Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

সেচে বারিড পাইপ : পানিসম্পদ ও অর্থ সাশ্রয়

সেচে বারিড পাইপ : পানিসম্পদ ও অর্থ সাশ্রয়  
প্রকৌশলী মোঃ জিয়াউল হক
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর প্রধানতম খাদ্যশস্য ধান। দেশে মোট আবাদি জমির প্রায় ৭৫% ধান চাষ হয়। সেচনির্ভর রবি মৌসুমে বোরোতে মোট ধানের প্রায় ৫৫-৬০% উৎপাদিত হয়। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে উৎপাদন ক্ষমতা ও প্রযুক্তির আধুনিক কলাকৌশল উন্নয়ন অনস্বীকার্য। ফসল উৎপাদনের মৌলিক উপকরণ তিনটি-উন্নতজাতের বীজ, সার ও সেচ। সেচ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও উৎপাদন খরচ কমানোর মুখ্য ভূমিকা পালন করে। রবি মৌসুমে বোরো উৎপাদনে সেচ ব্যবস্থাপনায় প্রায় ৩০-৩৫% অর্থ ব্যয় হয়। সেচ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিবহন ও প্রয়োগ। সেচের পানি পরিবহন ও প্রয়োগ যথাযথভাবে নিশ্চিত হলে খরচ অনেকাংশে কমানো সম্ভব। বর্তমানে দেশে কাঁচা সেচনালায় সেচ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এতে উন্মুক্ত ডিসচার্জ বক্স এবং কাঁচা সেচনালায় অনুস্রাবণ, চোয়ানো, ইঁদুর/পোকামাকড়ের গর্ত, আগাছা ও বাষ্পীয়ভবনে প্রায় ৪০-৫০% পানির অপচয় হয় (বারি বুকলেট-১৯৯৭)। কাঁচা সেচনালায় সেচযন্ত্রের কমান্ড এরিয়ার ২-৪% জমিও অপচয় হয়। সেচের পানি উৎস হলো-ক) ভূপরিস্থ ও খ) ভূগর্ভস্থ। সারাদেশে সেচ মৌসুমে সেচকাজে উত্তোলিত পানির পরিমাণ প্রায় ৫৫ বিসিএম (বিলিয়ন কিউবিক মিটার)। তন্মধ্যে শুধুমাত্র ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলিত প্রায় ৭২%, যার পরিমাণ প্রায় ৪০ বিসিএম। তাই আধুনিক লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তির বারিড (ইঁৎরবফ) পাইপে সেচের পানির অপচয় ১% নিচে এবং জমির অপচয় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব।
সেচযন্ত্রের কমান্ড এরিয়া বৃদ্ধি এবং জমি ও পরিবহন অপচয়বিহীন স্বল্প সময়ে সহজে সুষ্ঠুভাবে সেচসুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে মাটির নির্দিষ্ট গভীরতায় পাইপ লাইনের যে নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হয় তাকে বারিড পাইপ সেচ পদ্ধতি বলা হয়। বর্তমানে আধুনিক লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তির পলি-ভিনাইল ক্লোরাইড ও আন-প্লাস্টিসাইজড পলি-ভিনাইল ক্লোরাইড এবং হাই-ডেনসিটি পলি ইথিলিন পাইপের মাধ্যমে বারিড পাইপ সেচ পদ্ধতি স্থাপিত হচ্ছে। যার স্থায়িত্বকাল প্রায় ৪০-৫০ বছরেরও অধিক। ফলে মেরামতের প্রয়োজন হয় না এবং যেকোন মৌসুমে সেচ প্রদান করা সম্ভব। আবার যে সকল এলাকা বারিড পাইপে পানি পরিবহনে অসুবিধা সময়মতো সেচ প্রদান করা সম্ভব হয় না, সে সকল এলাকায় ফিতা/হাজ পাইপ খুবই উপযোগী ও কার্যকরী পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে পানি প্রবাহের মাধ্যমে সেচ প্রদানে পানি ও জমির অপচয় হয় না এবং সেচ খরচ অর্ধেক হয়।
বারিড পাইপে সুবিধাসমূহ
জমির অপচয় হয় না, ফলে সেচনালায় ব্যবহৃত জমিতে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদিত হয়; অনুস্রাবণ, চোয়ানো, আগাছা, বাষ্পীয়ভবন হয় না। এতে পানির অপচয় মাত্র ১% নিচে নামানো সম্ভব; বন্যা/বৃষ্টি/প্রাকৃতিক দুর্যোগে বারিড পাইপ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, ফলে মেরামত প্রয়োজন হয় না; প্রাথমিক খরচ বেশি, তবে দীর্ঘমেয়াদি খরচ কম। সেচে সময় কম লাগে, শ্রম ও জ্বালানি সাশ্রয় হয়;  উঁচু-নিচু বা খাল-বিল অতিক্রম করে সেচ প্রদান এবং কৃষিজ যন্ত্রপাতি, ফসল পরিবহন ও ন্যায্য মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত হয়; সেচযন্ত্রের ১০-১২% কমান্ড এরিয়া বৃদ্ধিসহ সেচ দক্ষতা ও সেচের নিবিড়তা বৃদ্ধি পায়; সর্বোপরি ভূগর্ভস্থ পানির নিম্নগামিতা রোধ এবং পরিবেশসম্মত আধুনিক লাগসই ও টেকসই সেচ প্রযুক্তি।
বারিড পাইপ স্থাপনে করণীয়সমূহ
    রবি সৌসুমে বোরোতে সেচকৃত এলাকা প্রায় ৭৩%। কৃষকদের  বারিড পাইপ ব্যবহারের সুবিধাদি, সম্প্রসারণ ও কম জীবনকালের ধানের জাত নির্বাচনে ব্যাপক প্রশিক্ষণ এবং মোটিভেশনের মাধ্যমে সচেতন করতে হবে। সেলক্ষ্যে সেচের পানি সুষ্ঠু ব্যবহারে কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দেশে মাথাপিছু আবাদি জমি মাত্র ০.০৪৯ হেক্টর। এ খ- খ- জমিতে বারিড পাইপে সেচ প্রদান অনেক সময় সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাই সমবায় ভিত্তিতে সেচ কার্যক্রম সম্পাদনের নিমিত্ত পানি ব্যবহারকারী দলকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
    কৃষি কাজে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১৮ ও তদ্বীয় বিধিমালা-২০১৯ অনুযায়ী সেচযন্ত্র স্থাপন করতে হবে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বারিড পাইপ সেচের সুবিধাদির বোধগম্যের ডকুমেন্টেশন তৈরি এবং কৃষকদের মাঝে প্রচার-প্রচারণা করতে হবে। কৃষি উদ্যোক্তাদের প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষিমূখীকরণ এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে। বারিড পাইপ মাঠপর্যায়ে বিস্তার ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সেচপাম্প মালিক/ম্যানেজারকে সহজশর্তে স্বল্প সুদে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা অথবা সরকারি পর্যায়ে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।  
২০২১-২২ সেচমৌসুমের সেচযন্ত্র জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে মোট সেচকৃত এলাকা ৫৬,৮৯,৫৮০ হেক্টর এবং সেচযন্ত্রের সংখ্যা ১৭,১২,৫১৫টি। তন্মধ্যে আধুনিক সেচযন্ত্রে (গভীর নলকূপ, অগভীর নলকূপ, সৌর শক্তিচালিত ও শক্তিচালিত পাম্প) সেচকৃত এলাকা ৫৪, ২৯,৫৬৯ হেক্টর এবং সনাতনী গঙঝঞও ও ‘গ্র্যাভিটি ফ্লো’তে মোট ২,৬০,০১২ হেক্টর (সূত্রঃ জওপ  প্রকল্প, বিএডিসি)। সেচযন্ত্রের কমান্ড এরিয়ার ওপরভিত্তি করে বারিড পাইপের দৈর্ঘ্য নির্ণয় করা হয়। সারা দেশে মোট সেচকৃত এলাকায় বারিড পাইপের চাহিদা প্রায় ৪.২৫ লক্ষ কিলোমিটার (কিমি.)। ইতোমধ্যে বিএডিসি ১২,৫২৪ কিমি. এবং বিএমডিএ কর্তৃক ১৫,০২৬ কিমি. অর্থাৎ মোট ২৭,৫৫০ কিমি. বারিড পাইপ স্থাপিত হয়েছে। যা মোট চাহিদার মাত্র ৬.৫% (প্রায়)। বাকি ৩.৯৭ লক্ষ কিমি. বারিড পাইপ স্থাপন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সেচযন্ত্রের কমান্ড এরিয়া, সেচের নিবিড়তা ও সেচ দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ বা জ্বালানি খরচ হ্রাস ও অপারেটর ভাতার বিপুল পরিমাণ অর্থের সাশ্রয় করা সম্ভব। এমতাবস্থায় নি¤েœ সাশ্রয়কৃত অর্থের পরিসংখ্যান প্রদত্ত হলো-
কাঁচা সেচনালার জমি উদ্ধার : কাঁচা সেচনালা তৈরিতে জমি অপচয় গড়ে ৩% হিসেবে মোট সেচকৃত এলাকা ৫৪,২৯,৫৬৯ হেক্টরে অপচয়ের পরিমাণ প্রায় ১.৬৩ লক্ষ হেক্টর। ইতোমধ্যে বিএডিসি এবং বিএমডিএ কর্তৃক ২৭,৫৫০ কিমি. বারিড পাইপ স্থাপনে প্রায় ১০.৫০ হাজার হেক্টর জমি উদ্ধার এবং আবাদের আওতায় এনে অতিরিক্ত প্রায় ৫২.৫ হাজার মে. টন খাদ্য শস্য উৎপন্ন করা সম্ভব হয়েছে (৫ টন/হেক্টর)। অতএব, বাকি কাঁচা সেচনালাসমূহ বারিড পাইপে রূপান্তরের মাধ্যমে প্রায় ১.৫২ লক্ষ হেক্টর জমি উদ্ধার করে আবাদের আওতায় এনে রবি মৌসুমে আরও অতিরিক্ত প্রায় ৭.৬২ লক্ষ মে.টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হবে। যার বাজারমূল্য প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা।
সেচযন্ত্রে তৈল-জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খরচ: কাঁচা সেচনালায় সেচমৌসুমে ইঞ্জিনচালিত গভীর নলকূপ, অগভীর নলকূপ ও শক্তিচালিত পাম্পে ব্যবহৃত তৈল-জ্বালানি বাবদ খরচের পরিমাণ প্রায় ১১,১০০ কোটি টাকা (তেলসহ ডিজেল ১১০ টাকা/লিটার)। অপরদিকে মোটরচালিত গভীর নলকূপ, অগভীর নলকূপ ও শক্তিচালিত পাম্পে বিদ্যুৎ বাবদ খরচের পরিমাণ প্রায় ১,০৯০ কোটি টাকা (বিদ্যুৎ ৪.৮২ টাকা/ইউনিট, রিবেট ২০%)। অর্থাৎ প্রতি সেচমৌসুমে ইঞ্জিন ও মোটরচালিত সেচযন্ত্রে মোট খরচের পরিমাণ ১২,১৯০ কোটি টাকা। তাই মাঠে কাঁচা সেচনালাগুলোকে বারিড পাইপে রূপান্তর করা হলে পরিবহন অপচয় প্রায় ৫০% হ্রাস পাবে। ফলে সেচমৌসুমে প্রায় ৬,০৯৫ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
সেচমৌসুমে পাম্প অপারেটর ভাতা : সেচমৌসুমে সেচযন্ত্র প্রতি একজন পাম্প অপারেটর প্রতি মাসে ১৫,৫০০/- টাকা (পাম্প পরিচালনা ও কাঁচা সেচনালা মেরামত ও সংরক্ষণ) হিসেবে ৩ মাসে মোট ১৭,১২,৫১৫ টি সেচযন্ত্রের অপারেটর ভাতা বাবদ মোট ৭,৯৬৩ কোটি টাকা। বারিড পাইপে রূপান্তর করার হলে সেচমৌসুমে পরিবহন অপচয় ৫০% হ্রাস হিসেবে সময়ও অর্ধেক কম লাগবে বিধায় পাম্প অপারেটর ভাতা ৩,৯৮২ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
এমতাবস্থায়, সেচমৌসুমে মোট সাশ্রয়কৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় ১২,০৭৭ কোটি টাকা। তাই কৃষিবান্ধব সরকার কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে, সীমিত পানিসম্পদের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি সেচযন্ত্রের প্রধান, শাখা ও উপশাখা কাঁচা সেচনালাগুলো বারিড পাইপে রূপান্তর করা হলে জমি, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও শ্রমের অপচয় হতে প্রতি সেচমৌসুমে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে, এতে সেচ খরচও হ্রাস পাবে। প্রতি সেচমৌসুমে প্রায় ২০ বিসিএম পানি কম উত্তোলিত, ভূগর্ভস্থ পানি নিম্নগামিতা হ্রাস এবং লবণ পানির অনুপ্রবেশ রোধ হবে। এ ক্ষতি জাতীয় কৃষিসম্পদের অর্থাৎ সরাসরি প্রতিটি কৃষকের ক্ষতি। বছরের পর বছর এ ক্ষতি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কৃষককুলকে করছে নিঃস্ব। আর কৃষিকে করছে অলাভজনক। শুধুমাত্র প্রকৌশলগত প্রযুক্তি ব্যবহারে স্বল্প সময়ে অল্প ব্যয়ে এবং সহজে এ ক্ষতি পুরাপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাই অবশিষ্ট ৩.৯৭ লক্ষ কিমি. বারিড পাইপ স্থাপনে মোট প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। যা মাত্র আড়াই সেচমৌসুমে খরচোত্তর পুনঃপ্রাপ্তি (জবপড়াবৎু) নিশ্চিত হবে। ফলে প্রতিটি সেচযন্ত্রের কমান্ড এরিয়া, সেচ দক্ষতা, সেচের নিবিড়তা বৃদ্ধি পাবে। দেশের পানিসম্পদ, যা কৃষি ও মাৎস্যসম্পদের উৎপাদনশীল রাখবে, তার নিরাপত্তা বিধানে আধুনিক লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তি প্রয়োগে অগ্রসর হতে হবে। অন্যথায়, আগামী প্রজন্মের প্রতি দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতার জন্য চিহ্নিত হতে হবে। এতে সেচযন্ত্রসমূহ সেন্সর যুক্ত রিমোট কন্ট্রোলে পরিচালিত হবে। ফলে বারিড পাইপ সেচ পদ্ধতি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে প্রবেশ করবে।

“কাঁচা নালা ভাল নয়, পানির অপচয় বেশি হয়”

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সদস্য পরিচালক (ক্ষুদ্রসেচ), বিএডিসি। ২৭/২ পশ্চিম নাখালপাড়া, এডাপ্টরহমান গার্ডেন (ফ্ল্যাট নং ৭/এ), তেজগাঁ, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৮৭৮১৯৭৯

বিস্তারিত
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট কৃষি

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট কৃষি
ড. মোহাম্মদ আহসান উল্লাহ
বাংলাদেশকে উন্নত দেশে রূপান্তরের রূপকল্প ২০৪১ এর নাম দেওয়া হয়েছে স্মার্ট বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশ মূলত চারটি প্রধান স্তম্ভের উপর নির্মিত- (১) স্মার্ট সিটিজিন (২) স্মার্ট সরকার (৩) স্মার্ট অর্থনীতি ও (৪) স্মার্ট সমাজ। আর এই প্রতিটি বিষয়ই কোন না কোনভাবে কৃষির সাথে জড়িত। মানবসভ্যতার উন্মেষ ঘটেছে কৃষির হাত ধরে। উন্নত বিশ্বে কৃষির যে যন্ত্রায়ন হয়েছে তাকে মূলত ৩য় প্রজন্মের কৃষি বা কৃষি ৩.০ নামে অভিহিত করা হচ্ছে। বর্তমানে স্মার্ট কৃষির যে ধারণা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে তাকে বলা হচ্ছে কৃষি ৪.০।
আশির দশকে যখন প্রথম সবুজ বিল্পবের সূচনা হয়, তার হাত ধরেই খাদ্য উৎপাদনে এসেছে যুগান্তকারী উন্নতি। ক্রমাবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে তার প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু কৃষি ভূমির যথেচ্ছ ব্যবহার পরিবেশকে করেছে বিপদ সংকুল। এটা অনুমান করা হয় যে, আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রায় ২০০ কোটি বৃদ্ধি পেয়ে ৯৭০ কোটিতে উন্নীত হবে। এই বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য আরো প্রায় ৭০% খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে, যা বর্তমান কৃষি ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। উপরন্তু বর্ধিত জনসংখ্যা কমিয়ে ফেলছে আবাদি জমি যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নতুন আপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই সমস্যা বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশকে সংকটময় অবস্থায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনের জন্য একই জমি বারবার ব্যবহার হচ্ছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অপরিমিত ব্যবহার জমিকে করে তুলছে বিষাক্ত। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে গেছে বহুগুণ। এই সকল কারণে মাটি, পানি, বাতাস হয়ে পড়ছে দূষিত, নেমে আসছে পরিবেশ বিপর্যয়। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশকে সমুন্নত রেখে নিরাপদ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কম খরচে বেশি খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিপণনের এক সমন্বিত প্রযুক্তির নামই কৃষি ৪.০ বা স্মার্ট কৃষি।
স্মার্ট বাংলাদেশের ভিত্তি মূলে আছে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন। দেশের প্রতিটি নাগরিক, প্রতিটি ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। যেহেতু বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও জীবিকা এখনো মূলত কৃষিনির্ভর, তাই স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়ন ছাড়া স্মার্ট বাংলাদেশ কল্পনা করা যায় না।
স্মার্ট কৃষির প্রধান অনুসঙ্গ ডিজিটাল প্রযুক্তি। কৃষি কর্মের সর্বক্ষেত্রে এই ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে পরিকল্পনা গ্রহণ, উন্নয়ন, বাস্তবায়ন ও নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করাই এর প্রধান কাজ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা কৃষি ৩.০ এর আরম্ভ মাত্র। আমরা চাইলেই কৃষি ৩.০ বাস্তবায়ন না করেও কৃষি ৪.০ এর গর্বিত অংশীদার হতে পারি। তার জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যথোপযোক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কল্পে একটি জাতীয় নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। বর্তমানে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের প্রচেষ্টা সরকার গ্রহণ করেছে (যেমন- কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানির উপর কর হ্রাস, কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে  কৃষকপর্যায়ে ভর্তুকি প্রদান ইত্যাদি), তা যেন স্মার্ট কৃষির উপযুক্ত হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। প্রকৃতপক্ষে কৃষি ও কৃষি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর এককভাবে স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তার জন্য কৃষিবিদ, পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী, আইটি বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী, পরিবেশবিদ, রাজনীতিবিদ, কৃষি বিজ্ঞানী ও জনসাধারণের সম্মিলিত সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা কৃষি  ৩.০ এর আরম্ভ মাত্র যা উন্নত বিশ্বে বিগত একশত বছর যাবৎ বাস্তবায়ন করেছে। তাই সকল ক্ষেত্রে স্মার্ট কৃষি আমাদের দেশে এই মুহূর্তে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কাজেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খাতসমূহ নির্ধারণ করে ডিজিটাল প্রযুক্তি সমৃদ্ধ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সেই সাথে ব্যয়বহুল ডিজিটাল প্রযুক্তি সমৃদ্ধি কৃষি যন্ত্রপাতি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনবল তৈরির চেষ্টা করতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় আগামী বছরে দেশের মোট প্রয়োজনীয় খাদ্যের চাহিদা নিরূপণ করবেন। সেই পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনের দেশে কতটুকু জমি আছে এবং সেই জমি কোথায় এবং কার অধিকারে আছে তা জানা যাবে ভূমি ব্যবস্থাপনা তথ্য ভা-ার থেকে। এই ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবে। সেই সাথে মাঠপর্যায়ের জমির বর্তমান অবস্থা, যেমন: জমির প্রকৃতি, জমিতে কি পরিমাণ নাইটোজেন, পটাশিয়াম, ফসফেট ও অন্যান্য উপাদন আছে তা ডিজিটাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে জমিতে কোন ফসল ভাল জন্মাবে এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কি হবে তার একটি বাস্তব ধারণা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে পাওয়া যাবে। সেই সাথে কৃষিবিষয়ক যে কোন সমস্যার সমাধান, সম্ভাবনা, পরামর্শ যে কোন সময় যে কোন স্থান থেকে গ্রহণ করা যাবে।
মাঠ পর্যায়ে ব্যবহৃত স্মার্ট যন্ত্রপাতির মধ্যে আছে স্বয়ংক্রিয় ট্রাক্টর, মনুষ্যবিহীন যান ড্রোন, স্বয়ংক্রিয় সেচযন্ত্র, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমৃদ্ধ রোবট, মাটি ও ফসলের বর্তমান আস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য বিভিন্ন প্রকার সেন্সর ইত্যাদি। স্বয়ংক্রিয় সেচযন্ত্র ফসলের প্রয়োজন বুঝে পরিমিত সেচ প্রদান করে যাতে পানির অপচয় রোধ করার সাথে সাথে পানির ব্যবহার হ্রাস করে। মাটি পরীক্ষণ সেন্সর মাটিতে দ্রবীভূত নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম ও ফসফেটের পরিমাণ নির্ণয়, মাটির পিএইচ ও তাপমাত্রা এবং পানির পরিমাণ নির্ণয় করে হালনাগাদ তথ্য কেন্দ্রীয় তথ্যভা-ারে প্রেরণ করে। প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্নেষণ করে জমিতে সারের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়। ফলে জমিতে অযাচিত রাসায়নিকের ব্যবহার হ্রাস পায় এবং মাটির গুণাগুণ অক্ষুণœ রাখার সাথে সাথে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমিয়ে দেয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবট আগাছা চিনতে পারে এবং ধ্বংস করতে পারে কোন প্রকার রাসায়নিক ব্যবহার না করেই। মাঠের বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য ড্রোন খুবই কার্যকরি একটি যন্ত্র। ড্রোন ব্যবহার করে কোন এলাকায় কি ধরনের ফসলের আবাদ হয়েছে তা যেমন নির্ধারণ করা যায় তেমনি ফসল কোন ধরনে বালাই দ্বারা আক্রান্ত হলে সহজেই নির্ণয় করা যায়। এতে ফসলে ক্ষতি হওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ সহজ হয়। একইভাবে ড্রোনের সাহায্যে জমিতে বীজ ছিটানো, সার ও কীটনাশক প্রয়োগের কাজও করা যায়।  
কৃষি জমির বর্তমান অবস্থা নিরূপণের জন্য সেন্সর যুক্ত বহনযোগ্য মাঠপর্যায়ে ব্যবহার উপযোগী যন্ত্র দেশে খুব কম খরচে তৈরি করা সম্ভব। কৃষিতে ব্যবহার উপযোগী ড্রোন ও প্রয়োজনীয় সফটওয়ার বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষার্থীরা সহজেই তৈরি করতে পারে। তাছাড়া কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনের সাথে যুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে যৌথভাবে কাজ করে তাদের উৎপাদিত যন্ত্রপাতি স্মার্ট কৃষির উপযুক্ত করে নিতে পারে। এর ফলে, একাধারে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে তেমনি দেশীয় প্রযুক্তি বিকাশে অনন্য ভূমিকা রাখবে।
স্মার্ট কৃষি কেবলমাত্র কৃষি যন্ত্রপাতি নির্ভর নয়। স্মার্ট কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে উৎপাদিত ফসলের সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিক্রয় সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য প্রদান করে। এতে কৃষক সরাসরি ভোক্তাপর্যায়ে পণ্য সরবরাহ করার মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে ফেলতে পারে। এতে কৃষক যেমন লাভবান হতে পারে তেমনি ভোক্তারাও স্বল্পমূলে সঠিক পণ্য ক্রয় করতে পারে। এই ক্ষেত্রে ব্লকচেইন প্রযুক্তি একটি নিরাপদ সমাধান হতে পারে।
বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে কৃষি রোবট হয়তো সঠিক সমাধান নয়। মাড়াই মৌসুমে শ্রমিকের অভাবে অনেক সময় বিপুল পরিমাণ শস্য নষ্ট হয় এবং মাড়াইকাজে কৃষকের খরচ বেড়ে যায় বহুগুণ। তাই মাড়াইকাজে কম্বাইন্ড হারভেস্টার এবং ধান রোপণের ক্ষেত্রে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রের বহুল ব্যবহার প্রয়োজন।
 যে কোন ডিজিটাল প্রযুক্তির বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তথ্য ও উপাত্তের নিরাপত্তা। স্মার্ট বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো সকল বিষয়ে তথ্য ও উপাত্তের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা। স্মার্ট কৃষিও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে আশার কথা হচ্ছে বাংলাদেশের ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ব্যবহারকারীরা এখন অনেকটাই সচেতন হয়ে উঠছে। তা ছাড়া বাংলাদেশ সরকার দেশের তথ্যভা-ার রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার লিমিটেড নামে একটি স্বতন্ত্র সংস্থা গঠন করেছে। যার মাধ্যমে স্মাট কৃষি প্রয়োজনীয় তথ্যের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারবে।
স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়নের চার স্তরের নেটওয়ার্কের প্রয়োজন। মাঠপর্যায়ে ব্যবহৃত বিভিন্ন সেন্সর থেকে তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করে। প্রথম স্তরের কাজ যা ব্যবহৃত কৃষি যন্ত্রপাতিতে স্থাপিত হবে। ২য় স্তরে রয়েছে আমাদের নিত্যদিনে ব্যবহৃত স্মার্ট ফোন, ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক, জিগবি, লোরা ইত্যাদি, যা দেশের সকল জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে বা খুব সহজেই স্থাপন করা যাবে। ২য় স্তরের মূল কাজই হলো প্রথম স্তরের তথ্য সংগ্রহ করে কোন কোন ক্ষেত্রে তার বিশ্লেষণ করা এবং প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া। সেই সাথে সংগৃহীত তথ্য মূল তথ্যভা-ারে  প্রেরণের জন্য তৃতীয় স্তরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা। তৃতীয় স্তরের কাজ হচ্ছে মাঠপর্যায়ের সকল তথ্য মূল তথ্যভা-ারে পৌঁছে দেওয়া। তার জন্য মোবইল টাওয়ার, টেলিফোন নেটওর্য়াক, অপটিক্যাল ফাইবার ইত্যাদি ব্যবহৃত হতে পারে, যা  দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় বিদ্যামান আছে। চতুর্থ বা শেষ স্তরে আছে মূল তথ্য ভা-ার। বাংলাদেশ ডাটাসেন্টার কোম্পানি লিমিটেড সংগৃহীত তথ্য প্রয়োজন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানে নিরাপদ সরবরাহ নিশ্চিত করবে।
স্মার্ট কৃষির মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে সকল কৃষকের জন্য স্মার্ট প্রযুক্তি, বৃহৎ বা ক্ষুদ্র যাই হোক, যে কোন সময় যে কোন স্থানে ব্যবহার উপযোগী হওয়া। কাজেই একটি নিতিমালার আওতায় প্রয়োজনীয় সফটওয়ার তৈরি করে তথ্যের যথোপযুক্ত নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলেই স্মার্ট বাংলাদেশ যেমন বাস্তবায়িত হবে তেমনি স্মার্ট কৃষির সুফল সকলেই উপভোগ করতে পারবে।

