Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

ফলে-পুষ্টি-অর্থ-বেশ-স্মার্ট-কৃষির-বাংলাদেশ

ফলে পুষ্টি অর্থ বেশ 
স্মার্ট কৃষির বাংলাদেশ
ওয়াহিদা আক্তার
‘ফলে পুষ্টি অর্থ বেশ- স্মার্ট কৃষির বাংলাদেশ’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক ৬-৮ জুন জাতীয় ফলমেলা ২০২৪ এর আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিপাদ্যটি অত্যন্ত সময়োপযোগী, যা জনগণের পুষ্টি উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।  
বাংলাদেশের মাটি উর্বর ও জলবায়ু ক্রান্তীয় মৌসুমি । আবহাওয়া উপযোগী হওয়ায় বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের উষ্ণম-লীয় ও উপ-উষ্ণম-লীয় ফল চাষ হচ্ছে। ফল উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আর্থসামাজিক ও পুষ্টি নিরাপত্তাসহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন সম্ভব। বাংলাদেশের ফল স্বাদে, গন্ধে, বর্ণে ও পুষ্টিমানে আকর্ষণীয় ও বৈচিত্র্যময়। ফলদবৃক্ষ পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ লবণের প্রধান উৎস হিসাবে কাজ করে। তাছাড়া ফলের ভেষজ গুণাবলিও অনেক। আমাদের খাদ্য, পুষ্টি, ভিটামিনের চাহিদাপূরণ, শারীরিক বৃদ্ধি, মেধার বিকাশ ও রোগ প্রতিরোধে ফলের ভূমিকা অপরিসীম। দেশের চলমান অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় ফল শিল্পের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা গড়ে তুলতে কৃষিকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় তার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এদেশের কৃষি খাতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। মাত্র ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই উন্নয়নশীল দেশটিতে এখন ১৭ কোটিরও বেশি লোকের বসবাস। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও ক্রমহ্রাসমান কৃষি জমির বিপরীতমুখী চাপ সত্ত্বেও বাংলাদেশের বর্তমান খাদ্যশস্য উৎপাদন ১৯৭২-৭৩ সালের তুলনায় প্রায় চার গুণ বেড়েছে। ফলের উৎপাদনও সমানতালে এগিয়ে চলছে। মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়, আমে নবম ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে আছে বাংলাদেশ। ২০ বছর আগে আম আর কাঁঠাল ছিল এই দেশের প্রধানফল। এখন বাংলাদেশে প্রায় ৭০-৮০ রকমের প্রচলিত, অপ্রচলিত ও বিদেশি ফল উৎপাদন হয়ে থাকে।
জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই অভীষ্ট (এসডিজি)-২ তে উল্লেখ আছে ক্ষুধা থেকে মুক্তি, খাদ্যের নিরাপত্তা বিধান, পুষ্টির মান উন্নয়ন এবং কৃষি ক্ষেত্রে টেকসই কর্মপদ্ধতির বিকাশ সাধন। টেকসই উন্নয়নের  একটি প্রধান লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে দরিদ্র মানুষের জন্য খাদ্য ও পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত করা। খাদ্য নিরাপত্তার অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন। তাই নিরাপদ ফল উৎপাদনের জন্য সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। সাধারণত ফল গাছ লাগানোর ২-৪ বছর পর ফল পাওয়া যায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে  বাংলাদেশে মোট ৭ লাখ ৩৪ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ফলের আবাদ হয়েছিল। উৎপাদন হয়েছিল ১৪৩.৩১২ লাখ মেট্রিক টন। এ বছর ২০২২-২৩ সালে সেই লক্ষ্যমাত্রা বেড়ে বাংলাদেশে মোট ৭ লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ফলের ১৫০.৩৩ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৫ হাজার হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছে এবং প্রত্যাশিত উৎপাদন ২৭ লাখ ৭ হাজার মেট্রিক টন। রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, নাটোর, গাজীপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে অধিকাংশ আমের ফলন হয়। লিচুর আবাদ হয়েছে প্রায় ৩১ হাজার হেক্টর জমিতে এবং প্রত্যাশিত উৎপাদন ২ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন। অধিকাংশ লিচুর ফলন হয় রাজশাহী, দিনাজপুর, পাবনা, গাজীপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলায়। কাঁঠালের আবাদ হয়েছে ৫৮ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে ও সম্ভাব্য উৎপাদন ১৮ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন। টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও রাঙ্গামাটিতে সবচেয়ে বেশি কাঁঠাল উৎপাদন হয়। অন্যদিকে, আনারসের আবাদ হয়েছে ২০ হাজার ২৮ হেক্টর জমিতে ও সম্ভাব্য উৎপাদন ৫ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন। আনারসের সিংহভাগ উৎপাদন হয় টাঙ্গাইলে। চলতি বছর (২০২৩-২৪) বাংলাদেশে বিভিন্ন ফলের উৎপাদন এলাকা বৃদ্ধিসহ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সংশি¬ষ্ট হর্টিকালচার উইং বিভিন্ন পদক্ষেপ ইতোমধ্যেই গ্রহণ করেছেন। 
একটি সুস্থ ও উৎপাদনশীল জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিসমৃদ্ধ সুষম খাদ্য পর্যাপ্ত গ্রহণ অত্যাবশ্যক। ফলে প্রায় সব ধরনের পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। ফলের পুষ্টিগত উপাদান ফলের প্রকৃতি, পরিপক্বতা, উৎপাদন কৌশল, সংগ্রহোত্তর প্রক্রিয়া আবহাওয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিশেষ করে ফল রান্না ছাড়াই সরাসরি খাওয়া যায় বলে এর পুরো ভিটামিন ও খনিজ লবণই অটুট থাকে এবং স্বাস্থ্য রক্ষায় উলে¬খযোগ্য ভূমিকা পালন করে। টাটকা ফলের প্রধান অংশ হচ্ছে পানি (৮০-৯৫%)। ফলে প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট তুলনামূলকভাবে কম থাকে, দ্রবণীয় শর্করা ও পেকটিন বাদে ফলের পুষ্টিমান প্রধানত খনিজ ও ভিটামিনের ওপর নির্ভরশীল, এজন্য ফলকে দেহ রক্ষাকারী খাদ্য বলা হয়। 
খাদ্যের সহজলভ্যতা, মূল্যস্তর এবং খাদ্যাভ্যাসের ওপর খাদ্যসামগ্রীর ব্যবহার নির্ভরশীল। বর্তমানে জনগণের পুষ্টি সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন হচ্ছে। ফল গ্রহণের পরিমাণও বাড়ছে। একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন প্রায় ১০০-২০০ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন। ঐঙটঝঊঐঙখউ ওঘঈঙগঊ অঘউ ঊঢচঊঘউওঞটজঊ ঝটজঠঊ (ঐওঊঝ-২০২২) তথ্য অনুসারে  বাংলাদেশের মানুষের দানাজাতীয় শস্য গ্রহণের পরিমাণ গত এক যুগে প্রতিদিন মাথাপিছু প্রায় ৪৪২ গ্রাম থেকে নেমে এসেছে ৩৫২ গ্রামে, আবার ফল গ্রহণের পরিমাণ প্রতিদিন মাথাপিছু ৪৪.৭ গ্রাম থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৫.৪ গ্রাম, যা ইতিবাচক। 
নিবিড় ফল চাষে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ফলের উৎপাদন, বিপণন ব্যবস্থাপনা এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ অত্যন্ত শ্রমঘন কাজ বিধায় এগুলো কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। অপরপক্ষে ফলের গড় ফলন দানাদার খাদ্যশস্য অপেক্ষা অনেক বেশি। এছাড়া ফলের মূল্য বেশি হওয়ায় তুলনামূলকভাবে আয়ও অনেক বেশি হয়। উদাহরণস্বরূপ এক হেক্টর জমিতে ধান, গম চাষে আয় হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। অথচ সমপরিমাণ জমিতে কলা ও আম চাষ করে যথাক্রমে ৭৫ হাজার ও ১ লাখ টাকা আয় হয়। 
বাংলাদেশ  এখন খোরপোশ কৃষি থেকে রপ্তানিমুখী বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের ফল বিশ্ব বাণিজ্যে অবদান রেখে চলছে। বিদেশে টাটকা ও প্রক্রিয়াজাতকৃত ফলের প্রচুর চাহিদা থাকায় বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে সীমিত আকারে টাটকা ফল রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানিকৃত উলে¬খযোগ্য ফলগুলোর মধ্যে কাঁঠাল, আম, আনারস, লেবু, কামরাঙা, বাতাবিলেবু, তেঁতুল, চালতা উল্লেখযোগ্য। টাটকা ফল ছাড়াও হিমায়িত ফল (সাতকরা, কাঁঠালবীজ, কাঁচকলা, লেবু, জলপাই, আমড়া ইত্যাদি) ইতালি, জার্মানি, সৌদিআরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান ও বাহরাইনে রপ্তানি হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের সূত্র অনুযায়ী বিগত ৫ বছরে আম রফতানির পরিমাণ প্রায় ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে উৎপাদিত ৭২টি জাতের মধ্যে ৮-৯টি জাতের আম রফতানি হচ্ছে। 
বাংলাদশে রপ্তানি ব্যুরো তথ্য মতে, ২০২২-২৩ র্অথবছরে ফলমূল রপ্তানি করে আয় হয়েছে প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সুষ্ঠু বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কৃষি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। এ ছাড়াও ফলের রপ্তানি বৃদ্ধিতে উত্তম কৃষি চর্চা (এঅচ) মেনে উৎপাদন, ফল সংগ্রহোত্তর ব্যবপনায় কৃাষ যান্ত্রিকীকরণ, রপ্তানি উপযোগী জাতের ব্যবহার, আধুনিক প্যাকিং হাউজ ও ল্যাবের মাধ্যমে নানা কাজ চলমান আছে। 
আমরা এখন স্মার্ট কৃষির যুগে প্রবেশ করছি। স্মার্ট টেকনোলজি কৃষিকে সহজ থেকে সহজতর করে তুলবে দিনে দিনে। ফল চাষে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, আইওটি, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এসব কিছুর সুবিধা কৃষকপর্যায়ে চলে আসার সাথে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন হবে। পাশাপাশি উন্নত বিশ্বের চাহিদার সাথে তালমিলিয়ে বাংলাদেশের ফল বিশ্ব বাজারে শক্তিশালী অবস্থান করে নেবে।  
জাতীয় ফলমেলা ২০২৪ কে সফল করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জাতীয় ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সেমিনার, মেলা, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা ইত্যাদি। এর মাধ্যমে আপামর জনসাধারণ বিভিন্ন ফলের চাষ সম্প্রসারণ ও দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় ফলকে স্থান দেয়াসহ সার্বিকভাবে ফলের গুরুত্ব সম্পর্কে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হবেন।

লেখক : সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়। ওয়েবসাইট :www.moa.gov.bd

বিস্তারিত
স্মার্ট-বাংলাদেশের-ভিশন-:-স্মার্ট-কৃষির-মাধ্যমে-পুষ্টি-ও-অর্থনৈতিক-সমৃদ্ধি

স্মার্ট বাংলাদেশের ভিশন : স্মার্ট কৃষির মাধ্যমে পুষ্টি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি
ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার১ ড. সুস্মিতা দাস২
বিশ্বের অনেক দেশের মতো, বাংলাদেশও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের (৪ওজ) পথে অগ্রসর হচ্ছে। এই বিপ্লব প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের একটি সময়, যা সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করছে। কৃষিক্ষেত্রেও এই বিপ্লবের প্রভাব অনুভব করা যাচ্ছে, যার মাধ্যমে কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১ এর মূল উদ্দেশ্য হলো একটি টেকসই, আধুনিক ও স্মার্ট জাতি গঠন যার স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশনের আওতায় বাংলাদেশ ৪ওজ প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষি খাতের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য ইতোমধ্যেই বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে স্মার্ট কৃষির যে ধারণা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে তাকে বলা হচ্ছে চতুর্থ প্রজন্মের কৃষি।
বাংলাদেশ একটি কৃষিভিত্তিক দেশ, যেখানে কৃষি খাত দেশের অর্থনীতির মেরুদ- হিসেবে কাজ করে। ফল উৎপাদন এই খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা শুধুমাত্র দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে না, বরং রপ্তানি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ঋৎঁরঃং ধৎব ভড়ড়ফ পড়ড়শবফ নু ঃযব ংঁহ. অর্থাৎ ফল হলো এমন একটি খাদ্য যা সূর্যের আলোয় রান্না করা হয়েছে। এর মধ্যে সব ধরনের খাদ্যগুণ বজায় আছে। আমাদের দেশে ফলের সংখ্যা ৭০ এর অধিক এবং এ সমস্ত ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ। তাই এই পুষ্টি সমস্যা সমাধানে ফলই হতে পারে একমাত্র হাতিয়ার।
 বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসে ফল গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ফল বিভিন্ন ভিটামিন, মিনারেল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করে। দেশে আম, কাঁঠাল, পেঁপে, কলা, লিচু, কমলা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের ফলের ব্যাপক উৎপাদন হয়। এই ফলগুলো শুধু দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে না, বরং বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতেও বিশেষ অবদান রাখে। এই বিষয়টিকে সামনে রেখেই এবারের ফল মেলার প্রতিপাদ্য- ‘ফলে পুষ্টি অর্থ বেশ-স্মার্ট কৃষির বাংলাদেশ’ যথার্থই হয়েছে।
কেননা স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশনের আওতায় ফল উৎপাদন এবং এর মাধ্যমে পুষ্টি ও আয়ের ক্ষেত্রে বিপ্লব আনার জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের কোন বিকল্প নেই। এই প্রযুক্তিগত বিপ্লবের মাধ্যমে একদিকে যেমন ফল উৎপাদন বাড়বে এর মাধ্যমে দেশের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। কৃষিতে প্রযুক্তির অভাব এবং অপ্রতুল হলেও, এই সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহারের চিন্তা করা হচ্ছে। বিশেষভাবে কৃষি সেক্টরে ব¬কচেইন, সেন্সর, ডেটা অ্যানালাইটিক্স, ইন্টারনেট অফ থিংস (ওড়ঞ) ও মেশিন লার্নিং এবং এক্সটেন্সিভ মেশিনিং উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি খাতে স্মার্ট প্রযুক্তির প্রয়োগ করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্মার্ট হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কৃষি বিজ্ঞানীরা কৃষির উন্নয়নে নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছে। কৃষিভিত্তিক শিল্প ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পের বিকাশ, উন্নত জাতের ফসল উৎপাদন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজন, উন্নত বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশের জীবননির্বাহ কৃষি আজ বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সরকারের নানামুখী উন্নয়ন কর্মকা- যেমন উচ্চফলনশীল জাতের উদ্ভাবন এবং সম্প্রসারণ, সেচ ব্যবস্থা উন্নয়ন, সার ও      কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি প্রদান, সহজশর্তে কৃষিঋণ বিতরণ ইত্যাদির জন্য দেশের শস্য নিবিড়তা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স জাতীয় কৌশল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ কর্তৃক মার্চ ২০২০ এ প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে অও এবং কৃষি ক্ষেত্রে এর ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলোর নির্দেশিকা সন্নিবেশিত রয়েছে। এই কৌশলগুলো কৃষি ক্ষেত্রে গবেষণা ও উন্নয়ন, কৃষিভিত্তিক শিল্প ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পের বিকাশসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অও এর ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব প্রযুক্তিগত সুফল সম্প্রতি কৃষিতে জাগরণ সৃষ্টি করেছে। ধীরে ধীরে আরও বিস্তৃত হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য ১৭টি সংস্থা ৪টি বিষয়ভিত্তিক এলাকায় স্বল্প, মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এই কর্মপরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য হলো ৪ওজ এর সাথে সঙ্গতি রেখে দেশের কৃষি খাতকে উন্নত করা এবং দেশের কৃষিকে বিশ্বমানের এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক করা। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল একটি প্রকল্প ‘টেকসই উৎপাদনের জন্য ওড়ঞ ভিত্তিক প্রিসিশন কৃষির বাস্তবতা যাচাই’ সমন্বয় করছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে (ব্রি) তিনটি প্রকল্প শুরু করেছে যেমন ৪ওজ প্রযুক্তির মাধ্যমে গবেষণা ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, অও এবং ওড়ঞ এর মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্ত সহায়তা সরঞ্জাম হিসাবে একটি ই-ভ্যারাইটি প্রোফাইলার প্রচার করা এবং সেন্সর স্থাপন, ড্রোন প্রযুক্তি ও এয়ারোবটের মাধ্যমে যে কোনও গবেষণা ক্ষেত্রের সাথে সংযোগ স্থাপন করা। তাছাড়া বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে (ব্রি) ধানের রোগবালাই চিহ্নিত করতে ‘রাইস সল্যুশন’ (সেন্সরভিত্তিক ধানের বালাই ব্যবস্থাপনা) নামক একটি মোবাইল অ্যাপস উদ্বোধন করা হয়েছে। এটি আক্রান্ত ধান গাছের ছবি দেখে রোগ চিহ্নিত করতে সক্ষম যা স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থার নিদর্শন। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট  ‘জুট এবং জুট ছাই থেকে ৩উ প্রিন্টার ফিলামেন্ট এবং সক্রিয় কার্বন উদ্ভাবন প্রোগ্রাম’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করেছে।
কৃষির আধুনিকায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল মুঠোফোনে ‘খামারি’ অ্যাপ উন্মোচন করেছে-যা কৃষক,কৃষিবিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারকদের কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। খামারি অ্যাপে আধুনিক ক্রপ জোনিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ক্রপ জোনিংয়ে মূলত এলাকাভিত্তিক মাটির বৈশিষ্ট্য, আবহাওয়া-জলবায়ু ও ফসলের অর্থনৈতিক দিক সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এসব তথ্য দিয়ে কোন জমি কোন মৌসুমে কোন ফসলের জন্য উপযোগী এবং এলাকাভিত্তিক কোন ফসল অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক তা চিহ্নিত করা যায়। এ ছাড়াও খামারি অ্যাপে আধুনিক জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস), রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি এবং উঁচু-নিচু জমির ক্ষেত্রে শাটল রাডার টপোগ্রাফি মেশনের (এসআরটিএম) তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করা।
স্মার্ট কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আরও প্রসারিত করতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) ও কানাডার সেস্কাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের গে¬াবাল ইনস্টিটিউট অব ফুড সিকিউরিটি (জি আইএফএস) এর মধ্যে কৃষিক্ষেত্রে বিভিন্ন সহযোগিতাসহ বঙ্গবন্ধু চেয়ার এবং বঙ্গবন্ধু-পিয়ারে ট্রুডো কৃষি প্রযুক্তি কেন্দ্র  স্থাপনের  লক্ষ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই প্রকল্পের আওতায় আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধাযুক্ত চারটি কৃষি প্রযুক্তিকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। একইভাবে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষিত জনবল দিয়ে গবেষণাকেন্দ্র কমপ্লেক্স, গবেষণাগার, গ্রোথ চেম্বার, টিস্যু কালচার ল্যাব, এনালাইটিক্যাল ল্যাব স্থাপন করা হবে। প্রকল্পের আওতায় ফসলের লক্ষ্যভিত্তিক জাত সুনির্দিষ্টভাবে ও কম সময়ে উদ্ভাবনের জন্য অত্যাধুনিক জিনোম এডিটিং প্রযুক্তির সহায়তায় ফসলের কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্যের জাত উদ্ভাবনসহ, পানি ও মৃত্তিকা সম্পদ, পোস্ট হার্ভেস্ট ফুড হ্যান্ডেলিং ও প্রসেসিং, তথ্য প্রযুক্তি ও বিগ ডাটা নিয়ে দেশের প্রচলিত কৃষি গবেষণায় আমূল পরিবর্তন আনবে।
কৃষি প্রধান বাংলাদেশে প্রযুক্তির ছোঁয়া বদলে দিয়েছে কৃষকের জীবন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তথ্যপ্রযুক্তিগত সেবা ‘কৃষি বাতায়ন’ এবং ‘কৃষক বন্ধু কল সেন্টার’ চালু করেছে। বিভিন্ন  কৃষি বিষয়ক সেবাগুলোর জন্য কল সেন্টার হিসেবে কাজ করছে ‘কৃষক বন্ধু’ (৩৩৩১ কল সেন্টার)। ‘কৃষি বাতায়ন’ প্রযুক্তি সেবার মাধ্যমে কৃষকরা এখন তাদের চাষের ফসল সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে পারছেন, বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে নিতে পারছেন পরামর্শ। সরকারের বিভিন্ন কৃষি-সম্পর্কিত সেবাও পেয়ে থাকেন এই অ্যাপস ব্যবহার করে। তাছাড়াও রয়েছে  ই-বালাইনাশক প্রেসক্রিপশন, কৃষি বায়োস্কোপ। ফলে কৃষকরা সহজেই ঘরে বসে বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করতে পারছেন।             ‘কৃষকের জানালা’ নামে একটি উদ্ভাবনী অ্যাপসের সহযোগিতায় ফসলের ছবি দেখেই কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাগণ তাৎক্ষণিকভাবে শস্যের রোগবালাই শনাক্ত করতে পারেন। এছাড়াও কৃষি তথ্য সার্ভিস কৃষি বিষয়ক তথ্য সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে কল সেন্টার (১৬১২৩) চালু করেছে। এসবের প্রভাবে কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। অনেক তরুণ শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা আধুনিক কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। ফলে ডিজিটাল কৃষির বাস্তবায়নে ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের লক্ষ্য পূরণে অন্যতম একটি অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) ও ক্লাউড বেজড অটোমেটেড এগ্রিকালচারাল সিস্টেম।
কৃষি জমি এবং ফসলের পুষ্টি বিশ্লেষণ করতে ড্রোনের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে ফসলের উৎপাদন বাড়ানো যায় এবং ফসলের পুষ্টির মূল্যায়ন, তথ্য সংগ্রহ, ম্যাপিং, কীটনাশক স্প্রে ইত্যাদি কাজ ড্রোনের মাধ্যমে করা যায়। দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মধ্যে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে বলে জানা যায়। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, নেদারল্যান্ডসের টুয়েন্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্র যৌথভাবে ‘স্টারস’ প্রকল্পের আওতায় দেশের কৃষি গবেষণায় আধুনিক, উন্নত ও কার্যকর প্রযুক্তি হিসেবে ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে।
ভবিষ্যৎ স্মার্ট বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে স্মার্ট  কৃষি ব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষিপণ্য ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ, বিপণন ও রপ্তানি ব্যবস্থাপনাই পারে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করতে। ২০২৬ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ হলে কৃষিপণ্য সরকারের নগদ প্রণোদনা ও বিভিন্ন দেশের দেওয়া রপ্তানি সুবিধাগুলো হারাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বাস্তবতায় আধুনিক পরীক্ষাগারে খাদ্যমান নিশ্চিত করা, বিশেষায়িত হিমাগার অবকাঠামোর ঘাটতি, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনে অপর্যাপ্ত গবেষণা ও বাজারজাতকরণে আধুনিক প্রযুক্তির অভাব দূর করার মাধ্যমে এই বাধা অতিক্রম করা সম্ভব। কৃষিখাতের রপ্তানি বহুমুখী করে বৈদেশিক মুদ্রাআহরণের পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব হবে। আগামীতে, স্মার্ট কৃষির মাধ্যমে পুষ্টি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুযোগ ও সম্ভাবনা সর্বোপরি কৃষিক্ষেত্রে একটি টেকসই উন্নতি সৃষ্টি করতে সাহায্য করবে। 

লেখক : ১চেয়ারম্যান, বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা কাউন্সিল ২প্রধান ডকুমন্টেশন কর্মকর্তা, বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, মোবাইল : ০১৭১১১০২১৯৮, ই-মেইল susmitabare@gmail.com

