নিবিড় শাকসবজির উৎপাদন ও পুষ্টি নিরাপত্তা
কৃষিবিদ দিলরুবা আখতার১
কৃষিবিদ সাবিনা ইয়াসমিন২
আমাদের দেশের মাটি ও জলবায়ু বিভিন্ন সবজি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। স্বল্প সময়ে ও স্বল্প যত্নে চাষ করা যায় বলে অর্থনৈতিক দিক, কর্মসংস্থান ও পুষ্টি বিবেচনায় শাকসবজি চাষের গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে বাংলাদেশে চাষকৃত প্রচলিত-অপ্রচলিত সবজির সংখ্যা প্রায় ৯০টি, যার মধ্যে ৩০-৩৫টি হলো প্রধান সবজি যা বাণিজ্যিকভাবে চাষোপযোগী। বাংলাদেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ৮.৭ মিলিয়ন হেক্টর (সূত্র: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, কৃষি উইং, ২০১৬-২০১৭)। দেশের শতকরা ৯.৩৮ ভাগ জমি সবজি চাষের জন্য ব্যবহার হচ্ছে যার মাধ্যমে বর্তমানে মাথাপিছু ১২৫ গ্রাম সবজি সরবরাহ নিশ্চিত হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (GAP) ডায়াটারি গাইডলাইন অনুসারে মানবদেহের পুষ্টি চাহিদাপূরণের জন্য একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ১০০ গ্রাম পাতাজাতীয় সবজি, ২০০ গ্রাম অন্যান্য সবজি এবং ১০০ গ্রাম ফল খাওয়া উচিত। কোভিড-১৯ এর ভয়াবহ আক্রমণের ফলে সারা বিশ্বে ৫৩ লাখ ৩১ হাজারের ও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ২৭ কোটি ১৯ লক্ষ মানুষ (সূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা: ১৯/১২/২০২১)। এই পরিস্থিতিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণের পরামর্শ হলো, সুস্থ থাকতে প্রত্যেকের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ ছাড়াও মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তির অধিকতর বিকাশসহ শারীরিক সক্ষমতা অর্জনের জন্য খণিজ লবণ ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। উৎপাদন প্রতি বছর বাড়লেও নিয়মিত সবজি গ্রহণের হার সেরকম হারে বাড়ছে না। সেজন্য কৃষি মন্ত্রণালয় অধীনস্থ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জনগণের পুষ্টিস্তর উন্নয়নে বদ্ধপরিকর।
কৃষিবান্ধব সরকারের দিকনির্দেশনায় ও সহযোগিতায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক মহোদয়ের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশে কৃষির ক্ষেত্রে এসেছে সাফল্য। কৃষি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন রকম উচ্চমূল্য শাকসবজি, উন্নতমানসম্পন্ন, উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের সবজিকে সফলভাবে চাষ করার জন্য আধুনিক ও টেকসই চাষ পদ্ধতি এবং ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাগণ। কৃষি কাজকে লাভজনক করার জন্য রপ্তানিযোগ্য উচ্চমূল্য ফসল চাষকে প্রাধান্য দেয়া ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি মেনে চলার পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমান কৃষিতে আরও যুক্ত হয়েছে বাণিজ্যিকীকরণ ও যান্ত্রিকীকরণের উদ্যোগ যা উন্মুক্ত করেছে উন্নয়ন ও সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। এ লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জাতীয় কৃষি নীতি-২০১৮, জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতি-২০১৫ এসডিজি-২০৩০ অর্জনের লক্ষ্যে ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করে যাচ্ছে।
পরিবর্তিত জলবায়ুতে নিবিড় সবজি উৎপাদনে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার, উচ্চমূল্যের ফসল চাষ, সর্জন পদ্ধতিতে সবজি চাষ, ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ, ছাদ কৃষি, মাশরুম চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করছে। সবজি চাষকে জনপ্রিয়করণের লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় ডিএই রাজস্ব, প্রণোদনা ও উন্নয়ন খাতের মাধ্যমে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে এবং বাংলাদেশের উন্নয়নে কৃষির অবদান উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সবজি উৎপাদন বৃদ্ধি ও পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা মিটানোর জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। যেমন: কন্দাল ফসল উন্নয়ন প্রকল্প, অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় পারিবারিক পুষ্টিবাগান স্থাপন প্রকল্প, ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্প, নিরাপদ উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল উৎপাদন, সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও বাজারজাতকরণ প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর-ইউনিসেফ পার্টনারশিপ অন নিউট্রিশন সেনসেটিভ এগ্রিকালচারাল সার্ভিস ডিএই-ইউনিসেফ পার্টনারশিপ এর মাধ্যমে পারিবারিক পুষ্টি অর্জনের জন্য কক্সবাজার এলাকার জনগণকে শাকসবজি চাষের প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ, আঙ্গিনা বাগান স্থাপন ও প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ বিতরণ করে সবজি চাষ বৃদ্ধিতে ও খেতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে।
কৃষি পণ্যের ন্যায্যামূল্য নিশ্চিতে ও কৃষিকে লাভজনক করতে ডিএই এর সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। নিরাপদ সবজি উৎপাদনে উত্তম কৃষি চর্চা (এঅচ) ২০২০ অনুসরণ করা হচ্ছে। সার, বীজসহ সব কৃষি উপকরণের মূল্যহ্রাস, কৃষকদের সহজ শর্তে ও স্বল্পসুদে ঋণ প্রদান, দশ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ, কৃষকদের নগদ সহায়তা, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও ই-কৃষির সম্প্রসারণসহ গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব প্রদান দেয়া হচ্ছে। এই সকল কার্যক্রমের মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন হবে যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ অর্জনে বিরাট ভূমিকা রাখবে। ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে কোভিড-১৯ নামক অতিমারির আঘাতের ফলে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলেও বাংলাদেশ বীরদর্পে এগিয়ে যাচ্ছে এবং খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ জাতিসংঘ থেকে পুরস্কৃত হয়েছে । শাকসবজি উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
সুস্থ-সবলভাবে বেঁচে থাকতে নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের বিকল্প নেই। পুষ্টির চাহিদা পূরণে শাকসবজির অবদান অনন্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুসারে এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে সে লক্ষ্যে ডিএই এর মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর চাষযোগ্য জমি কমে যাওয়া সত্ত্বেও উন্নত জাত ও আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় উৎপাদন বৃদ্ধি করা হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইংয়ের তথ্যানুসারে দেখা যাচ্ছে যে, ২০১৩-২০১৪ সালে প্রায় ৯.৬৮ লাখ হেক্টর জমিতে ১৯৩.৯৭ লাখ মে.টন আলুসহ সবজি উৎপাদন হলেও তা ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বেড়ে ১৪.৩৩ লাখ হেক্টর জমিতে ৩১৬.৮৬ লাখ মে.টন উৎপাদিত হয়েছে। যা কৃষি সেক্টরের উন্নয়ন ও বর্তমান সরকারের সাফল্যের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। বাংলাদেশে সবজি উৎপাদনের তথ্যচিত্র সারণি দ্রষ্টব্য।
অর্জন | ||
অর্থবছর | জমির পরিমাণ (হেক্টর) | |
২০১৩-২০১৪ | ৯,৬৮,৮২৭ | আলুসহ সবজি উৎপাদন (লাখ মে.টন) ১৯৩.৯৭ |
২০১৪-২০১৫ | ৯,৯০,৭৭২ | ২১০.৪১ |
২০১৫-২০১৬ | ১০,৬৩,৩৮৫ | ১৯৯.৮৪ |
২০১৬-২০১৭ | ১০,৭৭,৩১৯ | ২২৩.৬৭ |
২০১৭-২০১৮ | ১১,৬৯,৩২৬ | ২৫৬.২৫ |
২০১৮-২০১৯ | ১২,৪৯,৯৩৬ | ২৬৬.৯৬ |
২০১৯-২০২০ | ১৩,০৬,৮৭৯ | ২৮৯.০২ |
২০২০-২০২১ | ১৪,৩৩,৭৫২ | ৩১৬.৮৬ |
সারণি : বাংলাদেশে সবজি উৎপাদনের তথ্যচিত্র
সূত্র: হর্টিকালচার উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে হর্টিকালচার উইং এর তত্ত্বাবধানে হর্টিকালচার সেন্টারসমূহ জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি সমস্যা সমাধানে কৃষক ও উদ্যোক্তাদের চাহিদামাফিক সেবা প্রদান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলছে। উচ্চমূল্য ফসলের উফশী এবং হাইব্রিড জাতের সবজির চারা উৎপাদন করে সরকারি মূল্যে সরবরাহ করছে। এই উইংয়ের আওতায় সারাদেশে মোট ৭৫টি হর্টিকালচার সেন্টার ও ১টি মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট মাশরুম ও সবজির উৎপাদন বৃদ্ধিতে অসাধারণ ভূমিকা রাখছে। প্রতিদিনের আহারে সবজির ব্যবহারকে জনপ্রিয় করতে কৃষি মন্ত্রণালয় অধীনস্থ দপ্তর সংস্থা জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে। এ ছাড়াও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রতি বছর ৩ দিনব্যাপী জাতীয় সবজি মেলা আয়োজন করে থাকে। সবজির গুণাবলী, চাষের আধুনিক প্রযুক্তিসমূহ উপস্থাপন ও প্রচার, অপ্রচলিত ও অধিক ফলনশীল জাতের পরিচিতি এবং কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ও উদ্যোক্তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় ও যোগাযোগের প্লাটফর্ম সৃষ্টি, ক্রেতা ও বিক্রেতার মিলনমেলা এবং নতুন প্রজন্মকে সবজি খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অনুধাবন করানোই এই মেলার মূল উদ্দেশ্য। বাংলাদেশের সবজির উৎপাদন বৃদ্ধিতে যারা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন তাদেরকে পুরস্কৃত করার মাধ্যমে সকল কৃষক-কৃষানি কে অনুপ্রাণিত করা হয়। রাজধানীর বুকে কেআইবি চত্বরে জানুয়ারি মাসে এই মেলাটি হয়ে থাকে। আশা করা যাচ্ছে মহামারি কোভিড-১৯ এর প্রকোপ কমে গেলে ২০২২ সালে জাতীয় সবজি মেলার আয়োজন হতে পারে
সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ যে বিপ্লব সাধন করেছে তা বর্তমানে সর্বজন স্বীকৃত। তবুও সবজি গ্রহণের হার বাড়ানো ও কৃষকের মুখে হাসি ফুটানো এখনো পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। তাই ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত, গ্রামীণ জণগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ও জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির অবদান বৃদ্ধিতে সবজির সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ, অপচয় রোধ, প্রসেসিং করা ও রপ্তানি বাড়ানো একান্ত প্রয়োজন। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে শাকসবজি রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে আলু, হিমায়িত সবজি, করলা, মুখীকচু, কচু, কচুরলতি, মিষ্টিকুমড়া, শিম বিচি, পটোল, কাঁচামরিচ, লাউ, চাল কুমড়াসহ অনেক সবজি বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। এ ছাড়াও মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মহোদয়ের বিশেষ উদ্যোগে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে স্থাপিত উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকার পূর্বাচলে এক্রিডেটেড ল্যাবরেটরি স্থাপনের প্রকল্প প্রস্তুত করা হচ্ছে। যা ভবিষ্যতে শাকসবজি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে ভূমিকা রাখবে।
সর্বোপরি বলা যায়, উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে বর্তমান সরকারের নিরন্তর প্রচেষ্টায় কৃষি ও কৃষিনির্ভর জনগণের উন্নয়নে আমূল অবদান রাখছে ও ভবিষ্যতেও রাখবে। সে সাথে সুস্থসবল পুষ্টিসমৃদ্ধ মেধাবী জাতি গঠনে সবজির উৎপাদন বৃদ্ধি ও নিয়মিত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
লেখক : ১পরিচালক, হর্টিকালচার উইং, ডিএই, ২উপজেলা কৃষি অফিসার, সংযুক্ত: হর্টিকালচার উইং, ডিএই, মোবাইল: ০১৬৮৮০৫৪৭৮৬, ইমেইল : sabina31st@gmail.com
পুষ্টিমানের বিবেচনায় বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত পাটশাক
ড. এ টি এম মোরশেদ আলম
মানুষের শরীরকে সুস্থ, সুন্দর-আকর্ষণীয়, পরিপুষ্ট ও কর্মক্ষম রাখার জন্য প্রয়োজন খাদ্যপুষ্টি। যে সব খাদ্য গ্রহণ করলে দেহে তাপ ও শক্তি উৎপন্ন হয়, দেহের বৃদ্ধি সাধন ও ক্ষয়পূরণ হয় এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে সেগুলোকে সুষম খাদ্য বলে। কাজেই আমাদের পুষ্টি চাহিদার বিবেচনায় প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অবশ্যই সঠিক পরিমাণে শক্তিদায়ক, শরীরবৃদ্ধিকারক ও ক্ষয়পূরক এবং রোগ প্রতিরোধকারী খাদ্যদ্রব্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শক্তিদায়ক খাদ্য হিসেবে আমরা সাধারণত কার্বহাইড্রেট বা ফ্যাট বা চর্বি জাতীয় খাবার খেয়ে থাকি। যেমন : ভাত, রুটি, আলু, ঘি, তেল, মাখন, মিষ্টি ইত্যাদি। শরীর বৃদ্ধিকারক ও ক্ষয়পূরক খাবার হিসাবে আমরা মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, দুধ, শীমের বিচি, বাদাম ইত্যাদি খেয়ে থাকি। আর রোগ প্রতিরোধকারী খাবার হিসেবে আমরা বিভিন্ন প্রকার শাকসবজি ও ফলমূল খেয়ে থাকি। এসব খাবার আমাদের দেহে ভিটামিন ও খনিজ লবণ সরবরাহ করে থাকে। এই ভিটামিন ও খনিজ লবণ বিভিন্ন ধরনের রোগের বিরুদ্ধে আমাদের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে এবং দেহকে রোগমুক্ত রাখতে সাহায্য করে।
বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত পাটশাক ও সবজি মেস্তা : পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের দৈনিক কমপক্ষে প্রায় ৩০০ গ্রাম শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। কারণ, শাকসবজিতে মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ভিটামিন, খনিজ লবণ ও আঁশ রয়েছে। এসব শাকসবজি কেবল শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় না, বরং ভক্ষণকৃত খাদ্যকে হজম, পরিপাক ও বিপাকে সহায়তা করে এবং খাবারে রুচি বৃদ্ধি ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শাকসবজির এসব গুণাগুণ বিবেচনা করে দেশের প্রাচীনতম গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট শাক হিসেবে ব্যবহারের জন্য পাটের তিনটি জাত উদ্ভাবন করেছে।
২০১৪ সালে বিজেআরআই দেশি পাটশাক-১ এবং ২০২০ সালে বিজেআরআই দেশি পাট শাক-২ ও বিজেআরআই দেশি পাটশাক-৩ উদ্ভাবন করেছেন। এ ছাড়া বিজেআরআই-এর বিজ্ঞানীগণ গবেষণার মাধ্যমে ২০১০ সালে খাওয়ার উপযোগী বিজেআরআই মেস্তা-২ বা সবজি মেস্তা-১ উদ্ভাবন করেছেন।
বিজেআরআই দেশি পাটশাক-১ : বিজেআরআই দেশি পাটশাক-১ (বিজেসি-৩৯০), প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) কর্তৃক উদ্ভাবিত দেশি পাটশাকের একটি উন্নত জাত। এটি অগ্রবর্তী লাইন ঈধঢ়. ফধিৎভ ৎবফ- এর সাথে বিনা পাটশাক-১ এর সংস্করায়ণের মাধ্যমে বেশি পাতা বিশিষ্ট ও মিষ্টি স্বাদযুক্ত এই জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে জাতটি সমগ্র বাংলাদেশে বপন উপযোগী বলে প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া জাতটিতে আমিষ, আঁশ, ভিটামিন-সি, অ্যাশ, কার্বহাইড্রেট এবং প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিন (ভিটামিন-এ) বিদ্যমান। খাদ্য ও পুষ্টিমানের সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক ২০১৪ সালে এ জাতটিকে পাটশাক হিসেবে সমগ্র বাংলাদেশে চাষবাদের জন্য বিজেআরআই দেশি পাটশাক-১ নামে নিবন্ধন করা হয়েছে।
