সূচিপত্র
নিবন্ধ/প্রবন্ধ
বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২৩- মাটি ও পানি : জীবনের উৎস ৩
মোঃ জালাল উদ্দীন
খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা ৫
ড. মো: নূরুল হুদা আল মামুন
ফসলের খাদ্যাপাদানের অভাবজনিত লক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সার ব্যবহার ৭
ড. উৎপল কুমার
পাহাড়ি ঢালে ভূমিক্ষয় নিয়ন্ত্রণে কার্যকর প্রযুক্তি ৯
কৃষিবিদ প্রসেনজিৎ মিস্ত্রী
স্মার্ট ফসল, স্মার্ট মাটি ও স্মার্ট উদ্ভাবনী চিন্তায় বাঁচাও ধরিত্রি ১১
ড. মোঃ আব্দুল আউয়াল, ড. মোঃ জাকির হোসেন
মৃত্তিকার স্বাস্থ্য রক্ষায় ভার্মিকম্পোস্ট প্রযুক্তি ১৩
ড. মো: আজিজুল হক
টেকসই কৃষি উৎপাদনে মাটির দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সুরক্ষা ১৬
মো: মোহসীন ফরাজী
মানসম্পন্ন আদা উৎপাদন ও সংরক্ষণে লাগসই কৌশল ১৮
ড. মো. আলাউদ্দিন খান, ড. মো. আশিকুল ইসলাম, মো. মুশফিকুর রহমান
ফলন বৃদ্ধিতে আগাম আখ চাষের কোনো বিকল্প নেই ২১
নিতাই চন্দ্র রায়
কৃষিপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য টেকসই মাটি ব্যবস্থাপনা ২৩
কৃষিবিদ মোঃ মামুন হোসেন
নিরাপদ মধুতে স্বাবলম্বিতা অর্জনে আমাদের করণীয় ২৫
মো. কাওছারুল ইসলাম সিকদার
আগামীর কৃষি ভাবনা
পিট মৃত্তিকা এবং পরিবেশের উপর এর প্রভাব ২৭
হাছিনা আকতার
আধুনিক কৃষিতে জিআইএস ও রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তির ব্যবহার ২৯
মোছাঃ আইরিন পারভীন
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ
ঝঅট স্মার্ট সোলার সান ড্রায়ার : নিরাপদ শুঁটকি মাছ উৎপাদন ও রপ্তানির হাতিয়ার ৩২
মোঃ মাসুদ রানা
বিএলআরআই উদ্ভাবিত মুরগির জাত মিট চিকেন-১ (সুবর্ণ) ৩৪
ড. শাকিলা ফারুক, ড. কামরুন নাহার মনিরা, মো: রাজিউল ইসলাম
সফল কৃষকের গল্প
কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণে সফল একজন কৃষকের গল্প ৩৬
মোহাঃ নুরে আলম
নিয়মিত বিভাগ
প্রশ্নোত্তর ৩৭
কৃষিবিদ আকলিমা খাতুন
পৌষ মাসের কৃষি (১৫ ডিসেম্বর-১৪ জানুয়ারি) ৩৯
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২৩ মাটি ও পানি : জীবনের উৎস
মোঃ জালাল উদ্দীন
বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস (World Soil Day প্রতি বছর ৫ ডিসেম্বর উদ্যাপন করা হয়। ২০০২ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব সয়েল সায়েন্স (IUSS) কর্তৃক মাটি নিয়ে প্রতি বছর একটি উৎসব বা অনুষ্ঠান করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক দিবস নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়। থাইল্যান্ড এর রাজার নেতৃত্বে এবং গ্লোবাল সয়েল পার্টনারশিপ এর কাঠামোর মধ্যে, FAO বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধির প্ল্যাটফর্ম হিসাবে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের আনুষ্ঠানিক যাত্রা বা সূচনাকে সমর্থন করে। ২০১৩ সালের জুন মাসে ঋঅঙ সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস পালনের ধারণাটিকে অনুমোদন করা হয় এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৮তম অধিবেশনে এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদনের অনুরোধ জানানো হয়। ডিসেম্বর ২০১৩ সালে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ৫ ডিসেম্বর ২০১৪ কে প্রথম বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস হিসেবে মনোনীত করে। থাইল্যান্ডের প্রয়াত রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদেজ মৃত্তিকা সম্পদের গুরুত্ব প্রচার-প্রসারের জন্য সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। ৫ ডিসেম্বর থাইল্যান্ডের প্রয়াত রাজার জন্মদিনও বটে। তাঁর অনবদ্য কাজের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এ দিনটিকে বিশ^ মৃত্তিকা দিবস উদ্যাপনের জন্য নির্বাচন করা হয়। সারা বিশ্বে দিনটিকে মাটির স্বাস্থ্য এবং এর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিজ্ঞানী, ছাত্র, কৃষকদেরকে অবহিত ও অনুপ্রাণিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য সুস্থ মাটির গুরুত্বের উপর সংশ্লিষ্ট সবার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা এবং মৃত্তিকা সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার প্রচারণার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য প্রতি বছর আলাদা আলাদা প্রতিপাদ্য (Tteme) ব্যবহার করা হয়।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (SRDI) কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এবারও দেশব্যাপী ৫ ডিসেম্বর ‘বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২৩’ পালন করতে যাচ্ছে। এ বছরের বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের প্রতিপাদ্য “ঝড়রষ ধহফ ডধঃবৎ : Soil and Water : a source of life” যার বাংলা ভাবার্থ-মাটি ও পানি : জীবনের উৎস। মাটি এবং পানির গুরুত্ব সর্ব মহলে অনুধাবনের জন্য এ বছরের প্রতিপাদ্যটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ও সময়োপযোগী হয়েছে বলে মনে করি।
পৃথিবী নামক এ গ্রহকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে রেখে যাওয়ার অঙ্গীকারের প্রেক্ষাপটে মাটি ও পানির গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের খাদ্যের শতকরা ৯৫ ভাগ উৎপাদিত হয় ভূমিতে, যেখানে মাটি ও পানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই সর্বমহলে প্রাকৃতিক সম্পদ মাটি ও পানির পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সমন্বিত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
টেকসই এবং ঘাতসহিষ্ণু কৃষিখাদ্য ব্যবস্থা অর্জনে মৃত্তিকা ও পানির সম্পর্ক আমাদের জানতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এবং ব্যবস্থাপনার প্রতিবন্ধকতাসমূহ এবং পরিবর্তনশীল পরিবেশে মৃত্তিকা ও পানি সম্পদের গবেষণার অগ্রাধিকার ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত করা প্রয়োজন। পানির দুষ্প্রাপ্যতা বা খরা এবং মৃত্তিকা অবক্ষয় রোধের জন্য টেকসই মৃত্তিকা ও পানি ব্যবস্থাপনার প্রসার এবং পারস্পরিক অংশগ্রহণ করা দরকার। ব্যবহারকারীদের কাছে মৃত্তিকা ও পানি সম্পদের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনুশাসনসমূহের পরিচিতি তুলে ধরতে হবে। টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা প্রসার, পানির দুষ্প্রাপ্যতা ও গুণগত মানসম্পন্ন পানির ব্যবহার ও পুনঃব্যবহার এবং মৃত্তিকা দূষণ কমিয়ে আনতে অংশীজনের সাথে যোগাযোগ এবং অংশীদারিত্বের কৌশলগুলো চিহ্নিত করতে হবে।
তাত্ত্বিকভাবে মৃত্তিকা ও পানি নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ হলেও মানুষের অপরিকল্পিত ব্যবহারে মানুষের অস্তিত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট হতে পারে। মৃত্তিকা সৃজনের জন্য শত বছর থেকে লক্ষ বছর পর্যন্ত সময়ের প্রয়োজন হয়। এ অর্থে মৃত্তিকা অনবায়নযোগ্য। প্রাকৃতিক সম্পদ পানির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। মৃত্তিকা ও পানির অবশ্যই যুক্তিসংগত ব্যবহার করতে হবে যেন এটি ভবিষ্যতের জন্য ব্যবহারযোগ্য থাকে। মানব, উদ্ভিদ, প্রাণী ও পরিবেশের জীবনে মৃত্তিকা ও পানি সম্পদের ভূমিকা এবং এদের আন্তঃসম্পর্ক বুঝে এদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন-
মাটির পানিধারণ ক্ষমতা এবং উদ্ভিদের আহরণযোগ্য পানি ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন, সহনীয় মাত্রায় ভূমি অবক্ষয় এবং খরা নিরূপণে মৃত্তিকা জৈব কার্বনকে নির্দেশক হিসাবে ব্যবহারের উপযোগিতা বিশ্লেষণ করা, বৃষ্টিনির্ভর কৃষিতে পানির প্রাপ্যতা এবং মৃত্তিকা কার্বন সঞ্চয়নের জন্য উত্তম মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার চর্চাসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা;
মৃত্তিকা অবক্ষয় প্রতিরোধে দক্ষ সেচ ব্যবস্থাপনা, পুষ্টি যোগানোর জন্য টেকসই পানি ব্যবস্থাপনার বৃত্তাকার অর্থনীতিক পন্থাসমূহ, সেচনির্ভর ব্যবস্থায় মৃত্তিকা লবণাক্ততা হ্রাসে পানির মান নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা এবং উন্নত পুষ্টি ব্যবহার দক্ষতার জন্য উদ্ভাবনী সেচ ব্যবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে।
একটাই স্বাস্থ্য এপ্রোচের (ঙহব ঐবধষঃয ধঢ়ঢ়ৎড়ধপয) মৃত্তিকা স্বাস্থ্য এবং পানির মানের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয় করা। ‘ওয়ান হেলথ এপ্রোচ’ হচ্ছে সমন্বিত এবং সম্মিলিত পন্থা যার লক্ষ্য হচ্ছে টেকসইভাবে মানব, প্রাণী এবং ইকোসিস্টেমের সুষম এবং সর্বোত্তম স্বাস্থ্য অর্জন। এই সহযোগিতামূলক, মাল্টিসেক্টরাল, ট্রান্সডিসিপ্লিনারি এপ্রোচটি স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে কাজ করে এবং মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ এবং তাদের চারপাশের পরিবেশের আন্তঃসম্পর্কের স্বীকৃতি দেয়।
মৃত্তিকা ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন সাধনের জন্য সরকারের উদ্যোগ এবং নীতিগ্রহণ; উদ্ভাবনী প্রযুক্তির বিস্তার যেমন: নির্ভুল কৃষি ((precision agriculture), দূর অনুধাবন (remote sensinৎ) এবং বৃহৎ ডাটা বিশ্লেষণ (big data analytics) প্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধি এবং কার্যকর সমন্বিত মৃত্তিকা ও পানি ব্যবস্থাপনার জন্য জেন্ডার বৈষম্য হ্রাস করা।
খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনাসহ শস্যের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট কর্তৃক বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। যেমন-
পাহাড়ি ঢালে ভূমিক্ষয় নিয়ন্ত্রণ এবং অধিক ও নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য ঝাড়ের বেড়া প্রযুক্তির ব্যবহার।
সারা বছর ফসল উৎপাদন এবং ভূমিক্ষয় নিয়ন্ত্রের জন্য পাহাড়ী ঢালে ধাপ (Bench Terrace) পদ্ধতিতে চাষাবাদ প্রযুক্তি।
ধসে যাওয়া/প্রায় ধসে যাওয়া ভূমি পুনরুদ্বারে জুট-জিও টেক্সটাইল (পাটের চট) প্রযুক্তির ব্যবহার।
লবণাক্ততা কবলিত এলাকায় শুকনো মৌসুমে ফসল চাষের কলস সেচ (Pitcher Irrigation) প্রযুক্তি।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ জমি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততায় বর্ষাকালে শুধুমাত্র আমন ধানের উৎপাদন ছাড়া সারাবছর পতিত থাকে। কারণ শুষ্ক মৌসুমে সেচের পানির স্বল্পতার জন্য চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না। এই পতিত জমিতে বিনা চাষে ডিবলিং এবং চারা রোপণ পদ্ধতিতে ভুট্টা চাষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ফসলের নিবিড়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা সম্ভব।
দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চেলের জেলাসমূহের ঘেরের পাড়ের মাটি ও সার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উচ্চমূল্যের ফসল তরমুজ চাষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে।
মধুপুরগড় অঞ্চল, বরেন্দ্র অঞ্চল এবং পাহাড়ি অঞ্চলের কিছু অংশ অত্যন্ত অম্লীয়। আমাদের দেশে দিন দিন মাটির উর্বরতা ও ফসলের উপর অম্লীয় মাটির বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের অম্লীয় মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে টেকসই ফসল উৎপাদন ও মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি কার্যক্রমসহ নানামুখী ব্যবস্থাপনা নেয়া হয়েছে।
পরিশেষে সুস্থ মাটি সুস্থ জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সে লক্ষ্যে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও অংশীজনসহ সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এভাবে আশা করা যায় টেকসই ভূমি ও মৃত্তিকা সম্পদের লাভজনক ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং মৃত্তিকা স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্ভব হবে। আমি বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২৩ উদ্যাপনের সার্বিক সফলতা কামনা করছি।
লেখক : মহাপরিচালক, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ফোন : ২২২২৪২২২২১, ই-মেইল : dg@srd.gov.bd
খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা
ড. মো: নূরুল হুদা আল মামুন
মানুষের জীবনে মৌলিক চাহিদাগুলো যথা- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মধ্যে প্রথম প্রয়োজনীয় চাহিদা হচ্ছে খাদ্য। বাকি সব উপাদানের সাথে আপস করা গেলেও খাদ্য ছাড়া বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব। পৃথিবীতে মানুষের মাথাপিছু ক্যালরির এক বিরাট অংশ আসে মাটিতে উৎপাদিত বিভিন্ন প্রকার শস্য থেকে। হিসাব করে দেখা গেছে, মাথাপিছু ক্যালরির প্রায় ৯৫ শতাংশ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে মাটি থেকে আসে। এ কারণে মাটির সাথে মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। বিষয়টা মায়ের সাথে শিশুর সম্পর্কের মতো। মায়ের স্বাস্থ্য ভাল থাকলে শিশুর স্বাস্থ্য ভাল থাকে। কিন্তু প্রকৃতির এই অমূল্য সম্পদ মাটিরূপী মায়ের স্বাস্থ্য দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। প্রভাবশালী সাময়িকী ফোর্বস লিখেছে, ‘পৃথিবীতে খুব দ্রুত মাটির গুণাগুণ নষ্ট হওয়ার সংবাদ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য নিঃসন্দেহে দুঃসংবাদ। পুষ্টিকর ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন ভালো ও সুস্থ মাটি।’ বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৩৮ শতাংশ ভূপৃষ্ঠ কৃষিকাজের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। জাতিসংঘের মৃত্তিকা সম্পদ পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত প্রতিবেদন (২০১৫) অনুযায়ী মাটি নষ্ট হওয়াকে পরিবেশ ও কৃষির জন্য বড় ধরনের হুমকি বলে অভিহিত করা হয়েছে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসেবে ইতোমধ্যে বিশ্বের ৩৩ শতাংশ মাটির অবক্ষয় সাধিত হয়েছে, যা উদ্বেগজনক। এ ছাড়া মাটির অবক্ষয়ের কারণে আগামী ২৫ বছরে খাদ্যের দাম ৩০ শতাংশ বাড়ার আশংকা করা হচ্ছে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য খাদ্য চাহিদা দিন দিন বেড়ে চলেছে। প্রতি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭% (বিবিএস-২০১৯)। এ বাড়তি জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে গোটা কৃষকসমাজ হিমসিম খাচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের আবাদি জমির পরিমাণ সীমিত হচ্ছে। এক হিসেবে দেখা যায়, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রতি বছর জমির পরিমাণ কমছে প্রায় ১% হারে। অর্থাৎ বাংলাদেশে বাড়তি জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে অবকাঠামো খাতে প্রতিদিন প্রায় ২২২ হেক্টর করে আবাদি জমি অনাবাদি খাতে চলে যাচ্ছে। এ সীমিত জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে হলে একই জমিতে নিবিড় চাষাবাদে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক সমাজ। বর্তমানে বাংলাদেশের শস্যের নিবিড়তা হলো ২১৪% (বিবিএস-২০২২)। অর্থাৎ একফসলি জমিতে বছরে একটি, দুটি, তিনটি এমনকি চারটি ফসল চাষ করা হচ্ছে। ফলে মাটিতে গাছের জন্য প্রয়োজনীয় ১৪টি পুষ্টি উপাদানের উপস্থিতি আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে, এক হেক্টর জমি থেকে ধান ফসল (ধানের ফলন ৬ টন/হেক্টর ধরে) বছরে ১০৮ কেজি নাইট্রোজেন, ১৮ কেজি ফসফরাস, ১০২ কেজি পটাশিয়াম এবং ১১ কেজি সালফার গ্রহণ করে থাকে। এর অর্থ হলো প্রতি বছর মাটি থেকে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান অপসারিত হয়। কিন্তু সে হারে সুষম মাত্রার জৈব ও রাসয়নিক সার জমিতে ব্যবহার করা হয় না। বরং অসমহারে শুধুমাত্র রাসায়নিক সার ব্যবহারের প্রতিযোগিতা কৃষক সমাজের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। ফলে মাটি উর্বরতা শক্তি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।
আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে মাটিতে মৌলিক উপাদানের ঘাটতি দেখা যায়। বাংলাদেশের মাটিতে নাইট্রোজেনের ঘাটতি দেখা দেয় ১৯৫১ সালে। এরপর ১৯৫৭ সাল থেকে ঘাটতির তালিকায় নাইট্রোজেনের সাথে ফসফরাস যুক্ত হয়। এ তালিকায় পটাশিয়াম যুক্ত হয় ১৯৬০ সালের দিকে। ১৯৮০ সাল থেকে সালফারও ঘাটতির তালিকায় যুক্ত হয়। ১৯৮২ সাল থেকে জিঙ্ক ঘাটতি তালিকায় যুক্ত হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে বোরণ ঘাটতি দেখা দেয়। ২০০০ সাল থেকে ঘাটতির তালিকা আরো দীর্ঘ হয়েছে। বর্তমানে আটটি মৌলিক পদার্থ যেমন নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, জিঙ্ক, বোরণ, ম্যাগনেশিয়াম এবং মলিবডেনামের ঘাটতি নিয়ে চলছে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন। এখন যেভাবে চলছে এ ভাবে কৃত্রিম সার নির্ভর কৃষি উৎপাদন পরিচালিত হলে অদূর ভবিষ্যতে ১৭টি মৌলিক পুষ্টি উপাদান তথা সার প্রয়োগ করে এ দেশে ফসল উৎপাদন করতে হবে বলে বিজ্ঞানীরা আশংকা করছেন। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে সব ধরনের বিশেষ করে আবাদি, বনভূমি, নদী, লেক, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, সুন্দরবন ইত্যাদি এলাকা মিলিয়ে জমির পরিমাণ ১ কোটি ৪৭ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে ফসফরাস ঘাটতিযুক্ত এলাকার পরিমাণ ৬৬ লাখ হেক্টর, যা মোট জমির প্রায় ৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে পটাশিয়ামের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৫২ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর (মোট জমির ৩৫.৭ শতাংশ)। সালফারের ঘাটতি রয়েছে ৬৫ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর (মোট জমির ৪৪.২ শতাংশ)। এর বাইরে বোরনের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৫১ লাখ ১০ হাজার হেক্টর (মোট জমির ৩৪ ৬ শতাংশ)। মোট জমির জৈব পদার্থের ঘাটতি রয়েছে ১ কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর (মোট জমির প্রায় ৭৮.৯০ শতাংশ)। এ ছাড়া অনেক জমিতে রয়েছে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের অভাব।
এ রকম এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে ক্রমাগত ফসল ফলানোর কারণে এবং মাটিকে যথাযথভাবে সার ব্যবহার না করায় উর্বরতা শক্তি নষ্ট হচ্ছে। অপরিকল্পিত চাষাবাদ, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার, ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ, শিল্পায়ন, দূষণ, ব্যাপক হারে বনভূমি ধ্বংস কারণে মাটির উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ইটভাটার জন্য মাটির উপরিভাগের পুষ্টিকর অংশ তুলে নেওয়া ছাড়াও মাটির টেকসই ব্যবস্থাপনার অভাবে ফসলের পুষ্টি উপাদানের ঘাটতির ফলে মৃত্তিকা সম্পদ এখন হুমকির মুখে রয়েছে। এসব কারণে মাটির স্বাস্থ্যহীনতায় এখন প্রতি বছর ফসল উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
দেশে ফসল উৎপাদনে সুষম সার ব্যবহার করা প্রয়োজন। দেশের ৯৮ শতাংশ জমিতে বর্তমানে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়। অনুমান নির্ভর সার ব্যবহার করে থাকেন প্রায় সকল কৃষক। নাইট্রোজেন বা ইউরিয়া সার ব্যবহারে উদ্ভিদের বৃদ্ধি হয়, যা সহজে দৃষ্টিগোচর হয় বলে এর ব্যবহার বেশি। দেশে রাসায়নিক সারের চাহিদা প্রায় ৫০ লাখ টন। শুধুমাত্র ইউরিয়া সার ব্যবহারের পরিমাণ ২৭ লাখ টন এবং অন্যান্য সার মিলে ২৩ লাখ টন। কিন্তু অন্যান্য উপাদান যেমন: ফসফরাস, সালফার, পটাশ, জিংক ইত্যাদির ব্যবহার সুষম নয়। বেশিরভাগ কৃষক জৈবসার কম ব্যবহার করে থাকেন, যার ফলে মাটি রুগ্ন হয়ে যাচ্ছে। পরবর্তীতে নাইট্রোজেন সার প্রয়োগেও ফসলের বৃদ্ধি কাক্সিক্ষত হয় না। উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, ফসলের দানা পুষ্ট হচ্ছে না, শীত-খরায় সহনশীলতা কমে যাচ্ছে। ফসলের গুণগত মান ও পরিমাণ দুটোই কমে যাচ্ছে।
বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, সিলেট, চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলসহ বরেন্দ্র ও মধুপুর গড় অঞ্চলের অধিকাংশ মাটি অত্যধিক থেকে অধিক অম্ল। প্রায় ২ লাখ ৭৮ হাজার হেক্টর জমির মাটি অত্যধিক অম্ল (পিএইচ মান ৪.৫ এর নিচে) এবং প্রায় ৩৬ লাখ ৪৪ হাজার হেক্টর জমির মাটি অধিক অম্ল (পিএইচ মান ৪.৫ থেকে ৫.৫)। ফলশ্রুতিতে, এই সকল অঞ্চলে আবাদকৃত ফসলের কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কাক্সিক্ষত ফলন পেতে হলে এ ধরনের মাটির অত্যধিক ও অধিক অম্লতা হ্রাস করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক।
বাংলাদেশের উপকূলবর্তী প্রায় ৫৩% অঞ্চল লবণাক্ততা দ্বারা সরাসরি আক্রান্ত। বর্তমানে দেশের উপকূলবর্তী অঞ্চল ছাড়িয়ে লবণাক্ততা আক্রান্ত অঞ্চল ক্রমে বেড়ে চলেছে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট এর ২০০৯ সালের লবণাক্ততা জরিপের তথ্য মতে, বাংলাদেশের প্রায় ১.০৫৬ মিলিয়ন হেক্টর চাষযোগ্য জমি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততা দ্বারা আক্রান্ত। মাটির লবণাক্ততা ফসলের স্বাভাবিক উৎপাদনে বিঘœ ঘটায়। ফলে মাটির উৎপাদনশীলতা কমে যায় অনেকাংশে।
দেশের একদশমাংশ জমি পাহাড় বেষ্টিত। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার পাহাড়ি মাটি দিন দিন ক্ষয় হয়ে হচ্ছে। যেখানে উপজাতীয় জনগণ তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বাস্তবতার কারণে জুম চাষ করে থাকেন। এ জুম থেকে তারা প্রধান খাদ্যশস্য ধানসহ বছরব্যাপী প্রয়োজনীয় ফসল আহরণ করে থাকে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি ও সচেতনতার অভাবে জুম চাষের ফলে ব্যাপক আকারে মাটির অবক্ষয় হয়। জুমের আশেপাশের নালা ও ছড়াগুলোতে পাহাড় থেকে নেমে আসা মাটি জমা হয়ে ভরাট হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বছরে প্রতি হেক্টর জমি থেকে ৪০ টন বা তার ও বেশি উর্বর মাটি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। অথচ একটু সচেতন হলে পাহাড়ি মৃত্তিকা ক্ষয়রোধ করে উর্বরতা বাড়ানো যায়।
এছাড়া নানা রকম বিষাক্ত পদার্থের কারণে দূষিত হয়ে পড়ছে দেশের উর্বর মাটি। আর মাটি দূষিত হয়ে গেলে জীববৈচিত্রেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। এতে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে। বিভিন্ন কারণে আজ ধ্বংসের মুখে এই বৃহৎ প্রাকৃতিক সম্পদ। মৃত্তিকা দূষণ পরিবেশবাদীদের জন্য একটি বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গৃহস্থালির বর্জ্য, পলিথিন, কল কারখানার কঠিন ও তরল বর্জ্য মাটি দূষণের একটি বড় উৎস। কলকারখানা থেকে প্রচুর ভারী ধাতু যেমন আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, সিসা, নিকেল ইত্যাদি নদীনালা ও জমিতে মিশে মাটি দূষিত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ময়লার ভাগাড় আরেকটি মারাত্মক মাটি দূষণকারী উৎস হিসেবে কাজ করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হওয়াতে প্রতি বছর নদী ভাঙনের কারণে উর্বর মৃত্তিকা পদ্মাসহ বড় বড় নদী বক্ষে চলে যায়।
মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষিত করতে এবং ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে নিয়মিত মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সুষম সার ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম জোরদার করা দরকার। ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করে তাৎক্ষণিক বিভিন্ন ফসলের জন্য সুষম সার সুপারিশ প্রদান কার্যক্রম জোরালো করা দরকার। মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব পদার্থ যোগ করতে হবে। প্রতি বছর হেক্টরপ্রতি ১০-১৫ টন জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে। গবেষণায় জানা যায়, এক টন জৈবসার থেকে ১২০-১৫০ ডলার মূল্যমানের রাসায়নিক সারের সাশ্রয় করা সম্ভব হয়। এর পাশাপাশি ভূমিক্ষয় রোধের সম্ভাব্য ব্যবস্থা গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। মাটিতে জলাবদ্ধতার সম্ভাবনা থাকলে পানি নিষ্কাশন করতে হবে। অধিক লবণযুক্ত মাটিতে লবণমুক্ত পানি দ্বারা সেচ প্রদান করতে হবে। এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে অধিক উৎপাদন করা সম্ভব হবে। অধিক উৎপাদন নিশ্চিতের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
পরিশেষে,মাটির স্বাস্থ্যের সঙ্গে মানবস্বাস্থ্যের সম্পর্ক নিবিড়। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশের কৃষি এখন খোরপোশ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে উত্তরণের প্রচেষ্টা চলছে। মাটির জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে এর উর্বরতা বজায় রাখা দেশের ভবিষ্যৎ কৃষি উৎপাদনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সিসি), মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, কৃষি মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক গবেষণাগার, ফরিদপুর। মোবাইল: ০১৭১১-৪৬৯৫০৯, ই-মেইল:nhalmamun@gmail.com