বিস্তারিত
পুষ্টি-নিরাপত্তা-ও-অর্থনৈতিক-উন্নয়নে-নিরাপদ-ফল-চাষ-সম্প্রসারণ

পুষ্টি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে 
নিরাপদ ফল চাষ সম্প্রসারণ 
কৃষিবিদ বাদল চন্দ্র বিশ্বাস
ফল শুধু খাদ্য হিসেবেই নয়- মানবদেহের পুষ্টি সাধন, ভিটামিনের চাহিদাপূরণ, শারীরিক বৃদ্ধি, মেধার বিকাশ ও রোগ প্রতিরোধে ফলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাছাড়া ফলের ভেষজ গুণাবলিও অনেক। আমাদের দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান বিশেষত ভিটামিন, খনিজ এর অন্যতম উৎস ফল। এ ছাড়াও ফলে রয়েছে জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান, যেমন- ক্যারোটিন, সেলুলোজ, অ্যান্টি অক্সিডেন্টগুলো ও পানি। ফল রান্না করতে হয় না এবং কাঁচা-পাকা উভয় অবস্থাতেই সরাসরি খাওয়া যায়। ফলে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানের অপচয় কম হয়। তাই পুষ্টির নিশ্চয়তায় ফলই উত্তম। 
ফলই বল। তাই পুষ্টিবিদরা দৈনিক মাথাপিছু ১০০-২০০ গ্রাম বিভিন্ন প্রকারের ফল খাবার পরামর্শ দিয়েছেন কিন্তু গড়ে আমরা প্রতিদিন মাথাপিছু প্রায় ৯৫.৪ গ্রাম ফল খেয়ে থাকি, যা দৈনিক চাহিদার প্রায় ৪৮ শতাংশ (ঐওঊঝ-২০২২)। বাকিটুকু যদি খাওয়ার অভ্যাস করতে পারি, তাহলে আমাদের ফলের উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে।
পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ খুব ছোট দেশ হলেও এদেশের মাটি ও আবহাওয়া ফল চাষের জন্য খুবই অনুকূল।  দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে চার শতাধিক প্রজাতির ফল জন্মে। এর মধ্যে ফলসম্ভারে পরিপূর্ণ  বাংলাদেশেই খাওয়ারযোগ্য ফল জন্মে ১৩০টি, তবে বর্তমানে ৭০-৮০ প্রজাতির বিভিন্ন জাতের ফলের চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে ১০-১২ প্রজাতির ফল প্রধান যেগুলোর চাষ বাণিজ্যিকভাবে করা হয়। ফলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এতে একদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে এবং ফল রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে ।  
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এর তথ্য মতে গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ফলের উৎপাদন ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে এবং বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ৩টি ফলের মোট উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়, আমে নবম ও পেয়ারায় অষ্টম, এ ছাড়াও মৌসুমি ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ বর্তমানে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় রয়েছে। বিগত ২০০৮-০৯ অর্থবছরে  ফলের আওতাধীন জমির পরিমাণ (বাণিজ্যিক ফল বাগান ও বসতবাড়ি বাগানসহ) ছিল ৯.৩৬ লাখ হেক্টর এবং তা থেকে ১০৩.৪১ লাখ মেট্রিক টন ফল উৎপাদিত হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ফল চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে ৭.৬৬ লাখ হেক্টর হয়েছে কিন্তু ফলের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ১৫০.৩৩ লাখ মেট্রিক টন। 
উত্তরাঞ্চলের ‘শস্যভা-ার’ খ্যাত বরেন্দ্র অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সমন্বিত মিশ্র ফল চাষ পদ্ধতি। একে অন্যের দেখা দেখি উৎসাহিত হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। আম ও লিচু চাষ করে এই অঞ্চলের কৃষকরা স্বাবলম্বি হয়েছেন অনেক আগেই। তবে বর্তমানে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তারা গড়ে তুলেছেন আম, পেয়ারা, পেঁপে, মাল্টা, লেবু, কলা এবং উন্নত জাতের বরই গাছের মিশ্র ফলের বাগান। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের উন্নত চাষপদ্ধতি বিষয়ক পরামর্শ নিয়ে লাভবানও হচ্ছেন তারা। 
ফল উৎপাদনে সম্প্রতি অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে পাহাড়ি এলাকা। ভূমি বৈচিত্র্যের জন্য বহু রকমের ফল পাহাড়ে চাষ করা যায়। দুই দশক আগেও পাহাড়ে বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষ হতো না। ২০০৪ সাল থেকে মূলত বাণিজ্যিকভাবে ফলের বাগান করা শুরু হয়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ফলবাগানের সংখ্যা। পাহাড়ি জমিও ফল চাষের আওতায় আসতে থাকে। ২০১৭ সালে প্রায় ৯২ হাজার হেক্টর জমিতে ১৫ লাখ ৫৯ হাজার টন ফল উৎপাদিত হয়। ছয় বছরের মাথায় উৎপাদন ১৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায়  ২০ লাখ টনে। ফল চাষে জমির পরিমাণ ১ লাখ হেক্টর। তিন পার্বত্য জেলায় সবচেয়ে বেশি ফল উৎপাদিত হয় বান্দরবান জেলায়। গত বছর প্রায় ৯ লাখ টন ফল উৎপাদিত হয়েছে এই জেলায়। ফল উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থান রাঙ্গামাটির, প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টন। আর খাগড়াছড়িতে উৎপাদিত হয় প্রায় ৪ লাখ টন। তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় ৪০ হাজার ছোট-বড় উদ্যোক্তা ফল চাষে যুক্ত হয়েছেন। তাদের হাত ধরে পাহাড়ি এলাকায় আম, কলা, কাঁঠাল, পেঁপে, আনারস, কমলাসহ ৪৪ জাতের ফল উৎপাদিত হচ্ছে। সারা দেশে উৎপাদিত ফলের প্রায় ১৫ শতাংশ এখন আসে এই তিন পার্বত্য জেলা থেকে।  তিন পার্বত্য জেলায় উৎপাদিত মোট ফলের প্রায় ৮১ শতাংশই ছয়টি ফল-আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, আনারস ও কমলা। এই ছয়টি ফল ১৪ লাখ ৬৭ হাজার ৫৯৪ টন উৎপাদিত হয়ে থাকে। এসব ফল ছাড়াও এখন ড্রাগন, রাম্বুটান, কাজুবাদাম, জলপাই, আপেলকুলসহ ৩৮টি ফল উৎপাদিত হয়। এসব চাষাবাদের বাইরেও এখনও পাহাড়ে ৫ লাখ হেক্টর জমি অনাবাদি পড়ে আছে, যেখান থেকে নির্দিষ্ট ফসল চাষ করে বছরে ১৭ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। মধুপুরের পাহাড়ি এলাকার জমিতে প্রচুর আনারস উৎপাদিত হয়। এবারও ৬ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হয়েছে। এর মধ্যে নতুন জাত এমডি-২ আনারস চাষ করা হয়েছে ১২ হেক্টরে। সংরক্ষণ সময় অধিক তাই বিদেশের বাজার ধরার জন্য নতুন জাতের এমডি-২ আনারস চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কারণ এই আনারস পাকার পর প্রাকৃতিকভাবেই এক মাস সংরক্ষণ করা যায়। গারো পাহাড়ের মাটির একটি বিশেষ গুণ রয়েছে, তা হলো পানি আটকে থাকে না। তাই এখানে সাম্মাম বা রকমেলন ফল চাষ হচ্ছে। 
দেশের মোট আয়তনের ২০ শতাংশ উপকূলীয় জমিকে প্রচলিত দেশীয় ফলের উৎপাদন হাব তৈরি করে সফেদা, মাল্টা, নারিকেল, কলা, আমরুল, বৈচি, বিলাতি গাব, পেঁপে এবং তরমুজের বাণিজ্যিক চাষ বৃদ্ধি করার বিশেষ সুযোগ রয়েছে। 
ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষিতে বর্তমান সরকারের দূরদর্শী নেতৃত্বে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক বিভিন্ন পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। 
বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়নের জন্য আম প্রাপ্তির সময় বৃদ্ধিতে গৌড়মতি, জাদুভোগসহ বিবিধ নাবী জাতের নতুন নতুন আমের জাতের সম্প্রসারণের ফলে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত আম পাওয়া যাচ্ছে যেখানে দেশে পূর্বে এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত আম পাওয়া যেত। অন্যদিকে, থাইল্যান্ডের কাটিমন জাতের আম চাষ সম্প্রসারণের ফলে সারা বছরই আম প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রতি বছর ১৬ শতাংশ হারে আমের উৎপাদন বাড়ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কতৃক সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নর ফলে বর্তমানে সারা বছরই পেয়ারা পাওয়া যাচ্ছে। কয়েক বছর আগেও দেশে শুধু বর্ষা মৌসুমে পেয়ারা পাওয়া যেতো। বিগত ১০ বছরে দেশে পেয়ারা উৎপাদন হয়েছে দ্বিগুণ। দেশে উৎপাদিত পেয়ারার ৭০ শতাংশই থাই জাতের পেয়ারা। বলসুন্দরী কুল একটি উচ্চফলনশীল জাত এবং ফলের গড় ওজন প্রায় ১০০ গ্রাম। পাকা ফলের মিষ্টতা অন্যান্য সকল কুল অপেক্ষা বেশি। এই কুল টেবিল ফ্রুট (ঞধনষব ঋৎঁরঃ) হিসেবে আপেলের পরিবর্তে খাওয়া যায়। প্রকল্পের মাধ্যমে বলসুন্দরী কুল চাষ সম্প্রসারণের ফলে দেশে আপেল আমদানির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে।
চারা-কলমের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিদ্যমান হর্টিকালচার সেন্টারগুলো সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ ও নতুন নতুন হর্টিকালচার সেন্টার স্থাপনের কর্মপরিকল্পনা করা হয়েছে। 
দেশের প্রচলিত ও অপ্রচলিত এবং চাষ উপযোগী দেশি ও বিদেশি ফলের জাত সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ৩টি জার্মপ্লাজম সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। এ সকল জার্মপ্লাজম সেন্টারে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুসহ প্রচলিত ফল এবং আমড়া, চালতা, আতা, কুলের বিবিধ জাতসহ অপ্রচলিত ফল ও দেশে চাষ উপযোগী বিদেশী ফল যেমন: রাম্বুটান, আরবি খেজুর, পার্সিমন, লংগান, অ্যাভোক্যাডো ইত্যাদি ফলের আধুনিক ও উন্নত জাতের চারা/কলম রোপণ করা হয়েছে। হর্টিকালচার সেন্টারগুলোর মাধ্যমে সারা দেশে এ সকল ফলের চারা/কলম বিতরণ সহজলভ্য হবে।
দেশের হারিয়ে যাওয়া বিশেষ পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ অপ্রচলিত যেমন- আতা, ডেউয়া, লটকন, বাতাবিলেবুসহ অন্যান্য ফলের ফলন বৃদ্ধিসহ দেশের ১১ কোটি শতক পতিত জমিতে দ্রুত বর্ধনশীল ফলগাছ এবং দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদি ফল গাছের সমন্বয়ে মিশ্র ফলবাগান সৃষ্টি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ফলের বাণিজ্যিকীকরণে নিরাপদ ফল উৎপাদনের জন্য উত্তম কৃষি চর্চা (এঅচ) ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মানসম্মত আমের বর্তমান অবস্থা হতে ৫% বৃদ্ধি করাসহ রফতানি আয় বৃদ্ধি ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন সাধনের প্রচেষ্টা চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩০৪৫.৪৬৭ মে.টন আম রপ্তানি করা হয়েছে।
ফল সংরক্ষণ এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং এ জন্য সরকার সারাদেশে কোল্ডস্টোরেজ সুবিধা চালুর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ম্যাংগো গ্রেডিং, ক্লিনিং ও কুলিং শেড নির্মাণ, ম্যাংগো প্লাকার ও হাইড্রোলিক ম্যাংগো হারভেস্টার সরবরাহ করছে। সেই সাথে নিরাপদ ফলের বাণিজ্যিকীকরণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্যাকিং হাউজকে শক্তিশালী করে এতে আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক প্যাকিং হাউজ ও ল্যাবের মাধ্যমে আমদানিকারক দেশের আমদানি শর্তানুযায়ী ২৫-৩০% রপ্তানি বৃদ্ধি করার পদক্ষেপ নিয়েছে।
সর্বোপরি, বাংলাদেশে ফলের ফলন সাড়ে ১১ শতাংশ হারে বাড়ায় মানুষের মাথাপিছু ফল গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে। ২০০৮-০৯ সালে দেশের ফলের উৎপাদন ছিলো প্রায় ১ কোটি টন আর বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে ১ কোটি ২২ লাখ টন এর পেছনে রয়েছে সরকারের দূরদর্শী পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই দেশে নীরবে ঘটে চলেছে ফলবিপ্লব। বাণিজ্যিক চাষাবাদ সম্প্রসারণ করা গেলে পুষ্টির চাহিদা তো পূরণ হবেই, আমদানি কমিয়ে বাঁচানো যাবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও। এ অর্জন কারও একার নয় বর্তমান সরকারের দূরদর্শী নেতৃত্বে সকল স্তরের কৃষিনির্ভর ব্যক্তিবর্গ এ সাফল্যের অংশীদার। 

লেখক : মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি,     ঢাকা-১২১৫। ই-মেইল : dg@dae.gov.bd

বিস্তারিত
বাণিজ্যিক-ফলবাগানে-উত্তম-কৃষি-চর্চা-অনুসরণ

বাণিজ্যিক ফলবাগানে উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ
প্রফেসর আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ
একটা সময় ছিল যখন মানুষ মূলত বসতবাড়িতে ফলের চাষ করতো। তবে সময়ের পরিবর্তনে কৃষকরা এখন ফলের বাণিজ্যিক উৎপাদনের দিকেও ঝুঁকছেন। গত দুই দশক ধরে বাণিজ্যিক চাষের সাফল্যের কারণে দেশে ফল উৎপাদনে নীরব বিপ্লব ঘটেছে। আয়তনে বিশ্বের অন্যতম ছোট দেশ বাংলাদেশ ফল উৎপাদনে সফলতার উদাহরণ হয়ে উঠেছে। এ মুহূর্তে বিশ্বে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির সর্বোচ্চ হারের রেকর্ড বাংলাদেশের। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ১০টি শীর্ষ গ্রীষ্মম-লীয় ফল উৎপাদনকারী দেশের একটি। এ ছাড়া গত ১৮ বছর ধরে ফল উৎপাদনে গড়ে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। 
একই সঙ্গে নিত্যনতুন ফল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ সফলতা পেয়েছে। এত কম আয়তনের দেশ হয়েও ফল চাষে জমি বৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে। বাংলাদেশে এখন ৭০-৮০ প্রজাতির ফলের চাষ হচ্ছে। শুধু ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির দিক থেকে নয়, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ফল খাওয়ার পরিমাণও গত এক যুগে দ্বিগুণ হয়েছে। একসময় দেশে কাঁঠাল ও আম ছিল প্রধান ফল। এখন অন্তত ২২ প্রজাতির ফল বাংলাদেশের মানুষ নিয়মিত খায়। চার-পাঁচ বছরের মধ্যে নতুন ফল ড্রাগন ও অ্যাভোক্যাডো এবং দেশি ফল বাতাবিলেবু, তরমুজ, খরমুজ, লটকন, আমড়া ও আমলকীর মতো পুষ্টিকর ফলের উৎপাদনও ব্যাপক হারে বাড়ছে। এসব ফলের প্রায় পুরোটাই দেশে বিক্রি হচ্ছে। বিগত এক দশকে অনেক তরুণ শিক্ষিত উদ্যোক্তা বাণিজ্যিক ফলচাষে মনোনিবেশ করেছে। কিন্তু নিরাপদ ও গুণগত মানসম্পন্ন ফল উৎপাদন ও বিদেশে রপ্তানির জন্য এসব বাণিজ্যিক ফলচাষে উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণের বাধ্যবাদকতা রয়েছে।
উত্তম কৃষি চর্চা  হলো সামগ্রিক কৃষি কার্যক্রমে অনুসরণকৃত একগুচ্ছ নীতি-বিধি ও প্রযুক্তিগত সুপারিশমালা যা সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন, সংগ্রহ ও সংগ্রহত্তর ব্যবস্থাপনা এবং পরিবহনের বিভিন্ন স্তরে প্রয়োগ করা হয় যা মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ, পণ্যের মান উন্নয়ন ও কৃষি শ্রমিকের সুস্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও কাজের পরিবেশ উন্নত করে থাকে। উত্তম কৃষি চর্চা সামগ্রিক কৃষি কার্যক্রমের পরিবেশগত, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সুরক্ষা সুসংহত করে। ফলশ্রুতিতে নিরাপদ এবং মানসম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত হয়। ইহা এমন পদ্ধতিসমূহের চর্চা যা খামারে প্রয়োগ করার ফলে উৎপাদন পূর্ব, উৎপাদনকালীন, সংগ্রহ এবং সংগ্রহোত্তর পর্যায় নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। উত্তম কৃষি চর্চার লক্ষ্য হলো নিরাপদ খাবার, পরিবেশ ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা প্রদান করা। এর সামগ্রিক উদ্দেশ্যসমূহ হলো - নিরাপদ ও খাদ্যমান সম্পন্ন ফসলের টেকসই উৎপাদন নিশ্চিতকরণ; ফসল উৎপাদনে সহনীয় পরিবেশ নিশ্চিতকরণ এবং কর্মীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও কল্যাণ সাধন; খাদ্য শৃঙ্খলের সকল স্তরে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিসমূহ অনুসরণ করা; ভোক্তার স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং মানসম্পন্ন উচ্চমূল্য ফসল উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি করা। 
ইউরোপের সুপারশপে কৃষিপণ্য সরবরাহকারীদের উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে ইউরোপগ্যাপ নামে পৃথিবীতে সর্বপ্রথম উত্তম কৃষি চর্চা কার্যক্রম শুরু হয়। যা পরবর্তীতে ২০০৭ সালে বৈশ্বিক স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে গ্লোবালগ্যাপ নামকরণ করা হয়। পরবর্তীতে আঞ্চলিক গ্যাপ (আশিয়ানগ্যাপ) ও বিভিন্ন দেশ তাদের নিজস্ব উত্তম কৃষি চর্চা বা গ্যাপ কার্যক্রম চালু করে। আমাদের দেশেও ‘গ্যাপ‘ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আশা করি অচিরেই এর সার্টিফিকেশন শুরু হবে। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে নিরাপদ ফল উৎপাদনসহ রপ্তানি বাজারে প্রবেশের জন্য উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশ ‘গ্যাপ’ বাস্তবায়নের ফলে উৎপাদিত কৃষি পণ্য নিরাপদ, উন্নত ও মানসম্পন্ন হবে, আয় বৃদ্ধি ও অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারসহ টেকসই পরিবেশ ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
বাংলাদেশ সরকার উত্তম কৃষি চর্চা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশে উত্তম কৃষি চর্চা এর স্ট্যান্ডার্ড হলো বাংলাদেশ গ্যাপ। খামারপর্যায় হতে শুরু করে ভোক্তাপর্যায়ে নিরাপদ ও মানসম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করতে খামারে উৎপাদন এবং সংগ্রহোত্তর প্রক্রিয়ায় উত্তম কৃষি চর্চা বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উত্তম কৃষি চর্চা (এঅচ) নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য উৎপাদনসহ টেকসই অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত উন্নয়ন নিশ্চিত করে। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সরকার ‘বাংলাদেশ উওম কৃষি চর্চা নীতিমালা-২০২০‘ প্রণয়ন করে। 
বাংলাদেশে এঅচ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) পরিকল্প স্বত্বাধিকারী (স্কিমওনার) এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) সার্টিফিকেশন বডি  (Bangladesh Agricultural Certification Body-BACB) হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। এঅচ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিভিন্ন অংশীজন সমন্বয়ে (স্টিয়ারিং, টেকনিক্যাল ও সার্টিফিকেশন) কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত নীতিমালা বাস্তবায়নে সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।GAP বাস্তবায়নের উপযোগী মানদ- ((Standards) প্রতিষ্ঠা করতে ২৪৬টি অনুশীলন চর্চা সম্বলিত নিরাপদ খাদ্য মডিউল; পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা মডিউল; কর্মীর স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও কল্যাণ মডিউল; পণ্যমান মডিউল এবং সাধারণ প্রয়োজনীয়তা মডিউলসহ মোট ৫টি মডিউল প্রস্তুত করা হয়েছে, যা মাঠর্পযায়ে এঅচ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে। GAP মানদ-ের গুরুত্ব বিবেচনায় অনুশীলনসমূহকে (Control Point)  “অতি গুরুত্বপূর্ণ” ((Major Must)-১০০% অনুসরণ বাধ্যতামূলক, “গুরুত্বপূর্ণ” (Minor Must)-৯০% অনুসরণ বাধ্যতামূলক এবং “সাধারণ” (General)-৫০% অনুসরণ বাধ্যতামূলক এ তিন শ্রেণিতে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে। 
কোন ফসল বিদেশে রপ্তানি করতে হলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন একান্ত প্রয়োজন। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য ফসল উৎপাদন হতে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ, সরবরাহ ও বিপণন প্রতিটি পর্যায়েই এঅচ মানদ- অনুসরণ জরুরি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন বোর্ড (ইঅই) স্বীকৃতি প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে এঅচ কার্যক্রম/বাস্তবায়নের স্বীকৃতি প্রদান করবে। বাংলাদেশে উত্তম কৃষি চর্চা বাস্তবায়নের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন পার্টনার প্রকল্পের আওতায় আগামী পাঁচ বছরে (২০২৩-২০২৮) তিন লক্ষ হেক্টর জমি উত্তম কৃষি চর্চা সার্টিফিকেশনের আওতায় আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক কৃষিকে টেকসই করা এবং স্থানীয় কৃষিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যেতে উত্তম কৃষি চর্চা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
উত্তম কৃষি চর্চা  নিরাপদ ও মানসম্মত খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি পরিবেশ এবং সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। কৃষিকার্যে ব্যবহৃত উপকরণ যেমন- বালাইনাশক, জৈব ও রাসায়নিক সার, পানি ইত্যাদির পরিমিত ব্যবহার এবং পরিবেশবান্ধব ফসল ব্যবস্থাপনাকে উত্তম কৃষি চর্চা উৎসাহিত করে। ফসল উৎপাদনের উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করল্লে­-ভৌত, রাসায়নিক বা অণুজীবী ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে ফসল চাষ করা যাবে না। গুণগত মানসম্পন্ন বীজ বা চারা লাগাতে হবে। সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে মাটি পরীক্ষা করে প্রয়োজনমাফিক সার দিতে হবে। সেচের ক্ষেত্রে নিরাপদ পানি ব্যবহার করতে হবে। বালাই দমনে আইপিএম বা সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা এবং নিরাপদ বালাইনাশক ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়াও রাসায়নিক বালাইনাশকের ক্ষেত্রে অবশ্যই সংগ্রহপূর্ব অপেক্ষমাণ সময় মেনে চলতে হবে। বালাইনাশক ও বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিকের ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহার থেকে কৃষি কাজে নিয়োজিত কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সকল ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার উপযুক্ত ব্যক্তি লিখিত পরামর্শ মোতাবেক হতে হবে। ফসল সংগ্রহ ও সংগ্রহোত্তর কাজে নিয়োজিত কৃষি শ্রমিকদের হাইজিন বা ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং এসব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কৃষিকাজের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি কমিয়ে আনতে হবে। উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণে খামারে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি নিরূপণ, ঝুঁকি প্রশমন পরিকল্পনা ও সংশোধনের লিখিত তথ্যাবলী সংরক্ষণ করতে হবে। খামারে উৎপাদক রেজিস্টার সংরক্ষণ করতে হবে। সকল ধরনের তথ্যাবলী কমপক্ষে দুই বছর সংরক্ষণ করতে হবে। খামারের শ্রমিক বা কর্মীদের সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। সকল অনুসরণীয় বিষয়সমূহ যথাযথভাবে প্রতিপালন হলে সার্টিফিকেশন বডি কর্তৃক বহিঃস্থ অডিট সম্পন্ন করতে হবে। অডিট সন্তোষজনক হলে এক বছরের জন্য সার্টিফিকেট প্রদান করা হবে। প্রতি বছর এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে।
বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্য চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে খাদ্যসামগ্রী এক দেশ থেকে অন্য দেশে আমদানি এবং রপ্তানি হচ্ছে। বিশ্বাব্যাপী খাদ্যসামগ্রী আনা নেয়ার ফলে খাদ্য শৃঙ্খলে সংক্রমন এবং জীবাণুসমূহের বিস্তৃতি ঘটার সম্ভাবনা থাকে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। ফল এবং সবজি প্রায়শই টাটকা ও কাঁচা অবস্থায় খাওয়া হয়, তাই এতে বাহ্যিকভাবে ক্ষতিকর বা স্বাস্থ্য হানিকর কোন কিছু যেন না থাকে তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কোন অঞ্চলের খাদ্যমান সম্পর্কিত নিরাপদ খাদ্য সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ হচ্ছে প্রয়োগকৃত রাসায়নিকের অবশিষ্টাংশ, দূষণকারী বস্তু, পোকা ও রোগ, রোগ সৃষ্টিকারী এবং বিনষ্টকারী অণুজীব, বাহ্যিক সংক্রামকসমূহ প্রভৃতি। 
নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক বিপত্তি/ঝুঁকি খাদ্য শৃঙ্খলের যে কোন পর্যায় ঘটতে পারে, তাই খাদ্য শৃঙ্খলের প্রত্যেক স্তরে নিরাপদ খাদ্য সংক্রান্ত যে কোন সমস্যা প্রতিরোধ বা দূরীভূত করা প্রয়োজন। নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির লক্ষ্যে উত্তম কৃষি চর্চা বাস্তবায়নে খাদ্য শৃঙ্খলের প্রাথমিক পর্যায় অর্থাৎ কৃষকপর্যায় থেকে প্রতিটি স্তরে প্রত্যেক কর্মীকে তার নিয়ন্ত্রণাধীন নির্দিষ্ট বিষয়ে দায়িত্বশীল এবং সকল কার্যক্রমের বিবরণ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। উৎপাদনকারীকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে উৎপাদিত পণ্য খাদ্য হিসেবে নিরাপদ। তবে উৎপাদকের পাশাপাশি সরবরাহ, পরিবহন, গুদামজাত ইত্যাদি সকলেরই দায়িত্ব রয়েছে খাদ্যকে নিরাপদ এবং মানসম্পন্ন রাখা। উত্তম কৃষি চর্চা নিশ্চিত করলে বাংলাদেশ থেকে ফলসহ অন্যান্য কৃষিপণ্যের রপ্তানি সম্ভাবনা বাড়বে।  
উত্তম কৃষি চর্চা নিরপদ, টেকসই ও দায়িত্বশীল কৃষির নিশ্চয়তা দেয়। গ্যাপ অনুসরণে ফসলের উৎপাদন করলে উৎপাদন খরচ কমে এবং কৃষি কার্যক্রম টেকসই হয়। পাশাপাশি পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে। বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অধীনে ফল চাষ ও উত্তম কৃষি চর্চা সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এগুলো হলো-প্রোগ্রাম অন এগ্রিকালচারাল এন্ড রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফর নিউট্রিশন, এন্টারপ্রেনিউরশিপ এন্ড রেজিলিয়েন্স ইন বাংলাদেশ প্রজেক্ট (পার্টনার প্রকল্প), রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্প, বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প, লেবুজাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ, ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প প্রভৃতি। এ ছাড়াও অন্যান্য প্রকল্পেও ফলচাষে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ আগামীতে বৈশ্বিক ফল রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আসীন হতে পারে। 

