Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

ভাদ্র মাস। শরতের আগমন। গ্রীষ্মের প্রচ- গরম আর বর্ষাকালের অবিরাম বর্ষণের পর এই ঋতু জনজীবনে আসে স্বস্তি নিয়ে। প্রকৃতি হয়ে ওঠে স্নিগ্ধ ও মনোরম। কৃষিনির্ভর বাংলার বুকে প্রাপ্তির আশা জাগিয়ে তোলে শরৎ।  সে সাথে পাকা তালের মোহনীয় গন্ধ জানান দেয় এটা ভাদ্র মাস। বাঙালির শিল্প-সাহিত্যে তালের প্রাচুর্য ও জনপ্রিয়তার কারণে রচিত হয়েছে প্রবাদসহ বিভিন্ন রচনাবলী। দেশে তালগাছ কমে যাচ্ছে। প্রকৃতিতেও আসছে বজ্রপাতের বিড়ম্বনা। বাড়ছে মানুষের মৃত্যু সংখ্যা। পরিবেশ সুরক্ষা ও তালের ঐতিহ্য ধরে রাখতে তালের বীজ বপনের এখন উপযুক্ত সময়। 
পেঁয়াজ বর্ষজীবী ফসল। পেঁয়াজ একদিকে যেমন মসলা অন্যদিকে সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশে পেঁয়াজ রবি ও খরিফ উভয় মৌসুমে চাষ হয়ে থাকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পেঁয়াজের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৭.২৫২ লাখ মেট্রিক টন এবং উৎপাদন হয়েছে ৩৮.৫০১ লাখ মেট্রিক টন। চাহিদাসম্পন্ন পেঁয়াজ উৎপাদন হলেও বিজ্ঞানসম্মত সংরক্ষণাগার না থাকায় প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ পেঁয়াজ নষ্ট হয়। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্ত বিরূপ প্রভাব আমাদের দেশে দৃশ্যমান। বিরূপ আবহাওয়ায় পেঁয়াজের ঘাটতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষি বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত গবেষণা করে ফসলের আধুনিক জাত উৎপাদন করে যাচ্ছে। বারি নেগি অনিয়ন-১ দেশের নতুন সম্ভাবনার ফসল। পেঁয়াজের বিকল্প ছাড়াও বহুমুখী ব্যবহার করা হয়। এ সম্পর্কে কৃষিকথায় এবারের সংখ্যায় ‘বারি নেগি অনিয়ন-১: পেঁয়াজের বিকল্প’ তথ্য ও প্রযুক্তি নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
এ ছাড়াও কৃষি বিশেষজ্ঞগণের সময়োপযোগী প্রবন্ধ, ফসল উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি, পুষ্টিবার্তা, আগামীর কৃষি ভাবনা, সফল কৃষকের গল্প এবং মৎস্য, প্রাণিসম্পদ বিভাগ ও নিয়মিত বিভাগ দিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের সংখ্যা। যারা এসব তথ্য-উপাত্তসমৃদ্ধ লেখা দিয়ে কৃষিকথা সমৃদ্ধ করেছেন তাদের প্রতি জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। আশা করি, কৃষিকথা কৃষির সমৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বিস্তারিত
বারি-নেগি-অনিয়ন-১-পেঁয়াজের-বিকল্প

বারি নেগি অনিয়ন-১ পেঁয়াজের বিকল্প
ড. মো. আলাউদ্দিন খান১ মো. মুশফিকুর রহমান২ রুম্পা সরকার৩
নেগি অনিয়ন এক বর্ষজীবী ফসল হিসেবে চাষ করা হয়। এ প্রজাতির পেঁয়াজের উৎপত্তি স্থল পূর্ব এশিয়া (উত্তর-পশ্চিম চীন, জাপান এবং সাইবেরিয়া)। বর্তমানে জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উৎপাদন করা হয়ে থাকে। নেগি অনিয়ন বাংলাদেশের জন্য নতুন ফসল। এ প্রজাতিটি ২০২০ সালে জাপান থেকে এ দেশে প্রবর্তন করা হয়। প্রদেশীয় আবহাওয়ায় নেগি অনিয়ন চাষের জন্য খুবই উপযোগী। বছরব্যাপী এ পেঁয়াজ চাষ করা যায়, তবে রবি মৌসুমে এর ফলন বেশি হয়। এ প্রজাতিটি সারা বছরই ছাদ বাগান, বসতভিটাসহ বিভিন্ন জায়গায় চাষ করা যায়। কৃষক পর্যায়ে চাষের জন্য এ ফসলটি বারি নেগি অনিয়ন-১ নামে জুন ২০২৪-এ অনুমোদিত হয়েছে। পেঁয়াজের বিকল্প ছাড়াও এর বহুমুখী ব্যবহার আছে বিধায় নতুন ফসলটি পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।   
বারি নেগি অনিয়ন-১ এর বৈশিষ্ট্য
সাধারণ পেঁয়াজের মতো বারি নেগি অনিয়ন-১ এ কন্দ উৎপাদন হয় না। কন্দের পরিবর্তে পাতার শিরাগুলো পরপর আচ্ছাদিত হয়ে একটি লম্বা ও মোটা সাদা সিউডোস্টেম উৎপন্ন হয়। সিউডোস্টেমের গঠন নরম ও রসালো হয়। মূল বাদে সিউডোস্টেম ও পাতা এর ভক্ষণযোগ্য অংশ। এর স্বাদ, গন্ধ ও ঝাল সাধারণ পেঁয়াজের মতো, বিধায় নেগি অনিয়ন পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত গাছে ফুল আসার পূর্ব পর্যন্ত সিউডোস্টেম খাওয়া হয়। গাছে ফুল দ- উৎপন্ন হওয়ার পরে সাদা সিউডোস্টেম তুলনামূলকভাবে শক্ত হয়ে যায়। এর পাতা ও ফুল দ-  ফাঁপা থাকে। এর ফুল দ- ও পাতার মতো। সাধারণ পেঁয়াজের পাতার তুলনায় এর পাতা খুবই বড়, নলাকার ও গাঢ় সবুজ হয়ে থাকে। বারি নেগি অনিয়ন-১ এর পাতার আকৃতি প্রায় গোলাকার, তাই এর পাতার প্রস্থচ্ছেদ দেখতে “ঙ” (গোলাকার) আকৃতির। কিন্তু সাধারণ পেঁয়াজ পাতার এর গাছের দিকের অংশ সমান এবং অন্য তিন দিকের অংশ গোলাকার, তাই এর পাতার প্রস্থচ্ছেদ দেখতে “উ” আকৃতির।  এ প্রজাতির পেঁয়াজের গাছের উচ্চতা ৭০-৭৫ সেমি. এবং প্রতিটি সাদা সিউডোস্টেমের দৈর্ঘ্য ও ওজন যথাক্রমে  ২৫-৩০ সেমি. ও ৮০-১০০ গ্রাম হয়ে থাকে। এ ফসলটিতে শুধুমাত্র বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার হয়ে থাকে। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে গাছে ফুল ধরা শুরু হয়। 
বারি নেগি অনিয়ন-১ এর ব্যবহার
পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন মাছ, মাংস, শাকসবজি, খিচুড়ি রান্নায় ব্যবহার ছাড়াও ইহা সালাদ, আচার, সস, সুপ, অমলেট, নুডলস, পিজা, স্যান্ডউইচসহ বিভিন্ন ফাস্ট ফুডের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় (ঐধর, ২০১৫ ধহফ)। এর গাঢ় সবুজ পাতা ও কা- সবজি হিসেবেও খাওয়া যায়। সিউডোস্টেম দ্বারা তৈরি ভর্তা খুবই সুস্বাদু। নেগি অনিয়নের সাদা সিউডোস্টেমটি আগুনে ঝলসিয়ে খেতেও খুবই মজাদার।
পুষ্টি ও ঔষধি গুণাবলী
নেগি অনিয়নে কার্বোহাইড্রেট, আঁশ, পটাশিয়াম, কপার, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, জিঙ্ক, ভিটামিন এ, ভিটামিন বি-১, ভিটামিন বি-২, ভিটামিন বি-৩, ভিটামিন বি-৫, ভিটামিন বি-৬, ভিটামিন বি-৯, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ই, ভিটামিন-কে ইত্যাদি পুষ্টিতে ভরপুর (জাপানের শিক্ষা, সংস্কৃৃতি, ক্রীড়া, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ২০১৫ এবং ইউএসডিএ, ২০২৩)। জাত ও চাষ পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ তারতম্য হতে পারে। নেগি অনিয়নে ফুরানিওল, ডাইমিথাইল ট্রাইসালফাইড, অ্যালাইল মিথাইল ট্রাইসালফাইড, মিথাইল প্রোপাইল ট্রাইসালফাইড ইত্যাদি সুগন্ধি থাকে (ডধহম বঃ ধষ., ২০২৩)। প্রতিরোধী ও এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে থাকে (ঈৎুংঃধষ বঃ ধষ., ২০০৩)। ইহা হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, সাধারণ ঠা-াজনিত রোগ, জ¦র, মাথাব্যথা, ক্ষত, শরীরের স্থুলতা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে থাকে। নেগি অনিয়ন শরীরের বিপাকীয় কার্যকারিতা এবং দৃষ্টিশক্তির উন্নতি করে (ঐধর, ২০১৫)। 
মাটি ও আবহাওয়া
বারি নেগি অনিয়ন-১ বিস্তৃত জলবায়ু এবং পরিবেশগত পরিস্থিতির সাথে ভালোভাবে অভিযোজিত। তাই এ প্রজাতিটি নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল এবং উষ্ণ/অব-উষ্ণ অঞ্চলে জন্মাতে পারে। রৌদ্রোজ্জ্বল জায়গায় ভালো নিষ্কাশনযুক্ত এটেল-দো-আঁশ থেকে বেলে-দো-আঁশ এবং ৫.৭-৭.৫ ঢ়ঐ মাটিতে এ ফসল সুন্দরভাবে জন্মে থাকে। তবে গাছের বৃদ্ধির জন্য ১৫-২২ক্ক সেলসিয়াস তাপমাত্রা উত্তম। এ প্রজাতিটি জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। 
জমি তৈরি
কমপক্ষে ২৫-৩০ সেমি. গভীর পর্যন্ত জমিতে ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে ঢেলা ভেঙে ঝুরঝুরে করে প্রস্তুত করা হয়। শিকড়ে নেমাটোডের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য মূল জমি তৈরির সময় প্রতি বিঘা জমিতে ৪ কেজি (৯ গ্রাম/৩ বর্গ মিটার, ৩০ কেজি/হেক্টর) রাগবী ৫ জি প্রয়োগ করতে হবে। আগাছাসহ অন্যান্য আবর্জনা ভালোভাবে পরিস্কার করতে হবে। পরে জমিতে ১ মিটার চওড়া এবং ৩ মিটার দৈর্ঘ্য (আদর্শ বেডের পরিমাপ) অথবা সুবিধামতো দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করে অনেকগুলো উঁচু বেড তৈরি করতে হবে। একটি বেড থেকে অন্য বেডের মাঝখানে কমপক্ষে ৫০ সেমি. নালার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে পানি নিষ্কাশন ও অন্যান্য আন্তঃপরিচর্যার কার্যক্রম সহজ হয়। নালার মাটি বেডের উপর দিতে হবে যাতে বেড উঁচু হয়। প্রয়োজন মতো জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া ছাদ বাগান, বিভিন্ন পাত্র, বসতভিটাসহ বিভিন্ন পতিত জায়গায় চাষ করা যায়। বারি নেগি অনিয়ন-১ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না বিধায় বর্ষা মৌসুমে উপরোল্লেখিত জায়গাসহ নিষ্কাশন যোগ্য যে কোন উঁচু স্থানে উৎপাদনের জন্য উপযোগী।
বীজ বপন 
বারি নেগি অনিয়ন-১ সারা বছর চাষযোগ্য, তাই যে কোনো মাসে এর বীজ বপন করা যায়। তবে মধ্য জুলাই (শ্রাবণের প্রথম) মাস থেকে বীজ বপন শুরু করলে এর ফলন বেশি হয়। রোপণ দূরত্ব ২০ সেমি. দ্ধ ২০ সেমি. বজায় রেখে নেগি অনিয়ন উৎপাদন করলে প্রতি বিঘা জমিতে ৪০০-৫৩৫ গ্রাম (১ গ্রাম/৩ বর্গ মিটার, ৩-৪ কেজি/হেক্টর) বীজের প্রয়োজন হয়। বপনের পূর্বে বীজ প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি বা অটোস্টিন ৫০ ডব্লিউ ডিজি ছত্রাকনাশকের (প্রতি কেজি বীজের জন্য ২.৫ গ্রাম ছত্রাকনাশক) মাধ্যমে শোধন করা ভালো।  
চারা রোপণ  
বীজ বপনের ৩৫-৪০ দিন পর চারা উত্তোলন করে মূল জমিতে রোপণ করা হয়। নেগি অনিয়নের উচ্চতা বেশি হওয়ায় প্রস্তুতকৃত জমিতে তুলনামূলকভাবে মাটির গভীরে চারা রোপণ করা হয়ে থাকে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০ সেমি. বজায় রেখে প্রতি সারিতে ২০ সেমি. পরপর চারা রোপণ করা হয়। প্রতি ৩ বর্গ মিটার বেডের জন্য ৭৫টি চারার প্রয়োজন হয়। রোপণের পূর্বে চারার গোড়া রোভরাল ৫০ ডব্লিউপি দ্রবণে (২ গ্রাম/লিটার পানি) শোধন করতে হবে। চারার উচ্চতা বেশি হলে ডগা থেকে কিছু অংশ কেটে দেওয়া উচিত, তাতে চারা সহজেই মাঠে প্রতিষ্ঠিত হবে।  
সার প্রয়োগ পদ্ধতি
বারি নেগি অনিয়ন-১ এ কন্দ হয় না, তাই এ ফসলের জমিতে ফসফরাস সার কম প্রয়োজন। সিউডোস্টেম ও পাতার বৃদ্ধির জন্য নাইট্রোজেন সার তুলনামূলক বেশি দরকার হয়। জমির অবস্থা বুঝে সারের মাত্রা কম-বেশি হয়ে থাকে। এ ফসলের জমিতে  বিঘাপ্রতি ৪০০-৬৫০ কেজি পচা গোবর সার,       ৩০-৩৩ কেজি ইউরিয়া, ১৬-২০ কেজি টিএসপি, ২০-২৩ কেজি এমওপি, ১৬-২০ কেজি জিপসাম প্রয়োগ করতে হয়। সম্পূর্ণ গোবর, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম এবং এক চতুর্থাংশ ইউরিয়া জমি তৈরির সময় দিতে হবে। বাকি ইউরিয়া উৎপাদন মৌসুমে তিন কিস্তিতে সমানভাবে চারা রোপণের ২৫-৩০, ৫০-৬০ এবং ৮০-৯০ দিন পর প্রয়োগ করতে হয়।
রোগবালাই ব্যবস্থাপনা
বারি নেগি অনিয়ন-১ এ সাধারণত পার্পল ব্লচ রোগ হয় না, তবে মাঝে মাঝে পাতার অগ্রভাগে স্টেমফাইলিয়াম ব্লাইট রোগ দেখা দিতে পারে। এ রোগের কারণে পাতার অগ্রভাগ কালো বর্ণ ধারণ করে। অধিক তাপমাত্রা ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এ রোগ হয়ে থাকে। সাধারণত আক্রান্ত গাছ, বায়ু ও গাছের পরিত্যক্ত অংশের মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। এ রোগ দমনের জন্য ছত্রাকনাশক অটোস্টিন ৫০ ডব্লিউপি বা প্রোভ্যাক্স ২০০ ডব্লিউপি  (প্রতি কেজি বীজের জন্য ২.৫ গ্রাম ছত্রাকনাশক) দ্বারা শোধন করে বীজ বপন করতে হবে। জমিতে এ রোগ দেখা দিলে ছত্রাকনাশক, রোভরাল ৫০ ডব্লিউপি (২ গ্রাম/লিটার পানি), এমিস্টার টপ ৩২৫ এসসি (১ মিলি/লিটার পানি), লুনা সেনসেশন (১ মিলি/লিটার পানি) ১০ দিন পরপর পর্যায়ক্রমে স্প্রে করতে হবে। বারি নেগি অনিয়ন-১ এ কোনো থ্রিপসের আক্রমণ হয় না। তবে কখনও কখনও কাটুই পোকার আক্রমণ দেখা যেতে পারে, যা সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য। লার্ভা নেগি অনিয়নের পাতা ছিদ্র করে এবং পাতা খেয়ে থাকে। আক্রান্ত পাতার ভেতর লার্ভার মল দেখা যায়। লার্ভা দমনের জন্য নেগি অনিয়নের জমিতে কীটনাশক এবামেকটিন বেনজয়েট  (প্রোক্লেম/বেল্ট) স্প্রে (১ মিলি/লিটার পানি) করতে হবে। পূর্ণবয়স্ক পোকা দমনের জন্য বিঘা প্রতি ৫টি ফেরোমন ফাঁদ (ঝঢ়ড়ফড়-খঁৎব) ব্যবহার করতে হবে।
আন্তঃপরিচর্যা
বারি নেগি অনিয়ন-১ এ সময়মতো আগাছা নিড়াতে হবে ও পানি সেচ দিতে হবে। গাছের উচ্চতা বেশি হওয়ার কারণে রোপণের এক মাস পর থেকে মাঝে মাঝে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে।
সংগ্রহ ও ফলন
বীজ বপন সময়ের উপর বারি নেগি অনিয়ন-১ এর জীবনকাল নির্ভর করে। জুলাই (শ্রাবণের প্রথম) মাসে বীজ বপন করলে এ ফসলের জীবনকাল ২৬০-২৭০ দিন (বীজ হতে বীজ সংগ্রহ) হয়। এ মাসে বীজ বপন করলে ১০০-১৮০ দিনের মধ্যে যে কোনো সময়ই সিউডোস্টেম সংগ্রহ করা যায়। এ সময় সিউডোস্টেমের গঠন নরম ও রসালো হয়। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে গাছে ফুল ধরা শুরু হলে সিউডোস্টেম তুলনামূলকভাবে কিছুটা শক্ত হয়ে। হাত দিয়ে সম্পূর্ণ গাছটি সংগ্রহের পর এর থেকে মূল এবং পুরাতন পাতাসহ পাতার শিরা (পত্রফলকের নিচের অংশ) ফেলে দিয়ে ২-৩টি নেগি অনিয়ন (সিউডোস্টেমসহ পাতা) লম্বা পলিথিন মোড়কের মধ্যে ঢুকিয়ে বাজারজাত করলে নেগি অনিয়ন তাজা থাকে। বারি নেগি অনিয়ন-১ (পাতাসহ সিউডোস্টেম) এর ফলন বিঘাপ্রতি ২.৫-৩.৩ মে. টন (২০-২৫ মে. টন/হেক্টর)। নেগি অনিয়ন পলিথিনের ভেতরে রেখে এক মাস পর্যন্ত রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করা যায়। বীজের ফলন হেক্টর প্রতি ১৫০-১৭০ কেজি। বীজের ফলন রোপণ দূরত্ব, প্রতি গোছায় ফুল দ-ের সংখ্যা এবং অন্যান্য পরিচর্যার উপর ভিত্তি করে কমবেশি হতে পারে। বারি নেগি অনিয়ন-১ এর ১০০০টি বীজের ওজন ২.০০-২.৫০ গ্রাম।

লেখক : ১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২-৩বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, ফরিদপুর। মোবাইল : ০১৭১১-৫৭৩৩৬১, ই-মেইল :khanalauddinsrsc@gmail.com