লেখক : অধ্যাপক, তড়িত ও ইলেক্ট্রনিক কৌশল বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মোবাইল : ০১৭৩৪৩১১৫৯০ ই-মেইল : ahsan@cuet.ae.bd

 

বিস্তারিত
কৃষি উন্নয়ন ও সাফল্যের ১৫ বছর

কৃষি উন্নয়ন ও সাফল্যের ১৫ বছর
কৃষিবিদ কাজী আব্দুর রায়হান
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং জনগণের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। জিডিপি’তে কৃষি খাতের অবদান ১১.২০%। কৃষিতে নিয়োজিত জনশক্তি ৪৬.৬৬% (শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২, বিবিএস)। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষির গুরুত্ব বিবেচনায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান  কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন এবং বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদ কৌশল প্রবর্তনের মাধ্যমে টেকসই কৃষির যাত্রার সূচনা করেছিলেন। ২০০৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকার কর্তৃক দেশের কৃষির উন্নয়নে নানাবিধ যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এতে কৃষি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়। আধুনিক, লাভজনক ও যান্ত্রিক কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়। ফসল উৎপাদনে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। কোভিড-১৯ অভিঘাত ও বৈশ্বিক সংকট সত্ত্বেও  কৃষি উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রেখে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতির ভিত্তিকে সুদৃঢ় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
খাদ্যশস্য ও অন্যান্য ফসল উৎপাদনে ধারাবাহিক সাফল্য : খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পর উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। ২০০৮-০৯ সালে যেখানে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ২৮ লক্ষ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন, সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে ৪ কোটি ৬৬ লক্ষ ৮৭ হাজার মেট্রিক টন হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে (বিস্তারিত সারণি-১)। বাংলাদেশের ২২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে রয়েছে; যেমন, ধান উৎপাদনে ৩য়, সবজি ও পেঁয়াজ উৎপাদনে ৩য়, পাট উৎপাদনে ২য়, চা উৎপাদনে ৪র্থ, জাম জাতীয় ফল উৎপাদনে ৪র্থ, গ্রীষ্মম-লীয় ফল (কাঁঠাল, লিচু) উৎপাদনে ৬ষ্ঠ এবং আলু ও আম উৎপাদনে ৭ম।
জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন : গবেষণা খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি, উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, গবেষণা অবকাঠামোর উন্নয়ন, গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি এবং দেশে বিদেশে বিজ্ঞানীদের উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিগত ১৫ বছরে বৈরী পরিবেশ সহনশীল জাতসহ মোট ৬৯৯টি উন্নত/উচ্চফলনশীল জাতের ফসল উদ্ভাবন ও ৭০৮টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
সার ব্যবস্থাপনা সংস্কার : জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে সার ব্যবস্থাপনা সংস্কারের সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ‘সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা ২০০৯’ প্রণয়ন করা হয়। প্রতিটি ইউনিয়নে একজন সার ডিলার ও ৯ জন খুচরা সার বিক্রেতা নিয়োগ করা হয়েছে। ফলে সার প্রাপ্তিতে কৃষকের ভোগান্তি দূর হয়।
বীজ সরবরাহ : মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন করে কৃষকের হাতে তুলে দিতে বিএডিসি কর্তৃক ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বীজ বিতরণের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ লক্ষ মে.টন যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১ লক্ষ ৫২ হাজার মে.টন।
উন্নয়ন সহায়তা (ভর্তুকি) :  কৃষকের উৎপাদন খরচ নিম্নপর্যায়ে রাখতে সরকার সার, সেচকাজে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ ও ইক্ষু চাষে উন্নয়ন সহায়তা (ভর্তুকি) প্রদানের নীতি গ্রহণ করে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় ছিল প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে উন্নয়ন সহায়তা বাবদ প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
প্রণোদনা/কৃষি পুনর্বাসন : বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ও কাক্সিক্ষত ফসল/জাত চাষাবাদে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে ৬ লক্ষ ৪৩ হাজার কৃষককে ৪৭.৮১ কোটি টাকা প্রণোদনা প্রদান করা হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৭ লক্ষ ৭৩ হাজার কৃষককে ৫০০ কোটি টাকা প্রণোদনা প্রদান করা হয়। এতে উপকারভোগী কৃষকের সংখ্যা।
উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন : বিগত ১৫ বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে গড় অগ্রগতির হার ৯৭.১৫%। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৬৪টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ৭০৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ৩৪১৯.৯৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
কৃষি যান্ত্রিকীকরণ : সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য হাওর ও উপকূলীয় এলাকায় ৭০% ও অন্যান্য এলাকায় ৫০% উন্নয়ন সহায়তার মাধ্যমে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হচ্ছে। ২০১০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত প্রায় ১ লক্ষ ৩৩ হাজারটি  কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতায় ৩০২০.০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ১২ ক্যাটাগরিতে ৫১,৩০০টি কৃষিযন্ত্র বিতরণের কার্যক্রম চলমান আছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে জুন/২০২৩ পর্যন্ত মোট ৩০,৫৮২টি কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। ফলে কৃষি শ্রমিকের অপ্রতুলতা মোকাবিলা এবং উৎপাদন ব্যয় হ্রাস হয়েছে।
সমলয় চাষাবাদ : ২০২০-২১ অর্থবছর হতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ কার্যকর করে ফসল ঘরে তুলতে সমলয় (ঝুহপযৎড়হরুব) চাষাবাদ শুরু করা হয়। উক্ত বছরে ৬১ জেলায় ৫০ একর করে ৬১টি ব্লকে সমলয় পদ্ধতিতে বোরো চাষ হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি করে ১৬২টি ব্লকে বোরোর পাশাপাশি আমনেও সমলয় চাষাবাদ করা হয়েছে।
সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ : বিএডিসি ও বিএমডিএ কর্তৃক মোট সেচকৃত এলাকা প্রায় ১২.৫৯ লক্ষ হেক্টর। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সম্প্রসারিত সেচ এলাকা প্রায় ৪.৯৯ লক্ষ হেক্টর।
কৃষিঋণ : প্রচলিত ব্যাংকিং চ্যানেলে সুবিধাবঞ্চিত বর্গাচাষিদের দোরগোড়ায় সময়মতো, স্বল্পসুদে, জামানতবিহীন কৃষি ঋণ সুবিধা পৌঁছে দিতে সরকার ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ‘বর্গাচাষিদের জন্য কৃষিঋণ’ কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষিঋণ প্রদান করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা’ এর আওতায় ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১৭.২৯ লক্ষ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ৪,৭৬৫ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৭.৩৬ লক্ষ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ২২,৪০২ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছেন।
কৃষি উপকরণ কার্ড ও ১০ টাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট : কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ডধারী কৃষকের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি এবং কৃষি উপকরণ কার্ডের মাধ্যমে খোলা ১০ টাকার সচল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। যার মাধ্যমে কৃষকগণ ফসল উৎপাদনের ঋণ এবং কৃষি উপকরণ সহায়তা পেয়ে থাকেন।
কৃষি বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন : উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহিত করার জন্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কর্তৃক ৪ তলাবিশিষ্ট ১৪,০০০ বর্গফুট করে ৫টি জেলায় ৫টি অফিস কাম ট্রেনিং অ্যান্ড প্রসেসিং সেন্টার, গাবতলীতে ফুলের ১টি সেন্ট্রাল মার্কেট, ২১টি পাইকারি বাজার, ৭২টি কৃষকের বাজার ও ২৩টি এসেম্বল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে।
জিনোম সিকুয়েন্সিং উদ্ভাবন : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে কৃষি গবেষণায় জীবপ্রযুক্তি ব্যবহারের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মাকসুদুল আলম ও তাঁর দল সফলভাবে বিশ্বে সর্বপ্রথম তোষা পাটের জীবন রহস্য উন্মোচন করেন (১৬ জুন ২০১০)। পরবর্তীতে পাটসহ পাঁচ শতাধিক উদ্ভিদের রোগের জন্য দায়ী ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করা হয় (২০১২) এবং দেশি পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন হয় (২০১৩)। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ধইঞ্চের জীবনরহস্যও উন্মোচন করা হয়েছে।
পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন : করোনা পরবর্তীকালীন সময়ে খাদ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখা ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা প্রদান করেন যে, ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে’। সে লক্ষ্যে ৪৩৮.৪৭ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ‘অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে জুন/২০২৩ পর্যন্ত স্থাপিত মোট পারিবারিক পুষ্টি বাগানের সংখ্যা ২,৫২,০৯৬টি।
পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা : পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর ফলে ২০২১-২২ অর্থবছরের পেঁয়াজ উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে ৩৬.৪১ লক্ষ মে.টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩৪.৫৬ লক্ষ মে.টন, যেখানে ২০০৯ সালে পেঁয়াজ উৎপাদন ছিল ১৪.২৩ লক্ষ মে.টন।
ভোজ্যতেলে ৪০% স্বয়ংসম্পূর্ণতা : তিন বছরের মধ্যে ভোজ্যতেলের আমদানি হ্রাসপূর্বক ৪০% স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে (২০২২-২৩ হতে ২০২৪-২৫)। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরিষার উৎপাদন হয়েছে ১১.৬১ লক্ষ মে.টন, যা বিগত বছরের তুলনায় ৩.৩৭ লক্ষ মে.টন বেশি। উল্লেখ্য, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে সরিষার উৎপাদন ছিল মাত্র ২.০৩ লক্ষ মে.টন। বর্তমানে উৎপাদিত ১১.৬১ লক্ষ মে.টন সরিষা হতে ৩.৮৭ লক্ষ টন  তেল উৎপাদন হবে।
বছরব্যাপী ফল উৎপাদন এবং অপ্রচলিত ফসলের প্রচলন : বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের পাশাপাশি দেশে চাষ উপযোগী বিদেশি ফল যেমন- ড্রাগন, অ্যাভোক্যাডো, স্ট্রবেরি, আরবি খেজুর, রাম্বুটান, পার্সিমনের চাষ বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর ফলে বছরব্যাপী বিভিন্ন ধরনের ফল পাওয়া যাচ্ছে।
উচ্চমূল্য ফসল কফি ও কাজুবাদাম চাষ : পাহাড়ি এলাকায় কফি, কাজুবাদাম চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে পাঁচ বছরমেয়াদি (২০২১-২০২৫) ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পে ব্যয় হবে ২১১.৮৫ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮.৫ লক্ষ কাজুবাদাম ও কফির চারা বিতরণ করা হয়েছে। প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছে। এতে প্রায় ২৫০০ হেক্টর জমিতে নতুন করে কাজুবাদাম ও কফি চাষের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
জৈব কৃষি ও উত্তম কৃষি চর্চা : পরিবেশবান্ধব জৈব কৃষি কার্যক্রমকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ‘জাতীয় জৈব কৃষি নীতি-২০১৭’ এবং ‘বালাইনাশক আইন ২০১৮’ অনুমোদন করা হয় এবং ‘বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চা নীতিমালা-২০২০’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ কার্যক্রমের আওতায় ১০০০টি নিরাপদ সবজি উৎপাদন গ্রাম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেসাথে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (ওচগ) ও সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনা (ওঋগঈ) চর্চার জন্য ৩,৬০০টি কৃষকগ্রুপ তৈরি করা হচ্ছে।
অ্যাক্রিডিটেড ল্যাব : কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানির জন্য সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। নিরাপদ কৃষিপণ্য রপ্তানির উদ্দেশ্যে ঢাকার শ্যামপুর কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে একটি অ্যাক্রিডিটেড ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। পূর্বাচলে একটি কেন্দ্রীয় ল্যাব স্থাপনের জন্য এরই মধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুই একর জায়গা প্রদান করেছেন এবং ল্যাব স্থাপনের জন্য প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে।
উপকূলীয় এলাকায় কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ : উপকূলীয় এলাকার উপযোগী কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণে ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ সম্প্রসারণ, সর্জান, পিরামিড এবং ঘের পদ্ধতি অবলম্বনে ফল, সবজি, ধান ও মাছ চাষ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া ফসলের লবণাক্ততা ও জলমগ্নতা সহনশীল জাত সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।
বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি : ভাসমান বেডে চাষাবাদ পদ্ধতিটিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা থেকে ২০১৫ সালে কৃষিতে বাংলাদেশের বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি : বিগত ১৫ বছরে কৃষি মন্ত্রণালয় ও দপ্তর-সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বীজ প্রত্যায়ন এজেন্সী, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) এবং কৃষি বিপণন অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জনবল বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেইসাথে নারায়ণগঞ্জে বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (বারটান) এবং দিনাজপুরের নশিপুরে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয় ।
কানাডায় বঙ্গবন্ধু চেয়ার এবং ‘বঙ্গবন্ধু-পিয়েরে ট্রুডো কৃষি প্রযুক্তি কেন্দ্র’ স্থাপন: কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কানাডার সাস্কাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গ্লোবাল ইনস্টিটিউট ফর ফুড সিকিউরিটি’-তে বঙ্গবন্ধু চেয়ার স্থাপন করা হয়েছে। উক্ত ইনস্টিটিউটের কারিগরি সহায়তায় ‘বঙ্গবন্ধু-পিয়েরে ট্রুডো কৃষি প্রযুক্তি কেন্দ্র’ স্থাপন করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রটি ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ উদ্বোধন করেন।
কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (এআইপি) ২০২০ সম্মাননা : কৃষিখাতে অবদানের জন্য গত ২৭ জুলাই ২০২২ কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রথমবারের মতো ১৩ জন ব্যক্তিকে ‘কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (এআইপি) ২০২০’ সম্মাননা প্রদান করা হয়।
বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরষ্কার : কৃষিতে অন্যান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতি বছর ১০টি ক্যাটাগরিতে ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার’ প্রদান করা হয়ে থাকে। সর্বশেষ ১২ অক্টোবর ২০২২ তারিখে ৪৪ জন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ১৪২৫ এবং ১৪২৬ প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন।
জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার আঞ্চলিক সম্মেলন আয়োজন : ঢাকাস্থ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এবং বিআইসিসিতে জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (ঋঅঙ) জবমরড়হধষ ঈড়হভবৎবহপব ভড়ৎ অংরধ ধহফ চধপরভরপ (অচজঈ) এর ৩৬তম সম্মেলন ৮-১১ মার্চ ২০২২ অনুষ্ঠিত হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি উদ্বোধন করেন। ওই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের মাননীয় মন্ত্রী, প্রতিনিধি, এফএওর ডাইরেক্টর জেনারেলসহ বিশ্বের ৪৬টি দেশের অতিথিগণ অংশগ্রহণ করেন।
নেদারল্যান্ডসের আন্তর্জাতিক হর্টিকালচার এক্সিবিশনে অংশগ্রহণ : নেদারল্যান্ডসের আলমিরাতে এপ্রিল’২২ থেকে নভেম্বর’২২ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ৭ম আন্তর্জাতিক হর্টিকালচার এক্সিবিশনে (ঋষড়ৎরধফব বীঢ়ড়-২০২২) বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করে। এক্সিবিশনে বাংলাদেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে কৃষির সাফল্য ও রপ্তানিযোগ্য কৃষি পণ্যের (প্রদর্শনী) ও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়।
কৃষিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার : কৃষি সেবাকে সহজে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য ‘কৃষি বাতায়ন’, ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি), কৃষি কল সেন্টার (নম্বর ১৬১২৩), কৃষি কমিউনিটি রেডিও, কৃষক বন্ধু ফোন-৩৩৩১, অনলাইন সার সুপারিশ, রাইস নলেজ ব্যাংক ইত্যাদির মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এলাকা উপযোগী শস্য আবাদের লক্ষ্যে ‘ঈৎড়ঢ় তড়হরহম ডবনংরঃব’ এবং ‘খামারি’ মোবাইল অ্যাপ চালু করা হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) : কৃষি মন্ত্রণালয় বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) বাস্তবায়নে ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ পরপর দুইবার ৫১টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ২য় শ্রেষ্ঠ স্থান অর্জন করে। পরবর্তীতে ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ এ কৃষি মন্ত্রণালয় ৩য় স্থান অর্জন করে।
কোভিড-১৯ এর অভিঘাত মোকাবিলা : ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাওর ও অন্যান্য শ্রমিক সংকট এলাকায় শ্রমিক ও কৃষিযন্ত্র এনে বোরো ধান কাটার ব্যবস্থা করা হয়। বিএডিসির সেচ যন্ত্রসমূহের চার্জ ৫০% হ্রাস করা হয়েছে এবং সেচকাজে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলে ২০% হারে রিবেট প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ৪% রেয়াতি সুদে ৮,৮৬,৮১৭ জন গ্রাহককে ৯১৭৫.৮৫ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করা হয়।
কৃষিপণ্য রপ্তানি বৃদ্ধি : কৃষিপণ্য রপ্তানি বৃদ্ধি করা হচ্ছে। বর্তমানে ৭০টির বেশি সবজি ও ফল বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। ইতোমধ্যে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ ১০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের মাইলফলক ছাড়িয়েছে।
সময়োচিত নীতি, কৌশল এবং কার্যকর কর্মকা-ের মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষিতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে। করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় দেশের কৃষিখাত অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে কৃষি মন্ত্রণালয় সচেষ্ট রয়েছে। সরকারের কৃষিবান্ধব নীতিসমূহ বাস্তবায়নে মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে সংকল্পে পদে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
(‘উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় কৃষি ২০০৯-২০২৩’ থেকে সংকলিত)

লেখক : উপসচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়। মোবাইল : ০১৭১১৯৩৬৪২৭,  ই-মেইল :qarayhan@gmail.com

বিস্তারিত
আলুর নাবি ধসা রোগের আক্রমণ ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনা

আলুর নাবি ধসা রোগের আক্রমণ
ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনা
ড. মোঃ জুলফিকার হায়দার প্রধান
আলু বাংলাদেশের প্রধান কন্দাল ফসল। বাংলাদেশে আলুর অবস্থান উৎপাদনের দিক দিয়ে দ্বিতীয়। ২০২১-২২ সালে দেশে আলুর আওতাধীন এলাকা ৪,৬৮,৮৮৯ হেক্টর এবং উৎপাদন ৯৮,৮৭,২৪২ মেট্রিক টন (কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ ২০২২)। আলুর নাবি ধসা (মড়ক) (খধঃব নষরমযঃ, চযুঃড়ঢ়যঃযড়ৎধ রহভবংঃধহং) রোগ বিশ^ব্যাপী একটি অত্যন্ত ক্ষতিকারক রোগ। এ রোগের আক্রমণে অল্প সময়ে একটি এলাকার ফসল সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমতাবস্থায় মড়ক রোগ হতে আলু ফসল রক্ষার জন্য এদের সঠিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা অত্যন্ত জরুরি। নি¤েœ আলু ফসলে মড়ক রোগের আক্রমণের ধরন এবং ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।   
রোগের লক্ষণ, বিস্তার ও উপযোগী আবহাওয়া
এ রোগ সবচেয়ে ক্ষতিকর এবং বাংলাদেশে প্রায়শই এ রোগে ফসল নষ্ট হয়। এ রোগ গাছের পাতা, ডগা ও কা-ে পানি ভেজা ধূসর থেকে সবুজ বর্ণের দাগ পড়ে। পাতার নিচের দিকে সাদা পাউডারের মতো ছত্রাকের জীবাণু দেখা যায়। পাতা, লতা ও কা-সহ গাছ পচে যায় এবং আক্রান্ত টিউবারের গায়ে ও ভেতরের অংশে গাঢ় বাদামি থেকে কালচে দাগ দেখা যায়। তাপমাত্রা (রাতে ১০-১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও দিনে ১৬-২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ও উচ্চ জলীয়বাষ্প তার সাথে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, কুয়াশাছন্ন আর্দ্র আবহাওয়া এবং পাতায় শিশির জমলে রোগটি মহামারি আকার ধারণ করে। এ রোগের জীবাণু বাতাস, বৃষ্টিপাত ও সেচের সাহায্যে বিস্তার লাভ করে। বাংলাদেশে প্রতি বছর এ রোগের আক্রমণ দেখা যায় এবং এদের আক্রমণে আলুর ১০০% পর্যন্ত ফলনের ক্ষতি হতে পারে।।
ব্যবস্থাপনা
রোগ প্রতিরোধের জন্য ম্যানফোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক ডাইথেন এম-৪৫ অথবা ইন্ডোফিল ২ গ্রা. প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭ দিন পরপর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
রোগের আক্রমণ শুরু হলে সিকিউর (২ গ্রাম/লিটার) বা মেলোডি ডুও (২ গ্রাম/লিটার) বা অ্যাক্রোভেট এম জেড (২ গ্রাম/লিটার) বা ঋড়ৎঁস গত (২ গ্রাম/লিটার) ৭ দিন পরপর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
যেহেতু রোগের জীবাণু পাতার নিচের দিকে থাকে এজন্য স্প্রে করার সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন পাতার নিচের অংশ ভিজে যায়। মড়ক রোগ দেখা দিলে সেচ বন্ধ করতে হবে।
ক্ষতিকর এ রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে বাংলাদেশের আলু ফসল রক্ষার জন্য কন্দাল ফসল গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট মড়করোগ প্রতিরোধী ৫টি জাত উদ্ভাবন করেছে। জাতগুলো আক্রান্ত এলাকায় চাষের মাধ্যমে ক্ষতিকর এ রোগ থেকে ফসল রক্ষা করা সম্ভব। জাতগুলোর বৈশিষ্ট্য সারণি দ্রষ্টব্য।
সারণি : আলুর নাবি ধসা রোগ প্রতিরোধী জাতের বৈশিষ্ট্য

লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বগুড়া। মোবাইল : ০১৭১৬০৭১৭৬৪, ই-মেইল :zulfikarhader321@gmail.com

বিস্তারিত
বিষমুক্ত বাঁধাকপি উৎপাদনে আমাদের করণীয়

বিষমুক্ত বাঁধাকপি উৎপাদনে আমাদের করণীয়
ড. বাহাউদ্দিন আহমেদ
বাঁধাকপি একটি জনপ্রিয় ও উৎকৃষ্ট শীতকালীন সবজি। বাঁধাকপিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ পাওয়া যায় যা শিশুর অন্ধত্ব রোগ নিবারণের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এ ভিটামিনের অভাবে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩০,০০০ শিশু অন্ধ হয়ে যায়। পুষ্টির দিক দিয়ে বাঁধাকপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিবিএস এর তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে প্রায় ২২০০০ হেক্টর জমিতে বাঁধাকপির চাষ করা হয়, যার মোট উৎপাদন মাত্র ৩,৮৪,০০০ টন। অর্থাৎ প্রতি হেক্টরে গড়ে ফলন হয় মাত্র ১৮ টন। বর্তমানে প্রায় সারা বছরই এই সবজিটি পাওয়া যায়। তবে শীতকালের তুলনায় গ্রীষ্মকালে এই সবজি আবাদে প্রচুর কীটনাশকের ব্যবহার করতে হয়। বেশি পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহারের অন্যতম কারণ হলো দুটি পাতা খেকো পোকা। প্রাথমিক অবস্থায় যদি এই পোকার আক্রমণ হয় তবে বাঁধাকপির মাথা বাঁধতে পারে না ফলে ঐ বাঁধাকপি গাছটি নষ্ট হয়ে যায়। বাঁধাকপির ফলন কম হওয়ার অন্যতম কারণই হচ্ছে পাতা খেকো (খবধভ-বধঃরহম) দুটো পোকার আক্রমণ। এই পোকা দুটোর নাম হচ্ছে ডায়মন্ড-ব্যাক মথ  এবং প্রোডনিয়া ক্যাটারপিলার , এরা বাঁধাকপির প্রচুর ক্ষতি করে।
পোকা এবং ক্ষতির বর্ণনা : ডায়মন্ড-ব্যাক মথের পূর্ণ বয়স্ক পোকা একটি ছোট আকারের মথ যার পিঠের উপরে ডায়মন্ডের মত দাগ আছে। এ জন্য একে ডায়মন্ড-ব্যাক মথ বলে। প্রোডনিয়া ক্যাটারপিলারের পূর্ণ বয়স্ক পোকাও মাঝারি আকারের ধূসর রংয়ের একটি মথ। এ দুটো পোকা শুধু কীড়া অবস্থায় বাঁধাকপির ক্ষতি করে। অন্যদিকে প্রোডনিয়া ক্যাটারপিলার বাঁধাকপি ছাড়া আরও অনেক ফসল যেমন : ফুলকপি, তামাক, আলু, মিষ্টিআলু, বাদাম, টমেটো, মরিচ, মটর, কাউপি, পাট ও কচুতে আক্রমণ করে থাকে। ডায়মন্ড-ব্যাক মথ-এর পূর্ণ বয়স্ক স্ত্রী মথ বাঁধাকপি বা ফুলকপির পাতার নিচের দিকে একটি একটি করে বা একত্রে ২-৩টি করে ডিম পাড়ে। তাপমাত্রা কমবেশি হলে ৩-৮ দিনে ডিম ফুটে কীড়া বের হয় এবং কীড়াগুলো প্রথম দিকে যে পাতায় স্ত্রী মথ ডিম পেড়েছিল সেই পাতা বা তার আশে-পাশের পাতা কুড়ে কুড়ে খায়। বড় হওয়ার সাথে সাথে কীড়াগুলো বাঁধাকপির মাঝ-পাতায় চলে যায় এবং বাঁধাকপি যখন বাঁধতে শুরু করে তখন মাঝের পাতাগুলো কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে। ফলে বাঁধাকপির পাতা বাঁধতে পারে না, অথবা অসম্পূর্ণভাবে বাধে। এইভাবে পাতা খেয়ে কীড়াগুলো পূর্ণঅবস্থায় পরিণত হয়। পূর্ণবয়স্ক কীড়াগুলো প্রায় ৮ মিমি. লম্বা হতে পারে, গায়ের রং সবুজ এবং পেট একটু মোটা হয়। পুত্তলী থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে মথ বেরিয়ে আসে। ডায়মন্ড-ব্যাক মথ-এর কীড়া একইভাবে ফুলকপি আক্রমণ ও ক্ষতি করে থাকে।
প্রোডনিয়া ক্যাটারপিলারের স্ত্রী-মথ বাঁধাকপির পাতার নীচের দিকে গুচ্ছাকারে, অর্থাৎ একসাথে অনেকগুলো ডিম পাড়ে যা বাদামি রঙের লোম দিয়ে ঢাকা থাকে। ডিম থেকে ৩-৪ দিনের মধ্যে কীড়া বের হয় এবং একসাথে সব কীড়াগুলো পাতা কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে। ফলে, বাঁধাকপির নিচের পাতাগুলো অনেক সময় ঝাঝরা হয়ে যায়। বড় হওয়ার সাথে সাথে কীড়াগুলো ক্ষেতের অন্যান্য গাছে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাঁধাকপির মাঝখানের পাতা খাওয়া শুরু করে। ফলে, বাঁধাকপির পাতা বাঁধতে পারে না বা অসম্পূর্ণভাবে বাঁধে। তাপমাত্রার হেরফেরের কারণে দুই থেকে তিন সপ্তাহে কীড়াগুলো পূর্ণঅবস্থায় আসে এবং ক্ষেতের মাটির মধ্যে শক্ত কোকুনের ভেতরে পুত্তলিতে পরিণত হয়। পূর্ণবয়স্ক কীড়াগুলো প্রায় ৪০-৪৫ মিমি. লম্বা হয় গায়ের রং কালো এবং পিঠে আড়াআড়িভাবে হলদে-সবুজ ডোরা কাটা দাগ থাকে। পুত্তলি থেকে ১০ দিন পর পূর্ণবয়স্ক মথ বেরিয়ে আসে।
কৃষকের ব্যবহৃত বর্তমান দমন পদ্ধতি : ডায়মন্ড-ব্যাক মথ ও প্রোডনিয়া ক্যাটারপিলার-এর ক্ষতি থেকে বাঁধাকপি ও ফুলকপি রক্ষার জন্য কৃষকগণ বর্তমানে শুধুমাত্র কীটনাশক ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল। প্রতি সপ্তাহে বা প্রতি দু-সপ্তাহ অন্তর তারা বিষাক্ত কীটনাশক ফসলের উপর স্প্রে করে থাকেন। কীটনাশক দিয়ে কিছু দমন হলেও, সন্তোষজনভাবে পোকা দমন হয় না। কারণ, প্রথমাবস্থায় কীড়াগুলো পাতার নিচে থাকে বলে স্প্রেকৃত কীটনাশক কীড়ার গায়ে লাগে না, ফলে বেশিরভাগ কীড়া বেঁচে যায়। দ্বিতীয়ত: কীড়াগুলো যখন বাঁধাকপি বা ফুলকপির মাঝখানে চলে যায়, তখন পাতার আড়ালে থাকে বলে কীটনাশকের সংস্পর্শে আসে না। ফলে, বেঁচে থাকা কীড়াগুলো খুব সহজেই বাঁধাকপি বা ফুলকপি ক্ষতি করতে থাকে। তৃতীয়ত: বারবার কীটনাশক ব্যবহার করার দরুন কীড়াগুলো কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে যায়। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাঁধাকপি বা ফুলকপি ফসলে যে সমস্ত কীটনাশক ব্যবহার হয় তার প্রায় প্রত্যেকটির বিরুদ্ধে ডায়মন্ড ব্যাক মথ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে পড়েছে। চতুর্থত: বারবার বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে এ দুটো পোকার প্রাকৃতিক শক্র (ঘধঃঁৎধষ বহবসরবং) মারা যায়। ফলে, ডায়মন্ড-ব্যাক মথ ও প্রোডনিয়া ক্যাটাপিলার-এর সংখ্যা বিনা বাধায় বাড়তে থাকে। সব কীটনাশকই মানুষের জন্য ক্ষতিকর। কীটনাশক ব্যবহারের পর এর বিষাক্ততা বাঁধাকপি ও ফুলকপিতে থেকে যায় এবং এসব সবজি খাওয়ার ফলে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া যেসব কৃষক কীটনাশক প্রয়োগে করেন তাদেরও নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়।
আইপিএম পদ্ধতিতে ডায়মন্ড-ব্যাক মথ ও প্রোডনিয়া ক্যাটারপিলার দমন ব্যবস্থাপনা : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীগণ আইপিএম সিআরএসপি (ওচগ ঈজঝচ) প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় কৃষকের ক্ষেতে পরীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন যে কীটনাশক ব্যবহার না করে আইপিএম (ওচগ) পদ্ধতির মাধ্যমে এই পোকা দু’টো সন্তোষজনকভাবে দমন করা যায়। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসম্মত ও বিষমুক্ত বাঁধাকপি উৎপাদন করা যায় এবং বেশি ফলন পাওয়া যায়।  অন্যদিকে বাঁধাকপির চারা লাগাবার ৩-সপ্তাহ থেকে প্রতি সপ্তাহে বাঁধাকপির ক্ষেত পর্যবেক্ষণ করে ঐ কীড়াগুলো সহজেই হাত দিয়ে ধরে মেরে ফেলা যায়। হাত দিয়ে ধরে মেরে ফেলার পরও যে সমস্ত কীড়া বেঁচে থাকে তারা প্রাকৃতিক শক্রর (বোলতা জাতীয় প্যারাসিটয়েড) আক্রমণে মারা যায়। আমাদের দেশের কৃষকগণ প্রতি সপ্তাহে অন্তত ২-৩ বার বাঁধাকপির ক্ষেত পরিদর্শন করে থাকেন। এই পরিদর্শনের সময় কপি গাছের পাতা উল্টিয়ে দেখতে হবে কোন কীড়া আছে কি না; থাকলে সঙ্গে সঙ্গে ধরে মেরে ফেলতে হবে। এইভাবে ৩-৫ বার কীড়া ধরে মেরে ফেলতে পারলে কীটনাশক ব্যবহারের কোন প্রয়োজন হয় না। তবে, পোকার আক্রমণ যদি অত্যন্ত বেশি হয় তাহলে ম্যালাথিয়ন জাতীয় কীটনাশক এক বা দুবার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে আইপিএম পদ্ধতিতে ব্যবহারের ফলে বিষমুক্ত বাঁধাকপি উৎপাদন করা যায় যা আমাদের স্বাস্থের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সবজি বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র বারি, জয়দেবপুর, গাজীপুর, মোবাইল :  ই-মেইল : bahauddinahmed57@yahoo.com

বিস্তারিত
সেচে বারিড পাইপ : পানিসম্পদ ও অর্থ সাশ্রয়

সেচে বারিড পাইপ : পানিসম্পদ ও অর্থ সাশ্রয়  
প্রকৌশলী মোঃ জিয়াউল হক
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর প্রধানতম খাদ্যশস্য ধান। দেশে মোট আবাদি জমির প্রায় ৭৫% ধান চাষ হয়। সেচনির্ভর রবি মৌসুমে বোরোতে মোট ধানের প্রায় ৫৫-৬০% উৎপাদিত হয়। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে উৎপাদন ক্ষমতা ও প্রযুক্তির আধুনিক কলাকৌশল উন্নয়ন অনস্বীকার্য। ফসল উৎপাদনের মৌলিক উপকরণ তিনটি-উন্নতজাতের বীজ, সার ও সেচ। সেচ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও উৎপাদন খরচ কমানোর মুখ্য ভূমিকা পালন করে। রবি মৌসুমে বোরো উৎপাদনে সেচ ব্যবস্থাপনায় প্রায় ৩০-৩৫% অর্থ ব্যয় হয়। সেচ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিবহন ও প্রয়োগ। সেচের পানি পরিবহন ও প্রয়োগ যথাযথভাবে নিশ্চিত হলে খরচ অনেকাংশে কমানো সম্ভব। বর্তমানে দেশে কাঁচা সেচনালায় সেচ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এতে উন্মুক্ত ডিসচার্জ বক্স এবং কাঁচা সেচনালায় অনুস্রাবণ, চোয়ানো, ইঁদুর/পোকামাকড়ের গর্ত, আগাছা ও বাষ্পীয়ভবনে প্রায় ৪০-৫০% পানির অপচয় হয় (বারি বুকলেট-১৯৯৭)। কাঁচা সেচনালায় সেচযন্ত্রের কমান্ড এরিয়ার ২-৪% জমিও অপচয় হয়। সেচের পানি উৎস হলো-ক) ভূপরিস্থ ও খ) ভূগর্ভস্থ। সারাদেশে সেচ মৌসুমে সেচকাজে উত্তোলিত পানির পরিমাণ প্রায় ৫৫ বিসিএম (বিলিয়ন কিউবিক মিটার)। তন্মধ্যে শুধুমাত্র ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলিত প্রায় ৭২%, যার পরিমাণ প্রায় ৪০ বিসিএম। তাই আধুনিক লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তির বারিড (ইঁৎরবফ) পাইপে সেচের পানির অপচয় ১% নিচে এবং জমির অপচয় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব।
সেচযন্ত্রের কমান্ড এরিয়া বৃদ্ধি এবং জমি ও পরিবহন অপচয়বিহীন স্বল্প সময়ে সহজে সুষ্ঠুভাবে সেচসুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে মাটির নির্দিষ্ট গভীরতায় পাইপ লাইনের যে নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হয় তাকে বারিড পাইপ সেচ পদ্ধতি বলা হয়। বর্তমানে আধুনিক লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তির পলি-ভিনাইল ক্লোরাইড ও আন-প্লাস্টিসাইজড পলি-ভিনাইল ক্লোরাইড এবং হাই-ডেনসিটি পলি ইথিলিন পাইপের মাধ্যমে বারিড পাইপ সেচ পদ্ধতি স্থাপিত হচ্ছে। যার স্থায়িত্বকাল প্রায় ৪০-৫০ বছরেরও অধিক। ফলে মেরামতের প্রয়োজন হয় না এবং যেকোন মৌসুমে সেচ প্রদান করা সম্ভব। আবার যে সকল এলাকা বারিড পাইপে পানি পরিবহনে অসুবিধা সময়মতো সেচ প্রদান করা সম্ভব হয় না, সে সকল এলাকায় ফিতা/হাজ পাইপ খুবই উপযোগী ও কার্যকরী পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে পানি প্রবাহের মাধ্যমে সেচ প্রদানে পানি ও জমির অপচয় হয় না এবং সেচ খরচ অর্ধেক হয়।
বারিড পাইপে সুবিধাসমূহ
জমির অপচয় হয় না, ফলে সেচনালায় ব্যবহৃত জমিতে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদিত হয়; অনুস্রাবণ, চোয়ানো, আগাছা, বাষ্পীয়ভবন হয় না। এতে পানির অপচয় মাত্র ১% নিচে নামানো সম্ভব; বন্যা/বৃষ্টি/প্রাকৃতিক দুর্যোগে বারিড পাইপ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, ফলে মেরামত প্রয়োজন হয় না; প্রাথমিক খরচ বেশি, তবে দীর্ঘমেয়াদি খরচ কম। সেচে সময় কম লাগে, শ্রম ও জ্বালানি সাশ্রয় হয়;  উঁচু-নিচু বা খাল-বিল অতিক্রম করে সেচ প্রদান এবং কৃষিজ যন্ত্রপাতি, ফসল পরিবহন ও ন্যায্য মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত হয়; সেচযন্ত্রের ১০-১২% কমান্ড এরিয়া বৃদ্ধিসহ সেচ দক্ষতা ও সেচের নিবিড়তা বৃদ্ধি পায়; সর্বোপরি ভূগর্ভস্থ পানির নিম্নগামিতা রোধ এবং পরিবেশসম্মত আধুনিক লাগসই ও টেকসই সেচ প্রযুক্তি।
বারিড পাইপ স্থাপনে করণীয়সমূহ
    রবি সৌসুমে বোরোতে সেচকৃত এলাকা প্রায় ৭৩%। কৃষকদের  বারিড পাইপ ব্যবহারের সুবিধাদি, সম্প্রসারণ ও কম জীবনকালের ধানের জাত নির্বাচনে ব্যাপক প্রশিক্ষণ এবং মোটিভেশনের মাধ্যমে সচেতন করতে হবে। সেলক্ষ্যে সেচের পানি সুষ্ঠু ব্যবহারে কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দেশে মাথাপিছু আবাদি জমি মাত্র ০.০৪৯ হেক্টর। এ খ- খ- জমিতে বারিড পাইপে সেচ প্রদান অনেক সময় সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাই সমবায় ভিত্তিতে সেচ কার্যক্রম সম্পাদনের নিমিত্ত পানি ব্যবহারকারী দলকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
    কৃষি কাজে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১৮ ও তদ্বীয় বিধিমালা-২০১৯ অনুযায়ী সেচযন্ত্র স্থাপন করতে হবে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বারিড পাইপ সেচের সুবিধাদির বোধগম্যের ডকুমেন্টেশন তৈরি এবং কৃষকদের মাঝে প্রচার-প্রচারণা করতে হবে। কৃষি উদ্যোক্তাদের প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষিমূখীকরণ এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে। বারিড পাইপ মাঠপর্যায়ে বিস্তার ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সেচপাম্প মালিক/ম্যানেজারকে সহজশর্তে স্বল্প সুদে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা অথবা সরকারি পর্যায়ে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।  
২০২১-২২ সেচমৌসুমের সেচযন্ত্র জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে মোট সেচকৃত এলাকা ৫৬,৮৯,৫৮০ হেক্টর এবং সেচযন্ত্রের সংখ্যা ১৭,১২,৫১৫টি। তন্মধ্যে আধুনিক সেচযন্ত্রে (গভীর নলকূপ, অগভীর নলকূপ, সৌর শক্তিচালিত ও শক্তিচালিত পাম্প) সেচকৃত এলাকা ৫৪, ২৯,৫৬৯ হেক্টর এবং সনাতনী গঙঝঞও ও ‘গ্র্যাভিটি ফ্লো’তে মোট ২,৬০,০১২ হেক্টর (সূত্রঃ জওপ  প্রকল্প, বিএডিসি)। সেচযন্ত্রের কমান্ড এরিয়ার ওপরভিত্তি করে বারিড পাইপের দৈর্ঘ্য নির্ণয় করা হয়। সারা দেশে মোট সেচকৃত এলাকায় বারিড পাইপের চাহিদা প্রায় ৪.২৫ লক্ষ কিলোমিটার (কিমি.)। ইতোমধ্যে বিএডিসি ১২,৫২৪ কিমি. এবং বিএমডিএ কর্তৃক ১৫,০২৬ কিমি. অর্থাৎ মোট ২৭,৫৫০ কিমি. বারিড পাইপ স্থাপিত হয়েছে। যা মোট চাহিদার মাত্র ৬.৫% (প্রায়)। বাকি ৩.৯৭ লক্ষ কিমি. বারিড পাইপ স্থাপন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সেচযন্ত্রের কমান্ড এরিয়া, সেচের নিবিড়তা ও সেচ দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ বা জ্বালানি খরচ হ্রাস ও অপারেটর ভাতার বিপুল পরিমাণ অর্থের সাশ্রয় করা সম্ভব। এমতাবস্থায় নি¤েœ সাশ্রয়কৃত অর্থের পরিসংখ্যান প্রদত্ত হলো-
কাঁচা সেচনালার জমি উদ্ধার : কাঁচা সেচনালা তৈরিতে জমি অপচয় গড়ে ৩% হিসেবে মোট সেচকৃত এলাকা ৫৪,২৯,৫৬৯ হেক্টরে অপচয়ের পরিমাণ প্রায় ১.৬৩ লক্ষ হেক্টর। ইতোমধ্যে বিএডিসি এবং বিএমডিএ কর্তৃক ২৭,৫৫০ কিমি. বারিড পাইপ স্থাপনে প্রায় ১০.৫০ হাজার হেক্টর জমি উদ্ধার এবং আবাদের আওতায় এনে অতিরিক্ত প্রায় ৫২.৫ হাজার মে. টন খাদ্য শস্য উৎপন্ন করা সম্ভব হয়েছে (৫ টন/হেক্টর)। অতএব, বাকি কাঁচা সেচনালাসমূহ বারিড পাইপে রূপান্তরের মাধ্যমে প্রায় ১.৫২ লক্ষ হেক্টর জমি উদ্ধার করে আবাদের আওতায় এনে রবি মৌসুমে আরও অতিরিক্ত প্রায় ৭.৬২ লক্ষ মে.টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হবে। যার বাজারমূল্য প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা।
সেচযন্ত্রে তৈল-জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খরচ: কাঁচা সেচনালায় সেচমৌসুমে ইঞ্জিনচালিত গভীর নলকূপ, অগভীর নলকূপ ও শক্তিচালিত পাম্পে ব্যবহৃত তৈল-জ্বালানি বাবদ খরচের পরিমাণ প্রায় ১১,১০০ কোটি টাকা (তেলসহ ডিজেল ১১০ টাকা/লিটার)। অপরদিকে মোটরচালিত গভীর নলকূপ, অগভীর নলকূপ ও শক্তিচালিত পাম্পে বিদ্যুৎ বাবদ খরচের পরিমাণ প্রায় ১,০৯০ কোটি টাকা (বিদ্যুৎ ৪.৮২ টাকা/ইউনিট, রিবেট ২০%)। অর্থাৎ প্রতি সেচমৌসুমে ইঞ্জিন ও মোটরচালিত সেচযন্ত্রে মোট খরচের পরিমাণ ১২,১৯০ কোটি টাকা। তাই মাঠে কাঁচা সেচনালাগুলোকে বারিড পাইপে রূপান্তর করা হলে পরিবহন অপচয় প্রায় ৫০% হ্রাস পাবে। ফলে সেচমৌসুমে প্রায় ৬,০৯৫ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
সেচমৌসুমে পাম্প অপারেটর ভাতা : সেচমৌসুমে সেচযন্ত্র প্রতি একজন পাম্প অপারেটর প্রতি মাসে ১৫,৫০০/- টাকা (পাম্প পরিচালনা ও কাঁচা সেচনালা মেরামত ও সংরক্ষণ) হিসেবে ৩ মাসে মোট ১৭,১২,৫১৫ টি সেচযন্ত্রের অপারেটর ভাতা বাবদ মোট ৭,৯৬৩ কোটি টাকা। বারিড পাইপে রূপান্তর করার হলে সেচমৌসুমে পরিবহন অপচয় ৫০% হ্রাস হিসেবে সময়ও অর্ধেক কম লাগবে বিধায় পাম্প অপারেটর ভাতা ৩,৯৮২ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
এমতাবস্থায়, সেচমৌসুমে মোট সাশ্রয়কৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় ১২,০৭৭ কোটি টাকা। তাই কৃষিবান্ধব সরকার কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে, সীমিত পানিসম্পদের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি সেচযন্ত্রের প্রধান, শাখা ও উপশাখা কাঁচা সেচনালাগুলো বারিড পাইপে রূপান্তর করা হলে জমি, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও শ্রমের অপচয় হতে প্রতি সেচমৌসুমে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে, এতে সেচ খরচও হ্রাস পাবে। প্রতি সেচমৌসুমে প্রায় ২০ বিসিএম পানি কম উত্তোলিত, ভূগর্ভস্থ পানি নিম্নগামিতা হ্রাস এবং লবণ পানির অনুপ্রবেশ রোধ হবে। এ ক্ষতি জাতীয় কৃষিসম্পদের অর্থাৎ সরাসরি প্রতিটি কৃষকের ক্ষতি। বছরের পর বছর এ ক্ষতি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কৃষককুলকে করছে নিঃস্ব। আর কৃষিকে করছে অলাভজনক। শুধুমাত্র প্রকৌশলগত প্রযুক্তি ব্যবহারে স্বল্প সময়ে অল্প ব্যয়ে এবং সহজে এ ক্ষতি পুরাপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাই অবশিষ্ট ৩.৯৭ লক্ষ কিমি. বারিড পাইপ স্থাপনে মোট প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। যা মাত্র আড়াই সেচমৌসুমে খরচোত্তর পুনঃপ্রাপ্তি (জবপড়াবৎু) নিশ্চিত হবে। ফলে প্রতিটি সেচযন্ত্রের কমান্ড এরিয়া, সেচ দক্ষতা, সেচের নিবিড়তা বৃদ্ধি পাবে। দেশের পানিসম্পদ, যা কৃষি ও মাৎস্যসম্পদের উৎপাদনশীল রাখবে, তার নিরাপত্তা বিধানে আধুনিক লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তি প্রয়োগে অগ্রসর হতে হবে। অন্যথায়, আগামী প্রজন্মের প্রতি দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতার জন্য চিহ্নিত হতে হবে। এতে সেচযন্ত্রসমূহ সেন্সর যুক্ত রিমোট কন্ট্রোলে পরিচালিত হবে। ফলে বারিড পাইপ সেচ পদ্ধতি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে প্রবেশ করবে।

