Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

মাঘ মাস। গ্রামীণ জনপদে আক্ষরিক অর্থে ব্যবহার হয়, মাঘ আসে শীতের দাপট নিয়ে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশব্যাপী পাল্টে যাচ্ছে মাঘের শীতে বাঘের কাঁপুনি প্রবাদটিও। বিরূপ  প্রকৃতির পাশাপাশি চলছে আবাদি জমি হ্রাস, বাড়তি জনসংখ্যার চাপ, বৈশ্বিক সংঘাতময় পরিস্থিতিসহ নানামুখী প্রভাব। এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুপ্রিয় সোনার বাংলা গড়তে থেমে নেই কৃষক, কৃষিবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী, গবেষক, সম্প্রসারণকর্মীসহ অংশীজনেরা।
জনসাধারণের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কৃষির ভূমিকা অপরিসীম। ফসলের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, শস্য বহুমূখীকরণ, পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসল উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা আধুনিকীকরণের মাধ্যমে কৃষিকে লাভজনক করা এবং জনসাধারণের পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের গৃহীত নীতি ও পরিকল্পনা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ফলে বাংলাদেশ এখন ২০টিরও বেশি ফসল উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ দশ দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে।
বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বিভিন্ন শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদন বেশ উপযোগী। কৃষিপণ্য উৎপাদনে ফসলের তুলনায় সবজিতে ফলন ও আয় দুইই বেশি হয়। এ ছাড়া শাকসবজি ও ফলমূল পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতি সংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী একজন মানুষের গড়ে প্রতিদিন ৪০০ গ্রাম শাকসবজি ফলমূল খাওয়া প্রয়োজন। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে সবজির উৎপাদন ছিল ২৯.০৯ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সবজি উৎপাদন ২২৫.৪১ লাখ মেট্রিক টন, যা ১৫ বছরে শতকরা ৬৭৫ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি ফলের উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে  কৃষি মন্ত্রণালয়ের রূপকল্প কৃষিপণ্য রপ্তানিমুখী করা। শাকসবজি ও ফলমূল রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। রপ্তানি বাড়াতে কৃষি মন্ত্রণালয় উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে ফসল উৎপাদন, রপ্তানি উপযোগী জাতের ব্যবহার, আধুনিক প্যাকিং হাউজ নির্মাণ, অ্যাক্রিডিটেড ল্যাব স্থাপনাসহ নানাবিধ কাজ বাস্তবায়ন করেছেন। এ সম্পর্কে ‘শাকসবজি ও ফলমূল সংগ্রহোত্তর পরিচর্যা, ব্যবস্থাপনা ও মূল্য সংযোজনের গুরুত্ব’ তথ্যসমৃদ্ধ নিবন্ধটিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এবারের কৃষিকথায়।
এ ছাড়াও কৃষি বিশেষজ্ঞবৃন্দের সময়োপযোগী প্রবন্ধ, কবিতা ও নিয়মিত বিভাগ দিয়ে সাজানো হয়েছে এ সংখ্যা। কৃষিকথায় এসব মানসম্পন্ন ও তথ্যপ্রযুক্তি লেখা দিয়ে যারা সমৃদ্ধ করেছেন তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। আশা করি সময়োপযোগী লেখাসমূহ নতুন বছরে আপামর জনসাধারণের জন্য কৃষি খাতকে বিজ্ঞানভিত্তিক ও স্মার্ট কৃষিতে এগিয়ে নিতে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা জোগাবে।

বিস্তারিত
সূচিপত্র

৮৩তম বর্ষ ড় ১০ম সংখ্যা ড়  মাঘ-১৪৩০ (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২৪)

সূচিপত্র

নিবন্ধ/প্রবন্ধ
    ফসলের সংগ্রহোত্তর পরিচর্যা, ব্যবস্থাপনা ও মূল্য সংযোজনের গুরুত্ব    ৩    
    মো. হাফিজুল হক খান, ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী
    বাংলাদেশে বেবীকর্ন চাষের সম্ভাবনা এবং উপযোগিতা    ৫    
    ড. নরেশ চন্দ্র দেব বর্মা
    তুলা উন্নয়ন বোর্ডের বিটি (ইঃ) কটন যুগে পদার্পণ    ৭    
    ড. মোঃ গাজী গোলাম মর্তুজা, অসীম চন্দ্র শিকদার
    গমের ব্লাস্ট রোগ ও  সমন্বিত ব্যবস্থাপনা    ৯
    কৃষিবিদ ড. মো: হুমায়ুন কবীর
    অনুপুষ্টির চাহিদা পূরণে ন্যূনতম খাদ্য বৈচিত্র্য    ১১
    তাসনীমা মাহজাবীন
    সম্ভাবনাময় ফসল লাল ও সবুজ সবজিমেস্তা বহুবিধ ব্যবহার    ১২    
    কৃষিবিদ ইফফাত জাহান নূর
    গুণগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদনে আম বাগানের যত্ন-পরিচর্যা    ১৪
    ড. মো. শরফ উদ্দিন
আগামীর কৃষি ভাবনা
    বাংলাদেশে অর্কিড চাষে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা    ১৭
    তাহসীন তাবাসসুম    
    সুস্বাদু মাংসের উৎস হিসেবে পেকিন হাঁস পালন : সুযোগ ও সম্ভাবনা    ১৮
    ডা: মোঃ সোলায়মান হোসাইন, মোঃ শাহরিয়ার হায়দার, শাহরিয়ার আল মাহমুদ

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ
    মাছের পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা    ২০
    রোমানা ইয়াসমিন মেজবাবুল আলম, মোঃ হাসিবুর রহমান
    বিপন্ন প্রজাতির মাছ রক্ষার্থে কৃত্রিম প্রজননের গুরুত্ব      ২২    
    ড. ডেভিড রিন্টু দাস, শাহনাজ পারভিন
    জলবায়ু পরিবর্তনে গবাদি পশু-পাখির উপর প্রভাব এবং অভিযোজন কলাকৌশল    ২৫    
    ডা. মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ

সফল কৃষকের গল্প
    সবজি চাষে বদলে যাওয়া গ্রামের গল্প    ২৭    
    কৃষিবিদ সাবরিনা আফরোজ
নিয়মিত বিভাগ
    প্রশ্নোত্তর    ২৯
    কৃষিবিদ আকলিমা খাতুন
    ফাল্গুন মাসের কৃষি (১৫ ফেব্রুয়ারি-১৪ মার্চ)    ৩১
    কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম

বিস্তারিত
ফসলের সংগ্রহোত্তর পরিচর্যা, ব্যবস্থাপনা ও মূল্য সংযোজনের গুরুত্ব

ফসলের সংগ্রহোত্তর পরিচর্যা, ব্যবস্থাপনা
ও মূল্য সংযোজনের গুরুত্ব
মো. হাফিজুল হক খান১ ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী২
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। একবিংশ শতাব্দীর কৃষি বিশে^র বিস্ময় ও রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত। উৎপাদিত কৃষিপণ্যের অনেক পণ্যই বিশে^ প্রথম স্থান হতে দশম স্থানের মধ্যে রয়েছে। কৃষিপণ্যের মধ্যে উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল যেমন-ফলমূল ও শাকসবজি আমাদের শরীরের জন্য অপরিহার্য। শরীরের সুস্থতা ও শক্তি প্রদানের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচ্য। আমাদের শরীরকে ঠিক রাখতে বিভিন্ন খনিজ পদার্থ, খাদ্যপ্রাণ, শর্করা, ¯েœহ জাতীয় উপাদানসহ বিভিন্ন ফাইটোক্যামিক্যালস্ প্রতিনিয়ত প্রয়োজন হয়। ফলমূল ও শাকসবজি খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায়ও বিশে^ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের খাদ্য ও  কৃষি সংস্থার (এফএও/ডব্লিউএইচও, ২০১৪) সুপারিশ অনুযায়ী একজন মানুষের গড়ে প্রতিদিন ৪০০ গ্রাম ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমরা দৈনন্দিন প্রায় ২০৪ গ্রাম (২০৮ কিলোক্যালরি) পরিমাণ ফলমূল ও শাকসবজি (বিবিএস, ২০১৮) খেয়ে থাকি যা প্রায় অর্ধেক পরিমাণ। তন্মধ্যে আমরা শাকসবজি ১৬৭ গ্রাম ও বাকি অংশ ফলমূল থেকে পাই। দেশে বর্তমানে ৯০ প্রকার শাকসবজি ও ৬০ প্রকার ফলমূল এর অধিক পরিমাণে সারাবছর উৎপাদিত হচ্ছে। উৎপাদিত কৃষি পণ্যগুলো মূলত দুটি মৌসুম-গ্রীষ্মকাল (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) ও শীতকাল (অক্টোবর-মার্চ) হয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে, মোট উৎপাদনের প্রায় শতকরা ১ ভাগ ফলমূল ও শাকসবজি কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে বিশে^র প্রায় ৪০টি দেশে আমাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিশেষ করে ফলমূল ও শাকসবজি রপ্তানি হচ্ছে। যাদের বেশির ভাগই মধ্যপ্রাচ্যের ৩টি দেশ সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত। এ ছাড়াও মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, ইতালিসহ অন্যান্য দেশে কিছু পরিমাণ রপ্তানি হচ্ছে।
ফলমূল ও শাকসবজিতে অধিক পরিমাণে পানি বিদ্যমান থাকে বিধায় খুবই পচনশীল পণ্য। ফসল কর্তন বা সংগ্রহের পর এর দ্রুত শ^সন চলতে থাকে এবং শরীরবৃত্তিয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। আবার ফলমূল ও শাকসবজি তাদের প্রকৃতি অনুযায়ী ক্লাইমেকটেরিক ও নন-ক্লাইমেকটেরিক ধরনের। ফলে সংগ্রহ থেকে শুরু করে বিপণন পর্যন্ত যেকোন স্তরে একটু ক্ষত, চাপ খাওয়া বা যেকোনভাবে আঘাত প্রাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে ক্লাইমেকটেরিক প্রকৃতির ফলমুল ও শাকসবজি থেকে প্রাকৃতিকভাবে ইথিলিন উৎপন্ন হয় ও শ^সন প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু হয়। এতে প্রচুর পরিমাণে শক্তির অপচয় হয়। এ দিক বিবেচনায় যথাযথ পরিচর্যা, যথাযথ পরিপক্বতা অনুসরণ করে ফসল সংগ্রহ করতে হবে। পাশাপাশি যথাযথ প্রয়োজন এভাবে মোড়কে রাখা, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ, নূন্যতম তাপমাত্রা নির্ধারণ, শ^সন দ্রুত হ্রাস করতে শীতলীকরণের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা, যথাযথ উপায়ে স্থানান্তর করার ব্যবস্থাপনা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ ও সংগ্রহোত্তর ক্ষতি হ্রাসের অন্যতম উপায়। মাঠ পর্যায়ের উৎপাদনকারী কৃষক, সম্প্রসারণকর্মী, উদ্যোক্তাদের এ বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফসলের পরিপক্বতার নিদের্শক বা নির্ণায়ক সম্পর্কে জ্ঞান থাকা, পানি দ্বারা শোধন করা, প্রাক-শীতলীকরণ, শুকানো, মোড়কজাত করা, নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ অত্যাবশ্যক। এতে ফসলের সংগ্রহোত্তর অপচয় যেমন কমবে তেমনি কৃষকের যথাযথ মূল্য পেতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সমগ্র বিশে^ই ফলমূল ও শাকসবজির সংগ্রহোত্তর অপচয় রোধে সময়োপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগ করে ক্ষতির পরিমাণ কমাতে গবেষণা চলমান রয়েছে। আমাদের দেশে প্রতি বছর উৎপাদিত প্রায় ৯৩ মিলিয়ন টন কৃষিপণ্যে অপচয় হচ্ছে তা টাকার অঙ্কে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা (বিবিএস, ২০২২)। উল্লেখ্য যে, উন্নত দেশে এই ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কম হলেও উন্নয়নশীল দেশে প্রায় ১২-৪৫ ভাগ (দানাশস্য, ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি) বা অধিক পরিমাণ। তবে ভরা মৌসুমে অনেক সময় এ অপচয়ের পরিমাণ অধিক হয়ে থাকে। ফসলের দাম অনেক সময় অতিমাত্রায় কমে যাওয়ায় কৃষকেরা ন্যায্যমূল্য পায় না বা মজুরি না উঠার ফলে কৃষিপণ্য তাদের জমিতে বা মাঠে তা রেখে আসে এমন নজিরও রয়েছে। ফলশ্রুতিতে কৃষি উৎপাদনে আগ্রহ ও মনোবল হারিয়ে ফেলে, অলাভজনক হওয়ায় পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় স্থানান্তর করে। অন্যদিকে বিবিএস ও জাতিসংঘের তথ্য মোতাবেক আমাদের দেশে প্রতি বছর ১.৪৫ কোটি টন খাবার নষ্ট হয়, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এর মধ্যে ৩৭ লক্ষ টন মাঠ হতে রান্না করা পর্যন্ত নষ্ট হয়ে থাকে। কাজেই যথাযথ প্রক্রিয়ায় কৃষিপণ্য পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অপচয় কমাতে উন্নত প্রযুক্তির বিকল্প নেই।  
বর্তমানে বিশে^ কৃষির রূপান্তরের মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন ও বাণিজ্যি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কৃষিপণ্য সরাসরি ভোগ্যপণ্য ছাড়াও এখন কাঁচামাল তৈরির উৎস হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। ফলমুল ও শাকসবজি থেকে খাদ্য দ্রব্য তৈরির পাশাপাশি উচ্ছিষ্টাংশ থেকে বিভিন্ন দ্রব্যাদি তৈরি হচ্ছে। পেকটিন, স্টার্চ, ফুড গ্রেড কালার বা রং, ইথানল, ভিনেগার, সুগন্ধি, ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী ইত্যাদি যেমন তৈরি হচ্ছে তেমনি রেডি-টু-কুক, রেডি-টু-ইট, ফ্রেশ-কাট পণ্যসহ বহুবিধ খাদ্যসামগ্রী মানুষের প্রতিনিয়ত সহজলভ্য হচ্ছে। স্টিপিং পদ্ধতিতে কাঁচা ফলমুল ও শাকসবজি ৬ মাসের অধিক সময় সংরক্ষণ করা, পাল্প সংরক্ষণ করা, ভিনেগার দ্রবণে রেখে ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, শসা ইত্যাদি পিকলিং এর মাধ্যমে সংরক্ষণ করা লাভজনক এবং বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। শীতকালে অধিক উৎপাদিত ফলমুল ও শাকসবজি কৃষক অনেক সময় কমমূল্যে বিক্রয় করে সেক্ষেত্রে প্রাথমিক পরিচর্যা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হলে বছরব্যাপী তা বিভিন্ন খাবারে যুক্ত করে খাওয়া সম্ভব। সতেজ সবজি ৩০-৪৫ সেকেন্ড বা ১ মিনিট গরম পানিতে শোধন বা স্যানিটাইজিং করতে হবে এবং পরে কিছুসময় স্বাভাবিক তাপামাত্রার পানিতে রাখতে হবে। অতঃপর প্রয়োজন অনুসারে লবণ, এসিটিক এসিড বা ভিনেগার, সংরক্ষক ইত্যাদি যুক্ত করে মোড়কজাত করলে গুণগতমান বজায় থাকে।
বর্তমানে কৃষিকে ব্যবসা হিসেবে তরুণ, যুবক ও মহিলারা উদ্যোক্তা হিসেবে যুক্ত হচ্ছে। আবার বহুমুখী খাবারের চাহিদাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে অনেকেই ঘরে বসেই সামাজিক যোগাযোগ ই-প্লাটফর্ম যেমন-ফুড পান্ডা, ইফুড, চালডাল, হাংড়িনাকি ইত্যাদি ব্যবহার করে বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্যাদি ও খাদ্যপণ্য ভোক্তাদের নিকট পৌঁছে দিচ্ছে। এতে করে কৃষিপণ্যের ব্যবসা দিন দিন বাড়ছে আবার মানুষের চাহিদাও বাড়ছে। এতে আত্ম কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে,        কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পারিবারিক আয়ও বাড়ছে। নিজের সুস্থতা বিবেচনায় ভোক্তা এখন পুষ্টি বিষয়ে সচেতন হচ্ছে। পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবারের চাহিদাও বাড়ছে। সর্বোপরি ফলমূল ও শাকসবজির পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনা পারিবারিক পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এতদ্সত্ত্বেও কৃষিপণ্য সংগ্রহ থেকে বিপণন পর্যন্ত প্রতি স্তরে রয়েছে বিরাট চ্যালেঞ্জ ও আবার রয়েছে সম্ভাবনা। উন্নত সংগ্রহোত্তর পরিচর্যার উপকরণ সহজলভ্য করা ও যথাযথ জ্ঞান থাকা, পরিপক্বতার লক্ষণসমূহ জানা, মোড়কজাত প্রযুক্তির সহজপ্রাপ্যতা ও যথাযথ মোড়কজাত প্রযুক্তির ব্যবহার ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সরবরাহ করা, সংরক্ষণ তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতের ঘাটতি ফলমূল ও শাকসবজির গুণগতমাণ যেমন কমাবে তেমনি সংরক্ষণ সময়ও হ্রাস করবে।
একুই শতকের এ কৃষিতে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার এখন সময়ের দাবি। ফলমূল ও শাকসবজির গুণগতমাণ ও সংরক্ষণ বাড়াতে মাইক্রোইমালশন প্রযুক্তির ব্যবহার (এডিবল ওয়াক্স কোটিং) প্রয়োজন যা উন্নত দেশ ব্যবহার করে। প্রয়োজনীয় গ্যাস বিনিময়ের মাধ্যমে সতেজ ফলমূল ও শাকসবজির গুণগতমান বজায় থাকে বা উন্নত করে ও সংরক্ষণ সময় বাড়াতে সাহায্য করবে নিঃসন্দেহে। আবার ন্যানো প্যাকেজিং এর ব্যবহার মোড়কজাতকরণে নবদিগন্তের সূচনা করবে যা কৃষিপণ্যের সতেজতা ও গুণগতমান বজায় রাখার নির্দেশক হিসেবে কাজ করবে। সর্বোপরি ফলমূল ও শাকসবজি সংগ্রহোত্তর উন্নত পরিচর্যা ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মূল্য সংযোজন হবে যা কৃষিকে বাণিজ্যিকীকরণে এগিয়ে নিবে নিঃসন্দেহে।

লেখক : ১মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ,, ফোন: ০২-৪৯২৭০১৭৬। ২খাদ্য প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষক ও উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, ই-মেইল: ferdous613@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১২২৭১১৬৩। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১।