বিস্তারিত
তালের-চিনি-ও-গুড়-তৈরির-আধুনিক-কৌশল

তালের চিনি ও গুড় তৈরির আধুনিক কৌশল
ড. মো. শরিফুল ইসলাম১, ড. মো. শামসুল আরেফীন২
তাল চাষ গ্রামীণ অর্থনীতি, কর্ম সংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন এবং পরিবেশ উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। তালগাছ বাংলাদেশের সকল এলাকায় অযত্ন অবহেলায় জন্মে থাকে। এ গাছ পানি ছাড়াই দীর্ঘদিন বাঁচতে পারে। আবার গাছের গোড়ায় পানি দাঁড়ালেও সহজে মারা যায় না। তালগাছ রাস্তার ধারে, বাড়ির আশে-পাশে, জমির আইলে, পুকুরপাড়, রেললাইন ইত্যাদি পরিত্যক্ত স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে জন্মাতে দেখা যায়। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা করে এ দেশে তাল চাষ হয় না। তালগাছে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল আলাদা আলাদাভাবে জন্মায়। ফুল না আসা পর্যন্ত স্ত্রী ও পুরুষ গাছ চেনা যায় না। তালগাছের পুরুষ গাছ হতেই সাধারণত রস সংগ্রহ করা হয়। তবে  কোন কোন এলাকায় স্ত্রী গাছ হতেও রস সংগ্রহ করা হয়।  
তালগাছ হতে রস সংগ্রহ ও গুড় উৎপাদন কৌশল
গাছ নির্বাচন 
তালগাছ হতে রস সংগ্রহের জন্য কমপক্ষে ১০-১২ বছর বয়সের সুস্থ গাছ নির্বাচন করা উচিত। যেসব গাছ দেখতে সুস্থ সবল সেসব গাছ নির্বাচন করলে অধিক রস আহরণ করা সম্ভব।
তাল বাগান
প্রয়োজনীয় উপকরণ 
ধারালো দা, মাটির পাত্র বা হাঁড়ি, লোহার বা স্টিলের কড়াই, চুলা, জ্বালানি, হাতা, ছাঁকনী, একটি বাঁশ গিড়াসহ ও দড়ি।
রস সংগ্রহ পদ্ধতি 
পুরুষ ও স্ত্রী উভয় গাছ হতে রস সংগ্রহ করা যায়। মার্চের শেষ সপ্তাহে (চৈত্রের ২য় সপ্তাহে) পুরুষ তালের পুষ্পমঞ্জরি বড় হয়। নরম পুষ্পমঞ্জরিকে প্রথম ৩ দিন প্রতিদিন আধা ঘণ্টা হাত দিয়ে উপর থেকে নিচে পর্যন্ত এক হাতে ধরে অপর হাতের তালুর চাপের মাধ্যমে উপর থেকে নিচে হালকাভাবে সকালে ও বিকেলে প্রায়    ৪৫-৫০ বার হালকাভাবে টানতে হবে। জোরে আঘাত করা যাবে না। পুষ্পমঞ্জরি একটু শক্ত হলে পুষ্পমঞ্জরির ২ পার্শ্বে ২টি কঞ্চি/বাঁশের বাতা দিয়ে উপর থেকে নিচে ২-৩ দিন সকাল ও বিকেলে ২০-২৫ বার টানতে হবে। এরপর পুষ্পমঞ্জরির শেষ প্রান্তে ধারালো দা দিয়ে সোজা করে কাটতে হবে।
পুরুষ তালগাছের পুষ্পমঞ্জরি 
পুরুষ তালগাছের পুষ্পমঞ্জরি
কাটা অংশ দিয়ে মিষ্টি রস পড়তে থাকে। রস সংগ্রহের জন্য মঞ্জরিদ-ের কাটা অংশের নিচে হাঁড়ি বেঁধে দিতে হবে। রস ভাল রাখতে হলে প্রতিদিন ৩ বার রস সংগ্রহ করা উচিত। সকাল ৬টা, দুপুর ১২টা ও বিকাল ৬টা। রস সংগ্রহের সময় পুষ্পমঞ্জরি ও হাঁড়ি পাটের চট/মোটা সুতি কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। একটি পুরুষ তালগাছে ৬-৭টি হাঁড়ি লাগানো যেতে পারে। প্রতিটি হাঁড়িতে ৪-৫ পুস্পমঞ্জরি রেখে বাকীগুলো কেটে ফেলতে হবে। মার্চ থেকে মধ্য জুলাই (আষাঢ় মাস) পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা যায়। পূর্ণ বয়স্ক একটি পুরুষ তালগাছ হতে প্রতিদিন ২৫-৩০ লিটার পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা যায়। 
স্ত্রী তালগাছ : মে মাসে ফলের মঞ্জরিদ- বেড় হলে ধারালো দা দিয়ে কাটতে হয়। এই কাটা অংশ দিয়ে ফোটায় ফোটায় মিষ্টি রস পড়তে থাকে। রস সংগ্রহের জন্য মঞ্জরিদ-ের কাটা অংশের নিচে মাটির হাঁড়ি লাগানো হয়।
স্ত্রী তালগাছের রস সংগ্রহ পদ্ধতি 
তালের গুড় উৎপাদন কৌশল 
স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তালের গুড় উৎপাদনের জন্য রস সংগ্রহের পর পরিষ্কার কাপড় দিয়ে রস ছেকে চুলার উপর বসানো লোহার বা স্টিলের কড়াইতে ঢালা হয়। চুলার উপর কড়াই বসানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন কড়াই ও চুলার মধ্যে কোনো ফাঁক না থাকে। আরও খেয়াল রাখতে হবে যেন চিমনি থেকে ফ্লু গ্যাসের সাথে বের হয়ে যাওয়া ছাই কড়াইয়ের রসের সঙ্গে মিশতে না পারে। রস জ্বাল দেয়ার প্রথম অবস্থায় রসের উপরিভাগে যে গাদ বা ফেনা ভেসে  উঠে তা যত দ্রুত সম্ভব ছাঁকনি বা হাতা দিয়ে উঠিয়ে ফেলে দিতে হবে। গাদ বা ফেনা উঠাতে দেরি হলে তা রসের সাথে মিশে জটিল অপরিশোধনযোগ্য অবস্থায় চলে যাবে। ফলে গুণগতমান সম্পন্ন গুড় উৎপাদন করা সম্ভব নয়। রস ঘনীভূত হয়ে সিরাপের মতো হলে কড়াইয়ের ফুটন্ত ঘনীভূত রস বা সিরাপ হাতলের সাহায্যে লাগাতারভাবে নাড়াত হবে এবং খুব দ্রুত চুলার তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে হবে। এই অবস্থায় কড়াইয়ের চার ধারে কিছু গাদ সৃষ্টি হয়, যা লাগাতারভাবে তুলে ফেলতে হবে। চুলা থেকে গুড় নামানোর সময় নিশ্চিত করতে চাইলে হাতলের সাহায্যে সামান্য গুড় অর্থাৎ এক চিমটি পরিমাণ গুড় ২০০ মিলি ঠা-া পানিতে ছেড়ে দিতে হবে। গুড় পানিতে দ্রুত জমাটবদ্ধ হলে বুঝতে হবে চুলা থেকে গুড় নামানোর উপযোগী হয়েছে এবং দ্রুত চুলা থেকে কড়াই নামিয়ে ফেলতে হবে।  
 তালের রস
মাটির হাঁড়িতে তালের গুড় 
 তালের পাটালি 
তালের চারা উৎপাদন, রস সংগ্রহ, রস বিক্রয়, গুড় তৈরি, গুড় পরিবহন, গুড় বাজারজাতকরণ এবং গুড় ব্যবহারের ফলে গ্রামীণ বিরাট জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচন এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের দুর্যোগ প্রতিরোধ, খরাপ্রবণ বরেন্দ্র এলাকার পরিবেশ উন্নয়নসহ দেশের সার্বিক পরিবেশ উন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। 

ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, শারীরতত্ত্ব ও চিনি রসায়ন বিভাগ, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ^রদী-৬৬২০, পাবনা। মোবাইল-০১৭১৫১৩৯২২১; ই-মেইল :sharifbsri75@gmail.com

বিস্তারিত
তিলের-ফলন-বৃদ্ধিতে-পানি-নিষ্কাশন-ব্যবস্থাপনা

তিলের ফলন বৃদ্ধিতে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা 
ড. মো. হোসেন আলী১ পার্থ বিশ্বাস২
বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনে তেল ফসল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিল বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম ভোজ্যতেল ফসল। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই তিলের চাষ হয়। আমাদের দেশে সাধারণত কালো ও খয়েরি রঙের বীজের তিলের চাষ বেশি হয়। তিলের বীজে ৪২-৪৫% তেল এবং ২০% আমিষ থাকে। বাংলাদেশে প্রায় ৩৩ হাজার হেক্টর জমিতে তিল চাষ হয় এবং মোট উৎপাদন প্রায় ২৯ হাজার মে. টন। কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ (২০০৫-২০১৭) অনুযায়ী তিলের জাতীয় গড় ফলন হেক্টর প্রতি ৮৪০ কেজি যা, ২০০৫ সালের পূর্বে ছিল ৫০০-৬২০ কেজি। বাংলাদেশে খরিফ এবং রবি উভয় মৌসুমেই তিলের চাষ করা হয়। তবে বর্তমানে দুই-তৃতীয়াংশ তিলের আবাদ খরিফ মৌসুমে হয়। খরিফ মৌসুমে ভালো ফলনের অন্যতম অন্তরায় অতি বৃষ্টি ও আকস্মিক ঝড় এবং জমিতে সঠিক নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব। সুষ্ঠু পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তিলের ফলন বাড়ানো সম্ভব।
স্থানীয় চাষাবাদ পদ্ধতিতে সমস্যা : সাধারণত কৃষকরা সমতল জমিতে ছিটিয়ে তিল ফসল বপন করেন। অধিকাংশ বপনকৃত জমিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা তথা বেড নালা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। খরিফ মৌসুমে ফুল আসা পর্যায়ে এবং ফল ধারণপর্যায়ে ঝড় ও অতি বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ঝড় হলে গাছ হেলে পড়ে এবং অতি বৃষ্টির ফলে অধিক সময় জলাবদ্ধতা থাকলে পরবর্তীতে রৌদ্রউজ্জ্বল আবহাওয়ায় তিল গাছ ঢলে পড়ে। ফলে তিলের স্বাভাবিক ফলন ব্যাহত হয় এবং বহুলাংশে হ্রাস পায়। 
প্রযুক্তির বর্ণনা : ১.৫ মিটার চওড়া বেড ও পর পর দু’টি বেডের মধ্যবর্তী ৩০ সেন্টিমিটার নালা করে নির্দেশনা অনুযায়ী সঠিক মাত্রার সার (প্রতি হেক্টরে ইউরিয়া-১৪০ কেজি, টিএসপি-১৪৫ কেজি, এমওপি-৬৫ কেজি, জিপসাম-১১২ কেজি, জিংক সালফেট-৫ কেজি এবং বোরিক এসিড-৯ কেজি) প্রয়োগসহ সারিতে বীজ বপন করতে হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী অনান্য পরিচর্যা করতে হবে যেমন- বপনের ১৫-২০ দিনের মধ্যে পাতলাকরণ ও আগাছা মুক্ত করা, নির্দিষ্ট মাত্রায় ১০ দিন ব্যবধানে দুবার ছত্রাকনাশক স্প্রে করা। প্রয়োজন হলে দুটি বেডের নালা সংস্কার করে দিতে হবে এবং জমির নালাগুলোর মুখ থেকে পানি নির্গমনের (নিচের দিকে) ব্যবস্থা রাখতে হবে।
টেবিল: বিভিন্ন ব্যবস্থাপনায় ফলন, প্রকৃত আয়, বিসিআর এবং ফলন বৃদ্ধি।
বি. দ্র.: তিন বছরের (২০২০, ২০২১ ও ২০২২) গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ।
ব্যবহৃত জাত : বিনাতিল-২, বিনাতিল-৩, বিনাতিল-৪, বারিতিল-৩ এবং বারিতিল-৪
প্রযুক্তির ব্যবহারিক প্রয়োগ : ময়মনসিংহ, মাগুরা, ‍কুষ্টিয়া এবং ঈশ্বরদী অঞ্চল।
প্রযুক্তি থেকে লাভ : গতানুগতিক সমতল জমিতে তিল চাষাবাদের পরিবর্তে উন্নত জাত এবং ১.৫ মিটার চওড়া বেড ও দুই বেডের মাঝে ৩০ সেন্টিমিটার নালা পদ্ধতিতে তিলের ফলন গড়ে প্রায় ৪৫-৬৭ শতাংশ বৃদ্ধি এবং হেক্টরপ্রতি প্রকৃত আয় প্রায় ২.৫ গুণ বৃদ্ধি পায় (টেবিল)।

লেখক: ১মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা২, কৃষি প্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), ময়মনসিংহ; ফোন-০১৭২৭৬৫৬২১৬, ই-মেইল: parthi.biswas@gmail.com

বিস্তারিত
গুণগত-মানসম্পন্ন-আম-উৎপাদনে-আধুনিক-পরিচর্যা

গুণগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদনে আধুনিক পরিচর্যা
ড. মোঃ শরফ উদ্দিন
উত্তম কৃষি চর্চা বা (এঅচ) হলো সামগ্রিক কৃষি কার্যক্রম যা অনুসরণে নিরাপদ এবং মানসম্পন্ন খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত পণ্য সহজলভ্য, পরিবেশগত, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সুরক্ষা সুসংহত করে। উত্তম কৃষি চর্চায় এমন পদ্ধতিসমূহের চর্চা করা হয়, যা খামারে প্রয়োগ করার ফলে উৎপাদন, সংগ্রহ এবং সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে নিরাপদ ও মানসম্পন্ন খাদ্যের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। ফলশ্রুতিতে নিরাপদ ও মানসম্পন্ন খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত কৃষিজাত পণ্য সহজলভ্য হয়ে থাকে। এটি একগুচ্ছ নীতি-বিধি ও প্রযুক্তিগত সুপারিশমালা যা সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও পরিবহনের বিভিন্ন স্তরে প্রয়োগ করা হয় যা মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও কাজের পরিবেশ উন্নত করে। এ সকল নিরাপদ মানদ- নিশ্চিতে বিশেষ করে ফসল মাঠে নির্দিষ্ট মানদ- অনুযায়ী নিরাপদ কৃষি পণ্য উৎপাদনের সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য নীতিমালা বা পদ্ধতিই হলো বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চা।
উত্তম কৃষি চর্চা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য হলো- নিরাপদ ও পুষ্টিমান সম্পন্ন ফসলের টেকসই উৎপাদন নিশ্চিতকরণ; পরিবেশ সহনীয় ফসল উৎপাদন নিশ্চিতকরণ এবং কর্মীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও কল্যাণ সাধন; খাদ্য শৃঙ্খলের সকল স্তরে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিসমূহ অনুসরণ করা; ভোক্তার স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং মানসম্পন্ন উচ্চমূল্য ফসল উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি করা।
আম বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী এবং বাণিজ্যিক ফসল। এ দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে এ ফলটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আম উৎপাদনকারী এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থা অনেকাংশেই আমের উপর নির্ভরশীল। প্রধান প্রধান আম উৎপাদনকারী এলাকা যেমন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, রংপুর, সাতক্ষীরা ইত্যাদি জেলাগুলোর   ৮০-৮৫ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমের সাথে জড়িত থাকে। বর্তমানে যে ফলগুলো বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে আম সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিবিএস ২০২৩ সালের তথ্য মতে এদেশে ১২.০৭ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা এর তথ্য অনুযায়ী এদেশে আম উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ২৩.৫ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ আমাদের দেশে আমের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় যথেষ্ঠ। এরপরও বাজারে গুণগত মানসম্পন্ন ও রপ্তানিযোগ্য আমের অভাব রয়েছে। ফলে আম রপ্তানি পরিমাণ আশানুরূপভাবে বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ভালোমানের গুণগত মানসম্পন্ন ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের এখনই উপযুক্ত সময়। এখন থেকে উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে আম উৎপাদন করা সম্ভব হলে ভালোমানের আম উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং রপ্তানির পরিমাণ বাড়বে। 
আম বাগানের যত্ন ও পরিচর্যা
বারোমাসী জাতের আম বারি আম-১১ এবং কাটিমুন প্রায় সারা বছরই বাগানে থাকে এবং এসব জাতের যত্ন-পরিচর্যা মৌসুমি জাতের মতো নয়। সুতরাং এ জাতগুলো নিয়ে আলাদা ব্যবস্থাপনা রয়েছে। 
ডালপালা ছাঁটাইকরণ : আম সংগ্রহের সাথে সাথেই এ কাজটি করার জন্য আম চাষিদের পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। গাছের মরা ও রোগাক্রান্ত ডালপালা, অন্য গাছের ভেতরে প্রবেশ করেছে এ সকল ডালপালা এবং গাছের আকৃতি সুন্দর রাখতে বড় ডালপালার কিছু অংশ কর্তন করতে হবে। এ ছাড়াও গাছের ক্যানোপি অত্যন্ত ঘন হলে গাছের ভেতরের কিছু ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে। আম সংগ্রহ করার পর মুঞ্জুরীটি গাছে লেগে থাকলে সেটি অপসারণ করতে হবে। এর ফলে গাছে দ্রুত নতুন কুশি জন্মাবে। আম সংগ্রহ করার পর একটি গাছে যত বেশি নতুন কুশি আসবে ততই পরের মৌসুমে ফুল আসার সম্ভবনা বেশি। জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে একটি ফলবান গাছে যত বেশি কুশি আনা যাবে ততই মঙ্গল। অর্থাৎ বাণিজ্যিকভাবে আম চাষাবাদের ক্ষেত্রে ডালপালা ছাঁটাইকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কিন্তু বেশিরভাগ চাষি এ বিষয়টি জানেন না অথবা গুরুত্ব দিয়ে সময়মতো কাজটি করেন না। গুণগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রুনিং ও ট্রেনিং এর গুরুত্ব রয়েছে।
আগাছা পরিষ্কার : আগাছা আম গাছের খাদ্যে ভাগ বসায় এবং রোগ ও পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। অধিকাংশ আম বাগানগুলো এসময় আগাছা দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে। বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করলে সারা বছর আম বাগান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আম বাগান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলে রোগবালাই এর আক্রমণ অনেক কমে যায় এবং উৎপাদিত ফলের গুণগত মান ভালো হয়। আম গাছের গোড়ায় এবং আমবাগানে যাতে আগাছা না জন্মায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আগাছা দমন করতে বাগানে লাঙ্গল বা টিলারের সহায্যে মাঝে মাঝে চাষের ব্যবস্থা করতে হবে।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি : আমবাগান হতে প্রতি বছর ভাল ফলন পাওয়ার জন্য সময়মত সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিটি গাছে প্রতি বছর কি পরিমাণ সার দিতে হবে তা নির্ভর করে মাটিতে বিদ্যমান সহজলভ্য পুষ্টি উপাদানের উপর। সব ধরনের মাটিতে সারের চাহিদা সমান নয়। সুতরাং মাটির অবস্থাভেদে সারের চাহিদা কম-বেশি হতে পারে। গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের চাহিদাও বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চায় আম বাগানে সার প্রয়োগের পূর্বে মাটির পুষ্টি উপাদান বিশ্লেষণের পর মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ফলে কোন উপাদানের ঘাটতি হওয়ার সম্ভবনা কম থাকে।
চারা রোপণের পর গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত সুষম সার প্রয়োগ করা আবশ্যক। গাছ বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের পরিমাণও বাড়াতে হবে। চারা রোপণের পূর্বে প্রতিটি গর্তে ১০ কেজি পচা গোবর সার, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ২০০ গ্রাম এমওপি, জিপসাম ৩১৩ গ্রাম, জিংক সালফেট ২৮ গ্রাম এবং বোরিক এসিড ৫৯ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। এরপর ভালোভাবে গর্তের মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর গর্ত ভরাট করে ১৫ দিন রেখে দিতে হবে। ভালোভাবে পচন সম্পন্ন হলে পুনরায় গর্তের মাটি ওলট-পালট করে গর্তের মাঝখানে কলমের চারা লাগাতে হবে। এরপর গাছের বয়স অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে (সারণি দ্রষ্টব্য)। 
সারণি : গাছের বয়স অনুযায়ী সারের পরিমাণ
মাটিতে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ কম/বেশি হলে এ মাত্রাটি সমন্বয় করে প্রয়োগ করতে হবে। 
সার প্রয়োগ পদ্ধতি : বয়সভেদে নির্ধারিত সম্পূর্ণ পরিমাণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম, জিংক সালফেট ও বোরিক এসিড এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও অর্ধেক এমওপি সার সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষ সময়ে প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমওপি সার সমান দুই ভাগ করে এক ভাগ জাতভেদে ফল যখন ফল মটর দানার মতো হয় তখন এবং অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমওপি সার ফল সংগ্রহের কমপক্ষে ১ মাস পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, গাছের চারিদিকে গোড়া থেকে কমপক্ষে ১ থেকে ১.৫ মি. দূরে হালকাভাবে কুপিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স বেশি হলে এই দূরত্ব বাড়তে পারে। সার প্রয়োগের পর হালকা সেচ দিতে হবে। 
সেচ প্রয়োগ পদ্ধতি
আমবাগানে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। তবে সেচের পানি যেন দূষিত না হয় বা পানিতে কোন ভারী ধাতু দ্বারা সংক্রমিত না হয় সেটি নিশ্চিত হতে হবে। সাধারণত গভীর নলকূপের পানি সেচ কাজের জন্য ব্যবহার করা যায়। খরা মৌসুমে ঘন ঘন সেচ দিতে হবে। তবে মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকলে সেচের প্রয়োজন পড়ে না। গবেষণা করে দেখা গেছে আম গাছে পরিবর্তিত বেসিন পদ্ধতিতে অর্থাৎ গাছের গোড়ার চারিদিকে ১ মিটার জায়গা সামান্য উঁচু রেখে দুপুর বেলা যতটুকু জায়গায় গাছের ছায়া পড়ে ততটুকু জায়গায় একটি থালার মতো করে বেসিন তৈরি করে সেচ প্রয়োগ করলে সেচে পানির পরিমাণ কম লাগে এবং গাছ বেশির ভাগ পানি গ্রহণ করতে পারে।
বেসিন পদ্ধতির আরেকটি সুবিধা হলো গাছের গোড়া পরিষ্কার থাকে ফলে আগাছা জন্মাতে পারে না। সেচ প্রয়োগকৃত জায়গা কচুরিপানা দ্বারা ঢেকে দিলে মাটিতে একমাস পর্যন্ত আর্দ্রতা ধরে রাখে। তবে আমগাছে ফুল আসার একমাস আগে সেচ না দেওয়া উত্তম। কারণ কোন কোন সময় দেখা গেছে, এই সময় সেচ দিলে গাছে নতুন পাতা বের হয় ফলে মুকুলের সংখ্যা কমে যায় এবং ফলন কম হয়। আমবাগানে জৈব পদার্থের ঘাটতি থাকলে ধৈঞ্চার চাষ করা যেতে পারে ফলে বাগানে জৈব পদার্থসহ অন্যান্য সার যোগ হবে এবং মাটির উৎপাদন ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে।
ধ্যারা বা পরগাছা : আমাদের দেশে আমগাছে দুই ধরনের পরগাছা উদ্ভিদ জন্মাতে দেখা যায়। স্থানীয়ভাবে পরগাছা উদ্ভিদ ধ্যারা নামে পরিচিত। ছোট গাছের চেয়ে বড় বা বয়স্ক আমগাছে পরগাছার আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। পরগাছা উদ্ভিদের বীজ আম গাছের ডালে অঙ্কুরিত হয়ে বাড়তে থাকে। পরগাছা আমগাছের শাখা-প্রশাখা থেকে  প্রয়োজনীয় পানি, খাদ্যরস, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি শোষণ করে বেঁচে থাকে। পরগাছার শেকড় থাকে না, তারা শেকড়ের মতো এক প্রকার হস্টোরিয়া তৈরি করে। হস্টোরিয়া গাছের ডালে প্রবেশ করে ডাল থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। আক্রান্ত ডালের প্রায় সব খাবার পরগাছা খেয়ে ফেলে, ফলে আক্রান্ত শাখা-প্রশাখা দুর্বল হয়ে পড়ে। আক্রমণ বেশি হলে আম ডালের অস্তিত্ব থাকে না বরং পরগাছা প্রভাব বিস্তার করে বাড়তে থাকে। লরানথাস জাতীয় পরগাছার পাতা দেখতে কিছুটা আম পাতার মতোই। তাই ভালোভাবে লক্ষ্য না করলে দূর থেকে পরগাছার উপস্থিতি বোঝা যায় না তবে পরগাছায় ফুল ও ফল ধারণ করলে দূর থেকে পরগাছার উপস্থিতি বোঝা যায়। এ সময়ে পরগাছা ফুল ফুটন্ত অবস্থায় থাকে ফলে সহজেই শনাক্ত করা যায়। পরগাছা আকর্ষণীয় ফুল ও ফল উৎপন্ন করে। বীজসহ ফল পাখিতে খায় কিন্তু বীজ হজম না হওয়ায় তা মলের সাথে বের হয়ে আসে। এ বীজ আমের ডালে পতিত হয়ে অঙ্কুরিত হয় ও বৃদ্ধি পেতে থাকে। বর্ষাকালে পরগাছার বীজ বিস্তার লাভ করে।  আক্রান্ত ডাল পরগাছার গোড়াসহ কেটে ফেলতে হবে। কাটাস্থানে রোগের সংক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বোর্দোপেস্টের প্রলেপ দিতে হবে। পরগাছায় ফুল ও ফল আসার আগেই সেটি ছাঁটাই করা উচিত।
বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চা শুধুমাত্র গুণগত মানসম্পন্ন উৎপাদন নিশ্চিত করেনা অধিকন্তু কর্মীর স্বাস্থ্য, পরিবেশগত এবং লাভজনক উৎপাদন নিশ্চিত করে। এ দেশে নিরাপদ ও গুণগত মানসম্পন্ন আমের উৎপাদন বাড়াতে হলে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৭১২১৫৭৯৮৯, ই-মেইল:sorofu@yahoo.com

