রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন
প্রফেসর ড. মো. আদনান আল বাচ্চু১
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন ভূঞা২
ইদুর মানুষের আশে পাশে থেকেই মাঠে, গুদামে, বাসা বাড়িতে, অফিস আদালতে প্রতিনিয়ত ক্ষতি করে চলেছে। পৃথিবীর এমন কোন দেশ নেই যেখানে ইঁদুরের সমস্যা নেই। বিশ্বে প্রতি বছর যে পরিমাণ খাদ্য ইঁদুর দ্বারা নষ্ট হয় তা দিয়ে প্রায় ২৫-৩০টি দরিদ্র্য দেশের মানুষ এক বছর বাঁচতে পারে। এ ছাড়াও ইঁদুর ৬০টিরও বেশি রোগের জীবাণু বহন এবং বিস্তার করে থাকে। তাই এদের দমন করা অতীব জরুরি। ইঁদুর দমন পদ্ধতিকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়: (১) অরাসায়নিক বা পরিবেশসম্মতভাবে ইঁদুর দমন (২) রাসায়নিক বা বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইঁদুর দমন।
রাসায়নিক বা বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইঁদুর দমন
রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বহুযুগ ধরে চলে আসছে। রাসায়নিক পদ্ধতিকে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়। যথা : তীব্র বা তাৎক্ষণিক বিষ, দীর্ঘমেয়াদি বিষ, ট্র্যাকিং পাউডার, ধূম্রবিষ/গ্যাস বডি, বিকর্ষক বা বিতাড়ক দ্রব্যের ব্যবহার, রাসায়নিক বন্ধ্যাকারক বা প্রজনন নিবারকের ব্যবহার।
তীব্র বা তাৎক্ষণিক বিষ : যেসব বিষ ইঁদুর খাওয়ার পর পরই দেহে তাৎক্ষণিক বিষক্রিয়া দেখা দেয় এবং মৃত্যু ঘটায় তাদের তীব্র বিষ বলা হয়। যেমন- জিংক ফসফাইড, বেরিয়াম কার্বনেট, আর্সেনিক ট্রাইঅক্সাইড, ব্রমেথিলিন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অন্যান্যের মধ্যে আনটু (অঘঞট- আলফা ন্যাফথাইল থায়োইউরিয়া), সোডিয়াম ফ্লরোঅ্যাসিটেট এবং থেলিয়াম সালফেট ইঁদুর দমনে অধিক কার্যকরী রাসায়নিক পদার্থ হলেও এটি মানুষ ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিপদজনক। যেহেতু এ বিষ একবার খেলেই ইঁদুর মারা যায় তাই এই বিষকে একমাত্রা বিষও বলা হয়। তবে একমাত্র সরকার অনুমোদিত তাৎক্ষণিক বা তীব্র বিষ হলো জিংক ফসফাইড। ১৯১১ সালে প্রথমে ইঁদুরনাশক (জড়ফবহঃরপরফব) হিসেবে এটি ইতালিতে ব্যবহৃত হয় এবং এন্টিকুয়াগুলেন্ট (১৯৪০–১৯৫০) আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এটি বহুল ব্যবহৃত একমাত্রা ব্রড স্পেকট্রাম ইঁদুরনাশক হিসেবে বিশ্বে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সাধারণত ২৫-৪০ মিলিগ্রাম/কেজি বডির ওজন হারে (LD50) বিভিন্ন ইঁদুরে এটি কার্যকরী। তীব্র বা তাৎক্ষণিক বিষের বিষক্রিয়ার ধরন হলো এ বিষটোপ খাওয়ার পর এদের পাকস্থলীর পাচক রসের সংস্পর্শে আসার পর এক প্রকার বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হয়। এ বিষাক্ত গ্যাস আক্রান্ত ইঁদুরের লিভার ও কিডনিকে অকেজো করে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ করে ইঁদুরের মৃত্যু ঘটায়। এ বিষটোপ খেয়ে ইঁদুর ১-২ ঘণ্টার মধ্যেই মারা য়ায় এবং মরা অবস্থায় ইঁদুরকে বিষটোপ পাত্রের আশে পাশেই পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু এ বিষটোপের বেশ কিছু অসুবিধা আছে। যেমন- বিষটোপ লাজুকতা বা বিষটোপ বিমুখতা, সেকেন্ডারি পয়জনিং এবং তা মানুষ ও পরিবেশের জন্য অতিমাত্রায় ক্ষতিকর। বিষটোপ পাত্রের আশে পাশে মরা ইঁদুর পড়ে থাকতে দেখে অন্য ইঁদুর আর বিষটোপ খেতে চায় না। একেই বিষটোপ লাজুকতা বলা হয়। এই বিষটোপ লাজুকতা কাটাতে বিষটোপ ব্যবহারের আগে প্রথম ২-৩ দিন বিষহীন টোপ (শুধুমাত্র গম) ব্যবহার করে ইঁদুরকে টোপ খেতে অভ্যস্ত করে নিলে ইঁদুরের মৃত্যু হার অনেক বেড়ে যায়। তবে একই স্থানে একাধিক্রমে দুই রাত্রের বেশি এ বিষটোপ ব্যবহার করা ঠিক না এবং অন্তত ২-৩ মাস বিরতি দিয়ে পুনর্বার ব্যবহার করতে হবে। এ বিষের সুনির্দিষ্ট কোন প্রতিষেধক নেই।
জিংক ফসফাইড (২%) প্রস্তুত প্রণালী : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীগণ কর্তৃক উদ্ভাবিত গমে মিশ্রিত ২% জিংক ফসফাইড আবরণ যুক্ত বিষটোপ যা ইঁদুর দমনে খুবই কার্যকরী এবং এটি কৃষক ভাইয়েরা সহজে তৈরি করতে পারেন (সারণি দ্রষ্টব্য)।
সারণি : এক কেজি বিষটোপ তৈরির উপাদানসমূহ
প্রস্তুত প্রণালী : একটি অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে প্রথমে ১০০ মিলি লিটার পানি নিয়ে তাতে ১০ গ্রাম বার্লি বা সাগু মিশিয়ে জাল (তাপ) দিতে হবে এবং যখন এই মিশ্রনটি ঘন হয়ে আসবে তখন পাত্রটি নামিয়ে ভালোভাবে ঠান্ডা করে তাতে ২৫ গ্রাম ধুসর কালো রঙের জিংক ফসফাইড (সক্রিয় উপাদান ৮০%) ভালোভাবে মিশাতে হবে। এরপর ৯৬৫ গ্রাম গম ওই মিশ্রণের মধ্যে ঢেলে আবার সমস্ত মিশ্রণটিকে একটি কাঠি বা চামুচ দিয়ে এমনভাবে নাড়াতে হবে যেন সমস্ত গমের চারিপাশে জিংক ফসফাইডের কালো আবরন পড়ে। এরপর এই মিশ্রণকে ১-২ ঘণ্টা রোদে শুকিয়ে নিয়ে ঠা-া করে তার সাথে ভালোভাবে তেল দিয়ে মেখে বায়ু নিরোধক পাত্রে বা পলিব্যাগে সংরক্ষণ করতে হবে। এভাবে তৈরিকৃত বিষটোপ ২-৩ বছর পর্যন্ত কৃষক ব্যবহার করতে পারেন।
ব্যবহার বিধি : ইঁদুরের চলাচলের রাস্তা যেমন ঘরের দেয়ালের পাশ ঘেসে, সিলিং এর উপর, গর্তের মুখে ও জমির আইলের পাশে এ বিষটোপ কোন পাত্রে রেখে দিতে হবে। তাছাড়াও ইঁদুরের সতেজ গর্তের মুখ পরিষ্কার করে একটি কাগজের মধ্যে ৫ গ্রাম (আনুমানিক) বিষটোপ রেখে তা মুড়িয়ে গর্তের ভেতর দিতে হবে। গর্তের ভেতর পুঁটলির বিষটোপ খেয়ে ইঁদুর মারা যাবে। যদি গর্তের বাইরে বিষটোপ রাখা হয় তাহলে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হবে ইঁদুর খেয়েছে কি না।
সতর্কতা : জিংক ফসফাইড বিষটোপ তৈরির সময় পরিষ্কার কাপড় দিয়ে নাক মুখ ঢেকে রাখতে হবে। বিষটোপ তৈরির ও ব্যবহারের পর সাবান অথবা হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে। মৃত ইঁদুরগুলো একত্র করে গর্তে পুঁতে ফেলতে হবে। শিশু ও গৃহপালিত পশুপাখি যেন কোনোক্রমেই এই বিষটোপের সংস্পর্শে না আসে সে ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। বিষটোপ প্রস্তুত ও প্রয়োগের সময় তাৎক্ষণিক কোন প্রকার অসুস্থতা অনুভব করলে রেজিষ্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি বিষ : যে সমস্ত বিষ খেলে ইঁদুর তাৎক্ষণিকভাবে বিষক্রিয়ায় মারা না যেয়ে ধীরে ধীরে অসুস্থ বা দুর্বল হয়ে ১-২ সপ্তাহের মধ্যে মারা যায় তাদের দীর্ঘমেয়াদি বিষ বলা হয়। এই জাতীয় সব বিষই রক্ত পানিকারক বা এন্টিকুয়াগুলেন্ট হিসাবে পরিচিত। দীর্ঘমেয়াদি বিষকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
একমাত্রা বিষ : একমাত্রা বিষ যেমন ব্রডিফেকাম একবার খেলেই ইঁদুর ৩-৪ দিনের মধ্যে মারা যায়। ক্লের্যাট , স্টর্ম ইত্যাদি সরকার অনুমোদিত একমাত্রা দীর্ঘমেয়াদি বিষ যা বাণিজ্যিকভাবে ইঁদুর দমনে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
বহুমাত্রা বিষ : বহুমাত্রা বিষ যেমন ব্রমাডিয়োলোন, ওয়ারফারিন, কৌমাট্রেট্রালিন ইত্যাদি ইঁদুর মরার জন্য ২-৩ বার খেতে হয় এবং ১-২ সপ্তাহের মধ্যে ইঁদুর মারা যায়। বাংলাদেশে বহুমাত্রা বিষের মধ্যে ল্যানির্যাট, ব্রমাপয়েন্ট, রেটোক্স, রোমা, র্যাটোনিল ইত্যাদি বাণিজ্যিক ভাবে পাওয়া যায়। সকল দীর্ঘমেয়াদি বিষই ইঁদুরের শরীরের রক্ত জমাট বাধার ক্ষমতাকে ব্যহত করে। ফলে ইঁদুরের নাক, মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণের মাধ্যমে ইঁদুর দুর্বল হয়ে মারা যায়। এই ধরনের বিষ যকৃতে ভিটামিন কে-১ তৈরিতে বাধাগ্রস্থ করে। ভিটামিন কে-১ হলো রক্ত জমাট বাধার উপাদান (যা সম্মিলিতভাবে প্রোথম্বিন নামে পরিচিত) সৃষ্টিতে অপরিহার্য। দীর্ঘমেয়াদি বিষ ভিটামিন কে-১ সৃষ্টিতে বাধা প্রদান করে রক্তের প্রোথম্বিন ধীরে ধীরে কমিয়ে রক্ত জমাট বাধার প্রক্রিয়াকে নষ্ট করে ফেলে। ফলশ্রুতিতে অনবরত রক্তক্ষরণ হতে থাকে। ইঁদুর এ ধরনের বিষ খেয়ে আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে গর্তের মধ্যে মারা যায় যার জন্য মৃত ইঁদুর সচরাচর দেখা যায় না। আবার এ ধরনের বিষ খেলে সহসা কোন আক্রান্ত লক্ষণ ধরা পড়ে না বলে অন্যান্য ইঁদুরও এ বিষ খেতে কুণ্ঠাবোধ করে না। ফলে ইঁদুরের বিষটোপ লাজুকতাও দেখা যায় না। তবে এ বিষটোপের খরচ একটু বেশি এবং কৃষকের শ্রম ও সময় বেশি লাগে।
দীর্ঘমেয়াদি বিষটোপ প্রয়োগ পদ্ধতি : এ বিষটোপ উপর্যুপরি বেশ কয়েকদিন ব্যবহার করতে হয়। এ ধরনের বিষটোপ যেন বৃষ্টিতে বা মাটির আর্দ্রতায় কার্যক্ষমতা হারিয়ে না ফেলে সে জন্য সাধারণত কোনো পাত্রে রেখে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। পাত্রে সাধারণত ২০০-৩০০ গ্রাম বিষটোপ নিয়ে ঘরে বা মাঠে ইঁদুরের গর্তে অথবা চলাচলের রাস্তায় রেখে দিতে হবে এবং প্রতিদিনই পর্যবেক্ষণ করতে হবে যেন বিষটোপ ইঁদুর খেল কি না । যদি খেয়ে থাকে তবে আবারও বিষটোপ ঐ পাত্রে দিতে হবে যেন ইঁদুর তা প্রয়োজন মতো খেতে পারে। বাড়িঘরে সাধারণত সন্ধ্যার পর বিষটোপ প্রয়োগ করা হয় ও পরের দিন সকালে তুলে নিতে হয়। তা না হলে গৃহপালিত প্রাণী এ বিষটোপ খেয়ে মারা যেতে পারে। ফসলের জমিতে পানি থাকলে কলার ভেলা তৈরি করে সেখানে বিষটোপ রাখতে হবে।
টেবিল -১ : সরকার অনুমোদিত কতিপয় ইঁদুরনাশকের তালিকা
ট্র্যাকিং পাউডার : ট্র্যাকিং পাউডার সাধারণত ইঁদুরের চলাচলের রাস্তায়, গর্তের মুখে ও ভেতরে ছিটিয়ে দিতে হয়। ইঁদুর যখন তার রাস্তা দিয়ে চলাচল করবে তখন তার পায়ে এবং গায়ে পাউডার লেগে যাবে। ইঁদুরের একটা বড় স্বভাব হলো তাদের দেহ জিহবা দিয়ে পরিষ্কার করা। যখন ইঁদুর দেহ পরিষ্কার করে তখন তার পা এবং শরীর হতে মুখের মধ্য দিয়ে পাউডার পেটের ভেতর যায় এবং এ বিষক্রিয়ায় ইঁদুর মারা যায়। মাঠের কালো ইঁদুরের চেয়ে বাদামি ইঁদুর দমনে এবং ঘরের নেংটি ইঁদুর দমনে এ বিষ বেশ কার্যকরী। সোডিয়াম ফলুরোসিলিকেট, ভ্যালোন, ক্লোরোফ্যাকিনোন (০.২%) বা কৌমাফেন (০.৫%) ট্র্যাকিং পাউডার হিসেবে কার্যকর। দীর্ঘস্থায়ী এ বিষ ব্যবহারে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত কেননা এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
ধূম্রবিষ/বিষ বাস্প/গ্যাস বডি : যে সমস্ত ইঁদুর বিশেষত মাটিতে গর্ত করে, তাদের দমন ব্যবস্থা হিসেবে গ্যাস বড়ি বেশ কার্যকর। সক্রিয় গর্তের মধ্যে ১টি গ্যাস বড়ি দিয়ে গর্তের সকল মুখ ভালোভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। গর্তের আর্দ্র বাতাসের সাথে এই ট্যাবলেট মিশে ফসফাইন (PH3) নামক এক প্রকার বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি করে ফলে ইঁদুর মারা যায়। ধুম্রবিষ যেমন- মিথাইল ব্রোমাইড, কার্বন টেট্রাক্লোরাইড, ইথিলিন ডাই ব্রোমাইড এবং অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (ফসটক্সিন, কুইকফিউম, সেলফস , কুইকফস) ইত্যাদি ফিউমিগ্যান্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই ধরনের গ্যাস জনস্বাস্থ্যের জন্য প্রাণঘাতী বিধায় ব্যবহারের পূর্বে স্বাস্থ্য সুরক্ষা পোশাক, বিশেষ প্রয়োগ যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক নিশ্চিত করা উচিত।
বিকর্ষক বা বিতাড়ক দ্রব্যের ব্যবহার : যে সব রাসায়নিক দ্রব্যাদি ইঁদুরের অপছন্দ এবং সব সময় ইঁদুর এড়িয়ে চলতে চায় সে সব পদার্থ বিশেষত্ব বিভিন্ন ধরনের বাক্সে, খাদ্য দ্রব্যের পাত্র (ছালার বস্তা, কাপড়ের বস্তা ইত্যাদি) এবং অন্যান্য জিনিসে বিতাড়ক হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ ছাড়াও উদ্ভিদ জাত পাউডার বা নির্যাস যেমন- নিম পাতার পাউডার, নিমতেল ইত্যাদি বিকর্ষক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। লরোনিট্রাইট, ডেনাটোনিয়াম বেনজয়েট ইত্যাদিও ইঁদুর বিতাড়ক হিসেবে স্বীকৃত।
রাসায়নিক বন্ধ্যাকারক বা প্রজনন নিবারকের ব্যবহার : আমরা জানি যে, ইঁদুর দ্রুত প্রজননশীল প্রাণী তাই তার দমন ব্যবস্থা খুবই দুঃসাধ্য। ফিউরাড্যান্টিন (০.০২ গ্রাম) এবং কলচিচিন (০.১৪ গ্রাম) পুরুষ ও স্ত্রী ইঁদুরের বন্ধ্যাত্ব তৈরি করে। অন্যান্য রাসায়নিক বন্ধ্যাত্বের মধ্যে গসিপল, মেটাপা, টেপা, থায়োটেপা, অ্যাকোলেট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ইঁদুর দমনের জন্য বিশেষ কোনো একক পদ্ধতি খুব বেশি কার্যকরী নয়। যেহেতু ইঁদুর একটি সামাজিক সমস্যা তাই এই সমস্যা আমাদের সামাজিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে এবং বাসাবাড়ি, ফসলের মাঠ, বেড়িবাঁধ, রাস্তাঘাট, খালের পাড়, অফিস আদালতে ইঁদুর সকলে দলগতভাবে প্রতিরোধ করতে হবে।
লেখক : ১চেয়ারম্যান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, কৃষি অনুষদ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর- ৫২০০; মোবাইল : ০১৭১৩-১৬৩৩৪২;
২প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন ভূঞা, কীটতত্ত্ব বিভাগ, কৃষি অনুষদ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর- ৫২০০; মোবাইল: ০১৭০৬৩০৪০৭০;