বিস্তারিত
ফসলের সংগ্রহোত্তর পরিচর্যা, ব্যবস্থাপনা ও মূল্য সংযোজনের গুরুত্ব

ফসলের সংগ্রহোত্তর পরিচর্যা, ব্যবস্থাপনা
ও মূল্য সংযোজনের গুরুত্ব
মো. হাফিজুল হক খান১ ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী২
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। একবিংশ শতাব্দীর কৃষি বিশে^র বিস্ময় ও রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত। উৎপাদিত কৃষিপণ্যের অনেক পণ্যই বিশে^ প্রথম স্থান হতে দশম স্থানের মধ্যে রয়েছে। কৃষিপণ্যের মধ্যে উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল যেমন-ফলমূল ও শাকসবজি আমাদের শরীরের জন্য অপরিহার্য। শরীরের সুস্থতা ও শক্তি প্রদানের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচ্য। আমাদের শরীরকে ঠিক রাখতে বিভিন্ন খনিজ পদার্থ, খাদ্যপ্রাণ, শর্করা, ¯েœহ জাতীয় উপাদানসহ বিভিন্ন ফাইটোক্যামিক্যালস্ প্রতিনিয়ত প্রয়োজন হয়। ফলমূল ও শাকসবজি খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায়ও বিশে^ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের খাদ্য ও  কৃষি সংস্থার (এফএও/ডব্লিউএইচও, ২০১৪) সুপারিশ অনুযায়ী একজন মানুষের গড়ে প্রতিদিন ৪০০ গ্রাম ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমরা দৈনন্দিন প্রায় ২০৪ গ্রাম (২০৮ কিলোক্যালরি) পরিমাণ ফলমূল ও শাকসবজি (বিবিএস, ২০১৮) খেয়ে থাকি যা প্রায় অর্ধেক পরিমাণ। তন্মধ্যে আমরা শাকসবজি ১৬৭ গ্রাম ও বাকি অংশ ফলমূল থেকে পাই। দেশে বর্তমানে ৯০ প্রকার শাকসবজি ও ৬০ প্রকার ফলমূল এর অধিক পরিমাণে সারাবছর উৎপাদিত হচ্ছে। উৎপাদিত কৃষি পণ্যগুলো মূলত দুটি মৌসুম-গ্রীষ্মকাল (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) ও শীতকাল (অক্টোবর-মার্চ) হয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে, মোট উৎপাদনের প্রায় শতকরা ১ ভাগ ফলমূল ও শাকসবজি কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে বিশে^র প্রায় ৪০টি দেশে আমাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিশেষ করে ফলমূল ও শাকসবজি রপ্তানি হচ্ছে। যাদের বেশির ভাগই মধ্যপ্রাচ্যের ৩টি দেশ সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত। এ ছাড়াও মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, ইতালিসহ অন্যান্য দেশে কিছু পরিমাণ রপ্তানি হচ্ছে।
ফলমূল ও শাকসবজিতে অধিক পরিমাণে পানি বিদ্যমান থাকে বিধায় খুবই পচনশীল পণ্য। ফসল কর্তন বা সংগ্রহের পর এর দ্রুত শ^সন চলতে থাকে এবং শরীরবৃত্তিয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। আবার ফলমূল ও শাকসবজি তাদের প্রকৃতি অনুযায়ী ক্লাইমেকটেরিক ও নন-ক্লাইমেকটেরিক ধরনের। ফলে সংগ্রহ থেকে শুরু করে বিপণন পর্যন্ত যেকোন স্তরে একটু ক্ষত, চাপ খাওয়া বা যেকোনভাবে আঘাত প্রাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে ক্লাইমেকটেরিক প্রকৃতির ফলমুল ও শাকসবজি থেকে প্রাকৃতিকভাবে ইথিলিন উৎপন্ন হয় ও শ^সন প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু হয়। এতে প্রচুর পরিমাণে শক্তির অপচয় হয়। এ দিক বিবেচনায় যথাযথ পরিচর্যা, যথাযথ পরিপক্বতা অনুসরণ করে ফসল সংগ্রহ করতে হবে। পাশাপাশি যথাযথ প্রয়োজন এভাবে মোড়কে রাখা, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ, নূন্যতম তাপমাত্রা নির্ধারণ, শ^সন দ্রুত হ্রাস করতে শীতলীকরণের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা, যথাযথ উপায়ে স্থানান্তর করার ব্যবস্থাপনা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ ও সংগ্রহোত্তর ক্ষতি হ্রাসের অন্যতম উপায়। মাঠ পর্যায়ের উৎপাদনকারী কৃষক, সম্প্রসারণকর্মী, উদ্যোক্তাদের এ বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফসলের পরিপক্বতার নিদের্শক বা নির্ণায়ক সম্পর্কে জ্ঞান থাকা, পানি দ্বারা শোধন করা, প্রাক-শীতলীকরণ, শুকানো, মোড়কজাত করা, নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ অত্যাবশ্যক। এতে ফসলের সংগ্রহোত্তর অপচয় যেমন কমবে তেমনি কৃষকের যথাযথ মূল্য পেতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সমগ্র বিশে^ই ফলমূল ও শাকসবজির সংগ্রহোত্তর অপচয় রোধে সময়োপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগ করে ক্ষতির পরিমাণ কমাতে গবেষণা চলমান রয়েছে। আমাদের দেশে প্রতি বছর উৎপাদিত প্রায় ৯৩ মিলিয়ন টন কৃষিপণ্যে অপচয় হচ্ছে তা টাকার অঙ্কে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা (বিবিএস, ২০২২)। উল্লেখ্য যে, উন্নত দেশে এই ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কম হলেও উন্নয়নশীল দেশে প্রায় ১২-৪৫ ভাগ (দানাশস্য, ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি) বা অধিক পরিমাণ। তবে ভরা মৌসুমে অনেক সময় এ অপচয়ের পরিমাণ অধিক হয়ে থাকে। ফসলের দাম অনেক সময় অতিমাত্রায় কমে যাওয়ায় কৃষকেরা ন্যায্যমূল্য পায় না বা মজুরি না উঠার ফলে কৃষিপণ্য তাদের জমিতে বা মাঠে তা রেখে আসে এমন নজিরও রয়েছে। ফলশ্রুতিতে কৃষি উৎপাদনে আগ্রহ ও মনোবল হারিয়ে ফেলে, অলাভজনক হওয়ায় পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় স্থানান্তর করে। অন্যদিকে বিবিএস ও জাতিসংঘের তথ্য মোতাবেক আমাদের দেশে প্রতি বছর ১.৪৫ কোটি টন খাবার নষ্ট হয়, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এর মধ্যে ৩৭ লক্ষ টন মাঠ হতে রান্না করা পর্যন্ত নষ্ট হয়ে থাকে। কাজেই যথাযথ প্রক্রিয়ায় কৃষিপণ্য পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অপচয় কমাতে উন্নত প্রযুক্তির বিকল্প নেই।  
বর্তমানে বিশে^ কৃষির রূপান্তরের মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন ও বাণিজ্যি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কৃষিপণ্য সরাসরি ভোগ্যপণ্য ছাড়াও এখন কাঁচামাল তৈরির উৎস হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। ফলমুল ও শাকসবজি থেকে খাদ্য দ্রব্য তৈরির পাশাপাশি উচ্ছিষ্টাংশ থেকে বিভিন্ন দ্রব্যাদি তৈরি হচ্ছে। পেকটিন, স্টার্চ, ফুড গ্রেড কালার বা রং, ইথানল, ভিনেগার, সুগন্ধি, ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী ইত্যাদি যেমন তৈরি হচ্ছে তেমনি রেডি-টু-কুক, রেডি-টু-ইট, ফ্রেশ-কাট পণ্যসহ বহুবিধ খাদ্যসামগ্রী মানুষের প্রতিনিয়ত সহজলভ্য হচ্ছে। স্টিপিং পদ্ধতিতে কাঁচা ফলমুল ও শাকসবজি ৬ মাসের অধিক সময় সংরক্ষণ করা, পাল্প সংরক্ষণ করা, ভিনেগার দ্রবণে রেখে ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, শসা ইত্যাদি পিকলিং এর মাধ্যমে সংরক্ষণ করা লাভজনক এবং বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। শীতকালে অধিক উৎপাদিত ফলমুল ও শাকসবজি কৃষক অনেক সময় কমমূল্যে বিক্রয় করে সেক্ষেত্রে প্রাথমিক পরিচর্যা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হলে বছরব্যাপী তা বিভিন্ন খাবারে যুক্ত করে খাওয়া সম্ভব। সতেজ সবজি ৩০-৪৫ সেকেন্ড বা ১ মিনিট গরম পানিতে শোধন বা স্যানিটাইজিং করতে হবে এবং পরে কিছুসময় স্বাভাবিক তাপামাত্রার পানিতে রাখতে হবে। অতঃপর প্রয়োজন অনুসারে লবণ, এসিটিক এসিড বা ভিনেগার, সংরক্ষক ইত্যাদি যুক্ত করে মোড়কজাত করলে গুণগতমান বজায় থাকে।
বর্তমানে কৃষিকে ব্যবসা হিসেবে তরুণ, যুবক ও মহিলারা উদ্যোক্তা হিসেবে যুক্ত হচ্ছে। আবার বহুমুখী খাবারের চাহিদাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে অনেকেই ঘরে বসেই সামাজিক যোগাযোগ ই-প্লাটফর্ম যেমন-ফুড পান্ডা, ইফুড, চালডাল, হাংড়িনাকি ইত্যাদি ব্যবহার করে বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্যাদি ও খাদ্যপণ্য ভোক্তাদের নিকট পৌঁছে দিচ্ছে। এতে করে কৃষিপণ্যের ব্যবসা দিন দিন বাড়ছে আবার মানুষের চাহিদাও বাড়ছে। এতে আত্ম কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে,        কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পারিবারিক আয়ও বাড়ছে। নিজের সুস্থতা বিবেচনায় ভোক্তা এখন পুষ্টি বিষয়ে সচেতন হচ্ছে। পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবারের চাহিদাও বাড়ছে। সর্বোপরি ফলমূল ও শাকসবজির পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনা পারিবারিক পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এতদ্সত্ত্বেও কৃষিপণ্য সংগ্রহ থেকে বিপণন পর্যন্ত প্রতি স্তরে রয়েছে বিরাট চ্যালেঞ্জ ও আবার রয়েছে সম্ভাবনা। উন্নত সংগ্রহোত্তর পরিচর্যার উপকরণ সহজলভ্য করা ও যথাযথ জ্ঞান থাকা, পরিপক্বতার লক্ষণসমূহ জানা, মোড়কজাত প্রযুক্তির সহজপ্রাপ্যতা ও যথাযথ মোড়কজাত প্রযুক্তির ব্যবহার ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সরবরাহ করা, সংরক্ষণ তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতের ঘাটতি ফলমূল ও শাকসবজির গুণগতমাণ যেমন কমাবে তেমনি সংরক্ষণ সময়ও হ্রাস করবে।
একুই শতকের এ কৃষিতে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার এখন সময়ের দাবি। ফলমূল ও শাকসবজির গুণগতমাণ ও সংরক্ষণ বাড়াতে মাইক্রোইমালশন প্রযুক্তির ব্যবহার (এডিবল ওয়াক্স কোটিং) প্রয়োজন যা উন্নত দেশ ব্যবহার করে। প্রয়োজনীয় গ্যাস বিনিময়ের মাধ্যমে সতেজ ফলমূল ও শাকসবজির গুণগতমান বজায় থাকে বা উন্নত করে ও সংরক্ষণ সময় বাড়াতে সাহায্য করবে নিঃসন্দেহে। আবার ন্যানো প্যাকেজিং এর ব্যবহার মোড়কজাতকরণে নবদিগন্তের সূচনা করবে যা কৃষিপণ্যের সতেজতা ও গুণগতমান বজায় রাখার নির্দেশক হিসেবে কাজ করবে। সর্বোপরি ফলমূল ও শাকসবজি সংগ্রহোত্তর উন্নত পরিচর্যা ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মূল্য সংযোজন হবে যা কৃষিকে বাণিজ্যিকীকরণে এগিয়ে নিবে নিঃসন্দেহে।

লেখক : ১মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ,, ফোন: ০২-৪৯২৭০১৭৬। ২খাদ্য প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষক ও উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, ই-মেইল: ferdous613@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১২২৭১১৬৩। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১।

বিস্তারিত
ধান-উৎপাদনে-সেচের-পানিসাশ্রয়ী-প্রযুক্তি-(AWD)

ধান উৎপাদনে সেচের পানিসাশ্রয়ী
প্রযুক্তি (AWD)
ড. সুরজিত সাহা রায়
ধান উৎপাদনে পানি বা সেচ প্রদান আবশ্যক। সেচের পানির আধিক্যে ফসলের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং রোগ পোকার আক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া সেচ দেয়ার জন্য বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা জ¦ালানির প্রয়োজন হয়। জলাবদ্ধ জমি থেকে ধান গাছ দস্তা ও জিপসাম সার গ্রহণ করতে পারে না। দস্তা গ্রহণ করতে না পারলে ধানে বাদামি দাগ রোগ দেখা দেয়। জলাবদ্ধ জমিতে বাদামি গাছ ফড়িং, চুঙ্গি পোকার আক্রমণ বৃদ্ধি পায়। জমিতে পানি আটকে থাকলে ধান গাছে কুশি উৎপাদন ব্যাহত হয়। জলাবদ্ধ জমিতে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা যায়না এবং মিথেন গ্যাস উৎপাদন হয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে বায়ু দূষণ করে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধিতে এডব্লিউডি খুবই লাগসই পানিসাশ্রয়ী একটি প্রযুক্তি।
এডব্লিউডি পরিচিতি
এডব্লিউডি প্রযুক্তি হলো জমিকে পর্যায়ক্রমে ভিজানো ও শুকানোর মাধ্যমে ধানক্ষেতে প্রয়োজনমত নিয়ন্ত্রিত সেচ দেয়া। এ পদ্ধতিতে সেচ দিলে ধানক্ষেতে ২৮% পানি সাশ্রয় করা সম্ভব।
সেচের পানি সাশ্রয়ী পাইপ পদ্ধতি
ধানক্ষেতে একটি ছিদ্রযুক্ত প্লাস্টিক  বা বাঁশের পাইপ বসিয়ে মাটির ভেতরের পানির স্তর পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনমতো সেচ দেয়াই হলো এ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য।     
ব্যবহার পদ্ধতি
২৫ সেন্টিমিটার লম্বা ও ৭-১০ সেমি. ব্যাসের বাঁশ বা প্লাস্টিকের পাইপের উপরের ১০ সেমি. বাদ দিয়ে বাকি ১৫ সেমি. পাইপে ৫ সেমি. পরপর ৩ সুতি ব্যাসের ড্রিল বিট দিয়ে ছিদ্র করতে হবে। এক একর পরিমাণ একটি সমতল ধানক্ষেতে ২-৩টি পাইপ বসাতে হবে।
পাইপটি এমনভাবে ধানক্ষেতে বসাতে হবে যেন এটির ছিদ্রহীন ১০ সেমি. মাটির উপরে থাকে। ছিদ্রযুক্ত ১৫ সেমি. মাটির নিচে থাকবে, যাতে করে মাটির ভেতরের পানি ছিদ্র দিয়ে পাইপে সহজে প্রবেশ করতে বা পাইপ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে।    চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর্যন্ত জমিতে ২-৪ সেমি. দাঁড়ানো পানি ধরে রাখতে হবে। এরপর সাশ্রয়ী পাইপ পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়।
এ পদ্ধতিতে প্রতিবার সেচের সময় এমন পরিমাণ পানি দিতে হবে যাতে জমির  ৫ সেমি. গভীরতায় পানি থাকে। অতঃপর পানির স্তর কমতে কমতে পানির গভীরতা যখন পাইপের ভেতর ১৫ সেমি. নেমে যাবে অর্থাৎ পাইপের তলার মাটি দেখা যাবে তখন আবার সেচ দিতে হবে। এ অবস্থায় মাটিভেদে ৫-৮ দিন সময় লাগে। এভাবে ফুল আসা পর্যন্ত সেচ দিয়ে যেতে হবে।
ফুল আসার পর ২ সপ্তাহ পর্যন্ত জমিতে সবসময় ২-৪ সেমি. পানি ধরে রাখতে হবে।
অতঃপর ধান কাটার ২ সপ্তাহ আগে সেচ বন্ধ করে দিতে হবে।
এ পদ্ধতিতে ফলনের কোন তারতম্য হয় না, উপরন্তু পানি ও জ¦ালানি (বিদ্যুৎ, ডিজেল ইত্যাদি) সাশ্রয় হয় অর্থাৎ কম খরচে বেশি লাভ। সর্বোপরি এটি একটি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি। তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট।

লেখক : পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১১৯৬৯৩১৮, ই-মেইল :www.ais.gov.bd

বিস্তারিত
গমের-ব্লাস্ট-রোগ-ও-সমন্বিত-ব্যবস্থাপনা

গমের ব্লাস্ট রোগ ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনা
কৃষিবিদ ড. মো: হুমায়ুন কবীর
গম  ধানের পরে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য যা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে এবং এই উচ্চ জনবহুল দেশের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। গম মোট ফসলি জমির ৩% এবং রবি মৌসুমে ১১% দখল করে আছে এবং বাংলাদেশের মোট শস্য উৎপাদনের ৭% অবদান রাখছে (বিবিএস-১০১৭ এবং গেইন রিপোর্ট-০৪-০৩-২০১৮)। ২০২১-২০২২ মৌসুমে গমের মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৩.১৯৮ লক্ষ হেক্টর এবং মোট উৎপাদন ছিল ১১.৬৭৩ লক্ষ মেট্রিক টন (কৃষি ডাইরি, ২০২৩)। বার্ষিক ৭০ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে দেশে উৎপাদন হয় মাত্র ১০-১২ লাখ টন। বাকিটা আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয় (ঞযব ইঁংরহবংং ঝঃধহফধৎফ, ১৫ অক্টোবর, ২০২৩)। ঋঅঙ এর তথ্য অনুসারে, বিশ্বে বর্তমানে গমের উৎপাদন ৬৪২ মিলিয়ন টন থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ৮৪০ মিলিয়ন টন গমের প্রয়োজন হবে। এই চাহিদা মেটাতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের গমের উৎপাদন ৭৭% বৃদ্ধি করা উচিত এবং চাহিদার ৮০% এর বেশি উল্লম্ব সম্প্রসারণ থেকে আসা উচিত ।
খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে মানুষ গমের দিকে ঝুঁকছে, ফলে গমের চাহিদা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক নাজমা শাহিন। আজকাল মানুষ কম ভাত খায়, কারণ গমে বেশি প্রোটিন থাকে এবং বেশি শক্তি জোগায়। অন্যদিকে, ভাতে স্টার্চ থাকে যা ডায়াবেটিস হতে পারে। রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভাতের পরিবর্তে রুটি (চ্যাপ্টা রুটি) খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। এ ছাড়া স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে অনেকেই দিনে একবার ভাত ও অন্য দুই বেলা রুটি খান। এইভাবে দেশে রুটি এবং গমের বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পণ্যের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে (দৈনিক প্রথম আলো, ০৬ জানুয়ারি, ২০১৯)। চাহিদা পূরণ ও আমদানি হ্রাসকল্পে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার গম উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
কৃষি বিপ্লবের শুরু থেকে, আমাদের গ্রহে কিছু ভয়ঙ্কর ফসলের রোগ মহামারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল যার ফলে দুর্ভিক্ষের মতো বিপর্যয় দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, আলুতে নাবি ধসা রোগের কারণে ১৮৪৫ সালে মহান আইরিশ দুর্ভিক্ষ (এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, ১৯৯৯) এবং ১৯৪৩ সালে ধানের ব্রাউন স্পট রোগের কারণে বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল (এযড়ং, ১৯৫৬)। বিগত কিছু বছর এবং সম্প্রতি অতি ক্ষতিকর গমের ব্লাস্ট রোগের নতুন উত্থান এবং পুনঃউত্থান যা একটি ফিলামেন্টাস ছত্রাক গধমহধঢ়ড়ৎঃযব ড়ৎুুধব ঞৎরঃরপঁস (ওমধৎধংযর, ১৯৮৬) এর স্বতন্ত্র প্যাথোটাইপের কারণে ঘটে।
একটি সমীক্ষা ইঙ্গিত করে যে দক্ষিণ এশিয়ার গম উৎপাদনকারী এলাকার ৬০% গম ব্লাস্ট সংক্রমণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, গম চাষের ব্লাস্ট-সংবেদনশীল এলাকা প্রায় ৬৫%। সেই সমীক্ষা থেকে প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতে প্রায় ৭ মিলিয়ন হেক্টর গম চাষের এলাকা এখনও ব্লাস্ট রোগের হুমকির মধ্যে রয়েছে।
১৯৮৫ সালে পারানা ব্রাজিল রাজ্যে গমের ব্লাস্ট রোগের প্রথম আক্রমন দেখা যায়, তারপর থেকে ছত্রাকটি বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে এবং আর্জেন্টিনায় ছড়িয়ে পড়ে যা গম চাষের জন্য হুমকিস্বরূপ। ২০০৯ সালে সেই বিপর্যয়ের কারণে ব্রাজিলের এক-তৃতীয়াংশ গম ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল (কড়যষর,২০১১).
২০১৬ সালে, বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, বরিশাল, ভোলা এবং দক্ষিণের অন্যান্য জেলায় হঠাৎ করে গমের ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয় (ঋঅঙ রিপোর্ট, ২০১৬)। গধমহধঢ়ড়ৎঃযব ড়ৎুুধব ঞৎরঃরপঁস কার্যকারণ ছত্রাক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল (মালাকার ২০১৬)। ২০১৫-১৬ সালে বাংলাদেশের মোট গম উৎপাদনকারী এলাকার প্রায় ২০% ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, যা দেশের সামগ্রিক গম উৎপাদনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে (গবধয, ২০১৬)। ২০১৭ সালে (ডেইলি স্টার রিপোর্ট, জানুয়ারি, ২০১৭) এই কয়েকটি জেলায় এই রোগটি আবার দেখা দেয়। ২০২০-২১ (গবধয, ২০২১) মৌসুম পর্যন্ত ও পরবর্তী বছরগুলোতে গমের ব্লাস্ট রোগ অব্যাহত ছিল। বাংলাদেশে গমের গমের ব্লাস্ট রোগ এর প্রাদুর্ভাব আন্তর্জাতিক ভুট্টা এবং গম উন্নয়ন কেন্দ্র (ঈওগগণঞ) বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণী প্রমাণ করেছে যে এই অঞ্চলে একই রকম আবহাওয়ার কারণে গমের ব্লাস্ট রোগ থেকে এশিয়া ও আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে (ঈওগগণঞ, ২০১৬)। বাংলাদেশ গম এবং ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইডগজও) এর উদ্ভিদ রোগ বিশেষজ্ঞরাও সতর্ক করেছেন যে এই রোগটি ভারত, পাকিস্তান এবং চীনে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে যা বিশ্ব গম উৎপাদনে যথাক্রমে তৃতীয়, সপ্তম এবং দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে (মুন্ডি, ২০১৬)।
বিধ্বংসী ব্লাস্ট রোগের সমস্যায় যদি গম চাষ করা না যায়, তাহলে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং এইভাবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কোনভাবেই সম্ভব না। গমের ব্লাস্ট রোগ এখন দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। একটি অরক্ষিত পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান গম চাষে এই বিপদ ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করবে। সুতরাং, গমের ব্লাস্ট রোগ নিয়ন্ত্রণে আমাদের পরিকল্পনা ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ খুবই জরুরি।
গমের ব্লাস্ট রোগের অনুকূল অবস্থা
   উষ্ণ এবং আর্দ্র আবহাওয়া;
    ফুল ফোটার সময় ১৮-২৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে বেশ কয়েক দিন একটানা বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রা, তারপরে গরম, রোদ ও আর্দ্র দিন খুবই অনুকূল;
    সংক্রমণের জন্য সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ ৩২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোত্তম ২৫০ -৩০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস;
    উচ্চ নাইট্রোজেন প্রয়োগ, বায়বীয় মাটি এবং খরার চাপ ব্লাস্ট রোগে সহায়ক হিসাবে কাজ করে;
    উচ্চ আপেক্ষিক আর্দ্রতা যা স্পোরুলেশনের জন্য প্রয়োজন;
    অ্যাপ্রেসোরিয়াম ফাংশন এবং স্পোর রিলিজের জন্য বৃষ্টি ভারী শিশির প্রয়োজন।
ব্লাস্ট রোগের লক্ষণ                        
ক) ব্লিচড স্পাইকস এবং স্পাইকের গোড়ায় কালচে ধূসর বর্ণের দাগ (গমের ব্লাস্টের সাধারণ লক্ষণ) খ) গমের ব্লাস্টের প্যাচ গ) চোখের আকৃতির পাতায় গাঢ় ধূসর দাগ ঘ) কা-ে গাঢ় ধূসর চোখের আকৃতির ক্ষত ঙ) ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত গমের বীজ চ) জীবাণু (ঈড়হরফরধ ড়ভ গড়ঞ)
প্রতিরোধ
    গমের ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী (বারি গম ৩৩ এবং বিডব্লিউএমআরআই গম ৩) ও সহনশীল ( বারি গম ৩০, বারি গম ৩২ এবং বিডব্লিউএমআরআই গম ২) চাষ করতে হবে।
    যেকোন উৎস থেকে গমের বীজ ব্লটার পদ্ধতিতে গড়ঞ-এর জন্য পরীক্ষা করা উচিত এবং সুস্থ বীজ না পাওয়া গেলে ১ কেজি বীজের জন্য ছত্রাকনাশক প্রোভাক্স (কার্বক্সিন ১৭.৫%+থিরাম ১৭.৫%) @ ২.৪-৩ গ্রাম দিয়ে বীজ শোধন করা উচিত।
    সরিষা, আলু, মসুর, মরিচ ইত্যাদির মতো অ-শস্যজাতীয় ফসলের সাথে ফসলের আবর্তন বা শস্যবিন্যাস অনুসরণ করা উচিত।
    সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করতে হবে এবং অতিরিক্ত ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা যাবে না।
    গমের ক্ষেত এবং আইল আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
    ১৫-৩০ নভেম্বর এর মধ্যে গম বপন করতে হবে।
    গমের খড় ক্ষেত থেকে অপসারণ করতে হবে।
    সিলিকন (সুপার সিলিকা) ১০০ কেজি/হেক্টর, জিংক (চিলেটেড জিংক) ১১.৫ কেজি/হেক্টর এবং বোরন (সলুবোর বোরন) ৬ কেজি/হেক্টর এর সম্মিলিত প্রয়োগ রোগকে একটি গ্রহণযোগ্য স্তরে বা অন্ততপক্ষে এমন একটি স্তরে কমাতে পারে যেখানে অন্যান্য কালচারাল অনুশীলন দ্বারা আরও নিয়ন্ত্রণ, কম ব্যয়বহুল এবং পরিবেশবান্ধব করা যায়।
    গমক্ষেতের কমপক্ষে ২ কিলোমিটারের এর মধ্যে বার্লি চাষ করা উচিত নয়।
মনিটরিং
    নিয়মিত গমক্ষেত মনিটরিং করতে হবে।
    গমের প্রি- হেডিং, হেডিং এবং মিল্ক স্টেহজ পর্যন্ত প্রতিদিন মাঠ মনিটরিং ও পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
    গমের নাড়া পুড়িয়ে দিতে হবে।
সরাসরি নিয়ন্ত্রণ
বুটিং, প্রি-হেডিং (ফুল আসার আগে) এবং হেডিং (ফূল আসার সময়) পর্যায়ে ন্যাটিভো (টেবোকোনাজল ৫০%+ ট্রাইফ্লক্সিস্ট্রবিন ২৫%) @০.৬ গ্রাম/লি. অথবা ফিলিয়া (ট্রাইসাইক্লাজল ৪০% + প্রোপিকোনাজল ১২.৫%) ২.০ মিলি/লি. অথবা সানফাইটার (হেক্সাকোনাজল ৩%+ ট্রাইসাইক্লাজল ২২%) ২.০ মিলি/লি. পানির সাথে মিশিয়ে ফলিয়ার স্প্রে করতে হবে। প্রি-হেডিং এর সময় একটি স্প্রে এবং এর ৭দিন পর হেডিং এর সময় আরেকটি স্প্রে খুবই কার্যকর । দানা গঠনের পর্যায়ে রাসায়নিক স্প্রে গড়ঞ সংক্রমণ প্রতিরোধ/বন্ধ করবে না কিন্তু উৎপাদন ক্ষতি কমিয়ে দিবে।
আক্রমণের তীব্রতা বেশি হলে ফিলিয়া (ট্রাইসাইক্লাজল ৪০% + প্রোপিকোনাজল ১২.৫%) ২.০ মিলি/লি. এবং সেলটিমা (পাইরাক্লোস্ট্রবিন ১০%) ২.০ মিলি/লি. ককটেল এর দুই থেকে তিনটি স্প্রে (বুটিং- হেডিং পর্যায়ে) ব্লাস্টের তীব্রতা হ্রাস করতে পারে।
পরিবেশ বান্ধব ট্রাইকোডার্মা- ৫মিলি/লি.(১০৭ ংঢ়ড়ৎবং/সষ)  হারে তিনদিন পরপর ৪ বার (বুটিং থেকে হেডিং পর্যায়ে) স্প্রে  করলে ব্লাস্ট এর তীব্রতা প্রায়  ৪২% হ্রাস পায়।