“কাঁচা নালা ভাল নয়, পানির অপচয় বেশি হয়”

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সদস্য পরিচালক (ক্ষুদ্রসেচ), বিএডিসি। ২৭/২ পশ্চিম নাখালপাড়া, এডাপ্টরহমান গার্ডেন (ফ্ল্যাট নং ৭/এ), তেজগাঁ, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৮৭৮১৯৭৯

বিস্তারিত
পাট-ও-পাটজাতীয়-আঁশ-ফসলের-বীজ-সংগ্রহ-সংরক্ষণ-ও-মাননিয়ন্ত্রণ

পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের বীজ
সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও মাননিয়ন্ত্রণ
কৃষিবিদ ড. মোঃ আল-মামুন
বাংলার নিজস্ব সম্পদ, অত্যন্ত মূল্যবান অর্থনৈতিক সম্পদ। বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় তিন শতাংশ পাট থেকে আসে এবং দেশের জিডিপিতে এর অবদান প্রায় শতকরা তিন ভাগ। এ দেশের প্রায় ৪০ লাখ কৃষক পাটের ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। বিশ্বে পাট উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারক দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমাদের দেশে প্রায় ৭ লাখ ৬৪ হাজার হেক্টর জমিতে পাট, কেনাফ ও মেস্তা ফসল চাষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষকের চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে জাতীয় বীজ বোর্ডের ১০৯তম সভায় এ বছর পাট, কেনাফ ও মেস্তা ফসলের বীজের বার্ষিক চাহিদা নির্ধারিত হয়েছে ৬ হাজার ৩৬৯ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বিএডিসি সরবরাহ করবে ১ হাজার ৩০০ টন বীজ, আর প্রায় ৫ হাজার ২০০ টন বীজ ভারত থেকে আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, গত ২০২২-২৩ উৎপাদন বছরে ৪ হাজার ১৬৬ টন পাট ও কেনাফ ফসলের বীজ আমদানি করা হয়েছিল ভারত থেকে। এভাবে প্রতি বছর পাট ও কেনাফ বীজ আমদানি করতে প্রায় ৫ থেকে ৭ শত মিলিয়ন টাকার বিশাল বাজার হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে আমাদের। তাছাড়া অনেক সময়ই কৃষক বীজের গুণাগুণ সম্পর্কে না জেনে, মাঠে বপন করে কাক্সিক্ষত ফলন না পেয়ে প্রতারিত হয়ে থাকেন। আমাদের দেশে পাট ও কেনাফ বীজ উৎপাদনে স্বাবলম্বী হওয়া এবং নিজের বীজ নিজেই উৎপাদন করে কৃষকরা যাতে অধিক লাভবান হতে পারেন, সেজন্য উন্নতমানের পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের বীজ উৎপাদন কলাকৌশল সম্পর্কে তাদের ধারনা থাকা দরকার।
বীজ ফসলের পরিচর্যা এবং রোগবালাই দমন
মাঝে মাঝে আঁচড়া বা নিড়ানি দিয়ে মাটি ঝুর ঝুরে রাখতে হবে। ২য় কিস্তির সার প্রয়োগের ২/১ দিন পূর্বে নিড়ানি দিয়ে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। শেষ বা ৩য় কিস্তির সার প্রয়োগের পূর্বে আর একবার নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। গাছে আগামরা বা কা- পচা রোগ দেখা দিলে প্রাথমিকভাবে রোগাক্রান্ত গাছসমূহ উপরে ফেলতে হবে অথবা আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে আক্রমণ রোধ করার জন্য ম্যানকোজেব গ্রুপের যেকোনো ছত্রাকনাশক ১০ লিটার পানি ২০ মিলি. ৭ দিন পরপর ০৩ বার স্প্রে করা যেতে পারে। নাবি পাট বীজ ফসলে সাধারণত হলদে মাকড়ের আক্রমণের শুরুতে নিম পাতার নির্যাস (১ ভাগ কাচা নিম পাতার রস ২০ ভাগ পানিতে মিশিয়ে) স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। সুস্থ ও নিরোগ বীজ বপন করলে এবং জমি পরিষ্কার রাখলে জমিতে রোগবালাই কম হবে।
বীজ ফসল থেকে ফসল সংগ্রহের সময়
পাটবীজ বেশি পাকলে ফল ফেটে বীজ জমিতেই ঝরে পড়ে অথবা ফলের খোসা ফেটে যায় এবং রাতের বেলায় কুয়াশার পানি চুইয়ে ফলের ভেতরে জমা হয়। ক্রমাগতভাবে কয়েকদিন কুয়াশার পানি ফলের ভেতর জমলে সেই বীজ খারাপ হয়ে যায়। আর কম পাকলে বীজ চিটা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শতকরা ৭০-৮০ ভাগ ফল বাদামি রং ধারণ করলে গাছের গোড়া সমেত কেটে ফসল সংগ্রহ করতে হবে। ফসল কাটার জন্য শুকনা দিন বেছে নিতে হবে। বৃষ্টি ভেজা দিনে পাকা ফসলসহ গাছ না কাটাই উত্তম। বৃষ্টির পানি বীজের ভেতরে ঢুকলে ছত্রাক জাতীয় জীবাণুর সংক্রমণ ঘটে বিধায় বীজের গুণগত মান কমে যায়। তাই ফসল সংগ্রহের সময় আবহাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা দরকার।
খুব সকালে পাট বীজ কর্তন করা উচিত নয়। পরিষ্কার দিন দেখে সকাল ১০টা থেকে পাট বীজ কর্তন করা ভালো। দিনের শেষ ভাগে ফল বেশি শুকনা অবস্থায় কর্তন করলে ফল ফেটে অনেক বীজ ঝরে পড়ে। বীজ ফসল কর্তনের সময় জমিতে মরা ও শুকনা গাছগুলো বাদে বীজ ফসল সংগ্রহ করতে হবে। মরা ও রোগাক্রান্ত গাছ একই সাথে কর্তন করলে সমস্ত বীজ রোগজীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। বীজ ফসলের ক্ষেত্রে বীজের পরিমাণের চেয়ে গুণগত মান অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
বীজ ফসল মাড়াই, ঝাড়াই ও শুকানো
ফলসহ গাছের ডগা সংগ্রহ করার পর স্তূপ আকারে জমা না করে, কিছুটা ফাঁকা ফাঁকা করে রৌদ্রে দাঁড় করিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে রাতের বেলা ত্রিপল দিয়ে গাছের ডগাসমূহ ঢেকে রাখতে হবে যাতে রাতের কুয়াশা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ক্রমাগতভাবে পাঁচ দিন রোদে শুকানোর পর লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বীজ আলাদা করতে হবে। গরু দিয়ে মাড়াই করা যাবে না। গরু দিয়ে মাড়াই করলে পাটের ছোট বীজ গরুর পায়ের চাপে নষ্ট হবে। মাড়াই করার পর বীজ ভালো করে পরিষ্কার করে শুকানোর জন্য পাকা থ্রেসিং ফ্লোরে ত্রিপল বা চটজাতীয় কোনো কিছুর উপর বীজ শুকাতে হবে। অন্যথায় গরম মেঝের সংস্পর্শে বীজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ অর্থাৎ ভ্রƒণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
বীজ শুকানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে গরম বীজ স্তূপ আকারে রাখা না হয়। প্রতিদিন বীজ শুকানো শেষে ঠা-া করে পলিথিন, চট বা ত্রিপল দিয়ে ভালো করে রাতের বেলা ঢেকে রাখতে হবে যেন কুয়াশা বা বৃষ্টিতে না ভিজে। বীজ ছাড়ানোর সময় বীজে পানির অংশ শতকরা ১২-১৫ ভাগ দেখা যায়। এই পানির ভাগ রোদে শুকিয়ে শতকরা ৭/৮ ভাগের মধ্যে আনতে হবে। সংগ্রহকৃত বীজের মধ্যে গাছের ডাল-পালা, ফলের খোসা, মাটির কণা, চিটা বা অর্ধ্য পুষ্ট বা রোগাক্রান্ত বীজ এবং অন্যান্য আবর্জনা থাকলে তা ভালো করে ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
কৃষকপর্যায়ে পাট বীজের গুণগত মান পরীক্ষা
আমরা জানি যে ভালো মানের বীজ সব ফসলের বেলাতেই প্রায় শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ বেশি ফলন দিয়ে থাকে। বীজ যত ভালো হবে তত তাড়াতাড়ি গজাবে। এটাই ভালো বীজের লক্ষণ। পাট, কেনাফ ও মেস্তা জাতের বীজ বপন করার আগে বীজের ভালোমন্দ বিশেষত অংকুরোদগম ক্ষমতা পরীক্ষা করে নেয়া ভালো। খুব সহজে এবং অল্প খরচে এ কাজ করা যায়। প্রথমে একটি মাটির সানকিতে একপরত ভেজা কাপড় বা চোষা কাগজ (ব্লটিং পেপার) বা তা না থাকলে নিউজপ্রিন্ট ২/৩ পরত বিছিয়ে পানি দিয়ে ভালো করে ভিজিয়ে নিয়ে তার উপর ১০০ টি বীজ সুন্দর করে ছড়িয়ে দিতে হবে। সানকির তলায় যে জায়গা থাকে তাই ১০০টি বীজ ছাড়ানোর জন্য যথেষ্ট। একটি সানকি বা সরা দিয়ে ঐ বীজ ওয়ালা সানকি ঢেকে দিতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে যেন সানকির কাপড় শুকিয়ে না যায় অথবা বীজ পানিতে ডুবে না যায়। সে জন্য দিনে একবার দেখে, শুকিয়ে থাকলে দরকার মত পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। বীজ বসানোর তিন দিন পর মোট যে কয়টি বীজ গজানো দেখা যাবে সেটাই হলো বীজ গজানোর শতকরা হার। শতকরা ৮০টির অধিক বীজ গজালে তাকে ভালো বীজ বলা যেতে পারে। যদি শতকরা ৭০টির অধিক কিন্তু ৮০টির কম বীজ গজায় তাহলে বীজ বপনের সময় বীজের অংকুরোদগমের অনুপাতে বীজের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে বপন করতে হবে। শতকরা ৭০টির কম বীজ গজালে ঐ বীজ বপন না করাই ভালো।
কৃষকপর্যায়ে পাটবীজের সংরক্ষণ
বীজ সংরক্ষণের পূর্বে সংগ্রহকৃত বীজের মধ্যে গাছের        ডাল-পালা, ফলের খোসা, মাটির কণা, চিটা বা অর্ধ পুষ্ট বা রোগাক্রান্ত বীজ এবং অন্যান্য আবর্জনা থাকলে তা ভালো করে ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। ভালোভাবে শুকানোর পর শুকনো বীজকে দুই দাঁতের ফাঁকে নিয়ে চাপ দিলে যদি কট করে বীজটি ভেঙে যায়, তাহলে বুঝতে হবে বীজ ভালো ভাবে শুকানো হয়েছে। শুকানোর পর বীজের আর্দ্রতা সাধারণত শতকরা ৮-৯ এর কাছাকাছি অবস্থায় টিনের কৌটা, প্লাস্টিকের ক্যান, প্লাস্টিক ড্রাম ইত্যাদি বায়ুরোধী পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করা ভালো। যদি বায়ুরোধী পাত্র না পাওয়া যায় তখন মাটির কলসী, হাড়ি বা মটকায় বীজ রাখা যেতে পারে। তবে এসব পাত্রে বীজ রাখার পূর্বে মাটির কলসী, হাড়ি বা মটকায় আলকাতরা বা রংয়ের প্রলেপ দিতে হবে অথবা বীজ রাখার পূর্বে মোটা পলিথিন দিয়ে ভালোভাবে ঐ পাত্র মুড়ে দিতে হবে যাতে মাটির পাত্রটি বায়ুরোধী হয়। বড়পাত্রে অল্প পরিমাণ বীজ রাখা ঠিক হবে না। এতে পাত্রের খালি অংশের আর্দ্রতা বীজের গুণগত মান খারাপ করে দিতে পারে। সঠিক আর্দ্রতায়, সাধারণ তাপমাত্রায় লেমোফয়েল ব্যাগে বীজ সংরক্ষণ করলে ৩ বছর পর্যন্ত তা ভালো থাকে। বায়ুরোধী প্লাস্টিক বা টিনের পাত্রে সংরক্ষণকৃত বীজ ২ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। অন্যান্য পাত্র যেমন- পাতলা পলিথিন ব্যাগ, কাপড়/ছালা বা কাগজের ব্যাগ অথবা সরাসরি মাটির পাত্রে সংরক্ষণ করলে তা ৩-৪ মাস পর্যন্ত ভালো থাকে। সংরক্ষণের সময় প্রতি কেজি বীজের জন্য ৪ গ্রাম ভিটাভেক্স-২০০ দিয়ে শোধন করে রাখলে বীজ দীর্ঘদিন ভালো থাকে এবং পরবর্তী বপন মৌসুমে বীজ ভালোভাবে গজিয়ে থাকে।
কৃষক ভাইয়েরা নিজেদের উদ্যোগে যে বীজ উৎপাদন করে থাকেন তা যদি উপযুক্ত সময়ে ও সঠিক পদ্ধতিতে কর্তন এবং সংরক্ষণ করা না হয় তাহলে একদিকে যেমন উৎপাদিত বীজের গুণগত মান খারাপ হবে অন্যদিকে বীজের অপচয় হওয়ারও আশংকা থাকে। বিশ্লেষকরা বলছেন, উৎপাদন বৃদ্ধিতে ঘাতসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন এবং কৃষকদের কাছে সব সুবিধা দ্রুত পৌঁছে দিতে পারলে আমাদের দেশে অন্তত ১০ লাখ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ সম্ভব। এছাড়া শুধুমাত্র ভালো মানের বীজ ব্যবহার করে শতকরা প্রায় ২৫-৩০ ভাগ ফলন বৃদ্ধি করা যায়। অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি ও মাটি পাট উৎপাদনের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা রয়েছে। বিশ্বের এই চাহিদা মেটাতে, পাটকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে আমাদের কাজ করতে হবে। পরিবেশবান্ধব পাট শিল্পের এ বৈপ্লবিক পরিবর্তন দ্রুতই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে পরিগণিত হবে এবং বিশ্ববাজারে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিতে সক্ষম হবে।

লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মোবাইলঃ ০১৭১১১৮৬০৫১, ই-মেইল :almamunbjri@gmail.com