এ জাতের গাছ সম্পূর্ণ সবুজ এবং পাতা গাঢ় সবুজ বর্ণের। এ জাতটি থেকে কোন প্রকার আঁশ পাওয়া যায় না। কারণ গাছটি খুবই খাট। দেশি জাত হওয়া সত্ত্বেও এ জাতের পাতা মিষ্টি স্বাদযুক্ত হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা অন্যান্য জাতের চেয়ে বেশি। এ জাতের পাট গাছের বয়স ৩৫-৪০ দিন হলে তখন থেকেই শাক খাওয়া যায়। প্রথমে ছোট চারা গাছ তুলে এবং পরবর্তীতে গাছের ডগা ছিঁড়ে শাক খাওয়া যায়। ডগা খাওয়ার কিছুদিন পর শাখা-প্রশাখা থেকে কচি পাতা বের হলে সেগুলোও শাক হিসেবে খাওয়া যায়। এভাবে বেশ কয়েকবার শাক সংগ্রহ করা যায়। বিজেআরআই পাটশাক-১ একবার চাষ করে দীর্ঘ কয়েক মাস পর্যন্ত শাক সংগ্রহ করা যায়। বাড়ির ছাদে/বারান্দায় কয়েকটি টবে পাটশাক চাষ করে ছোট পরিবারের শাকের চাহিদা সহজেই পূরণ করা যায়। বিজেআরআই দেশি পাটশাক-১ এর পাতার ফলন প্রায় ৩.০-৩.৫০ টন/হেক্টর।
বিজেআরআই দেশি পাটশাক-২ : বিজেআরআই দেশি পাটশাক-২ ম্যাড়াশাক (লাল) নামে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে পরিচিত। এটিকে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের কৃষকের নিকট থেকে সংগ্রহ করে নির্বাচন পদ্ধতিতে অভিযোজন-এর মাধ্যমে এ জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে জাতটি সমগ্র বাংলাদেশে বছরব্যাপী চাষ উপযোগী বলে প্রমাণিত হয়েছে। এ জাতের পাটশাকে আমিষ, ভিটামিন-সি, আঁশ এবং প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিন (ভিটামিন-এ) পাওয়া যায়। খাদ্য ও পুষ্টিমানের বিবেচনায় জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক ২০২০ সালে এ জাতটিকে পাটশাক হিসেবে সমগ্র বাংলাদেশে চাষাবাদের জন্য বিজেআরআই দেশি পাটশাক-২ নামে নিবন্ধন করা হয়েছে। এ জাতের পাটগাছ বিজেআরআই দেশি পাটশাক-১ এর তুলনায় আকারে ছোট। গাছের কাণ্ড, পাতার বৃন্ত ও শিরা গাঢ় লাল। পাতা গাঢ় সবুজ বর্ণের ও মিষ্টি স্বাদযুক্ত। এ জাতটি মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর মাসের শেষ (ফাল্গুন মাস থেকে মধ্য কার্তিক) পর্যন্ত বপন করা যায়। তবে মার্চ থেকে জুলাই এর শেষ (মধ্য ফাল্গুন থেকে মধ্য শ্রাবণ) পর্যন্ত সময়ে বপন করলে অধিক ফলন পাওয়া যায়। বিজেআরআই দেশি পাট শাক-২ এর পাতার ফলন প্রায় ৩.০০-৩.৫০ টন/হেক্টর।
বিজেআরআই দেশি পাটশাক-৩ : বিজেআরআই দেশি পাটশাক-৩ ম্যাড়াশাক (সবুজ) নামে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে সুপরিচিত। পাটের এ শাকটিকে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের কৃষকের নিকট থেকে সংগ্রহ করে নির্বাচন পদ্ধতিতে অভিযোজন-এর মাধ্যমে এ জাতটি উদ্ভাবন করা হয়। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে জাতটি সমগ্র বাংলাদেশে বছরব্যাপী চাষ উপযোগী বলে প্রমানিত হয়েছে। ম্যাড়াশাক (সবুজ)-এ আমিষ, ভিটামিন-সি, আঁশ, প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ (ক্যারোটিন) এবং অ্যাশ আছে। খাদ্য ও পুষ্টিমান বিবেচনায় নিয়ে এ লাইনটিকে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক ২০২০ সালে পাটশাক হিসেবে সমগ্র বাংলাদেশে চাষাবাদের জন্য বিজেআরআই দেশি পাটশাক-৩ নামে নিবন্ধন করা হয়েছে।
বিজেআরআই দেশি পাটশাক-৩ আকার বিজেআরআই দেশি পাটশাক-১ এর তুলনায় ছোট। গাছের কাণ্ড, পাতার বৃত্ত ও শিরা গাঢ় সবুজ। পাতা মিষ্টি স্বাদযুক্ত ও গাঢ় সবুজ বর্ণের।
এ জাতটি ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর মাসের শেষ পর্যন্ত বপন করা যায়। তবে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত সময়ে বীজ বপন করলে অধিক ফলন পাওয়া যায়। পাট গাছের বয়স ৩০-৩৫ দিন হলে শাক সংগ্রহ করা শুরু হয়। তবে এ জাতে দ্রুত ফুল এসে যায় বলে এক বা দুই ধাপেই শাক সংগ্রহ করতে হয়। ম্যাড়াশাক (সবুজ) এর ফলন ৩.০-৪.০ টন/হেক্টর। তবে বীজ বপনের সময় ভেদে ফলনের তারতম্য হতে পারে।
বিজেআরআই মেস্তা-২ বা সবজি মেস্তা-১ : বিজেআরআই মেস্তা-২ বা সবজি মেস্তা-১ স্থানীয়ভাবে চুকুর নামে পরিচিত। এ জাতটি বিশুদ্ধ সারি নির্বাচন পদ্ধতিতে উদ্ভাবন করা হয়েছে যা ২০১০ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক জাত হিসেবে অবমুক্ত করা হয়। সবজি মেস্তার-১ এর কাণ্ড তামাটে বর্ণের এবং শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট। পাতা আঙ্গুল আকৃতির (খণ্ডিত), হালকা সবুজ, মসৃন এবং স্বাদে টক।
বৈশাখের প্রথম থেকে শ্রাবণের শেষ সময় (১৫ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন) পযন্ত সবজি মেস্তার বীজ বপন করা যায়। বীজ বপনের ৬০ দিন পর থেকে পাতা এবং ফল আসার পর থেকে বৃতি সংগ্রহ করা যায়। বৃতির ফলন ২.০০-২.৫০ টন/হেক্টর বা ৭.৫০-৯.০০ মন/বিঘা। পাতার ফলন ৬.০০-৭.০০ টন/হেক্টর বা ২২.০০-২৬.০০ মন/বিঘা।
বিজেআরআই-৪ : বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত সবজি মেস্তা-১ খরা সহনশীল ও নেমাটোড প্রতিরোধী এ জাতটি উঁচু, মাঝারি উঁচু জমিতে এবং বাড়ির আঙ্গিনায় চাষ করা যায়। ফল থেকে বৃতি সংগ্রহ করে খাওয়া যায় এবং এর বীজ থেকে ২০% ভোজ্যতেল পাওয়া যায়। সবজি মেস্তার পাতা ও ফলের মাংসল বৃতি (শাঁস) টক এবং সুস্বাদু। তাই, রান্না করে তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়। তাছাড়া এর মাংসল বৃতি থেকে কনফেকশনারি খাদ্য সামগ্রী যেমন- জ্যাম, জেলি, জুস, আচার, চা সদৃশ পানীয় ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। মেস্তার ক্যালিক্স বা বৃতি দিয়ে তৈরি চা সদৃশ পানীয় নিয়মিত পান করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। এ ছাড়াও এ পানীয় হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় ও শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করে। প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ এ পানীয় মেয়েদের মাসিক পিরিয়ডের ব্যথা প্রশমন করে। গবেষণায় দেখা গেছে মেস্তার ক্যালিক্স দিয়ে তৈরি এ পানীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ যা ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সক্ষম।
পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের আবাদি চারটি প্রজাতির প্রায় ২০-২৫টি জাত বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় চাষাবাদ হয়ে থাকে। তবে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত মানের দেশি ও তোষা পাট একমাত্র বাংলাদেশেই উৎপন্ন হয়। মানুষ বহুদিন যাবৎ পাটপাতা শাক হিসেবে খেয়ে আসছে। পাটশাক বহু পুষ্টিগুণ ও বিভিন্ন ঔষধিগুণে ভরপুর। এমতাবস্থায় পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ ও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় পাটের শাক অত্যাবশ্যকীয় করা একান্ত প্রয়োজন।
লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ বিভাগ, বিজেআরআই, ঢাকা-১২০৭। মোবাইল :০১৭৪০৫৫৯১৫৫, ই-মেইল : morshedbjri@gmail.com
প্রক্রিয়াজাত প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে রূপান্তরিত কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ
মো: হাফিজুল হক খান১ ড. মো: গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী২
বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষির ভূমিকা অনস্বীকার্য যার প্রমাণ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। গত পাঁচ দশকে দেশের জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে, যা পূর্বের চেয়ে প্রায় দেড়গুণ বেশি। কিন্তু বর্ধিত জনসংখ্যার বিপরীতে কৃষি জমি হ্রাস পেয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। এতদসত্ত্বেও বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য জোগানে কৃষিই রেখে চলেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। গত পাঁচ দশকে খাদ্যশস্যের উৎপাদন আশাব্যঞ্জক বেড়েছে যা প্রায় ২ দশমিক ৩ গুণ। এ সব অর্জন সম্ভব হয়েছে সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির প্রণয়ন, যথাযথ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে। কৃষির আধুনিকায়ন ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে কৃষি তথা সবুজ বিপ্লবের সূচিত হয়েছে। বিভিন্ন ফল ও সবজি চাষে জমি বৃদ্ধি পেয়েছে, বাংলাদেশ উৎপাদনের দিক থেকে বিশে^ শীর্ষ ১০ এ জায়গা করে নিয়েছে। দেশে ৭০ ধরনের ফল ও ৯০ প্রকার সবজি এখন উৎপাদিত হচ্ছে। এ ছাড়াও ফুল, মসলা, ডাল, তেল, কন্দালজাতীয় ফসলসহ অন্যান্য ফসলের উৎপাদনও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে যা এখন দৃশমান। কিন্তু উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি কৃষিপণ্যের অপচয় সমগ্র বিশে^ অধিক হারে বেড়ে চলেছে। উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশে কৃষিপণ্যের অপচয়ের পরিমাণ প্রায় ২৫-৪৫ ভাগ। এক্ষেত্রে আমাদের উৎপাদিত কৃষিজাত দ্রব্যাদির প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনস্ত পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল বিশেষ করে ফলমূল ও শাকসবজির ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ, পরিবহন, প্যাকেটজাতকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষয়ে গবেষণার মাধ্যমে প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গবেষণা পরিচালনা করছে যা গুণগত মানবজায় রেখে সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি ও বিদেশে রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে নিঃসন্দেহে।
নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় ফল ও সবজির সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি
সঠিক পরিপক্বতায় নির্ধারিত ফানজিসাইড যেমন সাইট্রাস জাতীয় ফলের জন্য থায়াবেনডাজল, ইমাজলিল প্রয়োগ ও ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা ও শতকরা ৯০-৯৫ ভাগ আর্দ্রতায় লেবুজাতীয় ফলকে দীর্ঘসময় গুণগতমান বজায় রেখে সংরক্ষণ করা যায়। একইভাবে পরিপক্ব আমকে ১৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা ও শতকরা ৮৫-৯০ ভাগ আর্দ্রতায় ২-৩ সপ্তাহ, আনারসকে ১১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা ও শতকরা ৮৫-৯০ ভাগ আর্দ্রতায় ৩-৪ সপ্তাহ, সবুজ কলাকে (পরিপক্ব কাঁচা) ফানজিসাইড দ্রবণে পরিশোধন করে ১২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা ও শতকরা ৮৫-৯০ ভাগ আর্দ্রতায় ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত গুণগতমান বজায় রেখে অনায়াসে সংরক্ষণ করা যায়।
পোস্টহারভেস্ট ট্রিটমেন্ট ও মডিফাইড এটমোসফিয়ার প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি
ফল ও সবজি যথাযথ পরিপক্বতায় সংগ্রহের পর স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সাধারণত ২-৩ দিনের বেশি সতেজ ও খাবার উপযোগী থাকে না। কিন্তু সংগ্রহকৃত সতেজ কৃষিপণ্য ২০০ পিপিএম/লিটার ক্লোরাক্স দ্রবণ (২/৩টি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট) দিয়ে ধৌত করার পর শিম ও পালং শাক মুখবন্ধ পলিপ্রপাইলিন প্যাকেটে পুঁইশাক, কাঁচা মরিচ ও লালশাক যথাক্রমে ৮ দিন, ১০ দিন, ১১ দিন এবং ৭ দিন পর্যন্ত ভালো অবস্থায় সংরক্ষণ করা যায়। একইভাবে ১.৫% ও ১.০% ছিদ্রযুক্ত ও মুখবন্ধ পলিপ্রপাইলিন প্যাকেটে ৯ দিন পর্যন্ত যথাক্রমে ঝিঙা ও ধুন্দুল গুণগতমান বজায় রেখে অনায়াসে সংরক্ষণ করা যায়।
ড্রাইং প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি
ফল ও সবজিকে নির্দিষ্ট আকৃতিতে কেটে টুকরা টুকরা করে ব্লাঞ্চিং করলে এনজাইম নিষ্ক্রীয় হয়। অতঃপর কিছুক্ষণ ঠান্ডা পানিতে রেখে পরে পোস্টহারভেস্ট ট্রিটমেন্ট ব্যবহার করে ড্রাইয়ারে নির্দিষ্ট আর্দ্রতায় শুকালে গুণগতমান বজায় থাকে। এভাবে কাঁচা আম, গাজর, পেঁপে, বাঁধাকপি, ফুলকপি ইত্যাদি শুকিয়ে মোড়কজাত করলে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়।
মাইক্রোবিয়াল ট্রিটমেন্ট ও নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় ফ্রেশকাট প্রযুুক্তি প্রয়োগ
ফ্রেশকাট পদ্ধতি হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রক্রিয়া যেখানে খাদ্যসামগ্রিকে সতেজ অবস্থায় প্রয়োজনীয় এবং পরিমাণমতো আকারে কেটে ন্যূনতম পরিচর্যা ও ট্রিটমেন্ট প্রয়োগ করে প্রক্রিয়াজাতকরণের পর মোড়কজাত করে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাতে খাদ্যসামগ্রির গুণগতমান অক্ষুণ্ন থাকে এবং কোন অণুজীবের সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে না। যেমন: পরিপক্ব আমকে পরিমিত আকারে টুকরো টুকরো করে প্রতি লিটার পানিতে ০.৬% ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড মিশ্রিত করতে হবে এবং তাতে ৮০০ গ্রাম আমের টুকরো ৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। অতঃপর সাইট্রিক এসিড বা ১ লিটার পানিতে ১টি লেবুর ৪ ভাগের ১ ভাগ পরিমাণ লেবুর রস মিশ্রিত পানিতে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রেখে পরে পানি ঝরিয়ে নিয়ে স্বচ্ছ ফিল্ম প্যাকেটে সংরক্ষণকৃত পরিপক্ব আমের ফ্রেশকাট খাদ্য সামগ্রী ২ ী ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রেফ্রিজারেটরে ৬-৭ দিন গুণগতমান বজায় রেখে সংরক্ষণ করা যায়।
অসমোটিক ডিহাইড্রেটেড প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন ফল যেমন: আম, কলা, কাঁঠাল, পেঁপে, আনারস ইত্যাদি অনায়াসে দীর্ঘদিন পুষ্টিমান বজায় রেখে সংরক্ষণ করা যায়। যেমন: পরিপক্ব (খাজা) কাঁঠালের কোষগুলো থেকে বীচি বের করে ৪৫ ডিগ্রি ব্রিক্সে চিনির দ্রবণে ১০-১৫ মিনিট ডুবিয়ে রেখে রান্না করতে হবে। অতঃপর চিনির দ্রবণ থেকে উঠিয়ে নিয়ে কেবিনেট ড্রায়ারে ৫৫-৬০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ২৪-৩৬ ঘন্টা শুকালে পরিমিত আর্দ্রতায় উন্নত প্যাকেটে ৬-৮ মাস গুণগতমান বজায় রেখে সংরক্ষণ করা যায়।
ফল ও সবজিতে ফ্রিজ ড্রাইড প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে উৎকৃষ্টমানের খাদ্য সামগ্রী তৈরিকরণ ও মোড়কজাতকরণ
ফ্রিজ ড্রায়ারে বিভিন্ন ফলমূল ও শাকসবজি যেমন : আম, কলা, কাঁঠাল, পেঁপে, আনারস, মিষ্টিআলু, টমেটোসহ অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য শুকিয়ে উৎকৃষ্টমানের খাদ্যসামগ্রী তৈরি করা যায় যা রপ্তানিযোগ্য পণ্য হিসেবে বিদেশে বিপণন করা অনায়াসে সম্ভব। উৎপাদিত পণ্যের আকৃতি, রং-এর তেমন পরিবর্তন ঘটে না এবং পুষ্টিমানও অক্ষুণ্ন থাকে।
স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি
ফল ও সবজিতে ১-এমসিপি (১-মিথাইল সাইক্লোপ্রোপেন) প্রয়োগের মাধ্যমে ন্যাচারাল হরমোন ইথিলিনের সংশ্লেষণকে বাধা দেয়া হয়। যেমন : টমেটোতে ব্রেকার-টার্নিং স্টেজে অর্থাৎ ফলের তলায় লালচে রঙের ছিটা দেখা দিয়েছে এমন অবস্থায় প্রতি লিটার পানিতে ২০০ মাইক্রোগ্রাম হারে ১-এমসিপি মিশিয়ে উক্ত মিশ্রণে ব্রেকার-টার্নিং স্টেজের টমেটো ১০ মিনিট ডুবিয়ে রেখে পরে বাতাসে শুকাতে হবে। অতঃপর টমেটো সংরক্ষণের জন্য ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও ৮৫-৯০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা সম্পন্ন কক্ষে রাখলে ২৪ দিন পর্যন্ত বাজারজাতকরণের উপযোগী থাকে।
এনজাইম নিষ্ক্রিয়করণের মাধ্যমে গুণগতমান বজায় রেখে ফল ও সবজির সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি
আম, জলপাই, আমড়া, গাজর, মটরশুঁটিসহ অন্যান্য কাঁচা ফলমূল ও শাকসবজিকে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় এনজাইম নিষ্ক্রিয়করণের মাধ্যমে সংরক্ষণকাল ৬-৮ মাস পর্যন্ত বৃদ্ধি করা যায়। যেমন : পরিপক্ব গাজর ৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২ মিনিট ব্লাঞ্চিং করে -১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় প্রায় ৬ মাস সংরক্ষণ করা যায়।
পোস্টহারভেস্ট ট্রিটমেন্ট ও ওয়াক্সিংয়ের মাধ্যমে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি
পোস্টহারভেস্ট ফানজিসাইড যেমন : থায়াবেনডাজল লেবুজাতীয় ফসলে (মাল্টা, কমলা, জাম্বুরা) প্রথমে প্রয়োগ করে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। অতঃপর গরম পানিতে কিছুক্ষণ শোধন করে ডিটারজেন্ট পাউডারযুক্ত পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে নিয়ে খাবারযোগ্য মোম (কারনোবা ওয়াক্স) দিয়ে পুরো ফলের উপরিভাগে সমভাবে প্রলেপ দিতে হবে। এভাবে প্রলেপ দেয়া ফল স্বাভাবিক তাপমাত্রায় অনায়াসে গুণগতমান বজায় রেখে ৩-৪ সপ্তাহ সংরক্ষণ করা যায়।
পোস্টহারভেস্ট ট্রিটমেন্ট প্রয়োগের মাধ্যমে পাল্প সংরক্ষণ
আম, পেঁপে, কাঁঠাল, টমেটো, পেঁয়াজ ইত্যাদির পাল্পকে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রান্না করে তাতে পরিমিত লবণ, সাইট্রিক এসিড ও নির্ধারিত সংরক্ষক যোগ করে ঢ়ঐ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সংরক্ষণ সময় বৃদ্ধি করা যায়। যেমন : পেঁয়াজের পেস্টের সাথে সাধারণ খাবার লবণ ৮% এবং ২ গ্রাম সাইট্রিক এসিড/কেজি হারে মিশাতে হবে যাতে পেঁয়াজের পেস্টের ঢ়ঐ এর মান ৪ হয়। অতঃপর পেঁয়াজের পেস্টকে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১০ মিনিটকাল ফুটিয়ে ১০০০ পিপিএম (১ গ্রাম) পটাশিয়াম মেটাবাইসালফাইট মিশিয়ে জীবাণুমুক্ত কাঁচের বোতলে ভর্তি করে বোতলের মুখে ভালভাবে ছিপি লাগিয়ে সাধারণ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যাবে।
ফল ও সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণ
সবুজ ফল ও শাকসবজিকে পরিচর্যা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন মসলা, লবণ, ভিনেগার ইত্যাদি মিশিয়ে উৎকৃষ্টমানের স্বাদ, গন্ধযুক্ত আচার, চাটনী, জ্যাম, জেলি, সস/কেচাপ তৈরিকরণ করা যায়। যেমন: ১ কেজি টমেটো পাল্পের সাথে পরিমাণমতো চিনি, লবণ, পেঁয়াজ, রসুন, দারুচিনি, এলাচ, জিরা, লবঙ্গ ইত্যাদি মিশিয়ে তাতে পেঁয়াজ ও রসুন কুঁচি কুঁচি করে কেটে এবং মরিচ, জিরা, গোলমরিচ, দারুচিনি ইত্যাদি গুঁড়া করে মিশিয়ে দিতে হবে। অতঃপর টমেটো পাল্প ও এক তৃতীয়াংশ পরিমাণ চিনি (২০ গ্রাম) একটি কড়াইয়ে নিয়ে জ্বাল দিয়ে আদা-রসুনসহ অন্যান্য মসলা যোগ করতে হবে। জ্বাল দেয়া টমেটো পাল্পের পরিমাণ এক তৃতীয়াংশ পরিমাণ হলে অবশিষ্ট ৪০ গ্রাম চিনি ও পরিমাণমত লবণ যোগ করে ২৪ ডিগ্রি ব্রিক্স পর্যন্ত রান্না করতে হবে। ২৪ ডিগ্রি ব্রিক্স আসলে পরিমাণমতো অ্যাসেটিক এসিড যোগ করতে হবে এবং সোডিয়াম বেনজোয়েট সামান্য পরিমাণ গরম পানিতে গুলিয়ে টমেটো পাল্পের সাথে মিশিয়ে ২৫ ডিগ্রি ব্রিক্স পর্যন্ত রান্না করে গরম অবস্থায় পানিতে ফুটানো জীবাণুমুক্ত কাঁচের বোতলে ভরে ছিপি এঁটে দিতে হবে। এ পদ্ধতিতে টমেটো কেচাপ/সস্ ১০-১২ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
লেখক : ১মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বিএআরআই, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৭১২২৭১১৬৩, ই-মেইল : Ferdous613@gmail.com
বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ
কৃষিবিদ প্রসেনজিৎ মিস্ত্রী
জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে পানীয় হিসাবে চায়ের পরেই কফির স্থান। কফি ফলের পরিপক্ব বীজ ভেজে গুঁড়ো করে কফি তৈরি করা হয়। বিশ্বের প্রধান কফি উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছেÑব্রাজিল, কলম্বিয়া, ভারত, ইন্দেনেশিয়া, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, গুয়েতেমালা প্রভৃতি।
কফি Rubiaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। কফি একটি চিরসবুজ, ছোট বৃক্ষ জাতীয় গাছ। পাতা সরল, চওড়া, গাঢ় সবুজ বর্ণের। ফুল সাদা, সুগন্ধযুক্ত এবং প্রতি কুড়িতে ২-২০টি ফুল থাকতে পারে। ফল ড্রুপ, লাল বা হলদে বর্ণের এবং আকারে অনেকটা গোলাকার। এটি বেরি অথবা চেরি ফল নামেই অধিক পরিচিত। প্রতি ফলে অর্ধ গোলাকার ২টি বীজ থাকে। এই বীজ বিন (Bean) নামে পরিচিত প্রাথমিক শাখাকে প্লাজিওট্রপিক শাখা বলে এবং এই শাখা অনেকটা ভূমির সমান্তরালভাবে বিদ্যমান থাকে। অন্যদিকে মাধ্যমিক শাখাকে শোষক বা অর্থোট্রপিক শাখা বলে এবং এই শাখা খাঁড়া থাকে। কেবল প্রাথমিক তথা সমান্তরাল শাখাতে ফুল ও ফল হয়।
পরিবেশগত চাহিদা : কফি উষ্ণমণ্ডলীয় ফসল। এর জন্য উষ্ণ এবং আর্দ্র জলবায়ুর প্রয়োজন। তবে ফসলের পরিপক্বতার সময়ে কিছুটা শুষ্ক জলবায়ু দরকার। কফির জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমপক্ষে ১২৫ সেন্টিমিটার হতে হবে। তবে কম বৃষ্টিপাতের স্থানে জমিতে সেচ, জাবড়া প্রয়োগ ও অন্যান্য পদ্ধতিতে মাটির রস সংরক্ষণের মাধ্যমে কফির চাষ করা যেতে পারে।
মাটি : যে কোন বুনটের মাটিতেই কফির চাষ করা সম্ভব। তবে ৬ থেকে ৬.৫ পিএইচ মানের সামান্য অম্লযুক্ত জৈব পদার্থ যুক্ত বেলে দোআঁশ মাটি কফির জন্য উত্তম। পাহাড়ি উপত্যকা, ঝরনার পাশের জমি এবং যে জমিতে লবণাক্ততা নেই সেসব জমি কফি চাষের জন্য উত্তম। কফি গাছ গোড়ায় জমানো পানি সহ্য করতে পারে না।
জমি প্রস্তুত : চা এর ন্যায় কফিও পাহাড়ের/টিলার ঢালেই বেশি চাষ করা হয়। জমিকে আগাছামুক্ত করে ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে। তবে কফি গাছ ছায়া পছন্দ করে বিধায় জমিতে বিদ্যমান কোন বড় গাছ থাকলে তা রেখে দিতে হবে। পাহাড়ের ঢালে ট্রেসিং এবং কন্টুর পদ্ধতি অনুসরণ করে কফি গাছ লাগানো যেতে পারে।
চারা তৈরি : কফির বীজ ও কলম থেকে চারা তৈরি করা যায়। বীজ থেকে চারা তৈরি করতে প্রথমে নির্বাচিত জাতের কফি গাছ থেকে সম্পূর্ণ পরিপক্ব, পুষ্ট এবং রোগ-পোকার আক্রমণ মুক্ত ফল সংগ্রহ করা হয়। এরপর ফলের খোসা ছাড়িয়ে পরিষ্কার পনি দ্বারা ধুয়ে নিয়ে চালুনির মাধ্যমে ছেকে ভালো বীজগুলোকে আলাদা করা হয়। বীজগুলো ভালোভাবে শুকানোর জন্য শুকনা কাঠের গুঁড়া বা ছাইয়ের সাথে মিশিয়ে ছায়াতে ছড়িয়ে রাখা হয়। ৪/৫ দিন পর বীজ থেকে কাঠের গুঁড়া/ছাই সরিয়ে ফেলা হয়। চারা তৈরির জন্য ১ মিটার চওড়া ও ১৫ সেন্টিমিটার উঁচু বীজতলা তৈরি করা হয়। ৬ মিটার লম্বা ও ১ মিটার চওড়া বীজতলার মাটিতে ৪ ঝুড়ি গোবর বা কম্পোস্ট, ২ কেজি কৃষি চুন এবং ২০০ গ্রাম টিএসপি সার ব্যবহার করা উচিত। বীজের সমতল দিক নিচের দিকে রেখে ১.৫ থেকে ২.৫ সেন্টিমিটার দূরে দূরে লাইনে বীজ বপন করা হয়। এরপর বীজের উপর খুব ছোট দানার মাটির গুঁড়া ছিটিয়ে পাতলা আবরণে ঢেকে দেয়া হয়। বীজতলার উপরে ৫ সেন্টিমিটার পুরু করে খড় বিছিয়ে তার উপর নিয়মিত ঝাঁজরি দিয়ে পানি সেচ দিতে হয়। বীজতলায় যাতে সরাসরি সূর্যালোক না পড়তে পারে সেজন্য ছাউনির ব্যবস্থা করতে হয়। বীজ বপনের ৪৫ থেকে ৫০ দিনের মধ্যে বীজ গজিয়ে যায়। এরপর ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে এই চারাকে দ্বিতীয় নার্সারি বেডে বা পলিব্যাগে স্থানান্তর করা হয়। খুব সকালে বা পড়ন্ত বিকেলে এ কাজটি করা হয়। পলিথিনের মাটির মিশ্রণ হবে দো-আঁশ মাটি ৬ ভাগ, গোবর বা কম্পোস্ট ২ ভাগ এবং বালু ১ ভাগ। নিয়মিত পানি সেচ দেয়ার পাশাপাশি চারার বয়স ২ মাস হলে ৪.৫ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম ইউরিয়া সার গুলিয়ে ১ বর্গমিটার স্থানের চারার উপর স্প্রে করলে সুস্থ-সবল চারা পাওয়া যায়। বীজতলার উপরের ছাউনি পাতলা করে দিতে হবে এবং বর্ষার শুরুতে পুরোপুরি সরিয়ে ফেলতে হবে।
রোপণ : বর্ষা মৌসুমের শুরুতে কফির চারা রোপণ করা উত্তম
(মে-জুন)। কোন কোন জাতের শাখা প্রশাখার যথেষ্ট বৃদ্ধি হতে বেশ সময় লাগায় ঐ ক্ষেত্রে ঘন করে গাছ রোপণ করা হয় এবং পরবর্তীতে মাঝে মাঝে গাছ কেটে পাতলা করা হয়। এরাবিকা জাতের জন্য গাছ থেকে গাছ এবং সারি থেকে সারির দূরত্ব ২ থেকে ২.৫মিটার আর রোবাস্টার জন্য ২.৫ মিটার থেকে ৪ মিটার পর্যন্ত রাখতে হবে। আবার প্রথমে ১ থেকে ১.৫ মিটার দূরত্বে ঘন করে গাছ লাগিয়ে ২/৩ বছর কফির ফলন তোলার পর অর্ধেক গাছ তুলে ফেলা যায়। জুন থেকে অক্টোবরে ১৬ থেকে ১৮ মাস বয়সের চারা লাগাতে হবে। গর্তের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং গভীরতা হবে ৪৫ সেন্টিমিটার করে। গর্তে চারা লাগানোর সময় প্রধান মূল যাতে পেচিয়ে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। রোপণের পর ভালোভাবে চারার গোড়ার মাটি চেপে দিতে হবে এবং গোড়ার মাটি কিছুটা উঁচু রাখতে হবে। প্রথম কিছুদিন চারা গাছকে প্রখর সূর্যালোক হতে রক্ষা করলে ভালো হয়। প্রবল বাতাসে হেলে যাওয়া রোধে চারাকে খুঁটির সংগে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
সার প্রয়োগ : সার প্রয়োগের মাত্রা সারণি-১ দ্রষ্টব্য। গাছের গোড়ার ৩০ সেন্টিমিটার দূর দিয়ে চওড়া নালায় সার প্রয়োগ করে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। সার দেয়ার পর সেচ দিয়ে খড় কুটার জাবড়া দিতে হবে। আবার গাছের বৃদ্ধি কমে গেলে এবং ফুল ও ফল ধরার সময় ২০০ লিটার পানিতে ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া, টিএসপি ৪০০ গ্রাম এবং ৩৫০ গ্রাম এমওপি মিশিয়ে গাছের পাতায় স্প্রে করা যেতে পারে।
অঙ্গ ছাঁটাই (ট্রেনিং/প্রুনিং) : কফি গাছকে সঠিক কাঠামো দেয়ার জন্য এবং ফলধারণক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অঙ্গ ছাঁটাই করা হয়। কম বয়সের কফি গাছে দুইভাবে ট্রেনিং করা হয়। যথা: একক কাণ্ড পদ্ধতি এবং একাধিক কাণ্ড পদ্ধতি এক্ষেত্রে এরাবিকা এবং রোবাস্টার ক্ষেত্রে গাছের উচ্চতা গড়ে যথাক্রমে ৭৫ এবং ১১৫ সেন্টিমিটার হলে প্রধান কাণ্ডের মাথার শীর্ষকুঁড়ি কেঁটে (topping/capping) দেয়া হয়। এতে পার্শ্বশাখা তথা ফলধারণক্ষম শাখার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে গাছ ঝোপালো হয়। মাটির উর্বরতা এবং গাছের বৃদ্ধির উপর ভিত্তি করে ৩/৪ বার ফলন নেয়ার পর পুনরায় আর একবার এটা করা যেতে পারে। বয়স্ক গাছ থেকে পরিপক্ব ফল সংগ্রহের ৩/৪ সপ্তাহ পর থেকে বর্ষা মৌসুম শুরুর আগ পর্যন্ত ৩/৪ বছর পরপর একবার কফি গাছের অতিরিক্ত মাধ্যমিক শাখা কেটে প্রুনিং করা হয়।
রোগ ও পোকামাকড় : কফির ক্ষেত্রে রোগ বা পোকামাকড়ের আক্রমণ খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় না। তবে বালাই আক্রমণের লক্ষণ দেখে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। সারণি-২ দ্রষ্টব্য।
ফল সংগ্রহ : চারা রোপণের ২ বছর পর ৩য় বছর থেকে কফি সংগ্রহ করা যায়। এরাবিকা কফিতে ফুল ফোটার ৮-৯ মাস এবং রোবাস্টা কফিতে ১০-১১ মাস পরে ফল সংগ্রহের উপযুক্ত হয়। নভেম্বর হতে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ফল সংগ্রহ করা যায়। পরিপক্ব ফলের রং লাল হয় এবং ফলে জোরে চাপ দিলে বীজ সহজে বের হয়ে আসে। সাধারণত হাত দ্বারাই ফল তোলা হয়। ১০-১৫ দিন পর পর ৪-৬ কিস্তিতে ফল সংগ্রহ করা হয়। একটি গাছ থেকে ৫০/৫৫ বছর পর্যন্ত ফল সংগ্রহ করা যায়। হেক্টরপ্রতি ৭৫০-১০০০ কেজি ফলন পাওয়া যায়।
কফি প্রক্রিয়াজাতকরণ : ভিজা পদ্ধতিতে কফিকে প্রক্রিয়াজাত করে প্লানটেশন বা পার্চমেন্ট কফি তৈরি করা হয়। এ পদ্ধতিতে গাছ থেকে পাকা ফল সংগ্রহের পরপর ফলের খোসা ও মাংসল অংশকে আলাদা করা হয়। এরপর সাধারণ তাপমাত্রায় ২৪ ঘণ্টা গাজিয়ে (fermentation) নিয়ে অথবা ১-২ ঘণ্টা ১০% কস্টিক সোডা দিয়ে ট্রিটমেন্ট করে বীজের গায়ে লেগে থাকা পিচ্ছিল পদার্থ অপসারণ করে পরিষ্কার পানি দ্বারা ধৌত করা হয়। তারপর কফি বিনকে ৭ থেকে ১০ দিন রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। আবার শুকনা পদ্ধতিতে চেরি কফি তৈরি করার জন্য গাছ থেকে পরিপক্ব ফল পাড়ার পর পরিষ্কার মেঝেতে ১২ থেকে ১৫ দিন রোদে শুকিয়ে নিয়ে সংরক্ষণ করা হয়।
সম্ভাবনা : পার্বত্য জেলাগুলোতে বিগত কয়েক বছর যাবত বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ হয়ে আসছে। খাগড়াছড়িতে অবস্থিত পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে কফি উৎপাদিত হচ্ছে, যা গুণগতভাবে আন্তর্জাতিক মানের। রাঙ্গামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং রাঙ্গমাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে রাঙ্গামাটি জেলায় বিভিন্নস্থানে কফির প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগিতায় বেশ কিছু কফি বাগান গড়ে উঠেছে।
লেখক : আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাঙ্গামাটি। মোবাইল : ০১৭১২৮১৬৩৫২, prosenjit0759@yahoo.com
কৃষি কাজে জৈবপদ্ধতি
নিরাপদে থাকুক উদ্ভিদ ও প্রাণী
কৃষিবিদ মোঃ মুকুল মিয়া
পরিবেশ এবং কৃষি একটি আরেকটির উপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। নিরাপদ কৃষি উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়ের জন্য আবশ্যক। প্রাণী যেমন তার নিজের খাদ্যের জন্য উদ্ভিদের উপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল, ঠিক তেমনি উদ্ভিদও বিভিন্নভাবে প্রাণিদের মাধ্যমে উপকৃত হয়ে থাকে। প্রাণির মাধ্যমে উদ্ভিদের বংশবিস্তার অনেক সময় প্রভাবিত হয়। উদ্ভিদ বায়ুমণ্ডল থেকে CO2 ও পানি নিয়ে সূর্যালোকের উপস্থিতিতে ক্লোরোফিলের সাহায্যে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় শর্করা-খাদ্য, অক্সিজেন (প্রাণিকূলের অপরিহার্য উপাদান) ও শক্তি উৎপাদন করে। যে পরিবেশ উদ্ভিদ ও প্রাণিকূলের বসবাসের জন্য পুরোপুরি উপযুক্ত সেটিই হলো নিরাপদ পরিবেশ। উদ্ভিদ ও প্রাণিকূলের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বা প্রযুক্তির ব্যবহারমুক্ত কৃষিই হচ্ছে নিরাপদ কৃষি। মানুষ এখন পরিবেশ ও নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে অনেক সচেতন হলেও অনেক সময় অর্থনৈতিক ও শিক্ষার অভাবে অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণ করে থাকে; পরিবেশ দূষিত করে বা দূষিত পরিবেশে বসবাস করে। কৃষি যদি নিরাপদ হয় তাহলে পরিবেশও নিরাপদ হবে। সুতরাং নিরাপদ কৃষিই নিশ্চিত করে পরিবেশের নিরাপত্তা।
জীব বৈচিত্র্যে রাসায়নিক পদার্থের ক্ষতিকর প্রভাব
আমাদের পরিবেশের চারপাশে যে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা, পশুপাখি, পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেগুলো নিয়েই গঠিত হয়েছে জীববৈচিত্র্য। আমরা ফসল উৎপাদনে, উদ্ভিদ ও প্রাণীর চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ওষুধ ব্যবহার করে থাকি। এছাড়াও বালাই দমনের জন্য ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের পর থেকে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমান সময়ে কৃষি জমিতে আঁগাছা, রোগ ও পোকা দমনে জৈব বালাইনাশকের পরিবর্তে ব্যাপক হারে নিয়ম না মেনে রাসায়নিক কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, ব্যাকটেরিসাইড, কৃমিনাশক (নেমাটিসাইড) ব্যবহৃত হচ্ছে। ফসল উৎপাদনে বা উদ্ভিদের বালাই দমনে ব্যবহৃত এসব রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে কোনো কোনোটির দীর্ঘ মেয়াদি রেসিডিউয়াল ইফেক্ট রয়েছে যা মাটি, পানি ও জীব জগৎকে ব্যাপকহারে দূষিত করছে। এর ফলে জমির উর্বরতা বা ফসল উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। মাটি, পানি ও বায়ু দূষিত হয়ে প্রাণিকূলে বিভিন্ন ধরনের রোগবালাইসহ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করছে।
পশুপাখি ও উদ্ভিদ মূলত পরিবেশের খাদ্যশৃঙ্খল ও বাস্তুসংস্থান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যেমন: ফিঙ্গে, শালিক, দোয়েল পাখি ক্ষেতখামারে ফসলের ক্ষতিকর পোকা খায়; ব্যাঙ, সাপ, গুইসাপ ফসল ও পরিবেশের বিভিন্ন ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খায়; টিকটিকি বসতবাড়িতে মশা মাছি খায়। সুতরাং এসব উপকারী প্রাণী, পাখিকে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। রাসায়নিক ওষুধের পরিবর্তে জৈব বালাইনাশক বিশেষ করে কৃষি জমিতে, ফসলে, উদ্ভিদের চিকিৎসায় ব্যবহার করতে হবে। তাহলে মাটি, উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়ের জন্যই ভালো হবে।