লেখক: সহকারী প্রকল্প পরিচালক, ফ্লাড রিকনস্ট্রাকশন এমারজেন্সি এসিস্টেন্স প্রজেক্ট (ফ্রিপ), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল : ০১৭১২৫৩৭৩৬৪, ই-মেইল:humayun7364@gmail.com

 

বিস্তারিত
গুণগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদনে আম বাগানের যত্ন-পরিচর্যা

গুণগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদনে আম
বাগানের যত্ন-পরিচর্যা
ড. মোঃ শরফ উদ্দিন
আম একটি জনপ্রিয় ও পছন্দনীয় ফল এবং বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ফসল। দেশে ও বিশ^ বাজারে এ দেশের সুস্বাদু আমের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত মৌসুমে এদেশ হতে তিন হাজার একশত মেট্রিক টন আম পৃথিবীর ৩৬টি দেশে রপ্তানি হয়েছে। এ দেশে যে পরিমাণ জমিতে ফলের চাষ হয় তার শতকরা ৪০ ভাগ জমিতেই আমের চাষাবাদ হয়। তুলনামূলকভাবে লাভজনক হওয়ায় আমের চাষাবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে পরিমাণ জমিতে আমবাগান আছে তার তুলনায় ফলন কম। অর্থাৎ আমাদের দেশে প্রতি একক জমিতে গড় ফলন কম। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে ফলনের ব্যপক তারতম্য দেখা যায়। যেমন: চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতে আমের  ফলন অন্য এলাকায় চেয়ে অনেক বেশি। উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে একটু যত্নবান হলেই আমের ফলন কয়েকগুণ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। যেমন- আমগাছ হতে আম সংগ্রহের পর হতে শুরু করে পরবর্তী ফুল আসা পর্যন্ত বিভিন্ন পরিচর্যা প্রয়োজন হয়। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, অনেক আমচাষি অসময়ে এসে ভাল ফলনের জন্য পরামর্শ চান। তাদের ধারণা আমগাছে মুকুল বের হওয়ার কিছুদিন পূর্বে থেকে যত্ন নিলেই ভাল ফলন পাওয়া সম্ভব। আসলে বিষয়টি এই রকম নয় বরং যত্ন নিতে হবে আম সংগ্রহ করার পর পরই। আমগাছ হতে আম সংগ্রহ করার পর রোগাক্রান্ত বা মরা ডাল পালা একটু ভাল অংশসহ কেঁটে ফেলতে হবে। ডালপালা এমনভাবে ছাঁটাই করতে হবে যেন গাছের ভেতরের অংশে সর্বাধিক পরিমাণ সূর্যালোক পৌঁছাতে পারে। গাছের ভেতরমুখী ডালে সাধারণত ফুল-ফল হয় না, তাই এ ধরনের ডাল কেটে ফেলতে হবে। সাধারণত ডগার বয়স ৫-৬ মাস না হলে ওই ডগায় ফুল আসেনা। আগামী বছরে একটি গাছে কি পরিমাণ ফলন হতে পারে তা আগস্ট মাসেই ধারণা পাওয়া যায়। এ সময়ের মধ্যে গাছে যতবেশী নতুন ডগা বের করা যায় ততই উত্তম।
এরপর যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো আমবাগানে সুষম সার প্রয়োগ। আমবাগান হতে প্রতি বছর ভাল ফলন পাওয়ার জন্য সময়মতো সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিটি গাছে প্রতি বছর কি পরিমাণ সার দিতে হবে তা নির্ভর করে মাটিতে বিদ্যমান সহজলভ্য পুষ্টি উপাদানের উপর। সব ধরনের মাটিতে সারের চাহিদা সমান নয়। সুতরাং মাটির অবস্থাভেদে সারের চাহিদা কম-বেশি হতে পারে। গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের চাহিদাও বাড়তে থাকে।
চারা রোপণের পর গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত সার প্রয়োগ করা আবশ্যক। বয়সভিত্তিতে গাছপ্রতি সারের পরিমাণ সারণি দ্রষ্টব্য।    
প্রয়োগ পদ্ধতি
বয়সভেদে নির্ধারিত সম্পূর্ণ পরিমাণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম, জিংক সালফেট ও বোরিক এসিড এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও অর্ধেক এমওপি সার সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষ সময়ে প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমওপি সার সমান দুই ভাগ করে এক ভাগ জাতভেদে ফল যখন ফল মটর দানার মত হয় তখন এবং অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমওপি সার ফল সংগ্রহের কমপক্ষে ১ মাস পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, গাছের চারিদিকে গোড়া থেকে কমপক্ষে ১ থেকে ১.৫ মি. দূরে হালকাভাবে কুপিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স বেশি হলে এই দূরত্ব বাড়তে পারে। সার প্রয়োগের পর হালকা সেচ দিতে হবে।
সার প্রয়োগের পর যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো আমবাগানে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। খরা মৌসুমে ঘন ঘন সেচ দিতে হবে। তবে মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকলে সেচের প্রয়োজন পড়ে না। গবেষণা করে দেখা গেছে আম গাছে পরিবর্তিত বেসিন পদ্ধতিতে অর্থাৎ গাছের গোড়ার চারিদিকে ১ মিটার জায়গা সামান্য উঁচু রেখে দুপুর বেলা যতটুকু জায়গায় গাছের ছায়া পড়ে ততটুকু জায়গায় একটি থালার মতো করে বেসিন তৈরি করে সেচ প্রয়োগ করলে সেচে পানির পরিমাণ কম লাগে এবং গাছ বেশির ভাগ পানি গ্রহণ করতে পারে।
বেসিন পদ্ধতির আরেকটি সুবিধা হলো গাছের গোড়া পরিষ্কার থাকে ফলে আগাছা জন্মাতে পারে না। সেচ প্রয়োগকৃত জায়গা কচুরিপানা দ্বারা ঢেকে দিলে মাটিতে একমাস পর্যন্ত আর্দ্রতা ধরে রাখে। তবে আমগাছে ফুল আসার একমাস আগে সেচ না দেওয়া উত্তম। কারণ কোন কোন সময় দেখা গেছে, এই সময় সেচ দিলে গাছে নতুন পাতা বের হয় ফলে মুকুলের সংখ্যা কমে যায় এবং ফলন কম হয়। আমবাগানে জৈব পদার্থের ঘাটতি থাকলে ধৈঞ্চার চাষ করা যেতে পারে ফলে বাগানে জৈব পদার্থসহ অন্যান্য সার যোগ হবে এবং মাটির উৎপাদন ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে।
আগাছা দমন
আগাছা আম গাছের খাদ্যে ভাগ বসায় এবং রোগ ও পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। আম গাছের গোড়ায় এবং আমবাগানে যাতে আগাছা না জন্মায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আগাছা দমন করতে বাগানে লাঙ্গল বা টিলারের সহায্যে মাঝে মাঝে চাষের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রথম বার বর্ষা আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথে এবং দ্বিতীয় বার বর্ষা শেষ হয়ে আসার পর পরই জমিতে চাষ দিয়ে আগাছা দমন করতে হবে।
ধ্যারা বা পরগাছা
আমাদের দেশে আমগাছে দুই ধরনের পরগাছা উদ্ভিদ জন্মাতে দেখা যায়। স্থানীয়ভাবে পরগাছা উদ্ভিদ ধ্যারা নামে পরিচিত। ছোট গাছের চেয়ে বড় বা বয়স্ক আমগাছে পরগাছার আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। পরগাছা উদ্ভিদের বীজ আম গাছের ডালে অঙ্কুরিত হয়ে বাড়তে থাকে। পরগাছা আমগাছের শাখা-প্রশাখা থেকে  প্রয়োজনীয় পানি, খাদ্যরস, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি শোষণ করে বেঁচে থাকে। পরগাছার শেকড় থাকে না, তারা শেকড়ের মত এক প্রকার হস্টোরিয়া তৈরি করে। হস্টোরিয়া গাছের ডালে প্রবেশ করে ডাল থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। আক্রান্ত ডালের প্রায় সব খাবার পরগাছা খেয়ে ফেলে, ফলে আক্রান্ত শাখা-প্রশাখা দুর্বল হয়ে পড়ে। আক্রমণ বেশি হলে আম ডালের অস্তিত্ব থাকে না বরং পরগাছা প্রভাব বিস্তার করে বাড়তে থাকে। লরানথাস জাতীয় পরগাছার পাতা দেখতে কিছুটা আম পাতার মতোই। তাই ভালোভাবে লক্ষ্য না করলে দূর থেকে পরগাছার উপস্থিতি বোঝা যায় না তবে পরগাছায় ফুল ও ফল ধারণ করলে দূর থেকে পরগাছার উপস্থিতি বোঝা যায়। এ সময়ে পরগাছা ফুল ফুটন্ত অবস্থায় থাকে ফলে সহজেই শনাক্ত করা যায়। পরগাছা আকর্ষণীয় ফুল ও ফল উৎপন্ন করে। বীজসহ ফল পাখিতে খায় কিন্তু বীজ হজম না হওয়ায় তা মলের সাথে বের হয়ে আসে। এ বীজ আমের ডালে পতিত হয়ে অঙ্কুরিত হয় ও বৃদ্ধি পেতে থাকে। বর্ষাকালে পরগাছার বীজ বিস্তার লাভ করে।  আক্রান্ত ডাল পরগাছার গোড়াসহ কেটে ফেলতে হবে। কাটাস্থানে রোগের সংক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বোর্দোপেস্টের প্রলেপ দিতে হবে। পরগাছায় ফুল ও ফল আসার আগেই সেটি ছাঁটাই করা উচিত।
এরপর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো বাগানের রোগ ও পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা। সঠিক ব্যবস্থাপনা সময়মত না নিলে আমের ফলন কখনও কখনও শূন্যতে নেমে আসতে পারে। ভাল গুণগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদনের জন্য বাগানে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ¯েপ্র করতে হয়। গবেষণার ফলাফল হতে দেখা গেছে, ফুল আসার পূর্বে থেকে আম সংগ্রহ পর্যন্ত ৩-৪টি ¯েপ্রই যথেষ্ঠ। তবে ক্ষেত্রবিশেষে আরও ১/২টি ¯েপ্র করা লাগতে পারে। প্রথম ¯েপ্রটি করা হয় মুকুল বা পু®পমঞ্জরি বের হওয়ার আনুমানিক ১৫-২০ দিন পূর্বে (সাইপারমেথ্রিন/ কার্বারিল/ ল্যামডা সাইহ্যালাথ্রিন/ ইমিডাক্লোপ্রিড) গ্রুপের কীটনাশক দিয়ে ভালোভাবে সমস্ত গাছ ধুয়ে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে গাছে বসবাসকারী হপার পোকাসহ অন্যান্য পোকার আক্রমণ হতে আমকে রক্ষা করা যাবে। আমের মুকুল যখন ১০-১৫ সেন্টিমিটার লম্বা হবে কিন্তু ফুল ফোটবে না তখন দ্বিতীয়বার (একটি কীটনাশক ও সালফার জাতীয় ছত্রাকনাশক) একত্রে মিশিয়ে ¯েপ্র করতে হবে ফলে পু®পমঞ্জরির বৃদ্ধি ও ফুটন্ত ফুলকে রক্ষা করা সম্ভব হবে এবং আমের গুটি মটরদানার সমান হলে তখন তৃতীয়বার কীটনাশকের সাথে মেনকোজেব (প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে)/কার্বেনডাজিম (প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে) গ্রুপের ছত্রাকনাশক নির্দেশিত মাত্রায় ¯েপ্র করতে হবে। কারণ আমের গুটি বাঁধার পর এ্যানথ্রাকনোজ রোগ দেখা যায় ফলে গুটির উপর কালো কালো দাগ হয় ও পরে গুটি ঝরে পড়ে। আমের মুকুলের ফুল ফোটার পর কোন অবস্থাতেই ¯েপ্র করা যাবে না।  আমের পরাগায়ন প্রধানত মাছি ও মৈামাছি দ্বারা হয়ে থাকে। তাই ফুল ফোটার পর কীটনাশক ¯েপ্র করলে মাছি মারা যেতে পারে এবং আমের পরাগায়ন ও ফলধারণ মারাত্মকভাবে ব্যহত হতে পারে। বর্তমানে বাগানে পরাগায়নে সহায়তাকারী কীটপতঙ্গের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। অতিরিক্ত কীটনাশক ¯েপ্রর ফলে এমনটি হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলা দরকার, কোন বাগানে ফল ছিদ্রকারী পোকা ও মাছি পোকার আক্রমণ দেখা দিলে তা দমনের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। ¯েপ্র করে পোকা দুইটিকে সম্পূর্ণভাবে দমন করা কঠিন। এইক্ষেত্রে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তিটি সবচেয়ে কার্যকরী এবং লাভজনক। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে রোগ ও পোকার আক্রমণ শতভাগ কমানো যায়। তবে ¯েপ্র করার সময় যে বিষয়টি মনে রাখতে হবে তা হলো সঠিক বালাইনাশক নির্বাচন করে নির্দেশিত মাত্রায় উপযুক্ত সময়ে এবং সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে আমের বৃদ্ধি পর্যায়ে তাপমাত্রা বেশি থাকে। উপরন্তু ঘন ঘন কীটনাশক ¯েপ্র করার ফলে আমগাছ ও আমের বিভিন্ন সমস্যা হতে দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও অধিক মাত্রায় ¯েপ্র করার ফলে আমের গুণগতমান কমে যায় এবং মানুষের স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। সঠিক বাগান ব্যবস্থাপনা না করে শুধুমাত্র ¯েপ্র করে আমে ফলন বাড়ানো সম্ভব নয়।
নিরাপদ আম চাষের ব্যাপারে সঠিক পরামর্শের জন্য স্থানীয় কৃষি কর্মী বা আম গবেষণা কেন্দ্রে যোগাযোগ করা উচিত। একই কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক বার বার ¯েপ্র্র না করে মাঝে মাঝে পরিবর্তন করা উচিত কারণ একই ঔষধ বার বার ¯েপ্র্র করলে পোকা বা রোগের জীবাণুর প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যেতে পারে। কুয়াশাছন্ন আবহাওয়া ও প্রখর রৈাদ্রে ¯েপ্র না করাই উত্তম। গাছ থেকে ফল সংগ্রহের ১৫-২০ দিন মধ্যে গাছে কোন বালাইনাশক ¯েপ্র্র করা উচিত নয়। সম্পূর্ণ ফুল ফোটা শেষ হলে মাটির অবস্থা বুঝে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। মৌসুমী বৃষ্টি আরম্ভ হওয়া পর্যন্ত আমগাছে প্রতি মাসে একবার সেচ দেওয়া উত্তম। উল্লিখিত বিষয়গুলোর প্রতি নজর দিলেই ভালোমানের আম উৎপাদন সম্ভব হবে।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বারি, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭১২১৫৭৯৪৯

 

বিস্তারিত
অনুপুষ্টির চাহিদা পূরণে ন্যূনতম খাদ্য বৈচিত্র্য

অনুপুষ্টির চাহিদা পূরণে ন্যূনতম
খাদ্য বৈচিত্র্য
তাসনীমা মাহজাবীন
আমাদের জীবনের বিভিন্ন বয়সে পুষ্টির চাহিদা বিভিন্ন রকম হয়। শিশুর জন্মের পর তার পুষ্টি চাহিদা একধরনের থাকে এরপর  যখন সে বাড়তে থাকে তখন তার চাহিদার পরিবর্তন হয়। শরীরের পুষ্টির চাহিদা পূরণে প্রতিদিনের খাদ্য গ্রহণ বৈচিত্র্যপূর্ণ হতে হবে এতে আমাদের শরীরের প্রতিদিনের অনুপুষ্টির (গরপৎড়হঁঃৎরবহঃ) চাহিদা পূরণ হয়, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ঋঅঙ), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ)  এই অনুপুষ্টি গ্রহণের মাত্রা পরিমাপের জন্য মহিলা এবং শিশুদের ন্যূনতম খাদ্য বৈচিত্র্য বা  গরহরসঁস উরবঃধৎু উরাবৎংরঃু (গউউ)’ স্কোর সুপারিশ করেছে।
মহিলাদের  ন্যূনতম খাদ্য বৈচিত্র্য
মহিলাদের ন্যূনতম খাদ্যবৈচিত্র (গউউ ভড়ৎ ড়িসবহ) বলতে বোঝানো  হয়েছে  নারীদের, বিশেষ করে একজন ১৫-৪৯ বছর বয়সের (জবঢ়ৎড়ফঁপঃরাব ধমব) নারীকে প্রতিদিন খাবারে নি¤েœালিখিত ১০ ধরনের খাদ্য শ্রেণি থেকে অন্তত ৫ ধরনের খাদ্য কমপক্ষে ১৫ গ্রাম পরিমান খেতে হবে। এতে তার প্রতিদিনের অনুপষ্টি চাহিদা অনেকাংশে পূরণ হবে।  খাদ্য শ্রেণিগুলো হলো: সব ধরনের শর্করা বহুল প্রধান খাদ্য (যেমন: ভাত, গম, ভুট্টা, রুটি); ডালজাতীয় খাদ্য (যেমন: ছোলা, সব ধরনের ডাল); বাদাম ও বীজ (যেমন: চীনাবাদাম, তিল, নারকেল); দুধ ও দুধজাতীয় খাদ্য; আমিষ জাতীয় খাদ্য (যেমন: মাছ এবং মাংস); ডিম; গাঢ় সবুজ পাতা জাতীয় শাকসবজি (সবুজশাক ও লালশাক); অন্যান্য ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ শাকসবজি ও ফল (যেমন: গাজর, মিষ্টিকুমড়া); অন্যান্য শাকসবজি (যেমন: বেগুন, লাউ); অন্যান্য ফল (যেমন: কলা, পেয়ারা, আমড়া, আমলকী)।
গউউ স্কোর নির্ণয় : আমরা খুব সহজেই নিজেদের গউউ স্কোর নির্নয় করতে পারি, যদি আমরা এই প্রতিটি শ্রেণী থেকে গত ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ১টি খাবার খেয়ে থাকি তাহলে প্রতিটি খাদ্য শ্রেণির অনুকূল নির্দিষ্ট নম্বর প্রাপ্ত হবো (যেমন সব ধরনের শর্করা শ্রেণিতে ভাত বা রুটি খেলে প্রাপ্ত নম্বর হবে ১ (এক) আর  না খেলে ০ (শূন্য) )। এভাবে যদি সর্বমোট স্কোর ১০ এর মধ্যে ৫ এর নিচে হয় তাহলে খাদ্য বৈচিত্র্য  প্রতিদিনের অনুপুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট না, ৫ হতে যতো বেশি স্কোর হবে ততটাই খাদ্য গ্রহণের বৈচিত্র্যতা নির্দেশ করবে।
শিশুদের ন্যূনতম খাদ্য বৈচিত্র্য : একজন শিশু জন্ম গ্রহণের পর পরবর্তী দুই (২) বছর মাতৃদুধের পাশাপাশি প্রয়োজন অনুযায়ী সুষম খাদ্য দিতে হবে। এই ধারাবাহিক খাদ্যাভাসকে  এককথায় ওহভধহঃ ধহফ ণড়ঁহম পযরষফ ভববফরহম (ওণঈঋ) বলা হয়ে থাকে। জন্মের প্রথম একঘণ্টার মধ্যে  মাতৃস্তন থেকে প্রথমাবস্থায় যে আঠালো ঘন হলুদ বর্ণের দুধ (শাল দুধ) বের হয় তা অবশ্যই শিশুকে  খেতে দিতে হবে। এরপর প্রথম ছয় মাস শিশুকে  যথানিয়মে শুধুমাত্র মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে,  পরবর্তীতে ৬ মাসের পর থেকে তার শারীরিক, মানসিক  বৃদ্ধি ও  প্রয়োজনীয় বাড়তি পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য মায়ের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার (পরিপূরক খাবার)  দিতে হবে। সেখানে নিন্মোলিখিত ৮টি খাদ্য শ্রেণির মধ্যে কমপক্ষে ৫টি বা তার বেশি খাদ্য শ্রেণি (মায়ের দুধ ও অন্য চারটি খাদ্য শ্রেণি) থেকে খাদ্যগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। একে বলা হয় শিশুদের ন্যূনতম খাদ্য বৈচিত্র্য বা গরহরসঁস উরবঃধৎু উরাবৎংরঃু ভড়ৎ পযরষফৎবহ।
উল্লিখিত ৮টি খাদ্যশ্রেণি নিরূপণ
(১) মায়ের দুধ; (২) শস্য ও শস্যজাত খাবার, মূল এবং কন্দ; (৩) ডাল, বীজ ও বাদামজাতীয় খাবার; (৪) দুধ ও দুধজাতীয় খাবার যেমন- দৈ, পনির ইত্যাদি); (৫) মাছ-মাংসজাতীয় খাবার; (৬) ডিম; (৭) ভিটামিন এ জাতীয় ফল ও সবজি (যেমন: গাজর, মিষ্টিকুমড়া); (৮) অন্যান্য ফল ও সবজি।
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও জনমিতি জরিপ (ইউঐঝ) ২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী মাত্র ৩৯% শিশু ন্যূনতম খাদ্য বৈচিত্র্য অনুযায়ী দৈনন্দিন খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। তাই শিশুর  প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় সামর্থ্য অনুযায়ী দেশীয় সহজলভ্য বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্য হতে প্রাপ্ত উৎস দিয়ে পুষ্টি চাহিদা পূরণের ব্যাপরে সচেষ্ট হতে হবে।