ফসলের মাঠে, গুদামে ও মানব স্বাস্থ্যে
ইঁদুরের ক্ষতিকর প্রভাব
কৃষিবিদ ড. মোঃ শাহ আলম ১ কৃষিবিদ ড. এ,টি,এম হাসানুজ্জামান ২
স্তন্যপায়ী শ্রেণীর মধ্যে রোডেনশিয়া বর্গের অন্তর্ভুক্ত ইঁদুর জাতীয় প্রাণী হলো একটি বিশেষ ধরনের প্রাণী এবং তাদের বিশেষত্ব এই যে, স্তন্যপায়ী শ্রেণীর ৫৪১৯টি প্রজাতির মধ্যে ২২৭৭টি প্রজাতিই এই বর্গের অন্তর্ভুক্ত। সারা বিশ্বে ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর বর্গে ৩৪টি পরিবার ও ৩৮৯টি প্রজাতি আছে। এর মধ্যে মাত্র ২০-২৫টি প্রজাতি আপদ বালাই বা অনিষ্টকারী হিসেবে চিহ্নিত। গঁৎরফধব পরিবারের অন্তর্ভুক্ত অনিষ্টকারী মেরুদ-ী প্রাণীর মধ্যে ইঁদুর জাতীয় প্রাণী হলো সবচেয়ে গুরুত¦পূর্ণ ও ক্ষতিকারক প্রাণী যা ফসল বপন থেকে শুরু করে ফসল কাটা ও সংগ্রহ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে ক্ষতি করে থাকে। এরা সাধারণত গর্তে বাস করে, তবে কোনো কোনো প্রজাতির ইঁদুর ঘরে বা গাছে বাসা তৈরি করে বাস করে। ইঁদুর যে কোনো পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে খুব দ্রুত বংশবিস্তার করতে সক্ষম। তাছাড়া ইঁদুর জাতীয় প্রাণী বিভিন্ন রোগের বাহক/সংরক্ষক হিসাবেও কাজ করে। ইঁদুর স্তন্যপায়ী, সর্বভুক ও নিশাচর প্রাণী। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে ফসলের জন্য ক্ষতিকর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে ইঁদুর মানুষের প্রধান শক্র। ইঁদুর মানুষের উপকারে আসে এমন ঘটনা বিরল। মানুষের আশেপাশে থেকেই এরা মাঠে গুদামে বাসাবাড়িতে অফিস আদালতে প্রতিনিয়ত ক্ষতি করে চলেছে। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যেখানে ইঁদুরের সমস্যা নেই। এদের উপদ্রবে পৃথিবীর বহুদেশে চরম দুর্যোগ নেমে এসেছে। মানবজীবনে ইঁদুরের ক্ষতিকর ভূমিকা অপরিসীম।
ইঁদুর মানুষ এবং গৃহপালিত পশুপাখির মূলত চারভাবে ক্ষতি করে থাকে। প্রথমত মাঠের কৃষিশস্য খেয়ে; দ্বিতীয়ত গুদামজাত খাদ্যশস্য খেয়ে ও নষ্ট করে; তৃতীয়ত অবকাঠামোর ক্ষতি করে ও চতুর্থত মানুষ ও পশুপাখির রোগজীবাণু বহন করে।
মাঠের কৃষিশস্যের ক্ষতি
ইঁদুর প্রতিদিন তার শরীরের তুলনায় দশ ভাগের এক অংশ খাবার খেয়ে থাকে এবং ইঁদুরের খাবারের পরিমাণ তাদের আকার প্রজাতি ও পারিপার্শিক আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে। ইঁদুর ধান, গম, ভুট্টা, আখ, আলুসহ বিভিন্ন ফল ও সবজির ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহুদেশে
এদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণীত হয়েছে। ইঁদুর প্রতি বছর মাঠ ফসলের প্রায় ২০% ক্ষতি করে থাকে। বাংলাদেশে ১৯১৪-১৫ সালের হিসেব অনুযায়ী ইঁদুরের আক্রমণে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৭৪৪ মেট্রিক টন ধানের ক্ষতি হয়েছে। যার বর্তমান বাজারদর ৪৩৯ কোটি ৮৩ লক্ষ টাকা। চালের ক্ষতির পরিমাণ ৬২ হাজার ৭৬৪ মেট্রিক টন। যার বাজারদর ২০০ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকা। গমের ক্ষতির পরিমাণ ২৯ হাজার ৬৬০ মেট্রিক টন। যার বাজারদর ৮৩ কোটি ৫ লক্ষ টাকা। সব মিলে ইঁদুর দ্বারা প্রায় ৭২৪ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে (প্রথম আলো, ২১ জুন ২০১৫)। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী ইঁদুর দ্বারা ক্ষতি করা নিয়ে গবেষণায় বলা হয়েছে এশিয়ায় ইঁদুর বছরে ১৮ কোটি মানুষের ১২ মাসের খাবার নষ্ট করে। বাংলাদেশে প্রায় ৫০-৫৪ লক্ষ লোকের এক বছরের খাবার ইঁদুর কারণে নষ্ট হয়। ইঁদুর বছরে আমন ধানের শতকরা ৫-৭ ভাগ, গমের শতকরা ৪-১২ ভাগ, গোলআলুর শতকরা ৫-৭ ভাগ, আনারসের শতকরা ৬-৯ ভাগ নষ্ট করে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, ইঁদুর প্রতি বছর বিশ্বের ৩ কোটি ৩৩ লক্ষ টন খাবার নষ্ট করে। বিশ্বে প্রতি বছর ইঁদুর যে পরিমাণ খাবার নষ্ট করে, সে খাবার খেয়ে অনায়াসেই ২৫-৩০টি দরিদ্র দেশের মানুষ এক বছর বাঁচতে পারে।
সংগ্রহোত্তর ক্ষতি
খাদ্য সংক্রমিত/নোংরা করে : প্রাণীর জন্য সরবরাহকৃত খাদ্য ও সংরক্ষিত শস্য গ্রহণ এবং দূষিত করার জন্য ইঁদুর কুখ্যাত। প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশস্য গুদামে সংরক্ষণ করা হয় যেখানে ইঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি পরিলক্ষিত হয়। উষ্ণ ও অবউষ্ণ অঞ্চলে ইঁদুর দ্বারা ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২-১৫%। বিশ্বস¦াস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী এক বছরে ভারতের মুম্বাইয়ে পর্যাপ্ত ইঁদুর দমন করে ৯০,০০০ লোকের খাবার সঞ্চয় করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা গিয়েছে ইঁদুর দ্বারা সংগ্রহোত্তর ক্ষতির পরিমাণ ২.৫-৩০ শতাংশ। ছোট কালো ইঁদুর, গেছো ইঁদুর এবং নেংটি ইঁদুর প্রধানত গুদামে, গবেষণাগারে, অফিসে, বাসাবাড়ীতে, ক্ষতি করে থাকে। গুদামে বিভিন্ন শস্যের যেমন ধান, চাল, গম, ডাল, আলু ইত্যাদির বস্তা কেটে, শস্য খেয়ে ও ইঁদুরের পশম, প্রস্রাব পায়খানা মিশে ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। একটি ইঁদুর বছরে খাবার খায় ৮-১০ কেজি, প্রস্রাব করে ৬ লিটারের মতো, পায়খানা করে ১৫,০০০ বার এর মতো যার ওজন প্রায় ২ কেজি ও গায়ের পশম ঝরে পড়ে ৫ লাখের মতো। একটি ধেড়ে ইঁদুর বছরে ২৫,০০০ এবং নেংটি ইঁদুর ১৭,০০০ মল তৈরি করতে পারে। ইঁদুর খেয়ে যতটা না নষ্ট করে তার থেকে ৫-১০ গুণ বেশি নষ্ট করে গর্তে নিয়ে, মাটিতে মিশিয়ে, পশম, প্রস্রাব, পায়খানা ইত্যাদি দিয়ে। এভাবে ইঁদুর আমাদের খাদ্যশস্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নষ্ট করে আমাদের অর্থনীতিতে উল্লেখ্যযোগ্য পরিমাণ ক্ষতি সাধন করছে। একটি ইঁদুর প্রতি পরিবারে গুদামে বছরে ৪০-৫০ কেজি দানাশস্য ক্ষতি করে থাকে এবং এ ক্ষতির পরিমাণ ৭৫,০০০-১,০০,০০০ মেট্রিক টন। ইঁদুর প্রতি বছর বিশ্বের ৩৩ মিলিয়ন টন গুদামজাত খাবার নষ্ট করে।
অবকাঠামোর ক্ষতি
ইঁদুর টেলিফোনের তার কেটে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ও বৈদ্যুতিক তার কেটে যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল ও ভয়াবহ অগ্নিকা- ঘটায়। ল্যাবরেটরিতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রিক তার, আসবাবপত্র ইত্যাদি কেটে ক্ষতি করে। নেংটি ইঁদুর বাসাবাড়ি ও ল্যাবরেটরিতে লেপতোষক, বই পুস্তক, কাগজ, ফাইল ইত্যাদি কেটে ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। রাস্তাঘাট, সড়ক, রেলপথ, ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ধ্বংস হওয়ার জন্য প্রধানত ইঁদুরই দায়ী।
ইঁদুরবাহিত রোগজীবাণু
মাঠে ও সংগ্রহোত্তর ক্ষতি ছাড়াও ইঁদুর প্লেগসহ প্রায় ৪০ থেকে ৬০ প্রকার রোগ ছড়ায়। মানুষ ও পশুপাখির নানা প্রকার মারাত্মক রোগজীবাণু বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবাদিপশু ও পোল্ট্রিতে ইঁঁদুর কমপক্ষে ৪৫টি রোগের বাহক হিসেবে স্বীকৃত, যেমন-সালমোনেলোসিস, পাস্চুরেলোসিস, লেপটোস্পাইরোসিস, সোয়াইন ডিসেন্ট্রি, ট্রাইচিনোসিস, টক্রোপ্লাজমোসিস এবং জলাতঙ্ক। এরা রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে সাধারণত এদের পায়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। ইঁদুরবাহিত কিছু রোগ ও তাদের লক্ষণ নি¤েœ দেয়া হলো-
হানট্যান ভাইরাস (রক্তক্ষরা জ্বর)
পৃথিবীর অনেক অংশের শহরের ইঁদুরের শরীরে হানট্যান বাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। এ ভাইরাস পোষক হতে পোষকে আক্রান্ত লালা, মূত্র এবং মলের মাধ্যমে বিস্তার ঘটে থাকে। কিছু স্ট্রেইনের মানুষের ওপর অল্প প্রভাব রয়েছে। অন্যগুলো নানা রকম লক্ষণসহ প্রধান অসুস্থতার কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে।
টিক টাইফাস
কুকুর এ রোগের জন্য প্রধান ভা-ার, কিন্তু ইঁদুরও গুরুত্বপূর্ণ ভা-ার বা আধার। এ রোগে আক্রান্ত টিকে (এক প্রকার কীট) কামড়ানোর ফলে মানুষে এ রোগের সংক্রমণ ঘটে। সমস্ত এশিয়াতে টিক এ রোগের বিস্তারের সহিত জড়িত।
স্ক্রাব টাইফাস
সমস্ত এশিয়া জুড়ে নানা রকম ইঁদুর জাতীয় প্রাণীরা (রোডেন্ট) এ রোগের প্রধান ভান্ডার বা আধার। গণভুক্ত বিভিন্ন প্রকার মাকড়ের শূককীট যা ‘চিগার’ (পযরমমবৎং) নামে পরিচিত, তাদের কামড়ে মানুষের মধ্যে রোগ সংক্রমিত হয়। মানুষের মৃত্যুর হার কম হবে যদি প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করা হয়।
মিউরিন টাইফাস
সমস্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে এর প্রদুর্ভাবের রিপোর্ট রয়েছে। এ রোগের বিস্তার ঘটে ফ্লির (ঋষবধ) কামড়ে অথবা আক্রান্ত মলের অথবা দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া ফ্লির মাধ্যমে। এ রোগের কারণ মানুষের মধ্যে বৃহৎ পরিসরে রোগের লক্ষণ দেখা যায় কিন্তু মৃত্যুর হার অনেক কম হয়।
লেপটোস্পাইরোসিস
খবঢ়ঃড়ংঢ়রৎধ গণভুক্ত নানা রকম স্পাইরোকিটস (ংঢ়রৎড়পযধবঃবং) জুনোটিক রোগের জীবাণু মাঠের কালো ইঁদুর বহন ও বিস্তার করে। প্রায় সকল ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর (রোডেন্ট) প্রজাতিরা পোষক হিসেবে কাজ করে। মানুষে সংক্রমণ ঘটে যখন একটি খোলা ক্ষতস্থান ইঁদুরের প্রসাব দ্বারা দূষিত পানি, আর্দ্র মাটি অথবা উদ্ভিদের সংস্পর্শে আসে। যারা রোপণকৃত গাছপালা অথবা মাঠে কাজ করে তাদের এ রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
ইঁদুরের ইউরিন (প্রস্রাব) বাহিত লেপ্টেস্পাইরা নামক এক ধরনের রোগের প্রকোপ বাড়ছে বাংলাদেশে। সাধারণ জ্বর, সর্দি-কাশি, জন্ডিস ও গায়ে লালচে রেশ উঠা এ রোগের উপসর্গ হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগটি সঠিকভাবে শনাক্তে ব্যর্থ হচ্ছেন চিকিৎসকরা। মহাখালী রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইসিডিডিআর, বি) পরিচালিত ২০ মাস মেয়াদি খাদ্যবাহিত রোগ নিরীক্ষণ প্রতিবেদনে এ রোগে প্রায় দেড়শ রোগী আক্রান্ত হওয়ার নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে। রাজধানীর বেসরকারি উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সর্বোচ্চ ২৫ রোগীর এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য প্রমাণ রয়েছে। আইসিডিডিআর,বি এর ল্যাবরেটরিতে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এ রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত করা হয়। জানা যায়, এ রোগে (লেপ্টেস্পাইরা) আক্রান্ত হয়ে নরসিংদীর একটি পরিবারের চার জনের মধ্যে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়। (জাগোনিইজ ২৪.কম, ৩১ জানুয়ারি ২০১৬)
ইঁদুর কামড়ানো জ্বর
ইঁদুর কামড়ানো জ্বর (ঝঢ়রৎরষষঁস সরহড়ৎ) স্পাইরোকিটস (ংঢ়রৎড়পযধবঃব) এর কারণে এ রোগ হয়। ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের (রোডেন্ট) কামড়ানো দ্বারা এ রোগের বিস্তার ঘটে থাকে। পৃথিবীর সর্বত্র এ রোগ দেয়া যায়। অনেক সপ্তাহ পর্যন্ত এ রোগ সুপ্তবস্থায় থাকে এবং উপসর্গ সাধারণত ক্ষত সেরে ওঠার/শুকানোর পর দেখা যায়।
প্লেগ
ইহা একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। যদি এ রোগ প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা যায় তবে এন্টিবায়োটিক দ্বারা চিকিৎসা করা যায়। এ রোগের জীবনচক্র হল-স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে ফ্লি থেকে স্তন্যপায়ী প্রাণী। ইঁদুর জাতীয় প্রাণীরা এ রোগের প্রাথমিক পোষক। ইতিহাস হতে জানা যায় যে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি ঘটার পরও প্লেগ পৃথিবীব্যাপী পূর্বের অনুরূপ আবার সমস্যা ঘটাতে পারে। যদিও পৃথিবীর অনেকাংশে এটি স্বাস্থ্যের জন্য একটি বিরাট সমস্যা হিসাবে বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে। এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়াতে ২০ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সর্বশেষ এ রোগ মহামারী আকারে অবতীর্ণ হয়েছিল।
সালমোনেলোসিস
পৃথিবী ব্যাপী সালমোনিলা (ঝধষসড়হবষষধ) ব্যাকটেরিয়া দ্বারা মানুষের সংক্রমিত হয়। সাধারণত এ রোগে আক্রান্ত ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর (ৎধঃং ধহফ সরপব) মলের মাধ্যমে দূষিত পানি অথবা খাদ্য গলাধঃকরণের মাধ্যমে হয়ে থাকে। কিন্তু সঠিকভাবে প্রস্তুত নহে এরূপ খাদ্য খেলেও এ রোগ হতে পারে। অনেক প্রজাতির বিভিন্ন রকমের মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে।
টক্সোপ্লাজমোসিস
এ রোগের কারণ পড়পপরফরধহ বর্গের ঃড়ীড়ঢ়ষধংসধ মড়হফরর প্রজাতি। এ রোগের প্রাথমকি পোষক গৃহপালিত বিড়াল। ইঁদুর এবং মাইস (সরপব) সহ অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণী এ রোগের মধ্যবর্তী পোষক।
লাসা জ্বর