জৈব বালাইনাশক
জীবের বিভিন্ন অংশ থেকে প্রস্তুতকৃত বালাইনাশক যা দ্রুত পচনশীল, মাটিতে মিশ্রণীয়, পরিবেশে কোন ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলে না সেগুলোই উদ্ভিদের বালাই দমনে ব্যবহৃত জৈব বালাইনাশক। জৈব বালাইনাশক বিভিন্ন ধরনের হয়। যেমন :
জৈব রাসায়নিক বালাইনাশক
বর্তমানে বাজারে সহজে পাওয়া যায় এবং সরকার অনুমোদিত বেশ কিছু জৈব বালাইনাশক রয়েছে। যেমন: শাক সবজি ও ফলের ক্ষতিকর পোকার পুরুষ মাছিকে মিলনে প্রলুব্ধ করে ফাঁদে ফেলে মেরে ফেলে সেক্স ফেরোমোন। ফসলের মাকড়, পাতা সুরঙ্গকারী পোকা, জাব পোকা দমন করে নিম তেল। ফলের পুরুষ মাছি পোকা দমন করে ফুজি ফ্রুট লিউর। ইহা কুমড়াজাতীয় ফলের পুরুষ মাছি পোকা মেরে ফেলে। ফেরোমোন লিউর বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা মেরে ফেলে। স্পোডো লিউর ফসলের লেদা পোকা এবং অ্যাজাডিরেক্টিন (অ্যাবামেক্টিন, নিমবিসিডিন, ফাইটোম্যাক্স, বায়োনিম প্লাস) ফসলের মাকড়, থ্রিপস, জাব পোকা, সাদা মাছি, হপার পোকা, পাতা সুরঙ্গকারী পোকা দমনে ভূমিকা রাখে। স্পাইনোসেড ফসলের পাতা সুরঙ্গকারী পোকা, বরবটির ফল ছিদ্রকারী পোকা, কাটুই পোকা, বেগুন ও ঢেঁড়সের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা, থ্রিপস দমনে উপকারী। ফাইটোক্লিন ফসলের মাকড়, ছাত্রা পোকা, জাব পোকা, সাদা মাছি দমন করে। মোনেক্স ০.৫ ডব্লিউপি টমেটোর ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট, আলু, মরিচ, বাঁধাকপি, মূলার ঢলে পড়া রোগ দমন করে। ডিকোপ্রাইমা বেগুনের ছত্রাকজনিত ঢলে পড়া রোগে বেশ কার্যকর।
অণুজীব বালাইনাশক
অণুজীব (ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্রোটোজোয়া) হতে তৈরীকৃত বালাই দমনকারী ওষুধই হলো অণুজীব বালাইনাশক। কিছু অণুজীব বালাইনাশক রয়েছে যা ফসলের আগাছাও দমন করতে পার। কয়েকটি অনুজীব বালাইনাশকের উদাহরণ যেমন- ট্রাইকোডার্মা কাইলোনিজ, ট্রাইকোডার্মা জ্যাপোনিকাম, ট্রাইডার্মা ভিরিডি, ব্যাসিলাস থুরিনজিয়েনসিস, নিউক্লিয়ার পলিহেড্রোসিস ভাইরাস (এনপিভি) ইত্যাদি। ট্রাইকোডার্মা প্রকৃতি থেকে আহরিত এমনই একটি অণুজীব যা জৈবিক পদ্ধতিতে উদ্ভিদের রোগ দমনে ব্যবহার করা হচ্ছে। মাটিতে মুক্তভাবে বসবাসকারি উপকারি ছত্রাক যা উদ্ভিদের শিকড়স্থ মাটি, পচা আবর্জনা ও কম্পোস্ট ইত্যাদিতে অধিক পরিমাণে ট্রাইকোডার্মা পাওয়া যায়। এটি মাটিতে বসবাসকারি উদ্ভিদের ক্ষতিকর জীবাণু যেমন- ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ও কৃমি বা নেমাটোডকে মেরে ফেলে। ট্রাইকোডার্মা কাইলোনিজ ও ব্রাকন বরবটি, শিম, ঢেঁড়সের ফল ছিদ্রকারী পোকা, কাটুই পোকা, কুমড়ার লেদা পোকা দমন করে। ট্রাইকোডার্মা (ট্রাইকস্ট ১% ডব্লিউপি) সবজির ঢলে পড়া, শিকড় ও গোড়া পচা, পাতায় ঝলসানো রোগ দূর করে। ট্রাইকোডার্মা (বায়োডার্মা, বাউ-বায়োফানজিসাইড) পানের পাতা পচা, কাণ্ড, শিকড় ও গোড়া পচা রোগ দূরীকরণে বেশ ব্যবহার্য্য। এছাড়াও মসুর ডালে নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী কিছু ব্যাকটেরিয়া সম্প্রতি আবিষ্কার হয়েছে যা ঐ গাছের শিকড়ে নডিউল তৈরির মাধ্যমে জমিতে ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমায়।
উদ্ভিদজাত/ভেষজ জৈব বালাইনাশক
উদ্ভিদ/উদ্ভিদাংশ বা জৈব উৎস থেকে উৎপন্ন বালাইনাশককে জৈব বালাইনাশক বলে। আবহমানকাল থেকেই মানুষের স্বাস্থ্য সেবায়, কৃষি ফসল উৎপাদন ও সংরক্ষণে গাছ-গাছালি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যেমন, নিমের থেঁতলানো বীজ, ছাল এবং গুড়া সাবান একত্র করে মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে তা ঠাণ্ডা করে ছেঁকে নিয়ে পানি যোগ করে স্প্রে করলে পাতা মোড়ানো পোকাসহ বিভিন্ন ধরনের কীড়া ও গান্ধী পোকা, মাছি পোকা, বিটল পোকা, কীড়া ও বিছা পোকা দমন করা যায়। নিম ও ধুতরা গাছের শুকনো পাতার গুঁড়া গুদামজাত ফসলের পোকা দমনে উপকারী। মেহগনির ফলের সাদা কুচি কুচি অংশ পানিতে ভিজিয়ে রেখে ডিটারজেন্ট পাউডার মিশিয়ে ছেঁকে স্প্রে করলে বাদামি গাছফড়িং, মাজরা, পাতামোড়ানো ও ডায়ামন্ড ব্যাকমথ দমন করা যায়। তামাকের শুকনো পাতা ভেজানো পানি ছেঁকে নিয়ে ফসলে প্রয়োগ করলে মাইট ও জেসিড দমন করা যায়। বিষকাটালী বা ঢোল কলমীর পেষানো পাতা-কাণ্ড পানিতে ভিজিয়ে ছেঁকে নিয়ে স্প্রে করলে এফিড, মাছি, পাতা ও ফলখেকো কীড়া দমন করা যায়। কালো কচুর পাতাসিদ্ধ পানি স্প্রে করলে ফসলের কীড়া, বাদামি গাছফড়িং, পাতা শোষক পোকা মারা যায়। শুকনা মরিচের গুঁড়া, পানি এবং গুঁড়া সাবান মিশিয়ে পানি যোগ করে স্প্রে করলে শশার মোজাইক ভাইরাস রোগের বাহক, পিঁপড়া, জাব পোকা দমন হয়। পাট বীজ কড়াইতে ভেজে নিয়ে গুঁড়া করে পানিতে ভিজিয়ে এক রাত রেখে ছেঁকে নিয়ে জমিতে স্প্রে করলে ধানের মাজরা, বাগ, পাতা শোষক পোকা দমন করা যায়। রসুনের রস ও নিমের পাতা ও বীজ দ্বারা পাটসহ বিভিন্ন ফসলের বীজ শোধন করলে বীজবাহিত রোগবালাই দূর করা হয়। পেঁপে পাতা কুচি কুচি করে কেটে পানি মিশিয়ে এক রাত রেখে উহাতে পানি যোগ করে ছেঁকে নিয়ে স্প্রে করলে ফসলের পাউডারি মিলডিউ রোগ নিরাময় হয়। গাঁদা ফুলের থেঁতলানো শিকড়ের সাথে পানি করে যোগ করে এক রাত রেখে ছেঁকে নিয়ে জমিতে বীজ বপনের সময় স্প্রে করলে মাটিতে থাকা কৃমি মারা যাবে।
রাসায়নিক বালাইনাশকের চেয়ে জৈব বালাইনাশক বিষাক্তহীন বা কম বিষাক্ত বালাইনাশক ব্যবহারকারীর কোন স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই। ইহা কেবল নির্দিষ্ট বালাইকে দমন করে, অন্য কোন ইকোসিস্টেমের ক্ষতি করে না। এ ধরনের বালাইনাশক প্রাকৃতিক পরিবেশে দ্রুত নিঃশেষিত হয় বলে এদের কোন ধরনের রেসিডিউয়াল ইফেক্ট নেই। কোন কোন ফসলে জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে অধিক ফলন দে। এ ধরনের বালাইনাশক প্রয়োগকৃত ফসল খাওয়া নিরাপদ এবং ফসলের উৎপাদন খরচও অনেক কম।
লেখক : বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি মন্ত্রণালয়, মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা-১২০৭। মোবাইল : ০১৫২০-০৮৩০৮৮, ই-মেইলঃ mukulbjribreeding@gmail.com
সম্ভাবনার দ্বার : কন্দাল ফসল
কৃষিবিদ মোছাঃ মাহ্মুদা আক্তার
বিশ^ব্যাপী করোনা মহামারি ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও কৃষির উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন ভাবনার সময় এসেছে। বর্তমান সরকারও কৃষির বহুমুখীকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ, যান্ত্রিকীকরণ ও আধুনিকায়ন এর উপর গুরুত্বারোপ করেছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই দানাদার খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে কিন্তু অন্যান্য ফসল উৎপাদনের এখনও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় শক্ত ভিত গড়তে ভূমিকা রাখতে পারে। সেক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা ও আয়ের উপর ভিত্তি করে কন্দাল ফসল হতে পারে শস্য বহুমুখীকরণের এক উল্লেখযোগ্য মাধ্যম। বাংলাদেশ সুপ্রাচীনকাল থেকেই কন্দাল ফসল চাষের উপযোগী। এ দেশের নিচু ও জলাভূমি বাদে প্রায় সমগ্র দেশেই এ জাতীয় ফসল চাষ সম্ভব যা শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনার জন্যও এই ফসল সবচেয়ে উপযোগী হতে পারে। একক জমিতে এর উৎপাদন যেমন বেশি, আবার সংরক্ষণগুণ দীর্ঘ হওয়ার জন্য সহজেই দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশে বিক্রির সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি উৎপাদন পরবর্তী প্রক্রিয়াকরণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে এ ফসলের। এই ফসলের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠতে পারে বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। বাংলাদেশে আলু, মিষ্টিআলু, কচু, গাছআলু বা মেটেআলু, কাসাবা, শটি ইত্যাদি কন্দাল ফসল হিসাবে আবাদ হয়। অধিক শর্করা সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে এটি অনেক দেশে প্রধান খাদ্য এবং প্রধান সম্পূরক খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশে প্রায় ৫.৬৫ লক্ষ হেক্টর জমিতে কন্দাল ফসলের চাষ করা হয় যার বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৯৫ লক্ষ টন সারণি দ্রষ্টব্য।
কন্দাল ফসল দেশের খাদ্য ঘাটতি এবং পুষ্টির অভাব পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কন্দাল ফসলসমূহ ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণ ও খনিজসহ অনেক পুষ্টিকর উপাদানে সমৃদ্ধ থাকে।
পুষ্টির দিক বিবেচনায় সাধারণত ধান ও গমের পরই আলুর অবস্থান। এটি ভিটামিন ও খনিজ লবণ সমৃদ্ধ। বর্তমানে মিষ্টিআলু বাংলাদেশের খাদ্য ফসলের মধ্যে চতুর্থ স্থান দখল করে আছে। মিষ্টিআলুতে প্রচুর পরিমাণ শর্করা, খনিজ ও ভিটামিন বিশেষ করে ভিটামিন-এ রয়েছে । এক পরীক্ষায় দেখা গেছে রঙ্গিন শ্বাস যুক্ত ১২৫ গ্রাম মিষ্টিআলু প্রতিদিন খেলে এক জন পূর্ণবয়স্ক লোকের ভিটামিন-এর চাহিদা পূরণ হয়। মিষ্টিআলুতে Glycemic index অনেক কম থাকার কারণে ডায়াবেটিস রোগীরা ও সহজে খেতে পারেন। মিষ্টিআলুর ভিটামিন ই৬ রক্তনালীকে স্বাভাবিক রেখে হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ করে। মেটেআলু বা গাছআলু ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের খুবই ভালো উৎস। এ ছাড়া প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম ও সোডিয়াম রয়েছে।
সকল ধরনের কচু ভিটামিন ও লৌহ সমৃদ্ধ । কচুর শাকে রয়েছে ভিটামিন-এ, বি, সি ক্যালসিয়াম ও লৌহ। ভিটামিন-এ রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে এবং ভিটামিন-সি শরীরের ক্ষত সারাতে সাহায্য করে। কচুতে আছে আয়রন যা রক্তশূন্যতা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এছাড়া কচুর শাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে আঁশ থাকে যা হজমে সহায়তা করে। কচুর ডাঁটায় প্রচুর পরিমাণে পানি থাকে, তাই গরমের সময় কচুর ডাঁটা রান্না করে খেলে শরীরের পানির ঘাটতি পূরণ হয়। কচুতে আছে প্রচুর ফাইবার, ফোলেট ও থায়ামিন যা মানব শরীরের জন্য অনেক দরকারী উপাদান। নিয়মিত কচু খেলে কোলন ক্যান্সার ও ব্রেন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে । জ¦রের সময় রোগীকে দুধকচু রান্না করে খাওয়ালে জ¦র দ্রুত ভালো হয়। কচুর লতিতে রয়েছে প্রচুর পরিমান আয়রন ও ক্যালসিয়াম। ক্যালসিয়াম হাড় শক্ত করে ও চুলের ভঙ্গুরতা রোধ করে। কচুরলতিতে বিদ্যমান ভিটামিন-‘বি’ হাত, পা, মাথার উপরিভাগে গরম হয়ে যাওয়া, হাত-পায়ে ঝিঝি ধরা বা অবসভাব এ সমস্যাগুলো দূর করে। কচুর লতি উচ্চ আয়োডিন সমৃদ্ধ যা দাঁত, হাড় ও চুল মজবুত করে। এ ছাড়া এটি অ্যাসিডিটি ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা নিরসনে খুব ভালো কাজ করে। এতে ডায়াটারি ফাইবার বা আঁশের পরিমাণ খুব বেশি যা খাবার হজমে এবং দীর্ঘ বছরের কোষ্ট কাঠিন্য দূরীকরণে সাহায্য করে।
ওল কচু ঔষধিগুণ সম্পন্ন। ওলকচু খেলে রক্তের কোলেস্টেরল কমে তাই উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য ওল কচুর রস বেশ উপকারী। এছাড়া ওলকচু অশ্র্বজনিত কোষ্টকাঠিন্য; অশের্^র রক্তস্রাব; অর্শজনিত অগ্নিমান্দ্য; শোথ; গেঁটেবাত; বাতেরব্যথা; দাদ ও ছুলি; মুখেরক্ষত; সর্দি ও কফপ্রবণতা; মৌমাছি বোলতা, ভিমরুল ও বিছার কামড়ের ক্ষেত্রে ওলের গুণ অসাধারণ।
মুখীকচু এনার্জি ধরে রাখে ও ক্লান্তি হ্রাস করে; ওজন কমায়; হজমে সহায়তা করে; পাকস্থলী পরিষ্কার করে; হৃদ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী; হাইপারটেনশন কমায়; অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, বয়স বৃদ্ধিকে প্রতিহত করে। এ ছাড়াও এতে ১৭ প্রকারের অ্যামাইনোএসিড এবং ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ অয়েল থাকে যা ক্যান্সার প্রতিরোধে ও কার্ডিওভাস্কুলার রোগ এবং অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
বাংলাদেশে কন্দাল ফসলের চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক “কন্দাল ফসল উন্নয়ন প্রকল্প” হাতে নেয়া হয়, যা দেশের বিভিন্ন উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলায় কন্দাল ফসল (ওলকচু, মুখীকচু, লতিকচু ও গাছআলু) ব্যাপকভাবে চাষ করা হয় এবং এতে পরীক্ষিতভাবে দেখা গেছে যে দানাদার ফসলের চেয়ে কন্দাল ফসলে লাভের হার বেশি। কম বিনিয়োগ, অধিক ফলন ও অধিক আয় এ ফসলের অন্যতম বেশিষ্ট্য যা প্রান্তিক চাষিদের মাধ্যমে সহজেই উৎপাদন করা যায়।
যেমন মনিরামপুর উপজেলার মোঃ ফিরোজ আহমেদ (চালুয়াহাটি), মোঃ আব্দুল হালিম (মশি^মনগর), আকতার হোসেন (খেদাপাড়া), মোঃ মোজাহার আলী (শ্যামকুড়) এবং ইব্রাহীম হোসেন (রোহিতা) প্রত্যেকে ২০ শতক জমিতে মাদ্রাজি ওলকচু চাষাবাদ করেন। ৫ মাসের এই ফসলে তাদের উৎপাদন গড় ৫০-৬০ মন ( ২৫-৩০ মেট্রিকটন/হেক্টর), এতে খরচ হয়েছে ৩০০০০-৩২০০০ টাকা এবং লাভ হয়েছে ৩০০০০-৩৫০০০ টাকা।
একইভাবে কৃষক শেখ আব্দুল্লাহ (ভোজগাতী), শেখ হাসান আলী (রোহিতা) ২০ শতক জমিতে বারি মুখীকচু-২ জাতের মুখীকচু চাষাবাদ করে গড়ে ৫০-৫৫ মণ (২৫-৩০ মেট্রিকটন/হেক্টর) উৎপাদন করেন। যেখানে খরচ হয় ২২০০০-২৩০০০ টাকা এবং লাভ হয় ২৫০০০-৩০০০০ টাকা।
অপরদিকে কৃষক মো: কুতুবউদ্দীন (পৌরসভা), মোঃ আমিরুল ইসলাম (পৌরসভা), মোঃ জাহাঙ্গীর আলম (মশি^মনগর) ২০ শতক জমিতে লতিরাজ জাতের লতিকচু চাষ করেন। ১৮০ দিনের এই ফসলে তাদের গড়ে খরচ পড়ে ১৩০০০-১৫০০০ টাকা, উৎপাদন হয় ৫০-৫৫ মণ ( ২৫-৩০ মেট্রিক টন/হেক্টর) এবং লাভ হয় ৪০০০০-৪৫০০০ টাকা।
কন্দাল জাতীয় ফসলের মধ্যে অন্যতম একটি ফসল হচ্ছে মেটে আলু বা গাছ আলু। কৃষক মোঃ শরিফুল ইসলাম (চালুয়াহাটি), মোঃ হাফিজুর রহমান (মশি^মনগর), সিরাজুল ইসলাম (মশি^মনগর), আব্দুল মান্নান (মশি^মনগর) এবং রিজাউল ইসলাম (চালুয়াহাটি) প্রত্যেকে ২০ শতক জমিতে স্থানীয় জাতের (সাদাচুপড়ি, লালচুপড়ি) মেটে আলু চাষা বাদ করেন। ফসলটির জীবনকাল ৮ মাস। খরচ হয়েছে ১৬০০০-১৮০০০ টাকা এবং গড় উৎপাদন হবে আনুমানিক ৫০-৫৫ মণ (২৫-৩০ মেট্রিক টন/হেক্টর) এবং লাভ ৬০০০০-৭০০০০ টাকা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
মেটে আলুর চাষাবাদে আর একটি বিশেষত্ব হচ্ছে এই ফসলটি চাষ করতে অনেক সময় মাচার প্রয়োজন হয় না। কৃষক বেগুন ক্ষেতের মাঝেই এটি চাষাবাদ করতে পারেন অর্থাৎ বেগুনের শেষ উত্তোলনের মধ্যেই মেটেআলুর কন্দ বপন করা হয় এবং বেগুন সংগ্রহ করা শেষ হলে মাঠে যে বেগুন গাছ থাকে সেই গাছই মেটেআলুর মাচার কাজ করে। এটি কৃষকের মাঝে “low-cost: প্রযুক্তি” নামে পরিচিত যা ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ ছাড়া এটি বাড়ির পরিত্যক্ত জায়গাতেও অনায়াসে জন্মানো যায়।
উপরোক্ত কন্দালফসলগুলোর দিকে লক্ষ্যপাত করলে দেখা যাচ্ছে যে, ধানের চেয়ে কন্দাল ফসলের চাষ অনেক লাভজনক। এটিকে উচ্চমূল্যের ফসল হিসাবে এই এলাকার কৃষকগণ দেখছেন এবং তারা এই ফসলগুলোকে রপ্তানি করার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে কৃষির আধুনিকীকরণের কোন বিকল্প নেই এক্ষেত্রে কৃষির বহুমুখীকরণ হতে পারে সমস্যা নিরসনের অন্যতম একটি উপায়। কৃষির এই বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে কন্দাল ফসলের বিস্তার যোগ করবে নতুন মাত্রা যা খাদ্য নিরাপত্তায় যেমন যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করতে পারে আবার প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে।
