, গাছের দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, পুষ্টির ঘাটতি, সঠিক পরাগায়ন বা নিষিক্তকরণের অভাব, নির্বিচার রাসায়নিক/ছত্রাকনাশক ব্যবহারজনিত ক্ষত ইত্যাদি বীজে দাগপড়ার জন্য দায়ী।
রোগজীবাণুর সংক্রমণ : বীজের দাগ রোগের প্রধান কারণ হলো বীজে রোগজীবাণুর সংক্রমণ। প্রচুর সংখ্যক ছত্রাক এবং ব্যাকটেরিয়া ধানের দাগ রোগের যুক্ত  ধানের দানার বিবর্ণতার সাথে যুক্ত। ছত্রাক অণুজীবের দুটি প্রধান গ্রুপ ফিল্ড-ফানজাই এবং স্টোরেজ মোল্ড ধানের দাগ রোগের জন্য দায়ী। ফিল্ড ফানজাই এবং বিভিন্ন মৃতজীবী ছত্রাক স্টোরেজ মোল্ড বীজে দাগ সৃষ্টি করে। শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ দাগপড়া ধানবীজে ব্যাকটেরিয়ার সংশ্লিষ্টতার কথা বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা রিপোর্ট করেছেন সাধারণত কম পরিমাণে হলেও কিছু ক্ষেত্রে ধানের টুংরো ভাইরাস বীজের দাগ বা বীজের বিকৃতি ঘটাতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা উল্লেখ করেছেন। 
পোকামাকড়ের আক্রমণ : কীটপতঙ্গ যেমন ধানের ওইভিল, ধানের মথ এবং অনেকসময় মাজরা পোকাও ধানে ক্ষত তৈরি করতে পারে, যার ফলে বীজে দাগ পড়া, ছত্রাকের মোল্ড জন্মে এবং অন্যান্য রোগজীবাণুর জন্য সংক্রমণের প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বীজের ফলন ও গুণগতমানের ক্ষতি করে।
পরিবেশগত কারণ : খরা, বন্যা, অতিরিক্ত আর্দ্রতা, উচ্চ তাপমাত্রা এবং মাটির অনুর্বরতাসহ প্রতিকূল পরিবেশগত অভিঘাত ধানে রোগবালাইয়ের আক্রমণ এবং দানার দাগ রোগের প্রতি আরও সংবেদনশীল করে তোলে ফলে বীজের ফলন ও গুণমানে ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে। 
বীজগুদামের অনুপযুক্ত পরিবেশ : অনুপযুক্ত স্টোরেজ ব্যবস্থা, যেমন উচ্চ আর্দ্রতা, অপর্যাপ্ত বায়ুচলাচল এবং তাপমাত্রার ওঠানামা, গুদামজাতকৃত বা সংরক্ষিত ধানে ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া এবং পোকামাকড়ের আক্রমনকে উৎসাহিত করতে পারে। অনুপযুক্তভাবে সংরক্ষণ করা ধানবীজে বিবর্ণতা, ছত্রাকের মোল্ড জন্মানো কিংবা গুধামজাত পোকার উপদ্রবে বীজের কোয়ালিটির অবনমন বা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। 
রাসায়নিক দূষক : রাসায়নিক দূষক, যেমন নির্বিচারে বালাইনাশক বা আগাছানাশকের ব্যবহার এবং ভারী ধাতুর সংস্পর্শে ধানে রাসায়নিক ক্ষত বা দাগ পড়ে বীজের বিবর্ণতা এবং গুণমানের ত্রুটি হতে পারে। এসব রাসায়নিক দূষকগুলো মাঠে ধানের দানার বিকাশ এবং শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে, যার ফলে বীজধানে দৃশ্যমান বিবর্ণতা এবং ভোক্তাদের জন্য স্বাস্থ্যের ঝুঁকি দেখা দেয়।
বীজের ফলন এবং গুণমানের উপর ধানের দাগ পড়া রোগের প্রভাব
ধানে বিভিন্ন আক্রমণকারী রোগজীবাণু যেমন ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত বীজে বিকশিত হয়, ফলে বীজের অভ্যন্তরীণ কোষগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে, অ্যালবুমেনের ক্ষতি করে এবং বীজের জীবনীশক্তিকে নষ্ট করে ফেলে ফলে অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা হ্রাস, ত্বক বা খোসার বিবর্ণতা, অঙ্গবিকৃতি এমনকি সংক্রামিত বীজ থেকে টক্সিন উৎপন্ন হতে পারে। বীজবাহিত রোগের কারণে জাতের সংবেদনশীলতা, আক্রমণের তীব্রতা এবং পরিবেশগত আনুকূল্যের উপর নির্ভর করে ধানের ফলন শতকরা ৫০ থেকে ৮০ ভাগ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। 
অঙ্কুরোদগম হার এবং শক্তি হ্রাস : আক্রান্ত বীজের মানের অগ্রহণযোগ্যভাবে অবনমন ঘটতে পারে, অঙ্কুরোদগমের হার ও ক্ষমতা উভয়ই হ্রাস পায় ফলে কম সংখ্যক চারা জন্মায় এবং গাছের বৃদ্ধিতেও রকমফের হয় ফলে ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে স্বাভাবিক ফলনের সম্ভাবনা হ্রাস পায়।
ফলন ও গুণমানের ক্ষতি : শস্য দানার ওজন হ্রাস পায়, শীষ বা ছড়ার আকৃতি ছোট হয়ে যায় ফলে ধানের সামগ্রিক ফলন হ্রাস পায়। বিবর্ণ ধানের মিলিংয়ে কম পরিমাণ চাল হওয়া, গুণমান কমে যাওয়ায় বাজারমূল্য কমে যায় এবং খাদ্য ও শিল্প প্রয়োগের জন্য উপযোগিতা কমে যেতে পারে, যা কৃষক এবং স্টেকহোল্ডারদের অর্থনৈতিক ক্ষতিকে আরো বাড়িয়ে তোলে।
রোগের বিস্তার এবং ফসলের স্বাস্থ্য : দীর্ঘ দূরত্বে উদ্ভিদের রোগজীবাণু বিস্তারের জন্য বীজ একটি অত্যন্ত কার্যকরী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। রোগজীবাণু দ্বারা সংক্রামিত বা দূষিত বীজ আমদানির ফলে উদ্ভিদ রোগের আন্তর্জাতিক বিস্তারের অসংখ্য নজির বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময় রিপোর্ট করেছেন। বীজবাহিত রোগগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেননা এটি নতুন রোগজীবাণু প্রবর্তন করতে পারে, পরিমাণগত এবং গুণগতভাবে ফসলের ক্ষতি এবং মাটির স্থায়ী দূষণ ঘটাতে পারে। আক্রান্ত ধানবীজ ক্ষেতে লাগানো হলে এর জীবাণু যেমন ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া আশেপাশের সুস্থ গাছপালা কিংবা পাশাপাশি জন্মানো ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। রোগের প্রাদুর্ভাব সামগ্রিকভাবে ফসলের স্বাস্থ্য নষ্ট করে, ব্যবস্থাপনার খরচ বাড়াতে পারে এবং রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে বালাইনাশক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়ে দিতে পারে।
ধানবীজের বাজারমূল্য হ্রাস এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি : এরোগে আক্রান্ত বীজের কোয়ালিটি নিম্নমানের হওয়ায় দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রত্যাখ্যান বা মূল্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে, যার ফলে কৃষক, ব্যবসায়ী এবং রপ্তানিকারকদের অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে। 
খাদ্য নিরাপত্তা এবং জীবিকায় প্রভাব : দানার দাগরোগের কারণে ধানের ফলন এবং গুণমান হ্রাস পাওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে, বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে ধান একটি প্রধান খাদ্যশস্য এবং পুষ্টির প্রাথমিক উৎস। ধান চাষ থেকে আয় কমে যাওয়ায় ধান চাষনির্ভর গ্রামীণ জীবনযাত্রাকে খারাপভাবে প্রভাবিত করতে পারে, দারিদ্র্যকে বাড়িয়ে তুলতে পারে যা গ্রামীণ অর্থনীতি এবং খাদ্য-নিরাপত্তাকে দুর্বল করে দিতে পারে।
যথোপযুক্ত কৃষি পরিচর্যা : অনুপযোগী ফসল পরিচর্যা বীজধানের চাষে ইনপুট সারের প্রয়োগ প্রয়োগে সতর্কতা ও উপযোগী শস্যপর্যায় অনুসরণ করা প্রয়োজন। 
ক্স রোগ-প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবনে নির্দিষ্ট ছত্রাক এবং ব্যাকটেরিয়াকে অকার্যকর করতে প্রজননবিদদেরকে সঠিক ব্রিডিং কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। 
ক্স রোপণের আগে ধানের বীজকে উপযুক্ত রাসায়নিক বা জৈব বালাইনাশক, বায়োকন্ট্রোল এজেন্ট বা অণুজীবীয় জীবাণুনাশক দিয়ে শোধন করা হয় যাতে বীজবাহিত রোগজীবাণু থেকে ফসলকে রক্ষা এবং বীজের দাগরোগ হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে। এক্ষেত্রে, সুপারিশকৃত নির্দেশিকা এবং নিরাপত্তা সতর্কতা অনুসরণ করে বীজ শোধন করা উচিত। 
ক্স পরিমিত আর্দ্রতা সংরক্ষণ সেচ কৌশল, পর্যায়ক্রমে মাটি ভেজানো এবং শুকানোর (অডউ) মতো কৌশলগুলো রোগের চাপ কমাতে পারে। 
ক্স মাটির স্বাস্থ্যকে উন্নত করে, যেমন মাটিতে জৈব পদার্থ সংযোজন, আচ্ছাদন ফসল বা কভার ক্রপিং এবং লিগুমিনাস জাতীয় ফসল সহযোগে শষ্য-পরিক্রমা মাটির গঠন, পুষ্টি উপাদানের সরবরাহতা এবং অণুজীবীয় ক্রিয়াকলাপকে উন্নত করে উর্বরতা বাড়ায়, যা রোগের প্রতি সংবেদনশীলতা কমিয়ে স্বাস্থ্যবান ফসল উৎপাদনে সহায়তা করে। 
ক্স রোগের লক্ষণ, কীটপতঙ্গের উপদ্রব এবং পরিবেশগত প্রভাব পর্যবেক্ষণের জন্য ধানক্ষেত নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে যা রোগবালাইয়ের প্রাথমিক শনাক্তকরণ এবং সময়মতো হস্তক্ষেপের জন্য অপরিহার্য। 
ক্স বীজকে যথাযথভাবে শুকিয়ে আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রিত, সঠিকভাবে বায়ু চলাচল সুবিধাযুক্ত সংরক্ষণাগারে সংরক্ষণ করা উচিত। 
ক্স দায়িত্বশীলভাবে পরিমিত মাত্রার রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করা প্রয়োজন। পরিবেশগত ক্ষতি যথাসম্ভব ন্যূনতম সীমায় নামিয়ে বালাইনাশক প্রতিরোধেী রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব এড়াতে সুপারিশকৃত প্রয়োগের হার ও মাত্রা ব্যবহার এবং অন্যান্য নিরাপত্তা সতর্কতা অনুসরণ করতে হবে।
ক্স বায়োকন্ট্রোল এজেন্ট ধানের বীজ বা মাটিতে প্রয়োগ করা হয় যাতে প্রতিযোগিতামূলকভাবে রোগজীবাণুর প্রতিষ্ঠা এবং বিস্তার রোধ করা যায়। নি¤েœ গুরুত্বপূর্ণ কিছু জৈবিক ব্যবস্থাপনা আলোকপাত করা হলো:
ট্রাইকোডার্মা প্রজাতির ছত্রাক ফর্মূলেশন : ট্রাইকোডার্মা প্রজাতির ছত্রাক, যেমন ট্রাইকোডার্মা হারজিয়ানাম এবং  ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি, বিভিন্ন উদ্ভিদের রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে তাদের এন্টি-প্যাথোজেনিক ক্ষমতার জন্য পরিচিত এবং এদের অণুবীজ সরাসরি কিংবা ফর্মুলেশন আকারে এখন বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে।  এসমস্ত অণুজীব গাছের রাইজোস্ফিয়ার এবং মূলের গাত্রে উপনিবেশ তৈরি করে প্যাথোজেনের সাথে পুষ্টির জন্য প্রতিযোগিতা করে অবদমিত করে রাখে এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল মেটাবোলাইট তৈরি করে, যার ফলে বীজবাহিত রোগের প্রকোপ হ্রাস পায়।
সিউডোমোনাস ও ব্যাসিলাস প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া ফর্মূলেশন : সিউডোমোনাস ব্যাকটেরিয়ার কিছু স্ট্রেন, যেমন সিউডোমোনাস ফ্লুরোসেন্স এবং সিউডোমোনাস পুটিডা ধানের রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে এন্টিপ্যাথোজেনিক কার্যকলাপ প্রদর্শন করে এবং বীজের দাগ দমন করতে পারে
মাইকোরাইজা জাতীয়ছত্রাকের ব্যবহার : আরবাস্কুলার মাইকোরাইজা জাতীয় ছত্রাক ধানের শিকড়ের সাথে মিথোজীবী বা সিম্বায়োটিক অ্যাসোসিয়েশন গঠন করে গাছের পুষ্টি গ্রহণে সহায়তা, চাপ সহনশীলতা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। অগঋ এর কলোণী মাটিবাহিত রোগজীবাণুর বৃদ্ধি দমন করতে পারে এবং ধানের বীজের দাগপড়া রোগ কমাতে পারে।
ইনডিউসড সিস্টেমিক রেজিস্ট্যান্স : ওঝজ-এর মধ্যে উদ্ভিদের অন্তর্নিহিত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সক্রিয়করণের ক্ষমতা রয়েছে, যেমন প্যাথোজেনেসিস-সম্পর্কিত প্রোটিন এবং ফাইটোঅ্যালেক্সিন উৎপাদন, যা রোগের বিরুদ্ধে গাছকে সুরক্ষা প্রদান করে।
শস্যপর্যায় এবং পলিকালচার বাড়াতে হবে। নন-হোস্ট বা অপোষক জাতীয় ফসলের সমন্বয়ে ধান চাষের ফসলচক্র নির্ধারণ এবং মিশ্রফসলের চাষ বা পলিকালচার অনুশীলন ধানের রোগচক্রকে ব্যাহত করতে পারে, মাটিতে রোগজীবাণুর জনসংখ্যা কমাতে পারে এবং জীববৈচিত্র্যকে সুসংহত করতে পারে। 
ধানের বীজকে উপকারী অণুজীব, যেমন মাইকোরাইজাল ছত্রাক বা রাইজোব্যাকটেরিয়া দিয়ে প্রাইমিং এবং ফোর্টিফিকেশন করলে রোপণের আগে উন্নত পুষ্টি গ্রহণ, চাপ সহনশীলতা এবং রোগ প্রতিরোধী চারা তৈরি হয়। বীজ বায়োফোর্টিফিকেশন বীজের জীবনীশক্তি এবং বীজ থেকে গজানো উদ্ভিদের স্বাস্থ্য বাড়ায়, দাগ পড়া রোধ করে, ফলে বীজের ফলন ও গুণগত মান ভালো হয়।
ধানবীজের দাগ রোগের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি যথেষ্ট হতে পারে, যা ধানচাষি বা বৃহত্তর পরিসরে দেশের অর্থনীতি উভয়কেই প্রভাবিত করে। বীজের গুণমান হ্রাসের ফলে ফলন কম হয়, বাজারমূল্য কমে যায় এবং রোগ ব্যবস্থাপনা ও দমন প্রচেষ্টার সাথে যুক্ত উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়। এতদ্ব্যতীত, বীজের দাগরোগ খাদ্য নিরাপত্তা এবং গ্রামীণ জীবিকাকে ব্যাপক প্রভাবিত করতে পারে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভরণ-পোষণ এবং আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে ধান।
 