লাসা জ্বর (খধংংধ ভবাবৎ/খধংংধ যবসড়ৎৎযধমরপ ভবাবৎ) সর্বপ্রথম আবিষ্কার হয় ১৯৬৯ সালে নামে ইজেরিয়ার বোর্নো প্রদেশের লাসা শহরে। লাসা ভাইরাস নামের এক ধরনের জীবাণুর সংক্রমণে রোগটি হয়। লাসা জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গের মধ্যে রয়েছে- জ্বর, মুখম-ল ফুলে যাওয়া, মাংসপেশী ঢিলে হয়ে যাওয়া, বমিভাব, রক্তবমি, ডায়রিয়া (রক্তসহ), পেটব্যথা, কোষ্ঠবদ্ধতা, কাশি। নাইজেরিয়ায় প্রাণঘাতী লাসা জ্বরে এখন পর্যন্ত ৯০ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে দেশটির সরকারি সংস্থা নাইজেরিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (এনসিডিসি)। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ৫৬ দিনে এই প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দিন দিন লাসা জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা খুব দ্রুত বাড়ছে (মার্চ ৩, ২০১৮ বাংলাদেশ প্রতিদিন)।
ইঁদুর মানব জীবনে কি পরিমাণ ক্ষতি করে তা উপরোক্ত আলোচনা থেকে অনুধাবন করা যায়। ইঁদরের উপদ্রব বেশি হলে সব রকম দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করেই ইঁদুর দমন করা উচিত। ইঁদুর দমনের জন্য কোন একক পদ্ধতি খুব বেশি কার্যকর নয়, এক্ষেত্রে একাদিক বা সমন্বিত দমন পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। ইঁদুর দমনের সফলতা নির্ভর করে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার উপর। অতএব, সম্মিলিতভাবে ইঁদুর দমন করলেই ইঁদুরের উপদ্রব কমিয়ে ইঁদুরের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
লেখক : ১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, ২ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, অনিষ্টকারী মেরুদন্ডী প্রাণী বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর, মোবাইল-০১৯১১৮৫৭৫৮৬।
ইঁদুরের পরিবেশসম্মত
দমন কৌশল
ড. এস এম মিজানুর রহমান
ইঁদুরবিষয়ক কিছু টুকরো চমকপ্রদ খবর দিয়েই শুরু করা যাক! ২০২১ সালের মধ্য-মার্চে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস-এ গত এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ইঁদুরের আক্রমণকে সেখানকার কর্তৃপক্ষ ‘অর্থনৈতিক ও জনস্বাস্থ্য সংকট’ হিসেবে অভিহিত করে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন। এ ইঁদুর বৃষ্টি (সরপব ৎধরহ) কৃষকের শতভাগ ফসলহানি ঘটানো ছাড়াও স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাভাবিক জীবনকেও দুর্বিষহ করে তুলেছিল। এমনকি অতিষ্ঠ হোটেল মালিকেরা তাদের ব্যবসাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এ সংকট সামাল দিতে নীতিনির্ধারকেরা সেদেশে আইনিভাবে নিষিদ্ধ অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট ‘ব্রোমাডায়োলোন’ পূর্ণব্যবহারের জন্য ৫০ ভাগ ভর্তুকি সহকারে অনুমোদন দিয়েছিলেন। ভিক্টোরিয়া রাজ্যের সরকার উদ্ভূত সংকট দ্রুত নিরসনে তীব্র বিষ ইঁদুরনাশক জিংক ফসফাইড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিষের কার্যকরী উপাদানের মাত্রাকে দ্বিগুণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বছর কয়েক আগে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদু বুহারির লন্ডনে কয়েক মাস চিকিৎসাধীন থাকাকালীন রাজধানী আবুজাতে তার সরকারি দপ্তরটির বিভিন্ন আসবাবপত্র ইঁদুরকুল এমনভাবে তছনছ ও ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল যে, দেশে ফিরে তিনি কিছুকাল বাসা থেকে অফিস করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে উৎপাদিত ৩৭.৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন দানাদার ফসল ও ৩.১ মিলিয়ন মেট্রিক টন শাকসবজির মধ্যে মোট ১.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন (মোট উৎপাদিত ফসলের ৪%) ফসল সাবাড় ও ধ্বংস করেছিল ইঁদুর। বছর কয়েক আগে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, কিশোরগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় হাওর উপজেলা অষ্টগ্রাম, ইটনা ও মিঠামইনকে এক সুতোয় গাঁথা ৮৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে নান্দনিক অলওয়েদার বা সব ঋতুর সড়ক, যেটি ইতোমধ্যে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে, সেটির প্রতিরক্ষা দেয়াল ইঁদুরের কবলে পড়ে এর ভিত দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এ ধরনীতে মানুষের পরই সবচেয়ে সফল স্তন্যপায়ী প্রাণি হিসেবে ইঁদুরকে বিবেচনা করা হয়। স্বল্প-প্রজনন চক্র সুবিধা-সম্পন্ন হওয়ায় পরিণত এক ইঁদুরযুগল প্রতি ২১ দিন অন্তর অন্তর নতুন বংশধর উৎপাদন করতে সক্ষম। ভিন্ন ও বৈরী পরিবেশেও ইঁদুরের সমভাবে প্রজনন সক্ষমতার একটি উদাহরণ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে প্রায় ছয় বছর ইঁদুরের শুক্রাণুকে হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রায় এবং ভূ-পৃষ্ঠের চেয়ে ১৭০ গুণ বেশি মাত্রার বিকিরণে উন্মুক্ত রেখেও পরবর্তীতে সে শুক্রাণুর সাথে অনিষিক্ত ডিম্বাণুর মিলন ঘটিয়ে অতি সম্প্রতি জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সির সুকুবা স্পেস সেন্টারের বিজ্ঞানীরা ১৬৮টি বাচ্চা ইঁদুর জন্মদান করাতে সক্ষম হয়েছেন। অবিরত কাটাকুটি ছাড়াও ক্রমাগত বিষ্ঠা ত্যাগ করে ইঁদুর মাঠ ও গুদামজাত ফসল, গৃহস্থালি সামগ্রী, বাণিজ্যিক স্থাপনা, কৃষি খামার, কলকারখানা, গবাদিপশুর খামার ইত্যাদিতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে আনে। মানুষের দেহে লেপ্টোস্পাইরোসিস, প্লেগ, স্ক্রাব ও মিউরিন টাইফাসসহ নানা প্রাণিবাহিত (ুড়ড়হড়ঃরপ) প্রাণঘাতী রোগ ছড়ায়। তাছাড়া ফ্লি, আঠালির পোষক হিসেবে কাজ করে পোষা প্রাণি ও মানুষের প্রভূত ক্ষতি করে।
ইঁদুর দমন ব্যবস্থাকে প্রধানত দুইভাবে ভাগ করা যায়। অরাসায়নিক বা পরিবেশসম্মত দমন এবং বিষ প্রয়োগ বা রাসায়নিক দমন পদ্ধতি। এ নিবন্ধে পরিবেশসম্মত দমন কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
অরাসায়নিক বা পরিবেশসম্মত পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন
আদিকাল থেকে কোন প্রকার বিষ বা বিষটোপ ছাড়া ইঁদুর দমন প্রচেষ্টা চলে আসছে। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে সংখ্যাধিক্য ঘটলে বিষ বা বিষটোপ ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তবে যথাসম্ভব পরিবেশসম্মত পদ্ধতিতে দমনব্যবস্থা নেয়া শ্রেয়।
পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা
চাষাবাদ পদ্ধতি : জমি তৈরির সময় ন্যূনতম ১৮ ইঞ্চি গভীর করে চাষ দিয়ে, আইল ছেঁটে ছোট বা চিকন রেখে, আইলের সংখ্যা কমিয়ে, নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করে, ইঁদুর-সৃষ্ট গর্ত দূর করে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সাধারণত ৬ ইঞ্চি উচ্চতা ও ৮ ইঞ্চি প্রশস্ততা বিশিষ্ট আইল তৈরি করলে ইঁদুর আইলে গর্ত করে বসবাস করতে পারে না। ইঁদুর আক্রমণপ্রবণ অঞ্চলে ‘শূন্য কর্ষণ কিংবা ‘ন্যূনতম কর্ষণ পরিহার করতে হবে। আখ লম্বা হয়ে বাতাসে ঢলে পড়লে ইঁদুরের উপদ্রব বাড়ে। তাই আখ বান্ডল বা গোছা করে বেঁধে ঠেকনা দিয়ে রাখতে হবে। উল্লেখ্য যে, আহার, বাসস্থান ও পানি এ তিনের যে কোনো একটির অভাব হলে ইঁদুর স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়।
শস্যাবর্তন পদ্ধতি বা শস্যপর্যায় অবলম্বন : গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে ধান-আখ-গম শস্যচক্র ইঁদুরের বিস্তার ও বংশবৃদ্ধিতে সহায়ক। কারণ ধান-গম শস্য ব্যবস্থায় ধান কর্তন শেষে ইঁদুর পার্শ্ববর্তী আখক্ষেতে গমন করে এবং আখ কর্তন শেষ হলে পুনরায় গমক্ষেতে ফিরে এসে বাধাহীন জীবনচক্র চালিয়ে যায়। তাই ভিন্ন শস্যপর্যায় অবলম্বন করলে ইঁদুরের স্বাভাবিক বিস্তার ও প্রজনন বাধাগ্রস্ত হয়। ইঁদুর শুকনোর চেয়ে ভেজা মাটি অধিক পছন্দ করে বিধায় শস্য বহুমুখীকরণ প্রক্রিয়ায় ধান কিংবা গমের স্থলে অন্য কোনো উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল যোগ করলে ইঁদুরের আক্রমণ হ্রাস পায়।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে : বসতবাড়ি, রান্নাঘর, ভা-ার, খাদ্য গুদাম, বাড়ির আঙ্গিনা, পুকুরপাড়, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, নদীরপাড় ও জমির চারপাশের ময়লা-আবর্জনা, উচ্ছিষ্ট খাবার-দাবার, অবাঞ্ছিত আগাছা ও ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও নির্মূল করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইঁদুরের দ্বারা ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায়। খড়ের গাদা মাটি হতে ১৮-২৪ ইঞ্চি উঁচুতে মাচা তৈরি করে স্থাপন করলে ইঁদুরের আক্রমণের মাত্রা হ্রাস পায়। মুরগির বিষ্ঠা মুরগির শেড থেকে দূরে রাখলে খামারে ইঁদুরের উপদ্রব কমে যায়।
শস্যসূচি মেনে চলে বা একযোগে চাষাবাদ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে : মাঠে সবাই মিলে একসাথে ফসল রুয়ে, বুনে ও কেটে আনলে দীর্ঘদিন মাঠে খাবার না পেয়ে ইঁদুরের জন্মহার হ্রাস পেলে পরোক্ষভাবে তা ইঁদুর দমনে সহায়ক হবে। কারণ, ইঁদুর আগাম বোনা ফসলে আহার্য ও আশ্রয়ের সন্ধানে আগে আক্রমণ করে কিন্তু উক্ত ফসল কর্তন শেষে তদসংলগ্ন অন্য নাবি ফসলে স্থানান্তরিত হয়। তাই বিস্তৃত এলাকায় একই সাথে একই সময়ে পরিপক্ব হওয়া জাত বপন বা রোপণ করলে ইঁদুরের আক্রমণের মাত্রা কমে।
ভৌত ও যান্ত্রিক দমন
ইঁদুরের ফাঁদ পেতে : বসতবাড়িতে ফাঁদ পেতে ইঁদুর ধরা একটি চিরায়ত আদি দমন পদ্ধতি। কৃষকেরা নিজস্ব উদ্ভাবনী কায়দায় বাঁশ, কাঠ, টিন ও লোহার তৈরি ফাঁদ কিংবা বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন ফাঁদ ব্যবহার করে কার্যকরভাবে ইঁদুর দমন করেন। এ সমস্ত ফাঁদে টোপ হিসেবে শুঁটকি মাছ, নারিকেলের টুকরা, কলা, বিস্কুট, রুটি, আম, আলু, চালভাজা ইত্যাদির সাথে কার্বন ডাইসালফাইড মিশ্রিত করে ব্যবহার করলে দ্রুত ভালো ফল পাওয়া যায় (৫০-৬০% বেশি)। ফাঁদে স্ত্রী বা পুরুষ ইঁদুরের মলমূত্র, গায়ের গন্ধযুক্ত টোপ ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। ফাঁদ ব্যবহার কৌশল ও তা স্থাপনের স্থান নির্ধারণ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, অন্যথায় ফাঁদ লাজুকতার সমস্যা দেখা দিতে পারে। ইঁদুরের আকার-আকৃতি অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের ফাঁদ ব্যবহার করা সমীচীন। যেমন- ঘরের নেংটি ইঁদুর ধরার ফাঁদ দিয়ে বড় আকৃতির মাঠের ধেড়ে কালো ইঁদুর ধরা সম্ভব নয়। এসব ফাঁদ ইঁদুরের চলাচলের পথ বা আনাগোনাবহুল স্থান যথা- ঘরের কিনারায়, দেয়ালের পার্শ্বে, মাচায়, চালের উপর বা গর্তের কাছাকাছি স্থাপন করতে হয়। মাঠে ইঁদুরের টাটকা গর্তের উঠানো মাটির ৩০ সেমি. দূরে টোপসহ ফাঁদ পাততে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন ফাঁদে ধৃত ইঁদুর যথাশীঘ্রই সম্ভব সরানো হয় এবং পুরাতন, খারাপ ও মোল্ডযুক্ত টোপ সরিয়ে নতুন টোপ দেওয়া হয়। প্রয়োজনানুযায়ী ফাঁদের সংখ্যা কম হলে সাফল্য হ্রাস পায়। কোন কোন ফাঁদে ইঁদুর ধরা পড়ার সময়ই যাঁতাকলে আটকে মারা যায়। এগুলোকে মৃত্যু-ফাঁদ বা মরণ-ফাঁদ বা কেচিকল বলে। আবার কোন কোন ফাঁদ যেমন-বাঁশের ফাঁদ, বাক্সের ফাঁদ বা শেরম্যান ফাঁদ, তারের খাঁচার ফাঁদ বা ওয়ান্ডার ফাঁদে ইঁদুর জীবন্ত ধরা পড়ে বলে এগুলোকে ‘জীবিত অবস্থায় ধরা ফাঁদ’ বলে। শেরম্যান ফাঁদ টিনের বা লোহার পাত দ্বারা তৈরি এবং এতে স্প্রিং নিয়ন্ত্রিত কপাট আছে। অন্যদিকে ওয়ান্ডার ফাঁদ তারজালি দিয়ে তৈরি এবং তা দ্বারা একসাথে একাধিক ইঁদুর ধরা যায়। ইঁদুরের ফাদ ভীতি কাটানোর জন্য প্রথম ২-৩ দিন এ ফাঁদের মুখ খোলা রেখে স্থাপন করা হয়। ধৃত জীবন্ত ইঁদুর পানিতে ডুবিয়ে মেরে এবং মৃত ইঁদুরসমূহ মাটির গভীরে গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে। ফাঁদ ইঁদুরের জরিপ ও পর্যবেক্ষণ কাজে সহায়তা করে, যাতে প্রজাতির ধরন ও ঘনত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।
আঠা ব্যবহারের মাধ্যমে : সাধারণত র্১দ্ধর্১ আকারের কাঠবোর্ড, মোটা শক্ত কাগজ, টিন, হার্ডবোর্ড ইত্যাদিতে একপ্রকার আঠার প্রলেপ দিয়ে ইঁদুরকে আকৃষ্ট করার জন্য লোভনীয় খাবারের টোপসহ ইঁদুরের চলাচলের রাস্তায় রাখা হয়। খাবারের লোভে ইঁদুর আঠার সংস্পর্শে এসে লোমসহ আটকে চলৎশক্তিহীন হয়ে মারা পড়ে। মৃত ইঁদুর পশমসহ শীঘ্রই সরিয়ে নিয়ে নতুন আঠার প্রলেপ লাগিয়ে পুনঃস্থাপন করা যায়। বাজারে ‘ঘড় জধঃ’, ‘জধঃ এষঁব’, ‘অষষ ঞৎধঢ়’ ইত্যাদি বাণিজ্যিক নামে আঠাসমূহ বেশ কার্যকর ও সমাদৃত।