বিস্তারিত
আমন-ধানের-ফলন-বৃদ্ধিতে-করণীয়

আমন ধানের ফলন বৃদ্ধিতে করণীয়
ড. মো. আব্দুল মোমিন
আমন শব্দটির উৎপত্তি আরবি শব্দ ‘আমান’ থেকে যার অর্থ আমানত। অর্থাৎ আমন কৃষকের কাছে একটি নিশ্চিত ফসল বা আমানত হিসেবে পরিচিত ছিল। আবহমান কাল থেকে এ ধানেই কৃষকের গোলা ভরে, যা দিয়ে কৃষক তার পরিবারের ভরণপোষণ, পিঠাপুলি, আতিথেয়তাসহ সংসারের অন্যান্য খরচ মিটিয়ে থাকেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে ২০২২-২৩ আমন মওসুমে দেশে ৫৯ লক্ষ ৩৩ হাজার হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৫৭ লক্ষ ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে উফশী রোপা আমন আবাদ হয়। ২০২৩-২৪ আমন মওসুমে আমন আবাদি জমি ২% বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। 
আমন ধান মূলত দুই প্রকার : রোপা আমন ও বোনা আমন। রোপা আমন অন্য জমিতে চারা প্রস্তুত করে, সেই চারা ক্ষেতে রোপণ করে ধান উৎপন্ন হয় বলে এর এরূপ নাম। রোপা আমন আষাঢ় মাসে বীজতলায় বীজ বোনা হয়, শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে মূল জমিতে রোপণ করা হয় এবং কার্তিক-অগ্রহায়ণ-পৌষ (এলাকাভেদে) মাসে ধান কাটা হয়। বোনা আমন ছিটিয়ে বোনা হয়। চৈত্র-বৈশাখ মাসে মাঠে বোনা আমনের বীজ বপন করা হয় এবং অগ্রহায়ণ মাসে পাকা ধান কাটা হয়। একে আছড়া আমন, বাওয়া আমন বা গভীর পানির আমনও বলা হয়। 
জাত নির্বাচন
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমন মওসুম ও এর পরিবেশ উপযোগী ৪৬টি (৪৪টি ইনব্রিড ও ২টি হাইব্রিড) উফশী ধানের জাত ও ধান উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নানা রকম কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা উদ্ভাবন করেছে। অনুকূল ও প্রতিকূল পরিবেশে চাষযোগ্য আমন জাতগুলো নি¤েœ উল্লেখ করা হলো।
অনুকূল পরিবেশ উপযোগী জাতসমূহ
বিআর৪, বিআর৫, বিআর১০, বিআর১১, ব্রি ধান৩০, ব্রি ধান৩২, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৯, ব্রি ধান৪৯, ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৭৯, ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭২, ব্রি ধান৭৫, ব্রি ধান৮০, ব্রি ধান৮৭, ব্রি ধান৯০, ব্রি ধান৯৩, ব্রি ধান৯৪, ব্রি ধান৯৫ এবং ব্রি ধান১০৩।
প্রিমিয়াম কোয়ালিটি জাত : দিনাজপুর, নওগাঁসহ যেসব এলাকায় সরু বা সুগন্ধি ধানের চাষ হয় সেখানে বিআর৫, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৭, ব্রি ধান৩৮, ব্রি ধান৭০, ব্রি ধান৭৫, ব্রি ধান৮০ ও ব্রি ধান৯০ চাষ করা যায়।
ব্রি উদ্ভাবিত হাইব্রিড জাত : আমন মওসুমের জন্য ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলো হলো ব্রি হাইব্রিড ধান৪ ও ব্রি হাইব্রিড৬। এ জাতগুলো বন্যামুক্ত এলাকায় রোপা আমনে অনুকূল পরিবেশে চাষযোগ্য। এ জাতগুলোর চাল মাঝারি চিকন, স্বচ্ছ ও সাদা এবং লম্বা, ভাত ঝরঝরে হওয়ায় কৃষকের কাছে পছন্দনীয়। 
বীজতলা তৈরি 
উঁচু এবং উর্বর জমিতে বীজতলা তৈরি করতে হবে যেখানে বন্যার পানি উঠার সম্ভাবনা নেই। যেসব এলাকায় উঁচু জমি নেই সেসব এলাকায় ভাসমান বীজতলা তৈরি করার জন্য পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। দীর্ঘ, মধ্যম ও স্বল্প জীবনকালের জাতের জন্য আলাদা আলাদা স্থান ও সময়ে বীজতলায় বপন করতে হবে। পরিমিত ও মধ্যম মাত্রার উর্বর মাটিতে বীজতলার জন্য কোনো সার প্রয়োগ করতে হয় না। তবে নিম্ন, অতি নিম্ন অথবা অনুর্বর মাটির ক্ষেত্রে গোবর অথবা খামারজাত সার প্রতি শতকে ২ মণ হিসাবে প্রয়োগ করতে হবে। ভালো চারা পাওয়ার জন্য ভালো বীজের বিকল্প নেই। তাই বিএডিসি, স্থানীয় কৃষি বিভাগ বা ব্রি কার্যালয়ের সাথে যোগাযোগ করে ভালো বীজ সংগ্রহ করে বীজতলায় বপন করতে হবে। 
আমন বীজতলায় রোগ ব্যবস্থাপনা
আমন বীজতলায় বাঁকানি রোগ দেখা দিতে পারে। বাঁকানি রোগাক্রান্ত ধানের চারা স্বাভাবিক চারার চেয়ে হালকা সবুজ, লিকলিকে হয়ে অন্য চারার ওপরে ঢলে পড়ে। আক্রান্ত চারাগুলো ক্রমান্বয়ে মারা যায়। আক্রান্ত চারার নিচের গিট থেকে অস্থানিক শিকড়ও দেখা যেতে পারে। 
দমন ব্যবস্থাপনা : বাঁকানি রোগ দমনের জন্য অটোস্টিন ৫০ডব্লিউপি বা নোইন দ্বারা বীজ অথবা চারা শোধন করা (১ লিটার পানিতে ৩ গ্রাম অটোস্টিন ৫০ডব্লিউপি বা নোইন মিশিয়ে তাতে ধানের বীজ অথবা চারা ১০-১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা) আক্রান্ত গাছ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। বীজতলা হিসেবে একই জমি ব্যবহার না করা। 
চারা রোপণ 
লাইন বা সারিবদ্ধভাবে চারা রোপণ করতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো ও বাতাস চলাচলের জন্য উত্তর-দক্ষিণ বরাবর সারি করে লাগালে ভালো। সাধারণত সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫ সেমি. (৮ ইঞ্চি) ও গুছি থেকে গুছির দূরত্ব ১৫ সেমি. (৬ ইঞ্চি) রাখলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে। তবে জমি উর্বর হলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫ সেমি. (১০ ইঞ্চি) ও গুছি থেকে গুছির দূরত্ব ১৫ সেমি. (৬ ইঞ্চি) রাখা যেতে পারে।
সম্পূরক সেচ 
আমন চাষাবাদ পুরোটাই বৃষ্টিনির্ভর। তবে প্রতি বছর সকল স্থানে বৃষ্টিপাত এক রকম হয় না। এমনকি একই বছরের একই স্থানে সবসময় সমানভাবে বৃষ্টিপাত হয় না। আমন মওসুমে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের প্রায় ৮০% হয়ে থাকে, যা আমন আবাদের জন্য যথেষ্ট। তবে আমনের বৃষ্টিপাত সময়মতো না হলে ফসলের ক্ষতি হতে পারে। বৃষ্টি-নির্ভর ধানের জমিতে যেকোন পর্যায়ে সাময়িকভাবে বৃষ্টির অভাবে খরা হলে অবশ্যই সম্পূরক সেচ দিতে হবে। প্রয়োজনে সম্পূরক সেচের সংখ্যা একাধিক হতে পারে। তা না হলে ফলনে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। 
সার ব্যবস্থাপনা
আবহাওয়া ও মাটির উর্বরতার মান যাচাই এবং ধানের জাত, জীবনকাল ও ফলন মাত্রার উপর ভিত্তি করে সারের মাত্রা ঠিক করা হয়। আলোক-অসংবেদনশীল দীর্ঘ ও মধ্যমমেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে বিঘাপ্রতি ইউরিয়া-ডিএপি -এমওপি-জিপসাম যথাক্রমে ২৬-৮-১৪-৯ কেজি হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির শেষ চাষে সমস্ত-এমওপি-ডিএপি-জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সমান ভাগে তিন কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। ১ম কিস্তি চারা রোপণের ৭-১০ দিন পর, ২য় কিস্তি চারা রোপণের ২৫-৩০ দিন পর এবং ৩য় কিস্তি কাইচ থোড় আসার   ৫-৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। 
আলোক-অসংবেদনশীল স্বল্পমেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে বিঘাপ্রতি ইউরিয়া-ডিএপি-এমওপি-জিপসাম যথাক্রমে ২০-৭-১১-৮ কেজি হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির শেষ চাষে ১/৩ অংশ ইউরিয়া এবং সমস্ত ডিএপি-এমওপি-জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। বাকি ইউরিয়া সমানভাগে দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। ১ম কিস্তি চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর এবং ২য় কিস্তি কাইচ থোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। 
নাবীতে রোপণকৃত আলোক-সংবেদনশীল জাতের ক্ষেত্রে বিঘাপ্রতি ইউরিয়া-ডিএপি-এমওপি-জিপসাম যথাক্রমে ২৩-৯-১৩-৮ কেজি হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির শেষ চাষে ২/৩ অংশ ইউরিয়া এবং সমস্ত ডিএপি-এমওপি-জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। বাকি ইউরিয়া কাইচ থোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। ব্রি ধান৩২ এবং স্বল্প আলোক-সংবেদনশীল সুগন্ধিজাত যেমন- বিআর৫, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৭ ও ব্রি ধান৩৮ ধানের ক্ষেত্রে বিঘাপ্রতি ইউরিয়া-ডিএপি-এমওপি-জিপসাম যথাক্রমে ১২-৭-৮-৬ কেজি হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে। 
সাশ্র্রয়ী সার ব্যবহারে কয়েকটি প্রযুক্তি 
আমরা জানি, উদ্ভিদের নাইট্রোজেনের অভাব পূরণে জমিতে ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ধরনের জৈবসার (যেমন-সবুজসার, আবর্জনা পচা সার, পচা গোবর), নাইট্রোজেন ফিক্সিং ব্যাকটেরিয়াল ইনোকুলাম প্রয়োগ এবং অ্যাজোলার চাষ বাড়ানো যেতে পারে। ব্রির তথ্য মতে, দুই সেমি. পর্যন্ত পানিযুক্ত কাদা মাটিতে গুটি ইউরিয়া ও প্রিল্ড ইউরিয়া প্রয়োগের মাধ্যমে শতকরা ২৫-৩০ ভাগ ইউরিয়া সাশ্রয় হয়। তবে জোয়ার-ভাটা অঞ্চলে গুটি ইউরিয়ার ব্যবহার করে ভালো ফলন পাওয়া যায়। অন্য দিকে ডাই এমোনিয়াম ফসফেট বা ডিএপি ব্যবহার করলে একই সঙ্গে ইউরিয়া ও ফসফরাসের অভাব পূরণ করা সম্ভব। জিংক সালফেট (মনো বা হেপ্টা) সার ফসফরাস জাতীয় সারের সঙ্গে একত্রে ব্যবহার করা যায় না। এ সমস্যা সমাধানে জিংক সারের সর্বশেষ প্রযুক্তি চিলেটেড জিংক প্রয়োগ করা যেতে পারে। মূল জমিতে ধানের চারা রোপণের ২০-২২ দিন পর প্রথমবার এবং ৪০-৪৫ দিন পর দ্বিতীয়বার ১ লিটার পানিতে ১ গ্রাম লিবরেল জিংক স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যাবে। রোপা আমন ধানের জমি তৈরির সময় বিঘাপ্রতি (৩৩ শতক) ৩০০ কেজি জৈবসার ব্যবহার করলে রাসায়নিক সারের ব্যবহার শতকরা ৩০ ভাগ কমানো সম্ভব। 
আগাছা ব্যবস্থাপনা
ধানক্ষেত ৩৫-৪০ পর্যন্ত আগাছামুক্ত রাখতে পারলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। হাত দিয়ে, নিড়ানি যন্ত্র দিয়ে এবং আগাছানাশক ব্যবহার করে আগাছা দমন করা যায়। রোপা আমন ধানে সর্বোচ্চ দু’বার হাত দিয়ে আগাছা দমন করতে হয়। প্রথমবার ধান রোপণের ১৫ দিন পর এবং পরের বার ৩০-৩৫ দিন পর। নিড়ানি যন্ত্র দিয়ে ধানের দু’সারির মাঝের আগাছা দমন হয় কিন্তু দু’গুছির ফাঁকে যে আগাছা থাকে তা হাত দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়। যান্ত্রিক দমনে অবশ্যই সারিতে ধান রোপণ করতে হবে। আগাছানাশক ব্যবহারে কম পরিশ্রমে ও কম খরচে বেশি পরিমাণ জমির আগাছা দমন করা যায়। প্রি-ইমারজেন্স আগাছানাশক ধান রোপনের ৩-৬ দিনের মধ্যে (আগাছা জন্মানোর আগে) এবং পোস্ট ইমারজেন্স আগাছানাশক ধান রোপণের ৭-২০ দিনের মধ্যে (আগাছা জন্মানোর পর) ব্যবহার করতে হবে। আগাছানাশক প্রয়োগের সময় জমিতে ১-৩ সেন্টিমিটার পানি থাকলে ভালো। আমন মওসুমে আগাছানাশক প্রয়োগের পর সাধারণত হাত নিড়ানির প্রয়োজন হয় না। তবে  আগাছার ঘনত্ব যদি বেশি থাকে তবে আগাছানাশক প্রয়োগের ৩০-৪৫ দিন পর হাত নিড়ানি প্রয়োজন হয়।
পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা
নিবিড় চাষাবাদ ও আবহাওয়াজনিত কারণে আমনে পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব ও আক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। এলাকাভেদে আমনের মুখ্য পোকাগুলো হলো- মাজরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা,  চুংগি পোকা, সবুজ পাতা ফড়িং, বাদামি গাছফড়িং, সাদা পিঠ গাছফড়িং, গান্ধি পোকা, শীষকাটা লেদা পোকা ইত্যাদি। প্রধান প্রধান ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ দমন করলে রোপা আমন মওসুমে শতকরা ১৮ ভাগ ফলন বেশি হতে পারে। ধানক্ষেতে ডালপালা পুঁতে দিয়ে মাজরা পোকা ও পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কমানো যায়। আলোক ফাঁদ/সোলার লাইট ট্রাপের সাহায্যে মাজরা পোকা ও পাতা মোড়ানো পোকা, সবুজ পাতাফড়িং ও গান্ধি পোকার আক্রমণ কমানো যায়। জমি থেকে পানি বের করে দিয়ে চুংগি পোকা, বাদামি গাছফড়িং এবং সাদা পিঠ গাছফড়িং পোকার আক্রমণ কমানো যায়। উল্লেখিত ব্যবস্থা গ্রহণের পরও পোকার আক্রমণ বেশি পরিলক্ষিত হলে মাজরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা ও চুংগি পোকা দমনের জন্য সানটাপ ৫০ পাউডার প্রতি বিঘায় ১৮০-১৯০ গ্রাম হারে ব্যবহার করতে হবে। মাজরা পোকা ও পাতা মোড়ানো পোকা দমনের জন্য ভিরতাকো ৪০ ডব্লিউজি  প্রতি বিঘায় ১০ গ্রাম হারে ব্যবহার করতে হবে। বাদামি গাছফড়িং ও সাদা পিঠ গাছফড়িং দমনের জন্য মিপসিন ৭৫পাউডার প্রতি বিঘায় ১৭৫ গ্রাম, পাইমেট্রোজিন ৪০ ডব্লিউজি ৬৭ গ্রাম, ডার্সবান ২০ ইসি ১৩৪ মিলি হারে ব্যবহার করতে হবে। পাতা মোড়ানো পোকা, চুংগি পোকা ও শীষকাটা লেদা পোকা দমনের জন্য কার্বারিল ৮৫পাউডার অথবা সেভিন পাউডার প্রতি বিঘায় ২২৮ গ্রাম হারে ব্যবহার করতে হবে।
রোগ ব্যবস্থাপনা
আমন মওসুমে ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া, খোলপোড়া, ব্লাস্ট, বাদামি দাগ, খোল পচা, টুংরো, বাকানি, এবং লক্ষ্মীরগু (ঋধষংব ঝসধৎঃ) সচরাচর দেখা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ রোগগুলো হলো খোলপোড়া, ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া, ব্লাস্ট, টুংরো, বাকানি  এবং লক্ষèীরগু রোগ। খোলপোড়া রোগ দমনের জন্য পটাশ সার সমান দুইকিস্তিতে ভাগ করে এক ভাগ জমি তৈরির শেষ চাষে এবং অন্য ভাগ শেষ কিস্তি ইউরিয়া সারের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। পর্যায়ক্রমে ভেজা ও শুকনা পদ্ধতিতে সেচ ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এ ছাড়া ফলিকুর, নেটিভো এবং স্কোর ইত্যাদি ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করে সফলভাবে দমন করা যায়। ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতাপোড়া রোগের প্রাথমিক অবস্থায় ৬০ গ্রাম এমওপি, ৬০ গ্রাম থিওভিট ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। থোড় বের হওয়ার আগে রোগ দেখা দিলে বিঘাপ্রতি ৫ কেজি পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। 
এ মওসুমে সকল সুগন্ধি ধানে নেক ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ দেখা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ধানে থোড়ের শেষ পর্যায় অথবা শীষের মাথা অল্প একটু বের হওয়ার সাথে সাথে প্রতিরোধমূলক ছত্রাকনাশক যেমন ট্রপার অথবা ন্যাটিভো ইত্যাদি অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। বিক্ষিপ্তভাবে দুইএকটি গাছে টুংরো রোগের লক্ষণ দেখা দিলে, আক্রান্ত গাছ তুলে পুঁতে ফেলতে হবে। রোগের বাহক পোকা সবুজ পাতাফড়িং উপস্থিতি থাকলে, হাতজালের সাহায্যে অথবা আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে সবুজ পাতাফড়িং মেরে ফেলতে হবে। হাতজালের প্রতি টানে যদি একটি সবুজ পাতাফড়িং পাওয়া যায় তাহলে বীজতলায় বা জমিতে কীটনাশক, যেমন মিপসিন, সেভিন অথবা ম্যালাথিয়ন অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। লক্ষèীরগু দমনের জন্য (বিশেষ করে ব্রি ধান৪৯ জাতে) ফুল আসা পর্যায়ে বিকাল বেলা প্রোপিকোনাজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন : টিল্ট (১৩২ গ্রাম/বিঘা) সাত দিন ব্যবধানে দুইবার প্রয়োগ করা। 
ফসল কাটা, মাড়াই ও সংরক্ষণ
শীষে ধান পেকে গেলেই ফসল কাটতে হবে। অধিক পাকা অবস্থায় ফসল কাটলে অনেক ধান ঝরে পড়ে, শীষ ভেঙে যায়, শীষকাটা লেদাপোকা এবং পাখির আক্রমণ হতে পারে। তাই মাঠে গিয়ে ফসল পাকা পরীক্ষা করতে হবে। শীষের অগ্রভাগের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। এ সময়ে ফসল কেটে মাঠেই বা উঠানে এনে মাড়াই করতে হবে। তাড়াতাড়ি মাড়াইয়ের জন্য ব্রি উদ্ভাবিত মাড়াই যন্ত্র যেমন- রিপার, হেড ফিড কম্ভাইন হার্ভেস্টার ও মিনি  কম্ভাইন হার্ভেস্টার ব্যবহার করতে হবে। ধান মাড়াই করার জন্য পরিচ্ছন্ন জায়গা বেছে নিতে হবে। কাঁচা খলায় সরাসরি ধান মাড়াই করার সময় চাটাই, চট বা পলিথিন বিছিয়ে নেয়া উচিত। এভাবে ধান মাড়াই করলে ধানের রঙ উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকে। মাড়াই করার পর অন্তত ৪-৫ বার রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। ভালোভাবে শুকানোর পর ঝেড়ে নিয়ে গোলাজাত বা সংরক্ষণ করতে হবে।