বিস্তারিত
পুষ্টি নিরাপত্তায় খেজুরের গুড়

পুষ্টি নিরাপত্তায় খেজুরের গুড়
ড. মোছা. কোহিনুর বেগম
খেজুরের গুড় হচ্ছে প্রাকৃতিক মিষ্টি। খেজুরের  গুড়ে রয়েছে মিষ্টি স্বাদ ও পুষ্টিগুণ দুটোই। গুড় শুধুমাত্র আমাদের আকাক্সক্ষাই মেটায় না বরং অনেক থেরাপিউটিক সুবিধা নিয়ে আসে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়। খেজুরের গুড়  খেজুর গাছের নির্যাস থেকে তৈরি করা হয় এবং এটি তরল বা শক্ত ব্লক  হিসেবে পাওয়া যায়। এটি একটি অপ্রক্রিয়াজাত বিশুদ্ধ চিনির রূপ।
খেজুরের গুড়ের প্রকারভেদ
নলেন গুড় : এই গুড় তৈরি করা হয় খুব ভোরে তোলা প্রথম রস থেকে। যশোরের নলেন গুড় তার স্বতন্ত্র স্বাদ  ও সতেজতার কারণে  অনেকের  হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
জিরেন গুড় : এই গুড়টি রসের দ্বিতীয় ব্যাচ থেকে তৈরি করা হয় যা ভোরবেলা প্রথম রসের পরে বের করা হয়।
ঝোলা গুড় : এই গুড় আকারে তরল। বায়ুম-লের তাপমাত্রা ২৪০ সে. এর নিচে না নামলে প্রাকৃতিকভাবে খেজুরের রসে সুক্রোজ বা চিনি তৈরি হয়না তাতে রিডিউসিং সুগার এর পরিমান বেশি থাকে। ফলে এই রস থেকে প্রস্তুতকৃত গুড় আকারে তরল হয়। আমাদের দেশে সাধারণত সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এবং মার্চ মাসে প্রস্তুতকৃত খেজুরের গুড় আকারে তরল হয় যদিও গুড় চাষিরা রস জ্বাল দেয়ার সময় এতে চিনি মিশিয়ে তা থেকে পাটালি প্রস্তুত করে।
পাটালি গুড় : এই গুড় আকারে শক্ত। আমাদের দেশে নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রস্তুতকৃত খেজুরের গুড় আকারে শক্ত হয় যা পাটালি নামে পরিচিত।
খেজুর গুড়ের পুষ্টিমাণ
চিনির স্বাস্থ্যকর বিকল্প হিসেবে খেজুরের গুড় খাওয়া যেতে পারে কারণ এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স অনেক কম (৪১)। এটা কোনো রকম রাসায়নিক এর ব্যবহার ছাড়াই তৈরি করা হয় এবং এতে সুক্রোজ বা নিয়মিত চিনির চেয়ে কম শক্তি থাকে। খেজুরের গুড়ে প্রতি ১০০ গ্রামে ৩৮৩ ক্যালরি রয়েছে। মাত্র ২০ গ্রাম এর মধ্যে ৩৮ ক্যালরি, ৯.৮ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৯.৭ গ্রাম চিনি, ০.০১ গ্রাম প্রোটিন, সেইসাথে কোলিন, বিটেইন, ভিটামিন বি ১২ এবং বি ৬, ফোলেট, ক্যালসিয়াম এবং ৯.৭ গ্রাম চিনি রয়েছে ।
খেজুর গুড়ের উপকারিতা
খেজুরের গুড়ের কিছু অবিশ্বাস্য উপকারিতা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো-
শক্তি বর্ধনকারী : খেজুর থেকে পাওয়া গুড় একটি জটিল কর্বোহাইড্রেট। সাদা চিনির বিপরীতে এটি হজম হতে বেশি সময় নেয় যা আমাদেরকে সারাদিন ধরে টেকসই শক্তি প্রদান করে।
স্বাস্থ্যকর হজম পুনরুদ্ধার করে : খেজুরের গুড়ের হজমের উপকারিতা রয়েছে। প্রতি বেলায় আহারের পরে অল্প পরিমাণ খেজুরের গুড় খাওয়া অন্ত্রের ট্র্যাক্ট পরিষ্কার করে এবং এনজাইমগুলো সক্রিয়  করে  হজমে সহায়তা করে।
কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি দেয় : খেজুরের গুড়ে প্রচুর ডায়েটারি ফাইবার রয়েছে। এই ফাইবারগুলো কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে সহায়তা করে।
পেশি স্বাস্থ্য উন্নত করে : বাংলাদেশে আয়রন ঘাটতি সাধারণ পুষ্টি ঘাটতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। আয়রন স্বাস্থ্যকর পেশি এবং ইমিউন সিস্টেম বজায় রাখার জন্য  একটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ। খেজুর থেকে তৈরি গুড় লোহার একটি বড় উদ্ভিদভিত্তিক উৎস, যা দৈনিক চাহিদার ১১ মিলিগ্রাম বা ৬১% প্রদান করে।
মাইগ্রেন কমাতে সাহায্য করে : খেজুর গুড়ের প্রাকৃতিক ঔষুধি উপাদান মাইগ্রেন কমাতে সাহায্য করে।
ত্বক ও চুলের জন্য দরকারী : গুড় ত্বকের জন্য উপকারী। কারণ এতে রয়েছে গ্লাইকোলিক এসিড যা ত্বকের অসঙ্গতি এবং ত্রুটিগুলি সংশোধন করতে কাজ করে। উপরন্তু এটি ত্বকের নমনীয়তা বাড়ায়, যা বলিরেখা এবং সূক্ষরেখার মতো বার্ধক্যের লক্ষণগুলোকে হ্রাস করে। গ্লাইকোলিক এসিড সুন্দর মসৃণ ত্বকের উন্নতির জন্য একটি হালকা এক্সফোলিয়েট হিসেবে কাজ করে। গুড়ে রয়েছে প্রচুর আয়রন যা চুল পড়া রোধ করে। আয়রন হিমোগ্লোবিনের সংশ্লেষণে সাহায্য করে যা ত্বকের শিরাগুলোতে রক্ত প্রবাহ বাড়ায়  এবং চুলের ক্ষতি কমাতে চুলের বিকাশকে উৎসাহিত করে ।
সর্দি ও কাশির চিকিৎসা করে : ইমিউন সিস্টেমের প্রদাহজনক প্রতিক্রিয়া সর্দি এবং কাশি উপসর্গ সৃষ্টি করে। খেজুরের গুড় সবচেয়ে নিবিড়ভাবে যে রোগের চিকিৎসা করতে পারে তা হলো সর্দি এবং কাশি। এটি এককাপ গরম পানি বা চায়ে যোগ করা হলে তা শ্বাসযন্ত্র পরিষ্কার করতে এবং বেশ কয়েকটি উপসর্গ উপশম করতে সহায়তা করে। খেজুরের গুড়ে বেশ কিছু ফেনোলিক এন্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে।
বিবিধ : খেজুরের গুড় নিয়মিত খেলে রক্তস্বল্পতা কমে এবং হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এতে ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে যা মস্তিস্কের সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণকে সমর্থন করে। খনিজ ক্যালসিয়াম হাড়ের গঠন শক্তিশালী করে।
এটিতে পটাশিয়ামও রয়েছে যার বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে হৃদরোগের উন্নতি। উপরন্তু এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, অন্যদের পাশাপাশি রক্ত সম্পর্কিত বেশ কিছু অসুস্থতা কমায়।
আমাদের স্বাস্থ্যকর খাদ্যতালিকাগত আইটেমগুলোর সাথে খেজুরের গুড় খাওয়ার আগে মনে রাখতে হবে যে, এই গুড় পরিমিতভাবে  খেতে হবে  কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে চিনি রয়েছে। এটি পানীয়, ডেজার্ট এবং অন্যান্য খাবারের জন্য প্রতিদিনের রেসিপিগুলোতে চিনির মতো  ব্যবহার করতে পারি ।         
বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট বহুগুণে ভরপুর এই মিষ্টিজাতীয় গাছটির উপর বিভিন্ন ধরনের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে এবং কিভাবে এটি থেকে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে রস এবং গুড় তৈরি করা যায় এবং এর পুষ্টিমান অক্ষুণœ রাখা যায় তার উপর পরিচালিত গবেষণালব্ধ ফলাফল দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ও পরিচালনা করে আসছে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১৫ কোটি ২৫ লাখ ৬৪ হাজার লিটার খেজুরের রস উৎপাদিত হয়, (বিবিএস ২০২১-২২)। ৮% রিকভারী ধরে হিসাব করলে এই রস থেকে উৎপাদিত গুড়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২২০.৫৩ মে.টন। বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট এর লক্ষ্যই হলো শতভাগ স্বাস্থ্যসম্মত গুড় উৎপাদন করা।

লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিএসআরআই, ঈশ্বরদী, পাবনা। মোবাইল: ০১৭৩১৯১৯১৭৪; মেইল: kohinoorbegum.bsri@gmail.com

বিস্তারিত
শীতকালীন সবজি চাষাবাদের বিশেষ প্রযুক্তি

শীতকালীন সবজি চাষাবাদের বিশেষ প্রযুক্তি
কৃষিবিদ মাহাজুবা তাসমিন
জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ^ পরিবেশ বিপর্যস্ত। পরিবেশবান্ধব কৃষি এখন সময়ের জলন্ত ইস্যু। আর তারই এক উল্লেখযোগ্য অংশ জৈব কৃষি প্রযুক্তি। রবি মৌসুম সবজি সমারোহের মৌসুম। বাংলাদেশে চাষকৃত প্রচলিত অপ্রচলিত সবজির সংখ্যা প্রায় ৯০টি যার মধ্যে ৩০টি প্রধান। সবজি চাষে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি মাটির স্বাস্থ্য ও গুণাগুণ ঠিক রাখে ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমায়। নিরাপদ/বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন, আগাছা দমন ও কীটনাশকের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে। এ সময়ে দু’টি উল্লেখযোগ্য জৈব কৃষি প্রযুক্তি ট্রাইকোকম্পোস্ট ও পলিমালচিং শিট প্রযুক্তি। নি¤েœ এ দু’টি প্রযুক্তির বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
মালচিং এর ধারাবাহিকতায় এসেছে আধুনিক চাষাবাদের এক উন্নত প্রযুক্তি পলিফিল্ম মালচ। মালচিং পেপারের উপরের দিকে অ্যাশ কালার ও ভেতরের দিকে কাল রং থাকে। সূর্যের আলো অ্যাশ কালারের উপরে পড়ায় তাপমাত্রা বিচ্ছুরণ হয়ে সালোকসংশ্লেষণ এর মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে উদ্ভিদটির স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। ভেতরের পেপার কালো রং এর হওয়ায় তা মাটির তাপমাত্রা ধরে রাখে। মাটি ঠা-া থাকে।
পলিফিল্ম মালচ ব্যবহারের সুবিধা : মাটিতে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদান ও সার পুরোটা গাছ পাবে। পরে ফলন বৃদ্ধি পাবে ১-১.৫ গুণ; সূর্যের তাপ সরাসরি না লাগায় সেচ কম লাগে। মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ রস বিদ্যমান থাকে; পলিফিল্ম মালচ ব্যবহারে শুধুমাত্র নালাতে আগাছা জন্মায়। মূল বেডে আগাছা জন্মানোর সুযোগ নেই। নালার আগাছা ৪৫ দিন পর কোদাল দিয়ে টেনে উপড়ে ফেলা সম্ভব। ফলে শ্রমিক খরচ কম হয়; অনেক গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারেনা যেমন, টমেটো। শিট ব্যবহার করলে অতিরিক্ত পানি ঝরে যায়; সারের ও পানির পরিমাণ কম লাগে পলিফিল্ম মালচ কমপক্ষে ২টা ফসলচক্র (১ বছর) পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। তাই আপাতদৃষ্টিতে বেশি খরচ মনে হলেও খরচ হয় কম; এ ধরনের পেপার বাইকালার হওয়ায় সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে গাছকে রক্ষা করে।
মালচিং বেড তৈরির নিয়ম : সাধারণত প্রতিটি বেড এর মাপ হবে ২ ফিট । রকমেলন, তরমুজ, লাউ, বেগুন, শসা ইত্যাদি ফসলের ক্ষেত্রে ২ ফিট এর বেড দরকার হয়। এছাড়া ক্যাপসিকাম, টমেটো, স্কোয়াশ ইত্যাদি সবজির ক্ষেত্রে ৩ ফিট এর বেড দরকার হয়। ২ ফিট এর একটা মাপ ধরে দড়ি পুঁতে দিতে হবে। সাধারণত মালচিং ফিল্ম ৪ ফিট হয় প্রস্থ ও ৫০০ মিটার লম্বা হয়। এরপর বেড এর দুইপাশে কোদাল দিয়ে এক কোদাল পরিমাণ মাটি দুইপাশে তুলে বেড সম্পূর্ণ করতে হবে। পরের ধাপ হলো রাসায়নিক সার বেডে মিশানো। এ পর্যায়ে ফসল অনুযায়ী ইউরিয়া, টিএসপি, পটাশ, জিপসাম, বোরন সার সব মিক্স করে বেডে ছিটিয়ে দিতে হবে। এরপর হাত দিয়ে বেডের শক্ত মাটি ঝুরঝুরে করতে হবে এবং সার মাটির সাথে মিক্স করতে হবে। বেড এর মাথার কাছে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে নিতে হবে যাতে মালচিং ফিল্ম বসে। ১ বিঘা জমিতে সাধারণত ২টা পলিফিল্ম মালচ সিট এর দরকার হয়। ১টা রোল এর দাম পড়ে ৫৫০০ টাকা। মালচিং ফিল্ম এর রোলের ভেতরে একটা চিকন বাশ বসিয়ে টান দিয়ে একবারে মালচিং ফিল্ম বসাতে হবে। মালচিং ফিল্ম এর ইলাসটিসিটি থাকা সত্ত্বেও বেশি টানটান করে বসানো যাবে না এবং সতর্কতার সাথে বসাতে হবে যাতে পরের ফসলচক্রে সুন্দরভাবে ব্যবহার করা যায়। এরপর দুই সাইড এর মাটি দিয়ে মালচিং ফিল শক্তভাবে আটকে দিতে হবে।
বেড এর নিচের দিকে মাটি তুলে নালা করতে হবে এবং মালচিং ফিল্ম রোল থেকে কাটতে হবে। এর উপরে মাটি তুলে বেডের নিচের অংশ আটকে দিতে হবে। হাত দিয়ে বেডের অতিরিক্ত মাটি সরিয়ে দিতে হবে যাতে করে বেডের কিছুটা অংশ ঢেকে না যায়।
সেচের সময়। প্লাবন সেচ বা ঢালাও সেচ দিতে হবে চারপাশের নালাতে এবং এ অবস্থায় ৫-৭ দিন রাখতে হবে। নালাতে পানি দিলে তা মালচিং বেড পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।
চারা রোপণ
৭-১০ দিন পর চারা রোপণ করতে হবে। প্লাস্টিকের ট্রে তে মাটির পরিবর্তে কোকোডাস্ট ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে চারা উৎপাদন করা হয়। এতে চারার  শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত কম হয়। পলিব্যাগে তৈরি চারাও ব্যবহার করা যাবে। একসারি বা দুই সারিতে চারা রোপণ করা যায়। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৭৫ সেমি: এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৬০ সেমি:। মালচিং ফিল্ম এ চারা বসানোর জন্য হাতে তৈরি গোল খাঁজকাটা যন্ত্রের সাহায্যে ফুটো করা হয় নিদিষ্ট দূরত্বে। চারার গোড়ায় অতিরিক্ত মাটি দেয়া যাবে না এবং চারা লাগানোর পর আলতো হাতে চাপ দিতে হবে। ২৫ থেকে ৩০ দিন বয়সে অনেক পার্শ্ব শাখা বের হয়। পার্শ্ব শাখা ভেঙে দিতে হয়। না হলে ফলন কম হয় অথবা ফল সঠিক আকার পায় না। এ সময়ে প্রতি গাছে একটা খুঁটি (উচ্চতা ২ হাত) দেয়া হয় যাতে করে গাছে ঢলে পড়া রোগ কম হয়।
(সূত্র : উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর)
ট্রাইকোকম্পোস্ট ও ট্রাইকোসলুশন/ট্রাইকোলিচেট প্রযুক্তি
ট্রাইকোকম্পোস্ট হচ্ছে এক ধরনের জৈবসার যা ট্রাইকোডার্মা নামক উপকারী ছত্রাকের সহায়তায় তৈরি করা হয়। বিভিন্ন জৈব উপাদানের সাথে ট্রাইকোডার্মা মিশ্রিত করে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ৪০-৪৫ দিন  রেখে পচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে কম্পোস্ট তৈরি করা হয় তাই ট্রাইকোকম্পোস্ট।
ট্রাইকোকম্পোস্ট তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ : ট্রাইকোডার্মা নামক ছত্রাক ১/২ লিটার, গ্যাসমুক্ত তাজা গোবর ৭ ডালি বা ৮৪ কেজি(২৮%), হাস মুরগীর বিষ্ঠা ৯ ডালি বা ১০৮ কেজি (৩৬%), কচুরিপানা ৮ ডালি বা ১৫ কেজি (২৫%), নিমপাতা ১ কেজি(১%), কাঠের গুঁড়া ১ ডালি বা ৫ কেজি( ৩%), ভুট্টা ভাঙা ১/২  কেজি (২%), ছাই ১ কেজি, চিটাগুড় ২ কেজি,৩ টি রিং বা কম্পোস্টহাউজ (সিমেন্ট রিং এর ব্যাস, উচ্চতা, পুরুত্ব ৭০: ৪০: ০৫ সেমি:), চালা দেয়ার জন্য টিন/খড় ও বাঁশ। পানি পরিমাণমতো।
ট্রাইকোকম্পোস্ট তৈরির পদ্ধতি : একটি উচু সমতল স্থান নির্বাচন করতে হবে যাতে কোন পানি না জমতে পারে। একদিকে একটু ঢালু করে মাটিকে ভালোভাবে পিটিয়ে শক্ত করে তার উপর পলিথিন বিছিয়ে দিতে হবে যাতে ট্রাইকোকম্পোস্ট তৈরির সময় যে তরল পদার্থ বের হয় তা জমা হতে পারে। পলিথিন এর উপর তিনটি স্যানিটারি রিং একটির উপর একটি বসাতে হবে অথবা ইট দ্বারা কম্পোস্টহাউজ তৈরি করতে হবে। একটি বড় বালতি বা পাতিল পানিতে ভর্তি করে তার সাথে চিটাগুড় মিশ্রিত করতে হবে। পরবর্তীতে চিটাগুড় মিশ্রিত পানির সাথে ট্রাইকোডার্মার দ্রবণ ভালভাবে মিশ্রিত করতে হবে। আলাদাভাবে মাটিতে পলিথিন বিছিয়ে তার উপর ট্রাইকোকম্পোস্ট এর বিভিন্ন উপাদান নির্দিষ্ট পরিমাণে স্তরে স্তরে ঢালতে হবে। উপাদানসমূহ ঢালার পর তার সাথে চিটাগুড় ও ট্রাইকোডার্মা মিশ্রিত দ্রবণ ও পরিমাণমতো পানি মিশাতে হবে। এরপর সমস্ত উপকরণ কোদাল দিয়ে ভালভাবে মিশ্রিত করতে হবে। ভালভাবে মেশানো হলে তা রিং এর মধ্যে বা কম্পোস্টহাউজে ঢালতে হবে। পরবর্তীতে উপরিভাগে চটের বস্তা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে যাতে মুরগী বা পাখি কম্পোস্টের উপরিভাগ নষ্ট না করতে পারে। ট্রাইকোকম্পোস্ট তৈরির সময় যে তরল পদার্থ বের হয় তাকে বলা হয় ট্রাইকোলিচেট। ১ম দশ দিন যে ট্রাইকোলিচেট বের হয় তা পুনরায় কম্পোস্ট হাউজে ঢালতে হবে এবং দশদিন পর যে লিচেট বের হবে তা বোতলে ভরে সংরক্ষণ করতে হবে। সংরক্ষণকৃত লিচেট পুনরায় ট্রাইকোকম্পোস্ট তৈরির সময় ব্যবহার করা যায় বা ফসলের মাঠে রোগবালই দমন বা পুষ্টির জন্য ব্যবহার করা যায়। ২০-২৫ দিন পর কম্পোস্টহাউজে উপাদানসমূহ শক্ত কাঠি দিয়ে ভালভাবে নেড়ে চেড়ে দিতে হবে। ৪০-৪৫ দিন পর কম্পোস্ট তৈরি হয়ে যাবে এবং হাউজ থেকে বের করতে হবে। কম্পোস্ট বের করে ছায়াযুক্ত স্থানে ভালভাবে শুকাতে হবে। শুকানোর পর বস্তায় ভরে ছায়াযুক্ত স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। ট্রাইকোকম্পোস্ট সার পলিব্যাগে ভরে ১৫-২০% আর্দ্রতায় ১ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
 ট্রাইকোকম্পোস্ট এর গুণাগুণ  
ট্রাইকোকম্পোস্ট সারে ৩৫% মুরগির বিষ্ঠা থাকে যা মাটিতে দেয়ার ফলে ফেনোলিক বস্তু নিসিঃরণ করে, যা গাছের ক্রিমি রোগ দমনে সহায়ক; মাটিতে বিদ্যমান ক্ষতিকর ছত্রাক থেকে গাছকে রক্ষা করে ও উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে; জমিতে গন্ধক, দস্তার ঘাটতি পূরণ করে এবং প্রাকৃতিকভাবে গাছের বৃদ্ধিকারক হরমোন সরবরাহ করে; মাটিতে পানিধারণ ক্ষমতা বাড়ায় ও মাটির গঠন উন্নত করে; উৎপাদিত ফসলের গুণগত মান বৃদ্ধি হয় ও গাছের মূলাঞ্চলে নিঃসৃত রাসায়নিক উপাদানকে পরিবর্তন করে জীবাণুর জন্য অনুপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে; মাটিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমায় ও মাটিতে বায়ু চলাচল বৃদ্ধি করে।
ট্রাইকোকম্পোস্ট ও ট্রাইকোলিচেট এর ব্যবহার : প্রতি শতাংশ জমিতে ফসলভেদে ৮-১০ কেজি ট্রাইকোকম্পোস্ট ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া ১৫-২০ মিলি লিটার ট্রাইকোলিচেট ১ লিটার পরিষ্কার পানিতে মিশিয়ে ব্যবহার করা যায়।
সবজি চাষে বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় দেশ। দেশের জনগণের দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণতার টেকসই রূপ দিতে নিরাপদ সবজি উৎপাদনে জৈব কৃষি প্রযুক্তির বিকল্প নেই। এ প্রযুক্তি ব্যবহারে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা সর্বোপরি জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও নিজেদের দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে সবজি রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
সূত্র: উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র ও স্মলহোল্ডার এগ্রিকালচারাল কম্পিটিটিভনেস প্রজেক্ট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, গাজীপুর।

লেখক : অতিরিক্ত কৃষি অফিসার (এল.আর), প্রশাসন ও অর্থ উইং,  সংযুক্ত, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, মোবাইল:-০১৮৬২৫৫৩০১২ ই-মেইল : mahajubatasmin@gmail.com