গর্তে পানি ঢেলে অথবা ধোঁয়া দিয়ে : পানির উৎস সহজ হলে ইঁদুরের গর্তে পানি ঢেলে শ্বাসরোধ করে বা পিটিয়ে ইঁদুর নিধন কার্যকরী। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এ কাজটি বেশ সোৎসাহেই করে থাকে। গর্তে গরম পানি ঢাললে ইঁদুর তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসে। গমের ক্ষেতে দিনের বেলায় সেচ দিলে গর্তের ইঁদুর বের হয়ে আসে। সেচ দেওয়ার সময় জমির চারিদিকে দাঁড়িয়ে থেকে পিটিয়ে ইঁদুর নিধন করতে হবে। প্রচলিত পদ্ধতিতে শুকনা মরিচ-পোড়া ধোঁয়া বা খড় জ্বালানো ধোঁয়া ইঁদুরের গর্তে ঢুকিয়েও ইঁদুর দমন ফলদায়ক। পানি বা ধোঁয়া প্রয়োগ করার সময় গর্তের মুখগুলো জাল দিয়ে ঢেকে দিলে ইঁদুর গর্ত থেকে বের হয়ে জালের ভেতর আটকা পড়ে পালাতে পারে না। একসাথে অনেক লোক মিলে দলবদ্ধভাবে এ ব্যবস্থা নিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। মাঠে ইঁদুরের আক্রমণ বেশি হলে সেচের পানি দ্বারা কয়েকদিন প্লাবিত রেখে ইঁদুর দমন করা যায়।
গর্ত খনন করে : ইঁদুরের গর্ত লম্বায় ১৫ মিটারের বেশি এবং গভীরতায় প্রায় ১ মিটার হয়ে থাকে। তাই জমিতে ফসল থাকা অবস্থায় গর্ত খোঁড়া সম্ভব হয় না। তবে ফসল কর্তনের পর মাঠে বা ক্ষেতের আইলের গর্তের মাটি খুঁড়ে ইঁদুর নিধন করা যায়। কিছু আদিবাসীর খাবার মেন্যুতে ইঁদুর একটি উপাদেয় খাদ্য।
প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে/ইঁদুর প্রতিরোধক্ষম ব্যবস্থা : দালানকোঠা, ঘরবাড়ি ও খাদ্যগুদামে দরজা-জানালা, গ্রিল, পাইপের খোলা মুখ ও অন্যান্য ইঁদুর প্রবেশ্য স্থানের ফাঁক-ফোকরে ধাতব পাত বা তারজালি লাগিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ইঁদুরের অনুপ্রবেশ বন্ধ এবং চলাচল প্রতিহত করা সম্ভব। পানির ট্যাপের ছিদ্র, ভাঙা ড্রেন সর্বদা মেরামত করতে হবে যাতে ইঁদুরের জন্য পানি সহজলভ্য না হয়। ঘরে ড্রাম, মটকা, টিনের পাত্র ইত্যাদিতে ধান, গম ও অন্যান্য শস্যসামগ্রী সংরক্ষণ করলে ইঁদুরের আক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। সম্ভব হলে শস্যাধারের মেঝে পাকা হওয়া বাঞ্ছনীয়। ইঁদুরের উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে নারিকেল, সুপারিসহ অন্যান্য ফলদ বৃক্ষে মাটি হতে ২-৩ মিটার উপরে গাছের খাঁড়া কা-ের চারদিকে ৪৫-৬০ সেমি চওড়া টিনের মসৃণ পাত শক্ত করে আটকাতে হবে যাতে ইঁদুর উপরে উঠতে না পারে। এক গাছের সাথে অন্য গাছের সংযোগ থাকতে পারবে না।
বৈদ্যুতিক বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে : ইঁদুরের চলাচলের পথে অল্প বিদ্যুতায়িত তারের বেড়া স্থাপন করে ইঁদুর দমন সম্ভব। ইঁদুর তারের বেড়ার সংস্পর্শে আসলে তড়িতাহত হয়ে মারা যায়। তবে এ পদ্ধতি ব্যয়বহুল এবং মানুষ ও অন্যান্য প্রাণির জন্য বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় অধিকতর সাবধানতা আবশ্যক। ফিলিপাইনের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাধীন প্লটে এ ব্যবস্থা বেশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।
জৈবিক দমন
কেবল পরিবেশ বিধ্বংসী রাসায়নিক দ্রব্যের সাহায্যে ইঁদুর নিধনযজ্ঞ চালানো সম্ভব নয়। তাই আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হবে পরিবেশবান্ধব জৈবিক দমনের দিকে। পরভোজী প্রাণীর মধ্যে দিবাচর শিকারি পাখি যেমন- ঈগল, তিলা বাজ, হেরিয়াল চিল; নিশাচর শিকারি পাখি যেমন- লক্ষী পেঁচা, ব্রাউন হক আওল (ঙষি); স্তন্যপায়ী প্রাণী যেমন- বনবিড়াল, মেছো বিড়াল, পাতি শিয়াল, খেঁকশিয়াল, বাগডাস, বেজি; সরীসৃপ যেমন- সাপ, গুইসাপ ইত্যাদি দৈনিক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইঁদুর শিকার করে ইঁদুরের আধিক্য কমায়। একটি লক্ষ্মী পেঁচা প্রতি রাতে ১-৬টি (গড়ে ১.৫৮টি) ইঁদুর শিকার করে। কিন্তু মানুষের অবিমৃষ্যকারিতায় ও অবৈধ শিকারিদের উৎপাতে প্রকৃতিতে এসব উপকারী প্রাণির সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান ও অস্তিত্ব বিপন্নপ্রায়। আমাদের নিজেদের স্বার্থে এসব ইঁদুরভুক উপকারী প্রাণিকুলের নির্বিচার নিধন বন্ধে ও সংরক্ষণে যথাযথ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ফসল ক্ষেতে পাখি বসার ডাল পুঁতে দিলে এদের ইঁদুর ধরা সহজ হয়। গৃহপালিত কুকুর-বিড়াল দ্বারাও ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
অণুজীবীয় জৈবিক দমনের অংশ হিসেবে প্রটোজোয়া পরজীবী ঞৎুঢ়ধহড়ংড়সধ বাহধংর যা গবাদিপশুতে ট্রিপ্যানোসোমিয়াসিস রোগ সৃষ্টি করে তা পৃথিবীর নানা দেশে গবেষণাগারে ঘরের ইঁদুর ও মাঠের কালো ইঁদুর দমনে শতভাগ সফল বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাণিবাহিত রোগ বিষয়ে গঠিত কমিটি মানুষ ও গবাদিপশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনায় এ অনুজীবঘটিত ইঁদুরনাশকের ব্যবহারিক প্রয়োগে সতর্কতা জারি করেছে। বিভিন্ন বহিঃপরজীবী যেমন-মাকড়, আঠালি, ফ্লি, উঁকুন শুধু ইঁদুরের রক্ত শোষণ করে না, এদের দেহে নানা রোগ-জীবাণুর সংক্রমণও ঘটায়। তাছাড়া অন্তঃপরজীবী হিসেবে ইঁদুরের দেহে ২০০টিরও বেশি প্রজাতির ফিতাকৃমি ও সুতাকৃমি শনাক্ত হয়েছে।
ইঁদুর আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এক বিরাট হুমকি। ইঁদুর দমনে কোন একক পদ্ধতি শতভাগ কার্যকর নয়। আমাদের কাছে এমন কোন হ্যামিলিনের মোহন বাঁশিও নাই যাতে নিমিষেই ইঁদুরের বংশকে নিশ্চিহ্ন করা যায়। ইঁদুরের আচরণগত জটিলতা ও পরিবেশে অধিক অভিযোজন ক্ষমতার কারণে প্রচলিত দমন পদ্ধতিসমূহ কম ফলদায়ক। ইঁদুরের উচ্চপ্রজনন ক্ষমতার কারণে দমন পদ্ধতি শেষে বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট জনসংখ্যা এবং দমনের আওতার বাইরের এলাকা থেকে অনুপ্রবেশেকারী সদস্যগণ থেকে ইঁদুর শীঘ্রই পূর্ব জন-ঘনত্বে ফিরে আসে। তাই দীর্ঘমেয়াদে কার্যকরভাবে ইঁদুর দমনে একইসাথে প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া অপরিহার্য। তাছাড়া এদেরকে শুধুমাত্র কৃষি-আপদ হিসাবে বিবেচনা না করে সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় কৃষি মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, নগর কর্তৃপক্ষ, রেল মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ তৃণমূল পর্যায়ের জনগণকে সম্পৃক্ত করে আদর্শ পরিচালন পদ্ধতি (ঝঙচ) অনুসরণপূর্বক সফলভাবে ইঁদুর নিধন সম্ভব।
লেখক : অধ্যাপক, কীটতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-১২০৭; মোবাইল : ০০৮৮-০১৭১২১২৭০৭৭, ই-মেইল:smmizanur@gmail.com; smmizanur@sau.edu.bd;
ইঁদুরের চিবানো অভ্যাসের
কারণ ও ক্ষতির ধরন
মোছা: মাসুমা মমতাজ মীম১ ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ২
ইঁদুর “রাটাস” গণের এবং রডেনশিয়া বর্গের একটি দন্তুর স্তন্যপায়ী প্রাণী। ইঁদুরের পা ৪টা, দুটি কান, দুটি চোখ আছে। রডেনট পরিবারের এই প্রাণীর দৈহিক গঠন ১২ সেমি অথবা ৫ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে (ছোট লেজযুক্ত ইঁদুরগুলিকে প্রায়শই ছোট ইঁদুর হিসাবে উল্লেখ করা হয়)। বৈজ্ঞানিক তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের ইঁদুরগুলো মূলত এশিয়া মহাদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্বের সংলগ্ন দ্বীপের রাটাস বংশের। কিছু প্রজাতি মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে তাদের স্থানীয় উৎপত্তি বা জন্মস্থানের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। বাদামি ইঁদুর, (যাকে নরওয়ে ইঁদুরও বলা হয়) এবং ঘরের ইঁদুর, (যাকে কালো ইঁদুর, জাহাজের ইঁদুর বা ছাদের ইঁদুরও বলা হয়), ঘন-বসতিপূর্ণ এলাকাতে বাস করে। উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে ইঁদুর বংশবৃদ্ধি এবং নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে, বিশেষ করে শহুরে এলাকায় বাদামি ইঁদুরের প্রাধান্য থাকে। সারা পৃথিবীতে ২৭০০টির বেশি ইঁদুরজাতীয় প্রজাতি আছে।
বাহ্যিক গঠন
ইঁদুরের সাধারণত চিকন মাথা, বড় চোখ এবং বিশিষ্ট, পাতলা পশমযুক্ত কান থাকে। তাদের মাঝারিভাবে লম্বা পা এবং লম্বা, ধারালো নখর রয়েছে। তাদের সরু পশ্চাৎ পায়ের তলগুলো প্রজাতির উপর নির্ভর করে পরিবর্তনশীল আকারের মাংসল প্যাড ধারণ করে। বাদামি ইঁদুরের দেহ ঘরের ইঁদুরের চেয়ে বড় এবং এর লেজ শরীরের তুলনায় খাটো। তাদের দাঁত জোড়া ক্রমাগত ক্রমবর্ধমান, ক্ষুর-তীক্ষè, খোলা শিকড়যুক্ত ইনসিসার ধরনের। এদের ১৬টি দাঁত থাকে। উভয় পাটিতে সামনে একজোড়া করে ছেদন দাঁত আছে, যা অত্যন্ত তীক্ষè ও ধারালো। তথ্য অনুসারে ইঁদুর প্রতি সেকেন্ডে ছয়বার কামড়াতে পারে এবং প্রতিটি কামড়ে এক বর্গ ইঞ্চির জন্য ৭,০০০ পাউন্ড শক্তি প্রয়োগ করতে পারে।
ছেদনগুলো হলো ইঁদুরের প্রধান দাঁত কারণ তারা এই দাঁত দিয়েই খাবার চিবিয়ে খায়। এগুলো হল সামনের দাঁত, দুটি উপরের দিকে এবং দুটি মুখের নিচে। সাধারণত লম্বা হয় এবং মাড়ির নিচে প্রসারিত হয়। ছেদন দাঁত গজানোর পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। কাটাকাটি না করতে পারলে দাঁত বেড়ে চোয়াল দিয়ে বের হয়ে যায় এবং ইঁদুরের খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। দাঁত ঠিক রাখার জন্য ইঁদুর সর্বদা শক্ত জিনিস কাটাকাটি করে। ইঁদুরের দাঁতগুলো এক বছরে কয়েক ইঞ্চি বাড়তে পারে, যা প্রাণীর জন্য মারাত্মক ব্যথার কারণ হতে পারে। এজন্যই তারা জিনিসপত্র চিবিয়ে চিবিয়ে তাদের দাঁতকে ঠিক রাখে।
ক্ষতির ধরন
এদের চোয়ালের শক্তি অনেক বড় বড় প্রাণীর থেকেও বেশি । এজন্যই এরা সবধরনের জিনিস চিবিয়ে খেতে পারে। ইঁদুরের দ্বারা ক্ষতি বিভিন্ন উপায়ে হয়ে থাকে যেমন : কাঠ, কাঠের তৈরি আসবাবপত্র, মুদিখানার জিনিসপত্রের মধ্যে বাসা তৈরি করে এবং জিনিসপত্র কেটে নষ্ট করে। মাটির দেয়ালে ও ফসলি জমিতে গর্তের মধ্যে থেকে ফসলের ক্ষতি সাধন করে। ৪. প্লাস্টিকের জিনিসপত্র, পানির বোতল এসব জিনিসও কেটে ফেলে। ধান, গম, ভুট্টাজাতীয় ফসলের বেশি ক্ষতি করে থাকে। বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং; যেমন টেলিভিশন, ল্যাম্প, এবং যন্ত্রপাতির তার এবং পুরনো বৈদ্যুতিক তার যেগুলো অ্যালুমিনিয়াম এর তৈরি এগুলোও কেটে ফেলে।
এছাড়াও, ইঁদুর মাঠ থেকে শুরু করে ফসল কর্তনের পরে গুদামজাত অবস্থায় বা গোলায় তোলার পরেও ক্ষতি করে। ইঁদুর শুধু ফসল নয় মানুষের স্বাস্থ্য, সম্পদেরও ক্ষতি করে থাকে এবং রোগজীবাণুর বাহক হিসেবে কাজ করে। ইঁদুর একটি চতুর স্তন্যপায়ী প্রাণী যার ক্ষতির ব্যাপকতা কৃষি প্রধান বাংলাদেশে অনেক বেশি।
ইঁদুর দ্বারা বৈদ্যুতিক তারের ক্ষতির কারণ
বৈদ্যুতিক তারের মধ্যে পাতলা ধাতু এবং রাবার বা প্লাস্টিক জাতীয় বিভিন্ন উপকরণ রয়েছে। ইঁদুরেরা তাদের দাঁত ঠিক রাখা ছাড়াও বিভিন্ন কারণে বৈদ্যুতিক তার চিবিয়ে খায়। তারা সাধারণত এমন জিনিস বা পথ বাছাই করে যা প্রতিদিনের চলাফেরা সময় তাদের পথে থেকে চলাফেরাতে সাহায্য করে। তারের উপর দিয়ে যাতায়াতের সময় কখনও কখনও তার কেটে ফেলে।
ইঁদুরের বৈদ্যুতিক তার চিবানোর আরেকটি কারণ হলো তারা তারের মধ্যে থাকা উপাদানগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়। উদাহরণস্বরূপ, কিছু তারের নিরোধক সয়াভিত্তিক। অন্যান্য তারগুলো, বিশেষ করে গাড়ির তারগুলো, চীনাবাদামের তেল, চালের ভুসি এবং অন্যান্য উদ্ভিদভিত্তিক উপকরণ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। যখন কিছু তার উষ্ণ হয়, তখন তারা ভ্যানিলার মতো একটি সুগন্ধ তৈরি করে থাকে, যা ইঁদুরকে আকর্ষণ করে।
কৃষিক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব
তথ্য অনুসারে, ইঁদুর কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে থাকে। বাংলাদেশে ইঁদুরের কারনে বছরে আমন ধানের শতকরা ৫-৭ ভাগ, গম ফসলের ৪-১২ ভাগ, গোল আলুতে ৫-৭ ভাগ এবং আনারস ৬-৯ ভাগ নষ্ট হয়। বাংলাদেশে ইঁদুরের কারনে ৫০-৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট হয়। কৃষিজাত ফসলে আক্রমণ করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রচুর ক্ষতি করে থাকে। বীজতলায় গর্ত করে চারার বৃদ্ধি রহিত করে। শুধু মাঠ নয়, মাঠ ও গুদাম উভয় স্থানে গর্তে করে, ফসল খেয়ে ফেলে এবং পায়খানা প্রস্রাব, শরীরের লোম খাদ্যশস্যের সাথে মিশে যায়, যা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, একটা ইঁদুর একরাত্রে ২০০-৩০০টি ধান বা গমের কুশি কাটতে সক্ষম। কিছু কিছু ইঁদুর সাঁতার কাটতে পারে। এরা ভাসা আমন ধানের জমিতে বাসা বাঁধে এবং ধানের ক্ষতি করে। সিলেটের হাওর অঞ্চলে এদের প্রাদুর্ভাব বেশি। ঘরের ইঁদুরগুলো সাধারণত গুদামজাত খাদ্য, ঘরে রাখা খাদ্যশস্য, ফলমূল, তরি তরকারি এসব খায় এবং কেটে নষ্ট করে। গম ক্ষেতে ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব বেশি। গাছ ও গমের শিষ কেটে নষ্ট করে, ফসলের উৎপাদন কমে যায়। শুধু ধান বা গম নয়, ইঁদুরের উৎপাত সর্বত্রই, যেমন: ইক্ষু ক্ষেতে, নারিকেল বাগানে, আনারসে, আলুর ক্ষেতে, সবজি বাগানে, মুরগির খামারে, গুদামে ইঁদুর তার ধ্বংসাত্মক কাজ করে থাকে যা আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন করে।