লেখক : ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। মোবাইল : ০১৭১৬৫৪০৩৮০ ইমেইল-ংsmmomin80@gmail.com

বিস্তারিত
খাদ্য-নিরাপত্তায়-মুগডাল-ও-চাষাবাদ-পদ্ধতি

খাদ্য নিরাপত্তায় মুগডাল
ও চাষাবাদ পদ্ধতি
ড. মো. কামরুজ্জামান
বাংলাদেশে ভাতের পরেই ২য় প্রধান খাবার হিসেবে ডালকে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নিকট ডাল আমিষের অন্যতম প্রধান যোগানদাতা। তবে ঋঅঙ এর তথ্য অনুযায়ী প্রতিটি মানুষের গড়ে প্রতিদিন ৪৫ গ্রাম করে ডাল খাওয়ার প্রয়োজন, কিন্তু আমরা খাচ্ছি মাত্র ১২-১৫ গ্রাম। ডাল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি এই ঘাটতি পূরণে সহায়ক হবে। বাংলাদেশের ডালজাতীয় ফসলের মধ্যে মসুর, মুগ,  মাসকলাই, ছোলা ও  মটরই মূলত প্রধান। তবে পুষ্টির দিক থেকে মুগডালকে (ঠরমহধ ৎধফরধঃধ খ.) সেরা বিবেচনা করা হয়। সকালের নাশতায় রুটি বা পরোটার সাথে আমরা সুস্বাদু খাবার হিসেবে প্রায়ই মুগডাল খেয়ে থাকি। তবে এর পুষ্টিগুণ জানা থাকলে চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়। গবেষণা বলছে শুষ্ক ওজনের ভিত্তিতে, মুগডালে ২২-২৮% আমিষ, প্রচুর ফাইবার, খাদ্য কনিকা এবং নানারূপ ভিটামিনসহ অপরিহার্য এমাইনো এসিড রয়েছে (খধসনৎরফবং ধহফ এড়ফরিহ, ২০০৭)। এর জটিল কার্বোহাইড্রেট শরীরকে টেকসই শক্তি সরবরাহ করে এবং রক্তে শর্করার মাত্রাকে  নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখতে সহায়তা করে। মুগ ডায়াবেটিক রোগীদের খাবার হজমে সাহায্য করে। এতে বিদ্যমান ভিটামিন বি১ ক্যান্সারের কোষের বৃদ্ধির মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এক কাপ (২০০ গ্রাম) রান্না করা মুগডালে ১৫.৪ গ্রাম ফাইবার, ১৪.২ গ্রাম প্রোটিন ও মাত্র ০.৮ গ্রাম চর্বি রয়েছে। এ ছাড়াও মুগে পটাশিয়াম, কপার, থায়ামিন, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, জিংক, আয়রন, সেলেনিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন কে রয়েছে যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এক কাপ রান্না করা মুগডাল আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয় ফোলেটের প্রায় ৮০% পূরণ করতে পারে। 
কৃষি জমির উর্বরতা বাড়াতে ডাল ফসলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ডালের শিকড় অঞ্চলে রাইজোবিয়াম প্রজাতির সাথে সিমবায়োসিস প্রক্রিয়ায় বায়ুমন্ডলীয় নাইট্রোজেন (৫৮-১০৯ কেজি/হেক্টর) মাটিতে ফিক্স করে, যা শুধুমাত্র নিজস্ব নাইট্রোজেনের চাহিদা মেটায় না, বরং পরবর্তী ফসলের জন্যও নাইট্রোজেন সারের পরিমাণ সাশ্রয় করে (অষর ধহফ এঁঢ়ঃধ, ২০১২)। দেশে বর্তমানে ৭.০৭ লক্ষ হেক্টর জমিতে ৭.৬৭ লক্ষ মে. টন ডাল উৎপাদিত হয় যা মোট চাহিদার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। উৎপাদন এরিয়া বিবেচনায় ডালের মধ্যে মুগ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১.৭০ লক্ষ হেক্টর জমিতে ১.৭৭ লক্ষ মে. টন মুগডাল উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশের সব জেলাতেই কমবেশি মুগের চাষ হয়, তবে উপকূলীয় অঞ্চলে এর ব্যাপকতা রয়েছে। দেশে উৎপাদিত মুগডালের প্রায় ৬০% উৎপাদিত হয় উপকূলীয় অঞ্চলে। জমি, আবহাওয়া এবং নদ-নদীর জোয়ার-ভাটা ইত্যাদি বিচারে উপকূলীয় অঞ্চল মুগডাল চাষের জন্য উপযুক্ত। তাই আমন কর্তন পরবর্তী পতিত জমিতে মুগ চাষ ব্যাপক বিস্তার লাভ করছে। এ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্বে দেশের এক-পঞ্চমাংশ জুড়ে রয়েছে পাহাড়ি এলাকা। এখানেও আমন ধান কাটার পর মুগডাল চাষ দিনদিন জনপ্রিয় হচ্ছে। পুরো এলাকা চাষের আওতায় আনা সম্ভব হলে আমিষের ঘাটতি আরও পূরণ হবে। সুতরাং ডালের প্রাপ্যতার যে ঘাটতি রয়েছে তার অনেকটাই ডালের আধুনিক জাত ও আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তির ব্যবহার, শস্যের নিবিড়তা এবং এরিয়া বৃদ্ধির মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব।
উচ্চফলনশীল মুগের জাতসমূহ
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে উদ্ভাবিত জাতসমূহের মধ্যে জনপ্রিয় ও স্বল্প জীবনকালীন জাত হিসেবে নিম্নলিখিত জাতগুলো কৃষক পর্যায়ে রয়েছে: বারি মুগ-২, বারি মুগ-৩, বারি মুগ-৪, বারি মুগ-৫, বারি মুগ-৬, বিনামুগ-৬,  বিনামুগ-৮, বিনামুগ-৯, বিনামুগ-১১ ও বিনা মুগ-১২। উল্লেখিত জাতগুলোর আমিষের পরিমাণ ১৯-২৪%, হেক্টর প্রতি ফলন ১.২-২.০ টন, জীবনকাল ৫৫-৭০ দিন এবং বেশির ভাগই সারকোস্পোরা দাগ ও হলদে মোজাইক ভাইরাস রোগ সহনশীল। বিইউ মুগ-৪ ও বিইউ মুগ-৫ জাতসমূহ কৃষকের মাঝে বেশ জনপ্রিয়।
মুগডালের  আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ও আন্তঃপরিচর্যা 
মাটি নির্বাচন ও জমি তৈরি : বেলে দো-আঁশ ও পলি দো-আঁশ মাটি মুগ চাষের জন্য উত্তম। জমিটি হতে হবে মাঝারি উঁচু যাতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয়। জমিতে ‘জো’ আসলে ৩-৪ টি চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে দিতে হবে। এরপর মই দ্বারা জমি সমান করে নিতে হবে। এতে বীজের অঙ্কুরোদগম হার বেড়ে যায়। 
বপনের সময় : খরিপ-১ মৌসুমে মুগ বপনের সময় ফাল্গুন মাসের প্রথম থেকে শেষ (ফেব্রুয়ারির শেষ হতে মার্চের মধ্য ভাগ) এবং খরিপ-২ মৌসুমে শ্রাবণ-ভাদ্র মাস (আগস্টের প্রথম হতে সেপ্টেম্বরের শেষ ভাগ) পর্যন্ত। উপকূলীয় অঞ্চলে মুগডাল চাষ এর উপযুক্ত সময় রবি মৌসুমের শেষভাগ অর্থাৎ ১৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। কারণ এ সময়ে জমিতে রসের পরিমাণ কমে চাষ উপযোগী পর্যায়ে আসে। আমন ধান কাটা হয়ে গেলে জমি থেকে খড় সরিয়ে ফেলতে হবে। এরপর জমিকে শুকিয়ে ‘জো’ অবস্থায় আনতে হবে। একই উপায়ে আমন ধান কাটার পর পাহাড়ি অঞ্চলে জমি তৈরি করতে হবে। 
বীজের হার ও বপন পদ্ধতি : জাতভেদে মুগের বীজের হার ভিন্ন হয়ে থাকে। মধ্যম সাইজের বীজের ক্ষেত্রে হেক্টর প্রতি ২৫-৩০ কেজি প্রয়োজন। ছোট বীজ যেমন বারি মুগ-৫ এর জন্য ৪০-৪৫ কেজি বীজের প্রয়োজন। বীজ ছিটিয়ে বা সারিবদ্ধভাবে বপন করা যায়। তবে সারি হতে সারির দূরত্ব ২৫-৩০ সেমি. রেখে ৩-৪ সেমি. গভীরে বীজ বপন করতে হবে এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১০-১৫ সেমি. রাখতে হবে। 
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি : জমিতে হেক্টর প্রতি নিম্নরূপ সার প্রয়োগ করতে হবে: ইউরিয়া ৪০-৫০ কেজি, টিএসপি  ৮০-৮৫ কেজি, এমপি ৩০-৩৫ কেজি, অণুজীব সার ৪-৫ কেজি। সমুদয় সার শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি কেজি বীজের জন্য ৮০ গ্রাম অণুজীব সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। সাধারণত অণুজীব সার ব্যবহার করলে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয় না।
সেচ ও অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা : মুগ চাষাবাদের সময় সেচের তেমন প্রয়োজন হয় না। তবে খরিপ মৌসুমে বীজ বপনের আগে খরা হলে সেচ দিয়ে জমিতে ‘জো’ আনার পর বীজ বপন করতে হবে। জমি একেবারেই শুকিয়ে গেলে হালকা সেচ দিয়ে নিড়ানি দিতে হবে। জমিতে গোড়াপচা অথবা অন্যান্য ছত্রাকের উপস্থিতি দেখা গেলে কোনভাবেই সেচ দেয়া যাবে না, দিলে ছত্রাক দ্রুত পুরো জমিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে একবার আগাছা দমন করা প্রয়োজন। 
রোগ দমন পদ্ধতি
মুগডাল চাষ করতে গিয়ে চারা থেকে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত যেকোনো পর্যায়ে রোগবালাই এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে পারে। 
পাতার দাগ রোগ : এ রোগ হলে পাতায় ছোট ছোট লালচে বাদামি বর্ণের গোলাকৃতি হতে ডিম্বাকৃতির দাগ পড়ে। বেশি আর্দ্রতা (৮০%) এবং উচ্চ তাপে (২৮ ডিগ্রি সে.) এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। রোগ দমনে ব্যাভিস্টিন (০.২%) বা অটোস্টিন ৫০ ডব্লিউডিজি (২ গ্রাম/১ লিটার পানি) নামক ছত্রাকনাশক ১২-১৫ দিন পরপর ২-৩ বার  স্প্রে করতে হবে। রোগ প্রতিরোধী জাত (যেমন-বারি মুগ-২, ৩, ৪, ৫ এবং বিনামুগ-৯) ব্যবহার করা যেতে পারে।
পাউডারি মিলডিউ : এ রোগে পাতায় পাউডারের  মতো আবরণ পড়ে। বীজ, পরিত্যক্ত গাছের অংশ ও বায়ুর মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। বিকল্প পোষক ও গাছের পরিত্যক্ত অংশ পুড়ে ফেলতে হবে। টিল্ট-২৫০ বা থিওভিট (০.২%) ১০-১২ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
হলদে মোজাইক ভাইরাস রোগ : বিকল্প পোষক ও সাদা মাছির আধিক্য এ রোগ দ্রুত বিস্তারে সহায়ক। আক্রান্ত পাতার উপর হলদে সবুজ দাগ পড়ে। রোগ একবার হলে তা ছড়িয়ে পড়ার আশক্সক্ষা থাকে। তাই আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়ে ফেলতে হবে বা দূরে নিয়ে মাটি চাপা দিতে হবে যাতে অন্য সুস্থ গাছ আক্রান্ত না হয়। সাদা মাছি দমনে ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক যেমন- ইমিটাফ ২০এসএল (০.৫ মিলি/১ লিটার পানি) স্প্রে করতে হবে এবং রোগ মুক্ত উৎস হতে বীজ ব্যবহার করতে হবে। 
পোকামাকড় দমন 
মুগডালে ফ্লি বিটল, পাতা মোড়ানো পোকা, জাবপোকা এবং থ্রিপস পোকার আক্রমন হতে পারে। ল্যাম্বডাসাইহ্যালোথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক যেমন- রীভা ২.৫ ইসি (১ মিলি/১ লিটার পানি) স্প্রে করে ফ্লি বিটল পোকা দমন করা যায়। পাতা মোড়ানো পোকা পাতার সবুজ অংশ কুড়ে কুড়ে খায়। এ পোকা দমনের জন্য ক্লোরোপাইরিফস গ্রুপের কীটনাশক যেমন- ডারসবান ২০ ইসি (১ মিলি/১ লিটার পানি) স্প্রে করতে হবে। জাবপোকা দেখা গেলে প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম ডিটারজেন্ট পাউডার মিশিয়ে স্প্রে করলে আক্রমণ কমে যায়। থ্রিপস ফুলের রেণু খেয়ে ফেলে ফলে গাছে ফুল ধরলেও ফল ধরে না। ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক যেমন- ইমিটাফ ২০ এসএল (০.৫ মিলি/১ লিটার পানি) স্প্রে করতে করা যেতে পারে। ইদানীং স্পোডোপটেরা লিটুরা নামে একটি পোকার আবির্ভাব হয়েছে যার লার্ভা পাতার নিচে অবস্থান করে কচি পাতার ক্লোরোফিল স্ক্র্যাপ করে খেয়ে ফেলে ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পাতা সাদা ও শুষ্ক হয়ে যায়। এ পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে, স্পিনোসেড গ্রুপের জৈব কীটনাশক যেমন: সাকসেস ২.৫ এসসি (১.২ মিলি/১ লিটার পানি) স্প্রে করলে আক্রমণ কমে যায়। 
ফসল সংগ্রহ
মুগডাল ক্ষেত থেকে সংগ্রহ করা খুবই কষ্টকর কারণ এর সবগুলো ফল একসাথে পাকে না। তাই কয়েকবারে সংগ্রহ করতে হয়। অন্য দিকে যেসব জাত যেমন: বারি মুগ-৫,৬ বিনামুগ-৮ এর ফল প্রায় একসাথে পাকে সেগুলোই কেবল একবারে সংগ্রহ করা যায়। সব ফল একসাথে পরিপক্ব হলে কাঁচি দিয়ে গোড়া থেকে গাছগুলো কেটে নিতে হয়। এভাবে কাটা হলে মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এরপর রোদে শুকানো, খোসা ছড়িয়ে মুগডাল বীজ বের করা এবং রোদে শুকানোর পর সংরক্ষণ অথবা বাজারজাত করা হয়। বীজ পলিথিন বা ত্রিপলের উপর ২-৩টি রোদ দিয়ে শুকাতে হবে।  রোদে শুকানোর পর বীজ নিয়ে দুই দাঁতের মাঝে রেখে চাপ দিলে যদি কট করে শব্দ হয় এবং বীজ দুভাগ হয়ে যায় কিন্তু গুড়া হবে না কিংবা দাঁতের সাথে লেগে থাকবে না এ অবস্থায় বীজে ১০-১২% আর্দ্রতা রয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। এ অবস্থায় শুকানো বীজ ঠা-া করে বায়ুরোধী পাত্রে যেমন- প্লাস্টিক বা ধাতব ড্রাম বা পলিথিন ইত্যাদিতে সংরক্ষণ করতে হবে।
লাভ-খরচ
মুগডাল উৎপাদনে কম পুঁজি লাগে। খরচের বেশির ভাগই হয়ে থাকে ফসল সংগ্রহের জন্য। অনেক এলাকায় সাধারণত ফলন ভাগাভাগির মাধ্যমে সংগ্রহের কাজটি সম্পন্ন হয়। এজন্য মোট উৎপাদনের শতকরা ৩৭.৫ ভাগ সংগ্রহকারীদের দিয়ে দিতে হয়। ফসল উত্তোলন কাজে নগদ অর্থ ব্যয় করতে হয় না বিধায় এ খাতকে অনেকে খরচের হিসাবে ধরেন না। তবে হিসেবে দেখা গিয়েছে এভাবে হেক্টর প্রতি খরচ প্রায় ২০ হাজার টাকা হয় এবং বিক্রি করে প্রায় ৪০,০০০ টাকা আয় করা যায় ফলে লাভ-খরচের অনুপাত দাঁড়ায় ২:১। মুগডালের এ অনুপাত কৃষকের জন্য লাভজনক।  
খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় মুগডাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কৃষক অল্প খরচেই মুগডাল চাষাবাদ করতে পারে। মাত্র দুই বা আড়াই মাসে ফসল পাওয়ায় কৃষক সহজেই আমন ধান কাটার পর পতিত জমি মুগডালের মাধ্যমে চাষাবাদের আওতায় আনতে পারে। তাছাড়া, কেজিপ্রতি মুগডালের বাজার অন্য যেকোনো ফসলের বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। তাই, মুগডাল চাষ করে কৃষক একদিকে যেমন পরিবারের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারবে, অন্য দিকে বাজারে বিক্রি করে আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হতে পারবে।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), উপকেন্দ্র, গোপালগঞ্জ, মোবাইলঃ ০১৭৭৬৯৬০৭৬৯, ই-মেইলঃkamruzzaman_bina2013@yahoo.com