ফসলের খাদ্যাপাদানের অভাবজনিত লক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সার ব্যবহার
ড. উৎপল কুমার
আমরা কথা বলে আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি। কিন্তু গাছ কথা বলতে পারে না। তবে তারা এমন কতকগুলো লক্ষণ প্রকাশ করে যার মাধ্যমে সহজেই বোঝা যায় তাদের খাবার প্রয়োজন না ঔষধ প্রয়োজন। গাছের এমন কিছু লক্ষণ আছে যার মাধ্যমে তার খাবারের চাহিদা প্রকাশ পায়, আবার এমন কিছু লক্ষণ আছে যার মাধ্যমে তার রোগ জীবাণুর আক্রমণের লক্ষণ বুঝা যায়। খাদ্যোপাদানের অভাবে যে সমস্ত লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং কখন তা সার প্রয়োগের মাধ্যমে নিরসন করা যায় নিম্নে তা বর্ণনা করা হলো-
নাইট্রোজেনের অভাবজনিত লক্ষণ ও প্রতিকার : গাছের নিচের দিকের বয়স্ক পাতা যদি হালকা সবুজ থেকে হলদে বর্ণ ধারণ করে তবে বুঝতে হবে এটা নাইট্রোজেনের অভাবজনিত লক্ষণ। এই লক্ষণ ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগের মাধ্যমে দূর করা যায়। তাৎক্ষণিকভাবে ইউরিয়া প্রয়োগ করা না হলে সম্পূর্ণ মাঠ ফসল ধীরে ধীরে সমানভাবে হলদে হয়ে যাবে। গাছ খাটো হবে ও বৃদ্ধি হবে না। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই গাছে ফুল ধরবে, ফুল ও ফল আকারে ছোট হবে এবং ফলন কমে যাবে। ধান, গম ও অন্যান্য দানা শস্যে কুশি কম হবে।
ফসফরাসের অভাবজনিত লক্ষণ ও প্রতিকার : যদি ফসল বা গাছের পাতাগুলো স্বাভাবিকের তুলনায় গাঢ় সবুজ রং ধারণ করে এবং পাতা ও কোন কোন সময় কান্ডে লালচে বেগুনি রং দেখা যায় তবে বুঝতে হবে ঐ জমির মাটিতে ফসফরাসের অভাব রয়েছে। এরূপ লক্ষণ দেখা গেলে টিএসপি অথবা এসএসপি অথবা ডিএপি সার প্রয়োগ করতে হবে। ফসল লাগানোর আগেই মাটি পরীক্ষা করে উর্বরতা মান অনুযায়ী এই সার প্রয়োগ করা উচিত। নতুবা মাটিতে অভাব থাকলে দানাদার ফসলে কুশির সংখ্যা কমে যায় ও গাছ খাটো হয়। গাছের শিকড়ের বৃদ্ধি কমে যায়, ফুল ও ফল কম ধরে এবং বীজ উৎপাদন কম হয়, ফসল পাকতে দেরি হয় এবং শিমজাতীয় গাছে নডিউলের পরিমাণ কমে যায়।
পটাশিয়ামের অভাবজনিত লক্ষণ ও প্রতিকার : বয়স্ক পাতার আগা ও কিনারা ঝলসে বা পুড়ে যাওয়ার মতো হলে এবং কা- দুর্বল ও লিকলিকে হলে বুঝতে হবে পটাশিয়ামের অভাবে হয়েছে। পটাশজাতীয় সার জমি প্রস্তুতির সময়ই প্রয়োগ করা উচিত। তা করা না হলে লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এমওপি অথবা পটাশিয়াম সালফেট সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। যদি এই সাার প্রযোগ না করা হয় তবে গাছ হেলে পড়বে, রোগ-পোকামাকড়ের আক্রমন বেশি দেখা দেবে এবং খরা ও শৈত্যঘাতে গাছ তাড়াতাড়ি মারা যাবে। পাতা, ফুল ও ফল ঝরে যেতে পারে, বীজ ও ফল আকারে ছোট হয় এবং কুঁচকে যায়। শিমজাতীয় গাছের পাতা হলদে হয়ে সাদা ছোপ ছোপ দাগে পরিণত হতে পারে।
দস্তার অভাবজনিত লক্ষণ ও প্রতিকার : কচি পাতার মধ্য শিরা বিশেষ করে গোড়ার দিকে যদি সাদা হয়ে যায় এবং পুরাতন পাতায় মরিচা পড়ার মতো ছোট ছোট দাগ দেখা যায় ও ধীরে ধীরে বাদামি রং ধারণ করতে থাকে তবে বুঝতে হবে এটি দস্তার অভাবে হচ্ছে। জিংক সালফেট সার প্রয়োগ করলেই এ লক্ষণ থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। তা না হলে গাছের পাতা, ফুল ফল আকারে ছোট হবে, পাতার কিনারা কুচকে যাবে। জমিতে ফসলের বৃদ্ধি অসমান মনে হবে এবং ফসল পাকতে দেরি হবে। শিমজাতীয় গাছে বাদামি ফোটা ফোটা দাগ ও সেই সাথে হলদেটে পাতা দেখা যায়।
সালফার/ গন্ধকের অভাবজনিত লক্ষণ ও প্রতিকার : গাছের উপরের দিকের কচিপাতা যদি হলদে সাদা বা ফ্যাকাশে বিবর্ণ রং ধারণ করে এবং ধীরে ধীরে নিচের পুরাতন পাতার দিকে ছড়াতে থাকে তবে বুঝতে হবে এটি গন্ধকের অভাবজনিত লক্ষণ। জিপসাম জাতীয় সার প্রয়োগ করে এ লক্ষণ দূর করা সম্ভব । কিন্তু এই সার প্রয়োগ করা না হলে ফসল পাকতে দেরি হবে, শস্যের গুণগত মান কমে যাবে, গাছ খর্বাকৃতি হবে এবং ফলন কমে যাবে।
বোরণের অভাবজনিত লক্ষণ : পাতার ফলকের ডগা ফ্যাকাশে সবুজ রং হলে কিংবা ব্রোঞ্জ আভাযুক্ত হলে কিংবা বাড়ন্ত ডগা মারা গেলে বুঝতে হবে এটি বোরণের অভাবে হয়েছে। সলুবর অথবা বরিক এসিড জাতীয় সার প্রয়োগ করে এ অভাব দূর করা য়ায়। অভাব স্থায়ী হলে দানাজাতীয় ফসলে যেমন- গম, ভুট্টা ইত্যাদিতে দানা গঠন বাধাগ্রস্ত হয, চীনাবাদমে শূন্য গর্ভ ও তুলা পাতায় বোঁটা প্রশস্ত ও প্যাঁচানো দাগ হয়।
ক্যালসিয়াম/ম্যাগনেসিয়ামের অভাবজনিত লক্ষণ ও প্রতিকার : নতুন পাতা যদি সাদা হয়ে যায় তবে তা ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত লক্ষণ এবং যদি বয়স্ক পাতায় হালকা সবুজ ও হলদে-জ্বলে যাওয়া বিবর্ণ আকার ধারণ করে কিন্তু শিরাগুলো সবুজ থাকে তবে তা ম্যাগনেসিয়ামের অভাবজনিত লক্ষণ। সাধারণত অম্লীয় মাটিতে এ দুটি উপাদানের অভাব দেখা যায়। তাই ডলোচুন প্রয়োগ করলে এ দুটি উপাদানের যেমন ঘাটতি পূরণ হয় অন্যদিকে মাটির অম্লত্ব কমিয়ে আনা যায়।
আমাদের দেশে বর্তমানে উপরে বর্ণিত কয়টি উপাদানের অভাবই পরিলক্ষিত হচ্ছে। অন্যান্য উপাদানগুলো এখনও যথেষ্ট পরিমাণে মাটিতে বিদ্যমান তাই সার হিসেবে প্রয়োগ করার প্রয়োজন পরে না। একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে ‘প্রতিরোধ প্রতিকার অপেক্ষা শ্রেয়’। তাই কৃষাণ-কৃষাণী ভাই ও বোনদের উচিত তাদের মাটি পরীক্ষা করে অথবা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রণীত ‘উপজেলা নির্দেশিকা’ থেকে তার জমির উর্বরতা মান জানা এবং সেই অনুসারে ফসলে খাদ্যোপাদানের অভাবজনিত লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার আগেই সার প্রয়োগ করা। তবে কোন কারণে যদি আগে সার প্রয়োগ করা না হয় তবে লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দানাদার বা তরল আকারে সার প্রযোগ করতে হবে। নতুবা চরম ফলন বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থাকবে।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, আঞ্চলিক কার্যালয়, টাঙ্গাইল। মোবাইল ঃ ০১৭১২-৭০৩৩৭৩ , ই-মেইল :uksrdi@yahoo.com
পাহাড়ি ঢালে ভূমিক্ষয় নিয়ন্ত্রণে কার্যকর প্রযুক্তি
কৃষিবিদ প্রসেনজিৎ মিস্ত্রী
দেশের মোট ভূমির প্রায় ১২% এলাকা পাহাড়ি ভূমি দ্বারা গঠিত। বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় বিভিন্ন প্রকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে প্রতিনিয়ত ভূমিক্ষয় ও ভূমিধসের ঘটনা ঘটে থাকে। দেশের বেশির ভাগ পাহাড় নরম মাটির হওয়ায় বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে মাটি ক্ষয় ও ভূমিধসের ঘটনা বেশি ঘটে। তাছাড়া অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়ের ঢালে ফসল চাষ ব্যবস্থাপনা, ব্যাপক হারে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদি কারণে মাটি ক্ষয় ও ভূমিধস ত্বরান্বিত হচ্ছে। পাহাড়ের ঢালে যুগ যুগ ধরে আদিবাসী কৃষকগণ অপরিকল্পিত জুম চাষ করে আসছে। কিছুকাল আগেও পার্বত্য অঞ্চলের এক একটি পাহাড়ে ২০-২৫ বছর পর পর জুম চাষ করা হতো যা পরিবেশের জন্য তত ক্ষতিকর ছিল না এবং প্রকৃতি তার জীব বৈচিত্র্যের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারতো। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বাড়তি লোকের অতিরিক্ত খাদ্য চাহিদা মেটাতে এখন একই জমিতে ২-৩ বছর পর পর জুম চাষের ফলে ভূমিক্ষয় এবং ভূমিধস ত্বরান্বিত হচ্ছে ও মাটির উর্বরতা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাচ্ছে। তাছাড়া ফসলের ফলন বাড়াতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে মাটির গঠন দুর্বল হয়ে মাটি ক্ষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমানে পাহাড়ে ক্রমবর্ধমান ফল বাগানে কৃষকরা ব্যাপকহারে আগাছানাশক ব্যবহার করায় পাহাড়ি ঢালের মাটি উন্মুক্ত হয়ে ভূমিক্ষয় ত্বরান্বিত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য অক্ষুণœ রেখে দীর্ঘকাল উৎপাদনশীল রাখার লক্ষ্যে পাহাড়ের। ভূমি ব্যবস্থাপনায় লাগসই প্রযুক্তির সফল প্রয়োগের কোন বিকল্প নেই। পাহাড়ি ঢালে ভূমিক্ষয় এবং ভূমিধস নিয়ন্ত্রণে বেশ বিছু প্রযুক্তি যেমন পাহাড়ি অঞ্চলে মৃত্তিকা ক্ষয়রোধে ঝাড়ের বেড়া (Hedge Row) পদ্ধতিতে চাষাবাদ, জুট-জিও ((Jute-Geo Textile) টেক্সটাইল পদ্ধতি, গ্যাবিয়ন (Gabion Check Dam) চেকডেম পদ্ধতি, ব্রাশ উড চেকডেম (Brush Wood Checkdam) পদ্ধতি, বেঞ্চ টেরাস ((Bench Terrace) পদ্ধতি, মৃত্তিকা সংরক্ষণে পাহাড়ি ঢালে কণ্টুর (Contou) চাষাবাদ, আচ্ছাদন ফসল (Cover crop) চাষ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। এই নিবন্ধে বেড়া ও বেঞ্চ টেরাস প্রযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
সারি (Hedge row) পদ্ধতিতে চাষাবাদ প্রযুক্তি
প্রযুক্তির বৈশিষ্ট্য : এ পদ্ধতিতে পাহাড়ি এলাকায় পাহাড়ের ঢালে শস্যের মাঝে, ফলজ এবং সবজি বাগানের ভেতর নির্দিষ্ট দূরত্বে বিভিন্ন হেজ বা বেড়া হিসাবে ব্যবহৃত প্রজাতির গাছ দ্বারা আড়াআড়িভাবে হেজ-রো বা হেজ স্ট্রিপ তৈরি করা হয়। পাহাড়ি ঢালের সাথে আড়াআড়িভাবে (ধপৎড়ংং ঃযব যরষষ ংষড়ঢ়ব) ভ্যাটিভার (বিন্না ঘাস), ন্যাপিয়ার, আনারস, বগা মেডুলা, ইন্ডিগোফেরা (নীল), ডেসমোডিয়া, গি¬রিসিডিয়া, খাগড়া, ফুলঝাড়–, লেমন ঘাস ইত্যাদি গাছকে হেজ বা বেড়া হিসাবে লাগিয়ে হেজ-রো স্থাপন করা হয়। বৃষ্টির পানিতে ক্ষয়প্রাপ্ত মাটি নিচের দিকে নেমে আসার সময় হেজ-রো-এর ঘন আচ্ছাদনে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে জমা হয় এবং সেখানে মাটির গভীরতা বৃদ্ধি পায়। এ প্রযুক্তি ব্যবহারে বৃষ্টির পানির গতিবেগ বাধাগ্রস্ত হয় এবং মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। হেজ-রো প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান ধুয়ে যাওয়া রোধ করে। যার ফলে অধিক রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে নিরাপদ ও অধিক ফসল উৎপাদন করা যায়। পাহাড়ি এলাকার ঢালু ভূমির ভূমিক্ষয় রোধে এ প্রযুক্তি বিশেষভাবে উপযোগী। যে কোন এলাকায় ঢালু জমির ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস রোধে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রযুক্তি ব্যবহারের তথ্য : পাহাড়ি এলাকায় বা ঢালু জমিতে ঢালের আড়াআড়িভাবে উপর থেকে নিচে ৪-৫ মিটার পরপর ভ্যাটিভার, ন্যাপিয়ার, আনারস, বগা মেডুলা, ইন্ডিগোফেরা ইত্যাদি গাছকে কৃষকের চাহিদা অনুসারে ঘনভাবে লাগিয়ে হেজ-রো বা হেজ স্ট্রিপ তৈরি করতে হবে; পাহাড়ি ঢালে দুটি হেজ-রো এর মাঝে ঢালের আড়াআড়িভাবে বিভিন্ন সবজি/ফসল/জুম চাষ /ফল বাগান ইত্যাদি পরিকল্পিতভাবে চাষ করা যেতে পারে; বছরে এক বা দুইবার হেজে জন্মানো আগাছা পরিষ্কার করতে হবে; হেজ বা ঝাড়ের গাছ বেশি লম্বা বা ঝোপালো হয়ে গেলে মাঝে মাঝে অতিরিক্ত অংশ বা ডালপালা ছাঁটাই করে দেয়া যেতে পারে, যা সবুজ সার বা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
প্রযুক্তির প্রভাব : এ প্রযুক্তির প্রধান উপকারিতা হচ্ছে মৃত্তিকা ও পানি সংরক্ষণ এবং পুষ্টি সমৃদ্ধ জৈব পদার্থের প্রাপ্যতা যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, মাটির গঠন উন্নত এবং ফসলের নিরাপদ ফলন বৃদ্ধিতে সহায়ক। এ প্রযুক্তি ব্যবহারে জ্বালানি কাঠের প্রাপ্যতা নিশ্চিত, পশু খাদ্যের যোগান, অবক্ষয় প্রাপ্ত ঢালু জমির পুনঃ উৎপাদনশীলতা ফিরিয়ে আনা যায়। তা ছাড়া হেজ রো হিসাবে ব্যবহৃত গাছ থেকে (যেমন আনারস, লেমন ঘাস) বাড়তি আয়ও করা যায়। এছাড়া ভূমিক্ষয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পানি দূষণ রোধ, ভূমিধস রোধ, ঝিরি ঝর্ণার পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধি ইত্যাদিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে কৃষকের আর্থসামাজিক উন্নতির পাশাপাশি মাটিতে জৈব পদার্থের জোগান নিরাপদ খাদ্য উপাদানে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
গতানুগতিক পদ্ধতিতে জুুম চাষ করলে প্রতি বছর ৪৫ টন/হে: মাটি ক্ষয় হয়। আর হেজ রো চাষাবাদ প্রযুক্তিতে পাহাড়ের
ঢালের আড়াআড়ি কন্টুর লাইন বরাবর ঝাড়ের বেড়া দ্বারা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মাটি ক্ষয়রোধ করা সম্ভব হয়। এই প্রকার ব্যবস্থাপনায় ভূমিক্ষয়ের পরিমাণ প্রতি বছর ৪৫ টনের স্থলে ৬ টনে নামিয়ে আনা সম্ভব। তাছাড়া ঝাড়ের বেড়া হতে
প্রায় ২৬ টন/হেক্টর সবুজ সার প্রতি বছর পাওয়া সম্ভব।
ধাপ পদ্ধতিতে চাষাবাদ প্রযুক্তি
প্রযুক্তির বৈশিষ্ট্য : মৃদু ও মধ্যম ঢালু পাহাড়ের ঢালে সারা বছর ফসল উৎপাদনের জন্য বেঞ্চ টেরাস একটি উপযুক্ত পদ্ধতি। টেরাস পদ্ধতি ব্যবহার করে একই ঢালে প্রতি বছর বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, মাঠ ফসল, স্বল্প ও মধ্যমমেয়াদি ফল ফলানো সম্ভব। এ পদ্ধতিতে পাহাড়ি ঢালে সার প্রয়োগ সহজীকরণ হওয়ায় মাটি পরীক্ষা করে সুষম সার প্রয়োগের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিতকরণ সম্ভব হয়। এ পদ্ধতিতে মাটি ও পানি সংরক্ষণ করা যায় এবং পানি সেচের ব্যবহার করতে পারলে বছরে একাধিক ফসল ফলানো যায়। ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস রোধে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রযুক্তি ব্যবহারের তথ্য : এ পদ্ধতিতে পাহাড়ের ঢালকে সমোচ্চতা রেখা (ঈড়হঃড়ঁৎ ষরহব) ঢালের মাটি অপসারণ করে স্থায়ীভাবে পরপর ধাপ বা সিঁড়িতে পরিণত করা হয়; টেরাসগুলো পাহাড়ের ঢালের আড়াআড়িভাবে তৈরি করা হয় যাতে বৃষ্টির পানি কম গড়িয়ে যায় এবং মাটির পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়; এই পদ্ধতিতে একটি লম্বা ঢালের দৈর্ঘ্যকে কয়েকটি ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করে ঢালের দৈর্ঘ্য কমানো যায়।
প্রযুক্তি হতে প্রাপ্তি : ভূমিক্ষয় নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মাটির পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। মাটিতে আর্দ্রতা বজায় থাকে। ঢালের দৈর্ঘ্য কমানো যায় ফলে পানির গতিবেগ (জঁহ ড়ভভ) নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেখানে চাষাবাদ করা কঠিন সেখানে ধাপ কেটে ধাপে চাষাবাদ করা যায়। পানি সেচের ব্যবস্থা করতে পারলে সারা বছর ফসল ফলানো যায়।
পাহাড়ি এলাকার ঢালু ভূমির ভূমিক্ষয় রোধে এ প্রযুক্তি বিশেষভাবে উপযোগী। যে কোন এলাকায় ঢালু জমির ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস রোধে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এ পদ্ধতিতে পাহাড়ের ঢালকে কেটে ধাপ তৈরি করা বেশ ব্যয়বহুল হওয়ায় তৃণমূল পর্যায়ের ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষকদের একার পক্ষে এর বাস্তবায়ন বেশ কঠিন। এক্ষেত্রে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কৃষকদের সহায়তা করা গেলে পাহাড়ে এ প্রযুক্তি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
(সূত্র : মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, বান্দরবান)
লেখক : আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাঙ্গামাটি, মোবাইল- ০১৭১২৮১৬৩৫২, ই-মেইল : chittagong@ais.gov.bd
স্মার্ট ফসল, স্মার্ট মাটি ও স্মার্ট উদ্ভাবনী চিন্তায় বাঁচাও ধরিত্রি
ড. মোঃ আব্দুল আউয়াল১ ড. মোঃ জাকির হোসেন২
মৃত্তিকা হলো জীব, খনিজ এবং জৈব উপাদান দ্বারা গঠিত একটি জগত যা উদ্ভিদের বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষ এবং প্রাণীদের জন্য খাদ্য সরবরাহ করে। আমরা জেনে অবাক হবো যে, এক টেবিল চামচ মাটিতে পৃথিবীর মানুষের চেয়ে বেশি জীবন্ত প্রাণী রয়েছে। আমাদের খাদ্যের ৯৫% আসে মাটি থেকে। ১৮ টি প্রাকৃতিকভাবে ঘটমান রাসায়নিক উপাদান উদ্ভিদের জন্য অপরিহার্য, যার ১৫টি মৃত্তিকা সরবরাহ করে থাকে। তাই মানুষের পুষ্টির মতো মাটির পুষ্টি রক্ষা করাও অত্যন্ত জরুরি। কারণ মাটিতে পুষ্টির ঘাটতি হলে পুষ্টির ঘাটতিযুক্ত উদ্ভিদ তৈরি হবে এবং পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহের চিত্রটি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
বৈশ্বিক টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (ঝউএ)-এর ১৫ নং লক্ষ্য অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের টেকসই ব্যবহার রক্ষা, পুনরুদ্ধার এবং প্রচার, টেকসইভাবে বন ব্যবস্থাপনা, মরুকরণের বিরুদ্ধে লড়াই, জমির অবক্ষয় বন্ধ ও বিপরীত করা এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি বন্ধ করতে হবে। সে লক্ষ্যে সকল স্থলজ প্রাণীর খাবারের প্রধান উৎস এবং বাস্তুতন্ত্রের ধারক ও বাহক মৃত্তিকার স্বাস্থ্য রক্ষার টেকসই ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। পৃথিবীর সকল জীবের খাদ্য উৎপাদনের শুরুটা মাটি থেকেই। মানুষের বেঁচে থাকার অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের প্রধান উৎসও এই মৃত্তিকা। তাই মৃত্তিকা সম্পদকে যথাযথভাবে সুস্থ রাখার উপর নির্ভর করছে আগামী দিনের মানুষের জীবিকা, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা। প্রতিটি ফসল চাষের পর জমি তার পুষ্টি হারায় এবং উর্বরতা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। জমির ক্রমহ্রাসমান উর্বরতা এখন বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা এবং স্থায়িত্বের জন্য সবচেয়ে জটিল সমস্যা হিসেবে বর্তমান বিশ্বে স্বীকৃত। কারণ মাটির পুষ্টির অবক্ষয় মাটিকে পুনঃ পুনঃ পুষ্টির ক্ষয় করতে প্ররোচিত করে এবং ফসল উৎপাদনের সহযোগিতা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আবার অন্যদিকে মাটিতে বিদ্যমান অদৃশ্য জীবন্ত প্রাণীর মিথস্ক্রিয়ায় একটি বিষাক্ত পরিবেশের প্রতিনিধিত্ব করে, যা পরিবেশকে দূষিত, আবহাওয়াকে অনিশ্চিত এবং জলবায়ুকে অনিয়ন্ত্রিত করে। পাশাপাশি অসমহারে ও যথেচ্ছভাবে মাটির অম্লমান নিয়ন্ত্রণ অথবা পরীক্ষা না করে রাসায়নিক সার প্রয়োগ, জৈবসার ব্যবহার না করা পরিমাণ অনুযায়ী, ফসল চাষের নিবিড়তা বৃদ্ধি, প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভূমি কর্ষণ, শস্যপর্যায় নীতিমালা অনুসরণ না করা, উফশী ও হাইব্রিড জাতের ফসলের আবাদ বৃদ্ধি, ফসলের অবশিষ্টাংশ জমিতে ব্যবহার না করা ইত্যাদি মাটির স্বাস্থ্য বিনষ্টের প্রধান কারণ।
দৈনন্দিন ব্যবহারে প্লাস্টিক ব্যাগ হয়ে ওঠছে নিত্য সঙ্গী। একটি প্লাস্টিক ব্যাগ ১০ থেকে ২০ বছর, প্লাস্টিক বোতল ৪০০ বছর এবং গ্লাস চার হাজার বছর পর্যন্ত মাটিতে অবিকৃত থেকে মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে দেয়। বাংলাদেশে উৎপাদিত ৮.৫ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিক না হওয়ার কারণে ভরাট হচ্ছে খাল বিল নদীর তলদেশ। খাদ্যচক্রের মাধ্যমে শরীরে ঢুকছে মাইক্রোপ্লাস্টিক এর মতো ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ভয়ংকর উপাদান, যার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন জটিল রোগের। দূষিত মাটি একই সাথে ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানির উৎস এবং ভূ-উপরিস্থ জলাধারসহ সব ধরনের পানির উৎসকে আর্সেনিক দূষণের মতো বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান (ঐবধাু সবঃধষং) দ্বারা দূষিত করছে। বিশ্বে প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে মিশে দূষণের শিকার হচ্ছে ১০ লাখের বেশি সামুদ্রিক পাখি, মাছসহ নানা জলজপ্রাণী। পুঁজিবাদ এবং এর সাথে শিল্প বিপ্লব-এর বর্ণিল মোড়কে আবাদযোগ্য উর্বর জমির পরিমাণ কমিয়ে, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নের শত শত কার্যকলাপের আড়ালে বাণিজ্যিক পরিকল্পনার ‘¯ে¬া-পয়জনিং’-এ প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে জলবায়ু আর বিদ্রোহী হয়ে উঠছে আমাদের এই প্রিয় ধরিত্রীর কেন্দ্রস্থল মাটি। প্রিয় মাটির কান্না যতদিন আমাদের স্পর্শ না করবে ততদিন বৈশ্বিক টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (ঝউএ)-গুলো মুখ থুবড়ে পড়বে।
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এখন সমগ্র পৃথিবী সোচ্ছার। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী না হয়েও ভুক্তভোগী (মাত্র ০.২%কার্বন নিঃসরণ করে)। বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ জায়গায় আমেরিকা, ইউরোপসহ প্রায় ১০০টিরও বেশি দেশ মরুকরণের ঝুঁকিতে আছে। ২০৫০ সালের মধ্যে ‘নেট জিরো’ লক্ষ্য অর্জনে মরিয়া হয়ে নানা পদক্ষেপের অঙ্গীকার করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার। অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের নিঃসরণকে কমানো বা শূন্যে নামিয়ে আনাকে উপায় হিসেবে বিবেচনা করছেন। বিজ্ঞানীরা বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য দায়ী কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস বায়ুম-লে ছড়াতে না দিয়ে বন্দী করা বা ‘কার্বন ক্যাপচার’ বা ‘কার্বন সিকুয়েস্ট্রেশন’-এর পরামর্শ দিয়ে চলেছেন। ‘কার্বন ক্যাপচার’-কে অনেকটা প্রদীপের দৈত্য বন্দী করার মতো ভাবা যেতে পারে। কোন এক বিশেষ ব্যবস্থায় কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসকে মাটির হাজার ফুট নিচে বছরের পর বছর সঞ্চিত করে রাখাকে সবুজ কার্বন আর পানির নিচেও অর্থাৎ সমুদ্রের তলদেশে রাখাকে নীল কার্বন নামে প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন টন মানব সৃষ্ট কার্বন ডাই অক্সাইড সঞ্চয় করে রাখা সম্ভব। এছাড়াও বিজ্ঞানীদের ‘জিওলজিক্যাল কার্বন সিকুয়েস্ট্রেশন’ ‘বায়োলজিক কার্বন সিকোস্ট্রেশন’ বিষয়ে গবেষণা চলমান। ‘বায়োলজিক কার্বন সিকোস্ট্রেশন’ হলো কার্বন সঞ্চয় করার জন্য অর্থাৎ জীবন এবং বাস্তুতন্ত্রের প্রাকৃতিক ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার জন্য ফসলি জমি, বন, জলাভূমি এবং উপকূলীয় জলাভূমির বাস্ততন্ত্রের উপাদানগুলোকে ব্যবহার করে কার্বন সংরক্ষণে বিশেষ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এ ক্ষেত্রে স্মার্ট ফসল, স্মার্ট মাটি ও স্মার্ট উদ্ভাবনী চিন্তার সমন্বয় দরকার।
বাংলাদেশ স্মার্ট ফসলের বৈচিত্রভরা সোনার দেশ। সোনালী ফসলের বাংলাদেশে রক্ষিত আছে বহু ফসলের হাজারো জার্মপ্লাজম। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই)-এ রক্ষিত আছে পাট ও সমজাতীয় আঁশ ফসলের ৬০৭০টি, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই)-এ ৯৪৯১টি, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআরআরআই)-এ ৭৯৭৯টি, বাংলাদেশ সুগার ক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই)-এ ৩২৯৭টি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বিএইউ)-এ ১০২৫৬ টি, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই)-এ ৪৭৫টি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমআরএইউ)-এ ৭৬৪টি, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (এসএইউ)-এ ১৭১টি এবং অন্যান্য সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিপর্যায়ে বিভিন্ন ফসলের অসংখ্য জার্মপ্লাজম সংগৃহিত আছে। আমরা জানি পাট ও সমজাতীয় আঁশ ফসল পরিবেশবান্ধব ও প্রাকৃতিক বায়ু পরিষ্কারক হিসেবে কাজ করে। ১০০ দিন বয়স পর্যন্ত প্রতি হেক্টর জমির পাট গাছ বাতাসের ১৫ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড (ঈঙ২) গ্যাস শোষণ করে এবং ১১ টন অক্সিজেন (ঙ২) গ্যাস বাতাসে ছাড়ে (সুত্রঃ ঋঅঙ)। অপরদিকে জমিতে চাষকৃত অবস্থায় ঝড়ে পড়া পাটপাতা মাটিতে পুষ্টির জোগান দিয়ে থাকে এবং পাটের শিকড় মাটির গভীর দিগন্তে প্রবেশ করার কারণে যে পরিমাণ বাতাস মাটিতে প্রবেশ করে তা ব্যবহার করে মাটির লক্ষ লক্ষ অণুজীবের জীবন সমৃদ্ধ হয়। আরেকটি স্মার্ট উদ্ভিদ হলো ধৈঞ্চা। ধৈঞ্চা উদ্ভিদকে প্রাকৃতিক সারের আঁধার বলা হয়। ধৈঞ্চা গাছের শিকড়ে থাকা নডিউল জমিতে সার সরবরাহ করে থাকে। বিজেআরআই পাট ও ধৈঞ্চার জিনোম নকশা/তথ্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে। স্মার্ট উদ্ভাবনী চিন্তার মাধ্যমে পাটসহ নতুন নতুন ফসলকে স্মার্ট ফসলে রূপান্তর করতে পারলে মাটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বিশ্বে রোল মডেল হয়ে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঘাতক জলবায়ু পরিবর্তনের পাগলা ঘোড়াকে থামানো সম্ভব হবে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের আবাদি জমি ও মাটির স্বাস্থ্য ক্রমক্ষয়িষ্ণু। অপরদিকে পৃথিবীর জনসংখ্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, বিশ্বের মানুষ্য ও পশু খাদ্য এবং জ্বালানির উচ্চ উৎপাদনশীলতার চাহিদার ক্ষেত্রে অস্থিরতার প্রক্ষেপণ পরিলক্ষিত। বিদ্যমান ফসলগুলোকে দ্বৈত কার্যকারিতা সম্পন্ন স্মার্ট ফসলে (উচ্চ উৎপাদন ও মাটির জৈব কার্বন (ঝঙঈ) সঞ্চয়কারী) রূপান্তর করা আর এই ধরিত্রিকে টিকিয়ে রাখার জন্য বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রশমনের জরুরি পদক্ষেপগুলো সমার্থক। তাই সালোকসংশ্লেষণ, বায়োমাস সঞ্চয়ন, কার্বন বরাদ্দ বৃদ্ধির ভারসাম্য, রাইজোস্ফিয়ার সিঙ্কের শক্তি বৃদ্ধি এবং উদ্ভিদের বৃদ্ধি-উন্নয়নকারী (চএচ) বিষয়গুলোকে আমলে নিতে হবে। সে অনুযাযী মাটির বাস্তুসংস্থানের অংশীদার ‘উদ্ভিদ-অণুজীব-মাটি’-এর সকল উপাদান বিবেচনা করে কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তিসহ অন্যান্য হাই-থ্রো-পুট জৈব ও ইনসিলিকো প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন নতুন স্মার্ট ফসলের জাত দেয়ার উপর নির্ভর করছে আগামী দিনের পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। কবি নজরুলের ভাষায় কাজে লেগে যেতে হবে-