লেখক : ১উদ্ভিদ রোগতত্ত্ববিদ, উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও ভাইস-চ্যান্সেলর মহোদয়ের একান্ত সচিব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, ১৭০৬ ২বীজ প্রযুক্তিবিদ, ডিএজিএম, এমএনটি সিড টেস্টিং ল্যাব, লালতীর সিড লিমিটেড, আর এন্ড ডি ফার্ম, বাসন, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭১৭৬৪৫৮৩৯, ই-মেইল : asad@bsmau.edu.bd
বিস্তারিত
কাজুবাদামের-উন্নত-চাষাবাদ-কৌশল
কাজুবাদামের উন্নত চাষাবাদ কৌশল 
কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী
কাজুবাদাম গাছ দ্রুত বর্ধনশীল, বহু বর্ষজীবী এবং চিরসবুজ বৃক্ষ। কাজুবাদাম গাছে পুরুষ এবং উভলিঙ্গ ফুল একই মুকুলে থাকে। ফুলগুলো ৫টি চোঙ্গাকার বৃতি দ্বারা আবৃত থাকে। খুব ছোট ছোট ফুল হয় যা লম্বায় প্রায় ৭-১৫ মিমি হয়। উভলিঙ্গ ফুলের পুংকেশরের ফিলামেন্ট ছোট হয় যার জন্য স্বপরাগায়ন কঠিন হয় এবং তুলনামূলকভাবে পরপরাগায়ন সহজ হয়। সকাল ৯টা থেকে ফুল ফোটে এবং দুপুর ১টা পরযন্ত পরাগায়ন চলতে থাকে। পরাগায়নের ৬-৮ সপ্তাহ পর ফলের দেখা পাওয়া যায়। প্রধানত মৌমাছি ও অন্যান কীটপতঙ্গ দ্বারা পরপরাগায়ন হয়।
কাজু ফল : কাজু ফলকে কাজু আপেল বলা হয়। কাজু আপেল মূলত একটি স্যুডো ফ্রুট যার নিচে নাট বা বাদামটি ঝুলে থাকে। পরাগায়নের এক সপ্তাহ পর ছোট আকারের সবুজ রংয়ের নাট সহ আপেল দেখা যায়। প্রথমত নাটটি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে ৮০% বৃদ্ধি হওয়ার পর কাজু আপেলটি বৃদ্ধি পায়। পরিপক্ব কাজু আপেল লাল, হলুদ, কমলা ইত্যাদি রঙের হয় এবং আপেলের আকার ধারণ করে। রসালো কাজু আপেল থেকে প্রাকৃতিক বা অ্যালকোহলিক পানীয়, জ্যাম, জুস, জেলি, সিরাপ ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত করা হয়। কাজু আপেল ভিটামিন সি, এন্টি অক্সিডেন্ট, মিনারেলস এবং সুগার সমৃদ্ধ হয়। ১০০ গ্রাম কাজু আপেল জুসে ২৪০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি থাকে যা অন্যান সাইট্রাস জাতীয় ফলের তুলনায় ৫-৬ গুণ বেশি।
কাজুবাদাম :  কাজুবাদাম বা বীজ কাজু ফলের বাইরের দিকে সংযুক্ত নিচে থাকে। কাজুবাদামই প্রকৃত ফল বা ড্রুপ জাতীয় ফল। কাজুবাদামের তিনটি অংশ যেমন: কারনেল, শেল এবং টেস্টা। কারনেলই হচ্ছে খাওয়ার উপযোগী কাজুবাদাম এবং অনন্য পুষ্টিগুণ সম্পন্ন মূল্যবান খাবার যার চাহিদা ও জনপ্রিয়তা গোটা পৃথিবীতে দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। 
কাজুবাদামে ৫% পানি, ৩০% কারবোহাইড্রেট, ৪৪% ফ্যাট এবং ১৮% প্রোটিন রয়েছে। ১০০ গ্রাম কাজুবাদাম ৫৫৩ কিলোক্যালরি শক্তি, ফ্যাটের ৬৭%, প্রোটিনের ৩৬%, ডায়েটরি ফাইবারের ১৩% এবং কার্বহাইড্রেটের ১১%  ডেইলি ভ্যালু সরবরাহ করে।
কাজুবাদাম মিনারেলের সমৃদ্ধ উৎস (২০ বা বেশি ডেইলি ভ্যালু)। এ ছাড়া কপার, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস ও ম্যাঙ্গানিজেরও সমৃদ্ধ উৎস (৭৯-১১০% ডেইলি ভ্যালু)। থায়ামিন, ভিটামিন বি-৬ এবং ভিটামিন কে (৩২-৩৭% ডেইলি ভ্যালু)। আয়রন, পটাশিয়াম, জিংক ও সেলেনিয়ামেরও উচ্চ মাত্রার উৎস (১৪-৬১% ডেইলি ভ্যালু)। ১০০ গ্রাম কাজুবাদামে বিটা-সাইটোসটেরল আছে ১১৩ মিলিগ্রাম।
কাজুবাদাম রোস্টেড, সল্টেড, সুইটি বা ফ্লেবারড খাবার হিসেবে ব্যাবহার করা হয়। কাজু কারনেল বা বাদাম আস্ত, টুকরা, গুঁড়া বা পাউডার রূপে খাওয়া হয়। ইদানীং কাজু মিল্কও জনপ্রিয় হচ্ছে। শেলে এক ধরনের নকশাস কারডল এবং এনাকার্ডিক এসিড থাকে যার সংস্পর্শে মুখে, চামড়ায় জ¦ালাপোড়া বা ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে। শেল থেকে এক ধরনের ফেনলিক অয়েল পাওয়া যায় যা সিএনএসএল নামে পরিচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বাই প্রোডাক্ট। সিএনএসএল রেজিন, জৈব বালাইনাশক, পলিমারাইজিং, ড্রাগ, সিমেন্ট ইত্যাদি শিল্পে ব্যবহার হওয়া আন্তর্জাতিক বাজারে একটি মূল্যবান বাই প্রোডাক্ট। 
জলবায়ু ও মাটি : পাহাড়, সমতল বা উপকূল সব জায়গায় কমবেশি কাজুবাদাম জন্মাতে পারে। বাণিজ্যিকভাবে কাজুবাদাম চাষাবাদের জন্য আদর্শ হলো মাটির পিএইচ ৫.৮ থেকে ৬.৮, সুনিষ্কাশিত বেলে দোয়াশ মাটি, ২০-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা এবং বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১০০০-২০০০ মিমি। ফুল আসা বা ফল ধরার সময় তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি থাকলে ফলনের ওপর খারাপ প্রভাব পড়ে। ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচের তাপমাত্রায় গাছে ফুল আসতে দেরি হয়। এ ছাড়া অত্যধিক বৃষ্টিপাত এবং উচ্চ আপেক্ষিক আর্দ্রতায় (৮৫% এর বেশি) ফুল ও ফল ঝরে যায়, ছত্রাকজনিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়।
জাত নির্বাচন : বাংলাদেশে কাজুবাদামের কোন অনুমোদিত জাত নেই। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় কিছু স্থানীয় জাতের চাষ করা হয়। কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের ডিএই ও  বারি অঙ্গ হতে কম্বোডিয়া ও ভারত হতে কিছু উচ্চফলনশীল হাইব্রিড ও ননহাইব্রিড জাতের চারা/কলম আমদানি করা হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে উন্নত ও উচ্চফলনশীল জাতের কাজুবাদাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। যেমন গাছপ্রতি ফলন, নাটের ওজন, কার্নেলের ওজন, শেলিং এর শতকরা হার ইত্যাদি। এ দেশে কাজুবাদামের গাছপ্রতি ফসল খুবই কম। কাজুবাদামের বাগান করার সময় অবশ্যই মানসম্পন্ন, উন্নত জাতের চারা/কলম রোপণ করতে হবে। যে জাতের গাছে বড় আকারের বাদাম হয় এবং ফলন ভালো হয় এমন গুণসম্পন্ন বাদামের চারা/কলম লাগাতে হবে।
রোপণ পদ্ধতি, মাদায় সার প্রয়োগ ও মালচিং: মাটির উর্বরতা, প্রকার এবং জমির টপোগ্রাফির উপর চারা/কলম লাগানোর পদ্ধতি বা লেআউট নির্বাচন করতে হবে। কাজুবাদামের বাণিজ্যিক বাগান স্থাপনের জন্য সাধারণত বর্গাকৃতি, আয়তাকার এবং ত্রিভুজাকৃতি বা কনট্যুর পদ্ধতিতে চারা/কলম লাগানোর সুপারিশ করা হয় (সারণি দ্রষ্টব্য)। 
আন্ত:ফসল : কাজুবাদাম গাছকে ছায়া প্রদান করবে না আবার ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের পোষক হবে না এমন ফসল আন্ত ফসল হিসাবে বেছে নিতে হবে। বর্গাকৃতির বা আয়তাকার পদ্ধতিতে সৃজিত বাগানের দুই সারির ফাঁকা স্থানে স্বল্পমেয়াদি আনারস, কচুুজাতীয় সবজি, মসলাজাতীয় ফসল যেমন-আদা হলুদ চাষ করা যায়। ফসলের মধ্যে সিম গোত্রীয় ফসল যেমন চীনা বাদাম, সিম, ফেলন সহ অন্যান্য ডাল জাতীয় ফসলের আবাদ করলে বাড়তি আয়ের পাশাপাশি মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় এবং আগাছার প্রাদুর্ভাব কমে।                                                               
মালচিং : কাজু বাগান সাধারণত পতিত, অনুর্বর ও বালি মাটিতে চাষ করা হয়। তাই সেখানে পানির অভাব পরিলক্ষিত হয়। মালচিং পদ্ধতি সে অবস্থায় গাছের উপকার করে থাকে। বিশেষ করে চারা অবস্থায় মালচিং আরো বেশি উপকারী। গবেষণায় দেখা গেছে কালো পলিথিন দ্বারা মালচিং করা হলে গাছের বৃদ্দি,সজীবতা ও ফলন বেশি হয়।
আগাছা দমন : আগাছা খাদ্য ও পানির উপর ভাগ বসায়। বৃষ্টির পর কোদাল দ্বারা হালকাভাবে কোপায়ে আগাছা দমন করতে পারলে ভাল। আগাছানাশক দ্বারা আগাছা দমন না করাই উত্তম। তবে সময়মতো শ্রমিক পাওয়া না গেলে আগাছানাশক দ্বারা আগাছা দমন করা যেতে পারে। 
সার ব্যাবস্থাপনা : গাছের সারের পরিমাণ নির্ভর করে মাটির বুনট, মাটির র্উরতা, আবহাওয়া ও গাছের বয়সের উপর। 
সেচ : খরার সময়ে সেচ দিতে পারলে ছোট চারা গাছের বৃদ্ধি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। চারা গাছে সেচ দেয়ার জন্য ড্রিপ বা স্প্রিংলার পদ্ধতিতে সেচ দেয়া ভালো উপায়। ফুল-ফল ধরার সময় অতিরিক্ত খরা হলে কচি ফল ঝরে পড়ার সমস্যা দেখা যায়। তাই খরা মৌসুমে সেচ দিতে পারলে ফল ঝরা রোধ করে ফলন বৃদ্ধি করে। পাহাড়ি অঞ্চলে সেচ পদ্ধতির মধ্যে ড্রিপ সেচ পদ্ধতি সবচেয়ে উপযুক্ত। কেননা এতে পানি সবচেয়ে বেশি সাশ্রয় হয়। আগাছার প্রাদুর্ভাব কম হয়। আর বাষ্পীভবনের  মাধ্যমে পানি নষ্ট কম হয়। 
ভূমির ক্ষয়রোধ ও মাটির আদ্রতা সংরক্ষণ : পাহাড়ি এলাকার ঢালু জমির জন্য ভূমি ক্ষয়রোধ ও মাটির আর্দ্রতা সংরক্ষণের জন্য কিছু পদ্ধতি রয়েছে। নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি ট্রেঞ্চ, ক্রিসেন্ট বাউন্ড ট্রেঞ্চ, বৃত্তাকার ট্রেঞ্চ ইত্যাদি পদ্ধতি ঢালু জমিতে কাজুবাদামের উৎপাদন বৃদ্ধিতে র্কাযকরী উত্তম পদ্ধতি। ৩.৫ মিটার লম্বা, ১ মিটার চওড়া ও .৫ মিটার গভীর ট্রেঞ্চে নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি পদ্ধতিতে খুব ভালোভাবে মাটির আর্র্র্দ্রতা সংরক্ষণ করা যায় 
ডালপালা ছাঁটাইকরণ (প্রুনিং) : গ্রাফটিং বা কলমের চারার ক্ষেত্রে রুটস্টক থেকে কোন প্রকার শাখা-প্রশাখা বের হলে তা  যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেটে দিতে হবে। কেননা এগুলো জোড়া লাগানো সায়নকে দুর্বল করে ফেলে এবং শেষ পর্যন্ত কলমটি মারা যায়। কাজুবাদামের গাছ দ্রুত বর্ধনশীল বিধায় রোপণের ২/৪ বছরের গাছ ঝড় বাতাসে সহজে হেলে পড়ে। শক্ত সামর্থ কাঠামো গঠনের জন্য গাছের নিচের এবং পাশের ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। গাছকে নির্দিষ্ট উঁচুতে রাখতে প্রায় ১-১.৫ মিটার উচ্চতায় মূল বা প্রধান কা-ের মাথা কেটে দিতে হবে। পরবর্তীতে মাটি থেকে ২-২.৫ মিটার হলে আবার প্রধান প্রধান কা-গুলোর মাথা কেটে দিতে হবে। এভাবে গাছকে ছোট অবস্থায় ঝোপালো গাছ গঠন করতে হবে। পরর্তীতে শুধু আড়াআড়ি ভাবে থাকা মরা ডাল রোগ/পোকামাকড়ে আক্রান্ত ডালপালা এবং অতিরিক্ত ঘন ডালপালা কেটে রাখতে হবে। বড় ডালপালার কাটা অংশে বোর্দ্রাে পেস্ট লাগাতে হবে। যাতে পরবর্তীতে ছত্রাকজনিত রোগের আক্রমণ রোধ করা যায়। ছাঁটাইয়ের কাজ ফল সংগ্রহের পর বর্ষার পূর্বে অথবা বর্ষা শেষে অর্থাৎ আগষ্ট- সেপ্টেম্বর মাসে করা উচিত। হাইডেনসিটি কাজুবাদামের বাগানে প্রতি বছর জুলাই আগস্ট মাসের মধ্যেই প্রুনিং এর কাজ শেষ করতে পারলে ভালো। 
বালাই ব্যবস্থাপনা : বাংলাদেশে কাজুবাদামের চারা কলম থেকে শুরু করে ফলন্ত গাছে বেশকিছু ক্ষতিকারক পোকামাকড় ও রোগ জীবাণুর সংক্রমণ হয় এবং কাজুবাদাম ফসলের অনেক ক্ষতিসহ ফলন কমে যায়। কাজুবাদামের মারাত্মক ক্ষতিকর কয়েকটি পোকা মাকড় ও রোগ জীবাণু যেমন : কা- ও মূল ছিদ্রকারী পোকা; টি মসকিউটু বাগ; থ্রিফস; ফল ও বাদাম ছিদ্রকারী পোকা; লিফ মাইনার ও মিলি বাগ ইত্যাদি । এই সকল পোকার আক্রমণে কাজুবাদামের ফলন প্রায় ৩০% কম হতে পারে। টি মসকুইটো বাগের অপরিণত নিম্ফ এবং পরিণত পোকা গাছের পাতা, কা-, পুষ্পমঞ্জরি এমনকি কাজুবাদামের ফলের রস চুষে খায়। কচি ডাল আক্রান্ত হলে আগামরা রোগ দেখা যায়। এই পোকার বংশবৃদ্ধি বর্ষার প্রারম্ভেই হয়ে থাকে যখন গাছে কচি ডালপালা ও কুশি দেখা যায়। কা- ও মূল ছিদ্রকারী পোকার গ্রাবসমূহ কা- ও মূলের টিস্যু ছিদ্র করে এবং সাব-এপিডারমাল টিস্যু খেয়ে অনিয়মিত সুড়ঙ্গ তৈরি করে। এর ফলে গ্যামোসিস দেখা যায়, পাতা হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে এবং ডালপালা শুকিয়ে যায়।
রোগ :  কাজুবাদামে বেশ কিছু রোগের সংক্রমণ দেখা যায়। যেমন: পাউডারি মিলডিউ, ডাইব্যাক, এনথ্রাকনোজ, ডেম্পিং অব ইত্যাদি রোগের সংক্রমণে কাজুবাদামের ক্ষতি হয়ে থাকে। প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক সমন্বিত বালাই দমনব্যবস্থার মাধ্যমে এ সকল ক্ষতিকারক পোকামাকড় ও রোগ জীবাণুর ক্ষতিকারক প্রভাব কমানো যায়। 
বাদাম সংগ্রহ : আমাদের দেশে সাধারণত নভেম্বর-জানুয়ারি মাসে ফুল আসে এবং এপ্রিল/মে মাসে কাজু বাদাম পরিপক্ব হয়। পরিপক্বের পরপরই এ বাদাম সংগ্রহ করতে হয়। পরিপক্ব হলে বাদাম গাছ থেকে পড়ে যায়। কচি অবস্থায় এ বাদামের ফল থেকে বাদামটি বেশ বড় এবং নরম থাকে। পাকার সময়  বাদামটি উজ্জ্বল রং ধারণ করে এবং খোসা খুব শক্ত, মসৃণ ও ভেতরের বাদাম ভালোভাবে পরিপুষ্ট হয়। এখানে উল্লেখ্য যে বীজের জন্য বাদাম সংগ্রহ করতে হলে  বাদামের  আপেক্ষিক ঘনত্ব ১ এর বেশি হতে হবে। অর্থাৎ বীজ বাদাম পানিতে ডুবালে বাদাম ডুবে যাবে। তখনই বাদাম সংগ্রহ করতে হবে। শুধু বাদাম সংগ্রহের প্রয়োজন হলে, পরিপক্ব ফল গাছ থেকে ঝরে পড়লে তখনই মাটি থেকে সংগ্রহ করতে হয়। ফল থেকে বাদামটি যতদ্রুত সম্ভব আলাদা করে বাদামটি ভালোভাবে ৪-৫ দিন রৌদ্রে শুকাতে হবে। 
কাজু আপেল সংগ্রহ : যদি ফল থেকে সিরাপ, জ্যাম, জেলি, ভিনেগার ইত্যাদি তৈরি করতে হয়, তবে পরিপক্ব ফল হাত দ্বারা সাবধানে গাছ থেকে সংগ্রহ করতে হবে। অথবা নিচে জাল বা কাপড় বিছিয়ে গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করতে হবে।  বাংলাদেশে ১০ বছরের একটি গাছ থেকে বছরে গড়ে ৪-৬ কেজি বাদাম পাওয়া যায়। উন্নত জাত বা হাইব্রিড জাতের একটি গাছ থেকে গড়ে প্রায় ১০ থেকে ২৫ কেজি বাদাম এবং ৭০-১০০ কেজি কাজু আপেল  পাওয়া সম্ভব। বর্তমানে  এদেশে হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ১ থেকে ২.৫ মে.টন। তবে উন্নত বা হাইব্রিড জাতের ফলন ৩ থেকে ৫ মে.টন পর্যন্ত হতে পারে।
বাদাম সংরক্ষণ : বাদামগুলো যদি সঠিকভাবে শুকানো না হয় তবে প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় অনেক বাদাম নষ্ট হয়ে বাদ পড়ে যায়। বাদামের আর্দ্রতা ১০% এর নিচে রেখে এবং শুকনা, ঠা-া এবং বাতাস চলাচলের সুব্যবস্থা রয়েছে এমন আদর্শ  গুদামে  ১ বৎসর সংরক্ষণ করা যায়। সংরক্ষণ করার পূর্বে রোগাক্রান্ত, পোকায় আক্রান্ত বা চিটা, দাগ পড়া ও বিকৃত আকারের বাদামগুলো বেছে বাদ দিতে হবে। শুকনা বাদামগুলো বায়ুরোধক বস্তায় সংরক্ষণ করা উচিত। ভালোভাবে শুকানো বাদামগুলো বায়ুরোধক বস্তায় না রাখা হলে বাদামগুলো বাতাসের আর্দ্রতা ধারণ করে নষ্ট হয়ে যায়। তা ছাড়া কাজুবাদামের বস্তাগুলো সরাসরি ফ্লোরে রেখে কাঠের পাটাতনের উপর রাখতে হবে। কাজুবাদাম বিক্রয় কিংবা প্রক্রিয়াজাতকরণের আগে অক্টোবর/নভেম্বর মাসে কাজুবাদামগুলোকে গুদাম থেকে বের করে পুনরায় রৌদ্রে দিয়ে শুকালে বাদামের গুণাগুণ ভালো থাকে বা সঠিক বিক্রয় মূল্য পাওয়া যায়। (সূত্র : USDA Food Data Central. BARI,) 
 