বিস্তারিত
খাদ্য-পুষ্টি-ও-সুস্বাস্থ্যের-কথকতা

খাদ্য, পুষ্টি ও সুস্বাস্থ্যের কথকতা
মোরসালীন জেবীন তুরিন
খাদ্য ও পুষ্টি দু’টি শব্দের খুব ঘনিষ্ঠতা থাকলে ও অর্থের ব্যাপকতায় এরা আলাদা। বেশ কিছুদিন আগেও খাদ্য ও পুষ্টি নিয়ে আলাদা  করে ভাবার অবকাশ ছিল না। কিন্তু বর্তমানে সুস্থ সবল ও কর্মক্ষম জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে হলে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ  বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা বিশাল জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারছি না, দেশে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও মানুষ সঠিক খাদ্যাভাস ও সঠিক জীবনযাত্রা না মেনে কারণে শারীরিক মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং যার ফলে মানুষকে ছুটতে হচ্ছে বিভিন্ন ডাক্তার কবিরাজের কাছে। সেজন্য আমাদের খাদ্য , পুষ্টি সম্পর্কে জানতে হবে।
আমরা বেঁচে থাকার তাগিদে খাবার খেয়ে থাকি এর সাথে পুষ্টি থাকতেও পারে নাও পারে। পুষ্টি হচ্ছে এমন একটি জৈবিক প্রক্রিয়া যাতে গ্রহণকৃত খাদ্য পরিপাক, বিপাকে ও পরিশোষণ হয়ে শরীরের বৃদ্ধি ক্ষয়পূরণ, শক্তি উৎপাদনে ও রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। মোট কথা পুষ্টি গ্রহণকৃত খাদ্যের বিভিন্ন উপাদানের মাধ্যমে পুষ্টি আমাদের শরীরের পরিচর্যা করে। 
খাদ্যের উপাদানগুলোর তালিকা আমাদের জানতে হবে। খাদ্যের উপাদানগুলো হলো : শর্করা, আমিষ, তেল/ চর্বি, ভিটামিন, খনিজ, আঁশ ও পানি। এই প্রতিটি উপাদান আমাদের শরীরে বিভিন্ন কাজ করে থাকে, যেমন- শর্করাজাতীয় খাদ্য আমাদের শরীরে শক্তি জোগায় যা আমাদের কাজ করতে সহায়তা করে। বিভিন্ন দানাদার খাদ্য যেমন- চাল, গম ভুট্টা, বার্লি, এ ছাড়া মিষ্টি আলু, কচু, চিনি মধু ইত্যাদিতে প্রচুর শর্করা আছে। আমাদের মোট ক্যালরি চাহিদার ৬০% -৭০% যেন শর্করাজাতীয় খাবার থেকে আসে। যদিও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শর্করাজাতীয় খাবার গ্রহণের পরিমাণটাই বেশি হয়ে থাকে, আমাদের দেশের মানুষ সর্বোপরি ৩৬৭ গ্রাম শর্করাজাতীয় খাবার খেয়ে থাকে, যেখানে শর্করা গ্রহণের পরিমাণ হওয়া উচিত সর্বোচ্চ ৩৫০ গ্রাম। এই অতিরিক্ত শর্করা গ্রহণই আমাদের দেহে শক্তি জোগান শেষে তা শরীরে চর্বি রূপে জমতে শুরু করে, যা পরবর্তীতে স্থূলতায় ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া অতিরিক্ত শর্করা গ্রহণ শরীরে আয়রন শোষণে বাধা দেয়, যা রক্তশূন্যতার জন্য দায়ী। তাই আমাদের পরিমিত  শর্করাজাতীয় খাবার খেতে হবে। 
এরপরে রয়েছে আমিষজাতীয় খাদ্য, যার উৎস সাধারণত প্রাণিজ (মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ইত্যাদি) ও উদ্ভিজ্জ (ডাল, বীজ ইত্যাদি) হয়ে থাকে। আমাদের শরীর গঠন, বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে। আমিষে নাইট্রোজেন ও প্রয়োজনীয় এ্যামিনো এসিড থাকায় এই খাদ্যের গুরুত্ব শর্করা ও স্নেহজাতীয় খাদ্য থেকে আলাদা।   ১ গ্রাম আমিষে ৪ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। রিকোমেন্ডেট ডায়েটারি এলাওয়েন্স (জউঅ) অনুযায়ী শরীরের প্রতি কেজি ওজনের বিপরীতে ১.০ গ্রাম আমিষের প্রয়োজন। আমাদের শরীরে একসংগে ৩০ গ্রাম আমিষ হজম করতে পারে। তাই এর বেশি আমিষ এক সাথে পেটে পড়লে তা কাজে লাগবে না। আমিষজাতীয় খাদ্য বাড়ন্ত বাচ্চাদের ও গর্ভবতী মহিলাদের তুলনামূলক বেশি লাগে যেহেতু বাচ্চারা ও গর্ভবতী মা ও গর্ভস্থ শিশু  দ্রুত বৃদ্ধি পায়, সেক্ষেত্রে বাচ্চা ও গর্ভবতী মা তাদের প্রতি কেজি ওজনের বিপরীতে ২-৩ গ্রাম আমিষজাতীয় খাবার খেতে পারে। আবার বয়স্ক ব্যক্তিদের পাকস্থলীতে হজমের প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে যায়, যার ফলে তারা আমিষজাতীয় খাবার দ্রুত হজম করতে পারে না আবার তারা ভারী কাজ করে ও হজম প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে না। তাই আমিষজাতীয় খাবার গ্রহণের পর সাথে সাথে যাতে না শুয়ে পড়ে এবং পরিমিত গ্রহণ করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এবার তেল বা চর্বি, যা সাধারণ তাপমাত্রায় তরল তাকে তেল আর সাধারণ তাপমাত্রা যা কঠিন তাকে চর্বি বলা হয় এই তেল বা চর্বিজাতীয় খাবারের থেকে আমরা প্রচুর ক্যালরি বা তাপ শক্তি পেয়ে থাকি। ১ গ্রাম তেল বা চর্বি থেকে ৯ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়, যা শর্করা ও আমিষের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। দুধের সর, পনির, ডিমের কুসুম, বাদাম, সরিষার তেল, সূর্যমুখীর তেল, সয়াবিন তেল উপাদান হতে দ্বিগুণেরও বেশি শক্তি পাওয়া যায়, বাচ্চারা এসব খাবার অল্প পরিমাণে গ্রহণ করে এবং তাদের মোট ক্যালরির চাহিদা পূরণ করতে পারে। তেল বা চর্বি বাচ্চাদের ব্রেন ডেভেলপমেন্টে সহায়তা করে। আর প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির জন্য জনপ্রতি ৩০ গ্রাম  তেল গ্রহণ করা উচিত। অতিরিক্ত ভাজা পোড়া ও তৈলাক্ত খাবার গ্রহণ করা উচিত নয়, কারণ এসব খাবার বদহজম, স্থূলতা কোন কোন ক্ষেত্রে কারসিনোজিস সৃষ্টি করে।
আঁশ, ভিটামিন ও মিনারেলসের নির্ভেজাল ও সহজলভ্য উৎস্য হলো বিভিন্ন প্রকার শাকসবজি, ফলমূল, বীজ, বাদাম, দুধ, ডিম, লাল চাল, লাল আটা, ছোট মাছ, মাশরুম ও কলিজা ও লাল মাংস।
শাকসবজি ও ফলমূল লো-ক্যালরি ও অনেক ভিটামিন ও মিনারেলস এর আধার। তাই আমাদের খাদ্য তালিকায় এই ধরনের খাবার বেশি রাখা উচিত। প্রতিদিন ১০০ গ্রাম শাক, ২০০ গ্রাম সবজি, ১০০ গ্রাম টক ও মিষ্টি মিলিয়ে ১০০ গ্রাম ফল গ্রহণ করা উচিত। আবার শাকসবজি যখন আমাদের প্লেটে আসে তখন আয়রন শোষণ করার জন্য শাকের সাথে লেবু বা কাঁচামরিচ রাখতে হবে। আবার লবণের আয়োডিন পরিপূর্ণভাবে পেতে হলে আয়োডিনযুক্ত লবণ ঢেকে রাখতে হবে, রান্নার শেষে লবণ দিতে হবে এবং পরিমিত (৫-৬ গ্রাম) লবণ গ্রহণ করতে হবে। অতিরিক্ত লবণ উচ্চরক্তচাপসহ অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। খাবারের সময় বাড়তি লবণ যেমন পরিহার করতে তেমনি ভাজা লবণ গ্রহণ থেকে ও বিরত থাকতে হবে। মিষ্টিজাতীয় খাবার ও আমাদের পরিমিত (২৫ গ্রাম) গ্রহণ করতে হবে, চেষ্টা করতে হবে যেন মৌসুমি ফল থেকেই প্রাকৃতিকভাবে মিষ্টিজাতীয় খাবারের চাহিদা পূরণ করা যায়। এ ছাড়া আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে গ্রহণকৃত খাবারের ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের কার্যকারিতা বাড়াতে শরীরে সূর্যের আলো ও লাগানো নিশ্চিত করতে হবে। সূর্যের আলো লাগানোর সঠিক সময় হলো সকাল ১০টা হতে বেলা ৩টা পর্যন্ত। এ ছাড়া আমাদের সব ধরনের খাবার সাথে   ২-৩ লিটার নিরাপদ পানি পান নিশ্চিত করতে হবে, যাতে আমাদের হজম, শোষণ, আত্ত¥ীকরণ ও শরীরে তাপমাত্রা সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে। কোমল পানীয় পরিহার করে ফলের রস পান করা বেশি পুষ্টিসম্মত। 
সর্বোপরি আমাদের সুষম খাবারের সাথে নিরাপদ খাবার গ্রহণ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, সঠিক শারীরিক পরিশ্রম, সঠিক বিশ্রামের ও সুস্থ চিন্তার মাধ্যমে নিজেদের সুস্বাস্থ্যের অধিকারি করতে পারব।
সুস্থতা আমাদের সবার কাম্য এর জন্য আমাদের সচেতনতা, সদিচ্ছা প্রয়োজন। তবেই  বাংলাদেশ সুস্থ, কর্মক্ষম ও উন্নত জাতি সম্মিলিতভাবে গঠন করা সম্ভব।

লেখক : ঊর্ধ্বতন প্রশিক্ষক, বারটান, আঞ্চলিক কার্যালয়, সিরাজগঞ্জ। মোবাইল : ০১৭২৩৬৭২১৯২, ই-মেইল :turinbsmrau@gmail.com

বিস্তারিত
কেশর-আলুর-বাণিজ্যিক-ব্যবহার

কেশর আলুর বাণিজ্যিক ব্যবহার
ড. শাহানা পারভীন
কেশর আলু একটি কন্দালজাতীয় ফসল। প্রচলিত অর্থে ফল না হলেও এটি ফল অথবা সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে এর ব্যবহার অথবা খাদ্যাভ্যাস খুব একটা না থাকলেও মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। সাধারণত পাহাড়ি এলাকায় এর চাষ হয় এবং জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সংগ্রহ করা হয়। উৎপাদনশীলতা কম এবং অধিক পচনশীল হওয়ায় এর বাজার ব্যবস্থা অপ্রতুল। অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক বিক্রিয়া, ফসল সংগ্রহের সময় আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া, অতিরিক্ত অংক্ররোদগম হওয়া, শুকিয়ে যাওয়া এবং ব্যকটেরিয়া এবং ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হওয়া ইত্যাদি কারণে কেশর আলু প্রচুর পরিমাণে অপচয় হয়। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এর অপচয় রোধ এবং বাজার মূল্য উন্নত করা সম্ভব।
ফল হিসেবে সরাসরি অথবা জুস হিসেবে কিংবা সালাদ হিসেবে এটি খাওয়া যায়। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে জেলি, কেক অথবা বিস্কুট তৈরি করেও খাওয়া যায়। এটি পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি, শর্করা ও পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য। এতে প্রায় ১০.৩% শর্করা এবং ১.৩% অপরিশোধিত আঁশ রয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে এর উপযোগিতা বাড়ানোর জন্য জুস থেকে জেলি অথবা পাউডার থেকে কেক অথবা বিভিন্ন রকমের বিস্কুট তৈরি করা যেতে পারে। 
কেশর আলুর জুস প্রস্তুতকরণ
জেলি তৈরির জন্য প্রথমে জুস তৈরি করতে হয়। জুস তৈরির জন্য সতেজ ও পরিপক্ব কেশর আলু ভালোভাবে ধুয়ে, খোসা ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরা করতে হবে। টুকরোগুলো সমপরিমাণ পানির সাথে প্রায় ১০ মিনিট ফুটাতে হবে। মিশ্রণটি ব্লেন্ড করে মসলিন কাপড় দিয়ে ছেঁকে -১০০ সে. তাপমাত্রায় ডিপফ্রিজে সংরক্ষণ করতে হবে। এই জুস দিয়ে জেলি তৈরি করা যাবে। জেলির গুণাগুণ এবং স্বাদ পরীক্ষার জন্য কেশর আলুর জুসের সাথে বিভিন্ন অনুপাতে গাজর, আম এবং কমলার জুস মিশিয়ে জেলি তৈরি করে পরীক্ষা করা হয়েছে। 
গাজরের জুস তৈরির জন্য সতেজ, পরিপক্ব গাজর খোসা ছাড়িয়ে, পরিষ্কার করে ধুয়ে টুকরা করে, সমপরিমাণ পানির সাথে মিশিয়ে ১০ মিনিট জ্বাল করতে হবে। মিশ্রণটি ব্লেন্ড করে মসলিন কাপড় দিয়ে ছেঁকে কেশর আলুর জুসের মতো -১০০ সে. তাপমাত্রায় ডিপফ্রিজে সংরক্ষণ করতে হবে। আমের জুস তৈরির জন্য অক্ষত, পরিপক্ব, পাঁকা আম ধুয়ে, খোসা ছাড়িয়ে, চেপে পাল্প বের করতে হবে। আমের পাল্প মসলিন কাপড় দিয়ে ছেঁকে প্রায় ১০ মিনিট ৮০-৮৫০ সে. তাপমাত্রায় পাস্তুরিত করার পর জেলি তৈরির জন্য প্রস্তুত হবে। কমলার জুস তৈরির জন্য অক্ষত, পরিপক্ব ও পাকা কমলা ভালোভাবে ধুয়ে আড়াআড়িভাবে কাটতে হবে। এরপর যান্ত্রিক নিষ্কাশনকারী দিয়ে রস বের করতে হবে। মসলিন কাপড় দিয়ে ছেঁকে প্রায় ১০ মিনিট ৮০-৮৫০ সে. তাপমাত্রায় পাস্তুরিত করার পর জেলি তৈরির জন্য প্রস্তুত হবে।
কেশর আলু, গাজর, আম এবং কমলার জুসের উপাদানসমূহ তুলনা করলে দেখা যায় যে, কেশর আলুতে প্রায় ৪% টিএসএস রয়েছে যেখানে গাজরে রয়েছে প্রায় ৬%, কমলাতে ১২% এবং আমে রয়েছে সবচেয়ে বেশি প্রায় ১৬%। কেশর আলুতে পানির পরিমাণ প্রায় ৮৪.৬%, গাজরে ৮৫%, আমে ৭৬.৬% এবং কমলাতে রয়েছে প্রায় ৮৯.৪%। দেখা যাচ্ছে আমে সব থেকে কম এবং কমলাতে সব চেয়ে বেশি পানি রয়েছে। গাজর, আম এবং কমলার তুলনায় কেশর আলুতে চিনির পরিমাণ কম। মোট চিনি (রিডিউসিং এবং নন-রিডিউসিং) প্রায় ২.৫% রয়েছে কেশর আলুতে, গাজরে ৪.৩২%,আমে ১০.৭% এবং কমলাতে প্রায় ৯.৯৪%। অম্লতার পরিমাণও কেশর আলুতে সব চেয়ে কম। যেমন- এতে অম্লতার পরিমাণ প্রায় ০.০২%, পক্ষান্তরে গাজরে ০.০৪%, আমে ০.৪৫% এবং কমলাতে প্রায় ০.৫৪% অম্লতা রয়েছে। পিএইচ মাত্রা পরিক্ষা করলে দেখা যায়, কেশর আলুর পিএইচ মাত্রা সবচেয়ে বেশি প্রায় ৬.৫। গাজরের জুসে প্রায় ৬.০, আমের জুসে ৪.৩ এবং কমলার জুসে ৪.৫ পিএইচ মাত্রা পাওয়া গেছে। এসকরবিক এসিডের পরিমাণ কেশর আলুর জুসে তলনামূলকভাবে কম পাওয়া গেছে। এর পরিমাণ মাত্র ১০ মি.গ্রা./১০০গ্রা.। গাজর, আম এবং কমলার জুসে এর পরিমাণ যথাক্রমে ১৫, ৪১ এবং ৪০ মি.গ্রা./১০০গ্রা.। এ ছাড়া কেশর আলু, গাজর, আম এবং কমলার জুসে অ্যাসের পরিমাণ পাওয়া গেছে যথাক্রমে ০.৬%, ০.৯%, ০.৯% এবং ০.১%। 
কেশর আলুর জেলি প্রস্তুতকরণ
জেলি প্রস্তুতের জন্য জুস এবং চিনি ৪৫:৫৫ অনুপাতে মিশিয়ে অল্প তাপে জ্বাল করতে হয়। কেশর আলুর জুস ১০০ ভাগ, কেশর আলুর জুস এবং গাজর, আম এবং কমলার জুস যথাক্রমে ৯০:১০, ৮০:২০, ৭০:৩০ অথবা ৫০:৫০ অনুপাতে মিশিয়ে প্রায় ১৩টি সংমিশ্রণের মাধ্যমে ১৩ রকমের জেলি তৈরি করে এর গুণাগুণ এবং স্বাদ পরীক্ষা করা হয়েছে। জুস জ্বাল করার সময় মাঝে মাঝে নাড়তে হবে। ফুটন্ত তাপমাত্রা যখন ১০৪.৫-১০৫০ সে. এর মত হবে এবং জুস পরিমাণ মতো ঘন হবে তখন এসিড এবং পেকটিন দিয়ে নেড়ে নামিয়ে ঠা-া করে বোতলজাত করতে হবে। জেলির গুণাগুণ পরীক্ষা করে এতে টিএসএস এর মাত্রা পাওয়া গেছে ৬৪.০%-৬৭.৫% এর মধ্যে। পানির পরিমাণ পাওয়া গেছে ২৯.৯৫-৩১.৯৫% এর মধ্যে। মোট চিনির পরিমাণ প্রায় ৬৪.২-৬৬.৫%। অম্লতার পরিমাণ প্রায় ০.৮-০.৯৯%। পিএইচ মাত্রা পাওয়া গেছে প্রায় ২.৯-৩.২৫ এর মধ্যে। এসকরবিক এসিড এবং অ্যাস এর পরিমাণ যথাক্রমে ১.৩২-২.৯৫% এবং ০.২৯-০.৪২% পাওয়া গেছে। 
কেশর আলুর পাউডার প্রস্তুতকরণ
সতেজ এবং পরিপক্ব কেশর আলু ভালোভাবে ধুয়ে, খোসা ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরা করতে হবে। টুকরোগুলো সমপরিমাণ পানির সাথে প্রায় ১০ মিনিট ফুটাতে হবে। মিশ্রণটি ব্লেন্ড করে কেবিনেট ড্রায়ারে ৭০০ সে. তাপমাত্রায় শুকাতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত এর আর্দ্রতা ৩-৫% এ পৌঁছে। শুকনো পাল্প গ্রাইন্ডারে পাউডার করে পলিথিলিন ব্যাগ এ প্যাকেটজাত করতে হবে। 
প্লেইন কেক এবং বিস্কুট প্রস্তুতকরণ
গমের ময়দা এবং কেশর আলুর পাউডার বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে প্লেইন কেক এবং বিস্কুট প্রস্তুত করে এর গুণাগুণ এবং স্বাদ পরীক্ষা করা হয়েছে। কেশর আলুর পাউডার এবং গমের ময়দার মিশ্রণের বিভিন্ন অনুপাত হলো: ১০:৯০, ২০:৮০ এবং ৩০:৭০। প্লেইন কেক তৈরির জন্য কেশর আলুর পাউডার, গমের ময়দা এবং বেকিং পাউডার পরিমাণ অনুযায়ী মিশ্রণ করতে হবে। আলাদা পাত্রে চিনি, বাটার ওয়েল, স্কিম মিল্ক, ডিম, এসেন্স, লবন ভালোভাবে মিশাতে হবে। উভয় মিশ্রণ পুনরায় মিশ্রণ করে ওয়াক্সড পেপার দিয়ে মোড়ানো পাত্রে ঢেলে ইলেকট্রিক ওভেন এ ১৭৭০  সে. তাপমাত্রায় প্রায় ৪৫ থেকে ৫৫ মিনিট বেক করতে হবে। ঘরের তাপমাত্রায় প্রায় ১০ মিনিট ঠা-া করার পর স্লাইস করে পরিবেশন উপযোগী হবে। 
বিস্কুট তৈরির জন্য কেশর আলুর পাউডার, গমের ময়দা এবং বেকিং পাউডার পরিমাণ অনুযায়ী মিশ্রণ করতে হবে। আলাদা পাত্রে চিনি, ডালডা, ঘি, স্কিম মিল্ক পাউডার, ডিম, এসেন্স, লবন ভালোভাবে মিশাতে হবে। সমস্ত মিশ্রণ ইলেকট্রিক মিক্সচার মেশিনে ভালোভাবে মিশিয়ে প্রায় ৫ মিনিট স্থির রাখতে হবে। ডো ভালোভাবে হয়ে গেলে বিস্কুটের আকার বানাতে হবে। প্রায় ১০ মিনিট বিস্কুটগুলো স্থিরভাবে রাখার পর ইলেকট্রিক ওভেন এ ২০৫০ সে. তাপমাত্রায় হালকা বাদামি রং হওয়া পর্যন্ত বেক করতে হবে। বিস্কুটগুলো ঠা-া করে প্যাকেটজাত করতে হবে। 
তৈরিকৃত প্লেইন কেক এ প্রায় ৩১.৫-৩১.৮১% আর্দ্রতা পাওয়া গেছে। অ্যাস পাওয়া গেছে ২.০২-২.০৭%। ফ্যাট, প্রোটিন এবং শর্করা পাওয়া গেছে যথাক্রমে প্রায় ২৮.৪%, ১২% এবং ২৫.৪৫%। পক্ষান্তরে বিস্কুট এ প্রায় ২.৮৭-২.৯% আর্দ্রতা পাওয়া গেছে। অ্যাস পাওয়া গেছে প্রায় ১.৩০-১.৪০%। ফ্যাট, প্রোটিন এবং শর্করা পাওয়া গেছে যথাক্রমে প্রায় ১৫.৫%, ৮% এবং ৭২%। 
সংবেদনশীল স্বাদ প্যানেল পরীক্ষণ
সংবেদনশীল স্বাদ প্যানেল পরীক্ষণের মাধ্যমে দেখা গেছে, প্রায় ১৫%, ৭৭% এবং ৮% জেলি যথাক্রমে অসাধারণ, ভালো এবং মোটামুটি ভালো খাদ্য পণ্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। কোনো জেলির নমূনা খারাপ বলে বিবেচিত হয়নি। কেশর আলু এবং গাজরের জুস ৮০:২০ অনুপাতে তৈরিকৃত জেলি এবং কেশর আলু এবং আমের জুস ৫০:৫০ অনুপাতে তৈরিকৃত জুস চমৎকার খাদ্যপণ্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। প্লেইন কেক এর ক্ষেত্রে ৬৭% এবং ৩৩% কেক যথাক্রমে অসাধারণ এবং মোটামুটি ভালো হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। অপরপক্ষে, বিস্কুট এর ক্ষেত্রে, ৬৭% এবং ৩৩% বিস্কুট যথাক্রমে ভালো এবং মোটামুটি ভালো হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। 
উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, কেশর আলুর জুস দিয়ে অথবা কেশর আলুর জুসের সাথে গাজর, আম এবং কমলার জুস বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে তৈরিকৃত জেলির একটি সুন্দর সম্ভাবনা হয়েছে। গমের ময়দার সাথে ২০% পর্যন্ত কেশর আলুর পাউডার মিশিয়ে অসাধারণ কেক এবং ভালো মানের বিস্কুট তৈরি করা য়ায়। এভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে কেশর আলুর অপচয় রোধ করা যাবে। 