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রধান কার্যালয়, বাংলাদেশ ফলিতপুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (বারটান)। মোবাইল : ০১৭৮১৮৮৭৮৮৫, ই-মেইল : mahjabin_79@yahoo.com

বিস্তারিত
বিপন্ন প্রজাতির মাছ রক্ষার্থে কৃত্রিম প্রজননের গুরুত্ব

বিপন্ন প্রজাতির মাছ রক্ষার্থে কৃত্রিম
প্রজননের গুরুত্ব  
ড. ডেভিড রিন্টু দাস১ শাহনাজ পারভিন২
কৃত্রিম প্রজনন কৌশলের মাধ্যমে পরিপক্ক মাছে একটি নিদ্দিষ্ট মাত্রায় হরমোন প্রয়োগ করে মাছকে প্রজননের জন্য প্ররোচিত করা হয়। এর ফলে একটি নিদ্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে মাছের ডিম্বানু (বমম) ও শুক্রানু (ঝঢ়বৎস) বের হয়। এই কৌশলে পিটুইটারি হরমোন বা অন্য কোন কৃত্রিম হরমোন প্রয়োগ করে মাছকে প্রজননের জন্য উদ্দীপিত করা হয়। কৃত্রিম প্রজনন হ্যান্ড-স্ট্রিপিং (ঐধহফ ংঃৎরঢ়ঢ়রহম) অথবা আধাপ্রাকৃতিক প্রজননের (ঝবসর-হধঃঁৎধষ নৎববফরহম) মাধ্যমে করা যায়। হ্যান্ড-স্ট্রিপিং পদ্ধতিতে মাছের পেট চেপে ডিম্বানু ও শুক্রাণু বের করে একটি ট্রেতে নিয়ে পালকের সাহায্যে মেশানো হয় যা কষ্টসাধ্য। অপরদিকে আধাপ্রাকৃতিক পদ্ধতিতে প্রজনন ট্যাংকে হরমোন প্ররোচিত মাছকে ছেড়ে দিলে তারা নিজেরাই ডিম্বানু ও শুক্রাণু ছেড়ে দেয়। এই পদ্ধতি বেশি সুবিধাজনক। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ভালো মানের পোনা পাওয়া যায়। যদি কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ৫০ শতাংশ ডিমেরও রেণু পোনা পাওয়া যায় তাও  কৃত্রিম প্রজনন অনেক লাভজনক। কারণ আমরা জানি প্রাকৃতিক প্রজনের মাধ্যমে যে ১-২ শতাংশ রেণু বা পোনা পাওয়া যায় তাও এখন অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে। এর বিভিন্ন কারণও রয়েছে। অন্যতম কারণ  প্রাকৃতিক প্রজনন স্থল (ঘধঃঁৎধষ নৎববফরহম মৎড়ঁহফ) নষ্ট হয়ে যাওয়া। আরও অনেক কারণের মধ্যে রয়েছে-
প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো থেকে নির্বিচারে মাছ আহরণ ফলে প্রজনন মৌসুমে ডিম ছাড়ার জন্য মাছ না থাকা; জলাশয় গুলো একেবারে শুকিয়ে ফেলে মাছ ধরা; জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতি ও আবহাওয়ার দীর্ঘ মেয়াদী পরিবর্তন। যার ফলে কোনো না কোনো প্রজাতি বিলুপ্তের পথে চলে যাচ্ছে; প্রাকৃতিক জলাশয়ের পরিমাণ কমে যাওয়া। জলাশয় গুলো ভরাট করে চাষের জমি ও আবাসস্থলে পরিণত করা; অবৈধ্য জালের যথেচ্ছা ব্যবহার; চাষের জমিতে নিয়ম না মেনে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার; অপরিকল্পিতভাবে রাস্তাঘাট নির্মাণ ; নদীতে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণ ; নদীতে কারখানার বজ্র নিষ্কাশন; মৎস্য সংরক্ষণ আইন অমান্য করে মাছ ধরা; নদীর নাব্যতা হ্রাস ও গতিপথ পরিবর্তন; জনসচেতনতার অভাব।
মাছের কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি
সাধারণত কৃত্রিম প্রজনন এর জন্য পুকুরে লালন-পালনকৃত মাছ হতে পরিপক্ব স্ত্রী ও পুরুষ মাছ বাছাই করতে হবে; এরপর পরিপক্ব স্ত্রী ও পুরুষ মাছ ১:২ অনুপাতে আলাদা আলাদা ট্যাংকে রাখতে হবে। পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে কৃত্রিম ঝর্ণা ব্যবহার করতে হবে; পুরুষ ও স্ত্রী মাছের বক্ষ পাখনার (চবপঃড়ৎধষ ভরহ) নিচে হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগ করতে হয়। হরমোন হিসেবে পিজি (চএ-চরঃঁরঃধৎু এষধহফ), ওভাপ্রিম (ঝ-এহজঐধ), ওভাটাইড (এহজঐ), এইচ সিজি (ঐঈএ-ঐঁসধহ পযড়ৎরড়হরপ মড়হধফড়ঃৎড়ঢ়রহ) প্রয়োগ করা হয়। শুরুর দিকে কৃত্রিম প্রজননের জন্য পিজি ব্যবহার করা হত কিন্তু পিজি সংগ্রহ করার জন্য মাছকে আত্নত্যাগ করতে হয়। কারণ মাছ ধরার পর মাছের মাথার অংশ হতে পিজি সংগ্রহ করতে হয় যা অনেকটা ব্যয় সাপেক্ষ। এর জন্যই সিনথ্যাটিক হরমোনের আর্বিভাব যার কার্যকারিতাও বেশি এবং সহজলভ্য। ফলে কৃত্রিম প্রজননে জনপ্রিয়তাও লাভ করেছে অতি দ্রুত; পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে একটি নির্দ্দিষ্ট মাত্রায় হরমোন প্রয়োগ করে ট্যাংকে নেট হাপা (ঐধঢ়ধ) স্থাপন করে উভয় মাছকে ছেড়ে দিতে হবে। হাপায় কৃত্রিম ঝর্ণার মাধ্যমে পানি সরবরাহ করতে হবে; ইনজেকশন প্রয়োগের পর মাছ ভেদে ডিম ছাড়ার (ঙাঁষধঃরড়হ) নির্দ্দিষ্ট সময় থাকে। মূলত ওভারি থেকে ডিম ছাড়ার প্রক্রিয়াকে ওভুলেশন বলে। ডিম ছাড়া শেষ হলে ব্রুড মাছ গুলোকে সরিয়ে ফেলতে হবে। ডিমগুলো হাপার দেয়ালে লেগে থাকে; বিভিন্ন মাছের রেণু প্রষ্ফুটনের বিভিন্ন সময় থাকে। ডিম নিষিক্ত হওয়ার পর রেণু হওয়ার মধ্যবর্তী এই সময়কে ইনকিউবেশন পিরিয়ড বলে। রেণু প্রস্ফুটনের পর রেণু/পোনা এক সপ্তাহ পরিচর্যা শেষে নার্সারি পুকুরে স্থানান্তর করতে হবে।
মাছের কৃত্রিম প্রজননের জন্য ব্যবহৃত কিছু হরমোন
বিপন্ন প্রজাতির মাছ রক্ষায় কৃত্রিম প্রজননের গুরুত্ব
অতীতে দেশের নদ-নদী, খাল-বিল ও প্লাবনভূমিতে প্রচুর পরিমাণ দেশীয় নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত; পরবর্তী সময়ে কিছু প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট কারণে মাছের উৎপাদন, জীববৈচিত্র হ্রাস পেয়েছে এবং অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে; আমাদের ২৬০ প্রজাতির মাছ রয়েছে মিঠাপানিতে। এরমধ্যে ১৪৩ প্রজাতির ছোট মাছ রয়েছে। আইইউসিএন (২০১৫) এর তথ্য অনুযায়ী দেশে মিঠাপানির ৬৪ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়; এসব বিপন্ন প্রজাতির মাছ পুনরুদ্ধার, সংরক্ষণ ও উন্নয়নে কৃত্রিম প্রজনন এক অনস্বীকার্য ভূমিকা পালন করছে; কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বিপন্ন প্রজাতির অনেক ছোট মাছ আবার বাঙ্গালীর খাবার টেবিলে ফেরত এসেছে; বিপন্ন প্রজাতির এসকল মাছ কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনলে মানব দেহের পুষ্টি চাহিদা অনেকাংশে পুরণ করা সম্ভব। এসকল মাছে প্রচুর পরিমাণ আমিষ, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ যেমনঃ আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ইত্যাদি থাকে যা দিয়ে মানব দেহ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়; বিপন্ন প্রজাতির মাছ পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ ছাড়াও কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পোনার চাষ সম্ভব। প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করলে মিশ্রিত পোনা হতে একক পোনা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আবার পর্যাপ্ত পোনাও পাওয়া যায় না। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমেই এই চাহিদা মেটানো সম্ভব; কয়েক দশক আগেও যেখানে মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ আহরণ হত এখন সেখানে বদ্ধ জলাশয় হতে দেশের মোট উৎপাদনের বেশির ভাগ মাছ আসে। নিচের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে এটি সহজেই অনুধাবন করা যায়।
২০২১-২০২২ অর্থবছরে মোট উৎপাদনের শতকরা হার : বদ্ধ জলাশয় (চাষ) ৫৭.৩৯; মুক্ত জলাশয় (স্বাদু) ২৭.৭৮, সামুদ্রিক জলাশয় ১৪.৮৩; কিন্তু ১৯৮৩-১৯৮৪ এর পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখি মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ আসত ৬২.৫৯ শতাংশ। এখন এত সংখ্যক চাষের মাছের পোনা তো আর প্রকৃতি থেকে আসে না। কৃত্রিম প্রজনন এর মাধ্যমেই এই পোনার সরবরাহ হয়; কৃত্রিম প্রজননের গুরত্ব আরো ভালোভাবে বুঝতে আমরা প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে কার্প জাতীয় মাছের রেণু/পোনার উৎপাদন পরিসংখ্যানের দিকে তাকাতে পারি। মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রকৃতি থেকে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে মাত্র ১৮৫৫ (০.২৯%) কেজি রেণু/পোনা পাওয়া গেছে। অপরদিকে কৃত্রিম প্রজনন করে পাওয়া গেছে ৬২৯৪৪১ (৯৯.৭১%) কেজি রেণু/পোনা। পরিসংখ্যান অনুসারে বিগত পাঁচ বছরের প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে কার্প জাতীয় মাছের রেণু/পোনার উৎপাদন গ্রাফ চিত্রে দ্রষ্টব্য।
বিএফআরআই (ইঋজও), বিলুপ্তপ্রায় মাছ ও কৃত্রিম প্রজনন  
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই দেশের মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে জোরদার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে; এরই ধারাবাহিকতায় বিপন্ন ও দেশী প্রজাতির মাছের উপর গবেষণা করে ৩৯টি মাছের কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি ও উন্নত চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে বিএফআরআই; যার ফলে সাম্প্রতিক কালে মাছের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পেযেছে এবং মাছের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে; বিএফআরআই এর স্বাদুপানি কেন্দ্র, ময়মনসিংহ, সান্তাহার, সৈয়দপুর ও যশোর উপকেন্দ্রে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বিপন্ন প্রজাতির মাছ সংরক্ষণে গবেষণা করে যাচ্ছে; বিএফআরআই কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বিভিন্ন মাছের পোনা (মেজর কার্প, এক্সোটিক কার্প, পাঙ্গাশ, থাই পাঙ্গাশ, বাটা, কই, শিং/মাগুর, গনিয়া, চিতল, গুলশা, পাবদা ইত্যাদি) উৎপাদন করে চাষীদের  মধ্যে বিনা মূল্যে সরবরাহ করে থাকে; বাংলাদেশে বিএফআরআই প্রথমবারের মতো দেশী ও বিপন্ন প্রজাতির মাছের লাইভ জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছসংগ্রহ করে সংরক্ষণ করাই হচ্ছে লাইভ জিন ব্যাংক; দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণে লাইভ জিন ব্যাংক এর গুরুত্ব অনেক। ভবিষ্যতে কোনো মাছের প্রকৃতিতে সংকট দেখা দিলে লাইভ জিন ব্যাংক থেকে মাছসংগ্রহ করে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে মাছকে পুনরুদ্ধার এবং সংরক্ষণ করা।  
দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ বাঙালির খাবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এসব মাছ ভিটামিন ও খনিজ পদার্থে ভরপুর। মানুষের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এই পুষ্টিগুণে ভরপুর এ খাদ্যটি থাকা অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এসকল দেশীয় মাছ আজ বিলুপ্তির পথে। বিপন্ন প্রজাতির এসকল মাছের প্রাপ্যতা বৃদ্ধির জন্য কৃত্রিম প্রজনন কৌশল এক পরম আর্শীবাদ। কৃত্রিম প্রজনন এর মাধ্যমেই বিভিন্ন বিপন্ন প্রজাতির মাছ আবার বাঙালীর পাতে ফেরত এসেছে। বাজারে প্রাচুর্যতাও বেড়েছে যা অবদান রাখছে সামগ্রিক মৎস্য উৎপাদনেও। সুতরাং কৃত্রিম প্রজননকে গবেষণার মাধ্যমে আরও উন্নত প্রযুক্তিময় করে তুলতে হবে। সেই সাথে কৃত্রিম প্রজনন কৌশলের যে সকল সীমাবদ্ধতা আছে তা নিরুপন করার চেষ্টা করতে হবে।

লেখক : ১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, প্লাবনভূমি উপকেন্দ্র, সান্তাহার,বগুড়া। মোবাইল : ০১৭১১৪২২১১৭,  ২বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, প্লাবনভূমি উপকেন্দ্র, সান্তাহার,বগুড়া। মোবাইল : ০১৭১৮৫৪৩৩৮৭, ই-মেইল :etee2407@gmail.com

বিস্তারিত
সুস্বাদু মাংসের উৎস হিসেবে পেকিন হাঁস পালন : সুযোগ ও সম্ভাবনা

সুস্বাদু মাংসের উৎস হিসেবে পেকিন
হাঁস পালন : সুযোগ ও সম্ভাবনা
ডা: মোঃ সোলায়মান হোসাইন১ মোঃ শাহরিয়ার হায়দার২ শাহরিয়ার আল মাহমুদ৩
কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করে চলেছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শীর্ষ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। পল্লী এলাকার জনগণের আর্থিক সক্ষমতাকে বৃদ্ধি করতে বরাবরই সম্ভাবনাময় কৃষি প্রযুক্তি, নতুন জাত প্রভৃতি নিয়ে গ্রামীণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে পিকেএসএফ। কেবলমাত্র নতুন প্রযুক্তি সম্প্রসারণই ৯ সদস্যদেরকে কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারের সহযোগী হিসাবে কাজ করছে জাতীয় ও আন্তর্জাাতিক পরিম-লে সুপরিচিত এ প্রতিষ্ঠান। প্রাণিসম্পদ খাতে এমনই একটি সম্ভাবনাময় উপখাত হলো সুস্বাদু ও অধিক মাংস উৎপাদনশীল পেকিন জাতের হাঁসের খামার স্থাপন কার্যক্রম। আমাদের স্থানীয় জাতের অধিকাংশ হাঁসই সুস্বাদু ও অধিক মাংস উৎপাদনশীল নয়, এগুলো মূলত ডুয়াল টাইপ অর্থাৎ একই সাথে ডিম এবং মাংস উভয়ই উৎপাদন করে থাকে। এ জাতীয় হাঁস বছরে গড়ে ১২০টি ডিম দেয় ওজন হয় ১.৫ থেকে সর্বোচ্চ ২.০ কেজি এবং এ ওজন হতে সময় লাগে ন্যূনতম ৬-৭ মাস। এ সকল হাঁসে মাংসের পরিমাণ কম থাকায় হাড়ের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি হয়, ফলে ভোজন রসিকদের তৃপ্তি পরিপূর্ণতা পায় না। দেশে ক্রমবর্ধমান হাঁসের মাংসের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আঞ্চলিক হাঁস প্রজনন খামার ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সুস্বাদু ও অধিক মাংস উৎপাদনশীল পেকিন জাতের হাঁসের প্যারেন্ট স্টক আমদানি করছে এবং বাচ্চা উৎপাদন করে খামারি পর্যায়ে সরবরাহ করছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ জাতের হাঁস সম্প্রসারণে সরকারের পরিপূরক হিসেবে পিকেএসএফ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে। পেকিন জাতের হাঁসের উৎপত্তিস্থল চীন দেশ হলেও বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অধিক উৎপাদনশীল স্ট্রেইন উৎপাদন ও বিপণন করে আসছে।
পেকিন হাঁসের বৈশিষ্ট্য
    দেশি হাঁসের তুলনায় আকারে প্রায় দ্বিগুণ, ধবধবে সাদা পালকে আবৃত শরীর এবং ঠোট ও পায়ের পাতা কমলা রঙের;
    আট সপ্তাহ বয়সে পুরুষ হাঁসের ওজন সর্বোচ্চ ৪ কেজি এবং মাদি হাঁসের ওজন ৩.৭ কেজি হয়ে থাকে;
    এ জাতের হাঁসের খাদ্যকে মাংসে রূপান্তর করার দক্ষতা প্রায় ২.৭; এবং
    এ জাতের হাঁস পালনে পুকুরের কোন  প্রয়োজনীয়তা নেই বরং মাচা পদ্ধতিতে মুরগির মতো পালন করা যায়।
পেকিন জাতের হাঁস পালনে করণীয় বিষয়সমূহ
বাচ্চা সংগ্রহ ও পরিবহন : গুণগত মানসম্পন্ন পেকিন জাতের হাঁসের বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে। সরকারি হাঁসের খামারসহ সুনাম আছে এমন হ্যাচারি হতে সুস্থ সবল বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে। বাচ্চা উৎপাদনকারীর নিকট হতে বাচ্চার দৈহিক বৃদ্ধি সম্পর্কিত তথ্য, খাদ্য রূপান্তরের দক্ষতা হার, বাচ্চা মৃত্যুর হার ইত্যাদি বিষয়ে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। বিশেষত নাভি শুকানো বাচ্চা দেখে নিতে হবে। বাচ্চা পরিবহনের সময় গাড়িতে অতিরিক্ত ঝাঁকুনি লাগানো যাবে না এবং প্রখর সূর্যের আলো থেকে রক্ষা করতে হবে।
আবাসন ব্যবস্থাপনা : সর্বোচ্চ উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করতে হলে মাচা পদ্ধতিতে পালন করা উত্তম। বাচ্চা সংগ্রহের পূর্বেই ঘর পরিষ্কার করে জীবাণুনাশক দিয়ে ঘর ও লিটার স্প্রে করতে হবে। বাচ্চা তোলার ১২ ঘণ্টা পূর্বেই চিকগার্ডের ভেতরে এক ইঞ্চি পরিমাণ উঁচু করে লিটার বিছিয়ে তাপ দেবার জন্য ব্রুডার চালু রাখতে হবে। সর্বোচ্চ ২৫০টি বাচ্চার জন্য একটি ব্রুডার দিলে সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য ব্রুডারের নিচে থার্মোমিটার রাখতে হবে। প্রতি ১০০টি বাচ্চার জন্য ৫-৬টি ছোট গোলাকার খাদ্য পাত্র এবং ৫টি পানির পাত্রের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ব্রুডারে ছাড়ার পর বাচ্চাকে প্রথম ৫-৬ ঘণ্টা স্যালাইন ও ভিটামিন-সি মিশ্রিত পানি খাওয়াতে হবে এবং একইসাথে স্টাটার ক্রাম্বল ফিড সরবরাহ করতে হবে। এ সময় ব্রুডারে বাচ্চার অবস্থান দেখে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বাচ্চার ব্রুডিং বা তাপ ব্যবস্থাপনা : হাঁসের বাচ্চাকে ৭-১০ দিন বয়স পর্যন্ত কৃত্রিম উপায়ে তাপ প্রদান করাকে ব্রুডিং বলে। এ সময়ে সাধারণত ব্রুডারের তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখতে হয় এবং ২৪ ঘণ্টা আলো প্রদান করতে হয়।
হাঁসের ঘর নির্মাণ : বন্যা বা বৃষ্টিতে পানি জমে না এমন উঁচু জমিতে মাটি হতে ২.৫ ফুট উঁচুতে মাচা তৈরি করতে হবে। ঘরের বেড়া প্লাস্টিক বা লোহার তারের জালি এবং টিনের চালা দেয়া যেতে পারে। প্রতি ১০০টি পেকিন জাতের হাঁসের জন্য ২০ হাত লম্বা (৩০ ফুট) এবং ৭ হাত (১০ ফুট) চওড়া ঘর হলে ভালো হয়। ঘরে এমনভাবে বেড়া দিতে হবে যাতে হাঁসের শরীরে পর্যাপ্ত বাতাস লাগে। ঘরের চতুর্দিকে ৪-৫ ফুট দূরত্বে নেট দিয়ে বেড়া দিয়ে বাফার এলাকা নির্মাণ করে দিলে খামারে রোগের সংক্রমণ অনেকাংশে হ্রাস পায়।
তাপ ও আলোক ব্যবস্থাপনা : বয়স অনুযায়ী পেকিন হাঁসের তাপ ও আলোক ব্যবস্থাপনা নিম্নে দেয়া হল-
খাদ্য ব্যবস্থাপনা : সাধারণত মাংস উৎপাদনশীল জাতের হাঁসকে প্রথম সপ্তাহে ক্রাম্বল এবং ২য় হতে ৮ম সপ্তাহ পর্যন্ত পিলেট জাতীয় খাদ্য সরবরাহ করতে হবে এবং যতটুকু খাবার খেতে পারে ততটুকু খাবার সরবরাহ করতে হয়। ঋববফ ঈড়হাবৎংরড়হ জধঃরড় (ঋঈজ) এর দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। কাক্সিক্ষত ওজন নিশ্চিত হচ্ছে কি-না তা যাচাই করার জন্য দৈবচয়ন ভিত্তিতে হাঁসের ওজন করে দেখতে হবে। খামারের জন্য ক্রয়কৃত খাদ্য শুকনা জায়গায় রাখতে হবে। দুই সপ্তাহ সময়ের বেশি সময় খাদ্য মজুদ করে না রাখাই উত্তম, কেননা এতে মোল্ড বা ছত্রাকের সংক্রমণ ঘটতে পারে। পোকামাকড় বা ইদুর দ্বারা খাদ্য যেন দুষিত না হয় সে বিষয়টিতে গুরুত্বারোপ করতে হবে।
পানি ব্যবস্থাপনা : হাঁস যতটুকু খাদ্য খায় তার দ্বিগুণ পরিমাণ পানি পান করে। তাই হাঁসের খামারে সার্বক্ষণিক পরিষ্কার ও পানযোগ্য পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং পানির পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে।  
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা : খামারের অভ্যন্তরে যেন বাইর হতে কোন জীবাণু প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যবস্থা রাখতে হবে আর খামারে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ থাকবে। প্রতিবার খামারে প্রবেশের পূর্বে ও পরে হাত-পা জীবাণুনাশক স্প্রে করে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। খামারে উৎপাদিত বর্জ্য নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। খামারে কোন হাঁস অসুস্থ হলে সেটিকে দ্রুত সুস্থ হাঁস হতে পৃথক করতে হবে। খামারে জটিল কোন সমস্যা হলে সাথে সাথে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে এবং নিম্নোক্ত টিকা প্রদান কর্মসূচি অনুসরণ করতে হবে-
মূলত দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বেকারত্ব হ্রাসে পেকিন জাতের হাঁস পালন একটি উল্লেখযোগ্য আয় বর্ধনমূলক কর্মকা- হতে পারে। এ হাঁস পালন করলে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ (যাদের কাছে থেকে উপকরণ বা উপাদান সংগ্রহ করে উৎপাদনের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করা হয়) এ পেকিন জাতের হাঁসের বাচ্চা উৎপাদন ও বিপণন, খাদ্য উৎপাদনকারী ও বিপণনকারী, ভ্যাকসিন উৎপাদন, ভ্যাকসিন প্রয়োগকারী এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদানকারী খাত যেমন গতিশীলতা অর্জন করতে পারে অপরদিক ফরোয়ার্ড লিংকেজ (যাদের মাধ্যমে ভোক্তার নিকট উৎপাদনকারী কর্তৃক উৎপাদনকৃত জিনিস পৌঁছায়) এর আওতায় পাইকার-ফড়িয়া, হাঁস-মুরগি বিক্রেতা, সুপারশপ প্রভৃতি খাতও মজবুত ভিত্তি পেতে পারে আর ভোক্তা পেতে পারে নিরাপদ ও সুস্বাদু মাংস। ফলশ্রুতিতে উপকৃত হতে পারে সমগ্র প্রাণিসম্পদ খাত সংশ্লিষ্ট সকল ব্যবসায়ী ও ভোক্তাগণ। শত বিপত্তি উপেক্ষা করে এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হতে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি খাতের আন্তরিক সমন্বয়। পিকেএসএফের  আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় সদস্যপর্যায়ে বাস্তবায়িত প্রদর্শনীতে উৎপাদিত মাংস নিরাপদ, কেননা এ সকল ক্ষেত্রে বেস্ট ম্যানেজমেন্ট প্র্যাকটিস অনুসরণ করায় খামারে রোগের সংক্রমণ হয় না বললেই চলে। খামারে যদি কোন কারণে রোগের বিস্তার ঘটে তাহলে রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারিয়ান দ্বারা চিকিৎসা প্রদান করা হয়। এন্টিবায়োটিক ঔষধ প্রয়োগ করা হলে ন্যূনতম মেয়াদের উইথড্রল পিরিওড (ঔষধ প্রত্যাহারকাল) অনুসরণ করা হয় যেন মাংসে কোন এন্টিবায়োটিক রেসিডিউ না থাকে। পিকেএসএফ এর সহযোগী সংস্থা নড়িয়া উন্নয়ন সমিতির (নুসা) সদস্য লাকিয়া বেগম, স্বামী: মজিবর হাওলাদার, কদমফুল মহিলা সমিতি, গ্রাম: সোন্ডা, ইউনিয়ন: ডিঙ্গামানিক, উপজেলা: নড়িয়া, জেলা: শরীয়তপুর কর্তৃক ৬০ দিন মেয়াদে পেকিন হাঁস পালন সংক্রান্ত আয়-ব্যয়ের তথ্য সারণি-১ দ্রষ্টব্য।লেখক : ১মহাব্যবস্থাপক, ২ব্যবস্থাপক এবং ৩উপ-ব্যবস্থাপক, সমন্বিত কৃষি ইউনিট, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), আগারগাঁও, ঢাকা-১২০৭। মোবাইল নম্বর: ০১৬৮২ ৭৫৮৫২৬; ই-মেইল:shahriar67bau@gmail.com;;