লেখক : অধ্যাপক, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও রেজিস্টার্ড ট্রেইনার, গ্লোবালগ্যাপ।Email: nomanfarook@yahoo.com; মোবাইল : ০১৮১৯৮২৩০৩০

বিস্তারিত
দেশি-ও-বিদেশি-ফল-বাগান-স্থাপনে-অর্থনৈতিক-ব্যবস্থাপনার-গুরুত্ব-ও-করণীয়

দেশি ও বিদেশি ফল বাগান স্থাপনে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও করণীয়
ড. মোঃ শরফ উদ্দিন 
বাণিজ্যিক কৃষিতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বলতে জনবল ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ে সবচেয়ে কম খরচে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানোকে বোঝায়। বর্তমানে অনেক শিক্ষিত যুবক উদ্যোক্তা হিসেবে কৃষিতে বিনিয়োগ করছেন। বিনিয়োগ করার পূর্বে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বিষয়টি ভালোভাবে বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। না হলে গৃহীত উদ্যোগ সফল হবে এমনটি কারো কাম্য নয়।
বর্তমানে ফলের চাষ লাভজনক হওয়ায় দেশের শিক্ষিত যুবক বা বেকার যুবকগণ দেশি ও বিদেশি ফল চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান, পাশর্^বর্তী চাষী বা উৎপাদনকারীর সফলতা দেখে তিনিও কোন একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। শুরু থেকে প্রত্যেকটি বিষয় আমলে নিয়ে এগিয়ে গেলে ঝুঁকি কমানো সম্ভব। দেশে বর্তমানে ৭০-৮০ প্রজাতির ফল চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে সবগুলো চাষ করে বাণিজ্যিভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভবনা নেই। যে ফলগুলো দেশের বিরাজমান আবহাওয়ায় ভালো ফলন দেয়, দেশের মানুষ পছন্দ করে এবং রপ্তানির সম্ভবনা আছে সেগুলো বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করা উত্তম। যেমন- আমের বিভিন্ন জাত (বারি আম-২, বারি আম-৩, বারি আম-৪, বারি আম-১১, বারি আম-১২, বারি আম-১৩, বারি আম-১৭, খিরসাপাত, ল্যাংড়া, ফজলি, আশি^না, কার্টিমুন, ব্যানানা ম্যাংগো ইত্যাদি), লিচু, কাঁঠাল, পেয়ারা, কলা, পেঁপে, নারিকেল, মাল্টা ইত্যাদি। বিদেশি ফল যেমন- ড্রাগন ফ্রুট, স্ট্রবেরী, রাম্বুতান, অ্যাভোক্যাডো চাষ করা যেতে পারে। 
এদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিবেচনায় যে কোন একটি ফলের একক বাগান না করাই উত্তম। মৌসুমে আবহাওয়াগত তারতম্যের কারণে কোন একটি বছরে কোন কোন ফলের ফলন বিপর্যয় দেখা যায়। সেক্ষেত্রে জায়গার পরিমাণ এক একরের মতো হলে দেশি-বিদেশি ফল মিলে মিশ্র ফল বাগান স্থাপন করা ভালো। এ ছাড়াও মিশ্র ফল বাগান হতে সারা বছর ফলের ফলন পাওয়া যাবে। ফলের বাগান স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রথম কয়েক বছর জায়গার ব্যবহার ভালো হয় না। সেক্ষেত্রে ফল বাগানের ফাকা জায়গায় স্বল্পকালিন ফল, সবজি ও ডাল জাতীয় ফসল আন্তঃফসল হিসেবে চাষ করলে বাড়তি আয় করা সম্ভব। 
বাজার বিশ্লেষণ
একজন চাষি বা উদ্যোক্তা দেশি বা বিদেশি যে কোন ধরণের ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের জন্য নির্বাচন করতে পারেন তবে সে ফলের মার্কেট যাচাই করতে হবে, ভোক্তার পছন্দ এবং ঐ ফসলের চাহিদার গ্রাফ পর্যালোচনা করতে হবে। যদি ফলাফল কাক্সিক্ষত হয় তবেই বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
উৎপাদন খরচ বিশ্লেষণ
একটি ফসল উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের খরচ হয়। খরচ নিরূপণের সময় যেন কোন আইটেম/খাত বাদ না যায় সেদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ প্রত্যেকটি কার্যকলাপের জন্য খরচ হয়। যেমন- জমি লিজ, বীজ, কলমের চারা, বেড়া নির্মাণ, ঠেস দেয়া, জৈব সার, রাসায়নিক সার, সেচ প্রয়োগ, বালাইনাশক, শ্রমিক মজুরি, প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, ক্রেইট, পরিবহন খরচ বিবেচনায় রাখতে হবে। উৎপাদন খরচ সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে পরিকল্পনা করলে ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ পেয়ারা চাষে উৎপাদন খরচ সারণি দ্রষ্টব্য।
সাধারণভাবে হিসেব করলে দেখা যায় আট চল্লিশ হাজার টাকায় এক একর জমিতে পেয়ারা উৎপাদন করা যায় কিন্তু একটু ভালোভাবে উৎপাদন খরচ বিবেচনা করলে খরচ প্রায় একগুণ বেড়ে যায় অর্থাৎ উৎপাদন খরচ ভালোভাবে বিবেচনা না করলে লাভের পরিমাণ কমে যেতে পারে অথবা কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।
বাজারদর বিশ্লেষণ
ফসলের মূল্য নির্ভর করে মূলত ফসলের সরবরাহ ও ভোক্তার চাহিদার উপর। সরবরাহ যত বেশি হবে দাম তত কম হবে। স্থানীয় বাজারের তুলনায় দূরবর্তী বাজারে দাম বেশি পাওয়া যায়। আবার চেইন শপ মার্কেটে ফলের দাম বেশি হয়। ফসলের দাম বেশি পাওয়ার জন্য ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। আগাম মৌসুমে এবং অমৌসুমে ফলের দাম বেশি হয়। ফলে দেশি-বিদেশি যে ফলই হোক না কেন অসময়ে ফলের চাহিদা বেশি থাকে ফলে দামও বেশি পাওয়া যায়। ফলের গুণমাত মান ভালো হলেও দাম ভালো পাওয়া যায়। সুতরাং বাজার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ক্রেতা/ভোক্তার সাথে লিংকেজ স্থাপন
উৎপাদিত ফল যতই ভালো হোক না কেন ভোক্তার কাছে ভালোভাবে না পৌঁছালে ভারো দাম পাওয়া যাবে না। সুতরাং উৎপাদিত ফসল বা পণ্য কাক্সিক্ষত মার্কেটে বা ভোক্তার কাছে পৌঁছানের জন্য কার্যকরী সরবরাহ চেইন গড়ে তুলতে হবে। এ সকল ফল চাষির কাছে থেকে সরাসরি ভোক্তার কাছে অথবা চাষির কাছ থেকে সরবরাহ চেইনের মাধ্যমে ভোক্তার কাছে পৌঁছান যায়। বর্তমানে অনেক চাষি সরাসরি বিভিন্ন হোটেল/রেস্টুরেন্টে এ ফল সরবরাহ করে থাকেন। ফলে তারা মূল্য বেশি পান।
সরবরাহ চেইন ব্যবস্থাপনা
ফল উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এ সরবরাহ চেইনে যেন ফলের মান নষ্ট না হয় বা কমে না যায় সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, সরবরাহ চেইনে অব্যবস্থাপনার পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় ফলে ক্রেতাদের বেশি দামে ক্রয় করতে হয়। এত পণ্যের চাহিদা কমে যায়।
উৎপাদিত ফলের মান নিয়ন্ত্রন
ফলের গুণগত উৎপাদনকারীকে নিশ্চিত করতে হবে। ক্রেতা বা ভোক্তার চাহিদানুযায়ী সবচেয়ে ভালোমানের ফল উৎপাদন করবে। যে সকল ক্রেতা একবার এ সকল ফল খাবেন, পুনরায় সেগুলো খাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করবেন। এ ভাবে উদ্যোক্তার সুনাম বৃদ্ধি পাবে, বাজারের এলাকা বাড়বে এবং ব্যবসায় সফলতা আসবে। বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে এর মার্ক ব্যবহার করা বা সার্টিফিকেট প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সার্টিফিকেট গ্রহণ করে তা ক্রেতা বা ভোক্তার কাছে প্রদর্শণের মাধ্যমে পণ্যের মান নিশ্চিত করা যায়।
বিপণন ও প্রচার
উৎপাদিত ফলের বিপণনের জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। জেলা ও উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের কাছে ফলের প্রাপ্যতা ও গুণগত মান সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। সম্ভব হলে নিজ উদ্যোগে বিক্রয় কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। যদি সম্ভব না হয় তাহলে ফল ব্যবসায়ীদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সেখানে পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের প্রচলিত প্রচার মাধ্যমগুলোকে প্রচারের কাজে লাগাতে হবে। অনলাইন ও অফলাইন মাধ্যমে প্রচার করতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রচারেই প্রসার।
পরিশেষে বলা যায়, নতুন কোন উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে আলোচিত সকল বিষয় বিবেচনায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করলে অবশ্যই সেই উদ্যোগ/ব্যবসা লাভজনক হবে এবং কৃষক বা উদ্যোক্তা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। উদ্যোক্তাদের ছোট ছোট উদ্যোগ সফল হলেই দেশের কৃষি ভিত্তি আরও শক্ত ও মজবুত হবে এবং জিডিপিতে আরও বেশি অবদান রাখবে।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বারি, গাজীপুর , মোবাইল- ০১৭১২১৫৭৯৮৯  ই-মেইল :sorofu@yahoo.com

বিস্তারিত
কাঁঠালের-ফল-ছিদ্রকারী-পোকা-দমন-ব্যবস্থা-প্রযুক্তি

কাঁঠালের ফল ছিদ্রকারী পোকা দমন ব্যবস্থা প্রযুক্তি
ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ১ মোঃ মেহেদী হাসান শরীফ২
কাঁঠাল বাংলাদেশের জাতীয় ফল। আকারের দিক থেকে কাঁঠাল সবচেয়ে বড় ফল। বাংলাদেশের সব জেলাতেই কাঁঠালের চাষ হয়, তবে ঢাকার উঁচু অঞ্চল, সাভার, ভালুকা, ভাওয়াল ও মধুপুর গড়, বৃহত্তর সিলেট জেলার পাহাড়ি এলাকা, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি এলাকায় সর্বাধিক পরিমাণে কাঁঠাল উৎপন্ন হয়। কাঁঠালে প্রচুর পরিমাণে শর্করা, আমিষ ও ভিটামিন ‘এ’ রয়েছে। দামের তুলনায় এত বেশি পুষ্টি উপাদান আর কোন ফলে পাওয়া যায় না। কাঁচা ফল তরকারি, পাকলে ফল হিসেবে এবং বীজ, ময়দা ও তরকারি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বীজ ভেজেও খাওয়া যায়।
কাঁঠালের এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকা মাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণের কারণে এর উৎপাদন ও বিদেশের বাজারে রপ্তানি ব্যাপকভাবে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। কাঁঠালের কিছু প্রধান ক্ষতিকর পোকার মধ্যে একটি হলো কাঁঠালের ফল ছিদ্রকারী পোকা। নিচে এই পোকা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
কাঁঠালের ফল ছিদ্রকারী পোকা 
পোকা চেনার উপায় : পূর্ণাঙ্গ মথের রঙ হালকা বাদামি; পাখার উপর পর্যায়ক্রমে গাঢ় বাদামি ছোট ছোট দাগ দেখা যায়; কীড়ার দেহের প্রতি খ-ে পশম বা শুঁয়া আছে; কীড়া দেখতে ধূসর বর্ণের যা ফলের আক্রান্ত অংশে পাওয়া যায় ও ক্ষতি করে।
আক্রমণের পর্যায় : ফলের বাড়ন্ত পর্যায় আক্রমণ হয়। ফেব্রুয়ারি-জুন মাসে সাধারণত এই পোকার আক্রমণ দেখা যায়। পোকা ফলের যে কোন স্থানে আক্রমণ করতে পারে। তবে বিশেষ করে ফলের বোঁটায় কিংবা দু’টি ফলের সংযোগ স্থানে আক্রমণের প্রকোপ বেশি দেখা যায়।
কাঁঠালের ফল ছিদ্রকারী পোকার জীবনচক্র
ডিম অবস্থায় : প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী পোকার ডিম পাড়ার মাধ্যমে জীবনচক্র শুরু হয়। এই ডিমগুলো সাধারণত কাঁঠাল ফলের পৃষ্ঠে বা বাঁকলের ফাটলে পাড়ে; ডিমগুলো ছোট, ডিম্বাকার আকৃতির এবং সাদা-হলুদ রঙের হয়।
লার্ভা অবস্থায় : প্রায় ৫-৭ দিনের ইনকিউবেশন পিরিয়ডের পর ডিম থেকে লার্ভা হয়; লার্ভা কাঁঠাল গাছের ফল বা কা-ে প্রবেশ করে এবং ভেতরে খাবার খায়; লার্ভা বাদামি মাথার ক্যাপসুলসহ ক্রিমি-সাদা রঙের হয়; তারা ফলের সজ্জার মধ্য দিয়ে সুড়ঙ্গ করে, ফলে ক্ষতি করে এবং ফলের গুণমান হ্রাস করে।
পিউপা অবস্থায় : লার্ভা পরিণত অবস্থায় পৌঁছানোর পরে, তারা গাছ থেকে বেরিয়ে যায় এবং মাটিতে বা গাছের গোঁড়ার চারপাশে পুত্তলি দশা সম্পূর্ণ করে; পুত্তলি পর্যায় প্রায় ১০-১৪ দিন স্থায়ী হয়; পুত্তলি সাধারণত মাটির পৃষ্ঠের ঠিক নিচে লার্ভা দ্বারা নির্মিত মাটির কোষগুলোতে পাওয়া যায়।
প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় : পুত্তলি পর্যায় শেষ করার পর, পূর্ণবয়স্ক পোকা মাটি থেকে বের হয়; প্রাপ্তবয়স্ক কাঁঠাল পোকা গাঢ় বাদামি থেকে কালো পোকা হয় যাদের ডানার উপর স্বতন্ত্র চিহ্ন থাকে; এরা নিশাচর এবং রাতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে; প্রাপ্তবয়স্ক পোকা কাঁঠাল গাছের পাতা এবং কোমল কা- খায়; পরবর্তী প্রজন্ম শুরু করার জন্য তারা সঙ্গী এবং স্ত্রীরাও ডিম পাড়ে।
প্রজনন চক্র : কাঁঠাল পোকার প্রজনন চক্র সাধারণত উপযুক্ত হোস্টে (কাঁঠাল গাছ) প্রাপ্যতা এবং তাদের বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশগত অবস্থার সাথে মিলে যায়; অনুকূল পরিস্থিতিতে কাঁঠাল পোকা এক বছরের একাধিক প্রজন্মের মধ্য দিয়ে যেতে পারে।
কাঁঠাল পোকার জীবনচক্র বিভিন্ন পরিবেশগত কারণ যেমন : তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাত দ্বারা প্রভাবিত হয়; উষ্ণতাপমাত্রা এবং উচ্চআর্দ্রতা সাধারণত তাদের বিকাশের জন্য অনুকূল; তবে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত বা জলাবদ্ধতা তাদের বেঁচে থাকার প্রতি বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
ক্ষতির লক্ষণসমূহ : এ পোকার আক্রমণে ফল ছিদ্র, ছিদ্রে পোকার মল ও কালো দাগ দেখা যায়। ফল কাটলে ভেতরে কীড়া দেখা যায়; এ পোকার কীড়া বাড়ন্ত ফলের গা ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে এবং শাঁস খেতে থাকে; আক্রান্ত ফল বেঁকে যায় বা ফেটে যায় এবং বৃষ্টির পানি ঢুকে ফল নষ্ট হয়ে যায়।
দমন ব্যবস্থাপনা
ব্যাগিং পদ্ধতি : পরাগায়ন শেষ হয়েছে এমন ফলে পাতলা পুরাতন কিংবা নতুন যে কোন পাতলা কাপড় দ্বারা আবৃত (ব্যাগিং) করে রাখলে এ পোকা আর ফলের গায়ে ডিম দিতে পারে না এবং ফল আক্রান্ত হয় না। তবে মনে রাখতে হবে পরাগায়নের পূর্বে কোন ফলে ব্যাগিং করা যাবে না এবং একমাস পর তা খুলে দিতে হবে। এক্ষেত্রে সব ফলকে একই সময় ব্যাগিং করতে হবে এমন নয়। যখন যে ফলের পরাগায়ন শেষ হবে তখন সেই ফলকে ব্যাগিং করা যেতে পারে। এ পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব ও অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চাষ পদ্ধতি : পূর্ণাঙ্গ স্ত্রীপোকা কচি ফলের গায়ে, কাঁঠাল জন্মানো উপযোগী কচি শাখার ডগায় এবং ফুলের কুঁড়িতে ডিম পাড়ে। এসময় ডিম থেকে সদ্য বের হওয়া কীড়ার কিছু সংখ্যক সুস্থ ফলকে আক্রমণ করে এবং কিছু সংখ্যক আক্রমণ শেষে বাড়ন্ত ফলের আশে-পাশের শুকনো অবশিষ্টাংশ ইত্যাদিতে লুকিয়ে থাকে। এসকল আবর্জনা পরিষ্কার করে ফেললে পোকার আক্রমণ শতকরা ৯০ ভাগ কমানো যায়। এ ছাড়া ফল একবার আক্রান্ত হয়ে গেলে তা শনাক্ত করে একটি সরু কাঠির সাহায্যে খুঁচিয়ে কীড়া বের করে মেরে ফেলা। আক্রান্ত অংশ ভালোভাবে পরিষ্কার করে দিলে ঐ অংশ সুস্থ হয়ে উঠে। এ পদ্ধতিও পরিবেশবান্ধব ও অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী।
নিমতেল স্প্রে দ্বারা দমন : সাধারণত জানুয়ারি মাসে কাঁঠাল গাছে ফুল আসার সাথে সাথে এ পোকা ডিম পাড়ে। এসময় কাঁঠালের মুচি বের হওয়ার পূর্বে একবার, ৫০ ভাগ ফুল ফোটার পর বা ২০ দিন অন্তর আর একবার এবং ১০০ ভাগ ফুল ফোটার পর বা ৪০ দিন অন্তর আরও একবার মোট তিনবার ১০ মিলি নিম তেল ও ৫ মিলি মিনি স্যাম্পু ১ লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে কাঁঠাল গাছের ফলে স্প্রে করলে এ পোকা দমন করা সম্ভব।
কীটনাশক স্প্রে : সাধারণত কাঁঠালে কীটনাশকের ব্যবহার হয় না। কারণ কীটনাশকের ব্যবহার পরাগায়নে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে এবং যা পরিবেশবান্ধব নয়। এতদসত্ত্বেও যদি কেউ কীটনাশক ব্যবহার করতে চান তবে সবিক্রন ৪২৫ ইসি ২মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে কাঁঠালের মুচি বের হওয়ার পূর্বে একবার, ৫০ ভাগ ফুল ফোটার পর বা ২০ দিন অন্তর একবার এবং ১০০ ভাগ ফুল ফোটার পর বা ৪০ দিন অন্তর আরও একবার মোট তিনবার স্প্রে করলে ৮০-৯০ ভাগ পর্যন্ত এ পোকা দমন করা সম্ভব।
এছাড়াও আক্রান্ত মঞ্জুরি ও ফল সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলা; ফল বেশি ঘন থাকলে পাতলা করে দেওয়া; ছিদ্র দিয়ে বড় সুচ বা লোহার রড ঢুকিয়ে পোকা মেরে ফেলা; চিকন রড দিয়ে ছিদ্র পরিষ্কার করে এর অভ্যন্তরে কেরোসিন, পেট্রোল বা উদ্বায়ী কীটনাশক সিরিঞ্জের মাধ্যমে ঢুকিয়ে কাদা বা মোম দিয়ে ছিদ্রপথ বন্ধ করে দিলে অভ্যন্তরে ধোঁয়া সৃষ্টি হয় এবং পোকা মারা যায়; গর্তের মুখে প্যারাডাইক্লোরোবেনজিন প্রবেশ করিয়ে মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে; সিরিঞ্জের মাধ্যমে কেরোসিন মিশ্রিত পানি বা কীটনাশক মিশ্রিত পানি ছিদ্রের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে ছিদ্রের মুখ কাদা মাটি দিয়ে লেপে দিলে ভেতরে অবস্থিত পোকা মারা যাবে; সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক ২ মি.লি/লি হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা; সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমন: কট বা রিপকর্ড বা সিমবুস বা ফেনম বা আরিভো ১০ ইসি ১০ মিলিলিটার) প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পরপর ২-৩ বার পুরো গাছে স্প্রে করুন; ফুল আসার সময় সুমিথিয়ন বা ডায়াজিনন ৬০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে মিশিয়ে ১০ দিনে অন্তত   ২-৩ বার স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়।
সাবধাণতা ও করণীয় : স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সেই ফল খাওয়া ও বিক্রি করা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন; ফল সংগ্রহ করা শেষ হবার পর প্রতিটি গাছের ফলের বোঁটা, মরা ডাল বা রোগ বা পোকা আক্রান্ত পাতা ও ডাল অপসারণ করে অনুমোদিত একটি ছত্রাকনাশক ও একটি কীটনাশক স্প্রে করে দিতে হবে; বাগান/গাছ সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা প্রয়োজন; ফল সংগ্রহ শেষে মরা ডালপালা, ফলের বোঁটা, রোগ বা পোকা আক্রান্ত ডাল পালা ও অতিঘন ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে। ঝরে পড়া কাঁঠাল সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। কাঁঠালের সংখ্যা বেশি হলে পাতলা করে দিলে ফল বড় হয়। পাশাপাশি লেগে থাকা দুটি কাঁঠালকে কাঠি দিয়ে ফাঁকা করে দিতে হবে। প্রাথমিকভাবে ছিদ্রে শিক বা বড় সুই ঢুকিয়ে খুঁচিয়ে ভেতরের পোকা মেরে ফেলা যায়।
ওয়ান কান্ট্রি ওয়ান প্রায়োরিটি প্রোডাক্টের উদ্যোগে কাঁঠাল উৎপাদনের প্রচার এবং এর রপ্তানি সম্ভাবনা অন্বেষণে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। এ ছাড়াও দেশে ওসিওপি বাস্তবায়নের তত্ত্বাবধানে ও সুবিধার্থে একটি জাতীয় টাস্ক ফোর্স প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং কাঁঠালের মূল্য শৃঙ্খল বিশ্লেষণ,কৃষকদের জন্য সক্ষমতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ, এফসিভি দ্বারা অর্থায়িত একটি বৈশ্বিক প্রকল্প এবং একটি টিসিপি প্রকল্পসহ বেশ কিছু কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