লেখক : কাজুবাদাম উৎপাদন বিশেষজ্ঞ, কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৭১২৫০১৪৯২, ইমেইল:chakrobortykc@gmail.com 
বিস্তারিত
পাট-আঁশের-মান-উন্নয়নে-পলিথিন-ব্যবহার-প্রযুক্তি

পাট আঁশের মান উন্নয়নে পলিথিন ব্যবহার প্রযুক্তি
ড. মোঃ আবুল ফজল মোল্লা
পলিথিন কাগজ ব্যবহারে পাটের পচন প্রযুক্তি তুলনামূলক সময় কম লাগে। কাটিংস মুক্ত উন্নতমানের পাট আঁশ পাওয়া যায়। জাকের পানি দ্রুত বেশি পচবে না বা কলুষিত করবে না। পাট মৌসুমে (মে-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশের সকল অহ্চলের জন্য প্রযোজ্য। পাট গাছের বয়স ১০০-১২০ দিনের মধ্যে হলে কর্তন হবে। পাট কর্তনের পর ৩-৪ দিন জমির উপর স্তূপ করে রেখে পাতা ঝরিয়ে নিতে হবে। পাট গাছগুলোর ৮-১০ কেজি ওজনের আঁটি বাঁধতে হবে। পাটের আঁটিগুলোকে প্রথম সারিতে লম্বালম্বি, দ্বিতীয় সারিতে আড়াআড়ি এবং তৃতীয় সারিতে আবার লম্বালম্বিভাবে সাজিয়ে বা পাটের বান্ডিলগুলোকে পর্যায়ক্রমে সামনের দিক থেকে পিছনের দিক হয়ে সজ্জিত করে জাক তৈরি করতে হবে যাতে পানি ও পচন জীবাণু জাকের মধ্যে সহজে চলাফেরা করতে পারে। ফলে পাট পচন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। যথাসম্ভব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও অল্প স্রোত যুক্ত খাল, বিল, পুকুর বা ডোবার পানিতে জাক দিয়ে পলিথিন কাগজ দ্বারা ঢেকে দিতে হবে। জাকে ভার হিসাবে মাটি/ইটের খোয়া ভর্তি প্লাস্টিকের বস্তা বা কনক্রিটের স্লাব ব্যবহার করতে হবে। বদ্ধ পুকুর বা ডোবায় পাট পচানোর সময় ইউরিয়া সার ব্যবহার করলে পাটের পচন তুলনামূলক তাড়াতাড়ি হয় এবং আঁশের রং ভাল হয়। প্রতি ১ টন বা ১০০০ কেজি পাট গাছের জন্য প্রায় ১০০-১৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার পাত্রে গুলে পানিতে মিশিয়ে অথবা সরাসরি জাকের আঁটির সারিতে ছিটিয়ে দিলে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৪-৫ দিন আগেই পচন সম্পন্ন হয়।
পাট পচনের শেষ সময় নির্ণয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পাটের পচন কম হলে আঁশের গায়ে ছালের শক্ত অংশ লেগে থাকে বা কাটিংস এর পরিমান বৃদ্ধি পায়। আবার বেশি পচলে ধৌত করার সময় আঁশগুলো ছিঁড়ে যায়, ফলে ফলন কমে যায়। কাজেই পাট পচনের সমাপ্তি নির্ণয় খুবই জরুরি। পাট জাক দেওয়ার ৮-৯ দিন পর থেকে জাক পরীক্ষা করা উচিত। ২-৩টি পচা পাট গাছ জাক থেকে বের করে ধুয়ে আঁশ পরীক্ষা করলে পচনের শেষ সময় নির্ণয় করা যায়। পচা পাটের মধ্যাংশ থেকে ১ ইঞ্চি বা ২.৫ সেন্টিমিটার পরিমাণ ছাল কেটে কাচের গ্লাসের ভেতর পানি দিয়ে ঝাঁকানোর পর পানি ফেলে আবার পরিষ্কার পানি দিয়ে ঝাঁকিয়ে যদি দেখা যায় যে আঁশগুলো পরস্পর পৃথক হয়ে গেছে তখন বুঝতে হবে যে পচন শেষ হয়েছে। পচন সম্পন্ন হলে আঁশগুলোকে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নিতে হবে যেন কোন রকম পচা ছাল, ভাঙ্গা পাট খড়ি, অন্য কোন ময়লা, কাঁদা ইত্যাদি আঁশের গায়ে লেগে না থাকে। কারণ এতে পাটের আঁশ নিম্নমানের হওয়ায় আর্থিক মূল্য কমে যায়। 
ভেজা পাট আঁশ মাটিতে না শুকিয়ে বাঁশের আড়ায় বা ঘরের চালে বা গাছের ডালে বা ব্রিজের রেলিংয়ে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হয়। লক্ষ্য রাখতে হবে, আঁশে যেন ময়লা/ধুলাবালু লেগে না থাকে। আঁশ ভালোভাবে শুকিয়ে গুদামজাত বা বাজারজাত করা উচিত অন্যথায় আঁশের মান নষ্ট হয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের মান ক্ষণœœ হয়। উন্নতমানের পাট আঁশ উৎপাদনের মাধ্যমে অধিক অর্থ উপার্জনসহ উন্নত পাট ও পাটজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। 
এই পদ্ধতিতে পাট পচনে তুলনামূলক সময় কম লাগে; কাটিংস মুক্ত উন্নতমানের পাট আঁশ পাওয়া যায়; জাকের পানি দ্রুত বেশি পচবে না বা কলুষিত করবে না। পাট মৌসুমে (মে-সেপ্টেম্বর) পানি সহজলভ্য অবস্থায় বাংলাদেশের পাট উৎপাদনকারী সকল ইকোলজিক্যাল অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য।
প্রযুক্তি ব্যবহারের পূর্বে প্রচলিত পাট পচন পদ্ধতিতে প্রাপ্ত পাটের বিক্রয় মূল্য ২৮০০-৩০০০/- হয়। অনুরূপভাবে প্রযুক্তি ব্যবহারের পরে প্রাপ্ত পাটের বিক্রয় মূল্য ৩২০০-৩৫০০/- হয়।

লেখক : চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার, ফাইবার কোয়ালিটি ইম্প্রূভমেন্ট বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৮৬১৬০৩৫। ই-মেইল :abulfazalmollah83@gmail.com

বিস্তারিত
ফল-রপ্তানিতে-আধুনিক-প্যাকিং-হাউজ-ও-ল্যাবের-স্মার্ট-কার্যক্রম

ফল রপ্তানিতে আধুনিক প্যাকিং হাউজ ও ল্যাবের স্মার্ট কার্যক্রম
ড. শামীম আহমেদ১ এ. কে. আজাদ ফাহিম২
সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের প্রিয় এই দেশ, বাংলাদেশ। ষড়ঋতুর এই সবুজ-সজীব স্বদেশটাকে ভালো না বেসে থাকার উপায় নেই। প্রতিটি ঋতুরই আছে আলাদা রূপবৈচিত্র্য। ভালো লাগা জাগানিয়া স্বতন্ত্র চিহ্ন আর ফল-ফসলের সমৃদ্ধতা।
গ্রীষ্মকাল এ অঞ্চলের মানুষের জন্য এক লোভাতুর মৌসুম। এ ঋতুতে রয়েছে মধু মাস জ্যৈষ্ঠ। গ্রীষ্মকালে আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি ফলমূল পাওয়া যায়। গ্রীষ্মের ছুটির প্রতীক্ষায় কাটতো আমাদের শৈশব। ‘গ্রীষ্ম’ আমাদের শৈশব-কৈশোরের দুরন্তপনার এক অনবদ্য ক্যানভাস। স্কুল, পড়ালেখা আর নিয়মকানুনের শৃঙ্খল থেকে আমাদেরকে কিছুটা মুক্তি দিতো গ্রীষ্মের ছুটি। সকাল দুপুরে, মধ্য পুকুরে সাঁতার কাটার স্মৃতি আর মামাবাড়ির পাকা ফলের স্বাদগ্রহণের স্মৃতিকথা এ প্রজন্মের কাছে হয়তো রূপকথার মতো মনে হবে!  
আমাদের দেশে প্রায় সব ঋতুতেই কমবেশি ফলমূল পাওয়া যায়। কৃষিতে গবেষণা ও কৃষি সম্প্রসারণের উৎকর্ষতার বদৌলতে ফলের নিত্যনতুন জাত উদ্ভাবন এবং এর ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়েছে সারাদেশে। এ ছাড়া ফলের মৌসুমও দীর্ঘায়িত হয়েছে। একসময়ের পারিবারিক চাহিদা পূরণের ফল উৎপাদন পদ্ধতি এখন রূপান্তরিত হয়েছে বাণিজ্যিক ফল উৎপাদনে।
এদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মূলে রয়েছে মাটি ও মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন কৃষি। এ মহান পেশাতে শিক্ষিত তরুণদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশে গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক ফলের খামার। এটি আমাদের আশার সঞ্চার করলেও এতে রয়েছে নানা ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ। কাছাকাছি সময়ে অনেক ফলের উৎপাদনের কারণে প্রথমত কৃষকরা উচ্চমূল্য ফসল ফল উৎপাদন করেও ন্যায্যমূল্য পায় না। সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি অনুশীলনের অদক্ষতা ও  মৌসুমে বাজারে চাহিদার তুলনায় ফলের জোগান বেশি থাকায় এর একটা বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায় বা পঁচে যায়। এতে কৃষকদের পাশাপাশি দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের দেশীয় অর্থনীতি। এছাড়া মৌসুমে ফলের সহজপ্রাপ্যতা থাকলেও অফসিজনে দেখা দেয় ব্যাপক ঘাটতি। তখন জনগণের ফলের চাহিদা পূরণের জন্য আমদানি করতে হয় বিদেশি ফল। এতে প্রতি বছরে এখাতে আমাদের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হচ্ছে। টেকসই কৃষি উৎপাদনের ধারায় বাণিজ্যিকীকরণ বর্তমান সময়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। রপ্তানিমুখী কৃষির কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য দরকার গুণগত মান নিশ্চিত করে আকর্ষণীয় প্যাকেজিং দিয়ে প্রক্রিয়াজাত মূল্য সংযোজনমূলক কৃষি উৎপাদনকে উৎসাহিত করা। 
  দেশের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টাও ইতোমধ্যে জোরদার হয়েছে।  গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে তাজা ফল ও সবজির রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এই ধারা বজায় রাখতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশসমূহে কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে অ-সম্মতি (ঘড়হ ঈড়সঢ়ষরধহপব) এর মাত্রা কমানোর লক্ষ্যে ঊট চাহিদার ভিত্তিতে ২০১৪ সালে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়ক থেকে পূর্বদিকে শ্যামপুরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নিজস্ব কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে কয়েকটি নতুন আইটেমসহ প্রায় শতাধিক কৃষিপণ্য সফলতার সাথে সর্বনিম্ন অ-সম্মতি (ঘড়হ ঈড়সঢ়ষরধহপব) এর মাধ্যমে ইউরোপের ১৪টি দেশে রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এ রপ্তানির পরিমাণ ও পণ্যের সুনাম ওই সব দেশে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
যেসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে তার মধ্যে ফলের অবদান অন্যতম। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সর্বাধিক রপ্তানিকৃত ফলের পরিমাণ মেট্রিক টন সারণি দ্রষ্টব্য।
সারণি : রপ্তানিকৃত ফলের পরিমাণ
আমাদের দেশের ফলমূল বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হলে নিসন্দেহে কৃষকরা লাভবান হওয়ার মাধ্যমে দেশও সমৃদ্ধ হবে। বর্তমানে আমাদের দেশের বেশির ভাগ পণ্যসামগ্রী বিদেশের এথনিক মার্কেটে (বাঙালি পরিচালিত) স্থান পায়। এসব পণ্যকে বিদেশের প্রাইম মার্কেটে প্রবেশ করাতে পারলে রপ্তানির পরিমাণ যেমন ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে পাশাপাশি উচ্চমূল্য পাওয়ার সুযোগও বহুগুণে বেড়ে যাবে। এ জন্য আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা বাড়াতে এক্রিডিটেড ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার মাধ্যমে পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। 
উন্নত বিশে^র মূল বাজারে রপ্তানির জন্য ফলমূল ও শাকসবজি ল্যাবে টেস্টের মাধ্যমে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সার্টিফিকেট প্রদান করার বাধ্যবাদকতা রয়েছে। কৃষি পণ্য উৎপাদন, উপকরণ এবং কৃষিজাত খাদ্যের গুণগতমান নিশ্চিতের লক্ষ্যে গবেষণাগারে পরীক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এ বিষয়টি উপলব্ধি করে উক্ত ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণ ও এক্রিডিটেশন করার পাশাপাশি প্যাকিং হাউজের সক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজন বিধায় কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজ, শ্যামপুরে স্থাপিত উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর (১ম সংশোধিত) প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে।
এই গবেষণাগারের প্রতিটি শাখা প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত সংখ্যক অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং বায়োসেফটি ইকুইপমেন্ট দ্বারা সজ্জিত করা হবে। গবেষণাগারটি ওঝঙ/ওঊঈ ১৭০২৫:২০১৭ মানদ- অনুযায়ী পরিচালিত হবে। কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে ইতোমধ্যে ১০টি ল্যাবরেটরি স্থাপনের কার্যক্রম বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। 
গবেষণাগারের কার্যক্রম
ব্যাকটেরিওলজি ল্যাবরেটরি : এ ল্যাবরেটরিতে আমদানি ও রপ্তানিযোগ্য সকল ধরনের কৃষিজাত পণ্যের রোগজীবাণু শনাক্ত করা হবে পাশাপাশি প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টইন সর্টিফিকেট পেতে ভূমিকা রাখবে। নির্দিষ্ট ফি পরিশোধ করে নমুনা পাঠানোর সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে কৃষক, আমদানিকারক, রপ্তানিকারক অথবা প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইন উইং এর পরিদর্শক ল্যাবরেটরিতে পাঠাবে। ল্যাবরেটরিতে প্রচলিত পদ্ধতির পাশাপাশি দ্রুত শনাক্তকরণ কৌশল ও সর্বশেষ আইকনিক প্রযুক্তিও ব্যবহার হবে।
ভাইরোলজি ল্যাবরেটরি : গবেষণাগারের এ শাখায় রপ্তানিযোগ্য কৃষিজাত পণ্যের বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস  জনিত রোগ শনাক্ত করা হবে। যেমন- ঢেঁড়সের মোজাইক ভাইরাস, টমেটোর উইল্ড ভাইরাস, হলুদের লিফকার্ল ভাইরাস, ফুলকপির মোজাইক ভাইরাস, কাঁকরোলের মোজাইক ভাইরাস, লাউয়ের লিফকার্ল ভাইরাস ইত্যাদি রোগ শনাক্তকরণ করা হয়।
মলিকুলার বায়োলজি ল্যাবরেটরি : উদ্ভিদ রোগ জীবাণু শনাক্তকরণে মলিকুলার মেথোড ক্রমবর্ধমানভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। শনাক্তকরণের জন্য এ মলিকুলার টেকনোলজি ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় রোগবালাই শনাক্ত করা হবে, এ ছাড়াও উক্ত ল্যাবে উদ্ভিদের  স্বাস্থ্যগত পরীক্ষা এবং জিনগত বিশ্লেষণ কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
মাইকোলজি ল্যাবরেটরি : এ ল্যাবে কৃষিজাত সকল পণ্যসহ বিভিন্ন শাকসবজি ফলমূল ইত্যাদিতে বিদ্যমান সকল ধরনের ছত্রাক শনাক্ত করা হবে। মাটি, পানি, কা-, শিকড়, ফল, পাতাসহ কৃষি সংশ্লিষ্ট যে কোন ধরনের নমুনা থেকে ছত্রাক শনাক্ত করা হবে।  উক্ত ল্যাবে ছত্রাক আইসোলেশন, কালচার করা, আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি, ইনকিউবেশন ইত্যাদি সুবিধার পাশাপাশি ছত্রাক স্পেরুলেশন করা হবে। যা কৃষিজাত পণ্যের আমদানি ও রপ্তানির জন্য ফাইটোস্যানিটারি সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হবে।
বিসিএ এবং এলএমও ল্যাবরেটরি : এ ল্যাবরেটরিতে মূলত জেনেটিক্যালি পরিবর্তিত বিভিন্ন শাকসবজি ও ফলমূল পরীক্ষা করা হবে। জেনেটিক্যালি মডিফাই করা পণ্য পরীক্ষা করে দেখা হবে গুণগত মান এর পরিবর্তন হয়েছে কিনা এবং রপ্তানি ঝুঁকি আছে কি না তা যাচাই করা হবে। এ ল্যাবের গুরুত্বপূর্ণ মেশিনে বিভিন্ন পণ্যের ও পণ্যের প্যাথোজেনের সিকুয়েন্স বিশ্লেষণ করা হবে এবং পণ্যের বর্তমান ও পরিবর্তিত রূপ পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হবে। এ ছাড়া এ ল্যাবে বায়ো কন্ট্রোল এজেন্টের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হবে। বর্তমান কৃষিতে কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই নিয়ন্ত্রণের জন্য জৈব এজেন্ট ব্যবহারের সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পাচ্ছে। জৈব কীটনাশক এবং বালাইনাশক ব্যবহার করে উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্যের গুণগত মান পরীক্ষা করা হবে। উক্ত ল্যাবে রপ্তানিযোগ্য কৃষি পণ্যের র‌্যাপিড ডিটেকশান কীট এর মাধ্যমে দ্রুত পরীক্ষা করা হবে।
ইনসেক্ট ডায়গোনোসিস ল্যাবরেটরি : গবেষণাগারের এ শাখায় সকল ধরনের পোকামাকড়সহ অন্যান্য প্রজাতির কীটপতঙ্গ প্রচলিত চাক্ষুস শনাক্তকরণের পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও শনাক্ত করা হবে। এ ল্যাবে যেসব পোকামাকড় শনাক্ত, যেগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের ক্ষতি করে এবং রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। যেমন- ফল আর্মিওয়ার্ম, বিভিন্ন প্রকার মথ, পঙ্গপাল, মিলিবাগ, ফল ও সবজির মাছি পোকা ইত্যাদি। 
নেমাটোলজি ল্যাবরেটরি : নেমাটোডের মাধ্যমে ফসলের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে থাকে। নেমাটোড মূলত ফসলের কা-, শিকড় ও পাতায় আক্রমণ করে, ফলে উৎপাদন ও গুণগত মানে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। ফসলের উৎপাদনের সাথে জড়িত থাকায়  কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি বা আমদানিতে নেমাটোড শনাক্ত করা জরুরি। এ ল্যাবে তাজা শাকসবজি ও ফলমূল আমদানি ও রপ্তানি অনুমতি দানের পূর্বে নেমাটোড শনাক্ত করা হবে। উক্ত ল্যাবে সকল ধরনের নেমাটোড, ভার্মিফর্ম, সিস্ট গঠনকারী নেমাটোড এবং উদ্ভিদের পরজীবী নেমাটোড পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করা হবে। 
উইড আইডেন্টিফিকেশন ল্যাবরেটরি : আগাছা উৎপাদিত ফসলের গুণগত মান নষ্ট করে। প্রতি বছর কৃষককে তার জমিতে জন্মানো বিভিন্ন ধরনের আগাছা দমনে একটা বড় ধরনের অর্র্থ খরচ করতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে আগাছার বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও উক্ত ল্যাবে আমদানি ও রপ্তানির মাধ্যমে এক দেশ থেকে অন্য দেশে আগাছার বিস্তার রোধে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। আধুনিক মাইক্রোস্কোপ দ্বারা প্রাথমিকভাবে আগাছা শনাক্ত করা হবে। 
কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি : এ ল্যাবরেটরিতে কৃষিজাত পণ্য যেমন-ফলমূল ও শাকসবজির কেমিক্যাল, মাইক্রো পুষ্টি বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন ভারী ধাতুর উপস্থিতি এবং পরিমাণগত মান পরীক্ষা করা হবে। প্রোটিন বিশ্লেষণের জন্য জেলডাল এবং প্রোটিন (দহন প্রকার) ব্যবহার করা হবে। এ ছাড়াও আর্দ্রতা, প্রোটিন, চর্বি, ফাইবার, এ্যাশ ইত্যাদির নমুনা দ্রুত পরীক্ষা করা হবে। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে, যা শাকসবজি, ফলমূল, মাটি, সার, এবং সেচের পানির নমুনায় আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, লেড ও মার্করি এর মতো ক্ষতিকারক ভারি ধাতু শনাক্তকরণে ব্যবহার করা হবে।
টক্সিকোলজি ল্যাবরেটরি : টক্সিকোলজি হলো গবেষণাগারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এ ল্যাবরেটরিতে কৃষি সংশ্লিষ্ট যেমন- শাকসবজি, ফলমূল, মাটি, সার, সেচের পানি ইত্যাদির নমুনা পরীক্ষা করে নমুনা থেকে কীটনাশক, রাসায়নিক উপাদান, মাইকোটক্সিন, বিভিন্ন কীটনাশকের সক্রিয় উপাদান, এন্টিবায়োটিক, স্টোরয়েড হরমোন, আফলাটক্সিন (ই১, ই২, এ১ ্ এ২) শনাক্ত করা হবে। 
 