‘ওঠ রে চাষি জগদ্বাসী ধর কষে লাঙল।
আমরা মরতে আছি - ভালো করেই মরব এবার চল।’
লেখক : ১মহাপরিচালক, ২প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পরিকল্পনা শাখা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মোবাইল : ০১৩০৬৭৬৯৯০০, ই-মেইল :zakirbjri@ gmail.com
স্মার্ট ফসল, স্মার্ট মাটি ও স্মার্ট উদ্ভাবনী চিন্তায় বাঁচাও ধরিত্রি
ড. মোঃ আব্দুল আউয়াল১ ড. মোঃ জাকির হোসেন২
মৃত্তিকা হলো জীব, খনিজ এবং জৈব উপাদান দ্বারা গঠিত একটি জগত যা উদ্ভিদের বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষ এবং প্রাণীদের জন্য খাদ্য সরবরাহ করে। আমরা জেনে অবাক হবো যে, এক টেবিল চামচ মাটিতে পৃথিবীর মানুষের চেয়ে বেশি জীবন্ত প্রাণী রয়েছে। আমাদের খাদ্যের ৯৫% আসে মাটি থেকে। ১৮ টি প্রাকৃতিকভাবে ঘটমান রাসায়নিক উপাদান উদ্ভিদের জন্য অপরিহার্য, যার ১৫টি মৃত্তিকা সরবরাহ করে থাকে। তাই মানুষের পুষ্টির মতো মাটির পুষ্টি রক্ষা করাও অত্যন্ত জরুরি। কারণ মাটিতে পুষ্টির ঘাটতি হলে পুষ্টির ঘাটতিযুক্ত উদ্ভিদ তৈরি হবে এবং পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহের চিত্রটি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
বৈশ্বিক টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (ঝউএ)-এর ১৫ নং লক্ষ্য অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের টেকসই ব্যবহার রক্ষা, পুনরুদ্ধার এবং প্রচার, টেকসইভাবে বন ব্যবস্থাপনা, মরুকরণের বিরুদ্ধে লড়াই, জমির অবক্ষয় বন্ধ ও বিপরীত করা এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি বন্ধ করতে হবে। সে লক্ষ্যে সকল স্থলজ প্রাণীর খাবারের প্রধান উৎস এবং বাস্তুতন্ত্রের ধারক ও বাহক মৃত্তিকার স্বাস্থ্য রক্ষার টেকসই ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। পৃথিবীর সকল জীবের খাদ্য উৎপাদনের শুরুটা মাটি থেকেই। মানুষের বেঁচে থাকার অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের প্রধান উৎসও এই মৃত্তিকা। তাই মৃত্তিকা সম্পদকে যথাযথভাবে সুস্থ রাখার উপর নির্ভর করছে আগামী দিনের মানুষের জীবিকা, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা। প্রতিটি ফসল চাষের পর জমি তার পুষ্টি হারায় এবং উর্বরতা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। জমির ক্রমহ্রাসমান উর্বরতা এখন বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা এবং স্থায়িত্বের জন্য সবচেয়ে জটিল সমস্যা হিসেবে বর্তমান বিশ্বে স্বীকৃত। কারণ মাটির পুষ্টির অবক্ষয় মাটিকে পুনঃ পুনঃ পুষ্টির ক্ষয় করতে প্ররোচিত করে এবং ফসল উৎপাদনের সহযোগিতা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আবার অন্যদিকে মাটিতে বিদ্যমান অদৃশ্য জীবন্ত প্রাণীর মিথস্ক্রিয়ায় একটি বিষাক্ত পরিবেশের প্রতিনিধিত্ব করে, যা পরিবেশকে দূষিত, আবহাওয়াকে অনিশ্চিত এবং জলবায়ুকে অনিয়ন্ত্রিত করে। পাশাপাশি অসমহারে ও যথেচ্ছভাবে মাটির অম্লমান নিয়ন্ত্রণ অথবা পরীক্ষা না করে রাসায়নিক সার প্রয়োগ, জৈবসার ব্যবহার না করা পরিমাণ অনুযায়ী, ফসল চাষের নিবিড়তা বৃদ্ধি, প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভূমি কর্ষণ, শস্যপর্যায় নীতিমালা অনুসরণ না করা, উফশী ও হাইব্রিড জাতের ফসলের আবাদ বৃদ্ধি, ফসলের অবশিষ্টাংশ জমিতে ব্যবহার না করা ইত্যাদি মাটির স্বাস্থ্য বিনষ্টের প্রধান কারণ।
দৈনন্দিন ব্যবহারে প্লাস্টিক ব্যাগ হয়ে ওঠছে নিত্য সঙ্গী। একটি প্লাস্টিক ব্যাগ ১০ থেকে ২০ বছর, প্লাস্টিক বোতল ৪০০ বছর এবং গ্লাস চার হাজার বছর পর্যন্ত মাটিতে অবিকৃত থেকে মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে দেয়। বাংলাদেশে উৎপাদিত ৮.৫ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিক না হওয়ার কারণে ভরাট হচ্ছে খাল বিল নদীর তলদেশ। খাদ্যচক্রের মাধ্যমে শরীরে ঢুকছে মাইক্রোপ্লাস্টিক এর মতো ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ভয়ংকর উপাদান, যার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন জটিল রোগের। দূষিত মাটি একই সাথে ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানির উৎস এবং ভূ-উপরিস্থ জলাধারসহ সব ধরনের পানির উৎসকে আর্সেনিক দূষণের মতো বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান (ঐবধাু সবঃধষং) দ্বারা দূষিত করছে। বিশ্বে প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে মিশে দূষণের শিকার হচ্ছে ১০ লাখের বেশি সামুদ্রিক পাখি, মাছসহ নানা জলজপ্রাণী। পুঁজিবাদ এবং এর সাথে শিল্প বিপ্লব-এর বর্ণিল মোড়কে আবাদযোগ্য উর্বর জমির পরিমাণ কমিয়ে, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নের শত শত কার্যকলাপের আড়ালে বাণিজ্যিক পরিকল্পনার ‘¯ে¬া-পয়জনিং’-এ প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে জলবায়ু আর বিদ্রোহী হয়ে উঠছে আমাদের এই প্রিয় ধরিত্রীর কেন্দ্রস্থল মাটি। প্রিয় মাটির কান্না যতদিন আমাদের স্পর্শ না করবে ততদিন বৈশ্বিক টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (ঝউএ)-গুলো মুখ থুবড়ে পড়বে।
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এখন সমগ্র পৃথিবী সোচ্ছার। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী না হয়েও ভুক্তভোগী (মাত্র ০.২%কার্বন নিঃসরণ করে)। বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ জায়গায় আমেরিকা, ইউরোপসহ প্রায় ১০০টিরও বেশি দেশ মরুকরণের ঝুঁকিতে আছে। ২০৫০ সালের মধ্যে ‘নেট জিরো’ লক্ষ্য অর্জনে মরিয়া হয়ে নানা পদক্ষেপের অঙ্গীকার করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার। অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের নিঃসরণকে কমানো বা শূন্যে নামিয়ে আনাকে উপায় হিসেবে বিবেচনা করছেন। বিজ্ঞানীরা বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য দায়ী কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস বায়ুম-লে ছড়াতে না দিয়ে বন্দী করা বা ‘কার্বন ক্যাপচার’ বা ‘কার্বন সিকুয়েস্ট্রেশন’-এর পরামর্শ দিয়ে চলেছেন। ‘কার্বন ক্যাপচার’-কে অনেকটা প্রদীপের দৈত্য বন্দী করার মতো ভাবা যেতে পারে। কোন এক বিশেষ ব্যবস্থায় কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসকে মাটির হাজার ফুট নিচে বছরের পর বছর সঞ্চিত করে রাখাকে সবুজ কার্বন আর পানির নিচেও অর্থাৎ সমুদ্রের তলদেশে রাখাকে নীল কার্বন নামে প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন টন মানব সৃষ্ট কার্বন ডাই অক্সাইড সঞ্চয় করে রাখা সম্ভব। এছাড়াও বিজ্ঞানীদের ‘জিওলজিক্যাল কার্বন সিকুয়েস্ট্রেশন’ ‘বায়োলজিক কার্বন সিকোস্ট্রেশন’ বিষয়ে গবেষণা চলমান। ‘বায়োলজিক কার্বন সিকোস্ট্রেশন’ হলো কার্বন সঞ্চয় করার জন্য অর্থাৎ জীবন এবং বাস্তুতন্ত্রের প্রাকৃতিক ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার জন্য ফসলি জমি, বন, জলাভূমি এবং উপকূলীয় জলাভূমির বাস্ততন্ত্রের উপাদানগুলোকে ব্যবহার করে কার্বন সংরক্ষণে বিশেষ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এ ক্ষেত্রে স্মার্ট ফসল, স্মার্ট মাটি ও স্মার্ট উদ্ভাবনী চিন্তার সমন্বয় দরকার।
বাংলাদেশ স্মার্ট ফসলের বৈচিত্রভরা সোনার দেশ। সোনালী ফসলের বাংলাদেশে রক্ষিত আছে বহু ফসলের হাজারো জার্মপ্লাজম। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই)-এ রক্ষিত আছে পাট ও সমজাতীয় আঁশ ফসলের ৬০৭০টি, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই)-এ ৯৪৯১টি, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআরআরআই)-এ ৭৯৭৯টি, বাংলাদেশ সুগার ক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই)-এ ৩২৯৭টি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বিএইউ)-এ ১০২৫৬ টি, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই)-এ ৪৭৫টি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমআরএইউ)-এ ৭৬৪টি, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (এসএইউ)-এ ১৭১টি এবং অন্যান্য সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিপর্যায়ে বিভিন্ন ফসলের অসংখ্য জার্মপ্লাজম সংগৃহিত আছে। আমরা জানি পাট ও সমজাতীয় আঁশ ফসল পরিবেশবান্ধব ও প্রাকৃতিক বায়ু পরিষ্কারক হিসেবে কাজ করে। ১০০ দিন বয়স পর্যন্ত প্রতি হেক্টর জমির পাট গাছ বাতাসের ১৫ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড (ঈঙ২) গ্যাস শোষণ করে এবং ১১ টন অক্সিজেন (ঙ২) গ্যাস বাতাসে ছাড়ে (সুত্রঃ ঋঅঙ)। অপরদিকে জমিতে চাষকৃত অবস্থায় ঝড়ে পড়া পাটপাতা মাটিতে পুষ্টির জোগান দিয়ে থাকে এবং পাটের শিকড় মাটির গভীর দিগন্তে প্রবেশ করার কারণে যে পরিমাণ বাতাস মাটিতে প্রবেশ করে তা ব্যবহার করে মাটির লক্ষ লক্ষ অণুজীবের জীবন সমৃদ্ধ হয়। আরেকটি স্মার্ট উদ্ভিদ হলো ধৈঞ্চা। ধৈঞ্চা উদ্ভিদকে প্রাকৃতিক সারের আঁধার বলা হয়। ধৈঞ্চা গাছের শিকড়ে থাকা নডিউল জমিতে সার সরবরাহ করে থাকে। বিজেআরআই পাট ও ধৈঞ্চার জিনোম নকশা/তথ্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে। স্মার্ট উদ্ভাবনী চিন্তার মাধ্যমে পাটসহ নতুন নতুন ফসলকে স্মার্ট ফসলে রূপান্তর করতে পারলে মাটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বিশ্বে রোল মডেল হয়ে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঘাতক জলবায়ু পরিবর্তনের পাগলা ঘোড়াকে থামানো সম্ভব হবে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের আবাদি জমি ও মাটির স্বাস্থ্য ক্রমক্ষয়িষ্ণু। অপরদিকে পৃথিবীর জনসংখ্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, বিশ্বের মানুষ্য ও পশু খাদ্য এবং জ্বালানির উচ্চ উৎপাদনশীলতার চাহিদার ক্ষেত্রে অস্থিরতার প্রক্ষেপণ পরিলক্ষিত। বিদ্যমান ফসলগুলোকে দ্বৈত কার্যকারিতা সম্পন্ন স্মার্ট ফসলে (উচ্চ উৎপাদন ও মাটির জৈব কার্বন (ঝঙঈ) সঞ্চয়কারী) রূপান্তর করা আর এই ধরিত্রিকে টিকিয়ে রাখার জন্য বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রশমনের জরুরি পদক্ষেপগুলো সমার্থক। তাই সালোকসংশ্লেষণ, বায়োমাস সঞ্চয়ন, কার্বন বরাদ্দ বৃদ্ধির ভারসাম্য, রাইজোস্ফিয়ার সিঙ্কের শক্তি বৃদ্ধি এবং উদ্ভিদের বৃদ্ধি-উন্নয়নকারী (চএচ) বিষয়গুলোকে আমলে নিতে হবে। সে অনুযাযী মাটির বাস্তুসংস্থানের অংশীদার ‘উদ্ভিদ-অণুজীব-মাটি’-এর সকল উপাদান বিবেচনা করে কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তিসহ অন্যান্য হাই-থ্রো-পুট জৈব ও ইনসিলিকো প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন নতুন স্মার্ট ফসলের জাত দেয়ার উপর নির্ভর করছে আগামী দিনের পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। কবি নজরুলের ভাষায় কাজে লেগে যেতে হবে-
‘ওঠ রে চাষি জগদ্বাসী ধর কষে লাঙল।
আমরা মরতে আছি - ভালো করেই মরব এবার চল।’
লেখক : ১মহাপরিচালক, ২প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পরিকল্পনা শাখা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মোবাইল : ০১৩০৬৭৬৯৯০০, ই-মেইল :zakirbjri@ gmail.com
মৃত্তিকার স্বাস্থ্য রক্ষায় ভার্মিকম্পোস্ট প্রযুক্তি
ড. মো: আজিজুল হক
বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে একই জমিতে বার বার উচ্চফলনশীল শস্যের চাষাবাদ করা হচ্ছে। ফলে মৃত্তিকা থেকে অধিক পুষ্টি উপাদান আহরণের কারণে জৈব পদার্থসহ উদ্ভিদ খাদ্যোপাদানের ঘাটতি দিন দিন বেড়েই চলেছে। সুষম ও পরিমিত রাসায়নিক সার ব্যবহার না করার কারণে এই সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। দিন দিন অধিক সংখ্যক পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি উদঘাটিত হচ্ছে। সমস্যা হতে পরিত্রান পেতে হলে জমিতে রাসায়নিক সারের পাশাপাশি পরিমাণমত জৈব সার ব্যবহার করতে হবে।
ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার একটি জৈবসার যা কেঁচো ও প্রাকৃতিকভাবে বিদ্যমান অনুজীবের জৈবনিকক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে গোবর ও অন্যান্য পচনশীল জৈব পদার্থ পঁচিয়ে তৈরি করা হয়। কেঁচো পচনশীল জৈব পদার্থ খেয়ে যে বিষ্ঠা ত্যাগ করে তাকেই ভার্মিকম্পোষ্ট বা কেঁচো সার বলা হয়।
ফসল উৎপাদন ও জমির উর্বরতা বজায় রাখতে ভার্মিকম্পোস্টের গুরুত্ব অনেক কিন্তু পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে দেশে উদ্যোক্তা ও কৃষকগণ যথেষ্ট পরিমাণ ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন করতে পারছে না। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা), মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ তিন প্রজাতির কেঁচো (ঊরংবহরধ ভবঃরফধ, চবৎরড়হুী বীপধাধঃঁং এবং ঊঁফৎরষঁং বঁমরহধব) ব্যবহার করে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরির বিভিন্ন কলাকৌশল উদ্ভাবন করেছে এবং তা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি, কৃষক প্রশিক্ষণ প্রভৃতির মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
ভার্মিকম্পোস্টের গুরুত্ব
ভার্মিকম্পোস্ট ফসল উৎপাদন ও জমির উর্বরতা রক্ষায় এবং আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
মৃত্তিকার ভৌত গুণাবলিতে প্রভাব : ১) পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে, ২) মাটির গঠন উন্নত করে, ৩) বায়ু চলাচল বৃদ্ধি করে, ৪) মৃত্তিকার রং পরিবর্তন করে, ৫) মাটি ঝুরঝুরে করে, ৬) ইনফিল্ট্রেশন বা অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি করে, ৭) মাটির ক্ষয়রোধ করে।
মৃত্তিকার রাসায়নিক গুণাবলিতে প্রভাব : ১) মৃত্তিকার পিএইচ নিয়ন্ত্রণ করে, ২) মৃত্তিকার লবণাক্ততা হ্রাসে সহায়তা করে, ৩) উদ্ভিদের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপদানসমূহ মাটিতে সরবরাহ করে, ৪) মাটিতে জৈব পদার্থ ও হিউমাস সমৃদ্ধ করে। উচ্চ মাত্রায় হিউমিক এসিডের ধারক ও বাহক যা সমস্ত উদ্ভিদ পুষ্টি উপাদানের আধার, ৫) মাটির বিষাক্ততা দূর করে এবং ৬) ভার্মিকম্পোস্টিং গ্রিন হাউজ গ্যাস নিসরণ কমায়।
মাটির জৈবিক গুণাবলিতে প্রভাব : ১) ভার্মিকম্পোস্টে সহজাতভাবে বিভিন্ন ধরণের উপকারী অনুজীব বিদ্যমান থাকে ফলে মৃত্তিকায় অনুজৈবিক বৈশিষ্টকে উন্নত করে, ২) মৃত্তিকাস্থ বিভিন্ন রোগ জীবাণুর বৃদ্ধিতে বাধা দিয়ে গাছকে রক্ষা করে। ৩) বহু রকম গ্রোথ হরমোন ও এনজাইমের ধারকবাহক যা মাটির খাদ্যোপাদান সহজলভ্যতায় এবং উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং ৪) ভার্মিওয়াশ (কেঁচো ধুয়া নির্ঝাস) মৃত্তিকায় অনেক রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করে এবং তরল জৈবসার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
পরিবেশকে উন্নতকরণ ও আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা : ১) অনেক ফেলনা আবর্জনা-খড়-কুটা, পয়:নিষ্কাশিত দ্রব্য ব্যবহৃত হয় বিধায় পরিবেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ২) কৃষক খামারজাত গোবর ও অন্যান্য জৈব পদার্থ ব্যবহার করে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরি করতে পারে এবং রাসায়নিক সারের পরিবর্তে ব্যবহার করে উৎপাদন খরচ কমানোর মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি করতে পারে, ৩) ব্যবসায়ীগণ ভার্মিকম্পোস্ট কারখানা তৈরি করে বাণিজ্যিক উৎপাদনের মাধ্যমে অর্থ আয় করতে পারে। ৪) কর্মস্থান ও শ্রম চাহিদার সুযোগ তৈরি করে।
ভার্মিকম্পোস্ট তৈরির পদ্ধতিসমূহ
সারা বিশ্বে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরি করা হয়। খরচ, জিনিসপত্রের সহজলভ্যতা, উদ্দেশ্য, উৎপাদনের পরিমাণ, বিরাজমান পরিবেশ প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে ভার্মিকম্পোস্টিং পদ্ধতি নির্বাচন করা হয়। ছোট আকারের একটি ভার্মিকম্পোস্ট খামার তৈরিতে আনুমানিক খরচ টেবিল-১ দ্রষ্টব্য।
ভার্মিকম্পোস্ট তৈরির কার্যক্রমকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে-
ঘর বা শেড নির্মাণ : ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদনের মাত্রার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন আকারের ঘর বা শেড সহজলভ্য জিনিসপত্র যেমন-টিন, বাঁশ, কাঠ, কুঁড়ে ঘর পভৃতির সমন্বয়ে নির্মাণ করা যায় যাতে ভার্মিকম্পোস্ট বেড বা হাউজ ছায়াযুক্ত হয় এবং রোদ ও বৃষ্টি থেকে রক্ষা পায়।
ভার্মিকম্পোস্টিং বেড বা হাউজ তৈরি : নিম্নে ভার্মিকম্পোস্টিং হাউজ তৈরির বিভিন্ন পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো।
সিমেন্টের রিং : রিং-এর উচ্চতা ১ হতে ২ ফুট এবং ব্যাস ২.৫ হতে ৩ ফুট হতে পারে। সিমেন্ট রিং পাকা জায়গায় বসানো যেতে পারে অথবা নিচে ঢালাই স্লাব বা মোটা ফ্লোর মেট ব্যবহার করা যেতে পারে।
সিমেন্টের চারি : উচ্চতা ১.৫ ফুট এবং ব্যাস বা চওড়া ২.৫ ফুট হতে পারে। তবে স্থান ভেদে সামান্য কম-বেশি হতে পারে। চারির নিচে মাটি থেকে সামান্য উঁচুতে দুই পাশে হাতের আঙুলের সমান ব্যাসার্ধের দুইটি ছিদ্র থাকা দরকার যাতে জমাকৃত রস বা পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা বজায় থাকে।
ইটের স্থায়ী ট্যাংক/বক্স/আয়তকার চৌবাচ্চা : স্থায়ীভাবে ইটের ৫ ইঞ্চি গাথুনী দিয়ে ট্যাংক/বক্স/আয়তকার চৌবাচ্চায় সব ধরণের ভার্মিকম্পোস্ট তৈরি করা যায়। এতে ২.৫ ফুট উচ্চতা ও ২.৫ ফুট প্রস্থ এবং প্রয়োজন মাফিক লম্বা যেতে পারে। তবে ৪-৫ ফুট দীর্ঘ হলে ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবস্থাপনা সুবিধা হয়। তা ছাড়াও অনুরূপ দৈর্ঘের অনেকগুলো চ্যাম্বার করা হলে বিভিন্ন রকম জৈব পদার্থ বা তাদের মিশ্রণ ব্যবহার করে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরি করা যেতে পারে। অধান্তঃচ্যাম্বারে ছিদ্র রেখে তৈরি করলে পরিপক্ব ভার্মিকম্পোস্ট থেকে কেঁচো পৃথক করার সুবিধা পাওয়া যায় কারণ পরিপক্ব কম্পোস্টে খাবারের অভাবে কেঁচো আপনাআপনি অপেক্ষাকৃত নতুন চ্যাম্বারের জৈব পদার্থে গমন করবে। ইট সামান্য ফাঁক-ফাঁক করে গাথুনী দিলে বায়ু চলাচল বৃদ্ধি পায় যা ভার্মিকম্পোস্ট তৈরিতে সুবিধা হয়। বায়ু চলাচল ও অন্ধকার অবস্থায় কেঁচোর কার্যক্রম বৃদ্বি পায়। তাই ট্যাংক/বক্স/আয়তকার চৌবাচ্চা ছিদ্রযুক্ত চটের ছালা দ্বারা ঢেকে রাখতে হবে।
প¬াস্টিকের ট্যাংক/ ড্রাম/ট্রে : উচ্চতায় ২-২.৫ ফুট এবং ব্যাসে ২ ফুট আকারের প্লাস্টিকের ট্যাংক/ ড্রাম/ট্রে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে তা অবশ্যই ছায়াযুক্ত শীতল স্থানে স্থাপন করতে হবে। তাপে প্লাস্টিকের ট্যাংক গরম হয় বিধায় কখনও রোদে বা রোদের তাপ লাগে এমন জায়গায় রাখা যাবে না। এ পদ্ধতির একটি সুবিধা হলো হালকা হওয়ায় সহজেই স্থানান্তর করা যায়।
খাবার হিসেবে জৈব পদার্থ বা তাদের মিশ্রণ দিয়ে হাউজ ভরাট করা ও কেঁচো প্রয়োগ : অসংখ্য জৈব পদার্থ ও তাদের মিশ্রণ হাউজে ভরাট করে ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন করা যায়। নি¤েœ বিভিন্ন জৈব পদার্থ দিয়ে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরির প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হলো।
গোবরের তৈরি ভার্মিকম্পোস্ট : শুধুমাত্র গোবরের ভার্মিকম্পোষ্ট নিম্মরূপভাবে তৈরি করা যায়-
উপরের যে কোন একটি হাউজ যেমন-সিমেন্ট রিং, চারি প্রভৃতির একটি নির্বাচন করতে হবে।
১৫-২০ দিনের গ্যাস মুক্ত গোবর দ্বারা ৮-১০ ইঞ্চি ভরাট করতে হবে।
তারপর সংগ্রহকৃত কেঁচো উক্ত গোবরে ছেড়ে দিতে হবে। প্রতি ৪ বর্গফুটে ২০০-২৫০ টি কেঁচো তবে বেশি হলে ক্ষতি নাই।
অন্ধকার প্রদান ও বায়ু চলাচলের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্রযুক্ত ঢাকনা দ্বারা ঢাকতে হবে।
সময়মতো উপরে বর্নিত নিয়মে পরিচর্যা করতে হবে।
৪৫-৬০ দিনের মধ্যে ভার্মিকম্পোস্ট সংগ্রহ শুরু করা যেতে পারে।
গোবর ও বিভিন্ন জৈব পর্দাথের মিশ্রণ ব্যবহার করে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরি টেবিল-২ দ্রষ্টব্য।
গোবরের সাথে বিভিন্ন জৈব পর্দাথ বা তাদের মিশ্রণ মিশিয়ে ভার্মিকম্পোষ্ট তৈরি করা যায়- যেমন-(ক) গোবর (১/২ ভাগ) + কচুরিপানা (১/৪ ভাগ) + ধানের খড় (১/৪ ভাগ) বা সরিষার খড় বা রান্না ঘরের বর্জ্য (১/৪ভাগ) প্রভৃতি ব্যবহার করা যেতে পারে।
টেবিল ২ : গোবর ও অন্যান্য জৈব পদার্থ স্থাপনের ধাপসমূহ
উপরের টেবিলে প্রদর্শিত নিয়মে প্রথমে ২ ইঞ্চি গোবরের স্তর তারপর অন্য জৈব পদার্থের স্তর সমূহ পর্যায়ক্রমে গোবরের স্তরের সাথে স্থাপন করে মোট ৩ ফুট পর্যন্ত উঁচু করে অথবা হাউজের উচ্চতা অনুযায়ী ভরাট করতে হবে। তবে সবার উপরের স্তর অবশ্যই গোবর দিয়ে শেষ করতে হবে।
২১ দিন থেকে ২৮দিন পর্যন্ত মাদা ঢেকে রাখতে হবে এবং মাঝে মধ্যে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। এ সময় প্রচুর তাপ তৈরি হয়। এ জন্য এ ধাপে কেঁচো ছাড়া যাবে না।
অতপর কম্পোষ্ট গাদা ওলট-পালট করে উপরে সমান করে পুনরায় ১-১.৫ ইঞ্চি পুরু গোবর দিয়ে প্রতি ৪ বর্গফুটে ১৫০-২০০ টি কেঁচো ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। তবে ওলট-পালট না করেও সরাসরি গাদাতে কেঁচো প্রয়োগ করা যায়। যখন কোন রকম দূর্গন্ধ থাকে না এবং জৈব পদার্থ কালো-বাদামী বর্ণের ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়ে যায় তখন বুঝতে হবে ভার্মিকম্পোস্ট সংগ্রহের উপযুক্ত হয়েছে। চালুনী দ্বারা কেঁচো ও কম্পোস্ট পৃথক করা যেতে পারে। অপচনকৃত দ্রব্য পুনরায় স্তুপ করে অবশিষ্টাংশটাও ভার্মিকম্পোস্টে পরিণত করতে হবে। এ ভাবে বিভিন্ন জৈব পদার্থ ও গোবরের মিশ্রনে কেঁচো প্রয়োগ করে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরি করা যায়।
ভার্মিকম্পোস্টে বিদমান পুষ্টি উপাদান : ভার্মিকম্পোস্টে উদ্ভিদ পুষ্টি উপাদান সব সময় এক হয় না। ভার্মিকম্পোস্ট তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামালের উপর নির্ভর করে উদ্ভিদ পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন হয়। বিনায় তৈরিকৃত ভার্মিকম্পোস্টে গড়ে ১৫-১৮% জৈব কার্বন, ১.৪২-২.০ % নাট্রোজেন, ১.৪৫-১.৭৫% ফসফরাস, ১.৫২-৩.৫% পটাশিয়াম ও ০.৩৫-৪৫% সালফার এবং উল্লেখযোগ্য পরিমানে গৌণ পুষ্টি উপাদান থাকে।
ভার্মি কম্পোস্টিংকালীন আন্তঃপরিচর্চা
ভার্মিকম্পোস্টিং এর জন্য সহায়ক উপাদান সমূহ : ১) পর্যাপ্ত ছায়াযুক্ত শীতল স্থান বা পরিবেশ বজায় রাখা, ৩) ১৫-২০ দিন বয়সের গ্যাসমুক্ত গোবর বা অন্য আংশিক পঁচা জৈব পদার্থের ব্যবহার, ৪) পর্যাপ্ত আর্দ্রতা (৫০-৭০%) বজায় রাখা। ৫) পর্যাপ্ত অন্ধকার ও বায়ুচলাচল অবস্থা বজায় রাখা। এ জন্য চটের ছালা হাউজের বা রিং বা চারি বা চৌবাচ্চার উপরে বিছিয়ে দিতে হবে। ৬) গোবরের সাথে অপেক্ষাকৃত ধীর পচনশীল বা উচ্চমাত্রার কার্বন বিশিষ্ট জৈব পদার্থ ( খড় জাতীয় দ্রব্য) ব্যবহার করা হলে শতকরা ৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার ছিটিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে, ৭) উপযুক্ত নিষ্কাশন অবস্থা বজায় রাখা, ৮) দুর্গন্ধ মুক্ত রাখা। তীব্র দূর্গন্ধ তৈরি হলে জৈব পদার্থ ওলট-পালট করে দেওয়া যেতে পারে, ৯) আদর্শ তাপমাত্রা (২০-৩০০ সে.) বজায় রাখা ১০) আদর্শ অম্লমান ৭.৫-৮.০ বজায় রাখা।
ভার্মিকম্পোস্টিং-এর জন্য ক্ষতিকর উপাদানসমূহ
ভার্মিকম্পোস্ট তৈরির সময়কালীন নি¤েœর ক্ষতিকর বিষয় সমূহ থেকে ভার্মিকম্পোস্টকে রক্ষা বা তৈরি প্রক্রিয়াকে নিরবচ্ছিন্ন রাখতে হবে। যেমন : ১) উচ্চ তাপমাত্রা/সরাসরি সূর্যের আলো, ২) অতিরিক্ত পানি/বৃষ্টির পানি জমে থাকা, ৩) বায়ু চলাচলহীন অবস্থা, ৪) হাঁস-মুরগী, পাখী, ইঁদুর, চীকা, সজারু, বেজী প্রভৃতি, ৫) পিঁপড়া বিশেষ করে লাল পিঁপড়া, সাদা ও লাল মাকড়/মাকড়াসা, কেঁল্লা, উরচূঙ্গা, তেলাপোকা, সাপ, ব্যাঙ প্রভৃতি, ৬) টক/এসিড তৈরি করে এমন দ্রব্য (যেমন-কাঁচা আনারসের ছোবরা, ফ্রেস কিচেন ওয়েস্ট) এবং ৭) অতিরিক্ত দূর্গন্ধযুক্ত গ্যাস তৈরি হলে।
ভার্মি কম্পোস্টের ব্যবহার ও উপকারিতা
ভার্মিকম্পোস্ট ছাদবাগানে, উদ্যানতাত্বিক (যেমন-সবজি, ফুল-ফল, মসলা প্রভৃতি) এবং মাঠ ফসলে (যেমন-ধান, সরিষা, পাট, গম প্রভৃতি) ব্যবহার উপযোগী। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য।
ফসলের চাহিদা ও মাটির গুনাগুনের উপর ভিত্তি করে ভার্মিকম্পোস্ট ও সারের মাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। ফসল ভেদে ১৫০০-২০০০ কেজি/হে.ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহারে ১৫-২০% রাসায়নিক সার সাশ্রয় করা যেতে পারে।
জমি প্রস্তুতের শেষ চাষের সময়ে অন্যান্য সার প্রয়োগের সময়েই ভার্মিকম্পোস্ট প্রয়োগ করা যায়।
তৈরি পদ্ধতি সহজ। কৃষক তার খামার জাত জৈব পদার্থ ও কেঁচো ব্যবহার করে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরি করতে পারবে।
খামার জাত অবদ্রব্যের ব্যবহার নিশ্চিত করে পরিবেশকে স্বাস্থ্য সম্মত রাখে।
এতে টেকসইভাবে মৃ্ত্িতকার স্বাস্থ্য ও উর্বরতা সুরক্ষিত করতে ভূমিকা রাখে।
পরিবেশ বান্ধব, সাশ্রয়ী, কর্মসংস্থান বৃদ্ধিজনক এবং লাভজনক।
ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদনে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও কৃষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রযুক্তিটি সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে বাংলাদেশের মাটির টেকসই স্বাস্থ্য রক্ষা হবে, রাসায়নিক সার সাশ্রয় হবে, মাটির উর্বরতা সংরক্ষিত হবে, ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, জৈব পদার্থের পুনর্ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে, পরিবেশ উন্নত হবে, গ্রামীন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং সর্বোপরি কৃষকের আয় বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। তাই বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ভার্মিকম্পোষ্ট উৎপাদনে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও কৃষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রযুক্তিটি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
“জৈব পদার্থ যার ভার্মি কম্পোস্ট তার”
লেখক : সিএসও এবং প্রধান, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাকৃবি ক্যাম্পাস ময়মনসিংহ। মোবাইল: ০১৭১৬৬২৭৩০৩, ই-মেইল : azizul_bina@yahoo.com
টেকসই কৃষি উৎপাদনে মাটির দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সুরক্ষা
মো: মোহসীন ফরাজী
উন্নয়নশীল বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার মূল চালিকাশক্তি হলো কৃষি। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের ৮৭,২২৩টি গ্রামে বাস করে দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ এবং প্রায় ১১ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কৃষি উৎপাদন বেড়েই চলছে। দেশে আবাদি জমি, বনভূমি, নদী, লেক, বনাঞ্চল মিলিয়ে মোট জমির পরিমাণ এক কোটি ৪৭ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। যার ৫৬ শতাংশ জমিতে ফসলের জন্য আবাদ করা হয়। দেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে গিয়ে শস্যের নিবিড়তা বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু দিনদিন মাটির উৎপাদনশীলতা ও উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। ফসল উৎপাদনের জন্য ভালো বীজ ও উত্তম ব্যবস্থাপনা যেমন প্রয়োজন তেমনি মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষারও বিকল্প নেই। উপযুক্ত মাটি না হলে অর্থাৎ ফসলের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সমৃদ্ধ মাটি না হলে দীর্ঘমেয়াদে কাক্সিক্ষত উৎপাদন টিকিয়ে রাখা অসম্ভব।
মটির স্বাস্থ্যহীনতার উল্লেখযোগ্য কারণসমূহ : মাটির সঠিক যতেœর অভাবে সুফলা মাটি তার ভারসাম্যতা হারাচ্ছে এবং স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছে। নানা কারণে মাটির স্বাস্থ্যহীন হয়ে থাকে:
অম্লধর্মী ইউরিয়া, অ্যামোনিয়া সালফেট প্রভৃতি নাইট্রোজেন সার প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহারে মাটির অম্লত্ব বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের প্রায় ৪.৬ মিলিয়ন হেক্টর আবাদি জমি বিভিন্ন মাত্রায় অম্লত্বের শিকার।
লবণের কারণে ফসলের উৎপাদন ৭০ শতাংশ কমে যায়। রোপা আমনে তেমন ক্ষতি না হলেও রবিশস্য লবণ সহ্য করতে পারে না। লবণ বিস্তারের কারণে তিন ফসলি জমি এক ফসলি হয়ে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে শস্যবিন্যাস। লবণাক্ত মাটিতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং জিঙ্কের পরিমাণ কমে যায়। ইতোমধ্যে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৮টি জেলার ৯৬টি উপজেলা বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততায় আক্রান্ত। বিগত চার দশকে লবণাক্ত আক্রান্ত জমির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ। লবণাক্ততার কারণে বর্তমানে উপকূলবর্তী এলাকায় শস্য নিবিড়তা মাত্র ১৩৩ শতাংশ।
দেশের মোট আবাদি জমির সাড়ে ৮০ শতাংশে জৈব ঘাটতি মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। জৈব পদার্থের ঘাটতিজনিত কারণে মাটিতে উপকারী অনুজীবের পরিমাণ কমে যাচ্ছে অর্থাৎ মাটির প্রকৃতি বা পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে।
গাছের/ফসলের প্রয়োজনীয় ১৬টি উপাদানের যে কোনো একটি যদি মাটিতে সঠিক মাত্রায় ও সহজলভ্য আকারে না থাকে; তবে মাটির স্বাস্থ্যের ব্যত্যয় ঘটে। দেশের ৫৪ লাখ হেক্টর জমিতে ফসফরাস, ২৬ দশমিক ৩০ লাখ হেক্টর জমিতে পটাশিয়াম, ৩৩ দশমিক ৩০ লাখ ৮ হাজার হেক্টর জমিতে গন্ধক, ২৭ দশমিক ৭ লাখ হেক্টর জমিতে দস্তা সার, ২৩ দশমিক ৯ লাখ হেক্টর জমিতে বোরন সার ও ৪৬ লাখ হেক্টর জমিতে সালফারের অভাব রয়েছে ।
অপরিকল্পিত ও যথেচ্ছভাবে রাসায়নিক সার ব্যবহারে মৃত্তিকা স্বাস্থ্য নষ্ট হচ্ছে। মাটিতে পুষ্টি উপাদানের বিষাক্ততা দেখা দিচ্ছে। অনেক কৃষক সুষমমাত্রায় সার ব্যবহার না করে অধিকহারে অনুমানভিত্তিক সার ব্যবহার করেন ফলে মাটির ইকোসিস্টেম ধ্বংস হচ্ছে। এক দশক আগেও জমিতে দুই থেকে তিন ধরনের সার ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে সব মিলিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে অন্তত ১৭ ধরনের সার। একেকটি ফসল উৎপাদনে ব্যবহার করা হচ্ছে ৮ থেকে ৯ ধরনের সার ও কীটনাশক। এছাড়াও মাত্রাতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ সেচের পানি ব্যবহার, রাসায়নিক সার, কীটনাশকে মাত্রাতিরিক্ত দূষক পদার্থের উপস্থিতি (লেড, ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক, মার্কারি, ক্রোমিয়াম নিকেল) মাটির দূষণ ঘটাচ্ছে।
অপ্রয়োজনে বেশি সংখ্যক চাষের মাধ্যমে ও বেশি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে মাটির সংযুক্তি নষ্ট হচ্ছে।
পাহাড়ি এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে জুম চাষের কারণে ভূমিক্ষয়ের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে ভূমি অবক্ষয় পরিবীক্ষণ টাস্কফোর্সের পরিচালিত ১৯৮৮ সালের এক জরিপ থেকে জানা যায়, পাহাড়ি জমির প্রায় ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ভূমি ক্ষয়ের ঝুঁকির আশঙ্কায় রয়েছে।
এ ছাড়াও প্রতি বছর মৃত্তিকা ক্ষয়, নগরায়ণ, আবাদি জমিতে স্থাপনা নির্মাণ, রাস্তাঘাট, খনিজ কর্মকা-, জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষত দীর্ঘমেয়াদি খরা প্রভৃতির কারণে মাটির স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে।
মাটির দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করনীয়
ভূমি ক্ষয় রোধ : মাটির উপরিভাগ সাধারণত ৭-৮ ইঞ্চি গভীরতা পর্যন্ত ফসলের পুষ্টি উপাদান থাকে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, পানি প্রবাহ, বাতাসের গতিরোধ ইত্যাদি কারণে উপরিভাগের মাটি স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে সঞ্চিত পুষ্টি উপাদান বিনষ্ট হয়ে মাটির উর্বরতা হ্রাস পায়। তাই বৃষ্টি ও বন্যার পানি গড়ানের সময় যাতে জমির উপরিভাগের মাটি অপসারিত না হয় এবং নালা ও খাদের সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া পাহাড়ি এলাকার মৃত্তিকায় ফসল উৎপাদনের উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে।
সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ : বিভিন্ন ফসল মাটি থেকে বিভিন্ন পরিমাণে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে থাকে। তাই ঘাটতি পূরণের জন্য জমিতে জৈব ও রাসায়নিক সারের সমন্বয়ে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করা উচিত।
বাংলাদেশে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) মাটির গুণাগুণ রক্ষার্থে কৃষকের জমির মাটি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে সুষম মাত্রার সার ব্যবহারের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনের জন্য সেবা প্রদান করে আসছে। ভালো হয় কৃষক পর্যায়ে স্বল্প মূল্যে মাটি পরীক্ষার কিটের বিস্তার ঘটানো, যাতে প্রয়োজন অনুযায়ী কৃষকরা তাদের মাটি পরীক্ষা এবং সেই অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে পারেন।
জৈব পদার্থ ব্যবহার : জৈব উপাদানের ওপর মাটির জৈব ও রাসায়নিক গঠন নির্ভর করে এবং এটি মাটির পরিবর্তনের সঙ্গেও জড়িত। জৈব পদার্থ বেড়ে গেলে মাটির টেক্সচার, স্ট্রাকচার ভালো হয়। মাইক্রো অর্গানিজম অ্যাক্টিভ হয় যেটা গাছের জন্য জরুরি। ফলে জৈবসার রাসায়নিক সারের তুলনায় মাটির জীববৈচিত্র্য ৩০ শতাংশ বাড়ায়। আদর্শ উর্বর জমিতে মাটির শতকরা ৫ ভাগ জৈব পদার্থ থাকা দরকার অথচ আমাদের দেশের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ কমতে কমতে ২ শতাংশ এমনকি কোথাও কোথাও তা ১ শতাংশের নিচে চলে এসেছে। জমিতে রাসায়নিক সারের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য মাটিতে কমপক্ষে ৩ শতাংশ হারে জৈব পদার্থ থাকা দরকার।
উপযুক্ত শস্যবিন্যাস অনুসরণ : জমিতে প্রতি বছর একই ফসল বা একই ধরনের ফসলের চাষ করলে একটি নির্দিষ্ট স্তরের নির্দিষ্ট পুষ্টি, উপাদান নিঃশোষিত হয়ে উর্বরতা বিনষ্ট হয়। তাই পর্যায়ক্রমে গুচ্ছমূল জাতীয় ফসলের পর প্রধান মূলজাতীয় ফসল, একবীজপত্রীর পর দ্বিবীজপত্রীর ফসল এবং অধিক খাদ্য গ্রহণকারীর পর অল্প খাদ্য গ্রহণকারী ফসল আবাদ করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ করা যেতে পারে। মাটি, প্রভৃতি এবং ভৌগোলিক অবস্থান ভেদে উপযুক্ত শস্যবিন্যাস অনুসরণ করতে হবে। ক্রপিং প্যাটার্নে সবুজসার তৈরির বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে।
ডালজাতীয় ফসলের চাষ : জমিতে মাঝে মধ্যে ডালজাতীয় ফসলের চাষ করে এ ঘাটতি অনেকাংশে পূরণ করা যায়। কারণ এগুলো শিকড়ে রাইজোবিয়াম নামক ব্যাকটোরিয়া বসবাস করে এবং বায়ু থেকে নাইট্রোজেন আহরণপূর্বক গুটিতে সঞ্চয় করে ও পরিণামে মাটির উর্বরতা বাড়ায় ।
জমিকে বিশ্রাম দেয়া : দীর্ঘদিন ধরে কোনোরূপ বিশ্রাম ছাড়া নিবিড় চাষাবাদ করা হলে মাটির ভৌত রাসায়নিক ও জৈব গুণাবলির অবনতি ঘটে। তাই কয়েক বছর পর অন্তত এক মৌসুমের জন্য জমি পতিত রেখে বিশ্রাম দেয়া প্রয়োজন। অবশ্য এ সময়ে জমিতে সবুজ সারের চাষ বা নিয়মিত পশু চারণের ব্যবস্থা করলে ভূমির উর্বরতা আরও বৃদ্ধি পায়।
চাষাবাদ পদ্ধতির উন্নয়ন : জমি সব সময় একই গভীরতায় কর্ষণ করলে ওই গভীরতার নিচে একটা শক্ত স্তরের সৃষ্টি হয় এবং ওই স্তরের নিচ থেকে খাদ্যোপাদান আহরণ করতে পারে না। তাই ভূমি কর্ষণের গভীরতা ও অন্যান্য আবাদ প্রক্রিয়া মাঝে মাঝে পরিবর্তন করা উর্বরতা সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য সহায়ক। বিনা কর্ষণে চাষের যন্ত্র দিয়ে কোনরকম কর্ষণ ছাড়াই একসঙ্গে সার ও বীজ সারিতে প্রয়োগ করলে ফসলের উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনই মাটির গঠন উন্নত হয়, মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং ভূমিক্ষয়ও কম হয়।
কনজারভেশন পদ্ধতিতে (ফসলের অবশিষ্টাংশ জমিতে রেখে সর্বনিম্ন চাষের মাধ্যমে জমি ব্যবহার) জমি চাষ, ফষল এবং মাটি উভয়ের জন্যই সহায়ক।
ক্ষতিকর রোগ ও পোকামাকড় এবং আগাছা দমন : মাটিতে অনেক সময় ক্ষতিকর রোগ ও কীটের জীবাণু বা ডিম থাকে এবং ফসল উৎপাদনকালে সেগুলো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। পর্যায়ক্রমে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে জমি চাষ করলে এবং মাটি রোদে শুকিয়ে নিলে সেগুলো বিনষ্ট হয়ে যায় এবং মাটির উন্নয়ন সাধিত হয়। নির্দিষ্ট সময় অন্তর ফসলের ধরন পরিবর্তন জমির আগাছা দমনে সহায়ক, পোকামাকড়ের আক্রমণ কমায়, ফসলের রোগবালাই কম হয়, সর্বোপরি ফসলের ফলন বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে সঠিক সময়ে সঠিক কৌশলে উপযুক্ত বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে।
মৃত্তিকা জীবাণু সংরক্ষণ : মাটিতে অসংখ্য হিতকর জীবাণু থাকে এবং এরা ফসফরাস, লৌহ প্রভৃতি অদ্রবণীয় পদার্থসমূহকে পানিতে দ্রবণীয় পদার্থে রূপান্তর ও বায়ু থেকে মাটিতে নাইট্রোজেন সংযুক্ত করে ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। তাই মাটিকে এমনভাবে পরিচর্যা করা দরকার যেন মৃত্তিকা জীবাণুসমূহের বসবাসের পরিবেশ সমুন্নত থাকে।
পাক মাটি ও বোঁদ মাটি ব্যবহার : সাধারণত বৃষ্টিপাত ও বন্যার পানির সাথে মাটির উপরিভাগের পুষ্টি উপাদান ও জৈব পদার্থ অপসারিত হয়ে পথিমধ্যে পুকুর, ডোবা, নালা প্রভৃতির তলদেশে জমা হয়। এভাবে জমাকৃত মাটিকে পাক মাটি বা বোঁদ মাটি বলে এবং এটা খুবই উর্বর হয়। শুষ্ক মৌসুমে ওই মাটি কেটে আবাদি জমিতে মিশিয়ে দিলে মাটির উৎকর্ষ সাধিত হয়। তাই ফসল আবাদের লক্ষ্যে উপরিউক্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণের মাধ্যমে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত ভীতিকর। গবেষকরা বলছেন জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রক্রিয়ায় ২০৬০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান ফসলগুলোর ফলন ব্যাপক হারে হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ অবস্থায় খাদ্যনিরাপত্তার জন্য টেকসই মাটির উর্বরতা ব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা নীতিমালা সুপারিশ করেছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এ নীতিমালা অনুসারে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পণা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি। তা না হলে বৈশ্বিক পরিবর্তিত জলবায়ুর বিরূপ প্রক্রিয়া মোকাবেলা করে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। এছাড়াও এসডিজির ১, ২, ৩, ৬, ১২, ১৪ ও ১৫ নং লক্ষ্য অর্জন লাগসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। কাজেই জাতিসংঘের ‘এসডিজি’ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উত্তম মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় ক্রপ জোনিং, ক্রপ প্ল্যানিং, সয়েল প্ল্যানিং করতে হবে। মৃত্তিকা স্বাস্থ্য রক্ষায় আইন প্রণয়ন প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকার মাটির টেকসই ব্যবহারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইসস্টিটিউট, বিভাগীয় গবেষণাগার, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১১১৫৪৫৬৮। ই-মেইল : farazi@srdi.gov.bd
মানসম্পন্ন আদা উৎপাদন ও সংরক্ষণে
লাগসই কৌশল
ড. মো. আলাউদ্দিন খান১ ড. মো. আশিকুল ইসলাম২ মো. মুশফিকুর রহমান৩
আদা (তরহমরনবৎ ড়ভভরপরহধষব জড়ংপ.) বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় অন্যতম প্রধান মসলা ফসল। ইহা প্রধানত ভারত, চীন, জাপানসহ এশিয়া মহাদেশে ব্যাপকভাবে উৎপাদন হয়ে থাকে। বাংলাদেশের লালমনিরহাট, রংপুর, দিনাজপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, বগুড়া, চট্টগ্রাম ইত্যাদি জেলার উঁচু জমি এবং রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির পাহাড়ের ঢালে আদা চাষ হয়ে থাকে। খাদ্য সংরক্ষণ শিল্পে আদার ব্যবহার অত্যন্ত সুস্পষ্ট। আদার সৌরভ ও সুগন্ধযুক্ত (টারপিনয়েড) যৌগগুলো হলো জিঞ্জিবেরেন, সিনিওল, টারপিনিওল, বোরনিওল, ফিলানড্রেন, লিনালোল ইত্যাদি। ঝাঁঝালো (ওলিওরেজিন) পদার্থগুলো হলো জিঞ্জেরল এবং শোগাওল। প্রতি ১০০ গ্রাম টাটকা আদায় আমিষ ২.৩ গ্রাম, শে^তসার ১২.০ গ্রাম, আঁশ ২.৫ গ্রাম, খনিজ পদার্থ ১.২ গ্রাম, লিপিড ১.০ গ্রাম এবং পানি ৮১.০ গ্রাম বিদ্যমান। আদা বিভিন্ন ঔষধিগুণ সম্পন্ন যেমন, সর্দি-কাশি, পেটফাঁপা, হজমে সমস্যা, কোলেস্টরল, এজমা ইত্যাদি নিরাময়ে কাজ করে থাকে। বর্তমানে দেশে বছরে প্রায় ৪.৮১ লাখ মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমিতে মাত্র ০.৮২ লাখ মেট্রিক টন আদা উৎপাদন হয়ে থাকে। অবশিষ্ট বিপুল পরিমাণ ঘাটতি আদা বৈদেশিক মূদ্রা ব্যয় করে থাইল্যান্ড, চায়না ইত্যাদি দেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। ভালোভাবে আদা চাষ করতে পারলে এ অর্থকরী ফসল দেশের অনেক আদা উৎপাদনকারীকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্য করে থাকে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ২টি পদ্ধতিতে যেমন, (ক) জমিতে ও (খ) বস্তায় বা পাত্রে আদা চাষ করা হয়ে থাকে। বর্ণিত ২টি পদ্ধতিতে মানসম্পন্ন আদা উৎপাদনের লক্ষ্যে আদার বীজ-রাইজোম নির্বাচন ও সংরক্ষণের লাগসই কৌশল প্রয়োগ খুবই জরুরি। নিম্নে বীজ-রাইজোম নির্বাচন ও সংরক্ষণের লাগসই কৌশল বর্ণনা করা হলো।
উন্নত জাত নির্বাচন
মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, বগুড়া কর্তৃক এ পর্যন্ত ৩টি জাত যথা বারি আদা-১ (ফলন ৩০-৩২ টন/হেক্টর), বারি আদা-২ (ফলন ৩৬-৩৮ টন/হেক্টর) ও বারি আদা-৩ (ফলন ২৮-২৯ টন/হেক্টর) উদ্ভাবন করা হয়েছে। আদার জাতের ভিন্নতার কারনে এর উৎপাদিত রাইজোমের গুণগতমানেরও ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। মসলা ও সবজি হিসেবে চাষকৃত আদার জাতের রাইজোমের গুণগতমান একেবারেই ভিন্নরূপ। জাত অবশ্যই উচ্চ শুষ্ক পদার্থ, অত্যাবশ্যকীয় তেল ও ঝাঁঝালো সমৃদ্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। আদার রাইজোমে শুষ্কপদার্থের পরিমাণ ৯.০-২৩.৫% এবং ঝাঁঝালো পরিমাণ ৪.৩-১০.৫% পর্যন্ত হতে পারে। চায়না ও বাংলাদেশী জাতের আদায় সতেজ ওজন ভিত্তিতে যথাক্রমে ০.২১% ও ০.২৩% অত্যাবশ্যকীয় তেল থাকে। তাছাড়া চায়না ও দেশী আদার জাতের এ অত্যাবশ্যকীয় তেলে প্রধান উপাদান যথাক্রমে জিঞ্জিবেরেন (৩৮.১০%, ৪১.৪৯%), ফিলানড্রেন (১২.০%, ৯.৯২%), কারকিউমিন (৯.২২%, ১১.৫৮%) থাকে। বাংলাদেশী জাত ও চায়না জাতে যথাক্রমে ৪.৬১% ও ৪.৩২% আঁশ থাকে। চাষাবাদের জন্য রোগবালাই ও পোকামাকড় সহিষ্ণু/প্রতিরোধী জাত নির্বাচন করা উত্তম।
সঠিকভাবে পরিপক্ব বীজ-রাইজোম নির্বাচন
বীজ অবশ্যই ভালভাবে পরিপক্ব হওয়া আবশ্যক। উপযুক্তভাবে পরিপ্ক্বতা হওয়ার পূর্বেই বীজ সংগ্রহ করলে, তা অঙ্কুরোদগম হলেও তা থেকে সুস্থ ও সবল গাছ উৎপন্ন হবে না। রাইজোমের পরিপক্বতা বীজ/ক্লোন এর গুণগত মাননির্ণয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সঠিক সময়ে বীজ সংগ্রহ করলে উপযুক্ত পরিপক্বতা নিশ্চিত করা যায়। বৃষ্টি হওয়ার আগে শুষ্ক আবহাওয়ায় বীজ উত্তোলন করা উত্তম। মসলা হিসেবে ব্যবহারের লক্ষ্যে রোপণের ৮-৯ মাস পরে রাইজোম সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু মানসম্পন্ন আদা উৎপাদনের লক্ষ্যে রোপণের ১০-১১ মাস পরে ফেব্রুয়ারি মাসে গাছ যখন সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে যায় তখন বীজ-রাইজোম সংগ্রহ করা উত্তম। এ সময় সংগ্রহকৃত বীজের অংকুরোদগম খুবই ভালো হয়। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, মাঠ থেকে তুলনামূলকভাবে অধিকতর রোগমুক্ত বীজ-রাইজোম সংগ্রহের লক্ষ্যে, ক্লোন রোপণের ৬-৮ মাস পরে সবুজ অবস্থায় সুস্থ-সবল গাছের ঝাড় (ঈষঁসঢ়) কে চিহ্নিত করে রেখে দেয়া যেতে পারে।
উপযুক্ত আকারের বীজ-রাইজোম নির্বাচন
দেশীয় আদার জাতের ২-৩টি সুস্পষ্ট চোখ বিশিষ্ট এবং গড়ে ৪৫-৫০ গ্রাম ওজনের সমাকৃতির ক্লোন মানসম্পন্ন আদা উৎপাদনের জন্য উত্তম। রোপণকৃত ক্লোনের আকারের উপর শুষ্ক পদার্থের পরিমান নির্ভর করে। বড় আকারের ক্লোন রোপণ করলে এর ভেতরে সংরক্ষিত খাবার বেশি থাকার কারণে অঙ্কুরোদগমের মাধ্যমে সুস্থ্য ও সবল গাছ উৎপাদন হয়। ছোট আকারের বীজ থেকে মানসম্পন্ন ক্লোন পাওয়া যায় না। এখানে উল্লেখ্য যে, বড় আকারের বীজ রোপণ করলে বীজের পরিমাণ বেশি লাগে।
আদার ক্ষতিকর রোগবালাই
রাইজোম পঁচা রোগের কারণে আদার ৫০-৮০% এর বেশি ক্ষতি হতে পারে। ছত্রাক আদার মূল ও রাইজোমে আক্রমণ করে। প্রথমে সাধারণত গাছের নিচের পাতার অগ্রভাগ হলুদ হয়। পরবর্তীতে গাছের সমস্ত পাতা হলুদ হয়ে শুকিয়ে যায়। গাছের মূল, রাইজোম এবং সিউডোস্টেম (চংবঁফড়ংঃবস) ও মাটির সংযোগস্থল (ঈড়ষষধৎ ৎবমরড়হ) পচে যায়। গাছ ভেঙে পরে এবং হালকা টান দিলে গাছ উঠে আসে। উচ্চতাপমাত্রায় মাটি স্যাঁতসেঁতে থাকলে সাধারণত রাইজোম পচা রোগের আক্রমণ দেখা যায়। ছত্রাকজনিত নরম পচা রোগও খুব ক্ষতিকর। এ রোগটিও রাইজোম পচার মতো। তবে ছত্রাক প্রথমে মাটি ও সিউডোস্টেমের সংযোগস্থলে আক্রমণ করে, যা পানিভেজা দাগের (ডধঃবৎ ংড়ধশবফ ষবংরড়হং) মাধ্যমে প্রকাশ পায়। পরে রোগটি রাইজোমে বিস্তার লাভের মাধ্যমে নরম পচা রোগের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে রোগ মূল ও গাছে ছড়িয়ে পরে। পরিশেষে গাছ হলুদ হয়ে শুকিয়ে নেতিয়ে পড়ে। উচ্চতাপমাত্রা এবং ব্যাপক বৃষ্টি হলে সাধারণত ছত্রাকজনিত নরম পচা রোগের আক্রমণ হয়ে থাকে। আদার জমিতে জলাবদ্ধতার কারণে ব্যকটেরিয়ার মাধ্যমেও নরম পচা রোগ হতে পারে। ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট রোগের কারণেও সিউডোস্টেম ও মাটির সংযোগস্থলে পানিভেজা দাগের মাধ্যমে লক্ষণ প্রকাশ পায়। পরে রোগ সিউডোস্টেম, পাতা এবং রাইজোমে ছড়িয়ে পরে। রাইজোমকে হালকা চাপ দিলে এর থেকে আঠালো উজ (ঙড়ুব) নির্গত হয়। পরিশেষে রাইজোম পচে যায়। পাতার দাগ রোগে পাতার উপর ডিম্বাকার দাগ পরে, যার কেন্দ্রে সাদা দাগ এবং চারিপার্শ্বে গাঢ় বাদামি রেখা পরিলক্ষিত হয়।
আদার ক্ষতিকর পোকাগুলো হলো রাইজোম ফ্লাই (মাছি), কা- ছিদ্রকারী পোকা, রাইজোম স্কেল, পাতার রোলার পোকা এবং নেমাটোড (গবষড়রফড়মুহব ংঢ়ঢ়.)। রাইজোম ফ্লাইর ম্যাগোট রাইজোমে ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে খেতে থাকে এবং ব্যাপকভাবে রাইজোমের ক্ষতি করে। পরবর্তীতে এখানে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জীবাণু যেমন- নেমাটোড, ছত্রাক ও ব্যাকটোরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়। সাধারণত মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য অক্টোবরের মধ্যেই এ পোকা দ্বারা বেশি ক্ষতি হয়ে থাকে। কা- ছিদ্রকারী পোকার লার্ভা আদার সিউডোস্টেম ছিদ্র করে গর্ত তৈরি করে। ফলে পাতা ও গাছ হলুদ হয়ে শুকিয়ে যায় সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে এ পোকার বেশি আক্রমণ লক্ষ্য করা যায়। রাইজোম স্কেল রাইজোম সংগ্রহের আগে এবং রাইজোম সংগ্রহকালীন সময় আক্রমণ করে। পূর্ণাঙ্গ পোকা রাইজোম থেকে রস চুষে খায়। আক্রমণের কারণে রাইজোম কুঁচকে যায় এবং শুকিয়ে যায়। ফলে রাইজোম অংকুরোগদমের হার কমে যায়। পাতার রোলার পোকার লার্ভা (ঈধঃবৎঢ়রষষবৎ) পাতা কাটে। লম্বালম্বিভাবে পাতা গুটিয়ে দেয় এবং পাতার ভেতর থেকে খায়। পরে পাতা শুকিয়ে মরে যায়। আদায় মূল নেমাটোড দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। ইহা মূলে গল (এধষষ) সৃষ্টি করে, ফলে রাইজোম পচা রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয় এবং গাছের কুশির সংখ্যা কমে যায় ও পাতায় দাগের (ঘবপৎড়ংরং) সৃষ্টি হয়।
সমন্বিত বালাইদমন ব্যবস্থাপনা
সুস্থ ও মানসম্পন্ন আদা উৎপাদনের লক্ষ্যে সমন্বিত বালাই দমনব্যবস্থা আবশ্যক। সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনাগুলো হলো : রোপণের পূর্বে আদার জমি চাষ দিয়ে রোদে উন্মুক্ত করে জমিকে প্রাকৃতিকভাবে শোধন করা; বালাইসহিষ্ণু জাতের আদা চাষ করা; এপ্রিল-মে মাসে আগাম ক্লোন রোপণ করা; জমিকে আগাছা মুক্ত রাখা; নেমাটোড নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে শেষ চাষের সময়ে জমিতে ৩০-৪০ কেজি কার্বফুরান ব্যবহার করা; বীজ-রাইজোম সংরক্ষণ এবং রোপণের পূর্বে প্রতি কেজি আদা বীজ প্রোভেক্স/অটোস্টিন (২ গ্রাম/লিটার পানি) দ্রবণে ১ ঘণ্টা ভিজিয়ে ও ছায়ায় শুকিয়ে শোধন করা; নেমাটোডের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ক্লোনকে ৫০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রার গরম পানিতে ১০-১২ মিনিট ডুবিয়ে শোধন করা; রোপন দূরত্ব (৪০ সেমিদ্ধ৩০ সেমি. অথবা ৫০ সেমি.দ্ধ২৫ সেমি.) সঠিক রাখা; রোগবালাই-পোকামাকড় মুক্ত সুস্থ রাইজোম সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও রোপণ করা; সুনিষ্কাশনের ব্যবস্থার মাধ্যমে জমি জলাবদ্ধতা/স্যাঁতসেঁতে ভাব থেকে মুক্ত রাখা; আদার রোগাক্রান্তÍ অংশ পুড়ে ধ্বংস করা; রাইজোম মাছি দমনে ডার্সবান (৩ মিলি/১ লিটার পানি) প্রয়োগ করা; জুলাই-অক্টোবর মাসে কা- ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণে ম্যালাথিয়ন (১-২ মিলি/১ লিটার পানি) ৩০ দিন পর পর স্প্রে করা; রাইজোম স্কেল ইনসেক্ট থেকে রক্ষার জন্য আদার গোড়ায় মাটি তুলে দেয়া; প্রতি বছর একই জমিতে আদা উৎপাদন না করে উপযুক্ত ফসল (মরিচ, শাকসবজি, সবুজ সার, ধান) দ্বারা শস্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা ।
বীজ-রাইজোম সংগ্রহত্তোর ব্যবস্থাপনা
ভালোভাবে অংকুরোদগমের জন্য বীজ রাইজোমকে অবশ্যই সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা জরুরি। ফেব্রুয়ারি মাসে সংগ্রহের পরে রোগবালাই, পোকামাকড় ও যান্ত্রিক ক্ষতবিহীন বীজ-রাইজোম সংরক্ষণের জন্য নির্বাচন করতে হবে। বীজ-রাইজোম সংগ্রহের পর পাতা, মূল এবং গায়ে লেগে থাকা মাটি ভালোভাবে পরিষ্কার করে সংরক্ষণের জন্য প্রস্তুত করা হয়। প্রথমে প্রতি কেজি আদা বীজ প্রোভেক্স/অটোস্টিন (২ গ্রাম/লিটার পানি) দ্রবণে ১ ঘণ্টা ভিজিয়ে ও ছায়ায় শুকিয়ে শোধন করতে হবে। পরে বীজকে ঘরের মধ্যে সুবিধাজনক আকারের গর্তে সংরক্ষণ করতে হয়। গর্তের নিচে ৪-৫ সেমি. পুরুত্বের শুকনো বালুর স্তর দেয়া যেতে পারে। এর পরে গর্তের ভেতরে বীজ-রাইজোমকে স্তরে স্তরে রাখা হয়। প্রতি স্তরের মাঝে শুকনা পাতা ব্যবহার করা হয়। বীজ-রাইজোম সংরক্ষণ ঘরে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বর্ণিত উন্নত কলাকৌশলগুলো অনুসরণ করলে সহজেই মানসম্পন্ন আদা উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