লেখক : কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার, মণিরামপুর, যশোর। মোবাইল : ০১৭৫৫৭১৬৫৩৯, ই-মেইল : kbdmahuda@gmail.com
ক্যাপসিকাম চাষে জীবিকার পথ পেয়েছেন রূপসার নাজিমউদ্দিন
মোঃ আবদুর রহমান
করোনা মহামারির ফলে মানুষের উপার্জন কমেছে। এতে গত এক বছরে কাজ হারিয়েছেন প্রায় ৬২ শতাংশ মানুষ। কর্মহীন মানুষের আয় নেই। করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন ও জীবিকা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে মানুষ টিকে থাকার লড়াই করছে। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এসব কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা আবশ্যক ।
উল্লেখ্য, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উচ্চমূল্যের ফসল ক্যাপসিকাম চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত করোনায় কর্মহীন বেকার যুবক মোঃ নাজিম উদ্দিন (৩৫)। তিনি এবছর ২০ শতক জমিতে ক্যাপসিকাম চাষ করে প্রথমবারই সফল হয়েছেন। রূপসা উপজেলার নৈহাটি গ্রামে তার বাড়ি। তিনি এলাকায় এখন বেকার যুবকদের কাছে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব।
নাজিমউদ্দিন একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। মহামারি করোনার সময় এ চাকরি থেকে অব্যাহতি পেয়ে তিনি বেকার ও কর্মহীন হয়ে পড়েন। এ সময় তিনি উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শে ও এলাকার এক কৃষকের ক্ষেত দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজদিয়া গ্রামে ২০ শতক জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ক্যাপসিকাম চাষ শুরু করেন। উচ্চমূল্যের এ ফসল চাষ করে স্বল্প সময়ে অধিক ফলন ও ভালো দাম পেয়ে জীবিকা নির্বাহের পথ খুঁজে পেয়েছেন নাজিমউদ্দিন ।
সরেজমিন ক্ষেতে গিয়ে দেখা যায়, তার প্রতিটি গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে সবুজ, বেগুনি, হলুদ আর লাল রঙের ক্যাপসিকাম। ক্ষেতজুড়ে দৃষ্টিনন্দন এই মিষ্টিমরিচ দেখে খুশিতে ভরে উঠছে কৃষকের মন। অধিক ফলনের আশায় ক্যাপসিকাম ক্ষেতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক নাজিম উদ্দিন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেন তিনি। নাজিমউদ্দিন বলেন, মাঝারি উঁচু প্রকৃতির দো-আঁশ মাটি ক্যাপসিকাম চাষের জন্য নির্বাচন করতে হয়। চারা রোপণের আগে জমিতে ৩/৪টি চাষ ও মই দিয়ে আগাছামুক্ত ও সমতল করে জমি তৈরি করে ২ হাত চওড়া বেড করে নিতে হবে। পাশাপাশি দুই বেডের মাঝে ৩০ সেমি. চওড়া ও ১৫ সেমি. গভীর সেচনালা থাকবে। ক্যাপসিকাম চাষের জন্য ২০ শতক জমির বেডে ১৬ কেজি ইউরিয়া, ১৮ কেজি টিএসপি, ১২ কেজি এমওপি, ১২ কেজি জিপসাম ও ১.০ কেজি দস্তা সার প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হয়। আগাছা দমন, আর্দ্রতা সংরক্ষণ ও সারের অপচয় রোধের লক্ষ্যে বেডের ওপর পলিথিনের মালচিং পেপার বিছিয়ে দিতে হবে। তারপর বেডের ওপর ৫০ সেমি. দূরে দূরে সারি করে প্রতি সারিতে ৪৫ সেমি. পর পর ৩০ দিন বয়সের আড়াই হাজার ক্যাপসিকাম চারা পৌষ মাসে রোপণ করা হয়। ঠান্ডা থেকে চারা রক্ষার জন্য পলিথিনের শেড দিয়ে চারাগুলো ঢেকে রাখা হয়।
কৃষক নাজিম উদ্দিন আরো বলেন, ক্যাপসিকামের ভালো ফলনের জন্য ইউরিয়া ও এমওপি সার দু’ভাগে ভাগ করে চারা রোপণের ২৫ দিন পর প্রথম এবং ৫০ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তিতে উপরিপ্রয়োগ করা হয়েছে। প্রতি কিস্তিতে ২৫ গ্রাম ইউরিয়া ও ২০ গ্রাম এমওপি সার গাছের গোড়া থেকে ১০-১৫ সেমি. দূরে চারদিকে উপরিপ্রয়োগ করে ছোট কোদাল দিয়ে হালকাভাবে কুপিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবার সার উপরিপ্রয়োগের পর গাছের গোড়ায় ঝাঝরি দিয়ে পানি সেচ দিতে হবে। তাছাড়া মাটিতে রসের অভাব হলে ক্যাপসিকাম গাছের গোড়ায় নিয়মিত পানি দিতে হবে। মালচিং পেপার ব্যবহারের কারণে ক্ষেতে আগাছার উপদ্রব অনেক কম হয়েছে বলে নাজিমউদ্দিন জানান। তিনি বলেন, সাদামাছি পোকার আক্রমণ থেকে ক্যাপসিকাম গাছের পাতা রক্ষার জন্য পেগাসাস-৫০ এসসি (১০ লিটার পানিতে ১০ মিলি. হারে) এবং পাতার অ্যানথ্রাকনোজ রোগ প্রতিরোধের লক্ষ্যে প্রথমে নোইন-৫০ ডব্লিউপি (১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম হারে) তারপর অরোজল-৫ এসসি (১০ লিটার পানিতে ১০ মিলি লিটার হারে) নামক ছত্রাকনাশক ক্যাপসিকাম ক্ষেতে নিয়মিত স্প্রে করা হয়েছে।
এভাবে কৃষক নাজিমউদ্দিনের হাতের ছোঁয়া আর যত্ন পরিচর্যায় ক্যাপসিকামের চারাগুলো হয়ে উঠেছে হৃষ্টপুষ্ট। চারা রোপণের দু’মাস পর থেকেই গাছে ফল ধরা শুরু হয়। এই ২০ শতক জমিতে ক্যাপসিকাম চাষে বীজ ক্রয়, জমি প্রস্তুত, সার, বালাইনাশক ও মালর্চিং পেপার ক্রয় এবং শেড তৈরিসহ সবমিলিয়ে তার প্রায় ২২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। যদিও নিজেরা কাজ করায় এর মধ্যে শ্রমিকের খরচ লাগেনি। চারা রোপণের দুই মাস পর থেকে তিনি ক্যাপসিকাম বিক্রি শুরু করেছেন। এক্ষেত থেকে তিনি ৫০০ কেজি ক্যাপসিকাম উৎপন্ন করে তা পাইকারি বাজারে ১৫০ টাকা কেজি হিসেবে মোট ৭৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। এতে তার উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ৫৩ হাজার টাকা লাভ হয়েছে বলে তিনি জানান।
বেকার যুবকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, বেকার ও অলস সময় অতিবাহিত না করে যাদের সামান্য জমি আছে, তাতে ক্যাপসিকামসহ বিভিন্ন লাভজনক সবজি আবাদ করে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারেন, এতে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি সবজি বাজারে বিক্রি করে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য আনা সম্ভব।
রূপসা উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ ফরিদুজ্জামান বলেন, ক্যাপসিকাম উচ্চমূল্যের একটি নতুন ফসল। এ উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে এ ফসল চাষ করে সাফল্য লাভ করেছেন তরুণ ও বেকার যুবক নাজিমউদ্দিন। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে তাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। বাজারে দাম ও চাহিদা ভালো হওয়ায় এ উপজেলায় আগামীতে ক্যাপসিকামের চাষ আরো বাড়বে বলে আশা করেন তিনি।
ক্যাপসিকাম এ দেশে সবার কাছে মিষ্টিমরিচ নামে পরিচিত। এ মরিচের আকার ও আকৃতি বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। তবে সাধারণত এর ফল গোলাকার ও ত্বক পুরু হয়। ক্যাপসিকাম সবুজ, লাল, হলুদ, ও বেগুনি রঙের হয়ে থাকে। এ মরিচ ঝাল নয়, আবার চিনির মতো মিষ্টিও নয়। মরিচের ঘ্রাণ আছে। তাই সালাদের জন্য এ মরিচ খুবই উপযুক্ত। ক্যাপসিকামে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন এ, বি, সি এবং ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও জিংক রয়েছে। এর কাঁচা ফল সালাদ হিসেবে খুবই মুখরোচক ও পুষ্টিকর। তাছাড়া ক্যাপসিকাম রান্না করে সবজি হিসেবে খাওয়া যায়।
পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করার পাশাপাশি ক্যাপসিকাম দেহের রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ক্যাপসিকামে থাকা ভিটামিন এ, সি এবং বিটা ক্যারোটিন চোখ ও ত্বককে ভালো রাখে। এ ছাড়া এটি লাইকোপেন সমৃদ্ধ হওয়ায় উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং হৃদরোগ দূর করে। ক্যাপসিকাম দেহের বাড়তি ক্যালরি পূরণে সহায়তা করে। ফলে দেহে উচ্চচর্বি জমে না, একই সাথে ওজনও বৃদ্ধি পায় না। এতে ক্যাপসাইসিনস নামে একটি রাসায়নিক উপাদান থাকে যা ডিএন এর সাথে যুক্ত হয়ে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদানের সংযুক্ত হওয়াতে বাধা দেয় । এভাবে এটি ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। ক্যাপসিকামে অ্যালকালোয়েড, ফ্লেবোনয়েড, ক্যানিন ইত্যাদি পাওয়া যায়। অ্যালকালোয়েড সমৃদ্ধ হওয়ায় এটি অ্যান্টি-ইনফ্লামেটোরি ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। আর এর ক্যানিন আন্ত্রিক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। ক্যাপসিকাম হজমে সাহায্য করে। মাইগ্রেন, সাইনাস, ইনফেকশন, দাঁতেব্যথা, অস্টিওআর্থ্রাইটিস ইত্যাদি ব্যথা দূর করতেও এটি কাজ করে। ক্যাপসিকাম ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতেও কার্যকর এবং রক্তে শর্করার মাত্রা স্থির রাখে। এটি রক্তের অনুচক্রিকা উদ্দীপিত করে সংক্রমণ রোধ করে থাকে।
প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান দেয়া ছাড়াও লাভজনক ও অর্থকরী ফসলের মধ্যে ক্যাপসিকাম অন্যতম। আমাদের দেশে বিভিন্ন শপিংমল, ফাস্টফুড ও চাইনিজ রেস্টুরেন্টসহ অভিজাত হোটেলগুলোতে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া ক্যাপসিকাম বিদেশে রপ্তানির সম্ভাবনাও প্রচুর। এর চাষ করে অনেক ফসলের তুলনায় কম সময়ে বেশি লাভ করা যায়। তাই দেশের বেকার যুবকদের ক্যাপসিকাম চাষের ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া একান্ত প্রয়োজন। এতে আর্থিক সচ্ছলতার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার মাধ্যমে বেকার সমস্যার সমাধান হবে এবং দেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল হবে।
লেখক : উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিস, রূপসা, খুলনা। মোবাইল: ০১৯২৩৫৮৭২৫৬, ইমেইল: rahman.rupsha@gmail.com
বাঙালির ঐতিহ্য খেজুরের রস ও গুড়
মো: কাওছারুল ইসলাম সিকদার
শীতকালের প্রধান আকর্ষণ খেজুরের রস ও খেজুরের গুড়। শীতের পিঠা পুলি তৈরিতে খেজুরের গুড়ের জুড়ি নেই। খেজুরের গুড়ের স্বাদ লাভের জন্য হেমন্তের শুরু থেকেই গ্রাম বাংলায় প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। এ সময়ে গাছিরা (যারা খেজুর গাছে কেটে রস সংগ্রহ করে) বাড়িবাড়ি ঘুরে গাছ পর্যবেক্ষণ করেন এবং কোন কোন গাছ হতে রস সংগ্রহ করবেন তা নির্ধারণ করেন। গাছ কাটার জন্য সংগ্রহ করেন ধারালো কাঁচি, ছোট ও মাঝারি আকারের ঘটি/হাঁড়ি, মোটা রশি, চুন ইত্যাদি। মাটির হাঁড়ি সমূহের বহিরাংশে চুন দিয়ে কয়েক দিন রৌদ্রে শুকিয়ে রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করেন। সেইসাথে শীতের শুরুতে ধারালো কাঁচি দিয়ে খেজুর গাছের পুরাতন ডালা কেটে দেন। যে দিকটায় রস সংগ্রহ করা হবে সেদিকে ত্রিভুজ আকৃতিতে বেশি করে কাটা হয়। যাতে গাছের দেহের সাদা অংশ স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হয়। ছাঁটাইকৃত ঢালাসমূহ ঘরের বেড়া ও রান্নাঘরে ছাদ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। অনেক ক্ষেত্রে জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। শীতর তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে গাছের মাথার ছাঁটাইকৃত অংশ হতে রস বের হতে শুরু করে। তখন গাছিরা প্রতিদিন/একদিন অন্তর অন্তর (গাছের বয়সভেদে) রস সংগ্রহ করার জন্য কেটে দেন। ত্রিভুজ আকৃতিতে কাটার সুবিধা হলো রস গড়িয়ে নিচের দিকের মধ্যখানে এসে জমা হয়। এ অংশে একটি বাঁশের নলা যুক্ত করে দেয়া হয়, যাতে সে নলা দিয়ে ঘটি/হাঁড়িতে রস জমা হতে পারে। এ ছাড়া উপরের দুইদিকে দুটি শক্ত বাঁশের কঞ্চি বা ফলা গাছে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়, যাতে নির্ধারিত হাঁড়ি/ঘটিটি রশির মাধ্যমে ঝুলিয়ে রাখা সম্ভব হয়। গাছে উঠা বা অবস্থানের জন্য শক্ত ও মোটা রশি ব্যবহার করা হয়। গাছের গায়ে নির্দিষ্ট উচ্চতা পরপর ছোট ছোট বাঁশের টুকরা শক্ত করে বেঁধে দেয়া হয় যাতে গাছের শীর্ষে উঠা সহজতর হয়। আর রসের হাঁড়ি উঠানো ও নামানোর জন্য গাছিরা তাদের দেহের পেছনে কোমড়ের দিকে একটি বাঁশের আংটা রশি দ্বারা ঝুলিয়ে রাখেন। সে আংটায় শূন্য হাঁড়ি ঝুলিয়ে বিকালে গাছে উঠেন আর ভোরে রস ভরা হাড়ি আবার সেই আংটায় ঝুলিয়ে নিচে নেমে আসেন। প্রতিদিন দুপুরের পর হতে গাছের গলার বাকল ছেটে দিয়ে শূন্য হাঁড়ি ঝুলিয়ে দেন। যা সন্ধ্যা অবধি চলতে থাকে। আবার পূর্ণ রসের হাঁড়ি কাকডাকা ভোর হতে নামানো শুরু হয়। রস সংগ্রহের জন্য ঘটি/হাঁড়িসমূহ সাধারণত মাটির তৈরি হয়ে থাকে। এসব হাঁড়ি হতে রস সংগ্রহের পর এগুলো প্রতিদিন ধুয়ে পরিষ্কার করে রৌদ্রে শুকাতে হয় যাতে পোকা বা ছত্রাকের আক্রমণ না ঘটে।
শীতের পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদে গাছিদের খেজুর গাছের শীর্ষে আহরণ এবং কুয়াশার চাদরে ঢাকা ভোরে রসের হাড়ি নামানো গ্রামীণ জনপদের একটি অতিসাধারণ ও মনোমুগ্ধকর চিত্র। তবে এসব গাছির আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। এদের অধিকাংশই সাধারণত মধ্য বয়সি এবং গরিব। যাদের ভালো মানের গরম কাপড়ও নেই, যার দ্বারা শীত নিবারণ করতে পারেন। শীত নিবারণে গাছিরা সাধারণত গায়ে একটি চাদর ব্যবহার করেন এবং প্রচণ্ড শীতের ভোরে হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে কুয়াশাচ্ছন্ন ও শিশিরসিক্ত মাঠ পেরিয়ে রস সংগ্রহে এ পাড়া হতে ও পাড়ায় দোড়ান। বর্তমানের তুলনায় অতীতে শীতের তীব্রতা অনেক বেশি ছিল। প্রবাদ আছে মাঘের শীতে বাঘ পালায়। প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল ভারসাম্যপূর্ণ। বৈশ্বিক উষ্ণতায় প্রভাব তখনও উপলব্ধি করা যায়নি। সে সময়ে গ্রামীণ অর্থনীতিতে খেজুরের রসের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। দেশে ব্যবসা বাণিজ্য বা চাকরির সুযোগ খুব একটা ছিল না। তাই কর্মসংস্থান ও উপার্জনের জন্য কৃষিই ছিল প্রধান অবলম্বন। খেজুরের রস সংগ্রহ কৌশল বা জ্ঞান সবার জানা ছিল না। যারা একাজ করতেন তাদের গুরুত্ব ছিল অধিক। শীতে গরিব গাছিদের আর্থিক উপার্জনের প্রধান অবলম্বনই ছিল খেজুরের রস সংগ্রহ। সংগৃহীত রস গাছের মালিক ও গাছির মধ্যে আধা আধি ভাগ হতো। পরিবারের প্রয়োজনের চাহিদার পর যে উদ্বৃত্ত রস থাকতো তা আড়ৎ (সকালের বাজার) বা নিকট প্রতিবেশীদের নিকট বিক্রয় করা হতো। এ ছাড়া কাঁচা খেজুরের রস জাল দিয়ে ঘন করে তরল গুড় তৈরি করে সংরক্ষণ করা হতো। আবার অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে গুড় ঘন করে বিভিন্ন আকৃতিতে রূপ দিয়ে পাটালী (গুড়) তৈরি করা হতো। যেহেতু পূর্বে গ্রাম বাংলায় চিনির ব্যবহার খুব একটা ছিল না। তাই মিষ্টান্ন তৈরিতে আখের বা খেজুরের গুড়ের উপরই গ্রামের মানুষকে নির্ভর করতে হতো। শীতে আতপ চালের পায়েস রান্নায় কাঁচা খেজুরের রসের ব্যবহার ছিল ব্যাপক। শীতের সকালে কাঁচা খেজুরের রস আর মুড়ি ছিল পাঠশালা/মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থীদের সকালের প্রাথমিক নাশতা। পাঠশালা শেষে বাড়ি গিয়ে খেজুরের রস নিয়ে রান্না আতপ চালের পায়েস ছিল শীতের সকালের প্রধান আকর্ষণ। কৃষকেরাও মাঠের কাজ শেষে কাঁচা খেজুরের রসের পায়েস খেতেন সকালের নাশতা হিসেবে।