লেখক : এসএসও, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১। মোবাইল : ০১৬৭২০৪১৪৮২, ই-মেইল :parveenboori98@yahoo.com

বিস্তারিত
বৈশ্বিক-জলবায়ু-মোকাবিলায়-পরিবেশবন্ধু-তাল-চাষের-গুরুত্ব

বৈশ্বিক জলবায়ু 
মোকাবিলায় পরিবেশবন্ধু 
তাল চাষের গুরুত্ব
আয়েশা সুলতানা
তাল সাধারণত গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চলের গাছ। তালগাছ এক লিঙ্গবিশিষ্ট উদ্ভিদ অর্থাৎ স্ত্রী ও পুরুষ গাছ আলাদা এবং শুধু স্ত্রী গাছেই ফল ধরে। পরাগায়নের সুবিধার জন্য ১৫/২০টি স্ত্রী গাছের জন্য একটি পুরুষ গাছ থাকা প্রয়োজন। চারা লাগানোর ১০-১২ বছর পর গ্রীষ্মের শুরুতে স্ত্রী গাছের মোচায় ফুল আসে। প্রতি মোচায় ১০১৫টি ফল ধরে। পরিপক্ব একটি গাছ থেকে বছরে ১৫০-২৫০টি ফল পাওয়া  যায়। জাতভেদে ফল গোলাকার, রং কালো থেকে গাঢ় হলুদ হয়ে থাকে। প্রতি ফলে ২-৩টি বীজ থাকে। তালগাছ খুবই ধীরগতিতে বৃদ্ধি পায় এবং দেড়শত বছরের মত বাঁচে।
সাময়িক বন্যা ও লবণাক্ততাসহিষ্ণু এই গাছটি বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে পাহাড়ি অঞ্চলের বিভিন্ন মাটিতে জন্মাতে পারে। অম্লভাবাপন্ন হালকা পলিমাটি তাল চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। বাংলাদেশের সব এলাকায় কমবেশি তাল উৎপাদন হলেও গাজীপুর, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনা এলাকায় সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে সারাদেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭১৪৯ হেক্টর জমিতে ১.২ লক্ষ মেট্রিক টন তাল উৎপাদন হয়েছে। পরিবেশবান্ধব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাত থেকে রক্ষাকারী পরম বন্ধু তালগাছের অপ্রতুল চাহিদা মেটাতে সরকারি নার্সারিগুলোতে দেশীয় উন্নত জাতের চারা উৎপাদনের কাজ চলমান রয়েছে।
খাদ্য ও ভেষজগুণ 
তালের ফল এবং বীজ দুটিই ভক্ষণযোগ্য। কাঁচা তালের শাঁস খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার। গরমে তালের শাঁস খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। তালের শাঁসকে নারিকেলের মতোই পুষ্টিকর বলে পুষ্টিবিদরা বিবেচনা করেন। এতে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন, ফাইবার এবং খনিজ উপাদান থাকে। ক্যালরির পরিমাণ কম থাকায় তালের শাঁস ওজন কমাতে ভূমিকা রাখে। একই সাথে এটি ক্যানসারের মতো মরণব্যাধি রোগ থেকে আমাদের বাঁচায়। পাকস্থলীর বিভিন্ন সমস্যা এবং হজমের সহায়ক হিসেবে প্রাকৃতিক ওষুধের মতো কাজ করে তালের শাঁস। এটা কোষ্টকাঠিন্য কমায় এবং হজমশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। আলসার এবং এসিডিটি দূর করতেও সাহায্য করে এটি। গভর্বতী নারীদের হজমের জন্য এটি বেশ উপকারী। তালের শাঁস আমাদের স্মৃতিশক্তি ভালো রাখে এবং শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষা করে থাকে। বমি ভাব আর মুখের অরুচিও দূর করতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তালের শাঁসে ক্যালসিয়াম থাকায় এটি দাঁতের জন্য অনেক ভালো। দাঁতের এনামেল ভালো রাখে এবং দাঁতের ক্ষয় রোধ করে। তালের শাঁস হাড়কে শক্তিশালী করে তোলে। কচি তালের শাঁস রক্তশূন্যতা দূরীকরণে দারুণ ভূমিকা রাখে। এছাড়াও চোখের এলার্জিসহ অন্যান্য চোখের রোগের প্রকোপ কমাতে তাল অনেক কার্যকরী। তালের শাঁস খেলে লিভারের সমস্যা দূর হয়। এতে থাকা ভিটামিন সি ও বি কমপ্লেক্স খাবারে রুচি বাড়াতে সাহায্য করে।
পরিবেশ রক্ষায় তালগাছের গুরুত্ব
পরিবেশ উন্নয়নে তালগাছ আগামী দিনের কৃষির পরমবন্ধু। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ঘন ঘন বন্যা, জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলায় তালগাছ অবদান রাখতে পারে। এছাড়া পাখিদের নিরাপদ অভয়াশ্রম গড়তে পারে তালগাছ। তালগাছ খরা এবং বন্যা সহনশীল গাছ। এ গাছের শিকড় মাটির বেশি গভীরে পৌঁছে না; তবে গুচ্ছ মূলগুলো চারদিকে সমানভাবে ছড়িয়ে মাটিকে শক্ত করে ধরে রাখে এবং ভূমির ক্ষয়রোধ করে। তালের পাতার আগা সুচালো হওয়ায় বজ্রপাত গাছ হিসেবে পরিচিত। বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বাড়ার ফলে এপ্রিল মাস থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত বৃষ্টির সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে বজ্রপাত হয়।  গ্রীষ্মকালের পাশাপাশি বর্ষাকালেও বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত লক্ষ করা যায়। আর বজ্রপাতে মারা যায় মাঠের কৃষক থেকে পথ চলতি সাধারণ মানুষজন। পরিবেশবিদরা মনে করেন বজ্রপাত রুখতে সক্ষম গ্রাম বাংলার এই তালগাছ। বিশেষজ্ঞদের মতে তালগাছে কার্বনের স্তর বেশি থাকায় তা বজ্রপাত নিরোধে সহায়তা করে। এর পাশাপাশি ভূমিক্ষয়, ভূমিধস, ভূগর্ভস্থ পানির মজুদ বৃদ্ধি ও মাটির উর্বরতা রক্ষা করে। তালগাছের আকর্ষণে বাড়ে মেঘের ঘনঘটা; ঘটে বৃষ্টিপাতও। তালগাছের শিকড় মাটির অনেক নিচ পর্যন্ত প্রবেশ করায় ঝড়ে হেলে পড়ে না কিংবা ভেঙে পড়ে না। যেখানে কোনো কিছু চাষ হয় না সেখানেও তালগাছ ভালোভাবেই টিকে যায়। নতুন রাস্তার ল্যান্ডস্কেপ, বাঁধ ও নদীভাঙন ঠেকাতে এর রয়েছে সফল প্রয়োগ রয়েছে।
তাল ফল ও তালগাছের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
আমাদের দেশে তালগাছ রাস্তার পাশে এমনকি জমির আইলের মধ্যে রোপণ করা সম্ভব। পরিবেশবান্ধব তালগাছ পরিবেশের ভারসাম্য যেমন আনবে তেমনি কৃষি অর্থনীতিকে করবে বেগবান। তাল ভারতীয় উপমহাদেশীয় অনেক অঞ্চলেরই জনপ্রিয় গাছ কারণ এর প্রায় সব অঙ্গ থেকেই কিছু না কিছু কাজের জিনিস তৈরি হয়, প্রায় কিছুই ফেলা যায় না। তাল পাতা দিয়ে ঘর ছাওয়া, পুতুল, হাতপাখা, তালপাতার চাটাই, মাদুর, আঁকার পট, লেখার পুঁথি, কু-লী ইত্যাদি বহুবিধ সামগ্রী তৈরি হয়। প্রাচীনকালে তালের কা- দিয়ে বাড়ি, নৌকা, নৌকা বাড়ি ইত্যাদি তৈরি হতো। বতর্মানে কুটির শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে তাল গাছের বিভিন্ন অংশ ব‍্যবহার করা হয়ে থাকে। পরিপক্ব একটি গাছ থেকে বছরে অন্তত ৫ হাজার টাকা আয় করা যায়।
উৎপাদন পদ্ধতি 
প্রায় সব ধরনের মাটিতেই তাল ফসলের আবাদ করা যায়। তবে উঁচু জমিতে এবং ভারী মাটি তাল চাষের জন্য বেশি উপযোগী। আগস্ট মাস থেকে তাল পাকতে শুরু করে এবং অক্টোবর মাস পর্যন্ত পাকা তাল পাওয়া যায়। তালবীজ সংগ্রহ করে নির্বাচন করা উত্তম। তবে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নির্বাচিত মাতৃবৃক্ষ হতে তালের বীজ সংগ্রহ করা উচিত। ভাদ্র হতে কার্তিক মাস বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। সারি থেকে সারি ৭ মিটার এবং চারা থেকে চারা ৭ মিটার। গর্তের আকার হবে ১ মিটার চওড়া ও ১ মিটার গভীর। গর্ত করার ১০-১৫ দিন পর প্রতি গর্তে ১৫-২০ কেজি জৈবসার, ২৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ২০০ গ্রাম এমওপি মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। বীজের মাধ্যমে তালের বংশবিস্তার হয়ে থাকে। দুই ভাবে তালগাছ লাগানো যায়। সরাসরি  বীজ বপন করে  অথবা বীজতলায় চারা উৎপাদন করে চারা রোপণের মাধ্যমে এর আবাদ করা যায়। বীজতলা তৈরির ক্ষেত্রে প্রায় ১০ ফুট লম্বা এবং ৩ ফুট চওড়া বীজতলায় এক হাজার তালের আঁটি বা বীজ বসানো যায়। বীজতলার নিচের অংশে পাতলা টিনের শিট বা পুরু পলিথিন বিছিয়ে অথবা তলায় ২-৩ ইঞ্চি পুরু করে সিমেন্ট বালু খোয়া দিয়ে ঢালাই করে নিলে শিকড় মাটির ভেতরে প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হয়। এতে গজানো আঁটি সহজেই উঠিয়ে পলিব্যাগে সংরক্ষণ উপযোগী হয়। বীজতলা তৈরিকালে নিচের অংশ কম্পোস্ট/পচা গোবর ও ছাই মিশ্রিত বেলে-দো-আঁশ মাটি দিয়ে ৩ ইঞ্চি পরিমাণ ভরাট করে তাতে সারি করে বীজ বসাতে হবে। বীজগুলো বসানো হলে মোটা বালু ও মাটির মিশ্রণ দিয়ে প্রায় ১ ইঞ্চি (২-৩ সেমি.) পুরু করে বসানো বীজের উপরিভাগ ঢেকে দিতে হবে। বীজতলার মাটিতে নিয়মিত হালকা পানি সেচ দিয়ে ভেজাতে হবে। ৮-১০ সপ্তাহ পরে চারাগুলো আঁটিসহ উঠিয়ে পুরু শক্ত ১০ ী ১০ ইঞ্চি মাপের পলিব্যাগে অথবা পরিত্যক্ত সিমেন্টের বস্তা দিয়ে তৈরি ব্যাগে ভালো মানের পটিং মিডিয়া (বেলে  দো-আঁশ মাটি ৫০%, জৈব পদার্থ ৪০% এবং ১০% কেকোডাস্ট/করাত কলের গুঁড়া) ব্যবহার করে তা সংরক্ষণ করতে হবে। মৌসুমি বৃষ্টিপাত আরম্ভ হওয়ার পরপরই পলিব্যাগে উত্তোলিত ৩০-৩৫ সেমি. লম্বা দুপাতা বিশিষ্ট চারা মাঠে রোপণ করা উচিত। তবে মাটিতে প্রচুর পরিমাণে আর্দ্রতা থাকলে অথবা পানি সেচের ব্যবস্থা থাকলে চারা এপ্রিল-মে মাস পর্যন্ত লাগানো যেতে পারে। সমতল ভূমিতে অন্যান্য বৃক্ষ প্রজাতির পলিব্যাগের চারার মতোই এ চারা লাগাতে হবে। 
পরিচর্যা
প্রতি বছরই বর্ষার আগে ও পরে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স বাড়ার সাথে প্রতি বছর সারের মাত্রা ১০% হারে বাড়িয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের পর পরই পানি সেচ দিতে হবে। সার প্রয়োগ ছাড়াও আগাছা পরিষ্কার, সেচ ও নিষ্কাশনের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। নিয়মিত যত্ন ও পরিচর্যা নিশ্চিত করা হলে ১০-১২ বছরের মধ্যেই তাল খাওয়া যায়। তাল গাছে কোন পোকামাকড় ও রোগবালাই দেখা যায় না ।
ফল সংগ্রহ
মধ্য পৌষ থেকে মধ্য চৈত্র (জানুয়ারি থেকে মার্চ) মাসে ফুল আসে। মে-জুন মাস কচি তাল প্রাপ্তির উপযোগী সময়। প্রতিটা গাছে ২০০-৩০০টা কাঁচা পাকা তাল ধরে। সুস্থ সবল গাছে ১০-১৫টা তালের কাদি/ছড়া থাকে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে তাল পাকা শুরু হলে   ৩-৫ সপ্তাহ পর্যন্ত ক্রামন্বয়ে পাকা ফল পাওয়া যায়। 
সর্বোপরি তালগাছ পরিবেশবান্ধব এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তালগাছের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। রাস্তার দুপাশের পতিত জমি, অনাবাদি জমি, জমির আইল, বাড়ির আশপাশের পতিত জমিতে তালগাছ রোপণ করে গ্রামীণ জনগণের বাড়তি আয়ের উৎস সৃষ্টি করা ছাড়াও চিনি এবং গুড়ের ঘাটতি অনেকাংশ মেটানো সম্ভব। পরিকল্পনা করে তালগাছভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা করার পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতি ও পরিবেশ উন্নয়নে তালগাছ হবে আগামী দিনের কৃষি, কৃষক ও পরিবেশের পরম বান্ধব। 

লেখক : অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা, হর্টিকালচার উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৭১৮৬৫৩২৫৫,ই-মেইল :ayesha-sultana07@yahoo.com