বিস্তারিত
দেশীয় শোল মাছের অধিক লাভজনক চাষ পদ্ধতি

দেশীয় শোল মাছের অধিক
লাভজনক চাষ পদ্ধতি
মো: তোফাজউদ্দীন আহমেদ
বাংলাদেশ স্বাদু পানির মাছ চাষে পৃথিবীর অন্যতম অগ্রসরমান (চৎড়মৎবংংরাব) দেশ। দীর্ঘদিন ধরে মাছের উৎপাদন একটি স্থিতিশীল অবস্থায় বিরাজ করছে। এ জন্য মাছের বাজার দর অন্যান্য কৃষি পণ্যের তুলনায় অনেকটা স্বস্তিদায়ক অবস্থায় আছে। আবার অনেক প্রজাতির মাছের দর বিগত দিনের তুলনায় বেশ কমে গেছে যেমন শিং, পাবদা, গুলশা, ট্যাংরা ইত্যাদি। বাণিজ্যিক কয়েকটা প্রজাতির মাছের দর এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, চাষি সে সব মাছের (বিশেষ করে তেলাপিয়া এবং পাংগাশ) চাষ থেকে বিকল্প প্রজাতির মাছচাষে ঝুঁকছে। অপরদিকে সাধারণভাবে প্রচলিত মাছের প্রজাতি (রুই, কাতল, সিলভার-বিগহেড ইত্যাদি) সমূহের বাজারদর গতানুগতিক হওয়ায়, কোন কোন সময় চাষি মাছচাষ থেকে লাভবান হন আবার অনেক ক্ষেত্রে সেভাবে লাভবান হতে পারেন না। এ জন্য দেশের অনেক মাছচাষি প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেন বিকল্প প্রজাতির মাছ চাষের, যা থেকে সে অধিক লাভবান হতে পারেন। প্রান্তিক চাষিদের ভাগ্য বদলের এ নিরন্তর প্রচেষ্টার হাত ধরে নতুন নতুন প্রজাতির মাছের চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে আমাদের দেশে। পাবদা-গুলশা, শিং-মাগুরের চাষের পাশাপাশি শোলমাছের চাষ এভাবে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। এ ধরনের মাছ চাষে সমস্যা সম্ভাবনা দুটি আছে। সবচেয়ে বড় বিষয় এ সব মাছের বাজার দর বেশ বেশি। বাজারে মাছের বৈচিত্র্যময় সরবরাহ ক্রেতাকে যথেষ্ট আকৃষ্ট করে। সে জন্য  দাম একটু বেশি হলেও এ ধরনের মাছ যথেষ্ট বিক্রি হতে দেখা যায়।
শোল মাছের খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস
শোল মাছ একটি আমিষভোজী ও রাক্ষুসে প্রকৃতির শিকারি মাছ, এ মাছটি মাংসাশী ( ঈধৎহরাড়ৎড়ঁং ) হিসেবে বিবেচিত হয়। এরা পুকুরের অন্যান্য ছোট ছোট মাছকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে অভ্যস্থ। শোল মাছের খাদ্য তালিকায় রয়েছে ক্রাস্টেসিয়ান, মোলাস্কস এবং ছোট মাছ। কিশোর শোল মাছের খাবার হলো ছোট রেণু বা জীবন্ত ছোট মাছ এবং টিউবিফেক্স। এরা রাক্ষুসে স্বভাবের ফলে এরা ছোট প্রায় সকল মাছের ধানি পোনা খেয়ে ফেলে। কিছুটা স্বজাতীভোজী স্বভাবের হওয়ায় এরা নিজস্ব প্রজাতির ছোটমাছও খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। রেণুপর্যায়ে শোল মাছ জুপ্লাংকটন, শেওলা (অষমধব), ডায়াটমসহ নানা জৈব পদার্থ খেয়ে থাকে।
শোল মাছচাষের সুবিধা
এ মাছ ছোট বড় সকল পুকুরে চাষ করা যায়; বাড়ির পাশে ছায়াযুক্ত (২-৫ শতক) পুকুরেও চাষ করা যায়, সাধারণত এ ধরনের পুকুরে অন্যান্য মাছ তেমন ভাল হয় না; দেশের উপকূলীয় এলাকার কিছুটা লবণাক্ত পানিতেও এ মাছচাষ করা যায়; এ মাছ বিস্তৃত পরিবশের তারতম্য সহ্য করতে পারে; এ মাছ পুকুরের পানির দূষণ, অনাকাক্সিক্ষত গ্যাসের প্রাচুর্যতা এমনকি অক্সিজেন স্বল্পতাও এ মাছচাষে সমস্যা সৃষ্টি করে না; পুকুরে অধিক ঘনত্বে তথা স্বল্প জায়গায় অনেক বেশি শোল মাছ উৎপাদন করা যায়; শোল মাছ দ্রুত বর্ধনশীল মাছ এবং প্রতি ৬ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যে প্রতিটির ওজন ৫০০ গ্রাম থেকে ২ কেজি পর্যন্ত হয়; শোল মাছ অত্যন্ত জনপ্রিয় কারণ মাছটি বেশ সুস্বাদু, আকারে বেশ বড় হয়; মাংসে বাড়তি কাটা নাই; বাজারে অন্যান্য মাছের তুলনায় এ মাছের দাম তুলনামূলক বেশি; পানির বাইরে দীর্ঘ সময় ধরে জীবিত থাকে ফলে সজীব অবস্থায় বাজারজাত করা যায়; চাষের পুকুরে এ মাছের তেমন কোন রোগব্যাধি দেখা দেয় না। শোল মাছ রাক্ষুসে প্রকৃতির হওয়ায় যে কোন মাছের পোনা এবং জীবন্ত/মৃত ছোট মাছ ও গুঁড়া চিংড়ি খাইয়ে লালন করা যায়।   
চাষের পুকুর প্রস্তুতি
কার্পজাতীয় মাছ অথবা অন্যান্য প্রজাতির মাছ চাষের জন্য যেভাবে পুকুর প্রস্তুত করতে হয় সেভাবে শোল  মাছ চাষের জন্য পুকুর প্রস্তুত করতে হবে। পুকুরের তলদেশে অধিক কাদা থাকলে তা অপসারণ করতে হবে। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে পুকুরের পাড়ে যেন কোন সুড়ং বা গর্ত না থাকে। বাজারের পাথুরে চুন (ক্যালসিয়াস অক্সাইড) ব্যবহার করায় ভাল। চুন প্রয়োগের সময় কাদার সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। চুন দেবার পরে পুকুরে পানি প্রবেশ করাতে হবে। পুকুরে পানির গভীরতা ৫ ফুটের বেশি রাখার চেষ্টা করতে হবে।
পুকুরে বেস্টনি স্থাপন
শোলমাছ পুকুর থেকে বের হওয়ার প্রবণতা আছে, এ জন্য পুকুরের চারিদিকে ৬-৭ ফুট উঁচু করে নাইলনের নেট দ্বারা বেস্টনি স্থাপন করতে হবে। বেস্টনির নেটের তলা ভালভাবে পাড়ের মাটির ৮-৯ ইঞ্চি গভীরে আটকাতে হবে যাতে কোনভাবে শোল মাছ বের হতে না পারে। শোল মাছ বের হওয়া আটকাতে অনেক চাষিকে পুকুরের উপর দিয়েও নেট দিতে দেখা যায়। নেটের পরিবর্তে বাঁশের বানা দিয়েও বেস্টনি দেয়া যায় তবে খেয়াল রাখতে হবে বেস্টনির উচ্চতা যেন ৬-৭ ফুটের কম না হয়।
মাছের আশ্রয় স্থল
শোল মাছ আলো তেমন পছন্দ করে না বা নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায়। এ জন্য পুকুরের কিনারের দিকে আগাছা (কলমিলতা, কচুরি পানা, টোপাপানা, ক্ষুদিপানা ইত্যাদি) জন্মাতে দেয়া যেতে পারে। পুকুরের পানির গভীরতা বেশি হলে আগাছা না থাকলেও অসুবিধা হয় না।
চাষের পুকুর প্রস্তুতের পর পুকুরে শোল মাছের পোনা ছাড়ার আগেই স্থানীয় তেলাপিয়া মাছের কিছু বড় মাছ/পোনা ছেড়ে দিতে হবে যাতে এরা বংশ বিস্তার করবে যা শোল মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করবে। সাধারণত তেলাপিয়া দ্রুত বাচ্চা দেয় এবং সারা বছর বাচ্চা দেয়। তেলাপিয়ার পোনা শোল মাছের উপাদেয় খাবার। শোল মাছের সাথে কার্পজাতীয় মাছও ছাড়া যেতে পারে এ ক্ষেত্রে কিছুটা বড় আকারের পোনা (১০০ গ্রামের বড়) মজুদ করতে হবে।
শোল মাছের পোনা সংগ্রহ
দেশে দুই ধরনের শোল মাছ চাষ হচ্ছে। ভিয়েতনামী শোল যার গায়ের রং কিছুটা বাদামি (লালাভ অনেকে মেটে রং বলেন) এবং আমাদের স্থানীয় শোল যার গায়ের রং কালাচে। মাছের স্বাদে তেমন পার্থক্য না থাকলেও সাধারণ মানুষ দেশীয় শোল মাছ বেশি পছন্দ করে। চাষের পুকুরে একই আকারের পোনা মজুদ করা ভাল কারণ বড়রা ছোটদের ধরে খাবার অভ্যাস আছে। দেশীয় শোল মাছের পোনা সাধারণত দুভাবে সংগ্রহ করা যায়।
া    নিজস্ব ব্রুড মাছ থেকে : দেশীয় শোল মাছের পোনা হ্যাচারিতে প্রনোদিত প্রজননের (ওহফঁপব ইৎববফরহম) মাধ্যমে উৎপাদন হয় না। এ ক্ষেত্রে চাষের পুকুর প্রস্তুত করে ঠিক বর্ষা মৌসুূমের আগে ২-৩ জোড়া পরিপক্ব শোল মাছ (স্ত্রী ও পুরুষ) জোগাড় করে পুকুরে মজুদ করতে হবে এবং নিয়মিত খাবার দিতে হবে। এ মা মাছ প্রাকৃতিক জলাশয়, মাছ বাজার অথবা অন্য কারো চাষের পুকুর থেকে সংগ্রহ করা যেতে পারে। পুকুরে ১-২ মাস রাখলে এ মাছে বাচ্চা দিবে এবং বাচ্চার ঝাঁক সহজেই চিহ্নিত করা যায়। বাচ্চা দেবার পরে মা মাছ অপসারণ করতে হবে।
া    প্রাকৃতিক উৎস থেকে : পুকুর বা প্রাকৃতিক জলাশয়, খাল-বিলে শোলমাছ বর্ষা মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে বাচ্চা দেয় সেখান থেকে সহজেই এ মাছের ঝাঁক সংগ্রহ করা যায়। একটি ঝাকে ৩-৪ হাজার বাচ্চা থাকে।  
শোল মাছের বাচ্চা প্রতিপালন
সংগৃহীত ছোট পোনা আগে থেকে প্রস্তুত করা ছোট একটি পুকুরে মজুদের পর কয়েক দিন হাঁস অথবা মুরগির ডিম খাওয়াতে হবে। ডিম একটি বাটিতে ভেঙে নিয়ে চামচ দিয়ে ভালভাবে ফেটে নিতে হবে। সকালে এবং বিকালে এ ফাটানো ডিম পোনার ঝাঁকের মাঝে অল্প অল্প করে দিতে হবে। ২-৩ দিন পরে তেলাপিয়া বা অন্য কোন কম দামের মাছ সিদ্ধ করে একটি শাক ধোয়া ডালার ভেতরে রেখে পুকুরের পানিতে ঝুলিয়ে দিতে হবে। অথবা সিদ্ধ মাছ পেস্ট করে ঝাঁকের মাঝে অল্প অল্প করে কয়েকদিন দিলে পোনা খাবারে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। এ ছাড়াও মাছের হ্যাচারি থেকে কম দামের যে কোন প্রজাতির মাছের রেণু সংগ্রহ করে পুকুরে ছাড়তে পারলে তা খেয়ে শোল মাছের পোনা বড় হয়ে থাকে। আবার ছোট আকারের চিংড়ি শুটকি গুড়া দিয়েও শোল মাছের ছোট পোনা প্রতিপালন করা যায়। এভাবে ১ মাস পালন করলে পোনা ৪-৫ ইঞ্চি আকারের হয় এবং চাষের পুকুরে ছাড়ার উপযুক্ত হয়।
পোনা মজুদ ঘনত্ব
শোল মাছের পোনা পুকুরে কি পরিমাণ ছাড়া যাবে তা অনেকাংশে নির্ভর করে পুকুরের ব্যবস্থাপনা ও খাবার সরবরাহের ওপর। সাধারণত প্রতি শতকে ৪-৫ ইঞ্চি আকারের ৫০০-১০০০টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে। সাথে তেলাপিয়া অথবা কিছু রুইজাতীয় (বড় আকারের পোনা) মাছের পোনা ছাড়া যেতে পারে।
শোল মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনা
দেশীয় শোল মাছ তিন ধরনের খাবার দিয়ে চাষ করা যায়। ক) জীবন্ত ছোট মাছ, খ) কম দামের যে কোন প্রজাতির মরা মাছ এবং গ) সম্পূরক খাবার। তবে উল্লেখিত তিন ধরনের খাবারের সমন্বয়েও চাষ করা যেতে পারে।
জীবন্ত মাছ দিয়ে শোল মাছচাষ : শোল মাছ রাক্ষুসে প্রজাতির মাছ এরা স্বভাবজাতভাবে তার থেকে ছোট যে কোন মাছ শিকার করে খেতে পছন্দ করে। শোল মাছচাষের জন্য কয়েকভাবে জীবন্ত মাছের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
া    পৃথক নার্সারি পুকুরে কম দামের রুইজাতীয় মাছের রেণু যেমন, সিলভার, মৃগেল, বাটা মাছের পোনা প্রতিপালন করে শোল  মাছের চাহিদা অনুযায়ী আকারের (১.৫-২.০ ইঞ্চি) পোনা ধরে চাষের পুকুরে ছাড়া যেতে পারে। প্রতি দিন এভাবে পোনা দেয়া যেতে পারে। তবে ৬ থেকে ৭ দিন পরপর নার্সারি পুকুর থেকে পরিমাণ মত পোনা ধরে চাষের পুকুরে ছেড়ে দিয়েও চাষ করা যায়। এতে উৎপাদন খরচ কিছুটা বেশি পড়ে। তবে এ পদ্ধতি অনুসরণ করলে চাষের পুকুরে কিছু পোনা আকারে বড় হয়ে যায় যা শোল মাছে আর ধরে খেতে পারে না। এ বড় আকারের পোনা বা মাছ বিক্রয় করে বাড়তি আয় হয়ে থাকে।
া    শোল মাছের পুকুরে দেশি তেলাপিয়া, টিতপুঁটি, চোখকুনি, দাড়কানি, মলা, কানপোনা, গাপ্পি প্রভৃতি ছোট প্রজাতির কিছু মা মাছ চাষের পুকুরে মজুদ করলে পুকুরে এসব প্রজাতির মাছ দ্রুত বংশবিস্তার করে যা শোল মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। ছোট প্রজাতির এ সব মাছের দ্রুত বৃদ্ধি ও বংশবিস্তারের জন্য অটোকুড়া বা পাউডার জাতীয় খাবার দিতে হয়।
া    চাষের পুকুরটি যদি এমন হয় যে, পুকুরের এক পাশের কাটা পাড় নদী-খাল কিংবা বিলের সাথে যুক্ত এবং কাটা অংশে মজবুতভাবে পাটাবাঁধ বা নেটের বেড়া দেয়া আছে তা হলে উক্ত নেটের ফাক দিয়ে অনেক ছোট প্রজাতির মাছের পোনা বা ডিম চাষের পুকুরে প্রবেশ করে যা থেকে শোল মাছ খাবার পেতে পারে। গ্রামে এ ধরনের অনেক পুকুর আছে যারা শোল মাছ তথা রাক্ষুসে প্রজাতির মাছচাষের এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন।
মরা মাছ দিয়ে শোল মাছচাষ : শোল মাছ সাধারণত মরা মাছ খাইয়ে চাষ করা হয়। অনুকূল সময়ে ছোট আকারের মরা মাছ সংগ্রহ করে শুঁটকি তৈরি করে মজুদ করেও অনেকে শোল মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করেন। এটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি। পর্যাপ্ত প্রাপ্তির সময় ছোট মাছ সংগ্রহ করে শুকিয়ে বায়ু প্রতিরোধী ব্যাগে ভরে মজুদ করে রাখতে হবে। শুঁটকি মাছ পুকুরে খাবার হিসেবে দেবার ৪-৫ ঘণ্টা আগে কিছুটা গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। মাছ নরম হলে মরা মাছের অনুরূপে একইভাবে শোল মাছকে খাবার হিসেবে দেয়া যায়। শোল মাছের ছোট বাচ্চা প্রতি পালনেও এ শুঁটকির গুঁড়া খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়।  
বাজারে অনেক সময় কম দামে ছোট আকারের (২০০-৩০০  গ্রাম ওজনের) সিলভারকার্প মাছ পাওয়া যায়। অনেকে সে মাছ সংগ্রহ করে ফ্রিজে সংরক্ষণ করেন এবং প্রয়োগের সময় ধারালো ছুরি দ্বারা কুচিয়ে শোল মাছের পুকুরে প্রয়োগ করেন। অনেক সময় এ কাজটি ছোট আকারের (৩০-১০০ গ্রামের) তেলাপিয়া বা অন্য যে কোন কম দামের মাছের জন্যও প্রযোজ্য হতে পারে। এ ধরনের কম দামের মাছ সংগ্রহ করে বড় আকারের ডিপফ্রিজে সংরক্ষণ করেও শোল মাছচাষে ব্যবহার করা যেতে পারে।
সম্পূরক খাবার দিয়ে শোল মাছচাষ : দেশীয় শোল মাছ সম্পূরক খাবার দিয়েও চাষ করা যায়। এ জন্য পোনা সংগ্রহের পর পৃথক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পোনাকে সম্পূরক খাবার ধরাতে হয়। সংগৃহীত পোনা একটি ড্রামের পাত্রে অথবা চৌবাচ্চার মধ্যে ছাড়তে হবে। প্রতি দিন অল্প পরিমাণে বাজারের ভাসমান (১-২ এম এম আকারের) খাবার (৩৫-৪০% আমিষ সমৃদ্ধ) দিতে হবে। এ সময় অন্য কোন খাবার দেয়া যাবে না। এভাবে কয়েকদিন চেষ্টা করলে দেশীয় শোল মাছের পোনা সম্পূরক খাবার গ্রহণ শুরু করবে। এর পরে পোনাগুলো প্রস্তুতকৃত চাষের পুকুরে ছাড়তে হবে। ছাড়ার পরে নিয়মিত ২-৩ বার ঐ একই ভাসমান খাবার প্রয়োগ করতে হবে। তবে ভারত বা অন্যান্য দেশে শোল মাছের জন্য তৈরি নির্দিষ্ট খাবার পাওয়া যায় সে খাবার খাওয়াতে পারলে মাছের বেশ ভাল বর্ধন হয়। আমাদের দেশের পাবদা-গুলশার খাবার দিয়ে চাষ করা যায় তবে বর্ধন হার কিছুটা কম হয়।  
শোল মাছচাষের অন্যান্য পরিচর্যা
মাছের চাষ নিরাপদ রাখার জন্য মাছচাষ চলাকালে নিয়মিত মাছের খাবার প্রদান ছাড়াও কিছু কাজ করা প্রয়োজন। এ ধরনের কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নি¤েœ উল্লেখ করা হলো :
পুকুরে পানি সরবরাহ : যেহেতু পুকুরে অধিক ঘনত্বে শোল মাছ থাকে এ জন্য পুকুরের পানির গভীরতা বজায় রাখার জন্য পানি সরবরাহের প্রয়োজন হলে তার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় মাছ পিড়ন অবস্থার সম্মুখীন হতে পারে।
চুন প্রয়োগ : শোল মাছে শীতের সময় ক্ষত রোগ হতে দেখা যায়। যাতে মাছে এ রোগ না হয় সে জন্য পুকুরে শীতের শুরুতে শতক প্রতি ০.৫ -১.০ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি মাঝে মধ্যে ভোরে গভীর নলকূপের পানি দিতে হবে।
জিওলাইট প্রয়োগ : যেহেতু শোল মাছ, মাছ খেয়ে বড় হয় সে জন্য পুুকুরে গ্যাসের আধিক্য দেখা দিতে পারে। গ্যাসের ক্ষতি কর প্রভাব কমানোর জন্য ১-২ মাস পরপর শতকে ১০০ গ্রাম হারে জিওলাইট ব্যবহার করা যেতে পারে।
সম্পূরক খাবার দিয়ে শোল মাছচাষ করলে অবশ্যই মাঝে মধ্যে ছোট মাছ খেতে দিতে হবে, অন্যথায় মাছ অপুষ্টির শিকার হবে এবং মাছে রোগ দেখা দিতে পারে।
মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণ
উপরে বর্ণিত পদ্ধতিতে নিয়মিত খাদ্য এবং পরিচর্যা চালিয়ে গেলে মোটামুটি ৭-৮ মাস চাষ করলে শোল মাছ বাজারে বিক্রয় উপযোগী হয় তবে যেহেতু এ মাছ রাক্ষুসে প্রজাতির সে জন্য সকল মাছে সমভাবে খাবার গ্রহণ করতে পারে না এ জন্য উৎপাদিত মাছের মধ্যে কিছুটা ছোট বড় হতে দেখা যায়। একই সময়ে কিছু মাছ ১.৫-২.০ কেজি আকারের হয় আবার কিছু কিছু ৭০০-৮০০ গ্রামের হতে দেখা যায়। শোল মাছ জীবন্ত অবস্থায় বাজারে বিক্রয় হয় এ জন্য মাছ পরিবহনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বেড় জাল দিয়ে সহজেয় এ মাছ পুকুর থেকে ধরা যায়, তবে সব মাছ ধরতে পুকুর সেচ দেবার প্রয়োজন হয়। এ মাছ পানির বাহিরে অনেক সময় ধরে জীবিত থাকে ফলে অধিক ঘনত্বে পরিবহন করা যায়। তবে মাছ ধরা বা পরিবহনের সময় মাছ যাতে আঘাত প্রাপ্ত না হয় সে দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। কারণ আঘাতপ্রাপ্ত মাছ বেশি সময় সজীবতা থাকে না এবং এ সব মাছের বাজার দরও কম পাওয়া যায়।
শোল মাছচাষ বেশ লাভজনক তবে যারা এ মাছের খাবার সরবরাহ করতে পারবেন না তাঁরা এ মাছচাষ না করায় উত্তম। খাবার হিসেবে ব্যবহৃত মাছের প্রতি কেজির গড় মূল্য ৫০ টাকার মধ্যে থাকে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে তা হলে এ মাছচাষে লাভবান হওয়া যাবে। চাষির ভাগ্য পরিবর্তন করতে হলে গতানুগতিক মাছচাষ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নতুন নতুন মাছের প্রজাতি চাষে মনোযোগী হতে হবে। মনে রাখতে হবে, যে মাছের চাষ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয় সে মাছের সরবরাহ বাড়ার কারণে বাজার দর কমে যায় এবং সে মাছচাষে আর আগের মতো লাভবান হওয়া যায় না।  

লেখক : উপপরিচালক (অব.), মৎস্য অধিদপ্তর। বাড়ি ১৭৩/১, ফ্ল্যাট : ৫/এ শাপলা হাউজিং পশ্চিম আগারগাঁও, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭৫১৯৩৯৯৩২, ই-মেইল :tofaz2010@gmail.com

বিস্তারিত
এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের (অগজ) সঠিক ব্যবহার

 এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের (অগজ) সঠিক ব্যবহার
ডা: মনোজিৎ কুমার সরকার
রোগজীবাণুর এন্টিবায়োটিক ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলাকে এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (অগজ) বলে। ফলে এন্টিবায়োটিক দ্বারা চিকিৎসায় রোগজীবাণুকে ধ্বংস করা যাবে না, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ, পশু পাখির মৃত্যু ঘটবে।
বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য খাতে নতুন এক অশনি সংকেত হলো অগজ যদি মানুষ বা পশু পাখির সংক্রামকজনিত রোগ নিরাময়ের জন্য এন্টিবায়োটিক ওষুধ প্রদান করা হয় এবং যদি তা সঠিক পরিমাণে ও পর্যাপ্ত সময় ধরে গ্রহণ না করে, তখন ব্যাকটেরিয়াগুলো ধ্বংস না হয়ে উল্টো আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে।
ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে মানুষ ও পশু পাখিতে অগজ দেখা দিয়েছে। ফলে রোগ ভাল হচ্ছে না বা অত্যন্ত উচ্চ মাত্রায় এন্টিবায়োটিক দিতে হচ্ছে।
এন্টিবায়োটিক
ইহা একটি উপাদান যা ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং অন্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাসকে ধ্বংস বা তার বংশবৃদ্ধি রোধ করার জন্য ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। ইহাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক আশীর্বাদ বলা হয়। এন্টিবায়োটিক সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এমনকি কোভিড-১৯ মহামারীর চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে।
অগজ এর সাথে সম্পর্কিত ডঐঙ এর গাইডলাইন অনুযায়ী এন্টিবায়োটিককে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে।
অ্যাক্সোস গ্রুপ (অপপবংং এৎড়ঁঢ়)
এ জাতীয় এন্টিবায়োটিক প্রধানত ঘধৎৎড়ি ঝঢ়বপঃৎঁস, সস্তা, সহজলভ্য। বেশির ভাগ সংক্রামক রোগ চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। যেমন : চবহরপরষষরহ. (পেনিসিলিন)
ওয়াচ গ্রুপ (ডধঃপয এৎড়ঁঢ়)
এ জাতীয় এন্টিবায়োটিক সুনির্দিষ্ট জাবাণুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। যেমন : ঈবভধষড়ংঢ়ড়ৎরহং, ঈধৎনধঢ়বহবসং.
রিজার্ভ গ্রুপ (জবংবৎাব এৎড়ঁঢ়)
এ জাতীয় এন্টিবায়োটিক মানব চিকিৎসায় শেষ অপশন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। অগজ ঝুঁকি কমাতে খুব সীমিত ব্যবহার করা হয়। এ গ্রুপের এন্টিবায়োটিক আন্তর্জাতিক স্টুয়ার্ডশিপ প্রোগ্রাম দ্বারা সুরক্ষিত। এ গ্রুপের  ওষুধ প্রাণী চিকিৎসায় ব্যবহার করা নিষেধ। যেমন : ৪ঃয মবহবৎধঃরড়হ ঈবভধষড়ংঢ়ড়ৎরহ, চড়ষুসরীরহং.
অগজ এর কারণসমূহ
    প্রয়োজন ছাড়াই মানুষ, পশু পাখিতে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা।
    সঠিক পরিমাণে ও সময় মতো এন্টিবায়োটিক না দেয়া।
    চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই, ইচ্ছামতো এন্টিবায়োটিক সেবন করা।
    একসঙ্গে একাধিক এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা।
    দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এবং জীবনিরাপত্তা ব্যবস্থা না মেনে চলা।
    নিম্ন মানসম্পন্ন এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার।
    পশু-পাখি, মাছ, শাকসবজিতে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে তাদের মলমূত্রের মাধ্যমে প্রকৃতিতে অবস্থিত ব্যাকটেরিয়া অগজ হয়ে যাচ্ছে।
অগজ এর ক্ষতিকর প্রভাব
    মানুষ দবাদি পশু পাখির মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাবে, শারীরিক অক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
    সামগ্রিক উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা কমে যাবে।
 পশু পাখির রোগ নিরাময় করা কঠিন হবে এবং চিকিৎসা খরচ বৃদ্ধি পাবে।
দীর্ঘ মেয়াদে চিকিৎসা প্রয়োজন হবে। ফলে খরচ বেড়ে যাবে।
প্রতিকার
 গবাদিপশু, হাঁসমুরগী এবং পশু খাদ্যে নিষিদ্ধ এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবে না।
 বিধি মোতাবেক সকল বর্জ অপসারণ করা।
    এন্টিবায়োটিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখা অর্থাৎ যৌক্তিকভাবে ব্যবহার করা।
    একইসাথে একাধিক এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবে না।
    প্রয়োজন না হলে ভাইরাসজনিত রোগে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার না করা।
    নির্দিষ্ট জীবাণু সংক্রমণে নির্দিষ্ট এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা।
    সঠিক রোগ নির্ণয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
    রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এন্টিবায়োটিক ব্যবহার ও বিক্রি না করা।
অগজ সূচকগুলোর ওপর নজর দেয়া হলে তা মানুষের স্বাস্থ্য, পশুর স্বাস্থ্য, খাদ্যব্যবস্থা এবং পরিবেশের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী অগজ নীতিমালা প্রণয়নে সহায়ক হতে পারে। (তথ্যসূত্র : প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল- উখঝ)

লেখক : ভেটেরিনারি অফিসার, জেলা ভেটেরিনারি হাসপাতাল, ঝিনাইদহ, মোবাইল : ০১৭১৫২৭১০২৬, ই-মেইল : drmonojit66@gmail.com

বিস্তারিত
অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কৃষির কোনো বিকল্প নেই

অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কৃষির
কোনো বিকল্প নেই
কৃষিবিদ শারমিনা শামিম
করোনার মতো অতিমারি সারা বিশ^কে যেন থামিয়ে দিয়েছিল চোখের পলকে। করোনার করাল থাবায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিশ^ অর্থনীতির কাঠামো। উন্নত দেশ যেখানে খাদ্য উৎপাদন নিয়ে দুর্ভাবনা কাটিয়ে উঠতে হিমসিম খেয়ে যায়, সেখানে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলো অবস্থা শোচনীয়। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ও দিকনির্দেশনা করোনা পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবিলায় এক অনন্য ভূমিকা রেখেছে। তাই এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ বর্তমানে বিশে^র কাছে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন এ দেশের এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি পড়ে না থাকে। আর সেই অনুপ্রেরণাকে সামনে রেখেই এদেশের আপামর জনগণ কাজে লেগে যায়। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় অনুপ্রাণিত হয়ে কৃষিকাজকে পেশা হিসেবে বেছে নেন খুলনার তেরখাদা উপজেলার শিক্ষিত সাহসী তরুণ শাকিল আহম্মেদ।
তেরখাদা উপজেলার পানতিতা গ্রামের ছেলে জনাব মো. শাকিল আহম্মেদ কর্মরত ছিলেন সাভারের একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। ২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক মন্দায় চাকরি হারান তিনি। চাকরি হারিয়ে দিশাহারা শাকিল নতুন আলোর সন্ধান পান। কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে। তিনি গ্রামে ফিরে আসেন। বাড়িতে ফিরে দেখলেন বসতবাড়ির আশেপাশে প্রায় এক একর (১০০ শতাংশ) জমি অযতেœ অবহেলায় অনাবাদি পড়ে আছে। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন এই পতিত জমিতে গড়ে তুলবেন কৃষিখামার। চাকরিরত অবস্থায় জমানো অর্থ ব্যয় করে তিনি এ খামার তৈরির প্রস্তুতি নেন।
ধীরে ধীরে তিনি বসতবাড়ির জমিসহ আরো বিশ বিঘা জমি লিজ নেন এবং গড়ে তোলেন সমন্বিত মৎস্য ও কৃষি খামার। টেলিভিশনে প্রচারিত বিভিন্ন কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান দেখে চাকরিরত অবস্থায় কৃষিকাজের প্রতি আগ্রহ গড়ে ওঠে তার। তখন থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন এরকম একটি খামারের। কিন্তু বাড়িতে ফিরে তিনি দেখলেন একাজে প্রতিবন্ধকতা অনেক। তখন তিনি উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করেন। তিনি অল্প দিনের মধ্যে বুঝতে পারলেন দক্ষিণাঞ্চলে কৃষিকাজ এর প্রধান অন্তরায় লবণাক্ততা। সেইসাথে প্রতি বছরই রয়েছে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঝড়, উপকূলীয় জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা। উপজেলা কৃষি অফিসারের পরামর্শে তাই তিনি প্রতিকূল পরিস্থিতিকে সম্ভাবনা হিসেবে কাজে লাগান। শুরু করেন চিংড়ি ও তেলাপিয়া মাছের চাষ। সেই সাথে ঘেরের চারিদিকে চওড়া পাড়ে করেন অফসিজন তরমুজ, গ্রীষ্মকালীন টমেটো ও আগাম শিমের চাষ। কিছু কিছু ঘেরের পাড়ে লাগান পেঁপে, থাই পেয়ারা, বলসুন্দরী কুল ও আপেল কুলের গাছ। এভাবে তিনি প্রায় পাঁচশটি পেয়ারা ও ছয়শটি পেঁপে গাছ লাগান। সবজি ও ফল বাগানে পাঁচ লক্ষ টাকা ব্যয় করে মাত্র আট মাসের ব্যবধানে তিনি প্রায় আট লক্ষ টাকা উপার্জন করেন। কৃষিকে আনুভূমিক ও উলম্বভাবে বৃদ্ধি করে এক জমি থেকে এক মৌসুমেই চার থেকে পাঁচটি ফসল উৎপাদন করেন। তিনি জানান, তার উৎপাদিত সবজি রাজধানীসহ খুলনার আশপাশের জেলাগুলোতে বিক্রি হয়ে থাকে। এসব সবজি ও মৌসুমি ফল উৎপাদনে তিনি জৈবসার ও জৈব বালাইনাশকের ব্যবহারকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। ঘেরের পাড়ে হওয়ায় রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের খুব বেশি সুযোগ থাকে না। এতে উৎপাদন খরচও তুলনামূলকভাবে কম পড়ে, অন্যদিকে বাজারমূল্য বেশি পাওয়া যায়। যখন গ্রামের অন্যান্য কৃষকেরা গতানুগতিক ফসল চাষ করে, তখন তিনি ব্যতিক্রমী ফসল চাষ করে অধিক বাজারমূল্য পেয়ে থাকেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কৃষক ভাইয়েরা একই ফসল সকলেই চাষ করে। যার ফলে বাজারমূল্য বেশ কম পাওয়া যায়। একটু সচেতনভাবে ফসল নির্বাচন করা সম্ভব হলে উৎপাদন ব্যয় ও লাভ অনেকাংশে বেশি পাওয়া যায়। এ কাজে শাকিলের পাশে সহযোদ্ধা হিসাবে নিরবিচ্ছিন্ন সেবা প্রদান করেছে উপজেলা কৃষি অফিস, তেরখাদা। উপজেলা কৃষি অফিসার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী কৃষি অফিসারগণ কারিগরি পরামর্শ ও উপকরণ সহায়তা দিয়েছেন প্রয়োজন অনুযায়ী, সেই সাথে জুগিয়েছে মনোবল।
শুধু শাকিলই নয় খুলনায় ডুমুরিয়া উপজেলার মেহেদী হাসান, মামুন, হানিফ মোড়ল এর মত কৃষকেরা অফসিজন তরমুজ ও আগাম শিম চাষ করে দক্ষিণের কৃষিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছেন। অফসিজন তরমুজ যেমন এখন ধরতে গেলে সারা বছরই পাওয়া যায়, এভাবেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে অফসিজন তরমুজ ও আগাম শিম চাষ দক্ষিণাঞ্চলে। ঘেরের পাড়ে শিম চাষ করে লক্ষ টাকার স্বপ্ন বুনছেন অনেক চাষিই। ঘেরের পাড়ে সবজি চাষের জন্য পাড়কে তিন হাত চওড়া করা হয়।
চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে জানান, ঘেরের চওড়া পাড়ে বাঁশ ও নেটের তৈরি মাচায় বিঘার পর বিঘা জমিতে চাষ করা হচ্ছে আগাম জাতের শিম ও গ্রীষ্মকালীন শিম। গ্রীষ্মকালীন ও আগাম জাতের শিমের মধ্যে রয়েছে-আইরেট, ইপসা-১, ইপসা-২, বিইউ শিম-৪, বারি শিম-৩ ও ৭ এবং অটো শিম । তবে দক্ষিণাঞ্চলে ঘেরের পাড়ে স্থানীয় কৃষকেরা লালফুল ও বিস্কুট জাতের শিম বেশি চাষ করে থাকেন।
আগাম জাতের এ শিম বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাসের মধ্যে লাগানো হয়। ঘেরের পাড়টি ঘেরের মাটি তুলে তৈরি করা হয় বিধায় পাড়ের মাটি যথেষ্ট উর্বর হয়ে থাকে। কৃষকেরা এখানে কোন বাড়তি রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন না। তবে স্থানীয় কৃষকদের উৎপাদিত ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহার করা হয়ে থাকে এসব আগাম শিমের জমিতে।
ঘেরের পাড় ঘেষে বাঁশের কঞ্চি পুঁতে এর গায়ে কারেন্ট জাল ব্যবহার করে তৈরি করা হয় শিম গাছের লতার বাউনি। এই ধরনের শিমের চাষ করতে তেমন কোন রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করা হয় না। এখানে পোকামাকড় দমনের জন্য ফেরোমন ফাঁদ, আঠালো ফাঁদ, ছাই ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। ছত্রাকজনিত রোগ দেখা দিলে আক্রান্ত ফুল ও পাতা হাত বাছাই করে মটিতে পুঁতে ফেলা হয়।
শিম চাষের জন্য তৈরি খাঁড়া মাচার পাশাপাশি ঘেরের জমিতে সমান্তরাল মাচা তৈরি করে একইসাথে করলা, লাউ, কুমড়া, অফসিজন তরমুজ প্রভৃতির আবাদ করা হয়ে থাকে।
ঘেরে যেহেতু মাছ চাষ হয়, তাই রাসায়নিক বিষ প্রয়োগের কোন সুযোগ থাকে না। শিম লাগানোর প্রায় দুই মাস পর থেকে শিম উত্তোলন করা যায়। প্রায় আট মাস পর্যন্ত শিম উত্তোলন করা সম্ভব।
বীজ ক্রয় ও মাদা প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে শিম উত্তোলন পর্যন্ত বিঘাপ্রতি মোট খরচ হয় আনুমানিক এক লক্ষ টাকা। তবে কৃষকদের মতে আট মাসে বিঘাপ্রতি প্রায় দশ লক্ষ টাকার শিম বিক্রি করা সম্ভব হয়। আগাম শিমের বাজার দর স্থানীয় পর্যায়ে ১০০ থেকে ১২০ টাকা। কখন আবার ১৪০-১৫০ টাকা করে বিক্রি করা হয়।
এ পদ্ধতিতে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা ঘেরের পাড়ের সামান্য জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে জৈব পদ্ধতিতে নিরাপদ ও বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। ঘেরের দু’পাড় জুড়ে যতদূর দৃষ্টি যায় সবুজের সমারোহ। এ যেন এক নান্দনিক দৃশ্য।
ঘেরের পাড়ে উৎপাদিত সবজি এর পুষ্টিগুণ
শিম আমিষ ও ক্যরোটিন সমৃদ্ধ আঁশজাতীয় সবজি। শিমের বিচিতে উচ্চমাত্রায় আমিষ রয়েছে। এছাড়া শিমের বিচি ক্যালসিয়াম, লৌহ ও ভিটামিনযুক্ত। এ খাবারটি হাড়ের রোগ ও ওজন কমাতে সাহায্য করে। শিম পরিপাকের জন্য ভালো আর দেহ ঠা-া রাখে। ব্যথা কমাতে ও রুচি বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। শিম শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ও কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করতে সহায়তা করে।
মিষ্টিকুমড়া ক্যারোটিন ও ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ একটি খাবার। রাতকানা ও ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। হার্ট এটাক ও ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিজ রোগ নিয়ন্ত্রণ করে।
লাউ চুল ভালো রাখতে, অনিদ্রা ও নার্ভের অসুখ সারাতে সাহায্য করে। করলা ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ একটি খাবার। এর রস বহুমূত্র, চর্মরোগ, বাত এবং হাঁপানি রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
শসা পটাশিয়াম সমৃদ্ধ একটি খাবার। এটি নখ গঠনে সহায়তা করে। দেহের তাপমাত্রা কমায়। স্থূলতা কমাতে, হার্টের স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়তা করে। কিডনি ও পাকস্থলীর প্রদাহ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তরমুজ ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন সমৃদ্ধ একটি খাবার। লিভারের ফোলা ভাব কমাতে ও প্রস্রাবের জ¦ালা পোড়া রোধে সাহায্য করে।
(সূত্র : অসিত কুমার সাহা ও ড. প্রণয় বালা, পুষ্টিকথা, জুন ২০১৯)
প্রধানমন্ত্রীর উদাত্ব আহবানে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে এসেছে এদেশের তরুণসমাজ। অনেকেই আজকাল চাকরি নামক সোনার হরিণের পেছনে না ছুটে স্বাবলম্বী হচ্ছেন কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে। তাই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশ ও গুটি গুটি পায়ে উন্নতদেশে রূপান্তরিত হতে দেশের কৃষিজীবী মানুষের ভূমিকা অপরিসীম। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে বর্ধিত জনগোষ্ঠীর খাদ্যের চাহিদা মেটাতে পরিকল্পিত চাষাবাদের কোন বিকল্প নেই। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাটির স্বাস্থ্য ধরে রেখে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয়। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সুখী-সমৃদ্ধ সোনারবাংলা গড়ে তোলা এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবে রূপ নিয়েছে।

লেখক : আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খুলনা। মোবাইল নম্বর: ০১৭০৬৫৭৬৯২২, ই-মেইল :khulna@ais.go.bd

 