লেখক : ১ উপ-পরিচালক (এল.আর), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ২উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজ, শ্যামপুর, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১১১৭৪৩৪৫, ই-মেইল :ashamim.uni@gmail.com

বিস্তারিত
চীনাবাদামের-গুরুত্ব-ও-খরিফ-২-মৌসুমে-চাষাবাদ-পদ্ধতি

চীনাবাদামের গুরুত্ব ও খরিফ-২ 
মৌসুমে চাষাবাদ পদ্ধতি
ড. এম. মনজুরুল আলম ম-ল
বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টি স্বল্পতা দূর করতে, মাটির হারানো উর্বরাশক্তি ফিরে পেতে, মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে এবং দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে চীনাবাদাম চাষের গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের খাদ্য তালিকায় আমিষের উৎস হিসেবে চীনাবাদাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনাবাদাম ভোজ্যতেল, প্রোটিন ও ভিটামিন ও মিনারেল এর  ভালো উৎস। চিনাবাদাম হল ভোজ্যতেল এবং খাদ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস কারণ কার্নেল তেল (৪৮-৫০%) এবং প্রোটিন (২৫-২৮%) সমৃদ্ধ এবং বিভিন্ন ভিটামিন, খনিজ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উৎস। ফাইবার সমৃদ্ধ চীনাবাদাম খেলে হজমশক্তিও উন্নত হয়। এছাড়া ওজন নিয়ন্ত্রণে এবং রক্তে শর্করাকে কম রাখতে সাহায্য করে এই বাদাম। চীনাবাদামে নিয়াসিন (ভিটামিন বি৩), ফোলেট (ভিটামিন বি৯) এবং ভিটামিন ই, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস এবং পটাশিয়ামের মতো খনিজ পদার্থ রয়েছে। বাদাম খাওয়া শরীরের জন্য জরুরি।
এর তেল প্রসাধনীর উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। চীনাবাদাম থেকে পাওয়া তেল ভোজ্য ও লুব্রিকেন্ট হিসেবে, তেলের কেক পশুখাদ্য এবং জৈবসার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। চীনাবাদামের খোসা সক্রিয় কার্বন তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।  চীনাবাদাম চাষে জমিতে নাইট্রোজেন বাড়ে হেক্টর প্রতি প্রতি ৪০-৫০ কেজি। সুতরাং শস্যপর্যায়ে চীনাবাদাম চাষ জমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তেল জাতীয় ফসলের মধ্যে একমাত্র চীনাবাদাম বালুময় চর এলাকায় সবচেয়ে ভাল ফলন দেয়। চীনাবাদাম চাষাবাদে খরচ অন্যান্য তেল ফসলের চেয়ে অনেক কম। দেশের নদী তীরবর্তী অঞ্চল এবং সমুদ্রতীরবর্তী এলাকার চরসমূহের ২ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর জমি ৪-৫ মাস অনাবাদি থাকে। চীনাবাদাম খরা সহিষ্ণু ফসল বিধায়  চীনাবাদাম ফসল চাষাবাদে সাধারণত সেচের প্রয়োজন হয় না। এবং সহজেই এ সকল পতিত জমিতে চীনাবাদাম চাষাবাদ করে কৃষক অর্থনৈতিক লাভবান হবে। এছাড়া পাট কাটার পর অধিকাংশ জমি রবি ফসল চাষ পর্যন্ত পতিত থাকে। এবং এ সমস্ত পতিত জমিতে সহজেই চীনাবাদাম চাষ করা সম্ভব। এছাড়া চীনাবাদামের বাজারমূল্য অন্যান্য যে কোন তেল ফসরের চেয়ে বাজার মূল্য বেশি (১৩০-১৫০ টাকা/কেজি), ফলে কৃষক চীনাবাদামের চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে বেশি লাভবান হবেন। এছাড়া চীনাবাদাম খেলে হজমেও সমস্যা হয় না। 
চীনাবাদামের উন্নত জাতসমূহ 
বর্তমানে বাংলাদেশে যা চীনাবাদাম উৎপাদিত হয় তা চাহিদার এক তৃতীয়াংশ মাত্র। এ চাহিদাকে সামনে রেখে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বেশ কিছু উচ্চফলনশীল বাদামের জাত উদ্ভাবন করেছেন যা প্রচলিত জাত থেকে ফলন বেশি এবং জীবনকাল প্রচলিত জাতের চেয়ে কম। এ যাবত বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট ১১টি ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট ১১টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। তন্মধ্যে বারিচীনাবাদাম-৮ এবং বিনাচীনাবাদাম-৪ ও ৮ সবচেয়ে জনপ্রিয় জাত। তবে জাত দুইটি অনেক পুরাতন জাত, ফলে পোকা ও রোগ বালাইয়ের আক্রমণ বেশি হচ্ছে বিধায় কৃষিবিদগণ অধুনা উদ্ভাবিত স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন উচ্চফলনশীন জাত বারিচীনাবাদাম-১০ ও ১১ এবং বিনাচীনাবাদাম-১০ ও ১১ চাষ করার পরামর্শ দিচ্ছেন। নি¤েœ উচ্চফলনশীল বাদামের জাতগুলোর বৈশিষ্ট্য উলে¬খ করা হলো যাতে কৃষক ও মাঠপর্যায়ের   কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী অঞ্চলভেদে সঠিক বাদামের জাতটি বেছে নিতে পারে।
বারি চীনাবাদাম-৫ : মাঝারি উঁচু গাছ (উচ্চতা ৩৫-৪০ সেমি.)। গাছ খাড়া এবং গুচ্ছাকার, পাতার রং হালকা সবুজ। ১০০ বীজের ওজন ৪৮-৫০ গ্রাম। বীজে তেলের পরিমাণ ৫১% এবং আমিষের পরিমাণ ২৬%। খরিফ-২ মৌসুমে  জীবনকাল ১১৫-১২৫ দিন এবং ফলন ২.২৫ টন/হেক্টর।
বারি চীনাবাদাম-৮ : মাঝারি উঁচু গাছ (উচ্চতা ৩৫-৪২ সেমি.)। গাছ খাঁড়া এবং গুচ্ছাকার, পাতার রং হালকা সবুজ। ১০০ বীজের ওজন ৫৫-৬০ গ্রাম। বাদামের খোসা মসৃণ ও কিছুটা সাদাটে। বীজে তেলের পরিমাণ ৫০% এবং আমিষের পরিমাণ ২৬%। খরিফ-২ মৌসুমে জীবনকাল ১২৫-১৪০ দিন এবং ফলন ২.২০ টন/হেক্টর।
বারি চীনাবাদাম-১০ : গাছের উচ্চতা মাঝারি (৪০-৪৫ সে.মি.)। এ জাতটি চরাঞ্চলে চাষাবাদের জন্য খুবই উপযোগী। প্রতি ১০০ বাদামের ওজন ৪০-৪৫ গ্রাম। জাতটি স্বল্প মাত্রায় খরা ও রোগ সহনশীল এবং জীবনকাল: খরিফ মৌসুমে ১২০-১৩০ দিন। ফলন: খরিফ মৌসুমে ১.৮০-২.০০ টন/হেক্টর।
বারি চীনাবাদাম-১১ :  প্রায় প্রতিটি বাদামে ৩-৪ টি বীজ থাকে এবং বীজের রং লালচে। বাদামের আকার বড় এবং ১০০ বাদামের (খোসা ছাড়া) ওজন ৫০-৫৫ গ্রাম। জীবনকাল খরিপ-২ মৌসুমে ১০৮-১১২ দিন। বাদামের খোসা মসৃণ এবং সাদাটে ও লম্বা। গাছের উচ্চতা খরিপ-২ মৌসুমে ১০২-১১০ সেমি.। পাতার রং গাঢ় সবুজ এবং কা-ের রং গাঢ় লালচে। প্রতি গাছে বাদামের সংখ্যা ১৭-২০ টি। শতকরা সেলিং হার ৭০-৭২ ভাগ। বাদামগুলো থোকায় থোকায় জন্মে। ফলন: খরিফ মৌসুমে ২.০০-২.২০ টন/হেক্টর।
বিনা চীনাবাদাম-৪ : প্রায় সব বাদামগুলো গাছের গোড়ায় একসাথে গুচ্ছাকারে থাকে। দানা মাঝারি। বীজে তেলের পরিমাণ ৪৯% এবং আমিষের পরিমাণ ২৭.৫%। খরিফ-২ মৌসুমে জীবনকাল ১১০-১২০ দিন এবং ফলন ২.৪০ টন/হেক্টর।
বিনা চীনাবাদাম-৮ : লবণ সহিষ্ণু (৮ ডিএস/মি.)। বীজের আকার বড়। দানা মধ্যম আকারের (১০০ দানার ওজন ২৯-৩০ গ্রাম), পডে দানার হার ৭৫-৭৭ %।  বীজে আমিষ ও তেলের পরিমাণ যথাক্রমে ২৮.১ ও ৪৬.৯%। খরিফ-২ জীবনকাল ১২০-১৩০ দিন। কলার রট ও মরিচা রোগ রোগ সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন ও জ্যাসিড, পাতা মোড়ানো ও বিছা পোকার আক্রমণ সহ্য ক্ষমতা বেশি। ফলন খরিফ-২ মৌসুমে ১.৯০-২.১০ টন/হেক্টর।
বিনা চীনাবাদাম-১০ : গাছ একটু লম্বাটে (৬৫-৭৬ সেমি.) এবং পাতার রং ফ্যাকাশে সবুজ রঙের। প্রায় সব বাদামগুলো গাছের গোড়ায় একসাথে গুচ্ছাকারে থাকে। দানা মাঝারি এবং তামাটে লাল রঙের। ফলে দানার পরিমাণ ৮০%। বীজে তেলের পরিমাণ ৫০.৫% এবং আমিষের পরিমাণ ২৮%। খরিফ-২ মৌসুমে জীবনকাল ১১০-১২০ দিন এবং ফলন ২.২০ টন/হেক্টর।
বিনা চীনাবাদাম-১১ : লবণ সহিষ্ণু (৮ ডিএস/মি.)। পাহাড়ি এলাকায় চাষ উপযোগী। দানা মাঝারি এবং গাঢ় লাল রঙের। গাছ খাট (৫৫-৬০ সেমি.)। প্রায় সব বাদামগুলো গাছের গোড়ায় একসাথে গুচ্ছাকারে থাকে। দানা মাঝারি বড় এবং তামাটে লাল রঙের। ফলে দানার পরিমাণ ৮০%। আমিষের পরিমাণ ২৭.৫%। খরিফ-২ মৌসুমে জীবনকাল ১১০-১১৫ দিন এবং ফলন ২.৩০ টন/হেক্টর।
বপন সময় : খরিফ-২ মৌসুমে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (আষাঢ়-আশ্বিন) পর্যন্ত বীজ বপন করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
চাষ উপযোগী জমি : বেলে, বেলে, দো-আঁশ ও এটেল দো-আঁশ মাটিতে অধিক ফলন পাওয়া যায়। শুষ্ক জমি বাদাম চাষের জন্য বেশ উপযোগী।
জমি তৈরি, বপন পদ্ধতি ও বীজের পরিমাণ : তিন-চারটি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হয়। শেষ চাষের সময় নির্ধারিত পরিমাণ সার দিয়ে চাষ ও মই দিতে হবে। বীজ সারিতে বপন করতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ১২ ইঞ্চি (৩০ সেমি.) এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৬ ইঞ্চি (১৫ সেমি.) রাখতে হবে। বীজগুলো ১.০-১.৫ ইঞ্চি মাটির নিচে পুতে দিতে হবে। হেক্টর প্রতি ১০০-১২০ কেজি (বিঘা প্রতি ১৫-১৭ কেজি) বীজের (খোসাসহ) প্রয়োজন হয়। বর্ষাকালে যাতে জমিতে পানি আটকে না থাকে, সেজন্য জমিতে ৪-৫ মিটার পরপর নালা করতে হবে। 
বীজ শোধন : বীজ শোধন করে নিয়ে বপন করলে ভাল হয়। প্রতি কেজি বীজের জন্য ২.৫ গ্রাম প্রোভেক্স/ অটোস্টিন/নোয়িন নামক বীজ শোধনকারী ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে। শোধনকারী বীজ জমিতে বপন করলে চারা গজানোর হার বেড়ে যায়।
সার প্রয়োগ : জমির উর্বরতার উপর নির্ভর করে সারের মাত্রার তারতম্য হতে পারে। তবে সাধারণভাবে হেক্টরপ্রতি ৪০-৫০ কেজি ইউরিয়া (একরপ্রতি ১৭-১৮ কেজি),  ১০০-১৩০ কেজি টিএসপি,  এমওপি ও জিপসাম (একর প্রতি ৩৫-৪০ কেজি) এবং ৩-৪ কেজি  (একরপ্রতি ১.২-২.৫ গ্রাম) দস্তা সার প্রয়োগ করতে হয়। তবে বেলে মাটির ক্ষেত্রে বোরন ও মলিবডেনাম ১-১.৫ কেজি প্রতি হেক্টরে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। জমি উর্বর হলে ইউরিয়া অর্ধেক প্রয়োগ করতে হবে এবং দস্তা সার প্রয়োগের প্রয়োজন নেই। সকল প্রকার সার শেষ চাষের পূর্বে জমিতে ছিটেয়ে প্রয়োগ করতে হবে। অন্যদিকে জীবাণূসার ব্যবহার করলে ইউরিয়া প্রয়োগের প্রয়োজন নাই (জীবাণুসার একর প্রতি ৩০০ গ্রাম)।
জীবাণুসার ব্যবহারের নিয়মাবলী : সুস্থ সতেজ ও শুকনা বীজে পরিমাণমত চিটাগুড় মিশিয়ে নিতে হবে। যাতে বীজগুলো আঠালো মনে হয় (চিটগুড়ের অভাবে ঠা-া ভাতের মাড় বা পানি ব্যবহার করা); আঠালো বীজগুলোর সংগে জীবাণুসার ভালভাবে মিশিয়ে নিবেন। যাতে প্রতিটি বীজে কালো প্রলেপ পড়ে যায়; কালো প্রলেপযুক্ত বীজ ছায়ায় সামান্য শুকিয়ে নিলে বীজগুলো গায়ে গায়ে লেগে থাকবে না; জীবাণুসার মিশ্রিত বীজ রৌদ্রহীন বা খুবই অল্প রৌদ্রে বপন করে বীজগুলো মাটি দিয়ে তাড়াতাড়ি ঢেকে দিতে হবে; ঠা-া, শুষ্ক, রোদমুক্ত জায়গায় জীবাণুসার এবং জীবাণুসার মিশ্রিত বীজ রাখতে হবে। জীবাণুসার উৎপাদনের ১৮০ দিনের মধ্যেই ব্যবহার করা  উত্তম।
আগাছা দমন : চারা গজানোর ২৫-৩০ দিন  পর নিড়ানী দিয়ে সতর্কতার সাথে হালকাভাবে আগাছা উঠিয়া ফেলতে হবে। শিকড়ে যেন কোন প্রকার আঘাত না লাগে সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার।
পানি সেচ : খরিফ-২ মৌসুমে চীনাবাদাম চাষে সেচ দেয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে বৃষ্টির পানি যাতে জমিতে জমে না থাকে সে ব্যবস্থা করতে হবে।  
পোকামাকড় দমন : জমিতে বাদাম লাগানোর পরপর পিপিঁলিকা আক্রমণ করে রোপিত বাদামের দানা খেয়ে ফেলতে পারে। এজন্য বাদাম লাগানো শেষ হলেই ক্ষেতের চারিদিকে সেভিন ডাস্ট ৬০ ডব্লিউপি ছিটিয়ি দিতে হবে। এছাড়া ক্ষেতের চারিদিকে লাইন টেনে কেরোসিন তেল দিয়েও পিপীলিকা দমন করা য়ায়। অনুরুপভাবে, উইপোকা চীনাবাদাম গাছের এবং বাদামের যথেষ্ট ক্ষতি করে থাকে। এরা বাদাম গাছের প্রধান শিকড় কেটে দেয় অথবা শিকড়ের ভিতর গর্ত তৈরি করে। ফলে গাছ মারা যায়। উইপোকা মাটির নিচের বাদামের খোসা ছিদ্র করে বীজ খায়। পানির সাথে কেরোসিন মিশিয়ে সেচ দিলে উইপোকা জমি ত্যাগ করে। অথবা উইপোকা দমনের জন্য ডায়াজিনন-১০ জি/বাসুডিন-১০ জি/ডারসবান-১০ জি যথাক্রমে হেক্টরপ্রতি ১৫, ১৪ ও ৭.৫ কেজি হারে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। বিছাপোকার আক্রমণের প্রথম অবস্থায় পাতার নিচে দলবদ্ধ বিছাগুলোকে হাত দিয়ে সংগ্রহ করে কোন কিছু দিয়ে পিষে মেরে ফেলতে হবে।
রোগ দমন : চীনাবাদামের পাতার দাগ এবং মরিচা রোগ বেশি হলে ২ গ্রাম ব্যাভিস্টিন-৫০ ডবি¬উপি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে জমিতে বিকালে স্প্রে করতে হবে। বপনের পূর্বে প্রতি কেজি বীজের জন্য ২.৫ গ্রাম প্রোভেক্স/অটোস্টিন/নোয়িন দ্বারা প্রতি কেজি বীজ শোধন করলে রোগের আত্রমণ কম হবে। মরিচা রোগ দেখা দিলে ফলিকুলার নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ১ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে।
ফসল সংগ্রহ, মাড়াই ও সংরক্ষণ : ভালো বীজ বা গুণগতমানের বীজ পেতে হলে ফসল যথাসময়ে উঠাতে হবে। ফসল সঠিক সময় তোলার জন্য ফসলের পরিপক্বতা সম্পর্কে যথাযথ ধারণা থাকা আবশ্যক। চীনাবাদাম বীজ খুবই স্পর্শকাতর বা সংবেদনশীল। যখন গাছের শতকরা ৮০-৯০ ভাগ বাদাম পরিপক্ব হবে তখনই চীনাবাদাম তোলার উপযুক্ত সময়। পরিপক্ব হলে বাদামের খোসার শিরা-উপশিরাগুলো স্পষ্টভাবে দেখা যায় এবং গাছের পাতাগুলো হলুদ রং ধারণ করে নিচের পাতা ঝড়ে পড়তে থাকে। বাদামের খোসা ভাঙ্গার পর খোসার ভিতরে সাদা কালচে রং ধারণ করলেই বুঝতে হবে ফসল উঠানোর উপযুক্ত সময় হয়েছে। পরিপক্ব হবার আগে বাদাম উঠালে তা ফল ও তেল কম হবে। আবার দেরীতে উঠালে বীজের সুপ্ততা না থাকার দরুন জমিতেই অংকুরিত হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। 
ক্ষেত থেকে তোলার পর বাদামের গায়ে লেগে থাকা মাটি বা বালু পরিষ্কার করতে হবে। তারপর আটিগুলো উপুর করে অর্থাৎ বাদামগুলো উপরের দিকে রেখে গাছের মাথা শুকনো মাটিতে বসিয়ে রৌদ্রে শুকাতে হবে। এতে করে বাদামের গায়ে লেগে থাকা পানি ঝড়ে যাবে। পরে গাছ থেকে বাদাম ছাড়িয়ে উজ্জ্বল রোদে দৈনিক ৭-৮ ঘণ্টা করে ৫-৬ দিন শুকাতে হবে। এ অবস্থায় বীজের আর্দ্রতা ৮-১০% হয়ে থাকে। এভাবে শুকানোর পর খোসাসহ বাদাম ঠা-া করে পলিথিন আচ্ছাদিত চটের বস্তায় মাচার উপর সংরক্ষণ করতে হবে।
সতর্কতা : এলাকায় উপযোগী জাত বাছাই করা, বপনের আগেই বীজের গজানোর হার পরীক্ষা করা, একই জমিতে বার বার চীনাবাদাম চাষ না করা। প্রয়োজনে এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা।