বাংলাদেশের বেশকিছু জেলা খেজুরের গুড়ের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। এসব এলাকা মূলত কৃষি প্রধান এবং জীবনযাত্রার মানও অন্যান্য জেলার তুলনায় নিম্ন। এসব অঞ্চলে শীতকালে খেজুরের রস সংগ্রহে পর্যাপ্ত গাছী পাওয়া যেতো। দেশের যশোর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, মাগুড়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ জেলায় খেজুর গাছের আধিক্য অদ্যাবধি লক্ষ করা যায়। এ সকল অঞ্চলে তৈরি উন্নত মানের খেজুরের গুড় এখন দেশের সব নামী-দামি সুপার শপে বা দোকানে বিক্রি হতে দেখা যায়। যদিও দেশের সর্বত্র কমবেশি খেজুরের গাছ রয়েছে। দেশের আর্থসামাজিক পরিবর্তন, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, শিক্ষা, ব্যবসা বাণিজ্য ও চাকরির প্রসার প্রভৃতি কারণে এ পেশায় লোকের সংকট দিন দিন তীব্র হতে তীব্রতর হচ্ছে। বর্তমানে গাছ থাকলেও রস সংগ্রহের জন্য উপযুক্ত গাছি পাওয়া যায় না। আবার খেজুর গাছ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক না হওয়ায় এ গাছ সংরক্ষণ ও বিস্তারে মানুষ আর আগের মতো আগ্রহী নন। জ¦ালানি হিসেবে ইটের ভাটায়ও রয়েছে গাছের ব্যাপক চাহিদা। তাই পুরাতন ও বয়স্ক খেজুর গাছ ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে নতুন করে আর খেজুর গাছ তৈরি হচ্ছে না। তাই খেজুরের রস ও গুড়ের জোগান প্রতিনিয়ত কমছে, অপরদিকে চাহিদা বাড়ছে। মানুষ এখনও বেশি দামেও ভাল মানের খেজুরের গুড়ের প্রত্যাশী। কিন্তু জোগান কম বিধায় প্রতি বছর শীত মৌসুমে খেজুরের রস ও গুড়ের দাম বাড়ছেই। সে সুযোগে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী খেজুরের গুড়ের সাথে চিনি, ময়দা, রং, হাইড্রোজ, ফিটকিরি, সালফার, খাবার সোডা ও ফ্লেবার মিশিয়ে বাজারে ভেজাল খেজুরের গুড় সরবরাহ করছে।
খেজুরের গুড় উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটাতে হবে। বর্তমানে শ্রমের মজুরী অনেক বেশি। সেইসাথে এই কাজের জন্য উপযুক্ত জ্ঞানসম্পন্ন জনবলেরও অভাব রয়েছে। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে ভোরে গাছের চুড়ায় উঠে রস সংগ্রহ এবং বিকেলে আবার গাছে ঘটি/পাত্র ঝুলিয়ে দেওয়া একটি অত্যন্ত কঠিন কাজ। একাজে বর্তমান প্রজন্মও আগ্রহী নয়। তবে খেজুরের গুড়ের কদর বা আগ্রহ রয়েছে দেশের প্রায় সর্বত্র। খেজুরের গুড়ের উৎপাদন বৃদ্ধি ও পেশায় পরবর্তী প্রজন্মকে আগ্রহী করাতে গাছের ডালা কাটা ও বাকল তোলার মতো কষ্টকর কাজটি যান্ত্রিক উপায়ে করতে হবে। এ ধরনের কাজের জন্য কোরিয়ায় লম্বা লাঠিযুক্ত কাঁচি বা করাত ব্যবহার করা হয়। এতে করে গাছে না উঠেই ভূমি হতে গাছের পরিচর্যা করা যায়। আবার থাইল্যান্ডে খেজুরের গুড় প্লাস্টিকের কৌটায় ঢালার পূর্বে উপরের স্তরের ও নিচের স্তরের গুড়কে একসাথে মিশাতে মোটরচালিত পাখা ব্যবহার করা যায়। এতে শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা অনেক কমে যায়। তাই খেজুরের গুড়ের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মিটাতে খেজুরের গুড় উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটাতে হবে। তবেই খেজুরের গুড়ের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। পেশাটি হবে লাভজনক।
খেজুরের গুড়ের চাহিদা মিটাতে খেজুর গাছের সংখ্যা বহুগুণে বাড়াতে হবে। যেহেতু খেজুর গাছ তৈরি ও এর ব্যবস্থাপনা এখন আর লাভজনক নয়, তাই এ গাছের বংশবৃদ্ধিতে কৃষকেরা খুব একটা আগ্রহী নন। সরকারি জমিতে, মহাসড়ক ও সড়কের মাঝে এবং গ্রামীণ রাস্তার দুইপাশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এ গাছ লাগাতে হবে। সেইসাথে দেশীয় খেজুরের চারার সাথে সাথে বিদেশি (আরব) জাতের খেজুরের চারা সংগ্রহ করে যুগপৎভাবে চাষ করতে হবে। যাতে শীতে দেশীয় জাতের খেজুরের গাছ হতে রস এবং গ্রীষ্মে বিদেশি জাতের খেজুরের গাছ হতে খেজুর পাওয়া যায়। যদি শীত ও গ্রীষ্ম উভয় মৌসুমেই এ পেশা হতে অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকে তবে কৃষকেরা আর্থিকভাবে লাভবান হবে এবং এ কার্যক্রম অর্থনৈতিকভাবে উপযোগিতাও লাভ করবে। অপরদিকে খেজুর গাছ কাটা, ছাঁটাই ও ঘটি প্রদান কার্যক্রম প্রযুক্তি নির্ভর হতে হবে। নতুন গাছ তৈরি, রস সংগ্রহ, গুড় তৈরি ও তা সংরক্ষণে কৃষকদের দিতে হবে প্রশিক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তি ও আর্থিক সহায়তা। নিশ্চিত করতে হবে খেজুরের গুড়ের যথাযথ মূল্য। তবেই খেজুরের গুড়ের ঐতিহ্য কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে। আর তা না হলে নামেই থাকবে খেজুরের রস, খেজুরের গুড়, দক্ষিণের দ্বার মাদারীপুর এর মতো ব্রান্ডিং।
লেখক : অতিরিক্ত পরিচালক (উপসচিব), বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, মোবাইল : ০১৫৫২৩৫৫৮৫৩, ই-মেইল : kawseru11173@gmail.com
স্বল্প পুঁজিতে গ্রাসকার্প নির্ভর লাভজনক মাছচাষ
মো: তোফাজউদ্দীন আহমেদ
বাংলাদেশ মাছচাষে পৃথিবীর অগ্রসরমান দেশগুলোর অন্যতম। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতে বাংলাদেশ মাছচাষে পৃথিবীর ৫ম বৃহত্তম দেশ। দেশে মাছচাষের আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে নিবিড়তা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকাংশে। বর্তমানে দেশে হেক্টরপ্রতি মাছের উৎপাদন ২ টন থেকে শুরু করে ১০০ টন পর্যন্ত উৎপাদন হচ্ছে। তলা পরিষ্কারকরণ (Bottom Clean) পদ্ধতিতে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন আরও অনেক বেশি চালু হয়েছে। এ ছাড়াও মাছ চাষ এখন ঘরের ভেতর হাউজের মধ্যে হচ্ছে। যেমন : রাশ (Raceway Aquaculture System) এবং বায়োফ্লক পদ্ধতিতে অত্যন্ত উচ্চ ঘনত্বে মাছচাষ হচ্ছে। এ সব পদ্ধতিতে মাছের উৎপাদন অত্যন্ত বেশি। গ্রাসকার্প সাধারণত আমাদের দেশে কার্প মিশ্রচাষে সাথী ফসল হিসেবে চাষ করা হয়। স্বল্প পুঁজিতে গ্রাসকার্প মাছচাষ প্রযুক্তি বিষয়ে আলোকপাত করা হলো।
একজন চাষির একটি পুকুর আছে। মাছচাষের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ নাই তার জন্যই এ প্রযুক্তি। সাধারণভাবে আমরা জানি মাছচাষে মোট বিনিয়োগের ৬০-৭০ ভাগ হয় মাছের খাদ্য সরবরাহ করতে। আলোচিত পদ্ধতিতে এই সমস্যাটিকে সমন্বয় করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে মোট মাছের উৎপাদন কিছুটা কমে যেতে পারে কিন্তু চাষি পদ্ধতি অনুসরণে অবশ্যই লাভবান হবে। এ পদ্ধতিতে কেবল গ্রাসকার্পকে নিয়মিত চাষি নিজের কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ঘাস সংগ্রহ করে পুকুরে দেবেন। গ্রাসকার্প সে খাবার খেয়ে বড় হবে পাশাপাশি এর মল অনেকাংশে সার হিসেবে কাজ করবে। এই সার পুকুরে অন্যান্য মাছের জন্য প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক খাবার তৈরি করবে এবং মাছ তা খেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি লাভ করবে। গ্রাসকার্পের এই মল পুকুরে কেবল সার হিসেবে কাজ করবে না, মাছের মলে যে অপরিপাককৃত (Un digestible) ঘাস বা আংশিক পরিপাককৃত (Partially Digestible) ঘাস থাকে তা পুকুরের অন্যান্য মাছে (যেমন: সরপুঁটি, রুই, মৃগেল ও কার্পিও মাছ) সরাসরি খাবার হিসেবে গ্রহণ করে এবং বৃদ্ধি লাভ করে।
গ্রাসকার্প মাছের পরিচিতি
এ মাছটি বাংলাদেশে অনেক দিন আগে থেকে চাষ হচ্ছে। প্রধানত এ মাছ ঘাস খেয়ে দ্রুত বড় হয়। ঘাস খেয়ে বড় হয় বলেই সম্ভবত এ মাছের নামকরণ এরূপ হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে চাষের অধীনে (Aquaculture Based) উৎপাদিত মাছের একটি বড় অংশের অবদান কার্পজাতীয় মাছের এবং কার্পজাতীয় মাছের মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি অবদান গ্রাসকার্প মাছের। একক প্রজাতি হিসেবে গ্রাসকার্প মাছের অবদান সর্বাধিক ১০.৫ ভাগ। বাংলাদেশের মাছচাষে গ্রাসকার্প মাছের ভূমিকাও (১.৫৮%) কম নয়। অত্যন্ত দ্রুত বর্ধনশীল এ মাছটি বছরে ১-৩ কেজি পর্যন্ত বড় হয়। গ্রাসকার্প মাছটি যদিও ঘাস খেয়ে বড় হয় কিন্তু বর্তমান সময়ে পৃথিবীর সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মাছচাষ In Pond Raceway Aquaculture System (IPRAS). সেখানে এ মাছের চাষ হচ্ছে অধিক ঘনত্বে এবং বাণিজ্যিক ভাসমান খাবার দিয়ে। এ মাছটি বড় হলে আমাদের দেশীয় রুই মাছের মতো স্বাদ লাগে। এ জন্য এ মাছের বাজার চাহিদাও বেশ ভালো।
বর্তমান সময়ে সম্পূরক খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে এ সময় গ্রাসকার্প চাষের বিষয়ে অগ্রাধিকার না দিয়ে উপায় নাই। এ মাছটি মৌসুমি বা বার্ষিক সব ধরনের জলাশয়ে চাষ করা যায়। হ্যাচারিগুলোতে এ মাছের পোনা পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদিত হয় এবং সারা দেশে এ মাছের পোনা পাওয়া যায়। মাছটি সুস্বাদু হওয়ায় এর বাজার চাহিদাও বেশি। মাছটি রাক্ষুসে স্বভাবের নয় বলে একক বা মিশ্র পদ্ধতিতে অন্যান্য মাছের সাথে চাষ করা যায়।
পুকুর নির্বাচন
ছোট বড় সকল পুকুরে এ মাছচাষ করা যায়। সাধারণত যে সকল পুকুরে আগাছা জন্মে বা ঘাস থাকে বিশেষ করে প্লাবনভূমিতে এ প্রজাতির মাছচাষ করা উত্তম। এ ছাড়া যেসব পুকুর নিজস্ব পুষ্টিতে উর্বর এবং পর্যাপ্ত ক্ষুদিপানা সৃষ্টি হয় সেসব পুকুর এ মাছ চাষের উপযোগী। প্রকৃতপক্ষে সকল পুকুরেই এ মাছ চাষ করা যাবে তবে বাইর থেকে সম্পূরক খাবার হিসেবে কলাপাতাসহ বিভিন্ন ধরনের নরম কোমল ঘাস বা জলজ আগাছা সরবরাহ করতে হবে।
চাষের পুকুর প্রস্তুতি
অন্যান্য সকল মাছের চাষের জন্য যেভাবে পুকুর প্রস্তুত করতে হয় সেভাবেই গ্রাসকার্প মাছ চাষের ক্ষেত্রেও একইভাবে পুকুর প্রস্তুত করতে হবে। পুকুর পাড়ে বড় ছায়া প্রদানকারী গাছ না থাকাই ভালো। পুকুরের পাড় শক্তভাবে মেরামত করতে হবে যাতে বাইরের পানি পুকুরের ভেতর প্রবেশ করতে না পারে। বেশি পুরাতন পুকুর হলে অবশ্যই শুকিয়ে নিতে হবে। গ্রাসকার্প মাছ যেহেতু অক্সিজেন স্বল্পতার প্রতি দুর্বল সে জন্য পুকুর প্রস্তুতে যত্নবান হতে হবে। পুকুরের তলদেশে অধিক কাদা থাকলে অপসারণের ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুর শুকনো হলে এ পর্যায়ে পুকুরে পানি প্রবেশ করাতে হবে। এ সময় পুকুর প্রস্তুতের অংশ হিসেবে শতকে ০.৫ -১.০ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। চুন বর্ষাকালে পুকুরের পাড়ের যে পর্যন্ত পৌঁছে সে পর্যন্ত ভালোভাবে চুন ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুরে চুন প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর শতকপ্রতি ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি সার দিতে হবে। সার প্রয়োগের ৪-৫ দিন পরে মাছের পোনা ছাড়তে হবে ।
মাছের পোনা মজুদ
ভালো হ্যাচারি থেকে সংগৃহীত রেণু থেকে উৎপাদিত ভালোমানের পোনা নির্বাচন চাষের সফলতার পূর্বশর্ত। কেজিতে ৪-৬টি আকারের পোনা সংগ্রহ করে চাষের পুকুরে ছাড়লে উত্তম ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। ছোট আকারের পোনা ছাড়লে বিশেষ যত্ন নিতে হবে। সাধারণত কার্প মিশ্র চাষে প্রতি শতকে অন্যান্য কার্পজাতীয় মাছের সাথে মাত্র ১টি গ্রাসকার্প ছাড়া হয়।
গ্রাসকার্প মাছের খাদ্য
গ্রাসকার্পের প্রধান খাবার বিভিন্ন ধরনের কোমল ঘাস। সম্পূরক যেকোনো খাবারও এ মাছ খায়। দুধের গরুকে যে নেপিয়ার বা অন্যান্য আমিষ সমৃদ্ধ ঘাস খাওয়ানো হয়, সেসব ঘাস এ মাছে খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। দেশের হাজামজা পুকুরে প্রচুর পরিমাণে ক্ষুদিপানা, ইদুরকানি জন্মে যা এ মাছের অন্যতম প্রধান খাবার। কলাগাছের পাতা, ফুলকপি-বাঁধাকপির কচিপাতা গ্রাসকার্প মাছের অত্যন্ত প্রিয় খাবার।
পুকুরে মাছের খাদ্য প্রদান পদ্ধতি
গ্রাসকার্পকে আমরা খাবার দেবার সময় সাধারণত বিশেষ কোন আলাদা যত্ন নেয়া হয় না। ক্ষুদিপানা, ইদুরকানি বা ছোট আকারের ঘাস সংগ্রহ করে সরাসরি পুকুরে সরবরাহ করলেই হবে। এক দিনে ২-৩ দিনের পরিমাণ খাবার দেয়া যেতে পারে। বড় ঘাস হলে বা কলাপাতা হলে কেটে ছোট করে দিতে হবে যাতে মাছ সহজে খেতে পারে। বিশেষ করে পুকুরে বাঁশ বা বাঁশের ফালি দিয়ে চার কোণা বেড় তৈরি করে দিলে ঘাস পুকুরে ছড়িয়ে পড়া থেকে রক্ষা করা যায়। মাত্র ৬-৭ মাস এভাবে চাষ করলে নিশ্চিত প্রতিটি মাছের ওজন বেশি হবে। একটি ৩০ শতকের পুকুরে অন্যান্য মাছ ছাড়া কেবল গ্রাসকার্প মাছের উৎপাদন হবে কমপক্ষে ৫০০ কেজি। মাছের সর্বনিম্ন ১০০ টাকা দরে বিক্রয় করলেও কেবল গ্রাসকার্প থেকেই আয় হবে ৫০ হাজার টাকা।
মাছ চাষে সতর্কতা
গ্রাসকার্প মাছচাষের সময় নিম্নে উল্লিখিত বিষয়ে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। অনেক সময় অসচেতনতার কারণে মাছচাষে চাষি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। যেমন : গ্রাসকার্প ঘাস খায় কিন্তু শুকনা বা শক্ত খসখসে, কাটাযুক্ত ধারাল ঘাস খাবার হিসেবে দেয়া যাবে না; গ্রাসকার্প মাছ পানির উপরে বা কিনারে এসে ঘাস খায় এ জন্য অনেক সময় শিকারি পাখি বা প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হয় সে জন্য এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে; মাছ চাষ চলাকালে অনেক সময় পুকুরে পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি হয় এ সময় অন্যান্য প্রজাতির তুলনায় গ্রাসকার্প মাছ বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বড়গুলো মারা যেতে পারে। এ জন্য পুকুরে দ্রবণীয় অক্সিজেন এর ঘাটতি না হয় সে দিকে নজর রাখতে হবে। দ্রবীভূত অক্সিজেনের অভাব হলে দ্রুত প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে; প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘাস দেয়া হলে সে ঘাস পচে পুকুরে ক্ষতিকর গ্যাস তৈরি হয় এবং পুকুরে পরিবেশ নষ্ট হয়, মাছ পীড়ন অবস্থার সম্মুখীন হতে পারে। এ জন্য অতিরিক্ত ঘাস দেয়া যাবে না। ২-৩ দিনের মধ্যে খেয়ে ফেলতে পারে সেই পরিমাণের বেশি ঘাস দেয়া যাবে না; ঘাসের শক্ত উচ্ছিষ্ট অংশ পুকুরে জমতে দেয়া যাবে না, মাঝে মধ্যে অপসারণ করতে হবে, অন্যথায় এ সব দ্রব্য পচে পুকুরের সার্বিক পরিবেশের ক্ষতি হয়ে মাছ পীড়ন অবস্থার সম্মুখীন হতে পার; ধানী জমিতে ধানের সাথে এ মাছ চাষ করা যাবে না। এ মাছে ধানের গাছ খেয়ে ক্ষতি করতে পারে।
বিশ্বে মাছ উৎপাদনে কার্প এর অবস্থান সর্বোউপরে এবং গ্রাস কার্পের অবস্থান তার মাঝে অন্যতম। অর্থাৎ কার্পজাতীয় মাছচাষ সবচেয়ে সহজ বলেই এ মাছচাষ বেশি হয়। অনেকের পুকুর আছে কিন্তু পুঁজির ও সঠিক পদ্ধতি না জানার কারণে অব্যবহৃত থেকে যায়। সাধারণভাবে মনে করে পুকুর থাকলে হবে না মাছচাষ করতে অনেক টাকার প্রয়োজন হয়। আজকের আলোচনা থেকে সহজেই বোধগম্য হবে যে পুঁজি নয় কেবল কায়িক পরিশ্রম দিয়েও মাছ চাষ করা যায়।
লেখক : বিভাগীয় উপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর, রাজশাহী বিভাগ, রাজশাহী। মোবাইল : ০১৯৮৮১১০৪২, ই-মেইল :tofaz2010@gmail.com
লেয়ার মুরগির ডিমপাড়া অবস্থায় পরিচর্যা
ডা: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
বাংলাদেশের ডিমের চাহিদা এখন দেশের উৎপাদিত ডিম দিয়েই পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। বাণিজ্যিক বৃহৎ লেয়ার খামারের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ে ছোট ছোট কিছু লেয়ার খামার দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ আমিষের জোগান দেয়ার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। ডিম দেয়ার পূর্বে এবং ডিম দেয়াকালীন অনেক ধরনের পরিচর্যা প্রয়োজন যা জানলে পোল্ট্রি বিজনেসকে লাভজনক রাখা ও সর্বোচ্চ ডিম পাওয়া সম্ভব।
ডিমের সর্বোচ্চ উৎপাদন পেতে হলে মুরগির কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রায় ওজন রাখতে হবে। যদি ওজন ধরে না রাখা যায় বা ওজন বৃদ্ধি পায় ও চর্বি জমা হয়। তাহলে তা সর্বাধিক উৎপাদন লেভেলে আসার পর মুরগির ডিমের পরিমাণ, খোসার গুণগতমান এবং মুরগির উর্বরতা মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে। এই সমস্যায় ৪০ সপ্তাহ বয়সের পর ডিমের আকার বড় হয়ে যায়। পিক প্রোডাকশনে আসার পরে পিক ফিড খাওয়াতে হয় এবং মুরগির অতিরিক্ত ওজন ঠেকাতে ও মুরগির ডিমে ম্যাস ঠিক রাখতে এই সময়ে খাবারের পরিমাণ কিছুটা কমাতে হয়। এইসব তথ্য ফিড সরবরাহকারী বা পুষ্টি কনসালট্যান্টের থেকে জেনে নিতে হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ হল যদি পুষ্টির মাধ্যমে কাক্সিক্ষত ফলাফল পেতে হয় তাহলে, নমুনা নিয়ে রুটিনমাফিক ফিডের টেস্ট এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। পাশাপাশি নিম্নলিখিত বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ লক্ষ্য রেখে দৈনিক খাবার গ্রহণ এবং পারফরম্যান্স জানতে হবে। দৈনিক খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ হিসাব রাখতে হবে। ফিডে উপযুক্ত এবং কাক্সিক্ষত মানের পুষ্টি উপাদান আছে কিনা দেখতে হবে। ফিডিং ব্যবস্থাপনার উপযুক্ত পদ্ধতি বা প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।