লেখক : ১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, ফরিদপুর; ২প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, লালমনিরহাট এবং ৩বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, ফরিদপুর। মোবাইল : ০১৭১১৫৭৩৩৬১, ই-মেইল :khanalauddinsrsc@gmail.com
ফলন বৃদ্ধিতে আগাম আখ চাষের কোনো বিকল্প নেই
নিতাই চন্দ্র রায়
আখ একটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল। আখ রোপণ থেকে মাড়াই পর্যন্ত ১২-১৪ মাস সময়ের দরকার হয়। ওই সময়ে একই জমিতে আমন ধান, আলু ও ভুট্টার মতো তিনটি ফসল চাষ করা যায়।
পৃবিবীতে সবচেয়ে বেশি আখ উৎপাদিত হয় ব্রাজিলে তারপর ভারতে। ভারতে বছরে আখ উৎপাদিত হয় ৪০ কোটি ৫৪ লাখ টন। আর আমাদের দেশে বর্তমানে বছরে আখ উৎপাতি হয় মাত্র ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার টন, যা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্ত কম। ক্রমবর্দ্ধমান ঘ্রাণ সংখ্যা এবং জমির কারণে। বাংলাদেশে আখ চাষের জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করে আখের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়। আখ চাষের আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে উলম্বভাবে আখের উৎপাদন বাড়াতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে হবে আগাম আখের সাথে আলু ও পেঁয়াজের মতো একটি মূল্যবান সাথি ফসলের চাষ ও অথবা একবার নতুন আখ করেও দুই বার মুড়ি আখ চাষের মাধ্যমে। বাংলাদেশে হেক্টরপ্রতি আখের গড় ফলন ৪৬ টন। আখের ফলন বৃদ্ধির যেসব প্রযুক্তি রয়েছে তার মধ্যে আগাম আখ চাষ অন্যতম।
আগাম আখের অনেক গুণ-বেশি চারা, বেশি কুশি’ ফলন দ্বিগুণ। আগে কৃষক আউশ ধান ও পাট কেটে ঐ জমিতে আগাম আখের চাষ করতেন। এখন অধিকাংশ কৃষক আমন ধান কাটার পর ঐ জমিতে রবি ফসলের চাষ করেন। রবি ফসল তোলার পর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে আখের চাষ করেন। বাংলাদেশে আখ চাষের উপযুক্ত সময় সময় হলো- অক্টোবর থেকে মধ্য ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ সময়ে অধিকাংশ জমিতে আমন ধান থাকার কারণে চাষির ইচ্ছে থাকলেও আগাম আখ চাষ করতে পারেন না। তাই আগাম আখ চাষ বৃদ্ধি করতে হলে নির্বাচিত জমিতে স্বল্প জীবনকালের আমন ধানের চাষ করে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি আমন ধান কেটে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কৃষক আগাম আখের চাষ করতে পারেন। আমনের এইসব আগাম জাতের মধ্যে রয়েছে বিনা-৭, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৯, ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৬৬, ব্রি ধান৭৫ উল্লেখযোগ্য।
শুধু আগাম আখ চাষের মাধ্যমে আখের ফলন শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ এবং চিনিগুড়ের আহরণ হারও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানো যায়। আগাম আখ চাষের অনেক সুবিধা রয়েছে যেমন- ১. জমিতে প্রচুর রস থাকে। ২. মাটিতে সন্তোষজনক তাপমাত্রা বিরাজ করে। ৩.বীজের পরিমাণ কম লাগে। ৪.ভালো অঙ্কুরোদগম হয়। ৫.খরা ও বন্যা প্রতিরোধ করতে পারে। ৬. অধিক কুশি গজায়। ৭.জমিতে তেমন ফাঁকা জায়গা থাকে না। ৮. পোকা-মাকড়ের আক্রমণ কম হয়। ৯. পদ্ধতিগতভাবে সাথী সফলের চাষ করা যায়। ১০. আগাম আখে চিনি/গুড় আহরণ হার বেশি থাকে ।
আগাম আখ রোপণের সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।
জমি নির্বাচন : উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি যেখানে বন্যা বা বৃষ্টির পানি জমে থাকে না, সেসব জমি আগাম আখ চাষের জন্য উপযোগী। তবে বালু মাটি ছাড়া যেকোনো মাটিতেই সফলভাবে আখের চাষ করা যায়। দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ এবং এঁটেল দো-আঁশ মাটি আখ চাষের জন্য উত্তম।
জাত নির্বাচন : সফলভাবে আখ চাষের জন্য প্রথম কাজটি হলো একটি উন্নত, উচ্চফলনশীল আখের জাত নির্বাচন। উঁচু জমির জন্য ঈশ্বরদী ১৬, ঈশ^রদী ২৬, ঈশ^রদী ৩২, ঈশ^রদী ৩৩, ঈশ^রদী ৩৫, ঈশ^রদী ৩৭, ঈশ^রদী ৩৯, ঈশ^রদী ৪০, বিএসআরআই আখ ৪৩, বিএসআআর আই আখ ৪৪, বিএসআরআই আখ ৪৫ ও বিএসআরআই আখ ৪৮ নির্বাচন করা যায় । মাঝারি উঁচু জমির জন্য ঈশ^রদী ২০, ঈশ^রদী ২১ , ঈশ^রদী ৩৪, বিএসআরআই আখ ৪৬, বিএসআরআই আখ ৪৫, ঈশ^রদী ২/৫৪ ও এলজে-সি জাতের আখ নির্বাচন করতে হবে। চিবিয়ে খাওয়া ও রস তৈরির জন্য বিএসআরআই আখ ৪১, বিএসআরআই আখ ৪২ (রংবিলাস), বিএসআরআই আখ ৪৭, মিশ্রিমালা, বনপাড়া গেন্ডারী ও কিউ ৬৯ জাতের আখ নির্বাচন করা উচিত। চিনি ও গুড় তৈরির চেয়ে চিবিয়ে খাওয়া ও কাঁচা রস বিক্রিতে অনেক বেশি আয় করা যায়। দেশের কোনো কোনো স্থানে একটি চিবিয়ে খাওয়া জাতের আখ ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি করা হয়। আর এক গ্লাস আখের কাঁচা রস বিক্রি করা হয় ১৫ টাকা। একটি পরিপুষ্ট আখ থেকে ৪ গ্লাস রস পাওয়া যায়। সে হিসেবে একটি আখের দাম দাঁড়ায় ৬০ টাকা।
জমি তৈরি : আখ লম্বা কা- ও প্রচুর শিকড় বিশিষ্ট দীর্ঘ মেয়াদি ফসল। রোপণ থেকে কাটা পর্যন্ত ১২ থেকে ১৪ মাস সময় লাগে। আখের শিকড় মাটির বেশ গভীরে প্রবেশ করে। শিকড়গুচ্ছ যাতে অবাধে বিস্তার লাভ করে মাটি হতে প্রচুর খাদ্য উপাদান গ্রহণ করতে পারে সেজন্য ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি গভীর করে আড়াআড়িভাবে ৪ থেকে ৫টি চাষ ও মই আখের জমি তৈরি করতে হবে ।
নালা তৈরি : ভাল ফলনের জন্য কোদাল দিয়ে ৮ থেকে ৯ ইঞ্চি গভীর নালা তৈরি করতে হবে। এটেল দো-আঁশ মাটির জন্য নালা থেকে নালার দূরত্ব হবে ৩ ফুট এবং দো-আঁশ মাটির জন্য নালা থেকে নালার দূরত্ব হবে ২.৫ ফিট।
বীজ নির্বাচন : আখের অধিক ফলনের জন্য অনুমোদিত জাতের সুস্থ-সবল পুষ্টি সমৃদ্ধ রোগ ও পোকামাকড় মুক্ত প্রত্যায়িত বীজক্ষেতের আখ বীজ হিসেবে নির্বাচন করা উচিত। বীজের জন্য ৮ থেকে ৯ মাস বয়সের আখই বেশি উপযোগী। আখের বয়স বেশি হলে উপরের অর্ধেক অংশ বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই শিকড় গজানো, চোখ ফোটা, রোগ ও পোকা আক্রান্ত আখ বীজ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
বীজ খ- তৈরি ও শোধন : আগাম আখ রোপণের জন্য ধারালো দা বা হাসুয়া দিয়ে ২ চোখ বিশিষ্ট বীজ খ- তৈরি করতে হবে। যে হাঁসুয়া বা দা দিয়ে আখ বীজ কাটা হবে, তা মাঝেমধ্যে আগুনে ঝলসিয়ে নিতে হবে। মাটিতে বসবাসকারী রোগজীবাণুর হাত থেকে বীজখ-কে মুক্ত রাখতে রোপণের পূর্বে বীজখ-গুলো অটোস্টিন বা নোইন নামক ছত্রাক নাশকের ০.১% দ্রবণে আধা ঘণ্টশোধন করতে হবে।
নালায় সার ও কীটনাশক প্রয়োগ : ভালো ফলনের জন্য নালায় একরপ্রতি ৭২ কেজি টিএসপি, ৫৫ কেজি ইউরিয়া, ৫৩ কেজি পটাশ, ৫ কেজি জিপসাম,২.৫ কেজি দস্তা ও ২০০ কেজি খৈল প্রয়োগ করে নালার ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি তলদেশ ভালোভাবে কুপিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
বীজখ- রোপণ ও মাটি শোধন : বীজখ- রোপণের সময় বীজখ-ের চোখ দুই পাশে রাখতে হবে। বীজখ-গুলো উঁই পোকার আক্রমণ হতে রক্ষার জন্য নালার মাটিতে বীজখ- স্থাপনের পর বীজখ-ের উপর দু’ আঙুলের চিমটি দিয়ে একর প্রতি ৬ কেজি পাইরিব্যান-১৫জি প্রয়োগ করে ২ ইঞ্চি গুঁড়া মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। পাইরিব্যানের অভাবে নালায় একরপ্রতি ৬ কেজি রিজেন্ট -৩ জিআর ব্যবহার করতে হবে। লাল ও বালু মিশ্রিত মাটিতে আখ রোপণের সাথে সাথে , দোআঁশ ও এটেল দোআঁশ মাটিতে আখ রোপণের ৭দিনের মধ্যে একটি হালকা সেচ দিতে হবে।
ফাঁকা স্থান পূরণ : আখ রোপণের ৩০ দিনের মধ্যে সাধারণত দু’ফুট দূরত্বের মধ্যে কোনো চারা না গজালে তাকে ফাঁকা স্থান হিসেবে চিহ্নিত করে একই জাতের চারা বা বীজ খ- দ্বারা ওই ফাঁকা স্থান পূরণ করতে হবে। বাংলাদেশে সরাসরি রোপণকৃত আখের জমিতে শতকরা ৩৩ ভাগ ও মুড়ি আখের জমিতে শতকরা ৫০ ভাগ পর্যন্ত ফাঁকা স্থান থাকে, যা আখের ফলন বৃদ্ধির প্রধান অন্তরায়।
মাটি আলগাকরণ : সেচ কিংবা ভারী বৃষ্টিপাতের পর জমিতে জো আসার সাথে সাথে বীজখ-ের ওপরের শক্ত মাটির স্তর অবশ্যই আলগা করে দিতে হবে। অন্যথায় অক্সিজেনের অভাবে অঙ্কুরোদগম ব্যাহত হবে।
আগাছা দমন : আগাছা আখের সাথে পানি ও খাবারে জন্য প্রতিযোগিতা করে। রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। তাই রোপণের ৩০ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে আখক্ষেতের আগাছা অবশ্যই কোদাল বা নিড়ানি দ্বারা দমন করতে হবে।
সারের উপরি প্রয়োগ : আখ রোপণের ৯০ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে একরপ্রতি ৫৫ কেজি ইউরিয়া ও ৫২ কেজি পটাশ সার আখের সারি থেকে ৬ ইঞ্চি দূরে লাঙ্গল দিয়ে ভাউর টেনে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। জমিতে রসের অভাব হলে সাথে সাথে সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
আখের পাতা ও নাবী কুশি ব্যবস্থাপনা : নাবী কুশি ও পুরাতন পাতা আখের ফলন এবং চিনি আহরণ হার কমিয়ে দেয়। এ জন্য এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে ১ থেকে ২ বার প্রতি ঝাড়ে ৮ থেকে ১০টি পরিপুষ্ট আখ রেখে অতিরিক্ত কুশি ও পুরাতন পাতা কেটে দিতে হবে। আগাম আখের বেলায় ৮ থেকে ১০ কুশি হওয়ার পর আখ গাছের গোড়ায় কোদাল দিয়ে মাটি তুলে দিতে হবে। ভাদ্র থেকে কার্তিক মাসে আখ যাতে বৃষ্টি ও ঝড়ো হওয়ায় হেলে না পড়ে এজন্য শুকনো পাতা দিয়ে প্রতিটি ঝাড় আলাদাভাবে বেঁধে দিতে হবে।
সেচ ও পানি নিষ্কাশন : ফাল্গুন-চৈত্র মাসে কয়েক সপ্তাহ পরপর জমিতে ২ থেকে ৪ বার ৪ থেকে ৫ একর/ইঞ্চি পানি দিলে আখের ফলন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে বর্ষাকালে আখের জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে আখক্ষেতে জমা পানি নালা কেটে দ্রুত বের করে দিতে হবে।
আখের ফলন : আখের বয়স ১২ থেকে ১৪ মাস হলে আখ পরিপক্ব হয়। আখে ফুল আসা পরিপক্বতার একটি লক্ষণ। পরিপক্ব আখ ধারালো কোদাল দিয়ে মাটির সমতলে কাটা উচিত। আগাম আখ চাষের মাধ্যমে অনায়াসে একর প্রতি ৩০ থেকে ৩৫ টন ফলন পাওয়া যায়। যার বর্তমান বাজারমূল্য ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ২লাখ টাকা। উৎপাদন খরচ ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা বাদ দিলে একর প্রতি নিট লাভ দাঁড়ায় ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন। বর্তমান ঠিকানাঃ জিপাল প্লাজা, ৩৮ রামবাবু রোড, নতুন বাজার, ময়মনসিংহ। মোবাইল: ০১৭২২৬৯৬৩৮৭। ইমেইল:netairoy18@yahoo.com
কৃষিপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য টেকসই মাটি ব্যবস্থাপনা
কৃষিবিদ মোঃ মামুন হোসেন
পৃথিবীর যে কোন দেশেই কৃষি পণ্য বা খাদ্যপণ্য রপ্তানির পূর্বতম শর্ত হচ্ছে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য হতে হবে। রোগ ও পোকার আক্রমণ থাকবে না বা কম হবে, আর এই সবই নির্ভর করে মাটির স্বাস্থ্যের উপর অর্থাৎ মাটির ব্যবস্থাপনার উপর। মাটি যদি দূষিত থাকে, রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি বেশি, ভারী ধাতুর পরিমাণ বেশি তাহলে সেই মাটির ফসল রপ্তানি করা যায় না। মাটি ভালো না হলে কোন ধরনের সার্টিফিকেশন ও পাওয়া যাবে না, যা রপ্তানিতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। ফল ও সবজি রপ্তানির যতগুলো পরীক্ষা বা সার্টিফিকেশন দরকার তার প্রত্যেকটাতেই মাটি পরীক্ষা অত্যাবশ্যক। তাই মাটি যদি ভালো না থাকে তাহলে রপ্তানি প্রায় অসম্ভব।
নদীমাতৃক এবং কৃষিনির্ভর সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি মূলত কৃষি ও মাটি কেন্দ্রিক। মাটিতে বা মাটির নিচে বসবাস করে খুদে প্রাণীদের এক বিশাল জগৎ, যা পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের প্রায় ২৫ শতাংশ। যেখানে মানুষ উদ্ভিদ প্রজাতির সম্পর্কে ৮০ শতাংশ জানতে পেরেছে, সেখানে মাটির অণুজীব সম্পর্কে কেবল ১ শতাংশ জানতে পেরেছে। এই বৈচিত্র্যময় ক্ষুদে প্রাণীরা উদ্ভিদ, ফসল ও আমাদের জীবনের নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এছাড়া সারা পৃথিবীর জীব সমূহের প্রায় ৯০ ভাগই জীবনচক্রের কোন না কোন অংশ মাটিতে অতিবাহিত করে। কৃষি ও পরিবেশগত ঝুঁকিসহ বিভিন্নভাবে বাংলাদেশে মাটির গুণাগুণ হ্রাস পাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ভূমির উপর প্রাকৃতিকভাবে ১ ইঞ্চি পরিমাণ মৃত্তিকা গঠিত হতে ৫০০-১০০০ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। অথচ নানা কারণে ভূমির উপরিভাগের মাটি যা চাষাবাদ ও বৃক্ষ জন্মাবার মাধ্যম তা নষ্ট হচ্ছে।
মাটি ছাড়া কৃষি অকল্পণীয় । মাটি দেহের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় সকল উপাদানের আধার। মাটিতে ধারণকৃত পানি উদ্ভিদেরও খাবার, আবার প্রাকৃতিক পানি পরিশোধনেও মাটি অনবদ্য ভূমিকা পালন করে।
সাস্টেনেবল মাটি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনের জন্য জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) পূর্বাভাস দিয়েছে যে, ২০৫০ সালের মধ্যে মাটির অবক্ষয়-এর কারণে ফসলের ফলন ১০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী খাদ্য সুরক্ষার জন্য হুমকিস্বরূপ। খাদ্য, জ্বালানি, ফাইবার এবং ঔষধি পণ্য সরবরাহের পাশাপাশি মাটি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে- মানবজাতির একক বৃহত্তম বিপদ - জৈব-রাসায়নিক চক্রের মাধ্যমে বায়ুম-লে কার্বন সংরক্ষণ করে এবং গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাস করে।
মাটি আমাদের জীবনধারণের লক্ষ্যে জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে খাদ্য এবং বিভিন্ন পরিবেশগত পরিষেবা সরবরাহ করে। অন্যান্য জৈব উপাদানগুলোর মতো মাটিও জীবন্ত সম্পদ, মাটিরও অক্সিজেন, খাদ্য, জলের প্রয়োজন হয় এবং সময়ের সাথে পরিবর্তিত হতে থাকে।
আমাদের খাদ্যের ৯৫ শতাংশ আসে মাটি থেকে। ২০৫০ সালে বিশ্বব্যাপী খাদ্য চাহিদা মেটাতে কৃষি উৎপাদন ৬০ শতাংশ বাড়াতে হবে। মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ৫৮ শতাংশ পর্যন্ত বেশি খাবার উৎপাদন করা যেতে পারে।
আয়তনে ছোট, ঘনবসতি ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার দেশ হওয়ার পাশাপাশি নানাবিধ প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ আজ দানাদার খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশ হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে। এর মূল কারণ হলো আমাদের দেশের সোনাফলা উর্বর মাটি এবং কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম। আর তাই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা, চাষের জমির উপযুক্ত ব্যবহার এবং অতিমাত্রায় সার ও কীটনাশকের ব্যবহার থেকে বিরত থাকা। বাংলাদেশে বর্তমানে ফসলি জমি প্রায় ৭ দশমিক ২৯ মিলিয়ন হেক্টর। পৃথিবীর মোট ভূখ-ের প্রায় ১০ শতাংশ জায়গায় ফসল আবাদ হলেও বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ৬০ শতাংশ জমিতে চাষাবাদ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার দক্ষতা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। নিবিড় চাষাবাদের হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে একেবারে প্রথম সারিতে।
মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হওয়ার কারণে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়, পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়, উপকারী অণুজীবের সক্রিয়তা কমে যায়, মাটিতে পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্যহীনতা দেখা যায়, ফসলের ফলন ও গুণগতমান কমে যায় এবং ফসলের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর কৃষি বিপ্লবের ডাক কৃষকসমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তিনি কৃষির উন্নয়নে সার, কীটনাশক, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার কৃষির উন্নয়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন কৃষক দরদি, আর বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে কোন জাদুর বলে নয় ,কৃষক দরদি মনবতার মা মাননীয় প্রধানন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বে ফসল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ এক ইঞ্চি মাটিও যেন কৃষি উৎপাদনের বাইরে না থাকে তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, মাটির পুষ্টি উপাদানের ঘাটতির ফলে মৃত্তিকা এখন হুমকির মুখে রয়েছে। এর কারণে বছরে ০.৪ শতাংশ ফসল উৎপাদন হ্রাস পায়। পাহাড়ি অঞ্চলে মৃত্তিকা ক্ষয়ের মাত্রা বেশি তা প্রায় ১২ শতাংশ। আর একটি সমস্যা হচ্ছে ইট ভাটা, এটি বেড়েই চলছে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ ব্যতীত টেকসই উন্নয়ন বা ংঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ সম্ভব নয়। সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদেও বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে, জলাভূমি সংরক্ষণকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কৃষি জমিতে ৫ শতাংশ হারে জৈব পদার্থের থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। মাটিতে দূষণ রোধ করতে জনসাধারণের সচেতনতাই হতে পারে টেকসই সমাধান।
পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের প্রায় এক-চতুর্থাংশের আবাসস্থল হচ্ছে মাটি। সুস্থ মাটির একটি অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে মাটির জীববৈচিত্র্য। বিজ্ঞানের ভাষায় মাটির জীববৈচিত্র্য হলো মাটিতে বসবাসকারী উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুজীবসহ জীবসম্ভার এবং সেগুলোর সমন্বয় গঠিত বাস্তুতন্ত্র। মাটিতে বসবাসকারী অসংখ্য অণুজীব, ছত্রাক, প্রটোজোয়া ইত্যাদি মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। একদিকে দেশের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, অন্যদিকে আবাদি জমি কমছে উল্লেখযোগ্য হারে। মাটি পরীক্ষা করে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করলে ফলন ২০-৩০% বৃদ্ধি পাবে।
‘ল্যান্ড কেয়ার অস্ট্রেলিয়া’ মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি শক্তিশালী অলাভজনক সংগঠন। সরকার, করপোরেট পার্টনার, কৃষক, পেশাজীবী, ছাত্রছাত্রী সবাইকে সঙ্গে নিয়ে নানা ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে সারা বছর। দান-অনুদানের অর্থের সঙ্গে দেশপ্রেম মিশিয়ে সব শ্রেণিপেশার মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ছে মৃত্তিকাকে বাঁচানোর জন্য। ‘গ্লোবাল ল্যান্ড কেয়ার’, ল্যান্ড কেয়ার ইউরোপসহ অনেক সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে মৃত্তিকা, পানি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য। আমাদের দেশে মৃত্তিকা, কৃষি, পানি কার্যক্রম নিয়ে সংগঠন ও পলিসি ফোরাম প্রয়োজন।
বাংলার মৃত্তিকার ‘কার্বন ক্রেডিট ভ্যালু’ কত, কেউ কি হিসাব করেছেন? নিবিড় চাষাবাদের ফলে মৃত্তিকা কার্বন হ্রাস পাচ্ছে অব্যাহতভাবে। জৈব পদার্থের আশঙ্কাজনক মাত্রাতেও থেমে নেই নিষ্ঠুর পীড়ন। পুষ্টি ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ ‘টপ সয়েল’ আমাদের অমূল্য সম্পদ। নগরায়ণের আগ্রাসনে এই অমূল্য টপ সয়েল চলে যায় ইটভাটার চিতানলে। ইটভাটার দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় পুষ্টিসমৃদ্ধ উর্বর টপ সয়েল। নির্জীব মাটি অভিশাপ দিয়ে যায় সভ্যতাকে, মানুষকে, মানুষের নির্লিপ্ততাকে। মৃত্তিকা কার্বন সংরক্ষণে ব্যবস্থা নেয়ার সময় এখনই।
মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করার জন্য পৃথিবীজুড়ে মানুষকে উৎসাহিত করা এবং সবাইকে একসাথে নিয়ে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের বিরুদ্ধে লড়াই করা। ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া হতে প্রাকৃতিক লাঙল কেঁচো ও অন্যান্য পোকামাকড়ের কথা। মাটির সাথে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও সম্পর্কিত। তাই আমাদের চিরন্তন স্লোগান হোক ‘মাটি বাঁচাও, কৃষি বাঁচাও, বাঁচাও সোনার দেশ’। আসুন, আমরা প্রিয় মৃত্তিকা ছুঁয়ে গেয়ে উঠি ‘মোরা মৃত্তিকা ভালোবাসী, মাটির আঁচলে সোনাঝরা রোদে ফসলের সঙ্গে হাসি’।
লেখক : úোস্টহার্ভেস্ট এন্ড কোয়ালিটি এসুরেন্স ¯েপশালিস্ট, হর্টেক্স ফাউন্ডেশন, মোবাইল : ই-মেইল :mamun@hortex.org
নিরাপদ মধুতে স্বাবলম্বিতা অর্জনে আমাদের করণীয়
মো. কাওছারুল ইসলাম সিকদার
সুন্দরবনের মধু অনেকের কাছে অত্যন্ত লোভনীয়। প্রাকৃতিক উপায়ে যে মধু সুন্দরবন হতে পাওয়া যায় তার চাহিদা ব্যাপক। সুন্দরবনে যে সকল মৌমাছি রয়েছে সেগুলোর আকার অনেকটা বড় ও বন্য। এ সকল মৌমাছি সুন্দরবনের বিভিন্ন গাছ-পালায় যে মৌচাক তৈরি করে তা হতে স্থানীয় মধু সংগ্রহকারীরা (মৌয়াল) মধু সংগ্রহ করে। মৌমাছির বিভিন্ন জাত রয়েছে। অঞ্চলভেদে মৌমাছির জাতের ভিন্নতা পাওয়া যায়। বাংলাদেশে সাধারণত পাঁচ (০৫) রকমের মৌমাছি দেখা যায়। বিশ^ব্যাপী প্রায় ২০,০০০ প্রজাতির মৌমাছি রয়েছে বলে জানা যায়। জাতের ভিন্নতার উপর মধু গুনাগুণ ও বৈচিত্র্য রয়েছে।
মধু স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। মধু দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, আরোগ্য লাভ, ওজন কমাতে, অনিদ্রা দূর করতে, পেটের সমস্যায় এবং ঠা-া ও সর্দিজনিত রোগ নিরাময়ে অত্যন্ত কার্যকর। আমাদের দেশে শীতকালে এর চাহিদা বেশি থাকে। মধু পানিতে মিশিয়ে শীতকালে খেলে দেহ উষ্ণ হয়, আবার গ্রীষ্মকালে দেহ শীতল বা প্রশান্তি লাভ করে। তাই নিরাপদ মধু ভোগ নিশ্চিতে মৌচাক সংগ্রহ হতে শুরু করে বিপণন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ শৃঙ্খলকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। তবেই দেশীয় মধুরপ্রতি ভোক্তার আস্থা বাড়বে ভিন্ন দেশীয় মধুরপ্রতি নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে।
মৌমাছি মানব সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর দ্বারা ফুলের পরাগায়ন ঘটে। পরাগায়নের মাধ্যমে পুরুষ ফুলের সাথে স্ত্রী ফুল নিষিক্ত হয়, ফলে ফুল হতে শস্য, ফল ও বীজ তৈরি হয়। মৌমাছি যখন এক ফুল হতে অন্য ফুলে গমন করে তখনই পরাগায়ন সংগঠিত হয়। এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। পরাগায়নের মাত্রা যত বাড়বে ততই শস্য, ফল, বীজের উৎপাদন বাড়বে। তাই মৌমাছি হতে কেবলমাত্র মধু পাওয়া যায় এমনটি নয় বরং ফল ও ফসলের উৎপাদনও বাড়ে। বর্তমানে ফসলি জমির মাত্র ১০ ভাগ জমিতে মধু চাষ হয়। এটির পরিমাণ বৃদ্ধি করে মধুর উৎপাদন বৃদ্ধি ও আমদানির নির্ভরশীলতা কমানো সম্ভব। মৌচাষের সাথে ফসলি জমিতে যে ফসল ফলানো হয় তাতে প্রায় ২০-৩০ ভাগ ফলন বৃদ্ধি পায়। তাই অধিক ফলন, কর্মসংস্থান, মধু উৎপাদন ও মধুতে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে মধুর চাষ বৃদ্ধি করার ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহন আবশ্যক। এছাড়া মৌমাছির তৈরি মৌচাক হতে প্রাকৃতিক মোম পাওয়া যায়। এটির বাজার মূল্যও কম নয়। এটি বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
এদেশের শীত ও গ্রীষ্ম উভয় মৌসুম মধু চাষের জন্য উপযুক্ত। শীতে বিভিন্ন শস্যের ফুল এবং গ্রীষ্মে বিভিন্ন ফল গাছের ফুল হতে মধু সংগ্রহ হয়। বর্ষা মৌসুমে মধু সংগ্রহের জন্য তেমন কোনো ফুল থাকে না তাই বাংলাদেশের বর্ষা মৌসুম মধু সংগ্রহের জন্য তেমন উপযুক্ত নয়। এই সময় চিনির সিরা দিয়েই মৌ চাষের মৌপোকাসমূহ বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চলে। গ্রীষ্ম মৌসুমে বিশেষ করে যখন আম, লিচু, পেয়ারা ইত্যাদি ফলের গাছে ফুল আসে এবং শীতকালে তিল, সরিষা, কালিজিরা ফসলে মাঠ ভরে যায়, তখন মৌচাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বর্তমানে মৌচাষের দিকে যুবসমাজ আকৃষ্ট হচ্ছে। বিসিকসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে (ঘএঙ) মৌচাষের কৌশল ও উপকরণ সরবরাহ করছে।
মধুর গুণগতমান পরীক্ষার অনেক প্রচলিত ধারণা রয়েছে। যেমন মধু পানিতে মিশবে না, আগুনে জ¦লবে না, নখের মধ্যে রাখলে পড়বে না, পিপড়ায় মধু খায় না, খাঁটি মধু জমবে না ইত্যাদি। এগুলোর কোনটিই ঠিক নয়। মধু পরীক্ষা করতে হবে পরীক্ষাগারে। এর মধ্যে বিদ্যমান উপকরণসমূহ যথাযথ পাওয়া গেলেই মধু খাঁটি বলে নিশ্চিত হওয়া যাবে। এছাড়া খাঁটি মধু নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ জন্য মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পরীক্ষা অত্যাবশ্যক। চহিদার তুলনায় দেশে মধুর যোগান ৭০% কম, সেক্ষেত্রে মৌচাষের পরিধি বাড়াতে হবে। তবেই ভেজাল মধুর দৌরাত্ম্য কমবে।