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর

প্রশ্নোত্তর

কৃষিবিদ আকলিমা খাতুন

নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন। সায়মা সরকার, উপজেলা : রামগতি, জেলা : লক্ষ্মীপুর
প্রশ্ন : অতিরিক্ত ঠা-ায় বীজতলার যত্ন ও পরিচর্যার সঠিক নিয়ম স¤পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : বোরো মৌসুমে শীতের জন্য চারার বাড়-বাড়তি ব্যাহত হয়। শৈত্যপ্রবাহের সময় বীজতলা স্বচ্ছ সাদা পলিথিন দিয়ে সকালে চারার পাতার উপরের শিশির শুকিয়ে গেলে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢেকে দিলে বীজতলার পানি সকালে বের করে দিয়ে আবার নতুন পানি দিলে ও চারার উপরে শিশির ঝড়িয়ে দিলে চারা ঠা-া থেকে রক্ষা পায়। বীজতলায় সবসময় নালা ভর্তি পানি ধরে রাখতে হবে। বীজ গজানোর ৪-৫ দিনপর বেডের উপর ২-৩ সেমি. পানি রাখলে আগাছা ও পাখির আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। চারাগাছ হলদে হয়ে গেলে প্রতি বর্গমিটারে ৭ গ্রাম ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া প্রয়োগের পর ও চারা সবুজ না হলে গন্ধকের অভাব হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। তখন প্রতি বর্গমিটারে ১০ গ্রাম জিপসাম সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগের পর বীজতলায় পানি ধরে রাখা উচিত।
নুরুল হক, উপজেলা : শিবালয়, জেলা : মানিকগঞ্জ
প্রশ্ন : জিংক সমৃদ্ধ আধুনিক গমের জাত সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : বারি গম ৩৩ গমের প্রথম ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী জিংক সমৃদ্ধ জাত। জাতটির উচ্চতা মাঝারি (১০০-১০৫) সেমি.। কুশির সংখ্যা ৩-৫টা। শীষ বের হতে ৬০-৬৫ দিন এবং বোনা থেকে পাকা ১১০-১১৫ দিন সময় লাগে। জাতটি ব্লাস্ট রোগ, পাতার দাগ রোগ ও মরিচা রোগ প্রতিরোধি। জাতটি স্বল্পমেয়াদি ও তাপ সহনশীল হওয়ায় দেরিতে বপনের জন্য উপযোগী। বীজ বপনের সময় (১৫-৩০ নভেম্বর) বীজ হার ১৩০ কেজি/ হেক্টর। দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ত এলাকা ছাড়া দেশের সর্বত্র আবাদের উপযোগী। হেক্টরপ্রতি ফলন ৪০০০-৫০০০ কেজি। দানার রং সাদা, চকচকে মাঝারি (হাজার দানার ওজন ৪৫-৫২ গ্রাম)। মাড়াই করার পর ৩-৪ দিন হালকা রোদে শুকিয়ে বীজের আর্দ্রতা ১২% তার নিচে নামিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে।
রফিক উদ্দিন, উপজেলা : বীরগঞ্জ, জেলা : দিনাজপুর
প্রশ্ন : আলুর জমিতে এক ধরনের পোকা গাছের পাতা, কা- ও ডগার রস চুষে খাচ্ছে। গাছের পাতা হলুদ বর্ণ ও কুঁকড়ে যাচ্ছে। এই সমস্যার সমাধান কী?
উত্তর : জাব পোকার আক্রমণে এই ধরনের সমস্যা জমিতে হয়ে থাকে। প্রতিকার হিসেবে প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি ডায়াজিনন গ্রুপ বা ইমিডাক্লোরপিড গ্রুপের এডমায়ার বা টিডো ০.৫ মিলি মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে ৩ বার। এ ছাড়াও জাবপোকার আক্রমণ বেশি হলে আলুর উত্তোলনের শেষের দিকে গাছ কেটে বা উপড়ে দিতে হবে।
লিটন আহমেদ, উপজেলা : পীরগঞ্জ, জেলা : রংপুর
প্রশ্ন : ক্ষিরা গাছের পাতায় ও ফলে কালো কালো দাগ দেখা যাচ্ছে ও ক্ষিরা পচে যাচ্ছে। করণীয় কী?
উত্তর : এটি ক্ষীরার এনথ্রাকনোজ রোগ। ঈড়ষষবঃড়ঃৎরপযঁস ংঢ় নামক এক প্রকার ছত্রাক দ্বারা এ রোগের বিস্তার ঘটে। এ রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে প্রোপামোকার্ব গ্রুপের দুদু ২ গ্রাম বা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের (নোইন ১ গ্রাম) বা প্রোপিকোনাজল গ্রুপের টিল্ট ০.৫ মিলি বা কপার হাইড্রোঅক্সাইড গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন ২ গ্রাম করে ১০ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে ৩ বার। এছাড়া আক্রান্ত গাছ তুলে নষ্ট বা পুড়ে ফেলতে হবে।  রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে ও সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে।
রাজীব শিকদার, উপজেলা : রাজাপুর, জেলা : ঝালকাঠি
প্রশ্ন : ধানের জমিতে জৈবসার হিসেবে মুরগির বিষ্ঠা প্রয়োগের কার্যকারিতা/ উপকারিতা কী কী?
উত্তর : জৈসসারকে মাটির উর্বরতা শক্তির চালক হিসেবে গণ্য করা হয়। বোরো মৌসুমে প্রতি বিঘায় ৮০০ কেজি মুরগীর বিষ্ঠা (পোলট্রি লিটার) রাসায়নিক সারের সাথে ব্যবহার করলে রাসায়নিক সার কম লাগবে। মুরগীর বিষ্ঠায় চাহিদা অনুসারে ফসফরাস বিদ্যমান থাকায় জমিতে ঐ মৌসুমে টিএসপি/ ডিএপি সার ব্যবহার করার প্রয়োজন নাই। তবে নাইট্রোজেনের অভাব পরিলক্ষিত হলে পরিমিত মাত্রায় ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করলে আরও ভাল ফলন পাওয়া যায়। মুরগির বিষ্ঠা টাটকা/২৫-৩০ দিন পচানো দুই অবস্থায়ই ব্যবহার করা যায়। তবে টাটকা ব্যবহার করলে মাটিতে প্রয়োগের ৫-৭ দিন পর চারা রোপণ করতে হবে। তা না হলে রোপণের পর কিছু চারা মারা যেতে পারে। সেজন্য চারা রোপণের পর অন্তত ১৪ দিন পর্যন্ত জমিতে পানি ধরে রাখতে হবে। অপরদিকে ২৫-৩০ দিনের পচানো বিষ্ঠা প্রয়োগ করলে সাথে সাথে চারা রোপণ করা যায়। এতে চারা মারা যায় না।
শফিক হোসেন, উপজেলা : জলঢাকা, জেলা : নীলফামারী
প্রশ্ন : ধানের চারার পাতা হলুদ হয়ে আস্তে আস্তে শুকিয়ে খড়ের মতো হয়ে যাচ্ছে। করণীয় কী?
উত্তর : এটি ধানের পাতা পোড়া রোগ নামে পরিচিত এবং এটি ব্যাকটেরিয়াজনিত একটি রোগ। বোরো মৌসুমে ধানের অন্যতম প্রধান রোগ পাতা পোড়া চারা এবং বয়স্ক গাছ দুই ক্ষেত্রেই দেখা যায়। চারার বাইরে পাতা হলুদ হয়ে শুকিয়ে খড়ের রঙে পরিণত হয় ফলে নতুন পাতাও শুকিয়ে যায় এবং চারা নেতিয়ে পড়ে। চারা গোড়ায় হাত দ্বারা চাপ দিলে পুঁজের মতো দুর্গন্ধযুক্ত পদার্থ বের হয়। বয়স্ক গাছে প্রথমে পাতার কিনারায় ও আগায় ছোট ছোট জলছাপের মতো দাগ দেখা যায়। পরে এই দাগগুলো বড় হয়ে অগ্রসর হতে থাকে এবং অক্রান্ত অংশ ধুসর বাদামি বর্ণে পরিণত হয় যা ঝলসানো বা পাতা পোড়া বলে মনে হয়। এই রোগ দেখা দেওয়ার পর পরই ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। রোগের প্রাথমিক অবস্থায় ৬০ গ্রাম এমওপি, ৬০ গ্রাম থিওভিট ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। থোড় বের হওয়ার আগে রোগ দিলে বিঘাপ্রতি ৫ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। এই সময় জমির পানি শুকিয়ে ৭-১০ দিন পর আবার পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করলে রোগের প্রকোপ কম হবে। এছাড়া কপার অক্সি ক্লোরাইড (ংঁহারঃ) ৪ গ্রাম বা কপার হাইড্রোক্সাইড গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে ৭-১০ দিন পরপর ৩ বার। প্রয়োজনে ১% বর্দ্দোমিকচার ব্যবহার করা যেতে পারে।
জলিল ভূঞা, উপজেলা : গদখালী, জেলা : যোশর
প্রশ্ন : বরবটি গাছের চারা হঠাৎ করে নেতিয়ে পড়ে মারা যাচ্ছে। করণীয় কী?
উত্তর : বরবটির চারা নেতিয়ে পড়া একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এই রোগ দেখা দিলে আক্রান্ত গাছ নষ্ট বা পুড়ে ফেলতে হবে। বপনের পূর্বে বীজ শোধন (প্রোভেক্স ২.৫ গ্রাম বা ব্যাভিষ্টিন-২ গ্রাম/প্রতি কেজি বীজ) করতে পারলে অনেকাংশে প্রতিরোধ করা যায়। চারা গজানোর পরে অতিরিক্ত সেচ দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এ রোগের আক্রমণ দেখা দিলে প্রতিলিটার পানিতে ২ গ্রাম কমপ্যানিয়ন  (ম্যানকোজেব+কার্বেনডাডিম) গ্রুপের বা কপার হাইড্রোক্সাইড গ্রুপের ২ গ্রাম চ্যাম্পিয়ন ব্যবহার করতে হবে ৭ দিন পরপর ৩ বার। এছাড়া মাদার মাটি শোধন করা যেতে পারে। মাদায় ট্রাইকোডার্মা ভিডিডি ৩০ গ্রাম, ৫০০ গ্রাম গোবরের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আবু তাহের, উপজেলা : রামগতি, জেলা : লক্ষ্মীপুর
প্রশ্ন : পোকা বাঁধাকপির পাতা খেয়ে ফেলছে। কী করতে হবে?
উত্তর :  লেদাপোকার কীড়া কপির বর্ধনশীল অংশ খেয়ে ফেলে। ফলে কপির মাথা নষ্ট হয় এবং খাওয়ার অনুপযোগী হয়। পাতার সবুজ অংশ খেয়ে বড় হতে থাকে। পোকার ডিম ও লেদা হাত দ্বারা বাছাই করতে হবে। ক্ষেত পরিষ্কার রাখতে হবে। সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক ( যেমন ওসতাদ ২০ মিলিলিটার অথবা ম্যাজিক ১০ মিলিলিটার) প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০-১২ দিন পরপর ২-৩ বার।
মো: সাহারুল ইসলাম, উপজেলা : চকোরিয়া, জেলা : কক্সবাজার
প্রশ্ন : পেঁয়াজের কা- পচে যাচ্ছে। কী করণীয়?
উত্তর : পেঁয়াজের কা- পচা রোগ (ঝপষবৎড়ঃরঁৎস ৎড়ষভংরর) ছত্রাকজনিত রোগ। আক্রান্ত গাছের পাতা হলুদ হয়ে যায় ও ঢলে পড়ে। আক্রান্ত গাছ খুব সহজেই মাটি থেকে কন্দসহ উঠে আসে। আক্রান্ত স্থানে পচন ধরে। আক্রান্ত জমিতে প্রতি বছর পেঁয়াজ চাষ করা যাবে না। আক্রান্ত পেঁয়াজ গাছ তুলে নষ্ট করতে হবে। প্রতি কেজি বীজে ২ গ্রাম (কার্বেন্ডাজিম) প্রুপের ব্যাভিস্টিন দিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। চারা আক্রান্ত হলে ২.৫ গ্রাম প্রোভেক্স (কার্বাক্সিন+থিরাম) গ্রুপের ২০০ বা ২ গ্রাম ব্যাভিষ্টিন বা (কার্বেন্ডাজিম) গ্রুপ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে চারার গোড়ায় স্প্রে করতে হবে।
রিফাত, উপজেলা : ঠাকুরগাঁও, জেলা : পীরগঞ্জ
প্রশ্ন : ছোলার গাছ হলুদ হয়ে যায়, ঢলে পড়ে ও শুকিয়ে যায় এবং টান দিলে সহজেই উঠে আসে না। লম্বালম্বিভাবে কাটলে কা-ের মাঝখানের অংশ কালো দেখা যায়। এটার প্রতিকার কি?
উত্তর : সাধারণত মাটির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে ও যথেষ্ট পরিমাণ আর্দ্রতা থাকলে এ রোগের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। বীজ শোধক দিয়ে বীজ বপনের পূর্বে বীজ শোধন করলে ছোলার উইল্ট রোগ দমন করা যায়,  (কার্বাক্সিন+থিরাম) গ্রুপের প্রোভেক্স অথবা ভিটাভেক্স ২০০ প্রতি কেজি বীজের জন্য ২.৫-৩.০ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। মাঠে ঢলে পড়া রোগ দেখা দিলে কার্বেন্ডাজিম (ব্যভিস্টিন ডি এফ অথবা নোইন) অথবা কার্বাক্সিন+থিরাম গ্রুপের প্রোভেক্স-২০০ ডব্লিউ পি ১ গ্রাম হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে বিকালে গাছের গোড়ায় ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।
রোগ প্রতিরোধী জাত, যেমন বারি ছোলা-৫ এবং বারি ছোলা-৯ এর চাষ করতে হবে। ফসলের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈবসার ব্যবহার করতে হবে।
রেজা, উপজেলা : বীরগঞ্জ, জেলা : দিনাজপুর
প্রশ্ন : সূর্যমুখীর ধূসর বা গাঢ় বাদামি বর্ণের অসম আকৃতির দাগ পড়ে। পরে দাগ মিশে গিয়ে বড় দাগের সৃষ্টি করে।  অবশেষে সম্পূর্ণ পাতা ঝলসে যায়।
উত্তর :  রোগ সহনশীল বারি সূর্যমুখী ২ জাত চাষ করতে হবে। রোগ দেখা দিলে সাথে সাথে (ইপোড্রিয়ন) গ্রুপের রোভরাল ৫০ ভব্লিউপি (২ গ্রা. হারে) পানির সাথে মিশিয়ে ১০ দিন পরপর ২-৩ বার পাতায় প্রয়োগ করলে রোগের প্রকোপ কমে যায়। ফসল কাটার পর  গাছের পরিত্যক্ত অংশ নষ্ট করলে বা পুড়িয়ে ফেললে ও রোগের উৎস নষ্ট হয়ে যায়।
সাইফুল, উপজেলা : বাকেরগঞ্জ, জেলা : রংপুর
প্রশ্ন : ভুট্টার মোচা ও দানায় সাদা সাদা আবরণ দেখা যাচ্ছে ও পচে  যাচ্ছে। করণীয় সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : এটি ভুট্টার মোচা ও দানা পচা রোগ। এটি উরঢ়ষড়ফরধ সধুফরং ও ঋঁংধৎরঁস সড়হষরঃধৎড়হ নামক ছত্রাকের আক্রমণে হয়ে থাকে। এ রোগে আক্রান্ত মোচার খোসা ও দানা বিবর্ণ হয়, দানা পুষ্ট হয় না, কুঁচকে অথবা ফেটে যায়, এবং পচে কালো হয়ে যায়। একই জমিতে বার বার ভুট্টা চাষ করা যাবে না। চকচকে প্লাস্টিকের ফিতা ফসলের উপর টাঙানো, ভুট্টা পেকে গেলে দেরি না করে দ্রুত কেটে ফেলা। ফসলের দানা শক্ত হওয়ার সময় প্রোপিকোনাজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক (টিল্ট/প্রাউড) ২ মিলি. প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

মাসুম বিল্লাহ, উপজেলা : নগরকান্দা, জেলা : ফরিদপুর
প্রশ্ন : ভুট্টা গাছের পাতায় ছোট ছোট হালকা সবুজ রঙের পোকা দেখা যাচ্ছে। করণীয় কী?
উত্তর : এটি ভুট্টার গাছের জাবপোকা। এ পোকার পূর্ণাঙ্গ ও বাচ্চা উভয়েই ভুট্টার পাতা, কা- ও ডগা থেকে রস চুষে খায়। ফলে পাতা কুঁকড়ায় যায় ও হলুদ বর্ণ ধারণ করে। সাধারণত ভুট্টাগাছে টাসেল আসার সময় এ পোকার আক্রমণ বেশি হয়। এ পোকা এক পাতার উপরে শ্যুটি মোল্ড নামক এক ধরনের ছত্রাক নি:সরণ করে। যা পরবর্তীতে পাতা উপরে কালো দাগের সৃষ্টি করে। এ জন্য উন্নত জাতের ভুট্টা বপন করতে হবে। পরভোজী পোকা যেমন লেডিবার্ড বিটল জমিতে ছেড়ে দেওয়া। আক্রমণ বেশি হলে ইমিডাক্লোরাপিড গ্রুপের কীটনাশক অ্যাডমায়ার/টিডো/ এসাটফ ০.৫ মিলি/লি. হারে পানিতে মিশিয়ে শেষ বিকেলে ১০ দিন পরপর ২/৩ বার স্প্রে করা।

লেখক : তথ্য অফিসার (পিপি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৯১৬৫৬৬২৬২; ই-মেইল :  aklimadae@gmail.com

বিস্তারিত
মাঘ মাসের কৃষি (১৫ জানুয়ারি-১৩ ফেব্রুয়ারি)

মাঘ মাসের কৃষি
(১৫ জানুয়ারি-১৩ ফেব্রুয়ারি)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
হাড় কাঁপানো শীতের আভাস নিয়ে হাজির হয় মাঘ মাস । কথায় আছে মাঘের শীত নাকি বাঘকেও হার মানায়। জলবায়ু পরিবর্তনে তীব্র শীতের মাঝেও খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যস্ত থাকে কৃষিজীবী ভাইবোনেরা। কেননা এ মাস বোরো মৌসুমের পাশাপাশি কৃষির ব্যস্ততম সময়। তাই আসুন আমরা জেনে নেই মাঘ মাসে কৃষিতে করণীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো।
বোরো ধান
ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ধানের চারা রোপণের  ১৫-২০ দিন পর প্রথম কিস্তি, ৩০-৪০ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তি এবং ৫০-৫৫ দিন পর শেষ কিস্তি হিসেবে ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। বোরো ধানে নিয়মিত সেচ প্রদান, আগাছা দমন, বালাই ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য পরিচর্যা করতে হবে। রোগ ও পোকা থেকে ধান গাছকে বাঁচাতে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ, আন্তঃপরিচর্যা, যান্ত্রিক দমন, উপকারী পোকা সংরক্ষণ, ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করা, আলোর ফাঁদ এসবের মাধ্যমে ধানক্ষেত বালাই মুক্ত করতে পারেন। এভাবে রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা না গেলে শেষ উপায় হিসেবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক বালাইনাশক, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
গম
গমের জমিতে যেখানে ঘনচারা রয়েছে তা পাতলা করে দিতে হবে। গম গাছ থেকে যদি শিষ বেড় হয় বা গম গাছের বয়স ৫৫-৬০ দিন হয় তবে জরুরিভাবে গমক্ষেতে একটি সেচ দিতে হবে। এতে গমের ফলন বৃদ্ধি পাবে। ভালো ফলনের জন্য দানা গঠনের সময় আরেকবার সেচ দিতে হবে। গম ক্ষেতে ইঁদুর দমনের কাজটি সকলে মিলে একসাথে করতে হবে।
ভুট্টা
ভুট্টাক্ষেতে গাছের গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য কারণে এসময় ভুট্টা ফসলে আর্মিওয়ার্ম, ফল আর্মিওয়ার্ম ইত্যাদি পোকার আক্রমণ দেখা যায়। আক্রান্ত গাছ থেকে লার্ভাগুলো হাত দ্বারা সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে স্পেনোসেড (ট্রেসার ৪৫এসসি@ ০.৪ মিলি./লিটার) বা এবামেকটিন বেনজোয়েট (প্রোক্লেম ৫ এসজি বা সাহাম ৫ এসজি @ ১ গ্রাম/লিটার) বালাইনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
আলু
আলু ফসলে নাবি ধসা রোগ দেখা দিতে পারে। সে কারণে ¯েপ্রয়িং শিডিউল মেনে চলতে হবে। মড়ক রোগ দমনে দেরি না করে ২ গ্রাম এক্সট্রামিল অথবা ডাইথেন এম ৪৫ অথবা সিকিউর অথবা মেলুডি ডুও প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে নিয়মিত ¯েপ্র করতে হবে। মড়ক লাগা জমিতে সেচ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। তাছাড়া আলু ফসলে মালচিং, সেচ প্রয়োগ, আগাছা দমনের কাজগুলোও করতে হবে। আলু  গাছের বয়স ৮০ দিন হলে মাটির  সমান করে গাছ কেটে দিতে হবে এবং ১০ দিন পর আলু তুলে ফেলতে হবে। খুব সহজে ও কম খরচে আলু উত্তোলন করতে পটেটো ডিগার যন্ত্র ব্যবহার করুন। ক্ষতির হার ১% এর নিচে এবং শ্রমিক ৫০% সাশ্রয় হয়। আলু তোলার পর  ভালো করে শুকিয়ে বাছাই করতে হবে এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
তুলা
তুলা সংগ্রহের কাজ এ মাস থেকেই শুরু করতে হবে। তুলা সাধারণত ৩ পর্যায়ে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। শুরুতে ৫০% বোল ফাটলে প্রথম বার, বাকি ফলের ৩০% পরিপক্ব হলে দ্বিতীয় বার এবং অবশিষ্ট ফসল পরিপক্ব হলে শেষ অংশের তুলা সংগ্রহ করতে হবে। রৌদ্রময় শুকনা দিনে বীজ তুলা উঠাতে হয়। ভালো তুলার সাথে যেন খারাপ তুলা (পোকায় খাওয়া, রোগাক্রান্ত) কখনো না মেশে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ভালো তুলা আলাদাভাবে তুলে ৩-৪ বার রোদে শুকিয়ে বস্তায় ভরে মাচা বা দানেস এর উপর সংরক্ষণ করতে হবে। ইঁদুর নষ্ট করতে না পারে, সেদিকে খেয়াল করতে হবে।
ডাল ও তেল ফসল
মসুর, ছোলা, মটর, মাসকালাই, মুগ, তিসি এ সময় পাকে। সরিষা, তিসি বেশি পাকলে রোদের তাপে ফেটে গিয়ে বীজ পড়ে যেতে পারে, তাই এগুলো ৮০ ভাগ পাকলেই সংগ্রহের ব্যবস্থা নিতে হবে। ডাল ফসলের ক্ষেত্রে গাছ গোড়াসহ না উঠিয়ে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি রেখে ফসল সংগ্রহ করতে হবে। এতে জমির উর্বরতা এবং নাইট্রোজেন সরবরাহ বাড়বে। এ সময় চর অঞ্চলে পেঁয়াজের সাথে বিলে ফসল হিসেবে বাদাম চাষ করতে পারেন।
শাকসবজি
বেশি ফলন পেতে  শীতকালীন শাকসবজি যেমন ফুলকপি,  বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, ওলকপি, শালগম, গাজর, শিম, লাউ, কুমড়া, মটরশুঁটি এসবের নিয়মিত যত্ন নিতে হবে। উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে জৈবসার, জৈব বালাইনাশক, ফেরোমন ফাঁদ  সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বালাই দমন করতে হবে। শীতকালে মাটিতে রস কমে যায় বলে সবজি ক্ষেতে চাহিদামাফিক সেচ দিতে হবে।
ফুল
জারবেরা ফুল নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সারা বছর চারা লাগানো যেতে পারে তবে শীত মৌসুম অর্থ্যাৎ অক্টোবর-নভে¤¦র মাস চারা লাগানোর সর্বোত্তম সময়। জারবেরার শিকড় গভীরে প্রবেশ করে বিধায় বার বার হালকা ¯িপ্রংকলার (ঝঢ়ৎরহশষবৎ) সেচের পরিবর্তে প্লাবন সেচ (ঋষড়ড়ফ ওৎৎরমধঃরড়হ) দেয়া উত্তম। পানি সেচের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয়। কারণ জারবেরা ক্ষেতে জলাবদ্ধতা মাটিবাহিত রোগ সংক্রমণ ত¦রানি¦ত করে। আবার মাটিতে পানির অভাব হলে গাছ ঢলে (ডরষঃরহম) পড়ে, সেক্ষেত্রে ফুলের পুষ্পদ- ছোট হয়ে যায়।
বেড তৈরি হলে চারা লাগানোর কমপক্ষে এক সপ্তাহ আগে বেডের প্রতি ১০ বর্গ মিটারের জন্য ৬০ কেজি পচা জৈব সার, ১.৫ কেজি ইউরিয়া অথবা ১ কেজি এমোনিয়াম সালফেট, ২.৫ কেজি ট্রিপল সুপার ফসফেট, ৫০০ গ্রাম মিউরেট অব পটাশ ও ৫০ গ্রাম ম্যাগনেশিয়াম সালফেট প্রয়োগ করে ভালভাবে মাটিতে মিশিয়ে দিয়া প্রয়োজন। জারবেরার বেড তৈরির সময় সারের যে বেসাল ডোজ দেয়া হয় তার পাশাপাশি নিম্নলিখিত মাত্রায় পুষ্টি সরবরাহ করতে হবে। চারা রোপণের প্রথম ২-৩ সপ্তাহ গাছে কোন সার প্রয়োগ করা যাবে না। জারবেরা বেডের প্রতি ১০ বর্গ মিটার জমিতে গাছের চারপাশে ২৫০ গ্রাম ক্যালসিয়াম এমোনিয়াম নাইট্রেট এবং ১৫০ গ্রাম মিউরেট অব পটাশ প্রতি ১৫ দিন অন্তর প্রয়োগ করতে হবে। ১২ সপ্তাহ পর থেকে গাছে ফুল আসা শুরু হলে এনপিকে (ঘচক) (১৫:২০:৩০) প্রতি লিটার পানিতে ১.৫ গ্রাম মিশিয়ে ২-৪ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতিদিন জমিতে প্রয়োগ করলে ভাল মানের বেশি ফুল পাওয়া যায়।
গাছপালা
শীতে গাছের গোড়ায় নিয়মিত সেচ দিতে হবে। গোড়ার মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছামুক্ত রাখতে হবে। সাধারণত এ সময় আমগাছে মুকুল আসে। গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার আগে টিল্ট-২৫০ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি অথবা ১ মিলি কন্জা প¬াস অথবা ২ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ¯েপ্র করতে হবে। এসময় প্রতিটি মুকুলে অসংখ্য হপার নিম্ফ দেখা যায়। আম গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার পূর্বেই একবার এবং এর একমাস পর আর একবার প্রতি লিটার পানির সাথে ১.০ মিলি সিমবুস/ফেনম/ডেসিস ২.৫ ইসি মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপাল ভালোভাবে ভিজিয়ে ¯েপ্র করতে হবে।
সুপ্রিয় পাঠক, অত্যন্ত সংক্ষেপে মাঘ মাসে কৃষিতে করণীয় কাজগুলোর উলে¬খযোগ্য দিক তুলে ধরা হলো। আপনারা আপনাদের অভিজ্ঞতা ও পরিবেশের গ্রহণযোগ্যতার সমন্বয়ে কাজ করলে সফলতা আসবেই। কৃষির যে কোনো সমস্যায় উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।

লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা।  টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪, editor@ais.gov.bd

বিস্তারিত