বিস্তারিত
মাছের-আঁইশ-সম্ভাবনাময়-রপ্তানি-পণ্য

মাছের আঁইশ সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্য 
এ. এম. ফরহাদুজ্জামান১ 
মোঃ সুজন খান২ 
মেহেদী হাসান ওসমান৩
পৃথিবীতে যেসব দেশ মাছ উৎপাদনে এগিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তাদের মধ্যে ৫ম (জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার রিপোর্ট-২০২২)। বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪৭.৫৯ লক্ষ মে. টন মৎস্য উৎপাদন হয়েছে এবং সে অর্থবছরে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য মিলিয়ে ৭৪ হাজার মে. টনের কিছু বেশি পরিমাণ রপ্তানি করা হয় (জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২৩ সংকলন, মৎস্য অধিদপ্তর)। অর্থাৎ উৎপাদিত সিংহভাগই অভ্যন্তরীণ বাজারের ভোক্তার চাহিদা মিটিয়েছে। একসময় জলাশয় থেকে মাছ ধরে বা বাজার থেকে কিনে এনে বাসা-বাড়িতে কুটে ধুয়ে রান্না করে খাওয়া আমাদের দেশে খুবই সাধারণ চিত্র ছিল। তবে আধুনিক সমাজে মানুষের কর্মব্যস্ততা বাড়ার সাথে সাথে বদলে যেতে শুরু করেছে এ চিত্র। শহর ও গ্রামের অধিকাংশ বাজারেই এখন বিক্রেতাই ক্রেতার মাছ কেটে দিচ্ছেন। ঘরের মতো এসব মাছ বাজারেও মাছের আঁইশ জমা করে একসময় ফেলে দেওয়া হতো। তবে ফেলে দেওয়া সেই আঁইশই এখন স্বপ্ন দেখাচ্ছে হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের। ২০০৮ সালের দিকে বাংলাদেশ হতে ক্ষুদ্র পরিসরে কিছু মাছের আঁইশ রপ্তানি শুরু হলেও এরই মধ্যে বাংলাদেশে বিভিন্ন জায়গায় উদ্যোক্তাদের হাত ধরে রপ্তানিকারক পর্যায়ে মাছের আঁইশ পৌঁছাতে মাঠপর্যায়ের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাতকারীদের মধ্যে একটি নিবিড় নেটওয়ার্ক গড়ে উঠছে বলে প্রতীয়মাণ হচ্ছে।  
মাছের আঁইশের ব্যবহার
বিশ^ব্যাপী মাছের আঁইশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ব্যবহার রয়েছে, যা নি¤েœ উল্লেখ করা হলো : মাছের আঁইশ থেকে কোলাজেন ও জিলেটিন তৈরি করা হয়। এসব উপাদান দিয়ে ঔষধ শিল্পে ক্যাপসুলের খোসা তৈরি করা হয়; মাছের আঁইশে গ্রাইসিন, প্রোলিন, হাইড্রোক্সিপ্রোলিন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অ্যামাইনো এসিড থাকায় এর পাউডার স্যুপের সাথে খাওয়া হয়; মাছের আঁইশ কোলাজেন সমৃদ্ধ হওয়ায় কৃত্রিম কর্ণিয়া ও কৃত্রিম হাড় তৈরিতে ব্যবহার করা হয়; প্রসাধন শিল্পে মাছের আঁইশ থেকে আহরিত গুয়ালিন যৌগ লিপস্টিক ও নেইল পলিশ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়; মাছের আঁইশের নির্যাস হতে তৈরি হয় কৃত্রিম মুক্তা। মাছের আঁইশের সঙ্গে স্টোন ও ফেব্রিকস মিশিয়ে গয়না তৈরি করা হচ্ছে; চীন ও জাপানে মাছের আঁইশ ব্যবহার করে বায়ো পাইজোইলেকট্রিক ন্যানো জেনারেটর তৈরি করা হয়, যেগুলো দ্বারা রিচার্জেবল ব্যাটারিতে চার্জ দেয়া যায়; মহিলাদের গয়না, কানের দুল, গলার মালা প্রভৃতি তৈরি হয় মাছের আঁশ থেকে এবং মাছ ও পোলট্রি খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়।
মাছের আঁইশের রপ্তানি বাজার
বাংলাদেশ হতে মাছের আঁইশ মূলত জাপান, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশগুলোতে রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) হতে প্রাপ্ত তথ্য মতে ১০-১২ জন ব্যবসায়ী মাছের আঁইশ রপ্তানির সাথে জড়িত। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসেবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ হতে মোট ৩,০২২ টন মাছের আঁইশ রপ্তানি করা হয় যেখান থেকে আয় হয় ৪০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে সাত মাস পর্যন্ত ২,৮৭৪ টন মাছের আঁইশ রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৮০ কোটি টাকা। প্রসঙ্গত, এ খাত হতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪.২৬ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৬.২৬ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০ কোটি টাকা আয় হয় অর্থাৎ প্রতি বছর মাছের আঁইশ হতে আশা জাগানিয়া হারে রপ্তানি আয় বাড়ছে। 
মাছের আঁইশ সংগ্রহ পদ্ধতি 
স্থানীয় বাজারের মাছ কাটার বটিওয়ালাদের কাছ থেকে মাছের আঁইশ সংগ্রহ করা হয়। সংগ্রহ করার পর অপ্রয়োজনীয় অংশ যেমন- মাছের পাখনা, লেজের অংশ, কানের অংশ, গাছের পাতা ইত্যাদি বাছাই করে ফেলে দেয়া হয়। এরপর পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে ২-৩ দিন রোদে শুকানো হয়। মাছে পাঁচ ধরনের আঁইশ দেখতে পাওয়া যায় যথা- কসময়েড, প্লাকয়েড, গ্যানয়েড, সাইক্লয়েড ও টিনয়েড। যেসব আঁইশ চাকতির মতো, প্রায় গোলাকার এবং কিনারা মসৃণ হয় তাদের সাইক্লয়েড আঁইশ বলে। রুই, কাতল, মৃগেল ইত্যাদি মাছে এ ধরনের আঁইশ থাকে। রপ্তানির জন্য বাজারে হতে সাধারণত এসব প্রজাতির মাছের আঁইশই বেশি সংগ্রহ করা হয়। বাজার হতে সংগ্রহের সময় ভেজা আঁইশ গড়ে ১০-১২ টাকা প্রতি কেজি এবং শুকনোর পরে এসব আঁইশ রপ্তানিকারকের নিকট ৬০-৭০ টাকা প্রতি কেজি দরে বিক্রি করা হয়। প্রায় প্রতি ৩ কেজি ভেজা মাছের আঁইশ রোদে শুকানোর পর সাধারণত ১ কেজি শুকনা আঁইশ পাওয়া যায় (৩:১)। 
মাছের আঁইশ ব্যবসা সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতাসমূহ : বেশির ভাগ পরিবার পর্যায়ে মাছের এই আঁশ উচ্ছিষ্টাংশ বা বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেয়া হয়, ফলে এর অর্থমূল্য মিলে না; মাছের আঁইশ সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য অপ্রতুল প্রচার-প্রচারণা; মাছের আঁইশ হতে বিভিন্ন ধরনের উপাদান তৈরিতে প্রযুক্তি উদ্ভাবনের গবেষণার অভাব; সরকারি বা বেসরকারি বিনিয়োগের অভাব; রপ্তানি আয়ে আলাদা খাত হিসেবে তথ্য না থাকা; রপ্তানিতে উপযুক্ত সরকারি প্রণোদনা না থাকা এবং আঁইশ প্রক্রিয়াজাতকরণে দক্ষ শ্রমিকের অভাব। 
মাছের আঁইশের সম্ভাবনা 
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন তাদের সমীক্ষায় দেখিয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিদিন ২৫ টন মাছের আঁশ সংগ্রহ করা হচ্ছে। বর্তমানে রফতানিকারক কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন বিভিন্ন বাজার থেকে ১০ টন করে মাছের আঁশ সংগ্রহ করে থাকে। এতে প্রতি মাসে ৩০০ টন মাছের আঁশ রফতানির জন্য প্রস্তুত করা হয়। তবে স্থানীয় বাজারে পাওয়া মাছের আঁশ সম্পূর্ণরূপে রফতানি উপযোগী করা গেলে এর পরিমাণ দাঁড়াবে প্রতি মাসে ৭৫০ টন। ঘরে ঘরে মাছের যে আঁশ পাওয়া যায় তা এখনো বাজারের বাইরে রয়ে গেছে। হোটেল-রেস্তোরাঁ, কমিউনিটি সেন্টারকেও এই প্রক্রিয়ার আওতায় আনা গেলে বর্জ্য হিসেবে স্বীকৃত মাছের আঁশ রপ্তানি করে বছরে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। 

লেখক : ১ব্যবস্থাপক; ২-৩উপব্যবস্থাপক; পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), আগারগাঁও প্রশাসনিক এলাকা, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৯৩০৯০৬৪।

বিস্তারিত
বাচ্চা-ফোটানোর-উপযোগী-ডিম-নির্বাচন-ও-ডিমের-যত্ন
বাচ্চা ফোটানোর উপযোগী ডিম 
নির্বাচন ও ডিমের যত্ন
ডা: মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ
মোরগের সাথে মুরগির মিলনের পর যেসব ডিম হয়, কেবল ঐ ডিমগুলোতে ভ্রƒণ থাকে। এরূপ ডিমকে বলা হয় নিষিক্ত ডিম। এ ধরনের ডিমের সঠিক গঠন ও আকারের উপর নির্ভর করে ডিমের স্ফুটন ক্ষমতা। এজন্য ফোটানোর জন্য ডিম বাছাই করা একান্ত অপরিহার্য। 
ডিম বাছাই করার সময় নি¤েœর বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ রাখতে হবে -
ডিমের আকার : ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদনের জন্য মাঝারি আকারের ডিম ভালো। বেশি বড় বা বেশি ছোট আকারের ডিম বাদ দেয়া উচিত। অস্বাভাবিক আকৃতির ও পাতলা খোসার ডিম নেয়া যাবে না। কেবল মসৃণ, মোটা ও শক্ত খোসা বিশিষ্ট ডিম বাছাই করতে হবে। দুই কুসুমযুক্ত বা ডিমের ভেতর ডিম হলে সেসব ডিম বাদ দিতে হবে। কারণ এসব ডিম থেকে বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ডিমের আকৃতি : ফোটানোর জন্য ডিমের আকৃতি স্বাভাবিক হওয়া উচিত। অর্থাৎ ডিম্বাকৃতির ডিম হতে হবে। অস্বাভাবিক ডিম (যেমন- আঁকা-বাঁকা ডিম, বেশি লম্বা, সরু প্রান্ত ও চওড়া প্রান্ত সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় না এমন ডিম) ফোটানোর জন্য নির্বাচন করা উচিত নয়। 
ডিমের খোসার রঙ : মুরগি জাতভেদে বিভিন্ন রঙের ডিম দেয়। ডিমের খোসার রঙ সাদা, বাদামি, কালো বা কালচে হতে পারে। যে জাত যে রঙের ডিম দেয় সে অনুযায়ী ডিম বাছাই করতে হবে। যে জাত বা উপজাতের মুরগি সাধারণত সাদা ডিম পাড়ে, ঐ জাতের মুরগি মাঝেমধ্যে বাদামি রঙের ডিমও পাড়তে পারে। ফোটানোর জন্য কেবল ঐ ডিমগুলো থেকে সাদা খোসাবিশিষ্ট ডিমগুলো বাছাই করা উচিত। যে জাত বা উপজাতের মুরগি বাদামি খোসার ডিম পাড়ে, ঐ জাতের মুরগি মাঝেমধ্যে সাদা ডিমও পাড়তে পারে। ফোটানোর জন্য কেবল বাদামি খোসাবিশিষ্ট ডিমগুলো বাছাই করে ইনকিউবেটরে বসানো উচিত।
ডিমের খোসার মসৃণতা : ডিমের খোসার গঠনের সাথে স্ফুটন ক্ষমতার সম্পর্ক রয়েছে। ডিম পাড়া মুরগির খাদ্যে যদি ক্যালসিয়াম অথবা ভিটামিন ডি-এর অভাব হয় তবে ডিমের খোসা পাতলা ও নরম হয়। এ পাতলা খোসার ডিম ফোটার হার অনেক কম। তাই পাতলা খোসাসম্পন্ন ডিম ফোটানোর জন্য বাছাই করা উচিত নয়। শক্ত খোসা ও মসৃণ এরূপ ডিম ফোটানোর জন্য নির্বাচন করা উচিত। 
ফাটা বা ভাঙা ডিম : ফাটা বা ভাঙা ডিম ফোটানোর জন্য মোটেই বিবেচনা করা যাবে না। কারণ ফাটা ডিম ফোটে না। ডিম ফাটা কি না পরীক্ষার জন্য দুটি ডিমকে একত্রে নিয়ে পরস্পরকে আস্তে আস্তে আঘাত করলে ডিম ফাটা কি না তা শব্দ হতে বোঝা যায়। আলোর সাহায্যে পরীক্ষা করলে ডিম ফাটা কি না তা শনাক্ত করা যায়।
ডিমের ভেতরের বৈশিষ্ট্য : ডিমের ভেতর স্বচ্ছ হলে এবং কুসুম ডিমের মাঝখানে থাকলে সেই ডিম ফোটানোর জন্য উত্তম। আলোর সাহায্যে ডিমের ভেতরের অংশ সহজে পরীক্ষা করা যায়। যদি নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ ধরা পড়ে তবে ঐ ডিম ফোটানোর জন্য নির্বাচন করা উচিত নয়-
া পচা ডিম, যা ডিমের মধ্যে বুদ বুদ দেখে বোঝা যাবে।
া বায়ু কোষবিহীন
া অস্থায়ী বায়ুকোষ বা ডিমের মোটা অংশ ব্যতীত মধ্যখানে অবস্থিত বায়ুকোষ বা বড় বায়ুকোষ। বায়ুকোষ বড় থাকলে বুঝতে হবে যে ডিমের ভেতরের আর্দ্রতা কমে গেছে। 
া মাংসের দাগ বা রক্তের দাগ।
ময়লাযুক্ত ডিম : ডিম বাছাই করার সময় ডিম পরিষ্কার কি না তা লক্ষ রাখতে হবে। অতিরিক্ত ময়লাযুক্ত ডিম ফোটানোর জন্য নির্বাচন করা যাবে না। অল্প ময়লাযুক্ত ডিম পরিষ্কার কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করে ফোটানোর জন্য নির্বাচন করা যেতে পারে। তবে ডিম পানিতে ধোয়া যাবে না। 
ডিমের ওজন : উন্নত জাতের মুরগির ডিমের ওজন ৫০-৬০ গ্রাম হতে হবে।
ডিমের বয়স : ফোটানোর উপযোগী ডিমের বয়স গ্রীষ্মকালে ৩-৫ দিন এবং শীতকালে ৭-১০ দিনের বেশি হওয়া উচিত নয়। 
বাচ্চা ফোটানোর জন্য নির্বাচিত ডিমের যত্ন
ফোটানোর জন্য নির্বাচিত ডিমকে ইনকিউবেটরে বসানোর পূর্ব পর্যন্ত যত্ন করা একান্ত প্রয়োজন। ডিম ফোটার হার ডিমের পরিচর্যার উপর নির্ভরশীল। ডিম বসানোর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত নি¤েœাক্ত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করতে হবে-
তাপমাত্রা : ফোটানোর জন্য বাছাইকৃত ডিম কোনো সময়ই অতিরিক্ত ঠা-া কিংবা অতিরিক্ত গরম পরিবেশে রাখা ঠিক নয়। ডিম সর্বদা ঠা-া এবং আর্দ্রতাসম্পন্ন এবং ছায়াযুক্ত স্থানে সংরক্ষণ করা উচিত। ফোটানোর জন্য বাছাইকৃত ডিম সংরক্ষণের আদর্শ তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। ডিম ০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করলে ডিমের ভেতর ভ্রƒণ মারা যাবে। আবার ২৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা ততোধিক তাপমাত্রায় ডিম সংরক্ষণ করলে ভ্রƒণের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটবে। সঠিকভাবে ডিম সংরক্ষণের জন্য তাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ বা হিমাগার ব্যবহার করা যেতে পারে।
আর্দ্রতা : সাধারণত ৬৫% থেকে ৭০% আপেক্ষিক আর্দ্রতায় ডিম সংরক্ষণ করলে ফোটার হার সবচেয়ে বেশি হয়। তাই ৬৫% থেকে ৭০% আর্দ্রতায় ফোটানোর জন্য ডিম সংরক্ষণ করা উচিত। ঘরের মধ্যে পানি ছিটিয়ে আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কক্ষে আর্দ্রতা কম থাকলে অধিক বাষ্পায়ন হয় এবং ডিমের বায়ুকোষের আকার বড়  হয়। ফলে ডিম ফোটার হার কমে যায়।
ডিম নাড়াচাড়া করা : ফোটানোর জন্য বাছাইকৃত ডিমের সরুপ্রান্ত নিচে এবং মোটা প্রান্ত উপরে রেখে ট্রেতে সাজিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। মোটা প্রান্তের দিকে বায়ুকোষ থাকে। যদি মোটা প্রান্ত নিচের দিকে রাখা হয় তবে ঘুরন্ত বায়ুকোষের উপস্থিতি বৃদ্ধি পায় এবং এতে ডিম ফোটার হার কমে যায়। অনিয়মিতভাবে ডিম নাড়াচাড়া করলে ডিম খোসা ফেটে বা ভেঙে যেতে পারে। 
ডিমের বয়স বা সংরক্ষণ সময় : ডিম সংরক্ষণের সময় তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে। মুরগির ডিম ১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে ১৫.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ৭ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। সদ্যপাড়া ডিম ফোটার হার ১ থেকে ৪ দিন বয়সের ডিমের ফোটার হার অপেক্ষা কম হয়। 
ডিম পরিষ্কার করা : মাটি মাখা বা ময়লাযুক্ত ডিম অপেক্ষা পরিষ্কার ডিম অনেক বেশি ফোটে। ফোটানোর জন্য বাছাইকৃত ডিম সাথে সাথে পরিষ্কার কাপড় অথবা সিরিস কাগজ দিয়ে পরিষ্কার করে রাখা উচিত। ডিম ময়লাযুক্ত হলে ঠিকমতো অক্সিজেন ডিমের ভেতর প্রবেশ করতে পারে না এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড ডিমের ভেতর থেকে বের হতে পারে না। ফলে ডিমের ভেতর ভ্রƒণের মৃত্যু ঘটে। সর্বদা লক্ষ রাখা উচিত যে, ডিম কখনো যেন পানি দিয়ে ধোয়া না হয়। কারণ পানির মাধ্যমে ডিমের খোসার সূক্ষ¥ ছিদ্রগুলো বড় হয়ে যায়। ফলে বিভিন্ন জীবাণু ডিমের মধ্যে প্রবেশ করে এবং এতে ডিম ফোটার হার কমে যেতে পারে। 
 
লেখক : ভেটেরিনারি সার্জন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, কৃষি খামার সড়ক, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল : ০১৮১১-৯৮৬৬০৫; ইমেইল-ংsmmohibullah@gmail.com
বিস্তারিত
কর্পোরেট-চাকরি-ছেড়ে-দিয়ে-সফল-কৃষি-উদ্যোক্তা-মো:-সাইফুল-ইসলাম

কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে দিয়ে সফল কৃষি উদ্যোক্তা মো: সাইফুল ইসলাম
কৃষিবিদ মনিরুল হক রোমেল
পৃথিবীতে মাটি হচ্ছে সকল ফসল উৎপাদনের প্রধান মাধ্যম। প্রাণীকূলের খাদ্যের যোগান দিয়ে মাটি আমাদের মায়ের মতো আগলে রেখেছে। মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার পিহর গ্রামের বাসিন্দা জনাব মোঃ সাইফুল ইসলাম, হয়েছেন একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা। মাটির প্রাণ জৈব পদার্থ। বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চলের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ অতি নিম্ন। তাই মাটির প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য ফলপ্রসূ এক উদ্যোগ গ্রহণ করেন মোঃ সাইফুল ইসলাম। পেশায় একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। 
কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে দিয়ে কেন তিনি কৃষি উদ্যোক্তায় পরিণত হলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে মো: সাইফুল ইসলাম জানান ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের হিংস্র থাবায় সারা বিশ্ব প্রায় অচল হয়ে পড়ছিল। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজার আইটি পদে কর্মরত অবস্থায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, গ্রামে ফিরে যাওয়ার, নিরাপদ খাদ্য সরবরাহে ভূমিকা রাখার।  ২০২১ সালে চান্দিনা উপজেলার তৎকালীন উপজেলা কৃষি অফিসার জনাব মনিরুল হক রোমেল, পিহর ব্লকের উপসহকারী কৃষি অফিসার ইকবাল হোসেন এবং সাইফুলের সহধর্মিণী মোসাঃ ফাতেমা আক্তার এর পরামর্শে চান্দিনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সার্বিক সহযোগিতায় ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রোগ্রাম-ফেজ ওও প্রজেক্ট (এনএটিপি-২) প্রকল্পের ১৬ টি রিং ও ১০ কেজি কেঁচো দিয়ে ভার্মিকম্পোস্ট খামার এর একটি প্রদর্শনী দিয়েছেন। নিজ গ্রামে সকলের কাছ থেকে পাগল উপাধি অর্জন করেন ও আনন্দের সহিত তা গ্রহন করে ২০০ কেজি সার উৎপাদন করেন। প্রতি কেজি ভার্মিকম্পোস্ট ১৫ টাকায় বিক্রি শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি তার ব্যবসা আরও সম্প্রসারিত করেন। 
ভার্মিকম্পোস্টের দুনিয়ায় তার যাত্রা শুরু হয়। চাকরি ছেড়ে দিয়ে হতাশ এক যুবক ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন স্বাবলম্বী, আত্মবিশ্বাসী, অধ্যবসায়ী ও প্রত্যয়ী এক যুবক। 
প্লান্ট পাওয়ার অর্গানিক ফার্টিলাইজার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভার্মিকম্পোস্ট খামার শতসহস্র প্রতিষ্ঠানের ভীড়ে এমন একটি অর্গানিক ফার্টিলাইজার প্রতিষ্ঠান, যার জন্ম হয়েছে কিছু ভিন্ন উদ্দেশ্য, ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনার চমৎকার বাস্তবায়নে।  মাটির স্বাস্থ্য, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, মাটির ক্ষয় রোধ, আধুনিক কৃষির  চিন্তাভাবনার আলোকেই এই প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে প্লান্ট পাওয়ার অর্গানিক ফার্টিলাইজার। 
গুণগত মান বজায় রেখে অনলাইনে দারাজ, ফেসবুকেও বিক্রি শুরু করেন। যার ফলে কিছুদিন পর অনলাইনের মাধ্যমে ১ টন সার ১৫,০০০ টাকায় বিক্রির পর থেকে ১৬ টি রিং থেকে ৫০ টি রিং এর মাধ্যমে উৎপাদন করেন।  ২০২২ সালের মধ্যে ২৩০ টি রিং দিয়ে বাণিজ্যিক আকারে ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন করেন।  
তার ইচ্ছা নিরাপদ খাদ্য ও মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা নিয়ে ভার্মিকম্পোস্ট খামার করে , রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে নিরাপদ সবজি উৎপাদন করা, কৃষকদের  প্রশিক্ষণ ও উদ্যোক্তা তৈরি এর ব্যবস্থা করা। শুধু চান্দিনা উপজেলা বা কুমিল্লা জেলা নয়, তিনি তার সৎ কর্মের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন সারা বাংলাদেশে। কৃষকদের দিয়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় চট্টগ্রাম, রংপুর, বরিশাল, সিলেট, পটুয়াখালি, চাঁদপুর, ঝালকাঠি জেলায় নতুন ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদনকারী ও উপজেলা কৃষি অফিসারদের সাথে সাক্ষাত করে  ভার্মিকম্পোস্ট  বিক্রির ব্যবস্থা করেন। 
অনেক কর্মকর্তা নিজেদের ছাদবাগানে ব্যবহারের জন্য তার নিকট থেকে ভার্মিকম্পোস্ট ক্রয় করে নিয়ে গেছেন। মোঃ সাইফুল কয়েক মাস পর পর তার খামারে উৎপাদিত ভার্মি কম্পোস্ট এর নমুনা মৃত্তিকা  সম্পদ উন্নয়ন ইন্সটিটিউটের ল্যাবে পরীক্ষা করেন, এবং গুণগত মান সম্পর্কে নিশ্চিত হন।
ভার্মিকম্পোস্ট বাজারজাতকরণে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা হচ্ছে- মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, মাটির ক্ষয় রোধ ও আধুনিক কৃষির চিন্তাভাবনার আলোকেই ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদনকারী উদ্যোক্তা ও কৃষকগণকে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যাতে ছোট বড় কোন উদ্যোক্তাই পিছিয়ে না থাকে, যেন কেউ হতাশ হয়ে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করা বন্ধ করে না দেয়।  কয়েকজন  মেধাবী, পরিশ্রমী ও স্বপ্নবাজ তরুণকে নিয়ে গড়ে তুলেছে বাংলাদেশ ভার্মি কম্পোস্ট প্রডিউসার অর্গানাইজেশন (ইঠঈচঙ)” এই সংগঠনটির শুভযাত্রা শুরু হয়েছে কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলা থেকে। বর্তমানে কুমিল্লা জেলার প্রায় সকল ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদনকারী কৃষক এই সংগঠনটির সাথে যুক্ত এবং তাদের উৎপাদিত ভার্মি সার বিক্রি দিন দিন বেড়েই চলেছে। এখন বড়, মাঝারি বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা কারও বিপনণজনিত কোন সমস্যা হচ্ছে না। একই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিক্রি করছেন।
কৃষি উদ্যোক্তা মোঃ সাইফুল ইসলামকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্বনামধন্য দৈনিক পত্রিকা যেমন- বাংলাদেশ প্রতিদিন, যুগান্তর, ভোরের কাগজ, আমোদ, জুম বাংলা নিউজ ও বিটিভিসহ বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেল বিটিভি ওয়ার্ল্ড, দেশ টিভি, আনন্দ টিভি, গ্লোবাল টিভি, এখন টিভি চ্যানেল ও এআইএসটিউবে প্রচার করা হয়।  