ফিডে পরিপাক হওয়া শক্তি পরিমাপ করে ভারসাম্য ডায়েট তৈরি করা প্রয়োজন। কোন উপাদানের ঘাটতি বা অতিরিক্ত হলে ফ্লকের ফলাফলে এবং বাচ্চার উপর নীতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। প্রতিদিনের বরাদ্দকৃত ফিডের মধ্যে এনার্জি এবং এমাইনো এসিডের সরবরাহের উপর ফ্লকের পারফম্যান্স নির্ভর করে। এসবের পরিবর্তন করতে হলে অন্যান্য সকল বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পুষ্টি সরবরাহ করা প্রয়োজন। সেখানে পুষ্টির হিসাব প্যারেন্ট স্টকের জন্য বরাদ্দকৃত এনার্জির দেয়া হয়েছে ১১.৭ মেগাজুল বা ২৮০০ কিলো ক্যালরি। স্ট্যাটার, গ্রোয়ার লেয়ার ফিডে প্রতি কেজিতে ২৮০০ কিলোক্যালরি রাখতে হবে। কি পরিমাণ কনসেনন্ট্রেটে কী পরিমাণ শক্তিমাত্রা আছে তার সাথে প্রতিদিনের চাহিদা অনুসারে ফিডের বরাদ্দ এবং সরবরাহ করতে হবে। বিশেষ করে বিভিন্ন সময়ে খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমে বা বেড়ে যায়। যেমন পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়লে পোল্ট্রির খাদ্য গ্রহণ কমে যায়। সেই ক্ষেত্রে পুষ্টির মান বিবেচনা করে ফিড খেতে দিতে হবে।
একটি মোরগ বা মুরগির দৈনিক খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ তার বংশগত বৈশিষ্ট্য এবং পরিবেশের উপর নির্ভর করে। খাদ্য গ্রহণের কাক্সিক্ষত পরিমাণ এবং প্রতিদিনের খাদ্যের পুষ্টি ঘনত্ব ঠিক করা এবং সে আনুযায়ী ফিড ব্যবস্থাপনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যের শক্তিমাত্রাকে সাধারণত ফিডের মধ্যে মেটাবোলাইজ হওয়া শক্তির পরিমাণকে নির্দিষ্ট করে ফিডের মধ্যে প্রোটিনের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকতে হবে যেন শারীরিক পুষ্টির জন্য সকল এমাইনো এসিড উৎপন্ন হতে পারে। ফিডের প্রোটিনের মধ্যে সব ধরনের চাহিদামতো প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় এমাইনো এসিড থাকতে হবে। যেন প্রতিটি উপাদানের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত হয়।
ফিডের মধ্যে অতিরিক্ত পরিমাণ প্রোটিন ব্রিডারের অতিরিক্ত মাংসপেশী তৈরি করে যা অনুর্বরতার অন্যতম কারণ। অন্যদিকে প্রোটিনের ঘাটতি হলে ফ্লকের ডিম উৎপাদন কমে যায় এবং পালকের সমস্যা হয়।
ক্যালসিয়ামের পরিমাণ ঠিক রাখতে একটা ডিমপাড়া লেয়ারের জন্য প্রতিদিন ৪-৫ গ্রাম ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন। উল্লেখযোগ্য ফলাফল পেতে ৫% ডিম উৎপাদনের পর থেকেই ব্রিডারের রেশনে বা ফিড এই মাত্রায় ক্যালসিয়ামের সরবরাহ রাখতে হবে। যথাযথ ডিমের গঠন রাখতে প্রতিটি মুরগিকে দৈনিক ১ গ্রাম হারে ক্যালসিয়ামের সরবরাহের জন্য বড় সাইজের লাইমস্টোন বা ওয়সেস্টার সেল বা ঝিনুক চূর্ণ ব্যবহার করা যেতে পারে। ফিডের সাথে মিশানো লাইমস্টোনের চেয়ে এভাবে হালকা চূর্ণ করা লাইমস্টোন বা ঝিনুক ব্যবহার বেশি যুক্তিযুক্ত বলে অনেকে মনে করেন। এতে পিলেটের সাহায্যে খাওয়ানো হলে যে অপচয় হয় তা কমানো যায়।
লেয়ারকে সকালে ফিডের মাধ্যমে ছোট চূর্ণ লাইমস্টোন খাওয়ানো হলে তা দ্রুত শোষণ হয়ে বিকেলে বা সন্ধ্যায় বৃক্কের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে। অন্যদিকে যদি বিকেলের ফিডে অপেক্ষাকৃত বড় আকারের লাইমস্টোন চূর্ণ খাওয়ানো হলে তা সারারাত পেটে শোষণ হয়ে ডিমের সেল প্রস্তুতের সময় যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয়। ফলে উপযুক্ত গুণাগুণ বিশিষ্ট ডিম পাড়তে পারে। আরেকটি অন্যতম উপায় হলো শেডে লিটারের মধ্যে এই অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম উৎসগুলো সরবরাহ করা হয়। তাছাড়া লিটারে বেশি পরিমাণ ক্যালসিয়াম গ্রহণ করালে সেলের কোয়ালিটিতে নীতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যদি লিটারে ক্যালসিয়াম সরবরাহ করা হয় তাহলে অতিরিক্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম ফিডে সরবরাহ করা যাবে না, যে পর্যন্ত লিটারে ক্যালসিয়াম অবশিষ্ট থাকে। ম্যাস ফিড ব্যবহৃত হলে বড় আকারের চূর্ণ খাবারের সাথে সহজে মানিয়ে যায় না।
পর্যাপ্ত পরিমাণ ফসফরাসের সরবরাহ মুরগির হাড়ের গঠন এবং ডিমের খোলস গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত পরিমাণে ফসফরাস ডিমের সেল গঠনে এবং হ্যাচাবিলিটিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যথাযথ মাত্রায় ফিডে ফসফরাস সরবরাহ ডিমের কোয়ালিটি সঠিক মাত্রায় রাখতে সহায়তা করে। সোডিয়াম, পটাশিয়াম এবং ক্লোরাইড প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মাত্রায় সরবরাহ করলে ফ্লকের পানি গ্রহণ বৃদ্ধি পায়। লিটারের মান কমে এবং ডিমের সেল গঠনে নীতিবাচক ভূমিকা রাখে। এসব সমস্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য উপরে বর্ণিত মূখ্য খনিজ লবণের পরিমাণ নির্দিষ্ট মাত্রায় রাখতে হবে।
ফিডে অতিরিক্ত পরিমাণে ফাইটেজ এনজাইম ব্যবহার করে ফসফরাস মুক্ত করা হয়। সর্বোচ্চ ডিমের উৎপাদনে আসার পর ঠিক কোন সময়ে ফিডের পরিমাণ কমাতে হবে তা কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। উৎপাদনের সময় এবং কি পরিমাণ খাবার কমাতে হবে তা নিচে দেয়া হলো।
প্রতিদিনের ডিমের ওজন এবং ডিমের ওজনের গড় বয়সের সাথে ডিমের ওজন ও ওজনের গড়ের আদর্শ মান থাকে। ফিড পরিষ্কারের সময় পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করতে হবে। প্রতিদিনের ওজন এবং ওজনের পরিবর্তন তা অবশ্যই কাক্সিক্ষত মানের সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে। প্রতিদিনের পরিবর্তিত ফিড পরিষ্কারের সময়। পরিছন্ন সময় বলতে ফিড দেয়া থেকে শুরু করে তা শেষ হওয়া পর্যন্ত। ম্যাস ফিডের ক্ষেত্রে সময়টা ৩-৪ ঘণ্টা এবং টুকরা টুকরা ফিডের ক্ষেত্রে ২-৩ ঘণ্টা ও পিলেটের ক্ষেত্রে ১-২ ঘণ্টা সময় লাগে। এই সময়ের চেয়ে কম বা বেশি সময় লাগলে এখানে ফিডের সরবরাহ খুব বেশি কিংবা খুব কম তা নিশ্চিত করে। তা ছাড়া ফার্ম ম্যানেজারের উচিত সময়তো বার্ড হ্যান্ডেল এবং পরীক্ষা করা স্বাস্থ্য ভালো আছে কিনা তা নিশ্চিত করা।
পিক লেভেলে আসে ৩১ সপ্তাহ বয়সে। অনেক সময় কোন কোন ফ্লকের উৎপাদন ক্ষমতা ব্যাপক পরিমাণে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পরিবর্তিত হয় এবং এমন অবস্থায় ফিড কমানো প্রোগ্রামকে প্রয়োজনমতো পরিবর্তন করে নিতে হয়। পিক লেভেলের পরে ডিমের ওজন এবং পোল্ট্রির দৈহিক ওজন পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ রাখা প্রধান কাজ। ফিড কমানো প্রোগ্রাম এমনভাবে নির্দিষ্ট করতে হবে যেন প্রতি সপ্তাহে ১৫-২০ গ্রাম ওজন বৃদ্ধি পায়। এতে ডিমের উৎপাদন, ডিমের ওজন এবং দৈহিক ওজন সঠিক মানে থাকে। এই সময়ে অস্বাভাবিক দৈহিক ওজন বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে উৎপাদন কমে যেতে পারে। ডিমের আকার আকৃতিতে সমস্যা হতে পারে। পরিশেষে উপরোক্ত বিষয় সঠিকভাবে পালন করলে লেয়ারের ডিম উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ ডিমের সংখ্যা বাড়বে। খামারের লাভজনক অবস্থা ধরে রাখা সহজ হবে। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তিতে প্রাণিসম্পদের কার্যক্রম আরো বেগবান হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক সেক্টর উন্নয়ন হবে।
লেখক : প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাঁসপাতাল, ভোলাহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মোবাইল- ০১৭১৬১২৬৩২৪
সুস্থ পরিবেশে উন্নত জীবন
ভালো পরিবেশই সবার উন্নত জীবন,
স্বর্গীয় প্রয়াসে মিষ্টি মধুর পরিবেশ আকিঞ্চন।
দ্রুম-শাখি সুশোভিত পাখালির ডাকে,
আনন্দময়ী বার্তাবহ কুলু কুলু গাঙের বাঁকে।
তারপর মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত চলা বলা,
অমিয় জ্যোস্না ছড়ানো স্নিগ্ধ পরিবেশ কলা
ফুলে-ফলে আদূরে অধরা দেহবিজ্ঞান,
উন্নত জীবনে পুলকিত মনে তানসেনের গান।
স্রষ্টার সৃষ্ট পরিবেশ উপযুক্ত অকুস্থলে,
মানব অনাচারেই অনুন্নত গত ইতিহাস বলে।
আমাদের পরিবেশে আমরা অবগাহি,
সুজীবনাচারে ভালো পরিবেশের বিকল্প নাহি।
সমুন্নত পরিবেশ হউক আমাদের সৃষ্টি,
যেমন সামাজিক দূরত্ব ও মাস্ক পরিধান কৃষ্টি।
জননীর অঙ্কপরে উন্নত পরিবেশ গড়ি,
উন্নত পরিবেশেই সমুন্নত জীবনকালের ঘড়ি।
বিধি বৈধ বিরচন হৃদে ঠাঁই সাধু জ্ঞানে,
ভালোর বিকল্প শুধু ভালো তা হৃদয় জানে।
টাকায় টাকা বাড়ে, রোগে বাড়ে রোগ,
ভালো উৎপাদনে সবার ভালো পুষ্টি যোগ।
কলুষিত কোনো কিছু যে সুধাতুল্য নয়,
ভেজাল উৎপাদন খেতে সবার বড় ভয়।
তাই যে ভালো উৎপাদনে ভালো পুষ্টি,
ভালোতেই ভালো কুসুমেই আত্মতুষ্টি।
যথারীতি সার, সেচ ও যত্ন উৎপাদনে,
এ খাদ্য অনবদ্য স্বাদ ও পূর্ণপুষ্টি আনয়নে।
পুষ্টিতে সৃষ্টি সাবলীল স্বাস্থ্য মঙ্গল যার,
রোগ প্রতিরোধ সুনীতি বোধ করে অহংকার।
বিজ্ঞানসম্মত খাঁটি পরিপাটি উৎপাদন,
পূর্ণ পুষ্টিতে সৃষ্ট সুস্থ দেহে সুস্থ মন বিরাজন।
বিশুদ্ধ ভালো উৎপাদনেই সবার তুষ্টি,
সুস্থ সবল সুন্দর মানুষ সৃজনে অমোঘ পুষ্টি।
ডিজিটাল চাষাবাদ
পোষের শীত মোষের গায়
মাঘে বাঘের চামড়া
কাঁপায়শুনি, চাষার শক্ত হাড়
ভয় করিনে আমরা।
বুড়ির ঘর পোড়া বিচল
দস্যি ছেলের দল,
মথ, পর্দা ক্ষতিকারক
পোকার চিতানল !
ঔই যে দূরে সবজি ক্ষেতে
মুলা, গাজর, লাউ
ফুলকপি, বাঁধাকপি,
শালগম লাউ।
নানান জাতের গোল আলু
আলতারাঙা টমেটো,
ফাঁক খুঁজছে, তাক করছে
ভব ঘুরে টো টো।
শীতের পালং দারুণ মজা
সঙ্গে তাজা শিম
বল বর্ধক, পুষ্টি গুণে
চাষির ছেলে ‘ভীম!’
ডাল ফসলে তেল ফসলে
রেশমী মেঠো চাদর
আমিষ পাবি যতো চাবি
করনা একটু আদর!
কীটনাশকের বিষে শরীর
দিসনে হায় বিষিয়ে,
বোবা কান্না বুকে আনাজ
বলছে ফিসফিসিয়ে!
বিষ টোপ, সেক্সফেরোমন
ফাঁদ পেতে চাষা
অপকারী পোকা-মাকড়
মারতে পারো খাসা!
সবাই মিলে একযোগে
আইপিএম এর ফেরে
শত্রু পোকা দমন করো
ছক্কাতুড়ি মেরে।
দূষণমুক্ত পরিবেশে
নিরাপদ তরকারি,
সুস্থ দেহে সুস্থ মন
আজকে বড়ো দরকারী।
মান্ধাতা সে আমলের
ধ্যানধারণা দাও বাদ,
ডিজিটাল বাঙলায়
ডিজিটাল চাষাবাদ।
লেখক : ১পরিচালক (উপসচিব) আইএমইডি, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১২৮২২৭৪৯, ই-মেইল : insanuzzaman12@gmail.com ২উপসহকারী কৃষি অফিসার (অবঃ), পি. সি.কলেজ বাগেরহাট, মোবাইল : ০১৭৩১-২৭৪৯৮৫।
তথ্য ও প্রযুক্তি পাতা
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জর হোসেন
বোরো ধান
* ধানের চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর প্রথম কিস্তি, ৩০-৪০ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তির ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করুন।
* বোরো ধানে অল্টারনেট ওয়েটিং ও ড্রায়িং (অডউ) পদ্ধতিতে সেচ দিন।
* রোগ ও পোকা থেকে ধান গাছকে বাঁচাতে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রয়োগ করুন।
* ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করুন।
* আলোর ফাঁদ ব্যবহার করে পোকা দমন করুন।
* রোগ ও পোকা দমনে অনুমোদিত বালাইনাশক ব্যবহার করুন।
গম
* গমের জমিতে যেখানে ঘন চারা রয়েছে তা পাতলা করে দিন।
* গম গাছ থেকে যদি শীষ বেড় হলে বা গম গাছের বয়স ৫৫-৬০ দিন হলে জরুরিভাবে গমক্ষেতে সেচ দিন।
* ভালো ফলনের জন্য দানা গঠনের সময় আরেকবার সেচ দিন।
* গমক্ষেতে ইঁদুর দমনের কাজটি সকলে মিলে একসাথে করুন।
ভুট্টা
* ভুট্টাক্ষেতে গাছের গোড়ার মাটি তুলে দিন।
* গোড়ার মাটির সাথে ইউরিয়া সার ভালো করে মিশিয়ে দিয়ে জমিতে একটি সেচ দিন।
* গাছের নিচের দিকের মরা পাতা ভেঙে দিতে হবে।
আলু
* আলু ফসলে নাবি ধসা রোগ দেখা দিতে পারে। সে কারণে স্প্রেয়িং শিডিউল মেনে চলুন।
* মড়করোগ দমনে দেরি না করে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক (২ গ্রাম এক্সট্রামিল অথবা ডায়থেন এম ৪৫ অথবা সিকিউর অথবা মেলুডি ডুও প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে) নিয়মিত স্প্রে করুন।
* মড়ক লাগা জমিতে সেচ দেয়া বন্ধ রাখুন।
* আলু গাছের বয়স ৯০ দিন হলে মাটির সমান করে গাছ কেটে দিন এবং ১০ দিন পর পটেটো ডিগার দিয়ে আলু তুলে ফেলুন।
* আলু তোলার পর ভালো করে শুকিয়ে বাছাই করুন এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিন।
তুলা
* তুলা সংগ্রহের কাজ এ মাস থেকেই শুরু করতে হবে।
* শুরুতে ৫০% বোল ফাটলে প্রথম বার, বাকি ফলের ৩০% পরিপক্ব হলে দ্বিতীয়বার এবং অবশিষ্ট ফসল পরিপক্ব হলে শেষ অংশের তুলা সংগ্রহ করুন।
গাছপালা
* শীতে গাছের গোড়ায় নিয়মিত সেচ দিন।
* গোড়ার মাটি আলগা করে দিন এবং আগাছামুক্ত রাখুন।
* আম গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার আগে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক (টিল্ট-২৫০ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি অথবা ১ মিলি কন্জা প্লাস অথবা ২ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে) স্প্রে করুন। আমের আকার মটর দানার মতো হলে গাছে ২য় বার স্প্রে করুন।
* আম গাছের হপার পোকা দমনের জন্য মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার পূর্বেই অনুমোদিত কীটনাশক (প্রতি লিটার পানির সাথে ১.০ মিলি সিমবুস/ফেনম/ডেসিস ২.৫ ইসি মিশিয়ে) গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপাল ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করুন।
* ফলগাছে স্প্রে করার জন্য ফুটস্প্রেয়ার ব্যবহার করুন।
বিবিধ
* উচ্চমূল্যের ফসল যেমন- ব্রোকলি, স্ট্রবেরি, ক্যাপসিকাম, তরমুজ এসব আবাদ করুন অধিক লাভবান হন।
* স্বল্পকালীন ও উচ্চফলনশীল জাত নির্বাচন করুন অধিক ফসল ঘরে তুলুন।
* আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করুন; শ্রম, সময় ও খরচ সাশ্রয় করুন।
কৃষি বিষয়ক যে কোনো বিষয় জানতে নিকটস্থ উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করুন অথবা কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি কল সেন্টার ১৬১২৩ নম্বরে কল করুন।
লেখক : তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৯১১০১৯৬১০, ই-মেইল : manzur_1980@yahoo.com
প্রশ্নোত্তর
কৃষিবিদ ড. মো. তৌফিক আরেফীন
কৃষি বিষয়ক
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুণ।
আরিফ মণ্ডল, গ্রাম: কালিগঞ্জ, উপজেলা: জলঢাকা, জেলা: নীলফামারী
প্রশ্ন: আলুর কাটুই পোকা দমন সম্পর্কে জানাবেন।
উত্তর: এই পোকার কীড়া দিনে মাটির নিচে লুকিয়ে থাকে এবং রাতে চারা গাছ কেটে দেয়। এ ছাড়া আলুতে ছিদ্র করে আলু ফসলের ক্ষতি করে। আক্রান্ত কাটা আলু গাছ দেখে তার কাছাকাছি মাটি উল্টে-পাল্টে কীড়া খুঁজে সংগ্রহ করে মেরে ফেলা দরকার। কাটুই পোকার উপদ্রব কমানোর জন্য কার্বোফুরান গ্রুপের যেমন ফুরাডান ৫জি প্রতি হেক্টরে ২০ কেজি জমি তৈরির সময় এবং শেষ সেচের পূর্বে প্রয়োগ করলে এই পোকার আক্রমণ কমে যায়। এ ছাড়া প্রতি লিটার পানির সাথে ক্লোরোপাইরফস ২০ ইসি জাতীয় কীটনাশক ৫ মিলি হারে মিশিয়ে গাছের গোড়া ও মাটিতে স্প্রে করে ভিজিয়ে দিতে হবে। আর এ কাজটি আলু লাগানোর ৩০-৪০ দিন পর করতে হবে। আশা করি এসব ব্যবস্থা নিলে আপনি উপকার পাবেন।
মো. সিরাজুল ইসলাম, গ্রাম: তাম্বুলখানা, উপজেলা: ফরিদপুর সদর, জেলা: ফরিদপুর
প্রশ্ন: সরিষার কাণ্ডপচা রোগ দমনে কী করণীয় ?