লেখক : চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ, মোবাইল: ০১৭১৬৭৪৯৪২৯, ই-মেইল :mmamondal@gmail.com 

বিস্তারিত
সঠিক-সময়ে-গাছ-রোপণ-ও-সংরক্ষণ

সঠিক সময়ে গাছ রোপণ ও সংরক্ষণ
কৃষিবিদ মো. বশিরুল ইসলাম
ছোট্টবেলা থেকে শুনে আসা একটা প্রবাদ বাক্য- অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। তেমনি অত্যধিক সূর্যালোক মাটির জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি চারার জন্যও ক্ষতিকর। বর্তমান পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ট্রেন্ডে গা ভাসিয়ে অনেকেই গাছের চারা রোপণ করছে। আমাদের বুঝতে হবে, গাছ লাগানো উপযুক্ত সময় কখন? কারণ আপনি যে গাছের চারাটা রোপণ করছেন তার পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে খাপখাইয়ে বেড়ে ওঠার জন্য উপযুক্ত আবহাওয়া প্রয়োজন। সাধারণত জুন, জুলাই ও আগস্ট মাস হচ্ছে গাছের চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। এ সময় আলো-বাতাস, অনুকূল তাপমাত্রা, বৃষ্টি পর্যাপ্ত থাকে বলে চারাও সুন্দরভাবে প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠে। 
বর্তমানে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকাল বিরাজ করছে। গ্রীষ্মে সূর্যের প্রখর তাবদাহে প্রকৃতি এক ভয়াল মূর্তি ধারণ করেছে। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকছে প্রায় প্রতিদিনই। এটা ঠিক যে, আবাসিক ও অনাবাসিক ভবনসহ ব্যাপক নির্মাণকাজে শহরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু শহরাঞ্চলে আবাদি জমি ও গাছপালা কমে যাওয়ায় বনায়ন ও বৃক্ষরোপণের সুযোগ নেই বললেই চলে। তবে, ছাদ-বাগান করে শহরের তাপমাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব। ছাদের বাগান বাইরের তাপমাত্রার চেয়ে ঘরের তাপমাত্রা প্রায় ১.৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাস করতে পারে। এমনটাই পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। ছাদ বাগানে ছাদের তাপমাত্রা ও ছাদ-বাগান বিহীন ছাদের তাপমাত্রার পার্থক্য প্রায় ৭.৮৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়। অব্যবহৃত ছাদে খুব সহজেই পরিকল্পিতভাবে ফুল, ফল ও শাকসবজির বাগান তৈরি করে পারিবারিক ফুল, ফল ও শাকসবজির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে।
যেসব গুণের কারণে আমাদের এ দেশকে সবুজ-শ্যামল বলা হতো তার কারণ চারদিকে ঘন গাছপালা আর সবুজের সমারোহ। এখন সেই সবুজ-শ্যামল রূপ খুব কমই চোখে পড়ে। গাছপালা ও ফসলি জমি ধ্বংসের কারণে পাখপাখালিও আগের মতো আর তেমন দেখা যায় না। গাছপালা কাটার ফলে পাখিদের আশ্রয়স্থলও কমে যাচ্ছে। অতিথি পাখির আগমনও সমীচীন হয়ে পড়েছে। প্রতিনিয়তই এভাবে গাছপালা কেটে উজাড় করতে থাকলে পাখিদের বংশবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এরকম পরিস্থিতিতে, পরিবেশ সুরক্ষায় সারা দেশে গাছ লাগানোর নির্দেশনা দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। বিশেষ করে সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় গাছ লাগাতে বলা হয়েছে।
এবারের গ্রীষ্মে আমরা যে প্রচ- তাপদাহে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছি, তার অন্যতম কারণ রেকর্ডসংখ্যক হারে গাছের পরিমাণ কমে যাওয়া! দুঃখের বিষয় হলো, প্রতি বছর গ্রীষ্মে যখন গরমে হাঁসফাঁস করতে থাকে মানুষ, তখনই বৃক্ষ নিধন নিয়ে বিলাপ, আর বেশি বেশি গাছ লাগানোর পরামর্শ চলতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বৃক্ষ রোপণের আন্দোলন চলে। আমরা জানি, সূর্যের প্রখর রোদ আর শুষ্ক গরম বাতাস থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়, আমাদের চারপাশটা গাছগাছালির সবুজে ভরিয়ে দেওয়া। তবে, এর অর্থ এই নাই যে, যখন তখন গাছ লাগিয়ে ভরিয়ে দিবো। এই তাপদাহ মধ্যে আপনি যদি গাছ লাগান সেই চারা গাছ বাঁচানো খুবই কষ্ট কর। কারণ প্রতিটি জীবই তার জীবন ধারণ ও সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য খাদ্য গ্রহন করে থাকে। উদ্ভিদের জীবন চক্র সম্পন্নের জন্য বিভিন্ন প্রকার খাদ্যের প্রয়োজন হয়। উদ্ভিদ মাটি ও বাতাস থেকে তার খাদ্যগ্রহণ করে থাকে।  মাটিতে অবস্থিত বিভিন্ন খাদ্য উপাদান পানির সাথে মিশে উদ্ভিদের গ্রহণ উপযোগী হয়। সাধারণত উদ্ভিদ মাটি থেকে মূল দ্বারা খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে এবং তা পাতার ক্লোরোফিলের দ্বারা সূর্যালোকের সাহায্যে নিজের খাদ্য তৈরি করে।
মনে রাখা প্রয়োজন, বৃক্ষের আবর্তন  কাল অনুযায়ী স্বল্পমেয়াদি (৫-১০ বছর), মধ্যমেয়াদি (১০-১৮ বছর) ও দীর্ঘমেয়াদি (১৮-৪০ বছর) বৃক্ষের প্রজাতি নির্বাচন করা প্রয়োজন। প্রজাতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেশি প্রজাতির চারা রোপণের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। যদি চারা নার্সারি থেকে সংগ্রহ করেন তাহলে উন্নত মানের চারা বাছাই করুন এবং দুর্বল ও রুগন্ চারা বাতিল করুন। বেশি বয়সের চারা রোপণ না করাই ভালো। মনে রাখবেন, বৈদ্যুতিক লাইনের নিচে বৃক্ষরোপণ করা উচিত নয়। উপযুক্ত মৌসুমে গাছের চারা রোপণের পাশাপাশি তাদের অনবরত পরিচর্যাও জরুরি। তা না হলে গাছের চারা টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব। অনেকে বাসার ছাদ এমনভাবে তৈরি করে নেন, যেন বাগান করতে সুবিধা হয়। নিজের বাসা হলে তো নিজের ইচ্ছামতো সাজিয়ে নেওয়া সম্ভব। তবে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই পানি দেওয়া ও ভালো নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও চারা রোপণের পর চারা টিকিয়ে রাখাই বড় কাজ। এ জন্য প্রথমেই গরু, ছাগল বা অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণীর হাত থেকে চারাকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে। চারা রোগাক্রান্ত হলে রোগ-বালাইনাশক প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে স্থানীয় বনকর্মী বা কৃষিকর্মীর পরামর্শ নিতে হবে। এই গরমের মধ্যে চারার গোড়ায় প্রয়োজনমাফিক পানি  দেয়ার বিষয়ে সচেতন হতে হবে। অপরদিকে চারাগাছে প্রয়োজনীয় সার দেওয়া জরুরি। সঠিকভাবে চারা বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত আলো-বাতাস। প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত আলো বাতাসে গাছ খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে। যেকোনো জাতের গাছের জন্য যা খুবই দরকারি। তাই বাড়িতে এমন স্থানে গাছ রাখুন, যেখানে নিয়মিত আলো-বাতাস মেলে। 
সুস্থ, সুন্দর ও বাসযোগ্য ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার জন্য যেকোনো দেশের আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। ৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী দেশের মোট আয়তনের ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ এলাকায় বনভূমি রয়েছে বলে জানিয়েছেন। এই তাপদাহে সহনীয় করতে চাইলে আমাদের বরং উচিত, নির্বিচারে বন নিধনের পরও এখনো যতখানি টিকে আছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিসংখ্যান ও মানচিত্র তৈরি করে সেগুলো সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার ও বর্ধনে জোর দেওয়া। বিভিন্ন এলাকায় এখনো পুরোনো ও বৃহৎ বৃক্ষ টিকে রয়েছে, সেগুলো সংরক্ষণে নজর দিতে হবে। বাড়াতে হবে জলাধার, উন্মুক্ত মাটি। সেই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব ভবন নির্মাণে দায়বদ্ধতা। আরও দরকার ব্যক্তিগত পরিবহন কমিয়ে গণপরিবহন এবং হাঁটার উপযোগী ফুটপাথ।
পরিবেশ রক্ষায় প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের দেশে বৃক্ষরাজি অনেক কম। তাই সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, যেমন- পরিবেশ মেলা, বৃক্ষমেলা, সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি, বসতবাড়ি বনায়ন কর্মসূচি, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, ফলদ-বনজ-ভেষজ বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম, ফলদ বৃক্ষমেলা। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠন থেকে বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। 
পরিবেশ সুরক্ষায় ২০১৯ সালে একদিনে এক কোটি ৩০ লাখ গাছ লাগিয়েছে তুরস্ক। এর মধ্যে এক ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃক্ষরোপণ বিচারে ইন্দোনেশিয়াকে হারিয়ে নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়েছে তারা। এর আগে ইন্দোনেশিয়া এক ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২ লাখ ৩২,৬৪৭টি চারা রোপণ করে রেকর্ড গড়েছিল। অন্যদিকে তুরস্ক এক ঘণ্টায় রোপণ করে ৩ লাখ ৩,১৫০টি চারা। জানা যায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া এক পোস্টের জেরে এ কর্মসূচি পালিত হয়। 
আসুন, আমরা এখন থেকে পরিবেশ দিবস উপলক্ষে বৃক্ষের চারা রোপণের জন্য পূর্বেই প্রস্তুতি গ্রহণ করি। কেননা এটিই সঠিক সময়। এরপর গাছটি কোথায় রোপণ করব সেই স্থানও নির্বাচন করে রাখি। এর ওপরই নির্ভর করবে আপনি কোন গাছ রোপণ করবেন। 