লেখক : ১শিক্ষার্থী ল্যাবরেটরি অব অ্যাপ্লাইড এন্টোমলজি এন্ড একারোলজি, (এমএস), কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২। ২অধ্যাপক, ল্যাবরেটরি অব অ্যাপ্লাইড এন্টোমলজি এন্ড একারোলজি, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২। মোবাইল: ০১৭১১৪৫২৪৯৬। ই-মেইল :ullahipm@bau.edu.bd
মৎস্য বর্জ্যরে বাণিজ্যিক ব্যবহার
ও রপ্তানি সম্ভাবনা
মোঃ মাসুদ রানা
বাংলাদেশ এখন মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ, বর্তমানে দেশে বছরে ৪৫ লক্ষ মেট্রিক টনের বেশি মাছ উৎপাদিত হচ্ছে। উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে মাছের বর্জ্যও তৈরি হচ্ছে। সাধারণত একটা মাছের দৈহিক ওজনের ২০-২৫% বর্জ্য হিসেবে ধরে নেয়া যায়। তাহলে খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে এই বিপুল পরিমাণ উৎপাদিত মাছ থেকে প্রতি বছর কী পরিমাণ বর্র্জ্য তৈরি হয়। এই মৎস্য বর্জ্যকে যদি সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা যায় তাহলে একদিকে যেমন পরিবেশের দূষণ কমিয়ে আনা যাবে, অন্য দিকে উৎপাদিত এসব বর্জ্যগুলো মানসম্পন্ন উপজাতপণ্য হিসেবে রূপান্তরিত করতে পারলে তা থেকে অর্থ উপার্জন করা সম্ভব। মাছের বাজারে বিক্রীত মাছ কাটিয়ে নেবার সময় মাছের আঁইশ, নাড়িভুঁড়ি, পাখনা, পটকা, ফুলকা, চিংড়ি মাছের মাথা ও খোলসসমূহ ইত্যাদি বর্জ্য হিসেবে থেকে যায়। অন্যদিকে বিভিন্ন প্রক্রিজাতকরণ কারখানায় বিশেষ করে চিংড়ি বা সামুদ্রিক মাছের মাথা, লেজ, আঁইশ, নাড়িভুঁড়ি, চর্বি ইত্যাদি বর্জ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এসব বর্জ্যকে যদি সঠিক উপায়ে বিশেষ করে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও জৈবপ্রযুক্তির মাধ্যমে মূল্যবান পণ্যে রূপান্তরিত করা যায় তবে এসব উপজাত পণ্য থেকে অর্থ উপার্জন, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। মাছের বর্জ্যসমূহে প্রচুর পরিমাণে আমিষ, তেল, ফাইবার ও অনান্য জৈব উপাদান বিদ্যমান থাকে, যেগুলোর সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারায় একদিকে যেমন অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে এগুলোর পচনের ফলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রায় সব মাছ বাজারেই মাছ কেটে বিক্রি হয় ফলে এসব বাজারে বিপুল পরিমাণ মৎস্য বর্জ্য উৎপাদিত হয়, এসব বর্জ্যরে সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ রোধ করার পাশাপশি বিভিন্ন প্রকার পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে মৎস্য বর্জ্যকে সম্পদে এ রূপান্তরিত করা সম্ভব। মৎস্য বর্জ্য থেকে উৎপাদিত এসব মূল্য সংযোজিত মৎস্য পণ্যের বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, যা আমাদের অর্থনীতির ভিত মজবুত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। মৎস্য বর্জ্যসমূহ থেকে উৎপাদিত উল্লেখযোগ্য কিছু পণ্যের পরিচিতি, ব্যবহার ও উৎপাদন কলাকৈৗশল তুলে ধরা হলো।
মাছের আঁইশ ও আঁইশ থেকে উৎপাদিত পণ্যসমূহ
মাছের সারা শরীরজুড়ে বিস্তৃত আবরণ হলো আঁইশ, যা মাছ কাটার পর সাধারণত ফেলে দেওয়া হয় কিন্তু এই মাছের আঁইশ একটি অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মৎস্য বর্জ্য যা আমিষ ও ক্যালসিয়ামে ভরপুর। মাছের আঁইশে সাধারণত ৬৫-৬০ শতাংশ আমিষ, ৩০-৪০ শতাংশ হাইড্রোক্সি পেপটাইট থাকে। মাছের আঁইশ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে কোলাজেন/কোলাজেন পেপটাইট, হাইড্রোক্সি পেপটাইট, জৈবসার, ঔষুধের ক্যাপসুল আবরণ, কসমেটিক্সসহ বিভিন্ন প্রকার মহামূল্যবান দ্রব্য ঊৎপাদন করা সম্ভব। কোলাজেন হাড়, ত্বক এবং প্রাণীর সংযোগকারী টিস্যুতে উপস্থিত একটি তন্তুযুক্ত প্রোটিন। মাছের আঁইশে প্রধানত কোলাজেন থাকে এবং এই কোলাজেনে সোডিয়াম, সালফার, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ম্যাগনেসিয়াম এই খনিজ লবণগুলো পাওয়া যায়। গড়ে মাছের প্রক্রিয়াজাতকরণ বর্জ্যের ৩০%-ই হলো প্রোটিন কোলাজেন। কোলাজেনে তুলনামূলকভাবে উচ্চ পরিমাণে অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে যেমন- গ্লাইসিন, প্রোলিন এবং হাইড্রোক্সপ্রোলিন যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। কোলাজেনকে নিয়ন্ত্রিত হাইড্রোলাইসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জৈবিকভাবে সক্রিয় পেপটাইড হিসেবে রূপান্তর করা যায়, যা ফার্মাসিউটিক্যাল, স্বাস্থ্য, খাদ্য এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ/সংরক্ষণ শিল্পের জন্য দরকারী। মাছের আঁইশ থেকে উৎপাদিত হাইড্রোক্সিপ্যাটাইট জৈবিকভাবে নিরাপদ এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে এটি সস্তা কাঁচামাল থেকে প্রস্তুত। হাইড্রোক্সিপ্যাটাইট মানুষের দেহের মধ্যে দাঁত এবং হাড় গুলিতে পাওয়া যায়। হাইড্রোক্সিপ্যাটাইট এবং ক্যালসিয়াম ফসফেট ভিত্তিক উপকরণ হাড় প্রতিস্থাপনের জন্য টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং এর ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। মাছ বাজারে বর্জ্য হিসেবে পরিচিত মাছের আঁইশ ফেলে না দিয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ রোধ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৈদশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনিতীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব।
মাছের ত্বক ও মাছের ত্বক থেকে উৎপাদিত পণ্য সমূহ : মাছের আঁইশের নিচে মসৃণ যে আবরণ দেখা যায় তা হলো মাছের ত্বক। মাছ বাজারে মাছ কাটার সময় অনেক ক্রেতা মাছের চামড়া বা ত্বক ছুলে নেন, বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায় ফলে প্রচুর পরিমাণ মাছের ত্বক উৎপাদিত হয়। আমাদের দেশের যে সকল কোম্পানি প্রক্রিয়াজাতকরণ মৎস্য পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করে তাদের দৈনিক বিপুল পরিমাণ মাছের ত্বক উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত মাছের ত্বক সাধারণত আমাদের দেশে তেমন কোন কাজে না লাগলেও বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিছু মাছের ত্বক সরাসরি আগুনে পুড়ে যাওয়া রোগীদের চামড়া দ্রুত রিকভারিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে যেমন-তেলাপিয়া। মাছের ত্বক প্রক্রিয়াজাতকরণ করে যে শুষ্ক চামড়া উৎপাদিত হয় তার বিদেশে বৃহৎ রপ্তানি বাজার রয়েছে। মাছের চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বিভিন্ন রকম অর্নামেন্টাল কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যেমন-মহিলাদের পোশাক, ব্যাগ, প্যান্টসহ বিভিন্ন পণ্যের আকর্ষণীয়তা বাড়াতে মাছের প্রক্রিয়াজাতকরণ চামড়া ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও মাছের ত্বক নির্দিষ্ট সেপে কেটে মেরিনেটিং করে মোখরোচক চিপস বানানো যায় যা একদিকে পুষ্টি জোগাবে অন্যদিকে মৎস্য বর্জ্যরে সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।
মাছের নাড়িভুঁড়ি, ফুলকা, কাঁটা ও পাখনার ব্যবহার : মাছ বাজারে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে যে বর্জ্য উৎপাদিত হয় তা হলো মাছের নাড়িভুঁড়ি, পাখনা, ফুলকা ও রক্ত। শুধু মাছ বাজার না, মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানি, শুঁটকি উৎপাদন কেন্দ্র সহ যেখানেই মাছ কাটা হয় সেখানেই বিপুল পরিমাণ মাছের নাড়িভুঁড়ি, ফুলকা, পাখনা, রক্ত ও অনান্য বর্জ্য উৎপাদিত হয়। মাছের নাড়িভুঁড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ করে একদিকে মাছের তেল এবং অন্যদিকে ফিশমিল উৎপাদন করা হ্য়। মাছ থেকে উৎপাদিত তেল ও ফিশমিল মাছ, মুরগি, গরু, হাঁসসহ অন্যান্য প্রাণির খাদ্যে আমিষ ও চর্বির উৎস্য হিসেবে দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। বাণিজ্যিকভাবে ফিশ অয়েল বা মাছের তেল এবং ফিশমিলের গুরুত্ব অপরিসীম কারণ পণ্য গুলোর দেশের ফিডমিলগুলোতে যেমন চাহিদা রয়েছে অন্যদিকে বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা আছে। মাছের রক্ত, নাড়িভুঁড়ি দিয়ে ফিশ সাইলেজ নামক এক ধরনের পুষ্টিকর খাদ্য উপাদান উৎপাদন করা হয় যা প্রাণি খাদ্যে ব্যবহার করে প্রাণির পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব, এছাড়াও মাছের সকল বর্জ্য পচন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে উন্নতমানের সার তৈরি করা হয় যা জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে অধিক ফলনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মাছের বর্জ্যরে কোন অংশই ফেলনা নয় তাই এগুলোর সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদে পরিণত করা এখন সময়ের দাবি।
বিভিন্ন প্রকার সামুদ্রিক মাছের পাখনার বিদেশে রপ্তানি সম্ভাবনা ব্যাপক। হাঙ্গরের পাখনা খুবই মূল্যবান একটি মৎস্য পণ্য যা বাংলাদেশ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। মাছের পাখনা সাধারণত উচ্চ আমিষ সমৃদ্ধ স্যুপ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। মাছের ফেলে দেওয়া কাটাগুলোকে যদি প্রক্রিয়াজাত করে পাউডার করা যায় তাহলে এটির দেশে ও বিদেশে ক্যালসিয়াম, মিনারেলস ও ফসফরাসের উৎস্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মাছের বর্জ্যকে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বায়ো ডিজেল, আঁঠাসহ বিভিন্ন প্রকার মূল্য সংযোজিত পণ্য উৎপাদন করা যায় যেগুলোর ব্যাপক রপ্তানি সম্ভাবনা রয়েছে।
মাছের পটকা ও এর বাণিজ্যিক ব্যবহার : পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কিছু মাছের পটকা সরাসরি মানুষের খাদ্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। চীনে এগুলো ফিশ মাও নামে পরিচিত এবং স্যুপ এ পরিবেশন করা হয়। এছাড়াও কোলাজেনের উৎস হিসাবে খাদ্য শিল্পে মাছের পটকা ব্যবহৃত হয়। বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত মাছের পটকা থেকে ৮০% পর্যন্ত কোলাজেন প্রোটিন পাওয়া যায়। এমনকি মাছের পটকা থেকে একটি শক্তিশালী, পানি প্রতিরোধী আঠা তৈরি হয় এবং মাছের পটকা থেকে অপারেশনের সেলাই করার সুতা তেরি করা হয়, যা মানুষের শরীরের কাটা স্থান শুকানোর সাথে সাথে শরীরের সাথে মিশে যায় ফলে সুতা কাটার প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশ থেকে মাছের পটকা সাম্প্রতিক সময়ে শুকানো অবস্থায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রজাতিভেদে ৪০-৬০ হাজার টাকা কেজি দরে রপ্তানি হচ্ছে।
চিংড়ির ও কাঁকড়ার খোলকের বাণিজ্যিক ব্যবহার ও রপ্তানি সম্ভাবনা : আমাদের দেশের মাছ বাজার, চিংড়ি ও কাঁকড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাসমূহে ও বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ব্যাপক চিংড়ির খোলক খাওয়ার অযোগ্য পণ্য হিসেবে ফেলে দেওয়া হয়। চিংড়ি ও কাঁকড়ার এসব ফেলে দেওয়া অংশে বিভিন্ন প্রকার পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকে তাই এগুলো অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। চিংড়ির ফেলে দেওয়া খোলক থেকে কাইটিন ও কাইটোসেন নামক মূল্যবান ঔষধি গুণসম্পন্ন পণ্য উৎপাদিত হয় যার বিদেশে রপ্তানি সম্ভাবনা ব্যাপক। চিংড়ি ও কাঁকড়ার খোলক ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ হওয়ায় এগুলো গুঁড়ো করে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণের জন্য বাণিজ্যিক পণ্য উৎপাদন করা যেতে পারে। চিংড়ির খোলক থেকে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান আলাদা করে ইতোমধ্যে আম, লিচু, আনারসহ বিভিন্ন গাছের ফল ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারক রাসায়নিক প্রস্তুত করা হচ্ছে যা বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাজারে বাড়ছে মাছের চাহিদা ফলশ্রুতিতে বাজারে মৎস্য বর্জ্যরে উৎপাদন বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। উৎপাদিত মৎস্য বর্জ্যরে সিংহভাগই ফেলে দেওয়া হয় বা পুঁতে ফেলা হয়। মাছের কোন অংশই ফেলনা নয় তাই সঠিক প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে মৎস্য বর্জ্যগুলোকে সম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব। মৎস্য বর্জ্যরে সঠিক ব্যবহার করতে গেলে অসংখ্য কল-কারখানা গড়ে উঠবে যেখানে প্রচুর বেকারের কর্মসংস্থান হবে অন্যদিকে পরিবেশ দূষণ কমানো সম্ভব হবে। মৎস্য বর্জ্যসমূহের সঠিক প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার মূল্য সংযোজিত মৎস্য পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব যেগুলো দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণ বৈদশিক মুদ্রা আয় করে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল : ০১৭৪-৫৬২৬১৫৩