সুন্দরবনের মধুকে অর্গানিক মধুও বলা যায়। কারণ প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বনফুল হতে এই মধু সংগৃহীত হয়। মধুতে গ্লুকোজ, ফুক্টোজ, পলিস্যাকারাইড, প্রোটিন, বিভিন্ন ভিটামিন, লবণ ও পানি থাকে। সুন্দরবনের মধুর তারল্যতা বেশি। কারণ এই মধুতে প্রায় ২৯-৩০% পর্যন্ত পানি থাকে। সুন্দরবনের মধুতে পানি বেশি থাকার অন্যতম কারণ পরিবেশ ও জলবায়ু। বঙ্গোপসাগরের তীরে সুন্দরবন, তাই স্থানীয় জলবায়ুতে আর্দ্রতা বেশি। যেহেতু এটি একটি “ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট” তাই প্রতিদিন একাধিকবার সমুদ্রের জোয়ারে এখানকার বৃক্ষসমূহ জলমগ্ন হয়। এসকল কারণে এই বনের গাছপালা, ফুলফল প্রভৃতিতে পানির পরিমাণ বেশি থাকে। মরুভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে যে মধু সংগ্রহ করা হয়, তাতে পানির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম থাকে। আবার মরুভূমির শুষ্ক আবহাওয়ায় মধুতে যে পানি থাকে তা দ্রুত শুকিয়ে যায়। যার কারণে মরুভূমি অঞ্চলের মধুর ঘনত্ব বেশি এবং দীর্ঘসময় প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত থাকে। তেমনিভাবে পাহাড় বা অঞ্চলভেদে মধুতে পানির পরিমাণের হেরফের ঘটে। মধুতে পানি থাকলে তা দ্রুত গাজন ঘটে এবং নষ্ট হয়ে যায়। দীর্ঘদিন গুণগতমান যথাযথ থাকে না। এ কারণে মধুকে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে পানির অংশ দূরীভূত করে মধু সংরক্ষণ করা হয়, যাতে দীর্ঘমেয়াদি তা সংরক্ষণ ও ভোগ করা সম্ভব হয়।
মধু দীর্ঘসময়ে ভাল রাখার জন্য মধু মোড়কীকরণে কি ধরনের পাত্র ব্যবহার করা উচিত সে বিষয়েও জ্ঞানের অভাব রয়েছে। তাই সুন্দরবনের প্রাকৃতিক মধু চাষিদের জন্য স্বতন্ত্র পোশাক, মাথা ও মুখে ব্যবহারের জন্য হেলম্যাট ও জাল এবং মধু সংগ্রহে ব্যবহৃত উপকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। সংশ্লিষ্ট বন বিভাগ কর্তৃক স্বতন্ত্র লগোযুক্ত পোশাক ও উপকরণ, বিসিক হতে প্রশিক্ষণ ও প্রশাসন হতে প্রয়োজনীয় অন্যান্য সহযোগীতা প্রদান করতে হবে। এতে দুটি লাভ হবে। প্রথমত মৌচাক রক্ষা ও নিরাপদ মধু সংগ্রহ, দ্বিতীয়ত মৌয়াল ছাড়া অন্য কেউ সুন্দরবন হতে মধু সংগ্রহ করতে পারবে না।
বিশেষ করে মাছ ধরার নৌকা মধু সংগ্রহে যুক্ত হতে পারবে না। স্থানীয় সংশ্লিষ্ট সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নিলে সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ এবং বিপণন প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করবে। মধুর নিরাপদতা সম্পর্কে ভোক্তাদের আস্থা অর্জিত হবে। মধুর বিশুদ্ধতা এবং নিরাপদতা নিশ্চিতে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মান নির্ধারণ এবং বিএসটিআই কর্তৃক তা বাজারজাতকরণের অনুমোদন প্রদান করা হলে জনগণের আস্থা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। এতে কেবলমাত্র দেশেই নয় বিদেশেও মধু রপ্তানি সম্ভব হবে। যেমনটি প্রতিবেশী দেশের ডাবর ব্র্যান্ড অর্জন করেছে। সুন্দরবনের মধুর ব্র্যান্ড সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে যেমন যথাযথ পরীক্ষা, লেবেলিং ও প্রচার। নিরাপদ মধু সংগ্রহে ও স্বালম্বিতা অর্জনে করণীয়
মধু সংগ্রহ হতে ভোক্তা অবধি পূর্ণাঙ্গ শৃঙ্খল বিজ্ঞানভিত্তিক হতে হবে।
মধু চাষে মহিলাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং প্রযুক্তি সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য করতে হবে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মধুর মাননির্ধারণ করে দিতে হবে।
নিরাপদ মধু জন্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা, পরীক্ষাগার ও ব্র্যান্ডিং নিশ্চিত করতে হবে।
মধুকে ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক দূষণ হতে রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সকল মৌয়াল ও মধু চাষিদের জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
বিপণনে নিরাপদ মোড়কীকরণ ও লেবেলিং নিশ্চিত করতে হবে।
মাস্টার প্ল্যান নিয়ে মধু সংগ্রহে স্বাবলম্বীতা অর্জন করতে হবে।
মধু আমদানি শূন্যের কোঠায় আনতে দীর্ঘমেয়াদি নীতি অবলোকন করতে হবে।
মধু উৎপাদন টেকসই করার জন্য অঞ্চলভিত্তিক মধু সংগ্রহ অভিযান বৃদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
সুন্দরবনের প্রাকৃতিক মধু সংগ্রহকারীদের মহাজনদের দৌরাত্ম্য হতে রক্ষায় জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সমিতির ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। গরিব মৌয়ালিদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে।
মধু সংগ্রহ নিষিদ্ধকালীন সময়ে মৌচাষিদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে।
মধু মৌচাক হতে মধু সংগ্রহ হতে ভোগ অবধি একটি পূর্ণাঙ্গ গাইড লাইন তৈরি করতে হবে।
মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বৃদ্ধি করতে হবে।
মধুচাষিদের অঞ্চলভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা ও সকল মৌচাষিদের অ্যাসোসিয়েশনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সকলের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।
প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় সকল মৌচাষিদের মধু নির্দিষ্ট দামে ক্রয় করতে হবে ।
একটিমাত্র ব্যান্ডে সুন্দরবনের মধু দেশে ও বিদেশে বিপণনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ।
সুন্দরবনের অর্গানিক মধুর দাম ও চাষের মাধ্যমে উৎপন্ন মধুর দাম জেলা প্রশাসনের সহায়তায় পৃথকভাবে নির্ধারণ ও বিপণন করতে হবে ।
আইন প্রয়োগ ও জনসচেতনতার মাধ্যমে অসাধু মধু সংগ্রহ ও বিক্রয়কারীদের নিষিদ্ধ করতে হবে ।
মধু চাষের জন্য স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও সহজ সরল প্রযুক্তি প্রয়োজন হয়। মধু চাষের জন্য খুব একটা বেশি বিনিয়োগেরও প্রয়োজন হয় না। ক্ষুদ্র বিনিয়োগের মাধ্যমে গ্রামীণ জনপদের মানুষের কর্মসংস্থান ও আয়ের সংস্থান করে লাভবান হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে আরো উদ্যোগী হতে হবে। তবেই টেকসই মধু উৎপাদন সম্ভব হবে। মধু উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে মধু আমদানি হ্রাস ও বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে।
লেখক : অতিরিক্ত পরিচালক (উপসচিব), বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, মোবাইল : ০১৫৫২৩৫৫৮৫৩ ই-মেইল: kawserul1173@gmail.com
পিট মৃত্তিকা এবং পরিবেশের উপর এর প্রভাব
হাছিনা আকতার
পিট হলো আংশিক ক্ষয়প্রাপ্ত গাছপালা বা জৈব পদার্থের জমে থাকা জৈব মৃত্তিকা, যাতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ২০ শতাংশের অধিক (২০-৮০%)। এসব জৈব পদার্থ বিভিন্ন মাত্রায় বিয়োজিত অবস্থায় থাকে। সামান্য বিয়োজিত বা অবিয়োজিত অবস্থার জৈব অবক্ষেপকে পিট এবং অধিক বিয়োজিত জৈব অবক্ষেপকে মাক বলা হয়। পিট অবক্ষেপ বিশেষ করে এর উপরের স্তরে সঞ্চিত বিভিন্ন প্রকার গাছপালাকে শনাক্ত করা যায়, কিন্তু মাক মৃত্তিকাতে বিয়োজনের মাত্রা এমন একপর্যায়ে পৌঁছায় যে, বিদ্যমান উৎস গাছপালার অংশগুলোকেও শনাক্ত করা যায় না। অবক্ষেপিত গাছপালার অবশেষের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে পিট স্থূল বা সূক্ষ্ম গঠন সংবলিত হতে পারে। অন্যদিকে অতি-বিয়োজিত মাক প্রায়ই সূক্ষ্ম গঠন সংবলিত হয়। এটি প্রাকৃতিক অঞ্চলের জন্য অনন্য, যাকে বলা হয় পিটল্যান্ডস। পিটল্যান্ড ইকোসিস্টেম ৩.৭ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে এবং এটি গ্রহের সবচেয়ে দক্ষ কার্বন সিঙ্ক, কারণ পিটল্যান্ড গাছপালা প্রাকৃতিকভাবে পিট থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে ভারসাম্য বজায় রাখে। বিশ্বব্যাপী পিট, কার্বন সঞ্চয় করে ৫৫০ গিগাটন পর্যন্ত ; যা সমস্ত মাটির কার্বনের ৪২%, যদিও এই পিট মৃত্তিকা ভূ-পৃষ্ঠের মাত্র ৩% জুড়ে রয়েছে।
উৎস
প্রাথমিকভাবে পিট সমন্বিত মাটি হিস্টোসল নামে পরিচিত। পিটল্যান্ড, বিশেষ করে বোগ ( জলাভূমি যা মৃত উদ্ভিদ সামগ্রীর জমা হিসেবে পিট জমা করে) পিটের প্রাথমিক উৎস। এ ছাড়া, ফেন, পোকোসিন এবং পিট সোয়াম্প ফরেস্টসহ অন্যান্য জলাভূমিও পিট জমা করে। জলাভূমি অবস্থায় পিট তৈরি হয়, যেখানে বন্যা বা স্থির জল বায়ুম-ল থেকে অক্সিজেনের প্রবাহকে বাধা দেয়, পচনের হারকে ধীর করে দেয়।
বাংলাদেশে পিট মৃত্তিকা
বাংলাদেশে পিট মৃত্তিকার পরিমাণ ০.১৩ মিলিয়ন হেক্টর। এসব মৃত্তিকা গোপালগঞ্জ-খুলনা অঞ্চলের নিচু এলাকাতে পাওয়া যায়। এছাড়া পূর্বাঞ্চলীয় সুরমা-কুশিয়ারা পললভূমির কোন কোন হাওর এবং তদসংলগ্ন উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের পাদদেশীয় সমভূমিতে স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন পিট মৃত্তিকা দেখা যায়। এগুলো পাললিক পিট। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পিট মজুতের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে মাদারীপুরের বাঘিয়া ও চান্দা বিল, খুলনা জেলার কোলা মৌজা, মৌলভীবাজার জেলার মৌলভীবাজার ও চাতাল বিল এবং সুনামগঞ্জ জেলার পাগলা ও চোরকাই-এর নাম উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে পিট ক্ষেত্রগুলো ভূপৃষ্ঠে বা এর খুব কাছে বিদ্যমান। বাংলাদেশে প্রাপ্ত পিট বাদামি থেকে ঘন বাদামি রঙের এবং আঁশময় ও নরম। এটি সংকুচিত হয় এবং শুকালে দৃঢ় ও ভঙ্গুর হয়। সাধারণত মৃত্তিকা পরিলেখের উপরের ৮০ সেন্টিমিটারের অর্ধেকেরও বেশি অংশ এবং কখনও কখনও একই মৃত্তিকার বিভিন্ন স্তরে জৈব পদার্থ বিদ্যমান থাকে। গাঢ় বাদামি মাক এসব মৃত্তিকার সাধারণ উপাদান। বাংলাদেশের কৃষি-পরিবেশ অঞ্চল- ১৪তে অন্তর্ভুক্ত এলাকাটি শুষ্ক মৌসুমে ভিজা থাকে এবং বর্ষা মৌসুমে গভীরভাবে প্লাবিত হয়। পিট মৃত্তিকা অর্থাৎ কৃষি-পরিবেশ অঞ্চল-১৪ মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, যশোর বাগেরহাট ও খুলনা জেলার বেশ কিছু সংখ্যক স্বতন্ত্র নিচু এলাকা দখল করে আছে। পৃষ্ঠদেশে পিট ও মাকসহ মৃত্তিকাগুলোতে সাধারণত নলখাগড়া জন্মে।
গঠন
পিট কয়লার প্রাথমিক পর্যায় বা জাত। অম্লীয় এবং অবায়বীয় অবস্থায় উদ্ভিদের উপাদান সম্পূর্ণরূপে ক্ষয় না হলে পিট গঠন করে। সামান্য পরিমাণ অক্সিজেন বিশিষ্ট বদ্ধ পানিতে উদ্ভিদাদির পচনের ফলে এটি গঠিত হয়। জলাভূমি ও আর্দ্রস্থানে বেড়ে ওঠা গাছপালা, গুল্মলতা, শৈবালের আংশিক পচন ও বিয়োজন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন একটি বাদামি অবশেষ। পিটে আর্দ্রতামূলক উপাদান ৭৫ শতাংশের বেশি, কার্বন ৬০% ও অক্সিজেন ৩০% (আর্দ্রতামুক্ত অবস্থায়)। শুষ্ক অবস্থায় এটি অবাধে জ্ব¡লে। এসব মৃত্তিকা চরম অম্লীয় এবং উদ্ভিদের জন্য অপরিহার্য পুষ্টি উপাদান কম থাকে। এতে শনাক্তযোগ্য উদ্ভিজ্জ কণিকা বিদ্যমান থাকলেও খনিজ নেই বললেই চলে। এটি ধীরে ধীরে আর্দ্র পরিস্থিতি তৈরি করে যা জলাভূমির এলাকাকে প্রসারিত করে দেয়।
সাধারণ ব্যবহার
পিট একবার শুকিয়ে গেলে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। শিল্প ব্যবহারের জন্য, কোম্পানিগুলো পিট থেকে জল বের করার জন্য চাপ ব্যবহার করতে পারে, যা নরম এবং সহজেই সংকুচিত হয়।
কৃষকরা গৃহের অভ্যন্তরে শীতকালে গবাদি পশুর মলমূত্র শোষণ করতে শুকনো পিট ব্যবহার করে। পিটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো পাত্রের মাটিতে আর্দ্রতা ধরে রাখা, যখন এটি শুকিয়ে যায় এবং ভেজা অবস্থায় অতিরিক্ত জল প্রতিরোধ করে। পিট পুষ্টি সঞ্চয় করতে পারে যদিও এটি নিজেই উর্বর নয়।
পিটল্যান্ড পানীয় জলের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেমন-যুক্তরাজ্যে, জনসংখ্যার ৪৩% পিটল্যান্ড থেকে পানীয় জল গ্রহণ করে, আয়ারল্যান্ডে এই সংখ্যা ৬৮%-এ পৌঁছেছে। ডাবলিনসহ বৃহৎ শহরগুলোর জন্য জলের প্রধান উৎস হলো পিটল্যান্ড সমন্বিত ক্যাচমেন্ট।
পিট জলাভূমি বন্যা প্রশমনের একটি প্রাকৃতিক উপায় হিসাবে কাজ করে। যে কোনো উপচে পড়া পানি পিট দ্বারা শোষিত হয়।
পিট কখনও কখনও মিঠা পানির অ্যাকোরিয়াতে ব্যবহৃত হয়। এটি আয়ন বিনিময়কারী হিসাবে কাজ করে। এটিতে এমন পদার্থ রয়েছে ; যা উদ্ভিদের জন্য এবং মাছের প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
ইহা বেলে মাটির পানি ধারণক্ষমতা এবং কর্দম মাটির অনুপ্রবেশ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বলে একে বাগানে এবং টবে ব্যবহার করা হয়। জীবাণু সার তৈরিতে বাহক বস্তু হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
পরিবেশগত সমস্যা
পিট যদিও কঠোরভাবে ফসিল ফুয়েল নয় তথাপি গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণে ফসিল ফুয়েলের সাথে তুলনাযোগ্য। পিটকে ধীর নবায়নয়োগ্য শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পিট একটি প্রধান অগ্নি বিপদের কারণ হতে পারে, কারণ এটি হালকা বৃষ্টি দ্বারা নির্বাপিত হয় না। পিট আগুন দীর্ঘ সময়ের জন্য জ্বলতে পারে, অথবা অক্সিজেনের উৎস উপস্থিত থাকলে শীতের পরে মাটির নিচে ধোঁয়া উঠতে পারে এবং পুনরায় জ্বলতে পারে। এমন অনেকগুলো কারণ রয়েছে ; যা জমির কার্বন সিঙ্ক থেকে ঈঙ২ নির্গমনকে ত্বরান্বিত করে এবং ইহা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
জমি পরিষ্কার করা যা পিট পৃষ্ঠের উপর সূর্যালোকের পরিমাণ বাড়ায়, যাতে মাটির তাপমাত্রা এবং পচনশীল অণুজীবের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়। কচুরিপানা এবং চালের খড় তাজা জৈব পদার্থের প্রাপ্যতা বাড়ায় ; যা সহজেই পচে বায়বীয় অবস্থায় ঈঙ২এবং অবায়বীয় অবস্থায় ঈঐ৪গ্যাস নির্গমন বৃদ্ধি করে।
পিট নিষ্কাশনের ফলে, জৈব কার্বন-যা হাজার হাজার বছর ধরে গঠিত এবং সাধারণত পানির নিচে থাকে, তা হঠাৎ করে বাতাসের সংস্পর্শে আসে। এটি পচনশীল এবং কার্বন ডাই-অক্সাইডে পরিণত হয়; যা বায়ুম-লে নির্গত হয়। জৈব জলাভূমি (পিট) মাটির বৃহৎ এলাকা বর্তমানে কৃষি, বনায়ন এবং পিট আহরণের জন্য নিষ্কাশন করা হয়। এটি শুধুমাত্র অনেক প্রজাতির বাসস্থান ধ্বংস করে না বরং জলবায়ু পরিবর্তনকেও ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত করে।
জ্বালানির জন্য শুকনো মৌসুমে পিট পোড়ানোর কারণে ঈঙ২ নির্গমন বৃদ্ধি পায়। সনাতন পদ্ধতিতে মাটির অম্লমান কমাতে, উর্বরতা বাড়াতে, কৃষিকাজ ও অন্যান্য কাজে পোড়ানো হয় ; যা ঈঙ২ নির্গমন বাড়িয়ে দেয়।
নাইট্রোজেন সারের মতো সার যোগ করলে মাটির ঈ/ঘ অনুপাত কমে যায় এবং অণুজীবের দ্বারা জৈব পদার্থের পচনকে উৎসাহিত করে, এর পরে পরিবেশে ঈঙ২ মুক্ত হয়। নাইট্রোজেন সার ঘ২ঙ গ্যাস নির্গমনেও অবদান রাখে। মাটির সঙ্গে সার বা অ্যামিলিওরেন্টস (উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য প্রাথমিকভাবে মাটির ভৌত অবস্থা পরিবর্তন করা) যোগ করা ; যা পিটের ঢ়ঐ বাড়ায় এবং পরে পিটের পচন ত্বরান্বিত করে।
পিট মাটির সংশোধন বা ব্যবস্থাপনা
ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের বিবেচনায় পিট মাটির ব্যাবস্থাপনা খুবই জটিল। তথাপি কিছু পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে সীমিত পরিসরে পিট মাটির সংশোধন করা যেতে পারে। যেমন:
যেসব স্থানে পৃষ্ঠ মৃত্তিকা এঁটেল প্রকৃতির সেখানে ব্যাপক আকারে বোরো ধানের চাষ করা যেতে পারে। পটাশিয়াম, সালফার, জিঙ্ক ও কপারের অলভ্যতাই কৃষিকাজে এসব মৃত্তিকা ব্যবহারের অন্তরায়।
জোয়ার-ভাটা সংলগ্ন নদী থেকে পলি জমার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে এই মাটি উন্নত করা যেতে পারে। নিষ্কাশন নিয়ন্ত্রন বা পললদ্বারা ঢেকে দিয়ে মৃত্তিকা সংশোধন করা ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া।
মাঝারি উঁচু এবং মাঝারি নিচু জমির একটি প্লটকে কয়েকটি সাব প্লটে বিভক্ত করে দুটি প্লটের মধ্য হতে মাটি তুলে পাশের প্লটে স্থাপন করে প্লটগুলো উঁচু করার মাধ্যমে নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতায় খননকৃত পরিখায় স্থানীয় মাছের চাষ করা যেতে পারে এবং উঁচু প্লটে শাকসবজি,আখ ও ধৈঞ্চা চাষ করা যেতে পারে।
জিওলাইট ব্যবহার করে। জিওলাইট হচ্ছে ক্ষারীয় প্রকৃতির হাইড্রেটেড ক্রিস্টালাইন এলোমিনোসিলিকেট খনিজ। অষঙ৪ এবং ঝরঙ৪ মিলে টেট্রাহেড্রাল শীট গঠন করে। জিওলাইট (চঐ-৮.৪৪) মাটির আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে এবং অম্লীয় মাটির চঐ বৃদ্ধি করে। ইহার রয়েছে-উচ্চ আয়ন বিনিময় ক্ষমতা, উচ্চ পানি ধারণক্ষমতা এবং উচ্চ অ্যাডজর্পশন ক্ষমতা। ইহা ঘঐ৪+, ঘঙ৩- এবং ক+ ধরে রাখে, ফলে লিচিং লস কম হয় এবং সার প্রয়োগের দক্ষতা বৃদ্ধি করে।
পরিশেষে বলা যায়, পিটল্যান্ড একটি গুরুত্বপূর্ণ কার্বন এবং জল সঞ্চয়ক, নিষ্কাশনের কারণে এই কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে একটি উদ্বেগের বিষয়। পিট ফায়ারিং কার্যকলাপ পানির টেবিলের গভীরতা হ্রাসের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে কার্বন নিঃসরণ এখন একটি আলোচিত বিষয়। পিট মাটির টেকসই ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের জন্য বিশ্বব্যাপী জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। পিট গঠনের জন্য একে নিষ্কাশনের মাধ্যমে কৃষি জমিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া বন্ধের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জলাবদ্ধতা পুনরুদ্ধার করতে হবে। জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ মাটির ক্ষেত্রে ভূমি উন্নয়নের জন্য সেডিমেন্টশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দৃঢ়ভাবে এই দিকগুলোর উপর গবেষণা, পরামর্শ, প্রযুক্তিগত, প্রণোদনা এবং নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা পিটল্যান্ড ব্যবহারের সর্বোত্তম সুবিধার জন্য উন্নত করা আবশ্যক।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, আঞ্চলিক গবেষণাগার, গোপালগঞ্জ। মোবাইল : ০১৯১১৬২১৪১৫, ই-মেইল : hasinasrdi@gmail.com
আধুনিক কৃষিতে জিআইএস ও রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তির ব্যবহার
মোছাঃ আইরিন পারভীন
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদ- এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রধান খাত হিসাবে বিবেচিত হয়। খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রাখার নিমিত্তে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কৃষি সংক্রান্ত তথ্যের সময়মতো প্রাপ্যতা অত্যাবশ্যক। ফসল উৎপাদন পরিসংখ্যানের নিয়মিত আপডেট তৈরি এবং টেকসই কৃষি অর্জনের লক্ষ্যে ইনপুট প্রদানের জন্য জিওস্পেশিয়াল প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জমিভিত্তিক পর্যবেক্ষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার কর্তৃক বিভিন্ন নীতিমালা গ্রহণ বা কৃষিসংক্রান্ত জাতীয় সমস্যাগুলো সমাধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণে জিআইএস ও রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) এবং রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ এবং কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য মূল্যবান তথ্য প্রদান করে আধুনিক কৃষি রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। জিআইএস কোনো স্থানের অবস্থানগত তথ্যের সাথে সেই স্থানের পরিমাণগত এবং গুণগত বিভিন্ন তথ্যকে একত্র করে মানচিত্র এবং চার্টের মাধ্যমে তথ্য প্রদর্শন, বিশ্লেষণ এবং প্রতিবেদন তৈরি করতে সহায়তা করে। জিআইএস তথ্য/ডেটা সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য, নির্ভুল এবং ব্যবহারকারী-বান্ধব। কোনো একটি নির্দিষ্ট ফসল উৎপাদনের জন্য সঠিক স্থান নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল তথ্যকে একটি একক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার মাধ্যমে জিআইএস সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
রিমোট সেন্সিং হল কোন বস্তুকে সরাসরি স্পর্শ না করে সেই বস্তু বা ঘটনা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার একটি প্রক্রিয়া। বর্তমানে ‘রিমোট সেন্সিং’ শব্দটি সাধারণত স্যাটেলাইট/বিমান/ ড্রোনভিত্তিক সেন্সর প্রযুক্তির ব্যবহারকে বোঝায় যা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বিকিরণ ব্যবহার করে ভূপৃষ্ঠে, বায়ুম-ল এবং মহাসাগরসহ পৃথিবীর বস্তুগুলোকে সনাক্ত এবং শ্রেণিবদ্ধ করার কাজে ব্যবহৃত হয়। রিমোট সেন্সিং দুই ভাগে বিভক্ত, ধপঃরাব এবং ঢ়ধংংরাব । ‘অপঃরাব’ রিমোট সেন্সিং (অর্থাৎ, যখন একটি স্যাটেলাইট/ বিমান/ড্রোন দ্বারা একটি সংকেত নির্গত হয়ে বস্তুর উপর পড়ে এবং বস্তু থেকে প্রেরিত প্রতিফলন সেন্সর দ্বারা শনাক্ত করা হয়) এবং চধংংরাব রিমোট সেন্সিং (অর্থাৎ, যখন সূর্য থেকে নির্গত রশ্মি বস্তুর উপর পড়ে এবং বস্তু থেকে প্রেরিত প্রতিফলন সেন্সর দ্বারা শনাক্ত করা হয়)।
রিমোট সেন্সিং থেকে সংগৃহীত তথ্যগুলো জিআইএস এ সন্নিবেশনের মাধ্যমে এটি ফসল এবং কৃষি কৌশল সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। কৃষিতে জিআইএস ও রিমোট সেনসিং প্রযুক্তির কিছু উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ রয়েছে, যেমন-
প্রিসিশন কৃষি : জিআইএস এবং রিমোট সেন্সিং প্রিসিশন কৃষি বাস্তবায়নে সহায়তা করে। মাটির ধরন, আর্দ্রতার মাত্রা, তাপমাত্রা এবং ফসলের স্বাস্থ্যের তথ্য সংগ্রহ করে কখন এবং কোথায় রোপণ করতে হবে, সেচ দিতে হবে এবং সার বা কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে সে সম্পর্কে কৃষকরা সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এটি ফসল উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় নির্ধারিত পরিমাণে পুষ্টি উপাদান এবং পানি প্রয়োগের মাধ্যমে পুষ্টি উপাদান ও পানি ব্যবস্থাপনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, খরাপ্রবণ এলাকায় রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তির মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ড্রিপ সেচ প্রদান করা হয়, যেমন- গাছ ও বায়ু তাপমাত্রার পার্থক্য ব্যবহার করে পানির ব্যবহারের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য এই ড্রিপ সেচ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এটি ইনপুট (পানি) খরচ হ্রাস এবং পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস করে। মাল্টিস্পেকট্রাল এবং হাইপারস্পেকট্রাল সেন্সরযুক্ত রিমোট সেন্সিং স্যাটেলাইট এবং ড্রোন কৃষি জমি থেকে সময়মতো উচ্চ-রেজুলেশনের ইমেজ (ছবি) প্রদান করতে পারে। এই ইমেজগুলো একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর ফসলের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ, রোগ, কীটপতঙ্গ এবং পুষ্টির ঘাটতি শনাক্ত করতে এবং শস্য ব্যবস্থাপনা করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ যেমন মাটির আর্দ্রতা, রোপণের তারিখ, বাতাসের তাপমাত্রা, দিনের দৈর্ঘ্য এবং মাটির অবস্থা সম্পর্কে ধারণা প্রদান করতে সহায়তা করে থাকে। ফসলের স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য ঘড়ৎসধষরুবফ উরভভবৎবহপব ঠবমবঃধঃরড়হ রহফবী (ঘউঠও) বিশ^ব্যাপী বহুল ব্যবহৃত একটি ইনডেক্স।
ঘউঠও এর মান-১ থেকে +১ পর্যন্ত হয়ে থাকে। ঘউঠও এর মান-১ এর কাছাকাছি হলে সেটি পানি, শূন্যের (০) কাছাকাছি হলে সেটি পতিত জায়গা এবং ০.১-০.৫ হলে ফাঁকা ফাঁকা সবুজগাছযুক্ত এলাকা এবং ০.৬ ও তার ঊর্ধ্বে হলে সেটি ঘন সবুজ এলাকা বা গাছের বেশি ভাল স্বাস্থ্য বোঝায়।
সম্পদ ব্যবস্থাপনা : জিআইএস ভূমি ব্যবহার, মাটির ধরন এবং টপোগ্র্যাফি বিষয়ক ম্যাপ তৈরি এবং তথ্য বিশ্লেষণ করতে ব্যবহৃত হয়। এই তথ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের সঠিক পরিমাণে পানি এবং সারের ব্যবহার নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। ফসলের গাছের স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্যNormalized Difference Vegetation index (NDVI) বিশ^ব্যাপী বহুল ব্যবহৃত একটি ইনডেক্স করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। সঠিক পরিমাণে সেচ এবং সার পরিকল্পনা তৈরির মাধ্যমে ফলন উন্নত করা এবং অপচয় কমানো সম্ভব। ফসলের মাঠে রোগ ও পোকামাকড় আক্রান্ত এলাকা সনাক্তকরণে রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মাটির আর্দ্রতা নির্ণয় : রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তির সাহায্য ব্যতীত মাটির আর্দ্রতা নির্ণয় করা খুব কঠিন। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে মাটিতে কি পরিমাণ আর্দ্রতা আছে তা জানা যায় এবং সেই অনুযায়ী কোন ফসল কখন আবাদ করা যাবে, সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সহজ হয়।
খরা মনিটরিং : রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তির সাহায্যে আবহাওয়ার ধরণ নির্ণয় করা যায়। এর সাহায্যে কোন একটি এলাকার বৃষ্টিপাতের ধরন অনুমান করা যায় এবং ভবিষ্যতে কখন বৃষ্টিপাত হবে সে সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় যা খরা উত্তরণে কৃষককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে Land surface Temperature (LST), NDVI, Normalized Difference Water Index, Normalized Difference Moisture Index (NDMI) and Soil Adjusted Vegetation Index (SAVI) ব্যবহার করে সহজেই খরা পরিমাপ করা যায়। ঘউডও এবং ঘউগও এই সূচকগুলোর পানির অভাবযুক্ত স্থানে কম মান এবং পানিযুক্ত স্থানে/ আর্দ্রতাযুক্ত স্থানে বেশি মান পাওয়া যায়।