লেখক : ১অধ্যাপক ল্যাবরেটরি অব অ্যাপ্লাইড এন্টোমলজি এন্ড একারোলজি, ২শিক্ষার্থী (এমএস), কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২। মোবাইল : ০১৭১১৪৫২৪৯৬। ই-মেইল :ullahipm@bau.edu.bd

বিস্তারিত
দেহের-রোগ-প্রতিরোধ-ক্ষমতা-বৃদ্ধিতে-ফলমূলের-পুষ্টি-গুণাগুণ

দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ফলমূলের পুষ্টি গুণাগুণ
তাসনীমা মাহজাবীন
আমাদের দেশে সারাবছরই কোন না কোন ফল পাওয়া যায়। বিভিন্ন প্রাকৃতিক পুষ্টি উপাদানে ভরপুর এসব ফল দেহকে সুস্থ রাখতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। ফলমূল ভিটামিন, খনিজ উপাদান  আঁশ  এবং পানির  উৎকৃষ্ট উৎস। আমাদের  অনেকেরই  ধারণা পুষ্টিকর ফল বলতে দামি বা বিদেশী ফল খেতে হবে কিন্তু তা একেবারেই ভুল। আমাদের দেশে আম, জাম, কাঁঠাল, তাল, লিচু, তরমুজ, সফেদা, বাঙ্গি, জামরুল, পেয়ারা, আমড়া, ডেউয়া ইত্যাদি ফল দেখতে পাওয়া যায়। এসব ফলে রয়েছে নানাবিধ পুষ্টিগুণ। গবেষণায় দেখা যায় দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ফলমূলে বিদ্যমান বিভিন্ন খনিজ, ভিটামিন ও এন্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 
হলুদ, কমলা ও লাল রঙের ফল যেমন আম, জাম, ডেউয়া  কাঁঠাল, তাল, লিচু, তরমুজ ইত্যাদিতে  বিটা ক্যরোটিন, ভিটামন ই  ফোলেট, বিভিন্ন রকমের  এন্টিঅক্সিডেন্ট যেমন ক্যারোটিনয়েড, লাইকোপেন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বিটাক্যারোটিন বা ভিটামিন এ  আমাদের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে। ফলে বিদ্যমান  বিটা ক্যারোটিন এবং ভিটামিন সি রক্তনালীতে চর্বি জমা হতে বাধা দেয় এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। তরমুজে ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে যা হার্টের স্বাস্থ্যকে ভাল রাখে এবং হৃদস্পন্দনকে স্থির রাখতে সাহায্য করে। পেয়ারা এবং আমলকী  ভিটামিন সি এর উল্লেখযোগ্য উৎস। আয়রন জাতীয় খাদ্য গ্রহণের সময় ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল গ্রহণ করলে দেহে আয়রনের পরিশোষণ বৃদ্ধি পায়। 
১০০ গ্রাম পেয়ারাতে ২২৮ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি থাকে, ১০০ গ্রাম আমলকীতে থাকে ৪৩৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি। একজন মানুষের প্রতিদিন ভিটামিন সি’ প্রয়োজন প্রায় ৭৫ মিলিগ্রাম। একটি পেয়ারা বা ২/৩টি আমলকী একদিনের ভিটামিন সি চাহিদা পূরণে যথেষ্ট।  ফলমূলের আঁশ শরীরের বর্জ্য, অতিরিক্ত কোলেস্টেরল এবং কিছু ক্যান্সার উৎপন্নকারী উপাদানকেও অপসারণ করে। প্রতি ১০০ গ্রাম দেশীয় ফলের মধ্যে কালোজাম, পেয়ারা, বেল, আতাফল ইত্যাদিতে ১.৫ থেকে ৫ গ্রাম পর্যন্ত খাদ্য আঁশ পাওয়া যায়। কলা এবং ডাবে  প্রচুর পরিমাণ পটাশিয়াম থাকে,  যা শরীরের কোষের ভেতরের পানি ও লবণের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে পাশাপাশি হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখতেও সাহায্য করে। পটাশিয়াম থাকার কারণে এই দুটি ফল গর্ভবতী  মায়েদের জন্য পুষ্টিকর ফল হিসাবে বিবেচিত। এ ছাড়াও বিভিন্ন ফলের পুষ্টি উপাদান সারণি দ্রষ্টব্য।
বিভিন্ন ফল যেমন-আম, জাম, তাল, লিচু, তরমুজ, সফেদায়  পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন যেমন- ভিটামিন বি৬, ফলিক এসিড বা বি৯, থায়ামিন, রিবোফ্লাবিন ইত্যাদি পাওয়া যায়  যা শরীরের বিপাকক্রিয়া ঠিক রাখে, শিশুদের কোষ বৃদ্ধি, বুদ্ধির বিকাশ ইত্যাদিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া শরীরের প্রতিটি কোষ, টিস্যু এবং অঙ্গ সঠিকভাবে কাজ করার জন্য পানির প্রয়োজন হয়।  প্রতিদিন বিভিন্ন বিপাকক্রিয়ার মাধ্যমে শরীর থেকে অনেক  পানি হারায়।  ফলে  ৮০ শতাংশের বেশি পানি থাকায় প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ ফল খেলে পানির প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে পূরণ হয়। 
শিশু এবং কিশোরীদের সুস্বাস্থ্য ধরে রাখতে এবং মেধাবিকাশে প্রত্যেককে প্রতি বেলা খাবারের সাথে ফল খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। এছাড়া পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, গর্ভবতী ও প্রসূতি মাকে অন্তত দিনে তিন থেকে পাঁচ প্রকার রঙিন শাকসবজির মিশ্রণে প্রস্তুত খাবার খাওয়ালে তার খাদ্য বৈচিত্র্য যথার্থ হবে। জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা-২০২০ অনুযায়ী একজন মানুষের প্রতিদিন ৩০০ গ্রাম শাকসবজি ও ১০০ গ্রাম ফল খেতে হবে। এই ফলের মধ্যে একটি টক এবং একটি মিষ্টি উৎস থেকে আসলে ভালো হয়। ফল সাধারণত অন্যান্য খাবার খাওয়ার পরপর খাওয়া ভালো এতে ফলে বিদ্যমান কো-এনজাইম, ভিটানি ইত্যাদি খাবারের পুষ্টি উপাদান এর শোষণ বাড়াতে সাহায্য করে। আমাদের অনেকের ভুল ধারণা আছে যে ফলমূলে ফরমালিন দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়, যেটা সম্পূর্ণ ভুল। ফরমালিন ফলে থাকা উদ্ভিজ্জ আমিষের সাথে বিক্রিয়া করতে পারে না তাই ফলমূল সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ফরমালিন কোন কাজ করে না। তাছাড়া ফলে প্রাকৃতিকভাবেই কিছু ফরমালিন থাকে যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর মাত্রার অনেক নিচে তাই আমরা নিশ্চিন্তে ফল খেতে পারি। ফল বাজার থেকে কেনার পর বাড়িতে এনে প্রথমেই খুব ভালো করে প্রবাহমান পানিতে (ৎঁহহরহম ধিঃবৎ) ধুয়ে নিতে হবে। এতে ফলের  খোসার  সাথে  লেগে থাকা ময়লা বা অন্য  কীটনাশক অনেকাংশে দূর হয়ে যায়।বাড়ির আঙিনা, ছাদ এমনকি বারান্দার টবেও আমরা কিছু ফলের গাছ লাগাতে পারি এবং সব বয়সের মানুষকে দেশীয় মৌসুমি  ফল খেতে উৎসাহিত করতে পারি এতে আমাদের শরীর ও মন দ’টোই ভালো থাকবে। 

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা , বাংলাদেশ  ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (বারটান) 

বিস্তারিত
স্বল্প-ও-মধ্যমেয়াদি-ফল-গাছের-স্মার্ট-সার-প্রযুক্তি
স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি ফল গাছের স্মার্ট সার প্রযুক্তি
ড. মো. সদরুল আমিন
সার প্রয়োগ ও সমন্বিত মাটি-ফসলের সমস্যা ব্যবস্থাপনায় সম্পর্কিত সকল উপকরণ ব্যালেন্স করে ব্যবহার করা, প্রয়োজন প্রতি একক জমিতে ফলন বাড়ানো এবং ফলনের মান বাড়ানোর জন্য স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি ফল গাছের স্মার্ট সার প্রযুক্তি অবলম্বন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রধান প্রধান করণীয় হলো- মাঠ, গাছ, পাতা ফুল-ফলে সমস্যা নিরূপণ করে সুষম সারদ্রব্য তৈরি ও প্রয়োগের সমন্বিত সম্প্রসারণ সুপারিশ দ্বারা কাক্সিক্ষত ফলন অর্জন।
হাইব্রিড ফসলের পুষ্টি চাহিদা বেশি বলে জমিতে সার প্রয়োগ বাড়াতে হচ্ছে। দুই দশক আগে যেখানে ৭-৮টি সার দিয়ে চাষাবাদ হতো, মাটি দুর্বল হওয়ার কারণে মাইক্রোসারসহ প্রায় ১৫-২০ ধরনের সার দিতে হচ্ছে। এতে অধিক দক্ষতার কৃষক লাগছে, ব্যয় বাড়ছে কিন্তু সেই অনুপাতে আয় বাড়ছে না। এখন সার ছাড়া ফসলই হচ্ছে না।
সার প্রয়োগের জরুরি বিষয় : সার প্রয়োগের পর তা মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। জমিতে ছিপছিপে পানি থাকা অবস্থায় ইউরিয়া দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে এ সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। জৈবসার ফসল রোপণের ৭-৮ দিন পূর্বে জমিতে  প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। ফসলের বর্ধনশীল অবস্থায় গৌণ পুষ্টির অভাব দেখা দিলে তা স্প্রে করাই উত্তম। এফএও-এর তথ্য মতে।
সঠিকভাবে ব্যবহার করা না হলে প্রয়োগকৃত ইউরিয়া সারের ৬০-৭০% অপচয় হতে পারে। বছরে বর্ষার অগে পরে ২-৩ বার অণুসার, পিজিআর মিরাকুলান প্রয়োজনমতো স্প্রে করতে হবে।
বয়সভিত্তিতে সারপ্রয়োগের সুপারিশ
বয়সভিত্তিতে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি ফল আম, লিচু, পেয়ারা, সাইট্রাস, কুল, সফেদা, কাঁঠাল প্রধানত কলমের গাছ হয়ে থাকে। এসব গাছের বয়স অনুযায়ী সার প্রয়োগের সুপারিশ সারণি দ্রষ্টব্য। 
সার বছরে মার্চ, জুলাই, অক্টোবরে ২-৩ বারে দিতে হবে। তৈরি যৌগিক সার দিলে লিটারেচার মানতে হবে। স্মার্ট সার (সলুবোর, লিবলের জিংক) বছরে ১ বার ও সাবধানে ন্যানো সার দিতে হবে। 
বর্তমানে বাংলাদেশে এনপিকে সারের পরই ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, দস্তা ও বোরন সারের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে গেছে। ক্যালসিয়াম ঘাটতি সম্পন্ন সম্ভাব্য মাটি : অম্লীয় মাটি, লাল মাটি, বেলে মাটি, চুনহীন ও বাদামি পাহাড়ি মাটি। 
ক্যালসিয়ামের অপুষ্টি লক্ষণ হচ্ছে-গাছের পাতা কুঁকড়ে বা কুঁচকে যায়। পাতা দুই পাশ থেকে মুড়ে হয়ে নৌকার মতো বাঁকা হয়ে যায়; 
ম্যাগনেসিয়াম গাছের ক্লোরোফিলের মূল পরমাণু হিসেবে কাজ করে; ম্যাগনেসিয়াম সার গাছের পাতার আকার বাড়ায়; ফসলের গুণগত মান বৃদ্ধি করে ।
ম্যাগনেসিয়াম সার/চুন ব্যবহার করলে এর অভাব দূর হয়। জমিতে প্রতি হেক্টরে ৪০০-৬০০ কেজি ডলোচুন জমি তৈরির সময় দিতে হয়। ম্যাগনেসিয়াম পাতায় ক্লোরোফিল অণু তৈরি করে। পাতায় আন্তঃশিরা ক্লেরোসিস লক্ষণ দেখা যায়।
উপস্থিত মাটি পরীক্ষা করেও সারের প্রকার ও পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা করা যায়। বর্ণিত স্মার্ট পদ্ধতিতে জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করে অন্তত ২০% ফলন বেশি পাওয়া যাবে এবং সার্বিক সার ব্যয় সমহারে কমে যাবে। 
লেখক: প্রফেসর (সাবেক), হাজী দানেশ মোহাম্মদ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, দিনাজপুর। মোবাইল : ০১৩২১২১৬১১৩
বিস্তারিত
আম-রফতানি-এবং-আর্থসামাজিক-ভাবনা
আম রফতানি এবং আর্থসামাজিক ভাবনা
মোহাম্মদ আরিফুর রহমান
বউভুলানী, জামাইপছন্দ শব্দগুলো শুনতেই কেমন যেন চটুলভাব জাগে। একটু হালকা আমেজ, রসালোভাব। প্রকৃত অর্থে এটি রসালো ফল আমেরই জাতের নাম। অনেকেই আমকে ফলের রাজা বলে অভিহিত করেন। স্বাদ, গন্ধে ও পুষ্টিতে অতুলনীয়। আম অর্থ সাধারণ। বাংলাদেশে আম জনসাধারণের অত্যন্ত জনপ্রিয় ফল। রসাল বা মধু ফলও বলা হয় আমকে।  অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সুস্বাদু আমকে জাতীয় ফল হিসেবে এশিয়া মহাদেশের তিনটি দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তানের পাশাপাশি ফিলিপাইনের জাতীয় ফল আম। বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে আম গাছকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। 
আমের অর্থনীতি
আমের আছে বাহারি নাম, বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদ। ফজলি, আশ্বিনা, ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাতি, গোপালভোগ, মোহনভোগসহ রয়েছে অসংখ্য জাতের আম। ধারণা করা হয় প্রায় ৩০০ জাতের আমের দেখা মেলে। তবে অনেকগুলো এখন বিলুপ্তপ্রায়। প্রত্যেকটি জাতের সাথে আছে এক একটি ইতিহাস, যেমন ফজল বিবি থেকে ফজলি। 
বিশ্বে ৫৩টি দেশে আম উৎপাদন হয়। বাংলাদেশ উৎপাদনের দিক থেকে ৯ম অবস্থানে রয়েছে (এফএও, ২০২২)। দেশে বছরে ২৪-২৫ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়। আমের মৌসুমে আম সংগ্রহ, পরিবহন, প্যাকেজিং এর সাথে জড়িত কর্মকা-ের সাথে জড়িয়ে আছে ব্যাংকিং লেনদেন। পাশাপাশি আম সংগ্রহের মৌসুমে কানসাট, বানেশ্বর, সাপাহারসহ স্থানীয় আড়তে হোটেল রেস্টুরেন্ট ব্যবসা থেকে শুরু করে অসংখ্য মৌসুমি লেবার বা ব্যক্তিবর্গ এর সাথে জড়িত। দেশে ১৩-১৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য আমকেন্দ্রিক হয়।
আম রফতানি
বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে আম উৎপাদন হলেও খুব সামান্য পরিমাণে আম রফতানি হয়। বিগত ৫ বছরে আম রফতানির চিত্র হতে দেখা যায় ২০১৯ সালে আম রফতানির পরিমাণ ২৮৩ মেট্রিক টন হলেও চলতি বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ৯১ মেট্রিক টন। ৫ বছরের রফতানির পরিমাণ প্রায় দশগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে উৎপাদিত ৭২টি জাতের মধ্যে ৮-৯টি জাতের আম রফতানি হচ্ছে। 
উত্তম কৃষি চর্চার মাধ্যমে আম উৎপাদন
খাদ্যাভাসের ব্যাপারে মানুষ দিন দিন সচেতন হচ্ছে। নিরাপদ খাদ্য গ্রহণে মানুষ আগ্রহী। নিরাপদ খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি মানুষ খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া জানতে চায়। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের একটি জনপ্রিয় প্রযুক্তি উত্তম কৃষি চর্চা (এড়ড়ফ অমৎরপঁষঃঁৎধষ চৎধপঃরপব)। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার উত্তম কৃষি চর্চা নীতিমালা-২০২০ অনুমোদন করেছে। বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চা নীতিমালার আলোকে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে ২৪৬টি প্যারামিটার অনুসরণ করে থাকে। ২০২২ সাল হতে মাঠপর্যায়ে আম ফসলে উত্তম কৃষি চর্চার প্রয়োগ হচ্ছে। সরকারিপর্যায়ে রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের আওতায় উত্তম কৃষি চর্চা প্রয়োগের জন্য ৮৪০০টি প্রদর্শনী স্থাপনের মাধ্যমে কৃষকদের হাতে কলমে নিরাপদ আম উৎপাদন কৌশল শিখানো হচ্ছে, যা বিদেশে আম রফতানি সম্পর্কে আগ্রহ বাড়াচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় নিরাপদ আম উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে উত্তম কৃষি চর্চা বিষয়ে কৃষক, রফতানিকারক এবং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।  
আম রফতানি ক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যা
বিশ্বে আম রফতানির বাজারটি বেশ প্রতিযোগিতামূলক। আন্তর্জাতিক বাজারে আম রফতানির ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এর পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির প্রধান শর্ত হলো আমদানিকারক দেশসমূহের চাহিদা অনুসারে মানসম্পন্ন আম উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। বাংলাদেশে আম রফতানির যেসকল প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তাহলো-
 পরিকল্পিতভাবে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে মানসম্পন্ন নিরাপদ আম উৎপাদন না করা;
 পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও জীবাণুমুক্ত স্বাস্থ্যকর পরিবেশে আম উৎপাদন ও উন্নত সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আমদানিকারক দেশের আরোপিত শর্তাবলী পূরণ না করা;
 রফতানিযোগ্য উন্নত আম উৎপাদন, বিপণনের ক্ষেত্রে ভ্যালুচেইনের সাথে সংশ্লিষ্ট আম উৎপাদনকারী, সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, কোয়ারেন্টাইন, গবেষক এবং রফতানিকারকদের সমন্বয়ের অভাব;
 আম সংগ্রহের পর আমের গুণগত মান বজায় রেখে যথাযথভাবে গ্রেডিং, প্যাকিং করে কুলিং ভ্যানের মাধ্যমে আম পরিবহন না করা;
 আমে উপস্থিত পেস্টিসাইডের রেসিডিউ এনালাইসিস ও ফলের গুণগত মান পরীক্ষার জন্য অ্যাক্রিডিটেশন ল্যাব না থাকা;
 আম উৎপাদনের সাথে প্রয়োজনীয় উপকরণ ফ্রুুট ব্যাগ ও অন্যান্য উপকরণসহ এয়ার ফেয়ার এর কারণে প্রতিযোগিতামূলক বাজারের সাথে প্রতিযোগিতা করার মানসিকতার অভাব; 
 সেলফ লাইফ কম, সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে যথাযথ প্রযুক্তি ও কৌশল ব্যবহার না করা এবং সংগ্রহ পর্যায় শনাক্তকরণের অভাব;
 নতুন বাজার সৃষ্টি করতে না পারা, ব্রান্ডিং ইমেজ তৈরি না করা;
 উৎপাদন এলাকায় আধুনিক প্যাকিং হাউজ এর সুযোগ-সুবিধার অভাব;
 রফতানিযোগ্য আম উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার, কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও সমন্বয়ের অভাব;
 আমের উন্নত সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কোয়ারেন্টাইন পেস্ট নিয়ন্ত্রণে সেন্সর বেইজড হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, ভিএইচটিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, অবকাঠামো ও উন্নত প্রযুক্তির অভাব;
 ট্রেসিবিলিটি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে রেকর্ড কিপিং যথাযথভাবে না করা।
আম রফতানি বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
আম রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যেসকল সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করা হয়েছে সেসকল সমস্যাসমূহ সমাধানকল্পে নি¤েœাক্ত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
 প্রধান প্রধান আম উৎপাদন অঞ্চল চিহ্নিত করা ও উৎপাদনের পদক্ষেপ গ্রহণ;
 কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর মাধ্যমে উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে আম উৎপাদন;
 জীবাণুমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্ম পরিবেশ নিশ্চিতকরণ;
 ফার্ম রেকর্ড বইয়ে যাবতীয় ডাটা লিপিবদ্ধকরণ;
 গবেষণা কার্যক্রম জোরদারকরণ;
 আধুনিক প্যাকিং হাউজ স্থাপন;
 আম সংগ্রহ, সংগ্রহোত্তর কাজ এবং পরিবহনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা।
সামগ্রিক বিবেচনায় খোরপোশ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরে যে ধারা চলমান রয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় বাণিজ্যনির্ভর আমকে রফতানি বাণিজ্যে সম্পৃক্ত করার সরকারের নীতিগত উদ্যোগের ফলে এই শিল্পের ক্রমবিকাশ অবশ্যম্ভাবী। দেশের ঐতিহ্য সুস্বাদু আম রফতানির লক্ষ্যে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিরাপদ ও উচ্চ মানসম্পন্ন আম উৎপাদন করা সম্ভব হবে। সম্ভাবনাময় আম রফতানি বাণিজ্য বৃদ্ধির সাথে সাথে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।  
 