লেখক : উপপরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়, মোবাইল : ০১৩০৩-৭০৬৮২০, ইমেইল- mbashirpro1986@gmail.com

বিস্তারিত
পাহাড়িদের-খাদ্যে-বাঁশকোড়লের-ব্যবহার-টেকসই-করতে-করণীয়

পাহাড়িদের খাদ্যে বাঁশকোড়লের 
ব্যবহার টেকসই করতে করণীয়
  মো: কাওছারুল ইসলাম সিকদার
পার্বত্য অঞ্চল রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এ তিন জেলায় প্রায় ১৩টি উপজাতি রয়েছে। তারা একরকম বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যেই বসবাস করে আসছে। উপজাতিরা সাধারণত নীরবে নিভৃতে থাকতে পছন্দ করে। তারা স্বল্প পরিসরে বসবাস করে থাকলেও পারস্পরিক যোগাযোগের অভাবে এদের ভাষার সকীয়তা লক্ষণীয়। উপজাতিদের ভাষা স্বতন্ত্র হলেও খাদ্যাভ্যাস একই রকম। চাকমাসহ বেশ কয়েকটি উপজাতি এরি মধ্যে শহরকেন্দ্রিক হয়েছে এবং আধুনিক যোগাযোগ ও শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করে উন্নত জীবন যাপন করেছে। এদের খাদ্যাভ্যাসেরও পরিবর্তন হয়েছে। তবে যারা এখনো পাহাড়ে আদিম জীবন যাপন করে, তারা নিরাপদ ও বহুমুখী খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে কম অবগত। পাহাড়িদের খাবারে মসলার ব্যবহার খুবই কম, তবে মরিচের ব্যবহার একটু বেশি। ছুড়ি, হাঙ্গরসহ নানা হরেক রকমের শুঁটকিও পছন্দ। চিংড়ি ও শুঁটকি দ্বারা তৈরি নাপ্পি পাহাড়িদের খুব পছন্দ। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের সবজি, ভাজি, মাশরুম ও মাছের ভর্তা খাদ্যাভ্যাসের অন্তর্ভুক্ত। ঢেঁকিশাকও পাহাড়িদের পছন্দ। হালকা খাবার, সবজি সিদ্ধ যেমনি তারা খায় তেমনি ঝালযুক্ত মাছ, মাংসও খায়। পাহাড়িরা শুকরের মাংস, শামুক, ঝিনুক ও ছোট্ট মাছ খেয়ে থাকে। মসলাজাতীয় গাছ হলুদের ফুল যা পাহাড়িরা ভাজি করে খায়। শিমুল ফুলও তারা সবজি হিসেবে খেয়ে থাকে। এ ছাড়া কচি বাঁশের গোড়া যা ‘বাঁশকোড়াল’ নামে পরিচিত তা তাদের প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাস এর অন্তর্ভুক্ত। বাঁশকোড়ল সাধারণত ভাজি, সবজি ও ডালে প্রদান করা হয়। 
পাহাড়িদের প্রতিদিনের খাদ্যে বাঁশকোড়ল বিভিন্নভাবে থাকে। তাই বাঁশের কচি অংশ বা বাঁশকোড়ল স্থানীয় বাজারসমূহে প্রতিদিন ক্রয়-বিক্রয় হতে দেখা যায়। ভাজিতে বাঁশ, ডালের সাথে বাঁশ, তরকারিতে বাঁশ, সবজিতে বাঁশ ইত্যাদি বিভিন্ন খাবারে কচি বাঁশ প্রদান করা হয়। এ ছাড়া মাছ, মুরগী ও বিরিয়ানি রান্নায় বড় মোটা বাঁশ রান্নার পাত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চিকন বাঁশের চোঙ্গায় পর্যটকদের চা পান করতে দেওয়া হয়। পাহাড়ে বাঙালি পর্যটকদের গমন বাড়ছে। শীতে প্রচুর পর্যটক পাহাড়েই গমন করে এবং পাহাড়িদের প্রচলিত খাদ্য গ্রহণ করছে। তাই খাদ্যে প্রতিনিয়ত বাঁশকোড়লের ব্যবহার বাড়ছে। 
পাহাড়ে বাঁশের ব্যবহার বহুমুখী। বাঁশ দিয়ে ঘড়, মাচা, শাকো, বেড়া, উপকরণ তৈরি এবং  জ্বালানি শিল্প ও খাদ্যে ব্যবহার অন্যতম। পাহাড় হতে বাঁশ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রয় হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিনিয়ত বাঁশের ব্যবহার বাড়ছে কিন্তু জোগান কমছে। যেহেতু নতুন বাঁশ জন্মানোর সাথে সাথে তা কেটে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার ও বাণিজ্যিক ব্যবহার হচ্ছে, সে কারণে বাঁশের পাহাড়ি এলাকায় বাঁশের বংশবিস্তারে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে পাহাড়ে বাঁশের সংকট দেখা দিবে। বর্তমানে শহর বা গ্রামাঞ্চলে বাঁশের তৈরি তৈজসপত্রের ব্যবহার কমে গেলেও পাহাড়িরা এখনো বাঁশের তৈরি বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে। এ ছাড়া কাগজ উৎপাদন শিল্পে বাঁশের ব্যবহার ছিল। বর্তমানে এর সংকট চলছে তাই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর পক্ষে এই বাঁশের টেকসই উৎপাদন ও ব্যবহার সম্ভব হবে না। বাঁশের ব্যবহার টেকসই করতে হলে বাঁশের উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং এর ব্যবহার সীমিত করতে হবে। সেজন্য বাঁশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে এর বংশবিস্তার ও গবেষণায় জোড় দিতে হবে। বিশেষ করে টেকসই উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা নিমিত্তে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে এর বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সকল স্থানীয় প্রতিষ্ঠান, জনপ্রতিনিধি ও সর্বোপরি সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য স্থানীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং ভূমির ক্ষয়রোধ পাহাড় ধসা হ্রাসে স্থানীয় বাঁশের সংরক্ষণ এবং বংশবিস্তার করতে হবে। শিল্প, ভোগ ও অন্যান্য ব্যবহার বিবেচনা করে গবেষণায় উপযুক্ত বাঁশের জাত নির্বাচন করে চাহিদা অনুযায়ী বংশবিস্তারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শিল্প ভোগের জন্য পুষ্টি সমৃদ্ধ ও সুস্বাধু জাত, শিল্পের জন্য দ্রুত বর্ধনশীল এবং পারিবারিক ও অন্যান্য প্রয়োজনে উপযুক্ত বাঁশের জাত নির্বাচন অর্থাৎ প্রতিটি ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ উপযোগ পেতে বিশেষায়ন অত্যন্ত জরুরি। আর এই সকল উদ্দেশ্য পূরণের জন্য চাই পরিকল্পনা, গবেষণা, অংশীজনদের সহিত আলোচনা এবং তাদের প্রয়োজন পর্যালোচনা এবং লক্ষ্য অর্জনে প্রকল্প গ্রহণ করে টেকসই বাঁশ উৎপাদন ও চাহিদার ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। পাহাড়ি সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও ভোগ দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই করার লক্ষ্যে বাঁশের মূল তথা কচি বাঁশ বা বাঁশকোড়াল ক্রয়-বিক্রয় সীমিত হওয়া উচিত। এ বিষয়ে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা যদি ব্যাপকভাবে জনসচেতনতা তৈরি করতে পারেন তবেই বাঁশের টেকসই উৎপাদন ও ব্যবহার সম্ভব হবে। পাহাড়িদের মেনুতে বাঁশকোড়ল দীর্ঘস্থায়ী হবে। 
গ্রামীণ উপজাতিদের নিরাপদ খাদ্যাভ্যাসের চর্চার অভাব রয়েছে। অসচেতনতা, অশিক্ষা ও আর্থিক অসঙ্গতি প্রভৃতির কারণে উপজাতীদের মধ্যে এসব সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা যায়। নিরাপদ খাদ্যাভ্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হলো ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপদ পানি। অসচেতনতা, অশিক্ষা ও আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে নিয়মিত গোসল, হাত ধোয়া, সাবান ব্যবহার, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন  কাপড় পরিধান, চুল ও নখ কাটা ইত্যাদি ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মানা হয় না। এ ছাড়া অধিকাংশ উপজাতি বন্যপ্রাণী শুকর, কুকুর, বিড়ালসহ অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণী লালন করে। এসকল প্রাণীর স্পর্শ পরবর্তী যে স্বাস্থ্যবিধি মানা উচিত তাও যথাযথাভাবে পালন করা হয় না। ফলে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন এবং নিরাপদ খাবার গ্রহণ তাদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়ে। শীত মৌসুমে নিরাপদ পানির প্রাপ্যতা কম থাকে। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সর্বত্র নিরাপদ পানি পৌঁছানো সম্ভব হয় না। আর নিরাপদ পানির প্রাপ্যতা পর্যাপ্ত না থাকায় গৃহস্থালি উপকরণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, খাবার উপকরণ যথাযথভাবে পর্যাপ্ত পানি দিয়ে ধুয়ে রান্না করা ও রান্না পরবর্তী ধোয়ার কার্যক্রম সম্ভব হয় না। খাদ্য নিরাপদতার স্বার্থে খাদ্য উৎপাদন হতে শুরু করে খাদ্য গ্রহণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে হয়। এজন্য পারিবারিক শিক্ষা ও আর্থিক সঙ্গতির মাধ্যমে অধিকাংশ গ্রামীণ উপজাতিদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

লেখক : উপসচিব, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। মোবাইল : ০১৫৫২৩৫৫৮৫৩, ই-মেইল : kawserul 1173@gmail.com