উত্তর: সরিষার কাণ্ডপচা রোগটি বীজ ও মাটিবাহিত। সে কারণে জমিতে সরিষা বীজ বপনের আগে ভালো উৎস থেকে বীজ ক্রয় করা এবং সরিষা চাষের জমির মাটি ভালোভাবে চাষ করা দরকার। এ ছাড়া যদি সরিষার আবাদকৃত জমিতে আগের বছরে এ রোগ হয়ে থাকে তবে জমি গভীরভাবে চাষ করা। তারপরও যদি জমিতে এ রোগ দেখা দেয় তবে ইপ্রোডিয়ন গ্রুপের যেমন: রোভরাল ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করা। আর এ স্প্রে করতে সরিষা গাছের বাড়ন্ত পর্যায়, ফুল ও পড ধরার পর্যায়ে তাহলে সরিষার কাণ্ডপচা রোগটি হবে না। আপনি লাভবান হবেন।
হামিদ হোসেন, গ্রাম: পাটগা মুন্সিপাড়া, উপজেলা: রানীশংকৈল, জেলা: ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন: জমিতে পেঁয়াজ পচা রোধে কী করব?
উত্তর: সুস্থ ও রোগমুক্ত বীজ ও চারা রোপণ করতে হবে। এ ছাড়া আক্রান্ত গাছগুলো তুলে ধ্বংস করতে হবে। পানি নিকাশের জন্য ড্রেন রাখার পাশাপাশি রোগের লক্ষণ দেখা দিলে কার্বেনডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন- প্রোভ্যাক্স-২০০, নোইন বা ব্যাভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম করে মিশিয়ে পেঁয়াজ গাছের গোড়াতে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। প্রতি ৭ থেকে ১০ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার সঠিক নিয়মে আপনি ছত্রাকনাশক স্প্রে করলে উপকার পাবেন।
ইছাহাক আলী, গ্রাম: সাকোয়া উপজেলা: বোদা, জেলা: পঞ্চগড়
প্রশ্ন: লেটুস চাষাবাদে সারের প্রয়োগ মাত্রা সম্পর্কে জানাবেন।
উত্তর: লেটুস চাষাবাদের জন্য হেক্টরপ্রতি ১০ টন গোবর, ২০০ কেজি ইউরিয়া, ৭৫ কেজি এমওপি ও টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হয়। লেটুস স্বল্পমেয়াদি ফসল বিধায় সব সার ফসল লাগানোর আগে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হয়। তবে পরিস্থিতিভেদে ইউরিয়ার এক অংশ উপরিপ্রয়োগ করতে হয় এবং ফসলে নিয়মিত সেচ দিতে হয়। এভাবে সার প্রয়োগ করলে আপনি সুফল পাবেন।
সুমন মজুমদার, গ্রাম: নারায়ণপুর, উপজেলা: কেশবপুর, জেলা: যশোর
প্রশ্ন: লিচু গাছের পাতায় মাকড়ের আক্রমণ হলে কী করণীয়?
উত্তর: লিচু গাছের পাতা, ফুল ও ফলে মাকড়ের আক্রমণ দেখা যায়। মাকড় আক্রমণ করলে পাতা কুঁকড়িয়ে যায় এবং পাতার নিচের দিক লাল মখমলের মতো হয়ে যায়। পাতা দুর্বল হয়ে মারা যায়। আক্রান্ত ডালে ফুল, ফল ও পাতা হয় না। এমনকি আক্রান্ত ফুলে ফল হয় না। রোগ দমনে ফল সংগ্রহের সময় মাকড় আক্রান্ত পাতা ডালসহ ভেঙে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। মাকড় দমনে মাকড়নাশক এবামেকটিন গ্রুপের যেমন ভার্টিমেক/এবাটিন প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি মিশিয়ে সঠিক নিয়মে নতুন পাতায় ১৫ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
মো. রুবেল ইসলাম, গ্রাম: খাটুরিয়া, উপজেলা: ডোমার, জেলা: নীলফামারী
প্রশ্ন: চন্দ্রমল্লিকা ফুলে সাধারণত কী কী ধরনের রোগ হয়ে থাকে? প্রতিকার কী?
উত্তর: চন্দ্রমল্লিকা ফুলে সাধারণত পাউডারি মিলডিউ ও পাতায় দাগ পড়া রোগ হয়ে থাকে। পাউডারি মিলডিউ রোগ হলে চন্দ্রমল্লিকার পাতার উপরে সাদা থেকে ধুসর গুঁড়ার মতো আবরণ পড়ে। পাতা আস্তে আস্তে কুঁকড়িয়ে বিকৃত হয়ে যায়। আর বেশি আক্রমণ হলে গাছ শুকিয়ে মারা যায়। গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এ রোগ বেশি হয়। সেজন্য সঠিক রোপণ দূরত্ব অনুসরণ করা দরকার এ ছাড়া রোগের আক্রমণ বেশি হলে কার্বেনডাজিম গ্রুপের ব্যাভিস্টিন বা সালটাফ ১/২ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়। চন্দ্রমল্লিকা ফুল গাছের পাতায় দাগ পড়া রোগের ক্ষেত্রে নিচের পাতায় প্রথমে হলদে দাগ পড়ে। রোগের আক্রমণ বেশি হলে পাতার দাগগুলো বাদামি থেকে কালো দাগে পরিণত হয়। এ রোগ দমনেও কার্বেনডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন ব্যাভিস্টিন ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে এ রোগ সহজে দমন করা যায়।
মৎস্যসম্পদ
মো. আলমগীর কবির, গ্রাম: নকিপুর, উপজেলা: শ্যামনগর, জেলা: সাতক্ষীরা
প্রশ্ন: মাছের পেট ফুলে গিয়েছে কী করব?
উত্তর : নিম্নমানের খাবারের উপাদান বা খাবারের ব্যবহার, খাবারের ডাইজেশন কম হওয়া এবং ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এই রোগ হয়। মাছের খাবার গ্রহণের অনীহা, পানির উপরে ভাসতে থাকা ও মাছের পেট অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যাওয়া। মাছকে পুষ্টিমান সম্পন্ন খাবার সরবরাহ করতে হবে, পুকুরে প্রতি শতাংশে ২০ গ্রাম টিমসেন ব্যবহার করতে হবে, খাবারের সাথে অক্সিটেট্রাসাইক্লিন গ্রুপের এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে ও পুকুরে গ্যাস নিয়ন্ত্রণের জন্য মেট্রিক্স ব্যবহার করতে হবে।
মো. জিয়াউর রহমান, গ্রাম: টেপিবাড়ি, উপজেলা: ভুয়াপুর, জেলা: টাঙ্গাইল
প্রশ্ন: মাছের দেহে সাদা দাগ বা ফুটকি রোগ দেখা যাচ্ছে। এর প্রতিকার কী?
উত্তর: মাছের মাথা, পৃষ্ঠদেশ ও পাখনায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোলাকার সাদা দাগ বা ফুটকি দেখা দিলে মাছের দেহে অতিরিক্ত পিচ্ছিল পদার্থ জমা হয়। মাছ অলসভাবে চলাফেরা করে এবং মাছ খাদ্য গ্রহণ করে না। বেশি আক্রান্ত হলে মাছগুলো দ্রুত মারা যায়। এ জন্য আক্রান্ত মাছকে ২ থেকে ৩% লবণ পানিতে ৩০ মিনিট বা ৫% অ্যামোনিয়াম সালফেট দ্রবণে ১ মিনিট ডুবিয়ে রেখে পুকুরে ছাড়তে হবে। এছাড়া এ সমস্যা রোধে পুকুর প্রস্তুতির সময় পরিমিত পরিমাণ চুন প্রয়োগ করতে হবে। আর নিরাময় পুকুরের প্রতি শতকে ১ মিটার গভীরতার জন্য ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম পটাশিয়াম প্যারম্যাঙ্গানেট পানিতে গুলে পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। তবে আপনি ভবিষ্যতে এ রোগ থেকে রেহাই পাবেন।
প্রাণিসম্পদ
জাহাঙ্গীর আলম গ্রাম : খালিশপুর, উপজেলা: পাবনা সদর, জেলা: পাবনা
প্রশ্ন: আমার গাভীর গর্ভধারণের ৫ মাস পর গর্ভপাত হয়ে যায়। এভাবে ২ বার হয়েছে। এমতাবস্থায় কী করণীয় ?
উত্তর: আক্রান্ত গাভীকে জেন্টামাইসিন অথবা অক্সিটেট্রাসাইক্লিন গ্রুপের ইনজেকশন দিতে হবে সাথে এন্টিহিস্টামিনিক গ্রুপের ইনজেকশন দিতে হবে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে খামারের বা বাড়িতে নতুন পশু আমদানির ক্ষেত্রে প্রথমে আলাদা স্থানে রেখে রোগ নির্ণয় করে জীবাণুর উপস্থিতি নিশ্চিত হলে পশুকে মেরে ফেলে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। ব্রসেলা আক্রান্ত পশু পরীক্ষা করতে হলে পরীক্ষার আগে ও পরে হাত জীবাণুনাশক দ্বারা ধৌত করতে হবে। ব্রুসেলা আক্রান্ত পশুর চারপাশের পরিবেশ জীবাণুনাশক দ্বারা পরিষ্কার করতে হবে।
রাজন রয়, গ্রাম: নিন্দুয়ার, উপজেলা: বালিয়াডাঙ্গি, জেলা: ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন: আমার টার্কির বয়স ৩ মাস। সবুজ রঙের পায়খানা হচ্ছে। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। কী করব?
উত্তর: সিফ্লোফ্লক্সাসিন অথবা ডেন্টামাইসন গ্রুপের ওষুধ খাওয়াতে হবে। সাথে খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। টার্কিকে ফাউল কলেরার ভ্যাকসিন দিতে হবে।
(মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক প্রশ্ন কৃষি কল সেন্টার হতে প্রাপ্ত)
কৃষির যে কোন প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান পেতে বাংলাদেশের যে কোন জায়গা থেকে যে কোনো মোবাইল থেকে কল করতে পারেন আমাদের কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ নাম্বারে।
*উপপরিচালক (হর্টিকালচার), জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমি (নাটা), কৃষি মন্ত্রণালয়, মোবাইল : ০১৭১১১১৬০৩২, ই-মেইল : taufiquedae25@gmail.com
ফাল্গুন মাসের কৃষি
(১৪ ফেব্রুয়ারি-১৪ মার্চ)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
ফাল্গুন মাস, ঋতুরাজ বসন্তের সূচনা। বসন্তের আগমনের সাথে সাথে বিভিন্ন গাছে নতুন ফুল ফোটে। সৌরভ ও সৌন্দর্যে কীটপতঙ্গ ও প্রজাপতির ছোটাছুটিতে প্রকৃতি সাজে নতুন রূপে। ঋতু পরিবর্তনের সাথে আমাদের কৃষিতেও পরিবর্তন সূচিত হয়। কৃষকরা উদ্যমী হয়ে নতুন চাষাবাদে আগ্রহী হয়। কৃষক ভাইবোনেরা আসুন জেনে নেই ফাল্গুন মাসের কৃষিতে করণীয় যা আছে।
বোরো ধান
ধানের চারার বয়স ৫০-৫৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সার দেয়ার আগে উইডার দিয়ে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে। ধানের কাইচ থোড় আসা থেকে শুরু করে ধানের দুধ আসা পর্যন্ত ক্ষেতে ৩/৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে। পোকা দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে (আলোর ফাঁদ পেতে, পোকা ধরার জাল ব্যবহার করে, ক্ষতিকর পোকার ডিমের গাদা নষ্ট করে, উপকারী পোকা সংরক্ষণ করে, ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করে) ধানক্ষেত বালাইমুক্ত রাখতে হবে। এ সময় ধানক্ষেতে উফরা, ব্লাস্ট, পাতাপোড়া ও টুংরো রোগ দেখা দেয়। জমিতে উফরা রোগ দেখা দিলে যেকোন কৃমিনাশক যেমন-ফুরাডান ৫ জি বা কিউরেটার ৫ জি প্রয়োগ করতে হবে। ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে এবং একরপ্রতি ১৬০ গ্রাম ট্রুপার বা জিল বা ন্যাটিভ বা ব্লাসটিন ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে দু’বার প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে পাতাপোড়া রোগ হলে অতিরিক্ত ৫ কেজি/বিঘা হারে পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে এবং জমির পানি শুকিয়ে ৭-১০ দিন পর আবার সেচ দিতে হবে। টুংরো রোগ দমনের জন্য এর বাহক পোকা সবুজ পাতাফড়িং দমন করতে হবে।
গম
এ মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম পাকা শুরু হয়। গম শীষের শক্ত দানা দাঁত দিয়ে কাটলে যদি কট কট শব্দ হয় তবে বুঝতে হবে গম কাটার সময় হয়েছে। কম্বাইন হারভেস্টার এর মাধ্যমে সকালে অথবা পড়ন্ত বিকেলে ফসল কাটা উচিত। বীজ ফসল কাটার পর রোদে শুকিয়ে সংগ্রহ করা বীজ ভালো করে ঠান্ডা করে সংরক্ষণ করতে হবে।
ভুট্টা (রবি)
জমিতে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ গাছের মোচা খড়ের রঙ ধারণ করলে এবং পাতার রঙ কিছুটা হলদে হলে মোচা সংগ্রহ করতে হবে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে শুকনো আবহাওয়ায় মোচা সংগ্রহ করে ফেলতে হবে। সংগ্রহ করা মোচা ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। মোচা সংগ্রহের পর উঠানে পাট বিছিয়ে তার উপর শুকানো যায় অথবা জোড়া জোড়া বেঁধে দড়ি বা বাঁশের সাথে অথবা টিনের চাল বা ঘরের বারান্দায় ঝুলিয়ে শুকানোর কাজটি করা যায়। মোচা থেকে দানা সংগ্রহ করতে প্রয়োজনে ভুট্টা মারাই যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে।
ভুট্টা (খরিপ)
খরিপ মৌসুমে ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এখনই বীজ বপন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে হবে। বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৭ প্রভৃতি ভুট্টার উন্নত জাত।
পাট
ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত পাটের বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। ফাল্গুন মাসে বপন উপযোগী পাটের ভালো জাতগুলো হলো সিসি-৪৫, বিজেআরআই দেশী পাট শাক-১ (বিজেসি-৩৯০), ফাল্গুনী তোষা (ও-৯৮৯৭), বিজেআরআই তোষা পাট-৪ (ও-৭২)। পাট চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করে আড়াআড়িভাবে ৫-৬টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। সারিতে বুনলে প্রতি শতাংশে ২৫ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বুনলে আরেকটু বেশি অর্থাৎ ৩০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। পাটের জমিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার (প্রায় ১ ফুট) এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৭ সেন্টিমিটার (প্রায় ৩ ইঞ্চি) রাখা ভালো। ভালো ফলনের জন্য প্রতি একরে ৭০ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি, ১২ কেজি এমওপি, ১৮ কেজি জিপসাম এবং প্রায় ৪.৫ কেজি জিংকসালফেট সার প্রয়োগ করতে হবে।
শাকসবজি
এ মাসে বসতবাড়ির বাগানে জমি তৈরি করে ডাঁটা, কমলিশাক,
পুঁইশাক, করলা, ঢেঁড়স, বেগুন, পটোল চাষের উদ্যোগ নিতে হবে। মাদা তৈরি করে চিচিঙ্গা, ঝিঙা, ধুন্দুল, শসা, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়ার বীজ বুনে দিতে পারেন। সবজি চাষে পর্যাপ্ত জৈবসার ব্যবহার করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে জৈবসার ব্যবহার করলে সবজি ক্ষেতে রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না।
গাছপালা
আমের মুকুলে অ্যানথ্রাকনোজ রোগ এ সময় দেখা দেয়। এ রোগ দমনে গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার পূর্ব পর্যন্ত আক্রান্ত গাছে প্রোপিকোনাজল অথবা মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এ ছাড়া আমের আকার মটর দানার মতো হলে গাছে ২য় বার স্প্রে করতে হবে। এ সময় প্রতিটি মুকুলে অসংখ্য হপার নিম্ফ দেখা যায়। আমগাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার আগেই একবার এবং এর এক মাস পর আর একবার সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক পানির সাথে মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপালা ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। কাঁঠালের ফল পঁচা বা মুচি ঝরা সমস্যা এখন দেখা দিতে পারে। কাঁঠাল গাছ এবং নিচের জমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আক্রান্ত ফল ভেজা বস্তা জড়িয়ে তুলে মাটিতে পুঁতে ধ্বংস করতে হবে। মুচি ধরার আগে ও পরে ১০ দিন পর পর ২/৩ বার বোর্দো মিশ্রণ বা মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। বাডিং পদ্ধতিতে বরই গাছের কলম করতে পারেন। এজন্য প্রথমে বরই গাছ ছাঁটাই করতে হবে এবং পরে উন্নত বরই গাছের মুকুল ছাঁটাই করে দেশি জাতের গাছে সংযোজন করতে হবে।
প্রাণিসম্পদ
এ সময় মুরগির রাণীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। সে কারণে প্রয়োজনীয় টিকা প্রদান করতে হবে। খাবারের সাথে
ভিটামিন সি ও ভিটামিন ই সরবরাহ করতে হবে। এসময় গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ (এলএসডি), পক্স,
ফুট এন্ড মাউথ ডিজিড (এফএমডি) ভাইরাস সংক্রমণে এক গরু হতে আরেক গরুতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলে দ্রুত প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। গবাদিপশুকে প্রয়োজনীয় ভ্যাক্সিন দিতে হবে এবং কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে। গবাদিপশুকে উন্নত খাবার যেমনÑসবুজ ঘাস, ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র, ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক এসব খাওয়াতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
মাছ চাষের জন্য পুকুর তৈরি ও সংস্কার করার উপযুক্ত সময় এখন। পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলে নিচ থেকে পচা কাদা তুলে ফেলতে হবে এবং শতাংশপ্রতি ১ কেজি চুন ও ১০ কেজি গোবর বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করতে হবে। পানি ভর্তি পুকুরে প্রতি শতাংশে ৬ ফুট পানির জন্য ১ কেজি চুন গুলে ঠান্ডা করে দিতে হবে। এ ছাড়া শতাংশপ্রতি ১০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি একসাথে মিশিয়ে পানি ভর্তি পুকুরে দিতে হবে। শীতের পর এ সময় মাছের বাড়বাড়তি দ্রুত হয়। তাই পুকুরে প্রয়োজনীয় খাবার দিতে হবে এবং জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
সুপ্রিয় পাঠক, কৃষিকথায় প্রতি বাংলা মাসে কৃষি কাজে অনুসরণীয় কাজগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়। এগুলোর বিস্তারিত ও তথ্যবহুল বিশ্লেষণের জন্য আপনার কাছের কৃষি বিশেষজ্ঞ, মৎস্য বিশেষজ্ঞ ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে জেনে নিতে হবে। এ ছাড়াও কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি কল সেন্টার ১৬১২৩ নম্বরে কল করে জেনে নিতে পারেন। আমাদের সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা কৃষিকে নিয়ে যাবে সাফল্যের শীর্ষে। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা।
লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা, টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪, মেইল: editor@ais.gov.bd