লেখক : আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, আঞ্চলিক কার্যালয়, কুমিল্লা, মোবাইল: ০১৬৮১৬৮৩৩৪২, ই-মেইল : monirulromel@gmail.com

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর

প্রশ্নোত্তর

কৃষিবিদ ড. আকলিমা খাতুন

নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।
জনাব রেজাউল করিম, উপজেলা : ডিমলা, জেলা : নীলফামারী
প্রশ্ন : ধানগাছের ডিগপাতার খোলে অসংখ্য বাদামি দাগ দেখা যাচ্ছে এবং আস্তে আস্তে দাগগুলো সমস্ত খোলে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিকার কী?
উত্তর : এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ এবং ধানের খোলপচা রোগ নামে পরিচিত। এই রোগ সাধারণত ধানগাছের ডিগপাতার খোলে হয়। প্রথমে খোলে ছোট ছোট নানা আকারের বাদামি দাগ হয়। দাগগুলো আস্তে আস্তে বেড়ে একত্রে মিশে সমস্ত খোলেই ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় যদি শীষ বের হয় তাহলে ধান চিটা ও অপুষ্ট হয়। অনেক সময় শীষ অর্ধেক বের হতে পারে বা একেবারেই পারে না। প্রতিকার হিসেবে রোগ প্রতিরোধ সম্পন্ন জাত ব্যবহার করতে হবে এবং সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে। রোগ দেখা দিলে জমির পানি শুকিয়ে কয়েকদিন পর আবার সেচ দিতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে টিল্ট ২৫০ ইসি  (প্রোপিকোনাজল গ্রুপের) অথবা নাটিভো (ট্রাইসাইক্লোজোল গ্রুপের) অথবা কনটাফ ৫ ইসি (হেক্সাকোনাজল গ্রুপের) ১ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে সাত  থেকে দশ দিন পর পর স্প্রে করে দিতে হবে। 
জনাব সবুজ আলম, উপজেলা : পাটগ্রাম, জেলা : লালমনিরহাট
প্রশ্ন : লালশাক চাষের জন্য শতকপ্রতি জমিতে বীজের পরিমাণ এবং সার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : লালশাকের বীজের পরিমাণ : শতকপ্রতি ৮-১০ গ্রাম। সরাসরি বীজ বুনলে লাইন থেকে লাইন ১৫ ইঞ্চি এবং চারা থেকে চারা ৮-১০ ইঞ্চি দূরে লাগাতে হবে।
সার ব্যবস্থাপনা :
টিএসপি সারের বদলে ডিএপি সার দিলে প্রতি কেজি ডিএপি সারের জন্য ৪০০ গ্রাম ইউরিয়া (হেক্টরপ্রতি) কম দিতে হবে।
জনাব হাবিবুর রহমান, উপজেলা : সিরাজদিখান, জেলা : মুন্সীগঞ্জ
প্রশ্ন : পোকা ধানগাছের পাতা মুড়িয়ে ফেলছে, কী করতে হবে?
উত্তর : ধানের পাতা মোড়ানো পোকা পাতা লম্বালম্বিভাবে মুড়িয়ে পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে, ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পাতায় সাদা লম্বা দাগ দেখা যায়। পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী পোকা পাতার মধ্য শিরার কাছে ডিম পাড়ে। কীড়াগুলো পাতার সবুজ অংশ খায় এবং বড় হওয়ার সাথে সাথে তারা পাতা লম্বালম্বিভাবে মুড়িয়ে নলের মতো করে ফেলে। পোকা দেখা দিলে আলোক ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে নষ্ট করতে হবে। শতকরা ১৫ ভাগ পাতার ক্ষতি হলে অনুমোদিত বালাইনাশক যেমন : হেক্টরপ্রতি ডাইমেথোয়েট গ্রুপের (টাফগর) ১.১২ লি: অথবা কারবারিল গ্রুপের (সেভিন) ১.৭০ কেজি ব্যবহার করতে হবে।
জনাব আলমগীর হোসেন, উপজেলা : বোদা, জেলা : পঞ্চগড়
প্রশ্ন : মরিচের পাতা কুঁকড়ে যাচ্ছে, কী করণীয়?
উত্তর : মরিচের জাবপোকা পাতা ও ডগার রস চুষে খেয়ে পাতাকে বিবর্ণ করে ও পাতা ফুল কুঁকড়ে যায়। আক্রান্ত বেশি হলে ইমিডাক্লোরোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক (যেমন এডমায়ার অথবা টিডো ৭-১০ মিলিলিটার) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সেই সবজি খাওয়া বা বিক্রি করা যাবে না। গাছের আক্রান্ত অংশ অপসারণ করতে হবে। হলুদ রঙের ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে।
জনাব মো. জসিম, উপজেলা : আমতলী, জেলা : বরগুনা
প্রশ্ন : মিষ্টি কুমড়ার ফলের নিচের দিকে পচন দেখা দিচ্ছে। ধীরে ধীরে পুরো ফলটিই পচে যাচ্ছে। প্রতিকার কী?
উত্তর : মিষ্টি কুমড়ার গাছে প্রথমে কচি ফলের নিচের দিকে পচন দেখা দেয়, ধীরে ধীরে পুরো ফলটিই পচে যায়। এই রোগের নাম মিষ্টি কুমড়ার ব্লোজম এন্ড রট রোগ। প্রতিকার হিসেবে ক্ষেতে পরিমিত সেচ দিতে হবে। গর্ত বা প্রতি পিটে ৫০ থেকে ৮০ গ্রাম করে জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে শতাংশ প্রতি চার কেজি হারে ডলোচুন প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সুষম সার ব্যবহার করে এ রোগ দমন করা যায়।
জনাব মো: ওমর আলী, উপজেলা : সাতকানিয়া, জেলা : চট্টগ্রাম
প্রশ্ন : গ্রীষ্মকালীন এবং বর্ষাকালীন পেঁয়াজ বপনের সময় সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই এবং বর্ষাকালীন পেঁয়াজ জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চারা লাগানো যায়।
জনাব আল আমিন, উপজেলা : পীরগঞ্জ, জেলা : রংপুর
প্রশ্ন : পটোল গাছে লাল মাকড় আক্রমণ করেছে। করণীয় কী?
উত্তর : পটোল লাল মাকড় আক্রমণ করলে পাতা শক্ত চামড়ার মতো হয় এবং পাতা বিবর্ণ হয়ে ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়। লালমাকড় আকারে অত্যন্ত ছোট হয়। এরা পাতার নিচের দিকে অবস্থান করে। ব্যাপক আক্রমণের ফলে সম্পূর্ণ পাতা হলুদ ও বাদামি রঙ ধারণ করে এবং ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়। ফলে গাছের বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফলন অনেক কমে যায়।
এ পোকা দমনের জন্য এক কেজি আধা ভাঙ্গা নিমবীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে ওই পানি পাতার নিচে স্প্রে করতে হবে। আক্রমণের হার বেশি হলে ক্লোর ফেনাপাইর গ্রুপের ইন্ট্রাপিড মাকড়নাশক ২ মিলি ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।

লেখক : তথ্য অফিসার (উদ্ভিদ সংরক্ষণ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৯১৬৫৬৬২৬২; ই-মেইল : 

বিস্তারিত
আশ্বিন-মাসের-কৃষি-(১৬-সেপ্টেম্বর-১৬-অক্টোবর)

আশ্বিন মাসের কৃষি
(১৬ সেপ্টেম্বর-১৬ অক্টোবর)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
আশি^ন মাস। ষড়ঋতুর বাংলা পঞ্জিকার ষষ্ঠতম মাস। ভােেদ্রর কাঠফাটা রোদ আর উষ্ণতম প্রকৃতিতে যখন জীবনপ্রাণ ওষ্ঠাগত, ঠিক তখনই যেন আশ্বিন নিয়ে আসে এক টুকরো স্বস্তির নিঃশ্বাস। তাইতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরপয়লা আশি^ন কবিতায় উল্লেখ করেন প্রকৃতই প্রকৃতিতে শরতের পরিপূর্ণ রূপ যেন ফুটে উঠে আশ্বিনেই। বৈশি^ক উষ্ণায়নের কারণে প্রকৃতি বিরূপ প্রভাব পড়ছে। প্রকৃতির এরূপ পরিস্থিতিতে আমরা জেনে নেই আশ্বিন মাসের বৃহত্তর কৃষি ভুবনের করণীয় বিষয়গুলো।      
আমন ধান
আমন ধানের বয়স ৪০-৫০ দিন হলে ইউরিয়ার শেষ কিস্তি প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হবে এবং জমিতে ছিপছিপে পানি রাখতে হবে। এ সময় বৃষ্টির অভাবে খরা দেখা দিতে পারে। সে জন্য সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। ফিতাপাইপের মাধ্যমে সম্পূরক সেচ দিলে অথবা কৃষি কাজে পানিসাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করলে পানির অপচয় অনেক কম হয়। শিষ কাটা লেদাপোকা ধানের জমি আক্রমণ করতে পারে। প্রতি বর্গমিটার আমন জমিতে ২-৫টি লেদা পোকার উপস্থিতি মারাত্মক ক্ষতির পূর্বাভাস। তাই সতর্ক থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সময় মাজরা, পামরি, চুঙ্গী, গলমাছি পোকার আক্রমণ হতে পারে। এক্ষেত্রে নিয়মিত জমি পরিদর্শন করে, জমিতে খুঁটি দিয়ে, আলোর ফাঁদ পেতে, হাতজাল দিয়ে পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। খোলপোড়া, পাতায় দাগ পড়া রোগ দেখা দিতে পারে। সঠিক রোগ শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
নাবি আমন রোপণ 
কোন কারণে আমন সময়মতো চাষ করতে না পারলে অথবা নিচু এলাকায় আশ্বিনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিআর ২২,       বিআর ২৩, ব্রি ধান৪৬, বিনাশাইল বা স্থানীয় জাতের চারা রোপণ করা যায়। গুছিতে ৫-৭টি চারা রোপণ করতে হবে। অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি ইউরিয়া প্রয়োগ ও অতিরিক্ত পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায় এবং দেরির ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায়।
তুলা
এ সময় তুলাক্ষেতে গাছের বয়স ৬০ দিন পর্যন্ত আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। গোড়ার সবচেয়ে নিচের ১-২টি অঙ্গজ শাখা কেটে দেয়া ভালো। লাগাতার বৃষ্টি এবং ঝড়ো বাতাসের কারণে গাছ হেলে পড়লে পানি নিষ্কাশনসহ হেলে যাওয়া গাছ সোজা করে গোড়ায় মাটি চেপে দিতে হবে। ইউরিয়া, এমওপি ও বোরনসহ অন্যান্য অনুখাদ্য নিয়মিতভাবে পাতায় প্রয়োগের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এ সময় রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা গেলে সঠিক বালাই শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
পাট
নাবি পাট ফসল উৎপাদনে এ সময় গাছ থেকে গাছের দূরত্ব সমান রেখে অতিরিক্ত গাছ তুলে পাতলা করে দিতে হবে। দ্বিতীয় কিস্তির ইউরিয়া সার ১৫-২০ দিনে এবং তৃতীয় কিস্তির ইউরিয়া সার ৪০-৪৫ দিনে প্রয়োগের সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকে। এ সময় সবজি ও ফল বাগানে সাথী ফসল হিসেবে বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারেন।
আখ
আখের চারা উৎপাদন করার উপযুক্ত সময় এখন। সাধারণত বীজতলা পদ্ধতি এবং পলিব্যাগ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করা যায়। পলিব্যাগে চারা উৎপাদন করা হলে বীজ আখ কম লাগে এবং চারার মৃত্যুহার কম হয়। চারা তৈরি করে বাড়ির আঙ্গিনায় সুবিধাজনক স্থানে সারি করে রেখে খড় বা শুকনো আখের পাতা দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। চারার বয়স ১-২ মাস হলে মূল জমিতে রোপণ করা উচিত। কাটুই বা অন্য পোকা যেন চারার ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
বিনা চাষে ফসল আবাদ
মাঠ থেকে বন্যার পানি নেমে গেলে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় বিনা চাষে অনেক ফসল আবাদ করা যায়। ভুট্টা, গম, আলু, সরিষা, মাসকালাই বা অন্যান্য ডাল ফসল, লালশাক, পালংশাক, ডাঁটাশাক বিনা চাষে লাভজনকভাবে আবাদ করা যায়। সঠিক পরিমাণ বীজ, সামান্য পরিমাণ সার এবং প্রয়োজনীয় পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে লাভ হবে অনেক। যেসব জমিতে উফশী বোরো ধানের চাষ করা হয় সেসব জমিতে স্বল্পমেয়াদি সরিষা  জাত (বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৭, বারি সরিষা-১৮, বিনা সরিষা-৪, বিনা সরিষা-৯, বিনা সরিষা-১০ ইত্যাদি) চাষ করতে পারেন।
শাকসবজি
আগাম শীতের সবজি উৎপাদনের জন্য উঁচু জায়গা কুপিয়ে পরিমাণ মতো জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে শাক উৎপাদন করা যায় যেমন- মুলা, লালশাক, পালংশাক, চীনাশাক, সরিষাশাক অনায়াসে করা যায়। সবজির মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, টমেটো, বেগুন, ব্রোকলি বা সবুজ ফুলকপিসহ অন্যান্য শীতকালীন সবজির চারা তৈরি করে মূল জমিতে বিশেষ যতেœ আবাদ করা যায়।
কলা
অন্যান্য সময়ের থেকে আশ্বিন মাসে কলার চারা রোপণ করা সবচেয়ে বেশি লাভজনক। এতে   ১০-১১ মাসে কলার ছড়া কাটা যায়। ভালো উৎস বা বিশ্বস্ত কৃষক-কৃষানির কাছ থেকে কলার অসি চারা সংগ্রহ করে রোপণ করতে হবে। কলার চারা রোপণের জন্য ২-২.৫ মিটার দূরত্বে ৬০ সেমি. চওড়া এবং ৬০ সেমি. গভীর গর্ত করে রোপণ করতে হবে। গর্ত প্রতি ৫-৭ কেজি গোবর, ১২৫ গ্রাম করে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সার এবং ৫ গ্রাম বরিক এসিড মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে            ৫-৭ দিন পর অসি চারা রোপণ করতে হবে। কলাবাগানে সাথী ফসল হিসেবে ধান, গম, ভুট্টা ছাড়া যে কোন রবি ফসল চাষ করা যায়। 
সরকারিভাবে মাদারীপুর হর্টিকালচার সেন্টারে জি-৯ কলার টিসু কালচার চারার উৎপাদন ও বিক্রি হচ্ছে। এ জাতের কলার ফলন অন্য জাতের চেয়ে দেড় থেকে দ্বিগুণ বেশি, সুস্বাদু ও রোগ প্রতিরোধী। মাত্র ৮-৯ মাসের মধ্যে কলা পাওয়া যায়।
গাছপালা
বর্ষায় রোপণ করা চারা কোনো কারণে নষ্ট হলে সেখানে নতুন চারা রোপণ করতে হবে। বড় হয়ে যাওয়া চারার সঙ্গে বাঁধা খুঁটি সরিয়ে দিতে হবে এবং চারার চারদিকের বেড়া প্রয়োজনে সরিয়ে বড় করে দিতে হবে। মরা বা রোগাক্রান্ত ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। চারা গাছসহ অন্যান্য গাছে সার প্রয়োগের উপযুক্ত সময় এখনই। গাছের গোড়ার মাটি ভালো করে কুপিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে। দুপুর বেলা গাছের ছায়া যতটুকু স্থানে পড়ে ঠিক ততটুকু স্থান কোপাতে হবে। পরে কোপানো স্থানে জৈব ও রাসায়নিক সার ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে।
এসময় তাল পাকে। তালের চারা তৈরি করার জন্য উত্তম মাতৃগাছ হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। পরিপক্ব তালের উপরের শক্ত খোসা ছাড়িয়ে কিছু সময় পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। পরে হাত দিয়ে কচলিয়ে আঁশ হতে রস বের করতে হবে। প্রতিটি তালে সাধারণত তিনটি করে বীজ থাকে এবং রস সংগ্রহ করার সময় বীজগুলো পৃথক হয়ে যাবে। বীজ সংগ্রহের পরপরই বীজতলায় বপন করতে হবে। বীজ শুকিয়ে গেলে অঙ্কুরোদগম হবে না। পরিপক্ব তালের বীজের অঙ্কুরোদগমের হার সাধারণত ৭০-১০০ ভাগ। 
আশ্বিন মাসে নিয়মিত কৃষি কাজের পাশাপাশি সারা দেশজুড়ে ইঁদুর নিধন অভিযান শুরু হয়। খাদ্য নিরাপত্তায় ইঁদুরের হাত থেকে ফসল রক্ষা করার জন্য এ অভিযান খুবই জরুরি। এককভাবে বা কোন নির্দিষ্ট এলাকায় ইঁদুর দমন করলে কোন লাভ হবে না। ইঁদুর দমন কাজটি করতে হবে দেশের জনগণকে একসাথে মিলে এবং ইঁদুর দমনের বৈজ্ঞানিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করে। আসুন সবাই একসাথে ইঁদুর দমন করি। সবাই ভালো থাকি। (ছবি: সংগৃহীত)

সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪; ই-মেইল : editor@ais.gov.bd.

বিস্তারিত