লেখক : প্রকল্প পরিচালক, রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্প, মোবাইল : ০১৮১৯৪৫৭৫৭৪, ই-মেইল : ঃamrahman46@gmail.com
বিস্তারিত
প্রক্রিয়াজাতকৃত-ফলমূল-ও-সবজি-সম্ভাবনার-এক-নবদিগন্ত

প্রক্রিয়াজাতকৃত ফলমূল ও সবজি 
সম্ভাবনার এক নবদিগন্ত
ড. শাহনাজ পারভীন১ ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী২
সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য আমাদের পুষ্টিকর খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করা প্রয়োজন। কারণ প্রয়োজনীয় পুষ্টি ব্যতীত কেউ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারে না। আবার দুর্বল পুষ্টিহীন ব্যক্তি সমাজে ও পরিবারে কোন অবদান রাখতে পারে না। স্বাস্থ্য যেমন- সকল সুখের মূল, একইভাবে পুষ্টি হল জাতির উন্নতির মূল চাবিকাঠি। ফলমূল ও শাকসবজি আমাদের শরীরের পুষ্টি উপাদান বিশেষ করে ভিটামিন ও খণিজ লবণের প্রধান উৎস। বাংলাদেশে পুষ্টি, আর্থিক ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় ফলমুল ও শাকসবজি আমাদের দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও/ডব্লিউএইচও, ২০১৪) সুপারিশ অনুযায়ী একজন মানুষের গড়ে প্রতিদিন ৪০০ গ্রাম ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমরা দৈনন্দিন প্রায় ২০৮ কিলোক্যালরি পরিমাণ ফলমূল ও শাকসবজি (বিবিএস, ২০১৮) খেয়ে থাকি যা প্রায় অর্ধেক পরিমাণ। যেমন-প্রস্তাবিত সবজির প্রাপ্যতা প্রতিজনের জন্য দৈনিক ২০০ গ্রাম, যা আছে প্রয়োজনের মাত্র ১/৫ ভাগ। অন্যদিকে যে পরিমাণ শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদিত হচ্ছে তার একটা বিরাট অংশ সংগ্রহের পর বিভিন্ন পর্যায়ে অপচয় হচেছ। এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, আমাদের দেশের উৎপাদিত ফলমূল ও সবজির অপচয় হচেছ মোট উৎপাদনের শকরা ২৫-৪০ ভাগ। এছাড়াও এসব ফসলের সংগ্রহোত্তর গুণগত অপচয়ের পরিমাণও অনেক বেশি। ভরা মৌসুমেও ফল ও সবজির অপচয় বেশী, আবার ঐ সময়ে ফল ও সবজির দামও অনেক কম থাকে এবং চাষিরা তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় না। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ বেশী হয়ে দাঁড়ায়। ফলে চাষিরা ঐ সব ফসল উৎপাদনে মনোবল হারিয়ে ফেলে অপচয়ের কারণে একদিকে যেমন- চাষিরা তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অন্যদিকে দেশবাসীও বঞ্চিত হচ্ছে পুষ্টির বিভিন্ন উপাদান থেকে। 
খাদ্যদ্রব্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে ফল ও সবজি ও তৎজাত দ্রব্যগুলোকে কোন এক বিশেষ সময়ের জন্য যেকোনরূপ পচন ক্রিয়ার হাত থেকে রক্ষা করে গ্রহণযোগ্য অবস্থায় রাখা যায়। বর্তমানে উৎপাদিত ফল ও সবজির মাত্র শতকরা ১ ভাগ দেশের শিল্প কারখানায় প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়। গ্রামের লোকজনদেরকে প্রক্রিয়াজাতকরণের উপর প্রশিক্ষণ দিতে পারলে একদিকে যেমন ফলও সবজির অপচয় রোধ হবে অন্যদিকে ফল ও সবজির পুষ্টিও সংরক্ষণ হবে এবং প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করে গ্রামীণ লোকজন তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘঠাতে পারবে। 
ফ্রিজিং হলো প্রক্রিয়াজাতকরণের অন্যতম একটি পদ্ধতি যা দ্রুত এবং সুবিধাজনক উপায় বাসা-বাড়ীতে বাড়িতে অনায়াসে পরিচর্যার মাধ্যমে ফলমুল এবং সবজি সংরক্ষণ সংরক্ষণ করা যায়। এই প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য হল ফলমুল ও শাকসবজির পুষ্টি উপাদান উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন না করেই এর মধ্যে থাকা অণুজীব বা ব্যাকটেরিয়াগুলোর সমস্ত কার্যকলাপকে নির্মূল করা যা ফলমুল ও শাকসবজিকে নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করে। সাধারণভাবে, হিমায়িত ফল এবং সবজি ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণ এবং খনিজ ধরে রাখে এবং শর্করা, প্রোটিন সামগ্রীতে কোন পরিবর্তন হয় না। কিছু ক্ষেত্রে, হিমায়িত ফল এবং সবজিতে তাজা ফল এবং সবজি অপেক্ষা বেশি ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান বিদ্যমান থাকে। কারণ তাজা ফল এবং সবজি সময়ের সাথে সাথে ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান হারাতে থাকে। ফ্রোজেন খাবারের পুরো বিশে^ চাহিদা ও বিপণন ব্যবস্থা রয়েছে এবং এটি দিন দিন রেডি-টু-কুক ও রেডি-টু-ইট হিসেবে ব্যাপক বৃদ্ধি পাচ্ছে। 
ফল ও সবজি নূণ্যতম প্রক্রিয়াজাতকৃত বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী সুপারশপ ও বিপণিবিতানে রেডি-টু-কুক, রেডি-টু-ইট, রেডি-টু-সার্ভ, ফ্রোজেন ফ্রেশ-কাট ইত্যাদি নামে পাওয়া যা মানুষের কর্মব্যস্ততায় খুবই সহায়ক। নিউভিশন সল্যুসন্স লিমিটেড (কেজিএফ পিসিআর প্রতিবেদন, ২০২৩) এর এক গবেষণা প্রতিবেদন এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, দেশে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের বিপণন প্রায় ৪১,০০০ কোটি টাকা এবং তার মধ্যে ফ্রোজেন খাবারের বিপণন ২০০০ কোটি টাকা। দেশে গোল্ডেন হার্ভেস্ট এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, প্রাণ আরএফ-এল গ্রুপ লি., মেক কেইন ফুড্স, এজি এগ্রো ফুড্স লি., কাজি ফার্মস গ্রুপ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ফলমুল ও শাক-সবজির ফ্রোজেন খাদ্যদ্রব্য তৈরি করছে এবং দেশে বিপণনের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করছে। খাদ্যদ্রব্যগুলো সাধারণত: আইকিউএফ এর মাধ্যমে হিমায়িত করে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ করে থাকে। বিএআরআই এর পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ হিমায়িত ফলমুল ও শাকসবজি সংরক্ষণের কিছু প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলো প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী, তথ্য বিনিময়সহ বিভিন্ন প্রযুক্তি হস্তান্তর কার্যক্রমের মাধ্যমে আগ্রহী ব্যক্তিবর্গ এবং উদ্যোক্তা মাঝে বিস্তার লাভ করছে।
কাঁচা কাঁঠালের ভেজিটেবল মিট
কাঁচা কাঁঠালের ভেজিটেবল মিট তৈরির জন্য অপরিপক্ব সতেজ, ত্রুটিমুক্ত ৫-৬ সপ্তাহের কচি কাঁচা কাঁঠাল সংগ্রহ করতে হবে। এখন ধারালো স্টেইনলেস স্টীলের (এসএস) চাকু/বটির সাহায্যে লম্বালম্বিভাবে কেটে টুকরো টুকরো করতে হবে। অতঃপর একটি প্লাস্টিক বোল/সসপেনে ১ লিটার পানিতে ৬৫০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম মেটাবাইসালফাইট (কেএমএস) যুক্ত করে টুকরোগুলো ৫ মিনিট কিছুক্ষণ রাখতে হবে। অতঃপর একটি পাত্রে পানি নিয়ে ৯৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় গরম করে কাঁঠালের ছোট টুকরোগুলো উক্ত গরম পানিতে ৫-৭ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে যাকে ব্লাঞ্চিং করা বলা হয়। এখন গরম পানি থেকে কাঁঠালের টুকরোগুলো উঠিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিতে কিছুক্ষণ রাখতে হবে। টুকরোগুলো থেকে পানি নিংড়িয়ে ৫০-৬০ মাইক্রনের এইচডিপিই মোড়কে ভর্তি করে বায়ুশূন্য (ভ্যাকুয়াম) করতে হবে এবং মোড়কের মুখ বন্ধ করতে হবে। এভাবে প্রস্তুতকৃত কাঁঠালের টুকরো ডিপ ফ্রিজে ৬-৮ মাস পর্যন্ত গুণগতমান বজায় রেখে অনায়াসে সংরক্ষণ করা যায় যা পরবর্তীতে ভেজিটেবল মিট বা বহুমুখী খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
এনজাইম নিষ্ক্রিয়করণের মাধ্যমে গাজরের সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি
শক্ত, পরিপক্ব এবং তাজা গাজর বা রোগমুক্ত গাজর সংগ্রহ করে ভালভাবে পরষ্কিার পানিতে ধুয়ে নিতে হবে। এরপর খোসা ছাড়ানো যন্ত্রের সাহায্যে খোসা ছাড়াতে হবে এবং পুনরায় ধৌত করতে হবে। খোসা ছাড়ানো গাজরটিকে ১০ মিমি টুকরো টুকরো করে কাটতে হবে। এরপর ওয়াটার বাথে ৮৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ২ মিনিট ব্লাঞ্চিং করতে হবে। ব্লাঞ্চিং এর পরে  টুকরো গাজর  গুলোকে ট্যাপের পানি দ্বারা ঠান্ডা করতে হবে এবং ভ্যাকুয়াম প্যাকেজিং মেশিনের সাহায্যে প্যাকেটজাত করতে হবে। প্যাকেটজাত গাজর ডিপফ্রিজে -১৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রাখতে হবে। এভাবে প্যাকটেজাত গাজর প্রায় ৩ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। গাজরের গুণাগুণ বজায় রেখে উৎপাদন মৌসুমের পরেও বাংলাদেশের সকল অঞ্চলে অধিক সময় পর্যন্ত গাজর বাজারজাতকরণ সম্ভব হবে। 
এনজাইম নিষ্ক্রিয়করণের মাধ্যমে বরবটির সংরক্ষণকাল বৃদ্ধিকরণ
বরবটির মধ্যে প্রচুর পরিমাণ পুষ্টি বিদ্যমান। বরবটিতে অল্প পরিমাণ ক্যালোরি থাকে এবং ফ্যাট একেবারেই নেই। তবে বরবটিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিক্যানসার উপাদান। ফলে তা শরীরের একাধিক কাজে লাগে। রোগমুক্ত বরবটি সংগ্রহ করে ভালভাবে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নিতে হবে । এরপর ৩ সেমি সাইজে লম্বা করে কেটে পুনরায় ধৌত করতে হবে। এখন ৯৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ২ মিনিট ব্লাঞ্চিং করতে হবে। ব্লাঞ্চিং এর পরে ট্যাপের পানি দ্বারা ঠান্ডা করতে হবে এবং ভ্যাকুয়াম প্যাকেজিং মেশিনের সাহায্য মোড়কজাত করতে হবে। মোড়কজাতকৃত বরবটি ডিপফ্রিজে -১৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রেখে গুণগতমান বজায় রাখা যায়। এভাবে মোড়কজাতকৃত বরবটি ছয় মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায় ।
উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের গুণগতমাণ ও সংরক্ষণ সময় বৃদ্ধিতে মাইক্রোইমালশন প্রযুক্তির ব্যবহার (ভক্ষণযোগ্য মোমের প্রলেপ বা ওয়াক্স কোটিং) অত্যাবশ্যক। প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও কার্বনডাই অক্সাইড গ্যাস বিনিময়ের মাধ্যমে ফলমুলকে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ সময় বাড়ানো ও গুণগতমান বজায় রেখে উৎকর্ষসাধন করে ক্রেতার নিকট আর্কষণ করা অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। বিদেশ থেকে আমদানি করা কমলা, মাল্টা, জাম্বুরা, আপেলসহ অন্যান্য ফলমূল এ প্রয়োগ আমাদের চোখে পড়ে। আবার ন্যানো প্যাকেজিং এর ব্যবহার মোড়কজাতকরণে নব দিগন্তের সূচনা করেছে যা ফলমূলের সতেজতা ও গুণগতমান বজায় রাখার নির্দেশক হিসেবে কাজ করছে। ফলমূল পরিবহণে কার্টুন বা ক্রেট্সে ভর্তির পূর্বে এর ব্যবহার করা হলে উপকারী বেনিফিসিয়াল মডিফাইড এটমসফিয়ার তৈরি করবে যা ফলমূলের শ^সন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ ও যথাযথ রাখবে। এতে করে সতেজতা বজায় রাখা সম্ভব হবে। প্রক্রিয়াজাতকৃত কৃষি পণ্য রপ্তানি করে দেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে। বিএআরআই এর পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নিম্নবর্ণিত রপ্তানিযোগ্য ফলমূলের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে।
কলা 
ক্যাভেন্ডিস জাতের পরিপুষ্ট কলা অ্যালাম (২০ গ্রাম/মি.লি.), থায়াবেন্ডাজল (০.৫ গ্রাম/লিটার), ইমিডাজল (০.৫ গ্রাম/লিটার) এবং জিব্রেলিক এসিড (০.০৫ গ্রাম/লিটার) মিশ্রিত দ্রবণে পরিশোধন করে পলিপ্রোপাইলিন মোড়কে ভর্তি করে ১৩ক্ট২ ডিগ্রি সে. এ এবং ৮৫ক্ট৫% আর্দ্রতা ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত অনায়াসে সংরক্ষণ করা যায়। এ প্রক্রিয়ায় কলা পাকার বিভিন্ন পর্যায়গুলো দীর্ঘায়িত করা যায়। আবার পরিপুষ্ট কলা (মেহের সাগর) সংগ্রহ করার পর ছড়া থেকে ৫টি, ৭টি কলা (৪০০ মাইক্রোগ্রাম/লিটার) ১-মিথাইল সাইক্লোপ্রোপেন দ্রবণে ১০ মিনিট রেখে পরে ১% পলিপ্রপাইলিন মোড়কে ২০ক্ট২ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা এবং ৮৫ক্ট৫% আর্দ্রতায় পরিপক্ব অবস্থায় ২০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
আনারাস 
পরিপুষ্ট আনারস (হানিকুইন) সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় সাকারসহ আনারসের উপরিভাগে স্টা-ফ্রেশ মোমের প্রলেপ (৬০ গ্রাম/লিটার) প্রয়োগ করে ১১ক্ট১ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা ও ৮৮ক্ট২% আর্দ্রতায় ৩ সপ্তাহের অধিক সময় গুণগতমান বজায় রেখে অনায়াসে সংরক্ষণ করা যায়। আবার, ১% ছিদ্রযুক্ত পলিপ্রপাইলিন মোড়কে আনারস কোল্ডরুমে রেখে ১১ ডিগ্রি সে. এবং ৮৮ক্ট২% আর্দ্রতায় কোল্ডরুমে ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত সতেজ অবস্থায় সংরক্ষণ করা যাবে। আবার এ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণকৃত আনারসকে বিদেশে জাহাজের মাধ্যমে রপ্তানি করা সম্ভব।
সাইট্রাস ফল 
বাছাইকৃত সাইট্রাস ফল ( লেবু, কমলা, মাল্টা, জাম্বুরা ইত্যাদি) ডিটারজেন্ট পাউডার যুক্ত পানিতে (১০-১২ গ্রাম/লি.) ব্রাশ প্যাডে ১-২ মিনিট ভালভাবে  ধৌত করে কনভেয়ার বেল্ট এর মাধ্যমে ওয়াক্সিং ইউনিটে নিয়ে  ফোম প্যাডে রেখে খাবারযোগ্য মোম (কার্নোবা ওয়াক্স) দিয়ে ফলের উপর ৩০  সেকেন্ড-১ মিনিট পর্যন্ত সমভাবে পুরো ফলের উপরিভাগে প্রলেপ দিতে হবে। অতঃপর কনভেয়ার  বেল্টের মাধ্যমে ড্রাইং ইউনিটে নিয়ে ৫৫ক্ট২ ডিগ্রি সে. এ গরম বাতাস প্রবাহিত করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় (২৭ক্ট১ ডি.সে.) উৎকর্ষ সাধনসহ ৩-৪ সপ্তাহ অনায়াসে গুণগতমান বজায়  রেখে সংরক্ষণ করা যায়। 

১ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, ই-মেইল: ভবৎফড়ঁং৬১৩@মসধরষ.পড়স, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১। মোবাইল : ০১৭১২২৭১১৬৩

বিস্তারিত
প্রচলিত-সারের-তুলনায়-ন্যানো-সারের-উপকারী-প্রভাব
প্রচলিত 
সারের তুলনায় ন্যানো সারের উপকারী প্রভাব
ড. মো: শহিদুল ইসলাম
ক্রমাগত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটির মাইক্রো ফ্লোরা বা উপকারী অণুজীব দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের কার্যক্ষমতা কমে যায়, অনেক সময় তারা মারাও যায়। মাটির রাসায়নিক এবং ভৌতিক গুণাবলি বিনষ্ট হয়, ফলে মাটির উর্বরতা বহুলাংশে হ্রাস পায়। রাসায়নিক সারের ব্যবহার ১৯৫২ সনে ২৬৯৮ টন অ্যামোনিয়াম সালফেটের  মাধ্যমে শুরু হয়ে বর্তমানে তা ৬৬ লক্ষ টনে পৌঁছেছে। এর মাধ্যে ইউরিয়া ২৭ লক্ষ টন, টিএসপি ও ডিএপি মিলে ২৩.৫ লক্ষ টন, মিউরেট অফ পটাশ ১০ লক্ষ টন, জিপসাম ১.৫ লক্ষ টন দস্তা সার ১.৫ লক্ষ টন, বোরণ সার ৪০ হাজার টন এবং অন্যান্য সকল (অ্যামোনিয়াম সালফেট, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট, এনপিকেএস) মিলে ১.৬ লক্ষ টন ব্যবহৃত হচ্ছে। 
সার ব্যবহারের তধ্য অনুযায়ী দেখা যায় ইউরিয়া সারের ব্যবহার ব্যাপক। ইউরিয়া সার প্রতিক্রিয়াশীল হ্্ওয়ার ফলে ইহার প্রয়োগে  মাটির গঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পরিবেশ দূষিত হয় এবং মাটির স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পরে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ১০০ কেজি ইউরিয়া সার ব্যবহারের ফলে মাটিতে যে অম্লতার সৃষ্টি হয় তা প্রশমিত করার জন্য ৭৪ কেজি চুন ব্যবহার করতে হয়। রাসায়নিক সার পানিতে দ্রবণীয় হওয়ার কারণে প্রয়োগের পরে চোয়ায়ে মাটির নিচে চলে যায়। বেলে মাটিতে চোয়ানো প্রক্রিয়া অনেক বেশি। আবার কোন কোন সারের যেমন টিএসপির ফসফেট আয়ন অম্লীয় মাটিতে অ্যালুমিনিয়াম এবং লৌহ পুষ্টি উপাদানের সহিত স্থিরকরণ প্রক্রিয়ায় সহজলভ্যতা হারিয়ে ফেলে। 
চুনযুক্ত ক্ষারীয় মাটিতে মাইক্রোনিয়ট্রিয়েন্ট দস্তার সহজলভ্যতা এমনিতেই কম, আবার ফসফেট আয়নের সহিত আবদ্ধ হলে লভ্যতা বহুলাংশে কমে যায়। এ মাটিতে পটাশিয়াম আয়ন স্থিরকরণ প্রক্রিয়াও অনেক বেশি। তাই সহজেই অনুমেয় বিভিন্ন মাটিতে রাসায়নিক সার হতে গাছের নিকট পুষ্টির প্রাপ্যতা সমান নয়। মাটির প্রকারভেদে সারের সুপারিশ ভিন্নতর হয়ে থাকে। এটা এখন সময়ের দাবি, এমন সার উদ্ভাবন করা দরকার - যা হবে পরিবেশবান্ধব এবং অধিক পুষ্টি সমৃদ্ধ - যা গাছকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন মৃক্তিকা পরিবেশে পুষ্টি উপাদান সব সময় সরবরাহ করতে পারবে।
ন্যানো সারের উপকারী প্রভাব
ন্যানো সার এমন একটি সার যা ন্যানো প্রযুক্তি ব্যাবহার করে তৈয়ার করা হয়েছে। প্রচলিত সারের তুলনায় এ সারের অনেক উপকারী প্রভাব রয়েছে যা নি¤েœ বর্ণনা করা হল।
পুষ্টির শোষণ বৃদ্ধি : ন্যানো সার গাছের শিকড় দ¦ারা পুষ্টি শোষণকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। ন্যানো আকারের  কণাগুলোর  একটি বৃহত্তর পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল রয়েছে যা উদ্ভিদের শিকড়গুলোর আরও মিথষ্ক্রিয়া করতে দেয় যার ফলে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম এবং আরও তাদের মতো অন্য পুষ্টি উপাদানের উন্নত গ্রহণকে সহজতর করে।
উন্নত পুষ্টি দক্ষতা : প্রচলিত সারগুলো প্রায়শই লিচিং, উদ্বায়ীকরণ এবং রানঅফের মতো সমস্যায় ভোগে, যার ফলে পুষ্টির অদক্ষ ব্যবহার এবং পরিবেশ দূষণ হয়। ন্যানো সারগুলো থেকে পুষ্টি আয়ন ধীরে ধীরে এবং সুনির্দিষ্টভাবে মুক্ত হয়, যার ফলে পুষ্টির অপচয় কম হয় এবং পরিবেশগত খারাপ প্রভাব বহুলাংশে কমে যায়।
লক্ষ্যমাত্রায় পুষ্টি সরবরাহ : ন্যানো প্রযুক্তি ন্যানো আকারের ক্যারিয়ারের মধ্যে পুষ্টির এনক্যাপসুলেশন সক্ষম করে এবং নির্দিষ্ট উদ্ভিদ টিস্যুতে কাক্সিক্ষত মাত্রায় পুষ্টি সরবরাহ করে। ফলে গাাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। এতে সারের অপচয় অনেক কম হয়।
বর্ধিত পুষ্টির স্থায়িত্ব : ন্যানো সার পুষ্টির স্থায়িত্ব উন্নত করতে পারে, মাটির পিএইচ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং অণুজৈবিক ক্রিয়াকলাপ বা কার্যক্রমকেও প্রভাবিত করে। ফলে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে যে সকল অবক্ষয় বা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, 
তা দূরীভূত হয়। এ বর্ধিত স্থিতিশীলতা উদ্ভিদে পুষ্টির দীর্ঘস্থায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করে। ফলে টেকসই বৃদ্ধি সম্ভব হয় এবং উৎপাদন বেড়ে যায়।
পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস : পুষ্টির দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ক্ষতি হ্রাসের মাধ্যেমে ন্যানো সার পরিবেশ দূষণ হ্রাস করতে সহায়তা করতে পারে। দূষণের এর মধ্যে রয়েছে পুষ্টির প্রবাহ থেকে পানির দূষণ এবং সার উৎপাদন ও প্রয়োগ থেকে গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমন।
কাস্টমাইজযোগ্য ফর্মুলেশন : ন্যানো প্রযুক্তি কণার আকার,  আকৃতি এবং পৃষ্ঠের বৈশিষ্টগুলোর সুনির্দিষ্ট নিয়স্ত্রণের অনুমতি দেয়, নির্দিষ্ট ফসলের চাহিদা এবং মাটির অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য করে কাস্টমাইজড সার তৈরি করতে সক্ষম করে। এ নমনীয়তা সর্বোত্তম পুষ্টি সরবরাহ এবং উদ্ভিদ প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করে           কৃষির উৎপাদনশীলতা সর্বাধিক বৃদ্ধি করে। 
টেকসই কৃষির সাথে সামঞ্জস্য : ন্যানো সার টেকসই কৃষির সকল উপকরণের দক্ষতা বৃদ্ধি করে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতি সমর্থন করে। এ সার দক্ষ পুষ্টি সরবরাহ করে টেকসই কৃষি মাধ্যমে অধিক খাদ্য উৎপাদনে অবদান রাখতে পারে। 
প্রয়োগকৃত মাত্রা কমানো : ন্যানো সারের বর্ধিত দক্ষতা এবং গাছের লক্ষ স্থানে সরবরাহের কারণে প্রয়োগমাত্রা প্রচলিত সারের সুপারিশ মাত্রার চেয়ে শতকরা ৩০ ভাগ কমানো যেতে পারে। এটি কৃষকদের জন্য ব্যয় সাশ্রয়ী এবং  পরিবেশগত প্রভাব আরও হ্রাস করতে পারে।
সহজভাবে বুঝার জন্য বিভিন্ন সূচকে প্রচলিত এবং ন্যানো সারের তুলনামূলক চিত্র সারণি দ্রষ্টব্য।
যদিও ন্যানো সার কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে, টেকসই কৃষির নিশ্চয়তা প্রদান করে এবং দূষণ থেকে মাটিকে রক্ষা করে, তথাপি মাটির স্বাস্থ্য, উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং বাস্তÍÍতন্ত্রের গতিশীলতার উপর উহার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবগুলো পুরাপুরি বুঝতে আরও গবেষণা প্রয়োজন। বাংলাদেশে এ সারের ব্যাপক প্রচলন করতে হলে কৃষকের সামর্থ্য, অ্যাকসেযোগ্যতা এবং নিয়ন্ত্রক অনুমোদন প্রয়োজন। এ চ্যালেজ্ঞ মোকাবিলায় নীতিনির্ধারক, গবেষক এবং শিল্প ষ্টেকহোল্ডদের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে গবেষণা এবং উন্নয়ন শক্তিশালী, পণ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত এবং এ সারগুলোর নিরাপদ ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত প্রবিধান প্রণয়ন করা অত্যান্ত জরুরি।
 