বিস্তারিত
জলবায়ু পরিবর্তনে গবাদি পশু-পাখির উপর প্রভাব এবং অভিযোজন কলাকৌশল

জলবায়ু পরিবর্তনে গবাদি পশু-পাখির উপর
প্রভাব এবং অভিযোজন কলাকৌশল
ডা. মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ
জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের দেশ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে। প্রতি বছর বন্যা ও জলাবদ্ধতায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। মানুষ হারাচ্ছে তাদের ফসল ও গবাদি পশু-পাখি। একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে সর্বস্বান্ত হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ। পার্বত্যঞ্চলে পাহাড়-ধসে ঘটছে জীবনহানির ঘটনা। বিভিন্ন ধরনের  প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা, অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, প্রবল বায়ুপ্রবাহ প্রভৃতি কারণে পশুপাখির ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফলে খামার মালিক বা কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এ ক্ষতির পরিমাণ অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের বাস্তবতা মেনে নিয়েই সামুদ্রিক ঝড়, টর্নেডো, বন্যা, খরা, পাহাড়ি ঢল, অতিবৃষ্টি ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধে বনাঞ্চলের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছাড়াও উপকূলীয় বনায়ন পরিকল্পনা, পার্বত্য চট্টগ্রামের অশ্রেণিভুক্ত বনাঞ্চলের বনায়ন সম্প্রসারণ, দেশের নদ-নদী খাল উদ্ধার ও পুনঃখনন এবং ছোট বড় পাহাড় রক্ষায় পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দেশে সামাজিক বনায়ন সম্প্রসারণসহ ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। এগুলো হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি স্থায়ী ব্যবস্থা। এসব বাস্তবায়নের পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হলে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে দেশ তথা পশু-পাখি রক্ষা করা যাবে। নি¤েœ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গবাদি পশু-পাখি পালনে প্রধান সমস্যাগুলো তুলে ধরা হলো -
খরাজনিত সমস্যা
খরায় যে সকল সমস্যা দেখা যায় সেগুলো হচ্ছে- কাঁচা ঘাসের অভাব দেখা দেয়; সুপেয় পানির সংকট দেখা দেয়; গবাদিপশু অপুষ্টিতে ভোগে; গবাদিপশুর বিভিন্ন রোগব্যাধি দেখা দেয়; মাঠ-ঘাটের ঘাস শুকিয়ে যায়; পশুর বহিঃদেশের (ঊীঃবৎহধষ) পরজীবীর উপদ্রব বৃদ্ধি পায়; অধিক তাপ পশুপাখির জন্য অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি করে; গবাদিপশুর স্বাস্থ্যের অবনতিসহ মৃত্যুর আশঙ্কা দেখা দেয়; তাপপীড়নে (ঐবধঃ ংঃৎবংং) খামারে ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির মৃত্যু হয়।
বন্যাজনিত সমস্যা
বন্যা পরিস্থিতিতে যে সকল সমস্যা দেখা যায় সেগুলো হচ্ছে- জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়; দেশের অধিকাংশ এলাকা পানিতে ডুবে যায়; রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটে; গো-খাদ্যের সংকট দেখা দেয়; পানি দূষিত হয়; পশুপাখি রক্ষণাবেক্ষণে সমস্যার সৃষ্টি হয়; গবাদি পশু অপুষ্টিতে ভোগে; বিভিন্ন সংক্রামক রোগ ও কৃমির আক্রমণ বৃদ্ধি পায়; ঘাসে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়, গবাদিপশু অসুস্থ হয়ে পড়ে; পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর হয়, অনেক পশুর মৃত্যু হয়।
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসজনিত সমস্যা
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় যে সকল সমস্যা দেখা যায় সেগুলো হচ্ছে- ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে বহু গবাদিপশু ও জীবজন্তু তাৎক্ষণিক মারা যায়; জলোচ্ছ্বাস-কবলিত এলাকার পানি দূষিত হয়ে সুপেয় পানির অভার দেখা দেয়; সৎকারের অভাবে মৃত পশুপাখি পচে বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি করে পরিবেশ দূষিত করে; পশু খাদ্যের সংকট দেখা দেয়; জীবিত গবাদিপশু উদরাময়, পেটের পীড়া ও পেট-ফাঁপাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে গবাদি পশু-পাখির অভিযোজন কলাকৌশল
কোনো প্রজাতি তার পরিবেশে নিজেকে খাপখাইয়ে নেওয়ার কৌশলকে অভিযোজন বলে। তাই অভিযোজন পরিবেশের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ ও বায়ুর উপাদান, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ঐসব স্থানের উচ্চতা এবং জীবের শারীরিক গঠন ও দৈহিক অবস্থা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। অভিযোজনের এসব উপাদান মোকাবিলা করেই জীব তার অবস্থানে টিকে থাকে। এটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। প্রতিকূল ও বিরূপ পরিবেশে পশু-পাখির অভিযোজনের জন্য মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন। তাই খরা, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসজনিত সমস্যা সমাধানের উপর অধিক গুরুত্ব¡ দিতে হবে।
খরায় পশু-পাখি রক্ষার কৌশল : অধিক উৎপাদন ও খরা সহনশীল জাতের ঘাস চাষ বাড়াতে হবে। কাঁঠাল, ইপিল-ইপিল,বাবলাসহ বিভিন্ন গাছ-পাতার চাষ বৃদ্ধি করতে হবে এবং খরার সময় এসব গাছের পাতা পশুকে খাওয়াতে হবে; খরার সময় পশুকে ভাতের ফেন, তরকারির উচ্ছিষ্ট অংশ, কুঁড়া, গমের ভুসি, ডালের ভুসি, খৈল, ঝোলাগুড় পর্যাপ্ত পরিমাণে খাওয়াতে হবে; গবাদিপশুকে নিয়মিত সংক্রামক রোগের টিকা দিতে হবে; পশুকে কাঁচা ঘাসের সম্পূরক খাদ্য (যেমন - সবুজ অ্যালজি) খাওয়াতে হবে; খরা মৌসুম আসার পূর্বেই ঘাস দ্বারা সাইলেজ ও হে তৈরি করে রাখতে হবে। যা খরা মৌসুমে গবাদিপশুকে খাওয়ানো যাবে; গবাদিপশুকে শুষ্ক খড় না খাইয়ে ইউরিয়া দ্বারা প্রক্রিয়াজাত খড় ও ইউরিয়া মোলালেস ব্লক খাওয়ানো যেতে পারে; গবাদিপশুকে পর্যাপ্ত দানাদার খাদ্য দিতে হবে; পশুকে বেশি করে পরিষ্কার পানি পান করাতে হবে; পশুকে নিয়মিত গোসল করাতে হবে; পশুর শরীর সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে; গবাদিপশুকে পরজীবী প্রতিরোধে নিয়মিত কৃমিনাশক ঔষধ খাওয়াতে হবে; পশুকে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে এবং প্রখর রোদে নেওয়া যাবে না।
বন্যায় পশু-পাখি রক্ষার কৌশল: গবাদিপশুকে যথাসম্ভব উঁচু ও শুকনো জায়গায় রাখতে হবে; গবাদিপশুকে পরিষ্কার পানি খাওয়াতে হবে, গবাদিপশুর মৃতদেহ গর্তে পুঁতে ফেলতে হবে; বন্যার সময় গবাদিপশুকে খাদ্য হিসাবে খড়, চালের কুঁড়া, ভুসি ও খৈল বেশি করে খাওয়াতে হবে; এ সময় কচুরিপানা, দলঘাস, লতাগুল্ম এমনকি কলাগাছও গবাদিপশুকে খাওয়ানো যেতে পারে; কাঁচা ঘাসের বিকল্প হিসাবে হে ও সাইলেজ খাওয়ানো যেতে পারে; বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে পতিত জমিতে বিভিন্ন জাতের ঘাসের বীজ ছিটিয়ে দিতে হবে; গবাদিপশুকে সংক্রামক রোগের টিকা দিতে হবে ও কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে।
ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে পশু-পাখি কলাকৌশল : উঁচুস্থানে গবাদি পশু-পাখির বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে; ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের সংকেত পাওয়ার সাথে সাথে গবাদিপশুকে উঁচু আশ্রয়স্থলে নিয়ে বেঁধে রাখতে হবে। সম্ভব হলে নিকটস্থ ‘মুজিব কেল্লায়’ নিয়ে যেতে হবে; ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের পর মৃত পশুকে দ্রুত মাটির নিচে চাপা দিতে হবে; এ সময় পশুর জন্য ভাতের মাড় ও ঝাউ, শুকনো খড় এবং দানাদার খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে; গবাদিপশুকে দানাদার খাদ্য যেমন-ভুসি, কুঁড়া, খৈল ও প্রয়োজন মতো লবণ খাওয়াতে হবে; গবাদিপশুকে কাঁচা ঘাসের পরিবর্তে বিভিন্ন গাছ-পাতা খাওয়াতে হবে; জলোচ্ছ্বাস কবলিত এলাকায় জরুরি ‘ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম’ গঠন করে পশুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে; গবাদিপশুকে নিয়মিত সংক্রামক রোগের টিকা দিতে হবে ও কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে; গবাদিপশুকে যাতে পঁচা দূষিত পানি খেয়ে রোগাক্রান্ত হতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে; প্রয়োজনে নিকটস্থ উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে।
গবাদিপশু অসুস্থ হলে ভেটেরিনারিয়ানের পরামর্শ মোতাবেক চিকিৎসা করাতে হবে; প্রয়োজনে নিকটস্থ উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে।

লেখক : ভেটেরিনারি সার্জন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর; কৃষি খামার সড়ক, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল-০১৮১১-৯৮৬৬০৫, ইমেইল-smmohibullah@gmail.com

বিস্তারিত
মাছের পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা

মাছের পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা
রোমানা ইয়াসমিন১ মেজবাবুল আলম২ মোঃ হাসিবুর রহমান৩
ঐতিহ্যগতভাবে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ নদী মাতৃক বাংলাদেশের চিরাচরিত প্রবাদ। মানব ইতিহাসের একেবারে আদিকালেও মাছ মানুষের খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয় ছিল। প্রায় চার শতের অধিক নদী, অসংখ্য খাল, বিল, হাওর, বাঁওড়, ডোবা, নালার বাংলাদেশে পাওয়া যায় নানা রং ও স্বাদের মাছ। আকার আকৃতিতে ও এরা যেমন বিচিত্র, নামগুলোও তেমনি নান্দনিক। এ সব মাছ সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও সহজপাচ্য। মাছের দিক দিয়ে বাংলাদেশ খুব সমৃদ্ধ। মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ সামনের কাতারে অবস্থান করছে। মৎস্য অধিদপ্তর (২০১৯) এর তথ্যানুসারে বাংলাদেশে জনপ্রতি বার্ষিক মাছ গ্রহণের পরিমাণ ২২.৮৪ কেজি, মাছের বার্ষিক চাহিদা ৪২.৩৮ লক্ষ মেট্রিক টন, জনপ্রতি মাছের বার্ষিক চাহিদা ২১.৯০ কেজি, জনপ্রতি মাছের দৈনিক চাহিদা ৬০ গ্রাম। বাংলাদেশে মাছের মোট উৎপাদন ৪২ লক্ষ ৭৬ হাজার ৬৪১ মেট্রিক টন। যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয় (আহরিত) থেকে আসে ১২,১৬,৫৩৯ মেট্রিক টন, অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয় (চাষকৃত) থেকে আসে ২৪,০৫,৪১৫ মেট্রিক টন এবং সমুদ্র থেকে আসে ৬,৫৪,৬৮৭ মেট্রিক টন। জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্য খাত এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। স্থুলজাতীয় উৎপাদনে এ খাতের অবদান শতকরা প্রায় ৩.৫ ভাগ এবং কৃষির উৎপাদনে শতকরা ২৫.৭১ ভাগ। জাতীয় রপ্তানি আয়ে মৎস্য খাতের শরিকানা শতকরা প্রায় ১.৫ ভাগ। আমাদের নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৬০ ভাগ সরবরাহ আসে মাছ থেকে। এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকা-ে প্রায় ১৩ লাখ শ্রমিক সার্বক্ষণিকভাবে এবং ১ কোটি ২৫ লাখ শ্রমিক খ-কালীনভাবে নিয়োজিত আছে। সুস্থ ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর জাতীয় উন্নয়নের পূর্বশর্ত ও শারীরিক সুস্থতার জন্য অন্যতম প্রধান শর্ত পরিমিত পরিমাণ সুষম খাদ্য গ্রহণ।
বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পুষ্টিগুণ
মাছ প্রাণিজ আমিষের প্রধান উৎস। আমিষ সরবরাহের পাশাপাশি মাছ বিভিন্ন খনিজ ও ভিটামিন সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমরা দৈনন্দিন যেসব খাবার গ্রহণ করি সেসব খাবার খাদ্য উপাদান অনুযায়ী যে ৬ ভাগে ভাগ করা যায় এর মধ্যে কিছু অ্যামাইনো এসিড ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ আমাদের শরীরের জন্য অত্যাবশ্যক মাছের। মাছের পেশিকলায় বা আমিষে ৬০-৮২% পানি, ১৩-২০% প্রোটিন এবং কম বেশি চর্বি থাকে (স্মারণি-১)। এগুলির জন্যই মাছ উপাদেয় খাদ্য এবং কেবল বাংলাদেশের মানুষেরই নয়, পৃথিবীর বহু জাতির কাছেও। উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরা যেন এক ধরনের শিকার। বাস্তবিকই, মাছ ধরা কৃষি কাজের চেয়েও পুরনো এবং মাছ সর্বদাই মানুষকে সুস্বাদু ও উচ্চমানের প্রোটিন সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
সুষম প্রাণিজ খাদ্য হিসেবে মাছে শর্করা, আমিষ, ¯েœহ, ভস্মসহ (খনিজ)  প্রচুর পরিমাণ শক্তি বিদ্যমান। প্রতি ১০০ গ্রাম মাছ থেকে ২৫০-১০৫০ কি.জু. শক্তি ১২.৩-১৮.৯ গ্রাম আমিষ ও ২০-১৮.৫ গ্রাম ¯েœহ পাওয়া যায়। যার মধ্যে সবচেয়ে কম কাঁচকি ও সবচেয়ে বেশি ইলিশ মাছ বিদ্যমান। প্রতি ১০০ গ্রাম মাছ থেকে প্রায় ০.৫-৪.২ গ্রাম ভস্ম (খনিজ) পাওয়া যায়। তন্মধ্যে, সবচেয়ে কম কাজুলী এবং সবচেয়ে বেশি খলিশা মাছ এ বিদ্যমান।
খাদ্য হিসেবে মাছের স্বাস্থ্য উপকারিতা
মাছকে বলা হয়ে থাকে নিরাপদ প্রোটিনের উৎস ও সহজে হজমযোগ্য। দৈনিক প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে মাংসের চেয়ে মাছের ভূমিকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের পাশাপাশি মাছের রয়েছে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধকারী উপাদান, নিয়মিত খেলে হার্ট, লিভার কিডনি ভালো থাকে ও ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। এক জরিপে দেখা যায় ৬৫ বছরের বেশি বয়সী নারীরা ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড গ্রহণের ফলে তাদের পেশিশক্তি প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। মাছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড থাকে, এ ছাড়াও এতে রয়েছে আয়রন, জিঙ্ক, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম, আয়োডিন, সেলেনিয়াম, পটাশিয়াম ইত্যাদি খনিজদ্রব্য ও ভিটামিন এ, ডি, ই এবং বি কমপ্লেক্স যা রোগ প্রতিরোধে মানুষের দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা মিটিয়ে নানা রোগ থেকে রক্ষা এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে (স্মারণি-২)।
বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে পুষ্টি চাহিদা পূরণে ও অপুষ্টি নিরসনে মানুষের খাদ্য তালিকায় মাছ অপরিহার্য ও নিরাপদ প্রোটিনের উৎস। মাছ সুষম পুষ্টি জোগানের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও এতে বিদ্যমান বিভিন্ন অ্যামাইনো এসিড, ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন ও খনিজ উপাদান সরবরাহ করে রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে সর্বোপরি, এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, কর্মসংস্থানে, দারিদ্র্য বিমোচনে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ বাস্তবায়ন কল্পে, অপুষ্টি নিরসনে, মৎস্য সম্পদের সঠিক ব্যবহার এবং প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি দূরীকরণে মৎস্য খাতের অবদান অনস্বীকার্য।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নদীকেন্দ্র, চাঁদপুর, মোবাইল : ০১৭১৭১১৫৫৫১, ই-মেইল : rumanabiva@yahoo.com

 