গবাদিপশুর জাত উন্নয়নে কৃত্রিম
প্রজননের গুরুত্ব
ডা: মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ
বংশবিস্তারের মাধ্যম হলো প্রজনন। প্রজননে গাভীর গর্ভে তার ডিম্বাণুর সাথে ষাঁড়ের শুক্রাণুর মিলনের ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্ভব হয়। ভাল জাতের বীজ বপন করলে যেমন ভালো জাতের ফসল হয় তেমনি ভালো জাতের ষাঁড়ের সিমেন (বীর্য) ভাল জাতের বাছুর উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গবাদিপশুর দুধ ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জাত উন্নয়ন অপরিহার্র্য। এজন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রজনন কার্যক্রম পরিচালনা ও প্রজনন ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন। সাধারণত গবাদিপশুর প্রজননের জন্য দু’টি পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়।
প্রাকৃতিক প্রজনন
এই পদ্ধতিতে কোন ষাঁড়ের দ্বারা সরাসরি গাভীকে প্রজনন করানো হয়।
কৃত্রিম প্রজনন
ষাঁড়ের সিমেন বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে তা গরম হওয়া (ইস্ট্রাস অবস্থা) গাভীর জরায়ুতে প্রয়োগ করে গর্ভ সঞ্চারণের পদ্ধতিকে কৃত্রিম প্রজনন বলা হয়। অর্থাৎ কৃত্রিম প্রজনন হচ্ছে এমন একটি কৌশল যার মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে ষাঁড় থেকে বীর্য সংগ্রহ করা হয়, সংগৃহীত বীর্যের গুণাগুণ পরীক্ষা করা হয়, বীর্যকে তরল করা হয় এবং যান্ত্রিক উপায়ে স্ত্রী জননতন্ত্রের নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট পরিমাণ বীর্য প্রবেশ করানো হয়। কৃত্রিম প্রজননে দুই ধরনের সিমেন/বীর্য ব্যবহার করা হয়। যথা-
তরল সিমেন : এই সিমেনের প্রতি মাত্রা থাকে এক মিলি যাতে ২০-৩০ মিলিয়ন শুক্রাণু থাকে। ৩-৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় এই সিমেন ২-৩ দিন সংরক্ষণ করা যায়।
হিমায়িত সিমেন : এই সিমেন ধারণের জন্য ব্যবহৃত নলে ০.২৫ মিলিলিটার সিমেন থাকে। যাতে ২০-৩০ মিলিয়ন শুক্রাণু থাকে। এই সিমেন ১৯৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় তরল নাইট্রোজেনে ২০-২৫ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
কৃত্রিম প্রজননের গুরুত্ব : গবাদিপশুর কৌলিকমান (জেনেটিক ভ্যালু) উন্নয়নের জন্য কৃত্রিম প্রজনন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। বর্তমানে সারা বিশে^ গবাদিপশুর জাত উন্নয়নের জন্য এ পদ্ধতি বহুলভাবে প্রচলিত। বর্তমানে আমাদের দেশেও এ পদ্ধতি চালু আছে। এক্ষেত্রে অধিক উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো ষাঁড় ব্যবহার করে বহুসংখ্যক গাভীকে পাল দেওয়ানোর জন্য কৃত্রিম প্রজনন কৌশলটি ব্যবহার করা হয়। বংশগত কারণে গাভী বা বলদ যথাক্রমে নির্দিষ্ট মাত্রায় দুধ উৎপাদন করে এবং আকারে বড় হয়। পশুর জাত উন্নয়ন ছাড়া তার উৎপাদন বৃদ্ধি ও গুণগতমান পরিবর্তন সম্ভব হয় না। তবে কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতিতে অধিক উৎপাদনশীল জাতের ষাঁড়ের সিমেন সংগ্রহ করে গাভীকে প্রজনন করানো হলে উন্নত গুণাবলি তার বাচ্চার দেহে সঞ্চালিত হয়। তাই উন্নত ষাঁড়ের পরিবর্তে উন্নত জাতের ষাঁড়ের সিমেন সংগ্রহ করে এদেশের গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন করার একমাত্র মাধ্যম কৃত্রিম প্রজনন।
কৃত্রিম প্রজননের সুবিধা
উন্নত জাতের ষাঁড়ের সিমেন দ্বারা অতিদ্রুত এবং ব্যাপক ভিত্তিতে উন্নত জাতের গবাদিপশু উৎপাদন সম্ভব। যার ফলে গাভী অধিক দুধ ও মাংস উৎপাদন করতে পারে।
প্রজননের পূর্বে শুক্রাণুর গুণাগুণ পরীক্ষা করে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে উন্নত ষাঁড় নির্বাচন করা যায়। ফলে অনুন্নত ষাঁড় ও অপ্রয়োজনীয় ষাঁড় ছাঁটাই করতে সুবিধা হয়।
একটি ষাঁড় থেকে একবার সংগৃহীত সিমেন দ্বারা ১০০-৪০০ গাভী প্রজনন করানো যায়। ফলে ষাঁড়ের ব্যবহার যোগ্যতা বৃদ্ধি পায় এবং খামার লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
ষাঁড়ের কিছু জন্মগত ও বংশগত রোগ থাকতে পারে। এ পদ্ধতিতে তা প্রজনন প্রক্রিয়ার পূর্বে যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয়। ফলে ষাঁড়ের রোগের বিস্তার প্রতিরোধ সম্ভব হয় এবং সুস্থ বাছুর পাওয়া যায়।
প্রাকৃতিক উপায়ে প্রজননের সময় বিভিন্ন মারাত্মক যৌনরোগ যেমন- ব্রুসেলোসিস, ভিব্রিওসিস, ট্রাইকোমনিয়াসিস ইত্যাদি ষাঁড়ের মাধ্যমে আক্রান্ত গাভী থেকে অন্য গাভীর মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। কিন্তু কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এসব যৌনরোগের সংক্রমণ ও বিস্তার সহজেই রোধ করা যায়।
কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতিতে কম খরচে অনেক বেশি গাভীকে পাল দেওয়া যায়, যেহেতু প্রজনন কাজে ব্যবহারের জন্য বাড়তি ষাঁড় পালনের প্রয়োজন হয় না।
নির্বাচিত ষাঁড়ের সিমেন সংরক্ষণ করা যায় এবং প্রয়োজনমতো যে কোন সময় ব্যবহার করা যায়। প্রয়োজন হলে বিদেশ থেকে উন্নত জাতের ষাঁড়ের পরিবর্তে অল্প খরচে তার সিমেন আমদানি করা যায়।
ষাঁড় ও গাভীর দৈহিক অসামঞ্জস্যতার কারণে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়ানো যায় এবং সংগমে অক্ষম উন্নত জাতের ষাঁড়ের সিমেন সংগ্রহ করে তা ব্যবহার করা যায়। যে সমস্ত গাভী ষাঁড়কে উপরে উঠতে দেওয়া পছন্দ করে না সে সমস্ত গাভীকে কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতিতে পাল দেওয়া যায়।
উন্নত পালন পদ্ধতি অনুসরণ করে সঠিক প্রজনন রেকর্ড রাখা সম্ভব হয় এবং ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির গবাদিপশুর মধ্যে প্রজনন ঘটিয়ে সংকর জাত সৃষ্টি করা যায়।
কৃত্রিম প্রজননের সীমাবদ্ধতা
কৃত্রিম প্রজননের কাজে সিমেন সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবহারের জন্য দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন হয়। খামার মালিককে কৃত্রিম প্রজনন টেকনিশিয়ানের সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে গাভীর উত্তেজনাকাল সুষ্ঠুভাবে নির্ণয় করে কৃত্রিম প্রজনন করতে হয়।
প্রজননের জন্য রক্ষিত ষাঁড়ের বিশেষ পরিচর্যা প্রয়োজন হয়। ঠিকঠাক পরিচর্যা না করা হলে ষাঁড় অসুস্থ হয়ে যেতে পারে।
কৃত্রিম প্রজনন কাজের জন্য সহায়ক গবেষণাগারে বিশেষ ধরনের যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় এবং সেখানে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মূল্য তুলনামূলকভাবে বেশি।
স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে প্রজনন না হলে গর্ভসঞ্চারের হার হ্রাস পায়।
সুষ্ঠু প্রজনন নিবন্ধনের (এআই রেকর্ড) প্রয়োজন হয়।
কৃত্রিম প্রজনন ফলপ্রসূ না হওয়ার কারণ
কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম ফলপ্রসূ না হওয়ার পিছনে প্রজননকারী, গাভী, গাভীর মালিক, সিমেন এবং সিমেন স্ট্র দায়ী হতে পারে (সারণি দ্রষ্টব্য)।
সূত্র : Kamal MM. 2020. Pranisampad O Unnayan (Livestock and Development), Third Edition, Bangla Prokashon, Saghata, Gaibandha. P-147-148, 150)
টেরিনারি সার্জন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, কৃষি খামার সড়ক, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল: ০১৮১১-৯৮৬৬০৫
ইমেইল:smmohibullah@gmail.com
ইঁদুর দমনে বর্তমান প্রেক্ষাপট
ও ভবিষ্যৎ করণীয়
ড. সন্তোষ কুমার সরকার
ইঁদুরের সমস্যা পৃথিবীর সর্বত্রই বিরাজমান, ইঁদুরের সমস্যা সামাজিকভাবে সকলের সমস্যা। যেখানে মানুষ ও প্রাণীর উপস্থিতি আছে, সেখানে ইঁদুরের উপস্থিতি আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারতের লাদাখ গাছপালাবিহীন উঁচু পর্বতের রাস্তা দিয়ে এবং কেদারনাথ মন্দিরে উঁচু পর্র্বতে ইঁদুরের বসবাস দেখা যায়। সেসব স্থানে ৭-৮ মাস বরফে ঢাকা থাকা সত্ত্বেও ইঁদুর ঘোরাফেরা করে। অনুরূপভাবে, খড়ের গাদায় নিচে ইঁদুর সাধারণত বাস করে। একবার গ্রামে বাড়ির খড়ের পালার নিকট দাঁড়িয়ে ছিলাম। একজন ব্যক্তি একপাশে অল্প খর টেনে বেড় করার সময় গোখরা সাপ দেখা গেল। এরপর লোকটি অন্য প্রান্তে খড় টেনে বের করতে সেখান থেকে একটি ছোট গুইসাপ বের হয়ে দৌড়ে পালিয়ে থাকল। খড়ের গাদার উপরে দুইটি ইঁদুরের গর্ত দেখা গেল। একই খড়ের গাদায় গুইসাপ, বিষধর সাপ ও ইঁদুরের বাস রয়েছে। খাদ্য ও বাসস্থানের প্রয়োজনে ইঁদুর এক জায়গায় বাস করছে।
ইঁদুর দমনে প্রয়োজন
ইঁদুর যেখানে থাকবে, সেখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতি করে থাকে। ইঁদুর প্রতিদিন তার দেহের ওজনের দশভাগ পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে। কোথাও যদি ইঁদুর দেখা যায়, তবে সেখানে কমপক্ষে ৫টি ইঁদুরের উপস্থিতি থাকবে। ইঁদুরের দাঁত জন্মের পর হতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত বাড়ে। দাঁতের বৃদ্ধি রোধ না করতে পারলে খাওয়া বন্ধ হয়ে ইঁদুর মারা যায়। তাই দাঁত ঠিক রাখার জন্য শক্ত জিনিস যেমন- কাঠ, বৈদ্যুতিক তার, প্লাস্টিক, কাপড়চোপড়, গাছপালা, শস্য ইত্যাদি যা পায় তা কেটে ক্ষতি করে থাকে। বাসাবাড়িতে, ঘরবাড়িতে, অফিসে, ফসলের মাঠে, হাঁস-মুরগীর খামার, ফলের বাগানে, সেচের নালায় একটি ইঁদুরই বিপুল পরিমাণ ক্ষতি করতে পারে। অতি অল্প সময়ে একজোড়া ইঁদুর হতে বিপুল বংশধর সৃষ্টি করতে পারে। তাই একটি ইঁদুরের উপস্থিতি দেখা মাত্র মারতে হবে। ক্ষয়ক্ষতি রোধ করতে হলে ইঁদুর সময়মতো নিজেরই প্রতিরোধ করতে হবে।
ইঁদুর দমনে বর্তমান প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ করণীয়
যেকোনো প্রযুক্তি সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হলে দমন প্রযুক্তি ও বালাইয়ের জীবনচক্র ও পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে ১৩ প্রজাতির ক্ষতিকারক ইঁদুরের প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে চারটি প্রজাতি ফসল ও সম্পদের
বেশি ক্ষতিকারক। যেমন- মাঠের বড় কালো ইঁদুর; মাঠের কালো ইঁদুর; গেছো ইঁদুর এবং সলই বা বাতি ইঁদুর। এদের মধ্যে মাঠের বড় কালো ইঁদুরের সামদ্রিক অঞ্চলে ও নিচু ভূমি হাওর বাঁওড় এলাকায় এদের উপস্থিতি বেশি রয়েছে। মাঠের কালো ইঁদুর বাংলাদেশে কৃষি ফসল, গুদাম, গ্রাম ও শহর এলাকাসহ সর্বত্র একটি প্রধান ক্ষতিকারক বালাই। গেছো ইঁদুর ঘরের সিলিং এবং নারিকেলসহ অন্যান্য ফলের গাছে বাস করে। গেছো ইঁদুর খাদ্যগুদামে ও সিলিংয়ে বেশি দেখা যায়। এরা গর্তে থাকে না। গ্রামের আবাস ভূমির অব্যবহিত দূরে গাছের ঝাড়ে এবং উঁচু ভূমিতে পাওয়া যায়। এরা এক গাছ হতে অন্য গাছে সহজেই যেতে পারে। সলই ইঁদুর আকারে ছোট হলেও খাদ্যশস্য ও ঘরের জিনিসপত্র এবং দানাদার শস্যের প্রতিনিয়ত ক্ষতি করে। ইঁদুর দমনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি কম রাখা। মাঠ ফসলে সঠিকভাবে দমন প্রযুক্তি প্রয়োগের জন্য ইঁদুরের প্রজননের সময় জানা প্রয়োজন। প্রজনন শুরু হওয়ার আগে ইঁদুর দমন করা হলে ইঁদুরের সংখ্যা কম রাখা সম্ভব হবে। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা তথ্য থেকে জানা গেছে যে, ইঁদুরের প্রজনন নির্ভর করে শস্যের নিবিড়তার উপর। যেখানে বছরে একটি ধান ফসল চাষ হয় সেখানে ইঁদুরের একটি প্রজনন হয়। আবার যেখানে বছরে তিনটি ফসল হয় সেখানে ইঁদুর তিনবার প্রজনন করে থাকে। বাংলাদেশে তিনবার ধান ফসলের চাষ হয়ে থাকে, তাই ইঁদুরের তিনবার প্রজনন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
নিজের ফসলের মাঠ বা ঘরবাড়ি ছাড়া দলগতভাবে কৃষকগণ ইঁদুর মারতে চায় না অথবা অভ্যস্ত নহে। ইঁদুর দ্বারা ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত ইঁদুর দমন করে না। কিন্তু পোকামাকড় দমনের জন্য গুরুত্ব বেশি দেয় এবং প্রতিষেধক হিসেবে বালাইনাশক প্রয়োগ করে থাকে। এ ছাড়া ইঁদুরবাহিত রোগ সম্পর্কে সর্বস্তরের জনসাধারণের ধারণা অত্যন্ত কম। ইঁদুরের মলমূত্র, লোম দ্বারা মানুষ ও পশুপাখির ৩০ প্রকারের বেশি যেমন- জন্ডিজ, প্লেগ, জ্বর টাইফয়েড, কলেরা, কৃমি, চর্মরোগ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। মাঙ্কিপক্স বা এমপক্স বর্তমানে বিশ^জুড়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। মাঙ্কিপক্স নাম শুনে বানরের কথা মনে হলেও ভাইরাসটি আসলে সংক্রমিত হয় ইঁদুর, বন্য কুকুর, কাঠবিড়ালি, বানর ও খরগোশের শরীর থেকে। সর্ব প্রথম এটি বানরের শরীরে আবিষ্কার হয়েছিল বলে এমন নামকরণ। ইঁদুর খাদ্যে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে। ইঁদুরবাহিত রোগের বিষয়ে বেশি বেশি গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে জোয়ারভাটা হয়, সেখানে জোয়ারের সময় আমন ধান পানির নিচে চলে যায়, তখন ফসলের মাঠের ইঁদুর গাছে, হুগলী গাছে, কচুরীপানায় ও অন্যান্য আগাছায় আশ্রয় নিয়ে থাকে। জোয়ারের সময় দশমিনা বিএডিসি বীজ বর্ধন খামারের প্রতিদিন ১০০-২০০ ইঁদুর ট্যাটা দিয়া মারা হয়। মাঠের ইঁদুর সাধারণত বড় হয়, তাই ট্যাটা দিয়ে নিধন করা যায়। ভরা বর্ষার সময় আমন ফসলের পাশে ইঁদুর কচুরীপানা বা আগাছার স্তূপে আশ্রয় নিয়ে থাকে। এ সময় ট্যাটা দিয়ে ইঁদুর নিধন করলে আমন ফসলে ইঁদুরের উপদ্রব কম হবে। বর্ষার প্রারম্ভে রাস্তাঘাট, বাঁধের ইঁদুর নিধনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে রাস্তাঘাটের ক্ষয়ক্ষতি কম হবে এবং আমন ফসলে ইঁদুরের উপদ্রব ও ক্ষয়ক্ষতি কম হবে। এ সব স্থানে গ্রামবাসীরা দলবদ্ধভাবে একদিন ইঁদুর মারতে হবে।