লেখক : প্রাক্তন মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ই-মেইল : dmsislam12@gmail.com  মোবাইল : ০১৭১৩০০২১৮০
বিস্তারিত
স্বাস্থ্যসম্মত-ও-নিরাপদ-শুঁটকি-উৎপাদন
স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদন
এ. এম. ফরহাদুজ্জামান১ মেহেদী হাসান ওসমান২ মোঃ সুজন খান৩ মোঃ নেয়ামুল হাসান শোভন৪ 
বাংলাদেশ জলজ সম্পদে পরিপূর্ণ। প্রাচুর্য ভরা এই সম্পদ আরও প্রাচুর্যময় হয়ে ওঠে আবহমান বাংলার চিরাচরিত ঋতু বিচিত্রতার মিশেল বন্ধনে। বর্ষার পর যখন পানি নেমে যায় তখন স্বাদুপানির এলাকায় মাছ ধরার ধুম পড়ে। একযোগে প্রচুর মাছ ধরা পড়ায় টাটকা মাছ বিপণনের পাশাপাশি মাছ শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে এক বিশাল জনগোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিল, হাওর, বাঁওড় এলাকায় স্বল্পমেয়াদ নির্ভর শুঁটকিমাছ ব্যবসায়ীরা মৌসুমভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করে। এ কাজে নারীকর্মীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো যা নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। শুঁটকিমাছ উৎপাদনে সম্ভাবনার দিকে তাকালে দেখা যায়, সামুদ্রিক মাছের শুঁটকির চাহিদা ও আগ্রহের পাশাপাশি স্বাদু পানির মাছের শুঁটকির প্রতি সব শ্রেণির ভোক্তার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। রঙ, স্বাদ ও গন্ধে স্বাদুপানির মাছের শুঁটকির একটি নিজস্বতা আছে, যা বিশেষভাবে জনপ্রিয়। এ ছাড়াও রুচিবর্ধক ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবারগুলোর মধ্যে শুঁটকি অন্যতম।
শুঁটকি মাছের গুরুত্ব : আবহমানকাল থেকেই বাংলায় শুঁটকি তৈরির প্রচলন এবং শুঁটকি মাছের বিশেষ জনপ্রিয়তা রয়েছে। পুষ্টিগুণ হিসেবেও শুঁটকি মাছের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। ১০০ গ্রাম শুঁটকিমাছ হতে প্রায় ৬২ গ্রাম প্রোটিন, ১৩ গ্রাম উপকারী ফ্যাট এবং প্রচুর পরিমাণে ‘ভিটামিন এ’ ও ‘ভিটামিন ডি’ পাওয়া যায়। তাজা মাছের তুলনায় শুঁটকিতে ক্ষণিজ লবণের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। তাজা মাছের তুলনায় শুঁটকি মাছের দামও অনেক বেশি হয়ে থাকে। তাই স্বল্পপরিসরে শুঁটকি উৎপাদন ও বিক্রয়ের মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। স্বল্পখরচে এবং প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ শুঁটকি অনেকদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
প্রচলিত পদ্ধতিতে শুঁটকি তৈরির অস্বাস্থ্যকর দিকগুলো : প্রচলিত পদ্ধতিতে মাছ আহরণের পর তা সরাসরি রোদে শুকনো হয় যার ফলে মাছে নোংরা, ময়লা, ধুলা, কাদা ইত্যাদি থেকেই যায়। উন্মুক্ত পরিবেশে শুকানোর ফলে কুকুর, বিড়াল, মাছি ও অন্যান্য কীটপতঙ্গের সংক্রমণ ঘটে থাকে। কখনো কখনো শুঁটকিমাছে নির্বিচারে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, যার ফলে তা খাবার উপযোগী থাকে না। বাসি বা পচা মাছ হতে তৈরিকৃত শুঁটকি গুণগত মানসম্পন্ন হয় না।
স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদন প্রক্রিয়া : স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদনের ক্ষেত্রে মাছ আহরণ থেকে শুরু করে মোড়কজাত ও বিপণন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে উত্তম ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি ধাপে সতর্কতার সাথে গাইডলাইন অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
প্রয়োজনীয় উপকরণসূহ : স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদন করতে প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহের মধ্যে রয়েছে- সংগ্রহকৃত সতেজ মাছ; মাছ ধোয়ার জন্য পরিষ্কার পাত্র বা বাকেট; ছুরি, চাকু ও চপিং বোর্ড; লবণ; মশারি; ৭.৫ ফিট দৈর্ঘ্য, ৪ ফিট প্রস্থ এবং ৩ ফিট উচ্চতা বিশিষ্ট বাঁশের মাচা; মাচার ওপর বিছানোর জন্য ছোট মেশের নেট; শুঁটকিমাছ সংরক্ষণের জন্য পলিথিন প্যাকেট ইত্যাদি।
স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদন প্রক্রিয়ার পর্যায়ক্রমিক ধাপসমূহ  
া  স্থানীয় বাজার বা পুকুর/বিল/নদী হতে মাছ আহরণ বা সংগ্রহের পর উত্তমরূপে টিউবওয়েলের পানি দিয়ে ধুয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বরফ আবৃত করতে হবে;
া  শুঁটকি তৈরির সময় অবশ্যই সতেজ মাছ ব্যবহার করতে হবে। কোন অবস্থাতেই বাসি বা পঁচা মাছ ব্যবহার করা যাবে না। সংগ্রহের সাথে সাথে মাছগুলোকে প্রয়োজন (প্রজাতি/পুরুত্ব/গুণগত মান) অনুসারে বিভিন্নভাগে আলাদা করা যেতে পারে;
া সংগৃহীত মাছ পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে তার আইশ ও নাড়িভুঁড়ি অপসারণ করতে হবে এবং পুনরায় পরিষ্কার পানি দিয়ে উত্তমরূপে ধৌত করতে হবে। অতপর তা পরিষ্কার চালুনির ওপর রেখে মাছের গায়ে লেগে থাকা পানি ঝরিয়ে ফেলতে হবে;
া  পানি ঝরানোর পর মাছগুলোকে ১৫-২০ মিনিট ৬-১০% লবণ পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে;
া  মাছগুলোকে লবণ পানি হতে উত্তোলন করে পুনরায় চালুনির ওপর রেখে মাছের গায়ে লেগে থাকা পানি ঝরিয়ে ফেলতে হবে;
া এরপর মাছগুলোকে মশারির অভ্যন্তরে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মাচায় স্থানান্তর করে সরাসরি সূর্যালোকে উত্তমরূপে শুকাতে হবে। মাছের প্রজাতি, মাছের আকার, সূর্যালোকের উপস্থিতি এবং পর্যাপ্ত বায়ু প্রবাহের ওপর ভিত্তি করে শুঁটকি তৈরি হতে ৪-৬ দিন সময় লাগে। উত্তমরূপে শুকানোর পর উৎপাদিত শুঁটকিতে পানির পরিমাণ ২০% এর কম হতে হবে। মাছগুলোকে সমানভাবে শুকানোর জন্য প্রয়োজনে কয়েকবার উল্টিয়ে দিতে হবে। ৭.৫ ফিট দৈর্ঘ্য, ৪ ফিট প্রস্থ এবং ৩ ফিট উচ্চতা বিশিষ্ট বাঁশের মাচায় এক একবার ৫ কেজি মাছ শুঁটকি তৈরি করা যায়; এবং
া  উৎপাদিত শুঁটকি বায়ুশূন্য পলিথিনে মোড়কজাত করে ঠা-া ও শুষ্কস্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। এ পদ্ধতিতে এক কেজি সতেজ মাছ থেকে প্রায় ৩০০-৪০০ গ্রাম শুঁটকি উৎপাদন করা যায়।
স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ শুঁটকিমাছ উৎপাদনে করণীয় বিষয়সমূহ :
ক্স শুঁটকি তৈরির সময় সর্বদা স্বাস্থ্যসম্মত বিধি অনুসরণ করা উচিত। ব্যবহার্য সব যন্ত্রপাতি ব্যবহারের আগে ও পরে ভালোভাবে পরিষ্কার করা উচিত এবং এতে ক্লোরিন পানি ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়;
ক্স মাছ শুকানোর আগে লবণ দ্রবণে চুবিয়ে নিলে মাছে মাছি ও পোকামাকড় আক্রমণ কম হয়;
ক্স শুঁটকিমাছ সঠিকভাবে শুকানো উচিত, যাতে পানির পরিমাণ ২০ শতাংশের বেশি না থাকে; পানির পরিমাণের চেয়ে বেশি হলে শুঁটকির গুণগতমান দ্রুত নষ্ট হয়; এবং
ক্স উন্মুক্ত স্থানে শুঁটকি মজুদ বা গুদামজাত না করে বায়ু নিরোধক পাত্রে শুঁটকি গুদামজাত করা উচিত। এ ছাড়া বায়ু নিরোধক পলিথিন ব্যাগও ব্যবহার করা যায়।
মলা মাছের শুঁটকি হতে সম্ভাব্য আয়-ব্যয় : একটি বাঁশের মাচা (৭.৫ ফুট দ্ধ ৪ ফুট দ্ধ ৩ ফুট)- ১০০০/- টাকা, প্লাস্টিকের বাকেট ১টি- ৫০০/- টাকা, ছুরি বা চাকু ১টি- ২৫০/- টাকা, চপিং বোর্ড ১টি- ২৫০/- টাকা, মশারি ও নেট ১টি-৫০০/- টাকা, মটকা ২টি-১০০০/- টাকা (মোট স্থায়ী ব্যয়- ৩৫০০/- টাকা), মলামাছ ৫ কেজি- ১০০০/- টাকা, লবণ ১ কেজি- ১৫/- টাকা, পলিথিন প্যাকেট ২৫০ গ্রাম- ১০/- টাকা (মোট পরিচালন ব্যয়- ১০২৫/- টাকা)। ৫ কেজি সতেজ মলামাছ থেকে প্রায় ১.৭৫/- কেজি মলা শুঁটকি উৎপাদন করা যায়। প্রতি কেজি মলামাছের শুঁটকি ১২০০/- টাকা টাকায় বিক্রয় করা হলে ১.৭৫ কেজি শুঁটকির বিক্রয়মূল্য হবে ২১০০/- টাকা। অর্থাৎ, ৪র্থ সাইকেল থেকে উদ্যোগটি লাভ-ক্ষতির সাম্যাবস্থা (ব্রেক ইভেন পয়েন্ট) অতিক্রম করবে। পরবর্তীতে ৪-৬ দিনের একটি সাইকেলে নিট মুনাফা হবে (২১০০-১০২৫)= ১০৭৫/- টাকা।
 
লেখক : ১ব্যবস্থাপক, ২-৩উপব্যবস্থাপক; ৪সহকারী ব্যবস্থাপক, মোবাইল নম্বর: ০১৭২১২২১৯৮৮; পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), আগারগাঁও, ঢাকা
বিস্তারিত
কোরবানির-জন্য-সুস্থ-পশু-চেনার-উপায়-এবং-আগে-পরে-করণীয়
কোরবানির জন্য সুস্থ পশু চেনার উপায় 
এবং আগে-পরে করণীয়
ডা: মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ
মুসলমানদের দ্বিতীয় বড় ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে ঈদুল আজহা। প্রতি বছর জিলহজ মাসের ১০, ১১ এবং ১২ তারিখে বিশ^জুড়ে মুসলমানরা ঈদুল আজহা উদযাপন করেন। ঈদে হজরত ইব্রাহিম (আ:) ও হজরত ইসমাইল (আ:) এর স্মৃতিকে হৃদয়ে ধারণ করে পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। তবে কোরবানিদাতাদের অনেকের পশু-ক্রয়, হালাল জবাই পদ্ধতি এবং কোরবানির আগে-পরে করণীয় সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকায় নানা সমস্যায় পড়েন। এখানে কোরবানির জন্য সুস্থ পশু চেনার উপায়, হালাল জবাই পদ্ধতি এবং কোরবানির আগে-পরে করণীয় বিষয়ে আলোকপাত করা হলো।
কোরবানির জন্য সুস্থ পশু চেনার উপায়
া পশু কেনার জন্য তাড়াহুড়ো না করে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে হাটে যেতে হবে।
া সুস্থ পশুর স্বাভাবিক চাঞ্চল্য থাকবে এবং মাঝে মাঝে জাবর কাটবে। অন্যদিকে অসুস্থ পশু ক্লান্ত থাকবে এবং ঝিমাবে।
া সুস্থ পশু সচেতন থাকবে এবং কোথাও কোন শব্দ হলে সেদিকে লক্ষ্য করবে।
া সুস্থ পশুর নাকে বিন্দুবৎ ঘাম থাকবে, নাকের উপরের কালো অংশ ভেজা ভেজা এবং চকচকে হবে। অন্যদিকে অসুস্থ পশুর নাক থাকবে শুকনা।
া সুস্থ পশুর গতিবিধি চটপটে থাকবে এবং কান ও লেজ দিয়ে মশামাছি তাড়াবে।
া সুস্থ পশুর সামনে খাবার ধরলে পশু নিজ থেকে জিহ্বা দিয়ে টেনে খাবে।
া সুস্থ পশুর শরীরের চামড়া টানটান, পশম মসৃণ ও উজ্জ্বল হবে। চামড়া টান দিয়ে ছেড়ে দিলে দ্রুত পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে।
া স্টেরয়েড বা ওষুধ দিয়ে মোটাতাজা করা পশুর মাংসপেশি থেকে শুরু করে শরীরের অন্য অঙ্গগুলো অস্বাভাবিক ফোলা থাকবে। শরীরে পানি জমায় বিভিন্ন অংশে চাপ দিলে সেখানে গর্ত হয়ে দেবে যাবে এবং পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সময় নেবে।
া সুস্থ পশুর শরীরের তাপমাত্রা থাকবে স্বাভাবিক। অসুস্থ পশুর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হবে।
া সুস্থ পশুর শ্বাসপ্রশ^াস স্বাভাবিক থাকবে এবং অযথা ছটফট করবে না।
া অনেকক্ষণ খেয়াল করলে সুস্থ পশুকে পায়খানা ও/অথবা প্রস্রাব করতে দেখা যাবে, গোবর স্বাভাবিক (পাতলা নয়) ও প্রস্রাব থাকবে পরিষ্কার।
া চলাফেরা স্বাভাবিক কিনা তার জন্য পশুকে হাঁটিয়ে দেখতে হবে।
া গর্ভবতী পশু কোরবানি দেওয়া যায় না। তাই কেনার আগে সেটা নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।
া অন্ধ, পঙ্গু, দাঁতহীন পশু কোরবানির অযোগ্য বলে গণ্য হবে।
া কোরবানির জন্য গরুর বয়স দুই বছর বা তার অধিক, ছাগল বা ভেড়ার বয়স এক বছর বা তার অধিক এবং উটের বয়স পাঁচ বছর বা তার অধিক হতে হবে।
পশু ক্রয়ের পর করণীয় 
া সুস্থ পশু ক্রয়ের পরে তাকে যতটা সম্ভব কম হাঁটিয়ে/গাড়িতে করে বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে।
া বাড়ি নিয়ে প্রথমেই পশুকে পটাশ (পিপিএম) পানি দিয়ে গোসল করানো ভালো।
া পশুহাট ফেরত সকলেই হাত-পা সাবান দিয়ে ধৌত করতে হবে, সম্ভব হলে গোসল করতে হবে।
া প্রথমে পশুকে ৩-৫ লিটার যথাযথভাবে মেশানো স্যালাইন পানি পান করাতে হবে।
া পেটফাঁপা বা বদহজম থাকলে ১ কেজি পানিতে ১০০ গ্রাম খাবার সোডা মিশিয়ে খাইয়ে দিতে হবে।
া এরপরে কিছু কাঁচা ঘাস/শুকনো খড় দিতে হবে, ঘণ্টা খানেক পরে দানাদার খাদ্য যেমন-কুঁড়া, ভুসি, খৈল প্রভৃতি খেতে দেওয়া যাবে।
কোরবানির আগের দিন পর্যন্ত করণীয় 
া পশুর থাকার জায়গা, দাঁড়ানোর ও শোবার জন্য উপযুক্ত হতে হবে নতুবা তার মাংসের গুণগত মান হ্রাস পাবে।
া প্রতিদিন কোরবানি পশুকে একই সময়ে গোসল করাতে হবে।
া সকালে ও রাতে পশুকে খড়/ঘাস (দানাদার খাদ্য নয়) খেতে দিতে হবে।
া দিনে কেবল দুইবার দানাদার খাদ্য দিতে হবে, তার মোট পরিমাণ পশুর শারীরিক ওজনের ১% এর বেশি হবে না।
া পশুর সামনে সবসময় পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি নিশ্চিত করতে হবে।
া সারাদিন পর্যাপ্ত কাঁচা ঘাস ও খড় খেতে দিতে হবে।
া কোরবানির ১২ ঘণ্টা পূর্ব হতে দানাদার খাদ্য বন্ধ করে শুধু খড় ও পানি খেতে দিতে হবে।
া অসুস্থতা দেখা গেলে সাথে সাথে রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারিয়ানের পরামর্শ নিতে হবে।
কোরবানির সময় করণীয় 
া কোরবানির সকালে কেবল খাবার সোডা মিশ্রিত পানি পান করানো যাবে, অন্য কিছু নয়।
া যত্রতত্র জবাই না করে যথাসম্ভব নির্ধারিত জায়গায় সকলে জবাই করতে হবে। একাধিক অপশন থাকলে জায়গা নির্বাচনের ক্ষেত্রে নাগরিকের স্বাচ্ছন্দ্যবোধ ইত্যাদি বিবেচনাপূর্বক একটি সার্বজনীন জায়গা নির্বাচন করতে হবে।
া জবাইয়ের পূর্বে নির্ধারিত স্থানে গর্ত খুঁড়ে রাখতে হবে।
া পশুকে ভালোভাবে বাঁধার জন্য পর্যাপ্ত পাটের নতুন/পরিষ্কার দড়ি আগে থেকে প্রস্তুত রাখতে হবে।
া জবাইয়ের সময় পশু যাতে কম কষ্ট পায় সেদিকে সর্বোচ্চ লক্ষ্য রাখতে হবে।
া জবাইয়ের জন্য বাঁধার পূর্বে পশুর গায়ে হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করে, হৈহুল্লোড় এড়িয়ে সর্বোচ্চ মানবিক আচরণ নিশ্চিত করতে হবে। উল্লেখ্য, যেকোন ধকল, ভীতি বা অপ্রয়োজনীয় ভোগান্তি পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা যা মাংসের গুণগত মান হ্রাস করবে।
া অবশ্যই অবশ্যই পর্যাপ্ত ধারালো ছুরি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
া শিশু, অতিবৃদ্ধ বা মানসিকভাবে সবল নয় এমন লোকজনকে জবাইয়ের সময় উপস্থিত থাকা যথাসম্ভব নিরুৎসাহিত করতে হবে।
হালাল জবাইয়ের প্রক্রিয়া (ডঐঙ এবং ঋঅঙ স্বীকৃত)
া কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী স্বাস্থ্যবান, হৃষ্টপুষ্ট ও তৃষ্ণা নিবৃত প্রাণী জবাই করতে হবে।
া জবাই পূর্ব সময়ে প্রাণীকে ন্যূনতম ৬ ঘণ্টা অভুক্ত রাখতে হবে (শুধুমাত্র পানি পান করানো যাবে), তবে অন্য কোনভাবে কষ্ট দেয়া ও অচেতন করা নিষিদ্ধ।
া পরিষ্কার স্থানে শুইয়ে, ধারালো ও পরিষ্কার ছুরি দ্বারা অভিজ্ঞ মুসলিম দ্বারা জবাই করতে হবে।
া প্রাণীর মাথা কেবলামুখী করে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করতে হবে।
া স্পাইনাল কর্ড বা ঘাড়ের হাড় বিচ্ছিন্ন না করে প্রাণীর শ^াসনালী, খাদ্যনালী, মূল ধমনী ও শিরা সম্পূর্ণভাবে কাটতে হবে।
া জবাইয়ের পর দেহের সম্পূর্ণ রক্ত প্রবাহ করতে হবে।
জবাইয়ের পর মাংস তৈরির হালাল পদ্ধতি
হালাল মাংস তৈরির জন্য নি¤েœাক্ত পদ্ধতি (ঐঅঈঈচ) অনুসরণ করতে হবে-
া ১ম ধাপ: খাদ্যনালী গিঁট দিয়ে ভালোভাবে বেঁধে দিতে হবে যেন খাদ্যের উচ্ছিষ্ট মাংসের সংস্পর্শে না আসে
া ২য় ধাপ: রক্তের স্বাভাবিক নিঃসরণ সম্পূর্ণ করে পা ও মাথা পরিষ্কার করতে হবে
া ৩য় ধাপ: প্রাণীর দেহের চামড়া যথাযথভাবে অক্ষত রেখে অপসারণ করতে হবে ও ষাঁড়ের যৌনাংগ অপসারণ করতে হবে
া ৪র্থ ধাপ: লেজ অপসারণ করে পায়ুপথ কেটে বেঁধে ফেলতে হবে যেন মাংস কোনভাবেই মল-মূত্রের সংস্পর্শে না আসে
া ৫ম ধাপ: সতর্কভাবে বুক ও পেট চিড়তে হবে যেন পাকস্থলীর উচ্ছিষ্ট মাংসের সংস্পর্শে না আসে
া ৬ষ্ঠ ধাপ: শরীরের ভেতরের অংগসমূহ (কলিজা, ভূড়ি ইত্যাদি) বের করতে হবে এবং খাদ্যনালী পরিষ্কার করতে হবে
া ৭ম ধাপ: লেজের মূল হতে মেরুদন্ডের মাঝ বরাবর লম্বালম্বি করে দু’ভাগ এবং প্রতি আধাভাগের ৫ম ও ৬ষ্ঠ অথবা ১২তম ও ১৩তম পাজরের হাড়দ্বয়ের মাঝ বরাবর আড়াআড়ি করে চার খ- করতে হবে
া ৮ম ধাপ: পরিষ্কার জায়গায় পরবর্তী মাংস তৈরির কাজ করতে হবে। 
পশুর চামড়া ছাড়ানো বিষয়ে করণীয় 
া ভালো চামড়া পেতে পশু জবাই করার পূর্বে ভালোভাবে গোসল করাতে হবে এবং প্রচুর পানি খাওয়াতে হবে।
া ধারালো ছুরির অগ্রভাগ দিয়ে জবেহ করার স্থান থেকে গলা, সিনা ও পেটের উপর দিয়ে সোজাসুজি দাগ কাটতে হবে।
া সামনের দুই পায়ের হাঁটু থেকে সিনা পর্যন্ত একটি দাগ কেটে প্রথম দাগের সাথে যোগ করতে হবে এবং অনুরূপভাবে পেছনের দুই পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে দাগ কেটে প্রথম দাগ পর্যন্ত কাটতে হবে।
া সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে চামড়া ছাড়িয়ে, তাতে দ্রুত পরিমাণমতো (প্রতি কেজিতে ২০০ গ্রাম) লবণ ছড়িয়ে দিতে হবে।
া ছাড়াইকৃত চামড়া যথাশীঘ্রই বিক্রয় কেন্দ্রে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
কোরবানির পর মাংস সংরক্ষণে করণীয়
া ফ্রিজারে সংরক্ষণের প্রয়োজন হলে কাটার পরপর মাংস স্তূপ না করে যথাসম্ভব ছড়িয়ে ঠা-া হতে দিতে হবে, দ্রুততার সাথে ছোট ছোট প্যাকেট ফ্রিজে রেখে কয়েক ঘণ্টা পরপর ওলটপালট করে সমভাবে শীতলীকরণ নিশ্চিত করতে হবে; অন্যথায় মাঝখানে রাখা মাংস নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে।
া ফ্রোজেন মাংস কোন কারণে একবার গলানো হলে/গলে গেলে দ্বিতীয়বার ফ্রিজিং করা যাবে না, এতে মাংস নষ্ট হয়ে যাবে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় করণীয় 
া সরকার কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে পশু জবাই করতে হবে।
া রক্ত, মলমূত্র ও বর্জ্য একত্রে গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে।
া পশু জবাইয়ের স্থান ডিটারজেন্ট ও ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে ভালো করে ধৌত করতে হবে এবং আশেপাশে চুন ছিটিয়ে দিতে হবে।
া পশু জবাই করার পর রক্ত যাতে চারদিকে ছড়িয়ে পরিবেশের ক্ষতি না করে সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
া সরকার কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে বর্জ্য ফেলতে হবে।
 