বিস্তারিত
বাণিজ্যিক-ব্রয়লার-ও-লেয়ার-মুরগির-ধকল-ব্যবস্থাপনা

বাণিজ্যিক ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির 
ধকল ব্যবস্থাপনা
মোঃ শাহরিয়ার হায়দার১, ড. মোঃ আব্দুল মালেক২ 
বাংলাদেশে প্রাণিজ আমিষের সহজলভ্য ও সুলভ উৎস হলো পোল্ট্রি খাতভুক্ত মুরগি হতে প্রাপ্ত ডিম ও মাংস। উৎপাদিত মাংসের শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ মুরগি পালন উপখাত হতে সরবরাহ হয়ে থাকে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মুরগি পালন প্রযুক্তির সম্প্রসারণে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করছে। এক্ষেত্রে, সম্প্রসারিত প্রযুক্তির আওতায় জীব-নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মুরগির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে প্রযোজ্য সহায়ক পরিবেশের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এরূপ সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে মুরগিতে বিভিন্ন ধরনের ধকল সৃষ্টিকারী নিয়মকসমূহ প্রতিরোধে বিভিন্ন ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এ পর্যায়ে মুরগিতে বিভিন্ন ধরনের ধকল এবং তাপ ধকল এর বিষয়ে আলোচনা করা হলো :
ধকল
ধকল এমন একটি পরিবর্তিত অবস্থা/পরিস্থীতি যেমন- অধিক তাপ, ভীতি ইত্যাদি যার সাথে খাপখাওয়ানোর জন্য প্রাণীকে তার স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ও আচরণগত বহিঃপ্রকাশের পরিবর্তে অস্বাভাবিকতা প্রদর্শন করতে বাধ্য হয়। পোল্ট্রি বিশেষত বাণিজ্যিক লেয়ার ও ব্রয়লার মুরগিতে ধকলের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের ধকল
প্রাণীতে প্রভাব বিস্তারকারী ধকলসমূহ যেমন- সামাজিক; শারীরবৃত্তীয়; মানসিক ইত্যাদি। ধকলের কারণ হতে পারে বিভিন্ন রকম। যেমন : শিকারী প্রাণী (তুলনামূলক বৃহৎ প্রাণী); রোগের সংক্রমণ; তাপমাত্রার পরিবর্তন; প্রজনন; স্থানান্তর বা পরিবহন; টিকা, কৃমিনাশক ও চিকিৎসা প্রদান; পুষ্টিগত; শব্দ; পরিবেশগত; প্রাণী প্রদর্শনী ইত্যাদি
উল্লেখ্য, বাণিজ্যিক মুরগি যেমন- লেয়ার, ব্রয়লার ইত্যাদিতে উপর্যুক্ত ধকলসমূহের মধ্যে তাপমাত্রার পরিবর্তনজনিত ধকলের প্রভাব মারাত্মকভাবে পরিলক্ষিত হয়। 
বাংলাদেশে মার্চ মাস হতে অক্টোবর মাস পর্যন্ত গরম তথা উষ্ণতার তীব্রতা পরিলক্ষিত হয়। এই সময়ই মূলত পোল্ট্রি তথা মুরগিতে তাপ ধকলের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
মুরগির সুস্থ থাকা এবং তা হতে অধিক উৎপাদন পেতে পরিবেশের তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখা আবশ্যক। এক্ষেত্রে, নির্দেশিত তাপমাত্রা হলো ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
মুরগিতে তাপ ধকলের দুই ধরনের প্রভাব যথা ক) প্রত্যক্ষ বা দৃশমান প্রভাব এবং খ) পরোক্ষ বা অদৃশ্য বা শারীরবৃত্তীয় প্রভাব পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। 
প্রত্যক্ষ বা দৃশমান প্রভাব : প্রত্যক্ষ প্রভাবসমূহ যেমন - মুরগি হাঁ করে নি:শ্বাস নিতে ও হাঁপাতে পারে এবং হিট স্ট্রোক এ মারা যেতে পারে; দৈহিক ওজন ও দৈহিক বৃদ্ধিও হার হ্রাস পেতে পারে মাংসের গুণগতমান হ্রাস পেতে পারে; খাদ্য রূপান্তরের হার হ্রাস পায় যা আর্থিক ক্ষতির কারণ; পাখা ঝুলে যেতে পারে;পানি গ্রহণ বেড়ে যেতে পারে; ক্ষুধামন্দা দেখা দিতে পারে; মুরগিতে অসাড়তা, স্নায়ুবিক ভারসাম্যহীনতা ও খিচুনি দেখা দিতে পারে; মুরগির বিষ্ঠায় পানির পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে এবং পানি শূন্যতা দেখা দিতে পারে; অলসতা প্রদর্শন করতে পারে ও ঝিমাতে পারে; আক্রমণাত্মক আচরণ প্রদর্শন করতে পারে; মারামারি করতে পারে; ঠোকরাঠুকরি করতে পারে; দৈহিক ওজন ও দৈহিক বৃদ্ধির হার হ্রাস পেতে পারে মাংসের গুণগতমান হ্রাস পেতে পারে; খাদ্য রূপান্তরের হার হ্রাস পায়, যা আর্থিক ক্ষতির কারণ; মুরগির চামড়ায় রক্ত জমার কারণে কালচে দেখাতে পারে; পালকের রং বিবর্ণ ও চামড়া রুক্ষ হতে পারে; ডিম উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে; ডিমের আকার ছোট হতে পারে; ডিমের খোসা পাতলা হতে পারে; বাচ্চা ফোটানোর জন্য উৎপাদিত ডিমের উর্বরতা হ্রাস পেতে পারে; প্যারেন্টস্টক মুরগির উর্বরতা হ্রাস পেতে পারে ইত্যাদি।
পরোক্ষ বা অদৃশ্য বা শারীরবৃত্তীয় প্রভাব : পরোক্ষ প্রভাবসমূহ যেমন : রক্তের প্লাজমা রসের পিএইচ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যেতে পারে; কোষের পিএইচ স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যেতে পারে; খনিজ লবণের শোষণ কমে যেতে পারে; ইলেকট্রলাইট-এর ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে; রক্তে স্ট্রেস হরমোনের উপস্থিতি দেখা দিতে পারে; তাপ ধকল সংক্রান্ত প্রোটিন সক্রিয় হয়ে মেটাবলিজম বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে তাপসহনশীল টিস্যুকে রক্ষা করে; রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়।
পোল্ট্রি তথা মুরগিতে তাপ ধকলের প্রভাবের কারণ : বিশ্বের অধিকাংশ প্রাণী তার শরীরের তাপের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে শরীরে উৎপাদিত প্রয়োজনের অতিরিক্ত তাপ ৪টি পদ্ধতিতে যেমন : বিকিরণ, পরিচলন, পরিবহন ও বাষ্পীভবন শরীর থেকে বের করে দেয় বা প্রশমিত করে। কিন্তু পোল্ট্রি তথা মুরগির শরীরে ঘর্মগ্রন্থি না থাকায় বাষ্পীভবন ব্যতীত বর্ণিত ৩টি পদ্ধতিতে তারা শরীরে উৎপাদিত অতিরিক্ত তাপ বের করে দেয়। এর ফলে মুরগি তার শরীরে উৎপাদিত অতিরিক্ত তাপ হাঁ করে নি:শ্বাসের মাধ্যমে বের করে দেয়। এক্ষেত্রে, অধিক আর্দ্রতার পাশাপাশি পরিবেশের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে সেসময় মুরগি তার শরীরের তাপের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে হাঁ করে নি:শ্বাসের মাধ্যমে অধিক হারে তাপ প্রশমনে ব্যর্থ হলে মুরগিতে হিট স্ট্রোক হয় এবং মুরগি মারা যায়। উল্লেখ্য, শরীরে তাপের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে বাষ্পীভবন পদ্ধতি বিশেষ কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 
তাপ ধকল প্রতিরোধে করণীয় : পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত ঘরে মুরগিতে তাপ ধকল হয় না বললেই চলে। তবে উন্মুক্ত ঘরে বাণিজ্যিক মুরগি পালনে তাপ ধকলের দৃশমান প্রভাব রয়েছে। উন্মুক্ত ঘরে বাণিজ্যিক মুরগিকে তাপ ধকলের প্রভাবমুক্ত রাখতে নি¤েœাক্ত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে।
মুরগির জাত নির্বাচন : মাংস উৎপাদনের জন্য দেশের বিভিন্ন ধরনের দেশি মুরগি যেমন : কমন নেটিভ, গলাছিলা, হিলি ইত্যাদি সহ সংকরজাতের সোনালি মুরগি পালন করা যেতে পারে কারণ এদের তাপ সহ্য করার ক্ষমতা বেশি। সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু কোম্পানি যেমন : তাপসহনশীল বাণিজ্যিক ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা যেমন : বাউ মুরগি ইত্যাদি বাজারজাত করছে সেগুলোও পালন করা যেতে পারে। একইভাবে জাত বিবেচনায় লেয়ার মুরগির বাচ্চা নির্বাচন করে পালন করা যেতে পারে। 
আবাসন ও বায়ু প্রবাহ : শেড নির্মাণের জন্য নির্বাচিত স্থানটি উঁচু ও উত্তম বায়ু চলাচল সম্পন্ন হওয়া জরুরি। শেডটির দৈর্ঘ্য পূর্ব-পশ্চিম বরাবর নির্মাণ করতে হবে। সঠিক বায়ু প্রবাহের জন্য শেডের উত্তর-দক্ষিণ পার্শ্বে দেয়াল নেট দ্বারা নির্মিত হওয়া আবশ্যক। শেডের মেঝে মাচা বা মাচা কাম ফ্লোর প্রকৃতির হওয়া বাঞ্ছনীয়। শেডের ছাদটি মনিটর বা সেমি. মনিটর টাইপ মডেলে তৈরি করা যেতে পারে। এর পাশাপাশি ছাদ নির্মাণে টিন ব্যবহার না করে অ্যাসবেস্টস ব্যবহার করা যেতে পারে। শেডের আকার বিবেচনায় ফ্যান দেয়া অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়াও ছাদের নিচের অংশে তাপ নিরোধক ইনসুলেটর দেয়া যেতে পারে। বর্ণিত বিষয়সমূহ নিশ্চিত করলে শেডে মুরগির জন্য সহনীয় তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বজায় রাখা সম্ভব হবে। দিনের মধ্যভাগ অর্থাৎ সকাল ১১টা হতে বিকাল ৪টা পর্যন্ত পানিতে স্যালাইন, ভিটামিন-সি, প্রাকৃতিক বিটেইন ইত্যাদি প্রদান করা যেতে পারে। ভিটামিন-সি পাউডার পাওয়া না গেলে লেবুর রস ব্যবহার করা যেতে পারে।
দিনের বেলা শেডের যে পার্শ্ব দিয়ে সূর্যের আলো প্রবেশ করে সে পার্শ্বে পর্দা ঝুলিয়ে/নামিয়ে দেয়া। অত্যধিক গরমকালীন সময়ে শেডে মুরগির ঘনত্ব বা সংখ্যা বেশি থাকলে, কিছু সংখ্যাক মুরগিকে সম্ভাব্যতা বিবেচনায় অন্য সেডে স্থানান্তর করা যেতে পারে। সোনালি মুরগি বা লেয়ার মুরগির ক্ষেত্রে শেডের ভেতর কিছু সংখ্যাক পার্চ/বাঁশ ঝুলিয়ে দেয়া যেতে পারে। মুরগির উপর ৪-৫ ফুট উচ্চতা হতে পানি স্প্রে করা যেতে পারে। উল্লেখ্য সরাসরি মুরগিতে স্প্রে না করাই উত্তম। শেডের ছাদ টিন দ্বারা নির্মিত হলে তাতে ভেজা চটের বস্তা দিয়ে ঢেকে দেয়া যেতে পারে।
মুরগির ঘনত্ব : শেডের আকার বিবেচনায় মুরগির নির্দিষ্ট জাত অনুযায়ী নির্দেশিত সংখ্যাক মুরগি পালন করতে হবে। মুরগির সংখ্যা বেশি হলে তাপ ধকলের প্রভাব বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 
খাদ্য ও পানি ব্যবস্থাপনা : দিনের উষ্ণতম সময়ে খাদ্য প্রদান না করে শীতলতম সময়ে অর্থাৎ সকাল বেলা ও বিকেল বা সন্ধ্যাবেলা খাদ্য প্রদান করলে মুরগিতে তাপ ধকলের প্রভাব কম পরিলক্ষিত হবে। উক্ত সময় খাদ্যের পাত্র খাদ্য দ্বারা পরিপূর্ণ রাখতে হবে। লেয়ার মুরগির ক্ষেত্রে খাদ্যের সাথে সোডিয়াম বাইকার্বনেট নির্দেশিত মাত্রায় মিশ্রিত করে খাওয়ানো যেতে পারে। পাশাপাশি খামারে সার্বক্ষণিক সুপেয় পানির সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। খামারে ন্যূনতম ৫-৬ বার পানি পরিবর্তন করে দেয়া আবশ্যক হবে।
 
লেখক : ১ব্যবস্থাপক, ২মহাব্যবস্থাপক, সমন্বিত কৃষি ইউনিট, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন, (পিকেএসএফ), আগারগাঁও, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭৪৫৬৬৮৮৫৫  
 

 

বিস্তারিত
ব্রি-হাইব্রিড-ধান-৮-ফলনে-করেছে-বাজিমাত

ব্রি হাইব্রিড ধান৮ ফলনে করেছে বাজিমাত
কৃষিবিদ ড. এম আব্দুল মোমিন
ব্রি উদ্ভাবিত বোরো মওসুমের নতুন হাইব্রিড ধানের জাত ব্রি হাইব্রিড ধান৮ প্রথম বছরেই সারাদেশে ফলনে কৃষকের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে। চলতি বোরো মওসুমে হাইব্রিড ধানের ফলনের ধারনা বদলে দিয়েছে এই জাতটি। কৃষকরা বলছেন এই জাত ফলনের দিক থেকে বাজিমাত করেছে। সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া গেছে কুমিল্লার দেবীদ্বারে ১২.৭ টন/হেক্টর যেখানে ব্রি’র বিজ্ঞানী, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বিএডিসির প্রতিনিধির উপস্থিতিতে কয়েকবার ফলন যাচাই করা হয়। ব্রি হাইব্রিড ধান৮ স্বল্প মেয়াদী ও অধিক ফলনশীল হাইব্রিড ধানের জাত। এই জাতটি ২০২২ সালে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুর অঞ্চলে কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদের জন্য জাতীয় বীজ বোর্ড এর ১০৮তম সভায় অবমুক্ত হয়। 
বাংলাদেশ সরকার কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদের জন্য ১৯৯৮-২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৩৮টি হাইব্রিড ধানের জাত বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সীর মাধ্যমে জাত হিসাবে অবমুক্ত করেছে। এসব জাতগুলোর ৬২% চীন, ২৭% ইন্ডিয়া ও ১১% বাংলাদেশ থেকে উদ্ভাবিত। মওসুম হিসাবে ধরলে বোরো মওসুমের জন্য ২০২টি, আমন মওসুমের জন্য ২৯টি এবং আউশ মওসুমের জন্য ৭টি হাইব্রিড ধানের জাত কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদের জন্য অবমুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ফলনের দিক থেকে সেরা জাত ব্রি হাইব্রিড ধান৮। প্রতি হেক্টরে জাতটির গড় ফলন ১০.৫-১১.০ টন। এই জাতের গাছের গড় উচ্চতা ১১০-১১৫ সে. মি। কান্ড শক্ত বিধায় গাছ ঢলে পড়েনা। স্বাভাবিক অবস্থায় গাছ প্রতি গুছির সংখ্যা ১০-১২ টি। ব্রি হাইব্রিড ধান৮ এর জীবনকাল ১৪৫-১৪৮ দিন। ধানের আকৃতি লম্বা চিকন। ১০০০ টি পুষ্ট ধানের ওজন ২৪.৩ গ্রাম। ধানে অ্যামাইলোজ ও প্রোটিনের শতকরা পরিমাণ যথাক্রমে ২৩.৩ ও ৯.২ ভাগ।
ব্রি আঞ্চলিক কার্যালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে বাস্তবায়িত ফলাফল পরিদর্শন ট্রায়ালে কৃষকের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে ব্রি হাইব্রিড ধান৮। কুমিল্লা, রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরা, হবিগঞ্জ, কুষ্টিয়া, সোনাগাজী, কুড়িগ্রাম, গোপালগঞ্জ ও বাগেরহাট জেলায় স্থাপিত ফলন পরীক্ষার গড় ফলন ১০ টনের উপরে পাওয়া গেছে। ব্রি’র মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর স্যারের উপস্থিতিতে সাতক্ষীরার তালায় এক ক্রপকাট অনুষ্ঠিত হয় যেখানে ফলন পাওয়া গেছে ১২ টন/হেক্টর। কৃষক বলছেন এত ফলন আগে কখনও দেখেনি তারা এবং উপস্থিত সকল কৃষক আগামীতে ব্রি হাইব্রিড ধান৮ করতে প্রচন্ড আগ্রহ প্রকাশ করেন। 
কৃষক পর্যায়ে ফলন ও অন্যান্য যে কারণে ব্রি হাইব্রিড ধান৮ করতে উৎসাহী তা হলো-আশাতীত ফলন, দানা চিকন ও আর্কষনীয় সোনালী বর্ণের, গাছ খাটো ও শক্ত তাই ঢলে পড়ার সম্ভাবনা কম, ডিগপাতা খাড়া ও পাকা অবস্থায় সবুজ থাকে, জীবনকাল অন্য হাইব্রিড জাতের তুলনায় কম (১৪৪-১৪৭ দিন), রোগ-পোকামাকড়ের আক্রমণ কম এবং এটি খরা সহনশীল জাত।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গোপালগঞ্জ আঞ্চলিক প্রধান ও সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার ড. মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম জানান, চলতি বোরো মৌসুমে গোপালগঞ্জ জেলায় ২০ হেক্টর জমিতে ৫০টি প্রদর্শনী প্লটে ব্রি হাইব্রিড ৮ ধানের আবাদ করেন কৃষকরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, কৃষি বিজ্ঞানী,         কৃষক ও ব্রি পরিসংখ্যান বিভাগের কর্মকর্তার উপস্থিতিতেই প্রদর্শনী প্লট থেকে ধান কেটে মাড়াই ও পরিমাপ করা হয়। সেখানে হেক্টরপ্রতি সাড়ে ১০ টন ফলন পাওয়া গেছে। 
টুঙ্গিপাড়া উপজেলার কুশলী গ্রামের কৃষক নাজমুল মোল্লা, রমজান সরদার, জাহাঙ্গীর গাজী, আরিফ গাজী ও মিজান মোল্লা বলেন, তারা এর আগে হীরা হাইব্রিড ধান২, এসএল৮ সহ আরো অনেক জাতের হাইব্রিড ধানের আবাদ করেছেন। ওইসব জাতে হেক্টরে ৮ থেকে সাড়ে ৮ টন ফলন পেয়েছে। কিন্তু ব্রি হাইব্রিড ৮ ধান চাষাবাদ করে শতাংশে ১ মণের বেশি ফলন পেয়েছে। সে হিসাবে হেক্টরে এই ধান সাড়ে ১০ টন ফলন দিয়েছে। এ ধানের চাল লম্বা। ওজনও বেশি। প্রতিটি ছড়ায় ধানের পরিমাণও বেশি পেয়েছে। 
ব্রি হাইব্রিড রাইস বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান ড. জামিল হাসান জানান, নতুন উদ্ভাবিত ব্রি হাইব্রিড ধান৮ আমদানিকৃত হাইব্রিড ধানগুলোর চেয়ে ফলন ও অন্যান্য গুণাগুণে উৎকৃষ্ট বিধায় বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে এবং আমদানি নির্ভর হাইব্রিড ধানের বাজারে ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হবে ।

লেখক : ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, প্রশিক্ষণ বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। মোবাইল : ০১৭১৬৫৪০৩৮০, ই-মেইল : smmomin80@gmail.com