বিস্তারিত
বাংলাদেশে-বেবীকর্ন-চাষের-সম্ভাবনা-এবং-উপযোগিতা

বাংলাদেশে বেবীকর্ন চাষের সম্ভাবনা এবং উপযোগিতা
ড. নরেশ চন্দ্র দেব বর্মা
বেবীকর্ন একটি উপাদেয়, পুষ্টিকর ও কোলেস্টেরল মুক্ত সবজি এবং স্বল্পমেয়াদি অর্থকরী ফসল। ইহা ভুট্টার কচি মোচা যা সিল্ক বের হওয়ার পূর্বেই হ্ারভেস্ট করা হয় (অর্থাৎ ভুট্টার পরাগায়নের পূর্বেই) বেবীকর্নকে দুইধরনে (উঁধষ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব)  ফসল হিসেবে গণ্য করা হয় কারণ বেবীকর্ন থেকে একই সাথে বেবীকর্ন/কচি মোচা এবং ফডার/সাইলেজ পাওয়া যায়। বেবীকর্ন উৎপাদন ও রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে থাইল্যান্ড ও চায়না অন্যতম। বাংলাদেশেও বেবীকর্নের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়। তবে বাংলাদেশে কোন কোন জেলায় বেবীকর্নের আবাদ শুরু হয়েছে যার বাজার ঢাকাকেন্দ্রিক পাইকারি বাজার ও চেইনসপগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। তাছাড়া পাহাড়ি এলাকায় খাদ্য হিসেবে ভুট্টার প্রচলন বেশি।
বেবীকর্ন একটি কম-ক্যালোরি, কম-কোলেস্টেরল যুক্ত এবং উচ্চ ফাইবার সমৃদ্ধ সবজি। বেবীকর্ন ভিটামিন এ, বি, ইসহ পটাসিয়াম, ফলিক এসিড এবং বিভিন্ন খনিজ পদার্থের ভালো উৎস। সাধারণভাবে একটি বেবীকর্নের মোচাকে একটি ‘ডিম’ এর সাথে তুলনা করা হয়। বেবীকর্ন বিটা-ক্যারোটিন ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ তাই এটি অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ। ফলে বেবীকর্নের পুষ্টিগুণ কয়েকটি উচ্চমূল্যে সবজির সাথে তুলনা করা হয়। বেবীকর্নের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স স্বাভাবিক ভুট্টার চেয়ে কম যা ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণের জন্য উপকারী। তাজা/ফ্রেশ, হিমায়িত এবং টিনজাত বেবীকর্ন -এর চাহিদা আমাদের দেশে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। ফ্রেশ বেবীকর্ন তরকারি, আচার, সুপ পোলাও, বিরিয়ানি, মিক্সড সবজি, সালাদ এবং বিভিন্ন ¯œ্যাক্সস তৈরিতে ব্যবহার করা যায় যা খাদ্যের পুষ্টিমান ও স্বাদ বৃদ্ধি করে। বেবীকর্ন পানি, লবণ, চিনি, সিরকার দ্রবণে বায়ুরোধী ক্যানেও পাওয়া যায়, যা অনেক দিন ধরে ব্যবহার করা যায়।
বেবীকর্ন আদর্শ ফডার বেবীকর্ন গাছ থেকে তৈরি ফডার/সাইলেজ নরম, মজাদার, সহজ পাচ্য। তাই বেবীকর্ন গবাদিপশুর খামার এবং দুগ্ধ খামারেও সরাসরি অথবা সাইলেজ হিসেবে ব্যবহার হয়। বেবীকর্ন গাছের সবুজ ফডার দুগ্ধ-দায়ী গাভীর জন্য বিশেষভাবে উপকারী। তাছাড়া গাছের স্টক, শুকনা পাতা, মোচার খোসা ইত্যাদি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
বাংলাদেশের আবহাওয়া ও মাটি ভুট্টা তথা বেবীকর্ন আবাদের জন্য খুবই উপযোগী। বেবীকর্ন এবং সাধারণ ভুট্টার চাষ পদ্ধতি প্রায় একই। মিষ্টি ভুট্টা বা ফিল্ড কর্ন দুটো থেকেই বেবীকর্ন উৎপাদন করা যায়। তবে বেবীকর্ন উৎপাদনের জন্য ভালো জাত নির্বাচন করা জরুরি। বেবীকর্ন উৎপাদনের জন্য বিশেষ জাত ব্যবহার করা উত্তম। গত ২০২০ সালে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে বিডব্লিউএমআরআই হাইব্রিড বেবী কর্ন-১ নামে একটি বেবীকর্নের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। বেবীকর্ন চাষে ব্যতিক্রমী বিষয়গুলি নিম্নরূপ:
 গাছের সংখ্যা বেশি রাখতে হয়
 নাইট্রোজেন সারের মাত্রা বেশি
 ডিটাসেলিং অর্থাৎ টাসেল বের হওয়ার সাথে সাথে অপসারণ করা
 সিল্কিং এর ১-৩ দিনের মধ্যে কচি মোচা হারভেস্ট করা, ইত্যাদি।
মানসম্পন্ন বেবীকর্ন উৎপাদনের জন্য ডিটাসেলিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা ভুট্টা বপনের ৪০-৪৫ দিনের মধ্যেই সম্পন্ন করতে হয়। ডিটাসেলিং করলে প্রায় ১৮% বেশি বেবীকর্ন উৎপাদন হয়। মৌসুম ও এলাকাভেদে বেবীকর্নের জীবনকাল ২-৩ মাস অন্যদিকে স¦াভাবিক ভুট্টার জীবনকাল ৪ মাস বা তার অধিক। সাধারণত মোচার আকার ১০-১২ সেন্টিমিটার লম্বা ও ব্যস ১.০-২.০ সেন্টিমিটার হলে বাজারজাতকরণের জন্য উপযুক্ত। বেবীকর্ন অতি দ্রুত বৃদ্ধি পায় তাই ২-৩ দিন পর পর বেবীকর্ন সংগ্রহ করতে হয়। ফ্রেশ বেবীকর্ন খোসাসহ বাজারজাত করা যায়। তবে খোসা ছাড়ানো বেবীকর্ন পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার ও সমআকারের বেবীকর্ন প্যাকেজিং করে চেইনশপে বাজারজাত করতে হয়। হেক্টরপ্রতি বেবীকর্ন মোচার ফলন ৬ টন বা এর উপরে এবং সবুজ ফডারের ফলন প্রায় ৩০ টন। বেবীকর্ন একটি স্বল্পমেয়াদি ফসল হওয়ায় বিভিন্ন ফসল বিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী বেবীকর্ন ফসল বছরে ৩-৪ বার উৎপাদন করা সম্ভব।
বেবীকর্ন উৎপাদন এবং এর বাজার সারা বিশ্বে বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশেষ করে এশিয়া মহাদেশে বেবীকর্নের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। বেবীকর্ন সাধারণত ফ্রেশ/টাটকা হিসেবে ব্যবহার হয় তবে হিমায়িত এবং টিনজাত কর্ন এর অভ্যন্তরীণ ব্যবহার এবং রফতানির বাজার বেশ বড়। বাংলাদেশেও বেবীকর্নের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে যা আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়। প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে বিদেশ থেকে বেবীকর্ন আমদানি করা হচ্ছে। অথচ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করলে দেশেই বেবীকর্ন উৎপাদন করা সম্ভব। বেবীকর্নের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে দেশের কয়েকটি জেলায় বিচ্ছিন্নভাবে বেবীকর্ন আবাদ শুরু হয়েছে। তবে ফ্রেশ/টাটকা বেবী কর্ন এর বাজার ঢাকাকেন্দ্রিক কয়েকটি চেইন সপ বা পাইকারি বাজারের মধ্যেই সীমিত।
দেশে ক্রম বর্ধমান গবাদিপশু ও দুগ্ধ খামারের চাহিদা মেটাতে ফডার/সাইলেজের চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। গবাদিপশুর উন্নত মানের ফডার বা সাইলেজ হিসেবে ব্যবহারের জন্য বেবীকর্নের সম্ভবনা যথেষ্ট। বেবীকর্নের বহুবিধ গুণগত ও পুষ্টমান এবং অন্যান্য সুবিধার কারণে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দেশে বেবীকর্নের আবাদ বৃদ্ধি পেলে বেবীকর্ন উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং, বাজারজাতকরণ ইত্যাদি কাজে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
পুষ্টিগুণে ভরপুর বেবীকর্নের আবাদ বৃদ্ধিকল্পে নীতিনির্ধারক এবং সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, প্রাণী সম্পদ বিভাগ কর্তৃক যৌথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ফলে একদিকে যেমন দেশে পুষ্টি নিরাপত্তায় অবদান রাখবে এবং অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ সবুজ ফডার এবং সাইলেজ উৎপাদিত হবে, যা বিভিন্ন গবাদিপশু ও দুগ্ধ খামারে ব্যবহার হবে। মার্কেট চেইন এর সাথে যুক্ত করে বেবীকর্ন উৎপাদন নীতিমালা গ্রহণ করা হলে কৃষকেরা বেবীকর্ন উৎপাদনে আগ্রহী হবে। এ ছাড়া বেবীকর্ন উৎপাদন, সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সাইলেজ উৎপাদন ইত্যাদি বিষয়ে কৃষক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে ভবিষ্যতে বেবীকর্ন ফসল হয়ে উঠতে পারে কৃষকের জন্য একটি অর্থকরী ও বাণিজ্যিক ফসল।

লেখক :  প্রাক্তন মহাপরিচালক, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং সিনিয়র স্পেশালিস্ট  (কেজিএফ), মোবাইল : ০১৭১২-২২৬৭৫৫, ইমেইল : ncdbarma@gmail.com

বিস্তারিত
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের বিটি (ইঃ) কটন যুগে পদার্পণ

তুলা উন্নয়ন বোর্ডের বিটি (ইঃ) কটন যুগে পদার্পণ
ড. মোঃ গাজী গোলাম মর্তুজা১ অসীম চন্দ্র শিকদার২
বাংলাদেশে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে গার্মেন্ট শিল্প গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। এই শিল্পের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে তুলা। দেশে বর্তমানে ৪৫০টি স্পিনিং মিল রয়েছে যার জন্য বার্ষিক ৯ মিলিয়ন বেল আঁশ তুলার প্রয়োজন। দেশে উৎপাদিত হয় মাত্র দুই লক্ষ বেল (১ বেল প্রায় ৪৮০ পাউন্ড) তুলা। বাকি তুলা আমদানি করতে বছরে প্রায় ২.৫ থেকে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক চাহিদার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে সুতি কাপড় ও তৈরি পোশাক উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ ইতোমধ্যে তুলার ব্যবহার ও আমদানির বাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে পরিণত হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো মূলত কৃষিনির্ভর; তাই দেশে তুলা উৎপাদন বৃদ্ধি জরুরি হয়ে পড়েছে। যদিও গত দশ বছরে দেশে উচ্চফলনশীল জাত এবং হাইব্রিড জাতের তুলা চাষাবাদের ফলে তুলার উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে; তবে তা দেশের চাহিদার ৫ শতাংশেরও কম।
তুলা উন্নয় বোর্ড ২০৪১ সালের মধ্যে চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ তুলা উৎপাদনের কর্মকৌশল হাতে নিয়েছে। এ ছাড়া নতুন জাত প্রবর্তন ও চাষ এলাকা সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশে ২০৩০ সালের মধ্যে তুলার উৎপাদন পাঁচগুণ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশে তুলা চাষের একটি প্রধান অন্তরায় হলো পোকামাকড়ের আক্রমণ; ফলে তুলা চাষে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের আবহাওয়া তুলার ক্ষতিকর পোকামাকড়ের বংশবৃদ্ধির জন্য অনুকূল; পোকামাকড়ের আক্রমণের ফলে কোন কোন জমির তুলার উৎপাদন অনেক সময় শূন্যের কোটায়ও চলে আসে। এ ছাড়া তুলার পোকা দমনের জন্য ব্যবহৃত কীটনাশক পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই পোকামাকড় প্রতিরোধী বিটি জাতের তুলার চাষাবাদ প্রচলন করার চেষ্টা তুলা উন্নয়ন বোর্ড দীর্ঘ দিন ধরে করে আসছিল। আশার কথা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ            কৃষিবান্ধব সরকার বিটি কটন চাষের জন্য তুলা উন্নয়ন বোর্ডকে অনুমতি প্রদান করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ইঘঞঈঈই এবং পরিবেশ অধিদপ্তর সম্প্রতি হায়দরাবাদভিত্তিক কোম্পানি ঔক অমৎরমবহবঃরপং-এর বিটি কটনের দুটি হাইব্রিড জাত বাংলাদেশে চাষের জন্য অনুমোদন দান করেছেন এবং সেই সংগে হাইব্রিড জাতের পর তুলা উন্নয়ন বোর্ড হাইব্রিড বিটি কটনের যুগে পদার্পণ করল।
বাংলাদেশের জন্য বিটি কটনের উপযোগিতা : বাংলাদেশে চাষের জন্য অনুমোদিত হাইব্রিড বিটি কটনের দুুুুুুুুুুুুুুুুুুু’টি জাতের ট্রায়ালে ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে। দেখা গেছে- প্রচলিত জাতের তুলার উৎপাদন যেখানে হেক্টরে ৩ টন, সেখানে হাইব্রিড বিটি কটনের জাত দু’টির উৎপাদন হেক্টরে ৪ টনেরও বেশি। ফলে বাংলাদেশের তুলা চাষিরা হেক্টরে অতিরিক্ত ১ লক্ষ টাকা আয় করতে পারবেন। এ ছাড়া তাদের আর পোকামাকড়ের সাথে লড়াইও করতে হবে না, ফলে বাড়তি উৎপাদন খরচও হবে না। এ ছাড়া বিটি তুলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির জন্য উপযোগী। তুলা উন্নয়ন বোর্ডের বিজ্ঞানী ড. এমডি. কামরুল ইসলাম যিনি বিটি কটন ট্রায়ালে জড়িত ছিলেন তিনি বলেন, বিটি কটনের জাত দুটি বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব। তাই বলাই যায় বাংলাদেশে বিটি কটন চাষ করে সাফল্য লাভের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।                                                                        
বিটি কটন : জেনেটিক্যালি মডিফায়েড অর্গানিজম (এগঙ) কটনকে বিটি কটন বলে অর্থাৎ জেনেটিক ইঞ্জিয়ারিং এর মাধ্যমে জিনগতভাবে বিবর্তিত কীটপতঙ্গ প্রতিরোধকারী উদ্ভিদই হলো বিটি কটন। অন্যভাবে বলা যায় এটি একটি জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড ক্রপ যে’টি উদ্ভিদের দেহে শুঁককীট বা লার্ভার মতো পোকামাকড়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তুলাগাছ নিজেই কীটনাশক তৈরি করে নিতে পারে। বিটি (ইধপরষষঁং ঃযঁৎরহমরবহংরং) নামক একটি সাধারণ মাটির ব্যাকটেরিয়ার জিনের একটি স্ট্রেইন উদ্ভিদ দেহে ২০০টির বেশি বিটি টক্সিন তৈরি করতে পারে যা বিভিন্ন পোকামাকড়ের জন্য ক্ষতিকারক। উক্ত ব্যাকটেরিয়ার জিনের স্ট্রেইন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজির সাহায্যে তুলা গাছে প্রবেশ করিয়ে বিটি কটন তৈরি করা হয়। জিন ট্রান্সপারের মাধ্যমে বিটি কটন তৈরি হয় বলে একে ট্রান্সজেনিক কটনও বলা হয়ে থাকে।                                                                                                                         
বিটি কটনের বৈশিষ্ট্য : বিটি কটনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো-তুলার সবচেয়ে ক্ষতিকর পোকা (খধঢ়রফড়ঢ়ঃবৎধ) বোলওয়ার্ম, (ঝঢ়ড়ফড়ঢ়ঃবৎধ) আঁচা পোকা অর্থাৎ সকল ধরনের শুঁয়োপোকা বা শুঁককীট প্রতিরোধী। এছাড়া বিটি কটনের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য হলো-উচ্চফলনশীল, দীর্ঘতন্তু বিশিষ্ট, উৎকৃষ্ট মানের এবং তুলনামূলক স্বল্প জীবনকাল। এছাড়া এ জাতের তুলায় ব্যাপক অভিযোজন ক্ষমতা রয়েছে; অর্থাৎ প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে।
চাষাবাদ প্রক্রিয়া : বিটি কটন চাষ হাইব্রিড তুলা চাষের অনুরূপ। বিটি কটন আগাম চাষ করা ভালো। বিশেষ করে জুলাই মাসের মধ্যে চাষ করলে ভাল হয়। জৈবসার যুক্ত বেলে দো-আঁশ ও দো-আঁশ মাটি বিটি কটন চাষের জন্য উপযুক্ত। বীজ আমদানিকৃত এবং মূল্য বেশি, তাই যত্ন সহকারে প্রতি মাদায় একটি করে বীজ হাফ ইঞ্চি থেকে এক ইঞ্চি মাটির গভীরে বপন করতে হবে। জমির উর্বরা শক্তি বিবেচনা করে লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ৯০ সেমি., বীজ থেকে বীজের দূরত্ব হবে ৪৫-৬০ সেমি. রাখতে হবে। ফলে বিঘা প্রতি বীজের প্রয়োজন হবে ৬০০ গ্রাম। তবে জমির উর্বরতা এবং বপন সময়ের উপর ভিত্তি করে লাইন ও বীজের দূরত্ব কম বেশি হতে পারে। বপনের সময় কিছু বীজ পলিব্যাগে বপন করে রাখলে ভালো হয়। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে সব বীজ নাও গজাতে পারে। তাই প্রয়োজনে পলিব্যাগের চারা দিয়ে গ্যাপ পূরণ করা যাবে। ভাল ফলন পেতে হলে, বিঘাপ্রতি কমপক্ষে ৪০০০টি গাছ নিশ্চিত করতে হবে।
বিঘাপ্রতি সারের মাত্রা ও প্রয়োগ : গোবর বা কম্পোস্ট সার ৬০০-৮০০ কেজি শেষ চাষের পূর্বে প্রয়োগ করে তুলা বীজ বপন করতে হবে। ব্যাসাল সার হিসেবে টিএসপি/ডিএপি ২০-২৫ কেজি, ইউরিয়া ৭-৮ কেজি, জিপসাম ৭ কেজি, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ১ কেজি বপনকৃত তুলা বীজ থেকে ৫-৬ সেমি. দূর দিয়ে নালায় প্রয়োগ করতে হবে। তুলাগাছের জীবনকালে তিন থেকে চার বার রাসায়নিক সার ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট পার্শ্ব প্রয়োগ করা যেতে পারে। তুলা গাছের বয়স ২০ থেকে ২৫ দিন হলে ইউরিয়া ৭-৮ কেজি, এমওপি ২০-২৫ কেজি, বোরাক্স ১ কেজি, জিংকসালফেট ১ কেজি তুলার লাইন থেকে ৫-৬ সেমি. দূর দিয়ে নালায় প্রয়োগ করতে হবে। তুলার বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে ২য় বার ইউরিয়া ১০-১১ কেজি, টিএসপি/ডিএপি ১৫ কেজি, এমওপি ২০-২৫ কেজি, জিপসাম ১২ কেজি, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ১ কেজি এবং জিংসালফেট ১ কেজি পার্শ্ব প্রয়োগ করতে হবে। তুলাগাছের বয়স ৬০ দিন হলে ইউরিয়া ১০-১১ কেজি, টিএসপি/ডিএপি ১৫ কেজি, এমওপি ১০ কেজি, জিপসাম ৬ কেজি, বোরাক্স ০.৫ কেজি, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ১ কেজি এবং জিংসালফেট ১ কেজি পার্শ্ব প্রয়োগ করতে হবে। এ সময় জমিতে রসের অভাব হলে সার প্রয়োগের পর হালকা সেচ দিতে হবে। তুলাগাছের বয়স ৭০-৮০ দিন হলে প্রয়োজনে ইউরিয় ৪-৫ কেজি পার্শ্ব প্রয়োগ করা যেতে পারে এবং প্রয়োজনে এ সময় হালকা সেচ দিতে হবে। ডিএপি প্রয়োগ করলে ইউরিয়া অর্ধেক প্রয়োগ করতে হবে এবং ব্যাসাল ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে না। এছাড়া ৩/৪ বার রাসায়নিক সার ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ফলিয়ার স্প্রের মাধ্যমে প্রয়োগ করলে ফলন ৪ থেকে ৫% বৃদ্ধি পাবে। হরমোন স্প্রেও করা যেতে পারে।    
বিটি তুলা যেহেতু পোকামাকড় প্রতিরোধী, তাই পোকমাকড় দমনের জন্য চাষি ভাইদের বাড়তি খরচ হবে না। তবে তুলার প্রাথমিক পর্যায়ে এফিড এবং তুলার শেষ জীবনকালে সাদা মাছির আক্রমণ হতে পারে। প্রয়োজন হলে কীটনাশক প্রয়োগ করে এ সকল পোকা দমণ করতে হবে। কারণ বিটি কটন এফিড ও সাদা মাছির উপর কোন ক্রিয়া করে না। বিটি কটন চাষে আইপিএম বা আইসিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করলে সবচেয়ে ভাল হয়। বিটি তুলার জীবনকাল হাইব্রিড জাতের মতোই, ১৭০-১৮০ দিন।                                                                                         
সীমাবদ্ধতা : জেনেটিক উদ্ভিদ তথা বিটি কটন বিভিন্ন প্রজাতির সঙ্গে সহজে বিবর্তন (ঊাড়ষঁঃরড়হ) ঘটাতে পারে। এছাড়া এফিড এবং সাদা মাছির মতো কীটপতঙ্গ থেকে নিজেকে বাঁচানোর ক্ষমতা নেই বিটি কটনের। তবে বাংলাদেশে তথা উপমহাদেশে তুলার এত প্রজাতি নেই যে, জেনেটিক তুলা চাষের কোন অন্তরায় সৃষ্টি করবে। চাষি ভাইদের এবং তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সম্প্রসারণ কর্মীদের এফিড এবং সাদা মাছির মতো পোকার আক্রমণের প্রতি সজাগ থাকতে হবে। উপকারী পোকামাকড়ের ক্ষেত্রে বিটি কটন হুমকি হতে পারে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে।
হাইব্রিডের তুলনায় বিটি কটন চাষিদের জন্য লাভজনক হলে তবেই তুলা উন্নয়ন বোর্ডের উদ্দেশ্য সফল হবে। হাইব্রিডের পর বিটি কটনের যুগে পদার্পণের ফলে তুলা উৎপাদনের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো অনেকটাই সহজ হবে আশা করা যায়। তবে এখন আমাদের প্রধান কাজটি হবে বিটি কটনের বীজের মূল্য সুলভ এবং সহজ প্রাপ্য করা। কারণ হাইব্রিড চাষেরও প্রধান অন্তরায় অধিক বীজের মূল্য। প্রয়োজনে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বীজ আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে অথবা বীজের মূল্যে ভর্তুকি প্রদান করে স্বল্পমূল্যে কৃষকদের মাঝে বীজ সরবরাহ করতে হবে। সেই সাথে আমাদের গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে হাইব্রিডের মতো বিটি কটনের বীজও উৎপাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।     
“দেশের মঙ্গল তুলা চাষে-বস্ত্র শিল্প তুলার আঁশে”
                                                                             
লেখক : ১প্রকল্প পরিচালক, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, খামারবাড়ি, ঢাকা। ২কটন ইউনিট অফিসার (অব:), তুলা উন্নয়ন বোর্ড, ১০৪/১ (বি-২), শেরে বাংলা রোড, রায়ের বাজার, জাফরাবাদ, মোহাম্মদপুর-১২০৭, মোবাইল : ০১৫৫২-৩৬২৯০১, ই- মেইল: asim.cdb@gmail.com
 