লেখক : ভেটেরিনারি সার্জন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, কৃষি খামার সড়ক, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫; মোবাইল-০১৮১১-৯৮৬৬০৫, ইমেইল-ংsmmohibullah@gmail.com
বিস্তারিত
মিশ্র-ফল-চাষে-সমৃদ্ধ-দিনাজপুর-উদ্যোক্তাদের-মুখে-হাসি

মিশ্র ফল চাষে সমৃদ্ধ দিনাজপুর 
উদ্যোক্তাদের মুখে হাসি
কৃষিবিদ সাবরিনা আফরোজ
উত্তরের শেষ সীমানার একটি গ্রাম। গ্রামের সামনের পিচঢালা পথের পাশে হঠাৎ যেন দেখা মেলে এক সবুজ সম্ভারের। চারপাশে ধানক্ষেতের মাঝে মনে হয় এক টুকরো অরন্য প্রবেশ করেছে। প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকলেই প্রশান্তিতে মন ভরে যায়। হরেক রকম রঙ-বেরঙের ফল ও সবজির এক টুকরো স্বর্গরাজ্য বলে মনে হয় প্রায় দুই একরের এই জায়গাটিকে। 
বলছিলাম দিনাজপুরের বীরগঞ্জে অবস্থিত তাসনিয়া এগ্রোফার্মিং এন্ড রিসার্চ সেন্টারের কথা। যার স্বত্ব¡াধিকারী কৃষিবিদ ইমরুল আহসান। পেশায় সহকারী উদ্যান উন্নয়ন কর্মকর্তা কৃষিবিদ ইমরুল আহসানের স্বপ্নগুলো যেন তার এই বাগানে বাস্তবের মুখ দেখেছে। ইমরুল আহসানের বাগানে দেখা মেলে হরেক প্রজাতির আম, মাল্টা, কমলা, আপেল, লিচু, কাঁঠাল, পেয়ারা, পেঁপে, জাম্বুরা, নারিকেল, সফেদা, আমড়া, কামরাঙ্গা, মিষ্টি তেঁতুলসহ নানা প্রজাতির ফল। এ ছাড়া আছে নানারকম মৌসুমি সবজি, করেছেন মাছ চাষ, হাঁস-মুরগী পালনসহ নানাবিধ             কৃষিকাজ। 
চাকরির পাশাপাশি এমন  বাগান করার কথা কেন তার মাথায় আসলো আর কিভাবেই বা তিনি এটা পরিচর্যা করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন খুব ছোটবেলা থেকেই তার গাছের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা। বড় হয়ে পড়াশোনা করেছেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি বিষয়ে। চাকরিও করেন কৃষি বিভাগে। এগুলো যেন তাকে গাছের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে। সহধর্মিণীও কৃষিবিদ দুজনে মিলে গড়ে তোলেন এই শখের খামার। প্রাথমিক অবস্থায় শখ থাকলেও বর্তমান এ বাগান ঘিরে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে অনেক মানুষের।
বাগান তৈরির প্রস্তুতি হিসেবে তিনি জানান অধিকাংশ ফলগাছ যেহেতু স্থায়ী ধরনের তাই দেখে শুনে ফলগাছ লাগানো প্রয়োজন। গাছের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সুস্থ সবল ভালো গঠনের চারা/কলম নির্বাচন করা প্রয়োজন। বর্ষার আগে ফলগাছ লাগানো উত্তম। তবে সেচ ও পানি নিষ্কাশন সুবিধা থাকলে সারা বছরই গাছ লাগানো যায়। ঝড় বাতাসে গাছের গোড়া যাতে নড়ে না যায় এজন্য গাছের গোড়ায় শক্ত খুঁটি দেওয়া দরকার। গাছের ঠিকমতো বৃদ্ধি ও ফলদান ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রতি বছর গ্রীষ্মের শুরুতে ও বর্ষার শেষে ফলগাছে নিয়মিত সার প্রয়োগ করা উচিত। একই সাথে মাটিতে রস কম থাকলে সেচ প্রয়োগ করা উচিত। সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে গাছের গোড়ায় সার না দিয়ে কিছুটা দূরে প্রয়োগ করা উচিত। তিনি আরও বলেন, ফল বাগান সবসময় আগাছামুক্ত রাখা দরকার। পানি দেওয়ার ফলে গোড়ার মাটির উপরিভাগ শক্ত হয়ে যায়। এর ফলে মাটিতে বাতাস চলাচল করতে শিকড় ছড়াতে এবং মাটিতে রস সংরক্ষণ ব্যাহত হয়। এজন্য গাছের গোড়ার চারিদিকে হালকাভাবে কুপিয়ে মাটি আলগা রাখা প্রয়োজন। গাছ লাগানোর শুরু থেকেই গাছের গোড়ায় গজানো অতিরিক্ত ডালসহ রুগ্ন দুর্বল অফলন্ত ডাল নিয়মিত ছাটাই করতে হবে। বাগানে সীমিত আকারে প্রয়োজনানুসারে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করেন তিনি। নিয়মিত বাগানের আশেপাশের ঝোপজঙ্গল পরিষ্কার করেন যার ফলে রোগ ও পোকামাকড় কম হয়। বাগানে তিনি সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব উপায়ে পোকা দমন করেন। তিনি তার বাগানে যেসব গাছে কলম করেছেন সেটির প্রথম বছরের ফুল ভেঙে দেন যাতে গাছ দুর্বল না হয়ে যায়। এ ছাড়া বাগানে ফুল ফল ঝরা কমানো এবং ফল ধরতে সহায়তার জন্য গাছে ফুল আসার ২৫ দিনের ব্যবধানে দুইবার ফ্লোরা স্প্রে করেন।
ইমরুল আহসানের বাগানে নানা প্রজাতির আমের দেখা মেলে। হাড়িভাঙ্গা, আ¤্রপালি, বারি-৩, বারি-৪, ল্যাংড়া, ব্যানানা, সূর্যডিম, মিয়াজাকি, আশ্বিনা, ফজলি, গৌরমতি, মল্লিকাসহ নানারকম আমের সমারোহ। তিনি তার বাগানের অনেক পুরনো অনুন্নত গাছকেও উন্নত জাতে রূপান্তর করেছেন। তার কাছে জানতে চাই কিভাবে তিনি অনুন্নত গাছকে উন্নত জাতে রূপান্তর করেছেন। 
এ প্রসঙ্গে তিনি জানান তিনি ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে অনুন্নত আম গাছের সমস্ত শাখা-প্রশাখা কেঁটে দেন। পরর্বতীতে জুন-জুলাই মাসে যখন নতুন ডাল গজায় সেখানে তিনি ভিনিয়ার/ক্লেফট পদ্ধতিতে উন্নত জাতের কলম করেন। কলমের নিচ থেকে কুশি বের হলে সেগুলো তিনি নিয়মিত অপসারণ করেন। তিনি জানান এভাবে প্রায় ২-৩ বছরের মধ্যে অনুন্নত আম গাছ উন্নত জাতে রূপান্তিত হবে।
 নিরাপদ বিষমুক্ত আম উৎপাদনের জন্য তিনি ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে। তিনি জানান, আমের আকার যখন মার্বেলের সাইজের হয় তখন তিনি ফ্রুট ব্যাগিং শুরু করেন। দুই স্তরের বাদামি ব্যাগ তিনি ব্যাগিংয়ের জন্য ব্যবহার করেন। ব্যাগিং করার পূর্বে তিনি কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক নির্দেশিত মাত্রায় ভালোভাবে মিশিয়ে স্প্রে করেন। তিনি বলেন, আম ব্যাগিং করলে রোগ পোকামাকড় মুক্ত আম উৎপাদন করা যায় এবং আম সংগ্রহ করার পর ১০-১৫ দিন পর্যন্ত ঘরে রেখে খাওয়া যায় এবং ভালো বাজারমূল্য পাওয়া যায়।
এ ছাড়া আম বাগানে তিনি বিভিন্ন আন্তঃফসল চাষ করেন। যেমন- টমেটো, বেগুন, ঢেঁড়স, পুঁইশাক, ডাঁটাশাক প্রভৃতি। এতে করে বাড়তি মুনাফা অর্জন হয় বলে তিনি জানান।
আমের রেশ কাটতে না কাটতে বাগানে শুরু হয় মাল্টা ও কমলার ধুম। নানা জাতের সুমিষ্ট স্বাদের কমলা শোভা পায় তার বাগানে। স্বাদে বর্ণে গন্ধে অতুলনীয় এই কমলার বাজারমূল্য বেশ ভালো বলে তিনি জানান।
কিভাবে কমলা চাষে ভালো ফলন পেতে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন চারা রোপণের ৩-৪ মাস পর থেকে তিনি নিয়মিত সার দেওয়া শুরু করেন। প্রতি গাছে তিনি প্রায় ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি এবং ১০০ গ্রাম এমওপি সার গাছের গোড়া থেকে ৫০ সেমি. দূরে চারদিকের মাটি কুপিয়ে সেখানে ছিটিয়ে দেন। এরপর তিনি সেচ দেন। মাঘ, চৈত্র ও ভাদ্র মাসে তিনি এ সার প্রয়োগ করেন। এ ছাড়াও বছরে দুইবার জিংক সালফেট, তুত ও ম্যাগনেসিয়াম সালফেট মিশিয়ে পাতা ভিজিয়ে স্প্রে করেন তাতে গাছ সুস্থ ও সতেজ থাকে। এতে ফলন বাড়ে এবং ফলের স্বাদ ভালো হয় তার প্রতিটি গাছে ৩০০-৮০০টি ফল ধরে। প্রতি কেজি ৭০-৮০ টাকায় বিক্রয় করে গাছ প্রতি তার আয় হয় প্রায় ৮০০০ টাকা। এদেশে কমলা গাছে ভালো ফলন না হওয়ার পেছনে দুর্বল ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেন ইমরুল আহসান। বাগানে সার প্রয়োগ ও যতেœর অভাব হলে বাগানে বিভিন্ন রকম ক্ষতিকারক ফসল, রোগ ও পোকার আক্রমণ হয়। এ ছাড়া ম্যাগনেসিয়াম তামা ও দস্তার অভাব মাটি থেকে সার চুইয়ে চলে যাওয়া, জৈবসার ব্যবহার না করা, সময়মতো সেচ না দেওয়া ইত্যাদি নানাবিধ কারণে কমলার আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না। সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকলে দিনাজপুরের মাটিতে খুব ভালো মানের কমলা পাওয়া সম্ভব বলে তিনি জানান।
ইমরুল আহসানের স্বপ্ন ছিল একটি জার্মপ্লাজম সেন্টার তৈরি করার। যেখানে নানা প্রজাতির গাছ থাকবে। সেই স্বপ্ন্ পূরণে তিনি তার এগ্রো ফার্মটি নানা রকম ফল, সবজি দিয়ে সাজিয়েছেন। তার বাগানের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো আপেল।
তার বাগানে দেখা যায় থোকায় থোকায় ঝুলছে ভিনদেশি আপেল। ৩ বছর বয়সি গাছগুলোর উচ্চতা প্রায় ৮-১০ ফুট। ডালে ডালে সবুজ আপেল যেন এক বিস্ময় তৈরি করেছে স্থানীয় মানুষের মাঝে। সামার রাম্বু, হরিমন, কাশ্মিরি এনা, অস্ট্রেলিয়ানসহ প্রায় ১২ প্রজাতির আপেল গাছ আছে তার বাগানে। আপেল নিয়ে রীতিমতো  গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছেন তিনি। গত বছর তার গাছে খুব অল্প সংখ্যক আপেল ধরেছিল কিন্তু এ বছর বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রতিটি গাছ যেন আপেলের ভারে নুইয়ে পড়েছে। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখার জন্য তার বাগানে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দর্শনার্থীর চাপ। বাংলাদেশে এত সুন্দর আপেল হতে পারে এ যেন অনেকের কাছে বিষ্ময়। ইমরুল আহসান জানান সঠিক পুষ্টি উপাদান ও কিছু হরমোনাল ট্রিটমেন্ট করে এবার তার আপেলের বিপুল ফলন হয়েছে। তিনি জানান আপেলের জন্য তাপমাত্রা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সব জায়গায় আপেলের চাষ সম্ভব হবে না। আপেল চাষের জন্য চিলিং তাপমাত্রা বেশ গুরুত্বপূর্ণ অর্থাৎ ১০০-৪০০ ঘণ্টা তাপমাত্রা ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা।
লো চিলিং অর্থাৎ ১০০ ঘণ্টার নিচে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সবুজ আপেলটা হয়, যা বাংলাদেশের আবহাওয়ায় চাষযোগ্য। দেশের ফলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে ইমরুল আহসান আপেল নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
দেড় একরের তাসনিয়া এগ্রো ফার্ম এন্ড রিসার্চ সেন্টারে আছে ৭০ রকমের ফলের ৫০০ প্রজাতির গাছ। কৃষিবিদ দম্পতি হিসেবে কৃষির প্রতি ভালোবাসা ছিল স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই। তাই তা চাকরির পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন বিশাল বাগান। সে সাথে নার্সারিও গড়ে তুলেছেন যাতে করে মানুষ সঠিক জাতের গাছ কিনতে পারেন। শখ ভালোবাসা দায়িত্বশীলতা পাশাপাশি অনেক লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেন ইমরুল আহসান। তার অর্জিত জ্ঞানের সবটুকু তিনি ঢেলে দিতে চান কৃষির পেছনে। তাকে দেখে উৎসাহী হয়ে বাগান করেছেন অনেকেই। বিনামূল্যে তাদের তথ্যসেবা দিয়ে যান তিনি। তার স্বপ্ন এই দিনাজপুরের মাটি একদিন ফলের রাজধানী। বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি জমি তৈরি হবে খাঁটি সোনায়। বাংলাদেশ হবে ফল ফসলে সমৃদ্ধ।

লেখক : আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৭৫২৬৮৪০; ই-মেইল :Dhaka@ais.gov.bd

বিস্তারিত
ফলে-পুষ্টি-অর্থ-বেশ-স্মার্ট-কৃষির-বাংলাদেশ

ফলে পুষ্টি অর্থ বেশ
স্মার্ট কৃষির বাংলাদেশ 

মোছলেহ উদ্দিন সিদ্দিকী 
কোন এক কালে 
বনে বাদারে আঙিনার ধারে 
অচেনা প্রান্তরে
আদরে অনাদরে আচ্ছাদিত ছিল রাশি রাশি বৃক্ষ,
ফলদ, বনজ, ওষুধির ছায়, কী মায়ায় মমতায় 
কেটেছে কৈশোর মোর, প্রশান্তির ¯িœগ্ধতায়। 

ফলদ অঙ্গ ভরা বন চারিধার 
দেখিনা তো এখন আর
নিজেই করেছি উজার,
বুঝে, না বুঝে, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে 
বিনাশ করেছি তারে বারেবারে
এখন ধরণীর রুদ্র রুষে প্রবল উষ্ণতার আলিঙ্গনে- ভাবি তাই,
আমার শিশু কি রবে সবুজের শূন্যতায়! 

দিন যায়, মাস যায়, বছর পেরিয়ে যুগ
গবেষণায় মেতে উঠে মেধাবী চোখ,
পুরনোর ভিত থেকে তুলে আনে উন্নত নতুনের জাত 
অতি অকস্মাৎ। 
সুমিষ্ট সুস্বাদু বাহারি ফলের আহারে পাই অমৃতের সুখ। 

বাগানে বাগানে ভরা আমের মিছিল
গাছ ভরা থোকা থোকা লিচু ঝিলমিল
কাঁঠালে কাঁঠাল ভরা বিশাল বলয় 
পেঁপে কলা আনারস কতো চাষ হয়। 
আগাম আর নাবী জাতে কতো বিষ্ময় 
ফলের মৌসুম তাই সুদীর্ঘ হয়।

অপ্রচলিত, বিলুপ্ত প্রায়
এখনো তো দেখা যায়-
করমচা কদবেল, লটকন জামরুল 
পেয়ারা জলপাই, তাল-তেঁতুল, আতা কুল
মালটা কমলা, তৈকর সাতকরা, 
কাউফল চালতা লুকলুকি আমড়া। 

দেশি ফল, পাশাপাশি বিদেশিও আছে তাই
রাম্বুটান অ্যাভোকেডো, স্ট্রবেরিটা কাছে পাই  
শানতোল পার্শিমন, আঙুর ড্রাগন
বাংলাকে ভালবেসে থাকো মিশে আজীবন।  

আমাদের দেশি ফল পুষ্টির আধার 
পুষ্টির তুষ্টিতে ফলদ আহার 
হয় যেন সমভোগ এই বাংলার 
আবাল বৃদ্ধ বনিতার। 
বিশাল পৃথিবী আজ ছোট এক গাঁও
তথ্য প্রযুক্তির দুরন্ত নায়ে আমরাও তুলেছি পাল উদ্যাম হাওয়ায়। 
অদম্য উৎসাহে উত্তম কৃষি চর্চায় 
আমরাও ফলাই ফল-ফসল এই বাংলায়। 

পৃথিবীর নানা প্রান্তরে অচেনা কত বন্ধুর হাতে রেখে হাত
পরিতৃপ্ত করি রসনার উল্লাসে, 
ফলের পসরা সাজাই বিশ^ বাজারে 
হাত বাড়ালেই বাংলার ফল পায়, নিজ আঙিনায়।

বিশে^র তালে তালে এগিয়েছে জাতি 
উন্নত হচ্ছে দেশ, খাদ্য নিরাপত্তায় 
পুষ্টি জোগানে, অর্থ আহরণে 
আজ উচ্চারিত হয় ক্ষণে ক্ষণে 
ফলে পুষ্টি, অর্থ বেশ
স্মার্ট কৃষির বাংলাদেশ ॥

লেখক : ফিল্ম প্রোডাকশন অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, কৃষি মন্ত্রণালয়, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল : ০১৫৫৬৩৩২৯৬৯, ই-মেইল : fpo@ais.gov.bd

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর

প্রশ্নোত্তর

কৃষিবিদ আকলিমা খাতুন

নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য আপনার ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ দমনে সমন্বিত বালাইব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন।