যারা ইঁদুরের মাংস খায়, তারা জীবন্ত ইঁদুর ধরে থাকে। দিনাজপুরে গর্তের ইঁদুরকে ম্যাটা ইঁদুর বলে থাকে। তাদের ভাষায় ইঁদুরের মাংস মুরগীর মাংসের চেয়ে সুস্বাদ্।ু দুপুরের রান্নার আগে মাঠে ইঁদুর ধরতে যায়। তারা অল্প সময়ে ইঁদুর ধরতে পারে। তারা গর্তের সম্পূর্ণ খুঁড়ে না। গর্তের আকার ও অল্প কিছু খুঁড়ে বুঝতে পারে কোথায় ইঁদুর অবস্থান করছে। ইঁদুরের অবস্থানের কাছে খুঁড়ে সহজে ধরে আনে। এদের ধরার কৌশল তাদের মাধ্যমে সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। বান্দরবান, রাঙ্গামাটি পাহাড়ি এলাকায় যারা ইঁদুরের মাংস খায় তারা বন থেকে ইঁদুর ধরে আনে এবং শুঁটকী করে বর্ষামৌসুমের জন্য রেখে দেয়। ইঁদুর ধরার তাদের জ্ঞান ও কলাকৌশল প্রসার ঘটানো প্রয়োজন। বাগেরহাট, বরিশাল, পিরোজপুর ও অন্যান্য এলাকায় কিছুলোক নারিকেল ও অন্যান্য ফলজ বৃক্ষের ইঁদুর ধরে থাকে। পারিশ্রমিক হিসেবে প্রতিটি ইঁদুরের জন্য ১০ টাকা নিয়ে থাকে। ইঁদুর ধরার কলাকৌশল অন্যান্য কৃষকদের মাঝে বিস্তার ঘটানো যেতে পারে।
ইঁদুর বর্ষা মৌসুমে রাস্তাঘাট, রেলরোড ও বাঁধ ও বেড়িবাঁধের গর্ত খোঁড়ার ফলে ভেঙে কোটি কোটি টাকার প্রতি বছর ক্ষতি হয়। এ সকল স্থানের ইঁদুর পরবর্তীতে আমন ফসলের ক্ষতি করে থাকে। বর্ষার সময় সড়কের ১০০টির বেশি ইঁদুরের গর্ত প্রতি কিমি. পাওয়া গেছে। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে ১০০ বেশি ইঁদুর বাস করে। দুঃখের বিষয় হলো সংশ্লিষ্ট সংস্থার যেমন সড়কও জনপথ, রেলওয়ে, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে ইঁদুর দমনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ইঁদুর দমন কলাকৌশল বিষয়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ কম থাকায় তারা বিষটোপের উপর নির্ভরশীল। ফসলের কুশি স্তরে কৃষকগণ ইঁদুর সাধারণত মারে না। ফসলের থোড় ও পাকা স্তরে ইঁদুর দমন করে থাকে। এতে দমনব্যবস্থা কার্যকর হয় না। প্রতি বছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর হতে জনগণকে ইঁদুর দমনে উৎসাহিত করার জন্য ইঁদুর দমন অভিযান পরিচালনা করা হয়। কৃষকদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় অর্থ ও দক্ষ জনবল না থাকায় প্রশিক্ষণ দেওয়া বাস্তবে সম্ভব হয় না। এজন্য ইঁদুর জাতীয় প্রাণী দমনে কলাকৌশল উন্নয়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। কারণ ইঁদুর দমন প্রযুক্তি অন্যান্য বালাই দমন হতে ভিন্ন সঠিক সময়ে, সঠিক প্রযুক্তি ও সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। একজন কৃষক বলেছেন ইঁদুর খুব চালাক, তাই তাকে মারতে হলে জ্ঞান ও বুদ্ধি বেশি হতে হবে। প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে কৃষকদের ইঁদুর দমন প্রযুক্তিগত জ্ঞান বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
ইঁদুরের দ্বারা ফসল ও সম্পদ রক্ষা করতে হলে প্রতিনিয়ত ইঁদুরের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ বা মনিটরিং করে ইঁদুরের দমনব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সবাই মিলে ইঁদুর দমনব্যবস্থা অধিক কার্যকর হয়। সারা বছর ধরে ইঁদুর দমন কার্যক্রম চলমান রাখা প্রয়োজন। সবাই মিলে ইঁদুর প্রতিরোধ করি তবেই বর্তমানে দেশে ভাইরাস মাঙ্কিপক্স রোগ বিস্তার রোধ করা সম্ভব হবে এবং ফসল ও সম্পদ রক্ষা পাবে।
লেখক : রূপায়ণ লোটাস, ৬বি, ১৩ তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০। মোবাইল : ০১৭১৪২২২১৫৭
রানীশংকৈলবাসীর কাছে এসএমই কৃষক জনাব মো: পয়গাম আলীর উৎপাদিত বীজ আস্থার প্রতীক
কৃষিবিদ মো. শাহাদৎ হোসেন
কৃষির মূল উপকরণ হচ্ছে বীজ। কৃষিনির্ভর এ দেশের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ এবং দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য প্রয়োজন উন্নতমানের ভালো বীজ। সেই ধারাবাহিকতায় কৃষকপর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ (৩য় পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় রানীশংকৈল উপজেলায় বীজ উৎপাদন এবং বিপণনে বেশ কিছু উদ্যোক্তার তৈরি হয়েছে। তাদেরই মধ্যে একজন পয়গাম আলী। কৃষি সম্প্রসারাণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণন করে হয়ে উঠেছেন একজন সফল এবং আদর্শ কৃষি উদ্যোক্তা।
জনাব মোঃ পয়গাম আলী, পিতা : মৃত তৈয়ব উদ্দীন, গ্রাম : বনগাঁও। তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৫ জন। কৃষিকাজের শুরুতে তিনি গরুর হাল ও পাওয়ার টিলার দিয়ে নিজ জমি চাষাবাদ করতেন। স্থানীয় জাতের ধান যেমন- স্বর্ণা, রত্নমালা চাষাবাদ করতেন। উৎপাদিত বীজ বস্তায় সংরক্ষণ করতেন এবং বীজ বিপণন করে তেমন লাভের মুখ দেখেননি। জমিতে ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহার সম্পর্কে জানতেন না। ভোজ্যতেল হিসেবে সয়াবিন তেল ব্যবহার করতেন এবং পুষ্টির ঘাটতি পূরণে ডাল, তেল ও মসলাজাতীয় ফসলের অপর্যাপ্ততা ছিল। পয়গাম আলীর বীজ উৎপাদন ও বিপণনের গল্পটা শুরু ২০১৮ সালে।
২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে রবি মৌসুমে প্রকল্পের সহায়তায় উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে এক একরের একটি সরিষা প্রদর্শনী, একটি মুগ প্রদর্শনী এবং একটি মাসকলাই প্রদর্শনী পান। যেখানে উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ জনাব সঞ্জয় দেবনাথের পরামর্শে এবং বনগাঁও ব্লকে কর্মরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জনাব মো. সাদেকুল ইসলামের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে অত্যন্ত সফলতার সাথে প্রথমবারেই ৯৬০ কেজি সরিষা বীজ, ৫০০ কেজি মাষকলাই বীজ, ২০০ কেজি মুগডাল বীজ উৎপাদন করেন। উক্ত বীজগুলো বিক্রি করে তিনি সর্বমোট ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা মুনাফা পান। অনুরূপভাবে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে রবি মৌসুমে প্রকল্পের সহায়তায় এক একরের একটি সরিষা প্রদর্শনী, একটি মুগ প্রদর্শনী, একটি মাষকলাই প্রদর্শনী এবং একটি সূর্যমুখী প্রদর্শনী পান। উক্ত প্রদর্শনীগুলো থেকে তিনি ১০০০ কেজি সরিষা বীজ, ৪০০ কেজি মাষকলাই বীজ, ৩০০ কেজি মুগডাল বীজ এবং ৮০০ কেজি সূর্যমুখী বীজ উৎপাদন করেন। উক্ত বীজগুলো বিক্রি করে তিনি সর্বমোট ২ লক্ষ ৫ হাজার টাকা এবং সরিষাক্ষেতে মধু চাষ করে তিনি (১০ হাজার) টাকা আয় করেন। পাশাপাশি ২০২০-২০২১ অর্থবছরে রবি মৌসুমে প্রকল্পের সহায়তায় এক একরের একটি সরিষা প্রদর্শনী, একটি মুগ প্রদর্শনী এবং একটি মাষকলাই প্রদর্শনী, একটি পেঁয়াজ প্রদর্শনী এবং একটি রসুন প্রদর্শনী পান। উক্ত প্রদর্শনীগুলো থেকে তিনি ৯৫০ কেজি সরিষা বীজ, ২৫০ কেজি মাষকলাই বীজ, ২০০ কেজি মুগডাল বীজ, ৮০ কেজি পেঁয়াজ বীজ এবং ১৫০০ কেজি রসুন বীজ উৎপাদন করেন। উক্ত বীজগুলোর মধ্যে তিনি মাষকলাই বীজ বিক্রি করে (৩০ হাজার) টাকা আয় করেন এবং সরিষাক্ষেতে মধু চাষ করে তিনি ১৫ হাজার টাকা আয় করেন। অবশিষ্ট বীজ মৌসুমে বিক্রয় করে সর্বমোট ৩ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা আয় করেন। এছাড়াও কৃষকপর্যায়ে ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ (৩য় পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় পয়গাম আলী একটি সেলাই মেশিন, একটি ওজন মেশিন, দুইটি মৌ বক্স সেট, তিনটি প্লাস্টিক ড্রাম, একটি ময়েশ্চার মিটার, একটি ড্রাইং বিডস সেট এবং ১৮০০টি বীজ বিপণনের জন্য প্যাকেট পান।
বর্তমানে বীজ উৎপাদন করতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান উন্নত জাতের উচ্চফলনশীল ব্রি ধান-৫৮, ব্রি ধান-৬৪, ব্রি ধান-৭৪, ব্রি ধান-৮৭, ব্রি ধান-৯৩, ব্রি ধান-৯৫ জাতের ধান চাষাবাদ করেন, যা পরিবারের জিংকের ঘাটতি পূরণসহ আর্থিক সচ্ছলতায় অবদান রাখছে। তিনি নিজে ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন করেন যা নিজ জমিতে ব্যবহার করে মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষার তেল ব্যবহার করেন এবং বনগাঁও ব্লকে অনুষ্ঠিত মাঠদিবসে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাগণ ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষার তেল ব্যবহারের পরামর্শ দেন। মাঠ দিবসে উপস্থিত সকল কৃষকগণ সরিষার তেল ভোজ্যতেল হিসেবে ব্যবহার করছেন। ফলে সয়াবিন তেলের আমদানি কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। এ ছাড়াও তিনি পর্যাপ্ত পরিমাণ ডাল, তেল ও মসলাজাতীয় ফসল উৎপাদন করেন। বিসিক, দিনাজপুর থেকে ট্রেনিং প্রাপ্ত হয়ে এবং প্রকল্প থেকে মৌ-বাক্স সহায়তার মাধ্যমে এবং নিজ উদ্যোগে তিনি কলোনি সংগ্রহ করে মধুচাষে অবদান রাখছেন। বীজ ব্যবসায়ী হিসাবে স্বীকৃতি লাভের পর বীজ বিপণন করে লাভের অর্থ দিয়ে তিনি মহেন্দ্র ট্রাক্টর এবং একটি কম্বাইন্ড হারভেস্টার ক্রয় করে নিজে ব্যবহার করেন এবং ভাড়ায়চালিত করেন। প্রকল্প থেকে প্রাপ্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বীজ সংরক্ষণ ও বিপণনের কাজ করছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আধুনিক জাতের এবং মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনে এবং বিপণনে বর্তমানে রানীশংকৈলবাসীর কাছে তিনি আস্থার প্রতীক। তার উৎপাদিত মানসম্পন্ন বীজ অত্র এলাকার কৃষকের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পুরো উপজেলার কৃষকের চাহিদা পূরণে তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। পাশাপাশি মৌচাষ সম্প্রসারণ করে অত্র এলাকার মানুষের মধুর চাহিদা পূরণে সচেষ্ট থাকবেন।
জনাব মো: পয়গাম আলী উপজেলা কৃষি অফিস রানাীশংকৈল এর মাধ্যমে কৃষকপর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ (৩য় পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় ২০১৯-২০২০ এবং ২০২০-২০২১ অর্থবছরে পরপর দুইবার ঠাকুরগাঁও জেলাপর্যায়ে শ্রেষ্ঠ বীজ উৎপাদনকারী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তার এই ধারাবাহিক সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও মাধ্যমে প্রকল্প থেকে নগদ অর্থ ও সনদ দেয়া হয়। অত্র এলাকার কৃষকদের কাছে তিনি বীজের ডিলার এবং নির্ভরযোগ্য বীজ ব্যবসায়ী হিসেবে ইতোমধ্যে খ্যাতি লাভ করেছেন।
লেখক : আঞ্চলিক বেতন কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রংপুর অঞ্চল, মোবাইল : ০১৭১২৬২৬২৯৬,rangpur@ais.gov.bd
ইঁদুর কথন
কৃষিবিদ সাবরিনা আফরোজ
শোনেন শোনেন দেশবাসী শোনেন দিয়া মন
ইঁদুরের কীর্তিকলাপ করিব বর্ণন।
চতুরতায় সেরা ইঁদুর সর্বজনে কয়
হালি ডজন বাচ্চা দেয়, না করিয়া ভয়।
কাটাকুটির খেলায় তারা অতিশয় পটু
বই কাপড় বিছানা বাদ রাখেনা কিছু।
কোটি কোটি মানুষের আহার নষ্ট করে
অনেক ফসল নষ্ট করে সারা জীবন ধরে।
প্লেগ, জন্ডিস, টাইফয়েড, জ্বর আমাশয়
আরো হয় নানা ব্যাধি, জীবনের সংশয়।
পশুপাখিও বাদ যায় না তাদের অত্যাচারে
শতপ্রকার রোগ জীবাণু বহন এরা করে।
রাস্তাঘাট, বাঁধের ইঁদুর মারা প্রয়োজন
সেচ নালার ইঁদুরও ক্ষতিকর, জানে প্রতিজন।
ঘরবাড়ি দোকানপাট হাঁস-মুরগির খামার
আমন ফসল, মাঠফসল ক্ষতি হয় সবার।
এসব থেকে রক্ষা পেতে ইঁদুর দমন কর
ফাঁদ হোক, বিষ হোক যে যেটা পার।
তীব্র বিষ, ক্রনিক বিষ, কিংবা গ্যাসবড়ি
বিষটোপও কাজে দেয় বলবে বাড়ি বাড়ি।
সারাদেশে মাসব্যাপী ইঁদুর দমন চলে
সবাই মিলে ইঁদুর মারি আসুন দলে দলে।
সবাই মিলে এক হয়ে মারলে ইঁদুর
লাভ হবে সকলের কষ্ট হবে দূর।
আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃতসা, ঢাকা অঞ্চল, মোবাইল-০১৭১৫২৬৮৪০;
ফসল ও চাষা
কে এম বদরুল হক শাহীন
ফসলের ফলন বাড়ানোর প্রাণান্ত চেষ্টায় আমি
ধান, গম, পাটের পরিচর্যায় আছি দিবানিশি।
চাষ, বীজ বপন, সার ও কীটনাশক স্প্রে
সময়মতো প্রয়োগে ফলন বাড়ে সর্বাগ্রে।
আমার চোখেমুখে সবুজ ঝিলিক
মনে পাই শান্তি আশার প্রদীপ।
ন্যায্য দাম পাইনা ফলানো ফসলে,
কষ্টের শ্রম সবই যায় বিফলে।
দুধ, ডিম, সবজি ফেলে করি প্রতিবাদ,
জানতে তো চাওনা কিভাবে করি এসব আবাদ।
যার শ্রমেতে অন্ন জোটে, তাকেই বলো চাষা!