বিস্তারিত
সম্ভাবনাময় ফসল লাল ও সবুজ সবজিমেস্তা বহুবিধ ব্যবহার

সম্ভাবনাময় ফসল লাল ও সবুজ সবজিমেস্তা বহুবিধ ব্যবহার
কৃষিবিদ ইফফাত জাহান নূর
সবজিমেস্তা একটি সম্ভাবনাময় লাভজনক ফসল। একদিকে যেমন উৎপাদন খরচ কম, অন্যদিকে এটি পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য। মানবদেহে দৈনিক পুষ্টি চাহিদা মেটাতে অনন্য একটি খাদ্য সবজিমেস্তা। এর পাতা ও ফলের বৃতি ভিটামিন সি, খনিজ লবণ (মিনারেল) ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উৎকৃষ্ট উৎস। মেস্তা ফসল সাধারণত পাটের মতোই পরিবেশবান্ধব আঁশ ফসল যার একটি ধরন ব্যবহৃত হয় সবজি হিসেবে। সবজিমেস্তার বৈজ্ঞানিক নাম ঐরনরংপঁং ংধনফধৎরভভধ  যা আমাদের দেশে চুকুর বা রোজেলা নামে পরিচিত। এটি পশ্চিম আফ্রিকা থেকে উদ্ভুত মালভেসি গোত্রের অন্তর্ক্তুক্ত একটি উপগুল্ম জাতীয় একবর্ষজীবী ফসল। এর খাদ্য উপযোগী অংশ এর পাতা ও ফল এবং এর মূল বাণিজ্যিক অংশ হল ফলের মাংসল বৃতি। সবজি মেস্তার পাতা শাক হিসেবে ও এর মাংসল বৃতি কনফেকশনারি খাদ্যসামগ্রী যেমন- চা, জ্যাম, জেলি, জুস, আচার, ড্রাইফ্রুট ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে সাধারণত গাঢ় লাল, লালচে সবুজ এবং সবুজ এই তিন রঙের সবজি মেস্তা দেখা যায়। এর আকর্ষণীয় রঙ ও টক মিষ্টি স্বাদের জন্য খাদ্য হিসেবে এটি খুবই জনপ্রিয় এবং পৃথিবীর অনেক দেশেই সবজিমেস্তা বাণিজ্যিক ভাবে চাষ করা হয়।
‘চুকুর’ ‘চুকাই’ ‘টকফল’ ’সরেল’ বা ‘রোজেলা’ নামে আমাদের সকলের কাছে সুপরিচিত ও দেশে বিদেশে যেটি জনপ্রিয়, সেটি মূলত বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রথম জাত ’বিজেআরআই মেস্তা ২’ (সবজিমেস্তা-১/ভিএম-১)। সম্প্রতি বিজেআরআই বন্য প্রজাতির মেস্তা (খড়পধষ ৎধপব) থেকে বিশুদ্ধ সারি নির্বাচন ও গবেষণার মাধ্যমে অধিক ফলনশীল সবজি হিসেবে আরো একটি উন্নত সবজিমেস্তার জাত উদ্ভাবন করেছে যা জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক ২০২২ সালে ‘বিজেআরআই মেস্তা ৪’ (সবজি মেস্তা ২/ভিএম ২) নামে অবমুক্ত করা হয়। দুটি জাতই অধিক পুষিমানসম্পন্ন এবং বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক ফসল। জাত দুইটির স্বাদ একই রকম টকমিষ্টি হলেও বাহ্যিকভাবে এদের কা- ও ফলের রঙে আছে ভিন্নতা। গাঢ় লাল বর্ণের সবজিমেস্তা-১ এবং সবুজ বর্ণের সবজিমেস্তা-২ যেন বাংলার লাল সবুজ পতাকারই প্রতিচ্ছবি। দুটি জাতের উৎপাদন প্রযুক্তি বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
দুটি জাতই সমগ্র বাংলাদেশে চাষ করা যায়। তবে বিশেষ করে উঁচু ও পাহাড়ি এলাকায় বেশি ভাল হয়। অধিক সহনশীলতা থাকায় বাড়ির আঙ্গিনা ও অনাবাদি প্রান্তিক জমিতে চাষ করেও ভালো ফলন পাওয়া যায়। এমনকি শহর এলাকায় বাড়ির ছাদবাগানেও চাষ করা যায়। সবজি মেস্তা আবাদের জন্য জমি তৈরির সময় হেক্টর প্রতি ২-৩ টন গোবর সার প্রয়োগ করা খুবই প্রয়োজন। গাবর সার প্রয়োগ করলে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করার প্রয়োজন হয় না। ছিটিয়ে ও সারিতে উভয় পদ্ধতিতে বীজ বপন করা গেলেও সারিতে বপন করলে গাছের পরিচর্যা করা সহজ হয় এবং এতে ফলনও বৃদ্ধি পায়। সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০-৪০ সেমি.। ছিটিয়ে বপন করলে প্রতি হেক্টরে ১৮-২০ কেজি এবং সারিতে বপন করলে ১৪-১৫ কেজি পরিমাণ বীজ প্রয়োজন হয়। গাছের বয়স ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে এক বার নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিস্কার করে গাছ পাতলা করে দিতে হয় যেন গাছ থেকে গাছের দূরত্ব আনুমানিক ৮-১০ সে.মি. থাকে। সাধারণত এ জাতে তেমন কোন রোগ ও পোকার আক্রমণ দেখা যায় না। তবে গাছের রোগ বালাই দেখা দিলে রোগবালাইয়ের আক্রমণ অনুযায়ী ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। এটি বপনের উত্তম সময় ১৫ জ্যৈষ্ঠ থেকে ১৫ শ্রাবন (জুন থেকে জুলাই) পর্যন্ত, যদিও মধ্য চৈত্র থেকে মধ্য আশি^ন (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ) পর্যন্ত এটি বপনযোগ্য।
বপন সময়ের উপর ভিত্তি করে চার থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে গাছে ফুল আসে।
ফুল আসার ৪০-৪৫ দিন পর ফল পরিপুষ্ট হলে ফল ছিড়ে নিয়ে অথবা মাংসল বৃতি সংগ্রহ করা হয়। এই মাংসল বৃতি ভালভাবে রোদে শুকিয়ে সুস্বাদু খাদ্যসামগ্রী তৈরির জন্য কনফেকশনারীতে প্রেরণ করা হয় বা রান্না করে খাওয়ার জন্য বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়। সবজিমেস্তার প্রতিটি ৬ গ্রাম ওজনের ফল থেকে প্রায় ৩ গ্রাম মাংসল বৃতি পাওয়া যায়। সবজিমেস্তার একটি গাছে ৬০-১০০টি ফল ধরে। প্রতি হেক্টরে সবজিমেস্তার ১০-১২ টন পাতা, ১৬-১৮ টন সতেজ বৃতি, ২.৫-৩.৫ টন শুকনো বৃতি এবং ১.১ টন বীজ উৎপাদন হয়। ফল পাতার ফলনের সাথে সঠিক পরিচর্যায় সবজিমেস্তা থেকে মেলে প্রতি হেক্টরে ১.২-১.৬ টন আঁশ। মেস্তার বীজে ২০-২২ শতাংশ তৈল থাকে যা পৃথিবীর অনেক দেশে ভোজ্য তেল হিসেবে এবং কনমেটিক্স শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
সবজিমেস্তার গাছের বয়স ৬০-৬৫ দিন হলেই তখন থেকে শাকসংগ্রহ করা যায়। গাছের ৩ মাস (৯০ দিন) বয়স পর্যন্ত পাতা শাক হিসেবে খাওয়া যেতে পারে। আমাদের দেশে এর কচি পাতা সরাসরি ছালাদ হিসাবে, শাক হিসেবে এবং টক পাতার ভর্তা হিসেবে জনপ্রিয়। শুকনা বৃতি পানীয় (ঞবধ), সচ, আচার/চাটনী এবং অন্যান্য ফলাহারে (উবংংবৎঃং) ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় কচি পাতা ও মাংসল বৃতি স্বাদবর্ধক হিসেবে তরিতরকারির সাথে মিশিয়ে খাওয়া হয়।
সবজিমেস্তার বহুবিধ ব্যবহার
সবজিমেস্তার পাতা ও ক্যালিক্স (মাংশল বৃতি) : ফাইবার, অ্যাশ, ভিটামিন সি, ভিটামিন বি, মিনারেল ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এর উৎকৃষ্ট উৎস। আফ্রিকান গবেষক সালামি (২০২১) তার গবেষণায় পুষ্টিমান বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, প্রতি ১০০ গ্রাম লাল ও সবুজ সব্জিমেস্তার সতেজ পাতায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রোটিন (১৬.৩৬-২১.২৮%) ও ফাইবার (২২.৮০-৩৫.০১%) রয়েছে এবং পাতা ও ফলের বৃতিতে রয়েছে ৯.৩৫-১৩.৭৪% অ্যাশ ও ২৬.৯৩-৪৮.৩৩% শর্করা।  বিজ্ঞানিদের মতে ১২% এর অধিক প্রোটিন সমৃদ্ধ যেকোন উদ্ভিদ প্রোটিনের একটি উৎকৃষ্ট উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। মানবদেহে ফাইবার কোষ্ঠকাঠিণ্য দুর করে, যকৃত ও পরিপাকতন্ত্রের রোগ কমায়। অ্যাশ বা ছাই বিপাকীয় কার্যকলাপের সময় একটি কোফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। বিজেআরআই এর বিজ্ঞানী মো: জাবলুল তারেক (২০২১) গবেষণা করে দেখেছেন, প্রতি ১০০ গ্রাম সব্জিমেস্তার পাতায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খনিজ লবন বিশেষ করে ক্যালসিয়াম (২.৭%), ম্যাগনেসিয়াম (১.৬%), ভিটামিন এ (১৬৫.৯%) ও ভিটামিন সি (৯৪.৮৮%) থাকে ও বৃতিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সোডিয়াম (৯.৫%), পটাসিয়াম (১.৯%), আয়রন (৪২২%) ও ম্যাঙ্গানিজ (১২৬%) থাকে।  হাড়, পেশী, হৃদপিন্ড এবং মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করার জন্য খনিজ লবণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। রোজেলা মানসিক বিকাশে ও অ্যান্টি ডিপ্রেশন চিকিৎসায়ও ব্যবহৃত হয়।
সবজিমেস্তার দুটি জাতই উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ যা সবজি হিসেবে দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় সংযোজন করলে মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিজেআরআই উদ্ভাবিত সবজিমেস্তা-১ এর উজ্জল লাল রঙ এতে উপস্থিত অ্যান্থোসায়ানিনের এর নির্দেশক। অন্যদিকে সবজিমেস্তা-২ এর সবুজ বৃতির গোলাপি আভা মৃলত এতে উপস্থিত ক্যারোটিনয়েডের জন্য হয়ে থাকে। অ্যান্থোসায়ানিন সামগ্রিক দৃষ্টিশক্তির উন্নয়নে ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এবং ক্যারোটিনয়েড ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধি রোধে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এছাড়াও বিজেআরআই এর বিজ্ঞানী ড. মো: আবুল ফজল মোল্লা (২০২০) এর গবেষনায় দেখা গেছে সব্জিমেস্তায় ফ্ল্যাভনয়েড, প্রোঅ্যান্থোসায়ানিডিন, ফেনলিক কমপাউন্ড ইত্যাদি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উপস্থিত যা ডায়াবেটিক, স্থুলতা ও ক্যান্সার রোগ নিরাময়ের পাশাপাশি কমায় হৃদরোগের ঝুকি। উল্লেখ্য, প্রতি ১০০ গ্রাম সবজি মেস্তা থেকে পাওয়া যায় ৪৫ ক্যালরি শক্তি।
সবজিমেস্তার বীজে রয়েছে ২২-২৪% ভোজ্যতেল যা মনো ও পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডের একটি ভালো উৎস। এটি রক্তরসের খউখ ও ঐউখ উভয় কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য কার্যকর হওয়ায় ঔষধ শিল্পে ব্যবহৃত হয়। এক কথায় মানবদেহের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এটি অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে। গবেষণায় পাওয়া গেছে এর বীজতেলে ‘টোকোফেরল’ নামক ক্যান্সার নিরোধক উপাদান পাওয়া গেছে যা ফার্মেসি ও চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়াও এর বীজের তৈল সাবানশিল্পে ও শিল্প কারখানাতেও ব্যবহৃত হয়।
পুষ্টিকর ও বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য এই ফসল বাণিজ্যিক উৎপাদনের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানি করে দেশীয় আয় বৃদ্ধিতে তথা বাংলাদেশী কৃষকদের আর্থসামাজিক অবস্থা উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এর সুনিশ্চিত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশে এর গুরুত্ব এখনো অস্বীকৃত।
বৈশ্বিক বাণিজ্য রোডম্যাপ অনুযায়ী, ভেষজ পণ্যের সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী সবজিমেস্তার চাহিদা দ্বিগুণ হবে। সুতরাং, এখনই আমাদের দেশে এর গুরুত্ব উপলব্ধি করার ও এর বহুমুখী ব্যবহার প্রচার করার উপযুক্ত সময়। সর্বোপরি ফলন, অভিযোজন, পুষ্টিগুণ ও বহুমুখী ব্যবহার বিবেচনায় বিজেআরআই উদ্ভাবিত দুটি জাতই (সবজি মেস্তা-১ ও সবজি মেস্তা-২) বাণিজ্যিক চাষের জন্য এবং মানুষের দৈনিক খাদ্য তালিকায় সংযোজন সুপারিশযোগ্য। ভেজাল, দুষণ ও মহামারীর এই কঠিন সময়ে নানাবিধ পুষ্টিগুণ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ সবজিমেস্তা মানুষের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করলে নিসন্দেহে কমবে স্বাস্থ্য ঝুঁকি।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, জেনেটিক রিসোর্সেস এন্ড সিড বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা-১২০৭। মোবাইল : ০১৭৬৪৮৫৫৩১৯, ই-মেইল :iffat.jessica@yahoo.com

বিস্তারিত
সবজি চাষে বদলে যাওয়া গ্রামের গল্প

সবজি চাষে বদলে যাওয়া
গ্রামের গল্প
কৃষিবিদ সাবরিনা আফরোজ
ঢাকার অদূরে অবস্থিত সাভার উপজেলাকে কিছুতেই যেন চিরাচরিত উপজেলার মাপকাঠিতে মাপা যায় না। এখানে এখনও গ্রাম আছে বললে হয়তো অনেকেরই চোখ কপালে উঠবে। নামে বেনামে হাজারো আবাসন কোম্পানির দৌরাত্ম্যে এখন সবুজের দেখা পাওয়া ভার। তবুও এখানকার  কৃষকেরা যেন দৃঢ়প্রত্যয়ে কৃষি কাজ করে যাচ্ছেন অবিরত। অল্প সময়ে লাভবান হওয়ার মতো কৃষি পণ্যে ঝুঁকছেন তারা। এর তালিকায় আছে রঙ বেরঙের বাহারি ফুল, চায়নিজ সবজি ইত্যাদি। চাইনিজ সবজি উৎপাদন করে সাভারের গ্রামগুলো এখন চায়না গ্রাম নামে পরিচিতি পাচ্ছে।
সাভারের তেঁতুলঝোড়ার দক্ষিণ মেইটকা ও ভাকুর্তা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম এখন চায়না গ্রাম নামে পরিচিতি লাভ করেছে। আদি পেশা কৃষিকে তারা ধরে রেখেছিল ধান চাষের মাধ্যমে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে তারা অল্প সময়ে ফসল আসার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয় সবজি চাষকে। ক্রমান্বয়ে তা চায়না সবজি চাষের দিকে মোড় নেয়। চাহিদা বাড়তে থাকায় আশপাশের গ্রামের কৃষকরাও যুক্ত হয়েছেন এসব সবজি চাষে। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, চট্টগ্রামসহ পার্শবর্তী বিভিন্ন স্থানে বাজার সৃষ্টি হওয়ায় এ সবজি চাষে আগ্রহ পাচ্ছেন কৃষকরা। দেশে চাইনিজ খাবারের জনপ্রিয়তার সাথে সাথে চাহিদা বাড়তে থাকে চায়নিজ সবজির। তাই সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ও বাজারের চাহিদা অনুযায়ী কৃষকেরা নিজে করছেন এ সবজি চাষ একই সাথে অন্যকে দিয়ে যাচ্ছেন উৎসাহ।
তেঁতুলঝোড়া গ্রামের কৃষক মো: কোব্বাত হোসেন। কৃষক মোঃ কোব্বাত হোসেনকে সবজি চাষে লাভ কেমন হয় প্রশ্নের উত্তরে জানান, প্রায় ২০০ বিঘা জমিতে সবজি উৎপাদন করছেন। তার ক্ষেতে শোভা পাচ্ছে ব্রোকলি, রেড ক্যাবেজ, ক্যাপসিক্যাম, লেটুস, স্যালোরি, থাই জিনজার, পার্সলি, বিটরুট, সুইটকন, বেবিকর্নসহ রঙ বেরঙের চাইনিজ সবজি। উচ্চমূল্যের এ ফসলগুলোতে বিঘাপ্রতি উৎপাদন খরচ হয়েছে ৩০,০০০ টাকা। তিনি বিঘাপ্রতি সবজি বিক্রয় করেন ৬০,০০০ টাকার। লাভ হয় ৩০,০০০ টাকা। বার্ষিক আয় ২৫ লক্ষ টাকা। অনুরূপভাবে কৃষক মো: সোহরাব হোসেন সবজি চাষ করছেন ৭০-৮০ বিঘায়। তার বার্ষিক আয় ৮-১০ লক্ষ টাকা। কৃষক মো: সোহরাব হোসেন সবজির চাষাবাদ বিশেষ প্রযুক্তির সম্পর্কে জানান ব্রোকলির ক্ষেত্রে ভাদ্র-আশ্বিন (মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য অক্টোবর) মাসে তার বীজ বপন করেন। কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণের মধ্যে (মধ্য নভেম্বর থেকে মধ্য ডিসেম্বর) জমিতে চারা রোপণ করেন। সার হিসেবে জৈবসার দেন। হেক্টরপ্রতি ফলন হয় ১২-১৫টন/হেক্টর। রবি মৌসুমে বিশেষ করে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লেটুসের চাষ করে থাকেন। লেটুসের জীবনকাল সাধারণত ৫০-৫৫ দিন। লেটুসের জন্য হেক্টরপ্রতি ১০ টন গোবর, ২০০ কেজি ইউরিয়া, ৭৫ কেজি টিএসপি এবং ১০০ কেজি এমওপি সার দিয়ে থাকেন। লেটুসের ফসল সংগ্রহের সুনির্দ্দিষ্ট কোন সয়ম নেই। মাথা বাঁধার পর এটি সংগ্রহ করতে হয়। হেক্টরপ্রতি এর ফলন ২০-৩৫ টন।
লেমনগ্রাস একটি সুগন্ধিযুক্ত ওষধি উদ্ভিদ। এ্ই উদ্ভিদ থেকে সাইট্রাল নামক একটি তেল পাওয়া যায়। প্রায় সবধরনের মাটিতে এটি সফলভাবে চাষ করা যায়। লেমনগ্রাস গাছ বেশি সেচের প্রয়োজন হয় না। একবার লেমনগ্রাস চাষ করলে প্রায় ৫ বছর ফসল পাওয়া যায়। প্রতি বছর ফসল ৪-৫ বার কাটা যায়।
সাভারে অন্যান্য সবজির মধ্যে সুপরিচিত এবং অধিক ব্যবহৃত ফসল হলো ক্যাপসিকাম। ক্যাপসিকাম সাভারে প্রচুর পরিমাণ হয়ে থাকে। সাধারণত আশি^ন (অক্টোবর) মাসে বীজ বপন করে কার্তিক (নভেম্বর) মাসে চারা রোপণ করলে ক্যাপসিকামের ভালো ফলন পাওয়া যায়। মানসম্মত ক্যাপসিকাম উৎপাদনের জন্য ১৬-২৫ সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও শুষ্ক পরিবেশ প্রয়োজন। রাতের তাপমাত্রা ১৬-২১ সেলসিয়াসের কম বা বেশি হলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ফুল ঝরে পড়ে, ফলন ও মান কমে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে একেবারেই ফলন হয় না। অক্টোবর মাসে বীজ বপন করে নভেম্বর মাসে চারা রোপণ করলে দেখা যায় যে, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ হতে জানুয়ারি পর্যন্ত রাতের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারনে গাছের দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এজন্য গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য পলিথিন ছাউনি, পলি হাউস, পরিভিনাইল হাউজে গাছ লাগালে রাতে ভেতরের তাপমাত্রা বাইরের অপেক্ষা বেশি থাকে।
সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি ক্যাপসিক্যাম চাষের জন্য উত্তম। সাধারণত ক্যাপসিক্যামের প্রতি এক গ্রাম বীজে ১৪০টি বীজ থাকে। প্রতি হেক্টরে বীজের প্রয়োজন ২৩০ গ্রাম এবং চারার প্রয়োজন ৩০,০০০। বীজ রোপণ করার জন্য বীজগুলোকে ১২ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। সুনিষ্কাশিত উঁচু বীজতলায় মাটি মিহি করে ১০২ সেমি. দূরে দূরে বীজ বপন করে হালকাভাবে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। বীজতলায় প্রয়োজনানুসারে ঝাঝরি দিয়ে হালকাভাবে সেচ দিতে হবে। সধারণত বীজ গজাতে ৩-৪ দিন সময় লাগে। বীজ   রোপণের ৭-১০ দিন পর চারা ৩-৪ পাতা বিশিষ্ট হলে ৯১২ সেমি. আকারের পলিব্যাগে স্থানান্তর করতে হবে। পটিং মিডিয়াতে ৩:১:১ অনুপাতে যথাক্রমে মাটি, কম্পোস্ট ও বালু মিশাতে হবে। পরে এগুলো ছায়াযুক্ত স্থানে স্থানান্তরিত করতে হবে। জমিতে সাধারণত ৩০ দিন বয়সের চারা ৪৫৪৫ সেমি. দূরত্বে রোপণ করতে হয়। প্রতি হেক্টর জমিতে ক্যাপসিক্যাম চাষের জন্য গোবর ১০ টন, ইউরিয়া ২৫০ কেজি, জিংক সালফেট ১২ কেজি হারে প্রয়োগ করতে হয়। জমি তৈরির সময় অর্ধেক গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক গোবর, টিএসপি, জিঙ্ক সালফেট, জিপসাম এবং ১/৩ ভাগ ইউরিয়া ও এমওপি পরবর্তীতে দুইভাগ করে চারা লাগানোর ২৫ এবং ৫০ দিন পরে প্রয়োগ করতে হবে। ক্যাপসিক্যাম সাধারণত পরিপক্ব অবস্থায় মাঠ থেকে উঠাতে হয়। সাধারণত সপ্তাহে একবার গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। ফল সংগ্রহের পর ঠা-া বা ছায়াযুক্ত স্থানে বাজারজাত করার পূর্ব পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে হবে। ফল সংগ্রহের সময় প্রতিটি কা-ে সামান্য পরিমাণ বোটা রেখে দিতে হবে। সঠিক পরিচর্যা করলে হেক্টর প্রতি ক্যাপসিকামের ফলন হয় ১৫-২৫ টন।
ক্রমান্বয়ে বাড়ছে জনসংখ্যার চাপ। তিলোত্তমা নগরীতে আজ তিলধারণের ঠাঁই নেই। তবু নিজের একখ- ঠিকানার খোঁজে মানুষ ছুটছে অবিরাম। ঢাকার আশেপাশে তাই চলছে আবাসন কোম্পানির আগ্রাসন। এরপরেও এখানে যখন বহুমূল্যেও ফসল ফলে এটা আমাদের জন্য সুখের বটে। সাভারের আনাচে কানাচে যেখানেই এক টুকরো জমি আছে সেখানেই হচ্ছে ফসলের চাষ। উচ্চমূল্যের এই ফসল একদিকে যেমন স্থানীয় চাষিদের জীবনমান উন্নত করছে অপরদিকে দেশের কৃষিকে করছে সমৃদ্ধ। অনেক শিক্ষিত তরুণ এখন কৃষি উদ্যোক্তা হচ্ছে যা আমাদের জন্য একটি আশার হাতছানি। এসব তরুণ উদ্যোক্তা, কৃষক সকলকে নিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে চাই সমৃদ্ধির পথে।