মো: আমজাদ হোসেন, উপজেলা : পীরগঞ্জ, জেলা : রংপুর
প্রশ্ন : রোপা আমন ধানের বীজতলা তৈরি এবং সার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : পরিমিত ও মধ্যম মাত্রার উর্বর মাটিতে বীজতলার জন্য কোন সার প্রয়োগ করতে হবে না। তবে নিম্ন, অতিনিম্ন বা অনুর্বর মাটির ক্ষেত্রে গোবর অথবা খামারজাত সার প্রতি শতকে ২ মণ হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে। বীজতলায় চারা হলুদ হয়ে গেলে প্রতি শতকে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার চারা গজানোর ২ সপ্তাহ পর মাটিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া প্রয়োগের পরও বীজতলায় চারা হলুদ হয়ে গেলে প্রতি শতকে ৪০০ গ্রাম জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এর মতে উফশী জাতের আমনের উচ্চফলন পেতে বিঘাপ্রতি (৩৩ শতক) ২১ কেজি ইউরিয়া, ৭-১০ কেজি টিএসপি/ডিএপি ১৪ কেজি এমওপি ৮-১১ কেজি জিপসাম ১-২ কেজি জিংক সালফেট এবং জৈব সার ৭০০-৮০০ কেজি প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণের আগে জমি তৈরির চূড়ান্ত পর্যায় সমুদয় সার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। জমি তৈরির সময় জিংক সালফেট না দিলে স্প্রে আকারে চিলেটেড জিংক ব্যবহার করা যায়। ইউরিয়া সার তিন কিস্তিতে দিতে হবে। জমি তৈরির চূড়ান্ত পর্যায়ে বা চারা রোপণের ৭-১০ দিন পর প্রথম কিস্তি, ২৫-৩০ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তি এবং কাইচ থোড় আসার ৫-৭ দিন আগে তৃতীয় কিস্তির সার ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
ফারুক মিয়া, উপজেলা : শ্রীপুর, জেলা : গাজীপুর
প্রশ্ন : ক্ষিরা গাছের কচি পাতা ও ডগা পোকা আক্রমণ করে নষ্ট করে ফেলছে। করণীয় কী?
উত্তর : সাধারণত বিটল পোকার আক্রমণে এই সমস্যা হয়ে থাকে। বিটল পোকা দ্বারা আক্রান্ত হলে করণীয় হলো ক্ষেতের আশে পাশের আগাছা নষ্ট করা। হাতজাল দিয়ে পোকা ধরা ও মেরে ফেলা। পতার উপরে ছাই ছিটিয়ে সাময়িকভাবে দমন করা যায়। চারা বের হওয়ার পর থেকে ২০-২৫ দিন পর্যন্ত মশারির জাল দিয়ে চারাগুলোকে ঢেকে রাখতে হবে। চারা বা গাছের মাদার  চারিদিকে ২-৫ গ্রাম দানাদার কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের ওষুধ ১ মিলি, মিপসিন/সপসিন (আইসোপ্রোকার্ব) ২ গ্রাম একতারা (থায়োমোথোক্সাম) ১ গ্রাম, সেভিন (কার্বারিল) ২ গ্রাম মিশিয়ে ৮-১০ দিন পর পর তিনবার স্প্রে করতে হবে।
আব্দুল হাকিম, উপজেলা : পলাশবাড়ি, জেলা : গাইবান্ধা
প্রশ্ন : ডাঁটা গাছের কা-ে ক্ষতর মতো সৃষ্টি হচ্ছে এবং গাছ মারা যাচ্ছে। করণীয় কী?
উত্তর : এটি একটি ছত্রাকজনিত সমস্যা। এই রোগে আক্রমণের ফলে প্রথমে গাছের কা-ে লম্বাটে ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং পরে পুরো কা-ই এতে আক্রান্ত হয়ে ও গাছ মারা যায়। এই  রোগের জন্য করণীয় হলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করা, পরিত্যক্ত অংশ নষ্ট বা পুড়ে ফেলা, রোগ প্রতিরোধ সম্পন্ন জাত ব্যবহার করা। বপনের আগে প্রোভেক্স ২.৫ গ্রাম বা ব্যাভিস্টিন-২ গ্রাম দিয়ে প্রতি কেজি বীজ শোধন করে নিতে হবে। রোগের আক্রমণ দেখা দিলে টিল্ট ২৫০ ইসি  (প্রোপিকোনাজল) ০.৫ মিলি, অটোস্টিন ৫০ ডব্লিউজি (কার্বেন্ডাজিম) ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে এক সপ্তাহ পর পর ২-৩ বার স্প্রে করে দিতে হবে।
মো: নুরে আলম, উপজেলা : ঈশ্বরদী, জেলা : পাবনা
প্রশ্ন : জামরুল গাছের পাতায়, ফলে কাল ময়লার আস্তরণ জমা হচ্ছে, এ থেকে কিভাবে পরিত্রাণ পেতে পারি?
উত্তর : এটি জামরুলের শুঁটিমোল্ড রোগ নামে পরিচিত। এই রোগের আক্রমণে পাতায় ফলে কা-ে কালো ময়লা জমে। খোসা পোকা, মিলিবাগ বা সাদা মাছির আক্রমণ এ রোগ ডেকে আনে। এই রোগে করণীয় হলো আক্রান্ত পাতা ও ডগা ছাঁটাই করে ধ্বংস করা। মিলিবাগ বা সাদা মাছির আক্রমণ এ রোগ ডেকে আনে তাই এদের দমনের জন্য এডমায়ার ২০০ এসএল (ইমিডাক্লোরপিড) ১ মিলি./লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে আট থেকে দশ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। টিল্ট ২৫০ ইসি  প্রোপিকোনাজল) ১০ লিটার  পানিতে ৫ মিলি. মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ২ বার স্প্রে করতে হবে। বাগান অপরিচ্ছন্ন রাখা যাবে না। ফল সংগ্রহ শেষে গাছের  মরা ডালপালা রোগ বা পোকা আক্রান্ত ডালপালা ছাঁটাই করে পরিষ্কার করতে হবে। 
সাকিল শরীফ, উপজেলা : চৌদ্দগ্রাম, জেলা : কুমিল্লা
প্রশ্ন : আমার ঢেঁড়সের সব পাতা হলুদ ও সবুজ রঙের ছোপ ছোপ দেখা যাচ্ছে এবং পাতার শিরাগুলো স্বচ্ছ ও হলুদ হয়ে যাচ্ছে, করণীয় কী?
উত্তর : এটি ঢেঁড়সের পাতার শিরা স্বচ্ছতা রোগ (ঠবরহ পষবধৎরহম ফরববধংব ড়ভ ষধফুং ভরহমবৎ ভাইরাস রোগ)। এই রোগের আক্রমণ হলে পাতা ও পাতার শিরাগুলো স্বচ্ছ ও হলুদ, সবুজ ছোপ ছোপ রঙের পাশাপাশি গাছের পাতাগুলো ছোট ও খর্বাকৃতি হয়ে যাবে। এই ভাইরাসের পোকা সাদা মাছির মাধ্যমে এই রোগটি ছড়ায়। বাহকপোকা (জ্যাসিড/সাদা মাছি) দমনের জন্য ইমিজক্লোরপিড গ্রুপের এডমায়ার ০.৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২-৩ বার শেষ বিকেলে স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করার ১৫ দিনের মধ্যে সেই গাছের সবজি খাওয়া যাবে না এবং বাজারে বিক্রি করা যাবে না। এছাড়াও আক্রান্ত গাছ দেখামাত্র তুলে নষ্ট বা পুঁতে ফেলতে হবে, আক্রান্ত ক্ষেত থেকে বীজ সংগ্রহ না করা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতের চাষ করতে হবে।
সুমন আহম্মেদ, উপজেলা : জলঢাকা, জেলা : নীলফামারী
প্রশ্ন : আমার বেগুন গাছের ফল, কা- ও পাতায় কালো ক্ষতের সৃষ্টি হচ্ছে, ফল পচে যাচ্ছে এবং গাছ মারা যাচ্ছে। করণীয় কী?
উত্তর : এটি বেগুনের ফল ও কা- পচা রোগ (ঋৎঁরঃ ধহফ ঝঃবসৎড়ঃ ড়ভ ইৎরহলধষ) এটি চযড়সড়ঢ়ংরং াবীধহং নাম ছত্রাকের আক্রমণে হয়ে থাকে। এই রোগের আক্রমণ হলে আক্রান্ত গাছের ডালে বা কা-ে ক্যাংকার সৃষ্টি হয়। ডাল চক্রাকারে পচে যায় ফলে গাছ মারা যায়। বেগুনের বীজ রোপণের পূর্বে বীজ কে শোধন করতে হবে (গরম পানি ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এ ১৫ মিনিট) অথবা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের (অটোস্টিন) অথবা কার্বোক্সিন+থিরাম গ্রুপের (প্রোভেক্স ২০০ঢ়ি) ২ গ্রাম/প্রতি কেজি বীজ শোধন করে নিতে হবে। মাঠে এই রোগ দেখা দিলে কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ব্যভিস্টিন ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ৩ বার শেষ বিকেলে স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করার ১৫ দিনের মধ্যে সেই সবজি খাওয়া বা বাজারে বিক্রি করা যাবে না। এছাড়াও একই জমিতে প্রতি বছর বেগুন চাষ না করা এবং ফসল সংগ্রহ শেষে শুকনো ডাল, কা-, ফল ইত্যাদি সংগ্রহপূর্বক নষ্ট বা পুড়ে ফেলতে হবে।
রৌশন আলম, উপজেলা : ভুরুসমারী, জেলা : কুড়িগ্রাম
প্রশ্ন : আমার আম গাছের শাখার অগ্রভাগের কিছু নিচে কালো দাগ দেখা যাচ্ছে। রোগটি প্রথমে কচি পাতা ও ডগায় শুরু হয় পরে আক্রান্ত ডাল শুকিয়ে ও সমস্ত পাতা ঝড়ে যাচ্ছে। করণীয় কী?
উত্তর : এটি আমের আগা মরা রোগ (সধহমড় ফরব-নধপশ) এটি ঈড়ষষবপঃড়ঃৎরপযঁস ঝঢ়. নামক ছত্রাকের আক্রমণে হয়ে থাকে। এই রোগের আক্রমণ হলে আক্রান্ত গাছের কা- কেটে অনেক সময় হলুদ রঙের আঠা ঝরে। এই রোগ দেখা দিলে আক্রান্ত ডগা কিছু সুস্থ অংশসহ কেটে ফেলতে হবে। কাটা অংশে বর্দ্দোপেস্ট (প্রতি লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম তুঁত ও ১০০ গ্রাম চুন) এর প্রলেপ দিতে হবে। এ ছাড়াও প্রতি লিটার পানিতে প্রপিকোনাজল গ্রুপের ছত্রাক নাশক টিল্ট ০.৫ মিলি মিশিয়ে ৭ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
মুরাদ হোসেন, উপজেলা : ফুলগাজী, জেলা : ফেণী
প্রশ্ন : আমার লিচু গাছের লিচুর বোঁটায় প্রথমে বাদামি বা কালো দাগ দেখা যায়। পরবর্তীতে ফলের খোসায় আক্রমণ করে এবং ফল দ্রুত পচে যায়। করণীয় কী?
উত্তর : এটি লিচু পচা রোগ (খরপযর ৎড়ঃ ফরংবধংব) । এই রোগটি উরঢ়ষড়ফরধ ংঢ়. নামক ছত্রাকের আক্রমণে হয়ে থাকে। গাছ থেকে ফল পারার সময় যাতে আঘাত প্রাপ্ত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বৃষ্টির দিনে লিচু পারা যাবে না। লিচু পারার পর গরম পানিতে ১০ মিনিট ডুবিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। গাছে ফল থাকা অবস্থায় রোগের আক্রমণ দেখা দিলে ম্যানকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক ডায়থেন এম-৪৫ ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর ২ বার শেষ বিকেলে স্প্রে করতে হবে।
মো: জাকির হোসেন, উপজেলা : বাকেরগঞ্জ, জেলা : বরিশাল।
প্রশ্ন : কাঁকরোল হলুদ হয়ে পচে ঝরে যাচ্ছে। কী করতে হবে?
উত্তর : মাছি পোকার আক্রমণে কাঁকরোল পচে ঝড়ে যায়। স্ত্রী মাছি কচি ফলের নিচের দিকে ওভিপজিটর ঢুকিয়ে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার স্থান থেকে পানির মতো তরল পদার্থ বেড়িয়ে আসে যা শুকিয়ে বাদামি রঙ ধারণ করে। ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ফলের শাস খেতে শুরু করে এবং ফল সংগ্রহ করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে। কচি ফল কাগজ বা পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। প্রথম ফুল আসা মাত্র ফেরোমন ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের (রিপকর্ড) কীটনাশক ১ মিলি./লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর  ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সেই সবজি খাবেন না বা বিক্রি করা যাবে না।

লেখক : তথ্য অফিসার (উদ্ভিদ সংরক্ষণ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫। মোবাইল : ০১৯১৬৫৬৬২৬২; ই-মেইল :aklimadae@gmail.com

বিস্তারিত
শ্রাবণ-মাসের-কৃষি-(১৬-জুলাই-১৫-আগস্ট)

শ্রাবণ মাসের কৃষি
(১৬ জুলাই-১৫ আগস্ট)
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
শ্রাবণ মাস। বাংলার প্রকৃতিতে ষড়ঋতু আসে ছয়টি ভিন্ন রূপে। ছয় ঋতুর বাংলাদেশে আষাঢ় এবং শ্রাবণ মাস মিলে বর্ষাকাল। যা মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের অঞ্চলগুলোতে উদযাপিত একটি ঋতু। এ সময় মৌসুমি বায়ুর প্রভাব সক্রিয় হওয়ায় প্রবল বৃষ্টিপাত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মৌসুমি বায়ু এ মাসে সক্রিয় অবস্থায় থাকে না। ফলে শ্রাবণ মাসে কাক্সিক্ষত বৃষ্টির দেখা হয় না। তারপরও খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে কৃষিজীবী ভাইবোনেরা ব্যস্ত থাকে কৃষি কাজে। আর এ প্রসঙ্গে জেনে নেবো কৃষির বৃহত্তর ভুবনে কোন কোন কাজগুলো করতে হবে আমাদের।
আউশ  
এসময় আউশ ধান পাকে। শিষের অগ্রভাগের ৮০% ধানের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ এবং শিষের নিচের অংশ ২০% ধানের চাল আংশিক শক্ত ও স্বচ্ছ হলে ধান ঠিক মতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। বীজ ধানের জন্য নির্বাচিত জমির আইলের পাশের ৬ ফুট বাদ দিয়ে ভেতরের অংশ হতে আলাদাভাবে ধান সংগ্রহ করা উচিত। রোগা ও পোকা আক্রান্ত জমি থেকে কোনোক্রমেই বীজ সংগ্রহ করা উচিত নয়। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে ধান কাটা উচিত। ফসল কর্তন ও পরিবহনে যাতে সংমিশ্রণ না ঘটে সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
কাটার পর ধান মাঠে ফেলে না রেখে যথা সম্ভব মাড়াই করা উচিত। মাটি থেকে বীজ যাতে আর্দ্রতা শুষে নিতে না পারে তার জন্য  কাঁচা খলার ওপর ধানমাড়াই করার সময় চাটাই, মোটা চট, ত্রিপল বা পলিথিন বিছিয়ে দিতে হবে। আধুনিক বীজ মাড়াই যন্ত্রের সাহায্যে বীজ মাড়াই করলে বীজের গুণাগুণ ভালো থাকে। এভাবে ধান মাড়াই করলে ধানের রঙ উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকে। ধান মাড়াইয়ের সময় যাতে অন্য জাতের বীজ মিশ্রিত না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে এবং সে জন্য মেঝে বা খলা থেকে অন্য জাতের ধান যতদূর সম্ভব দূরে রাখতে হবে। মাড়াই করা ধান অন্তত ৪ থেকে ৫ দিন রোদে ভালোভাবে  শুকানোর পর ঝেড়ে গোলাজাত করতে হবে।
সংগৃহীত বীজ ভালোভাবে ঝাড়াই করে অপরিপক্ব বীজ, রোগাক্রান্ত বীজ, খড়কুটা, ধুলাবালু ভালোভাবে পরিষ্কার করে বড় বড় পুষ্ট দানা বাছাই করে নিতে হবে। বীজ সংরক্ষণের আগে পর পর কয়েকবার রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে যেন বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগের নিচে থাকে। দাঁত দিয়ে কাটলে যদি কট করে শব্দ হয় তাহলে বুঝতে হবে বীজ ঠিকমতো শুকিয়েছে।
যে পাত্রে বীজ রাখা হবে তাতে যেন কোনো ছিদ্র না থাকে।  অল্প পরিমাণ বীজ রাখার জন্য তেলের ড্রাম কিংবা বিস্কুট বা কেরোসিনের টিন প্রভৃতি ধাতব পাত্র ব্যবহার করা ভালো।
ধাতব পাত্র ব্যবহার করা সম্ভব না হলে, মাটির মটকা, কলস বা পলিথিন যুক্ত চটের বস্তা অথবা চটের বস্তায় পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক ড্রাম ব্যবহার করা যেতে পারে। মাটির পাত্র হলে পাত্রের বাহিরের গায়ে আলকাতরার প্রলেপ দিতে হবে। পাত্রে বীজ রাখার আগে পাত্রগুলো আর্দ্রতামুক্ত করার জন্য ভালো করে রোদে শুকিয়ে নেয়া প্রয়োজন। রোদে শুকানো বীজ ঠা-া করে পাত্রে ভরতে হবে। পাত্রটি সম্পূর্ণ বীজ দিয়ে ভরাট করে রাখতে হবে। যদি বীজের পরিমাণ কম হয় তবে বীজের ওপর কাগজ বিছিয়ে তার ওপর শুকনো বালি দিয়ে পাত্র পরিপূর্ণ করতে হবে। এবার পাত্রের মুখ ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে যাতে পাত্রের মধ্যে বাতাস ঢুকতে না পারে।
সংরক্ষণ করা বীজ মাঝে মধ্যে পরীক্ষা করা দরকার যাতে কোনো প্রকার পোকামাকড় বা ইঁদুর ক্ষতি করতে না পারে। দরকার হলে মাঝে বীজ শুকিয়ে নিতে হবে। এতে বীজের আর্দ্রতা সঠিক থাকবে। প্রতি টন গুদামজাত বীজে ৩টি ফসটক্সিন ট্যাবলেট সর্বনিম্ন ৭২ ঘণ্টা ব্যবহারে গুদামের সব ধরনের পোকামাকড় মারা যায়। তবে জৈব বালাই ব্যবস্থাপনাই শ্রেয়।
টন প্রতি ধানে ৩.২৫ কেজি নিম, নিশিন্দা বা বিষকাটালি পাতার গুঁড়া, শুকনা তামাক দিয়ে গোলাজাত করলে পোকার আক্রমণ হয় না। এসব পাতা পোকামাকড় প্রতিরোধক।
আমন ধান
শ্রাবণ মাস আমন ধানের চারা রোপণের ভরা মৌসুম। চারার বয়স ৩০-৪০ দিন হলে জমিতে রোপণ করতে হবে।
রোপা আমনের অনুকূল পরিবেশ উপযোগী উন্নত জাত, যেমন বিআর১০, ব্রি ধান৩০, ব্রি ধান৩২, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৮, ব্রি ধান৩৯, ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭২, ব্রি ধান৭৫, ব্রি ধান৭৯, ব্রি ধান৮০, ব্রি ধান৮৭, ব্রি ধান৯০, ব্রি ধান৯১, ব্রি ধান৯৩, ব্রি ধান৯৪, ব্রি ধান৯৫, ব্রি ধান১০৩, ব্রি হাইব্রিড ধান৪, ব্রি হাইব্রিড ধান৬, বিনা ধান-৭, বিনা ধান-১১, বিনা ধান-১৬, বিনা ধান-১৭, বিনা ধান-২২, বিনা ধান-২৩ প্রতিকূল পরিবেশ উপযোগী উন্নত জাত চাষ করতে পারেন;
খরাপ্রবণ এলাকাতে নাবি রোপার পরিবর্তে যথাসম্ভব আগাম রোপা আমনের (ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৯, ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬৬, ব্রি ধান৭১ এসব), লবণাক্ত ও লবণাক্ত জোয়ারভাটা অঞ্চলে ব্রি ধান৭৩, ব্রি ধান৭৮, অলবণাক্ত  জোয়ারভাটা অঞ্চলে ব্রি ধান৭৬, ব্রি ধান৭৭ এবং জলাবদ্ধতা সহনশীল জাত ব্রি ধান৭৯ চাষ করা যেতে পারে;
চারা রোপণের ১২-১৫ দিন পর প্রথমবার ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এর ১৫-২০ দিন পর দ্বিতীয়বার এবং তার ১৫-২০ দিন পর তৃতীয়বার ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য ধানের ক্ষেতে বাঁশের কঞ্চি বা ডাল পুঁতে দিতে পারেন যাতে পাখি বসতে পারে এবং এসব পাখি পোকা ধরে খেতে পারে।
পাট
ক্ষেতের অর্ধেকের বেশি পাট গাছে ফুল আসলে পাট কাটতে হবে। এতে আঁশের মান ভালো হয় এবং ফলনও ভালো পাওয়া যায়। মুক্ত জলাশয় ও স্বল্প পানিতে পাটের পচন 
পাট পচানোর জন্য আঁটি বেঁধে পাতা ঝরানোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং জাগ দিতে হবে। ইতোমধ্যে পাট পচে গেলে আঁশ ছাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পাটের আঁশ ছাড়িয়ে ভালো করে ধোয়ার পর ৪০ লিটার পানিতে এক কেজি তেঁতুল গুলে তাতে আঁশ ৫-১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে, এতে উজ্জ্বল বর্ণের পাট পাওয়া যায়। যেখানে জাগ দেয়ার পানির অভাব সেখানে রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পচাতে পারেন। এতে আঁশের মান ভালো হয় এবং পচন সময় কমে যায়।
বন্যার কারণে অনেক সময় সরাসরি পাট গাছ থেকে বীজ উৎপাদন সম্ভব হয় না। তাই পাটের ডগা কেটে উঁচু জায়গায় লাগিয়ে তা থেকে খুব সহজেই বীজ উৎপাদন করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
পাটের ভালো বীজ পেতে হলে দেশী পাট বীজ এ মাসে বপন করতে হবে। সারিতে বপন করলে প্রতি শতাংশ জমিতে ১৬ গ্রাম তোষা এবং ২০ গ্রাম দেশী বীজ বপন করতে হবে। আর ছিটিয়ে বপন করলে শতাংশে ২০ গ্রাম তোষা এবং ২৪ গ্রাম দেশী পাটের বীজ বপন করতে হবে।
তুলা
রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চলে আগাম শীত আসে, সে জন্য এসব অঞ্চলে এ মাসের মধ্যে তুলার বীজ বপন করতে হবে।
শাকসবজি
বর্ষাকালে শুকনো জায়গার অভাব হলে টব, মাটির চাড়ি, কাঠের বাক্স এমনকি পলিথিন ব্যাগে সবজির চারা উৎপাদনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ মাসে সবজি বাগানে করণীয় কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে মাদায় মাটি দেয়া, আগাছা পরিষ্কার, গাছের গোড়ায় পানি জমতে না দেয়া, মরা বা হলুদ পাতা কেটে ফেলা, প্রয়োজনে সারের উপরিপ্রয়োগ করা।
লতাজাতীয় গাছের বৃদ্ধি বেশি হলে ১৫-২০ শতাংশ পাতা ও লতা কেটে দিলে তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল ধরবে। কুমড়াজাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন অধিক ফলনে দারুণভাবে সহায়তা করবে। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন ভোর বেলা হাত পরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে। গত মাসে শিম ও লাউয়ের চারা রোপণের ব্যবস্থা না নিয়ে থাকলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। শিম ও লাউয়ের বীজ পচা কচুরিপানার স্তূপে বপন করে অতপর মূল মাদায় স্থানান্তর করতে পারেন। মাদার দূরত্ব হবে ৩ ফুট, ১ ফুট চওড়া ও ১ ফুট গভীর করে মাদা তৈরি করতে হবে। সবজিক্ষেতে বালাই আক্রমণ দেখা দিলে জৈব বালাই ব্যবস্থাপনা যেমন- ফেরোমন ট্রাপ ব্যবহার করা যেতে পারে। পাতায় দাগপড়া রোগ দেখা দিলে অনুমোদিত মাত্রায় ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। বর্ষাকালীন সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতকালীন শাকসবজি চাষের প্রস্তুতি নিতে হবে।
গ্রীষ্মকালীন টমেটো ফসল মাঠে থাকলে গাছ বেঁধে দিতে হবে। এ মাসে নাবী পাট বীজ ফসলের সাথে সাথী ফসল হিসাবে সবজি চাষ করা যেতে পারে।
আগাম রবি সবজি যেমন : বাঁধাকপি, ফুলকপি, লাউ, টমেটো, বেগুনের বীজতলা তৈরি, বীজ বপন শুরু করা যেতে পারে।
গাছপালা
এখন সারা দেশে গাছ রোপণের কাজ চলছে। ফলদ, বনজ এবং ঔষধি বৃক্ষজাতীয় গাছের চারা বা কলম রোপণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে একহাত চওড়া এবং একহাত গভীর গর্ত করে অর্ধেক মাটি এবং অর্ধেক জৈবসারের সাথে ১০০ গ্রাম টিএসপি এবং ১০০ গ্রাম এমওপি ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। সার ও মাটির এ মিশ্রণ গর্ত ভরাট করে রেখে দিতে হবে। দশ দিন পরে গর্তে চারা বা কলম রোপণ করতে হবে। ভালো জাতের মানসম্পন্ন চারা রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের পর গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে এবং খুঁটির সাথে সোজা করে বেঁধে দিতে হবে। গরু ছাগলের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য রোপণ করা চারার চারপাশে খাঁড়া বা বেড়া দিতে হবে।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, কৃষিক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের জন্য আধুনিক কৃষির কৌশলগুলো যেমন অবলম্বন করতে হবে তেমনি সকল কাজ করতে হবে সম্মিলিতভাবে। যা কৃষিকে নিয়ে যাবে উন্নতির শিখরে। আর কৃষির যে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য আপনার নিকটস্থ উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন। এছাড়া কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ এ নম্বরে যে কোন মোবাইল অপারেটর থেকে কল করে নিতে পারেন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ।

লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪; ই-মেইল : editor@ais.gov.bd

 

 

 

 

 

 

 

বিস্তারিত