তোমার কথার তাচ্ছিল্যে আমি হারিয়ে ফেলি ভাষা।
আমাদের কষ্টের সহমর্মী হওনা তোমরা কভু,
এভাবেই আমাদের ধুঁকে ধুঁকে বাঁচিয়ে রেখেছেন প্রভু।
লেখক : উপপরিচালক (এলআর), খামারবাড়ি, ঢাকা, মোবাইল : ০১৭১১৫৮৩৩১০
কার্তিক মাসের কৃষি
(১৭ অক্টোবর-১৫ নভেম্বর)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
কার্তিক হলো বর্ষা আর শীতের মিলন ক্ষণ। বাংলাদেশের প্রাণ ও প্রকৃতি দেখার সবচেয়ে সুন্দর সময় এই কার্তিক। বাংলার মাঠ প্রান্তরে সোনালি নতুন ধানের ম ম গন্ধে ছড়িয়ে পড়ে। মাঠে বীর কৃষকরাও ব্যস্ত থাকে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে। তাহলে আসুন আমরা জেনে নেই কার্তিক মাসে সমন্বিত কৃষির সীমানায় কোন কাজগুলো আমাদের করতে হবে।
আমন ধান
এ মাসে অনেকের আমন ধান পেকে যাবে তাই রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে। আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে প্রথমেই সুস্থ সবল ভালো ফলন দেখে ফসল নির্বাচন করতে হবে। এরপর কেটে, মাড়াইঝাড়াই করার পর রোদে ভালোমতো শুকাতে হবে। এসব কাজে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। শুকানো গরম ধান ঝেড়ে পরিষ্কার করে ছায়ায় রেখে ঠা-া করে বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ রাখার পাত্রটিকে মাটি বা মেঝের ওপর না রেখে পাটাতনের উপর রাখতে হবে। পোকার উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে ধানের সাথে নিম, নিসিন্দা, ল্যান্টানার পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে মিশিয়ে দিতে হবে।
গম
কার্তিক মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম বীজ বপনের প্রস্তুতি নিতে হয়। দো-আঁশ মাটিতে গম ভালো হয়। অধিক ফলনের জন্য গমের আধুনিক জাত যেমন: তাপসহিষ্ণু বারি গম-৩০,বারি গম-৩২, বিডব্লিউএমআরআই গম-৪; যেসব এলাকায় শীত তাড়াতাড়ি চলে যায় বারি গম-৩২, বিডব্লিউএমআরআই গম-১, বিডব্লিউএমআরআই গম-৪; এবং যেসব এলাকায় শীত বেশি দিন স্থায়ী হয় বারি গম-৩০,বারি গম-৩২, বিডব্লিউএমআরআই গম-১, বিডব্লিউএমআরআই গম-২, বিডব্লিউএমআরআই গম-৩, বিডব্লিউএমআরআই গম-৪, বিডব্লিউএমআরআই গম-৫ এবং লবণাক্ততাসহিষ্ণু বিনা গম-১ রোপণ করতে পারেন। বীজ বপনের আগে অনুমোদিত ছত্রাকনাশকের নাম দিলে ভালো হয়। দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। সেচযুক্ত চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৬ কেজি এবং সেচবিহীন চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৩ কেজি বীজ বপন করতে হবে। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার জমি তৈরির শেষ চাষের সময় এবং ইউরিয়া তিন কিস্তিতে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপনের ১৩-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ প্রয়োজন এবং এরপর প্রতি ৩০-৩৫ দিন পর ২ বার সেচ দিলে খুব ভালো ফলন পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, চাষে বেড প্লান্টার যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। এই যন্ত্র ব্যবহার সেচ খরচ ও সময় ২৫% কমে।
আখ
এখন আখের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। ভালোভাবে জমি তৈরি করে আখের চারা রোপণ করা উচিত। আখ রোপণের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব ৯০ সেমি. থেকে ১২০ সেমি. এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৬০ সেমি. রাখতে হয়। এভাবে চারা রোপণ করলে বিঘাপ্রতি ২২০০-২৫০০টি চারার প্রয়োজন হয়।
ভুট্টা
ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এ সময় যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে এবং জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হবে। ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো খই ভুট্টা, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৯, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৬, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৭ বারি মিষ্টি ভুট্টা-১, বারি বেবি কর্ন-১, বিডাব্লিউএমআরআই হাইব্রিড ভুট্টা ১, বিডাব্লিউএমআরআই হাইব্রিড ভুট্টা ২ ইত্যাদি। প্রভৃতি খরা প্রধান এলাকা ও সাদা দানার ক্ষেত্রে বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১২, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৩, ঝড় বাতাসে হেলে ও ভেঙে পড়া প্রতিরোধী জাত বিডাব্লিউএমআরআই হাইব্রিড ভুট্টা ১, ডাব্লিউএমআরআই বেবি কর্ণ ১ আবাদ করতে পারেন।
সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল
কার্তিক মাস সরিষা চাষেরও উপযুক্ত সময়। সরিষার প্রচলিত স্বল্পমেয়াদি জাতগুলোর মধ্যে বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৭, বারি সরিষা-২০, বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯, বিনা সরিষা-১০, বিনা সরিষা-১১, বিনা সরিষা-১২ ইত্যাদি। দীর্ঘমেয়াদি জাতগুলোর মধ্যে বারি সরিষা-১১, বারি সরিষা-১৬, বারি সরিষা-১৮, বারি সরিষা-১৯, উল্লেখযোগ্য। জাতভেদে সামান্য তারতম্য হলেও বিঘাপ্রতি গড়ে ১ থেকে ১.৫ কেজি সরিষার বীজ প্রয়োজন হয়। বিঘাপ্রতি ৩৩-৩৭ কেজি ইউরিয়া, ২২-২৪ কেজি টিএসপি, ১১-১৩ কেজি এমওপি, ২০-২৪ কেজি জিপসার ও ১ কেজি দস্তা সারের প্রয়োজন হয়। সরিষা ছাড়াও অন্যান্য তেল ফসল যেমন- তিল, তিসি, চীনাবাদাম, সূর্যমুখী এ সময় চাষ করা যায়।
তুলা
এ সময় শেষ বারের মতো তুলা ফসলের আগাছা দমন করতে হবে। বিঘাপ্রতি ৭-৭.৫ কেজি ইউরিয়া সারের তিন কিস্তির শেষ কিস্তি পাশর্^ প্রয়োগ করতে (গাছ থেকে ৫-৬ সেমি. দূরত্বে) হবে। গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে; যাতে বাতাসে গাছ হেলে না পড়ে। এ সময় জ্যাসিড ও এফিডের পাশাপাশি আঁচা পোকা, বোলওয়ার্ম এবং রোগের মধ্যে পাতা ঝলসানো, এনথ্রাকনোজ, নেতিয়ে পড়া রোগের আক্রমণ হতে পারে। হাত বাছাই করে আঁচা পোকা ও বোলওয়ার্মের ক্রীড়া দমন করে জ্যাসিড ও এফিডের জন্য সিস্টেমিক, আঁচ পোকা ও বোলওয়ার্মের জন্য স্পর্ম কীটনাশক এবং রোগের জন্য ৫% কপার অক্সিক্লোরাইড বা ২.৫ ডাইথেন এমএ-৪৫ মাত্রা অনুযায়ী জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। অধিক ফসলের জন্য ফলিয়ার স্প্রে এবং হরমোন যেমন-প্লানোফিক্স/ফ্লোরা স্প্রে করা যেতে পারে। ফলিয়ার স্প্রে বলতে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার যেমন-ইউরিয়া/ডিএপি ২% হারে (১০ লিটার পানিতে ২০০ গ্রাম), পটাশ ১% হারে (১০ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম) এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট যেমন: সলুবর বোরণ, জিঙ্কসালফেট ০.১০-০.১৫% হারে (১০ লিটার পানিতে ১০-১৫ গ্রাম), পানির সাথে মিশিয়ে স্প্রেমেশিনের সাহায্যে পাতায় প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স ৫০-৬০ দিনের পর থেকে পরবর্তী ১০০ দিন পর্যন্ত অর্থাৎ ৩-৪ বার ফলিয়ার স্প্রে করা যায়। এতে বোলের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং বোল আকারে বড় হয়, ফলে ফলন ৪-৫% বৃদ্ধি পায়। পোকামাকড় দমনের জন্য আইপিএম অথবা শুধু ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করলে তুলার উৎপাদন খরচ অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়। সিড ব্লগ হলেও এ মাসেই রগিং এর কাজ শেষ করতে হবে।
আলু
আলুর জন্য জমি তৈরি ও বীজ বপনের উপযুক্ত সময় এ মাসেই। হালকা প্রকৃতির মাটি অর্থাৎ বেলে দো-আঁশ মাটি আলু চাষের জন্য বেশ উপযোগী। বারি কর্তৃক উদ্ভাবিত আগাম জাত ও উচ্চফলনশীল জাতগুলো নির্বাচন করা প্রয়োজন। এ ছাড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানি ও খাবার উপযোগী জাত নির্বাচন করা প্রয়োজন। প্রতি একর জমি আবাদ করতে ৬০০ কেজি বীজ আলুর দরকার হয়। এক একর জমিতে আলু আবাদ করতে ১৩০ কেজি ইউরিয়া, ৯০ কেজি টিএসপি, ১০০ কেজি এমওপি, ৬০ কেজি জিপসাম এবং ৬ কেজি দস্তা সার প্রয়োজন হয়। তবে এ সারের পরিমাণ জমির অবস্থাভেদে কমবেশি হতে পারে। তাছাড়া একরপ্রতি ৪-৫ টন জৈবসার ব্যবহার করলে ফলন অনেক বেশি পাওয়া যায়। আলু উৎপাদনে আগাছা পরিষ্কার, সেচ, সারের উপরিপ্রয়োগ, মাটি আলগাকরণ বা কেলিতে মাটি তুলে দেয়া, বালাই দমন, মালচিং করা আবশ্যকীয় কাজ। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বিনা চাষে মালচিং দিয়ে আলু আবাদ করা যায়।
মিষ্টিআলু
নদীর ধারে পলি মাটিযুক্ত জমি এবং বেলে দো-আঁশ প্রকৃতির মাটিতে মিষ্টিআলু ভালো ফলন দেয়। কমলাসুন্দরী, বারি মিষ্টিআলু-১২, বারি মিষ্টিআলু-১৪, বারি মিষ্টিআলু-১৫, বারি মিষ্টিআলু-১৬ ও বারি মিষ্টিআলু-১৭ আধুনিক মিষ্টিআলুর জাত। প্রতি বিঘা জমির জন্য তিন গিঁটযুক্ত ২২৫০-২৫০০ খ- লতা পর্যাপ্ত। বিঘাপ্রতি ৪-৫ টন গোবর/জৈবসার, ১৬ কেজি ইউরিয়া, ৪০ কেজি টিএসপি, ৬০ কেজি এমওপি সার দিতে হবে।
ডাল ফসল
মুসুর, মুগ, মাষকলাই, খেসারি, ফেলন, অড়হর, সয়াবিন, ছোলাসহ অন্যান্য ডাল এসময় চাষ করতে পারেন। এজন্য উপযুক্ত জাত নির্বাচন, সময়মতো বীজ বপন, সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ, পরিচর্যা, সেচ, বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করতে হবে।
শাকসবজি
শীতকালীন শাকসবজি চাষের উপযুক্ত সময় এখন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বীজতলায় উন্নতজাতের দেশি-বিদেশি ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, বাটিশাক, টমেটো, বেগুন এসবের চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলায় বীজ বপন করতে হবে। আর গত মাসে চারা উৎপাদন করে থাকলে এখন মূল জমিতে চারা রোপণ করতে পারেন। মাটিতে জোঁ আসার সাথে সাথে শীতকালীন শাকসবজি রোপণ করতে হবে। এ মাসে হঠাৎ বৃষ্টিতে রোপণকৃত শাকসবজির চারা নষ্ট হতে পারে। এ জন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। রোপণের পর আগাছা পরিষ্কার, সার প্রয়োগ, সেচ নিকাশসহ প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে। তাছাড়া লালশাক, মুলাশাক, গাজর, মটরশুঁটির বীজ এ সময় বপন করতে পারেন।
কলা : কলার চারা বছরে এ মৌসুমে রোপণ করা যায়। প্রথম রোপণের সময় আশি^ন-কার্তিক (মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য নভেম্বর)। বারি কলা-১, বারি কলা-২, বারি কলা-৩, বারি কলা-৪, বারি কলা-৫ দেশের সর্বত্র চাষ উপযোগী। রোপণের জন্য অসি তেউড় (ংড়িৎফ ংঁবফবৎ) উত্তম। তিন মাস বয়স্ক সুস্থ সবল রোগমুক্ত বাগান থেকে সংগ্রহ করা ভালো। সাধারণত খাটো জাতের গাছের ৩৫-৪৫ সেমি. ও লম্বা জাতের গাছের ৫০-৬০ সেমি. দৈর্ঘ্যরে তেউর ব্যবহার করা হয়।
গাছপ্রতি সারের পরিমাণ জৈবসার ১৫-২০ কেজি, টিএসপি ৪০০ গ্রাম, এমওপি ৬০০ গ্রাম, ইউরিয়া ৫০০-৬৫০ গ্রাম, জিপসাম ২০০-৩০০ গ্রাম দেয়া প্রয়োজন। তবে সারের ৫০% গোবর, টিএসপি ও জিপসাম জমি তৈরির সময় এবং বাকি ৫০% গোবর, টিএসপি ও জিপসাম এবং ২৫% এমওপি গর্তে দিতে হবে। রোপণের দেড় থেকে দুই মাস পর ২৫% ইউরিয়া ও ২৫% এমওপি জমিতে ছিটিয়ে ভালোভাবে কুপিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এর ২ মাস পরপর গাছপ্রতি ৫০ গ্রাম এমওপি ও ৭৫ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে। ফুল আসার পরই পরিমাণ দ্বিগুণ করতে হবে। এছাড়াও টিস্যু কালচার মাধ্যমে উৎপাদিত জি-৯ জাতের কলা চাষ এখন জনপ্রিয়।
গাছপালার অন্যান্য পরিচর্যা : সাধারণত ফল গাছপালা কিস্তিতে পরিমাণ মতো সার প্রয়োগ করতে হয়। বর্ষার মৌসুমে আরম্ভ হওয়ায় পূর্বে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে এবং পরবর্তী কিস্তি বর্ষার শেষে আশি^ন-কার্তিক মাসে বয়স্ক গাছের ফল সংগ্রহের পর এসময় অঙ্গ ছাঁটাই করা ভালো। অঙ্গ ছাঁটাই করলে গাছে নতুন ডালপালা গজায় এবং তাতে প্রচুর ফল ধরে। শুষ্ক মৌসুমে বিশেষত চারা গাছে এবং বয়স্ক গাছে সেচের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪, ই-মেইল:editor@ais.gov.bd