লেখক : আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৭৫২৬৮৪০, ই-মেইল :dhaka@ais.gov.bd

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর

প্রশ্নোত্তর

কৃষিবিদ আকলিমা খাতুন

নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
জনাব মামুন মিয়া, উপজেলা : বদলগাছী, জেলা : নওগাঁ
প্রশ্ন : আলুর শুকনো পচা রোগ কিভাবে দমন করব?
উত্তর : ফিউজারিয়াম প্রজাতির ছত্রাকের আক্রমণে আলুর শুকনো পচা রোগ  হয়। আলুর গায়ে কিছুটা গভীর কালো দাগ পড়ে ও ভেতরে গর্ত হয়ে যায়। প্রথম পচন ভিজা থাকলেও পরে তা শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়। আক্রান্ত অংশে গোলাকার ভাঁজ এবং কখনো কখনো ঘোলাটে সাদা ছত্রাক জালিকা দেখা যায়। এ রোগ দমন করার জন্য নি¤েœাক্ত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
    আলু ভালভাবে বাছাই গ্রহণ করে সংরক্ষণ করতে হবে।
    যথাযথভাবে কিউরিং করে আলু গুদামজাত করতে হবে।
     ম্যানকোজেব গ্রুপের ডাইথেন এম-৪৫ দ্রবণ ০.২% দ্বারা বীজ আলু শোধন।
     বস্তা, ঝুড়ি, গুদামঘর ইত্যাদি ৫% ফরমালিন দিয়ে শোধন করতে হবে।
জনাব মো: আমজাদ মিয়া, উপজেলা : হরিরামপুর, জেলা : মানিকগঞ্জ
প্রশ্ন : আদা গাছের পাতা হলুদ হয়ে গাছ আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ছে এবং শুকিয়ে মারা যাচ্ছে। করণীয় কী?
উত্তর : এটি আদার কন্দ পচা বা রাইজম রট রোগ নামে পরিচিত, যা ছত্রাকের আক্রমণে হয়ে থাকে। কা-ের উপরের অংশে এ রোগ আক্রমণ করে। আক্রান্ত গাছের পাতা প্রথমে হলুদ হয়ে যায় কিন্তু গাছের পাতায় কোন দাগ থাকে না। পরবর্তীতে গাছ শুকিয়ে মারা যায়। আক্রান্ত গাছের কন্দ পচে যায় এবং পচা দুর্গন্ধ বের হয়। অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্ত গাছে রাইজম ফ্লাই নামক পোকার আধিক্য দেখা যায়। এ রোগ আক্রান্ত হলে আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে নষ্ট বা পুড়ে ফেলতে হবে। কাঁচা গোবর পানিতে গুলে কন্দ শোধন করে ছায়ায় শুকিয়ে ব্যবহার করতে হবে। ২ গ্রাম হারে রিডোমিল গোল্ড ম্যানকোজেব ৬৪% মেটালেক্সিল ৮% বা নোইন ৫০ ডব্লিউপি (কার্বেন্ডাজিম) বা ম্যানকোজেব ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে আধা ঘণ্টা শোধন করে ছায়ায় শুকিয়ে ব্যবহার করতে হবে। স্টেবল ব্লিচিং পাউডার প্রতি হেক্টরে (২৪৭ শতকে) ২০ কেজি হারে শেষ চাষের সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। রোগ দেখা দেওয়া মাত্রই প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম কমপ্যানিয়ন (ম্যানকোজেব ৬৩%+ কার্বেন্ডাজিম ১২% বা নোইন ৫০ ডব্লিউপি (কার্বেন্ডাজিম) বা রিডোমিল গোল্ড (ম্যানকোজেব ৬৪%+ মেটালেক্সিল ৮% বা ডাইথেন এম-৪৫ (ম্যানকোজেব) বা ১% বর্দোমিক্সচার মিশিয়ে গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে।
জনাব বিপ্লব, উপজেলা : রানীশংকৈল, জেলা : ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন : মিষ্টি আলুর গাছে খর্বাকৃতির ও হলুদ রঙের হয়। পরে আক্রান্ত গাছ কালো কালো হয়ে যায়। গুদামজাত অবস্থায় টিউবারেও এ দাগ হয়। এই রোগ দমনে করণীয় কি?
উত্তর : রোগমুক্ত মিষ্টি আলুর লতা লাগাতে হবে। শস্যপর্যায় অবলম্বন করতে হবে। কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক  যেমন (অটোস্টিন) অথবা কার্বোক্সিন+ থিরাম গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন- প্রোভ্যাক্স ২০০ উব্লিউপি) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে তার মধ্যে লতা ডুবিয়ে শোধন করে নিয়ে জমিতে লাগাতে হবে। সংরক্ষিত টিউবারকে এ রোগের আক্রমন হতে রক্ষা করতে টিউবারকে সংরক্ষণের পূর্বে ভালোভাবে কিউরিং করে নিতে হবে। এ রোগ কমানোর জন্য কাটা, ছেঁড়া ও থেঁতলানো টিউবার বেছে নিতে নিখুঁত টিউবার সংরক্ষণ করতে হবে।
জনাব সিয়াম, উপজেলা : নলছিটি, জেলা : ঝালকাঠি
প্রশ্ন : বার্লির পাতায় ছোট ছোট দাগ পড়ে । পরে বাড়তে থাকে এবং গাঢ় বাদামি থেকে কালো বর্ণ ধারণ করে। এই রোগ কেন হচ্ছে এবং দমনে করণীয় কী?
উত্তর : গাছের পরিত্যক্ত অংশ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। প্রোপিকোনাজন গ্রুপের ঔষধ টিল্ট ২৫০ ইসি (.০৫%) ০.৫ মিলি হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিতে ১০-১২ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। ভিটাভেক্স ২০০ প্রতি কেজি বীজে (২.৫-৩.০) গ্রাম মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।
জনাব রুবেল, উপজেলা : কুষ্টিয়া সদর, জেলা : কুষ্টিয়া
প্রশ্ন : লাউয়ের পাতার উপরের দিকে সাদা রঙের পাউডারের মতো দাগের সৃষ্টি হয়েছে। কী করণীয়?
উত্তর : লাউয়ের পাউডারি মিলডিউ রোগ (ড়রফরঁস ংঢ়ঢ়.) ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগের কারণে পাতার উপরের দিকে সাদা রঙের পাউডারের মতো দাগের সৃষ্টি হয় এবং পরে দাগগুলো বড় হয়ে সমস্ত পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। এ রোগের কারণে ফলের গুণগত মান কমে যায় এবং ফলন কমে যায়। আক্রমণ বেশি হলে পাতা হলুদ বা কালো হয়ে মারা যায়। আগাম বীজ বপন করতে হবে। রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে হেক্টর প্রতি  ১৫ কেজি সালফার গুড়া ক্ষেতের গাছে ছিটিয়ে দিলে ভাল ফল পাওয়া যায়। সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে। আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশ সংগ্রহ করে নষ্ট করতে হবে।  ৭ দিন পর পর ৩ বার প্রোপিকোনাজল ০.৫ মিলি বা সালফার (রনভিট)-২ গ্রাম/প্রতিলিটার পানি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। বীজবপনের আগে প্রতিলিটার পানিতে ২ গ্রাম ইপ্রোডিয়ন রোভরাল বা মেনকোজেব গ্রুপের ডাইথেন এম-৪৫, ছত্রাকনাশক মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।
জনাব সাগর আহমেদ, উপজেলা : পাটগ্রাম, জেলা : লালমনিরহাট
প্রশ্ন : মরিচের পাতা সাদা হয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে, কী করণীয়?
উত্তর : থ্রিপস পেকার আক্রমণে পাতা সাদা হয়ে কুঁকড়ে যায়। পোকা ও কীড়া পাতা ও কচি ডগার রস চুষে নেয়। আক্রান্ত গাছের পাতা নৌকার মতো উপরের দিকে গুটিয়ে যায়। আক্রান্ত ফুলের বোঁটা বাদামি রঙের হয়ে ঝরে পড়ে। প্রাথমিক অবস্থায় শুকনো ছাই প্রয়োগ করতে হবে। সাবানের পানি (১০ লিটার পানিতে  ২০ গ্রাম) স্প্রে করা যেতে পারে। অতিরিক্ত আক্রমণ হলে প্রতি লিটার পানিতে ০.২৫ মিলি ইমিডাক্লোরপ্রিড (টিডো) বা আইসেপ্রোকার্ব (মিপসিন/সপসিন) ২ গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পর পর ৩ বার।
জনাব মারুফ, উপজেলা : হরিরামপুর, জেলা :  মানিকগঞ্জ
প্রশ্ন : করলার পাতা ছোট হয়ে গুচ্ছ আকারে হয়ে গেছে। করণীয় কী?
উত্তর : এটি করলার মাইকোপ্লাজমাজনিত রোগ। আক্রান্ত গাছের পাতাগুলো গুচ্ছ আকারে দেখা যায়। গাছ বাড়ে না। ফুল ও ফল কমে যায়। বাহক পোকা হিসাবে জ্যাসিড পোকা দ্বারা এ রোগ ছড়ায়। এ রোগে আক্রান্ত গাছ দেখা মাত্র তুলে নষ্ট অথবা  পুড়ে ফেলতে হবে। রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। ক্ষেতের আশে পাশের আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। বাহক পোকা ধ্বংস করার জন্য বালাইনাশক ইমিডাক্লোরপ্রিড (টিডো, এডমায়ার) ১ মিলি প্রতিলিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পরপর ৩ বার।
জনাব আবদুল মান্নান, উপজেলা : লোহাগড়া, জেলা : নড়াইল,
প্রশ্ন : মসুর গাছের পাতায় সাদা ছত্রাকের জালিকা দেখা যাচ্ছে। জমির কোন কোন অংশে গাছ কালচে বাদামি রং ধারণ করেছে। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
উত্তর : স্টেমফাইলাম প্রজাতির ছত্রাক দ্বারা এ রোগ সৃষ্টি হয়। দূর থেকে আক্রান্ত ফসল আগুনে ঝলসানো মনে হয়। বীজ, বিকল্প পোষক, বায়ু প্রভৃতির মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। আক্রান্ত জমিতে ইপ্রোডিয়ন গ্রুপের রোভরাল-৫০ ডব্লিউ নামক ছত্রাকনাশক (০.২%) ১০ দিন অন্তর অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। এছাড়া ফসলের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
জনাব মামুন, উপজেলা : মুক্তাগাছা, জেলা : ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : কুল গাছে বিছাপোকা আক্রমণ করেছে।  এখন কী করণীয়?
উত্তর : বিছা পোকা কুল গাছের একটি মারাত্মক পোকা। এ পোকার আক্রমণ বেশি হলে সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের রিপকর্ড ১ মিলি. প্রতি লিটার পানিতে অথবা ইবামেকটিন বেনজয়েট গ্রুপের প্রোক্লেম-১ গ্রাম/লি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে  ১০ দিন পরপর ৩ বার এবং গাছের গোড়া ও ডালপালা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
জনাব জামান, উপজেলা : শিবগঞ্জ, জেলা :  বগুড়া
প্রশ্ন : রসুন গাছের গোড়া পচে যাচ্ছে। সমাধানের উপায় কী?
উত্তর : ঝপষবৎড়ঃরঁস ৎড়ষভংরর নামক ছত্রাকের আক্রমণে রসুন গাছের গোড়া পচে যায়। এ রোগের আক্রমণে কন্দের গোড়ায় ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং পরে পচে যায়। এ রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে কপার অক্সি ক্লোরাইড গ্রুপের ৪ গ্রাম সুলকক্স বা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ২ গ্রাম ব্যভিস্টিন মিশিয়ে চারার গোড়ায় স্প্রে করতে হবে। এছাড়া আক্রান্ত চারা সংগ্রহ করে নষ্ট করতে হবে। আক্রান্ত জমিতে প্রতি বছর রসুন বা পেঁয়াজ চাষ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
জনাব মো: মামুন, উপজেলা : ঠাকুরগাঁও  সদর, জেলা : ঠাকুরগাঁও
প্রশ্ন : ফুলকপির ফুল পচে কালো কালো হয়ে যাচ্ছে। কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : এটি ফুলকপির কার্ড পচা রোগ। এটি দুই প্রজাতির ছত্রাক ফিউজারিয়াম ইকোইজিটি ও অলটারনারিয়া প্রজাতি এবং আরউইনিয়া কেরোটোভোরা নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়। ছত্রাক দ্বারা আক্রমণের ফলে ফুলকপির কার্ডে প্রথমে বাদামি রঙের গোলাকার দাগ পড়ে। পরবর্তীতে দাগগুলো একত্র হয়ে বড় দাগের সৃষ্টি করে এবং কার্ড পচে যায়। আর ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত কার্ড খুব দ্রুত পচে যায়। বীজ বপনের আগে কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক এমকোজিম/অটোস্টিন/ নোইন ২-৩ গ্রাম/ কেজি হারে বীজ শোধন করে রোপণ করতে হবে। ইপ্রোডিয়ন গ্রুপের ছত্রাকনাশক (কিউরেট ৫০ ডব্লিউ পি/ ইভারাল ৫০ ডব্লিউপি) অথবা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক (অটোস্টিন/নোইন ২) গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার গাছে স্প্রে করতে হবে। এ ছাড়া ব্যাকটেরিয়াজনিত কারণে হলে বিসমার্থিওজল গ্রুপের ব্যাকটেরিয়ানাশক ব্যাকট্রল/থায়াজল/ব্যাকট্রোবান প্রতি লিটার পানিতে ৩-৪ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।

লেখক : তথ্য অফিসার (পিপি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৯১৬৫৬৬২৬২; ই-মেইল :aklimadae@gmail.com

বিস্তারিত
ফাল্গুন মাসের কৃষি (১৪ ফেব্রুয়ারি-১৪ মার্চ)

ফাল্গুন মাসের কৃষি
(১৪ ফেব্রুয়ারি-১৪ মার্চ)

কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
ফাল্গুন মাস বছরের শেষ ঋতু। শীতের পরে প্রকৃতিতে রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ, আর অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে আগমন ঋতুরাজ বসন্তের। ঋতু পরিবর্তনের সাথে আমাদের কৃষিতেও পরিবর্তন সূচিত হয়। কৃষকরা উদ্যমী হয়ে নতুন চাষাবাদে আগ্রহী হয়। কৃষক ভাইবোনেরা আসুন জেনে নেই ফাল্গুন মাসের কৃষিতে করণীয় যা আছে।
বোরো ধান
ধানের চারার বয়স ৫০-৫৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সার দেয়ার আগে উইডার দিয়ে জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে। ধানের কাইচ থোড় আসা থেকে শুরু করে ধানের দুধ আসা পর্যন্ত ক্ষেতে ৩/৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে। পোকা দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে (আলোর ফাঁদ পেতে, পোকা ধরার জাল ব্যবহার করে, ক্ষতিকর পোকার ডিমের গাদা নষ্ট করে, উপকারী পোকা সংরক্ষণ করে, ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করে) ধানক্ষেত বালাইমুক্ত রাখতে হবে। এ সময় ধানক্ষেতে উফরা, ব্লাস্ট, পাতাপোড়া ও টুংরো রোগ দেখা দেয়। জমিতে উফরা রোগ দেখা দিলে যেকোন কৃমিনাশক যেমন-ফুরাডান ৫ জি বা কিউরেটার ৫ জি প্রয়োগ করতে হবে। ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে এবং একরপ্রতি ১৬০ গ্রাম ট্রুপার বা ন্যাটিভো বা ব্যাবিস্টিন ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে দু’বার প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে পাতাপোড়া রোগ হলে অতিরিক্ত ৫ কেজি/বিঘা হারে পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে এবং জমির পানি শুকিয়ে ৭-১০ দিন পর আবার সেচ দিতে হবে। টুংরো রোগ দমনের জন্য এর বাহক পোকা সবুজ পাতাফড়িং দমন করতে হবে।
গম
এ মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম পাকা শুরু হয়। গম শীষের শক্ত দানা দাঁত দিয়ে কাটলে যদি কট কট শব্দ হয় তবে বুঝতে হবে গম কাটার সময় হয়েছে। কম্বাইন হারভেস্টার এর মাধ্যমে সকালে অথবা পড়ন্ত বিকেলে ফসল কাটা উচিত। বীজ ফসল কাটার পর রোদে শুকিয়ে সংগ্রহ করা বীজ ভালো করে ঠা-া করে সংরক্ষণ করতে হবে।
ভুট্টা (রবি)
জমিতে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ গাছের মোচা খড়ের রঙ ধারণ করলে এবং পাতার রঙ কিছুটা হলদে হলে মোচা সংগ্রহ করতে হবে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে শুকনো আবহাওয়ায় মোচা সংগ্রহ করে ফেলতে হবে।  সংগ্রহ করা মোচা ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। মোচা সংগ্রহের পর উঠানে পাটি বিছিয়ে তার উপর শুকানো যায় অথবা জোড়া জোড়া বেঁধে দড়ি বা বাঁশের সাথে অথবা টিনের চাল বা ঘরের বারান্দায় ঝুলিয়ে শুকানোর কাজটি করা যায়। মোচা থেকে দানা সংগ্রহ করতে প্রয়োজনে ভুট্টা মাড়াইযন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে।  
ভুট্টা (খরিপ)
খরিপ মৌসুমে ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এখনই বীজ বপন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে হবে। বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৭ প্রভৃতি ভুট্টার উন্নত জাত।
পাট
ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত পাটের বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। ফাল্গুন মাসে বপন উপযোগী পাটের ভালো জাতগুলো হলো সিসি-৪৫, বিজেআরআই দেশী পাটশাক-১ (বিজেসি-৩৯০), ফাল্গুনী তোষা (ও-৯৮৯৭), বিজেআরআই তোষা পাট-৪ (ও-৭২)। পাট চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করে আড়াআড়িভাবে ৫-৬টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। সারিতে বুনলে প্রতি শতাংশে ২৫ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বুনলে আরেকটু বেশি অর্থাৎ ৩০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। পাটের জমিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার (প্রায় ১ ফুট) এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৭ সেন্টিমিটার (প্রায় ৩ ইঞ্চি) রাখা ভালো। ভালো ফলনের জন্য প্রতি একরে ৭০ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি, ১২ কেজি এমওপি, ১৮ কেজি জিপসাম এবং প্রায় ৪.৫ কেজি জিংকসালফেট সার প্রয়োগ করতে হবে।
শাকসবজি
এ মাসে বসতবাড়ির বাগানে জমি তৈরি করে ডাঁটা, কমলিশাক, পুঁইশাক, করলা, ঢেঁড়স, বেগুন, পটোল চাষের উদ্যোগ নিতে হবে। মাদা তৈরি করে চিচিঙ্গা, ঝিঙা, ধুন্দুল, শসা, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়ার বীজ বুনে দিতে পারেন। সবজি চাষে পর্যাপ্ত জৈবসার ব্যবহার করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে জৈবসার ব্যবহার করলে সবজি ক্ষেতে রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না। নিরাপদ সবজি উৎপাদনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা ও উত্তম কৃষি চর্চা মেনে শাকসবজি আবাদ করতে হবে।
গাছপালা
আমের মুকুলে অ্যানথ্রাকনোজ রোগ এ সময় দেখা দেয়। এ রোগ দমনে গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার পূর্ব পর্যন্ত আক্রান্ত গাছে  প্রোপিকোনাজল অথবা মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক পানিতে মিশিয়ে ¯েপ্র করতে হবে। এ ছাড়া আমের আকার মটর দানার মতো হলে গাছে ২য় বার ¯েপ্র করতে হবে। এ সময় প্রতিটি মুকুলে অসংখ্য হপার নিম্ফ দেখা যায়। আমগাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার আগেই একবার এবং এর এক মাস পর আর একবার সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক পানির সাথে মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপালা ভালোভাবে ভিজিয়ে ¯েপ্র করতে হবে।
কাঁঠালের ফল পচা বা মুচি ঝরা সমস্যা এখন দেখা দিতে পারে। কাঁঠাল গাছ এবং নিচের জমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আক্রান্ত ফল ভেজা বস্তা জড়িয়ে তুলে মাটিতে পুঁতে ধ্বংস করতে হবে। মুচি ধরার আগে ও পরে ১০ দিন পর পর ২/৩ বার বোর্দো মিশ্রণ বা মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
গ্রাফটিং পদ্ধতিতে বরই গাছের কলম করতে পারেন। এজন্য প্রথমে বরই গাছ ছাঁটাই করতে হবে এবং পরে উন্নত বরই গাছের বাডিং বা চোখ, দেশি জাতের গাছে সংযোজন করতে হবে।   
সুপ্রিয় পাঠক, কৃষিকথায় প্রতি বাংলা মাসে কৃষি কাজে অনুসরণীয় কাজগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়। এগুলোর বিস্তারিত ও তথ্যবহুল বিশ্লেষণের জন্য আপনার কাছের কৃষি বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে জেনে নিতে হবে। এ ছাড়াও কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি কল সেন্টার ১৬১২৩ নম্বরে কল করে জেনে নিতে পারেন। আমাদের সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা কৃষিকে নিয়ে যাবে সাফল্যের শীর্ষে। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা।   

লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা, টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪, মেইল:editor@ais.gov.bd

 

বিস্তারিত