আগাছা ব্যবস্থাপনা : কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানে আগাছা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করা একটি সময় এবং শ্রমসাপেক্ষ বিষয়। নির্দিষ্ট স্থানে আগাছা ব্যবস্থাপনার জন্য আগাছা শনাক্তকরণে ইমেজভিত্তিক রিমোট সেন্সিং-এর ব্যবহার করা হয়। ফসল এবং আগাছা থেকে নির্গত স্পেকট্রাল প্রতিফলনের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন স্পেকট্রাল সিগনেচার তৈরি হয়, যার মাধ্যমে গাছকে আগাছা থেকে সহজেই পৃথকভাবে সনাক্ত করা এবং ক্ষেতে আগাছার অবস্থান ম্যাপ তৈরি করা হয় যা আগাছা দমন পরিকল্পনা প্রণয়নে বিশেষ অবদান রাখে।
কৃষি আবহাওয়া : জিআইএস এবং রিমোট সেনসিং প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষি ব্যবস্থাপনায় প্রকৃত সময়ের (রিয়েল-টাইম) আবহাওয়া এবং জলবায়ু তথ্যের সন্নিবেশ ঘটানো হয়। এটি আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং জলবায়ু তথ্যের উপর ভিত্তি করে ফসল রোপণ, ফসল কাটা এবং সেচ সংক্রান্ত সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
ফসল মনিটরিং এবং আবাদী জমির পরিমাণ নির্ণয় : জিআইএস ও রিমোট সেনসিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজেই মাঠ ফসল মনিটরিং এবং প্রধান প্রধান ফসলের আবাদী জমির পরিমাণ নির্ণয় করা যায় যা সরকারের নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
ফলন পূর্বাভাস : ফসলের ফলন প্রাক্কলন করতে রিমোট সেন্সিং এবং জিআইএস প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ফসল সূচকসমূহ (ঘঠউও, ঊঠও, ঝঅঠও) এবং বিগত বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে, কৃষক এবং নীতিনির্ধারকরা সঠিকভাবে ফসলের ফলনের ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন। এই তথ্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
ভূমি ব্যবস্থাপনা : কৃষি জমি ব্যবহারের সঠিক পরিকল্পনার জন্য জিআইএস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি মাটির গুণাগুণ, জলবায়ু এবং টপোগ্র্যাফির মতো বিষয়গুলো বিবেচনা করে বিভিন্ন ফসলের জন্য উপযুক্ত এলাকা চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। এটি পতিত এলাকা বা নতুন উন্নত চর এলাকায় কৃষি জমি সম্প্রসারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। এছাড়াও ফসলের শ্রেণীবিভাগ এবং ফসলের এলাকা নির্ধারণ করতে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তির মাধ্যমে কোন এলাকার জমি ব্যবহারের ধরন সম্পর্কে জানা যায় অর্থাৎ কি পরিমাণ জমি ফসলের আওতায়, কি পরিমাণ জায়গায় বন/পানি/পতিত/চর/দালানকোঠা আছে ইত্যাদি জানা যায় এবং সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারকে সহযোগিতা করতে পারে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : জিআইএস এবং রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষিতে বন্যা এবং খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব মূল্যায়ন করা যায়। এটির মাধ্যমে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সংঘটিত প্রকৃত ক্ষতি মূল্যায়ন করা যেতে পারে এবং সে অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়া যেতে পারে।
কৃষি পণ্যের বাজার বিশ্লেষণ : জিআইএস ব্যবহার করে বাজারের প্রবণতা এবং কৃষি পণ্যের চাহিদার ধরন বিশ্লেষণ করা যায়। বাজারের চাহিদা এবং দামের পূর্বাভাসের উপর ভিত্তি করে কি কি ফসল ফলানো হবে সে সম্পর্কে কৃষকরা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
টেকসই কৃষি এবং পরিবেশ সংরক্ষণ : জিআইএস এবং রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি টেকসই কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ভূমির ব্যবহার পরিবর্তন এবং পরিবেশগত প্রভাব পর্যবেক্ষণ করে, কৃষি পরিবেশগতভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না তা এই জিআইএস এবং রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি জানতে সহায়তা করে।
সংক্ষেপে, সারা বিশ্বে জিআইএস এবং রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি আধুনিক কৃষিতে অপরিহার্য হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। কৃষক এবং কৃষি স্টেকহোল্ডারদের তথ্যনির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, সম্পদ সংরক্ষণ এবং ঝুঁকি হ্রাস করতে সক্ষম করে, যা কৃষি খাতকে টেকসই এবং লাভজনক কৃষিতে রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
লেখক : উপজেলা কৃষি অফিসার (সংযুক্তি: পরিকল্পনা, প্রকল্প বাস্তাবায়ন ও আইসিটি উইং), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মোবাইল : ০১৭২৭২৪৯৪৪৮, ই-মেইল : irin.dae 28@gmail.com
SAU স্মার্ট সোলার সান ড্রায়ার : নিরাপদ শুঁটকি মাছ উৎপাদন ও রপ্তানির হাতিয়ার
মোঃ মাসুদ রানা
মাছ হচ্ছে প্রানিজ আমিষের অন্যতম প্রধান উৎস, মাছ আমরা বিভিন্নভাবে খেয়ে অভ্যস্ত। যেমন ৭০-৮০ শতাংশ মাছ আমরা সরাসরি রান্না করে খেয়ে থাকি। সরাসরি রান্না না করে মাছ দীর্ঘদিন সংরক্ষণের অনেকগুলো পদ্ধতি আছে তার মধ্যে মাছ থেকে রোদ ও বাতাসের সহায়তায় পানি বের করে দিয়ে সংরক্ষণ যা শুঁটকি মাছ বলে আখ্যায়িত হয়, লবণ দিয়ে মাছ সংরক্ষণ, বরফ দিয়ে সংরক্ষণ, ধোঁয়া দিয়ে মাছ সংরক্ষণ ও কাচা মাছকে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বিভিন্ন মৎস্যজাত পণ্য উৎপাদন করে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ উল্লেখযোগ্য। মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ করে সংরক্ষণের যতগুলো পদ্ধতি চলমান আছে তার মধ্যে সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো রোদে মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করা, যা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় যুগ যুগ ধরে অনুসরণ করে আসছে। দিনের বেলা মাছের শরীরে রোদ পড়ে, যা মাছের শরীর থেকে পানি বের করে দেয় এবং প্রবাহমান বাতাস মাছের শরীরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মাছকে পানিশূন্য করে শুকিয়ে ফেলে। মাছ পচনের জন্য দায়ী অণুজীবসমূহের বেঁচে থাকা ও বংশবৃদ্ধি পরিপূর্ণভাবে নির্ভর করে মাছের শরীরের উপস্থিত পানির পরিমাণের উপর, যদি তা না থাকে তাহলে অণুজীবসমূহ বংশবৃদ্ধিও করতে পারে না এবং পচনও ঘটে না। ফলশ্রুতিতে শুঁটকি মাছ সাধারণ তাপমাত্রায় দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়।
বাংলাদেশে আদিকাল থেকে যে পদ্ধতিতে মাছ শুকানো হয় তা হলো খোলা আকাশের নিচে চাটাই বা মাচার উপর জলাশয়, নদী বা সমুদ্র থেকে ধৃত মাছ ছড়িয়ে। প্রচলিত পদ্ধতিতে মাছ শুকানোর প্রতিবন্ধকতাগুলো হচ্ছে-
া যেহেতু উন্মুক্ত পরিবেশে মাছ শুকানো হয় সেহেতু মাছের শরীরে পানির পরিমাণ বেশি থাকে। মাছ একটি অন্যতম পচনশীল দ্রব্য হওয়ার কারণে দ্রুত সময়ে না শুকানোর কারণে মাছ পচতে শুরু করে এবং মাছের শরীরে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানগুলো ভেঙে অন্য উপাদানে পরিণত হতে শুরু করে যা মানব শরীরের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
মাছের শরীরে বিদ্যমান চর্বি তাপ ও অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে অক্সিডাইজড হয়ে দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে, যা মাছ শুকানোর পরেও মাছের শরীরে বিদ্যমান থাকে। ফলশ্রুতিতে অধিকাংশ ভোক্তা দুর্গন্ধের কারণে শুটকী মাছ পছন্দ করেন না।
প্রচলিত পদ্ধতিতে যে কাঁচামাল ব্যবহার করা হয় তা খুব কম গুণগতমানসম্পন্ন ফলে খোলা বাতাসে ছড়ানোর সাথে সাথে পচন শুরু হয়। মাছ শুকানোর জায়গা খোলামেলা হওয়ার কারণে মাছি ও অন্যান্য পোকামাকড় মাছের শরীরে বসে এবং তারা সেখানে জায়গা করে ডিম দেয় এবং বংশবৃদ্ধি করে। পোকামাকড় রোধ করার জন্য উৎপাদকরা বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক ব্যবহার করে থাকেন যেমন-ডিডিটি, এলড্রিন, ডায়ালড্রিন। শুঁটকি মাছ উৎপাদকগণ যে সকল রাসায়নিক মাছের শরীরে ব্যবহার করেন তার সবগুলোই মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং ক্যান্সারের বাহক।
আমাদের দেশে যেমন শুঁটকি মাছের কদর আছে তেমনি বিশ্ব বাজারে শুঁটকি মাছের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। আমাদের দেশের শুঁটকি মাছ রপ্তানির অন্যতম বাধা হলো আমাদের উৎপাদিত শুঁটকি মাছ নিরাপদ না। ফলে আমাদের দেশে বিপুল পরিমাণে শুঁটকি মাছ উৎপাদন করলেও রপ্তানি করে বৈদশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারছি না। এখন প্রয়োজনের তুলনায় অধিক মাছ উৎপাদন হচ্ছে এবং দেশে রয়েছে বিশাল সমুদ্র। যদি নিরাপদ ও স্বাস্থ্য সম্মত শুঁটকি মাছ উৎপাদন করা যায় তাহলে বাংলাদেশে যেমন ভোক্তার সংখ্যা বাড়বে তেমনি বিশ্ববাজারে নিরাপদ শুঁটকি রপ্তানি করে দেশের অর্থনিতীতে অবদান রাখা সম্ভব হবে। অধিকন্তু দেশের বেকারত্ব দূরীকরণেও সহায়ক ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।
নিরাপদ শুঁটকি মাছ উৎপাদন, প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদিত শুঁটকি মাছের সমস্যাগুলো সমাধান ও রপ্তানি বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে আমি লেখক ও প্রফেসর ড. কাজী আহসান হাবীব মৎস্য অধিদপ্তরের সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের আর্থিক সহায়তায় উদ্ভাবন করা হয়েছে। ‘ঝঅট স্মার্ট সোলার সান ড্রায়ার’ যা দেশের প্রথম আইওটি বেইজড মাছ শুকানোর যন্ত্র। উদ্ভাবিত যন্ত্রটিতে স্মার্ট টেকনোলজি ব্যবহার করে অটোমেশন করা হয়েছে ফলে ড্রায়ারটি নিজের ড্রায়িং এনভায়ারমেন্ট নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। উদ্ভাবিত ড্রায়ারটিতে সোলার ব্যবহার করা হয়েছে যেখান থেকে ব্যাটারিতে শক্তি সঞ্চিত হয় যা রাতের বেলা তাপ সৃষ্টিতে ব্যবহার করা হয়।
উদ্ভাবিত ড্রায়ারটি দিনের সূর্যের তাপ ব্যবহার করে মাছ শুকাবে রাতের বেলা সোলার থেকে প্রাপ্ত শক্তির সহায়তায় হিটারের মাধ্যমে রাতের বেলা বা সূর্যের অনুপস্থিতিতে তাপ সৃষ্টি করবে ফলে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা মাছ থেকে পানি অপসারণ হবে। মেশিনটিতে ২টি এক্সজাস্ট ফ্যান ব্যবহার করা হয়েছে, যা মাছ থেকে বের হওয়া পানি দ্রুত সময়ের মধ্যে বাইরে বের করে দিবে এবং হিউমিডিটি নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে। মেশিনটির ভেতরে ১টি রোটেটিং ফ্যান ব্যবহার করা হয়েছে যা, ভেতরে তাপ সমভাবে বিন্যাস্ত করবে যা যন্ত্রটির সকল র্যাকে মাছ থেকে পানি বের করে দিতে সহায়তা করবে। প্রচলিত পদ্ধতিতে মাছ শুকানোর জন্য দিনের বেলা সময় পাওয়া যায় ৫-৭ ঘণ্টা/দিন কিন্তু উদ্ভাবিত ড্রায়ারটিতে ২৪ ঘণ্টা মাছ শুকানো যাবে ফলে মাছ শুকানোর সময় ৬০% কমে আসবে। একই সময়ে দ্বিগুণ পরিমাণ শুঁটকি মাছ উৎপাদন করে দ্বিগুণ মুনাফা অর্জন করা সম্ভবপর হবে। যেহেতু ড্রায়ারটি সম্পূর্ণ উচ্চমাত্রার সহনশীল পলিথিন দিয়ে ঘেরা সেহেতু ভেতরে মাছি বা অন্য পোকামাকড় প্রবেশের কোন সুযোগ নাই তাই বিষ প্রয়োগের দরকার পড়বে না ফলে উৎপাদিত শুঁটকি মাছ হবে ভোক্তার জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। ড্রায়ারটিতে সেনসর বেইজড সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে যা মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং মেশিনটির ভেতরের সকল প্যারামিটারের মান মোবাইলে আসে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে যন্ত্রটির ভেতরে তখনও মাছ শুকাবে কারণ দিনের বেলা মাত্র ৩-৪ ঘণ্টা রোদের তাপ পেলেই সোলার ও ব্যাটারি স্বয়ংক্রিয় থাকবে।
শেরোবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবিত ড্রায়ারটি ইতোমধ্যে কক্সবাজারের নাজিরাটেক এ অবস্থিত দেশের বৃহত্তম শুঁটকি পল্লীতে তিনটি গ্রুপে ০৩টি বিনামূল্য সরবরাহ করা হয়েছে যেখানে তারা নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদন করছে, সরকারি বা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ড্রায়ারটি দেশের সকল শুঁটকি উৎপাদনশীল এলাকায় সরবরাহ করে নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি করা এবং দেশের বেকারত্ব দূরীকরণে সবসময় কাজ করে যাবে বলে উদ্ভাবকগণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
পরিশেষে বলা যায়, উদ্ভাবিত ড্রায়ারটি যেমন নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে তেমনি বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে রাখবে অনন্য ভূমিকা। এককথায় বলা যায় ড্রায়ারটি হবে স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য স্মার্ট টেকনোলজির এক অনন্য প্রয়াস।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ফিশিং অ্যান্ড পোস্ট হার্ভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল: ০১৭৪৫৬২৬১৫৩, ই-মেইল :ranadof.bd@yahoo.com
বিএলআরআই উদ্ভাবিত মুরগির
জাত মিট চিকেন-১ (সুবর্ণ)
ড. শাকিলা ফারুক১ ড. কামরুন নাহার মনিরা২ মো: রাজিউল ইসলাম৩
সুস্থ, সবল ও মেধাবী জাতি গঠনে প্রাণিজ আমিষের কোন বিকল্প নেই। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের মানুষের জীবনমান উন্নত হওয়ায় ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসেরও পরিবর্তন এসেছে। তাই প্রাণিজ আমিষের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে দেশে মোট মাংসের চাহিদার শতকরা ৪০-৪৫ শতাংশ আসে পোল্ট্রি থেকে। প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে সরকারের ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নের জন্য দৈনিক ৩৫-৪০ হাজার মেট্রিক টন মুরগির মাংস উৎপাদন করা প্রয়োজন। বর্তমানে মুরগির মাংসের অর্ধেকের বেশি আসে বাণিজ্যিক ব্রয়লার থেকে যার পুরোটাই আমদানি নির্ভর। কিন্তু বৈশি^ক আবহাওয়া ও জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাব পোল্ট্রি শিল্পের উপর দৃশ্যমান। ফলে, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় দেশি আবহাওয়া উপযোগী অধিক মাংস উৎপাদনকারী মুরগির জাত উদ্ভাবন করা জরুরি। সেই বিবেচনায়, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) পোল্ট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগের বিজ্ঞানীবৃন্দ দেশীয় জার্মপ্লাজম ব্যবহার করে ধারাবাহিক সিলেকশন ও ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে সম্প্রতি একটি অধিক মাংস উৎপাদনকারী মুরগির জাত উদ্ভাবন করেছে। দেশীয় পরিবর্তনশীল আবহাওয়া উপযোগী মুরগির এই জাতটির নামকরণ করা হয়েছে বিএলআরআই মিট চিকেন-১ (সুবর্ণ)।
ব্রিডিং (ইৎববফরহম) শুরুর ইতিহাস
বাংলাদেশ সরকার ও জাইকার যৌথ উদ্যোগে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৯ সালে ন্যাশনাল লাইভস্টক ব্রিডিং সেন্টার, ওকাজাকি জাপান চার (০৪)টি মুরগির বিশুদ্ধ লাইন বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) বিনামূল্যে প্রদান করে। সে সময় থেকে এ লাইনগুলো সিলেক্টিভ ব্রিডিং-এর মাধ্যমে অধিক উৎপাদনশীল লাইনে উন্নীত করা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের পোল্ট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগের বিজ্ঞানীবৃন্দ ধারাবাহিক দশ (১০) জেনারেশন পর্যন্ত সিলেকশন ও ব্রিডিং-এর মাধ্যমে বিএলআরআই কর্তৃক উন্নয়নকৃত দেশি জাতের মেইল লাইন এবং দেশীয় আবহাওয়ায় অভিযোজিত বিদেশি জাতের ফিমেল লাইন ব্যবহার করে সম্প্রতি একটি অধিক মাংস উৎপাদনশীল মুরগির জাত উদ্ভাবন করেছে। দেশীয় পরিবর্তনশীল আবহাওয়া উপযোগী মুরগির এই জাতটির নামকরণ করা হয়েছে বিএলআরআই মিট চিকেন-১ (সুবর্ণ) নামে। বিএলআরআই উদ্ভাবিত মাংস উৎপাদনকারী এই জাতটি পরিবর্তনশীল আবহাওয়ায় উপযোগী, রোগ প্রতিরোধক্ষম এবং মাংসের স্বাদ দেশি মুরগির ন্যায়। মাংসের স্বাদ ও পালকের রং দেশি মুরগির ন্যায় মিশ্র বর্ণের হওয়ায় বাজার চাহিদা ও বাজারমূল্যও প্রচলিত সোনালী ও অন্যান্য জাতের ককরেল মুরগির তুলনায় বেশি।
সুবর্ণ প্যারেন্টস মুরগির উৎপাদন ক্ষমতা
পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার কারণে বর্তমানে খোলা শেডে মুরগি পালন বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, রোগবালাই এর প্রাদুর্ভাব ও পারিপাশির্^ক অবস্থা বিবেচনা করে জাত নির্বাচন করা উচিত। এ সকল বিষয় বিবেচনা নিয়ে দেশীয় আবহাওয়ায় অভিযোজিত ফিমেল লাইন এবং উন্নত দেশি জাতের মেইল লাইন সিলেকশন ও ব্রিডিং-এর মাধ্যমে কৌলিকমান উন্নয়ন করে সুবর্ণ জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে, যা আমাদের দেশীয় আবহাওয়ায় সহজেই পালন করা যায়। এই জাতের কৌলিকমান এমনভাবে উন্নয়ন করা হয়েছে যাতে ক্ষুদ্র খামারি ও বাণিজ্যিক খামারি লাভবান হতে পারে। বিএলআরআই এর গবেষণা এবং মাঠ পর্যায়ে বাণিজ্যিক খামারে পরিচালিত গবেষণার ফলাফল নি¤েœ উল্লেখ করা হলো।
সুবর্ণ মুরগির প্যারেন্টসের ফিমেল লাইনের উৎপাদন দক্ষতার তুলনামূলক চিত্র
সুবর্ণ ও অন্যান্য মাংস উৎপাদনকারী মুরগির তুলনামূলক উৎপাদন দক্ষতা
বিএলআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত সুবর্ণ মুরগির সাথে অন্যান্য মাংস উৎপাদনকারী মুরগির উৎপাদন দক্ষতা তুলনা করা হয় এবং সুবর্ণ মুরগির ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। নি¤েœ সুবর্ণ ও অন্যান্য মাংস উৎপাদনকারী মুরগির তুলনামূলক উৎপাদন দক্ষতা (গড় ওজন, মোট খাদ্যগ্রহণ এবং খাদ্য রূপান্তর হার)।
সুবর্ণ ও অন্যান্য মাংস উৎপাদনকারী মুরগির উৎপাদন দক্ষতার তুলনামূলক চিত্র (০-৫৬ দিন)
আয় ও ব্যয়ের হিসাব
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২৬ লক্ষ শিক্ষিত বেকার রয়েছে। সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোক্তা এতগুলো মানুষের চাকরি দেয়া সম্ভব নয়। তাই এই বিপুলসংখ্যক মানুষ যদি নিজেদেরকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে পারে বিশেষভাবে কেউ যদি পোল্ট্রি সেক্টরে উদ্যোক্তা হতে চায়, তাহলে তার জন্য বিএলআরআই উদ্ভাবিত মিট চিকেন-১ (সুবর্ণ) জাতটি আদর্শ হতে পারে। কেননা এই মুরগি দেশীয় আবহাওয়ায় উদ্ভাবিত হওয়ায় এর রোগবালাই কম, আমাদের দেশের তাপমাত্রার সাথে খাপখাওয়ানো, দেশি মুরগির মতোই এর উৎপাদন খরচ কম এবং মাংস দেশি মুরগির মত স্বাদ যুক্ত হওয়ায় বাজারে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এছাড়া মানুয়ের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ এখন পোল্ট্রি থেকে তৈরি বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী যেমন- চিকেন গ্রিল, চিকেন নাগেট, চিকেন বল, চিকেন সুপ ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করছে। এভাবে একদিকে যেমন বেকার যুবকদের বেকারত্ব দূর হচ্ছে, অন্যদিকে নিজে স্বাবলম্বী হয়ে অন্য বেকার যুবকদের এসব পোল্ট্রি খামারে কাজের সুযোগ হচ্ছে। বিএলআরআই-এ পরিচালিত গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, আট সপ্তাহ পর্যন্ত ১০০০টি সুবর্ণ জাতের মুরগি এক ব্যাচ লালন-পালন করে বাজার মূল্যভেদে প্রায় ৪৫-৬০ হাজার টাকা তথা বছরে অন্তত ৪টি ব্যাচ পালন করলে ১ লক্ষ ৮০ হাজার থেকে ২ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব।
পরিবেশের উপর প্রভাব
বৈশি^ক তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণে বিশে^র ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম দিকে। প্রতিনিয়ত পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাব কমবেশি সব খাতের উপরই দৃশ্যমান। অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় পোল্ট্রি প্রজাতি পরিবেশের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। অন্যদিকে দেশের ব্রয়লার-লেয়ারের সব জাতের প্যারেন্টস বিদেশ থেকে আমদানিকৃত হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে মুরগির কাক্সিক্ষত উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সেই দিক বিবেচনা করে বিএলআরআই উদ্ভাবিত মাংস উৎপাদনকারী জাত বিএলআরআই মিট চিকেন-১ (সুবর্ণ) পরিবর্তনশীল আবহাওয়া উপযোগী এবং উৎপাদনের উপর কোন ক্ষতিকর প্রভাব নেই। তাছাড়া, খামারের বিষ্ঠা দিয়ে বায়োগ্যাস করা যেতে পারে এবং বায়োগ্যাসের উপজাত জৈবসার হিসেবে বিভিন্ন ফসল, খাদ্যশস্য ও ঘাস উৎপাদনে ব্যবহার করা যেতে পারে।
নতুন উদ্ভাবিত মাংসল জাতের মুরগি (সুবর্ণ) খামারি পর্যায়ে সম্প্রসারণ সঠিকভাবে করতে পারলে একদিকে স্বল্পমূল্যে প্রান্তিক খামারিগণ অধিক মাংস উপাদনকারী জাতের বাচ্চা পাবেন, অন্যদিকে আমদানি নির্ভরশীলতা অনেকাংশেই হ্রাস পাবে। উদ্ভাবিত এ জাতটি দেশের সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় প্রাণিজ আমিষসহ অন্যান্য পুষ্টির চাহিদা পূরণে এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত আত্মনির্ভরশীল দেশ গড়ায় যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে।
লেখক : ১মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (রুঃ দাঃ) ও বিভাগীয় প্রধান, ২প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ৩বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পোল্ট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগ, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, সাভার, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১২২০৫২২৩ ই-মেইল : shakila_bari@yahoo.com
কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণে সফল একজন কৃষকের গল্প
মোহাঃ নুরে আলম
জীবন গল্পের সাথে হার না মানা একজন কৃষক, যার নাম মোঃ মুসা আহমেদ অপু, পিতা: সৈয়দ আহমেদ, গ্রাম: এক্তারপুর, পো: বিজয় হরষপুর, হরষপুর, বিজয়নগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ২০২০ সাল সারা বিশ্বে করোনা মহামারী তুঙ্গে। সবকিছু যেন স্থবির হয়ে আছে। ৭ সদস্যবিশিষ্ট পরিবার নিয়ে দিশেহারা। করোনা মহামারীর আগে তিনি সিলেটের ভোলাগঞ্জে পাথরের ব্যবসা করে কোনমতে পরিবার নিয়ে দিনাতিপাত করতেন। করোনার থাবায় তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কি করবে ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছিলেন না। ঠিক এমন সময় দেখা হয় কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ে কর্মরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জনাব সবুজ হুসাইন এর সাথে। তিনি (কৃষক) তাকে পরিবারের সকল অভাব অনটনের কথা খোলামেলাভাবে বললেন। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জনাব সবুজ হুসাইন তার সবকিছু মনোযোগ সহকারে শুনলেন এবং পরামর্শ দেন কৃষি বিভাগ থেকে ভর্তুকীর আওতায় একটি কম্বাইন হারভেস্টর ক্রয় করার জন্য। তার আগে বলে নেই করোনার থাবায় সবকিছু বন্ধ হলেও কৃষি বিভাগ বন্ধ হয় নাই। কৃষি বিভাগের কার্যক্রম দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। জনাব মুছা আহমেদ অপুর অভাবের কথা শুনে এগিয়ে আসলেন আবেদীন ইকুইপমেন্টস লিঃ কোম্পানিও। তিনি সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প এর আওতায় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বিজয়নগর এর সহতায় আবেদীন ইকুইপমেন্টস লিঃ হতে কিস্তিতে পরিশোধের শর্তে ২০২১-২২ অর্থবছরে বোরো মৌসুমে একটি কম্বাইন হারভেস্টার ক্রয় করেন।
কৃষিযন্ত্র গ্রহণের পর কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থা : কৃষি যন্ত্র তথা কম্বাইন হারভেস্টরটি ক্রয় করার পর জনাব মুছা আহমেদ অপুকে আর পেছনের দিকে তাকাতে হয়নি। তিনি কম্বাইন হারভেস্টরের মাধ্যমে এলাকার অনেক কৃষকের ধান কাটতে শুরু করেন। করোনা কালীন সময়ে তখন শ্রমিক পাওয়াও কষ্টকর ছিল। সবাই মেশিনের সহায্যে বিঘাপ্রতি ১,৮০০/- টাকা দরে ধান কাটতে শুরু করেন। এত করে একদিকে কৃষক লাভবান হচ্ছেন। কারণ কম্বাইন হারভেস্টার এর সাহায্যে এক সাথে ধানকাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও বস্তাবন্দী করে কৃষক ধান ঘরে তুলতে পারছেন।
জনাব মুছা আহমেদ অপু অদ্য বধি ১,১০০ বিঘা জমির ধান ১,৮০০/- টাকা করে কর্তন করে মোট ১৯,৮০,০০০/- টাকা আয় করেন। তাহার সকল খরচ বাদ দিয়ে নিট আয় করেন ১৩,২০,০০০/- টাকা। এতে করে অভাব আর তার পিছু তাড়া করতে পারছে না। তিনি এখন একজন কৃষিনির্ভর কর্মব্যস্ত মানুষ। তিনি তাহার পরিবারের সকলকে নিয়ে খুব হাসিখুশিভাবে দিনযাপন করছেন। তার এই গল্প অনেকের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।
মেশিন না হলে ধান কাটাই যেতনা, আগে ধান কাটতে খুব কষ্ট করতে হতো। শ্রমিকের অভাবে ধান কাটা যেতনা। অনেক ধান জমিতে নষ্ট হতো। শ্রমিকের মাধ্যমে ধান কাটতে গেলে খরচ হতো বিঘাপ্রতি ৫,০০০-৬,০০০/- টাকা। কিন্তু মেশিনের মাধ্যমে ধান কর্তন, মাড়াই, ঝাড়াই ও বস্তাবন্দীসহ মোট খরচ হচ্ছে মাত্র ২,০০০/- টাকা। কম্বাইন হারভেস্টর এর মাধ্যমে এখন প্রায় ৭০ ভাগ ধান, গম, ভুট্টা কর্তন, মাড়াই ও ঝাড়াই এর কাজ সম্পাদন করছেন কৃষকেরা।
লেখক : উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ অফিসার, বিজয়নগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। মোবাইল : ০১৮১৯৯২৬৩৪৭
প্রশ্নোত্তর
কৃষিবিদ আকলিমা খাতুন
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
মো: দুলাল, উপজেলা : শিবগঞ্জ, জেলা : বগুড়া।
প্রশ্ন : লাউয়ের গাছের কা- ফেটে আঠা বের হচ্ছে। কী করণীয়?