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর

প্রশ্নোত্তর

কৃষিবিদ ড. আকলিমা খাতুন

নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
রায়হান, উপজেলা : সুন্দরগঞ্জ, জেলা : গাইবান্ধা
প্রশ্ন : আমার ঝিঙা গাছের পাতার গায়ে সাদা বা হলদে থেকে বাদামি রং এর তালির মতো দাগ দেখা যাচ্ছে। অনেকটা মোজাইকের মতন, ধীরে ধীরে পুরো গাছের পাতায় ছড়িয়ে পড়ছে। করণীয় কী?
উত্তর : এটি ঝিঙার ডাউনি মিলডিউ রোগ। এটি (ঢ়ংবঁফড়ঢ়বৎবহড়ংঢ়ড়ৎধ ংঢ়) ছত্রাকের আক্রমণে হয়। এই রোগের আক্রমণে পাতার নিচের পৃষ্ঠে গোলাপী রং এর ছত্রাক দেখা যায়। এই রোগের আক্রমণ দেখা দিলে (ম্যানকোজেব+ মেটালঅক্সিল) গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন : পুটামিল বা রিডোমিল গোল্ড অথবা (ম্যানকোজেব+ ফেনামিডন) গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন : সিকিউর ২  গ্রাম/লিটার হারে অথবা সালফার গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন : কুমুলাস ২ কেজি/ হেক্টর বা ম্যাকভিট ২ মিলি./লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন অন্তর অন্তর ১-৩ বার শেষ বিকেলে স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করার ১৫ দিনের মধ্যে সেই সবজি খাওয়া বা বাজারে বিক্রি করা যাবে না।
মো: জাহিদ আলম, উপজেলা : বিরামপুর, জেলা : দিনাজপুর
প্রশ্ন : আমার কাঁঠাল গাছের শিকড় ও গুঁড়ি পোকা খেয়ে নষ্ট করে ফেলছে। করণীয় কী?
উত্তর : এটি কাঁঠালের উইপোকার আক্রমণে হয়ে থাকে। কাঁঠাল গাছে পোকা আক্রমণ দেখা দিলে ক্লোরোপাইরিফস গ্রুপের কীটনাশক ডার্সবান প্রতি লিটার পানিতে  ৫ মিলি মিশিয়ে গাছের গোড়ায় বা কা-ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার শেষ বিকেলে স্প্রে করতে হবে। এছাড়াও গাছের কা- ও গুঁড়ি থেকে উইপোকার মাটি পরিষ্কার করতে হবে এবং গাছের গোড়ার মাটি কুপিয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে।
শেখ ফরিদ, উপজেলা : ফুলবাড়ী, জেলা : কুড়িগ্রাম।
প্রশ্ন : আমার লাউ গাছের পাতার শিরা বাদে পূর্ণবয়স্ক পোকা ও কীড়া পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ফেলছে। আক্রান্ত পাতা শুকিয়ে মারা যাচ্ছে। করণীয় কী?
উত্তর : এটি লাউয়ের কাঁঠালে পোকার এর আক্রমণে হয়ে থাকে। এই পোকার আক্রমণ হলে ফেনিট্রোথিয়ন গ্রুপের কীটনাশক যেমন সুমিথিয়ন ২ মিলি/লিটার অথবা কার্বারিল গ্রুপের কীটনাশক সেভিন ২ গ্রাম/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার শেষ বিকেলে স্প্রে করতে হবে। এ ছাড়াও ক্ষেত সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে এবং পোকা সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে। স্প্রে করার ১৫ দিনের মধ্যে সেই গাছের সবজি খাওয়া বা বাজারে বিক্রি করা যাবে না।
মোমিন ইসলাম, উপজেলা : দেবীগঞ্জ, জেলা : পঞ্চগড়
প্রশ্ন : আমার পান গাছের পাতার শীর্ষে বা কিনারায় প্রথমে হলুদাভ বাদামি রঙের দাগ দেখা যায়। দাগ ভেতরের দিকে যেতে থাকে। ৭-৮ দিনে পাতা পচে যায়। করণীয় কী?
উত্তর : এটি পানের পাতা পচা রোগ (ঢ়যুঃড়ঢ়যঃযড়ৎধ ঢ়ধৎধংরঃরপধ) নামক ছত্রাকের আক্রমণে হয়। বর্ষাকালে এই রোগ বেশি দেখা যায়। এই রোগ দেখা দিলে ম্যানকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক ডাইথেন এম-৪৫ ২.৫ গ্রাম/লিটার অথবা কপার অক্সিক্লোরাইড গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন : সানভিট কপার ব্লু ৫০ঢ়ি ব্লিটক্স ৫০ঢ়ি ৪গ্রাম/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে ১২-১৫ দিন অন্তর ২/৩ বার শেষ বিকেলে স্প্রে করতে হবে।
আব্দুস সালাম, উপজেলা : হাটহাজারী, জেলা : চট্টগ্রাম
প্রশ্ন : বেগুনের ফল ও কা- পচে যাচ্ছে। কী করণীয়?
উত্তর : বেগুনের ফল ও কা- পচা রোগ ঢ়যড়সড়ঢ়ংরং াবীধহং নামক ছত্রাকজনিত রোগ। আক্রান্ত গাছের ডালে ও কা-ে ক্যাংকার সৃষ্টি হয়। ডাল চক্রাকারে পচে যায় ফলে গাছ মারা যায়। পরবর্তীতে এ রোগ ফলেও আক্রমণ করে, কালো ক্ষতের সৃষ্টি হয় ও ফল পচে যায়। এ রোগ থেকে রক্ষা পেতে একই জমিতে প্রতি বছর বেগুন চাষ করা যাবে না। বীজ শোধন করতে হবে (কার্বেন্ডাজিম প্রোভেক্স ২ গ্রাম/প্রতি কেজি বীজ)। মাঠে রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে কার্বেন্ডাজিম (ব্যাভিষ্টিন) ২ গ্রাম দিয়ে ৭ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
ফরিদ, উপজেলা : মেহেরপুর সদর, জেলা : মেহেরপুর
প্রশ্ন : পেঁপের গাছে সাদা তুলার মতো দেখা যাচ্ছে। কি করতে হবে?
উত্তর : পেঁপের মিলিবাগ আক্রমণে সাদা সাদা তুলার মতো দেখা যায়। দলবদ্ধভাবে ফল, পাতা ও ডালের রস চুষে নেয় ফলে গাছ দুর্বল হয়। পোকার আক্রমণে পাতা, ফল ও ডালে সাদা সাদা তুলার মতো দেখা যায়। অনেক সময় পিঁপড়া দেখা যায়। এর আক্রমণে অনেক সময় পাতা ঝরে যায় এবং ডাল মরে যায়। আক্রমণ বেশি হলে ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক  (যেমন এডমায়ার অথবা টিডো ৭-১০ মিলিলিটার) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পর পর ২/৩ বার।
আনিসুর রহমান, উপজেলা : দেবীগঞ্জ, জেলা পঞ্চগড়
প্রশ্ন : কাঁকরোল হলুদ হয়ে পচে ঝরে যাচ্ছে। ভিতরে পোকা আছে কী করণীয়?
উত্তর : কাঁকরোলের সাদা মাছির আক্রমণে এ লক্ষণ দেখা যায়। স্ত্রী মাছি কচি ফলের নিচের দিকে ওভিপজিটর ঢুকিয়ে ডিম পাড়ে।  ডিম পাড়ার স্থান থেকে পানির মতো তরল পদার্থ  বেড়িয়ে আসে যা শুকিয়ে বাদামি রঙ ধারণ করে। ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ফলের শাস খেতে শুরু করে এবং ফল বিকৃত হয়ে যায় এবং হলুদ হয়ে পচে ঝরে যায়। আক্রান্ত ফল বা ফুল সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে। কচি ফল কাগজ বা পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক বিপর্কড ১ মিলি./লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সেই সবজি খাওয়া যাবে না বা বিক্রি করা যাবে না।
মো: ফরহাদ হোসেন, উপজেলা : ফুলবাড়ী, জেলা : কুড়িগ্রাম
প্রশ্ন : মরিচের গায়ে কালো দাগ দেখা যাচ্ছে এবং মরিচ পচে যাচ্ছে। কী করতে হবে?
উত্তর : মরিচের ক্ষত বা এ্যানথ্রাকনোজ রোগ (ঈড়ষষবঃড়ঃযৎরপযঁস পধঢ়ংরপর) ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগে আক্রান্ত পাতা, কা- ও ফলে বাদামি কালো দাগ দেখা যায়। পরে দাগগুলো বড় হয় এবং মরিচ পচে যায়। আক্রান্ত পরিত্যক্ত অংশ সংগ্রহ করে নষ্ট করতে হবে। প্রোভেক্স বা ভিটাভেক্স ২০০ দ্বারা  বীজ শোধন (প্রতি কেজি বীজ ২.৫ম ছত্রাকনাশক) করে লাগাতে হবে। রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি টিল্ট ২৫০ ইসি বা ৪ গ্রাম সানভিট ১০-১২ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
মো: মাসুদ মিয়া, উপজেলা : পলাশবাড়ি, জেলা : গাইবান্ধা
প্রশ্ন : করলা গাছের পাতা সব একসাথে হয়ে গুচ্ছ আকারে দেখা যাচ্ছে এবং গাছের বৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। করণীয় কী?
উত্তর : এটি করলার পাতার গুচ্ছ রোগ নামে পরিচিত। এতে আক্রান্ত গাছের পাতাগুলো গুচ্ছ অকারে থাকে, গাছ বাড়ে না এবং ফুল ও ফল কমে যায়।  বাহক পোকা হিসাবে জ্যাসিড পোকা দ্বারা এই রোগ ছড়ায়। আক্রান্ত গাছ দেখা মাত্র তুলে নষ্ট অথবা পুড়ে ফেলতে হবে। রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। ভাইরাসের মতো মাইকোপ্লাজমা রোগ (গুচ্ছ রোগ) বাহকপোকা দ্বারা বিস্তার লাভ করে। তাই বাহকপোকা ধ্বংস করার জন্য বালাইনাশক যেমন এসাটাফ ৭৫ এসপি গ্রাব (এসিফেট), ইমিব্রক্লোপিড টিডো/এডমায়ায় (ইমিজক্লোপ্রিড) ইত্যাদি প্রয়োগ করতে হবে। টেট্রাসাইক্লিন বা লেডার মাইসিন (৫০০ পিপি এম বা ০.৫ গ্রাম/লিটার পানি) ছিটিয়ে রোগ দমনে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে।
আমজাদ হোসেন, উপজেলা : কাপাসিয়া, জেলা : গাজীপুর
প্রশ্ন : ধানের বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : ভালো বীজের জন্য যে জমির ধান ভালোভাবে পেকেছে, রোগ ও পোকার আক্রমণ হয়নি এবং আগাছামুক্ত সেসব জমির ধান বীজ হিসাবে রাখতে হবে। বীজ রোদে ৫-৬ দিন ভালোভাবে শুকাতে হবে যাতে বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগের নিচে থাকে। দাঁত দিয়ে বীজ কাটলে যদি কটকট শব্দ হয় তাহলে বুঝতে হবে বীজ ঠিকমতো শুকিয়েছে। পুষ্ট ধান কুলা দিয়ে বা অন্যভাবে ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হবে। বায়ুরোধী পাত্রে বীজ রাখতে হবে। বীজ রাখার জন্য প্লাস্টিকের ড্রাম উত্তম তবে বায়ুরোধী মাটি বা টিনের পাত্রে রাখা যেতে পারে। মাটির মটকা বা কলসে বীজ রাখলে গায়ে দুইবার আলকাতরার প্রলেপ দিতে হবে। আর্দ্রতারোধক মোটা পলিথিনেও বীজ মজুদ করা যেতে পারে। রোদে শুকানো বীজ ঠা-া করে পুরোপাত্র বীজ দিয়ে না ভরলে বীজের উপর কাগজ বিছিয়ে তার উপর শুকনো বালু বা ছাই দিয়ে পূর্ণ করতে হবে। পাত্রের তলা যেন মাটির সংস্পর্শে না আসে এমনভাবে রাখতে হবে। টনপ্রতি ধানে ৩.২৬ কেজি (প্রতি কেজি বীজ ধানে ৩ গ্রাম) নিম, নিশিন্দা বা বিষকাটালি পাতার গুঁড়া মিশিয়ে গোলাজাত করলে পোকার আক্রমণ হয় না।
আব্দুর রহিম, উপজেলা : পীরগঞ্জ, জেলা : রংপুর
প্রশ্ন : বাঁধাকপি চাষের সময় এবং চারা উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : মৌসুমভেদে বাঁধাকপির বীজ বপনের সময় হলো :
বাঁধাকপির চারা বীজতলায় উৎপাদন করে জমিতে লাগানো হয়। বীজতলার আকার ১ মিটার চওড়া ও ৩ মিটার লম্বা হওয়া উচিত। সমপরিমাণ বালু, মাটি ও জৈবসার মিশিয়ে ঝুরঝুরা করে বীজতলা তৈরি করতে হয়। দ্বিতীয় বীজতলায় চারা রোপণের আগে ৭-৮ দিন পূর্বে প্রতি বীজতলায় ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৫০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০ গ্রাম এমওপি সার ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। পরে চারা ঠিকমতো না বাড়লে প্রতি বীজতলায় প্রায় ১০০ গ্রাম পরিমাণ ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দেয়া ভালো।

লেখক : তথ্য অফিসার (উদ্ভিদ সংরক্ষণ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৯১৬৫৬৬২৬২; ই-মেইল :aklimadae@gmail.com 

বিস্তারিত
ভাদ্র-মাসের-কৃষি- (১৬-আগস্ট-১৫-সেপ্টেম্বর)

ভাদ্র মাসের কৃষি 
(১৬ আগস্ট-১৫ সেপ্টেম্বর)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
ভাদ্র মাস। ষড়ঋতুর এদেশে শরৎ ঋতুর আগমন হয়। প্রকৃতিতে নিয়ে আসে অসহনীয় গরম। কোথাও  কোথাও এই মাস ‘তালপাকা ভাদ্র’ নামে পরিচিত। আবার এই ভাদ্রতেও ঝরে অবিশ্রান্ত বর্ষণ। শীতল হতে থাকে আবহাওয়া। ¯িœগ্ধ শরতকে বলা হয় ফসল সম্ভাবনার ঋতু। কৃষকেরা নবান্নের আশায় দিন গোনেন। বৈশি^ক আবহাওয়া পরিবর্তনে এসময় ঝরে অঝোর বৃষ্টি। আগাম বন্যা বা নাবি বন্যার কারণে কৃষিতে অনেক সময় বিপর্যয় ডেকে আনে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের নিতে হবে বিশেষ ব্যবস্থাপনা। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনাগুলো যথাযথভাবে শেষ করার জন্য ভাদ্র মাসে কৃষিতে করণীয় বিষয়গুলো জেনে নেবো সংক্ষিপ্তভাবে।
আমন ধান
আমন ধান ক্ষেতের অন্তর্বর্তীকালীন যত্ন নিতে হবে। ক্ষেতে আগাছা জন্মালে তা পরিষ্কার করে ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। আমন ধানের জন্য প্রতি একর জমিতে ৮০ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োজন হয়। এ সার তিনভাগ করে প্রথম ভাগ চারা লাগানোর ১৫-২০ দিন পর, দ্বিতীয় ভাগ ৩০-৪০ দিন পর এবং তৃতীয় ভাগ ৫০-৬০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে। আমন মৌসুমে মাজরা, পামরি, চুঙ্গী, প্রভৃতি পোকা এবং খোলপড়া, পাতায় দাগ পরা রোগ দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে নিয়মিত জমি পরিদর্শন করে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বালাই নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
পাট
এসময় পাট বীজ উৎপাদনের জন্য ভাদ্রের শেষ পর্যন্ত দেশি পাট এবং আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত তোষা পাটের বীজ বোনা যায়। বন্যার পানি উঠে না এমন সুনিষ্কাশিত উঁচু জমিতে জো বুঝে  লাইনে বুনলে প্রতি শতাংশে ১০ গ্রাম আর ছিটিয়ে বুনলে ১৬ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। জমি তৈরির সময় শেষ চাষে শতকপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬৫০ গ্রাম টিএসপি, ৮০ গ্রাম এমওপি সার দিতে হবে। পরবর্তীতে শতাংশ প্রতি ইউরিয়া ৩০০ গ্রাম করে দুই কিস্তিতে বীজ গজানোর ১০-২০ দিন পরপর জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
আঁশের মান উন্নয়নে পলিথিন কাগজ ব্যবহারে পাটের পচন প্রযুক্তি (২০২২-২৩) ব্যবহার করা যায়। এই পদ্ধতিতে পাট পচনে তুলনামূলক সময় কম লাগে। কাটিংস মুক্ত উন্নতমানের পাট আঁশ পাওয়া যায়। জাকের পানি দ্রুত বেশি পচবে না বা কলুষিত করবে না। পাট মৌসুমে (মে- সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশের সকল অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের পূর্বে প্রচলিত পাট পচন পদ্ধতিতে প্রাপ্ত পাটের বিক্রয় মূল্য ২৮০০-৩০০০/- এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের পরে প্রাপ্ত পাটের বিক্রয় মূল্য ৩২০০-৩৫০০/- হয়ে থাকে,যা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব। 
আখ
এসময় আখ ফসলে লালপচা রোগ দেখা দিতে পারে। লালপচা রোগের আক্রমণ হলে আখের কা- পচে যায় এবং হলদে হয়ে শুকিয়ে যেতে থাকে। এজন্য আক্রান্ত আখ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং জমিতে যাতে পানি না জমে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া রোগ প্রতিরোধী জাত ঈশ্বরদী ১৬, ঈশ্বরদী ২০, ঈশ্বরদী ৩০, ঈশ^রদী ৩৯, ঈশ^রদী ৪০, বিএসআরআই আখ৪৫, বিএসআরআই আখ ৪৬, বিএসআরআই আখ৪৮  চাষ করলে রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। 
তুলা
ভাদ্র মাসের প্রথম দিকেই তুলার বীজ বপন কাজ শেষ করতে হবে। হাতে সময় না থাকলে জমি চাষ না দিয়ে নিড়ানি বা আগাছা নাশক প্রয়োগ করে ডিবলিং পদ্ধতিতে বীজ বপন করা যায়। বীজ গজানোর পর কোদাল দিয়ে সারির মাঝখানের মাটি আলগা করে দিতে হবে।
শাকসবজি
এ সময় লাউ ও শিমের বীজ বপন করা যায়। এজন্য ৪-৫ মিটার দূরে দূরে ৭৫ সেমি. চওড়া এবং ৬০ সে.মি গভীর করে মাদা বা গর্ত তৈরি করতে হবে। এরপর প্রতি মাদায় ২০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম টিএসপি এবং ৭৫ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। মাদা তৈরি হলে প্রতি মাদায় ৪-৫টি বীজ বুনে দিতে হবে এবং চারা গজানোর ২-৩ সপ্তাহ পর দুই-তিন কিস্তিতে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৭৫ গ্রাম এমওপি সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এ সময় আগাম শীতকালীন সবজি চারা উৎপাদনের কাজ শুরু করা যেতে পারে। সবজি চারা উৎপাদনের জন্য উঁচু এবং আলো-বাতাস লাগে এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে। এক মিটার চওড়া এবং জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বা করে বীজতলা করে সেখানে উন্নতজাতের ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, টমেটো এগুলোর বীজ বপন হবে।
গাছপালা
ভাদ্র মাসেও ফলদবৃক্ষ এবং ঔষধি গাছের চারা রোপণ করা যায়। বন্যায় বা বৃষ্টিতে মৌসুমের রোপিত চারা নষ্ট হলে মরা চারা তুলে নতুন চারা রোপণ করতে হবে।
এ মাসে আম, কাঁঠাল, লিচু গাছ ছেঁটে দিতে হয়। ফলের বোঁটা, গাছের ছোট ডালপালা, রোগাক্রান্ত অংশ ছেটে দিলে পরের বছর বেশি করে ফল ধরে এবং ফল গাছে রোগও কম হয়। 
তালের ফল ও বীজ আগস্ট মাস থেকে শুরু করে অক্টোবর মাস পর্যন্ত সংগ্রহ করা সম্ভব। নির্বাচিত মাতৃবৃক্ষ থেকে পাকা তাল থেকে রস বের করে নেয়ার পর সংগৃহীত বীজ সাথে সাথে বীজ তলায় বপন করতে হবে। বীজ শুকিয়ে গেলে তা থেকে চারা পাওয়া যাবে না। পরিপক্ব তালের বীজের অংকুরোদগমের হার ৭০% এর উপর হয়ে থাকে।

লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪; ই-মেইল : editor@ais.gov.bd

বিস্তারিত