উত্তর : গাছের কা- ফেটে আঠা বের হওয়া এ রোগকে গ্যামোসিস বা আঠাঝরা রোগ বলে। এ রোগে আস্তে আস্তে গাছ নষ্ট হয়ে যায়। এ রোগ দমনে আক্রান্ত গাছ তুলে নষ্ট বা পুড়ে ফেলতে হবে। আক্রান্ত কা-ে বর্দোপেস্ট (১০০ গ্রাম তুঁত+১০০ গ্রাম চুন+১ লিটার পানি) লাগাতে হবে এবং ১% বর্দোমিকচার বা (কপার অক্সিক্লোরাইড) ক্রপের যে কোন ছত্রাকনাশক (সানভিট) (০.৪%) রোগাক্রান্ত লাউগাছে সঠিক নিয়মে ৭ দিন পরপর ৩ বার স্প্রে করতে পারেন।
সবুজ চন্দ্র, উপজেলা : ফুলবাড়ি, জেলা : কুড়িগ্রাম।
প্রশ্ন : মুলার পাতায় দাগ দেখা যাচ্ছে। কি করণীয়?
উত্তর : মুলার পাতায় দাগ রোগ দেখা যায় অষঃবৎহধৎরধ নৎধংংরপধব ছত্রাকের কারণে। ছোট ছোট বাদামি দাগ পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে আক্রান্ত পাতা শুকিয়ে যায়। আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলতে হবে। রোগের আক্রমণ দেখা দিলে ইপ্রোভিয়ন গ্রুপের ইভারাল/ রোভরাল ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭ দিন পরপর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
শামীম মিয়া, উপজেলা : মিঠাপুকুর, জেলা : রংপুর।
প্রশ্ন : টমেটোর পাতা কোঁকড়ায়ে যাচ্ছে। কি করণীয়?
উত্তর : সাদা মাছি দ্বারা এ রোগের ভাইরাস ছড়ায়। পাতার গায়ে ঢেউয়ের মতো ভাজের সৃষ্টি হয় ও পাতা ভীষণভাবে কোঁকড়ায়ে যায়। আক্রমণ বেশি হলে পাতা মরে যায়। এ রোগের প্রতিকারে আক্রান্ত গাছ তুলে ধ্বংস করতে হবে। ভাইরাসের বাহক পোকা দমনের জন্য ডায়মেথোয়েট, ইমিডাক্লোরাপিড (০.২৫ মিলি/লি:) যে কোন একটি কীটনাশক ১০ দিন পরপর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
মতিউর রহমান, উপজেলা : মোহনপুর, জেলা : রাজশাহী।
প্রশ্ন : পালং শাকের সার প্রয়োগ ও বীজ বপনের হার সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : সারের নাম ও শতক প্রতি পরিমাণ : গোবর- ৪০ কেজি, ইউরিয়া- ১ কেজি, টিএসপি- ৫০০ গ্রাম, এমপি- ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া ছাড়া সব সার জমির শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হয়। তবে গোবর জমি তৈরির প্রথম দিকে প্রয়োগ করাই উত্তম। ইউরিয়া সার চারা গজানোর ৮-১০ দিন পর থেকে ১০-১২ দিন পর পর ২-৩ কিস্তিতে উপরিপ্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। বীজ বপনের সময় আগস্ট ১৫ অক্টোবর ১৫।
বীজ বপনের হার প্রতি আল ৩৫-৪০ গ্রাম, প্রতি শতকে ১১৭ গ্রাম, প্রতি একরে ৯-১১ কেজি, প্রতি হেক্টরে ২৫-৩০ কেজি।
মো: শুভ, উপজেলা : জয়পুরহাট সদর, জেলা : জয়পুরহাট।
প্রশ্ন : পোকা ধানের শীষ কেটে দিচ্ছে। কি করতে পারি?
উত্তর : ধানের শীষ আসার পর ধানের শীষ কাটা লেদাপোকার (বৈজ্ঞানিক নাম : গুঃযরসধ ংবঢ়ধৎধঃধ) কীড়া শীষ কেটে ক্ষতি করে। মেঘলা আবহাওয়ায় এ পোকার বংশ বৃদ্ধি বেশি হয়। পোকা দমনের জন্য ক্ষেত পরিষ্কার রাখতে হবে। ধান কাটার পর নাড়া পুড়ে ফেলে ও জমি চাষ দিতে ফেলে রাখতে হবে। আক্রান্ত ক্ষেত থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফসল সংগ্রহ করতে হবে। ক্ষেতে অধিকাংশ গাছে প্রতি বর্গমিটারে গড়ে অন্তত একটি করে কীড়ার উপস্থিতি থাকলে বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে প্রতিলিটার পানিতে ২ গ্রাম কারবারিল গ্রুপের সেভিন), ২ মিলি. ক্লোরপাইরিফস গ্রুপের (মর্টার ৪৮ ইসি) যে কোন একটি বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে। ১০ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
মো: রাকিব মিয়া, উপজেলা : জামালপুর সদর, জেলা : জামালপুর
প্রশ্ন : বোরো ধানের বীজতলার চারা হলুদ হয়ে যাচ্ছে। করণীয় কি?
উত্তর : চারা হলুদ হয়ে গেলে প্রতি শতক বীজতলায় ২৮০ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সার প্রয়োগের পর চারা সবুজ না হলে প্রতি শতক বীজতলায় ৪০০ গ্রাম হারে জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে। অতিরিক্ত ঠা-ার সময় বীজতলাকে স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢেকে রাখতে হবে।
মো: আবু সাইদ, উপজেলা : খানসামা, জেলা : দিনাজপুর।
প্রশ্ন : সরিষা গাছের পাতার নিচে পাউডারের মতো দেখা যাচ্ছে এবং পাতার উপরের অংশ হলুদ হয়ে যাচ্ছে। কি করব?
উত্তর : এটি ডাউনি মিলডিউ রোগ নামে পরিচিত। এই রোগ দেখা দেয়া মাত্র ম্যানকোজেব গ্রুপের ডাইথেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে ম্যানকোজেব+ মেটালঅক্সিল এই গ্রুপের রিডোমিল এমজেড ৭২, ৭-১০ দিন অন্তর ৩ বার পুরো গাছে স্প্রে করতে হবে। এ ছাড়া সুষম সার সঠিক পরিমাণে সঠিক সময়ে ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত ক্ষেতে প্রতি বছর সরিষার চাষ না করে পর্যায়ক্রমে ফসল চাষ করা উচিত। এছাড়া বীজ বপনের পূর্বে বীজ শোধন (ভিটাভেক্স-২.৫ গ্রাম বা ২ গ্রাম ব্যাভিস্টিন প্রতি কেজি বীজ) করে নিলে এই রোগের প্রকোপ অনেকাংশে রোধ সম্ভব।
অনুপ কুমার, উপজেলা : লালপুর, জেলা : নাটোর।
প্রশ্ন : মরিচ গাছের কচি পাতা ও ডগার রস পোকা শুষে খেয়ে ফেলছে এবং গাছকে দুর্বল করে দিচ্ছে। প্রতিকার কি?
উত্তর : থ্রিপস পোকার আক্রমণে এই লক্ষণ দেখা যায়। পাতা শুকিয়ে যায় এবং গাছ দুর্বল হয়ে পরে। কুঁকড়ানো পাতা কুঁকড়ানো এড়াতে হলুদ রঙের ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে। করণীয় হিসেবে আগাম বীজবপন, সুষম সার ব্যবহার রোগের প্রাথমিক অবস্থায় গাছে ছাই ছিটিয়ে দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। জৈব বালাইনাশক হিসেবে ১ কেজি আধা ভাঙা নিম বীজ ২০ লিটার পানিতে ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে উক্ত পানি পাতার উপরের দিকে স্প্রে করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে ফিপ্রোনিল গ্রুপের (রিজেন্ট/এসেনড) গ্রুপের ডাইমেথয়েট (বিস্টারসোয়েট/ টাফগর) ১০ লিটার পানিতে ২০ মিলি হারে বা ১০ দিন পরপর ৩ বার স্প্রে করে এসব পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সেই মরিচ তুলে খাবেন না/বিক্রি করবেন না।
আব্দুল আলীম, উপজেলা : মনিরামপুর, জেলা : যশোর
প্রশ্ন : শসা গাছের কচি ফল ও ডগা পোকার কীড়া ছিদ্র করে ফেলছে। এখন কি করব?
উত্তর : শসা ও খিরার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতিকারক পোকা ফলের মাছি পোকা। এ পোকা প্রথমে ফলের মধ্যে প্রথমে ডিম পাড়ে। পরবর্তীতে ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ফলের ভিতর খেয়ে নষ্ট করে ফেলে। আগাম বীজ বপন, সুষম সার ব্যবহার এবং ক্ষেত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেখে এই পোকার হাত থেকে ফসল রক্ষা করা অনেকাংশে সম্ভব। আক্রান্ত ডগা ও ফল সংগ্রহ করে নষ্ট করতে হবে। সেক্সফেরোমেন ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। ফেরোমেনের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে পুরুষ মাছি পোকা প্লাস্টিক পাত্রের ভেতরে প্রবেশ করে ও সাবান পানিতে পরে মারা যায়। জৈব বালাইনাশক যেমন: নিমবিসিডিন ৩ মিলি./লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। শতকরা ১০ ভাগের বেশি ক্ষতি হলে যে কোন বালাইনাশক যেমন সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের (রিপকর্ড ১ মি.লি)/ ১ লি. ডেল্টামেথ্রিন গ্রুপের (ডেসিস ০.৫ মিলি) ৩ লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পরপর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
মো: জালাল উদ্দিন, উপজেলা : আমতলী, জেলা : বরগুনা
প্রশ্ন : বাঁধাকপি গাছের গোড়া পোকা কেটে দেয়, এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?
উত্তর : কাটুই পোকা বা ঈঁঃ ড়িৎস এর আক্রমণে এ সমস্যা হয়ে থাকে। প্রতি লিটার পানিতে ক্লোরপাইরিফস গ্রুপের কীটনাশক (ডার্সবান/ লার্ভিন-২) গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে ১.৫ মিলি ১০ দিন পরপর ৩ বার মিশিয়ে গাছের গোড়ায় বিকালে স্প্রে করতে হবে। জমি চাষ দিয়ে মাটি উলট-পালট করে পোকা নষ্ট করতে হবে। জমিতে গভীর সেচ দিয়ে পোকা নষ্ট করতে হবে। বিষটোপ তৈরির জন্য এক কেজি চাউলের কুঁড়া বা গমের ভুসির সাথে ২০ গ্রাম পাদান অথবা কারবারিন গ্রুপের সেভিন কীটনাশক পানি বা চিটাগুড়ের সাথে মিশিয়ে তৈরি করতে হবে।
মো: আল আমিন, উপজেলা : শেরপুর সদর, জেলা : শেরপুর
প্রশ্ন : গম ফসল চাষের জন্য কতবার সেচের প্রয়োজন হয়?
উত্তর : গমে মাটির প্রকারভেদে সাধারণত ২-৩টি সেচের প্রয়োজন হয়। প্রথম সেচ চারার তিন পাতার সময় (বপনের ১৭ থেকে ২১ দিন পরে), দ্বিতীয় সেচ গমের শীষ বের হওয়ার সময় (বপনের ৫৫ থেকে ৬০ দিন পর) এবং তৃতীয় সেচ দানা গঠনের সময় (বপনের ৭৫ থেকে ৮০ দিন পর) দিতে হবে। গমক্ষেতে ধানের মতো ঢালাও সেচ দিতে হবে না। নালা বা ফিতা পাইপের মাধ্যমে সেচের পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। সঠিক সেচ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফলন ৫৮% পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব। বপনের ২৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে ১ম সেচের পর একটি নিড়ানি দিলে ফলন প্রায় ১০ থেকে ১২ ভাগ বৃদ্ধি পায়।
মো: পারভেজ হোসাইন, উপজেলা: চারঘাট, জেলা : রাজশাহী
প্রশ্ন : মসুরে গোড়া পচা রোগের আক্রমণ হয়েছে? করণীয় কী?
উত্তর : এ রোগের জীবাণু স্কেলেরোসিয়াম রলফসি নামক এক প্রকার ছত্রাক। গাছ আক্রান্ত হলে পাতা ক্রমান্বয়ে হলদে রং ধারণ করে। আক্রান্ত গাছ ঢলে পড়ে ও শুকিয়ে যায়। মাটি ভিজা থাকলে গাছের গোড়ায় ছত্রাকের সাদা মাইসেলিয়াম ও সরিষার দানার ন্যায় স্কেলেরোসিয়াম গুটি দেখা যায়। এ জীবাণু গাছের অবশিষ্টাংশে বিকল্প পোষক ও মাটিতে বেঁচে থাকে এবং পরবর্তী বছরে ফসলে আক্রমণ করে। তাই ফসলের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং অধিক পরিমাণে জৈবসার ব্যবহার করতে হবে। বীজ লাগানোর আগে ভিটাভেক্স ২০০ (০.২৫%) হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে কার্বেন্ডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন নোইন ৫০ ডব্লিউপি অথবা (এমকোজিম ৫০ ডব্লিউপি) প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১০ গ্রাম মিশিয়ে ৫ শতক জমিতে ৭ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
মো: রবিউল আলম, উপজেলা : ধুনট, জেলা : বগুড়া
প্রশ্ন : আলুর পাতায় এলোমেলো গোলাকার দাগ দেখা যাচ্ছে যা, কালো রং হয়ে যাচ্ছে এবং পাতা পচে যাচ্ছে। কী করতে পারি?
উত্তর : এ রোগ প্রতিরোধে আগাম আলুর চাষ অর্থাৎ ১৫ নভেম্বরের মধ্যে আলু রোপণ করা যেতে পারে। রোগসহনশীল জাত যেমন বারি আলু ৪৬, বারি আলু ৫৩ আলু চাষ করা যেতে পারে। নিম্ন তাপমাত্রায়, কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া ও বৃষ্টির পূর্বাভাস পাওয়ার সাথে সাথে রোগ প্রতিরোধের জন্য ৭ থেকে ১০ দিন অন্তর অন্তর ৩ বার ম্যানকোজেব গ্রুপের অনুমোদিত ছত্রাকনাশক যেমন ডায়থেন এম-৪৫ বা পেনকোজেব ৮০ ডব্লিউপি প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করে গাছ ভালভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে। রোগ দেখা দেয়ার পর আক্রান্ত জমিতে রোগ নিয়ন্ত্রণ না হওয়া পর্যন্ত সেচ প্রদান বন্ধ রাখতে হবে। রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হলে ৩ থেকে ৪ দিন অন্তর ছত্রাকনাশকের মিশ্রণ স্প্রে করতে হবে। ছত্রাকনাশক অবশ্যই পাতার উপরে ও নিচে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।
লেখক : তথ্য অফিসার (পিপি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৯১৬৫৬৬২৬২; ই-মেইল : aklimadae@gmail.com
পৌষ মাসের কৃষি
(১৬ ডিসেম্বর-১৪ জানুয়ারি)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
পৌষ মাস। হেমন্ত শেষ। ঘন কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে শীতের আগমন। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আপনাদের সবার জন্য রইল শীতের শুভেচ্ছা। শীতের মাঝেও মানুষের খাদ্য চাহিদা নিশ্চিতে কৃষক-কিষানি ব্যস্ত হয়ে পড়েন মাঠের কাজে। মাঠের কাজে সহায়তার জন্য আসুন সংক্ষেপে আমরা জেনে নেই পৌষ মাসে সমন্বিত কৃষির সীমানায় কোন কাজগুলো আমাদের করতে হবে।
বোরো ধান
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন যারা এখনও বোরো ধানের বীজতলা তৈরি করেননি তাদের জন্য পরামর্শ- বীজতলায় ব্রি ধান২৮/স্বল্পমেয়াদি জাতের পরিবর্তে ব্রি ধান৮৮ এবং বঙ্গবন্ধু ধান ব্রি ধান২৯ এর পরিবর্তে ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, বঙ্গবন্ধু ধান১০০, ব্রি ধান১০১, ব্রি ধান ১০২ চাষ করুন।
অতিরিক্ত ঠা-ার সময় বীজতলা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢেকে রাখা যায় এবং বীজতলার পানি সকালে বের করে দিয়ে আবার নতুন পানি দেয়া যায়। সে সাথে প্রতিদিন সকালে চারার ওপর জমাকৃত শিশির ঝরিয়ে দিতে হবে। এতে চারা ভালোভাবে বেড়ে ওঠে। বীজতলায় সব সময় নালা ভর্তি পানি রাখতে হয়। চারাগাছ হলদে হয়ে গেলে প্রতি বর্গমিটারে ৭ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এরপরও যদি চারা সবুজ না হয় তবে প্রতি বর্গমিটারে ১০ গ্রাম করে জিপসাম দিলে সুফল পাওয়া যায়। চারা রোপণের জন্য মূল জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে পানিসহ কাদা করতে হবে। জমিতে জৈবসার এবং শেষ চাষের আগে ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার দিতে হবে। চারার বয়স ৩৫-৪৫ দিন হলে মূল জমিতে চারা রোপণ করতে হয়। ধানের চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর প্রথম কিস্তি, সাধারণত গুছিতে কুশি দেখা দিলে দ্বিতীয় কিস্তি এবং কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন আগে শেষ কিস্তি হিসেবে ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করা ভাল।
গম
গমের জমিতে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ এবং প্রয়োজনীয় সেচ দিতে হবে। চারার বয়স ১৭-২১ দিন হলে গমক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করে একরপ্রতি ১২-১৪ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয় এবং সেচ দিতে হয়। সেচ দেয়ার পর জমিতে জো এলে মাটির ওপর চটা ভেঙে দিতে হবে। গমের জমিতে যেখানে ঘনচারা রয়েছে সেখানে কিছু চারা তুলে পাতলা করে দেয়া ভাল।
ভুট্টা
ভুট্টাক্ষেতের গাছের গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে। গোড়ার মাটির সাথে ইউরিয়া সার ভালো করে মিশিয়ে দিয়ে সেচ দিতে হয়। গাছের নিচের দিকের মরা পাতা ভেঙে দেয়া ভাল। ভুট্টার সাথে সাথী বা মিশ্র ফসলের চাষ করে থাকলে সেগুলোর প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে।
আলু
চারা রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর অর্থাৎ দ্বিতীয়বার মাটি তোলার সময় ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হয়। দুই সারির মাঝে সার দিয়ে কোদালের সাহায্যে মাটি কুপিয়ে সারির মাঝের মাটি গাছের গোড়ায় তুলে দিতে হবে। ১০-১২ দিন পরপর এভাবে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে না দিলে গাছ হেলে পড়বে এবং ফলন কমে যাবে। এ সময় আলু ফসলে নাবি ধসা রোগ দেখা যায়। নিম্ন তাপমাত্রা, কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া ও বৃষ্টির পূর্বাভাস পাওয়ার সাথে সাথে ডাইথেন এম-৪৫ অথবা ইন্ডোফিল এম-৪৫ অথবা ম্যানেকোজেব গ্রুপের যেকোন ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হয়। গাছে রোগ দেখা দেয়া মাত্রই ৭ দিন পর পর সিকিউর অথবা অ্যাক্রোভেট এম জেড ২ গ্রাম/লিটার হারে মিশিয়ে স্প্রে করা প্রয়োজন। মড়ক লাগা জমিতে সেচ দেয়া বন্ধ রাখতে হবে। তাছাড়া আলু ফসলে মালচিং, সেচ প্রয়োগ, আগাছা দমনের কাজগুলোও করতে হয়। আলু গাছের বয়স ৯০ দিন হলে মাটিরসমান করে গাছ কেটে রেখে দিতে হবে ১০ দিন পর আলু তুলে ফেলতে হবে। আলু তোলার পর ভালো করে শুকিয়ে বাছাই করতে হবে এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
তুলা
এ সময় তুলা সংগ্রহের কাজ শুরু করতে হয়। তুলা সাধারণত ৩ পর্যায়ে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। শুরুতে ৫০% বোল ফাটলে প্রথম বার, বাকি ফলের ৩০% পরিপক্ব হলে দ্বিতীয় বার এবং অবশিষ্ট ফসল পরিপক্ব হলে শেষ অংশের তুলা সংগ্রহ করতে হবে। রৌদ্রময় শুকনা দিনে বীজ তুলা সংগ্রহ করা ভাল। ভালো তুলা আলাদাভাবে তুলে ৩-৪ বার রোদে শুকিয়ে চট অথবা ব্যাগে সংরক্ষণ করতে হবে।
ডাল ও তেল ফসল
মসুর, ছোলা, মটর, মাষকলাই, মুগ, তিসি পাকার সময় এখন। সরিষা, তিসি বেশি পাকলে রোদের তাপে ফেটে গিয়ে বীজ পড়ে যেতে পারে, তাই এগুলো ৮০ শতাংশ পাকলেই সংগ্রহের ব্যবস্থা নিতে হবে। আর ডাল ফসলের ক্ষেত্রে গাছ গোড়াসহ না উঠিয়ে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি রেখে ফসল সংগ্রহ করতে হয়। এতে জমিতে উর্বরতা এবং নাইট্রোজেন সরবরাহ বাড়বে।
শাকসবজি
ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, ওলকপি, শালগম, গাজর, শিম, লাউ, কুমড়া, মটরশুঁটি এসবের নিয়মিত যত্ন নিতে হয়। বিভিন্ন শাক যেমন- লালশাক, মুলাশাক, পালংশাক একবার শেষ হয়ে গেলে আবার বীজ বুনে দিতে পারেন। টমেটো ফসলের মারাত্মক পোকা হলো ফলছিদ্রকারী পোকা। ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে এ পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রতি বিঘা জমির জন্য ১৫টি ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। আক্রমণ তীব্র হলে কুইনালফস গ্রুপের কীটনাশক (দেবীকুইন ২৫ ইসি/ কিনালাক্স ২৫ ইসি/করোলাক্স ২৫ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার পরিমাণ মিশিয়ে স্প্রে করে এ পোকা দমন করা যায়। টমেটো সংগ্রহ করে বাসায় ৪-৫ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করার জন্য আধা পাকা টমেটোসহ টমেটো গাছ তুলে ঘরের ঠা-া জায়গায় উপুর করে ঝুলিয়ে টমেটোগুলোকে পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। শীতকালে মাটিতে রস কমে যায় বলে সবজিক্ষেতে চাহিদামাফিক নিয়মিত সেচ দিতে হবে। এ ছাড়া আগাছা পরিষ্কার, গোড়ায় মাটি তুলে দেয়া, সারের উপরিপ্রয়োগ ও রোগবালাই প্রতিরোধ করা জরুরি।
পেঁয়াজ কন্দকে পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন
পেঁয়াজ রোপণ সময়ের উপর বীজ উৎপাদনের প্রভাব রয়েছে। বেশি আগাম রোপণে ফুলদন্ডে ফুলের সংখ্যা কম হয়। নাবিতে রোপণে গাছের বৃদ্ধি কম হয়, ফুল কম আসে এবং পার্পল ব্লচ রোগ ও থ্রিপস পোকার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়, তাছাড়া বিলম্বে রোপণ করলে সে সব বীজ ফসল কালবৈশাখী ঝড় ও শীলা বৃষ্টিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অক্টোবরের শেষ হতে মধ্য নভেম্বর মাস পর্যন্ত পেঁয়াজের মাতৃকন্দ রোপণের উপযুক্ত সময়। সারি হতে সারির দুরত্ব ২৫-৩০ সেমি. এবং কন্দ থেকে কন্দের দুরত্ব ১৫-২০ সেমি. হওয়া ভাল। নির্দিষ্ট দুরত্বে ছোট লাঙ্গল অথবা রডের টানা দ্বারা ৫-৬ সেমি. গভীর নালা টেনে উক্ত নালায় পেঁয়াজের মাতৃকন্দ রোপন করে পার্শ্ববর্তী মাটি দ্বারা মাতৃকন্দ ঢেকে দেওয়া আবশ্যক। মাতৃকন্দ বীজের পরিমাণ, বীজ উৎপাদনের জন্য আমাদের দেশে এক হেক্টর জমিতে ৮০০-৯০০ কেজি মাতৃকন্দের প্রয়োজন হয়।
পাতা পেঁয়াজ উৎপাদন
বারি পাতা পেঁয়াজ-১ ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে বীজতলায় বীজ বপন করা প্রয়োজন। প্রতি হেক্টরে সারি পদ্ধতিতে ৪-৫ কেজি এবং ছিটিয়ে বপন করলে ৬-৮ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। এক হেক্টর জমির জন্য ৬-৬.৫ লক্ষ চারা প্রয়োজন।
গাছপালা
বর্ষায় রোপণ করা ফল, ঔষধি বা কাঠ গাছের যত্ন নিতে হয়। গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। প্রয়োজনে গাছকে খুঁটির সাথে বেঁধে দেয়া যায়। রোগাক্রান্ত গাছের আক্রান্ত ডালপালা ছাঁটাই করে দিতে হবে। গাছের গোড়ায় নিয়মিত সেচ দেয়া জরুরি।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, শীতকাল শুকনো মৌসুম বলে মাটিতে রস কম থাকে। তাই প্রতি ফসলে চাহিদামাফিক সেচ প্রদান নিশ্চিত করতে পারলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে। কৃষির মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করতে পারি। কৃষির যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য আপনার নিকটস্থ উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন অথবা ১৬১২৩ এ নম্বরে যে কোনো মোবাইল অপারেটর থেকে কল করে নিতে পারেন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা।
লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪, মেইল :editor@ais.gov.bd